অদ্বৈতমতে জীবের বন্ধন ও মুক্তি
অদ্বৈতমতে জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ হলেও অনাদি অবিদ্যাবশত অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয় এবং দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধ করে। জীবের এই ব্রহ্মস্বরূপত্ব বিস্মরণ ও দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে জীবের ‘অহং বোধ’ জন্মায়। জীব তখন নিজেকে সকল বস্তু থেকে পৃথক করে ক্ষুদ্র, পরিচ্ছিন্ন, সসীম সত্তার অধিকারী হয়। এই পরিচ্ছিন্ন জীবই বদ্ধ জীব। বদ্ধ জীব নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
বিদ্যার দ্বারা জীব যখন অবিদ্যাজনিত ভেদজ্ঞান দূর করে এবং দেহাদিসম্বন্ধ ছিন্ন করে, তখন সে নিজেকে ব্রহ্ম-অভিন্ন বলে জানে। নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানাকেই জীবের মুক্তি বলা হয়। অদ্বৈতমতে তাই জীবের বন্ধন ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে- আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি।
বিভিন্ন বেদান্তশাস্ত্রে নানা কাহিনীর মাধ্যমে জীবাত্মার এই দুই অবস্থা তথা আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি এরকম-
এক গর্ভবতী সিংহী একদল মেষশাবককে তাড়া করে পাহাড় থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ায় তার মৃত্যু হলো। কিন্তু ঐ সিংহীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলো এক সিংহশাবক। সিংহশাবক নিরুপায় হয়ে মেষশাবকদের দলে আশ্রয় নিলো এবং দিনে দিনে মেষশাবকদের অনুসরণে তার প্রকৃতিও মেষশাবকদের অনুরূপ হয়ে ঊঠলো। সিংহের হুংকার ভুলে তখন সে মেষশাবকদের মতো করে ডাকতে শিখলো। এ যেন জীবের আত্ম-বিস্মরণ ও বন্ধন-দশা প্রাপ্তি। পরবর্তীকালে অন্য এক সিংহ মেষশাবক শিকার করতে এসে এই সিংহশাবককে আবিষ্কার করলো। অন্যান্য মেষশাবকদের মতো সিংহশাবকও তখন সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণভয়ে পলায়মান। সিংহ সেই সিংহশাবককে ধরে তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝিয়ে দিলো। কয়েকবার চেষ্টার পর সিংহের অনুকরণে সিংহশাবকও তখন হুংকার দিয়ে উঠলো। এ যেনো গুরুর কাছ থেকে ‘তত্ত্বমসি’ বাক্য শ্রবণান্তর মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা জীবের আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধি। আত্মসাক্ষাৎকার জীবের পরম পুরুষার্থ। আত্মসাক্ষাৎকারেরই অপর নাম ব্রহ্মোপলব্ধি। তাই বেদ-বেদান্তে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ, আত্মা বা নিজেকে জানো।
উপনিষদানুসারী দর্শন হিসেবে অদ্বৈতমতানুযায়ী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই জীবের বন্ধনদশা দূর হয় এবং জীব মোক্ষলাভ করে। এজন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনকেই মোক্ষলাভের উপায় বলা হয়। যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রেই এই উপদেশ উক্ত হয়েছে-
বিদ্যার দ্বারা জীব যখন অবিদ্যাজনিত ভেদজ্ঞান দূর করে এবং দেহাদিসম্বন্ধ ছিন্ন করে, তখন সে নিজেকে ব্রহ্ম-অভিন্ন বলে জানে। নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানাকেই জীবের মুক্তি বলা হয়। অদ্বৈতমতে তাই জীবের বন্ধন ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে- আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি।
বিভিন্ন বেদান্তশাস্ত্রে নানা কাহিনীর মাধ্যমে জীবাত্মার এই দুই অবস্থা তথা আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি এরকম-
এক গর্ভবতী সিংহী একদল মেষশাবককে তাড়া করে পাহাড় থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ায় তার মৃত্যু হলো। কিন্তু ঐ সিংহীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলো এক সিংহশাবক। সিংহশাবক নিরুপায় হয়ে মেষশাবকদের দলে আশ্রয় নিলো এবং দিনে দিনে মেষশাবকদের অনুসরণে তার প্রকৃতিও মেষশাবকদের অনুরূপ হয়ে ঊঠলো। সিংহের হুংকার ভুলে তখন সে মেষশাবকদের মতো করে ডাকতে শিখলো। এ যেন জীবের আত্ম-বিস্মরণ ও বন্ধন-দশা প্রাপ্তি। পরবর্তীকালে অন্য এক সিংহ মেষশাবক শিকার করতে এসে এই সিংহশাবককে আবিষ্কার করলো। অন্যান্য মেষশাবকদের মতো সিংহশাবকও তখন সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণভয়ে পলায়মান। সিংহ সেই সিংহশাবককে ধরে তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝিয়ে দিলো। কয়েকবার চেষ্টার পর সিংহের অনুকরণে সিংহশাবকও তখন হুংকার দিয়ে উঠলো। এ যেনো গুরুর কাছ থেকে ‘তত্ত্বমসি’ বাক্য শ্রবণান্তর মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা জীবের আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধি। আত্মসাক্ষাৎকার জীবের পরম পুরুষার্থ। আত্মসাক্ষাৎকারেরই অপর নাম ব্রহ্মোপলব্ধি। তাই বেদ-বেদান্তে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ, আত্মা বা নিজেকে জানো।
উপনিষদানুসারী দর্শন হিসেবে অদ্বৈতমতানুযায়ী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই জীবের বন্ধনদশা দূর হয় এবং জীব মোক্ষলাভ করে। এজন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনকেই মোক্ষলাভের উপায় বলা হয়। যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রেই এই উপদেশ উক্ত হয়েছে-
‘…আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতাব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো মৈত্রেয়ী, আত্মনো বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।।
অর্থাৎ : মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে। অমৃতের মধুমাখা অনুভূতি নিয়ে অখণ্ড-সত্তায় তার প্রাণ ভরে উঠবে। আত্মজ্ঞান যার হয়, সবকিছুর সঙ্গে যে একাত্ম হতে পারে, তার কাছ থেকে কি অমৃত দূরে থাকতে পারে (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫) ?
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বেদান্তমতে বলা হয়ে থাকে, একমাত্র বেদান্তপাঠের অধিকারীই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের অধিকারী। তাই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের পূর্বে জীবকে বেদান্তপাঠের অধিকার অর্জন ও তার জন্য তৎকারণ বিধিপূর্বক বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন, জন্ম ও জন্মান্তরে কাম্যকর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধকর্ম পরিত্যাগ এবং কেবলমাত্র নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্ত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়াও বেদান্তের অধিকারীকে বিবেক, বৈরাগ্য, শমদমাদি ও মুমুক্ষুত্ব- এই সাধন-চতুষ্টয় অর্জন করতে হবে। এই সাধন-চতুষ্টয়-সমন্বিত ব্যক্তিই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের নিকট বেদান্তপাঠের অধিকারী। বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকরা এই যে পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, তার পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবদ্ধ’।
বেদান্তের অনুবন্ধ :
বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’।
‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রের আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত।
যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত থাকা আবশ্যক।
অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করতে হবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধনসম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।
‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।
এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।
বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।
সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।
প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।
REPORT THIS AD
মোক্ষ বা মুক্তির উপায় :
শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বেদান্ত-পাঠেরই ত্রি-অঙ্গ। প্রথমে আচার্যের নিকট বেদান্তপাঠ শ্রবণ, তারপর যুক্তি ও তর্কের দ্বারা আচার্যের উপদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপাদন বা মনন এবং পরিশেষে আচার্য-উপদিষ্ট তত্ত্বের নিরন্তর ধ্যান বা নিদিধ্যাসনের দ্বারা মোক্ষকামী ব্যক্তির অবিদ্যাজন্য মিথ্যাজ্ঞান বিনষ্ট হয় এবং ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি বা ব্রহ্মস্বরূপতার উপলব্ধি হয়। জীবের এই আত্মোপলব্দিই মোক্ষলাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি। অদ্বৈতমতে মোক্ষলাভ তাই জীবের পক্ষে নতুন কোন প্রাপ্তি-যোগ নয়। এ যেন নিজের হাতের মুঠোয় চাবিকাঠি রেখে সারা ঘরে চাবির অনুসন্ধান এবং অবশেষে মুঠোর ভিতর চাবির আবিষ্কার। তাই মোক্ষপ্রাপ্তি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি।
অদ্বৈতমতে বলা হয়, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। এই অধ্যাসের ফলেই জীব দুঃখাদি-জর্জরিত বদ্ধজীবন ভোগ করে। ব্রহ্ম যখন সূক্ষ্ম-শরীর, স্থূল-শরীর, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সকল উপাধির দ্বারা উপহিত (সীমিত) হন, তখনই তাকে জীব বলা হয়। সুতরাং ব্রহ্মে বিভিন্ন উপাধি আরোপের ফলেই জীবের আবির্ভাব হয়। এই আরোপ আবার অবিদ্যা-জনিত। ব্যষ্টি-অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত আত্মা ঐ সকল উপাধি-উপহিত হয়। উপাধিই জীবের দেহ, বর্ণ, জাতি ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে। অসংখ্য অন্তঃকরণ-উপহিত হয়ে একই আত্মা বহু জীবে রূপান্তরিত হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টিকে বলা হয় অন্তঃকরণ। অন্তঃকরণের ভিন্নতার দ্বারাই জীবের ভিন্নতা নির্ণীত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন জীব ভিন্ন ভিন্ন কর্মফল ভোগ করে।
উপাধি উৎপত্তি-বিনাশশীল। মৃত্যুতে জীবের স্থূলশরীর বিনষ্ট হয়। মৃত্যুর পর জীবের লিঙ্গ-শরীর বা সূক্ষ্ম-শরীর কর্মানুযায়ী বিভিন্ন লোকে গমন করে এবং ঐ কর্মানুযায়ীই পুনরায় নতুন স্থূল শরীর পরিগ্রহ করে। এরই নাম ‘পুনর্জন্ম’। সূক্ষ্ম শরীরেও জীব অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে জীবের কর্মফলও স্থূল-শরীরান্তরে গমন করে। শ্রুতিশাস্ত্রেও বলা হয়েছে-
‘…যত্রাস্য পুরুষস্য মৃতস্য অগ্নিং বাগপ্যেতি, বাতং প্রাণঃ, চক্ষুরাদিত্যং, মনশ্চন্দ্রং, দিশঃ শ্রোত্রং, পৃথিবীং শরীরং, আকাশং আত্মা, ওষধীর্লোমিনি, বনস্পতীন, কেশা, অপ্সু লোহিতং চ রেতশ্চ নিধীয়তে ক্বায়ং তদা পুরুষো ভবতীতি?… তৌ হ যদুচতুঃ কর্ম হৈব তদুচরথ। যৎ প্রশশংসতুঃ কর্ম হৈব তৎ প্রশশংসতুঃ পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি, পাপঃ পাপেনেতি।…’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৩/২/১৩)।।
অর্থাৎ : …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন?
…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।
আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তর-এ গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘তে যে এবমেতদ্ বিদুর্ষে চামী অরণ্যে শ্রদ্ধাং সত্যমুপাসতে তেহর্চিরভিসংভবন্তি অর্চিষোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্যান ষণ্মাসানূদঙ্ঙাদিত্য এতি মাসেভ্যো দেবলোকং দেবলোকদাদিত্যম্ আদিত্যাৎ বৈদ্যুতং, তান্ বৈদ্যুতান্ পুরুষো মানস এত্য ব্রহ্মলোকান্ গময়তি। তে তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতো বসন্তি। তেষাং ন পুনরাবৃত্তি’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/২/১৫)।।
অর্থাৎ : পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাঁকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।
অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারেও মোক্ষলাভে জীবের স্থূল-শরীরের নাশ হয় এবং জন্ম-প্রবাহ রুদ্ধ হয়। জীব তখন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে লীন হয়ে নিজেকে ব্রহ্ম বলে উপলব্ধি করে (সোহহম্)।
অদ্বৈতবেদান্তমতে মুক্তি দুই ধরনের- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। এই মতে, মুক্ত অবস্থাতেও জীবের দেহ থাকতে পারে। দেহ থাকাকালীন জীবের যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অন্যদিকে, দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। জীবন্মুক্তি সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ, সাংখ্য ও জৈন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমত হয়ে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন।
আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মোপলব্ধিতে জীবের মুক্তি হয়। মুক্তিলাভকালে জীবের সঞ্চিত কর্মফল শেষ হয়ে যায়। মুক্তজীব বাসনাহীন। সুতরাং তার কর্মজন্য কোন নতুন ফলোৎপত্তির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তার প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ নাও হতে পারে। প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ না হলে সেই ফলভোগ শেষ করার জন্য মুক্ত পুরুষকে আরও কিছুকাল দেহ ধারণ করে থাকতে হয়। জীবের এইপ্রকার মুক্তিকে বলা হয় জীবন্মুক্তি।
জীবন্মুক্ত পুরুষকে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে হলেও তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি আর থাকে না। বরং সংসারের মায়ায় তিনি আর আবদ্ধ হন না। তিনি অনাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে জীবনযাপন করেন এবং বদ্ধজীবের হিতার্থে নিষ্কাম কর্ম করেন। মুক্তপুরুষের কাছে কর্মের সৎ-অসৎ বা পাপ-পুণ্যের ভেদ থাকে না। রাগ-দ্বেষ থেকেই অসৎ বা পাপকর্মের উৎপত্তি হয়। মুক্ত পুরুষ রাগ-দ্বেষহীন। তাই মুক্ত পুরুষের পক্ষে কোন অসৎ বা পাপকর্ম করার প্রশ্নই নেই। প্রারব্ধ কর্মফল নিঃশেষিত হলে মুক্ত পুরুষের স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুরুষ বিদেহমুক্তি লাভ করে।
অদ্বৈতমতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপ হলো ব্রহ্মসাযুজ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হয়ে যাওয়া। উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, ‘আমিই ব্রহ্ম’ এই উপলব্ধির সাথে লীন হয়ে যাওয়া। এটাই জীবন্মুক্ত অবস্থা। কিন্তু বেদান্তের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ অবশ্য জীবের জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন নি। তিনি বিদেহমুক্তির সমর্থক। তাঁর কাছে মুক্তির অর্থ ব্রহ্মস্বারূপ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সদৃশ হওয়া। ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হওয়া নয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ