শাসদ্বহ্নির্দুহিতুর্নপত্যম্ দাদ্বিদ্বাম্ ঋতস্য দীভিতিম্ সপর্য়ন্।
পিতা যত্র দুজিতুঃ সেকমৃঞ্জন্তসম্ শগম্যেন মনসা দধন্বে।। [ঋগ্বেদ০ ৩/৩১/১]
পদঃ-শাসত্। বহ্নিঃ। দুহিতুঃ। নপত্যম্। গাত্। বিদ্বান্। ঋতস্য। দীধিতিম্। সপর্যন্। পিতা। যত্র। দুহিতুঃ। সেকম্। ঋঞ্জন্। সম। শগম্যেন। মনসা। দধন্বে।
পদার্থ-হে বিদ্বান্ মনুষ্য! ( যত্র) যে ব্যবহারে ( পিতা) উৎপন্ন কর্তা ( বহ্নিঃ) বহন করে অর্থাৎ ব্যবহারে চালনাকারী ( দুহিতুঃ) কন্যার ( সেকম্) সেচন কে ( ঋঞ্জন্) সিদ্ধ করা ( গাত্) প্রাপ্ত হয়ে সেই আচরণে ( বিদ্বান্) জানার যোগ্য ব্যবহারে জ্ঞানী ( ঋতস্য) সত্যের ( দীধিতিম্) ধারণকর্তাকে ( সপর্য্যন্) মেবা করা ( দুহিতুঃ) দূরের হিতকারিণী কন্যার (নপত্যম্) পৌত্রে উৎপন্ন হয়েছে (শাসত্) শিক্ষা দিবে এই (শগম্যেন) সুখে বর্তমান (মনসা ) অন্তঃকরণে ( সম,দধন্বে) সম্যক প্রসন্ন হয়।। निघं० ३। ६। (मनसा) अन्तःकरणेन
ভাবার্থ-হে মনুষ্য!যেমন পিতার সান্নিধ্যে কন্যা উৎপন্ন হয়, তেমনি সূর্য দ্বারা প্রাতঃকালের প্রকট হয়,এবং যে পতি নিজ স্ত্রীর গর্ভ ধারণ করান উপায় দ্বারা সদৃশ বর্তমান প্রাতঃকালর বেলায় সূর্য কিরণরূপ বীর্য্যকে ধারণ করে,তার থেকে দিবসরূপ পুত্র উৎপন্ন হয়।। -( ভাষ্যম্- মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী)
পুরাণেই প্রথম মনসার জন্ম-সংক্রান্ত উপাখ্যানটি পাওয়া যায় । মনসা সর্পের আভূষণে সজ্জিতা,হংস অধিষ্ঠাত্রী দেবি। তিনি সর্পার বাহন। দেবী নিজে সর্পরূপা নন,তাঁর অবয়ব মানবীর। প্রাচীন কোন সংস্কৃত পুরাণ,এমন কি পাণিনির ব্যাকরণেও "মনসা" নামের উল্লেখ নেই। অর্বাচীন সংস্কৃত অভিধানে আছে "মনসা সৃষ্টি ইতি" মনসা। ভারতীয় সংস্কৃতিতে "নাগ" পূজার রীতি আছে। রামায়ন-মহাভাতেও মনসার কোন কথা উল্লেখ নেই। জৈনদের সর্পদেবী পদ্মাবতী, এই জৈনদের থেকে মনসা পূজার উৎপত্তি। মহাযান বৌদ্ধধর্মে "জাঙ্গুলি তারা"-র কথা আছে। "সাপুড়ে" বোঝাতে বানভট্ট "জাঙ্গুলি" শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। জাঙ্গুলি দেবীর বাহন মনসারমত হংস। বিপ্রদাসের মনসা-মঙ্গল কাব্যে দেবীর নাম "জাঙ্গুলি"।খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে মনসা প্রমুখ দেবদেবীদের নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক এক শ্রেণির ভক্তিমূলক লৌকিক গাথাকাব্য রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য ও বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় (১৪৯৫) কাব্যে দেবী মনসার উৎপত্তি ও কিংবদন্তিগুলি বর্ণিত হয়েছে। পুরাণ মতে , মনসা ঋষি কশ্যপের সন্তান তথা কাশ্যপ গোত্রজ । উল্লেখ্য , মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না । একবার সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত শুরু করলে , ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন । মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন ।
মনসা তার মন্ত্রবলে পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন । শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে । মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন । এর ফলে দেবী হিসেবে মনসার কর্তৃত্ব সুবিদিত হয় ।
কশ্যপ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিয়ে দেন । জরৎকারু এই শর্তে মনসাকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন যে , যদি মনসা তার কথার অবাধ্য হন , তবে তিনি মনসাকে পরিত্যাগ করবেন । একবার মনসা জরৎকারুর নিদ্রাভঙ্গ করতে দেরি করেছিলেন । এতে সেদিন জরৎকারুর পূজা করা হয়ে ওঠেনি । এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে জরৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন । পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে এক পুত্রের জন্ম দেন ।
বিষহরি পূজা’ই প্রকারান্তরে মনসা পূজা। আমাদের দেশে যেখানেই সাপের ভয় বা সাপের উৎপাত বেশি সেখানেই সাপের দেবী রয়েছে। তার পুজো হয়। নানা লোকাচার পালিত হয় সর্দপদেবীকে কেন্দ্র করে। বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের দেবীর মাহাত্ম নিয়ে লোকাচারও বেশি। এখানে সাপের দেবতা – মনসা ।গ্রামে গ্রামে মনসার থান আছে। সেখানে নিয়মিত মনসার পুজো হয়। আবার বাড়িতেও তুলসী তলার পাশে একটা মনসার ডাল পোঁতা থাকে। সেই মনসার গাছেও মনসা দেবীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। বাংলার বাইরেও সাপের নানা দেবতা আছে। কোথাও নাগরাজ, কোথাও নাগাম্মা। আবার বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা ইত্যাদি আরো কতো নাম। দেবীর মাহাত্মনিয়ে অনেক গল কথা মুখেমুখে প্রচলিত। তা নিয়ে কত গল্প , নাটক সিনেমা হয়েছে। এখনো তা মানুষের কাছে অসীম আগ্রহের বিষয়।
মনসাবিজয় কাব্যে আছে, বাসুকীর মাতা একটি বালিকার মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তিতে শিবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী মনসাকে নিজ ভগিনী বলে স্বীকার করে নেন। রাজা পৃথু যখন গাভীরূপী পৃথিবীকে দোহন করছিলেন, তখন তা থেকে বিষের উৎপত্তি হয়। বাসুকী মনসাকে সেই বিষের কর্তৃত্ব প্রদান করেন। শিব মনসাকে দেখে আকৃষ্ট হন। কিন্তু মনসা তাকে নিজ পিতৃপরিচয় দান করলে, শিব মনসাকে গৃহে নিয়ে আসেন। শিবের স্ত্রী চণ্ডী মনে করেন, মনসা শিবের অপর স্ত্রী বা তার জারজ সন্তান। তিনি মনসাকে অপমান করে তার একটি চোখ দগ্ধ করেন। মনসা একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবীতে পরিণত হন। পরে সমুদ্রমন্থনের সময় হলাহল বিষের প্রভাবে শিব যখন মৃতপ্রায় হন, তখন মনসা তার প্রাণরক্ষা করেন। একদিন চণ্ডী মনসাকে লাথি মারেন। মনসা তখন বিষদৃষ্টি দিয়ে চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে চণ্ডী ও মনসার বিবাদে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শিব মনসাকে একটি গাছের নিচে পরিত্যাগ করেন। তবে তিনি মনসার চোখের জল থেকে নেতো বা নেতা নামে মনসার এক সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেন।
পরে ঋষি জরৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার রাত্রিটি মাটি করে দেন। তিনি মনসাকে সর্পালঙ্কার পরিধান করতে বলেছিলেন। তারপর তিনি ফুলশয্যার ঘরে একটি ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ফলে সাপগুলি ঘরময় ছুটে বেড়াতে শুরু করে। ভয় পেয়ে জরৎকারু ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। কয়েক দিন পর অবশ্য তিনি ফিরে আসেন। এরপর তাদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।
নেতোর পরামর্শে মনসা মর্ত্যে নেমে আসেন মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে মানুষ তাকে উপহাস করত। কিন্তু যারা মনসার ক্ষমতা অস্বীকার করল, তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলে মনসা তাদের বাধ্য করলেন তার পূজা করতে। মুসলমান শাসক হাসানের মতো বিভিন্ন জাতির মানুষকে মনসা তার ভক্ত করে তুললেন। কিন্তু চাঁদ সদাগর তার পূজা করলেন না। মনসা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো একজন দেবী হতে চাইছিলেন। তাতে সফল হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের হাতে পূজাগ্রহণ তার কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু চাঁদ সঙ্কল্প করেছিলেন, তিনি মনসার পূজা করবেন না। মনসা চাঁদকে ভয় দেখানোর জন্য একে একে চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করলেন। শেষে মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক-নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। এঁদের নাম ছিল অনিরুদ্ধ ও ঊষা। অনিরুদ্ধ চাঁদ ও তার স্ত্রী সনকার সপ্তম পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তার নাম হল লখিন্দর। ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করলেন। লখিন্দর ও বেহুলার বিবাহ হল। মনসা লখিন্দরকে হত্যা করলেন। কিন্তু বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নদীতে ভেসে চললেন। শেষে তিনি চাঁদের সাত পুত্রের প্রাণ ও হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করার উপায় জেনে ফিরে এলেন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়েই বাঁ হাতে তার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিলেন। মনসা এতেই খুশি হলেন। তিনি চাঁদের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দিলেন এবং তার হারানো সম্পদও ফিরিয়ে দিলেন। মঙ্গলকাব্যে রয়েছে, এরপর মনসার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেল।
মনসামঙ্গল কাব্য গ্রন্থে রয়েছে, পূর্বজন্মে মনসা চাঁদকে বিনা কারণে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাই চাঁদও মনসাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তিনি মনসার পূজা না করলে, মনসাপূজা মর্ত্যে জনপ্রিয়তা পাবে না। এই কারণেই, ভক্তদের আকর্ষণ করতে মনসার অসুবিধা হচ্ছিল।
আনন্দ কে. কুমারস্বামী ও ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, “[চাঁদ সদাগর] ও মনসা দেবীর কিংবদন্তিটি [...] নিশ্চয়ই এশীয় সমাজের মাইকিনিয়ান পর্যায়ের সমসাময়িক। এই কিংবদন্তিতে শৈবধর্ম ও বাংলার নারী লোকিক দেবীদের সংঘাতটির প্রতিফলন দেখা যা। এরপর মনসা বা পদ্মা ‘শক্তি’র একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃত হয় [...] এবং শৈবরা তার পূজা স্বীকার করে নেন। তিনি ঈশ্বরের মাতৃকাশক্তির এমন একটি ধারা, যাঁকে অনেক ভক্ত দূরবর্তী ও নির্গুণ শিব ধারণার থেকে নিকটতর ও প্রিয়তর মনে করেন।...”
'মনস্' শব্দের উত্তর স্ত্রীলিঙ্গের আপ প্রত্যয় করে ‘মনসা’ শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে সর্পভয় থেকে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য ব্রহ্মা কশ্যপ মুনিকে মন্ত্র বা বিদ্যা বিশেষ আবিষ্কারের জন্য আদেশ করেন। মনসা শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় মনে চিন্তন। কিন্তু দেবী রূপে মনসা কি চিন্তনের কোন বিষয়? মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়, মনন কে সুখশ্রাবী করার জন্য মন্ত্রের উদ্ভব। মন্ত্রই মনকে ঊর্ধ্বগামী করে। সেই মন যদি বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তবে তো সমগ্র দেহই বিষাক্ত হয়ে যাবে। তাই মনসার উৎপত্তি যেমন আর্যঋষি গণ দেখিয়েছেন বিষহরী দেবীরুপে সেরূপ বিষহরণ করে মনকে বিষযুক্ত করারও ব্যবস্থা তার হাতে। সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু নিজে যখন খায় তাতে বিষ লাগে না। কিন্তু হিংসায় বা আত্মরক্ষায় যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনে বিষ হলো হিংসা ক্রোধ, লোভ এগুলো দূর করার দেবী মনসা। চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই তবু চিন্তা যাতে যুক্ত হতে পারে, চিন্তা যাতে রিপুর বশ না হয় তার চেষ্টাই আমাদের করতে হবে-এই শিক্ষাই দিয়েছেন দেবী মনসা।দেবীর বাহনসরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহন হংস। বাহনকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে মনসাও জ্ঞানযুতা, জ্ঞানলক্ষণা। দেবী মনসার জ্ঞানশক্তি মনোময়। শুদ্ধযোগ ও আধ্যত্ম জ্ঞানের সাধন সিদ্ধি দেবী মনসার দান।
গ্রামের সার্বজনীন মনসা থানে সমবেত হয়ে যে সমস্ত বার ব্রত ও উপবাস গুলির পালন করা হয় তার মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দশমীতে অনুষ্ঠিত বিষহরি মনসা পূজার ব্রত অন্যতম এক মাঙ্গলিক ব্রত রূপে বিবেচিত হয়।যদিও দক্ষিনবঙ্গে এই একই দিনে দশহরা গঙ্গা পূজারও আয়োজন হয়ে থাকে।
ব্রতগুলি গ্রামীন মহিলাদের অজস্র সংস্কারে আকীর্ণ। প্রতিটি পূজার ব্রতর ন্যায় মনসা পূজার ব্রততেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সধবা নারীরা এই পূজার ব্রতাচার পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঠিক পূজার আগের দিন নিরামিষ খাবার রান্না করে থাকে। দশহরা পূজার দিন রান্নার কোনো বাহ্যিক রীতি রিয়াজ বা নিয়ম নাই। ওই দিন দশ প্রকার পুষ্পবতীপত্র, ফুল ও ফলমূলাদি সহ দুধ-কলা ও মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয় বলে এরূপ পূজার নামকরণ দশহরা পূজা রাখা হয়েছে। প্রধানত দুধ-কলা ও চিনি সন্দেশের নৈবেদ্যে পূজা দেয়া এই ব্রতের অন্যতম প্রধান রীতি ও নিয়ম। এই ব্রততে দেবী মনসার সন্তুষ্ট হওয়ার নানান মাহাত্ম্য কথা লোক সমাজে অধিক প্রচলিত আছে। তিনি সর্প কূলের আরাধ্য দেবী। আষাঢ় ও শ্রাবনের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে যেমন ধানে অপরিণত শষ্যের (আগড়ার)পরিমাণ বাড়ে। আবার এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের উৎপাতে মানুষ বেশি অতিষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাটে জলে ভরপুর হয় তখনও এই একই পরিণতি ঘটে। শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের বিষের পরিমাণ ও তার তীক্ষ্ণতা এতোটাই বাড়ে যে (কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া) সাপের কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাগ মূহুর্তে প্রাণ হারায়। তাই বিষধর কাল সাপের কামড়ের হাত থেকে বিরত থাকার অন্যতম এক মানসিক শক্তি লাভের পথ হিসাবে মানুষ বিষহরা মনসা পূজার প্রচলন শুরু করেছিল এমনই কিছু অনুমান করা হয় লোক শিক্ষার অন্দর মহলে। মনসা কালসাপ কূলের প্রধানা রূপে খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে উপশাস্ত্রীয় দেবীপুরাণে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মনসা মঙ্গলের পালাতে মনসার লীলামহিমার ভয়াবহ ঘটনায় তার সেই বাহন কালসর্পের পরিচয় অতি সহজেই মেলে। তাই সেই বাহন স্বরূপ কাল সাপের হাত থেকে জীবন রক্ষার দরুন বিষহরি ব্রত ও পূজার আয়োজন করে থাকে দক্ষিণবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলার নারী সমাজ। ব্রতের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা মূর্তি হলেও প্রকৃত পক্ষে পূজার নৈবেদ্যাদি নিবেদন সমার্পন করা হয় একটি কাটা সিজ মনসার ডালের সন্নিকটে। যেখানে লাল রঙের সিঁদুর দিয়ে রাঙায়িত করা হয়। তার সামনে দুধের বাটি ও কলা নিবেদন করেন গ্রামের মায়েরা। এই সিজ মনসার ডাল পূজার প্রচলন যে ঠিক কবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের উপস্থাপন মোটেই সহজ নয়। তবে অধিকাংশ লোক দেবদেবীদের মূর্তি পূজার পূর্বে যেমন তাদের (আটেশ্বর, পেঁচাপেচি, ধর্মঠাকুর) বৃক্ষ পূজারই অধিক প্রচলন ছিল। মনসা পূজার ক্ষেত্রেও এই তথ্য একেবারে অযৌক্তিক নয়। বৃক্ষের মধ্যে বট, অশ্বথ্ব, পাকুর, বেল, তাল, সিজ মনসার বহুল প্রচলিত ছিল বলেই অনুমান করা হয়।
মঙ্গল কাব্যের যে সমস্ত দেবী, দেবতারা বাংলার বুকে সুদীর্ঘদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছে এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ভয়াল ভয়ঙ্কর দেবী হিসেবে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মা মনসার নাম। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে তিনি নাগকুলের মূল আধিষ্ঠাত্রী সর্পকুলের প্রধান দেবী রূপে জগতে প্রতিষ্ঠিত। মনসা আদি বৈদিক যুগের বা পুরাণের মহিমান্বিত বা রামায়ণ অথবা মহাভারতের যুগের মানুষের আরাধ্য কোনো দেবী নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শাস্ত্র গুলি ভালো করে অধ্যায়ন করে স্পষ্ট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সেকালে কেবলমাত্র বাসুকি নাগ ও পরবর্তীতে কৃষ্ণের কালে কালীও নাগ নামটি ছাড়া আর অন্য কোনোও বিশেষ সর্পের দেব দেবতার নাম পুরাণাদি গ্রন্থগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগ কুলের অধিষ্ঠাতা দেবতা বাসুকি হলেন নাগেদের রাজা। সাংস্কৃত শাস্ত্র ও উপপুরানে বলা হয়েছে নাগরাজ বাসুকির ভগিনী হল এই মনসা দেবী। সর্পকূলের দেবী নাগিনী নামটির দ্বারা এই সীদ্ধান্তে অনুমান হওয়া যায় যে ইহা আধা নর ও আধা সর্পের এক ভয়ঙ্কর মূর্তি বিশেষ কোনো রূপ অথবা ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান কোনো বিশেষ বিষধর সর্প হবে যার মধ্যে রূপ পরিবর্তন করার ইচ্ছাশক্তি আছে । ইতিহাসের পাতায় যা স্কাইথীয় নামে পরিচিত। কিন্তু মনসা নামটির সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে জগতে প্রচলিত হয়েছে তা গভীর অনুসন্ধানের একটা বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে তাহার নাগ পরিবার, নাগরাজ বাসুকির ভগিনী তিনি তাই সেই কারনে দেবীর সঙ্গে সর্পের এই রূপ সম্পর্ক। যদিও শৈবপুরাণে দেবাদিদেব মহাদেবের সন্নিকটে যে বিষধর সর্পটির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে উদয় নাগ উহাতে সর্প দেবতাদের অনুচর স্বরুপ পূজিত হয়ে এসেছে। ব্যাক্তিস্বতন্ত্র রূপে কোনো দেবতা বা দেবী রূপে অধিষ্ঠানের কথা পুরাণের কোথাও বা শাস্ত্রে উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগের মানুষ দেবীমূর্তি আরাধনার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান, যাগযজ্ঞ ও প্রকৃতি পূজার প্রতি বেশি মনোযোগী হতেন। বেদ, পুরাণে স্পষ্ট তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে – ‘ধ্যায় শূন্য অহর্নিশম’। অতএব এত্যদ্বারা এই সত্য প্রমাণিত হয় যে মনসা পূজার সৃষ্টি বিগত আটশো নয়শো বছরের মধ্যবর্তী কোনোও এক সময় হবে, ইহার পূর্বে নহে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও পর্যন্ত যে কয়টি পৌরাণিক মনসা মন্দির ও মনসা দেবীর খোদায় করা মূর্তির সন্ধান পেয়েছে ইহাদের অধিকাংশ মূর্তি সর্বোচ্চ সেন বংশের রাজাদের আমল পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সেনরাজ বিজয় সেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত মনসা মূর্তির কয়েকটি প্রমাণ ও পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ ইহার থেকে আরো বিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে এই দেবীর জগতে অধিষ্ঠান হলেও সত্য হতে পারে কিন্তু তাহার এক কাঁচা পূর্বে নয়। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা নামটির আদি সৃষ্টি বা উৎপত্তি ঠিক কবে এ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত শাস্ত্র অথবা পুরাণ গুলির একটিতেও মনসা নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বপ্রথম সাংস্কৃত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবী পুরাণ ও দেবী ভাগবত উপপুরাণে মনসা নামটির সহিত সাক্ষাৎ লাভ করা যায়। এই সমস্ত গ্রন্থের প্রতিটির রচনা খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর এক কাঁচাও পূর্বে নয়। মনসা শব্দটি ভারতীয় অর্বাচীন অনার্য ভাষা গোষ্ঠী হইতে এসেছে । মনসা নামটি অলুক সমাস। এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন নামটি এসেছে তো এসেছে কোথা থেকে।
দক্ষিণ ভারতের লোক সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্রাবিড় সভ্যতার নিম্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা আজও বহু সর্পের দেব দেবীর পূজা করে আসছে। যেমন- নাগাম্মা, বালাম্মা, মুদামা ইত্যাদি। নাম গুলি শুনে মনে হয় দাক্ষিণাত্য তেলেগু ভাষায় রচিত বিশেষ সর্প রূপের জাগ্রত দেবীই হবে। নাগাম্মা মা সর্প ও বালাম্মা ইহার কন্যা। প্রতিটি সর্পদেবীর আঞ্চলিক ভেদে নানান মাহাত্ম্যও রয়েছে। যেমন নাগাম্মা দেবীর কাহিনী পুতুল নাচ, সামাজিক পালাগানের মধ্যে দিয়ে আজও বর্ণনা করে চলেছে অন্ধ্রপ্রদেশের একশ্রেণীর স্ত্রী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দল। শুধু অন্ধ্রে নয় চেন্নাই সহ দক্ষিণের সমগ্র গ্রামাঞ্চল তথা শহরাঞ্চলেও বহুজাতিক সর্পের দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে।
কর্নাটকের মহীশূরে মুদামা নামে এক বিশেষ ধরনের সর্প দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে আজও। সমগ্র দক্ষিণের নারী সমাজ আজও দেবী রূপে ইহাকে পূজা করে। দাক্ষিণাত্যে প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভাস্কর্য খোদায় করা এই দেবীর বহু মূর্তির সন্ধান পেয়েছে। এই সর্প দেবীর মূর্তি অন্যান্য সর্পদেবীর মূর্তির তুলনায় একটু আলাদা। এই মূর্তির বিশেষত্ব হলো ইহার উদরের নিম্ন ভাগ সর্পাকৃতি ও উদর থেকে মস্তক পর্যন্ত কন্যাকৃতি। অর্থাৎ আধা নাগিনী ও আধা নারী মূর্তি বিশেষ মূর্তি।
https://www.ধর্ম্মতত্ত্ব.com |
আবার নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ভিন্ন দক্ষিন ভারতের কানাড়া প্রদেশে মঞ্চাম্মা নামে এক দেবীর পূজার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। ইহার মাহাত্ম্য হল ইহার কোনো মানবী রূপী দেবী মূর্তি বা রূপ নাই। মনে মঞ্চাম্মা এক অদ্ভুত অদৃশ্য সর্পের নাম। এই সর্পটি স্বর্গের নাগ জাতিগোষ্ঠীর একাংশ বলে মনে করা হয় বলে সর্পটির উপর দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই মঞ্চাম্মা দেবীর পূজার আয়োজন করে ভক্তরা। বল্মীক রূপ এক স্তুপ বা ঢিবির সামনে পূজার নৈবেদ্যাদি ফুল,পুষ্পচন্দনে সুসজ্জিত করে পূজা দেওয়া হয় এই দেবীকে।
এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন বাংলার অনার্য সভ্যতার ভাষাগোষ্ঠীর শব্দভাণ্ডারে সৃষ্ট এই মনসা নামের সঙ্গে ইহাদের মিল কতখানি। উপরিউক্ত যে সর্প দেব দেবীদের নাম গুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটি নাম দেখে ও উচ্চারন বুঝে স্পষ্ট বলা যেতে পারে ইহাদের প্রতিটি নাম স্ত্রী লিঙ্গ অর্থাৎ দেবীমাতা। তেলেগু, তামিল, বা কন্নড় যে ভাষায় দেবী গুলির নাম যে ভাবেই সৃষ্টি হউক না কেন প্রতিটি দেবীর নামের উৎপত্তি গত ও ব্যাকারণ গত মাধূর্য আছে। মনে মঞ্চাম্মা দক্ষিন ভারতের সর্পের দেবীর নাম। আবার আমাদের বাংলার সর্পের দেবীর নাম মনসা। দক্ষিণ ভারতের এই দেবী বাংলাদেশের বুকে নাম একটু বদলে মঞ্চাম্মা’থেকে মনসা আম্মা রূপে পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব নহে। শুধু মঞ্চা-এর চা এর পরিবর্তে সা শব্দটি উচ্চারণ করিলে মনসা উচ্চারণ হতে পারে। এখন বিচার করা প্রয়োজন যে, যদি এই তথ্যের ভিত্তিতে মনসা নামটি এসে থাকে তবে এই নামের বার্তা বাহক কে বা কারা ? একমাত্র সর্পদের নিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে বেদিয়া সাঁপুরের দল এর বার্তা বাহক হতে পারে। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বলা যায় না যে এই তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। যদিও এককালে বেদে সাপুড়ের দল সারা দেশে ভ্রমণ করতে করতে সাপ খেলা দেখাত।
আবার নাগাম্মা রুপী দক্ষিন ভারতের সর্প দেবীর সঙ্গে মনসা দেবীর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করে দেখলে কিছু কিছু মিল ও অমিল পরিলক্ষিত হয়। নাগাম্মার প্রকৃত রুপ যেহেতু আধা নাগিনী ও আধা কন্যা তাই মনসার সঙ্গে ইহার পার্থক্য রয়েছে। শুধু তাই নয় বৈসাদৃশ্যের দিক দিয়ে আরোও কিছু কিছু পার্থক্যও রয়েছে। মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও দক্ষিণ ভারতের এই প্রতিটি সর্প দেবীর মাহাত্ম্য কাহিনীও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এখন দক্ষিনবঙ্গে মনসা ও তার অন্যতম প্রধান বাহন সর্পের কয়েকটি লোক বিশ্বাস সম্পর্কে দেওয়া হল। যেগুলি খুব আন্তরিক ভাবে মান্য হয়ে আসছে কয়েক দশক আগে থেকে।
মনসার বাহন সাপ সম্পর্কে দক্ষিনবঙ্গে গ্রাম্য সমাজে প্রচলিত কিছু যাদুকরী লোকবিশ্বাস যা অযুক্তিক
1. সর্পের দেবী মনসার স্বপ্নবরে ঘর সংসার সুখী হওয়ার জন্য গুপ্তধন, রত্নসম্পদের সুযোগ সন্ধান সম্পর্কিত কিছু আবেগপ্রবন লোক গল্পের প্রবাদ প্রচলন এই সমাজে রয়েছে। সর্পের মাথার মণি সাত রাজার ধন। তাই তাকে প্রসন্ন করতে পারলে অনেক বেশি রত্ন সম্পদের মালিক হওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় বুক বাঁধে নারীপুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সবাই।
2. দেবী মনসাকে দুধ-কলা ও অন্যান্য নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে তার কৃপায় নিজদের শাঁখা সিঁদুর সতীসাবিত্রী ও বেহুলার ন্যায় চির অক্ষয় থাকবে এরকম একটা কল্পনাও সচরাচর করা হয়।
3. বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর দেহে পুনরায় প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র এই দেবীর। মনসামঙ্গলে তার রূপ চিত্রায়ন হয়েছে। তাই অন্যান্য লোক দেবীর পূজা অপেক্ষা এই দেবীর পূজায় বাস্তবিক জীবন সুস্থ সবল ও বিপদমুক্ত থাকার একটা মানসিক তৃপ্তিও অনুভব করা হয়।
4. বিষধর সর্পের কোনো প্রকারে একবার মৃত্যু ঘটলে কোনো কোনো জায়গায় তার বিষদাঁত ভেঙে তা সংগ্রহ করে রাখার রীতি নীতি রয়েছে। পরে ওই বিষদাঁত টি মাদুলি ও কবচে ভরা হয়। এই মাদুলি ও কবচ বয়োঃজ্যাষ্ঠ মানুষদের বাতের ব্যাথা হলে তাকেই পড়িয়ে দেওয়া হয়। বাতের ব্যাথা থেকে চীর মুক্তি লাভের আশায় আশায়।
5. যারা নিতুই বিষধর সর্পের স্বপ্ন দেখে, বহুমূত্র ব্যাধির স্বীকার, পরিণত কৈশোরেও বিছানায় ঘুম ঘোরে মূত্রত্যাগ করে তাদের অধিকাংশই সাঁপুরে, বাজিকরদের স্মরণাপন্ন হয়। বাজিকরেরা যখন গ্রামে গঞ্জে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত তখন তাদের ঝোলাতে নানান রোগ নিরাময়কারী ঔষধের সম্ভার থাকত। প্রতিটি রোগের মাদুলি ও কবচের ব্যবহার। অর্থাৎ এই সুযোগে সাঁপুরে বাজিকরদের দল ঔষধ বিক্রি করার একটা ফাঁদ পেতে বসে।
6. প্রতিটি বাড়িতে একটি করে বাস্তুসাপ থাকে। এই সাপ কারো ক্ষতি করে না। গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাস্তুর মঙ্গল কামনার্থে এই সাপের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
7. কোনো সাপের একবার মৃত্যু ঘটলে তাকে দাহ করার রীতি দক্ষিনবঙ্গের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তুসাপ মারা গেলে অনেক গৃহস্থ ভক্তরা ক্ষৌরকর্ম, শ্রাদ্ধ শান্তি ও মস্তক মুণ্ডনও পর্যন্ত করে থাকে। তবে কারো আঘাতে কোনো বিষধর সর্পের মৃত্যু ঘটলে মূলত তার বংশোদ্ভূতদের দ্বারা প্রতিশোধ নেওয়ার এক ভৌতিক লোক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস বিশেষত তার চোখ ও স্মৃতিতে ওই আঘাতকারী ব্যাক্তির প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়। তাই সাপের মুখমণ্ডল দাহ করে দিলে এর থেকে চীর মুক্তি পাওয়া যায়।
8. রাত্রে এলোমেলো বিছানায় বিষধর সাপের কামড়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। তাই গ্রামের মানুষের লোক বিশ্বাস মনসা ও তার স্বামীর নাম স্মরণ করে বালিশে ‘আস্তিমাতা ‘টোকা দিলে আর এরূপ অনিষ্ট ঘটে না।
9. বিনের আওয়াজে মনসার বাহন কালসর্প খুবই নেশা গ্রস্থ হয় এমন এক অদ্ভুত ধারণা আজও বেদেদের একদল গ্রামে গঞ্জে ঘুরে খেলা দেখিয়ে প্রমাণ করে বেড়ায়। শুধু তাই নয় ধূনার গন্ধেও সে ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্যমূহুর্তে কোনোরূপ ধূনা ব্যবহারের রীতি নাই। এসবের ব্যবহারে তিনি রুষ্ট হন বলে পুরোহিতদের একদলকে বলতে শোনা যায়।
10. হেঁতালের গন্ধে কালসর্প ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্য লগ্নে হেঁতালের ব্যবহৃত ছড়ির পরিবর্তে কঞ্চির ছড়ি ব্যবহার করে কাঁসা বাজানোর রীতি রিয়াজ আজও কমবেশি চোখে পড়ে।
11. সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রাণ বিয়োগ হলে সেই দেহে কেবলমাত্র মনসার সাধনায় সিদ্ধ গুনীন, বদ্যি ও ওঝারাই প্রান ফিরিয়ে আনতে পারেন- এই কথা আজও নিরক্ষর মানুষের মনে বিশ্বাস। ওঝা ও গুনীনরা এই দেবীর আশির্বাদ ধন্য মানস বা বরপুত্র। তাদের কাছে সাপে কাটার যাবতীয় ঔষধের সম্ভার রয়েছে ।তাই গ্রামের মানুষ বিজ্ঞানের ধারাপাত অপেক্ষা মনসা ও তার আশির্বাদধন্যা ওঝা, বদ্যিদেরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
12. সর্পে দংশিত রোগীরা মারা গেলে তাদের পোড়ানোর রীতি দক্ষিনবঙ্গের লোক সমাজে নাই। সমাধি দেওয়া হয় এই কারনে রোগীর দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায়, বিশ্বাসে ও কল্পনায়।
13. লোক সমাজে প্রবাদ প্রচলন রয়েছে যে সাপে কাটা রোগীদের প্রান দেহের মধ্যে থেকে যায়। বিষের জ্বালায় নীল হয়ে যায় সমস্ত শরীর। শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য মৃতদের আগুনের সৎকারে মৃতদেহ চীর ভষ্মীভূত হয়ে যায় শ্মশানে। কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। তার একটি মাত্র কারন কোনো সহৃদয় ওঝা বা গুনীনের সান্নিধ্যে এসে যদি আবার পুনঃজন্ম লাভ করে এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত আশায়।
14. সাপের বিষ থেকে যে (SAVS) স্নেক এন্টি ভেনম সিরাম তৈরি করা হয় তা দিয়ে সাপে কাটা রোগীর প্রান বাঁচানো সম্ভব। তাই একটি বুদ্ধিজীবী মানুষের চিন্তা ভাবনায় বিষাক্ত সাপকে হত্যা না করে বরং তাঁকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
15. সাপ বংশের ধারক বাহকের প্রতীক। নিঃসন্তান মাতাপিতা একটি সন্তান কামনায় এই দেবীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে ভক্তি দিয়ে পূজা করে, ছলনা দেয়, গন্ডি দেয় ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
https://www.ধর্ম্মতত্ত্ব.com
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ