প্রাণায়াম - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

23 July, 2020

প্রাণায়াম

প্রাণায়াম (Pranayama):
যে প্রক্রিয়া দেহের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে এবং জরা, ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর হাত থেকে দেহকে রা করে, তাই প্রাণায়াম (Pranayama)। প্রাণায়ামের কাজ হলো বায়ুকে অর্থাৎ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করে দেহের প্রাণশক্তিকে বৃদ্ধি করা।
যোগ-শাস্ত্র অনুযায়ী বায়ুই দেহের প্রাণশক্তি এবং তা রস-রক্তকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিচালিত করে। বায়ু প্রধানতঃ ‘প্রাণ’, ‘উদান’, ‘সমান’, ‘অপান’ ও ‘ব্যাণ’- এই পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। গলদেশে ‘উদান’, হৃদয়ে ‘প্রাণ’, নাভিদেশে ‘সমান’, গুহ্যদেশে ‘অপান’ এবং দেহের সর্বত্র ‘ব্যাণ’ কার্যরত।

এই পাঁচ প্রকার বায়ুর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘প্রাণ’ বায়ুর। শ্বাসগ্রহণ ও ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালনা করা, খাদ্যবস্তুকে পাকস্থলীতে পাঠানো, ধমনী-শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তরস আনা-নেয়া করা, ধমনী, শিরা, উপশিরা, স্নায়ুজালকে কাজে প্রবৃত্ত ও সাহায্য করা প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিয়ত এই প্রাণবায়ু করে যাচ্ছে। কাজেই দেহে প্রাণবায়ুর ভূমিকা প্রধান।

‘উদান’ বায়ুর কাজ হচ্ছে শব্দ করা। এই বায়ুর সূক্ষ্মাংশ বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তিকে পুষ্ট করে। ‘উদান’ বায়ুর সাহায্যে আমরা হাসি, কাঁদি, গান করি, শব্দ করি ইত্যাদি। ‘সমান’ বায়ু আমাদের জঠরাগ্নিকে উদ্দীপ্ত করে, পাকস্থলী থেকে জরাজীর্ণ খাদ্যবস্তুকে গ্রহণী নাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর সার ও অসার অংশে ভাগ করে অসার অংশকে মলনাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। ‘অপান’ বায়ুর কাজ হচ্ছে প্রাণবায়ুকে সাহায্য করা এবং মেয়েদের রজঃনিঃসরণ, সন্তানধারণ ও সন্তান প্রসবে সাহায্য করা ইত্যাদি। আর ‘ব্যাণ’ বায়ুর কাজ হচ্ছে প্রাণবায়ুকে রক্ত পরিচালনায় সাহায্য করা, পেশী সঙ্কোচন ও প্রসারণে সাহায্য করা এবং দেহ থেকে ঘাম বের করে দেয়া।


যোগ-শাস্ত্রে বলা হয়, এই পাঁচটি বায়ুর একটি কূপিত হলে দেহে রোগাক্রমণ ঘটে, আসে মৃত্যুর হাতছানি।

যোগ-শাস্ত্র মতে বায়ু গ্রহণকে ‘পূরক’, ধারণকে ‘কুম্ভক’ এবং ত্যাগকে ‘রেচক’ বলা হয়। এই তিন প্রকার কাজকে একসঙ্গে বলা যেতে পারে প্রাণায়াম। অন্যদিকে প্রাণ ও অপান-বায়ুর পরস্পর সংযোগকেও প্রাণায়াম বলা হয়ে থাকে। প্রাণায়াম প্রক্রিয়ায় শ্বাস গ্রহণ করতে সাধারণত যে সময় নেয়া হয়, শ্বাস ত্যাগ করতে প্রায় তার দ্বিগুণ সময় নিতে হয়। এ বিষয়ে নানা জনের নানা মত। অনেকে বলেন পূরক, কুম্ভক ও রেচকের অনুপাত ২ ঃ ১ ঃ ২ হওয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে কুম্ভকের সময়কালকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। তা হতে হবে আয়াসহীন ও সুখকর। তবেই শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক, রেচক যত সময় নিয়েই করা যাক না কেন, আয়াসহীন হওয়া চাই। শরীরের ক্ষতি তখনই হয়, যখন জোর করে ফুসফুসের শক্তির বিচার না করে শ্বাস-ব্যায়াম করা হয়। তাই প্রাণায়াম অভ্যাসের সময়কাল আপেক্ষিক এবং ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রাণায়াম ততক্ষণ করা যেতে পারে, যতক্ষণ ফুসফুস ক্লান্ত না হয়। যখন দেখা যাবে, সে আর অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারছে না, তখন তার প্রাণায়াম করা উচিৎ নয়।
বায়ুর প্রধান উপাদান চারটি। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও কার্বন। ফসফরাস, সালফার প্রভৃতি আরও কয়েকটি উপাদান আছে। সেগুলোও মূলত বায়ুরই পরিণতি। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে পরিমাণ বায়ু দেহে গ্রহণ করি, তা ঠিকমত কাজে লাগাতে বা দেহ উপাদানে পরিণত করতে পারলে আমাদের খাদ্য-সমস্যা অনেকটাই মিটে যেতো। অনেক যোগী দিনের পর দিন কোন খাবার না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। অথচ আমরা সাধারণ মানুষ একদিন না খেলেই আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। দেহ-বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের দেহের শতকরা বাষট্টি ভাগ অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি এবং এতে যে শতকরা একুশ ভাগ অক্সিজেন থাকে, তার মাত্র চার ভাগ আমরা দেহের কাজে লাগাতে পারি। বাকি প্রায় সতের ভাগ আবার নিঃশ্বাসের সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। এই অভাব আমাদেরকে খাদ্যবস্তু দ্বারা পূরণ করতে হয়।
আমরা যদি এমন কিছু প্রক্রিয়া অভ্যাস করতে পারি, যার দ্বারা প্রচুর পরিমাণে বায়ু শরীরের ভেতরে নিতে পারি এবং তা দেহোপযোগী উপাদানে পরিণত করতে পারি তবে দেহের খাদ্য বা পুষ্টি-সমস্যা অনেকটা মিটে যায়। আবার যদি গভীরভাবে রেচক করতে পারি অর্থাৎ নিঃশ্বাস ছাড়তে পারি, তবে দেহের অপ্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে যেতে পারে এবং দেহও বিষমুক্ত হয়। কেবল প্রাণায়াম দ্বারাই এই কাজগুলো যথাযথ করা যেতে পারে। তাই প্রাণায়ামকে উত্তম শ্বাস-ব্যায়াম বলা হয়। এতে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং প্রাণায়াম অভ্যাস দীর্ঘ ও কর্মক্ষম জীবন লাভের একটি উৎকৃষ্ট উপায়।
আমাদের শরীরটা একটা দেহ-কারখানা। এখানে যেসব যন্ত্র আছে যেমন হৃদযন্ত্র, স্নায়ু, গ্রন্থি, ধমনী, শিরা, উপশিরা প্রভৃতি, সেগুলো সঠিকভাবে কাজ করলেই কেবল সুস্বাস্থ্য লাভ সম্ভব। স্বাস্থ্য রক্ষায় স্নায়ুজালের বিরাট ভূমিকা। শ্বাস-প্রশ্বাস, পরিপাক, রক্ত-রস সঞ্চালন প্রভৃতি কাজ স্নায়ুজালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার নালীহীন গ্রন্থিগুলোর ভূমিকাও দেহে কোন অংশে কম নয়। এইসব গ্রন্থিনিঃসৃত রস দেহকে রোগাক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে, দেহযন্ত্রগুলোকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখে এবং শক্তি যোগায়। এই গ্রন্থিগুলো যদি প্রয়োজনমতো রস নিঃসরণ না করে, তবে অন্যান্য দেহযন্ত্রের মতো স্নায়ুতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তা একদিন অকেজো হয়ে যায়। তাই নালীহীন গ্রন্থির সক্রিয়তার উপর স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে।
অন্যদিকে অক্সিজেনযুক্ত বিশুদ্ধ বায়ু ও রক্ত সংবহন ছাড়া নালীহীন গ্রন্থি ও স্নায়ুমণ্ডলী সতেজ ও সক্রিয় থাকতে পারে না। শ্বাসযন্ত্র যদি ঠিকমতো কাজ না করে, আবশ্যকীয় অক্সিজেন ফুসফুসে যেতে পারে না এবং দেহের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া প্রভৃতি বিষও বের হয়ে যেতে পারে না। শ্বাসযন্ত্র ও পরিপাকযন্ত্র কর্মক্ষম না থাকলে দেহে এইসব বিষ জমতে শুরু করে। ফলে এক এক করে দেহযন্ত্রগুলো বিকল হয়ে আসতে থাকে। রক্তবাহী শিরা-উপশিরা এই বিষ ফুসফুসে টেনে আনে এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে তা বের হয়ে যায়। তেমনি মূত্রাশয় ও মলনাড়ী দেহের বিষ ও অসার পদার্থ বের করে দেয়।


মূত্রাশয় ও মলনাড়ী তলপেটে এবং ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড আমাদের বুকে অবস্থিত। এর মাঝে রয়েছে শক্ত পেশীর দেয়াল ‘ডায়াফ্রাম’। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে এই ডায়াফ্রামের যে উত্থান-পতন হয় এবং তলপেটের পেশীসমূহের যে সঙ্কোচন ও প্রসারণ হয়, তা দ্বারা প্লীহা, যকৃৎ, মূত্রাশয়, ক্ষুদ্রান্ত্র প্রভৃতিতে মৃদু কম্পন ও ঘর্ষণ লাগে। এতে করে এইসব যন্ত্রগুলোর ভালো ব্যায়াম হয়। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে প্রাণায়াম শ্বাসযন্ত্র থেকে শুরু করে দেহের প্রধান প্রধান যন্ত্রগুলো সবল ও সক্রিয় রাখে। এছাড়া আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে এতো অনিয়ম যে ফুসফুস ঠিকমতো সবখানি উঠানামা করে না। সাধারণভাবে আমরা যখন দম নেই ও ছাড়ি তখন ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণের দ্বারা ২/৩ অংশ প্রসারিত হয়। ফলে ফুসফুসের ঠিক প্রয়োজনমতো ব্যায়াম হয় না। এতে ফুসফুস আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। শ্বাসগ্রহণের সময় রোগ-জীবাণু ঐ দুর্বল ফুসফুসে গিয়ে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। ফলে দেহে নানা দূরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। প্রণায়াম অভ্যাসের দ্বারা ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের খুব ভালো ব্যায়াম হয় এবং আমরা ফুসফুসকে সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত করতে পারি। ফলে শ্বাসযন্ত্র সবল ও সুস্থ থাকে আর তাদের কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

একজন সুস্থ মানুষের সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি মিনিটে ১৭/১৮ বার। প্রাণায়াম অভ্যাসের মাধ্যমে এই সাধারণ গতিবিধিকে ইচ্ছামতো কমিয়ে আনতে পারা যায়। এতে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড বিশ্রাম পায়। এবং আমরা আমাদের চঞ্চল মনকে শান্ত করে নিজের কাছে বশীভূত করতে পারি।

প্রাণায়াম অভ্যাস করতে যে চারটি বস্তুর আয়ত্ত একান্ত প্রয়োজন তা হলো- (১) উপযুক্ত স্থান, (২) বিহিত কাল, (৩) পরিমিত আহার এবং (৪) নাড়ীশুদ্ধি।

এই নাড়ীশুদ্ধি বা নাড়ী শোধন প্রাণায়াম কোন প্রাণায়ামের অন্তর্ভূক্ত না হলেও যে কোন প্রাণায়াম অভ্যাসের আগে তা অভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজন। নাড়ী শোধন প্রাণায়াম বা অনুলোম বিলোম প্রাণায়াম অভ্যাসের ফলে প্রাণায়াম অভ্যাসকারী খুব সহজেই যে কোন প্রাণায়াম অভ্যাসের পদ্ধতি সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে।

প্রাণায়াম অভ্যাসকারীদের যতদূর সম্ভব কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলা উচিত-
১) সকালে বা সন্ধ্যায় নির্মল বায়ুতে প্রাণায়াম অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। যেখানে বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে সকালে সুর্যোদয়ের পূর্বে প্রাণায়াম অভ্যাস করা উত্তম।
২) প্রাতঃক্রিয়াদির পূর্বে, স্নানের পরে অথবা কোন শ্রমসাধ্য কাজের বা ব্যায়ামের ঠিক পরে প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিৎ নয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তবেই তা করা যেতে পারে।
৩) ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় প্রাণায়াম করা আবশ্যক নয়। এরূপ ক্ষেত্রে কফ্-প্রবণ ব্যক্তির রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত প্রাণায়াম করা নিষেধ। তবে, রোদ উঠলে করা যেতে পারে।
৪) ভরপেটে আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম কোনটাই করা উচিৎ নয়।
৫) শীর্ষাসনের পরে যেমন আর কোন আসন করা ঠিক নয়, তেমনি প্রাণায়ামের পর তখনকার মতো আর কোন ব্যায়াম করা উচিৎ নয়।
৬) প্রাণায়াম আট-নয় বছর বয়স থেকে আজীবন করা যেতে পারে। তবে অধিক বয়সে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
৭) তাড়াহুড়ো করে, চিন্তাযুক্ত মন নিয়ে প্রাণায়াম, আসন, মুদ্রা কোনটাই করা ঠিক নয়। মন শান্ত, ধীর ও চিন্তাশূন্য রাখার চেষ্টা করতে হবে। আসন ও মুদ্রার মতো প্রাণায়াম অভ্যাসের সময়ও একাগ্রতা থাকা আবশ্যক।

প্রাণায়াম চার প্রকার- (১) সহজ প্রাণায়াম, (২) লঘু প্রাণায়াম, (৩) বৈদিক প্রাণায়াম ও (৪) রাজযোগ প্রাণায়াম। কোন গৃহীর পক্ষে এই চার ধরনের প্রাণায়াম আয়ত্ত করা সহজসাধ্য নয়। সদগুরু বা প্রাণায়াম সিদ্ধ যোগীর সাহায্য ব্যতীত কেবল বই পড়ে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে বৈদিক ও রাজযোগ প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিত নয়। এতে বিপদের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। রাজযোগ প্রাণায়াম সাধারণতঃ গৃহীদের পক্ষে নিষিদ্ধ। কেবল যোগী ও সাধকই এই প্রাণায়াম অভ্যাসের অধিকারী। প্রথমোক্ত দু’ধরনের অর্থাৎ সহজ ও লঘু প্রাণায়ামই কেবল গৃহীরা দিনে দুইবার সকাল ও সন্ধ্যায় অভ্যাস করতে পারে।
সহজ প্রাণায়াম
লঘু প্রাণায়াম 


কুলকুণ্ডলিনী (Kulakundalini):
আমাদের শরীরের মধ্যে অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন। কুলকুণ্ডলিনী হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে মত অনুসরণ করেই যুগে যুগে সাধকপুরুষরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভের অন্বিষ্ট খুঁজেছেন।

বলা হয়ে থাকে, আমাদের শরীরের মধ্যে মৃণালতন্তুর ন্যায় সূক্ষ্ম জগন্মোহিনী আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি নিজের মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারের মুখ আবৃত করে জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী কুন্দস্থানে সর্বদা নিদ্রিত রয়েছেন। এ স্থানকে বলে মূলাধারচক্র। এটা সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়।

বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।
অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।

এই ষট্চক্র হচ্ছে, (১) ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra), (২) আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra), (৩) বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra), (৪) অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra), (৫) মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra), (৬) স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।

সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়। কুণ্ডলিনীর অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজননশক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই কুণ্ডলিনী; এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের একটিমাত্র লক্ষ্য।’


কুণ্ডলিনীকে জাগরিত করার উপায় হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ প্রাণায়ামের পূর্বে ঐ ত্রিকোণ মণ্ডলকে ধ্যানে দেখবার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে এঁর ছবি মনে মনে স্পষ্টরূপে কল্পনা কর। ভাবো এর চার পাশে আগুনের শিখা, তার মাঝখানে কুণ্ডলীকৃত সর্প ঘুমিয়ে রয়েছে। ধ্যানে যখন কুণ্ডলিনীশক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে তখন কল্পনায় তাকে মেরুদণ্ডের মূলাধারে স্থাপন কর; এবং তাকে অনুভব করার চেষ্টা কর। প্রাণায়ামসহ বিভিন্ন মুদ্রা ও বন্ধন অভ্যাস কালে কুম্ভকে শ্বাস রুদ্ধ রাখার সময় সুপ্ত কুণ্ডলিনীকে জাগাবার জন্যে ঐ রুদ্ধ বায়ু সবলে তার মস্তকে নিক্ষেপ করবে। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জাগেন। যতদিন তিনি না জাগেন ততদিন কল্পনা কর- তিনি জাগছেন। আর ইড়া ও পিঙ্গলার গতি অনুভব করার চেষ্টা কর, জোর করে তাদের সুষুম্না পথে চালাতে চেষ্টা করো- এতে কাজ খুব তাড়াতাড়ি হবে। মনের সংযমের দ্বারাই কল্পনা করা সম্ভব।’

মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি কুণ্ডলিনী শক্তি হঠ্তন্ত্রের আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষট্চক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।

প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে। এই ‘ওজস’ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব। যাঁর ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হন।

যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে (Sahastrara Chakra) উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।

কোন শক্তিই সৃষ্টি করা যায় না, তবে তাকে শুধু ঈপ্সিত পথে চালিত করা যেতে পারে। এটাই রাজযোগের উদ্দেশ্য। কিন্তু এটা সাধারণ গৃহীদের কাজ নয়। একমাত্র যোগীরাই যোগ প্রভাবে এই সমস্ত নাড়ী সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে পারেন এবং তা অনুভবও করেন। রাজযোগ অভ্যাস করতে হলে প্রথমে হঠযোগ আয়ত্তে আনতে হয়। হঠযোগই রাজযোগের সোপান। আর এই হঠযোগের একটা বিরাট অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ (Astanga Yoga)। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি- (১) যম (Yama), (২) নিয়ম (Niyama), (৩) আসন (Asana), (৪) প্রাণায়াম (Pranayama), (৫) প্রত্যাহার (Pratyahara), (৬) ধারণা (Dharana), (৭) ধ্যান (Dhyana) ও (৮) সমাধি (Samadhi)।

তবে সাধারণ চর্চাকারীদের জন্য মূলত প্রথম চারটি অঙ্গের নির্বাচিত অংশই অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।
ভ্রমণ-প্রাণায়াম (Bhramana-Pranayama):
কুম্ভক ছাড়া পূরক ও রেচকসহ যে প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হয় তাকেই সহজ প্রাণায়াম (Sahaja Pranayama) বলে। তাই কুম্ভকের ব্যবহার নেই বলে ভ্রমণ-প্রাণায়াম এই সহজ-প্রাণায়ামেরই অন্তর্ভূক্ত।

পদ্ধতি:
মেরুদণ্ড সরল ও টানটান রেখে সোজা হয়ে সমান তালে হাঁটুন। হাঁটার সময় প্রতি ৪ (চার) পদক্ষেপের সাথে সাথে মনে মনে ১, ২, ৩, ৪ গুনতে হবে এবং একই সাথে উভয় নাক দিয়ে পুরক বা শ্বাস গ্রহণ করুন। পুরক বা শ্বাসগ্রহণ শেষ হওয়া মাত্রই আবার ৪ (চার) পদক্ষেপের সঙ্গে আগের মতো মনে মনে ১, ২, ৩, ৪ গুনার সাথে সাথে উভয় নাক দিয়ে রেচক বা শ্বাস ত্যাগ করুন। ৩/৪ সপ্তাহ এভাবে অভ্যাসের পর এবার ১ থেকে ৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে পুরক বা শ্বাস নিতে হবে, কিন্তু রেচক বা শ্বাস ছাড়ার সময় ১, ২, ৩, করে ৬ পর্যন্ত গুনতে হবে এবং সময় নিতে হবে। আবার কিছুদিন অভ্যাসের পর এভাবে ৬ পর্যন্ত গুনে শ্বাস নিতে হবে এবং শ্বাস ছাড়তে হবে ৮ পর্যন্ত গুনে। এভাবে আরো কিছুদিন অভ্যাসের পর ৮ পদক্ষেপ পর্যন্ত পুরক বা শ্বাস নেয়া এবং ১২ পদক্ষেপ পর্যন্ত রেচক বা শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস রপ্ত হয়ে গেলে সাধ্যে কুলালে একইভাবে ১২ পদক্ষেপ পর্যন্ত পুরক বা শ্বাস গ্রহণ এবং ১৮ পদক্ষেপ পর্যন্ত রেচক বা শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস করা যেতে পারে। এরপর আর মাত্রা বাড়াবার দরকার হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ অভ্যাসের মাধ্যমে এভাবে হাঁটাকে ভ্রমণ-প্রাণায়াম বলে। এই ভ্রমণ-প্রাণায়াম নিজ নিজ সামর্থানুযায়ী ১০/১৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টাও করা যেতে পারে। কিংবা অভ্যাসের সময়কাল আরো বাড়ালেও কোন ক্ষতি হয় না।

ক্ষতি তখনই হবে যদি প্রাণায়ামটি অভ্যাসের সময় হাঁপ ধরে যায়। কেননা প্রাণায়াম অভ্যাস সব সময়ই আয়াসহীন হওয়া চাই। হাঁপ ধরে গেলে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস রেখে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রাণায়ামটি অভ্যাসের সময় যদি বাঁ বুকে একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়, বুঝতে হবে, ফুসফুসের ক্ষমতা অনুযায়ী মাত্রা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ওইদিন ওইখানেই অভ্যাস বন্ধ রাখতে হবে। একদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে এক মাত্রা কমিয়ে পুনরায় শুরু করতে হবে।

এ প্রাণায়াম প্রাতে ও সন্ধ্যায় খোলা বা মুক্ত স্থানে, মাঠে বা ধূলাবিহীন রাস্তায় নির্মল বায়ুতে অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।
উপকারিতা:
এই ভ্রমণ-প্রাণায়াম সবার পক্ষে বিশেষ উপকারী। বয়স্ক বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য তা মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করে থাকে। তবে তার মাত্রা স্বাস্থ্যানুযায়ী হতে হবে। অন্যান্য প্রাণায়ামে যত রকমের উপকার রয়েছে তার প্রায় সবই এই ভ্রমণ-প্রাণায়ামে রয়েছে। নিয়মিত ও নিয়মানুযায়ী প্রাণায়ামটি অভ্যাস রাখলে যক্ষ্মা, হাঁপানি, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগ কখনোই হতে পারে না এবং ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রাদি অধিক কর্মক্ষম থাকে। রক্ত অধিকতর পরিশোধিত হয়।


অন্য ব্যায়াম না করেও কেবল ভ্রমণ-প্রাণায়াম অভ্যাস রাখলে দেহ চমৎকার রোগমুক্ত থাকে। যে কোন রোগ থেকে আরোগ্যের পরপরই এই প্রাণায়াম অভ্যাস করলে রোগীর শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার সহজ হয়।
নাড়ী শোধন প্রাণায়াম (Nadi Shodhana Pranayama):

পদ্ধতি:
পদ্মাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে শিরদাঁড়া সোজা অথচ শিথিল রেখে (চোখ বন্ধ থাকা ভালো) স্বাভাবিক অবস্থায় বসুন। এবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ডান নাকে এবং কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুলদ্বয় একত্রে বাঁ নাকের কাছে নিয়ে যান। তর্জনি এবং মধ্যমা আঙুলদ্বয় একত্রে ভাঁজ হয়ে হাতের তালু স্পর্শ করে থাকবে।

এখন বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ডান নাক চেপে ধরে ছিদ্র বন্ধ করে বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে যতটা সম্ভব বুক ভরে পুরক বা দম নিতে থাকুন। শ্বাস নেয়া শেষ হলে এবার একত্রে কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে বাঁ নাক চেপে ছিদ্র বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে রেচক বা দম ছাড়তে থাকুন। রেচকের পরপরই বাঁ নাক চেপে রেখেই এখন ডান নাক দিয়ে পুরক বা দম নিন এবং পুরক শেষ হলে বুড়ো আঙুলে ডান নাক চেপে বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে রেচক বা দম ছাড়ুন। এভাবে প্রতি নাকে ৩/৪ বার করে উভয় নাকে ৬ থেকে ৮ বার অভ্যাস করুন।

লক্ষ্য রাখতে হবে, দম নেয়া ও ছাড়ার সময় যাতে নাকে বা গলায় কোন আওয়াজ না হয়। একই সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, পুরক বা দম নেয়া এবং রেচক বা দম ছাড়ার সময় যেন ১ ঃ ২ অনুপাতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু সময় ধরে দম নেয়া হবে তার দ্বিগুণ সময় নিয়ে দম ছাড়তে হবে। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম প্রথম তা আয়ত্তে আনা সহজ না হলেও কিছুদিনের নিয়মিত চর্চায় তা আয়ত্তে চলে আসবে।

এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যারা পুরক ও রেচকের মধ্যবর্তী কুম্ভক বা দম আটকে রাখার চর্চাও যুক্ত করতে চান সেক্ষেত্রে পুরক, কুম্ভক ও রেচক এই তিন প্রক্রিয়ার সময়ানুপাত যথাক্রমে ১ ঃ ২ ঃ ২ বা ২ ঃ ১ ঃ ৪ হিসাবে অভ্যাস করতে হবে। অর্থাৎ যতক্ষণ পুরক বা শ্বাসগ্রহণ হবে তার দ্বিগুণ সময় ধরে রেচক বা শ্বাসত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কুম্ভক বা দম আটকে রাখার সময়কাল নিজের সামর্থ্যমতো ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। তবে গৃহীদের পক্ষে কুম্ভক অভ্যাস না করাই বাঞ্ছনীয়। বই পড়ে কুম্ভক অভ্যাস করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। একান্তই কেউ তা অভ্যাস করতে চাইলে অবশ্যই সদগুরুর কাছে হাতে কলমে এই প্রাণায়ামের সম্পূর্ণ পদ্ধতি শিখে তবে চর্চা করতে হবে।

উপকারিতা:
দেহ থেকে যাবতীয় রোগবিষ টেনে বের করে দেয় বলে এটির নাম নাড়ী শোধন প্রাণায়াম। এই প্রাণায়াম বিশেষভাবে দেহের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে এবং সর্দি-কাশির দোষ নষ্ট করে।

ধৌতি (Dhauti):
‘হঠযোগ-প্রদীপিকা’ গ্রন্থের ২/১৪ স্তোত্রে বলা হয়েছে-

ধৌতিবস্তি স্তথা নেতিস্ত্রাটকং নৌলিকং থো।
কপালভাতিশ্চৈতানি ষট্কর্মাণি প্রচক্ষ্যতে।।

অর্থাৎ নাড়ী শোধনের জন্য ধৌতি, বস্তি, নেতি, নৌলিক, ত্রাটক ও কপালভাতি- এই ষট্কর্ম অভ্যাস করা উচিত।

যদিও প্রত্যেক যোগাসন অভ্যাসকারীকেই যে এই ষট্কর্ম করতেই হবে এমন কোন বিধান নেই, তবু যাদের দেহে মেদ ও শ্লেষ্মা অধিকমাত্রায় রয়েছে তাদের জন্য ষট্কর্ম অভ্যাস করা প্রয়োজন বলে যোগশাস্ত্রীরা বলে থাকেন। তবে আসন অভ্যাসকারী তাঁর নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী উপরোক্ত ষট্কর্মের এক বা একাধিক বেছে নিয়ে যথানিয়মে অভ্যাস করলে আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেন।

উপরোক্ত ষট্কর্ম বা ধৌতিক্রিয়া অভ্যাসে বুকে ও পেটে সঞ্চিত দুষিত পদার্থ স্বাভাবিকভাবে নির্গত হয়ে যাওয়ায় বুক ও পেটে সহজে কোন রোগ আশ্রয় করতে পারে না। একান্তই পূর্বে কোন রোগ বাসা বেঁধে থাকলে এই ধৌতিক্রিয়া তা নিরাময় করতে সাহায্য করে। একই সাথে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে থাকে, যা প্রাণায়াম অভ্যাসে বিশেষ প্রয়োজন হয়।

এই ষট্কর্ম বা ধৌতিক্রিয়ার উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- কপালভাতি, বাতসার, অগ্নিসার, বারিসার বা বমন ধৌতি, সহজ নেতিক্রিয়া বা নাসাপান, সহজ বস্তিক্রিয়া, ত্রাটক ইত্যাদি।
কপালভাতি (Kapalbhati):
কপালভাতিকে কেউ কেউ প্রাণায়ামও বলে থাকেন।

পদ্ধতি:
পদ্মাসনে চোখ বন্ধ রেখে সোজা হয়ে বসুন। এবার উভয় নাক দিয়ে কর্মকারদের হাপরের মতো দ্রুত শ্বাস নেয়া ছাড়ার মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্রকে সশব্দে দ্রুত বায়ুপূর্ণ এবং পরক্ষণেই বায়ুশূন্য করতে থাকুন। এক্ষেত্রে দম নেয়ার চাইতে দম ছাড়া হবে বেশি পরিমাণে এবং খুব জোরের সঙ্গে। দম নেয়া ও ছাড়ার সময় মেরুদণ্ড, বুক ও কাঁধ যতটা সম্ভব স্থির থাকবে এবং তলপেট হাপরের মতোই ভিতরে বাইরে দ্রুত আসা-যাওয়া করবে।

নতুন অভ্যাসকারীরা সামর্থ্য অনুযায়ী প্রথম প্রথম মিনিটে ১৫/২০ বার দম ছাড়া ও নেয়ার মাত্রা রাখতে পারেন। কিছুদিন অভ্যাসের পর সামর্থ্য বাড়ার সাথে সাথে এই হার মিনিটে ৫০/৬০ বার থেকে ১২০ বার পর্যন্ত অভ্যাস করতে পারেন।

উপকারিতা:
কপালভাতি অভ্যাসে কপালে সর্দি জমতে পারে না এবং কফ্ দোষ বিনষ্ট হয়। এতে সাইনাস হবার সম্ভাবনা থাকে না এবং সাইনাস থাকলে তা দ্রুত সেরে যায়। এছাড়াও হৃদযন্ত্র সবল হয়, পেটের মেদ কমায় এবং কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।

বাতসার (Batasara):

পদ্ধতি:
পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার ঠোঁট দুটো কাকের ঠোঁটের মতো ছুঁচালো করে ধীরে ধীরে দম নিতে নিতে বায়ু পান দ্বারা উদর পূর্ণ করুন। এবং পরক্ষণেই মুখ দিয়ে বায়ু ত্যাগ করুন। এভাবে ধৌতিটি ৮/১০ বার অভ্যাস করুন।

উপকারিতা:
বাতসার অভ্যাস শরীরকে নির্মল করে। যোগশাস্ত্রীদের মতে বাতসার সর্বপ্রকার রোগ দূর করে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি করে। মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
 অগ্নিসার (Agnisara):

পদ্ধতি:
অগ্নিসার একধরনের নৌলিক ধৌতি। এটা দাঁড়িয়ে বা যে কোন আসনে বসে দু’ভাবেই করা যেতে পারে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটো কোমরের দু’পাশে রাখুন। অথবা পদ্মাসন বা যে কোন ধ্যানাসনে বসে হাত দুটো হাঁটুর উপর রাখুন। এবার পেট ও তলপেটকে উড্ডীয়ান অবস্থায় আনুন। অর্থাৎ প্রথমে শ্বাস ত্যাগ করে উদর বায়ুশূন্য করে কুম্ভক করুন বা দম বন্ধ করে থাকুন। এ অবস্থায় পেট ও তলপেটের মাংসপেশীকে শিথিল করে পরক্ষণেই পেট ও তলপেট কুঞ্চিত করে পেশী মেরুদণ্ডের দিকে টানতে থাকুন এবং পুনরায় শিথিল করে আবার কুঞ্চিত করুন ও পরক্ষণেই শিথিল করে দিন।

এভাবে এক কুম্ভকে আয়াসহীনভাবে যতবার সম্ভব প্রক্রিয়াটি অভ্যাস করুন। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ করুন এবং পেট ও তলপেট শিথিল করে দিন। ৮/১০ বার প্রক্রিয়াটি অভ্যাস করুন।

উপকারিতা:
এই ক্রিয়া উদরের যাবতীয় পীড়া নিরাময়ে সাহায্য করে। পাকস্থলী, প্লীহা, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, যৌনগ্রন্থি ইত্যাদি সবল ও সক্রিয় থাকে। মেদ কমে পেট ও তলপেটের পেশী দৃঢ় হয়। কোষ্ঠবদ্ধতা সেরে যায় এবং যৌনমিলনে অক্ষম ব্যক্তিদের সক্ষম হতে সাহায্য করে।
নিষেধ:
যাদের হৃদযন্ত্র দুর্বল তাদের এবং অল্পবয়সী মেযে যাদের ঋতু প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের জন্য এই ক্রিয়া অভ্যাস করা নিষেধ।

# সহজ অগ্নিসার (Sahaja Agnisara):

পদ্ধতি (ক):
হাত দুটো জানুর উপর রেখে কোমর থেকে দেহের উপরের অংশ সামান্য একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দাঁড়ান। এবার দম নিতে নিতে পেটের নিম্নভাগ ও নাভিদেশ আকুঞ্চন করতে করতে যতটা সম্ভব মেরুদণ্ড-সংলগ্ন করার চেষ্টা করুন। শ্বাস নেযা শেষ হলে এখন শ্বাস ত্যাগ করতে করতে আকুঞ্চন শিথিল করে দিন। এভাবে ২০/২৫ বার প্রক্রিয়াটি অভ্যাস করুন।

পদ্ধতি (খ):
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ডানদিকের কোমরের খাঁজে এবং বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল একইভাবে বাঁদিকের কোমরে রাখুন। এবার উভয় কোমরে বুড়ো আঙুল দৃঢ়ভাবে রেখে দু’হাতের অন্য সব আঙুল দিয়ে নাভিদেশ চাপ দিয়ে সঙ্কুচিত করে যতটা সম্ভব মেরুদণ্ড-সংলগ্ন করুন। নাভিদেশ মেরুদণ্ডে লাগার সঙ্গে সঙ্গে নাভির উপর আঙুলগুলো আলগা করে নাভিপ্রদেশ চাপমুক্ত করে শিথিল করে দিন। এভাবে ২০/২৫ বার প্রক্রিয়াটি অভ্যাস করুন।

উপকারিতা:
প্রক্রিয়াটি অভ্যাসকালে পেট ও তলপেট রক্তে প্লাবিত হয় বলে তলপেটে জমা সমস্ত রোগজীবাণু নাশ হয়। আমাশয়, কোষ্ঠতারল্য প্রভৃতি রোগ হয না এবং থাকলেও তা নিরাময় হয়ে যায়। যতদিন অগ্নিসার ধৌতি আয়ত্তে না আসে ততদিন এই সহজ অগ্নিসার ক্রিয়া অভ্যাস করা উচিত।

নিষেধ:
যাদের হৃদযন্ত্র দুর্বল তাদের এবং অল্পবয়সী মেযে যাদের ঋতু প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের জন্য এই ক্রিয়া অভ্যাস করা নিষেধ।
 বারিসার (Barisara) বা বমন-ধৌতি (Bamana-Dauti):

পদ্ধতি:
সাধ্যানুযায়ী এক থেকে দুই লিটার ঈষৎ গরম জলে চা চামচের এক থেকে দুই চামচ লবণ মিশ্রিত করে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় আকণ্ঠ পান করুন। কিছুক্ষণ পর মুখ নিচু করে প্রয়োজনে গলায় আঙুল দিয়ে আলজিভে আস্তে আস্তে নাড়া দিয়ে ঐ জল বমি করে বের করে দিন। একবারে সব জল বের না হলে কয়েকবার প্রক্রিয়াটি করুন।

উপকারিতা:
মুখ দিয়ে বহিরাগত জলের সাথে পেটের সঞ্চিত দূষিত পিত্ত, শ্লেষ্মা ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ সহজে বের হয়ে আসায় দেহ নির্মল হয়। ফলে পিত্ত রোগ, অম্ল-রোগ ও সর্দি-কাশির প্রকোপ হ্রাস পায়। অর্থাৎ খাওয়ার আধ-ঘণ্টা বা একঘণ্টা পরে যাদের চোঁয়া ঢেকুর উঠে বা রোজ বিকেলে ঢেকুর উঠতে থাকে এবং ঢেকুর উঠলে মুখ তেতো বা টক টক লাগে তাদের জন্য এই ধৌতি-প্রক্রিয়াটি বিশেষ উপকারী।

প্রথম প্রথম সপ্তাহে দু’তিনদিন এবং ৪/৫ সপ্তাহ পর থেকে সপ্তাহে একদিন করে এই প্রক্রিয়া অভ্যাস করে গেলে কোনদিন অম্ল বা পিত্তদোষ হবে না।

সতর্কতা:
বারিসার অভ্যাসের অব্যবহিত পরেই খাদ্য গ্রহণ করা উচিত নয়। অন্তত একঘণ্টা পর খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। এবং প্রয়োজন ছাড়া নিয়মিত বারিসার অভ্যাস করা নিষেধ।

নাসাপান (Nasapana) বা সহজ নেতিক্রিয়া (Sahaja Netikriya):
জলের সাহায়্যে নাসাপথে যে নেতিক্রিয়া অভ্যাস করা হয়, তাকে নাসাপান বলে। আর এই প্রক্রিয়াটি অতি সহজ বলেই একে সহজ নেতিক্রিয়া বলে।

পদ্ধতি:
একটি বড় চ্যাপ্টা মুখওয়ালা পাত্র জলভর্তি করে এতে নাক ও মুখ ডুবিয়ে দিন। এবার মুখ বন্ধ রেখে দম নিতে নিতে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে পাত্রের জল ভিতরে টানার চেষ্টা করুন। প্রথম প্রথম অভ্যাসকালে নাক দিয়ে জল টানতে একটু কষ্ট হবে। দু’একদিন নাক জ্বালা করবে, হাঁচিও আসতে পারে। তবে নিষ্ঠার সাথে দু’চারদিন অভ্যাসে জলটানা প্রক্রিয়াটি আয়ত্তে আনতে পারলে মুখ দিয়ে জলপানের মতোই নাক দিয়েও নাসাপান সহজ হয়ে যাবে। যদিও এই জল পেটে গেলেও কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই, তবু নাক দিয়ে জল টেনে দেহে রাখা উচিত নয়, মুখ দিয়ে তা বের করে দিতে হবে।

প্রাথমিক অবস্থায় নাসাপান ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে ২/৩ মাস অভ্যাস করা যেতে পারে। পরে যখন মনে হবে নাসিকায় বা কণ্ঠে কোন দূষিত পদার্থ সঞ্চিত হয়েছে, কেবল তখনই নাসাপান অভ্যাস করা উচিত। তবে নাসাপানের পর কপালভাতি করা আবশ্যক।

উপকারিতা:
নাসাপান অভ্যাসে নাসিকা ও কণ্ঠদেশে সঞ্চিত দূষিত পদার্থ নির্গত হয়ে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস সহজসাধ্য হয়। এতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে, কোনভাবেই মাথাধরা রোগ হয় না। সাইনাস বা পুরনো সর্দি সারাতে এই নেতিক্রিয়াটি অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে গণ্য হয়।
সহজ বস্তিক্রিয়া (Sahaja Basthikriya):
যে ক্রিয়ায় বস্তি অর্থাৎ তলপেট পরিষ্কার হয়, তারই নাম বস্তি-ক্রিয়া। কোষ্ঠবদ্ধতা বহু রোগের মূল উৎস হওয়ায় কোষ্ঠ বা পায়খানা পরিষ্কার রাখার জন্য প্রত্যেকেই কয়েকটি নিয়ম মেনে চললে এই দুঃসহ কোষ্ঠবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এই নিয়মগুলোকে বস্তি-ক্রিয়া বলা হয়ে থাকে।

পদ্ধতি:
সকালে ঘুম থেকে উঠে কুলকুচি করে মুখ ধুয়ে এক গ্লাস ঈষদুষ্ণ পানিতে একটি পাতি বা কাগজি লেবুর রস এবং পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে পান করুন। এরপর ছ’বার পবন-মুক্তাসন, চারবার বিপরীতকরণী মুদ্রা, তিনবার অর্ধচন্দ্রাসন বা শলভাসন এবং তিনবার পদহস্তাসন করুন।

তবে উচ্চ রক্তচাপ ও অম্লরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য যথাক্রমে লবণ ও লেবুর রস ব্যবহার না করাই ভালো।

উপকারিতা:
এই বস্তি-ক্রিয়া অভ্যাসে রাখলে অজীর্ণ ও কোষ্ঠবদ্ধতা রোগ কোনদিন হতে পারে না এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।

অত্যধিক বয়েসী কিংবা যাদের শরীর অত্যন্ত দুর্বল বা রুগ্ন, অথবা যাদের পক্ষে কোনরকম আসন বা ব্যায়াম করা সম্ভব নয়, তারা সূর্যোদয়ের পূর্বে বিছানা ত্যাগ করে পরিমাণমতো ঠাণ্ডা বা ঈষদুষ্ণ পানি পান করে খোলা জায়গায় নির্মল বাতাসে কিছু সময় পায়চারি করলেই কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ত্রাটক (Trataka):
বিভিন্ন আসন বা ব্যায়াম অভ্যাসে শরীরের বিভিন্ন উন্নতি সাধন হলেও ত্রাটক অভ্যাসের মাধ্যমে চোখের দৃষ্টি যতোটা বৃদ্ধি করা সম্ভব তা অন্য কোন পদ্ধতির দ্বারা সম্ভব নয়। চোখ হচ্ছে দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়। তাই ত্রাটক অভ্যাসের সময় চোখের উপর বা চোখের সূক্ষ্ম স্নায়ুমণ্ডলী এবং মাংসপেশীর উপর যেন কোন রকম চাপ না পড়ে সেদিকে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।

পদ্ধতি:
যে কোন ধ্যানাসনে বসে প্রথমে মনটাকে সুস্থির করুন। এবার সামনের পরিষ্কার দেয়ালে একটি কালো বিন্দু কিংবা মোমবাতির আলোর সামনে বসে এক নিবিষ্টে তাকিয়ে থাকুন। কিছু সময় পর চোখ দিয়ে অল্প অল্প জল বেরিয়ে আসতে পারে। এজন্যে চিন্তার কোন কারণ নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, আশপাশ থেকে অন্য কোন আলো যাতে বেশি পরিমাণে চোখের উপর এসে না পড়ে। এভাবে নির্দিষ্ট দিকে সামর্থ্য অনুযায়ী ৪/৫ মিনিট তাকিয়ে থাকার অভ্যাস করুন।

কিছুদিন এই প্রক্রিয়ায় অভ্যাসের পর যে কোন ধ্যানাসনে বসে শরীর সুস্থির রেখে এবার শুধুমাত্র চোখের মণি’কে ধীরে ধীরে একবার ডানদিকে, পরে বামদিকে এবং একবার উপর দিকে, পরে নিচের দিকে নিতে থাকুন। তবে একদিক থেকে অপর দিকে যাবার সময় চোখের মণি’কে সামনের দিকে স্বাভাবিক অবস্থায় অল্প কিছুক্ষণ রাখতে হবে। এভাবে প্রতিটি দিকে সামর্থ্য অনুযায়ী ৫/৬ বার চোখের মণি ঘুরানোর অভ্যাস করুন।

আরো কিছুদিন এরকম অভ্যাসের পর এবার চোখের মণি একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে কক-ওয়াইজ ঘুরিয়ে এবপর আবার উল্টোদিকে একবার এন্টি কক-ওয়াইজ ঘোরাতে থাকুন। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ৫/৬ বার এই প্রক্রিয়াটি অভ্যাস করুন।

যা-ই করুন, কিছুতেই যেন মাত্রাধিক্য না হয়। পরিমাণে কম সংখ্যকবার করা যেতে পারে, কিন্তু বেশি বার করা মোটেও উচিত হবে না। এভাবে অভ্যাসের পর হাতের তালু দিয়ে চোখের উপর হালকা মালিশ করে নিন।

উপকারিতা:
এই ত্রাটক অভ্যাসে চোখের অনেক রোগ সেরে যায় এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়। কোন আবেগীয় কারণ ছাড়াই যাদের চোখ দিয়ে জল পড়ে কিংবা ঘুম থেকে উঠার পর চোখে যন্ত্রণা হয়, তাদের জন্য ত্রাটক অভ্যাস বিশেষ ফলদায়ক।

ব্রহ্মপ্রাপ্তি হলে সমস্থ দুঃখের নিবৃত্তি হয়,  আর ব্রহ্মপ্রাপ্তির জন্য যোগসাধনার গুরুত্ব অপরিসীম, এজন্য শিখোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে,
“জ্ঞাননিষ্ঠো বিরক্তোহপি ধর্মজ্ঞ বিজিতেন্দ্রিয় ৷
বিনা দেহেহপি যোগেন ন মোক্ষং লভতে বিধে ৷৷”
অর্থ - হে বিধে সাধক যদি জ্ঞাননিষ্ঠ, বিরাগী ,ধর্মজ্ঞ এবং জিতেন্দ্রিয় ও হয় তথাপি যোগসাধন ব্যাতিরেকে এই দেহ মুক্তিলাভ করতে পারে না |
আবার গীতায় শ্রীভগবান যোগীকে মুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন ।
স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে বােঃ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ। ৫/২৭
যতেন্দ্ৰিয়মনােবুদ্ধিমুনির্মোক্ষপরায়ণঃ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধাে যঃ সদা মুক্ত এব সঃ ॥ ৫/২৮
অর্থ:-(২৭-২৮) বাইরের বিষয়সমূহ বাইরেই ত্যাগ করে, চোখের দৃষ্টিকে ভুযুগলের মধ্যস্থলে স্থিত করে এবং নাকের অভ্যন্তরে বিচরণকারী প্রাণ-
অপান বায়ুকে সমান করে যিনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করেছেন এবং যে মােক্ষপরায়ণ মুনি ইচ্ছা, ভয় এবং ক্রোধরহিত হয়েছেন; তিনি
সর্বদা মুক্ত।
আবার যোগ সম্পর্কে বলেছেন, —
“ চিত্তং নিরুদ্ধং যােগসেবয়া।
যত্র চৌবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ॥৬/২০
সুখমাত্যন্তিকং যত্তস্ফুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্।
বেত্তি যত্ৰ ন চৌবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥ ৬/২১
যং লব্ধ, চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্ স্থিতাে ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥ ৬/২২
তং বিদ্যাদুঃখসংযােগবিয়ােগং যােগসংজ্ঞিতম্।
স নিশ্চয়েন যােক্তব্যো যােগােহনির্বিচেতসা। ৬/২৩”
অর্থ:-(২০) যে অবস্থায় যােগের অনুষ্ঠান দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত নিবৃত্ত (ক্ষান্ত) হয় এবং যে অবস্থায় (অষ্টাঙ্গযােগের অভ্যাসে) শুদ্ধ চিত্ত দ্বারা পরমাত্মার সাক্ষাৎ করে পরমাত্মাতেই সন্তুষ্ট হয়,...
অর্থ:-(২১) যে অবস্থায় অনন্ত সুখ অনুভব হয়, যে আনন্দ ইন্দ্রিয়েরঅনুভূতি থেকেও ঊর্ধ্বে স্থিত, কেবল শুদ্ধবুদ্ধি দ্বারা গ্রহণযােগ্য এবং যেঅবস্থাতে স্থিত হয়ে এই যথার্থ তত্ত্ব (পরমাত্মা) থেকে বিচলিত হন না,..
অর্থ:-(২২) যে অবস্থা লাভ করলে অন্য কোনাে প্রাপ্তিকে উত্তম মনে হয়না এবং যে অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ মহাদুঃখেও বিচলিত হয় না,...
অর্থ:-(২৩) যে অবস্থায় দুঃখের সাথে কোনাে সংযােগ থাকে না, সেই অবস্থাকে যােগ বলে। অধ্যবসায় সহকারে, তৎপরায়ণ চিত্তে এই যােগ অভ্যাস করা কর্তব্য।
যোগের অর্থ —
যোগের অর্থই এই যে, সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে পরমানন্দে স্থিতিলাভ করা ।
মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন “যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধ” অর্থাৎ মনের সঙ্কল্প বিকল্প রূপ কাম , ক্রোধ, দ্বেষ আদি সমস্ত অনাবশ্যক চিন্তা কে রুদ্ধ করে মন কে অভিষ্ট ধ্যেয় তে নিযুক্ত করে মনের সাত্ত্বিক বৃত্তিরও নিরোধ করে ঈশ্বর কে প্রাপ্ত করাই হচ্ছে যোগ ।
ব্যুৎপত্তি অর্থ অনুসারে যোগ শব্দ “যুজ সমাধৌ” আত্মেনপদী ধাতুর সহিত “ঘঞ্” প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নিষ্পন্ন হয়েছে । অতঃ “যোগ” শব্দের অর্থ “সমাধি” অর্থাৎ চিত্তের বৃত্তির নিরোধ ।
বৈদিক শাস্ত্রে যোগসাধনার মহিমা বর্ণন—
বেদে যোগের মহত্বঃ -
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে( ৩।১০।১১।৩) “অনন্তা বৈ বেদা” “সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ” (মনু০২l৭) অর্থাৎ বেদ সর্বজ্ঞানময়  । বেদ বিদ্যাই সমস্ত বিদ্যার আদিমূল অর্থাৎ সমস্ত বিদ্যার উৎপত্তি বেদ হতে । ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞানের বিনা কোন ব্যক্তির ব্যবহার সিদ্ধি, ব্যক্তির ভৌতিক বিজ্ঞান এবং না কোন আধ্যাত্মিক বিদ্যার লাভ হতে পারতো । আর না তো তারা লৌকিক সুখ লাভ করতে পারতো আর না তো মোক্ষসুখ ।
যোগদর্শন আদি সমস্ত আর্ষশাস্ত্রে প্রতিপাদিত যে বিদ্যা তা বেদের মাধ্যমে প্রদানকারী আদিমূল ঈশ্বরই । এভাবে যোগের ধারণার স্রোতও বেদ হতেই প্রবাহিত ।
যথাঃ
.
ই॒মং যব॑মষ্টায়ো॒গৈঃ ষ॑ড্যো॒গেভি॑রচর্কৃষুঃ। তেনা॑ তে ত॒ন্বো॒ রপো॑ঽপা॒চীন॒মপ॑ ব্যযে ॥
স্বর রহিত মন্ত্র
ইমং যবমষ্টায়োগৈঃ ষড্যোগেভিরচর্কৃষুঃ। তেনা তে তন্বো রপোঽপাচীনমপ ব্যযে ॥
[ অর্থববেদ ৬/৯১/১]
পদার্থঃ (ইমম্) এই [ সর্বব্যাপী ] (য়বম্) সংযোগ-বিয়োগ কারী পরমেশ্বর কে (অষ্ঠায়োগৈঃ) আট প্রকারের [ যম-নিয়ম আদি ] যোগ আর (ষড্যোগেভিঃ) ছয় প্রকারের [ পঠন-পাঠন আদি ব্রাহ্মণের কর্ম থেকে ] (অচর্কৃষুঃ) সে [মহাত্মাদের] কর্ষণ করে অর্থাৎ পরিশ্রম করে প্রাপ্ত করেছেন । (তেন) তার [কর্ম] থেকে (তে) তোমার (তন্বঃ) শরীরের (রপঃ) পাপপ্রবৃত্তিসমূহকে (অপাচীনম্)
বিপরীতমুখী করে (অপ ব্যয়ে) আমি সরিয়ে দিচ্ছি ।
ভাবার্থঃ যেই প্রকারে মহর্ষিগণ যোগসাধন আর ব্রাহ্মণগণ কর্ম দ্বারা ঈশ্বর কে লাভ করেন, সেভাবেই বিদ্বান মনুষ্য ঈশ্বর প্রাপ্তির দ্বারা আত্মদোষ ত্যাগ করে আনন্দিত হবেন । 
যুঞ্জতে মন-উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ।
বি হোত্রা দধে বয়ুনাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ।।
(ঋগবেদ ৫।৮১।১)
পদার্থঃ যাহারা ঈশ্বরের উপাসক (বিপ্রাঃ) অত্যন্ত মেধাবী, বিদ্বান্ ও হোত্রা, অর্থাৎ উপাসনারূপ যোগক্রিয়াশীল যোগীজন (বিপ্রস্য) সেই বৃহতের অপেক্ষা বৃহৎ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ (বিপশ্চিতঃ) সর্বজ্ঞ সর্বপ্রকার বিদ্যাযুক্ত পরমেশ্বরের মধ্যে (মন যুঞ্জতে) আপনার মন কে যথাযোগ্য বা সম্যক প্রকার যুক্ত বা স্থির [ অর্থাৎ চিত্তবৃত্তির নিরোধ] করেন, তথা (উত ধিয়) আপনার বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানকেও (যুঞ্জতে) সদা পরমাত্মাতে ধারণ করে থাকেন। যে পরমাত্মা এই সমগ্র জগতের (বিদধে) ধারণ ও বিধান করেন (বয়ুনাবিদেক ইৎ) যিনি সকল জীবের শুভাশুভ কর্ম বিষয়ে জ্ঞাত আছেন এবং যিনি সাক্ষীস্বরূপ, যিনি একমাত্র অদ্বিতীয় ও সর্বব্যাপক, যাহাপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠতম কোন পদার্থ নেই, সেই (দেবস্য) দেব অর্থাৎ জগতের প্রকাশক ও (সবিতুঃ) সকল পদার্থের রচয়িতা স্রষ্টারুপী পরমেশ্বরের (মহী পরিষ্টুতিঃ) আমরা সর্বপ্রকারে অত্যন্ত মহতী স্তুতি করি ।
যুঞ্জানঃ প্রথমং মনস্তত্ত্বায় সবিতা ধিয়ঃ।
অগ্নের্জ্যোতিনর্নিচায্য পৃথিব্যা অধ্যাভরত।।
(যজুর্বেদ ১১।১)
পদার্থঃ (যুঞ্জানঃ) যোগাভ্যাসী মানুষেরা (তত্ত্বায়) তত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মবস্তু বা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য (প্রথম মনঃ) সর্বাগ্রে মনকে পরমেশ্বর যুক্তি করিয়া থাকেন (সবিতা) পরমেশ্বরও এইরূপ যোগীর প্রতি কৃপা করিয়া তাহার (ধিয়ম্) বুদ্ধিকে আপনাতে যুক্ত করিয়া নেন (অগ্নের্জ্যো) তখন সেই যোগী পরমেশ্বরের প্রকাশ নিশ্চয় করিয়া জ্ঞাত হইয়া (অধ্যাভরৎ) স্বীয় আত্মাতে পরমেশ্বর কে ধারণ করেন (পৃথিব্যাঃ) পৃথিবীর মধ্যে যোগীর উপরোক্ত লক্ষণ প্রসিদ্ধ আছে ।
যুক্তেন মনসা বয়ং দেবস্য সবিতুঃ সবে।
স্বর্গায় শক্ত্যা।।
(যজুর্বেদ ১১।২)
ভাবার্থঃ মনুষ্যমাত্র এরূপ ইচ্ছা করিবেন (বয়ম্) যেন আমরা (স্বর্গায়) মোক্ষসুখ হেতু (শক্ত্যা) যথাযোগ্য সামর্থ ও যোগবলানুসারে (দেবস্য) সর্বপ্রকাশক ও সর্ব্বানন্দপ্রদ (সবিতু) সর্বান্তর্যামী পরমেশ্বরের সৃষ্টি মধ্যে উপাসনারুপ যোগসাধন দ্বারা (যুক্তেন মনসা) শুদ্ধান্তঃকরণ হইয়া, নিজ আত্মায় সেই পরমাত্মস্বরূপ আরাধিত করিয়া পরমানন্দ প্রাপ্ত হই ।
অষ্টাবিংশনি শিবানি শগ্নানি সহ যোগং ভজন্ত মে।
যোগং প্রপদ্যে ক্ষেমং প্রপদ্যে যোগং চনমোহোরাত্রাভ্যামন্ত।।
(অথর্ববেদ ১৯।৮।২)
পদার্থঃ হে পরমেশ্বর! ( অষ্টাবিংশনি) ২৮ [দশ ইন্দ্রীয়, দশ প্রাণ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার বিদ্যা, স্বভাব, শরীর এবং বল ] (শিবানি) কল্যাণকারক এবং (শগ্নানি) সুখকারক হয়ে (সহ) একসাথে (মে) আমার (যোগম্) উপাসনা যোগ কে (ভজন্তাম্) সেবন করে। (যোগম্) সেই যোগ কে (চ) এবং (ক্ষমম্) রক্ষা কে [অর্থাৎ যোগের দ্বারা রক্ষা কে (প্র পদ্যে) আমি প্রাপ্ত হবো এবং (ক্ষেমম্) রক্ষা কে (চ) এবং (যোগম্) যোগ কে [রক্ষা দ্বারা যোগ কে ] (প্র পদ্যে) আমি প্রাপ্ত হবো, এইজন্য আমার আপনাকে (অহোরাত্রাভ্যামন্ত) দিন রাত্রি (নমঃ অস্তু) নমস্কার হোক ।
য়োগেয়োগে তবস্তরং বাজেবাজে হবামহে‌ ।
সখায় ইন্দ্রমূতয়ে ॥
[ অথর্ববেদ ২০l২৬l১ ]
পদার্থঃ (য়োগে য়োগে) যোগের বিভিন্ন স্তর - যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, [ সবিকল্পক-নির্বিকল্পক ] সমাধিতে (তবস্তরম্) ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, যোগ-বিঘ্নকে নষ্টকারী তথা সাধকদের উন্নতিকারী ['সর্বধাতুভ্যোঽসুন্' উণা ৪।১৯০] (ইন্দ্ৰম্) সিদ্ধি প্রদানকারী পরমেশ্বরকে (সখায়ঃ) আমরা সাথী যোগীগণ (বাজে বাজে) প্রত্যেকে নিজ অন্তরের দেবাসুর সংগ্রামে ['বাজ ইতি সংগ্রামনাম' নিঘ০ ২।১৭] (উতয়ে) রক্ষা বা বিজয় প্রাপ্তির জন্য (হামহে) আহ্বান করি ['লেটোঽডাটৌ' অষ্টা ৩।৪।৯৪, 'বহুলং ছন্দসি' অষ্টা ৬।১।৩৪]
সরলার্থঃ যোগের বিভিন্ন স্তর- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, [ সবিকল্পক-নির্বিকল্পক ] সমাধিতে ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, যোগ-বিঘ্নকে নষ্টকারী তথা সাধকদের উন্নতিকারী সিদ্ধিপ্রদানকারী পরমেশ্বরকে আমরা সাথী যোগীগণ প্রত্যেকে নিজ অন্তরের দেবাসুর সংগ্রামে রক্ষা বা বিজয় প্রাপ্তির জন্য আহ্বান করি l
ভাবার্থঃ যোগাভ্যাস করার মার্গে মানুষের ব্যাধি, সংশয়, প্রমাদ, আলস্য ইত্যাদি অধিক পরিমাণে বিঘ্ন সৃষ্টি করে । ঈশ্বর প্রণিধান বা প্রণব জপ দ্বারা এই সব বিঘ্ন দূর করা যায় । এইজন্য যখন যখন আমাদের অন্তঃকরণে দেবাসুর সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হয়,তখন তখন আমরা বিঘ্নকে পরাজিত করতে এবং যোগসিদ্ধি প্রাপ্ত করতে বলের অধিষ্ঠাতা পরমেশ্বরকে আহ্বান করি ।
অ॑ষ্ট॒ধা যু॒ক্তো বহ॑তি॒ বহ্নি॑রু॒গ্রঃ পি॒তা দে॒বানাং॑ জনি॒তা ম॑তী॒নাম্। ঋ॒তস্য॒ তন্তুং॒ মন॑সা মি॒মানঃ॒ সর্বা॒ দিশঃ॑ পবতে মাত॒রিশ্বা॑। তস্য॑ দে॒বস্য॑ ক্রু॒দ্ধস্যৈ॒তদাগো॒ য এ॒বং বি॒দ্বাংসং॑ ব্রাহ্ম॒ণং জি॒নাতি॑। উদ্বে॑পয় রোহিত॒ প্র ক্ষি॑ণীহি ব্রহ্ম॒জ্যস্য॒ প্রতি॑ মুঞ্চ॒ পাশা॑ন্ ॥
[ অথর্ববেদ ১৩l৩ l১৯ ]
পদার্থঃ (অষ্টধা) আট প্রকারে [ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি−যোগে অষ্ট অঙ্গ দ্বারা ] (যুক্তঃ) ধ্যানকৃত , (উগ্রঃ) প্রচণ্ড (বহ্নিঃ) বাহক , (দেবানাম্) গতিমান [পৃথিবী আদি ] লোকসমূহের (পিতা) পিতা [রক্ষক ] এবং (মতীনাম্) বুদ্ধিমানগণের (জনিতা) উৎপাদক [পরমেশ্বর, সংসারকে ] (বহতি) ধারণ করে নিয়ে যান । (ঋতস্য) সত্যজ্ঞানের (তন্তুম্) সূত্রসমূহ [শ্রেণী] -কে (মনসা) স্বীয় বিজ্ঞান দ্বারা (মিমানঃ) পরিমাপকারী , (মাতরিশ্বা) আকাশে গতিশীল [পরমেশ্বর] (সর্বাঃ) সকল (দিশঃ) দিকে (পবতে) গমন করেন [ব্যাপিত হন ] । (তস্য) সেই (ক্রুদ্ধস্য) ক্রুদ্ধ (দেবস্য) প্রকাশমান [ঈশ্বর] -এর জন্য ... [ম০ ১]
ভাবার্থ: যে পরমেশ্বর সর্বস্বামী,সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী,সর্ব কিছুর নিয়ন্ত্রণকর্তা, সব মানুষ যোগের মাধ্যমে তার উপাসনা করে আনন্দ পাক ।
পরি ত্যং হর্য়তং হরিং বভ্রুং পুনন্তি বারেণ।
য়ো দেবাম্বিশ্বাং ইৎপরি মদেন সহ গচ্ছতি ॥৮॥ 
[ সামবেদ ০৫৫২ ]
যোগসাধনাকারীগণ (ত্যম্) সেই (হৰ্ষতম্) আকাঙ্ক্ষিত (বক্রম্) শরীরের ভরণ-পোষণকর্তা [বিভর্তীতি বভ্রুঃ, ডুভূঞ্ ধারণপোষণয়োঃ স উ০ ১।২২] (হরিম্) নিজ আত্মাকে (বারেণ) দোষ-নিবারক যম, নিয়ম প্রভৃতি এবং ঈশ্বরপ্রণিধান দ্বারা (পুনন্তি) শুদ্ধ করেন, (য়ঃ) যেই আত্মা যোগসিদ্ধ হওয়ার পর (মদেনসহ) আনন্দের সাথে (বিশ্বান্ ইৎ) সকল (দেবান্) প্ৰাণ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি সমূহকে (পরিগচ্ছতি) ব্যাপ্ত করে ফেলে l
সরলার্থঃ যোগসাধনাকারীগণ সেই আকাঙ্ক্ষিত, শরীরের ভরণ-পোষণকর্তা নিজ আত্মাকে দোষ-নিবারক যম, নিয়ম প্রভৃতি এবং ঈশ্বরপ্রণিধান দ্বারা শুদ্ধ করেন যে আত্মা যোগসিদ্ধ হওয়ার পর আনন্দের সাথে সকল প্রাণ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার, ইন্দ্রিয়প্রভৃতি সমূহকে ব্যাপ্ত করে ফেলে l
গীতা মধ্যে দুঃখের বিয়োগকেই যোগের সঙ্গা দেওয়া হয়েছে -
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগ বিয়োগং বিয়োগং যোগসঙ্গিতম্।
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগহনবর্ব্বিণ্নচেতসা।।
(গীতা ৬।২৩)
অর্থাৎ দুঃখ সংযোগের বিয়োগ কে যোগ বলে জানবে । এই প্রকার অধ্যাবসায় সহকারে যোগাভ্যাস করা কর্তব্য ।
যোগ কে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে যোগেশ্বর শ্রী কৃষ্ণ অর্জুন কে যোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন -
তপস্বিভ্যোহধিকোযোগী জ্ঞানিভ্যোহপিমতোহধিকঃ।
কর্ম্মিভ্যশ্চা ধিকাযোগী তস্মাদযোগী ভবার্জ্জুন।।
(গীতা ৬।৪৬)
অর্থাৎ যোগীগণ তপস্বী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার মত । অতএব যে অর্জুন তুমি যোগী হও ।
অষ্টাঙ্গযোগ —
যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ করার জন্য যােগদর্শনে আট প্রকার যোগাঙ্গের কথা বলা হয়েছে ; যা একত্রে অষ্টাঙ্গযোগ নামে পরিচিত ।
অষ্টাঙ্গযোগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যোগদর্শনে বলা হয়েছে -
‌যোগাঙ্গনুষ্টানশুদ্ধিক্ষয়ে জ্ঞানদ্বীপ্তিরাবিবেকখ্যাতে। (যোগ০— ২/২৮)
অর্থ= যোগাঙ্গসমূহ বা অষ্টাঙ্গযোগের অনুশীলন করার ফলে অশুদ্ধির নাশ হয়ে জ্ঞানের প্রকাশ বিবেকখ্যাতি পর্যন্ত হয়ে যায় ।
 বিবেকখ্যাতির অর্থ আত্মসাক্ষাৎকার । অর্থাৎ আত্মা যে বুদ্ধি, অহংকার ও ইন্দ্রিয় থেকে পৃথক যোগী তা অনুভব করতে পারেন ।
যোগাঙ্গগুলো হলো —
'যম-নিয়মাসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধয়ো-হষ্টাবঙ্গানি। '
যোগদর্শন (২/২৯)।।
অর্থ= যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি । এগুলো হচ্ছে যোগসাধনার আটটি অঙ্গ ।
এদের মধ্যে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার এই পাঁচটিকে বহিরঙ্গ সাধনা এবং ধারণা ধ্যান ও সমাধি এই তিনটিকে অন্তরঙ্গ সাধনা বলা হয়েছে ।
যোগের এই অষ্টাঙ্গ যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে চিত্তের মলিনতা নষ্ট হয় এবং জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পায় ।
যোগাঙ্গসমূহ (অষ্টাঙ্গযোগ) এবং তাদের শাখাসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা—
(১) যম —
'যম' শব্দটি দ্বারা মূলত সংযমের কথা বোঝানো হয়েছে । যোগদর্শনে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন -
অহিংসাসত্যাস্তেয়ব্রহ্মচর্য্যাপরিগ্রহা যমাঃ।।
যোগ০- (২/৩০)
অর্থাৎ : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ- এই পাঁচটি সাধনকে একসঙ্গে বলা হয় যম ।
পাঁচ প্রকার যমের বর্ণনা—
(i) অহিংসা :
অহিংসা হলো সর্বপ্রকারে, সর্বদা, সর্বভূতের প্রতি হিংসা থেকে থেকে বিরত থাকা । হিংসা বলতে কায়িক, বাচিক ও মানসিক- তিনপ্রকার হিংসার কথাই বলা হয়েছে । এই তিনপ্রকার হিংসাই বর্জনীয় । অর্থাৎ কোনো ভাবেই অপরকে আঘাত করা বা অপরকে ব্যথা দেয়া যাবে না । এককথায়  মনকে সবসময় বিদ্বেষভাব থেকে দূরে রাখা ই হলো অহিংসা ।
যোগদর্শনে অহিংসা ব্রত পালনের বিধি—
 যোগদর্শনের বর্ণনা অনুযায়ী যোগীদের অহিংসা পালন করতে হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে । অর্থাৎ যে সামান্য থেকে সামান্যতম হিংসাকে সাধারণ মানুষ হিংসা বলে গণ্যই করেন না । যোগীর পক্ষে সেই হিংসাকেও ত্যাগ করা উচিত । যোগীরা সর্বভূতের প্রতি দ্বেষ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে জাতি, দেশ, কাল এবং নিয়ম সব অবস্থায় অহিংসা মহাব্রতকে ধারণ করবেন । যোগ দর্শনে এই বিষয়ে বলা হয়েছে,
“জাতিদেশকালসময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্বভৌমা মহাব্রতম্” ৷৷
(যোগ০— ২|৩১)
অর্থ= অহিংসা ইত্যাদি মহাব্রত জাতি, স্থান, কাল ও নিয়ম বিশেষ দ্বারা অবাধিত অর্থাৎ সব অবস্থায় পালনীয় ।
 যদি কোনো অবস্থায় যোগী অপর কোনো ব্যাক্তি বা প্রাণীর দ্বারা পীড়িত হন তখন তাঁর মনে বিতর্কের ভাব সৃষ্টি হয় । যেমন কেউ গালি দিলে, আঘাত করলে বা অপর কোনো ভাবে দুঃখ দিলে তার প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা হয় । এটি মানুষের মনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি । এই প্রবৃত্তি যম নিয়মের বিরোধী বলে একে বিতর্ক বলা হয় ।
বিতর্ক যেভাবে সংঘটিত হয় তার বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে -
“বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভমোহাক্রোধপূর্ব্বিকা মৃদুমধ্যাধিমাত্রা
(যোগ০—২/৩৪)
অর্থ— যম নিয়মের বিরোধী হিংসাভাবকে বিতর্ক বলা হয় । এটি তিনভাবে সংঘটিত হয় যেমন ব্যাক্তি নিজে করলে, কারো দ্বারা করালে এবং অনুমোদন করলে বিতর্ক লোভ, ক্রোধ, এবং মোহ থেকে উৎপন্ন হয় । এটি(বিতর্ক) আবার তিন মাত্রার হয়ে থাকে যেমন, মৃদু(কম), মধ্য(মাঝারি)  এবং অধিক মাত্রার (তীব্র) ।
বিতর্ক বা হিংসাভাব যেভাবে দমন করা উচিত —
যোগদর্শন অনুসারে বলা যায়, যোগীর পক্ষে বিতর্কের ভাবকে প্রতিপক্ষ ভাবনা দ্বারা দমন করা উচিত ।  যেমন বিতর্কের ভাবে ভাবিত হয়ে যম নিয়ম ইত্যাদি ভঙ্গ করলে যোগ মার্গে অনেক বড় হানি হয়ে যাবে এমন চিন্তা করে বিতর্কভাব ত্যাগ করা উচিত । এ বিষয়ে বলা হয়েছে,
‘বিতর্কবাধনে প্রতিপক্ষভাবনম্’।
 (যোগ০— ২/৩৩)
অর্থ = যম নিয়ম ইত্যাদি পালনের সময় বিতর্ক দ্বারা বাধা উৎপন্ন হলে বিরুদ্ধ পক্ষের ভাবনা করা উচিত ।
বিরুদ্ধ পক্ষের ভাবনা বা প্রতিপক্ষ ভাবনা কিভাবে করা উচিত তা এর পরের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ।  যেমন,
…...“দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্”।।
(যোগ০—২/৩৪)
অর্থ= বিতর্ক ভাবনার ফল অত্যাধিক দুঃখ এবং অজ্ঞানদায়ক হয় এরকম বিবেচনা করে সকল প্রকার বিতর্ক ভাবের নিরোধ করা উচিত ।
এভাবে যোগী যখন অহিংসার আচরণে দৃঢ় স্থিতি লাভ করেন তখন সকল প্রানীরা তাঁর সান্নিধ্যে থেকে বৈরিভাব ত্যাগ করে ।
“অহিংসাপ্রতিষ্ঠায়াং তৎসন্নিধৌ বৈরত্যাগঃ”।।  
(যোগ০- ২|৩৫)
অর্থ= অহিংসার আচরণে দৃঢ় স্থিতি হয়ে গেলে সেই যোগীর সান্নিধ্যে এসে সকল প্রাণীরা বৈরীভাব ত্যাগ করে ।
(ii) সত্য- সদা সত্য কথা বলা, সত্যের পথে চলা এবং কখনো মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়াকে সত্য বলা হয় । সত্য হলো কোনোভাবেই মিথ্যাচার না করা । যোগী ব্যাক্তি কোনও বিষয়কে যেমন দেখেছেন, যেমন শুনেছেন, এবং যেমন উপলব্ধি করেছেন তেমনটাই ব্যক্ত করবেন। কোনো কথাকে অতিরঞ্জিত করে বলবেন না । এবং কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিবেন না । যোগীর এমন আচরণকে বলা হয় সত্য ।
সত্যাচরণে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে যোগীর কর্ম উত্তম ফলদায়ী হয় এবং তাঁর অধীন হয়ে যায় । এ সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
“সত্যপ্রতিষ্ঠায়াং ক্রিয়াফলাশ্রয়ত্বম্”।
(যোগ০ -২/৩৬)
অর্থ =  মন বাণী ও শরীর দ্বারা সত্যাচরণে দৃঢ় স্থিতি হলে যোগীর কর্ম এবং ফল একটি সীমা পর্যন্ত তাঁর অধীন হয়ে যায় ।
(iii) অস্তেয়— চুরি করা, অন্যের বস্তুকে অবৈধভাবে নিজের করে নেওয়া ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকে বলা হয় "স্তেয়"। এবং এসব থেকে দূরে থাকাই হলো "অস্তেয়"। এক কথায় সর্বোতভাবে চৌর্যবৃত্তির পরিত্যাগই হলো "অস্তেয়" । অস্তেয় তে দৃঢ় স্থিতি হলে সকল প্রকার উত্তম বস্তু প্রাপ্ত হওয়া যায়।  অস্তেয়র ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
‘অস্তেয়প্রতিষ্ঠায়াং সর্ব্বরত্নোপস্থানম্’।
(যোগ০ -২/৩৭)
অর্থ=  সম্পূর্ণরূপে চৌর্যবৃত্তি ত্যাগ হলে সমস্ত রত্নই প্রাপ্ত হওয়া যায় ।
ব্যাখ্যা - এখানে সর্বরত্ন বলে সকল উত্তম বস্তুকে/ সৌভাগ্যকে বোঝানো হয়েছে । যখন যোগী চুরিকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেন তখন অসৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চিন্তা তাঁর মনে স্থান পায় না ।  তখন তিনি পরিশ্রমী হন এবং পরিশ্রমের ফলে অবশ্যই উত্তম ফল প্রাপ্ত হন ।
কথায় আছে পরিশ্রমই সৌভাগ্যের চাবিকাঠি । এ সম্পর্কে বেদেও বলা হয়েছে "উৎক্রাম মহতে সৌভগায়" (যজু০ ১১|২১) অর্থ= মহান সৌভাগ্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করো ।
(iv) ব্রহ্মচর্য – জননেন্দ্রিয়কে সংযত রাখা,  বীর্যরক্ষা করা,  সকল প্রকারে অশ্লীলতাকে ত্যাগ করা, যেমন- অশ্লীল কর্ম ও অষ্টবিধ মৈথুন না করা, অশ্লীল দৃশ্য না দেখা, অশ্লীল কথা চিন্তা না করা, অশ্লীল বাক্য না বলা । সর্বোপরি কায় মন ও বাক্যে সংযত থাকাকেই ব্রহ্মচর্য বলা হয় ।
মহর্ষি স্বামী শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে ব্রহ্মচর্য পালনের বিধি সম্পর্কে লিখেছেন, “স্ত্রী/পুরুষ দর্শন, স্পর্শন, একান্ত সেবন, সম্ভাষণ, বিষয়ালাপ,পরষ্পর ক্রীড়া, বিষয়ের চিন্তা, এবং সঙ্গ এসব ত্যাগ করা উচিত ।
ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠার ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে-
‘ব্রহ্মচর্য্য প্রতিষ্ঠায়াং বীর্য্যলাভঃ’।
 (যোগ০-২/৩৮)
অর্থ = যখন ব্যক্তি মন, বাণী এবং শরীর দ্বারা ব্রহ্মচর্য পালনে দৃঢ় হয়ে যায় তখন তার বৌদ্ধিক এবং শারীরিক বলের প্রাপ্তি হয় ।
 ব্যাখ্যা- ব্রহ্মচর্যে দৃঢ় প্রতিষ্টা লাভ করলে এমন কোনও  শুভ গুণ থাকে না যেটি যোগী প্রাপ্ত করতে পারেন না । ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে যোগীর শারীরিক, মানসিক এবং বৌদ্ধিক শক্তির বৃদ্ধি হয় যার ফলে তিনি শীঘ্র অধ্যয়ন অধ্যাপন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করেন । তাছাড়া ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে যোগীর দেহ শক্তিশালী হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয় ।
(v) অপরিগ্রহ—বিষয়ের উপার্জন, সংগ্রহ ইত্যাদিতে হিংসা ইত্যাদি দোষ দেখে  নিজের সুখের জন্য প্রয়োজনের অধিক বস্তু, গ্রহণ না করা এবং ধনসম্পদ সঞ্চয়ের জন্য চেষ্টা না করাকে অপরিগ্রহ বলা হয় । যোগসাধনাকালে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিষয় অর্জন করলে দুঃখ, বিষয়ের রক্ষণে দুঃখ, বিষয়ের ক্ষয়ে দুঃখ এবং বিষয়ের গ্রহণেও দুঃখ অবশ্যম্ভাবী । ভোগবিলাসে মেতে থাকলে যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে । এজন্য যোগীর পক্ষে সকল প্রকার ভোগ বিলাস করা উচিত। অপরিগ্রহে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে যোগী নিজের অতীত ও ভবিষ্যৎ জন্ম সম্পর্কে অবগত হন।  যোগদর্শনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,
অপরিগ্রহস্থৈর্য়ে জন্মকথন্তাসম্বোধঃ।।
(যোগ০ —২|৩৯)
অর্থ= যখন যোগী হানিকারক এবং অনাবশ্যক বস্তুকে তথা হানিকারক এবং অনাবশ্যক বিচারকে দৃঢ়তা পূর্বক ত্যাগ করে দেয় তখন তার ভূত,ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান জন্ম সম্বন্ধী জিজ্ঞাসা এবং জ্ঞান হয় ।
ব্যাখ্যা - অপরিগ্রহ পালন করলে যোগীর পূর্ব জন্মের, বর্তমান জন্মের এবং ভবিষ্যৎ জন্মের জিজ্ঞাসা উৎপন্ন হয় । যেমন- আমি কে ? কেমন ছিলাম ? কেমন হব ? এই শরীর কি ? কোথা থেকে উৎপন্ন হয়েছে ? এরকম জিজ্ঞাসা উৎপন্ন হলে সেটির সন্ধান করতে গিয়ে যোগী নিজের ভূত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারেন ।
উল্লেখ্য — পাঁচ প্রকার যম মূলত যোগসাধনার প্রথম ধাপ এবং সংযমের বিধি । এগুলোকে যোগ সাধনার প্রথম ধাপ বলার কারণ হলো, যারা সংযতচিত্ত নয় তারা কখনো যোগসাধনার মার্গে উন্নতি লাভ করতে পারে না বরং অসংযমী ব্যাক্তিরা যোগভ্রষ্ট হয়ে যোগমার্গ থেকে দূরে সরে যায়  ।
২. নিয়ম : -
একজন যোগাভ্যাসী ব্যাক্তির জন্য যা যা অবশ্যই পালনীয় তা হলো নিয়ম । যোগাভ্যাসী ব্যাক্তির জন্য পালনীয় নিয়ম পাঁচটি ।
যথা— শৌচসন্তোষতপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ।
(২/৩২)
অর্থাৎ-শৌচ,সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান এই পাঁচ বিষয়কে একত্রে নিয়ম বলা হয় ।
পাঁচ প্রকার নিয়মের বর্ণনা-
(i) শৌচ — ‘শৌচ’ শব্দের অর্থ শুচিতা বা শুদ্ধি বা পবিত্রতা । এই পবিত্রতা দুই প্রকারের যথা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ । ভালোভাবে স্নান করা ও নিজে পরিচ্ছন্ন থাকা, বাসস্থান পরিচ্ছন্ন রাখা, সাত্ত্বিক আহার করা ইত্যাদির মাধ্যমে বাহ্যিক এবং ও নির্মল বুদ্ধি, সৎ চিন্তা, অহিংসা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্তঃকরণের বা মনের পবিত্রতা লাভ হয় । যোগসাধনার জন্য দেহ ও মন উভয়েরই পবিত্রতা আবশ্যক ।
 শৌচের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে -
'শৌচাৎস্বাঙ্গজুগুপ্সা পরৈরসংসর্গঃ' ।।
(যোগ০— ২|৪০)
অর্থ= বাহ্য এবং আন্তরিক শুদ্ধি হয়ে গেলে নিজের অঙ্গ হতে ঘৃণা উৎপন্ন হয় এবং অন্যের শরীর হতেও আসক্তি রহিত হয়ে যায় ।
(ii) সন্তোষ— সতত প্রসন্নচিত্ত ও সন্তুষ্ট থাকাকেই সন্তোষ বলে । যোগীর পক্ষে প্রাপ্তিতে অতি উল্লসিত কিংবা অপ্রাপ্তিতে ভারাক্রান্ত হওয়া অনুচিত । যোগী ব্যাক্তি সবসময় সন্তুষ্ট, প্রসন্ন ও প্রফুল্ল মনে থেকে সাধনায় মনোনিবেশ করবেন ।
 সন্তোষের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
‘সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ’।।
 (যোগ০ -২/৪২)
অর্থ= পূর্ণ সন্তোষ থেকে উত্তম সুখ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠসুখ লাভ হয়, যে সুখের অপর নাম দিব্যসুখ‌ ।
(iii) তপঃ— ‘তপঃ’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা । যোগসাধনার সময় বিভিন্ন দুঃখ, আঘাত, ক্ষুধা, পিপাসা, দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকার কষ্টকে শান্ত মনে সহ্য করার সাধনাকে বলা হয় তপস্যা বা তপ ।
  তপস্যার ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধিক্ষয়াত্তপসঃ ।।
(যোগ০— ২|৪৩)
অর্থ= তপের অনুষ্ঠান দ্বারা বাত, পিত্ত এবং কফের বিষমতা হতে উৎপন্ন বিকার, তমোগুণ হতে উৎপন্ন আলস্য ইত্যাদি দোষের নাশ হওয়ায় শরীর স্বস্থ্য, বলবান্, স্বচ্ছ এবং স্ফূর্তিমান্ হয়ে যায় তথা ইন্দ্রিয়তে বিশেষ সামর্থ্য উৎপন্ন হয় । যেমন- দূরদৃষ্টি হওয়া, স্পষ্ট দেখতে-শুনতে পাওয়া ইত্যাদির সামর্থ্য বেড়ে যায় ।
(iv) স্বাধ্যায়— 'স্বাধ্যায়’ শব্দের অর্থ অধ্যয়ন ও জপ । প্রণব বা ওঁকারের জপ এবং বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রকে পাঠ করা এবং যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করাকে বলে স্বাধ্যায় । স্বাধ্যায়ের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান লাভ ।  যে জ্ঞানের জ্যোতিতে যোগীর জীবন আলোময় হয়ে উঠে । স্বাধ্যায়ের ফলে অর্জিত জ্ঞান যোগীর আচার আচরণে প্রতিভাত হয়ে উঠে ।  
 স্বাধ্যায়ের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
‘স্বাধ্যায়াদিষ্ট দেবতা সম্প্রযোগঃ’।
 (যোগ০ —২|৪৪)
অর্থ= স্বাধ্যায় সিদ্ধ হলে, ইষ্টদেবতা (ঈশ্বরের) সন্দর্শন হয়ে থাকে ।
ব্যাখ্যা— স্বাধ্যায় অর্থাৎ বেদাদি সত্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করার ফলে ঈশ্বরকেও সম্যকভাবে জানতে পারা যায়। বা ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করা যায় ।
(v) ঈশ্বর প্রণিধান— সতত ঈশ্বরচিন্তা করা, ঈশ্বরে কর্ম ও আত্মসমর্পণ করা, বেদে বর্ণিত ঈশ্বরের আজ্ঞা মনে প্রাণে পালন করা, এবং ঈশ্বরের প্রতি অনন্য ভক্তি ও প্রেমে নিমগ্ন থাকা ইত্যাদিকে ঈশ্বর প্রণিধান বলা হয় ।
 ঈশ্বর প্রণিধানের ফল বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
সমাধিসিদ্ধিরীশ্বরপ্রণিধানাৎ ।।
(যোগ০ —২|৪৫)
অর্থ= ঈশ্বর প্রণিধান দ্বারা শীঘ্রই সমাধিতে সিদ্ধিলাভ হয় ‌।
(৩) আসন: —
যোগদর্শনে আসন সম্পর্কে বলা হয়েছে "স্থিরসুখমাসনম্" ॥
(যোগ০—২/৪৬)
অর্থ = যে অবস্থায় অবস্থিত থাকলে শরীর স্থির এবং সুখযুক্ত হয় তাকেই আসন বলা হয় ।
ব্যাখ্যা = যোগাভ্যাসী যে অবস্থায় বসে সুখের অনুভব করেন তাকেই ‘আসন’ বলা হয় । যে আসনে বসে ব্যাথা অনুভূত হয় এবং ব্যাথার দিকে মন চলে যায় সে আসনে বসে যোগ অনুশীলন করা উচিত নয় ।
আসনের পদ্ধতি সম্বন্ধে গীতায় শ্রীভগবান বলেন,
সমং কায়শিরােগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলােকয়ন৷ (গীতা—৬/১৩)
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ।
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ॥
(গীতা— ৬/১৪)
অর্থ:- মেরুদণ্ড, মস্তক, গ্রীবা সমান ও অচলভাবে ধারণ করে স্থির হয়ে নিজের নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি রেখে অন্য দিকে না তাকিয়ে ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত হয়ে; ভয় ছেড়ে ও প্রশান্ত-চিত্ত যােগী সতর্কতার সাথে মনকে সংযত করে আমাতেই চিত্ত-যুক্ত মৎপরায়ণ হয়ে স্থিত হবে ।
অনুরুপ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও বলা হয়েছে,
যোগ তত্ত্ববিদ জ্ঞানী সাধক নিজের মস্তক গ্রীবা ও বক্ষ । শরীরের এই তিন অংশ সমুন্নত করে শরীরকে সমভাবে স্থাপন করবেন ।
(শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ ২|৮)
আসন নানা প্রকারের রয়েছে, যেমন- সুখাসন, পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন, বৃক্ষাসন, ইতাদি । এতোসব আসন থাকলেও সব আসনে স্থির হওয়া দুঃসাধ্য এবং সবার জন্য অসাধ্য ব্যাপার । তাই যে আসনে যোগী দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে বসতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাঁর জন্য সে আসনই গ্রহণ করা উচিত । এ কারণে সূত্রকার এই সূত্রে কোনো আসনের কথা উল্লেখ না করে শুধু বলেছেন "স্থিরসুখমাসনম্"। অর্থাৎ যে ব্যাক্তি যে আসনে সুখে এবং স্থির হয়ে বসতে পারবেন; সে আসনই তাঁর জন্য উপযুক্ত ।
 যদি কঠিন যোগাসনেও কেউ স্থির হতে পারেন তবে সে আসনও তাঁর জন্য উপযুক্ত হবে ‌।
আসন দুই প্রকারে সিদ্ধ হয় ‌। এ সম্পর্কে যোগ দর্শনে বলা হয়েছে,
প্রযত্নশৈথিল্যান্তসমাপ্তিভ্যাম্ ॥
(যোগ০— ২|৪৭)
অর্থ=  ১. প্রযত্নে শীথিলতা এনে, ও ২. অনন্তে চিত্ত নিবিষ্ট করলে আসনে সিদ্ধিলাভ হয় ।
এখানে‌ ,
 প্রযত্নের শীথিলতা মানে =আসনে বসার পর শরীর সম্বন্ধীয় সকল চেষ্টাকে ত্যাগ করে দেওয়াকে বোঝানো হয়েছে‌ ।
 আর অনন্তে চিত্ত নিবিষ্ট করা = অর্থাৎ ঈশ্বরচিন্তায় তন্ময় হওয়াকে বুঝানো হয়েছে ।
আসনে সিদ্ধিলাভ করলে যোগী যা প্রাপ্ত হন এ সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে ।
ততাে দ্বানভিঘাতঃ || ৪৮ ৷
অর্থ= আসনের সিদ্ধিলাভ হয়ে গেলে শীত-উষ্ণ, ক্ষুধা-পিপাসা ইত্যাদি দ্বন্দ্ব সেই যোগীকে একটি সীমা পর্যন্ত বাধিত করে না ।
ব্যাখ্যা -আসনের সিদ্ধিলাভের ফলে যোগী শীতোষ্ণ, ক্ষুধা-পিপাসায় বাধিত হয় না । তার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে- বরফ দিয়ে তাঁর শরীরকে ঢেকে দিলেও তাঁর কোনও অনুভূতি হয় না অথবা আগুনের মধ্যে তাঁকে বসিয়ে দিলেও তাঁর শরীর জ্বলে না । কিন্তু একটি উচ্চতর গ্রহণ সীমা পর্যন্ত সে দ্বন্দ্ব গুলিকে সহন করতে তিনি সক্ষম হন । যোগীর সহ্যসীমা সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চ হয় । এটা আসন সিদ্ধিলাভেরই ফল ।।
একেকটি আসন অনুশীলনের ফলে শরীরে নানা রকম উপকার সাধিত হয় । এভাবে একেকটি আসনের আছে বহুবিধ উপকারিতা । আসন এবং আসন প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক । প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা আসনের প্রভাবে সুস্থ সবল ও নিরোগ দেহ নিয়ে দীর্ঘ আয়ু ভোগ করতেন । এখনও বিশ্বব্যাপী আসন অনুশীলন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে এবং আসনের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরে আসন অনুশীলনকারীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে বাড়ছে ।
⚠️⚠️ সতর্কতা— কঠিন যোগাসন অনুশীলনের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ শিক্ষক বা গুরুর পরামর্শ গ্রহণ এবং গুরুর সান্নিধ্যে থেকে নিজের দৈহিক সামর্থ্য অনুযায়ী অনুশীলন করা উচিত । নাহলে অবৈজ্ঞানিকভাবে আসন অনুশীলন করলে নানাভাবে অসুস্থ কিংবা আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
(৪) প্রাণায়াম :—
শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে  নিজের আয়ত্তে আনা-কে প্রাণায়াম বলা হয় ।
প্রাণায়াম সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়াের্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ৷৷ (২/৪৯)
অর্থ = আসনের সিদ্ধি লাভ হয়ে গেলে শ্বাস এবং প্রশ্বাসের গতিকে যথাশক্তি নিরুদ্ধ করে দেওয়াকে 'প্রাণায়াম' বলা হয় ।
ব্যাখ্যা—এখানে আসন সিদ্ধির পরে প্রাণায়াম অনুশীলন করার কথা বলা হয়েছে । অর্থাৎ আসন সিদ্ধি না হলে প্রাণায়াম অনুশীলন করা যাবে না ।
প্রাণায়ামের তিনটি ভেদ হল—‘‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তি…. যোগ০ -(২/ ৫০)
অর্থাৎ প্রাণায়াম তিন প্রকারের যথা- বাহ্যবৃত্তি,
আভ্যন্তর বৃত্তি ও স্তম্ভবৃত্তি।
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম সম্পর্কে গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন,
‘‘অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেঽপানং তথাঽপরে।
প্রাণাপানগতী রুদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।। ’’
অর্থ = কেউ অপান বায়ুতে প্রাণ-বায়ুকে আহুতি প্রদান করেন। অপর কেউ প্রাণ ও অপানের গতিকে রোধ করে প্রাণায়াম পরায়ণ হন।
 ব্যাখ্যা— এখানে প্রাণ = শ্বাসবায়ু/ অভ্যন্তরবৃত্তি/ পূরক।
অপান = প্রশ্বাসবায়ু/ বাহ্যবৃত্তি/ রেচক
প্রাণ ও অপানের গতিকে রোধ করা বলতে = স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভককে বলা হয়েছে।
তিন প্রকার প্রাণায়ামের বর্ণনা—
১) অভ্যন্তরবৃত্তি— প্রাণবায়ুকে গ্রহণ করে অভ্যন্তরদেশে যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক আটকে রাখা যায় ততক্ষণ আটকে রাখতে হবে।
এ প্রক্রিয়ায় শ্বাস গ্রহণ করা হয় বলে এর অন্য নাম হয়েছে পূরক।
২) বাহ্যবৃত্তি— মানে প্রাণবায়ুকে বাইরে বের করে যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক দম আটকে রাখা যায় ততক্ষণ আটকে করে রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় শ্বাসকে পরিত্যাগ করা হয় বলে, এর অন্য নাম হলো রেচক।
৩) স্তম্ভবৃত্তি— স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ না করে, অর্থাৎ রেচক-পূরক কিছুই না করে প্রাণবায়ুকে কুম্ভের ভেতরে যেমনি রাখা হয় সেভাবে রুদ্ধ বা স্তম্ভিত করে রাখাকে বলা হয় স্তম্ভবৃত্তি। দেহকে কুম্ভের মতো ব্যাবহার করে বায়ুকে স্তম্ভিত করা হয় বলে ‘স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামের অপর নাম হল‘কুম্ভক’।
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম অনুশীলনের বিধি
‘‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তির্দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ’’।। (২/৫০ সম্পূর্ণ সূত্র)
অর্থাৎ ত্রিবিধ প্রাণায়াম, যথা- বাহ্যবৃত্তি, অভ্যন্তরবৃত্তি, স্তম্ভবৃত্তি দেশ কাল ও সংখ্যা দ্বারা ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয় এবং ক্রমে দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম হয়।
 এখানে দেশ দ্বারা=  শ্বাস গ্রহণ, বর্জন ও স্তম্ভিত করে রাখার সময় প্রাণবায়ু শরীরের ভেতরে বা বাইরে যেখানে অবস্থান করে, সেটিই তার দেশ।  
 কাল দ্বারা = শ্বাস গ্রহণ, ত্যাগ ও স্তম্ভিত করে বায়ুকে যতক্ষণ আটকে রাখা যায় তা হলো কাল।
 সংখ্যা দ্বারা = প্রাণের স্বাভাবিক গতি বা শ্বসনের হারকে বোঝানো হয়েছে। বা যখন  প্রাণকে নিরুদ্ধ করা হয় তত সময়ে স্বাভাবিকভাবে যত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা যেত সেটিকে তার ‘সংখ্যা' বলা হয়।
 পরিলক্ষিত অর্থাৎ দেশ কাল এবং সংখ্যার হিসাব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে করে তিন প্রকার প্রাণায়াম অনুশীলন করা উচিত। যেমন বাহ্য, অভ্যন্তর কিংবা স্তম্ভবৃত্তি অনুশীলনের সময় প্রাণবায়ু কোন দেশে অবস্থান করছে, একে কতক্ষণ সুখপূর্বক আটকে রাখা যাচ্ছে এবং যতক্ষণ আটকে রাখা হয় ততক্ষণ স্বাভাবিকভাবে কতবার শ্বাস নেওয়া যেতো তার হিসাব করা উচিত। প্রাণায়ামকে এভাবে দেশ, কাল এবং সংখ্যা দ্বারা অভ্যাস করলে প্রাণায়ামের সময় বাড়তে থাকে এবং প্রাণায়াম করতে সহজতা অনুভব হয় অর্থাৎ বেশি পরিশ্রম করতে হয় না এবং ক্লান্তিও আসে না । পরবর্তীকালে সমাধি অবস্থায় শ্বাস গ্রহণ বর্জন জনিত উপবিঘ্ন গুলির দ্বারা সমাধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না ।
 উল্লেখ্য— কোনো সুস্থ মানুষের একবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে যে সময় লাগে তাকে মাত্রা বলা হয় । বারো মাত্রাকে এক উদ্ঘাত বলা হয় । চব্বিশ মাত্রাকে দ্বিতীয় উদ্ঘাত বলা হয় । ছত্রিশ মাত্রাকে তৃতীয় উদ্ঘাত বলা হয় । এক উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে মৃদু বলা হয় । দ্বিতীয় উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে মধ্য এবং তৃতীয় উদ্ঘাত যুক্ত প্রাণায়ামকে তীব্র বলা হয় ।
এই তিন প্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও আরেক প্রকারের প্রাণায়ামের কথা যোগদর্শনে বর্ণিত হয়েছে। যাকে চতুর্থ প্রাণায়াম বলা হয়।
যথা —‘‘বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়ক্ষেপী চতুর্থঃ’’ ॥
(যোগ০—২| ৫১)
অর্থ= বাহ্য ও অভ্যন্তরের বিষয় সম্বন্ধীয় চিন্তা ত্যাগের ফলে যা সহজভাবে স্বতঃ সম্পাদিত হয়, তাই হল চতুর্থ প্রাণায়াম।
ব্যাখ্যা— বাহ্য ও অভ্যন্তর বিষয়সমূহের চিন্তা ত্যাগ করে অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধিতে মনযোগ না দিয়ে মনকে গভীরভাবে ইষ্টের চিন্তায় নিমগ্ন রাখলে দেশ, কাল ও সংখ্যার হিসাব ছাড়াই প্রাণের গতি থামিয়ে রাখা যায় ।
চতুর্থ প্রাণায়াম ও ত্রিবিধ প্রাণায়ামের পার্থক্য হলো, চতুর্থ প্রাণায়ামের অবস্থায় মন পূর্ণরূপে স্থিরতা প্রাপ্ত হওয়ার ফলে প্রাণের গতি তথা শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অনায়াসেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু ত্রিবিধ তথা বাহ্য, অভ্যন্তর, ও স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামে অভ্যাস, অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এজন্য আগের ত্রিবিধ প্রাণায়াম থেকে এই চতুর্থ প্রাণায়াম সম্পূর্ণ ভিন্ন ।
 সঠিকভাবে অনুশীলনকৃত প্রাণায়ামের যেমন বহু উপকারী দিক রয়েছে তেমনি ভুল পদ্ধতিতে প্রাণায়াম অনুশীলন করলে কিছু সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয় ।
প্রাণায়ামের ফল বর্ণনায় বিভিন্ন শাস্ত্রের উক্তি,
‘‘ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশবরনম্’’।।
(যোগ০—২|৫২)
অর্থ= ঐসকল প্রাণায়ামের অনুশীলন করলে বিবেক জ্ঞানের আবরণ তথা অজ্ঞানতা ক্ষীণ হয়ে যায়।
 ‘‘ধারণাসু চ যােগ্যতা মনসঃ’’ ।।
(যোগ০ — ২| ৫৩)
অর্থ= প্রাণায়াম করতে থাকলে ধারণা প্রদেশে মনকে দীর্ঘ সময় স্থির করার যােগ্যতা বেড়ে যায় ।
 ব্যাখ্যা— মনকে কোনাে একটি স্থানে স্থির রাখাকে ধারণা বলা হয় । প্রাণায়াম করার ফলে ধারণায় মনকে স্থির করার যোগ্যতা তৈরি হয় ।
‘‘দ্বাবিমৌ বাতৌ বাত অসিন্ধোরা পরাবতঃ।
দক্ষং তে অন্য আবাতু ব্যহন্যো বাতু যদ রপঃ।।’’
- অথর্ববেদ (৪/১৩/১)
অনুবাদঃ প্রাণ বায়ু ও অপান বায়ু দুইই প্রবাহিত হইতাছে৷ অপান বায়ু সমুদ্র সদৃশ গভীর ফুসফুস হইতে আসিতেছে এবং প্রাণবায়ু দূর বায়ুমন্ডল হইতে আসিতেছে। প্রাণবায়ু তোমার জন্য বল সঞ্চয় করিতেছে এবং অপান বায়ু শরীরের রোগ পাপকে শরীর হইতে বাহির করিতেছে।
‘‘ ইহেব শৃণ্ব এষাং কশা হস্তেষু য়দ্বদান্ ।
নি য়ামং চিত্রমৃঞ্জতে’’ ।। (সামবেদ —০১৩৫)  সরলার্থঃ এই প্রাণসমূহের পূরক- কুম্ভক ক্রিয়ারূপ হাতে যে অশ্রুত সূক্ষ্ম বাণীসমূহ ধ্বনিত হয়, সেই শব্দকে যেন এই প্রণাভ্যাসের অতিরিক্ত অবস্থাতেও শুনতে পাচ্ছি । এই প্রাণসমূহ অভ্যাস মার্গে অদ্ভুত রূপে প্রাণায়াণামভ্যাসী যোগীকে যোগৈশ্বর্যসমূহ দ্বারা অলংকৃত করে ।
 আ গন্তা মা রিষণ্যত প্রস্থাবানো মাপ স্থাত সমন্যবঃ।
দৃঢা চিদ্যময়িষ্ণবঃ ।।  (সামবেদ -০৪০১)
সরলার্থঃ পূরক-কুম্ভক-রেচক ইত্যাদিকে নিয়ম বিধি দ্বারা প্রাণায়ামের অভ্যাসকৃত যোগসাধক প্রাণকে সম্বোধিত করছে‌ । হে প্রাণায়ামের জন্য উপস্থিত আমার প্রাণ! তুমি রেচক প্রাণায়াম হতে বাহিরে গিয়ে পূরক প্রাণায়াম দ্বারা পুনঃ ভিতরে এসো, আমাদের স্বাস্থ্যহানি করো না । হে তেজস্বী প্রাণ! শরীরে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ রোগ, মলিনতা ইত্যাদিকে দূর করতে সমর্থ প্রাণ" তুমি শরীর থেকে বাইরে স্থিত হয়ো না, কিন্তু পূরক,কুম্ভক,রেচক আর স্তম্ভবৃত্তির ব্যাপার দ্বারা আমার প্রাণসিদ্ধি করাও । এখানে মূলভাব এমন যে, আমরা যেন প্রাণায়াম থেকে বিরত না হয়ে নিয়মমত এর অভ্যাস দ্বারা প্রকাশের আবরণ ক্ষয় করে ধারণাসমূহতে মনের যোগ্যতা সম্পাদিত করি
⚠️ প্রাণায়াম অনুশীলনে বিশেষ সতর্কতা —
(I) সর্বপ্রথম একজন যোগগুরুর সান্নিধ্যে থেকে প্রাণায়াম শিখে নেওয়া উচিত। নিজে থেকে ভুলভাবে অনুশীলন করতে গেলে বিপদ হতে পারে।
(II) ভরা পেটে বা দুধ পান করে প্রাণায়াম করা উচিত নয় । খালি পেটেই প্রাণায়াম করা উচিত।
(III) দুর্বল শরীরে প্রাণায়াম করা উচিত নয়।
(IV) প্রাণায়াম কমপক্ষে তিনবার এবং অধিক পক্ষে একুশবার করা উচিত ।
(V) প্রাণায়াম করার সময় ও৩ম্ অথবা প্রাণায়াম মন্ত্র অথবা যে সকল মন্ত্রে ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণিত রয়েছে, তার অর্থ সহিত মানসিক জপ পূর্বক প্রাণায়াম করা উচিৎ ।
(VI) যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত নির্মল বায়ুতে প্রাণায়াম করা উচিত।
(VII) একটি প্রাণায়াম দীর্ঘকাল অভ্যাস হয়ে গেলে অন্য প্রাণায়াম তার সাথে করা উচিৎ । অন্যথা একটি প্রাণায়ামই প্রাথমিক অবস্থায় করা উচিৎ ।
(VIII)  প্রাণায়াম অনুশীলনের সময় যতক্ষণ সম্ভব সুখপূর্বক প্রাণবায়ুকে আটকে রাখতে হবে । অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণই ।  কখনোই জোর করে বেশি সময় রেখে অনুশীলন করা উচিত নয় । কারণ  এতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
(৫) প্রত্যাহার :—
ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগত করাই প্রত্যাহার ।
 প্রত্যাহার সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
স্ববিষয়াসম্প্রয়ােগে চিত্তস্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং
প্রত্যাহারঃ ।।
(যোগ০—২/ ৫৪)
অর্থ = নেত্র ইত্যাদি ইন্দ্রিয় নিজের বিষয়ের সাথে সম্বন্ধ না হলে এবং মনের অনুসারী হয়ে যাওয়াকে ‘প্রত্যাহার' বলা হয় ।
ব্যাখ্যা -  সুস্বাদু খাবার খাওয়ার জন্য স্বাদেন্দ্রিয় বা জিহ্বা আকর্ষিত হয় । সুন্দর গান বা কথাবার্তা শুনলে সেটা শুনার জন্য শ্রবণেন্দ্রিয় বা কান আকর্ষিত হয় । সুগন্ধ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয় বা নাক আকর্ষিত হয় । একইভাবে দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয় নিজ নিজ বিষয়ের প্রতি আকর্ষিত হয় । যোগী ব্যাক্তি সাধনকালে ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজ নিজ বিষয়ের আকর্ষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন । যেমন কান যদি গানের দিকে আকৃষ্ট হয়, নাসিকা যদি সুগন্ধের দিকে আকৃষ্ট হয় তখন সেই আকর্ষণকে ত্যাগ করতে হবে । এককথায় এ সময় যোগী ব্যাক্তি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি ইন্দ্রিয়ের অনুগামিতা বিচ্ছিন্ন করে ইন্দ্রিয়সমূহকে মনের কাছে সমর্পণ করবেন । এবং মনকে ধ্যেয়র প্রতি নিবিষ্ট করবেন । এটাই হচ্ছে প্রত্যাহার । এ বিষয়ে একটি সুন্দর উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন,  রানী মৌমাছি উড়তে শুরু করে দিলে সকল মৌমাছি তার সাথে -সাথে উড়তে শুরু করে দেয়। যেখানে রানী মৌমাছি বসে সেখানেই সকল মৌমাছি বসে যায় । একই রকমভাবে সকল ইন্দ্রিয় গুলিও চিত্তের অনুকরণ করে ।
যদি তখন ইন্দ্রিয়সমূহের বাহ্য বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বিচ্ছিন্ন না হয়, যেমন নাসিকা ঘ্রাণের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, কানে গানের শব্দ আসায় সেদিকে মন চলে যাচ্ছে, তখন বুঝতে হবে যে ‘প্রত্যাহার’ সিদ্ধ হয়নি ।  প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভের একটি উত্তম পন্থা বলা যায় এভাবে, যে যখন কোনো শ্রমিক যন্ত্রের শব্দে দূষিত কোনো কারখানায় প্রবেশ করে তখন প্রথম দিকে তার অনেক সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে যন্ত্রের বিকট শব্দের প্রতি তার মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি এমন যে, শ্রবণেন্দ্রিয় সেই শব্দটিকে গ্রহণ করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করার পর মস্তিষ্ক তা অগ্রাহ্য করে।  এখানে লক্ষণীয় যে, যন্ত্রের বিকট শব্দকেও অভ্যাস দ্বারা মস্তিষ্কে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে। এই অগ্রাহ্য করার ফলে শ্রমিক কারখানায় যেমন বিব্রতবোধ করেন না। একইভাবে প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভ হলে যোগী প্রতিকূল অবস্থাতেও যোগসাধনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর জন্য  নিরন্তর অভ্যাস পালন করা উচিত।
 যোগদর্শনে প্রত্যাহারের ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে
ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম ৷৷
(যোগ০ — ২/৫৫)
অর্থ= প্রত্যাহারে দৃঢ় স্থিতি  হয়ে গেলে ইন্দ্রিয়ের সর্বোৎকৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হয় ।
 ব্যাখ্যা- প্রত্যাহারের ফলে ইন্দ্রিয়সমূহ সম্পূর্ণভাবে যোগী ব্যাক্তির অধীন হয়ে যায় । তখন ইন্দ্রিয় জয়ের জন্য পুনরায় কোনো সাধনার প্রয়োজন হয় না । আর ইন্দ্রিয় জয় হলে চিত্তে বিষয়-আসক্তি নষ্ট হয় । এমতাবস্থায় চিত্তকে ধ্যেয়তে নিবিষ্ট করা সহজ হয় ।
শ্রীমদভগবদগীতায়ও  শ্রীভগবান অর্জুনকে বলেন,, -
তানি সর্বানি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ|
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ||
(গীতা —২|৬১)
অর্থ —আত্মপরায়ন মানুষ সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংঘত করে আত্মস্থ হয়ে ইন্দ্রিয়সমূহ বশীভূত করেছেন , তিনিই স্থির বুদ্ধি যুক্ত ৷
তস্মাদ যস্য মহাবাহু নিগৃহীতানি সর্বশঃ|
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ||
 (গীতা —২|৬৮)
হে মহাবাহু! (অর্জুন), যার সমস্ত ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়ের বিষয় সকল থেকে নিগৃহীত হয়েছে, তাঁরই বুদ্ধি স্থির হয়েছে।
 অর্থাৎ যিনি প্রত্যাহারে সিদ্ধিলাভ করেন, সেই জিতেন্দ্রিয় ব্যাক্তির বুদ্ধি স্থির হয়, চঞ্চল মন শান্ত হয়। এবং যার বুদ্ধি স্থির হয়, তিনি যোগমার্গে প্রভূত উন্নতি লাভ করেন।
 প্রত্যাহারের ফলে ইন্দ্রিয়সমূহ সম্পূর্ণভাবে যোগী ব্যাক্তির অধীন হয়ে যাওয়ার কারণে ইন্দ্রিয় জয়ের জন্য পুনরায় কোনো সাধনার প্রয়োজন হয় না ।
 ইন্দ্রিয় জয় হওয়ার কারণে  চিত্তে বিষয়-আসক্তি নষ্ট হয় । এমতাবস্থায় চিত্তকে ধ্যেয়তে নিবিষ্ট করা সহজ হয় ।
এখন পাঁটটি বহিরঙ্গ সাধনার আলোচনা শেষ হলো এবার তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা যথা ধারণা ধ্যান ও সমাধি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
 উল্লেখ্য, তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা পরষ্পর গভীর সম্পর্কযুক্ত। যেমন, সাধক ধারণাতে মনকে ঈশ্বরে বা কোনো দেশে স্থির করেন ।  ধ্যানে সেই দেশ অথবা ঈশ্বর সম্পর্কে গভীর এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবনা চালিয়ে যান, এবং সমাধিতে তিনি ধ্যানের চরম শিখরে আরোহণ করেন।
তিনটি অন্তরঙ্গ সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
৬. ধারণা :—
ধারণা হলো, অদ্বিতীয় লক্ষ্যে বা অভিষ্টে মনকে পূর্ণরূপে স্থির রাখার অভ্যাস ।  ধারণাকে একাগ্রতার সাধনাও বলা হয় ।  ধ্যেয় তথা অভিষ্টতে মনকে একাগ্রতার সাথেই স্থির রাখতে হয় । কারণ একাগ্রতা ছাড়া যোগসাধনাতে সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়।
যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা ।।
(যোগ০—৩/১)
অর্থ=মনকে কোনো দেশ (স্থান) বিশেষে বেধে রাখাকে ‘ধারণা’ বলা হয় ।
ব্যাখ্যা - নাভিচক্র, হৃদপদ্ম নাসিকাগ্র, ভ্রূমধ্য, জিহ্বাগ্র, প্রভৃতি হল শরীরের ভিতরের দেশ এবং পৃথিবীর প্রকৃতি থেকে শুরু করে মহাকাশ, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্ররাজি ইত্যাদি হলো শরীরের বাইরের দেশ । এগুলোর মধ্যে যে বিষয়টি যোগীর অভিষ্ট তিনি শুধুমাত্র তাতেই একাগ্রতার সাথে মনকে স্থির করবেন । যোগী যদি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে ইচ্ছা করেন তবে একমাত্র ব্রহ্মতেই মন স্থির করবেন । সর্বোপরি অদ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তুতে একাগ্রতার সাথে মনকে স্থির করাই হলো ধারণা ।
“বিষয়বতী বা প্রবৃত্তিরুৎপন্না মনসঃ স্থিতিনিবন্ধনী”।।
(যোগ০— ১|৩৫)
অর্থ= গন্ধ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সম্বন্ধ দ্বারা উৎপন্ন অনুভূতি মনের স্থিরতাকে বেধে রাখে।
ব্যাখ্যা— নাসিকার অগ্রভাগে ধারণাকারী সাধকের যে দিব্য গন্ধের অনুভূতি হয় তাকে গন্ধপ্রবৃত্তি বলে, জিহ্বার অগ্রভাগে যে দিব্যরসের অনুভূতি হয় তাকে রসপ্রবৃত্তি বলা হয়। তালুতে যে দিব্যরূপের সাক্ষাৎকার হয় তাঁকে রূপপ্রবৃত্তি বলে।  জিহ্বার মধ্যভাগে যে দিব্য স্পর্শের সাক্ষাৎকার হয় তাকে স্পর্শপ্রবৃত্তি ও জ্বিহ্বামূলে যে দিব্যশব্দের সাক্ষাৎকার হয় তাকে শব্দপ্রবৃত্তি বলা হয়। এসকল প্রবৃত্তির মাধ্যমে মনকে স্থির রাখা হয়।  একইভাবে সূর্য চন্দ্র, প্রদীপ ইত্যাদি কোনো এক বিষয়ে ধারণা করলেও মনকে স্থির করা যায়।
এভাবে মন স্থির করলে তা সমাধির উচ্চ অবস্থায় যেতে সাহায্য করে।
এর পরের সূত্রে বলা হয়েছে,
“বিশোকা বা জ্যোতিষ্মতী”।।
যোগ০— ১|৩৬
অর্থ= শোকরহিত বা প্রকাশযুক্ত প্রবৃত্তি মনের স্থিরতাকে বেধে রাখে।
যোগশাস্ত্রে গ্রাহ্য, গ্রহণ এবং গ্রহীতা ভেদে ত্রিবিধ ধারণার কথা বলা হয়েছে । আবার তত্ত্বজ্ঞানময় ধারণা ও বৈষয়িক ধারণা ভেদে ধারণাকে দ্বিবিধ বলা হয় ।
৭. ধ্যান—
ধারণার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহই ধ্যান ।  যোগদদর্শনে  ধ্যান সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্”।।
(যোগ০ ৩|২)
অর্থ= যে স্থানে ধারণা করা হয়েছে সেই স্থানে জ্ঞেয় বিষয়ক জ্ঞানের এক সমান অবস্থা চলতে থাকাকে ‘ধ্যান’ বলা হয় ।
ব্যাখ্যা - যে প্রদেশে ধারণা করা হয়েছে সেই প্রদেশ সম্বন্ধী জ্ঞানের এক সমান প্রবাহ চলতে থাকা এবং অন্য কোনোও বিষয়ের জ্ঞানকে সেখানে উপস্থিত না করাকে ‘ধ্যান' বলা হয়।
সহজভাবে বলা যায় ধারণায় যে বিষয়ে মনকে স্থির করা হয়েছে ধ্যানে সেই বিষয় নিয়ে ভাবনার প্রবাহকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে । ধ্যেয়র প্রতি ভাবনার ধারাকে নিরন্তর একভাবে চালিয়ে যেতে হবে । তখন শুধুমাত্র ধ্যেয় সম্পর্কেই গভীরভাবে ভাবতে হবে । অন্য কোনো বিষয়ের চিন্তাকে মনে বিন্দুমাত্র স্থান দেওয়া যাবে না ।
পরমতত্ত্বকে উপলব্ধি করার জন্য ধ্যান অত্যন্ত আবশ্যক । ধ্যানশক্তির বলে সাধক যে কোন বিষয় অবলম্বন করে ধ্যান করতে পারেন ।
যোগদর্শনে বলা হয়েছে-
‘যথাভিমতধ্যানাৎ বা।’- (যোগ-১/৩৯)
অর্থাৎ : নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান করো না কেন, তার প্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হবে‌ ।
ধ্যানের লক্ষণ
ধ্যানের লক্ষন সম্পর্কে সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে, ‘‘ধ্যানং নির্বিয়ং মনঃ ’’
সাংখ্যদর্শন ৬/২৫
অর্থ = মন হইতে বিষয় চিন্তা রহিত বা নিরােধ করার নাম ধ্যান। অর্থাৎ একনিষ্ট হয়ে ধ্যেয়র চিন্তার নাম ধ্যান।
ব্রহ্মজিজ্ঞাসু ব্যাক্তির ধ্যেয় একমাত্র ব্রহ্মই হওয়া উচিত। ধ্যানের সময় সকল জাগতিক বিষয় থেকে মুক্ত হয়ে ধ্যেয়র ভাবনায় যুক্ত হওয়া উচিত। ব্যাক্তি যতক্ষণ জাগতিক বিষয়ে মগ্ন থাকে ততক্ষণ সে পরমাত্মা থেকে বিচ্ছন্ন থাকে। এজন্য মনকে জাগতিক বিষয় থেকে মুক্ত করেই ধ্যানে যুক্ত করা উচিত।
ধ্যানের লক্ষণ সম্পর্কে গীতায় শ্রীভগবান বলেন,
‘‘যথা দীপাে নিবাস্থাে নেঙ্গতে সােপমা স্মৃতা।
যােগিননা যতচিত্তস্য যুঞ্জতে যােগমাত্মনঃ ॥’’
(গীতা— ৬/১৯)
অর্থ= যে প্রকার বায়ুপ্রবাহ শূন্য স্থানে প্রদীপ-শিখা বিচলিত হয় না, সেইরূপ উপমা পরমাত্মার ধ্যানে সংযতচিত্ত যােগীর বশীভূত চিত্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য —ধারণা ও ধ্যান পরষ্পর গভীর সম্পর্কযুক্ত । কারণ ধারণায় ইষ্টতে মন স্থির হয় এবং ধ্যানে সেই স্থিরতা অটুট থাকার সাথে সাথে, ইষ্টের অবিচ্ছিন্ন চিন্তায় যোগীর মন তন্ময় থাকে । ধারণায় সিদ্ধিলাভ না হলে ধ্যানে পৌছানো সম্ভব নয়।
(৮) সমাধি—  সম্+আঙ্ পূর্বক নিষ্পন্ন "ধা" ধাতুর সাথে "কিঃ" প্রত্যয় যোগ করে সমাধিঃ শব্দ কে ব্যাসমুনি " যোগ " এর পর্যায় বানিয়েছেন যেটা  "অঙ্গ " এবং " অঙ্গীর " অভেদ সূচক । যোগের পূর্ণতা হলো সমাধি, যা চিত্তের ধর্ম । এই দিকে সমাধির পরিভাষা সম্পর্কে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন যে, নিজের ধ্যানাত্মকরূপ থেকে রহিত কেবল ধ্যেয়রূপ দ্বারা প্রতীত ধ্যানের নামই সমাধি । বিগ্রহরূপেতে "বিগ্ন" এর নিবারণ করে মনকে একাগ্র করার নাম সামধিঃ
‘তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ’- (যোগসূত্র : ৩/৩)
অর্থাৎ : ধ্যান যখন ধ্যেয়ের স্বভাবের আবেশে জ্ঞানাত্মক স্বভাবশূন্য হয় তখন তাকে সমাধি বলা হয়।
ব্যাখ্যা - ধ্যান কালে ‘ধ্যাতা' অর্থাৎ ধ্যানকারী; ‘ধ্যান' অর্থাৎ যে জ্ঞান দ্বারা ধ্যেয় বিষয়ের গবেষণা করা হয় সেই জ্ঞান এবং ‘ধ্যেয়’ অর্থাৎ যে বিষয়ের গবেষণা করা হয় সেই পদার্থ। এই তিনটি ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ভাসিত হয়। কিন্তু সমাধি অবস্থায় কেবল ‘ধোয়'-এর অর্থাৎ পদার্থের স্বরূপ মুখ্য রূপে প্রকাশিত হয়। সমাধি অবস্থায় 'ধ্যাতা’ এবং, ‘ধ্যান গৌণ হয়ে যায় অর্থাৎ আমার দ্বারা ধ্যান করা হচ্ছে এবং ওই পদার্থের জ্ঞান এই দুটি শূন্যের মতাে হয় এবং পদার্থের স্বরূপ মুখ্য রূপে বিদ্যমান থাকে; এই অবস্থাকে সমাধি' বলা হয়। যেমন- কোনাে ছােট্ট শিশুকে মধু চাটালে সে মধুর জ্ঞান এবং আমি মধুকে চাটছি এই দুটি যেমন সে জানতে পারে না কিন্তু মধুর স্বাদেই সে নিমগ্ন হয়ে যায় । সেইরকম সমাধি অবস্থাকে জানা উচিত  ।
সহজভাবে বললে তখন ধ্যান-কর্তা, ধ্যানের বিষয় এবং ধ্যান প্রক্রিয়া এই তিনটি মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে যায় । সমাধির অবস্থায় অবস্থায় ধ্যানকর্তার নিজস্ব কোনাে অনুভূতি থাকে না; বরং ধ্যেয়র সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে.
(I) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (II) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
(I) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি—
সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যকরূপে জ্ঞাত। অর্থাৎ যে সমাধির অবস্থায় নিজ ধ্যেয়কে সম্যকভাবে জানা যায় তাকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে। সম্প্রজ্ঞাত সমাধির বিষয়ে যোগদর্শনে বলা হয়েছে
‘বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ’- (যোগ০—১/১৭)
অর্থ= বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা নামক অবস্থাসমূহের অনুভূতিকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।
1️⃣ স্থূল বাহ্যবস্তু,
যথা- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূত,
2️⃣স্থূল আন্তরবস্তু,
যথা- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়- যথা মুখ, হাত, পা, পায়ু, লিঙ্গ। এবং মন সর্বমোট একাদশ ইন্দ্রিয়।
3️⃣ সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু,
যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহ
4️⃣ সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু,
যথা- অহং ও বুদ্ধি।
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু তথা অবলম্বন ভেদে সম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে চারপ্রকারে ভাগ করা হয়েছে যথা - বিতর্ক, বিচার,আনন্দ ও  অস্মিতা।
এখানে বিতর্ক’-এর অর্থ হল চিত্তের নিজ ধ্যেয় রূপ বিষয়ে স্থুল ভূত পৃথিবী-শরীর-বৃক্ষ ইত্যাদির সাক্ষাৎকার হওয়া।  সম্প্রজ্ঞাত সমাধির প্রথম স্তরে স্থুল বাহ্যবস্তুকে বা কোনো জড় বস্তুকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
বিচার’-এর অর্থ হল চিত্তের নিজ ধেয় রূপ বিষয়ে গন্ধতন্মাত্রা, রসতন্মাত্রা, রূপতন্মাত্রা, সম্পৰ্শতন্মাত্রা এবং শব্দতন্মাত্রা-এর সাক্ষাৎকার হওয়া। এ অবস্থায় স্থুল আন্তরবস্তু বা একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
আনন্দ’-এর অর্থ হল মহৎতত্ত্ব অহংকার,
মন এবং ইন্দ্রিয়তে চিত্ত একাগ্র করলে; এইসব বস্তু সত্ত্বগুণ প্রধান হওয়ায় এগুলিকে
সাক্ষাৎকার করার সময় সুখের (আনন্দের) অনুভূতি হওয়া।  এ অবস্থায় সূক্ষ বাহ্যবস্তুকে যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়।
অস্মিতা'-এর অর্থ হল জীবাত্মার
সাক্ষাৎ কার হওয়া । এই অবস্থায় নিজের অহং ও বুদ্ধিকে অবলম্বন করতে হয়।
উল্লেখ্য —বিতর্ক বিচার আনন্দ ও অস্মিতা এই চারটি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধির একেকটি স্তর যেখানে বিতর্ক হলো প্রথম ও অস্মিতা হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ স্তর।
সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে উৎকর্ষ লাভ করলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়।  সম্প্রজ্ঞাত ও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির মধ্যকার পার্থক্য হলো — সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো অবলম্বনযুক্ত এবং অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো অবলম্বন বিহীন।  যোগী ব্যাক্তি অবলম্বনকে ধরে সমাধি করতে করতে অবলম্বন ছেড়ে দিয়ে অভীষ্টে লীন হন।
(ii) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
শাস্ত্রে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থে বলা হয়েছে—
‘ন কিঞ্চিৎ প্রজ্ঞায়তে ইতি অসম্প্রজ্ঞাতঃ’।
অর্থাৎ : যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে—
‘বিরামপ্রত্যয়াভ্যাসপূর্ব্বঃ সংস্কারশেষোহন্যাঃ’- (যোগ০— ১|১৮)
অর্থ= সকল বৃত্তির নিরােধের যে কারণ পরবরাগ্য সেই পরবৈরাগ্যের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তির দ্বারা যে সমাধি হয় এবং যেখানে কেবল সংস্কারমাত্র অবশিষ্ট থাকে  তাকে ‘অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি' বলা হয়।
ব্যাখ্যা - চিত্তের সকল বৃত্তি অস্ত হয়ে যাওয়ার পর যেখানে সংস্কারমাত্র শেষ থাকে, এরকম অবস্থাকে ‘অসম্প্ৰজ্ঞাত সমাধি' বলা হয়। এই সমাধির কারণ হল
‘পরাবৈরাগ্য। অবলম্বন সহিত অভ্যাস এই সমাধির সাধন হয় না, এই জন্য বৃত্তি নিরোধের যে কারণ পদার্থহীন পরবৈরাগ্য তাকেই সাধন রূপে গ্রহণ করা হয় । যেহেতু পরবৈরাগ্য পদার্থহীন হয়ে থাকে ।
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে এসে জীবাত্মার এবং পরমাত্মার সাক্ষাৎকার হয় । জীবাত্মার সাক্ষাৎকার যদিও সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতেও হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে জীবাত্মার সাক্ষাৎকার আরােও সুস্পষ্ট ভাবে হয় ।
সংস্কারমাত্র শেষ কী ? সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পৌঁছে গেলে নিরােধ অবস্থার সংস্কার বর্তমান থাকে এবং ব্যুত্থান তথা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সংস্কার সুপ্ত রূপে
বিদ্যমান থাকে।  যখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি ভঙ্গ হয়ে যায় তখন সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সংস্কার কার্য করা শুরু করে দেয়। যখন সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ভঙ্গ হয়ে যায় সেই অবস্থায় ব্যুত্থান অর্থাৎ সাংসারিক বৃত্তির সংস্কার প্রকট হয়ে যায়। অতএব এর দ্বারা এটা সিদ্ধ হয়ে যায় যে- সম্প্রত সমাধি হয়ে গেলেও অন্য অবস্থার সংস্কার সুপ্ত রূপে বিদ্যমান থাকে, একেই সংস্কারমাত্র শেষ জানা উচিৎ। প্রসঙ্গত এটাও জানা উচিৎ যে- অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়ে গেলেই মােক্ষ হয়ে যায় না। চিত্তে বিদ্যমান পাঁচটি ক্লেশও দগ্ধবীজ হওয়া অনিবার্য।।
যোগদর্শনে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকেও দুই’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং উপায়প্রত্যয়।
এ বিষয়ে যোগদর্শনে বলা হয়েছে।
‘ভব প্রত্যয়োবিদেহপ্রকৃতিলয়ানাম্’।-
 (যোগ০-১|১৯)
অর্থ= বিদেহ এবং প্রকৃতিলয় নামক যোেগীদের 'ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়।
ব্যাখ্যা- । ‘ভব’ শব্দের অর্থ হল সংসার এবং প্রত্যয়'-এর অর্থ হল কারণ। অর্থাৎ যে
সমাধিতে এই সংসার এবং সংসারের জ্ঞান কারণ হয়ে থাকে সেই সমাধিকে ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। সংসার এবং সংসারের জ্ঞান অর্থাৎ যােগী সংসারের ঘটনা গুলিকে দেখে তাঁর পূর্বজন্মের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে যায়। যার ফলে তাঁৱ বৈরাগ্য চরমে উঠে যায়। এখন তিনি সংসারের সমস্ত পদার্থকে
নাশ মনে করেন এবং এই সমস্ত পদার্থের তা ঈশ্বরকে মনে করে সাধনা করেন। এই ‘ভবপ্রত্যয়' নামক অসম্প্রতি সমাধি দুই প্রকারের যোগীদের হয়ে থাকে -
(১) বিদেহ নামক যােগী—
 বিদেহ নামক যােগীদের ‘ভবপ্রত্যয়’ নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। ‘বিদেহ’-এর অর্থ হল শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধির অভিমান হতে রহিত হওয়া এবং ঈশ্বরকে এই সকল পদার্থের স্বামী মনে করে উপাসনা
করা। এই অবস্থা প্রাপ্তকারী যােগীকে ‘বিদেহ’ যােণী বলা হয়। তিনি নিজের সংস্কারমাত্র অবশিষ্ট চিত্ত দ্বারা সমাধিতে কৈবল্য পদের মত অনুভব করতে-করতে
নিজের সংস্কারের অনুরূপ ফলকে ভােগ করে সমাপ্ত করেন।
(২) প্রকৃতিলয় নামক যােগী। প্রকৃতিলয় নামক যােগীদেরও ‘ভবপ্রত্যয়
নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। প্রকৃতিলয়’-এর অর্থ হল তন্মাত্রা, অহংকার, মহৎ ও এবং প্রকৃতির স্বরূপকে গভীরতা পূর্বক জ্ঞান করে এই পদার্থের দোষকে জেনে; এগুলিকে উপাস্য না মনে করে, ঈশ্বরের উপাসনা করা। এই অবস্থা প্রাপ্তকারী যােগীকে ‘প্রকৃতিলয়’ যোগী বলা হয়। তিনিও বৌদ্ধিক ভাবে অকৃতকৃত্য চিত্তকে
প্রকৃতিতে বিলীন করে সমাধিতে কৈবল্য পদের মত অনুভব করেন। চিত্ত অধিকারের জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি সমাধি অবস্থায় অবস্থিত থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু সমাধি ভঙ্গ হয়ে গেলে সেই অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। পুনরায় যখন সমাপি লাগান তখন তিনি পুনরায় ঈশ্বরের অনুভূতি  লাভ করেন ।
 উপায়প্রত্যয় নামক অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি কিভাবে হয়, এটির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে
“শ্ৰদ্ধাবীর্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্বক ইতরেষাম”
(যোগ০— ১|২০)
অর্থ = বিদেহ এবং প্রকৃতিলয় যােগীদের হতে ভিন্ন যােগীদের অর্থাৎ উপায়প্রত্যয় নামক যােগীদের অসপ্রজ্ঞাত সমাধি শ্রদ্ধা (রুচি), বীর্য (উৎসাহ),
স্মৃতি (যােগ সম্বন্ধী পঠিত এবং এ বিষয়ের সারণ), সমাধি (একাগ্রতা) এবং প্রজ্ঞা (ঋতম্ভবা প্রজ্ঞা) পূর্বক হয়।
ব্যাখ্যা - ‘উপায় শব্দের অর্থ হল অভ্যাস। উপায়প্রত্যয় নামক অসম্প্রপ্জ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত যােগীরা যে সকল সাধনগুলির দ্বারা সমাধিকে প্রাপ্ত করেন সেগুলি হল শ্রদ্ধা অর্থাৎ চিত্তের অভিরুচি অর্থাৎ সত্যকে ধারণ করার তীব্র ইচ্ছা। এই শ্রদ্ধা মায়ের মত কল্যাণকারিণী হয়ে যােগীকে রক্ষা করে। সেই শ্রদ্ধালু বিবেক অভিলাষী যােগীকে বীর্য’ অর্থাৎ বল (উৎসাহ) প্রাপ্ত হয়। এই ধরনের বলযুক্ত যােগীর স্মৃতি উপস্থিত হয়; স্মৃতি অর্থাৎ পূর্বকৃত যােগ সম্বন্ধী অনুভবের স্মৃতি উপস্থিত হয়। স্মৃতি উপস্থিত হলে চঞ্চল চিও 'সমাধি' অর্থাৎ চিও সমাহিত অর্থাৎ একাগ্র হয়ে যায় চিত্ত স্থির হয়ে গেলে যােগীকে ‘প্রজ্ঞা' অর্থাৎ পরম উৎকৃষ্ট বুদ্ধি প্রাপ্ত হয়; যার দ্বারা সেই যােগী বস্তুকে যথার্থভাবে জানতে পারেন। এই বিবেক জ্ঞানের অভ্যাস
এবং এই বিবেক জ্ঞানের বিষয় হতে পরবৈরাগ্য হয়ে গেলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির সিদ্ধিলাভ হয়।
সমাধি সিদ্ধির বর্ণনায় যোগদর্শনে বলা হয়েছে
‘তীব্রসংবেগানামাসন্নঃ।’-
অর্থ উচ্চ বিবেক বৈরাগ্য এবং অভ্যাস যুক্ত যোগীদের শীঘ্রই সমাধি লাভ ও সমাধি ফলের প্রাপ্তি হয়
(যোগ০ —১|২১)
‘মৃদুমধ্যাধিমাত্রত্বাত্ততোহপি বিশেষঃ।’-
 (যোগ০ -১|২২)
অর্থ= উচ্চ বিবেক বৈরাগ্য অভ্যাসকারী যোগীদের মধ্যেও নিম্ন মধ্য ও অধিক ভেদ (পার্থক্য) হওয়ায় অপেক্ষাকৃত যে অধিক বিবেক বৈরাগ্য ও অভ্যাসের অধিকারী তাঁর সমাধি লাভ এবং ফলের প্রাপ্তি সবার আগে হয় ।
 তবে শুধুমাত্র উচ্চ বিবেক, অভ্যাস ও বৈরাগ্য  এসবের উপর নির্ভর করে থাকলেই সমাধির সিদ্ধি দ্রুত হয় না । সমাধিকে সিদ্ধির মার্গে আরও বেগবান করার জন্য মহর্ষি পতঞ্জলি আরো কয়েকটি বিধানের উল্লেখ করেছেন ।
যথা
↘️
‘ঈশ্বর প্রণিধানাৎ বা।’-
(যোগ০ -১|২৩)
অর্থ= ঈশ্বর প্রণিধানের দ্বারা আরও শীঘ্র সমাধি ফলের লাভ হয়ে থাকে।
↘️
‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।’-
‘তজ্জপস্তদর্থ ভাবনম্’
(যোগ০-১|২৭-২৮)
অর্থ= ঈশ্বরের নাম প্রণব বা ও৩ম্ । এই নামের জপ এবং ঈশ্বরের মহান গুণসমূহের চিন্তন করা উচিত ।
 উল্লেখ্য— ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটি যোগাঙ্গ হচ্ছে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন । এ তিন সাধনাকে একত্রে সংযম বলা হয় । যেমন যোগদর্শনে বলা হয়েছে,
‘ত্রয়মেকত্র সংযমঃ’।
 (যোগ০ -৩/৪)
পূর্বোক্ত বহিরঙ্গ সাধনার যম এবং এই সংযমের মধ্যে পার্থক্য হলো,, বহিরঙ্গ সাধনার যম হলো ইন্দ্রিয়জয়ের সাধনা এবং এই সংযম হলো চিত্তস্থৈর্যের এবং কৈবল্য প্রাপ্তির সাধনা । 
এ সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে
 ‘ত্রয়মন্তরঙ্গং পূর্ব্বেভ্যঃ’।
(যোগ০ ৩/৭)
অর্থাৎ পূর্ববর্ণিত সাধনার চেয়ে এই সংযম অন্তরঙ্গ।
‘তদপিবহিরঙ্গং নির্বীজস্য’।
(যোগ০-৩/৮)
অর্থ= সেই অন্তরঙ্গ সাধনা গুলোও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির পক্ষে বহিরঙ্গ সাধনা।
ব্যাখ্যা— ধারণা ধ্যান ও সমাধিকে নির্বীজ বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ক্ষেত্রে বহিরঙ্গ বলা হয়েছে কারণ এ তিনটি সরে গেলেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির সিদ্ধিলাভ হয় ।
সংযমে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে তার সম্পর্কে যোগদর্শনে বলা হয়েছে ।
‘তজ্জয়াৎ প্রজ্ঞালোকঃ’।
 (যোগ০-৩/৫)
অর্থ= সেই সংযমে দৃঢ় স্থিতি লাভ হলে সমাধি প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটে ।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ