বেদাঙ্গ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 July, 2021

বেদাঙ্গ

‘বেদ’ বা ‘শ্রুতি’ বলতে ‘সংহিতা’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’ বোঝায়। কিন্তু এই বেদ-পাঠের সহায়ক হিসেবে আরও কয়েক-রকম রচনা সৃষ্টি হয়েছিলো। সামগ্রিকভাবে সেগুলিকে বলা হয় ‘বেদাঙ্গ’। এদের প্রয়োজন ব্যবহারিক। বেদ-পাঠ ও যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সাহায্য করতো বলে এদের নাম বেদের-অঙ্গ বা বেদাঙ্গ। মূলত পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীদের জন্য বেদাঙ্গ সাহিত্য রচিত হয়েছিলো।

বেদাঙ্গ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাওয়া যাবে বেদ+অঙ্গ, অঙ্গ মানে যেহেতু অংশ বা পার্ট, সেহেতু বেদাঙ্গ মানে মনে হতে পারে বেদের অঙ্গ বা অংশ আসলে ব্যাপারটি সেরকম নয়, বেদাঙ্গ বলতে আসলে বেদের অঙ্গ বা অংশকে বোঝায় না, এগুলোর দ্বারা এমন কিছু বোঝায়, যা বেদ পড়ে বুঝতে সহায়ক। এককথায় বেদ পড়ে বুঝতে এবং বেদের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে বেদাঙ্গ আবশ্যক ছয় ধরনের বিষয়বস্তুতে বিভক্ত ছিলো এই বেদাঙ্গ সাহিত্য। যেমন– শিক্ষা, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ ও কল্প।
শিক্ষা অর্থাৎ- উচ্চারণ করিবার প্রণালী
কল্প অর্থাৎ- যজ্ঞ করিবার প্রণালী
ব্যাকরণ অর্থাৎ-শব্দের উৎপত্তি
নিরুক্ত অর্থাৎ- শব্দের অর্থ
ছন্দঃ অর্থাৎ- অক্ষরে সংখ্যা অনুসারে বেদবাক্য সজ্জিত করা
জ্যোতিষ অর্থাৎ- নক্ষত্রদের সংস্থান
বেদাঙ্গ ছ’টিঃ
শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দসাং চয়ঃ।
জ্যোতিষাময়নং চৈব ষড়ঙ্গো বেদ উচ্যতে।।-[মুন্ডকোপনিষদ ১।১।৫]
বিশাল বেদপুরুষের পাদস্বরূপ ছন্দ, হস্তস্বরূপ কল্প, জ্যোতিষ নেত্রস্বরূপ, নিরুক্ত কর্ণ, ঘ্রাণেন্দ্রিয় হচ্ছে শিক্ষা এবং ব্যাকরণ হল মুখস্বরূপ। অঙ্গ ছাড়া যেমন অঙ্গী অসম্ভব, তেমনি বেদাঙ্গ ছাড়া বেদও অকল্পনীয়।
(১) শিক্ষা (নীতিবিদ্যা)।
‘শিক্ষা’ হলো প্রথম বেদাঙ্গ। এ-জাতীয় সাহিত্যের আলোচ্য বিষয় হলো নির্ভুলভাবে বৈদিক শব্দ উচ্চারণের পদ্ধতি। সেকালে বেদ-অধ্যয়ন নিত্য কর্তব্য ছিলো। যজ্ঞেও বেদ পাঠের প্রয়োজন হতো। দৈনিক পাঠকে স্বাধ্যায় বলা হতো। শিক্ষা-গুরু বেদের শব্দরাশির নির্ভুল উচ্চারণ শিক্ষা দিতেন। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য তা গ্রহণ করতো। বেদের সংহিতা অংশই প্রধানত শিক্ষার আলোচনার বিষয়।

সংহিতা দুভাবে পাঠ করা হতো। তার পাঠকে পদপাঠ বলা হতো। এই দু’রকম পদপাঠ হলো– অব্যাকৃত পদপাঠ এবং ব্যাকৃত পদপাঠ। সংহিতায় পরস্পর সন্নিবদ্ধ অবস্থায় পদগুলি যেভাবে আছে তেমনভাবে রেখে পাঠ করাকে বলা হয় অব্যাকৃত পদপাঠ। আর ব্যাকৃত পদপাঠে প্রতি পদকে সন্নিবদ্ধ রূপ হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে পৃথকভাবে উচ্চারণ করা হয়। স্বভাবতই বেদের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে এই জাতীয় উচ্চারণ-পদ্ধতির আলোচনা সংযুক্ত ছিলো। সংহিতা পাঠের সঙ্গে পদপাঠের সম্পর্ক নির্দেশ করতে প্রাতিশাখ্য গ্রন্থের উদ্ভব হয়। তাই প্রাচীনতম ‘শিক্ষা’-গ্রন্থের নাম ‘প্রাতিশাখ্য’।
বেদাঙ্গ

প্রত্যেক বেদের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাতিশাখ্য সূত্র আছে। ঋগ্বেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ হলো ‘ঋগ্বেদ-প্রাতিশাখ্য’ বা ‘শাকল-প্রাতিশাখ্য’। সামবেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ অনেকগুলি, যেমন– ‘সাম-প্রাতিশাখ্য’, ‘পুষ্পসূত্র’, ‘পঞ্চবিধান-সূত্র’ ও ‘ঋকতন্দ্র ব্যাকরণ’। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের ‘তৈত্তিরীয়-প্রাতিশাখ্য-সূত্র’ এবং শুক্ল-যজুর্বেদের ‘বাজসনেয়-প্রাতিশাখ্য-সূত্র’। অথর্ববেদের দুটি প্রাতিশাখ্য সূত্র– ‘অথর্ববেদ-প্রাতিশাখ্য-সূত্র’ ও ‘শৌনকীয়-চতুরধ্যায়িকা’।

প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলি ছাড়াও ছন্দে রচিত কিছু শিক্ষাগ্রন্থ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে প্রধান হলো ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের পাণিনীয় শিক্ষা, সামবেদের নারদীয় শিক্ষা, কৃষ্ণ-যজুর্বেদের ব্যাস শিক্ষা, শুক্ল-যজুর্বেদের যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা এবং অথর্ববেদের মাণ্ডুক্য শিক্ষা।

(২) ব্যাকরণ (ভাষার পদ বিশ্লেষণ-সংকলন)।
দ্বিতীয় বেদাঙ্গ হচ্ছে ‘ব্যাকরণ’। ব্যাকরণের সঙ্গে শিক্ষার খানিকটা যোগ আছে। সংহিতার অব্যাকৃত পাঠকে সন্ধিবিচ্ছেদ করে ব্যাকৃতরূপে অর্থাৎ পদপাঠে পরিণত করতে সন্ধি বা সংশ্লিষ্ট নিয়মগুলি জানা দরকার। সেগুলি ব্যাকরণের বিষয়। তাছাড়াও বেদপাঠে বা যজ্ঞে তার আরও প্রয়োগ আছে। মন্ত্রকে যজ্ঞে প্রয়োগ করবার সময় কোনও কোনও ক্ষেত্রে পদের লিঙ্গ বিভক্তি প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। ব্যাকরণ না জানলে পদের অর্থগ্রহণ করা সহজ হয় না, ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখাও প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে ব্যাকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

তবে প্রকৃত বেদাঙ্গ বলতে যে প্রাচীন ব্যাকরণ তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। ভারতীয় সাহিত্যে প্রাচীনতম ব্যাকরণ-গ্রন্থ বলতে যা পাওয়া যায় তা হলো পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ বা ‘পাণিনি-সূত্র’। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু পাণিনির ব্যাকরণকে বেদাঙ্গ বলা যায় না, কেননা বৈদিক ভাষা উপলক্ষ্য করেই এবং বেদ পাঠের সহায়ক হিসেবেই এ-ব্যাকরণ রচিত হয়নি। বস্তুত পাণিনির প্রধানতম আলোচ্য বিষয় হলো বেদ-পরবর্তী সংস্কৃত ভাষাই। এখানে স্মর্তব্য যে, বেদের ভাষা এই সংস্কৃতের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

(৩) ছন্দ (পংক্তির পঠনছন্দ বিষয়ক)।
‘ছন্দ’ হলো তৃতীয় বেদাঙ্গ। এটি স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। ঋক্-সংহিতার এবং সাম-সংহিতার সব মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। অবশ্য সাম-সংহিতার মন্ত্র গাওয়া হতো। অথর্ব সংহিতারও বেশিরভাগ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। প্রধানত সামবেদের ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘উপনিষদে’ই বৈদিক ছন্দ সংক্রান্ত নানা আলোচনা পাওয়া যায়। আরও পরবর্তী কালে বেদাঙ্গ হিসেবে বৈদিক ছন্দ সংক্রান্ত আরও নানা আলোচনা-গ্রন্থ রচিত হয়েছিলো।
সকল প্রাতিশাখ্যের শেষে, সামবেদের নিদানসূত্রে, শাংখ্যায়ন শ্রৌতসূত্রে এবং বিভিন্ন অনুক্রমণিকাতে ছন্দ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। পিঙ্গলের ‘ছন্দঃসূত্র’কেই বেদাঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এটিকে বিশুদ্ধভাবে বেদাঙ্গ গণ্য করা যায় না। তার প্রথম চার অধ্যায়ে বৈদিক ছন্দের আলোচনা আছে। তারপর অতিরিক্তভাবে লৌকিক ছন্দেরও বিবরণ রয়েছে। অনুমান হয় এ-জাতীয় আরও কয়েকটি ছন্দ-আলোচনা বিলুপ্ত হয়েছে। ছন্দ জ্ঞানের অভাবে বেদ পাঠ সম্পূর্ণ হয় না, বেদের রস উপলব্ধি হয় না এবং উচ্চারিত শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারিত না হওয়ায় তা হৃদয়াঙ্গম হয় না; এজন্য বেদ পাঠ করতে গেলে ছন্দজ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। গায়ত্রী, উষ্ণীক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী- এই সাতটি হলো বৈদিক ছন্দ, এই সাত ছন্দের মাধ্যমেই বৈদিক মন্ত্রগুলো লিখিত হয়েছে; তাই বেদের মন্ত্রগুলো সঠিক উচ্চারণে পাঠ ক'রে তা শ্রুতিমধুর করতে এবং হৃদয়াঙ্গম করতে ছন্দজ্ঞান খাকা অত্যাবশ্যক, এই বিষয়টিই হলো বেদাঙ্গের ছন্দ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে- বেদ ই পৃথিবীকে প্রথম ছন্দের শিক্ষা দিয়েছে এবং বেদের উপর্যুক্ত সাতটি ছন্দ থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ছন্দের উৎপত্তি হয়েছে।
ছন্দ শব্দটি তে লোক এটি বোঝে যে বেদে যে সব মন্ত্র আছে, উহার কোনো বাক্যকে ছন্দ বলা হয়। যেমন গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ আদি এ সবই ছন্দ । এ কথা নিশ্চিত সত্য । কিন্তু বেশির ভাগ লোকই জানেনা যে ছন্দ কেই বেদ বলা হয়। বেদই ছন্দ রূপ। বেদে আসা শব্দের সমূহ কেই ছন্দ বলা হয় অর্থাৎ বেদ হচ্ছে ছন্দ রূপ। বেদে অনেক ছন্দ আছে। সরল শব্দে যদি বলা হয় তো বেদের কোনো মন্ত্রে যতো শব্দ আছে, তার মধ্যে কিছু নির্ধারিত শব্দের সমূহকেই ছন্দ বলা হয় অর্থাৎ এক মন্ত্রে একের অধিক অথবা বহু ছন্দ হতে পারে।
(ক) ছন্দের বেদ হওয়ার প্রমাণ
বেদঃ বেদাংশ্ ছন্দাংসি ।।( গোপথ ব্রাহ্মণ ১|৩২)
অর্থাৎ ছন্দ কেই বেদ বলা হয়।
ছন্দ কেবল মন্ত্র অথবা শব্দকেই নয়। ছন্দ একটি পদার্থ অর্থাৎ বেদ মন্ত্রে যতোগুলি ছন্দ আছে, উহা সকল ছন্দ কে পদার্থ বলা হয়।
(খ) ছন্দের পদার্থ হওয়ার প্রমাণ :-
মহর্ষি পিঙ্গল রচিত ছন্দ শাস্ত্র যাকে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী আপ্ত পাঠ বিধির অন্তর্গত এটিকে সম্মিলিত করেছে ও ছন্দ শাস্ত্র , যাকে এক বেদাঙ্গ মানা হয় । মহর্ষি পিঙ্গল ছন্দ শাস্ত্রের তৃতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন ছন্দ কে বিভিন্ন রঙ( Colour) বলেছেন ।
"সিতসারঙ্গপিশঙ্গকৃষ্ণনীললোহিতগৌরা বর্ণা:" ( পিঙ্গলছন্দ সূত্রম্ ৩|৬৫)
অর্থাৎ গায়ত্রী ছন্দের রঙ - শ্বেত ( সিত)
উষ্ণিক ছন্দের রঙ- রঙিন, রঙ- বিরঙ( সারঙ্গ )
অনুষ্টুপ ছন্দের রঙ- লাল মিশ্রিত বাদামি ( পিশাঙ্গ)
বৃহতী ছন্দের রঙ - কালো (কৃষ্ণ)
পংক্তি ছন্দের রঙ- নীল ( নীলা)
ত্রিষ্টুপ ছন্দের রঙ- লাল ( লোহিত)
জগতি ছন্দের রঙ- গৌর( গৌরা)
যদি ছন্দ কেবল শব্দ রূপ হয় তো উহায় প্রকাশ কোথা থেকে আসবে? এটি দ্বারা কি প্রমাণিত হয়? এটির দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে ছন্দ কে "পদার্থ" বলে। যদি তা না হয় তবে সেখান থেকে আলাদা রঙ(প্রকাশ) আসতে পারে না।
এবার পদার্থ বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ লোক এটি কদাপি বুঝতে পারে না যে ছন্দে রঙ বা বিভিন্ন প্রকাশ হওয়ার জন্যই ছন্দ পদার্থ হওয়ার প্রমাণ যা মহর্ষি পিঙ্গল দ্বারা রচিত ছন্দ শাস্ত্রের দ্বারা সিদ্ধ হইল ।
ছন্দ বিষয়ে অন্যান্য ঋষি গণের প্রমাণ:-
১| ছন্দাংসি অচ্ছাদনাত্ ( নিরুক্ত ৭|১২)
অর্থাৎ ছন্দ কোনো কন কে, কোনো পদার্থ কে, কোনো কিরন কে লোক- লোকান্তরে আচ্ছাদিত করে , এজন্য ছন্দ কে পদার্থ বলা হয়।
২| ছন্দ উহা যা সবাইকে আচ্ছদন করে । ( দৈবত ব্রাহ্মণ ৩|১৯)
এবার ,
প্রাণা কম্পনাত্ ( ব্রহ্ম সূত্র ১|৩|৩৯)
অর্থাৎ কম্পন করবার জন্য প্রাণ বলা হয়।
প্রাণা রশ্ম্যঃ ( তৈতরীয় ব্রাহ্মণ ৩|২|৫|২)
অর্থাৎ রশ্মি কে প্রাণ বলা হয়।
প্রাণ বৈ ছন্দাংসি ( কৌশিক ব্রাহ্মণে ১৭|২)
অর্থাৎ ছন্দ প্রাণ রশ্মি রূপে হয় , তাই তাকে প্রাণ রশ্মি বলা হয় । ( যেমন উপরে রেফারেন্স দেখানো হয়েছে প্রাণ কে রশ্মি হওয়ার )

বেদ মন্ত্র ছন্দে রচিত কারণ ছন্দ ছাড়া পদ্যের অস্তিত্ব নেই ।। বৈদিক মন্ত্রের এক এক পাদে পরিমিত অক্ষর সন্নিবেশ থেকে ছন্দের উৎপত্তি । বেদের সাতটি ছন্দ । যথা – গায়ত্রী (২৪ অক্ষর) , উষ্ণিক (২৮ অক্ষর) , অনুষ্টুপ (৩২ অক্ষর) , বৃহতী (৩৬ অক্ষর) , পঙ্ক্তি (৪০ অক্ষর) , ত্রিষ্টুপ (৪৪ অক্ষর) , জগতী (৪৮ অক্ষর) ।। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, প্রাতিশাখ্যের শেষে , সামবেদের নিদান সূত্রে , সাংখ্যায়ন শ্রৌতসূত্রে , বিভিন্ন অনুক্রণিকাতে ছন্দের উল্লেখ আছে ।। ছন্দসূত্রের রচয়িতা হলেন পিঙ্গল মুনি ।। ৬. জ্যোতিষ ➮ ইহাতে ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমানের জ্ঞান রয়েছে, ইহাতে অঙ্ক, বীজ, রেখা গণিত বিদ্যা সত্য এবং ফলবিদ্যা মিথ্যা। এই গ্ৰন্থ বসিষ্ঠমুনি আদি কৃত জ্যোতিষ, সূর্যসিদ্ধান্ত আদি আছে.বৈদিক যজ্ঞের প্রয়োজনে তিথি নক্ষত্রের সেই বিশেষ অবস্থান বিচার যে শাস্ত্রে বর্ণিত তাকে “জ্যোতিষ” বলে । অহোরাত্র পক্ষ, মাস , ঋতু , অয়ন , সংবৎসর , গণনা এবং রাশি-নক্ষত্র , অমাবস্যা , পূর্ণিমা, সংক্রান্তি প্রভৃতির বিস্তারিত আলোচনা জ্যোতিষ এর বিষয় ।। লগধের বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, পরবর্তীতে গর্গ্য মুনির গ্রন্থ গুলি এই জ্যোতিষ এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

(৪) নিরুক্ত (সূক্তের শব্দার্থ কোষ)।
বেদে ব্যবহৃত শব্দাবলীর উৎপত্তি, অর্থ এবং অর্থান্তর প্রভৃতির আলোচনা-গ্রন্থ হলো চতুর্থ বেদাঙ্গ ‘নিরুক্ত’। নিরুক্তের সঙ্গে নিঘণ্টুর ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। প্রাচীনতম বৈদিক শব্দকোষ হিসেবে যে-গ্রন্থটি পাওয়া গেছে তার নাম ‘নিঘণ্টু’। নিঘণ্টুর মতো তখন আরও অনেক বৈদিক শব্দ-সংগ্রহ ছিলো, সেগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। যাস্ক এই ‘নিঘণ্টু’র ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তারই নাম ‘নিরুক্ত’। ‘নিঘণ্টু’তে তালিকাবদ্ধ শব্দগুলি কোন্ ঋকে ঠিক কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ‘নিরুক্তে’ তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৫০০ অব্দের মধ্যে যাস্কের কাল-নির্ণয় করা হয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যায়, ওই সুপ্রাচীন যুগেই ঋগ্বেদের প্রকৃত অর্থ নিয়ে নানা রকম মতভেদ দেখা দিয়েছিলো; কেননা যাস্ক এ-জাতীয় নানা মতভেদের উল্লেখ করেছেন। স্বভাবতই ‘নিঘণ্টু’র রচনাকাল ‘নিরুক্ত’র চেয়ে আরও অনেক পুরনো।

‘নিঘণ্টু’তে তিনটি কাণ্ডে পাঁচটি অধ্যায় আছে। প্রথম তিনটি অধ্যায় নিয়ে ‘নৈঘণ্টুক কাণ্ড’। তাতে একার্থবাচক শব্দের সংগ্রহ তাছে। চতুর্থ অধ্যায় হলো ‘ঐকপদিক’ বা ‘নৈগস কাণ্ড’। তাতে একটি অর্থ সূচিত করে এমন শব্দের সংগ্রহ আছে। পঞ্চম অধ্যায় ‘দৈবত কাণ্ড’। তাতে বেদের দেবতাদের নামের সংগ্রহ আছে।
‘নিরুক্তে’র দুটি ষট্-কে বারোটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম ষট্-কে নিরুক্তের প্রথম দুটি কাণ্ডের ব্যাখ্যা আছে। দ্বিতীয় ষট্-কে দৈবত কাণ্ডের ব্যাখ্যা রয়েছে। 

‘নিরুক্ত’র ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ভেঙে বলা। এই অর্থে তা ব্যাকরণের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দগুলিকে ভেঙে পৃথক করে দেয়। নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সম্বন্ধ শব্দের সাথে, নিরুক্তের সম্বন্ধ অর্থের সাথে। পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করা সহজ হয়। সুতরাং ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক।

(৫) জ্যোতিষ (যজ্ঞাদির জ্যোতির্জ্ঞাননির্ভর কাল (সময়) পরিমাপন)।
পঞ্চম বেদাঙ্গ হলো ‘জ্যোতিষ’। বিভিন্ন তিথি-নক্ষত্রে বিভিন্ন বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদনের ব্যবস্থা ছিলো। যিনি যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা তাঁকে ঋত্বিক বলে। যজ্ঞের কাল নিরূপিত হতো দিনের বেলায় শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণকে লক্ষ্য করে। এই প্রসঙ্গে অহোরাত্র, পক্ষ, মাস, ঋতু, অয়ন, সংবৎসর গণনা করা ঋত্বিকের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়তো। স্বভাবতই এজন্যে বেদাঙ্গ হিসেবে জ্যোতিষ-শাস্ত্রের উদ্ভব হয়।
লগধের ‘বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ’ নামে একটি প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া যায়। গ্রন্থটি ছোট এবং এখনও অনেকাংশ দুর্বোধ্য বলে জানা যায়। যাজুষ এবং আর্চভেদে তার দুটি শাখা আছে।

(৬) কল্প (গৃহ্য(গার্হস্থ্য)-শ্রৌত (যজ্ঞের পরশোধণ)-শূল্ব্য (পরিমিতি ও জ্যামিতি)-সূত্রাদি)।
ষষ্ঠ বেদাঙ্গ হলো ‘কল্প’। কল্পগুলি সূত্র আকারে গ্রথিত। এ-জাতীয় সাহিত্যের আলোচ্য বিষয় হলো নির্ভুলভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকাণ্ড অনুষ্ঠানের পদ্ধতি। অবশ্যই ‘ব্রাহ্মণ’-গ্রন্থগুলিতে এই আলোচনাই বিস্তৃতভাবে করা হয়েছিলো; কিন্তু পরবর্তী কালের পুরোহিতদের পক্ষে এই সুবিশাল ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্যের সমস্ত আলোচনা মুখস্থ রাখা নিশ্চয়ই সহজ হয়নি। তাই সংক্ষিপ্ত সূত্রাকারে যজ্ঞানুষ্ঠানমূলক আলোচনা মনে রাখবার সুবিধার জন্য ‘কল্প-সূত্র’ রচিত হয়েছিলো। তাতে যেমন যজ্ঞের প্রয়োগবিধি বর্ণিত হয়েছে, তেমনি গার্হস্থ্য জীবনের সংস্কার প্রভৃতির আলোচনাও রয়েছে। যেহেতু বৈদিক যাগযজ্ঞ বলতে নানা রকম এবং সে-বিষয়ে আলোচনাও নানা ধরনের, তাই ‘কল্প-সূত্র’ও এক-রকমের নয়। ‘কল্প-সূত্রে’র চারটি শ্রেণী রয়েছে, যেমন– (ক) শ্রৌতসূত্র, (খ) গৃহ্যসূত্র, (গ) ধর্মসূত্র ও (ঘ) শূল্বসূত্র।
সূত্রসাহিত্যের ছটি শ্রেণীর মধ্যে কল্পসূত্রগুলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কল্পসূত্রগুলি আবার চারভাগে বিন্যস্ত : শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শুল্ব। এদের মধ্যে বেদের সঙ্গে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত হল শৌতি সূত্র–প্রধান, বিশেষত সামূহিকভাবে পালনীয়, যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির বিভিন্ন অনুপুঙ্খ এতে বিবৃত হয়েছে। শ্রৌতসূত্রে আলোচিত অনুষ্ঠানগুলি মুখ্যত তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায় : (ক) নিত্য অর্থাৎ আবশ্যিক অনুষ্ঠান–প্ৰত্যহিক ও সাময়িক; যেমন : অগ্নিহোত্র ও দর্শপুর্ণমাস। আর্য পুরুষকে সমগ্র জীবনব্যাপী এই অনুষ্ঠানগুলি পালন করতে হত। (খ) নৈমত্তিক অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ সময়ে পালনীয় অনুষ্ঠান যেমন রাজসূয়, বাজপেয় এবং (গ) কাম্য অর্থাৎ পুত্র, গোধন, বৃষ্টিপাত, বিজয়লাভ প্রভৃতি বিশেষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অনুষ্ঠান। যজ্ঞের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় মনে হয় যে শ্রৌতসূত্রগুলি বিভিন্ন পুরোহিত পরিবারেই উদ্ভূত হয়েছিল এবং সম্ভবত এগুলি প্রাচীনতম সূত্ৰ-সাহিত্যের নিদর্শন। প্রতি বেদে, এমন কি তার প্রতি শাখায় যজ্ঞসম্পাদক পুরোহিতদের নিজস্ব শৌতিসূত্র ছিল। ঋগ্বেদের দুটি শ্রৌতসূত্র ছিল : আশ্বলায়ন ও শাখায়ন। অধিকাংশ শ্রৌতসূত্রের অধ্যায়গুলি ‘প্রশ্ন’ নামে অভিহিত; তাই অনুমান করা যায় যে, এই গ্রন্থগুলি যজ্ঞের যথার্থ পালন-বিধি সংক্রান্ত শিক্ষানবীশ পুরোহিতের প্রশ্ন ও শিক্ষকের উত্তর প্রত্যুত্তর প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। অবশ্য এই দ্বান্দ্ৰিক আঙ্গিক প্রচলিত পাঠে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেননা সম্ভাব্য প্ৰশ্নসমূহ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে; তবে উৎসগত বিচারে প্রাগুক্ত আঙ্গিক ও অব্যবহিত পূর্ববর্তী উপনিষদ সাহিত্যের সঙ্গে শ্রৌতসূত্রের নিবিড় সাদৃশ্য রয়েছে।

আশ্বালায়ন শ্রৌতসূত্রে বারোটি অধ্যায় আছে। বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রে নামকরণ শিক্ষকের নামে হয়েছিল, কিন্তু আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের ক্ষেত্রে ছাত্রের নামই রয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রকৃত রচয়িতা যদিও শৌনক, তিনি তার শিষ্য আশ্বলায়নের নামে রচনাটিকে পরিচিত হতে অনুমতি দিয়েছিলেন, হয়ত আশ্বলায়ন কিছু পরিমার্জন করেছিলেন। অশ্বমেধ, প্রবর্গ ও রাজসূয় ব্যতীত প্ৰায় সমস্ত প্রাচীনতর ও প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠান এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে; তাছাড়া এতে হােতা, মৈত্রাবরণ, আচ্ছাবাক ও গ্রাবষ্টুতের মতো ঋগ্বেদীয় পুরোহিত, এবং অথর্ববেদীয় পুরোহিত ব্ৰহ্মা ও যজমানের কর্মপদ্ধতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী বিবৃত পয়েছে। অন্যান্য অর্বাচীন শ্রৌতসূত্রের মতো আশ্বালায়নে মন্ত্রবিশ্লেষণের সাধারণ নিয়মাবলী সংক্রান্ত পৃথক ‘পরিভাষা’ অধ্যায় নেই; এ ধরনের নিয়ম গ্রন্থের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে এবং প্রসঙ্গ অনুযায়ী এদের আবির্ভাব ঘটেছে। নিয়মগুলি জটিল, তাই রচনাও দুরূহ।

শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র আশ্বলায়ন অপেক্ষা প্রাচীনতর এবং ঋথেদের বাষ্কল শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু আশ্বলায়ন শাকল ও বাষ্কল–এই উভয় শাখার সঙ্গে সম্পর্কিত; শঙ্খ পরিবারভুক্ত সুযজ্ঞ আলোচ্য গ্রন্থের রচয়িতা। সতেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্রে সবগুলি নিবিদ বিবৃত হয়েছে (৮ : ১৬-২৩)। শেষ দুটি অধ্যায়ে আলোচিত মহাব্ৰত অনুষ্ঠানটি পরবর্তীকালে সংযোজিত; একই শাখার আরণ্যকে বিন্যস্ত অনুরূপ অধ্যায়টির নিবিড় অনুসরণ এখানে স্পষ্ট। শাখায়নের অবশ্য একটি পৃথক পরিভাষা অধ্যায় আছে। আশ্বলায়নের তুলনায় এই গ্রন্থে অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক যজ্ঞ আলোচিত হলেও এর তালিকায় কয়েকটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়েছেযা থেকে আমরা প্রাচীন যজ্ঞের কিছু কিছু নুতন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হই। পুরুষমেধ সম্পর্কে এই গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ ও বিবিধ-অনুপুঙ্খাযুক্ত অংশ রয়েছে; তবে স্পষ্ট বোঝা যায়, বহু পূর্বেই অনুষ্ঠানটি অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ব্রাহ্মণসাহিত্যের সঙ্গে এর প্রবল সাদৃশ্য স্পষ্ট, এতেও গ্রন্থটির অধিকতর প্রাচীনতা প্ৰমাণিত হয়।


তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু শ্রৌতসূত্রে সন্ধান পাওয়া যায়; পুরোহিতের কার্যকলাপের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বিধিগ্রন্থের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশেষভাবে, বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভূত বিভিন্ন শাখার আনুষ্ঠানিক কর্মপদ্ধতি পরস্পর ভিন্ন হতে বাধ্য। তৈত্তিরীয় শাখার শ্রৌতসূত্রগুলির সময়ানুক্রমিক তালিকা এভাবে দেওয়া যায় : বৌধায়ন ও বাধুল; তারপর ভরদ্বাজ, আপস্তম্ব, সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী এবং শেষে বৈখান্‌স।

আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র ত্রিশটি প্রশ্ন বা অধ্যায়ে বিন্যস্ত একটি প্রাচীন গ্রন্থ। এতে প্রায় সমস্ত প্ৰধান যজ্ঞানুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে; এগুলির মধ্যে সৌত্রামণী, বাজপেয়, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও সর্বমেধের মতো নবীনতর অনুষ্ঠানও আছে। পিতৃপুরুষের তালিকা-সহ একটি পৃথক পরিভাষা অংশ, মন্ত্রসংগ্রহ এবং হােতৃশ্রেণীর পুরোহিতের কর্মপদ্ধতি এখানে বিবৃত হয়েছে। এই গ্রন্থটি নিকক শ্রৌতসূত্র থেকে অনেকাংশে পৃথক, অন্য শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় এটি পূর্ণতর এবং প্রকৃতপক্ষে একটি সম্পূর্ণ কল্পসূত্র; কারণ এর একটি করে গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্বসূত্র আছে। তৈত্তিরীয় শাখার ভরদ্বাজ শ্রৌতসূত্রের সঙ্গে আলোচ্য আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্রের প্রভূত সাদৃশ্য সুস্পষ্ট। এটা আরো কৌতুহলপ্ৰদ, কারণ অন্য সহযোগী রচনা থেকে ঋণ গ্রহণে এর কুষ্ঠা নেই।


ত্রিশটি প্রশ্নে বিন্যস্ত বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র সম্ভবত প্ৰাচীনতম; বাধূল সম্ভবত একই যুগ কিংবা সামান্য পরবর্তীকালের রচনা। বৌধায়নে আলোচিত বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে প্ৰধান যজ্ঞগুলি, এবং প্রবর্গ্য ও অশ্বমেধ এবং কয়েকটি অপরিচিত বিষয়। স্পষ্টতই এটি এমন যুগে রচিত যখন শ্রৌতবিষয়ক মুখ্য রচনাংশেই এমন সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল যা পরবর্তী পর্যায়ে পৃথক সহায়ক রচনাসমূহে স্থান পেয়েছিল। তাই এতে কর্মান্ত অনুষ্ঠান, প্ৰায়শ্চিত্ত ও প্রবর-তালিকা সম্বলিত বিভিন্ন অংশ এবং শুল্বসূত্রের উপযোগী একটি অংশ পাওয়া যায়। রচনা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রচলিত গ্রন্থটি একাধিক লেখকের রচনা; বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির রচনারীতির নিদর্শন রয়েছে। এই প্ৰাচীন গ্রন্থে অনেক প্রাচীনতর বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে শ্রৌতসূত্রগুলি রচনার পশ্চাতে সুদীর্ঘ একটি ইতিহাস রয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতার উল্লেখ থাকায় মনে হয় সূত্র রচিত হওয়ার পূর্বেই এই সংহিতা তার প্রচলিত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অবশ্য কাঠক সংহিতার সঙ্গেই এই সূত্রের সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ট। লিপিগত সাক্ষ্য থেকে মনে হয় বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র দক্ষিণাঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল। সম্ভবত দক্ষিণাঞ্চলের পাণ্ডুলিপি রাণায়নীয় ও উত্তরাঞ্চলের পাণ্ডুলিপি কৌথুম শাখার পাঠ আমাদের কাছে পৌঁছেছে।

তৈত্তিরীয় শাখার দীর্ঘতম শ্রৌতসূত্র হল সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী রচিত গ্রন্থ। উনচল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বহু সূত্র উভয়ের মধ্যে সাধারণ। বিষয়বস্তুর তালিকাটি দীর্ঘ এবং একটি পৃথক পরিভাষা অংশ এর প্রথম অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। অর্বাচীনতর যজ্ঞসমূহের মধ্যে প্রবর্গ্য, বাজপেয়, রাজসূয়, সৌত্রামণী, অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ, মহাব্রত ও গবাময়ন এতে আলোচিত হয়েছে। সৌত্রিমণীর দুটি রূপভেদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই–চারক ও কোকিলী। ‘সব’ যজ্ঞের নিয়মাবলী এতে বিবৃত; তাছাড়া ভরদ্বাজ প্রণীত পিতৃমেন্ধের বিশেষ রূপভেদও এতে রয়েছে। গৃহ, শুল্ব ও ধর্ম সূত্রের অন্তর্ভুক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে আলোচ্য গ্রন্থটি ব্যাপক সূত্র ঐতিহ্যের অন্তৰ্গত।


পনেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বাধূল শ্রৌতসূত্র সূত্রসাহিত্যের প্রাচীনতম পর্যায়ের অন্যতম, সম্ভবত তা বৌধায়নের সমকালীন। অধ্যাপক কাশীকারের মতে গ্রন্থটি হয়তো তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সম্পূক্ত ছিল না, এর সঙ্গে বিশেষ সাদৃশ্যযুক্ত অন্য কোনো পাঠভেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। পরিভাষা বিষয়ক কোনো পৃথক অধ্যায়। এতে নেই; তবে প্রধান যজ্ঞগুলির বিবরণ ছাড়াও এতে ‘ব্রাহ্মণ’ নামক কয়েকটি অংশও রয়েছে (তুলনীয় পশুবন্ধ বা অগ্নিচয়ন ব্ৰাহ্মণ)-এতে একই সঙ্গে রচনাটির প্রাচীনত্ব এবং ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের সঙ্গে কালগত সান্নিধ্য প্রমাণিত হচ্ছে। তাই একে আমরা সূত্রব্রাহ্মণের যুগলবন্ধ রােপ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। এই গ্রহে বাধুলের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত; পণ্ডিতরা মনে করেন যে এটা প্রকৃতপক্ষে গোষ্ঠীনাম-যা যাস্ক ও ভৃগুদের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে বন্ধ ছিল। এই শ্রৌতসূত্রের লেখক। আপস্তম্বের প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে আবির্ভূত হয়ে অগ্নিবেশ্যকে শিক্ষা দান করেছিলেন-অগ্নিবেশ্যের গৃহ্যসূত্র আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে। বাধূল শ্রৌতসূত্রের প্রাচীনতা নানাভাবে প্রমাণ করা যায়; যেমন : রচনার মিশ্র সূত্ৰ-ব্ৰাহ্মণ চরিত্র, বহু গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তি, মন্ত্রের ব্যাপক সংগ্রহ এবং কোনো কিছুকে বিনা প্রশ্নে গ্ৰহণ না-করার মনোভাব–ঐতিহ্যগত নির্দেশগুলিকে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ না করে এটি প্রতিটি অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছে।

বৈখানস শ্রৌতসূত্র ‘ঔখীয়সূত্র’ নামেও পরিচিত; একুশটি প্রশ্নে বিন্যস্ত এই রচনাটি তৈত্তিরীয় শাখার অপর প্রধান সূত্র। কোনো কোনো পাণ্ডুলিপিতে গৃহ্যসূত্র শ্রৌতসূত্রকে অনুসরণ করেছে; ঐ গৃহসূত্রে এগারটি প্রশ্ন রয়েছে। একটি পরিভাষা অধ্যায় ছাড়াও তাতে বহু প্ৰধান যজ্ঞানুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে; তবে অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ বা রাজসূয়ের মতাে অর্বাচীন যজ্ঞসমূহ আলোচিত হয় নি। সোমব্যাগগুলির উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। ইষ্টি ও সোমের সঙ্গে সম্পর্কিত প্ৰায়শ্চিত্ত বিষয়ক দুটি অংশে এতে রয়েছে সেগুলিই এর শেষ দুটি অধ্যায়। তৈত্তিরীয় শাখার মধ্যে বৈখানস শ্রৌতসূত্র যে অর্বাচীনতম রচনা, তা এর সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকেই প্রমাণিত। এটা স্পষ্টত বৈষ্ণব ধারার গ্ৰন্থ; এতে নারায়ণের স্তুতি এবং নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী ভস্ম দিয়ে ললাট চিহ্নিত করার বিশেষ বৈষ্ণবীয় আচারের বিবরণ আছে। তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে এই ভস্ম গাৰ্হাপত্য অগ্নি থেকে আহরণ করতে হত। সম্প্রদায়কেন্দ্ৰিক পৌরাণিক বিশ্বাস যে ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে, তা নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতিতে স্পষ্ট : ‘এই ভস্ম-চিহ্ন যে ব্যবহার করে, সে পূণ্য অর্জন করে” শেষ পর্যন্ত পরমাত্মার সঙ্গে সম্মিলিত হয়”। মনে হয়, একদা এই শাখার জন্য একটি পৃথক ব্রাহ্মণ ছিল; কিন্তু পরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বৈখানস নিজস্ব মন্ত্রসংহিতার অস্তিত্বকে অনুমান করে নিয়েছে, তবে তার সমগ্র রূপটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে নি। এর ভাষা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে প্ৰযুক্ত গদ্যের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরী—তাই বহু দুর্বোধ্য ও ত্রুটিপূর্ণ রীতির অস্তিত্ব তার বৈশিষ্ট্য সূচিত করছে।


পনেরোটি প্রশ্নে বিন্যস্ত সংক্ষিপ্ত ভারদ্বাজ শ্রৌতসূত্র মাত্র দশটি যজ্ঞ আলোচনা করেছে। জ্যোতিক্টোম ছাড়া অন্য কোনো সোমােযাগ এতে আলোচিত হয় নি; তবে এতে অধ্বর্যু শ্রেণীর পুরোহিতদের ভূমিকা সম্পর্কে একটি এবং পূর্বানুমিত প্ৰায়শ্চিত্ত সম্পর্কে আরেকটি অংশ রয়েছে। সম্ভবত মূল গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ রূপটি আমাদের কাছে পৌঁছয় নি। কারণ পরবর্তী সাহিত্যে আরো কিছু যজ্ঞ সম্পর্কে ভারদ্বাজ শ্রৌতসূত্রের এমন সব বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে যা প্রচলিত পাঠে পাওয়া যায় না। এরকম একটি যজ্ঞ হল অশ্বমেধ। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এই রচনার সঙ্গে বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

কাঠক শ্রৌতসূত্রের পাঠটি নামমাত্রে পর্যবসিত; কারণ এর সামান্য কিছু অংশই মাত্র আমাদের কাছে পৌঁছেছে–রচনার বিপুল অংশই এখনও বিলুপ্ত। এরকম একটি প্রচলিত অংশে আমরা পিণ্ডপিতৃ যজ্ঞের যে নির্দেশাবলী পাই—তাতে শ্রৌতসূত্রে আলোচিত হওয়ার যৌক্তিকতা সংশয়াতীত নয়, কেননা গৃহসূত্রেই এগুলি অধিক মানানসই।

মৈত্রায়ণী শাখায় দুটি শ্রৌতসূত্র রয়েছে : মানব ও বারাহ। মানব শ্রৌতসূত্র নানাভাবে পরিচিত : মানব মৈত্রায়ণীয়’ বা শুধু মৈত্রায়ণীয়’। এর একুশটি অধ্যায়ে বহু প্ৰধান যজ্ঞ আলোচিত হয়েছে; কিছু কিছু অংশে বিচিত্র বিষয়বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যযুক্ত কিছু কিছু বৈষ্ণব অনুষ্ঠান এবং ‘গোনামিক’ ও ‘অনুগ্রাহিক’। এছাড়া এতে আছে পিতৃপুরুষের একটি তালিকা, একটি পরিশিষ্ট, শ্ৰাদ্ধবিষয়ক একটি অংশ এবং একটি সংশ্লিষ্ট শুল্বসূত্র।


বারাহ শ্রৌতসূত্র নামক অর্বাচীন রচনাটি তেরটি অধ্যায়ে ও তিনটি পৃথক অংশে বিন্যপ্ত। কয়েকটি প্রধান যজ্ঞের সঙ্গে (এদের মধ্যে সোমব্যাগের বিবিধ রূপভেদই প্রধান) মহাব্ৰত এবং ‘উৎসৰ্গিণাম আয়ন’ ও ‘একাদশিনী’ মতো অপ্রচলিত অপ্রধান অনুষ্ঠানও এতে আলোচিত হয়েছে। মানব শ্রৌতসূত্রের সঙ্গে এর নিবিড় সাদৃশ্য লক্ষণীয়; একমাত্র পার্থক্য এই যে, বারাহে পরিভাষা অংশ অনুপস্থিত। এর শব্দভাণ্ডারে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়; এতে এমন কিছু শব্দ প্ৰযুক্ত হয়েছে যা অন্য কোনো সূত্র গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

বাজসনেয়ী শাখার কথা ও মাধ্যন্দিন–এই উভয় পাঠে একটিমাত্র শ্রৌতসূত্র রয়েছে; কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র; এর সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট গৃহ্যসূত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় যদিও সেই গৃহ্যসূত্রের নামকরণে কাত্যায়ন অনুপস্থিত। এই শাখায় গৃহ্যসূত্রকে পারস্কর গৃহ্যসূত্র বলা হয়। পারস্কর সম্ভবত কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রেরও রচয়িতা কারণ এই সূত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাত্যায়ন এবং সর্বানুক্রমণীয় রচয়িতা অভিন্ন নন। এতে পরিভাষা সম্পর্কে একটি পৃথক অধ্যায়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর পিতৃপুরুষের একটি তালিকা এবং কৌকিলী, সৌত্ৰিমণী, পিতৃমেধ ও দীক্ষায়ণ যজ্ঞের মতো কিছু কিছু স্বল্প প্রচলিত অনুষ্ঠানের বিবরণ আছে। বাজসনেয়ী সংহিতা ও শতপথ ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ; যদিও এমন কিছু অনুষ্ঠান এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা সংহিতায় পাওয়া যায় না, তবু সূত্রটি প্রাগুক্ত সংহিতাকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছে।


সামবেদের পাঁচটি শ্রৌতসূত্র আমাদের কাছে পৌঁছেছে : ল্যাটায়ন, দ্রাহ্যায়ণ, জৈমিনীয়, আর্যেয়কল্প ও নিদানসূত্র। ল্যাটায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ–এই দুটিকেই কৌথুম ও রাণায়নীদের দশটি শ্রৌতসূত্রের তালিকার মধ্যে পাওয়া যায়। এই দুটি গ্রন্থ নিশ্চিতই প্রাচীনতর, যেহেতু নিজেদের শাখায় এগুলি প্ৰথম সূত্র। লাট্যায়ন দশটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত–প্রতিটি প্ৰপাঠক আবার বারোটি করে কণ্ডিকায় বিভক্ত। সামবেদীয় রচনারূপে এতে প্ৰধানত উদগাতা শ্রেণীর পুরোহিত ও তার সহায়কদের দায়িত্ব এবং সোমযাগে ব্ৰহ্মা শ্রেণীর পুরোহিতদের কর্মপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। এতে কয়েকটি অনুষ্ঠান বিবৃত হলেও এই সব যজ্ঞে গীত মন্ত্রসমূহই প্রধান বিবক্ষিত বস্তু। পঞ্চবিংশ ব্ৰাহ্মণের প্রচুর উদ্ধৃতি এই সূত্রে রয়েছে। বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতিতে বহু প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের নাম উল্লিখিত হওয়ার ফলে এই গ্রন্থের পশ্চাদবর্তী দীর্ঘ ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা অবহিত হই।

দ্রাহ্যায়ণ শ্রৌতসূত্রের রূপটি স্পষ্ট নয়; কারণ এর বত্রিশটি পটলের মধ্যে মাত্র পনেরোটি এখনো পর্যন্ত প্ৰকাশিত হয়েছে। প্ৰতি পটল আবার চার খণ্ডে বিন্যস্ত। মোট সাতটি যজ্ঞ এতে বিবৃত হয়েছে—মূলত এগুলি হল সোমযাগের রূপভেদ। ল্যাটায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ একই বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়েছে বলে এবং ভাষারীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক নিবিড় সাদৃশ্যযুক্ত হওয়াতে এদের একটি অভিন্ন গ্রন্থের সামান্য ভোদযুক্ত দুটি শাখা হিসাবে গণ্য করা হয়। অবশ্য, এদের মধ্যে লাট্যায়ন সংবদ্ধতর এবং দ্রাহ্যায়ণে প্ৰাপ্ত অনুষ্ঠানতত্ত্ব অংশ প্রথমোক্ত গ্রন্থে বর্জিত হয়েছে বলে বিশুদ্ধতর পাঠ এতে সংরক্ষিত।


জৈমিনীয় শ্রৌতসূত্র একটি সংক্ষিপ্ত গ্ৰন্থ; এতে মাত্র বিশটি খণ্ড আছে। অগ্নিচয়ন অনুষ্ঠানে গীত সামমন্ত্রগুলি বিবৃত হওয়ার পরেই রয়েছে প্রবর্গ অনুষ্ঠান বিষয়ক একটি পৃথক অংশ মন্ত্ৰ-গানের ক্রম বর্ণনার ক্ষেত্রে জৈমিনীয় বৌধায়নকে অনুসরণ করেছে।

চৌদ্দটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত ‘আর্যেয়কল্পে’ ‘মশক কল্পসূত্ৰ’ নামেও পরিচিত; আবার, শেষ তিনটি প্ৰপাঠক নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্রসূত্র। এই গ্রন্থের রচয়িতা মশক এবং তা নিশ্চিতই লাট্যায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ অপেক্ষা প্রাচীনতর, যেহেতু এই দুটি গ্রন্থের নিকট আর্যেয়কল্প পরিচিত ছিল। এতে যে আটটি যজ্ঞ আলোচিত হয়েছে মূলত সেসব সোমযোগেরই রূপভেদ; এই যজ্ঞগুলিতে গীত সামমন্ত্রের তালিকা ছাড়াও প্ৰায়শ্চিত্তবিষয়ে একটি অংশও পাওয়া যায়। এই গ্ৰন্থ পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছে; অবশ্য দ্বিতীয়োক্ত রচনায় যেসব অনুষ্ঠান বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে, সেসব এতে বর্জিত হয়ে গেছে। যে গ্ৰামগেয়, আরণ্যগেয়, ঊহ, উহ্যগানগুলি আর্যেয়কল্পে প্রদত্ত সামমন্ত্রের ক্রমকে অনুসরণ করেছে বলে মনে হয়–তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ যোগসূত্র রয়েছে। এই গ্ৰন্থ মোটামুটিভাবে সুসংবদ্ধ, পুনরাবৃত্তির প্রবণতা থেকেও মুক্ত। ক্ষুদ্রসূত্রের নামকরণের সম্ভাব্য কারণ হলো রচনার সংক্ষিপ্ততা; এতে মাত্র তিনটি অধ্যায় আছে। পরবর্তীকালের সামবেদীয় সহায়ক রচনাগুলিতে এটি এই বর্ণনাত্মক নামেই পরিচিত ছিল। ‘উপগ্রন্থসূত্র’ নামক কাত্যায়ণ রচিত ক্ষুদ্রসূত্রের অংশবিশেষে ‘প্ৰতিহার’ নামক সামমন্ত্রের বিশেষ একটি শ্রেণী ব্যাখ্যাত হয়েছে। ভাষাগত বিচারে একে আর্যেয়কল্প অপেক্ষা প্ৰাচীনতর বলে মনে হয়।


দশটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত নিদানসূত্ৰ’ প্রকৃতপক্ষে আর্যেয়কল্প গ্রন্থের পাঠান্তর; সামবেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহ এর প্রত্যক্ষ পূর্বসূরী। গৌতম তীর পিতৃমেধসূত্র গ্রন্থে আলোচ্য রচনার যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে নিদানসূত্রের রচয়িতারূপে পতঞ্জলির নাম উল্লেখিত হয়েছে। রাণায়নীয় বা কৌঘুম শাখার পাঠভেদের সঙ্গে এর কোনো প্ৰত্যক্ষ সম্পর্ক নেই বলে কেউ কেউ মনে করেছেন, এটি ‘ভাল্লবেয়’ শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বহু ঐতিহাসিক ও সাহিত্যবিষয়ক তথ্য জোগান দিয়েছে বলে রচনাটি কৌতুহলজনক। এর প্রথম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হল বৈদিক ছন্দ। দুটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত ‘কল্পনুপদসূত্র’ নামক পরিশিষ্টকে ক্ষুদ্রসূত্রের বিভিন্ন অংশ-সম্পর্কিত ভাষ্য বলে মনে হয়। নিদানসূত্রের নবীনতা ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকেই স্পষ্ট; তবে প্রচলিত পাণ্ডুলিপি বিকৃতিমুক্ত নয়।

‘বৈতান’ ও ‘কৌশিক’ —অথর্ববেদের এই দুটি সূত্রে একটি অসাধারণ ক্রম পরিলক্ষিত হয়; কেননা গৃহসূত্রের বৈশিষ্ট্যযুক্ত কৌশিক সূত্র বৈতানের পূর্ববর্তী। বিভিন্ন লেখকের রচনা হলেও এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক লক্ষণীয়। বৈতানসূত্রের রচয়িতা কৌশিকের উপর নির্ভরশীল এবং বেশ কিছু উদ্ধৃতিও চয়ন করেছেন; শাস্ত্ৰ-অংশে আশ্বলায়নের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রচনাটি যদিও শৌনক শাখার অন্তৰ্গত, তবু এটি পৈপ্পালাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈতানসূত্রে আটটি অধ্যায় ও তেতাল্লিশটি কণ্ডিকা রয়েছে; রচনার প্রথম শব্দ অনুযায়ী এর এরূপ নামকরণ হয়েছে। পরিভাষা অধ্যায় দিয়ে গ্রন্থের সূত্রপাত; এছাড়া এতে প্রধান যজ্ঞসমূহ, বিশেষত সোমযাগগুলি এবং রাজসূয়, বাজপেয়, সৌত্রামণী, অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ ও গবাময়ন আলোচিত হয়েছে। রাজাদের উপযোগী বিশেষ অনুষ্ঠানগুলির উপর প্রচুর গুরুত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়; কারণ আমরা জানি, অথর্ববেদের পুরোহিত মূলত রাজপুরোহিত। গ্রন্থটি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন; অথৰ্ববেদের স্বীকৃতিলাভের পরে, তবে সম্ভবত গোপথ ব্রাহ্মণের উদ্ভবের পূর্বে এটি রচিত হয়েছিল।


শৌনক শাখার অন্তর্গত কৌশিকসূত্রে প্রায়শ বিকল্প অনুষ্ঠানই বিবৃত হয়েছে; এই গ্রন্থটি অবশ্য যথার্থ শ্রৌতসূত্ৰ-পদবাচ্য নয়। এতে বহু গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানও আলোচিত হয়েছে; যেমন, জন্ম ও মৃত্যুসংক্রান্ত এবং ঐন্দ্রজালিক ও ডাকিনীবিদ্যা বিষয়ক অনুষ্ঠান। একে অবশ্য একজনমাত্র লেখকের রচনারূপেও গ্রহণ করা যায় না; আলোচিত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন রচনাংশের একটি সংগ্ৰহ। গোপথ ছাড়াও অন্য একটি ব্ৰাহ্মণ সম্পর্কে এগ্ৰন্থ অবহিত ছিল, অবশ্য সেই ব্ৰাহ্মণটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বৈতান বা কৌশিক-কোথাও প্ৰায়শ্চিত্ত সম্পর্কিত কোনো অংশ নেই; কারণ, সম্ভবত, প্ৰায়শ্চিত্তসংক্রান্ত নিয়মাবলী ‘অথর্ব-প্ৰায়শ্চিত্তানি’ নামক ছ’টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত একটি পৃথক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাকে বৈতানের আটটি অধ্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে মোট চোদ্দটি অধ্যায়ে সম্প্রসারিত করা হল যাতে সমসংখ্যক অধ্যায়ে বিন্যস্ত কৌশিকসূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়; আনুষ্ঠানিক শিথিলতার উপর অথর্ববেদীয় শ্রৌতসূত্রের গুরুত্ব আরোপ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ আনুষ্ঠানিক বিচূতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপযুক্ত প্ৰায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানের বিধান-দানই ব্ৰহ্মাশ্রেণীর পুরোহিতের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। চৈনিক ধর্মানুষ্ঠানবিষয়ক পুথি ‘লি খী’র মতো শ্রৌতসূত্রগুলিও যথাযথ নির্দেশ-সহ প্ৰকৃত অনুষ্ঠানের বিবরণ, অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময়, কার্যপরিচালকদের নির্বাচন করার নিয়ম, সংখ্যাবিষয়ক বিধি এবং যজ্ঞ আয়োজনের পদ্ধতি, অবস্থান ও উদ্দেশ্যসংক্রান্ত নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ করেছে।

ক। ‘শ্রৌত-সূত্র’– শ্রৌত-যজ্ঞের আলোচনা। ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্যে যে সমস্ত যজ্ঞের উল্লেখ আছে তাদের বলা হয় শ্রৌত-যজ্ঞ, কারণ ব্রাহ্মণ শ্রুতির অঙ্গ। এই যজ্ঞগুলির সংখ্যা চৌদ্দটি– সাতটি হবির্যজ্ঞ অর্থাৎ ঘৃতাহুতি দিয়ে নিষ্পন্ন করতে হয়, এবং সাতটি সোম-যজ্ঞ অর্থাৎ সোমরস আহুতি দিতে হয়। শ্রৌত-সূত্রে এই চৌদ্দটি যজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর জন্য তিনটি অগ্নির আধান করতে হয়– গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণ। এদের বিষয়েও আলোচনা রয়েছে। শ্রৌত সূত্র গুলিকে প্রচলিত ভাবে এক একটি বেদের সাথে যুক্ত করা হয়। যেমন ঋগ্বেদ শ্রৌতসূত্রের নাম আশ্বলায়ন ও শাঙ্খায়ন। এছাড়াও বিভিন্ন বেদের সংযুক্ত বৌধায়ন, বাধুল, ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, হিরণ্যেকেশী ও বৈখান্‌স, কাত্যায়ন, লাট্যায়ন, দ্রাহ্যায়ণ, জৈমিনীয়, মৈত্রায়ন বা মানব ইত্যাদি নামের শ্রৌতসূত্রে খোঁজ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বৌধায়নের শ্রৌতসূত্র প্রাচীনতম ও বৈখান্‌স নবীনতম মনে করা হয়। অধিকাংশ শ্রৌতসূত্রগুলির বিভিন্ন অধ্যায়কে প্রশ্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার থেকে বোঝা যায় যে এদের বিষয়বস্তু পুরোহিত/ঋষি ও ছাত্রের মধ্যে প্রশ্নোত্তরের ছলে ব্যাখ্যা করা। সামবেদীয় শ্রৌতসূত্র গুলিতে সামগানের প্রণালী ব্যাখ্যা করা আছে।

খ। ‘গৃহ্য-সূত্র’— গৃহ্য-যজ্ঞের আলোচনা। চৌদ্দটি শ্রৌত-যজ্ঞ ছাড়া আরও অতিরিক্ত যজ্ঞ আছে। তাদের ‘স্মার্ত-যাগ’ বলা হয়। তাতে ঔপাসন, হোম, বৈশ্বদেব প্রভৃতি সাতটি যজ্ঞের বিধান আছে। এদের আলোচনা রয়েছে গৃহ্য-সূত্রে। স্মার্ত-কর্মগুলি স্মার্ত-অগ্নিতে করা নিয়ম। স্মার্ত-অগ্নির অন্য নাম বৈবাহিক, গৃহ্য, অবিসথ্য ও ঔপাসন অগ্নি। কতকগুলি যজ্ঞের শ্রৌত এবং গৃহ্য উভয় রূপই আছে, যেমন– অগ্নিহোত্র, দশপূর্ণমাস, পশুযাগ, পিতৃযাগ।
এছাড়া হিন্দু-সংস্কৃতিতে জন্ম হতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত যে দশটি সংস্কার ব্যক্তির জীবনে পালন করতে হয়; কারণ বৈদিক যুগ হতে এগুলি পালিত হয়ে আসছে। যেমন– জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, কর্ণবেধ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এগুলি কিভাবে সম্পাদিত হবে তার বিধি গৃহ্য-সূত্রে রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সংস্কারগুলি হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিতরূপে এখনও বর্তমান আছে। পারস্কর গৃহসূত্র
শৌতসূত্রগুলিতে যেখানে প্রধান সামূহিক যজ্ঞসমূহ বিবৃত হয়েছে, গৃহ্যসূত্রগুলিতে সেখানে গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানবিষয়ের নিয়মাবলী আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানসমূহ-সন্তানসম্ভাবনা থেকে মৃত্যুর বহু পরবর্তী পারলৌকিক ক্রিয়া পর্যন্ত সেসব বিস্তৃত। এগুলি তাদের লক্ষ্য, বিষয়পরিধি ও ক্রমিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে শৌতি অনুষ্ঠান অপেক্ষা ভিন্ন। শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলি যেখানে মূলত সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সামূহিক কল্যাণ কামনা করে, গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ সেক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, কেননা এগুলি সর্বতোভাবে পরিবার-কেন্দ্ৰিক। গৃহ্যসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে ‘পাকযজ্ঞ’ নামে অভিহিত প্ৰায় চল্লিশটি অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী বিবৃত হয়েছে। এদের আবার তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : (ক) হুত অর্থাৎ যখন অগ্নিতে আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন বিবাহে বা গর্ভবতী রমণীর সীমস্তোন্নয়ন অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। (খ) অহুত অর্থাৎ যেখানে আহুতি আদান-প্ৰদান হয়; যেমন উপনয়নে ও স্নাতকদের জন্য দীক্ষান্ত অনুষ্ঠানে। (গ) প্ৰহুত অর্থাৎ যেখানে বিশেষ ধরনের আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠানে। প্রধান অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে বহু গৌণ সহায়ক আচারও রয়েছে; যেমন, গর্ভাবস্থার অনুষ্ঠানগুলি-এদের মধ্যে আছে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন।

জন্মের পরে নবজাত শিশুর কল্যাণের জন্য জাতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একে-একে পালিত হয় আদিত্যদর্শন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চোল বা চুড়াকরণ, গোদান ও উপনয়ন অনুষ্ঠান। উপনয়নের পরে বেদাধ্যয়ন বা স্বাধ্যায়ের সূচনা হয়; এই সঙ্গে থাকে। অন্যধ্যায় ও শেষে সমাবর্তন। তারাপ স্নাতক গ্রামে প্ৰত্যাবর্তন করে গ্ৰাহঁত্যু আশ্রমে প্রবেশের জন্য প্ৰস্তুত হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাণিগ্রহণ, অগ্নিপরিগ্রহণ, অশ্বারোহন, সপ্তপদী ও লাজহােম। বিবাহিত গৃহস্থকে প্রতিদিন আবশ্যিক নিত্যকর্ম ও বিভিন্ন সাময়িক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়।

এইসব প্ৰধান অনুষ্ঠান ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সমস্ত সম্ভাব্য ক্ষেত্রের জন্য নানাধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে; যেমন–গৃহনির্মাণ, বীজ বপন, শস্য আহরণ, সর্প ও বিষাক্ত কীট বিতাড়ন, অতিথিকে খাদ্য ও আশ্রয়দান, আরোগ্যলাভ, দারিদ্র্য নিবারণ, বিভিন্ন উদ্যোগে সফলতা, অমঙ্গলসূচক লক্ষণ, এমনকি অশুভ স্বপ্নের জন্য উপযুক্ত প্ৰতিবিধান। মানুষের সমগ্র জীবন প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুষ্ঠান দ্বারা আবৃত ছিল; আদিম মানুষের মানসিকতায় ধর্মীয় ও লোকায়িত জীবনধারার মধ্যে কোনও স্পষ্ট ভেদরেখা ছিল না। এই মানসিকতায় পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অসংখ্য অমঙ্গল শক্তির দ্বারা আকীর্ণ ছিল; এদের মধ্যে রয়েছে জীবনের সুখকর ভোগ থেকে বঞ্চিত মৃতমানুষের আত্মা—এরা জীবিত মানুষ সম্পর্কে অসূয়াপরায়ণ হয়ে সর্বদা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে এমন বিশ্বাস ছিল। জীবনকে যেহেতু নেতিবাচক ও ধবংসাত্মক শক্তি থেকে রক্ষা করতে হবে, তাই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যযুক্ত পরিস্থিতির জন্য কোনো অনুষ্ঠান নির্দেশিত হয়েছিল, যার সাহায্যে এইসব অমঙ্গলপ্রদ শক্তিকে শান্ত, সন্তুষ্ট, বিতাড়িত বা সংগ্রামে প্রতিহত করা যায়। তাই শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় গৃহ্যসূত্ৰসমূহ অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ঐন্দ্রজালিক। এটা সত্য যে সূত্র-সাহিত্য রচিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা আদিম অবস্থা থেকে বহুদূর সরে এসেছিলেন; কিন্তু সূত্রগুলি বহু সহস্ৰ বৎসরের পুরাতন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলিকে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র। জীবনের প্রতি প্ৰাগ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃতিক স্তরে মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে প্ররোচিত করেছে।
একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক দিয়ে গৃহ্যসূত্রগুলি ব্রাহ্মণ সাহিত্য ও অথর্ববেদ থেকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভব হয়েছে। আর শ্রৌতসূত্রগুলি উদ্ভূত হয়েছে শুধু ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য থেকে। অথর্ববেদ সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা দেখেছি যে তা অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও আদর্শগত বাতাবরণ সৃষ্ট হয়েছিল; একদিকে ছিল তিনটি বেদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রয়োগবিধি-জনিত একমুখী সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে অথর্ববেদ—যা কিছু মৌলিক উপায়ে ত্রয়ীর তুলনায় শুধুমাত্র ভিন্ন ছিল না, সম্পূর্ণ বিরোধিতাও করেছিল। পরবর্তীকালে অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই ধারায় প্রচলিত গৃহ্য অনুষ্ঠানসমূহের প্রবল উপস্থিতি। সামূহিক শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে সামাজিক জীবন সম্পূর্ণত গড়ে উঠেছিল; জনসাধারণ তাদের পারিবারিক, গাৰ্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনযাপনে বহুবিধ বাধাবিয়ের সম্মুখীন হত-ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য বা শ্রৌতসূত্রগুলি দিয়ে যাদের পুরোপুরি সমাধান করা যেত না। এইসব ক্ষেত্রে জিকরি প্রয়োজনসমূহ ছিল নিতান্ত বাস্তব ও পৌনঃপুনিক; এইগুলি অবস্থার উন্নতি সাধন, শাস্তিবিধান, প্রেতবিতাড়ন ও আশীৰ্বাদ প্ৰাপ্তির জন্য উপযুক্ত আনুষ্ঠানিক প্ৰতিবিধান অনিবাৰ্য করে তুলেছিল। অথর্ববেদ তার ব্যবস্থা করেছিল; সুদূর অতীত কাল থেকে বৈদিক ধর্মের পশ্চাৎপটে অথর্ববেদীয় পুরোহিতেরা সক্রিয় ছিলেন এবং জনসাধারণের বিপদে পড়ে তাদের শরণাপন্ন হতেন। তারপর ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্রমোন্নতিশীল ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রধানরা প্রতিবেশী রাজাদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত হওয়ার জন্য ঐন্দ্ৰজালিক প্রতিরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। প্রাচীনতর ধর্মে এধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা খুব কমই ছিল; তাই অথর্ববেদীয় পুরোহিত যখন উদ্যোগী হলেন, তাকে রাজপুরোহিতরূপে নিয়োগ করা হল এবং কালক্রমে তার গোষ্ঠী ও মতবাদ বিলম্বিত স্বীকৃতি লাভ করল। এই স্বীকৃতি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত অনিচ্ছা! সত্ত্বেই দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু রাজপুরোহিত রূপে অথর্ববেদীয় পুরোহিত যেহেতু একটি নক্ষতাসম্পন্ন অবস্থান থেকে দরকষাকষি করতে সমর্থ ছিলেন। তাই তিনি আপন অধিকার অর্জন করে নিলেন। তার জয়ের স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে : সমগ্ৰ যজ্ঞদক্ষিণার অর্ধেক অংশ একা ব্ৰহ্মার প্রাপ্য, বাকি অর্ধেক হােতা, উদগাতা ও অধিবৰ্ষর। অন্যভাবে বলা যায়, অন্য তিনজন পুরোহিত একত্রে যা লাভ করতেন, ব্ৰহ্মাশ্রেণীর পুরোহিত একই তা পেয়ে যেতেন। অথর্ববেদীয় পুরোহিতের ক্ষমতার অপর বাস্তব উৎস নিহিত ছিল গাৰ্হস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে—সেখানে তাঁর মতবাদ ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপ অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সমগ্ৰ সূত্রসাহিত্য যেহেতু পরবর্তীকালে রচিত, গৃহ্যসূত্রগুলিতে শুধুমাত্র অথর্ববেদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির জয় প্রতিফলিত হয় নি, অন্যান্য বেদের শাখাগুলিতেও তার অন্তর্ভুক্তি প্রমাণিত হয়েছে। অথর্ববেদের পরিগ্রহণের পশ্চাতে রয়েছে লোকায়ত ধর্মের স্বীকৃতি অর্থাৎ নিজস্ব দেবতা, আচার অনুষ্ঠান, প্ৰত্নকথা ও বিশ্বাসসহ লঘু ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি। তাই এখানে আমরা বহু-সংখ্যক অপরিচিত অর্ধদেবতা, উপদেবতা, দানব ও পিশাচ প্রভৃতির সম্মুখীন হই, কেননা লোকায়ত ধর্ম মূলত এদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসময়ে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের উল্লেখ আমরা লক্ষ্য করি–হস্তরেখা-বিচার, সর্ববিধ ভবিষ্যৎ-কথন, জ্যোতির্বিদ্যা অর্থাৎ অন্তরিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ থেকে আহৃত শুভাশুভ গণনা, স্বপ্নবিশ্লেষণ করে আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস নির্ণয়, বস্ত্রে মুষিকদংশনের ফলে উদ্ভূত চিহ্ন ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যদবাণী, অগ্নির উদ্দেশ্যে যজ্ঞ, বহুবিধ দেবতার প্রতি অৰ্পিত অৰ্ঘ্য, শুভাশুভ স্থান নিরাপণ, প্ৰেত-সঞ্চালন, সৰ্প নিয়ন্ত্রণ বিদ্যা, প্ৰেত্যাবিষ্ট বালিকার মাধ্যমে দেবতাদের পরামর্শ গ্ৰহণ, পরামদেবতার উপাসনা, ব্ৰতপালন ও মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা সন্তান-উৎপাদনের শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস ইত্যাদি।
এই পর্যায়ে জনপ্রিয় ধর্মের মধ্যে বৃহৎ ও লঘু ঐতিহ্যের যে বিচিত্র সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়, তার সম্ভাব্য কারণ এই যে, দুটি ধারার মধ্যে পরস্পর অভিমুখীনতা সর্বদা অব্যাহত ছিল। তাই দীর্ঘ-নিকায়ের মহাসময়সুত্তান্ত অংশে পৃথিবী ও বিশাল পর্বতসমূহের আত্মা, দিকসমূহের চারজন অধিপতি, গন্ধৰ্ব, নাগ, গরুঢ়, দানব এবং ব্ৰহ্মা, পরমাত্মা ও সনৎকুমার উল্লিখিত। ‘বেদাঙ্গ’গুলিতে বিদেহী আত্মার উপাসনা অধিকতর প্রকট; কারণ আদিম মানুষের মানসিকতায় বিশ্বজগৎ বৈরিতাকামী মন্দ আত্মার পরিপূর্ণ যারা নিয়ত মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সুখ আক্রমণ এবং ধ্বংস করতে উদ্যত। তাই বহুদূর পর্যন্ত গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলি আপাত-দৃষ্টিতে নেতিবাচক, মুখ্যত অমঙ্গল দূর করাই এগুলির উদ্দেশ্য।

শৌতি ও গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে বিপুল অংশ এক সাধারণ বৃত্তের অন্তর্গত; যেমন অগ্নিহোত্র, দর্শপূৰ্ণমাস, পিণ্ডপিতৃ যজ্ঞ এবং কিছু কিছু চাতুর্মাস্য অনুষ্ঠান উভয়বিধ গ্রন্থেই আলোচিত হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র কল্পসূত্রই প্রচলিত ছিল; পরবর্তীকালে অনুষ্ঠানসমূহ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুযায়ী রচনাকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছিল। তিনটি যজ্ঞাপ্লির প্রয়োগদ্বারাও নির্ধারিত হত–কোন বিষয় কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে; শ্রৌত যাগে যেহেতু এই তিনটি অগ্নিরই প্রয়োজন ছিল, তাই এই তিনটির যে কোনো একটি অগ্নিদ্বারা অনুষ্ঠিত যে কোনো যজ্ঞ প্ৰাচীনতম শ্রৌতসূত্র গুলিতে আলোচিত হয়েছিল এবং ফলত প্রত্যেকটি গৃহ্য অনুষ্ঠান তার অন্তর্ভুক্ত হল। ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে এমন কিছু বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে যা গৃহ্যসূত্রগুলির পক্ষে উপযোগী; স্পষ্টত এর কারণ এই যে, সে সময় কোনো পৃথক সূত্র সাহিত্যের অস্তিত্ব ছিল না–গৃহ্যসূত্রের তো কোনো প্রশ্নই উঠে না। উপনয়ন, গার্হ্যপত্য অগ্নির প্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মৃত্যু ও মরণোত্তর শ্ৰাদ্ধাদি এসবই মূলত গৃহ্যানুষ্ঠান—এগুলি ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতেও আলোচিত হয়েছে। যখন পৃথক শ্রেণীর রচনারূপে সূত্রগুলিতে আলোচিত হয়েছে। যখন পৃথক শ্রেণীর রচনারূপে সূত্রগুলি রচিত হতে লাগল, তখনো যে মিশ্র বিষয়বস্তুনির্ভর একটি সূত্র ছিল—তা আপস্তম্ব সূত্র থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম চৌদ্দটি অধ্যায়ে শ্রৌতসূত্রটি গঠিত; তারপর যথাক্রমে পরিভাষা ও গৃহসূত্রের মন্ত্রপাঠ অংশ পাওয়া যায়; শেষ দুটি অধ্যায়ে ধর্ম ও শুদ্ধৰ সূত্রগুলি গঠিত হয়েছে। এর থেকে আমরা কল্পসূত্র সাহিত্যের স্পষ্ট ঐতিহাসিক স্তর সম্পর্কে অবহিত হই; এর প্রাথমিক স্তরে প্রতি শাখা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল।


সামূহিক বৈদিক যজ্ঞে তিনটি অগ্নি প্রয়োজনীয় ছিল-আহবনীয়, দক্ষিণা ও গাৰ্হাপত্য–মোটামুটিভাবে এগুলি দেবতা, পিতৃপুরুষ ও মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের মধ্যে শুধুমাত্ৰ গাৰ্হাপত্য অগ্নি গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত হয়। শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি দেবকাহিনীতে। ইড়া বা শ্রৌত যাগের যজ্ঞীয় হব্যের উৎস বর্ণিত হয়েছে। এটা যেহেতু মনু কর্তৃক নিবেদিত প্ৰথম পাক যজ্ঞে উদ্ভূত হয়েছিল, তাই কোনো পাক যজ্ঞে ইড়া নেই। প্রকৃতপক্ষে এই অনুপস্থিতি সামূহিক ও গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলির প্রধান প্রতীকী পার্থক্যকে সূচিত করছে। এদিক দিয়ে এই শেষোক্ত অনুষ্ঠানগুলি প্রাচীনতর ও অধিকতর সর্বজনীন–সম্ভবত ইড়া আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে কোনও সময়ে এর উদ্ভব হয়েছিল।

শ্রৌতসূত্রগুলিতে যেমন প্রধান কোনো গোষ্ঠীর মঙ্গলের জন্য যজ্ঞানুষ্ঠান, তেমনি গৃহ্যসূত্রগুলিতে একক গৃহস্থ্যের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিশদ প্রণালী ব্যাখ্যা করা আছে। শিশুর জন্ম থেকে মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পদ্ধতির দীর্ঘ তালিকা আছে গৃহ্যসূত্রগুলিতে। যেমন নবজাত শিশুর জাতকর্ম, আদিত্যদর্শন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন। তারপর গুরুগৃহে বেদাধ্যয়ন, অনধ্যায় ও শেষে সমাবর্তন। তারপর গৃহস্থ আশ্রমে বিবাহ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পদ্ধতি, পাণিগ্রহণ, অগ্নিপরিগ্রহণ, সপ্তপদী, লাজহোম, ইত্যাদি। নারীদের গর্ভাবস্থার বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, ইত্যাদি। এছাড়াও গৃহ্যসূত্রগুলিতে গার্হপত্য অগ্নি প্রজ্বলন বিধি, প্রায়শ্চিত্ত, কূপ ও দীঘি খনন,  হলকর্ষণ, ইত্যাদি লোকাচারের নির্দেশ আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যে এই তালিকার প্রচুর আচার এখনো হিন্দু সমাজে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শ্রৌত সূত্রের মত গৃহ্য সূত্রেরও বিভিন্ন শাখা আছে যাদের চার বেদের সাথে যুক্ত করা হয়। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন ও শাঙ্খায়ন, শুক্লযজুর্বেদের বাজসেনয় ও পারস্কর, কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতার বৌধায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, প্রভৃতি, সামবেদের গোভিল, জৈমিনীয়, খাদিল ইত্যাদি। অথর্ববেদের কৌশিক সূত্র, যা শ্রৌতসূত্র ও গৃহ্যসূত্রের মিশ্রণ।  এদের মধ্যে রচনাকাল হিসেবে আশ্বলায়ন, বৌধায়ন, গোভিল প্রাচীনতম এবং জৈমিনীয়, খাদিল নবীনতম।


গ। ‘ধর্ম-সূত্র’— ন্যায়-অন্যায়, কর্তব্য-অকর্তব্য, দেশাচার-লোকাচার প্রভৃতির আলোচনা। ‘ধর্ম-সূত্র’ পরিবারকে ছাড়িয়ে সমাজে পরিব্যাপ্ত। এর আর এক নাম হলো ‘সাময়াচারিক-সূত্র’। এখানে সময় অর্থে সর্বসম্মত অনুশাসন বোঝানো হয়েছে। সুতরাং তাতে রয়েছে সর্বসম্মত অনুশাসন এবং আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ। এগুলি ‘গৃহ্য-সূত্রে’র সঙ্গে সংযুক্ত এবং বলা বাহুল্য, ন্যায়-অন্যায় বা কর্তব্য-অকর্তব্য সংক্রান্ত প্রাচীন বৈদিক ধারণা যাগযজ্ঞ-অনুষ্ঠান নিরপেক্ষ নয়। তবুও এই ‘ধর্ম-সূত্র’গুলিই ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীনতম আইন-গ্রন্থের নিদর্শন বলে মনে করা হয়।

ঘ। ‘শূল্ব-সূত্র’— বৈদিক যজ্ঞের যজ্ঞবেদি প্রভৃতির মাপজোক কী রকম হবে তারই আলোচনা এই ‘শূল্ব-সূত্রে’। ‘শূল্ব’ মানে জমি মাপবার দড়ি বা সুতো, গজফিতে ধরনের। তাতে নানা ধরনের যজ্ঞবেদির পরিমাণ, আকার, আয়তন ইত্যাদি ঠিক করবার নিয়ম দেওয়া আছে। এগুলি ‘শ্রৌত-সূত্রে’র সঙ্গে সংযুক্ত এবং ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে জ্যামিতি-বিদ্যার প্রাচীনতম নিদর্শন বলা যায়।

বেদের বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন ‘শ্রৌত-সূত্র’, ‘গৃহ্য-সূত্র’ প্রভৃতি ‘কল্প-সূত্র’ ছিলো; অনেকগুলি বর্তমান আছে, অনেকগুলি বিলুপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন ‘কল্প-সূত্রে’র সঙ্গে বিভিন্ন প্রাচীন বেদ-বিদ্ বা বিদ্বানের নাম সংযুক্ত। প্রতিটি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত নানা শ্রেণীর যেসব ‘কল্প-সূত্র’ পাওয়া যায়, তার একটি তালিকা নিম্নরূপ–

ঋগ্বেদ :
শ্রৌত-সূত্র : শাংখ্যায়ন-ব্রাহ্মণের সাথে সংযুক্ত ‘শাংখ্যায়ন-শ্রৌতসূত্র’ ও ঐতরেয়-ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংযুক্ত ‘আশ্বলায়ন-শ্রৌতসূত্র’।
গৃহ্য-সূত্র : ‘শাংখ্যায়ন-গৃহ্যসূত্র’, ‘আশ্বলায়ন-গৃহ্যসূত্র’, ‘শম্বিবৎ-গৃহ্যসূত্র’।
তবে ঋগ্বেদে ধর্ম-সূত্র বা শূল্ব-সূত্র নেই।

সামবেদ :
শ্রৌত-সূত্র : পঞ্চবিংশ-ব্রাহ্মণের সাথে যুক্ত ‘মশক-শ্রৌতসূত্র’ ও ‘লাট্টায়ন-শ্রৌতসূত্র’, এবং রাণায়নীয় শাখার ‘দ্রাহ্যায়ণ-শ্রৌতসূত্র’।
গৃহ্য-সূত্র : ‘গোভিল-গৃহ্যসূত্র’, রাণায়নীয় শাখার ‘খাদির-গৃহ্যসূত্র’ এবং জৈমিনীয় শাখার ‘জৈমিনীয়-গৃহ্যসূত্র’।
ধর্ম-সূত্র : রাণায়নীয় শাখার ‘গৌতম-ধর্মসূত্র’।
তবে সামবেদের কোন শূল্ব-সূত্র নেই।

কৃষ্ণ-যজুর্বেদ :
শ্রৌত-সূত্র : তৈত্তিরীয় শাখায়– ‘বৌধায়ন-শ্রৌতসূত্র’, ‘বাধূল-শ্রৌতসূত্র’, ‘ভারদ্বাজ-শ্রৌতসূত্র’, ‘আপস্তম্ব-শ্রৌতসূত্র’, ‘হিরণ্যকেশি-শ্রৌতসূত্র’, ‘বৈখানস-শ্রৌতসূত্র। কাঠক শাখায় ‘কাঠক-শ্রৌতসূত্র’, মৈত্রায়ণীয় শাখার ‘মানব-শ্রৌতসূত্র’ এবং ‘বারাহ-শ্রৌতসূত্র’।
গৃহ্য-সূত্র : তৈত্তিরীয় শাখার– ‘বৌধায়ন, বাধূল, ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশি ও বৈখানস– গৃহ্যসূত্র।
কাঠক শাখায় ‘কাঠক-গৃহ্যসূত্র’। মৈত্রায়ণীয় শাখার– মানব এবং বারাহ– গৃহ্যসূত্র।
ধর্ম-সূত্র : তৈত্তিরীয় শাখায়– বৌধায়ন, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশি এবং বৈখানস– ধর্মসূত্র।
শূল্ব-সূত্র : তৈত্তিরীয় শাখায়– বৌধায়ন, আপস্তম্ব ও হিরণ্যকেশি– শূল্বসূত্র। কাঠক শাখার ‘কাঠক-শূল্বসূত্র’। মৈত্রায়ণীয় শাখার– মানব এবং বারাহ– শূল্বসূত্র।

শুক্ল-যজুর্বেদ :
শ্রৌত-সূত্র : ‘কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্র’।
গৃহ্য-সূত্র : ‘পারষ্কর-গৃহ্যসূত্র’।
শূল্ব-সূত্র : ‘কাত্যায়ন-শূল্বসূত্র’।
তবে শুক্ল-যজুর্বেদে ধর্ম-সূত্র নেই।

অথর্ববেদ :
শ্রৌত-সূত্র : ‘বৈতান-শ্রৌতসূত্র’।
গৃহ্য-সূত্র : ‘কৌশিক-গৃহ্যসূত্র’।
তবে এগুলি অন্য বেদের সূত্রের মতো নয়। কৌশিক-সূত্রে অনেক তুকতাকের কথা রয়েছে।
অথর্ববেদে ধর্ম-সূত্র বা শূল্ব-সূত্র নেই।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ