যোগদর্শন হলো প্রধানত সাধনশাস্ত্র ও প্রয়োগবিদ্যা। যোগমতে প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হলো কৈবল্য লাভ বা মুক্তিলাভের উপায়। বিবেকখ্যাতির অর্থ হলো পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার থেকে পৃথক শুদ্ধ চৈতন্য সত্তা। এই বিবেকখ্যাতির জন্য প্রয়োজন চিত্তবৃত্তির নিরোধ। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী চিত্তবৃত্তি নিরোধের দুটি প্রধান উপায় হলো অভ্যাস ও বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়ে বৈরাগ্য আসে এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেক-জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু ধারণা, ধ্যান, সমাধি প্রভৃতি অভ্যাস করার মতো চিত্তশুদ্ধি যাদের হয়নি তাদের জন্য প্রথমে চিত্তবৃত্তি নিরোধের সাক্ষাৎ উপায় হিসেবে আটটি যোগাঙ্গ অভ্যাসের মাধ্যমে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়েছে। এগুলি একসঙ্গে অষ্টাঙ্গ-যোগ নামে পরিচিত।হঠযোগের একটা বিরাট অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ (Astanga Yoga)। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি- (১) যম (Yama), (২) নিয়ম (Niyama), (৩) আসন (Asana), (৪) প্রাণায়াম (Pranayama), (৫) প্রত্যাহার (Pratyahara), (৬) ধারণা (Dharana), (৭) ধ্যান (Dhyana) ও (৮) সমাধি (Samadhi)। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘যমনিয়মাসন-প্রাণায়ামপ্রত্যাহারধারণাধ্যানসমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি’- (যোগসূত্র : ২/২৯)
অর্থাৎ : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ।
.
যোগের এই অষ্টাঙ্গ যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে চিত্তের মলিনতা নষ্ট হয় এবং জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পায়। যোগশাস্ত্রকাররা বলেন, যোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অষ্টাঙ্গিক যোগের অনুষ্ঠানের দ্বারা অশুদ্ধি অর্থাৎ অজ্ঞান এবং তার থেকে উৎপন্ন সংস্কার যতোই ক্ষয় হয়, প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান ততোই দীপ্তিমান হয়ে ওঠে। জ্ঞানের দীপ্তির চরম সীমাই হলো বিবেকখ্যাতি বা ভেদজ্ঞান। বিবেকখ্যাতি লাভের উপায় হিসেবে যোগের এই অষ্টাঙ্গের অনুশীলন অপরিহার্য।
.
.
যম :
প্রথম যোগাঙ্গ হলো যম। যম হলো একপ্রকার নিষেধাত্মক বিধি। যম সম্পর্কে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘অহিংসাসত্যাস্তেয়ব্রহ্মচর্য্যাপরিগ্রহা যমাঃ’- (যোগসূত্র : ২/৩০)
অর্থাৎ : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ- এই পাঁচটি সাধনকে একসঙ্গে বলা হয় যম।
.
(ক) অহিংসা : অহিংসা হলো সর্বপ্রকারে, সর্বদা, সর্বভূতের প্রতি হিংসা থেকে বিরত থাকা। হিংসা বলতে এখানে কায়িক, বাচিক ও মানসিক- তিনপ্রকার হিংসার কথাই বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার হিংসাই বর্জনীয়। অর্থাৎ কোনপ্রকারেই অপরকে আঘাত না করা বা অপরকে ব্যথা না দেয়া। অহিংসার ইতিবাচক ভাব হলো মৈত্রী।
.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যোগী পুরুষরা যেভাবে অহিংসা মহাব্রত পালন করেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব নয়। যেমন আততায়ীকে বধ করা, খাবার জন্য ফসল, গাছ প্রভৃতি নাশ করা, অপকারী প্রাণীকে বধ করা ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ হিংসারূপে গণ্যই করেন না। কেননা দেহধারণের জন্য কিছু না কিছু খেতেই হবে। আবার প্রতি পদক্ষেপে কিছু না কিছু জীবাণুর প্রাণহানি হয়। এমনকি গৃহস্থের বাড়িতে অসময়ে ও অনাহূতভাবে অন্নগ্রহণ করলেও তা একপ্রকার পীড়নই বলা চলে। বস্তুত এক্ষেত্রে এরূপ বিধান দেয়া হয়েছে যে, অবশ্যম্ভাবী কিছু হিংসা ত্যাগ করা না গেলেও যোগীপুরুষ যথাসম্ভব হিংসাকে বর্জনের সংকল্প করে চিত্তশুদ্ধি করবেন। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যোগী পুরুষরা যেভাবে অহিংসা মহাব্রত পালন করেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব নয়। যেমন আততায়ীকে বধ করা, খাবার জন্য ফসল, গাছ প্রভৃতি নাশ করা, অপকারী প্রাণীকে বধ করা ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ হিংসারূপে গণ্যই করেন না। কেননা দেহধারণের জন্য কিছু না কিছু খেতেই হবে। আবার প্রতি পদক্ষেপে কিছু না কিছু জীবাণুর প্রাণহানি হয়। এমনকি গৃহস্থের বাড়িতে অসময়ে ও অনাহূতভাবে অন্নগ্রহণ করলেও তা একপ্রকার পীড়নই বলা চলে। বস্তুত এক্ষেত্রে এরূপ বিধান দেয়া হয়েছে যে, অবশ্যম্ভাবী কিছু হিংসা ত্যাগ করা না গেলেও যোগীপুরুষ যথাসম্ভব হিংসাকে বর্জনের সংকল্প করে চিত্তশুদ্ধি করবেন। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিতর্কবাধনে প্রতিপক্ষভাবনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৩)
‘বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভমোহাক্রোধপূর্ব্বিকা মৃদুমধ্যাধিমাত্রা দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৪)
‘অহিংসা প্রতিষ্ঠায়াং তৎসন্নিধৌ বৈরত্যাগঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৫)
অর্থাৎ :
যোগবিঘ্ন হিংসা প্রভৃতি বিতর্ক নিবারণ করতে হলে যোগের অনুকূল অবিতর্ক অহিংসা প্রভৃতির যাতে স্ফূরণ হয়, তারই চেষ্টা করতে হয় (পাতঞ্জল-২/৩৩)। লোভ, মোহ এবং ক্রোধ বশতই নিজ ইচ্ছাক্রমে অন্য কারো অনুরোধে অথবা নিজ অনুমোদনের দ্বারা হিংসা প্রভৃতি বিবিধ বিতর্ক সম্পাদিত হয়ে থাকে। ঐ লোভ, মোহ এবং ক্রোধ, মৃদু, মধ্য অথবা উগ্রভাবে উৎপন্ন হয়। মৃদুভাবে লোভ, মোহ কিংবা ক্রোধের উদয় হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মৃদু হয়। ঐগুলি মধ্যভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মধ্য হয়। আর সেগুলি উগ্রভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও উগ্র হয়। হিংসা প্রভৃতি বিতর্কবৃত্তি যেভাবেই স্ফূরিত হোক না কেন, তারা দুঃখ অজ্ঞান এবং ঐ উভয়ের অনন্ত ফল উৎপন্ন করে, এইভাবে ভাবনার নামই প্রতিপক্ষভাবনা। এই প্রতিপক্ষভাবনাবলে হিংসা বিতর্কসমূহের দোষ অনুসন্ধানে সেইসব থেকে যেসব দুঃখ হয়, তাদের আলোচনায় সমস্ত বিতর্কেরই নিবৃত্তি হয় (পাতঞ্জল-২/৩৪)। যে মহাপুরুষ সম্পূর্ণ হিংসাশূন্য হয়েছেন, তাঁর কাছে হিংস্র বন্য জন্তুরাও হিংসা পরিত্যাগ করে, তিনি হিংস্র জন্তুদের সহবাসেও নিরাপদে অবস্থান করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৫)।
.
(খ) সত্য : সত্য হলো চিন্তায় এবং বাক্যে কোনরূপ মিথ্যাচরণ না করা। তবে যোগশাস্ত্রে সত্য কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত। কাল ও পরিবেশ নির্বিশেষে সত্য যেন অপরের কল্যাণকর হয়। যথাদৃষ্ট, যথাশ্রুত এবং যথাউপলব্ধকে ব্যক্ত করাকে বলা হয় সত্যনিষ্ঠ। সৎ উদ্দেশ্যেও অসত্যের কথন বর্জনীয়, এমনকি অর্ধসত্যও অসত্যের মতোই বর্জন করা উচিত। তত্ত্ব বা সত্য যদি অপ্রিয় হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে মৌন থাকার বিধান দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সত্যপ্রতিষ্ঠায়াং ক্রিয়াফলাশ্রয়ত্বম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৬)
অর্থাৎ : সত্যে প্রতিষ্ঠা জন্মিলে, সত্য ছাড়া মিথ্যা কথা না বললে, বাকসিদ্ধি হয়। কেউ যদি কোন ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান না করেন, অথচ কোন বাকসিদ্ধ পুরুষ যদি তার ভক্তি হবে বলেন, তাহলে সেই ভক্তি প্রাপ্তির অনুকূল কার্য না করেও সেসব কার্যের ফল ভক্তি লাভ করেন (পাতঞ্জল-২/৩৬)।
.
(গ) অস্তেয় : অস্তেয় হলো চৌর্যবৃত্তি পরিত্যাগ। যা নিজের নয় এমন দ্রব্য, এককথায় যা পরদ্রব্য তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, এমন কি তাতে স্পৃহাও না করাই হলো অস্তেয়। এর দ্বারা চিত্তমল দূরীভূত হয়। এ সম্পর্কে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অস্তেয়প্রতিষ্ঠায়াং সর্ব্বরত্নোপস্থানম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৭)
অর্থাৎ : সম্পূর্ণরূপে চৌর্য ত্যাগ হলে সমস্ত রত্নই প্রাপ্ত হওয়া যায় (পাতঞ্জল-২/৩৭)।
.
(ঘ) ব্রহ্মচর্য : ব্রহ্মচর্য হলো জননেন্দ্রিয়ের সংযম। কাম-আচরণ ও কাম-চিন্তা থেকে বিরত থাকা। রমণীসম্ভোগ ত্যাগ এবং বীর্য-ধারণকে ব্রহ্মচর্য বলে। ব্যাপক অর্থে ব্রহ্মচর্য হলো শরীর ও মনের পবিত্রতা। এইজন্য সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করে অল্প আহার এবং অল্প নিদ্রার বিধান দেয়া হয়েছে। ব্রহ্মচর্যের দ্বারা বাক্য ও সংকল্পের শক্তি বৃদ্ধি হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘ব্রহ্মচর্য্য প্রতিষ্ঠায়াং বীর্য্যলাভঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৮)
অর্থাৎ : যিনি নিষ্কাম হয়েছেন, যিনি জিতেন্দ্রিয় হয়েছেন, যিনি সর্বতোভাবে ব্রহ্মচর্যে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁর অতুল বিক্রম, অদ্ভূত শক্তিলাভ হয়েছে। যে শক্তিপ্রভাবে কতো অলৌকিক কার্য করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৮)।
.
(ঙ) অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ হলো দেহরক্ষার বা প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া সমস্ত প্রকার ভোগ বিলাসের আকাঙ্ক্ষা বর্জন, এবং অপরের দান অগ্রহণ। যোগসাধনাকালে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিষয় অর্জন করলে দুঃখ, বিষয়ের রক্ষণে দুঃখ, বিষয়ের ক্ষয়ে দুঃখ এবং বিষয়ের গ্রহণেও দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ, অধিক ভোগ্য বস্তুর অধিকারী হলে মোক্ষে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরিগ্রহের দ্বারা চিত্তে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত হয়। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে-
‘অপরিগ্রহস্থৈর্য্যে জন্মকথন্তাসংবোধ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৯)
অর্থাৎ : দৃঢ়রূপে অপরিগ্রহ বৃত্তির স্ফূরণে যখন সর্বত্যাগ হয়, যখন সকল প্রকার ভোগবিলাসে বীতরাগ হয়, তখন নিজের সকল জন্মবৃত্তান্তই সুগোচর হয় (পাতঞ্জল-২/৩৯)।
.
যম হলো নিষেধাত্মক বিধি। কতকগুলি কর্ম থেকে প্রতিনিবৃত্ত হওয়ার সাধনাই হলো যম। যম যোগাঙ্গের প্রথম অঙ্গ এই কারণে যে, ইন্দ্রিয়াসক্ত, বিষয়ভোগী ও অসংযতচিত্ত ব্যক্তি কখনো যোগ সাধনার দুর্গম পথে অগ্রসর হতে পারে না। পাঁচপ্রকার যম জাতি, দেশ ও কাল অতিক্রান্ত হলে তা মহাব্রত বলে গণ্য হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘এতে জাতিদেশকালসময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্ব্বভৌমা মহাব্রতম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩১)
অর্থাৎ : এই পাঁচপ্রকার যম যদি জাতি, দেশ, কাল ও সময় কর্তৃক বিচ্ছিন্ন না হয়ে সর্বাবস্থায় সমানভাবে আচরিত হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকটিকে একেকটি মহাব্রত বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৩১)।
.
.
নিয়ম :
যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ হলো নিয়ম। নিয়ম অর্থ নিয়মিত ব্রতপালনের অভ্যাস। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ’- (যোগসূত্র : ২/৩২)
অর্থাৎ : শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধানকে বলা হয় নিয়ম।
.
(ক) শৌচ : ‘শৌচ’ শব্দের অর্থ শুচিতা বা শুদ্ধি। যোগের জন্য দেহ ও মন উভয়েরই শুচিতা দরকার। এ কারণে শৌচ দ্বিবিধ- বাহ্য ও আন্তর। প্রাত্যহিক স্নান হলো বাহ্য শৌচ। বাসগৃহ নির্মল রাখা এবং সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা যোগীর বাঞ্ছনীয়। কারণ মদ, মাংস ইত্যাদি তামসিক আহার চিত্তের স্থিরতা নষ্ট করে এবং তার ফলে ব্রহ্মচর্যের হানি হয়। অপরপক্ষে আন্তর শৌচ হলো অহঙ্কার, অভিমান এবং হিংসা ইত্যাদি চিত্তের মলীনতা থেকে মুক্ত হওয়া। অহঙ্কারে উন্মত্ত, অভিমানী এবং হিংসাযুক্ত চিত্ত সর্বদা বিক্ষুব্ধ থাকায় সমাধিস্থ হতে পারে না। শৌচের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয় এবং চিত্তশুদ্ধির ফলে চিত্তে প্রসন্নতা আসে। পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন-
‘শৌচাৎ সাঙ্গজুগুপ্সা পরৈপরসঙ্গশ্চ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪০)
‘সত্ত্বশুদ্ধিসৌমনস্যৈকাগ্র ইন্দ্রিয়জয়াত্মদর্শন যোগ্যত্বানি’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪১)
অর্থাৎ :
শৌচ সিদ্ধ হলে নিজ শরীর পর্যন্ত অশুচি বোধ হয়। সেজন্য নিজ শরীরের প্রতিও ঘৃণা ও বীতরাগ হয়। শৌচসিদ্ধের পর পরসঙ্গ-ইচ্ছাও ত্যাগ হয়ে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪০)। বাহ্যশৌচ সিদ্ধ হয়ে, পরে আন্তর শৌচ সিদ্ধ হলে সত্ত্বশুদ্ধি (অপূর্ব সুখপ্রকাশিনী সাত্তিকী বুদ্ধি শুদ্ধি) হয়। সত্ত্বশুদ্ধি থেকে সৌমনস্য (খেদ সম্পর্ক বিহীনা মানসী প্রীতি) হয়। সৌমনস্য থেকে একাগ্রতা (স্থৈর্য্য) হয়। ইন্দ্রিয়জয় থেকে আত্মদর্শন-শক্তি (আত্মজ্ঞান) হয় (পাতঞ্জল-২/৪১)।
.
(খ) সন্তোষ : ‘সন্তোষ’ বলতে বোঝায় অহেতুক আকাঙ্ক্ষাকে বর্জন করে যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। কেবলমাত্র সন্তোষের দ্বারাই সুখ পাওয়া যায়। কারণ সমস্ত কাম্য বিষয় পেলে তবেই তুষ্ট হবো এরূপ ভাবলে সমস্ত কাম্য বিষয় কখনোই পাওয়া যায় না। সন্তোষ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪২)
অর্থাৎ : পূর্ণ সন্তোষ থেকে উত্তম সুখ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠসুখ লাভ হয়, যে সুখের অপর নাম দিব্যসুখ (পাতঞ্জল-২/৪২)।
.
তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধান ক্রিয়াযোগের অন্তর্গত। চিত্তের স্থিরতার উদ্দেশ্যে যেসব ক্রিয়া বা কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাদের বলা হয় ক্রিয়াযোগ। ক্রিয়াযোগ সাধারণত তিনপ্রকার, যথা- তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধান। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘তপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি ক্রিয়াযোগঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/১)
‘স সমাধিভাবনার্থঃ ক্লেশতনূকরণার্থশ্চ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/২)
অর্থাৎ :
তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধানকেই ক্রিয়াযোগ বলা হয় (পাতঞ্জল-২/১)। ঐ ক্রিয়াযোগের অন্তর্গত তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধান অভ্যাস করতে করতে নানাপ্রকার ক্লেশের ক্ষয় হতে থাকে এবং তার সাথে সাথে সমাধির অনুকূলশক্তিও বৃদ্ধি হতে থাকে (পাতঞ্জল-২/২)।
.
(গ) তপঃ : ‘তপঃ’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা বা ব্রত। যে যে কর্মে আপাতত সুখ হয় সেই সেই কর্মের নিরোধের চেষ্টাকে বলা হয় তপের চর্যা। যেমন, উপবাস করা বা শয্যাগ্রহণ না করা ইত্যাদি। বস্তুত শরীরের ত্রিধাতুর বৈষম্য না ঘটিয়ে চিত্তকে রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি থেকে মুক্ত করে যে কষ্টসাধন করা হয়, তাই তপঃ। এই যোগ শরীরসংক্রান্ত বলে একে শারীর ক্রিয়াযোগ বলা হয়। তপস্যা বা ব্রতাচারের মাধ্যমে চিত্ত দৃঢ় হয়। বস্তুত বিচলিত না হয়ে শান্তভাবে শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা সহকারে মহাব্রতের সাধনই হলো তপস্যা। মহর্ষি পতঞ্জলি তপস্যার ব্যাখ্যায় পাতঞ্জলসূত্রে বলেছেন-
‘কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধি ক্ষয়াত্তপসঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৩)
অর্থাৎ : কঠোর তপস্যা দ্বারা শরীর ও ইন্দ্রিগণের অশুদ্ধি ক্ষয় হলে, শরীর ও ইন্দ্রিয়গণ সম্বন্ধেও সিদ্ধ হওয়া যায়। তখন শরীর ও ইন্দ্রিয়গণকে নিজ বশে আনা যায়। নিজ ইচ্ছানুসারে শরীরকে অতি স্থূল কিংবা অতি সূক্ষ্ম করা যেতে পারে। ইন্দ্রিয়দেরকে সুদূরবর্তী অতি সূক্ষ্ম ব্যবহিত পদার্থ মধ্যেও নিয়োগ করা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৪৩)।
.
(ঘ) স্বাধ্যায় : স্বাধ্যায় হলো বাচিক ক্রিয়াযোগ। ‘স্বাধ্যায়’ শব্দের অর্থ অধ্যয়ন ও জপ। প্রণব বা ওঁকারের জপ এবং আধ্যাত্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করাই মূলত স্বাধ্যায়। অধ্যয়ন আত্মজ্ঞানের প্রতি স্পৃহার উদ্রেক করে এবং জপ আত্মতত্ত্বে অনুপ্রবেশ ঘটায়। এর ফলে বিষয়চিন্তা ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে এবং পরমার্থ সত্যে আগ্রহ ও জ্ঞান বাড়ে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘স্বাধ্যায়াদিষ্ট দেবতা সম্প্রযোগঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৪)
অর্থাৎ : স্বাধ্যায় সিদ্ধ হলে, ইষ্টদেবতা সন্দর্শন এবং তাঁর সাথে সম্ভাষণ ঘটে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪৪)।
.
(ঙ) ঈশ্বরপ্রণিধান : আর ক্রিয়াযোগ ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার মানসক্রিয়াযোগ। ঈশ্বরের ধ্যান এবং সকল কর্ম ও কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণই হলো ঈশ্বরপ্রণিধান। ‘যা কিছু হচ্ছে সব ঈশ্বরের দ্বারাই হচ্ছে, আমি অকর্তা’- প্রত্যেক কর্মে এরূপ ভাবনা করে সমস্ত কর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে এইভাবে বার বার ঈশ্বর-প্রণিধান করতে করতে যোগীর চিত্তের মালিন্য দূর হয়ে স্বরূপদর্শন হয়। যোগীর তখন এরূপ উপলব্ধি হয় যে ঈশ্বর যেমন শুদ্ধ অর্থাৎ ধর্ম এবং ধর্মরহিত, প্রসন্ন অর্থাৎ অবিদ্যা ইত্যাদি ক্লেশশূন্য, কেবল এবং বিপাকবর্জিত অর্থাৎ জাতি আয়ু ভোগরূপ কর্মফল শূন্য, তেমনি পুরুষ বা প্রত্যগাত্মাও নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্তস্বভাব। এভাবেই বুদ্ধি থেকে পুরুষ ভিন্ন হয়ে সমাধি লাভ করেন। ঈশ্বরপ্রণিধান থেকে সমাধি সিদ্ধি হয়। সমাধি সিদ্ধির ফলে দেহান্তরে, দেশান্তরে এবং কালান্তরে যা ঘটে তা সবই জানা যায়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সমাধিরীশ্বর প্রণিধানাৎ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৫)
অর্থাৎ : ঈশ্বর প্রণিধান বা ভগবানে চিত্ত নিবেশ দ্বারা সমাধি হয় (পাতঞ্জল-২/৪৫)।
.
.
আসন :
আসন :
অষ্টাঙ্গের তৃতীয় যোগাঙ্গ হলো আসন। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘স্থিরসুখম্ আসনম্’- (যোগসূত্র : ২/৪৬)
অর্থাৎ : দেহের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্থির রেখে নিশ্চলভাবে সুখজনক অবস্থায় উপবেশনই আসন।
.
আসনের দ্বারা সুস্থ ও নীরোগ দেহ লাভ করা যায়। আসন নানা প্রকারের রয়েছে, যেমন- পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন প্রভৃতি। সুস্থ ও শুচি দেহ যোগীদের সমাধিলাভের পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল। স্থির হয়ে আসন করতে করতে যোগীর নিজের শরীরকে শূন্য মনে হয় এবং তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, তাপে কাতর হন না। ক্রমশ যোগীর শারীরবোধ বিলীন হয়ে যায় এবং তাঁর মনে হয় যে তিনি অনন্ত আকাশে মিলিয়ে গিয়ে আকাশের মতো সর্বব্যাপী হয়ে গিয়েছেন। একেই বলা হয় অনন্ত সমাপত্তি। আসন একপ্রকার যৌগিক ব্যায়াম। আসন অভ্যাসের দ্বারা নির্বিঘ্নে সমাহিত হওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়-
‘প্রযত্নশৈথিলানন্তসমাপত্তিভ্যাম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৭)
‘ততোদ্বন্দ্বানভিঘাতঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৮)
অর্থাৎ :
স্বাভাবিকভাবে যেসব পদ্ধতিক্রমে উপবেশন করা হয়, সেসব পরিহারপূর্বক যোগীদের পদ্ধতি অনুসারে আসন অভ্যাস করতে করতে অনন্তে মগ্ন হতে পারলে, অচৈতন্যবারক তদাত্ম্য (তন্ময়তা) প্রাপ্তি হয়। তদাত্ম্য প্রাপ্তি হলে আসন অভ্যাসে কোন কষ্টবোধই হয় না (পাতঞ্জল-২/৪৭)। আসন সিদ্ধি দ্বারা শীত গ্রীষ্মে অভিভূত হতে হয় না। তার দ্বারা ক্ষুৎপিপাসাও ব্যাকুল করতে পারে না। তা প্রাণায়ামের বিশেষ অনুকূল (পাতঞ্জল-২/৪৮)।
.
.
প্রাণায়াম :
প্রাণায়াম :
চতুর্থ যোগাঙ্গ হলো প্রাণায়াম। যোগী আসন সিদ্ধ হলে তবে তার প্রাণায়াম হয়। প্রাণায়াম হলো বায়ুর শ্বাসরূপ আভ্যন্তরিক গতি এবং প্রশ্বাসরূপ বহির্গতির বিচ্ছেদ। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘তস্মিন্ সতি শ্বাস-প্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ’- (যোগসূত্র : ২/৪৯)
অর্থাৎ : শ্বাসগতি ও প্রশ্বাসগতির যে বিচ্ছেদ তাকেই বলে প্রাণায়াম।
.
স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস একটা ছন্দ অনুসারে বিরামহীনভাবে চলে। ঐ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে গতিবিচ্ছেদ আনাই প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য। শ্বাস নিয়ে প্রশ্বাস না ফেলে থাকা অবস্থায় যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটি একপ্রকার প্রাণায়াম। আবার প্রশ্বাস ফেলে শ্বাস না নিয়ে থাকলে যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটাও একপ্রকার প্রাণায়াম। পরম্পরাক্রমে এই প্রাণায়ামগুলি অভ্যাস করা হয়। তবে এই গতিবিচ্ছেদের সময় চিত্তকে অবশ্যই অচঞ্চল ও একাগ্র অবস্থায় রাখতে হয়। প্রাণায়ামের এই গতিবোধ তিন প্রকার- বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি এবং স্তম্ভবৃত্তি। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভ বৃত্তির্দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টোদীর্ঘঃ সূক্ষ্মঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫০)
অর্থাৎ :
একই প্রাণায়াম তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের নাম রেচক বা বাহ্যবৃত্তি, দ্বিতীয় ভাগের নাম পূরক বা অভ্যন্তরবৃত্তি, তৃতীয় ভাগের নাম কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি। ঐ তিন আবার দীর্ঘ ও সূক্ষ্মরূপে দেশ কাল এবং সংখ্যার দ্বারা সাধিত হয়ে থাকে। রেচক প্রাণায়ামের দেশ বহির্ভাগে, রেচক প্রাণায়াম করবার সময় বহির্ভাগে রেচিত বায়ু যদি অধিক দূর যায় তাহলে তার নাম দীর্ঘ, অল্পদূরে গেলে তার নাম সূক্ষ্ম। অভ্যন্তরই পূরক ও কুম্ভকস্থান। পূরক ও কুম্ভক করবার সময় শরীরের মধ্যে সর্বত্র বায়ু পূর্ণ হলে দীর্ঘ বলা যায়। তার বিপরীত হলে সূক্ষ্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। কালের দ্বারা ঐ তিন প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা স্থির করতে হলে, ঐ তিনের স্থিতিকাল নির্বাচন করতে হয়। ঐ তিন অধিক স্থায়ী হলে তাদের দীর্ঘ বলা যায়, অল্পস্থায়ী হলে সূক্ষ্ম। সংখ্যা অনুসারে মন্ত্র জপ দ্বারা ঐ তিনের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্ণয় হতে পারে। নির্দিষ্ট অধিক জপে যে সকল প্রাণায়াম শেষ হয়, সেগুলি দীর্ঘপ্রাণায়াম। অল্প সংখ্যক জপে শেষ হলে সূক্ষ্ম প্রাণায়াম বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫০)।
.
(ক) রেচক বা বাহ্যবৃত্তি : শাস্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে ভিতরের বায়ুকে বাইরে স্থাপন করার নাম বাহ্যবৃত্তি বা রেচক।
(খ) পূরক বা আভ্যন্তরবৃত্তি : অপরদিকে বাইরের বায়ুকে শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে ভিতরে স্থাপন করাকে বলা হয় আভ্যন্তরবৃত্তি বা পূরক।
(গ) কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি : আর রেচক ও পূরক কিছুকাল অভ্যাস করে তাদের সাহায্য ব্যতীতই দেহস্থ বায়ুকে ধরে রেখে সারা শরীরকে বায়ুপূর্ণ করার নাম স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভক। এ অবস্থায় শরীর জলপূর্ণ কুম্ভের ন্যায় স্থির ও নিষ্কম্প থাকে।
দেশ, কাল ও সংখ্যার দ্বারা প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্মিত হয়। মূলত প্রাণায়াম হলো শরীর এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াহীনতা। প্রাণায়ামের দ্বারা চিত্ত ক্রমশ বৃত্তিশূন্য হয়।
.
পাতঞ্জলসূত্রে এই তিনপ্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও চতুর্থ এক প্রকার প্রাণায়ামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
(খ) পূরক বা আভ্যন্তরবৃত্তি : অপরদিকে বাইরের বায়ুকে শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে ভিতরে স্থাপন করাকে বলা হয় আভ্যন্তরবৃত্তি বা পূরক।
(গ) কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি : আর রেচক ও পূরক কিছুকাল অভ্যাস করে তাদের সাহায্য ব্যতীতই দেহস্থ বায়ুকে ধরে রেখে সারা শরীরকে বায়ুপূর্ণ করার নাম স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভক। এ অবস্থায় শরীর জলপূর্ণ কুম্ভের ন্যায় স্থির ও নিষ্কম্প থাকে।
দেশ, কাল ও সংখ্যার দ্বারা প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্মিত হয়। মূলত প্রাণায়াম হলো শরীর এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াহীনতা। প্রাণায়ামের দ্বারা চিত্ত ক্রমশ বৃত্তিশূন্য হয়।
.
পাতঞ্জলসূত্রে এই তিনপ্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও চতুর্থ এক প্রকার প্রাণায়ামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
‘বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী চতুর্থঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫১)
অর্থাৎ : প্রাণায়ামকর্তা যদি নিজ শরীরের অন্তর বাহ্য বিশেষরূপে পর্যালোচনা করে এই ত্রিবিধ প্রাণায়ামের অনুষ্ঠান করেন, তাহলে সেই অনুষ্ঠান চতুর্থ শ্রেণির প্রাণায়াম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫১)।
.
প্রাণায়াম অভ্যাসের ফললাভ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
প্রাণায়াম অভ্যাসের ফললাভ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশবরনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫২)
‘ধরনাসুযোগ্যতা মনসঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫৩)
অর্থাৎ :
ঐ চতুর্বিধ প্রাণায়াম অভ্যাস করতে করতে যখন সিদ্ধ হওয়া যায়, তখন সর্বশক্তিসম্পন্ন সর্ববস্তুপ্রকাশক বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশ হয়। বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশে মানসস্বরূপ অপ্রচ্ছন্ন হলে, তার অদ্ভূত ক্ষমতা তৈরি হয়। সেই ক্ষমতাবলে ধারণাশক্তি স্ফূরিত হয় (পাতঞ্জল-৫২-৫৩)।
.
.
প্রত্যাহার :
প্রত্যাহার :
যোগমতে প্রত্যাহার হলো পঞ্চম যোগাঙ্গ। ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগত করাই প্রত্যাহার। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘স্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্তস্য স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ’- (যোগসূত্র : ২/৫৪)
অর্থাৎ : স্ববিষয় অসংযুক্ত হয়ে চিত্তের স্বরূপানুকার লাভকেই ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার বলা হয়। যেসব বিষয়ে যেসব বস্তুতে ইন্দ্রিয়গণ আসক্ত, সেসব বিষয় সেসব বস্তু থেকে তাদেরকে বিরত করে, সম্যক প্রকারে বিকৃতিহীন করে, নির্বিকার চিত্ত স্বরূপের অধীন করার নামই প্রত্যাহার (পাতঞ্জল-২/৫৪)।
.
যোগের জন্য ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার প্রয়োজন। বিষয়সমূহ থেকে পঞ্চ বাহ্য ইন্দ্রিয় ও আন্তরিন্দ্রিয় মনকে বিযুক্ত বা নিবৃত্ত করা প্রয়োজন। তাই বিষয়বিযুক্তি সাধনের উপায় দুটি- (১) বাহ্য বিষয় লক্ষ্য না করা, (২) মানসভাব নিয়ে থাকা। এইভাবে চিত্ত যখন ইন্দ্রিয়গুলিকে চালনা করে তখন বিষয়ের প্রতি আসক্তি দূর হওয়ার ফলে যোগসাধনা সম্ভব হয়।
অনেক সময় অন্যমনস্কতাবশত ইন্দ্রিয়সমূহ বিষয় থেকে নিবৃত্ত হয়। এইরূপ নিবৃত্তি প্রত্যাহার নয়। ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজের বশীভূত করে বিষয় গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত হওয়াকেই প্রত্যাহার বলে। উল্লেখ্য যে, যম, নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাস করার পর প্রত্যাহার অভ্যাস করলে তবেই যথাযথ ফল পাওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন-
অনেক সময় অন্যমনস্কতাবশত ইন্দ্রিয়সমূহ বিষয় থেকে নিবৃত্ত হয়। এইরূপ নিবৃত্তি প্রত্যাহার নয়। ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজের বশীভূত করে বিষয় গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত হওয়াকেই প্রত্যাহার বলে। উল্লেখ্য যে, যম, নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাস করার পর প্রত্যাহার অভ্যাস করলে তবেই যথাযথ ফল পাওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন-
‘ততঃ পরম বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫৫)
অর্থাৎ : এই প্রত্যাহার প্রভাবে অবশীভূত ইন্দ্রিয়রা সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয় (পাতঞ্জল-২/৫৫)।
.
.
ধারণা :
ধারণা :
ধারণা হলো, যে দেশে ধ্যেয়বস্তুকে ধ্যান করতে হবে, সেই দেশে চিত্তকে আবদ্ধ করা। যেমন, পূজার সময় দেখা যায় অন্য বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তকে শরীরের মধ্যে নাভিচক্র বা নাকের ডগায় স্থাপন করা হয় অথবা বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি মূর্তিতে চিত্তকে স্থির রাখা হয়। ধারণার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে-
‘দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা’- (যোগসূত্র : ৩/১)
অর্থাৎ : চিত্তকে কোন দেশে (নাড়ীচক্রে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে অথবা কোন দিব্যমূর্তিতে) আবদ্ধ বা সংস্থিত রাখাকেই বলা হয় ধারণা (পাতঞ্জল-৩/১)।
.
চিত্তকে বাহ্য বা আন্তর দেশ বিশেষে আবদ্ধ রাখা যায়। পূর্ববর্ণিত যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার ও চিত্তশুদ্ধি ঘটলে চিত্তকে নাসিকাগ্র, ভ্রূমধ্য, নাভিচক্র, জিহ্বাগ্র বা হৃদপদ্মে স্থাপন করাকেই ধারণা বলা হয়। যোগশাস্ত্রে গ্রাহ্য, গ্রহণ এবং গ্রহীতা ভেদে ত্রিবিধ ধারণার কথা বলা হয়েছে। আবার তত্ত্বজ্ঞানময় ধারণা ও বৈষয়িক ধারণা ভেদে ধারণাকে দ্বিবিধ বলা হয়। অন্যদিকে যৌগিক তন্ত্রশাস্ত্রে ষট্চক্রকে ধারণার বিশেষ কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
.
ষট্চক্র : আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়। বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
‘গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।’- (বিমুক্তিসোপান)
অর্থাৎ : ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।
.
এই ষট্চক্র হচ্ছে, (১) ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra), (২) আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra), (৩) বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra), (৪) অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra), (৫) মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra), (৬) স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।
.
.
ধ্যান :
ধ্যেয় বস্তুতে চিত্তকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আবদ্ধ করাই ধ্যান। যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে-
‘তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্’- (যোগসূত্র : ৩/২)
অর্থাৎ : ধারণাতে প্রত্যয় বা জ্ঞানবৃত্তির স্থির আলম্বন বা একতানতাকেই ধ্যান বলে।
.
ধারণা গভীরতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে ধ্যানে পর্যবসিত হয়। সাধারণভাবে ধারণাতে জ্ঞানবৃত্তি কেবল অভীষ্ট বিষয়েই আবদ্ধ থাকে। এইরূপ বিষয়ক জ্ঞান খণ্ড খণ্ড ভাবে ধারাবাহিক ক্রমে চলতে থাকে। অভ্যাসের দ্বারা যখন তাদের মধ্যে একতান বা অখণ্ড ধারা প্রবাহিত হয় তখনই তাকে যোগের পরিভাষায় ‘ধ্যান’ বলে। ধ্যান তাই চিত্তস্থৈর্যের অবস্থা বিশেষ। ধ্যানশক্তির বলে সাধক যে কোন বিষয় অবলম্বন করে ধ্যান করতে পারেন। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘যথাভিমতধ্যানাৎ বা।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/৩৯)
অর্থাৎ : নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান করো না কেন, তার প্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হবে (পাতঞ্জল-১/৩৯)।
ধারণা ও ধ্যানের মধ্যে পার্থক্য হলো, ধ্যান অবিচ্ছিন্ন আর ধারণা বিচ্ছিন্ন। একই বিষয় সম্পর্কে চিন্তা হলেও ধারণার ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ড জ্ঞানের উদ্ভব হয়, আর ধ্যানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহের মতো চলতে থাকে। ধারণার প্রত্যয়কে বিন্দু বিন্দু জল বা তেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্যদিকে ধ্যানের প্রত্যয় হলো অবিচ্ছিন্ন জলধারা বা তৈলধারার ন্যায়।
.
.
সমাধি :
অষ্টাঙ্গিক যোগের সর্বশেষ যোগাঙ্গ হলো সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যাতা অর্থাৎ ধ্যানকর্তা এবং ধ্যেয় বিষয়ের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে লীন হওয়ার ফলে ধ্যেয়স্বরূপতা প্রাপ্ত হয়। যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে-
সমাধি :
অষ্টাঙ্গিক যোগের সর্বশেষ যোগাঙ্গ হলো সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যাতা অর্থাৎ ধ্যানকর্তা এবং ধ্যেয় বিষয়ের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে লীন হওয়ার ফলে ধ্যেয়স্বরূপতা প্রাপ্ত হয়। যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে-
‘তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ’- (যোগসূত্র : ৩/৩)
অর্থাৎ : ধ্যান যখন ধ্যেয়ের স্বভাবের আবেশে জ্ঞানাত্মক স্বভাবশূন্য হয় তখন তাকে সমাধি বলা হয়।
.
সমাধি হলো ধ্যানের চরম উৎকর্ষ, চিত্তস্থৈর্যের সর্বোত্তম অবস্থা। প্রগাঢ় ধ্যানে বিষয়ের স্বভাবে চিত্ত আবিষ্ট হয়ে যখন আত্মহারা হয় তখন তাকে বলে সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যেয় বিষয়ের সত্তারই উপলব্ধি হয়। আত্মসত্তা অভিভূত হয়। ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে ধ্যানকর্তার কোন ভেদ থাকে না। তাই সমাধিতে ধ্যানের জ্ঞানও থাকে না, ধ্যানকর্তার জ্ঞানও থাকে না। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে সম্পূর্ণ লীন হয়ে ধ্যেয়-স্বরূপই প্রাপ্ত হয়।
.
অষ্টাঙ্গিক যোগের যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গকে যোগের বহিরঙ্গ সাধন বলা হয়। কারণ এগুলির সেরূপ কোন বিষয় নেই। যোগের এই বহিরঙ্গ মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সাধনপাদে বর্ণিত হয়েছে। আর ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটি যোগাঙ্গ হচ্ছে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন। কেননা এগুলি চিত্তবৃত্তিনিরোধের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কিত। এই তিনটি যোগাঙ্গকে একসঙ্গে বলা হয় সংযম। পাতঞ্জলসূত্রে সংযমের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-
‘ত্রয়মেকত্র সংযমঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৪)
অর্থাৎ : পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোন বস্তুতে বা বিষয়ে ধারণা, ধ্যান ও সমাধির যে সন্মিলিত প্রয়োগ, তারই এক নাম সংযম (পাতঞ্জল-৩/৪)।
সংযম জয় করলে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় সম্বন্ধে তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা হয়। যোগসূত্রের বিভূতিপাদে এই তিনটি যোগাঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। পতঞ্জলি বলেন-
‘তজ্জয়াৎ প্রজ্ঞালোকঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৫)
অর্থাৎ : সংযম আয়ত্ত হলে দিব্যজ্ঞানময়ী পরমাবুদ্ধি স্ফূরিত হয়। সেই বুদ্ধিপ্রভাবে অসম্ভব সম্ভব হয়। অসাধ্য সাধ্য হয়। তার প্রভাবে করা যায় না এমন কার্য নেই (পাতঞ্জল-৩/৫)।
.
উপরিউক্ত অষ্টাঙ্গ যোগ সবীজ বা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির উপযোগী। নির্বীজ বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি এই অষ্ট যোগাঙ্গের লক্ষ্য নয়। যোগমতে সম্প্রজ্ঞাত সমাধির মাধ্যমেই কেবল অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে উন্নীত হওয়া যায়। অর্থাৎ, উপরিউক্ত অষ্ট যোগাঙ্গ সম্প্রজ্ঞাত সমাধির পথ প্রস্তুতকারক। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে-
ধ্যান যখন সমুদয় বাহ্য-উপাধি পরিত্যাগ করে কেবল অর্থমাত্রকে প্রকাশ করে, তখন তাকে সমাধি বলে। ধ্যান গাঢ় হলে ধেয় বস্তু (যে বস্তুর ধ্যান করা হয়) ও আমি এরকম জ্ঞান থাকে না এবং চিত্ত তখন ধ্যেয় বস্তুতেই লীন হয়। সেই লয় অবস্থাকেই সমাধি বলে। কেবল সেই ধেয় বস্তু আছেন, সেরকম আভাস জ্ঞান মাত্র থাকবে আর কিছু থাকবে না, চিত্তের ধেয় বস্তুতে এরকম তন্ময়তাকেই সমাধি বলে। মূলত ধ্যানের পরিণামই সমাধি। ধ্যানের সময় সাধকের এই ভাব থাকে যে, তিনি একটি বিষয়ে চিন্তা করছেন কিন্তু সমাধির ক্ষেত্রে সে ভাবটিও থাকে না। সমাধি দুই প্রকার, যথা- সবিকল্প বা সম্প্রজ্ঞাত এবং নির্বিকল্প বা অসস্প্রজ্ঞাত। জ্ঞাত, জ্ঞান, জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান সত্ত্বেও অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে অখণ্ডাকারে চিত্তবৃত্তির অবস্থানকে সবিকল্প সমাধি বলে। সবিকল্প সমাধিতে চিত্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে ব্রহ্মবস্তু বা আত্মাতে স্থির হলেও জ্ঞাত (যোগী নিজে), জ্ঞান (ধেয় বস্ত্ত সম্পর্কিত জ্ঞান) এবং জ্ঞেয় (ধেয় বস্তু দ্বারা যে বিষয়গুলো জানা যায়) এই তিনটি বিষয়ে পৃথক চৈতন্য থাকে। জ্ঞাত, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি না হয়ে অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে অখণ্ডাকার চিত্তবৃত্তির অবস্থানেকে নির্বিকল্প সমাধি বলে। নির্বিকল্প সমাধিতে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থ সম্পর্কেই যোগীর কোন পৃথক চৈতন্য থাকে না। সহজ কথায় যোগী বাহ্য-সংজ্ঞা হারিয়ে এক ধেয় বস্তুতেই নিবিষ্টি থাকেন। নির্বিকল্প সমাধিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে। সমাধি-সত্মরে গিয়ে সাধক এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। সাধক সমাধি-স্তর থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে সমাধি-স্তরে কি উপলব্ধি করেছিলেন, তা স্মরণ করতে পারেন না। সুতরাং সমাধিকে ভাষা দ্বারা ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সমাধি স্তরে যে পৌঁছাতে পারে কেবল সেই সমাধি-স্তরকে উপলব্ধি করতে পারে।‘অয়মন্তরঙ্গং পূর্ব্বেভ্যঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৭)
‘তদপিবহিরঙ্গং নির্বীজস্য’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৮)
‘তস্য প্রশান্ত বাহিতা সংস্কারাৎ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/১০)
‘সর্ব্বার্থতৈকাগ্রতয়োঃ ক্ষয়োদয়ৌ চিতস্য সমাধিপরিণামঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/১১)
অর্থাৎ :
সংযম অপেক্ষা যমনিয়মাদি সমাধির অন্তরঙ্গ নয়। সংযম-বলে অতি সূক্ষ্ম বস্তুতেও চিত্ত সমাহিত হয় (পাতঞ্জল-৩/৭)। সর্বমনোবৃত্তির নিরোধের নাম নির্বীজ সমাধি। সংযম সেই নির্বীজ সমাধির বহিরঙ্গ ব্যতীত অন্তরঙ্গ নয় (পাতঞ্জল-৩/৮)। বারবার চিত্ত নিরোধপরিণাম উৎপন্ন হলে তার প্রভাবে যে সুদৃঢ় সংস্কার জন্মায়, সেই সংস্কার-বলে সেই চিত্ত নিরোধপরিণামের প্রশান্ত স্থৈর্য্যস্রোত নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে (পাতঞ্জল-৩/১০)। নানা বস্তু সম্বন্ধীয় নানা প্রকার মনোবৃত্তির নিবৃত্তি হলে যে এক পরমবস্তু বিষয়ক পরমাবৃত্তি উদিত হয়, তা-ই সমাধি-পরিণাম (পাতঞ্জল-৩/১১)।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ