বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান এই সবকটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক-যানেরই নির্ভর মূলত যোগ-সাধনার উপর। বলা বাহুল্য, এদের সবারই দর্শনদৃষ্টির মূল যোগাচার ও মাধ্যমিক দর্শনে। একই ধ্যান-কল্পনা থেকেই এই তিন যান উদ্ভূত এবং ব্যবহারিক সাধনার ক্ষেত্রে এই তিন যানের মধ্যে পার্থক্যও খুব বেশি ছিলো না। এদের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা টানা বস্তুতই কঠিন। তাছাড়া একই সিদ্ধাচার্য একাধিক যানের উপর পুস্তক রচনা করেছেন, এমন প্রমাণও দুর্লভ নয়। তবে এই তিন যানের উদ্ভব যেখানেই হোক, তৎকালীন বাঙলা অঞ্চলেই এগুলো লালিত ও বর্ধিত হয়েছিলো । প্রধানত এই ত্রিযানপন্থী বাঙালি সিদ্ধাচার্যরাই এই বিভিন্ন গুহ্য সাধনার গ্রন্থাদি রচনা ও দেবদেবীর ধ্যান-কল্পনা গড়ে তুলেছিলেন। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের অভিমত হলো, ‘বস্তুত এই তিন যানের ইতিহাসই পাল-চন্দ্র-কম্বোজ-পর্বের বাঙলার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস।’
যে-যোগের উপর এই তিন তন্ত্র-যানের নির্ভর, সেই যোগ হঠযোগ নামে পরিচিত এবং মানবদেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শারীর-জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। শরীরের নাড়ীপ্রবাহ ও তাদের উর্ধ্বমুখী গতি, বিভিন্ন নাড়ীর সংযোগ কেন্দ্র, তাদের উৎপত্তিস্থল, নাড়ীচক্র প্রভৃতি সমস্তই এই শারীর-জ্ঞানের অন্তর্গত। শাক্ত-তন্ত্রে মানবদেহের মধ্যে ষট্চক্র বা ছয়টি স্নায়ুচক্রের কথা আছে। বৌদ্ধতন্ত্রে এই স্নায়ুচক্রের সংখ্যা তিনটি যেগুলি বুদ্ধের ধর্মকায়, সম্ভোগকায় ও নির্মাণকায়ের প্রতীক। এ ছাড়া আরও একটি চক্র আছে যা উষ্ণীষকমল বা সর্বোচ্চ মস্তিষ্কে অবস্থিত, যা বুদ্ধের বজ্রকায় বা সহজকায়ের প্রতীক। উষ্ণীষকমলের নিচে গ্রীবাপ্রদেশের তলায় সম্ভোগচক্র অবস্থিত, আরও নিচে হৃৎপিণ্ড অঞ্চলে ধর্মচক্র, এবং সবচেয়ে নিচে নাভিমূলে নির্মাণচক্র। দেহের অসংখ্য নাড়ীর মধ্যে যে তিনটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলির মধ্যে সুষুম্নাকাণ্ডের দু’পাশের দুটির নাম প্রজ্ঞা ও উপায়, নামান্তরে ললনা ও রসনা। এবং মধ্যেরটি, যেখানে ওই দুটি এসে মিলেছে, সহজ বা অবধূতী নামে পরিচিত। এই ললনা-রসনা-অবধূতীই শাক্ত-তন্ত্রের ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না নাড়ী। এই তিন নাড়ীপ্রবাহের মধ্যে অবধূতীর উর্ধ্বমুখী গতি ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত। শাক্ত-তন্ত্রের কুণ্ডলিনী শক্তির ন্যায় বৌদ্ধ-তন্ত্রে একটি অগ্নিময়ী নারীশক্তির কল্পনা আছে, যার বাস নির্মাণচক্রে এবং যা চণ্ডালী নামে পরিচিত। এই চণ্ডালী ধর্মচক্র ও সম্ভোগচক্রকে প্রজ্জ্বলিত করে উপর দিকে উঠতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত উষ্ণীষকমল বা মস্তিষ্ক অঞ্চলে উপস্থিত হয়ে আবার সেখান থেকে স্বস্থানে নেমে আসে। যৌগিক ক্রিয়ার দ্বারা এই শক্তিকে প্রজ্ঞা ও উপায়রূপ নাড়ীদ্বয়ের মাধ্যমে উষ্ণীষকমলে নিয়ে যেতে পারলে অনন্তসুখ বা প্রকৃত নির্বাণের উপলব্ধি ঘটে। নাড়ীপ্রবাহের গতিকে সাধক স্বেচ্ছায় চালনা করতে পারেন এবং সেই চালনার শক্তি অনুযায়ী বোধিচিত্তের ধ্যান-দৃষ্টি উন্মীলিত ও প্রকাশিত হয়।
বৌদ্ধ-তন্ত্রের সাধনপন্থায় চক্রভেদ প্রসঙ্গে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত বর্ণনা অনুযায়ী– ‘হিন্দু-তন্ত্রের মধ্যে এবং বিবিধ যোগ-গ্রন্থের মধ্যে আমরা কুলকুণ্ডলিনী-শক্তির কথা জানিতে পারি; এই শক্তি সর্বনিম্ন চক্র বা পদ্ম মূলাধারে সর্পাকারে কুণ্ডলিত হইয়া নিদ্রিত আছে; সাধকের সর্বপ্রথম কাজ হইল এই সুপ্তা শক্তিকে জাগ্রত করিয়া তোলা। দেবী মূলাধারে জাগ্রত হইয়া উঠিবার পূর্ব পর্যন্ত সাধনায় সাধকের কোনও অনুভূতির স্পন্দনই নাই– দেবীর বা শক্তির জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হয় আনন্দময় অনুভূতির স্পন্দন। শক্তির জাগরণের পরেই আরম্ভ হয় তাঁহার উর্ধ্বগতি– একটি একটি করিয়া চক্রকে ভেদ করিয়া শক্তি উর্ধ্বে উত্থিত হন– সর্বোচ্চধামে সহস্রারে গিয়া শক্তির পরমা স্থিতি। শক্তির একটি একটি চক্রভেদের সঙ্গে সঙ্গে সাধকের নূতন নূতন আনন্দানুভূতির স্পন্দন লাভ হইতে থাকে; সেই আনন্দানুভূতির স্পন্দন চরমবিশুদ্ধি এবং পরমপূর্ণতা লাভ করে সর্বোচ্চধামে শক্তির স্থিতির সহিত। এই কুলকুণ্ডলিনী-শক্তির অধ্যাত্ম-রহস্যের গভীরে প্রবেশ না করিয়া সহজে দেখিতে পাই, যোগ-তন্ত্রাদিতে এই শক্তির উত্থান ও গতি একটি বিচিত্র-স্পন্দনাত্মক বিদ্যুৎ-প্রবাহের ন্যায় বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। এই প্রবাহের প্রতিক্ষণে সাধকের বিচিত্র দিব্যানন্দের অনুভূতি। বৌদ্ধ-তান্ত্রিক সাধনায়ও এই-জাতীয় একটি বিদ্যুৎ-প্রবাহবৎ স্পন্দনাত্মিকা শক্তির বর্ণনা দেখিতে পাই। এই শক্তির অভ্যুত্থানের সঙ্গে যে আনন্দানুভূতির আরম্ভ, মন্তকস্থিত উষ্ণীষকমলে পৌঁছিয়া তাহারই পরিণতি বৌদ্ধ-তান্ত্রিকগণের পরম কাম্য মহাসুখে। এই মহাসুখই সহজানন্দ। ‘সহজ’ই হইল প্রত্যেক প্রাণীর– শুধু প্রাণীর নয়- সকল ধর্মের স্বরূপ; আর এই স্বরূপ হইল বিশুদ্ধ আনন্দ– তাহাই মহাসুখ; সুতরাং আনন্দই হইল সহজের নিত্য স্বভাব। বৌদ্ধ-তন্ত্রমতে দেহমধ্যে চারিটি চক্র বা পদ্ম অবস্থিত, নিম্নতম হইল নির্মাণচক্র, ইহা নাভিদেশে অবস্থিত; তদূর্ধ্বে হৃদয়ে হইল ধর্মচক্র, কণ্ঠে হইল সম্ভোগচক্র– আর মন্তকে উষ্ণীষকমলে হইল মহাসুখচক্র। নির্মাণচক্র শুধু নিম্নতম চক্র নয়– ইহাই স্থূলতম তত্ত্বের ক্ষেত্র। কিন্তু শক্তির জাগরণ প্রথমে এই নির্মাণচক্রের চৌষট্টি-দল-যুক্ত পদ্মে; এইখানে এই শক্তির জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের উদ্বোধন। কিন্তু তখন পর্যন্ত এই স্পন্দনাত্মক আনন্দ বিশুদ্ধ নহে– বিষয়ানন্দের সঙ্গে তাহা জড়িত; উর্ধ্বগতিতে এই আনন্দ পরমানন্দে, পরমানন্দ বিরমানন্দে, বিরমানন্দ সহজানন্দে পরিণতি লাভ করে; সহজানন্দের পরিপূর্ণ অনুভূতি উষ্ণীষকমলে। এই সহজানন্দদায়িনী শক্তিই হইলেন বৌদ্ধ-সহজিয়া– তথা বৌদ্ধ-তান্ত্রিকগণের দেবী; এইজন্য তিনি সর্বদাই সহজস্বরূপা বা সহজানন্দরূপিণী। এই সহজানন্দের মধ্যে চিত্তের সম্পূর্ণ বিলোপেই যথার্থ নৈরাত্ম্যে প্রতিষ্ঠা। তাই এই শক্তি নৈরাত্মারূপিণী বা আদরিণী ‘নৈরামণি’। এই আনন্দরূপিণীর প্রথম উদ্বোধের পরে তাঁহাকে ক্রমে হৃদয়ে (ধর্মচক্রে) ধারণ– সেখান হইতে তাঁহাকে কণ্ঠে ধারণ (সম্ভোগচক্রে)– এই সমস্তের ভিতর দিয়াই দেবী বা যোগিনীর সহিত বজ্রধর সাধকচিত্তের সুরত-যোগ; এই সুরতযোগের পরিণতি দেহ-পর্বতের উচ্চশিখর উষ্ণীষকমলে অচ্যুত সহজানন্দের পূর্ণানুভূতিতে– সে অনুভূতিতে সাধকচিত্তের সহজ-স্বরূপিণীর ভিতরে সম্পূর্ণ বিলোপে অদ্বয় সামরস্যের উদ্ভব– তখনই দেবীসঙ্গে সর্বতোভাবে যুক্ত বজ্রধরের যুগনদ্ধস্থিতি।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১৩৮-৩৯)
তবে এই গুরুমুখী সাধনা গুরুর মাধ্যমে এবং গুরুর কৃপা ছাড়া সফল হওয়া সম্ভব নয় বলে তন্ত্রে নির্দেশনা রয়েছে। হিন্দু-তন্ত্রে যেভাবে এই গুরুর অপরিহার্যতা বর্ণিত হয়েছে, বৌদ্ধ-তন্ত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু গুরুর পক্ষে শিষ্য নির্বাচন এবং তাকে যথার্থ সাধনপন্থায় চালনা করে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিলো না। এ-প্রেক্ষিতে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষণ হলো–
‘সাধনমার্গের কোন্ পথে শিষ্যের স্বাভাবিক প্রবণতা গভীর বিচার করিয়া তাহা স্থির করিতে হইত। এই বিচার-বিশ্লেষণের অভিনব একটি পদ্ধতি তাঁহারা আবিষ্কার করিয়াছিলেন; এই পদ্ধতির নাম ছিল কুলনির্ণয়-পদ্ধতি। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী এই পাঁচ রকমের কুল। এই পাঁচটি কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। যে পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চবায়ুর সারোত্তম দ্বারা এই ভৌতিক মানবদেহ গঠিত, ব্যক্তি বিশেষের দেহে তাহাদের মধ্যে যে স্কন্ধটি অধিকতর সক্রিয়, সেই অনুযায়ী তাহার কুল নির্ণীত হয় এবং তদনুযায়ী সাধনপন্থাও স্থিরীকৃত হয়। বৈষ্ণব পদকর্তা ও সাধক চণ্ডীদাসের রজকী বা রজকিনী বজ্রযান-সহজযান মতে চণ্ডীদাসের কুলেরই সূচক, আর কিছুর নহে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫২৯)
‘সাধনমার্গের কোন্ পথে শিষ্যের স্বাভাবিক প্রবণতা গভীর বিচার করিয়া তাহা স্থির করিতে হইত। এই বিচার-বিশ্লেষণের অভিনব একটি পদ্ধতি তাঁহারা আবিষ্কার করিয়াছিলেন; এই পদ্ধতির নাম ছিল কুলনির্ণয়-পদ্ধতি। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী এই পাঁচ রকমের কুল। এই পাঁচটি কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। যে পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চবায়ুর সারোত্তম দ্বারা এই ভৌতিক মানবদেহ গঠিত, ব্যক্তি বিশেষের দেহে তাহাদের মধ্যে যে স্কন্ধটি অধিকতর সক্রিয়, সেই অনুযায়ী তাহার কুল নির্ণীত হয় এবং তদনুযায়ী সাধনপন্থাও স্থিরীকৃত হয়। বৈষ্ণব পদকর্তা ও সাধক চণ্ডীদাসের রজকী বা রজকিনী বজ্রযান-সহজযান মতে চণ্ডীদাসের কুলেরই সূচক, আর কিছুর নহে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫২৯)
তন্ত্রসাধনার চক্রভেদ পর্যায়ের আলোচনায় শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য) বক্তব্যেও দেখি,– ‘এই আনন্দসন্দোহ-রূপিণী শক্তির যখন প্রথম নির্মাণচক্রে জাগরণ তখন সহসা জ্বলিত অগ্নির ন্যায় তাঁহার প্রচণ্ড দাহন; সেই চণ্ডস্বভাবা দেবীকেই বলা হইয়াছে ‘চণ্ডালী’ [‘চণ্ডালী জ্বলিতা নাভৌ’- হেবজ্রতন্ত্র]। আবার এই অতীন্দ্রিয় অনুভূতিরূপা দেবী ইন্দ্রিয় দ্বারা সর্বথা অস্পর্শা– এইজন্যই দেবী ‘ডোম্বী’ [‘অস্পর্শা ভবতি যস্মাৎ তস্মাৎ ডোম্বী প্রকীর্তিতা’- হেবজ্রতন্ত্র]। দেহরূপ নগরের বাহিরে অবস্থিত হইল এই ডোম্বীর কুঁড়েঘর– ‘ব্রাহ্মণ-নাড়িয়া’র দল তাহাদের সকল আচার-বিচার ও পাণ্ডিত্যাভিমান লইয়া ইহাকে যেন ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায়– ঠিক সঙ্গলাভ করিতে পারে না; সঙ্গলাভ করিতে পারে নিঘৃণ ‘নাঙ্গ’ (অর্থাৎ সর্ববিধ-আবরণ-রহিত) কপালিক যোগী। একটি হইল পদ্ম, চৌষট্টিটি তাহাতে পাপড়ি (নির্মানচক্রস্থিত চৌষট্টিদলযুক্ত পদ্ম), তাহাতে চড়িয়া নাচে এই ‘ডোম্বী বাপুড়ী’ [১০ম সংখ্যক চর্যা]। যে পর্যন্ত এই নির্মাণচক্রের পদ্মেই ‘ডোম্বী’র আনন্দস্পন্দনের নৃত্য সে পর্যন্ত ‘ডোম্বী’ খুব ভাল নহে– কারণ তখনও বিষয়ানন্দের সঙ্গে বজ্রধর সাধকচিত্তের যোগ আছে; তাহার পরে নৃত্যের তালে তালে যখন ঊর্ধ্বায়ন আরম্ভ হইল তখন ডোম্বী আদরিণী হইয়া হৃদয়ে– পরে কণ্ঠে স্থান পাইল; উষ্ণীষকমলে গিয়া–
ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো।
খুহ ণ ছাড়অ সহজ উন্মত্তো।।’
ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো।
খুহ ণ ছাড়অ সহজ উন্মত্তো।।’
চর্যাপদাদিতে বর্ণিত এই সহজানন্দরূপিণী শক্তিরূপিণী দেবীর কল্পনা তথা সহজযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গূঢ় সাধন-পদ্ধতি ও ধ্যান-ধারণার সূক্ষ্ম গভীর পরিচয় দোহাকোষের দোহা এবং চর্যাগীতির গীতগুলিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিধৃত হয়ে আছে।
বৌদ্ধ মহাযান ধর্মের এই যে সহজযানে বিরাট বিবর্তন তার নেতৃত্ব যাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, সমসাময়িক বৌদ্ধ ঐতিহ্যে তাঁদেরকেই বলা হয়েছে সিদ্ধ বা সিদ্ধাচার্য। এঁদেরকে চুরাশি-সিদ্ধাও বলা হয়। চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের সবাই ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা বলা কঠিন, তবে তাঁদের অনেকেই যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে তাঁরা জীবিত ছিলেন সে-সম্বন্ধে সন্দেহের কোন কারণ নেই বলে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের অভিমত। কেননা,–
‘অনেকে অনেক গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহাদের তিব্বতী অনুবাদ আজও বিদ্যমান। ইহাদের মধ্যে সরহপাদ বা সরহবজ্র, নাগার্জুন, লুইপাদ, তিল্লোপাদ, নাড়োপাদ, শবরপাদ, অদ্বয়বজ্র, কাহ্নপাদ, ভুসুকু, কুক্কুরিপাদ প্রভৃতি সিদ্ধাচার্যেরাই প্রধান। বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুযায়ী সরহের বাড়ি ছিল পূর্ব-ভারতের রাজ্ঞী-শহরে; তিনি ছিলেন রত্নপালের সমসাময়িক। উড্ডিয়ানে তাঁহার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা এবং আচার্যের পদ অধিকার করিয়াছিলেন নালন্দা-মহাবিহারে। নাগার্জুন ছিলেন সরহপাদের শিষ্য এবং নালন্দায় তাঁহার দীক্ষা হইয়াছিল। তিল্লোপাদের বা তৈলিকপাদের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে, তাঁহার বংশ ব্রাহ্মণ বংশ; তিনি ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক এবং পণ্ডিত-বিহারের অধিবাসী। নাড়োপাদ জয়পালের সমসাময়িক ছিলেন, বাড়ি ছিল বরেন্দ্রীতে এবং প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক জেতারির তিনি শিষ্য ছিলেন। নাড়োপাদ প্রথমে ছিলেন ফুল্লহরি-বিহারে; পরে বিক্রমশীল-বিহারের অধিবাসী হন। ভুসুকুর বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে এবং তিনি ছিলেন অতীশ-দীপঙ্করের শিষ্য। লুইপাদও বোধ হয় বাঙালী ছিলেন, যদিও পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে তাঁহাকে বলা হইয়াছে ‘উড্ডিয়ান-বিনির্গত’। অবধূতপাদ অদ্বয়বজ্র সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে। কুক্কুরিপাদ ছিলেন বাঙলার এক ব্রাহ্মণ-পরিবার হইতে উদ্ভূত, পরে বৌদ্ধতন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া ডাকিনীদের দেশ হইতে মহাযানতন্ত্র উদ্ধার করিয়া আনেন। শবরপাদ ছিলেন সরহপাদের শিষ্য; সিদ্ধপূর্বজীবনে তিনি ছিলেন বঙ্গালদেশের পার্বত্যভূমির একজন শবর। ত্যাঙ্গুরে অবশ্য শবরীপাদের বাড়ি যেন ইঙ্গিত করা হইয়াছে মগধে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩০)
‘অনেকে অনেক গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহাদের তিব্বতী অনুবাদ আজও বিদ্যমান। ইহাদের মধ্যে সরহপাদ বা সরহবজ্র, নাগার্জুন, লুইপাদ, তিল্লোপাদ, নাড়োপাদ, শবরপাদ, অদ্বয়বজ্র, কাহ্নপাদ, ভুসুকু, কুক্কুরিপাদ প্রভৃতি সিদ্ধাচার্যেরাই প্রধান। বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুযায়ী সরহের বাড়ি ছিল পূর্ব-ভারতের রাজ্ঞী-শহরে; তিনি ছিলেন রত্নপালের সমসাময়িক। উড্ডিয়ানে তাঁহার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা এবং আচার্যের পদ অধিকার করিয়াছিলেন নালন্দা-মহাবিহারে। নাগার্জুন ছিলেন সরহপাদের শিষ্য এবং নালন্দায় তাঁহার দীক্ষা হইয়াছিল। তিল্লোপাদের বা তৈলিকপাদের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে, তাঁহার বংশ ব্রাহ্মণ বংশ; তিনি ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক এবং পণ্ডিত-বিহারের অধিবাসী। নাড়োপাদ জয়পালের সমসাময়িক ছিলেন, বাড়ি ছিল বরেন্দ্রীতে এবং প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক জেতারির তিনি শিষ্য ছিলেন। নাড়োপাদ প্রথমে ছিলেন ফুল্লহরি-বিহারে; পরে বিক্রমশীল-বিহারের অধিবাসী হন। ভুসুকুর বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে এবং তিনি ছিলেন অতীশ-দীপঙ্করের শিষ্য। লুইপাদও বোধ হয় বাঙালী ছিলেন, যদিও পাগ-সাম-জোন-জাং-গ্রন্থে তাঁহাকে বলা হইয়াছে ‘উড্ডিয়ান-বিনির্গত’। অবধূতপাদ অদ্বয়বজ্র সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে। কুক্কুরিপাদ ছিলেন বাঙলার এক ব্রাহ্মণ-পরিবার হইতে উদ্ভূত, পরে বৌদ্ধতন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া ডাকিনীদের দেশ হইতে মহাযানতন্ত্র উদ্ধার করিয়া আনেন। শবরপাদ ছিলেন সরহপাদের শিষ্য; সিদ্ধপূর্বজীবনে তিনি ছিলেন বঙ্গালদেশের পার্বত্যভূমির একজন শবর। ত্যাঙ্গুরে অবশ্য শবরীপাদের বাড়ি যেন ইঙ্গিত করা হইয়াছে মগধে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩০)
হঠযোগ
ভারতবর্ষীয় প্রায় সকল উপাসক সম্প্রদায়ের মধ্যেই দৈহিক কায়সাধন প্রধানতম সাধনপ্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃত। আর তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যে কায়সাধনের উপায় হিসেবে যোগাভ্যাস চর্চাই সর্বাধিক গৃহীত এবং সাধক যোগীদের সাধনপন্থায় হঠযোগকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হঠপ্রদীপিকা, দত্তাত্রেয়সংহিতা, গোরক্ষসংহিতা– এই তিন গ্রন্থে যোগী-সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠেয় যোগপ্রণালীর আসন প্রাণায়ামাদি সমুদায় অঙ্গের ও ষট্চক্র-সাধনের সবিশেষ বৃত্তান্ত বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
দত্তাত্রেয়সংহিতায় যোগের অষ্ট অঙ্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে–
যমশ্চ নিয়মশ্চৈব আসনঞ্চ ততঃ পরম্ ।
প্রাণায়ামশ্চতুর্থঃ স্যাত্ প্রত্যাহারশ্চ পঞ্চমঃ।।
ষষ্ঠী তু ধারণা প্রোক্তা ধ্যানং সপ্তমমূচ্যতে।
সমাধিরষ্টমঃ প্রোক্তঃ সর্বপুণ্যফলপ্রদঃ।।- (দত্তাত্রেয়সংহিতা)
অর্থাৎ : যম প্রথম, নিয়ম দ্বিতীয়, তৎপরে আসন তৃতীয়, প্রাণায়াম চতুর্থ, প্রত্যাহার পঞ্চম, ধারণা ষষ্ঠ, ধ্যান সপ্তম, এবং সমস্ত পুণ্য-ফল-দায়ক সমাধি অষ্টম অঙ্গ।
তবে গোরক্ষসংহিতা’য় হঠপ্রদীপিকা ও দত্তাত্রেয়সংহিতার প্রণালীক্রমে আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই ছয় যোগাঙ্গ নির্দেশিত হলেও যম ও নিয়ম এই দু’টি অঙ্গের প্রসঙ্গ নেই। যেমন–
আসনং প্রাণসংরোধঃ প্রত্যাহারশ্চ ধারণা।
ধ্যানং সমাধিরেতানি যোগাঙ্গানি বদন্তি ষট্ ।।- (গোরক্ষসংহিতা)
অর্থাৎ : আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি– এই ছয়টি বিষয় যোগের অঙ্গ বলিয়া উল্লিখিত হয়।
গোরক্ষসংহিতায় যম ও নিয়মের বিষয়টি উল্লিখিত না হলেও হঠপ্রদীপিকার প্রথম উপদেশে কিন্তু যম ও নিয়মের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে–
অহিংসা সত্ত্যমস্তেয়ং ব্রহ্মচর্য্যং কৃপার্জবম্ ।
ক্ষমাধৃতির্ম্মিতাহারঃ শৌচং চেতি যমা দশ।।
তপঃ সন্তোষ আস্তিকাং দানং দেবস্য পূজনম্ ।
সিদ্ধান্তশ্রবণঞ্চৈব হ্রী মতিশ্চ জপোহুতম্ ।।
দশৈতে নিয়মাঃ প্রোক্তা যোগশাস্ত্রবিশারদৈঃ।। (হঠপ্রদীপিকা প্রথম উপদেশ)
অর্থাৎ : যোগশাস্ত্র বিশারদদের মতে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, কৃপা, ক্ষমা, ধৃতি, সারল্য, পরিমিত আহার, শৌচাচার এই দশের নাম যম। তপস্যা, সন্তোষ, আস্তিকতা, দান, দেব-পূজা, সিদ্ধান্ত শ্রবণ, লজ্জা, মতি, জপ, হোম, এই দশের নাম নিয়ম।
কেবল পরিমিত আহার নয়, ভোজন বিষয়েও যোগীদের এমন কিছু কঠোর নিয়ম পালন করবার ব্যবস্থা রয়েছে যে তাতে করে তান্ত্রিক পঞ্চতত্ত্বের সাধনগামিতা থেকে এই যোগীদের সাধনপন্থার ভিন্নতা খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। এই যোগীরা বস্তুত নাথ-যোগী বা অবধূত-যোগী। কারণ হঠপ্রদীপিকার বিধানানুসারে অম্ল, লবণ, কটু, তিক্ত– এই চার প্রকার রস এবং মৎস্য, মাংস, মদ্য প্রভৃতি তাদের অভক্ষ্য ঘোষণা করে বলা হয়েছে–
কটুম্লতিক্তলবণোষ্ণহরীত শাক-
সৌবীরতৈলতিলসর্ষপমত্সামদ্যম্ ।।
অজাদিমাংসদধিতক্রকুলন্থকোল-
পিন্যাকহিঙ্গুলসুনাদ্যমপথ্যমাহুঃ।।- (হঠপ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : কটু, অম্ল, তিক্ত, লবণ, উষ্ণ দ্রব্য, হরীত শাক, বদরী ফল, তৈল, তিল, সর্ষপ, মৎস, মদ্য, ছাগলাদির মাংস, দধি, তক্র, কুলন্থ, কলায়, বরাহ মাংস, পিন্যাক, হিঙ্গু, লসুনাদি দ্রব্য যোগীদিগের অপথ্য।গোধূমশালিয়বযষ্টিশভৌনান্নং
ক্ষীরাদ্যখণ্ডনবনীতসিতামধূনি।
শুঠোকপোলকফলাদিকপঞ্চশাকং
মুদ্গাদিদিব্যমূদকঞ্চ যমীন্দ্রপথ্যম্ ।।- (হঠপ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : গোধূম, শালিধান্য, যব, যষ্টিক ধান্যরূপ সুচারু অন্ন, ক্ষীর, অখণ্ড নবনীত, চিনি মধু, শুণ্ঠী, কপোলক ফল, পঞ্চশাক, মুদ্গ প্রভৃতি এবং উত্তম জল এই সকল সামগ্রী যোগীর পথ্য।
শুধু তাই নয়, তন্ত্র-সাধনায় পঞ্চোপচারে যেখানে মৈথুনতত্ত্ব আবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, সেখানে এই যোগীদের জন্য দত্তাত্রেয়সংহিতায় স্ত্রী-সংসর্গ কোনরূপেই কর্তব্য নয় বলে বিধানারোপ করে বলা হয়েছে–
যদি সঙ্গং করোত্যেব বিন্দুস্তস্য বিনশ্যতি।
আয়ুক্ষয়োবিন্দুহীনাদসামর্থঞ্চ জায়তে।।
তস্মাৎ স্ত্রীণাং সঙ্গবর্জ্যং কুর্যাদভ্যাসসমাদরাৎ।
যোগিনোহঙ্গল্য সিদ্ধিঃস্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ।।- (দত্তাত্রেয়সংহিতা)
অর্থাৎ : স্ত্রী-সঙ্গ করিলে বিন্দু-ক্ষয় হয় এবং বিন্দু-ক্ষয় হইলে আয়ু-নাশ ও বল বিনাশ হয়। অতএব যত্নপূর্বক স্ত্রীলোকের সঙ্গ ত্যাগ অভ্যাস করিবে। বিন্দু ধারণ দ্বারা যোগীদের যোগাঙ্গ সমুদায় সতত সিদ্ধ হইয়া থাকে।
হঠপ্রদীপিকায় বিধান আছে যে, হঠযোগীরা উপদ্রব-শূন্য নির্জন-স্থানে অবস্থিতিপূর্বক যোগ-মঠে উপবিষ্ট হয়ে যোগাভ্যাস করবেন। এই মঠ যে স্থানে যেভাবে নির্মাণ করতে হবে এবং যেভাবে পরিষ্কৃত রাখতে হবে তাও বর্ণিত হয়েছে এভাবে–
সুরাজ্যে ধার্মিকে দেশে সুভিক্ষে নিরুপদ্রবে।
একান্তমাঠকামধ্যে স্থাতক্যং হঠযোগিণাম্ ।।- (হঠপ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : যেখানে বহু সংখ্যক ধার্মিক লোকের বাস আছে এবং সুন্দররূপ ভিক্ষা পাওয়া যায় এইরূপ উপদ্রব-শূন্য উত্তম রাজ্য-স্থিত যোগ মঠে হঠযোগীরা নির্জনে বাস করিবেন।স্বল্পদ্বারমরন্ধ্রগর্তপিটকং নাত্যুচ্চনীচায়তং
সম্যগ্গোময়সান্দ্রলিপ্তমমলং নিঃশেষবাধোজ্ঝিতম্ ।
বাহ্যেমণ্ডপকূপবেদিরচিতং প্রাকারসম্বেষ্টিতং
প্রোক্তং যোগমঠস্য লক্ষণমিদং সিদ্ধৈর্হঠাভ্যাসিভিঃ।।- (হঠপ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : যোগ-মঠ ক্ষুদ্র দ্বার বিশিষ্ট, রন্ধ্রহীন, না অতি উচ্চ না নিম্ন, সম্যকরূপে গোময়-লিপ্ত, পরিষ্কৃত ও নিঃশেষরূপে যোগ-বাধক দ্রব্য-বিহীন হইবে, বাহিরে মণ্ডল, কূপ ও বেদি প্রস্তুত হইবে, এবং সমগ্র মঠ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকিবে। হঠযোগীরা যোগমঠের এইরূপ লক্ষণ বলিয়া গিয়াছেন।
এভাবে যোগ-মঠ সর্বদা পরিষ্কৃত রেখে এবং সুগন্ধ দ্বারা সুবাসিত করে তার মধ্যে উপবেশনপূর্বক যোগাভ্যাস করার কথা দত্তাত্রেয়সংহিতায় বলা হয়েছে। এখানে বলা বাহুল্য যে, হঠযোগীদের এই দেহাশ্রয়ী হঠযোগ চর্চা তান্ত্রিক বামাচারী কায়সাধনেও আবশ্যক বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই বর্তমান আলোচনা শেষ করার আগে এই হঠযোগাভ্যাসের অন্য বিশিষ্ট দিকগুলো সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে কিছুটা পরিচিত হতে পারি।
হঠযোগচর্চায় উপবেশনের যে নানারূপ কৌশল আছে, তাকে আসন বলে। এই আসন চৌরাশি প্রকার, তার মধ্যে পদ্মাসনই সচরাচর প্রচলিত। দত্তাত্রেয়-সংহিতায় ঐ আসনই শ্রেষ্ঠ আসন বলে উক্ত হয়েছে, যদিও হঠপ্রদীপিকায় সিদ্ধাসন সর্বশ্রেষ্ঠ বলে লিখিত আছে। কিভাবে এই আসন অনুষ্ঠান করতে হয়, তা গোরক্ষসংহিতায় বলা হয়েছে–
বামোরূপরি দক্ষিণং হি চরণং সংস্থাপ্র্য বামং তথা-
প্যন্যোরূপরি তস্য বন্ধনবিধৌধৃত্বা করাভ্যাং দৃঢ়ম্ ।
অঙ্গুষ্ঠং হৃদয়ে নিধায় চিবুকং নাসাগ্রমালোকয়ে-
দেতদ্ব্যাধিবিনাশকারি যমিনাং পদ্মাসনং প্রোচ্যতে।।- (গোরক্ষসংহিতা)
অর্থাৎ : বাম ঊরুপরি দক্ষিণ পদ ও দক্ষিণ ঊরুপরি বাম পদ সংস্থাপন করিবে, ও যেরূপ করিয়া কোন বস্তু বন্ধন করিতে হয় সেইরূপে পশ্চাৎভাগ দিয়া দুই হস্ত দ্বারা অঙ্গুষ্ঠ ধারণ করিবে এবং চিবুক বক্ষঃস্থলে স্থাপন করিয়া নাসিকার অগ্রভাগ দৃষ্টি করিতে থাকিবে। যতিদিগের এই আসনকে পদ্মাসন বলে। ইহা ব্যাধি-নাশক।
এভাবে আসন-বদ্ধ হয়ে যোগের প্রাণায়াম করার বিধান রয়েছে অর্থাৎ নাসিকা দ্বারা শরীর-মধ্যে বায়ু পূরণ ও ধারণ করে পরে রেচন করবে। তার বিশেষ বিশেষ কাল, সংখ্যা ও প্রকার উল্লিখিত যোগশাস্ত্রগুলিতে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। যোগশাস্ত্রের বিধানক্রমে- শরীর-মধ্যে বায়ু-স্তম্ভন অর্থাৎ নিশ্বাস অবরোধ করাকে কুম্ভক বলে (দক্ষিণ হস্তেন নাসাপুটদ্বয়ং ধৃত্বা প্রাণায়ামাঙ্গং বায়ুস্তম্ভনমিতিতন্ত্রম), তা প্রাণায়ামেরই অঙ্গ-বিশেষ। কুম্ভক নানাপ্রকার–
‘যে কুম্ভকের দ্বারা বিজৃম্ভন এবং মুখ ও নাসিকার শীৎকার হয়, তাহার নাম শীৎকার-কুম্ভক। যে কুম্ভক দ্বারা বায়ু পূরণ-কালে ভৃঙ্গ-নাদ এবং রেচন-কালে ভৃঙ্গী-নাদ হয়, তাহার নাম ভ্রমরী-কুম্ভক। হঠপ্রদীপিকাররচয়িতা এইরূপ নানা কুম্ভকের বিবরণ করিয়া পরে লিখিয়াছেন, যোগীরা অভ্যাস-বলে রেচন ও পূরণ না করিয়াও কুম্ভকসাধন করিতে সমর্থ হন। এ অবস্থায় তাঁহাদের কিছুই দুর্লভ থাকে না। এইরূপ লিখিত আছে যে, ক্রমাগত অভ্যাস দ্বারা সাধকেরা আসন হইতে শূন্যে উত্থিত হইয়া অবস্থিতি করিতে পারেন।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, অক্ষয় কুমার দত্ত)
‘যে কুম্ভকের দ্বারা বিজৃম্ভন এবং মুখ ও নাসিকার শীৎকার হয়, তাহার নাম শীৎকার-কুম্ভক। যে কুম্ভক দ্বারা বায়ু পূরণ-কালে ভৃঙ্গ-নাদ এবং রেচন-কালে ভৃঙ্গী-নাদ হয়, তাহার নাম ভ্রমরী-কুম্ভক। হঠপ্রদীপিকাররচয়িতা এইরূপ নানা কুম্ভকের বিবরণ করিয়া পরে লিখিয়াছেন, যোগীরা অভ্যাস-বলে রেচন ও পূরণ না করিয়াও কুম্ভকসাধন করিতে সমর্থ হন। এ অবস্থায় তাঁহাদের কিছুই দুর্লভ থাকে না। এইরূপ লিখিত আছে যে, ক্রমাগত অভ্যাস দ্বারা সাধকেরা আসন হইতে শূন্যে উত্থিত হইয়া অবস্থিতি করিতে পারেন।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, অক্ষয় কুমার দত্ত)
যোগীদের এরকম বিশ্বাস আছে যে, প্রাণায়াম সিদ্ধ হলে দেহের লঘুতা, দীপ্তি ও অগ্নি-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। যেমন–
শরীরলঘুতা দীপ্তিতর্জঠরাগ্নিবিবর্ধনম্ ।
কৃশত্বঞ্চ শরীরস্য তস্য জায়েত নিশ্চিতম্ ।।- (দত্তাত্রেয়-সংহিতা)
অর্থাৎ : তাঁহার শরীরের লঘুতা ও দীপ্তি এবং জঠরাগ্নি-বৃদ্ধি ও দেহের কৃশতা অবশ্যই হয়।
এভাবে প্রাণায়াম অভ্যাসে শরীর শুদ্ধ না হয়ে শ্লেষ্মাদি-ঘটিত পীড়া জন্মিলে, ধৌতী নেতী প্রভৃতি কতকগুলি ব্যাপারের অনুষ্ঠান করবার ব্যবস্থা যোগশাস্ত্রে বর্ণিত আছে, যেমন–
চতুরঙ্গুলবিস্তারং হস্তপঞ্চদশেন তু।
গুরুপদিষ্টমার্গেন সিক্তবস্ত্রং শনৈর্গ্রসেৎ।
ততঃ প্রত্যাহরেচ্চৈতৎ ক্ষালনং বস্তিকর্ম তৎ।।
কাসশ্বাসপ্লীহকুষ্ঠকক্ষরোগাশ্চ বিংশতিঃ।
ধৌতীকর্মপ্রসাদনে শুদ্ধ্যন্তে ন চ সংশয়ঃ।।- (হঠপ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : দৈর্ঘ্যে পনের হাত ও প্রস্থে চারি অঙ্গুলি প্রমাণ একখণ্ড জলসিক্ত বস্ত্র গুরুপদিষ্ট পথ দ্বারা ক্রমশঃ গ্রাস করিবে এবং পরে তাহা নির্গত করিয়া ফেলিবে। ইহাকে বস্তি-কর্ম কহে। এই ধৌতী-কর্ম দ্বারা কাশ, শ্বাস, প্লীহা, কুষ্ঠ, কক্ষ-রোগ প্রভৃতি বিংশতি প্রকার রোগের শান্তি হয়।
এভাবে, নাসিকা দ্বারা সূত্র প্রবেশ করিয়ে মুখ দ্বারা নির্গত করণের নাম নতী-কর্ম। আবার, নেত্র-যুগল স্থির করে যতক্ষণ না অশ্রুপাত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সূক্ষ্ম লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখবার নাম ত্রাটক-কর্ম। এভাবে, শরীর-মধ্যে জল-পূরণ বায়ু-পূরণ ও ঐ উভয়ের নির্গমন প্রভৃতি নানাবিধ অনুষ্ঠানের বিধান আছে। এসব কর্মানুষ্ঠান ছাড়া যোগীরা কয়েক প্রকার অঙ্গ-ভঙ্গি প্রভৃতি অভ্যাস করে থাকেন, তার নাম মুদ্রা। যেমন–
অন্তঃকপালবিবরে জিহ্বাং ব্যাবত্ত বন্ধয়েৎ।
ভ্রূমধ্যে দৃষ্টিরপ্যেষা মুদ্রা ভবতি খেচরী।।- (দত্তাত্রেয়-সংহিতা)
অর্থাৎ : কপাল-বিবরের অভ্যন্তরে জিহ্বাকে ব্যাবৃত্ত ও বন্ধ করিয়া ভ্রূ-মধ্যে দৃষ্টি রাখিবে। ইহার নাম খেচরী মুদ্রা।অধঃশিরশ্চোর্দ্ধপাদঃ ক্ষণং স্যাৎ প্রথমে দিনে।
ক্ষণাঞ্চ কিঞ্চিদধিকম্ভ্যসেদ্ধি দিনে দিনে।।
বলিতং পলিতং চৈব ষন্মাসাদ্ধি বিনাসয়েৎ।
যামমাত্রন্তু যো নিত্যমভ্যসেৎ স তু কালজিৎ।।- (হঠপ্রদীপিকা তৃতীয় উপদেশ)
অর্থাৎ : অধোভাগে মস্তক এবং ঊর্ধ্বদিকে পদ রাখিবে। প্রথম দিনে এইরূপ ক্ষণকাল সাধন করিবে এবং পরে দিন দিন অধিককাল ব্যাপিয়া অভ্যাস করিতে থাকিবে। এই প্রকার অনুষ্ঠান দ্বারা শুক্ল কেশ ও মাংস-কুঞ্চনরূপ বার্ধক্যের চিহ্ন ছয় মাস মধ্যে নষ্ট হইয়া যায়। প্রতিদিন এক প্রহর ব্যাপিয়া যিনি এইরূপ অভ্যাস করেন, তিনি মৃত্যুজয়ী হন।
কুম্ভক করবার সময় ইন্দ্রিয় সকলকে স্ব স্ব বিষয় থেকে নিরস্ত করার অন্যতম যোগাঙ্গের নাম প্রত্যাহার। দত্তাত্রেয়-সংহিতায় বলা হয়েছে–
একবারং প্রতিদিনং কুর্য্যাৎ কেবলকুম্ভকম্ ।
প্রত্যাহারোহি এবং স্যাৎ এবং কুর্য্যুর্হি যোগিনঃ।।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যো যৎ প্রত্যাহরতে স্ফুটম্ ।
যোগী কুম্ভকমাস্থায় প্রত্যাহারঃ স উচ্যতে।।- (দত্তাত্রেয়-সংহিতা)
অর্থাৎ : প্রতিদিন একবার করিয়া কেবল কুম্ভক করিবে। এইরূপেই প্রত্যাহার হইবে। যোগীরা এই রূপই অনুষ্ঠান করিবেন। যোগীতে কুম্ভকের অনুষ্ঠানপূর্বক ইন্দ্রিয় বিষয় হইতে ইন্দ্রিয় সকলকে সম্যকরূপ প্রত্যাহার করে, এই নিমিত্ত ইহা প্রত্যাহার বলিয়া উল্লিখিত হয়।
যোগের অন্য আরেক অঙ্গ ধারণা হলো শরীর-মধ্যে স্থান-বিশেষে বায়ু-ধারণ। এই ধারণা পাঁচ প্রকার– পৃথিবী ধারণা, আম্ভসী ধারণা, আগ্নেয়ী ধারণা, বায়বী ধারণা এবং নভো ধারণা।
‘পায়ু-দেশের ঊর্ধ্বে এবং নাভির অধোভাগে পাঁচ দণ্ডকাল বায়ু-ধারণের নাম পৃথিবী ধারণা। নাভি-স্থলে বায়ু-ধারণকে আম্ভসী, নাভির ঊর্ধ্ব মণ্ডলে বায়ু-ধারণকে আগ্নেয়ী, হৃদয়ে বায়ু-ধারণকে বায়বী এবং ভ্রূ-মধ্য হইতে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত মস্তকের সমুদায় স্থানে বায়ু-ধারণ করাকে নভো ধারণা কহে। যোগীদের বিশ্বাস এই যে, পৃথিবী ধারণ করিলে পৃথিবীতে মৃত্যু হয় না। আম্ভসী ধারণা করিলে জলে মৃত্যু হয় না, আগ্নেয়ী ধারণা করিলে অগ্নিতে শরীর দগ্ধ হয় না, বায়বী ধারণা করিলে কোন ভয় থাকে না এবং নভো ধারণা করিলে কোনরূপে মৃত্যু হয় না। শরীরের মধ্যে বায়ু-সঞ্চালন এবং বায়ু-ধারণই হঠযোগের প্রধান অনুষ্ঠান। গোরক্ষনাথ বলেন, বায়ু স্থির না হইলে কিছুই স্থির হয় না। সুতরাং সিদ্ধিলাভও হয় না।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, অক্ষয় কুমার দত্ত)
‘পায়ু-দেশের ঊর্ধ্বে এবং নাভির অধোভাগে পাঁচ দণ্ডকাল বায়ু-ধারণের নাম পৃথিবী ধারণা। নাভি-স্থলে বায়ু-ধারণকে আম্ভসী, নাভির ঊর্ধ্ব মণ্ডলে বায়ু-ধারণকে আগ্নেয়ী, হৃদয়ে বায়ু-ধারণকে বায়বী এবং ভ্রূ-মধ্য হইতে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত মস্তকের সমুদায় স্থানে বায়ু-ধারণ করাকে নভো ধারণা কহে। যোগীদের বিশ্বাস এই যে, পৃথিবী ধারণ করিলে পৃথিবীতে মৃত্যু হয় না। আম্ভসী ধারণা করিলে জলে মৃত্যু হয় না, আগ্নেয়ী ধারণা করিলে অগ্নিতে শরীর দগ্ধ হয় না, বায়বী ধারণা করিলে কোন ভয় থাকে না এবং নভো ধারণা করিলে কোনরূপে মৃত্যু হয় না। শরীরের মধ্যে বায়ু-সঞ্চালন এবং বায়ু-ধারণই হঠযোগের প্রধান অনুষ্ঠান। গোরক্ষনাথ বলেন, বায়ু স্থির না হইলে কিছুই স্থির হয় না। সুতরাং সিদ্ধিলাভও হয় না।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, অক্ষয় কুমার দত্ত)
মন্-থীরিতে পবন্-থীর পবন্-থীরিতে বিন্দুথীর।
বিন্দুথীরিতে কন্দথীর বলে গোরক্ষদেব সকলথীর।।- (হঠপ্রদীপিকা-ধৃত গোরক্ষ-বাক্য)
অর্থাৎ : গোরক্ষদেব বলেন, মন স্থির হইলে বায়ু স্থির হয়, বায়ু স্থির হইলে বিন্দু স্থির হয়, বিন্দু স্থির হইলে কন্দ স্থির হয়, এবং তাহা হইলেই সকল স্থির হয়।গজ বাধিয়া রাজ্য পবন বাধিয়া যোগী।
ধান্য বাধিয়া গৃহস্থ বিন্দু বাধিয়া ভোগী।।- (হঠপ্রদীপিকা-ধৃত নাথ-বাক্য)
অর্থাৎ : রাজা গজের বাধ্য, যোগী বায়ুর বাধ্য, গৃহস্থ ধান্যের বাধ্য, ভোগী বিন্দুর বাধ্য।
এরপর আসে যোগের পরবর্তী অঙ্গ ধ্যান। যোগশাস্ত্রের মতে ধ্যান দুই প্রকার– সগুণ অর্থাৎ সাকার দেবতার ধ্যান, এবং নির্গুণ অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান। যোগীরা সগুণ ধ্যান দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্য লাভ করেন, আর নির্গুণ ধ্যান দ্বারা সমাধিযুক্ত হয়ে ইচ্ছানুরূপ সকল শক্তি প্রাপ্ত হতে পারেন। দত্তাত্রেয়-সংহিতায় বলা হয়েছে–
সমভ্যসেত্তদা ধ্যানং ঘটিকাষষ্ঠীমেবচ।
বায়ুং নিরুদ্ধ তাং ধ্যায়েৎ দেবতামিষ্টদায়িনীম্ ।।
সগুণধ্যানমেতৎ স্যাদণিমাদিসুখপ্রদম্ ।
নির্গুণং খমির ধ্যায়ন্মোক্ষমার্গে প্রবর্ততে।।
নির্গুণধ্যানসম্পন্নঃ সমাধিঞ্চ সমভ্যসেৎ।
দিনদ্বাদশকেনৈব সমাধিং সমবাপ্নুয়াৎ।।- (দত্তাত্রেয়-সংহিতা)
অর্থাৎ : তখন ষাট দণ্ড কালই ধ্যান অভ্যাস করিবে, বায়ু নিরোধ করিয়া ইষ্টদায়িনী দেবতার ধ্যান করিবে। এই সগুণ ধ্যানে অণিমাদি সুখ লাভ হয়। আর আকাশের ন্যায় ব্যাপন-শীল নির্গুণ দেবতার ধ্যান করিলে, মোক্ষ-পথে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। নির্গুণ-ধ্যান সম্পন্ন হইয়া সমাধি অভ্যাস করিবে। করিলে, দ্বাদশ দিনে সমাধি প্রাপ্ত হইবে।
যোগীরা বিশ্বাস করেন, সমাধি সিদ্ধ হলে ইচ্ছানুসারে দেহত্যাগ বা দেহরক্ষা করে সুখ-সম্ভোগ করতে সক্ষম হন। কেননা তাঁদের বিশ্বাস, মহাদেব স্বীয় সাধককে নিম্নোক্ত অষ্ট ঐশ্বর্য দান করেন-
অণিমা লঘিমা ব্যাপ্তিঃ প্রাকাম্যং মহিমেশিত্য।
বশিকামাবসায়িত্বে ঐশ্বর্যমষ্টধা স্মৃতম।।- (শধশরদ্রুম-ধৃতশব্দমালা-বচন)
অর্থাৎ : অণিমা বা সূক্ষ্মতা অর্থাৎ ইচ্ছানুরূপ স্বীয় শরীর সূক্ষ্ম করিবার ক্ষমতা, লঘিমা বা লঘুতা অর্থাৎ ইচ্ছানুসারে নিজ দেহ লঘু করিবার ক্ষমতা, ব্যাপ্তি অর্থাৎ সর্বত্র গমন করিবার ক্ষমতা, প্রাকাম্য অর্থাৎ ভোগেচ্ছা পূর্ণ করিবার ক্ষমতা, মহিমা অর্থাৎ শরীরকে ইচ্ছামত স্থূল করিবার ক্ষমতা, ঈশিত্ব অর্থাৎ সকলকে শাসন করিবার ক্ষমতা, বশিত্ব অর্থাৎ সকলকে বশ করিবার ক্ষমতা এবং কামাবসায়িতা অর্থাৎ আপনার সর্ব কামনা পূর্ণ করিবার ক্ষমতা। এই আট প্রকার ক্ষমতার নাম অষ্ট ঐশ্বর্য।
তাই সমাধি সিদ্ধ হলে, যদি দেহ-ত্যাগের ইচ্ছা হয় তবে যোগী তৎক্ষণাৎ পরব্রহ্মে লীন হতে পারেন, নতুনা অণিমাদি ঐশ্বর্য লাভ করে স্বেচ্ছানুসারে সকল লোকে অশেষবিধ সুখ-সম্ভোগ পূর্বক বিচরণ করতে পারেন। দত্তাত্রেয়-সংহিতায় বলা হয়েছে–
সর্বলোকেষু বিচরেদণিমাদিগুণান্বিতঃ।
কদাচিৎ স্বেচ্ছয়া দেবোভূত্বা স্বর্গেহপি সঞ্চরেৎ।
মনুষ্যোবাপি যজ্ঞোবা স্বেচ্ছয়াপি ক্ষণাম্ভবেৎ।
সিংহোব্যাঘ্রোগজোবাপি স্যাদিচ্ছাতো হন্যজন্মতঃ।।- (দত্তাত্রেয়-সংহিতা)
অর্থাৎ : অণিমাদি ঐশ্বর্য বিশিষ্ট হইয়া সর্বলোকে বিচরণ করেন, কদাচিৎ ইচ্ছাধীন দেব-রূপ ধারণ করিয়া স্বর্গ-লোকে ভ্রমণ করেন এবং জন্মান্তরে ইচ্ছামত ক্ষণমাত্রে মনুষ্য, যক্ষ, সিংহ, ব্যাঘ্র বা হস্তী হইয়া থাকেন।
হঠপ্রদীপিকা প্রভৃতি গ্রন্থে যোগীদের অলৌকিক ক্রিয়া সাধনের এমন অনেক বৃত্তান্ত রয়েছে। এই সাধন-তান্ত্রিক বিশ্বাস যেগুলি সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনা থেকেই উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। উল্লেখ্য, ষট্চক্রভেদ যোগীদের একটি প্রধান সাধন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি প্রায় অনুরূপ হওয়ায় এবং এ-বিষয়ে ইতঃপূর্বে তন্ত্র-সাধনা অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে তার পুনরুক্তি ঘটানো বাহুল্য হবে।
বৌদ্ধ-তন্ত্রের পরিণতি
হীনযান, মহাযান, বজ্রযান প্রভৃতিকে পণ্ডিতেরা প্রথাগত ধর্ম না বলে বিশিষ্ট সাধনপদ্ধতি আখ্যা দিয়েছেন। কেননা তাঁদের মতে ধর্ম ব্যাপারটা সাধারণ গৃহী মানুষের জন্য। দর্শনতাত্ত্বিক যে সকল বিষয় নিয়ে হীনযানী সম্প্রদায়সূহের মধ্যে বিতর্ক বর্তমান সেগুলি সাধারণ মানুষের বিষয় নয়, একমাত্র মঠবাসী ভিক্ষুরাই এসকল বিষয়ে আকৃষ্ট হতে পারেন। এ-প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন,–
‘মহাযানীরা এই সমস্যা সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং বুদ্ধপূজার প্রবর্তন করে ও কিছু স্থানীয় দেবদেবীকে বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের মধ্যে নিয়ে এসে সাধারণ মানুষের নিকট যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মহাযান মতের বিশেষত্বের জন্যেই সেক্ষেত্রে সাফল্য আসেনি। ধর্মশূন্যতা ও পুদ্গলশূন্যতার যুগপৎ উপলব্ধি, বা জগতকে ‘বন্ধ্যা নারীর কন্যার সৌন্দর্যের ন্যায় মিথ্যা’ হিসাবে উপলব্ধির ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের এলাকায় আসে না। নিজেকে বুদ্ধ এবং সঙ্গিনীকে বুদ্ধের শক্তি হিসাবে কল্পনা করে প্রজ্ঞোপায়ের অদ্বয়ত্বের উপলব্ধির জন্য যুগনদ্ধ সাধনা সাধারণ গৃহী মানুষের কল্পনাতেও আসতে পারে না। এই কারণে এইগুলিকে ‘যান’ বা সাধনমার্গ বলা হয়েছে, যার সঙ্গে সর্বজনের পক্ষে সহজপালনীয় ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১১৮)
‘মহাযানীরা এই সমস্যা সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং বুদ্ধপূজার প্রবর্তন করে ও কিছু স্থানীয় দেবদেবীকে বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের মধ্যে নিয়ে এসে সাধারণ মানুষের নিকট যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মহাযান মতের বিশেষত্বের জন্যেই সেক্ষেত্রে সাফল্য আসেনি। ধর্মশূন্যতা ও পুদ্গলশূন্যতার যুগপৎ উপলব্ধি, বা জগতকে ‘বন্ধ্যা নারীর কন্যার সৌন্দর্যের ন্যায় মিথ্যা’ হিসাবে উপলব্ধির ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের এলাকায় আসে না। নিজেকে বুদ্ধ এবং সঙ্গিনীকে বুদ্ধের শক্তি হিসাবে কল্পনা করে প্রজ্ঞোপায়ের অদ্বয়ত্বের উপলব্ধির জন্য যুগনদ্ধ সাধনা সাধারণ গৃহী মানুষের কল্পনাতেও আসতে পারে না। এই কারণে এইগুলিকে ‘যান’ বা সাধনমার্গ বলা হয়েছে, যার সঙ্গে সর্বজনের পক্ষে সহজপালনীয় ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১১৮)
কিন্তু সাধন-পর্যায়ের বিবর্তন বা ক্রম-পরিবর্তনকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ-তন্ত্রযানের পরিণতি সম্পর্কে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষণ হলো–
‘বজ্রযান ও কালচক্রযানে ব্যবহারিক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্ষীণ হইলেও শ্রাবকযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের কিছু আভাস তবু বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ক্রমশ এই ধর্মের ব্যবহারিক অনুষ্ঠান কমিয়া আসিতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে গুহ্য সাধনা বাড়িতে আরম্ভ করিয়া অবশেষে গুহ্য সাধনটাই প্রবল ও প্রধান হইয়া দেখা দিল। তাহার উপর, সহজযান আবার লৌকিক বা লোকোত্তর কোনো বুদ্ধকেই স্বীকার করিল না; প্রব্রজ্যা বিনয়-শাসন, বজ্রযানের দেবদেবী প্রভৃতি সমস্ত কিছুই হইল নিন্দিত ও পরিত্যক্ত। রহিল শুধু কায়সাধন এবং দেহাশ্রয়ী হঠযোগ। বাঙলার ব্রাহ্মণ্য শক্তি-ধর্মেও অনুরূপ এক বিবর্তন ঘটিতেছিল এবং সেখানেও ক্রমশ শক্তিধর্মের বাহ্য আচারানুষ্ঠান পরিত্যক্ত হইয়া সূক্ষ্ম মিথুনযোগের গুহ্য সাধনপন্থাই প্রধান হইয়া উঠিল। উভয় ক্ষেত্রেই অবস্থাটা যখন এক তখন বৌদ্ধ মহাসুখবাদ ও গুহ্য সাধনপন্থার সঙ্গে শক্তি বা ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক মোক্ষ ও গুহ্য সাধনপন্থার পার্থক্য আর বিশেষ কিছু রহিল না, দু’য়ের মিলনও খুব সহজ হইয়া উঠিল। এই মিলন পাল-পর্বের শেষের দিকেই আরম্ভ হইয়াছিল এবং চতুর্দশ শতক নাগাদ পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। এই সময়ের মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম একেবারে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শক্তিধর্মের কুক্ষিগত হইয়া গেল।’– (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩০)
‘বজ্রযান ও কালচক্রযানে ব্যবহারিক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্ষীণ হইলেও শ্রাবকযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের কিছু আভাস তবু বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ক্রমশ এই ধর্মের ব্যবহারিক অনুষ্ঠান কমিয়া আসিতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে গুহ্য সাধনা বাড়িতে আরম্ভ করিয়া অবশেষে গুহ্য সাধনটাই প্রবল ও প্রধান হইয়া দেখা দিল। তাহার উপর, সহজযান আবার লৌকিক বা লোকোত্তর কোনো বুদ্ধকেই স্বীকার করিল না; প্রব্রজ্যা বিনয়-শাসন, বজ্রযানের দেবদেবী প্রভৃতি সমস্ত কিছুই হইল নিন্দিত ও পরিত্যক্ত। রহিল শুধু কায়সাধন এবং দেহাশ্রয়ী হঠযোগ। বাঙলার ব্রাহ্মণ্য শক্তি-ধর্মেও অনুরূপ এক বিবর্তন ঘটিতেছিল এবং সেখানেও ক্রমশ শক্তিধর্মের বাহ্য আচারানুষ্ঠান পরিত্যক্ত হইয়া সূক্ষ্ম মিথুনযোগের গুহ্য সাধনপন্থাই প্রধান হইয়া উঠিল। উভয় ক্ষেত্রেই অবস্থাটা যখন এক তখন বৌদ্ধ মহাসুখবাদ ও গুহ্য সাধনপন্থার সঙ্গে শক্তি বা ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক মোক্ষ ও গুহ্য সাধনপন্থার পার্থক্য আর বিশেষ কিছু রহিল না, দু’য়ের মিলনও খুব সহজ হইয়া উঠিল। এই মিলন পাল-পর্বের শেষের দিকেই আরম্ভ হইয়াছিল এবং চতুর্দশ শতক নাগাদ পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। এই সময়ের মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম একেবারে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শক্তিধর্মের কুক্ষিগত হইয়া গেল।’– (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩০)
তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ও শক্তি ধর্ম এবং নব বৌদ্ধ ধর্মের গুহ্য সাধনবাদের একত্র মিলনে পরবর্তীতে শক্তিধর্মের যে সব নতুন রূপ দেখা দিলো তার মধ্যে গবেষকদের মতে কৌলধর্মই প্রধান। কৌলধর্মের কয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থ নেপাল রাজকীয় গ্রন্থসংগ্রহে পাওয়া গেছে। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষ্যে–
‘কৌলধর্মীরা বলেন, তাঁহাদের ধর্মের মূল সূত্রগুলি গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথের শিক্ষা হইতে পাওয়া। মৎস্যেন্দ্রনাথকে অনেকে চুরাশি সিদ্ধাচার্যের অন্যতম লুইপাদের সঙ্গে অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে কৌলধর্ম নব বৌদ্ধ গুহ্য সাধনবাদ হইতেই উদ্ভূত, এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। তাহা ছাড়া পূর্বেই দেখিয়াছি, কুল বৌদ্ধ গুহ্য সাধনপন্থার একটি বিশেষ অঙ্গ; পঞ্চকুল প্রজ্ঞা বা শক্তির পাঁচটি রূপ; তাঁহাদের কর্তা হইতেছেন পঞ্চতথাগত। এই কুলতত্ত্ব যাঁহারা মানিয়া চলেন তাঁহারাই কৌল বা কুলপুত্র। কৌলমার্গীদের মতে কুল হইতেছেন শক্তি, কুলের বিপরীত অকুল হইতেছেন শিব এবং দেহের অভ্যন্তরে যে শক্তি কুণ্ডলাকারে সুপ্ত তিনি হইতেছেন কুলকুণ্ডলিনী। এই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করিয়া শিবের সঙ্গে পরিপূর্ণ এক করাই কৌলমার্গীর সাধনা।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩১)
‘কৌলধর্মীরা বলেন, তাঁহাদের ধর্মের মূল সূত্রগুলি গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথের শিক্ষা হইতে পাওয়া। মৎস্যেন্দ্রনাথকে অনেকে চুরাশি সিদ্ধাচার্যের অন্যতম লুইপাদের সঙ্গে অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে কৌলধর্ম নব বৌদ্ধ গুহ্য সাধনবাদ হইতেই উদ্ভূত, এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। তাহা ছাড়া পূর্বেই দেখিয়াছি, কুল বৌদ্ধ গুহ্য সাধনপন্থার একটি বিশেষ অঙ্গ; পঞ্চকুল প্রজ্ঞা বা শক্তির পাঁচটি রূপ; তাঁহাদের কর্তা হইতেছেন পঞ্চতথাগত। এই কুলতত্ত্ব যাঁহারা মানিয়া চলেন তাঁহারাই কৌল বা কুলপুত্র। কৌলমার্গীদের মতে কুল হইতেছেন শক্তি, কুলের বিপরীত অকুল হইতেছেন শিব এবং দেহের অভ্যন্তরে যে শক্তি কুণ্ডলাকারে সুপ্ত তিনি হইতেছেন কুলকুণ্ডলিনী। এই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করিয়া শিবের সঙ্গে পরিপূর্ণ এক করাই কৌলমার্গীর সাধনা।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩১)
কৌলমার্গীরা ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম স্বীকার করতেন। কিন্তু একই গুহ্য সাধনবাদ থেকে উদ্ভূত নাথধর্ম, অবধূত ধর্ম ও সহজিয়া ধর্ম বৌদ্ধ সহজযানীদের মতো বর্ণাশ্রমকে একেবারে অস্বীকার করতো। নাথ ও অবধূত এই দু’টি ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পাল-পর্বেই জানা নায়, আর সহজিয়া ধর্মের প্রথম সংবাদ পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতকে রাজা হরিকালদেবের একটি লিপিতে যেখানে উল্লেখ রয়েছে যে, হরিকালদেবের এক প্রধান রাজপুরুষ পট্টিকেরক নগরে সহজ-ধর্মকর্মে লিপ্ত ছিলেন। এসব ধর্ম ও সম্প্রদায় কখন কিভাবে উদ্ভূত হয়েছিলো আজ তা বলা কঠিন হলেও, সূচনায় এসব মতবাদের মধ্যে যে খুব একটা পার্থক্যও কিছু ছিলো না তা অনুমান করা যায়। ধারণা করা হয়, দ্বাদশ শতকের মধ্যেই নিজস্ব মতামত ধ্যান-ধারণা নিয়ে প্রত্যেকটি ধর্ম ও সম্প্রদায় নিজস্ব সীমারেখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো।
প্রচলিত মতে, নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। কৌলমার্গীরাও মৎস্যেন্দ্রনাথকে গুরু বলে মানতেন। অতএব, মৎস্যেন্দ্রনাথ ও লুইপাদ যদি এক ও অভিন্ন হন তাহলে নাথধর্মও সিদ্ধাচার্যদেরই প্রবর্তিত ধর্মের অন্যতম। নাথধর্মীদের গুরুদের মধ্যে মীননাথ, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, জালন্ধরীপাদ (হাড়িপা) প্রভৃতি নাথযোগীরা প্রসিদ্ধ। হঠপ্রদীপিকা’র প্রথম উপদেশে উক্ত হয়েছে–
শ্রীআদিনাথ মৎস্যেন্দ্র সারদানন্দ ভৈরবাঃ।
চৌরঙ্গী মীন গোরক্ষ বিরুপাক্ষ বিলেশয়াঃ।।
মন্থানভৈরবোযোগী সিদ্ধবোধশ্চ কন্থড়ী।
কোরণ্ডকঃ সুরানন্দ সিদ্ধপাদশ্চ চর্পটী।।
কণেরিঃ পূজ্যপাদশ্চ নিত্যনাথো নিরঞ্জনঃ।
কাপালি র্বিন্দুনাথশ্চ কাকচণ্ডীশ্ববোময়ঃ।।
অক্ষয়ঃ প্রভুদেবশ্চ ঘোড়াচূলী চ টিণ্টিনী।
ভল্লটির্নাগবোধশ্চ খণ্ডকাপালিকস্তথা।।
ইত্যাদয়ো মহাসিদ্ধা হঠযোগপ্রভাবতঃ।
খণ্ডয়িত্বা কালদণ্ডং ব্রহ্মাণ্ডে বিচরন্তি যে।। (হঠপ্রদীপিকা প্রথম উপদেশ)
অর্থাৎ : আদিনাথ, মৎস্যেন্দ্র, সারদানন্দ, ভৈরব, চৌরঙ্গী, মীন, গোরক্ষ, বিরূপাক্ষ, বিলেশয়, মন্থানভৈরব, সিদ্ধবোধ, কন্থড়ী, কোরণ্ডক, সুরানন্দ, সিদ্ধপাদ, চর্পটী, কণেরি, পূজ্যপাদ, নিত্যনাথ, নিরঞ্জন, কাপালি, বিন্দুনাথ, কাকচণ্ডীশ্বর, ময়, অক্ষয়, প্রভুদেব, ঘোড়াচুলী, টিণ্টিনী, ভল্লটি, নাগবোধ, খণ্ডকাপালিক ইত্যাদি মহাসিদ্ধ ব্যক্তি সকল হঠযোগ-প্রভাবে যম-দণ্ডকে খণ্ডন করিয়া ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে বিচরণ করিতেছেন।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী– ‘ত্যাঙ্গুর-গ্রন্থ অনুযায়ী মীননাথ ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথের পিতা। তাঁহার অন্য নাম বজ্রপাদ ও অচিন্ত্য। মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের একজন ধীবর। তাঁহার রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে পাঁচখানি নেপালে পাওয়া গিয়াছে; তাহারই একখানির নাম কৌলজ্ঞাননির্ণয়। এই গ্রন্থের মতে মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সিদ্ধ বা সিদ্ধামৃত সম্প্রদায়ভুক্ত। মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ ছিলেন ময়নামতীর রাজা গোপীচন্দ্রের (বঙ্গাল-দেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্রের?) সমসাময়িক। গোপীচাঁদ বা গোপীচন্দ্রের মাতা সিদ্ধ গোরক্ষনাথের শিষ্যা মদনাবতী বা ময়নামতীর যোগশক্তি সম্বন্ধে নানা কাহিনী আজও বাঙলাদেশে প্রচলিত। ত্যাঙ্গুরে জালন্ধরীপাদকে বলা হইয়াছে আদিনাথ। এই জালন্ধরীপাদই বোধ হয় রাজা গোপীচাঁদের গুরু হাড়িপা বা হাড়িপাদ; হাড়িপাদ ছিলেন গোরক্ষনাথের শিষ্য। নাথপন্থা যে সূচনায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিল, এ-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। বস্তুত, কোনও কোনও সিদ্ধাচার্যকে নাথপন্থীরা নিজেদের আচার্য বলিয়া স্বীকার করিতেন। নানাপ্রকার যোগে, বিশেষভাবে হঠযোগে, নাথপন্থীদের প্রসিদ্ধি ছিল। মানুষের যত দুঃখ শোক তাহার হেতু এই অপক্ক দেহ; যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করিয়া সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হইয়া সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ব লাভ করাই নাথপন্থার উদ্দেশ্য। উত্তর ও পূর্ব-বঙ্গে নাথপন্থীদের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট; ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক শক্তিধর্মের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কারণে নাথধর্ম ও সম্প্রদায় টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। ক্রমশ ব্রাহ্মণ-সমাজের নিম্নস্তরে কোনও রকমে তাঁহারা নিজের স্থান করিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নাথ-যোগীদের জাত হইল ‘যুগী’ (!); বৃত্তি হইল কাপড় বোনা এবং নাথপন্থার শেষ চিহ্ন বাঁচিয়া রহিল শুধু নামের পদবীতে বা অন্ত্যনামে !’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩১-৩২)
এবং অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে– ‘নাথ সাধনা সম্পর্কে সংক্ষেপে যা বলা যায় তা হচ্ছে এই যে এই ধর্মের উদ্ভব বহু সংস্কৃতির সমবায়ে ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ্য প্রভাব এই ধর্মে অল্প, এবং নাথ সম্প্রদায় এই স্বাতন্ত্র্য দীর্ঘকাল বজায় রেখেছিল। সম্প্রতি অবশ্য এই সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ ঘটেছে, কেউ কেউ রুদ্রজ ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচিত হতে চাইছেন। তাঁদের আচার অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে রুদ্রজ ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নাথ ধর্ম একান্তই লৌকিক ধর্ম যার প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে যে হিন্দুসমাজের নানা বর্ণের মানুষদের সামনে তা একটি নতুন জীবনাদর্শ উপস্থাপিত করতে সমর্থ হয়েছিল, জাতিপ্রথাকে অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছিল। মূলত খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যেই এই ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। ধর্মের তত্ত্বসমূহ গড়ে উঠেছিল মূলত শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ও বৌদ্ধ তন্ত্রসমূহের লৌকিক ও উদারপন্থী বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করে। এই সকল ধর্মের মানবিক ও মানবকল্যাণমুখী দিকগুলির উপরেই নাথপন্থীরা জোর দিয়েছিলেন।’
‘নাথপন্থা অনুযায়ী চরম সত্তার দুটি দিক, যাদের প্রতীক সূর্য এবং চন্দ্র। সূর্য হচ্ছেন কালাগ্নি যিনি বিনাশের আদর্শ, যিনি মৃত্যু ও ধ্বংসের পদ্ধতির ধারক। পক্ষান্তরে চন্দ্র হচ্ছেন অপরিবর্তনীয়তার আদর্শ। নাথপন্থার চরম আদর্শ হচ্ছে নিজের মধ্যে অদ্বয়ের উপলব্ধি যা সম্ভব অমরত্ব অর্জন ও দিব্য দেহের দ্বারা। এই অদ্বয় অবস্থার প্রতীক সাধারণত শিব, যা চন্দ্র ও সূর্যের সংযোগের দ্বারা সম্ভব। দিব্য এবং অপরিবর্তনীয় দেহ অর্জন হঠযোগের এবং রসায়নের দ্বারা সম্ভব। সেখানে চন্দ্র সূর্যের মিলন ঘটবে। এই মিলনটা যে প্রতীকী বলাই বাহুল্য।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২৫৮-৫৯)
‘নাথপন্থা অনুযায়ী চরম সত্তার দুটি দিক, যাদের প্রতীক সূর্য এবং চন্দ্র। সূর্য হচ্ছেন কালাগ্নি যিনি বিনাশের আদর্শ, যিনি মৃত্যু ও ধ্বংসের পদ্ধতির ধারক। পক্ষান্তরে চন্দ্র হচ্ছেন অপরিবর্তনীয়তার আদর্শ। নাথপন্থার চরম আদর্শ হচ্ছে নিজের মধ্যে অদ্বয়ের উপলব্ধি যা সম্ভব অমরত্ব অর্জন ও দিব্য দেহের দ্বারা। এই অদ্বয় অবস্থার প্রতীক সাধারণত শিব, যা চন্দ্র ও সূর্যের সংযোগের দ্বারা সম্ভব। দিব্য এবং অপরিবর্তনীয় দেহ অর্জন হঠযোগের এবং রসায়নের দ্বারা সম্ভব। সেখানে চন্দ্র সূর্যের মিলন ঘটবে। এই মিলনটা যে প্রতীকী বলাই বাহুল্য।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২৫৮-৫৯)
আর যেহেতু নাথপন্থার চরম আদর্শ হচ্ছে নিজের মধ্যে অদ্বয়ের উপলব্ধি যা সম্ভব অমরত্ব অর্জন ও দিব্য দেহের দ্বারা, তাই নাথপন্থা অনুযায়ী–
‘কায়সাধনের দ্বারা দিব্যদেহ লাভ করা যায়। চন্দ্র হচ্ছেন সোম বা অমৃতের উৎস যিনি মানবদেহে অবস্থিত সহস্রার অঞ্চলের (মস্তিষ্ক প্রদেশ) নীচে থাকেন। যে নির্যাস পরিদৃশ্যমান মানবদেহকে টিকিয়ে রাখে তা উৎপন্ন হয় ওই সোম বা অমৃত থেকে। একে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলেই অমরত্ব অর্জন করা যায়। কিন্তু এখানে একটি বিরাট অসুবিধা আছে। দেহের মধ্যে অবস্থিত চন্দ্র বা সোম থেকে ক্ষরিত অমৃতবিন্দু সূর্য শুষে নেন, যে সূর্য বাস করেন মানবদেহের নাভিমূলে। কাজেই এই অমৃতকে সূর্যের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। সেটা একটি উপায়ে করা সম্ভব। দেহের মধ্যে একটি আঁকাবাঁকা সর্পাকার নালী আছে (বঙ্ক-নাল), যার দুটি মুখ এবং যা শংখিনী নামেও পরিচিত। এই নালীর মুখটি, যা দিয়ে সোম ক্ষরিত হয়, দশম দ্বার নামে পরিচিত। এই মুখটি বন্ধ করতে পারলেই কাল বা মৃত্যুরূপী সূর্যের গ্রাস থেকে সোম বা অমৃতকে রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য কায়সাধন দরকার। কোন কোন গ্রন্থে তান্ত্রিক কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানোর পদ্ধতির দ্বারাই অমৃতক্ষরণ রোধ করা যাবে এমন কথাও বলা হয়েছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
‘কায়সাধনের দ্বারা দিব্যদেহ লাভ করা যায়। চন্দ্র হচ্ছেন সোম বা অমৃতের উৎস যিনি মানবদেহে অবস্থিত সহস্রার অঞ্চলের (মস্তিষ্ক প্রদেশ) নীচে থাকেন। যে নির্যাস পরিদৃশ্যমান মানবদেহকে টিকিয়ে রাখে তা উৎপন্ন হয় ওই সোম বা অমৃত থেকে। একে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলেই অমরত্ব অর্জন করা যায়। কিন্তু এখানে একটি বিরাট অসুবিধা আছে। দেহের মধ্যে অবস্থিত চন্দ্র বা সোম থেকে ক্ষরিত অমৃতবিন্দু সূর্য শুষে নেন, যে সূর্য বাস করেন মানবদেহের নাভিমূলে। কাজেই এই অমৃতকে সূর্যের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। সেটা একটি উপায়ে করা সম্ভব। দেহের মধ্যে একটি আঁকাবাঁকা সর্পাকার নালী আছে (বঙ্ক-নাল), যার দুটি মুখ এবং যা শংখিনী নামেও পরিচিত। এই নালীর মুখটি, যা দিয়ে সোম ক্ষরিত হয়, দশম দ্বার নামে পরিচিত। এই মুখটি বন্ধ করতে পারলেই কাল বা মৃত্যুরূপী সূর্যের গ্রাস থেকে সোম বা অমৃতকে রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য কায়সাধন দরকার। কোন কোন গ্রন্থে তান্ত্রিক কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানোর পদ্ধতির দ্বারাই অমৃতক্ষরণ রোধ করা যাবে এমন কথাও বলা হয়েছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
একইভাবে অবধূত-মার্গীদের সাধনপন্থাও সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনা থেকে উদ্ভূত। বৌদ্ধ-তন্ত্রের চক্রভেদ যোগমার্গে যে তিনটি প্রধান নাড়ীর উপর সিদ্ধাচার্যদের যোগ-সাধন প্রক্রিয়ার নির্ভর, তার প্রধানতমটির নাম অবধূতী। অবধূত-যোগ এই অবধূতী নাড়ীর গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভর করতো। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষ্য হলো–
‘অবধূত-মার্গীরা সকলেই কঠোর সন্ন্যাস-জীবন যাপন করিতেন; এ-বিষয়েও প্রাচীনতর বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সন্ন্যাসাদর্শের সঙ্গে ইহাদের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুদের যে সব ধূতাঙ্গ আচরণ করিবার কথা অবধূতরাও তাহাই করিতেন। এই ধূত বা ধূতাঙ্গ আচরণের জন্যেও হয়তো তাঁহাদের নামকরণ হইয়াছিল অবধূত। লোকালয় হইতে দূরে বনের মধ্যে গাছের নীচে তাঁহারা বাস করিতেন, ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করিতেন, জীর্ণ চীবর পরিধান করিতেন। জৈনদের ধূতাচরণের তালিকাও ঠিক এইরূপ; দেবদত্ত ও আজীবিক সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাহাই করিতেন। বহু শতাব্দী পর অবধূত-মার্গীরা আবার এই সব ধূতসাধন পুনঃপ্রবর্তিত করেন। তাঁহারা বর্ণাশ্রম স্বীকার করিতেন না, শাস্ত্র, তীর্থ কিছুই মানিতেন না। কোনও বস্তুতেই তাঁহাদের কোনও আসক্তি ছিল না; উন্মাদের মতো ছিল তাঁহাদের আচরণ। প্রসিদ্ধ সিদ্ধাচার্য অদ্বয়বজ্রের আর এক নাম অবধূতী-পাদ; নিঃসংশয়ে তিনি অবধূত-মার্গী ছিলেন। চৈতন্য-সহচর নিত্যানন্দও ছিলেন অবধূত; চৈতন্য-ভাগবতে অবধূতদের জীবনাচরণের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩২)
‘অবধূত-মার্গীরা সকলেই কঠোর সন্ন্যাস-জীবন যাপন করিতেন; এ-বিষয়েও প্রাচীনতর বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সন্ন্যাসাদর্শের সঙ্গে ইহাদের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুদের যে সব ধূতাঙ্গ আচরণ করিবার কথা অবধূতরাও তাহাই করিতেন। এই ধূত বা ধূতাঙ্গ আচরণের জন্যেও হয়তো তাঁহাদের নামকরণ হইয়াছিল অবধূত। লোকালয় হইতে দূরে বনের মধ্যে গাছের নীচে তাঁহারা বাস করিতেন, ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করিতেন, জীর্ণ চীবর পরিধান করিতেন। জৈনদের ধূতাচরণের তালিকাও ঠিক এইরূপ; দেবদত্ত ও আজীবিক সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাহাই করিতেন। বহু শতাব্দী পর অবধূত-মার্গীরা আবার এই সব ধূতসাধন পুনঃপ্রবর্তিত করেন। তাঁহারা বর্ণাশ্রম স্বীকার করিতেন না, শাস্ত্র, তীর্থ কিছুই মানিতেন না। কোনও বস্তুতেই তাঁহাদের কোনও আসক্তি ছিল না; উন্মাদের মতো ছিল তাঁহাদের আচরণ। প্রসিদ্ধ সিদ্ধাচার্য অদ্বয়বজ্রের আর এক নাম অবধূতী-পাদ; নিঃসংশয়ে তিনি অবধূত-মার্গী ছিলেন। চৈতন্য-সহচর নিত্যানন্দও ছিলেন অবধূত; চৈতন্য-ভাগবতে অবধূতদের জীবনাচরণের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে।’- (বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৩২)
পরবর্তীকালে এই গৃহত্যাগী অবধূত-মার্গী সন্ন্যাসীরাই হয়তো ক্রমে তান্ত্রিক শৈবাগমে আত্মীকৃত হয়ে পড়ে। কেননা, এই অবধূতদের বর্ণনা মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে–
‘যে সমস্ত শৈব উদাসীন দণ্ডীদের ন্যায় অমাবস্যায় মস্তকাদি মুণ্ডন না করিয়া সচরাচর জটা ও শ্মশ্রু ধারণ করেন এবং এই প্রস্তাবের মধ্যে লিখিত নিয়মানুসারে যাঁহাদের সন্ন্যান গ্রহণ, ষট্কর্ম-সাধন ও নানাবিধ বৃত্তি অবলম্বন করা হয়, তাঁহাদিগকেই অবধূত ও তাঁহাদের বৃত্তিকেই অবধূতী বলে।
‘যে সমস্ত শৈব উদাসীন দণ্ডীদের ন্যায় অমাবস্যায় মস্তকাদি মুণ্ডন না করিয়া সচরাচর জটা ও শ্মশ্রু ধারণ করেন এবং এই প্রস্তাবের মধ্যে লিখিত নিয়মানুসারে যাঁহাদের সন্ন্যান গ্রহণ, ষট্কর্ম-সাধন ও নানাবিধ বৃত্তি অবলম্বন করা হয়, তাঁহাদিগকেই অবধূত ও তাঁহাদের বৃত্তিকেই অবধূতী বলে।
শাণু দেবী প্রবজ্ঞানি অবধূতো যথা ভবেৎ।
বীরসা মূর্তিং জানীয়াৎ সদা তত্ত্বপরায়ণঃ।।
যদ্রূপং কথিতং সর্বং সন্ন্যাসধারণম্ পরম্ ।
তদ্রূপং সর্বকর্মাণি প্রকুর্য্যাৎ বীরবল্লভম্ ।।
দণ্ডিনো মুণ্ডনং চামাবস্যায়ামংচরেদ্ যথা।
তথা নৈব প্রকুয্যাত্তু বীরসা মুণ্ডনং প্রিয়ে।।
অসংস্কৃত কেশজালং মুক্তালম্বিকচোচ্চয়ম্ ।
অস্থিমালাবিভূষা বা রুদ্রাক্ষানপি ধারয়েৎ।।
দিগম্বরো বা বীরেন্দ্রাশ্চাথ বা কৌপিনী ভবেৎ।
রক্তচন্দনসিক্তাঙ্গং কুর্য্যাদ্ভস্মাঙ্গভূষণম্ ।।- (নির্বাণতন্ত্র চতুর্দশ পটল)
দেবি! যে রূপে অবধূত হয়, বলিতেছি শুন। তিনি সতত পঞ্চতত্ত্ব-সেবায় তৎপর থাকিয়া বীর (বীরাচার-বিশিষ্ট) স্বরূপের জ্ঞান লাভ করিবেন। সন্ন্যাস সংক্রান্ত সমস্ত উৎকৃষ্ট বিষয়ের যেরূপ বিবরণ করিয়াছি, তিনি সেইরূপ বীর-প্রিয় ভাবে সমুদায় কার্যের অনুষ্ঠান করিবেন। দণ্ডী সকলে অমাবস্যার দিনে যেরূপ মস্তক মুণ্ডন করেন, প্রিয়! বীবাবধূতে সেরূপ করিবে না। অসংস্কৃত কুন্তলরাশি ও লম্ববান মুক্ত-কেশ সমূহ ধারণ করিবে। অস্থি-মালায় শোভিত হইবে বা রুদ্রাক্ষ ব্যবহার করিবে। বীর-শ্রেষ্ঠ অবধূতে বিবস্ত্র থাকিবে বা কৌপীন ধারণ করিবে এবং শরীরে রক্তচন্দন ও ভস্ম লেপন করিতে থাকিবে।
শৈব-সম্প্রদায়ে রুদ্রাক্ষ মালার বড় গৌরব। অনেকে মস্তকে কর্ণ যুগলে, গলদেশে, বাহুদ্বয়ে ও প্রকোষ্ঠে রুদ্রাক্ষ মালা ব্যবহার করে। কেহ কেহ রুদ্রাক্ষের মুকুট প্রস্তুত করিয়া মস্তকে ধারণ করিয়া থাকে।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, পৃষ্ঠা-৪৮)
এখানে উল্লেখ্য যে, তন্ত্রকারেরা বলেন, কলিযুগে বেদোক্ত সন্ন্যাসাশ্রম নিষিদ্ধ। তন্ত্রোক্ত অবধূতাশ্রমই সন্ন্যাসাশ্রম। এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, সামান্য বর্ণ সকলেরই অবধূতাশ্রম অবলম্বনে অধিকার আছে। যেমন–
ভিক্ষুকেহপ্যাশ্রমে দেবি বেদোক্তদণ্ডধারণম্ ।
কলৌ নাস্ত্যেব তত্ত্বজ্ঞে যতস্তৎ শ্রৌতসংস্কৃতিঃ।।
শৈবসংস্কারবিধিনাবধূতাশ্রমধারণম্ ।
তদেব কথিতং ভদ্রে সন্ন্যাসগ্রহণং কলৌ।।- (মহানির্বাণতন্ত্র অষ্টমোল্লাস)
অর্থাৎ : তত্ত্বজ্ঞে! কলিকালে সন্ন্যাসাশ্রমে বেদোক্ত দণ্ড ধারণের বিধান নাই; কেননা তাহা শ্রৌত সংস্কার। শৈব সংস্কার দ্বারা যে অবধূতাশ্রম গ্রহণ, তাহাই কলিতে সন্ন্যানগ্রহণ।ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যঃ শূদ্রঃ সামান্য এব চ।
কুলাবধূতসংস্কারে পঞ্চানামধিকারিতা।।- (প্রাণতোষিণী-ধৃত মহানির্বাণতন্ত্র বচন)
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, সামান্য এই পঞ্চ প্রকার বর্ণেরই কুলাবধূত হইবার অধিকার আছে।মাতরং পিতরং বৃদ্ধং ভার্যাঞ্চৈব পতিব্রতাং।
শিশুঞ্চ তনয়ং হিত্বা নাবধূতাশ্রমং ব্রজেৎ।।- (মহানির্বাণতন্ত্র অষ্টম উল্লাস)
অর্থাৎ : বৃদ্ধ পিতা, মাতা, পতিব্রতা ভার্যা ও শিশু পুত্র পরিত্যাগ করিয়া অবধূতাশ্রম অবলম্বন করিবে না।
এই অবধূত-মার্গীরা সচরাচর গৃহত্যাগী উদাসীন হলেও তন্ত্রের কোথাও কোথাও আবার গৃহাশ্রমী সাধক-বিশেষকেও অবধূত সংজ্ঞা দিতে দেখা যায়। যেমন–
অবধূতশ্চ দ্বিবিধো গৃহস্থশ্চ চিতানুগঃ।
সচেলশ্চাপি দিগ্বাসাবিধিয়োনিবিহারবান্ ।।
সদারঃ সর্বদারস্থো অট্টহাসো দিগম্বরঃ।
গৃহাবধূতো দেবেশি দ্বিতীয়স্তু সদাশিবঃ।।- (প্রাণতোষিণী-ধৃত মুণ্ডমালাতন্ত্র-বচন)
অর্থাৎ : দেবেশি! অবধূত দুই প্রকার– গৃহস্থ ও উদাসীন। বস্ত্র-ধারী বা বিবস্ত্র দার-পরিগ্রাহী, যথাবিধি সর্ব-স্ত্রীগামী ও অট্টহাস-যুক্ত গৃহস্থ অবধূত, দ্বিতীয় সদাশিব-স্বরূপ।
সে যাক্, এই সন্ন্যাস-মার্গী উপাসক সম্প্রদায়ের আচার-বিচার সাধন-পন্থা ইত্যাদি বিষয় উপাসনার ভিন্ন আরেক বিচিত্র জগৎ। বর্তমান আলোচনায় তা অনিবার্য নয়। তবে পরিশেষে, পরবর্তী বাঙলার সহজিয়া-ধর্ম সিদ্ধাচার্যদের সহজযান থেকেই উদ্ভূত বলে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, মধ্যযুগীয় বাঙলার সহজিয়া ধর্মের আদি ও শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখক হচ্ছে বড়ুচন্ডীদাস। তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বৌদ্ধ সহজযানের মূলসূত্রগুলি ধরতে পারা কঠিন নয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ