নিরুক্ত (বেদাঙ্গসূত্র)
যাস্ক তাঁহার নিরুক্ত গ্রন্থে তাঁহার পূর্ববর্তী সতের জন বৈয়াকরণের নাম করিয়াছেন। নামগুলিঃ ঔদুম্বরায়ণ, ক্রৌষ্ঠুকী, শতবলাখ্য, মৌদগব্য, শাকপূণি, শকটায়ন, স্থৌলোষ্ঠীবী, আগ্রায়ণ, ঔর্ণবাম, কাত্থক্য, কৌৎস, গার্গ্য, গালব, চর্ম্মশিরস, তৈটীকি, রার্য্যায়ণ এবং শাকল্য
বিঃদ্রঃ গার্গ্য সম্ভবতঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সময়ে বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক সিংহ কর্তৃক হত হন।
বিঃদ্রঃ গার্গ্য সম্ভবতঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সময়ে বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক সিংহ কর্তৃক হত হন।
যাঙ্ক যে নিরুক্ত রচনা করিয়াছেন, উগ্র, দুর্গ, স্কন্দস্বামী যাস্কের নিরুক্তই শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে পৃথিবীর প্রথমতম গ্ৰন্থ।নিরুক্ত তিনটি কাণ্ড ও পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। নৈঘণ্টুক কাণ্ডরূপে পরিচিত প্ৰথম তিনটি অধ্যায়ে প্রতিশব্দ; নৈগম কাণ্ড বা ঐকপাদিকরূপে অভিহিত চতুর্থ অধ্যায়ে সমার্থক শব্দ; এবং দৈবত কাণ্ড-রূপে পরিচিত পঞ্চম অধ্যায়ে বৈদিক দেবতাদের নামের ব্যুৎপত্তি আলোচিত হয়েছে। ঐকপদিকে আলোচিত শব্দসমূহের অধিকাংশ ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়ের রচনা থেকে সংগৃহীত। নৈঘন্টুকের তিনটি অধ্যায়ের প্রথমটিতে বায়ু, জল, পৃথিবী ইত্যাদির মতো ভৌত উপাদান; দ্বিতীয়ে মানুষ, তার দেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আবেগ ইত্যাদি এবং তৃতীয় মূলত দেবতা ও তৎসংসৃষ্ট কিছু বিমূর্ত ধারণাসমূহ আলোচিত হয়েছে। নিরুক্তের দুটি অর্ধে মোট বারোটি পরিচ্ছেদ আছে; প্রথম ছটি পরিচ্ছেদে নিঘণ্টর প্রথম দুটি কাণ্ড এবং শেষের ছ’টি পারচ্ছেদে দৈবত কাণ্ড ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রতি অর্ধে মৌলিক বিধি ও আলোচ্য বিষয়ের পরিধি সম্পর্কে সাধারণ ভূমিকা রয়েছে; সম্ভবত তাতে রচনার দুটি স্তরের মধ্যবর্তী ব্যবধান আভাসিত।
.‘নির্ঘণ্টু’ নামক পঞ্চ অধ্যায়ে বিভক্ত কোষ গ্রন্থই নিরুক্তের প্রাচীনতম উৎস। এ কোষ গ্রন্থটি অজানা কোনো এক ঋষি প্রণীত। এ নির্ঘণ্টু নামক ১৭৭১টি শব্দতালিকার উপরই যাস্ক মুনি ব্যাখ্যামূলক একটি কোষগ্রন্থ রচনা করেন; তাই নিরুক্ত। নিঃশেষরূপে পদসমূহ এতে উক্ত হয়েছে বলে একে নিরুক্ত বলে। ‘নির্ঘণ্টু’ এবং যাস্কমুনি রচিত এর ব্যাখ্যা নিরুক্তই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন অভিধান কোষ। নিরুক্ত তিনটি ভাগে বিভক্ত।
.
(১) নৈর্ঘণ্টুকাণ্ড,
(২) নৈগম কাণ্ড ও
(৩) দৈবত কাণ্ড।
ব্যাকরণ ব্যুৎপত্তির কাঠামোও আঙ্গিকগত দিক সম্পর্কে নিরুক্ত অবহিত, অন্যদিকে শব্দের অর্থান্তর-সংক্রমণের তত্ত্বও বিশ্লেষণ করেছে। বহুলাংশে কাল্পনিক এবং অবাস্তব হলেও ব্যুৎপত্তি ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে এবং নিতান্ত প্ৰাথমিক রূপে ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। যাস্ক তার গ্রন্থে অন্তত ষোলজন পূর্বসূরী শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত উল্লেখ করেছেন। এতে মনে হয়, যাস্কের কয়েক শতাব্দী পূর্বেও সম্ভবত ব্যুৎপত্তি শাস্ত্ৰ অনুশীলিত হত। আমরা দেখেছি যে ছদ্মযুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তিতে শব্দের অর্থসংক্রমণগত উৎস নির্ধারণের প্রথম অনুমাননির্ভর প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায় ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যে। যাস্ক তার পূর্বসূরী হিসাবে সংহিতা (সবগুলি শাখায় বিন্যস্ত রূপে), ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও প্রাতিশাখাগুলিকে পেয়েছিলেন। এসব রচনা থেকে তিনি উপাদান আহরণ করেছিলেন এবং এগুলির উপর ভিত্তি করেই নিজস্ব বক্তব্য শঠন করেছিলেন। সেযুগে বেদাধ্যয়ন যে পরিশীলিত স্তরে উপনীত হয়েছিল, তা বেদ বিষয়ক চিন্তার বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে যাস্কের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যথা যাজ্ঞিক, বৈয়াকরণ, নৈদান, ঐতিহাসিক ও নিরুক্ত। বৈদিক মন্ত্রগুলিকে যিনি অর্থহীন বলে মনে করতেন, সেই কৌৎসের অভিমত সম্পর্কে নিরুক্তের আলোচনা (১ : ১৫) কিংবা ঐতিহাসিক পক্ষের অস্তিত্ব (৩ : ১২) থেকে প্রমাণিত হয় যে বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছিল।
সর্বমোট ১৭ জন বৈদিক অভিধান প্রণেতা বা নিরুক্তকারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়; এর মধ্যে সর্বশেষ জনের নাম যাস্ক। বর্তমানে বৈদিক সাহিত্যে যে নিরুক্তটি টিকে আছে বা ব্যবহার হয়, তার প্রণেতা যাস্ক। যাস্কের নিরুক্ততে মোট ১৪টি অধ্যায় আছে এবং এর বিভিন্ন অধ্যায়ে বেদে বর্ণিত শব্দগুলোর অর্থ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা আছে।
কঃ নৈঘন্টুক – এতে পাঁচটি অধ্যায় আছে । একে শব্দার্থ কান্ড বলে । এই নৈঘন্টুক এ একার্থবাচক অনেক শব্দ এবং অনেকার্থবাচক এক শব্দের ব্যবহার হয়েছে।।
খঃ নৈগম – নৈগমে ছয়টি অধ্যায় আছে । যাস্কাচার্য নৈগমে বেদে প্রযুক্ত বহু শব্দের নির্ণয় করেছেন । মন্ত্রের সমস্ত শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নির্দেশ করেছেন ।।
গঃ দৈবত – দৈবতে ৬ টি অধ্যায় । এই কান্ডে যাস্কাচার্য বৈদিক দেবতাতত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনা করেছেন , তা ছাড়াও কোনো দেবতার মন্ত্র বেদের কোন ছন্দে রচিত , সেটিও নির্ণয় এবং বিশ্লেষণ করেছেন ।
নিরুক্ত গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিলুপ্ত শব্দের তালিকার উপর ভাষ্য; একটি পৃথক শব্দ-তালিকা রূপে যদি কখনো তার অস্তিত্ব থেকে থাকে, ভাষ্যকৃত শব্দগুলি থেকে এখন তার পুননির্মাণ করা যেতে পারে। এই তালিকাকে নিঘন্টু বলা হত; তাই প্ৰথম অধ্যায় সম্পর্কে নৈঘণ্টক নামটি প্রযুক্ত হয়। মনে হয় যে নিঘণ্ট বলতে মূলত প্রতিশব্দ-বিষয়ক গ্ৰন্থই বোঝােত; পরবর্তীকালে অভিধাের বৃত্তকে প্রসারিত সমার্থক শব্দ ও দেবনামকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার ফলে প্রবলভাবে সীমাবদ্ধ হয়েও যাস্ক নিরুক্তে ব্যুৎপত্তি অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন; তিনি দৃঢ়ভাবে এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে শব্দসমূহের নির্বাচন সম্ভব, তবে এই অভিমতের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভট ব্যুৎপত্তির সন্ধান দিয়েছেন। বহুক্ষেত্রে কোনো মূল ধাতু থেকেই ব্যুৎপত্তি সন্ধানের প্রবণতার ফলে তিনি ভ্ৰান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন; অনুরূপভাবে একটি দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ব্যুৎপত্তি অনুশীলন প্রক্রিয়ার অভাবের ফলে শব্দের বহুমুখী নির্বাচন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এইসব ক্রটিবিচ্যূতি সত্ত্বেও যাস্ক একটি বিস্ময়কর সতর্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ মনের পরিচয় দিতে পেরেছেন; এ ক্ষেত্রে তার অবদানের মূল্য মূলগত নির্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বহুগুণ বর্ধিত হয়েছে যেহেতু তিনি বিরোধী পক্ষের সম্পূর্ণ প্রতিবাদী অভিমতকেও স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করেন নি। যাস্ক বিশ্বাস করেন যেন ব্যুৎপত্তি কখনোই অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়; কারণ নিছক ব্যাকরণের নিয়ম কোনাে শব্দের উৎস নির্ণয়ে সফল না হলেও শব্দার্থ পরিবর্তনগত অনুষঙ্গকে অবলম্বন করে আমরা সেই শব্দের সম্ভাব্য উৎসস্থলে উপনীত হতে পারি। তাই যাস্ক সর্বদা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় প্রক্রিয়াকে শব্দার্থ-পরিবর্তন তত্ত্ব ও শাব্দিক প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।
যাস্ক চার ধরনের পদকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন-নাম (বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম, আখ্যাত (ক্রিয়া), উপসর্গ ও নিপাত (অব্যয়); এ আলোচনায় তিনি আশ্চর্য স্পষ্টতা ও বিজ্ঞানসম্মত ঋজুতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনো কখনো যেন সে-সমস্ত ধ্বনিতাত্ত্বিক নিয়মের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, পাণিনি তার ব্যাকরণে পরবর্তীকালে যেগুলি ব্যবহার করেছিলেন; কখনো বা কোনো ব্যুৎপত্তিতে বহু সম্ভাব্য ধাতুর সম্পর্ক নির্ণয় করে তিনি তার বিষয়বস্তুতে আশ্চর্য অন্তদৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন। তাত্ত্বিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে তিনি বহু ভাষাতাত্ত্বিক প্রবণতাকে উপভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং তৎপ্রসূত ভাষাগত সংমিশ্রণের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেও আমাদের বহু ভাষাতাত্ত্বিক প্রবণতাকে উপভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং তৎপ্রসূত ভাষাগত সংমিশ্রণের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেও আমাদের বিবেচনার জন্য বহু তাৎপর্যপূর্ণ সূত্র রেখে গেছেন। যাস্ক স্পষ্টতই বহু বৈয়াকরণ ও ব্যুৎপত্তিবিদের দীর্ঘািয়ত ঐতিহ্যের পরিণত পর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কিন্তু তার নিজস্ব অবদান এত অসামান্য ছিল যে তা পূর্বসূরীদের কীর্তিকে সম্পূর্ণ স্নান করে দিয়েছিল; নিরুক্তের ভাষার মধ্যে বৈদিক ভাষার বিবর্তনের নিদর্শন স্পষ্ট; তাই যাস্ক বহু বৈদিক শব্দকে ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে পরবর্তী ও অধিকতর প্রচলিত রূপের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।
ব্যুৎপত্তি শাস্ত্রের অন্যতম প্রাচীনতর বিশেষজ্ঞ শাকটায়ন মনে করতেন যে সমস্ত বিশেষণকে ধাতু থেকে নিম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু ব্যুৎপত্তিবিদরূপে মাস্ক অষ্টি, এক ভারসাম্য-বোধের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু এ ধরনের চরম অভিমতকে সমর্থন করেন নি। তাছাড়া কৌৎসের বক্তব্যকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও যে কৌৎস বৈদিক মন্ত্রসমূহককে অর্থহীন বলে ঘোষণা করে মৌলিক প্ৰতিবাদী চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন-তা আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে।
বেদার্থ বুঝতে গেলে নিরুক্তশাস্ত্র জ্ঞান অবর্জনীয়। এই জন্য় যারা আজকালকার সাহেবী চিন্তার দ্বারা বেদ বুঝতে চায় তারা মিষ্টান্ন বর্জন করে বৃদ্বাঙ্গুলী চোষণই মাত্র করে। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ সহস্র সহস্র বৎসর যে মনন নিদিধ্যাসন তপস্যাদি দ্বারা বেদর্থ বুঝেছিলেন ,তাই তাঁরা নিরুক্ত প্রকাশ করে গেছেন। আর দুই চারি বৎসর মাত্র সংকৃও না জেনে একেবারে বেদার্থ বুঝে ফেলতে যারা চেষ্টা করে তাদের সাহস বলিহারী যাই আরো আশচার্য এই যে- সেই আধুনিক দু'চারদিনের বেদ স্রষ্টাকে যারা সমর্থন করে, প্রাচীন ভাষ্যকারদের নস্য়াৎ করে দেন।
নিরুক্তশাস্ত্র না জানলে বেদের অর্থ পরিপূর্ণভাবে জানতে পারা যায় না।এইজন্য বেদার্থ নিশ্চয় নিরুক্তশাস্ত্রের অধীন।
প্রধানত বেদাঙ্গগুলিকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয় – শিক্ষা(নীতিবিদ্যা), ব্যাকরণ (ভাষার পদ বিশ্লেষণ-সংকলন), ছন্দ(পংক্তির পঠনছন্দ বিষয়ক), নিরুক্ত(সূক্তের শব্দার্থ কোষ), জ্যোতিষ(যজ্ঞাদির জ্যোতির্জ্ঞাননির্ভর কাল (সময়) পরিমাপন) ও কল্প (গৃহ্য(গার্হস্থ্য)-শ্রৌত (যজ্ঞের পরশোধণ)-শূল্ব্য (পরিমিতি ও জ্যামিতি)-সূত্রাদি)। কল্পসূত্রগুলি ধর্মবিষয়ক, এদের আবার চার ভাগে ভাগ করা হয় ধর্ম, শ্রৌত, গৃহ্য ও শুল্ব। ভাষা, আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিচার করে পণ্ডিতেরা সূত্রগুলি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দর মধ্যে লেখা হয়েছিল মনে করেন। সূত্র রচয়িতাদের অধিকাংশদের নামের শেষে অয়ন থাকার জন্যে, যেমন বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, অনেকে মনে করেন এঁরা কোনো এক গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন।
বেদাঙ্গসূত্রগুলি আখ্যান, দেবস্তুতি বা দেবকাহিনীর জন্য লেখা হয় নি, তাই তাদের স্মৃতিতে রাখা কঠিনতর ছিল। তাই এতে শব্দসংক্ষেপ করে বাহুল্যবর্জিত এক আঙ্গিক দেখতে পাওয়া যায়, যা প্রায় সাংকেতিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, উপযুক্ত ভাষ্য ব্যতীত যাদের অর্থবোধ দুষ্কর হয়ে পড়ে। ভাষার দিক থেকে এদের প্রাক্পাণিনীয় বলেই ধরা হয়। আশ্ব্লায়ন গৃহ্যসূত্রে ‘ভারত’ ও ‘মহাভারত’-এর উল্লেখ আছে, তাই মনে করা হয়, যে সেই যুগে মহাকাব্যদুটির প্রাচীন এক সংস্করণ প্রচলিত ছিল।
বেদাঙ্গসূত্রগুলি রচনার কাল ছিল ভারতের ইতিহাসেরও এক গভীর পরিবর্তনের সময়। এই যুগে যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মীয় আচার প্রণালীর ওপর যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি বিদেশী পারসিক, গ্রীক, শক, কুষাণ ও কিছু পরে হূণ জাতির সাথে সংযোগ ঘটেছে। তক্ষশীলা, পাটলিপুত্র, কোশাম্বী বা মথুরার মত নগরী তখন রীতিমত বিশ্বজনীন। ভারতে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসার হয়েছে, বিদেশী ভাবধারা, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি আস্তে আস্তে ভারতের মধ্যে মিশে গেছে। এই বিদেশী সংমিশ্রণ ও ভাবধারার আত্মীকরণ ভারতবর্ষের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, গণিত, রসায়ন – এই সমস্ত ক্ষেত্রেও জোরালো প্রভাব ফেলেছিল।
এর সাথে সাথে ছিল দেশীয় তথাকথিত অনার্য জনগোষ্ঠীর সাথে ক্রমাগত মিশ্রণ। এই যুগসন্ধিক্ষণে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতো ধর্মবিশ্বাসগুলি, যাদের অনেকে প্রতিবাদী ধর্ম বলে থাকেন, সেগুলিও প্রচারিত হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম রাজানুকুল্য লাভ করাতে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার যজ্ঞকেন্দ্রিকতা থেকে অনেক সরে এসেছে ও যজ্ঞের প্রাচীন গৌরব অনেক স্তিমিত হয়েছে, (তবে বিলুপ্ত কখনোই হয়ে যায় নি, কারণ আমরা সে যুগের কয়েকজন রাজাকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে দেখি)।
ভাষার ক্ষেত্রেও এক বড়ো পরিবর্তন হয়েছিল। প্রাচীন বৈদিক ভাষা কথ্য ভাষার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, উচ্চারণ, ব্যাকরণ, ব্যুৎপত্তি, সব কিছুই এক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছিল। পতঞ্জলি বৈদিক ভাষাকে ছন্দঃ ও কথ্য ভাষাকে লৌকিক বা ভাষা নাম দিয়েছিলেন। সেই জন্য ভাষা, উচ্চারণ ও ব্যুৎপত্তির জন্য শিক্ষা, ব্যাকরণ, ছন্দ ও নিরুক্ত সূত্র গুলি লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
বেদাঙ্গের শিক্ষা সূত্রগুলিতে মূলত ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনা পাওয়া যায়। সময়ের সাথে বেদমন্ত্র উচ্চারণের নিয়মগুলি শিথিল হয়ে এসেছিল, ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী উচ্চারণের ভেদ এসেছিল। তাই শিক্ষাসূত্র গুলিতে বেদমন্ত্র উচ্চারণের বিশেষ প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বহু শিক্ষাগ্রন্থের নাম পাওয়া গেলেও তার মধ্যে বেশির ভাগই লুপ্ত হয়েছে। যাদের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আছে ‘পাণিনীয়’, ‘সর্বসম্মত’ ও ‘সিদ্ধান্ত’। বিভিন্ন মন্ত্রের উচ্চারণপ্রণালী, গান, সুর-সমেত সংহিতা পাঠ ও বাদ্যযন্ত্রের সাথে অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি এই গ্রন্থগুলির মূল উপজীব্য। ‘পাণিনীয়’ শিক্ষা গ্রন্থে উচ্চারণ, সন্ধিবিচ্ছেদ, সংহিতা পাঠ কৌশল দেওয়া আছে। নামকরণ থেকে বোঝা যায় যে এই গ্রন্থ স্বয়ং পাণিনীর রচনা নয়। ভারদ্বাজ শিক্ষা তৈত্তিরীয় সংহিতার সাথে যুক্ত। এতে আছে সন্ধি, সমাস, আবৃত্তির নিয়ম, স্বরন্যাস, পদ, যতি, ছন্দ ইত্যাদি বিষয়ের চর্চা। এই নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য জানাতে চাই – অথর্ববেদীয় আপিশলী শিক্ষায় বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষরের শ্রেণীবিভাগ, তাদের যথার্থ উচ্চারণ ও ধ্বনি নিয়ে আলোচনা আছে। এই ধরনের আলোচনা এর আগে আর কোথাও নেই।
বেদাঙ্গসূত্রের ব্যাকরণ আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হচ্ছেন পাণিনি। আরো অনেক প্রাচীন বিশেষজ্ঞ থাকলেও, শুধু মাত্র পাণিনির ব্যাকরণটিই এখন পাওয়া যায়। যদিও তাতে ধ্রুপদী বৈদিক ব্যাকরণ সংক্রান্ত একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত অধ্যায় আছে। পাণিনির ব্যাকরণ রচনার সময় সংস্কৃত সাধারণের কথ্য ভাষা ছিল না, সেই স্থান অধিকার করেছিল প্রাকৃতভাষা। সেই কারণে পাণিনিকে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বলে ধরা হয়। পাণিনি সংক্ষেপে, শব্দের বাহুল্য বর্জন করে, বিদ্ববত্তার সাথে ভাষাকে সুসংহত করে বেঁধেছিলেন তাই পাণিনির বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর ব্যাকরণকে পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণ ও প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাকরণ বলেন।
ধর্ম্মতত্ত্ব.comনিরুক্ত
প্রথম অধ্যায়
প্রথম পাদ
প্রথম পরিচ্ছেদ
সমান্বায়ঃ সমাম্নাত॥ নি০ ১।১।১।১॥
স ব্যাখ্যাতব্য॥ নি০ ১।১।১।২॥
তমিমং সমান্নায়ং নিঘন্টব ইত্যাচক্ষতে॥ ১।১।১।৩॥
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ