দেবী-কল্পনার বিবর্তন
বৃক্ষপ্রতীকে দেবীপূজা: আমরা দেখি যে,– ‘বৃক্ষ প্রতীকে দেবীপূজাও অনার্য গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক কাল থেকেই প্রচলিত ছিলো। বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গ্রামে দেবীরা এখনও বৃক্ষে বসবাস করেন বলেই বিশ্বাস। বিভিন্ন গ্রামের দেবীস্থানগুলি বিশেষ বিশেষ বৃক্ষতলেই অবস্থিত। ঐ সব দেবীস্থানে যে সব গাছকে দেবীজ্ঞানে বা দেবীর আবাস হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়, সেগুলির সর্বদাই যে শাস্ত্রীয় মর্যাদা আছে তাও নয়। মনসা গাছে দেবী মনসার পূজা বাংলার সর্বত্র প্রচলিত। বিল্ববৃক্ষকে দেবীর বাসস্থান হিসাবে শাস্ত্রকাররা উল্লেখ করেছেন। দুর্গা পূজার সময় যে নবপত্রিকা পূজিতা হন, তার মধ্যেও বৃক্ষরূপিনী দেবীর পূজার সুষ্ঠ প্রমাণ আছে।’- (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ দুর্গামাহাত্ম্য ও পূজাপ্রসঙ্গ)
এখানে উল্লেখ্য, নবপত্রিকা বলতে নয়টি গাছকে বোঝানো হয়। একটি সপত্র কলা গাছের সঙ্গে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে, শ্বেত অপরাজিতা লতার দ্বারা বেষ্টন করে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে এই নবপত্রিকা প্রস্তুত করা হয়। দুর্গাপূজায় গণেশের পাশে দেবীমূর্তির ডানদিকে এই নবপত্রিকা স্থাপনের বিধি দুর্গপূজা পদ্ধতিগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। এজন্যেই হয়তো কেউ কেউ ভুল করে নবপত্রিকাকে গণেশের বৌ বলে থাকেন। নবপত্রিকার নয়টি গাছের নাম হলো– কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, সাধারণ কচু, বেল, অশোক ও জয়ন্তী। নব্য স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য রচিত ‘তিথিতত্ত্বে’র একটি শ্লোকে এই নবপত্রিকার পরিচয় দেয়া হয়েছে–
দেবী সনাতনী আদ্যাশক্তি: শাক্ত-তান্ত্রিক ভাবধারার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী, যিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিতা।– ‘শাক্ত পুরাণসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্বয়ং আদ্যাশক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীকস্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এই আদ্যাশক্তি বা শক্তিতত্ত্বের মূল সুপ্রাচীন যুগের মানুষের জীবনচর্যার মধ্যে নিহিত। আদিম চেতনায় নারী শুধুমাত্র উৎপাদনের প্রতীকই নয় সত্যকারের জীবনদায়িনীর ভূমিকাও তারই। সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরগুলিতে তাই এই মাতৃত্বের ভূমিকাই ছিল প্রধান, জীবনদায়িনী মাতৃদেবীই ছিলেন ধর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারীশক্তির সঙ্গে পৃথিবীর, মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার, সমীকরণ সাংখ্য ও তন্ত্রোক্ত প্রকৃতির ধারণার উদ্ভবের হেতু, যা থেকে পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম কৃষিজীবী কৌমসমাজে ধরণীর ফলোৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে নারীজাতির সন্তান-উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি বর্তমান। সংস্পর্শ বা অনুকরণের দ্বারা একের প্রভাব অন্যের উপর সঞ্চারিত করা সম্ভব এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই আদি-তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বতত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতির রহস্য মানবদেহেরই রহস্য, কারণ মানবদেহই বিশ্বপ্রকৃতির সংক্ষিপ্তসার।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্র একই মুদ্রার দুই দিক বলে একটি ধারণা বহুল প্রচলিত। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয় বলেই অনেকে মনে করেন। কেননা, ভারতীয় ধর্মচেতনার বিকাশের প্রভাতকাল থেকেই একটি বিকল্প লোকায়তিক জ্ঞান, কর্ম ও সাধনার ধারা হিসেবে তান্ত্রিক ধারাটি বরাবর বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটির বিকাশ ঋগ্বেদের কিছু অংশে, অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধও এই ধারাটি থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তাঁর দেহাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদের উৎস প্রাচীন তান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার মধ্যে অন্বেষণ করা যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তন্ত্র অত্যন্ত প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ তান্ত্রিক গ্রন্থই মধ্যযুগে রচিত, যেখানে বহু ও বিচিত্র নানা মতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। যার ফলে বহু ক্ষেত্রেই মূল বক্তব্যসমূহ নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে। সে যাই হোক, একটা সময়ে এসে তান্ত্রিক ধারার অনুগামীরা বৌদ্ধমত গ্রহণ করার পরেও নিজেদের প্রাচীন জীবনচচর্চা ও সাধন পদ্ধতিকে বজায় রেখেছিলেন এবং সংঘের মধ্যেই নানা ধরনের গুহ্যসমাজের সৃষ্টি করেছিলেন। এই তন্ত্রসাধকদের প্রভাবেই পরবর্তীকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়।
‘তান্ত্রিক আদর্শসমূহ কিভাবে বৈষ্ণবধর্মকে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ লক্ষ্মীতন্ত্র (নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত) থেকে পাওয়া যায় যেখানে লক্ষ্মী বিষ্ণুর চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং সকল সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। তাঁর যে সাধনার কথা উল্লিখিত হয়েছে তা একান্তভাবেই পঞ্চমকারসহ বামাচারী। আদিতে শ্রী বা লক্ষ্মী এক দেবী ছিলেন না, তাঁদের সমীকরণ ঘটেছে মহাকাব্যদ্বয়ে ও পুরাণসমূহে। মুদ্রা, সীল ও ভাস্কর্যে এই দেবীর মূর্তি পদ্মফুলের উপর উপবিষ্ট অথবা দণ্ডায়মান ভঙ্গীতে দেখা যায়। আর একটি প্রচলিত ভঙ্গীর নাম গজলক্ষ্মী যেখানে দুটি হস্তীর জলসেচনের দ্বারা তাঁকে অভিষিক্ত হতে দেখা যায়। মহাভারতে (৪/৬, ৬/২৩) দুর্গাকে বাসুদেবের ভগিনী এবং নন্দগোপকুলোদ্ভবা বলা হয়েছে। হরিবংশের আর্যাস্তবেও তাঁকে লক্ষ্মী, বলদেবের ভগিনী, নন্দগোপসূতা প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে (যা সচরাচর চণ্ডী নামে পরিচিত) দেবী বৈষ্ণবী শক্তি যোগনিদ্রারূপিণী মহামায়া যাঁর প্রেরণায় বিষ্ণু মধু ও কৈটভকে বধ করেছিলেন। শুম্ভনিশুম্ভ ও মহিষাসুরমর্দিনী দেবী অন্যান্য দেবতাগণ কর্তৃক নারায়ণী হিসাবে স্তুত হয়েছেন। কৃষ্ণবলরামের ভগিনী একানংশা নামে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন। বৃহৎসংহিতায় বরাহমিহির বলেছেন কৃষ্ণবলদেয়োর্মধ্যে একানংশা কার্যা। ভুবনেশ্বরের অনন্তবাসুদেবের মন্দিরস্থ গর্ভগৃহে কৃষ্ণবলরামের মধ্যস্থিত একানংশা মূর্তি আজও বর্তমান। পুরীর জগন্নাথ বলরামের মধ্যবর্তী ইনিই সুভদ্রা। শাক্ত ভাবধারায় পুষ্ট বৈষ্ণবী বা লক্ষ্মীর শক্তি উপাদানটি বৈদান্তিক বৈষ্ণব তাত্ত্বিকেরাও অস্বীকার করেননি। রামানুজের শ্রীবৈষ্ণব ও মধ্ব সম্প্রদায় ব্রহ্ম বা বিষ্ণুর শক্তি হিসাবে লক্ষ্মীর উপাসক ছিলেন। পক্ষান্তরে নিম্বার্ক, বল্লভ ও শ্রীচৈতন্য সম্প্রদায়ের নিকট এই শক্তি রাধা। কৃষ্ণ ও রাধার মিলন, বৌদ্ধ শূন্যতা ও করুণা অথবা প্রজ্ঞা ও উপায়ের মতই পুরুষ ও স্ত্রী আদর্শেই মিলনের প্রতীক। দক্ষিণ ভারতের বৈখানস সম্প্রদায় অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মত ব্রহ্ম, জীবাত্মা ও জড়জগৎ এই ত্রিতত্ত্ব মানলেও সর্বোপরি ব্রহ্মস্বরূপ বিষ্ণুর শক্তি হিসাবে শ্রী বা লক্ষ্মীকে স্থান দেন যিনি ব্রহ্মের বিভূতি বা ঐশ্বর্য, ‘নিত্যানন্দ-মূল-প্রকৃতি’ এবং চেতন ও অচেতন জগতের স্রষ্টা। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্রে বিষ্ণুর দশাবতারের সঙ্গে শাক্ত দশমহাবিদ্যার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
বলা হয়, শাক্ততান্ত্রিক ধারণাসমূহ স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে শৈবধর্মকে অবলম্বন করেছিলো। সাংখ্যোক্ত ও তন্ত্রোক্ত পুরুষ প্রকৃতির ধারণাই শিব ও শক্তির ধারণার উৎস। শৈব ও শাক্তধর্মের মূল তত্ত্বগুলি একই, পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটির ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাধান্য, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে প্রকৃতি প্রাধান্য। এখানে উল্লেখ্য যে– ‘শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের পাকাপাকি সংযোগের সূত্রপাত গুপ্তযুগ থেকে। লেখসমূহ ও সাহিত্য ছাড়াও এই সংযোগের অন্য পরিচয় পাওয়া যায় ভাস্কর্য থেকে। উমা-মহেশ্বর ও কল্যাণসুন্দর মূর্তিসমূহের সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সকল শ্রেণীর শৈবমতেরই মূল কথা চরম সত্তা ব্রহ্ম বা শিব একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। যিনি বিশ্বময় তিনি শক্তি, যিনি বিশ্বাতীত তিনি শিব। শিব ও শক্তি কোন পৃথক সত্তা নয়, শক্তি সর্বদাই শিবের সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তির মত (শিবদৃষ্টি, ৩/৭)। শক্তি শিবের ঐশ্বর্য, হৃদয় এবং সার (ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা ১/৫/১৪)। বিভিন্ন শৈব মতবাদে এই শক্তি মূলত পাঁচ প্রকার– চিৎ, আনন্দ, ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়া। কাশ্মীর শৈববাদে শক্তিকে বলা হয়েছে প্রকাশ-বিমর্শময়। বিমর্শের অনেক অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে স্পন্দনশীল। এই শব্দটি শক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে প্রকাশ শব্দটি শিবের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত। বিমর্শকে চমৎকৃতিও বলা হয়। প্রকাশ ও বিমর্শ একই সত্তার দুই দিক। কিন্তু বিমর্শ হচ্ছে প্রকাশের আত্মসচেতনতার দিক। একজন ব্যক্তির উদাহরণ দিয়ে বলা যায় প্রকাশ হচ্ছে গুণাবলী এবং বিমর্শ হচ্ছে সেই গুণাবলীর বিষয়ে ওই ব্যক্তির সচেতনতা। বিশ্বজগৎ চরম সত্তার সঙ্গে অভিন্ন সম্পর্কেই বর্তমান যে চরম সত্তা একই সঙ্গে স্থাণু ও গতিশীল, বিদ্যমান ও রূপান্তরী (প্রত্যভিজ্ঞাহৃদয় ৪, মহার্থমঞ্জরী ১৪)। গতিশীল দিকটিই হচ্ছে শক্তি, যিনি নিজের থেকেই নিজেকে বিশ্বজগৎরূপে ব্যক্ত করেন, বটের বীজ থেকে যেমন বটবৃক্ষের উন্মেষ হয় (‘বটধানিকাবৎ’)। সৃষ্টি যেমন তাঁর উন্মেষ, প্রলয় তেমনই তাঁর নিমেষ, যা চলছে পর্যায়ক্রমে (স্পন্দনির্ণয় ১/১)।- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
বীরশৈব মতে শক্তির প্রাধান্য এতো বেশি যে, এই মতকে দার্শনিকেরা শক্তিবিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলে বর্ণনা করেছেন। এখানে শক্তিকে শিবের বিমর্শ শক্তি হিসেবেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে–
‘ব্রহ্ম বা পরাশিব অনন্ত অস্তিত্ব, চৈতন্য ও আনন্দের অধিকারী এবং তিনি যে এই সকল বিষয়ে সচেতন তার কারণ তাঁর বিমর্শ শক্তি। শিবের সচেতন প্রকৃতি হচ্ছে তাঁর অপরিবর্তনীয়ত্ব এবং অব্যক্ততা, রত্নের মতই তিনি স্বয়ংপ্রভ, কিন্তু রত্ন যেমন নিজের থেকে সে বিষয়ে সচেতন নয়, বিমর্শশক্তি ব্যতিরেকে তিনিও এই বিষয়ে সচেতন নন। বিমর্শ এই কারণেই তাঁর সামরস্য বা তাদাত্ম্য সম্পর্কে বিদ্যমান, যেমন উত্তাপ এবং আলোক যথাক্রমে অগ্নি ও সূর্যের সম্পর্কে বিদ্যমান। একথা বলে আপত্তি তোলা যেতে পারে যে এই রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি ও শক্তের (শক্তির অধিকারী) মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ থাকা সম্ভব। এর উত্তরে বীরশৈবরা বলেন যে অগ্নির উত্তাপ বা সূর্যের আলোর ক্ষেত্রে বস্তুর প্রকৃতি থেকে গুণের বিভিন্নতা নেই, এখানে গুণ ও বস্তুর পৃথকীকরণ হয় না, যেহেতু উভয়ের সম্পর্ক অভেদাত্মক। এই কারণেই শক্তিকে বলা হয় ব্রহ্মনিষ্ঠা সনাতনী (সিদ্ধান্তশিখামণি ৫/৩৯)। শক্তি শিবের অন্তর্নিহিত, তাঁর আত্মসচেতনকারী বিমর্শশক্তি। শক্তির বিমর্শতাই তাঁর বিশিষ্টত্ব যার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় বলেই বীরশৈব মতবাদকে শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
দুর্গা, কালী ও করালী : শক্তিপূজায় দেবীর যে দুটি নাম– দুর্গা ও কালী– প্রধান স্থান অধিকার করে, এর মধ্যে দুর্গা বা দুর্গি নামের প্রথম উল্লেখ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সংশ্লিষ্ট গায়ত্রীটি ইতঃপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার এই তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম খণ্ডের দ্বিতীয় অনুবাকে দুর্গার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ–
অন্নপূর্ণা শাকম্ভরী : ইতঃপূর্বে মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে দেবীর যে রূপের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি তা তাঁর উগ্ররূপ। পাশাপাশি দেবীর একটি সৌম্যরূপ আছে। সৌম্য রূপের দেবীদের মধ্যে আমরা পৃথিবী-দেবী, শ্রী, শাকম্ভরী, পার্বতী-উমা, সতী প্রভৃতিকে গণ্য করতে পারি। বেদে পৃথিবী-দেবীর উল্লেখ রয়েছে আমরা জানি। এই পৃথিবী-দেবী থেকেই সীতা, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী প্রভৃতি শস্যদেবীরা উদ্ভূতা হয়েছেন। আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি, বৈদিক সাহিত্যে (ঋক-৪/৫৭/৭) সীতা ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিতা শস্যদেবী। পুরাণসমূহে পৃথিবী শ্রী ও লক্ষ্মীর অপর নাম, এবং তাঁকে বরাহরূপী বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের বিষ্ণুমূর্তিগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রী ও ভূ এই দুই দেবীকে দু’পাশে দেখা যায়। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে পৃথিবীই জগদ্ধাত্রী (পৃথিব্যহং জগদ্ধাত্রী মদ্রূপং মৃন্ময়ন্ত্বিদম্’- কালিকাপুরাণ- ৩৮, ৬৩)। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী দেবী শাকম্ভরী অনাবৃষ্টির সময়ে আত্মদেহসমুদ্ভূত শাকাদির দ্বারা জগৎ প্রতিপালন করেন।–
পার্বতী ও কৌশিকী : চণ্ডিকা বা অম্বিকা, কখনও কখনও ইনি কৌশিকী নামেও পরিচিতা, মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশের নায়িকা, বহু দেবীকে আত্মসাৎ করে গড়ে উঠেছেন। পার্বতীর কৃষ্ণবর্ণ কোষ থেকে উদ্ভূত বলে তাঁর নাম কৌশিকী। গবেষকদের মতে আসলে ইনি কুশ বা কুশিক উপজাতির দেবী। তাঁর অপরাপর নাম একানংশা, বিন্ধ্যবাসিনী ও রাত্রি। এই কৃষ্ণবর্ণ কোষ থেকে উদ্ভবের কাহিনীটি নানারূপে পল্লবিত। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে, কৌশিকীরূপে পার্বতীর দেহ থেকে নিঃসৃতা দেবীই কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে কালী বা কালিকা হয়েছেন। সবচেয়ে পল্লবিত কাহিনীটি পাওয়া যায় পদ্মপুরাণে (সৃষ্টিখণ্ড-৪৩-৪৪), যেখানে বলা হয়েছে, সতী যখন পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করার জন্য মেনকার জঠরে ছিলেন তখন ব্রহ্মা একটি গূঢ় উদ্দেশ্যে রাত্রি দেবীকে অনুরোধ করেন যেন তিনি নিজ সত্তা দিয়ে মাতৃগর্ভেই দেবীকে কৃষ্ণবর্ণ করে দেন। এই কৃষ্ণবর্ণা পার্বতীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। পরে একদিন শিব তাঁর গাত্রবর্ণ নিয়ে বক্রোক্তি করলে, দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং ব্রহ্মার বরে তিনি কৃষ্ণবর্ণ ত্যাগ করে গৌরী হন। দেবীর কৃষ্ণবর্ণ ত্বক থেকে কৌশিকী দেবী উৎপন্ন হলেন, যিনি চণ্ডিকা, একানংশা, বিন্ধ্যবাসিনী ও রাত্রি নামেও পরিচিতা।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, ইন্দ্রাদি দেবগণ শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য পার্বতীর কাছে প্রার্থনা জানালে পার্বতীর শরীরকোষ থেকে কৌশিকী দেবী নিঃসৃতা হলেন। কৌশিকী তাঁর দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেলে পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গেলেন এবং এইজন্য তিনি হিমালয়বাসিনী কালিকা নামে আখ্যাতা হলেন। আবার দেবীমাহাত্ম্যের অন্যত্র কালীর উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরগণ দেবীর নিকটবর্তী হলে তাঁর ভ্রূকুটি-কুটিল ললাটফলক থেকে অসিপাশধারিণী করালবদনা কালী বিনিষ্ক্রান্তা হলেন এবং চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করে চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হলেন। পরবর্তীকালে পুরাণ, উপপুরাণ এবং তন্ত্রে এই দেবীর রীতিমতো বিস্তার ও বিবর্তন হয়েছে, শিবের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি ঘটেছে এবং তন্ত্রশাস্ত্রের তিনি প্রধান ও পরমতত্ত্ব হয়ে উঠেছেন। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে,– ‘সকল কালী মূর্তিতেই দেবী শিবের বক্ষোপরি দণ্ডায়মান। এই মূর্তি তিনটি বিষয়বস্তুর প্রতীক। প্রথমটি হচ্ছে, তন্ত্রোক্ত এবং সাংখ্যোক্ত প্রকৃতি-পুরুষতত্ত্ব যেখানে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিই ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র চালিকাশক্তি। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, উদাসীন ও অক্ষম; দ্বিতীয়টি হচ্ছে তন্ত্রের বিপরীতবিহারতত্ত্ব (মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্); তৃতীয়টি হচ্ছে, শক্তিদেবীর প্রাধান্য।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
দক্ষ-তনয়া সতী : কৌশিকী বা কালীপ্রসঙ্গে দেখা গেলো কিভাবে এক দেবীর সঙ্গে অপর দেবীর সমীকরণ হয়। আসলে কৃষিভিত্তিক বাঙলা তথা ভারতবর্ষের সর্বত্রই অসংখ্য বিভিন্ন মর্যাদার স্থানীয় মাতৃকাদেবী ছিলেন এবং আজও আছেন। বিশ্বনিয়ন্ত্রিকা শক্তিরূপিণী মহাদেবীর একত্বের ধারণা বিকাশলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান প্রধান আঞ্চলিক দেবীদের সঙ্গে ওই মহাদেবীর সমীকরণের প্রয়োজন দেখা দিলে ওই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানা পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণা করা হয়। দক্ষযজ্ঞের কাহিনী এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এই কাহিনী অনুযায়ী, পতিনিন্দা শ্রবণে সতীর দেহত্যাগের পর শিব উন্মত্তপ্রায় হয়ে সতীর মৃতদেহ কাঁধে করে পৃথিবী ভ্রমণ করতে থাকলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডীকৃত করেন। যে সকল স্থানে ওই দেহাংশগুলি পড়ে, সেই সকল স্থানে শাক্তপীঠ গড়ে ওঠে, যেখানে দেবীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিভূ হিসেবে কোন অমূর্ত প্রতীক ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত থাকে। শিবলিঙ্গ এখানে ভৈরবের প্রতীক। শিব ভৈরব-রূপ ধারণ করে বিভিন্ন পীঠে সতীর দেহাংশ রক্ষা করেন বলে প্রকাশ। আসলে বিভিন্ন পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা ছিলেন আঞ্চলিক দেবী। শাক্ত মহাদেবীর সঙ্গে তাঁদের সমীকরণ করার জন্যই দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, তাঁর দেহের খণ্ডীকরণ এবং খণ্ডিত অংশগুলির পতনস্থলে শাক্ত পীঠস্থান গড়ে ওঠার কাহিনী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিবরণ অনুযায়ী–
‘মহাভারতের বনপর্বস্থ তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে দেবীর দুই প্রত্যঙ্গ যোনি ও স্তনের সঙ্গে তিনটি শাক্ত পীঠের পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়। যোনিকুণ্ডদ্বয়ের একটি পঞ্চনদের বাহিরে ভীমাস্থানে এবং অপরটি উদ্যতপর্বত নামক গিরিশিখরে অবস্থিত। স্তনকুণ্ড গৌরীশিখর নামক পর্বতশৃঙ্গের উপরে অবস্থিত ছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ প্রাচীন গন্ধার প্রদেশে ভীমাস্থানের অবস্থিতি উল্লেখ করেছেন যেখানে ভীমাদেবীর গাঢ় নীলবর্ণের প্রস্তরের এক প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। শাক্ত পীঠসমূহের প্রথাগত সংখ্যা ৫১ হলেও, বিভিন্ন উপপীঠ সহ পীঠের সংখ্যা প্রচুর। এছাড়া বিভিন্ন পুরাণে দেবীর ১০৮ নাম ও রূপ এবং তাঁদের অবস্থান ক্ষেত্রের কথা উল্লিখিত হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে ললিতাসহস্রনাম অধ্যায়ে দেবীর সহস্র নাম ও রূপভেদের পরিচয় আছে।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
‘মাতৃকাদেবীরা ছিলেন গোড়ায় স্থানীয় দেবী, মূলত মাতৃত্ব ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার প্রতীক। প্রাচীন মাতৃকা মূর্তিগুলি পোড়ামাটির নির্মিত। পরবর্তীকালে তাঁর প্রস্তর নির্মিত মূর্তিও হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমষ্টিগতভাবে সপ্ত বা অষ্ট মাতৃকা মূর্তি মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ করা হত। কোন কোন স্থানে তাঁদের মাতৃকা হিসেবে চেনাবার জন্য ক্রোড়ে শিশু দেখানো হয়েছে। মহাভারতের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে সাতজন মাতৃকা স্কন্দকে লালন-পালন করেছিলেন। উত্তরকালে মাতৃকাগণ বিভিন্ন দেবতার শক্তি হিসাবে কল্পিতা হয়েছেন যেমন ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বারাহী, ইন্দ্রাণী ও চামুণ্ডী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশে মাতৃকাদের সংখ্যা সাত থেকে বেড়ে ন’য়ে দাঁয়িয়েছে, ওই তালিকার সঙ্গে শিবদূতী ও নারসিংহী যুক্ত হয়েছে। কালক্রমে কোন কোন মাতৃকার সঙ্গে খোদ শাক্ত মহাদেবীর সমীকরণ হয়েছে।’– (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
বলার অপেক্ষা রাখে না, মানবসভ্যতায় দেবীপূজার ইতিহাসও অতি প্রাচীন। পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগুলির মধ্যেও প্রাচীন কালে দেবীপূজার প্রচলন ছিলো। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, ভূমধ্যসাগরের তীরে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে মাতৃদেবীর পূজার সর্বব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে সব প্রত্ন-উপাদান পাওয়া গেছে, তা থেকে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, প্রাক্-আর্যযুগে ভারতবর্ষে মাতৃদেবীর পূজার ব্যাপক প্রসার ছিলো। মূর্তিতে মাতৃপূজা কেবল মাত্র সিন্ধুযুগেই প্রচলিত ছিলো না, কৃষ্ণসাগরের তীরে এবং দানিয়ুব উপত্যকাতেও একইভাবে মূর্তির মাধ্যমে মাতৃদেবীর পূজা হতো।
অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে,– ‘পণ্ডিতদের মতে হিন্দুদের শক্তি উপাসনা এসেছে অনার্যদের কাছ থেকে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে শক্তি বা মাতৃকা উপাসনা প্রস্তর যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। ইয়োরোপে সুপ্রাচীন যুগে (Palaeolithic and Neolithic ages) ভেনাসের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দুইটি সন্তান ও স্বামী সহ মাতৃকামূর্তির আবিষ্কারও ঐযুগে শক্তিপূজার প্রমাণ দেয়। সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেষ্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রীট্ ও মিশরে মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। মার্শাল সাহেবের মতে নীলনদ থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ মাতৃকা পূজার ক্ষেত্র ছিল।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৬০)
শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থের নিবেদনে বলেছেন– ‘মাতৃপূজার প্রচলন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কালে নানারূপে দেখা যায়, এখনও হয়ত স্থানে স্থানে কিছু কিছু অবশেষ রহিয়া গিয়াছে; কিন্তু ইহার কোথাওই ভারতবর্ষের অনুরূপ শক্তিবাদ বা শক্তিসাধনা গড়িয়া উঠিতে দেখি না। শক্তিবাদ এমন করিয়া আমাদের ভারতীয় চিন্তাধারার একটি বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক বলিয়া এবং আমাদের জীবনের উপর এমন করিয়াই ইহার একটি সামগ্রিক প্রভাব বলিয়া ইহা বিশেষ করিয়া আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’… ‘শাক্ত ধর্মমত ও সাধনা নানাভাবে এখনও ভারতবর্ষের প্রায় সব অঞ্চলেই অল্পবিস্তর দেখা যায় বটে, কিন্তু যেটুকু তথ্য আমার অধিগত হইয়াছে তাহাতে মনে হইয়াছে, এই সাধনা বাঙলাদেশে যেরূপ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, এমন অন্যত্র কোথাও নহে; এবং প্রকারে ও পরিমাণে বাঙলাদেশে যে শাক্ত সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাও অন্যত্র কোথাও পাওয়া যায় না।’
অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে,– ‘পণ্ডিতদের মতে হিন্দুদের শক্তি উপাসনা এসেছে অনার্যদের কাছ থেকে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে শক্তি বা মাতৃকা উপাসনা প্রস্তর যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। ইয়োরোপে সুপ্রাচীন যুগে (Palaeolithic and Neolithic ages) ভেনাসের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দুইটি সন্তান ও স্বামী সহ মাতৃকামূর্তির আবিষ্কারও ঐযুগে শক্তিপূজার প্রমাণ দেয়। সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেষ্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রীট্ ও মিশরে মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। মার্শাল সাহেবের মতে নীলনদ থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ মাতৃকা পূজার ক্ষেত্র ছিল।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৬০)
শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থের নিবেদনে বলেছেন– ‘মাতৃপূজার প্রচলন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কালে নানারূপে দেখা যায়, এখনও হয়ত স্থানে স্থানে কিছু কিছু অবশেষ রহিয়া গিয়াছে; কিন্তু ইহার কোথাওই ভারতবর্ষের অনুরূপ শক্তিবাদ বা শক্তিসাধনা গড়িয়া উঠিতে দেখি না। শক্তিবাদ এমন করিয়া আমাদের ভারতীয় চিন্তাধারার একটি বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক বলিয়া এবং আমাদের জীবনের উপর এমন করিয়াই ইহার একটি সামগ্রিক প্রভাব বলিয়া ইহা বিশেষ করিয়া আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’… ‘শাক্ত ধর্মমত ও সাধনা নানাভাবে এখনও ভারতবর্ষের প্রায় সব অঞ্চলেই অল্পবিস্তর দেখা যায় বটে, কিন্তু যেটুকু তথ্য আমার অধিগত হইয়াছে তাহাতে মনে হইয়াছে, এই সাধনা বাঙলাদেশে যেরূপ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, এমন অন্যত্র কোথাও নহে; এবং প্রকারে ও পরিমাণে বাঙলাদেশে যে শাক্ত সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাও অন্যত্র কোথাও পাওয়া যায় না।’
বিঃদ্রঃ-বেদের রূঢ় অর্থের কারনে নানা মত,পন্থ,ঠাকুরের উৎপত্তি
ঋগ্বেদের দেবী সূক্ত মন্ডল ১০ সূক্ত ১২৫
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোমা।।১।।
সরলার্থঃ আমি দুষ্টের দমকারী এবং পৃথিবী আদি সমস্ত লোকের সাথে বাপ্য। আমি ১২ মাস এবং সমস্ত তেজোময় পদার্থের সাথে ব্যাপ্য। দিন এবং রাত্রী উভয় কে আমিই ধারণ করি। সূর্য ও অগ্নি, দ্যুলোক ও পৃথিবীলোক উভয় কেও আমিই ধারণ করি।।১।।
অহম সোমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পুষণং ভগম্।
অহং দধামি দ্রবণং হবিষ্মতে সুপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বতে।।২।।
সরলার্থঃ আমি সব দুষ্ট কে নাশকারী শাসক কে ধারণ করি। আমি কান্তিমান সূর্য কে এবং সর্বপোষক ভূমি কে এবং সমস্ত ঐশ্বর্য্য কে ধারণ করি। আমি অন্নাদি হবিষ্য পদার্থ সম্পন্ন দানশীল যজ্ঞকর্তা এবং সুখ পূর্বক উত্তম রীতি দ্বারা সবাইকে রক্ষাকারী উপসনাশীল, ঐশ্বর্য্যযুক্ত শাসক কে ধন প্রদান করি।। ২।।
অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসুনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যবেশ্যন্তীম্।।৩।।
সরলার্থঃ আমি রাষ্ট্রের স্বামিনী। আমি নানা ঐশ্বর্য্য কে প্রাপ্ত করানোকারী, যজ্ঞ দ্বারা উপাস্য, সব থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানবতী। সেই আমাকেই বহু প্রকার দ্বারা বিদ্যমান এবং বহু তত্ব বা শক্তির প্রদানকারী আমাকেই বিদ্বান জন বিবিধ প্রকার দ্বারা প্রতিপাদন করেন।
ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ই শৃণোত্যুক্তম্।
অমন্তবো মাং ত উপ ক্ষিয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রুদ্ধিবং তে বদামি।। ৪।।
সরলার্থঃ আমার দ্বারা অনুমোদিত তিনি ভোজন করেন, যিনি বিশিষ্টরূপে দেখেন, যিনি প্রাণ ধারণ করেন, যিনি উক্ত শ্রবন করেন। আমাকে অমান্যকারী তিনি নাশ প্রাপ্ত হয়, তোমাকে শ্রদ্ধাযুক্ত সত্যবচন বলছি - হে বিশ্রুদ্ধ শ্রবন করো ৪।।
অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ।
যং কাময়ে তংমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমৃষি তং সুমেধাম্।।৫।।
সরলার্থঃ আমিই ইহা স্বয়ম উপদেশ করি যাকে বিদ্বান এবং মননশীল জন প্রেমপূর্বক শ্রবন এবং মনন করে। আমি যাকে ইচ্ছা করি তাকে তাকে বলবান করি তাকে চতুর্বেদবিত্ করি তাকে ঋষি এবং তাকে উত্তম মেধাযুক্ত করি।। ৫।।
অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আ বিবেশ।।৬।।
সরলার্থঃ আমি ব্রাহ্মণ, বেদের হিংসক শত্রুবর্গকে নাশের জন্য দুষ্টের রোদনকারী ধনু কে বিস্তার করি। আমি মনুষ্যের উপকারের জন্য সংগ্রাম করি, আমি আকাশ এবং ভূমি উভয়ের মধ্যে ব্যাপ্য।।৬।।
অহং সুবে পিতরমস্য মূর্ধন্মম যোনিরপ্স্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বি তিষ্ঠে ভূবনানু বিশ্বোতামূ দ্যাং বর্ষ্মণোপ স্পৃশামি।। ৭।।
সরলার্থঃ আমি এই সংসারের সবার উপরে এই জগতের পালক সূর্যকে উৎপন্ন করি। জলের মধ্যে তথা সমুদ্রের প্রতিটি পরমাণুতে আমার নিবাস ।সেই আমিই সমস্ত লোক কে বিশেষ রুপ দ্বারা ব্যাপিয়া আছি। এবং আমি সুখপ্রদ রূপ দ্বারা এই মহান আকাশ বা সূর্য্য কে প্রাপ্ত হই।
অহমেব বাত ইব প্র বাম্যারভমাণা ভূবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতাবতী মহিনা সম্বভূব।।৮।।
সরলার্থঃ আমিই বায়ুর ন্যায় প্রগতি করি। আমি সমস্ত ভূবন কে নির্মাণ করি, দ্যুলোক থেকে পরেও এই পৃথিবী থেকে পরেও আমার মহানত্ব এতটাই হয়।।৮।।
বৃক্ষপ্রতীকে দেবীপূজা: আমরা দেখি যে,– ‘বৃক্ষ প্রতীকে দেবীপূজাও অনার্য গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক কাল থেকেই প্রচলিত ছিলো। বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গ্রামে দেবীরা এখনও বৃক্ষে বসবাস করেন বলেই বিশ্বাস। বিভিন্ন গ্রামের দেবীস্থানগুলি বিশেষ বিশেষ বৃক্ষতলেই অবস্থিত। ঐ সব দেবীস্থানে যে সব গাছকে দেবীজ্ঞানে বা দেবীর আবাস হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়, সেগুলির সর্বদাই যে শাস্ত্রীয় মর্যাদা আছে তাও নয়। মনসা গাছে দেবী মনসার পূজা বাংলার সর্বত্র প্রচলিত। বিল্ববৃক্ষকে দেবীর বাসস্থান হিসাবে শাস্ত্রকাররা উল্লেখ করেছেন। দুর্গা পূজার সময় যে নবপত্রিকা পূজিতা হন, তার মধ্যেও বৃক্ষরূপিনী দেবীর পূজার সুষ্ঠ প্রমাণ আছে।’- (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ দুর্গামাহাত্ম্য ও পূজাপ্রসঙ্গ)
এখানে উল্লেখ্য, নবপত্রিকা বলতে নয়টি গাছকে বোঝানো হয়। একটি সপত্র কলা গাছের সঙ্গে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে, শ্বেত অপরাজিতা লতার দ্বারা বেষ্টন করে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে এই নবপত্রিকা প্রস্তুত করা হয়। দুর্গাপূজায় গণেশের পাশে দেবীমূর্তির ডানদিকে এই নবপত্রিকা স্থাপনের বিধি দুর্গপূজা পদ্ধতিগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। এজন্যেই হয়তো কেউ কেউ ভুল করে নবপত্রিকাকে গণেশের বৌ বলে থাকেন। নবপত্রিকার নয়টি গাছের নাম হলো– কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, সাধারণ কচু, বেল, অশোক ও জয়ন্তী। নব্য স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য রচিত ‘তিথিতত্ত্বে’র একটি শ্লোকে এই নবপত্রিকার পরিচয় দেয়া হয়েছে–
‘কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ।
বিল্বাশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা।।’
তবে নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে পূজিতা হন– উদ্ভিদগুলি দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে গণ্য হয়। এই নয় দেবী হলেন– রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা ও জয়ন্তাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী। নয়টি উদ্ভিদের একত্র অবস্থান নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিতা হয়। নবপত্রিকা সম্পর্কে পণ্ডিতেরা প্রায় সমস্বরে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে নবপত্রিকা শস্যদেবীর পূজা। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী–
‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে।…বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
শবর প্রভৃতি জাতির মধ্যে প্রচলিত শস্যোৎসব থেকে দুর্গাপূজার এই অঙ্গটি আসতে পারে বলে যোগেশচন্দ্র রায় মহাশয় অনুমান করেন– ‘বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে। মানুষের স্বভাব- যেটা কোথাও হয়, সেটা অন্যত্র প্রচারিত হয়।’- (পূজাপার্বণ)
শক্তিসাধনার দেবীসংক্রান্ত আলোচনায় বিভিন্ন বিদ্বান পণ্ডিতেরা প্রসঙ্গক্রমে এই নবপত্রিকার বিষয়টিকে তাঁদের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনা প্রসঙ্গে ড. অতুল সুর তাঁর ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ গ্রন্থে বলেছেন–
‘বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, মানুষ ও প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, ‘টোটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূতপ্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা-জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই প্রাক্-আর্য ধর্ম গঠিত ছিল। কালের গতিতে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি ক্রমশ আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। এই সকল সংস্কারই ক্রমশ হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক কিছু পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান যেমন– দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁদুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় ও পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও গৃহীত হয়েছিল আটকৌড়ে, সুবচনীপূজা, শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠীপূজা, বিবাহে পাত্রহরিদ্রা, পানখিলি, গুটিখেলা, স্ত্রী-আচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মীপূজার সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন ইত্যাদি আচার যা বর্তমান কালেও বাঙালী হিন্দু পালন করে থাকে। এসবই প্রাক্-আর্য সংস্কৃতির দান। এ ছাড়া নানারূপ গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা, ধ্বজাপূজা, বৃক্ষের পূজা, যাত্রাজাতীয় পর্বাদি, যেমন– স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, মনসা, শীতলা, জাঙ্গুলি, পর্ণশবরী, প্রভৃতির পূজা ও অম্বুবাচী অরন্ধন, পৌষপার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক্-আর্য-জাতিসমূহের কাছ থেকে গৃহীত।’- (বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন)
‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে।…বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
শবর প্রভৃতি জাতির মধ্যে প্রচলিত শস্যোৎসব থেকে দুর্গাপূজার এই অঙ্গটি আসতে পারে বলে যোগেশচন্দ্র রায় মহাশয় অনুমান করেন– ‘বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে। মানুষের স্বভাব- যেটা কোথাও হয়, সেটা অন্যত্র প্রচারিত হয়।’- (পূজাপার্বণ)
শক্তিসাধনার দেবীসংক্রান্ত আলোচনায় বিভিন্ন বিদ্বান পণ্ডিতেরা প্রসঙ্গক্রমে এই নবপত্রিকার বিষয়টিকে তাঁদের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন বাংলার ধর্মসাধনা প্রসঙ্গে ড. অতুল সুর তাঁর ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ গ্রন্থে বলেছেন–
‘বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, মানুষ ও প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, ‘টোটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূতপ্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা-জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই প্রাক্-আর্য ধর্ম গঠিত ছিল। কালের গতিতে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি ক্রমশ আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। এই সকল সংস্কারই ক্রমশ হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক কিছু পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান যেমন– দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁদুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় ও পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও গৃহীত হয়েছিল আটকৌড়ে, সুবচনীপূজা, শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠীপূজা, বিবাহে পাত্রহরিদ্রা, পানখিলি, গুটিখেলা, স্ত্রী-আচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মীপূজার সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন ইত্যাদি আচার যা বর্তমান কালেও বাঙালী হিন্দু পালন করে থাকে। এসবই প্রাক্-আর্য সংস্কৃতির দান। এ ছাড়া নানারূপ গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা, ধ্বজাপূজা, বৃক্ষের পূজা, যাত্রাজাতীয় পর্বাদি, যেমন– স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, মনসা, শীতলা, জাঙ্গুলি, পর্ণশবরী, প্রভৃতির পূজা ও অম্বুবাচী অরন্ধন, পৌষপার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক্-আর্য-জাতিসমূহের কাছ থেকে গৃহীত।’- (বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন)
দেবী সনাতনী আদ্যাশক্তি: শাক্ত-তান্ত্রিক ভাবধারার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী, যিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিতা।– ‘শাক্ত পুরাণসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্বয়ং আদ্যাশক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীকস্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এই আদ্যাশক্তি বা শক্তিতত্ত্বের মূল সুপ্রাচীন যুগের মানুষের জীবনচর্যার মধ্যে নিহিত। আদিম চেতনায় নারী শুধুমাত্র উৎপাদনের প্রতীকই নয় সত্যকারের জীবনদায়িনীর ভূমিকাও তারই। সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরগুলিতে তাই এই মাতৃত্বের ভূমিকাই ছিল প্রধান, জীবনদায়িনী মাতৃদেবীই ছিলেন ধর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারীশক্তির সঙ্গে পৃথিবীর, মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার, সমীকরণ সাংখ্য ও তন্ত্রোক্ত প্রকৃতির ধারণার উদ্ভবের হেতু, যা থেকে পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম কৃষিজীবী কৌমসমাজে ধরণীর ফলোৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে নারীজাতির সন্তান-উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি বর্তমান। সংস্পর্শ বা অনুকরণের দ্বারা একের প্রভাব অন্যের উপর সঞ্চারিত করা সম্ভব এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই আদি-তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বতত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতির রহস্য মানবদেহেরই রহস্য, কারণ মানবদেহই বিশ্বপ্রকৃতির সংক্ষিপ্তসার।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্র একই মুদ্রার দুই দিক বলে একটি ধারণা বহুল প্রচলিত। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয় বলেই অনেকে মনে করেন। কেননা, ভারতীয় ধর্মচেতনার বিকাশের প্রভাতকাল থেকেই একটি বিকল্প লোকায়তিক জ্ঞান, কর্ম ও সাধনার ধারা হিসেবে তান্ত্রিক ধারাটি বরাবর বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটির বিকাশ ঋগ্বেদের কিছু অংশে, অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধও এই ধারাটি থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তাঁর দেহাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদের উৎস প্রাচীন তান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার মধ্যে অন্বেষণ করা যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তন্ত্র অত্যন্ত প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ তান্ত্রিক গ্রন্থই মধ্যযুগে রচিত, যেখানে বহু ও বিচিত্র নানা মতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। যার ফলে বহু ক্ষেত্রেই মূল বক্তব্যসমূহ নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে। সে যাই হোক, একটা সময়ে এসে তান্ত্রিক ধারার অনুগামীরা বৌদ্ধমত গ্রহণ করার পরেও নিজেদের প্রাচীন জীবনচচর্চা ও সাধন পদ্ধতিকে বজায় রেখেছিলেন এবং সংঘের মধ্যেই নানা ধরনের গুহ্যসমাজের সৃষ্টি করেছিলেন। এই তন্ত্রসাধকদের প্রভাবেই পরবর্তীকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়।
‘তান্ত্রিক আদর্শসমূহ কিভাবে বৈষ্ণবধর্মকে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ লক্ষ্মীতন্ত্র (নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত) থেকে পাওয়া যায় যেখানে লক্ষ্মী বিষ্ণুর চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং সকল সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। তাঁর যে সাধনার কথা উল্লিখিত হয়েছে তা একান্তভাবেই পঞ্চমকারসহ বামাচারী। আদিতে শ্রী বা লক্ষ্মী এক দেবী ছিলেন না, তাঁদের সমীকরণ ঘটেছে মহাকাব্যদ্বয়ে ও পুরাণসমূহে। মুদ্রা, সীল ও ভাস্কর্যে এই দেবীর মূর্তি পদ্মফুলের উপর উপবিষ্ট অথবা দণ্ডায়মান ভঙ্গীতে দেখা যায়। আর একটি প্রচলিত ভঙ্গীর নাম গজলক্ষ্মী যেখানে দুটি হস্তীর জলসেচনের দ্বারা তাঁকে অভিষিক্ত হতে দেখা যায়। মহাভারতে (৪/৬, ৬/২৩) দুর্গাকে বাসুদেবের ভগিনী এবং নন্দগোপকুলোদ্ভবা বলা হয়েছে। হরিবংশের আর্যাস্তবেও তাঁকে লক্ষ্মী, বলদেবের ভগিনী, নন্দগোপসূতা প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে (যা সচরাচর চণ্ডী নামে পরিচিত) দেবী বৈষ্ণবী শক্তি যোগনিদ্রারূপিণী মহামায়া যাঁর প্রেরণায় বিষ্ণু মধু ও কৈটভকে বধ করেছিলেন। শুম্ভনিশুম্ভ ও মহিষাসুরমর্দিনী দেবী অন্যান্য দেবতাগণ কর্তৃক নারায়ণী হিসাবে স্তুত হয়েছেন। কৃষ্ণবলরামের ভগিনী একানংশা নামে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন। বৃহৎসংহিতায় বরাহমিহির বলেছেন কৃষ্ণবলদেয়োর্মধ্যে একানংশা কার্যা। ভুবনেশ্বরের অনন্তবাসুদেবের মন্দিরস্থ গর্ভগৃহে কৃষ্ণবলরামের মধ্যস্থিত একানংশা মূর্তি আজও বর্তমান। পুরীর জগন্নাথ বলরামের মধ্যবর্তী ইনিই সুভদ্রা। শাক্ত ভাবধারায় পুষ্ট বৈষ্ণবী বা লক্ষ্মীর শক্তি উপাদানটি বৈদান্তিক বৈষ্ণব তাত্ত্বিকেরাও অস্বীকার করেননি। রামানুজের শ্রীবৈষ্ণব ও মধ্ব সম্প্রদায় ব্রহ্ম বা বিষ্ণুর শক্তি হিসাবে লক্ষ্মীর উপাসক ছিলেন। পক্ষান্তরে নিম্বার্ক, বল্লভ ও শ্রীচৈতন্য সম্প্রদায়ের নিকট এই শক্তি রাধা। কৃষ্ণ ও রাধার মিলন, বৌদ্ধ শূন্যতা ও করুণা অথবা প্রজ্ঞা ও উপায়ের মতই পুরুষ ও স্ত্রী আদর্শেই মিলনের প্রতীক। দক্ষিণ ভারতের বৈখানস সম্প্রদায় অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মত ব্রহ্ম, জীবাত্মা ও জড়জগৎ এই ত্রিতত্ত্ব মানলেও সর্বোপরি ব্রহ্মস্বরূপ বিষ্ণুর শক্তি হিসাবে শ্রী বা লক্ষ্মীকে স্থান দেন যিনি ব্রহ্মের বিভূতি বা ঐশ্বর্য, ‘নিত্যানন্দ-মূল-প্রকৃতি’ এবং চেতন ও অচেতন জগতের স্রষ্টা। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্রে বিষ্ণুর দশাবতারের সঙ্গে শাক্ত দশমহাবিদ্যার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
বলা হয়, শাক্ততান্ত্রিক ধারণাসমূহ স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে শৈবধর্মকে অবলম্বন করেছিলো। সাংখ্যোক্ত ও তন্ত্রোক্ত পুরুষ প্রকৃতির ধারণাই শিব ও শক্তির ধারণার উৎস। শৈব ও শাক্তধর্মের মূল তত্ত্বগুলি একই, পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটির ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাধান্য, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে প্রকৃতি প্রাধান্য। এখানে উল্লেখ্য যে– ‘শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের পাকাপাকি সংযোগের সূত্রপাত গুপ্তযুগ থেকে। লেখসমূহ ও সাহিত্য ছাড়াও এই সংযোগের অন্য পরিচয় পাওয়া যায় ভাস্কর্য থেকে। উমা-মহেশ্বর ও কল্যাণসুন্দর মূর্তিসমূহের সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সকল শ্রেণীর শৈবমতেরই মূল কথা চরম সত্তা ব্রহ্ম বা শিব একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। যিনি বিশ্বময় তিনি শক্তি, যিনি বিশ্বাতীত তিনি শিব। শিব ও শক্তি কোন পৃথক সত্তা নয়, শক্তি সর্বদাই শিবের সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তির মত (শিবদৃষ্টি, ৩/৭)। শক্তি শিবের ঐশ্বর্য, হৃদয় এবং সার (ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা ১/৫/১৪)। বিভিন্ন শৈব মতবাদে এই শক্তি মূলত পাঁচ প্রকার– চিৎ, আনন্দ, ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়া। কাশ্মীর শৈববাদে শক্তিকে বলা হয়েছে প্রকাশ-বিমর্শময়। বিমর্শের অনেক অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে স্পন্দনশীল। এই শব্দটি শক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে প্রকাশ শব্দটি শিবের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত। বিমর্শকে চমৎকৃতিও বলা হয়। প্রকাশ ও বিমর্শ একই সত্তার দুই দিক। কিন্তু বিমর্শ হচ্ছে প্রকাশের আত্মসচেতনতার দিক। একজন ব্যক্তির উদাহরণ দিয়ে বলা যায় প্রকাশ হচ্ছে গুণাবলী এবং বিমর্শ হচ্ছে সেই গুণাবলীর বিষয়ে ওই ব্যক্তির সচেতনতা। বিশ্বজগৎ চরম সত্তার সঙ্গে অভিন্ন সম্পর্কেই বর্তমান যে চরম সত্তা একই সঙ্গে স্থাণু ও গতিশীল, বিদ্যমান ও রূপান্তরী (প্রত্যভিজ্ঞাহৃদয় ৪, মহার্থমঞ্জরী ১৪)। গতিশীল দিকটিই হচ্ছে শক্তি, যিনি নিজের থেকেই নিজেকে বিশ্বজগৎরূপে ব্যক্ত করেন, বটের বীজ থেকে যেমন বটবৃক্ষের উন্মেষ হয় (‘বটধানিকাবৎ’)। সৃষ্টি যেমন তাঁর উন্মেষ, প্রলয় তেমনই তাঁর নিমেষ, যা চলছে পর্যায়ক্রমে (স্পন্দনির্ণয় ১/১)।- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
বীরশৈব মতে শক্তির প্রাধান্য এতো বেশি যে, এই মতকে দার্শনিকেরা শক্তিবিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলে বর্ণনা করেছেন। এখানে শক্তিকে শিবের বিমর্শ শক্তি হিসেবেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে–
‘ব্রহ্ম বা পরাশিব অনন্ত অস্তিত্ব, চৈতন্য ও আনন্দের অধিকারী এবং তিনি যে এই সকল বিষয়ে সচেতন তার কারণ তাঁর বিমর্শ শক্তি। শিবের সচেতন প্রকৃতি হচ্ছে তাঁর অপরিবর্তনীয়ত্ব এবং অব্যক্ততা, রত্নের মতই তিনি স্বয়ংপ্রভ, কিন্তু রত্ন যেমন নিজের থেকে সে বিষয়ে সচেতন নয়, বিমর্শশক্তি ব্যতিরেকে তিনিও এই বিষয়ে সচেতন নন। বিমর্শ এই কারণেই তাঁর সামরস্য বা তাদাত্ম্য সম্পর্কে বিদ্যমান, যেমন উত্তাপ এবং আলোক যথাক্রমে অগ্নি ও সূর্যের সম্পর্কে বিদ্যমান। একথা বলে আপত্তি তোলা যেতে পারে যে এই রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি ও শক্তের (শক্তির অধিকারী) মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ থাকা সম্ভব। এর উত্তরে বীরশৈবরা বলেন যে অগ্নির উত্তাপ বা সূর্যের আলোর ক্ষেত্রে বস্তুর প্রকৃতি থেকে গুণের বিভিন্নতা নেই, এখানে গুণ ও বস্তুর পৃথকীকরণ হয় না, যেহেতু উভয়ের সম্পর্ক অভেদাত্মক। এই কারণেই শক্তিকে বলা হয় ব্রহ্মনিষ্ঠা সনাতনী (সিদ্ধান্তশিখামণি ৫/৩৯)। শক্তি শিবের অন্তর্নিহিত, তাঁর আত্মসচেতনকারী বিমর্শশক্তি। শক্তির বিমর্শতাই তাঁর বিশিষ্টত্ব যার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় বলেই বীরশৈব মতবাদকে শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
কোন মানব-সমাজে প্রচলিত ঐতিহ্য ও কৃষ্টির মধ্যে ধর্ম ও সংস্কৃতির যে অবিচ্ছেদ্য বয়ন, তা অস্বীকার না-করেও এটুকু অন্তত বলা চলে যে, আজকের যে কুলপ্লাবী মহানদী– তার অভিমুখী উৎসেও রয়ে গেছে শত-সহস্র সূক্ষ্ম জলধারার স্বতন্ত্র স্পন্দন আর বিচিত্র কলতানের সম্মিলিত গুঞ্জন। যে ধারাটি বা ধারাগুলি মুখ্য তা-ই হয়তো নির্ধারণ করে দেয় পরবর্তী বৃহত্তর স্রোতস্বীর আগাম অভিমুখ। কিন্তু নদীর স্বভাব আর ধর্ম বা সংস্কৃতির স্বভাব কি এক? শ্রীদাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের উপক্রমণিকার শুরুতেই বলছেন–
‘একটি বিশেষ-জাতীয় দৃঢ়বদ্ধ বিশ্বাসকে অবলম্বন করিয়া বহু দিন ধরিয়া একটি জাতির মধ্যে যখন একটি ধর্মমত গড়িয়া উঠিতে থাকে তখন বিশ্লেষণ করিলেই দেখিতে পাওয়া যাইবে, একটি-দুইটি থাকে মুখ্য ধারা,– তাহার সহিত বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন উৎস হইতে নানা ধারা আসিয়া তাহাকে পরিপুষ্ট করিয়া তোলে। ধর্মমতের ক্রমাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেবলই চলিতে থাকে সমন্বয় ও স্বীকরণ; ফলে বহু দিন পরে কোনও একটি ক্ষণে দাঁড়াইয়া আমরা যখন বিচার-বিশ্লেষণ করিতে বসি, তখন কোনটি যে মূলধারা, আর কোনগুলি যে উপধারা তাহা স্পষ্ট চেনা শক্ত হইয়া ওঠে। ভারতবর্ষের শাক্তধর্ম ও শাক্তসাহিত্যের সম্বন্ধেও সেই কথা বলা চলে। আমাদের শাক্তসাহিত্যের মধ্যে উমাকে পাই, তিনিই পার্বতী গিরিজা; আমরা দক্ষকন্যা সতীকে পাই– তিনিই আবার দশমহাবিদ্যা-রূপে রূপান্তরিতা; একান্ন মহাপীঠে আবার তাঁহার একান্ন দেহাংশ অবলম্বনে একান্ন দেবী; আমরা অসুরনাশিনী চণ্ডীকে পাই, তিনিই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, অভয়দায়িনী অভয়া, মঙ্গলকারিণী সর্বমঙ্গলা; আর পাই আমরা কালিকা বা কালী-দেবীকে– শাক্ত সাধকগণের তিনিই প্রধানভাবে আরাধ্যা। ইহা ব্যতীত পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে একই মূল দেবীর সহিত অভিন্নরূপে দেবীর আরও অনেক রূপভেদ আছে, শাক্ত-ধর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে তাঁহাদের উল্লেখ রহিয়াছে। ইঁহাদের সঙ্গে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী প্রভৃতি আঞ্চলিক দেবীগণের কথাও স্মরণ রাখিতে হইবে, কারণ সুবিধামতন ইঁহারাও মূল দেবীর সঙ্গে অভিন্না। বিদ্যারূপিণী সরস্বতী ও শ্রী– ও সম্পদ্-রূপিণী লক্ষ্মীর কথাও ভুলিলে চলিবে না। জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী প্রভৃতি দেবী সহজেই মূলদেবীর রূপভেদ বলিয়া গৃহীতা। সাহিত্যে অনুল্লিখিত বহু দেবীর পূজাও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে।’… ‘এই-সকল দেবীসম্বন্ধে আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে ইঁহারা বহু নহেন, স্থান-কাল-পাত্রানুসারে আকৃতিতে ও প্রকৃতিতে পৃথক্ পৃথক্ রূপে বহু হইয়া দেখা দিলেও ইঁহারা মূলতঃ এক; দ্বিতীয়রহিত এই সনাতনী মহাদেবী হইতে সকল দেবী প্রসৃতা,– মূলে কোথাও কোনও ভেদ নাই।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
সাধারণজনের মধ্যে এই ঐক্যবুদ্ধির একটা অস্পষ্ট ধারণা বহমান থাকলেও বলা অসঙ্গত হবে না যে, এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেখাটা বস্তুত উচ্চকোটির দার্শনিক ও সাধকেরই অনুভববেদ্য অথবা বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্বদৃষ্টি। তাই দাশগুপ্ত বলেন–
‘দার্শনিক দৃষ্টির ঝোঁক সর্বদা একের দিকে; বহুকে দেখিয়া-শুনিয়া বাছ-বিছার করিয়া মূলতত্ত্বের আবিষ্কার এবং সেই মূল একতত্ত্বের মধ্যেই বহুর সার্থকতা ব্যাখ্যা– ইহাই দার্শনিকের মূল কাজ। সাধক ত আরও অদ্বয়বাদী; সমস্ত সৃষ্টির মূলে এক সত্য ব্যতীত দুই সত্যকে তিনি ত কখনও বিশ্বাসই করেন না। তাহা ছাড়া তাঁহার উপলব্ধিতে সত্য কালাতীত তত্ত্ব; দেশে কালে তাহার অনন্ত বৈচিত্র্যে প্রকাশ মাত্র। সুতরাং সাধক বাহিরে দেবীকে যে রূপেই গ্রহণ করুন না কেন, অন্তরে তাঁহার এক অদ্বিতীয়া সনাতনী।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
যেমন, শ্রীশ্রীচণ্ডী’র প্রথম অধ্যায়ের নিম্নোক্ত শ্লোকসমূহে (চণ্ডী ১/৬৩-৮২) দেখি–
‘একটি বিশেষ-জাতীয় দৃঢ়বদ্ধ বিশ্বাসকে অবলম্বন করিয়া বহু দিন ধরিয়া একটি জাতির মধ্যে যখন একটি ধর্মমত গড়িয়া উঠিতে থাকে তখন বিশ্লেষণ করিলেই দেখিতে পাওয়া যাইবে, একটি-দুইটি থাকে মুখ্য ধারা,– তাহার সহিত বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন উৎস হইতে নানা ধারা আসিয়া তাহাকে পরিপুষ্ট করিয়া তোলে। ধর্মমতের ক্রমাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেবলই চলিতে থাকে সমন্বয় ও স্বীকরণ; ফলে বহু দিন পরে কোনও একটি ক্ষণে দাঁড়াইয়া আমরা যখন বিচার-বিশ্লেষণ করিতে বসি, তখন কোনটি যে মূলধারা, আর কোনগুলি যে উপধারা তাহা স্পষ্ট চেনা শক্ত হইয়া ওঠে। ভারতবর্ষের শাক্তধর্ম ও শাক্তসাহিত্যের সম্বন্ধেও সেই কথা বলা চলে। আমাদের শাক্তসাহিত্যের মধ্যে উমাকে পাই, তিনিই পার্বতী গিরিজা; আমরা দক্ষকন্যা সতীকে পাই– তিনিই আবার দশমহাবিদ্যা-রূপে রূপান্তরিতা; একান্ন মহাপীঠে আবার তাঁহার একান্ন দেহাংশ অবলম্বনে একান্ন দেবী; আমরা অসুরনাশিনী চণ্ডীকে পাই, তিনিই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, অভয়দায়িনী অভয়া, মঙ্গলকারিণী সর্বমঙ্গলা; আর পাই আমরা কালিকা বা কালী-দেবীকে– শাক্ত সাধকগণের তিনিই প্রধানভাবে আরাধ্যা। ইহা ব্যতীত পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে একই মূল দেবীর সহিত অভিন্নরূপে দেবীর আরও অনেক রূপভেদ আছে, শাক্ত-ধর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে তাঁহাদের উল্লেখ রহিয়াছে। ইঁহাদের সঙ্গে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী প্রভৃতি আঞ্চলিক দেবীগণের কথাও স্মরণ রাখিতে হইবে, কারণ সুবিধামতন ইঁহারাও মূল দেবীর সঙ্গে অভিন্না। বিদ্যারূপিণী সরস্বতী ও শ্রী– ও সম্পদ্-রূপিণী লক্ষ্মীর কথাও ভুলিলে চলিবে না। জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, বাসন্তী প্রভৃতি দেবী সহজেই মূলদেবীর রূপভেদ বলিয়া গৃহীতা। সাহিত্যে অনুল্লিখিত বহু দেবীর পূজাও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে।’… ‘এই-সকল দেবীসম্বন্ধে আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে ইঁহারা বহু নহেন, স্থান-কাল-পাত্রানুসারে আকৃতিতে ও প্রকৃতিতে পৃথক্ পৃথক্ রূপে বহু হইয়া দেখা দিলেও ইঁহারা মূলতঃ এক; দ্বিতীয়রহিত এই সনাতনী মহাদেবী হইতে সকল দেবী প্রসৃতা,– মূলে কোথাও কোনও ভেদ নাই।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
সাধারণজনের মধ্যে এই ঐক্যবুদ্ধির একটা অস্পষ্ট ধারণা বহমান থাকলেও বলা অসঙ্গত হবে না যে, এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেখাটা বস্তুত উচ্চকোটির দার্শনিক ও সাধকেরই অনুভববেদ্য অথবা বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্বদৃষ্টি। তাই দাশগুপ্ত বলেন–
‘দার্শনিক দৃষ্টির ঝোঁক সর্বদা একের দিকে; বহুকে দেখিয়া-শুনিয়া বাছ-বিছার করিয়া মূলতত্ত্বের আবিষ্কার এবং সেই মূল একতত্ত্বের মধ্যেই বহুর সার্থকতা ব্যাখ্যা– ইহাই দার্শনিকের মূল কাজ। সাধক ত আরও অদ্বয়বাদী; সমস্ত সৃষ্টির মূলে এক সত্য ব্যতীত দুই সত্যকে তিনি ত কখনও বিশ্বাসই করেন না। তাহা ছাড়া তাঁহার উপলব্ধিতে সত্য কালাতীত তত্ত্ব; দেশে কালে তাহার অনন্ত বৈচিত্র্যে প্রকাশ মাত্র। সুতরাং সাধক বাহিরে দেবীকে যে রূপেই গ্রহণ করুন না কেন, অন্তরে তাঁহার এক অদ্বিতীয়া সনাতনী।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
যেমন, শ্রীশ্রীচণ্ডী’র প্রথম অধ্যায়ের নিম্নোক্ত শ্লোকসমূহে (চণ্ডী ১/৬৩-৮২) দেখি–
ঋষিরুবাচ। ৬৩
নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্ । ৬৪
তথাপি তৎ সমুৎপত্তির্বহুধা শ্রূয়তাং মম।
দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভবতি সা যদা। ৬৫
উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যভিধীয়তে।।
যোগনিদ্রাং যদা বিষ্ণুর্জগত্যেকার্ণবীকৃতে। ৬৬
আস্তীর্য শেষমভজং কল্পান্তে ভগবান্ প্রভুঃ।।
তদা দ্বাবসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধুকৈটভৌ। ৬৭
বিষ্ণুকর্ণমলোম্ভূতৌ হন্তুং ব্রহ্মাণমুদ্যতৌ।।
স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতো ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ। ৬৮
দৃষ্ট্বা তাবসুরৌ চোগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্ ।।
তুষ্টাব যোগনিদ্রাং তামেকাগ্রহৃদয়স্থিতঃ। ৬৯
বিবোধনার্থায় হরের্হরিনেত্রকৃতালয়াম্ ।।
(ওঁ ঐঁ) বিশ্বেশ্বরীং জগদ্ধাত্রীং স্থিতিসংহারকারিণীম্ ।। ৭০
নিদ্রাং ভগবতীং বিষ্ণোরতুলাং তেজসঃ প্রভুঃ। ৭১
ব্রহ্মোবাচ। ৭২
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা। ৭৩
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ। ৭৪
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।।
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ। ৭৫
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে। ৭৬
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে।।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ। ৭৭
মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।।
প্রকৃতিস্ত্বং হি সর্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী। ৭৮
কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা।।
ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা। ৭৯
লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্ত্বং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ।।
খড়্গিনী শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা। ৮০
শঙ্খিনী চাপিনী বাণভুসণ্ডীপরিঘায়ুধা।।
সৌম্যাসৌম্যতরাশেষসৌম্যেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী। ৮১
পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।।
যচ্চ কিঞ্চিৎ ক্বচিদ্বস্তু সদসদ্ বাখিলাত্মিকে। ৮২
তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বং কিং স্তূয়সে ময়া।।
অর্থাৎ :
মেধা ঋষি বলিলেন– সেই মহামায়া নিত্যা (জন্মমৃত্যুরহিতা); আবার এই জগৎপ্রপঞ্চই তাঁহার বিরাট মূর্তি। তিনি সর্বব্যাপী এবং নিত্যা হইলেও তাঁহার বহুপ্রকার আবির্ভাবের বৃত্তান্ত আমার নিকট শ্রবণ করুন।-(৬৩-৬৫)।। যখন তিনি দেবগণের কার্যসিদ্ধির নিমিত্ত আবির্ভূতা হন, স্বরূপতঃ নিত্যা হইলেও তিনি তখন পৃথিবীতে উৎপন্না, এইরূপ অভিহিতা হন।-(৬৫-৬৬)।। প্রলয়কালে (ব্রহ্মার দিবাবসানে) পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হইলে যখন ভগবান প্রভু বিষ্ণু অনন্তনাগকে শয্যারূপে বিস্তৃত করিয়া যোগনিদ্রায় নিমগ্ন হইলেন-(৬৬-৬৭) তখন মধু ও কৈটভ নামে প্রসিদ্ধ ভয়ঙ্কর অসুরদ্বয় বিষ্ণুর কর্ণমল হইতে উৎপন্ন হইয়া ব্রহ্মাকে হত্যা করিতে উদ্যত হইল।-(৬৭-৬৮)।। বিষ্ণুর নাভি-পদ্মে অবস্থিত সেই প্রজাপতি প্রভু ব্রহ্মা বিষ্ণুকে যোগনিদ্রামগ্ন এবং উগ্র অসুরদ্বয়কে সমীপে দেখিয়া বিষ্ণুর জাগরণের নিমিত্ত তেজঃস্বরূপ বিষ্ণুর নয়নাশ্রিতা অতুলা তামসী-শক্তি বিশ্বেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতি-সংহার-কারিণী, ভগবতী সেই যোগনিদ্রার স্তব করিতে লাগিলেন।-(৬৮-৭১)
ব্রহ্মা বলিলেন– নিত্যে, অক্ষরে, আপনিই দেবোদ্দেশে হবিদানের স্বাহামন্ত্ররূপা। আপনিই পিতৃলোকের উদ্দেশে দ্রব্যদানের স্বধামন্ত্ররূপা। আপনিই দেবাহ্বানের বষট্মন্ত্র-স্বরূপা ও উদাত্তাদিস্বররূপা। আপনিই অমৃতরূপা এবং অ-উ-ম ত্রিবিধ মাত্রারূপে অবস্থিতা প্রণবরূপা।-(৭২-৭৪)।। বিশেষরূপে যাহা অনুচ্চার্যা নির্গুণা বা তুরীয়া, তাহাও আপনি। হে দেবি, আপনি গায়ত্রীমন্ত্ররূপা এবং আপনি পরিণামহীনা শ্রেষ্ঠা শক্তি ও দেবগণের আদি মাতা।-(৭৪-৭৫)।। হে দেবি, আপনিই জগৎ-ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। আপনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন, আপনিই ইহা পালন করেন এবং সর্বদা প্রলয়কালে আপনি ইহা সংহার করেন।-(৭৫-৭৬)।। হে জগৎস্বরূপা, আপনি এই জগতের সৃষ্টিকালে সৃষ্টিশক্তিরূপা, পালনকালে স্থিতিশক্তিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা।-(৭৬-৭৭)।। আপনি মহাবাক্যলক্ষণা ব্রহ্মবিদ্যা ও সংসৃতিকর্ত্রী মহামায়া। আপনি মহতী মেধা (ধারণা), মহতী স্মৃতি ও মহামোহ। আপনি মহতী দেবশক্তি এবং মহতী অসুরশক্তি।-(৭৭-৭৮)।। আপনিই সর্বভূতের প্রকৃতি ও ত্রিগুণের পরিণাম-বিধায়িনী। আপনি কালরাত্রি (যাহাতে ব্রহ্মার লয় হয়) ও মহারাত্রি (যাহাতে জগতের লয় হয়)। আপনি দুষ্পরিহারা মহামোহনিশা বা মানুষী রাত্রি (যাহাতে জীবের নিত্য লয় হয়)।-(৭৮-৭৯)।। আপনি লক্ষ্মী, আপনি ঈশ্বরশক্তি, আপনি হ্রী, আপনি নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি। আপনি লজ্জা, পুষ্টি এবং তুষ্টি। আপনিই শান্তি ও ক্ষান্তি।-(৭৯-৮০)।। আপনি খড়্গধারিণী, ত্রিশূলধারিণী, (এক হস্ত নরশিরধারণে) ভয়ঙ্করী, গদাধারিণী, চক্রধারিণী, শঙ্খধারিণী, ধনুর্ধারিণী এবং বাণ, ভুসন্ডী ও পরিঘাস্ত্রধারিণী (মহাকালী দশভূজা এবং দশ হস্তে দশপ্রহরধারিণী-বৈকৃতিরহস্য)।-(৮০-৮১)।। আপনি দেবগণের প্রতি সৌম্যা এবং দৈত্যগণের প্রতি ততোধিক রুদ্রা। আপনি সকল সুন্দর বস্তু অপেক্ষাও সুন্দরী। আপনি ব্রহ্মাদিরও শ্রেষ্ঠ। আপনি সর্বপ্রধানা দেবী এবং পরমেশ্বরের মহাশক্তি।-(৮১-৮২)।। হে বিশ্বরূপিণী, যে-কোনও স্থানে যাহা কিছু চেতন বা জড় বস্তু অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে হইবে সেই সকলের যে শক্তি, তাহা আপনিই। সুতরাং কিরূপে আপনার স্তব করিব? (বিশ্বপ্রপঞ্চে আপনি ভিন্ন যখন আর কিছুই নাই, তখন আপনার স্তব কিরূপে সম্ভব?)-(৮২-৮৩)।।
শাক্তধর্মের বিকাশ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য পুরাণসমূহ অনুশীলন করার প্রয়োজন বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। প্রায় সকল পুরাণেই দেবীর ক্রিয়াকলাপ, নামসমূহ ও গুণাবলী বিবৃত আছে। তবে দেবী-কেন্দ্রিক পুরাণগুলিই এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আলোকপাত করে। এই পর্যায়ের পুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মার্কণ্ডেয় পুরাণ। কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ ও দেবীভাগবত অনেক পরবর্তীকালের রচনা, যেগুলি পুরোদস্তুরভাবেই শাক্তধর্মের প্রচারক।
দেব-তেজঃসম্ভবা দেবী চণ্ডী: মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যের ত্রয়োদশ অধ্যায়ের (যা সচরাচর চণ্ডী নামে পরিচিত এবং ভিন্নভাবে শ্রীশ্রীচল্ডী নামে গ্রন্থও প্রকাশিত হয়ে থাকে) দেবী কল্পনা এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবীর প্রতিষ্ঠা এই মার্কণ্ডেয় পুরাণ অবলম্বন করে। এই ‘চণ্ডী’-শাস্ত্র পাঠ করলে দেখা যায়, এখানে এক পরমা দেবীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। এই দেবী অধিকাংশ স্থলে শুধু ‘দেবী’-রূপেই খ্যাত। কোথাও তিনি ভগবতী, পরমেশ্বরী। এই দেবীর উদ্ভব সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে যে, মহিষাসুরের অত্যাচারে নিপীড়িত দেবতাগণ বিষ্ণু ও মহাদেবের নিকট প্রতিকার প্রার্থনা করলে বিষ্ণু, শিব ও ব্রহ্মার মুখ থেকে ক্রোধজাত যে তোজোরাশি উদ্ভব হয়,–
ইত্থং নিশম্য দেবানাং বচাংসি মধুসূদনঃ।
চকার কোপং শম্ভুশ্চ ভৃকুটী কুটিলাননৌ।।
অন্যেষাঞ্চৈব দেবানাং শক্রাদীনাং শরীরতঃ।
নির্গতং সুমহত্তজস্তচ্চৈক্যং সমগচ্ছত।। –(চণ্ডী-২/৯-১০)
অর্থাৎ– দেবতার এই কথা শুনে মধুসূদন কোপ প্রকাশ করলেন, ভৃকুটী-কুটিল মুখ শম্ভুও কুপিত হলেন। তখন অতিকোপপূর্ণ বিষ্ণু ব্রহ্মার এবং শঙ্করের মুখ থেকে, ইন্দ্র প্রভৃতি অন্যান্য দেবগণের শরীর থেকে মহৎ তেজ নির্গত হয়ে একতা প্রাপ্ত হোল।
বিষ্ণু, শিব ও ব্রহ্মার মুখ থেকে উদ্ভূত এই ক্রোধজাত তোজোরাশির সঙ্গে অন্যান্য দেবগণের দেহ-নির্গত তেজ মিলিত হয়ে এক অপূর্ব নারী-রূপ গঠিত হয়।–
অতুলং তত্র তত্তেজঃ সর্বদেবশরীরজম্ ।
একস্থং তদভূন্নারী ব্যাপ্তলোকত্রয়ং ত্বিষা।। — (চণ্ডী-২/১৩)
অর্থাৎ– সকল দেবের শরীর জাত অতুলনীয় সেই তেজ একত্রিত হয়ে নারীরূপ পরিগ্রহ করে ত্রিলোক ব্যাপ্ত করেছিল।
মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী (চণ্ডী-২/১৪-১৮) অনুযায়ী–
যদভূচ্ছাম্ভবং তেজস্তেনাজায়ত তন্মুখম্ ।
যাম্যেন চাভবন্ কেশা বাহবো বিষ্ণুতেজসা।। ১৪
সৌম্যেন স্তনয়োর্যুগ্মং মধ্যং চৈন্দ্রেণ চাভবৎ।
বারুণেন চ জঙ্ঘোরূ নিতম্বস্তেজসা ভুবঃ।। ১৫
ব্রহ্মণস্তেজসা পাদৌ তদঙ্গুল্যোহর্কতেজসা।
বসূনাঞ্চ করাঙ্গুল্যঃ কৌবেরেণ চ নাসিকা।। ১৬
তস্যাস্তু দন্তাঃ সম্ভূতাঃ প্রাজাপত্যেন তেজসা।
নয়নত্রিতয়ং জজ্ঞে তথা পাবকতেজসা।। ১৭
ভ্রুবৌ চ সন্ধ্যয়োস্তেজঃ শ্রবণাবনিলস্য চ।
অন্যেষাঞ্চৈব দেবানাং সম্ভবস্তেজসাং শিবা।। ১৮
অর্থাৎ– শম্ভু বা শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ উৎপন্ন হলো। ১৪।। চন্দ্রতেজে স্তনযুগল, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরুদ্বয়, পৃথিবীর তেজে তাঁর নিতম্ব উদ্ভূত হলো। ১৫।। ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পদাঙ্গুলি, বসুগণের তেজে করাঙ্গুলি এবং কুবেরের তেজে নাসিকা উৎপন্ন হলো। ১৬।। প্রজাপতির তেজে দন্তসকল এবং বহ্নির তেজে তাঁর চক্ষুত্রয় উৎপন্ন হলো। ১৭।। সন্ধ্যার তেজে ভ্রূযুগল, পবনের তেজে কর্ণদ্বয় এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজপুঞ্জ থেকে শিবা বা দুর্গাদেবীর আবির্ভাব হলো। ১৮।।
ইনিই হবেন অসুরহন্তা মহাদেবী। তখন দেবগণ নিজ নিজ অস্ত্র, ভুষণ ও বাহনের দ্বারা দেবীকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-২/২০-৩১)। মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি, মরুদ্গণ ধনু ও বাণপূর্ণ তূণ, ইন্দ্র বজ্র ও ঘণ্টা, যম দিলেন দণ্ড, সমুদ্র দিলেন নাগপাশ, প্রজাপতি ব্রহ্মা অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য সমস্ত রোমকূপে নিজ রশ্মি ছড়িয়ে দিলেন, কাল দিলেন খড়্গ ও চর্ম (ঢাল)। এভাবেই দেবগণ সবাই দেবীর আবির্ভাবে সহায়তা করেছিলেন। মহাশক্তির আবির্ভাব সকল দেবতার শক্তি বা তেজের সমবায়ে।
এখানে অন্যান্য দেবতার সঙ্গে চণ্ডীর যে সম্পর্ক, শিবের সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। আর হিমালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেবলমাত্র এই যে, অন্যান্য দেবগণ দেবীকে অস্ত্রশস্ত্র ভূষণ প্রভৃতি দ্বারা যখন সাজিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহ এবং বিবিধ রত্ন– ‘হিমবান্ বাহনং সিংহং রত্নানি বিবিধানি চ।’–(চণ্ডী-২/৩০)।
এখানে অন্যান্য দেবতার সঙ্গে চণ্ডীর যে সম্পর্ক, শিবের সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। আর হিমালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেবলমাত্র এই যে, অন্যান্য দেবগণ দেবীকে অস্ত্রশস্ত্র ভূষণ প্রভৃতি দ্বারা যখন সাজিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহ এবং বিবিধ রত্ন– ‘হিমবান্ বাহনং সিংহং রত্নানি বিবিধানি চ।’–(চণ্ডী-২/৩০)।
দেবী ভাগবতে দেখা যায়, মহিষাসুরবধের জন্য ব্রহ্মা যখন মহাদেবের কাছে এসেছিলেন তখন শিব বলেছিলেন, আপনিই তাকে বর দিয়ে বাড়িয়েছেন। তাকে বধ করার মত নারী কোথায়?–
কা সমর্থা বরা নারী তং হন্তুং মদদর্পিতম্ ।
ই মে ভার্য্যা ন তে ভ্যার্যা সংগ্রামং গন্তুমর্হতি।। –(দেবীভাগবত-৫/৭/৫০)
অর্থাৎ– তাকে বধ করার মত স্বদর্পিত সমর্থ নারী কোথায়? আপনার বা আমার স্ত্রী যুদ্ধে যেতে পারেন না।
এখানে কেন সমর্থ নারী খোঁজা হচ্ছে? কারণ, ব্রহ্মার বরে কোন পুরুষের দ্বারা মহিষাসুর নিহত হবে না। তাই দেবগণ বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন–
ধাত্রা তস্মৈ বরো দত্তো হ্যবধ্যোহসি নরৈঃ কিল।
কা স্ত্রী ত্বেবংবিধা বালা যা হন্যাত্তং শঠং রণে।।
উমা মা বা শচী বিদ্যা কা সমর্থাস্য ঘাতনে। –(দেবীভাগবত-৫/৮/২৪)
অর্থাৎ– ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছেন যে পুরুষদের অবধ্য হও। এই শঠকে যুদ্ধে হত্যা করবে এমন স্ত্রীলোক কোথায়? উমা, লক্ষ্মী, শচী, সরস্বতী কে তাকে বধ করতে সমর্থ?
বিষ্ণু তখন বললেন,–
অদ্য সর্বপুরাণাং বৈ তেজোভী রূপসম্পদা।
উৎপন্না চেদ্বরারোহা সা হন্যাত্তং রণে বলাৎ।।
হয়ারিং বলদৃপ্তঞ্চ মায়াশতবিশারদম্ ।
হন্তুং যোগ্যা ভবেন্নারী শক্ত্যংশৈস্তেজোরাশির্ভবেদ্ যথা।। –(দেবীভাগবত-৫/৮/৩০)
অর্থাৎ– আজ সকল দেবতার তেজ ও রূপসম্পদের দ্বারা উৎপন্না সুন্দরীনারী তাকে বধ করবেন। বলদৃপ্ত মায়াশতবিশারদ ইন্দ্রশত্রুকে বধের যোগ্যা দেবতাদের তেজের অংশে তেজোরাশিরূপিণী নারী আবির্ভূতা হবেন।
তারপর দেবতাদের মুখ থেকে তেজ নির্গত হতে লাগলো এবং সেই তেজ বিশাল আকার ধারণ করে নারীরূপ পরিগ্রহ করলো। (দেবীভাগবত-৮/৮/৩৩-৪৩)–
ইত্যুক্তবতি দেবেশে ব্রহ্মণো বদনাত্ততঃ।
স্বয়মেবোদ্বভৌ তেজোরাশিশ্চাতীব দুঃসহঃ।। ৩৩
রক্তবর্ণং শুভাকারং পদ্মরাগমণিপ্রভম্ ।
কিঞ্চিচ্ছীতং তথাচোষ্ণং মরীচিজালম-িতম্ ।। ৩৪
নিঃসৃতং হরিণা দৃষ্টং হরেণ চ মহাত্মনা।
বিস্মিতৌ তৌ মহারাজ বভূবতুরুরুক্রমৌ।। ৩৫
শঙ্করস্য শরীরাত্তু নিঃসৃতং মহদদ্ভুতম্ ।
রৌপ্যবর্ণমভূত্তীব্রং দুর্দর্শং দারুণং মহৎ।। ৩৬
ভয়ঙ্করঞ্চ দৈত্যানাং দেবানাং বিস্ময়প্রদম্ ।
ঘোররূপং গিরিপ্রখ্যং তমোগুণমিবাপরম্ ।। ৩৭
ততো বিষ্ণুশরীরাত্তু তেজোরাশিমিবাপরম্ ।
নীলং সত্ত্বগুণোপেতং প্রাদুরাস মহাদ্যুতি।। ৩৮
ততশ্চেন্দ্রশরীরাত্তু চিত্ররূপং দুরাসদম্ ।
আবিরাসীৎ সুসংবৃত্তং তেজঃ সর্বগুণাত্মকম্ ।। ৩৯
কুবের যমবহ্নীনাং শরীরেভ্যঃ সমন্ততঃ।
নিশ্চক্রাম মহত্তেজো বরুণস্য তথৈব চ।। ৪০
অন্যেষাষ্ণৈব দেবানাং শরীরেভ্যোহতিভাস্বরম্ ।
নির্গতং তন্মহাতেজোরাশিরাসীন্মহোজ্জ্বলঃ।। ৪১
তং দৃষ্ট্বা বিস্মিতাঃ সর্বে দেবা বিষ্ণুপুরোগমাঃ।
তেজোরাশিং মহাদিব্যং হিমাচলমিবাপরম্ ।। ৪২
পশ্যতাং তত্র দেবনাং তেজঃপুঞ্জসম্ভবা।
বভূবাবিতবরা নারী সুন্দরী বিস্ময়প্রদা।। ৪৩
অর্থাৎ– দেবেশ বিষ্ণু এই কথা বললে ব্রহ্মার বদন থেকে অতীব দুঃসহ তেজোরাশি স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছিল। ৩৩।। পদ্মরাগমণিতুল্য রক্তবর্ণ শুভাকার, ঈষৎ শীতল, ঈষৎ উষ্ণ কিরণজালমণ্ডিত–। ৩৪।। –সেই নির্গত তেজ ভূরিগতিসম্পন্ন হরি এবং হর বিস্মিত হয়ে দেখলেন। ৩৫।। শঙ্করের শরীর থেকেও মহৎ অদ্ভুত, রৌপ্যবর্ণ, দুর্দর্শ,–। ৩৬।। –দেব ও দানবদের পক্ষে ভয়ংকর তমোগুণসদৃশ, পর্বততুল্য বিশাল ঘোর তেজ নির্গত হোল। ৩৭।। তারপর বিষ্ণুর শরীর থেকে অপর তেজোরাশির মত সত্ত্বগুণান্বিত নীলবর্ণ মহৎ জ্যোতি প্রকাশিত হোল। ৩৮।। তারপর চন্দ্রের শরীর থেকে বিবিত্ররূপী সর্বগুণান্বিত সুসংহত তেজ আবির্ভূত হয়। ৩৯।। কুবের, বরুণ, অগ্নি ও বরুণের দেহ থেকেও সেইভাবে চতুর্দিকে তেজ নির্গত হতে লাগলো। ৪০।। অন্য দেবতাদেরও শরীর থেকে অত্যুজ্জ্বল মহাতেজোরাশি নির্গত হোল। ৪১।। হিমালয়ের মত মহাদিব্য বিশাল তেজোরাশি দেখে বিষ্ণু প্রভৃতি সকল দেবতা বিস্মিত হলেন। ৪২।। দেবগণের সন্মুখেই তেজঃপুঞ্জসম্ভবা বিস্ময়করী শ্রেষ্ঠা নারী আবির্ভূতা হলেন। ৪৩।।
এই বিবরণ অনুযায়ী সকল দেবতার পর্বতোপম তেজ দেবী মহামায়ার রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ব্রহ্মার তেজ রক্তবর্ণ, বিষ্ণুর তেজ নীলবর্ণ এবং শিবের তেজ শুভ্রবর্ণ। যে দেবতার যে রূপ তাঁর তেজও তদনুরূপ। এখান থেকে দেবশক্তির সমন্বিতরূপ মহাশক্তির স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়। এই মহাশক্তি উমা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও শচী থেকে ভিন্না রূপে বর্ণিতা হলেও স্বরূপতঃ অভিন্না।
বলা বাহুল্য, মানুষের কর্মদক্ষতা বা কর্মক্ষমতা যেমন শক্তি, জড়েরও কর্মক্ষমতা শক্তি, তেমনি দেবগণেরও কর্মক্ষমতা বা তেজ শক্তি নামে কথিত হয়। এই শক্তিকে দেবীরূপে কল্পনা করা হয়। সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই শক্তিদেবতার তাৎপর্য বুঝাতে গিয়ে বলেছেন–
‘দেবতা আপন ক্ষমতার দ্বারা আপনার করণীয় কাজ নির্বাহ করেন, সেই ক্ষমতার নাম শক্তি। অগ্নির দাহ করিবার ক্ষমতাই তাঁর শক্তি। তাহার নাম স্বাহা। ইন্দ্র বৃষ্টি করেন, বৃষ্টিকারিণী শক্তির নাম ইন্দ্রাণী। পবন বায়ুর দেবতা, বহনশক্তির নাম পবনানী। রুদ্র সংহারকারী দেবতা, তাঁহার সংহার শক্তির নাম রুদ্রাণী।’
মার্কণ্ডেয়-পুরাণান্তর্গত চণ্ডী-উপাখ্যানেও দেখা যায়, মহাশক্তি চণ্ডীর সঙ্গে শুম্ভদৈত্যের যুদ্ধের সময় চণ্ডীর দেহ থেকে যে দেব-শক্তিগণের আবির্ভাব হয়েছিল তাঁরা হলেন, (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৮৮/১৫-১৮, ২১)–
‘দেবতা আপন ক্ষমতার দ্বারা আপনার করণীয় কাজ নির্বাহ করেন, সেই ক্ষমতার নাম শক্তি। অগ্নির দাহ করিবার ক্ষমতাই তাঁর শক্তি। তাহার নাম স্বাহা। ইন্দ্র বৃষ্টি করেন, বৃষ্টিকারিণী শক্তির নাম ইন্দ্রাণী। পবন বায়ুর দেবতা, বহনশক্তির নাম পবনানী। রুদ্র সংহারকারী দেবতা, তাঁহার সংহার শক্তির নাম রুদ্রাণী।’
মার্কণ্ডেয়-পুরাণান্তর্গত চণ্ডী-উপাখ্যানেও দেখা যায়, মহাশক্তি চণ্ডীর সঙ্গে শুম্ভদৈত্যের যুদ্ধের সময় চণ্ডীর দেহ থেকে যে দেব-শক্তিগণের আবির্ভাব হয়েছিল তাঁরা হলেন, (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৮৮/১৫-১৮, ২১)–
হংসযুক্তবিমানাগ্রে সাক্ষসূত্রকমণ্ডলুঃ।
আয়াতা ব্রহ্মণঃ শক্তির্ব্রহ্মাণী সাভিধীয়তে।। ১৫
মাহেশ্বরী বৃষারূঢ়া ত্রিশূলবরধারিণী।
মহাহিবলয়া প্রাপ্তা চন্দ্ররেখা বিভূষণা।। ১৬
কৌমারী শক্তিহস্তা চ ময়ূরবরবাহনা।
যোদ্ধুমভ্যাযযৌ দৈত্যাম্বিকাগুহরূপিণী।। ১৭
তথৈব বৈষ্ণবী শক্তির্গরুড়োপরিসংস্থিতাম্ ।
শঙ্খচক্রগদার্শার্ঙ্গ খড়্গহস্তাভ্যুপাযযৌ।। ১৮
বজ্রহস্তা তথৈবৈন্দ্রী গজরাজোপরিস্থিতা।
প্রাপ্তা সহস্রনয়না যথা শত্রুস্তথৈব সা।। ২১
অর্থাৎ– ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী হংসবাহনা, অক্ষমালা কমণ্ডলুধারিণী; মহেশ্বর-শক্তি মাহেশ্বরী বৃষারূঢ়া, ত্রিশূলধারিণী, সর্পবলয় ও চন্দ্রকলাবিভূষিতা; কুমার কার্তিকেয়ের শক্তি কৌমারী শক্তিহস্তা ময়ূরবাহনা; বিষ্ণুশক্তি বৈষ্ণবী গরুড় বাহনা শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গখড়্গ-হস্তা; ইন্দ্রশক্তি ঐন্দ্রী ঐরাবতাসীনা বজ্রহস্তা সহস্রনয়না।
এখানে লক্ষ্যণীয় হলো, যে পুরুষ-দেবতার যে আকৃতি যে প্রকৃতি, তাঁর শক্তিও একই আকৃতির একই প্রকৃতির– পুরুষদেবতার স্ত্রীরূপ মাত্র। মার্কণ্ডেয়-পুরাণেই তাই বলা হয়েছে–
‘যে দেবতার যে আকার, যে সজ্জা ও বাহন, তাঁর শক্তিও তদনুরূপা’–
যস্য দেবস্য যদ্রূপং যথা ভূষণ বাহনম্ ।
তদ্বদেব হি তচ্ছক্তিরসুরান্ যৌদ্ধুমাযযৌ।।– (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৮৮/১৪)
অতএব দেখা যাচ্ছে, শক্তি ও শক্তির অধিকারীতে কোন ভেদ নেই। কেবলমাত্র লৌকিক দৃষ্টিতে দেব ও দেবশক্তিতে পতি-পত্নী সম্পর্ক কল্পিত হয়েছে। কিন্তু সকল দেবসত্তা যেমন এক ও অদ্বয়, তেমনি তাঁদের শক্তিও এক ও অদ্বয়। তাই মার্কণ্ডেয়-পুরাণে দেখি, শুম্ভাসুর যখন দেবী চণ্ডিকাকে বলেছিল, তুমি অন্যের শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করছো, এজন্য গর্ব করার কিছু নেই, দেবী তখন বলেছিলেন,–
একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।
ততঃ সমস্তাস্তা দেব্যো ব্রহ্মাণীপ্রমুখা লয়ম্ ।
তস্যা দেব্যাস্তনৌ জগ্মুরেকৈবাসীৎ তদাম্বিকা।।– (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৯০/৫-৬)
অর্থাৎ– আমি ছাড়া জগতে আর দ্বিতীয় কে আছে? আমি এক অদ্বিতীয়া, দেখ সব শক্তি আমাতেই লীন হয়ে যাচ্ছে। তখনই ব্রহ্মাণী প্রভৃতি শক্তিবর্গ দেবীর স্তনে প্রবেশ করে মিলিয়ে গেল।
এরপর দেবী বললেন–
অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রূপৈর্যদা স্থিতা।
তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব তিষ্টাম্যাজৌ স্থিরো ভব।।– (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৯০/৮)
অর্থাৎ– আমি বিভূতিদ্বারা যে বহুরূপে বর্তমান ছিলাম, তা ফিরিয়ে নিয়েছি, আমি একা, তুমি যুদ্ধে স্থির হও।
অর্থাৎ তিনিই সনাতনী আদ্যাশক্তি অদ্বিতীয়া মহাদেবী। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণে, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের বর্ণনায়,– ‘তাঁহার মুখ্য পরিচয় চণ্ডিকা; তাঁহার প্রসিদ্ধ অন্যান্য নামগুলির মধ্যে অম্বিকা নামটি খুব বেশি ব্যবহৃত হইতে দেখি; দুর্গা নামও কয়েক স্থলে ব্যবহৃত হইয়াছে। গৌরবর্ণ বলিয়া এক স্থলে তিনি ‘গৌরদেহা’ বলিয়া আখ্যাতা; ‘গৌরী’ সম্বোধনও কয়েক স্থলে পাওয়া যায়। তাহা ব্যতীত তিনি কাত্যায়নী, শিবদূতী, শাকম্ভরী, ভীমা, ভ্রামরী ইত্যাদি। এই-জাতীয় নামগুলি তিনি কখন কেন গ্রহণ করিয়াছেন গ্রন্থমধ্যেই তাহার ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। তাঁহা হইতেই কৌশিকী, কালী বা চামুণ্ডা প্রসূতা হইয়াছিলেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষা কৌতূহলজনক হইল যে তথ্যটি তাহা এই যে, এই দেবী কোথাওই হিমাচল-দুহিতা উমা নহেন। সমস্ত ‘চণ্ডী’র মধ্যে দেবীর উমা নামটির উল্লেখ একবারের জন্যও নাই। পঞ্চম অধ্যায়ে দেবীকে তিনবার মাত্র পার্বতী বলিয়া উল্লিখিত দেখিতে পাই, তাহাও পর্বত-কন্যা পার্বতীরূপে নহে– পর্বতবাসিনী পার্বতীরূপে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে যে কথাটি তাই অত্যন্ত বড় করিয়া মনে হয় তাহা হইল এই যে, দেবীরূপে চণ্ডীর ধারা ভারতবর্ষের প্রাচীন দেবী পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি স্বতন্ত্র ধারা।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫০)
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যে কয়েকটি দেবীস্তুতি তাঁর রূপের কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করে। ব্রহ্মাদি দেবগণ বারে বারে মধুকৈটভ, মহিষাষুর, শুম্ভনিশুম্ভ প্রভৃতি দৈত্য ও অসুরগণের দ্বারা বিমর্দিত হলে এই সকল স্তব করে তাঁরা দেবীকে তুষ্ট করেন এবং দেবী এই সকল দৈত্য ও অসুরদের বিনাশ সাধন করেন। দেবীমাহাত্ম্যের নারায়ণী স্তুতি অংশে দেখা যায় দেবীর বিশ্বাধার, বিশ্ববীজ, বৈষ্ণবী শক্তি, মাতৃকা (ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ঐন্দ্রী বা ঐন্দাণী, চামুণ্ডা, নারসিংহী ও শিবদূতী), লক্ষ্মী, নারায়ণী সরস্বতী, কাত্যায়নী, দুর্গা, ভদ্রকালী, অম্বিকা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশের স্তব করা হয়েছে। সর্বশেষে বলা হয়েছে তিনি বিভিন্ন যুগে বিন্ধ্যবাসিনী, রক্তদন্তিকা, শতাক্ষি, শাকম্ভরী, দুর্গা, ভীমা, ভ্রামরী প্রভৃতি নানাবিধ নামে অবতীর্ণ হয়ে দানবনিধন ও বিশ্বকল্যাণের হেতু হন। অধ্যাপক ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে–
‘বিভিন্ন দেবসত্তার নারীরূপই শক্তি। ব্যাপক অর্থে তাই সরস্বতী, লক্ষ্মী, মনসা, শীতলা, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সকল স্ত্রীদেবতাই শক্তিদেবতা। কিন্তু প্রচলিত রীতিতে শিবশক্তি শিবানী এবং তাঁর রূপভেদ দুর্গা, কালী, চণ্ডী, চামুণ্ডা প্রভৃতি মহাশক্তি মহামায়ারূপে সুপ্রসিদ্ধা। এই মহাশক্তিই পৃথক্ সত্তায় বিকশিত হ’য়ে অন্যান্য স্ত্রীদেবতার মধ্যে প্রধান স্থান গ্রহণ করেছেন। একই মহাশক্তির বহুবিচিত্ররূপ সাধকের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে এবং স্থানীয় গ্রাম্য পৌরাণিক অপৌরাণিক সকল স্ত্রী দেবতাই এক শক্তিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছেন।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ-তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৫৮)
‘বিভিন্ন দেবসত্তার নারীরূপই শক্তি। ব্যাপক অর্থে তাই সরস্বতী, লক্ষ্মী, মনসা, শীতলা, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সকল স্ত্রীদেবতাই শক্তিদেবতা। কিন্তু প্রচলিত রীতিতে শিবশক্তি শিবানী এবং তাঁর রূপভেদ দুর্গা, কালী, চণ্ডী, চামুণ্ডা প্রভৃতি মহাশক্তি মহামায়ারূপে সুপ্রসিদ্ধা। এই মহাশক্তিই পৃথক্ সত্তায় বিকশিত হ’য়ে অন্যান্য স্ত্রীদেবতার মধ্যে প্রধান স্থান গ্রহণ করেছেন। একই মহাশক্তির বহুবিচিত্ররূপ সাধকের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে এবং স্থানীয় গ্রাম্য পৌরাণিক অপৌরাণিক সকল স্ত্রী দেবতাই এক শক্তিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছেন।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ-তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৫৮)
বিষ্ণুমায়া যোগনিদ্রা চণ্ডী : বলাবাহুল্য, দার্শনিক শক্তিবাদের পরিচয় তন্ত্র থেকে বেশি পাওয়া যায় প্রাচীন পুরাণগুলোতে। শক্তিতত্ত্বের উদ্ভব পুরাণতন্ত্রের যুগেই। অথচ এখানে যে শক্তিবাদের আলোচনা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগ জায়গাতেই শক্তি মূলত বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুমায়া। শিবশক্তি নয়। আর এই বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুমায়াই সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষ, বেদান্তের ব্রহ্ম-মায়া ও তন্ত্রের শিব-শক্তি। এঁরা সবাই কোনও এক জনপ্রিয় পদ্ধতিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে যে শক্তিতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, তা বিষ্ণুপুরাণের ও পঞ্চরাত্র সংহিতাগুলোতে যে শক্তিতত্ত্বের কথা বলা আছে তাদের থেকে প্রাচীন বলে মনে হয় না। মার্কণ্ডেয় পুরাণের রচনাকাল চতুর্থ শতকের আগে বলে মনে হয় না। সেই সময়কালে বিষ্ণুমায়া বা বিষ্ণশক্তিকে অবলম্বন করেই শক্তিবাদের প্রচার প্রসার হতে দেখা যায়। তাই সম্ভবত ‘চণ্ডী’র মধ্যেও দেবীর বিষ্ণুমায়া-রূপই প্রধানভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘চণ্ডী’র মধ্যে মূল অংশ দু’টি– প্রথমটা দেবীর অসুর-নিধন কাহিনী, আর অন্যটা হলো দেবী-তত্ত্ব– দেবতাদের স্তব-স্তুতিতে দেবীর যে রূপ ফুটে উঠেছে।
এখানে আরও উল্লেখ্য, ‘চণ্ডী’-গ্রন্থের অসুর-নিধন অংশে তিনকালে তিনটি প্রধান ঘটনা অবলম্বন করে দেবীর মহিমা প্রচারিত হয়েছে। প্রথমে দেবীর সহায়তায় বিষ্ণু কর্তৃক মধুকৈটভ অসুরদ্বয় বিনাশ, দ্বিতীয়ে স্বয়ং দেবী কর্তৃক মহিষাসুর নিধন, এবং তৃতীয়ে দেবী কর্তৃক শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয় বধ। এই শুম্ভ-নিশুম্ভ-বধ উপলক্ষে দেবীকে অবশ্য চণ্ড-মুণ্ড এবং রক্তবীজ প্রভৃতি আরও অনেক অসুর বধ করতে হয়েছে। কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় তথ্য হলো, দেবী সমগ্র ‘চণ্ডী’-গ্রন্থের মধ্যে কোথাও শিব-শক্তি নন। শিবের সাথে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত গৌণ– প্রায় নেই বললেই চলে। কালিদাস যেমন পার্বতী-পরমেশ্বরের ভিতরকার সম্পর্ককে বাক্য ও অর্থের নিত্য-সম্পর্কের ন্যায় অবিনাভাবের সম্পর্ক বলেছেন, চণ্ডীতে কিন্তু বর্ণিত দেবীর সাথে শিবের কোনও উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে আরও উল্লেখ্য, ‘চণ্ডী’-গ্রন্থের অসুর-নিধন অংশে তিনকালে তিনটি প্রধান ঘটনা অবলম্বন করে দেবীর মহিমা প্রচারিত হয়েছে। প্রথমে দেবীর সহায়তায় বিষ্ণু কর্তৃক মধুকৈটভ অসুরদ্বয় বিনাশ, দ্বিতীয়ে স্বয়ং দেবী কর্তৃক মহিষাসুর নিধন, এবং তৃতীয়ে দেবী কর্তৃক শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয় বধ। এই শুম্ভ-নিশুম্ভ-বধ উপলক্ষে দেবীকে অবশ্য চণ্ড-মুণ্ড এবং রক্তবীজ প্রভৃতি আরও অনেক অসুর বধ করতে হয়েছে। কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় তথ্য হলো, দেবী সমগ্র ‘চণ্ডী’-গ্রন্থের মধ্যে কোথাও শিব-শক্তি নন। শিবের সাথে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত গৌণ– প্রায় নেই বললেই চলে। কালিদাস যেমন পার্বতী-পরমেশ্বরের ভিতরকার সম্পর্ককে বাক্য ও অর্থের নিত্য-সম্পর্কের ন্যায় অবিনাভাবের সম্পর্ক বলেছেন, চণ্ডীতে কিন্তু বর্ণিত দেবীর সাথে শিবের কোনও উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রথমে মধুকৈটভ-বধের সময় স্পষ্টই দেখা গেল, দেবী হলেন জগৎপতির যোগনিদ্রা– তিনি হলেন হরির মহামায়া। শ্রীদাশগুপ্তের ভাষ্যে– ‘দেবী জগৎপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা শব্দের অর্থ স্তৈমিত্য-রূপা নিত্যা সমবায়িনী শক্তি।’ তাই প্রথমে আদিদেব ব্রহ্মা স্তবের দ্বারা এই নিস্তরঙ্গা দেবীকে জাগ্রত করলেন। সমবায়িনী শক্তির জাগরণের ফলেই বিষ্ণুর অসুর-হননাদি ক্রিয়া সম্ভব হলো। শক্তি একদিক থেকে শক্তিমান অপেক্ষাও প্রধান, কারণ শক্তি ব্যতীত শক্তিমানের শক্তিমত্তা সিদ্ধ হয় না। তাই পরমেশ্বর বিষ্ণুর উপরেও পরমেশ্বরী বিষ্ণুশক্তিরই অখণ্ড অধিকার। সেজন্যে চণ্ডীতে বলা হয়েছে–
যয়া ত্বয়া জগৎস্রষ্টা জগৎপাতাত্তি যো জগৎ।
সোহপি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।।– (চণ্ডী-১/৮৩)
অর্থাৎ– যিনি জগৎস্রষ্টা, জগৎপাতা– এবং যিনি জগৎ-গ্রাসকারী– তিনিও তোমাদ্বারা নিদ্রাবশে নীত হন, সেই তোমাকে স্তব করিতে কে সমর্থ?
দ্বিতীয় আখ্যানে দেখা যায়, দেবতারা মহিষাসুরের পরাক্রমে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্রহ্মার পেছন পেছন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়ে নিবেদন করলেন– ‘শরণঞ্চ প্রপন্নাঃ স্মো বধস্তস্য বিচিন্ত্যতাম্’– ‘আমরা সকলে আপনারই শরণ গ্রহণ করলাম,– আপনি সেই অসুরের বধের কথা ভাবুন।’ দেব নিগ্রহের কথা শুনে শ্রীমধুসূদন ও শম্ভু ভ্রূকুটি-কুটিল করলে প্রথমে অতিকোপ-পরিপূর্ণ চক্রধারী বিষ্ণুর এবং তার পরে শঙ্করের মুখ থেকে এক মহাতেজ নির্গত হলো। এ ছাড়াও ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে সুবিপুল তেজরাশি নির্গত হয়ে সমস্ত তেজ একীভূত ও ঘনীভূত হয়ে এক অপূর্ব নারীমূর্তি পরিগ্রহ করলো– সে মূর্তির দীপ্তিচ্ছটায় ত্রিভুবন উদ্ভাসিত হলো। প্রত্যেক দেবতা এই তেজোময়ী নারীকে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করলেন। তার মধ্যে ‘পিনাকধৃক’ দিলেন শূল। এ ছাড়া শিবের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই জ্যোতির্ময়ী নারীই হলেন মহিষাসুরমর্দিনী মহাদেবী। দেবীর অসুরনাশিনী রূপের মধ্যে এই মহিষাসুরমর্দিনী রূপই অতি প্রাচীন এবং প্রধান। পরবর্তীকালের শারদীয়া দুর্গাপূজায় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিতে এই মহিষাসুরমর্দিনী রূপই গৃহীত হয়েছে। বহু প্রাচীন ভাস্কর্যে ও চিত্রেও দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপেরই প্রাধান্য।
‘এই মহিষমর্দিনী রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন পাই মধ্য-ভারতের উদয়গিরিতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কালে নির্মিত প্রস্তরমূর্তিতে। এই মূর্তি খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের। মূর্তিখানি দ্বাদশভূজা, দ্বাদশভুজে বিবিধ প্রহরণ। গুপ্তযুগের আরও অনেক ছোট ছোট প্রস্তরমূর্তির কথা মার্শাল উল্লেখ করিয়াছেন; মূর্তিগুলি দ্বিভুজা এবং অসুরের সঙ্গে সংগ্রামনিরতা।’– (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৩)
‘এই মহিষমর্দিনী রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন পাই মধ্য-ভারতের উদয়গিরিতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কালে নির্মিত প্রস্তরমূর্তিতে। এই মূর্তি খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের। মূর্তিখানি দ্বাদশভূজা, দ্বাদশভুজে বিবিধ প্রহরণ। গুপ্তযুগের আরও অনেক ছোট ছোট প্রস্তরমূর্তির কথা মার্শাল উল্লেখ করিয়াছেন; মূর্তিগুলি দ্বিভুজা এবং অসুরের সঙ্গে সংগ্রামনিরতা।’– (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৩)
তৃতীয়বারে দেবীর শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের সময়ও কোনও নতুন পরিচয় পাওয়া যায় না। মহিষাসুর বধের পরে দেবী দেবতাদের অভয় দিয়েছিলেন, যখনই তাঁরা কোনও বিপদে পড়বেন, তখনই দেবীকে স্মরণ করলেই দেবী আবির্ভূতা হয়ে বিপদ নাশ করবেন। এ কথা স্মরণ করেই দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে দেবীর শরণ নিলেন এবং দেবীও অসুর (শুম্ভ-নিশুম্ভ) নিধন করে দেবতাদের বিপদমুক্ত করেন। এখানেও লক্ষ্যণীয় যে, দেবতারা ‘দেবীং বিষ্ণুমায়াং প্রতুষ্টুবুঃ’ যে দেবীকে হিমালয়ে গিয়ে স্তব দ্বারা তুষ্ট করলেন, সে দেবী বিষ্ণুমায়া, শিবমায়া নন।
এখানে দেবী যখন শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরতা তখন ঈশানরূপে মহাদেব শিবকে একবার দেখা পাওয়া যায়। দেবীর সাহায্যের জন্য ব্রহ্মা, শিব, কার্তিক, বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের শরীর থেকে তাঁদের শক্তিসমূহ নির্গত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভূতা হলেন। এই দেবীদের মধ্যে ছিলেন ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী– অক্ষমালা ও কমণ্ডলু-হস্তে হংসযুক্ত বিমানে। আসলেন মহেশ্বরের শক্তি মাহেশ্বরী– তিনি ত্রিশূলবরধারিণী, মহাসর্পবলয়ধারিণী, চন্দ্ররেখাবিভূষণা বৃষারূঢ়া। কুমার কার্তিকের শক্তি আসলেন কৌমারী– তিনি শক্তিহস্তা ও ময়ূরবাহনা। বিষ্ণুশক্তি আসলেন বৈষ্ণবী– শঙ্খ-চক্র-গদা-ধনু-খড়্গ-ধারিণী– গরুড়বাহনা। বিষ্ণু-অবতার বরাহের শক্তি আসলেন বারাহী, নরসিংহের শক্তি নারসিংহী, ইন্দ্রশক্তি গজারূঢ়া ঐন্দ্রী। এসব দেবশক্তি দ্বারা পরিবৃত হয়ে ঈশান (শিব) চণ্ডিকাকে বললেন, ‘আমার প্রতি প্রীতিবশতঃ (মম প্রীত্যা) এই-সকল দেবীগণকে লইয়া সত্বর অসুর বিনাশ করুন।’ দেবী ঈশানকে দূতত্ব স্বীকার করে শুম্ভ-নিশুম্ভের নিকট যেতে বললেন, শিবও দেবীর দূতত্ব স্বীকার করে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে গিয়েছিলেন। তাই তাঁকে ‘শিবদূতী’ বলা হয়।
এখানে দেবী যখন শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরতা তখন ঈশানরূপে মহাদেব শিবকে একবার দেখা পাওয়া যায়। দেবীর সাহায্যের জন্য ব্রহ্মা, শিব, কার্তিক, বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের শরীর থেকে তাঁদের শক্তিসমূহ নির্গত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভূতা হলেন। এই দেবীদের মধ্যে ছিলেন ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী– অক্ষমালা ও কমণ্ডলু-হস্তে হংসযুক্ত বিমানে। আসলেন মহেশ্বরের শক্তি মাহেশ্বরী– তিনি ত্রিশূলবরধারিণী, মহাসর্পবলয়ধারিণী, চন্দ্ররেখাবিভূষণা বৃষারূঢ়া। কুমার কার্তিকের শক্তি আসলেন কৌমারী– তিনি শক্তিহস্তা ও ময়ূরবাহনা। বিষ্ণুশক্তি আসলেন বৈষ্ণবী– শঙ্খ-চক্র-গদা-ধনু-খড়্গ-ধারিণী– গরুড়বাহনা। বিষ্ণু-অবতার বরাহের শক্তি আসলেন বারাহী, নরসিংহের শক্তি নারসিংহী, ইন্দ্রশক্তি গজারূঢ়া ঐন্দ্রী। এসব দেবশক্তি দ্বারা পরিবৃত হয়ে ঈশান (শিব) চণ্ডিকাকে বললেন, ‘আমার প্রতি প্রীতিবশতঃ (মম প্রীত্যা) এই-সকল দেবীগণকে লইয়া সত্বর অসুর বিনাশ করুন।’ দেবী ঈশানকে দূতত্ব স্বীকার করে শুম্ভ-নিশুম্ভের নিকট যেতে বললেন, শিবও দেবীর দূতত্ব স্বীকার করে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে গিয়েছিলেন। তাই তাঁকে ‘শিবদূতী’ বলা হয়।
যতো নিযুক্তো দৌত্যেন তয়া দেব্যা শিবঃ স্বয়ম্ ।
শিবদূতীতি লোকেহস্মিংস্ততঃ সা খ্যাতিমাগতা।।– (চণ্ডী-৮/২৮)
অর্থাৎ, যে-হেতু দেবী কর্তৃক স্বয়ং শিব দৌত্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন এই কারণে দেবী জগতে ‘শিবদূতী’ নামে খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন।
এখানে যে শিব বা ঈশানকে পাওয়া যায় তিনিও দেবতাদের মধ্যে একজন হয়ে গৌণভাবে দেখা দিলেন, তিনি চিরপরিচিত ‘মহেশ্বর’ নন। ‘চণ্ডী’তে দেবীকে বেশ কয়েকবার ‘শিবা’ নামে আখ্যাত হতে দেখা যায়। প্রসঙ্গের পারম্পর্য লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, এই শিবা অর্থে তিনি শিব-গৃহিণী বা শিব-শক্তি নন। ‘শিবা’ শব্দ এখানে সাধারণভাবে মঙ্গলময়ী। এ ছাড়া চণ্ডীতে বহুবার ‘অম্বিকা’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে অম্বিকাকে রুদ্রভগিনী-রূপে পাওয়া যায়। আবার অন্যত্র রুদ্রপত্নী-রূপেও দেখা যায়। এই ক্ষীণ সূত্র ধরে দেবীর সঙ্গে শিবের যোগাযোগ প্রমাণ করা যায় না বলে পণ্ডিতদের অভিমত। সম্ভবত অম্বিকা নামটা এখানে সাধারণভাবেই গৃহীত হয়েছে।
‘চণ্ডী’র বিভিন্ন অধ্যায়ে তাঁকে সর্বদাই বলা হয়েছে বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুমায়া– শিবশক্তি বা শিবমায়া কখনওই নন। যেমন একাদশ অধ্যায়ে দেবীস্তুতিতে তাঁকে বলা হয়েছে– ‘ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীর্যা’। আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দেবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে– ‘বিদ্যা তথৈব ক্রিয়তে ভগবদ্ বিষ্ণুমায়য়া’। এছাড়া পঞ্চম অধ্যায়ে দেবীর প্রসিদ্ধ পঁয়ষট্টিটি নমস্কার স্তোত্রগুলোতে ‘নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ বলে দেবীকে নমস্কার করা হয়েছে, এই শ্লোকগুলোর মধ্যে দেবীর সর্বপ্রথম পরিচয়েই দেখা যায় বলা হয়েছে–
‘চণ্ডী’র বিভিন্ন অধ্যায়ে তাঁকে সর্বদাই বলা হয়েছে বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুমায়া– শিবশক্তি বা শিবমায়া কখনওই নন। যেমন একাদশ অধ্যায়ে দেবীস্তুতিতে তাঁকে বলা হয়েছে– ‘ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীর্যা’। আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দেবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে– ‘বিদ্যা তথৈব ক্রিয়তে ভগবদ্ বিষ্ণুমায়য়া’। এছাড়া পঞ্চম অধ্যায়ে দেবীর প্রসিদ্ধ পঁয়ষট্টিটি নমস্কার স্তোত্রগুলোতে ‘নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ বলে দেবীকে নমস্কার করা হয়েছে, এই শ্লোকগুলোর মধ্যে দেবীর সর্বপ্রথম পরিচয়েই দেখা যায় বলা হয়েছে–
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।– (চণ্ডী-৫/১৪)
অর্থাৎ– যে দেবী সকল প্রাণীতে বিষ্ণুমায়া নামে [আগমশাস্ত্রে] অভিহিতা হন, তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
আবার দেখা যাচ্ছে, ‘চণ্ডী’র একাদশ অধ্যায়ের আট থেকে তেইশ পর্যন্ত শ্লোকে দেবীর যে প্রসিদ্ধ নমস্কার-শ্লোকগুলো রয়েছে তার সর্বত্র দেবীকে নমস্কার করা হয়েছে ‘নারায়ণি নমোহস্তু তে’ বলে। দেবীকে কখনও ‘ত্র্যম্বকে গৌরি’ কখনও ‘মাহেশ্বরীস্বরূপেণ’ ইত্যাদি বলা হয়েছে, অথচ নমস্কারের বেলায় (নারায়ণ-শক্তি) ‘নারায়ণি নমোহস্তু তে’। যেমন–
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।– (চণ্ডী-১১/১০)
ত্রিশূলচন্দ্রাহিধরে মহাবৃষভবাহিনি।
মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণি নমোহস্তু তে।।– (চণ্ডী-১১/১৪)
অর্থাৎ : আপনি সর্বমঙ্গলস্বরূপ, সর্বাভীষ্টসাধিকা, একমাত্র শরণযোগ্যা, ত্রিভুবন-জননী ও গৌরবর্ণা (বা ত্রিনয়না= সূর্যচন্দ্রাগ্নিলোচনা)। হে নারয়ণি, আপনাকে প্রণাম। (১১/১০)।। হে দেবী, আপনি ত্রিশূল, অর্ধচন্দ্র ও সর্প ধারণ করেন এবং মহাবৃষ আপনার বাহন। আপনি মহেশ্বর-শক্তিরূপা। হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। (১১/১৪)।।
এ-প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেবী চণ্ডিকা এভাবে নারায়ণীরূপে নমস্যা কেন। বিষয়টা অত্যন্ত গূঢ়ার্থ-ব্যঞ্জক বলেই মনে হয়। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে–
‘ভারতবর্ষের দার্শনিক শক্তিবাদ মূলতঃ শিবকে অবলম্বন করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে বলিয়া আমাদের মনে একটা দৃঢ়সংস্কার রহিয়াছে; কিন্তু এই দার্শনিক শক্তিবাদের ইতিহাস লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইব আমাদের এই সংস্কারটি সর্বাংশে সত্য নহে। ইতিহাস-লব্ধ তথ্যের উপরে নির্ভর করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলে বলিতে হয়, দার্শনিক শক্তিবাদ বেশি করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে বিষ্ণুশক্তিকে অবলম্বন করিয়া। দার্শনিক শক্তিবাদের বীজ উপনিষদাদিতেই নানাভাবে ছড়াইয়া আছে; কিন্তু শক্তিবাদ-সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট এবং সুষ্ঠু আলোচনা প্রথম দেখিতে পাই পঞ্চরাত্র-সংহিতাগুলির মধ্যে। বিষ্ণুশক্তিকে অবলম্বন করিয়া যে শক্তিতত্ত্বের আলোচান দেখিতে পাই তৎপূর্বে এরূপ আলোচনা কোনও শৈব বা শাক্ত গ্রন্থে আছে বলিয়া আমাদের জানা নাই।… এই সংহিতাগুলিকে অতি প্রাচীন বলিয়া গণ্য করা হয়; সম্প্রদায়ের লোকগণ এগুলিকে যত প্রাচীন বলিয়া মনে করিয়াছেন পণ্ডিতগণ এগুলিকে তত প্রাচীন বলিয়া স্বীকার না করিলেও এগুলিকে খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতকের কাছাকাছি সময়ে রচিত বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। ইহার পরে শক্তিবাদ-সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক আলোচনা দেখিতে পাই কাশ্মিরের শৈব-দর্শনে। এই শৈব-দর্শনগুলি মোটামুটিভাবে খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দী হইতে খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যে লিখিত বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। কাশ্মীরে শৈব-দর্শনের প্রাচীন আচার্যগণ যে পঞ্চরাত্র-শাস্ত্রের সহিত পরিচিত ছিলেন তাহার প্রমাণ আছে। বাঙলাদেশে এবং দাক্ষিণাত্যের কেরলাদি অঞ্চলে যে-সকল শাক্ত-তন্ত্র প্রচলিত আছে তাহাতে দার্শনিক শক্তিবাদ নানাভাবে ছড়ান আছে, কিন্তু কোনও এক গ্রন্থে ব্যাপক এবং স্পষ্টভাবে নাই। তাহা ছাড়া বাঙলাদেশে ও দাক্ষিণাত্য-অঞ্চলে রচিত বা প্রচলিত এই তন্ত্রাদিগ্রন্থের কোনও গ্রন্থই দশম শতকের পূর্ববর্তী কালে রচিত বলিয়া মনে করি না।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৯-৬০)
সে যাক্, চণ্ডী পাঠ করলে সেখানে দেবীর দু’টি রূপ প্রধানভাবে ভেসে ওঠে। একটি হলো দেবীর ‘বিষ্ণুশক্তি’ রূপ, অন্যটি হলো দেবীর পরম ‘স্বতন্ত্রা’ রূপ। দেবীর ‘বিষ্ণুশক্তি’ রূপ বিষয়ে আমরা কিছুটা অবগত হতে পেরেছি। এবার আসা যাক ‘স্বতন্ত্রা’ রূপে।
‘ভারতবর্ষের দার্শনিক শক্তিবাদ মূলতঃ শিবকে অবলম্বন করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে বলিয়া আমাদের মনে একটা দৃঢ়সংস্কার রহিয়াছে; কিন্তু এই দার্শনিক শক্তিবাদের ইতিহাস লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইব আমাদের এই সংস্কারটি সর্বাংশে সত্য নহে। ইতিহাস-লব্ধ তথ্যের উপরে নির্ভর করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলে বলিতে হয়, দার্শনিক শক্তিবাদ বেশি করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে বিষ্ণুশক্তিকে অবলম্বন করিয়া। দার্শনিক শক্তিবাদের বীজ উপনিষদাদিতেই নানাভাবে ছড়াইয়া আছে; কিন্তু শক্তিবাদ-সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট এবং সুষ্ঠু আলোচনা প্রথম দেখিতে পাই পঞ্চরাত্র-সংহিতাগুলির মধ্যে। বিষ্ণুশক্তিকে অবলম্বন করিয়া যে শক্তিতত্ত্বের আলোচান দেখিতে পাই তৎপূর্বে এরূপ আলোচনা কোনও শৈব বা শাক্ত গ্রন্থে আছে বলিয়া আমাদের জানা নাই।… এই সংহিতাগুলিকে অতি প্রাচীন বলিয়া গণ্য করা হয়; সম্প্রদায়ের লোকগণ এগুলিকে যত প্রাচীন বলিয়া মনে করিয়াছেন পণ্ডিতগণ এগুলিকে তত প্রাচীন বলিয়া স্বীকার না করিলেও এগুলিকে খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতকের কাছাকাছি সময়ে রচিত বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। ইহার পরে শক্তিবাদ-সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক আলোচনা দেখিতে পাই কাশ্মিরের শৈব-দর্শনে। এই শৈব-দর্শনগুলি মোটামুটিভাবে খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দী হইতে খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যে লিখিত বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। কাশ্মীরে শৈব-দর্শনের প্রাচীন আচার্যগণ যে পঞ্চরাত্র-শাস্ত্রের সহিত পরিচিত ছিলেন তাহার প্রমাণ আছে। বাঙলাদেশে এবং দাক্ষিণাত্যের কেরলাদি অঞ্চলে যে-সকল শাক্ত-তন্ত্র প্রচলিত আছে তাহাতে দার্শনিক শক্তিবাদ নানাভাবে ছড়ান আছে, কিন্তু কোনও এক গ্রন্থে ব্যাপক এবং স্পষ্টভাবে নাই। তাহা ছাড়া বাঙলাদেশে ও দাক্ষিণাত্য-অঞ্চলে রচিত বা প্রচলিত এই তন্ত্রাদিগ্রন্থের কোনও গ্রন্থই দশম শতকের পূর্ববর্তী কালে রচিত বলিয়া মনে করি না।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৯-৬০)
সে যাক্, চণ্ডী পাঠ করলে সেখানে দেবীর দু’টি রূপ প্রধানভাবে ভেসে ওঠে। একটি হলো দেবীর ‘বিষ্ণুশক্তি’ রূপ, অন্যটি হলো দেবীর পরম ‘স্বতন্ত্রা’ রূপ। দেবীর ‘বিষ্ণুশক্তি’ রূপ বিষয়ে আমরা কিছুটা অবগত হতে পেরেছি। এবার আসা যাক ‘স্বতন্ত্রা’ রূপে।
বলাবাহুল্য, ভারতবর্ষের শাক্ত-ধর্ম ও শাক্ত-দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে দেবীর মুখ্য তিনটি রূপ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত দেখা যায়, দেবী শিবাশ্রয়া– পরমেশ্বর শিবই হলেন পরমতত্ত্ব– দেবী সেই পরমতত্ত্ব মহেশ্বরের পত্নী বা শক্তিরূপে গৃহীতা। শক্তি ও শক্তিমানের অভেদত্ব স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও এখানে ধর্মে ও সাহিত্যে শিবেরই পরমশক্তিমান রূপে প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় মতে দেখা যায় শিব ও দেবী বা শক্তির সমপ্রাধান্য– তন্ত্রের মধ্যে এই তত্ত্বেরই প্রাধান্য দেখা যায়। আর তৃতীয় যে মতটি পাওয়া যায়, সেখানে দেবী ‘স্বতন্ত্রা’– তিনিই পরমতত্ত্ব। এখানে দেবী হলেন ত্রিভুবনব্যাপিনী এক অদ্বিতীয়া মহাশক্তি– সেই মহাশক্তি থেকেই সব কিছু প্রসূত– সেই দেবীর উপরে আর কিছুই নাই। অন্যান্য দেবতাদের বিভিন্ন ও বিচিত্রভাবে এই অদ্বিতীয়া মহাশক্তির আধার-স্বরূপত্বেই যা-কিছু মহিমা।
উপনিষদাদিতে দেখা যায়, ব্রহ্মই এক এবং অদ্বিতীয়– তিনিই পরাৎপর– তাঁহার ভাস বা দীপ্তি নিয়েই দেবগণ পশ্চাৎ প্রকাশ হন। এই ‘স্বতন্ত্রা’ বা সর্বেশ্বরবাদী রূপ ‘চণ্ডী’তেও চোখে পড়ে। যেমন–
উপনিষদাদিতে দেখা যায়, ব্রহ্মই এক এবং অদ্বিতীয়– তিনিই পরাৎপর– তাঁহার ভাস বা দীপ্তি নিয়েই দেবগণ পশ্চাৎ প্রকাশ হন। এই ‘স্বতন্ত্রা’ বা সর্বেশ্বরবাদী রূপ ‘চণ্ডী’তেও চোখে পড়ে। যেমন–
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।। –(চণ্ডী-১/৫৮)
পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।। –(চণ্ডী-১/৮২)
অর্থাৎ: তিনিই সংসারবন্ধনের কারণস্বরূপা অবিদ্যা এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু আদি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী। (১/৫৮)।। আপনি ব্রহ্মাদিরও শ্রেষ্ঠ। আপনি সর্বপ্রধানা দেবী এবং পরমেশ্বরের মহাশক্তি। (১/৮২)।।
এছাড়া, দেবীর হাতে নিশুম্ভের মৃত্যুর পরে শুম্ভ যখন দেবীকে বলেছিল– ‘অন্যাসাং বলমাশ্রিত্য যুধ্যসে যাহতিমানিনী’– ‘যে অতিমানিনী তুমি অন্যান্য দেবীগণের বল আশ্রয় করিয়াই যুদ্ধ করিতেছ।’ উত্তরে দেবী দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন–
একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট মষ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।– (চণ্ডী-১০/৫)
অর্থাৎ– জগতে আমি একাই। আমার পরে কে আর দ্বিতীয়া আছে? এই সব (দেবীগণ) আমারই বিভূতিমাত্র– হে দুষ্ট, দেখ, সেই আমার বিভূতিসকল আমার মধ্যেই প্রবেশ করিতেছে।
–এ কথা বলে দেবী তাঁর সমস্ত দেবীরূপধারী বিভূতি নিজের মধ্যেই আবার নিঃশেষে সংহরণ করে রণক্ষেত্রে একাকিনী বিরাজ করতে রইলেন। ‘চণ্ডী’র মধ্যে দেবীর এই যে স্বতন্ত্র রূপ দেখতে পাই তারই বিস্তার দেখা যায় পরবর্তীকালে রচিত ‘দেবী-ভাগবতে’র মধ্যে। যেমন, দেবী-ভাগবতের এক জায়গায় দেখা যায়, ব্রহ্মই পরতত্ত্ব কি দেবীই পরতত্ত্ব এই সংশয় তোলে ব্রহ্মা দেবীকে প্রশ্ন করেছেন–
একমেবাদ্বিতীয়ং যদ্ ব্রহ্ম বেদা বদন্তি বৈ।
সা কিং ত্বং বাপ্যসৌ বা কিং সন্দেহং বিনির্বতয়।।– (দেবী-ভাগবত-৩/৫/৪৩)
অর্থাৎ : বেদ-সকল যে এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মের কথা বলেন, তুমিই বা কী এবং সেই ব্রহ্মই বা কী– এই সন্দেহ দূর কর।
উত্তরে দেবী বললেন–
সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ।
যোহসৌ সাহমহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ।।- (দেবী-ভাগবত-৩/৬/২)
অর্থাৎ : আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নাই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নয়।
পৃথক পৃথক শক্তি ও মহিমাকে কোন এক সনাতনীদেবীর ধারণার মধ্যে একত্রিকরণ ভারতীয় বা বাঙলা পুরাণ সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বৈকি। এখানে উল্লেখ্য, শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থটি মূলত চতুর্থ শতাব্দীর রচনা মার্কণ্ডেয় পুরাণের সপ্তশতী চণ্ডী অংশ, যা কিনা প্রক্ষিপ্ত অংশ হিসেবে পরবর্তীকালের সংযোজন বলে বিদ্বান বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যদিও এতে সাধকদৃষ্টির ঐক্যবুদ্ধি ক্ষুণ্ন হয় না। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে (২/৬৬/৭-১০) আছে, মহাশক্তি মূলা প্রকৃতি হতে বিশ্ব উৎপন্ন এবং তিনিই বিশ্বপ্রপঞ্চের সারভূতা পরা সত্তা। এ প্রেক্ষিতে আমাদের প্রাচীন সাংখ্য দর্শনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ঐকমত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আবার বৃহন্নারদীয় পুরাণে দেবীকে সর্বশক্তিমতী বিশ্বপ্রসবিনীরূপে বর্ণনান্তে বলা হয়েছে–
উমেতি কেচিদাহুস্তাং শক্তিং লক্ষ্মীং তথাপরে।
ভারতীত্যপরে চৈনাং গিরিজেতামবিকেতি চ।।
দুর্গেতি ভদ্রকালীতি চণ্ডী মাহেশ্বরীতি চ।
কৌমারী বৈষ্ণবী চেতি বারাহীতি তথাপরে।।
অর্থাৎ : সেই দেবীকে কেহ শক্তি, কেহ উমা, কেহ বা লক্ষ্মী বলেন। ভারতী, গিরিজা, অম্বিকা, দুর্গা, ভদ্রকালী, চণ্ডী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী প্রভৃতি নামেও তিনি অভিহিতা।
দেবীভাগবতের মতে সর্বভূতে শক্তি আত্মারূপে বিদ্যমান এবং প্রাণী শক্তিহীন হলে শববৎ নিষ্ক্রিয় হয়। এই পুরাণ অনুসারে পরম পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত– এক ভাগ সচ্চিদানন্দ এবং দ্বিতীয় ভাগ পরাশক্তি, মায়াশক্তি। কিন্তু দুই ভাগ মূলত অভিন্ন। বহ্নি ও তৎশক্তির ন্যায় পরম পুরুষ ও পরমা প্রকৃতি অদ্বৈত। দেবীভাগবতে আছে–
সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিণী।
রূপং বিভর্তারূপা চ ভক্তানুগ্রহহেতবে।।
অর্থাৎ : সেই সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হইয়াও ভক্তগণকে কৃপা করিবার জন্য রূপ ধারণ করেন।
কারো কারো মতে, পূর্বে বৈদিক কবিদের চিত্তেও মাতৃদেবীর রূপকল্পনা উদিত হয়েছিলো এবং তা অদিতি, ঊষা, সরস্বতী, পৃথিবী, রাত্রি, পুরন্ধি, ইড়া, ধীষণা প্রভৃতি দেবীর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। বেদোত্তর সাহিত্যে যাকে ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত (১০/১২৫) বলে অভিহিত করা হয় তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বৈদিক ঋষি সমস্ত প্রাণী, মনুষ্য, দেবতা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যে এক দেবীশক্তি নিহিত আছে তা স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বোধকরি যথেষ্ট পর্যালোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। তবে অম্বিকা, উমা, দুর্গা, কালী প্রভৃতি যে সব দেবীকে আশ্রয় করে শাক্ত ধর্ম প্রবর্তিত হয় তাঁদের নামোল্লেখ উত্তর-বৈদিক সাহিত্যেই দেখা যায়।
দেবী কাত্যায়নী : দেবীসূক্ত ছাড়াও ঋগ্বেদে (১০/১২৭) আরও একটি সূক্ত বর্তমান যা রাত্রিসূক্ত নামে পরিচিত। কারো কারো মতে এখানে কিছু তান্ত্রিক ধারণার পূর্বাভাষ পাওয়া যায়। বেদ-সংহিতা উত্তর তৈত্তিরীয় আরণ্যকে কাত্যায়নী, কন্যাকুমারী, ও দুর্গি বা দুর্গার উল্লেখ আছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম খণ্ডের প্রথম অনুবাকে উদ্ধৃত দুর্গা গায়ত্রীটি হলো–
‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারিং ধীমহি। তন নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।’
জিতেন্দ্রনাথ বলেন,- ‘ইহাতে দেবীর তিনটি নামই নূতন, এবং ইহাদের প্রত্যেকটি পৌরাণিক শক্তি-পূজায় ব্যবহৃত হইয়াছিল। কন্যাকুমারী দক্ষিণ ভারতের একটি প্রসিদ্ধ তীর্থের নাম, এবং ইহার সমধিক প্রাচীনত্ব খৃষ্টীয় প্রথম শতকের এক অজ্ঞাতনামা যবন লেখকের উক্তি দ্বারা সমর্থিত হয়। ইনি বলিয়াছেন যে, ‘কোমরি নামক স্থানে কোমরি অন্তরীপ ও বন্দর অবস্থিত; এখানে সেই সকল ব্যক্তি (স্ত্রী ও পুরুষ) আসেন যাঁহারা তাঁহাদের উৎসর্গীকৃত (দেবীর উদ্দেশে?) স্নান করিতে ইচ্ছা করেন; কারণ ইহা কথিত আছে যে একটি দেবী এক সময়ে এখানে বসবাস করিতেন এবং সমুদ্রে স্নান করিতেন’। এই দেবীই যে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে উক্ত ও কুমারী কন্যা রূপে বর্ণিত কন্যাকুমারী দেবী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। কাত্যায়নী নামের তাৎপর্য সম্বন্ধে রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর জার্মান পণ্ডিত ওয়েবারের মত অনুসরণ করিয়া বলিয়াছেন যে কাত্য বংশীয় ব্রাহ্মণদিগের ইষ্টদেবী ছিলেন বলিয়াই বোধ হয় তাঁহার এই নামকরণ হইয়াছিল। প্রসঙ্গতঃ ইহাও তিনি বলিয়াছেন যে দেবীর কৌশিকী নামেরও অনুরূপ ব্যাখ্যা সঙ্গত; রাত্রিসূক্তের ঋষি কুশিক, এবং যেহেতু কুশিক গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণের তিনি ইষ্টদেবী, সেহেতু দেবীর অন্য নাম কৌশিকী।’- (পঞ্চোপসনা)
মহিষাসুর নিধনের জন্যই দেবতাদের কোপ থেকে যে দেবীর জন্ম, দেবীভাগবতে সেই দেবতেজঃসম্ভূতা মহাশক্তির নাম মহালক্ষ্মী; আর বামনপুরাণে সেই দেবীর নাম কাত্যায়নী। বামনপুরাণ (বাঃ পুঃ-১৮/৫-৮) উপাখ্যান অনুসারে দেবতেজ ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে উপস্থিত হলে ঋষি কাত্যায়নের তেজ দেবতেজের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ায় এই সম্মিলিত তেজ থেকে দেবতেজঃসম্ভূতা চঞ্চল ও দীর্ঘনয়না যোগবিশুদ্ধদেহা কাত্যায়নীর জন্ম হয়। যেমন, (বামনপুরাণ-১৮/৫-৮)–
ইত্থং মুরারিঃ সহ শঙ্করেণ শ্রুত্বা বচো বিপ্লুতচেতসাং হি।
দৃষ্ট্বাত্র চক্রে সহসৈব কোপং কালাগ্নিকল্পো হরিরব্যয়াত্মা।। ৫
ততোহনুকোপান্মধুসূদনস্য শঙ্করস্যাপি পিতামহস্য।
তথৈব শক্রাদিষুদৈবতেষু মহদ্ধিতেজো বদনাদ্বিনিঃসৃতম্ ।। ৬
তচ্চেকতাং পর্বতকূটসন্নিভং জগাম তেজঃ প্রবরাশ্রমে মুনে।
কাত্যায়নস্যাপ্রতিমেন তেজসা মহার্ষিণা তেজ উপাকৃতঞ্চ।। ৭
তেনর্ষিসৃষ্টেন চ তেজসাবৃতং জ¦লৎপ্রকাশার্কসহস্রতুল্যং।
তস্মাচ্চজাতা তরলায়তাক্ষী কাত্যায়নী যোগবিশুদ্ধদেহা।। ৮
অর্থাৎ– এইভাবে বিষ্ণু শঙ্করের সঙ্গে দেবতাদের কথা শুনে এবং তাঁদের অবস্থা দেখে বিহ্বলচিত্ত হয়ে অব্যয়াত্মা হরিহর সহসা কালাগ্নিসদৃশ কোপ প্রকাশ করলেন। ৫।। তারপর মধুসূদন শঙ্কর ও পিতামহ ব্রহ্মার অনুরূপভাবে ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবগণের বদন থেকে মহৎ তেজ নির্গত হোল। ৬।। হে মুনে, সেই পর্বতশৃঙ্গসদৃশ একতাপ্রাপ্ত তেজ কাত্যায়নের শ্রেষ্ঠ আশ্রমে গমন করে। কাত্যায়নের অতুলনীয় তেজের দ্বারা মহর্ষি ঐ তেজকে বর্ধিত করলেন। ৭।। ঋষিসৃষ্ট তেজের দ্বারা আবৃত হওয়ায় ঐ তেজ সহস্র সূর্যতুল্য প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো, সেই তেজ থেকে চঞ্চল ও দীর্ঘনয়না যোগবিশুদ্ধদেহা কাত্যায়নী জন্মালেন। ৮।।
শিবের তেজে হলো দেবীর মুখ, অগ্নির তেজে জন্মাল ত্রিনয়ন, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে অষ্টাদশ বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তনযুগল, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে উরু, জঙ্ঘাদ্বয় ও নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পাদযুগল সৃষ্টি হলো। এভাবে সকল দেবতার তেজে দেবী কাত্যায়নীর অবয়ব গঠিত হলো। এখানেও কাত্যায়নীর সঙ্গে অন্যান্য দেবতার সম্পর্ক যতটুকু, শিবের সঙ্গে তার বেশি নয়। মহিষাসুর বধের পর কাত্যায়নী শিবের পাদমূলে প্রবেশ করেছিলেন–
সংস্তূয়মানা সুরসিদ্ধসঙ্ঘৈঃ কাত্যায়নী সা হরপাদমূলে।
ভূয়োভবিষ্যাম্যমরার্থমেবমুক্ত্বা সুরাংস্তান্ প্রাবিবেশ দুর্গা। –(বামনপুরাণ-২০/৫১)
অর্থাৎ– দেবগণ এবং সিদ্ধগণের দ্বারা স্তুতা হয়ে সেই কাত্যায়নী দুর্গা দেবগণকে আবার আমি আবির্ভূতা হব বলে শিবের পাদমূলে প্রবেশ করেছিলেন।
একইভাবে কালিকাপুরাণেও দেখা যায়, দেবতেজ বিনির্গতা মহাশক্তি ঋষি কাত্যায়নের দ্বারা কায়াবতী হয়েছিলেন এবং কাত্যায়নী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন–
ইতি প্রকুপ্যতাং তেষাং শরীরেভ্যঃ পৃথক্ পৃথক্ ।
নিশ্চক্রমুশ্চ তেজাংসি শক্তিরূপাণি তৎক্ষণাৎ।।
তত্তেজোভির্ধ্বতবপুর্দেবী কাত্যায়নেন বৈ।
পশ্চাজ্জঘান মহিষং জগদ্ধাত্রী জগন্ময়ী।। –(কালিকাপুরাণ-৬৩/৭৬-৭৭)
অর্থাৎ– এইভাবে প্রকুপিত দেবগণের শরীর থেকে শক্তিরূপী তেজ তৎক্ষণাৎ নির্গত হয়েছিল। সেই তেজ কাত্যায়নের দ্বারা কায়া লাভ করেছিল। পরে জগদ্ধাত্রী জগন্ময়ী দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।
দেবগণের রোষসম্ভূতা চণ্ডী ও কাত্যায়নী বস্তুত একই দেবতার নামান্তর মাত্র। এই দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তন্ত্রসারে কাত্যায়নীর ধ্যানমন্ত্রে কাত্যায়নীকে দশভূজা মহিষাসুর মর্দিনী চণ্ডীরূপেই বর্ণনা করা হয়েছে বলে অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, পৃষ্ঠা-১৬৭)–
সব্যপাদসরোজেনালঙ্কৃতোরুমৃগাধিপাম্ ।
বামপাদাগ্রদলিতমহিষাসুরনির্ভরাম্ ।।
সুপ্রসন্নাং সুবদনাং চারুনেত্রত্রয়ান্বিতাম্ ।
হারনূপুরকেয়ূরজটামুকুটমণ্ডিতাম্ ।
বিচিত্রপট্টবাসামর্ধচন্দ্রবিভূষিতাম্ ।।
খড়্গখেটকবজ্রাণি ত্রিশূলং বিশিখং তথা।
ধারয়ন্তীং ধনুঃ পাশং শঙ্খং ঘণ্টাং সরোরুহাম্ ।
বাহুভির্ললিতৈর্দেবীং কোটিচন্দ্রসমপ্রভাম্ ।। –(তন্ত্রসার)
অর্থাৎ– যিনি দক্ষিণ পাদপদ্ম দ্বারা বিশাল মৃগরাজকে অলংকৃত করিয়া বামপদের অগ্রদ্বারা মহীষাসুরকে বিদলিত করিতেছেন, যাঁহার সুন্দর বদন সর্বদা সুপ্রসন্ন, মনোহর তিনটি নেত্র, হার, নূপুর, কেয়ুর, জটামুকুট প্রভৃতি অলঙ্কারে যিনি বিভূষিতা, যাঁহার পরিধানে বিচিত্র পট্টবস্ত্র ও কপালে অর্ধচন্দ্র, সুকোমল দশবাহু দ্বারা যিনি খড়্গ, খেটক, বজ্র, ত্রিশূল, বাণ, ধনুঃ, পাশ, শঙ্খ, ঘণ্টা ও পদ্ম এই দশবিধ অস্ত্র ধারণ করিতেছেন, কোটি চন্দ্রের ন্যায় যাঁহার দেহপ্রভা… সেই দেবীকে ধ্যান করিবে। (অনুবাদ– পঞ্চানন তর্করত্ন)
বলা বাহুল্য, এই মূর্তি মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার। যদিও বামনপুরাণের মতোই হরিবংশে দেবী কাত্যায়নী অষ্টাদশভুজা, চণ্ডীর উপাখ্যানে চণ্ডী ও কাত্যায়নী একই দেবতার দুই নাম। চণ্ডীর একাদশ অধ্যায় নারায়ণীস্তুতিতে দেখা যায়, শুম্ভনিশুম্ভ বধের পর দেবগণ কাত্যায়নীর স্তুতি করেছিলেন–
দেব্যা হতে তত্র মহাসুরেন্দ্রে সেন্দ্রাঃ সুরা বহ্নিপুরোগমাস্তাম্ ।
কাত্যায়নীং তুষ্টুবুরিষ্টলম্ভাদ্ বিকাসিবক্ত্রাস্তু বিকাসিতাশাঃ।। –(চণ্ডী-১১/২)
অর্থাৎ– মেধা ঋষি বলিলেন– সেই যুদ্ধে দেবী কর্তৃক অসুরাধিপতি শুম্ভ নিহত হইলে অগ্নিপ্রমুখ ইন্দ্রাদি দেবগণ শুম্ভাদিবধরূপ অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ায় প্রফুল্লবদনে সকল দিক উদ্ভাসিত করিয়া সেই কাত্যায়নী দেবীকে স্তব করিতে লাগিলেন।
অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে,– ‘কাত্যায়নী পূজা অনেক প্রাচীন। বাণভট্ট কাদম্বরীতে কাত্যায়নীর উল্লেখ করেছেন– কাত্যায়ন্যা ত্রিশূলেনেবাঙ্কিতম্ । ভাগবতে কুমারীরা মনোমত পতিলাভের কামনায় কাত্যায়নী পূজা করতেন। চণ্ডীতে কাত্যায়নী চণ্ডীরই নাম। শুম্ভনিশুম্ভ বধের পর দেবগণ কাত্যায়নীর স্তুতি করেছিলেন। গোপাল চক্রবর্তী চণ্ডীর (মার্কণ্ডেয় পুঃ-১২/২২) টীকায় কাত্যায়নী শব্দের অর্থ প্রসংগে লিখেছেন, “কাত্যায়নাশ্রমে প্রাদুর্ভুতত্বাৎ কাত্যায়নী।” মনে হয়, কাত্যায়ন ঋষি বা কাত্যায়ন বংশীয়দের দ্বারা দেবী পূজিতা হতেন।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৬৭)
গিরিসূতা গৌরী : গিরিসূতা-গৌরী নামটি পাওয়া যায় মৈত্রায়ণী সংহিতায়, যা আমাদের কেনোপনিষদের শেষ দুুটি আখ্যায়িক বা কাহিনী আকারের গদ্যে বর্ণিত উমা-হৈমবতীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কৃষ্ণযজুর্বেদ শাখাভুক্ত মৈত্রায়নীয় সংহিতায় শতরুদ্রীয় সূক্তগুলির উপক্রমণিকা হিসেবে তৎপুরুষ-মহাদেব, কুমার কার্তিকেয়, হস্তিমুখ (গণেশ), চতুর্মুখ ব্রহ্মা, কেশব-নারায়ণ, ভাস্কর-প্রভাকর প্রভৃতি গৌরাণিক দেবতার গায়ত্রীর সাথে গিরিসুতা গৌরীর গায়ত্রীও পাওয়া যায়। এখানে দেবী-গায়ত্রীটি হলো–
‘তদ্-গাঙ্গৌচ্যায় বিদ্মহে গিরিসুতায় ধীমহি। তন্নো গৌরী প্রচোদয়াৎ।’
তবে শ্রদ্ধেয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘মৈত্রায়নীয় সংহিতার এই অংশ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম খণ্ডের ন্যায় অর্বাচীন বৈদিক সাহিত্য, কারণ দুইটিতেই লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর স্পষ্ট উল্লেখ রহিয়াছে।’
দুর্গা, কালী ও করালী : শক্তিপূজায় দেবীর যে দুটি নাম– দুর্গা ও কালী– প্রধান স্থান অধিকার করে, এর মধ্যে দুর্গা বা দুর্গি নামের প্রথম উল্লেখ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সংশ্লিষ্ট গায়ত্রীটি ইতঃপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার এই তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম খণ্ডের দ্বিতীয় অনুবাকে দুর্গার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ–
তাং অগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্ ।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।। (তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০/২)
অর্থাৎ : অগ্নিবর্ণা তপপ্রদীপ্তা সূর্য (বা অগ্নির) কন্যা, যিনি কর্মফলের (পুরস্কার প্রদানের জন্য লোকদিগের দ্বারা) প্রার্থিত হন, এমন দুর্গা দেবীর আমি শরণাপন্ন হই; হে সুন্দর রূপে ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার।
এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ বলেন,– ‘মহাকাব্য ও পুরাণাদি যুগের যে সকল দুর্গাস্তবে তাঁহার ত্রাণকারিণী ও সিদ্ধিদায়িকা রূপ পরিস্ফুট হইয়াছে, উক্ত রূপ-বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রথম প্রকাশ আমরা এই অর্বাচীন বৈদিক সাহিত্যে পাই। উপরন্তু তাঁহার তপস্যা ও অগ্নি বা তেজের সহিত ঘনিষ্ট সম্পর্কও এই অনুবাকে সুনির্দিষ্ট হইয়াছে। জার্মান পণ্ডিত ওয়েবার দুর্গাকে যজ্ঞাগ্নির সহিত সংযুক্ত করিয়াছিলেন। দেবীর আর এক নাম কালী ও উহার অন্য রূপ করালী মুণ্ডক উপনিষদে প্রথম দেখিতে পাওয়া যায়।’- (পঞ্চোপাসনা)
মুণ্ডকোপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নামে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন–
কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বাঃ।। (মুন্ডক-১/২/৪)
অর্থাৎ : যজ্ঞাগ্নির সেই লেলিহান শিখা আকাশপানে ওঠে সাত শিখা হয়ে। শৌনক, সেই সাতটি শিখার নাম– কালী, করালী, মনোজবা (মনের মতো দ্রুতগামী), সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী আর বড় সৌন্দর্যশালিনী বিশ্বরূচী। এই সাতটি শিখা হলো অগ্নিদেবের সাতটি জিভ। টলটলে, লকলকে এই জিভ দিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞের আহুতি দেন।
‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে,– ‘কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী এবং বিশ্বরূচী এই সপ্ত নাম লেলায়মান অগ্নির এক বৈশিষ্ট্যসূচক বর্ণনা। নামগুলির নির্দিষ্ট সংখ্যা পরবর্তী কালের মাতৃকাগণের নামসংখ্যার সহিত তুলনীয়; মাতৃকাগণও সাধারণতঃ সপ্তসংখ্যক। শিবপত্নী দুর্গার উগ্ররূপ হিসাবে কালী ও করালী পৌরাণিক যুগে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, এবং এই ঘোররূপা দেবীর মন্দিরে নরবলি প্রদানের প্রথা ছিল। ভবভূতির মালতীমাধবে করালী চামুণ্ডার মন্দিরে তান্ত্রিক উপাসক কাপালিক অঘোরঘণ্টা কর্তৃক মালতীকে বলিদান করিবার প্রচেষ্টার কথা এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে বলা হইয়াছে (পৃঃ ১৬১)। ওয়েবার এই তালিকার তৃতীয় নাম মনোজবার সহিত শুক্ল যজুর্বেদ শাখার বাজসনেয়ী সংহিতারয় উক্ত (৫, ১১) মৃত্যুর দেবতা যমের অন্যতম অভিধা মনোজবসের তুলনা করিয়া প্রশ্ন করিয়াছেন যে ইহা কি পরবর্তী যুগে দেবীকে যমের স্ত্রী রূপে পরিচিত করিয়াছিল? তাঁহার এ প্রশ্ন নিতান্ত যুক্তিহীন নহে। কারণ পুরাণাদিতে উক্ত সপ্ত মাতৃকার শেষসংখ্যক মাতৃকা চামুণ্ডা যামী বা যমপত্নী বলিয়া কোথাও কোথাও বর্ণিত হইয়াছেন।’
‘উপরিলিখিত নামগুলি ব্যতীত দেবীর অপর কয়টি নাম যথা ভদ্রকালী, শ্রী, ভবানী ইত্যাদি সাংখ্যায়ন ও হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র প্রভৃতি শেষের স্তরের বৈদিক সাহিত্যনিচয়ে পাওয়া যায়। শ্রীদেবী যদিও এই নামে তান্ত্রিক শক্তি উপাসনায় কোনও প্রধান স্থান অধিকার করেন নাই, তথাপি ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবতা রূপে তাঁহার ক্রমবিকাশ এ প্রসঙ্গে লক্ষ্য করা আবশ্যক। কারণ শক্তিপূজায় তাঁহার অন্য নাম লক্ষ্মীর আর এক রূপ মহালক্ষ্মীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছিল। ঋগ্বেদে উক্ত সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য ইত্যাদি দেবীদিগের কথা বলা হইয়াছে। উহাদের মধ্যে শ্রীদেবীর নাম নাই। শতপথ ব্রাহ্মণেই বোধ হয় দেবী হিসাবে তাঁহার প্রথম প্রকাশ। ইহাতে লিখিত আছে যে বিশ্বসৃষ্টি ক্রিয়াহেতু বিশেষ ক্লান্ত প্রজাপতির দেহ হইতে শ্রীদেবীর উদ্ভব হয়। দেবীর অপরূপ সৌন্দর্যের দীপ্তিতে দেবতারা ঈর্ষান্বিত হইয়া তাঁহাকে বধ করিতে উদ্যত হইলে, প্রজাপতি স্ত্রী অবধ্যা বলিয়া তাঁহাদিগকে নিরস্ত করেন, এবং তাঁহার নির্দেশানুযায়ী দেবীর রূপ, ঐশ্বর্য এবং বিবিধ গুণাবলী দেবতারা নিজেদের মধ্য বণ্টন করিয়া লন। পরে শ্রীদেবী প্রজাপতির উপদেশে দেবতাদিগকে বলিপ্রদানের দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া নিজের যাবতীয় রূপ, গুণ, ঐশ্বর্যাদি তাঁহাদিগের নিকট হইতে ফিরিয়া পান (শতপথ ব্রাহ্মণ, ১১. ৪. ১—)। এই কাহিনী এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদ ইত্যাদি গ্রন্থে শ্রীসম্বন্ধীয় উক্তসমূহ ইহাই প্রমাণিত করে যে সাধারণ মানবের কাম্য শ্রেয় ও প্রেয় বস্তু মাত্রেরই প্রতীক রূপে দেবী কল্পিত হইয়াছিলেন। ঋগ্বেদ পরিশিষ্টান্তর্গত শ্রীসূক্তের পঞ্চদশসংখ্যক অনুবাকগুলিতে তাঁহার এই বৈশিষ্ট্য মূর্ত হইয়াছে; তাঁহার লক্ষ্মীনামও বোধ হয় সর্বপ্রথম ইহাতেই পাওয়া যায়। তিনি এখানে সুবর্ণরজত মাল্যভূষিতা হিরণ্যবর্ণা হরিণী রূপে বর্ণিত হইয়াছেন–
‘উপরিলিখিত নামগুলি ব্যতীত দেবীর অপর কয়টি নাম যথা ভদ্রকালী, শ্রী, ভবানী ইত্যাদি সাংখ্যায়ন ও হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র প্রভৃতি শেষের স্তরের বৈদিক সাহিত্যনিচয়ে পাওয়া যায়। শ্রীদেবী যদিও এই নামে তান্ত্রিক শক্তি উপাসনায় কোনও প্রধান স্থান অধিকার করেন নাই, তথাপি ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবতা রূপে তাঁহার ক্রমবিকাশ এ প্রসঙ্গে লক্ষ্য করা আবশ্যক। কারণ শক্তিপূজায় তাঁহার অন্য নাম লক্ষ্মীর আর এক রূপ মহালক্ষ্মীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছিল। ঋগ্বেদে উক্ত সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য ইত্যাদি দেবীদিগের কথা বলা হইয়াছে। উহাদের মধ্যে শ্রীদেবীর নাম নাই। শতপথ ব্রাহ্মণেই বোধ হয় দেবী হিসাবে তাঁহার প্রথম প্রকাশ। ইহাতে লিখিত আছে যে বিশ্বসৃষ্টি ক্রিয়াহেতু বিশেষ ক্লান্ত প্রজাপতির দেহ হইতে শ্রীদেবীর উদ্ভব হয়। দেবীর অপরূপ সৌন্দর্যের দীপ্তিতে দেবতারা ঈর্ষান্বিত হইয়া তাঁহাকে বধ করিতে উদ্যত হইলে, প্রজাপতি স্ত্রী অবধ্যা বলিয়া তাঁহাদিগকে নিরস্ত করেন, এবং তাঁহার নির্দেশানুযায়ী দেবীর রূপ, ঐশ্বর্য এবং বিবিধ গুণাবলী দেবতারা নিজেদের মধ্য বণ্টন করিয়া লন। পরে শ্রীদেবী প্রজাপতির উপদেশে দেবতাদিগকে বলিপ্রদানের দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া নিজের যাবতীয় রূপ, গুণ, ঐশ্বর্যাদি তাঁহাদিগের নিকট হইতে ফিরিয়া পান (শতপথ ব্রাহ্মণ, ১১. ৪. ১—)। এই কাহিনী এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদ ইত্যাদি গ্রন্থে শ্রীসম্বন্ধীয় উক্তসমূহ ইহাই প্রমাণিত করে যে সাধারণ মানবের কাম্য শ্রেয় ও প্রেয় বস্তু মাত্রেরই প্রতীক রূপে দেবী কল্পিত হইয়াছিলেন। ঋগ্বেদ পরিশিষ্টান্তর্গত শ্রীসূক্তের পঞ্চদশসংখ্যক অনুবাকগুলিতে তাঁহার এই বৈশিষ্ট্য মূর্ত হইয়াছে; তাঁহার লক্ষ্মীনামও বোধ হয় সর্বপ্রথম ইহাতেই পাওয়া যায়। তিনি এখানে সুবর্ণরজত মাল্যভূষিতা হিরণ্যবর্ণা হরিণী রূপে বর্ণিত হইয়াছেন–
হিরণ্যবর্ণাং হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজাম্ ।
চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং জাতবেদো মমাবহ।।’
বাজসনেয় সংহিতায় অম্বিকা রদ্রের ভগিনী হিসেবে কল্পিতা। ধারণা করা হয়, ফসলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে সীতার উল্লেখ ঋগ্বেদে (৪/৫৭) বর্তমান এবং সূত্রগ্রন্থসমূহে তিনি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছেন বলে জানা যায়। সীতা প্রসঙ্গে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে–
অর্বাচী সুভগে ভব সীতে বন্দামহে ত্বা।
যথা নঃ সুভগাসসি যথা নং সুফলাসসি।। (ঋক-৪/৫৭/৬)
ইন্দ্রঃ সীতাং নি গৃহ্লাতু তাং পূষানু যচ্ছৃতু।
সা নঃ পরস্বতী দুহামুত্তরামুত্তরাং সমাম্ ।। (ঋক-৪/৫৭/৭)
অর্থাৎ : হে সৌভাগ্যবতী সীতা! তুমি অভিমুখী হও, আমরা তোমাকে বন্দনা করছি, তুমি আমাদের সুন্দর ধন প্রদান কর ও সুফল প্রদান কর। ৬।। ইন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করুন, পৃষা তাঁকে পরিচালিত করুন, তিনি জলবতী হয়ে বৎসরের পর বৎসর শস্য দোহন করুন। ৭।। (টীকাভাষ্য অনুযায়ী, সীতা অর্থে লাঙ্গলের দ্বারা চিহ্নিত ভূমিতে রেখা। ঋষি স্তুতি করেছেন যে, সে লাঙ্গল কর্ষিত রেখা বৎসর বৎসর শস্য দোহন করুক।)
সাধারণভাবে সর্বব্যাপিনী মাতৃদেীর ধারণা পাওয়া যায় বাজপেয় যজ্ঞ প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ ও সূত্রগ্রন্থসমূহে। উপরিউক্ত দেবীগণের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছেন। ধারণা করা হয়, কাত্যায়নী সম্ভবত আদিতে ছিলেন কাত্য উপজাতির দেবতা। পরে এই নামটি শাক্ত দেবীর বিশেষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্গা, উমা, গৌরী ও কালী পরবর্তীকালে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এবং শাক্ত দেবীর সঙ্গে অভিন্না বলে ঘোষিত হয়েছেন।
‘বৈদিক ও উত্তর-বৈদিক সাহিত্যে উক্ত দেবীর বিভিন্ন নামরূপাদির সম্বন্ধে উপরে আলোচিত তথ্যাদি হইতে বুঝা যায় যে তখন সুগঠিত পদ্ধতি হিসাবে শক্তিপূজা রূপ গ্রহণ করিয়া না থাকিলেও ইহার উপাদানগুলি সে সময়ে ধীরে ধীরে সংগৃহীত হইতেছিল। মহাকাব্যদ্বয়ে দেবী সম্বন্ধে যে সকল স্বল্পপ্রমাণ তথ্য পাওয়া যায় উহা আমাদিগকে জানাইয়া দেয় যে দেবীর সমষ্টিগত রূপকল্পনায় পূর্বকথিত উপাদান ব্যতীত আরও বিভিন্নজাতীয় উপাদান অংশ গ্রহণ করিয়াছিল। মূল রামায়ণে শক্তিপূজা সম্বন্ধে বিশেষ কোনও উল্লেখ নাই। শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণবধার্থে অকালে দুর্গাপূজার যে কাহিনী বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এবং যাহা এদেশে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গোৎসবের ভিত্তিস্বরূপ, উহার কথা কবি কৃত্তিবাস কর্তৃক বঙ্গভাষায় রচিত রামায়ণ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। কৃত্তিবাস কোথা হইতে ইহা সংগ্রহ করিয়াছিলেন সে বিষয়ে সঠিক কিছু বলা যায় না। মূল সংস্কৃত রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের ১০৬ অধ্যায় পাঠে জানা যায় যে রণক্লান্ত রাম রাবণবধের জন্য চিন্তাকুল হইলে অগস্ত্য ঋষি তাঁহাকে নিষ্ঠার সহিত আদিত্যহৃদয় স্তব পাঠ করিয়া সূর্যদেবের উপাসনা করিতে উপদেশ দেন, এবং রামচন্দ্র সেই উপদেশানুযায়ী কার্য করিলে রাবণবধে সমর্থ হন। রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন অংশে দেবীর ভিন্ন ভিন্ন নাম ও রূপের উল্লেখ থাকিলেও, সেগুলি প্রায়ই কিংবদন্তীমূলক; উহা হইতে দেবীপূজার প্রসার বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিন্তু মহাভারতের দুইটি দুর্গাস্তোত্রে এবং উহর পরিশিষ্ট হরিবংশের অন্তর্ভুক্ত আর্যাস্তবে শক্তিপূজকের ইষ্টদেবীর যে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় উহা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।’- (পঞ্চোপাসনা)
মহাভারতের দুটি দুর্গাস্তোত্র এবং হরিবংশের বিষ্ণুপর্বস্থ তৃতীয় অধ্যায়ে উদ্ধৃত আর্যাস্তবে দেবীর ক্রিয়াকলাপ, বিভিন্ন নাম ও গুণাবলী বিবৃত হয়েছে।– ‘মহাভারতে তাঁকে নারায়ণবরপ্রিয়া, নন্দগোপকুলজাতা, কুলবর্ধিনী, কংসবিদ্রাবণকারী, অসুরনাশিনী প্রভৃতি বিশেষণযুক্ত করা হয়েছে। তিনি কুমারী ও ব্রহ্মচারিণী, বিন্ধ্যপর্বতে তাঁর বাস, তিনি রক্তমাংসপশুপ্রিয়া, ভক্তগণকে নানাপ্রকার দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন বলেই তিনি দুর্গা। তাঁর নামগুলি তাঁর চরিত্রের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যগুলির দ্যোতক : আর্যা, মন্দরবাসিনী, কুমারী, কালী, কপালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, চণ্ডী, কাত্যায়নী, করালী, শিখিপিচ্ছধ্বজধারিণী, মহিষসৃকপ্রিয়া, কৌশিকী, গোপেন্দ্রানুজা, নন্দগোপকুলোদ্ভবা, কোকামুখা, শাকম্ভরী, ব্রহ্মবিদ্যা, বেদশ্রুতি, সাবিত্রী, বেদমাতা, স্কন্দমাতা প্রভৃতি। হরিবংশের আর্যাস্তবেও এই সকল নাম বিদ্যমান। হরিবংশে প্রসঙ্গক্রমে একথাও বলা হয়েছে যে পর্বতগুহায় নদীতীরে ও বনমধ্যে তিনি শবর, বর্বর, পুলিন্দ প্রভৃতি উপজাতি দ্বারা পূজিতা। তিনি বিন্ধ্যবাসিনী। তাঁর বাসস্থান কুক্কুট, ছাগ, মেষ, সিংহ ব্যাঘ্রাদি পশুগণের দ্বারা পূর্ণ। তিনি অপর্ণা অর্থাৎ বিবসনা। তাঁর এক নাম তারা, যিনি ত্রাণ করেন, ভক্তগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে, অগ্নিদাহে, নদীতীরে, কান্তারে, প্রবাসে, রাজরোষে, তস্কর ও শত্রুসঞ্জাত ভয়ে রক্ষা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ দেবী তারাও অগ্নিভয়, দস্যুভয়, বন্ধনভয়, মজ্জনভয়, সর্পভয় ইত্যাদি অষ্টবিধ ভয় থেকে ভক্তগণকে রক্ষা করেন।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস/ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)
‘বৈদিক ও উত্তর-বৈদিক সাহিত্যে উক্ত দেবীর বিভিন্ন নামরূপাদির সম্বন্ধে উপরে আলোচিত তথ্যাদি হইতে বুঝা যায় যে তখন সুগঠিত পদ্ধতি হিসাবে শক্তিপূজা রূপ গ্রহণ করিয়া না থাকিলেও ইহার উপাদানগুলি সে সময়ে ধীরে ধীরে সংগৃহীত হইতেছিল। মহাকাব্যদ্বয়ে দেবী সম্বন্ধে যে সকল স্বল্পপ্রমাণ তথ্য পাওয়া যায় উহা আমাদিগকে জানাইয়া দেয় যে দেবীর সমষ্টিগত রূপকল্পনায় পূর্বকথিত উপাদান ব্যতীত আরও বিভিন্নজাতীয় উপাদান অংশ গ্রহণ করিয়াছিল। মূল রামায়ণে শক্তিপূজা সম্বন্ধে বিশেষ কোনও উল্লেখ নাই। শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণবধার্থে অকালে দুর্গাপূজার যে কাহিনী বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এবং যাহা এদেশে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গোৎসবের ভিত্তিস্বরূপ, উহার কথা কবি কৃত্তিবাস কর্তৃক বঙ্গভাষায় রচিত রামায়ণ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। কৃত্তিবাস কোথা হইতে ইহা সংগ্রহ করিয়াছিলেন সে বিষয়ে সঠিক কিছু বলা যায় না। মূল সংস্কৃত রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের ১০৬ অধ্যায় পাঠে জানা যায় যে রণক্লান্ত রাম রাবণবধের জন্য চিন্তাকুল হইলে অগস্ত্য ঋষি তাঁহাকে নিষ্ঠার সহিত আদিত্যহৃদয় স্তব পাঠ করিয়া সূর্যদেবের উপাসনা করিতে উপদেশ দেন, এবং রামচন্দ্র সেই উপদেশানুযায়ী কার্য করিলে রাবণবধে সমর্থ হন। রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন অংশে দেবীর ভিন্ন ভিন্ন নাম ও রূপের উল্লেখ থাকিলেও, সেগুলি প্রায়ই কিংবদন্তীমূলক; উহা হইতে দেবীপূজার প্রসার বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিন্তু মহাভারতের দুইটি দুর্গাস্তোত্রে এবং উহর পরিশিষ্ট হরিবংশের অন্তর্ভুক্ত আর্যাস্তবে শক্তিপূজকের ইষ্টদেবীর যে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় উহা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।’- (পঞ্চোপাসনা)
মহাভারতের দুটি দুর্গাস্তোত্র এবং হরিবংশের বিষ্ণুপর্বস্থ তৃতীয় অধ্যায়ে উদ্ধৃত আর্যাস্তবে দেবীর ক্রিয়াকলাপ, বিভিন্ন নাম ও গুণাবলী বিবৃত হয়েছে।– ‘মহাভারতে তাঁকে নারায়ণবরপ্রিয়া, নন্দগোপকুলজাতা, কুলবর্ধিনী, কংসবিদ্রাবণকারী, অসুরনাশিনী প্রভৃতি বিশেষণযুক্ত করা হয়েছে। তিনি কুমারী ও ব্রহ্মচারিণী, বিন্ধ্যপর্বতে তাঁর বাস, তিনি রক্তমাংসপশুপ্রিয়া, ভক্তগণকে নানাপ্রকার দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন বলেই তিনি দুর্গা। তাঁর নামগুলি তাঁর চরিত্রের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যগুলির দ্যোতক : আর্যা, মন্দরবাসিনী, কুমারী, কালী, কপালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, চণ্ডী, কাত্যায়নী, করালী, শিখিপিচ্ছধ্বজধারিণী, মহিষসৃকপ্রিয়া, কৌশিকী, গোপেন্দ্রানুজা, নন্দগোপকুলোদ্ভবা, কোকামুখা, শাকম্ভরী, ব্রহ্মবিদ্যা, বেদশ্রুতি, সাবিত্রী, বেদমাতা, স্কন্দমাতা প্রভৃতি। হরিবংশের আর্যাস্তবেও এই সকল নাম বিদ্যমান। হরিবংশে প্রসঙ্গক্রমে একথাও বলা হয়েছে যে পর্বতগুহায় নদীতীরে ও বনমধ্যে তিনি শবর, বর্বর, পুলিন্দ প্রভৃতি উপজাতি দ্বারা পূজিতা। তিনি বিন্ধ্যবাসিনী। তাঁর বাসস্থান কুক্কুট, ছাগ, মেষ, সিংহ ব্যাঘ্রাদি পশুগণের দ্বারা পূর্ণ। তিনি অপর্ণা অর্থাৎ বিবসনা। তাঁর এক নাম তারা, যিনি ত্রাণ করেন, ভক্তগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে, অগ্নিদাহে, নদীতীরে, কান্তারে, প্রবাসে, রাজরোষে, তস্কর ও শত্রুসঞ্জাত ভয়ে রক্ষা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ দেবী তারাও অগ্নিভয়, দস্যুভয়, বন্ধনভয়, মজ্জনভয়, সর্পভয় ইত্যাদি অষ্টবিধ ভয় থেকে ভক্তগণকে রক্ষা করেন।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস/ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)
দেবীপূজার ইতিহাসে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ মহাভারতের দুর্গাস্তব দু’টির একটি বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব, আর অন্যটি হলো ভীষ্মপর্বে যুদ্ধের প্রারম্ভকালে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন যে দুর্গাস্তব করেছিলেন তা। গুরুত্ব বিবেচনায় যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তবের (স্বদেশরঞ্জন চক্রবর্তী অনূদিত) বঙ্গানুবাদ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো–
‘পুরাকালে ঋষিরা যেভাবে আর্যাস্তব করেছিলেন, সেইভাবে আমিও ত্রিভুবনেশ্বরী দেবী নারায়ণীকে প্রণাম করে স্তব শুরু করছি।
নমঃ শ্রী আর্যায়ৈ
তুমিই সিদ্ধি, ধৃতি, কীর্তি, শ্রী, বিদ্যা, সন্ততি, মতি, সন্ধ্যা, রাত্রি, প্রভা, নিদ্রা ও কালরাত্রি।। ১।
আবার (তুমি) আর্যা, কাত্যায়নী, দেবী, কৌশিকী, ব্রহ্মচারিণী, উগ্রচারী, মহাবলা ও সিদ্ধসেনের জননী।। ২।
(তুমি) জয়া, বিজয়া, পুষ্টি, তুষ্টি, ক্ষমা, দয়া, জ্যেষ্ঠা, যমভগিনী, নীল ও কাষায় বসন পরিহিতা।। ৩।
(তুমি) বহুরূপা, বিশালাক্ষী, ভক্তদের রক্ষাকারিণী, বিরূপা ও বিবিধ বিধি আচরণকারিণী।। ৪।
হে মহাদেবী, দুরারোহ পর্বতে, দুস্তর নদীসমূহে, দুর্গম গুহামধ্যে ও বন-উপবন মধ্যে তোমার নিবাস।। ৫।
হে মহাদেবী, তুমি শবর, বর্বর, পুলিন্দ ইত্যাদি জাতির মানুষজনের দ্বারা সুপূজিতা। ময়ূর পালক ধ্বজা বিশিষ্ট হে মহাদেবী, তুমি ত্রিভুবনে সর্বদা বিচরণ কর।। ৬।
(তুমি) কুক্কুট (বনমোরগ), ছাগল, মেষ, সিংহ-ব্যাঘ্র গর্জন ও ঘণ্টা নিনাদে নিনাদিত বিন্ধ্যবাসিনী নামে অভিহিতা হে মহাদেবী।। ৭।
(তুমি) ত্রিশূল ও পট্টীশ ধারিণী, সূর্য-চন্দ্রের মতো প্রভাশালিনী। কৃষ্ণপক্ষের নবমী ও শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি তোমার অত্যন্ত প্রিয়।। ৮।
হে দেবী, তুমি বলদেবের ভগিনী, কলহপ্রিয়া রজনী (গভীর ভাবে কলনাদিনী অর্থাৎ সদাকলহাস্যময়ী)। তুমি সমস্ত জীবের আশ্রয়স্থল, পরানিষ্ঠার দ্বারা তোমাতে লীন হওয়া যায়।। ৯।
(তুমি) নন্দ গোপসুতা (যোগমায়া) দেবতাদের জয়স্বরূপা। (তুমি) রোদ্রী (ভয়ংকরী) সন্ধ্যাচারী, নিশা। (তুমি) সুন্দর সূক্ষ্ম রেশম বস্ত্র পরিধান কর।। ১০।
(তুমি) দানবদের বধের জন্যে মুক্তকেশী, মৃত্যু, মদ্য-মাংস-বলি প্রিয়া, লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী রূপে অবতীর্ণা।। ১১।
(তুমি) দেবতাদেরও সাবিত্রী (প্রসবিনী) মন্ত্রসমূহের মাতৃরূপিণী, কন্যাকুলের ব্রহ্মচারী স্বরূপিণী ও স্ত্রীগণের সৌভাগ্য স্বরূপিণী।। ১২।
(তুমি) যজ্ঞসমূহের অন্তর্বেদী স্বরূপ (ব্রহ্মবেদী যা যোগীর মধ্যে স্থিত), ঋত্বিকগণের দক্ষিণা (অর্থাৎ তাঁদের প্রতি দয়াশীলা), কৃষকদের সীতা স্বরূপ, প্রাণীসমূহের পৃথিবী স্বরূপ।। ১৩।
যাত্রিগণের সিদ্ধিস্বরূপ, সাগরের বেলাভূমি স্বরূপ, যক্ষদের প্রথমা যক্ষী, নাগসমূহের সুরমা স্বরূপ।। ১৪।
অনন্তর মা তুমি ব্রহ্মবাদিনী দীক্ষা, তুমিই পরম শোভা, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে তুমি শ্রেষ্ঠ জ্যোতিস্বরূপিণী, নক্ষত্রগণের মধ্যে তুমি রোহিণী।। ১৫।
রাজদ্বার, তীর্থ ও নদী সঙ্গমগুলোর মধ্যে (তুমিই) শ্রেষ্ঠা, তুমি পূর্ণা, তুমি চন্দ্র বিষয়ে পূর্ণিমা, তুমি ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা।। ১৬।
(তুমি) বাল্মীকির কাছে সরস্বতী, শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের কাছে তুমি স্মৃতি স্বরূপিণী, ঋষিগণের ধর্মবুুদ্ধি স্বরূপিণী, দেবতাদের মানসী মা (তুমি)।। ১৭।
তুমি প্রাণিদের সুরাস্বরূপিণী অর্থাৎ তোমার কৃপাদৃষ্টি আকাঙ্ক্ষায় মানুষ বিহ্বল। প্রাণীরা নিজ নিজ কর্মসিদ্ধির জন্যে তোমার আরাধনায় তৎপর। (তুমি মা) দেবরাজ ইন্দ্রের সুশোভন নয়ন স্বরূপিণী, তাই (তুমি) সহস্রনয়না নামে অভিহিতা।। ১৮।
তাপসদের কাছে (তুমি) সাক্ষাৎ মহামায়া অগ্নিহোত্রীগণের (নিত্য যজ্ঞকারী) গণের কাছে (তুমি) অরণি কাষ্ঠস্বরূপা, অর্থাৎ অগ্নি।। ১৯।
(তুমি) সমস্ত প্রাণিদের ক্ষুধাস্বরূপ ও দেবতাদের তৃপ্তি সাধনের জন্যে (তুমি) স্বাহা, তৃপ্তি, ধৃতি, মেধা ও বসুদের কাছে বসুমতী।। ২০।
(তুমি) নরকুলের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বরূপ, কর্মঠ ব্যক্তিদের কাছে পুষ্টিস্বরূপা। (তুমি) দিগ্বিদিক, (তুমি) অগ্নিশিখা, (তুমি) প্রভা, (তুমি) শকুনী, পুতনা, (তুমি) রেবতী (নক্ষত্র) ও সুদারুণাও।। ২১।
সমস্ত প্রাণীদের (তুমি) নিদ্রা, প্রাণিকুলের সম্মোহিনী, (তুমি) ক্ষত্রিয়া (বীর্যবতী)। (তুমি) পরাবিদ্যা অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা, (তুমি) ওঁ-কার (সগুণ ও নির্গুণ, পরমব্রহ্ম), (তুমি) বষট্কার।। ২২।
প্রজাপতি ব্রহ্মার সিদ্ধান্তে (তুমি) নারীমধ্যে পার্বতী, সাধ্বী স্ত্রীমধ্যে অরুন্ধতী, (তুমি) পুরাণ প্রবক্তা ঋষিদের জ্ঞেয়।। ২৩।
(তুমি) যথার্থনামা, (তুমি) ইন্দ্রাণী নামে খ্যাতা, (তুমি) মা সমগ্র জগৎ, স্থাবর ও জঙ্গমে ব্যাপ্ত।। ২৪।
সমস্ত রকম যুদ্ধবিগ্রহে, অগ্নিদাহে, নদীতীরে, দূরবিস্তীর্ণ মরুভূমিতে, মহাভয় সামনে উপস্থিত হলে, প্রবাসে কারাগারে, শত্রুনিগ্রহে, প্রাণশঙ্কা উপস্থিত হলে, সকলকেই (তুমি) উদ্ধার কর বা রক্ষা কর।। ২৫।
হে দেবী (তুমি) আমার হৃদ্দেশে, (তুমি) আমার চিত্তে, (তুমি) আমার মনোরাজ্যে অবস্থান কর; (তুমি) আমাকে সমস্ত পাপ থেকে রক্ষা করে আমার প্রতি প্রসন্ন হও।। ২৬।’
অন্নপূর্ণা শাকম্ভরী : ইতঃপূর্বে মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে দেবীর যে রূপের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি তা তাঁর উগ্ররূপ। পাশাপাশি দেবীর একটি সৌম্যরূপ আছে। সৌম্য রূপের দেবীদের মধ্যে আমরা পৃথিবী-দেবী, শ্রী, শাকম্ভরী, পার্বতী-উমা, সতী প্রভৃতিকে গণ্য করতে পারি। বেদে পৃথিবী-দেবীর উল্লেখ রয়েছে আমরা জানি। এই পৃথিবী-দেবী থেকেই সীতা, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী প্রভৃতি শস্যদেবীরা উদ্ভূতা হয়েছেন। আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি, বৈদিক সাহিত্যে (ঋক-৪/৫৭/৭) সীতা ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিতা শস্যদেবী। পুরাণসমূহে পৃথিবী শ্রী ও লক্ষ্মীর অপর নাম, এবং তাঁকে বরাহরূপী বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের বিষ্ণুমূর্তিগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রী ও ভূ এই দুই দেবীকে দু’পাশে দেখা যায়। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে পৃথিবীই জগদ্ধাত্রী (পৃথিব্যহং জগদ্ধাত্রী মদ্রূপং মৃন্ময়ন্ত্বিদম্’- কালিকাপুরাণ- ৩৮, ৬৩)। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী দেবী শাকম্ভরী অনাবৃষ্টির সময়ে আত্মদেহসমুদ্ভূত শাকাদির দ্বারা জগৎ প্রতিপালন করেন।–
‘ততঃ অহম্ অখিলং লোকম্ আত্মদেহ-সমুদ্ভবৈঃ।
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈঃ অবৃষ্টৈঃ প্রাণধারকৈঃ।।
শাকম্ভরী ইতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যামি অহং ভুবি।…’ (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৯২/৪২-৩)
অর্থাৎ : অনন্তর বর্ষাকালে আত্মদেহ-সমুদ্ভূত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সমগ্র জগতের পুষ্টি-সরবরাহ করবো; তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবো।
এই শাকম্ভরীই অন্নদা বা অন্নপূর্ণায় রূপান্তরিত হয়েছেন। পার্বতী পর্বতের দেবী, যাঁর সঙ্গে পরে উমার যোগ হয়েছে। পুরাণসমূহে উমা একটু চাপা পড়ে গেছেন কিন্তু তাঁর বিকাশ হয়েছে বিশুদ্ধ সাহিত্যে, যেখানে তিনি জগজ্জননীও বটে, শিবপত্নীও বটে।
দুর্গার মধ্যে দেবীর সৌম্য ও উগ্র উভয় রূপের সংমিশ্রণ হয়েছে। দুর্গা আসলে শস্যদেবী যাঁর প্রতিষ্ঠা ও পূজা নবপত্রিকায়। একটি কলাগাছের সঙ্গে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, ডালিম, অশোক, মান ও ধান্য একত্রে বন্ধন করে যে শস্যবধু গঠন করা হয় তা-ই হচ্ছে নবপত্রিকা। এই শস্যদেবী কিভাবে দানব-দলনী হয়ে উঠলেন সেটা খুব কৌতুহলের বিষয়। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই বলে তার ব্যাখ্যা করেছেন যে, মহিষ, শুম্ভ-নিশুম্ভ, দুর্গম প্রভৃতি অসুররা, যাঁদের দেবী বধ করেছেন, আসলে অনাবৃষ্টির রূপক। দুর্গ রক্ষার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল যা তাঁর দুর্গা নামের কারণ হতে পারে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে অবশ্য বলা হয়েছে–
দুর্গার মধ্যে দেবীর সৌম্য ও উগ্র উভয় রূপের সংমিশ্রণ হয়েছে। দুর্গা আসলে শস্যদেবী যাঁর প্রতিষ্ঠা ও পূজা নবপত্রিকায়। একটি কলাগাছের সঙ্গে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, ডালিম, অশোক, মান ও ধান্য একত্রে বন্ধন করে যে শস্যবধু গঠন করা হয় তা-ই হচ্ছে নবপত্রিকা। এই শস্যদেবী কিভাবে দানব-দলনী হয়ে উঠলেন সেটা খুব কৌতুহলের বিষয়। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই বলে তার ব্যাখ্যা করেছেন যে, মহিষ, শুম্ভ-নিশুম্ভ, দুর্গম প্রভৃতি অসুররা, যাঁদের দেবী বধ করেছেন, আসলে অনাবৃষ্টির রূপক। দুর্গ রক্ষার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল যা তাঁর দুর্গা নামের কারণ হতে পারে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে অবশ্য বলা হয়েছে–
‘দুর্গামি দুর্গ-ভবসাগর-নৌ রসঙ্গা।’- (মার্কণ্ডেয়-দেবীমাহাত্ম্য)
অর্থাৎ : অসঙ্গা তুমি দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ বলে দুর্গা।
পার্বতী ও কৌশিকী : চণ্ডিকা বা অম্বিকা, কখনও কখনও ইনি কৌশিকী নামেও পরিচিতা, মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশের নায়িকা, বহু দেবীকে আত্মসাৎ করে গড়ে উঠেছেন। পার্বতীর কৃষ্ণবর্ণ কোষ থেকে উদ্ভূত বলে তাঁর নাম কৌশিকী। গবেষকদের মতে আসলে ইনি কুশ বা কুশিক উপজাতির দেবী। তাঁর অপরাপর নাম একানংশা, বিন্ধ্যবাসিনী ও রাত্রি। এই কৃষ্ণবর্ণ কোষ থেকে উদ্ভবের কাহিনীটি নানারূপে পল্লবিত। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে, কৌশিকীরূপে পার্বতীর দেহ থেকে নিঃসৃতা দেবীই কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে কালী বা কালিকা হয়েছেন। সবচেয়ে পল্লবিত কাহিনীটি পাওয়া যায় পদ্মপুরাণে (সৃষ্টিখণ্ড-৪৩-৪৪), যেখানে বলা হয়েছে, সতী যখন পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করার জন্য মেনকার জঠরে ছিলেন তখন ব্রহ্মা একটি গূঢ় উদ্দেশ্যে রাত্রি দেবীকে অনুরোধ করেন যেন তিনি নিজ সত্তা দিয়ে মাতৃগর্ভেই দেবীকে কৃষ্ণবর্ণ করে দেন। এই কৃষ্ণবর্ণা পার্বতীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। পরে একদিন শিব তাঁর গাত্রবর্ণ নিয়ে বক্রোক্তি করলে, দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং ব্রহ্মার বরে তিনি কৃষ্ণবর্ণ ত্যাগ করে গৌরী হন। দেবীর কৃষ্ণবর্ণ ত্বক থেকে কৌশিকী দেবী উৎপন্ন হলেন, যিনি চণ্ডিকা, একানংশা, বিন্ধ্যবাসিনী ও রাত্রি নামেও পরিচিতা।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, ইন্দ্রাদি দেবগণ শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য পার্বতীর কাছে প্রার্থনা জানালে পার্বতীর শরীরকোষ থেকে কৌশিকী দেবী নিঃসৃতা হলেন। কৌশিকী তাঁর দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেলে পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গেলেন এবং এইজন্য তিনি হিমালয়বাসিনী কালিকা নামে আখ্যাতা হলেন। আবার দেবীমাহাত্ম্যের অন্যত্র কালীর উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরগণ দেবীর নিকটবর্তী হলে তাঁর ভ্রূকুটি-কুটিল ললাটফলক থেকে অসিপাশধারিণী করালবদনা কালী বিনিষ্ক্রান্তা হলেন এবং চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করে চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হলেন। পরবর্তীকালে পুরাণ, উপপুরাণ এবং তন্ত্রে এই দেবীর রীতিমতো বিস্তার ও বিবর্তন হয়েছে, শিবের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি ঘটেছে এবং তন্ত্রশাস্ত্রের তিনি প্রধান ও পরমতত্ত্ব হয়ে উঠেছেন। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে,– ‘সকল কালী মূর্তিতেই দেবী শিবের বক্ষোপরি দণ্ডায়মান। এই মূর্তি তিনটি বিষয়বস্তুর প্রতীক। প্রথমটি হচ্ছে, তন্ত্রোক্ত এবং সাংখ্যোক্ত প্রকৃতি-পুরুষতত্ত্ব যেখানে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিই ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র চালিকাশক্তি। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, উদাসীন ও অক্ষম; দ্বিতীয়টি হচ্ছে তন্ত্রের বিপরীতবিহারতত্ত্ব (মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্); তৃতীয়টি হচ্ছে, শক্তিদেবীর প্রাধান্য।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
দক্ষ-তনয়া সতী : কৌশিকী বা কালীপ্রসঙ্গে দেখা গেলো কিভাবে এক দেবীর সঙ্গে অপর দেবীর সমীকরণ হয়। আসলে কৃষিভিত্তিক বাঙলা তথা ভারতবর্ষের সর্বত্রই অসংখ্য বিভিন্ন মর্যাদার স্থানীয় মাতৃকাদেবী ছিলেন এবং আজও আছেন। বিশ্বনিয়ন্ত্রিকা শক্তিরূপিণী মহাদেবীর একত্বের ধারণা বিকাশলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান প্রধান আঞ্চলিক দেবীদের সঙ্গে ওই মহাদেবীর সমীকরণের প্রয়োজন দেখা দিলে ওই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানা পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণা করা হয়। দক্ষযজ্ঞের কাহিনী এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এই কাহিনী অনুযায়ী, পতিনিন্দা শ্রবণে সতীর দেহত্যাগের পর শিব উন্মত্তপ্রায় হয়ে সতীর মৃতদেহ কাঁধে করে পৃথিবী ভ্রমণ করতে থাকলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডীকৃত করেন। যে সকল স্থানে ওই দেহাংশগুলি পড়ে, সেই সকল স্থানে শাক্তপীঠ গড়ে ওঠে, যেখানে দেবীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিভূ হিসেবে কোন অমূর্ত প্রতীক ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত থাকে। শিবলিঙ্গ এখানে ভৈরবের প্রতীক। শিব ভৈরব-রূপ ধারণ করে বিভিন্ন পীঠে সতীর দেহাংশ রক্ষা করেন বলে প্রকাশ। আসলে বিভিন্ন পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা ছিলেন আঞ্চলিক দেবী। শাক্ত মহাদেবীর সঙ্গে তাঁদের সমীকরণ করার জন্যই দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, তাঁর দেহের খণ্ডীকরণ এবং খণ্ডিত অংশগুলির পতনস্থলে শাক্ত পীঠস্থান গড়ে ওঠার কাহিনী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিবরণ অনুযায়ী–
‘মহাভারতের বনপর্বস্থ তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে দেবীর দুই প্রত্যঙ্গ যোনি ও স্তনের সঙ্গে তিনটি শাক্ত পীঠের পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়। যোনিকুণ্ডদ্বয়ের একটি পঞ্চনদের বাহিরে ভীমাস্থানে এবং অপরটি উদ্যতপর্বত নামক গিরিশিখরে অবস্থিত। স্তনকুণ্ড গৌরীশিখর নামক পর্বতশৃঙ্গের উপরে অবস্থিত ছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ প্রাচীন গন্ধার প্রদেশে ভীমাস্থানের অবস্থিতি উল্লেখ করেছেন যেখানে ভীমাদেবীর গাঢ় নীলবর্ণের প্রস্তরের এক প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। শাক্ত পীঠসমূহের প্রথাগত সংখ্যা ৫১ হলেও, বিভিন্ন উপপীঠ সহ পীঠের সংখ্যা প্রচুর। এছাড়া বিভিন্ন পুরাণে দেবীর ১০৮ নাম ও রূপ এবং তাঁদের অবস্থান ক্ষেত্রের কথা উল্লিখিত হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে ললিতাসহস্রনাম অধ্যায়ে দেবীর সহস্র নাম ও রূপভেদের পরিচয় আছে।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
‘মাতৃকাদেবীরা ছিলেন গোড়ায় স্থানীয় দেবী, মূলত মাতৃত্ব ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার প্রতীক। প্রাচীন মাতৃকা মূর্তিগুলি পোড়ামাটির নির্মিত। পরবর্তীকালে তাঁর প্রস্তর নির্মিত মূর্তিও হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমষ্টিগতভাবে সপ্ত বা অষ্ট মাতৃকা মূর্তি মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ করা হত। কোন কোন স্থানে তাঁদের মাতৃকা হিসেবে চেনাবার জন্য ক্রোড়ে শিশু দেখানো হয়েছে। মহাভারতের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে সাতজন মাতৃকা স্কন্দকে লালন-পালন করেছিলেন। উত্তরকালে মাতৃকাগণ বিভিন্ন দেবতার শক্তি হিসাবে কল্পিতা হয়েছেন যেমন ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বারাহী, ইন্দ্রাণী ও চামুণ্ডী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশে মাতৃকাদের সংখ্যা সাত থেকে বেড়ে ন’য়ে দাঁয়িয়েছে, ওই তালিকার সঙ্গে শিবদূতী ও নারসিংহী যুক্ত হয়েছে। কালক্রমে কোন কোন মাতৃকার সঙ্গে খোদ শাক্ত মহাদেবীর সমীকরণ হয়েছে।’– (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
এখানে উল্লেখ্য, ‘স্কন্দ-কার্তিকেয় একজন লৌকিক দেবতা যিনি কালক্রমে ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্থান পেয়েছিলেন। ইনি কৃষি ও প্রজননের দেবতা, প্রাচীন গ্রীস, এশিয়া মাইনর, মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরের কৃষিদেবতাদের অনুরূপ (যেমন আদোনিস, আটিস, তম্মুজ, ওসিরিস প্রভৃতি), যাঁর প্রণয়িনী একজন আদিম মাতৃকাদেবী যিনি লৌকিক ধর্মে সন্তানোৎপাদনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ষষ্ঠী হিসাবে পরিচিতা। উচ্চবর্ণ কর্তৃক গৃহীত হবার পর তিনি দেব-সেনাপতি হিসাবে গণ্য হন, এবং ষষ্ঠী হন তাঁর পত্নী দেবসেনা। ইনি শিব ও পার্বতীর পুত্র হিসাবে কল্পিত হন যিনি তারকাসুরকে বধ করেছিলেন। তাঁর জন্মের কাহিনীই মহাকবি কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যের ভিত্তি।’
‘কার্তিকেয় নামক আদিম শস্য দেবতা ও তাঁর প্রণয়িনী দেবী ষষ্ঠী কালক্রমে জাতে উঠেছিলেন, এবং স্কন্দ, বিশাখ, কুমার, মহাসেন, ব্রহ্মণ্যদেব প্রভৃতি নামে পরিচিত হয়েছিলেন। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পাণিনির একটি সূত্রের (৫, ৩, ৯৯) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পতঞ্জলি স্কন্দ ও বিশাখের মূর্তি নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন। মহাভারতেও স্কন্দ-কার্তিকের বহু উল্লেখ আছে। বনপর্বের স্কন্দোৎপত্তি পর্বাধ্যায়ে স্কন্দ-কার্তিকের উদ্ভবের অনেকগুলি কাহিনী আছে। এক হিসাবে তিনি অগ্নি ও স্বাহার পুত্র, এক হিসাবে কৃত্তিকাদের, অন্য হিসাবে গঙ্গার, কিন্তু কালক্রমে শিব ও দুর্গার। একটি কাহিনী অনুযায়ী দেবগণের শত্রু হিসাবেই স্কন্দের উদ্ভব (এখানে তাঁর লৌকিক ও আদিম সত্তাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে), জন্মলগ্নেই যাঁকে খতম করার জন্য ইন্দ্র মাতৃকাদের পাঠান, কিন্তু তাঁরা তাঁকে নিহত করার পরিবর্তে স্তন্য দিয়ে লালনপালন করেন। স্কন্দ দেবতগণকে নিপীড়ন করতে শুরু করেন এবং দেবতাদের প্রচণ্ড ভীতির কারণ হন। ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে স্কন্দের দক্ষিণ পঞ্জর বিদীর্ণ হয়ে তা থেকে বিশাখ বা কার্তিক নির্গত হন এবং তাঁর প্রচণ্ড আক্রমণে দেবগণের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায়। তখন একটা আপোস হয়, স্কন্দ-কার্তিকেয় দেব-সেনাপতির পদ পান এবং শিব ও দেবী তাঁর পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব স্বীকার করে নেন। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক দেবকুলে এই লৌকিক দেবতাটিকে গায়ের জোরেই স্থান করে নিতে হয়েছে।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
‘কার্তিকেয় নামক আদিম শস্য দেবতা ও তাঁর প্রণয়িনী দেবী ষষ্ঠী কালক্রমে জাতে উঠেছিলেন, এবং স্কন্দ, বিশাখ, কুমার, মহাসেন, ব্রহ্মণ্যদেব প্রভৃতি নামে পরিচিত হয়েছিলেন। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পাণিনির একটি সূত্রের (৫, ৩, ৯৯) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পতঞ্জলি স্কন্দ ও বিশাখের মূর্তি নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন। মহাভারতেও স্কন্দ-কার্তিকের বহু উল্লেখ আছে। বনপর্বের স্কন্দোৎপত্তি পর্বাধ্যায়ে স্কন্দ-কার্তিকের উদ্ভবের অনেকগুলি কাহিনী আছে। এক হিসাবে তিনি অগ্নি ও স্বাহার পুত্র, এক হিসাবে কৃত্তিকাদের, অন্য হিসাবে গঙ্গার, কিন্তু কালক্রমে শিব ও দুর্গার। একটি কাহিনী অনুযায়ী দেবগণের শত্রু হিসাবেই স্কন্দের উদ্ভব (এখানে তাঁর লৌকিক ও আদিম সত্তাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে), জন্মলগ্নেই যাঁকে খতম করার জন্য ইন্দ্র মাতৃকাদের পাঠান, কিন্তু তাঁরা তাঁকে নিহত করার পরিবর্তে স্তন্য দিয়ে লালনপালন করেন। স্কন্দ দেবতগণকে নিপীড়ন করতে শুরু করেন এবং দেবতাদের প্রচণ্ড ভীতির কারণ হন। ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে স্কন্দের দক্ষিণ পঞ্জর বিদীর্ণ হয়ে তা থেকে বিশাখ বা কার্তিক নির্গত হন এবং তাঁর প্রচণ্ড আক্রমণে দেবগণের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায়। তখন একটা আপোস হয়, স্কন্দ-কার্তিকেয় দেব-সেনাপতির পদ পান এবং শিব ও দেবী তাঁর পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব স্বীকার করে নেন। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক দেবকুলে এই লৌকিক দেবতাটিকে গায়ের জোরেই স্থান করে নিতে হয়েছে।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
শাক্ত দেবীপীঠ : বরাহমিহির তাঁর বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে বলেছেন যে,– ‘মাতৃগণঃ কর্তব্যঃ স্বনামদেবানুরূপকৃত চিহ্নঃ’-(বৃহৎসংহিতা-৫৭/৫৬) অর্থাৎ, মাতৃকাগণ নিজ নিজ দেবতার নামানুযায়ী লাঞ্ছনযুক্ত হয়ে চিত্রিত হবেন। একই বক্তব্য মার্কণ্ডেয় পুরাণেও বলা হয়েছে– ‘যস্য দেবস্য যদ্রুপং যথা ভূষণ বাহনম্’- (মার্কণ্ডেয়-৮৮/১৩)। এ বক্তব্য আবিষ্কৃত মাতৃকামূর্তিগুলির দ্বারা সমর্থিত হয়। বরাহমিহির আরও বলেছেন,– ‘মাতৃণামপি মণ্ডলক্রমবিদো’- (বৃহৎসংহিতা-৫৯/১৯) অর্থাৎ, মাতৃকাগণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য মণ্ডলক্রমবিদগণই উপযুক্ত। এর উপর ভাষ্য করতে গিয়ে উৎপল বলেছেন,– ‘মাতৃণাং ব্রাহ্ম্যাদীনাং (সপ্তমাতৃকাঃ) মণ্ডলক্রমবিদ্যে যে মণ্ডলক্রমং পূজাক্রমং বিদন্তি জানন্তি’– অর্থাৎ, তাঁরাই ব্রাহ্মী ইত্যাদি সপ্ত মাতৃকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন যাঁরা এই পূজাক্রম সম্পর্কে অভিজ্ঞ। তিনি আরও বলেছেন,– ‘মাতৃণাং স্বকল্পবিহিত বিধানেন’– অর্থাৎ মাতৃকাগণের জন্য স্ব-স্ব কল্প অনুযায়ী বিধান রয়েছে। এখানে কল্প বলতে বোঝানো হয়েছে তান্ত্রিকদের আগম, ডামর, যামল ও তন্ত্র।
তন্ত্রসমূহে ডাকিনী, লাকিনী, শাকিনী, হাকিনী, যোগিনী প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্ত্রমতে যোগিনীদের সংখ্যা চৌষট্টি। অন্যদিকে অগ্নিপুরাণে (১/১৪৬) বলা হয়েছে যে, মাতৃকা আটজন এবং প্রত্যেকেরই আবার আটরকম করে প্রকাশ, যার ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় আটের আটগুণ। মধ্যযুগে চৌষট্টি যোগিনীর পূজা খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে জানা যায়, যার প্রমাণ ভারতে জব্বলপুরের নিকটে ভেরাঘাট, খাজুরাহো, ভুবনেশ্বরের নিকটে হীরাপুর, সম্বলপুরের নিকটে রাণীপুর, ঝরিয়াল প্রভৃতি চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরসমূহ।
তন্ত্রসমূহে ডাকিনী, লাকিনী, শাকিনী, হাকিনী, যোগিনী প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্ত্রমতে যোগিনীদের সংখ্যা চৌষট্টি। অন্যদিকে অগ্নিপুরাণে (১/১৪৬) বলা হয়েছে যে, মাতৃকা আটজন এবং প্রত্যেকেরই আবার আটরকম করে প্রকাশ, যার ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় আটের আটগুণ। মধ্যযুগে চৌষট্টি যোগিনীর পূজা খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে জানা যায়, যার প্রমাণ ভারতে জব্বলপুরের নিকটে ভেরাঘাট, খাজুরাহো, ভুবনেশ্বরের নিকটে হীরাপুর, সম্বলপুরের নিকটে রাণীপুর, ঝরিয়াল প্রভৃতি চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরসমূহ।
বিভিন্ন শাস্ত্র-পুরাণ গ্রন্থাবলীতে শক্তির এরূপ একীকরণ ও সমন্বয়ের উদাহরণের ঘাটতি নেই। অতএব বলতেই হয় যে, সাধক বাহিরে দেবীকে যে রূপেই গ্রহণ করুন না কেন, অন্তরে তাঁর এক অদ্বিতীয়া সনাতনী। কিন্তু ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি একটু অন্য রকম। কীরকম?–
‘ইতিহাস একতত্ত্বকে কেবলই দেশ ও কালের বিভিন্ন অবস্থানে ভাঙিয়া ভাঙিয়া দেখিতে বুঝিতে চায়। সাধক তাই যে ক্ষেত্রে এক কি করিয়া বহু হইল এই রহস্যই উপলব্ধি করিতে চান, ঐতিহাসিক সেখানে বহু একত্রিত হইয়া কি করিয়া একের সৃষ্টি করিতেছে তাহা লক্ষ্য করিতে চান। ইতিহাস তাই বলিবে ভারতবর্ষের দেবীতন্ত্রের পিছনে মূলে এক দেবী ছিলেন, সেই এক দেবী হইতেই বহু দেবী, বহু পূজাবিধি ও উপাখ্যানের সৃষ্টি হইয়াছে এই কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে; বহু স্পষ্ট-অস্পষ্ট উৎসমূল হইতে আবির্ভূতা বহু দেবী, তাঁহাদের অবলম্বন করিয়া বহু পূজাবিধি, বহু উপাখ্যান; সেই দেবীগণের ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে বঙ্কিম গতিতে আসিয়া ঘটিয়াছে এক ধারার সহিত অন্য ধারার মিলন; তাহার সহিত আবার যুক্ত হইয়াছে আমাদের ক্রমবর্ধমান তত্ত্ববুদ্ধি– তখন যে স্থানে যে কালে যত দেবী ছিলেন সকলকে মিলাইয়া গড়িয়া উঠিয়াছেন এক মহাদেবী। এই যে একীকরণের প্রক্রিয়া তাহা সমানভাবে চলিতেছেই; তাই এখনও যদি কোনও স্থানে কোনও বিশেষ-প্রকৃতি-যুক্তা গ্রাম্যদেবীর আবিষ্কার হয় তবে আমাদের তত্ত্ববুদ্ধি অমনই তাঁহার আকৃতি-প্রকৃতির একটি বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়া তাঁহাকে মহাদেবীর অঙ্গীভূত করিয়া লইতেছে। বৈষ্ণব-দর্শন, শৈব-দর্শন ও শাক্ত-দর্শনকে অবলম্বন করিয়া এক আদিভূতা সনাতনীর ধারণা আমাদের মধ্যে যতই স্পষ্ট এবং দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছে তত্ত্বব্যাখ্যা ও উপাখ্যান-সৃষ্টির দ্বারা ততই আমরা বিভিন্ন দেবীর ভিতরে যোগসাধনের দ্বারা আমাদের অন্বয়-প্রবণতাকে তৃপ্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। একান্ন পীঠের একান্ন দেবী মূলে হয়ত স্থানীয় দেবীরূপে একান্ন জনই ছিলেন; বিষ্ণুকর্তৃক মহাদেবী সতীর মৃতদেহকে শিবের অজ্ঞাতে একান্ন খণ্ডে ভাগ করিয়া একান্ন পীঠে ছড়াইয়া দিবার উপাখ্যান সৃষ্টি করিয়া আমরা একান্ন পীঠের একান্ন দেবীকে এক করিয়া লইবার সুযোগ পাইয়াছি। এই একান্ন দেবীকে যখন একবার একদেবীর অংশ করিয়া লইলাম তখন অনায়াসেই তাঁহারা একের সহিত অভিন্না হইয়া উঠিলেন; কারণ নিত্য এবং পূর্ণের অংশও ত নিত্য এবং পূর্ণ। দশমহাবিদ্যার দশ দেবী মূলতঃ দশ দেবীই; সতীর পিত্রালয়ে গমনের উপাখ্যানের ভিতর দিয়া দশ দেবী এক মহাদেবীর দশাবস্থা হইয়া উঠিয়াছেন। কালী এবং দক্ষকন্যা সতী বা হিমালয়-কন্যা পার্বতী যে পৃথক্ দেবী– তাঁহাদিগকে এক করিয়া তুলিতে অর্বাচীন পুরাণগুলি যে কত উপাখ্যান সৃষ্টি করিয়াছে…। তারা দেবী বৌদ্ধ দেবী বলিয়া পরিচিতা। অবশ্য এই বৌদ্ধ পরিচয়টাকে আমরা খুব বড় পরিচয় বলিয়া মনে করি না; কারণ এই বৌদ্ধ দেবী ও হিন্দু দেবী সবই বৃহত্তর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় দেবী। দশমহাবিদ্যার কোন কোনও দেবী সম্ভবতঃ আদিম অধিবাসিগণের সামাজিক স্তর অতিক্রম করিয়া পুরাণ-তন্ত্রাদির মারফতে ব্রাহ্মণ্য সমাজে তাঁহাদের স্থান প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছেন।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
বিভিন্ন পুরাণাদিতে দেখা যায় দেবী ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মূর্তি ও নামে পূজিতা। যেমন ‘পদ্মপুরাণে’র সৃষ্টিখণ্ডে দেখা যায়, বিষ্ণু সাবিত্রী দেবীকে পরম ভক্তিসহকারে স্তব করে বলছেন–
‘ইতিহাস একতত্ত্বকে কেবলই দেশ ও কালের বিভিন্ন অবস্থানে ভাঙিয়া ভাঙিয়া দেখিতে বুঝিতে চায়। সাধক তাই যে ক্ষেত্রে এক কি করিয়া বহু হইল এই রহস্যই উপলব্ধি করিতে চান, ঐতিহাসিক সেখানে বহু একত্রিত হইয়া কি করিয়া একের সৃষ্টি করিতেছে তাহা লক্ষ্য করিতে চান। ইতিহাস তাই বলিবে ভারতবর্ষের দেবীতন্ত্রের পিছনে মূলে এক দেবী ছিলেন, সেই এক দেবী হইতেই বহু দেবী, বহু পূজাবিধি ও উপাখ্যানের সৃষ্টি হইয়াছে এই কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে; বহু স্পষ্ট-অস্পষ্ট উৎসমূল হইতে আবির্ভূতা বহু দেবী, তাঁহাদের অবলম্বন করিয়া বহু পূজাবিধি, বহু উপাখ্যান; সেই দেবীগণের ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে বঙ্কিম গতিতে আসিয়া ঘটিয়াছে এক ধারার সহিত অন্য ধারার মিলন; তাহার সহিত আবার যুক্ত হইয়াছে আমাদের ক্রমবর্ধমান তত্ত্ববুদ্ধি– তখন যে স্থানে যে কালে যত দেবী ছিলেন সকলকে মিলাইয়া গড়িয়া উঠিয়াছেন এক মহাদেবী। এই যে একীকরণের প্রক্রিয়া তাহা সমানভাবে চলিতেছেই; তাই এখনও যদি কোনও স্থানে কোনও বিশেষ-প্রকৃতি-যুক্তা গ্রাম্যদেবীর আবিষ্কার হয় তবে আমাদের তত্ত্ববুদ্ধি অমনই তাঁহার আকৃতি-প্রকৃতির একটি বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়া তাঁহাকে মহাদেবীর অঙ্গীভূত করিয়া লইতেছে। বৈষ্ণব-দর্শন, শৈব-দর্শন ও শাক্ত-দর্শনকে অবলম্বন করিয়া এক আদিভূতা সনাতনীর ধারণা আমাদের মধ্যে যতই স্পষ্ট এবং দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছে তত্ত্বব্যাখ্যা ও উপাখ্যান-সৃষ্টির দ্বারা ততই আমরা বিভিন্ন দেবীর ভিতরে যোগসাধনের দ্বারা আমাদের অন্বয়-প্রবণতাকে তৃপ্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। একান্ন পীঠের একান্ন দেবী মূলে হয়ত স্থানীয় দেবীরূপে একান্ন জনই ছিলেন; বিষ্ণুকর্তৃক মহাদেবী সতীর মৃতদেহকে শিবের অজ্ঞাতে একান্ন খণ্ডে ভাগ করিয়া একান্ন পীঠে ছড়াইয়া দিবার উপাখ্যান সৃষ্টি করিয়া আমরা একান্ন পীঠের একান্ন দেবীকে এক করিয়া লইবার সুযোগ পাইয়াছি। এই একান্ন দেবীকে যখন একবার একদেবীর অংশ করিয়া লইলাম তখন অনায়াসেই তাঁহারা একের সহিত অভিন্না হইয়া উঠিলেন; কারণ নিত্য এবং পূর্ণের অংশও ত নিত্য এবং পূর্ণ। দশমহাবিদ্যার দশ দেবী মূলতঃ দশ দেবীই; সতীর পিত্রালয়ে গমনের উপাখ্যানের ভিতর দিয়া দশ দেবী এক মহাদেবীর দশাবস্থা হইয়া উঠিয়াছেন। কালী এবং দক্ষকন্যা সতী বা হিমালয়-কন্যা পার্বতী যে পৃথক্ দেবী– তাঁহাদিগকে এক করিয়া তুলিতে অর্বাচীন পুরাণগুলি যে কত উপাখ্যান সৃষ্টি করিয়াছে…। তারা দেবী বৌদ্ধ দেবী বলিয়া পরিচিতা। অবশ্য এই বৌদ্ধ পরিচয়টাকে আমরা খুব বড় পরিচয় বলিয়া মনে করি না; কারণ এই বৌদ্ধ দেবী ও হিন্দু দেবী সবই বৃহত্তর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় দেবী। দশমহাবিদ্যার কোন কোনও দেবী সম্ভবতঃ আদিম অধিবাসিগণের সামাজিক স্তর অতিক্রম করিয়া পুরাণ-তন্ত্রাদির মারফতে ব্রাহ্মণ্য সমাজে তাঁহাদের স্থান প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছেন।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
বিভিন্ন পুরাণাদিতে দেখা যায় দেবী ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মূর্তি ও নামে পূজিতা। যেমন ‘পদ্মপুরাণে’র সৃষ্টিখণ্ডে দেখা যায়, বিষ্ণু সাবিত্রী দেবীকে পরম ভক্তিসহকারে স্তব করে বলছেন–
সর্বগা সর্বভূতেষু দ্রষ্টব্যা সর্বতোহদ্ভুতা।
সদসচ্চৈব যৎকিঞ্চিদ্দৃশ্যং তন্ন বিনা ত্বয়া।।- (পদ্মপুরাণ-১৭/১৮২)
তথাপি যেষু স্থানেষু দ্রষ্টব্যা সিদ্ধিমীপ্সুভিঃ।
স্মর্তব্যা ভূতিকামৈ র্বা তৎ প্রবক্ষ্যামি তেহগ্রতঃ।।- (পদ্মপুরাণ-১৭/১৮৩)
অর্থাৎ :
তুমি সর্বগা, সর্বভূতে দ্রষ্টব্যা, সর্বরকমে অদ্ভুতা; সৎ-অসৎ যাহা কিছু দৃশ্য তোমা বিনা কিছুই নয়। (পপু-১৭/১৮২)।। তথাপি যে-সকল স্থানে সিদ্ধিকামী ব্যক্তিগণ-কর্তৃক তুমি দ্রষ্টব্য, অথবা ভূতিকামী ব্যক্তিগণ-কর্তৃক স্মরণীয়া সেই-সকল তোমার অগ্রে বলিতেছি। (পপু-১৭/১৮৩)।।
এই বলে বিষ্ণু পদ্মপুরাণের পরবর্তী শ্লোকগুলোতে (পদ্মপুরাণ-১৭/১৮৪-২১১) দেবীর যে বর্ণনা দিচ্ছেন তাতে দেখা যায়, দেবী–
পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতা দেবী, গন্ধমাদনে কামুকা, মানসে কুমুদা, অম্বরে বিশ্বকায়া, গোমন্তে গোমতী, মন্দরে কামচারিণী, চৈত্ররথবনে মদোৎকটা, হস্তিনাপুরে জয়ন্তী, কান্যকুব্জে গৌরী, মলয়াচলে রম্ভা, একাম্রকাননে কীর্তিমতী, বিল্বেশ্বরে বিল্বা, কর্ণিকপুরে পুরুহস্তা, কেদারে মার্গদায়িকা, হিমালয়ে নন্দা, গোকর্ণে ভদ্রকালিকা, স্থান্বীশ্বরে ভবানী, বিল্বকে বিল্বপত্রিকা, শ্রীশৈলে মাধবী দেবী, ভদ্রেশ্বরে ভদ্রা, বরাহগিরিতে জয়া, কমলালয়ে কমলা, রুদ্রকোটীতে রুদ্রাণী, কালঞ্জরে কালী, মহালিঙ্গে কপিলা, কর্কোটে মঙ্গলেশ্বরী, শালগ্রাম-ক্ষেত্রে মহাদেবী, শিবলিঙ্গে জলপ্রিয়া, মায়াপুরীতে কুমারী, সল্তানে ললিতা, সহস্রাক্ষে উৎপলাক্ষী, হিরণাক্ষে মহোৎপলা, গঙ্গায় মঙ্গলা, পুরুষোত্তমে বিমলা, বিপাশায় অমোঘাক্ষী, পুণ্যবর্ধনে পাটলা, সুপার্শ্বগিরিতে নারায়ণী, ত্রিকূটে ভদ্রসুন্দরী, বিপুলে বিপুলা, মানসাচলে কল্যাণী, কোটিতীর্থে কোটবী, মাধবীবনে সুগন্ধা, কুব্জাম্রকে ত্রিসন্ধ্যা, গঙ্গাদ্বারে হরিপ্রিয়া, শিবকুণ্ডে শিবানন্দা, দেবিকাতটে নন্দিনী, দ্বারবতীতে রূক্সিণী, বৃন্দাবনে রাধা, মথুরায় দেবকী, পাতালে পরমেশ্বরী, চিত্রকূটে সীতা, বিন্ধ্যাচলে বিন্ধ্যনিবাসিনী, সহ্য-অদ্রিতে একবীরা, হরিশ্চন্দ্রে চন্দ্রিকা, রামতীর্থে রমণা, যমুনায় মৃগাবতী, করবীরে মহালক্ষ্মী, বিনায়কে উমা দেবী, বৈদ্যনাথে অরোগা, মহাকালে মহেশ্বরী, পুষ্পতীর্থে অভয়া, বিন্ধ্যাকন্ধরে অমৃতা, মান্ডব্যাশ্রমে মান্ডবী, মাহেশ্বরপুরে স্বাহা দেবী, বেগলে প্রচণ্ডা, অমরকণ্টকে চণ্ডিকা, সোমেশ্বরে বরারোহা, প্রভাসে পুষ্করাবতী, সরস্বতীর উভয় তটে দেবমাতা, মহালয়ে মহাপদ্মা, পয়োঞ্চীতে পিঙ্গলেশ্বরী, কৃতশৌচে সিংহিকা, কার্তিকেয়ক্ষেত্রে শঙ্করী, উৎপলাবর্তকে লোলা, সিন্ধু-সঙ্গমে সুভদ্রা, সিদ্ধবনে উমা, ভরতাশ্রমে অনঙ্গা লক্ষ্মী, জালন্ধরে বিশ্বমুখী, কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতে তারা, দেবদারুবনে পুষ্টি, কাশ্মীরমণ্ডলে মেধা, হিমাচলে ভীমা দেবী, বস্ত্রেশ্বরে তুষ্টি, কপালমোচনে শ্রদ্ধা, কায়াবরোহণে মাতা, শঙ্খোদ্ধারে ধ্বনি, পিণ্ডারকে ধৃতি, চন্দ্রভাগায় কালী, অচ্ছোদে সিদ্ধিদায়িনী, বেণায় অমৃতা দেবী, বদরিকাশ্রমে উর্বশী, উত্তরকুরুতে ঔষধী, কুশদ্বীপে কুশোদকা, হেমকূটে মন্মথা; এই দেবী কুমুদে সত্যবাদিনী, অশ্বত্থে বন্দনীয়া, বৈশ্রবণালয়ে নিধি, বেদবদনে গায়ত্রী, শিবসন্নিধানে পার্বতী, দেবলোকে ইন্দ্রাণী, ব্রহ্মাস্যে সরস্বতী, সূর্যবিশ্বে প্রভা, মাতৃকাগণমধ্যে বৈষ্ণবী, সতীমধ্যে অরুন্ধতী, রমণীমধ্যে তিলোত্তমা, চিত্রে ব্রহ্মকলা ও সর্বশরীরিগণের শক্তি।
এখানে প্রশ্ন হলো, এ-জাতীয় তালিকাকে কি সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য কোন ঐতিহাসিক তথ্য বলে গ্রহণ করা চলে? এখানে যেমন দেখা যাচ্ছে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল বিনা বাধায় উল্লিখিত হয়েছে, তেমনি আবার স্থানের তালিকার মধ্যে দেবতার কথা চলে এসেছে। তাও আবার দেবতার মধ্যে বৃক্ষ-গুল্মের কথা যেমন এসেছে, মাতৃকাগণ, সতীগণ, রমণীগণ এবং শেষপর্যন্ত সর্বশরীরীর কথাও এসেছে। তাছাড়া, এ তালিকায় ভারতবর্ষের যে-সব স্থানের কথা উল্লিখিত হয়েছে, বিজ্ঞ গবেষক ও ইতিহাসবেত্তাদের মতে সে-সব স্থানের স্পষ্ট নির্দেশ এখনকার দিনে সম্ভব নয়। তবুও এ-জাতীয় তালিকার যথেষ্ট মূল্য রয়েছে, কেননা, বিভিন্ন পুরাণেই এরকমের তালিকা পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে সম্পূর্ণ ঐকমত্য না থাকলেও মোটামুটি কতকগুলো মিল দেখতে পাওয়া যায়। এবং এই মিলের দিকে লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও এ-কথা বলা যায় যে–
‘এই তালিকাগুলির মধ্যে জনপ্রসিদ্ধিকে অবলম্বন করিয়া আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিতা বহু দেবীর উল্লেখ পাই। এই দেবীগণের মধ্যে অনেক দেবীই মূলে স্বতন্ত্রা ছিলেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। ইঁহাদের উদ্ভবের বা অভিব্যক্তির ইতিহাস, ইঁহাদের আকৃতি-প্রকৃতি, ইঁহাদের পূজাবিধি, ইঁহাদিগকে অবলম্বন করিয়া কিংবদন্তী-উপাখ্যান অধিকাংশ স্থলেই পৃথক্; দার্শনিক শক্তিতত্ত্বের ক্রমবিকাশের সঙ্গে যখন আমরা স্থির বুদ্ধি লাভ করিতে লাগিলাম যে শক্তি কখনও মূলে এক বই দুই হইতে পারে না, তখন শক্তি-প্রতিমূর্তি দেবীরাও সব এক হইয়া উঠিতে লাগিলেন। ক্রমে আমাদের তত্ত্বদৃষ্টি গড়িয়া উঠিল,– পৃথিবীর যে অঞ্চলে যে যুগে যে সমাজবিধির ভিতরেই কোনও দেবীর উদ্ভব বা অভিব্যক্তি হৌক না কেন, তাঁহারা শক্তিরূপিণী এক সনাতনী মহাদেবীরই অংশ বা রূপভেদ মাত্র।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
বিভিন্ন পুরাণাদিতে যেমন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিতা এবং পূজিতা দেবীগণের উল্লেখ পাওয়া যায় তেমনই বাঙলা ধর্মমঙ্গলগুলোর মধ্যে দেব-বন্দনার ভেতরে আবার বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিতা এবং পূজিতা বহু দেবীরও উল্লেখ দেখা যায়। এসব তালিকায় নানা ধরনের মিশ্রণ ঘটলেও তার ঐতিহাসিক মূল্যকে উপেক্ষা করা যায় না। কেননা, তা থেকে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে কোন্ কোন্ দেবীর প্রতিষ্ঠা ছিলো তার একটা আভাস পাওয়া যায়। যেমন মাণিক গাঙ্গুলীর ‘শ্রীধর্মমঙ্গলে’ উল্লেখ পাই–
‘ফুলায়ে জয়দুর্গা, বৈতালে ঝক্ (ঝক্ বুড়ী), খপুতে খেপাই, আমতায় মেলাই, কালীঘাটে কালী, সৌলায় রঙ্কিণী, বিক্রমপুরে বিশালা (বিশালাক্ষী), বড়দায় বিশালা, রাজবলহাটে রাজবল্লভী, সিয়াখলায় বাসুলী, বেতায় সর্বমঙ্গলা, বর্ধমানে সর্বমঙ্গলা, হিঙ্গুলাতে (হিংলাজ) হিঙ্গুলাটেশ্বরী, কামরূপে কামাখ্যা (কামেশ্বরী), ঢাকায় ঢাকেশ্বরী, আড়ুতে অর্পণা, কিরীটিকোণায় কিরীটিশ্বরী, যাজগ্রামে বিরজা, আশ্বিনকোটরায় অষ্টভুজা, সেনবাহিড়ে সাপরূপা, খাতরে মহাকালী, পড়াশে ঘাঁটু দেবী, নাড়চায় সর্বমঙ্গলা, আনুড়ে বিশালা, মড়াগড়া গ্রামে নানেশ্বরী, নাও গ্রামে দম্ভেশ্বরী, লক্ষ্মীপুরে লক্ষ্মী, বুঞায়ে চণ্ডী, রঙ্গপুরে বিশালাক্ষী, মানপুরে মনসা, ছিরামপুরে ত্রিপুরাসুন্দরী, বেলায় চণ্ডী, ছাতনায় বাসুলী, তমলুকে বর্গভীমা, রায়খায় কালী, শালাঘাটে শুভা দেবী, শাটীনন্দে লক্ষ্মী, পলাশীতে পলাশচণ্ডিকা, ভাণ্ডারগড়ে ভাতারচণ্ডী, সর্মিখীর গ্রামে নৃমুণ্ডমালিনী, তালুপুরে ষষ্ঠী, গোগ্রামে ভগবতী, ময়নাপুরে ষষ্ঠী।’
আবার অন্য কোন তালিকায় পুরনো দেবীর সাথে নতুন নামের নতুন বৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া অস্বাভাবিক হয় না। তাতেই বুঝা যায়, ভারতীয় সাহিত্যে আমরা যে শক্তি বা দেবীর উল্লেখ পাই তাঁর মধ্যে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন ধারা কৌতুহলজনকভাবে মিশে গেছে। তবে বাঙলা অঞ্চলকে আমরা যেভাবে শাক্তধর্মের দেশ বলে জানি, তার শুরুটা ঠিক কখন থেকে অর্থাৎ কোন্ সময় থেকে এই অঞ্চল বা শাক্ত-প্রবণ বা শাক্তধর্মের দেশ হয়ে উঠেছে তা নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট প্রামাণ্য বিচার আবশ্যক। প্রাচীন বিভিন্ন দানলিপি ও প্রশস্তিলিপি থেকে এবং প্রাপ্ত দেবীমূর্তি তথা মূর্তিশিল্পের নমুনা থেকে যে তথ্য এযাবৎ সংগ্রহ করা হয়েছে তাতে করে গুপ্ত পাল সেন সাম্রাজ্যে বাঙলা অঞ্চলে শাক্তধর্মের অস্তিত্ব নানাদিক থেকে লক্ষ্য করা গেলেও বিশেষ কোন প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়নি বলে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত। তাঁর মতে, বিভিন্ন যুগে কিছু কিছু হিন্দু এবং বৌদ্ধ দেবীমূর্তি প্রাপ্ত হলেও দেবীপূজারূপে শাক্তধর্মকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশে একটি গৌণ ধর্ম বলেই মনে হয়। তবে দেহকে অবলম্বন করে এবং শক্তিকে অবলম্বন করেও তান্ত্রিক সাধনা এ যুগের মধ্যেই একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। বাঙলাদেশে দেবীপূজার কাহিনী ও বিধিবিধান-সংবলিত যে কয়খানি পুরাণ-নামধেয় উপপুরাণ পাওয়া যায় তাদের রচনা-তারিখ নিশ্চিত করে বলা শক্ত; কিন্তু মোটামুটিভাবে এগুলিকে দশম হতে দ্বাদশ শতকের রচনা বলেই মনে হয়। কতগুলো চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের লেখাও হতে পারে।
পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতা দেবী, গন্ধমাদনে কামুকা, মানসে কুমুদা, অম্বরে বিশ্বকায়া, গোমন্তে গোমতী, মন্দরে কামচারিণী, চৈত্ররথবনে মদোৎকটা, হস্তিনাপুরে জয়ন্তী, কান্যকুব্জে গৌরী, মলয়াচলে রম্ভা, একাম্রকাননে কীর্তিমতী, বিল্বেশ্বরে বিল্বা, কর্ণিকপুরে পুরুহস্তা, কেদারে মার্গদায়িকা, হিমালয়ে নন্দা, গোকর্ণে ভদ্রকালিকা, স্থান্বীশ্বরে ভবানী, বিল্বকে বিল্বপত্রিকা, শ্রীশৈলে মাধবী দেবী, ভদ্রেশ্বরে ভদ্রা, বরাহগিরিতে জয়া, কমলালয়ে কমলা, রুদ্রকোটীতে রুদ্রাণী, কালঞ্জরে কালী, মহালিঙ্গে কপিলা, কর্কোটে মঙ্গলেশ্বরী, শালগ্রাম-ক্ষেত্রে মহাদেবী, শিবলিঙ্গে জলপ্রিয়া, মায়াপুরীতে কুমারী, সল্তানে ললিতা, সহস্রাক্ষে উৎপলাক্ষী, হিরণাক্ষে মহোৎপলা, গঙ্গায় মঙ্গলা, পুরুষোত্তমে বিমলা, বিপাশায় অমোঘাক্ষী, পুণ্যবর্ধনে পাটলা, সুপার্শ্বগিরিতে নারায়ণী, ত্রিকূটে ভদ্রসুন্দরী, বিপুলে বিপুলা, মানসাচলে কল্যাণী, কোটিতীর্থে কোটবী, মাধবীবনে সুগন্ধা, কুব্জাম্রকে ত্রিসন্ধ্যা, গঙ্গাদ্বারে হরিপ্রিয়া, শিবকুণ্ডে শিবানন্দা, দেবিকাতটে নন্দিনী, দ্বারবতীতে রূক্সিণী, বৃন্দাবনে রাধা, মথুরায় দেবকী, পাতালে পরমেশ্বরী, চিত্রকূটে সীতা, বিন্ধ্যাচলে বিন্ধ্যনিবাসিনী, সহ্য-অদ্রিতে একবীরা, হরিশ্চন্দ্রে চন্দ্রিকা, রামতীর্থে রমণা, যমুনায় মৃগাবতী, করবীরে মহালক্ষ্মী, বিনায়কে উমা দেবী, বৈদ্যনাথে অরোগা, মহাকালে মহেশ্বরী, পুষ্পতীর্থে অভয়া, বিন্ধ্যাকন্ধরে অমৃতা, মান্ডব্যাশ্রমে মান্ডবী, মাহেশ্বরপুরে স্বাহা দেবী, বেগলে প্রচণ্ডা, অমরকণ্টকে চণ্ডিকা, সোমেশ্বরে বরারোহা, প্রভাসে পুষ্করাবতী, সরস্বতীর উভয় তটে দেবমাতা, মহালয়ে মহাপদ্মা, পয়োঞ্চীতে পিঙ্গলেশ্বরী, কৃতশৌচে সিংহিকা, কার্তিকেয়ক্ষেত্রে শঙ্করী, উৎপলাবর্তকে লোলা, সিন্ধু-সঙ্গমে সুভদ্রা, সিদ্ধবনে উমা, ভরতাশ্রমে অনঙ্গা লক্ষ্মী, জালন্ধরে বিশ্বমুখী, কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতে তারা, দেবদারুবনে পুষ্টি, কাশ্মীরমণ্ডলে মেধা, হিমাচলে ভীমা দেবী, বস্ত্রেশ্বরে তুষ্টি, কপালমোচনে শ্রদ্ধা, কায়াবরোহণে মাতা, শঙ্খোদ্ধারে ধ্বনি, পিণ্ডারকে ধৃতি, চন্দ্রভাগায় কালী, অচ্ছোদে সিদ্ধিদায়িনী, বেণায় অমৃতা দেবী, বদরিকাশ্রমে উর্বশী, উত্তরকুরুতে ঔষধী, কুশদ্বীপে কুশোদকা, হেমকূটে মন্মথা; এই দেবী কুমুদে সত্যবাদিনী, অশ্বত্থে বন্দনীয়া, বৈশ্রবণালয়ে নিধি, বেদবদনে গায়ত্রী, শিবসন্নিধানে পার্বতী, দেবলোকে ইন্দ্রাণী, ব্রহ্মাস্যে সরস্বতী, সূর্যবিশ্বে প্রভা, মাতৃকাগণমধ্যে বৈষ্ণবী, সতীমধ্যে অরুন্ধতী, রমণীমধ্যে তিলোত্তমা, চিত্রে ব্রহ্মকলা ও সর্বশরীরিগণের শক্তি।
এখানে প্রশ্ন হলো, এ-জাতীয় তালিকাকে কি সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য কোন ঐতিহাসিক তথ্য বলে গ্রহণ করা চলে? এখানে যেমন দেখা যাচ্ছে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল বিনা বাধায় উল্লিখিত হয়েছে, তেমনি আবার স্থানের তালিকার মধ্যে দেবতার কথা চলে এসেছে। তাও আবার দেবতার মধ্যে বৃক্ষ-গুল্মের কথা যেমন এসেছে, মাতৃকাগণ, সতীগণ, রমণীগণ এবং শেষপর্যন্ত সর্বশরীরীর কথাও এসেছে। তাছাড়া, এ তালিকায় ভারতবর্ষের যে-সব স্থানের কথা উল্লিখিত হয়েছে, বিজ্ঞ গবেষক ও ইতিহাসবেত্তাদের মতে সে-সব স্থানের স্পষ্ট নির্দেশ এখনকার দিনে সম্ভব নয়। তবুও এ-জাতীয় তালিকার যথেষ্ট মূল্য রয়েছে, কেননা, বিভিন্ন পুরাণেই এরকমের তালিকা পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে সম্পূর্ণ ঐকমত্য না থাকলেও মোটামুটি কতকগুলো মিল দেখতে পাওয়া যায়। এবং এই মিলের দিকে লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও এ-কথা বলা যায় যে–
‘এই তালিকাগুলির মধ্যে জনপ্রসিদ্ধিকে অবলম্বন করিয়া আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিতা বহু দেবীর উল্লেখ পাই। এই দেবীগণের মধ্যে অনেক দেবীই মূলে স্বতন্ত্রা ছিলেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। ইঁহাদের উদ্ভবের বা অভিব্যক্তির ইতিহাস, ইঁহাদের আকৃতি-প্রকৃতি, ইঁহাদের পূজাবিধি, ইঁহাদিগকে অবলম্বন করিয়া কিংবদন্তী-উপাখ্যান অধিকাংশ স্থলেই পৃথক্; দার্শনিক শক্তিতত্ত্বের ক্রমবিকাশের সঙ্গে যখন আমরা স্থির বুদ্ধি লাভ করিতে লাগিলাম যে শক্তি কখনও মূলে এক বই দুই হইতে পারে না, তখন শক্তি-প্রতিমূর্তি দেবীরাও সব এক হইয়া উঠিতে লাগিলেন। ক্রমে আমাদের তত্ত্বদৃষ্টি গড়িয়া উঠিল,– পৃথিবীর যে অঞ্চলে যে যুগে যে সমাজবিধির ভিতরেই কোনও দেবীর উদ্ভব বা অভিব্যক্তি হৌক না কেন, তাঁহারা শক্তিরূপিণী এক সনাতনী মহাদেবীরই অংশ বা রূপভেদ মাত্র।’- (শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত/ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
বিভিন্ন পুরাণাদিতে যেমন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিতা এবং পূজিতা দেবীগণের উল্লেখ পাওয়া যায় তেমনই বাঙলা ধর্মমঙ্গলগুলোর মধ্যে দেব-বন্দনার ভেতরে আবার বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিতা এবং পূজিতা বহু দেবীরও উল্লেখ দেখা যায়। এসব তালিকায় নানা ধরনের মিশ্রণ ঘটলেও তার ঐতিহাসিক মূল্যকে উপেক্ষা করা যায় না। কেননা, তা থেকে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে কোন্ কোন্ দেবীর প্রতিষ্ঠা ছিলো তার একটা আভাস পাওয়া যায়। যেমন মাণিক গাঙ্গুলীর ‘শ্রীধর্মমঙ্গলে’ উল্লেখ পাই–
‘ফুলায়ে জয়দুর্গা, বৈতালে ঝক্ (ঝক্ বুড়ী), খপুতে খেপাই, আমতায় মেলাই, কালীঘাটে কালী, সৌলায় রঙ্কিণী, বিক্রমপুরে বিশালা (বিশালাক্ষী), বড়দায় বিশালা, রাজবলহাটে রাজবল্লভী, সিয়াখলায় বাসুলী, বেতায় সর্বমঙ্গলা, বর্ধমানে সর্বমঙ্গলা, হিঙ্গুলাতে (হিংলাজ) হিঙ্গুলাটেশ্বরী, কামরূপে কামাখ্যা (কামেশ্বরী), ঢাকায় ঢাকেশ্বরী, আড়ুতে অর্পণা, কিরীটিকোণায় কিরীটিশ্বরী, যাজগ্রামে বিরজা, আশ্বিনকোটরায় অষ্টভুজা, সেনবাহিড়ে সাপরূপা, খাতরে মহাকালী, পড়াশে ঘাঁটু দেবী, নাড়চায় সর্বমঙ্গলা, আনুড়ে বিশালা, মড়াগড়া গ্রামে নানেশ্বরী, নাও গ্রামে দম্ভেশ্বরী, লক্ষ্মীপুরে লক্ষ্মী, বুঞায়ে চণ্ডী, রঙ্গপুরে বিশালাক্ষী, মানপুরে মনসা, ছিরামপুরে ত্রিপুরাসুন্দরী, বেলায় চণ্ডী, ছাতনায় বাসুলী, তমলুকে বর্গভীমা, রায়খায় কালী, শালাঘাটে শুভা দেবী, শাটীনন্দে লক্ষ্মী, পলাশীতে পলাশচণ্ডিকা, ভাণ্ডারগড়ে ভাতারচণ্ডী, সর্মিখীর গ্রামে নৃমুণ্ডমালিনী, তালুপুরে ষষ্ঠী, গোগ্রামে ভগবতী, ময়নাপুরে ষষ্ঠী।’
আবার অন্য কোন তালিকায় পুরনো দেবীর সাথে নতুন নামের নতুন বৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া অস্বাভাবিক হয় না। তাতেই বুঝা যায়, ভারতীয় সাহিত্যে আমরা যে শক্তি বা দেবীর উল্লেখ পাই তাঁর মধ্যে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন ধারা কৌতুহলজনকভাবে মিশে গেছে। তবে বাঙলা অঞ্চলকে আমরা যেভাবে শাক্তধর্মের দেশ বলে জানি, তার শুরুটা ঠিক কখন থেকে অর্থাৎ কোন্ সময় থেকে এই অঞ্চল বা শাক্ত-প্রবণ বা শাক্তধর্মের দেশ হয়ে উঠেছে তা নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট প্রামাণ্য বিচার আবশ্যক। প্রাচীন বিভিন্ন দানলিপি ও প্রশস্তিলিপি থেকে এবং প্রাপ্ত দেবীমূর্তি তথা মূর্তিশিল্পের নমুনা থেকে যে তথ্য এযাবৎ সংগ্রহ করা হয়েছে তাতে করে গুপ্ত পাল সেন সাম্রাজ্যে বাঙলা অঞ্চলে শাক্তধর্মের অস্তিত্ব নানাদিক থেকে লক্ষ্য করা গেলেও বিশেষ কোন প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়নি বলে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত। তাঁর মতে, বিভিন্ন যুগে কিছু কিছু হিন্দু এবং বৌদ্ধ দেবীমূর্তি প্রাপ্ত হলেও দেবীপূজারূপে শাক্তধর্মকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশে একটি গৌণ ধর্ম বলেই মনে হয়। তবে দেহকে অবলম্বন করে এবং শক্তিকে অবলম্বন করেও তান্ত্রিক সাধনা এ যুগের মধ্যেই একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। বাঙলাদেশে দেবীপূজার কাহিনী ও বিধিবিধান-সংবলিত যে কয়খানি পুরাণ-নামধেয় উপপুরাণ পাওয়া যায় তাদের রচনা-তারিখ নিশ্চিত করে বলা শক্ত; কিন্তু মোটামুটিভাবে এগুলিকে দশম হতে দ্বাদশ শতকের রচনা বলেই মনে হয়। কতগুলো চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের লেখাও হতে পারে।
মূর্তিশিল্পে শক্তিদেবী : দেবীমূর্তি তথা মূর্তিশিল্পের যে সব নমুনা এযাবৎ সংগ্রহ করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে গুপ্তযুগ থেকেই দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপটি জনপ্রিয় হয়। তারও আগের যেসব নমুনা পাওয়া গেছে সেগুলিতে দেবীর বিভিন্ন রূপের মূর্তি দেখা যায়। যেমন–
‘প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রাসমূহে গজলক্ষ্মী মূর্তি, ষণ্ডসহ নগরলক্ষ্মী মূর্তি এবং পদ্মস্তবকসমূহের মধ্যে উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান দেবীমূর্তি বহুল পরিমাণে উৎকীর্ণ দেখা যায়। এই প্রতিকৃতিগুলি এত জনপ্রিয় ছিল যে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৈদেশিক শাসকবর্গ তাঁদের মুদ্রায় এগুলি ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। কুনিন্দ উপজাতির মুদ্রাসমূহে মৃগসহ একজন দেবীর উপস্থাপনা দেখা যায়। এই সকল মুদ্রার প্রচলন খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই শুরু হয়েছিল। শকসম্রাট আজেসের মুদ্রায় পার্বতী বা দুর্গার মূর্তি অঙ্কিত আছে। কণিষ্কের মুদ্রায় বহির্ভারতীয় দেবী ননার উল্লেখ আছে। কুষাণরাজ হুবিষ্কের মুদ্রায় উমা উল্লিখিত হয়েছেন। বাসুদেবের মুদ্রাতেও সিংহাসনে উপবিষ্টা এক বৈদেশিক দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। গুপ্তদের মুদ্রাতেও দেবীমূর্তি অঙ্কিত আছে, তবে তাঁদের সনাক্ত করা কঠিন। তবে গুপ্ত ও তৎপূর্ববর্তী যুগের পোড়ামাটি নির্মিত কতিপয় সীলে দুর্গা এবং শিবকে দেখা যায়। ভিটা এবং বসার থেকে প্রাপ্ত সীলে সিংহবাহিনী দুর্গার প্রতিকৃতি বর্তমান। তক্ষশিলা, কোশাম্বী, পাটনা প্রভৃতি স্থান থেকে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে প্রথম খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে নির্মিত অসংখ্য পাথরের চাকতিতে উর্বরতামূলক এক নগ্ন দেবীর প্রতিমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। বসার, বুলন্দিবাঘ, কুমবাহার, ভিটা, নগরী, সংকিসা, কোশাম্বী, তক্ষশিলা প্রভৃতি স্থানে পোড়ামাটির তৈরি দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। রাজস্থানের রাইর থেকে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের বহু নগ্ন ও অর্ধনগ্ন মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে। মহিষমর্দিনীর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে রাজস্থানের টঙ্ক জেলার উর্নিয়ারার নিকটবর্তী নগর থেকে। মৃৎফলকের উপর উৎকীর্ণ এই মূর্তিসমূহ খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের।’
‘…পার্বতীর কয়েকটি আসনমূর্তি বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। …বিক্রমপুরের কাগজীপাড়া থেকে আবিষ্কৃত দ্বাদশ শতকের মহামায়া মূর্তিটি উচ্চতায় চার ফুট, অধোভাগে শিবলিঙ্গ, উপরিভাগে দেবীর উপরার্ধ নির্গমনশীল, সম্মুখস্থ হস্তদ্বয় ধ্যানমুদ্রাগত, অপর দুটি হাতে অক্ষমালা ও পুস্তক।… উত্তরবঙ্গ থেকে কিচু দন্তুরা মূর্তি পাওয়া গেছে। সপ্তমাতৃকা শ্রেণীতে কখনও কখনও বৈষ্ণবীর পরিবর্তে বাগীশ্বরীকে স্থান দেওয়া হয়। একটি অষ্টভুজা বাগীশ্বরী মূর্তি রাজশাহী সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে।… ঢাকা জেলার ডালবাজার থেকে প্রাপ্ত চণ্ডী মূর্তিটি লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের তৃতীয় বৎসরের তারিখ যুক্ত। কেউ কেউ এটিকে ভুবনেশ্বরীর মূর্তি বলেন। একটি ষড়ভুজ ভুবনেশ্বরীর মূর্তি পাওয়া গেছে যশোহর জেলার শেখাতি থেকে। পাল যুগের একটি চতুর্ভুজা সর্বাণী মূর্তি দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়ি থেকে পাওয়া গেছে। অপরাপর চতুর্ভুজা দেবীমূর্তিসমূহের মধ্যে রাজশাহীর মান্দাইল এবং খুলনার মহেশ্বরপাশা থেকে প্রাপ্ত পার্বতী এবং বগুড়া, নওগাঁ ও নিয়ামতপুর থেকে প্রাপ্ত বালুকাপ্রস্তরের অপরাজিতা মূর্তি উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী জেলার শিমলা থেকে দশম শতকে নির্মিত কুড়ি হস্তযুক্ত মহালক্ষ্মীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। বেতনা, অট্টহাস এবং রামপালের ধ্বংসাবশেষ থেকে চামুণ্ডামূর্তি পাওয়া গেছে। নদীয়া জেলার দেবগ্রাম থেকে একটি ব্রহ্মাণী মূর্তি পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ দেবীদেরও নানা মূর্তি বঙ্গদেশ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবী তারার মূর্তি পাওয়া গেছে ফরিদপুরের উজানী ও মাঝবাড়ি এবং ঢাকার সোমপাড়া থেকে, উগ্রতারার মূর্তি পাওয়া গেছে বাকরগঞ্জের শিকারপুর থেকে, প্রজ্ঞাপারমিতা, সিতাতপত্রা, চুন্দা ও পর্ণশবরীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যথাক্রমে মালদহ, ত্রিপুরা, রাজশাহীর নিয়ামতপুর ও বিক্রমপুর থেকে। সন্তানপরিবৃত একটি জৈন অম্বিকামূর্তি চব্বিশ পরগনা জেলার নালগোরা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে।’
‘গুপ্তযুগ থেকেই দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপটি জনপ্রিয় হয়। রাজস্থান থেকে প্রাপ্ত প্রাচীনতম নিদর্শনটির কথা আমরা আগেই বলেছি। গুপ্তযুগের উল্লেখযোগ্য মহিষমর্দিনী মূর্তিসমূহের মধ্যে মধ্যপ্রদেশের ভীলসার নিকট উদয়গিরির গুহামন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ দ্বাদশভুজা মহিষাসুর নিধনরতা দেবীর কথা বলা যায়। রাজস্থানের গঙ্গানগরের অন্তর্গত ভদ্রকালী থেকে প্রাপ্ত মৃৎফলকে যে মহিষমর্দিনী মূর্তি উৎকীর্ণ আছে সেখানে দেখা যায় যে চতুর্ভুজা দেবী মহিষের পৃষ্ঠে আরোহণ করে তাকে ত্রিশূল দ্বারা বধ করছেন। অম্বর সংগ্রহশালায় রক্ষিত একটি মৃৎফলকে দেবীর উপরের দুই হাতে ঢাল ও বজ্র, নীচের হস্ত মষিষের জিহ্বা আকর্ষণরত। আইহোলির বিখ্যাত দুর্গামন্দির খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে চালুক্যরাজগণ কর্তৃক নির্মিত। এই মন্দিরের দেওয়ালে মহিষনিধনরতা অষ্টভুজা দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ। বাদামির গুহামন্দিরের বারান্দায় নানা ভঙ্গীর মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। ইলোরার রামেশ্বর গুহার (৬৫০ খ্রীঃ) উৎকীর্ণ বিশাল অর্ধচিত্রের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। মামল্লপুরমের বিখ্যাত পল্লব মহিষমর্দিনী (সপ্তম শতক) সিংহবাহিনী ও অষ্টভুজা, মহিষাসুর মহিষের মস্তকযুক্ত, হাতে গদা ও তরবারি। মহিষমর্দিনী মূর্তি শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উজবেকিস্তানের অন্তর্গত পাইয়েনজাইকেন্ট নামক স্থানে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের দুর্গামূর্তিটির কথা উল্লেখ করা চলে, যে মূর্তিটি রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যাবলী বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন করা হয়নি।’
‘…চোল আমলের দুর্গামূর্তিসমূহ পল্লব রীতির ধারাবাহিকতাকেই অনুসরণ করে অষ্টভুজা, তবে কুম্ভকোনমের নাগেশ্বর স্বামী মন্দিরের মূর্তিটি চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ভারতের কোন কোন দুর্গামূর্তির সঙ্গে মৃগের সম্পর্ক বর্তমান যা আমাদের গ্রীক দেবী আর্তেমিস এবং কুনিন্দদের মুদ্রায় উৎকীর্ণ দেবীর সঙ্গে মৃগমূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পূর্বভারত থেকে অসংখ্য অষ্ট অথবা দশভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। দিনাজপুর জেলা থেকে একটি নবদুর্গা মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মূল মূর্তিটি অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনীর। সেটিকে কেন্দ্র করে রচিত আরও আটটি ক্ষুদ্রমূর্তির প্রত্যেকটি ষোড়শভুজা। ওই জেলা থেকে বত্রিশ হস্তবিশিষ্ট অসুরনিধনরতা একটি দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। রাজস্থানেও মহিষমর্দিনী মূর্তি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। উদয়পুরের নিকটবর্তী জগৎ নামক স্থানের অম্বিকামন্দিরে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনীর অনেকগুলি ধরন দেখা যায়। ওসিয়ান, আবানেরি ও পরনগরের মহিষমর্দিনীর মূর্তিসমূহও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশে ত্রিপুরা জেলার দক্ষিণ মহম্মদপুর থেকে একটি দ্বিভুজা দুর্গামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মানভূমের দুর্লাম এবং ঢাকার সকটা থেকে দ্বাদশ শতকের দুটি আকর্ষণীয় দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাচীনতর মূর্তিসমূহে মহিষাকৃতি অসুরকে বধনিরত অবস্থায় দেবীকে দেখানো হয়েছে। কালক্রমে মূর্তিতে দেবীর বাহন সিংহ, মহিষরূপী অসুরের দেহ হতে নির্গমনশীল মানুষরূপী অসুর এবং বঙ্গদেশীয় শারদীয় দুর্গোৎসবে পূজিতা মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমায় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশাদির অবস্থান দেখা যায়।’– (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
‘প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রাসমূহে গজলক্ষ্মী মূর্তি, ষণ্ডসহ নগরলক্ষ্মী মূর্তি এবং পদ্মস্তবকসমূহের মধ্যে উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান দেবীমূর্তি বহুল পরিমাণে উৎকীর্ণ দেখা যায়। এই প্রতিকৃতিগুলি এত জনপ্রিয় ছিল যে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৈদেশিক শাসকবর্গ তাঁদের মুদ্রায় এগুলি ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। কুনিন্দ উপজাতির মুদ্রাসমূহে মৃগসহ একজন দেবীর উপস্থাপনা দেখা যায়। এই সকল মুদ্রার প্রচলন খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই শুরু হয়েছিল। শকসম্রাট আজেসের মুদ্রায় পার্বতী বা দুর্গার মূর্তি অঙ্কিত আছে। কণিষ্কের মুদ্রায় বহির্ভারতীয় দেবী ননার উল্লেখ আছে। কুষাণরাজ হুবিষ্কের মুদ্রায় উমা উল্লিখিত হয়েছেন। বাসুদেবের মুদ্রাতেও সিংহাসনে উপবিষ্টা এক বৈদেশিক দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। গুপ্তদের মুদ্রাতেও দেবীমূর্তি অঙ্কিত আছে, তবে তাঁদের সনাক্ত করা কঠিন। তবে গুপ্ত ও তৎপূর্ববর্তী যুগের পোড়ামাটি নির্মিত কতিপয় সীলে দুর্গা এবং শিবকে দেখা যায়। ভিটা এবং বসার থেকে প্রাপ্ত সীলে সিংহবাহিনী দুর্গার প্রতিকৃতি বর্তমান। তক্ষশিলা, কোশাম্বী, পাটনা প্রভৃতি স্থান থেকে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে প্রথম খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে নির্মিত অসংখ্য পাথরের চাকতিতে উর্বরতামূলক এক নগ্ন দেবীর প্রতিমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। বসার, বুলন্দিবাঘ, কুমবাহার, ভিটা, নগরী, সংকিসা, কোশাম্বী, তক্ষশিলা প্রভৃতি স্থানে পোড়ামাটির তৈরি দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। রাজস্থানের রাইর থেকে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের বহু নগ্ন ও অর্ধনগ্ন মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে। মহিষমর্দিনীর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে রাজস্থানের টঙ্ক জেলার উর্নিয়ারার নিকটবর্তী নগর থেকে। মৃৎফলকের উপর উৎকীর্ণ এই মূর্তিসমূহ খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের।’
‘…পার্বতীর কয়েকটি আসনমূর্তি বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। …বিক্রমপুরের কাগজীপাড়া থেকে আবিষ্কৃত দ্বাদশ শতকের মহামায়া মূর্তিটি উচ্চতায় চার ফুট, অধোভাগে শিবলিঙ্গ, উপরিভাগে দেবীর উপরার্ধ নির্গমনশীল, সম্মুখস্থ হস্তদ্বয় ধ্যানমুদ্রাগত, অপর দুটি হাতে অক্ষমালা ও পুস্তক।… উত্তরবঙ্গ থেকে কিচু দন্তুরা মূর্তি পাওয়া গেছে। সপ্তমাতৃকা শ্রেণীতে কখনও কখনও বৈষ্ণবীর পরিবর্তে বাগীশ্বরীকে স্থান দেওয়া হয়। একটি অষ্টভুজা বাগীশ্বরী মূর্তি রাজশাহী সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে।… ঢাকা জেলার ডালবাজার থেকে প্রাপ্ত চণ্ডী মূর্তিটি লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের তৃতীয় বৎসরের তারিখ যুক্ত। কেউ কেউ এটিকে ভুবনেশ্বরীর মূর্তি বলেন। একটি ষড়ভুজ ভুবনেশ্বরীর মূর্তি পাওয়া গেছে যশোহর জেলার শেখাতি থেকে। পাল যুগের একটি চতুর্ভুজা সর্বাণী মূর্তি দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়ি থেকে পাওয়া গেছে। অপরাপর চতুর্ভুজা দেবীমূর্তিসমূহের মধ্যে রাজশাহীর মান্দাইল এবং খুলনার মহেশ্বরপাশা থেকে প্রাপ্ত পার্বতী এবং বগুড়া, নওগাঁ ও নিয়ামতপুর থেকে প্রাপ্ত বালুকাপ্রস্তরের অপরাজিতা মূর্তি উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী জেলার শিমলা থেকে দশম শতকে নির্মিত কুড়ি হস্তযুক্ত মহালক্ষ্মীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। বেতনা, অট্টহাস এবং রামপালের ধ্বংসাবশেষ থেকে চামুণ্ডামূর্তি পাওয়া গেছে। নদীয়া জেলার দেবগ্রাম থেকে একটি ব্রহ্মাণী মূর্তি পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ দেবীদেরও নানা মূর্তি বঙ্গদেশ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবী তারার মূর্তি পাওয়া গেছে ফরিদপুরের উজানী ও মাঝবাড়ি এবং ঢাকার সোমপাড়া থেকে, উগ্রতারার মূর্তি পাওয়া গেছে বাকরগঞ্জের শিকারপুর থেকে, প্রজ্ঞাপারমিতা, সিতাতপত্রা, চুন্দা ও পর্ণশবরীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যথাক্রমে মালদহ, ত্রিপুরা, রাজশাহীর নিয়ামতপুর ও বিক্রমপুর থেকে। সন্তানপরিবৃত একটি জৈন অম্বিকামূর্তি চব্বিশ পরগনা জেলার নালগোরা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে।’
‘গুপ্তযুগ থেকেই দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপটি জনপ্রিয় হয়। রাজস্থান থেকে প্রাপ্ত প্রাচীনতম নিদর্শনটির কথা আমরা আগেই বলেছি। গুপ্তযুগের উল্লেখযোগ্য মহিষমর্দিনী মূর্তিসমূহের মধ্যে মধ্যপ্রদেশের ভীলসার নিকট উদয়গিরির গুহামন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ দ্বাদশভুজা মহিষাসুর নিধনরতা দেবীর কথা বলা যায়। রাজস্থানের গঙ্গানগরের অন্তর্গত ভদ্রকালী থেকে প্রাপ্ত মৃৎফলকে যে মহিষমর্দিনী মূর্তি উৎকীর্ণ আছে সেখানে দেখা যায় যে চতুর্ভুজা দেবী মহিষের পৃষ্ঠে আরোহণ করে তাকে ত্রিশূল দ্বারা বধ করছেন। অম্বর সংগ্রহশালায় রক্ষিত একটি মৃৎফলকে দেবীর উপরের দুই হাতে ঢাল ও বজ্র, নীচের হস্ত মষিষের জিহ্বা আকর্ষণরত। আইহোলির বিখ্যাত দুর্গামন্দির খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে চালুক্যরাজগণ কর্তৃক নির্মিত। এই মন্দিরের দেওয়ালে মহিষনিধনরতা অষ্টভুজা দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ। বাদামির গুহামন্দিরের বারান্দায় নানা ভঙ্গীর মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। ইলোরার রামেশ্বর গুহার (৬৫০ খ্রীঃ) উৎকীর্ণ বিশাল অর্ধচিত্রের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। মামল্লপুরমের বিখ্যাত পল্লব মহিষমর্দিনী (সপ্তম শতক) সিংহবাহিনী ও অষ্টভুজা, মহিষাসুর মহিষের মস্তকযুক্ত, হাতে গদা ও তরবারি। মহিষমর্দিনী মূর্তি শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উজবেকিস্তানের অন্তর্গত পাইয়েনজাইকেন্ট নামক স্থানে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের দুর্গামূর্তিটির কথা উল্লেখ করা চলে, যে মূর্তিটি রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যাবলী বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন করা হয়নি।’
‘…চোল আমলের দুর্গামূর্তিসমূহ পল্লব রীতির ধারাবাহিকতাকেই অনুসরণ করে অষ্টভুজা, তবে কুম্ভকোনমের নাগেশ্বর স্বামী মন্দিরের মূর্তিটি চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ভারতের কোন কোন দুর্গামূর্তির সঙ্গে মৃগের সম্পর্ক বর্তমান যা আমাদের গ্রীক দেবী আর্তেমিস এবং কুনিন্দদের মুদ্রায় উৎকীর্ণ দেবীর সঙ্গে মৃগমূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পূর্বভারত থেকে অসংখ্য অষ্ট অথবা দশভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। দিনাজপুর জেলা থেকে একটি নবদুর্গা মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মূল মূর্তিটি অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনীর। সেটিকে কেন্দ্র করে রচিত আরও আটটি ক্ষুদ্রমূর্তির প্রত্যেকটি ষোড়শভুজা। ওই জেলা থেকে বত্রিশ হস্তবিশিষ্ট অসুরনিধনরতা একটি দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। রাজস্থানেও মহিষমর্দিনী মূর্তি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। উদয়পুরের নিকটবর্তী জগৎ নামক স্থানের অম্বিকামন্দিরে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনীর অনেকগুলি ধরন দেখা যায়। ওসিয়ান, আবানেরি ও পরনগরের মহিষমর্দিনীর মূর্তিসমূহও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশে ত্রিপুরা জেলার দক্ষিণ মহম্মদপুর থেকে একটি দ্বিভুজা দুর্গামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মানভূমের দুর্লাম এবং ঢাকার সকটা থেকে দ্বাদশ শতকের দুটি আকর্ষণীয় দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাচীনতর মূর্তিসমূহে মহিষাকৃতি অসুরকে বধনিরত অবস্থায় দেবীকে দেখানো হয়েছে। কালক্রমে মূর্তিতে দেবীর বাহন সিংহ, মহিষরূপী অসুরের দেহ হতে নির্গমনশীল মানুষরূপী অসুর এবং বঙ্গদেশীয় শারদীয় দুর্গোৎসবে পূজিতা মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমায় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশাদির অবস্থান দেখা যায়।’– (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
তান্ত্রিক শক্তিদেবী : তান্ত্রিক শক্তিপূজার প্রচলন যে ভারতবর্ষের কোন্ প্রদেশে সর্বপ্রথম আরম্ভ হয় সে বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। মহাশয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,–
‘তবে ইহার প্রাচীনতম প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ মহাভারতে প্রাপ্ত প্রথম কুমারগুপ্তের সমকালীন গাঙ্গধার শিলালিপি।… গুপ্তোত্তর যুগের (আনুমানিক ৮ম-৯ম খৃষ্টীয় শতকের) জব্বলপুরের নিকটবর্তী নর্মদাতীরস্থ ভেড়াঘাটের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও এ সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে। পরবর্তী কালে শক্তিপূজা গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিল ও তেলেগু ভাষাভাষী প্রদেশসমূহেও ন্যূনাধিক বিস্তৃতি লাভ করে। ইহার কিছু সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যযুগে ও পরে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনা যে পূর্ব ভারতে, বিশেষ করিয়া– উড়িষ্যা, বাংলা, মিথিলা ও কামরূপ অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, ইহা প্রত্নতত্ত্ব ও সাহিত্যগত প্রমাণ আমাদিগকে যুগপৎ জানাইয়া দেয়। উড়িষ্যার হীরাপুর, রানীপুর, ঝরিয়াল, বৈতাল দেউল প্রভৃতি শক্তিমন্দিরের কথা বলিয়াছি। তান্ত্রিক গ্রন্থমালার একটি বিশিষ্ট ও প্রামাণ্য অংশ অনেকের মতে বাংলায় ও তৎপার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে রচিত হইয়াছিল। উড়িষ্যা যে তান্ত্রিক সাধনার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ছিল, উহার সাহিত্যগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহারও কাহারও মতে ওডিয়ান নামক স্থান, যাহা চারিটি তান্ত্রিক ক্ষেত্রের অন্যতম ( আনুমানিক ৮ম শতকের হেবজ্র তন্ত্রে এইরূপ চারি ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে– জালন্ধর, ওডিয়ান, পূর্ণগিরি ও কামরূপ), বর্তমান উড়িষ্যা প্রদেশকেই বুঝায়। কিন্তু এ বিষয়ে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন ওডিয়ান ভারতের উত্তর-পশ্চিম ভাগে অবস্থিত প্রাচীন উদ্যান (বর্তমানে সোয়াট নদীর উপত্যকা,– ইহা প্রাচীন গন্ধারের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে স্থিত) প্রদেশ। এই মতের কিছু সমর্থনসূচক ইঙ্গিত মনে হয় হিউয়েন সাং-এর সি-ইউ-কিতে পাওয়া যায়। চীন পরিব্রাজক এখানকার অধিবাসীগণ সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে ইহারা ঐন্দ্রজালিক মন্ত্রাদি সাধনেই (আসলে তান্ত্রিক মন্ত্রাদি) প্রধানতঃ ব্যস্ত থাকিতেন। ভারতের উত্তর প্রান্তস্থ পঞ্চাব প্রদেশের জালন্ধরে যে তান্ত্রিক উপাসনা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল উহা হেবজ্র তন্ত্রের উপরিলিখিত উক্তি সপ্রমাণ করে। ওডিয়ান ও প্রাচীন উদ্যানের একত্ব গৃহীত হইলেও উড়িষ্যা যে মধ্যযুগে তান্ত্রিক উপাসনার প্রধান ক্ষেত্র ছিল ইহা অপ্রমাণিত হয় না। পঞ্চোপাসনার পঞ্চক্ষেত্র এখানে এইরূপে অবস্থিত, যথা বৈষ্ণব-শ্রীক্ষেত্র (পুরী), শৈব-একাম্রক্ষেত্র (ভুবনেশ্বর), শক্তি-বিরজাক্ষেত্র (যাজপুর), সৌর-অর্কক্ষেত্র (কোনার্ক-কোনারক), গাণপত্য-গণপতিক্ষেত্র (কপিলাশ রোড স্টেশন সন্নিকট মহাবিনায়ক পর্বত)। উড়িষ্যার বৈষ্ণব ও শৈব ক্ষেত্রেও শাক্ত উপাসনার প্রভাব বিশেষ ভাবে বর্তমান ছিল এবং এখনও আছে; উহার প্রমাণ জগন্নাথের মন্দিরাভ্যন্তরে বিমলা ও অন্নপূর্ণা দেবীর পূজামন্দির এবং জগন্নাথের পূজাক্রমে কিছু প্রচ্ছন্ন তান্ত্রিক বিধি, ও ভুবনেশ্বরে অনন্ত বাসুদেবের (প্রকৃতপক্ষে একানংশার,– জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান বিগ্রহত্রয় একত্রে দেবী একানংশাকে রূপায়িত করে) মন্দির এবং বৈতাল দেউল, মোহিনী, ভূবাসিনী প্রভৃতি দেবীর মন্দির হইতে পাওয়া যায়। পুরীর মার্কন্ডেয় সরোবরস্থ সপ্তমাতৃকার মূর্তিগুলি, যাজপুরে প্রাপ্ত অনুরূপ মূর্তি, এবং প্রদেশের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত দুর্গা, মহিষাসুরমর্দিনী, দন্তুরা প্রভৃতি মধ্যযুগের শক্তিমূর্তিসমূহ এবিষয়ক অতিরিক্ত প্রমাণ। আসাম বা কামরূপেও যে তান্ত্রিক উপাসনার প্রাবল্য ছিল, এবং এখনও আছে উহার সম্বন্ধে কামাখ্যায় অবস্থিত যোনিপীঠ ও তত্রত্য কামাখ্যা দেবীর মন্দির সাক্ষ্য প্রদান করে। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে ও তাহার পরে এই যোনিপীঠ ভারতের উত্তর-পশ্চিমস্থ গন্ধার প্রদেশে অবস্থিত ছিল। এ বিষয়ে মহাভারত, মহামায়ূরী ও সি-ইউ-কি (হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ-বিবরণী) প্রভৃতি সাক্ষ্য দেয়। কামাখ্যাতন্ত্র নামে একটি তান্ত্রিক গ্রন্থের কথা কিছু আগে বলা হইয়াছে। ইহাও কামরূপ প্রদেশে শক্তি-উপাসনার বিস্তৃতি প্রমাণিত করে। উত্তর বিহারে, তথা মিথিলায়ও তান্ত্রিক শক্তিপূজার সমধিক প্রচলন ছিল; উহার সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ পাওয়া যায়। হেবজ্র তন্ত্রের এবং সাধনমালাস্থ বজ্রযোগিনী সাধনের পূর্ণগিরি যে কোথায় অবস্থিত ছিল উহা সঠিক বলা যায় না। তবে দক্ষিণ ভারতের শ্রীশৈলম্ নামক স্থান শক্তি-উপাসনার সহিত জড়িত। পূর্ণগিরির সহিত উহার ঐক্য সমর্থন করা যাইতে পারে। সাধনমালাস্থ দুইটি সাধনে (সংখ্যা ২৩২ ও ২৩৪) চারিটি তান্ত্রিক ক্ষেত্রের (ওডিয়ান, পূর্ণগিরি, কামাখ্যা ও সিরিহট্ট) পূজার বিধান দেওয়া আছে।’- (পঞ্চোপাসনা)
‘তবে ইহার প্রাচীনতম প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ মহাভারতে প্রাপ্ত প্রথম কুমারগুপ্তের সমকালীন গাঙ্গধার শিলালিপি।… গুপ্তোত্তর যুগের (আনুমানিক ৮ম-৯ম খৃষ্টীয় শতকের) জব্বলপুরের নিকটবর্তী নর্মদাতীরস্থ ভেড়াঘাটের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও এ সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে। পরবর্তী কালে শক্তিপূজা গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিল ও তেলেগু ভাষাভাষী প্রদেশসমূহেও ন্যূনাধিক বিস্তৃতি লাভ করে। ইহার কিছু সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যযুগে ও পরে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনা যে পূর্ব ভারতে, বিশেষ করিয়া– উড়িষ্যা, বাংলা, মিথিলা ও কামরূপ অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, ইহা প্রত্নতত্ত্ব ও সাহিত্যগত প্রমাণ আমাদিগকে যুগপৎ জানাইয়া দেয়। উড়িষ্যার হীরাপুর, রানীপুর, ঝরিয়াল, বৈতাল দেউল প্রভৃতি শক্তিমন্দিরের কথা বলিয়াছি। তান্ত্রিক গ্রন্থমালার একটি বিশিষ্ট ও প্রামাণ্য অংশ অনেকের মতে বাংলায় ও তৎপার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে রচিত হইয়াছিল। উড়িষ্যা যে তান্ত্রিক সাধনার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ছিল, উহার সাহিত্যগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। কাহারও কাহারও মতে ওডিয়ান নামক স্থান, যাহা চারিটি তান্ত্রিক ক্ষেত্রের অন্যতম ( আনুমানিক ৮ম শতকের হেবজ্র তন্ত্রে এইরূপ চারি ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে– জালন্ধর, ওডিয়ান, পূর্ণগিরি ও কামরূপ), বর্তমান উড়িষ্যা প্রদেশকেই বুঝায়। কিন্তু এ বিষয়ে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন ওডিয়ান ভারতের উত্তর-পশ্চিম ভাগে অবস্থিত প্রাচীন উদ্যান (বর্তমানে সোয়াট নদীর উপত্যকা,– ইহা প্রাচীন গন্ধারের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে স্থিত) প্রদেশ। এই মতের কিছু সমর্থনসূচক ইঙ্গিত মনে হয় হিউয়েন সাং-এর সি-ইউ-কিতে পাওয়া যায়। চীন পরিব্রাজক এখানকার অধিবাসীগণ সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে ইহারা ঐন্দ্রজালিক মন্ত্রাদি সাধনেই (আসলে তান্ত্রিক মন্ত্রাদি) প্রধানতঃ ব্যস্ত থাকিতেন। ভারতের উত্তর প্রান্তস্থ পঞ্চাব প্রদেশের জালন্ধরে যে তান্ত্রিক উপাসনা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল উহা হেবজ্র তন্ত্রের উপরিলিখিত উক্তি সপ্রমাণ করে। ওডিয়ান ও প্রাচীন উদ্যানের একত্ব গৃহীত হইলেও উড়িষ্যা যে মধ্যযুগে তান্ত্রিক উপাসনার প্রধান ক্ষেত্র ছিল ইহা অপ্রমাণিত হয় না। পঞ্চোপাসনার পঞ্চক্ষেত্র এখানে এইরূপে অবস্থিত, যথা বৈষ্ণব-শ্রীক্ষেত্র (পুরী), শৈব-একাম্রক্ষেত্র (ভুবনেশ্বর), শক্তি-বিরজাক্ষেত্র (যাজপুর), সৌর-অর্কক্ষেত্র (কোনার্ক-কোনারক), গাণপত্য-গণপতিক্ষেত্র (কপিলাশ রোড স্টেশন সন্নিকট মহাবিনায়ক পর্বত)। উড়িষ্যার বৈষ্ণব ও শৈব ক্ষেত্রেও শাক্ত উপাসনার প্রভাব বিশেষ ভাবে বর্তমান ছিল এবং এখনও আছে; উহার প্রমাণ জগন্নাথের মন্দিরাভ্যন্তরে বিমলা ও অন্নপূর্ণা দেবীর পূজামন্দির এবং জগন্নাথের পূজাক্রমে কিছু প্রচ্ছন্ন তান্ত্রিক বিধি, ও ভুবনেশ্বরে অনন্ত বাসুদেবের (প্রকৃতপক্ষে একানংশার,– জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান বিগ্রহত্রয় একত্রে দেবী একানংশাকে রূপায়িত করে) মন্দির এবং বৈতাল দেউল, মোহিনী, ভূবাসিনী প্রভৃতি দেবীর মন্দির হইতে পাওয়া যায়। পুরীর মার্কন্ডেয় সরোবরস্থ সপ্তমাতৃকার মূর্তিগুলি, যাজপুরে প্রাপ্ত অনুরূপ মূর্তি, এবং প্রদেশের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত দুর্গা, মহিষাসুরমর্দিনী, দন্তুরা প্রভৃতি মধ্যযুগের শক্তিমূর্তিসমূহ এবিষয়ক অতিরিক্ত প্রমাণ। আসাম বা কামরূপেও যে তান্ত্রিক উপাসনার প্রাবল্য ছিল, এবং এখনও আছে উহার সম্বন্ধে কামাখ্যায় অবস্থিত যোনিপীঠ ও তত্রত্য কামাখ্যা দেবীর মন্দির সাক্ষ্য প্রদান করে। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে ও তাহার পরে এই যোনিপীঠ ভারতের উত্তর-পশ্চিমস্থ গন্ধার প্রদেশে অবস্থিত ছিল। এ বিষয়ে মহাভারত, মহামায়ূরী ও সি-ইউ-কি (হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ-বিবরণী) প্রভৃতি সাক্ষ্য দেয়। কামাখ্যাতন্ত্র নামে একটি তান্ত্রিক গ্রন্থের কথা কিছু আগে বলা হইয়াছে। ইহাও কামরূপ প্রদেশে শক্তি-উপাসনার বিস্তৃতি প্রমাণিত করে। উত্তর বিহারে, তথা মিথিলায়ও তান্ত্রিক শক্তিপূজার সমধিক প্রচলন ছিল; উহার সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ পাওয়া যায়। হেবজ্র তন্ত্রের এবং সাধনমালাস্থ বজ্রযোগিনী সাধনের পূর্ণগিরি যে কোথায় অবস্থিত ছিল উহা সঠিক বলা যায় না। তবে দক্ষিণ ভারতের শ্রীশৈলম্ নামক স্থান শক্তি-উপাসনার সহিত জড়িত। পূর্ণগিরির সহিত উহার ঐক্য সমর্থন করা যাইতে পারে। সাধনমালাস্থ দুইটি সাধনে (সংখ্যা ২৩২ ও ২৩৪) চারিটি তান্ত্রিক ক্ষেত্রের (ওডিয়ান, পূর্ণগিরি, কামাখ্যা ও সিরিহট্ট) পূজার বিধান দেওয়া আছে।’- (পঞ্চোপাসনা)
তবে মধ্যযুগ থেকে বাঙলা অঞ্চলই যে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার প্রধানতম ক্ষেত্র ছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে জিতেন্দ্রনাথ বলছেন–
‘মধ্যযুগে ও উহার পরেও বাংলাদেশই যে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার প্রধানতম ক্ষেত্র ছিল এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। তৎকালীন বিভিন্ন জাতীয় দেবীমূর্তি এ দেশে এত আবিষ্কৃত হইয়াছে, যে ঐগুলি হইতেই জানা যায় যে এ স্থানের অধিবাসীরা কি পরিমাণে দেবী-উপাসক ছিলেন। এতদ্দেশে প্রচলিত বিষ্ণু ও শিবের উপাসনাতেও শক্তিপূজার একটি বিশিষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কৃষ্ণপূজায় তাঁহার হ্লাদিনী শক্তি রাধার ও শিবের পূজায় তাঁহার ঘরণী দুর্গা-পার্বতীর অংশ প্রধান বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। উত্তর-মধ্যযুগের পরবর্তী কালের কালীমূর্তি বাঙ্গালী তান্ত্রিক সাধকের নিজস্ব পরিকল্পনা। এই মূর্তির রূপায়নে বজ্রযান বৌদ্ধ দেবতা নৈরাত্মার কোনও প্রভাব ছিল কিনা বলা যায় না; তবে ইহা অনস্বীকার্য যে উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে এবং কালীমূর্তির প্রাচীনত্ব অধিক নহে। (কিংবদন্তী এই যে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নাকি কালীরূপ কল্পনার আদি স্রষ্টা। ইহা সত্য কিনা জোর করিয়া বলা যায় না।) ন্যূনাধিক তিন শতাব্দীর মধ্যে বঙ্গীয় তান্ত্রিক সাধকের উপাস্য হিসাবে দেবীর এই উগ্ররূপ পরিকল্পিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়, এবং ইহাকে কেন্দ্র করিয়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রমুখ শক্তি-উপাসকগণ যে ভাব ও ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীত সুললিত বাংলা ভাষায় রচনা করিয়াছিলেন উহা আজিও শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বাঙ্গালী জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও আদরের বস্তু। এ দেমে যে দশ মহাবিদ্যার সাধারণ প্রচলিত তালিকা আছে কালিকা দেবী উহার সর্বপ্রথম। তালিকাটি এই–
‘মধ্যযুগে ও উহার পরেও বাংলাদেশই যে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার প্রধানতম ক্ষেত্র ছিল এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। তৎকালীন বিভিন্ন জাতীয় দেবীমূর্তি এ দেশে এত আবিষ্কৃত হইয়াছে, যে ঐগুলি হইতেই জানা যায় যে এ স্থানের অধিবাসীরা কি পরিমাণে দেবী-উপাসক ছিলেন। এতদ্দেশে প্রচলিত বিষ্ণু ও শিবের উপাসনাতেও শক্তিপূজার একটি বিশিষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কৃষ্ণপূজায় তাঁহার হ্লাদিনী শক্তি রাধার ও শিবের পূজায় তাঁহার ঘরণী দুর্গা-পার্বতীর অংশ প্রধান বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। উত্তর-মধ্যযুগের পরবর্তী কালের কালীমূর্তি বাঙ্গালী তান্ত্রিক সাধকের নিজস্ব পরিকল্পনা। এই মূর্তির রূপায়নে বজ্রযান বৌদ্ধ দেবতা নৈরাত্মার কোনও প্রভাব ছিল কিনা বলা যায় না; তবে ইহা অনস্বীকার্য যে উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে এবং কালীমূর্তির প্রাচীনত্ব অধিক নহে। (কিংবদন্তী এই যে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নাকি কালীরূপ কল্পনার আদি স্রষ্টা। ইহা সত্য কিনা জোর করিয়া বলা যায় না।) ন্যূনাধিক তিন শতাব্দীর মধ্যে বঙ্গীয় তান্ত্রিক সাধকের উপাস্য হিসাবে দেবীর এই উগ্ররূপ পরিকল্পিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়, এবং ইহাকে কেন্দ্র করিয়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রমুখ শক্তি-উপাসকগণ যে ভাব ও ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীত সুললিত বাংলা ভাষায় রচনা করিয়াছিলেন উহা আজিও শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বাঙ্গালী জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও আদরের বস্তু। এ দেমে যে দশ মহাবিদ্যার সাধারণ প্রচলিত তালিকা আছে কালিকা দেবী উহার সর্বপ্রথম। তালিকাটি এই–
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতে দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্তিতাঃ।।
এই শ্লোক দুইটি চামুণ্ডা ও মুণ্ডমালা তন্ত্র হইতে গৃহীত। তন্ত্রদ্বয় যে খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত হইয়াছিল তাহা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসারে উহাদের উল্লেখ হইতে জানা যায়। আগমবাগীশ মহাশয় মালিনীবিজয় নামক তন্ত্র হইতে দ্বাদশটি (?) মহাবিদ্যার নাম সম্বলিত চারিটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইঁহাদের নাম এইরূপ– কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, মাতঙ্গী ও শৈলবাসিনী। তবে কামাখ্যাবাসিনী ও শৈলবাসিনী যদি বালা ও মাতঙ্গীর বিশেষণ রূপে ধরা হয়, তাহা হইলে সংখ্যা ঠিক দশই হয়। চামুণ্ডা ও মুণ্ডমালা তন্ত্র হইতে আগমবাগীশ মহাশয় কর্তৃক উদ্ধৃত দশমহাবিদ্যার এই তালিকা কিছু ভিন্ন প্রকৃতির। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে মহীধর বিরচিত মন্ত্রমহোদধি গ্রন্থে কালী, তারা, ছিন্নমস্তা ও সুন্দরী (ষোড়শী) এই কয়টি নাম পাওয়া যায়। ইঁহারা যে মহাবিদ্যা এ অনুমান সঙ্গত। মহীধর ঠিক কোন সময়ের লোক ছিলেন তাহা বলা যায় না; তবে তিনি বঙ্গদেশীয় ছিলেন বলিয়াই মনে হয়। দেবীগোষ্ঠী হিসাবে সিদ্ধবিদ্যা-মহাবিদ্যার কল্পনা বঙ্গদেশীয় তান্ত্রিক সাধকদিগেরই দান।’- (পঞ্চোপাসনা)
শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ই প্রথম সবার নজরে আনেন যে, বঙ্গদেশের দুর্গাপূজা আসলে শস্যদেবীর পূজা, যা অনুষ্ঠিত হয় তান্ত্রিক সর্বতোভদ্রমণ্ডল যন্ত্রে ও নবপত্রিকায়, যা হচ্ছে নয়টি গাছ– কদলী বা রম্ভা, কচ্চী, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িম, অশোক, মানক ও ধান্য এবং তিনি পুরশ্চর্যার্ণবের তৃতীয় খণ্ড থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন যে, উক্ত নয়টি বৃক্ষের প্রত্যেকটির অধিষ্ঠাত্রী দেবী যথাক্রমে ব্রহ্মাণী, কালিকা, দুর্গা, (কার্তিকী) কৌমারী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুণ্ডা এবং লক্ষ্মী। দুর্গা আরাধনায় দেবীকে উদ্ভিজ্জসমূহের অধিষ্ঠাত্রীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেবীর শাকম্ভরী নামের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে বর্ণিত তাঁর অন্নপূর্ণা রূপ, এবং কুলচূড়ামণি, শাক্তানন্দতরঙ্গিণী, তন্ত্রসার প্রভৃতি গ্রন্থে তান্ত্রিক শাক্ত উপাসনায় যে কুলবৃক্ষ পূজার উল্লেখ আছে, তা দেবীর সঙ্গে উদ্ভিদ জগতের সম্পর্ক ব্যক্ত করে।
এই উৎসব যে এককালে বস্তুত প্রাচীন কৌম-সমাজের একটি শস্য-প্রজনন-উৎসব ছিল তার স্বপক্ষে বিদ্বান গবেষকেরা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। শ্রদ্ধেয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, শূলপাণি তাঁর দুর্গোৎসববিবেক গ্রন্থে কালিকাপুরাণ (কালিকাপুরাণ-৬১/১৭-২১) থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিতব্য শাবরোৎসব নামক এক বিধি সম্পর্কিত কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। জিতেন্দ্রনাথ তাঁর ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে– ‘রঘুনন্দনও বিজয়াদশমীতে প্রতিমা-বিসর্জন সম্পর্কে এই শাবরোৎসবের কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিতেছেন, ‘ততো ধূলিকর্দম-বিক্ষেপক্রীড়াকৌতুকমঙ্গল ভগলিঙ্গাভিধানং ভগলিঙ্গপ্রগীত পরাক্ষিপ্ত পরাক্ষেপকরূপং শাবরোৎসবং কুর্যাৎ’। শারদীয়া দুর্গাপূজায় পুরাকালে অনুষ্ঠিত শাবরোৎসব এখন কোথাও পালিত হয় কিনা জানি না, তবে শাবরমার্গ নামে যে সেকালের তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার এক শাখা ছিল উহা মেরুতন্ত্রের একটি উক্তি হইতে আমরা জানিতে পারি। এই তন্ত্রে বামমার্গের পাঁচটি শাখাকে যথা কৌলিক, বাম, চীনক্রম, সিদ্ধান্তীয় ও শাবর, হাতের পাঁচ অঙ্গুলির সহিত তুলনা করা হইয়াছে; কৌলিক অঙ্গুষ্ঠ, বাম তর্জনী, চীনক্রম মধ্যম, সিদ্ধান্তীয় অনামিকা এবং শাবর কনিষ্ঠাঙ্গুলি। শ্লোকটি এইরূপ–
কৌলিকোহঙ্গুষ্ঠতাং প্রাপ্তো বামঃ স্যাত্তর্জনীসমঃ।
চীনক্রমো মধ্যমঃ স্যাৎ সিদ্ধান্তীয়োহবরো ভবেৎ।
কনিষ্ঠঃ শাবরো মার্গঃ ইতি বামন্তু পঞ্চধা।।
এই উৎসব যে এককালে বস্তুত প্রাচীন কৌম-সমাজের একটি শস্য-প্রজনন-উৎসব ছিল তার স্বপক্ষে বিদ্বান গবেষকেরা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। শ্রদ্ধেয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, শূলপাণি তাঁর দুর্গোৎসববিবেক গ্রন্থে কালিকাপুরাণ (কালিকাপুরাণ-৬১/১৭-২১) থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিতব্য শাবরোৎসব নামক এক বিধি সম্পর্কিত কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। জিতেন্দ্রনাথ তাঁর ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে– ‘রঘুনন্দনও বিজয়াদশমীতে প্রতিমা-বিসর্জন সম্পর্কে এই শাবরোৎসবের কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিতেছেন, ‘ততো ধূলিকর্দম-বিক্ষেপক্রীড়াকৌতুকমঙ্গল ভগলিঙ্গাভিধানং ভগলিঙ্গপ্রগীত পরাক্ষিপ্ত পরাক্ষেপকরূপং শাবরোৎসবং কুর্যাৎ’। শারদীয়া দুর্গাপূজায় পুরাকালে অনুষ্ঠিত শাবরোৎসব এখন কোথাও পালিত হয় কিনা জানি না, তবে শাবরমার্গ নামে যে সেকালের তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার এক শাখা ছিল উহা মেরুতন্ত্রের একটি উক্তি হইতে আমরা জানিতে পারি। এই তন্ত্রে বামমার্গের পাঁচটি শাখাকে যথা কৌলিক, বাম, চীনক্রম, সিদ্ধান্তীয় ও শাবর, হাতের পাঁচ অঙ্গুলির সহিত তুলনা করা হইয়াছে; কৌলিক অঙ্গুষ্ঠ, বাম তর্জনী, চীনক্রম মধ্যম, সিদ্ধান্তীয় অনামিকা এবং শাবর কনিষ্ঠাঙ্গুলি। শ্লোকটি এইরূপ–
কৌলিকোহঙ্গুষ্ঠতাং প্রাপ্তো বামঃ স্যাত্তর্জনীসমঃ।
চীনক্রমো মধ্যমঃ স্যাৎ সিদ্ধান্তীয়োহবরো ভবেৎ।
কনিষ্ঠঃ শাবরো মার্গঃ ইতি বামন্তু পঞ্চধা।।
আবার, ‘তন্ত্রমতে যে বর্ণমালা দিয়ে শব্দ গঠিত হয়, তার প্রতিটি বর্ণই মাতৃকা হিসাবে কল্পিত। বর্ণমালার প্রতিটি বর্গের একজন করে অধিষ্ঠাত্রী দেবী বর্তমান স্বচ্ছন্দতন্ত্রে বলা হয়েছে অ-বর্গে মহালক্ষ্মী, ক-বর্গে কমলোদ্ভবা, চ-বর্গে মহেশানী, ট-বর্গে কুমারিকা, ত-বর্গে নারায়ণী, প-বর্গে বারাহী, য-বর্গে ঐন্দ্রী এবং শ-বর্গে চামুণ্ডা। এখানে সপ্তমাতৃকা ও তৎসহ মহালক্ষ্মীকে পাওয়া যাচ্ছে। বামকেশ্বরতন্ত্রে আবার এই আটটি বর্ণের দেবীদের নাম পৃথক যাঁরা হলেন বশিনী, কামেশ্বরী, মোদিনী, বিমলা, অরুণা, জয়িনী, সর্বেশ্বরী ও কালিনী। মাতৃকা ছাড়া তান্ত্রিক দেবীদের আর একটি গোষ্ঠী হলেন মহাবিদ্যা, সংখ্যায় তাঁরা দশ। এঁরা হলেন মহাকালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, বগলা, ছিন্না, মহাত্রিপুরসুন্দরী, ধূমাবতী এবং মাতঙ্গী। ভিন্ন তালিকা অনুযায়ী কালী, তারা, ষোড়শী (ত্রিপুরাসুন্দরী), ভুবনেশ্বরী (রাজরাজেশ্বরী), ছিন্নমস্তা, ভৈরবী, (ত্রিপুরভৈরবী), ধূমাবতী (অলক্ষ্মী), বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা (লক্ষ্মী)। মালিনীবিজয়তন্ত্রে দ্বাদশ মহাবিদ্যার উল্লেখ আছে– কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, মাতঙ্গী ও শৈলবাদিনী। দেবী কালিকার প্রধান রূপ দুই প্রকার– দক্ষিণকালিকা ও বামাকালিকা। দক্ষিণকালীর পূজার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু ওই দেবীর ‘রহস্যপূজার’ অধিকার একমাত্র দীক্ষিত তান্ত্রিকদেরই। এই রহস্যপূজার প্রারম্ভে কামিনীদেবীর (বঙ্গদেশে দুর্গা, দক্ষিণভারতে শ্রীবিদ্যা বা ললিতা বা কামেশ্বরী) পূজার বিধি আছে। রহস্যপূজার নিয়ম হচ্ছে চক্রে বা মণ্ডলে পূজা। দক্ষিণাকালীর প্রকৃত মূর্তি হচ্ছে দেবী শিবের উপর বিপরীতরতাতুরা ভঙ্গীতে উপবিষ্টা। বামাকালীর পূজা একমাত্র সন্ন্যাসীরাই করতে পারেন। বামাকালীর বামপদ সম্মুখে বিস্তৃত উভয়ের ধ্যানমন্ত্রে সামান্য পার্থক্য আছে। দেবী তারা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই পূজিতা। তাঁর তিনটি প্রধান রূপ– একজটা, নীলসরস্বতী ও উগ্রতারা। মহাযান বৌদ্ধধর্মে তারা অবলোকিতেশ্বরের শক্তি। তোড়লতন্ত্রে শিবকে বলা হয়েছে অক্ষোভ্য এবং তারাকে বলা হয়েছে তাঁর শক্তি, যা ওই তন্ত্রের উপর বৌদ্ধ প্রভাব সূচনা করে। শক্তিসঙ্গমতন্ত্রেও ওই একই ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। তারার মত কমলা ও ছিন্নমস্তারও কিছু বৌদ্ধ সম্পর্ক আছে। কমলার ধ্যানমূর্তির সঙ্গে ভারহুতের স্তূপবেষ্টনীতে অঙ্কিত শ্রী ও গজলক্ষ্মীর মূর্তির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ছিন্নমস্তার, যাঁর অপর নাম প্রচণ্ডচণ্ডিকা, ধ্যানের সঙ্গে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের ভট্টারিকা বজ্রযোগিনীর ধ্যান মিলে যায়।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)
তবে শ্রীদাশগুপ্তের মতে, এ-সকল পুরাণ উপপুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রকে অবলম্বন করে আমরা যে বাঙলাদেশে একটা বিশেষ মাতৃপূজাবিধি গড়ে উঠতে দেখি তা দ্বাদশ শতকের পূর্বে একটা ব্যাপক ধর্মমতের পরিচয় বহন করে না। সংবৎসরের মধ্যে বিশেষ বিশেষ মাসে বিশেষ বিশেষ তিথিতে এ-সকল পূজা বিধেয়। তিনি বলেন–
‘গুহ্য তন্ত্রসাধনাও ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বলিয়া মনে হয়। শক্তিপূজা নিত্যপূজারূপে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকেও যে ব্যাপক প্রসার লাভ করিয়াছিল এমন কথা বলিবার মতন আমাদের যথেষ্ট তথ্য নাই। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের মধ্যে আমরা যে-সকল দেবীর আবির্ভাব এবং পূজাপ্রতিষ্ঠা ও পূজাপ্রসারের ইতিহাস লক্ষ্য করি সেই-সকল দেবী সম্পূর্ণভাবে আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন মহাদেবীর প্রতিভূত্ব লইয়াই আসিয়া আবির্ভূতা হন নাই; তাঁহারা স্থানীয় দেবী– অনেকাংশে চণ্ডীমঙ্গলের চণ্ডীও। প্রতিকূল বিদেশী রাজশক্তির নিষ্পেষণে উচ্চকোটির ব্রাহ্মণ্যধর্ম যখন বিপর্যস্ত তখন সমাজদেহের নিম্নভাগ হইতে ইঁহারা মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়া সমাজে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার যে প্রচণ্ড চেষ্টা আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহারই ইতিহাস আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলিতে। যে ভক্তগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় দেবীগণের এই ‘আপ্রাণ’ আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রচারের চেষ্টা সেই ভক্তগোষ্ঠী স্বভাবতঃই চেষ্টা করিয়াছেন সমাজের উপরতলায় নবাগতা এই দেবীগণকে প্রাচীন মহাদেবীর সঙ্গে যুক্ত করিয়া ক্রমে তাঁহার সহিত অভিন্ন করিয়া তুলিতে। শাক্তধর্ম বাঙালীর মধ্যে ব্যাপক ধর্মরূপ গ্রহণ করিয়াছে খ্রীস্টীয় সপ্তদশ শতক হইতে।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
‘গুহ্য তন্ত্রসাধনাও ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বলিয়া মনে হয়। শক্তিপূজা নিত্যপূজারূপে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকেও যে ব্যাপক প্রসার লাভ করিয়াছিল এমন কথা বলিবার মতন আমাদের যথেষ্ট তথ্য নাই। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের মধ্যে আমরা যে-সকল দেবীর আবির্ভাব এবং পূজাপ্রতিষ্ঠা ও পূজাপ্রসারের ইতিহাস লক্ষ্য করি সেই-সকল দেবী সম্পূর্ণভাবে আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন মহাদেবীর প্রতিভূত্ব লইয়াই আসিয়া আবির্ভূতা হন নাই; তাঁহারা স্থানীয় দেবী– অনেকাংশে চণ্ডীমঙ্গলের চণ্ডীও। প্রতিকূল বিদেশী রাজশক্তির নিষ্পেষণে উচ্চকোটির ব্রাহ্মণ্যধর্ম যখন বিপর্যস্ত তখন সমাজদেহের নিম্নভাগ হইতে ইঁহারা মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়া সমাজে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার যে প্রচণ্ড চেষ্টা আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহারই ইতিহাস আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলিতে। যে ভক্তগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় দেবীগণের এই ‘আপ্রাণ’ আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রচারের চেষ্টা সেই ভক্তগোষ্ঠী স্বভাবতঃই চেষ্টা করিয়াছেন সমাজের উপরতলায় নবাগতা এই দেবীগণকে প্রাচীন মহাদেবীর সঙ্গে যুক্ত করিয়া ক্রমে তাঁহার সহিত অভিন্ন করিয়া তুলিতে। শাক্তধর্ম বাঙালীর মধ্যে ব্যাপক ধর্মরূপ গ্রহণ করিয়াছে খ্রীস্টীয় সপ্তদশ শতক হইতে।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া সম্পর্কে পুরাণে দুই শ্রেণির কাহিনী প্রচলিত। এক শ্রেণির কাহিনীতে দেবী দেব-তেজঃসম্ভূতা– জ্যোতির্ময়ী তেজোরূপা– অসুরঘাতিনী। এক্ষেত্রে তিনি বৈদিক দিব্য সরস্বতীর সগোত্রা। আর অন্য শ্রেণির কাহিনীতে দেবী দক্ষতনয়া, জন্মান্তরে হিমালয়-নন্দিনী উমা-পার্বতী। উভয় জন্মেই তিনি শিবশক্তি শিব-জায়া। উমা-পার্বতী গজানন-কার্তিকেয়ের জননী। ইনি দৈত্যনাশিনী নন। আর দেবতেজঃসম্ভূতা যে মহাশক্তি চণ্ডী, তিনিই বিষ্ণুমায়া– বিষ্ণুর যোগনিদ্রা– শিবজায়া বা হিমালয় কন্যা নন। ইনি সকল দেবতার শক্তিরূপা– সুতরাং প্রকৃতই মহাশক্তি। পরে ক্রমে ক্রমে দেবীর এই দুই রূপ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুর্গা-পার্বতী-চণ্ডী মিলেমিশে একই দেবসত্তায়, একই মহাশক্তি শিবশক্তি শিবানীতে পরিণত হয়েছেন। দেবী-কল্পনার বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের ধারায় পার্বতী উমার ধারাটির উৎস খুঁজে দেখা যেতে পারে।
অভিধানে উমা শব্দের স্পষ্ট কোনও প্রকৃতি-প্রত্যয় পাওয়া যায় না। তাহলে উমা শব্দের অর্থ কী? অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে,– ‘কতকগুলি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তাহার অধিকাংশই মনগড়া। কেহ কেহ বলিয়াছেন, ‘উ’ শব্দের অর্থ শিব, আর ‘মা’ শব্দের অর্থ শ্রী; শিবের শ্রী এই অর্থে পার্বতী হইলেন উমা। আবার ‘মা’ শব্দের অর্থ ‘মননকারী’ও করা হইয়াছে; যিনি শিবকে (পতিরূপে) ধ্যান করেন তিনি উমা। ‘মা’ শব্দের ‘পরিমাণ করা’ অর্থও লওয়া যাইতে পারে; শিবের যিনি পরিমাপক অর্থাৎ যাঁহার ভিতর দিয়া অপরিমেয় শিব সৃষ্টি-প্রপঞ্চ রূপে পরিমিত হন সেই শক্তিরূপিণীই হইলেন উমা।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৬)
কবি ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে উমা অর্থে শিবের শ্রীই গ্রহণ করেছেন–
অভিধানে উমা শব্দের স্পষ্ট কোনও প্রকৃতি-প্রত্যয় পাওয়া যায় না। তাহলে উমা শব্দের অর্থ কী? অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে,– ‘কতকগুলি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তাহার অধিকাংশই মনগড়া। কেহ কেহ বলিয়াছেন, ‘উ’ শব্দের অর্থ শিব, আর ‘মা’ শব্দের অর্থ শ্রী; শিবের শ্রী এই অর্থে পার্বতী হইলেন উমা। আবার ‘মা’ শব্দের অর্থ ‘মননকারী’ও করা হইয়াছে; যিনি শিবকে (পতিরূপে) ধ্যান করেন তিনি উমা। ‘মা’ শব্দের ‘পরিমাণ করা’ অর্থও লওয়া যাইতে পারে; শিবের যিনি পরিমাপক অর্থাৎ যাঁহার ভিতর দিয়া অপরিমেয় শিব সৃষ্টি-প্রপঞ্চ রূপে পরিমিত হন সেই শক্তিরূপিণীই হইলেন উমা।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৬)
কবি ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে উমা অর্থে শিবের শ্রীই গ্রহণ করেছেন–
উ শব্দে বুঝহ শিব মা শব্দে শ্রী তার।
বুঝিয়া মেনা উমা নাম কৈল সার।। –(অন্নদামঙ্গল)
এই অর্থ গ্রহণ করলে শিব ও শ্রী বা লক্ষ্মী একত্রিত হয়ে বিষ্ণুমায়া শিবানী চণ্ডীর সঙ্গে উমার অভিন্নতা প্রতিপাদিত হয়। পুরাণমতে ‘উ’ শব্দ সম্বোধনার্থক এবং ‘মা’ শব্দ নিষেধার্থক– এই দুই শব্দ একত্রিত হয়ে উমা শব্দ নিষ্পন্ন হয়। কালিকাপুরাণ অনুসারে কঠোর তপশ্চরণে প্রবৃত্তা পার্বতীকে মা মেনকা ‘উ অর্থাৎ হে কন্যা, মা অর্থাৎ তপস্যা কোরো না, বলে নিষেধ করায় পার্বতীর নাম হয়েছিল উমা–
যতো নিরস্তা তপসে বনং গন্তুঞ্চ মেনয়া।
উমেতি তেন সোমেতি নাম প্রাপ তদা সতী।। –(কালিকাপুরাণ-৪৩/২৩)
অর্থাৎ– যেহেতু তপস্যা থেকে এবং বনগমন থেকে মেনার দ্বারা নিরস্তা হয়েছিলেন, সেই জন্যই সতী উমা, সোমা নাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
মহাকবি কালিদাসও অবিকল একই কথা বলেছেন। মদনভস্মের পরে শিবকর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা হয়ে পার্বতী হিমালয়ের গৌরীশৃঙ্গে গমন করে একাকিনী কৃচ্ছ্র-তপস্যায় মনোনিবেশ করলে, স্নেহের দুলালী কন্যার নবযৌবনে এই তপঃ-কৃচ্ছ্রতা মায়ের অন্তরে আঘাত করলো–
তাং পার্বতীত্যাভিজনেন নাম্না
বন্ধুপ্রিয়াং বন্ধুজনো জুহাব।
উ মেতি মাত্রা তপসো নিষিদ্ধা
পশ্চাৎ উমাখ্যাং সুমুখী জগাম।।
অর্থাৎ– বন্ধুজনেরা স্বজনপ্রিয়া তাকে তার কুলোপাধি অনুসারে পার্বতী বলে ডাকতেন। পরে ‘উ– ওহে বা হে কন্যা, মা– তপস্যা কোরো না’– এই বলে মায়ের দ্বারা তপস্যা থেকে নিষিদ্ধা হয়ে পরে সুমুখী উমা আখ্যা পেয়েছিলেন।
কালিদাস যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে কাব্য-চমৎকৃতি বেড়েছে হয়তো, কিন্তু উমা শব্দের মূল অর্থ সম্বন্ধে সংশয় নিরসন হয় না। তাই এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হলো, উমা নামটি হিমালয়-দুহিতার মূল নাম নয়। মূলে তিনি পার্বতী, গিরিজা প্রভৃতি নামেই খ্যাতা ছিলেন। যেভাবেই হোক, উমা নামটি তাঁর সম্বন্ধে পরে প্রযুক্ত হয়েছে। পুরাণাদিতে উমা শব্দের অন্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়, তবে সে-সব ব্যাখ্যায় তত্ত্ব-গভীরতা যা-ই থাক, ব্যুৎপত্তিগত সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান মেলে না।
এ প্রসঙ্গে যদি পার্বতী নামটির দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে, পার্বতী শব্দটিকে আমরা পর্বততনয়া অর্থেই বর্তমানে গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু মূলে শব্দটির এ অর্থ ছিল না। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে–
‘পার্বতী শব্দটিকে আমরা পর্বততনয়া এই অর্থেই বর্তমানে গ্রহণ করিয়া থাকি। মূলে শব্দটির এই অর্থ ছিল না। পর্বত-সম্বন্ধীয়া এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার বেদে পাওয়া যায়। ‘শতপথ-ব্রাহ্মণে’ পর্বত-স্বরূপা এই অর্থে পার্বতী ও পর্বতপুত্রী এই অর্থে পার্বতেয়ী শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাই (১/৫/১৫, ১৭)। সাংখ্যায়ন-ব্রাহ্মণে পর্বত-পুত্র এই অর্থে দক্ষকেই ‘পার্বতি’ বলা হইয়াছে (৪/৪)। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে পর্বতে আছে বা পর্বত-সম্বন্ধীয় এই অর্থ হইতেই পরে পর্বত-পুত্র বা পর্বত-কন্যা এই অর্থের বহুল প্রচার দেখা দিয়াছে। আমরা পরে দেখিতে পাইব, মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে যেখানে চণ্ডীকে পার্বতী বলা হইয়াছে সেখানে পার্বতী পর্বত-কন্যা নহেন, পর্বতস্থিতা বা পর্বতবাসিনী। এ-তথ্যগুলির উল্লেখ করিতেছি এইজন্য যে, আমাদের দেবী পার্বতীও হয়ত মূলে পর্বত-কন্যা পার্বতী নহেন, তিনি পর্বতাধিষ্ঠাত্রী দেবী বা পর্বতবাসিনী দেবী বলিয়া পার্বতী। পৃথিবীর ধর্মের ইতিহাসে পুরাকালে আমরা বহু দেশেই এইরূপ পার্বতী-দেবীর (Mountain-goddess) উল্লেখ পাই।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৮)
‘পার্বতী শব্দটিকে আমরা পর্বততনয়া এই অর্থেই বর্তমানে গ্রহণ করিয়া থাকি। মূলে শব্দটির এই অর্থ ছিল না। পর্বত-সম্বন্ধীয়া এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার বেদে পাওয়া যায়। ‘শতপথ-ব্রাহ্মণে’ পর্বত-স্বরূপা এই অর্থে পার্বতী ও পর্বতপুত্রী এই অর্থে পার্বতেয়ী শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাই (১/৫/১৫, ১৭)। সাংখ্যায়ন-ব্রাহ্মণে পর্বত-পুত্র এই অর্থে দক্ষকেই ‘পার্বতি’ বলা হইয়াছে (৪/৪)। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে পর্বতে আছে বা পর্বত-সম্বন্ধীয় এই অর্থ হইতেই পরে পর্বত-পুত্র বা পর্বত-কন্যা এই অর্থের বহুল প্রচার দেখা দিয়াছে। আমরা পরে দেখিতে পাইব, মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে যেখানে চণ্ডীকে পার্বতী বলা হইয়াছে সেখানে পার্বতী পর্বত-কন্যা নহেন, পর্বতস্থিতা বা পর্বতবাসিনী। এ-তথ্যগুলির উল্লেখ করিতেছি এইজন্য যে, আমাদের দেবী পার্বতীও হয়ত মূলে পর্বত-কন্যা পার্বতী নহেন, তিনি পর্বতাধিষ্ঠাত্রী দেবী বা পর্বতবাসিনী দেবী বলিয়া পার্বতী। পৃথিবীর ধর্মের ইতিহাসে পুরাকালে আমরা বহু দেশেই এইরূপ পার্বতী-দেবীর (Mountain-goddess) উল্লেখ পাই।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৮)
শুক্লযজুর্বেদে শতরুদ্রীয় স্তোত্রে রুদ্রের এক নাম সোম। আচার্য মহীধর সোম শব্দের ব্যাখ্যায় ‘উমার সহিত বর্তমান’ এই অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু উমার সাক্ষাৎ বৈদিক সংহিতায় মেলে না। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে উমার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘কেন’-উপনিষদে। ‘কেন’-উপনিষদে দেখি ইন্দ্রের সম্মুখে দেবী প্রথমে বহুশোভমানা হৈমবতী উমারূপে আবির্ভূতা। কী অবস্থার মধ্যে দেবী ইন্দ্রের সম্মুখে আবির্ভূতা হয়েছিলেন তা বুঝতে হলে সংক্ষেপে সে উপাখ্যানটি আলোচনা করা দরকার।
দেবাসুর যুদ্ধে ব্রহ্মই দেবতাগণের জন্য বিজয় লাভ করলেন। কিন্তু দেবতাগণ এই বিজয়ের মধ্যে সর্বশক্তিমান ব্রহ্মের মহিমা উপলব্ধি করতে পারলেন না। তাঁরা ‘আমাদেরই এই বিজয়’ বলে নিজেদেরকেই মহিমান্বিত মনে করতে লাগলেন। ব্রহ্ম দেবতাদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হলে তাঁরা তাঁকে চিনতে না পেরে অগ্নিকে তাঁর কাছে পাঠালেন– এই যক্ষ কে তা জেনে আসতে। অগ্নি যক্ষের কাছে এসে গর্বভরে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন যে তিনিই জাতবেদা অগ্নি। যক্ষ তাঁর সামনে একটি তৃণ রেখে তা পোড়াতে বললেন। অগ্নি শত চেষ্টা করেও তাতে সমর্থ হলেন না। বায়ুও সগর্বে যক্ষের সমীপবর্তী হয়ে অশেষ চেষ্টা করেও এক গুচ্ছ তৃণ উড়াতে পারলেন না। সর্বশেষ নিরহঙ্কার ইন্দ্রের নিকট উমারূপিণী ব্রহ্মবিদ্যার আবির্ভাব হলো। (কেনোপনিষদ-৩/১-১২, ৪/১)–
দেবাসুর যুদ্ধে ব্রহ্মই দেবতাগণের জন্য বিজয় লাভ করলেন। কিন্তু দেবতাগণ এই বিজয়ের মধ্যে সর্বশক্তিমান ব্রহ্মের মহিমা উপলব্ধি করতে পারলেন না। তাঁরা ‘আমাদেরই এই বিজয়’ বলে নিজেদেরকেই মহিমান্বিত মনে করতে লাগলেন। ব্রহ্ম দেবতাদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হলে তাঁরা তাঁকে চিনতে না পেরে অগ্নিকে তাঁর কাছে পাঠালেন– এই যক্ষ কে তা জেনে আসতে। অগ্নি যক্ষের কাছে এসে গর্বভরে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন যে তিনিই জাতবেদা অগ্নি। যক্ষ তাঁর সামনে একটি তৃণ রেখে তা পোড়াতে বললেন। অগ্নি শত চেষ্টা করেও তাতে সমর্থ হলেন না। বায়ুও সগর্বে যক্ষের সমীপবর্তী হয়ে অশেষ চেষ্টা করেও এক গুচ্ছ তৃণ উড়াতে পারলেন না। সর্বশেষ নিরহঙ্কার ইন্দ্রের নিকট উমারূপিণী ব্রহ্মবিদ্যার আবির্ভাব হলো। (কেনোপনিষদ-৩/১-১২, ৪/১)–
ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে, তস্য হ ব্রহ্মণ্যে বিজয়ে দেবা অমহীয়ন্ত। ত ঐক্ষন্তাস্মাকমেবায়ং বিজয়োহস্মাকমেবায়ং মহিমেতি। ৩/১।। তদ্ধৈষাং বিজজ্ঞৌ, তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব, তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি। ৩/২।। তেহগ্নিমব্রুবন্– জাতবেদ, এতদ্বিজানীহি, সিমেতদ্ যক্ষমিতি। তথেতি। ৩/৩।। তদভ্যদ্রবৎ তমভ্যবদৎ কোহসীতি। অগ্নির্বা অহমস্মীত্যব্রবীৎ জাতবেদা বা অহমস্মীতি। ৩/৪।। তস্মিংস্ত্বয়ি কিং বীর্যমিতি। অপীদং সর্বং দহেয়ং যদিদং পৃথিব্যামিতি। ৩/৫।। তস্মৈ তৃণং নিদধাবেতদ্দহেতি। তদুপপ্রেয়ায় সর্বজবেন, তন্ন শশাক দগ্ধুম্ । স তত এব নিব্বৃতে– নৈতদশকং বিজ্ঞাতুং যদেতদ্ যক্ষমিতি। ৩/৬।। অথ বায়ুমব্রুবন্– বায়বেতদ্ বিজানীহি, কিমেতদ্ যক্ষমিতি। তথেতি। ৩/৭।। তদভ্যদ্রবৎ তমভ্যবদৎ– কোহসীতি। বায়ুর্বা অহমস্মীত্যব্রবীৎ মাতরিশ্বা বা অহমস্মীতি। ৩/৮।। তস্মিংস্ত্বয়ি কিং বীর্যমিতি। অপীদং সর্বমাদদীয় যদিদং পৃথিব্যামিতি। ৩/৯।। তস্মে তৃণং নিদধাবেতদাদৎস্বেতি। তদুপপ্রেয়ায় সর্বজবেন, তন্ন শশাকাদাতুম্ । স তত এব নিব্বৃতে, নৈতদশকং বিজ্ঞাতুং যদেতদ্ যক্ষমিতি। ৩/১০।। অথেন্দ্রমব্রুবন্– মঘবন্নেতদ্ বিজানীহি কিমেতদ্ যক্ষমিতি। তথেতি। তদভ্যদ্রবৎ। তস্মাত্তিরোদধে। ৩/১১।। স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীম্ । তাং হোবাচ– কিমেতদ্ যক্ষমিতি। ৩/১২।। সা ব্রহ্মেতি হোবাচ। ব্রহ্মণ্যে বা এতদ্বিজয়ে মহীয়ধ্বমিতি। ততো হৈব বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি। ৪/১।।
অর্থাৎ–
একদা দেবতাদের গৌরব-বর্ধনার্থ দেবাসুর-সংগ্রামে ব্রহ্ম অসুরদিগকে জয় করিলেন। ব্রহ্মের এই বিজয়ে দেবতারাই মহিমান্বিত হইলেন। কিন্তু তাঁহারা মনে করিলেন– এই বিজয় আমাদেরই, এই মহিমা আমাদেরই। ১।। ব্রহ্ম দেবতাদের এই মিথ্যা অভিমান জানিতে পারিয়া তাঁহাদের মঙ্গলার্থ তাঁহাদের সমীপে আবির্ভূত হইলেন। কিন্তু দেবগণ এই আবির্ভূত রূপ দেখিতে পাইয়াও ঐ পূজনীয় মূর্তিটি কে তাহা জানিতে পারিলেন না। ২।। তাঁহারা অগ্নিকে বলিলেন– হে জাতবেদ (সর্বজ্ঞকল্প অগ্নিদেব), সম্মুখস্থ এই যক্ষ অর্থাৎ পূজনীয় মূর্তিটি কে তাহা তুমি বিশেষরূপে অবগত হও। অগ্নি বলিলেন– তাহাই হউক। ৩।। অগ্নি ঐ যক্ষের নিকটে গেলেন। যক্ষ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন– ‘তুমি কে?’ অগ্নি বলিলেন– ‘আমি প্রসিদ্ধ অগ্নি, আমিই প্রসিদ্ধ জাতবেদা।’ ৪।। ব্রহ্ম বলিলেন– ‘এমন প্রসিদ্ধ নাম ও গুণযুক্ত তোমাতে কি শক্তি আছে?’ অগ্নি বলিলেন– ‘এই পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহা সমস্তই আমি দগ্ধ করিতে পারি।’ ৫।। ‘ইহা দগ্ধ কর’– এই কথা বলিয়া ব্রহ্ম অগ্নির নিকট একটি তৃণ স্থাপন করিলেন। অগ্নি পূর্ণ উৎসাহে সবেগে উহার নিকটে গেলেন কিন্তু উহা দগ্ধ করিতে সমর্থ হইলেন না। তৃণ দগ্ধ করিতে না পারিয়া তিনি ফিরিয়া আসিলেন এবং দেবগণকে বলিলেন– ‘এই পূজনীয় স্বরূপ কে তাহা জানিতে পারিলাম না।’ ৬।। অতঃপর দেবতারা বায়ুকে বলিলেন– ‘হে বায়ু, সম্মুখস্থ পূজনীয় স্বরূপ যক্ষ কে তাহা বিশেষভাবে জানিয়া আসিও।’ বায়ু বলিলেন– তাহাই হউক।’ ৭।। বায়ু সেই যক্ষের নিকট গেলেন। যক্ষ বায়ুকে জিজ্ঞাসা করিলেন– ‘তুমি কে?’ বায়ু বলিলেন– ‘আমি প্রসিদ্ধ বায়ু, আমি প্রসিদ্ধ মাতরিশ্বা।’ ৮।। ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করিলেন– ‘এমন প্রসিদ্ধ নাম ও গুণযুক্ত তোমাতে কি শক্তি আছে?’ বায়ু বলিলেন– ‘পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহা সমস্তই আমি গ্রহণ করিতে অর্থাৎ উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারি।’ ৯।। ব্রহ্ম তাঁহার নিকট একটি তৃণ রাখিয়া বলিলেন– ‘ইহা গ্রহণ কর।’ বায়ু পূর্ণ উৎসাহে বেগের সহিত উহার নিকটে গেলেন, কিন্তু সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়াও উহা উড়াইতে পারিলেন না। তখন সেই স্থান হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেবগণকে বলিলেন, ‘ এই যক্ষ কে তাহা আমি জানিতে পারিলাম না।’ ১০।। অনন্তর দেবতারা ইন্দ্রকে বলিলেন– ‘হে ইন্দ্র, আপনি বিশেষভাবে জানিয়া আসুন, এই যক্ষ কে?’ ইন্দ্র বলিলেন– ‘তাহাই হউক।’ এই কথা বলিয়া ইন্দ্র যক্ষের নিকটে গেলেন, কিন্তু যক্ষ তাঁহার সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত হইলেন। ১১।। ইন্দ্র সেই আকাশেই স্ত্রীরূপিণী বহু শোভায় শোভান্বিতা হৈমবতী (স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা) উমাকে দেখিতে পাইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন– ‘এই যক্ষ (পূজনীয় রূপ) কে?’ ১২।। উমা ইন্দ্রকে বলিলেন– ‘ইনি ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মেরই বিজয়ে তোমরা এই প্রকার মহিমান্বিত বোধ করিতেছ।’ তাঁহার কথা হইতেই ইন্দ্র জানিলেন যে ইনি ব্রহ্ম। ৪/১।।
দার্শনিক দৃষ্টিতে এই উমাকে বলা হয়েছে ব্রহ্মবিদ্যা-রূপিণী। তিনিই দেবতাগণকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেছেন। এই ব্রহ্মবিদ্যাই ব্রহ্মজ্যোতিরূপিণী আদিশক্তি– প্রথম জ্যোতিরূপা বলে তিনি সুবর্ণকান্তি– তিনি হৈমবতী। এ প্রেক্ষিতে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো–
‘শক্তিরূপিণী উমাই প্রথমে ব্রহ্মের শক্তি ও মহিমা বর্ণনা করিয়াছেন– ইহাই সুন্দর এবং স্বাভাবিক হইয়াছে। এই দার্শনিক দৃষ্টি অস্বীকার না করিয়া একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও আমরা উপাখ্যানটিকে বিচার করিতে পারি। এই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে প্রথমেই বড় করিয়া চোখে পড়ে এই প্রসঙ্গটিতে উমা কথাটির ব্যবহার। উমা এখানে বিশেষ কোনও ব্যুৎপত্তিগত দার্শনিক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না; উমা এখানে নানাভরণ-অলঙ্কৃতা শোভমানা নারীরূপে বিরাজিতা– ইহা স্পষ্টতঃ দেবীর নামরূপে ব্যবহৃত। এই নামটি এখানে কোনও প্রকার ভূমিকা বা ভণিতাবর্জিত ভাবে এমন সহজে ব্যবহৃত হইয়াছে যে, মনে হয়, এই উপনিষৎকারের নিকট এই নামটি একটি বিশিষ্ট দেবীর নামরূপে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। অথচ ইহাও লক্ষ্য করিতে হইবে, এই ‘কেন’-উপনিষদের পূর্বে কোনও গ্রন্থেই আমরা আর এই উমা কথাটির উল্লেখ পাই নাই। দ্বিতীয়তঃ, এই প্রসঙ্গে ‘হৈমবতী’ শব্দটির ব্যবহারও বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতে হইবে। হেমকান্তি জ্ঞানের সহিত যুক্ত বলিয়াও কেমন দেবী হৈমবতী হইতে পারেন, আবার হিমবৎ পর্বতের কন্যা বলিয়াও তিনি হৈমবতী হইতে পারেন। উমা শব্দে এখানে যখন নামই বুঝাইতেছে, তখন হৈমবতী শব্দের দ্বারা এখানে হিমালয়-পর্বতের সহিত উমার যোগের ইঙ্গিত বোঝানই স্বাভাবিক। তাহা হইলে আমরা এখানে এইটুকু অবগত হইতে পারি যে, ‘কেন’-উপনিষৎকার যখন আবির্ভূত হইয়াছিলেন তখন হিমবৎ-পর্বতের কন্যা উমার একটি বিশিষ্টা দেবীরূপে প্রসিদ্ধি ছিল।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৫-৩৬)
এ বিষয়ে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমতটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি বলছেন– ‘দেবীর পাহাড় পর্বতের সহিত সংযোগ তাঁহার উমা রূপের একটি বিশেষণ হইতে বহুপূর্বকালে স্পষ্টতর হইয়াছিল। উমার প্রথম উল্লেখ আমরা কেন উপনিষদে পাই, এবং সেখানে (৩, ২৫) তিনি হৈমবতী (হিমবতের কন্যা) বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। তাঁহার এ পরিচয় খুবই স্বাভাবিক, কারণ শতরুদ্রীয়ে রুদ্র গিরীশ ও গিরিত্র নামাদির দ্বারা অভিহিত। বলা বাহুল্য যে কেন উপনিষদে প্রাপ্ত উমার এই বিশেষণ পৌরাণিক যুগে তাঁহার গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যারূপ পরিচয় এবং তদাশ্রয়ী কিংবদন্তীসূহের উৎস। এই উপনিষদে নির্দিষ্ট উমার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি রুদ্রপত্নী বলিয়া প্রত্যক্ষভাবে বর্ণিত হন নাই; তিনি অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতাদিগের অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালিনী ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী দেবী রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছেন।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২২৭)
‘শক্তিরূপিণী উমাই প্রথমে ব্রহ্মের শক্তি ও মহিমা বর্ণনা করিয়াছেন– ইহাই সুন্দর এবং স্বাভাবিক হইয়াছে। এই দার্শনিক দৃষ্টি অস্বীকার না করিয়া একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও আমরা উপাখ্যানটিকে বিচার করিতে পারি। এই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে প্রথমেই বড় করিয়া চোখে পড়ে এই প্রসঙ্গটিতে উমা কথাটির ব্যবহার। উমা এখানে বিশেষ কোনও ব্যুৎপত্তিগত দার্শনিক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না; উমা এখানে নানাভরণ-অলঙ্কৃতা শোভমানা নারীরূপে বিরাজিতা– ইহা স্পষ্টতঃ দেবীর নামরূপে ব্যবহৃত। এই নামটি এখানে কোনও প্রকার ভূমিকা বা ভণিতাবর্জিত ভাবে এমন সহজে ব্যবহৃত হইয়াছে যে, মনে হয়, এই উপনিষৎকারের নিকট এই নামটি একটি বিশিষ্ট দেবীর নামরূপে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। অথচ ইহাও লক্ষ্য করিতে হইবে, এই ‘কেন’-উপনিষদের পূর্বে কোনও গ্রন্থেই আমরা আর এই উমা কথাটির উল্লেখ পাই নাই। দ্বিতীয়তঃ, এই প্রসঙ্গে ‘হৈমবতী’ শব্দটির ব্যবহারও বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতে হইবে। হেমকান্তি জ্ঞানের সহিত যুক্ত বলিয়াও কেমন দেবী হৈমবতী হইতে পারেন, আবার হিমবৎ পর্বতের কন্যা বলিয়াও তিনি হৈমবতী হইতে পারেন। উমা শব্দে এখানে যখন নামই বুঝাইতেছে, তখন হৈমবতী শব্দের দ্বারা এখানে হিমালয়-পর্বতের সহিত উমার যোগের ইঙ্গিত বোঝানই স্বাভাবিক। তাহা হইলে আমরা এখানে এইটুকু অবগত হইতে পারি যে, ‘কেন’-উপনিষৎকার যখন আবির্ভূত হইয়াছিলেন তখন হিমবৎ-পর্বতের কন্যা উমার একটি বিশিষ্টা দেবীরূপে প্রসিদ্ধি ছিল।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৫-৩৬)
এ বিষয়ে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমতটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি বলছেন– ‘দেবীর পাহাড় পর্বতের সহিত সংযোগ তাঁহার উমা রূপের একটি বিশেষণ হইতে বহুপূর্বকালে স্পষ্টতর হইয়াছিল। উমার প্রথম উল্লেখ আমরা কেন উপনিষদে পাই, এবং সেখানে (৩, ২৫) তিনি হৈমবতী (হিমবতের কন্যা) বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। তাঁহার এ পরিচয় খুবই স্বাভাবিক, কারণ শতরুদ্রীয়ে রুদ্র গিরীশ ও গিরিত্র নামাদির দ্বারা অভিহিত। বলা বাহুল্য যে কেন উপনিষদে প্রাপ্ত উমার এই বিশেষণ পৌরাণিক যুগে তাঁহার গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যারূপ পরিচয় এবং তদাশ্রয়ী কিংবদন্তীসূহের উৎস। এই উপনিষদে নির্দিষ্ট উমার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি রুদ্রপত্নী বলিয়া প্রত্যক্ষভাবে বর্ণিত হন নাই; তিনি অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতাদিগের অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালিনী ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী দেবী রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছেন।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২২৭)
বৈদিক সাহিত্যের অন্য কোথাও আমরা আর উমার উল্লেখ পাই না। আরণ্যক উপনিষদের যুগের পরে রামায়ণ-মহাভারতে এসে উমার উল্লেখ দেখা যায়। বাল্মীকি-রামায়ণের বালকাণ্ডে দেখা যায়–
শৈলেন্দ্রো হিমবান্ রাম ধাতূনামাকরো মহান্ ।
তস্য কন্যাদ্বয়ং রাম রূপেণাপ্রতিমং ভুবি।।
যা মেরুদুহিতা রাম তয়োর্মাতা সুমধ্যমা।
নাম্না মেনা মনোজ্ঞা বৈ পত্নী হিমবতঃ প্রিয়া।।
তস্যাং গাঙ্গেয়মভূজ্জ্যেষ্ঠা হিমবতঃ সুতা।
উমা নাম দ্বিতীয়াভূৎ কন্যা তস্যৈব রাঘব।।
অথ জ্যেষ্ঠাং সুরাঃ সর্বে দেবকার্যচিকীর্ষয়া।
শৈলেন্দ্রং বরয়ামাসুর্গঙ্গাং ত্রিপথগাং নদীম্ ।।
দদৌ ধর্মেণ হিমবান্ তনয়াং লোকপাবনীম্ ।
স্বচ্ছন্দপথগাং গঙ্গাং ত্রৈলোক্যহিতকাম্যয়া।।…
যা চান্যা শৈলদুহিতা কন্যাসীদ্রঘুনন্দন।
উগ্রং সুব্রতমাস্থায় তপস্তেপে তপোধনা।।
উগ্রেণ তপসা যুক্তাং দদৌ শৈলবরঃ সুতাম্ ।
রুদ্রায়াপ্রতিরূপায় উমাং লোকনমস্কৃতাম্ ।।
অর্থাৎ– ধাতু সকলের আকর পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমবানের দুইটি কন্যা; মেরুদুহিতা মেনা এই হিমবানের মনোজ্ঞা পত্নী, এই মেনাই উক্ত কন্যাদ্বয়ের মাতা। এই দুই কন্যার মধ্যে গঙ্গা হইলেন জ্যেষ্ঠা কন্যা, আর দ্বিতীয়া কন্যা হইলেন উমা। সুরগণ দেবতাগণের কার্যের নিমিত্ত শৈলেন্দ্র হিমালয়ের নিকট এই ত্রিপথগা নদী গঙ্গাকে যাচ্ঞা করিয়াছিলেন, শৈলেন্দ্রও এই লোকপাবনী তনয়াকে ত্রৈলোক্যের হিতের জন্য দান করিয়াছিলেন।… শৈলেন্দ্রের অন্য যে কন্যা ছিলেন, তিনি সুব্রত অবলম্বন করিয়া উগ্র তপস্যা করিয়াছিলেন। সেই উগ্র-তপস্যা-যুক্ত কন্যা উমাকে হিমালয় উমার অনুরূপ দেবতা লোকপূজ্য রুদ্রকে অর্পণ করিয়াছিলেন।
রামায়ণ বর্ণিত উপরিউক্ত কাহিনীর পল্লবিত প্রতিধ্বনি আমরা পরবর্তীকালে পুরাণগুলোতে দেখতে পাই। যেমন পুরাণানুসারে বলা হচ্ছে–
মেনা ও হিমালয়ের দুই পুত্র মৈনাক ও ক্রৌঞ্চ এবং দুই কন্যা গৌরী ও গঙ্গা।–
মেনা হিমবতঃ সুতে মৈনাকং ক্রৌঞ্চমেব চ।
গৌরীঞ্চ গঙ্গাঞ্চ ততঃ কন্যে যে লোকমাতরৌ।। -(সৌরপুরাণ-২৬/৩৪)
অসূত মেনা মৈনাকং ক্রৌঞ্চন্তস্যানুজামুমাম্ ।
গঙ্গাং হৈমবতীং যজ্ঞে ভবাঙ্গাশ্লেষপাবনীম্ ।। -(লিঙ্গপুরাণ-৬/৭)
–মেনা মৈনাক, ক্রৌঞ্চ এবং ক্রৌঞ্চের ভগিনী উমা এবং শিবের আলিঙ্গনে পবিত্রা হৈমবতী গঙ্গাকে প্রসব করেছিলেন।
এখানে গঙ্গা হৈমবতী এবং শিবের আলিঙ্গনে পরিত্রা। বামনপুরাণে (৫১ অধ্যায়) বলা হয়েছে– ‘মেনকার তিন কন্যা– রাগিণী, কুটিলা ও কালী। শিবতেজ ধারণের জন্য এঁদের তিনজনকেই স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কুটিলা ও রাগিণী ব্রহ্মার শাপে হলেন যথাক্রমে নদী ও সন্ধ্যারাগ। আর কালী মায়ের দ্বারা তপস্যায় নিষিদ্ধা হয়ে উমা নাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন।’ অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে– ‘কুটিলা ও গঙ্গা সম্ভবতঃ অভিন্না। কেননা, কুটিলা কার্তিকেয়জন্মের হেতুভূত শিববীর্য ধারণ করেছিলেন।’
পুরাণানুসারে উমা ও গঙ্গা দুই সহোদরা– হিমবান্ ও মেনার কন্যা। উভয়েই শিব-জায়া এবং হৈমবতী বা পার্বতী। অন্যদিকে মহাভারতেও উমা শিবজায়া। এখানে শিবের নামান্তর উমাপতি, উমাকান্ত এবং উমাধর– ‘উমাপতিরুমাকান্তো জাহ্নবীধৃগুমাধবঃ।’-(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব-১৭/১৩৫)। তাছাড়া রামায়ণে (আদি, ৩৭ সর্গ) এবং মহাভারতে (অনুশাসন পর্ব ৮৪ অঃ) দেখা যায়, বিবাহের পর মিলনকালে দেবগণের অনুরোধে শিব ঊর্ধ্বরেতা হয়েছিলেন বলে উমা দেবগণকে নিঃসন্তান হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন। মহাভারতের বনপর্বে চৈত্রমাসে মানস সরোবরে যজ্ঞ করলে সপার্ষদ শিব উমার সঙ্গে দর্শন দিয়ে থাকেন বলে উল্লেখ রয়েছে–
সহোময়া চ ভবতি দর্শনং কামরূপিণঃ।
অস্মিম্ সরসি সত্রৈর্বৈ চৈত্রমাসি পিণাকিনম্ ।। -(মহাঃ বনপর্ব-১৩০/১৫)
মহাভারতের শান্তিপর্বে (২৮৩-৮৪ অঃ) দেখা যায়, উমা মহাদেবকে দক্ষযজ্ঞবিনাশে প্ররোচিত করেছিলেন। পুরাণে কাব্যে দেবী দুর্গা-পার্বতীর উমা নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে মহাভারতের মধ্যে উমার যে উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ হলো আনুশাসনিক পর্বের ১৪০শ থেকে ১৪৭শ অধ্যায়ে বর্ণিত উমা-মহেশ্বর-সংবাদ বা হর-পার্বতী-সংবাদ। এখানে দেখা যায়–
‘ভগবান্ ভূতনাথ জটাজূটধারী মহাদেব ব্যাঘ্রচর্মের পরিধেয়, সিংহচর্মের উত্তরীয় ও সর্পের উপবীত ধারণ করিয়া বিচিত্রধাতুশোভিত হিমগিরিতটে উপবিষ্ট ছিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে শৈলসুতা পার্বতী মহাদেবের ন্যায় বস্ত্র পরিধানপূর্বক সমুদায় তীর্থের জলপূর্ণ স্বর্ণ কলস কক্ষে লইয়া প্রমথপত্নীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া পুষ্পবৃষ্টি করিতে করিতে মহাদেবের নিকট আগমন করিতে লাগিলেন। আগমনকালে গিরিনদী-সকল তাঁহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইল। এইরূপে তিনি হিমালয়ের পার্শ্ব দিয়া ক্রমে ক্রমে মহাদেবসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া পরিহাসচ্ছলে ঈষৎ হাস্যবদনে স্বীয় করতলদ্বারা সহসা প্রিয়তমের নেত্রদ্বয় সমাচ্ছন্ন করিলেন। দেবদেবের নেত্রদ্বয় সমাচ্ছন্ন হইবামাত্র সমুদায় জগৎ অন্ধকারময় এবং হোম ও বষটকার শূন্য হইল। সকলেরই মন ভয়ে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। অনন্তর সহসা মহাদেবের ললাটদেশে এক যুগান্তকালীন প্রচণ্ড-মার্তণ্ডসদৃশ নেত্র সমুৎপন্ন হইল। ঐ নেত্র হইতে প্রদীপ্ত জ্যোতিঃ বিনির্গত হইয়া ক্ষণকালমধ্যে সমুদায় অন্ধকার বিনাশপূর্বক হিমালয় পর্বত দগ্ধ করিতে লাগিল। পার্বতীর প্রার্থনা ও অনুনয়ে মহাদেব প্রীতিপূর্ণ-লোচনে আবার হিমালয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করায় হিমালয় পুনরুজ্জীবিত হইয়া উঠিল। পার্বতী তখন শিবকে প্রশ্ন করিলেন, কেন শিবের ললাটে এই তৃতীয় নয়ন, কেন পঞ্চানন শিবের দক্ষিণ দিক্স্থ আনন এমন ভীষণ, কেন তিনি বৃষভবাহন, শ্মশানচারী? প্রেয়সী পার্বতী উমা এইভাবে একটি একটি করিয়া প্রশ্ন করিতেছেন, প্রসন্নমুখ মহাদেব একটি একটি করিয়া তাহার উত্তর দিতেছেন। এইভাবে আসিতে লাগিল অনেক প্রশ্ন, ধর্ম কি– তাহা অনুষ্ঠানের উপায় কি, চতুর্বর্ণের পৃথক্ পৃথক্ আচরণীয় ধর্ম কি, সমুদায় বর্ণের ধর্ম কি, গার্হস্থ্য ধর্ম ও ঋষিধর্ম কি, মনুষ্যগণের বন্ধন-বিমুক্তির উপায় কি– এইভাবে সকল ধর্মরহস্য তপস্যারহস্য মোক্ষরহস্য– সব আলোচনাই উঠিতে লাগিল, জ্ঞান-পুরুষ যোগেশ্বর মহাদেব একটি একটি করিয়া ইহার ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।’
পণ্ডিতেরা অনেকেই এই ‘উমা-মহেশ্বর-সংবাদে’র অধ্যায়গুলোকে পরবর্তীকালের প্রক্ষেপ বলে মনে করেন। প্রক্ষিপ্ত হলে কোন্ সময়কার প্রক্ষেপ তা জানার উপায় নেই। তবে মহাভারতের এই উমা-মহেশ্বর-সংবাদ একান্ত অর্বাচীনকালের প্রক্ষেপ না হলে একদিক থেকে তা অত্যন্ত গুরুত্ববহ; কেননা পরবর্তীকালের আগম-গুন্থগুলোর মূল আমরা এখানেই দেখতে পাই। হিন্দু বা বৌদ্ধ সকল প্রসিদ্ধ তন্ত্রেই দেখা যায়, দেবী (তিনি যে রূপেই হোন) জিজ্ঞাসু এবং দেবাদিদেব ভগবান নিজে বক্তা। জীবহিত-কামনায় দেবী সকল প্রকার তত্ত্ব এবং সাধন-রহস্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে থাকেন, আর দেবীকে প্রীত করবার ছলে ভগবান্ সকল তত্ত্ব ও সাধন-রহস্য প্রকাশ করতে থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্রে এই প্রশ্নোত্তরপর্বে দেবাদিদেব ভগবান্ যখন বক্তা এবং দেবী যেখানে শ্রোতা, তাকে বলে আগম। আর যে প্রশ্নোত্তরপর্বে দেবী বক্তা এবং ভগবান্ শ্রোতা, সেটি নিগম। মহাভারতের এই উমা-মহেশ্বর-সংবাদের মধ্যেই এ জাতীয় সকল আগমের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে, একান্তই যদি সব অংশ অর্বাচীন কালের প্রক্ষেপ না হয়ে থাকে। একই কারণে নিগমের উৎসও পাওয়া যেতে পারে। কেননা, উমা-মহেশ্বর-সংবাদের মধ্যে দেখা যায়, মহাদেব নিজে আবার প্রশ্ন করে পার্বতীর উমার নিকট থেকে নারীধর্ম জেনে নিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে মহাদেব পার্বতীর যে পরিচয় দিয়েছেন তাও লক্ষ্যণীয়।–
‘প্রিয়ে তুমি উৎকর্ষ, অপকর্ষ ও ধর্মবিষয় বিলক্ষণ অবগত আছ। এই তপোবনই তোমার প্রধান বাসস্থান, তুমি সাধ্বী, সুকেশী, কার্যদক্ষা, দম ও শান্তি-গুণযুক্তা; মমতা-পরিশূন্যা এবং ধর্মানুষ্ঠাননিরতা।…কি ধর্ম, কি শীলতা, কি ব্রত; কি সারাংশ, কি বীর্য, কোন বিষয়েই তুমি আমা অপেক্ষা ন্যূন নহ। তুমি কঠোর তপঃ-অনুষ্ঠান করিয়াছ। তুমি অবলাগণের একমাত্র গতি, ভূমণ্ডলস্থ ধর্মানুষ্ঠাননিরত কামিনীগণ তোমারই চরিত্রের অনুসরণ করিয়া থাকে। তোমার অর্ধশরীর দ্বারা আমার অর্ধশরীর নির্মিত হইয়াছে। তুমি দেবতা ও মনুষ্যদিগের মঙ্গলসাধন করিয়া থাক।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৮)
এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো, মহাভারতে এই উমা-মহেশ্বর-সংবাদের প্রামাণিকতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ আছে। কিন্তু যে-সব স্থলে সংশয়ের অবকাশ নেই সেরূপ কিছু কিছু স্থলেও আমরা পার্বতীকে মহাভারতে শিবপত্নী-রূপে দেখতে পাই।
‘প্রিয়ে তুমি উৎকর্ষ, অপকর্ষ ও ধর্মবিষয় বিলক্ষণ অবগত আছ। এই তপোবনই তোমার প্রধান বাসস্থান, তুমি সাধ্বী, সুকেশী, কার্যদক্ষা, দম ও শান্তি-গুণযুক্তা; মমতা-পরিশূন্যা এবং ধর্মানুষ্ঠাননিরতা।…কি ধর্ম, কি শীলতা, কি ব্রত; কি সারাংশ, কি বীর্য, কোন বিষয়েই তুমি আমা অপেক্ষা ন্যূন নহ। তুমি কঠোর তপঃ-অনুষ্ঠান করিয়াছ। তুমি অবলাগণের একমাত্র গতি, ভূমণ্ডলস্থ ধর্মানুষ্ঠাননিরত কামিনীগণ তোমারই চরিত্রের অনুসরণ করিয়া থাকে। তোমার অর্ধশরীর দ্বারা আমার অর্ধশরীর নির্মিত হইয়াছে। তুমি দেবতা ও মনুষ্যদিগের মঙ্গলসাধন করিয়া থাক।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৮)
এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো, মহাভারতে এই উমা-মহেশ্বর-সংবাদের প্রামাণিকতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ আছে। কিন্তু যে-সব স্থলে সংশয়ের অবকাশ নেই সেরূপ কিছু কিছু স্থলেও আমরা পার্বতীকে মহাভারতে শিবপত্নী-রূপে দেখতে পাই।
এর পর উমা সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য আলোচনা পাওয়া যায় কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে। কালিদাসের মতে দক্ষকন্যা সাধ্বী সতীই পিতৃকৃত অপমান সহ্য করতে না-পেরে যোগবলে তনুত্যাগপূর্বক জন্মলাভ-কামনায় শৈলবধূ মেনকার গর্ভে স্থান পেয়েছিলেন। এদিকে সতী যেমন দেহত্যাগ করলেন, মহাদেবও সেদিন থেকে সমস্ত বিষয়-বাসনা পরিত্যাগ করে দেবদারুবৃক্ষ-পরিবৃত হিমালয়ের এক সানুপ্রদেশে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। এরপর উমাকর্তৃক যোগেশ্বর মহাদেবের তপোভঙ্গ এবং উমা-মহেশ্বরের পরিণয় এবং দেবকার্য সাধনের জন্য দেবসেনাপতি কুমার কার্তিকের জন্ম প্রভৃতি উপাখ্যান সর্বজনবিদিত। পরবর্তীতে পুরাণাদিতে এই কাহিনীই নানাভাবে পল্লবিত রূপ ধারণ করতে লাগলো।
তবে উমা বিষয়ক আলোচনা থেকে কয়েকটি তথ্যের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে– ‘প্রথমেই লক্ষ্য করিতে পারি, উমা শৈলসুতা; তাঁহার অপর নাম পার্বতী বা গিরিজা তাঁহাকে মুখ্যতঃ পর্বতের সঙ্গেই যুক্ত করিতেছে। আরও দেখিতে পাই, এই দেবী হয় কৈলাসবাসিনী, না হয় মন্দরবাসিনী, না হয় বিন্ধ্যবাসিনী। সর্বক্ষেত্রেই পর্বতের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ সূচিত হইতেছে। দ্বিতীয় আর একটি জিনিস লক্ষ্য করিতে পারি, এই উমা বা পার্বতী দেবী সিংহবাহনা। পার্বত্য দেবীর সিংহকে বাহনরূপে গ্রহণ করার ভিতরেও বেশ একটি সঙ্গতি রহিয়াছে। এই সিংহবাহিনী শৈলসূতা উমা দেবী বা পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তিদেবীর প্রাচীন রূপ বলিয়া মনে হয়; এই দেবীর সহিতই পরবর্তী কালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেবীগণ একত্র হইয়া একটি সর্বরূপা মহেশ্বরী দেবীর সৃষ্টি করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৯)
তবে উমা বিষয়ক আলোচনা থেকে কয়েকটি তথ্যের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে– ‘প্রথমেই লক্ষ্য করিতে পারি, উমা শৈলসুতা; তাঁহার অপর নাম পার্বতী বা গিরিজা তাঁহাকে মুখ্যতঃ পর্বতের সঙ্গেই যুক্ত করিতেছে। আরও দেখিতে পাই, এই দেবী হয় কৈলাসবাসিনী, না হয় মন্দরবাসিনী, না হয় বিন্ধ্যবাসিনী। সর্বক্ষেত্রেই পর্বতের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ সূচিত হইতেছে। দ্বিতীয় আর একটি জিনিস লক্ষ্য করিতে পারি, এই উমা বা পার্বতী দেবী সিংহবাহনা। পার্বত্য দেবীর সিংহকে বাহনরূপে গ্রহণ করার ভিতরেও বেশ একটি সঙ্গতি রহিয়াছে। এই সিংহবাহিনী শৈলসূতা উমা দেবী বা পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তিদেবীর প্রাচীন রূপ বলিয়া মনে হয়; এই দেবীর সহিতই পরবর্তী কালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেবীগণ একত্র হইয়া একটি সর্বরূপা মহেশ্বরী দেবীর সৃষ্টি করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৯)
পৌরাণিক দুর্গা ও শস্যদেবী শাকম্ভরী
পার্বতী উমা দেবীই পরবর্তীকালে দুর্গা নামে সুপ্রসিদ্ধা হয়েছেন বলে মনে করা হয়। এই দুর্গা দেবীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে। দুর্গা বা দুর্গি নামের প্রথম উল্লেখ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ওই যাজ্ঞিকা উপনিষদের দুর্গা-গায়ত্রীটিতে পাওয়া যায়,–
‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারীং ধীমহি, তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।’
অর্থাৎ– কাত্যায়নকে জানি, কন্যাকুমারীকে ধ্যান করি, সুতরাং দুর্গি আমাদের প্রেরণ করুন।
এখানে দুর্গির সাথে শিবের কোন সংযোগ আছে কিনা আদৌ জানা যায় না। আবার এই তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম খণ্ডের দ্বিতীয় অনুবাকে দুর্গার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা হলো–
তাং অগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্ ।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।। (তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০/২)
অর্থাৎ : অগ্নিবর্ণা তপপ্রদীপ্তা সূর্য (বা অগ্নির) কন্যা, যিনি কর্মফলের (পুরস্কার প্রদানের জন্য লোকদিগের দ্বারা) প্রার্থিত হন, এমন দুর্গা দেবীর আমি শরণাপন্ন হই; হে সুন্দর রূপে ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার।
এই শ্লোকটি নারায়ণ-উপনিষদ (নারাঃ উপঃ-২/২) এবং দেবীভাগবতেও (দেবীভাগ: ৭/৩১/৪৫) উদ্ধৃত হয়েছে। দুর্গাদেবীর সঙ্গে সূর্যাগ্নির সম্পর্ক এখানে স্পষ্ট, কিন্তু রুদ্র বা শিবের সঙ্গে কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত নয়।
সাধারণত দুর্গতিনাশিনী বলেই দেবীকে আমরা ‘দুর্গা’ বলে জানি। পরবর্তীকালে যদিও দুর্গার অনেক অর্থ দেখা যায়, এবং সেসব অর্থের সাহায্যেই পুরাণাদিতে ‘দুর্গা’র ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী শব্দকল্পদ্রুমে দুর্গা শব্দের যে অর্থ ধৃত হয়েছে তা হলো–
সাধারণত দুর্গতিনাশিনী বলেই দেবীকে আমরা ‘দুর্গা’ বলে জানি। পরবর্তীকালে যদিও দুর্গার অনেক অর্থ দেখা যায়, এবং সেসব অর্থের সাহায্যেই পুরাণাদিতে ‘দুর্গা’র ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী শব্দকল্পদ্রুমে দুর্গা শব্দের যে অর্থ ধৃত হয়েছে তা হলো–
দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নো ভববন্ধে কুকর্মণি।
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি।।
এহাভয়েহতিরোগে চাপ্যাশব্দো হন্তৃবাচকঃ।
এতান্ হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতা।। –(শব্দকল্পদ্রুম)
অর্থাৎ : দুর্গ শব্দের বাচ্য দুর্গনামক দৈত্য, মহাবিঘ্ন, ভববন্ধ, কুকর্ম, শোক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ড, জন্ম, মহাভয় এবং অতিরোগ; আ-শব্দ হইল হন্তৃবাচক। এইসকলকে হনন করেন যে দেবী তিনিই দুর্গা নামে পরিকীর্তিতা।
এই শ্লোক দুটি ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণেও (ব্রহ্মবৈঃ পুঃ-৫৭/৭-৮) রয়েছে। কৌতুহলের বিষয় হলো, দুর্গাকে যেসব আপদ-বিপদে জনসাধারণ সাধারণত স্মরণ করে থাকে তার মধ্যে বেছে বেছে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করে এখানে দুর্গার ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে অনুমান। এ ধরনের আরও গুটিকয় ব্যাখ্যা শব্দকল্পদ্রুমে রয়েছে বলে জানা যায়। এসব ব্যাখ্যায় হয়তো প্রচলিত বিশ্বাসের কথাই জানা যায়, কিন্তু তা থেকে ঐতিহাসিক সত্য পাওয়ার সম্ভাবনা নাই বলেই মনে হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে একবার বলা হয়েছে– ‘দুর্গাসি দুর্গ-ভবসাগর-নৌ-রসঙ্গা’ (চণ্ডী-৪/১১)– অর্থাৎ– ‘অসঙ্গা তুমি দুর্গম ভবসাগরে নৌকা-স্বরূপ বলেই দুর্গা।’ আবার অন্যত্র বলা হয়েছে–
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্ ।
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।।– (চণ্ডী-১১/৪৯-৫০)
অর্থাৎ– দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করিবেন বলিয়া দেবী দুর্গা দেবী নামে খ্যাত হইবেন।
স্কন্দপুরাণে (কাশীখণ্ডে) রুরুদৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরের সঙ্গে দেবীর যুদ্ধ ও দুর্গাসুরবধ-বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণিত আছে। দুর্গাসুরের নিধনের পরে দেবী দুর্গা নামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন–
অদ্য প্রভৃতি মে নাম দুর্গেতি খ্যাতিমেষ্যতি।
দুর্গদৈতস্য সমরে পাতনাদতিদুর্গমাৎ।।
যে মাং দুর্গাং শরণগা ন তেষাং দুর্গতিঃ ক্বচিৎ।।
— (স্কন্দপুরাণ-কাশী উত্তরার্ধ-৭২/৭১-৭২)
অর্থাৎ– আজ থেকে অতি দুর্গম দুর্গদৈত্যকে সমরে বধ করার জন্য আমার খ্যাতি হবে দুর্গা নামে। যে আমার বা দুর্গার শরণ গ্রহণ করবে, তার কখনও দুর্গতি হবে না।
মহাভারতেও (বিরাটপর্ব–৬/২০-২২) দেবী দুর্গা কর্তৃক দুর্গতিনাশের বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন–
দুর্গাত্তারয়সে দুর্গে তস্মাৎ দুর্গা স্মৃতাজনৈঃ।
কান্তারেষ্ববসন্নানাং মগ্নানাঞ্চ মহার্ণবে।।
দস্যুভির্বা নিরুদ্ধানাং ত্বং গতিঃ পরমা নৃণাম্ ।
জলপ্রতরণে চৈব কান্তারেষ্বটবীযু চ।।
যে স্মরন্তি মহাদেবি ন চ সীদন্তি তে নরাঃ। (মহা-বিরাটপর্ব-৬/২০-২২)
অর্থাৎ– হে দুর্গে, তুমি দুর্গতি নাশ কর বলেই লোকে তোমায় দুর্গা বলে থাকে। কান্তার মধ্যে যারা অবসন্ন হয়ে পড়ে, মহাসমুদ্রে যারা মগ্ন হয়, দস্যুর দ্বারা যারা বন্দি হয়, সেই মনুষ্যগণের তুমিই পরমা গতি। জল (নদী বা সমুদ্র) পার হওয়ার সময়ে কান্তারে এবং অরণ্যে, হে মহাদেবি! যারা তোমাকে স্মরণ করেন তাঁরা কখনও বিপন্ন হন না।
তবে কোনও কোনও পণ্ডিতের প্রণিধানযোগ্য মতটি হলো, দুর্গ-রক্ষাকারিণী দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন দুর্গা। দেবী-পুরাণে, দেবী-ভাগবতে এবং খিল হরিবংশে এই মতের সাক্ষ্য পাওয়া যায় বলে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত উল্লেখ করেছেন। দেবীপুরাণে দেবীকে দুর্গে বিরাজমানা দুর্গেশ্বরী বলে উল্লেখ করা হয়েছে–
রমসে দেবি দুর্গেষু দুর্গেশ্বরি নমোহস্তুতে।– (দেবীপুরাণ-৮৩/৬২)
দুর্গেষু কারয়েৎ দুর্গাং মহিষাসুরঘাতিনীম্ ।– (দেবীপুরাণ-৭২/১২৪)
দেবীভাগবতে দেবী নগরপালিকা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন–
নগরেহত্র ত্বয়া মাতঃ স্থাতব্যং মম সর্বদা।
দুর্গা দেবীতি নাম্না বৈ ত্বং শক্তিরিহ সংস্থিতা।।– (দেবীভাগবত-৩/২৪/৫-৬)
আর স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে বলা হয়েছে– মহাদেব কাশী রক্ষার নিমিত্ত নন্দীকে প্রতি দুর্গে দুর্গাপ্রতিমা সন্নিবেশ করতে আদেশ দিয়েছিলেন–
প্রতিদুর্গং দুর্গারূপাঃ পরিতঃ পরিবাসয়।– (স্কন্দঃ-কাশীঃ-উত্তরার্ধ-৬৯/১৭৮)
আদেশ পেয়ে নন্দী কাশীর সর্বত্র প্রতি দুর্গে দুর্গামূর্তি স্থাপন করেছিলেন–
আহূয় সর্বতো দুর্গাঃ প্রতিদুর্গং ন্যবেশয়ৎ।।– (স্কন্দঃ-কাশীঃ-উত্তরার্ধ-৬৯/১৮০)
অন্যদিকে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দুর্গ মধ্যে যেসব দেবতার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের অন্যতমা হলো অপরাজিতা। পণ্ডিতেরা মনে করেন অপরাজিতাই দুর্গা। [পুরমধ্যে বহিশ্চ দেবালয়-নির্মাণবিধিঃ]–
অপরাজিতাহপ্রতিহত-জয়ন্ত-বৈজয়ন্ত-কোষ্ঠকান্ শিব-বৈশ্রবণাশ্বিশ্রী-মদিরা-গৃহাণি চ পুরমধ্যে কারয়েৎ। কোষ্ঠকালয়েষু যথোদ্দেশং বাস্তু-দেবতাঃ স্থাপয়েৎ। ব্রাহ্মৈন্দ্রযাম্য-সৈনাপত্যানি দ্বারাণি। বহিঃ পরিখায়া ধনুঃশতাপকৃষ্টাশ্চৈত্য-পুণ্যস্থান-বন-সেতুবন্ধাঃ কার্যাঃ, যথাদিশং চ দিগ্দেবতাঃ। –(অর্থশাস্ত্র-২/৪/৫)
অর্থাৎ–
দুর্গ-নগরের মধ্যবর্তী স্থানে অপরাজিতা (দুর্গা), অপ্রতিহত (বিষ্ণু), জয়ন্ত (ইন্দ্রপুত্র বা সুব্রহ্মণ্য) ও বৈজয়ন্তের (ইন্দ্রের) আলয় বা মন্দির এবং শিব, বৈশ্রবণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, শ্রী (লক্ষ্মী) ও মদিরা দেবীর মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। (নগরের চারদিকে বিভিন্ন দেবতার নামে দ্বার নির্মাণ করাতে হবে।–) যেমন, উত্তর দিকে ব্রহ্মদেবতাত্মক ব্রাহ্ম-দ্বার, পূর্বদিকে ইন্দ্রসম্বন্ধীয় ইন্দ্র-দ্বার, দক্ষিণদিকে যম-সম্পর্কীয় যাম্য-দ্বার এবং পশ্চিমদিকে সেনাপতি- (কার্তিকেয়) সম্পর্কীয় সৈনাপত্য-দ্বার। নগরের বাইরে পরিখা থেকে ধনুঃশত বা দণ্ডশত (চারশত হাত) ব্যবধানে চৈত্য, পুণ্যস্থান, বন ও সেতুবন্ধ স্থাপন করাতে হবে; এবং নিজ নিজ দিক্ অনুসারে দিগ্দেবতাদের আলয় স্থাপন করাতে হবে।
যদি অপরাজিতাই দুর্গা হয় তাহলে দুর্গরক্ষিণী দেবী দুর্গার নাম না করে কৌটিল্য অপরাজিতার নাম করলেন কেন? নিশ্চয়ই দুর্গা নাম তখনও প্রসিদ্ধ হয়নি। তবে দুর্গাপূজার অন্তে অপরাজিতা পূজার রীতি একালেও বর্তমান আছে। যেমন, দুর্গাপূজাতে দশমীর দিন পূজা অন্তে ঘট বিসর্জনের পর ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে তার উপর অপরাজিতা লতা রেখে অপরাজিতা পূজার রীতি প্রচলিত। কালিকাপুরাণে বর্ণিত দুর্গাপূজা পদ্ধতিতে এই অপরাজিতা পূজার ধ্যানমন্ত্র হলো–
নীলোৎপলদলশ্যামাং ভুজগাভরণোজ্জলাং।
বালেন্দুমৌলিনীং দেবীং নয়নত্রিতয়ান্বিতাম্ ।
শঙ্খচক্রধরাং দেবীং বরদাং ভয়নাশিনীম্ ।
পীনোত্তুঙ্গস্তনাং শ্যামাং বরপদ্মসুমালিনীম্ ।।
অর্থাৎ– নীলপদ্মের পাপড়ির তুল্য শ্যামবর্ণা, সর্পের অলংকারে উজ্জ্বলা, মস্তকে কলাচন্দ্রশোভিতা, ত্রিনয়নসমন্বিতা, শঙ্খচক্রধারিণী বরদা ও অভয়দাত্রী, পীনোন্নতস্তনী, শ্যামা শ্রেষ্ঠপদ্মমালাভূষিতা।
চতুর্ভুজা এই অপরাজিতা বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া লক্ষ্মী ও শিবশক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা। দুর্গার এক নাম অপরাজিতা বলেই সম্ভবত নামসাদৃশ্যের কারণে অশোক প্রভৃতি নবপত্রিকার মতো অপরাজিতা লতা পূজার রীতি প্রচলিত হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্গে নিবেশিতা দেবীর নাম অপরাজিতা বলেই, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের জিজ্ঞাসা– ‘দুর্গা কি প্রাথমিক রূপে নগরপালিকা দুর্গরক্ষিণী দেবী ছিলেন? দুর্গাধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপেই কি তিনি সর্বশক্তিময়ী দেবীরূপে পূজিতা হইলেন? শক্তিময়ীর মহাদেবীত্ব লাভ অতি সহজেই সম্ভব হইয়াছিল।’
মহাদেবীরূপে পূজালাভের বেলায় পার্বতী উমা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন, সেক্ষেত্রে মায়ের দুর্গারূপই প্রাধান্য লাভ করেছে। মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীতেই আমরা দেখেছি যে, যিনি দেবতেজঃসম্ভবা চণ্ডী, তিনিই কাত্যায়নী, তিনিই কালী, দুর্গা, পার্বতী প্রভৃতি বিচিত্র নামে অভিহিতা। দেবী চামুণ্ডারূপে চণ্ডমুণ্ড বধ করেছেন, দুর্গারূপে বধ করেছেন দুর্গাসুর, কালীরূপে পান করেছেন রক্তবীজের রক্ত। একই মহাশক্তির যেমন বিচিত্র নাম, তেমনি বিচিত্র তাঁর রূপ। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডী, কালী, চামুণ্ডা, পার্বতী, দুর্গা, কৌশিকী, বিন্ধ্যবাসিনী, রক্তদন্তিকা, শতাক্ষী, শাকম্ভরী, ভীমা, ভ্রামরী প্রভৃতি বিচিত্র নাম-রূপের সমন্বয় ঘটেছে। এই দেবী মহিষাসুর বধ করার জন্যই মহিষাসুরমর্দিনী বা মহিষমর্দিনী নামে খ্যাত হয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণের এই বিবরণ অনুসারেই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার মূর্তি নির্মিত ও পূজিত হয়। কিন্তু মার্কণ্ডেয় পুরাণের কোথাও উমার উল্লেখ নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণেই শরৎকালে চণ্ডীর পূজার উল্লেখ রয়েছে– ‘শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।’
মহাদেবীরূপে পূজালাভের বেলায় পার্বতী উমা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন, সেক্ষেত্রে মায়ের দুর্গারূপই প্রাধান্য লাভ করেছে। মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীতেই আমরা দেখেছি যে, যিনি দেবতেজঃসম্ভবা চণ্ডী, তিনিই কাত্যায়নী, তিনিই কালী, দুর্গা, পার্বতী প্রভৃতি বিচিত্র নামে অভিহিতা। দেবী চামুণ্ডারূপে চণ্ডমুণ্ড বধ করেছেন, দুর্গারূপে বধ করেছেন দুর্গাসুর, কালীরূপে পান করেছেন রক্তবীজের রক্ত। একই মহাশক্তির যেমন বিচিত্র নাম, তেমনি বিচিত্র তাঁর রূপ। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডী, কালী, চামুণ্ডা, পার্বতী, দুর্গা, কৌশিকী, বিন্ধ্যবাসিনী, রক্তদন্তিকা, শতাক্ষী, শাকম্ভরী, ভীমা, ভ্রামরী প্রভৃতি বিচিত্র নাম-রূপের সমন্বয় ঘটেছে। এই দেবী মহিষাসুর বধ করার জন্যই মহিষাসুরমর্দিনী বা মহিষমর্দিনী নামে খ্যাত হয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণের এই বিবরণ অনুসারেই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার মূর্তি নির্মিত ও পূজিত হয়। কিন্তু মার্কণ্ডেয় পুরাণের কোথাও উমার উল্লেখ নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণেই শরৎকালে চণ্ডীর পূজার উল্লেখ রয়েছে– ‘শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।’
ভারতবর্ষের একটি ধর্মসম্প্রদায়-রূপে দেবীপূজা বা মাতৃপূজার প্রচলন কখন থেকে হয়েছে তা বলা শক্ত। তবে মহাদেবীরূপে মায়ের পূজালাভের ক্ষেত্রে দুর্গারূপ প্রাধান্য পাবার কারণ হয়তো প্রবাদ-কিংবদন্তী-রূপে শ্রীরামচন্দ্রের রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর বোধন করে পূজার প্রচার। বাল্মীকি-রামায়ণে যার আভাস-মাত্রও নেই। রামায়ণে যদিও উমার উল্লেখ আছে এবং রামায়ণে বিষ্ণুর সঙ্গে শ্রী বা লক্ষ্মীর উল্লেখও কয়েক জায়গায় পাওয়া যায়। এর বাইরে কোনও দেবী বা দেবীপূজার উল্লেখ বাল্মীকির রামায়ণে নেই। অন্যদিকে প্রচলিত মহাভারতে এ জাতীয় দেবীদের উল্লেখ ও স্তবস্তুতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ হলো দু’টি দুর্গাস্তব (যা ইতঃপূর্বে বর্ণিত হয়েছে)। দুর্গাস্তব দু’টির একটি হলো বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠির-কর্তৃক দুর্গাস্তব, অন্যটি হলো ভীষ্মপর্বে যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন যে দুর্গাস্তব করেছিলেন তা।
যুধিষ্ঠিরের এই স্তবের মধ্যে দেখা যায়– দুর্গা যশোদাগর্ভসম্ভূতা এবং নন্দগোপকুলে জাতা, কংস-কর্তৃক শিলাতলে নিক্ষিপ্তা হয়ে তিনি আকাশদেশে অন্তর্হিতা হয়েছিলেন। তিনি দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তিনি বালার্কবর্ণা, পূর্ণচন্দ্রনিভাননা, চতুর্ভুজা ও চতুর্বক্ত্রা। দেবী আবার কখানও কৃষ্ণবর্ণা এবং অষ্টভুজা-রূপেও পূজিতা। তিনি দিব্যকুণ্ডলধারিণী, কেশবন্ধে দিব্যমুকুটধারিণী। তিনি মহিষমর্দিনী ও বিন্ধ্যবাসিনী। আর অর্জুন-কর্তৃক দেবীর স্তবে দেখা যায়– দেবী ভগবতী যোগিগণের পরমসিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কারিণী, জরামৃত্যুহীনা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরমা সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী।
এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো,– ‘দেবীপূজার ইতিহাসে মহাভারতের এই দুইটি দুর্গাস্তবের উপর এত দিন আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করিতাম। কিন্তু মহাভারত-সম্বন্ধে নূতন যে-সকল অধ্যয়ন ও গবেষণা হইয়াছে তাহাতে দেখা যায় যে এই স্তবগুলি খাঁটি নয়– প্রক্ষিপ্ত। পুণা হইতে মহাভারতের যে প্রামাণিক সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতে এই-সকল স্তবস্তুতির অংশ পরবর্তী কালের যোজনা বলিয়া বাদ দেওয়া হইয়াছে। মহাভারতে পার্বতী উমাকেও স্বতন্ত্রা স্বপ্রধানা দেবী রূপে পাই না, শিবপত্নী-রূপেই সেখানে তাঁহার পরিচয়। মহাভারতের পরিশিষ্টরূপে পরিগণিত ‘খিল হরিবংশে’ যে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি তখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না; তখন পর্যন্ত মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া দেবী শবর, পুলিন্দ এবং বর্বরগণ-কর্তৃকই পূজিতা। পার্বতী উমার সহিত অভিন্নতা লাভ করিয়াই ব্রাহ্মণ্যধর্মে তাঁহার দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ বলিয়া মনে হয়। পৌরাণিক যুগেই এই মিলন সঙ্ঘটিত হইয়াছে।’
‘একটি তথ্য এইখানেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে হইবে। দুর্গা দুর্গতি-নাশিনীই হোন, দুর্গাসুর-নাশিনীই হোন বা দুর্গরক্ষিণীই হোন, তিনি শস্ত্র-ধারিণী এবং অরিমর্দিনী; কিন্তু পার্বতী উমার কোনও প্রাচীন উল্লেখের মধ্যেই আমরা এই শস্ত্রধারিণী অরিমর্দিনী রূপের উল্লেখ পাই না। উমাকে প্রথমে পাইলাম কন্যারূপে– বহুশোভমানা হৈমবতী-রূপে; তাহার পরে পাইলাম শিবপ্রিয়া-রূপে– তাহার পরে পাই গণেশ-জননী ও কুমার-জননী-রূপে। তাহার পরে যখন লক্ষ্মী-সরস্বতীও তাঁহাদের স্বাতস্ত্র্য বর্জন করিয়া মায়ের কন্যাত্ব স্বীকার করিলেন তখন মায়ের সোনার সংসারকে পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এই পার্বতী উমার প্রেমময়ী পত্নীত্ব এবং অনন্ত-স্নেহময়ী মাতৃত্বের রূপই প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিয়াছে; শিবের সহিত প্রণয়-কলহ বা গৃহ-কলহ ব্যতীত মায়ের ভ্রূকুটিকুটিল মুখ কখনও বড় একটা দেখা যায় নাই– অন্ত্র-শস্ত্র ধারণ ত দূরের কথা। কিন্তু মহাদেবী যখনই ভয়ঙ্করী– রণোন্মাদিনী– অসুরনাশিনী– তখনই তিনি দুর্গা, চণ্ডী, কালী। মায়ের এই অসুরনাশিনী মূর্তির সহিত সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত হইল মায়ের চণ্ডী-রূপ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দেবীর এই অসুরনাশিনী চণ্ডী বা চণ্ডিকার ধারা মায়ের পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি পৃথক ধারা। পরবর্তী কালে দুই ধারা নির্বিশেষে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০)
কিন্তু আমরা পরে দেখবো, শক্তিবাদের অনার্য বিশ্বাসাশ্রিত যে অন্তর্গত ধারাটি শাক্তচেতনার প্রাচীনতম উপাদানগুলোকে ধারণ করে শস্যদেবী-রূপে একাত্ম হয়ে আছে তা একাধারে কৌতুহলোদ্দীপক এবং শক্তি-সাধনার মৌলিক অভিব্যক্তির দ্যোতকও। যেখানে প্রকৃতি মাতৃরূপে কল্পিত।
যুধিষ্ঠিরের এই স্তবের মধ্যে দেখা যায়– দুর্গা যশোদাগর্ভসম্ভূতা এবং নন্দগোপকুলে জাতা, কংস-কর্তৃক শিলাতলে নিক্ষিপ্তা হয়ে তিনি আকাশদেশে অন্তর্হিতা হয়েছিলেন। তিনি দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তিনি বালার্কবর্ণা, পূর্ণচন্দ্রনিভাননা, চতুর্ভুজা ও চতুর্বক্ত্রা। দেবী আবার কখানও কৃষ্ণবর্ণা এবং অষ্টভুজা-রূপেও পূজিতা। তিনি দিব্যকুণ্ডলধারিণী, কেশবন্ধে দিব্যমুকুটধারিণী। তিনি মহিষমর্দিনী ও বিন্ধ্যবাসিনী। আর অর্জুন-কর্তৃক দেবীর স্তবে দেখা যায়– দেবী ভগবতী যোগিগণের পরমসিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কারিণী, জরামৃত্যুহীনা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরমা সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী।
এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো,– ‘দেবীপূজার ইতিহাসে মহাভারতের এই দুইটি দুর্গাস্তবের উপর এত দিন আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করিতাম। কিন্তু মহাভারত-সম্বন্ধে নূতন যে-সকল অধ্যয়ন ও গবেষণা হইয়াছে তাহাতে দেখা যায় যে এই স্তবগুলি খাঁটি নয়– প্রক্ষিপ্ত। পুণা হইতে মহাভারতের যে প্রামাণিক সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতে এই-সকল স্তবস্তুতির অংশ পরবর্তী কালের যোজনা বলিয়া বাদ দেওয়া হইয়াছে। মহাভারতে পার্বতী উমাকেও স্বতন্ত্রা স্বপ্রধানা দেবী রূপে পাই না, শিবপত্নী-রূপেই সেখানে তাঁহার পরিচয়। মহাভারতের পরিশিষ্টরূপে পরিগণিত ‘খিল হরিবংশে’ যে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি তখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না; তখন পর্যন্ত মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া দেবী শবর, পুলিন্দ এবং বর্বরগণ-কর্তৃকই পূজিতা। পার্বতী উমার সহিত অভিন্নতা লাভ করিয়াই ব্রাহ্মণ্যধর্মে তাঁহার দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ বলিয়া মনে হয়। পৌরাণিক যুগেই এই মিলন সঙ্ঘটিত হইয়াছে।’
‘একটি তথ্য এইখানেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে হইবে। দুর্গা দুর্গতি-নাশিনীই হোন, দুর্গাসুর-নাশিনীই হোন বা দুর্গরক্ষিণীই হোন, তিনি শস্ত্র-ধারিণী এবং অরিমর্দিনী; কিন্তু পার্বতী উমার কোনও প্রাচীন উল্লেখের মধ্যেই আমরা এই শস্ত্রধারিণী অরিমর্দিনী রূপের উল্লেখ পাই না। উমাকে প্রথমে পাইলাম কন্যারূপে– বহুশোভমানা হৈমবতী-রূপে; তাহার পরে পাইলাম শিবপ্রিয়া-রূপে– তাহার পরে পাই গণেশ-জননী ও কুমার-জননী-রূপে। তাহার পরে যখন লক্ষ্মী-সরস্বতীও তাঁহাদের স্বাতস্ত্র্য বর্জন করিয়া মায়ের কন্যাত্ব স্বীকার করিলেন তখন মায়ের সোনার সংসারকে পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এই পার্বতী উমার প্রেমময়ী পত্নীত্ব এবং অনন্ত-স্নেহময়ী মাতৃত্বের রূপই প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিয়াছে; শিবের সহিত প্রণয়-কলহ বা গৃহ-কলহ ব্যতীত মায়ের ভ্রূকুটিকুটিল মুখ কখনও বড় একটা দেখা যায় নাই– অন্ত্র-শস্ত্র ধারণ ত দূরের কথা। কিন্তু মহাদেবী যখনই ভয়ঙ্করী– রণোন্মাদিনী– অসুরনাশিনী– তখনই তিনি দুর্গা, চণ্ডী, কালী। মায়ের এই অসুরনাশিনী মূর্তির সহিত সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত হইল মায়ের চণ্ডী-রূপ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দেবীর এই অসুরনাশিনী চণ্ডী বা চণ্ডিকার ধারা মায়ের পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি পৃথক ধারা। পরবর্তী কালে দুই ধারা নির্বিশেষে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০)
কিন্তু আমরা পরে দেখবো, শক্তিবাদের অনার্য বিশ্বাসাশ্রিত যে অন্তর্গত ধারাটি শাক্তচেতনার প্রাচীনতম উপাদানগুলোকে ধারণ করে শস্যদেবী-রূপে একাত্ম হয়ে আছে তা একাধারে কৌতুহলোদ্দীপক এবং শক্তি-সাধনার মৌলিক অভিব্যক্তির দ্যোতকও। যেখানে প্রকৃতি মাতৃরূপে কল্পিত।
দুর্গাপূজা : দুর্গাপূজা মুখ্যত বাঙলাদেশের পূজা। এই পূজা শারদীয়া পূজা হিসেবে খ্যাত। বাঙালি হিন্দুর বৃহত্তম উৎসব শরৎকালীন দুর্গোৎসব। অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে দুর্গাপূজার গোটা প্রক্রিয়াটা নিম্নরূপ,–
‘আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দশভূজা মহিষমর্দিনীর পূজা হয়। দেবী প্রতিমার সঙ্গে সংযুক্ত হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয় গণেশের মূর্তি। দশমী তিথিতে হয় দেবী প্রতিমার বিসর্জ্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। এই দিনটি দশেরা উৎসব নামে সারা ভারতে পালিত হয়। এই দিনে উত্তর ভারতের প্রায় সর্বত্র রাবণের পুত্তলিকা দাহ করা হয় ও রামলীলা গান করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিল। ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠ্যাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্র মতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। কোন কোন স্থলে কৃষ্ণানবমীতে কোথাও কোথাও শুক্ল প্রতিপদে দেবীর বোধনের রীতি প্রচলিত। কৃষ্ণা নবমী বা শুক্ল প্রতিপদ থেকে প্রত্যহই ঘটে দেবীর পূজা হয়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ– কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়া বেল একত্র বেঁধে শাড়ী পরিয়ে একটি বধূর আকৃতি বিশিষ্ট করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, এই উদ্ভিদ সমন্বয়কে নবপত্রিকা– প্রচলিত ভাষায় কলাবৌ– বলা হয়ে থাকে। দশমীতে দেবীর বিসর্জনের দিনে অপরাজিতা পূজা, সিদ্ধিপান ও পারস্পরিক প্রীতি সম্ভাষণ, আলিঙ্গন, প্রণাম প্রভৃতি দ্বারা মনোমালিন্য দূর করে সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠার রীতি। নূতন বস্ত্র পরিধান পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ষষ্ঠী তিথিতেই সাধারণতঃ অধিকাংশ স্থলে দেবীর বোধন হয়, এর দ্বারা ষষ্ঠী দেবী ও দুর্গার একাত্মতা সুপ্রতিষ্ঠিত। এই দিনকে দুর্গা-ষষ্ঠীও বলা হয়। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান– অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা সন্ধিপূজা। অর্ধরাত্রি পূজাও কোন কোন স্থলে প্রচলিত। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিন দিন কোন কুমারী বালিকাকে অভ্যর্থনা করে এনে পূজা করা হয়। অনেক জায়গাতেই দশমী তিথিতে অশ্লীল বাদ্যগীত শবরোৎসব নামে অনুষ্ঠিত হয়। নবমীতে হোমযাগের দ্বারা পূজার পূর্ণাহুতি দেওয়ার রীতি। তিন দিনই এবং সন্ধি ও অর্ধরাত্রি পূজায় মহিষ, মেষ ও ছাগ বলি দেওয়ার রীতি। আজকাল অনেক জায়গাতেই বৈষ্ণবীয় প্রভাবে বলি রহিত হয়েছে। এই ভাবে বৈদিক, পৌরাণিক, তান্ত্রিক, লৌকিক বিচিত্র রীতি-পদ্ধতি দুর্গাপূজায় সম্মিলিত হয়ে দুর্গা পূজাকে বাঙ্গালীর সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২২২-২৩)
‘আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দশভূজা মহিষমর্দিনীর পূজা হয়। দেবী প্রতিমার সঙ্গে সংযুক্ত হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয় গণেশের মূর্তি। দশমী তিথিতে হয় দেবী প্রতিমার বিসর্জ্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। এই দিনটি দশেরা উৎসব নামে সারা ভারতে পালিত হয়। এই দিনে উত্তর ভারতের প্রায় সর্বত্র রাবণের পুত্তলিকা দাহ করা হয় ও রামলীলা গান করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিল। ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠ্যাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্র মতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। কোন কোন স্থলে কৃষ্ণানবমীতে কোথাও কোথাও শুক্ল প্রতিপদে দেবীর বোধনের রীতি প্রচলিত। কৃষ্ণা নবমী বা শুক্ল প্রতিপদ থেকে প্রত্যহই ঘটে দেবীর পূজা হয়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ– কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়া বেল একত্র বেঁধে শাড়ী পরিয়ে একটি বধূর আকৃতি বিশিষ্ট করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, এই উদ্ভিদ সমন্বয়কে নবপত্রিকা– প্রচলিত ভাষায় কলাবৌ– বলা হয়ে থাকে। দশমীতে দেবীর বিসর্জনের দিনে অপরাজিতা পূজা, সিদ্ধিপান ও পারস্পরিক প্রীতি সম্ভাষণ, আলিঙ্গন, প্রণাম প্রভৃতি দ্বারা মনোমালিন্য দূর করে সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠার রীতি। নূতন বস্ত্র পরিধান পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ষষ্ঠী তিথিতেই সাধারণতঃ অধিকাংশ স্থলে দেবীর বোধন হয়, এর দ্বারা ষষ্ঠী দেবী ও দুর্গার একাত্মতা সুপ্রতিষ্ঠিত। এই দিনকে দুর্গা-ষষ্ঠীও বলা হয়। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান– অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা সন্ধিপূজা। অর্ধরাত্রি পূজাও কোন কোন স্থলে প্রচলিত। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিন দিন কোন কুমারী বালিকাকে অভ্যর্থনা করে এনে পূজা করা হয়। অনেক জায়গাতেই দশমী তিথিতে অশ্লীল বাদ্যগীত শবরোৎসব নামে অনুষ্ঠিত হয়। নবমীতে হোমযাগের দ্বারা পূজার পূর্ণাহুতি দেওয়ার রীতি। তিন দিনই এবং সন্ধি ও অর্ধরাত্রি পূজায় মহিষ, মেষ ও ছাগ বলি দেওয়ার রীতি। আজকাল অনেক জায়গাতেই বৈষ্ণবীয় প্রভাবে বলি রহিত হয়েছে। এই ভাবে বৈদিক, পৌরাণিক, তান্ত্রিক, লৌকিক বিচিত্র রীতি-পদ্ধতি দুর্গাপূজায় সম্মিলিত হয়ে দুর্গা পূজাকে বাঙ্গালীর সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২২২-২৩)
এখানে উল্লেখ্য, শরৎকালে দুর্গাদেবীর বোধন ও পূজাকে অকাল বোধন বলা হয়ে থাকে। প্রসিদ্ধি আছে যে, রামচন্দ্র রাবণ বধের নিমিত্ত দেবীর কৃপালাভের উদ্দেশ্যে অকালে (শরৎকালে) দেবীর পূজা করেছিলেন। দেবীর বর লাভ করে রামচন্দ্র দশমী তিথিতে রাবণ বধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই দশমী তিথি বিজয়া দশমী। দশেরা উৎসব রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ-বিজয়ের উৎসব। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কৃত্তিবাস লিখেছেন,– ‘অকালে শরতে কৈল চণ্ডীর বোধন।’ আদিতে দুর্গাপূজা বসন্তকালেই অনুষ্ঠিত হতো, যে বাসন্তীপূজা আজও বর্তমান। এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য হলো,–
‘শারদীয়া পূজার উল্লেখ কালিকাপুরাণে (৬৫, ১) পাওয়া যায়। রামচন্দ্র কর্তৃক দেবীর অকালবোধনের কাহিনী বাল্মীকি রামায়ণে নেই, কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণেই তা সবিস্তারে উল্লিখিত আছে। কালিকাপুরাণ কৃত্তিবাসের পূর্ববর্তী, কাজেই কৃত্তিবাসের পূর্বেই শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রচলন ছিল। ষোড়শ শতকের স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর শ্রীদুর্গোৎসবতত্ত্বে দুর্গাপূজার নিয়ম কানুন বর্ণনা প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী লেখকদের মত উল্লেখ করেছেন। বাচস্পতি মিশ্র, শ্রীনাথ, শূলপাণি, জীমূতবাহন, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি নিবন্ধকারদের রচনার সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতকে শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং তার মৃন্ময় মূর্তির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। হয়ত তার আগেও ছিল কিন্তু সে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক অষ্টোত্তরশত বা একশত আটটি নীলপদ্মদ্বারা দুর্গা পূজার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। কালিকাপুরাণে এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণে এরকম অকাল বোধনের উল্লেখ আছে। যেমন, কালিকাপুরাণ (কাঃ পুঃ-৬০/২৬-২৭, ৩২)-এ বলা হয়েছে–
‘শারদীয়া পূজার উল্লেখ কালিকাপুরাণে (৬৫, ১) পাওয়া যায়। রামচন্দ্র কর্তৃক দেবীর অকালবোধনের কাহিনী বাল্মীকি রামায়ণে নেই, কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণেই তা সবিস্তারে উল্লিখিত আছে। কালিকাপুরাণ কৃত্তিবাসের পূর্ববর্তী, কাজেই কৃত্তিবাসের পূর্বেই শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রচলন ছিল। ষোড়শ শতকের স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর শ্রীদুর্গোৎসবতত্ত্বে দুর্গাপূজার নিয়ম কানুন বর্ণনা প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী লেখকদের মত উল্লেখ করেছেন। বাচস্পতি মিশ্র, শ্রীনাথ, শূলপাণি, জীমূতবাহন, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি নিবন্ধকারদের রচনার সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতকে শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং তার মৃন্ময় মূর্তির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। হয়ত তার আগেও ছিল কিন্তু সে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।’- (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)
মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক অষ্টোত্তরশত বা একশত আটটি নীলপদ্মদ্বারা দুর্গা পূজার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। কালিকাপুরাণে এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণে এরকম অকাল বোধনের উল্লেখ আছে। যেমন, কালিকাপুরাণ (কাঃ পুঃ-৬০/২৬-২৭, ৩২)-এ বলা হয়েছে–
রামস্যানুগ্রহার্থায় রাবণস্য বধায় চ।
রাত্রাবেব মহাদেবী ব্রহ্মণা বোধিতা পুরা।। ২৬
ততস্তু ত্যক্তনিদ্রা সা নন্দায়ামাশ্বিনে সিতে।
জগাম নগরীং লঙ্কাং যত্রাসীৎ রাঘবঃ পুরা।। ২৭
নিহতে রাবণে বীরে নবম্যাং সকলৈঃ সুরৈঃ।
বিশেষপূজাং দুর্গায়াশ্চক্রে লোকপিতামহঃ।। ৩২
অর্থাৎ– পুরাকালে রামের অনুগ্রহের এবং রাবণের বধের নিমিত্ত মহাদেবী রাত্রিতে ব্রহ্মার দ্বারা বোধিতা হয়েছিলেন। ২৬।। তারপর নিদ্রা ত্যাগ করে তিনি আশ্বিনের শুক্লপক্ষে যেখানে পূর্বে রাম ছিলেন, সেই লঙ্কা নগরীতে গমন করেছিলেন। ২৭।। বীর রাবণ নিহত হলে সকল দেবতার সঙ্গে পিতামহ ব্রহ্মা দুর্গার বিশেষ পূজা করেছিলেন। ৩২।।
তবে এখানে দেবীর পূজা রামচন্দ্র করেননি, করেছিলেন ব্রহ্মা। বৃহদ্ধর্মপুরাণেও দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা স্বয়ং। এখানে ব্রহ্মা পুরোহিতরূপে প্রার্থনা করেছিলেন (বৃহদ্ধর্ম, পূর্ব খণ্ড-২২/১৪-১৫)–
ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে তু শিবে বোধস্তব দেব্যাঃ কৃতো ময়া।। ১৪
তস্মাদদ্যাদ্রয়াযুক্ত নবম্যামাশ্বিনে শুভে।
রাবণস্য বধং যাবদর্চয়িষ্যামহে বয়ম্ ।। ১৫
অর্থাৎ– রাবণের বধ এবং রামের অনুগ্রহের নিমিত্ত হে শিবে তোমার বোধ আমি করেছি। ১৪।। সুতরাং শুভ আশ্বিন মাসে আদ্রা নক্ষত্রযুক্ত নবমী তিথিতে রাবণের বধ পর্যন্ত আমরা তোমার অর্চনা করবো। ১৫।।
এই বৃহদ্ধর্মপুরাণেই (বৃহদ্ধর্ম, পূর্ব খণ্ড-২২/২৬-২৭) দেবী বলেছিলেন, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে শুক্লাষ্টমী পর্যন্ত বিল্ববৃক্ষে তাঁর পূজা বিধেয় এবং সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত তাঁর পূজাকাল–
এবং পঞ্চদশাহনি মম পূজা মহোৎসবঃ।
অথ ত্রয়োদশাহনি বিল্বে মাং পূজয়েৎ কৃতী।।
সপ্তম্যাং গৃহমানীয় পূজয়েন্মাং দিনদ্বয়ম্ ।
অর্থাৎ– এইভাবে পনেরো দিন আমার পূজা মহোৎসব। অনন্তর তেরো দিন বিল্ববৃক্ষে কৃতী আমাকে পূজা করবে, সপ্তমীতে গৃহে এনে দু’দিন আমাকে পূজা করবে।
আর কৃত্তিবাস লিখেছেন,–
সায়াহ্ন কালেতে রাম করিল বোধন।
আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের অভিমত হলো,– ‘কোন প্রাচীন পুরাণে অকাল বোধনের উল্লেখ না থাকলেও অকাল বোধনের স্মৃতি হিসাবেই বাঙ্গালাদেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাল্মীকি প্রণীত রামায়ণে অকালবোধনের কোন উল্লেখ নেই। রামচন্দ্র রাবণ বধের পূর্বে দুর্গা পূজা করেন নি, ব্রহ্মাও করেন নি। রামচন্দ্র করেছিলেন আদিত্য হৃদয় স্তব অর্থাৎ সূর্যস্তব পাঠ। বাল্মীকির রামায়ণ রচনাকালে পৃথক দেবসত্তা হিসাবে দুর্গা-চণ্ডীর আবির্ভাব হয়নি। দেবী দুর্গা-চণ্ডী সূর্য ও অগ্নির তেজোরূপা বলেই সম্ভবতঃ সূর্যপূজার স্থলে দুর্গা পূজার রীতি প্রবর্তিত হয়েছে।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২২৪)
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, শরৎকালে দেবীর বোধনকে অকালবোধন বলা হয় কেন? ইতঃপূর্বেই আমরা দেখেছি, কালিকাপুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা রাত্রিতে দেবীর বোধন করেছিলেন। দেবতার অর্চনার পক্ষে রাত্রি নিশ্চয়ই অকাল। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, দেবীপূজার প্রকৃষ্ট সময় বসন্তকাল– চৈত্রমাসের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর বাসন্তী পূজার রীতি প্রচলিত আছে। ‘পূজাপার্বণ’-এর গ্রন্থকার আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে দুর্গা পূজা বৈদিক রুদ্রযজ্ঞের আধুনিক সংস্করণ, রুদ্রযজ্ঞের অগ্নিই দুর্গা। আবার কারও কারও ব্যাখ্যায়,– শাস্ত্রানুসারে ছয়মাস উত্তরায়ণ দেবতাদের একদিন ও ছয়মাস দক্ষিণায়ণ দেবতাদের এক রাত্রি। দক্ষিণায়ণ শুরু হলে বিষ্ণু শয়ন করেন; তখন শয়ন একাদশী হয়। দক্ষিণায়ণান্তে বিষ্ণুর উত্থান,– সে সময়ে উত্থান একাদশী হয়। দেবগণ রাত্রিতে অর্থাৎ দক্ষিণায়ণে নিদ্রিত থাকেন, দিনে অর্থাৎ উত্তরায়ণে জাগ্রত হন। উত্তরায়ণ তাই যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের প্রকৃষ্ট কাল। বিষ্ণুশক্তি বিষ্ণুমায়া দুর্গাও রাত্রিতে শায়িতা বা নিদ্রিতা থাকেন। তাই দক্ষিণায়ণকালে শরতে দেবীর উদ্বোধন বা জাগরণ বা অকালবোধন।
কিন্তু বৈদিক যুগে এক সময়ে যে শরৎকালে বৎসর শুরু হতো এবং সে কারণে বৎসর অর্থে ‘শরৎ’শব্দের প্রয়োগ বৈদিক সাহিত্যে যথা ঋগ্বেদ (ঋগ্বেদ-১০/১৬১/২-৪), অথর্ববেদ (অথর্ববেদ-১৯/৬৭/২-৪) ইত্যাদিতে বহুবার পাওয়া যায়। যেমন, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে–
কিন্তু বৈদিক যুগে এক সময়ে যে শরৎকালে বৎসর শুরু হতো এবং সে কারণে বৎসর অর্থে ‘শরৎ’শব্দের প্রয়োগ বৈদিক সাহিত্যে যথা ঋগ্বেদ (ঋগ্বেদ-১০/১৬১/২-৪), অথর্ববেদ (অথর্ববেদ-১৯/৬৭/২-৪) ইত্যাদিতে বহুবার পাওয়া যায়। যেমন, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে–
যদি ক্ষিতায়ুর্যদি বা পরেতো যদি মৃত্যোরন্তিকং নীত এব।
তমা হরামি নিঋর্রৃতেরুপস্থাদস্পার্ষমেনং শতশারদায়।। (ঋক-১০/১৬১/২)
শতং জীব শরদো বর্ধমানঃ শতং হেমন্তাঞ্জতমু বসন্তান্ ।
শতমিন্দ্রাগ্নী সবিতা বৃহস্পতিঃ শতায়ুষা হবিষেমং পুনর্দুঃ।। (ঋক-১০/১৬১/৪)
অর্থাৎ : যদিও এ রোগীর পরমায়ু ক্ষয় হয়ে থাকে অথবা যদি এ মরেও গিয়ে থাকে, যদি একেবারে মৃত্যুর নিকটেই গিয়ে থাকে তথাপি আমি মৃত্যুদেবতা নির্ঋতির নিকট হতে তাকে ফিরিয়ে আনছি। আমি একে এরূপ স্পর্শ করেছি যে এ ব্যক্তি একশত শরৎ (বৎসর) জীবিত থাকবে। ২।। হে রোগী! একশত শরৎকাল জীবিত থাক, সুখে সচ্ছন্দে একশত হেমন্ত, একশত বসন্ত জীবিত থাক। ইন্দ্র, অগ্নি, সবিতা ও বৃহস্পতি হব্যদ্বারা তৃপ্ত হয়ে একে একশত বৎসর পরমায়ু প্রদান করুন। ৪।।
অনুমান হয়, শরৎ প্রবেশে নববর্ষের সূচনায় রুদ্রযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে রুদ্র-ভগিনী অম্বিকার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ধ্বংসের দেবতা রুদ্রের ধ্বংস কার্যের সহায়িকা ছিলেন অম্বিকা। এই অম্বিকা কে? তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে (তৈঃ ব্রাঃ-১/১/৬-১০) শরৎকেই অম্বিকা বলা হয়েছে। যেমন–
করদ্বাস্যাম্বিকা স্বসা। তয়া বা এষ হিনস্তি। যং হিনস্তি তয়ৈবৈনং সহ শময়তি।
অর্থাৎ– শরৎ তাঁর (রুদ্রের) ভগিনী অম্বিকা। তাঁর সাহায্যে ইনি (রুদ্র) ধ্বংস করেন। তাঁর সাহায্যে যাঁকে ধ্বংস করেন, (যজ্ঞীয় পুরোডাশাদির দ্বারা) তুষ্টা হয়ে তিনিই তাঁকে (রুদ্রকে) শান্ত করেন।
শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে,– ‘আমরা শরৎকালে সুরথ রাজা এবং সমাধি বৈশ্যকর্তৃক দুর্গাপূজার উপাখ্যানের সহিত যুক্ত করিয়া অথবা শ্রীরামচন্দ্রের শরৎকালে অকালে দেবীর বোধনের সহিত যুক্ত করিয়া ইহার শারদীয়া বিশেষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া থাকি। বাজসনেয়-সংহিতায় আমরা রুদ্র-ভগিনী অম্বিকার উল্লেখ পাই। সেখানে ভগিনী অম্বিকার সহিত তাঁহাকে যজ্ঞ-ভাগ গ্রহণ করিতে বলা হইয়াছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও আমরা রুদ্র-ভগিনী অম্বিকার উল্লেখ পাই। শতপথ-ব্রাহ্মণেও অনুরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই। সেখানে বলা হইয়াছে,– “তিনি তাহা (এই মন্ত্রে) হোম করেন। হে রুদ্র, এই ভাগ তোমার, ভগিনী অম্বিকার সহিত তাহা সেবন কর! স্বাহা!” “অম্বিকা নামে ইহার ভগিনী (আছেন), তাঁহারই সহিত ইঁহার (রুদ্রের) এই ভাগ।” (৫/৩/৯)। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে আবার অম্বিকাকে রুদ্রের পত্নীরূপে দেখিতে পাইতেছি। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এবং কাঠক-সংহিতায় আবার দেখিতে পাই এই অম্বিকাকেই ‘শরৎ’ বলা হইয়াছে (শরদ্বৈ অম্বিকা)। এই শরৎ-রূপিণী অম্বিকার পূজাই হইল শারদীয়া পূজা।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৪-২৫)
এখানে আরেকটি বিষয়ে কৌতুহল হলো, রুদ্র কিভাবে অম্বিকার সাহায্যে ধ্বংস করেন? অম্বিকার ভূমিকা কী? এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের একটি উদ্ধৃতি– শুক্লযজুর্বেদের একটি মন্ত্রের (৩/৫৩) ব্যাখ্যায় আচার্য মহীধর লিখেছেন,–
যোহয়ং রুদ্রাখ্যো ক্রূরো দেবস্তস্য বিরোধিনং হন্তুমিচ্ছা ভবতি। তদানয়া ভগিন্যা ক্রূরদেবতয়া সাধনভূতয়া তং হিনস্তি সা চাম্বিকা শরদ্রূপং প্রাপ্য জ্বরাদিকমুৎপাদ্য তং বিরোধিনং হন্তি।
–(অস্যার্থ) এই যিনি রুদ্র নামক নিষ্ঠুর দেবতা, তাঁর বিরোধীকে হত্যা করতে ইচ্ছা করেন, তিনি এই ক্রূরা দেবী ভগিনীর সহায়তায় তাঁকে হত্যা করেন। সেই অম্বিকা শরদ্রূপ গ্রহণ করে জ্বর প্রভৃতি উৎপাদন করে বিরোধীকে হত্যা করেন।
অতএব, অধ্যাপক হংসনারায়ণের ব্যাখ্যা হলো,– ‘শরৎকালে নানা রোগের প্রাদুর্ভাবে দেশে মড়ক দেখা দিত। নববর্ষের সূচনায় নানা রোগের আবির্ভাবে বিব্রত আর্যমানব রুদ্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন সর্বজীবের কল্যাণ কামনায়। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, রুদ্রভগিনী-অম্বিকাই শরদ্রূপ ধারণ করে রুদ্রের ধ্বংসকার্যে রোগ সৃষ্টির দ্বারা সাহায্য করে থাকেন। তাই রুদ্রযজ্ঞে সূর্যাগ্নিরূপী রুদ্রের সঙ্গে রুদ্রতেজোরূপা অম্বিকাকেও পশু পুরোডাশ ইত্যাদির দ্বারা প্রসন্ন করার আয়োজন করা হোত। বর্ষগণনা রীতি পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু রুদ্রযজ্ঞের স্মৃতি রয়ে গেল। শরতে বর্ষারম্ভ না হওয়ায় হয়ে গেল অকাল। রুদ্রযজ্ঞের স্থলাভিষিক্ত হোল রুদ্রশক্তি রুদ্রাণীর পূজার্চনা। যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে দুর্গোৎসব প্রকৃতপক্ষে নববর্ষের উৎসব। গৃহসজ্জা, নববস্ত্র পরিধান, উৎকৃষ্ট দ্রব্য ভোজন, আত্মীয়-বন্ধুদের প্রতি প্রীতিসম্ভাষণ, আলিঙ্গন, গুরুজনদের আশীর্বাদ গ্রহণ প্রভৃতি নববর্ষের অঙ্গীভূত।’– (হিন্দুদের দেবদেবী, পৃষ্ঠা-২২৬)
‘এখানে লক্ষ্য করিতে হইবে, শরৎকাল হইতে বাঙলাদেশের শস্যঋতুর আরম্ভ; দেবীপূজার আরম্ভও তাই শরৎকালে। আমাদের শস্যঋতুর শেষ প্রকৃতপক্ষে বসন্তের শেষে; আবার লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইব, এই শরৎ হইতে বসন্ত পর্যন্তই হইল বাঙলাদেশে সর্বপ্রকারের দেবীপূজার কাল; শারদীয়া অম্বিকাপূজা-দ্বারা দেবীপূজার আরম্ভ; তার পরে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, বাসন্তীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজায় বাৎসরিক দেবীপূজার শেষ।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫)
‘এখানে লক্ষ্য করিতে হইবে, শরৎকাল হইতে বাঙলাদেশের শস্যঋতুর আরম্ভ; দেবীপূজার আরম্ভও তাই শরৎকালে। আমাদের শস্যঋতুর শেষ প্রকৃতপক্ষে বসন্তের শেষে; আবার লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইব, এই শরৎ হইতে বসন্ত পর্যন্তই হইল বাঙলাদেশে সর্বপ্রকারের দেবীপূজার কাল; শারদীয়া অম্বিকাপূজা-দ্বারা দেবীপূজার আরম্ভ; তার পরে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, বাসন্তীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজায় বাৎসরিক দেবীপূজার শেষ।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫)
দুর্গাপূজার ভেতরেও দেখা যায়, পূজার প্রথম অঙ্গ হলো ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন। এই বোধনের সময়ে দেবীর প্রতীক কী? দেবী সেখানে বিল্বশাখা। এর তাৎপর্য কী? এর পরেই দেখা যায়, দেবীর স্নান, প্রতিষ্ঠা এবং পূজা হলো নবপত্রিকায়। এই নবপত্রিকা কী? নবপত্রিকা বলতে নয়টি গাছকে বোঝানো হয়। একটি সপত্র কলা গাছের সঙ্গে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে, শ্বেত অপরাজিতা লতার দ্বারা বেষ্টন করে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে এই নবপত্রিকা প্রস্তুত করা হয়। দুর্গাপূজায় গণেশের পাশে দেবীমূর্তির ডানদিকে এই নবপত্রিকা স্থাপনের বিধি দুর্গপূজা পদ্ধতিগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। এজন্যেই হয়তো কেউ কেউ ভুল করে এই শস্য-বধূ নবপত্রিকাকে গণেশের বৌ বলে থাকেন। নবপত্রিকার নয়টি গাছের নাম হলো– কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, সাধারণ কচু, বেল, অশোক ও জয়ন্তী। নব্য স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য রচিত ‘তিথিতত্ত্বে’র একটি শ্লোকে এই নবপত্রিকার পরিচয় দেয়া হয়েছে–
‘কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ।
বিল্বাশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা।।’
এই নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে পূজিতা হন– উদ্ভিদগুলি দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে গণ্য হয়। এই নয় দেবী হলেন– রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা ও জয়ন্তাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী। নয়টি উদ্ভিদের একত্র অবস্থান নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিতা হয়। নবপত্রিকা সম্পর্কে পণ্ডিতেরা প্রায় সমস্বরে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে নবপত্রিকা শস্যদেবীর পূজা। শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী–
‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। দূর্গাপূজাবিধিতে দেখিতে পাই রম্ভার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন ব্রাহ্মণী, কচুর কালিকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্তিকী, বিল্বের শিবা, দাড়িম্বের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন লক্ষ্মী। নবপত্রিকার শস্যসমূহের দেবীর সহিত যোগের ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে; দেবী হরিদ্রাবর্ণ বলিয়া হরিদ্রার দেবীত্ব, তিনি জয়রূপিণী বলিয়া জয়ন্তী, মানদায়িনী বলিয়া মানের সহিত তাঁহার যোগ; বিল্ব শঙ্কর-প্রিয় বলিয়া দেবীর স্বরূপত্ব লাভ করিয়াছে; দেবী শোকরহিতা বলিয়া অশোকে তাঁহার অধিষ্ঠান; জীবের প্রাণদায়িনীরূপে দেবী ধান্যরূপা; দেবী অসুর-বিনাশকালে দাড়িম্ববীজের ন্যায় রক্তদন্তবিশিষ্টা হইয়া রক্তদন্তিকা নামে খ্যাতা– এইজন্য দাড়িম্বেও দেবীর অধিষ্ঠান। বলা বাহুল্য, এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদি-মাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিলিয়া আছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
শবর প্রভৃতি জাতির মধ্যে প্রচলিত শস্যোৎসব থেকে দুর্গাপূজার এই অঙ্গটি আসতে পারে বলে যোগেশচন্দ্র রায় মহাশয় অনুমান করেন– ‘বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে। মানুষের স্বভাব– যেটা কোথাও হয়, সেটা অন্যত্র প্রচারিত হয়।’- (পূজাপার্বণ)
‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। দূর্গাপূজাবিধিতে দেখিতে পাই রম্ভার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন ব্রাহ্মণী, কচুর কালিকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্তিকী, বিল্বের শিবা, দাড়িম্বের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন লক্ষ্মী। নবপত্রিকার শস্যসমূহের দেবীর সহিত যোগের ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে; দেবী হরিদ্রাবর্ণ বলিয়া হরিদ্রার দেবীত্ব, তিনি জয়রূপিণী বলিয়া জয়ন্তী, মানদায়িনী বলিয়া মানের সহিত তাঁহার যোগ; বিল্ব শঙ্কর-প্রিয় বলিয়া দেবীর স্বরূপত্ব লাভ করিয়াছে; দেবী শোকরহিতা বলিয়া অশোকে তাঁহার অধিষ্ঠান; জীবের প্রাণদায়িনীরূপে দেবী ধান্যরূপা; দেবী অসুর-বিনাশকালে দাড়িম্ববীজের ন্যায় রক্তদন্তবিশিষ্টা হইয়া রক্তদন্তিকা নামে খ্যাতা– এইজন্য দাড়িম্বেও দেবীর অধিষ্ঠান। বলা বাহুল্য, এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদি-মাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিলিয়া আছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
শবর প্রভৃতি জাতির মধ্যে প্রচলিত শস্যোৎসব থেকে দুর্গাপূজার এই অঙ্গটি আসতে পারে বলে যোগেশচন্দ্র রায় মহাশয় অনুমান করেন– ‘বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে। মানুষের স্বভাব– যেটা কোথাও হয়, সেটা অন্যত্র প্রচারিত হয়।’- (পূজাপার্বণ)
সন্ধিপূজা : পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সাথে শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলিয়ে নেয়ার যে সচেতন প্রচেষ্টা, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত মনে হয় সন্ধিপূজার অনুষ্ঠান। দুর্গাপূজায় অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে দেবীর যে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠান হয় তা-ই সন্ধিপূজা নামে প্রসিদ্ধ। লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী এই সময়ে প্রতিমায় আবির্ভূতা হন। সন্ধিপূজার বিশেষ মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে বৃহদ্ধর্মপুরাণে। এই পুরাণানুসারে (বৃহদ্ধর্মপুরাণ-পূর্বখণ্ড-২২/২০-২৫),–
‘ব্রহ্মা রাবণ বধের নিমিত্ত দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমীতে। দেবী চণ্ডিকা জাগ্রত হয়ে রাক্ষস নিধনের বর দিয়েছিলেন। তাঁর বরে কৃষ্ণানবমীতে কুম্ভকর্ণ, ত্রয়োদশীতে লক্ষ্মণের অস্ত্রে অতিকায়, অমাবস্যার রাত্রিতে লক্ষ্মণ কর্তৃক ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, প্রতিপদে মকরাক্ষ ও দ্বিতীয়াতে দেবান্তক প্রভৃতি রাক্ষস নিহত হবে। সপ্তমীতে দেবী শ্রীরামের অস্ত্রে প্রবেশ করবেন, অষ্টমীতে রাম-রাবণের যুদ্ধ প্রবল রূপ ধারণ করবে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের শিরসমূহ ছিন্ন হবে, আর সেই শির পুনর্যোজিত হলে নবমীতে রাবণ নিহত হবে।’
এই দেবীদত্ত বর অনুসারে– বৃহদ্ধর্মপুরাণ-২২/৪৮-এ বলা হয়েছে– রামচন্দ্র অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড ছিন্ন করেছিলেন– ‘পাতয়ামাস দশ বৈ মস্তকান্ কালসন্ধিকে।’
এবং সেজন্যই বৃহদ্ধর্মপুরাণে সন্ধিপূজার মাহাত্ম্য প্রকাশ করতে গিয়ে দেবী বলেছেন যে, অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণের পূজার মহিমা খুব বেশি–
‘ব্রহ্মা রাবণ বধের নিমিত্ত দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমীতে। দেবী চণ্ডিকা জাগ্রত হয়ে রাক্ষস নিধনের বর দিয়েছিলেন। তাঁর বরে কৃষ্ণানবমীতে কুম্ভকর্ণ, ত্রয়োদশীতে লক্ষ্মণের অস্ত্রে অতিকায়, অমাবস্যার রাত্রিতে লক্ষ্মণ কর্তৃক ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, প্রতিপদে মকরাক্ষ ও দ্বিতীয়াতে দেবান্তক প্রভৃতি রাক্ষস নিহত হবে। সপ্তমীতে দেবী শ্রীরামের অস্ত্রে প্রবেশ করবেন, অষ্টমীতে রাম-রাবণের যুদ্ধ প্রবল রূপ ধারণ করবে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের শিরসমূহ ছিন্ন হবে, আর সেই শির পুনর্যোজিত হলে নবমীতে রাবণ নিহত হবে।’
এই দেবীদত্ত বর অনুসারে– বৃহদ্ধর্মপুরাণ-২২/৪৮-এ বলা হয়েছে– রামচন্দ্র অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড ছিন্ন করেছিলেন– ‘পাতয়ামাস দশ বৈ মস্তকান্ কালসন্ধিকে।’
এবং সেজন্যই বৃহদ্ধর্মপুরাণে সন্ধিপূজার মাহাত্ম্য প্রকাশ করতে গিয়ে দেবী বলেছেন যে, অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণের পূজার মহিমা খুব বেশি–
অষ্টমীনবমীসন্ধিকালোহয়ং বৎসরাত্মকঃ।
তত্রৈব নবমীভাগঃ কালঃ কল্পাত্মকো মম।।– (বৃহদ্ধর্মপুরাণ-২২/২৯)
অর্থাৎ– অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণের পূজা এক বৎসরের পূজার তুল্য,– তার মধ্যে নবমীভাগে পূজা কল্পকাল পূজার তুল্য।
আর এই মাহাত্ম্যের অন্য প্রেক্ষিতটি আমরা জানতে পারি যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির অভিমত থেকে। তাঁর মতে শরৎঋতুর সূচনা লগ্ন ছিল বৈদিক যুগে অষ্টমী নবমীর সন্ধিতে– ‘হিম বৎসরের আট চান্দ্রমাস গতে অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে শরৎ ঋতুর আরম্ভ। এই কারণে দুর্গাপূজায় সন্ধিক্ষণের মাহাত্ম্য হইয়াছে।’– (পূজাপার্বণ, পৃষ্ঠা-৯৪)
কুমারীপূজা : দুর্গাপূজার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো কুমারীপূজা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী– এই তিনদিনই দেবীপূজার অন্তে কোন কুমারী বালিকাকে নূতন বস্ত্র পরিধান করিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করার রীতি। যদিও বর্তমানে এই তিনদিনের প্রতিদিন এবং সর্বত্র এই পূজা হয় না। কালিকাপুরাণে কুমারীপূজার ধ্যানমন্ত্র হলো–
বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবর্ণিনীম্ ।
নানালংকার নম্রাঙ্গীং ভদ্রবিদ্যাপ্রকাশিনীম্ ।।
চারুহাস্যাং মহানন্দহৃদয়াং শুভদাং শুভাম্ ।
ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিণীম্ ।।
এই মন্ত্রে কুমারীরূপিণী দেবীর পূজা করা হয়, দেবী দুর্গা কুমারী নামে প্রসিদ্ধা। বৃহদ্ধর্মপুরাণে দেখা যায়, দেবতাদের স্তবে প্রীতা হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূতা হয়ে বিল্ববৃক্ষে দেবীর বোধন করতে বলেছিলেন– ‘কন্যারূপেণ দেবানামগ্রতো দর্শনং দদৌ।’ –(বৃহঃ-পুরাণ-পূর্বখ–২১/৬২)
দেবীপুরাণ মতে, দেবীর পূজার পর উপযুক্ত উপচারে কুমারীদের ভোজনে তৃপ্ত করার নির্দেশনায় বলা হয়েছে–
দেবীপুরাণ মতে, দেবীর পূজার পর উপযুক্ত উপচারে কুমারীদের ভোজনে তৃপ্ত করার নির্দেশনায় বলা হয়েছে–
নৈবেদ্যং শালিজং ভক্তং শর্করা কন্যকাস্বপি। –(দেবীপুরাণ-৩৩/৯১)
অর্থাৎ– শালিচালের ভাত, শর্করা (মিষ্টান্ন) প্রভৃতির নৈবেদ্য দ্বারা কুমারীদের ভোজন করাবে।
দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা সংযুক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে তান্ত্রিক সাধনা থেকে। তান্ত্রিক মতে কুমারী দেবীর প্রতীক। তাই যে-কোন প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠে কুমারীপূজার রীতি। কামরূপ কামাখ্যার মন্দিরে নিয়মিত কুমারীপূজা করা হয়ে থাকে। কুমারীপূজার প্রাধান্য থেকেই বাঙলাদেশে ‘গৌরীদান’ প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্রসারে কুমারীপূজার স্বপক্ষে জ্ঞানার্ণবতন্ত্রের বচন উদ্ধার করেছেন–
হোমাদিকং হি সকলং কুমারী পূজনং বিনা।
পরিপূর্ণফলং ন স্যাৎ পূজয়া তদ্ ভবেদ্ ধ্রুবম্ ।
কুমারীপূজয়া দেবী ফলং কোটিগুণং ভবেৎ।।
পুষ্পং কুমার্যৈ যদ্দত্তং তন্মেরুসদৃশং ফলম্ ।
কুমারী ভোজিতা যেন ত্রৈলোক্যং তেন ভোজিতম্ ।। –(তন্ত্রসার)
অর্থাৎ– কুমারী পূজা ছাড়া হোম প্রভৃতি সকল কর্ম পরিপূর্ণ ফললাভ করে না। কুমারীপূজায় সেই ফল অবশ্যই লাভ হয়। কুমারীকে পুষ্প দিলে তার ফল হয় মেরুপর্বত সমান, কুমারীকে ভোজন করালে ত্রিলোককে ভোজন করান হয়।
এই তন্ত্রসারেই দেখি দেবী শিবকে বলছেন–
কুমারিকা হ্যহং নাথ সদা ত্বং কুমারিকা। -(তন্ত্রসার)
অর্থাৎ– হে নাথ, আমিও কুমারী তুমিও কুমারী। (অর্থাৎ সকল কুমারীই শিব-পার্বতীর অংশ।)
আবার তন্ত্রসারে বলা হচ্ছে–
কুমারী যোগিনী সাক্ষাৎকুমারী পরদেবতা। –(তন্ত্রসার)
অর্থাৎ– কুমারী সাক্ষাৎ যোগিনী, কুমারী পরদেবতা।
এবং মহানবমীতে কুমারীপূজার বিধান তন্ত্রসারেই আছে এভাবে– ‘মহানবম্যাং দেবেশি কুমারীং চ প্রপূজয়েৎ।’
এখানে উল্লেখ্য, তন্ত্র মতে– এক বৎসর থেকে ষোল বৎসর পর্যন্ত বালিকারা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারীরূপে পূজিত হওয়ার যোগ্য। একেক বর্ষীয়া কুমারীদের একেক নাম রয়েছে। যেমন–
‘একবৎসরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, দ্বিবর্ষা কন্যা সরস্বতী, তিনবৎসরের ত্রিধামূর্তি, চতুবর্ষা কালিকা, পঞ্চবর্ষা সুভগা, ষড়্বর্ষা উমা, সপ্তবর্ষা মালিনী, অষ্টবর্ষা কুব্জিকা, নববর্ষীয়া কন্যার নাম কালসন্দর্ভা, দশমবর্ষীয়া অপরাজিতা, একাদশবর্ষীয়া কন্যা রুদ্রাণী, দ্বাদশবর্ষা ভৈরবী, ত্রয়োদশবর্ষীয়া মহালক্ষ্মী, চতুর্দশবর্ষীয়া পীঠনায়িকা, পঞ্চদশবৎসরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোড়শবর্ষীয়া কুমারী অম্বিকা।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, পৃষ্ঠা-২৩৮-৩৯)
এখানে উল্লেখ্য, তন্ত্র মতে– এক বৎসর থেকে ষোল বৎসর পর্যন্ত বালিকারা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারীরূপে পূজিত হওয়ার যোগ্য। একেক বর্ষীয়া কুমারীদের একেক নাম রয়েছে। যেমন–
‘একবৎসরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, দ্বিবর্ষা কন্যা সরস্বতী, তিনবৎসরের ত্রিধামূর্তি, চতুবর্ষা কালিকা, পঞ্চবর্ষা সুভগা, ষড়্বর্ষা উমা, সপ্তবর্ষা মালিনী, অষ্টবর্ষা কুব্জিকা, নববর্ষীয়া কন্যার নাম কালসন্দর্ভা, দশমবর্ষীয়া অপরাজিতা, একাদশবর্ষীয়া কন্যা রুদ্রাণী, দ্বাদশবর্ষা ভৈরবী, ত্রয়োদশবর্ষীয়া মহালক্ষ্মী, চতুর্দশবর্ষীয়া পীঠনায়িকা, পঞ্চদশবৎসরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোড়শবর্ষীয়া কুমারী অম্বিকা।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, পৃষ্ঠা-২৩৮-৩৯)
দেবীর কুমারী নাম বহু প্রাচীন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে এবং নারায়ণী-উপনিষদেও দেবীকে কন্যা ও কুমারী বলা হয়েছে এভাবে–
কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারি ধীমহি। তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ।
–(তৈঃ আঃ-১০/২, নারাঃ-উপঃ-২/১/৩৪)
অর্থাৎ– হে দুর্গে, তুমি কন্যা ও কুমারী, কাত্যায়নকে জানি, তোমাকে ধ্যান করি, তুমি আমাদের প্রেরণ কর।
মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রে দেবী কুমারী, কৌমার্য-ব্রত ধারিণী–
নমোহস্তু বরদে কৃষ্ণে কুমারি ব্রহ্মচারিণি। –(মহাঃ-বিরাটপর্ব-৬/৭)
কৌমারং ব্রতমাস্থায় ত্রিদিবং পালিতং ত্বয়া। –(মহাঃ-বিরাটপর্ব-৬/১৪)
কুমারি কালি কাপালি কপিলে কৃষ্ণ পিঙ্গলে। –(মহা:-ভীষ্মপর্ব-২১/৪)
আবার শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী চণ্ডীও কুমারী–
কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমোহস্তু তে। –(চণ্ডী-১১/১৫)
অর্থাৎ– অপাপবিদ্ধা (নিত্যশুদ্ধা) ও কুমার-শক্তিরূপিণী হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম।
আর দেবীপুরাণ দেবীর কৌমারী নামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন–
কুমার-রূপধারী চ কুমার-জননী তথা।
কুমার-রিপুহন্ত্রী চ কৌমারী তেন সা স্মৃতা। –(দেবীপুরাণ-৩৭/৮৫)
অর্থাৎ– কুমার রূপ ধারণ করেন, কুমারের জননী, কুমার রিপুনাশিনী বলেই তিনি কৌমারী নামে স্মৃতা।
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে কন্যাকুমারী নামক বিখ্যাত পীঠে দেবীর কন্যাকুমারী বিগ্রহ দেবীর কুমারী নামের সার্থকতা প্রতিপাদন করে।– ‘খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লিখিত ‘Periplus of the Erythraean Sea’ গ্রন্থে কুমারিকা অন্তরীপে কন্যা কুমারী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।… এখানে শুধু যে কন্যা কুমারী দেবীর ইঙ্গিত পাই তা নয়, দেবীর উপাসক উপাসিকারও উল্লেখ পাওয়া যায়। ছত্রিশগড় অঞ্চলে কুমারী মেয়েরা ভাদ্রের কৃষ্ণাষ্টমী থেকে আশ্বিনের শুক্লানবমী পর্যন্ত সতেরো দিন ব্যাপী একবেলা উপবাস করে ‘কুমারী ওষা’ নামক ব্রত পালন করে। বিজয়চন্দ্র মজুমদারের মতে (প্রবাসী, আশ্বিন ১৩২৯) এই ব্রত অনার্যসংস্কৃতি থেকে আগত।’– (হিন্দুদের দেবদেবী, পৃষ্ঠা-২৩৯-৪০)
দেবী মহাশক্তিকে কুমারী বলার বিশেষ তাৎপর্য উল্লেখ করে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি লিখেছেন,– ‘দুর্গা কুমারী। তাঁহার পুত্রকন্যা নাই। এই কারণে দুর্গা পূজায় কুমারী-পূজা বিহিত হইয়াছে।’– (পূজাপার্বণ)
এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক হংসানারায়ণ ভট্টাচার্যের বর্ণনায়– ‘দেবতেজঃসম্ভূতা চণ্ডী অবশ্যই কুমারী। তিনি শিব-ভার্যাও নন, গণেশ কার্তিকেয়ের জননীও নন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে উমা-পার্বতী শিব-জায়া হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে পুত্রকন্যার জননী নন। কার্তিকেয়ও তাঁর গর্ভজাত পুত্র নন। তথাপি প্রচলিত অর্থে শিবের বিবাহিতা হিসাবে তাঁকে কুমারী বলা যায় না।’ –(হিন্দুদের দেবদেবী-তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২৪০)
প্রকৃতপক্ষে বৈদিক, পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ধর্মোপাসনার রীতি বিভিন্নভাবে একত্র সম্মিলিত হয়েছে দুর্গাপূজায়।
দেবী মহাশক্তিকে কুমারী বলার বিশেষ তাৎপর্য উল্লেখ করে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি লিখেছেন,– ‘দুর্গা কুমারী। তাঁহার পুত্রকন্যা নাই। এই কারণে দুর্গা পূজায় কুমারী-পূজা বিহিত হইয়াছে।’– (পূজাপার্বণ)
এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক হংসানারায়ণ ভট্টাচার্যের বর্ণনায়– ‘দেবতেজঃসম্ভূতা চণ্ডী অবশ্যই কুমারী। তিনি শিব-ভার্যাও নন, গণেশ কার্তিকেয়ের জননীও নন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে উমা-পার্বতী শিব-জায়া হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে পুত্রকন্যার জননী নন। কার্তিকেয়ও তাঁর গর্ভজাত পুত্র নন। তথাপি প্রচলিত অর্থে শিবের বিবাহিতা হিসাবে তাঁকে কুমারী বলা যায় না।’ –(হিন্দুদের দেবদেবী-তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২৪০)
প্রকৃতপক্ষে বৈদিক, পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ধর্মোপাসনার রীতি বিভিন্নভাবে একত্র সম্মিলিত হয়েছে দুর্গাপূজায়।
শারদীয়া-প্রতিমার প্রাচীনত্ব : বাঙলায় শারদীয় দুর্গাপ্রতিমায় যে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ সহ মহিষমর্দিনীকে উপস্থাপিত করা হয় তা কতো প্রাচীন বলা যায় না। প্রসিদ্ধ ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে মহাশয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য অনুযায়ী– ‘যে প্রথায় প্রতি বৎসর আশ্বিন-কার্তিক মাসে বঙ্গদেশের সর্বত্র দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাদেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি অনেকদিন ধরিয়া পূজাপূর্বক বিজয়া দশমীতে বিসর্জন দেওয়া হয়, উহার সমধিক প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে ঠিক করিয়া কিছু বলা যায় না। বঙ্গদেশে এবং অন্যত্র আদি-মধ্যযুগ হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর-মধ্যযুগ পর্যন্ত যে সকল প্রস্তর বা ধাতু-নির্মিত মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে, উহাতে সচরাচর মহিষাসুরের সহিত যুদ্ধরত অবস্থায় দশপ্রহরণধারিণী দেবীকে এবং দেবীর বাহন সিংহ ও কর্তিতশির মহিষের দেহ হইতে নির্গমনশীল নররূপী অসুরকে দেখানো হইয়া থাকে। বাংলার শারদীয়া দুর্গাপ্রতিমায় যেরূপ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে অতিরিক্ত পরিবার দেবতা রূপে দেখানো হয়, সেরূপ কোনও প্রাচীন ধাতু বা প্রস্তরনির্মিত মূর্তি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু ইহা মনে রাখিতে হইবে যে শারদীয়া মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমা প্রতি বৎসর পূজার পর জলে বিসর্জিত করা, এবং পূর্ব পূর্ব বৎসরের ‘কাঠামো’র উপর নূতন করিয়া নির্মাণ করাই বিধি। সুতরাং এরূপ মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ ও পূজাশৈলী যে কত প্রাচীন উহার প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ সংগ্রহ করা অসম্ভব। এ বিষয়ে আমাদিগকে সাহিত্যগত সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিতে হইবে। দেবীমাহাত্ম্যে লিখিত আছে যে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য ঋষি মেধসের নিকট হইতে মহামায়া-দুর্গাতত্ত্ব সবিশেষ জানিয়া নদীতীরে গমন করেন, এবং সেখানে অবস্থানপূর্বক জগন্মাতার দর্শনলাভ কামনায় শ্রেষ্ঠ জপ দেবীসূক্ত পাঠ করিয়া ও সেই নদীতটে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করিয়া পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্যাদির দ্বারা পূজা করেন (মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ৯২ অধ্যায়, শ্লোকসংখ্যা ৯-১১)। এখানে ‘মহীময়ী মূর্তি’ পূজার কথা আছে সত্য, কিন্তু মূর্তি ও মূর্তি-পরিবারাদির কোনও বর্ণনা নাই। রাজা ও বৈশ্য তিন বৎসর এইরূপ পূজা করিয়া তবে দেবীর দর্শন পাইয়াছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ হইতে জানা যায় যে পূজাশেষে তাঁহারা মৃন্ময়ী প্রতিমা নদীতে বিসর্জন দিয়াছিলেন। মৃন্ময়ী মূর্তি ক্ষণিক পর্যায়ের, এবং ইহা নদীজলে বিসর্জিত করাই স্বাভাবিক। সুরথ রাজার দেবীপূজার সময় শরৎকালে ছিল না, উহা বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল বলিয়া কিংবদন্তী। আজিও ইহার অনুকল্প রূপে বসন্তকালে বাসন্তী নামে দেবীর পূজা বাংলাদেশে অল্প প্রচলিত আছে। শরৎকালে দেবীর যে পূজা ব্যাপকভাবে এ দেশে প্রচলিত উহার অন্যতম প্রথম উল্লেখ আমরা কালিকাপুরাণে পাই। ইহার পঞ্চষষ্ঠীতম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোক এইরূপ–
শরৎকালে পুরা যস্মান্নবম্যাং বোধিতা সুরৈঃ।
শারদা সা সমাখ্যাতা পীঠে লোকে চ মানব।।
(যেহেতু পূর্বে শরৎকালে দেবগণ কর্তৃক মহাদেবী বোধি হইয়াছিলেন, সেই নিমিত্ত পীঠস্থানে এবং লোকমধ্যে তিনি শারদা নামে বিখ্যাত হন।)
এখানে দেবগণ কর্তৃক তাঁহার শরৎকালে বোধনের কথা বলা হইয়াছে, কৃত্তিবাস কথিত শ্রীরামচন্দ্রের দ্বারা অকালে তাঁহার বোধনের কথা নাই। …বঙ্গদেশীয় শারদীয়া পূজার অন্যতম ভিত্তি কৃত্তিবাসী রামায়ণ। কালিকাপুরাণ বাংলাদেশেই রচিত হইয়াছিল বলিয়া অনেকের বিশ্বাস। ইহার রচনাকাল কৃত্তিবাসের পূর্বে; ইহাতে শারদীয়া পূজার কথা আছে, কিন্তু দেবতাদিগকেই এই পূজার প্রথম প্রবর্তক বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে।’
‘রঘুনন্দন প্রমুখ প্রসিদ্ধ বঙ্গদেশীয় স্মৃতিনিবন্ধকারদিগের গ্রন্থে আমরা শারদীয় দুর্গোৎসবের বিবরণ পাই। স্মার্ত রঘুনন্দন খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। তাঁহার অষ্টাবিংশতি তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত শ্রীদুর্গোৎসবতত্ত্বে তাঁহার পূর্ববর্তী গ্রন্থকার ও পূর্বপ্রচলিত প্রবচনাদির উপর নির্ভর করিয়া তিনি পূজা-পদ্ধতি সম্বন্ধে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে তিনি এতৎসম্পর্কিত অনেক উপাদান সংগ্রহ করেন। বাচস্পতি মিশ্র, শ্রীনাথ, শূলপাণি, জীমূতবাহন, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি রঘুনন্দনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নিবন্ধকারগণ তাঁহাদের দুর্গাপূজা সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিপূজার পদ্ধতি লিখিয়া গিয়াছেন। খৃষ্টীয় চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি তাঁহার দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী নামক গ্রন্থেও দেবীর এইরূপ মূর্তির পূজার্চনার কথা লিখিয়াছেন। শূলপাণি ও জীমূতবাহন একই সময়ে বর্তমান ছিলেন। শূলপাণি তাঁহার দুর্গোৎসববিবেক, বাসন্তীবিবেক এবং দুর্গোৎসবপ্রয়োগ নামক তিনটি নিবন্ধে জীকন ও বালক নামক তাঁহার পূর্ববর্তী নিবন্ধকার দুইজনের এতৎসম্পর্কিত উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন। জীকন ও বালক বাঙ্গালী ছিলেন; তাঁহাদের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা না গেলেও, ইহা বলা যায় যে তাঁহারা বাংলার অন্যতম প্রাচীন স্মৃতিনিবন্ধকার ভবদেব ভট্টের পূর্ববর্তী ছিলেন। রাজা হরিবর্মদেবের (খৃষ্টীয় একাদশ শতক) প্রধান মন্ত্রী ভবদেব ভট্ট তাঁহার নিবন্ধাবলীতে জীকন, বালক এবং আর একজন প্রাচীন গ্রন্থকার শ্রীকরের অনেক উক্তির আলোচনা করিয়াছেন। এই সকল তথ্য আমাদিগকে জানাইয়া দেয় যে মৃন্ময়ী প্রতিমায় দেবীর পূজার্চন বাংলাদেশে ন্যূনাধিক সহস্র বৎসর ধরিয়া প্রচলিত আছে। তবে দেবীর ও তাঁহার পরিবারাদির রূপায়ণে যে এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে কোনও পরিবর্তন আনীত হয় নাই ইহা বলা যায় না। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ যেভাবে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত দেবীর পরিবার-দেবতা রূপে প্রদর্শিত হইতেন, এবং এখনও কোনও কোনও প্রাচীনতন্ত্রী প্রতিমাতে প্রদর্শিত হন, উহা যে ঠিক কোন সময়ে প্রথম প্রচলিত হয় সে বিষয়ে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না।’- (পঞ্চোপাসনা, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)
‘রঘুনন্দন প্রমুখ প্রসিদ্ধ বঙ্গদেশীয় স্মৃতিনিবন্ধকারদিগের গ্রন্থে আমরা শারদীয় দুর্গোৎসবের বিবরণ পাই। স্মার্ত রঘুনন্দন খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। তাঁহার অষ্টাবিংশতি তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত শ্রীদুর্গোৎসবতত্ত্বে তাঁহার পূর্ববর্তী গ্রন্থকার ও পূর্বপ্রচলিত প্রবচনাদির উপর নির্ভর করিয়া তিনি পূজা-পদ্ধতি সম্বন্ধে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে তিনি এতৎসম্পর্কিত অনেক উপাদান সংগ্রহ করেন। বাচস্পতি মিশ্র, শ্রীনাথ, শূলপাণি, জীমূতবাহন, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি রঘুনন্দনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নিবন্ধকারগণ তাঁহাদের দুর্গাপূজা সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিপূজার পদ্ধতি লিখিয়া গিয়াছেন। খৃষ্টীয় চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি তাঁহার দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী নামক গ্রন্থেও দেবীর এইরূপ মূর্তির পূজার্চনার কথা লিখিয়াছেন। শূলপাণি ও জীমূতবাহন একই সময়ে বর্তমান ছিলেন। শূলপাণি তাঁহার দুর্গোৎসববিবেক, বাসন্তীবিবেক এবং দুর্গোৎসবপ্রয়োগ নামক তিনটি নিবন্ধে জীকন ও বালক নামক তাঁহার পূর্ববর্তী নিবন্ধকার দুইজনের এতৎসম্পর্কিত উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন। জীকন ও বালক বাঙ্গালী ছিলেন; তাঁহাদের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা না গেলেও, ইহা বলা যায় যে তাঁহারা বাংলার অন্যতম প্রাচীন স্মৃতিনিবন্ধকার ভবদেব ভট্টের পূর্ববর্তী ছিলেন। রাজা হরিবর্মদেবের (খৃষ্টীয় একাদশ শতক) প্রধান মন্ত্রী ভবদেব ভট্ট তাঁহার নিবন্ধাবলীতে জীকন, বালক এবং আর একজন প্রাচীন গ্রন্থকার শ্রীকরের অনেক উক্তির আলোচনা করিয়াছেন। এই সকল তথ্য আমাদিগকে জানাইয়া দেয় যে মৃন্ময়ী প্রতিমায় দেবীর পূজার্চন বাংলাদেশে ন্যূনাধিক সহস্র বৎসর ধরিয়া প্রচলিত আছে। তবে দেবীর ও তাঁহার পরিবারাদির রূপায়ণে যে এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে কোনও পরিবর্তন আনীত হয় নাই ইহা বলা যায় না। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ যেভাবে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত দেবীর পরিবার-দেবতা রূপে প্রদর্শিত হইতেন, এবং এখনও কোনও কোনও প্রাচীনতন্ত্রী প্রতিমাতে প্রদর্শিত হন, উহা যে ঠিক কোন সময়ে প্রথম প্রচলিত হয় সে বিষয়ে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না।’- (পঞ্চোপাসনা, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)
শাবরোৎসব : শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের কথা ইতঃপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনিই প্রথম সবার নজরে আনেন যে, বঙ্গদেশের দুর্গাপূজা আসলে শস্যদেবীর পূজা, যা অনুষ্ঠিত হয় তান্ত্রিক সর্বতোভদ্রমণ্ডল যন্ত্রে ও নবপত্রিকায়, যা হচ্ছে নয়টি গাছ– কদলী বা রম্ভা, কচ্চী, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িম, অশোক, মানক ও ধান্য এবং তিনি পুরশ্চর্যার্ণবের তৃতীয় খণ্ড থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন যে, উক্ত নয়টি বৃক্ষের প্রত্যেকটির অধিষ্ঠাত্রী দেবী যথাক্রমে ব্রহ্মাণী, কালিকা, দুর্গা, (কার্তিকী) কৌমারী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুণ্ডা এবং লক্ষ্মী। দুর্গা আরাধনায় দেবীকে উদ্ভিজ্জসমূহের অধিষ্ঠাত্রীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেবীর শাকম্ভরী নামের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে বর্ণিত তাঁর অন্নপূর্ণা রূপ, এবং কুলচূড়ামণি, শাক্তানন্দতরঙ্গিণী, তন্ত্রসার প্রভৃতি গ্রন্থে তান্ত্রিক শাক্ত উপাসনায় যে কুলবৃক্ষ পূজার উল্লেখ আছে, তা দেবীর সঙ্গে উদ্ভিদ জগতের সম্পর্ক ব্যক্ত করে।
এই উৎসব যে এককালে বস্তুত প্রাচীন কৌম-সমাজের একটি শস্য-প্রজনন-উৎসব ছিল তার স্বপক্ষে বিদ্বান গবেষকেরা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। শ্রদ্ধেয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, শূলপাণি তাঁর দুর্গোৎসববিবেক গ্রন্থে কালিকাপুরাণ (কালিকাপুরাণ-৬১/১৭-২১) থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিতব্য শাবরোৎসব নামক এক বিধি সম্পর্কিত কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যও তাঁর ‘হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থের তৃতীয় পর্বে (পৃষ্ঠা-২৬৩) তা উপস্থাপন করেছেন। কালিকাপুরাণে শাবরোৎসবের নির্দেশ ও বিবরণে বলা হয়েছে–
এই উৎসব যে এককালে বস্তুত প্রাচীন কৌম-সমাজের একটি শস্য-প্রজনন-উৎসব ছিল তার স্বপক্ষে বিদ্বান গবেষকেরা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। শ্রদ্ধেয় জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, শূলপাণি তাঁর দুর্গোৎসববিবেক গ্রন্থে কালিকাপুরাণ (কালিকাপুরাণ-৬১/১৭-২১) থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিতব্য শাবরোৎসব নামক এক বিধি সম্পর্কিত কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যও তাঁর ‘হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থের তৃতীয় পর্বে (পৃষ্ঠা-২৬৩) তা উপস্থাপন করেছেন। কালিকাপুরাণে শাবরোৎসবের নির্দেশ ও বিবরণে বলা হয়েছে–
বিসর্জয়েৎ দশম্যান্তু শ্রবণে শাবরোৎসবৈঃ।। ১৭।।
— — —
তদা সম্প্রেষণং দেব্যা দশম্যাং কারয়েদ্বুধঃ।। ১৮।।
সুবাসিনীভিঃ কুমারীভির্বেশ্যাভির্নর্তকৈ স্তথা।
শঙ্খতূর্যনিনাদৈশ্চ মৃদঙ্গৈঃ পটহৈস্তথা।। ১৯।।
ধ্বজৈর্বস্ত্রৈর্বহুবিধৈর্লাজপুষ্প প্রকীর্ণকৈঃ।
ধূলিকর্দমবিক্ষেপৈঃ ক্রীড়াকৌতুকমঙ্গলৈঃ।। ২০।।
ভগলিঙ্গাভিধানৈশ্চ ভগলিঙ্গপ্রগীতকৈঃ।
ভগলিঙ্গাদিশব্দৈশ্চ ক্রীড়ায়েষুরলং জনাঃ।। ২১।।
পরৈর্নাক্ষিপ্যতে যস্তু য পরান্নাক্ষিপেদ্ যদি।
ক্রুদ্ধা ভগবতী তস্য শাপং দদ্যাং সুদারুণম্ ।। ২২।।
অর্থাৎ : দশমীর দিবস শ্রবণা নক্ষত্রে শাবরোৎসবের সহিত দেবীর বিসর্জন করিবে। —জ্ঞানীব্যক্তি দশমীতে শ্রবণা নক্ষত্রে দেবীকে জলে প্রেরণ করিবেন। সুন্দর বস্ত্রে সজ্জিতা কুমারী ও বেশ্যা এবং নর্তকগণ সঙ্গে লইয়া শঙ্খ, তূরী, মৃদঙ্গ এবং পটহের শব্দ করিতে করিতে নানাবিধ বস্ত্রের ধ্বজা উড়াইয়া খই এবং ফুল ছড়াইতে ছড়াইতে ধূলিকর্দম নিক্ষেপ করতঃ নানা ক্রীড়াকৌতুক ও মঙ্গলাচরণপূর্বক ভগলিঙ্গাদিবাচক গ্রাম্যশব্দ উচ্চারণ ও তাদৃশ শব্দবহুল গান এবং তাদৃশ অশ্লীল বাক্যালাপ করিয়া বিসর্জনের সময়ে ক্রীড়া করিবে। সেই দিবস (অর্থাৎ বিজয়াদশমীর দিন) যদি কোনও মনুষ্য নিজের উপর অশ্লীল ব্যবহার করিতে না চাহে, অথবা যদি অন্যকে অশ্লীল ব্যবহারের দ্বারা আক্ষিপ্ত না করে, তবে ভগবতী ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে শাপ প্রদান করিয়া গমন করেন।
কিন্তু, শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, রমাপ্রসাদ চন্দ শূলপাণির গ্রন্থ থেকে যে পাঠ উদ্ধার করেছেন তার শেষ চরণটি ভিন্নরূপ : ভগলিঙ্গক্রিয়াভিশ্চ ক্রীড়য়েষুরলজ্জিত। দুটি শ্লোকের রীতিমতো অর্থভেদ বর্তমান বলে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন। জিতেন্দ্রনাথ তাঁর ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে– ‘রঘুনন্দনও বিজয়াদশমীতে প্রতিমা-বিসর্জন সম্পর্কে এই শাবরোৎসবের কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিতেছেন, ‘ততো ধূলিকর্দম-বিক্ষেপক্রীড়াকৌতুকমঙ্গল ভগলিঙ্গাভিধানং ভগলিঙ্গপ্রগীত পরাক্ষিপ্ত পরাক্ষেপকরূপং শাবরোৎসবং কুর্যাৎ’। শারদীয়া দুর্গাপূজায় পুরাকালে অনুষ্ঠিত শাবরোৎসব এখন কোথাও পালিত হয় কিনা জানি না, তবে শাবরমার্গ নামে যে সেকালের তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার এক শাখা ছিল উহা মেরুতন্ত্রের একটি উক্তি হইতে আমরা জানিতে পারি। এই তন্ত্রে বামমার্গের পাঁচটি শাখাকে যথা কৌলিক, বাম, চীনক্রম, সিদ্ধান্তীয় ও শাবর, হাতের পাঁচ অঙ্গুলির সহিত তুলনা করা হইয়াছে; কৌলিক অঙ্গুষ্ঠ, বাম তর্জনী, চীনক্রম মধ্যম, সিদ্ধান্তীয় অনামিকা এবং শাবর কনিষ্ঠাঙ্গুলি। শ্লোকটি এইরূপ–
কৌলিকোহঙ্গুষ্ঠতাং প্রাপ্তো বামঃ স্যাত্তর্জনীসমঃ।
চীনক্রমো মধ্যমঃ স্যাৎ সিদ্ধান্তীয়োহবরো ভবেৎ।
কনিষ্ঠঃ শাবরো মার্গঃ ইতি বামন্তু পঞ্চধা।।
আধুনিককালে অবশ্য এ ধরনের অশ্লীল নৃত্যগীত দুর্গোৎসবের অঙ্গ হিসেবে অপ্রচলিত হয়ে গেছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি উক্ত শবরোৎসবকে লৌকিক বিশ্বাসজাত এবং বৈদিক যুগ থেকে আগত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন,–
‘লোকের বিশ্বাস ছিল, নববর্ষের প্রথম দিন চক্ষু কর্ণ কিম্বা দেহ অশুচি করিলে সে বৎসর যমদুত স্পর্শ করিতে পারে না। মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ অন্ত্যজ স্পর্শ দ্বারা দেহ অশুচি করে, পরে স্নান করে। এই বিশ্বাস অল্পকালের নয়, অন্ততঃ সাড়ে চারি সহস্র বৎসর হইতে আছে। ইহার প্রমাণ আছে। বৈদিক কালে সম্বৎসর ব্যাপী সত্রের পর এইরূপ অশ্লীল ক্রীড়া কৌতুক হইত। আমার বিশ্বাস, বৈদিক কালের সোমরস বর্তমান ভাং (সিদ্ধি)। আমরা বিজয়া দশমীতে সিদ্ধি পান করি।’– (পূজাপার্বণ, পৃষ্ঠা-৮)
অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, যোগেশচন্দ্রের বক্তব্য যথার্থ হলে এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে অশ্লীল ক্রীড়া কৌতুক যদি শবরাদি অনার্য জাতির কাছ থেকে এসে থাকে, ত তা এসেছে বৈদিক যুগেই। বৈদিক যজ্ঞরূপা দুর্গার অর্চনায় বৈদিক যুগের উৎসব সংযুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। হয়তো বা তার সঙ্গে শবর জাতির উৎসবও সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে।
‘লোকের বিশ্বাস ছিল, নববর্ষের প্রথম দিন চক্ষু কর্ণ কিম্বা দেহ অশুচি করিলে সে বৎসর যমদুত স্পর্শ করিতে পারে না। মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ অন্ত্যজ স্পর্শ দ্বারা দেহ অশুচি করে, পরে স্নান করে। এই বিশ্বাস অল্পকালের নয়, অন্ততঃ সাড়ে চারি সহস্র বৎসর হইতে আছে। ইহার প্রমাণ আছে। বৈদিক কালে সম্বৎসর ব্যাপী সত্রের পর এইরূপ অশ্লীল ক্রীড়া কৌতুক হইত। আমার বিশ্বাস, বৈদিক কালের সোমরস বর্তমান ভাং (সিদ্ধি)। আমরা বিজয়া দশমীতে সিদ্ধি পান করি।’– (পূজাপার্বণ, পৃষ্ঠা-৮)
অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, যোগেশচন্দ্রের বক্তব্য যথার্থ হলে এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে অশ্লীল ক্রীড়া কৌতুক যদি শবরাদি অনার্য জাতির কাছ থেকে এসে থাকে, ত তা এসেছে বৈদিক যুগেই। বৈদিক যজ্ঞরূপা দুর্গার অর্চনায় বৈদিক যুগের উৎসব সংযুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। হয়তো বা তার সঙ্গে শবর জাতির উৎসবও সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে।
শস্যদেবী শাকম্ভরী দুর্গা : শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ যে কয়েকটি চিত্তাকর্ষক সাহিত্যমূলক সাক্ষ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তা হলো,– ‘মার্কণ্ডেয়-পুরাণে’র দেবী-মাহাত্ম্যে স্বয়ং দেবী ঘোষণা করছেন–
‘ততঃ অহম্ অখিলং লোকম্ আত্মদেহ-সমুদ্ভবৈঃ।
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈঃ অবৃষ্টৈঃ প্রাণধারকৈঃ।।
শাকম্ভরী ইতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যামি অহং ভুবি।…’ (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ-৯২/৪২-৪৩)
অর্থাৎ : অনন্তর বর্ষাকালে আত্মদেহ-সমুদ্ভূত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সমগ্র জগতের পুষ্টি-সরবরাহ করবো; তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবো।
এখানে শাকম্ভরী নামের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হলো, শাকাদি উদ্ভিদ দেবীগর্ভপ্রসূত। এ কারণেই দেবী শাককে আত্মদেহ-সমুদ্ভূত বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ দেবী বলতে এখানে বসুমাতা, পৃথিবী। বলা বাহুল্য, সংস্কৃত শাস্ত্রকাররা শাক-শব্দের দ্বারা কেবলমাত্র লতা জাতীয় বস্তুকেই বুঝতেন না– পত্র, মূল ইত্যাদি দশ প্রকার বস্তুকে বুঝতেন–
‘পত্রমূলকরীরাগ্রফলকাণ্ডাস্থিরূঢ়কাঃ।
ত্বক্ পুষ্পং কবকং চেতি শাকং দশবিধং স্মৃতম্ ।।’
অর্থাৎ : পত্র, মূল, করীর (মরুদেশস্থ বৃক্ষবিশেষ), অগ্র, ফল, কাণ্ড, অস্থিরূঢ়ক, ত্বক, পুষ্প ও কবক এই দশপ্রকার শাক স্মৃতিতে উক্ত হয়েছে।
আবার লক্ষ্মীতন্ত্রে শাকম্ভরী দেবীর সঙ্গে উমা, দুর্গা, পার্বতী, চণ্ডী, সতী ও কালিকেশা দেবীকে এক করে দেয়া হয়েছে–
‘শাকম্ভরী শতাক্ষী সা সৈব দুর্গা প্রকীর্তিতা।
উমা গৌরী সতী চণ্ডী কালিকেশা চ পার্বতী।।
শাকম্ভরী স্তুবন্ ধ্যায়ন্ শত্রু সংপূজয়ন্ নমন্ ।
অক্ষয়ামশ্নুতে ভূতিমন্নং পানং ভবান্তরে।।
অর্থাৎ : শতাক্ষী শাকম্ভরী জগতে দুর্গা, উমা, গৌরী, সতী, চণ্ডী, কালিকেশা ও পার্বতী নামে খ্যাত। শাকম্ভরীর স্তব, পূজা ও ধ্যান করলে অপর জন্মে অক্ষয় অন্ন পান ও ঐশ্বর্য লাভ হয়।
যে-সুপ্রাচীন বিশ্বাস থেকে এই দেবী-নামের উদ্ভব হয়েছিলো তার একটি মূর্ত নিদর্শন হরপ্পা ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। হরপ্পায় এমন একটি অদ্ভূত সীল আবিষ্কৃত হয়েছে– তার এক-পিঠে উত্তানপদ দেবীমূর্তি, এই দেবীর গর্ভ থেকেই উদ্ভিদের উদ্ভব অঙ্কিত হয়েছে। অতএব অনুমান হয়, মার্কণ্ডেয়-পুরাণের এই শাকম্ভরী দেবী পুরাণের চেয়ে অনেক পুরনো; প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু-যুগেও তাঁর পরিচয় অস্পষ্ট নয়।
সিন্ধু-সভ্যতায় দেবী-রহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সম্পর্ক ইঙ্গিত যে শুধুমাত্র এই সীলটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ তা নয়। অন্যান্য অনেক সীলেও দেবীকে উদ্ভিদ-পরিবৃতা বা উদ্ভিদ-অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে অঙ্কিত করা হয়েছে। এ-জাতীয় নজির থেকেই সিন্ধু-সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন পরিচালনাকারী বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল অনুমান করেছিলেন, সিন্ধু-সভ্যতায় বৃক্ষ-উপাসনাও প্রচলিত ছিলো। এবং এ-বিষয়ে তিনি আরো একটি যুক্তি দিয়েছেন যে– উত্তরকালে ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বিশ্বাসে বৃক্ষের অধিষ্ঠাত্রী বলতে সর্বত্রই দেবীর কল্পনা।
সিন্ধু-সভ্যতায় দেবী-রহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সম্পর্ক ইঙ্গিত যে শুধুমাত্র এই সীলটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ তা নয়। অন্যান্য অনেক সীলেও দেবীকে উদ্ভিদ-পরিবৃতা বা উদ্ভিদ-অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে অঙ্কিত করা হয়েছে। এ-জাতীয় নজির থেকেই সিন্ধু-সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন পরিচালনাকারী বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল অনুমান করেছিলেন, সিন্ধু-সভ্যতায় বৃক্ষ-উপাসনাও প্রচলিত ছিলো। এবং এ-বিষয়ে তিনি আরো একটি যুক্তি দিয়েছেন যে– উত্তরকালে ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বিশ্বাসে বৃক্ষের অধিষ্ঠাত্রী বলতে সর্বত্রই দেবীর কল্পনা।
এখানে উল্লেখ্য, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের একটি সূক্তে (ঋগ্বেদ-১০/৭২) দেবী অদিতির বর্ণনাতেও এই কৌতুহলোদ্দীপক ‘উত্তানপদ’ শব্দ ও ধারণা ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন–
‘দেবানাং যুগে প্রথমেহসতঃ সদজায়ত।
তদাশা অন্বজাযন্ত তদুত্তানপদস্পরি’।। (ঋক-১০/৭২/৩)
‘ভূর্জজ্ঞ উত্তানপদো ভুব আশা অজায়ন্ত।
অদিতের্দক্ষো অজায়ত দক্ষাদ্বদিতিঃ পরি’।। (ঋক-১০/৭২/৪)
অর্থাৎ :
দেবোৎপত্তির পূর্বতন কালে অবিদ্যমান হতে বিদ্যমান বস্তু উৎপন্ন হলো। পরে উত্তানপদ (উত্তানপদ বলতে বৃক্ষ : সায়ণ) হতে দিক সকল জন্ম গ্রহণ করলো (ঋক-১০/৭২/৩)। উত্তানপদ হতে পৃথিবী জন্মিল, পৃথিবী হতে দিক সকল জন্মিল, অদিতি হতে দক্ষ জন্মিলেন, দক্ষ হতে আবার অদিতি জন্মিলেন (ঋক-১০/৭২/৪)।
আারো বেশ কিছু সূক্তের মতোই ঋগ্বেদের এই সূক্তটির রচয়িতা হলেন বৃহস্পতি ঋষি। তবে এখানে এই ঋকসমূহে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, বেদ-পূর্ব বা তারচেয়েও অন্তত হাজার বছরের পুরনো সিন্ধু-ধর্মীয় কৃষিভিত্তিক উত্তানপদ-ধারণা ঋগ্বেদেও বহমান থাকা। এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ী হয়ে যাওয়া আর্য-সভ্যতায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবেচনায় ধীরে ধীরে নিজেদের জীবন-ব্যবস্থাকে অবশ্যম্ভাবীরূপে কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থার সাথে খাপ-খাইয়ে নেয়া। এবং অবশ্যই তাদের পুরুষ-প্রাধান্য বজায় রেখে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, জন মার্শাল যে সিন্ধু-সভ্যতার অন্যতম উপাদান হিসেবে বৃক্ষ-উপাসনার কথা উল্লেখ করেছেন, এই তথাকথিত বৃক্ষ-উপাসনাকে কি সিন্ধু-ধর্মের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে, না কি একে শক্তি-সাধনার কোন অভিব্যক্তি বা লক্ষণ মনে করা যুক্তিসঙ্গত? এক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসকে যদি এ-প্রশ্নের উপর আলোকপাত করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, পরবর্তী কালের শক্তি-সাধনার বিশেষ অঙ্গই হলো উদ্ভিদ-অধিষ্ঠাত্রী বা শস্যদেবীর উপাসনা। কারণ–
‘এ-বিষয়ে আধনিক বিদ্বানেরা ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন : যাঁর নাম শাকম্ভরী তাঁরই নাম দুর্গা। তাই ফসলের সময়টিতেই দুর্গোৎসবের আয়োজন। কিন্তু দুর্গা-মূর্তি বলতে তো দশভূজা মহিষমর্দিনীর রূপ। কিন্তু শ্রীযুক্ত চন্দ দেখাচ্ছেন, এ-রূপ তুলনায় অনেক অর্বাচীন : প্রচলিত পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে রাবণ-বধের বরপ্রার্থনায় রামচন্দ্র ওই মহিষ-মর্দিনীর উপাসনা করেছিলেন। কিন্তু বাল্মীকির মূল রামায়ণে এ-উপাখ্যান নেই; তার বদলে রামচন্দ্র সেখানে সূর্যের কাছেই বর-প্রার্থনা করছেন। অতএব এই মহিষ-মর্দিনী রূপটি অনেক পরবর্তীকালের; এবং পরবর্তী কালের বলেই (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিতে) “এখন যে সিংহবাহিনী দশভূজার প্রতিমা গড়াইয়া আমরা পূজা করিয়া থাকি, শত বৎসর পূর্বে ঠিক এমনভাবে প্রতিমা বাংলা কারিগর গড়িত না।… কারণ, আসল কথা এই যে, দুর্গোৎসবের সময় যে-প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডিমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে-উৎসব করিয়া থাকি সেই উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণঘটের; দেবীকে আহ্বান করিতে হয় ‘যন্ত্রে’ ও ঘটে।” ঘটের উপর নবপত্রিকা স্থাপন করতে হয় এবং দুর্গাপূজার প্রধানতম অনুষ্ঠান এই নবপত্রিকাকে কেন্দ্র করেই। আবার, ওই নয়টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটিরই অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে এক-একটি দেবীর কল্পনা। তা হলে দুর্গাপূজার– অর্থাৎ, পরবর্তী ভারতবর্ষীয় ধর্মে মাতৃপূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিব্যক্তিটির– ক্ষেত্রেও দেবীরহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখা যায়। শ্রীযুক্ত চন্দ বলেছেন, এই কারণেই শাক্তরা প্রত্যুষে কুলবৃক্ষ বা কুলতরুকে প্রণাম করেন এবং আদি-পর্যায়ে শক্তি বা দুর্গা শস্যদেবী হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর নামান্তর অন্নদা বা অন্নপূর্ণা।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭০)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, জন মার্শাল যে সিন্ধু-সভ্যতার অন্যতম উপাদান হিসেবে বৃক্ষ-উপাসনার কথা উল্লেখ করেছেন, এই তথাকথিত বৃক্ষ-উপাসনাকে কি সিন্ধু-ধর্মের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে, না কি একে শক্তি-সাধনার কোন অভিব্যক্তি বা লক্ষণ মনে করা যুক্তিসঙ্গত? এক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসকে যদি এ-প্রশ্নের উপর আলোকপাত করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, পরবর্তী কালের শক্তি-সাধনার বিশেষ অঙ্গই হলো উদ্ভিদ-অধিষ্ঠাত্রী বা শস্যদেবীর উপাসনা। কারণ–
‘এ-বিষয়ে আধনিক বিদ্বানেরা ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন : যাঁর নাম শাকম্ভরী তাঁরই নাম দুর্গা। তাই ফসলের সময়টিতেই দুর্গোৎসবের আয়োজন। কিন্তু দুর্গা-মূর্তি বলতে তো দশভূজা মহিষমর্দিনীর রূপ। কিন্তু শ্রীযুক্ত চন্দ দেখাচ্ছেন, এ-রূপ তুলনায় অনেক অর্বাচীন : প্রচলিত পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে রাবণ-বধের বরপ্রার্থনায় রামচন্দ্র ওই মহিষ-মর্দিনীর উপাসনা করেছিলেন। কিন্তু বাল্মীকির মূল রামায়ণে এ-উপাখ্যান নেই; তার বদলে রামচন্দ্র সেখানে সূর্যের কাছেই বর-প্রার্থনা করছেন। অতএব এই মহিষ-মর্দিনী রূপটি অনেক পরবর্তীকালের; এবং পরবর্তী কালের বলেই (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিতে) “এখন যে সিংহবাহিনী দশভূজার প্রতিমা গড়াইয়া আমরা পূজা করিয়া থাকি, শত বৎসর পূর্বে ঠিক এমনভাবে প্রতিমা বাংলা কারিগর গড়িত না।… কারণ, আসল কথা এই যে, দুর্গোৎসবের সময় যে-প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডিমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে-উৎসব করিয়া থাকি সেই উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণঘটের; দেবীকে আহ্বান করিতে হয় ‘যন্ত্রে’ ও ঘটে।” ঘটের উপর নবপত্রিকা স্থাপন করতে হয় এবং দুর্গাপূজার প্রধানতম অনুষ্ঠান এই নবপত্রিকাকে কেন্দ্র করেই। আবার, ওই নয়টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটিরই অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে এক-একটি দেবীর কল্পনা। তা হলে দুর্গাপূজার– অর্থাৎ, পরবর্তী ভারতবর্ষীয় ধর্মে মাতৃপূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিব্যক্তিটির– ক্ষেত্রেও দেবীরহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ-জগতের সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখা যায়। শ্রীযুক্ত চন্দ বলেছেন, এই কারণেই শাক্তরা প্রত্যুষে কুলবৃক্ষ বা কুলতরুকে প্রণাম করেন এবং আদি-পর্যায়ে শক্তি বা দুর্গা শস্যদেবী হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর নামান্তর অন্নদা বা অন্নপূর্ণা।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭০)
তার মানে, বৃক্ষ-উপাসনাকে সিন্ধু-ধর্মের কোন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যাখ্যা না করে বরং এ-কথা অনুমান করাই যুক্তিসঙ্গত হবে যে, সুপ্রাচীন কাল থেকে ওই তথাকথিত বৃক্ষ-উপাসনা শাক্ত-ধর্মেরই একটি প্রধানতম উপাদান ছিলো। এখন প্রশ্ন হলো, শক্তি-সাধনা বা মাতৃ-উপাসনার সঙ্গে শস্য জগতের বা উদ্ভিদ-জগতের এ জাতীয় সম্পর্ক কেন? নৃতত্ত্ববিদেরা এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন–
‘পৃথিবী বা প্রকৃতির ফলপ্রসূতামূলক কামনা থেকেই বসুমাতা বা আদ্যা-শক্তি বা জগদম্বা পরিকল্পনার উদ্ভব। অর্থাৎ, এই বসুমাতা-কল্পনার উৎসে আছে এক আদিম বিশ্বাস, সে-বিশ্বাস অনুসারে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা ও মানবীয় ফলপ্রসূতা সমগোত্রীয়। তাই শস্যদায়িনী প্রকৃতিও সন্তানদায়িনী মাতার অনুরূপ– প্রকৃতিও মাতৃরূপে পরিকল্পিত। অতএব প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাও মানবীয় প্রজননের সংস্পর্শ বা অনুকরণের সঙ্গে সংযুক্ত। নৃতত্ত্ববিদদের পরিভাষায় এই আদিম বিশ্বাসের নাম ‘ফার্টিলিটি ম্যাজিক’– উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে দেশে দেশান্তরে যে-সব বহুবিধ আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়েছে, নৃতত্ত্ববিদদের রচনায় তার বহুল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭১)
‘পৃথিবী বা প্রকৃতির ফলপ্রসূতামূলক কামনা থেকেই বসুমাতা বা আদ্যা-শক্তি বা জগদম্বা পরিকল্পনার উদ্ভব। অর্থাৎ, এই বসুমাতা-কল্পনার উৎসে আছে এক আদিম বিশ্বাস, সে-বিশ্বাস অনুসারে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা ও মানবীয় ফলপ্রসূতা সমগোত্রীয়। তাই শস্যদায়িনী প্রকৃতিও সন্তানদায়িনী মাতার অনুরূপ– প্রকৃতিও মাতৃরূপে পরিকল্পিত। অতএব প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাও মানবীয় প্রজননের সংস্পর্শ বা অনুকরণের সঙ্গে সংযুক্ত। নৃতত্ত্ববিদদের পরিভাষায় এই আদিম বিশ্বাসের নাম ‘ফার্টিলিটি ম্যাজিক’– উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে দেশে দেশান্তরে যে-সব বহুবিধ আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়েছে, নৃতত্ত্ববিদদের রচনায় তার বহুল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭১)
এ প্রেক্ষিতে ড. অতুল সুরের পর্যবেক্ষণটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন–
‘বাঙলার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্ঠতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে লোথালে ধান্যের ব্যবহার। চাউল বাঙালীর প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ধান্যের চাষ যে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল, এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে কোন দ্বিমত নেই। কারলো চিপোলো তাঁর ‘দি ইকনমিক হিস্টরি অভ্ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে এই মতই প্রকাশ করেছেণ এবং বাঙলাদেশকে নির্দেশ করেছেন।’
‘মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি নগরে মাতৃদেবীর পূজার যে ব্যাপক প্রচলন ছিল তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূর্তিসমূহ থেকে প্রকাশ পায়। বাঙলাই মাতৃদেবীর পূজার লীলাকেন্দ্র। —মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব নবোপলীয় যুগে কৃষির সূচনার সঙ্গে ঘটেছিল। বাঙলায় নবোপলীয় বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ধান্যের চাষ নিয়ে। মনে হয়, ধান্যের চাষের সঙ্গে মাতৃদেবীর পূজা বাঙলাতেই শুরু হয়েছিল। ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীপূজার অপর নাম খন্দপূজা। খন্দ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ফসলাদি। লক্ষ্মীপূজা যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে, তা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকেই প্রকাশ পায়। সূচনায় মাতৃদেবীর পূজা যে ফসলাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল তা সিন্ধসভ্যতার কেন্দ্রে (হরপ্পায়) প্রাপ্ত এক সীলের ওপর খোদিত নারীমূর্তি থেকে প্রকাশ পায়। এই নারীমূর্তির যোনি-মুখ থেকে নির্গত হয়েছে পল্লবিত ছোট চারা-গাছ, লতা-পাতা, গুল্ম ইত্যাদি। ষাট বছর পূর্বে আমি আমার ‘প্রি-অ্যারিয়ান এলিমেন্টস্ ইন ইন্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে বলেছিলাম যে মাতৃদেবী আদিতে যে শস্যাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তা তাঁর অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী ইত্যাদি অভিধা থেকেই প্রকাশ পায়। অবশ্য অন্নপূর্ণা নামটি সংস্কৃত। কিন্তু আদিতে এই শব্দটির কী রূপ ছিল, তা আমরা জানি না। তবে প্রাচীন সুমেরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘এ-নান্না’ নামের সঙ্গে এর যথেষ্ট নৈকট্য আছে। (তুলনা করুন হিংলাজের অধিষ্ঠাত্রী ‘নানা’ দেবী)।’
‘মাত্র নামের সাদৃশ্য নয়। সুমের ও ভারতের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে এক অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। এই উভয় দেশের মাতৃদেবীর মূলগত সাদৃশ্য হচ্ছে– (১) উভয়দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী’ হিসাবে কল্পিত হয়েছিলেন, অথচ তাঁদের ভর্তা ছিল। বোধ হয়, মহাষ্টমীর দিন বাঙলাদেশে ‘কুমারী’ পূজা তারই স্মারক। (২) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর বাহন ‘সিংহ’ ও তাঁর ভর্তার বাহন ‘বলীবর্দ’। (৩) উভয় দেশেই মাতৃদেবীর নারীসুলভ গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি পুরুষোচিত কর্ম, যথা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। (৪) প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লিপিসমূহে তাঁকে বারম্বার ‘সৈন্যবাহিনীর নেত্রী’ বলা হয়েছে। আমাদের দেশের ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর ‘দেবীমাহাত্ম্য’ বিভাগেও বলা হয়েছে যে দেবতারা যখন অসুরগণ কর্তৃক পরাহত হয়েছিলেন, তখন তাঁরা মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। (৫) মেসোপটেমিয়ার মাতৃদেবী পর্বতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট সেজন্য তাঁকে ‘পর্বতের দেবী’ বলা হত। ভারতে মাতৃদেবীর পার্বতী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি নাম তাই সূচিত করে। (৬) সুমেরে মাতৃদেবীর নাম ছিল ‘এ-নান্না’; সে নাম হিংলাজে ‘নানা’দেবীর নামে এখনও বর্তমান। (৭) সুমেরীয়দের পরিধেয় বসন ‘কৌনক’ তালপাতা দিয়ে তৈরী করা হত; প্রাচীন ভারতে দেশজ লোকদের পাতা ও ‘বল্কল’ পরিধান ও পর্ণশবরীর (দেবীর এক নাম) নাম আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৮) দু’দেশেই ধর্মীয় গণিকাবৃত্তি (বা সাময়িকভাবে সতীত্বের বিসর্জন দেওয়া) প্রথা প্রচলিত ছিল। পশ্চিম এসিয়ায় এটার উদ্ভব হয়েছিল ঐন্দ্রজালিক (mimetic or homoeopathic) পদ্ধতি থেকে। সধবা ও অনূঢ়া উভয়দেশীর মেয়েরাই দেবীর প্রসন্নতালাভের জন্য সাময়িকভাবে তাদের সতীত্বের বিসর্জন দিত। বলা বাহুল্য, ভারতে এটা বামাচারী তন্ত্রধর্মের বৈশিষ্ট্য। সব তন্ত্রেই বলা হয়েছে মৈথুন ছাড়া কুলপূজা (তন্ত্র অনুযায়ী দেবীর পূজা) হয় না। যেমন, ‘গুপ্তসংহিতা’য় বলা হয়েছে, ‘কুলশক্তিম বিনা দেবী যো যপেত স তু পামর’। আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণম্ ন কুলার্চনে’। তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতি ত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না। (৯) উভয়দেশেই দেবীপূজার সঙ্গে নরবলি প্রচলিত ছিল। (কালিকাপুরাণ, ৭ অধ্যায়)।’- (ড. অতুল সুর / ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, পৃষ্ঠা-৪১-৪৩)
‘বাঙলার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্ঠতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে লোথালে ধান্যের ব্যবহার। চাউল বাঙালীর প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ধান্যের চাষ যে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল, এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে কোন দ্বিমত নেই। কারলো চিপোলো তাঁর ‘দি ইকনমিক হিস্টরি অভ্ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে এই মতই প্রকাশ করেছেণ এবং বাঙলাদেশকে নির্দেশ করেছেন।’
‘মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি নগরে মাতৃদেবীর পূজার যে ব্যাপক প্রচলন ছিল তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূর্তিসমূহ থেকে প্রকাশ পায়। বাঙলাই মাতৃদেবীর পূজার লীলাকেন্দ্র। —মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব নবোপলীয় যুগে কৃষির সূচনার সঙ্গে ঘটেছিল। বাঙলায় নবোপলীয় বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ধান্যের চাষ নিয়ে। মনে হয়, ধান্যের চাষের সঙ্গে মাতৃদেবীর পূজা বাঙলাতেই শুরু হয়েছিল। ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীপূজার অপর নাম খন্দপূজা। খন্দ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ফসলাদি। লক্ষ্মীপূজা যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে, তা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকেই প্রকাশ পায়। সূচনায় মাতৃদেবীর পূজা যে ফসলাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল তা সিন্ধসভ্যতার কেন্দ্রে (হরপ্পায়) প্রাপ্ত এক সীলের ওপর খোদিত নারীমূর্তি থেকে প্রকাশ পায়। এই নারীমূর্তির যোনি-মুখ থেকে নির্গত হয়েছে পল্লবিত ছোট চারা-গাছ, লতা-পাতা, গুল্ম ইত্যাদি। ষাট বছর পূর্বে আমি আমার ‘প্রি-অ্যারিয়ান এলিমেন্টস্ ইন ইন্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে বলেছিলাম যে মাতৃদেবী আদিতে যে শস্যাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তা তাঁর অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী ইত্যাদি অভিধা থেকেই প্রকাশ পায়। অবশ্য অন্নপূর্ণা নামটি সংস্কৃত। কিন্তু আদিতে এই শব্দটির কী রূপ ছিল, তা আমরা জানি না। তবে প্রাচীন সুমেরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘এ-নান্না’ নামের সঙ্গে এর যথেষ্ট নৈকট্য আছে। (তুলনা করুন হিংলাজের অধিষ্ঠাত্রী ‘নানা’ দেবী)।’
‘মাত্র নামের সাদৃশ্য নয়। সুমের ও ভারতের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে এক অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। এই উভয় দেশের মাতৃদেবীর মূলগত সাদৃশ্য হচ্ছে– (১) উভয়দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী’ হিসাবে কল্পিত হয়েছিলেন, অথচ তাঁদের ভর্তা ছিল। বোধ হয়, মহাষ্টমীর দিন বাঙলাদেশে ‘কুমারী’ পূজা তারই স্মারক। (২) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর বাহন ‘সিংহ’ ও তাঁর ভর্তার বাহন ‘বলীবর্দ’। (৩) উভয় দেশেই মাতৃদেবীর নারীসুলভ গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি পুরুষোচিত কর্ম, যথা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। (৪) প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লিপিসমূহে তাঁকে বারম্বার ‘সৈন্যবাহিনীর নেত্রী’ বলা হয়েছে। আমাদের দেশের ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর ‘দেবীমাহাত্ম্য’ বিভাগেও বলা হয়েছে যে দেবতারা যখন অসুরগণ কর্তৃক পরাহত হয়েছিলেন, তখন তাঁরা মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। (৫) মেসোপটেমিয়ার মাতৃদেবী পর্বতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট সেজন্য তাঁকে ‘পর্বতের দেবী’ বলা হত। ভারতে মাতৃদেবীর পার্বতী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি নাম তাই সূচিত করে। (৬) সুমেরে মাতৃদেবীর নাম ছিল ‘এ-নান্না’; সে নাম হিংলাজে ‘নানা’দেবীর নামে এখনও বর্তমান। (৭) সুমেরীয়দের পরিধেয় বসন ‘কৌনক’ তালপাতা দিয়ে তৈরী করা হত; প্রাচীন ভারতে দেশজ লোকদের পাতা ও ‘বল্কল’ পরিধান ও পর্ণশবরীর (দেবীর এক নাম) নাম আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৮) দু’দেশেই ধর্মীয় গণিকাবৃত্তি (বা সাময়িকভাবে সতীত্বের বিসর্জন দেওয়া) প্রথা প্রচলিত ছিল। পশ্চিম এসিয়ায় এটার উদ্ভব হয়েছিল ঐন্দ্রজালিক (mimetic or homoeopathic) পদ্ধতি থেকে। সধবা ও অনূঢ়া উভয়দেশীর মেয়েরাই দেবীর প্রসন্নতালাভের জন্য সাময়িকভাবে তাদের সতীত্বের বিসর্জন দিত। বলা বাহুল্য, ভারতে এটা বামাচারী তন্ত্রধর্মের বৈশিষ্ট্য। সব তন্ত্রেই বলা হয়েছে মৈথুন ছাড়া কুলপূজা (তন্ত্র অনুযায়ী দেবীর পূজা) হয় না। যেমন, ‘গুপ্তসংহিতা’য় বলা হয়েছে, ‘কুলশক্তিম বিনা দেবী যো যপেত স তু পামর’। আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণম্ ন কুলার্চনে’। তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতি ত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না। (৯) উভয়দেশেই দেবীপূজার সঙ্গে নরবলি প্রচলিত ছিল। (কালিকাপুরাণ, ৭ অধ্যায়)।’- (ড. অতুল সুর / ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, পৃষ্ঠা-৪১-৪৩)
দেবীপূজায় তন্ত্রবিধি : এখান যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো, উপরে উল্লিখিত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিতে ‘যন্ত্র’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, যেখানে বলা হয়েছে ‘দুর্গোৎসবের সময় যে-প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডিমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে-উৎসব করিয়া থাকি সেই উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণঘটের; দেবীকে আহ্বান করিতে হয় ‘যন্ত্রে’ ও ঘটে।’ কেননা ‘যন্ত্র’ শব্দটি তন্ত্র-সাধনার পক্ষে অবিচ্ছেদ্য একটি উপাদান। তন্ত্রে একজাতীয় চিত্রের ব্যবহার আছে, সেগুলিকে যন্ত্র বলে–
‘যন্ত্র সাধারণত দুই প্রকার– পূজাযন্ত্র ও ধারণ-যন্ত্র। পূজাযন্ত্রে যে দেবতার পূজা করিতে হইবে, সেই দেবতার যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া তাহাতে পূজা করিতে হয়। ঐরূপ যন্ত্রকে পূজাযন্ত্র বলা হয়।
যে যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া ধারণ করা হয় তাহার নাম ধারণ-যন্ত্র। এই ধারণ-যন্ত্র ভূর্জপত্রে অঙ্কিত করিয়া ধারণ করিতে হয়।…
তন্ত্রে লিখিত আছে,– যন্ত্রে দেবতার অধিষ্ঠান হইয়া থাকে, এইজন্য যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া দেবতার পূজা করিতে হয়। (বিশ্বকোষ-১৫/৪৫)
‘যন্ত্র সাধারণত দুই প্রকার– পূজাযন্ত্র ও ধারণ-যন্ত্র। পূজাযন্ত্রে যে দেবতার পূজা করিতে হইবে, সেই দেবতার যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া তাহাতে পূজা করিতে হয়। ঐরূপ যন্ত্রকে পূজাযন্ত্র বলা হয়।
যে যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া ধারণ করা হয় তাহার নাম ধারণ-যন্ত্র। এই ধারণ-যন্ত্র ভূর্জপত্রে অঙ্কিত করিয়া ধারণ করিতে হয়।…
তন্ত্রে লিখিত আছে,– যন্ত্রে দেবতার অধিষ্ঠান হইয়া থাকে, এইজন্য যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া দেবতার পূজা করিতে হয়। (বিশ্বকোষ-১৫/৪৫)
গন্ধর্বতন্ত্রে বলা হয়েছে–
‘বিনা যন্ত্রেণ চেৎ পূজা দেবতা ন প্রসীদতি। (গন্ধর্বতন্ত্র-৫/১)
অর্থাৎ : যন্ত্র ছাড়া পূজা করলে দেবতা সন্তুষ্ট হন না।
তবে মাতৃকাভেদ তন্ত্রের মতে, যেখানে প্রতিমার পূজা হয় সেখানে যন্ত্র অঙ্কনের কোনো প্রয়োজন নেই। যন্ত্রও প্রতীক, প্রতিমাও প্রতীক, তাই একসঙ্গে দুটি প্রতীক অনাবশ্যক বলেই হয়তো মাতৃকাভেদ তন্ত্রে এমন বিধান দেয়া হয়েছে। তবে তন্ত্রাভিজ্ঞদের মতে অবশ্য যন্ত্র শুধু দেবীর প্রতীক নয়, তা শক্তিলেখও বটে। অগ্রসর সাধকের জন্যেই যন্ত্রপূজা। প্রত্যেক দেবীর আলাদা আলাদা যন্ত্র থাকলেও ভূপুর এবং পদ্ম সকল যন্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য। তন্ত্র ও পুরাণ মতে পদ্ম হলো সৃষ্টির প্রতীক। কাজেই সৃষ্টির আদি কারণ স্বরূপিণী দেবীর পূজার জন্য যন্ত্র উৎকৃষ্ট আধার।
কখনো কখনো যন্ত্রের পরিবর্তে বিভিন্ন মণ্ডলেও দেবীর পূজা করার বিধান শাস্ত্রে পরিলক্ষিত হয়। কুলার্ণব তন্ত্রে তাই বলা হয়েছে–
কখনো কখনো যন্ত্রের পরিবর্তে বিভিন্ন মণ্ডলেও দেবীর পূজা করার বিধান শাস্ত্রে পরিলক্ষিত হয়। কুলার্ণব তন্ত্রে তাই বলা হয়েছে–
‘মণ্ডলেন বিনা পূজা নিষ্ফলা কথিতা প্রিয়ে।
তস্মান্মণ্ডলমালিখ্য বিধিবত্তত্র পূজয়েং।। (কুলার্ণবতন্ত্র-৬/২০)
অর্থাৎ : মণ্ডল ছাড়া পূজা নিষ্ফল হয় বলে যথানিয়মে মণ্ডল এঁকে পূজা করতে হবে।
দূর্গাপূজা মূলত পৌরাণিক পূজা হলেও দেবীপূজার সাধারণ নিয়মানুসারে এখানেও যন্ত্রে বা মণ্ডলে পূজার ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। আর তন্ত্রমতে এই যন্ত্রগুলি অবধারিতভাবেই নারী-জননাঙ্গের প্রতীকচিত্র। ‘কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যন্ত্রগুলি যে পূজা, দেবতা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয়ের চেয়ে প্রাচীনতর,– অর্থাৎ, পূজা ও দেবতাদির বিষয় পরে কৃত্রিমভাবে যন্ত্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে,– যন্ত্রগুলিকে ভালো করে পরীক্ষা করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মোটের উপর একই চিত্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেবদেবীর সম্পর্ক বা ঐক্য পরিকল্পিত হয়েছে (বৃহৎতন্ত্রসারে বিভিন্ন যন্ত্রের চিত্র দ্রষ্টব্য)। তার থেকেই বোঝা যায়, উক্ত সম্পর্কাদির চেয়েও যন্ত্রগুলি প্রাচীনতর। দ্বিতীয়ত, বহু যন্ত্রের সঙ্গেই যন্ত্রসংযুক্ত দেবতাটির স্পষ্ট বিরোধ দেখা যায়। আধুনিক তান্ত্রিক গ্রন্থাদিতে কয়েকটি প্রসিদ্ধ যন্ত্রের নাম হলো, গণেশযন্ত্র, শ্রীরামযন্ত্র, নৃসিংহযন্ত্র, গোপালযন্ত্র, কৃষ্ণযন্ত্র, শিবযন্ত্র, মৃত্যুঞ্জয়যন্ত্র ইত্যাদি (বৃহৎতন্ত্রসার দ্রষ্টব্য)। উল্লেখিত দেবতাগুলি সকলেই পুরুষ। অথচ, যন্ত্রগুলি অবধারিতভাবেই নারী-জননাঙ্গের প্রতীকচিত্র।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪০২)
তান্ত্রিক যন্ত্রগুলি যে নারী-জননাঙ্গের প্রতীকমাত্র, এ-বিষয়ে শ্রীচক্রপূজা প্রসঙ্গে স্যার ভান্ডারকরের বক্তব্য হলো–
‘It consists in the worship of picture of the female organ drawn in the centre of another consisting of a representation of nine such organs, the whole of which forms the `Sricakra’….The pictures are drawn on a`bhurja’ leaf or a piece of silken cloth or a gold leaf.’- (বিশ্বকোষ-১৫/৫৪৫)
‘It consists in the worship of picture of the female organ drawn in the centre of another consisting of a representation of nine such organs, the whole of which forms the `Sricakra’….The pictures are drawn on a`bhurja’ leaf or a piece of silken cloth or a gold leaf.’- (বিশ্বকোষ-১৫/৫৪৫)
তার মানে, এভাবে নারী-জননাঙ্গের চিত্র অঙ্কন করবার পিছনে এক আদিম বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়; সেই বিশ্বাস হলো নারী-জননাঙ্গের উপরই প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাও নির্ভরশীল। এ-বিষয়ে তন্ত্র-সাধনার আভ্যন্তরীণ তথ্যটুকুও যাচাই করে নেয়া যায়। যেমন, আদিতে দুর্গা যে শস্য-জননী ছিলেন এবং দুর্গোৎসব যে শস্য-উৎসবই ছিলো– সে-বিষয়ে শ্রীযুক্ত চন্দের বক্তব্য থেকেই জানতে পেরেছি আমরা। প্রমাণ হিসেবে তিনি কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, দুর্গোৎসব হলো শারদোৎসব– ফসল পাকবার ঋতু তখন। দ্বিতীয়ত, শাকম্ভরী, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দুর্গার নাম। তৃতীয়ত, দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার গুরুত্ব। শ্রীযুক্ত চন্দের এই প্রমাণগুলি অসামান্য মূল্যবান নিঃসন্দেহে। তার সাথে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিটি স্মরণ করতে পারি–
‘আমাদের দেশে একটা রীতি প্রচলিত আছে যে, সিদ্ধ সাধকগণ জপ-যজ্ঞের ফলে যে ধ্যানগম্য মূর্ত্তি দর্শন করিয়া থাকেন, যাহার মানস পূজা করিয়া কৃতার্থ হন, স্তব স্তোত্রের ইশারায় তাঁহারা সেই রূপের বর্ণনা লোকসাধারণের শ্রবণগোচর করিয়া দেন। সাধারণ পূজকে সাধকের মুখ-নিঃসৃত স্তব শুনিয়া একটা রূপের, একটা প্রতিমার কল্পনা করিয়া লয়, এবং ধাতু, পাষাণ বা মাটির মূর্ত্তি গড়িয়া তাহারই প্রকাশ্যে পূজা অর্চ্চনা করে। লোকহিতের জন্য, সমাজে একটা ভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতি অনুসারে বাঙ্গালায় মূর্ত্তিপূজার প্রচলন হইয়াছে। এখন যে সিংহবাহিনী দশভূজা দুর্গার প্রতিমা গড়িয়া আমরা পূজা করিয়া থাকি, শত বর্ষ পূর্বে ঠিক এমনভাবে প্রতিমা বাংলার কারিকর গড়িত না। গোড়ায় যখন সিংহবাহিনীর মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা এ দেশে প্রচলিত হয়, তখন কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী, কেহই ছিলেন না, তখন একা সিংহবাহিনী মহিষাসুর মথন করিতেছেন। সেকালের সিংহের চেহারা আর এক রকমের ছিল, মহিষাসুরও আজকালকার চোরা অসুরের মতন ছিল না। যাহার যেমন অভিরুচি হইয়াছে, যেমন শখ হইয়াছে, ধ্যানে যে যখন নতুন কিছু দেখতে পাইয়াছে, তখন সে তাহাই প্রতিমার সঙ্গে বসাইয়া দিয়াছে। কারণ, আসল কথা এই যে, দুর্গোৎসবের সময়ে যে প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডীমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে উৎসব করিয়া থাকি, সে উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণ ঘটের, দেবীকে আহ্বান করিতে হয় যন্ত্রে ও ঘটে; কেন না, ঘট ঐখানে পূজকের দেহঘটের অনুকল্প মাত্র। প্রতিমা বাহ্য শোভার জন্য রাখা হয় এবং লোকসাধারণের তুষ্টির জন্য উপার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সামান্য একটু পূজা করা হয়। কালীপূজাতেও ঐ একই ব্যাপার ঘটে। পঞ্চাশৎবর্ণরূপিণী মুণ্ডমালিনী কালীকে আরাধনা করিতে হয় বর্ণে বর্ণে, চক্রে চক্রে; মন্ত্রের উপর হোম করিতে হয়, মন্ত্রের উপর কালিকাশক্তির আহ্বান করিতে হয়। বাহিরের মূর্ত্তি অবলম্বন মাত্র, লোক দেখাইবার ছবি মাত্র।’ (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/২৬৫)
‘আমাদের দেশে একটা রীতি প্রচলিত আছে যে, সিদ্ধ সাধকগণ জপ-যজ্ঞের ফলে যে ধ্যানগম্য মূর্ত্তি দর্শন করিয়া থাকেন, যাহার মানস পূজা করিয়া কৃতার্থ হন, স্তব স্তোত্রের ইশারায় তাঁহারা সেই রূপের বর্ণনা লোকসাধারণের শ্রবণগোচর করিয়া দেন। সাধারণ পূজকে সাধকের মুখ-নিঃসৃত স্তব শুনিয়া একটা রূপের, একটা প্রতিমার কল্পনা করিয়া লয়, এবং ধাতু, পাষাণ বা মাটির মূর্ত্তি গড়িয়া তাহারই প্রকাশ্যে পূজা অর্চ্চনা করে। লোকহিতের জন্য, সমাজে একটা ভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতি অনুসারে বাঙ্গালায় মূর্ত্তিপূজার প্রচলন হইয়াছে। এখন যে সিংহবাহিনী দশভূজা দুর্গার প্রতিমা গড়িয়া আমরা পূজা করিয়া থাকি, শত বর্ষ পূর্বে ঠিক এমনভাবে প্রতিমা বাংলার কারিকর গড়িত না। গোড়ায় যখন সিংহবাহিনীর মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা এ দেশে প্রচলিত হয়, তখন কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী, কেহই ছিলেন না, তখন একা সিংহবাহিনী মহিষাসুর মথন করিতেছেন। সেকালের সিংহের চেহারা আর এক রকমের ছিল, মহিষাসুরও আজকালকার চোরা অসুরের মতন ছিল না। যাহার যেমন অভিরুচি হইয়াছে, যেমন শখ হইয়াছে, ধ্যানে যে যখন নতুন কিছু দেখতে পাইয়াছে, তখন সে তাহাই প্রতিমার সঙ্গে বসাইয়া দিয়াছে। কারণ, আসল কথা এই যে, দুর্গোৎসবের সময়ে যে প্রতিমা গড়াইয়া, চণ্ডীমণ্ডপ জোড়া করিয়া আমরা যে উৎসব করিয়া থাকি, সে উৎসবে ঠিক সেই প্রতিমার পূজা হয় না; পূজা হয় ভদ্রকালীর, পূজা হয় পূর্ণ ঘটের, দেবীকে আহ্বান করিতে হয় যন্ত্রে ও ঘটে; কেন না, ঘট ঐখানে পূজকের দেহঘটের অনুকল্প মাত্র। প্রতিমা বাহ্য শোভার জন্য রাখা হয় এবং লোকসাধারণের তুষ্টির জন্য উপার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সামান্য একটু পূজা করা হয়। কালীপূজাতেও ঐ একই ব্যাপার ঘটে। পঞ্চাশৎবর্ণরূপিণী মুণ্ডমালিনী কালীকে আরাধনা করিতে হয় বর্ণে বর্ণে, চক্রে চক্রে; মন্ত্রের উপর হোম করিতে হয়, মন্ত্রের উপর কালিকাশক্তির আহ্বান করিতে হয়। বাহিরের মূর্ত্তি অবলম্বন মাত্র, লোক দেখাইবার ছবি মাত্র।’ (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/২৬৫)
তাহলে মূল কথা দাঁড়াচ্ছে, দুর্গাপূজার আদি-অকৃত্রিম রূপটিকে চিনতে হলে পুত্রকন্যাপরিবৃতা ওই দশভূজাকে বাদ দিয়ে যন্ত্র ও ঘটের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা প্রয়োজন। এর বর্ণনায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ (পৃষ্ঠা-৪০৪-৯) এ বর্ণিত তথ্যমূলক দীর্ঘ বিবৃতির সহায়তা নিতে পারি–
‘দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ ওই যন্ত্র ও ঘটের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যাক। যন্ত্রটির নাম সর্বতোভদ্রমণ্ডল। এটি তন্ত্রের একটি বিখ্যাত যন্ত্র :
এই চিত্রটি আঁকবার নির্দেশ দিয়ে বলা হচ্ছে (বৃহৎতন্ত্রসার: ৭৪-৫)–
এই চিত্রটি আঁকবার নির্দেশ দিয়ে বলা হচ্ছে (বৃহৎতন্ত্রসার: ৭৪-৫)–
ষটত্রিংশতা পদৈর্মধ্যে লিখেৎ পদ্মং সুলক্ষণম্ ।
বহিঃপঙক্ত্যা ভবেৎ পীঠং পংক্তিযুগ্মেন বীথিকা।।
দ্বারশোতোপশোভাস্রাং শিষ্টাভ্যাং পরিকল্পয়েৎ।
শাস্ত্রোক্তবিধিনা মন্ত্রী ততঃ পদ্মং সমালিখেৎ।।
পদ্মক্ষেত্রস্য সংত্যজ্য দ্বাদশাংশং বিহঃ সুধীঃ।
তন্মধ্যং বিভজেদ্বৃত্তৈস্ত্রিভিঃ সমবিভাগতঃ।।
আদ্যং স্যাৎ কর্ণিকাস্থানং কেশরাণাং দ্বিতীয়কম্ ।
তৃতীয়ং তত্র পত্রাণাং মুক্তাংশেন দলাগ্রকম্ ।।
বাহ্যবৃত্তান্তরালস্য মানেন বিধিনা সুধীঃ।
নিধায় কেশরাগ্রেষু পরিতোহর্ধনিশাকরান্ ।।
লিখিত্বা সার্দ্ধসংস্থানি তত্র সূত্রাণি পাতয়েৎ।
দলাগ্রাণাঞ্চ যন্মানং তন্মানাৎ বৃত্তমালিখেং।।
তদন্তরালং তন্মধ্যসূত্রস্যোভয়তঃ সুধীঃ।
আলিখেদ্বাহ্যহন্তেন দলাগ্রাণি সমন্ততঃ।।
দলমূলেষু যুগশঃ কেশরাণি প্রকল্পয়েৎ।
এতৎ সাধারণং প্রোক্তং পঙ্কজং তন্ত্রবেদিভিঃ।।
———————————————
অঙ্গুলোৎসেধবিস্তারাঃ সীমারেখাঃ নিতাঃ শুভাঃ।
কর্ণিকাং পীতবর্ণেন কেশরাণ্যরুণেন চ।।
শুক্ল-বর্ণানি পত্রাণি তৎসন্ধীন্ শ্যামলেন চ।
রজসা রঞ্জয়েন্মন্ত্রী যদ্বা পীতৈব কর্ণিকা।।
কেশরাঃ পীতরক্তাঃ স্যুররুণানি দলানি চ।
সন্ধয়ঃ কৃষ্ণবর্ণাঃ স্যুঃ সিতেনাপ্যসিতেন বা।।
রঞ্জয়েৎ পীঠগর্ভাণি পাদাঃ স্যুররুণপ্রভাঃ।
গাত্রাণি তস্য শুক্লানি বীথিষু চ চতসৃষু।।
আলিখেৎ কল্পলতিকাং দল-পুষ্প-সমন্বিতাম্ ।
বর্ণৈনানাবিধৈশ্চিত্রৈঃ সর্ব্বদৃষ্টিমনোহরাম্ ।।
দ্বারানি শ্বেতবর্ণানি শোভা রক্তাঃ সমীরিতাঃ।
উপশোভাঃ পীতবর্ণাঃ কোণান্যসিতভানি চ।।
তিস্রো রেখা বহিঃ কার্য্যাঃ সিতরক্তাসিতাঃ ক্রমাৎ।
মণ্ডলং সর্ব্বতোভদ্রমেতৎ সাধারণং মতম্ ।।
অর্থাৎ :
তন্মধ্যে ৩৬টি ঘর লইয়া সুলক্ষণ পদ্ম অঙ্কিত করিবে। ৩৬টি ঘরের বাহিরের এক পংক্তিতে পীঠ, তাহার পরের দুই পংক্তিতে বীথিকা হইবে। পরে অবশিষ্ট দুই পংক্তি দ্বারা মধ্যস্থলে দ্বার, উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া শোভা এবং শোভাদ্বয়ের পার্শ্বে দুইটি করিয়া উপশোভা এবং পরে কোণ প্রস্তুত করিতে হইবে। যে ৩৬টি ঘর লইয়া পদ্ম অঙ্কিত, তাহার দ্বাদশটি ঘর বাহিওে পৃথক রাখিয়া তন্মধ্যস্থ ২৪টি ঘরকে ৩টি বৃত্ত দ্বারা সমভাগে বিভক্ত করিবে। উহার প্রথম বৃত্ত কর্ণিকা, দ্বিতীয় বৃত্ত কেশর ও তৃতীয়টি পদ্মপত্র। যে দ্বাদশাংশ বাহিরে রাখা হইয়াছে, উহা পত্রের অগ্র। তৃতীয় বৃত্তের মধ্যস্থ স্থানের পরিমাণে পদ্মপত্র রচনা করিবে। কেশর সমূহের অগ্রভাগে অর্ধচন্দ্র অঙ্কিত করিবে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি রেখা-সমূহের মধ্যভাগে সূত্রপাত করত পদ্মপত্রের অগ্রগুলির সমান মাপে বৃত্তরেখা আঁকিবে।
মধ্যস্থ সূত্রপাতের দুই পার্শ্বে স্থির হস্তে দলাগ্র আঁকিবে। দলমূলে দুই দুইটি করিয়া কেশর করিতে হয়। ইহাকেই তন্ত্রবেত্তারা সাধারণ পদ্ম কহেন।…
এক অঙ্গুলি উৎসেধ অর্থাৎ বেধ পরিমাণে শুভ্রবর্ণদ্বারা সীমারেখা সকল চিত্রিত করিয়া পীতবর্ণদ্বারা কর্ণিকা, রক্তবর্ণ গুণ্ডিকাদ্বারা কেশর ও শুক্লবর্ণদ্বারা পত্রসকল রঞ্জিত করিয়া শ্যামবর্ণে সমস্ত সন্ধিস্থানে চিত্রিত করিবে। প্রকারান্তরে যথা– কর্ণিকা পীতবর্ণ, কেশরসকল পীত রক্তবর্ণ, পত্রসকল রক্তবর্ণ, সন্ধি কৃষ্ণবর্ণ, পীঠগর্ভ শুক্লবর্ণ কিংবা কৃষ্ণবর্ণ, পীঠপাদ রক্তবর্ণ ও পীঠগাত্র শুক্লবর্ণ করিয়া বীথিচতুষ্টয়ে পত্র ও পুষ্প সহিত কল্পলতা সর্ববর্ণদ্বারা বিচিত্রিত করিবে। এই কল্পলতিকা দর্শনমনোহর করিবে। দ্বারসকল শুক্লবর্ণ, শোভা রক্তবর্ণ, উপশোভা পীতবর্ণ ও কোণ চতুষ্টয় কৃষ্ণবর্ণ করিবে। মন্ডলের বহির্দেশে শ্বেত রক্ত ও কৃষ্ণবর্ণ তিনটি রেখা চিত্রিত করিবে। এই প্রকারে সাধারণ সর্বতোভদ্রমণ্ডল নির্মাণ করিতে হইবে।
এতোখানি জ্যামিতিক নিষ্ঠা নিয়ে, শোভা এবং উপশোভায় বিভূষিত করে, এই যে সর্বতোভদ্রমণ্ডলটি আঁকবার নির্দেশ পাওয়া গেলো, এর মূল কথা কী? তন্ত্রবেত্তারা জানেন, এর মূল কথা হলো অষ্টদলপদ্ম ও বীথিকা:
ষটত্রিংশতা পদৈর্মধ্যে লিখেৎ পদ্মং সুলক্ষণম্ ।
বহিঃপঙক্ত্যা ভবেৎ পীঠং পংক্তিযুগ্মেন বীথিকা।।
(অর্থাৎ : তন্মধ্যে ৩৬টি ঘর লইয়া সুলক্ষণ পদ্ম অঙ্কিত করিবে। ৩৬টি ঘরের বাহিরের এক পংক্তিতে পীঠ, তাহার পরের দুই পংক্তিতে বীথিকা হইবে।)
ষটত্রিংশতা পদৈর্মধ্যে লিখেৎ পদ্মং সুলক্ষণম্ ।
বহিঃপঙক্ত্যা ভবেৎ পীঠং পংক্তিযুগ্মেন বীথিকা।।
(অর্থাৎ : তন্মধ্যে ৩৬টি ঘর লইয়া সুলক্ষণ পদ্ম অঙ্কিত করিবে। ৩৬টি ঘরের বাহিরের এক পংক্তিতে পীঠ, তাহার পরের দুই পংক্তিতে বীথিকা হইবে।)
সুলক্ষণ পদ্ম এবং বীথিকা; ওই বীথিকার নাম কল্পলতিকা :
আলিখেৎ কল্পলতিকাং দল-পুষ্প-সমন্বিতাম্ ।
(অর্থাৎ : পত্র ও পুষ্প সহিত কল্পলতা সর্ববর্ণদ্বারা বিচিত্রিত করিবে।)
প্রথমে মনে রাখা দরকার, তন্ত্রে এই পদ্ম এবং বীথিকার গুরুত্ব কতোখানি। কেননা, শুধুমাত্র সর্বতোভদ্রমণ্ডল নয়, প্রায় সমস্ত তান্ত্রিক যন্ত্রেরই মূল বিষয়বস্তু বলতে এই পদ্ম এবং বীথিকাই। তান্ত্রিক যন্ত্রের ছবিগুলিকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে খুঁটিনাটির তারতম্য থাকলেও অষ্টদলপদ্ম এবং বীথিকাই সমস্ত চিত্রের মূল বিষয়বস্তু।
অতএব, যন্ত্র-প্রসঙ্গে প্রধানতম প্রশ্ন ওঠে, ওই পদ্ম বা অষ্টদলপদ্মের প্রকৃত তাৎপর্য কী ? বাংলার পূজাপদ্ধতি এবং তন্ত্রেও যন্ত্র-সংকেতের সঙ্গে সামান্যমাত্র পরিচয় যাঁর আছে তিনিই জানেন, তন্ত্রে পদ্ম বা অষ্টদলপদ্ম নারী-জননাঙ্গের প্রতীক মাত্র। অনেক সময় তান্ত্রিক রচনায় পদ্ম শব্দটিকে একেবারে সোজাসুজি সেই অর্থেই গ্রহণ করা হয়। যথা :
অতএব, যন্ত্র-প্রসঙ্গে প্রধানতম প্রশ্ন ওঠে, ওই পদ্ম বা অষ্টদলপদ্মের প্রকৃত তাৎপর্য কী ? বাংলার পূজাপদ্ধতি এবং তন্ত্রেও যন্ত্র-সংকেতের সঙ্গে সামান্যমাত্র পরিচয় যাঁর আছে তিনিই জানেন, তন্ত্রে পদ্ম বা অষ্টদলপদ্ম নারী-জননাঙ্গের প্রতীক মাত্র। অনেক সময় তান্ত্রিক রচনায় পদ্ম শব্দটিকে একেবারে সোজাসুজি সেই অর্থেই গ্রহণ করা হয়। যথা :
‘পদ্মমধ্যে গতে শুক্রে সন্ততিস্তেন জায়তে।।’ (বিশ্বকোষ-৭/৫৪১)
(অর্থাৎ, পদ্মমধ্যে শুক্রের মিলনে সন্ততির জন্ম।)
তন্ত্রে ‘পদ্ম’-শব্দের এই জাতীয় ব্যবহার একটুও দুর্লভ নয়। বৌদ্ধতন্ত্র প্রসঙ্গে আধুনিক বিশেষজ্ঞ বলছেন (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪০৯)–
‘Vajra’ (with the variant `mani’) is a decent or mystic phrase for `linga’, the male organ, just as `padma’, lotus, is the literary rendering of `bhaga’ or `yoni’.’
অর্থাৎ : বজ্র (বা মণি) শব্দ পুরুষ-অঙ্গবাচক, যেমন পদ্ম শব্দ হলো ভগ বা নারী-জননাঙ্গের সাহিত্যিক প্রতিশব্দ।
‘Vajra’ (with the variant `mani’) is a decent or mystic phrase for `linga’, the male organ, just as `padma’, lotus, is the literary rendering of `bhaga’ or `yoni’.’
অর্থাৎ : বজ্র (বা মণি) শব্দ পুরুষ-অঙ্গবাচক, যেমন পদ্ম শব্দ হলো ভগ বা নারী-জননাঙ্গের সাহিত্যিক প্রতিশব্দ।
তাহলে পদ্মের অর্থ নারীজননাঙ্গই। এই পদ্মই হলো সর্বতোভদ্রমণ্ডলের– তথা সমস্ত তান্ত্রিক যন্ত্রের– মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু সেই সঙ্গেই লক্ষ্য করা দরকার, তান্ত্রিক যন্ত্রগুলিতে শুধুমাত্র পদ্মের চিত্র নয়; পদ্মকে ঘিরে রয়েছে বীথিকা। নারী-জননাঙ্গের সঙ্গে বীথিকার সম্পর্ক কী? তান্ত্রিক যন্ত্র প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটি স্বভাবতই সবচেয়ে মৌলিক। যুক্তি অনুসারে, এর মূলে আছে এক আদিম বিশ্বাস : যে-বিশ্বাস থেকে দেবীর নাম হয়েছিলো শাকম্ভরী, কিংবা, যে-বিশ্বাসের মূর্ত পরিচয় হরপ্পার ওই অত্যাশ্চর্য সীলটিতে টিকে আছে। এবং, এইভাবে প্রাকৃতিক উর্বরতার সঙ্গে মানবীর উর্বরতার সংযোগ কল্পনা করা হয়েছে বলেই তন্ত্রে নারী-জননাঙ্গকে উদ্ভিদ-বাচক নাম (লতা) দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায়– ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার বিশেষ বিশেষ ফুলকেই যন্ত্র হিসাবে ধরে নিয়ে তার উপর দেবীপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। ঐ ফুলগুলির অনেকগুলির ক্ষেত্রেই বাহ্যত দেখা যায় যোনি আকৃতি অথবা স্ত্রীপুং মিলনের আকৃতি। জগজ্জননীর পূজার আধার হয়েছে তাই ঐ সব পুষ্প। এ ফুলগুলিকে তান্ত্রিক মহলে বলা হয় যন্ত্রপুষ্প। শাস্ত্রকারের উক্তি হলো–
ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায়– ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার বিশেষ বিশেষ ফুলকেই যন্ত্র হিসাবে ধরে নিয়ে তার উপর দেবীপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। ঐ ফুলগুলির অনেকগুলির ক্ষেত্রেই বাহ্যত দেখা যায় যোনি আকৃতি অথবা স্ত্রীপুং মিলনের আকৃতি। জগজ্জননীর পূজার আধার হয়েছে তাই ঐ সব পুষ্প। এ ফুলগুলিকে তান্ত্রিক মহলে বলা হয় যন্ত্রপুষ্প। শাস্ত্রকারের উক্তি হলো–
“যত্রাপরাজিতা পুষ্পং জবাপুষ্পঞ্চ বিদ্যতে।
করবীরে শুক্লরক্তে দ্রোণঞ্চ যত্র তিষ্ঠতি।
তত্র দেবী বসেন্নিতাং তদ্ যন্ত্রে চণ্ডিকার্চনম্ ।।”
( যেখানে অপরাজিতা, জবা, শ্বেতকরবী, রক্তকরবী ও দ্রোণপুষ্প থাকে, সেখানে চণ্ডিকাদেবী নিত্য বাস করেন। তাই এইসব যন্ত্রপুষ্পে দেবীর পূজা করবে।)
এই তালিকায় পদ্মের নাম করা হয়নি। এর কারণ পদ্মকে শাস্ত্রকাররা স্বাভাবিক যন্ত্র বলে থাকেন।’- (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় / দুর্গামাহাত্ম্য ও পূজাপ্রসঙ্গ)
এই আদিম বিশ্বাসটির দিক থেকে শক্তি-সাধনার তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তন্ত্রমতে নারী-জননাঙ্গের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। যেমন- ‘স্ত্রীভগং পূজনাধারঃ’ অর্থাৎ, ‘স্ত্রীভগ বা নারীযোনি হচ্ছে সকল উপাসনার আধার বা উৎস’; এজাতীয় কথা তন্ত্রে বহুবার পাওয়া যায়। তন্ত্রের একটি প্রসিদ্ধ সাধনার নামই হলো ‘ভগযাগ’। এছাড়া তন্ত্র সাহিত্যে ‘লতা’ শব্দের প্রচুর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কেননা, তন্ত্র-সাহিত্যে ‘লতা’ শব্দের একটি পারিভাষিক অর্থ আছে। সে-অর্থ হলো, নারী-জননাঙ্গ। তন্ত্র-সাধনায় অন্যান্য গুহ্য সাধনার মতো আরেকটি গুহ্য ও কঠিন সাধনার নাম লতা-সাধনা। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন–
‘সে সাধনা অতি কঠোর, অতি দুরারাধ্য। শিব বলিয়াছেন যে, “ হে দেবি, তোমার মত নারী এবং আমার মতন পুরুষ হইলেই এই খেলা খেলিতে পারে। বরং ফণী ধরিয়া বিষভক্ষণ করা সহজ, বরং সিংহশার্দূলের সহিত যুদ্ধ করা সহজ, কিন্তু লতা-সাধনা অতি কঠিন, অতি কঠোর। যে পুরুষের নারীরূপ দেখিয়া কামমোহ উৎপন্ন হইতে পারে, যে রতিজন্য সুখাস্বাদে বিভোর হয়, সে যেন এমন কাজ না করে।” এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া শিব আবার বলিতেছেন,– সমস্ত জগৎকে স্ত্রীময় ভাবিতে হইবে। শক্তিই শিব, শিবই শক্তি– এই সমস্ত জগৎই শক্তির স্বরূপ। যিনি এই নিখিল জগৎ শক্তিরূপে দর্শন করিতে না পারেন, তিনি যে এ সাধনায় প্রবৃত্ত না হন।’- (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী-২/২৫১)
‘সে সাধনা অতি কঠোর, অতি দুরারাধ্য। শিব বলিয়াছেন যে, “ হে দেবি, তোমার মত নারী এবং আমার মতন পুরুষ হইলেই এই খেলা খেলিতে পারে। বরং ফণী ধরিয়া বিষভক্ষণ করা সহজ, বরং সিংহশার্দূলের সহিত যুদ্ধ করা সহজ, কিন্তু লতা-সাধনা অতি কঠিন, অতি কঠোর। যে পুরুষের নারীরূপ দেখিয়া কামমোহ উৎপন্ন হইতে পারে, যে রতিজন্য সুখাস্বাদে বিভোর হয়, সে যেন এমন কাজ না করে।” এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া শিব আবার বলিতেছেন,– সমস্ত জগৎকে স্ত্রীময় ভাবিতে হইবে। শক্তিই শিব, শিবই শক্তি– এই সমস্ত জগৎই শক্তির স্বরূপ। যিনি এই নিখিল জগৎ শক্তিরূপে দর্শন করিতে না পারেন, তিনি যে এ সাধনায় প্রবৃত্ত না হন।’- (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী-২/২৫১)
গুপ্তসাধনতন্ত্রের প্রথম পটলেও দেখি মহেশ্বর শিব দেবী পার্ব্বতিকে বলছেন (গুপ্তসাধনতন্ত্র-১/৮-৯)–
কিঞ্চিন্ময়া তু চাপল্যাৎ কথায়ামি শৃণুষ্ব মে।
শক্তিমুলং জগৎ সর্ব্বং শক্তিমুলং পরন্তপঃ।। ৮
শক্তিমাশ্রিত্য নিবসেদ্ যত্র কুত্রাশ্রমে বসন্ ।
সাধকস্যার্চ্চিতাং শক্তিং সাধকজ্ঞানকারিণীম্ ।। ৯
অর্থাৎ :
দেবি! তোমার নিকট কুলাচার মাহাত্ম্য বর্ণন করা আমার চপলতা মাত্র। তথাপি তোমার নিকট যথাশক্তি কিঞ্চিন্মাত্র কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। শক্তিই অনন্ত জগতের আদিকারণ এবং শক্তিই সমস্ত তপস্যার মূল। ৮।। সাধকগণ শক্তিকে আশ্রয় করিয়া যে কোন আশ্রমে বাস করুক না কেন, তাহাতেই তাহারা সিদ্ধিলাভ করিতে পারে। সাধকগণ শক্তির অর্চনা করিলেই সেই শক্তি সাধকের জ্ঞান প্রদান করেন। ৯।।
এই কুলশক্তির অর্চনা করতে প্রয়োজন হয় কুলাঙ্গনার। কারণ গুপ্তসাধনতন্ত্রেই দেখতে পাই, মহেশ্বর পার্বতীকে বলছেন (গুপ্তসাধনতন্ত্র-১/১০-১৪)–
ইহলোকে সুখং ভুক্ত্বা দেবীদেহে প্রলীয়তে।
সাধকেন্দ্রো মহাসিদ্ধিং লব্ধ্বা যাতি হরেঃ পদম্ ।। ১০
পঞ্চাচারেণ দেবেশি কুলশক্তিং প্রপূজয়েৎ।
নটী কাপালিকী বেশ্যা রজকী নাপিতাঙ্গনা।। ১১
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যাঃ প্রকীর্ত্তিতাঃ।। ১২
বিশেষবৈদগ্ধ্যযুতাঃ সর্ব্বা এব কুলাঙ্গনাঃ।
রূপযৌবনসম্পন্না শীলসৌভাগ্যশালিনী।। ১৩
পূজনীয়া প্রযত্নেন ততঃ সিদ্ধির্ভবেদ্ ধ্রুবম্ । ১৪
অর্থাৎ :
যে সাধক শক্তির আরাধনা করেন, তিনি ইহলোকে বিবিধ সুখভোগ করিয়া দেবীদেহে প্রলীন হইতে পারেন এবং সেই সাধকেন্দ্র শক্তিসাধনবলে মহাসিদ্ধি লাভ করিয়া অন্তে হরিপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। ১০।। দেবেশি! পঞ্চাচার ক্রমে কুলশক্তির অর্চ্চনা করিবে। নটী, কাপালিককন্যা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতপত্নী, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা ও মালাকারকন্যা ইহারাই নবকন্যা বলিয়া কীর্ত্তিত আছে। ১১-১২।। বিশেষতঃ যাহারা বিশেষ গুণশালিনী এইরূপ সর্ব্বজাতীয় রূপযৌবনসম্পন্না, সুশীলা ও সৌভাগ্যশালিনী কন্যাও কুলাঙ্গনা বলিয়া গ্রহণ করা যায়। ১৩।। উক্ত কুলাঙ্গনা সকলকে যত্নপুরঃসর পূজা করিবে। এইরূপ অর্চ্চনাদ্বারা সাধকের নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হইয়া থাকে। ১৪।
এক্ষেত্রে সম্ভবত সহজেই অনুমেয় হয় যে, বস্তুত কুলাচার বা কুলশক্তির অর্চনা ও লতা-সাধনার মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য নেই। তাহলে এরকম গুহ্য ও কঠিন লতা-সাধনার মূল কথাটা কী? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৩৯৯) উদ্ধৃতি টেনেছেন এভাবে–
‘এই সাধনার প্রধান অধিকরণ স্ত্রী, এইজন্য ইহাকে লতাসাধনা কহে। এই সাধনার বিষয় তন্ত্রে বর্ণিত হইয়াছে…
লতায়াঃ সাধনং বক্ষ্যে শৃণুস্ব হরবল্লভে।
শতং কেশে শতং ভালে শতং সিন্দুরমন্ডলে।।
স্তনদ্বয়ে শতদ্বন্দ্বং শতং নাভৌ মহেশ্বরি।
শতং যোনৌ মহেশানি উত্থায় চ শতত্রয়ম্ ।।
এবং দশশতং জপ্ত্বা সর্ব্বসিদ্ধিশয়ো ভবেৎ।
অথান্যৎ সংপ্রবক্ষ্যামি সাধনং ভুবি দুর্লভম্ ।।
রজোহবস্থাং সমানীয় তদ্ যোনৌ স্বেষ্টদেবতাম্ ।
পূজয়িত্বা মহারাত্রৌ ত্রিদিনং পূজয়েন্মনুম্ ।।
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
[ভাবার্থ : বিশ্বকোষ, ১৭ খন্ড, ১৮৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
বলাই বাহুল্য, আমাদের আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে এ জাতীয় চিন্তাধারা বীভৎস কামবিকারের পরিচায়কমাত্র বলেই দেবীপ্রসাদ বাংলা তর্জমাটুকু এখানে উদ্ধত না করে কেবল সূত্র উল্লেখ করেছেন। প্রায় অনুরূপ কুলাচার পালন ও সাধনার বর্ণনা গুপ্তসাধনতন্ত্র’র চতুর্থ পটলে (গুপ্তসাধনতন্ত্র-৪/৩-৯) এবং কুমারীতন্ত্রেও (কুমারীতন্ত্র-৬/২১-২৩) দেখতে পাওয়া যায় (গ্রন্থান্তরে তন্ত্র প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)।
আবার বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তাও রীতিমতো কৌতুহলোদ্দীপকই বলা যায়–
আবার বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তাও রীতিমতো কৌতুহলোদ্দীপকই বলা যায়–
বৃহস্পতিসমো যন্তু ভবিতুং কাময়েন্নরঃ।
সর্ব্বো বৃহস্পতিসমো ভবেচ্চৈব ন সংশয়ঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/১৯)
সুন্দরীং যৌবনোন্মত্তাং নারীমানীয় নিত্যশঃ।
অষ্টোত্তরশতং জপ্তা কুলমামন্ত্র্য মন্ত্রবিৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২০)
মৈথুনং যঃ করোত্যেব স তু সর্ব্বং ফলং লভেৎ।
তন্মুখে চ মুখং চ দত্ত্বা সহস্রং মানসং জপেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২১)
স ভবেৎ সর্ব্বসিদ্ধিদো নাত্র কার্য্যবিচারণা।
সর্ব্বেষাং সাধনাং মধ্যে শ্রেষ্ঠঃ স্যাৎ কুলসাধনম্ ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২২)
তস্মাৎ সর্ব্বপ্রযত্নেন সাধয়েৎ সুসমাহিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২৩)।
অর্থাৎ :
যে ব্যক্তি বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হইতে ইচ্ছা করে সে ব্যক্তি এই সাধনাপ্রভাবে বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান হইয়া থাকে, এতদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ১৯।। প্রত্যহ সুন্দরী যৌবনোন্মতা কুলযুবতী আনয়নপূর্ব্বক প্রথমে কুলাগার অভিমন্ত্রিত করিবে। তৎপর মন্ত্রজ্ঞ সাধক অষ্টোত্তর শতবার কালিকামন্ত্র জপ করিয়া ঐ কুলস্ত্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে কুলস্ত্রীর সহিত রতিক্রিয়া সম্পন্ন করিলে সাধক পূর্ণফল লাভ করিয়া থাকে। রতিকালে কুলযুবতীর মুখে মুখ প্রদান করিয়া এক-সহস্র সংখ্যক মানস জপ করিবে। ২০-২১।। যে ব্যক্তি এইরূপে কার্য্য করে সে সর্ব্বসিদ্ধিদাতা হইয়া থাকে। এতদ্বিষয়ে বিচার বিতর্ক অনাবশ্যক। সর্ব্বপ্রকার সাধন পদ্ধতির মধ্যে কুলাচারমতে সাধনই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং সর্ব্বপ্রযত্নে অত্যন্ত একাগ্রতার সহিত কুলাচার পদ্ধতিতে সাধন করিবে। ২২-২৩।
বস্তুত, তান্ত্রিক মতের মূল চেতনা হলো- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে দেহভাণ্ডে।’ তান্ত্রিক সাধনার এই দৃষ্টিভঙ্গি শাক্ত-ধারণার সাধনরূপ মাত্র। রহস্য-চিহ্নায়ক তন্ত্র-নির্দেশনায় প্রাচীন তন্ত্র-সাধনার গূঢ়তত্ত্বে আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে পঞ্চমকারের তথ্য এখন হয়তো আর গোপন নেই। এক্ষেত্রে যদিও তান্ত্রিক রিচ্যুয়াল বা আধ্যাত্মিক তন্ত্রবিশ্বাস মতে বলা হয়ে থাকে, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গূঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। তবে তন্ত্রসাধনায় যত গূঢ় রহস্যই থাকুক না কেন, এটা যে কোন প্রাচীন উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসের মাধ্যমে বিবর্তিত এক কামপ্রধান আচারই হবে তা বিদ্বান গবেষকেরা দৃঢ়ভাবে অনুমান করেন। কিন্তু সবকথা ছাপিয়ে তন্ত্রসাধনায় বীজমন্ত্রের প্রাধান্যকে কখনোই অবহেলা করা হয়নি। যেমন-
কামেন মায়য়া চৈব পুটিতং কামবীজকম্ ।
তদা কামেশ্বরো মন্ত্রঃ সর্ব্বকামফলপ্রদঃ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৩৫)
অর্থাৎ : কামবীজ (ক্লীং) এবং মায়াবীজ (হ্রীং) দ্বারা কামবীজকে পুটিত করিলে, তাহা সর্ব্বকাম ফলপ্রদ কামেশ্বর মন্ত্র হয়। (ক্লীং হ্রীং ক্লীং হ্রীং ক্লীং)।
তন্ত্রসাধকদের ধ্যান-ধারণায় একাক্ষরী বা দ্ব্যক্ষরী ইত্যাদি মন্ত্রচৈতন্য বা বীজমন্ত্রের ব্যবহার ও তার প্রতীকী কর্মশক্তি ও ফলপ্রদানের উপর প্রচণ্ড আস্থা ও বিশ্বাসের ছাপ আমরা ইতোমধ্যেই অনুধাবন করেছি। তাই দেখতে পাই, তন্ত্রে বলা হচ্ছে–
অস্যাঃ স্মরণমাত্রেণ জীবন্মুক্তশ্চ সাধকঃ।
একোচ্চারণমাত্রেণ অশ্বমেধাযুতং ফলম্ ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৪৯)
অর্থাৎ : কালিকামন্ত্র স্মরণমাত্রই সাধক জীবন্মুক্তি লাভ করে এবং একবার মাত্র উচ্চারিত হইলে অযুত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পাদনের ফল লাভ হয়।
এবং এই বীজমন্ত্র যে কোন-না-কোনো দেবীশক্তির ধ্যানপ্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা তন্ত্রসাহিত্যগুলি ঘাটলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন তন্ত্রে এই শক্তিদেবীর বিভিন্ন নাম থাকলেও তান্ত্রিক আচারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কোথাও তিনি চণ্ডিকা, কোথাও অম্বিকা, কোথাও কামেশ্বরী, কোথাও চামুণ্ডা, কোথাও জগদম্বিকা, কোথাও তারা, কোথাও বা কালী বা কালিকা ইত্যাদি। কিন্তু তন্ত্রযোগের সাধনপ্রক্রিয়ায় এইসব মন্ত্রচৈতন্য তথা বীজমন্ত্রের ভূমিকা ও কার্যকর শক্তি যে কী বিপুল, তা তন্ত্রসাধনায় কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের ‘কুলাচার-কথন’ উপাখ্যানের মাধ্যমেও অনুধাবন করা যায়, যেমন–
শ্রীদেব্যুবাচ-
দেবদেব মহাদেব জগৎপ্রলয়কারকঃ।।
কুলাচারে তু মদ্যাদ্যৈঃ কথং সিদ্ধির্ভবেৎ প্রভো।
অর্ধমকারনং হ্যেতৎ সংশয়ং ছিন্দি মে প্রভো।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১)
শ্রীভৈরব উবাচ-
সাধু পৃষ্ঠো হি দেবেশি কথয়ামি শৃণুম্ব মে।
পুরা দারুবনে রম্যে মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মদ্যং পিবন্তি নিত্যশঃ।
তদ্দষ্টানুচিতং কর্ম্ম বির্ষ্ণুমাং সমুপস্থিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৩)
দেবদেব মহাদেব সৃষ্টিস্থিতিলয়াত্মকঃ।
প্রভো দারুবনে পাপা মদ্যপানরতাস্তথা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৪)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।
দিগম্বরাশ্চ মত্তাশ্চ কিং গতিশ্চ ভবিষ্যতি।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৫)
ইতি বিষ্ণুবচঃ শ্রুত্বা তমবাদমহং প্রিয়ে।
কালিকায়া মহাবিদ্যা অনিরুদ্ধঃ সরস্বতী।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৬)
বিদ্যারাজ্ঞীতি সা প্রোক্তা এতন্মন্ত্রপ্রজপকাঃ।
পরং মুক্তা ভবিষ্যন্তি তদ্গায়ত্রীং জপন্তি চ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৭)
কালিকায়াঃ প্রভাবেন সর্ব্বে দেবা বিমোহিতাঃ।
ভ্রুণহত্যা-মাতৃবধাৎ পরশুরামো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৮)
দত্তাত্রেয়শ্চ ত্রিপুরঃ সুরাপানাদ্বিমোচিতঃ।
ব্রহ্মহত্যা-শিরচ্ছেদাদহং রুদ্রোহপি মোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৯)
গৌতমস্ত্রীধর্ষণাচ্চ দেবেন্দ্রোহপি বিমোচিতঃ।
কন্যায়া ধর্ষণাদ্বাপি ব্রহ্মাবাচং বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১০)
চাণ্ডালীগমনাদ্বাপি বশিষ্ঠোহপি বিমোচিতঃ।
রাবণস্য বধাচ্চাপি রামচন্দ্রো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১১)
.
অর্থাৎ :
দেবী কহিলেন- হে দেবদেব মহাদেব। আপনি জগৎ প্রলয়কারক। হে প্রভু ! কুলাচারবিধি-নির্দ্দিষ্ট মদ্যাদি পঞ্চমকার অধর্ম্ম অর্থাৎ পাপ সৃষ্টির কারণ। সুতরাং তৎসমুদয় কিরূপে মন্ত্রসিদ্ধি-প্রদায়ক হইতে পারে প্রকাশ করিয়া আপনি আমার সন্দেহ দূর করুন। ১।
ভৈরব কহিলেন- দেবেশি ! তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে মুনিগণ কামমোহিত চিত্তে রম্য দারুবনে নিয়ত মদ্যপান এবং পরস্ত্রী ধর্ষণকার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। মুনিগণের এই সকল অন্যায় কার্য্য দর্শন করিয়া, বিষ্ণু আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। ২-৩।
তখন বিষ্ণু আমাকে বলিতে লাগিলেন, হে দেবদেব মহাদেব ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের কর্ত্তা। হে প্রভো ! দারুবনে কামমোহিত মদ্যপায়ী পাপাত্মা দিগম্বর ও পানমত্ত মুনিগণ পরস্ত্রী ধর্ষণ করিতেছে। ইহাদের কি গতি হইবে। ৪-৫।
হে প্রিয়ে ! তৎকালে বিষ্ণুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, কালিকা-নামক যে মহামন্ত্র এবং অনিরুদ্ধ যাহার সরস্বতী, যাহা মন্ত্রসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এই সকল মুনিগণ সেই মহামন্ত্র জপ করে। সেই কালিকা গায়ত্রী জপ করিয়া ইহারা সকলেই শ্রেষ্ঠ মুক্তি লাভ করিবে। ৬-৭।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দেবতারাও বিমোহিত হইয়া থাকেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে পরশুরাম ভ্রুণহত্যা ও মাতৃবধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। ৮।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দত্তাত্রেয় এবং ত্রিপুর সুরাপানের পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। আমি রুদ্রও স্বয়ং ব্রহ্মহত্যা বা ব্রহ্মার শিরচ্ছেদরূপ পাতক হইতে কালিকাদেবীর প্রভাবেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলাম। ৯।
সুরপতি ইন্দ্রও কালিকাদেবীর প্রভাবে গুরুপত্নী গৌতমীতে ধর্ষণজনিত পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন এবং ব্রহ্মাও কন্যাধর্ষণহেতু পাপ হইতে, বশিষ্ঠ চাণ্ডালীগমন পাপ হইতে এবং রামচন্দ্র রাবণবধজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। ১০-১১।
সে যাই হোক, আমাদের আধুনিক যুগের পটভূমিতে এই তান্ত্রিক সাধনপদ্ধতিকে যতো বীভৎস বিকৃতি বলে প্রতীয়মান হোক না কেন, সমাজবিকাশের যে-পর্যায়ে এগুলির উদ্ভব হয়েছিলো একমাত্র তারই পটভূমিতে এগুলির আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধান করা যাবে। অতএব, তান্ত্রিক সাধনপদ্ধতিকে বীভৎস-বিকৃতি বলে নিজস্ব ধারণা-আরোপ করার আগে এই সাধনপন্থার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে অবহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তন্ত্রের তত্ত্বদৃষ্টি প্রসঙ্গে আলোচনা অন্যত্র করা যাবে। কিন্তু দেবীপূজার প্রধান অঙ্গ হিসেবে তন্ত্র-বিহিত ‘যন্ত্র’ যে বস্তুত দেবী বা অনুরূপ কল্পনার প্রতীকী পরিকল্পনাই, সে বিষয়ে দ্বিধা থাকা সঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়। গুপ্তসাধনতন্ত্রেও আমরা এই যন্ত্রে পূজার বিধান উল্লেখ দেখতে পাই (গুপ্তসাধনতন্ত্র-৮/১২-১৪, ১৬-১৭)–
শালগ্রামে মণৌ যন্ত্রে প্রতিমায়াং সুরেশ্বরি।
পুস্তিকায়াঞ্চ গঙ্গায়াং সামান্যে চ জলে তথা।। ১২
অথবা পুষ্পযন্ত্রে চ পূজয়েচ্ছিবলিঙ্গকে।
যন্ত্রভেদেন দেবেশি ফলং সম্যক্ প্রজায়তে।। ১৩
শালগ্রামে শতগুণং মণৌ তদ্বৎ ফলং লভেৎ।
যন্ত্রে লক্ষগুণং প্রোক্তং প্রতিমায়াং তথৈব চ।। ১৪
পুষ্পযন্ত্রে মহেশানি পূজনাং সর্ব্বসিদ্ধিভাক্ ।
শিবলিঙ্গে মহেশানি অনন্তফলমীরিতম্ ।। ১৬
ন কুর্য্যাৎ পার্থিবে লিঙ্গে দেবীপূজাদিকাঃ ক্রিয়াঃ।
পার্থিবে পূজনাদ্দেবি সিদ্ধিহানিঃ প্রজায়তে।। ১৭
অর্থাৎ :
শালগ্রামে, শিলাতে, মণিতে, যন্ত্রে, প্রতিমাতে, পুস্তকে, গঙ্গাতে, সামান্যজলে, পুষ্পযন্ত্রে অথবা শিবলিঙ্গে সাধক দেবীর পূজা করিবে। দেবেশি! যন্ত্রবিশেষে পূজা করিলে ফলের তারতম্য হইয়া থাকে। ১২-১৩।। শালগ্রাম শিলাতে দেবীর পূজা করিলে সেই পূজাতে শতগুণ ফললাভ হয়, মণিতে পূজা করিলেও উক্তরূপ ফললাভ হইয়া থাকে। যন্ত্রেতে ও প্রতিমাতে পূজা করিলে লক্ষগুণ ফল কথিত আছে। ১৪।। মহেশানি পুষ্পযন্ত্রে পূজা করিলে সাধক সর্ব্বপ্রকার সিদ্ধিভাগী হয়, শিবলিঙ্গে পূজা করিলে অনন্তফল হইয়া থাকে। ১৬।। প্রিয়ে! কদাচ পার্থিবলিঙ্গে দেবীর পূজাদি ক্রিয়া করিবে না, দেবী! পার্থিবলিঙ্গে পূজা করিলে সিদ্ধিহানি হইয়া থাকে। ১৭।।
অতএব, আমাদের আলোচ্য দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ যে যন্ত্র ও ঘট, তান্ত্রিক প্রণালীতে ইতঃপূর্বে যন্ত্রের তাৎপর্য দেখেছি সর্বতোভদ্রমণ্ডলের আলোচনায়। এরপর সর্বতোভদ্রমণ্ডলের উপর ঘট প্রতিষ্ঠা করা হবে। এক্ষেত্রে ‘ক্রিয়াকাণ্ড-বারিধি’তে ঘট স্থাপন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে–
‘অনন্তর সর্বতোভদ্রমণ্ডলোপরি ঘট স্থাপন করিবে। যথা,– শুদ্ধ মৃত্তিকায় পঞ্চশস্য নিক্ষেপ করিবে, তদুপরি ধৌত সুলক্ষণ ঘট, তাহাতে দধ্যক্ষত (দধি মাখানো আতপ চাউল) দিয়া শুদ্ধ জলপূর্ণ করিয়া স্থাপন করিবে। তাহার কণ্ঠে আচারৎ লাল সুতা ও আলতা দেওয়া হয়। মধ্যে পঞ্চপল্লব (আম্র, অশ্বত্থ, বট, পাকুড়, যজ্ঞীয়ডুম্বুর শাখা), অলভে কেবল আম্রপল্লব দিবে। তদভাবে দুইটি পানও দিবার ব্যবস্থা আছে। এক সরা চাউলে একটি হরিতকী কিংবা সুপারী দিয়া তদুপরি স্থাপন করিবে। তদুপরি একটি নির্দোষ সশীর্ষ ফল (নারিকেল অথবা কদলী) দিবে; ঐ ফলকে সিন্দুর রঞ্জিত করিবে। ঘটে একটি সিন্দুর পুত্তলিকা আঁকিবে, পুষ্পমাল্য দিয়া শোভিত করিবে…।’ (ক্রিয়াকাণ্ড-বারিধি-১/২৩৯)
‘অনন্তর সর্বতোভদ্রমণ্ডলোপরি ঘট স্থাপন করিবে। যথা,– শুদ্ধ মৃত্তিকায় পঞ্চশস্য নিক্ষেপ করিবে, তদুপরি ধৌত সুলক্ষণ ঘট, তাহাতে দধ্যক্ষত (দধি মাখানো আতপ চাউল) দিয়া শুদ্ধ জলপূর্ণ করিয়া স্থাপন করিবে। তাহার কণ্ঠে আচারৎ লাল সুতা ও আলতা দেওয়া হয়। মধ্যে পঞ্চপল্লব (আম্র, অশ্বত্থ, বট, পাকুড়, যজ্ঞীয়ডুম্বুর শাখা), অলভে কেবল আম্রপল্লব দিবে। তদভাবে দুইটি পানও দিবার ব্যবস্থা আছে। এক সরা চাউলে একটি হরিতকী কিংবা সুপারী দিয়া তদুপরি স্থাপন করিবে। তদুপরি একটি নির্দোষ সশীর্ষ ফল (নারিকেল অথবা কদলী) দিবে; ঐ ফলকে সিন্দুর রঞ্জিত করিবে। ঘটে একটি সিন্দুর পুত্তলিকা আঁকিবে, পুষ্পমাল্য দিয়া শোভিত করিবে…।’ (ক্রিয়াকাণ্ড-বারিধি-১/২৩৯)
দেবীপ্রসাদ বলেন, সর্বতোভদ্রমণ্ডলের অর্থ হলো নারী-জননাঙ্গ : সর্বতোভদ্রমণ্ডলের উপর ঘট, ঘটের গায়ে সিন্দুরপুত্তলিকা– মানবীয় প্রজননের প্রায় একটি পূর্ণাঙ্গ নকল তোলবার আয়োজন। এইভাবে মানবীয় প্রজননের নকল তুলে কোন্ কামনা সফল করবার কল্পনা করা হচ্ছে তার আভাস আমরা আগেই পেয়েছি : নারী-জননাঙ্গের তান্ত্রিক নাম লতা, তান্ত্রিক যন্ত্রে অষ্টদলপদ্মকে ঘিরে রয়েছে বীথিকা। অর্থাৎ, নারী অঙ্গের জননশক্তির স্পর্শে প্রকৃতিকে ফলপ্রসূ করবার কল্পনা। ঘট-স্থাপনার মধ্যে সেই চেষ্টাকেই আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যাবার আয়োজন করা হলো। শুদ্ধ মৃত্তিকায় পঞ্চশস্য নিক্ষেপ করে ফসল ফলানোর মহড়া শুরু হলো। আর তারপর ঘটের উপরস্থ পল্লবকে স্পর্শ করে কামনা জানানো হবে :
‘ওঁ, অয়মূর্জাবতো বৃক্ষ উজ্জীব ফলিনী ভব। পর্ণং বনস্পতের্নুত্বা নুত্বা চ সুয়তাং রয়িঃ।’ (ক্রিয়াকাণ্ড-বারিধি-১/২৪০)
অর্থাৎ : হে শক্তিমতি বৃক্ষ, (তুমি) বাঁচিয়া ওঠো ও ফলবতী হও। বনস্পতির পাতাকে সেবা করিয়া ধন প্রসব করো।
অনেক সময় ঘটের উপরের ডাবটির গায়েই সিন্দুরপুত্তলি এঁকে দিয়ে মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সাদৃশ্যে বিশ্বাসকে আরো স্পষ্ট ও অভ্রান্ত করবার আয়োজন দেখা যায়। ওই যন্ত্র আর ঘটই হলো দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ। তার মানে, কৃষি-আবিষ্কার পর্যায়ের এক আদিম বিশ্বাসই এ-পূজার প্রাণবস্তু। একটু গভীরভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, আদিপর্বে দুর্গাপূজা আসলে পূজাই ছিলো না। পূজার বদলে ছিলো জাদুঅনুষ্ঠান। জাদুঅনুষ্ঠানের মূল কথাটা হলো একটা কামনা সফল করবার চেষ্টাই। কিন্তু তা প্রার্থনা-উপাসনার সাহায্যে ঈশ্বরের করুণা উদ্রেক করে নয়। তার বদলে, কামনা সফল হওয়ার একটা নকল তুলে ওই নকলের সাহায্যেই বাস্তবভাবে কামনাটিকে সফল করবার কল্পনা। অষ্টদলপদ্মের ছবি এঁকে সিন্দুরপুত্তলীর ছবি এঁকে, মানবীয় ফলপ্রসূতার নকল তোলা হলো আর কল্পনা করা হলো প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার কামনাও এইভাবেই সফল হবে।
বলাই বাহুল্য, আমাদের আধুনিক চেতনার দিক থেকে এ-বিশ্বাস একেবারে অর্থহীন। নারী-জননাঙ্গের সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সম্পর্ক কোথায়? কিন্তু আধুনিক চেতনার মাপকাঠিতে তন্ত্রকে বোঝা যাবে না। তার বদলে এই তান্ত্রিক বিশ্বাসটিকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের আচর-অনুষ্ঠানকে– বা পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের আচার-অনুষ্ঠানের স্মারকগুলিকে– বিচার করতে হবে। কিভাবে? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায় অধ্যাপক জর্জ টমসন-এর উদ্ধৃতি–
‘উত্তর আমেরিকায় ফসলে পোকা ধরলে ঋতুমতী মেয়েরা রাত্রে নগ্ন হয়ে ক্ষেতের উপর হাঁটে। ইয়োরোপের চাষীদের মধ্যে এ-প্রথা আজো টিকে আছে। খারাপ পোকার প্রতিষেধ হিসেবে প্লিনি ব্যবস্থা দিয়েছেন, ঋতুমতী মেয়েরা খালিপায়ে এলোচুলে কোমরের ওপর পর্যন্ত কাপড় তুলে ক্ষেতের উপর হাঁটবে। কলিউমেল্লার মতে ডিমোক্রাইটসেরও সেই বিধান : তিনি বলেছেন, মেয়েরা খালিপায়ে আর এলোচুলে তিনবার দৌড়ে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করবে। ধারণাটা স্পষ্ট এই যে, এ-অবস্থায় নারীদেহে যে-উর্বরাশক্তির আবির্ভাব হয় তাই এ-ভাবে ক্ষেতের মধ্যে সঞ্চারিত করা হবে। অন্যত্র দেখা যায়, ওই শক্তিকে নারীত্বের সহজাত শক্তি হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। জুলুদের মধ্যে প্রথা হলো, ক্ষেতে ঘোরবার সময় মেয়েরা নগ্ন হবে, কিন্তু তখন ঋতুমতী যে হতেই হবে তা নয়। মেয়েদের জননাঙ্গ প্রদর্শন-মূলক অনুষ্ঠানাদিরও একই উৎস– এই অনুষ্ঠান গ্রীসে বিশেষ করে ডিমিটর-দেবীর সঙ্গে সংযুক্ত। নানান গ্রীক পূজাপদ্ধতিতে ব্যবস্থা দেখা যায়, পূজারিণীরা খালিপায়ে আর এলোচুলে সার বেঁধে হাঁটবে– ওই পূজাপদ্ধতিগুলিও একই জাতীয় ধারণা থেকে এসেছে।’ (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪১২)
বলাই বাহুল্য, আমাদের আধুনিক চেতনার দিক থেকে এ-বিশ্বাস একেবারে অর্থহীন। নারী-জননাঙ্গের সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সম্পর্ক কোথায়? কিন্তু আধুনিক চেতনার মাপকাঠিতে তন্ত্রকে বোঝা যাবে না। তার বদলে এই তান্ত্রিক বিশ্বাসটিকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের আচর-অনুষ্ঠানকে– বা পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের আচার-অনুষ্ঠানের স্মারকগুলিকে– বিচার করতে হবে। কিভাবে? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায় অধ্যাপক জর্জ টমসন-এর উদ্ধৃতি–
‘উত্তর আমেরিকায় ফসলে পোকা ধরলে ঋতুমতী মেয়েরা রাত্রে নগ্ন হয়ে ক্ষেতের উপর হাঁটে। ইয়োরোপের চাষীদের মধ্যে এ-প্রথা আজো টিকে আছে। খারাপ পোকার প্রতিষেধ হিসেবে প্লিনি ব্যবস্থা দিয়েছেন, ঋতুমতী মেয়েরা খালিপায়ে এলোচুলে কোমরের ওপর পর্যন্ত কাপড় তুলে ক্ষেতের উপর হাঁটবে। কলিউমেল্লার মতে ডিমোক্রাইটসেরও সেই বিধান : তিনি বলেছেন, মেয়েরা খালিপায়ে আর এলোচুলে তিনবার দৌড়ে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করবে। ধারণাটা স্পষ্ট এই যে, এ-অবস্থায় নারীদেহে যে-উর্বরাশক্তির আবির্ভাব হয় তাই এ-ভাবে ক্ষেতের মধ্যে সঞ্চারিত করা হবে। অন্যত্র দেখা যায়, ওই শক্তিকে নারীত্বের সহজাত শক্তি হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। জুলুদের মধ্যে প্রথা হলো, ক্ষেতে ঘোরবার সময় মেয়েরা নগ্ন হবে, কিন্তু তখন ঋতুমতী যে হতেই হবে তা নয়। মেয়েদের জননাঙ্গ প্রদর্শন-মূলক অনুষ্ঠানাদিরও একই উৎস– এই অনুষ্ঠান গ্রীসে বিশেষ করে ডিমিটর-দেবীর সঙ্গে সংযুক্ত। নানান গ্রীক পূজাপদ্ধতিতে ব্যবস্থা দেখা যায়, পূজারিণীরা খালিপায়ে আর এলোচুলে সার বেঁধে হাঁটবে– ওই পূজাপদ্ধতিগুলিও একই জাতীয় ধারণা থেকে এসেছে।’ (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪১২)
নারী জননাঙ্গকেই মানুষ এককালে উৎপাদন-শক্তির আধার মনে করেছে আর তাই প্রাকৃতিক উৎপাদনে সংকট দেখা গেলে মেয়েরা নগ্নতার সাহায্যে সে-সংকট দূর করতে চেয়েছে।
এ প্রসঙ্গেই স্মর্তব্য যে আধুনিক বিদ্বানদের অনেকেই দাবি করেছেন, সিন্ধু-সভ্যতার প্রচলিত নানা চিত্রলিপি এবং অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে পরবর্তীকালে তন্ত্র সাধনায় ব্যবহৃত নানা চিত্রাবলীর সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রত্ন-তত্ত্ব খননে এমন কিছু মাতৃমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যে মাতৃমূর্তিগুলির রচনায় যোনি বা নারী-জননাঙ্গের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপণ করার চেষ্টা খুবই স্পষ্ট। তাছাড়া মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তুপ থেকে পোড়ামাটির যোনি-মূর্তিও এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। এই যোনি ক্রমশই জামিতিক ত্রিকোণের আকার ধারণ করেছে। কেননা তন্ত্র-সাধনায় যন্ত্র হিসেবে প্রচলিত চিত্রগুলির সঙ্গে এই মূর্তির নিম্ন-ভাগের সাদৃশ্যের আভাস পাওয়া যায় বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অভিমত। তন্ত্রে যেগুলিকে যন্ত্র বলা হয় সেগুলি আর কিছুই নয়, ওই নারী-জননাঙ্গের প্রতীক-চিহ্নমাত্র।
এ প্রসঙ্গেই স্মর্তব্য যে আধুনিক বিদ্বানদের অনেকেই দাবি করেছেন, সিন্ধু-সভ্যতার প্রচলিত নানা চিত্রলিপি এবং অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে পরবর্তীকালে তন্ত্র সাধনায় ব্যবহৃত নানা চিত্রাবলীর সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রত্ন-তত্ত্ব খননে এমন কিছু মাতৃমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যে মাতৃমূর্তিগুলির রচনায় যোনি বা নারী-জননাঙ্গের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপণ করার চেষ্টা খুবই স্পষ্ট। তাছাড়া মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তুপ থেকে পোড়ামাটির যোনি-মূর্তিও এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। এই যোনি ক্রমশই জামিতিক ত্রিকোণের আকার ধারণ করেছে। কেননা তন্ত্র-সাধনায় যন্ত্র হিসেবে প্রচলিত চিত্রগুলির সঙ্গে এই মূর্তির নিম্ন-ভাগের সাদৃশ্যের আভাস পাওয়া যায় বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অভিমত। তন্ত্রে যেগুলিকে যন্ত্র বলা হয় সেগুলি আর কিছুই নয়, ওই নারী-জননাঙ্গের প্রতীক-চিহ্নমাত্র।
আদিম মাতৃপ্রধান বা শক্তি-প্রধান চিন্তাধারা ক্রমশ কী করে নারী-জননাঙ্গ-কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এ-পর্যায়ে তার ব্যাখ্যা কী হতে পারে?–
‘প্রাচীন মাতৃমূর্তির পরিকল্পনায় যদি জননাঙ্গকেই ক্রমশ নারীদেহের প্রধানতম অবয়ব বলে গ্রহণ করবার চেষ্টা দেখা যায় তাহলে স্বভাবতই কৃষিভিত্তিক প্রচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নারীদেহের অন্যান্য অবয়ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যোনি বা নারী-জননাঙ্গের মূর্তি খুঁজে পাওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না।…
মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা এ-জাতীয় যোনি-মূর্তি রচনা করেছিলেন কেন? এর পিছনে নিশ্চয়ই প্রজননের কামনা ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র প্রজননের কামনাই নয়। তার সঙ্গে জড়িত ছিলো ধনোৎপাদনের কামনাও– কৃষিকাজের সাফল্য-কামনাও। কেননা এই যোনি-মূর্তি মানব-বিশ্বাসের এমন এক স্তরের সাক্ষ্য বহন করছে, যেখানে শুধুমাত্র সন্তান-উৎপাদনই নয়– প্রাকৃতিক উৎপাদনও– নারী-জননাঙ্গের উপর নির্ভরশীল।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৯৫)
‘প্রাচীন মাতৃমূর্তির পরিকল্পনায় যদি জননাঙ্গকেই ক্রমশ নারীদেহের প্রধানতম অবয়ব বলে গ্রহণ করবার চেষ্টা দেখা যায় তাহলে স্বভাবতই কৃষিভিত্তিক প্রচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নারীদেহের অন্যান্য অবয়ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যোনি বা নারী-জননাঙ্গের মূর্তি খুঁজে পাওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না।…
মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা এ-জাতীয় যোনি-মূর্তি রচনা করেছিলেন কেন? এর পিছনে নিশ্চয়ই প্রজননের কামনা ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র প্রজননের কামনাই নয়। তার সঙ্গে জড়িত ছিলো ধনোৎপাদনের কামনাও– কৃষিকাজের সাফল্য-কামনাও। কেননা এই যোনি-মূর্তি মানব-বিশ্বাসের এমন এক স্তরের সাক্ষ্য বহন করছে, যেখানে শুধুমাত্র সন্তান-উৎপাদনই নয়– প্রাকৃতিক উৎপাদনও– নারী-জননাঙ্গের উপর নির্ভরশীল।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৯৫)
ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসটির স্মারক সিন্ধু-সভ্যতার মধ্যেই পরিসমাপ্ত নয়, বরং উত্তরকালের তন্ত্র-সাধনার মধ্যেই যে তার অবিচ্ছেদ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, ইতোমধ্যে আমরা কিছুটা অবগত হয়েছি বটে। এবং আমাদেরকে এটা মনে রাখতে হবে যে, উত্তরকালের তান্ত্রিক আচারসম্পন্ন শাক্তসাধকদের কথিত প্রকৃতিসাধনার সঙ্গিনী হিসেবে যে সাধনসঙ্গীটি থাকেন, তিনি কিন্তু কোন-না-কোনোভাবে একজন কুলরমণীই। আর প্রাকৃতিক উৎপাদনের সাথে নারী জননাঙ্গের প্রাধান্যের ধারণাটি প্রোথিত আছে যে প্রাচীনতম বদ্ধমূল বিশ্বাসের উপর তা হলো এক উর্বরতা-কেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস।
বলা বাহুল্য, দেবীপূজারূপে শাক্তধর্ম খ্রিস্টাব্দের চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এক গৌণ ধর্ম বলেই মনে করা হয়। তবে দেহ ও শক্তিকে অবলম্বন করে তান্ত্রিক সাধনা এই যুগের মধ্যেই এক বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে গুপ্তবিদ্যা রূপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।
বলা বাহুল্য, দেবীপূজারূপে শাক্তধর্ম খ্রিস্টাব্দের চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এক গৌণ ধর্ম বলেই মনে করা হয়। তবে দেহ ও শক্তিকে অবলম্বন করে তান্ত্রিক সাধনা এই যুগের মধ্যেই এক বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে গুপ্তবিদ্যা রূপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।
শক্তিদেবী কালী
বাঙলা ও ভারতে শক্তিসাধনা মূল দুইভাগে বিভক্ত– প্রথমটা হলো দুর্গা-কেন্দ্রিক, আর দ্বিতীয়টা কালী-কেন্দ্রিক। পার্বতী উমা, সতী এবং দুর্গা-চণ্ডিকার ধারা মিলে পুরাণ-তন্ত্রাদিতে যে দুর্গাকেন্দ্রিক এক মহাদেবীর বিবর্তন দেখতে পাই, তার সাথে এসে মিলেছে কালী, করালী, চামুণ্ডা, তারা ও অন্যান্য দশমহাবিদ্যাকে নিয়ে আরেকটি ধারা, তা হলো দেবী কালিকা বা কালীর ধারা। এই কালী বা কালিকাই বাঙলা অঞ্চলের শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে দেবীর অন্য সব রূপ পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত সর্বেশ্বরী হয়ে উঠেছেন। তাই বাঙলার শক্তি-সাধনা ও শাক্ত-সাহিত্যকে বুঝতে হলে এই কালী বা কালিকার ধারাটির প্রাচীন ইতিহাস একটু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে মনে হয়।
‘ব্রহ্মযামলে’ আদ্যাস্তোত্রে আদ্যা দেবী কোন্ দেশে কী মূর্তিতে পূজিতা হন তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপে পূজিতা। উক্তিটিকে ইতিহাসের দিক থেকে গভীরার্থব্যঞ্জক বলে মনে হয়। কেননা বাঙলা অঞ্চলই শক্তিসাধনার প্রধান কেন্দ্র। শুধু পূজার দিক দিয়ে বিচার করলে বাঙলায় কালীপূজা থেকে দুর্গাপূজা প্রাচীনতর। এখনও পর্যন্ত ধর্মোৎসব হিসেবে দুর্গাপূজাই অনেক বেশি জাকজমকপূর্ণ ও জনপ্রিয় হলেও বাঙালির এই শাক্ত-প্রবণতা শুধুমাত্র ধর্মোৎসবের মধ্যেই সীমায়িত নয় মোটেও; এর বীজ নিহিত আছে সাধনার অন্তরালে। আর এই সাধনার শুরু– প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। এর পরে ঐতিহাসিক যুগের সূচনার আদি-মধ্য ও নব্য পর্যায়ে এই সাধনার ধারা ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য (প্রাকৃত বা অবৈদিক) এই দুই ধারাস্রোতে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাধনার দিক থেকে বিচার করলে, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এতদঞ্চলের শক্তিসাধনার কেন্দ্রে কালী। দেবী তারাকেও কালীস্থানীয়া করে নেয়া হয়েছে, এমনকি দশমহাবিদ্যার মধ্যকার অন্যান্য মহাবিদ্যাগণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
‘ব্রহ্মযামলে’ আদ্যাস্তোত্রে আদ্যা দেবী কোন্ দেশে কী মূর্তিতে পূজিতা হন তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপে পূজিতা। উক্তিটিকে ইতিহাসের দিক থেকে গভীরার্থব্যঞ্জক বলে মনে হয়। কেননা বাঙলা অঞ্চলই শক্তিসাধনার প্রধান কেন্দ্র। শুধু পূজার দিক দিয়ে বিচার করলে বাঙলায় কালীপূজা থেকে দুর্গাপূজা প্রাচীনতর। এখনও পর্যন্ত ধর্মোৎসব হিসেবে দুর্গাপূজাই অনেক বেশি জাকজমকপূর্ণ ও জনপ্রিয় হলেও বাঙালির এই শাক্ত-প্রবণতা শুধুমাত্র ধর্মোৎসবের মধ্যেই সীমায়িত নয় মোটেও; এর বীজ নিহিত আছে সাধনার অন্তরালে। আর এই সাধনার শুরু– প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। এর পরে ঐতিহাসিক যুগের সূচনার আদি-মধ্য ও নব্য পর্যায়ে এই সাধনার ধারা ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য (প্রাকৃত বা অবৈদিক) এই দুই ধারাস্রোতে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাধনার দিক থেকে বিচার করলে, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এতদঞ্চলের শক্তিসাধনার কেন্দ্রে কালী। দেবী তারাকেও কালীস্থানীয়া করে নেয়া হয়েছে, এমনকি দশমহাবিদ্যার মধ্যকার অন্যান্য মহাবিদ্যাগণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
কালিকা দেবী কী করে মহাদেবীর সঙ্গে মিলে গেলেন তার ইতিহাস বহু পুরাণের মধ্যেই পাওয়া যায়। বেদের কোথাও কালী বা কালিকা দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় না, অর্থাৎ, কালী বৈদিক কোনও দেবী নন। আবার বৈদিক ঋষিদের মধ্যেও একটা অদ্ভূত সংশ্লেষণী প্রবণতা দেখা যায়। যখনই কোনও অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবী বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে লৌকিক স্তর থেকে উত্তরিত হয়ে আঞ্চলিক বা আরও বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পায়, তখনই সেই দেব-দেবীকে বৈদিক দেবমণ্ডলীতে একীভূত করে দার্শনিকতার মোড়কে মহিমান্বিত করে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়। তাই বেদের রাত্রিসূক্তকে (ঋগ্বেদ-১০/১২৭) অবলম্বন করে পরবর্তীতে যে এক রাত্রিদেবীর ধারণা গড়ে উঠেছে, কারও কারও মতে সেই অন্ধকাররূপিণী রাত্রিদেবীই পরবর্তীকালে কালিকা রূপ ধারণ করেছেন। আবার পাশহস্তা কৃষ্ণা-ভয়ঙ্করী নির্ঋতি দেবীও (শতপথ-ব্রাহ্মণ-৭/২/৭ এবং ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ-৪/১৭) কালীর সঙ্গে একীভূত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। এই নির্ঋতি দেবীর পরবর্তীকালের ইতিহাস সম্ভবত বৌদ্ধ দেবী নৈরাত্মা।
বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। এই উপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নামে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন–
বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। এই উপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নামে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন–
কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বাঃ।। (মুণ্ডক-১/২/৪)
অর্থাৎ : যজ্ঞাগ্নির সেই লেলিহান শিখা আকাশপানে ওঠে সাত শিখা হয়ে। শৌনক, সেই সাতটি শিখার নাম– কালী, করালী, মনোজবা (মনের মতো দ্রুতগামী), সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী আর বড় সৌন্দর্যশালিনী বিশ্বরূচী। এই সাতটি শিখা হলো অগ্নিদেবের সাতটি জিভ। টলটলে, লকলকে এই জিভ দিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞের আহুতি দেন।
এখানে ‘কালী’ আহুতি-গ্রহণকারিণী অগ্নিজিহ্বা মাত্রই; মাতৃদেবীত্বের কোনও আভাসই এখানে নাই। শুধু বিশ্বরূচীর ক্ষেত্রে দীপ্যমানা অর্থে দেবী কথাটির ব্যবহার দেখা যায়। মহাভারতেও (আদিপর্ব-২৩২/৭) যজ্ঞাগ্নির এই সপ্তজিহ্বার উল্লেখ পাওয়া যায়। দার্শনিক মতে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও মন– এই সাতটিকে অগ্নির সপ্তজিহ্বা বলে গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রচলিত মহাভারতে একাধিক স্থলে ‘কালী’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং পৌরাণিক কালী-দেবীর সাথে মহাভারতে বর্ণিত কালী-দেবীর বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে দেখা যায়– কুরুক্ষেত্রে অন্যতম কৌরব-সেনাপতি আচার্য দ্রোণের মৃত্যুর পরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন গভীর রাত্রে পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে নিদ্রিত বীরগণকে হত্যা করছিলেন তখন সেই হন্যমান বীরগণ ভয়ঙ্করী কালী-দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই কালী-দেবী রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা এবং ভয়ঙ্করী। কালীর ভীষণ স্বরূপ সংহারের প্রতীক; কালরাত্রিরূপিণী এই দেবী বিগ্রহবর্তী সংহার।
এ প্রসঙ্গে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো, মহাভারতে কালী-দেবীর এই উল্লেখ পরবর্তীকালের যোজনা হতে পারে। পরবর্তীকালের যোজনা না হলেও এসব বর্ণনায় কালীর কোনও দেবীত্বের আভাস নাই; কালী এখানে অত্যন্ত ভীত মনের একটা ভয়ঙ্করী ছায়ামূর্তি দর্শনের ন্যায়। কবি কালিদাসের সময়েও কালী কোনও প্রধানা দেবী বলে গৃহীতা হননি। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে উমার সাথে মহাদেবের বিবাহ-প্রসঙ্গে বরযাত্রার বর্ণনায় দেখা যায়, কৈলাস-পর্বতের মাতৃকাগণ বিবাহযাত্রায় মহাদেবের অনুগমন করেছিলেন; আর–
প্রচলিত মহাভারতে একাধিক স্থলে ‘কালী’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং পৌরাণিক কালী-দেবীর সাথে মহাভারতে বর্ণিত কালী-দেবীর বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে দেখা যায়– কুরুক্ষেত্রে অন্যতম কৌরব-সেনাপতি আচার্য দ্রোণের মৃত্যুর পরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন গভীর রাত্রে পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে নিদ্রিত বীরগণকে হত্যা করছিলেন তখন সেই হন্যমান বীরগণ ভয়ঙ্করী কালী-দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই কালী-দেবী রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা এবং ভয়ঙ্করী। কালীর ভীষণ স্বরূপ সংহারের প্রতীক; কালরাত্রিরূপিণী এই দেবী বিগ্রহবর্তী সংহার।
এ প্রসঙ্গে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো, মহাভারতে কালী-দেবীর এই উল্লেখ পরবর্তীকালের যোজনা হতে পারে। পরবর্তীকালের যোজনা না হলেও এসব বর্ণনায় কালীর কোনও দেবীত্বের আভাস নাই; কালী এখানে অত্যন্ত ভীত মনের একটা ভয়ঙ্করী ছায়ামূর্তি দর্শনের ন্যায়। কবি কালিদাসের সময়েও কালী কোনও প্রধানা দেবী বলে গৃহীতা হননি। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে উমার সাথে মহাদেবের বিবাহ-প্রসঙ্গে বরযাত্রার বর্ণনায় দেখা যায়, কৈলাস-পর্বতের মাতৃকাগণ বিবাহযাত্রায় মহাদেবের অনুগমন করেছিলেন; আর–
তাসাঞ্চ পশ্চাৎ কনকপ্রভাণাং কালী কপালাভরণা চকাশে।
বলাকিনী নীলপয়োদরাজী দূরং পুরঃক্ষিপ্তশতহ্রদেব।।– (কুমারসম্ভব-৭/৩৯)
অর্থাৎ– কনকপ্রভা তাঁহাদের (সেই মাতৃকাগণের) পশ্চাতে কপালাভরণা কালী অগ্রে বিদ্যুৎপ্রসারকারিণী বলাকাসমন্বিতা নীলমেঘরাজির ন্যায় শোভা পাইতেছিলেন।
মাতৃকাগণের পশ্চাৎগামিনী এই কালী-দেবী কালিদাসের যুগেও একজন অপ্রধানা দেবী বলেই মনে হয়। ‘রঘুবংশে’র মধ্যে একটি উপমাতেও এই কালী বা কালিকা-দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–
জ্যানিনাদমথ গৃহ্নতী তয়োঃ প্রাদুরাস বহুলক্ষপাচ্ছবিঃ।
তাড়কা চলকপালকুণ্ডলা কালিকেব নিবিড়া বলাকিনী।।– (রঘুবংশ-১১/১৫)
অর্থাৎ– রাম-লক্ষ্মণের জ্যা-নিঃস্বন শুনিয়া ভয়ঙ্করী তাড়কা রাক্ষসী যখন আত্মপ্রকাশ করিল তখন সেই ঘনকৃষ্ণ রাত্রির ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা তাড়কাকে মনে হইতেছিল চঞ্চলকপালকুণ্ডলা বলাকাযুক্তা কালিকার মত।
এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য হলো,– “মল্লিনাথ ‘কালিকা’ শব্দের অর্থ কালিকা-দেবী করেন নাই, ‘কালিকা’ শব্দের এক অর্থ ‘ঘনাবলী’, সেই অর্থ ধরিয়া এবং ‘বলাকিনী’ কথার সহিত যুক্ত করিয়া ‘ঘনাবলী’ অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু ‘চলকপালকুণ্ডলা’ কথাটি তাড়কাসম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলেও ইহা কালিকা-দেবীর কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়।” “এই প্রসঙ্গে আর-একটি তথ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবি কালিদাসের ‘কালিদাস’ নামটির ব্যুৎপত্তি কি? ‘কালীর দাস’ এই অর্থে কি কালিদাস? কালিদাসের লেখার মধ্যে কালী তেমন কোনও প্রসিদ্ধ দেবীত্ব লাভ করেন নাই বটে, কিন্তু কালিদাস নামের ব্যুৎপত্তিতে মনে হয়, কালীর দেবীত্ব তখন যত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রেই হোক, প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।”– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৫)
এখানে উল্লেখ্য, ‘মহাভারতের বর্তমান রূপগ্রহণের আগেই অর্থাৎ আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে দুর্গার সঙ্গে কালী অভিন্নতা লাভ করে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে। শিবের স্ত্রী দুর্গার সঙ্গে কালের (অর্থাৎ শিবের) শক্তিরূপে যাঁকে কল্পনা করা হয়, সেই কালীর অভিন্নতার কল্পনা তাঁকে মাতৃদেবীরূপে স্বীকৃতি দেয়। তিনি শুধুমাত্র অসুর নিধনের ভূমিকায় ভয়ংকরী রণোন্মাদিনী ধ্বংসের দেবী নন– তিনি একাধারে অশুভ শক্তিনাশিনী ও পরমমঙ্গলময়ী ও মাতৃস্বরূপিণী। তাই ভদ্রকালী রূপের মধ্যে দিয়েই দেখা যায় তাঁর পরমমঙ্গলময়ী মাতৃরূপের প্রকাশ।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩০-৩১)
কালিদাসের পর সংস্কৃত সাহিত্যের স্থানে স্থানে এক রক্তলোলুপা ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তা তখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মে জায়গা করে নিতে পারেনি।
অন্যদিকে– ‘খিল হরিবংশে’ মদ্যমাংসপ্রিয়া এক দেবীকে বর্বর, শবর ও পুলিন্দদের দ্বারা পূজিত হতে দেখা যায়। এর পরে (৭ম শতকে) বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তেও বনের মধ্যে শবর পূজিত নরমাংস ও রক্তস্নাত দেবীর কথা পাই। আবার (আনুমানিক ৭ম শতাব্দী) ভবভূতির ‘মালতী মাধব’ নাটকে নরমাংস বলিদানে পূজিতা ভয়ংকরী শ্মশানবাসিনী এক করালা দেবীর বর্ণনা পাই। বলাই বাহুল্য ইনি কৃষ্ণবর্ণা ও উগ্রা। (৮ম শতাব্দী) এক সাহিত্যে দেবীকে শবর পূজিতা পর্ণপত্র পরিহিতা বলা আছে। এরপরে পৌরাণিক যুগে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে– দেবী কালিকা অসুরবধের প্রয়োজনেই ধরাধামে অবতীর্ণা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাত শত শ্লোক নিয়েই সপ্তশতী ‘চণ্ডী’ গ্রন্থ। এখানেই (উত্তর চরিতে) আছে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্যে হিমালয়স্থিতা দেবীর কাছে অনুরোধ করলে দেবীর শরীরকোষ থেকে আর এক দেবী সমুদ্ভূতা হলেন। শরীরকোষ থেকে নিসৃতা বলে তিনি ‘কৌশিকী’ নামে পরিচিতা হলেন। এদিকে কৌশিকী দেবী বিনির্গত হওয়ায় পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে হিমাচলবাসিনী ‘কালিকা’ নামে সমাখ্যাতা হলেন। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবী কালিকা কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই তাঁকে হিমাচলবাসিনী দেবীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। এই কৌশিকীদেবী মূলে কুশিক জাতির পূজিতা দেবী ছিলেন বলে ভান্ডারকরের অভিমত। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে তাঁকে গৌরবর্ণা অনিন্দ্যসুন্দরী বলা হলেও পদ্মপুরাণ ও কালিকা পুরাণে অন্য কথা বলা আছে। সেখানে বলা আছে, দেবীর দেহ থেকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা যে রাত্রিদেবী বা কালরাত্রি দেবী বার হলেন– তিনিই কৌশিকী। এই কৌশিকী দেবীকে ব্রহ্মা বিন্ধ্যাচলে প্রতিষ্ঠিতা হতে বললেন। এই সব পরস্পরবিরোধী উপাখ্যানগুলো থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, কৌশিকী নামে যে স্বতন্ত্র দেবী ছিলেন, তাঁকে মহাদেবীর সঙ্গে এক করে দেওয়ার এ এক অনলস, পৌরাণিক প্রচেষ্টা।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২২৮-২৯)
এখানে ‘কালিকা’র আবির্ভাব-রহস্য এভাবে দেখা গেলেও একটু পরেই আবার অন্যরূপে দেখা যায়। যেমন, অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড-মুণ্ড এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্য অসুরেরা দেবীর নিকটবর্তী হলে–
অন্যদিকে– ‘খিল হরিবংশে’ মদ্যমাংসপ্রিয়া এক দেবীকে বর্বর, শবর ও পুলিন্দদের দ্বারা পূজিত হতে দেখা যায়। এর পরে (৭ম শতকে) বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তেও বনের মধ্যে শবর পূজিত নরমাংস ও রক্তস্নাত দেবীর কথা পাই। আবার (আনুমানিক ৭ম শতাব্দী) ভবভূতির ‘মালতী মাধব’ নাটকে নরমাংস বলিদানে পূজিতা ভয়ংকরী শ্মশানবাসিনী এক করালা দেবীর বর্ণনা পাই। বলাই বাহুল্য ইনি কৃষ্ণবর্ণা ও উগ্রা। (৮ম শতাব্দী) এক সাহিত্যে দেবীকে শবর পূজিতা পর্ণপত্র পরিহিতা বলা আছে। এরপরে পৌরাণিক যুগে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে– দেবী কালিকা অসুরবধের প্রয়োজনেই ধরাধামে অবতীর্ণা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাত শত শ্লোক নিয়েই সপ্তশতী ‘চণ্ডী’ গ্রন্থ। এখানেই (উত্তর চরিতে) আছে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্যে হিমালয়স্থিতা দেবীর কাছে অনুরোধ করলে দেবীর শরীরকোষ থেকে আর এক দেবী সমুদ্ভূতা হলেন। শরীরকোষ থেকে নিসৃতা বলে তিনি ‘কৌশিকী’ নামে পরিচিতা হলেন। এদিকে কৌশিকী দেবী বিনির্গত হওয়ায় পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে হিমাচলবাসিনী ‘কালিকা’ নামে সমাখ্যাতা হলেন। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবী কালিকা কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই তাঁকে হিমাচলবাসিনী দেবীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। এই কৌশিকীদেবী মূলে কুশিক জাতির পূজিতা দেবী ছিলেন বলে ভান্ডারকরের অভিমত। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে তাঁকে গৌরবর্ণা অনিন্দ্যসুন্দরী বলা হলেও পদ্মপুরাণ ও কালিকা পুরাণে অন্য কথা বলা আছে। সেখানে বলা আছে, দেবীর দেহ থেকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা যে রাত্রিদেবী বা কালরাত্রি দেবী বার হলেন– তিনিই কৌশিকী। এই কৌশিকী দেবীকে ব্রহ্মা বিন্ধ্যাচলে প্রতিষ্ঠিতা হতে বললেন। এই সব পরস্পরবিরোধী উপাখ্যানগুলো থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, কৌশিকী নামে যে স্বতন্ত্র দেবী ছিলেন, তাঁকে মহাদেবীর সঙ্গে এক করে দেওয়ার এ এক অনলস, পৌরাণিক প্রচেষ্টা।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২২৮-২৯)
এখানে ‘কালিকা’র আবির্ভাব-রহস্য এভাবে দেখা গেলেও একটু পরেই আবার অন্যরূপে দেখা যায়। যেমন, অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড-মুণ্ড এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্য অসুরেরা দেবীর নিকটবর্তী হলে–
ততঃ কোপং চকারোচ্চৈরম্বিকা তানরীন্ প্রতি।
কোপেন চাস্যা বদনং মসীবর্ণমভূৎ তদা।।
ভ্রূকুটীকুটিলাৎ তস্যা ললাটফলকাৎদ্রুতম্ ।
কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৫-৬)
অর্থাৎ– তখন অম্বিকা সেই শত্রুগণের প্রতি অত্যন্ত কোপ করিলেন; তখন কোপের দ্বারা তাঁহার বদন মসীবর্ণ হইল। তাঁহার ভ্রূকুটীকুটিল ললাটফলক হইতে দ্রুত অসিপাশধারিণী করালবদনা কালী বিনিষ্ক্রান্তা হইলেন।
এই কালী-দেবী–
বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।
দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।।
অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।
নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৭-৮)
অর্থাৎ– বিচিত্র নরকঙ্কালধারিণী, নরমালাবিভূষণা, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, শুষ্কমাংসা (মাংসহীন অস্থিচর্মময় দেহ), অতিভৈরবা, অতি বিস্তারবদনা, লোলজিহ্বা-হেতু-ভীষণা, কোটরাগত রক্তবর্ণ-চক্ষুবিশিষ্টা– তাঁহার নাদে দিঙ্মুখ আপূরিত।
এর পর দেবীর সঙ্গে চণ্ড-মুণ্ডের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন– ‘দেবী হইতে বিনিষ্ক্রান্ত হইয়াই সেই কালী-দেবী বেগে দেবশত্রু অসুরগণের সৈন্যমধ্যে অভিপতিতা হইয়া সেখানে মহা-অসুরগণকে বিনাশ করিতে করিতে তাহাদের সৈন্যবলকে ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই দেবী পৃষ্ঠ-রক্ষক, অঙ্কুশ-গ্রাহক, যোদ্ধা ও গলঘণ্টাদিসহ হস্তীগুলিকে হস্তে লইয়া মুখে গ্রাস করিতে লাগিলেন। শুধু হস্তুগুলিকে নয় ঘোড়ার সহিত যোদ্ধাকে, সারথির সহিত রথকে মুখে ফেলিয়া দিয়া দন্তদ্বারা অতি ভীষণভাবে চর্বণ করিতে লাগিলেন। কাহাকেও চুলে ধরিলেন, আবার কাহাকেও গ্রীবায় ধরিলেন; কাহাকেও পায়ের দ্বারা আক্রমণ করিয়া অন্যকে বক্ষের দ্বারা মর্দিত করিলেন। সেই অসুরগণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত শস্ত্রগুলিকে এবং মহাস্ত্রগুলিকে তিনি মুখে গ্রহণ করিলেন এবং রোষে দন্তদ্বারাই মথিত (চূর্ণ) করিলেন। অসুরদলের কতকগুলিকে তিনি মর্দন করিলেন, কতকগুলিকে ভক্ষণ করিলেন, কতকগুলিকে বিতাড়িত করিলেন। অসুরগণ কেহ কেহ অসিদ্বারা নিহত হইল, কেহ কেহ কঙ্কালের দ্বারা তাড়িত হইল, কেহ কেহ দন্তাঘাতে বিনাশ প্রাপ্ত হইল। ক্ষণকালমধ্যে সমস্ত অসুরসৈন্য নিপতিত দেখিয়া চণ্ড সেই অতিভীষণা কালীর দিকে ধাবিত হইল। সেই মহাসুর চণ্ড মহাভীম শরবর্ষণের দ্বারা এবং মুণ্ড চক্রসমূহের দ্বারা সেই ভীষণ-নয়নাকে ছাইয়া ফেলিল। কিন্তু কালমেঘের উদয়ে যেমন অসংখ্য সূর্যবিম্ব শোভা পায় সেইরূপ চক্রসমূহ তাঁহার মুখগহ্বরে প্রবিষ্ট হইয়া শোভা পাইল। অতঃপর ভৈরবনাদিনী কালী অতিরোষে ভীষণভাবে অট্টহাস্য করিলেন– তাঁহার করাল বক্ত্রের অন্তঃপাতী ভীষণদর্শন দশনগুলি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহার পরে মহাখড়্গ উত্তোলনপূর্বক দেবী হুঙ্কারনাদে (হং শব্দে) চণ্ডের প্রতি ধাবিত হইলেন, এবং তাহার চুলে ধরিয়া সেই খড়্গের দ্বারাই তাহার শিরশ্ছেদ করিলেন। চণ্ডকে নিপতিত দেখিয়া মুণ্ড দেবীর প্রতি ধাবিত হইল; দেবী ক্রোধে তাহাকেও খড়্গরে দ্বারা আহত করিয়া ভূমিতে পাতিত করিলেন। হতশেষ অসুরসৈন্য চণ্ড-মুণ্ডকে নিহত দেখিয়া ভয়ে চতুর্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৭-৮)
এরপর চণ্ড-মুণ্ডের ছিন্ন মুণ্ড হাতে নিয়ে দেবী কালিকা চণ্ডীকে তা উপহার দিলেন। দেবী চণ্ডিকা তখন কালীকে বললেন–
এরপর চণ্ড-মুণ্ডের ছিন্ন মুণ্ড হাতে নিয়ে দেবী কালিকা চণ্ডীকে তা উপহার দিলেন। দেবী চণ্ডিকা তখন কালীকে বললেন–
যস্মাৎ চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতা।
চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/২৭)
অর্থাৎ– যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডকে (তাহাদের ছিন্ন শির) লইয়া আসিয়াছ, সেই কারণে তুমি লোকে (জগতে) চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হইবে।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, চণ্ড ও মুণ্ড শব্দদ্বয় থেকে খুব গোঁজামিল না দিলে ব্যুৎপত্তিগতভাবে চামুণ্ডা শব্দ হয় না। আসলে পুরাণকারেরা কালীদেবীর সঙ্গে চামুণ্ডা দেবীকে এক করে দিয়ে অম্বিকা-চণ্ডী-পার্বতী-কালী ও চামুণ্ডাকে দেবী মহামায়ার রূপভেদ মাত্র বলে, সমস্ত দেবীকে মহাদেবীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন করে তুলতে চেয়েছেন।
এরপরে রক্তবীজ বিনাশের সময়ও কালী-দেবী চণ্ডিকাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। কারণ রক্তবীজের রক্তধারা ভূমিস্পর্শ করলেই তা থেকে শত শত রক্তবীজ জন্মাবে। তাই দেবীচণ্ডী কালীকে বদন বিস্তার করে রক্তবীজের দেহ থেকে নির্গত সমস্ত রক্তবিন্দু মুখব্যাদানের দ্বারা গ্রহণ করতে বললেন– এবং সেই রক্তনির্গত অসুরগণকেও ভক্ষণ করতে বলে শূল দিয়ে তাকে আহত করলেন, কালীও মুখের দ্বারা তাঁর রক্ত লেহন করলেন। কালী-চামুণ্ডার মুখে পতিত শোনিত থেকে যত অসুর সমুদ্গত হয়েছিল তাদেরকেও চামুণ্ডা ভক্ষণ করলেন। চামুণ্ডার এরূপ রক্ত পানের ফলে রক্তবীজ নিরক্ত হয়ে গেল, দেবী তখন সহজেই তাকে হনন করলেন। এভাবেই কালী-চামুণ্ডার রক্তলোলুপতা ও ভয়ঙ্কর ভয়ালরূপ ‘চণ্ডী’তে প্রকাশ পেল। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী–
‘রক্তলোলুপা কালীর এখানে যে ভয়ঙ্করী রণোন্মাদিনী রূপ দেখিতে পাইলাম অন্যান্য পুরাণে এই জাতীয় বহু বর্ণনা দেখিতে পাই। উপ-পুরাণগুলিতে ইহার আর কিছু কিছু বিস্তারও দেখিতে পাই। পরবর্তী কালের পুরাণতন্ত্রাদিতে আমরা কালী ও চামুণ্ডাকে এক করিয়াও পাই, পৃথক্ করিয়াও পাই। উভয় দেবীর ধ্যানেও পার্থক্য আছে। চামুণ্ডা চতুর্ভুজা নন, দ্বিভুজা; আলুলায়িত-কুন্তলা নন, ‘পিঙ্গলমূর্ধ্বজা’ (জটাধারিণী?); উলঙ্গিনী নন, শার্দূলচর্মাবৃতা; (কোন কোন পুরাণে গজচর্মাম্বরা); সর্বস্থলের বর্ণনাতেই দেখি, চামুণ্ডা-দেবী নির্মাংসা এবং কৃশোদরী, তাঁহার চক্ষু কোটরাগত। কোন স্থলেই কালিকার এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই না। সংস্কৃত সঙ্কলন-গ্রন্থগুলিতে কালিকার বর্ণনায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই যে কালিকা অজিনাবৃতা। ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ ধৃত উমাপতি ধরের একটি শ্লোকেও কালীকে অজিনাবৃতাই দেখিতে পাই। ইহা পরবর্তী কালের মিশ্রণের ফলে ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করি। চামুণ্ডার বর্ণনায় একটা জিনিস প্রায় সর্বত্রই লক্ষ্য করি, চামুণ্ডা অতি ক্ষুধায় কৃশোদরী। কবিগণ কর্তৃক কালীর বর্ণনায়ও স্থানে স্থানে কালীকে ক্ষুধার্তারূপে দেখি। ভাসোক কবি কালীকে ‘ক্ষুৎক্ষামা’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৯)
এরপরে রক্তবীজ বিনাশের সময়ও কালী-দেবী চণ্ডিকাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। কারণ রক্তবীজের রক্তধারা ভূমিস্পর্শ করলেই তা থেকে শত শত রক্তবীজ জন্মাবে। তাই দেবীচণ্ডী কালীকে বদন বিস্তার করে রক্তবীজের দেহ থেকে নির্গত সমস্ত রক্তবিন্দু মুখব্যাদানের দ্বারা গ্রহণ করতে বললেন– এবং সেই রক্তনির্গত অসুরগণকেও ভক্ষণ করতে বলে শূল দিয়ে তাকে আহত করলেন, কালীও মুখের দ্বারা তাঁর রক্ত লেহন করলেন। কালী-চামুণ্ডার মুখে পতিত শোনিত থেকে যত অসুর সমুদ্গত হয়েছিল তাদেরকেও চামুণ্ডা ভক্ষণ করলেন। চামুণ্ডার এরূপ রক্ত পানের ফলে রক্তবীজ নিরক্ত হয়ে গেল, দেবী তখন সহজেই তাকে হনন করলেন। এভাবেই কালী-চামুণ্ডার রক্তলোলুপতা ও ভয়ঙ্কর ভয়ালরূপ ‘চণ্ডী’তে প্রকাশ পেল। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী–
‘রক্তলোলুপা কালীর এখানে যে ভয়ঙ্করী রণোন্মাদিনী রূপ দেখিতে পাইলাম অন্যান্য পুরাণে এই জাতীয় বহু বর্ণনা দেখিতে পাই। উপ-পুরাণগুলিতে ইহার আর কিছু কিছু বিস্তারও দেখিতে পাই। পরবর্তী কালের পুরাণতন্ত্রাদিতে আমরা কালী ও চামুণ্ডাকে এক করিয়াও পাই, পৃথক্ করিয়াও পাই। উভয় দেবীর ধ্যানেও পার্থক্য আছে। চামুণ্ডা চতুর্ভুজা নন, দ্বিভুজা; আলুলায়িত-কুন্তলা নন, ‘পিঙ্গলমূর্ধ্বজা’ (জটাধারিণী?); উলঙ্গিনী নন, শার্দূলচর্মাবৃতা; (কোন কোন পুরাণে গজচর্মাম্বরা); সর্বস্থলের বর্ণনাতেই দেখি, চামুণ্ডা-দেবী নির্মাংসা এবং কৃশোদরী, তাঁহার চক্ষু কোটরাগত। কোন স্থলেই কালিকার এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই না। সংস্কৃত সঙ্কলন-গ্রন্থগুলিতে কালিকার বর্ণনায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই যে কালিকা অজিনাবৃতা। ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ ধৃত উমাপতি ধরের একটি শ্লোকেও কালীকে অজিনাবৃতাই দেখিতে পাই। ইহা পরবর্তী কালের মিশ্রণের ফলে ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করি। চামুণ্ডার বর্ণনায় একটা জিনিস প্রায় সর্বত্রই লক্ষ্য করি, চামুণ্ডা অতি ক্ষুধায় কৃশোদরী। কবিগণ কর্তৃক কালীর বর্ণনায়ও স্থানে স্থানে কালীকে ক্ষুধার্তারূপে দেখি। ভাসোক কবি কালীকে ‘ক্ষুৎক্ষামা’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৯)
পুরাণ, উপপুরাণ ও তন্ত্রাদির মধ্যে কালী বা কালিকার যে বিস্তার ও বিবর্তন দেখা যায়, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কালীর শিবের সঙ্গে যোগ। শিব কালীর পদে স্থিতা, কালীর এক পা শিবের বুকে ন্যস্ত। সাধকের দিক থেকে এ তত্ত্বকে নানাভাবে গভীরার্থক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি উপাদান মুখ্যভাবে এই শিবারূঢ়া দেবীর বিবর্তনে সাহায্য করেছে বলে শ্রীদাশগুপ্তের ধারণা–
‘প্রথমতঃ, সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির তত্ত্ব। দ্বিতীয়তঃ, তন্ত্রের ‘বিপরীতরতাতুরা’ তত্ত্ব। তৃতীয়তঃ, নিষ্ক্রিয়া দেবতা শিবের পরাজয়ে বলরূপিণী শক্তিদেবীর প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রধান কারণ যাহা মনে হয় তাহা হইল এই, প্রাচীন বর্ণনায় কালিকা শিবারূঢ়া নন, শবারূঢ়া; অসুরনিধন করিয়া অসুরগণের শব তিনি পদদলিত করিয়াছেন, সেই কারণেই তিনি শবারূঢ়া বলিয়া বর্ণিতা।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭০)
দক্ষিণাকালীর প্রচলিত ধ্যানের মধ্যেও দেখা যায়–
‘প্রথমতঃ, সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির তত্ত্ব। দ্বিতীয়তঃ, তন্ত্রের ‘বিপরীতরতাতুরা’ তত্ত্ব। তৃতীয়তঃ, নিষ্ক্রিয়া দেবতা শিবের পরাজয়ে বলরূপিণী শক্তিদেবীর প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রধান কারণ যাহা মনে হয় তাহা হইল এই, প্রাচীন বর্ণনায় কালিকা শিবারূঢ়া নন, শবারূঢ়া; অসুরনিধন করিয়া অসুরগণের শব তিনি পদদলিত করিয়াছেন, সেই কারণেই তিনি শবারূঢ়া বলিয়া বর্ণিতা।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭০)
দক্ষিণাকালীর প্রচলিত ধ্যানের মধ্যেও দেখা যায়–
শবরূপ-মহাদেব-হৃদয়োপরি-সংস্থিতাম্ । … … …
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্ ।।
পরবর্তীকালের দার্শনিক চিন্তায় শক্তি-বিহনে শিবের শবত্ব-প্রাপ্তির তত্ত্ব খুবই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। মনে হয় তখন শিবই পূর্ববর্তীকালের বর্ণিত শবের স্থান গ্রহণ করেন, শবারূঢ়া দেবীও হয়ে ওঠেন শিবারূঢ়া। অসুরের শবারূঢ়া বলেই যে দেবী শিবারূঢ়া বলে কীর্তিতা বাঙলাদেশের শাক্ত পদাবলীর মধ্যে এই সত্যটির প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। তাই শ্রীদাশগুপ্তের উল্লেখকৃত সাধক রামপ্রসাদের গানে দেখতে পাই, বলা হয়েছে–
শিব নয় মায়ের পদতলে।
ওটা মিথ্যা লোকে বলে।।
দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে,
মা দাঁড়ায়ে তার উপরে,
মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ
শিবরূপ হয় রণস্থলে।।
মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহও শিবরূপতা প্রাপ্ত হয়– কথাটার আসল অর্থ হলো, এ কথার মধ্যে দিয়েই শক্তিতত্ত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। এ ছাড়াও তন্ত্রে শিবের বুকে কালীর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বহুরকম দার্শনিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। যেমন, মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে–
কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।
কালসংগ্রহণাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।। –(মহানির্বাণতন্ত্র)
অর্থাৎ– তিনি মহাকাল, তিনি সর্বপ্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলিয়াই মহাকাল; দেবী আবার এই মহাকালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, এই নিমিত্ত তিনি আদ্যা পরম ‘কালিকা’। কালকে গ্রাস করেন বলিয়াই দেবী কালী। তিনি সকলের আদি, সকলের কালস্বরূপা এবং আদিভূতা, এই নিমিত্তই লোকে দেবীকে আদ্যাকালী বলিয়া কীর্তন করে।
বিভিন্ন পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে ‘কালীতন্ত্র’-ধৃত কালীর বর্ণনাই কালীর ধ্যানরূপে কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হয়েছে। তন্ত্রসারে বর্ণিত কালীর এ রূপই এখন সাধারণভাবে বাঙলা অঞ্চলের মাতৃপূজায় গৃহীত। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী কালীর রূপ হলো–
‘দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ; দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা (এইজন্যই কালী-দেবী শ্যামা নামে খ্যাতা) এবং দিগম্বরী; তাঁহার কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; আর দুইটি শবশিশু তাঁহার কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্ট্রা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা; শবসমূহের করদ্বারা নির্মিত কাঞ্চী পরিহিতা হইয়া দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা-দ্বারা দেবী বিস্ফুরিতাননা; তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী– শ্মশানগৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের ন্যায় দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা; তিনি চতুর্দিকে ঘোররবকারী শিবাকুলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সহিত ‘বিপরীতরতাতুরা’, সুখপ্রসন্নবদনা এবং ‘স্মেরাননসরোরুহা’।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭১)
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-সঙ্কলিত এই সুপ্রসিদ্ধ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হয়েছে। বাঙলা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ‘কালী’ আছেন। তন্ত্রসারে বিভিন্ন প্রকার কালীর সাধনার পদ্ধতি দেখা যায়। এখানে কালী– বা শ্যামা-পূজার বিধি ছাড়াও তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাগণের সাধনবিধিও সঙ্কলিত হয়েছে। কৃষ্ণানন্দকে ষোড়শ শতকের লোক বলে ধরা হয়। কৃষ্ণানন্দ ছাড়া তান্ত্রিক সাধনা ক্রিয়াকলাপবিধি সম্বন্ধে গ্রন্থরচয়িতারূপে ব্রহ্মানন্দ ও সর্বানন্দের প্রসিদ্ধি রয়েছে। ব্রহ্মানন্দ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম বা মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে শাক্তদের আচার-অনুষ্ঠান বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তারারহস্যে’ তারার উপাসনা বিবৃত হয়েছে। ব্রহ্মানন্দের শিষ্য পূর্ণানন্দ পরমহংস ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লোক। তাঁর রচিত ‘শ্যামারহস্যে’ কালীর উপাসকের আচার-অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও আরও একজন গ্রন্থকার গৌড়ীয় শঙ্কর (শঙ্কর আগমাচার্য, ১৬৩০) তার উপাসনার আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে রচনা করেন– ‘তারারহস্যবৃত্তিকা’।
‘দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ; দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা (এইজন্যই কালী-দেবী শ্যামা নামে খ্যাতা) এবং দিগম্বরী; তাঁহার কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; আর দুইটি শবশিশু তাঁহার কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্ট্রা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা; শবসমূহের করদ্বারা নির্মিত কাঞ্চী পরিহিতা হইয়া দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা-দ্বারা দেবী বিস্ফুরিতাননা; তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী– শ্মশানগৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের ন্যায় দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা; তিনি চতুর্দিকে ঘোররবকারী শিবাকুলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সহিত ‘বিপরীতরতাতুরা’, সুখপ্রসন্নবদনা এবং ‘স্মেরাননসরোরুহা’।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭১)
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-সঙ্কলিত এই সুপ্রসিদ্ধ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হয়েছে। বাঙলা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ‘কালী’ আছেন। তন্ত্রসারে বিভিন্ন প্রকার কালীর সাধনার পদ্ধতি দেখা যায়। এখানে কালী– বা শ্যামা-পূজার বিধি ছাড়াও তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাগণের সাধনবিধিও সঙ্কলিত হয়েছে। কৃষ্ণানন্দকে ষোড়শ শতকের লোক বলে ধরা হয়। কৃষ্ণানন্দ ছাড়া তান্ত্রিক সাধনা ক্রিয়াকলাপবিধি সম্বন্ধে গ্রন্থরচয়িতারূপে ব্রহ্মানন্দ ও সর্বানন্দের প্রসিদ্ধি রয়েছে। ব্রহ্মানন্দ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম বা মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে শাক্তদের আচার-অনুষ্ঠান বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তারারহস্যে’ তারার উপাসনা বিবৃত হয়েছে। ব্রহ্মানন্দের শিষ্য পূর্ণানন্দ পরমহংস ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লোক। তাঁর রচিত ‘শ্যামারহস্যে’ কালীর উপাসকের আচার-অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও আরও একজন গ্রন্থকার গৌড়ীয় শঙ্কর (শঙ্কর আগমাচার্য, ১৬৩০) তার উপাসনার আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে রচনা করেন– ‘তারারহস্যবৃত্তিকা’।
বর্তমানে নিত্য কালীপূজার প্রথা রয়েছে বা বিশেষ কোন উপলক্ষে ‘মানসিক’-করা কালীপূজার ব্যবস্থা হয়। এ ছাড়া দীপালি-উৎসবের বা দীপাবলির দিনে যে সাংবাৎসরিক কালী বা শ্যামাপূজার জনপ্রিয় প্রচলন রয়েছে তার সর্বপ্রথম বিধিব্যবস্থা পাওয়া যায় কাশীনাথ (১৭৬৮) রচিত ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে। শ্রীদাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গ্রন্থে কাশীনাথ যেভাবে কালীপূজার সপক্ষে যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন তাতে মনে হয়, তখন ‘বাঙলাদেশে’ এই সাংবাৎসরিক দীপাবলির দিনে কালীপূজা বা শ্যামাপূজা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল না। কালীপূজা বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই এই পূজার প্রবর্তন করেন এবং তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রজাদের মধ্যে যারা কালীপূজা করতে অস্বীকৃত হবে তাদেরকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। এ আদেশের ফলে প্রতি বছর দশ হাজার করে কালীমূর্তি পূজিত হতো বলে জানা যায়। কথিত আছে, পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র সহস্র সহস্র মন নৈবেদ্য, সহস্র সহস্র বস্ত্র ও সেই পরিমাণ বিভিন্ন উপচার সহযোগে কালীপূজা করেছিলেন। এছাড়া রটন্তী চতুর্দশীর রাত্রিতে (মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে) কালীপূজার কথা ‘স্মৃতিসমুচ্চয়’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই দেবীকে অবলম্বন করেই বাঙলায় তন্ত্র-সাধনা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের বর্ণনায়–
‘এই দেবী-পূজার ইতিহাসটাই বাঙলাদেশের শাক্তধর্মের ক্ষেত্রে প্রধান কথা নহে; প্রধান জিনিস হইল দেবীকে অবলম্বন করিয়া বাঙলার তন্ত্র-সাধনা, এই তন্ত্র-সাধনা মুখ্যভাবে যুক্ত হইয়া গিয়াছিল কালী-সাধনা এবং দশমহাবিদ্যার সাধনার সঙ্গে, এবং খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতক হইতে আমরা কালী এবং অন্যান্য দশমহাবিদ্যার সাধনা অবলম্বনে বিখ্যাত শক্তি-সাধকগণের কথা জানিতে পারি। আমরা পূর্বে কালীপূজার বিধান রচয়িতৃরূপে কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছি; ইঁহারা সাধকও ছিলেন। অন্যান্য সাধকগণের মধ্যে ষোড়শ শতকের সর্বানন্দ ঠাকুর অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ত্রিপুরা জেলার মেহার গ্রামে তাঁহার আবির্ভাব হয়। তিনি শবরূপী ভৃত্য পূর্ণানন্দের দেহের উপরে বসিয়া সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং দশমহাবিদ্যার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে তাঁহার বংশধর তান্ত্রিক সাধকগণ ‘সর্ববিদ্যা’র বংশ বলিয়া খ্যাত। তন্ত্র-সাধনার ক্ষেত্রে ‘অর্ধকালী’রও প্রসিদ্ধি আছে। প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মুক্তাগাছার সমীপবর্তী পণ্ডিতবাড়ি গ্রামে দ্বিজদেব-নামক সাধকের গৃহে ইনি কন্যারূপে আবির্ভূতা হন। তাঁহার নাম ছিল জয়দুর্গা, তিনি স্বয়ং মহেশ্বরী বলিয়া প্রবাদ। তাঁহার দেহের অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক গৌরবর্ণ ছিল বলিয়া তাঁহার অর্ধকালী নাম হইয়াছিল। গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে খ্যাত রত্নগর্ভ-নামক সাধক ঢাকা জেলার মায়ৈসারের দিগম্বরীতলায় বীরাচারে সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। কথিত হয়, ইনি প্রসিদ্ধ ‘বারভূঞা’র মধ্যে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গুরু ছিলেন। প্রায় শত বর্ষ পূর্বে বীরভূম জেলার তারপীঠের নিকট আটলাগ্রামে সাধক বামাক্ষেপার জন্ম হয়; তারাপীঠ তাঁহার সাধনা ও সিদ্ধির স্থান।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭৬)
আর অশোক রায়ের বর্ণনায়– ‘সাহিত্যে ও সাধনার শাক্তধারায় জোয়ার আসে অষ্টাদশ শতকে। সাধক রামপ্রসাদ সেন বাংলা ভাষায় শাক্ত পদাবলীর সূচনা করেন। তাঁর পরে, কমলাকান্ত ও গোবিন্দ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও প্রায় একশত বছর ধরে বীরভূম জেলার তারাপীঠের সাধক বামাখ্যাপার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপরে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের সাধক পূজারি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখেরা শাক্ত-সাধনাকে সারা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যোগীপুরুষ শ্রীঅরবিন্দ শক্তি সাধনার গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যকে তাঁর ‘অখণ্ড মহাযোগে’র সঙ্গে সংযুক্ত করে এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক দার্শনিক রূপদান করেন। এ ছাড়াও এই সময়কালে বহু সাধক-সাহিত্যিক গায়ক (কালীকেন্দ্রিক) শাক্তসাধনাকে চরমোৎকর্ষতার স্তরে উত্তরিত করেন। শ্যামাসংগীত গেয়ে বাঙালির মনজয় ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন দুই ভাই শ্রীপান্নালাল ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আর দুর্গাকেন্দ্রিক শাক্তধারাতে সাম্প্রতিক কালের শ্রেষ্ঠ সাধকেরা হলেন শ্রীশ্রীসত্যদেব, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ ও মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, এঁরা ‘চণ্ডী’ গ্রন্থের নবরূপকার।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩৯)
‘এই দেবী-পূজার ইতিহাসটাই বাঙলাদেশের শাক্তধর্মের ক্ষেত্রে প্রধান কথা নহে; প্রধান জিনিস হইল দেবীকে অবলম্বন করিয়া বাঙলার তন্ত্র-সাধনা, এই তন্ত্র-সাধনা মুখ্যভাবে যুক্ত হইয়া গিয়াছিল কালী-সাধনা এবং দশমহাবিদ্যার সাধনার সঙ্গে, এবং খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতক হইতে আমরা কালী এবং অন্যান্য দশমহাবিদ্যার সাধনা অবলম্বনে বিখ্যাত শক্তি-সাধকগণের কথা জানিতে পারি। আমরা পূর্বে কালীপূজার বিধান রচয়িতৃরূপে কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছি; ইঁহারা সাধকও ছিলেন। অন্যান্য সাধকগণের মধ্যে ষোড়শ শতকের সর্বানন্দ ঠাকুর অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ত্রিপুরা জেলার মেহার গ্রামে তাঁহার আবির্ভাব হয়। তিনি শবরূপী ভৃত্য পূর্ণানন্দের দেহের উপরে বসিয়া সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং দশমহাবিদ্যার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে তাঁহার বংশধর তান্ত্রিক সাধকগণ ‘সর্ববিদ্যা’র বংশ বলিয়া খ্যাত। তন্ত্র-সাধনার ক্ষেত্রে ‘অর্ধকালী’রও প্রসিদ্ধি আছে। প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মুক্তাগাছার সমীপবর্তী পণ্ডিতবাড়ি গ্রামে দ্বিজদেব-নামক সাধকের গৃহে ইনি কন্যারূপে আবির্ভূতা হন। তাঁহার নাম ছিল জয়দুর্গা, তিনি স্বয়ং মহেশ্বরী বলিয়া প্রবাদ। তাঁহার দেহের অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক গৌরবর্ণ ছিল বলিয়া তাঁহার অর্ধকালী নাম হইয়াছিল। গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে খ্যাত রত্নগর্ভ-নামক সাধক ঢাকা জেলার মায়ৈসারের দিগম্বরীতলায় বীরাচারে সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। কথিত হয়, ইনি প্রসিদ্ধ ‘বারভূঞা’র মধ্যে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গুরু ছিলেন। প্রায় শত বর্ষ পূর্বে বীরভূম জেলার তারপীঠের নিকট আটলাগ্রামে সাধক বামাক্ষেপার জন্ম হয়; তারাপীঠ তাঁহার সাধনা ও সিদ্ধির স্থান।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭৬)
আর অশোক রায়ের বর্ণনায়– ‘সাহিত্যে ও সাধনার শাক্তধারায় জোয়ার আসে অষ্টাদশ শতকে। সাধক রামপ্রসাদ সেন বাংলা ভাষায় শাক্ত পদাবলীর সূচনা করেন। তাঁর পরে, কমলাকান্ত ও গোবিন্দ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও প্রায় একশত বছর ধরে বীরভূম জেলার তারাপীঠের সাধক বামাখ্যাপার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপরে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের সাধক পূজারি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখেরা শাক্ত-সাধনাকে সারা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যোগীপুরুষ শ্রীঅরবিন্দ শক্তি সাধনার গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যকে তাঁর ‘অখণ্ড মহাযোগে’র সঙ্গে সংযুক্ত করে এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক দার্শনিক রূপদান করেন। এ ছাড়াও এই সময়কালে বহু সাধক-সাহিত্যিক গায়ক (কালীকেন্দ্রিক) শাক্তসাধনাকে চরমোৎকর্ষতার স্তরে উত্তরিত করেন। শ্যামাসংগীত গেয়ে বাঙালির মনজয় ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন দুই ভাই শ্রীপান্নালাল ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আর দুর্গাকেন্দ্রিক শাক্তধারাতে সাম্প্রতিক কালের শ্রেষ্ঠ সাধকেরা হলেন শ্রীশ্রীসত্যদেব, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ ও মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, এঁরা ‘চণ্ডী’ গ্রন্থের নবরূপকার।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩৯)
বাঙলা অঞ্চলে মাতৃপূজার যে ইতিহাস তাতে দেখা যায় যে, দুর্গাপূজা কালীপূজা অপেক্ষা প্রাচীনতর কালে এদেশে প্রবর্তিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পূজাকে অবলম্বন করে ধর্মোৎসবের ব্যাপকতায় দুর্গাপূজা এখনও বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান পূজা। দুর্গাপূজা সাংবৎসরিক উৎসব-বিশেষ মাত্র। সাংবৎসরিক পূজা ছাড়া দুর্গার কোনও নিত্যপূজার প্রচলন তেমন কোন অঞ্চলে দেখা যায় না। রোগে, শোকে, দৈব-দুর্বিপাকে সংকল্পপূর্বক চণ্ডীপাঠ বা দুর্গানাম জপের ব্যবস্থা শান্তি-স্বস্ত্যয়নের অঙ্গরূপে দেখা যায়। কিন্তু এসব ছাড়া সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গার তেমন কোনও প্রাধান্য দেখা যায় না। শারদীয়া দুর্গাপূজার পর থেকে শুরু করে বসন্তকাল পর্যন্ত দেবীকে নানারূপে পূজা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, সরস্বতীপূজা– সর্বশেষ বসন্তকালে দেবীর বাসন্তী মূর্তির পূজা– এর মধ্যে এক কালীপূজা ছাড়া আর সবই সাংবৎসরিক পূজা। শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রাধান্য লাভ করলেন সাধারণভাবে কালী– বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দশমহাবিদ্যার অন্য কোনও রূপ।
এখানে প্রশ্ন আসে, বাঙলা অঞ্চলে শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গাকে পেছনে ফেলে এই যে কালী-দেবীরই প্রাধান্য দেখা যায়, তার কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতদের অভিমত হলো,– শারদীয়া দুর্গাপূজায় পূজা অপেক্ষা উৎসব-আনন্দের দিকটাকেই বড় করে দেখা হয়। এই উৎসব-আনন্দের রূপটা যে ভক্তিহীন জাঁকজমক-প্রধান বিংশ শতাব্দীতেই প্রধান হয়ে উঠেছে তা নয়, শারদীয়া পূজার প্রথমাবধিই এ জিনিসটি আমরা লক্ষ্য করি। দুর্গাপূজাকে আমরা শস্য-সম্পদ্-শক্তি-রূপিণী মায়ের আগমনী-উৎসব বলেই জানি। শ্রদ্ধেয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় মনে করেন, শারদীয়া পূজার মূলে সবটাই উৎসব,– শরৎকালীন নববর্ষের উৎসব। শরৎ ঋতু প্রবেশ জনিত উৎসব– শরদোৎসব। অতএব, শারদীয়া দুর্গাপূজা যে শুধু দুর্গাপূজা নয়– মূলেও যে এর একটি উৎসব-প্রকৃতি ছিল এবং পরবর্তীকালেও যে নানা উৎসব এর সাথে নানাভাবে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দুর্গাপূজায় এই উৎসব প্রাধান্যের জন্যেই মনে হয় সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করেননি, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীরা।
শুধু এটুকুই নয়, বাঙলা শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে কালী-প্রাধান্যের ভিতরে আরও অনেক তথ্য নিহিত আছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অতএব, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে–
‘বিভিন্ন পুরাণ এবং উপপুরাণের মধ্যে কালীর কথা যেভাবে পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, প্রথমতঃ এই উপপুরাণকারগণ নানাভাবে দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন কালী এবং পার্বতী-দেবী (তাঁহার উমা, দুর্গা, গৌরী, চণ্ডী সর্বরূপে) অভিন্না এবং এই করিয়া কালী-দেবীকে প্রথমে মহাদেবীরূপে স্বীকৃতা এবং প্রতিষ্ঠিতা করিয়া লইতে হইয়াছে। ইহার পরে দ্বিতীয় রকমের চেষ্টা দেখিতে পাই, কালীই যে মূল দেবী এবং পার্বতী দেবী তাঁহার উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি সর্বরূপেই এই সর্বমূলা কালী-দেবী হইতেই প্রসৃতা, সেই মূলা দেবীরই রূপভেদ মাত্র। এইভাবেই কালিকা বা কালী-দেবীকে প্রধানা করিয়া উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী রূপধারিণী দেবীকে মূল হইতে প্রসৃতা দেবী করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৮০-৮১)
এখানে প্রশ্ন আসে, বাঙলা অঞ্চলে শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গাকে পেছনে ফেলে এই যে কালী-দেবীরই প্রাধান্য দেখা যায়, তার কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতদের অভিমত হলো,– শারদীয়া দুর্গাপূজায় পূজা অপেক্ষা উৎসব-আনন্দের দিকটাকেই বড় করে দেখা হয়। এই উৎসব-আনন্দের রূপটা যে ভক্তিহীন জাঁকজমক-প্রধান বিংশ শতাব্দীতেই প্রধান হয়ে উঠেছে তা নয়, শারদীয়া পূজার প্রথমাবধিই এ জিনিসটি আমরা লক্ষ্য করি। দুর্গাপূজাকে আমরা শস্য-সম্পদ্-শক্তি-রূপিণী মায়ের আগমনী-উৎসব বলেই জানি। শ্রদ্ধেয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় মনে করেন, শারদীয়া পূজার মূলে সবটাই উৎসব,– শরৎকালীন নববর্ষের উৎসব। শরৎ ঋতু প্রবেশ জনিত উৎসব– শরদোৎসব। অতএব, শারদীয়া দুর্গাপূজা যে শুধু দুর্গাপূজা নয়– মূলেও যে এর একটি উৎসব-প্রকৃতি ছিল এবং পরবর্তীকালেও যে নানা উৎসব এর সাথে নানাভাবে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দুর্গাপূজায় এই উৎসব প্রাধান্যের জন্যেই মনে হয় সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করেননি, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীরা।
শুধু এটুকুই নয়, বাঙলা শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে কালী-প্রাধান্যের ভিতরে আরও অনেক তথ্য নিহিত আছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অতএব, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে–
‘বিভিন্ন পুরাণ এবং উপপুরাণের মধ্যে কালীর কথা যেভাবে পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, প্রথমতঃ এই উপপুরাণকারগণ নানাভাবে দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন কালী এবং পার্বতী-দেবী (তাঁহার উমা, দুর্গা, গৌরী, চণ্ডী সর্বরূপে) অভিন্না এবং এই করিয়া কালী-দেবীকে প্রথমে মহাদেবীরূপে স্বীকৃতা এবং প্রতিষ্ঠিতা করিয়া লইতে হইয়াছে। ইহার পরে দ্বিতীয় রকমের চেষ্টা দেখিতে পাই, কালীই যে মূল দেবী এবং পার্বতী দেবী তাঁহার উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি সর্বরূপেই এই সর্বমূলা কালী-দেবী হইতেই প্রসৃতা, সেই মূলা দেবীরই রূপভেদ মাত্র। এইভাবেই কালিকা বা কালী-দেবীকে প্রধানা করিয়া উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী রূপধারিণী দেবীকে মূল হইতে প্রসৃতা দেবী করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৮০-৮১)
ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাঙলা অঞ্চলে প্রচলিত মাতৃপূজার মধ্যে প্রধান যে কয়েকটি ধারা রয়েছে আমরা দেখলাম, এই প্রধান ধারাগুলির সাথে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে স্থানীয় মাতৃদেবীরা মিলেমিশে মূল ধারাকেই সুবিচিত্র এবং পরিপুষ্ট করে তুলেছে। তাই ‘দেবী-ভাগবতে’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলা হয়েছে–
কলা যা যাঃ সমুদ্ভূতাঃ পূজিতাস্তাশ্চ ভারতে।
পূজিতা গ্রামদেব্যশ্চ গ্রামে চ নগরে মুনে।।
অর্থাৎ– ভারতবর্ষের যত নগরে এবং গ্রামে যত দেবী রয়েছেন তাঁরাও বিধিপূর্বক মহাদেবীরূপেই পূজিতা হয়ে থাকেন– কারণ, মূলে তাঁরা আদ্যাদেবী থেকে কিছু পৃথক নন, তাঁরাও সবাই একই মহাদেবীর বিশেষ বিশেষ কলামাত্র।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ