মূত্তি শিল্পচর্চার একটি মাধ্যম যার দ্বারা অবয়ব বা প্রতীকের চিহ্নিতকরণ, বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বা বিশদীকরণের চর্চা করা হয়। এটি একটি বিজ্ঞান। আক্ষরিক অর্থে মূর্তিতত্ত্বকে (Iconography) বলা হয় ‘অবয়ব অংকন’ বা ‘Image Writing’. শিল্পি তার কল্পনাকে একটি দৃশ্যমান অবয়ব বা আকার দিয়ে মূর্তি (ভাস্কর্য) সৃষ্টি করে। এটিই আইকোনোগ্রাফি বা মূর্তিতত্ত্বের প্রধান দিক। আঠারো শতকের পূর্বে ইউরোপে ব্যাপকভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা শুরু হয়নি। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাচীণকাল থেকেই এর চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামোর গাত্রে বা স্বতন্ত্রভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা বাংলায়ও প্রাচীনকাল থেকে ব্যাপক হারে হয়েছে। মাটি, পাথর বা ধাতু ছিল মূর্তিতত্ত্বের চর্চার প্রধান মাধ্যম। যদিও পাথরের ভাস্কর্য তৈরির জন্য যে পরিমাণ পাথরের প্রয়োজন, তা বাংলায় নেই, তথাপি খ্রিস্টীয় নয় হতে তেরো শতকের মধ্যে বাংলায় প্রচুর সংখ্যক শিল্পসম্মত ও সৌন্দর্যমন্ডিত প্রস্তর ভাস্কর্য, বিশেষত বিভিন্ন ধর্মীয় মূর্তি, নির্মিত হয়েছিল। বাংলায় এ সমস্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করার জন্য পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে ধূসর কালো পাথর আমদানি করা হতো।
হিন্দু ধর্মীয় ভাস্কর্য কুষাণ যুগের শেষ দিকে বাংলায় হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রস্তর ভাস্কর্যের উৎপত্তি হয়েছে। এ সময় প্রস্তর ভাস্কর্যের পাশাপাশি কিছু কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্যও তৈরি হয়েছিল। বগুড়া জেলার শারসাবাজে প্রাপ্ত ও মহাস্থানগড় জাদুঘরে রক্ষিত চতুর্ভুজ মহিষমর্দিনী মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পরীতি ও সৌন্দর্যের দিক থেকে এ দেবী-প্রতিমাটি শুধু বাংলায় নয়, উপমহাদেশে এ যাবৎ প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য (চিত্র-১)। খুব সম্ভব এ দেবী-প্রতিমা প্রমাণ করে বাংলায় কেন দুর্গা-মহিষমর্দিনী এত প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তাশিল্পচর্চার একটি মাধ্যম যার দ্বারা অবয়ব বা প্রতীকের চিহ্নিতকরণ, বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বা বিশদীকরণের চর্চা করা হয়। এটি একটি বিজ্ঞান। আক্ষরিক অর্থে মূর্তিতত্ত্বকে (Iconography) বলা হয় ‘অবয়ব অংকন’ বা ‘Image Writing’. শিল্পি তার কল্পনাকে একটি দৃশ্যমান অবয়ব বা আকার দিয়ে মূর্তি (ভাস্কর্য) সৃষ্টি করে। এটিই আইকোনোগ্রাফি বা মূর্তিতত্ত্বের প্রধান দিক। আঠারো শতকের পূর্বে ইউরোপে ব্যাপকভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা শুরু হয়নি। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাচীণকাল থেকেই এর চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামোর গাত্রে বা স্বতন্ত্রভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা বাংলায়ও প্রাচীনকাল থেকে ব্যাপক হারে হয়েছে। মাটি, পাথর বা ধাতু ছিল মূর্তিতত্ত্বের চর্চার প্রধান মাধ্যম। যদিও পাথরের ভাস্কর্য তৈরির জন্য যে পরিমাণ পাথরের প্রয়োজন, তা বাংলায় নেই, তথাপি খ্রিস্টীয় নয় হতে তেরো শতকের মধ্যে বাংলায় প্রচুর সংখ্যক শিল্পসম্মত ও সৌন্দর্যমন্ডিত প্রস্তর ভাস্কর্য, বিশেষত বিভিন্ন ধর্মীয় মূর্তি, নির্মিত হয়েছিল। বাংলায় এ সমস্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করার জন্য পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে ধূসর কালো পাথর আমদানি করা হতো।
হিন্দু ধর্মীয় ভাস্কর্য কুষাণ যুগের শেষ দিকে বাংলায় হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রস্তর ভাস্কর্যের উৎপত্তি হয়েছে। এ সময় প্রস্তর ভাস্কর্যের পাশাপাশি কিছু কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্যও তৈরি হয়েছিল। বগুড়া জেলার শারসাবাজে প্রাপ্ত ও মহাস্থানগড় জাদুঘরে রক্ষিত চতুর্ভুজ মহিষমর্দিনী মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পরীতি ও সৌন্দর্যের দিক থেকে এ দেবী-প্রতিমাটি শুধু বাংলায় নয়, উপমহাদেশে এ যাবৎ প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য (চিত্র-১)। খুব সম্ভব এ দেবী-প্রতিমা প্রমাণ করে বাংলায় কেন দুর্গা-মহিষমর্দিনী এত প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তাশিল্পচর্চার একটি মাধ্যম যার দ্বারা অবয়ব বা প্রতীকের চিহ্নিতকরণ, বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বা বিশদীকরণের চর্চা করা হয়। এটি একটি বিজ্ঞান। আক্ষরিক অর্থে মূর্তিতত্ত্বকে (Iconography) বলা হয় ‘অবয়ব অংকন’ বা ‘Image Writing’. শিল্পি তার কল্পনাকে একটি দৃশ্যমান অবয়ব বা আকার দিয়ে মূর্তি (ভাস্কর্য) সৃষ্টি করে। এটিই আইকোনোগ্রাফি বা মূর্তিতত্ত্বের প্রধান দিক। আঠারো শতকের পূর্বে ইউরোপে ব্যাপকভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা শুরু হয়নি। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাচীণকাল থেকেই এর চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামোর গাত্রে বা স্বতন্ত্রভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা বাংলায়ও প্রাচীনকাল থেকে ব্যাপক হারে হয়েছে। মাটি, পাথর বা ধাতু ছিল মূর্তিতত্ত্বের চর্চার প্রধান মাধ্যম। যদিও পাথরের ভাস্কর্য তৈরির জন্য যে পরিমাণ পাথরের প্রয়োজন, তা বাংলায় নেই, তথাপি খ্রিস্টীয় নয় হতে তেরো শতকের মধ্যে বাংলায় প্রচুর সংখ্যক শিল্পসম্মত ও সৌন্দর্যমন্ডিত প্রস্তর ভাস্কর্য, বিশেষত বিভিন্ন ধর্মীয় মূর্তি, নির্মিত হয়েছিল। বাংলায় এ সমস্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করার জন্য পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে ধূসর কালো পাথর আমদানি করা হতো।
হিন্দু ধর্মীয় ভাস্কর্য কুষাণ যুগের শেষ দিকে বাংলায় হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রস্তর ভাস্কর্যের উৎপত্তি হয়েছে। এ সময় প্রস্তর ভাস্কর্যের পাশাপাশি কিছু কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্যও তৈরি হয়েছিল। বগুড়া জেলার শারসাবাজে প্রাপ্ত ও মহাস্থানগড় জাদুঘরে রক্ষিত চতুর্ভুজ মহিষমর্দিনী মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পরীতি ও সৌন্দর্যের দিক থেকে এ দেবী-প্রতিমাটি শুধু বাংলায় নয়, উপমহাদেশে এ যাবৎ প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য (চিত্র-১)। খুব সম্ভব এ দেবী-প্রতিমা প্রমাণ করে বাংলায় কেন দুর্গা-মহিষমর্দিনী এত প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং কেন আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। এ দেবী-প্রতিমা ছাড়া হিন্দু ধর্মানুসারীদের প্রধান ও জনপ্রিয় অন্যান্য দেব-মূর্তি ছিল ব্র্হ্মা, বিষ্ণু, সূর্য, শিব ও গণেশ।
ব্রহ্মা যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রহ্মা একজন অপ্রধান দেবতা, তথাপি আশ্চর্যের বিষয় তিনি বাংলায় পূজিত দেবদেবীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। ব্রহ্মার প্রচুর সংখ্যক প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রাপ্তি বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করছে। পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার ভদ্রকালীতে প্রাপ্ত ও কলকাতা আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত ব্রহ্মার প্রাথমিক রূপের একটি ভাস্কর্যে ব্রহ্মার মূর্তিলক্ষণগুলি হলো: দ্বিভুজ, ত্রিমুন্ড ও সাদামাটা বেদির উপর উপবিষ্ট (বেদির উপর পদ্ম তখনও অনুপস্থিত)। তাঁর ডান হাতে অক্ষমালা (জপমালা) এবং বাম হাতে কমন্ডলু রয়েছে। তাঁর বাম পদতলে রয়েছে একটি ছোট হংস। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে মনে হয় এ মূর্তিটি খ্রিস্টীয় আট ও নয় শতকে নির্মিত হয়েছিল (চিত্র-২)। পাহাড়পুর মন্দিরে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির ফলকেও অনুরূপ একটি ব্রহ্মার মূর্তি দৃষ্ট হয়। তবে পুরাণে চতুরানন ও চতুর্ভুজ ব্রহ্মার উল্লেখ আছে।
দিনাজপুর জেলায় প্রাপ্ত ও দিনাজপুর জাদুঘরে এগারো ও বারো শতকের ব্রহ্মার পূর্ণরূপের একটি ভাস্কর্য রয়েছে (চিত্র-৩)। এ ভাস্কর্যের প্রতিমা লক্ষণগুলি হলো: চতুরানন, চতুর্ভুজ এবং মুখমন্ডল গোঁফ ও শ্মশ্রুমন্ডিত; চার হাতে রয়েছে যথাক্রমে জপমালা, (অক্ষমালা), কমন্ডলু, শ্রুক ও স্রুব। তিনি দ্বিপত্রযুক্ত পদ্মাসনে উপবিষ্ট এবং তাঁর ডান পায়ের নিচে আর একটি ছোট পদ্ম রয়েছে। বেদির উপরে দুজন পূজারীসহ একটি হংস রয়েছে। তাঁর বামে চতুর্ভুজা পার্শ্বদেবী সাবিত্রী ও ডানে চতুর্ভুজা সরস্বতী দেবী উপবিষ্ট। এ ভাস্কর্যের মূল প্রতিমার চালচিত্রের উপর দুই বিদ্যাধরযুক্ত কীর্তিমুখ রয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রহ্মার যে রূপ দেখা যায় সেখানে তাঁর মুখমন্ডলে গোঁফ-দাড়ি লক্ষ্য করা যায় না।
গণেশ ব্রহ্মার পরে হস্তিমুখযুক্ত গণেশদেব খুবই জনপ্রিয় হিন্দু দেবতা। তাঁকে কখনও উপবিষ্ট, আবার কখনও বা দন্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। বাংলায় প্রাপ্ত তাঁর পরমানন্দদায়ক রূপ, বিশেষ করে নৃত্যরত গণেশ মূর্তি, উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত গণেশ মূর্তি হতে স্বতন্ত্র। গণেশকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একক দেবতা হিসেবে দেখা যায়, তথাপি কোন কোন সময় তাঁকে ললিতার সঙ্গে, কোন সময় গৌরী ও শিশু শিবের সঙ্গে, কোন কোন সময় মাতৃকা দেবী বা কোন সময় নবগ্রহের সঙ্গে দেখা যায়। বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মের সাথে জড়িত পাহাড়পুর মহাবিহার ও হলুদ বিহার থেকেও গণেশমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। কুমিল্লা জেলার মন্ধুকে উপবিষ্ট একটি অনিন্দ্যসুন্দর গণেশ ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে এবং বর্তমানে তা ময়নামতী জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ভাস্কর্যটির বেদীতে উৎকীর্ণ লিপি অনুযায়ী এটি পাল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় গোপালের ১ম রাজ্যাঙ্কে তৈরি করা হয়েছিল। মূর্তিটি মহারাজলীলা বা সুখাসনে উপবিষ্ট এবং চতুর্ভুজ। তাঁর চার হাতে যথাক্রমে মাতুলুঙ্গ, মূলক, মোদকভান্ড এবং পরশু (কুঠার) রয়েছে। বাংলা-বিহারে প্রাপ্ত গণেশ ভাস্কর্যে মূলক-মুদ্রা একটি বিশেষ রূপ। তিনি সর্পযুক্ত উপবিত পরিধান করেছেন এবং বেদিতে তাঁর বাহন হিসেবে রয়েছে ক্রীড়ারত মূষিক। পাল রাজা প্রথম মহীপালের চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে নির্মিত আর একটি অনিন্দ্যসুন্দর শিল্পমন্ডিত গণেশমূর্তি কুমিল্লা জেলার নারায়ণপুরে পাওয়া গিয়েছে এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরএ সংরক্ষিত আছে (চিত্র-৪)। বিশাল আকৃতির এ ভাস্কর্যটি চতুর্ভুজ এবং তাঁর চার হাতে যথাক্রমে মূলক, পরশু, অক্ষমালা এবং মোদকভান্ড রয়েছে। মূর্তিটির চালচিত্রের উপরে পত্রসহ একগুচ্ছ আম এবং গণেশের বাহন মূষিককে তাঁর ডান পায়ের নিচে দেখানো হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপাল হতে একটি অপূর্ব কারুকার্যখচিত পঞ্চমুন্ড বিশিষ্ট গণেশ ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে, তবে বর্তমানে ভাস্কর্যটি কোথায় রয়েছে তা জানা যায় না। এ ভাস্কর্যে গণেশ সিংহের উপর উপবিষ্ট। বারো শতকে নির্মিত এই দশভুজ মূর্তির কোন কোন মুদ্রা ধ্বংস প্রাপ্ত। এ ভাস্কর্যটির পিছনের চালির দুপাশে উড়ন্ত বিদ্যাধরের উপরে আরও ছয়টি উপবিষ্ট গণেশ মূর্তি রয়েছে। এ ধরনের গণেশ ভাস্কর্যকে শারদাতিলকে প্রদত্ত ধ্যান অনুসরণে নলিনীকান্ত ভট্টশালী ’হেরম্ভগণপতি’ বলে অভিহিত করেছেন।
বাঙালি ভাস্করদের তৈরি অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত নৃত্যরত গণেশ ভাস্কর্য ‘নৃত্য-গণপতি’ নামে পরিচিত। নৃত্যরত গণেশ হয় ছয় হাত বিশিষ্ট, নয় আট হাত বিশিষ্ট এবং দুপাশে গো-কর্ণ ও গজ-কর্ণ নামে দুজন বাদক রয়েছে। এ ধরনের গণেশ মূর্তি হয় পদ্মের উপর উপবিষ্ট, না হয় মূষিকের উপর সমাসীন।
বার্লিন ভারতীয় শিল্প সংগ্রহশালায় এগারো শতকে নির্মিত একটি নৃত্যরত অষ্টভুজ গণেশ ভাস্কর্য সংরক্ষিত রয়েছে। এটি উত্তরবঙ্গ থেকে পাওয়া গিয়েছে। এ দেবমূর্তি তাঁর আট হাতে যথাক্রমে অভয় মুদ্রা, অক্ষমালা, পরশু, তাঁর ভগ্ন দন্ত, নৃত্যহস্ত নীলোৎপল, সর্প এবং মোদকভান্ড ধরে আছেন। গো-কর্ণ ও গজ-কর্ণ নামক বাদকদ্বয় ঢোল ও করতাল বাজাচ্ছে। মূষিক অভিভূত হয়ে তাঁর প্রভুর নৃত্য উপভোগ করছে।
বিষ্ণু বাংলায় সকল দেবতার মধ্যে বিষ্ণু সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবতা। প্রায় ৮১৫টি বিষ্ণু ও বৈষ্ণব মূর্তির তালিকা পাওয়া যায়; এগুলির প্রায় সবই প্রস্তর মূর্তি। বাংলায় প্রাপ্ত বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের মূর্তি এবং এর পর্যায়ক্রমিক বিবর্তন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। রাজশাহীর হাকরাইল ও বগুড়ার নরহট্টে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরএ সংরক্ষিত বিষ্ণু মূর্তির ভাস্কর্যদুটি বাংলায় প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। চতুর্ভুজ এ মূর্তির পিছনের ডান ও বাম বাহু অধস্তন এবং ডান হাতে গদা ও বাম হাতে চক্র রয়েছে। অপরদিকে উপরের ডান ও বাম হাতে যথাক্রমে মাতুলুঙ্গ ও শঙ্খ রয়েছে এবং এ শঙ্খবৃত্তের উপরের অংশ সর্বদাই বাংলায় প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিতে দেখা যায়। প্রাচীনতম বিষ্ণু মূর্তিগুলিতে তাঁর বাহন গরুড় পক্ষীকে দেখা যায় না।
পরবর্তী পর্যায়ে বিষ্ণুর দুটি মুদ্রা গদা বা চক্র যথাক্রমে গদাদেবী ও চক্রপুরুষ নামে অভিহিত হয়েছেন। শিববাড়িতে প্রাপ্ত ও কলকাতা সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রক্ষিত, দিনাজপুরের কড়াইচারচর থেকে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত এবং দিনাজপুরের ক্ষীয়ারমামুদপুরে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিগুলিতে উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি তুলনীয়। বর্ধমানের চৈতনপুরে প্রাপ্ত এবং কলকাতা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটিও এই একই শ্রেণির। বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীন বিষ্ণু মূর্তিগুলির হাতে পদ্ম লক্ষ্য করা যায় না। বিষ্ণু মূর্তি প্রধানত চতুর্ভুজ এবং তাঁর হাতে যে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মের উল্লেখ আছে, এসব মুদ্রার বিভিন্ন অবস্থানের কারণে বাংলায় প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিগুলির মধ্যে চতুর্বিংশ বিভিন্ন রূপ সন্ধান করা সমীচীন নয়। তবে ক্ষীয়ারমামুদপুরে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিতে দেখা যায়, তিনি লম্বা বনমালা পরিধান করেছেন।
তৃতীয় পর্যায়ের বিষ্ণু মূর্তিতে লক্ষ্য করা যায়, তাঁর পিছনের দুটি হাত উপরের দিকে রয়েছে। এই পর্যায়ে গদাদেবী ও চক্রপুরুষ-এর পরিবর্তে বিষ্ণুর দুই স্ত্রী অথবা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এগারো শতকে পাল শাসক প্রথম মহীপালের ৩য় রাজ্যাঙ্কে তৈরি এবং বাঘাউরাতে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিতে উপর্যুক্ত মূর্তি লক্ষণগুলি ফুটে উঠেছে। এ ভাস্কর্যে বিষ্ণু তাঁর চার হাতে যথাক্রমে পদ্ম, গদা, চক্র ও শঙ্খ ধারণ করে আছেন এবং তিনি কিরীট-মুক্তা ও লম্বা বনমালা পরিধান করেছেন। তাঁর ডান দিকে লক্ষ্মী এবং বামদিকে বীণাবাদনরত সরস্বতী দন্ডায়মান। এ ভাস্কর্যে বিষ্ণুর বাহন গরুড়পক্ষীকে তাঁর বেদিপীঠে দেখা যাচ্ছে।
সাত শতকে তৈরি বরিশাল জেলার লক্ষ্মণকাঠির বিষ্ণুমূর্তিটি উপমহাদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য (চিত্র-৫)। মূর্তিটি এখনও বর্তমান এবং এখনও পূজিত হয়। এ ভাস্কর্যের মূর্তিলক্ষণগুলি হলো: বিষ্ণুর দুই পার্শ্বদেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী যথাক্রমে তাঁর ডান ও বাম দিকে রয়েছেন। গরুড়ে উপবিষ্ট বিষ্ণুর ডান দিকের নিচের হাতে চক্রপুরুষসহ চক্র এবং বামদিকের নিচের হাতে ছোট গদাযুক্ত গদাদেবী রয়েছেন এবং উপরের প্রত্যেকটি হাতে একটি করে পদ্ম রয়েছে। ডান হাতের পদ্মের উপর দুটি হস্তিযুক্ত লক্ষ্মী দেবী-মূর্তি এবং অন্য হাতের পদ্মের উপর বীণাবাদনরত সরস্বতী দেবী-মূর্তি উপবিষ্ট। এ ভাস্কর্যে এক ছোট চতুর্ভুজ দেব-প্রতিমা তাঁর দুহাতে শঙ্খ ও পদ্মযুক্ত হয়ে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় যোগাসনে উপবিষ্ট। এ ধরনের ভাস্কর্য বৌদ্ধ ধর্মের সাথে যুক্ত কোন কোন ভাস্কর্যেও লক্ষ করা যায়। বিষ্ণু ভাস্কর্যের মূর্তিলক্ষণের শেষ পর্যায়ে তাঁর মুদ্রা শঙ্খ-পুরুষ ও চক্র-পুরুষকে যথাক্রমে লক্ষ্মীদেবী ও সরস্বতী দেবী-প্রতিমার সঙ্গে দেখা যায় (চিত্র-৬)।
বিষ্ণু ছাড়া তাঁর বিভিন্ন অবতারের মূর্তি বাংলার বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। এগুলির মধ্যে মুন্সিগঞ্জে বজ্রযোগিনীতে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত মৎস্য অবতার মূর্তি (চিত্র-৭), হুগলী জেলার মহানদে প্রাপ্ত ও কলকাতা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত কুম্ভ অবতার মূর্তি, বগুড়ার সিলিমপুরে প্রাপ্ত এবং বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত বরাহ অবতার মূর্তি, বিক্রমপুরে প্রাপ্ত নরসিংহ অবতার মূর্তি, জোরদেউলে প্রাপ্ত ত্রিবিক্রম-বামন অবতার মূর্তি এবং রানীহাটিতে প্রাপ্ত পরশুরাম অবতার মূর্তিগুলি (চিত্র-৮) বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত। অন্যদিকে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত এবং সোনারং-এ প্রাপ্ত রাম অবতার ও দিনাজপুরের প্রাপ্ত বলরাম অবতার (চিত্র-৯) মূর্তিগুলি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য। এগুলির মধ্যে বরাহ ও বলরাম অবতার মূর্তি বাংলায় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত বিভিন্ন অবতারের মূর্তিগুলির মধ্যে দুটি মূর্তিতে কেন্দ্রীয় বিষ্ণুর চার পাশে তাঁর বিভিন্ন অবতারের প্রতিমা-লক্ষণগুলি ফুটে উঠেছে। দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ হতে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিগুলির প্রতিমা-লক্ষণের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিগুলিতে তাঁর পরিহিত উপবিত আকারে ছোট, বক্ষদেশ কৌস্তভমণিযুক্ত এবং তাঁর বাহন গরুড়কে বেদীর মাঝখানে দেখানো হয়েছে।
বাংলায় প্রাপ্ত আর এক শ্রেণির বিষ্ণু মূর্তি, মূর্তিতত্ত্বের প্রতিমা-লক্ষণের দিক দিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরের সুরহারে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি বিষ্ণু মূর্তিতে প্রতিমা-লক্ষণগুলি হচ্ছে: তিনি এখানে সর্পচালীযুক্ত এবং চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। এ ভাস্কর্যে সর্পচালীর উপর দুহাত যুক্ত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আর একটি মূর্তি দেখানো হয়েছে এবং এ ভাস্কর্যের বেদীতে নৃত্যরত অবস্থায় একটি সুদর্শনচক্র রয়েছে। তবে এ ভাস্কর্যে তাঁর বাহন গরুড়কে দেখানো হয়নি। দিনাজপুরের বিরোলে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি ভগ্ন বিষ্ণু মূর্তির ভাস্কর্য রয়েছে। এ ভাস্কর্যের প্রতিমা-লক্ষণের মধ্যে দুহাত যুক্ত দুটি ধ্যানমগ্ন মূর্তি কেন্দ্রীয় মূর্তির উপরে না দেখিয়ে ডান দিকে দেখানো হয়েছে। বিষ্ণুর প্রচলিত সমভঙ্গ মুদ্রার পরিবর্তে এ ভাস্কর্যে তাঁকে আভঙ্গ ভঙ্গিতে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখানো হয়েছে।
অষ্টভুজ বিষ্ণুমূর্তি বাংলাদেশে বৈকুণ্ঠ-বিশ্বরূপ বিষ্ণু নামে পরিচিত। আনুমানিক নয় শতকের এ ধরনের একটি প্রাচীন মূর্তি টাঙ্গাইলের পাঁচবিথাইর-এ পাওয়া গেছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ ভাস্কর্যের মূর্তি-লক্ষণ হচ্ছে: তিনি অষ্টভুজ এবং পঞ্চমুন্ডযুক্ত মূর্তিসহ যুদ্ধাবস্থায় আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে ছোরা হাতে এক নারীমূর্তি এবং তাঁর বাহন গরুড়পক্ষীকে তরবারি হাতে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে দশভুজ ও সর্পচালীযুক্ত বিষ্ণুমূর্তি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলা থেকে পাওয়া গিয়েছে। উপরে ছোট ধ্যানমগ্ন মূর্তিসহ সর্পচালীযুক্ত এই বিষ্ণু মূর্তিকে ভুলবশত বিষ্ণু-লোকেশ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মূর্তিতত্ত্বের দিক থেকে উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত বিংশতিভুজ বিষ্ণুমূর্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ভাস্কর্যে তিনি তাঁর চিরাচরিত চারটি মুদ্রা শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ছাড়া অন্যান্য আট হাতে অন্যান্য মুদ্রা সম্ভবত আট দিক্পাল ধারণ করেছেন। তাঁর দুপাশে উপবিষ্ট ভুঁড়িওয়ালা দুটি মূর্তি রয়েছে এবং তাঁর বাহন গরুড়কে বেদীর বাম দিকে দেখানো হয়েছে। এ মূর্তিটি এগারো-বারো শতকে নির্মিত হয়েছিল।
শিব গুরুত্বের দিক থেকে বাংলার দেবতাদের মধ্যে শিব দ্বিতীয়। শিবলিঙ্গ সাধারণত মন্দির বা গাছের নিচে বা উন্মুক্ত স্থানে পূজিত হয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় শত শত শৈবমূর্তি পাল যুগে বাংলায় তৈরি হয়েছিল। পাল-পূর্বযুগের পাথরের তৈরি শিবমূর্তি খুব একটা পাওয়া যায় না। পালবংশের অন্তত তিনজন শাসক শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন। পালযুগের পূর্বে গৌড়ের শাসক শশাঙ্ক শৈবমতাবলম্বী ছিলেন। তাঁর সময়ে জারিকৃত বিভিন্ন মুদ্রায় শিবের বাহন ষাঁড়কে দেখা যায়।
বাংলায় প্রাপ্ত শৈব মূর্তিগুলির মধ্যে উমা-মহেশ্বর, সদাশিব ও নর্ত্তেশ্বর (ভুল করে নটরাজ বলা হয়) মূর্তিরূপগুলি বিশেষভাবে পরিচিত। বাংলার প্রাপ্ত শিবমূর্তিগুলির মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে তিনি তাঁর দুই স্ত্রী গঙ্গাদেবী ও গৌরীদেবী এবং দুই পুরুষ সহচর নন্দী ও মহাকালকে নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। শিল্পকলার ঐতিহাসিকগণ শিবের বাহন বৃষকে ভুল করে নন্দী বা নন্দীন বলে থাকেন। বাংলায় প্রাপ্ত শিব মূর্তিগুলির মধ্যে বেশির ভাগ অর্ধলিঙ্গরূপে দেখা যায়। রাজশাহীর গণেশপুরে প্রাপ্ত বারো শতকে তৈরি শিবমূর্তিটি চতুর্ভুজ এবং আভঙ্গ ভঙ্গিতে ও ঊর্ধ্বলিঙ্গ অবস্থায় লক্ষ্য করা যায়। এ মূর্তিতে তাঁর সঙ্গী মহাকাল ও গঙ্গা তাঁর ডানদিকে এবং গৌরী ও নন্দী বামদিকে অবস্থিত। এ ভাস্কর্যে গঙ্গা ও গৌরীদেবীকে তাঁদের নিজস্ব বাহন ব্যতীত দেখানো হয়েছে। শিবের বাহন বৃষকে এ মূর্তির বেদিপীঠের বামদিকে দেখানো হয়েছে।
বাংলার সেন বংশের রাজারা সদাশিব নামে পরিচিত চতুর্মুখ ও দশভুজ উপবিষ্ট শিবমূর্তিকে তাঁদের রাজকীয় সীলে খোদিত করেছিলেন। তবে সেন যুগের পূর্বেই বাংলায় শিবের এই মূর্তিরূপ প্রচলিত ছিল। পালশাসক চতুর্থ গোপালের রাজত্বকালে তৈরি বাণগড়ে প্রাপ্ত একটি লিপিযুক্ত অনিন্দ্যসুন্দর সদাশিব মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এ মূর্তিতে তাঁর দশ হাতে বিভিন্ন মুদ্রা রয়েছে এবং মহাকাল ও নন্দী এবং তাঁর বাহন বৃষকে তাঁর বেদিপীঠে দেখানো হয়েছে (চিত্র-১০)।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রধানত নৃত্যরত শিবমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। লেখমালাতে এ দেবতা নর্ত্তেশ্বর নামে পরিচিত। নৃত্যরত শিবমূর্তি হয় দশ হাত নতুবা বার হাত বিশিষ্ট। উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো নৃত্যরত শিবমূর্তি পাওয়া যায়নি। নঁওগা জেলার আত্রাই থানার মনিয়ারী গ্রাম হতে লিপিযুক্ত একটি শিবমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এগারো শতকে তৈরি এ নৃতরত শিবমূর্তিতে তিনি দ্বাদশভুজ এবং তাঁর প্রধান দুহাত দিয়ে তিনি বীণা বাদনরত এবং তাঁর দুপাশে গঙ্গা ও গৌরীদেবী মূর্তি। তিনি এখানে তাঁর বাহন বৃষের উপর নৃত্যরত অবস্থায় দন্ডায়মান (চিত্র-১১)। ঢাকার আউটশাহী ও উওর বৈখাল থেকে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দুটি অনুরূপ পাথরের ভাস্কর্যে শিবকে বৃষের উপর নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। উত্তর বৈখাল থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যে গণেশ, কার্তিক এবং অন্য দুটি দেবমূর্তির সাথে একটি ষাড় উপরে লক্ষ্য করা যায়।
শিবের আরেকটি জনপ্রিয় রূপ হচ্ছে উমা-মহেশ্বর মূর্তি। এ উমা-মহেশ্বর মূর্তি ভাস্কর্যে মহেশ্বর দুই বা চার বাহু বিশিষ্ট এবং উমা দুই বাহু বিশিষ্ট। মহেশ্বরের বাহন বৃষকে তাঁর ডান পায়ের নিচে এবং উমার বাহন সিংহকে বাম পায়ের নিচে দেখানো হয়েছে। ঢাকার জোড়দেউল মন্দিরে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দশ ও এগারো শতকের তৈরি চমৎকার একটি দ্বিভুজ মহেশ্বর মূর্তি রয়েছে। এ ভাস্কর্যে মহেশ্বর তাঁর ডান হাতে একটি ছোট ফুল এবং বাম হাত দিয়ে উমার বাম স্তন ধরে রেখেছেন (চিত্র-১২)। এ ভাস্কর্যে উভয় মূর্তি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে স্থাপিত। সম্ভবত এ কুলুঙ্গিটিকে কৈলাশ পর্বতের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ মূর্তির চালচিত্রের উপরের মধ্যভাগে ধ্যানরত শিবমূর্তিকে তাঁর বাহন বৃষ ও অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে দেখানো হয়েছে। এছাড়া তাঁর ডান দিকে সর্প প্যাঁচানো একটি ত্রিশূল লক্ষ্য করা যায়।
ঢাকা জেলার শংকরবন্ধ থেকে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বারো শতকের একটি মূর্তিতে শিব-পার্বতী বিবাহচিত্রকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ধরনের মূর্তি উত্তরভারতে কল্যাণসুন্দর-মূর্তি নামে বহুল পরিচিত। এ ভাস্কর্যে (শিব ও পার্বতী) বর ও কনের ভাস্কর্য ছাড়াও মূর্তির পিছনের প্লেটে অন্যান্য মূর্তিকে দেখানো হয়েছে। সম্ভবত ধ্যানমগ্ন শিবের একটি মূর্তি এ ভাস্কর্যের চালচিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে এখানে শিবের বাহন বৃষ ও সিংহকেও দেখানো হয়েছে।
ঢাকা জেলার পুড়পাড়া থেকে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত শিব-পার্বতীর একটি মনোমুগ্ধকর মূর্তিতে শিব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর রূপকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ মূর্তির প্রতিমা লক্ষণ হলো মূর্তিটির অর্ধেক অংশ শিব ও বাকি অর্ধেক পার্বতী। বাংলায় প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে গঠনকৌশলের দিক থেকে এটি একটি মনোমুগ্ধকর মূর্তি এবং নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এটি বারো শতকের মূর্তি বলে স্থির করা যায় (চিত্র-১৩)।
এছাড়া শিবের শান্তসৌম্য রূপ ব্যতীত তাঁর উগ্ররূপ যেমন ভৈরব, বটুক-ভৈরব, অঘোর ইত্যাদি রূপের বিভিন্ন ভাস্কর্য বাংলার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গিয়েছে। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মাতৃকাদেবী দ্বারা বেষ্টিত নৃত্যরত দশভুজ ভৈরবমূর্তিটি একটি অদ্বিতীয় ভাস্কর্য। রাজশাহীর দেউল-তালন্দা থেকে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত দ্বাদশভুজ ভগ্ন শিবের অন্ধকাসূরবধ-মূর্তি শিল্পসৌন্দর্যের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ মূর্তিতে শিবের অন্ধকাসূরবধ-মূর্তি অবতারকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ভাস্কর্যে একদিকে শিব যেমন হস্তীকে বিদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে তিনি ত্রিশূল দ্বারা অপদেবতা অন্ধককে বিদ্ধ করেছেন। এটি এগারো শতকে নির্মিত।
সূর্য গুরুত্বের দিক থেকে বাংলায় দেবমূর্তিগুলির মধ্যে সূর্যমূর্তির স্থান তৃতীয়। এদেশে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তিগুলির মধ্যে বেশির ভাগই স্বতন্ত্র মূর্তি হিসেবে দেখা যায়; তবে কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁকে নবগ্রহের সঙ্গেও দেখা যায়। বিষ্ণুমূর্তির মতো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তিগুলি উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তিগুলি থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। বগুড়া জেলায় প্রাপ্ত এবং মহাস্থান জাদুঘরে রক্ষিত পোড়ামাটির ভগ্ন একটি প্রাচীন সূর্যমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ভাস্কর্যে তিনি একটি পাতলা কাপড় পরিধান করেছেন এবং উঁচু পাদুকা তাঁর পদযুগলে রয়েছে, অন্যদিকে তাঁর কোমরে একটি তরবারি বাঁধা লক্ষ্য করা যায়। এ মূর্তিটি গুপ্তযুগে নির্মিত হয়েছিল। তিনি সমপদস্থানক ভঙ্গীতে সপ্তঘোড়াবাহিত রথের উপর দন্ডায়মান এবং দুহাতের মৃণালে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল রয়েছে। প্রতিমার মাথায় লম্বা কিরীট, কানে দুল, কণ্ঠদেশে মণিহার, হাতে বালা, বাজুবন্ধ এবং বুকে উপবিত ও বর্ম ধারণ করেছেন এবং তাঁর পদযুগল উঁচু পাদুকা দ্বারা আবৃত। তবে প্রাচীন সূর্য মূর্তিগুলিতে তাঁকে সাশানিয়ানদের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। বৃহৎসংহিতা থেকে সূর্যের প্রাথমিক রূপটি জানা যায়; তবে এখানে তাঁর পাদুকার উল্লেখ নেই। এছাড়া পুরাণাদিতেও এ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
বগুড়ার দেওরায় ছয়-সাত শতকের একটি মনোমুগ্ধকর সূর্যমূর্তি পাওয়া গিয়েছে এবং বর্তমানে এটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে রক্ষিত। এখানে প্রতিমা সপ্তাশ (সাতটি ঘোড়া) চালিত রথের উপর দন্ডায়মান। তাঁর উভয় হাতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল, ডানে পার্শ্ব দেবতা পিঙ্গল ও বামে দন্ডিন। রথচালক রাহুর পাশে শরনিক্ষেপরতা অবস্থায় নারীদেবী উষা ও প্রত্যুষা রয়েছেন। দিনাজপুরের মাহীসন্তোষে প্রাপ্ত ও কলকাতার সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রক্ষিত একটি সূর্যমূর্তি মূর্তিতত্ত্বের দিক থেকে খুবই মনোমুগ্ধকর। এ মূর্তিটির উপরের অংশ ধ্বংস প্রাপ্ত এবং এটি পাল শাসক মহেন্দ্রপালের (নয় শতক) পনেরো রাজ্যাঙ্কে নির্মিত।
পরবর্তীযুগে নির্মিত সূর্য প্রতিমাকে মহাশ্বেতা বা কখনও কখনও অষ্টগ্রহ সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু ছাড়াও তাঁর দুই স্ত্রী, রাজ্ঞী ও নিক্ষুভার সাথে দেখা যায়। বগুড়ার গোপিনাথপুরে প্রাপ্ত এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত সূর্য মূর্তিতে উপর্যুক্ত মূর্তি লক্ষণগুলি দেখা যায় (চিত্র-১৪)। কোন কোন সময় সূর্যকে তাঁর চার পাশে একাদশ বা দ্বাদশ আদিত্য মূর্তি দ্বারা পরিবৃত অবস্থায় দেখা যায়। পশ্চিম দিনাজপুরের বৈর্হট্টে প্রাপ্ত উপবিষ্ট ও লিপিযুক্ত একটি সূর্যমূর্তি খুবই সৌন্দর্যমন্ডিত। এটি এখন কলকাতা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। সূর্য মূর্তিগুলির মধ্যে খুবই জনপ্রিয় দেবতা হলো অষ্টগ্রহের সাথে যুক্ত সূর্যমূর্তি। এসব ভাস্কর্যে গণেশকে এ গ্রহগুলির সঙ্গে দেখান হয়েছে। এছাড়া কিছু ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে যা রেবন্তমূর্তি (সূর্যের পুত্র) নামে পরিচিত। এ ভাস্কর্যগুলিতে রেবন্তকে চলন্ত ঘোড়ার উপর এবং তাঁর সঙ্গে কুকুরকেও দেখানো হয়েছে।
পাহাড়পুরএ দিকপাল মুদ্রাযুক্ত কিছু কিছু পাথরের ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। এগুলির মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি ও বায়ু দেবতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিচিছন্নভাবে কিছু অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো গরুড়-ধ্বজ নামে পরিচিত।
দেবী প্রতিমা দেবী প্রতিমার মধ্যে দুর্গা, গৌরী বা পার্বতীর বিভিন্ন রূপ ছাড়াও আরও কিছু দেবীমূর্তি বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।মনসা বা সর্পদেবীপ্রতিমা একটি পরিচিত দেবীপ্রতিমা। সংস্কৃত গ্রন্থ প্রতিষ্ঠালক্ষণ-সারসমুছ্ছ এবং উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত ও জার্মানির লিন্ডেন জাদুঘরে রক্ষিত লিপিযুক্ত একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি অনুসারে সর্পদেবী স্বঙ্গাই বা সুঙ্গাই-ভট্টারিকা নামে পরিচিত। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সর্বপ্রথম এই দেবীকে মনসাদেবী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলায় প্রাপ্ত সকল সর্পদেবীর ভাস্কর্য এগারো ও বারো শতকে তৈরি হয়েছিল। তাঁর দুই হাত ললিতাসানে উপবিষ্ট, ডান পা জানুদেশে ন্যস্ত, বাম পা পদ্মের উপরে স্পর্শ করে আছে। তাঁর ডান হাতে একটি ফল এবং বাম হাতে হয় একটি শিশু নতুবা সর্প রয়েছে এবং মাথার উপরে পূর্ণফণা বিস্তার করে আছে সপ্তবাসুকি এবং সর্পসহ একটি পাত্র বিদ্যমান তাঁর ডান পায়ের পাদপীঠের উপরে। তাঁর ডান দিকে জটাধারী একজন তপস্বী এবং বাম দিকে সর্পফণাযুক্ত একটি পুরুষ মূর্তিকে দেখানো হয়েছে। সম্ভবত উপর্যুক্ত মূর্তি দুটির একটি তাঁর স্বামী জরতকারু এবং অন্যটি তাঁর ভাই বাসুকি। সর্পফণাযুক্ত শিশু মূর্তিটি সম্ভবত তাঁর পুত্র আস্তিক।
এক হাতে সর্প এবং অষ্টসর্প পরিবেষ্টিত একটি চমৎকার মনসা প্রতিমা নওগাঁ জেলার বাদল থেকে পাওয়া গিয়েছে এবং এটি বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত। এ ভাস্কর্যের উপরে একটি শিবলিঙ্গকে দেখানো হয়েছে। কোন কোন সময়ে সর্পদেবীকে চতুর্ভুজা অবস্থায় দেখা যায়। এ চতুর্ভুজা দেবী-প্রতিমার একটি প্রকৃত নমুনা হচ্ছে এগারো শতকে নির্মিত এবং বগুড়ার ক্ষীদ্রপল্লীতে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র যাদুঘরে রক্ষিত মনসা দেবীর ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যটি আংশিক ভগ্ন এবং এটি বদ্ধ পদ্মাসনে একটি প্রকান্ড পদ্মের উপর উপবিষ্ট। তাঁর ডান দিকে নিচের হাতে একটি অক্ষমালা, উপরের হাতে একটি সর্প এবং বাম দিকের উপরের হাতে জলপাত্র ও নিচের হাতে পুস্তক রয়েছে। তাঁর পাদপীঠের একদিকে অঞ্জলিমুদ্রায় দশজন নাগিনী এবং অন্যদিকে চারজন নাগিনীকে দেখানো হয়েছে। একটি মনসাঘট পাদপীঠের নিচে এবং মাথার উপরে একটি শিবলিঙ্গ এ ভাস্কর্যে দেখানো হয়েছে (চিত্র-১৫)। মালদহ জাদুঘরে রক্ষিত আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত একটি মনসামূর্তিতে দেবী-প্রতিমার ডান পায়ের নিচে একটি হাতিকে দেখানো হয়েছে।
শিশু শিবের সাথে গৌরী বাংলায় এক বিশেষ ধরনের ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে যেখানে একটি দেবীমূর্তি অলংকারভূষিত হয়ে পিছনের দিকে হেলান দিয়ে বিশ্রামরত অবস্থায় আছেন। এ ভাস্কর্যে দেবী তাঁর বাম হাতের উপর মাথা হেলানরত অবস্থায় কুলুঙ্গির ভিতর বিশ্রামরত। তাঁর ডান হাতে রয়েছে উৎপল এবং একটি ছোট শিশু তাঁর বক্ষোদেশের সামনে শুয়ে আছে। একজন পার্শ্বদেবী তাঁর বাম পা মর্দনরত ও অপর দুজন পার্শ্বদেবী তাঁর দুপাশে দন্ডায়মান। এছাড়া শিবলিঙ্গ, গণেশ, কার্তিক এবং অন্য নবগ্রহ দেবমূর্তি তাঁর উপরে লক্ষ্য করা যায়। ধর্মীয় কাজে ব্যবহূত দ্রব্যাদি ভাস্কর্যটির নিচে দেখানো হয়েছে। কোন কোন সময় এ ধরনের ভাস্কর্য কোন শ্রেণির দেবীপ্রতিমা চিহ্নিত করে তা নির্দিষ্টকরণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। ভট্টশালীই প্রথম ব্যক্তি যিনি শিব-পার্বতীর বৈবাহিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এ ধরনের দেবী ভাস্কর্যকে গৌরী ও শিশু শিব বলে আখ্যায়িত করেছেন। বগুড়া জেলার ক্ষেতলাল থানার কোশাম-সাহারে এ ধরনের শিলালিপিযুক্ত একটি ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। ভাস্কর্যটিতে খোদিত লিপি থেকে প্রমাণিত হয়েছে এটি পাল শাসক তৃতীয় বিগ্রহ পালের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল এবং এ ভাস্কর্যটি গৌরী মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত (চিত্র-১৬)।
পার্বতী বাংলায় প্রাপ্ত অন্য ধরনের পার্বতী দেবীপ্রতিমা বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। চতুর্ভুজ দেবীমূর্তি যথাক্রমে ফল, কাজলতারা, আয়না ও কার্তিকের মাথা স্পর্শ করে আছেন। তিনি সপদস্থানক ভঙ্গিতে পদ্মের উপর গোধাসহ দন্ডায়মান। ভট্টশালী ও অন্যান্য পন্ডিতগণ এ ভাস্কর্যকে গৌরী বলে অভিহিত করেছেন। তবে অগ্নিপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী মলম্যান একে ললিতা মূর্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন (চিত্র-১৭)।
দেবী পার্বতীর আরও দুধরনের রূপ রয়েছে, যথা: তাঁর তপস্বী বা যোগিরূপ এবং বরবধূরূপ। উভয় রূপেই তিনি হাতে যথাক্রমে বরদ-মূদ্রা, অক্ষমালা, এিদন্ড ও কমন্ডলু ধারণ করেছেন। উভয় রূপেই তাঁর বাহন গাধা। এছাড়া কদলীবৃক্ষ, সিংহ ও মৃগকেও তাঁর সাথে দেখা যায়। বাংলায় পার্বতীদেবীর বিভিন্ন রূপের ভাস্কর্য দেখা যায়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার মন্ডাইলে প্রাপ্ত এবং বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি বৃহদাকার অনন্যসুন্দর ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। এ ভাস্কর্যের মূর্তি লক্ষণগুলি হলো: দেবী তাঁর বাহন ব্যতীত আর্বিভূত এবং তাঁর চারহাতে যথাক্রমে বরদ-মুদ্রা, অক্ষমালা, ত্রিদন্ড ও কমন্ডলু (চিত্র-১৮)। তাঁর ডান পাশে কদলীবৃক্ষ ও কার্তিক মূর্তি এবং বাম পাশে মৃগ ও গণেশ মূর্তি রয়েছে। একটি শিবলিঙ্গ দেবীর মাথার উপরে খোদিত। ভাস্কর্যটি এগারো শতকে নির্মিত।
দুর্গা চতুর্ভুজা বা বহুভুজা দুর্গা প্রতিমা সিংহের উপর দন্ডায়মান বা উপবিষ্ট অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপ বাংলায় বহুল পরিচিত। বাংলায় প্রাপ্ত দশ ও এগারো শতকে নির্মিত বেশির ভাগ দুর্গা প্রতিমা অষ্টভুজা। তবে দশভুজা দুর্গামূর্তি বাংলায় পরবর্তীকালে আবির্ভূত হয়েছে। পশ্চিমবাংলার মালদহ জাদুঘরে কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর ভাস্কর্য রক্ষিত আছে।
নওগাঁর পোরশা থেকে প্রাপ্ত মহিষাসুরমর্দিনীর একটি চমৎকার ভাস্কর্য বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত। দুর্গার এ রূপ নবদুর্গা নামে পরিচিত। এ ভাস্কর্যে কেন্দ্রীয় প্রতিমার চারদিকে আরও আঠারো হস্তযুক্ত আটটি দেবী-প্রতিমাকে দেখা যায় (চিত্র-১৯)। তবে এ ভাস্কর্যের কেন্দ্রীয় দেবী প্রতিমার মাথা ধ্বংস প্রাপ্ত এবং শিল্পশৈলীর দিক থেকে এটি বারো শতকে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
মাতৃকা রাজশাহী জেলার গোদাগারী থানার জগপুর গ্রামে প্রাপ্ত এবং বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত মাতৃদেবীর ভাস্কর্যটি একটি দুর্লভ নমুনা। এ ভাস্কর্যে চতুর্ভুজা দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির চারপাশে আরও আটটি দেবীপ্রতিমা রয়েছে (চিত্র-২০)। এছাড়া মাতৃকা দেবীর মধ্যে তাঁর বরাহী রূপ খুবই জনপ্রিয়। পিচলীতে প্রাপ্ত ও মালদহ জাদুঘরে একটি কারুকার্য খচিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত আনুমানিক দশ শতকের বরাহী দেবীপ্রতিমা রয়েছে। এ ভাস্কর্যে দেবীপ্রতিমা সুখাসন ভঙ্গিতে পদ্মের উপর উপবিষ্ট এবং তাঁর বাহনকে উড়ন্ত অবস্থায় দেখা যায়। তিনি চার হাতে যথাক্রমে মৎস্য, তরবারি, বর্ম ও জলপাত্র ধারণ করে আছেন।
তবে তান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী বাংলায় এ দেবীপ্রতিমা চামুন্ডা বা চর্চিকা নামে বহুল পরিচিত। উপবিষ্ট বা নৃত্যরত অবস্থার অনেকগুলি ভাস্কর্য বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে পাওয়া গিয়েছে। তবে রামপালে প্রাপ্ত ও জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ভাস্কর্যটি শিল্পশৈলীর দিক থেকে খুবই উন্নত ধরনের (চিত্র-২১)। দ্বাদশভুজা এ দেবীপ্রতিমা হস্তিচর্মসহ বিভিন্ন মুদ্রা ধারণ করেছেন এবং তিনি তাঁর চারদিকে দুহাতযুক্ত নৃত্যরত মূর্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ মূর্তিটি বারো শতকে নির্মিত হয়েছিল। কোন কোন সময় চামুন্ডাকে প্রেতের উপরে এবং বটবৃক্ষের নিচে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। এ ধরনের একটি ভাস্কর্য রাজশাহীর তানোর থানার ডুবাইল থেকে পাওয়া গিয়েছে। এখানে প্রতিমাটি একটি চলন্ত গাধার উপর উপবিষ্ট। প্রতিমাটি তাঁর চার হাতে যথাক্রমে সর্প, তরবারি, বর্ম এবং মাথার খুলি ধারণ করেছেন এবং নির্মাণশৈলীর দিক থেকে ধারণা করা হয়, এটি এগারো শতকে তৈরি করা হয়েছিল। সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে কুমিল্লার মোহাম্মদপুরে প্রাপ্ত ও ভারতীয় সংগ্রহ শালায় রক্ষিত পার্বতী প্রতিমা ভাস্কর্যটি একটি চমৎকার উদাহরণ। এখানে দেবীপ্রতিমার মাথার উপরে গণেশ, ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু এবং কার্তিক দেব-প্রতিমাকে দেবীর পিছনের চালিতে দেখানো হয়েছে।
বাংলায় এ যাবৎ প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির মধ্যে বিক্রমপুরের কাগজীপাড়াতে প্রাপ্ত ভাস্কর্যটি খুব অলংকরণযুক্ত ও সৌন্দর্যমন্ডিত, যেটি মহামায়া নামে পরিচিত এবং এ ভাস্কর্যটি সেন যুগে নির্মিত ভাস্কর্যগুলির মধ্যে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ (চিত্র-২২)। এ ভাস্কর্যে চতুর্ভুজা দেবী একটি বড় শিব লিঙ্গের উপরে সামনের দুটি হস্ত ধ্যান-মুদ্রাসহ দন্ডায়মান। তিনি তাঁর উপরের ডান হাতে অক্ষমালা এবং উপরের বাম হাতে পুস্তক ধরে রেখেছেন। এই প্রতিমাটির মূর্তিলক্ষণগুলিকে বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ডি.সি ভট্টাচার্য একে অপীতাকুচা মূর্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অন্যান্য দেবীপ্রতিমার ভাস্কর্যগুলির মধ্যে সরস্বতী (মেষের উপর উপবিষ্ট), লক্ষ্মী (স্নানরত দুই হাতির উপর উপবিষ্ট যাঁকে গজলক্ষ্মী বলে অভিহিত করা হয়েছে), ষষ্ঠী, বাগীশ্বরী এবং গঙ্গা দেবীপ্রতিমা উল্লেখযোগ্য। দেওপাড়ায় প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি বৃহদাকৃতি পাথরের তৈরি চমৎকার গঙ্গা ভাস্কর্য কাগজীপাড়াতে প্রাপ্ত দেবীপ্রতিমার সঙ্গে তুলনীয়। এ মূর্তিটি একই সময়ে প্রস্তুত হয়েছিল (চিত্র-২৩)। মকরের উপর দন্ডায়মান একটি অনিন্দ্যসুন্দর গঙ্গাদেবী ভাস্কর্য দিনাজপুর জেলার ভদ্রশীলাতে পাওয়া গিয়েছে।
বৌদ্ধ মূর্তি যদিও গৌতম বুদ্ধ বাংলায় আসেননি, তথাপি কয়েক শতাব্দী ধরে বৌদ্ধধর্ম বাংলায় বিকাশলাভ করেছিল। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যতগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় প্রাচীনতম। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য যুগে এ অঞ্চলটি পুডনগল (পুন্ড্রনগর) বলে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে মহাস্থানগড়ের ভূগর্ভে প্রোথিত। পুন্ড্রনগরের পরে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর মহাবিহার। এছাড়া এ ধর্মের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে প্রাচীন সমতট অঞ্চল (আধুনিক কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলা) উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী সেং-চি তাঁর বর্ণনায় এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি দেখে বলেছেন, একসময় অঞ্চলটি বৌদ্ধ সভ্যতার সমৃদ্ধ কেন্দ্র ছিল। সমতটের রাজধানী দেবপর্বত ছিল আধুনিকলালমাই–ময়নামতী অঞ্চলে। সাম্প্রতিককালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ময়নামতীতে প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ ভাস্কর্য ও তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে।
বুদ্ধ বাংলায় এ যাবৎ প্রাপ্ত বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলির মধ্যে লাল বেলে পাথরে তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি রূপবান মুড়াতে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে ময়নামতী জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ মূর্তির প্রতিমালক্ষণগুলি হলো, তিনি সমপাদস্থানিক ভঙ্গিতে একটি পদ্মের উপর দন্ডায়মান এবং ডান হাতে অভয়-মুদ্রা ও বাম হাতে চাদরের একাংশ ধারণ করে আছেন (চিত্র-২৪)। এ মূর্তিটি ২.৪৪ মিটার লম্বা এবং খ্রিস্টীয় সাত শতকে নির্মিত হয়েছিল। তবে প্রাচীনতম বুদ্ধমূর্তিগুলি খ্রিস্টীয় পাঁচ শতকে তৈরি করা হয়েছিল। বাংলায় প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে রাজশাহী জেলার বিহারৈলে প্রাপ্ত চুনারের লাল বেলেপাথরের ১০৭ সেমি মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। এ মূর্তির প্রতিমালক্ষণ হচ্ছে, এটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দন্ডায়মান এবং হাতে অভয়-মুদ্রা রয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ এ বুদ্ধ ভাস্কর্যটি বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া ভাসুবিহারে প্রাপ্ত ও মহাস্থান জাদুঘরে সংরক্ষিত খ্রিস্টীয় ছয় শতকের আরেকটি বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এ মূর্তিটিও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দন্ডায়মান এবং হাতে বরদ-মুদ্রা রয়েছে।
পাহাড়পুর মহাবিহারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ একটি বৃহদাকৃতির ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি ছাড়া পাথরের তৈরি কোন বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় মন্দিরে ডান হাতে বরদ-মুদ্রা ও বাম হাতে প্রস্ফুটিত পদ্মসহ একটি অবলোকিতেশ্বর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। মূর্তিটির মস্তকের পিছনে পদ্মাকৃতি নকশাখচিত, যার চারদিকে গুটিকা দ্বারা আবৃত। অবলোকিতেশ্বরের ডান পাশে তারামূর্তি (মুখমন্ডল ক্ষতিগ্রস্থ) এবং বাম পাশে হয়গ্রীবমূর্তি রয়েছে। ডিম্বাকৃতির প্রভামন্ডলের পরিবর্তে প্রত্যেকটি মূর্তি একটি করে পদ্মের উপর দন্ডায়মান।
পাল যুগের বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে বোঁচাগঞ্জের (দিনাজপুর জেলা, বাংলাদেশ) সতিমনডাঙ্গি হতে সংগৃহীত কালো পাথরের তৈরি মূর্তিটি (১২২ × ৮৪) সেমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনুমানিক খ্রিস্টীয় নয় শতকে তৈরি ও শিল্প সৌন্দর্যের দিক থেকে অতি মূল্যবান এ মূর্তিটির বেশির ভাগ অঙ্গ-প্রতঙ্গই ভগ্ন (চিত্র-২৫)। এ মূর্তিতে বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ-মুদ্রায় সিংহাসনের (পদ্ম ছাড়া) উপর উপবিষ্ট। সিংহাসনের পেছনে স্তম্ভের মাঝে তিনটি সিংহমূর্তি খোদিত। মূর্তিটির মূখমন্ডলে শান্তসৌম্য রূপ বাংলার মূর্তিশিল্পে এক উল্লেখযোগ্য অবদান।
ফরিদপুর জেলার উজানী গ্রামে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত খ্রিস্টীয় দশ শতকের কালো পাথরের তৈরি বুদ্ধমূর্তিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। বুদ্ধ এখানে ভূমিস্পর্শ-মুদ্রায় সিংহাসনে জোড়া-পদ্মের উপর উপবিষ্ট। ভাস্কর্যটির মাথার উপরে রয়েছে বোধিবৃক্ষের তিনটি শাখা। বোধিবৃক্ষের দুপাশে রয়েছে দুটি বিদ্যাধর। এ ভাস্কর্যটির গুরুত্ব এখানে যে, বেদীর সামনে বিশ্ববজ্রের পাশে নৈবেদ্য (পূজার উপকরণ) ও অর্চনাকারিসহ রাজচক্রবর্তীনের সপ্তরত্ন উৎকীর্ণ করা হয়েছে (চিত্র-২৬)। সমাধি-মুদ্রায় উপবিষ্ট বুদ্ধের আরেকটি বিশাল মূর্তি (হাত ভাঙা) উজানী গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশ শতকে নির্মিত কালো পাথরের এ মূর্তিটি ত্রিপত্রাকৃতি খিলানের নিচে উপবিষ্ট এবং এর খিলানের উপরে দুপাশে বিদ্যাধর এবং পূজারীসহ মন্দিরের শিখর (মহাবোধি) দেখানো হয়েছে।
খ্রিস্টীয় দশ শতকে নির্মিত বুদ্ধের একটি প্রমাণ সাইজ মূর্তি কুমিল্লার ময়নামতী অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। এ ভাস্কর্যে বুদ্ধ ভদ্রাসনে উপবিষ্ট এবং ধর্মচক্র-মুদ্রায় দৃশ্যমান। এ ভাস্কর্যটি শিল্পশৈলীর দিক থেকে আরাকান ও বার্মায় প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ ভাস্কর্যে বুদ্ধকে শিখর রীতির (বোধগয়ার মহাবোধি) মন্দির অভ্যন্তরে আসীন দেখান হয়েছে। উপরে একটি ছোট অমোঘসিদ্ধি মূর্তি খোদিত। এছাড়া চারটি পুরুষ মূর্তি তাঁর চারদিকে উপবিষ্ট। পাদপীঠের নিচে সারনাথের প্রতীক, সিংহ মূর্তি এবং পূজারীকে দেখানো হয়েছে। যদিও মূর্তিতত্ত্বের দিক থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম, কিন্তু বর্তমানে এ ভাস্কর্যটির কোন হদিস নেই।
বাংলায় প্রাপ্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য থেকে বৌদ্ধ ভাস্কর্যের উন্নতির চরম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাগেরহাটের শিববাটিতে প্রাপ্ত ও বর্তমানে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত একটি বুদ্ধমূর্তি এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীতে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বেতাগীর রত্নাঙ্কুর বিহারে সংরক্ষিত অপর একটি মূর্তি। বেতাগীতে প্রাপ্ত ভাস্কর্যটিতে বুদ্ধকে যথাক্রমে তাঁর ডানে মৈত্রেয় এবং বামে অবলোকিতেশ্বর মূর্তিসহ খোদাই করা হয়েছে। ভাস্কর্যে মূল বুদ্ধমূর্তিটি বোধগয়াস্থ মহাবোধি মন্দির অভ্যন্তরে ভূমিস্পর্শ-মূদ্রায় উপবিষ্ট অবস্থায় দৃশ্যমান (চিত্র-২৭)। উভয় মূর্তিই বারো-তেরো শতকে নির্মিত বলে মনে হয়।
মহাযান বৌদ্ধ ধর্মমতে এবং পরবর্তীকালে বজ্রযান অথবা তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধর্মমতে পঞ্চবুদ্ধের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এ পঞ্চবুদ্ধ হলেন অমিতাভ, অক্ষোভ্য, অমোঘসিদ্ধি, রত্নসম্ভব এবং বৈরোচন। এঁদের প্রত্যেকের আবার রয়েছে অনেক পুরুষ ও নারী বোধিসত্ত্ব। প্রত্যেক মহাজাগতিক বুদ্ধ (ভুলবশত ও জনপ্রিয়ভাবে বলা হয় ধ্যানী-বুদ্ধ) এক একটি পরিবারের (কুলের) প্রধান। শাক্যমুণি যিনি পরম বুদ্ধ ছিলেন, বজ্রযান অথবা তন্ত্রযান বৌদ্ধধর্মমতে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং পাঁচ মহাজাগতিক বুদ্ধের একজন অক্ষোভ্য বুদ্ধের অধীনস্থ হন। পরবর্তীকালে বাংলায় প্রাপ্ত বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলিতে তাঁকে মহাজাগতিক বুদ্ধ বোধিসত্ত্বের অধীনে দেখানো হয়েছে। তুলনামূলক উদাহরণ হিসেবে নওগাঁ জেলার অন্তর্গত মান্দা-র থানার কিরতৈল থেকে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ শাক্যমুনিকে অন্যান্য বোধিসত্ত্বের সঙ্গে দেখানো হয়েছে। এখানে পাঁচ মহাজাগতিক বুদ্ধকে দেখানো হয়েছে উপরে, অক্ষোভ্যকে মাঝখানে বসানো হয়েছে। এতে মনে হয় অক্ষোভ্য হলেন শাক্যমুনির পূর্বসুরি। এ ভাস্কর্যটি খ্রিস্টীয় এগারো শতকের (চিত্র-২৮)।
দিনাজপুর থেকে অনুরূপ আর একটি বিশাল দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি, সম্ভবত অভয়-মুদ্রায়, পাওয়া গেছে। এটি বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত। আনুমানিক বারো শতকে নির্মিত এ ভাস্কর্যে অক্ষোভ্যকে পঞ্চবোধিসত্ত্বের মাঝখানে দেখা যায়। এছাড়া মুন্সিগঞ্জ জেলার বেতকা থেকে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি বৌদ্ধ ভাস্কর্যে অক্ষোভ্যকে পঞ্চবোধিসত্ত্বের মাঝখানে ভূমিস্পর্শ-মুদ্রায় উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এ ভাস্কর্যটি আনুমানিক এগারো শতকে নির্মিত (চিত্র-২৯)।
মহাজাগতিক বা পঞ্চবোধিসত্ত্ব বাংলায় পৃথকভাবে পূজিত হতেন। মান্দা-র (নওগাঁ জেলা) ভারসন থেকে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত মস্তকবিহীন কালোপাথরে খোদিত ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্যের এ অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্যটি পঞ্চবোধিসত্ত্ব ভাস্কর্যের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি খ্রিস্টীয় বারো শতকে তৈরি করা হয়েছিল। পঞ্চতন্ত্রবোধিসত্ত্ব ভাস্কর্যের আরেকটি বুদ্ধ রত্নসম্ভব মূর্তি বিক্রমপুর থেকে পাওয়া গিয়েছে এবং তা বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত। এখানে মূল বুদ্ধমূর্তিটি মহাবোধি মন্দিরের অনুকৃতির নিচে একটি কুলুঙ্গির মধ্যে উপবিষ্ট এবং ডান হাতে রত্ন ও তাঁর উষ্ণীষে আর একটি রত্ন রয়েছে। এছাড়া এ ভাস্কর্যটির বেদীতে আরও সাতটি রত্ন খোদিত রয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দর এ ভাস্কর্যটি খ্রিস্টীয় এগারো শতকে নির্মিত (চিত্র-৩০)।
অবলোকিতেশ্বর পাল-চন্দ্র যুগে বাংলায় বুদ্ধ ভাস্কর্য ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাস্কর্য তৈরি হয়। বাংলার ভাস্করগণ বৌদ্ধ ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রে বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্বের বিখ্যাত গ্রন্থ সাধনমালা দ্বারা প্রভাবিত হন। বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলির মধ্যে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর মূর্তি নিঃসন্দেহে বাংলায় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ভাস্কর্যে বুদ্ধকে পদ্মফুলের উপর হয় উপবিষ্ট, না হয় দন্ডায়মান অবস্থায় এবং দুই, চার, ছয় বা বারো বাহু বিশিষ্ট দেখানো হয়েছে। জনপ্রিয় দুই বাহু বিশিষ্ট বুদ্ধ মূর্তির ডান হাতে বরদ-মুদ্রা এবং বাম হাতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল থাকত। এ মূর্তিটিতে বুদ্ধকে জটামুকুট, উপবিত এবং অন্যান্য অলংকরণ পরিধান করতে দেখা যায়। উপবিষ্ট ভঙ্গিতে মূর্তিটি ললিতাসনে উপবিষ্ট এবং দন্ডায়মানকালে আভঙ্গ ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। বৌদ্ধতান্ত্রিক গ্রন্থসাধনমালায় বুদ্ধের বিভিন্ন রূপের পরিচয় পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে লোকনাথ, লোকেশ্বর ইত্যাদি নাম দেখা যায়। এগুলির মধ্যে খসর্পণ-লোকেশ্বর মূর্তিরূপ খুবই পরিচিত। এই মূর্তিরূপে লোকেশ্বরকে দেবী তারা, সুধনকুমার ও ভৃকূটী এবং হয়গ্রীবের সঙ্গে দেখা যায়। কখনও কখনও বুদ্ধের নিচে সূচীমুখ প্রেতকে ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায় দেখা যায়। মুন্সিগঞ্জ জেলার মূলচার গ্রামে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আনুমানিক এগারো শতকের উপরোক্ত ধরনের একটি অনিন্দ্যসুন্দর লোকেশ্বর ভাস্কর্য রয়েছে (চিত্র-৩১)। এ ভাস্কর্যে পঞ্চবোধিসত্ত্ব বুদ্ধ অমিতাভকে (যার পরিবারে অবলোকিতেশ্বর অন্তর্ভুক্ত) দুবার দেখানো হয়েছে- একবার বোধিসত্ত্বের জটামুকুটে এবং আরেকবার উপরে পঞ্চবোধিসত্ত্বের মাঝে। এ মূর্তির অনুরূপ একটি বোধিসত্ত্ব লোকেশ্বর মূর্তি মুন্সিগঞ্জ জেলার সোনারং গ্রামে পাওয়া গিয়েছে এবং তা বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত।
আনুমানিক নয় শতকের তৈরি একটি অনিন্দ্যসুন্দর ছয় হাত বিশিষ্ট সুগতি-সন্দর্শন-লোকেশ্বর ভাস্কর্য বগুড়ার নামুজা গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে মহাস্থানগড় জাদুঘরে সংরক্ষিত। এ ভাস্কর্যে লোকেশ্বরের ডান তিন হাতে বরদ-মুদ্রা, রত্ন ও অক্ষমালা রয়েছে এবং বাম তিন হাতে রয়েছে ত্রিদন্ড, পদ্ম ও কলস। তার সঙ্গে আছে তারা, ভৃকূটী ও হয়গ্রীব। এছাড়া প্রেত সূচীমুখকেও এ ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে (চিত্র-৩২)।
ষড়ক্ষড়ী-লোকেশ্বর মূর্তি অবলোকিতেশ্বর মূর্তির একটি বিশেষ রূপযিনি অবলোকিতেশ্বর-ধারণী নামে উত্তর বঙ্গে ওঁ-মনি-পদ্মে-হুঁ মন্ত্রে পূজিত হয়ে আসছেন। এগারো ও বারো শতকে নির্মিত একটি ষড়ক্ষড়ী-লোকেশ্বরের অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য আংশিক ভগ্ন অবস্থায় নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর হতে সংগৃহীত হয়েছে এবং বর্তমানে তা বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত (চিত্র-৩৩)। মূর্তিটি চতুর্ভুজি এবং সামনের হাত দুটি অঞ্জলি বা নমস্কার মুদ্রায় বুকের উপরে রাখা এবং পিছনের হাত দুটিতে যথাক্রমে অক্ষমালা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। মূর্তির ডান দিকে মণিধর এবং বাম দিকে ষড়ক্ষড়ী মহাবিদ্যা দেবী উপবিষ্ট। মাথার উপরে পঞ্চবোধিসত্ত্বের মাঝে অমিতাভকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর মূর্তির আরেকটি ভাস্কর্য মালদা জেলার হাবিবপুরে পাওয়া গিয়েছে এবং বর্তমানে তা মালদা জাদুঘরে সংরক্ষিত। এ ভাস্কর্যটিও বারো শতকে নির্মিত।
খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, সিংহের উপরে উপবিষ্ট সিংহনাদ-লোকেশ্বর নামে অভিহিত অবলোকিতেশ্বরের আরেকটি মূর্তিরূপ পাল যুগে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু এ ধরনের কোন ভাস্কর্য বাংলায় পাওয়া যায়নি। তবে অনুরূপ মূর্তি, যেমন সিংহের উপর উপবিষ্ট মঞ্জুশ্রী মূর্তি, যিনি মঞ্জুবর নামে বাংলায় পরিচিত, বাংলায় পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ কার যায়, যেমন- গোদাগাড়ির তেলাইতে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য, নওগাঁর নিয়ামতপুরে প্রাপ্ত ও জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত কুসুম্বাহন ভাস্কর্য, রাজশাহীর পত্নীতলার মহেশপুরে প্রাপ্ত ও জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্য, নওগা জেলার নিয়ামতপুরে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত ক্ষতিগ্রস্ত আরেকটি ভাস্কর্য এবং কুমিল্লার মতলবের সাচারে প্রাপ্ত ও ময়নামতী জাদুঘরে রক্ষিত ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তি। মূর্তিতে বুদ্ধ গর্জনোন্মুখ সিংহের উপর ললিতাসনে ধর্মচক্র-মুদ্রায় উপবিষ্ট এবং প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থসহ নীলোৎপল ধারণ করে আছেন। এ ধরণের মূর্তি এগারো ও বারো শতকে তৈরি হয়েছিল (চিত্র-৩৪)।
মঞ্জুশ্রী মূর্তির আরেকটি পরিচিত রূপ হচ্ছে অরপচন-মঞ্জুশ্রী মূর্তি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ও জলকুন্ডিতে প্রাপ্ত ভাস্কর্যটি ডান হাতে তরবারি এবং বাম হাতে প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ ধারণ করে আছে। মূল মূর্তির চারপাশে ক্ষুদ্রাকৃতির অনুরূপ আরও চারটি মূর্তি রয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তির সঙ্গে পঞ্চবোধিসত্বের আরও চারটি মূর্তি খোদিত। লিপিযুক্ত এ ভাস্কর্যটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় বারো শতকে নির্মিত।
নোয়াখালী জেলার হাটপুকুরিয়াতে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত মঞ্জুশ্রী মূর্তির একটি ভাস্কর্য রয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দর এ ভাস্কর্যে বুদ্ধ আভঙ্গ ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান এবং তাঁর দুপাশে সূর্যপ্রভ ও চন্দ্রপ্রভ নামেও দুটি মূর্তি রয়েছে এবং এ ভাস্কর্যটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় এগারো শতকে নির্মিত।
সীমিত সংখ্যক হলেও বাংলায়, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে বৌদ্ধ ধনদেবতা জম্ভলমূর্তির অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি থানার ভানপুরে প্রাপ্ত ও বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত একটি ভাস্কর্য এবং পাবনায় প্রাপ্ত ও মহাস্থান জাদুঘরে রক্ষিত আরেকটি ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য (চিত্র-৩৫)। এ ভাস্কর্যগুলি আনুমানিক খ্রিস্টীয় এগারো শতকে নির্মিত। অন্যান্য বৌদ্ধমূর্তির মধ্যে কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার শুভপুরে প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দুবাহু বিশিষ্ট হেরুক মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। মূর্তিটি পদ্মের উপর নৃত্যরত, গলায় নরমুন্ডের মালা ও হাতে একটি পতাকাসহ খট্বাঙ্গ ধারণ করে আছে। এ ভাস্কর্যটি আনুমানিক এগারো শতকে নির্মিত। ময়নামতী জাদুঘরে বৌদ্ধ দেবতা হেরুকের আরেকটি মূর্তি রয়েছে, যেখানে বুদ্ধ মনুষ্যদেহের উপর নৃত্যভঙ্গীতে দন্ডায়মান (চিত্র-৩৬)। পাহাড়পুর হতে বৌদ্ধদেবতা হেবজ্র-এর একটি ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে হেবজ্রকে তাঁর প্রজ্ঞাসহ যব যুম (যুক্ত) ভঙ্গিতে নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর থেকে বুদ্ধ দেবতা নামসংগীতার নারীরূপে একটি দুর্লভ ও খুবই আকর্ষণীয় ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এটি সম্প্রতি বিক্রমপুর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে আনা হয়েছে। তিনমাথা ও বারো হাতযুক্ত এ মূর্তিটি একটি চৈত্যের ভিতর যোগাসনে উপবিষ্ট এবং অনিন্দ্যসুন্দর এ ভাস্কর্যটি আনুমানিক এগারো শতকে নির্মিত।
বৌদ্ধ নারী দেবী দেবী তারা বৌদ্ধ দেবীগণের মধ্যে প্রধান। দুবাহু বিশিষ্ট এ দেবীর ডান হাতে বরদ-মুদ্রা ও বাম হাতে নীলোৎপল দেখা যায়। তাঁর গাত্রবর্ণ অনুযায়ী তিনি কখনও শ্যামা আবার কখনও শ্বেত তারা নামে অভিহিত। সাধারণত তিনি ললিতাসন বা ললিতাক্ষেপ ভঙ্গিতে উপবিষ্ট থাকেন। তবে কোন কোন সময় তিনি দাঁড়ানো অবস্থায়ও থাকেন, যেমন- মুন্সিগঞ্জ জেলার সুখবাসপুরের প্রাচীন তারামূর্তি অথবা মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপালে প্রাপ্ত পরবর্তীকালের আর একটি তারা মূর্তি। এ মূর্তি দুটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এ ভাস্কর্যগুলিতে অনিন্দ্যসুন্দর তারা মূর্তিকে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। মাধুর্যপূর্ণ ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান মূর্তির ডান পাশে অশোকাকান্তা-মারীচী ও বাম পাশে একজটা দেবী অবস্থান করছেন। মূর্তিটির উপরে আছে পাঁচ বোধিসত্ত্ব বুদ্ধের মূর্তি এবং মাঝখানে রয়েছে অমোঘসিদ্ধি। তারা অমোঘসিদ্ধি পরিবারভুক্ত দেবীপ্রতিমা (চিত্র-৩৭)। উপবিষ্ট অবস্থায় তারা ভাস্কর্যগুলির মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনীর সোমপাড়াতে আবিষ্কৃত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত তারা ভাস্কর্যটি উল্লেখযোগ্য। এ ভাস্কর্যে ডান পাশে মহাময়ূরী এবং বাম পাশে একজটা দেবীকে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। এর চারপাশে রয়েছে আটটি উপবিষ্ট তারা। এরা আটটি বিপদ (মহাভয়) থেকে মুক্তির প্রতিরূপ রূপে চিহ্নিত। এজন্যই এ ধরনের তারা প্রতিমাকে অষ্ট মহাভয়-তারা বলে আখ্যায়িত করা হয়। লিপিযুক্ত এ ভাস্কর্যটিতে এর দাতার নাম উল্লিখিত আছে (চিত্র-৩৮)। সাধনমালা গ্রন্থ অনুযায়ী তারা যখন অশোককান্তা-মারীচী ও একজটা দেবীসহ আবির্ভূত হন, তখন তাঁকে আখ্যায়িত করা হয় খদিরবণী তারা দেবী বলে।
দেবী তারার পরে বৌদ্ধদেবীর মধ্যে মারীচী উল্লেখযোগ্য। তিনি ঊষার দেবী, তাই তাঁকে হিন্দুদের সূর্য দেবতার সমতুল্য মনে করা হয়। কিন্তু যেখানে সূর্য দেবতার রথ বহন করে সাতটি ঘোড়া সেখানে মারীচীর রথ টানে সাতটি শূকর। মারীচীকে নানা রূপে দেখা যায়; হয় তিনি স্বাভাবিক মানবীয় মুখ বিশিষ্ট অথবা তিন মুখ বিশিষ্ট হন। তিন মুখ বিশিষ্ট হলে তার একটি অথবা দুটি হয় শূকরীর মুখ। তিনি সাধারণত দুই, ছয়, আট, দশ বা বারো হাত বিশিষ্ট হতে পারেন। তিন মাথা (বাম দিকের মাথাটি শূকরীর) ও আট হাত বিশিষ্ট মারীচী মূর্তিটি ফরিদপুর জেলার ভেদরগঞ্জের পন্ডিতসার (পন্ডিসার?) হতে আবিষ্কৃত এবং বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত (চিত্র-৩৯)। এখানে দেবী রথের উপর স্থাপিত বিশাল পদ্মের উপর প্রত্যয়ালীঢ় ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। রথ চালাচ্ছে সপ্ত শূকর। রথ চালক হিসেবে অশোক শাখা বেষ্টিত চৈত্যের অভ্যন্তরে রাহুর মাথাও দেখা যাচ্ছে। মূর্তির আট হাতে রয়েছে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী যথাক্রমে সুচ, তীর, অঙ্কুশ, বজ্র, অশোক-শাখা, ধনুক, সুতা, তর্জনী-মুদ্রা এবং চারদিকে রয়েছে শূকর-মুখ বিশিষ্ট চারজন সহযোগী, যথা- বদালী, বত্তালী, বরালী এবং বরাহমুখী। এ দেবী মারীচী বৈরচন পরিবারভুক্ত দেবী প্রতিমা এবং এ মূর্তিটি এগারো শতকে নির্মিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে আট হাত বিশিষ্ট মারীচী ভাস্কর্য বরেন্দ্র জাদুঘর ও ময়নামতী জাদুঘরে রক্ষিত আছে। বাংলায় পাথরের তৈরী আট হাত বিশিষ্ট মারীচী ভাস্কর্য খুবই দেখা যায়।
পর্ণশবরী নামে অনিন্দ্যসুন্দর বৌদ্ধ প্রতিমা শুধু পূর্ববঙ্গ থেকেই পাওয়া গেছে। পর্ণশবরী উপজাতীয় নারী, যিনি পরিধেয় হিসেবে বৃক্ষপত্রাদি পরিধান করেন। স্ফীত উদর বিশিষ্ট এ দেবী প্রত্যয়ালীঢ় ভঙ্গিতে রুগ্নতার প্রতীক দুজন পুরুষকে পদদলিত করছে। এ দেবী তিন মাথা ও আট বাহু বিশিষ্ট। মূতির্র ছয় হাতে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী রয়েছে যথাক্রমে অঙ্কুশ, তীর, বজ্র, পর্ণগুচ্ছ, ধনুক ও তর্জনী মুদ্রা। তিনি দুজন পার্শতদেবীসহ উপস্থাপিত। এদের মধ্যে একজন গাধার উপরে উপবিষ্ট। এছাড়া বেদির নিচে গণেশ মূর্তি দেখা যাচ্ছে, যার এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে ঢাল। ভাস্কর্যটি বিঘ্ন বা বাঁধাকে প্রকাশ করছে। উপরে মাঝে অমোঘসিদ্ধিসহ পঞ্চবোধিসত্ত্ব দৃশ্যমান। বজ্রযোগিনী ও নয়নন্দাতে আবিষ্কৃত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ভাস্কর্য দুটি আনুমানিক এগারো শতকের (চিত্র-৪০)।
অন্যান্য বৌদ্ধ দেবী প্রতিমার মধ্যে পঞ্চরক্ষা দেবী বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের দেবী প্রতিমাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পঞ্চরক্ষাদেবী প্রতিমা শুধুমাত্র বাংলার এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিন মুখমন্ডল ও আট হাত বিশিষ্ট এবং সত্ত্বপর্যঙ্কাসনে উপবিষ্ট প্রতিসরা বা মহা-প্রতিসরা দেবী প্রতিমা মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তা সংরক্ষিত। মূর্তিটির আট হাতে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী যথাক্রমে চক্র, ত্রিশূল, তীর, তরবারি, ধনুক, বজ্র, কুঠার ও তর্জনী মুদ্রাসহ দড়ির ফাঁস রয়েছে। মূর্তিটি আনুমানিক এগারো শতকে নির্মিত (চিত্র-৪১)।
একই ধরনের অন্য একটি দেবী প্রতিমাকে ভট্টশালী ভুলবশত ভৃকুটী তারা বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা বর্তমানেও এই নামে পরিচিত (চিত্র-৪২)। এগারো শতকে নির্মিত এ দেবী মূর্তি মুন্সিগঞ্জ জেলার ভবানীপুর হতে আবিষ্কৃত। এর আট বাহুতে রয়েছে ত্রিশূল, তরবারি, বজ্র, দড়ির ফাঁস ও কুঠার। অন্য তিনটি প্রতীক নিশ্চিহ্ন। বেদিতে হস্তিমুখযুক্ত ও দ্বিভুজ বিঘ্নমূর্তি খোদিত (এ মূর্তিটিকে সাধারণত গণেশ মূর্তি বলা হয়)। এ ভাস্কর্যের অন্যান্য অনিয়মিত বৈশিষ্ট্যগুলি হচ্ছে এর বাম মুখমন্ডলে প্রকট দাঁত, ডানের মুখমন্ডলে ভীতিপ্রদ হাসি ও সামনের দিকে প্রসারিত দাঁত। গণেশ মূর্তির সামনে ধ্যানী-বুদ্ধ অমিতাভের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি। বেদিতে হস্তিমাথাযুক্ত বিগ্রহ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য থেকে মনে হয় না যে, এ ভাস্কর্যটি মহাপ্রতিসরা ভাস্কর্য। সাম্প্রতিককালে এ মূর্তিকে মারীচী মূর্তির অন্য একটি রূপ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জৈন ধর্মীয় মূর্তি জৈনধর্ম প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছিল এবং বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা জৈন-তীর্থংকর বর্ধমানের নামানুসারে উৎপন্ন হয়েছে। শুধু বর্ধমানেই নয় পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলাগুলিতে প্রচুর সংখ্যক পাথরের জৈন ভাস্কর্য ও অন্যান্য পুরাবস্ত্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে কিছু কিছু এখনও সেখানে পূজিত হচ্ছে, আবার কিছু কিছু জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিছু বৃহদাকার ও অনিন্দ্যসুন্দর তীর্থংকর মূর্তি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুডা জেলার বহুলারা ও হরমশ্র এবং বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থেকে পাওয়া গেছে। উত্তরবঙ্গ (বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশ) জৈন ধর্মের সমৃদ্ধ কেন্দ্র। পাল শাসনামলে তৈরি অনিন্দ্যসুন্দর পাথরের জৈন ভাস্কর্যগুলি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পশ্চিম দিনাজপুরের ইটাহারের অন্তর্গত সুরোহর গ্রামে প্রাপ্ত ও বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত ঋষভনাথের ভাস্কর্যটি (চিত্র-৪৩)। বেদির নিচে ঋষভনাথের বাহন ষাঁড়কে দেখা যায়। মাঝখানে উপবিষ্ট তীর্থংকরের চারপাশে স্ব স্ব বাহনসহ আরও ২৩ জন তীর্থংকরের মূর্তি উৎকীর্ণ এবং এ ভাস্কর্যটি খ্রিস্টীয় দশ শতকে নির্মিত বলে মনে হয়।
শিল্পশৈলীর দিক থেকে একটি অনিন্দ্যসুন্দর পার্শ্বনাথ মূর্তি বাংলাদেশের দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত। মূর্তিটি কায়োৎসর্গ ভঙ্গিতে পদ্মের উপর দন্ডায়মান। তাঁর মাথার উপরে পূর্ণফণা বিশিষ্ট সপ্তবাসুকি রয়েছে। তাঁর পার্শতদেবতা দিকপালদেরকে প্রাণির উপরে চলন্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এবং দেবী চক্রেশ্বরীকে তাঁর বেদির নিচে দেখানো হয়েছে। এ ভাস্কর্যটিকে আনুমানিক এগারো শতকের বলে ধরা যায় (চিত্র-৪৪)। জৈনতীর্থংকর শান্তিনাথের একটি মূর্তি গোদাগাড়ির মানদৈল হতে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে এটি বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত। এ মূর্তির চারদিকে উপবিষ্ট অবস্থায় আরও ২৪জন তীর্থংকরের মূর্তি রয়েছে। বেদিতে গণেশ মূর্তিসহ নবগ্রহ মূর্তি খোদিত। মূর্তিটি আনুমানিক এগারো শতকে নির্মিত হয়েছিল। [গৌড়েশ্বর ভট্টাচার্য্য]
গ্রন্থপঞ্জি NK Bhattasali, Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculptures in the Dacca Museum, Dacca, 1929, Reprinted, Varanasi, Delhi, 1972; RD Banerji, Eastern Indian School of Mediaeval Sculpture, Delhi, 1933, Reprinted New Delhi, 1981; Benoytosh Bhattacharyya, The Indian Buddhist Iconography, Reprinted. Calcutta, 1968; SK Saraswati, Tantrayana Art : An Album, Calcutta, 1977; Susan L Huntington, The Pala-Sena School of Sculptures, Leiden, 1984; AKM Shamsul Alam, Sculptural Art of Bangladesh: Pre-Muslim Period, Dhaka, 1985; Enamul Haque, Bengal Sculptures: Hindu Iconography upto c 1250 AD, Dhaka, 1992; Mukhlesur Rahman, Sculpture in the Varendra Research Museum: A Descriptive Catalogue, Rajshahi, 1998; Claudine Bautze-Picron, The Art of Eastern India in the Collection of the Museum für Indische Kunst, Berlin: Stone & Terracotta Sculptures, Berlin,1998
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ