ভারতে ইসলামের আগমন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 February, 2022

ভারতে ইসলামের আগমন


ভারতে ইসলামের আগমন
ভারতে ইসলামের আগমন

হত্যা, দাসত্ব এবং মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস

হজরত মুহাম্মদ ( স: ) এর জীবদ্দশাতেই সাহাবী মালিক ইবনে দিনার ২০ জন সঙ্গী নিয়ে ইসলাম প্রচারে ভারত আসেন। ৬২৯- সনে ভারতের কেরালাতে চেরামান জুম্মা মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সমসাময়িক কালে গুজরাট এবং বাংলার মুসলিমেরা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন । ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে – সাহাবী , ওলী আল্লাহ ,গাউস , কুতুব , আউলিয়া, ছুফি, পীর, মাশায়েখ , মৌলানা , মৌলবী , তানজিম , তাবলীগ এর সৎ , নিষ্ঠাবান , জ্ঞানী,গুণী ত্যাগী ইসলাম প্রচারক দের ভূমিকা সব সময়ই মূল ও প্রধান। তবে এটাও সত্য – পরবর্তীতে ভারতে মুসলিম শাসন ইসলাম ধর্ম প্রচারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।
ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা সারা বিশ্বে ইসলাম প্রচারে ছড়িয়ে পড়েন। ওই একই সময় তারা ভারত , শ্রীলংকা , আফগানিস্তানেও ইসলামের বাণী নিয়ে আসেন। এবং এই অঞ্চলের মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন। ভারতে সব ধর্মের, সর্ব শ্রেণীর সর্ব পেশার মানুষ -বৌদ্ধ , হিন্দু ,জৌন , দলিত ,বর্ণভেদে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণীকে উদার ভাবে গ্রহণ করেন। প্রথম যুগের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কারীদের মাঝে যেমন সাধারণ জনগণ ছিলেন তেমনি ছিলেন উচ্চ বর্ণ শ্রেণীর মানুষও ।
৭১০ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারত অভিযানে আসেন এবং সিন্ধ ও মুলতান জয় করেন । এই অভিযানটি ৬২৯ সনে ভারতে চেরামান জুম্মা মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর পরের ঘটনা ।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের পটভূমিতে যে বিষয় গুলি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে – তার মাঝে অন্যতম ,নব দীক্ষিত মুসলমানদের উপর স্থানীয় শাসক কুলের হয়রানি , জুলুম , অত্যাচার । শ্রীলংকা থেকে হজ্জের উদ্দেশে স্ব -পরিবারে আরব গামী কিছু মুসলিম কে যাত্রা পথে সিন্ধু অঞ্চলে বল পূর্বক অপহরণ। অপহৃতদের উদ্ধারে – এবং নৌ পথের নিরাপত্তা রক্ষায় বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোন ‘এ্যাকশন’ না নেওয়া – পলাতক কিছু রাজ্দ্রোহী , ফিতনা সৃষ্টি কারীদের ভারতে আশ্রয় প্রদান ইত্যাদি ।
ইরাকের তৎকালীন গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (উমাইদ খলিফা – ওলীদের আমলে। ) মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তা , বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা , জল দস্যু দমন , অপহৃত নারী , শিশু ,উদ্ধার , সহ পলাতক বিদ্রোহীদের বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করাবার উদ্দেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম কে ভারত অভিযানের অনুমতি দেন।
এই অভিযানে যুদ্ধ ময়দানেই রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হন। মুহাম্মদ বিন কাসিম এর ভারত অভিযান – ভারতে -মুসলিম শাসনের ইতিহাস আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধু বিজয় কে ভারতে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের ভিত্তি হিসাবে ধরা যায়।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে , মুহাম্মদ বিন কাসিম সিরাজ থেকে ভারত অভিযানে রওনা হন। সম্পর্কের দিক থেকে তিনি ছিলেন ইরাকের তৎকালীন গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এর জামাতা। আপন চাচা ও শশুর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এর বড় মেয়ে জুবাইদার সঙ্গে ভারত অভিযানের মাত্র কিছু দিন আগে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর বিয়ে হয়। সিন্ধু ও মুলতান বিজয়ের পর তিনি ইরাক ফিরে যান। মোহাম্মদ বিন কাসিম সমর ইতিহাসে এক প্রতিভাবান বিস্ময়। একাধারে নির্ভিক , সাহসী , কুশলী যোদ্ধা , দক্ষ শাসক ও সফল নেতা। ( ক্ষণ জন্মা এই বীর মাত্র বিশ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন। )

 হিন্দুরা সুদূর অতীত থেকে ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানেও প্রতিনিয়ত শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসের কারণে পুরো ধর্মীয় সম্প্রদায় নিশ্চিহ্নকরণ এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার। হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায় নিশ্চিহ্নকরণের শিকার হয়েছে কয়েকটি পদ্ধতিতে সংক্ষেপে বললে বলা যায় বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণ, হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে গণহত্যা, হিন্দুদের মন্দির, মন্দিরের মূর্তি ধ্বংস করে মসজিদে রূপান্তর এবং মন্দিরের বিগ্রহ, স্বর্ণালংকার, অর্থ-সম্পত্তি-জমি দখল করে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে।
প্রাচীন আর্যদের বৈদিক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে বেড়ে ওঠা ধর্মটির ঐতিহ্য যেমন সুপ্রাচীন তেমনি এই ধর্মের অনুসারীরা আক্রমণের শিকারও হয়েছিল অতীতকাল থেকেই বিশেষত ইসলামের আগমনের সাথে সাথে। ৮শ শতক থেকেই আফগানিস্তানের গিরিপথ পার হয়ে দলে দলে মুসলিম সেনা, ধর্মপ্রচারক, সুফি আসতে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশের এই বিস্তৃত অঞ্চলে। এই অঞ্চলের প্রধান সুবিধা এবং সমস্যা হলো উর্বর জমি, নির্বিঘ্নে বসবাসের উপযোগী ভূপ্রকৃতি, আরামদায়ক জলবায়ু, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি। এতসব সুবিধার কারণেই এই লোকেরা কিছুটা অলস, যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ এবং তাদের জীবনযাত্রা সহজ সরল। ইসলামের আগমনের আগে এই বিশাল অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ কেমন ছিল তার দিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিপাত অত্যন্ত আবশ্যক। হিন্দু ধর্ম তখন থেকে প্রচণ্ড ব্রাহ্মণ্যবাদী আর বর্ণের অন্ধকারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নিজ ধর্মের মধ্যেই ঘৃণাকে হিন্দুরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব এখনো এই আধুনিক সমাজেও প্রবলভাবে বিদ্যমান। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের এত অত্যাচার, নিপীড়ন করত যে, যখন কোন মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করে তখন ক্ষেত্রবিশেষে আক্রমণকারীকে স্বাগত জানায় শুধু অত্যাচার থেকে মুক্তির আশায়। ছোট ছোট সামন্ত রাজন্যবর্গ আন্তঃ-কলহে এত ব্যস্ত ছিল যে বহির্শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার ন্যুনতম প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের কপালে সুখ নাই, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ধর্মান্তরিত কিংবা মুসলিম শাসনের অধীনে আসলেও সামাজিক জীবনে তাদের অর্থনৈতিকভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব, রাজ্যবিস্তার নিয়ে লিখিত সবথেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পার্সিয়ান ভাষায় লিখিত চাচনামা/ ফতেহ নামা সিন্ধ এবং তারিখ আল-হিন্দ ওয়া আস-সিন্ধ (সিন্ধু বিজয়ের কাহিনী) গ্রন্থ থেকে জানায় যায় খলিফা উমাইয়ার নিয়োজিত মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাকের) গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা/জামাতা সেনাপতি মুহম্মদ বিন কাশিম ৬০০০ সিরিয়ান সৈন্য নিয়ে ৭১২ সালে সিন্ধু আক্রমণ করে। সিন্ধু যে একেবারে বিনা বাধায় মুসলিমরা জিতে নিয়েছিল তা কিন্তু নয়, ইতিপূর্বে তিনবার আক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের তরুণ মুহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে প্রতিবেশী বিভিন্ন শহর যেমন দেবল (করাচি), নিরুন, রেওয়ার, ব্রাহ্মণাবাদ (মনসুরাবাদ), আলোর, মুলতান দখলে নিয়ে প্রথমবারেরমত ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের চানতারা পতাকা তুলে ধরতে সক্ষম হয় এবং তারা সমগ্র অঞ্চলে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে। যুদ্ধে পরাজিত সব সৈন্যদেরকে একবারে হত্যা করা হয় এবং নিহত সৈনিকদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদেরকে দাস হিসেবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে ইরাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত রাজ্য জয়ের সপ্তাহ থেকে মাস খানেকের মধ্যে মুহম্মদ বিন কাশিম শহরের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক, ব্যবসায়ীদের ডেকে ট্যাক্সের হার নির্ধারণ এবং ব্যবসা বাণিজ্য পুনরায় স্বাভাবিক করতে চুক্তির ব্যবস্থা করত। চুক্তিতে নগরবাসীর জন্য কয়েকটি সুযোগ আছে যেমন সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য আদেশ দেয়া হয়, অথবা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করো, অথবা যুদ্ধে জিতলে বা মরলে তো ভালো কথা কিন্তু হারলে দাস হয়ে যাও। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ জামাতা কাশিমকে একটা চিঠি লিখে নির্দেশ দেন যারা অস্ত্র বহন করবে (আহি-আল-হার্ব) তাদের সবাইকে হত্যা করো, অস্ত্রধারীর স্ত্রী সন্তানদের বন্দী করে দাস বানাও, যারা যুদ্ধ করেনি সাধারণ নাগরিক তাদেরকে ধর্ম রক্ষার কর (ধিম্মাহ) প্রদানের চুক্তিতে ছেড়ে দাও। কিন্তু রাজ্য জয়ের কাশিমের বাহিনী স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধদেরকে দুইটা সুযোগ দিলো, হয় প্রাণ বাঁচাতে ইসলাম গ্রহণ করো না হয় তরবারির নিচে মাথা পেতে দাও।
কাশিম যেসব অঞ্চলে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, মুসলিম-বাহিনীর সৈন্য-ক্ষয়ের সম্ভাবনা ছিল সেখানে অবরোধ আরোপ করে আস্তে আস্তে ক্ষমতা নগর দখলের চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করত। অবরোধ কৌশলের কারণেই মুসলিম-বাহিনীর তেমন সৈন্যক্ষয় ছাড়াই আরমাবিল, নিরুন, আলোর দখল করতে সক্ষম হয়। চাচ নামা গ্রন্থে বলা হয়েছে মুহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু অববাহিকার প্রায় ৬০% নগর দখল করতে পেরেছিল অবরোধ রণনীতির কারণে। যদিও হাজ্জাজ বিন ইউসুফ জামাতা কাশিম যথেষ্ট নির্দয় না হওয়ার কারণে দুর্বল হৃদয়ের মানুষ বলে তিরস্কার করে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দেবল (করাচি) দখলের পর কড়া নির্দেশ দেয় একটা বয়স্ক পুরুষও যেন বেঁচে না থাকে।
সিন্ধু জয়ে মুহম্মদ বিন কাশিমের নিজের কৃতিত্ব থেকেও বেশি কৃতিত্ব স্থানীয় অত্যাচারী রাজা দাহিরের নিপীড়নের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধ প্রজা। স্থানীয় বিদ্রোহী জাট এবং মেধ সৈন্যরা অতিষ্ঠ হয়ে রাজা দাহিরকে পরাজিত করতে কাশিমের সাথে যোগ দেয়। মুহম্মদ বিন কাশিমের সহজেই সিন্ধু জয়ের আরও কিছু কারণ আছে যেমন-
১. উন্নত সমরাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম (কাশিম বাহিনীর কাছে দুর্গের শক্ত দরজা ভাঙার যন্ত্র এবং আধুনিক তীর ধনুক ছিল)
২. সৈন্যদের মাঝে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা এবং সময়োপযোগী নেতৃত্ব
৩. মুসলিম সৈন্যদের উজ্জীবিত করেছিল জিহাদের ধারণা। তাদেরকে বলা হয়েছিল বেঁচে থাকলে তারা হবে গাজী, ভোগ করতে পারবে অবাধ নারী লুণ্ঠিত ধনরত্ন সামগ্রী। (ঘুচে যাবে তাদের অভাব, কারণ সিরিয়ান সৈন্যদের বেশিরভাগই ছিল দারিদ্রে কোনমতে দিনাতিপাত করা ভবঘুরে দস্যু।)
৪. সিন্ধু অঞ্চলে আগে থেকেই ইসলামের দিগ্বিজয়ের গুজব বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়েছিল।
৫. অধিকাংশ বৌদ্ধ, হিন্দুরা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়, যুদ্ধে নরহত্যার থেকে আত্মসমর্পণ শ্রেয় মনে করে।
৬. প্রজাদের রাজা দাহির এবং তার মন্ত্রী আমলাদের সীমাহীন অত্যাচার, নিপীড়ন।
৭. নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের সাথে সামাজিক বৈষম্য।
ইতিহাসবিদ স্যার হেনরি মিলার ইলিয়ট তার History of India ইতিহাস বইতে অন্যান্য মুসলিম আক্রমণকারীদের তুলনায় কাশিমকে কম ধ্বংসাত্মক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও মন্দির ধ্বংস, লুট এবং স্থানীয় হিন্দুদেরকে হত্যা থেমে থাকেনি। সিন্ধুর সব অধিবাসীদেরকে বলপূর্বক ধর্মান্তর করা হয়। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত উপেন্দ্র ঠাকুরের Sindhi Culture বইতে সেই সময়টাকে অন্ধকার ইতিহাস বলে চিহ্নিত করেন। সিন্ধুতে গণ ধর্মান্তর করার সময়ে মন্দির ভাঙা হয়েছে যেখানে যা পাওয়া গেছে সব এবং ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করায় হিন্দু বৌদ্ধ সবাইকে জবাই করে হত্যা করে। রাজা দাহিরের ‘গো হত্যা’ নিষিদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবে দেবলের (করাচি) ব্রাহ্মণদের জোরপূর্বক খতনা করানো হয়। সিন্ধু বিজয়ের পরে মুহম্মদ বিন কাশিম তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে হানাফি এবং শরিয়া আইন বলবত করে হিন্দু, বৌদ্ধদেরকে জিজিয়া করের বিনিময়ে স্বধর্ম পালনের সুযোগ দেয়।
সিন্ধু আক্রমণের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের যাত্রা শুরু। এরপরেই দলে দলে আক্রমণকারী, পর্যটক, সুফি, ধর্মপ্রচারক আসতে লাগল এই অঞ্চলে, শুরু করল স্থায়ী বসবাস। পাকিস্তানের জনক মুহম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের সময় বলে, যেদিন মুসলিমরা প্রথম সিন্ধুর মাটিতে পা রেখেছে সেদিনই ভারতে ইসলামের প্রবেশ পথ রচিত হয়েছে।
শত শত বছর ধরে হিন্দুরা গণহত্যার শিকার হলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো বেশীরভাগ হিন্দুই গণহত্যার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয় এবং কোন মানবাধিকার সংস্থাও এগিয়ে আসেনি হিন্দুদের গণহত্যার প্রতিবাদ করতে, দেয়নি পত্রিকায় দুই লাইনের বিবৃতি। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোন হিন্দুর সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে, বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, পরিবারের যুবক ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, সংসারের হাল ধরা ব্যক্তিটি খুন হয়ে যাচ্ছে, বাড়ির মেয়েকে তুলে নিয়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করছে, মা মেয়ে, ঘরের বউ ধর্ষিত হচ্ছে কিন্তু হিন্দুরা যাপন করে যাচ্ছে প্রতিদিনের সেই আটপৌরে স্বাভাবিক জীবন। প্রতিবেশীর মেয়ে ধর্ষিত হলেও তাদের কিছু যায় আসে না কারণ তার কাছে স্বস্তি তার নিজের পরিবারে তো আর এমনটা ঘটেনি! হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কিশোরী শরণ লাল Theory and Practice of Muslim State in India বইতে দাবী করেন, ১০০০ সালে এখানের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ২০০ মিলিয়ন সেখানে ১৫০০ সালের জনসংখ্যা কমে গিয়ে ১৭০ মিলিয়নে পরিণত হয়। In Growth of Muslim Population in Medieval India বইতে ইতিহাসবিদ কিশোরী শরণ লাল লিখেছেন মুঘল আমলের যুদ্ধ, হত্যা, নির্বাসন, স্থানীয় অধিবাসীদের ব্যাপক দেশান্তর, দুর্ভিক্ষে তারা সংখ্যায় কমে গেছে। কিশোরী শরণ লালের বইকে অবশ্য সমালোচনা করেছেন প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইরফান হাবিব এবং তাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক’র মুখপাত্র বলে অভিযোগ করেন। সমালোচনার জবাবে শরণ লাল বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণের কারণে ১০০০ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে ৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু মাহমুদ গজনীর একার আক্রমণেই ২ মিলিয়ন হিন্দু নিহত হয়েছে। উইল ডুরান্ট ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণ এবং রাজ্যপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায় বলে চিহ্নিত করলেও তার সমসাময়িক ইতিহাসবিদগণ তার দাবীকে অগ্রাহ্য করেন।
হিন্দু গণহত্যার প্রেক্ষাপটকে আলোচনার সুবিধার্থে চারটা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে:১। হিন্দু ধর্ম গ্রহণে অস্বীকার করার কারণে মুসলিম শাসকেরা হিন্দুদের হত্যা করে
২। হিন্দু রাজ্য দখলের সময় হিন্দু হত্যা
৩। দেশবিভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং গণহত্যা
৪। হিন্দুদের উপর চলমান সমসাময়িক আক্রমণ, অত্যাচার, নিপীড়ন।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল তখনকার সময়ে বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব শিক্ষার তীর্থস্থান। মন্দির এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, পণ্ডিতদের খুন হয়ে যাওয়া আর ছাত্রদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার কারণে তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, বিরাট একটা প্রজন্ম থেকে যায় শিক্ষার আড়ালে। অর্থ এবং রাজার আনুকূল্যের অভাব, মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির প্রতিকূল পরিবেশে মুখ থুবড়ে পড়ল বিজ্ঞান চর্চা। সংস্কৃত ভাষা, বৈদিক দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞান চর্চা প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে যায়। মুসলিম শাসনামলের শিক্ষার চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পণ্ডিতদের টোলভিত্তিক শিক্ষা চলছিল নিভুনিভু। এই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে মোঘল সম্রাট আকবর এগিয়ে আসেন। সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণদের তত্ত্বাবধানে উচ্চবর্ণের পড়াশোনা পূজাপার্বণ, ব্যাকরণ, ধর্মশাস্ত্র পর্যন্ত উন্নিত হলেও নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধরা রয়ে গেল অশিক্ষার অন্ধকারে। আকবরের অসাম্প্রদায়িক রাজ্যপরিচালনার মধ্যেও কিন্তু থেমে থাকেনি মন্দির ভাঙা, মন্দির দখল, দেবালয়ের মূর্তির শরীর থেকে লুটে নেয়া অলংকার। মন্দির এবং মূর্তি ভাঙার উৎসবের সময়ে উত্তর ভারতের গঙ্গা অববাহিকার হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান, দিল্লীর কোন অঞ্চলের মন্দির ভাঙা বাদ ছিল না। লুটতরাজও চলেছিল সমানতালে। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য কোন মন্দিরও গড়ে ওঠেনি। যে কয়জন মুসলিম আক্রমণকারী ভারতে আক্রমণ করেছিল তাদের মধ্যে গজনীর সুলতান মাহমুদ অন্যতম ভয়ংকর যোদ্ধা এবং লুটেরা খুনি। যদিও পাকিস্তানের পাঠ্যক্রমে, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আলোচনায় মাহমুদকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য উল্লেখযোগ্য বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সুলতান মাহমুদ গজনী:
সুলতান মাহমুদ গজনী ১১শতকের শুরুর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আক্রমণ শুরু করে তখন পরাক্রমশালী রাজপুতদের ক্ষমতা পড়তে শুরু করেছে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও চরমে। মাহমুদ প্রথমে কাবুল (বর্তমানে আফগানিস্তান), পাকিস্তান দখলে করে ভারতে প্রবেশ করে ১০০১ সালে। মুলতানে রাজা জয়পাল এবং তার ছেলে আনন্দ পাল মাহমুদের সাথে যুদ্ধ করলেও মাহমুদের দুর্বার গতির সৈন্যদলের কাছে তাদের সৈন্যদল খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। রাজপুতদের হস্তি-বাহিনীর সৈন্যদল মূলত মাহমুদের ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের গতির কাছেই হেরে যায়, কারণ মাহমুদের সৈন্যদলের অপ্রতিরোধ্য গতি। ১০০৯ থেকে ১০২৭ সালের মধ্যে মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে মাহমুদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আক্রমণ মাহমুদের প্রথম আক্রমণ ছিল খায়বার শহরে। সেখানে কয়েকটি দুর্গ দখল করে পছন্দের শাসকের হাতে অর্পণ করে আবার গজনীতে ফিরে যায়।
মাহমুদের দ্বিতীয় আক্রমণ ছিল ১০০১ সালে বর্তমানের পাকিস্তানের অন্তর্গত পেশোয়ারের তৎকালীন রাজা জয়পালের রাজ্যে। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রাজা জয়পাল হেরে যায় এবং মাহমুদ জয়পালের কাছ থেকে ২,৫০,০০০ দিনার এবং ৫০টি হাতি আদায় করে। ভারতীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি লেন পুল বলেন, “যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে জয়পাল নিজেই চিতায় আত্মাহুতি দেন।” জয়পালের স্থলাভিষিক্ত হন তার ছেলে আনন্দ পাল।
মাহমুদের তৃতীয়বার ভারত আক্রমণের সময়টা ছিল ১০০৫ সালে বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ভেরা অঞ্চলে। ভেরা তখন ছিল কাবুলের সাথে বাণিজ্যের প্রধান পথ। ভেরার রাজা বিজয় রায় বীরত্বের সাথে মাহমুদকে বাঁধা দিলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। বিজয় রায়ের সব প্রতিরোধ চূর্ণ করে মাহমুদ যখন রাজ্য দখল করে নিলো তখন অসম্মানের আত্মগ্লানিতে বিজয় রায় আত্মহত্যা করে। মাহমুদ পুরো ভেরা নগরটাকেই তছনছ করে দেয়, লুটে নেয় সব সম্পদ এবং নগরের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদেরকে নির্দয়-ভাবে হত্যা করে এবং শিশু ও নারীদেরকে দাস হিসেবে গজনী এবং খোরাসানে চালান করে দেয়।
১০০৫ এবং ১০০৬ সালের মধ্যে চতুর্থ আক্রমণে সুলতান মাহমুদ মুলতান দখল করে নেয়। তখন মুলতানের শাসক ছিল একজন আরব বংশোদ্ভূত ফতেহ দাউদ এবং জয়পালের দৌহিত্র জানুজা নামের দুজন সামন্ত রাজা। যুদ্ধে হেরে গিয়ে জানুজা প্রাণ বাঁচাতে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়।
ইসলাম গ্রহণ করলে সুলতান মাহমুদের আনুগত্যে জানুজা মুলতানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পায়। মুসলিম নাম ধারণ করে আফগানিস্তানের লাংমান থেকে কাশ্মীর, শিরহিন্দ, ফতেনগর, মুলতান এবং পেশোয়ার অঞ্চলে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাজ্য শাসন শুরু করে। একই সাথে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে সে ইসলাম ত্যাগ করে। জানুজার ইসলাম ত্যাগের খবর শুনে সুলতান মাহমুদ আবার তার রাজ্য আক্রমণ করে, পরাজিত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। হত্যাকাণ্ডের তীব্রতায় প্রাণের দায়ে নব্য-মুসলিম কেউ আর ইসলাম ত্যাগের সাহস করেনি।
১০০৮ থেকে ১০০৯ সালে পরিচালিত ষষ্ঠ আক্রমণে সুলতান মাহমুদ আনন্দ পাল এবং তার মিত্রবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যদুস্ত করে। আনন্দ পাল উজ্জয়নী, গোয়ালিয়র, কালিনজার, আজমিরের রাজাদের নিয়ে মিত্রবাহিনী গড়ে তোলে। ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্ট্যানলি পুল বলেন, আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীর সেনাদের সংগঠিত করে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নারীরা পর্যন্ত তাদের গহনা বেচে দিয়ে আনন্দ পালকে সাহায্য করেছিল। আনন্দ পালের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, মাহমুদ প্রায় ধরাশায়ী হয়ে এসেছিল এমন মুহূর্তে হঠাৎ করে আনন্দ পালের হাতি পাগলা হয়ে যায় এবং দিক্বিদিক দৌড়াতে শুরু করে, ফলে সেনাবাহিনী ভেবে বসে তাদের রাজা বুঝি ভয়ে যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করছে। অহেতুক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ভয় দানা বাঁধতে শুরু করে আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীর মধ্যে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে মিত্রবাহিনীর এক সেনানায়ক পদপিষ্ট হয়ে নিহত হয়। মাহমুদ বুঝতে পারে মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাতে শুরু করেছে। এই তো সময়, মাহমুদ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করে না। সে নব উদ্যোগে মিত্রবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুইদিন ধরে মাহমুদের বাহিনী আনন্দ পালের মিত্রবাহিনীকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এবং বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয় এবং অত্র এলাকার ধন সম্পত্তি, রত্ন সম্ভার লুটে নেয়। ১০০৯ সালে সপ্তম আক্রমণে সুলতান মাহমুদ হিমাচল প্রদেশের কাঙরা থেকে শুরু করে নেপালের নাগরকোট পর্যন্ত দখল করে নেয়। ইতিহাসবিদগণের মতে, নাগরকোট এবং কাঙরা লুট করে এত পরিমাণ মণিমাণিক্য, ধন, সম্পত্তি দখল করে নেয় যে তখনকার সময়ে মাহমুদ পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী সম্রাটে পরিণত হয়।
মাহমুদের মথুরা আক্রমণ: প্রায় সহস্রাধিক মন্দিরের সৌন্দর্যমণ্ডিত মথুরা শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য ভুবন বিখ্যাত। শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থভূমি। মাহমুদ নিজেই মথুরার বর্ণনা লিখেছিল, “বিশ্বের সবথেকে মেধাবী একদল স্থপতি যদি ২০০ বছর ধরে হাজার হাজার রাজমিস্ত্রি নিয়ে কোটি কোটি দিনারও ব্যয় করে তবুও মথুরার মন্দিরের মত এত সুন্দর স্থাপত্য কীর্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।” মথুরা জয় করে মাহমুদ বরাবরের মত মথুরার সব মন্দির লুট করে, মন্দিরের যাবতীয় প্রতিমা ভাংচুর করে এবং সবশেষে সবগুলো মন্দির ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। রুটিন মাফিক আক্রমণে মাহমুদ পরের বছর দ্বারকা, বারানসি, থানেশ্বর, জ্বালামুখী, মহেশ্বর দখল করে সবগুলো মন্দির লুট করে। হত্যা করে প্রতিরোধকারী সেনাবাহিনীকে।
মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণ: মূলত সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণ এবং ধ্বংস করার কারণেই ইসলামের ইতিহাসে মাহমুদ মহান বীর হিসেবে চিহ্নিত। স্ট্যানলি লেন পুলের মতে, “সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে মাহমুদ বিশাল যুদ্ধ বিজয়ী ইসলামি নায়কে পরিণত হয়”।
সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে মাহমুদ একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে মাহমুদের ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। মাহমুদ বুঝতে পেরেছিল, হাজার হাজার হিন্দু সোমনাথে পুজো দেবার সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ দক্ষিণা হিসেবে মন্দিরে দিতো। ফলে সোমনাথ মন্দির ছিল তৎকালীন সময়ে ধন-সম্পদ, সোনা, রত্নের বিশাল ভাণ্ডার। মাহমুদের ১৭তম আক্রমণ ছিল সোমনাথ মন্দিরে লুট করার উদ্দেশ্যে। রাজপুত সৈন্যবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও সোমনাথ মন্দিরের শেষ রক্ষা করতে পারে না। তিনদিন যুদ্ধের পর মাহমুদের বাহিনী মন্দিরে ঢুকে পড়ে, মন্দিরের সব মূর্তি এবং শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলে, সোনার মূর্তি, মূল্যবান পাথর, নগদ অর্থ, অলংকার যা ছিল সব নির্বিচারে লুট করে নিয়ে যায়, মূর্তি যেহেতু বিদআত তাই মাহমুদ সোনার মূর্তি গলিয়ে মাহমুদ তৎকালীন বাজার মূল্য ২ কোটি দিনার মুদ্রায় পরিণত করে। মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুটের সময় ৫০০০ রাজপুত সৈন্যকে মন্দিরের মধ্যেই হত্যা করে। দিল্লীর গার্গী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মীনাক্ষী জৈনের মতে, “মাহমুদের সোমনাথ মন্দির এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছিল যে ১০২৫ থেকে ১০৩৮ সাল পর্যন্ত এখানে কোন তীর্থ যাত্রী আসতে পারেনি। তুর্কি-পার্সিয়ান সাহিত্যে মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপিত হয়েছে।” মাহমুদের আক্রমণে সোমনাথ মন্দিরের নগরী সৌরাষ্ট্রে ৫০,০০০ মানুষের মৃতদেহের যে স্তূপ জমে উঠে তা সৎকার করার মত অবশিষ্ট লোক পর্যন্ত ছিল না।
মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফলাফল:১. পাঞ্জাব গজনী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
২. রাজপুতদের দুর্বলতা, রাজ্য রক্ষার অক্ষমতা প্রকাশ পায়।
৩. মাহমুদের ভারতে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের শাসনের পথ সুগম হয়।
৪. ভারতের বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তি গজনিতে পাচার হয়ে যায়।
৫. ভারতের শিল্পকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞানচর্চা, দার্শনিক আলোচনা, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার পঠন পাঠন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ধ্বংস হয়ে যায় অসংখ্য মন্দির, মন্দির-ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মঠ এবং গুরু-শিষ্যের পরম্পরা শিক্ষা ব্যবস্থা।
৬. ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারে মাহমুদের ভারতে আক্রমণের বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
৭. বারংবার আক্রমণের মুখে ভেঙে পড়েছিল ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অর্থনীতি।
৮. প্রতিটি আক্রমণে ভারত হারিয়েছিল হাজার হাজার সৈন্য। ফলে ভারত অরক্ষিত সম্পদের ভাণ্ডার। যেকেউ অতি সহজেই আক্রমণ করে লুটে নিয়ে যেতে পারত অর্থ, সম্পদ এবং বন্দী করে নিয়ে পারত নারী এবং শিশু, পরে তাদেরকে দাস হিসেবে বেচে দিতো। তৎকালীন হারেমগুলো ছিল যুদ্ধবন্দী ভারতীয় নারীদের হাহাকারের সমষ্টি।

মাহমুদের ভারত আক্রমণের কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদগণ বলেছেন মোটামুটি চারটি কারণে মাহমুদ ভারতে বারংবার আক্রমণ করেছিল।
সম্পদের লোভ: ধনসম্পত্তির প্রতি লোভ মাহমুদকে করে দুর্বিনীত, দুঃসাহসী। মাহমুদ শুনেছিল সমৃদ্ধ ভারতের কথা। সম্পদের প্রতি মাহমুদের অপরিসীম মোহ, সুতরাং সম্পদ লুট করতে সে ভারতে আক্রমণ করে। বিখ্যাত কবি ফেরদৌসির প্রতি দুর্ব্যবহারই প্রমাণ করে মাহমুদ কতটা লোভী। মাহমুদ কবি ফেরদৌসিকে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘শাহনামা’ লেখার শুরুতে প্রতিটি পঙক্তির জন্য একটা সোনার মোহর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে ৬০০০ পঙক্তি লিখে প্রতিশ্রুত ৬০০০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দাবী করলে মাহমুদ স্বর্ণমুদ্রা দিতে অস্বীকার করে। স্বর্ণমুদ্রার বদলে মাহমুদ কবি ফেরদৌসিকে ৬০০০ রূপার মুদ্রা দিতে চায়, কবি এই মুদ্রা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফেরদৌসির সাথে এহেন দুর্ব্যবহারের প্রসঙ্গে শিল্প ইতিহাস আলোচক আর্নেস্ট বিনফিল্ড হাভেল যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন, “মুসলিমদের পবিত্র নগরী বাগদাদের কোন মসজিদেও যদি সোমনাথ মন্দিরের মত এত বিপুল ধনসম্পত্তি থাকত তবে হয়ত লোভের বশে মাহমুদ সেটাও আক্রমণ করত”।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারস্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল জিওগ্রাফির প্রফেসর আদম মাহমুদ হাবিব বলেন, “ভারতের মন্দিরের ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন করাই ছিল সুলতান মাহমুদের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, ইউরোপের কোন চার্চে তেমন আক্রমণ হয়নি, কারণ সেখানে এত ধনসম্পত্তির ছড়াছড়ি ছিল না।”
ধর্মীয় কারণ: মাহমুদের সমসাময়িক ইতিহাসবিদ আবুল হুসাইন উতবি মন্তব্য করেন, “মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার করা”। মাহমুদ ভারতের হিন্দু মন্দির এবং দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি এবং ইসলামের প্রচার প্রসার করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। উতবি মাহমুদের ভারত আক্রমণকে জিহাদ হিসেবে উপস্থাপন করেন। মাহমুদ রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করেই ঘোষণা দেয়, সে প্রতি বছর একবার করে ভারত আক্রমণ করে ইসলামের রাজ্য সীমানা বৃদ্ধি করবে। যুদ্ধে হেরে যাওয়া বিধর্মীদেরকে মাহমুদ জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করত, ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করলে মৃত্যু অনিবার্য। লুটের টাকা দিয়ে মাহমুদ বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে এবং রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে ইসলাম প্রসারের জন্য মাহমুদ ভারতে আক্রমণ চালায়। মনে রাখতে হবে, নতুন ধর্মান্তরিত তুর্কি যুবকদের ইসলামের প্রতি আগ্রহ তখন তুঙ্গে, ইসলাম প্রচারের জন্য তারা জান বাজি রেখে লড়ছে, কারণ বেঁচে থাকলে সুন্দরী নারী ও নগদ অর্থ আর মরে গেলে সোজা বেহেস্ত, সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ৭২ জন হুর।
রাজনৈতিক কারণ ও খ্যাতির মোহ: মাহমুদ চেয়েছিল সে হবে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা যাতে তার কথা মানুষ চিরদিন মনে রাখে। কিছু কিছু ইতিহাসবিদগণ যুক্তি দেখিয়েছেন, মাহমুদের উদ্দেশ্য ছিল ভারত বিজয় করে সেখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু মাহমুদের ভারত আক্রমণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৭ বার সফলভাবে ভারত আক্রমণ করে বিজয় অর্জন করলেও এই অঞ্চলে স্থায়ী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি। যদিও মাহমুদ শুধু পাঞ্জাবকে গজনবী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। স্ট্যানলি লেন পুলের মতে, সেই সময় তুর্কিরা হয়ত ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের কথা চিন্তা করেনি। বলা হয়ে থাকে, উচ্চাভিলাষী মাহমুদের মনে সুপ্ত ইচ্ছা ছিল ভারত জয় করে বীরের খ্যাতি অর্জন করবে, ইসলামের ইতিহাসে তার চিরদিন লেখা হবে শ্রদ্ধার সাথে।
খ্যাতির মোহ: মাহমুদ প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের শুরুতে ভারত আক্রমণ শুরু করে। সুদৃশ্য ইমারতের প্রতি মাহমুদের খুব আগ্রহ ছিল বলে সে প্রতিবার আক্রমণ করে ইমারত নির্মাণের সুদক্ষ কারিগরদের খুঁজে খুঁজে বন্দী করে নিয়ে যেত। ইসলাম প্রচারের ঈমানি দায়িত্ব, সম্পদের লোভ, খ্যাতির মোহ ছাড়াও ইমারত নির্মাণের কারিগর ও দাস সংগ্রহও হতে পারে ভারত আক্রমণের অন্যতম কারণ।
ভারতে ইসলামের আগমন
মুহম্মদ বিন কাশিম এবং সুলতান মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে একের পর এক আক্রমণ করে স্থানীয় রাজাদের পরাজিত করার মাধ্যমে তাদের সেনাবাহিনী ধ্বংস করে প্রচুর ধন-সম্পত্তি লুট করে, নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বন্দী করলেও স্থায়ীভাবে রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেনি। অনেকসময় বিশ্বস্ত এবং মনোনীত শাসকদের হাতে সদ্যজয়কৃত রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে আবার ফিরে গেছে নিজেদের রাজ্যে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে তখন পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃত মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মুইজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ওরফে মুহম্মদ ঘুরি। বারবার হামলা এবং প্রতি-হামলা সহ্য করে মুহম্মদ ঘুরি এই অঞ্চলে শক্তিশালী বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাত এবং গজনী অঞ্চলের মধ্যবর্তী ছোট্ট একটা এলাকার নাম ঘর। ঘরের সামন্ত রাজা ছিল মুহম্মদ ঘুরির বাবা বাহাউদ্দিন সাম। বাহাউদ্দিন সামের দুই সন্তান; গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদ এবং অপরজন মুইজউদ্দিন মুহম্মদ। গিয়াসউদ্দিনের গজনী দখলের সময় খোরাসানের যুদ্ধে মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি বড়ভাইকে সাহায্য করে। মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক নেতা ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার মনে হতে থাকে এত ছোট রাজ্য তার জন্য নয়, ছোট্ট গজনীকে দুই ভাই ভাগে শাসন করে সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তার দরকার আরও ক্ষমতা, আরও বড় রাজ্য। তাই পুরো ভারত ভারতবর্ষ কীভাবে পদানত করা যায় সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়ে। সুতরাং যুদ্ধবিদ্যাটা ভালমতো শিখেই সে অভিযানে নেমে পড়ে। ঘুরি ১১৭৫ সালে বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান আক্রমণ করে, মুলতানের শাসক ইসলামের ইসমাইলি সম্প্রদায়ের মালিক খসরু্র ছেলেকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। মূলত মুলতান দখলের মধ্য দিয়েই তার রাজ্য বিস্তারের শুরু। মুলতান দখলের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে সিন্ধু অববাহিকার ছোট ছোট রাজ্যগুলো দখল করতে থাকে। ১১৭৮ সালে সিন্ধুর উচ রাজ্য দখল করে সেখানে একটা দুর্গ নির্মাণ করে। সিন্ধু থেকে মুহম্মদ ঘুরি গুজরাটে ঢুকার চেষ্টা করে। প্রাথমিকভাবে মুহম্মদ ঘুরি স্থানীয় রাজপুত যোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে, কারণ তখন পর্যন্ত রাজপুতরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, ভ্রাতৃ-ঘাতী আন্তঃ-কোন্দল তখনো ততটা তীব্রভাবে দানা বেঁধে ওঠেনি। গুজরাটের রাজপুত রাজা ভীমদেব সোলাঙ্কি গুজরাটের রাজধানী আনিলবারের কাছে কায়াদারার যুদ্ধে ঘুরিকে পরাজিত করে। কিন্তু যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা রাজপুতদের যুদ্ধের নিয়ম বিরুদ্ধ হওয়ায় মুহম্মদ ঘুরিকে জীবিত ছেড়ে দেয়। যুদ্ধে হেরে গেলেও মুহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী ফিরতি পথের দুপাশের মন্দির, গঞ্জ, নগর ধ্বংস এবং লুট করতে করতে গেছিল। কিন্তু কথায় আছে না, পরাজয়ে ডরে না বীর, ১১৭৯ সালে আরও একবার গুজরাট আক্রমণের চেষ্টা করলে গুজরাটের রাণী নাইকি দেবীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। গুজরাট দখলে ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মরুভূমি অতিক্রম করে আবার সিন্ধুতে ফিরে গেলেও তার অভিযান কিন্তু থেমে থাকেনি।
১১৭৯ সালে ঘুরি পেশোয়ার দখল করে নেয়। ১১৮২ সালের মধ্যে পুরো সিন্ধু অববাহিকার সবগুলো রাজ্য তার দখলে চলে আসে। সিন্ধুর পরে মুহম্মদ ঘুরির চোখ পড়ে পাঞ্জাব এবং লাহোরের উপর। মুহম্মদ ঘুরি ভারতের রাজনীতি, রাজায় রাজায় বিভক্তি, ধর্মীয় রীতিনীতি, হিন্দুদের জাতি-বিভাজন, সামাজিক এবং সামরিক শক্তি, দুর্বলতা, সম্ভাবনা এবং হুমকি সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ওয়াকিবহাল ছিল। সে জানত, ভারত ধন সম্পদে, সোনা, জহরতে যতটা পরিপূর্ণ প্রতিরক্ষায় ঠিক ততটাই দুর্বল। কারণ সে ইতিপূর্বে মুহম্মদ বিন কাশিম এবং সুলতান মাহমুদের বারংবার প্রায় প্রতিরোধহীন ভারত আক্রমণের কাহিনী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখত। রাজ্য দখল করে শুধু লুট করে নিজের দেশে ফেরত যাওয়া নয় মুহম্মদ ঘুরি পরিকল্পনা করল, রাজ্য জয় করে স্থানীয় বাসিন্দাদের ইসলাম কায়েম করে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবে। যেই চিন্তা সেই কাজ; সুতরাং আক্রমণ শুরু।
তারাইনের প্রথম যুদ্ধ: ১১৯১ সালে মুহম্মদ ঘুরি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যবর্তী খায়বার গিরিপথ অতিক্রম করে ভারত এবং বর্তমান পাকিস্তান সীমান্তের পাঞ্জাবে পৌঁছায়। পাঞ্জাব পৌঁছেই ঘুরি দিল্লী অভিযান শুরু করে এবং পাঞ্জাবের শিরহিন্দ দখল করে। পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজ্যের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের একটা শক্তিশালী দুর্গ দখল করে নেয়। কাজি জিয়া উদ্দিনের উপর দুর্গের ভারার্পণ করে গুজরাট অভিমুখে আগাতেই মুহম্মদ ঘুরি সংবাদ পেল যুবরাজ গোবিন্দ রাইয়ের নেতৃত্বে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সসৈন্যে দুর্গ পুনরুদ্ধারে দুর্গের তিনদিক থেকে ঘিরে ধরে। দুই সেনাবাহিনী থানেশ্বর (হরিয়ানা) থেকে ১৪ মাইল দূরে তারাইনে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। মুহম্মদ ঘুরির মামলুক সেনারা প্রথম তীর নিক্ষেপ শুরু করলে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনী সাহসিকতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করে এবং যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। পৃথ্বীরাজের ভাই গোবিন্দ রাইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরি মারাত্মকভাবে জখম হয়, গোবিন্দ নিজেও আহত হয়। শেষ পর্যন্ত পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনী চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে এবং ঘুরির সেনাবাহিনী রণে ক্ষান্ত দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে যুদ্ধে পরাজিত করলেও গোবিন্দ কিন্তু আক্রমণকারী পরাজিত সেনাদের হত্যা করে না। মারাত্মক আহত মুহম্মদ ঘুরিকে কুতুবউদ্দিন আইবেক ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দ্রুত যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে হেরে যাওয়ার মধ্যেই লিখিত আছে ঘুরির ভারত বিজয়ের ইতিহাস।
তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ: তারাইনের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মুহম্মদ ঘুরি অপমানে ফুঁসতে থাকে এবং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। সে প্রতিদিন আঁকতে থাকে ভারত আক্রমণের ছক। ভারতে চূড়ান্ত আক্রমণের লক্ষ্যে সে এবারে তুর্কি, আফগান, পার্সিয়ানদের সমন্বয়ে গঠন করে ১,২০,০০০ সৈন্যের বিশাল সেনাবাহিনী। ১১৯২ সালে মাত্র একবছরের মধ্যেই ঘুরি পুনরায় ভারত আক্রমণ করার জন্য মনঃস্থির করে। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় আক্রমণ করতে অনেকেই নিরুৎসাহিত করলেও তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরি অনেক পরিণত, সংগঠিত, শত্রুপক্ষের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য, শক্তিমত্তা জেনে আটঘাট বেঁধেই যুদ্ধের ময়দানে নামে। মুহম্মদ ঘুরির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর পরামর্শে শেষ রাতের দিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণে চৌহানের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে ঘোড়সওয়ারী তরোয়ালধারী দুর্ধর্ষ আফগান-তুর্কি সেনাদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ করতে করেই বিপুল সৈন্যক্ষয় হয়ে যায়। ঘোড়ায় চড়া তীরের মত গতিবেগের দুর্ধর্ষ সেনাদের রুখতে পারে না চৌহানবাহিনী। শেষ রাত থেকে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনী তখন ক্লান্ত, তাদের শেষ শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে, এদিকে যুদ্ধ চলছে একনাগাড়ে শেষরাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সেনাদের মাঝে সেনাপতি খাণ্ডে রাও মারা যাওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোবল ভগ্নপ্রায় এবং অবিন্যস্ত। এরকম ছত্রভঙ্গ সেনাদের উপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে দ্রুত গতির অশ্বারোহী অপ্রতিরোধ্য ১২০০০ আফগান সেনা। তাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তখন আসলেই পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনীর আর অবশিষ্ট ছিল না। তারা নিরুপায় বেঘোরে আফগানদের হাতে মারা পড়তে লাগল।
এদিকে যুদ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫০ জন ঊর্ধ্বতন সেনানায়ক এবং মিত্র রাজাদের নিয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহান একটা গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়ায়। তারা মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার আগেই তুর্কি আফগান বাহিনী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং একই সাথে চলতে থাকে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ, তখনই আসলে বেজে গেছে মরণঘন্টা। তুর্কি এবং আফগান যৌথবাহিনীর আক্রমণে রাজপুতরা নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে চৌহান রাজপ্রাসাদের দিকে পালানোর চেষ্টা করলেও ঘুরির হাতে বন্দী হয়ে যায়। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বন্দী করেই মুহম্মদ ঘুরি চলে যায় রাজপ্রাসাদে রাণী সংযুক্তার খোঁজে। তখন সম্ভ্রম রক্ষায় সংযুক্তা তার দাসীদের নিয়ে জহরব্রত করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও ততক্ষণে ঘুরি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যায় এবং তাকেও বন্দী করে নিয়ে আসে। বাইরে তখনো যুদ্ধ চলছে সমান তালে, এদিকে কিছুমাত্র সময় দেরী না করে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সামনেই তার প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তাকে ধর্ষণ করে ঘুরি। পৃথ্বীরাজকে ইসলাম কবুল করার জন্য চাপ দিতে থাকে ঘুরি। কিন্তু চৌহান রাজি হয় না। আর এদিকে চলতে থাকে সংযুক্তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ। বন্দী অবস্থায় চৌহান ঘুরিকে হুংকার দিলে ঘুরি চৌহানের চোখ অন্ধ করে দেয়। ১৫ দিন একনাগাড়ে সংযুক্তাকে ধর্ষণ করার পর ঘুরি চৌহানের শিরশ্ছেদ করে কাটা মাথাটা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে উপহার দেয়। চৌহানের কাটা মাথা দেখে, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কষ্টের পর অবশেষে আমরা চূড়ান্ত বিজয় পেলাম।”
ততদিনে ঘুরির সেনাবাহিনী রাজধানী অজয়মেরুর রাজপ্রাসাদ, কোষাগার, অস্ত্রাগার, টাকশাল, প্রতিটি নাগরিকের বাড়িঘর তছনছ করে, যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সামান্য যা প্রতিরোধ আসে সেটা আফগান, তুর্কি বাহিনীর সামনে শ্রেফ আত্মাহুতি দেয়া ছাড়া কিছুই নয়। নগরের সমস্ত সৈন্য নিহত হয় প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে। তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে অন্যতম হত্যাযজ্ঞ। মাত্র দশ ঘণ্টার ব্যবধানে তিন লাখ সৈন্যকে হত্যা করে ঘুরির সৈন্যদল। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি বলেন, “ঘুরির সেনাবাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে, বাদ যায় না যুবক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ। মাত্র দুইদিন স্থায়ী যুদ্ধে অজয়মেরু শহরের ২০ লাখ অধিবাসীকে হত্যা করা হয়, ৫ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়, নারী ও শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা হয় হারেমে যৌন বিনোদন এবং কৃতদাস হিসেবে বেচার জন্য। যে শহরটি এখন আজমির বলে পরিচিত সেটা ছিল তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী নগরী। তিব্বত, মধ্য এশিয়া এবং আরবীয়রা ব্যবসার কাজে এখানে আসত। বলা হয়ে থাকে, আজমির ছিল রোমের থেকে দ্বিগুণ আর বেইজিং থেকে তিনগুণ বড়। এখন মুসলিম অধ্যুষিত আজমির শহরে হিন্দুরাই সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে।” আজমির, দিল্লী দখলের কয়েকদিনের মধ্যেই মুহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী প্রায় বিনা প্রতিরোধে উত্তর ভারতের সরস্বতী, সামানা, কোরাম, হাসি দখল করে নেয়। রাজ্য দখলের সময় জোরালো বাঁধা না আসলেও হত্যা করা হয় প্রতিটি নগরের দ্বাররক্ষী, সমস্ত সৈন্য, এবং বিনা উস্কানিতে সাধারণ নাগরিকরাও হত্যা থেকে রেহাই পায়নি।
তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে ভারতে ৬০০ বছর স্থায়ী ইসলামী শাসনামলের শুরু। দিল্লী এবং আজমির মুহম্মদ ঘুরির দখলে আসার পরে একের পর এক রাজ্যের পতনের পালা শুরু। কনৌজের রাজা জয়চাঁদ রাঠোরের সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শত্রুতা ছিল। মুহম্মদ ঘুরি যখন পৃথ্বীরাজ চৌহানকে হত্যা করে তখন জয়চাঁদ রাঠোর উল্লাস প্রকাশ করেছিল। এখানে উল্লেখ্য পৃথ্বীরাজ চৌহান ছিল জয়চাঁদ রাঠোরের জামাতা। কিন্তু অপরিণামদর্শী রাজনীতি চিন্তার জয়চাঁদ রাঠোর চিন্তাও করতে পারেনই তার কন্যা ইতিমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে গেছে, জানতো না তার দিনও ঘনিয়ে আসছে। ১১৯৪ সালে ঘুরি কনৌজ আক্রমণ করে এবং চান্দাবারের যুদ্ধে জয়চাঁদ রাঠোরকে হত্যা করে। কনৌজ জয় করে মুহম্মদ ঘুরি কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে শাসনভার অর্পণ করে খোরাসান রণক্ষেত্রে চলে যায় বিদ্রোহ দমন করতে। কুতুবউদ্দিন আইবেক পুরো ভারত জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকে।
ফ্রান্সের সাংবাদিক Francois Gautier তার ‘Rewriting Indian History’ (1996) বইতে লিখেছেন, “মুসলিমদের তরোয়ালের আঘাতে দীর্ঘমেয়াদী চলমান ভারতের হিন্দু গণহত্যায় ঘুরির নেতৃত্বে আফগান, তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা যার কোন তুলনা হয় না। ঘুরির নেতৃত্বে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ হিন্দু জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার সঠিক পরিমাণ কোনদিন জানা সম্ভব হবে না। কারণ মুসলিম শাসকরা হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস হিন্দুদের লাশের সাথেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তবে গণহত্যা শুধু মানুষ হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং হিন্দুদেরকে গণ-ধর্মান্তরকরণ, মন্দির ধ্বংস, মন্দিরের মূর্তি বিনষ্ট, লুটপাট, ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদেরকে যেতে হয়েছে। মুসলিম-বাহিনী মন্দির লুটে নিয়ে, মন্দির ধ্বংস করে দিয়ে প্রথমেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হত্যা করত, তাদের স্ত্রী, কন্যাদের ধর্ষণ করে হারেমে পাঠিয়ে দিত বা দাস হিসেবে বেচে দিতো। রাজা, অমাত্য, মন্ত্রী, যুবরাজদের হত্যা করত সবার পরে। কিছু যুবরাজকে হত্যা না করে তাদেরকে খোজা করে দিয়ে হারেমের পাহারায় নিযুক্ত করত। বিশাল-সংখ্যক নারী সম্ভ্রম রক্ষা করতে বা যৌন-দাসী হওয়ার ভয়ে বিষপানে বা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
মুহম্মদ ঘুরির সাফল্যের পিছনে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর ভূমিকা: মুহম্মদ ঘুরির বিজয়ের পিছনে তার দক্ষ সেনাবাহিনী, রণকৌশল ছাড়াও সূফী সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর ভূমিকা অপরিসীম। মুহম্মদ ঘুরির আজমির আক্রমণের আগে থেকেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী সেখানে ইসলাম প্রচার করছিল। কিন্তু হিন্দু রাজার অধীনে তার ইসলাম প্রচার খুব বেশি সফল ছিল না। ফলে তার জন্য দরকার ছিল রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। তাই কৌশলে আজমিরের ধন সম্পদের প্রাচুর্য, পৃথ্বীরাজ চৌহানের সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তার সৌন্দর্যের কথা ঘুরির কাছে উপস্থাপন করে। পৃথ্বীরাজ চৌহান, জয়চাঁদ রাঠোরের কন্যা সংযুক্তাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে। ফলে রাঠোর এবং পৃথ্বীরাজের মাঝে শত্রুতা শুরু হয়। সেই শত্রুতাকে কাজে লাগায় খাজা মইনুদ্দিন চিশতী। চিশতী গুপ্তচরের মত গোপনে পৃথ্বীরাজের সৈন্যবল, শক্তিমত্তা, রণকৌশল, অস্ত্রসম্ভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর জোগাড় করে ঘুরিকে নিয়মিত জানাতে থাকে। চিশতীর মাধ্যমে ঘুরি জানতে পারে রাজপুতরা সূর্যাস্তের পরে আর যুদ্ধ করে না। সুতরাং এটা আক্রমণের মোক্ষম সময়। স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন, “চিশতীর পরামর্শেই শেষ রাতের আঁধারে ঘুরি ঘুমন্ত রাজপুত সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত চৌহানের সেনাবাহিনী আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায়। এদিকে মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করলে মইনুদ্দিন চিশতী রাজপুত-বাহিনীর পানির উৎসে বিষ মিশিয়ে দেয়”। বিজয়ীদের দ্বারা লিখিত ইতিহাসে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে একজন ধর্মপ্রচারক সূফী এবং দার্শনিক হিসেবে মহিমান্বিত করা হলেও বাস্তবে স্থানীয় হিন্দুদের জন্য সে লালন করত অপরিসীম ঘৃণা। ইতিহাসবিদ এস.এস.এ রিজভি ‘A History of Sufism in India’, Vol. 1 (Munshiram Manoharlal, 1978)’ লিখেছেন, “খাজা মইনুদ্দিন চিশতী কিছু মুসলিম অনুসারী নিয়ে আজমিরের অন্নসাগর দীঘির পাড়ে আস্তানা গাড়ে। দীঘির চারপাশ ঘিরে বেশ কয়েকটি মন্দির অবস্থিত। সেখানে সে নিয়মিত গরু জবাই দিয়ে মাংস রান্না করে খাওয়ার পর মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে গরুর হাড়, বর্জ্য ফেলে দিতো। আলী আজগর বিন শাইখ মাহমুদের “জওহর-ই-ফরিদি” বইতে উল্লেখ আছে, “হিন্দুদের পবিত্র গরু জবাইয়ের অভিযোগে পৃথ্বীরাজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে গ্রেফতারের জন্য সেনা পাঠালে সে কোনক্রমে পালিয়ে রক্ষা পায়। স্থানীয় হিন্দু নারীদের প্রতি তার যৌন লালসার কথা অবিদিত নয় কিন্তু ইসলামকে গৌরাবন্বিত করতে গিয়ে এবং ইসলামিক শাসকদের রক্তচক্ষুর ভয়ে সেসব কুকীর্তি চিরদিন থেকে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। মন্দিরের সেবায়ত নারীরা সেখানে স্নান করতে, জল আনতে গেলে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী প্রায়ই তাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। অন্নসাগর দীঘির পাড়ে কামদেবের মন্দিরে পুজো দিতে আসা পৃথ্বীরাজের অসাধারণ রূপসী স্ত্রী সংযুক্তাকে দেখে সে এতটাই কামার্ত হয়ে পড়ে যে নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে তাকে ধর্ষণ করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখায়।” পৃথ্বীরাজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে শিরশ্ছেদের জন্য সৈন্য পাঠালে এবারেও সে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে আজমির থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মূলত তখনই সে সংযুক্তার রূপ-যৌবনের প্রশংসা করে আজমির আক্রমণে প্রলুব্ধ করে মুহম্মদ ঘুরিকে চিঠি লেখে। সেই সাথে জানিয়ে দেয় আজমিরের বিপুল ধন সম্পত্তি ও পৃথ্বীরাজের রাজপ্রাসাদের অতুলনীয় নারীদের ভোগ করার সীমাহীন সম্ভাবনা।
মুহম্মদ ঘুরির সাফল্যের কারণ: ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি A Study of History বইতে লিখেছেন, “মুহম্মদ ঘুরির সৈন্যদল গঠিত হয়েছিল ইন্দাস এবং অক্সাস নদীর মধ্যবর্তী অববাহিকার পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের সমন্বয়ে যাদের জীবনযাত্রা ছিল সবসময় সংগ্রাম-মুখর এবং বিপদসংকুল। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ছিল শান্তিপ্রিয়, অপেক্ষাকৃত অলস ও বিলাসী, ফলে তারা স্বভাবতই যুদ্ধ-বিমুখ। তাদের যুদ্ধের কলাকৌশল আফগান বা তুর্কিদের মত উন্নত ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ নিত্যদিনের সঙ্গী। কোন রাজ্য আক্রান্ত হলে অন্য কেউ এগিয়ে আসত না।” যদিও যদুনাথ সরকার টয়েনবির বিরোধিতা করে বলেন, ভারতীয়দের যুদ্ধ কৌশল, বীরত্বের কোন ঘাটতি ছিল না। রাজপুত সম্প্রদায় তো অসীম সাহসী এবং যোদ্ধাজাতি ছিল। তবুও তাদের পতনের কারণ কী? যদুনাথ সরকারের মতে ভারতীয়দের সামাজিক কাঠামো তাদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। আরব, আফগান, পাঠান অথবা তুর্কি যে জাতির সৈন্য হোক না কেন, দাস বা মালিক, ত্বকের রঙ যাই হোক না কেন ইসলাম তাদেরকে দিয়েছে সাম্যতা। তিনটি অনন্য কারণে ঘুরির সৈন্যদল পৃথ্বীরাজ বাহিনী থেকে আলাদা।
১. সকল মুসলিম ভাই ভাই। সেখানে কোন জাতিভেদ নাই, বর্ণপ্রথা নাই। যুদ্ধের ময়দানে সবাই সবার বিপদে আপদে এগিয়ে আসে। তাদের মাঝে সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ়।
২. আল্লাহ এবং পরকালের উপর অটুট বিশ্বাস।
৩. ইসলামে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা মুসলিমদের বাঁচিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। প্রবল প্রতাপশালী রাজপুত, মারাঠাদের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ তাদের সুরাসক্তি।
ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো, সমরনীতি তুর্কিদের যুদ্ধে জিতিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সামন্ত রাজারা পারস্পারিক বিদ্বেষে এত মগ্ন ছিল যে বহিঃশত্রু পাশের রাষ্ট্র আক্রমণ করলে বরং তারা খুশি হতো। ছুতমার্গ ভারতের একটা ভয়াবহ সামাজিক ব্যধি। ছুতমার্গের কারণে একবর্ণের হিন্দু অন্য-বর্ণের হিন্দুদের সাথে মেলামেশা করতে পারত না, ফলে হিন্দুদের সেনাবাহিনীর দক্ষতা এবং একতা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘুরি অন্যায়ভাবে রাতের আঁধারে আক্রমণ করলে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। সকাল পর্যন্ত খাবার আসতে আসতে রাজপুত বাহিনী আগে জিজ্ঞেস করে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা খাবার রান্না হয়েছিল কিনা। রাজপুত বাহিনী অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও তারা ছিল রক্ষণশীল আর হাতিতে চড়ে তাদের গতিও ছিল অনেক ধীর। কিন্তু তুর্কি, আফগান বাহিনীর ঘোড়ায় চড়া গতি ছিল বিদ্যুতের বেগে। তুর্কি ও আফগান বাহিনীর যুদ্ধের নিয়মনীতি মেনে চলার দায় ছিল না, তারা আক্রমণকারী, অন্যায়ভাবে মানুষ মারতে তাদের দ্বিধা লাগে না, তাদের মৃত্যুর কোন ভয় নেই। যেকোনভাবে হোক শত্রুপক্ষের কেন্দ্রে গিয়ে আক্রমণ করা তাদের অন্যতম রণকৌশল। আজমির শহর ধ্বংস করা শেষ হতেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী দিলো সন্ধ্যার আযান। শব্দ লক্ষ্য করে ঘুরি আযানের উৎসে পৌঁছে গেল, সেখানে নামাজের জামাত প্রস্তুত। খাজা গরীবে নেওয়াজ মইনুদ্দিন চিশতীর ইমামতিতে মুহম্মদ ঘুরি দাঁড়িয়ে গেল মাগরিবের নামাজে।
Reference:
1. S.A. Rizvi in ‘A History of Sufism in India’, Vol. 1 (Munshiram Manoharlal, 1978)
2. Jawahar-i Faridi, written in 1033AH/1633 AD by Ali Asghar bin Shaikh Maudud of Fatehpur near Alllahabad, is another famous biographical work of the seventeenth century.
3. Medieval India: From Sultanat to the Mughals (1206–1526) by Satish Chandra .
4. A History of India By August Friedrich Rudolf Hoernle, Herbert Alick Stark
5. The Story of Civilization and The Case for India by Will Durant.
6. Rewriting Indian History (1996) by Francois Gautier
7. A Study of History by Arnold Joseph Toynbee
 মুহম্মদ ঘুরির সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক তার মালিক মুহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিল্লীতে মামলুক (দাস বংশের) শাসনামলের সূচনা করে। ছোটবেলায় দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া কুতুব উদ্দিন আইবেক ইরানের নিশাপুরের এক কাজির (বিচারক) কাছে বেড়ে ওঠে। কাজির কাছেই কুতুব উদ্দিন ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধবিদ্যা, তীর চালানো শিক্ষা লাভ করে। কাজির কাছ থেকে কুতুব উদ্দিনকে কিনে নেয় মুইজ উদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি। যুদ্ধের কৌশল আর বুদ্ধির জোরে কুতুব উদ্দিন, ঘুরির সেনাপ্রধান, সাহসী যোদ্ধা এবং ঘুরির বিশ্বস্ত সহচরে পরিণত হয়। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে কুতুব উদ্দিনের সাহসিকতা আর উপস্থিত বুদ্ধির কারণেই ঘুরি প্রাণে বেঁচে যায়। মুহম্মদ ঘুরি ভারত দখল করে কুতুব উদ্দিন আইবেকের কাছে রাজ্য শাসনের ভার দিয়ে খোরাসানে ফিরে যায় সেখানকার বিদ্রোহ দমন করতে। শাসনভার পেয়েই আইবেক রাজস্থানের শাকম্ভারীর চৌহান রাজবংশকে উৎখাত করে, রাজপুতদের নাম নিশানা মুছে দিয়ে চৌহান রাজের রাজধানী অজয়মেরুর নাম বদলে আজমির শরীফ নামকরণ করে। সেখানে খাজা নিজামউদ্দিন চিশতীর জন্য নির্মাণ করে খানকা শরীফ,, দরগা এবং মাদ্রাসা। কুতুব উদ্দিন ধীরে ধীরে গাহাদাবলা, চালুক্য, চান্ডেলা এবং আশেপাশের ছোটবড় রাজাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্যগুলো দখল করে নেয়। রাজস্থান থেকে ক্রমে ক্রমে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বারানসি, গঙ্গা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, কনৌজ তার দখলে চলে আসে।
কোন রাজ্য দখলই রক্তপাত ছাড়া সম্ভব না, কুতুব উদ্দিন আইবেকের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাজ্য বিস্তারের পরতে পরতে রক্তের প্রবাহ, স্থানীয়দের মৃতদেহের স্তূপ, পরাজিত সৈন্যদের হত্যার সময়ের আর্তনাদ, রক্তের ফোয়ারা, ধর্ষিত হয়েছে স্বামীহারা নারী ও পিতাহারা কিশোরী কন্যা আর কিশোর ও শিশুরা হয়েছে ধর্মান্তরিত শ্রমদাস। ধর্ষণের পর নারীদের স্থান হয়েছে সুলতানের হারেমে। পৃথ্বীরাজকে হত্যার পর মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজের রাজ্য শাসনের ভার দেয় কাওমুল মূলকের উপর। পৃথ্বীরাজের ভাই হরিরাজা কাওমুল মূলকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং রাথোম্বোর দুর্গ দখলের চেষ্টা করে। কুতুব উদ্দিন কঠোর হাতে হরিরাজার আক্রমণকে প্রতিহত করে। হরিরাজার সাথে আক্রমণে যোগ দেয়া একজন সেনাও সেদিন জীবিত ফেরত যেতে পারেনি।
কুতুব উদ্দিনের মূল কৃতিত্ব আসলে রাজ্য বিস্তারের থেকেও ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং ইসলামী স্থাপত্য নির্মাণের সূচনা করা। ইতিহাসবিদগণের হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক কমপক্ষে এক হাজার মন্দির ধ্বংস করে সেই ভিত্তির উপরেই নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করে। হিন্দুদের উপর ন্যক্কারজনক হত্যা, নিপীড়ন, তাদের মন্দির দখলের প্রক্রিয়া চলতেই থাকল শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ মদদে এবং ছত্রছায়ায়। দিল্লীর জামে মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে কোরআনের আয়াত লেখা সোনার পাতগুলো বানানো হয়েছে বিভিন্ন মন্দির থেকে লুট করা ২৭টি সোনার প্রতিমা গলিয়ে।
কুতুব উদ্দিন আইবেকের মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙার খ্যাতি অতীতের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তার সমসাময়িক বা পরেও মন্দির বা প্রতিমা ভাঙার ক্ষেত্রে তার ধারে কাছে কেউ নেই। ইরান, আফগানিস্তান থেকে দলে আসতে লাগল সুফি দরবেশ, ইসলামী পণ্ডিত। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় হিন্দুদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া চলতে লাগল সমানতালে। পরিস্থিতি কেমন ছিল, একটা উদাহরণ দিলে হয়ত একটু বোধগম্য হবে, কুতুব উদ্দিন আইবেক যখন কৈল/কালিঞ্জার (বর্তমান আলীগড়ে) পৌঁছায় তখন যেসব সৈন্য বুদ্ধিমান এবং ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিল তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করতে শুরু করে। আর যারা নিজেদের আবহমান কালধরে পিতৃপুরুষের প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের ছায়া তলে আসে না তারা চিরতরে তলোয়ারের ছায়াতলে চলে যায়। Kishori Saran Lal তার “Indian muslims: Who are they” বইতে কুতুব উদ্দিন আইবেকের প্রশংসা করে লেখা পারস্য থেকে আগত কবি ও লেখক হাসান নিজামির লেখা ইতিহাসের গ্রন্থ Taj-ul-Maasir’এর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃতি করেন, “those of the garrison who were wise and acute were converted to Islam, but those who stood by their ancient faith were slain with the sword.” Taj-ul-Maasir গ্রন্থে কবি হাসান নিজামি ইতিহাস লিখতে গিয়ে কাব্যিকভাবে কুতুব উদ্দিনের বীরত্ব তুলে ধরেন।
হাসান নিজামি লিখেছেন, ১১৯৩ সালে সদ্য জয় করা রাজ্য কালিঞ্জার (বর্তমান আলিগড়ে) হিন্দুদের বিদ্রোহ দমনের পর কুতুব উদ্দিন আইবেক কালিঞ্জারের হিন্দু প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মাথা কেটে তিনটে দুর্গ সমান স্তূপ করে, তাদের মাথা বিচ্ছিন্ন শরীর ফেলে রাখে বনে বাদাড়ে কুকুর শিয়ালের খাবারের ব্যবস্থা করতে। পুরো কালিঞ্জারে কোন মন্দির ভাঙা পড়তে বাকি ছিল না, পুরো এলাকা মূর্তি শূন্য করে করা হয়। ১১৯৪ সালে আইবেক দিল্লীতে ২৭টি মন্দির ধ্বংস করে। মন্দিরের ভাঙা ইট, সুরকি দিয়েই নির্মাণ করে ‘ক্বুয়াত-উল-ইসলাম’ (ইসলামের শক্তি) মসজিদ এবং ১১৯৫ সালে আইবেক এই মসজিদের উদ্বোধন করে। পারস্যের নিশাপুর থেকে আগত হাসান নিজামের লেখা ইতিহাসের জবানী থেকেই জানা যায়, কুতুব উদ্দিন আইবেক ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ নির্মাণ করে মন্দিরের লুট করা অর্থ রত্ন পাথর দিয়ে, মসজিদ নির্মাণের শ্রমিকরাও সদ্য বন্দী হওয়া হিন্দু দাস। ১১৯৫ সালে গুজরাটের সৌরাষ্ট্র এবং আজমির এলাকার ‘মার (Mehr) আদিবাসী গোত্র’ বিদ্রোহ করলে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে গুজরাটের চালুক্য রাজ্যের সেনাবাহিনী। মার বিদ্রোহ দমন করার জন্য কুতুব উদ্দিন আইবেক গজনী থেকে দ্রুত নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে আসে। ১১৯৬ সালে আইবেক গুজরাটের রাজধানী অনিলবার পাটানের দিকে ধাবিত হয় বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে নতুন উদ্যমে। রাজা কর্ণ যুদ্ধে পরাজিত হলে নিজামি লিখেছেন, “মার গোত্রের রাজা কর্ণ পরাজিত হয় এবং পালিয়ে যায়। মার গোত্রের ৫০ হাজার বিধর্মীকে একদিনেই তরোয়ালের আঘাতে দোযখে পাঠিয়ে দেয় কুতুব উদ্দিনের মামলুক বাহিনী। মার জনগোষ্ঠীর ২০ হাজারের অধিক মানুষকে বন্দী করে দাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য, অগণিত গবাদিপশু, ধনসম্পত্তি, লুটেরমাল চলে আসে বিজয়ীদের হাতে”। গজনী থেকে যুদ্ধ করতে আসা সেনাদের কেউ খালি হাতে ফেরেনি সেদিন। ধর্ষিত হয়েছিল অসংখ্য নারী, কিশোরী। বনে জঙ্গলে যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিল তারা সৌভাগ্যবান। পুরো অনিলবারা শহরে লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ চলে কয়েকদিন ধরে, প্রতিটি মন্দির ভাঙা হয়, প্রাসাদে লুট হয়। অনিলবারা শহর ধ্বংস করে আজমীর ফেরার পথে বিশালদেবা এলাকার সংস্কৃত টোল, মঠ, আশ্রম সব ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মামলুক সেনাবাহিনী। কুতুবের সেনাদল প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বিশালদেবা সংস্কৃত পাঠশালা নিশ্চিহ্ন করে সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করে কুতুব উদ্দিন এবং নাম দেয় Arhai din ka Jhonpra. ১২০২ সালে কালিঞ্জার বিজয় ছিল কুতুব উদ্দিনের ভারত বিজয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন। নিজামি তার লেখার সমাপ্তি টেনেছেন এই বলে যে, “কালিঞ্জার বিজয় করে কুতুব উদ্দিন সেখানের মন্দিরগুলোকে মসজিদে পরিণত করে, সেখান থেকে ৫০ হাজার দাসদাসী পাওয়া যায় এবং এই যুদ্ধজয়ে এত হিন্দু নিহত হয় যে কালিঞ্জারের সমতল মাটিও রক্তে ভিজে থকথকে কাদা হয়ে গিয়েছিল।”
কুতুব উদ্দিন আইবেক ১২০০ থেকে ১২১০ সালের মধ্যে গোয়ালিয়র, বুন্দেলখণ্ড, আজমির, রানথাম্ভর, অনিলবারা, মধ্যপ্রদেশ এবং মালবা দখল করে নেয়। গুজরাটের কাছেই নাহারবালা শহরে এক যুদ্ধে কুতুব উদ্দিন আইবেক একদিনেই ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। সেনাদের মাঝে লুটের অর্থ দান করে কুতুব বিশাল খ্যাতি অর্জন করে। জনশ্রুতি হয়ে গিয়েছিল যে, কুতুব উদ্দিন ‘লাখবাকস’ লাখ টাকা দানকারী উপাধি পায়, তেমনি একদিনে এত মানুষ হত্যা করে ‘লাখোহত্যাকারী’ খ্যাতিও অর্জন করে। ইরানের ইতিহাসবিদ ও লেখক Fakhr-i-Mudabbir লিখেছেন, যুদ্ধজয়ের পুরষ্কার হিসেবে কুতুব উদ্দিন আইবেক সেনাদের মাঝে বন্দী নারী শিশু বণ্টন করে দেয় ফলে একজন একেবারে মামুলি মুসলিম সেনাও রাতারাতি কয়েকজন দাসদাসীর মালিক হয়ে যায়।
কুতুব উদ্দিন আইবেক যুদ্ধজয়ের পর একটু থিতু হয়ে সুন্দর সুন্দর ইমারত, মসজিদ, মিনার নির্মাণে মনোযোগ দেয়। প্রথম সুলতান হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে বসে ভারতে মুসলিমদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দ্রুত স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি নতুন রাজ্যের স্থানীয় অধিবাসীদের মনে প্রভাব বিস্তার করাও তার নতুন দায়িত্বের মধ্যে চলে আসে। দৃশ্যত স্থাপত্যকলা হয়ে ওঠে মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনীর উৎকৃষ্ট মাধ্যম। কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকি নামের একজন ইসলাম প্রচারক সুফির নামে নির্মিত কুতুব মিনার বা ‘বিজয় স্তম্ভ’ মুসলিমদের ভারত বিজয়ের নিশানা। কুতুব মিনারের পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১৯৬ সালে, যদিও এটির নির্মাণ কাজ শেষ করে আইবেকের জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ। ইলতুতমিশ নিজেও তার শ্বশুরের মতই মিনার নির্মাণের খরচ নির্বাহ করে লুটের অর্থ দিয়ে আর শ্রমের জন্য তো যুদ্ধবন্দী দাস শ্রমিক ছিলই। দিল্লী, গুজরাটের আশেপাশের ২৭টি হিন্দু এবং জৈন মন্দির এবং রাজপ্রাসাদ থেকে লুট করা রত্নপাথর বিকৃতি ঘটিয়ে বা গলিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হয় কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজে। ক্ষেত্র বিশেষে লুটের চিহ্ন গোপন করতে মূল্যবান পাথর, মার্বেল শ্লেটকে উলটে বা গাঁথুনির ভিতরে ব্যবহার করা হয়। প্রায় ১৫০ বছর পরে মরক্কোর মুসলিম পর্যটক তার ভ্রমণকাহিনীতে কুতুব মিনার এবং ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কুতুব মিনারের পেঁচানো সিঁড়ি এতটাই প্রশস্ত যে একটা হাতি পর্যন্ত অনায়াসে উপরে উঠে যেতে পারবে। ইবনে বতুতার ক্বুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদের পর্যবেক্ষণ বেশ আকর্ষণীয়, তিনি লিখেছেন, “মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে রয়েছে পাথরের সাথে আটকানো দুটি বিশাল পিতলের মূর্তি, মসজিদে যারা আসে যায় তাদেরকে প্রতিবার পিতলের মূর্তি অতিক্রম করে যেতে হয় এবং সবার নজরে পড়ে। মসজিদের অন্যপাশেই রয়েছে একটা মূর্তির ঘর, বোঝা যাচ্ছে কিছুদিন আগেও এটা মন্দির ছিল। দিল্লী জয়ের পর কুতুব উদ্দিন আইবেক মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর করলেও মূর্তি বেরিয়ে পড়েছে।” ২৭টি মন্দির লুট করে পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়, সেটা দিয়েই মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয় এবং খোদাই করে ভারত বিজয়ের তারিখ আর বিজয়ীর নাম লেখা হয় মসজিদের পূর্বদিকের দরজায়। মন্দিরের মার্বেল শ্লেট, উল্টো করে গাঁথুনির প্রসঙ্গে ইতিহাসের অধ্যাপক Abu Mohammd Habibullah বলেন, এটা সুপরিকল্পিত না হলেও পুরো স্থাপত্যের মধ্যে মামলুকদের বিজয় ও শাসনের প্রতীক ফুটে উঠেছে।
মুইজ উদ্দিন মুহম্মদ ঘুরির সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক ১১৯১ সালে দিল্লী দখল করার পরে পৃথ্বীরাজ চৌহানের দুর্গ ‘রাই পিথোরা’কে মসজিদে রূপান্তর করে। দুর্গের ভিতরের মন্দির থেকে সব মূর্তি অপসারণ করা হয়। মন্দিরের ভিতরে, দেয়ালে, দরজায়, পিলারে যেসব দেবদেবীর টেরাকোটা, মূর্তি খোদাই করা ছিল সেগুলো শাবল দিয়ে খুঁচে তুলে ফেলা হয়। কিছুটা বিকৃত হয়ে গেলেও মন্দিরের মূল কাঠামো এখনো কোনভাবে টিকে আছে।
১১৯৫ সালে গুজরাটের একটা ছোট রাজ্য সোলাংকির রাজা ভীমকে আক্রমণ করে তার রাজ্য দখলে নেয় কুতুব উদ্দিন। সোলাংকি থেকে ২০ হাজার যুদ্ধবন্দী লাভ করে আইবেকের সেনাবাহিনী। সোলাংকির মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে, মূর্তি ভেঙে দিয়ে সেখানেও মসজিদ স্থাপন করা হয়। হাসান নিজামি লিখেছেন, “সেনাবাহিনী আটককৃত বন্দীদের উদ্দেশ্যে বলে, মূর্তিপূজা বন্ধ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। কালিঞ্জারের ৫০ হাজার বন্দীদেরকে দাস বানিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়, ফলে গুজরাট, কালিঞ্জার এলাকায় দ্রুত বেড়ে যায় মুসলিম জনসংখ্যা।”
আলি ইবনে আল-আসির (Ali ibn al-Athir) তার Al-Kāmil fī al-tārīkh ইংরেজিতে অনুদিত (The Complete History) ইতিহাস বইতে লিখেছেন, “কুতুব উদ্দিন আইবেক হিন্দ (ভারতের) রাজ্যগুলোর উপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সে হত্যা করেছে প্রচুর, সে রাজ্যগুলোকে দখল করে প্রতিবার ফিরে এসেছে অসংখ্য যুদ্ধবন্দী আর বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি নিয়ে বিজয়ীর বেশে। সে বেনারসে অগণিত হিন্দুকে জবাই করেছে, নারী ও শিশু ছাড়া ১৬ বছরের উপর কেউ রেহাই পায় নাই। যথারীতি নারী ও শিশুরা হয়ে গেছে দাসী-বান্দি, কারো কারো স্থান হয়েছে হারেমে।”
কিশোরী লাল শরণ Muslim slave system in medieval India বইতে কলিকাতা এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক Abu Mohammd Habibullah’র The Foundation of Muslim Rule in India বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “মুহম্মদ ঘুরির নেতৃত্বে তার সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দিন আইবেক ঝিলাম নদীর তীরবর্তী পাথুরের লবনাক্ত এলাকার খোখারস জনপদের উপর হামলা চালায়। অতর্কিত হামলা করে সেখানে তারা পুরুষদের হত্যা করে, জনপদ লুট করে অনেক সাধারণ মানুষকে বন্দী করে নিয়ে আসে।” মামলুক সাম্রাজ্যে এত দাসী হয়ে যায় যে প্রতিটি তুর্কির বাড়িতে রাতের খাবার পরিবেশন করার জন্য পাঁচজন দাসী চলে আসত। যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রচুর স্থানীয় মানুষকে খোরাসানে বেচে দেয় তারা, ফলে যুদ্ধ হয়ে ওঠে নতুন ব্যবসা”।
কুতুব উদ্দিন আইবেকের জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ ১২৩৩ সালে মালভা এবং উজ্জয়নি দখল করে মহাকাল মন্দিরটি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। সেখান থেকে রাজা বিক্রমজিতের ভাস্কর্য টানতে টানতে দিল্লীর মসজিদের সামনে নিয়ে আসে ভাঙচুর ও পদদলিত করার জন্য, ইতিহাস বইতে লেখা আছে মসজিদ-ই-আদিনা এবং দিল্লীর জামে মসজিদের নাম।
বেঁচে থাকা হিন্দুদের পড়ালেখা শেখার জন্য অবশিষ্ট ছিল না কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তারা দীর্ঘ দিন থেকে গেছে শিক্ষার আলোকের বাইরে। যেহেতু মন্দিরগুলোর আশেপাশেই ছিল সংস্কৃত পাঠশালা, টোল, আশ্রম সেহেতু পণ্ডিতদের কপাল পুড়েছে সবার আগে।
রেফারেন্স:
1. Dr. Murray Titus quoted from B.R. Ambedkar, Pakistan or The Partition of India (1946)
2. Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 8 and 10 (quoting A.B.M. Habibullah, The Foundation of Muslim Rule in India)
3. Lal, K. S. (1992). The legacy of Muslim rule in India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 7 (quoting Kamil-ut-Tawarikh, E and D, II, p. 250-1; Tarikh-i-Fakhruddin Mubarak Shah, p. 20.)
4. About antiquities of Delhi. Syed Ahmed Khan, Translated from the Urdu of Asaru’s-Sanadid, edited by Khaleeq Anjum, New Delhi, 1990. Vol. I, p. 305-16
5. Ibn Asir, Kamil-ut-Tawarikh, E.D., II, 250. quoted from Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5
6. Hasan Nizami, Taj-u-Maasir, E.D., II, 231. Farishtah, I, 62. quoted from Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5
7. Quoted from Lal, K. S. (1999). Theory and practice of Muslim state in India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 5 (quoting Gordon Sanderson, ‘Archaeology at the Qutb’, Archaeological Survey of India Report, 1912-13; Ibn Battutah)
8. Hasan Nizami, quoted from Goel, Sita Ram (2001). The story of Islamic imperialism in India. ISBN 9788185990231 Ch. 6
9. Shajara-yi ansāb by Fakhr-i Mudabbir,
10. The History of Civilization by Will Durant
11. The Foundation of Muslim Rule in India by Abu Mohammd Habibullah.





















No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ