পুরাণ শাস্ত্রে শিব ও লিঙ্গ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

24 July, 2020

পুরাণ শাস্ত্রে শিব ও লিঙ্গ

আমরা দেখতে পাই, পৌরাণিক যুগে পরম শিব ও পরব্রহ্মতত্ত্ব প্রচারের পর থেকে লিঙ্গপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। পণ্ডিতদের মতে এই সময়টা গুপ্ত যুগ। কারণ পরবর্তী কালের মন্দিরগুলিতে মূলতঃ লিঙ্গমূর্তিই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে মানবাকার মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিষয়গত ধারণার লক্ষ্যে অধ্যায়ের শুরুতেই শিব ও লিঙ্গ বিষয়ে এ দুয়ের অদ্বয়ত্ব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের জন্য শৈব মতানুসারী পুরাণগুলিতে উপস্থাপিত লিঙ্গের পূজা ও তার বৈচিত্র্য ও প্রকারভেদ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে সেগুলোর পুনরুক্তির দরকার নেই। তবে এটা জানা যায় যে,–
‘কেবল ভারতবর্ষেই নয়, ভারতের সীমা ছাড়িয়ে কম্বোজ, চম্পা প্রভৃতি রাজ্যেও লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী তাঁর ‘South Indian Influences in the Far East’ গ্রন্থে কম্বোজ ও চম্পায় লিঙ্গরূপী শিবের উপাসনার কথা বলেছেন। ঐতিহাসিক ইলিয়টের মতে প্রায় ৫৫০ খৃষ্টাব্দের প্রথমার্ধে কম্বোডিয়ায় লিঙ্গপূজার প্রচলন ছিল। কম্বোডিয়া অউথিয়া, লোপচুরি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে রাম, বিষ্ণু, শিব, গণেশ, স্কন্দ, উমা, লক্ষ্মী প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য দেবতার মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। থাইল্যান্ড অঞ্চলে প্রাপ্ত শিবের ত্রিশূল, ঐ অঞ্চলে শৈব ধর্মের প্রসারের কথাই বলে।’– (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১১)
বিঃদ্রঃ বেদের ভুল অর্থের কারনে নানা মত, পন্থ সৃষ্টি হয়েছে
             ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, শৈব তন্ত্র ও পুরাণের অনুযায়ী লিঙ্গার্চক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হলো, শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন এবং যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।
লিঙ্গের আবির্ভাব সম্পর্কে লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের বিবাদাত্মক একটি আখ্যান কথিত হয়েছে। সেই কাহিনীতে বলা হয়েছে– শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার নিয়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে বিরোধ থেকে ক্রমশঃ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাধলো। তখন তাঁদের মোহ দূর করার জন্য শিব অনল স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে আবির্ভূত হলেন–
প্রলয়ার্ণবমধ্যে তু রজসা বদ্ধবৈরয়োঃ।
এতস্মিন্নন্তরে লিঙ্গমভবচ্চাবয়োঃ সুরাঃ।।
বিবাদশমনার্থঞ্চ প্রবোধার্থঞ্চ ভাস্বরম্ ।
জ্বালামালাসহস্রাভং কালনলশৎপোমম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)
অর্থাৎ : প্রলয়-সমুদ্রের মধ্যে রজোগুণ-প্রভাবে আমাতে (অর্থাৎ ব্রহ্মাতে) ও বিষ্ণুতে বিরোধ হইতেছিল, এমন সময়ে সেই বিরোধ-ভঞ্জন ও প্রবোধ-প্রদান জন্য শত-সংখ্যক কালাগ্নি স্বরূপ ও সহস্র অগ্নিশিখা তুল্য দীপ্তিমান্ লিঙ্গ উৎপন্ন হইল।
প্রজাপতি ব্রহ্মার বয়ানে লিঙ্গপুরাণের বাকি উদ্ধতাংশটি এরকম–
‘আমরা দুজনেই তখন রজোগুণে আবিষ্ট হবার ফলে প্রলয় সমুদ্রের মধ্যে লোমহর্ষক এক মহাযুদ্ধ আমরা আরম্ভ করলাম। আমাদের পারস্পরিক বিবাদ বন্ধ করে প্রবোধের জন্য সেই সময় উভয়ের সম্মুখে আবির্ভূত হল ভাস্বর লিঙ্গ। এই লিঙ্গের আভা সহস্র শিখায় সমুজ্জ্বল অগ্নির মতই ছিল ভয়ঙ্কর। আদি মধ্য ও অন্তহীন, ক্ষয় ও বৃদ্ধিশূন্য, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত ও বিশ্ববীজস্বরূপ সেই লিঙ্গের উজ্জ্বল সহস্র শিখা দেখে মোহিত হয়ে ভগবান বিষ্ণু আমাকে বললেন– এই অগ্নির কিভাবে উৎপত্তি হল তা আমাদের পরীক্ষা করা দরকার। আমি এই অগ্নি স্তম্ভের নীচের দিকে যাচ্ছি, তুমি ওপরের দিকে যাও। সেই সময়েই ভগবান হরি তাঁর বরাহরূপ প্রকাশ করেছিলেন। আমিও আকাশে উড়ে যাবার জন্য তখন হংসরূপ গ্রহণ করলাম।… লিঙ্গের স্বরূপ জানার জন্য শুভ্রবর্ণ হংসরূপ ধরে আগুনের মত রক্তচক্ষু ও সুন্দর পাখা যুক্ত হয়ে আমি বায়ুর মত বেগে ওপরে উড়তে লাগলাম। নারায়ণও দশযোজন বিস্তৃত শতযোজন আয়ত মেরুপর্বতের মত নীল কাজলের মত বিশাল বরাহ মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তখন তাঁর তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁতগুলো সূর্য্যরে মত চক্চক্ করছিল, নাসিকা ঘোর গর্জন করছিল এবং হাত-পা গুলি বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করছিল। এইভাবে তিনি পাতালে প্রবেশ করলেন। তৎসত্ত্বেও শূকর রূপ ধারণকারী বিষ্ণু লিঙ্গের মূল কোথায় তা সামান্য পরিমাণেও বুঝতে পারলেন না। এদিকে আমিও অনন্ত আকাশে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, অথচ লিঙ্গের অন্ত কোথায় তা বুঝতে পারলাম না। অবশেষে অহঙ্কার-বশতঃ নীচের দিকে নেমে এলাম। দেবতাদের উৎপত্তির বীজস্বরূপ বিষ্ণুও পরিশ্রান্ত হয়ে ভয়-কম্পিতনেত্রে শীঘ্রই মাটির তলা থেকে উপরে উঠে এলেন। মায়ার দ্বারা মুগ্ধ বিষ্ণু আমার সঙ্গে মিলিত হবার পর আমরা উদ্বিগ্ন মনে ভগবান শম্ভুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং তাঁকে প্রণাম করলাম।’– (লিঙ্গ পুরাণ পূর্বভাগ, সপ্তদর্শ অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩১-২)

             শিবপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতা (৩/২৭-৬১, ৫/১১, ৭/১৯-২০ ইত্যাদি) অংশের কাহিনীতে এবং লিঙ্গপুরাণ ইত্যাদির কাহিনীতেও শিবের স্তম্ভমূর্তির কথা আছে। তাই অনেক পণ্ডিত এই স্তম্ভ মূর্তিকেই শিবের আদিরূপ বলে মনে করেন। তাছাড়া আখ্যানগুলির মৌলিক ঐক্য থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে বিন্যাসগত পার্থক্য আছে। তবে কোনও আখ্যানেই কিন্তু লিঙ্গকে জননেন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। অতএব সাধারণ ভাবে পৌরাণিক ধারায় লিঙ্গোপাসনার অন্য একটা দিক আছে।
পুরাণ আখ্যান অনুযায়ী আদ্যান্তহীন সেই স্তম্ভের শেষ ব্রহ্মা বিষ্ণু খুঁজে পেলেন না। শিবপুরাণে শিব তাই ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলেছেন–
অনাদ্যন্তমিদং স্তম্ভমণুমাত্রং ভবিষ্যতি।
দর্শনার্থং হি জগতাং পূজনার্থং হি পুত্রকৌ।।
ভোগাবহমিদং লিঙ্গং ভুক্তিমুক্ত্যেকসাধনম্ ।
দর্শনস্পর্শনধ্যানাজ্জন্তূনাং জন্মমোচনম্ ।। (শিবপুরাণ)
অর্থাৎ : জগৎবাসীর দর্শন ও পূজনের জন্য এই আদি ও অন্তহীন স্তম্ভ ক্ষুদ্ররূপ ধারণ করবে। ভোগাবহ এই লিঙ্গ একাধারে ভুক্ত ও মুক্তির সাধন। এই লিঙ্গের দর্শন, স্পর্শন ও ধ্যানের দ্বারা জীবের জন্ম বন্ধ ঘুচে যায়।
            এ কারণে– ‘বৈদিক যূপ উপাসনা থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা অনেকে বলতে চেয়েছেন। শূলগব যজ্ঞের স্মারক হিসাবে যূপের পাশে উৎকীর্ণ বৃষমূর্তি যৌধেয়দের মুদ্রায় আবিষ্কৃত হয়েছে। আনন্দকামারস্বামী স্তম্ভপূজন থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা বলেছেন। কুষাণযুগের শেষ দিককার একটি চতুর্ভুজ দণ্ডায়মান শিবমূর্ত্তির গায়ে স্তম্ভের মত প্রতীক দেখা যায়।’
‘খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের মুদ্রার থেকে একথা যেমন একদল প্রমাণ করতে চান, তেমনি ভারতীয় ও বিদেশী শাসকদের মুদ্রার থেকে শিবপূজার আদি উৎসকে একদল আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। কারো কারো মুদ্রায় বৃষ ও যূপ অঙ্কিত দেখে তাদেরই শিব ও শিবলাঞ্ছন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন অনেকে।’
‘বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত স্তূপ পূজা থেকে লিঙ্গ পূজার উদ্ভব ঘটেছে বলে একদল পণ্ডিত মনে করেন। আপাত ভাবে বৌদ্ধস্তূপের সঙ্গে শিবলিঙ্গের আকারগত সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায় না। বৌদ্ধ যুগেই সাচীস্তূপ প্রভৃতির এবং পরবর্তী কালের সারনাথ, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি স্থানে স্তূপ পূজার প্রচলন ছিল এবং এখনও আছে। লিঙ্গকে যেভাবে অক্ষত, চন্দন, পুষ্প, ধূপ, দীপ প্রভৃতি দ্বারা অর্চনা করা হয় বোধিসত্ত্বাবদানকল্পলতাতেও সেই ভাবেই স্তূপ অর্চনার বিধান পরিলক্ষিত হয়। সাচীস্তূপ অবশ্য বুদ্ধকায়স্বরূপ বৌদ্ধ স্মৃতি মন্দিরেরই নিদর্শন। মনে রাখতে হবে যে শিবলিঙ্গও কিন্তু সেই অর্থে শিবপ্রতীক। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত ফলকগুলি যদি সত্য সত্যই শিবলিঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু বৌদ্ধস্তূপ অর্চনা থেকে লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল– একথা বলা যাবে না, কারণ বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্ব থেকেই সেক্ষেত্রে লিঙ্গপূজার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।’- (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
          এবং লিঙ্গপূজার উৎপত্তি যে বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্বেই ঘটেছে ইতঃপূর্বের আলোচনা থেকে আমরা এই ধারণা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। আর পুরাণের রচনাকাল মূলত গুপ্তযুগেই এবং লিঙ্গ পুরাণের রচনাকাল মোটামুটি ৭০০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা হয়। তবুও ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে পুরাণগুলি বেদেরই প্রবর্ধিত রূপ। ড. উদয়চন্দ্রের মতে,– ‘তাই অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে– ‘পুরাণম্ বেদসম্মতম্’। পুরাণগুলি দুভাবে বৈদিক তথ্যকে ব্যবহার করেছে– (১) কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজিয়ে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেমন উমা হৈমবতীর কেনোপনিষদযুক্ত আখ্যান লিঙ্গ পুরাণে ১/৫৩/৫৫-তে আমরা পেয়েছি। (২) আবার বৈদিক মন্ত্রগুলিকে বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির সঙ্গে পুরাণগুলি যুক্ত করেছে। লিঙ্গপুরাণে উল্লিখিত মন্ত্রগুলি আমরা নিম্নলিখিত বৈদিক গ্রন্থে পেয়ে থাকি– ঋগ্বেদের মূল অংশ, ঋগ্বেদের খিল অংশ, সামবেদ, অথর্ববেদ, মাধ্যন্দিন বাজসনেয়ী সংহিতা, বাজসনেয়ীসংহিতা, তৈত্তিরীয়সংহিতা, মৈত্রায়নী সংহিতা, কাঠক সংহিতা, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, মহানারায়ণ উপনিষদ্, নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদ্, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র, হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি। মন্ত্রগুলিকে কোথাও কোথাও বিশেষ সংজ্ঞার দ্বারা বিধান করা হয়েছে, কখনো আদি অংশ উদ্ধৃত করে বিধান দেওয়া হয়েছে আবার কখনো বা মন্ত্রমধ্যস্থ অংশ তুলে হয়তো পর পর কয়েকটি মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়েছে। এখানে যজুর্বেদের তথা কৃষ্ণযজুর প্রভাব বেশী বলেই মনে হয়েছে।’
‘বিভিন্ন সময়েই লিঙ্গপুরাণে রুদ্রাধ্যায়ের মন্ত্র উদ্ধৃত হয়েছে এবং শতরুদ্রীয় ইত্যাদির কথাও প্রায়ই বলা হয়েছে। ‘ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্ । উর্বারুকমিব বন্ধনাত্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্ ।’ ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়ে থাকে এবং (লিঙ্গপুরাণের) উত্তর ভাগের ৫৪ অধ্যায়ে একেই মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়েছে। তন্ত্রের যামল ধারায় কিন্তু এই মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় বলা হয়নি। তাদের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র আরো ছোট এবং মন্ত্রটি তান্ত্রিকমন্ত্র। বর্তমানে অনেক পুরোহিতকে (বিশেষতঃ বাংলার বাইরেকার) লিঙ্গপুরাণোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের সঙ্গে তন্ত্রোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জুড়ে নিয়ে জপ করতে দেখেছি। হয়তো তন্ত্র ও বেদের মিশ্রণের ফলেই এরূপ ঘটেছে। লিঙ্গ পুরাণেও অনেক ক্ষেত্রে বৈদিক মন্ত্রটির আগে তন্ত্রোক্ত মন্ত্র পুটিত করে পাঠের বিধান পরিলক্ষিত হয়। যেমন উত্তর ভাগের ৫১ অধ্যায়ে শত্রুজয়ের জন্য ব্যবহৃত গায়ত্রী মন্ত্রের পূর্বে ‘ওঁ ফট্ জহি হুং ফট্ হিন্দি ভিন্দি জহি হন হন স্বাহা’ ইত্যাদি যুক্ত করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রের অবয়ব শাক্তদের বগলামুখী মন্ত্রের কথাই মনে করায়। এভাবেই প্রত্যেকটি মন্ত্রের আলোচনা হলে একটা নতুন দিকের আভাস পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়। বৈদিক এবং ধর্মশাস্ত্রধৃত মন্ত্রগুলি সাধারণ ভাবে লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাগে এসেছে এবং তন্ত্রোক্ত মন্ত্রের প্রাধান্য উত্তর ভাগে এসেছে। পাশুপতাদি শৈবধারাকে কেউ কেউ বৈদিক ধারা বলেছেন আবার কেউ কেউ অবৈদিক ধারা বলেছেন। সমন্বয়ধর্মী ব্রাহ্মণ্য রচনা পুরাণে যখন এসব ধারা বিধৃত হয়েছে, তখন তার উপর বৈদিক শান্তিবারির প্রলেপ অবশ্যই পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই লিঙ্গপুরাণে খাঁটি অবৈদিক শৈব ধারার পূর্ণ পরিচয় অবিকৃত ভাবে বোধ হয় পাওয়া যাবে না।’– (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ)
          শিবপুরাণ কোটিরুদ্র সংহিতা , ১২ অধ্যায় , শ্লোক
পূর্ব সময়ে দারু বনে ব্রাহ্মণ দের সাথে যে বৃত্তান্ত হয়েছিল তা ধ্যান পূর্বক শুনুন , বলছি , দারু বনে ঋষিপুরুষ গণ নিজের পত্নীদের সাথে বাস করতেন , তারা সবাই শিব ভক্ত ছিল ,একসময় ঋষিগণ জঙ্গলে গেছিলেন কাঠ ইত্যাদি আনতে তখন তাদের স্ত্রীরা একা একা ছিল তখন :-
एतस्मिन्नन्तरे साक्षाच्छंकरो नीललोहितः।विरूपं च समास्थाय परीक्षार्थं समागतः ॥৯॥
दिगम्बरोऽतितेजस्वी भूतिभूषणभूषितः।स चेष्टामकरोदुष्टां हस्ते लिङ्ग विधारयन् ॥১০॥
অর্থ :- এই সময়েই সাক্ষাৎ মহাদেব জী বিকৃত রূপে পরীক্ষা করাই জন্য চলে আসেন , একেবারে উলঙ্গ শরীর , অত্যন্ত তেজস্বী শরীরে ভস্মিত মহাদেব জী তার লিঙ্গ হাতে নিয়ে কুকর্ম করার চেষ্টা করতে থাকে , তা দেখে ঋষিদের স্ত্রী রা অত্যন্ত ভীত হয়ে যায় তারপর তারা ব্যাকুল হয়ে কাছে মহাদেব জীর কাছে চলে আসে ।
अलिलिंगुस्तथा चान्याः करं धृत्वा तथापराः।परस्परं तु संघर्षात्सम्मग्नास्ताः स्त्रियस्तदा ॥১৩॥
एतस्मिन्नेव समये ऋषिवर्याः समागमन्।विरुद्धं तं च ते दृष्ट्वा दुःखिताः क्रोधमूर्छिताः॥১৪॥
तदा दुःखमनुप्राप्ताः कोऽयं कोऽयं तथाऽब्रुवन्।समस्ता ऋषयस्ते वै शिवमायाविमोहिताः ॥১৫॥
सवा च नोक्तवान् किञ्चित्सोऽवधूतो दिगम्बरः।ऊचुस्तं पुरुषं भीमं तदा ते परमर्षयः ॥১৬॥
त्वया विरुद्धं क्रियते वेदमार्गविलोपि यत्।ततस्त्वदीयं तल्लिङ्गं पततां पृथिवीतले ॥১৭॥
इत्युक्ते तु तदा तैश्च लिङ्गं च पतितं क्षणात्।अवधूतस्य तस्याशु शिवस्याद्भुतरूपिणः ॥১৮॥
तल्लिङ्गं चाग्निवत्सर्वं यद्ददाह पुरा स्थितम्। यत्रयत्र च तद्याति तत्र तत्र बहेत्पुनः ॥১৯॥
অর্থ :- ঋষিদের সেই স্ত্রী রা মহাদেব জীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন , বহু স্ত্রী রা তার হাত ধরেন , নিজেদের মধ্যে এই সমস্ত কর্মে মত্ত হয়ে জান । ঠিক এই সময় ঋষিগণ জঙ্গল থেকে চলে আসেন , তারা এই সমস্ত অসভ্যতা দেখে দুঃখী আর ক্রুদ্ধ হন । আর এই তারা দুঃখী হয়ে বলেন - ইনি কে হন ইনি কে ? শিবের মায়া তে মোহিত হিয় ঋষিরা কোলাহল শুরু করেন , তখন ঋষিগণ উলঙ্গ ভয়ঙ্কর এই ব্যক্তি অর্থাৎ শিব জী কে বলেন ।কেন তুমি বেদ বিরুদ্ধ , ধর্মের বিনাশকারী ,অসভ্য কর্ম করছে , এমন বলে তারা অভিশাপ দেন যে - " তোমার যে লিঙ্গ তা কেটে গিয়ে ভূমিতে পরবে " , তখন ঋষিদের এমন বলার পর ওই অদ্ভুত রূপধারী শিবের লিঙ্গ ক্ষনিকের মধ্যে ভূমিতে কেটে পরে ।
সেই লিঙ্গ টি অগ্নির মতো জ্বলতে শুরু করে , যেখানে যেখানে সে লিঙ্গ যাচ্ছে সেখানে সেখানে সব কিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো , সেই লিঙ্গ পাতাল , স্বর্গ আর পৃথিবীতে দৌড়তে শুরু করে , পরন্তু কোনো ভাবেই সেই লিঙ্গ স্থির হতে চাইছিল না , সম্পূর্ণ সংসার ব্যাকুল হয়ে যায় তখন দুঃখী হয়ে দেবতাদের সাথে ঋষিগণ ব্রহ্মার কাছে জান পরামর্শ নেবার জন্য , এবং তাকে প্রণাম করে সমস্ত বৃত্তান্ত বলেন ,তাদের কথা শুনে ব্রহ্মা জী বলেন তোমরা ভুল করে ফেলেছো মহাদেবের মতো অতিথির সৎকার না করে । যতক্ষণ পর্যন্ত এই লিঙ্গ স্থাপিত না হচ্ছে ততক্ষণ ত্রিলোকে শান্তি স্থাপিত হবে না , তারপর ব্রহ্মাজী লিঙ্গ কে স্থাপিত করার উপায় বললেন ।
आराध्य गिरिजां देवीं प्रार्थयन्तु सुराः शिवम्।योनिरूपा भवेच्चेद्वै तदा तत्थिरतां व्रजेत् ॥৩২॥
इत्युक्तास्ते द्विजा देवाः प्रणिपत्य पितामहम्।शिवं तं शरणं प्राप्तः सर्वलोक्यसुखेप्सया॥৪৩ ।।
पूजितः परया भक्त्या प्रार्थितः शंकरस्तदा।सुप्रसन्नस्ततो भूत्वा तानुवाच महेश्वरः ॥৪৪॥
हे देवा ऋषयः सर्वे मद्वचः शृणुतादरात्।योनिरूपेण मल्लिङ्गंधृतं चेत्स्यात्तदा सुखम् ॥৪৫॥
पार्वती च विना नान्या लिङ्गं धारयितुं क्षमा।त्वया धृतं च मल्लिङ्ग द्रुतं शान्तिं गमिष्यति ॥৪৬॥
तच्छु्त्वा ऋषिभिर्देवैस्सुप्रसन्नैर्मुनीश्वराः।गहीत्वा चैव ब्रह्माणं गिरिजां प्रार्थिता तदा ॥৪৭॥
प्रसन्नां गिरिजां कृत्वा वृषभध्वजमेव च।पूर्वोक्तं च विधिं कृत्वा स्थापितं लिङ्गमुत्तमम् ॥৪৮॥
অর্থ :- তখন ব্রহ্মা বললেন যে দেবতা গন ! তোমরা পার্বতী কে প্রসন্ন করে শিবের প্রার্থনা করো , যদি পার্বতী জি যোনি রূপ ধারণ করে তাহলেই একমাত্র এই লিঙ্গ স্থির হবে । এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ও দেবতাগণ ব্রহ্মা কে প্রণাম করে সারা বিশ্ব সংসারের সুখের যিনি শিবের শরণে আসেন , তখন পরম ভক্তি ,প্রার্থনার দ্বারা পূজিত মহাদেব জী প্রসন্ন হয়ে বলেন - হে দেবতাগণ ! হে ঋষিগণ ! তোমরা আমার কথা শোনো ,যদি আমার লিঙ্গ যোনিতে স্থাপিত হয় তাহলেই একমাত্র সুখ হয়ে পারে । পার্বতীর ছাড়া আর কোনো স্ত্রী আমার লিঙ্গ কে ধারণ করতে পারবে না । তাতে যদি আমার লিঙ্গ ধারণ করা হয় তাহলে খুবই তাড়াতাড়ি শান্তি কে প্রাপ্ত হবে । এই কথা শুনে ঋষি , দেবতাগণ প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে পার্বতীর প্রার্থনা শুরু করে , পার্বতী কে প্রসন্ন করে মহাদেব কেও প্রসন্ন করেন তারপর সেই লিঙ্গ স্থাপিত হয় ।

শিবলিঙ্গের কাহিনী- ভবিষ্যপুরাণ, প্রতিসর্গপর্ব, চতুর্থখণ্ড, ১৭ অধ্যায়, ৬৭-৭৫ শ্লোক

"একসময় ভগবান অত্রি মুনি নিজের স্ত্রী অনসূয়া এর সাথে গঙ্গা নদীর তীরে বসে ব্রহ্মধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তপ করা আরম্ভ করেন, সেই সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব নিজেদের বাহনের ওপর বসে সেখানে গিয়ে পৌঁছে জান,ইহার পর এই তিন দেবতা ব্রহ্মপুত্র অত্রি কে সনাতন বচন বলেন, কিন্তু অত্রি জী ইহাদের কথনে কোনো ধ্যান না দিয়ে পুণরায় ব্রহ্মধ্যানে মগ্ন হন, উহার ভাব কে জেনে এই তিন দেবতা অত্রি জীর স্ত্রী অনসুয়ার কাছে গিয়ে তাকে বলতে শুরু করেন। ওই সময় অনসুয়ার বশীভূত হয়ে শিব নিজের লিঙ্গ কে হাত দিয়ে নাড়তে থাকে, বিষ্ণু-ব্রহ্মাও কাম ভাবে মোহিত হয়ে জান। কামে অত্যন্ত মোহিত হওয়ার কারণে বলপূর্বক অনসূয়া কে ধরে ফেলেন আর মৈথুন করার চেষ্ঠা শুরু করে। তখন খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে মুনি পত্নী অনসূয়া তাদের শাপ দেন আর বলেন যে - শিবের লিঙ্গ, বিষ্ণুর চরণ আর ব্রহ্মার মাথার পূজা সর্বদা মনুষ্য দ্বারা হবে, যা এক উত্তম উপহাসের বিষয় হবে।"

             সে যাক্, আমরা যদি শিব প্রসঙ্গে আসি তাহলে এ পর্যায়ে এসে বোঝা যাচ্ছে যে, আজকের দিনের শিবঠাকুর ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রকৃতই যেন– দেবাদিদেব। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন মানুষের কাছে আশ্রয়-ভরসার প্রতীক স্বরূপ। তাই তিনি সেই সময় থেকেই সর্বপূজিত ও সর্বপ্রণম্য। তারপর মানব বিবর্তনের ধারা বেয়ে তাঁরও রূপবিবর্তন ঘটতে থাকে। এই মহাকালের পথ পরিক্রমার বিভিন্ন নিদর্শনগুলোই ক্রমে তাঁর বাহন, অঙ্গভূষণ ও পূজা প্রকারণ রূপে দেবাংশী হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। আদিতে তিনি ছিলেন অমূর্ত বা বিমূর্ত। এরপরে সিন্ধু সভ্যতায় তিনি হলেন মূর্ত ও অমূর্ত। সমগ্র আর্য সভ্যতায় ঋগ্বেদ সংহিতার যুগ থেকে অথর্ববেদ সংহিতার যুগ পর্যন্ত তিনি আবার অমূর্ত, কারণ, আর্যরা মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এরপরে পৌরাণিক যুগে এসে আর্য-অনার্য এই দুই সভ্যতার চূড়ান্ত ধারা সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আবার তিনি মূর্তিরূপ পরিগ্রহ করলেন; আবার একই সাথে তিনি লিঙ্গ প্রতীকেও পূজিত হতে থাকলেন। সবশেষে আজ তিনি তাঁর লিঙ্গ প্রতীকে এতোটাই জনপ্রিয় যে, তার ফলে তাঁর কায়ারূপ জনমানস থেকে ক্রম-অপস্রিয়মাণ।
বর্তমানে শিবঠাকুরের যে মূর্তিরূপ দেখি, তার উৎপত্তি সম্ভবত পৌরাণিক যুগেই সূচিত হয়েছে। সেখানে সিন্ধু সভ্যতার আদি শিবের মূর্তি বহু পরবর্তী অনার্য সভ্যতার মধ্যে ফল্গুধারার মতো প্রাগার্য সভ্যতা থেকে অনুপ্রবেশ করেছিল কিনা তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাঁর যে গৌরীপট্ট সমন্বিত লিঙ্গ প্রতীকরূপ দেখি তা মোটেও বেশি প্রাচীন কালের কথা নয়। কারণ প্রাগৈতিহাসিক আত্মা প্রস্তর থেকে শুরু করে পৌরাণিক কাল পর্যন্ত লিঙ্গ প্রতীক বহুবার বহু-সংস্কৃত হলেও আদি পিতার সাথে আদি মাতার সমন্বয় মূর্তি রচনা কখনোই সম্ভব হয়নি। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলো থেকেও অনুমান করা যায় যে তখনো লিঙ্গ ও মাতৃদেবী (আদি পিতা ও আদি মাতা) আলাদা আলাদা ভাবেই পূজিত হতেন। পৌরাণিক যুগে এসেও লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। বরং, পণ্ডিতজনদের মতে, এই সময়ে বোধহয় কোনও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে লিঙ্গমূর্তি ক্রমে ক্রমে একান্ত বাস্তবানুগ রূপ নেয়, আবার একই সাথে ক্রমশ তা আকারেও বড় হতে থাকে। এরকম বহু নিদর্শনের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের গুড্ডিমল্লম গ্রামের মনুষ্যপ্রমাণ (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর) লিঙ্গমূর্তিটি আজও সাড়ম্বরে পূজিত হওয়ার কথা ইতঃপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
‘এই সময়কার লিঙ্গমূর্তিগুলো সরাসরি মাটির উপরে খাড়াভাবে প্রোথিত অবস্থায় থাকত। যা ক্রমশ শ্লীলতার সীমারেখা অতিক্রম করতে থাকে। তারপর এই বাস্তবানুগ রূপ খুব সম্ভবত জনরোষেই ধীরে ধীরে পরিশীলিত হয়। যার ফলে পরবর্তীকালের নিদর্শনগুলো বাস্তবানুগতা ছেড়ে বিভিন্ন মাপের নানা ধরনের (লম্বা, ডিম্বাকৃতি, উপবৃত্তাকার, গোলাকার ইত্যাদি) হতে থাকে। আর তা সরাসরি মাটির উপরে খাড়া ভাবে প্রোথিত থাকত।’
‘এইরকম শিবলিঙ্গ আজও বহু জায়গায় (প্রাচীন মন্দিরগুলোতে) পূজিত হচ্ছে। একটু ভালভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, সেইসব লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট পরবর্তীকালে বিভিন্ন কায়দায় সংযোজন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়– কাশীর বিশ্বনাথ, কেদারনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর, লিঙ্গরাজ, তারকেশ্বর ইত্যাদি। এই উদাহরণগুলো দেখে অনেক প্রাজ্ঞ মানুষ আপত্তি করতে পারেন যে, ওইসব মন্দিরগুলো তো আরও অনেক প্রাচীন কালের নিদর্শন। তা হলে তাঁদেরকে কি এই যুক্তিতে আনা যায়? কথাটা ঠিকই বিশ্বনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর ইত্যাদি মন্দিরগুলো অতি প্রাচীন। কিন্তু ইতিহাস বলে ওই মন্দিরগুলো বহুবার বহুভাবে বিনষ্ট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৫)
            ঐতিহাসিকেরা যদিও গুপ্তযুগকে পৌরাণিক ও হিন্দু সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলেন, কিন্তু এই সময়েও লিঙ্গমূর্তিতে আদিপিতার সাথে আদিমাতার সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি। তা সম্ভব হয়েছে গুপ্তোত্তর কালে এসে (খ্রি. ষষ্ঠ শতাব্দী) কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। আবিষ্কৃত হলো ‘সনালিকা গৌরীপট্ট সমন্বিতম্’ শিবলিঙ্গ। জানা যায়, এর ঠিক কিছুকাল আগে পাঞ্জাবের উদম্বর জনগোষ্ঠী বহুভাবে লিঙ্গমূর্তির রূপ সংস্কারের বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যার নিদর্শন আজও পাওয়া যায় বলে গবেষকদের অভিমত।
‘তৈরি হল মানুষের দার্শনিকতার সাথে মেলবন্ধন করে যুগোপযোগী ও রুচিসম্মত শিবলিঙ্গ মূর্তি। যাতে বাস্তবানুগতার চেয়ে দার্শনিকতাই বেশি প্রাধান্য লাভ করেছে। আর তাই এই মূর্তি আসমুদ্রহিমাচলে সর্বত্র আদৃত, পূজিত ও প্রণম্য হল– আদি পিতা ও আদি মাতার– শিবশক্তির– বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং-এর দার্শনিক বিমূর্ত প্রকাশরূপে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৬)
আর এই দার্শনিকতার সাহিত্য নিদর্শনও আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালের শৈব তন্ত্র ও পুরাণ সাহিত্য নিদশনগুলিতে। যেমন, বায়বীয় সংহিতায় বলা হয়েছে–
লিঙ্গবেদী মহাদেবী লিঙ্গং সাক্ষান্মহেশ্বরঃ। (বায়বীয় সংহিতা উত্তরভাগ-২৭/১৩)
অর্থাৎ : লিঙ্গের বেদীতে মহাদেবীর এবং লিঙ্গেতে মহেশ্বরের অধিষ্ঠান।
প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচনেও বলা হয়েছে–
লিঙ্গবেদো মহাদেবী লিঙ্গং সাক্ষান্মহেশ্বরঃ।
ত্রয়োঃ সংপূজনান্নিত্যং দেবী দেবশ্চ পূজিতৌ।। (প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচন)
অর্থাৎ : লিঙ্গ-বেদী মহাদেবী ভগবতী-স্বরূপ। আর লিঙ্গ সাক্ষাৎ মহাদেব স্বরূপ। এই লিঙ্গ ও বেদীর পূজাতে শিব ও শক্তি উভয়ের পূজা হয়।
পরবর্তীকালের তান্ত্রিক দৃষ্টিতেও একই তত্ত্ব পাওয়া যায়। যেমন, নিরুত্তর তন্ত্রের ভাষায়–
লিঙ্গরুপো মহাকালো যোনিরূপা চ কালিকা। (নিরুত্তরতন্ত্র-১৪পটল)
অর্থাৎ : লিঙ্গরূপে মহাকাল এবং যোনিরূপে কালিকা দেবী অবস্থান করেন।

নারদপঞ্চরাত্রেও লিঙ্গযোনির নিত্যসম্বন্ধের কথা পাওয়া যায়, যেমন–
যত্র লিঙ্গস্তত্র যোনির্যত্র, যোনিস্ততঃ শিবঃ। (নারদপঞ্চরাত্র)
অর্থাৎ : যেখানে লিঙ্গ সেখানেই যোনি এবং যেখানে যোনি সেখানেই শিবের অবস্থান।
একইভাবে–
শক্তিং বিনা মহেশানি প্রেতত্বং তস্য নিশ্চিতম্ ।
শক্তিসংযোগমাত্রেণ কর্মকর্তা সদ্যশিবঃ।
অতএব মহেশানি পূজয়েচ্ছিবলিঙ্গবম্ ।।
অর্থাৎ : মহেশানি ! শক্তি-সংযুক্ত না থাকিলে শিব নিশ্চিত শব-স্বরূপ হন, এবং শক্তি-যুক্ত হইলেই কর্ম-ক্ষম হইয়া উঠেন। অতএব শক্তির সহিত শিব-লিঙ্গের পূজা করিবে।
লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, হয়তো এর থেকেই জগৎ পিতা-মাতার কল্পনা শাস্ত্রকারদের বুদ্ধিতে উদিত হয়েছিল। সে কারণেই নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে–
যোনিশ্চ জনিকা মাতা লিঙ্গশ্চ জনকঃ পিতা।
মাতৃভাবং পিতৃভাবমুভয়োরপি চিন্তয়েৎ।।
অর্থাৎ : যোনিতে মাতা এবং লিঙ্গে পিতা, এভাবে উভয়কে মাতৃ-পিতৃজ্ঞানে চিন্তা করবে।
তাই হয়তো পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্য্যরে অন্নপূর্ণাস্তোত্রে বলা হয়েছে–
মাতা মে পার্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ।
বান্ধবাঃ শিবভক্তাশ্চ স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্ ।। (অন্নপূর্ণাস্তোত্র)
অর্থাৎ : দেবী পার্বতী আমার মা, পিতা মহেশ্বর; শিবভক্তরা বান্ধব তাই ত্রিভুবনই স্বদেশ।

 [পরের পোস্টশৈব সম্প্রদায়] 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ