অদ্বৈতমতে জীব - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

24 July, 2020

অদ্বৈতমতে জীব

অদ্বৈতমতে জীব
অদ্বৈতমতে জীব
শঙ্করাচার্য বর্ণিত অদ্বৈতবেদান্তের মূল সূত্রেই জীব সম্পর্কেও বলা আছে- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তার মানে, শঙ্করের তৃতীয় বাণীটি হলো- ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন তথা জীব ব্রহ্মস্বরূপ।

এখন প্রশ্ন হলো, অদ্বৈত মতানুসারে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট। কিন্তু জীব তো সত্যস্বরূপ নয়, জ্ঞানস্বরূপ নয় এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে জীব ও ব্রহ্মকে কিভাবে এক ও অভিন্ন বলা যাবে ?
উত্তরে বলা হয়, জীবেরও ব্রহ্মের মতোই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হওয়া উচিত। অর্থাৎ আগুন এবং আগুনের একটা ফুলকি যে অর্থে এক, জীব ও ব্রহ্ম সেই অর্থেই অভিন্ন। কিন্তু জীবের ব্রহ্মস্বরূপতা আমাদের উপলব্ধি হয় না। কারণ দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং বিষয়-বাসনার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে জীবের জ্ঞান, ঐশ্বর্য ইত্যাদি তিরোহিত হয়। সংসারদশায় অবিদ্যা জীবের ব্রহ্ম-স্বভাবকে আবৃত করে রাখে। এই অবিদ্যা মলিনসত্ত্বপ্রধান-ব্যষ্টি-অবিদ্যা। এর ফলে জীব নিজেকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।

জীবের সংসারদশা :
ব্যবহারিক স্তরে ‘আমি’কে আমরা প্রত্যেকেই জানি। এই ‘আমি’ই হলো আমাদের জ্ঞান অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদির অধিষ্ঠান ও কর্তা। ‘আমি জানি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ইচ্ছা করি’- এইসব বাক্যগুলির মধ্য দিয়ে সেই ব্যবহারিক আত্মা বা জীবের অস্তিত্ব বা বোধ প্রকাশিত হয়। আমার জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছার কর্তা হলো আমি বা অহং। সুতরাং, এখানে জীব কর্তা এবং ভোক্তা। কিন্তু ব্রহ্ম কর্তা নয়, এবং জ্ঞানের বিষয়ও নয়। জানা, অনুভব করা এবং ইচ্ছা করা- এগুলি সবই চৈতন্যের ক্রিয়া।
কিন্তু এই চৈতন্য শুদ্ধ চৈতন্য নয়। এগুলি মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা সীমিত চৈতন্যের ক্রিয়া। শুদ্ধ-চৈতন্য থেকে ভিন্ন জীবাত্মাকে তাই সাক্ষী-চৈতন্য বলে। জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছায় দ্বৈতভাব থাকে। যেমন- জ্ঞাতা ও বিষয়ের সম্পর্ক, অনুভব ও তার বিষয়ের সম্পর্ক, ইচ্ছা ও ইচ্ছার বিষয়ের সম্পর্ক। ব্রহ্ম কিন্তু অদ্বয় ও সকল প্রকার ভেদশূন্য। অপরপক্ষে কিছু জানতে গেলে, অনুভব করতে গেলে এবং কিছু ইচ্ছা হলে বিষয়ী ও বিষয়ের মধ্যে ভেদ অবশ্যম্ভাবী। তাই আমাদের অহং বা আমি-টি ব্রহ্ম নয়। অহং হলো অবিদ্যার দ্বারা সীমিত ব্রহ্ম বা জীব।

এ প্রেক্ষিতে শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেন-

‘তদ্যথা পুত্রভার্য্যাদিষু বিকলেষু সকলেষু বা অহমেব বিকলঃ সকলো বা ইতি বাহ্যধর্ম্মান্ আত্মনি অধ্যাসতি। তথা দেহধর্ম্মান্ স্থূলোহহং কৃশোহহং গৌরোহহং তিষ্ঠামি লঙ্ঘয়ামি চ ইতি। তথা ইন্দ্রিয়ধর্ম্মান্ মূকঃ ক্লীবঃ বধিরঃ কাণঃ-অন্ধঃ অহম্- ইতি। তথা অন্তঃকরণধর্ম্মান্ কামসংকল্প বিচিকিৎসাধ্যবসায়াদীন্ । এবং অহংপ্রত্যয়িনং অশেষ স্বপ্রচার সাক্ষিণি প্রত্যগাত্মনি অধ্যস্য তঞ্চ প্রত্যগাত্মানং সর্ব্ব সাক্ষিণং তদ্বিপর্ষ্যয়েণ অন্তঃকরণাদিষু অধ্যস্যতি। এবময়ং অনাদিঃ অনন্তঃ নৈসর্গিকঃ অধ্যাসঃ মিথ্যাপ্রত্যয়রূপঃ কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বপ্রবর্ত্তকঃ সর্ব্বলোকপ্রত্যক্ষঃ। অস্য অনর্থ হেতোঃ প্রহাণায় আত্মৈকত্ব বিদ্যাপ্রতিপত্তয়ে সর্ব্বে বেদান্তা আরভ্যন্তে।’- (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১, বেদান্তসূত্রম্,পৃষ্ঠা-৩১)
অর্থাৎ :
আমাদের মধ্যে কারও পুত্র বা স্ত্রী প্রভৃতি যদি পীড়িত অথবা সুস্থ হয়, তাহলে, সে যথাক্রমে নিজ আত্মাকেই পীড়িত বা সুস্থ বলে বোধ করে থাকে- এটাই আত্মার উপর বাহ্যধর্মসমূহের অধ্যাস। এভাবে আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি গৌড়বর্ণ, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমি চলছি ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর দেহের ধর্মগুলির আরোপ করে থাকে। এভাবে আমি মূক, আমি ক্লীব, আমি বধির, আমি কাণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর ইন্দ্রিয়গুলির ধর্মগুলিকে আরোপিত করে থাকে। এভাবেই আবার অন্তঃকরণের ধর্মগুলি অর্থাৎ কাম, সংকল্প, সংশয় ও নিশ্চয় প্রভৃতি- আত্মাতে আরোপ করে থাকে। এভাবেই আবার সেই আমি- এই প্রত্যয়যুক্ত জীবকে সকলপ্রকার মানসবৃত্তির সাক্ষী- সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মাতে আরোপিত করা যায়, এবং বিপরীতভাবে আবার সেই সর্ববৃত্তির সাক্ষীস্বরূপ- প্রকাশময় পরমাত্মাকে- সেই আমি-প্রত্যয়ের বিষয় জীবাত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। এই যে পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাস- তার আদি খুঁজে পাওয়া যায় না- তার অন্তও নাই। এই অধ্যাস আমাদের নৈসর্গিক- এটাই মিথ্যাজ্ঞান অর্থাৎ অবিদ্যা। এই অধ্যাসই আমাদেরকে কর্তা ও ভোক্তা এই দুভাবে সংসারে প্রবর্তিত করে থাকে। তা সব লোকেরই প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই সকল প্রকার অনর্থের হেতু অধ্যাসকে বিধ্বস্ত করতে হলে- অদ্বিতীয় আত্মতত্ত্বজ্ঞানই একমাত্র আবশ্যক (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১)
ব্যবহারিক জগতে জ্ঞান, অনুভূতি বা ইচ্ছার কর্তা যে অহং তা সর্বদাই একটি শরীরের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের সঙ্গে অহং-এর যোগ আছে বলেই আমি জানি, আমি অনুভব করি এবং আমি ইচ্ছা করি। এই অহংকে শরীর থেকে পৃথক করা যায় না। যদি কল্পনা করি যে শরীর নেই, তাহলে প্রশ্ন ওঠে- কার জ্ঞান? কার অনুভূতি? কার ইচ্ছা? যে শরীর অন্যান্যদের ইন্দ্রিয়গোচর তা হলো ‘স্থূলশরীর’। এই স্থূলশরীর ছাড়াও সূক্ষ্মশরীর ও কারণশরীর আছে। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সতেরোটি উপাদানের সমন্বয়ে জীবের সূক্ষ্মশরীর নির্মিত। তবে এই তিনরকম শরীরই মায়ার সৃষ্টি। শরীরমাত্রই নশ্বর অর্থাৎ, চিরকাল থাকে না।

জীবত্বের উৎপত্তি :
শঙ্করাচার্যের মতে, জীব হলো আত্মা ও অনাত্মার সংমিশ্রণ। শুদ্ধ আত্মায় অনাত্মার অধ্যাসের ফলে অর্থাৎ, যখন আত্মার উপর অনাত্মা আরোপিত হয়, তখনই শুদ্ধ চৈতন্য বা আত্মা সাক্ষী-চৈতন্য জীবে পরিণত হয়। শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহংকার প্রভৃতি হলো অনাত্মা। সাক্ষী-চৈতন্য অন্তঃকরণের (মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টি হলো অন্তঃকরণ) সঙ্গে যুক্ত হলে ভ্রান্তিবশত যখন আত্মা-অনাত্মার অভেদ বোধ হয়, তখনই অহং-রূপ জীবত্বের সৃষ্টি হয়। যেমন আমরা বলি- ‘আমি রোগা’ বা ‘আমি মোটা’ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আত্মা এবং শরীরের অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আবার যখন বলি- ‘আমি অন্ধ’ বা ‘আমি খোঁড়া’, তখন আত্মার সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রিয় বা কর্মেন্দ্রিয়ের অভেদ বোধ থাকে। তেমনি যখন বলি- ‘আমি সুখী’ বা ‘আমি দুঃখী’, তখন আত্মা ও মানসিক অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আত্মার উপর অনাত্মার অধ্যাস বা আরোপের ফলেই জীব দুঃখ ভোগ করে। আত্মা বা ব্রহ্ম কিন্তু স্বরূপত রোগা, মোটা, অন্ধ, খোঁড়া, সুখী, দুঃখী- এসব কিছুই নয়। চৈতন্য মায়ার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা উপহিত হলেই এইরকম অভেদ বোধ জন্মায়। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অহংকারের দ্বারা সীমিত বা অবচ্ছিন্ন আত্মা প্রকৃত বা শুদ্ধ আত্মা নয়। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বর, জীব ও জাগতিক বিষয় সবই মিথ্যা, ব্রহ্মের বিক্ষেপমাত্র। এ প্রেক্ষিতে অদ্বৈতবেদান্তের আধুনিক প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ’র বাণীতেও উক্ত হয়েছে-
‘অদ্বৈতবাদীদের কাছে জীবাত্মার কোন স্থান নেই। তাহাদের মতে জীবাত্মা মায়ার সৃষ্টি; আসলে জীবাত্মার কোন (পৃথক) অস্তিত্ব থাকিতে পারে না।’– (স্বামীজীর বাণী ও রচনা ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৭)

অদ্বৈতমতে অবিদ্যাপ্রসূত, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। শঙ্করের ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, এবং বিভিন্ন শ্রুতিতে জীবাত্মার উৎপত্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাই অদ্বৈতমতেও জীবাত্মা অবিনাশী। বেদান্তসূত্রকার বাদরায়ণও বলেছেন-

‘নাত্মা, অশ্রুতেঃ নিত্যত্বাৎ চ তাভ্যঃ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)
ভাবার্থ : জীবাত্মা উৎপন্ন হন এ কথা শ্রুতি বলেন নি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন।

জীবের স্বরূপ-উপলব্ধি :
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে উপলব্ধ বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনার মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী জীব ও ব্রহ্মের এই অভিন্নতাকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি- এই তিনটি ভিন্ন অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। জাগ্রত অবস্থায় জীবের ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ প্রভৃতি সক্রিয় থাকে। তাই এই অবস্থায় আমরা যতক্ষণ জাগ্রত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের স্থূলশরীর, ইন্দ্রিয়, মন প্রভৃতির সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা বোধ করি এবং নানা বিষয়কে জানি। জাগ্রত অবস্থায় যেমন বিষয়ী ও বিষয়ের (অর্থাৎ, জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের) ভেদ থাকে, তেমনি স্বপ্নেও জ্ঞান ও তার বিষয়ের মধ্যে ভেদের বোধ থাকে। স্বপ্নাবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু অন্তঃকরণ সক্রিয় থাকে বলে জাগ্রত অবস্থার অনুভবের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্নাবস্থায় জীব বিষয়কে জানে। এই অবস্থায় জীবের জ্ঞান অনুভবের সংস্কারের দ্বারা সীমিত। সুষুপ্তিতে ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ নিষ্ক্রিয় থাকে। তাই সুষুপ্তিকালে অর্থাৎ, স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার সময় কোন বিষয়ের ধারণা থাকে না। ফলে সুষুপ্তির সময় আমরা জ্ঞাতা হই না। তখন বিষয়ী ও বিষয়ের, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে ভেদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয় এবং শরীর, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা সীমিত হবার কোন বোধ থাকে না। কিন্তু তখনও চৈতন্য থাকে। যদি চৈতন্য না থাকতো, তবে সুষুপ্তির থেকে জেগে আমরা কখনোই বলতে পারতাম না যে, গভীর নিদ্রা হয়েছিলো। এ অবস্থা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘পুংস্ত্বাদিবৎ ত্বস্য সতঃ অভিব্যক্তিযোগাৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)
ভাবার্থ : পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
আত্মা স্বরূপত কেমন, তা সুষুপ্তির অবস্থাটি বিশ্লেষণ করলে আংশিক পরিচয় পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। তখন আত্মা সীমিত এবং দুঃখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট নয়। আত্মা তখন সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। এই অবস্থায় আমরা আত্মার অনন্দজ্ঞান, বিষয়হীনতা, আনন্দস্বরূপতা উপলব্ধি করি। কিন্তু এই উপলব্ধি ক্ষণিকের জন্য। জাগ্রত হবার পর জীব আবার ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ-সংশ্লিষ্ট হয়ে জগৎভ্রমে পতিত হয়।
শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম শরীর ও অন্তঃকরণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জীবে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্তা আছে এবং জীবের ব্যবহারিক সত্তা আছে। অবিদ্যা-সংশ্লিষ্ট আত্মাই জীব। তত্ত্বজ্ঞান লাভের দ্বারা অবিদ্যা দূরীভূত হলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ লোপ পায় এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন- এই উপলব্ধি হয়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ :
পারমার্থিক দিক থেকে যদিও জীব ব্রহ্মস্বরূপ, তবুও ব্যবহারিক দিক থেকে জীব ব্রহ্ম-ভিন্ন। এ বিষয়ে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘অংশো নানাব্যপদেশাৎ, অন্যতা চ অপি দাশকিতবাদিত্বম্ অধীয়ত একে’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৩)
ভাবার্থ : জীব পরমাত্মার অংশ, কারণ শ্রুতিও জীব এবং ব্রহ্মের ভেদ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; আবার অভেদও উপদেশ করেছেন। অতএব জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয়।

অদ্বৈতমতে, অবিদ্যা-উপহিত ব্রহ্মই জীব। এই অবস্থায় জীব ব্রহ্মস্বরূপতা বিস্মৃত হয়। জীব তাই ব্রহ্মের সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই। অদ্বৈতবেদান্তী একদিকে যেমন জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা দেখিয়েছেন, তেমনি অপরদিকে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা দেখিয়েছেন। তবে এই ব্যবহারিক ভিন্নতা ব্যাখ্যায় অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। বেদান্তসূত্রের যে সূত্রটিকে কেন্দ্র করে ঐ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিলো, সেটি হলো-

‘আভাস এব চ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০)
ভাবার্থ : এবং জীব পরমাত্মার একটি আভাস বা প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই জীবের সুখ-দুঃখ পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।

জীব ও ব্রহ্মের আপাত ভেদ-
এই সূত্রকে কেন্দ্র করে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা সম্পর্কে বিভিন্ন অদ্বৈতবেদান্তী বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাগুলি প্রধানত তিনটি মতবাদ সৃষ্টি করেছে। মতবাদ তিনটি হলো- অবচ্ছেদবাদ, প্রতিবিম্ববাদ এবং আভাসবাদ।
অদ্বৈতমতে জীব

অবচ্ছেদবাদ : অবচ্ছেদবাদ অনুযায়ী স্বরূপত অভিন্ন বস্তু অবচ্ছেদভেদে ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হয়। যেমন আকাশকে ঘর ইত্যাদির দ্বারা সীমিত বোধ হয়, তেমনি এক ও অদ্বয় সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মও বিভিন্ন অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে প্রতিভাত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকাশ যেমন বিভিন্ন কক্ষের দ্বারা সীমিত হয় না, তেমনি ব্রহ্মও বুদ্ধির দ্বারা সীমিত হয় না। অন্তঃকরণ অবিদ্যাজন্য। অবিদ্যা দূর হলে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম অবচ্ছেদমুক্ত হয়ে একক সৎরূপে উপলব্ধ হয়।

প্রতিবিম্ববাদ : আয়নার মতো স্বচ্ছ পদার্থে বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়। বিভিন্ন স্বচ্ছ পদার্থে একই বস্তুর বিভিন্ন প্রতিবিম্ব পড়ে। সূর্য বিভিন্ন জলাশয়ে প্রতিবিম্বিত হয়, কিন্তু জলাশয়ের প্রকৃতির দ্বারা সূর্য প্রভাবিত হয় না। তেমনি একই ব্রহ্ম ভিন্ন ভিন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে আবির্ভূত হয়। ব্রহ্ম বিম্ব, জীব তার প্রতিবিম্ব। বিম্ব ও প্রতিবিম্বের ব্যবহারিক ভিন্নতা সর্বজনসিদ্ধ। প্রতিবিম্বের কারণ দূর হলে কেবল বিম্বই অবশিষ্ট থাকে।
প্রতিবিম্ববাদের সমর্থকদের মধ্যে নৃসিংহাশ্রম ও তাঁর অনুগামী বিবরণ-সম্প্রদায়ের অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বররূপে প্রতীয়মান হন। আবার ব্রহ্ম অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত হলে জীবের সৃষ্টি হয়।

আভাসবাদ : বস্তুর আপাত প্রতীয়মান রূপকে বলা হয় আভাস। আভাস মিথ্যা হলেও বস্তু থেকে তার ভিন্ন ব্যবহার স্বীকৃত। প্রতিবিম্ব বিম্বের আভাস। জীব ব্রহ্মের আভাস। আভাসের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যা দূর হলে আভাসের ভিন্ন অস্তিত্ব থাকে না। আভাসবাদ বস্তুত প্রতিবিম্ববাদেরই নামান্তর। এই কারণে আভাসবাদ ও প্রতিবিম্ববাদকে একই মতবাদ রূপেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই মতের সমর্থকরা যেমন সর্বজ্ঞাত্মমুনি প্রভৃতি প্রতিবিম্ববাদ সমর্থকদের মতো মায়া ও অবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য করেননি। তাঁরা বলেছেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা উৎপন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হলে জীব উৎপন্ন হয়।

বস্তুত প্রতিবিম্ববাদ এবং অবচ্ছেদবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অদ্বৈতবেদান্তের মূল বক্তব্য হলো জীব এবং ব্রহ্ম এক। জীব এবং ব্রহ্ম যে এক তা জীব বদ্ধ অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারে না। মোক্ষই হলো সেই অভেদের উপলব্ধি। অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ঐ অভেদের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো। প্রতিবিম্ববাদের সমর্থক দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন যে, ব্রহ্ম ও জীবের অভেদের উপলব্ধিই মোক্ষ। তাঁদের মতে বস্তু ও তার প্রতিবিম্ব এক। কিন্তু অবচ্ছেদবাদের সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিবিম্বের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন করলে মোক্ষলাভ হয়। যেমন রজ্জুতে সর্পের প্রত্যক্ষ ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞান হয়, তেমনি ব্রহ্মে অহং এর আরোপ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলেই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। অর্থাৎ, ‘আমিত্ব’ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রতিপন্ন হলে ব্রহ্মোপলব্ধি বা মোক্ষলাভ হয়।

জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভেদ-
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্মে বস্তুত কোন ভেদ নেই, অর্থাৎ, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তবুও আমরা যে জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সম্পূর্ণই অবিদ্যাবশত ব্যবহারিক ভেদের কল্পনা করি, বেদান্তের সূত্রগ্রন্থ বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণ তাই বলেছেন-

‘স্থানবিশেষাৎ, প্রকাশাদিবৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৪)
ভাবার্থ : স্থান এবং পাত্রের দ্বারা আলোক আকাশ যেমন সীমিত হয়, তেমনি নিরাকার অসীম ব্রহ্মও উপাধিহেতু রূপবান বলে কল্পিত হন।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপনিষদের জীব ও ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদক উপদেশ উদ্ধৃত করে অদ্বৈতবেদান্তীরা জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন উপনিষদে জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। অদ্বৈত-বেদান্তীদের মতে, সকল সাধনার সিদ্ধি ও সকল উপদেশের সারস্বরূপ বিভিন্ন উপনিষদে চারটি মহাবাক্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চারটি মহাবাক্য হলো-
(১) ‘তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ, তুমিই সেই– (ছান্দোগ্য উপনিষদ), (২) ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ), (৩) ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম– (ঐতরেয় উপনিষদ), (৪) ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, আত্মাই ব্রহ্ম– (মাণ্ডুক্য উপনিষদ)।

যেসব শ্রুতিতে এই চারটি মহাবাক্যের আবির্ভাব হয়েছে, সেই শ্রুতিগুলো হলো-

(১)
‘স যথা তত্র ন অদাহ্যেত ঐতদাত্ম্যম্ ইদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি তৎ হ অস্য বিজজ্ঞৌ ইতি বিজজ্ঞাবিতি।’- (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৬/১৬/৩)
অর্থাৎ : (সত্যনিষ্ঠার জন্য) সেই ব্যক্তি তপ্ত কুঠার দ্বারা দগ্ধ হয় না। এই সৎ বস্তুই সব কিছুর আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, ‘তত্ত্বমসি’- তুমিই সেই (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।
(২)
‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ, তৎ আত্মানম্ এবাবেৎ- অহং ব্রহ্মাস্মি ইতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ। তদ্ যো যো দেবানাম্ প্রত্যবুধ্যত স এব তৎ অভবৎ। তথা ঋষীণাং তথা মনুষ্যাণাং, তদ্ধৈতৎ পশ্যন্ ঋষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবৎ সূর্যশ্চেতি। তৎ ইদমপি এতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি…।’- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১/৪/১০)
অর্থাৎ : এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো। ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- আমিই ব্রহ্ম, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্মসদৃশ বলে জেনেছিলেন তিনিও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। এই একইভাবে ঋষি এবং মানুষদের মধ্যেও যাঁরা নিজেকেই ব্রহ্ম বলে জানতে পেরেছিলেন, তাঁরাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিতভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তাঁর আত্মা তখন সর্বব্যাপী (বৃহদারণ্যক-১/৪/১০)।
(৩)
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- … সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।’- (ঐতরেয় উপনিষদ-৩/৩)
অর্থাৎ : সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত।… প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞানই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সবকিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সবকিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনি এক অখণ্ড সত্তা, অদ্বিতীয় (ঐতরেয়-৩/৩)।
(৪)
‘সর্বম্ হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, সোহয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।’- (মাণ্ডুক্য উপনিষদ-২)
অর্থাৎ : তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবাই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ বা (জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, তূরীয়) অবস্থা জীবদেহে থেকে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ (মাণ্ডুক্য-২)।

‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ও ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’- এই চারটি মহাবাক্য বস্তুত চতুর্বেদের প্রধান বাক্য। ‘তত্ত্বমসি’ সামবেদের, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ যজুর্বেদের, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ঋগ্বেদের এবং ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অথর্ববেদের প্রধানবাক্য। চারটি মহাবাক্যেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। এই মহাবাক্য চতুষ্টয়ের তাৎপর্যের মধ্যেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদপ্রতিপাদক প্রামাণ্য রয়েছে বলে অদ্বৈতবেদান্তীরা ঘোষণা করেন।

মহাবাক্যের তাৎপর্য-
এক্ষেত্রে অদ্বৈতবেদান্তীরা কিভাবে অভেদপ্রতিপাদক ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের তাৎপর্য পরিস্ফুট করেছেন, তা সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে।
‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের বাক্যাংশগুলি হলো- ‘তৎ ত্বং অসি’। ‘তৎ’ মানে ‘সেই’, ‘ত্বং’ মানে ‘এই’। মহাবাক্যটিতে উক্ত ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা ‘সেই’ নির্গুণ ব্রহ্ম এবং ‘ত্বং’ শব্দের দ্বারা ‘এই’ জীবাত্মাকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভিন্নতা তিনভাবে দেখানো যেতে পারে- সামানাধিকরণ্য, বিশেষ্য-বিশেষণভাব ও লক্ষ্যলক্ষণভাব সম্বন্ধ বা লক্ষণার দ্বারা।

সামানাধিকরণ্য : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটি একই অধিকরণের অভিন্নবাচক শব্দ হিসেবে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘এই সেই দেবদত্ত’- এই বাক্যের অন্তর্গত ‘এই’ শব্দ ও ‘সেই’ শব্দ দুটি ভিন্নার্থবোধক হয়েও যেমন একই অধিকরণ দেবদত্তকে নির্দেশ করে, তেমনি ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও একই পদার্থ ব্রহ্ম বা শুদ্ধচৈতন্যকে নির্দেশ করে।

বিশেষ্য-বিশেষণভাব : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটিকে বিশেষ্য-বিশেষণভাবে গ্রহণ করেও তাদের অভিন্নতা দেখানো যায়। যেমন, ‘শ্বেতপদ্মে’র জ্ঞানে ‘শ্বেত’ শব্দটি বিশেষণবোধক এবং ‘পদ্ম’ শব্দটি বিশেষ্যবোধক। ‘শ্বেত’ ও ‘পদ্ম’ পদদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও বস্তুত এই পদদ্বয় একটি পদার্থকেই নির্দেশ করে। পদ্ম নানা রকম রঙের হতে পারে, কিন্তু শ্বেতপদ্ম একই রকম। সেইরূপ ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ পরস্পর পরস্পরের বিশেষ্য-বিশেষণ রূপে এক ও অদ্বয় অখণ্ড চৈতন্যের প্রকাশক, এবং তিনিই ব্রহ্ম।

লক্ষণা : বাক্যের মুখ্য অর্থকে পরিত্যাগ না করে কিংবা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে তাৎপর্য অনুধাবন-পূর্বক গৌণ অর্থ গ্রহণকে বলে লক্ষণা। লক্ষণা তিনপ্রকার- জহৎ, অজহৎ ও জহদজহৎ। জহৎ-লক্ষণায় মুখ্য অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা হয়। অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে অন্য অর্থ যুক্ত করা হয়। আর জহদজহৎ অর্থাৎ জহৎ-অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থের আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণ করা হয়।
এক্ষেত্রে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারা ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভেদ প্রতিপাদন করা হয়। ‘তৎ’ পরোক্ষ চৈতন্য, কিন্তু ‘ত্বং’ অপরোক্ষ চৈতন্য। পরোক্ষত্ব ও অপরোক্ষত্ব পরস্পর বিরুদ্ধ। কিন্তু চৈতন্যাংশে উভয়ে অবিরুদ্ধ। বিরুদ্ধাংশ পরিত্যাগ করে অবিরুদ্ধাংশে উভয়ের ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। চৈতন্যাংশে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর কোন বিরোধ নেই। এই অবিরুদ্ধ চৈতন্যাংশই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য।

অদ্বৈতবেদান্তীরা সামানাধিকরণ্য ও বিশেষ্য-বিশেষণভাব পরিত্যাগ করে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্যকে গ্রহণ করেছেন। অপর তিনটি মহাবাক্যও অনুরূপভাবে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করে। এই জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার ভেদাভেদ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘তুমি যখন নিজেকে দেহমাত্র বলিয়া ভাব তখন তুমি বিশ্বজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন; নিজেকে যখন জীব বলিয়া ভাব, তখন তুমি সেই শাশ্বত মহান জ্যোতির একটি কণিকামাত্র, আর যখন নিজেকে আত্মা বলিয়া ভাব, তখন তুমিই সবকিছু।

জীব এক না বহু ?
জীব এক না বহু, অদ্বৈতবেদান্তীদের কাছে এই প্রশ্নটি অন্যন্ত জটিল বলে মনে হয়। এদের কেউ কেউ বলেন যে অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। অন্তঃকরণে যেহেতু এক নয় বহু, তাই জীবও এক নয়, বহু। এই সম্প্রদায় অনেকজীববাদী নামে পরিচিত। আবার অন্য অদ্বৈতবৈদান্তিকদের মতে অজ্ঞানে বা মায়ায় প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। মায়া যেহেতু এক, সেহেতু জীবও এক। এই সম্প্রদায়কে একজীববাদী বলা হয়।

অনেকজীববাদীদের বক্তব্য হলো, যদি জীব এক হয় তাহলে একটি জীবের মুক্তি হলে সমস্ত জীবেরই মুক্তি হবে। কিন্তু সমস্ত জীবের কখনোই একসঙ্গে মুক্তি হয় না। সুতরাং, একজীববাদ গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, একজীববাদ স্বীকার করলে বলতে হবে যে, এক জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে একটি জীবের সুখদুঃখবোধ হলেই সকলেরই সুখদুঃখবোধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। একজনের সুখে সর্বদা অন্যজনের সুখ উৎপন্ন হয় না। আবার একজনের দুঃখও অন্যের দুঃখ নয়।
কিন্তু অনেকজীববাদীদের বিরুদ্ধে একজীববাদীদের বক্তব্য হলো, অনেক জীব স্বীকার করলে সৃষ্টি ও প্রলয়ের ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ প্রলয়ের সময় অন্তঃকরণগুলি তাদের উপাদান কারণে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তার ফলে সমস্ত জীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই বক্তব্যের উত্তরে অনেকজীববাদীরা বলেন যে, প্রলয়কালে অন্তঃকরণগুলি বিলীন হয়ে গেলেও তাদের সংস্কারগুলি যেহেতু থেকে যায়, সেহেতু সমস্ত জীবের ধ্বংসের আপত্তি হয় না।

একজীববাদীরা বলেন, বিভিন্ন মানুষের সুখদুঃখ ভোগের অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণ হলো অন্তঃকরণগুলির পার্থক্য। অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মের বহু অন্তঃকরণ। এই কারণে একই জীবের অন্তঃকরণ বহু।
প্রত্তোত্তরে বলা হয়, বস্তুত একজীববাদকে সত্য গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হবে যে অন্যান্য জীবের অস্তিত্বের জ্ঞান ভ্রান্ত, যেহেতু একটিমাত্র জীবেরই অস্তিত্ব আছে। যেমন এক ব্যক্তি স্বপ্নে নানা বিষয় ও প্রাণী প্রত্যক্ষ করে, তেমনি এক জীব অন্যান্য ব্যক্তি ও বিষয়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের বিষয়ের মতোই অন্যান্য জীবের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এই মতে ‘তুমি’ ও ‘সে’ হলো প্রকৃত আমির বিভিন্ন প্রতিভাসমাত্র। 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ