বেহুলা লখিন্দর - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

12 July, 2020

বেহুলা লখিন্দর

মনসা মঙ্গলকাব্য বাঙ্গালীর আপন সৃষ্টি, তার নিজস্ব সম্পদ। স্বর্গলোকে গিয়ে মহাদেব শিবের মুখ থেকে শুনলাম, বেহুলা আর লখিন্দরের আসল নাম যথাক্রমে ঊষা আর অনিরুদ্ধ। বেহুলা আর লখিন্দর দুই স্বর্গীয় অপ্সরা। কী ভাবে এরা মর্ত্যে এলেন সেটা বুঝতে হলে আগে আমাদেরকে মনসার পরিচয় জানা দরকার।
বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বাসর ঘর আমাদের বগুড়া সদরের গোকুল গ্রামে অবস্থিত। বাংলাদেশের বগুড়া সদরের উত্তরে মহাস্থান গড় থেকে মাত্র দুই কিঃমিঃ দক্ষিণে গোকুল গ্রামে অবস্থিত বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর। এই স্থানকে অনেকে গোকুল মেধ বা লক্ষিন্দরের মেধ বলেও জানে।বেহুলা ও লক্ষিন্দরের প্রেম কাহিনী সর্বপ্রথম মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ পাওয়া যায়। বেহুলা ও লক্ষিন্দরের ভালোবাসার গল্প গ্রাম-বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। বেহুলা ও লখিন্দরের প্রেমগাঁথা অমর এক লোককাহিনী। ধারনা করা হয় খ্রিস্টাব্দ সপ্তম শতাব্দী থেকে ১ হাজার ২০০ শতাব্দীর মধ্যে এটা নির্মান করা হয়। আনুমানিক ১৭২টি কক্ষ আছে এখানে। বেহুলার বাসর ঘর একটি অত্যান্ত সুন্দর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। গবেষকদের মতে, এ মনুমেন্ট ৮০৯ থেকে ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল নির্মিত একটি বৈদ্যমঠ। এ স্তূপটি বাসর ঘর নয়। এ স্তূপটির পশ্চিমাংশে আছে বাসর ঘরের স্মৃতিচিহ্ন। পূর্বাংশে রয়েছে চৌবাচ্চাসদৃশ একটি স্নান ঘর। ব্রিটিশরা ১৯৩৪-৩৬ সালের দিকে প্রথম এখানে খনন কাজ চালায়। এরপর এই স্থানটি অখননকৃত অবস্থায়ই থেকে যায়। ফলে এটা যে আসলে কি ছিল তা এখনও অজানা। তবে বেহুলা লক্ষিন্দরের বাসরঘরের ইতিহাসটাই প্রচলিত হয়ে গেছে।
বেহুলা লখিন্দর
বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘর
মনসার পিতার নাম শিব। শিব সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। আর্যদের সাথে অনেক কুস্তি-দুস্তি করে, প্রবল ঘাতপ্রতিঘাতের পর অগ্নি, বরুণ, মিত্র, বৃহস্পতি, পুষন, ব্রহ্মা, রুদ্র, বিষ্ণু-প্রমূখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে তিনি সর্বভারতীয় প্রধান দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। এতে বড় বিজয়টা হয়েছে অনার্য ভারতীয় ভুমিপুত্রদের। শিব ভারতমাতার অনার্য দ্রাবিড় জাতির সৃষ্টি, আর্যদের বেদে শিবের নাম উল্লেখ নেই। যদিও তারা রুদ্রকে শিবই মনে করেন। শিবের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাঁর তৃতীয় নয়ন। মহাভারতে শিবকে ত্রিনয়ন রূপে কল্পনা করা হয়েছে; তাই উক্ত নামটির আক্ষরিক অর্থ করা হয়ে থাকে “তৃতীয় নয়নধারী’’। এই নয়ন দ্বারা শিব কাম-দেবকে ভস্ম করেছিলেন। কাম-দেব শব্দটির অর্থ ‘দিব্য প্রেম’ বা ‘প্রেমের দেবতা’। অর্থাৎ মানুষের মনে কাম দেন যে সত্তা। এখানে আমরা যদি ‘কাম-দেব’ এর জন্ম পরিচয় আর শিবের ‘তৃতীয় নয়ন’ এর শানে নুজুল জানতে চাই, তাহলে বেহুলা লখিন্দর কাহিনির বারোটা বেজে যাবে। ‘স্মার্ত’, “শৈব” ‘শাক্ত্‌ ‘বেদ’, ‘পুরান্‌ ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ এখানে মতের-পথের, কিতাবের সীমা-সংখ্যা নাই। এক শিবকে বহু জায়গায় বহুরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যে মনসা, তি্নিও প্রথমে সর্বপ্রধান দেবতা শিবের কন্যা ছিলেন না। হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করতে অনেক কাঠখড় পুড়েছে। তার বাবা ছিলেন কশ্যপ। পুরাণ অনুসারে তিনি ঋষি কশ্যপের কন্যা। একদা সর্প ও সরীসৃপগণ পৃথিবীতে কলহ শুরু করলে কশ্যপ তাঁর মন থেকে মনসার জন্ম দেন। ব্রহ্মা তাঁকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন। মনসা মন্ত্রবলে বিশ্বের উপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। এরপর মনসা শিবের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেন। শিব তাঁকে কৃষ্ণ-আরাধনার উপদেশ দেন। মনসা কৃষ্ণের আরাধনা করলে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তাঁকে সিদ্ধি প্রদান করেন এবং প্রথামতে তাঁর পূজা করে মর্ত্যলোকে তাঁর দেবীত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কশ্যপ জরুৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ দেন। ‘মনসা তাঁর অবাধ্যতা করলে, তিনি মনসাকে ত্যাগ করবেন’, এই শর্তে জরুৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। একদা মনসা দেরী করে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করলে তাঁর পূজায় বিঘ্ন ঘটে। এই অপরাধে জরুৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন। পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়।
আমরা আমাদের কাহিনি মনসা মঙ্গলেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করবো, অন্যতায় মহাসমুদ্রে ধ্রুবতারা বিহীন নাবিক, পথ-হারা পথিক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এক দিকে বিরক্তির সাথে অবাক হয়েছি, দেব-দেবীগণের জন্ম-সৃষ্টি, উত্থান-পতনের একাধিক ধারার বিচিত্র বর্ণনা পেয়ে। অন্য দিকে এ আমাকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাহায্য করেছে যে আমি বলবো, কেউ জীবনে যদি মানব প্রজাতির বা জীববিবর্তনের প্রাথমিক শিক্ষা নিতে চায় তাহলে সে যেন ঋদবেগ থেকে মহাভারত একবার ঘুরে আসে। শিবের যত ছিফতি নাম আছে, সবগুলো উল্লেখ করতে গেলে কাহিনি শেষ হতে সাত দিন সাত রাত লেগে যেতে পারে। কয়েকটা পরিচিত নাম যেমন- বিশ্বেশ্বর, বিষমাক্ষ, বীরেশ্বর, বৃষধ্বজ, ভবানীপতি, ভূতনাথ, ভূতপতি, ভূতভাবন, ভূতেশ, ভৈরব, ভোলা, ভোলানাথ, বাণদেব, বাণেশ্বর, বিরূপাক্ষ, বীরেশ্বর, মহাকাল, মহাদেব, মহানট, রুদ্র, মহেশ, মহেশান, মহেশ্বর, কৈলাসপতি, কৈলাসেশ্বর কাশীনাথ, কাশীশ, কাশীশ্বর, কাশীপতি, কুলেশ্বর, বিষকণ্ঠ, রুদ্র, আশুতোষ, পশুপতি ইত্যাদি। মানুষের অসাধ্য এক একটা অসাধারণ অলৌকিক কর্ম সাধনের সাথে এই গুণবাচক নামগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। যেমন; একই সাথে ইনি যখন ভয়ানক তখন রুদ্র, আর যখন কল্যাণকর তখন শিব। মহাকালরূপী রুদ্র সংহারকারক। প্রলয় শেষে ধ্বংসের মধ্য থেকেই তাঁর উৎপত্তি ঘটে। সে কারণে ইনি শিব, শঙ্কর বা ভৈরব নামে চিহ্নিত। জনন শক্তির পরিচায়ক হিসাবে শিবলিঙ্গ। তিনি ধ্বংস ও সৃষ্টি উভয়েরই কারণ তাই তিনি ঈশ্বর। তিনি অল্পে সন্তুষ্ট হন তাই আরেক নাম আশুতোষ। পশুদের অধিপতি বলে পশুপতি নামে খ্যাত। একবার সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃত দেবতারা গ্রহণ করার পর, অসুররা পুনরায় তা মন্থন করে। এই অতিরিক্ত মন্থনজনীত কারণে সমুদ্রে হলাহল নামক বিষ উত্থিত হয়। এর ফলে সমগ্র চরাচরের প্রাণীকূল বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। এই বিষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা মহাদেবের শরণাপন্ন হলে, মহাদেব উক্ত বিষ শোষণ করেন। বিষের প্রভাবে তাঁর কণ্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করেছিল বলে শিব নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন। আবার হরিবংশ পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী- ‘বিষ্ণু একবার শিবের গলা টিপে ধরেছিলেন। শিব পলায়নে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ তাতে নীল হয়ে যায়’। বৈষ্ণবরা বললেই হলো, আমরা তা মানবো কেন? শিয়া বা সুফীরা আলীকে নবি বলুক আর ইমাম বলুক তাতে সুন্নীদের কী?
শিব নিরপেক্ষ ন্যায় বিচারকারী। পক্ষপাতিত্ব তার ধর্ম নয়, যদিও তার স্ত্রী পার্বতি আর কন্যা মনসা বরাবরই তার উপর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ইন্দ্রসভায় সকল দেবতাদের সামনেই উত্থাপন করেছেন। শিব একই সাথে পরম করুণাময় আবার কঠিন শাস্তি দানকারী। অর্থাৎ অন্য ভাষায় বললে শিবই খালিক, মালিক, রাহমান ও কাহহার। মর্ত্যবাসী মানুষের মাঝে একই সাথে এই গুণাবলী থাকা অসম্ভব। শিবের স্ত্রী পার্বতীর অন্যান্য রূপ ও নামগুলো হল- সতী, উমা, গঙ্গা, দুর্গা, ললিতা, মহামায়া, চন্ডী, চামুন্ডা, ভগবতী, আদ্যাশক্তি, গৌরী, শক্তি ও কালী।
বলা হয়, শুধু শিবের বীর্য থেকে মাতৃগর্ভ ছাড়াই মনসার জন্ম। ও মা! আগে জানতাম দুনিয়ায় বাইবেলের মাতা ম্যেরির ছাওয়াল যিশুই একমাত্র বাপ-নাই সন্তান। মহাভারতে দেখি এটা কোন সমস্যাই না। এখানে বাপ ছাড়া সন্তান, মা ছাড়া সন্তানের কোনই অভাব নাই। মা ছাড়াই মনসার জন্ম কেমনে হলো? সেই কথাটা একটু পরে বলি, তার আগে শিব ও তার বউ নিয়ে আরো কিছু কথা জেনে নিই। আমরা সর্বদাই শিবলিঙ্গ ও শিবলিঙ্গ-পূজোর কথা শুনি কিন্তু অনেকেই এর পেছনের ইতিহাসটা জানিনা। মহেশ্বর শিবের মনে বাঙ্গালীর আশা, আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ, দয়া, আবেগ, অনুভুতি, প্রেম-কাম কোন কিছুরই কমতি ছিলনা আজও নেই। তিনি আজও বাঙ্গালীর-মনে-প্রাণে, অন্তরে-মানসে আগের রুপেই বিরাজিত আছেন। এমন কি বাহিরে বাহাদুর আর গৃহে স্ত্রী’সম্মুখে কাতর-অসহায় বাঙ্গালী চরিত্রও তার মাঝে বিদ্যমান। মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম যে হয়নি তা নয়। অনেকে বলেন পার্বতী বিনে শিবের কাম বাসনা মোটেই জাগতোনা। কথাটা আসলে পুরোপুরি সত্য কিনা তা আমরা পরে দেখবো।
পার্বতির পিতার নাম ছিল দক্ষ। তিনি জীব-সৃষ্টা দশ প্রজাপতির একজন। দক্ষের কন্যা সতী অর্থাৎ আমাদের পার্বতির সাথে শিবের বিবাহ হয়। সতীর নাম পার্বতি কী ভাবে হলো এর পেছনেও একটি ঘটনা আছে, তা পরে জানা যাবে। শিব তার শ্বশুর দক্ষকে খুব একটা সম্মান দেখাতেন না। জামাতার হেন কান্ডে, শ্বশুর দক্ষ বিরূপ হয়ে উঠেন। সতীর বিবাহের এক বৎসর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। এই যজ্ঞে দক্ষ তার জামাতা মহাদেব (শিব) ও কন্যা সতীকে দাওয়াত দিলেন না। সতী বিষয়টা জানতে পেরে অযাচিতভাবে যজ্ঞে যাবার উদ্যোগ নেন। মহাদেব তাঁর স্ত্রী সতীকে বাধা দেয়ায় সতী ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর মহামায়ার দশটি রূপ প্রদর্শন করে মহাদেবকে বিভ্রান্ত করেন। এই রূপ দশটি ছিল- কালী, তারা, রাজ-রাজেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামূখী, মাতঙ্গী ও মহালক্ষ্মী। শেষ পর্যন্ত শিব সতীকে তার পিতার যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু যজ্ঞস্থলে পিতা দক্ষ তার মেয়ের সামনেই শিবের নিন্দা করলে- সতী তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। সতীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের জটা ছিন্ন করে ফেলেন। সেই জটা থেকে বীরভদ্র নামক এক শক্তিশালী পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। এরপর এই বীরভদ্র মহাদেবের অন্যান্য অনুচরসহ তার আদেশে দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান পণ্ড করে দেন এবং দক্ষের মুণ্ডুচ্ছেদ করেন। শিবের শ্বশুড়ি বীরিণী তার স্বামী দক্ষের মৃত্যুতে আকুল হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। এরপর ব্রহ্মার অনুরোধে মহেশ্বর শিব, তার শ্বশুর দক্ষের ঘাড়ে একটি ছাগলের মুণ্ডু স্থাপন করেন।
সতীর দেহত্যাগের পর, স্ত্রী শোকে কাতর ভোলানাথ শিব তাঁর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। এর ফলে সৃষ্টি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে, বিষ্ণু তাঁর চক্র দ্বারা সতীদেহকে একান্নভাগে বিভক্ত করে দেন। এই একান্নটি খণ্ড ভারতের বিভিন্নস্থানে পতিত হয়। পতিত প্রতিটি খণ্ড থেকে এক একটি মহাপীঠ উৎপন্ন হয়। সতীর দেহাংশ যে সকল স্থানে পতিত হয়েছিল, মহাদেব সেখানে লিঙ্গরূপে অধিষ্ঠিত হলেন। বিশেষ করে সতীর মস্তিষ্ক পতিতস্থানে শিব শোকাহত অবস্থায় উপবেশন করেন। এই সময় দেবতারা সেখানে উপস্থিত হলে- শিব লজ্জায় প্রস্তর-লিঙ্গে পরিণত হন। পরে দেবতারা এই লিঙ্গরূপী মহাদেবকে পূজা করতে থাকেন। হিন্দু পুরাণে মহাদেবের এই লিঙ্গপ্রতীক শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত। সতীর পূনর্জনম হয় হিমালয়ের গৃহে। এর পর থেকে সতীর বিবর্তনীয় নাম হয় পার্বতি।
পার্বতি ছাড়া কারো প্রতি শিবের কাম হয় না। প্রেমে মগ্ন শিব একদিন পার্বতির কথা চিন্তা করে কাম চেতনায় বীর্য বের করে দেন। সেই বীর্য পদ্ম পাতার ওপরে রাখেন। বীর্য পদ্মের নাল বেয়ে পাতালে চলে যায়। সেখানে সেই বীর্য থেকেই মনসার জন্ম। মনসা বড় হন বাসুকীর কাছে । কে এই বাসুকী? তা পরে দেখা যাবে। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দেন। যুবতী মনসা পিতার কাছে ফিরে এসে তার পরিচয় দেন। আবদার করেন কৈলাসে বাপের বাড়ি যাবার। শিব তার স্ত্রী পার্বতির ভয়ে কন্যাকে নিতে চান না। মনসাকে তিনি পরে মন্দিরে ফুলের ডালিতে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পার্বতি মনসাকে দেখে ফেলেন। তিনি মনসাকে সতীন মনে করে হিংসায় মনসার এক চোখ অন্ধ করে দেন। শিবের প্রতি পার্বতির মানসিক নির্যাতন আর মনসার প্রতি শারিরিক অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মনসা একদিন পার্বতিকে দংশন করে বসেন। সে দংশনে পার্বতির মৃত্যু হয়। শিব মনসাকে অনুরোধ করেন পার্বতির জীবন ফিরিয়ে দিতে। পিতার অনুরোধে মনসা পার্বতিকে আবার জীবিত করে তোলেন। পার্বতির রোষে ভীত শিব তার আপন কন্যা মনসাকে বনবাসে পাঠিয়ে দেন। মনসা ব্রহ্মর বীর্য ধারণ করে উনকোটি নাগ জন্ম দেন। এরপর মনসা সর্পদেবী আকারে হাজির হন। বনবাস থেকে ফিরে মনসা পিতার কাছে নিজের পূজা প্রচলনের আবদার প্রকাশ করেন। শিব বলেন, যদি চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিতে রাজী হয়, তবে দুনিয়ায় মনসার পূজার প্রচলন হবে।
মঙ্গলকাব্যে মনসা শিবের কন্যা, পুরাণ অনুসারে ঋষি কশ্যপের কন্যা। মনসাবিজয় কাব্য থেকে জানা যায়, বাসুকীর মা একটি ছোটো মেয়ের মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। শিবের বীর্য এই মূর্তি স্পর্শ করলে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী তাঁকে নিজ ভগিনীরূপে গ্রহণ করেন। রাজা পৃথু পৃথিবীকে গাভীর ন্যায় দোহন করলে উদগত বিষের দায়িত্বও বাসুকী মনসাকে দেন। একদিন শিব যুবতি মনসাকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন। কি আশ্চর্য! স্বয়ং মহেশ্বর তার আপন মেয়েকে চিনতে পারলেন না? মনসা যে ভাবেই হউক তার পিতাকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে তিনি তারই কন্যা। শিব তখন মনসাকে স্বগৃহে আনয়ন করেন। শিবের পত্নী পার্বতি মনসাকে শিবের উপপত্নী মনে করেন। করার কথা। শিবকে পার্বতি চিনবেন না তো কে চিনবে? তিনি মনসাকে অপমান করেন এবং ক্রোধবশত তাঁর একটি চোখ দগ্ধ করেন। পরে শিব একদা বিষের জ্বালায় কাতর হলে মনসাই তাঁকে রক্ষা করেন। একবার পার্বতি মনসাকে পদাঘাত করলে মনসা তাঁর বিষদৃষ্টি হেনে পার্বতিকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে মনসা ও পার্বতির কলহে হতাশ হয়ে শিব মনসাকে পরিত্যাগ করেন। দুঃখে শিবের চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল পড়ে আর সেই জলে জন্ম হয় মনসার সহচরী নেতার (মনসার ভাষায় নিতী)। মনসা তাকে সব সময় দিদি বলে ডাকেন। এরপর মনসা তাঁর সহচরী নেতার সঙ্গে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন মানব ভক্ত সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে লোকেরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু যারা তাকে পূজা করতে অস্বীকার করে, তাদের চরম দুরবস্থা সৃষ্টি করে তাদের পূজা আদায় করেন মনসা। তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পূজা লাভে সক্ষম হন। এমনকি তখনকার মুসলমান শাসক হাসানও তাঁর পূজা করেন। জরৎকারুর সঙ্গে যখন মনসার বিবাহ হয়, পার্বতি মনসার ফুলশয্যার রাতটিকে ব্যর্থ করে দেন। তিনি মনসাকে উপদেশ দিয়েছিলেন সাপের অলঙ্কার পরতে আর বাসরঘরে ব্যাঙ ছেড়ে রাখতে যাতে সাপেরা আকর্ষিত হয়ে তাঁর বাসরঘরে উপস্থিত হয়। এর ফলে, ভয় পেয়ে জরৎকারু পালিয়ে যান। পরে তিনি ফিরে আসেন এবং তাঁদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়। মনসার জন্ম যে ভাবেই হউক না কেন, তিনি যে একজন জনম দুঃখিনী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। শিশুকালে তাকে তার বাবা ত্যাগ করলেন যৌবনে তার স্বামীও ত্যাগ করলেন। বনবাস থেকে ফিরে এসে মনসা পিতার কাছে নতজানু হয়ে করজোড়ে মিনতি করে বলেছিলেন- ‘পিতা আমি দেবীত্ব চাইনা, তোমার কন্যা হওয়ার অধিকারটুকু চাই’। শিব তাতেও অপারগতা দেখালেন। পার্বতির ডরে মহাদেব মনসাকে ফুলের মধ্যে লুকিয়ে শিবলোকের এক কোণে স্থান দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন এই ফুল কেউ যেন স্পর্শ না করেন। দেবী পার্বতি মহেশ্বরের নির্দেশ অমান্য করে সেই ফুল থেকে মনসাকে খুঁজে বের করে তাকে অপমান করেন। কেন? মনসার জন্মের জন্যে কেউ দোষী হলে তিনিই হবেন যিনি তাকে জন্ম দিয়েছেন। মনসার জন্মের জন্যে তো মনসা দোষী হতে পারেন না। কেন মনসার প্রতি দেবী পার্বতির এত ক্ষোভ এত ঘৃণা? নিম্নবর্ণের আদিবাসী দেবতা বলে? হ্যাঁ মনসা আদিবাসী দেবতা ছিলেন। কিন্তু এরাও যে স্বর্গলোকের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে, দেবীত্ব অর্জন করতে পারে, মানুষের পুঁজো পেতে পারে, ইন্দ্রসভায় সঠান বুকে দাঁড়িয়ে, তর্জনী উঁচিয়ে দেবকুলের অনাচারের প্রতিবাদ করার স্পর্ধা দেখাতে পারে, উচ্চপদের দম্ভ আর অহংকারে আকন্ঠ নিমজ্জিত দেবী পার্বতি তা বুঝি ভাবতেও পারেন নি? বাসুকী যদি মনসাকে আশ্রয় না দিতেন, মনসাবিজয় কাব্য হয়তো লেখাই হতোনা আর স্বর্গলোকের উচ্চবর্ণের রাজা-মহারাজা, শাসক-শোসক, দেব-দেবীদের সুকীর্তি- কুকীর্তি মর্ত্যলোকের নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষের অজানাই থেকে যেতো।
বলছিলাম বাসুকীর কথা পরে জানাবো। বাসুকীর নাম, দুটো কবিতায় উল্লেখ হতে দেখেছি, আপনাদের জন্যে সংক্ষেপিত করে এখানে তুলে দিলাম-
মহাভারত: আদিপর্ব
সুকুমার রায়
বুদ্বিভ্রংশ ঘটে হায় শান্তনু রাজার,
বিবাহের লাগি বুড়া করে আবদার।
মৎস্যরাজকন্যা আছে নামে সত্যবতী,
তারে দেখি শান্তনুর লুপ্ত হল মতি।
মৎস্যরাজ কহে, ‘রাজা, কর অবধান,
কিসের আশায় কহ করি কন্যাদান?
সত্যব্রত জ্যেষ্ঠ সেই রাজ্য অধিকারী,
আমার নাতিরা হবে তার আজ্ঞাচারি,
রাজমাতা কভু নাহি হবে সত্যবতী,
তেঁই এ বিবাহ- কথা অনুচিত অতি।’
ভগ্ন মনে হস্তিনায় ফিরিল শান্তনু
অনাহারে অনিদ্রয় জীর্ন তার তনু।
মন্ত্রী মুখে সত্যব্রত শুনি সব কথা
মৎস্যরাজপুরে গিয়া কহিল বারতা-
রাজ্যে মম সাধ নাহি, করি অঙ্গীকার
জন্মিলে তোমার নাতি রাজ্য হবে তার।’
রাজা কহে, ‘সাধুতুমি, সত্য তব বাণী,
তোমার সন্তান হতে তবু ভয় মানি।
কে জানে ভবিষ্যকথা, দৈবগতিধারা-
প্রতিবাদী হয় যদি রাজ্যলাভে তারা?’
সত্যব্রত কহে, ‘শুন প্রতিজ্ঞা আমার,
বংশ না রহিবে মম পৃথিবী মাঝার।
সাক্ষী রহ চন্দ্র সূর্য লোকে লোকান্তরে
এই জন্মে সত্যব্রত বিবাহ না করে।’
শুনিয়া অদ্ভুত বাণী ধন্য কহে লোকে,
স্বর্গ হতে পুষ্পধারা ঝরিল পলকে।
সেই হতে সত্যব্রত খ্যাত চরাচরে
ভীষণ প্রতিজ্ঞাবলে ভীষ্ম নাম ধরে।
ঘুচিল সকল বাধা, আনন্দিত চিতে
সত্যবতী রাণী হয় হস্তিনাপুরীতে।
ক্রমে হলে বর্ষ গত শান্তনুর ঘরে
জন্ম নিল নব শিশু, সবে সমাদরে।
রাখিল বিচিত্রবীর্য নামটি তাহার
শান্তনু মরিল তারে দিয়া রাজ্যভার।
অকালে বিচিত্রবীর্য মুদিলেন আঁখি
পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্র রাখি।।
হস্তিরায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল
রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল।
সেই কুলে জন্মি তবু দৈববশে হায়
অন্ধ বলি ধৃতরাস্ট্র রাজ্য নাহি পায়।
কনিষ্ঠ তাহার পাণ্ডু, রাজত্ব সে করে,
পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে।
জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন
‘সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র’ কহে সর্বজন।
দ্বিতীয় সে মহাবলী ভীম নাম ধরে,
পবন সমান তেজ পবনের বরে।
তৃতীয় অর্জুন বীর, ইন্দ্রের কৃপায়
রুপেগুণে শৌর্যেবীর্যে অতুল ধরায়।
এই তিন সহোদর কুন্তীর কুমার,
বিমাতা আছেন মাদ্রী দুই পুত্র তাঁর-
নকুল ও সহদেব সুজন সুশীল
এক সাথে পাঁচজনে বাড়ে তিল তিল।
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র তার,
অভিমানী দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ সবাকার।
পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই নষ্ট হয় কিসে,
এই চিন্তা করে দুষ্ট জ্বলি হিংসাবিষে।
হেনকালে সর্বজনে ভাসাইয়া শোকে
মাদ্রীসহ পান্ডরাজা যায় পরলোকে।
‘পান্ডু গেল’, মনে মনে ভাবে দুর্যোধন,
এই বারে যুধিষ্ঠির পাবে সিংহাসন!
ইচ্ছা হয় এই দণ্ডে গিয়া তারে মারি-
ভীমের ভয়েতে কিছু করিতে না পারি।
আমার কৌশলে পাকে ভীম যদি মরে
অনায়াসে যুধিষ্ঠিরে মারি তারপরে।’
কুচক্র করিয়া তবে দুষ্ট দুর্যোধন
নদীতীরে উৎসবের করে আয়োজন-
একশত পাঁচ ভাই মিলি একসাথে
আমোদ আহ্লাদে ভোজে মহানন্দে মাতে।
হেন ফাঁকে দুর্যোধন পরম যতনে
বিষের মিষ্টান্ন দেয় ভীমের বদনে।
অচেতন হল ভীম বিষের নেশায়,
সুযোগ বুঝিয়া দুষ্ট ধরিল তাহায়,
গোপনে নদীর জলে দিল ভাসাইয়া,
কেহ না জানিল কিছু উৎসবে মাতিয়া।।
এদিকে নদীর জলে / ডুবিয়া অতল তলে
ভীমের অবশ দেহে / কেমনে জানে না কেহ,
কোথায় ঠেকিল শেষে / বাসুকী নাগের দেশে।
ভীমের বিশাল চাপে / নাগের বসতি কাঁপে
দেহ ভারে কত মরে / কত পলাইল ডরে ,
কত নাগ দলে বলে / ভীমেরে মারিতে চলে
দংশিয়া ভীমের গায় / মহাবিষ ঢালে তায়।
অদ্ভুত ঘটিল তাহে / ভীম চক্ষু মেলি চাহে ,
বিষে হয় বিষক্ষয় / মুহুর্তে চেতনা হয়,
দেখে ভীম চারিপাশে / নাগেরা ঘেরিয়া আসে
দেখিয়া ভীষণ রাগে / ধরি শত শত নাগে
চূর্ণ করে বাহুবলে / মহাভয়ে নাগে দলে
ছুটে যায় হাহাকরে / বাসুকী রাজার দ্বারে।
বাসুকী কহেন, ‘শোন / আর ভয় নাহি কোন,
তুষি তারে সুবচনে / আন হেথা সযতনে।’
রাজার আদেশে তবে / আবার ফিরিয়া সবে
করে গিয়া নিবেদন / বাসুকীর নিমন্ত্রণ !
শুনি ভীম কুতুহলে / রাজার পুরীতে চলে ,
সেথায় ভরিয়া প্রাণ / করিয়া অমৃত পান
বিষের যাতনা আর / কিছু না রহিল তার ,
মহাঘুমে ভরপুর / সব ক্লান্তি হল দুর
তখন বাসুকী তারে / স্নেহভরে বারে বারে
আশিস করিয়া তায় / পাঠাইল হস্তিনায় ।
সেথা ভাই চারিজনে / আছে শোকাকুল মনে
কুন্তীর নয়নজল / ঝরে সেথা অবিরল ,
মগন গভীর দুখে / ফিরে সবে ম্লান মুখে ।
হেন কালে হারানিধি / সহসা মিলালো বিধি
বিষাদ হইল দুর / জাগিল হস্তিনাপুর ,
উলসিত কলরবে / আনন্দে মাতিল সবে।।
এবার প্রথম বাঙ্গালী মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বন্দনাগীতি : মলুয়া থেকে-
আদিতে বন্দনা গাই অনাদি ইশ্বর।
দেবের মধ্যে বন্দি গাই ভোলা মহেশ্বর।।
দেবীর মধ্যে বন্দি গাই শ্রীদুর্গা ভবানী।
লক্ষী-সরস্বতী বন্দুম যুগল নন্দিনী।।
ধন-সম্পদ মিলে লক্ষ্মীরে পূজিলে।
সরস্বতী বন্দি-গাই বিদ্যা যাতে মিলে।।
কার্ত্তিক-গণেশ বন্দুম যত দেবগণ।
আকাশ বন্দিয়া গাই গড়ুর-পবন।।
চন্দ্র-সূর্য্য বন্দিয়া গাই জগতের আখি।
সপ্ত পাতাল বন্দুম নাগান্ত বাসুকী।।
মনসা দেবীরে বন্দুম আস্তিকের মাতা।
যাহার বিষের তেজে ডরায় বিধাতা।।
ভক্তমধ্যে বন্দিয়া গাই রাজা চন্দ্রধর।
তার মধ্যে বন্দিয়া গাই বেউলা-লক্ষ্মীন্দর।।
চার কুনা পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি।
সলাভ্য? বন্দনা গীত গায় চন্দ্রাবতী।।
(মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি দ্বিজবংশী দাসের কন্যা, বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ফুলেশ্বরী নদীর পাশে পাতোয়াইর গ্রামে। এই মন্দিরে বসে চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখতেন)
আর এই চন্দ্রাবতীর বাড়ি- (সুত্র প্রথম আলো)
http://www.youtube.com/watch?v=87c2Q1VnKSw
– পার্বতি মহাদেবের আদেশ অমান্য করলেন-
http://www.youtube.com/watch?v=pbcRFiPYZM8
আমরা জানলাম মনসা আদিবাসী দেবতা। পূর্বে শুধু নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। মনসার সাথে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের আত্বীয়তা কীভাবে গড়ে উঠলো সেই কথাটা একটু বলি। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ, মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলশ্রুতি। এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন। (তথ্য-উইকি থেকে)
শ্রী আশুতোষ ভট্রাচার্য তার মনসামঙ্গল নামক সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন-
‘’এখন দেখিতে হয় পশ্চিম-ভারতের ‘মনসা’ নামটি কখন হইতে জাঙ্গুলী দেবীর পরিবর্তে ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ হয়। পূর্বেই বলিয়াছি জাঙ্গুলির সঙ্গে বৌদ্ধ সমাজের সম্পর্ক ছিল, তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবী ছিলেন। পাল রাজত্বের অবসানে সেন রাজত্বের যখন প্রতিষ্ঠা হইল, তখন এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ও তাহার স্থানে হিন্দুধর্মের পুনরাভ্যুত্থান হইয়াছিল, সেই সময়ে যে সকল বৌদ্ধ দেবদেবীকে নুতন নাম দিয়া হিন্দুসমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হইয়াছিল, এই সর্পদেবী তাহাদের অন্যতম। বৌদ্ধ সংস্রবের জন্য তাঁহার জাঙ্গুলী নাম পরিত্যাক্ত হয় এবং তাহার পরিবর্তে মনসা নামকরণ হয়। বাংলার পূর্বোক্ত অর্বাচীন পুরাণগুলি ইহার কিছুকাল মধ্যেই রচিত হয় এবং তাহার মধ্য দিয়া মনসাকে শিবের কন্যারুপে দাবী করিয়া হিন্দু-সমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হয়’’।
জাঙ্গুলী থেকে মনসা, রুদ্র থেকে শিব আর সতী থেকে পার্বতী, যে যেভাবেই আমাদের গল্পে আসুন না কেন তাদের মাঝে আমরা খুঁজে পাই ভারত মাতার সন্তানাদির আচার আচরণ, ক্ষোভ ভালবাসা, আশা প্রত্যাশা, সুখ দুঃখের জীবনকাহিনি। আর্যরা কালো না লাল ছিলেন, বৌদ্ধ থেকে ব্রাহ্মণ, নাকি আর্য থেকে ব্রাহ্মণ সে সব ইতিহাস লেখকদের জন্যেই থাক। এই খাল-বিল, নদী-নালা, এই কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের সর্প, ভেলা সব আমাদের, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা, চাঁদ সওদাগর শিব-পার্বতি আমাদের নিকটাত্মীয়, এই মনসামঙ্গলও শুধুই আমাদের। এক কথায় মনসামঙ্গল আমাদের সুখ-দুঃখ, ঝগড়া-বিবাদ, প্রেম-ভালবাসা আমাদের এক জীবনগাঁথা।
যাক, এখন কথা হলো মনসার প্রতি দেবী পার্বতীর এতো ক্ষোভ এতো ঘৃণা কিসের কারণ। মনসার জন্ম প্রক্রীয়া? পার্বতীর ছেলে গনেশের জন্ম কি স্বাভাবিক প্রক্রীয়ায় হয়েছিল? দেখি এ ব্যাপারে কিতাবে কী লেখা আছে-
শিব পুরানঃ
পার্বতী একদিন নন্দীকে দ্বারী নিযুক্ত করে স্নান করতে যান। এমন সময় শিব সেখানে উপস্থিত হলে, তিনি নন্দীকে তিরষ্কার করে পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করেন। এতে পার্বতী অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। (হবেন না কেন? একেবারে বাথরুমে পারমিশন ছাড়াই?) পার্বতী তার সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে জল থেকে পাঁক তুলে একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মান করেন ও সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাকে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করেন। এরপর একদিন এই কুমারকে দ্বারী নিয়োগ করে পার্বতী স্নানে গমন করলে শিব তথায় উপস্থিত হন। কুমার শিবকে যেতে বাধা দেন। এতে প্রথমে প্রমথগণের সঙ্গে তার বিবাদ ও পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ হয়। প্রমথগণ, শিব ও সকল দেবতা এই যুদ্ধে পরাজিত হন। তখন নারদের পরামর্শে বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করেন ও শিব শূলের দ্বারা তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। এই সংবাদ শুনে পার্বতি ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বসৃষ্টি বিনষ্ট করতে উদ্যোগী হন। নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করেন। পার্বতী তাঁর পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করেন ও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যেন এই পুত্র সকলের পূজ্য হয়। কিন্তু কুমারের মুণ্ডটি তখন আর পাওয়া যায় না। শিব তখন প্রমথগণকে উত্তরমুখে প্রেরণ করেন এবং যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মস্তক নিয়ে আসতে বলেন। তারা একটি একদন্ত হস্তিমুণ্ড নিয়ে উপস্থিত হন ও দেবগণ এই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই তাঁকে জীবিত করেন। অনন্তর শিব তাঁকে নিজপুত্র রূপে স্বীকার করেন। দেবগণের আশীর্বাদে এই কুমার সকলের পূজ্য হন ও গণেশ নামে আখ্যাত হন।
স্কন্দ পুরানঃ
সিন্দূর নামে এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে প্রবেশ করে গণেশের মস্তক ছিন্ন করে। কিন্তু এতে শিশুটির মৃত্যু ঘটে না, বরং সে মুণ্ডহীন অবস্থাতেই ভূমিষ্ট হয়। জন্মের পরে, নারদ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে গণেশ তাঁকে ঘটনাটি জানান। নারদ
এরপর তাকে এর একটি বিহিত করতে বললে, সে নিজের তেজে গজাসুরের মস্তক ছিন্ন করে নিজের দেহে যুক্ত করে।
বৃহদ্ধর্মপুরাণঃ
পার্বতী পুত্রলাভে ইচ্ছুক হলে শিব অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অগত্যা পার্বতীর পীড়াপীড়িতে শিব পার্বতীর বস্ত্র টেনে সেটিকেই পুত্রজ্ঞানে চুম্বন করতে বলেন। পার্বতী সেই বস্ত্রকে পুত্রের আকার দিয়ে কোলে নিতেই সেটি জীবিত হয়ে ওঠে। তখন শিব পুত্রকে কোলে নিয়ে বলেন, এই পুত্র স্বল্পায়ু। উত্তরদিকে মাথা করে শায়িত এই শিশুর মস্তকও তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হয়ে যায়। পার্বতী শোকাকুল হন। এমন সময় দৈববাণী হয় যে উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে এমন কারোর মাথা এনে জুড়ে দিলে তবেই এই পুত্র বাঁচবে। পার্বতী তখন নন্দীকে মস্তকের সন্ধানে পাঠান। নন্দী ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মাথা কেটে আনেন। দেবতারা বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। এই মাথাটি জুড়ে শিব পুত্রকে জীবিত করেন। শিবের বরে, ইন্দ্র ঐরাবতকে সমুদ্রে ফেলে দিলে সে আবার মস্তক প্রাপ্ত হয়।
পদ্মপুরাণঃ হরপার্বতী ঐরাবতের বেশে বনে বিহার করছিলেন, তাঁদের সেই মিলনের ফলে গণেশের জন্ম হয়।
লিঙ্গপুরাণঃ
দেবগণ শিবের নিকট উপস্থিত হন ও ব্রহ্মা অসুরদের হাত থেকে নিরাপত্তা চান। শিব তখন নিজ দেহ থেকে গণেশের জন্ম দেন।
দেবীপুরাণঃ
শিবের রাজসিক ভাব দেখা দিলে তাঁর দুই হাত ঘামতে থাকে এবং সেই ঘাম থেকে গনেশের জন্ম হয়।
মৎসপুরাণঃ
পার্বতী চূর্ণক বা বেসম দিয়ে নিজের গাত্রমার্জনা করছিলেন। সেই সময় এই চূর্ণক দিয়ে একটি হাতির মাথা ওয়ালা মূর্তি নির্মান করে তা গঙ্গাজলে ফেলে দেন। পুতুলটি বিরাট হয়ে পৃথিবী পূর্ণ করতে উদ্যত হলে পার্বতী ও গঙ্গা একে পুত্র সম্বোধন করেন ও ব্রহ্মা একে গণাধিপতি করে দেন।
বামনপুরাণঃ
পার্বতী স্নানের সময় নিজের গাত্রমল দিয়ে চতুর্ভূজ গজানন মূর্তি নির্মান করলে মহাদেব তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। বলেন, যেহেতু আমাকে ছাড়াই পুত্রের জন্ম হয়েছে সেহেতু এ বিনায়ক নামে প্রসিদ্ধ হবে এবং বিঘ্ননাশকারী হবে।
শিব ছাড়া গনেশের জন্ম আর পার্বতী ছাড়া মনসার জন্ম বুঝলাম, তাহলে মনসার দোষটা কোথায়? তো এই জনম দুঃখিনী বাপ হারা, মা হারা স্বামী হারা মনসা, রাগী, বদমেজাজী, প্রতিশোধ পরায়ণ, বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাকে আর দোষ দেয়া যায় কি? পিতা তাকে ফুলের ভিতরে লুকিয়ে শিবলোকে নিলেন কিন্তু পার্বতী মনসাকে সেখানে থাকতে দিলেন না। দেবী পার্বতী মহাদেবকে জানিয়ে দিলেন, মনসাকে তিনি স্বর্গলোকে কোনদিনই ঢুকতে দেবেন না, এ তার পণ। দেবগণ সংবিধানে আইন করে রেখে দিয়েছেন, স্বর্গলোকে স্থান পেতে হলে মর্ত্যলোকে মানুষের পূজো অর্ঘ্য পেতে হবে। মহাদেব মনসার উপর শর্ত আরোপ করেছেন, স্বর্গলোকে আসতে হলে তাকে চম্পক নগরীর প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি চন্দ্রধর বণিকের পূজো পেতে হবে। চন্দ্রধর বণিক, দেবী পার্বতী ও মহাদেবের একনিষ্ঠ পূজারী। এদিকে চন্দ্রধর বণিকের (চাঁদ সওদাগর) পণ তিনি নিম্ন বর্ণের জাতপাতহীন নিকৃষ্ট মনসার পূজো দিবেন না। চাঁদ সওদাগর জানেন দেবী পার্বতী মনসাকে ঘৃণা করেন। মনসাকে তাড়ানোর জন্যে পার্বতী চাঁদের হাতে হাতাল বৃক্ষের যষ্টি দিয়ে রেখেছেন। দেখা মাত্র চাঁদ সওদাগর যষ্টির এক আঘাতে মনসাকে মেরে ফেলবেন। চাঁদ জানেন তার মহাদেবী পার্বতী মনসার একটি চোখ দগ্ধ করেছিলেন আর সেই কারণেই চাঁদ কথায় কথায় মনসাকে পাতালপূরী চ্যাংমুড়ী কানি বলে ব্যঙ্গ করেন। করবেন ই তো, ধন-সম্পধ, মান-সম্মান কিসের অভাব চাঁদ সওদাগরের? তার হাত যে অনেক উপরে। যে হাত দিয়ে সর্বোচ্চ দেবতার চরণে অর্ঘ প্রদান করেন সেই হাত এতো নিচে নামিয়ে মনসাকে তিনি ফুল দিবেন না, এ তার প্রতিজ্ঞা। আর মনসারও পণ, চাঁদের সকল দম্ভ-অহংকার ভেঙ্গে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে তার হাত দুটোকে নিচে নামিয়ে ছাড়বেন, মনসার সামনে চাঁদ সওদাগরকে মাথা নত করতেই হবে। এখানে একটা কথা জেনে রাখা ভাল যে, মনসা কোনদিনই বিনা দোষে বা অকারণে কাউকে আঘাত করেন না। কারো অপকার করার জন্যে মনসার জন্ম হয়নি, মনসা তার স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকারটুকুই চান। এতে কেউ বাঁধার সৃষ্টি করলে, প্রতিপক্ষ হয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ালে তিনি অবশ্যই ভয়ংকর ভুমিকা নিতে দ্বিধাবোধ করেন না।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ