কালী পূজা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 July, 2021

কালী পূজা

কালী নামের বর্ণনা 
এটা সঠিক কালী মূর্তি প্রাচীন নয়! মুণ্ডকোপনিষৎ ১.২.৪ অনুসারে কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী এবং বিশ্বরুচী যাজ্ঞিক অগ্নির জিহ্বা সমূহ। যা প্রতিক অর্থে যাজ্ঞিকঅগ্নি স্বরূপী ঈশ্বরের একটি শক্তি।
কালী পূজা

এই ধারণার ভিত্তিতে শিবপুরাণের রুদ্র সংহিতা ও উমা সংহিতাতে মা কালী পরমা প্রকৃতির (মাতা সতী ও মাতা পার্বতীর) একটি উগ্র স্বরূপ। যেহেতু দার্শনিক দৃষ্টিকোণে মা কালী হল পরম পুরুষের শক্তি স্বরূপী পরমা প্রকৃতির একটি উগ্র স্বরূপ, তাই মা কালীই হল এক দিক থেকে পরমা প্রকৃতি। তন্ত্রদর্শনে উক্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে মা কালীকে আদ্যাশক্তি হিসাবে নামকরণ করেছে। পরে এই কালীই শাক্ত দর্শনের আধারে বিভিন্ন রূপভেদে বিভক্ত হয়েছে যেমন :- সিদ্ধকালী, ভদ্রকালী, গৃহ্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, মহাকালী, ফলহারিণী কালী, রটন্তী কালী প্রভৃতি। এমনই একটি রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে (মহাভারত ১০.৮.৬৪) যেখানে মা কালীর প্রাচীনতম কালরাত্রি স্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে।

ওতম্ নরাশংসমিহ প্রিয়মস্মিন্ যজ্ঞ উপ হ্নয়ে।
মধুজিহ্নং হবস্কৃিতম্।।
ঋগ্বেদ০ মন্ডল ১ সূক্ত ১৩ মন্ত্র ৩
পদার্থঃ আমি (অন্মিন্) এই (য়জ্ঞ) অনুষ্ঠান করিবার যােগ্য যজ্ঞ তথা (ইহ) সংসারে (হবস্কৃিতম্) যে সব হােম করিবার যােগ্য পদার্থ হইতে প্রদীপ্ত করা হইয়া থাকে এবং (মধুজিহ্বম্) ১যাহার কালী, করালী, মনােজবা,
সুলােহিতা, সুধূস্রবর্ণা, ফূল্লিঙ্গিনী এবং বিশ্বরূপী এই অতি প্রকাশমান চঞ্চল জ্বালারূপী জিহ্বা আছে, (প্রিয়ম্) যে সব জীবের প্রীতি দানে এবং (নরাশংসম্)২ যে সুখকে মনুষ্য প্রশংসা করেন, তাহার প্রকাশকারী অগ্নিকে
(উপহ্নয়ে) নিকটে প্রজ্বলিত করিয়া থাকি।।
সরলার্থঃ আমি এই অনুষ্ঠান করিবার যােগ্য যজ্ঞ তথা সংসারে যে সব হােম করিবার যােগ্য পদার্থ হইতে প্রদীপ্ত করা হইয়া থাকে এবং যাহার কালী, মনােজবা, সুলােহিতা, সুধুম্রবর্ণা, স্ফূলিঙ্গিনী এবং বিশ্বরূপী এই অতি প্রকাশমান চঞ্চল জ্বালারূপী জিহ্বা আছে, যে সব জীবের প্রীতি দানে এবং যে
১।জেহুবা নিরু০ ৫-২৬। কালী করালী চ মনােজবা চ সুলােহিতা যা চ সুধুস্রবর্ণা স্ফূলিঙ্গিনী বিশ্বরূপী চ দেবী লেলযমানা ইতি সস্তু জিহ্বাঃ।। ইতি মুন্ডক উপনিষদ মুন্ডক০ ১।২।৪।
২।নরাশংসো যজ্ঞ ইতি কাৎথক্যাে নৱা অস্মিন্নাসীনাঃ শংসন্ত্যগ্নিমিতি শাককপূণির্ণরৈঃ। প্রশস্যে ভবতি। নিরু০ ৮।৬ সুখকে মনুষ্য প্রশংসা করেন, তাহার প্রকাশকারী অগ্নিকে নিকটে প্রজ্বলিত করিয়া থাকি।।
ভাবার্থঃ যে ভৌতিক অগ্নি এই সংসারে হােমের নিমিত্ত যুক্তি হইতে গ্রহণকৃত প্রাণীদিগকে প্রসন্নতা প্রদানকারী, সেই অগ্নির সাত জিহ্বা আছে অর্থাৎ কালী যাহা সুপথ আদি রঙ্গের প্রকাশকারী, করালী সহন করা কঠিন,
মনােজবা মনের সমান বেগবান, সুলােহিতা যাহার উত্তম রক্ত বর্ণ, সুধুম্রবর্ণা যাহার সুন্দর ধূমলাসা বর্ণ, স্ফূলিংগিনী যাহা হইতে বহু অগ্নিকণা উঠিয়া থাকে তথা বিশ্বরূপী যাহার সব রূপ। এই দেবী অর্থাৎ অতিশয় করিয়া প্রকাশমান এবং লেহনকারী-প্রকাশ হইতে সর্বত্র বেগবান সাত প্রকরের জিহ্বা অর্থাৎ সব
পদার্থের গ্রহণকারী হইয়া থাকে, এই উক্ত সাত প্রকারের অগ্নীর জিহ্বা দ্বারা সব পদার্থের উপকার গ্রহণ করা সকল মনুষ্যের কর্তব্য ।।

বাঙলা ও ভারতে শক্তিসাধনা মূল দুইভাগে বিভক্ত– প্রথমটা হলো দুর্গা-কেন্দ্রিক, আর দ্বিতীয়টা কালী-কেন্দ্রিক। পার্বতী উমা, সতী এবং দুর্গা-চণ্ডিকার ধারা মিলে পুরাণ-তন্ত্রাদিতে যে দুর্গাকেন্দ্রিক এক মহাদেবীর বিবর্তন দেখতে পাই, তার সাথে এসে মিলেছে কালী, করালী, চামুণ্ডা, তারা ও অন্যান্য দশমহাবিদ্যাকে নিয়ে আরেকটি ধারা, তা হলো দেবী কালিকা বা কালীর ধারা। এই কালী বা কালিকাই বাঙলা অঞ্চলের শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে দেবীর অন্য সব রূপ পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত সর্বেশ্বরী হয়ে উঠেছেন। তাই বাঙলার শক্তি-সাধনা ও শাক্ত-সাহিত্যকে বুঝতে হলে এই কালী বা কালিকার ধারাটির প্রাচীন ইতিহাস একটু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। ‘ব্রহ্মযামলে’ আদ্যাস্তোত্রে আদ্যা দেবী কোন্ দেশে কী মূর্তিতে পূজিতা হন তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপে পূজিতা। উক্তিটিকে ইতিহাসের দিক থেকে গভীরার্থব্যঞ্জক বলে মনে হয়। কেননা বাঙলা অঞ্চলই শক্তিসাধনার প্রধান কেন্দ্র। শুধু পূজার দিক দিয়ে বিচার করলে বাঙলায় কালীপূজা থেকে দুর্গাপূজা প্রাচীনতর। এখনও পর্যন্ত ধর্মোৎসব হিসেবে দুর্গাপূজাই অনেক বেশি জাকজমকপূর্ণ ও জনপ্রিয় হলেও বাঙালির এই শাক্ত-প্রবণতা শুধুমাত্র ধর্মোৎসবের মধ্যেই সীমায়িত নয় মোটেও; এর বীজ নিহিত আছে সাধনার অন্তরালে। আর এই সাধনার শুরু– প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। এর পরে ঐতিহাসিক যুগের সূচনার আদি-মধ্য ও নব্য পর্যায়ে এই সাধনার ধারা ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য (প্রাকৃত বা অবৈদিক) এই দুই ধারাস্রোতে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাধনার দিক থেকে বিচার করলে, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এতদঞ্চলের শক্তিসাধনার কেন্দ্রে কালী। দেবী তারাকেও কালীস্থানীয়া করে নেয়া হয়েছে, এমনকি দশমহাবিদ্যার মধ্যকার অন্যান্য মহাবিদ্যাগণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। কালিকা দেবী কী করে মহাদেবীর সঙ্গে মিলে গেলেন তার ইতিহাস বহু পুরাণের মধ্যেই পাওয়া যায়। বেদের কোথাও কালী বা কালিকা দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় না, অর্থাৎ, কালী বৈদিক কোনও দেবী নন। আবার বৈদিক ঋষিদের মধ্যেও একটা অদ্ভূত সংশ্লেষণী প্রবণতা দেখা যায়। যখনই কোনও অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবী বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে লৌকিক স্তর থেকে উত্তরিত হয়ে আঞ্চলিক বা আরও বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পায়, তখনই সেই দেব-দেবীকে বৈদিক দেবমণ্ডলীতে একীভূত করে দার্শনিকতার মোড়কে মহিমান্বিত করে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়। তাই বেদের রাত্রিসূক্তকে (ঋগ্বেদ-১০/১২৭) অবলম্বন করে পরবর্তীতে যে এক রাত্রিদেবীর ধারণা গড়ে উঠেছে, কারও কারও মতে সেই অন্ধকাররূপিণী রাত্রিদেবীই পরবর্তীকালে কালিকা রূপ ধারণ করেছেন। আবার পাশহস্তা কৃষ্ণা-ভয়ঙ্করী নির্ঋতি দেবীও (শতপথ-ব্রাহ্মণ-৭/২/৭ এবং ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ-৪/১৭) কালীর সঙ্গে একীভূত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। এই নির্ঋতি দেবীর পরবর্তীকালের ইতিহাস সম্ভবত বৌদ্ধ দেবী নৈরাত্মা। বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। এই উপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নামে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন– কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা। স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বাঃ।। (মুণ্ডক-১/২/৪) অর্থাৎ : যজ্ঞাগ্নির সেই লেলিহান শিখা আকাশপানে ওঠে সাত শিখা হয়ে। শৌনক, সেই সাতটি শিখার নাম– কালী, করালী, মনোজবা (মনের মতো দ্রুতগামী), সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী আর বড় সৌন্দর্যশালিনী বিশ্বরূচী। এই সাতটি শিখা হলো অগ্নিদেবের সাতটি জিভ। টলটলে, লকলকে এই জিভ দিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞের আহুতি দেন। এখানে ‘কালী’ আহুতি-গ্রহণকারিণী অগ্নিজিহ্বা মাত্রই; মাতৃদেবীত্বের কোনও আভাসই এখানে নাই। শুধু বিশ্বরূচীর ক্ষেত্রে দীপ্যমানা অর্থে দেবী কথাটির ব্যবহার দেখা যায়। মহাভারতেও (আদিপর্ব-২৩২/৭) যজ্ঞাগ্নির এই সপ্তজিহ্বার উল্লেখ পাওয়া যায়। দার্শনিক মতে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও মন– এই সাতটিকে অগ্নির সপ্তজিহ্বা বলে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রচলিত মহাভারতে একাধিক স্থলে ‘কালী’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং পৌরাণিক কালী-দেবীর সাথে মহাভারতে বর্ণিত কালী-দেবীর বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে দেখা যায়– কুরুক্ষেত্রে অন্যতম কৌরব-সেনাপতি আচার্য দ্রোণের মৃত্যুর পরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন গভীর রাত্রে পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে নিদ্রিত বীরগণকে হত্যা করছিলেন তখন সেই হন্যমান বীরগণ ভয়ঙ্করী কালী-দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই কালী-দেবী রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা এবং ভয়ঙ্করী। কালীর ভীষণ স্বরূপ সংহারের প্রতীক; কালরাত্রিরূপিণী এই দেবী বিগ্রহবর্তী সংহার। এ প্রসঙ্গে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের অভিমত হলো, মহাভারতে কালী-দেবীর এই উল্লেখ পরবর্তীকালের যোজনা হতে পারে। পরবর্তীকালের যোজনা না হলেও এসব বর্ণনায় কালীর কোনও দেবীত্বের আভাস নাই; কালী এখানে অত্যন্ত ভীত মনের একটা ভয়ঙ্করী ছায়ামূর্তি দর্শনের ন্যায়। কবি কালিদাসের সময়েও কালী কোনও প্রধানা দেবী বলে গৃহীতা হননি। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে উমার সাথে মহাদেবের বিবাহ-প্রসঙ্গে বরযাত্রার বর্ণনায় দেখা যায়, কৈলাস-পর্বতের মাতৃকাগণ বিবাহযাত্রায় মহাদেবের অনুগমন করেছিলেন; আর– তাসাঞ্চ পশ্চাৎ কনকপ্রভাণাং কালী কপালাভরণা চকাশে। বলাকিনী নীলপয়োদরাজী দূরং পুরঃক্ষিপ্তশতহ্রদেব।।– (কুমারসম্ভব-৭/৩৯) অর্থাৎ– কনকপ্রভা তাঁহাদের (সেই মাতৃকাগণের) পশ্চাতে কপালাভরণা কালী অগ্রে বিদ্যুৎপ্রসারকারিণী বলাকাসমন্বিতা নীলমেঘরাজির ন্যায় শোভা পাইতেছিলেন। মাতৃকাগণের পশ্চাৎগামিনী এই কালী-দেবী কালিদাসের যুগেও একজন অপ্রধানা দেবী বলেই মনে হয়। ‘রঘুবংশে’র মধ্যে একটি উপমাতেও এই কালী বা কালিকা-দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন– জ্যানিনাদমথ গৃহ্নতী তয়োঃ প্রাদুরাস বহুলক্ষপাচ্ছবিঃ। তাড়কা চলকপালকুণ্ডলা কালিকেব নিবিড়া বলাকিনী।।– (রঘুবংশ-১১/১৫) অর্থাৎ– রাম-লক্ষ্মণের জ্যা-নিঃস্বন শুনিয়া ভয়ঙ্করী তাড়কা রাক্ষসী যখন আত্মপ্রকাশ করিল তখন সেই ঘনকৃষ্ণ রাত্রির ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা তাড়কাকে মনে হইতেছিল চঞ্চলকপালকুণ্ডলা বলাকাযুক্তা কালিকার মত। এক্ষেত্রে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য হলো,– “মল্লিনাথ ‘কালিকা’ শব্দের অর্থ কালিকা-দেবী করেন নাই, ‘কালিকা’ শব্দের এক অর্থ ‘ঘনাবলী’, সেই অর্থ ধরিয়া এবং ‘বলাকিনী’ কথার সহিত যুক্ত করিয়া ‘ঘনাবলী’ অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু ‘চলকপালকুণ্ডলা’ কথাটি তাড়কাসম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলেও ইহা কালিকা-দেবীর কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়।” “এই প্রসঙ্গে আর-একটি তথ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবি কালিদাসের ‘কালিদাস’ নামটির ব্যুৎপত্তি কি? ‘কালীর দাস’ এই অর্থে কি কালিদাস? কালিদাসের লেখার মধ্যে কালী তেমন কোনও প্রসিদ্ধ দেবীত্ব লাভ করেন নাই বটে, কিন্তু কালিদাস নামের ব্যুৎপত্তিতে মনে হয়, কালীর দেবীত্ব তখন যত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রেই হোক, প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।”– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৫) এখানে উল্লেখ্য, ‘মহাভারতের বর্তমান রূপগ্রহণের আগেই অর্থাৎ আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে দুর্গার সঙ্গে কালী অভিন্নতা লাভ করে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে। শিবের স্ত্রী দুর্গার সঙ্গে কালের (অর্থাৎ শিবের) শক্তিরূপে যাঁকে কল্পনা করা হয়, সেই কালীর অভিন্নতার কল্পনা তাঁকে মাতৃদেবীরূপে স্বীকৃতি দেয়। তিনি শুধুমাত্র অসুর নিধনের ভূমিকায় ভয়ংকরী রণোন্মাদিনী ধ্বংসের দেবী নন– তিনি একাধারে অশুভ শক্তিনাশিনী ও পরমমঙ্গলময়ী ও মাতৃস্বরূপিণী। তাই ভদ্রকালী রূপের মধ্যে দিয়েই দেখা যায় তাঁর পরমমঙ্গলময়ী মাতৃরূপের প্রকাশ।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩০-৩১) কালিদাসের পর সংস্কৃত সাহিত্যের স্থানে স্থানে এক রক্তলোলুপা ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তা তখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মে জায়গা করে নিতে পারেনি। অন্যদিকে– ‘খিল হরিবংশে’ মদ্যমাংসপ্রিয়া এক দেবীকে বর্বর, শবর ও পুলিন্দদের দ্বারা পূজিত হতে দেখা যায়। এর পরে (৭ম শতকে) বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তেও বনের মধ্যে শবর পূজিত নরমাংস ও রক্তস্নাত দেবীর কথা পাই। আবার (আনুমানিক ৭ম শতাব্দী) ভবভূতির ‘মালতী মাধব’ নাটকে নরমাংস বলিদানে পূজিতা ভয়ংকরী শ্মশানবাসিনী এক করালা দেবীর বর্ণনা পাই। বলাই বাহুল্য ইনি কৃষ্ণবর্ণা ও উগ্রা। (৮ম শতাব্দী) এক সাহিত্যে দেবীকে শবর পূজিতা পর্ণপত্র পরিহিতা বলা আছে। এরপরে পৌরাণিক যুগে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে– দেবী কালিকা অসুরবধের প্রয়োজনেই ধরাধামে অবতীর্ণা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাত শত শ্লোক নিয়েই সপ্তশতী ‘চণ্ডী’ গ্রন্থ। এখানেই (উত্তর চরিতে) আছে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্যে হিমালয়স্থিতা দেবীর কাছে অনুরোধ করলে দেবীর শরীরকোষ থেকে আর এক দেবী সমুদ্ভূতা হলেন। শরীরকোষ থেকে নিসৃতা বলে তিনি ‘কৌশিকী’ নামে পরিচিতা হলেন। এদিকে কৌশিকী দেবী বিনির্গত হওয়ায় পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে হিমাচলবাসিনী ‘কালিকা’ নামে সমাখ্যাতা হলেন। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবী কালিকা কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই তাঁকে হিমাচলবাসিনী দেবীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। এই কৌশিকীদেবী মূলে কুশিক জাতির পূজিতা দেবী ছিলেন বলে ভান্ডারকরের অভিমত। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে তাঁকে গৌরবর্ণা অনিন্দ্যসুন্দরী বলা হলেও পদ্মপুরাণ ও কালিকা পুরাণে অন্য কথা বলা আছে। সেখানে বলা আছে, দেবীর দেহ থেকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা যে রাত্রিদেবী বা কালরাত্রি দেবী বার হলেন– তিনিই কৌশিকী। এই কৌশিকী দেবীকে ব্রহ্মা বিন্ধ্যাচলে প্রতিষ্ঠিতা হতে বললেন। এই সব পরস্পরবিরোধী উপাখ্যানগুলো থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, কৌশিকী নামে যে স্বতন্ত্র দেবী ছিলেন, তাঁকে মহাদেবীর সঙ্গে এক করে দেওয়ার এ এক অনলস, পৌরাণিক প্রচেষ্টা।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২২৮-২৯) এখানে ‘কালিকা’র আবির্ভাব-রহস্য এভাবে দেখা গেলেও একটু পরেই আবার অন্যরূপে দেখা যায়। যেমন, অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড-মুণ্ড এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্য অসুরেরা দেবীর নিকটবর্তী হলে– ততঃ কোপং চকারোচ্চৈরম্বিকা তানরীন্ প্রতি। কোপেন চাস্যা বদনং মসীবর্ণমভূৎ তদা।। ভ্রূকুটীকুটিলাৎ তস্যা ললাটফলকাৎদ্রুতম্ । কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৫-৬) অর্থাৎ– তখন অম্বিকা সেই শত্রুগণের প্রতি অত্যন্ত কোপ করিলেন; তখন কোপের দ্বারা তাঁহার বদন মসীবর্ণ হইল। তাঁহার ভ্রূকুটীকুটিল ললাটফলক হইতে দ্রুত অসিপাশধারিণী করালবদনা কালী বিনিষ্ক্রান্তা হইলেন। এই কালী-দেবী– বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা। দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।। অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা। নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৭-৮) অর্থাৎ– বিচিত্র নরকঙ্কালধারিণী, নরমালাবিভূষণা, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, শুষ্কমাংসা (মাংসহীন অস্থিচর্মময় দেহ), অতিভৈরবা, অতি বিস্তারবদনা, লোলজিহ্বা-হেতু-ভীষণা, কোটরাগত রক্তবর্ণ-চক্ষুবিশিষ্টা– তাঁহার নাদে দিঙ্মুখ আপূরিত। এর পর দেবীর সঙ্গে চণ্ড-মুণ্ডের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন– ‘দেবী হইতে বিনিষ্ক্রান্ত হইয়াই সেই কালী-দেবী বেগে দেবশত্রু অসুরগণের সৈন্যমধ্যে অভিপতিতা হইয়া সেখানে মহা-অসুরগণকে বিনাশ করিতে করিতে তাহাদের সৈন্যবলকে ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই দেবী পৃষ্ঠ-রক্ষক, অঙ্কুশ-গ্রাহক, যোদ্ধা ও গলঘণ্টাদিসহ হস্তীগুলিকে হস্তে লইয়া মুখে গ্রাস করিতে লাগিলেন। শুধু হস্তুগুলিকে নয় ঘোড়ার সহিত যোদ্ধাকে, সারথির সহিত রথকে মুখে ফেলিয়া দিয়া দন্তদ্বারা অতি ভীষণভাবে চর্বণ করিতে লাগিলেন। কাহাকেও চুলে ধরিলেন, আবার কাহাকেও গ্রীবায় ধরিলেন; কাহাকেও পায়ের দ্বারা আক্রমণ করিয়া অন্যকে বক্ষের দ্বারা মর্দিত করিলেন। সেই অসুরগণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত শস্ত্রগুলিকে এবং মহাস্ত্রগুলিকে তিনি মুখে গ্রহণ করিলেন এবং রোষে দন্তদ্বারাই মথিত (চূর্ণ) করিলেন। অসুরদলের কতকগুলিকে তিনি মর্দন করিলেন, কতকগুলিকে ভক্ষণ করিলেন, কতকগুলিকে বিতাড়িত করিলেন। অসুরগণ কেহ কেহ অসিদ্বারা নিহত হইল, কেহ কেহ কঙ্কালের দ্বারা তাড়িত হইল, কেহ কেহ দন্তাঘাতে বিনাশ প্রাপ্ত হইল। ক্ষণকালমধ্যে সমস্ত অসুরসৈন্য নিপতিত দেখিয়া চণ্ড সেই অতিভীষণা কালীর দিকে ধাবিত হইল। সেই মহাসুর চণ্ড মহাভীম শরবর্ষণের দ্বারা এবং মুণ্ড চক্রসমূহের দ্বারা সেই ভীষণ-নয়নাকে ছাইয়া ফেলিল। কিন্তু কালমেঘের উদয়ে যেমন অসংখ্য সূর্যবিম্ব শোভা পায় সেইরূপ চক্রসমূহ তাঁহার মুখগহ্বরে প্রবিষ্ট হইয়া শোভা পাইল। অতঃপর ভৈরবনাদিনী কালী অতিরোষে ভীষণভাবে অট্টহাস্য করিলেন– তাঁহার করাল বক্ত্রের অন্তঃপাতী ভীষণদর্শন দশনগুলি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহার পরে মহাখড়্গ উত্তোলনপূর্বক দেবী হুঙ্কারনাদে (হং শব্দে) চণ্ডের প্রতি ধাবিত হইলেন, এবং তাহার চুলে ধরিয়া সেই খড়্গের দ্বারাই তাহার শিরশ্ছেদ করিলেন। চণ্ডকে নিপতিত দেখিয়া মুণ্ড দেবীর প্রতি ধাবিত হইল; দেবী ক্রোধে তাহাকেও খড়্গরে দ্বারা আহত করিয়া ভূমিতে পাতিত করিলেন। হতশেষ অসুরসৈন্য চণ্ড-মুণ্ডকে নিহত দেখিয়া ভয়ে চতুর্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৭-৮) এরপর চণ্ড-মুণ্ডের ছিন্ন মুণ্ড হাতে নিয়ে দেবী কালিকা চণ্ডীকে তা উপহার দিলেন। দেবী চণ্ডিকা তখন কালীকে বললেন– যস্মাৎ চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতা। চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/২৭) অর্থাৎ– যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডকে (তাহাদের ছিন্ন শির) লইয়া আসিয়াছ, সেই কারণে তুমি লোকে (জগতে) চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হইবে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, চণ্ড ও মুণ্ড শব্দদ্বয় থেকে খুব গোঁজামিল না দিলে ব্যুৎপত্তিগতভাবে চামুণ্ডা শব্দ হয় না। আসলে পুরাণকারেরা কালীদেবীর সঙ্গে চামুণ্ডা দেবীকে এক করে দিয়ে অম্বিকা-চণ্ডী-পার্বতী-কালী ও চামুণ্ডাকে দেবী মহামায়ার রূপভেদ মাত্র বলে, সমস্ত দেবীকে মহাদেবীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন করে তুলতে চেয়েছেন। এরপরে রক্তবীজ বিনাশের সময়ও কালী-দেবী চণ্ডিকাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। কারণ রক্তবীজের রক্তধারা ভূমিস্পর্শ করলেই তা থেকে শত শত রক্তবীজ জন্মাবে। তাই দেবীচণ্ডী কালীকে বদন বিস্তার করে রক্তবীজের দেহ থেকে নির্গত সমস্ত রক্তবিন্দু মুখব্যাদানের দ্বারা গ্রহণ করতে বললেন– এবং সেই রক্তনির্গত অসুরগণকেও ভক্ষণ করতে বলে শূল দিয়ে তাকে আহত করলেন, কালীও মুখের দ্বারা তাঁর রক্ত লেহন করলেন। কালী-চামুণ্ডার মুখে পতিত শোনিত থেকে যত অসুর সমুদ্গত হয়েছিল তাদেরকেও চামুণ্ডা ভক্ষণ করলেন। চামুণ্ডার এরূপ রক্ত পানের ফলে রক্তবীজ নিরক্ত হয়ে গেল, দেবী তখন সহজেই তাকে হনন করলেন। এভাবেই কালী-চামুণ্ডার রক্তলোলুপতা ও ভয়ঙ্কর ভয়ালরূপ ‘চণ্ডী’তে প্রকাশ পেল। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী– ‘রক্তলোলুপা কালীর এখানে যে ভয়ঙ্করী রণোন্মাদিনী রূপ দেখিতে পাইলাম অন্যান্য পুরাণে এই জাতীয় বহু বর্ণনা দেখিতে পাই। উপ-পুরাণগুলিতে ইহার আর কিছু কিছু বিস্তারও দেখিতে পাই। পরবর্তী কালের পুরাণতন্ত্রাদিতে আমরা কালী ও চামুণ্ডাকে এক করিয়াও পাই, পৃথক্ করিয়াও পাই। উভয় দেবীর ধ্যানেও পার্থক্য আছে। চামুণ্ডা চতুর্ভুজা নন, দ্বিভুজা; আলুলায়িত-কুন্তলা নন, ‘পিঙ্গলমূর্ধ্বজা’ (জটাধারিণী?); উলঙ্গিনী নন, শার্দূলচর্মাবৃতা; (কোন কোন পুরাণে গজচর্মাম্বরা); সর্বস্থলের বর্ণনাতেই দেখি, চামুণ্ডা-দেবী নির্মাংসা এবং কৃশোদরী, তাঁহার চক্ষু কোটরাগত। কোন স্থলেই কালিকার এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই না। সংস্কৃত সঙ্কলন-গ্রন্থগুলিতে কালিকার বর্ণনায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই যে কালিকা অজিনাবৃতা। ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ ধৃত উমাপতি ধরের একটি শ্লোকেও কালীকে অজিনাবৃতাই দেখিতে পাই। ইহা পরবর্তী কালের মিশ্রণের ফলে ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করি। চামুণ্ডার বর্ণনায় একটা জিনিস প্রায় সর্বত্রই লক্ষ্য করি, চামুণ্ডা অতি ক্ষুধায় কৃশোদরী। কবিগণ কর্তৃক কালীর বর্ণনায়ও স্থানে স্থানে কালীকে ক্ষুধার্তারূপে দেখি। ভাসোক কবি কালীকে ‘ক্ষুৎক্ষামা’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৯)

কালী পূজা
সাধক কৃষ্ণানন্দের কালী সৃষ্টি
পুরাণ, উপপুরাণ ও তন্ত্রাদির মধ্যে কালী বা কালিকার যে বিস্তার ও বিবর্তন দেখা যায়, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কালীর শিবের সঙ্গে যোগ। শিব কালীর পদে স্থিতা, কালীর এক পা শিবের বুকে ন্যস্ত। সাধকের দিক থেকে এ তত্ত্বকে নানাভাবে গভীরার্থক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি উপাদান মুখ্যভাবে এই শিবারূঢ়া দেবীর বিবর্তনে সাহায্য করেছে বলে শ্রীদাশগুপ্তের ধারণা– ‘প্রথমতঃ, সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির তত্ত্ব। দ্বিতীয়তঃ, তন্ত্রের ‘বিপরীতরতাতুরা’ তত্ত্ব। তৃতীয়তঃ, নিষ্ক্রিয়া দেবতা শিবের পরাজয়ে বলরূপিণী শক্তিদেবীর প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রধান কারণ যাহা মনে হয় তাহা হইল এই, প্রাচীন বর্ণনায় কালিকা শিবারূঢ়া নন, শবারূঢ়া; অসুরনিধন করিয়া অসুরগণের শব তিনি পদদলিত করিয়াছেন, সেই কারণেই তিনি শবারূঢ়া বলিয়া বর্ণিতা।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭০) দক্ষিণাকালীর প্রচলিত ধ্যানের মধ্যেও দেখা যায়– শবরূপ-মহাদেব-হৃদয়োপরি-সংস্থিতাম্ । … … … মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্ ।। পরবর্তীকালের দার্শনিক চিন্তায় শক্তি-বিহনে শিবের শবত্ব-প্রাপ্তির তত্ত্ব খুবই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। মনে হয় তখন শিবই পূর্ববর্তীকালের বর্ণিত শবের স্থান গ্রহণ করেন, শবারূঢ়া দেবীও হয়ে ওঠেন শিবারূঢ়া। অসুরের শবারূঢ়া বলেই যে দেবী শিবারূঢ়া বলে কীর্তিতা বাঙলাদেশের শাক্ত পদাবলীর মধ্যে এই সত্যটির প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। তাই শ্রীদাশগুপ্তের উল্লেখকৃত সাধক রামপ্রসাদের গানে দেখতে পাই, বলা হয়েছে– শিব নয় মায়ের পদতলে। ওটা মিথ্যা লোকে বলে।। দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে, মা দাঁড়ায়ে তার উপরে, মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ শিবরূপ হয় রণস্থলে।। মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহও শিবরূপতা প্রাপ্ত হয়– কথাটার আসল অর্থ হলো, এ কথার মধ্যে দিয়েই শক্তিতত্ত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। এ ছাড়াও তন্ত্রে শিবের বুকে কালীর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বহুরকম দার্শনিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। যেমন, মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে– কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ। মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।। কালসংগ্রহণাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী। কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।। –(মহানির্বাণতন্ত্র) অর্থাৎ– তিনি মহাকাল, তিনি সর্বপ্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলিয়াই মহাকাল; দেবী আবার এই মহাকালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, এই নিমিত্ত তিনি আদ্যা পরম ‘কালিকা’। কালকে গ্রাস করেন বলিয়াই দেবী কালী। তিনি সকলের আদি, সকলের কালস্বরূপা এবং আদিভূতা, এই নিমিত্তই লোকে দেবীকে আদ্যাকালী বলিয়া কীর্তন করে। বিভিন্ন পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে ‘কালীতন্ত্র’-ধৃত কালীর বর্ণনাই কালীর ধ্যানরূপে কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হয়েছে। তন্ত্রসারে বর্ণিত কালীর এ রূপই এখন সাধারণভাবে বাঙলা অঞ্চলের মাতৃপূজায় গৃহীত। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী কালীর রূপ হলো– ‘দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ; দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা (এইজন্যই কালী-দেবী শ্যামা নামে খ্যাতা) এবং দিগম্বরী; তাঁহার কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; আর দুইটি শবশিশু তাঁহার কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্ট্রা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা; শবসমূহের করদ্বারা নির্মিত কাঞ্চী পরিহিতা হইয়া দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা-দ্বারা দেবী বিস্ফুরিতাননা; তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী– শ্মশানগৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের ন্যায় দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা; তিনি চতুর্দিকে ঘোররবকারী শিবাকুলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সহিত ‘বিপরীতরতাতুরা’, সুখপ্রসন্নবদনা এবং ‘স্মেরাননসরোরুহা’।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭১) কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-সঙ্কলিত এই সুপ্রসিদ্ধ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হয়েছে। বাঙলা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ‘কালী’ আছেন। তন্ত্রসারে বিভিন্ন প্রকার কালীর সাধনার পদ্ধতি দেখা যায়। এখানে কালী– বা শ্যামা-পূজার বিধি ছাড়াও তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাগণের সাধনবিধিও সঙ্কলিত হয়েছে। কৃষ্ণানন্দকে ষোড়শ শতকের লোক বলে ধরা হয়। কৃষ্ণানন্দ ছাড়া তান্ত্রিক সাধনা ক্রিয়াকলাপবিধি সম্বন্ধে গ্রন্থরচয়িতারূপে ব্রহ্মানন্দ ও সর্বানন্দের প্রসিদ্ধি রয়েছে। ব্রহ্মানন্দ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম বা মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে শাক্তদের আচার-অনুষ্ঠান বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তারারহস্যে’ তারার উপাসনা বিবৃত হয়েছে। ব্রহ্মানন্দের শিষ্য পূর্ণানন্দ পরমহংস ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লোক। তাঁর রচিত ‘শ্যামারহস্যে’ কালীর উপাসকের আচার-অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও আরও একজন গ্রন্থকার গৌড়ীয় শঙ্কর (শঙ্কর আগমাচার্য, ১৬৩০) তার উপাসনার আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে রচনা করেন– ‘তারারহস্যবৃত্তিকা’। বর্তমানে নিত্য কালীপূজার প্রথা রয়েছে বা বিশেষ কোন উপলক্ষে ‘মানসিক’-করা কালীপূজার ব্যবস্থা হয়। এ ছাড়া দীপালি-উৎসবের বা দীপাবলির দিনে যে সাংবাৎসরিক কালী বা শ্যামাপূজার জনপ্রিয় প্রচলন রয়েছে তার সর্বপ্রথম বিধিব্যবস্থা পাওয়া যায় কাশীনাথ (১৭৬৮) রচিত ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে। শ্রীদাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গ্রন্থে কাশীনাথ যেভাবে কালীপূজার সপক্ষে যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন তাতে মনে হয়, তখন ‘বাঙলাদেশে’ এই সাংবাৎসরিক দীপাবলির দিনে কালীপূজা বা শ্যামাপূজা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল না। কালীপূজা বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই এই পূজার প্রবর্তন করেন এবং তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রজাদের মধ্যে যারা কালীপূজা করতে অস্বীকৃত হবে তাদেরকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। এ আদেশের ফলে প্রতি বছর দশ হাজার করে কালীমূর্তি পূজিত হতো বলে জানা যায়। কথিত আছে, পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র সহস্র সহস্র মন নৈবেদ্য, সহস্র সহস্র বস্ত্র ও সেই পরিমাণ বিভিন্ন উপচার সহযোগে কালীপূজা করেছিলেন। এছাড়া রটন্তী চতুর্দশীর রাত্রিতে (মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে) কালীপূজার কথা ‘স্মৃতিসমুচ্চয়’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই দেবীকে অবলম্বন করেই বাঙলায় তন্ত্র-সাধনা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের বর্ণনায়– ‘এই দেবী-পূজার ইতিহাসটাই বাঙলাদেশের শাক্তধর্মের ক্ষেত্রে প্রধান কথা নহে; প্রধান জিনিস হইল দেবীকে অবলম্বন করিয়া বাঙলার তন্ত্র-সাধনা, এই তন্ত্র-সাধনা মুখ্যভাবে যুক্ত হইয়া গিয়াছিল কালী-সাধনা এবং দশমহাবিদ্যার সাধনার সঙ্গে, এবং খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতক হইতে আমরা কালী এবং অন্যান্য দশমহাবিদ্যার সাধনা অবলম্বনে বিখ্যাত শক্তি-সাধকগণের কথা জানিতে পারি। আমরা পূর্বে কালীপূজার বিধান রচয়িতৃরূপে কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছি; ইঁহারা সাধকও ছিলেন। অন্যান্য সাধকগণের মধ্যে ষোড়শ শতকের সর্বানন্দ ঠাকুর অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ত্রিপুরা জেলার মেহার গ্রামে তাঁহার আবির্ভাব হয়। তিনি শবরূপী ভৃত্য পূর্ণানন্দের দেহের উপরে বসিয়া সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং দশমহাবিদ্যার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে তাঁহার বংশধর তান্ত্রিক সাধকগণ ‘সর্ববিদ্যা’র বংশ বলিয়া খ্যাত। তন্ত্র-সাধনার ক্ষেত্রে ‘অর্ধকালী’রও প্রসিদ্ধি আছে। প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মুক্তাগাছার সমীপবর্তী পণ্ডিতবাড়ি গ্রামে দ্বিজদেব-নামক সাধকের গৃহে ইনি কন্যারূপে আবির্ভূতা হন। তাঁহার নাম ছিল জয়দুর্গা, তিনি স্বয়ং মহেশ্বরী বলিয়া প্রবাদ। তাঁহার দেহের অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক গৌরবর্ণ ছিল বলিয়া তাঁহার অর্ধকালী নাম হইয়াছিল। গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে খ্যাত রত্নগর্ভ-নামক সাধক ঢাকা জেলার মায়ৈসারের দিগম্বরীতলায় বীরাচারে সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। কথিত হয়, ইনি প্রসিদ্ধ ‘বারভূঞা’র মধ্যে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গুরু ছিলেন। প্রায় শত বর্ষ পূর্বে বীরভূম জেলার তারপীঠের নিকট আটলাগ্রামে সাধক বামাক্ষেপার জন্ম হয়; তারাপীঠ তাঁহার সাধনা ও সিদ্ধির স্থান।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭৬) আর অশোক রায়ের বর্ণনায়– ‘সাহিত্যে ও সাধনার শাক্তধারায় জোয়ার আসে অষ্টাদশ শতকে। সাধক রামপ্রসাদ সেন বাংলা ভাষায় শাক্ত পদাবলীর সূচনা করেন। তাঁর পরে, কমলাকান্ত ও গোবিন্দ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও প্রায় একশত বছর ধরে বীরভূম জেলার তারাপীঠের সাধক বামাখ্যাপার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপরে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের সাধক পূজারি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখেরা শাক্ত-সাধনাকে সারা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যোগীপুরুষ শ্রীঅরবিন্দ শক্তি সাধনার গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যকে তাঁর ‘অখণ্ড মহাযোগে’র সঙ্গে সংযুক্ত করে এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক দার্শনিক রূপদান করেন। এ ছাড়াও এই সময়কালে বহু সাধক-সাহিত্যিক গায়ক (কালীকেন্দ্রিক) শাক্তসাধনাকে চরমোৎকর্ষতার স্তরে উত্তরিত করেন। শ্যামাসংগীত গেয়ে বাঙালির মনজয় ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন দুই ভাই শ্রীপান্নালাল ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আর দুর্গাকেন্দ্রিক শাক্তধারাতে সাম্প্রতিক কালের শ্রেষ্ঠ সাধকেরা হলেন শ্রীশ্রীসত্যদেব, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ ও মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, এঁরা ‘চণ্ডী’ গ্রন্থের নবরূপকার।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩৯) বাঙলা অঞ্চলে মাতৃপূজার যে ইতিহাস তাতে দেখা যায় যে, দুর্গাপূজা কালীপূজা অপেক্ষা প্রাচীনতর কালে এদেশে প্রবর্তিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পূজাকে অবলম্বন করে ধর্মোৎসবের ব্যাপকতায় দুর্গাপূজা এখনও বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান পূজা। দুর্গাপূজা সাংবৎসরিক উৎসব-বিশেষ মাত্র। সাংবৎসরিক পূজা ছাড়া দুর্গার কোনও নিত্যপূজার প্রচলন তেমন কোন অঞ্চলে দেখা যায় না। রোগে, শোকে, দৈব-দুর্বিপাকে সংকল্পপূর্বক চণ্ডীপাঠ বা দুর্গানাম জপের ব্যবস্থা শান্তি-স্বস্ত্যয়নের অঙ্গরূপে দেখা যায়। কিন্তু এসব ছাড়া সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গার তেমন কোনও প্রাধান্য দেখা যায় না। শারদীয়া দুর্গাপূজার পর থেকে শুরু করে বসন্তকাল পর্যন্ত দেবীকে নানারূপে পূজা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, সরস্বতীপূজা– সর্বশেষ বসন্তকালে দেবীর বাসন্তী মূর্তির পূজা– এর মধ্যে এক কালীপূজা ছাড়া আর সবই সাংবৎসরিক পূজা। শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রাধান্য লাভ করলেন সাধারণভাবে কালী– বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দশমহাবিদ্যার অন্য কোনও রূপ। এখানে প্রশ্ন আসে, বাঙলা অঞ্চলে শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গাকে পেছনে ফেলে এই যে কালী-দেবীরই প্রাধান্য দেখা যায়, তার কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতদের অভিমত হলো,– শারদীয়া দুর্গাপূজায় পূজা অপেক্ষা উৎসব-আনন্দের দিকটাকেই বড় করে দেখা হয়। এই উৎসব-আনন্দের রূপটা যে ভক্তিহীন জাঁকজমক-প্রধান বিংশ শতাব্দীতেই প্রধান হয়ে উঠেছে তা নয়, শারদীয়া পূজার প্রথমাবধিই এ জিনিসটি আমরা লক্ষ্য করি। দুর্গাপূজাকে আমরা শস্য-সম্পদ্-শক্তি-রূপিণী মায়ের আগমনী-উৎসব বলেই জানি। শ্রদ্ধেয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় মনে করেন, শারদীয়া পূজার মূলে সবটাই উৎসব,– শরৎকালীন নববর্ষের উৎসব। শরৎ ঋতু প্রবেশ জনিত উৎসব– শরদোৎসব। অতএব, শারদীয়া দুর্গাপূজা যে শুধু দুর্গাপূজা নয়– মূলেও যে এর একটি উৎসব-প্রকৃতি ছিল এবং পরবর্তীকালেও যে নানা উৎসব এর সাথে নানাভাবে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দুর্গাপূজায় এই উৎসব প্রাধান্যের জন্যেই মনে হয় সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করেননি, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীরা। শুধু এটুকুই নয়, বাঙলা শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে কালী-প্রাধান্যের ভিতরে আরও অনেক তথ্য নিহিত আছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অতএব, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে– ‘বিভিন্ন পুরাণ এবং উপপুরাণের মধ্যে কালীর কথা যেভাবে পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, প্রথমতঃ এই উপপুরাণকারগণ নানাভাবে দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন কালী এবং পার্বতী-দেবী (তাঁহার উমা, দুর্গা, গৌরী, চণ্ডী সর্বরূপে) অভিন্না এবং এই করিয়া কালী-দেবীকে প্রথমে মহাদেবীরূপে স্বীকৃতা এবং প্রতিষ্ঠিতা করিয়া লইতে হইয়াছে। ইহার পরে দ্বিতীয় রকমের চেষ্টা দেখিতে পাই, কালীই যে মূল দেবী এবং পার্বতী দেবী তাঁহার উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি সর্বরূপেই এই সর্বমূলা কালী-দেবী হইতেই প্রসৃতা, সেই মূলা দেবীরই রূপভেদ মাত্র। এইভাবেই কালিকা বা কালী-দেবীকে প্রধানা করিয়া উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী রূপধারিণী দেবীকে মূল হইতে প্রসৃতা দেবী করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৮০-৮১) ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাঙলা অঞ্চলে প্রচলিত মাতৃপূজার মধ্যে প্রধান যে কয়েকটি ধারা রয়েছে আমরা দেখলাম, এই প্রধান ধারাগুলির সাথে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে স্থানীয় মাতৃদেবীরা মিলেমিশে মূল ধারাকেই সুবিচিত্র এবং পরিপুষ্ট করে তুলেছে। তাই ‘দেবী-ভাগবতে’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলা হয়েছে– কলা যা যাঃ সমুদ্ভূতাঃ পূজিতাস্তাশ্চ ভারতে। পূজিতা গ্রামদেব্যশ্চ গ্রামে চ নগরে মুনে।। অর্থাৎ– ভারতবর্ষের যত নগরে এবং গ্রামে যত দেবী রয়েছেন তাঁরাও বিধিপূর্বক মহাদেবীরূপেই পূজিতা হয়ে থাকেন– কারণ, মূলে তাঁরা আদ্যাদেবী থেকে কিছু পৃথক নন, তাঁরাও সবাই একই মহাদেবীর বিশেষ বিশেষ কলামাত্র।

[প্রতিমার উদ্দেশ্য]
কালীমূর্তির তত্ত্ব জানার আগে বুঝতে হবে এই কালীমূর্তি সর্বপ্রথম কে বা কাদের দ্বারা এবং কিসের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে? অবশ্যয় আদ্যাশক্তির সাধকদের দ্বারা! তবে তাদের কোনো কল্পনা বা কারো রূপকে নকল করে নয়, যা বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। তারা এই মূর্তি নির্মাণ করেছে তাদের ধ্যান ও সাধনা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে।
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য :- "আগমবাগীশ নামে এক পণ্ডিত কোনও আদিবাসী রমণীর শরীরের গড়ন দেখে এই মূর্তির রূপ দিয়েছিলেন।"

কে এই আগমবাগীশ?
আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দ হল তন্ত্রসার গ্রন্থের রচয়িতা। উনি ১৫০০ বা ১৭০০ খ্রীস্টাব্দের দিকে নবদ্বীপে একটি কালীমূর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে তা কোনো আদিবাসী রমণীর শরীরের গড়ন দেখে নয়! যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। উনার জন্মের বহু আগে থেকে ভারতে কালীমূর্তি পূজার প্রচলন ছিলো।
( → https://m.timesofindia.com/city/madurai/1000-year-old-kali-idol-found-in-a-channel-near-palani/articleshow/60822823.cms )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য যে কতটা অযথার্থ তা উনার মন্তব্য থেকে বুঝা যায়। কারণ কোনো আদিবাসী রমণী চার হাত বিশিষ্ট নয়, হাতে খড়গ, নরমুণ্ডু সব সময় নিয়ে বেড়াই না, গলাই মুণ্ডমালা পড়বে না, ত্রি-নয়না নয়। কাজেই এক আদিবাসী রমণীর গড়ন দেখে সম্পূর্ণ কালীমূর্তির নির্মাণ সম্ভব নয়! হয়তো কালীমূর্তির কয়েকটি গঠনগত চরিত্রের সাথে তৎকালীন আদিবাসী রমণীদের কিছু গঠনগত চরিত্রের মিল থাকার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দৃষ্টিতে উক্ত ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে! কিন্তু কালীমূর্তির গঠনগত চরিত্রের প্রতিটি অংশের ব্যাখা তন্ত্র ও শাক্ত দর্শনে আছে, এই ভিত্তিতেই কালীমূর্তি নির্মাণ করা হয়।

ব্রহ্মের দুটি অবস্থা একটি মনুষ্য মনস্থিত অপরটি সর্ব্ব্যাপী। যার জন্য বৈদিক সময়কাল থেকে ঋষিগণেরা যোগ ও যজ্ঞ দুটি উপায়ে ব্রহ্মকে পূজিত করে আসছেন।
যোগের দ্বারা মনস্থিত ব্রহ্ম পূজিত হয়। এইক্ষেত্রে যোগীরা অন্তঃকরণ সংযম ও যোগবলের মাধ্যমে ঔঁকার আদি মন্ত্রবীজ জপের দ্বারা মনের অগোচরে পরমাত্মাকে স্থাপিত করে যোগাচারে তার উপাসনা করেন।
যজ্ঞের দ্বারা সর্ব্ব্যাপী স্বরূপী ব্রহ্ম পূজিত হয়, এইক্ষেত্রে যজ্ঞের সম্পাদক (ঋত্ত্বিক) বিভিন্ন মন্ত্র উপচার পালনের মাধ্যমে, যজ্ঞকুণ্ডে পুরোহিত রূপী অগ্নিকে স্থাপন এবং যাজ্ঞিক অগ্নির দ্বারা স্থূল যাজ্ঞিক হাবি সমূহের দহনের ফলে প্রাপ্ত সূক্ষ্ম হাবি সমূহের দ্বারা সর্ব্ব্যাপী ব্রহ্মের উপাসনা করেন।

কিন্তু কলিযুগের মানুষদের যোগবল ও আধ্যাত্মবল নাই বললেই চলে! তাই যোগ ও যজ্ঞ এর দ্বারা সূক্ষ্ম উপাসনা করতে বর্তমান মানুষেরা অসমর্থ। তাই স্থূল উপাসনার প্রসার ঘটেছে, এইক্ষেত্রে ব্রহ্মের প্রতিক স্বরূপী "প্রতিমা" ব্যাবহার করা হয়। এই প্রতিমাটি তৈরী করা হয় সাধকদের সাধনা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জ্ঞান ও ধ্যানে সময় চিন্তার ভিত্তিতে।এই তথ্য ও জ্ঞানের সমাহার কে প্রতিমাতত্ত্ব বলা হয়।
এই স্থূল উপাসনার মাধ্যমে ভক্তিযোগ প্রশস্ততা লাভ করে, সাধকের মনে আধ্যাত্মবলের সঞ্চার হয়। সাধক যোগীদের ন্যায় সম্পূর্ণরূপে অন্তঃকরণ সংযমের আসক্তি লাভ করে এবং প্রতিমা তত্ত্ব, আরাধ্য তত্ত্ব ও উপাসনা তত্ত্ব প্রভৃতির বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। উক্ত যোগ্যতা গুলো অর্জন করতে পারলেই, তবে সে এই ভরা কলিযুগে সূক্ষ্ম উপাসনা বা মানসোপচারে মানস পূজা করার জন্য সামর্থতা লাভ করে।

এই মানস পূজাই হল প্রতিমা পূজার অবিচ্ছেদ অঙ্গ ও উদ্দেশ্য। যা প্রায় যোগাচারে মনস্থিত ব্রহ্মের পূজার অনুরূপ।এই মানস পূজোটি কিরূপ?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রের সাপেক্ষে অতি সংক্ষেপে সেটা বলছি।
* প্রথমে সাধক ধ্যানের মাধ্যমে মনে আরাধ্যের আহ্বান করে, নিজ হৃদয়পদ্মকে আসনস্বরূপে প্রদান করবে।
* সহস্রাধার চ্যুত অমৃতের দ্বারা আরাধ্যের পাদমূলে পাদ্য প্রদান করবে।
নিজ মনকে অর্ঘ্যস্বরূপে নিবেদন করবে।
* পূর্ব্বোক্ত সহস্রারচ্যুত অমৃত দ্বারাই আচমনীয় ও স্নানীয় জল নিবেদন করবে।
* আকাশতত্ত্ব কে বসন, গন্ধতত্ত্ব কে সুগন্ধ, ভাব কে পুস্প এবং প্রাণকে ধূপ, অগ্নিতত্ত্বকে দীপ, অমৃত রূপী ভক্তিকে নৈবেদ্যরূপে প্রদান করবে।
* হৃদয়মধ্যস্থ অনাহতধ্বনিকে ঘন্টা এবং বায়ুতত্ত্বকে চামর, অনন্তর ইন্দ্রিয়ের কার্য্যসমূদয় এবং মনের চঞ্চলতাকে নৃত্যরূপে কল্পনা করে আরাধ্যের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবে।

ভাব পুস্প গুলি হল - অমায়িকতা, নিরহঙ্কার, রাগশূন্যতা, মদহীনতা, দম্ভশূন্যতা, মোহশূন্যতা, দ্বেষহীনতা, ক্ষোভরহিততা, মাৎসর্য্যহীনতা ও নির্লোভতা - এই দশবিধ পুস্প এবং এদের মধ্যে আরাধ্যের প্রতি ভক্তি হল পরম পুস্প।
স্থূল পূজা বা প্রতিকের পূজোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রং ও আকারের ফুল গুলি হল এই ভাব পুস্পের প্রতিক। একই ভাবে ব্যাবহৃত আসন,ধূপ, দীপ, চামর, নৈবেদ্য, ঘন্টা ইত্যাদি গুলো মানস পূজাতে ব্যাবহৃত বিভিন্ন তত্ত্ব সমূহের প্রতিক।


[ কালী প্রতিমার তত্ত্ব ও তার আধ্যাত্ম ব্যাখা ]

(১) মা কালীর সূক্ষ্ম ও স্থূল স্বরূপ
মা কালী সূক্ষ্ম স্বরূপে মূর্তিহীন! অভীষ্টসিদ্ধি ও সূক্ষ্মধ্যান বোধের জন্যই মাতৃ সাধকরা এই কালী মূর্তির নির্মাণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব মাতা পার্বতীকে বলছেন :-
মনসো ধারণার্থায় শীঘ্রং স্বাভীষ্টসিদ্ধয়ে।
সূক্ষ্মধ্যানপ্রবোধায় স্থূলধ্যানং বদামি তে।। ৫.১৩৯
অরূপায়াঃ কালিকায়াঃ কালমাতুর্মহাদ্যুতেঃ।
গুণক্রিয়ানুসারেণ ক্রিয়তে রূপকল্পনা।। ৫.১৪০

এক্ষণে মনের ধারণার জন্য সত্বর অভীষ্টসিদ্ধি এবং সূক্ষ্মধ্যানাববোধের জন্য তোমার নিকটে স্থূলধ্যানতত্ত্ব বলিতেছি। ৫.১৩৯
প্রকৃতপক্ষে মহাকালজননী মহাদ্যুতি কালিকার রূপ নাই, সত্ত্বাদিগুণত্রয়েয় প্রাদুর্ভাব বশতঃ সৃষ্ট্যাদিকার্য্যানুসারে ইদানীং তাঁহার রূপকল্পনা করা যাইতেছে। ৫.১৪০

অর্থ্যাৎ, আমরা যে কালী মূর্তি বা স্থূল স্বরূপ দেখে থাকি তা বাস্তবিক নয়! এই মূর্তিটি একটি প্রতিক, সেই সব তথ্য ও জ্ঞানের যা মা কালীর সূক্ষ্ম উপাসনা করতে আবশ্যক। উক্ত তথ্য ও জ্ঞান গুলিকেই একত্রে প্রতিমাতত্ত্ব বলা হয়।


(২) মা কালীর রূপভেদ
সূক্ষ্ম স্বরূপে মা কালীই হল পরমা প্রকৃতি। যেহেতু আদি প্রকৃতি থেকে সমস্থ জীব ও জড়ের উৎপত্তি হয়েছে, তাই তিনি জগৎমাতা। তার বিভিন্ন রূপভেদের জন্য তাকে বিভিন্ন নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব মাতা পার্ব্বতীকে বলছেন :-
শৃণু দেবি মহাভাগে তবারাধনকারণম।
তব সাধনতো যেন ব্রহ্মসাষুজ্যমশ্নতে।।৪.৯
ত্বং পরা প্রকৃতিঃ সাক্ষাৎ ব্রহ্মণঃ পরমাত্মনঃ।
ত্বত্তো জাতং জগৎ সর্ব্বৎত্বং জগজ্জননী শিবে।। ৪.১০
মহদাদ্যণুপর্য্যন্তং বদেতৎ সচরাচরম।
ত্বয়ৈবোৎপাদিত ভদ্রে ত্বদধীনমিদং জগৎ।। ৪.১১
ত্বমাদ্যা সর্ব্ববিদ্যানামস্মাকমপি জন্মতুঃ।
ত্বং জানাসি জগৎ সর্ব্বং ন ত্বাং জানাতি কশ্চন।। ৪.১২
ত্বং কালী তারিণী দুর্গা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ধূমাবতী ত্বং বগলা ভৈরবী ছিন্নমস্তকা।। ৪.১৩
ত্বমন্নপূর্ণা বাগ্দেবী ত্বং দেবী কমলালয়া।
সর্ব্বশক্তিস্বরূপা ত্বং সর্ব্বদেবময়ী তনুঃ।। ৪.১৪
ত্বমেব সূক্ষ্মা ত্বং স্থূলা ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী।
নিরাকারাপি সাকারা কস্থাং বেদিতুমহতি।। ৪.১৫
উপাসকানাং কার্য্যার্থং শ্রেয়সে জগতামপি।
দানবানাং বিনাশায় ধৎসে নানাবিধাস্তনূঃ।। ৪.১৬
চতুর্ভূজা ত্বং দ্বিভূজা ষড়ভুজাষ্টভূজা তথা।
ত্বমেব বিশ্বরক্ষার্থং নানাশস্ত্রাস্ত্রধারিণী।। ৪.১৭
তত্তদ্রূপবিভেদেন মন্ত্রযন্ত্রাদিসাধনম।
কথিতং সর্ব্বতন্ত্রেষু ভাবাশ্চ কথিতাস্ত্রয়ঃ।। ৪.১৮

সদাশিব কহিলেন, হে মহাভাগে দেবি! লোকে তোমার সাধনায় ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করিতে পারে, এজন্য আমি তোমারই উপাসনার কথা বলিতেছি, শ্রবণ কর। ৯
তুমিই পরমাত্মা পরব্রহ্মের সাক্ষাৎ পরমা প্রকৃতি। হে শিবে, তোমা হইতে জগতের উৎপত্তি হইয়াছে, তুমি জীবের জননী। ১০
হে ভদ্রে! মহত্তত্ব হইতে পরমাণু পর্য্যন্ত এবং সমস্ত চরাচর সহিত এই জগৎ তোমা হইতে উৎপাদিত হইয়াছে, এই নিখিল জগৎ একমাত্র তোমারই অধীনতায় আবদ্ধ। ১১
তুমি সমুদয় বিদ্যাব আদিভূত এবং আমাদের জন্মভূমি, তুমি সমগ্র জগৎকে অবগত আছ, কিন্তু তোমাকে কেহই জানিতে পারে না। ১২
তুমি কালী, দূর্গা, তারিণী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, বগলা, ভৈরবী ও ছিন্নমস্তা ; তুমিই অন্নপূর্ণা, সরস্বতী ও লক্ষ্মী ; তোমার দেহ সর্ব্বদেবময় ও তুমি সর্ব্বশক্তি স্বরূপিণী। ১৩-১৪
তুমিই স্থূল, তুমিই সূক্ষ্ম, তুমিই ব্যক্ত এবং অব্যক্তস্বরূপিণী ; তুমি নিরাকার হইয়া সাকার, তোমার প্রকৃততত্ত্ব কেহই অবগত নহে। ১৫
তুমি উপাসকগণের কার্য্যার্থ, মঙ্গলার্থ এবং দানবগণের দমনার্থে নানাবিধ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাক। ১৬
তুমি বিশ্বরক্ষার জন্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক কখনও দ্বিভূজা, কখনও চতুর্ভূজা, কখনও ষড়ভূজা মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাক। ১৭
সকল তন্ত্রে তোমার নানাপ্রকার রূপভেদ, যন্ত্রভেদ ও মন্ত্রভেদ কথার উল্লেখ আছে এবং তোমার ত্রিবিধ ভাবময় উপাসনার কথাও প্রকটিত আছে। ১৮


(৩) কালী নামের তাৎপর্য
মায়ের নাম কালী, এর কারণ অর্থ্যাৎ সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা কি রূপ? সেই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্ব্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়তে।। ৪.৩২

তুমি কালকে গ্রাস কর বলিয়া তোমার নাম কালী, সকলের আদিকালত্ব ও আদিভূতত্ব নিবন্ধন লোকে তোমাকে আদ্যাকালী বলিয়া থাকে। ৪.৩২

অতয়েব মায়ের কালী নামের তাৎপর্য হল - যিনি ভবিষ্যৎ বর্তমান অতীত এই তিন কাল কে গ্রাস করেন অর্থ্যাৎ ত্রি-কালের অন্তিম গন্তব্যস্থল হল মা কালী। সেই অর্থে মায়ের নামকরণ করা হয়েছে "কালী"।



(৪) মা কালী কেনো কালো?
মা কালীর প্রকৃত মূর্তির বর্ণ কালো। এই কৃষ্ণ বর্ণ হওয়ার তাৎপর্য কি? সেই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
শ্বেতপীতাদিকো বর্ণো যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশক্তি তথা কাল্যাং সর্ব্বভূতানি শৈলজে।। ১৩.৫
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নির্গুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।। ১৩.৬

হে শৈলজে! শ্বেত, পীত, প্রভৃতি বর্ণ সকল যেরূপ একমাত্র কৃষ্ণবর্ণে বিলীন হয়, তাহার ন্যায় সমুদয় পদার্থ ই আদ্যাকালীতে বিলীন হইয়া থাকে। ৫
এই জন্য যাঁহারা যোগী, তাঁহারা সেই নির্গুণা, নিরাকার, বিশ্বহিতৈষিণী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ কল্পিত করিয়াছেন। ৬

প্রতিটি বর্ণ কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলী বহন করে। যেমন শ্বেত বর্ণ - পবিত্রতা, শুভ্রতা, পূর্ণতা, আশা, শুভ, শান্তির প্রভৃতির প্রতিক। পীত বর্ণ - জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আলো, তাপ, ভালোবাসার প্রভৃতির প্রতিক। নীল - প্রশান্তি, শীতলতা, নিদ্রা, স্বপ্ন, মৃত্যু প্রভৃতির প্রতিক। এই ভাবে সমস্ত বর্ণ (গুণাবলী) মিলে কালো রঙ সৃষ্টি করে, তাই মা কালী হল সমস্ত গুণাবলীর সমাহার। এছাড়া যদি আমরা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সাপেক্ষে দেখি তবে এটাই পাবো সৌর জগত ধ্বংশের পরে সেই ব্যাকহোল আদিতেই সৌর জগত মিশে যায়। সেই সাপেক্ষে মা কালীর বর্ণ কালো।

তবে মায়ের কিছু কিছু মূর্তিতে আকাশী নীল রং করা হয়। এটার দ্বারা ব্যাক্ত করা হয় মায়ের দেহটিই আকাশ দ্বারা গঠিত। আকাশ হল বাস্তবে নিরাকার ও বিমূর্ত, তাই মা সূক্ষ্ম স্বরূপে যে নিরাকার ও বিমূর্ত, তাই ব্যক্ত করার জন্য মায়ের মূর্তির রং আকাশী নীল রঙে রঞ্জিত করা হয়।




(৫) মায়ের কপালে অর্ধচন্দ্রকৃতির চন্দ্র কেনো?
যদি আমরা মায়ের মূর্তিটি ভালোভাবে দেখি তবে দেখতে পাবো তৃতীয় নয়নের নিচে একটি অর্ধচন্দ্র আছে। এর তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
নিত্যায়াঃ কালরূপায়া অব্যয়ায়াঃ শিবাত্মনঃ।
অমৃতত্বাল্ললাটেহস্যাঃ শশিচিহ্নং নিরূপিতম।। ১৩.৭

তিনি কালরূপিণী, নিত্যা, অব্যয়া, শিবাত্মিকা ও কল্যাণময়ী সুতরাং তিনি অমৃতস্বরূপ হেতু তদীয় ললাটে চন্দ্রকলা কল্পিত হইয়াছে।




(৬) মা কালীর কেনো তিনটি চোখ?
এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
শশিসূর্য্যাগ্নিভির্নেত্রৈরখিলং কালিকং জগৎ।
সম্পশ্যতি যতস্তস্মাৎ কল্পিতং নয়নত্রয়ম।। ১৩.৮

তিনি চন্দ্র, সূর্য্য ও অগ্নিরূপ ত্রিনেত্র দ্বারা কালসম্ভূত এই জগৎ পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন। এই হেতু যোগিগণ তাঁহার ত্রিনয়ন কল্পনা করিয়াছেন। ৮

অর্থ্যাৎ আলোর তিনটি প্রাকৃতিক উৎসই হল মা কালীর প্রকৃত নয়ন। এই আলো দ্বারাই তিনি এই অন্ধকারময় জগৎকে পর্যবেক্ষণ করছেন। অর্থ্যাৎ বিজ্ঞান যাকে আলোশক্তি বলছে, তাই হল সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণে দেবীর নয়ন। (৭) মা কালীর পরিধান ও কাঠামোর তাৎপর্য
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে মাতৃকা ধ্যানে উল্লেখ করা বর্ণনা অনুসারে -
মেঘাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রক্তাম্বয়ং বিভ্রতীং,
পাণিভ্যামভয়ং বরঞ্চ বিলসদরক্তারবিন্দস্থিতাম।
নৃত্যন্তং পুরতো নিপীয় মধুরং মাধ্বীকমদ্যং মহাকালং
বীক্ষ্য বিকাসিতাননবরামাদ্যাং ভজে কালিকাম।। ৫.১৪১

যাহার বর্ণ মেঘতুল্য, ললাটে চন্দ্রলেখা জাজ্বল্যমান, যাহার তিন চক্ষু, পরিধান রক্তবস্ত্র, দুই হস্তে বর ও অভয়, যিনি ফুল্লারবিন্দে উপবিষ্ট, যাঁহার সম্মুখে মাধ্বীকপুষ্পজাত সুমধুর মদ্য পান করিয়া মহাকাল নৃত্য করিতেছেন, যিনি মহাকালের এরূপ অবস্থা দর্শনে হাস্য করিতেছেন, সেই আদ্যা কালিকাকে ভজন করি। ৫.১৪১

অতয়েব মায়ের ধ্যান করার সময় মাকে রক্তবস্ত্র পরিধানত রূপে, যিনি প্রস্ফুটিত কমলে অধ্যাসিত, দ্বিভূজা রূপে বিরাজমান এবং যিনি মহাকাল রূপী সময়ের লীলা দেখে প্রফুল্লিত হচ্ছেন, উক্ত মূর্তিতেই মায়ের ধ্যান করা বাঞ্ছনীয়।

অর্থ্যাৎ মা সুধু আমাদের স্থূল কামনা বাসনা পূর্ণ দৃষ্টিকোণেই বিবসনা! সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণে তিনি রক্তবস্ত্র পরিধানত মাতৃকা দেবী। উক্ত জিনিসটিকেই রামকৃষ্ণদেব তার কথামৃতে বলেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন মা কে দূরে থেকে দেখছি বলেই মা বিবসনা, কাছে থেকে দেখলে মায়ের মতো তিনি বস্ত্র পরিধানত।

কিন্তু কালী মূর্তিই কি সত্যিই বিবসনা?
একদম নয়!!! না পুরাণে না হিন্দু তন্ত্র সমূহে মা কালী কে বিবসনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এইক্ষেত্রে মা কালী ব্যাঘ্রচর্ম পরিধানত অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক ও রক্তবর্ণের পুস্প দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদ আচ্ছাদিত ভয়ঙ্করী দেবী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌদ্ধ তন্ত্রের আদব কাইদাতে রচিত আধুনিক তন্ত্র সমূহেই মা কালী কেবল বিবসনা, যা হিন্দু তন্ত্রের সাথে বিরোধীতা পূর্ণ।


কিন্তু এই ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত করে রাখার তাৎপর্য কি?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
গ্রসনাৎ সর্ব্বসত্ত্বানাং কালদন্তেন চর্ব্বণাৎ।
তদ্রক্তসঙ্ঘো দেবেশ্যা বাসোরূপেণ ভাষিতম।। ১৩.৯

তিনি প্রলয়সময়ে সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন বলিয়া জীবের রুধিরসঙ্ঘাত সেই মহাকালীর রক্তবস্ত্ররূপে কল্পিত হইয়াছে। ১৩.৯

অর্থ্যাৎ ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত করা হল সেই রক্তবস্ত্রেরই একটি প্রতিক। ছেদিত হস্ত, মস্তক ও চর্ম গুলো এই ইঙ্গিত বহন করছে প্রলয়কালে সমস্ত জীবকূল জগতের ধ্বংশকারী দেবী দ্বারা আগ্রাসিত ও চর্বণিত হবে। অতয়েব মায়ের পরিধান বা পরিচ্ছদ উভয়ে মৃত্যুকে বর্ণনা করে।


মায়ের গলাই রক্ত জবার মালা ও গা ভর্তি সোনার গহনা থাকার তাৎপর্য কি?
মা রজোগুণজাত বিশ্বে অধিষ্ঠান করেন (পরের অংশে তথ্যসূত্র উল্লেখ আছে) বলেই রক্ত জবার মালা ও স্বর্ণ অলঙ্কারে সজ্জিত হয়েছেন। কারণ দুটিই রজঃ গুণের প্রতিক বহন করে।


মায়ের খোলা অগুচ্ছিত কেশরাশির তাৎপর্য?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
পুনঃ স্বরূপমাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।।৪.৩৩

তুমি প্রলয় সময়ে বাক্যের অতীত, মনের অগোচর, নিরাকারস্বরূপ তমোময় রূপ অবলম্বন করিয়া একমাত্র বিদ্যমান থাক। ৪.৩৩

মায়ের পায়ের হাঁটু অবদি থাকা খোলা অগুচ্ছিত কেশরাশি সেই প্রলয় কালে অতীতময়, মনের অগোচর, নির্দিষ্ট আকার বিহীন ও তমরূপে আচ্ছাদিত সেই জগৎ কে নির্দেশিত করে। যাকে অবলম্বন করে মা কালী অবস্থান করছে।


(৮) মা কালীর চারটি হাতের তাৎপর্য ?
ধ্যানমূর্তিতে মা দ্বিভূজা, কিন্তু প্রতিমাতে চর্তুভূজা! কারণ প্রতিমাতে মায়ের চারটি হাত কালীতত্ত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকে তুলে ধরে। মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
সাকারাপি নিরাকারা মায়য়া বহুরূপিণী।
ত্বং সর্ব্বাদিরনাদিস্ত্বং কর্ত্রী হর্ত্রী চ পালিকা।। ৪.৩৪

তুমি সাকারা হইয়াও নিরাকার, কিন্তু মায়ার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নানাবিধ রূপ ধারণ করিয়া থাক; তুমি সকলের আদি কিন্তু তোমার আদি কেহই নাই, তুমি রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টিকর্ত্রী, সত্ত্বগুণে পালনকর্ত্রী এবং তমোগুণ দ্বারা সকলের নিধনকর্ত্রী। ৪.৩৪

সময়ে সময়ে জীবরক্ষণং বিপদঃ শিবে।
প্রেরণং স্বস্বকার্য্যেষু বরশ্চাভয়মীরিতম।। ১৩.১০

হে শিবে! তিনি বিপদ হইতে যথাযথ সময়ে জীবগণকে রক্ষা ও স্ব স্ব কার্য্যে প্রেরণ করেন বলিয়া তাঁহার হস্তে বর ও অভয় শোভা পাইয়া থাকে। ১৩.১০

মা বাম হাতের এক হাতে অভয় ও আরেক হাতে বর মুদ্রা ধারণ করেছে। এই অভয় মুদ্রার দ্বারা তিনি ভক্তদের প্রতি সুরক্ষা, মুক্তি ও শক্তি প্রদান করছেন এবং বর মুদ্রা দিয়ে তিনি দান, দয়া ও আর্শিবাদ প্রদান করছেন। যার দ্বারা তিনি সত্ত্বগুণে পালনকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন।
মাতৃস্তনের দ্বারা তিনি রজোগুণে একজন মায়ের বা সৃষ্টিকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন। ডান হাতে রক্তমাখা খড়গ ও ছেদিত মস্তক ধারণ করে তিনি তমোগুণে সকলের নিধনকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন।

আরেকটি অর্থে যেহেতু ছেদিত মস্তুকটি একটি অসুরের, তাই মা কালী অজ্ঞান কে ছেদিত করে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করছেন। এই সাপেক্ষে মা কালীকে অজ্ঞান নাশীনি বলা হয়।





(৯) মা কালীর পায়ের নিচে শিব কেনো ?
উক্ত বিষয়টি মূলত পুরাণজাত! তবে তন্ত্রসার সহ কয়েকটি আধুনিক তন্ত্রে মা কালীকে শবারূঢ়া হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহানির্ব্বাণ তন্ত্র অনুসারে :-
রজোজনিতবিশ্বানি বিষ্টভ্য পরিতিষ্ঠতি।
অতো হি কথিতং ভদ্রে রক্তপদ্মাসনস্থিতা।। ১৩.১১

হে ভদ্রে! তিনি রজোগুণজাত বিশ্বে অধিষ্ঠান করেন বলিয়া তাঁহার রক্তপদ্মে অধিষ্ঠান কথিত হইয়া থাকে। ১৩.১১

ক্রীড়ন্তং কালিকং কালং পীত্বা মোহময়ীং সুরাম।
পশ্যন্তী চিন্ময়ী দেবী সর্ব্বসাক্ষিস্বরূপিণী।। ১৩.১২

সৃষ্টিকালসম্ভূত মহাকাল মোহময়ী সুরাপান করিয়া ক্রীড়া করিতেছেন, অর্থ্যাৎ কালের প্রভাবে শূন্যস্থানে নুতন জগৎ প্রতিষ্ঠিত হইতেছে, কোথাও জীবসঙ্কুল জগৎ শূন্য হইয়া যাইতেছে, কোথাও ঘোর তিমিরাবৃত স্থান আলোকিত হইতেছে, কোথাও আলোকিত স্থান তিমিরাবৃত হইয়া পড়িতেছে। প্রত্যেক জগৎ প্রতি নক্ষত্র যথাযথ মার্গে প্রভাবিত হইয়া পড়িতেছে, চিন্ময়ী সর্ব্বসাক্ষিস্বরূপিণী দেবী ইহা দর্শন করিয়া থাকেন। ১৩.১২

পুরাণজাত তথ্য অনুসারে একবার মা কালী ক্রোধোন্মত্ত হয়ে সৃষ্টির বিনাসে নিয়োজিত হন, তখন মহাদেব মা কালীকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে শব রূপে শায়িত হন মায়ের চরণে। পরমা প্রকৃতির ক্রোধ স্বরূপী মহাকালী নিজ চরণের তলে পরম পুরুষ মহাদেবকে দেখতে পেয়ে ত্রপান্বিত হয়ে নিজ জিহ্বা অবারিত করেন এবং ক্রোধ স্বরূপ থেকে বেরিয়ে আসেন।

মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে ১৩.৯ তে উল্লেখ আছে :-
"তিনি প্রলয়সময়ে সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন বলিয়া জীবের রুধিরসঙ্ঘাত সেই মহাকালীর রক্তবস্ত্ররূপে কল্পিত হইয়াছে"

প্রলয় কালে যেহেতু মা কালী সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন, তাই তার জিভের বর্ণ রক্তিম লাল। মা কালী দন্ত দ্বারা জিহ্বাকে আটকে মুখকে উন্মুক্ত হওয়া থেকে রোধ করেছেন, যা জগতের স্থিতি মুদ্রা কে বর্ণিত করে। যার জন্য পৌরাণিক ঘটনাতে মা কালী যখন উক্ত মুদ্রাটি ধারণ করেন তখন জগতের প্রলয় বন্ধ হয় এবং মা তার ক্রোধ স্বরূপ থেকে বেড়িয়ে আসেন।

মায়ের চরণের নিচে অবস্থানকারী শবরূপী শিব হল বিশ্ব জগতের প্রতিক (শিব পুরাণ ২.৪৯.২১), কারণ শিব শব্দটি শী ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ "শায়িত" অর্থ্যাৎ যিনি বিশ্বব্যাপী শায়িত আছেন। মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে উল্লেখিত মায়ের আসন রূপী রক্তপদ্মটি সেই শায়িত শিবেরই একটি প্রতিক। শিব স্বরূপী এই নিখিল জগতের যেখানে যেখানে মা কালীর চরণ পড়ছে সেখানে সেখানে জগৎ (Clime) ঘন তিমিরাবৃত হয়ে ধ্বংশ হচ্ছে।

১৬৯৯ শকাব্দে (১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দে) কাশীনাথ বিরচিত ‘শ্যামাসপর্যায়বিধি’তে এ পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ লক্ষনীয়। পূজার প্রমাণস্বরূপ এ গ্রন্থে পুরাণ ও তন্ত্রের বচন উল্লেখিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে বলরাম বিরচিত কালিকা মঙ্গলকাব্যে একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান কালীকে নিবেদিত মর্মে উল্লেখিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় প্রথম কালীপূজার প্রবর্তন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কালীপূজা বাংলায় বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র এবং কোলকাতার সমাজের বিত্তবান ও উচ্চশ্রেণীর লোকজনের মধ্যে এ পূজার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। ক্রমে দুর্গা পূজার সাথে সাথে কালী পূজাও বিশেষত বাংলায় একটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়।
শিবের উপর দণ্ডায়মানা কেন তার তিনটি ব্যাখ্যা বর্তমান এর একটি প্রচলিত কাহিনী, একটি পৌরাণিক, অন্যটি তান্ত্রিক ব্যাখ্যা। এটা বলা হয়ে থাকে যে শক্তি ছাড়া শিব হচ্ছে শব। শিবের উপর দন্ডায়মানা কালী এটাই বুঝায় যে শক্তি বাদ দিলে বস্তু মৃতমাত্র। পৌরাণিক ব্যাখ্যা মতে, পার্বতী একদিন স্বামীকে প্রশ্ন করলেন তার দশটি রূপের মধ্যে কোনটি শিবের পছন্দ ? বিস্মিত পার্বতী শুনলেন, কালীর ভয়াল মূর্ত্তিতেই শিবের সাচ্ছন্দ্য। এই ধারণাটি দেবী ভাগবত পুরাণে ব্যাখাত। দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর ভক্তিমূলক শ্যামাসঙ্গীতেও মায়ের বর্তমান রূপের এই ধারণাটি গুরুত্ব পেয়েছে। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর ভয়াল রূপ সত্ত্বেও রাত দুপুরে শ্মশানে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জন এবং অন্যদিকে তাঁর প্রতি বাঙালিদের শিশুর মতো শর্তহীন ভালবাসা উভয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাকে মেনে নেওয়াই মুখ্য কাজ।
দুর্গার মতো কালীও সাধারণ সর্বজনীন হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে সরাসরি বহুল ভাবে তিনি পূজিতা হন মহাকালী বা ভদ্রকালী রূপে। আদি পরাপ্রকৃতি (দেবী দুর্গা) অথবা ভাগ্যবতীর দশমহাবিদ্যা রূপের একটি রূপে কালী পূজিতা হন। দেবী বন্দনার এই স্তোত্রকে বলা হয় দেবী অর্গলা স্তোত্রম্ যা নি-রূপ

মধ্যযুগের শেষের দিকে বাঙালীর ভক্তিমূলক সাহিত্যে কালী ব্যাপক স্থান নিয়ে বিরাজমান। সাধক রামপ্রসাদ সেন(১৭১৮-১৭৭৫) এর মতো কালীভক্ত উপাসকরা কালীকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য ভক্তিমূলক গান। অথচ শিবপত্নী হিসেবে পার্বতীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে নানা কাহিনীতে উচ্চারিত হওয়া ছাড়া কালীকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাঙালীর ঘরে ঘরে আবাহনী গেয়ে পূজিত হতে কদাচিৎ দেখা গেছে। আর বাঙালির ঘরে তাঁর ভয়াল রূপের বর্ণনা, বৈশিষ্ট, অভ্যাসসমূহ উল্লেখযোগ্য কোন রূপান্তর ঘটেনি। বাংলাদেশে অনেক কালী মন্দির আছে। এর অনেকগুলোই সুপ্রাচীন। অধুনা লুপ্ত ঢাকার রমনা কালী মন্দির তেমনি একটি পুরাতন কালী মন্দির। ব্রহ্মযামলে উল্লেখ আছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, অর্থাৎ, ‘বঙ্গদেশে দেবী কালিকা বা কালী নামে পূজিতা হন।’ নানা রূপে নানা স্থানে কালী পূজিতা হন, যেমন দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি নামে মাহাত্ম্যে এ কালীর মধ্যে কিছু কিছু ভিন্নতা বর্তমান। অন্যদিকে বিভিন্ন মন্দিরে দশমহাবিদ্যা ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি নামে কালী’র পূজা হয়। চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী শ্রী কালীবাড়ী, গোলপাহাড় শ্মশান কালীবাড়ী, দেওয়ানহাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ী,সদরঘাট কালীবাড়ী, পটিয়া পিঙ্গলা কালীবাড়ী, ধলঘাট বুড়াকালীবাড়ী সহ চট্টগ্রামে অনেক প্রসিদ্ধ কালী মন্দির বর্তমান। এর প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার এবং অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা’র দিন কালীপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়।
সর্বজনীন মণ্ডপে যেখানে দুর্গাপূজা হয় সেখানে অধিকাংশ মণ্ডপে কালীপূজাও হয়ে থাকে। অনেক কালীসাধক বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধার্হ। শ্রীরামকৃষ্ণ কালীর উপাসক ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দও কালীর ভক্ত ছিলেন। কালী প্রশস্তিমূলক গান তথা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের একটি ভিন্ন ধারা। কালীসাধক রাম প্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য এ ধারায় অন্যতম অবদান রাখেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলামও এ ধারার উৎকৃষ্ট মানের গান রেখে গেছেন। নিরক্ষর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী কালী সচেতনতায় সিক্ত হয়ে অনবদ্য বাণী উচ্চারণ করতেন যা শ্রীশ রচিত অমর গ্রন্থ ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’তে স্থান পেয়েছে। ‘মৃত্যুরূপা কালী’ দেবী কালীকে নিয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত একটি বিখ্যাত সুদীর্ঘ কবিতা। ভগিনী নিবেদিতা মাতৃরূপা কালী নামক একটি কালী বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
দীপাবলী বা দীপান্বিতা বা বা আশ্বিনী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত কালীপূজা উপলক্ষে দেবী মূর্তির দক্ষিণা কালীর অবয়বে তৈরী হয়, এক্ষেত্রে দেবীবৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে দেবী করালবদনা, কৃষ্ণবর্ণা, নীলবর্ণা বা মহামেঘবর্ণা। দেবী আলুলায়িত কেশা। রামপ্রসাদী গানে ভক্তিভরে মাকে বলা হচ্ছে,‘…এলোকেশী সর্বনাশী..’,মা এলোকেশী, রক্তচক্ষু, লোল জিহ্বা, চতুর্ভূজা, নৃমু-মালিনী,, নরহস্তের কোমরবন্ধ, বাম করযুগলে উন্মুক্ত খড়গ এবং নরমু-, ডান করদ্বয়ে বর ও অভয়মুদ্রা। দক্ষিণা কালী’র দক্ষিণ পা শিবদেহে স্পর্শমান, বাম পা খানিকটা দূরত্বে। স্বামীর গায়ে পা পড়ায় অসুর-রক্ত পানে সিক্ত জিহ্বায় কামড়। ত্রিনয়নী মা অসুর হত্যার মহাঘোরে হাস্যরতা ও ভয়াল দর্শন। মায়ের গলায় নৃমুণ্ড মালায় সাধারণত ১০৮টি অথবা ৫১ টি নরমুণ্ড বর্তমান। ১০৮ হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র সংখ্যা, মন্ত্রপাঠের সময় গুণার জন্য জপমালায় ১০৮টি গুটিকা থাকে। দেবনাগরী বর্ণমালায় সর্বসমেত ৫১টি বর্ণ আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস সংস্কৃত একটি চলমান জীবন্ত ভাষা এবং এর ৫১ টি বর্ণমালায় অপার শক্তি নিহিত আছে।
মায়ের কোন চিরস্থায়ী গুণ বা প্রকৃতি নেই, যার মানে দাঁড়ায় বিশ্ব-প্রকৃতি ধ্বংসের পরেও তিনি বর্তমান থাকবেন।
হিন্দু শাস্ত্রে পূজিতা দেবীদের মধ্যে কালীর রূপ ও চরিত্র সর্বাধিক রোমাঞ্চকর ও বিস্ময় উদ্রেককারী। ঘোর অমাবস্যার গভীর রাতে তাঁর পূজা সম্পন্ন হয়। কালী ভীষণ দর্শনা, ক্রোধান্বিতা, লজ্জাহীনা। কালী ভয়ঙ্কর যোদ্ধা, রক্তপিয়াসী। কালী চির ব্যতিক্রমী। ঐশী সংযোগ সত্ত্বে ও এক দীর্ঘকালীন উপেক্ষার আখ্যান। তবে দুর্বল, দ্বিধান্বিত মন যখনই শক্তি প্রার্থনা করেছে, বল ভিক্ষা করেছে, ওই করাল বদনা মহাতেজার শরনাপন্ন হয়েছে। ঘোর আমানিশায় জনাকীর্ণ মধ্যরাতের পূজাতেই ছিল তাঁর অধিকার। কোনো ক্ষেত্রে সূর্যের আলো স্পর্শ ও ছিল নিষিদ্ধ। হাজার বছরের বিমুখতা অতিক্রম করে আজকের দীপাবলী উৎসবে যথেষ্ট ধূমধাম সহযোগে তাঁর উপাসনা হয়ে থাকে। তবে বাঙালীর উৎসবমুখীতাই যে এই পূজার জনপ্রিয়তার অংশত কারণ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ বহু ঘটা সহযোগে সম্বৎসরের এই মাতৃ আরাধনা তথা শক্তি পূজা আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতাকে বিন্দু মাত্র প্রভাবিত করে না।
বর্তমান সময়ের দীপান্বিতা উৎসব যদি মোহনা হয় তবে এই তরঙ্গিনীর উৎস সম্পর্কে আগ্রহ স্বাভাবিক। এই অনুসন্ধান সহজ নয়। কালের প্রবাহে উপনদীর মতো অসংখ্য উপগাথা এসে মিশে গেছে মূল তথ্যে - আজ তাদের পৃথক করা বেশ কঠিন কাজ। অনেক সময়ই অসম্ভব। তবে প্রতিটি অংশই অতীব চিত্তাকর্ষক তাতে সন্দেহ নেই। পুরান তথা বিভিন্ন সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কালীর বর্তমান রূপ পরিগ্রহে সময় লেগেছে অন্তত দুই হাজার বছর। কালীর বৈদিক পরিচয় অথর্ব বেদের সুত্রে।এই বেদে প্রথম কালীর স্বরূপ প্রকাশিত হয়। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কালিকা পুরাণ ইত্যাদিতে ও কালীর উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে কালরাত্রি নাম্নী এক দেবীর বর্ণনা পাই। এই দেবী কালিকারই অন্য রূপ বলে উল্লিখিত হয়ে থাকে। অরিজিন খুঁজতে গিয়ে দেবী কালীর প্রথম পর্যায়ের সাথে অনার্য সম্বন্ধের সম্ভাবনা জোরালো ভাবে উঠে আসে। হরপ্পা - মহেঞ্জদরো সভ্যতায় মাতৃ পূজা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। এই সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। পূজিতা এই দেবীর সাথে দেবী কালিকার প্রভূত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ কালীকে আদিবাসি সম্প্রদায়ের দেবী রূপে ও বর্ণনা করে থাকেন। সপ্তম - অষ্টম দশকের কিছু লেখায় এর উল্ল্যেখ আছে তবে ঈষৎ ভিন্ন ভাবে। যেমন বান ভট্টের নাটক কাদম্বরীতে দেবী চণ্ডীর উপাখ্যান পাওয়া যায়। ইনি শবর জাতির দ্বারা পূজিতা হতেন। সমকালীন কবি বাকপতি বিরচিত " গৌড় বহও " নামক প্রাকৃত ভাষায় রচিত কাব্য গ্রন্থে বিন্ধ্যবাসিনি নামে এক দেবীর কথা আছে যিনি ছিলেন শবরদের আরাধ্যা। তাঁর সাথে ও কালীর বিশেষ মিল পাওয়া যায়। মূল বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী ভীষণ দর্শনা, মুণ্ডমালিনী, প্রায় নগ্ন এক মূর্তি। খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০ থেকে প্রায় ৬০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি কালী মূলত যুদ্ধের দেবী রূপে পূজিতা হতেন। বৈদিক দেবী হলেও তৎকালীন সময়ে সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল স্রোতে তিনি কিছুটা ব্রাত্যই ছিলেন। কালীর আরাধনা বিশেষত নিম্ন বর্ণ বা অবৈদিক সমাজেই বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। নগরের বাইরে শ্মশানের কাছাকাছি অঞ্চলেই কালী মন্দিরের অবস্থান বেশি পরিলক্ষিত হয়। তবে ষষ্ঠ শতকের 'দেবী মাহাত্মম' রচনায় মহাকালী রূপে কালীর রূপ ও মাহাত্ম্যের বিস্তৃত বর্ণনা পাই। অশুভ বিনাশ করে ইনি শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী দুর্গার ললাট উৎপন্না মহা শক্তিশালিনী দেবী রূপে তিনি স্বীকৃতি পান। আবার স্বামী অভেদানন্দের মতে বৈদিক দেবী 'রাত্রি' পরবর্তীতে দেবি কালিকা হয়ে ওঠেন। তবে তন্ত্র সাধনার সাথে সুনিবিড় যোগাযোগ এক সুদীর্ঘ সময় কালীকে সাধারন মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এক ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা এর কারণ হয়তো। তবে পরবর্তীতে এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে সহজ হয়। সতেরশ খ্রিস্টাব্দ উত্তর সময়ে কালী সাধনা এক অন্য রূপ পায়। ভয়াল ভয়ঙ্কর রক্ত পিপাসু দেবী স্নেহময়ী মা হয়ে ওঠেন। সাধক রাম প্রসাদ, সাধক বামাখ্যাপা তথা শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ন্যায় কালী উপাসকেরা দেবী কালিকার ভবতারিনি মাতৃ রূপ পূজা প্রচার করেন। ক্রমশ এই রূপ সাধারন বাঙালী মনের কাছাকাছি আসে । বাঙালী হৃদয় আসনে তখন থেকেই তাঁর করুনাঘন অবস্থান।
ব্রিটিশ শাসিত বাংলা তথা ভারতে কালী উপাসনা বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পরাধীন জাতির অন্তরের ক্ষোভ আর প্রতিবাদের উচ্চারণ কালীর দৃপ্ত ব্যক্তিত্বকে অনুসরন করতে চাইত। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে শক্তি আরাধনা তথা কালী উপাসনার প্রচলনের বহু প্রমান পাওয়া যায়। কালীর তেজোময়ী, লড়াকু ভাবময়তা তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রখর নারী সত্ত্বা যা ছিল উপেক্ষিত, বিপর্যয়ের ক্ষণে তা দৈবী স্বরূপে স্বীকৃত হয়। অপর কারণটি ছিল কালী সম্পর্কে শাসক জাতির অবহেলা মিশ্রিত আতঙ্ক ও ভয়। এই উগ্র ভয়াল প্রায় নগ্ন রূপ ব্রিটিশ মানসিকতাকে সজোরে আঘাত করে।
রক্তপিপাসু এবং যৌনতার প্রতীক রূপেই কালীর পরিচয় হয়। কালীকে নিয়ে অবজ্ঞা ভাব তখনকার বহু বিদেশী বিদ্বদজনের মধ্যেও দেখা যায়। এমনকি পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার ও কালীকে নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখান নি। তবে পরবর্তীতে বিশেষত উনিশশো ষাট ও সত্তরের দশকে কালীর এই ব্যতিক্রমী স্ত্রী সত্ত্বা বহু গবেষণার মূল বিষয় হয়ে ওঠে।
কালী শব্দের ব্যুৎপত্তি ও অর্থ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত উল্ল্যেখ ব্যতিরেকে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শ্রী শ্রী চণ্ডী মতে কালী তিনি যিনি 'কাল' নিয়ন্ত্রন করেন। 'কাল' অর্থে সময়। বেদ তত্ত্ব অনুসারে তিনি আদি শক্তি - মহাকাল শিবের অর্ধাঙ্গিনী! শক্তি উপাসনা এ ক্ষেত্রে অনেকাংশেই পুরুষ তথা শিব নির্ভর। তবে তন্ত্র মতে কালীর দৈবী সত্ত্বা বহুলাংশে স্বাধীন ও একক। এই মতোবাদ অনুযায়ী কালী শব্দের মধ্যে 'কল' ধাতু আছে। কল্ ধাতুর ভাবগত অর্থ হলো গণনা, গতি, আশ্রয়, শব্দ, সংখ্যা ! তাই কালী শব্দের তাৎপর্য হলো সংখ্যায়নী গতি সম্পন্না যিনি। শিবের বুকের উপর দণ্ডায়মান কালী - এটা সৃষ্টি তত্ত্বের প্রথমিক পর্যায়ের ইঙ্গিতবাহী। সাংখ্য দর্শন বলে পুরুষ অক্রিয় , প্রকৃতির সংস্পর্শে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাই পুরুষ শিব এখানে শব রূপে শায়িত। বস্তুবাদী এই দর্শন অনুসারে পুরুষ স্থানু বা স্থির ধর্মী , প্রকান্তরে তীব্র ধনাত্মক শক্তি। আর নারী চরিষ্ণু বা ঋণাত্মক। এই দুই বিপরীতধর্মী শক্তির পারস্পরিক মিলনে সৃষ্টির সূচনা। আর তারই প্রতীক নিস্ক্রিয় শিবের বুকে চঞ্চলা কালীর পদ চারণা! মধ্যযুগীয় তন্ত্র মতোবাদের প্রসারে এই সাংখ্য দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
কালী নারী সত্ত্বার এমন এক রূপ যা স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রচলিত স্ত্রী ভাবনার পরিপন্থী, অনন্য। তাঁর দৈবী ভাবমূর্তি বিতর্কিত ও বটে। কারণ কালী পৃথক - লোল জিহ্বা, উন্মুক্ত স্তন, নগ্ন জঙ্ঘা অথচ অনায়াস সাবলীল ভঙ্গিমায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। আবহমান কাল ধরেই ভক্তি মার্গে তাঁর আসনে উপেক্ষার ছায়া। তাঁর রণরঙ্গিণী রক্ত লোলুপ নির্লজ্জ রূপে তথা কথিত সভ্য মন সদা বিব্রত - সে একাল হোক বা সেকাল। বেদ ও পুরানের অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বে ও তাঁর ঐশী অস্তিত্বের সামগ্রিক গ্রহনীয়তা দীর্ঘসময় ধরে ছিল অবহেলিত। এখানে ও এক লড়াইয়ের কাহিনি - আপস না করার লড়াই। অতি প্রাচীনকাল থেকেই কালী আধুনিক। তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে কখনই আরোপিত মনে হয় না। যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবল পরাক্রমে অসুর নিধন তাকে কখনই অসহজ করে তোলে না। এই স্বাচ্ছন্দ্যই হয়তো নারী ক্ষমতায়নের প্রথম সোপান।

শ্রীশ্রী মা কালীর নাম উৎপত্তি ও রূপভেদ: ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’। মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ। মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে "সময়ের থেকে উচ্চতর"। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে।
★ রূপভেদ- তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা। শ্রী অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। যথা: সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী। জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল: ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী। নিম্নে মা কালীর মূল রূপগুলির (অষ্টধা কালী) ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলাম।
● দক্ষিণাকালী- দক্ষিণাকালীর কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামে আখ্যাতা। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুলে বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তাঁর দন্ত ভয়ানক; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। তাত্ত্বিকের তাঁর নামের যে ব্যাখ্যা দেন তা নিম্নরূপ: দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। তাঁর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়।
● সিদ্ধকালী- সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না; তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্র-এ তাঁকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তাঁর মূর্তিটি নিম্নরূপ: দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি কপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। তিনি সালংকারা। তাঁর বামপদ শিবের বুকে ও বামপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।
● গুহ্যকালী- গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা। মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। তাঁর মন্ত্র বহু – প্রায় আঠারো প্রকারের।
● মহাকালী- তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে তাঁকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ,চক্র,গদা,ধনুক,বাণ,পরিঘ,শূল,ভূসুণ্ডি,নরমুণ্ড ও শঙ্খ। ইনিও ভৈরবী; তবে গুহ্যকালীর সঙ্গে এঁর পার্থক্য রয়েছে। ইনি সাধনপর্বে ভক্তকে উৎকট ভীতি প্রদর্শন করলেও অন্তে তাঁকে রূপ, সৌভাগ্য, কান্তি ও শ্রী প্রদান করেন।
● ভদ্রকালী- ভদ্রকালী নামের ভদ্র শব্দের অর্থ কল্যাণ এবং কাল শব্দের অর্থ শেষ সময়। যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গলবিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। ভদ্রকালী নামটি অবশ্য শাস্ত্রে দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অপর নাম রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, মাথায় জটাজুট, ললাটে অর্ধচন্দ্র ও গলদেশে কণ্ঠহার। তন্ত্রমতে অবশ্য তিনি মসীর ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী; তিনি জগৎকে গ্রাস করছেন; তাঁর হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম। গ্রামবাংলায় অনেক স্থলে ভদ্রকালীর বিগ্রহ নিষ্ঠাসহকারে পূজিত হয়। এই দেবীরও একাধিক মন্ত্র রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রটি হল – ‘হৌঁ কালি মহাকালী কিলি কিলি ফট স্বাহা’।
● চামুণ্ডাকালী- চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা ভক্ত ও সাধকদের কাছে কালীর একটি প্রসিদ্ধ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, চামুণ্ডা চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুর বধের নিমিত্ত দেবী দুর্গার ভ্রুকুটিকুটিল ললাট থেকে উৎপন্ন হন। তাঁর গাত্রবর্ণ নীল পদ্মের ন্যায়, হস্তে অস্ত্র, দণ্ড ও চন্দ্রহাস; পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম; অস্তিচর্মসার শরীর ও বিকট দাঁত। দুর্গাপূজায় মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপূজার সময় দেবী চামুণ্ডার পূজা হয়। পূজক অশুভ শত্রুবিনাশের জন্য শক্তি প্রার্থনা করে তাঁর পূজা করেন। অগ্নিপুরাণ-এ আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। তাঁর মন্ত্রও অনেক। বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণে বর্ণিত চামুণ্ডা দেবীর ধ্যানমন্ত্রটি এইরূপ - নীলোৎপলদলশ্যামা চতুর্বাহুসমন্বিতা । খট্বাঙ্গ চন্দ্রহাসঞ্চ বিভ্রতী দক্ষিণে করে ।। বামে চর্ম্ম চ পাশঞ্চ ঊর্দ্ধাধোভাগতঃ পুনঃ । দধতী মুণ্ডমালাঞ্চ ব্যাঘ্রচর্মধরাম্বরা ।। কৃশোদরী দীর্ঘদংষ্ট্রা অতিদীর্ঘাতিভীষণা । লোলজিহ্বা নিমগ্নারক্তনয়নারাবভীষণা ।। কবন্ধবাহনাসীনা বিস্তারা শ্রবণাননা । এষা কালী সমাখ্যাতা চামুণ্ডা ইতি কথ্যতে ।।
● শ্মশানকালী- কালীর "শ্মশানকালী" রূপটির পূজা সাধারণত শ্মশানঘাটে হয়ে থাকে। এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর ধ্যানসম্মত মূর্তিটি নিম্নরূপ:
"শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তিনি সর্বদা বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাস্যমুখে আমমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও, তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।"
শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তাঁর বাঁ-পাটি শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। এই রূপটিও ভয়ংকর রূপ। তন্ত্রসাধকেরা মনে করেন, শ্মশানে শ্মশানকালীর পূজা করলে শীঘ্র সিদ্ধ হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে শ্মশানকালীর পূজা করেছিলেন। কাপালিকরা শবসাধনার সময় কালীর শ্মশানকালী রূপটির ধ্যান করতেন। সেকালের ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাবার আগে শ্মশানঘাটে নরবলি দিয়ে শ্মশানকালীর পূজা করতেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রাচীন শ্মশানঘাটে এখনও শ্মশানকালীর পূজা হয়। তবে গৃহস্থবাড়িতে বা পাড়ায় সর্বজনীনভাবে শ্মশানকালীর পূজা হয় না। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, শ্মশানকালীর ছবিও গৃহস্থের বাড়িতে রাখা উচিত নয়।
● শ্রীকালী- গুণ ও কর্ম অনুসারে শ্রীকালী কালীর আরেক রূপ। অনেকের মতে এই রূপে তিনি দারুক নামক অসুর নাশ করেন। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। শিবের ন্যায় ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা।

সেকালের কালী পূজা: আজ আমরা যে কালীমূর্তির আরাধনা সর্বত্র দেখতে পাই, তার রূপটি (দক্ষিণাকালী) সর্বপ্রথম বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ (১৬ শতক) কল্পনা করেছিলেন বলে কথিত আছে। শোনা যায়, তিনি অমাবস্যার রাতে স্বহস্তে কালীমূর্তি তৈরি করে সে-রাতেই নিজে পূজা সম্পন্ন করে প্রতিমা বিসর্জন দিতেন। অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, তাঁর আগেও বাঙলায় কালী আরাধনা প্রচলিত ছিল। এ-ভাবেই বাঙলার কালী আরাধনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। জনশ্রুতি এই যে, এই কালীভক্ত রাজা আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে প্রতি গৃহস্থকে কার্তিকী অমাবস্যায় তার বাড়িতে কালীপূজা করতে হবে, অন্যথায় শাস্তি পেতে হবে। তাঁর পরবর্তী দুই পুরুষও এই আদেশ বহাল রাখেন। এর ফলে শুধু কৃষ্ণনগর জেলাতেই নাকি দশ সহস্রাধিক বাড়িতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হতো, যার পরিণতিতে ঐ অঞ্চলে শ্যামাপূজার রাত্রিতে পূজারী ব্রাহ্মণের অভাব দেখা দেয়। কালীপূজায় ঐ জেলায় পশুবলিও নাকি হতো প্রায় দশ হাজারের মতো। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙলার পূজাপার্বন’ বইটিতে এই তথ্য পাওয়া যায়। এই লেখকের মতে আঠারো শতকের শেষের দিকেও কালীপূজা বাংলাদেশে ততটা জনপ্রিয় হয়নি। ‘তন্ত্রসার’-এর মতো প্রাচীন কোনো গ্রন্থে কালীপূজার উল্লেখ নেই। যে ‘শ্যামাসপর্যা’ গ্রন্থে এই পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা অপেক্ষাকৃত আধুনিক।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রের কালী আরাধনা নিয়েও অনেক কাহিনী শোনা যায়। কালীপূজায় তাঁর এক হাজার মণ মিষ্টান্ন ও সেই ওজনের চিনি, চাল-কলা ইত্যাদি সহ এক হাজারটি শাড়ি ও মেয়েদের এক হাজার রেশমি পোশাক ইত্যাদির হাজার রকমের ভোগ নিবেদনের কাহিনী পাওয়া যায়। ঐ কাহিনী অনুসারে এই কালীপূজায় মহিষ, পাঁঠা ও ভেড়া (প্রতিটি এক হাজার করে) বলি দেবার খরচ পড়েছিল প্রায় দশ হাজার টাকা আর পূজার অন্যান্য খরচ ধরলে আরও প্রায় কুড়ি হাজার টাকা! এই বেহিসেবী ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঈশানচন্দ্রকে নাকি সর্বস্বান্ত হতে হয়েছিল।
কালীপূজার আড়ম্বরে এমনই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আর এক রাজার গল্প পাওয়া যায় শ্রীরামপুরের মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখায় (১৮১৫)। এই রাজা রামকৃষ্ণ বরানগরে কালীর এক মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠার উৎসবে নাকি তখনকার দিনে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। ওয়ার্ড লিখেছেন, কালীর নামে রাজা বিপুল সম্পত্তি দান করেছিলেন, সেই সম্পত্তির আয় থেকে দৈনিক পাঁচশ’ লোক খাওয়ানো হয়।... কালীপূজার খরচের ফলে এখন তিনি প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন।
সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ‎ঐতিহ্যমন্ডিত কালী-আরাধনার কেন্দ্র আর তাদের নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনীরও শেষ নেই! যেমন, মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ার দেবী কীরিটেশ্বরী, জনশ্রুতি - বাংলার নবাব মীরজাফর অসুস্থ অবস্থায় এই দেবীর চরণামৃত পান করতেন। এ-রকম আরো কয়েকটি কালীমন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিপুরে শাক্ত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ আর বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্যের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত কালী, রামপ্রসাদের সাধনপীঠ কুমারহট্টের (হালিশহর) ও কমলাকান্তের কোটালহাটের কালী, ভদ্রপুরে মহারাজা নন্দকুমারের প্রতিষ্ঠিত দ্বিভুজা কালী, বিষ্ণুপুরের ময়নাপুরে প্রাচীন কালী, কালনা, সিঙ্গুর ও রাণাঘাটের সিদ্ধেশ্বরী, সিউড়ি ও নবদ্বীপের ভবতারিণী, চূঁচুড়ার দয়াময়ী, নলহাটির ললাটেশ্বরী, শেওড়াফুলির নিস্তারিনী, বাগনানের মহাকালী, বর্ধমানের কঙ্কালেশ্বরী ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া বীরভূমে বীরসিংহপুরের কালী, অম্বিকা-কালনার দারুময়ী অম্বিকা ও ২৪ পরগ্ণার ময়দার কালীও বিখ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও বিশ্রুত কালীক্ষেত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঝাড়খন্ডে ধানবাদের নিকটবর্তী কল্যাণেশ্বরী ও রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তার মন্দির ভক্তদের কাছে সুপরিচিত। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) বিক্রমপুরে সোনারঙের কালী, ঢাকার জয়দেবপুরে শ্মশানকালী, বগুড়ার কালঙ্কেশ্বরী (বা প্রেতাসনা কালী), ত্রিপুরার মেহারে মেহার-কালী ইত্যাদিও সুপরিচিত। তমলুকের দেবী বর্গভীমা এবং কাঁথির কপালকুণ্ডলার নামাঙ্কিত মন্দির বা বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরে পূজিতা দেবীও আদতে কালীরই নানা রূপ। বীরভূমের তারাপীঠে পূজিতা দেবী কালীর নিকটতম রূপান্তর তারার মন্দিরের কথা ছেড়ে দিলেও সেখানে রয়েছে বোলপুরের কাছে কঙ্কালী, ভাঙ্গালি ও বর্ধমান সীমান্তে অট্টহাস ইত্যাদি কালী-উপাসনাস্থলগুলি, যার মধ্যে কয়েকটি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে নানা ডাকাতের নামের সঙ্গে জড়িত অগণিত কালীমন্দির।
এ-রকমই একটি, সিঙ্গুরের ডাকাতকালীর মন্দির দেখতে যাবার এক বিবরণ মেলে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিখ্যাত বই ‘বাংলার ডাকাত’-এ। শেওড়াফুলি যাবার পথের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখছেন, “শীর্ণ সংকীর্ণ সর্পিল পথ। চৈত্র মাস। শুষ্ক পথের পাশে স্থানে স্থানে জঙ্গলঘেরা ডোবা। অতিকষ্টে মন্দিরের কাছে আসিলাম। ডাকাত কালীর মন্দির ভগ্ন ও জীর্ণ। ইঁট খসিয়া পড়িতেছে। এদিক ওদিক সাপ ছোটাছুটি করিতেছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকার। মন্দিরে ভীষণাকৃতি কালীমূর্তি। ভিতরে আবর্জনা পূর্ণ।......একপাশে একটি বড় হাড়িকাঠভূমিতে পড়িয়া আছে।......আমি ডাকাতে কালীকে দেখিতে আসিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম...। নানা আগাছায় পূর্ণ ভয়াল স্থান। দিনের বেলায়ও ভয় করে।...” সিঙ্গুরের এই ডাকাতে কালীর মন্দির কিন্তু আজও আছে, যদিও প্রাচীন জরাজীর্ণ মন্দিরের সংস্কার হয়েছে। এই কালীর নাম সিদ্ধেশ্বরী। গগন সর্দার, সনাতন বাগদি, রঘু ডাকাত ইত্যাদি নানা ডাকাতের নাম ও গল্প সিঙ্গুরের এই কালীর সঙ্গে জড়িত।
এই সূত্রে কালীপূজোয় আরও দুটি বিদেশী-লিখিত নরবলির বিবরণের উল্লেখ এখানে করা যায়। একটি পর্তুগীজ জার্নালে ক্যাপটেন নরোনহা নামে এক ধর্মভীরু পর্তুগীজের বিবরণ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের কাছাকাছি কোনো স্থানে ডাকাতদের সঙ্গে গিয়ে তিনি এক বটগাছের নীচে তিনি তাদের আরাধ্যা কালীমূর্তি দেখতে পান। বলি হিসেবে সেখানে দু’টি অর্ধমূর্ছিত বালক ও অদুরে সিঁদুর মাখানো খড়গ দেখে তিনি ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। আর একটি বিবরণ যার লেখা, তিনি ধর্মে ক্যাথলিক হলেও পেশায় ছিলেন ডাকাত। এক স্থানীয় জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খুলনা ও নোয়াখালি অঞ্চলে ডাকাতি করতেন, পরে পালিয়ে যান সুন্দরবনের গভীরে। সেখানে তিনি ‘ভবানীপূজা’র আয়োজন করেন বলে জানিয়েছেন, যাতে নরবলির জন্য মানুষ কেনাবেচার কথা পাওয়া যাচ্ছে ও বলির যোগ্য মানুষের লক্ষণ মিলিয়ে সওদা করছেন স্ব্য়ং পুরোহিত!
ওয়ার্ডের বিবরণে এরকম আরো কালীভক্তদের বিবরণ মেলে, যারা কালীপূজো উপলক্ষে বিপুল ব্যয় করতেন, যেমন ধরা যাক, খিদিরপুরের ন্যায়নারায়ণ ঘোষাল বা গোপীমোহন নামে কলকাতার এক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। প্রথমজন নাকি ১৭৯৫ সাল নাগাদ কালীপূজায় পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় করে ২৫টি মহিষ, ১০৮টি পাঁঠা ও ৫টি ভেড়া বলি দিয়েছিলেন। অপর ব্যক্তি ১৮১১ সালে কালীপূজায় দশ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন।
কলকাতার আরেক বাবু শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির কালীপূজার আড়ম্বরের বিবরণ পাওয়া যায় হরিহর শেঠের লেখায়ঃ- “কালীশঙ্কর ঘোষের বাটীতে তান্ত্রিকমতে অতি ভয়ানক ভাবে কালীপূজা হইত। শ্যামাপূজার রাত্রে মদ্যপান অব্যাহতভাবে চলিত এবং বলির রক্তে প্রাঙ্গণ ভরিয়া যাইত, নর্দমা দিয়া রক্তস্রোত বহিয়া যাইত।” এই বাড়ির পূজোতেই পশুবলির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন পূর্বে উল্লিখিত পাদ্‌রি ওয়ার্ড তাঁর বইয়ে। বাড়ির মাঝখানে খোলা আঙিনায় রয়েছে বলির পশুগুলি, পাশেই স্ব্য়ং কালীশংকর। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী ও বলির কাজে সহায়তার জন্য জনা বিশেক লোক। আঙ্গিনার চারদিক ঘিরে দালান, তার একটি ঘরে উত্তরমুখী করে প্রতিমা বসানো, অপর কয়েকটি ঘর দর্শকে ঠাসা। এর পর এই পাদরি জানিয়েছেন যে, প্রথমে বলি পড়ে পাঁঠা, তারপর মহিষ ও সবশেষে দু’ তিনটি ভেড়া। ওয়ার্ডের বর্ণনা কিছুটা শোনা যাকঃ- “একজন পূজারী বলি দেওয়া পাঁঠার মুন্ডুটি ধরে নাচতে নাচতে মূর্তির সামনে নিয়ে গেল। সদ্য কাটা মুন্ড থেকে তাজা রক্ত তার সর্বাঙ্গে গড়িয়ে পড়তে থাকে। বলিদান শেষ হলে কালীশঙ্কর, যে লোকটি বলি দিল, তাকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। তাকে বস্ত্র ইত্যাদি প্রভূত জিনিষপত্র দান করা হলো। পশুর মুন্ড, রক্ত, দেহের বিভিন্ন অংশের মাংস পূজারী দেবীকে নিবেদন করলেন। তারপর বালির ওপর আগুন জ্বেলে ঘৃত সহযোগে হোম শুরু হলো। তখন সারা আঙিনা রক্তে ভাসছে।” এ-ছাড়াও কালীপূজার বিষয়ে ওয়ার্ড যে-সব তথ্য জানিয়েছেন, তার মধ্যে আছে, দেবীকে যে মদ্য নিবেদন করা হয়, তা কর্তা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের লোকেরা একান্তে পান করে। আর প্রতিমার সম্মুখে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
পশুবলি অবশ্য গৃহস্থ বাড়ির কালীপূজোয় ছিল বহুল প্রচলিত প্রথা। কাঁসারিপাড়ার মল্লিকবাড়িতে আর সিমলার হোগলকুঁড়িয়ায় গুহবাড়িতে কালীপূজোয় মহিষ বলির প্রথা ছিল বলে জানা যায়। পাঁঠা বলি তো ছিল সাধারণ ব্যাপার! আবার বিখ্যাত ধনী আশুতোষ দেবের (ছাতুবাবু) বাড়ির কালীপূজায় কোনো বলিই হতো না। ১৭৫৭ সালে সুতানুটি অঞ্চলে রাজা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত পুঁটে-কালীর মন্দিরে বৈশিষ্ট্যই ছিল অসংখ্য বলিদান। পলাশির যুদ্ধের সমকালে যখন কলকাতার অধিকাংশ জায়গা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, তখন ডাকাতি করতে যাবার আগে কালীমূর্তির সামনে এমন কি, নরবলি দেবার গল্পও শোনা যায়। চিতু ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরে ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মের এক অমাবস্যায় এমনই নরবলি হয়েছিল বলে জানা যায়। কালীঘাটেও কোম্পানির আমলে নাকি একবার নরবলির জন্য একজনের ফাঁসি হয়েছিল বলে ডঃ ডাফের বিবরণে উল্লিখিত আছে।
কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মন্দিরে কার্তিকী অমাবস্যায় কালী আরাধনার আড়ম্বরের উল্লেখ করে মিশনারি ওয়ার্ড জানিয়েছেন যে, এই পূজায় প্রায় হাজার চারেক লোকের সমাগম হতো। অনেকেই পূজা উপলক্ষে প্রচুর খরচ করত। ১৭৬৫ সালে রাজা নবকৃষ্ণ নাকি এই কালীমন্দিরের পূজোয় লাখ খানেক টাকা ব্যয় করেন ও মূর্তির জন্য দান করেন সোনার মুন্ডমালা। পাদরি ওয়ার্ডের বিবরণ অনুযায়ী এই রাজা কালীমূর্তির জন্য দান করেন হাজার টাকা মূল্যের সোনার হার সহ অন্যান্য অলঙ্কার ও রুপোর বাসনপত্র। তিনি দু’ হাজার আতুরকে অর্থদান করেন ও যে-পরিমাণ ভোজ্যবস্তু ও মিষ্টি দান করেন, তা দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল এক হাজার মানুষকে। এই বিশ্রুত কালীমন্দিরে কালীর নিত্যপূজাও হতো এবং সে সূত্রে এর সঙ্গে নানা ধনাঢ্য মানুষের নাম শোনা যায় নানাজনের লেখা বিবরণে ও সমকালের সংবাদপত্রের পাতায়। শোভাবাজারের রাজা গোপীমোহন দেব ১৮২২ সালে একবার কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে ধূমধাম সহকারে কালীঘাটে পূজো দিয়েছিলেন ও এই পূজো দেখতে এত ভীড় হয় যে শান্তিরক্ষায় পুলিশের প্রয়োজন হয়েছিল। রাজা বাহাদুর কালীমূর্তির হাতের রুপোর খড়্গ আর সোনার নরমুন্ড গড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও নানা রকমের অলঙ্কার পট্টবস্ত্র আর শাল-দোশালায় মূর্তিকে মন্ডিত করেন।
অতীত বাঙলার, এমন কি, ভারত ও নেপালের নানা ধনী ভক্তজন নানা সময়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির জন্য বিভিন্ন আভরণ দান করেন বলে শোনা যায়। দেবীর চারটি রুপোর হাত দিয়েছিলেন খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল। পরে চারটি সোনার হাত দেন কলকাতার কালীচরণ মল্লিক। বেলেঘাটার রামনারায়ণ সরকার দিয়েছিলেন সোনার একটি মুকুট আর পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ দেবীর সোনার জিভটি গড়িয়ে দেন। পাতিয়ালার মহারাজা দিয়েছিলেন দেবীমূর্তির গলার একশো আটটি নরমুন্ডের মালা, মূর্তির মাথার ওপরের রুপোর ছাতাটি নাকি দেন নেপালের প্রধান সেনাপতি জঙবাহাদুর।
মূর্তির পরেই কালীঘাটের মন্দিরের ও মন্দির পরিসরের নানা অংশের নির্মাণেও রয়েছে নানা বিচিত্র মানুষের যোগদান। ১৭৭০-৭১ সাল নাগাদ মন্দিরের সামনের গঙ্গার ঘাটটি এক বিশ্বস্ত পাঞ্জাবি সৈনিক হুজুরিমল্লের শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাঁধিয়ে দেয় ইংরেজ সরকার। কালীর বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল বরিশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরী ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের সৌজন্যে। এছাড়াও শ্যামরায়ের মন্দির, তোরণদ্বার, বিভিন্ন ভোগঘর, নহবতখানা ইত্যাদির নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাওয়ালির বৈষ্ণব জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল, গোরখপুরের টীকা রায়, শ্রীপুরের জমিদার তারকচন্দ্র চৌধুরী, তেলেনিপাড়ার জমিদার কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নাম। ১৮৩৫ সালে নাটমন্দিরটি তৈরি করান আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই নাটমন্দিরেই ১৮৯৯ সালে কালী সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা। সে এক অন্য কাহিনী!
অ্যালবার্ট হলে [অর্থাৎ এখনকার কফি হাউস] কালী বিষয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন আইরিশ দুহিতা নিবেদিতা। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার শিক্ষিত সমুদায় ও ব্রাহ্মসমাজের নানা বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন সত্যেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ডাঃ নিশিকান্ত চ্যাটার্জি ও ড: মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ। সাধারণ শ্রোতারা নিবেদিতার ভাষণে সন্তুষ্ট হলেও কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তি তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। নিবেদিতা এই বক্তৃতায় কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে সবচেয়ে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন মহেন্দ্রলাল। কলকাতার কালীবিরোধীদের বক্তব্যের জবাব দেবার সুযোগ আসে যখন কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত হালদারেরা নিবেদিতাকে মন্দির প্রাঙ্গনে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানান। এই কালীঘাটেই নাটমন্দিরের চত্বরে নিবেদিতা ২৮শে মে শ্রোতায় ঠাসা এক সভায় কালী আরাধনার বলিপ্রথা, মূর্তিপূজা ও মূর্তির তথাকথিত কুৎসিত রূপ ইত্যাদি অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। পরে তাঁর এই বক্তৃতা পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। উল্লেখযোগ্য যে, ‘কালী দি মাদার’ নামে নিবেদিতার একটি বইও আছে।
কালীঘাটের কালীর প্রতি শুধু যে বাঙালি বা হিন্দুরাই ভক্তি বা বিশ্বাস পোষণ করতেন, এমন কিন্তু নয়। শোনা যায়, পাঞ্জাব আর বার্মা দখল করবার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কালীঘাটে ষোড়শোপচারে পূজো পাঠানো হয়েছিল। মার্শম্যানের বিবরণেও এর সমর্থন মেলে। কালীপূজোয় কোম্পানির এই এলাহি খরচের পেছনে অবশ্য ভক্তির চেয়ে দেশী সেপাইদের সন্তুষ্ট করার বাসনাই সম্ভবত কাজ করেছিল। কিন্তু পাদরি ওয়ার্ড কালীঘাট সহ বিভিন্ন কালীমন্দিরে অহিন্দু ভক্তদের আনাগোনার কথা লিখেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, “শুধু হিন্দুরাই যে এই কালো পাথরের দেবীমুর্তির পূজা করে, এমন কিন্তু নয়। আমি জানতে পেরেছি, অনেক ইয়োরোপীয় বা তাদের এ-দেশীয় স্ত্রীরা কালী মন্দিরে যায় ও দেবীর আরাধনায় হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে। আমি যে-ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে এই বিবরণ প্রস্তুত করেছি, তিনি বলেছেন, তিনি...... বহুবার সাহেব-মেমদের কালী মন্দিরে পূজো দিতে পালকি করে আসতে দেখেছেন।...... তাঁকে মন্দিরের কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত ভাবে জানিয়েছেন, কোনো প্রার্থনা নিয়ে কালীর কাছে দিতে ইয়োরোপীয়রা প্রায়ই এসে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক বিশিষ্ট কর্মচারী সম্প্রতি মামলা জিতে কালীদেবীকে দু’ তিন হাজার টাকা দামের টাকা মূল্যের নানা সামগ্রী দান করেছেন।”
কালীঘাটের মন্দির সম্পর্কে পাদ্রি ওয়ার্ড লিখেছেন, “কলকাতার কাছে কালীর এক বিখ্যাত মন্দির রয়েছে। সমগ্র এশিয়া, এমন কি, সমগ্র বিশ্বের হিন্দু এই দেবীর পূজা করে।” ওয়ার্ডের বিবরণে এই অতিরিক্ত সংবাদও পাওয়া যায় যে, প্রায় পাঁচশো মুসলমান নাকি প্রতি মাসে কালীকে পূজো দিয়ে যেতেন। এর পরে তাঁর অধিকন্তু মন্তব্যঃ- “কি আশ্চর্য ভাবেই না এই দেবীমূর্তি সাধারণ লোকের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে! ......বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমসংখ্যক গণিকারা এসেও মন্দিরে পূজো দিয়ে যায়। তাদের কারো প্রার্থনা উপপতির রোগমুক্তি, কেউ বা চায় তার ঘরে আরও বেশি লোকের আগমন!” পবিত্রকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, একসময় অবিভক্ত বাংলার, পরে পূর্ব পাকিস্তানের জননেতা শহিদ সুরাওয়ার্দি নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনায় কালীঘাটে মানত করেছিলেন ও কলকাতায় দু’জন লোক পাঠিয়ে তাঁর হিন্দু বন্ধুদের মারফৎ ‘বিরাট ডালা সাজিয়ে’ কালীঘাটে পূজো দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর একজন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জিও নাকি প্রতি সপ্তাহে কালীঘাটের মন্দিরে পূজো দিতেন।
কালীঘাট ব্যতিরেকে কলকাতার অন্যান্য প্রাচীন কালী মন্দিরগুলি নিয়েও আড়ম্বর-বৈচিত্র্যের কাহিনী কম নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিপত্তিশালী দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্রের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির ছিল কলকাতার মনুমেন্টের থেকেও উঁচু, আর তা খ্যাত ছিল ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামে। এই মন্দির বেশ কয়েকবার ঝড়ে আর ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে ও তা পুনরায় তৈরি করা হয়। তাঁর কালীপূজোর ঘটাও নাকি ছিল খুব বিখ্যাত।
কলকাতার কালীমন্দিরগুলোর মধ্যে সম্ভবত প্রাচীনতা আর খ্যাতির বিচারে কালীঘাটের পরেই চিত্তেশ্বরী মন্দিরের নাম উল্লেখ্য। অতীতের সেই যুগে গঙ্গার তীর ধরে তীর্থযাত্রীরা চিৎপুরে দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিত্রেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজো দেবার পর মশাল জ্বালিয়ে দল বেঁধে যেত কালীঘাটে। জনশ্রুতি আছে, এই পথের ধারেই তীর্থযাত্রীদের ওপর লুঠপাট চালাতো চিতে ডাকাত, এমন কি, এইসব অসহায় যাত্রীকে ধরে নাকি বলিও দিত কালীর সামনে। এই চিতু ডাকাতের নাম থকেই দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিৎপুর নামের জন্ম হয়েছে (বা এর উল্টোটাও হতে পারে), এমন লোকশ্রুতিও আছে (কলকাতা কলেক্টরেটের ১৭৬১ সালের এক পাট্টায়ও এ কথার উল্লেখ আছে)। জঙ্গলাকীর্ণ এই পায়ে চলা রাস্তাটি ইংরেজদের নথিতে পরিচিত ছিল পিলগ্রিমস রোড নামে। বর্তমানে এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে (কাশীপুরে) প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহটি দুর্গা বা চন্ডীর হলেও কলকাতার আদিযুগে এটি যে কালীমন্দির হিসেবেই পরিচিত ছিল, তার বহু প্রমাণ আছে। ‘ক্যালকাটা রিভিয়ু’ পত্রিকায় ১৮৪৫ সালে লেখা হয়েছিল, “Chitrapur was noted for the temple of ChitreswariDeby or the goddess of Chitru, known among Europeans as the temple of Kali at Chitpore”। এখানে আরও লেখা হয়েছিল, “This was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to the goddess in Bengal before the establishment of the British Government.” একই ধরনের কথা পাওয়া যায় কটন সাহেবের ‘ক্যালকাটাওল্ড অ্যান্ড নিউ’ গ্রন্থেও। এই বইটির মতে এই স্থানটি ছিল “noted for the temple of Chitru or Kalee, renowned for the number of human sacrifices formerly offered at her shrine.”
কলকাতা বা তার উপকন্ঠের আর একটি প্রসিদ্ধ কালীক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বর, যা রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে এই মন্দিরে ভবতারিণী কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিনের কাহিনী পাওয়া যায় ‘সমাচার দর্পণে’, সেদিন নাকি “কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক্‌, পাণিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন হইয়া উঠে। এইমত জনরব যে পাঁচশত মণ সন্দেশ লাগে।” এই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণির পূজারী হিসেবে নিযুক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে এই মন্দির পরবর্তী কালে বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠে। অথচ একথা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য বিবেকানন্দের এই মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল সমুদ্র অতিক্রম করে ম্লেচ্ছদেশে যাবার কারণে! এই মন্দিরের কালীকে নিয়ে ইংরেজিতে চমৎকার একটি কবিতা লিখেছিলেন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতার প্রাচীন ও প্রথম বারোয়ারি (সম্ভবত বাংলার প্রথম বারোয়ারি কালীপূজা), মধ্য কলকাতার "আদি বারোয়ারি কালী পূজা" নামে উদযাপিত হয়ে থাকে। ১৮৫৮ সালে, জনৈক শ্রী বিহারী লাল বসুর হাতে এই পূজাটি শুরু হয়। ১৯২৪-২৬ সালের মধ্যে পূজাটি বারোয়ারি কালী পূজায় পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে সেই সময় বাংলায় কালী পূজার প্রচলন (সার্বজনীন ভাবে) সেই রকম ভাবে ছিল না।

(তথ্যসূত্র:
১- Tantric visions of the divine feminine: the ten mahavidyas By David R. Kinsley.

২- Mother of my heart, daughter of my dreams By Rachel Fell McDermott.

৩- Encountering Kali: in the margins, at the center, in the West By Rachel Fell McDermott, Jeffrey John Kripal.

৪- The camphor flame: popular Hinduism and society in India By Christopher John Fuller)

ঋগ্বেদ ১০/১২৭ সূক্তঃ রাত্রি সুক্ত

देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: विराड्गायत्री स्वर: षड्जः
रात्री॒ व्य॑ख्यदाय॒ती पु॑रु॒त्रा दे॒व्य१॒॑क्षभि॑: । विश्वा॒ अधि॒ श्रियो॑ऽधित ॥ [ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:1]
(आयती रात्रिः-देवी) आती हुई रात्रि देवी (अक्षभिः) नेत्र जैसे नक्षत्रों के साथ (व्यख्यत्) अपने को विशेषरूप से दर्शाती है (विश्वाः श्रियः) सारी शोभाओं को (अधि-अधित) अपने में धारण करती है ॥-ब्रह्ममुनि

भावार्थभाषाः -रात्रि जब आती है, तो आकाश के नक्षत्रों के द्वारा अपने को दर्शाती है, समस्त शोभाओं को अपने अन्दर धारण करती है अर्थात् समस्त शोभाओं को रात्रि पुष्ट करती है, आकाश की शोभा नक्षत्रों द्वारा रात्रि को ही दिखाई देती है, मनुष्यों की दिन में थकान की ग्लानि स्वस्थता के रूप में भासित होती है, वृक्षों के फूल भी रात्रि में ही विकसित होते हैं ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: पादनिचृद्गायत्री स्वर: षड्जः
ओर्व॑प्रा॒ अम॑र्त्या नि॒वतो॑ दे॒व्यु१॒॑द्वत॑: । ज्योति॑षा बाधते॒ तम॑: ॥[ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:2]
पदार्थान्वयभाषाः -(अमर्त्या) स्वरूप से नित्य (देवी) रात्रि देवी (अद्वतः) ऊँचे प्रदेशों को (निवतः) नीचे प्रदेशों को (उरु-आ-अप्राः) बहुत व्याप जाती है अर्थात् ऊँचे नीचे को समान कर देती है (ज्योतिषा) गगन ज्योति से (तमः) अन्धकार को (बाधते) निवृत्त करती है, अपितु प्राणियों को सुलाकर मन के अन्दर वर्त्तमान अन्धकार जड़ता को निवृत्त करती है पूर्ण विश्राम प्रदान करके ॥
भावार्थभाषाः -रात्रि शाश्वत है, आरम्भ सृष्टि से चली आती है, ऊँचे स्थानों और नीचे स्थानों को व्यापती है, उन्हें एकरूप में दिखाती है, नक्षत्रसमूह की ज्योति से अन्धकार को हटाती है तथा सुलाकर-निद्रा लाकर मन में विद्यमान अन्धकार व जड़ता को विश्राम देकर हटाती है, रात्रि को शयन ही करना चाहिये ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: विराड्गायत्री स्वर: षड्जः
निरु॒ स्वसा॑रमस्कृतो॒षसं॑ दे॒व्या॑य॒ती । अपेदु॑ हासते॒ तम॑: ॥[[ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:3]
पदार्थान्वयभाषाः -(देवी-आयती) रात्रि देवी आती हुई (उषसं स्वसारम्) रात्रि के पीछे आनेवाली उसकी सहयोगिनी उषा प्रभातवेला को (निर् अकृत) संस्कृत करती है-सुशोभित करती है (तमः-इत्-उ-अप हासते) अन्धकार भी हट जाता है उषाकाल में ॥३॥
भावार्थभाषाः -रात्रि आती है तो उसके पीछे चलती हुई भगिनी जैसी उषा के आने पर रात्रि का अन्धकार भाग जाता है, उषा की शोभा रात्रि के आश्रय पर है ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: गायत्री स्वर: षड्जः
सा नो॑ अ॒द्य यस्या॑ व॒यं नि ते॒ याम॒न्नवि॑क्ष्महि । वृ॒क्षे न व॑स॒तिं वय॑: ॥[[[ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:4]
पदार्थान्वयभाषाः -(सा) वह रात्रि (नः) हमारे लिए (अद्य) आज-प्रतिदिन कल्याणकारी हो (यस्याः-ते) जिस तेरे (यामन्) प्राप्त करने में (वयम्) हम (नि-अविक्ष्महि) सुखपूर्वक रहें (वृक्षे न) जैसे वृक्ष पर (वसतिं वयः) वास घौंसले पर निवेश करता है-रहता है, वैसे ही रात्रि सुख से सुलानेवाली हो ॥
भावार्थभाषाः -रात्रि मनुष्यों के लिए कल्याणकारी आती है, जिसके आने पर मनुष्य निविष्ट हो जाते हैं, जैसे पक्षी अपने घौंसले में निविष्ट हो जाता है ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: गायत्री स्वर: षड्जः
नि ग्रामा॑सो अविक्षत॒ नि प॒द्वन्तो॒ नि प॒क्षिण॑: । नि श्ये॒नास॑श्चिद॒र्थिन॑: ॥-[ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:5]
पदार्थान्वयभाषाः -(ग्रामासः) जनसमूह रात्रि में (नि-अविक्षत) शयन करते हैं-करें (पद्वन्तः-नि) पैरवाले पशु शयन करें (पक्षिणः-नि) पक्षी भी शयन करें (श्येनासः-अर्थिनः) तीव्र गतिमान् भी शयन करें (चित्-नि) थकावट दूर करने के लिए भी शयन करें।
भावार्थभाषाः -रात्रि में मनुष्य पशु पक्षी शान्तिप्रयोजन साधने के लिए शयन करें ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: विराड्गायत्री स्वर: षड्जः
या॒वया॑ वृ॒क्यं१॒॑ वृकं॑ य॒वय॑ स्ते॒नमू॑र्म्ये । अथा॑ नः सु॒तरा॑ भव ॥[ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:6]
(ऊर्म्ये) हे रात्रि ! (वृक्यं वृकं यवय) भेड़ियन भेड़िये घातक पशु को हमारे से पृथक् कर सुला दे (स्तेनं यवय) चोर को हमसे पृथक् कर सुला दे (अथ न सुतरा भव) हमारे लिए सुख से बीतनेवाली हो ॥
भावार्थभाषाः -रात्रि में मनुष्य सो जाते हैं। सो जाने पर भेड़िये आदि जङ्गली पशु एवं चोरों के आक्रमण की सम्भावना रहती है। मानव की भावना है कि वे हमारे ऊपर आक्रमण न करें और सो जावें, या हम ऐसे गहरे न सोएँ, जिससे वे सता सकें ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: निचृद्गायत्री स्वर: षड्जः
उप॑ मा॒ पेपि॑श॒त्तम॑: कृ॒ष्णं व्य॑क्तमस्थित । उष॑ ऋ॒णेव॑ यातय ॥ [ऋग्वेद0 मण्डल:10 सूक्त:127 मन्त्र:7]
पदार्थान्वयभाषाः -(उषः) हे उषो वेले ! (कृष्णं तमः) घने अन्धकार को अपना रूप देती हुई (पेपिशत्) अत्यन्त चूर्ण कर दे (व्यक्तं मा-उप अस्थित) मुझे पूर्णरूप से उपस्थित होती है (ऋणा-इव यातय) ऋणों की भाँति दूर कर-उतार, रात्रि के अनन्तर उषा आया करती है, जो रात्रि के अन्धकार को मिटाती है ॥७॥
भावार्थभाषाः -प्रभातवेला उषा जब आती है, रात्रि के अन्धकार को चूर्ण करती हुई आती है तथा हमारे मानस अन्धकार से ऋण की भाँति विमुक्त कराती है, ज्ञान जागृति देती है ॥
देवता: रात्रिस्तवः ऋषि: कुशिकः सौभरो, रात्रिर्वा भारद्वाजी छन्द: गायत्री स्वर: षड्जः
उप॑ ते॒ गा इ॒वाक॑रं वृणी॒ष्व दु॑हितर्दिवः । रात्रि॒ स्तोमं॒ न जि॒ग्युषे॑ ॥[१०.१२७.८]
पदार्थान्वयभाषाः -(रात्रि) हे रात्रि ! (ते) तेरे लिये (गाः इव) दूध देनेवाली गौ की भाँति-जैसे घास आदि दिया जाता है, वैसे (उप आ अकरम्) होम से उपचार करता हूँ (वृणीष्व) तू इसे अनुकूल बना, हमारे लिये उससे सुखकरी हो (दिवः-दुहितः) सूर्य की कन्या (जिग्युषे) विरोधी को जीतने के इच्छुक के लिये (स्तोमम्-इव) स्तुतिसमूह के समान हव्य देता हूँ, जैसे इष्टदेव को स्तुतिसमूह को अर्पित किया जाता है, वैसे तुझे हव्य पदार्थ देता हूँ, उससे सुवासित हो ॥८॥
भावार्थभाषाः -रात्रि सूर्य की पुत्री के समान है उसका स्वागत करना चाहिए, होम द्वारा सायं होम करके, रोगादि विरोध पर विजय पाने के लिये ॥



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

  সম্পাদকীয় বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ