তন্ত্র সাধনা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 July, 2020

তন্ত্র সাধনা

তন্ত্র সাধনা
বেদের ভুল অর্থের ফলস্বরুপঃ
শক্তি-সাধন / তন্ত্র-সাধনা
শক্তি-সাধনের এক গুহ্য রহস্যমার্গ হলো তন্ত্র বা তান্ত্রিক-সাধনা। ব্যাপকভাবে তন্ত্র শব্দ দ্বারা শাস্ত্রমাত্রকেই বুঝানো হয়ে থাকে। তাই সাংখ্যদর্শনের অপর নাম কপিলতন্ত্র বা ষষ্টিতন্ত্র; ন্যায়দর্শনের নাম গোতমতন্ত্র; বেদান্তদর্শনের নাম উত্তরতন্ত্র; মীমাংসা দর্শনের নাম পূর্বতন্ত্র। শঙ্করাচার্য বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদকে বৈনাশিকতন্ত্র নামে নির্দেশ করেছেন। প্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্রের উপাধি ছিল ‘সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র’। তবে উপাসনাবিশেষ-প্রতিপাদক শাস্ত্রবিশেষ অর্থেই তন্ত্র শব্দ সাধারণত প্রযুক্ত হয়ে থাকে এবং এ অর্থই সমধিক প্রসিদ্ধ।
বস্তুত তন্ত্রশাস্ত্র হলো সাধনার শাস্ত্র, যা অতি গুহ্য বিদ্যা। গুরুর উপদেশ ছাড়া এই শাস্ত্রের তত্ত্ব কেউ বুঝতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, ন্যায়, বৈশেষিক প্রভৃতি বিচার-শাস্ত্র লৌকিক বুদ্ধির গম্য, কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্র সেরকম নয়। গুরুর উপদেশ না পেলে এ বিদ্যায় একেবারেই প্রবেশ করা যায় না। যদিও বা কোন তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি শুধু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেই শাস্ত্রার্থ বুঝতে পারেন, তবুও শাস্ত্রবিহিত সাধনাতে তাঁর অধিকার আছে কিনা– এর বিচারক সিদ্ধ পুরুষ বা সৎগুরু। তাই ‘তন্ত্রতত্ত্ব’ গ্রন্থের অবতারণায় সাধক শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব বলছেন– ‘মন্ত্রময় তন্ত্রশাস্ত্র মন্দিরের অভ্যন্তর ভিন্ন প্রাঙ্গণে বাজিবার যন্ত্র নহে, সিদ্ধ-সাধকের হৃদয় ব্যতীত সভায় সমাজে আলোচনার বস্তু নহে।’ কুলার্ণবতন্ত্রেও বলা হচ্ছে–
ইয়ন্তু শাম্ভবী বিদ্যা গুপ্তা কুলবধূরিব।
অর্থাৎ : শিবশক্তির কথোপকথন হইতে অবতারিত এই বিদ্যা কুলবধূর ন্যায় গোপনে রক্ষিত হইবে।
অনধিকারীর নিকট এই বিদ্যা প্রকাশ করতে শাস্ত্রে গুরুগণকে বারবার নিষেধ করা হয়েছে। সাধক ব্যক্তি নিজের আচার ও উপাসনার ব্যাপার কোথাও প্রকাশ করবেন না। তাই শ্রী সুখময় ভট্টাচার্য শাস্ত্রী তাঁর ‘তন্ত্রপরিচয়’ গ্রন্থে বলেছেন– ‘একটি কথা গোড়াতেই স্মরণ রাখা প্রয়োজন। অধ্যয়নলব্ধ পাণ্ডিত্য আর সাধনা এক বস্তু নহে। বিশেষতঃ যশ এবং অর্থের লোভে যোগ-শাস্ত্র ও সাধন-শাস্ত্র বিষয়ে গবেষণা– ভারতীয় দৃষ্টিতে একপ্রকার ধৃষ্টতার মধ্যে গণ্য হইয়া থাকে।’ সুতরাং এই শাস্ত্রের তথ্য যথাযথভাবে পাওয়া ও দেওয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ ও অপ্রতুলতার বিষয়টি কৌতুহলী পাঠকমনে বিবেচনায় রাখা আবশ্যক মনে করি।
মোটামুটিভাবে বলতে গেলে, তন্ত্রের আলোচ্য বিষয় প্রধানত দুইটি– দর্শন ও ক্রিয়া। মূলত আলোচ্য বিষয়ের এরূপ বিভাগ-ভেদ অবলম্বন করেই কেউ কেউ তন্ত্রগ্রন্থের দুটি শ্রেণী নির্দেশ করেন– (১) যোগতন্ত্র (২) ক্রিয়াতন্ত্র। পণ্ডিত চিন্তাহরণ চক্রবর্তী বলেন–
‘তন্ত্র্রোক্ত উপাসনা আলোচনা করিলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথা, মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র, মুদ্রা, আসন, ন্যাস, দেবতার প্রতীকস্বরূপ বর্ণ-রেখাত্মক যন্ত্র্র, পূজায় মৎস্য, মাংস, মদ্য, মুদ্রা, মৈথুন– এই পঞ্চ মকারের ব্যবহার, কার্যে সিদ্ধিলাভের জন্য মারণ, উচাটন, বশীকরণ প্রভৃতি ষট্কর্মের আশ্রয়গ্রহণ এবং যোগানুষ্ঠান। অবশ্য কালক্রমে তন্ত্রোপাসনাকে পূর্ণাঙ্গ করিবার জন্য দশ সংস্কার, শ্রাদ্ধ, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি বৈদিক ক্রিয়াকলাপেরও তান্ত্রিক ভেদ কল্পিত হইয়াছিল।’– (নিবন্ধসংগ্রহ ১ . তন্ত্র, পৃষ্ঠা-১৪)
তন্ত্রোপাসনার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে যেসব তন্ত্রগ্রন্থ আমরা পাই, এগুলো যে-সময়কার লেখাই হোক-না কেন, এ অনুষ্ঠানগুলি অতি প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর নানা দেশের লোকের মধ্যে নানাভাবে চলে আসছে। অবশ্য ভারতে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের সাথে যে দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সমাবেশ করবার একটা চেষ্টা হয়েছিল, তার নিদর্শন বিভিন্ন দেশের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে না থাকলেও– তাদের মধ্যে প্রচলিত আচার যে তান্ত্রিকতার অতি প্রাচীনতা সূচিত করে, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। তন্ত্র্রের ষট্কর্মের ও কৌলাচারের অনুরূপ ক্রিয়া, উপাসনায় মদ্যাদির ব্যবহার, মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস– বিভিন্ন প্রাচীন জাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, প্রাক্তন ধর্মের এগুলোই ছিল আবশ্যিক অঙ্গ। তাছাড়া, অপরকে বশীভূত করবার জন্য বিভিন্ন কিয়াকলাপের অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালে বিশেষ রূপেই প্রচলিত ছিল। যেমন–
‘মোম অথবা তজ্জাতীয় কোনও দ্রব্যের দ্বারা ব্যক্তিবিশেষের প্রতিকৃতি প্রস্তুত করিয়া, ওই প্রতিকৃতিকে অভিমন্ত্রিত করা এবং শত্রুর অঙ্গাদি অথবা প্রাণ নষ্ট করিবার জন্য্য নখাদির দ্বারা ওই প্রতিকৃতিকে আহত করা অথবা অগ্নিতে দ্রবীভূত করার প্রথা সেমেটিক জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল [Thompson: Semitic Magic—Its Origin and Devolopment, পৃ. ২৪২-২৪৩]। কেহ কেহ অনুমান করেন, ইরানীয়দিগের মধ্যেও এইরূপ আচার বর্তমান ছিল [Journal of the Anthropological Society, Bombay, ৭ম খন্ড, পৃ. ৫৪৭ প্রভৃতি]।
উপাসনার অঙ্গরূপে ইন্দ্রিয়-পরতন্ত্র কার্যাবলীর উদাহরণও বিভিন্ন দেশে দেখিতে পাওয়া যায়। গ্রিস ও রোমে ‘পান’ পূজায় এইরূপ কার্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও কোনও দ্বীপে আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে স্ত্রী-সঙ্গাদি কার্য ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গরূপে বিবেচিত হয় [Brown: Sex-worship and Symbolism of Primitive Races, পৃ. ২৭-২৮]। এই ইন্দ্রিয়-পরতন্ত্রতা বা লিঙ্গ-পূজার চিহ্ন পরবর্তী যুগে নানা বেশে নানা ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় [Brown: Sex-worship and Symbolism of Primitive Races, পৃ. ২৩]। ওয়াল সাহেবের মতে সমস্ত ধর্মে গৌণ অথবা মুখ্য ভাবে লিঙ্গ-পূজার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় [Wall: Sex and Sex-worship, পৃ. ২]। নায়ক নায়িকার প্রেম ও রতিসুখ ভোগের বিস্তৃত বর্ণনাকে রূপক কল্পনা করিয়া ভগবদুপাসনার বিবরণ সুফী, বৈষ্ণব এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। নিজেকে স্ত্রীরূপে কল্পনা করিয়া ভগবদুপাসনার প্রথা তন্ত্রে ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়বিশেষের মধ্যে অজ্ঞাত ছিল না। ধর্মোৎকর্ষ লাভের জন্য মাদক দ্রব্যের ব্যবহারের উল্লেখও নানা দেশের আদিম অধিবাসীদিগের মধ্যে পাওয়া যায় [Tylor: Primitive Culture, vol. II, পৃ. ৪১০, ৪১৬ প্রভৃতি]।
সমস্ত দেশেই অভিচার-কার্যে আপাতত নিরর্থক শব্দ-সমষ্টির অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসের আতিশয্য দেখিতে পাওয়া যায়। বস্তুত, যে শব্দটি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য, তাহাই অধিক ফলদায়ক বলিয়া মনে করা হয়।’– (চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, নিবন্ধসংগ্রহ ১. মন্ত্র, পৃষ্ঠা-১৪-১৫)
ভারতে তান্ত্রিক আচার প্রবর্তনের বিষয়ে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, দ্রাবিড়াদি বিভিন্ন অনার্য জাতির মধ্যে তান্ত্রিকাচারের অনুরূপ আচার অতি প্রাচীনকালেই ভারতে এবং তার সমীপবর্তী দেশে প্রচলিত ছিল। তাদের নিকট থেকেই ভারতীয় আর্যগণ তা গ্রহণ করে নিয়মবদ্ধ করেছেন বলে পণ্ডিত চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর অভিমত। কোনও কোনও তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের প্রথম সূচনা প্রাগৈতিহাসিক যুগেই ভারতে পাওয়া যায়। চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ভাষ্য অনুযায়ী–
‘অধ্যাপক শ্যামশাস্ত্রীর মতে খ্রিস্টের জন্মের সহস্র বৎসর পূর্বেই ভারতে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায় [Indian Antiquary, 1906, পৃ. ২৭৪ প্রভৃতি]। খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর কতকগুলি ভারতীয় মুদ্রার উপর যে সমস্ত দুর্বোধ্য চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার মতে তাহা তান্ত্রিক যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নহে।
বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশেও তান্ত্রিকতার পূর্ব রূপ নিঃসন্দিগ্ধরূপেই পাওয়া যায়। তান্ত্রিকদিগের মতে সমস্ত তন্ত্রানুষ্ঠানই বৈদিক– বেদ হইতেই তন্ত্রের উৎপত্তি। এমনকী, বৈদিক মন্ত্রের মধ্যেই তান্ত্রিক বীজমন্ত্রাদি অনুস্যূত রহিয়াছে বলিয়া তাঁহারা মনে করেন। সাধারণ ধারণা এই যে, তন্ত্রমত অথর্ববেদের সৌভাগ্যকাণ্ড হইতে গৃহীত হইয়াছে। কোনও কোনও তন্ত্রগ্রন্থে এই বিষয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নেপাল দরবার লাইব্রেরির কালীকুলার্ণবতন্ত্র পুঁথির প্রথমেই আছে– ‘অথাত আথর্বণসংহিতায়াং দেব্যুবাচ’। রুদ্রযামলের ১৭শ পটলে মহাদেবীকে অথর্ববেদশাখিনী বলা হইয়াছে। দামোদর-কৃত যন্ত্রচিন্তামণি গ্রন্থের ভূমিকায় গ্রন্থ-প্রশংসা-প্রসঙ্গে উহাকে অথর্ববেদসারভূত বলা হইয়াছে। কুলার্ণবতন্ত্রে (২/১০) কৌলাচারেরও বৈদিকত্ব প্রতিপাদিত হইয়াছে। ওই গ্রন্থে (২/৮৫) কুলশাস্ত্রকে ‘বেদাত্মক’ বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে এবং কুলাচারের মূলীভূত কয়েকটি শ্রুতি উদ্ধৃত হইয়াছে (২/১৪০-১৪১)। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত শ্যামশাস্ত্রী দেখাইয়াছেন– তান্ত্রিক যন্ত্র ও চক্রের বর্ণনা অথর্ববেদ, তৈত্তিরীয়-আরণ্যক প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থে পাওয়া যায় [Indian Antiquary, 1906, পৃ. ২৬২-২৬৭]। সৌন্দর্য্যলহরীর ৩২শ শ্লোকের টীকায় লক্ষ্মীধর শ্রীবিদ্যার বৈদিকত্ব প্রতিপাদনের জন্য তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক হইতে শ্রুতি উদ্ধৃত করিয়াছেন।
সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য দৃষ্টিতে দেখিলেও বেদের মধ্যে তান্ত্রিকতার আভাস স্পষ্টতই অনুভূত হয়। ঐতরেয় আরণ্যকে (৪/২৭) তান্ত্রিকমন্ত্রের সম্পূর্ণ অনুরূপ একটি মন্ত্র পাওয়া যায়। সায়ণাচার্যের মতে ওই মন্ত্র অভিচার-কর্মে প্রযুক্ত হয়।’– (নিবন্ধসংগ্রহ ১. মন্ত্র, পৃষ্ঠা-১৫-১৬)
ধর্মার্থ ইন্দ্রিয়োপভোগের নিদর্শনও বেদের নানা অংশে পরিলক্ষিত হয়। শতপথ-ব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থে স্ত্রী-সঙ্গাদির একটা আধ্যাত্মিক ভাব দেখানোর চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বামদেব্য উপাসনার স্পষ্ট নির্দেশ, কোনও স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না। বর্তমান লেখকের ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে ‘বৈদিক সাহিত্যে বামাচার’ প্রসঙ্গে এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপনাসহ বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে শুধু তার দুয়েকটি নমুনা উদ্ধৃত করা হলো। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হচ্ছে–
‘এষাং বৈ ভূতানাং পৃথিবী রসঃ, পৃথিব্যা আপোহপাম্ ওষধয়, ওষধীনাং পুষ্পাণি, পুষ্পাণাং ফলানি, ফলানাং পুরুষঃ, পুরুষস্য রেত। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।। সহ প্রজাপতিরীক্ষাঞ্চক্রে হন্তাস্মৈ প্রতিষ্ঠাং কল্পয়ানীতি। স স্ত্রীয়ং সসৃজে। তাং সৃষ্টবাধ উপাস্ত; তস্মাৎ স্ত্রিয়মধ উপাসীত। স এতং প্রাঞ্চং গ্রাবাণমাত্মন এব সমুদপারয়ৎ। তেন এনাম অভ্যসৃজৎ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।। তস্যা বেদিরুপস্থো, লোমানি বহিশ্চর্মাধিষবণে, সমিদ্ধ্যো মধ্যতস্তৌ মুস্কৌ। স যাবান্ হ বৈ বাজপেয়ন যজমানস্য লোকে ভবতি, তাবানস্য লোকো ভবতি, য এবং বিদ্বান্ অধোপহাসং চরত্যাসাং স্ত্রিয়ঃ সুকৃতং বৃঞ্জতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।
অর্থাৎ :
যাবতীয় ভূতের রস এই পৃথিবী। জল পৃথিবীর রস। ওষধি লতা-পাতা জলের রস। ফুল ওষধির রস। ফল ফুলের রস। ফলের সার পুরুষ। রেতঃ বা জীববীজ পুরুষের রস বা নির্যাস। এইভাবে ক্রমানুসারে পুরুষদেহে এলো সৃষ্টির বীজ– বীর্য। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি সেই জীববীজকে দেখে চিন্তিত হলেন– এর উপযুক্ত আধার (পাত্র) কোথায়? অনেক ভেবে তিনি এর পাত্ররূপে সৃষ্টি করলেন নারীকে, স্ত্রীকে। সৃষ্টি করে, তিনি তাকে নিচে রেখে তার অধোদেশে মিলিত হয়ে মৈথুনকর্মের উপাসনা করেছিলেন। সেই কারণে, আজও পুরুষ স্ত্রীকে নিচে রেখেই তার অধোদেশে মৈথুনের উপাসনা করে আসছে। প্রজাপতি তাঁর সোমলতা পেষার পাষাণদণ্ড বা নোড়ার মতো সুকঠিন জননেন্দ্রিয় বা পুরুষাঙ্গ দিয়ে সেই স্ত্রী সংসর্গ করে তাকে গর্ভবতী করেছিলেন। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।। তার (স্ত্রীলোকটির) উপস্থ অর্থাৎ নিম্নাঙ্গ বা নিতম্ব হলো যজ্ঞের বেদী, তার লোমরাজি কুশ বা যজ্ঞ-তৃণ, তার চর্মাবরণ আশ্রয় বা অধিযবন (=সোমরস নিষ্কাশনের যন্ত্র), তার মধ্যস্থল প্রদীপ্ত অগ্নি, মুষ্কদ্বয় অর্থাৎ দুদিকের দুটি স্থূল মাংসপিন্ড হোমকুন্ডের দুদিকের দুই ফলক বা পাথরের আড়াল। বাজপেয় যজ্ঞ যারা করে তারা যে সুফল পায়, স্ত্রীর নিম্নাঙ্গকে যারা এইভাবে দেখে, তারাও সেই সুফল পায়। এটি জেনে যে ‘অধোপহাস’ অর্থাৎ মৈথুন কর্ম করে, সে স্ত্রী দ্বারা নিজে শক্তিমান হয়। আর যে এ তত্ত্ব না জেনে মৈথুন করে সে তার সুকৃতি স্ত্রীকে দেয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।
এ-রকম প্রকট বামাচারী চিন্তা কিন্তু উপনিষদে মাত্র একবারই উঁকি দেয়নি, ছান্দোগ্য উপনিষদেও দেখা যায় ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন–
যোষা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিদ্ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরর্চির্যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।। তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।
অর্থাৎ :
হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি। তার উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশ-ক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতিসম্ভোগই হলো বিস্ফুলিঙ্গ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।। দেবতারা এই অগ্নিতে রেত বা শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।
এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও হুবহু এ-কথারই প্রতিধ্বনি দেখা যায়–
‘যোষা বা অগ্নির্গৌতম। তস্যা উপস্থ এব সমিৎ, লোমানি ধূমো। যোনিরর্চিঃ। যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা, অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি। তস্যা আহুত্যৈ পুরুষঃ সংভবতি। স জীবতি যাবজ্জীবত। অথ যদা ম্রিয়তে। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অর্থাৎ :
গৌতম, যোষা অর্থাৎ স্ত্রী যজ্ঞের অগ্নি। তার উপস্থদেশ হলো সেই অগ্নির সমিধ বা ইন্ধন। (উপস্থদেশের) লোমরাজি হলো সেই ইন্ধনের ধোঁয়া। যোনিদেশ হলো সেই অগ্নির শিখা। মৈথুন হলো অঙ্গার। আর শীৎকারাদি যে ক্ষণিক পুলক শিহরণ, তা হচ্ছে সেই যজ্ঞাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। এই যজ্ঞাগ্নিতে দেবতারা সেই রেতঃ বা জীববীজ আহুতি দেন। তা থেকে উৎপন্ন হয় পুরুষ (প্রজাতি)। যতদিন প্রাণ থাকে, সেই সন্তান বেঁচে থাকে। তারপর মারা যায়। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপনিষদের অতি প্রসিদ্ধ ঋষিরাই মৈথুন-ক্রিয়াকে খোলাখুলিভাবেই যজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন। এবং কথায় কথায় সোমযাগ থেকে উপমা নেয়ার চেষ্টাটাও লক্ষ্য করবার মতো বলে দেবীপ্রসাদ তাঁর লোকায়ত দর্শন গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। আমাদের আধুনিক রুচিতে এ-সব কথাবার্তা যতোই কদর্য লাগুক না কেন (যেমন আধুনিককালের স্বামী লোকেশ্বরানন্দও তাঁর উপনিষদ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের ৫/৮/১-২ শ্রুতির বাংলা তর্জমা প্রায় গোটাটাই ফাঁকা রেখে এড়িয়ে গেছেন), উপনিষদের ঋষিরা এই তত্ত্বটির প্রতিই যে কতোখানি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান দিক থেকে। যেমন বৃহদারণ্যকের ঋষি এই তত্ত্ব বলবার পরই তিনজন প্রাচীন জ্ঞানীর নজির দেখিয়ে বলেছেন, বিদ্বান উদ্দালক আরুনি, বিদ্বান নাক মৌদ্গল্য ও বিদ্বান কুমারহারিত– এই তিনজনই নাকি এই তত্ত্ব জানতেন এবং সেই মর্মে উপদেশ দিয়েছেন। এবং এই তত্ত্বের অসাধারণ গুরুত্ব বিবেচনায় বৃহদারণ্যকের ঋষি আরো এগিয়ে উপদেশ প্রদান করতে করতে বলছেন–
এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ উদ্দালক আরুণিয়াহ, এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ নাকো মৌদ্গল্য আহৈতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ কুমারহারিত আহ-বহবো মর্যা ব্রহ্মণায়না নিরিন্দ্রিয়া বিসুকৃৎতোহস্মাল্লোকাৎ প্রষন্তি য ইদম্ অবিদ্বাংসোহধোপহাসং চরন্তীতি বহু বা ইদং সুপ্তস্য বা জাগ্রতো বা রেতঃ স্কন্দতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।। অথ যদ্ উদক আত্মানং পণ্যেৎ তদভিমন্ত্রয়েত-মরি তেজ ইন্দ্রিয়ং যশো দ্রবিণং সৃকৃতমিতি শ্রীর্হ বা এষা স্ত্রীণাং যন্মলোৎবাসাঃ তস্মাৎ মলোৎবাসসং যশস্বিনীম্ অভিক্রম্য উপমন্ত্রয়েতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।। সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমেনাম্ অবক্রীণীয়াৎ। সা চেদস্মৈ নৈব দদ্যাৎ কামমেনাং যষ্ট্যা বা পামিনা বোপহত্যা অতিক্রামেৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদদ ইতি। যশা এব ভবতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।। সা চেদস্মৈ দদ্যাৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদধামীতি যশাস্বিনৌ এব ভবতঃ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।। স যামিচ্ছেৎ কাময়েত মেতি তস্যাং অর্থং নিষ্ঠাং, মুখেন মুখং সন্ধ্যায় উপস্থমস্যা অভিমৃশ্য জপেৎ অঙ্গাদঙ্গাৎ সংভবসি, হৃদয়াৎ অধিজায়সে, স ত্বং অঙ্গকষায়োহসি দিগ্ধবিদ্ধামিব মাদয় ইমাম্ অমূং ময়ীতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।
অর্থাৎ :
(বাজপেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মতোই এই অধোপহাস অর্থাৎ মৈথুনকর্ম জেনে) বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, মুদ্গল-তনয় নাক ঋষি, কুমারহারিত বলেছিলেন– নামেমাত্র ব্রাহ্মণ, এমন অনেকে আছে যারা এই বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞান না জেনে স্ত্রীসংসর্গ এবং মৈথুনকর্ম করার ফলে বিকলেন্দ্রিয় হয়ে এবং সুকৃতি হারিয়ে মারা যায়। জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত, যে কোন অবস্থাতেই তাদের অনেক-অনেক বীর্যস্খলন ঘটে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।। যদি কেউ জলে স্খলিত বীর্য হয়ে নিজের ছায়া দেখে তবে সে নিজের মঙ্গলের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা জানাবে–‘ময়ি তেজ…সুকৃতম্’ অর্থাৎ আমার তেজ, ইন্দ্রিয়শক্তি, যশ, ধন, সৌভাগ্য দেবতারা আমায় দান করুন। যে নারী মলোদ্বাসা অর্থাৎ ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা। অতএব মলোদ্বাসা সেই সৌভাগ্যবতী নারীতে গর্ভাধান করার জন্য পুরুষ তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আহ্বান করবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।। যদি সেই নারী পুরুষকে কাম দিতে রাজী না হয়, তবে প্রথমে উপহার সামগ্রি দিয়ে তাকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করবে। যদি তাতেও সে সাড়া না দেয় তবে সেই স্ত্রীকে হাত বা লাঠি দিয়ে প্রহার করে অভিভূত করে বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ তে…আদদ’ অর্থাৎ আমার ইন্দ্রিয়শক্তিরূপ যশ দিয়ে আমি তোমার যশ কেড়ে নিচ্ছি। এই বলে তাতে উপগত হবে। তখন সেই নারী বশে আসতে বাধ্য হবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।। আর আহ্বান-মাত্রেই যদি সে স্ত্রী পুরুষের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য নিজেকে দান করতে চায়, বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ…আদধাম’– অর্থাৎ, আমার ইন্দ্রিয়রূপ যশ দিয়ে তোমাকে যশস্বী করছি। এতে নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যশস্বী হয়, সুখী হয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।। পুরুষ যদি নারীটিকে কামনাপরায়ণা করে তুলতে চায়, তবে সে স্ত্রী-অঙ্গে নিজের অর্থ অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ সংযোগ করে, মুখে মুখ রেখে বা মুখচুম্বন করে স্ত্রীর উপস্থ অর্থাৎ নিতম্ব ছুঁয়ে এই মন্ত্র জপ করবে–‘অঙ্গাদঙ্গাৎ…ময়ীতি’– অর্থাৎ, হে রেতঃ, তুমি উৎপন্ন হয়েছো আমার প্রতিটি অঙ্গ হতে, তোমার জন্ম আমার হৃদয়ে। তুমি আমার সর্বাঙ্গের রস। বাণবিদ্ধা হরিণীর-মতো তুমি এই নারীকে বিদ্ধ করো। রসসিক্তা করে একে আনন্দে অধীরা করে তোলো। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।
বলাই বাহুল্য, এ-ধরনের উপদেশ দিয়েও ঋষির গৌরব প্রাপ্ত তাঁদের রচিত গ্রন্থকে প্রাচীনেরা জ্ঞানের আকর বলেই মনে করেছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় মৈথুন ও কাম সম্বন্ধে আজকের দিনের ধারণার সঙ্গে সেকালের মানুষদের ধারণার একেবারে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কেননা, বামদেব্য-ব্রত সম্পর্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য-২/১৩) বলা হয়েছে–
‘উপমন্ত্রয়তে স হিঙ্কারো জ্ঞপয়তে স প্রস্তাবঃ স্ত্রিয়া সহ শেতে সঃ উদ্গীথঃ প্রতি স্ত্রীং সহ শেতে স প্রতিহারঃ কালং গচ্ছতি তন্নিধনং পারং গচ্ছতি তন্নিধনমেতদ্-বামদেব্যং মিথুনে প্রোতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
‘স য এবমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতং বেদ মিথুনীভবতি মিথুনান্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্-জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।
অর্থাৎ :
মৈথুনে লিপ্ত হওয়ার আগে যে পুরুষ স্ত্রীলোককে আহ্বান করে সেই হলো পঞ্চবিধ সামের প্রথম সাম ‘হিঙ্কার’। স্ত্রীর মনোরঞ্জন করা বা তাকে সন্তুষ্ট করা হলো দ্বিতীয় সাম ‘প্রস্তাব’। স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় শয়ন হলো ‘উদ্গীথ’। সঙ্গমের প্রাক-মুহূর্তে স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করা ‘প্রতিহার’। মিথুন-অবস্থায় থাকা হলো ‘নিধন’। আবার চরিতার্থতাও ‘নিধন’। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে জানে সে নিয়ত মিথুনে মিলিত হয়। (তার) প্রত্যেক মিথুন থেকেই প্রজার (সন্তানের) উৎপত্তি হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে নাÑ এই-ই ব্রত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।
অতএব, বামদেব্য ব্রতে- ‘মিথুনাৎ মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বম্ আয়ুঃ এতি জ্যোক্ জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা’– এই হলো আসল কথা। মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে? তালিকা হলো–
সন্তান পাওয়া যাবে।
পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে।
পশু পাওয়া যাবে।
মহান কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে।
এখানে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো, উপনিষদের ঋষি মৈথুনকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেরই উপায় মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ধন-উৎপাদনের উপায় বলেও বর্ণনা করছেন। উপনিষদের যুগেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানিই পশুপালনমূলক বলে আমরা জানি, তাই ধনউৎপাদন বলতে প্রধানতই পশুবৃদ্ধি। আর এই ধারণার দরুনই মিথুনকে এতোটা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে যে, উপনিষদের ঋষি মিথুনের বিভিন্ন স্তরকে যজ্ঞের হিঙ্কার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার প্রভৃতি পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে এক বলে বর্ণনা করছেন। শুধু তাই নয়, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’– কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, এই-ই ব্রত।
মাদক দ্রব্যের ব্যবহারের উল্লেখও বেদের মধ্যে একাধিক স্থলে দেখা যায়। সৌত্রামণিযজ্ঞে ইন্দ্র, সরস্বতী ও অশ্বিদ্বয়কে সুরা প্রদান করবার বিধান আছে। বাজপেয় যজ্ঞেরও বিধি এরূপ। যজ্ঞকার্যে বহুল ব্যবহৃত সোমরসের মাদকতা গুণের সবিশেষ বর্ণনা বৈদিক সাহিত্যে আছে [এক্ষেত্রে পূর্বোল্লিখিত ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের ‘পৃথিবী-স্থানের দেবতা…সোম’ প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য]। মাদকত্ব-দায়ী এ-জাতীয় বর্ণনা ঋগ্বেদে বারবার পাওয়া যায়। যেমন–
এষ স্য মদ্যো রসোহব চষ্টে দিবঃ শিশুঃ। য ইন্দুর্বারমাবিশৎ।। (ঋক-৯/৩৮/৫)।
ইযমূর্জং পবমানাভ্যর্ষসি শ্যেনো ন বংসু কলশেষু সীদসি।
ইন্দ্রায় মদ্বা মদ্যো মদঃ সুতো দিবো বিষ্টম্ভ উপমো বিচক্ষণঃ।। (ঋক-৯/৮৬/৩৫)।
পিবা সোমমিন্দ্র মন্দতু ত্বা যং তে সুষাব হর্যশ্বাদ্রিঃ।
সোতুর্বাহুভ্যাং সুয়তো নার্বা।। (ঋক-৭/২২/১)।
অর্থাৎ :
এ মদ্যরস সকল পদার্থ দর্শন করছে। তিনি স্বর্গের শিশু, এ সোম দশাপবিত্রে প্রবেশ করছেন। (ঋক-৯/৩৮/৫)।। হে সোম ! তুমি অন্ন ও পরাক্রম উৎপাদন কর। শ্যেনপক্ষী যেমন আপনার বাসায় বসে, তেমনি তুমি কলসের মধ্যে উপবেশন কর। তুমি নিষ্পীড়িত হয়ে ইন্দ্রের আনন্দ ও মত্ততা উপস্থিত কর, যেহেতু তুমি মাদকতাশক্তিসম্পন্ন। তুমি দ্যুলোকের সমযোগ্য স্তম্ভস্বরূপ, তুমি চতুর্দিক দৃষ্টি কর। (ঋক-৯/৮৬/৩৫)।। হে ইন্দ্র ! সোম পান কর, সোম তোমায় মত্ত করুক। হে হরি-নামক অশ্ববিশিষ্ট ইন্দ্র ! রশ্মিদ্বারা সংযত অশ্বের ন্যায় অভিষব-কর্তার হস্তদ্বয়ে পরিগৃহীত প্রস্তর, এ সোম অভিষব করছে। (ঋক-৭/২২/১)।।
তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে পশুবলির ন্যায় বৈদিক যজ্ঞে পশু নিহত করবার প্রথা ছিল। এ উপলক্ষে নর, অশ্ব, বৃষ, মেষ ও ছাগ বলি দেওয়ার বিধি ছিল। তাছাড়া তান্ত্রিক ষট্কর্মেরও কিছু কিছু পরিচয় বৈদিক যুগেও পাওয়া যায়। অথর্ববেদের অধিকাংশই এরূপ কার্যের বিবরণে পরিপূর্ণ। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে (১৪৫, ১৫৯ সূক্তে) সপত্নী-বিনাশন ও পতিবশীকরণের কথা আছে। যেমন–
ইমাং খনাম্যোষধিং বীরুধং বলবত্তমাম্ ।
যয়া সপত্নীং বাধতে যয়া সংবিন্দতে পতিম্ ।। (ঋক-১০/১৪৫/১)।
উত্তানপর্ণে সুভগে দেবজূতে সহস্বতি।
সপত্নীং মে পরা ধম পতিং মে কেবলং কুরু।। (ঋক-১০/১৪৫/২)।
উত্তরাহমুত্তর উত্তরেদুত্তরাভ্যঃ।
অথা সপত্নী যা মমাধরা সাধরাভ্যঃ।। (ঋক-১০/১৪৫/৩)।
নহ্যস্যা নাম গৃভ্ণামি নো অস্মিন্রমতে জনে।
পরামেব পরাবতং সপত্নীং গময়ামসি।। (ঋক-১০/১৪৫/৪)।
অহস্মমি সহমানাথ ত্বমসি সাসহিঃ।
উভে সহস্বতী ভূত্বী সপত্নীং মে সহাবহৈ।। (ঋক-১০/১৪৫/৫)।
উপ তেহধাং সহমানামভি ত্বাধাং সহীয়সা।
মামনু প্র তে মনো বৎসং গৌরিব ধাবতু পথা বারিব ধাবতু।। (ঋক-১০/১৪৫/৬)।
অর্থাৎ :
এই যে তীব্র শক্তিযুক্ত লতা, এ ওষধি, এ আমি খননপূর্বক উদ্ধৃত করছি, এ দ্বারা সপত্নীকে ক্লেশ দেওয়া যায়, এ দ্বারা স্বামীর প্রণয় লাভ করা যায়। (ঋক-১০/১৪৫/১)।। হে ওষধি! তোমার পত্র উন্নতমুখ, তুমি স্বামীর প্রিয় হবার উপায়স্বরূপ, দেবতারা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমার তেজ অতি তীব্র, তুমি আমার সপত্নীকে দূর করে দাও, যাতে আমার স্বামী আমারই বশীভূত থাকেন, তুমি তা করে দাও। (ঋক-১০/১৪৫/২)।। হে ওষধি! তুমি প্রধান, আমি যেন প্রধান হই, প্রধানের উপর প্রধান হই। আমার সপত্নী যেন নীচেরও নীচ হয়ে থাকে। (ঋক-১০/১৪৫/৩)।। সে সপত্নীর নাম পর্যন্ত আমি মুখে আনি না। সপত্নী সকলের অপ্রিয়, দূর অপেক্ষা আরও দূরে আমি সপত্নীকে পাঠিয়ে দিই। (ঋক-১০/১৪৫/৪)।। হে ওষধি! তোমার বিলক্ষণ ক্ষমতা, আমারও ক্ষমতা আছে, এস আমরা উভয়ে ক্ষমতাপন্ন হয়ে সপত্নীকে হীনবল করি। (ঋক-১০/১৪৫/৫)।। হে পতি! এ ক্ষমতাযুক্ত ওষধি তোমার শিরোভাগে রাখলাম। সে শক্তিযুক্ত উপাধান (বালিশ) তোমার মস্তকে দিতে দিলাম। যেমন গাভী বৎসের প্রতি ধাবিত হয়, যেমন জল নিম্নপথে ধাবিত হয়, তেমনি যেন তোমার মন আমার দিকে ধাবিত হয়। (ঋক-১০/১৪৫/৬)।।
উল্লেখ্য, এ সূক্তটি হলো সপত্নীদের উপর প্রভুত্বলাভের মন্ত্র। বলা বাহুল্য, বেদজ্ঞদের মতে এটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক সূক্ত। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, এই সূক্ত রচনার সময় বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল এবং সপত্নীদের মধ্যে বিশেষ বিদ্বেষভাব ছিল। বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্যে এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়-সংহিতার দ্বিতীয় কাণ্ডের তৃতীয় প্রপাঠকের নবম অনুবাকে (২/৩/৯/১) সাংগ্রহণী নামে এক ইষ্টির বিবরণ পাওয়া যায়। এই সাংগ্রহণী ইষ্টি ও তান্ত্রিক বশীকরণের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নাই। তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ (২/৩/১০) থেকে জানতে পারা যায়, প্রজাপতিদুহিতা সীতা সোমকে বশীভূত করবার জন্য আভিচারিক ক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
বৈদিক সাহিত্যের এসব তন্ত্রানুরূপ বশীকরণ ও আভিচারিক ক্রিয়ার দৃষ্টান্তের প্রেক্ষিতে তান্ত্রিক আচার্যরা তন্ত্রের প্রামাণ্য স্থাপনের জন্য এর বৈদিকত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদন করতে প্রচুর চেষ্টা করেছেন। তবে কোন কোন তন্ত্রে আবার বেদের প্রতি একটা বিরোধের ভাব পরিলক্ষিত হয়।
তন্ত্রের প্রামাণ্য
কোন শাস্ত্রেরই প্রামাণ্য বিষয়ে স্থির করে কিছু বলার উপায় নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রচনাকারেরা আপন রুচি ও বিশ্বাস অনুসারেই সিদ্ধান্ত প্রচার করে থাকেন। তাই হয়তো বলা হয়েছে– ‘ব্যাখ্যা বুদ্ধিবলাপেক্ষা’-(নৈষধীয়চরিত-১৭/৫০)। এ কথাটি সকলপ্রকার ভাষ্য, বার্তিক, টীকা, টিপ্পনী ও সমালোচনার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। তন্ত্রের প্রামাণ্য-বিচারেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।
চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ভাষ্যে– ‘তন্ত্রগ্রন্থ বা তান্ত্রিক আচার যত প্রাচীনই হউক-না কেন, ইহার প্রামাণিকতা সম্বন্ধে অতি প্রাচীনকাল হইতেই বিভিন্ন মতের অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। তান্ত্রিক আচার্যগণ ইহার প্রামাণ্য স্থাপনের জন্য ইহার বৈদিকত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদন করিতে প্রচুর চেষ্টা করিয়াছেন। কেবল তন্ত্রের প্রামাণিকতা আলোচনার জন্যই একাধিক গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে যামুনাচার্য্য-কৃত ‘তন্ত্রপ্রামাণ্য’, বেদোত্তম-কৃত ‘পাঞ্চরাত্রপ্রামাণ্য’, বেদান্ত-দেশিকাচার্য্য-কৃত ‘পাঞ্চরাত্র-রক্ষা’ ও ভট্টোজি দীক্ষিত-কৃত ‘তন্ত্রাধিকারিনির্ণয়’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহা ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থমধ্যে প্রসঙ্গক্রমে ভাস্কররায়, লক্ষ্মীধর প্রমুখ এই বিষয়ের আলোচনা করিয়াছেন। এই আলোচনার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য স্থাপন করিয়া অপর সম্প্রদায়গুলিকে অপ্রমাণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। তাই পাঞ্চরাত্রগ্রন্থে শাক্তের নিন্দা ও শাক্তগ্রন্থে পাঞ্চরাত্র-নিন্দা বহুল পরিমাণে দেখিতে পাওয়া যায়। এক সম্প্রদায়ের গ্রন্থের মধ্যেও আবার তদন্তর্গত উপ-সম্প্রদায় ও শাখার নিন্দা প্রচুর পরিমাণে করা হইয়াছে। কৌলমার্গাবলম্বিগণ সময়মার্গের, সময়মার্গাবলম্বিগণ কৌলমার্গের, পশ্বাচারিগণ কুলাচারীগণের, কুলাচারীগণ পশ্বাচারিগণের ভূয়োভূয়ো নিন্দা করিয়াছেন।
এইরূপ নিন্দার সূচনা আমরা প্রাচীন গ্রন্থেই দেখিতে পাই। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে যে স্থলেই তান্ত্রিক আচার সদৃশ আচার উল্লিখিত হইয়াছে, সে স্থলেই ইহা যে নিন্দনীয়, তাহা প্রতিপাদন করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। বৌদ্ধগ্রন্থে অনেক স্থলে ইহা দুক্কত বা দুষ্কৃত নামে অভিহিত হইয়াছে।… পুরাণে, এমনকী, কোনও কোনও তন্ত্রেও স্পষ্টতই তন্ত্রের নিন্দাবাদ উৎঘোষিত হইয়াছে।’– (নিবন্ধসংগ্রহ ১. তন্ত্র, পৃষ্ঠা-২০-২১)
এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের দোষোদ্ঘাটনের সময় তার অর্বাচীনত্ব প্রতিপাদন করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। পাঞ্চরাত্রপ্রামাণ্য গ্রন্থে বেদোত্তম স্পষ্টতই বলছেন–
‘কেনচিদর্বাকৃতনেন ক্ষেত্রজ্ঞেন মহেশ্বরসমাননাম্না ত্রয়ীমার্গবহিষ্কৃতেয়ং প্রক্রিয়া বিরচিতা। তন্নামসামান্যেন কেচিদ্ ভ্রান্তা মহেশ্বরোপদিষ্টমার্গমবলম্বিতবন্তঃ’– (পাঞ্চরাত্র-প্রামাণ্য)
অর্থাৎ, মহেশ্বর নামে অর্বাচীন এক ব্যক্তি বেদ-বিরুদ্ধ তন্ত্রমার্গ প্রচার করে। নামসাদৃশ্য দেখে কেউ কেউ ভ্রমে তাকেই মহাদেব-প্রণীত মনে করে ওই মার্গ অবলম্বন করেছে।
আবার যামুনার্য্য তাঁর তন্ত্র-প্রামাণ্য গ্রন্থে পাঞ্চরাত্র-বিরোধীদের মত উপস্থাপন করবার সময় একই পদ্ধতিতে বলেছেন–
বাসুদেবাভিধানেন কেনচিদ্ বিপ্রলিপ্সুনা।
প্রণীতং প্রস্তুতং তন্ত্রমিতি নিশ্চিনুমো বয়ম্ ।।– (তন্ত্র-প্রামাণ্য)
অর্থাৎ: বাসুদেব নামে এক প্রবঞ্চক ব্যক্তি এই তন্ত্রশাস্ত্র প্রণয়ন করেছে।
সৌন্দর্য্য-লহরীর টীকায় লক্ষ্মীধর কৌলমার্গকে স্পষ্টই অবৈদিক বলে উল্লেখ করেছেন। ভৈরবডামরের মতে– ‘আপাতত সুগমরূপে প্রতীয়মান তন্ত্র দুষ্টদিগের প্রতারণার জন্য প্রণীত হইয়াছিল’– ‘দুষ্টানাং মোহনার্থায় সুগমং তন্ত্রমীরিতম্’। –(ভৈরবডামর, উত্তরভাগ)
যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির টীকাকার অপরার্ক একটি বচন উদ্ধৃত করেছেন, তাতে– ‘তন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে বৈদিক শ্রাদ্ধাদি নিষিদ্ধ’ হয়েছে– ‘দীক্ষিতস্য চ বেদোক্তং শ্রাদ্ধকর্ম্মাতিগর্হিতম্’– (যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতা)। এবং অপরার্ক-ধৃত অন্য এক স্মৃতিবাক্য অনুসারে–
কাপালিকাঃ পাশুপতাঃ শৈবাশ্চ সহ কারুকৈঃ।
দৃষ্টাশ্চেদ্ রষিমীক্ষেত স্পৃষ্টাশ্চেৎ স্নানমাচরেৎ।।
অর্থাৎ : কাপালিক, পাশুপত ও শৈবদিগকে দেখিলেই সূর্য্য-দর্শনরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে এবং স্পর্শ করিলে স্নান করিতে হইবে।
এরূপ তন্ত্রনিন্দার কারণ অনুসন্ধান করলে, মনে হয়, তন্ত্রের কতকগুলো আচার, ধর্ম ও নীতিবিষয়ে সর্ববাদিসম্মত ধারণার বিশেষ বিরোধী হয়ে উঠেছিল। বিশেষত, সাধারণ লোক তন্ত্রোপাসনাকে সাধনার চরমপন্থা মনে না করে ইন্দ্রিয়োপভোগের প্রকৃষ্ট উপায় ও সিদ্ধিলাভের সুসাধ্য সাধনরূপে মনে করে তার উচ্চ আদর্শ বিস্মৃত হয়। যে তন্ত্রানুষ্ঠানকে কুলার্ণবতন্ত্রে অতি কঠিন নির্দেশ করে বলা হয়েছে– তন্ত্রানুষ্ঠান অপেক্ষা ক্ষুরধারাশয়ন ও ব্যাঘ্রকণ্ঠাবলম্বন করাও অনেক সহজ, সেই অনুষ্ঠানকেই কালক্রমে সাধারণ লোকে হয়তো অতি সুসাধ্য বলে মনে করে নিলো। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কবিরাজ রাজশেখর-রচিত ‘কর্পূরমঞ্জরী’ নাটকে তারই প্রতিফলন দেখা যায় এভাবে–
রণ্ডা চণ্ডা দিকখিয়া ধম্মদারা
মজ্জং মাংসং পিজ্জএ খজ্জএ অ।
ভিকখা ভোজ্জং চম্মখন্ডং চ সেজ্জা
কোলো ধম্মো কস্স নো ভাদি রম্মো।।– (কর্পূরমঞ্জরী-১/২৩)
অর্থাৎ, যে ধর্ম্ম অনুসরণ করিলে মদ্য-মাংস উপভোগ করা চলে, সেই কৌলধর্ম্ম কাহার নিকটই বা রমণীয় বলিয়া প্রতিভাত হয় না?মুক্তিং ভণন্তি হরিবহ্মমুহা হি দেআ
ঝানেন বেঅপঠনেন কদুক্কিআএ।
এক্কেণ কেবলমুমাদইএণ দিটঠো
মোকখো সমং সুরঅকেলিসুরারসেহিং।।– (কর্পূরমঞ্জরী-১/২৪)
অর্থাৎ, হরি, ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারা বলেন– মুক্তি পাওয়া যায় ধ্যান, বেদপাঠ ও যজ্ঞানুষ্ঠানের দ্বারা। কেবল উমানাথ মহেশ্বর সুরতকেলি ও মদ্যপানের সাহায্যে মোক্ষলাভের উপায় দর্শন করিয়াছেন।
চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ভাষ্যে– ‘জৈনদিগের ভরটকদ্বাত্রিংশিকা নামক গ্রন্থে পরম শৈব ক্ষেমেন্দ্রের নর্ম্মমালায় ও মাধবাচার্য্য-কৃত শঙ্করবিজয়ের পঞ্চদশাধ্যায়ে তান্ত্রিকদিগের অধঃপাতের চরম সীমার চিত্র প্রদর্শিত হইয়াছে। চৈতন্য-সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গ্রন্থে শাক্তদিগের চরিত্র মসীবর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে অতিরঞ্জন থাকিতে পারে, কিন্তু এ চিত্রকে একেবারে অসত্য বলিয়া উপেক্ষা করিবার উপায় নাই।’– (নিবন্ধসংগ্রহ ১. তন্ত্র, পৃষ্ঠা-২০-২১)
উপেক্ষার যে উপায় নেই, তার কারণ হয়তো অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের নিম্নরূপ বক্তব্য। এরকম বক্তব্যের অভাব নেই। তবে সত্য-অসত্য বিষয়টা যে আপেক্ষিক অবস্থানের এক রহস্যময় বিভ্রম, তা বিবেচনায় নিয়েই আমরা নমুনা উদ্ধৃতিগুলো দেখে নিতে পারি–
ন কষ্টকল্পনাং কুর্য্যান্নোপবাসং ন চ ক্রিয়াম্ ।
ন চাপি বন্দয়েদ্দেবান্ কাষ্ঠপাষাণমৃন্ময়ান্ ।।
পূজামস্যৈব কায়স্য কুর্য্যান্নিত্যং সমাহিতঃ।।– (অদ্বয়সিদ্ধি)
অর্থাৎ, উপবাসাদি ক্লেশ করিবে না– কাষ্ঠ-পাষাণ-মৃন্ময় দেববিগ্রহের পূজা করিবে না– কেবল এই দেহের তৃপ্তি বিধান করিবে।সম্ভোগার্থমিদং সর্ব্বং ত্রৈধাতুকমশেষতঃ।
নির্ম্মিতং বজ্রনাথেন সাধকানাং হিতায় চ।।
অর্থাৎ, বজ্রনাথ সাধকের উপভোগ ও মঙ্গলের জন্যই সমস্ত দ্রব্য সৃষ্টি করিয়াছেন।সুখেন প্রাপ্যতে বোধিঃ সুখং ন স্ত্রীবিয়োগতঃ।– (একল্লবীরচন্ড-মহারোষণতন্ত্র)
অর্থাৎ, সুখের মধ্য দিয়া বোধি লাভ করা যায় এবং সুখ স্ত্রী-সঙ্গ ব্যতিরেকে হয় না।দুষ্করৈর্নিয়মৈস্তীব্রৈঃ সেব্যমানৈর্ন সিধ্যতি।
সর্ব কামোপভোগৈশ্চ সেবয়ংশ্চাশু সিধ্যতি।।– (তথাগতগুহ্যক)
অর্থাৎ, কঠোর নিয়মের অনুষ্ঠানের দ্বারা সিদ্ধিলাভ হয় না– সকল কামোপভোগের দ্বারাই মানব আশু সিদ্ধিলাভ করে।
বক্তব্যগুলোর গূঢ়ার্থ যা-ই হোক, এসব মতবাদের আপাত-প্রতীয়মান অর্থ ও সে অনুযায়ী আচারসমূহ তন্ত্র সম্বন্ধে অনেকের মনে একটা বিতৃষ্ণার ভাব জাগিয়ে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। তান্ত্রিক আচার্যগণও তন্ত্রপ্রামাণ্য স্থাপনের চেষ্টায় তন্ত্রের সমস্ত আচারই যে সমর্থন করেছেন, তা নয়। বস্তুত, ভাস্করাচার্য্য প্রভৃতি তান্ত্রিকচূড়ামণিগণকেও সদাগম ও অসদাগম, বৈদিক তন্ত্র ও অবৈদিক তন্ত্র, এই দুই ভাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাঁদের মতে এ সমস্ত নিন্দা অসদাগম বা অবৈদিক তন্ত্র সম্বন্ধেই প্রযোজ্য– সদাগম সম্বন্ধে নয়। আর তাই বোধ হয়, তন্ত্রের এতো নিন্দাবাদ প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও আজ ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ তান্ত্রিকভাবে অনুপ্রাণিত।
‘তন্ত্রের যে সমস্ত আচার দোষ-দুষ্ট নয়, বর্তমানে বৈদিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যেও তাহাদের আংশিক অন্তর্ভাব হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায়। তাই বঙ্গদেশে বিবাহাদি বৈদিক সংস্কারের মধ্যে গৌর্য্যাদিষোড়শ-মাতৃকা পূজাদি তান্ত্রিক কার্য্যরে অনুষ্ঠান দেখিতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত পূজার মধ্যেই বীজমন্ত্রাদি ও ন্যাস প্রভৃতি তান্ত্রিক প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। উপনীত ব্রাহ্মণকেও তান্ত্রিক দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া শুদ্ধ ও পবিত্র হইতে হয়। তান্ত্রিক ইষ্টদেবতার মন্ত্র বৈদিক গায়ত্রী অপেক্ষা অধিক সম্মানিত হয়। বিভিন্ন গ্রাম্য দেবতার পূজায় তন্ত্রের প্রভাব সবিশেষ আলোচনার বিষয়। এই গ্রাম্য দেবতাদিগের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, অনেক স্থলে ব্রাহ্মণ্য-সম্প্রদায়-বহির্ভূত দেবতাগণ তান্ত্রিকভাব ধারণ করিয়া ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। কোথাও তন্ত্র সাহায্যে নূতন নূতন দেবতার কল্পনা করা হইয়াছে।’– (চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, নিবন্ধসংগ্রহ ১ . তন্ত্র, পৃষ্ঠা-২৩-২৪)
তন্ত্রসাধক পণ্ডিতগণ তন্ত্রকে বেদের ন্যায়ই অপৌরুষেয় মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে তন্ত্রশাস্ত্র মানুষের রচনা নয়। স্বয়ং সদাশিব ও মহামায়া থেকে তন্ত্রের প্রকাশ। ভারতবর্ষে সবসময়ই তন্ত্রের আদর ছিল, আছে এবং থাকবে। সাধনপ্রণালীও একইভাবে প্রবাহিত আছে। বিশেষত্ব এই যে, শুধু কলিযুগে তান্ত্রিক সাধনা বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করেছে। কলিকালে মানব স্বল্পায়ু এবং ভোগপ্রবণ। এইহেতু কলিকালে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানই প্রশস্ত। কারণ, তন্ত্রোপদিষ্ট পদ্ধতিতে সাধনা করলে শীঘ্র শীঘ্র ফল লাভ করা যায় বলে শাস্ত্রে উপদিষ্ট হয়েছে– কলৌ তন্ত্রোদিতা মন্ত্রাঃ সিদ্ধাস্তূর্ণফলপ্রদাঃ। (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
বৈদিক সাধনার শেষ লক্ষ্য এবং তান্ত্রিক সাধনার শেষ লক্ষ্য একই। মুক্তিই উভয় মতে চরম উপেয়। রুদ্রযামলে বলা হয়েছে–
যদ্ বেদৈর্গম্যতে স্থানং তৎ তন্ত্রৈরপি গম্যতে। (রুদ্রযামল)
অর্থাৎ : পথ বিভিন্ন হইলেও বেদ ও তন্ত্র উভয়েরই গন্তব্য স্থল অভিন্ন।
ভারতীয় চিন্তারীতিতে যে-কোনো শাস্ত্র বা তত্ত্বের গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে তার প্রামাণ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তন্ত্রের প্রামাণ্য উল্লেখ করতে গিয়ে সুখময় শাস্ত্রী বলেন– ‘ভাস্কর রায় প্রমুখ আচার্যগণের মতে তন্ত্রশাস্ত্রও শ্রুতির ন্যায়ই প্রমাণ। শৈব দার্শনিক শ্রীকণ্ঠাচার্য ব্রহ্মসূত্রের শিববিশিষ্টাদ্বৈত-ভাষ্যে তন্ত্রশাস্ত্রকে শ্রুতির সমকক্ষরূপে প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার মতে বেদ ও তন্ত্র উভয় শাস্ত্রই শিব হইতে প্রকাশিত। শিববিশিষ্টাদ্বৈত-ভাষ্যের উপর অপ্পয় দীক্ষিত শিবার্কমণিদীপিকা-টীকা প্রণয়ন করিয়াছেন। এই টীকায় প্রসঙ্গক্রমে তন্ত্রের প্রামাণ্য বিচার করিতে যাইয়া গ্রন্থকার বলিয়াছেন– তন্ত্র দ্বিবিধ, বেদানুকূল ও বেদবিরুদ্ধ। অনুমান হয়, বৌদ্ধ তন্ত্রগুলিকেই দীক্ষিত বেদবিরুদ্ধ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। বরিবস্যারহস্যপ্রকাশে তন্ত্রকে ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। পার্থক্য এই যে, মন্বাদি স্মৃতি কর্মকান্ডের পরিপূরক, আর তন্ত্রশাস্ত্র ব্রহ্মকাণ্ডের পরিপূরক।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-১৬)
তন্ত্রশাস্ত্র ঈশ্বরের আজ্ঞাস্বরূপ। তন্ত্রের প্রকাশ বা অবতারণা সম্বন্ধে ‘শিবতত্ত্বরহস্য’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সদাশিবের পাঁচটি মুখ থেকে পাঁচপ্রকার তন্ত্রের উদ্ভব। পূর্ব মুখের নাম ‘সদ্যোজাত’। এই মুখ থেকে প্রকাশিত তন্ত্রগুলি ‘পূর্বাম্নায়’ নামে খ্যাত। দক্ষিণ মুখের নাম ‘অঘোর’। এই মুখ থেকে নিঃসৃত তন্ত্রগুলির নাম ‘দক্ষিণাম্নায়’। পশ্চিম মুখের নাম ‘তৎপুরুষ’। এই মুখ থেকে প্রকাশিত তন্ত্রসমূহের নাম ‘পশ্চিমাম্নায়’। ‘বামদেব’ নামক উত্তর মুখ থেকে উদ্ভূত তন্ত্রগুলিকে ‘উত্তরাম্নায়’ বলে। ঊর্ধ্ব মুখের নাম ‘ঈশান’। এই মুখ থেকে বিনির্গত তন্ত্রসমূহের নাম ‘ঊর্ধ্বাম্নায়’।
সদাশিব ও পার্বতী অভিন্ন। পার্বতী জিজ্ঞাসু শিষ্যারূপে সদাশিবের শরণ নিয়েছেন, আর সদাশিব তন্ত্রের উপদেশে পার্বতীর সংশয় ভঞ্জন করেছেন। কোন কোন স্থলে জিজ্ঞাসু মহাদেবকে পার্বতী উপদেশ দিয়েছেন। এই গুরুশিষ্য-ভাব লীলা ব্যতীত কিছুই নয়। তবে কোন কোন গ্রন্থ অনুযায়ী যেক্ষেত্রে বক্তা শিব এবং শ্রোতা গিরিজা বা পার্বতী, সেগুলোকে বলে আগম-তত্ত্ব। আর যেক্ষেত্রে বক্ত্রী গিরিজা এবং শ্রোতা গিরিশ বা শিব, সেগুলো নিগম-তত্ত্ব। আবার তান্ত্রিক গ্রন্থকারদের কেউ কেউ বলে থাকেন, দক্ষিণাচারের সাধনশাস্ত্রের নাম আগম এবং বামাচার-সম্প্রদায়ের সাধনশাস্ত্রের নাম নিগম।
প্রচলিত তন্ত্রশাস্ত্র বলতে মোটের উপর সেই সকল গ্রন্থাদি বোঝায় যেগুলিতে শক্তি সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে নানাপ্রকার দেবদেবী সংক্রান্ত ধারণাগত ও আচার-অনুষ্ঠানগত বিধিব্যবস্থা ও সেগুলির প্রয়োগ আলোচিত হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্য, সৌরাদি পূজাক্রম, যেখানে শক্তির বিশেষ ভূমিকা আছে, সেগুলিও তান্ত্রিক পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ হিন্দু তন্ত্রের মধ্যেও শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি বিভাগ রয়েছে। শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, সৌর, গাণপত্য প্রমুখ সকল উপাসকই তন্ত্রানুসারে উপসনা করে থাকেন। বৈষ্ণব পূজাক্রমে পাঞ্চরাত্র সংহিতাসমূহের মধ্যে তন্ত্রসাগর, পাদ্মসংহিতাতন্ত্র, পাদ্মতন্ত্র, লক্ষ্মীতন্ত্র প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। শেষোক্ত লক্ষ্মীতন্ত্র গ্রন্থটিকে শাক্ত তান্ত্রিকেরাও প্রামাণ্য বলে মনে করেন। আবার সৌর ও গাণপত্য ধর্মমত সংক্রান্ত কোন রচনাকেও তন্ত্রের পর্যায়ে ফেলা হয়। আর শৈব তন্ত্রসমূহকে শাক্তরা বহুস্থলেই প্রামাণ্য বলে মনে করেন। তাছাড়া অভিনবগুপ্ত প্রমুখ শৈব লেখকেরা শাক্তদের নিকটও বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য হয়ে থাকেন। তার মানে এসবের পেছনে যে সুদীর্ঘ শাক্ত-ঐতিহ্য বহমান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে তন্ত্র বিষয়ক আলোচনায় শাক্ত-সাধনা বা এতৎবিষয়ক ধারণাগুলি এতোটাই অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িয়ে আছে যে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
শাক্ত ও তন্ত্র
শাক্তধর্ম নামে বর্তমানে যা প্রচলিত তার উৎস যে আদিম যুগের মাতৃকাদেবীর উপাসনা এবং তৎকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান, এ ব্যাপারে আজ আর কোন দ্বিমত নেই। আর শক্তি-উপাসকদের আরাধ্যা দেবী যে নানাপ্রকার এক বা ভিন্ন জাতীয় দেবী-কল্পনার সংমিশ্রণের ফলে পরবর্তীকালে পূর্ণ রূপ গ্রহণ করেছিলেন তার ইঙ্গিত আমরা ইতঃপূর্বে পেয়েছি। এদের এক বা একাধিক আদিরূপের সঙ্গে বহির্ভারতীয় অনেক প্রাচীন জাতির দ্বারা পূজিত দেবীর মূল কল্পনার ঐক্যও যে ছিলো সে ব্যাপারে অনেক তথ্য-নিদর্শন ইতিহাস সমাজতত্ত্ব প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিদ্বান গবেষকরা বিভিন্নভাবে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন এবং পেয়েছেনও। ফলে মাতৃকারূপে দেবীর পূজা শুধু যে ভারতেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত ছিলো এমন নয়, বরং পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং অন্যান্য স্থানে বহু পূর্বকাল থেইে যে সেসব প্রচলিত ছিলো, এ ব্যাপারেও এখন আর দ্বিমত নেই। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রাচীনতম উপাসনার এই ধারায় উপাস্য পর্যায়ে দেবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপকল্পনা সুপ্রাচীন হলেও বৈষ্ণব শৈবাদি উপাসক সম্প্রদায়গুলির উল্লেখ যেভাবে খৃষ্টপূর্ব যুগের সাহিত্যে পাওয়া যায় সেভাবে শক্তি-পূজকগোষ্ঠীর উল্লেখ তৎকালীন সাহিত্যে প্রায় দুর্লভ। তবে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে–
‘শাক্ত সম্প্রদায় সম্পর্কিত এই নেতিবাচক তথ্য ইহার অর্বাচীনত্ব প্রমাণিত করে না। ইহা হইতে এই মাত্র অনুমিত হইতে পারে যে বৈষ্ণব শৈবাদি সম্প্রদায়গুলির ন্যায় ইহা সুপ্রাচীনকালে এত ব্যাপক ও সুগঠিত ছিল না। আরও একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক। দেবীপূজার এক পর্যায় প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ যে বিষ্ণু শিবাদি দেবতাকে আশ্রয় করিয়া বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।’- (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় / পঞ্চোপাসনা)
এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য হবে না যে, ভারতের প্রায় সকল ধর্ম ব্যবস্থাই কোন-না কোনভাবে তান্ত্রিক অন্তঃস্রোতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। শাক্ততান্ত্রিক ধারণাসমূহ, স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, শৈবধর্মকেই আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছিল বলেই হয়তো শৈবধর্মের ক্ষেত্রে এই প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। সাংখ্যোক্ত ও তন্ত্রোক্ত পুরুষ-প্রকৃতির ধারণাই শিব ও শক্তির ধারণার উৎস। একটি অন্যনিরপেক্ষ নয়।
এ প্রেক্ষিতে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন– ‘শাক্ততান্ত্রিক ধারণাসমূহ স্বতন্ত্র ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে শৈবধর্মকে অবলম্বন করেছিল। সাংখ্যোক্ত ও তন্ত্রোক্ত পুরুষ প্রকৃতির ধারণাই শিব ও শক্তির ধারণার উৎস। শৈব ও শাক্তধর্মের মূল তত্ত্বগুলি এই, পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটির ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাধান্য, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে প্রকৃতি প্রাধান্য। শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের পাকাপাকি সংযোগের সূত্রপাত গুপ্তযুগ থেকে। লেখসমূহ ও সাহিত্য ছাড়াও এই সংযোগের অন্য পরিচয় পাওয়া যায় ভাস্কর্য থেকে। উমা-মহেশ্বর ও কল্যাণসুন্দর (বৈবাহিক) মূর্তিসমূহের সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৫৯)
তবে এক্ষেত্রে এটাও স্মর্তব্য যে,– ‘একটি ভ্রান্ত ধারণা বহুল প্রচলিত যা হচ্ছে শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্র যেন একই মুদ্রার দুই দিক। এই ধারণা সঠিক নয়। ভারতীয় ধর্মচেতনার বিকাশের প্রভাতকাল থেকেই একটি বিকল্প লোকায়তিক জ্ঞান, কর্ম ও সাধনার ধারা হিসাবে তান্ত্রিক ধারাটি বরাবর বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটির বিকাশ ঋগ্বেদের কিছু অংশে, অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে দেখা যায়। বুদ্ধও এই ধারাটি থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁর দেহাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদের উৎস প্রাচীন তান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার মধ্যে অন্বেষণ করা যায়। (এখানে অবশ্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে তন্ত্র অত্যন্ত প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ তান্ত্রিক গ্রন্থই মধ্যযুগে রচিত, যেখানে বহু ও বিচিত্র নানা মতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে যার ফলে বহু ক্ষেত্রেই মূল বক্তব্যসমূহ নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে)। সে যাই হোক, তান্ত্রিক ধারার অনুগামীরা বৌদ্ধমত গ্রহণ করার পরেও নিজেদের প্রাচীন জীবনচর্যা ও সাধন পদ্ধতিকে বজায় রেখেছিলেন এবং সংঘের মধ্যেই নানা ধরনের গুহ্যসমাজের সৃষ্টি করেছিলেন। এই তন্ত্রসাধকদের প্রভাবেই পরবর্তীকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়,…। তান্ত্রিক আদর্শসমূহ কিভাবে বৈষ্ণবধর্মকে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ লক্ষ্মীতন্ত্র (নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত) থেকে পাওয়া যায় যেখানে লক্ষ্মী বিষ্ণুর চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং সকল সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। তাঁর যে সাধনার কথা উল্লিখিত হয়েছে তা একান্তভাবেই পঞ্চমকারসহ বামাচারী।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৫৮)
তার মানে, শক্তি-সাধনার যে ধারাটি প্রাচীনতম বিশ্বাস ও মাতৃপূজার রহস্যময় আদিম ধারণাগুলোকে পরম্পরাক্রমে বয়ে এনে এতদঞ্চলের লৌকিক ধর্মচর্যাকে এক আধা-বিমূর্ত আধ্যাত্মিক চেতনায় পল্লবিত করে নতুন মাত্রায় গতিশীল করেছিল বলে মনে করা হয়, সেটি হলো তন্ত্র ও তান্ত্রিক ধর্মচর্যা। তান্ত্রিক ধর্মচর্যা ও বিশ্বাসগুলোর দিকে আলোকপাত করলেই বস্তুত শক্তি-সাধনার রহস্যময়ী মোহিনী রূপটি আমাদের দৃষ্টি-সমীক্ষায় চলে আসে।
‘শাক্ত-তান্ত্রিক ভাবধারার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এখানে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী, যিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিতা। শাক্ত পুরাণসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্বয়ং আদ্যাশক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীকস্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এই আদ্যাশক্তি বা শক্তিতত্ত্বের মূল সুপ্রাচীন যুগের মানুষের জীবনচর্যার মধ্যে নিহিত। আদিম চেতনায় নারী শুধুমাত্র উৎপাদনের প্রতীকই নয় সত্যকারের জীবনদায়িনীর ভূমিকাই ছিল প্রধান, জীবনদায়িনী মাতৃদেবীই ছিলেন ধর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারীশক্তির সঙ্গে পৃথিবীর, মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার, সমীকরণ সাংখ্য ও তন্ত্রোক্ত প্রকৃতির ধারণার উদ্ভবের হেতু, যা থেকে পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম কৃষিজীবী কৌমসমাজে ধরণীর ফলোৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে নারীজাতির সন্তান-উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি বর্তমান। সংস্পর্শ বা অনুকরণের দ্বারা একের প্রভাব অন্যের উপর সঞ্চারিত করা সম্ভব এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই আদি-তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বতত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতির রহস্য মানবদেহেরই রহস্য, কারণ মানবদেহই বিশ্বপ্রকৃতির সংক্ষিপ্তসার।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৫৭)
তবে সর্বোপরি শাক্তধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই ধর্ম প্রকৃতির দিক থেকে নমনীয় হওয়ার দরুন বিভিন্ন যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় চাহিদার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পেরেছিলো বলে মনে করা হয়। শাক্তধর্ম ও তন্ত্রের সামাজিক ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন,– মোটামুটিভাবে আমরা তাদের সামাজিক অবদানগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।
(১) শাক্তধর্ম ও তন্ত্র জাতিভেদ বিরোধী। যদিও পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ্য হস্তাবলেপের প্রভাবে কোন কোন তন্ত্রে জাতিপ্রথাকে যুক্তিসহ করার চেষ্টা হয়েছে, ওই অংশগুলি তন্ত্রের মৌল অংশ নয় বলে আমাদের মনে করতে হবে। কেননা, তন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বার বার বলা হয়েছে যে জাতিগত ধারণা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার নিয়ে এ পথে আসা চলবে না। দীক্ষিত হলে জাতিধর্মে বিশ্বাস রাখা চলবে না। নীচ জাতীয় ব্যক্তিরাও গুরু হতে পারেন এবং ব্রাহ্মণকেও তাঁর চরণাশ্রিত হতে হবে। অসংখ্য নীচ জাতীয় গুরুর উল্লেখ তন্ত্রে দেখা যায়, যাঁদের মধ্যে হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল সকলেই আছেন।
(২) তন্ত্র পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরোধী। শাক্তধর্ম অনুযায়ী সকল নারী, এমন কি সে পেশায় গণিকা হলেও, সাক্ষাৎ মহামায়া এবং সেই হিসাবে শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র। তন্ত্রমতে নারী কখনও অধঃপতিত হতে পারে না, ইচ্ছামত দীক্ষাদাত্রী হতে পারেন। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একালের সমাজ-সংস্কারকদের চেষ্টার বাস্তব ফল কি হয়েছে জানি না, তবে তান্ত্রিকদের সম্পর্কে এটুকু বলা যায় পুরুষ-সংসর্গ করলেও তার কোন চরিত্র দোষ ঘটে না। নারীরাও গুরু এবং মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ঊনিশ শতক পর্যন্ত তাঁরা অসংখ্য সমাজচ্যুতা, পতিতা হিসাবে পরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও অপমানিতা নারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন; তাঁদের সাধিকা, ভৈরবী, যোগিনী ইত্যাদিতে পরিণত করেছিলেন; তাঁদের কাছে নূতন জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন; সমাজের চোখে তাঁদের শ্রদ্ধেয়া করে তুলেছিলেন। হয়ত তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়নি, কিন্তু তাঁরা সামাজিক মর্যাদা পেয়েছিলেন, উচ্চবর্ণের ও বিত্তবান ব্যক্তিরা তাঁদের পদধূলি গ্রহণ করেছিলেন, অনেকে দীক্ষাও নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণকেও দীক্ষা দিয়েছিলেন একজন তান্ত্রিক ভৈরবী, যিনি তাঁকে পরমহংস বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং দীর্ঘকাল তাঁর ধর্মজীবনের পরিচালিকা ছিলেন। তাঁর জাত-কুল-গোত্র-চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামাবার সাহস সে যুগের সমাজের হয়নি।
(৩) বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তান্ত্রিকদের বিশিষ্ট অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। ভারতীয় রসায়নশাস্ত্র মূলত তাঁদের সৃষ্টি। চিকিৎসাশাস্ত্রেও তাঁদের অবদান অতুলনীয়। মানবদেহের গঠন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার সূত্রপাত তাঁরাই করেন। শব ব্যবচ্ছেদ, নিষিদ্ধ খাদ্যসমূহের গুণাগুণ পরীক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি বর্ণাশ্রয়ী ব্রাহ্মণ্যসমাজ বরদাস্ত করেনি। চিকিৎসকের প্রতি স্মৃতিশাস্ত্রকারদের বিষোদ্গারের ধরন দেখলেই তা বোঝা যায়। অত্যন্ত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই এদেশে বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটেছে। তান্ত্রিকদের পক্ষেই এপথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল, কেননা তাঁরা সামাজিক অনুশাসনের বড় একটা ধার ধারতেন না, লোকে তাঁদের ভয়ও করত, আত্মরক্ষার্থেই তাঁরা সামাজিক অনুশাসনের নিজেদের চারপাশে একটা ভীতির প্রাচীর খাড়া করেছিলেন। নিষিদ্ধ খাদ্যাখাদ্যের ভৈষজ্য গুণ পরীক্ষার জন্যই তাঁরা ওইগুলিকে নিজস্ব ধর্মচর্যার উপকরণ করেছিলেন, শবদেহ ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজনেই তাঁরা শ্মশানচারী ছিলেন, শব সাধনায় যা হচ্ছে আসল তাৎপর্য।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সবিশেষ তাৎপর্য বিবেচনায় না রাখলে তন্ত্রচর্যা ও তার সমকালীন প্রেক্ষাপট অনুধাবনে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাই প্রকট বলে অভিজ্ঞরা মনে করেন।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্বে’র ‘ধর্মকর্ম : ধ্যান-ধারণা’ অধ্যায়ে শাক্তধর্ম প্রসঙ্গে বলেন,– ‘দেবীপুরাণে (খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম-অষ্টম শতক) বলা হইয়াছে, রাঢ়া-বরেন্দ্র-কামরূপ-কামাখ্যা-ভোট্টদেশে (তিব্বতে) বামাচারী শাক্তমতে দেবীর পূজা হইত। এই উক্তি সত্য হইলে স্বীকার করিতেই হয়, খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম-অষ্টম শতকের পূর্বেই বাঙলাদেশের নানা জায়গায় শক্তিপূজা প্রবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। ইহার কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তোত্তর পর্বে এবং মধ্য-ভারতে রচিত জয়দ্রথ-যামল গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ঈশান-কালী, রক্ষা-কালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী প্রভৃতি কালীর নানা রূপের সাধনা বর্ণিত আছে। তাহা ছাড়া ঘোরতারা, যোগিনীচক্র, চক্রেশ্বরী প্রভৃতির উল্লেখও এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। আর্যাবর্তে শাক্তধর্ম যে গুপ্ত-গুপ্তোত্তর পর্বেই বিকাশ লাভ করিয়াছিল আগম ও যামল গ্রন্থগুলিই তাহার প্রমাণ। খুব সম্ভব ব্রাহ্মণ্য অন্যান্য ধর্মের স্রোত-প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিধর্মের স্রোতও বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইয়াছিল এবং এই দেশ পরবর্তী শক্তিধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এইসব আগম ও যামল গ্রন্থের ধ্যান ও কল্পনাই, অন্তত আংশিকত, পরবর্তী কালে সুবিস্তৃত তন্ত্র সাহিত্যের ও তন্ত্রধর্মের মূলে এবং এই তন্ত্র-সাহিত্যের প্রায় অধিকাংশ গ্রন্থই রচিত হইয়াছিল বাঙলাদেশে। তন্ত্রধর্মের পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিকাশও এই দেশেই। দ্বাদশ শতকের আগেকার রচিত কোনও তন্ত্র-গ্রন্থ আজও আমরা জানি না এবং পাল-চন্দ্র-কম্বোজ লিপিমালা অথবা সেন-বর্মণ লিপিমালায়ও কোথাও এই গুহ্য সাধনার নিঃসংশয় কোনও উল্লেখ পাইতেছি না, এ-কথা সত্য। কিন্তু পাল-পর্বের শাক্ত দেবীদের রূপ-কল্পনায়, এক কথায় শক্তিধর্মের ধ্যানধারণায় তান্ত্রিক ব্যঞ্জনা নাই, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। জয়পালের গয়া-লিপিতে মহানীল-সরস্বতী নামে যে দেবীটির উল্লেখ আছে তাঁহাকে তো তান্ত্রিক দেবী বলিয়াই মনে হইতেছে। তবু, স্বীকার করিতেই হয় যে, পাল-পর্বের অসংখ্য দেবী মূর্তিতে শাক্তধর্মের যে রূপ-কল্পনার পরিচয় আমরা পাইতেছি তাহা আগম ও যামল গ্রন্থবিধৃত ও ব্যাখ্যাত শৈবধর্ম হইতেই উদ্ভূত এবং শাক্তধর্মের প্রাক্-তান্ত্রিক রূপ। এ তথ্য লক্ষণীয় যে, পুরাণকথানুযায়ী সকল দেবীমূর্তিই শিবের সঙ্গে যুক্ত, শিবেরই বিভিন্নরূপিণী শক্তি, কিন্তু তাঁহাদের স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল এবং সেইভাবেই তাঁহারা পূজিতাও হইতেন। শাক্তধর্ম ও সম্প্রদায়ের পৃথক অস্তিত্ব ও মর্যাদা সর্বত্র স্বীকৃত ছিল।’
শক্তি বা মাতৃকা পূজকগোষ্ঠীর সাহিত্যনিদর্শন-রূপ সুস্পষ্ট উল্লেখ মনে হয় বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা গ্রন্থেই প্রথম পাওয়া যায়। শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, এই গ্রন্থের প্রতিমাপ্রতিষ্ঠাপনম্ নামক অধ্যায়ে (৫৯তম অধ্যায়, সুধাকর দ্বিবেদী সম্পাদিত সংস্করণ) ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ইষ্টদেবতার বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবার প্রকৃত অধিকারীর কথাপ্রসঙ্গে গ্রন্থকার বলেছেন–
‘মাতৃণামপি মণ্ডলক্রমবিদো।’- (বৃহৎসংহিতা)
অর্থাৎ : মাতৃকাগণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবার জন্য মণ্ডলক্রমবিদগণই উপযুক্ত।
এবং তার উপর ভাষ্যকালে উৎপলাচার্য বলছেন যে–
‘মাতৃণাং ব্রাহ্ম্যাদীনাং (সপ্তমাতৃকাঃ) মণ্ডলক্রমবিদো যে মণ্ডলক্রমং পূজাক্রমং বিদন্তি জানন্তি’।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মী ইত্যাদি সপ্তমাতৃকাগণের (বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা তাঁরাই করবেন), যাঁরা পূজাক্রম সম্বন্ধে অভিজ্ঞ।
জিতেন্দ্রনাথ বলেন– ‘ভাষ্যকার মণ্ডলক্রম সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই বলেন নাই, ইহার অর্থ পূজাক্রম বলিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন। কিন্তু মণ্ডলক্রম যে তান্ত্রিক পূজাবিধি, এবং ইহার প্রয়োগে যে শাক্তগণই বিশেষ পারদর্শী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।… তবে উৎপল এ প্রসঙ্গে বৃহৎসংহিতার এই শ্লোকের (৫৯, ১৯) শেষ চরণের ‘স্ববিধিনা’ কথাটির ব্যাখ্যাকালে বলিয়াছেন যে মাতৃকা-পূজকদিগের পক্ষে ‘স্ববিধিনা’ বলিতে স্বকল্পবিহিত বিধানই বুঝায় (মাতৃণাং স্বকল্পবিহিত বিধানেন)। এখানে কল্প কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝিলেই জানা যাইবে যে উৎপল তান্ত্রিক পূজাবিধানের কথাই বলিয়াছেন।’- (পঞ্চোপাসনা)
কল্প কী? শব্দকল্পদ্রুম কোষগ্রন্থে বারাহীতন্ত্র থেকে উদ্ধৃত শ্লোক হতে জানা যায়–
‘কল্পশ্চতুর্বিধঃ প্রোক্ত আগমো ডামরস্তথা।
যামলশ্চ তথা তন্ত্রং তেষাং ভেদাঃ পৃথক্ পৃথক্ ।।
অর্থাৎ : কল্প চতুর্বিধ, যথা আগম, ডামর, যামল ও তন্ত্র। এগুলির প্রত্যেকটিরই পৃথক পৃথক ভেদ আছে।
তাহলে উৎপলকথিত স্বকল্পবিধানের অর্থ এই বুঝতে হবে যে, তিনি ভিন্ন ভিন্ন কল্পভুক্ত শক্তি-পূজকগণকেই মাতৃকাগণের মূর্তি নিজ নিজ কল্পোক্ত বিধান অনুসারে প্রতিষ্ঠা করবার অধিকারী বলে বর্ণনা করেছেন।
আমরা জানি যে, এককালে পূর্বভারতের বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি স্থানে শক্তিপূজার প্রবল আধিক্য দেখা দিয়েছিলো। তান্ত্রিকতা মূলত শক্তিপূজাই। তাই শক্তিপূজার অন্যতম প্রধান অঙ্গ তন্ত্র ও তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতি সম্বন্ধে না-জানলে বস্তুত শক্তি-সাধনার বিষয়টি আমাদের কাছে অনধিতই থেকে যায়। আর এ প্রসঙ্গে দেবীপূজা সম্পর্কিত তান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা, তার প্রয়োগ ও এ-সম্পর্কিত সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমাদের কাছে তার এক বিরাট ও বৈচিত্র্যময় রূপ আধা-প্রত্যক্ষ হয়ে ধরা দেয়।
তন্ত্র কথাটির অভিধান বা কোষগত অর্থ বহুবিধ হলেও শক্তিপূজা সম্পর্কিত তার যে দুয়েকটি অর্থ আছে সেটি দেখা যেতে পারে। V.S.Apte তাঁর ‘Sanskrit-English Dictionary’-তে তন্ত্রের অন্যতম অর্থ করেছেন– ‘The regular order of ceremonies and rites, system, framework, ritual’, অর্থাৎ, ধর্মগত ক্রিয়ানুষ্ঠানের নিয়মানুগ ব্যবস্থা, বিধিবদ্ধ ধর্মাচারানুষ্ঠান-সম্বন্ধীয় শাস্ত্র, কাঠামো ইত্যাদি। আর শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কৃত বৃহৎতন্ত্রসার গ্রন্থে তন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে–
তন্ত্রস্য লক্ষণং। সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ তন্ত্রনির্ণয় এব চ।। দেবতানাঞ্চ সংস্থানং তীর্থানাঞ্চৈব বর্ণনং। তথৈবাশ্রমধর্ম্মশ্চ বিপ্রসংস্থানমেব চ। সংস্থানঞ্চৈব ভূতানাং যন্ত্রাণাঞ্চৈব নির্ণয়ঃ। উৎপত্তির্বিবুধানাঞ্চতরূণাং কল্পসংজ্ঞিতং।। সংস্থানং জ্যোতিষাঞ্চৈব পুরাণাখ্যানমেব চ। কোষস্য কথনঞ্চৈব ব্রতানাং পরিভাষণং।। শৌচাশৌচস্য চাখ্যানং নরকাণাঞ্চ বর্ণনং। হরচক্রস্য চাখ্যানং স্ত্রীপুংসোশ্চৈব লক্ষণং।। রাজধর্ম্মেঅ দানধর্ম্মো যুগধর্ম্মস্তথৈব চ। ব্যবহারঃ কথ্যতে চ তথা চাধ্যাত্মবর্ণনং।। ইত্যাদিলক্ষণৈর্যুক্তং তন্ত্রমিত্যভিধীয়তে।- (বৃহৎতন্ত্রসারঃ)
ভাবার্থ :
সৃষ্টি ও প্রলয় প্রকরণ, তন্ত্র নির্ণয়, দেবতা সংস্থান, তীর্থবর্ণন, ব্রহ্মচর্য্যাদি আশ্রম ধর্ম, ব্রাহ্মণাদি বর্ণের কর্তব্যাকর্তব্য, প্রাণিসংস্থান, পুরাণকথন, কোষকথন, ব্রতবর্ণন, শৌচাশৌচ কথন, নরক বর্ণন, হরচক্র কথন, স্ত্রীপুরুষ লক্ষণ, রাজধর্ম, দানধর্ম, যুগধর্ম, ব্যবহার ও আত্মনির্ণয় ইত্যাদি বিষয় যে শাস্ত্রে বর্ণিত আছে তাহাকে তন্ত্র শাস্ত্র বলে।
তবে তন্ত্রের বিশেষ অর্থানুযায়ী তাকে বেদবিহিত ক্রিয়াদি থেকে পৃথক বুঝতে হবে, এবং যজ্ঞাদি বৈদিক ক্রিয়ানুষ্ঠান দেববিগ্রহ পূজাদি তান্ত্রিক ধর্মাচরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর উপাসনার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ-সকল দেবতাকে আশ্রয় করে যে-সকল ধর্মাচারক্রম উদ্ভূত হয়, সেগুলোকে ন্যায্যত অবৈদিক পর্যায়ে ফেলা হয়ে থাকে। এদিক থেকে বিচার করলে গাণপত্য, বৈষ্ণব, শৈব, সৌর ইত্যাদি পূজাক্রম শাক্ত পূজাক্রমের মতো তান্ত্রিক পর্যায়ভুক্ত বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে। কিছু সংগৃহিত পাঞ্চরাত্র গ্রন্থাবলীর তালিকায় তন্ত্রসাগর, পাদ্মসংহিতাতন্ত্র, পাদ্মতন্ত্র, লক্ষ্মীতন্ত্র প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। এভাবে সৌর ও গাণপত্য ধর্মমত সংক্রান্ত কোনও কোনও গ্রন্থ তন্ত্র নামে অভিহিত হতে পারে।
বারাহী-তন্ত্রোক্ত চতুর্বিধ কল্পের কথা আমরা জেনেছি– আগম, ডামর, যামল ও তন্ত্র। জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিতে–
‘তন্ত্রকার আগম-সংখ্যা দ্বাদশ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন, এবং ইহাদিগের নাম দিয়াছেন,– মুক্তক, প্রপঞ্চ, সারদা, নারদ, মহার্ণব, কপিল, যোগ, কল্প, কপিঞ্জল, অমৃতশুদ্ধি, বীর ও সিদ্ধসম্বরণ; প্রত্যেকটি আগমের শ্লোকসংখ্যা বহু সহস্র। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই আগমগুলি শৈবাগম হইতে পৃথক। ডামর ষট্সংখ্যক (ডামরঃ ষড়বিধো জ্ঞেয়ঃ), এবং উহাদিগের নাম এইরূপ– যোগ, শিব, দুর্গা, সারস্বত, ব্রহ্ম ও গন্ধর্ব। যামলের সংখ্যাও ছয় (যামলাঃ ষট্ চ সংখ্যাতাঃ), যথা আদিযামল, ব্রহ্মযামল, বিষ্ণুযামল, রুদ্রযামল, গণেশযামল ও আদিত্যযামল। তন্ত্রের দুই উপবিভাগ, তন্ত্র ও উপতন্ত্র; তন্ত্রের সংখ্যা বিংশতি এবং উপতন্ত্রের সংখ্যা একাদশ। বিংশতি তন্ত্র এইগুলি– নীলপতাকা, বামকেশ্বর, মৃত্যুঞ্জয়, যোগার্ণব, মায়া (মহাতন্ত্র নামে আখ্যাত), দক্ষিণামূর্তি, কালিকা, কামেশ্বরী, হরগৌরী, কুব্জিকা (এটিও মহাতন্ত্র), কাত্যায়নী, প্রত্যঙ্গিরা, মহালক্ষ্মী, ত্রিপুরার্ণব (মহাতন্ত্র), সরস্বতী, যোগিনী (ইহাকে তন্ত্ররাজ আখ্যা দেওয়া হইয়াছে), বারাহী, গবাক্ষী (ক্ষ), নারায়ণীয় ও মৃড়ানী (তন্ত্ররাজ)। একাদশটি উপতন্ত্র এইরূপ– বশিষ্ঠ, কপিল, নারদ, গর্গ, পুলস্ত্য, ভার্গব, সিদ্ধ, যাজ্ঞবল্ক্য, ভৃগু, শুক্র ও বৃহস্পতি। ’- (পঞ্চোপাসনা)
সহজ কথায়, বারাহীতন্ত্রের মতে তান্ত্রিক সাহিত্য চার প্রকার– আগম, ডামর, যামল ও তন্ত্র। আগম বারোটি– মুক্তক, প্রপঞ্চ, সারদা, নারদ, মহার্ণব, কপিল, যোগ, কল্প, কপিঞ্জল, অমৃতশুদ্ধি, বীর ও সিদ্ধসম্বরণ। ডামর ছয়টি– যোগ, শিব, দুর্গা, সারস্বত, ব্রহ্ম ও গন্ধর্ব। যামল ছয়টি– আদিত্য, ব্রহ্ম, আদি, বিষ্ণু, রুদ্র ও গণেশ। তন্ত্র কুড়িটি ও উপ-তন্ত্র এগারোটি। কুড়িটি তন্ত্র হলো– নীলপতাকা, বামকেশ্বর, মৃত্যুঞ্জয়, যোগার্ণব, মায়া, দক্ষিণামূর্তি, কালিকা, কামেশ্বরী, হরগৌরী, কুব্জিকা, কাত্যায়নী, প্রত্যঙ্গিরা, ত্রিপুরার্ণব, সরস্বতী, যোগিনী, বারাহী, গবাক্ষী, নারায়ণীয় এবং মৃড়ানী। একাদশটি উপতন্ত্র হলো– বশিষ্ঠ, কপিল, নারদ, গর্গ, পুলস্ত্য, ভার্গব, সিদ্ধ, যাজ্ঞবল্ক্য, ভৃগু, শুক্র ও বৃহস্পতি।
তবে উপরিউক্ত তালিকাকে সম্পূর্ণ মনে করা ভুল হবে। কেননা এর বাইরে আরও বহু তন্ত্রের নাম পাওয়া যায়।
‘স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহার ‘Catalogue of Palmleaf and Selected Paper Manuscripts belonging to the Durber Library, Nepal’ নামক গ্রন্থের দুই খণ্ডে উপরোক্ত তালিকার বাহিরে বহু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে প্রাচীন তন্ত্রগুলি উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম এই চতুর্বিধ শাসনগত বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বারাহীতন্ত্রোক্ত কুব্জিকা মহাতন্ত্র (এখানে কুব্জিকামত বলিয়া বর্ণিত) পশ্চিমশাসনান্তর্গত ছিল। কুব্জিকামতে লিখিত আছে যে বৈদিক ধর্ম হইতে শৈবধর্ম শ্রেষ্ঠ, দক্ষিণাচার শৈবধর্ম হইতে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু পশ্চিমাম্নায় সকল ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। শাস্ত্রী মহাশয় এ জাতীয় অনেকগুলি পুঁথি অনুশীলন করিয়া মীমাংসা করিয়াছিলেন যে পশ্চিমশাসনের কুব্জিকামত, কুলালিকাম্নায়, শ্রীমত, কাডিমত বিদ্যাপীঠ প্রভৃতি বিবিধ নামবিশিষ্ট একটি তান্ত্রিক শাখা ছিল। ইহার কয়েকটি পরিশিষ্ট (উত্তর) ছিল, যথা শ্রীমতোত্তর বা মন্থানভৈরব এবং কুব্জিকামতোত্তর। মূল শাখা ষট্ক নামক চারি অংশে বিভক্ত এবং প্রতি অংশে ৬,০০০ সংখ্যক শ্লোক থাকিলে, মূলে সর্বসাকুল্যে ২০,০০০ শ্লোক ছিল। ইহা হইতে এই তান্ত্রিক শাখা সাহিত্যের বিরাটত্ব নির্ণীত হইবে। ইহার ন্যূনাধিক প্রাচীনত্বও এসিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি-সংগ্রহভুক্ত গুপ্তোত্তর ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর একটি কুব্জিকামত পুঁথি হইতে প্রমাণিত হয়। কাশ্মীর শৈবাচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁহার ত্রিংশিকা নামক গ্রন্থে কুব্জিকা তন্ত্রের উল্লেখ করিয়াছেন। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর কুব্জিকামত পুঁথি পাওয়া গিয়াছে। ইহার পর কুব্জিকামত শাখার সাহিত্যসৃষ্টি কার্য বন্ধ হইয়া যায়। শাস্ত্রী মহাশয় আরও বলিয়াছেন যে ইহা অপেক্ষা অধিক প্রাচীন তান্ত্রিক শাখাও যে ছিল উহা কুব্জিকামত লিখিত দেবযান, পিতৃযান, প্রভৃতি প্রাচীনতর নাম হইতে বুঝা যায়।’- (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় / পঞ্চোপাসনা)
অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, ‘এই তালিকার বাইরে অনেক তন্ত্রগ্রন্থ আছে যেগুলির বিষয়বস্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ। ভূতডামর, জযদ্রথযামল, গ্রহযামল, দেবীযামল, যামলাক্ষ্য তন্ত্র, নিত্যা, নিরুত্তর, গুপ্তসাধন, চামুণ্ডা, মুণ্ডমালা, মালিনীবিজয়, ভূতশুদ্ধি, মন্ত্রমহোদধি, ত্রিপুরাসার, ত্রিপুরারহস্য, কুলার্ণব, জ্ঞানার্ণব, মহাকৌলজ্ঞানবিনির্ণয়, প্রাণতোষণী, মহানির্বাণ, প্রপঞ্চসার, শারদাতিলক, মৎস্যসূক্ত ইত্যাদি অনেক তান্ত্রিক গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এছাড়া শক্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যান ও সর্বদা ব্যবহারযোগ্য গ্রন্থ হিসাবে সৌন্দর্যলহরী, ললিতাসহস্রনাম, ললিতোপাখ্যান, ষট্দ্রক্রক্রম, যোগচিন্তামণি, শাক্তানন্দ-তরঙ্গিণী, তন্ত্রসার প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২২৫)
আবার, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কৃত বৃহৎতন্ত্রসার গ্রন্থের ভূমিকায় আমরা তন্ত্রাগমের এক দীর্ঘ তালিকা পেয়ে যাই, যেমন–
সিদ্ধেশ্বর, মহাতন্ত্র, কালীতন্ত্র, কুলার্ণব, জ্ঞানার্ণব, নীলতন্ত্র, ফেৎকারিণী, দেব্যাগম, উত্তরা, শ্রীক্রম, সিদ্ধিজামল, মৎস্যসূক্ত, সিদ্ধসার, সিদ্ধসারস্বত, বারাহী, যোগিনী, গণেশবিহর্ষিণী, নিত্যাতন্ত্র, শিবাগম, চামুণ্ডা, মুণ্ডমালা, হংসমাহেশ্বর, নিরুত্তর, কুলপ্রকাশ, কল্প, গান্ধর্ব্ব, ক্রিয়াসার, নিবন্ধ, সম্মোহন, তন্ত্ররাজ, ললিতাখ্য, রাধা, মালিনী, রুদ্রযামল, বৃহৎশ্রীক্রম, গবাক্ষ, সুকুমুদিনী, বিশুদ্ধেশ্বর, মালিনী, বিজয়, সময়াচার, ভৈরবী, যোগিনীহৃদয়, ভৈরব, সনৎকুমার, যোনিতন্ত্র, নবরত্নেশ্বর, কুলচূড়ামণি, ভাবচূড়ামণি, দেবপ্রকাশ, কামাখ্যা, কামধেনু, কুমারী, ভূতডামর, মালিনীবিজয়, যামল, ব্রহ্মযামল, বিশ্বসার, মহাকাল, কুলামৃত, কুলোড্ডীশ, কুব্জিকা, তন্ত্রচিন্তামণি, মহিষমর্দ্দিনী, মাতৃকা, মহানির্ব্বাণ, মহানীল, মহাকালসংহিতা, মেরু, ডামর, বীরভদ্র, বিজয়চিন্তামণি, একজটিকা, নির্ব্বাণ, ত্রিপুরা, কালীবিলাস, বরদা, বাসুদেবরহস্য, বৃহৎগৌতমীয়, বর্ণোদ্ধৃত, বিষ্ণুজামল, বৃহন্নীল, বৃহৎযোনি, রহস্য, ব্রহ্মজ্ঞান, বামকেশ্বর, ব্রহ্মযামল, অদ্বৈত্য, বর্ণবিলাস, পুরশ্চরণচন্দ্রিকা, রসোল্লাস, পঞ্চদশী, পিচ্ছিলা, প্রপঞ্চসার, পরমেশ্বর, হংসাদ্য, নবরত্নেশ্বর, নিত্য, লীল, নারায়ণী, নারদীয়, নাগার্জ্জান, দক্ষিণামূর্ত্তি, সংহিতা, দত্তাত্রেয়, অষ্টাবক্র, যক্ষিণী, যোগসারার্ণব, অনুত্তম, যোগেশ্বর, যামলভৈরব, রাজরাজেশ্বরী, রেবতী, রামার্চ্চনচন্দ্রিকা, স্ববোদয়, ইন্দ্রজাল, কালীতন্ত্র, কালীকুলসর্ব্বস্ব, কুমারী, কৃকলাশদীপিকা, কঙ্কালমালিনী, কালোত্তর, কুব্জিকা, কুলার্ণব, কল্পসূত্র, গৌরীতন্ত্র, গন্ধর্ব্বতন্ত্র, শ্রীগণেশ, বিমর্ষিণী, গুরুতন্ত্র, গায়ত্রী, গবাক্ষ, গবাক্ষসংহিতা, জ্ঞানভাষ্য, অন্নদাকল্প, উৎপত্তি, উত্তর, উড্ডীশ, যক্ষডামর, সরস্বতী, শারদা, শক্তিসঙ্গম, আগমসর্ব্বস্ব, চীনাচার, তারারহস্য, শ্রীশ্যামারহস্য, স্কন্দযামল, নিগমকল্পদ্রুম, লতা, লতাসার, উর্দ্ধাম্নার। সৈন্ধোক্ত, কাপিল, অদ্ভূত, জৈমিনী, বশিষ্ঠ, কপিল, নারদ, গর্গ, পুলস্ত, ভার্গব, সিদ্ধ, যাজ্ঞবল্ক, ভৃগু, শুক্র, বৃহস্পতি ইত্যাদি।
এই বিশাল তান্ত্রিক ও শাক্ত-সাহিত্যের অধিকাংশ রচয়িতাদের নাম জানা যায় না। মাত্র অল্প কয়েকটির বিভিন্ন রচয়িতার পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায়। যাঁদের পরিচয় জানা যায় তাঁদের মধ্যে বাঙালি শক্তি-পূজকদের নামই উল্লেখযোগ্য, যেমন– কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, রামতোষণ বিদ্যালঙ্কার ইত্যাদি। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে,–
‘বঙ্গদেশে শাক্ত-তান্ত্রিক লেখকদের মধ্যে মহামহোপাধ্যায় পরিব্রাজকাচার্যের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য যাঁর কাম্যযন্ত্রোদ্ধার নামক গ্রন্থের তারিখ ১২৯৭ শকাব্দ অর্থাৎ ১৩৭৫ খ্রীষ্টাব্দ। পরবর্তী তান্ত্রিক লেখকদের মধ্যে সর্বানন্দের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম সর্বোল্লাস। তিনি ত্রিপুরা জেলার মেহার নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন এবং তৎপ্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি মেহারকালী নামে আজও বিদ্যমান। সর্বানন্দের জানা তারিখ ১৪২৫ খ্রীষ্টাব্দ।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
অন্যদিকে ‘শাক্ত দার্শনিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য অভিনবগুপ্ত যাঁর তন্ত্রালোক প্রভৃতি গ্রন্থ শৈব-শাক্ত দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ। এছাড়া গোরক্ষ বা মহেশ্বরানন্দের মহার্ঘমঞ্জরী, পুণ্যানন্দের কামকলাবিলাস, নথনানন্দের চিদ্বল্লীটীকা, অমৃতানন্দের যোগিনীহৃদয়দীপিকা ও সৌভাগ্যসুভগোদয়, ও স্বতন্ত্রানন্দের মাতৃকাচক্রবিবেক শাক্তদর্শনের উপর রীতিমত আলোকপাত করে। অভিনবগুপ্তের পর সবচেয়ে বিদ্বান শাক্ত দার্শনিক ছিলেন অষ্টাদশ শতকের ভাস্কর রায়। নিত্যাষোড়শিকার্ণবের ভাষ্য সেতুবন্ধ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর সৌভাগ্যভাস্কর, গুপ্তবতী, শান্তবানন্দকল্পলতা, বরিবস্যাপ্রকাশ প্রভৃতি গ্রন্থে তান্ত্রিক শাক্তদর্শন অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে ব্যাখ্যাত হয়েছে।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)
কিংবদন্তী আছে যে, স্বয়ং শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী হলেও তান্ত্রিক উপাসক ছিলেন, এবং তিনি সৌন্দর্যলহরী, ললিতাসহস্রনাম প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এর সত্যতা অনিশ্চিত। ষট্চক্রক্রমের গ্রন্থকার ছিলেন ব্রহ্মানন্দগিরি। তিনি ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর অন্য দুটি বিখ্যাত রচনার নাম শাক্তানন্দতরঙ্গিণী ও তারারহস্য। তাঁর শিষ্য পূর্ণানন্দ নামে একজন তান্ত্রিক সাধক এই গ্রন্থের একটি টীকা যোগচিন্তামণি রচনা করেন। পূর্ণানন্দের অন্যান্য রচনা শ্যামারহস্য, শাক্তক্রম, শ্রীতত্ত্বচিন্তামণি, তত্ত্বানন্দতরঙ্গিণী, ষট্কর্মোল্লাস প্রভৃতি। তন্ত্রসার রচনা করেছিলেন স্বনামধন্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, যাঁর সময়কাল ১৫৯৬-১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ। তিনি মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রায় এক শতাব্দী পরে জীবিত ছিলেন বলে কারো কারো অভিমত। তাঁর অধস্তন সপ্তম পুরুষ রামতোষণ বিদ্যালঙ্কার প্রাণতোষিণীতন্ত্রের রচয়িতা। মধ্যযুগের অপর উল্লেখযোগ্য শাক্ত তান্ত্রিক লেখক গৌড়ীয় শঙ্কর যাঁর তারারহস্যবৃত্তির রচনাকাল ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি শঙ্কর আগমাচার্য নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর অন্যান্য রচনা হলো শিবার্চনমহারত্ন, শৈবরত্ন, কুলমুলাবতার, ক্রমস্তব প্রভৃতি। মন্ত্রমহোদধির রচয়িতা যে মহীধর তা উক্ত গ্রন্থের মধ্যেই স্পষ্টভাষায় লিখিত আছে।
‘মন্ত্রমহোদধি ন্যূনাধিক দ্বাবিংশ তরঙ্গে বিভক্ত, এবং ইহাতে তান্ত্রিক ধর্মাচরণ সংক্রান্ত বহু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। ইহার প্রথম তরঙ্গের একটি শ্লোকে পঞ্চোপাসনার কথা এইরূপ ভাবে লিখিত দেখা যায়– বিষ্ণুশিবোগণেশার্কো দুর্গা পঞ্চৈব দেবতাঃ। আরাধ্যাঃ সিদ্ধিকামেন তন্ত্রমন্ত্রৈর্যথোদিতম্ ।। অন্যান্য পটলে গণেশ মন্ত্র, কালীসুমূখী মন্ত্র, তারা মন্ত্র, ছিন্নমস্তাদিকথন, শ্যামা মন্ত্র, মহাপূর্ণা মন্ত্র, ষট্কর্মাদি নিরূপণ, হনুমন্মন্ত্র, বিষ্ণু, শিব, কার্তবীর্যাদি মন্ত্র নিরূপণ, এবং স্নান, পূজা, পবিত্রার্চন, মন্ত্রশোধন, সূন্দরী (ষোড়শী) পূজন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের অবতারণা করা হইয়াছে। মহাতন্ত্র নামে অভিহিত মৎস্যসূক্ত মহারাজাধিরাজ লক্ষ্মণসেনের ধর্মাধ্যক্ষ পণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্রের রচনা। ইহা চতুঃষষ্টি পটলে বিভক্ত একটি প্রামাণিক তান্ত্রিক গ্রন্থ। ইহাতেও নানাবিধ তান্ত্রিক ধর্মাচরণের কথা আছে, এবং মহীধর প্রণীত মন্ত্রমহোদধিতে যেমন দশমহাবিদ্যার কালী, তারা, ষোড়শী ও ছিন্নমস্তার নাম পাওয়া যায়, তেমন মৎস্যসূক্তের ষষ্টিতম পটলে আর একটি মহাবিদ্যা মাতঙ্গিনীর (মাতঙ্গী) নামের উল্লেখ আছে। এই পটলে মাতঙ্গিনীবিদ্যার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এই গ্রন্থের একষষ্টিতম পটলের বিষয়বস্তু হইতেছে সর্বগ্রহনিবারিণী মহাবিদ্যা সংক্রান্ত; কিন্তু ইহাতে দশমহাবিদ্যার অন্য নামগুলি পাওয়া যায় না। পরবর্তীর পটলে অপরাজিতার নাম আছে, এবং গ্রন্থের অন্যত্র ছয়টি মাতৃকা ও তাঁহাদের স্থানের কথা আছে, যথা– ব্রহ্মাণী (শিরে), মাহেশ্বরী (নেত্রে), কৌমারী (কর্ণে), বারাহী (উদরে), ইন্দ্রাণী (নাভীতে) এবং চামুণ্ডা (গুহ্যে); ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে এ প্রসঙ্গে বৈষ্ণবীর নাম করা হয় নাই।…’
‘এই বিশাল সাহিত্যের কোনও কোনও অংশের সহিত ভারতীয় অনার্য ও তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন, কারণ এগুলি অত্যন্ত অশুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত, এবং ইহাদের বিষয়বস্তু নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় পশ্চিমাম্নায়ের অন্তর্গত কুব্জিকামত সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে ভেলক (ভেল্কী) বা নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা অর্জনই এইসব তান্ত্রিক উপাসকের পরম লক্ষ্য ছিল, এবং যাঁহারা এ বিষয়ে কৃতকার্য হইতেন তাঁহাদিগকে নাথ বলা হইত; নাথপন্থীরা সমাজের নিম্নস্তরের লোক ছিলেন, ও এ কারণেই ইহাদিগের দ্বারা রচিত তান্ত্রিক গ্রন্থসমূহের সংস্কৃত ভাষা অশুদ্ধ, ব্যাকরণবহির্ভূত ও দুর্বোধ্য ছিল। ১৬৪২ খৃষ্টাব্দে লিখিত জয়দ্রথযামল সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন যে ইহার বিষয়বস্তু সাধারণতঃ কুলার্ণব তন্ত্র হইতে গৃহীত। ইহাতে লিখিত আছে যে পর্ণশবরী দেবীর পূজা হয় কুম্ভকারের নয় কলুর গৃহে অনুষ্ঠিত হইবে, এবং ইহারা হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরে অবস্থিত।- (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা)
তবে দুর্বোধ্য এবং অশুদ্ধ সংস্কৃতে বহু তান্ত্রিক গ্রন্থ লিখিত হলেও মহানির্বাণতন্ত্রের ন্যায় অনেক গ্রন্থও লিখিত হয়েছিলো, যেগুলোর ভাষা ও ভাবসমৃদ্ধি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। তবে কেউ কেউ মনে করেন এই তন্ত্র আধুনিক কালের, এবং এটি রাজা রামমোহন রায়ের গুরু স্বামী হরিহরানন্দ ভারতীর রচনা।
তান্ত্রিক গ্রন্থগুলির অনেকগুলি মহেশ্বর শিব ও মহেশ্বরী পার্বতীর মধ্যে সংলাপের আকারে লিখিত। দক্ষিণাম্নায়ভুক্ত বারাহীতন্ত্র গুহ্য কালিকা দেবী ও চণ্ডভৈরব দেবতার কথোপকথন বলে বর্ণিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, হিন্দুতন্ত্রে আলোচিত তত্ত্বসমূহ মৎস্যেন্দ্রনাথ, আদিনাথ, কণ্ঠনাথ প্রভৃতি নয়জন অবতারিতের দ্বারা মর্ত্যে আনীত হয়েছিলো। গোরক্ষনাথ প্রণীত হঠযোগদীপিকায় তাঁদের নাম পাওয়া যায়। নাথপন্থীরা পূর্বভারতীয় তান্ত্রিক পর্যায়ের এক বৃহৎ শৈবসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁদের আরম্ভকাল খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর শুরুতে। কথিত আছে যে, মহাকৌলজ্ঞানবিনির্ণয় নামে অন্যতম মূলতন্ত্র মৎস্যেন্দ্রনাথের দ্বারা আনীত হয়েছিলো। এটি বেশ প্রাচীন, কারণ তাঁর পুঁথি গুপ্তোত্তর ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত। পুঁথিশেষে এটি চন্দ্রদ্বীপ বিনির্গত বলে বর্ণিত হয়েছে। তবে কি তা পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চল হতে উদ্ভূত বলা ধরা যেতে পারে? প্রাচীন বঙ্গদেশের এ অঞ্চল তান্ত্রিক উপাসনার অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন কেন্দ্র বলে পরিচিত। কামাখ্যা গুহ্যতন্ত্র নামে একটি তন্ত্রের নামও মৎস্যেন্দ্রনাথের সাথে জড়িত।
‘তান্ত্রিক ঐতিহ্যে তিনটি স্রোত স্বীকৃত হয়– দক্ষিণ, বাম ও মধ্যম। দক্ষিণ স্রোতের অন্তর্গত তন্ত্রসমূহের নাম যোগিনীজাল, যোগিনীহৃদয়, মন্ত্রমালিনী, অঘোরেশী, অঘোরেশ্বরী, ক্রীড়াঘোরেশ্বরী, লাকিনীকল্প, মারিচী, মহামারিচী ও উগ্রবিদ্যাগণ। মধ্যম স্রোতের অন্তর্গত তন্ত্রসমূহ হচ্ছে বিজয়, নিশ্বাস, স্বায়ম্ভূব, বাতুল, বীরভদ্র, রৌরব, মাকুট ও বীরেশ। বাম স্রোতের তন্ত্র হচ্ছে চন্দ্রজ্ঞান, বিশ্ব, প্রোদ্গীত, ললিত, সিদ্ধ, সন্তান, সর্বোদ্গীত, কিরণ ও পরমেশ্বর। ব্রহ্মযামলের পরিশিষ্ট পিঙ্গলামতে দু’ধরনের তন্ত্রের উল্লেখ আছে, কামরূপী ও উড্ডিয়ানী। অপর একটি পরিশিষ্ট জয়দ্রথযামলে তিন ধরনের মহাযোগী তন্ত্রের উল্লেখ আছে যথা মঙ্গলাষ্টক, চক্রাষ্টক ও শিখাষ্টক। মহাসিদ্ধসার তন্ত্রে ভারতবর্ষকে তিনটি ভৌগোলিক ভাগে ভাগ করা হয়েছে– বিষ্ণুক্রান্তা, রথক্রান্তা ও অশ্বক্রান্তা, প্রতিটি অঞ্চলে চৌষট্টিটি করে তন্ত্র বর্তমান। শক্তিসঙ্গমতন্ত্রের মতে বিন্ধ্য থেকে যবদ্বীপ পর্যন্ত এলাকা বিষ্ণুক্রান্তা, উত্তরে বিন্ধ্য থেকে মহাচীন পর্যন্ত রথক্রান্তা এবং পশ্চিমের অবশিষ্ট অংশ অশ্বক্রান্তা। ষট্সম্ভবরহস্যে চারটি তন্ত্র সম্প্রদায়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে– গৌড়, কেরল, কাশ্মীর ও বিলাস। বাস্তবে মোটামুটি তিনটি তান্ত্রিক সম্প্রদায় স্বীকৃত– গৌড়ীয়, কাশ্মীরীয় এবং দ্রাবিড়ীয়।’
‘কাশ্মীর শৈববাদের গ্রন্থসমূহ কাশ্মীরীয় তন্ত্রের অন্তর্গত। অনুরূপভাবে শৈব সিদ্ধান্তীদের রচনাসমূহ দ্রাবিড়ীয় তন্ত্রের অন্তর্গত।… গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের গ্রন্থসমূহের মধ্যে কৌলাবলী, গান্ধর্ব, কুলার্ণব, ফেৎকারিণী, সনৎকুমার, মহাচীনাচার, কামাখ্যা, গুপ্তসাধন, মাতৃকাভেদ, তারারহস্য, গায়ত্রী, গৌতমীয়, মহানির্বাণ, শ্যামারহস্য, ত্রিপুরাসারসমুচ্চয়, উড্ডামেশ্বর, নিরুত্তর, কামধেনু, কঙ্কালমালিনী, নীলতন্ত্র, নির্বাণ, বৃহন্নীল, রুদ্রযামল, যোগিনী, যোগিনীহৃদয়, তন্ত্ররাজ, প্রভৃতি। জয়দ্রথতন্ত্রলোকে (১/১৮) কথিত হয়েছে যে শিবের যোগিনী মুখ হতে চৌষট্টিটি ভৈরব আগম নির্গত হয়েছিল যেগুলি অদ্বৈতপন্থী ছিল। এ ভিন্ন দশটি দ্বৈতপন্থী শৈব আগম এবং আঠারোটি মিশ্র মতবাদের রৌদ্র আগম বর্তমান ছিল। শঙ্করের উপর আরোপিত সৌন্দর্যলহরীতে (৫/৩৭) চৌষট্টিটি তন্ত্রের উল্লেখ আছে, যেগুলির নামের তালিকা লক্ষ্মীধরের ভাষ্যে দেওয়া আছে। বিভিন্ন শাক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীবিদ্যা সম্প্রদায়ের সাহিত্য অতি বিস্তৃত, কালীসম্প্রদায়েরও নিজস্ব সাহিত্য আছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৬৫-১৬৬)
বাঙলাদেশে যে পঞ্চমকার যুক্ত তান্ত্রিক সাধনা মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত ছিলো সে সম্বন্ধে অনেকের ধারণা যে এটি চীন বা মহাচীন বা কারও কারও মতে বর্তমান তিব্বত থেকে এখানে আসে। এ প্রসঙ্গে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমতটি উল্লেখযোগ্য–
‘মাতৃপূজা এবং শক্তিসাধনার প্রচলন বাঙলাদেশে অনেক পূর্ব হইতে প্রচলিত থাকিলেও খ্রীস্টীয় সপ্তদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ইহা এখানে একটা নবরূপ লাভ করিয়াছে এবং এই নবরূপেই বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে তাহা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করিয়াছে। কিন্তু বাঙলাদেশে তন্ত্রসাধনার প্রচলন এবং প্রভাব অনেক পূর্ব হইতে। বাঙলাদেশে এবং তৎসংলগ্ন পূর্বভারতীয় অঞ্চলসমূহে এই তন্ত্রপ্রভাব খ্রীস্টীয় অষ্টম শতক হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধধর্মের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া মহাযান বৌদ্ধধর্মকে বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করিয়া দিয়াছিল। আমার ধারণা, বাঙলাদেশে যত হিন্দুতন্ত্র প্রচলিত আছে তাহা মোটামুটিভাবে খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে রচিত। বাঙলাদেশে এই হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র বলিয়া যে দুইটি জাতিভেদ করা হয় সেই ভেদলক্ষণ আমার কাছে খুব স্পষ্ট এবং নিঃসন্দিগ্ধ মনে হয় না। সংস্কারবর্জিতভাবে বিচার করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, ভারতবর্ষের তন্ত্রসাধনা মূলতঃ একটি সাধনা। তন্ত্রের মধ্যে দার্শনিক মতবাদগুলি বড় কথা নয়– বড় হইল দেহকেই যন্ত্রস্বরূপ করিয়া কতকগুলি গুহ্য সাধনপদ্ধতি। এই সাধনপদ্ধতিগুলি পরবর্তী কালের লোকায়ত বৌদ্ধধর্মের সহিত মিলিয়া-মিশিয়া বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছে, আবার হিন্দুধর্মের সহিত মিলিয়া-মিশিয়া হিন্দুতন্ত্রের রূপ ধারণ করিয়াছে; কিন্তু আসলে বৌদ্ধ ‘প্রজ্ঞা-উপায়ে’র পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনাশ্রিত সাধনা, আর হিন্দু শিব-শক্তির পরিকল্পনা এবং তদাশ্রিত সাধনার মধ্যে বিশেষ কোনো মৌলিক পার্থক্য আছে বলিয়া মনে হয় না। এই তন্ত্রসাধনার একটি বিশেষ ধারা বৌদ্ধ দোঁহাকোষ এবং চর্যাগীতিগুলির ভিতর দিয়া যে সহজিয়া রূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্রম-পরিণতি বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে।’– (দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
অপরদিকে নরেন্দ্রনাথ বলেন,– ‘বজ্রযান-কালচক্রযান-সহজ পরিমণ্ডলে একটি তান্ত্রিক ধারার উদ্ভব বঙ্গদেশে হয়েছিল যা সিদ্ধ ধারা নামে পরিচিত। এই ধারার অনুগামীদের লক্ষ্য ছিল সিদ্ধি বা অলৌকিক শক্তিলাভ। বর্ণরত্নাকর, শবরতন্ত্র এবং বিভিন্ন তিব্বতী পুঁথিতে চুরাশী জন সিদ্ধের উল্লেখ আছে। সিদ্ধদের লক্ষ্য ছিল জীবন্মুক্তি বা অমরত্বের সাধনা। এই জন্য তাঁরা যৌগিক কায়সাধন ছাড়াও ঔষধপত্র ব্যবহারে বিশ্বাসী ছিলেন। এই সকল ঔষধ প্রধানত পারদ ও অভ্রের দ্বারা প্রস্তুত করা হত। তাঁরা রসায়নশাস্ত্রের প্রভূত চর্চা করেছিলেন এবং এই তান্ত্রিক রসায়নবিদ্যা রসেশ্বর দর্শন নামে পরিচিত হয়েছিল। মহারাষ্ট্র ও দক্ষিণ ভারতের সিদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বঙ্গদেশের সিদ্ধরা বিশেষ যোগাযোগ রাখতেন। চুরাশীজন সিদ্ধের তালিকায় কয়েকজন প্রসিদ্ধ নাথ সম্প্রদায়ের গুরুর নাম পাওয়া যায়। কৌলজ্ঞাননির্ণয় গ্রন্থে মৎস্যেন্দ্রনাথকে যোগিনী কৌলের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বলা হয়েছে। অকুলবীরতন্ত্রের লেখকত্ব তাঁর উপর আরোপ করা হয়েছে। গোরক্ষনাথ রচিত গোরক্ষসংহিতা, জালন্ধরী বা হাড়ি-পা রচিত বজ্রযোগিনীসাধনা, শুদ্ধিবজ্রপ্রদীপ, শ্রীচক্রসংবরগর্ভতত্ত্বনিধি, হুংকারচিত্তবিন্দুভাবনাক্রম প্রভৃতি তন্ত্রের কথা এখানে উল্লেখ করা চলতে পারে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৬৭)
এ প্রেক্ষিতে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত আরো বলছেন,– ‘অন্তত দেড় হাজার বৎসর ধরিয়া বাঙলাদেশে এই একটি তান্ত্রিক ধারা প্রবহণের কারণ কি? এ-বিষয়ে আমার একটি ধারণা আছে– তাহা স্থির সিদ্ধান্ত না হইলেও সুধীগণের বিচারের জন্য উপস্থাপিত করিতেছি। আজকাল আমরা ভারতবর্ষের বহু স্থানে তন্ত্রশাস্ত্র এবং তন্ত্রসাধনার কিছু কিছু উল্লেখ এবং সন্ধান পাইতেছি বটে, কিন্তু তথাপি আমার মনে হয়, বৃহত্তর ভারতে এই তান্ত্রিকতার একটি বিশেষ ভূমিভাগ আছে। উত্তর-পশ্চিমে কাশ্মীর হইতে আরম্ভ করিয়া নেপাল, তিব্বত, ভূটান, কামরূপ এবং বাঙলাদেশ– হিমালয় পর্বতসংশ্লিষ্ট এই ভূভাগকেই বোধহয় বিশেষভাবে তান্ত্রিক অঞ্চল বলা চলে। হিমালয়সংশ্লিষ্ট এই বিস্তৃত অঞ্চলটিই কি তন্ত্রবর্ণিত ‘চীন’ দেশ বা মহাচীন? তন্ত্রাচার ‘চীনাচার’ নামে সুপ্রসিদ্ধ; বশিষ্ঠ চীন বা মহাচীন হইতে এই তন্ত্রাচার লাভ করিয়াছিলেন, এইরূপ প্রসিদ্ধিও সুপ্রচলিত। এই-সকল কিংবদন্তীও আমাদের অনুমানেরই পরিপোষক বলিয়া মনে হয়। আমরা লক্ষ্য করিতে পারি, প্রাচীন তন্ত্র অনেকগুলিই কাশ্মীরে রচিত; ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও কিছু কিছু তন্ত্র রচিত হইলেও বঙ্গ-কামরূপ মুখ্যভাবে পরবর্তী তন্ত্রের রচনাস্থান– নেপাল-ভূটান-তিব্বত-অঞ্চলে এগুলির বহুল প্রচার এবং অদ্যাবধি সংরক্ষণ। ইহা ব্যতীতও পার্শ্বপ্রমাণরূপে আমরা আরো কতকগুলি তথ্যের উল্লেখ করিতে পারি। তন্ত্রোক্ত দেহস্থ ষট্চক্রের পরিকল্পনা সুপ্রসিদ্ধ; নিম্নতম মূলাধার চক্র হইতে আরম্ভ করিয়া ভ্রূমধ্যস্থ আজ্ঞাচক্রকে লইয়া এই ষট্চক্র। এই ছয়টি চক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রহিয়াছেন– নিম্ন হইতে আরম্ভ করিয়া এই দেবীগণ যথাক্রমে হইলেন ডাকিনী, রাকিণী, লাকিনী, কাকিনী, শাকিনী এবং হাকিনী। এই নামগুলির প্রতি লক্ষ্য করিলেই বেশ বোঝা যায় এই নামগুলি সম্ভবতঃ সংস্কৃত নহে। পক্ষান্তরে দেখিতে পাই, ‘ডাক’ কথাটি তিব্বতী, অর্থ জ্ঞানী; ইহারই স্ত্রীলিঙ্গে ডাকিনী। আমাদের ‘ডাক ও খনার বচনে’র ডাকের বচন কথার মূল অর্থ বোধহয় জ্ঞানীর বচন। ডাকিনী কথার মূল অর্থ বোধহয় ছিল ‘গুহ্যজ্ঞানসম্পন্না’; আমাদের বাঙলা ‘ডাইনী’ কথার মধ্যে তাহার রেশ আছে; মধ্যযুগের নাথসাহিত্যের রাজা গোপীচাঁদের মাতা ময়নামতী ‘মহাজ্ঞান’সম্পন্না এই-জাতীয় ‘ডাইনী’ ছিলেন। সুতরাং মনে হয়, এই ‘ডাকিনী’ দেবী কোনো নিগূঢ়জ্ঞানসম্পন্না তিব্বতী দেবী হইবেন। ‘লাকিনী’ ও ‘হাকিনী’ নামে ভারতবর্ষের অন্যত্র কোনো দেবীর উল্লেখ পাইতেছি না, কিন্তু ভূটানে ‘লাকিনী’ ও ‘হাকিনী’ দেবীর সন্ধান পাওয়া যাইতেছে। তাহা হইলে তিব্বত-নেপাল-ভূটান-অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবীরাই কি তন্ত্রের ষট্চক্রের মধ্যে আপন আপন আসন প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছেন?’
‘এই প্রসঙ্গে আরো একটি তথ্যের প্রতি পণ্ডিতগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। তন্ত্রের মধ্যে মন্ত্রের অতিশয় প্রাধান্য। এই মন্ত্রতত্ত্বের বিভিন্ন দিক্ রহিয়াছে। কিন্তু সেই-সকল তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে অশ্রদ্ধা না করিয়াও কতকগুলি ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাইতে পারে। তন্ত্রের মন্ত্রসমূহের মধ্যে আমরা বীজমন্ত্রের নানাভাবে উল্লেখ দেখিতে পাই। এই বীজমন্ত্রগুলি সাধারণতঃ একাক্ষরী। এই একাক্ষরী বীজমন্ত্রসমূহের মধ্যে প্রণব বা ‘ওঁ’ সুপ্রসিদ্ধ বৈদিক মন্ত্র। অন্য মন্ত্রগুলি বৈদিক বলিয়া মনে হয় না। হ্রীং ক্লীং হৈঁ ক্রীং প্রভৃতি মন্ত্র মূলতঃ সংস্কৃত ভাষাজাত কি-না এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশের অবকাশ আছে। এই বীজমন্ত্র ব্যতীত তন্ত্রের মধ্যে আমরা আর-এক রকমের মন্ত্রমালা পাই, এই মন্ত্রগুলি সাধারণতঃ দ্বিমাত্রিক– ইহাদের কোনো অর্থ আমরা বুঝিতে পারি না। মহাযানী বৌদ্ধ দার্শনিক অসঙ্গ একস্থানে বলিয়াছেন যে, এই অর্থহীনতাই ইহাদের যথার্থ তাৎপর্য। অবশ্য অর্থহীন মন্ত্র অথর্বাদি বেদের মধ্যেও পাওয়া যায়। তন্ত্রে যে একাক্ষরী বীজমন্ত্রের এবং দ্ব্যক্ষরী মন্ত্রমালার বহুল ব্যবহার পাওয়া যায় সেগুলি সম্বন্ধে এমন কথা মনে করা কি একান্ত ভ্রমাত্মক হইবে যে, এগুলি আমাদের পূর্বোক্ত তান্ত্রিক অঞ্চলের কোনো প্রাচীনকালে প্রচলিত ভাষার লুপ্তাবশেষ? আমরা সাধারণভাবে যাহাকে চীনাঞ্চল বা মহাচীনাঞ্চল বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছি সেখানকার ভাষায় একাক্ষরিত্ব বা দ্ব্যক্ষরিত্বের প্রাধান্যের কথাও আমাদের এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিতে হইবে।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
তন্ত্রের সঙ্গে চীন বা মহাচীনের এই যে প্রাচীন যোগ খোঁজার প্রয়াস, এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের নিম্নোক্ত বক্তব্যটিও কৌতুহলজনক। তিনি বলছেন–
‘তাওবাদ সংক্রান্ত অধ্যাপক নীড্হামের (J. Needham : Science and Civilisation in China. Vol. II).. বিশ্লেষণ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে তন্ত্রের ভূমিকাকে– এবং, অতএব, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসকেই– সম্পূর্ণ নতুন আলোয় দেখবার দাবি তুলেছে। কেননা, তাঁর বিশ্লেষণ অনুসারেই, দার্শনিক তত্ত্ব এবং সাধন-পদ্ধতি উভয় দিক থেকেই তাওবাদ ও তন্ত্র প্রায় অভিন্ন; এমনকি তিনি এ-কথা কল্পনা করতেও দ্বিধা বোধ করেন নি যে, চীনা তাওবাদই হয়তো ভারতের জমিতে এসে ভারতীয় তন্ত্রের রূপ গ্রহণ করেছিল :
At first sight, then, Tantrism seems to have been an Indian importation to China. But closer inspection of the dates leads to a consideration, at least, of the possibility that the whole thing was really Taoist. (P. 427)
আপাতদৃষ্টিতে এ-মন্তব্য যতই বিস্ময়কর ঠেকুক না কেন, মনে রাখা দরকার যে ভারতীয় তন্ত্রগ্রন্থে মহাচীন এবং চীনাচারের উল্লেখ অস্পষ্ট নয়; এমনকি তারা-তন্ত্রে এমন কথাও বলা হয়েছে যে ঋষি বশিষ্ঠ চীনদেশে গিয়ে বুদ্ধদেবের কাছে তন্ত্রে দীক্ষা পেয়েছিলেন এবং ভারতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি এই তন্ত্রেরই প্রচার করেছিলেন। এ-জাতীয় সাক্ষ্যর উপর নির্ভর করেই প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও সিল্ভ্যাঁ লেভি ইতিপূর্বেই ভারতীয় তন্ত্রে চীনা প্রভাব প্রতিপন্ন করবার প্রয়োস করেছিলেন। কিন্তু তান্ত্রিক ধ্যানধারণার আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সমস্যার আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করব। আপাতত এটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে, তন্ত্রের সঙ্গে তাওবাদের সাদৃশ্য কম নয়। অধ্যাপক নীড্হাম যেমন বলেছেন,
In any case, it is possible to find detailed parallels of much precision between Taoism and Tantrism. (P. 428)
তন্ত্র ও তাওবাদের মধ্যে সাদৃশ্য যদি এমন গভীর হয় এবং এই তাওবাদই যদি চীনদেশের চিন্তা-ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের বাহক হয়ে থাকে– তাহলে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসেও তন্ত্রের অনুরূপ গুরুত্ব সন্দেহ করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত বা অস্বাভাবিক হবে না।’– (সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ইত্যাদি অগ্রন্থিত রচনা, পৃষ্ঠা-২৩-২৪)
এ প্রেক্ষিতে আরেকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও সমাজভাবনার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল বা সংক্ষেপে জে. ডি. বার্নাল (১৯০১-১৯০৭১) তাঁর জগদ্বিখ্যাত ‘ইতিহাসে বিজ্ঞান’ (Science in History) গ্রন্থে বলেন,–
‘রসায়নিক ধ্যানধারণার উদ্ভব হয় সাদৃশ্যবিচারের মাধ্যমে চিন্তা করার কার্যকর প্রণালীর মধ্যে থেকে। সে-চিন্তাপ্রণালী মূলত জীববিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। রসায়নে এক মৌলিক দ্বৈতরূপের অস্তিত্ব রয়েছে, যা ধাতু এবং অধাতুর মধ্যে পরিস্ফুট। আজ আমরা জানি, এই দ্বৈতরূপের কারণ হচ্ছে, ইলেকট্রনের ঘাটতি বা বাড়তি। সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে মনে হয় এই দ্বৈতচরিত্রের প্রথম ফলিত প্রয়োগ ঘটায় চিনারা। সুদূর প্রাগৈতিহাসিক কালেই তারা রক্তের জাদু-বিকল্প হিসেবে লাল হিঙ্গুল ব্যবহার করেছিল। সেই হিঙ্গুল-কে তারা গন্ধক আর পারদ– এই দুই মৌল উপাদানে বিভক্ত করে নিয়েছিল। তাও-পন্থীরা এই দুটি মৌলকে তাঁদের পুরুষ-উপাদান ইন আর স্ত্রী-উপাদান ইয়াং-য়ের সাধারণ তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে নেন (এই দুই উপাদানের মূল আবার নিহিত ছিল প্রাচীনতর টোটেমের মধ্যে)। এর মধ্যে থেকে তাঁরা আলকেমির এক ধারা গড়ে তোলেন। সম্ভবত এই উৎস থেকেই প্রথমে ভারতীয় এবং পরে আরবি আলকেমির উদ্ভব ঘটে। প্রথম দিকে অবশ্য সোনা নয়, অমৃত পানীয় তৈরির পন্থা আবিষ্কারই ছিল এর লক্ষ্য।’– (ইতিহাসে বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা-১৭৯)
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে তন্ত্রের যে গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে তা হলো রসায়ন বা অ্যালকেমিবিদ্যায়– এবং সাধারণভাবে ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে– তান্ত্রিকদের অবদান। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় দুই পর্বে রচিত তাঁর বিখ্যাত ’হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস’ (History of Hindu Chemistry) শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের মাধ্যমে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে প্রাচীন ভারতের আয়ুর্ব্বেদ ও রসায়নে তান্ত্রিকদের এই অবদানের ইতিহাস হাজির করেছেন। এ বিষয়ে যথাস্থানে আলোচনা করা যাবে। তবে তন্ত্রের সঙ্গে তাওবাদের কিছু মৌলিক সাদৃশ্য দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
‘প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাক্ষেত্রের মতোই প্রাচীন চীনের চিন্তাক্ষেত্রেও প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্ব দেখতে পাওয়া যায়। চীনা ভাষায় প্রকৃতি ইন্ (Yin), এবং পুরুষ ইয়াঙ (Yang)। ফর্কে প্রমুখ ইয়োরোপীয় চীন-তত্ত্ববিদেরা ইতিপূর্বেই দেখিয়েছিলেন যে ইন্-ইয়াঙ তত্ত্ব সামগ্রিকভাবে সমস্ত প্রাচীন চীন চিন্তাধারাকেই সঞ্জীবিত করেছিল; প্রমাণ হিসেবে, ফর্কে বলেছেন, প্রাচীন চীনের দুটি প্রধান সম্প্রদায়ই– অর্থাৎ কন্ফুসীয়-সম্প্রদায় এবং তাও-সম্প্রদায় উভয়ই– এই ইন্-ইয়াঙ বা প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্বকে আশ্রয় করেছে (ERE [Encyclopaedia of Religion and Ethics] viii, 492)। অধ্যাপক নীড্হাম-ও অবশ্যই এ-কথা স্বীকার করেছেন (P.61); কিন্তু এদিক থেকে উক্ত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে প্রভেদ এবং বিশেষ করে তাও-সম্প্রদায়ের যে-বৈশিষ্ট্য ইতিপূর্বে ইয়োরোপীয় বিদ্বানদের চোখে পড়ে নি সেদিকে তিনি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্র্ষণ করেছেন :
If it were not unthinkable (from the Chinese point of view) that the Yin and the Yang could ever be separated, one might say that Taoism was a Yin thought-system and Confucianism a Yang one. (P. 61)
কিংবা,
Confucian knowledge was masculine and managing; the Taoists condemned it and sought after a feminine and receptive knowledge which could arise only as the fruit of a passive and yielding attitude in the observation of Nature. (P. 33)
অর্থাৎ, ভারতীয় দর্শনের পরিভাষায় এই কথাটি বলতে গেলে বলা দরকার, তাওবাদ প্রকৃতি-প্রধান চিন্তাধারার পরিচায়ক এবং এইদিক থেকেই কন্ফুসীয়-সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাও-সম্প্রদায়ের মৌলিক প্রভেদ, কেননা কন্ফুসীয় সম্প্রদায় পুরুষ-প্রধান।
ভারতীয় তন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, তথাকথিত বিভিন্ন তান্ত্রিক সম্প্রদায় এই [সাংখ্যোক্ত] প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্বকে বিভিন্ন নামে এবং বিভিন্ন ভাবে ব্যক্ত করবার চেষ্টা করেছে : তথাকথিত বৌদ্ধ-তন্ত্রে বলা হয়েছে প্রজ্ঞা ও উপায়, শূন্যতা ও করুণা বা বজ্র ও পদ্ম-র কথা; তথাকথিত শাক্ততন্ত্রে বলা হয়েছে শক্তি ও শিব বা হর ও গৌরীর কথা; আবার বৈষ্ণব সহজিয়ারা এই কথাকেই রাধা ও কৃষ্ণ বা রতি ও রসের তত্ত্ব বলে প্রচার করেছেন। কিন্তু তন্ত্রের যে সম্প্রদায়ই হোক না কেন, এই প্রকৃতি-পুরুষের মধ্যে সর্বত্র প্রকৃতিই প্রধান।’– (তন্ত্র ও তাওবাদ, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ইত্যাদি অগ্রন্থিত রচনা, পৃষ্ঠা-২৫)
এছাড়া, যদিও তাওবাদে এই প্রকৃতি-প্রাধান্য সর্বত্র একভাবে কীর্তিত নয়, তবু দেবীপ্রসাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাও-কাব্যের সঙ্গে আমাদের তান্ত্রিক-কাব্যের আশ্চর্য সাদৃশ্য তাওবাদীদের ঐ Mysterious Feminine-এর পরিচয় আমরা পেয়েছি চর্যা-সঙ্গীতের ডোম্বী, শবরী, সহজসুন্দরী নামের অন্তরালে। বৈষ্ণব-কবিদের গানেও তাও-কাব্যের প্রায় হুবহু কথারই পরিচয় পাওয়া যায়, যেমন– ‘প্রকৃতি আচার পুরুষ বেভার/ যে-জনা জানিতে পারে’, কিংবা ‘পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবে/ একদেহ হয়ে নিত্যতে রবে’ ইত্যাদির সঙ্গে ‘He who knows the male, yet cleaves to what is female’ কথার পার্থক্য কোথায়?
‘অবশ্য তাওবাদীদের কাব্যও অনেকাংশে সন্ধ্যা-ভাষায় রচিত; এ-কাব্যও আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হেঁয়ালির মতো প্রতীত হয়। চীন-ভাষায় বলা হয়, তাওবাদীরা সমাজের বাইরে হাঁটেন– তাই আমাদের তান্ত্রিকদের কাব্যের মতোই তাঁরাও তাঁদের বলবার কথাটা সোজা সমাজ-স্বীকৃত ভাষায় ব্যক্ত করেন না। কিন্তু অধ্যাপক নীড্হাম এর যে-কারণ প্রদর্শন করছেন তাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। প্রচলিত সমাজকে মানেন নি বলেই ওরা সমাজের বাইরে হাঁটেন; সমাজের উচ্চ-মহল-উচ্ছ্বসিত জ্ঞানকে জ্ঞান বলে স্বীকার করেন নি বলেই তাঁরা জ্ঞানীদের প্রসঙ্গে বিদ্রূপ-মুখর আর তাঁদের বক্তব্য উচ্চ-সমাজ সমর্থিত ও প্রচলিত নীতিবোধ এবং ধর্মবোধের তীব্র বিরোধী বলেই তাঁদের বলবার কথাটা সোজাসুজি সামাজিক ভাষায় তাঁরা বলতে চান নি। স্বভাবতই আমাদের চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যদের কথা মনে পড়ে। দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই।’– (ঐ, পৃষ্ঠা-২৭)
পরবর্তী পর্ব...>> তন্ত্রের প্রাচীনত্ব

1 comment:

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ