শৈব সম্প্রদায় |
পঞ্চোপাসক সম্প্রদায় হলো– শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। আবার সম্প্রদায়গতভাবে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ও শিব ঠাকুরের পূজা মূর্ত ও অমূর্ত বা বিমূর্তরূপে শালগ্রাম শিলায় ও শিবলিঙ্গে বহুল প্রচলিত। এর মধ্যে শিবলিঙ্গ পূজা সমাজ জীবনে এতটাই জনপ্রিয় যে, জনমানসে তাঁর মূর্তিরূপই ক্রমবিলীয়মান। এ প্রসঙ্গে মহাশায় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন–
‘শিবের সহিত অন্য অন্য দেবতার একটি বিষয়ে বিশেষ বিভিন্নতা দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহার সর্বাবয়বের প্রতিমূর্তি অতীব বিরল; ভারতবর্ষের সকল অংশেই তদীয় লিঙ্গ-মূর্তিতেই তাঁহার পূজা হইয়া থাকে। উহা সর্বত্র এরূপ প্রচলিত যে, শিবের উপাসনা বলিলে শিবের লিঙ্গ-মূর্তির উপাসনাই বুঝিতে হয়। শিবালয় ও শিব-মন্দির সমুদায় কেবল ঐ মূর্তিরই আলয়। শৈবতীর্থে কেবল ঐ মূর্তিরই মহিমা প্রকাশিত আছে। স্বতন্ত্র একখানি বৃহৎ পুরাণ ঐ মূর্তিরই গুণ-কীর্তন উদ্দেশে বিরচিত হইয়াছে।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় : দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮৯)
উল্লিখিত ঐ স্বতন্ত্র পুরাণটি হলো লিঙ্গপুরাণ। এই লিঙ্গপুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে– অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন–
‘শিবের সহিত অন্য অন্য দেবতার একটি বিষয়ে বিশেষ বিভিন্নতা দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহার সর্বাবয়বের প্রতিমূর্তি অতীব বিরল; ভারতবর্ষের সকল অংশেই তদীয় লিঙ্গ-মূর্তিতেই তাঁহার পূজা হইয়া থাকে। উহা সর্বত্র এরূপ প্রচলিত যে, শিবের উপাসনা বলিলে শিবের লিঙ্গ-মূর্তির উপাসনাই বুঝিতে হয়। শিবালয় ও শিব-মন্দির সমুদায় কেবল ঐ মূর্তিরই আলয়। শৈবতীর্থে কেবল ঐ মূর্তিরই মহিমা প্রকাশিত আছে। স্বতন্ত্র একখানি বৃহৎ পুরাণ ঐ মূর্তিরই গুণ-কীর্তন উদ্দেশে বিরচিত হইয়াছে।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় : দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮৯)
উল্লিখিত ঐ স্বতন্ত্র পুরাণটি হলো লিঙ্গপুরাণ। এই লিঙ্গপুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে– অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন–
জগদ্যোনি মহাভূতং স্থূলং সূক্ষ্মমজং বিভূম্ ।
বিগ্রহং জগতাং লিঙ্গং অলিঙ্গাদভবত্ স্বয়ম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ তৃতীয় অধ্যায়)
অর্থাৎ : স্থূল, সূক্ষ্ম, জন্ম-রহিত ও সর্ব-ব্যাপী মহাভূত-স্বরূপ লিঙ্গ শিব জগতের কারণ ও বিশ্ব-রূপ। তিনি অলিঙ্গ-শিব হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন।
বিঃদ্রঃ বেদের কিছু ভাষ্যকার ভূল অর্থ করায় নানা মত,পন্থের সূচনা হয়।
অন্যদিকে বিদ্যেশ্বর সংহিতার মতে–
শিব একো ব্রহ্মরূপত্বান্নিষ্কলঃ পরিকীর্তিতঃ।
রূপিত্বাৎ সকল স্তদ্বৎ তস্মাৎ সকল নিষ্কলঃ।।
নিষ্কলত্বান্নিরাকারং লিঙ্গং তস্য সমাগতম্ ।
সকলত্বাৎ তথা রেবং সাকারং তস্য সঙ্গতম্ ।। (বিদ্যেশ্বর-সংহিতা)
অর্থাৎ : ব্রহ্ম যেমন নির্গুণ ও সগুণ দুই প্রকারই হন, তেমনি নিষ্কল শিব নিরাকার লিঙ্গরূপী এবং সগুণ শিব সাকার রূপধারী।
উপরের এই উদ্ধৃতিতে স্পষ্টতই ব্রহ্মবাদী বেদান্ত ধারণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়, তবু প্রজননমূলক বিশ্বাসাশ্রিত লিঙ্গ ধারণা যে বেদান্তের চেয়ে বহু বহু প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক সময়কালে নিহিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রাচীন জনমানসে এই লিঙ্গের সাথে কখন কিভাবে কোথায় শিব নামক বেদবাহ্য এক বিপুল পূজ্য দেবতার ধারণার একাত্মতা ঘটেছে এবং কালে কালে দেবতামূর্তি ছাপিয়ে তাঁর প্রতীকী লিঙ্গমূর্তি রূপটাই এতো জনপ্রিয় ও বহুল পূজ্য হয়ে ওঠেছে সেটা নিশ্চয়ই গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। কেননা ঐ লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, মহাদেবের সৃজন-শক্তিই লিঙ্গ। যেমন–
প্রধানং লিঙ্গমাখ্যাতং লিঙ্গী চ পরমেশ্বরঃ। (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)
অর্থাৎ : মহেশ্বর লিঙ্গী এবং তাঁহার প্রকৃতি অর্থাৎ সৃজন-শক্তি লিঙ্গ বলিয়া খ্যাত।
শিব ও লিঙ্গ
লিঙ্গকে মহাপ্রতীক মেনে যাঁরা দেবতা শিবকে পরমেশ্বরজ্ঞানে উপাসনা করেন তাঁদেরকে বলা হয় শৈব। এই শৈবদের মধ্যেও তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধনাচারের পার্থক্যপ্রসূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ভেদ রয়েছে। রয়েছে ধ্যান-ধারণাগত পার্থক্য ও আচার-বিচারে বৈচিত্র্য। লিঙ্গায়েৎ শৈব সম্প্রদায়ের মতে লিঙ্গ নিষ্কল ব্রহ্মের প্রতীক। কোন কোন পন্ডিতের মতে, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই তাঁরা নাকি এরূপ লিঙ্গার্চনা শুরু করেন। তবে শৈব সম্প্রদায়গুলোর নিজেদের মধ্যকার তত্ত্বীয় অভিন্নতা হলো, এরা পরমেশ্বর শিবকেই সৃষ্টির আদিদেবতা বলে স্বীকার করেন এবং লিঙ্গকে তাঁরই সূক্ষ্ম প্রতীক হিসেবে গণ্য করেন। ‘লী’ ধাতুর অর্থ লয় পাওয়া এবং ‘গম’ ধাতুর অর্থ বহির্গত হওয়া। কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে তাই বলা হয়েছে–
যস্যেচ্ছয়া ভবেৎ সৃষ্টির্লয়স্তত্রৈব গচ্ছতি।
তেন লিঙ্গন্তু বিখ্যাতং যত্র লীনং চরাচরম্ ।।’ (কৌলজ্ঞাননির্ণয়-৩/১০)
অর্থাৎ : যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।
স্কন্দপুরাণেও প্রায় একইরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়–
আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা।
আলয়ঃ সর্বদেবানাং লয়নাল্লিঙ্গমুচ্যতে।।
শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার মতে–
লিঙ্গঞ্চ শিবয়োর্দেহস্তাভ্যাং যস্মাদধিষ্টিতং। (বা. স. উত্তরভাগ- ২৭/১২)
অর্থাৎ : শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন।
লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ ও স্কন্দপুরাণেই শিব ও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। পুরাণের স্বাভাবিক ধারা অনুসারে লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন প্রকার শিবমূর্তির বর্ণনা এলেও এবং সেই সব মূর্তির পূজাদির কথা বলা হলেও লিঙ্গার্চনার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। শিবের লিঙ্গমূর্তির পূজা না করার জন্যই যে তারকাসুরের ধ্বংস হয়েছিল সেকথা জানিয়ে পিতামহ ব্রহ্মা অতঃপর বলছেন–
পূজনীয়ঃ শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপুঙ্গবৈঃ।
সর্বলিঙ্গময়ো লোকঃ সর্বং লিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
তস্মাত্সম্পূজয়েল্লিঙ্গং যইচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।
সর্বে লিঙ্গার্চনাদেব দেবাদৈত্যাশ্চদানবাঃ।।
যক্ষা বিদ্যাধরাঃ সিদ্ধা রাক্ষসাঃ পিশিতাশনাঃ।
পিতরো মুনয়শ্চাপি পিশাচাঃ কিন্নরাদয়ঃ।।
অর্চয়িত্বালিঙ্গমূর্তিং সংসিদ্ধানাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গং যজেন্নিত্যং যেনকেনাপিবা সুরাঃ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯)
অর্থাৎ : যে নিজের অভিষ্ট সিদ্ধি করতে চায়, সে লিঙ্গ পূজা করবে। কারণ সমস্ত জগৎ লিঙ্গাধীন এবং লিঙ্গে সমগ্র জগৎ অধিষ্ঠিত। দেব, দৈত্য, দানব, যক্ষ, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, রাক্ষস, পিতৃপুরুষগণ, মুনি, কিন্নর সকলেই লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে পূজো করে সিদ্ধ হবে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গার্চনের বিবরণ আছে। বলা হচ্ছে,– ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে লিঙ্গ প্রস্তুত করে দেবতাদের দেন। বিষ্ণু ইন্দ্রনীলমণি নির্মিত লিঙ্গ পূজা করতে লাগলেন। ইন্দ্র পদ্মরাগের লিঙ্গ, কুবের সোনার লিঙ্গ, বিশ্বদেবগণ রজতলিঙ্গ, অষ্টবসু চন্দ্রকান্তমণির লিঙ্গ, বায়ু পিতলের, অশ্বিনীকুমার যুগল মাটির, বরুণ স্ফটিকের, দ্বাদশাদিত্য তামার, চন্দ্র মুক্তার, অনন্তাদি নাগেরা প্রবালের, দৈত্য ও রাক্ষসেরা লোহার, গুহ্যকেরা ত্রৈলোহিক, প্রমথেরা লোহার, চামুণ্ডাদি মাতৃগণ বালির, নিরুতি কাঠের, যম পান্নার, রুদ্রগণ ভস্মের, পিশাচেরা সীসার, লক্ষ্মী বৃক্ষের, কার্ত্তিক গোময়ের, শ্রেষ্ঠ মুনিরা কুশাগ্র নির্মিত, বামারা পুষ্পলিঙ্গ, মনোন্মনী গন্ধদ্রব্য নির্মিত লিঙ্গ, বাগদেবী রত্নময় লিঙ্গ, দুর্গা বেদিসমেত স্বর্ণলিঙ্গ পূজা করেন।
লিঙ্গপুরাণের মতোই শিবপুরাণের জ্ঞানসংহিতার পঞ্চবিংশ অধ্যায়ে প্রায় একই প্রকার কথা পাওয়া যায়, যেমন–
অর্থাৎ : হে দেবগণ! সর্বদুঃখ নাশের জন্য শঙ্কর যে সেবনীয় তা তোমরা পূর্বে দেখেছো এবং এখনও দেখছো, তাহলে কেন আবার সেই কথা জিজ্ঞাসা করছো? এই বিষয়ে দেবেশ্বর মহাদেব আমার ও ব্রহ্মার কাছে বিশেষ রূপে বলেছেন। তোমরা দেখেছো যে তারক পুত্রগণ লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে অনাদর করে সবান্ধবে বিনষ্ট হয়েছে। আমি প্রথমতঃ তাদের মায়ায় মোহিত করে দূর করে দিলাম এবং পরে যখন তারা শিবকে অবজ্ঞা করতে লাগলো তখন সকলে বিনষ্ট হলো। অতএব হে সুরেশ্বরগণ! যদি সর্বদা সুখবাসনা থাকে, তাহলে সব সময় লিঙ্গমূর্তিধর মহাদেবকে পূজা করা উচিত। দুঃখ দূর করার জন্য দেবতাদেরও সর্বলিঙ্গে অন্তর্যামিরূপে প্রতিষ্ঠিত শিবকে পূজা করা উচিত। (বন্ধনীযুক্ত বাকি শ্লোকগুলির অর্থ পূর্বোক্ত লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯ শ্লোকের অনুরূপ।)প্রস্তুতঞ্চৈব দৃষ্টঞ্চ সর্বং দৃষ্টান্তমদ্ভূতম্ ।
সন্ত্যজ্য দেবদেবেশং লিঙ্গমূর্তিং মহশ্বেরম্ ।।
তারপুত্রাস্তথৈতে বৈ নষ্টাস্তে চৈব বান্ধবাঃ।
ময়া চ বিমোহিতাস্তে বৈ মায়য়া দূরতঃ কৃতাঃ।।
সর্বে বিনষ্টাঃ প্রধ্বস্তাঃ শিবেন রহিতা যদা।
তস্মাৎ সদা পূজনীয়া লিঙ্গমূর্তিধরো হরঃ।।
যদি সুখং সুরেশাশ্চ বৈরন্তর্যং ভবেদিহ।
(পূজনীয়ঃ শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপূঙ্গবৈঃ।।
সর্বলিঙ্গময়েঅদেবঃ সর্বলিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতঃ।
তস্মাৎ সম্পূজয়েন্নিত্যং যদীচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।।
সর্বে লিঙ্গার্চনাদেব দেবা দৈত্যাশ্চ দানবাঃ।
বয়ষ্ণৈব তথা ব্রহ্মন্ কিমথং বিস্তৃতং ত্বয়া।।
অর্চয় ত্বং লিঙ্গমূর্তিং সংসিদ্ধেৎ নাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গেহর্চয়েন্নিত্যং যেন কেনাপি বৈ সুরাঃ।।)- (শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা-২৫ অ/২২-২৮)
এই শিবপুরাণেও লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১ অংশের শ্লোকের অনুরূপ বক্তব্যে বলা হয়েছে যে–
লিঙ্গানি কল্পয়িত্বৈবঞ্চাধিকারানুরূপতঃ।
বিশ্বকর্মা দদৌ তেভ্যো নিয়োগাদ্ ব্রহ্মণঃ প্রভোঃ।। (জ্ঞানসংহিতা-২৫/৩৮)
অর্থাৎ : ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ নির্মাণ করেন ও দেবতাদের প্রদান করেন।
এই বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ প্রসঙ্গে লিঙ্গপুরাণের চুয়াত্তর অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণিত আছে। যেমন–
ষট্-বিধং লিঙ্গমিত্যাহুর্দ্রব্যাণাঞ্চপ্রভেদতঃ।
তেষাং ভেদাশ্চতুর্যুক্তশ্চত্বারিংশদিতি স্মৃতাঃ।।
শৈলজং প্রথমং প্রোক্তং তদ্ধি সাক্ষাচ্চতুর্বিধম্ ।
দ্বিতীয়ং রত্নজং তচ্চ সপ্তধা মুনিসওমাঃ।।
তৃতীয়ং ধাতুজং লিঙ্গমষ্টধা পরমেষ্ঠিনঃ।
তুরীয়ং দারুজং লিঙ্গং তত্তু ষোড়শধোচ্যতে।।
মৃন্ময়ং পঞ্চমং লিঙ্গং দ্বিধা ভিন্নং দ্বিজোত্তমাঃ।
ষষ্ঠন্তু ক্ষণিকং লিঙ্গং সপ্তধা পরিকীর্ত্তিতম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৩-১৬)
অর্থাৎ : দ্রব্য উপাদানভেদে লিঙ্গকে প্রথমত ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের আবার চতুঃচত্বারিংশ বা চুয়াল্লিশ ভাগে বিভাগ করা হয়েছে। প্রথমে শৈলজালিঙ্গ বা প্রস্তরনির্মিত লিঙ্গ চার প্রকার, দ্বিতীয় রত্নজ লিঙ্গ সাত প্রকার, তৃতীয় ধাতুজ লিঙ্গ আট প্রকার, তারপর দারুজ বা কাষ্ঠনির্মিত লিঙ্গ ষোড়শ প্রকার, পঞ্চমে মৃন্ময় বা মৃত্তিকানির্মিত লিঙ্গ দুই প্রকার এবং ষষ্ঠত রঙ্গ বা রাং নির্মিত রিঙ্গ সাত প্রকার।
বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গের বিবরণ শাস্ত্রে শ্রুত হলেও এটাও বলা আছে যে সমস্ত প্রকার লিঙ্গের পূজনে একই ফল লাভ হয় না। যেমন–
শ্রীপ্রদাং রত্নজং লিঙ্গং শৈলজং সর্বসিদ্ধিদম্ ।
ধাতুজং ধনদং সাক্ষাদ্দারুজং ভোগসিদ্ধিদম্ ।।
মৃন্ময়ঞ্চৈব বিপ্রেন্দ্রাঃ সর্বসিদ্ধিকরং শুভম্ ।
শৈলজং চোত্তমং প্রোক্তং মধ্যমঞ্চৈব ধাতুজম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৭-১৮)
অর্থাৎ : রত্ন নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা শ্রীলাভ হয়, শৈলজ (প্রস্তর নির্মিত) লিঙ্গ সর্বসিদ্ধি দায়ক, ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ সাক্ষাৎ ধনদ, কাঠের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ ভোগ ও সিদ্ধি দান করে, মৃন্ময় লিঙ্গ সর্বসিদ্ধিদায়ক ও শুভ। প্রস্তর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ অতি উত্তম এবং ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ মধ্যম প্রকৃতির।
কেবল যে দ্রব্যের প্রকারগত ভিন্নতার কারণে লিঙ্গপূজা ভিন্ন ফলদায়ক হয় তাই নয়, লিঙ্গের আকৃতিগত ভিন্নতার কারণেও ফলভিন্নতা হতে পারে। যেমন লিঙ্গপুরাণ মতে–
বহুধা লিঙ্গভেদাশ্চ নব চৈব সমাসতঃ।
মূলে ব্রহ্মা তথা মধ্যে বিষ্ণুস্ত্রিভুবনেশ্বরঃ।।
রুদ্রোপরি মহাদেবঃ প্রণবাখ্যঃ সদা শিবঃ।
লিঙ্গবেদী মহাদেবী ত্রিগুণাত্রিময়াত্মিকা।।
তথা চ পূজয়েদ্যস্তু দেবী দেবশ্চ পূজিতৌ। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৯-২১)
অর্থাৎ : লিঙ্গের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। লিঙ্গের মূলে বাস করেন ব্রহ্মা, মধ্যে বিষ্ণু ও উপরে ওঙ্কাররূপী মহাদেব রুদ্র। ত্রিগুণাত্মিকা মহাদেবী হলেন লিঙ্গবেদি। যে ব্যক্তি বেদি সমেত লিঙ্গ পূজা করে, তার সর্ব দেবদেবীর পূজা ফল লাভ হয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে গৌরীপট্ট সংবলিত যে কৃত্রিম শিবলিঙ্গ দৃশ্যমান হয়, বেদবিহিত পৌরাণিক ব্যাখ্যায়– লিঙ্গের তিন ভাগের মধ্যে– শিবলিঙ্গে গৌরীপট্টের উপরের অংশকে রুদ্রভাগ বলে, মাঝের অংশ অর্থাৎ গৌরীপট্টের অঞ্চলকে বিষ্ণুভাগ এবং গৌরীপট্টের নিচের অংশকে ব্রহ্মভাগ বলে। কিন্তু সকল লিঙ্গে– বিশেষ করে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট লিঙ্গে– এই গৌরীপট্ট দেখা যায় না।
শিবলিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গৌরীপীঠ বা গৌরীপট্টের কথা এসে যায়। শাক্তচিন্তা প্রসূত বেদবাহ্য ব্যাখ্যায় এই গৌরীপট্টকে যোনিও বলা হয়। যোনিমুদ্রার আকৃতিও গৌরীপট্টের মতো। লিঙ্গোপাসনাকে যাঁরা যৌন উপাসনা বলেন তাঁরা স্ত্রী ও পুং জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক হিসেবেই যোনি ও লিঙ্গকে দেখাতে চান। প্রাণতোষিনী তন্ত্রের একটি বচনে বলা হয়েছে– লিঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ সাক্ষাৎ মহেশ্বর এবং যোনি জগন্ময়ী মহামায়া। নিরুত্তর তন্ত্রেও প্রায় একই কথা পাওয়া যায়–
শিবলিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গৌরীপীঠ বা গৌরীপট্টের কথা এসে যায়। শাক্তচিন্তা প্রসূত বেদবাহ্য ব্যাখ্যায় এই গৌরীপট্টকে যোনিও বলা হয়। যোনিমুদ্রার আকৃতিও গৌরীপট্টের মতো। লিঙ্গোপাসনাকে যাঁরা যৌন উপাসনা বলেন তাঁরা স্ত্রী ও পুং জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক হিসেবেই যোনি ও লিঙ্গকে দেখাতে চান। প্রাণতোষিনী তন্ত্রের একটি বচনে বলা হয়েছে– লিঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ সাক্ষাৎ মহেশ্বর এবং যোনি জগন্ময়ী মহামায়া। নিরুত্তর তন্ত্রেও প্রায় একই কথা পাওয়া যায়–
অর্থাৎ : লিঙ্গরূপে স্বয়ং মহাকাল এবং যোনিরূপে দেবী কালিকা অধিষ্ঠিত।লিঙ্গরূপো মহাকালো যোনিরূপা চ কালিকা।
এভাবে শিব ও শক্তির অভেদের কল্পনা করেই নারদ-পঞ্চরাত্রের একটি বচনে তাই দেখা যায়–
যত্র লিঙ্গস্তত্র যোনিযত্র যোনিস্ততঃ শিবঃ।
অর্থাৎ : যেখানে লিঙ্গ (শিব) সেখানেই যোনি (শক্তি), যেখানে যোনি সেখানেই শিব।
লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, তাই (গৌরীপট্ট সমন্বিত) লিঙ্গ একই সঙ্গে পিতামাতার প্রতীক। লিঙ্গপুরাণের উত্তরভাগেও (১১/৩১) আমরা এধরনের মতবাদের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই–
পীঠাকৃতিরুমাদেবী লিঙ্গরূপশ্চ শঙ্করঃ।
প্রতিষ্ঠাপ্য প্রযত্নেন পূজয়ন্তি সুরাসুরাঃ।।
অর্থাৎ : উমাদেবীকে লিঙ্গপীঠ রূপে এবং মহাদেব শঙ্করকে লিঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত সুর ও অসুরেরা তার পূজা করে থাকেন।
বেদপন্থীরা যে যোনিরূপ গৌরীপট্টের ব্যাখ্যা অন্যভাবে দিয়ে থাকেন, তা ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় (ঋক-১/১০৪/১) সায়ণাচার্য্য যোনিকে যজ্ঞবেদী হিসেবে অর্থবাদ করেছেন। যেমন–
যোনিষ্ট ইন্দ্র নিষদে অকারি তমা নি ষীদ স্বানো নার্বা।
বিমুচ্যা বয়োহবসায়াশ্বান্দোষা বস্তোর্বহীয়সঃ প্রপিত্বে।। (ঋগ্বেদ-সংহিতা-১/১০৪/১)
অর্থাৎ : হে ইন্দ্র! তোমার বসবার (অবস্থানের) জন্য যে বেদি (যোনি) প্রস্তুত হয়েছে শব্দায়মান অশ্বের ন্যায় তথায় উপবেশন কর। অশ্ববন্ধন রশ্মিবিমোচন করে অশ্বদের মুক্ত করে দাও, সে অশ্ব যজ্ঞকাল সমাগত হলে দিন রাত তোমাকে বহন করে।
পরবর্তী চিন্তায় সেই বেদীকে দক্ষতনয়া উমা গৌরীর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। এই যোনি বা বেদির উপর প্রজ্বলিত অগ্নি হলেন লিঙ্গ। মহাভারতকারও যে সমস্ত পুরুষের প্রতীক হিসাবে লিঙ্গকে এবং সমস্ত নারীর প্রতীক হিসেবে যোনিপীঠকে বিবেচনা করতেন, তা উপমন্যু কথিত শিবলিঙ্গ কথা থেকে বোঝা যায়। সেখানে বলা হয়েছে–
পুংলিঙ্গং সর্বমীশানং স্ত্রীলিঙ্গং বিদ্ধিচাপ্যুমাম্ ।
দ্বাভ্যাং তনুভ্যাং ব্যাপ্তং হি চরাচরমিদং জগৎ।। (মহাভারত-১৩/১৪/২৫৩)
অর্থাৎ : সমস্ত পুরুষ ঈশান এবং সমস্ত স্ত্রীমূর্তিই উমা। শিবশক্তির পুরুষ এবং স্ত্রী এই দুই তনুর দ্বারা জগৎ ব্যাপ্ত।
একই কথা শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে পাওয়া যায়। সেখানে ৫৫ শ্লোকে বলা হয়েছে–
শঙ্কর পুরুষাঃ সর্বে স্ত্রিয়ঃ সর্বা মহেশ্বরী।
সর্বে স্ত্রী-পুরুষাস্তস্মাৎ তয়োরেব বিভূতয়ঃ।।
অর্থাৎ : পুরুষ মাত্রেই সেই দেব-দেব শঙ্কর এবং স্ত্রীমাত্রেই দেবী শঙ্করী। সমস্ত স্ত্রী-পুরুষ সেই ভব-ভবানীর বিভূতি।
শিব-শক্তির সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে এখানে যেসব কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে যে তন্ত্রের বীজ রয়েছে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং হয়তো পঞ্চম-মকারের কথাও এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ভগবতীর যোনিরূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে পুরাণের আখ্যায়িকাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেবী ভাগবতে এই আখ্যানের কথা যেমন আছে তেমনি শিবতত্ত্বপ্রদীপিকায় ‘শৈবে’ বলে উদ্ধৃত অংশে বিস্তৃতভাবে সেই আখ্যান পাওয়া যায়। ঐ আখ্যানে বলা হয়েছে (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়)–
‘দারুকবনে শিবভক্ত ঋষিরা যখন ত্রিসন্ধ্যা শিবপূজা ও শিব আরাধনায় রত তখন তাদের ভক্তি পরীক্ষার জন্য শিব দিগম্বর মূর্তিতে নিজের লিঙ্গটি (পুং জননেন্দ্রিয়) ধারণ করে ঋষিপত্নীদের কাছে উপস্থিত হয়ে নানা রকম ভাবভঙ্গী দেখাতে লাগলেন। বিপ্র নারীরাও তাঁর সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। এমন সময় ঋষিরা সমিধ আহরণের জন্য সেই বনে উপস্থিত হয়ে স্ত্রীদের এরূপ কাণ্ড দেখে উলঙ্গ পুরুষটির কাছে বার বার তার পরিচয় জানতে চাইলেন। পুরুষটি আত্ম-পরিচয় না দেওয়ায় ক্রোধোন্মত্ত হয়ে তাঁরা অভিশাপ দিলেন যে ‘তোমার লিঙ্গ ধরাতলে নিপতিত হোক’। অগ্নিতুল্য শিবলিঙ্গ ধরাতলে পতিত হয়ে সব ধ্বংস করল এবং তা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সর্বত্র ঘুরতে লাগল ও সবকিছু ধ্বংস করতে লাগল। তখন দেবতা ও ঋষিরা ভয় পেয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন এবং সব ঘটনা জানালেন। ব্রহ্মা তখন দেবতাদের কাছ থেকে সব ঘটনা জানলেন এবং বললেন– যতক্ষণ না ঐ লিঙ্গ স্থির হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ত্রিজগতের মঙ্গল হবে না। এরপর তিনি ঋষিদের উপদেশ দিলেন গিরিজা দেবীর আরাধনার জন্য। যদি গিরিজা দেবী যোনিরূপ ধারণ করে ঐ লিঙ্গ ধারণ করেন তাহলেই কেবলমাত্র ঐ লিঙ্গ স্থির হবে। অষ্টদশ পদ্মের মণ্ডলে কিভাবে দেবীর আরাধনা করতে হবে তাও ব্রহ্মা উপদেশ দিলেন। পার্বতী যোনিরূপ ধারণের পর শিবলিঙ্গ তাতে আধারিত হল এবং জগৎ শান্তি পেল।’এই প্রসঙ্গে ভগবতীর যোনিরূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে পুরাণের আখ্যায়িকাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেবী ভাগবতে এই আখ্যানের কথা যেমন আছে তেমনি শিবতত্ত্বপ্রদীপিকায় ‘শৈবে’ বলে উদ্ধৃত অংশে বিস্তৃতভাবে সেই আখ্যান পাওয়া যায়। ঐ আখ্যানে বলা হয়েছে (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়)–
শিব সংক্রান্ত বিভিন্ন আখ্যানাদি বিভিন্ন পুরাণে ছড়িয়ে আছে। শৈব পুরাণগুলি শিবকেই প্রাধান্য দিতে চায় বলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতির মুখে শিবমাহাত্ম্য স্তুতি স্থাপন বসানো হয়েছে। আর সেখানে শিব মানেই শিবলিঙ্গের মাধ্যমে তার অবস্থিতিই প্রধান। তাছাড়া পঞ্চোপাসক সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই লিঙ্গপূজাকে জনপ্রিয় করার বিভিন্ন কায়দা শাস্ত্রকারেরা নিয়েছেন। এজন্য অর্থবাদের দ্বারা বলা হয়েছে যে–
সেই কারণেই ঐ তন্ত্রে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়কেই বিল্বপত্রের দ্বারা লিঙ্গপূজা করে, তারপর অন্যপূজায় ব্রতী হতে বলা হয়েছে। কিন্তু লিঙ্গপূজা করতে বললেই পূজা হবে না, কেননা লিঙ্গের বহু প্রকারভেদ, পূজার মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও রয়েছে। সেগুলো জানার প্রয়োজনও রয়েছে।লিঙ্গপূজাং বিনা দেবি! অন্য পূজাং করোতি যঃ।
বিফলা তস্য পূজাস্যাদন্তে নরকমাপ্নুয়াৎ।। (লিঙ্গার্চনতন্ত্র)
অর্থাৎ : লিঙ্গপূজা না করে অন্য দেবতার পূজা করলে সেই পূজা বিফল হবে এবং সেই পূজক অন্তে নরকে যাবে।
ভারতীয় তথা এতদঞ্চলের সকল ধর্ম ব্যবস্থাই কোন-না-কোনভাবে তান্ত্রিক অন্তঃস্রোতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, এ বিষয়ে খুব একটা দ্বিমত নেই কারো। আর শৈবধর্মের ক্ষেত্রে এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। শাক্ততান্ত্রিক ধারণাসমূহ, স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগে, শৈবধর্মকেই আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছিল। সাংখ্যোক্ত ও তন্ত্রোক্ত পুরুষ-প্রকৃতির ধারণাই শিব ও শক্তির ধারণার উৎস। একটি অন্যনিরপেক্ষ নয়। শৈব ও শাক্তধর্মের মূল তত্ত্বগুলি একই, পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি অর্থাৎ শৈবধর্মের ক্ষেত্রে পুরুষ-প্রাধান্য, দ্বিতীয়টি অর্থাৎ শাক্তধর্মের ক্ষেত্রে প্রকৃতি-প্রাধান্য। আর তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানগুলি সমভাবেই শৈব ও শাক্ত ধর্মে বর্তমান। তন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থান্তরে এসবের বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।
শিব ও শক্তির ধারণায় যে তান্ত্রিক প্রভাব প্রযুক্ত হয়েছে তা আসলে একটি পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারি। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেই এখানে স্মর্তব্য যে, যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতাতেই (শুক্লযজুর্বেদ-৩/৫৭) আমরা প্রথম রুদ্রের (শিব) সঙ্গে অম্বিকার (দেবী) সংযোগ দেখি, ভ্রাতা-ভগ্নী হিসেবে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও (তৈ:ব্রা:-১/৬/১০/৪৫) উভয়ের ওই একই সম্পর্ক, যেখানে বলা হয়েছে রুদ্র তাঁর ভগিনী অম্বিকার সাহায্যেই ধ্বংস-কার্যে লিপ্ত থাকেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে (তৈ: আ:-১০/১৮) উভয়ের সম্পর্ক পতি-পত্নীর সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং এই সম্পর্কটাই পরবর্তীকালে স্থায়ী হয়েছে। কেনোপনিষদে (কেন-৩/২৫) আমরা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী উমা-হৈমবতীর উল্লেখ পাই, কিন্তু এখানে তিনি রুদ্র-পত্নী নন। রামায়ণ ও মহাভারতের আখ্যান অংশগুলিতে শিব ও দেবী (উমা-পার্বতী) পতিপত্নী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যদিও মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রদ্বয়ে এবং হরিবংশের আর্যাস্তবে দেবীর সঙ্গে শিবের বিশেষ সম্পর্ক দেখানো হয়নি। তবে রামায়ণ ও মহাভারতের আখ্যান অংশগুলিতে শিব ও দেবীর পতিপত্নী সম্পর্কের ভিত্তিতে যে সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, পরবর্তীকালের কালিদাস প্রভৃতি সংস্কৃত কবি ও নাট্যকারগণ সেগুলিকে তাঁদের সাহিত্য রচনার উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলে যে অভিমত, তার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ খুবই কম।
শিব ও শক্তির ধারণায় যে তান্ত্রিক প্রভাব প্রযুক্ত হয়েছে তা আসলে একটি পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারি। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেই এখানে স্মর্তব্য যে, যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতাতেই (শুক্লযজুর্বেদ-৩/৫৭) আমরা প্রথম রুদ্রের (শিব) সঙ্গে অম্বিকার (দেবী) সংযোগ দেখি, ভ্রাতা-ভগ্নী হিসেবে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও (তৈ:ব্রা:-১/৬/১০/৪৫) উভয়ের ওই একই সম্পর্ক, যেখানে বলা হয়েছে রুদ্র তাঁর ভগিনী অম্বিকার সাহায্যেই ধ্বংস-কার্যে লিপ্ত থাকেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে (তৈ: আ:-১০/১৮) উভয়ের সম্পর্ক পতি-পত্নীর সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং এই সম্পর্কটাই পরবর্তীকালে স্থায়ী হয়েছে। কেনোপনিষদে (কেন-৩/২৫) আমরা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী উমা-হৈমবতীর উল্লেখ পাই, কিন্তু এখানে তিনি রুদ্র-পত্নী নন। রামায়ণ ও মহাভারতের আখ্যান অংশগুলিতে শিব ও দেবী (উমা-পার্বতী) পতিপত্নী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যদিও মহাভারতের দুর্গাস্তোত্রদ্বয়ে এবং হরিবংশের আর্যাস্তবে দেবীর সঙ্গে শিবের বিশেষ সম্পর্ক দেখানো হয়নি। তবে রামায়ণ ও মহাভারতের আখ্যান অংশগুলিতে শিব ও দেবীর পতিপত্নী সম্পর্কের ভিত্তিতে যে সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, পরবর্তীকালের কালিদাস প্রভৃতি সংস্কৃত কবি ও নাট্যকারগণ সেগুলিকে তাঁদের সাহিত্য রচনার উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলে যে অভিমত, তার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ খুবই কম।
শিব ও দেবীর প্রাধান্য যে বৈদিক ঐতিহ্যে স্বীকৃত হয়নি, রামায়ণ ও মহাভারতে দক্ষযজ্ঞের বর্ণনা থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। দক্ষযজ্ঞ বিষয়ে ইতঃপূর্বে আলোকপাত করা হয়েছে। আর আমরা যদি মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য অংশে অভিনিবেশ করি তবে দেখবো সেখানে শিবের কিছু ভূমিকা থাকলেও তা একান্তই গৌণ। তবে গুপ্তযুগের পর থেকেই যে শিব ও দেবী পাকাপাকিভাবে সংযুক্ত হয়েছেন তা বিভিন্ন লেখমালার সাক্ষ্যে পাওয়া যায়। বিভিন্ন পুরাণ থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের পাকাপাকি সংযোগের সূত্রপাতও গুপ্তযুগ থেকে হয়েছে বলে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের অভিমত। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন–
‘সকল শ্রেণীর শৈবমতের মূলকথা চরম সত্তা ব্রহ্ম বা শিব একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। যিনি বিশ্বময় তিনি শক্তি, যিনি বিশ্বাতীত তিনি শিব। শিব ও শক্তি দুটি পৃথক সত্তা নয়, একই সৎ-এর দুটি ধারণাগত দিক। শক্তি সর্বদাই শিবের সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নি এবং তার দাহিকাশক্তির মত। (শিবদৃষ্টি-৩/৭)। প্রকৃত বিশ্বাতীত হিসাবে শিব শব মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু শিব ও শক্তির সমতা বা সামরস্য বিদ্যমান। আসলে শক্তি শিবের ঐশ্বর্য, হৃদয় এবং সার। (ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা-১/৫/১৪)। বিভিন্ন শৈব মতবাদে এই শক্তি মূলত পাঁচ প্রকার– চিৎ, আনন্দ, ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়া।’ –(ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২১৬)
‘সকল শ্রেণীর শৈবমতের মূলকথা চরম সত্তা ব্রহ্ম বা শিব একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। যিনি বিশ্বময় তিনি শক্তি, যিনি বিশ্বাতীত তিনি শিব। শিব ও শক্তি দুটি পৃথক সত্তা নয়, একই সৎ-এর দুটি ধারণাগত দিক। শক্তি সর্বদাই শিবের সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নি এবং তার দাহিকাশক্তির মত। (শিবদৃষ্টি-৩/৭)। প্রকৃত বিশ্বাতীত হিসাবে শিব শব মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু শিব ও শক্তির সমতা বা সামরস্য বিদ্যমান। আসলে শক্তি শিবের ঐশ্বর্য, হৃদয় এবং সার। (ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা-১/৫/১৪)। বিভিন্ন শৈব মতবাদে এই শক্তি মূলত পাঁচ প্রকার– চিৎ, আনন্দ, ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়া।’ –(ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২১৬)
শিব ও শক্তি পরস্পর অভিন্নভাবে পরস্পরের মধ্যে অনুস্যুত। তান্ত্রিক পরিভাষায় তাকে ‘সমরস’ অবস্থা বলা হয়। সমান অর্থাৎ অন্যূন এবং অনতিরিক্ত রস (আনন্দ) আছে যাঁদের, তাঁরাই ‘সমরস’। এই সমরসের ভাবই ‘সামরস্য’। শিব-শক্তির পরস্পর অত্যন্ত সংশ্লিষ্ট মিলনের নাম সামরস্য। এই সামরস্য-সম্বন্ধে শক্তি-বিশিষ্ট শিবই পর ব্রহ্ম।
‘শিব শক্তির সামরস্য বিষয়ে চিন্তা করিলে বোঝা যায়, প্রত্যেক জীবে শিব-শক্তি-ভাব বিদ্যমান। বিশেষতঃ পুরুষে শিবভাব এবং নারীতে শক্তিভাবের সমধিক প্রকাশ। পঞ্চম মকারের গূঢ় রহস্যও শিব-শক্তির সামরস্যের আস্বাদন।’ ‘বস্তুতঃ শিব ও শক্তির পৃথক সত্তা না থাকিলেও পরম শিবই শক্তির অধিষ্ঠান। শিবগত সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কার্যে শক্তি হইতেছেন– সঙ্কল্প-নির্বাহিকা। শক্তি সদ্রূপা এবং পরানন্দরূপিণী।’– (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৯)।
অগস্ত্যসংহিতায়ও বলা হয়েছে–
‘শিব শক্তির সামরস্য বিষয়ে চিন্তা করিলে বোঝা যায়, প্রত্যেক জীবে শিব-শক্তি-ভাব বিদ্যমান। বিশেষতঃ পুরুষে শিবভাব এবং নারীতে শক্তিভাবের সমধিক প্রকাশ। পঞ্চম মকারের গূঢ় রহস্যও শিব-শক্তির সামরস্যের আস্বাদন।’ ‘বস্তুতঃ শিব ও শক্তির পৃথক সত্তা না থাকিলেও পরম শিবই শক্তির অধিষ্ঠান। শিবগত সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কার্যে শক্তি হইতেছেন– সঙ্কল্প-নির্বাহিকা। শক্তি সদ্রূপা এবং পরানন্দরূপিণী।’– (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৯)।
অগস্ত্যসংহিতায়ও বলা হয়েছে–
শিবের সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছাকেই শক্তি-তত্ত্ব বলা হয়। শিবের ধর্মই শক্তি। এই শক্তি ‘বিমর্শ-শক্তি’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। শ্রুতি অনুযায়ী, সৃষ্টির প্রারম্ভে পরম ব্রহ্মের সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছার যে স্ফূরণ হয়েছিল, এই স্ফূরণের নামই বিমর্শ। এটিই শক্তির প্রথম প্রকাশ। এক পরম শিবই অনাদি-সিদ্ধ মায়ার যোগে ধর্মী ও ধর্ম– এই উভয়রূপে প্রকাশিত হচ্ছেন। শ্রী সুখময় শাস্ত্রী তাঁর তন্ত্রপরিচয় গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভাস্কর রায় আগম-শাস্ত্র থেকে কতকগুলি শক্তিবাচক শব্দ চয়ন করে গুপ্তবতীতে প্রকাশ করেন, যেমন– বিমর্শ, চিতি, চৈতন্য, আত্মা, স্বরসোদিতা, পরা বাক্, স্বাতন্ত্র্য, ঐশ্বর্য, সত্তত্ত্ব, সত্তা, স্ফুরত্তা, সার, মাতৃকা, মালিনী, হৃদয়মূর্তি, সংবিৎ, কর্তৃত্ব, স্পন্দ ইত্যাদি।যয়া দেব্যা বিরহিতঃ শিবোহপি হি নিরর্থকঃ। -(অগস্ত্যসংহিতা)
অর্থাৎ : শক্তিবিরহিত শিবের কোন সার্থকতাই নাই।
‘যদিও নিখিল বিশ্বই পরম শিবের শক্তি, তথাপি জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া এই তিন রূপেই শক্তির সমধিক প্রকাশ। মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী পাঠ করিতে পাঠকগণ মহাসরস্বতী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই জ্ঞানশক্তি। মহাকালী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই ইচ্ছাশক্তি এবং মহালক্ষ্মী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই ক্রিয়াশক্তি। এই তিনের মধ্যে কোন ভেদ নাই। সকল বিশ্বই শক্তি-স্বরূপ। সুতরাং শক্তি ও শক্তিমানের অভেদই তান্ত্রিক-সম্মত পরম তত্ত্ব।’– (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৬)
শিব ও শক্তিতে যে আসলে কোন প্রভেদ নেই, তা লিঙ্গপুরাণ থেকেও জানা যায়–
উমাশঙ্করয়োর্ভেদো নাস্ত্যেব পরমার্থতঃ।
দ্বিধাসৌ রূপমাস্থায় স্থিতো একো ন সংশয়ঃ।।
অর্থাৎ : পারমার্থিকভাবে উমা (শক্তি) ও শঙ্করে (শিব) কোন ভেদ নাই। দুই রূপে অবস্থান করিলেও উভয়ে যে এক, তাহাতে কোন সংশয় নাই।
উভয়ের এই মিলিত মূর্তিই অর্ধনারীশ্বরে প্রকাশিত। আচার্য শঙ্করও তাঁর আনন্দলহরীতে বলেছেন–
ত্বমেব স্বাত্মানং পরিণময়িতুং বিশ্ববপুষা,
চিদানন্দাকারং শিবযুবতি ভাবেন বিভৃষে।
অর্থাৎ : শিব ও শক্তি বস্তুতঃ একই তত্ত্ব। শক্তিই শিবের দেহ। উভয়ের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি-ভাব সম্বন্ধ। উভয়ই সমরস, পরানন্দ।
আনন্দলহরীতে আরও দেখা যায়, বলা হচ্ছে–
শরীরং ত্বং শম্ভোঃ শশিমিহিরবক্ষোরুহযুগম্,
তবাত্মানাং মধ্যে ভগবতি ভবাত্মানমঘম্ ।
অতঃ শেষঃ শেষীত্যয়মুভয়সাধারণতয়া,
স্থিতঃ সম্বন্ধো বাং সমরসপরানন্দপদয়োঃ।।
অর্থাৎ : মাতঃ ভগবতি, তুমিই শিবের শরীর। তোমার স্তনযুগল চন্দ্র ও সূর্য-স্বরূপ। তোমার স্বরূপই ভবের (শিবের) স্বরূপ বলিয়া মনে করি। তোমাদের মধ্যে পরস্পর অঙ্গাঙ্গি-ভাব বিদ্যমান রহিয়াছে। (কিন্তু অঙ্গ ও অঙ্গী নির্ণয় করা যায় না।) উভয়ের এই সমরস (মিলন) পরমানন্দ সম্বন্ধই দেখিতেছি।
শিব ও শক্তির মিলনের পরিণামই বিশ্বপ্রপঞ্চ। তান্ত্রিকের দৃষ্টিতে জগতের সকল পদার্থেই চৈতন্যরূপিণী শক্তির লীলা চলছে। অতএব সকল পদার্থই চেতন। অচেতন বলে কিছুই নেই। সাধক এই চিৎ-শক্তিকেই প্রণতি নিবেদন করেন। শক্তি থেকে শিব স্বতন্ত্র নন। তার মানে, শক্তিবিরহিত কেবল শিব কর্তৃত্বাদি-ধর্মশূন্য। বামকেশ্বর-তন্ত্রের টীকায় ভাস্কর রায় সিদ্ধান্ত করেছেন– ‘সকলকেই এই মহাশক্তির উপাসনা করিতে হয়। মায়াশক্তিকে আশ্রয় করিয়াই ঈশ্বর মূর্তি পরিগ্রহ করেন। এইহেতু তাঁহার পুংমূর্তি ও স্ত্রীমূর্তি সবই শক্তি-স্বরূপ। শিব ও শক্তির সম্বন্ধ নিত্য। কখনও তাঁহাদের বিচ্ছেদ নাই। শক্তির পুংশক্তির স্ফুরণে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার আবির্ভাব, আর স্ত্রীশক্তির স্ফুরণে দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি স্ত্রী-দেবতার আবির্ভাব। এই তত্ত্ব সবিশেষ অবগত হইয়া উপাসনা করিতে হয়।’
শিব ও শক্তি উভয়ের মধ্যে প্রভেদ যে কল্পিত, বাস্তব নয়– তা-ই দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই ভেদ-কল্পনারও সার্থকতা আছে। কারণ শিব প্রকাশস্বরূপ মাত্র। তিনি অখণ্ড পূর্ণস্বভাব। তবুও তিনি বিশেষ বিশেষ শক্তির মধ্যস্থতায় ধ্যানের বিষয়ীভূত হয়ে থাকেন। সেই আংশিক রূপ বা লক্ষণকে অভিনবগুপ্ত ‘শৈবীমুখ’ বলেছেন। তার অপর সংজ্ঞা ‘শক্তি’। শক্তি-বিষয়ক জ্ঞানের দ্বারা সাধককে শিব-বিষয়ক জ্ঞান লাভ করতে হয়। অন্য কোন উপায় নেই। সুতরাং শক্তিই হচ্ছেন শক্তিমান্ শিবের জ্ঞানের উপায়-স্বরূপ। শক্তিমান শিব হচ্ছেন– উপেয়। শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্যে–
‘যদিও শিবতত্ত্ব বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় না, তথাপি ইহা মানস জ্ঞানের বিষয় হইয়া থাকে। আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত না হইলেও মানস অনুভবের বিষয়ীভূত হইয়া থাকে। শিবও এইভাবে মানস জ্ঞানের গোচর হইতে পারেন। কিন্তু প্রথমতঃ শক্তি-বিষয়ক জ্ঞান আবশ্যক। শক্তিজ্ঞানের দ্বারাই শিবজ্ঞান হইয়া থাকে।’– (তন্ত্রপরিচয়)
শিব ও শক্তি উভয়ের মধ্যে প্রভেদ যে কল্পিত, বাস্তব নয়– তা-ই দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই ভেদ-কল্পনারও সার্থকতা আছে। কারণ শিব প্রকাশস্বরূপ মাত্র। তিনি অখণ্ড পূর্ণস্বভাব। তবুও তিনি বিশেষ বিশেষ শক্তির মধ্যস্থতায় ধ্যানের বিষয়ীভূত হয়ে থাকেন। সেই আংশিক রূপ বা লক্ষণকে অভিনবগুপ্ত ‘শৈবীমুখ’ বলেছেন। তার অপর সংজ্ঞা ‘শক্তি’। শক্তি-বিষয়ক জ্ঞানের দ্বারা সাধককে শিব-বিষয়ক জ্ঞান লাভ করতে হয়। অন্য কোন উপায় নেই। সুতরাং শক্তিই হচ্ছেন শক্তিমান্ শিবের জ্ঞানের উপায়-স্বরূপ। শক্তিমান শিব হচ্ছেন– উপেয়। শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্যে–
‘যদিও শিবতত্ত্ব বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় না, তথাপি ইহা মানস জ্ঞানের বিষয় হইয়া থাকে। আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত না হইলেও মানস অনুভবের বিষয়ীভূত হইয়া থাকে। শিবও এইভাবে মানস জ্ঞানের গোচর হইতে পারেন। কিন্তু প্রথমতঃ শক্তি-বিষয়ক জ্ঞান আবশ্যক। শক্তিজ্ঞানের দ্বারাই শিবজ্ঞান হইয়া থাকে।’– (তন্ত্রপরিচয়)
তান্ত্রিকদের নিকট এই দৃশ্যমান জগৎ শিব-শক্তির বিচিত্র লীলার রঙ্গমঞ্চ। অভিনেতা রামাদির ভূমিকায় অভিনয় করলেও তিনি যেমন বাস্তবিকই নিজেকে রাম বলে মনে করেন না, বরং রাম-স্বরূপে তিনি নির্লিপ্তই থাকেন, শিব-শক্তিও তেমনি লীলার দ্বারা সংসারে লিপ্ত হয়ে যান না। তাঁর নিকট তাঁর লীলা স্বরূপতঃ সত্য না হলেও সাংসারিক জীবের নিকট অবশ্যই সত্য। সাধনার উচ্চ সোপানে আরোহণ করলে সাধক এই সংসারকেও লীলা বলে মনে করতে পারেন। এই সংসার শিব-শক্তির লীলা। শিব-শক্তির তত্ত্ব হৃদয়ে পরিস্ফুরিত হলে সর্বত্রই লীলা চোখে পড়বে। এভাবেই অধিকারী-ভেদে গ্রহণযোগ্য দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ উভয়ই তন্ত্রশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে।
লিঙ্গ-উপাসনা :
ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি যে, প্রাক্-বৈদিক ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সিন্ধু-ধর্মের প্রধানতম উপাদান হলো উর্বরতামূলক আদিম জাদুবিশ্বাস বা তার স্মারক। আর এ-বিশ্বাসের মূলসূত্র অনুসারে মানবীয় ফলপ্রসূতা ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা একই সূত্রে বাঁধা। স্বভাবতই আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই বিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে– এবং এই বিশ্বাস-উদ্ভূত নানান প্রচলিত ধর্মের ক্ষেত্রেও– জনন-অঙ্গের উপর বিশেষ গুরুত্ব-আরোপণের পরিচয় পাওয়া যায়। সিন্ধু-ধর্মও যে স্বভাবতই তার ব্যতিক্রম নয়, তার প্রমাণ হলো সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে আবিষ্কৃত অজস্র লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি। জন মার্শল প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এগুলির বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন এবং প্রায় একবাক্যে এগুলিকে সিন্ধু-ধর্মের পরিচায়ক বলেই গ্রহণ করেছেন।
এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্যেও সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋগ্বেদে শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসকেরা নিন্দিত হয়েছে। যেমন-
‘ন যাতব ইন্দ্র জুজুবুর্নো ন বন্দনা শবিষ্ঠ দেব্যাভিঃ।
স শর্ধদর্যো বিষুণস্য জন্তোর্মা শিশ্নদেবা অপি গুর্ঋৃতং নঃ’।। (ঋক-৭/২১/৫)
অর্থাৎ : হে ইন্দ্র! যাতুগণ যেন আমাদের হিংসা না করে। হে বলবত্তম ইন্দ্র! তারা যেন আমাদেরকে বেদীস্থ ব্যক্তিদের থেকে পৃথক না করে। প্রভু ইন্দ্র যেন বিষম প্রাণীর শাসনে যেন আমাদেরকে উৎসাহ দেন এবং শিশ্নদেবগণ যেন আমাদের ঋতকে পরাজিত না করে।
কিন্তু এখানে এই শিশ্নদেব বলতে ঠিক কাদেরকে বোঝানো হয়েছে? অন্য একটি ঋক থেকে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যেমন-
‘স বাজং যাতাপদুষ্পদা সন্ত্স্বর্ষাতা পরি ষদৎসনিষ্যন্ ।
অনর্বা যচ্ছতদুরস্য বেদো ঘ্নঞ্ছিশ্নদেবা অতি বর্পসা ভূৎ’।। (ঋক-১০/৯৯/৩)
অর্থাৎ : তিনি সুচারু গতিতে গমনপূর্বক যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। সর্ববস্তুর দাতা (সেই ইন্দ্র) দিতে উদ্যত হয়ে যুদ্ধে অবস্থিত হন। তিনি নিজতেজে অবিচলিতভাবে শিশ্নদেবগণকে হত্যা করতে করতে পরাভূত করে শতদ্বারবিশিষ্ট শত্রুপুরী হতে ধন অপহরণ করেন।
অতএব অনুমান হয়, ঋগ্বেদে যাদের শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসক বলে উল্লেখ করা হয়েছে তারা শুধুই যে ইন্দ্র-আক্রান্ত ও আর্যদল-লুণ্ঠিত হয়েছিলো তাই নয়, তারাই ছিলো ঐশ্বর্যপূর্ণ শতদ্বার-বিশিষ্ট শত্রুপুরীর অধিবাসীও। কিন্তু বৈদিক আর্যরা কি সিন্ধু-সভ্যতার পুর বা নগর ছাড়াও আর কোনো ঐশ্বর্যপূর্ণ পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলো? দেবীপ্রসাদ বলেন-
‘এ-জাতীয় কল্পনার পক্ষে প্রত্নতত্ত্বে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং পাবার কোনো ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনাও নেই। অপরপক্ষে, হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া অজস্র লিঙ্গ ও যোনি-মূর্তি থেকে অবশ্যই প্রমাণ হয় ওই প্রাচীন ঐশ্বর্যপূর্ণ নগরবাসীরা শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসক ছিল। অতএব এখানেও সাহিত্যমূলক সাক্ষ্যের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্বমূলক সাক্ষ্যের পূণ-সঙ্গতি দেখা যায় : সিন্ধু-অধিবাসীদেরই ঋগ্বেদ-উল্লিখিত শিশ্নদেব বলে সনাক্ত করতে হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৫)
অন্যদিকে সিন্ধু-সভ্যতাকে আর্য-কীর্তি বলে প্রতিপন্ন করার আশায় হয়তো এমন কল্পনা করা যেতে পারে যে ঋগ্বেদ-নিন্দিত ওই শিশ্নদেব বলতেও আর্য-গোষ্ঠিভুক্ত কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষই বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে শিশ্নদেবদের সঙ্গে শতদ্বারবিশিষ্ট পুরের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে এ-কথা কল্পনা করা একান্তই অসম্ভব যে প্রাচীন আর্যরাও নগর-সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। যদিও পরবর্তী কালের বৈদিক সাহিত্যে– বিশেষত যজুর্বেদ, ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্য এবং শ্রৌতসূত্রে– উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাসের প্রচুর স্মারক দেখা যায়, এক্ষেত্রে বৈদিক মানুষদের অর্থনীতিতে কৃষিকাজের ক্রমবধমান গুরুত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক অনুমেয় বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন।
কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঋগ্বেদে ওই শিশ্নদেবদের প্রতি মনোভাব যত বিরূপই হোক না কেন পরবর্তীকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসকে এ-মনোভাব খুব একটা প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় না। কেননা উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রধান পরিচয় বলতে ওই লিঙ্গ-উপাসনাই। এই উপাস্য লিঙ্গ সাধারণত শিবলিঙ্গ- বা শিব বলেই অভিহিত হয়। আর তাই ওই লিঙ্গ-উপাসনাকে শৈব-সাধনার পরিচায়ক বলে গ্রহণ করানোর উৎসাহ অকারণ মনে হয় না। এবং এই উৎসাহের পরিণাম হিসেবেই হয়তো প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ মার্শাল কর্তৃক অনুমিত হয়েছে, ‘শক্তি-সাধনার মতোই শৈব-সাধনারও সূত্রপাত প্রাচীন প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু যুগে এবং বেদোত্তর ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও শক্তি-সাধনার মতোই ওই শৈব-সাধনার অবিচ্ছিন্ন প্রভাব টিকে থেকেছে।’
এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠে, সিন্ধু যুগেও ওই উপাস্য লিঙ্গ-মূর্তিকে উত্তরকালের মতো শিব-মূর্তি বা শিব-লিঙ্গ আখ্যা দেয়া হতো কিনা তা জানা নেই; অন্তত সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের পূর্বে এ-বিষয়ে কোনো সুনিশ্চিত অনুমানেরও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, উত্তরকালে ওই ‘শিব’ নামটিকে কেন্দ্র করে যে অসংখ্য পৌরাণিক কল্পনার জটিলতা সৃষ্ট হয়েছে, এই পৌরাণিক উপাদানগুলির নির্ভুল ইতিহাস নির্ণয় করাও হয়তো একান্তই অসম্ভব। অতএব প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতায় মার্শাল কর্তৃক দাবীকৃত ‘শৈব’-সাধনার স্বাক্ষর কতোটা গ্রহণযোগ্য?
‘সিন্ধু-যুগে প্রচলিত শৈব-ধর্মের নজির হিসেবে মার্শাল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত কোণা-ভাঙা একটি সীলের উপর। এ-বিষয়ে তাঁর প্রধান যুক্তি হলো, সীলটির উপর অঙ্কিত নানা চিহ্ন থেকে শিব-কল্পনার বিভিন্ন পৌরাণিক উপাদানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়- অতএব ওই সীলের কেন্দ্রস্থ মূর্তিটিকে অবধারিতভাবেই শিবমূর্তি বলে গ্রহণ করতে হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)
কিন্তু শিবের মতো জনপ্রিয় দেবতাকে নিয়ে কল্পিত প্রচুর পৌরাণিক কাহিনীর জটিলতার মধ্য থেকে পরবর্তীকালে প্রচলিত কয়েকটি নির্বাচিত পৌরাণিক উপাদান অবলম্বন করে প্রাচীন কালের কোনো চিত্রকে অবধারিতভাবে শিবমূর্তি বলে সনাক্ত করা সুসঙ্গত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। তাছাড়া সিন্ধু-যুগের অন্যান্য এমন সীলও পাওয়া গেছে যার কেন্দ্রস্থ মূর্তিটি আলোচ্য সীলেরই অনুরূপ, কিন্তু সে মূর্তির সঙ্গে মার্শাল-আলোচিত সীলে পাওয়া পৌরাণিক উপাদানের সম্পর্ক নেই; হয়তো বা অধুনা-অজ্ঞাত-কোনো পৌরাণিক কাহিনীর সম্পর্ক-মুলক ইঙ্গিত থাকা অসম্ভব নয়। তারচেয়ে বরং ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-উপাসনার যে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তার সঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া অজস্র লিঙ্গমূর্তি যে প্রাগৈতিহাসিক অতীতের ইঙ্গিত দেয়, তার যোগসূত্র অন্বেষণের মধ্যেই হয়তো বা এর সমাধান লুকিয়ে আছে। উত্তরকালের প্রথা অনুসারে এই উপাস্য লিঙ্গমূর্তিগুলিকে আমরা যদি শিবলিঙ্গ অ্যাখ্যা দিতে সম্মত হই তা হলেই এই দিক থেকেই সিন্ধু ধর্মে শৈব-সাধনার আদি-রূপ স্বীকারযোগ্য হতে পারে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের ওই ধর্ম-বিশ্বাসে লিঙ্গ-উপাসনার এমন গভীর ও ব্যাপক প্রভাব কেন? উত্তর-লাভের মূলসূত্রটা আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি-
‘অন্যান্য নানা দেশের নানা ধর্ম-বিশ্বাসের মতোই আমাদের দেশের এই প্রাগৈতিহাসিক ধর্মবিশ্বাসটিও এক আদিম উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছিল। সেই আদিম পর্যায়ের মানুষ প্রাকৃতিক উৎপাদিকা-শক্তির বাস্তব রহস্য উদ্ঘাটন করতে শেখেনি, প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকেও মানবীয় ফলপ্রসূতার অনুরূপ বলেই কল্পনা করেছিল এবং মানবীয় প্রজননের সান্নিধ্যে বা সাহায্যে প্রাকৃতিক উৎপাদিকা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার আয়োজন করেছিল। অতএব আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই জাদুবিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানবীয় জননাঙ্গ ও তার অনুকরণের বিবিধ প্রয়োগ চোখে পড়ে; প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলি থেকে তার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়নি- সিন্ধু যুগের ধর্মবিশ্বাস থেকেও নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৭)
আবার সিন্ধু-ধর্মের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য যে মাতৃপ্রাধান্য- মার্শালের এ-সিদ্ধান্ত অবশ্য-স্বীকার্য। অথচ পৌরাণিক ইঙ্গিতের উপর নির্ভর করে পূর্বোল্লিখিত সীলের তথাকথিত শিব-মূর্তিকে তিনি পুরুষ দেবতা বলেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য সীলের মূর্তিটি পৌরাণিক শিব হোক-বা-নাই-হোক সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে যে-অজস্র লিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মূর্ত সাক্ষ্য কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়, এবং এগুলি অবধারিতভাবেই পুরুষাঙ্গের নিদর্শন। অতএব, ওই মাতৃপ্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে এগুলির নিদর্শন অন্তত কোনো-এক আপাত-অসঙ্গতির পরিচায়ক বলেই প্রতীত হয়। তাই এখানেও প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের শক্তি-সাধনায়– ওই বসুমাতা বা শাকম্ভরীর উপাসনায়– এই পুরুষতত্ত্বের তাৎপর্য কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ভারতবর্ষীয় শাক্ত ধর্ম এই প্রশ্নের উপর কী ধরনের আলোকপাত করে তা খুঁজতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী থেকে প্রথমে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যাংশের উদ্ধৃতি টানেন-
অন্যদিকে সিন্ধু-সভ্যতাকে আর্য-কীর্তি বলে প্রতিপন্ন করার আশায় হয়তো এমন কল্পনা করা যেতে পারে যে ঋগ্বেদ-নিন্দিত ওই শিশ্নদেব বলতেও আর্য-গোষ্ঠিভুক্ত কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষই বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে শিশ্নদেবদের সঙ্গে শতদ্বারবিশিষ্ট পুরের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে এ-কথা কল্পনা করা একান্তই অসম্ভব যে প্রাচীন আর্যরাও নগর-সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। যদিও পরবর্তী কালের বৈদিক সাহিত্যে– বিশেষত যজুর্বেদ, ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্য এবং শ্রৌতসূত্রে– উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাসের প্রচুর স্মারক দেখা যায়, এক্ষেত্রে বৈদিক মানুষদের অর্থনীতিতে কৃষিকাজের ক্রমবধমান গুরুত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক অনুমেয় বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন।
কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঋগ্বেদে ওই শিশ্নদেবদের প্রতি মনোভাব যত বিরূপই হোক না কেন পরবর্তীকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসকে এ-মনোভাব খুব একটা প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় না। কেননা উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রধান পরিচয় বলতে ওই লিঙ্গ-উপাসনাই। এই উপাস্য লিঙ্গ সাধারণত শিবলিঙ্গ- বা শিব বলেই অভিহিত হয়। আর তাই ওই লিঙ্গ-উপাসনাকে শৈব-সাধনার পরিচায়ক বলে গ্রহণ করানোর উৎসাহ অকারণ মনে হয় না। এবং এই উৎসাহের পরিণাম হিসেবেই হয়তো প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ মার্শাল কর্তৃক অনুমিত হয়েছে, ‘শক্তি-সাধনার মতোই শৈব-সাধনারও সূত্রপাত প্রাচীন প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু যুগে এবং বেদোত্তর ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও শক্তি-সাধনার মতোই ওই শৈব-সাধনার অবিচ্ছিন্ন প্রভাব টিকে থেকেছে।’
এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠে, সিন্ধু যুগেও ওই উপাস্য লিঙ্গ-মূর্তিকে উত্তরকালের মতো শিব-মূর্তি বা শিব-লিঙ্গ আখ্যা দেয়া হতো কিনা তা জানা নেই; অন্তত সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের পূর্বে এ-বিষয়ে কোনো সুনিশ্চিত অনুমানেরও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, উত্তরকালে ওই ‘শিব’ নামটিকে কেন্দ্র করে যে অসংখ্য পৌরাণিক কল্পনার জটিলতা সৃষ্ট হয়েছে, এই পৌরাণিক উপাদানগুলির নির্ভুল ইতিহাস নির্ণয় করাও হয়তো একান্তই অসম্ভব। অতএব প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতায় মার্শাল কর্তৃক দাবীকৃত ‘শৈব’-সাধনার স্বাক্ষর কতোটা গ্রহণযোগ্য?
‘সিন্ধু-যুগে প্রচলিত শৈব-ধর্মের নজির হিসেবে মার্শাল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত কোণা-ভাঙা একটি সীলের উপর। এ-বিষয়ে তাঁর প্রধান যুক্তি হলো, সীলটির উপর অঙ্কিত নানা চিহ্ন থেকে শিব-কল্পনার বিভিন্ন পৌরাণিক উপাদানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়- অতএব ওই সীলের কেন্দ্রস্থ মূর্তিটিকে অবধারিতভাবেই শিবমূর্তি বলে গ্রহণ করতে হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)
কিন্তু শিবের মতো জনপ্রিয় দেবতাকে নিয়ে কল্পিত প্রচুর পৌরাণিক কাহিনীর জটিলতার মধ্য থেকে পরবর্তীকালে প্রচলিত কয়েকটি নির্বাচিত পৌরাণিক উপাদান অবলম্বন করে প্রাচীন কালের কোনো চিত্রকে অবধারিতভাবে শিবমূর্তি বলে সনাক্ত করা সুসঙ্গত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। তাছাড়া সিন্ধু-যুগের অন্যান্য এমন সীলও পাওয়া গেছে যার কেন্দ্রস্থ মূর্তিটি আলোচ্য সীলেরই অনুরূপ, কিন্তু সে মূর্তির সঙ্গে মার্শাল-আলোচিত সীলে পাওয়া পৌরাণিক উপাদানের সম্পর্ক নেই; হয়তো বা অধুনা-অজ্ঞাত-কোনো পৌরাণিক কাহিনীর সম্পর্ক-মুলক ইঙ্গিত থাকা অসম্ভব নয়। তারচেয়ে বরং ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-উপাসনার যে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তার সঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া অজস্র লিঙ্গমূর্তি যে প্রাগৈতিহাসিক অতীতের ইঙ্গিত দেয়, তার যোগসূত্র অন্বেষণের মধ্যেই হয়তো বা এর সমাধান লুকিয়ে আছে। উত্তরকালের প্রথা অনুসারে এই উপাস্য লিঙ্গমূর্তিগুলিকে আমরা যদি শিবলিঙ্গ অ্যাখ্যা দিতে সম্মত হই তা হলেই এই দিক থেকেই সিন্ধু ধর্মে শৈব-সাধনার আদি-রূপ স্বীকারযোগ্য হতে পারে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের ওই ধর্ম-বিশ্বাসে লিঙ্গ-উপাসনার এমন গভীর ও ব্যাপক প্রভাব কেন? উত্তর-লাভের মূলসূত্রটা আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি-
‘অন্যান্য নানা দেশের নানা ধর্ম-বিশ্বাসের মতোই আমাদের দেশের এই প্রাগৈতিহাসিক ধর্মবিশ্বাসটিও এক আদিম উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছিল। সেই আদিম পর্যায়ের মানুষ প্রাকৃতিক উৎপাদিকা-শক্তির বাস্তব রহস্য উদ্ঘাটন করতে শেখেনি, প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকেও মানবীয় ফলপ্রসূতার অনুরূপ বলেই কল্পনা করেছিল এবং মানবীয় প্রজননের সান্নিধ্যে বা সাহায্যে প্রাকৃতিক উৎপাদিকা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার আয়োজন করেছিল। অতএব আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই জাদুবিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানবীয় জননাঙ্গ ও তার অনুকরণের বিবিধ প্রয়োগ চোখে পড়ে; প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলি থেকে তার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়নি- সিন্ধু যুগের ধর্মবিশ্বাস থেকেও নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৭)
আবার সিন্ধু-ধর্মের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য যে মাতৃপ্রাধান্য- মার্শালের এ-সিদ্ধান্ত অবশ্য-স্বীকার্য। অথচ পৌরাণিক ইঙ্গিতের উপর নির্ভর করে পূর্বোল্লিখিত সীলের তথাকথিত শিব-মূর্তিকে তিনি পুরুষ দেবতা বলেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য সীলের মূর্তিটি পৌরাণিক শিব হোক-বা-নাই-হোক সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে যে-অজস্র লিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মূর্ত সাক্ষ্য কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়, এবং এগুলি অবধারিতভাবেই পুরুষাঙ্গের নিদর্শন। অতএব, ওই মাতৃপ্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে এগুলির নিদর্শন অন্তত কোনো-এক আপাত-অসঙ্গতির পরিচায়ক বলেই প্রতীত হয়। তাই এখানেও প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের শক্তি-সাধনায়– ওই বসুমাতা বা শাকম্ভরীর উপাসনায়– এই পুরুষতত্ত্বের তাৎপর্য কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ভারতবর্ষীয় শাক্ত ধর্ম এই প্রশ্নের উপর কী ধরনের আলোকপাত করে তা খুঁজতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী থেকে প্রথমে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যাংশের উদ্ধৃতি টানেন-
‘তন্ত্রের শাক্ত সাধকগণ বলেন যে, শিব তো স্থাণু-সদৃশ একটা বিদ্যমানতার দ্যোতকমাত্র, তাঁহার উপাসনা করি কোন্ হিসাবে। শক্তি না থাকিলে শিব তো শব, অথচ শক্তি-শূন্যে শিব হইতেই পারেন না। অতএব শিব আছেন, মাথার উপর থাকুন, আমরা মায়ের– আদ্যাশক্তির– উপাসনা করিব। কারণ, তিনিই তো সব– তিনি মেধা, তিনি মায়া, তিনি লজ্জা, তিনি ক্ষমা, তিনি বুদ্ধি, তিনি ধৃতি, তিনি বিদ্যা, তিনি ছাড়া, তিনি শান্তি, তিনি ক্ষান্তি– তাঁহাকে পূজা করিব না তো কাহার পূজা করিব?’
অতঃপর দেবীপ্রসাদ বলেন- ‘অতএব দেখা যায়, উত্তরকালের শাক্ত-তত্ত্ব ঐকান্তিক অর্থে মাতৃপ্রধান হলেও তার মধ্যে শিব বা পুরুষতত্ত্বের যে কোনো-ভাবেই হোক না কেন একটা স্থান থেকে গিয়েছে। শক্তিই প্রধান, শক্তিই মূলতত্ত্ব, তবুও অন্তত গৌণ অর্থে শিব বা পুরুষ-তত্ত্বও স্বীকৃত হয়েছে। স্বভাবতই এই প্রসঙ্গে সাংখ্য-দর্শনের কথা মনে পড়ে : প্রকৃতিই প্রধান তবু পুরুষও সত্য- যদিচ এই পুরুষ অপ্রধান এবং উদাসীন মাত্র।… আপাতত মন্তব্য হলো, পরবর্তীকালের শাক্ত-ধর্মকে যদি সিন্ধু-ধর্মেরই রেশ বলে স্বীকার করা হয় তা হলে অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে সিন্ধু-যুগের ওই প্রাগৈতিহাসিক শাক্ত-ধর্মের মধ্যেই আলোচ্য বৈশিষ্ট্যের বীজ ছিল- হয়তো তারই মূর্ত নিদর্শন হলো ওই বসুমাতামূলক ধর্মবিশ্বাসের স্মারকগুলির মধ্যে যোনি-মূর্তি ছাড়াও লিঙ্গ-মূর্তি বা শিবলিঙ্গগুলি। অতএব সিন্ধু-ধর্মেও এই শিবলিঙ্গ নির্দেশিত পুরুষ তত্ত্বের স্থান গৌণ– অপ্রধান এবং উদাসীন– বলেই অনুমেয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৮)
যদিও অবশ্যই উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে শক্তি-সাধনা ও শৈব-সাধনার মধ্যে পার্থক্য ও প্রভেদ ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং শৈব-ধর্মে ওই শিব বা পুরুষ-তত্ত্ব স্বভাবতই স্বাতন্ত্র এবং প্রাধান্য লাভ করেছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সেখানেও ওই আদিম মাতৃতত্ত্বের– শক্তির বা প্রকৃতির– গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়নি। যেমন উদাহরণস্বরূপ, শৈব-সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘হর’ বা ‘শিব’ (ঈশ্বর) সৃষ্টির নিমিত্ত-কারণ মাত্র; সৃষ্টির উপাদান-কারণ বলতে ‘মায়া’ বা ‘প্রকৃতি’। এদিক থেকে অনুমান হয়, উত্তরকালের শৈব-সাধনায় শিব বা পুরুষতত্ত্বের উপর যতোখানিই আপেক্ষিক গুরুত্ব আরোপিত হোক না কেন তা থেকে ওই আদিম মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান বিশ্বাসের চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়নি বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। অবশ্যই উত্তরকালের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওই মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের অকৃত্রিম ও প্রকৃষ্টতম পরিচয় শক্তি-সাধনা বা তন্ত্র সাধনাতেই- এই তন্ত্র-সাধনা পরবর্তীকালে যতই জটিল ও পল্লবিত রূপ গ্রহণ করুক না কেন।
এ পর্যায়ে এসে আমাদেরকে একটি আপাত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, সিন্ধু-সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজ অবশ্যই মাতৃপ্রধান। কিন্তু নগর-সভ্যতার সুউন্নত পর্যায়েও সমাজ-ব্যবস্থা মাতৃপ্রধান ছিলো এমনটা বলার উপায় নেই। উন্নততর কৃষিকাজের পর্যায়ে গৃহপালিত পশুর সাহায্যে লাঙল দেবার ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কৃষিকাজে পুরুষের ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠায় ক্রমশ সমাজ-ব্যবস্থাও পুরুষ প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজ-ব্যবস্থায় মাতৃ-প্রাধান্য ক্ষুণ্ন ও পরিবর্তিত হলেও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে মাতৃপ্রাধান্যের সুস্পষ্ট স্মারক রয়ে গেছে। তার সাথে পুরুষবাচক কিছু কিছু সহায়ক উপজীবিকা যুক্ত হয়েছে হয়তো, যদিও তা অপ্রধান। যেহেতু কৃষিভিত্তিক উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসগুলো বরাবরই মাতৃপ্রাধান্যমূলক, তাই সেটি অক্ষুণ্ন থেকেই হয়তো পরবর্তীকালে সেখানে প্রকৃতির সমরূপী প্রজননমূলক জাদুবিশ্বাস হিসেবে আচার-বিশ্বাসে প্রতীকি লিঙ্গ-সাধনার বিষয়টি কালক্রমে ঢুকে গেছে। তারপরও তার অপ্রাধান্যের কারণেই হয়তোবা সেই সিন্ধুবাসীদেরকে পরবর্তীকালের আধিপত্যবাদী আর্য-প্রচারকরা ঋগ্বেদে শিশ্নদেব বলে বিদ্রুপ ও নিন্দা করেছেন। তবে ওই সুপ্রাচীন মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান ধর্ম-বিশ্বাসের সুস্পষ্ট দার্শনিক পরিণতি প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনে ঘটেছিলো বলেই অনুমান হয়। এবং যেহেতু ওই প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুসারে আদি-মাতৃকা বলতে বসুমাতা বা পৃথিবী, সেই কারণেই এ-তত্ত্বের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে সাংখ্যদর্শনেও সৃষ্টির আদি কারণ বলতে জড়-রূপা প্রকৃতি বা প্রধান বা মায়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘পুরুষ’-তত্ত্ব পরিচয় পাওয়া যায় এই দর্শনে। সাংখ্য-দর্শনের আদি-অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে ওই ‘পুরুষ’-তত্ত্বের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, সাংখ্যর পুরুষ ‘অপ্রধান’ ও ‘উদাসীন’ বলেই প্রখ্যাত– উত্তরকালের শাক্ত-সাধকদের কাছে যেমন শক্তিই প্রধান, যদিও ‘শিব আছে, মাথায় থাকুন–কিন্তু শক্তি-শূন্য শিব তো শবের মতোই’।
তবে এ-প্রসঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, পুরুষ-প্রধান বৈদিক ঐহিহ্যের দার্শনিক পরিণতির ক্ষেত্রে তথা উপনিষদের চিন্তাধারায় পুরুষই চরম তত্ত্ব, শেষ সত্য। যেমন কঠ-উপনিষদে বলা হয়েছে-
যদিও অবশ্যই উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে শক্তি-সাধনা ও শৈব-সাধনার মধ্যে পার্থক্য ও প্রভেদ ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং শৈব-ধর্মে ওই শিব বা পুরুষ-তত্ত্ব স্বভাবতই স্বাতন্ত্র এবং প্রাধান্য লাভ করেছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সেখানেও ওই আদিম মাতৃতত্ত্বের– শক্তির বা প্রকৃতির– গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়নি। যেমন উদাহরণস্বরূপ, শৈব-সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘হর’ বা ‘শিব’ (ঈশ্বর) সৃষ্টির নিমিত্ত-কারণ মাত্র; সৃষ্টির উপাদান-কারণ বলতে ‘মায়া’ বা ‘প্রকৃতি’। এদিক থেকে অনুমান হয়, উত্তরকালের শৈব-সাধনায় শিব বা পুরুষতত্ত্বের উপর যতোখানিই আপেক্ষিক গুরুত্ব আরোপিত হোক না কেন তা থেকে ওই আদিম মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান বিশ্বাসের চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়নি বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। অবশ্যই উত্তরকালের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওই মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের অকৃত্রিম ও প্রকৃষ্টতম পরিচয় শক্তি-সাধনা বা তন্ত্র সাধনাতেই- এই তন্ত্র-সাধনা পরবর্তীকালে যতই জটিল ও পল্লবিত রূপ গ্রহণ করুক না কেন।
এ পর্যায়ে এসে আমাদেরকে একটি আপাত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, সিন্ধু-সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজ অবশ্যই মাতৃপ্রধান। কিন্তু নগর-সভ্যতার সুউন্নত পর্যায়েও সমাজ-ব্যবস্থা মাতৃপ্রধান ছিলো এমনটা বলার উপায় নেই। উন্নততর কৃষিকাজের পর্যায়ে গৃহপালিত পশুর সাহায্যে লাঙল দেবার ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কৃষিকাজে পুরুষের ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠায় ক্রমশ সমাজ-ব্যবস্থাও পুরুষ প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজ-ব্যবস্থায় মাতৃ-প্রাধান্য ক্ষুণ্ন ও পরিবর্তিত হলেও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে মাতৃপ্রাধান্যের সুস্পষ্ট স্মারক রয়ে গেছে। তার সাথে পুরুষবাচক কিছু কিছু সহায়ক উপজীবিকা যুক্ত হয়েছে হয়তো, যদিও তা অপ্রধান। যেহেতু কৃষিভিত্তিক উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসগুলো বরাবরই মাতৃপ্রাধান্যমূলক, তাই সেটি অক্ষুণ্ন থেকেই হয়তো পরবর্তীকালে সেখানে প্রকৃতির সমরূপী প্রজননমূলক জাদুবিশ্বাস হিসেবে আচার-বিশ্বাসে প্রতীকি লিঙ্গ-সাধনার বিষয়টি কালক্রমে ঢুকে গেছে। তারপরও তার অপ্রাধান্যের কারণেই হয়তোবা সেই সিন্ধুবাসীদেরকে পরবর্তীকালের আধিপত্যবাদী আর্য-প্রচারকরা ঋগ্বেদে শিশ্নদেব বলে বিদ্রুপ ও নিন্দা করেছেন। তবে ওই সুপ্রাচীন মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান ধর্ম-বিশ্বাসের সুস্পষ্ট দার্শনিক পরিণতি প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনে ঘটেছিলো বলেই অনুমান হয়। এবং যেহেতু ওই প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুসারে আদি-মাতৃকা বলতে বসুমাতা বা পৃথিবী, সেই কারণেই এ-তত্ত্বের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে সাংখ্যদর্শনেও সৃষ্টির আদি কারণ বলতে জড়-রূপা প্রকৃতি বা প্রধান বা মায়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘পুরুষ’-তত্ত্ব পরিচয় পাওয়া যায় এই দর্শনে। সাংখ্য-দর্শনের আদি-অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে ওই ‘পুরুষ’-তত্ত্বের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, সাংখ্যর পুরুষ ‘অপ্রধান’ ও ‘উদাসীন’ বলেই প্রখ্যাত– উত্তরকালের শাক্ত-সাধকদের কাছে যেমন শক্তিই প্রধান, যদিও ‘শিব আছে, মাথায় থাকুন–কিন্তু শক্তি-শূন্য শিব তো শবের মতোই’।
তবে এ-প্রসঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, পুরুষ-প্রধান বৈদিক ঐহিহ্যের দার্শনিক পরিণতির ক্ষেত্রে তথা উপনিষদের চিন্তাধারায় পুরুষই চরম তত্ত্ব, শেষ সত্য। যেমন কঠ-উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।
পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।।’ (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)
অর্থাৎ : ‘মহৎ’-এর চেয়ে ‘অব্যক্ত’ (‘প্রকৃতি’) শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে ‘পুরুষ’ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নয়। তিনিই শেষ, তিনিই পরা গতি অর্থাৎ চূড়ান্ত পরিণতি।
ঋগ্বেদের ‘পুরুষ-সূক্তে’ এই চিন্তাধারার সূত্রপাত মনে করা হয় এবং ঔপনিষদিক দর্শনে তার চূড়ান্ত পরিণতি। স্বভাবতই বৈদিক চিন্তাবিকাশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ‘পুরুষ’ শব্দের অর্থ অপরিবর্তিত নয়। যেমন ছান্দোগ্য-উপনিষদে দেখা যায় এই ‘পুরুষ’ এক জ্যোতির্ময় ‘অ-মানব’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন-
তাঁরা (যারা মৃত্যুর পর অর্চিলোক প্রাপ্ত হন) সেখান (অর্চি, দিন, শুক্লপক্ষ, উত্তরায়ণের ছয় মাস) থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রে এবং চন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে [ব্রহ্মলোক থেকে] এক ‘অমানব-পুরুষ’ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ।‘মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাৎ আদিত্যম্ আদিত্যাচ্চন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষোহমানবঃ স এনান্-ব্রহ্ম গময়ত্যেষ দেবযানঃ পন্থা ইতি।’ (ছান্দোগ্য-৫/১০/২)
অর্থাৎ :
এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, এই অমৃতময় ‘পুরুষ’ চিৎস্বরূপ ব্রহ্ম বা আত্মার সঙ্গে অভিন্ন-
‘অয়মাত্মা সর্বেষাং ভূতানাং মধু, অস্যাত্মনঃ সর্বাণি ভূতানি মধু। যশ্চায়ম্ অস্মিন্নাত্মনি তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুরুষো যশ্চায়মাত্মা তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুরুষোহয়মেব স যোহয়মাত্মা, ইদং অমৃতমিদং ব্রহ্মেদং সর্বম্ ।’ (বৃহদারণ্যক-২/৫/১৪)
অর্থাৎ :
এই আত্মা অর্থাৎ দেহ যাবতীয় বস্তুর মধু। যাবতীয় বস্তুও এই দেহের কাছে মধুস্বরূপ। এই দেহে যে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ আছেন আর দেহ মধ্যে যে জীবাত্মারূপী তেজোময় অমৃতময় অধ্যাত্ম পুরুষ আছেন- দুই-ই এক। ইনি অমৃত, ইনি ব্রহ্ম। ইনিই সব কিছু।
কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, উপনিষদ-প্রতিপাদ্য ওই পরব্রহ্ম বা পরমতত্ত্বকে বোঝাবার উদ্দেশ্যেও প্রাচীন ‘পুরুষ’ শব্দটি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়নি। এবং উপনিষদের স্থান-বিশেষে এমন ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে যা থেকে অনুমান হয় এই অমূর্ত দার্শনিক তত্ত্বটির নিচে একান্ত মূর্ত ও মানবাত্মক অর্থ ঢাকা পড়ে আছে। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে লক্ষ্যণীয়-
‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ।
অজো হ্যেকো জুষমাণোহনুশেতে জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ।।’-(শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
অর্থাৎ :
প্রকৃতি নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ বা কালো। একজন অজ্ঞান জীব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা ভোগ করে। কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল ব্যক্তি পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন তিনি বুঝেছেন যে এই স্থূল জগৎ অজ্ঞান-অবিদ্যারূপী ক্ষণস্থায়ী; সেই কারণেই তিনি এই জগৎকে ত্যাগ করেন।
তাই দেবীপ্রসাদ বলেন- ‘স্বভাবতই উপনিষদের চিন্তাধারায় চিন্ময় ব্রহ্ম অর্থে পুরুষ-তত্ত্বের উপর এ-জাতীয় ঐকান্তিক গুরুত্ব আরোপণের ফলে জড়রূপা প্রকৃতি বা মায়া, অজ্ঞান বা অবিদ্যা-বোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই মায়া-নিবৃত্তিই উপনিষদে পরম-পুরুষার্থ বলে ঘোষিত। অতএব অত্যন্ত সুপ্রাচীন কালেই– উপনিষদের যুগেই– ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট মতাদর্শগত সংঘাত পরিলক্ষিত হয় : একদিকে আদিম মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে জড়রূপা প্রকৃতি বা মায়াকে প্রধান বলে গ্রহণ করবার পরিচয়, অপর দিকে আদিম পুরুষপ্রধান বিশ্বাসের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে প্রকৃতি বা মায়াকে অবিদ্যা বা মিথ্যা বলে উপেক্ষা করে চিন্ময় পুরুষ বা ব্রহ্মকেই পরম-সত্তা বা পরম-তত্ত্ব বলে গ্রহণ করবার পরিচয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৯)
পরবর্তীকালের দার্শনিক আলোচনায় ব্রহ্মবাদী বেদান্ত-দর্শন ও প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনের মধ্যকার দার্শনিক সংঘাতের তাৎপর্যটাও যে এখানেই লুকায়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বেদান্তদর্শনের সূত্রগ্রন্থ ‘ব্রহ্মসূত্রে’ বিরাট অংশ জুড়ে সাংখ্য-খণ্ডনের আয়োজন এ-কারণেই। এছাড়া প্রাচীন নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বরে রূপান্তরের প্রয়াস এবং সমান্তর দর্শন হিসেবে সেশ্বর-সাংখ্য হিসেবে পরিচিত যোগ-দর্শনের জন্ম-বৃত্তান্তও খুব সম্ভবত এখানেই জড়িয়ে আছে। এ-প্রেক্ষিতে সিন্ধু-ধর্মের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ আবশ্যক।
‘সীলের উপর অঙ্কিত যে-মূর্তিকে মার্শাল পৌরাণিক শিব বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন সেটি প্রকৃত শিব-মূর্তি হোক আর নাই হোক তার আসন-ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য অবশ্যই লক্ষণীয়। কেননা পরবর্তী কালের ধর্ম-সাধনার ক্ষেত্রে এরই নাম যোগাসন– যোগ-সাধনার আসন-ভঙ্গি। বস্তুত মার্শাল নিজেও এই আসন-ভঙ্গিকে যোগাসন বলেই সনাক্ত করেছেন। তাঁর যুক্তি হলো, পুরাণের শিব ‘যোগী’ অতএব আলোচ্য মূর্তির ওই যোগাসন থেকেও তাকে শিবমূর্তি বলেই গ্রহণ করতে হবে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য সীল এবং কোনো কোনো ভগ্ন প্রস্তরমূর্তিতে এই আসন ভঙ্গিরই পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব এই মূর্ত প্রমাণগুলির দিক থেকে আমরা অনুমান করতে বাধ্য, যে সিন্ধু যুগেও ‘যোগ’-সাধনা প্রচলিত ছিল, কিংবা উত্তরকালে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘যোগ’ সিন্ধু-ধর্মের মধ্যেই তার সুস্পষ্ট সূত্রপাত দেখা যায়।
কিন্তু সিন্ধু-ধর্মে যোগ-সাধনর নিদর্শক হিসেবে শুধুমাত্র এগুলির উপরই নির্ভর করবার প্রয়োজন নেই। বস্তুত এগুলি আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই রমাপ্রসাদ চন্দ মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত দু’টি প্রস্তরমূর্তির বিশেষত চোখের ভঙ্গি থেকে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় ভাস্কর্যে যোগী-মূর্তি রচনার যে-বিশিষ্ট রীতি দেখা যায় তার সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর ওই প্রস্তরমূর্তিগুলির অত্যন্ত নিকট সাদৃশ্য সুস্পষ্ট।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৯-৮০)
কী সেই সাদৃশ্য? রমাপ্রসাদ চন্দ বলছেন (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮০)-
অতএব সিন্ধু-ধর্মে যোগ-সাধনার পরিচয় উপেক্ষা করা যায় না। অবশ্যই পরবর্তীকালে এই সাধন-পদ্ধতি অত্যন্ত পল্লবিত রূপ গ্রহণ করেছে এবং পরবর্তীকালে ‘যোগ’ নামের একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক সম্প্রদায়েরও পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সিন্ধু-যুগে যোগ-সাধনা কতখানি পল্লবিত ও জটিল রূপ গ্রহণ করেছিলো এবং ‘যোগ’ নামের কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় একান্তই গড়ে উঠেছিলো কিনা সে-কথা প্রত্নতত্ত্বমূলক গবেষণার বর্তমান পর্যায়ে– বিশেষত সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের পূর্বে– আমাদের পক্ষে জানতে পারা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু-
‘একটি কথা অবশ্যই অবধারিতভাবে প্রমাণ হয় : উত্তরকালে এই যোগের রূপ ও রূপান্তর যেমনই হোক না কেন, একে যেভাবে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে দাবি করা হয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে একান্তই অবাস্তব; কেননা বাস্তব ঘটনা হলো শ্রুতি– এমনকি ঋগ্বেদ-সংহিতা– রচিত হবার সহস্রাধিক বছর পূর্বেই এবং আর্য-পূর্বদের মধ্যেই এই সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বৈদিক ঐহিহ্যের বাহকেরা যে-অর্থেই এবং যে-কোনো কারণেই এই সাধন-পদ্ধতিকে স্বীকার এবং গ্রহণ করুন না কেন, একে প্রকৃতপক্ষে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে কল্পনা করবার কোনো রকম সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮১)
যোগ যে আদিতে কোনো-এক অ-বৈদিক বা বেদ-বহির্ভূত সাধন-পদ্ধতি ছিলো– বিশেষ করে মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের পর– বিদ্বান ও পণ্ডিতদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। ওই অ-বৈদিক সাধন-পদ্ধতির ইতিহাস যে কতো প্রাচীন এ-বিষয়েও সংশয় নেই। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা যে বৈদিক আর্যদের আক্রমণেই বিধ্বস্ত হয়েছিলো- একথা অনুমিত হবার পর আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের কয়েকটি সাক্ষ্য বিষয়ে নতুন করে বিচার করবার প্রয়োজন হয়েছে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে প্রতর্দনের প্রতি ইন্দ্র যখন আস্ফালন করে বলছেন-
‘একটি কথা অবশ্যই অবধারিতভাবে প্রমাণ হয় : উত্তরকালে এই যোগের রূপ ও রূপান্তর যেমনই হোক না কেন, একে যেভাবে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে দাবি করা হয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে একান্তই অবাস্তব; কেননা বাস্তব ঘটনা হলো শ্রুতি– এমনকি ঋগ্বেদ-সংহিতা– রচিত হবার সহস্রাধিক বছর পূর্বেই এবং আর্য-পূর্বদের মধ্যেই এই সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বৈদিক ঐহিহ্যের বাহকেরা যে-অর্থেই এবং যে-কোনো কারণেই এই সাধন-পদ্ধতিকে স্বীকার এবং গ্রহণ করুন না কেন, একে প্রকৃতপক্ষে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে কল্পনা করবার কোনো রকম সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮১)
যোগ যে আদিতে কোনো-এক অ-বৈদিক বা বেদ-বহির্ভূত সাধন-পদ্ধতি ছিলো– বিশেষ করে মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের পর– বিদ্বান ও পণ্ডিতদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। ওই অ-বৈদিক সাধন-পদ্ধতির ইতিহাস যে কতো প্রাচীন এ-বিষয়েও সংশয় নেই। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা যে বৈদিক আর্যদের আক্রমণেই বিধ্বস্ত হয়েছিলো- একথা অনুমিত হবার পর আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের কয়েকটি সাক্ষ্য বিষয়ে নতুন করে বিচার করবার প্রয়োজন হয়েছে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে প্রতর্দনের প্রতি ইন্দ্র যখন আস্ফালন করে বলছেন-
‘ত্রিশীর্ষাণাং ত্বাষ্ট্রম্ অহনম্ । অরুণ্মুখান্ যতীন্ সালাবৃকেভ্যঃ প্রাযচ্ছং। বহ্বীঃ সন্ধা অতিক্রম্য দিবি প্রহ্লাদীয়ান্ অতৃণম্ অহম্ অন্তরীক্ষে পৌলোমান্, পৃথিব্যাং কালখাঞ্জান্ । তস্য মে তত্র ন লোম চ মা মীয়তে।’- (কৌষীতকি-৩/১)
অর্থাৎ :
আমি ত্রিশীর্ষ ত্বষ্টৃপুত্রকে হত্যা করেছি; আমি অরুণ্মুখ যতিদেরকে সালাবৃকের অর্থাৎ নেকড়ের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছি। অনেক সন্ধিকে লঙ্ঘন করে আমিই স্বর্গে প্রহ্লাদের অসুরদলের অসুরদের, অন্তরীক্ষে পুলোমার আর পৃথিবীতে কালখঞ্জের অনুচরদের নিধন করেছি। এত বিশাল বিশাল কাজ করেও আমার একটা কেশও কারো নষ্ট করার সাধ্য হয়নি।
এখানে ত্রিশীর্ষ বিশেষণটি চিত্তাকর্ষক, কেননা সিন্ধু-সভ্যতার যে-মূর্তিটিকে মার্শাল যোগী-শিব বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন সেটিও সম্ভবত ত্রিশীর্ষ এবং সিন্ধু-সভ্যতার অন্যান্য সীলেও তিনটি শিংযুক্ত মূর্তি পাওয়া গেছে বলে দেবীপ্রসাদের ভাষ্য। যদিও এই ত্রিশীর্ষ বিষয়ক উপনিষদীয় উদ্ধৃতির প্রকৃত পৌরাণিক ব্যাখ্যা বহুলাংশেই বিতর্কসাপেক্ষ। কেননা, পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ত্বষ্ট্রা মানে বিশ্বকর্মা এবং ত্রিশীর্ষ ত্বষ্ট্রাপুত্র হলো বিশ্বরূপ। কিন্তু ইন্দ্রের উপরিউক্ত উক্তির মধ্যে আরও চিত্তাকর্ষক বক্তব্য হলো, আমি অরুণ্মুখ যতিদেরকে সালাবৃকের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছি। সালাবৃক মানে নেকড়ে বা হায়না, অরুণ্মুখ মানে বেদনার্ত-মুখ হওয়া সম্ভব।
কিন্তু ‘যতি’ মানে কী? এর সাধারণ অর্থ করা হয় তপস্বী। তবে মুণ্ডক-উপনিষদ এবং গীতার উক্তি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় এই যতিরা প্রকৃত যোগ-সাধকই ছিলো। কেননা এই গ্রন্থগুলিতে যোগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যতিদের সুস্পষ্টভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। যোগসূত্র অনুসারে যোগ-এর আটটি অঙ্গ-
‘যমনিয়মাসন-প্রাণায়ামপ্রত্যাহারধারণাধ্যানসমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি’- (যোগসূত্র : ২/২৯)
অর্থাৎ : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ।
মুণ্ডক উপনিষদে যতিদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
যাঁরা বেদান্তশাস্ত্রের মর্মার্থ জেনেছেন, সন্ন্যাস ও যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে যেসব যতির চিত্তশুদ্ধি হয়েছে, তাঁরা এই জীবনেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন এবং মৃত্যুকালে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন (মুণ্ডক-৩/২/৬)। কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুসরণ ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাসের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করতে হয়। দেহের মধ্যে সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার উপলব্ধির মাধ্যমে যতিরা শুদ্ধ ও অনাসক্ত হয় (মুণ্ডক-৩/১/৫)।‘বেদান্তবিজ্ঞানসুনিশ্চিতার্থাঃ সন্ন্যাসযোগাৎ যতয়ঃ শুদ্ধসত্ত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্বে।।’- (মুণ্ডক-৩/২/৬)
‘সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ আত্মা সম্যগ্জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্যেণ নিত্যম্ ।
অন্তঃশরীরে জ্যোতির্ময়ো হি শুভ্রো যং পশ্যন্তি যতয়ঃ ক্ষীণদোষাঃ।। (মুণ্ডক-৩/১/৫)
অর্থাৎ :
আর গীতায় বলা হয়েছে যতিরা ‘প্রাণায়াম-পরায়ণাঃ’, তারা কাম-ক্রোধ-বিযুক্ত ও সংযতচিত্ত, তারা যোগ-ধারণাসম্পন্ন। যেমন-
‘দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাহপরে।
স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ।।’ (ভগবদ্গীতা-৪/২৮)
‘অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেহপানং তথাহপরে।
প্রাণাপানগতী রদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।।’ (ভগবদ্গীতা-৪/২৯)
‘কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্ ।
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্ ।।’ (ভগবদ্গীতা-৫/২৬)
অর্থাৎ :
যতিরা ত্যাগ, তপস্যা, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার ও স্বাধ্যায় ইত্যাদি যোগরূপ সাধনা করেন (গীতা-৪/২৮)। তাঁরা প্রাণ ও অপান বায়ুর দ্বারা গ্রহণ, আহুতি ও রুদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে পূরক, রেচক ও কুম্ভকরূপ প্রাণায়াম-পরায়ণ যোগ-সাধক (গীতা-৪/২৯)। কাম-ক্রোধ-বিযুক্ত ও সংযতচিত্ত যতিগণ জীবিতাবস্থায় ও মৃত্যুর পরে উভয়ত ব্রহ্ম-নির্বাণ লাভ করেন (গীতা-৫/২৬)।
অতএব এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, যতিরা যোগ-সাধক। যোগ-সাধনার প্রধান লক্ষণগুলি যতিদের মধ্যে দেখা যায়। তাহলে তাদের প্রতি ইন্দ্রের ওই আক্রোশ কেন? এখানে উল্লেখ্য, ইন্দ্র যে যতিদেরকে হায়নার মুখে সমর্পণ করেছিলেন তার স্মৃতি শুধুমাত্র কৌষীতকি উপনিষদের মধ্যেই আবদ্ধ নয়; তৈত্তিরীয় সংহিতা (তৈঃ সঃ-৩/৩/৭/৩, ২/৫/১/১), ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ঐঃ ব্রাঃ-৭/২৮), শতপথ ব্রাহ্মণ (শঃ ব্রাঃ-১/২/৩/২, ১২/৭/১/১), পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ (পঃ ব্রাঃ-১৪/১১/২৮) এবং জৈমিনীয় ব্রাহ্মণেও (জৈঃ ব্রাঃ-১/১৮৫-৬) বারবার একই কথা পাওয়া যায়– ইন্দ্র যতিদের সালাবৃকের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া যতিরা যে অত্যন্ত প্রাচীন কালের যোগ-সাধক ছিলো– ঋগ্বেদে তাদের উল্লেখ থেকে এ-কথা সহজেই অনুমতি হয়। যেমন-
‘তৎ তভ্যামি সুবীর্য্যম তদ্ ব্রহ্ম পূর্বচিত্তয়ে।
য ন যতিভ্যঃ ভর্গবে ধনে হিত য ন প্রষ্কণ্বমাভিতঃ।।’- (ঋগ্বেদ-৮/৩/৯)
অর্থাৎ : হে বীর্যবান ইন্দ্র, তোমার নিকট পূর্ব-যুগের প্রজ্ঞাবিশিষ্ট ব্যক্তিদের অপেক্ষা অধিক অন্ন যাঞ্চা করছি। যতিদের নিকট থেকে ভৃগুদের ধন প্রদান করে তার দ্বারা কণ্বের পুত্রকে রক্ষা কর।
টীকাকার সায়ণের ব্যাখ্যা অনুসারে ‘যতি’র অর্থ হলো, কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন যজ্ঞবিহীন জনগণ। তৈত্তিরীয় সংহিতা থেকে কৌষীতকি উপনিষদ পর্যন্ত যতিদের প্রতি ইন্দ্রের যে বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হতে পারে না। কিন্তু যতিদের প্রতি ইন্দ্রের এই নিষ্ঠুরতা কেন? ১৯২৯ সালেই শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই প্রশ্নের একটি উত্তর দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালের প্রত্নতত্ত্বমূলক আবিষ্কারের আলোয় সে-উত্তরের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে বলেই অনুমিত হয়। শ্রীযুক্ত চন্দের বক্তব্যটি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত তর্জমাসহ (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮২-৩) উদ্ধৃত করা যেতে পারে-
সংক্ষেপে, বৈদিক সাহিত্যে যতিদের প্রতি যে ইন্দ্র-আক্রোশের পরিচয় পাওয়া যায় তার একমাত্র ব্যাখ্যা হলো, যতিরা বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের অনুগামী ছিল না; তারা সিন্ধু-উপত্যকার স্থানীয় আর্য-পূর্ব জনসাধারণের অ-বৈদিক ধর্মানুষ্ঠান পালন করত। ইন্দ্রের যতি-হত্যা কাহিনীতে সম্ভবত ইতিহাস-আভাসিত যুগে স্থানীয় পুরোহিতশ্রেণীর সঙ্গে আগন্তুক ঋষিদের সংঘর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনীটির এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হলে প্রশ্ন উঠবে, যতিদের ধর্মানুষ্ঠান বা যাদু অনুষ্ঠানমূলক আচরণের প্রকৃতি কী ছিল? ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে যতি শব্দের অর্থ হল তপস্বী।… পুরোহিত-বোধক হিসেবে যতি শব্দের একমাত্র তাৎপর্য হলো তপস্যা এবং যোগমূলক ধর্মানুষ্ঠানে নিরত মানুষ।… মহেঞ্জোদারোর মর্মর-মূর্তিতে যোগাসনের নির্ভুল পরিচয় পাওয়া যায়, মাথা, গলা ও দেহের কঠিন ঋজুভাব, অর্ধনিমীলিত চোখ নাসিকাগ্রের উপর নিবদ্ধ। অতএব এই মূর্তিকে সিন্ধু-উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক এবং ইতিহাস-আভাসিত যুগের যতির মূর্তি বলে সনাক্ত করতে পারি।… ঋগ্বেদ-পূর্ব এবং ঋগ্বেদ সূচনা যুগে বৈদিক ঋষিদের মতোই ওই যোগী যতিরাও প্রধানতই ম্যাজিসিয়ান বা জাদুকর ছিল।…‘The only possible answer to this question is, that yatis were not originally priests of the Vadic cult like the Bhrigus and the Kanvas, but of non-Vedic rites practiced by the indigenous pre-Aryan population of the Indus Valley, in the legend of the slaughter of the Yatis by Indra we probably hear an echo of the conflict between the native priesthood and the intruding Rishis in the proto-historic period. If this interpretation of the legend is correct, it may be asked, what was the religious or magico-religious practice of the Yatis? In classical Sanskrit Yati denotes an ascetic. The term is derived from the root `yat’, to strive, to exert oneself, and is also connected with the root `Yam’, to restrain, to subdue, to control. As Applied to a priest, etymologically Yati can only mean a person engaged in religious exercise such as `tapas’, austerities, and `yoga’…. The marble statuettes of Mohenjo-daro with head, neck and body quite erect and half shut eyes fixed on the tip of the nose has the exact posture of one engaged in practicing Yoga. I therefore propose to recognize in these statuettes the image of the Yatis of the proto-historic and pre-historic Indus Valley intended either for worship or as votive offering. Like the Rishis of the pre-Regvedic and early Regvedic period, these Yatis, who practiced Yoga were also primarily magicians.’
অর্থাৎ :
‘যোগ এবং যোগীদের বিরুদ্ধে বৈদিক ঋষিদের ওই প্রাচীন বিরূপতা সত্ত্বেও কালক্রমে কীভাবে এবং কেন বৈদিক ঐতিহ্যেই যোগ-সাধনার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল- এ প্রশ্ন অবশ্যই জটিল। কিন্তু আপাতত মন্তব্য হলো, সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে যোগ-সাধনার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় এবং এই সভ্যতা আর্য-আক্রমণেই বিধ্বস্ত হয়েছে; অতএব বৈদিক ঋষিদের রচনায় সিন্ধু-সভ্যতার যোগীদের বিরুদ্ধে আক্রোশের পরিচয় থাকাই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে, যতি বলতে প্রাচীনকালের যোগসাধক বোঝাতো এবং বৈদিক সাহিত্যে বারবার এই উপাখ্যানই পাওয়া যায় যে ইন্দ্র অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাঁদের হত্যা করেছিলেন। অতএব এ-ক্ষেত্রেও প্রত্নতত্ত্বমূলক এং সাহিত্যমূলক সাক্ষ্যের মধ্যে সঙ্গতি খুঁজতে হলে শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের ওই পুরানো অনুমানটিকে স্বীকার করতে হয়। এবং এই দিক থেকে প্রাচীন সিন্ধু-ধর্মের সঙ্গে বৈদিক-ধর্মের সংঘাত চিত্রটিও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। কেননা, সিন্ধু-ধর্মের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বলতে মাতৃ-উপাসনা, লিঙ্গ-উপাসনা এবং যোগ-সাধনা। অপর পক্ষে বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়, ইন্দ্র প্রাচীন পূজনীয়া মাতৃদেবীকে আক্রমণ ও বিধ্বস্ত করেছেন, শিশ্ন-দেবদের শতদ্বার-বিশিষ্ট নগর লুণ্ঠন করেছেন এবং যতি বা যোগীদের নেকড়ের মুখে সমর্পণ করেছেন। বৈদিক মানুষেরা সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংস করে থাকে তা হলে তাদের সাহিত্যে সিন্ধু-ধর্মের বিরুদ্ধে এ-জাতীয় আক্রোশের পরিচয় থাকাই স্বাভাবিক।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৩)
অতএব, কৃষিজীবীদের যে-উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস থেকে এই সুপ্রাচীন আর্য-পূর্ব সিন্ধু-ধর্মবিশ্বাসে বসুমাতা-উপাসনা এবং শিশ্ন-উপাসনার উদ্ভব হয়েছিলো তারই মধ্যে যোগ-সাধনার আদি এবং আদিম রূপটির সূত্র অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এবং সিন্ধু-ধর্মের এই তিনটি বৈশিষ্ট্য পরস্পর-নিরপেক্ষ বা স্বতন্ত্র নয়, যদিও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সিন্ধু-ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ বহুলাংশেই পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র রূপ গ্রহণ করে উত্তরকালে শক্তি-সাধনা, শৈব-সাধনা এবং যোগ-সাধনায় পরিণত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষীয় তথা এতদঞ্চলের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এগুলির প্রভাব যে কতো ব্যাপক ও গভীর তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আর্য-আক্রমণের ফলে ওই প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বিধ্বস্ত হলেও ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্র থেকে তার প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। বিলুপ্ত যে হয়নি তা মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের বক্তব্য থেকেও তার আভাস মেলে-
অতএব, কৃষিজীবীদের যে-উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস থেকে এই সুপ্রাচীন আর্য-পূর্ব সিন্ধু-ধর্মবিশ্বাসে বসুমাতা-উপাসনা এবং শিশ্ন-উপাসনার উদ্ভব হয়েছিলো তারই মধ্যে যোগ-সাধনার আদি এবং আদিম রূপটির সূত্র অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এবং সিন্ধু-ধর্মের এই তিনটি বৈশিষ্ট্য পরস্পর-নিরপেক্ষ বা স্বতন্ত্র নয়, যদিও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সিন্ধু-ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ বহুলাংশেই পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র রূপ গ্রহণ করে উত্তরকালে শক্তি-সাধনা, শৈব-সাধনা এবং যোগ-সাধনায় পরিণত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষীয় তথা এতদঞ্চলের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এগুলির প্রভাব যে কতো ব্যাপক ও গভীর তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আর্য-আক্রমণের ফলে ওই প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বিধ্বস্ত হলেও ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্র থেকে তার প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। বিলুপ্ত যে হয়নি তা মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের বক্তব্য থেকেও তার আভাস মেলে-
‘An enquir into the ancient cultures would show that the cult of `Sakti’ is very old in India as in other parts of the world. And it is quite possible that it existed along with Saiva and Pasupata cults in the days of the pre-historic Indus-Valley civilization.’—
`The cult of `Sakti’ produced a profound influence on general Indian thought. A topographical surveyof India would show that the country is scattered over with numerous centers of `Sakti-sadhana’. It was widespread in the past and has continued unbroken till today.’
অর্থাৎ :
প্রাচীন সংস্কৃতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ফলে দেখা যায়, শাক্ত পূজা-পদ্ধতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সুপ্রাচীন। খুব সম্ভব, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু-সভ্যতাতে শৈব ও পাশুপত পূজাপদ্ধতির পাশাপাশি এই শাক্ত পূজাপদ্ধতিও বর্তমান ছিলো।…
শাক্ত-পূজাপদ্ধতি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় চিন্তাধারার উপর অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। স্থানবিবরণের দিক থেকে ভারতবর্ষের আলোচনা করলে দেখা যায়, দেশের উপর অসংখ্য শক্তিসাধনার কেন্দ্র ছড়ানো রয়েছে। অতীতে এই শাক্ত-ধর্ম অত্যন্ত প্রবল ছিলো এবং আজকের দিন পর্যন্ত তা অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসছে। (সূত্র: লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৮২)
ইতঃপূর্বে শৈবদের উপাস্য দেবতা রুদ্র-শিবের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচিত হলেও গোষ্ঠীবদ্ধ শৈব উপাসক সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিষয়ে আলোকপাত করা যায়নি। এ চেষ্টার শুরুতেই বলে রাখা আবশ্যক যে, গবেষকরা ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন শৈব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেও তাঁদের উৎপত্তি নির্ণয়ে প্রধানত নির্ভর করেছেন সাহিত্যগত প্রমাণের উপর। যেহেতু বৈদিক যুগের পূর্বেকার কোনও সাহিত্য এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও আর হবে এমন ভরসা নেই, তাই ঐতিহাসিক কালের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকেই তার অনুসন্ধান শুরু করতে হয়।
এক্ষেত্রে ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে ঋগ্বেদের একটি সূক্তের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যা কেশীসূক্ত নামে পরিচিত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এই সূক্তটি হলো (ঋগ্বেদ-১০/১৩৬)–
কেশ্যগ্নিং কেশী বিষং কেশী বিভর্তি রোদসী।
কেশী বিশ্বং স্বর্দৃশে কেশীদং জ্যোতিরুচ্যতে।। ১
মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা।
বাতস্যানু ধ্রাজিং যন্তি যদ্দেবাসো অবিক্ষত।। ২
উন্মদিতা মৌনেয়েন বাতা আ তস্থিমা বয়ম্ ।
শরীরেদস্মাকং যূয়ং মর্তাসো অভি পশ্যথ।। ৩
অন্তরিক্ষেণ পততি বিশ্বা রূপাবচাকশৎ।
মুনির্দেবস্য দেবস্য সৌকৃত্যায় সখা হিতঃ।। ৪
বাতস্যাশ্বো বায়োঃ সখাথ দেবেষিতো মুনিঃ।
উভৌ সমুদ্রাবা ক্ষেতি যশ্চ পূর্ব উতাপরঃ।। ৫
অপ্সরসাং গন্ধর্বাণাং মৃগাণাং চরণে চরণ্ ।
কেশী কেতস্য বিদ্বান্ত্ব সখা স্বাদুর্মদিন্তমঃ।। ৬
বায়ুরশ্মা উপামন্থৎ পিনষ্টি স্মা কুনংনমা।
কেশী বিষস্য পাত্রেণ যদ্রুদ্রেণাপিবৎ সহ।। ৭
অর্থাৎ :
কেশীনামক যে দেব, তিনি অগ্নিকে তিনিই জলকে তিনিই দ্যুলোক ও ভূলোককে ধারণ করেন। সমস্ত সংসারকে কেশীই আলোকের দ্বারা দর্শনযোগ্য করেন। এ যে জ্যোতি, এরই নাম কেশী। ১।। বাতরশনের বংশীয় মুনিরা পিঙ্গলবর্ণ মলিন বস্ত্র ধারণ করেন, তাঁরা দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে বায়ুর গতির অনুগামী হয়েছেন। ২।। তপস্যা-রসের রসিক হয়ে আমরা তাতে উন্মত্তবৎ, আমরা বায়ুর উপর আরোহণ করলাম। হে মনুষ্যগণ! তোমরা কেবল আমাদের শরীর মাত্র দেখতে পাচ্ছ অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত আত্মা বায়ুরূপী হয়েছে। ৩।। যিনি মুনি হন, তিনি আকাশে উড্ডীন হতে পারেন, সকল বস্তু দেখতে পান। যে স্থানে যত দেবতা আছেন, তিনি সকলের প্রিয় বন্ধু, সৎকর্মের জন্যই তিনি জীবিত আছেন। ৪।। যিনি মুনি হন, তিনি বায়ুপথে ভ্রমণ করবার ঘোটকস্বরূপ, তিনি বায়ুর সহচর, দেবতারা তাঁকে পেতে ইচ্ছা করেন। পূর্ব ও পশ্চিম এ দুই সমুদ্রে তিনি বাস করেন। ৫।। কেশীদেব অপ্সরাদের, গন্ধর্বদের এবং হরিণদের বিচরণ স্থানে বিহার করেন। তিনি জ্ঞাতব্য সকল বিষয়ই জানেন ও তিনি অতি চমৎকার, সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ী বন্ধুস্বরূপ। ৬।। কেশী যখন রুদ্রের সাথে একত্রে জলপান (বিষপান) করেন তখন বায়ু সে জল আলোড়িত করে দেন এবং কঠিন করকাগুলি ভঙ্গ করে দেন। ৭।।
বলাবাহুল্য, এই কেশীসূক্তটি ঋগ্বেদের অন্যতম অর্বাচীন পুরুষসূক্তের মতোই পরবর্তীকালের সংযোজন বলে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা মনে করেন। এ প্রেক্ষিতে ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য হলো–
‘সূক্তটি পুরুষসূক্তের ন্যায় অপেক্ষাকৃত পরবর্তী স্তরের, এবং ইহার প্রধান বিষয়বস্তু কেশী ও মুনিগণের বর্ণনা দ্বারা বৈদিক ঋষিরা যে ঠিক কাহাদের লক্ষ্য করিয়াছেন ইহা সহজবোধ্য নহে। স্বর্গত অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদার মহাশয় তাঁহার এক অপ্রকাশিত রচনায় (ইহা আংশিক মুদ্রিত হইলেও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই) এই সূক্ত প্রাচ্যদেশবাসী এক ভ্রাম্যমাণ ও তপশ্চর্যানিরত পরিব্রাজক মণ্ডলীর বৈদিক ঋষি কর্তৃক বর্ণনা বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। সপ্তসংখ্যক অনুবাক বিশিষ্ট এই সূক্তটির দ্বিতীয় অনুবাকে মুনিগণ এইভাবে বর্ণিত হইয়াছেন– ‘(প্রায়) দিগম্বর মুনিগণ ধূলিমলিন পিঙ্গলবর্ণ বস্ত্র’ (পরিধান করেন; এই বর্ণনায় কি মুনি কর্তৃক কৌপীন পরিধানের ইঙ্গিত আছে?– মূল পদ এইরূপ– মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা)।’ প্রথম ও আরও কয়টি অনুবাকে কেশীকে এই মুনিগণের অন্যতম বলা হইয়াছে; কেশী (দীর্ঘকেশ বিশিষ্ট), বায়ুর সখা, দেবতাদিগের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তপশ্চর্যার দ্বারা উন্মদিত (উন্মত্ত– উন্মদিতাঃ মৌনেয়েন), মুনি (কেশী) পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে বাস বা ভ্রমণ করেন, তিনি বিষপাত্রের দ্বারা যাহা নত হয় না এইরূপ দ্রব্যসকলকে ভগ্ন করেন, এই বিষপাত্র তিনি রুদ্রের সহিত পান করিয়াছিলেন (…পিনষ্টি স্ম কুনন্নমা। কেশী বিষস্য পাত্রেণ যদ্রুদেণাপিবৎ সহ)। দীর্ঘকেশ (জটা?) মণ্ডিত প্রায় দিগম্বর ধূলিমলিন পিঙ্গল বস্ত্রাংশ পরিহিত উন্মত্তাপূর্ণ মুনি কি পাশুপত ব্রতধারী রুদ্র-শিব পূজকদিগের পূর্বপুরুষ? এই অনুমান আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসঙ্গত কল্পনা নাও হইতে পারে। পাশুপত সাধকদিগের ন্যায় কেশী-মুনিগণেরও তপশ্চর্যারূপ ব্রতসাধনার দ্বারা অতিপ্রাকৃত ঐশী শক্তি অর্জনের কথা এ সূক্তে বলা হইয়াছে। সর্বোপরি রুদ্রসহচর কেশী-মুনি রুদ্রের সহিত যে বিষপান করিয়াছিলেন ইহারও উল্লেখ এ সূক্তে বর্তমান। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৬, ৩৩) ঐতস মুনির উন্মত্ততা ও প্রলাপ ভাষণের যে আর এক দুর্বোধ্য বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, উহাও পাশুপতদিগের উন্মত্ত আচরণ ও প্রলাপ ভাষণের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। কিন্তু উক্তরূপ অনুমানের সাপক্ষে এইসব যুক্তি থাকিলেও, ইহা যে সর্বাংশে গৃহীতব্য এ কথা বলা যায় না। কারণ যেকালে এই সূক্ত রচিত হইয়াছিল, তখন রুদ্র-শিব দেবতা আর্যগণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যমূলক পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারেন নাই। এতদ্ব্যতীত সূক্তটির কোন অংশেও রুদ্রদেবতার পূজার এমন কি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পর্যন্ত নাই। ইহার শেষ চরণে মাত্র একবার রুদ্রের নাম পাওয়া যায়, তাহাও বিষপাণ প্রসঙ্গে। সায়ন এ বিষ কালকূট বিষ অর্থে গ্রহণ করেন নাই, ইহার ‘জল’ অর্থ গ্রহণ করিয়া প্রখর রশ্মিরূপ অসংখ্য জটাবিশিষ্ট সূর্যদেবতা কর্তৃক জলশোষণের ইঙ্গিত সূক্তটিতে দেখিয়াছেন। সে যাহা হউক, কেশী সূক্তের প্রকৃত অর্থ এত দুরুহ এবং অনিশ্চিত যে ইহার একরূপ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়া ইহার রচনাকালে রুদ্রপূজক গোষ্ঠীর অস্তিত্বের বিষয় নির্বিচারে স্বীকৃত হইতে পারে না। তবে এই সূক্তের শেষ চরণে রুদ্র কর্তৃক বিষ (জল?) পানের কথাই যে পৌরাণিক যুগের নীলকণ্ঠ শিব কর্তৃক কালকূট বিষপান কাহিনীর উৎস সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৩-৪৫)
‘সূক্তটি পুরুষসূক্তের ন্যায় অপেক্ষাকৃত পরবর্তী স্তরের, এবং ইহার প্রধান বিষয়বস্তু কেশী ও মুনিগণের বর্ণনা দ্বারা বৈদিক ঋষিরা যে ঠিক কাহাদের লক্ষ্য করিয়াছেন ইহা সহজবোধ্য নহে। স্বর্গত অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদার মহাশয় তাঁহার এক অপ্রকাশিত রচনায় (ইহা আংশিক মুদ্রিত হইলেও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই) এই সূক্ত প্রাচ্যদেশবাসী এক ভ্রাম্যমাণ ও তপশ্চর্যানিরত পরিব্রাজক মণ্ডলীর বৈদিক ঋষি কর্তৃক বর্ণনা বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। সপ্তসংখ্যক অনুবাক বিশিষ্ট এই সূক্তটির দ্বিতীয় অনুবাকে মুনিগণ এইভাবে বর্ণিত হইয়াছেন– ‘(প্রায়) দিগম্বর মুনিগণ ধূলিমলিন পিঙ্গলবর্ণ বস্ত্র’ (পরিধান করেন; এই বর্ণনায় কি মুনি কর্তৃক কৌপীন পরিধানের ইঙ্গিত আছে?– মূল পদ এইরূপ– মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা)।’ প্রথম ও আরও কয়টি অনুবাকে কেশীকে এই মুনিগণের অন্যতম বলা হইয়াছে; কেশী (দীর্ঘকেশ বিশিষ্ট), বায়ুর সখা, দেবতাদিগের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তপশ্চর্যার দ্বারা উন্মদিত (উন্মত্ত– উন্মদিতাঃ মৌনেয়েন), মুনি (কেশী) পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে বাস বা ভ্রমণ করেন, তিনি বিষপাত্রের দ্বারা যাহা নত হয় না এইরূপ দ্রব্যসকলকে ভগ্ন করেন, এই বিষপাত্র তিনি রুদ্রের সহিত পান করিয়াছিলেন (…পিনষ্টি স্ম কুনন্নমা। কেশী বিষস্য পাত্রেণ যদ্রুদেণাপিবৎ সহ)। দীর্ঘকেশ (জটা?) মণ্ডিত প্রায় দিগম্বর ধূলিমলিন পিঙ্গল বস্ত্রাংশ পরিহিত উন্মত্তাপূর্ণ মুনি কি পাশুপত ব্রতধারী রুদ্র-শিব পূজকদিগের পূর্বপুরুষ? এই অনুমান আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসঙ্গত কল্পনা নাও হইতে পারে। পাশুপত সাধকদিগের ন্যায় কেশী-মুনিগণেরও তপশ্চর্যারূপ ব্রতসাধনার দ্বারা অতিপ্রাকৃত ঐশী শক্তি অর্জনের কথা এ সূক্তে বলা হইয়াছে। সর্বোপরি রুদ্রসহচর কেশী-মুনি রুদ্রের সহিত যে বিষপান করিয়াছিলেন ইহারও উল্লেখ এ সূক্তে বর্তমান। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৬, ৩৩) ঐতস মুনির উন্মত্ততা ও প্রলাপ ভাষণের যে আর এক দুর্বোধ্য বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, উহাও পাশুপতদিগের উন্মত্ত আচরণ ও প্রলাপ ভাষণের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। কিন্তু উক্তরূপ অনুমানের সাপক্ষে এইসব যুক্তি থাকিলেও, ইহা যে সর্বাংশে গৃহীতব্য এ কথা বলা যায় না। কারণ যেকালে এই সূক্ত রচিত হইয়াছিল, তখন রুদ্র-শিব দেবতা আর্যগণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যমূলক পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারেন নাই। এতদ্ব্যতীত সূক্তটির কোন অংশেও রুদ্রদেবতার পূজার এমন কি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পর্যন্ত নাই। ইহার শেষ চরণে মাত্র একবার রুদ্রের নাম পাওয়া যায়, তাহাও বিষপাণ প্রসঙ্গে। সায়ন এ বিষ কালকূট বিষ অর্থে গ্রহণ করেন নাই, ইহার ‘জল’ অর্থ গ্রহণ করিয়া প্রখর রশ্মিরূপ অসংখ্য জটাবিশিষ্ট সূর্যদেবতা কর্তৃক জলশোষণের ইঙ্গিত সূক্তটিতে দেখিয়াছেন। সে যাহা হউক, কেশী সূক্তের প্রকৃত অর্থ এত দুরুহ এবং অনিশ্চিত যে ইহার একরূপ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়া ইহার রচনাকালে রুদ্রপূজক গোষ্ঠীর অস্তিত্বের বিষয় নির্বিচারে স্বীকৃত হইতে পারে না। তবে এই সূক্তের শেষ চরণে রুদ্র কর্তৃক বিষ (জল?) পানের কথাই যে পৌরাণিক যুগের নীলকণ্ঠ শিব কর্তৃক কালকূট বিষপান কাহিনীর উৎস সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৩-৪৫)
ঋগ্বেদে রুদ্রপূজক গোষ্ঠীর উপরিউল্লিখিত সন্দেহাত্মক উল্লেখের কথা বাদ দিলে, শিবপূজক-শৈবদের অস্তিত্বের প্রথম অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট ইঙ্গিত পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থেই পাওয়া যায় বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেন। তাঁর মতে–
‘ইহার (পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী) চতুর্থ অধ্যায়ের একটি সূত্র (৪, ১, ১১২) ‘শিবাদিভ্যোন’ পরোক্ষভাবে শিবপূজকগণকেই বুঝাইতেছে বলিয়া মনে হয়। সূত্রের অর্থ এই যে শিবাদি শব্দের পর ‘অন’ প্রত্যয় করিয়া যে পদ নিষ্পন্ন হয় উহা দ্বারা শিব ইত্যাদির অপত্যগণকেই বুঝায়। প্রত্যয়ান্ত শৈব শব্দ অপত্যার্থে দেবতার এক ভক্ত পূজকদিগের কথাই যে বলিতেছে এ অনুমান অসঙ্গত নহে। বহু পরবর্তী কালে রচিত লিঙ্গপুরাণের একটি উক্তি এই অনুমান সমর্থন করে। শিবের লকুলীশাবতারের কথা বলিতে গিয়া, পুরাণকার লকুলীশের প্রধান চারিজন ভক্ত শিষ্য, যথা কুশিক, মিত্র, গর্গ এবং কৌরুষ্যকে তাঁহার পুত্র বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পাণিনি ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু নদের অপর পারে গন্ধার প্রদেশের সলাতুর নামক একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁহার সময়ে (খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে) ঐ অঞ্চলে শিবের পূজা প্রচলিত ছিল।… পাণিনির সময়ের ন্যূনাধিক এক শতাব্দী পরে পঞ্জাব প্রদেশের এক অংশে যে শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত লোকগণ বাস করিতেন, ইহার প্রমাণ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সংক্রান্ত সমসাময়িক গ্রীক গ্রন্থাদি হইতে কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের বৈদেশিক গ্রন্থকারদিগের উদ্ধৃতি হইতে জানা যায়। কুইন্টাস কার্টিয়াস, ডিওডোরাস প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণের উদ্ধৃতি প্রমাণ করে যে শিবি (Sibae, Siboi) নামক এক জাতি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে ঝিলাম ও চিনাব নদীর (তাঁহাদের গ্রন্থে এই দুই নদীর নাম– Hydaspes ও Acesines, সংস্কৃত বিতস্তা এবং অসিক্লীর গ্রীক রূপ) সঙ্গমস্থলের নিকট বাস করিতেন। বহু পূর্বে পণ্ডিতপ্রবর ল্যাসেন (Christini Lassen) যথার্থ অনুমান করিয়াছিলেন যে গ্রীক গ্রন্থে বর্ণিত শিবি বা শিবয় এবং মহাকাব্য ও পুরাণাদিতে লিখিত ঔশীনর শিবি ইহারা একই প্রাচীন ভারতীয় জাতিকে বুঝাইতেছে। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলান্তর্গত অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম অনুবাকে অলিন, পক্থ, ভলানস, বিশানিন প্রভৃতি জাতির সহিত শিব জাতির নাম দেখা যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৫-৪৬)
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঋগ্বেদ সূক্তের সংশ্লিষ্ট ঋকের উল্লিখিত জাতিগুলোর নামের স্থানে সায়নাচার্য যেসব বৈশিষ্ট্যসূচক অর্থাবলি ব্যবহার করে তার অর্থ নির্ধারণ করেছেন, তা কৌতুহলজনক বৈকি। সায়ণকৃত বেদটীকার সহায়তায় রমেশচন্দ্র দত্তের তর্জমায় পাঠকের কৌতুহল নিবৃত্তির সুবিধার্থে প্রথম বন্ধনীতে মূল বৈদিক জাতি-নামগুলো আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। উক্ত ঋকটি হলো–
‘ইহার (পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী) চতুর্থ অধ্যায়ের একটি সূত্র (৪, ১, ১১২) ‘শিবাদিভ্যোন’ পরোক্ষভাবে শিবপূজকগণকেই বুঝাইতেছে বলিয়া মনে হয়। সূত্রের অর্থ এই যে শিবাদি শব্দের পর ‘অন’ প্রত্যয় করিয়া যে পদ নিষ্পন্ন হয় উহা দ্বারা শিব ইত্যাদির অপত্যগণকেই বুঝায়। প্রত্যয়ান্ত শৈব শব্দ অপত্যার্থে দেবতার এক ভক্ত পূজকদিগের কথাই যে বলিতেছে এ অনুমান অসঙ্গত নহে। বহু পরবর্তী কালে রচিত লিঙ্গপুরাণের একটি উক্তি এই অনুমান সমর্থন করে। শিবের লকুলীশাবতারের কথা বলিতে গিয়া, পুরাণকার লকুলীশের প্রধান চারিজন ভক্ত শিষ্য, যথা কুশিক, মিত্র, গর্গ এবং কৌরুষ্যকে তাঁহার পুত্র বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পাণিনি ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু নদের অপর পারে গন্ধার প্রদেশের সলাতুর নামক একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁহার সময়ে (খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে) ঐ অঞ্চলে শিবের পূজা প্রচলিত ছিল।… পাণিনির সময়ের ন্যূনাধিক এক শতাব্দী পরে পঞ্জাব প্রদেশের এক অংশে যে শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত লোকগণ বাস করিতেন, ইহার প্রমাণ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সংক্রান্ত সমসাময়িক গ্রীক গ্রন্থাদি হইতে কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের বৈদেশিক গ্রন্থকারদিগের উদ্ধৃতি হইতে জানা যায়। কুইন্টাস কার্টিয়াস, ডিওডোরাস প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণের উদ্ধৃতি প্রমাণ করে যে শিবি (Sibae, Siboi) নামক এক জাতি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে ঝিলাম ও চিনাব নদীর (তাঁহাদের গ্রন্থে এই দুই নদীর নাম– Hydaspes ও Acesines, সংস্কৃত বিতস্তা এবং অসিক্লীর গ্রীক রূপ) সঙ্গমস্থলের নিকট বাস করিতেন। বহু পূর্বে পণ্ডিতপ্রবর ল্যাসেন (Christini Lassen) যথার্থ অনুমান করিয়াছিলেন যে গ্রীক গ্রন্থে বর্ণিত শিবি বা শিবয় এবং মহাকাব্য ও পুরাণাদিতে লিখিত ঔশীনর শিবি ইহারা একই প্রাচীন ভারতীয় জাতিকে বুঝাইতেছে। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলান্তর্গত অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম অনুবাকে অলিন, পক্থ, ভলানস, বিশানিন প্রভৃতি জাতির সহিত শিব জাতির নাম দেখা যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৫-৪৬)
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঋগ্বেদ সূক্তের সংশ্লিষ্ট ঋকের উল্লিখিত জাতিগুলোর নামের স্থানে সায়নাচার্য যেসব বৈশিষ্ট্যসূচক অর্থাবলি ব্যবহার করে তার অর্থ নির্ধারণ করেছেন, তা কৌতুহলজনক বৈকি। সায়ণকৃত বেদটীকার সহায়তায় রমেশচন্দ্র দত্তের তর্জমায় পাঠকের কৌতুহল নিবৃত্তির সুবিধার্থে প্রথম বন্ধনীতে মূল বৈদিক জাতি-নামগুলো আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। উক্ত ঋকটি হলো–
আ পক্থাসো ভলানসো ভনন্তালিনাসো বিষাণিনঃ শিবাসঃ।
আ যোহনয়ৎ সধমা আর্যস্য গব্যা তৃৎসুভ্যো অজগন্যুধা নৃন্ ।। (ঋগ্বেদ-৭/১৮/৭)
অর্থাৎ : হব্যসমূহের পাচক (পক্থ), ভদ্রমুখ (ভলানস), অপ্রবৃদ্ধ (ভনন্ত-অলিন) ও বিষাণহস্ত (বিষাণিন) মঙ্গলকর (শিব) ব্যক্তিগণ ইন্দ্রের স্তুতি করে। ইন্দ্র সোমপানে মত্ত হয়ে আর্যের গাভীসমূহ হিংসকগণ হতে এনেছেন, স্বয়ং লাভ করেছেন এবং যুদ্ধে মনুষ্যগণকে বধ করেছেন।
কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন যে এই শিব এবং শিবি এক জাতি। শিবি জাতির যে বর্ণনা উপরে উল্লিখিত গ্রীক গ্রন্থকারেরা দিয়েছেন তা থেকে মনে হয় তাঁরা শিবপূজক গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। শিবিরা বন্যপশুর চর্ম পরিধান করতেন, তাঁরা দণ্ডপাণি ছিলেন, এবং তাঁদের পশুদেরকে দণ্ডাঙ্ক দ্বারা চিহ্নিত করতেন। এ বর্ণনা শিবভক্তদের যে বিবরণ মহাভাষ্যে পাওয়া যায় তার সাথে আংশিকভাবে মিলে বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত। কেননা মহাভাষ্যে উদ্ধৃত শিবপুর বা শৈবপুর নামে এক উদীচ্য গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। বৌদ্ধ মহামায়ূরী গ্রন্থেও শিবপুরের কথা রয়েছে। পাঞ্জাবের এ অঞ্চলের একটি নগর যে গুপ্তযুগেও শিবিপুর বলে পরিচিত ছিল তা বর্তমান সোরকোট নামক স্থানে প্রাপ্ত একটি বৃহৎ ধাতুপাত্রে উৎকীর্ণ ৮৩ গৌপ্তাব্দের একটি লেখ থেকে জানা যায় বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও বলেন–
‘পাণিনির সূত্র, ‘অয়ঃশূলদণ্ডাজিনাভ্যাং ঠক্ঠঞৌ’ (৫, ২, ৭৬) এর ভাষ্যকালে পতঞ্জলিই প্রথম সুস্পষ্টভাবে শিবভক্তদিগের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে ‘শিবভাগবত’দিগের নাম করিয়াছেন, এবং বলিয়াছেন যে পাণিনীয় সূত্রানুসারে ‘ঠক্’ ও ‘ঠঞ’ প্রত্যয় দুইটি ‘অয়ঃশূল’ ও ‘দণ্ডাজিন’ শব্দদ্বয়ের পরে প্রয়োগ করিলে এমন ব্যক্তি বিশেষকে বুঝাইবে যাঁহারা লৌহশূল দণ্ড ও অজিন (পশুচর্ম) ইত্যাদি ব্যবহারের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস পান। পতঞ্জলি আরও বিশদভাবে এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে শিবভাগবতগণই আয়ঃশূলিক অর্থাৎ লৌহত্রিশূলধারী; তিনি দণ্ডাজিনিক কথাটি বোধ হয় বাহুল্যবোধে এ স্থলে ব্যবহার করেন নাই, কিন্তু মূলসূত্রে দণ্ডজিন কথাটি থাকা হেতু শিবভাগবতরা যে দণ্ডজিনিকও (দণ্ডধারী ও পশুচর্ম পরিধানকারী) ছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকিতে পারে না। পশুচর্মে গাত্রাচ্ছাদন, লৌহত্রিশূল ও দণ্ডধারণ প্রভৃতি ক্রিয়া শিবভাগবতেরা তাঁহাদের একাত্মিকা শিবভক্তির বাহ্য রূপ বলিয়া বিবেচনা করিলেও সকলে যে তাঁহাদের এই সব ক্রিয়া সুচক্ষে দেখিতেন না ইহার সাহিত্যগত প্রমাণ বর্তমান। পতঞ্জলি নিজেই ইহার অনুমোদ করিতেন না, কারণ তিনি এ প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে এই জাতীয় শিবভক্তদিগের দল যে সিদ্ধি শান্ত প্রক্রিয়ার দ্বারা অন্বেষণ করা যায়, তাহা উগ্র বেগশীল অনুষ্ঠানের সাহায্যে পাইতে ইচ্ছা করেন (যো মৃদুনোপায়েনান্বেষ্টব্যানর্থান্ রভসেনান্বিচ্ছতি)। প্রখ্যাত বৈয়াকরণিক অতি অল্প কথায় শিবভাগবতদিগের বাহ্য ধর্মাচরণের রূপ সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়া উহার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন।… এই শিবভাগবতগণই কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালে পাশুপত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন; পাশুপতদিগের ধর্মাচরণ প্রণালী যে কিরূপ উগ্রবেগশীল ছিল তাহা আলোচনাকালে প্রদর্শিত হইবে। পতঞ্জলিপ্রমুখ সামাজিক ব্যক্তিগণ তাহাদিগের উগ্র পন্থার বিরোধী ছিলেন, এবং এজন্যই পতঞ্জলির পরবর্তী ভাষ্যকারেরা ‘দণ্ডাজিনিক’ শব্দের অর্থ করিয়াছেন ‘দাম্ভিক’। সে যাহাই হউক, মহাভাষ্যোক্ত শিবভাগবতদিগের বর্ণনার সহিত বৈদেশিক লেখকগণ প্রদত্ত শিবিদিগের বর্ণনার আশ্চর্য মিল দেখিতে পাওয়া যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৭-৪৮)
‘পাণিনির সূত্র, ‘অয়ঃশূলদণ্ডাজিনাভ্যাং ঠক্ঠঞৌ’ (৫, ২, ৭৬) এর ভাষ্যকালে পতঞ্জলিই প্রথম সুস্পষ্টভাবে শিবভক্তদিগের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে ‘শিবভাগবত’দিগের নাম করিয়াছেন, এবং বলিয়াছেন যে পাণিনীয় সূত্রানুসারে ‘ঠক্’ ও ‘ঠঞ’ প্রত্যয় দুইটি ‘অয়ঃশূল’ ও ‘দণ্ডাজিন’ শব্দদ্বয়ের পরে প্রয়োগ করিলে এমন ব্যক্তি বিশেষকে বুঝাইবে যাঁহারা লৌহশূল দণ্ড ও অজিন (পশুচর্ম) ইত্যাদি ব্যবহারের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস পান। পতঞ্জলি আরও বিশদভাবে এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে শিবভাগবতগণই আয়ঃশূলিক অর্থাৎ লৌহত্রিশূলধারী; তিনি দণ্ডাজিনিক কথাটি বোধ হয় বাহুল্যবোধে এ স্থলে ব্যবহার করেন নাই, কিন্তু মূলসূত্রে দণ্ডজিন কথাটি থাকা হেতু শিবভাগবতরা যে দণ্ডজিনিকও (দণ্ডধারী ও পশুচর্ম পরিধানকারী) ছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকিতে পারে না। পশুচর্মে গাত্রাচ্ছাদন, লৌহত্রিশূল ও দণ্ডধারণ প্রভৃতি ক্রিয়া শিবভাগবতেরা তাঁহাদের একাত্মিকা শিবভক্তির বাহ্য রূপ বলিয়া বিবেচনা করিলেও সকলে যে তাঁহাদের এই সব ক্রিয়া সুচক্ষে দেখিতেন না ইহার সাহিত্যগত প্রমাণ বর্তমান। পতঞ্জলি নিজেই ইহার অনুমোদ করিতেন না, কারণ তিনি এ প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে এই জাতীয় শিবভক্তদিগের দল যে সিদ্ধি শান্ত প্রক্রিয়ার দ্বারা অন্বেষণ করা যায়, তাহা উগ্র বেগশীল অনুষ্ঠানের সাহায্যে পাইতে ইচ্ছা করেন (যো মৃদুনোপায়েনান্বেষ্টব্যানর্থান্ রভসেনান্বিচ্ছতি)। প্রখ্যাত বৈয়াকরণিক অতি অল্প কথায় শিবভাগবতদিগের বাহ্য ধর্মাচরণের রূপ সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়া উহার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন।… এই শিবভাগবতগণই কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালে পাশুপত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন; পাশুপতদিগের ধর্মাচরণ প্রণালী যে কিরূপ উগ্রবেগশীল ছিল তাহা আলোচনাকালে প্রদর্শিত হইবে। পতঞ্জলিপ্রমুখ সামাজিক ব্যক্তিগণ তাহাদিগের উগ্র পন্থার বিরোধী ছিলেন, এবং এজন্যই পতঞ্জলির পরবর্তী ভাষ্যকারেরা ‘দণ্ডাজিনিক’ শব্দের অর্থ করিয়াছেন ‘দাম্ভিক’। সে যাহাই হউক, মহাভাষ্যোক্ত শিবভাগবতদিগের বর্ণনার সহিত বৈদেশিক লেখকগণ প্রদত্ত শিবিদিগের বর্ণনার আশ্চর্য মিল দেখিতে পাওয়া যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৭-৪৮)
শৈব-সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশুপত সম্প্রদায়ই প্রাচীনতম হলেও পরবর্তীকালে শৈবপূজক হিসেবে আরও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব শৈব-সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্বে সামান্য প্রভেদ ও আরাধনা পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এই শিবপূজকদের আচার-বিচারে অনেক ক্ষেত্রেই বাহ্যিক অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে শিবারাধকদের প্রসঙ্গে বলেন–
‘শৈবেরাও অন্যান্য উপাসকের ন্যায় বিশেষ বিশেষ বীজ মন্ত্রে উপদিষ্ট হন। একাক্ষর মন্ত্র ‘হৌ’। ত্র্যক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ জুঁ সঃ’; ইহার নাম মৃত্যুঞ্জয়াত্মক মন্ত্র। চতুরক্ষর মন্ত্র ‘ঊর্ধ্বফট্’; ইহার নাম চণ্ড মন্ত্র। পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’। ষড়ক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। অষ্টাক্ষর মন্ত্র ‘হ্রীঁ ওঁ নমঃ শিবায় হ্রীঁ!’ এইরূপ বিংশত্যক্ষর পর্যন্ত মন্ত্র আছে এবং মন্ত্র-বিশেষে বিশেষ বিশেষ ধ্যান ও পদ্ধতি উক্ত হইয়াছে। কৃষ্ণানন্দ-কৃত তন্ত্রসারে ও অপরাপর উপাসনাতন্ত্র-সংগ্রহে সে সমুদায়ের বিস্তারিত বৃত্তান্ত বিনিবেশিত আছে। শিবারাধনায় শরীরে বিভূতি-লেপন ও রুদ্রাক্ষ-ধারণ নিতান্ত আবশ্যক।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১১)
বিদ্বেন্মোদতরঙ্গিণীতে শৈবদের বেশ-ভূষা সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় এভাবে–
‘শৈবেরাও অন্যান্য উপাসকের ন্যায় বিশেষ বিশেষ বীজ মন্ত্রে উপদিষ্ট হন। একাক্ষর মন্ত্র ‘হৌ’। ত্র্যক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ জুঁ সঃ’; ইহার নাম মৃত্যুঞ্জয়াত্মক মন্ত্র। চতুরক্ষর মন্ত্র ‘ঊর্ধ্বফট্’; ইহার নাম চণ্ড মন্ত্র। পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’। ষড়ক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। অষ্টাক্ষর মন্ত্র ‘হ্রীঁ ওঁ নমঃ শিবায় হ্রীঁ!’ এইরূপ বিংশত্যক্ষর পর্যন্ত মন্ত্র আছে এবং মন্ত্র-বিশেষে বিশেষ বিশেষ ধ্যান ও পদ্ধতি উক্ত হইয়াছে। কৃষ্ণানন্দ-কৃত তন্ত্রসারে ও অপরাপর উপাসনাতন্ত্র-সংগ্রহে সে সমুদায়ের বিস্তারিত বৃত্তান্ত বিনিবেশিত আছে। শিবারাধনায় শরীরে বিভূতি-লেপন ও রুদ্রাক্ষ-ধারণ নিতান্ত আবশ্যক।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১১)
বিদ্বেন্মোদতরঙ্গিণীতে শৈবদের বেশ-ভূষা সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় এভাবে–
শ্রীমানসাবেতি জটালমৌলির্ব্যঘ্রত্বগালম্বিতমধ্যভাগঃ।
বিভূতিসংভূষিতভাস্বদঙ্গোরুদ্রাক্ষমালাকলিতোর্ধ্বদেহঃ।। (বিদ্বেন্মোদতরঙ্গিণী)
অর্থাৎ : জটা-যুক্ত, ব্যাঘ্র-চর্ম-পরিধান, বিভূতি-বিভূষিত উজ্জ্বল অঙ্গবিশিষ্ট এবং শরীরের ঊর্ধ্বভাগে রুদ্রাক্ষ-মালায় শোভিত এই শ্রীমান্ পুরুষ আগমন করিতেছেন।
বিভূতি-লেপন হিসেবে শৈব-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভস্ম-লেপনেরই আধিক্য দেখা যায়। তবে অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে ‘ভারতবর্ষের দক্ষিণভাগে মাইশোর দেশের মধ্যে মলৈশ্বরবেট্ট নামক পর্বতে একরূপ শ্বেত বর্ণ মৃত্তিকা পাওয়া যায়। সে প্রদেশের শৈবেরা বিভূতির পরিবর্তে সেই মৃত্তিকা ব্যবহার করিয়া থাকেন।’ আর রুদ্রাক্ষ-ধারণ শৈবদের মধ্যে আবশ্যকীয় হিসেবেই বিবেচিত হয়। রুদ্রাক্ষ প্রসঙ্গে যোগসার-এ বলা হয়েছে–
শিখায়াং হস্তয়োঃ কণ্ঠে কর্ণয়োশ্চাপি যো নরঃ।
রুদ্রাক্ষং ধারয়েদ্ভক্ত্যা শিবলোকমবাগ্নুয়াৎ।। (যোগসার)
অর্থাৎ : শিখাতে, হস্ত-দ্বয়ে, কণ্ঠে এবং কর্ণ-যুগলে যে মনুষ্য ভক্তিপূর্বক রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তিনি শিব-লোক প্রাপ্ত হন।
এছাড়া বীরাচারী শাক্ত-সম্প্রদায়ের সুরা সেবনের মতোই শৈবদের বিশেষ করে শৈব-তান্ত্রিকদের সম্বিদা-সেবন ইষ্ট সাধনার একটি অঙ্গ-বিশেষ। সাধকদেরকে তা মন্ত্র-পূত করে ধ্যান ও স্তুতিপূর্বক পুলকিত-চিত্তে পান করতে হয়। শৈব তন্ত্রে বলা হয়েছে–
কলয়তি কবিতাং মহতীং কুরুতে স্বার্থদর্শনং পুং সাং।
অপহরতি দুরিতনিলয়ং কিং কিং ন করোতি সম্বিদুল্লাসঃ।। (প্রাণতোষিণী)
অর্থাৎ : সম্বিদুল্লাস দ্বারা মহতী কবিতার রচনা হয়, পুরুষদিগের স্বার্থ দর্শন হয়, ও পাপসমূহ নষ্ট হয়, অতএব তদ্বারা কি না হইয়া থাকে?
শৈব-সাধনার আরেকটি অঙ্গ হলো বিজয়া অর্থাৎ গাঁজা। শৈবেরা জল-মিশ্রিত বিজয়া অর্থাৎ সিদ্ধি-পানের ন্যায় বিজয়া ধূম-পানও করে থাকেন। প্রাণতোষিণীতে বলা হয়েছে–
অনেন মনুনানেন বিজয়াধূমশোধনং।
শোধয়িত্বা পিবেদ্ধূমং ন দোষোবিদ্যতে হর।।
মন্ত্রস্তূ ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ। — (প্রাণতোষিণী)
অর্থাৎ : ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ এই মন্ত্র দ্বারা বিজয়া-ধূম শোধন করিয়া পান করিবে, মহাদেব! তাহাতে দোষ নাই।
শৈবদের মধ্যে উদাসীন সম্প্রদায়ীই বেশি। তাঁরা সচরাচর প্রায় সন্ন্যাসী ও গোঁসাই বলে উক্ত হয়ে থাকে। বাঙলা-অঞ্চলে বৈষ্ণবদের প্রধান গুরুদের নাম গোঁসাই, কিন্তু ভারতের পশ্চিমোত্তর অঞ্চলে শৈব সন্ন্যাসীদেরকেই গোঁসাই বলা হয়। সেখানে সাধু-লোক বললে যেমন বৈষ্ণব উদাসীন বুঝায়, তেমনি গোঁসাই-লোক বললে শৈব উদাসীন বুঝতে হয়। কোন উদাসীন শৈব কি বৈষ্ণব, তা তিলক দেখলেই অক্লেশে জানতে পারা যায়। অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে,– ‘বৈরাগীরা নাসা-মূল হইতে কেশ পর্যন্ত ঊর্ধ্বরেখা করেন, আর শৈবেরা ললাটের বাম পার্শ্ব হইতে দক্ষিণ পার্শ্ব পর্যন্ত বিভূতি দিয়া তিনটি রেখা করিয়া থাকেন। প্রথমোক্ত তিলককে ঊর্ধ্বপুণ্ড্র ও শেষোক্ত তিলককে ত্রিপুণ্ড্র বলে।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১২)
বাঙলা অঞ্চলে বিশেষত গৃহস্থদের মধ্যে শিবোপাসক প্রায় দেখাই যায় না। এখানে শক্তি-উপাসকেরই প্রাধান্য। ভারতবর্ষের দক্ষিণ ও পশ্চিম খণ্ডে শিবোপাসনার প্রচলন ছিল এবং আছে। বাঙলা অঞ্চলের গৃহস্থদের মধ্যে পৃথক শিবোপাসক প্রায় না থাকলেও শাক্তেরা শক্তি-পতি শিবের অর্চনা ও শিব-ব্রত পালন করে থাকেন। এটাই তাঁদের কর্তব্য কর্ম। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে–
আদৌ শিবং পূজয়িত্বা শক্তিপূজা ততঃ পরং।
নতুবা মূত্রবৎ সর্বং গঙ্গাতোয়ং ভবেদ্ যদি।
অতএব মহেশানি আদৌ লিঙ্গং প্রপূজয়েৎ। –(প্রাণতোষিণী-ধৃত তোড়লতন্ত্রবচন)
অর্থাৎ : অগ্রে শিব-পূজা করিয়া পরে শক্তি পূজা করিবে, নতুবা সমুদায় পূজা-দ্রব্য গঙ্গা-জল হইলেও মূত্র-সদৃশ হয়। অতএব মহেশানি! অগ্রে শিব-পূজা করিবে।
অগ্রে শিব-পূজা করার পরামর্শের অর্থ এটাই যে, এরা বস্তুত শিবোপাসক নয়। তাঁরা যে দেবীর উপাসক, সেই দেবীর সাথে শিবের সংযোগ নিবিড় এবং দার্শনিকভাবে অদ্বয় সম্পর্কে সম্পর্কিত। ফলে শিব এখানে অনিবার্যভাবেই উপস্থিত। এজন্যেই বাঙলায় লিঙ্গ প্রতীকে শিবের উপস্থিতিমূলক যত্রতত্র অগুনতি মন্দির বা উপাসনাকেন্দ্র চোখে পড়লেও এগুলো মূলত শক্তি-উপাসনা কেন্দ্রই। এখানে শক্তিই প্রধান, শক্তিমান গৌন কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিভা নিয়ে শক্তির সাথে দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কে বর্তমান। সে যাক, তন্ত্রের তত্ত্ব-দর্শন প্রসঙ্গে অন্যত্র এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে বাঙলায় শৈবধর্মের প্রাধান্য না থাকলেও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে শিবোপাসকদের বিস্তৃতি প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন–
‘এদেশীয় লোকের মধ্যে, বিশেষতঃ গৃহস্থেতে, শিবোপাসক প্রায় দৃষ্ট হয় না। দক্ষিণে দ্রাবিড় ও পশ্চিমে রাজস্থান প্রভৃতি অনেক দেশের গৃহস্থেরা শিবের উপাসক। রাজস্থানের অন্তর্গত মেওয়ার প্রদেশের ইতিহাস মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়, বহুকাল পূর্বাবধি তদীয় রাজবংশীয়েরা শিবের আরাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন। ঐ প্রদেশের মধ্যে স্থানে স্থানে উৎকৃষ্ট শিব-মন্দির ও শিবলিঙ্গ সকল বিদ্যমান আছে। তথাকার একলিঙ্গ নামক শিবের মন্দিরটি অতি বৃহৎ। তাহা শ্বেত প্রস্তরে নির্মিত ও নানারূপ চিত্র-কার্যে এরূপ পরিপূর্ণ যে, তাহার সবিশেষ বর্ণনা করা সুকঠিন। বহুশত বৎসর পূর্বাবধি মেওয়ার অঞ্চলে যে শৈব-ধর্ম প্রবলরূপ প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে। পূর্বে এ বিষয়ের বিবরণ করা গিয়াছে। ঐ প্রদেশীয় অনেকানেক নৃপতি ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা বহুতর শিব-মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করাইয়া যান।’
‘ভারতবর্ষের দক্ষিণ খণ্ডেও অনেককাল পূর্বে শিবোপাসনার প্রচার ছিল…। এখনও তথায় গৃহস্থ ও উদাসীন বহু সংখ্যক শৈবের অবস্থিতি আছে। বাঙ্গালাদেশীয় গৃহস্থদিগের মধ্যে পৃথক শিবোপাসক প্রায় নাই বটে, কিন্তু শাক্তেরা শক্তি-পতি শিবের অর্চনা ও শিব-ব্রত সকল পালন করিয়া থাকেন। ইহা তাঁহাদের কর্তব্য কর্ম।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১২)
অতএব, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রদায়গতভাবে যেসব বিভিন্ন শৈব-উপাসক ছিলো বা আছে, তারা প্রচলিত সমাজ ও জনমনে কিভাবে কতোটা প্রভাবিত করেছে তা বুঝতে হলে তাঁদের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং উপাসক ভেদে তাঁদের আচার-বিচার ও তত্ত্ব-বিশ্বাস বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান জারি রাখা দরকার। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান কয়েকটি শৈব-সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচিত হওয়াই বর্তমান আলোচনার জন্য সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
‘এদেশীয় লোকের মধ্যে, বিশেষতঃ গৃহস্থেতে, শিবোপাসক প্রায় দৃষ্ট হয় না। দক্ষিণে দ্রাবিড় ও পশ্চিমে রাজস্থান প্রভৃতি অনেক দেশের গৃহস্থেরা শিবের উপাসক। রাজস্থানের অন্তর্গত মেওয়ার প্রদেশের ইতিহাস মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়, বহুকাল পূর্বাবধি তদীয় রাজবংশীয়েরা শিবের আরাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন। ঐ প্রদেশের মধ্যে স্থানে স্থানে উৎকৃষ্ট শিব-মন্দির ও শিবলিঙ্গ সকল বিদ্যমান আছে। তথাকার একলিঙ্গ নামক শিবের মন্দিরটি অতি বৃহৎ। তাহা শ্বেত প্রস্তরে নির্মিত ও নানারূপ চিত্র-কার্যে এরূপ পরিপূর্ণ যে, তাহার সবিশেষ বর্ণনা করা সুকঠিন। বহুশত বৎসর পূর্বাবধি মেওয়ার অঞ্চলে যে শৈব-ধর্ম প্রবলরূপ প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে। পূর্বে এ বিষয়ের বিবরণ করা গিয়াছে। ঐ প্রদেশীয় অনেকানেক নৃপতি ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা বহুতর শিব-মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করাইয়া যান।’
‘ভারতবর্ষের দক্ষিণ খণ্ডেও অনেককাল পূর্বে শিবোপাসনার প্রচার ছিল…। এখনও তথায় গৃহস্থ ও উদাসীন বহু সংখ্যক শৈবের অবস্থিতি আছে। বাঙ্গালাদেশীয় গৃহস্থদিগের মধ্যে পৃথক শিবোপাসক প্রায় নাই বটে, কিন্তু শাক্তেরা শক্তি-পতি শিবের অর্চনা ও শিব-ব্রত সকল পালন করিয়া থাকেন। ইহা তাঁহাদের কর্তব্য কর্ম।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১২)
অতএব, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রদায়গতভাবে যেসব বিভিন্ন শৈব-উপাসক ছিলো বা আছে, তারা প্রচলিত সমাজ ও জনমনে কিভাবে কতোটা প্রভাবিত করেছে তা বুঝতে হলে তাঁদের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং উপাসক ভেদে তাঁদের আচার-বিচার ও তত্ত্ব-বিশ্বাস বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান জারি রাখা দরকার। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান কয়েকটি শৈব-সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচিত হওয়াই বর্তমান আলোচনার জন্য সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
বিভিন্ন শৈব সম্প্রদয়ঃ
কাশ্মীর শৈববাদ বীরশৈব বা লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়
পাশুপত ধর্মসম্প্রদায়
শুদ্ধশৈব বা শিবাদ্বৈত সম্প্রদায়
আগমান্ত শৈব সম্প্রদায়
কাপালিক, কালামুখ, মত্তময়ূর সম্প্রদায়
নায়নার সম্প্রদায়
শিব ও লৌকিক শৈবধর্ম
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ