শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

30 July, 2020

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য

১৫৩৩ সালের ২৯ জুন গান গাইতে গাইতে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ঢুকে ছিলেন পুরীর মন্দিরে৷ তারপর…… তারপর আর নেই ৷ এরপর আর কেউ নাকি মহাপ্রভুর দেখা পাননি ৷ তিনি বিলীন হলেন কোথায়? গৌরাঙ্গকে ঘিরে সেটাই তো রহস্য ৷
অনেকের ধারণা, ওই দিনই মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর ৷ কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, ওই দিনটিতেই কি তিনি খুন হন? আবার অনেকে তাঁর মৃত্যুর বদলে ‘অন্তর্ধান’ শব্দটাই ব্যবহার করতে চান, কারণ মহাপ্রভু তো সেই দিনটির পর থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ কেউ তো তাঁকে আর কখনও দেখতে পায়নি ৷ সেক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যু অথবা অন্তর্ধান ঘিরে একটা অজানা ‘রহস্য’ বা ‘মিথ’, যাই বলি না কেন কাজ করেছে ৷ আশ্চর্যের কথা, ওই সময় থেকে সাড়ে চারশো বছর পরে সেই রহস্যই ভেদ করতে গিয়ে “কঁহা গেলে তোমা পাই” নামক চৈতন্য অনুসন্ধানী গ্রন্থের লেখক জয়দেব মুখোপাধ্যায়ও ১৯৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল অস্বাভাবিকভাবে মারা যান ৷ অন্তর্তদন্ত বলছে, জয়দেববাবুও নিহত হন। শ্রীচৈতন্য এবং জয়দেব মুখোপাধ্যায় দুই জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুই আসলে খুন বলে দাবি করছে দু’টি প্রবন্ধ ৷ একটি সম্প্রতি লেখা, অন্যটি বেশ কয়েক বছর আগের ৷
 সম্প্রতি সপ্তডিঙা-জুন ২০১৬ সংখ্যায় তমাল দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে’ নামে প্রবন্ধটি৷ অন্যটি বেশ কয়েক বছর আগের ৷ শারদীয়া আজকালে ‘চৈতন্য খুনের কিনারা করতে গিয়ে খুন’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধ লিখেছিলেন অরূপ বসু ৷ শ্রীচৈতন্যেকে ঘিরে মিথ অনেক রকম ৷ যেমন, বর্তমানে পুরীর নীলাচল নামে যে অঞ্চল পরিচিত সেখানেই কৃষ্ণনাম জপতে জপতে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলে যান আর সেই পথেই বিলীন হন মহাপ্রভু । তারপর থেকেই ওই অঞ্চলের নাম নীলাচল। আবার শোনা যায় চৈতন্যদেব নাকি জগন্নাথের মূর্তিতে লীন হয়েছিলেন৷ আবার কেউ কেউ বলেন, নগর সংকীর্তনে বের হয়ে পথে তাঁর পায়ে ইটের আঘাত লেগেছিল৷ তার থেকেই সেপটিসিমিয়া, এবং মৃত্যু ৷ যদিও মন্তান্তরে বলা হয়ে থাকে ইটের টুকরো নয়, পায়ে কাঠি ঢুকে যাওয়াতেই সেপটিসিমিয়া, আর তার জেরে মৃত্যু ৷ কৃষ্ণের সঙ্গে মহাপ্রভুকে মিলিয়ে দিতে দুজনের মৃত্যুতেও মিল টানার একটা অভিপ্রায় রয়েছে এমন মিথ্যের পেছনে ৷ কারণ মহাভারতে ব্যাধের ছোঁড়া তীর লেগেছিল কৃষ্ণের পায়ে আর তার থেকেই মৃত্যু হয়েছিল যশোদা-নন্দনের ৷ কিন্তু উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধই ইঙ্গিত দিয়েছে, শ্রীচৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সেটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের তৎকালীন পাণ্ডারা করেছিল৷ প্রবন্ধকারদ্বয়ের যুক্তি, ঈর্ষাবশত পুরীর পাণ্ডারা চৈতন্যকে হত্যা করেন গুণ্ডিচা মন্দিরের গরুড় স্তম্ভের তলায়। তার পর তাঁর নশ্বর দেহ মন্দিরেই পুঁতে দেওয়া হয় ৷ আর এই সত্য জানতে পারায় পরবর্তীকালে গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়কেও হত্যা করা হয়। প্রসঙ্গত স্বর্গদ্বারে এখন যে চৈতন্যমূর্তিটি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাও জয়দেববাবুর উদ্যোগেই বসানো হয়েছিল ৷ শ্রীচৈতন্যের সংস্পর্শে কলিঙ্গের সেই সময়কার রাজা প্রতাপরুদ্র এতটাই আবিষ্ট হয়ে যান যে, তাঁর ওপর পুরীর পাণ্ডাদের প্রভাব কমে আসে ৷ মহাপ্রভুর মহিমায় রাজা ক্রমশ যুদ্ধবিরোধী হয়ে পড়ায় যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম বিক্রেতারাও অসুবিধায় পড়েছিল৷ তাছাড়া কালকূটের (সমরেশ বসু) ‘জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য’ উপন্যাসেও চৈতন্য হত্যার প্রসঙ্গ এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন তমালবাবু ৷ তিনি প্রবন্ধটিতে আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, চৈতন্য হত্যা নিয়ে মালীবুড়ো (যুধিষ্ঠির জানা) “চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য” নামে একটা বই লিখেছেন৷ তাছাড়া আর বেশ কিছু গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিতে দেখা গিয়েছে নিজ যুক্তির সমর্থনে ৷ অন্যদিকে, অরূপ বসুর প্রবন্ধটিতে প্রশ্ন তোলা হয়, জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হল? তাঁর অন্তর্তদন্তে ইঙ্গিত, ওই গবেষক পুরীতে খুনই হয়েছিলেন ৷ সেক্ষেত্রে তড়িঘড়ি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে পুরো কেসটাই ধামাচাপা দিয়ে দেয় ওড়িশা পুলিশ ৷ আরও প্রশ্ন উঠছে এ কারণেই যে, প্রথমে সংবাদ মাধ্যমে গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর বের হলেও পরবর্তী সময়ে সেই খবরের কোনও ফলো-আপ দেখা গেল না কেন? “কঁহা গেলে তোমা পাই” গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড বের হলেও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের আগেই মারা যান জয়দেববাবু ৷ যদিও দ্বিতীয় খণ্ডের রসদ জোগাড় হয়ে গিয়েছিল তাঁর ৷ অরূপবাবুর প্রবন্ধ থেকেই জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ৫ আগস্ট চৈতন্য গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে পাঠানো একটি চিঠিতে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছিলেন, “চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোনও অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল।…এই বয়সে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল।” আর নীহাররঞ্জন রায় যেটা বলতে চাননি, সেটা হল– জগন্নাথধামের মন্দিরের ভেতরেই চৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়েছিল এবং খুন করেছিল উড়ে পাণ্ডারাই। খোলাখুলি এমন বার্তাই দিয়েছিলেন সাহসী দুই প্রাবন্ধিক ।।
চৈতন্যের থেকে বয়েসে একটু বড়, চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মুরারি গুপ্ত, চৈতন্য কড়চা লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়, সেটাই চৈতন্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ। এতে চৈতন্যের পূর্বপুরুষদের যাজপুর থেকে আসার কোনও দূরদূরান্তের ইঙ্গিত নেই। এরপর চৈতন্যের আরও অনেকগুলো জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়, সেখানেও এমন কিছুর উল্লেখ নেই। মাধব পট্টনায়ক, উড়িয়া কবি, তার চৈতন্য বিলাস গ্রন্থে (১৫১৬) দাবী করেছিলেন, যে চৈতন্যর পূর্বপুরুষ ছিলেন উড়িয়া, মধুকর মিশ্র যাজপুর থেকে গেছিলেন সিলেটে। এই প্রথম এই দাবী উচ্চারিত হল। উল্লেখ্য গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবকেও উড়িয়া বলে দাবী করেছিলেন প্রথম এই মাধব পট্টনায়কই। অর্থাৎ এর একটা প্রবণতাই ছিল বিখ্যাত বৈষ্ণব (জয়দেব অবশ্যই বৈষ্ণব সাধু ছিলেন না, তিনি রাজসভার কবি ছিলেন, রাজসিক ছিলেন। এমনকি তার একটা বীররসের কাব্যও ছিল, যেটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার কিছু শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে ইতিউতি, নীহাররঞ্জন জানাচ্ছেন। এছাড়া জয়দেব বাঙালির নিজস্ব সহজিয়া আদিরসের রসিক, তিনি যৌনতায় সাবলীল। কিন্তু এই মাধব একেবারে জয়দেবকে ভক্ত সাধুসন্ত বানিয়ে সেরেছেন, যিনি নাকি পুরীর কাছে কেঁদুলিশাসন গ্রামে জন্মান এবং কস্মিনকালে তিনি উৎকলের বাইরে যান নি, পুরীর মন্দিরে বসেই গীতগোবিন্দ লেখেন। আমার জয়দেব সংক্রান্ত ইংরেজি প্রবন্ধে এই দাবিগুলোর বিস্তারিত খণ্ডন করেছি) ব্যক্তিদের উড়িয়া বলে দাবী করার। জয়দেব সংক্রান্ত প্রবল মিথ্যাচারিতা যিনি করেছেন, সেই ব্যক্তির চৈতন্য সংক্রান্ত তথ্যকে সত্যি বলে ভাবার কারণ আছে কি? এবং বাঙালিদের মধ্যে এই যাজপুর প্রথম উল্লেখ পাই জয়ানন্দে, যিনি তাঁর চৈতন্য জীবনীটি লেখেন সম্ভবত ১৫৪৮ থেকে ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। জয়ানন্দের সোর্স মাধব। এরপর থেকে ক্রমে ক্রমে বাংলার বৈষ্ণবরাও এই যাজপুর তত্ত্বটি মেনে নেন।
সেযুগে গৌড়ে মুসলমান শাসক। শ্রীহট্টেরও পতন ঘটেছে। বিজয়গুপ্ত তাঁর কাব্যে জানিয়েছেন, কিভাবে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার ঘটত। মধ্যযুগের বাংলার বিবরণ সুকুমার সেন চমৎকার ভাবে দিয়েছেন তার বইতে, সেটা আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন। এইসময়কার বিবরণ তুহিনবাবুর লোকায়ত শ্রীচৈতন্য বইতেও খুব নিরপেক্ষভাবে দেওয়া আছে, সেটাও পড়ে নিতে পারেন। প্রশ্ন হল, এইসময় কে যাবে সিলেটে, হিন্দুরাজ্য যাজপুর ছেড়ে? যাজপুরের রাজা অত্যাচারী, ভালো কথা, কিন্তু সেখান থেকে তাই বলে সোজা যবন শাসনাধীন সিলেট? এ তো পশ্চিমবঙ্গে তৃণ অরাজকতা আছে বলে আফগানিস্তানে গিয়ে সেটল করার সিদ্ধান্তের মত আজগুবি। শাহজালালের সময় (১৩০৩) থেকেই তো সিলেটের অধিকার মুসলমানদের হাতে। চৈতন্যের প্রপিতামহ মধুকর মিশ্র (তাঁর পুত্র উপেন্দ্র, তাঁর পুত্র জগন্নাথ, জগন্নাথের পুত্র চৈতন্য) এই ডামাডোলের মধ্যে কোন আহ্লাদে যাজপুর ছেড়ে সিলেটে থাকতে যাবেন, যেরকমটা দাবী করা হয়েছে মাধব অনুসারী জয়ানন্দের বয়ানে?
বরং চৈতন্যর পিতা যে সিলেটে ইসলামিক উপদ্রব থেকে বাঁচতে নবদ্বীপে চলে আসেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়। ওই সময়ে আরও অনেক ব্রাহ্মণ সিলেট থেকে নবদ্বীপে চলে এসেছিলেন, নবদ্বীপের চৈতন্য আন্দোলনে এই পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা মানুষজন একটা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এবং এই পূর্ববঙ্গীয় ব্যাপারটাই পাই বারবার। কোথাও একবারের জন্যও চৈতন্যর ঠাকুরদা যে উড়ে ছিলেন, সেই প্রসঙ্গ চৈতন্যের সমসাময়িক বাঙালি সঙ্গীসাথীরা বলছেন না।
এইসব কারণে আমার ধারণা মধুকর মিশ্র সিলেটেরই আদি বাসিন্দা ছিলেন, যাজপুর থেকে যান নি। তাছাড়াও চৈতন্যর বংশটি ছিল পাশ্চাত্য বৈদিক (“আসী শ্রীহট্ট মধ্যস্থ্যে মিশ্রোমধুকরাভিধঃ । পাশ্চাত্যে বৈদিকবিশ্বেব তপস্বী বিজিতন্দ্ৰিয়ঃ।" -শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যোদয়াবলী), এই শ্রেণীর ব্রাহ্মণ যে উড়িষ্যায় মেলে না, সেটা জোর দিয়ে বলছেন চৈতন্য গবেষক বিমান বিহারী মজুমদার এবং মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল। উভয়েই যাজপুর তত্ত্বের প্রবল বিরোধিতা করেছেন, এবং ওটিকে অসত্য বলেছেন। ঐতিহাসিক যুক্তিগুলো এঁদের লেখায় পাবেন।
কিন্তু আমার মতে চৈতন্য সবার আগে একজন বাঙালি ছিলেন, চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধান করতে গেলে সবথেকে আগে এই সত্যটিকে অনুধাবন করতে হয়। সেযুগের বাঙালিত্বের মন্থনে যে অমৃত উঠে এসেছিল, তার নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া, সাধে কি আর কবি লিখেছিলেন? সেই চৈতন্য কেন, কি পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটার উত্তর চৈতন্য কে ছিলেন, চৈতন্য কি ছিলেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত।
চৈতন্যলীলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমাদের আওতার বাইরে। এবার সরাসরি তাঁর নীলাচলে যাওয়ার প্রসঙ্গে আসব, তারপরে মৃত্যুপ্রসঙ্গ।
সেসময়ের নবদ্বীপ এক মহামন্থনস্থল। ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দু তখন নবদ্বীপ, একের পর এক মহাধনুর্ধর পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটছে সেখানে। বঙ্কিমের ভাষায়, এই সময়ে বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস।
“ইউরোপ সভ্য কত দিন? পঞ্চদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ চারি শত বতসর পূর্ব্বে ইউরোপ আমাদিগের অপেক্ষাও অসভ্য ছিল। একটি ঘটনায় ইউরোপ সভ্য হইয়া গেল। অকস্মাৎ বিনষ্ট বিস্তৃত অপরিজ্ঞাত গ্রীকসাহিত্য ইউরোপ ফিরিয়া পাইল। ফিরিয়া পাইয়া যেমন বর্ষার জলে শীর্ণা স্বোতস্বতী কুলপরিপ্লাবিনী হয়, যেমন মুমূর্ষু রোগী যৌবনের বলপ্রাপ্ত হয়, ইউরোপের অকস্মাৎ সেইরূপ অভ্যুদয় হইল। … আমাদিগেরও একবার সেই দিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়; তার পর রূপসনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধর্ম্মতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত। এ দিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণী, গদাধর, জগদীশ; স্মৃতিতে রঘুনন্দন, এবং তৎপরগামিগণ। আবার বাঙ্গালা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, চৈতন্যের পূর্ব্বগামী। কিন্তু তাহার পর চৈতন্যের পরবর্ত্তিনী যে বাঙ্গালা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তাহা অপরিমেয় তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়া; সে কোথা হইতে?
আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দিপ্তী হইল? এ রোশনাইয়ে কে কে মশাল ধরিয়াছিল? ধর্ম্মবেত্তা কে? শাস্ত্রবেত্তা কে? দর্শনবেত্তা কে? ন্যায়বেত্তা কে? কে কবে জন্মিয়াছিল? কে কি লিখিয়াছিল? কাহার জীবনচরিত কি? কাহার লেখায় কি ফল? এ আলোক নিবিল কেন? নিবিল বুঝি মোগলের শাসনে। হিন্দু রাজা তোড়লমল্লের আসলে তুমার জমার দোষে।” (বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা)
শিশিরকুমার ঘোষ এই প্রসঙ্গে অমিয় নিমাই চরিতে বলছেন বাসুদেব সার্বভৌমের কথা, যিনি সমস্ত ন্যায়শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে এনেছিলেন মিথিলা থেকে (কারণ মিথিলার পণ্ডিতরা গৌড়ীয় ব্রাহ্মণের মেধাতীক্ষ্ণতায় আশঙ্কিত হয়ে কোনও পুঁথি মিথিলা থেকে নিয়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন)।
“সার্বভৌম যখন টোল বসাইলেন, তখন রঘুনাথ, রঘুনন্দন, কৃষ্ণানন্দ প্রভৃতি ছাত্রগণ সেখানে বিদ্যা উপার্জন করিতেছিলেন, এবং সার্বভৌম টোল করিলেই উহারা সকলেই তাঁহার টোলে প্রবেশ করিলেন।
রঘুনাথ – ইনি দিধীতির গ্রন্থকার। ন্যায়ের এরূপ গ্রন্থ আর তাঁহার ন্যায় নৈয়ায়িক জগতে আর সৃষ্ট হয় নাই।
ভবানন্দ – ইনি রঘুনাথের সমকক্ষ জগদীশের গুরু। ইহাই বলিলে যথেষ্ট হইবে যে পণ্ডিত জগদীশের নামে ন্যায়শাস্ত্রকে জাগদিশী বলে।
রঘুনন্দন – ইনি স্মার্ত ভট্টাচার্য। ইনি স্মৃতি অষ্টবিংশতি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়া যে স্মৃতি তত্ত্বের সৃষ্টি করেন, তাহা অদ্যাবধি বাংলায় রাজত্ব করিতেছে।
কৃষ্ণানন্দ – ইনি তন্ত্রসার গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইনি তন্ত্রসারের রাজা।
এই সকল লোক চিরদিন পূজিত থাকিবেন। ইঁহাদের ন্যায় পণ্ডিত বঙ্গদেশে প্রায় কেহ জন্মগ্রহণ করে নাই।” (অমিয় নিমাই চরিত)
বাসুদেব সার্বভৌমের টোলের ছাত্রদের মধ্যে নিমাই-ও ছিলেন। তিনি কিছুদিন এখানে পড়েছিলেন।
সার্বভৌম এরপরে নবদ্বীপ ছেড়ে উড়িষ্যায় চলে যান। সেযুগের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি অধ্যাপক পুরীতে গিয়ে টোল খুলে বসেন, যার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকা খুবই সম্ভব। বাঙালির প্রজ্ঞা উৎকলকে নিয়ন্ত্রণ করলে তাতে হিন্দুধর্মের ও হিন্দুসমাজের মঙ্গল ছিল, ভারতের মঙ্গল ছিল। পরবর্তীতে এই সার্বভৌমের নেটওয়ার্কই ব্যবহার করবেন চৈতন্য স্বয়ং। সার্বভৌমের প্রস্থানের সঙ্গে প্রাচীন যুগে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের তিব্বতে চলে যাওয়ার সামান্য মিল আছে, কিন্তু অতীশ চলে যাওয়ায় ভারত অন্ধকার হয়ে গেছিল বলা হয়, সেটা বাসুদেবের প্রস্থানের ফলে বাংলার ক্ষেত্রে হয়নি, কারণ তাঁর হাতে গড়া তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীরা ছিলেন। নবদ্বীপ তখন বাংলার শুধু নয়, ভারতের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। চৈতন্য হত্যা নিয়ে আমাদের আলোচনায় উড়ে পাণ্ডাদের প্রতি মনোযোগ সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত, কিন্তু সর্ষের মধ্যেও তো ভূত থাকতে পারে, এবং আছে। অর্থাৎ চৈতন্যকে নিয়ে ইতিহাসনিষ্ঠ আলোচনায় একদল বাঙালিও প্রাণপণে ব্যাগড়া দিয়েছেন। নমুনা দিচ্ছি নিচে। চৈতন্য গবেষণায় যা যা এদের মনঃপূত হয় না, সেগুলো নিষিদ্ধ করার চেষ্টা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একদল করেছেন। প্রকাশ্যে এরা বলেন, চৈতন্য ঐশ্বরিক চরিত্র, তাঁর ওপরে মানবতা আরোপ করে তাঁকে পাণ্ডাদের হাতে নিহত দেখালে বৈষ্ণবধর্মের আধ্যাত্মিক চেতনা নষ্ট হয়। গোপনে গোপনে যে এরা কাদের দালালি করছেন, সে এক বিপজ্জনক সম্ভাবনার জগত।
উড়েদের জয়দেব-চুরির বিরুদ্ধে সবথেকে অসাধারণ কাজ করেছিলেন প্রশান্ত দাশগুপ্ত, তার বাংলা ইংরেজি দুটো বই-ই আউট অফ প্রিন্ট হয়ে আছে, কোথাও পাওয়া যায় না। কেন কে জানে! এদিকে, “চৈতন্যকে কেন্দ্র করে তথ্যলোপের ঘটনা নতুন কিছু নয়”, তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেনঃ “স্বরূপ দামোদরের 'কড়চা' আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি বৃন্দাবনদাস রচিত 'চৈতন্যভাগবত'এর শেষ অংশ। অনেকেই সন্দেহ করেন, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থ দুটিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুরারি গুপ্তের 'কড়চা'র মূল পুঁথিটিও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় নি। … ঐতিহাসিক ড. অমূল্যচন্দ্র সেন-এর লেখা 'ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য' গ্রন্থটিও (সেপ্টেম্বর ১৯৬৫) বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়।”
বিমান বিহারী মজুমদারের চৈতন্যচরিতের উপাদান হল চৈতন্য গবেষণার এক অমূল্য আকরগ্রন্থ। মজার ব্যাপার হল, এই বিমান বিহারী নিজেই রসরাজ গৌরাঙ্গ -স্বভাব নামে একটা বইয়ের সমস্ত কপি খুঁজে খুঁজে এনে নষ্ট করিয়েছিলেন, বইটির বিরুদ্ধে চৈতন্য চরিত্রে অশ্লীলতা আরোপের অভিযোগ তুলে, তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন। সে বইতে কি লেখা হয়েছিল আর জানার উপায় নেই বলে অভিযোগের যথার্থতা যাচাই করা আর সম্ভব নয়। তবে চৈতন্য আন্দোলনকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও শুচিবাই দিয়ে মাপতে গেলে ভুল হয়। এর উৎসে যে বাংলার সহজসাধনা, তা ভুলে গেলে এর প্রতি মহা অবিচার ঘটে।
কালকূটের জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য উপন্যাসে চৈতন্যহত্যার কথা বলা হয়েছে। এখন সেই উপন্যাসে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত থেকে যে উদ্ধৃতি রয়েছে (যাতে দাবী করা হয়েছে যে চৈতন্যের সহজিয়া সাধনার সঙ্গিনী ছিলেন সার্বভৌম কন্যা ষষ্ঠী), তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সেটা আর কৃষ্ণদাসের রচনায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি চৈতন্যচরিতামৃতের মত মহাপুস্তকও সেনসরশিপের শিকার হয়েছে? চৈতন্যকে বাংলার সহজিয়া চেতনার ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপটে দেখতে কোন্‌ ব্রাহ্মণ্যবাদী, আধা-আব্রাহামিক, আধা-ভিক্টোরীয় এবং সম্পূর্ণ না-বাঙালি ধ্যানধারণা আজও বাধা দিয়ে চলেছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। এদের সঙ্গে চৈতন্য-হন্তা পাণ্ডাতন্ত্রের কি কি যোগাযোগ আছে, এরা পাণ্ডাতন্ত্রের স্বাভাবিক মিত্র কি না, সেগুলোও আজ খতিয়ে দেখা দরকার।
চৈতন্যের ও তাঁর আন্দোলনের দুটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, এক, এই আন্দোলন পূর্ব ও উত্তর ভারতে বাঙালির চিরাচরিত প্রভাবাধীন ভূমিতে বাঙালির জীবনীশক্তিকে পুনরায় স্থাপিত করছিল। উত্তর ভারতে গয়া থেকে বারাণসী থেকে বৃন্দাবন, চৈতন্যের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈষ্ণব ঘাঁটিগুলোর এই সারকিটটা দেখুন। আর এদিকে দক্ষিণদিকে বালাসোর (যেখানে ঈশ্বরপুরীর ঘাঁটি ছিল) থেকে পুরী - এ দেখে মনে হয় না, রাজা শশাঙ্কের, বা ধর্মপাল-দেবপাল, বা বল্লালসেন-লক্ষ্মণসেনের রাজ্যের মানচিত্র আবার অঙ্কিত হচ্ছে? কি আশ্চর্য! ইতিহাস কি রক্তকণিকায় প্রবাহিত হয়? সে ইতিহাস তো বিলুপ্ত, ধ্বংস, চৈতন্যের সময়ে ভক্ত বৈষ্ণবে সে ইতিহাস, সে মানচিত্র পাঠ করেছে বলে মনেও হয় না। তা সত্ত্বেও আবার যে বাঙালি তার ঘর সাজাতে শুরু করল, সেই প্রাচীন গঙ্গারিডাই সভ্যতার দিনকাল থেকে সহস্র সহস্র বছর ধরে তার যে প্রভাববলয়, সেখানে আবার সে ডানা মেলতে শুরু করল, একে কি বলব, জাতিগত স্মৃতি? যাই হোক না কেন, চৈতন্য আন্দোলন ভারতভূমিতে বাঙালি মননের প্রাধান্যর পুনর্বিস্তারে আরেক পদক্ষেপ। চৈতন্যর পূর্বসূরী অদ্বৈত গোস্বামী দীক্ষা নিয়েছিলেন ঈশ্বরপুরীর কাছে, চৈতন্যের দীক্ষাও এই ঈশ্বরপুরীরই কাছে। এই ঈশ্বরপুরী বাঙালি বৈদ্যজাতে জন্ম নিয়েছিলেন, বাড়ি ছিল কুমারহট্টে (হালিশহরে)। চৈতন্য আন্দোলনের পেছনে বৈদ্যজাতের ভূমিকা নিয়ে একটা সম্পূর্ণ প্রবন্ধ হতে পারে, তবে সে অন্য কথা।
দ্বিতীয়ত, চৈতন্য-নিত্যানন্দের এই আন্দোলন সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামির থেকে বেরিয়ে এসে সহজিয়া চেতনার পথে এ দেশ, এ সমাজের পুনরুজ্জীবনের পথে হাঁটছিল। যে মূর্খ পাণ্ডার দল কালাচাঁদ রায় সাতদিন ধরে পুরীর মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পরে তাকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় এবং সেই কালাচাঁদ পরে কালাপাহাড় হয়ে ফিরে আসে এই বিদ্বেষময়, গোঁড়া সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে নেমেসিস হয়ে, তাদের পক্ষে চৈতন্যের এই ভাব আন্দোলনের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। যে গৌড়ীয় ব্রাহ্মণরা সুবুদ্ধি রায়কে গরম ঘি খেয়ে কিংবা তুষানলে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করতে বলেছিল (সুবুদ্ধিকে হুসেন শাহ মুসলমানের জল খাইয়ে তার ধর্মনষ্ট করেছিলেন, তারই পরিণতিতে সুবুদ্ধি হিন্দুসমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হন, এবং সুবুদ্ধি যখন হিন্দুসমাজে ফেরার জন্য ব্রাহ্মণদের কাছে নিদান চান, তখন এই চমৎকার ব্যবস্থা করেন সেই ব্রাহ্মণেরা), সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার স্ব-ভাব নয়। সেই নির্মম, সঙ্কীর্ণ, নির্বোধ, ছুঁৎমার্গী, অমানবিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার নিজস্ব নয়। সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বাঁচিয়েছিলেন। যখন সুবুদ্ধি বারাণসীতে গমন করেন, নিদান চাইতে, সেখানে ভাগ্যবশতঃ চৈতন্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, এবং সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বৃন্দাবনে প্রেরণ করেন। শিশির ঘোষ তাঁর অমিয় নিমাই চরিতে এই ঘটনাটি দিয়ে উপক্রমণিকা শুরু করছেন। অর্থাৎ চৈতন্য ধর্মের স্বরূপ হল এর মানবিক অ্যাপ্রোচ, যা একান্তভাবেই বাংলার সহজিয়া সাধনার ঐতিহ্য। এবং বাংলার মুসলমান শাসকের আগ্রাসনের মুখোমুখি চৈতন্যের স্ট্র্যাটেজির যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা আছে, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ধরণের স্ট্র্যাটেজি যখন তিনি জগন্নাথ মন্দিরে বসে নেবেন, তখন তাঁকে যে ধাক্কাটা সামলাতে হবে, সেটা শুধু পাণ্ডা-হিন্দুত্বের গোঁড়ামির নয়, সেটা তাদের বাঙালি-বিদ্বেষেরও বটে, যারা এই প্রেমধর্মকে বুঝতে পারে না, আর নিজেদের নির্বোধ ঘৃণাকেই হিন্দুধর্মের আকর বানিয়ে ফেলে। যে নিত্যানন্দ ছিলেন অবধূত, যিনি সমস্ত সঙ্কীর্ণ আচার-ব্যবহারের উর্ধ্বে, যাকে কোনও ছুঁৎমার্গে ফেলা যায় না, আর যে চৈতন্য ছিলেন সর্বজীবে সমকরুণার আকর, তারা বাঙালিকে রিপ্রেজেন্ট করেন, বাঙালির প্রকৃত প্রেমধর্মের প্রতিনিধি তাঁরা। পাণ্ডাধর্মের সঙ্গে প্রেমধর্মের ঠুকোঠুকি লেগেছিল, লাগাটা অবশ্যম্ভভাবী ছিল।
চৈতন্যকে বা জয়দেবকে উড়ে বানানোর পেছনে যে বাঙালি-বিদ্বেষ কাজ করছে, তাকে চেনা ও জানা খুবই দরকার। হরিদাসকে যখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ ব্রাহ্মণ বানাতে চায় (আসলে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম কিন্তু মুসলমান-গৃহে পালিত – এই মিথ ও মিথ্যার প্রচার করে। দীনেশ সেন বলছেন, হরিদাস জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন, ব্রাহ্মণ ছিলেন না মোটেই, সমস্ত প্রাচীন নথি সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এবং জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন বলেই এমন চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁর হরিভক্তির। সে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, বাইশটি বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেত্রাঘাত করে মেরে ফেলা হবে, এমন আদেশ দিয়েছিলেন গৌড়ের সুলতান। অসম্ভব বলশালী দীর্ঘদেহী স্বাস্থ্যবান পুরুষ ছিলেন হরিদাস, তাই কোনওমতে বেঁচে যান), তখনও একটা মুসলমান বিদ্বেষ কাজ করে। এগুলো অন্যায় তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এগুলো শেষ বিচারে হিন্দু ছুঁৎমার্গ, যা হিন্দুধর্মকেই যুগে যুগে দুর্বল করেছে। বাঙালির থেকে যদি উড়িষ্যাকে জয়দেবের অমর কাব্য নিতে হয়, হিন্দুকে যদি জন্মসূত্রে মুসলমান হরিদাসের কাছ হরিভক্তি শিখতে হয়, সে তো আনন্দের, সে তো আহ্লাদের কথা, এই প্রসারণের মধ্যে দিয়েই তো মানব-সভ্যতা প্রাচীন কাল থেকে এগিয়ে চলেছে, এভাবেই তো বাঙালির দেশজ ধর্ম সমস্ত বিজাতীয় আগ্রাসনকে হারিয়ে দেয়।
কিন্তু না, এগুলো এদের বোঝানো যাবে না, কাজেই হরিদাস মুসলমান হতেই পারেন না। তাকে ব্রাহ্মণ বানাতেই হবে। আর এভাবেই জয়দেব ও চৈতন্যকে না-বাঙালি প্রমাণ করে, আদতে উড়িষ্যাবাসী প্রমাণ করে মাধব পট্টনায়ক সেযুগের একটা শক্তিশালী উড়ে লবির বাঙালি-বিদ্বেষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের স্তোক দিতে চেয়েছিলেন। শেষ বিচারে, এটা হিন্দুত্ববাদের জঘন্যতম অংশগুলোর অন্যতম। অপর (আদার)কে এই নির্বোধ একবগগা বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে হিন্দুধর্মের যত অপকার হয়েছে, এতটা কোনও বহিরাগত শক্তির আক্রমণেও হয়নি। সর্বোপরি, যে পাণ্ডাতন্ত্র যবন হরিদাসের সঙ্গে আগ্রাসী মুসলমানের ফারাক করতে পারে না, যে পাণ্ডাতন্ত্র কালাচাঁদ রায়কে কালাপাহাড় বানিয়ে দেয়, যারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভক্তিধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সামাজিক গুরুত্ব বোঝে না, সেই পাণ্ডাতন্ত্রের থেকে বড় শত্রু হিন্দুধর্মের আর নেই, এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা দরকার।
গণ-আন্দোলনের গুরুত্ব চৈতন্যরা জানতেন, পাণ্ডাতন্ত্র বুঝত না। হিন্দুসমাজের সংস্কারের পথিক চৈতন্য নিত্যানন্দ প্রমুখ, যাঁরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্রেমধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, সেযুগের বদ্ধ হিন্দুসমাজে এক বিপ্লব এনেছিলেন, এবং এই মূর্খ, ক্ষমতালোভী পাণ্ডারা, যাদেরকে আজকের হিন্দুত্ববাদেরই পূর্বসূরী বলা যায়, সেই চৈতন্যকেই মেরে ফেলল, সেই চৈতন্যকেই মুসলমান শাসকের গুপ্তচর ভাবল। এ অত্যন্ত স্বাভাবিক ট্র্যাজেডি, এরকমই হওয়ার ছিল। হিন্দুসমাজের ভেতরে যে পচন ধরেছিল, সেই পচন, সেই পুঁজরক্তময় ঘা একদিন চৈতন্যস্বরূপ ঔষধিকেই বিষ বলে প্রচার করতে শুরু করল।
চৈতন্যপন্থা ছিল বাঙালির সহজাত সহজিয়া প্রেমসাধনা। এর সঙ্গে কনট্র্যাস্ট করুন উড়ে অ্যাপ্রোচের, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তির ভালো মিল আছেঃ দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি। এদের মনের দরজা বন্ধ, এরা অপরের ভালোটা বরং পারলে চুরি করে হাতিয়ে নেবেন, তবুও কদাপি অপরকে ভালো বলে স্বীকার করবেন না।
আলোচনা চলবে।
সঙ্গের ছবিটি বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ যবন হরিদাসকে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতের বর্ণনা করছে। পুরীতে যবন হরিদাসের সমাধি মঠে এই ছবিটি রাখা আছে।
আমরা দেখছি, চৈতন্য বাংলার সেই আবহমান প্রেমধর্মের প্রতিনিধি, যার ডকুমেন্টেড ইতিহাস আমরা ধর্মপাল দেবপালের আমলে দেখেছি, বাঙালি যোগীপাল ভোগীপাল মহীপালের সঙ্গীতে যে ভালবাসার সময়কে ধরে রেখেছিল। চৈতন্য অবশ্য বৌদ্ধবিরোধী ছিলেন, তবে সে তো যুগধর্মের প্রকাশ, সেযুগে বৌদ্ধবিরোধিতা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু চৈতন্যধর্মের শেকড় যেখানে, সেখানে বৌদ্ধ সহজযানের নির্যাস পরমসযত্নে ধরে রাখা আছে। সেখানে ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণের ছুঁৎমার্গ নেই। চৈতন্য যে শুধু হরিদাসের মত যবনকে বুকে টেনে নিয়েছেন তাই নয়, তিনি হোসেন শাহের রাজ-প্রশাসন ও সৈন্যদলের কর্তা দবীর খাস ও সাকর মালিককে রূপ সনাতনে রূপান্তরিত করছেন। মালীবুড়ো বলছেন যে হোসেন শাহ রূপ ও সনাতনের দলত্যাগের পরে গৌড় থেকে উড়িষ্যার দিকে আর একটাও আগ্রাসন চালাতে পারেন নি, তার রাজ্যপাট কানা হয়ে গিয়েছিল। স্মর্তব্য, রূপ সনাতন যখন মুসলমান শাসকের চাকরি করতেন, ওঁরা নিজেরাই আচার ব্যবহারে প্রায় মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক গবেষক বলেন যে ওঁরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমানই হয়েছিলেন, আর সেজন্যই পুরীতে এলে ওঁরা যবন হরিদাসের আশ্রয়েই বাস করতেন, অন্যত্র ওঁদের ঠাঁই মিলত না। প্রসঙ্গত বলি, বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ যবন হরিদাসকে কোনওদিন জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেয় নি পাণ্ডারা।
রূপ সনাতনকে যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের উদার পক্ষপুটে আশ্রয় দিলেন, ঘরে ফেরালেন, তাঁর থেকে হিন্দুধর্মের বড় বন্ধু আর কে? সেই চৈতন্যকে যারা মুসলমান শাসকের আগ্রাসনের সহায়ক আখ্যা দিয়ে হত্যা করল, সেই পাণ্ডাতন্ত্রের থেকে হিন্দুধর্মের বড় শত্রু আর কে? বস্তুত হোসেন শাহের গুপ্তচর যদি কেউ থেকে থাকে, তো এই লোভী আত্মপরায়ণ পাণ্ডাদের মধ্যেই সেটা থাকার প্রভূত সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রমাণের অভাবে এ বিষয়ে অধিক আলোচনা করতে পারছি না। কিন্তু যুক্তি বলছে, থাকা খুবই সম্ভব।
বাংলা ত্যাগ করে নীলাচলে কেন এসেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু, আমরা জানি। গৌড়ে থাকলে তাঁর প্রাণসংশয় হত। নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হবে, এই প্রবাদ চালু আছে শুনে গৌড়ের মুসলমান শাসক হোসেন শাহ নবদ্বীপে যে মারাত্মক অত্যাচার শুরু করেছিলেন, সে স্মৃতি তখনও টাটকা। চৈতন্যর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় হিন্দুবিদ্বেষী শাসকের সন্দেহ পুনরায় জাগ্রত হতে পারত বলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় নীলাচলে। অনেক আগে বাসুদেব সার্বভৌমও সম্ভবত একই রকম আশঙ্কায় নীলাচলে চলে গিয়েছিলেন।
এইবার চৈতন্য নীলাচলে পৌঁছলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের নেতা চৈতন্যর সঙ্গে মহাপ্রতিপত্তিশালী বাসুদেব সার্বভৌমের যোগাযোগ ঘটান সার্বভৌমেরই ভগ্নীপতি, চৈতন্য অনুরাগী গোপীনাথ আচার্য, যিনি নবদ্বীপের বাসিন্দা, এবং চৈতন্যের নীলাচল আগমনের সময়ে সেখানে ছিলেন (যেটা পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা হওয়ার অত্যন্ত সম্ভাবনা)। উপরন্তু, সার্বভৌম এসে সঠিক সময়ে না বাঁচালে চৈতন্যদেবের প্রাণসংশয় হত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশের প্রথমদিনই। পাণ্ডারা তাঁকে “মার মার” শব্দে খুন করতে উদ্যত হয়েছিল, সে প্রমাণ আমরা শিশির ঘোষের অমিয় নিমাই চরিতে পাই।
জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শুরুতে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের একটা চিঠির কথা বলা হচ্ছে, সেই চিঠির কথা চৈতন্য হত্যা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই বলেছি।
“পুরীগামী জগন্নাথ এক্সপ্রেসের প্রথমশ্রেণীর কামরার চারটি বার্থের একটিতে শুয়ে আনন্দ কেবল চিন্তার আগুনে দগ্ধই হয়ে চলছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল তার ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের লেখা পত্রের সেই সাংঘাতিক রোমহর্ষক কথাগুলি। ৫।৮।৭৬ তারিখের দীর্ঘ পত্রের এক জায়গায় বেশ জোরের সঙ্গেই লিখেছেন তিনি - 'শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে গুম খুন্‌ করা হয়েছিল পুরীতেই এবং সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয় নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিম্বদন্তী প্রচারের প্রয়োজনও হয়েছিল। … ঐ গুম্‌খুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিন চিন্তিত, বহুজন সমর্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা এই চক্রান্ত করেছিলেন আমার অনুমান একটা আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না। কারণ এখনও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই।”
আশ্চর্য! নীহাররঞ্জনের এই চিঠি যদি সত্যি হয় (মিথ্যা বলে ভাবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই, কারণ নীহাররঞ্জনের মৃত্যুর পরে এই মর্মে দেশ পত্রিকায় ১৯৯০ সালে প্রকাশিত একটা প্রবন্ধের রেফারেন্স মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের বইতে পাচ্ছি, যেখানে চৈতন্য হত্যার কথা নীহাররঞ্জন পুনরায় বলছেন। উল্লেখ্য নীহাররঞ্জনের মৃত্যু ১৯৮১ সালে), তাহলে জয়দেব মুখোপাধ্যায় প্রাণ দিয়ে সেই আশঙ্কার যথার্থতা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি আমাদের আলোচনার শেষে তথ্যসূত্রে দেওয়া লিঙ্কে গেলে পড়তে পারবেন।
পুরীর কথা বইটির টীকা আমাদের বলছেঃ
“পরবর্তী যুগের বহু গবেষক মহাপ্রভুর অন্তর্ধান খোলা মনে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা সন্দেহ করেছেন বিভিন্ন কারণে, শ্রীচৈতন্যের প্রতি ঈর্ষায় তাঁকে গোপনে হত্যা করে মৃতদেহ গুম করে দেওয়া হয়। এঁদের কারো বক্তব্য জগন্নাথ মন্দিরের কোইলি বৈকুণ্ঠে, যেখানে দারুব্রহ্মের পুরোনো মূর্তি সমাধিস্থ করা হয়, সেখানেই মহাপ্রভুর দেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছে। চৈতন্যদেবকে হত্যার কারণ হিসেবে এরা উড়িয়া ও গৌড়ীয়দের বিবাদ বা চৈতন্যদেবের প্রভাবে ধর্মমুখি (sic) হয়ে রাজা প্রতাপরুদ্রদেব বা মন্ত্রী রায় রামানন্দ প্রভৃতির রাজকার্যে অবহেলা এবং ফলে কলিঙ্গ রাজ্যে বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং সীমানা হ্রাস রোধ করতে চাওয়ার রাজনৈতিক কারণ প্রভৃতির কথা বলে থাকেন।”
এই সময় প্রতাপরুদ্রের রাজ্যে আগ্রাসন শুধু গৌড়ের মুসলমান শাসক করছিলেন না। বিজয়নগর সাম্রাজ্য থেকেও কৃষ্ণদেবরায়ের নেতৃত্বে আক্রমণ আসছিল অনবরত (যা এক অখণ্ড হিন্দুত্বের মিথের অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকাশ করে), সেগুলো প্রতিহত করা যাচ্ছিল না। চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যা দুর্বল হয়নি, সেটার অনেক প্রমাণ আছে, আলোচনার শুরুতেই বলেছি। কিন্তু চৈতন্যবিরোধী, বাঙালিবিরোধী শক্তি চৈতন্য আন্দোলন ও উড়িষ্যার সামরিক বিপর্যয়, এ দুটোকে এক করে দেখাতে সক্রিয় ছিল। চৈতন্য শেষদিকে গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গেই শুধু স্বচ্ছন্দ থাকতেন, তাঁরা নীলাচল থেকে চলে গেলেই তাঁর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিত, যাকে জীবনীকাররা কৃষ্ণবিরহের আকুলতা বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। এ আসলে চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বৈষ্ণব আন্দোলনের পুরোধার অসহায়তা।
যবন হরিদাস এইসময়ে অনশনে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। সম্ভবত এই সময়ে যবন হরিদাসকে কেন্দ্র করেও চৈতন্যবিরোধী চক্র অপপ্রচার চালাচ্ছিল (এরকম একটা সন্দেহ তুহিন মুখোপাধ্যায় করছেন), এবং চৈতন্যদেবকে তাঁর জন্য কুৎসার শিকার হতে হচ্ছে, এই দুঃখে সম্ভবত অশীতিপর বৃদ্ধ হরিদাস (১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম) গৌড়ীয় ভক্তরা চলে যাওয়ার পরেই প্রাণত্যাগ করেন। এই মৃত্যুর পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল কি না, সেটা কেউ খতিয়ে দেখেন নি এখনও পর্যন্ত। চৈতন্যদেব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গ পরিকরদের অন্তর্ধানকে গবেষকরা মোটামুটি সবাই চৈতন্য হত্যার ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবেই দেখেন। এমন কি হতে পারে, হরিদাসের মৃত্যু দিয়েই সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল?
অদ্বৈত আচার্যের সেই বিখ্যাত হেঁয়ালি কি চৈতন্যের প্রতি একটা সতর্কবাণী ছিল? শিশিরকুমার ঘোষ প্রণীত শ্রী অমিয় নিমাই চরিত থেকে উদ্ধৃত করছি।
জগদানন্দ শ্রীনবদ্বীপ ত্যাগ করিয়া নীলাচল অভিমুখে যাইতে অদ্বৈতের নিকটে চলিলেন। সেখান হইতে বিদায় হইয়া মহাপ্রভুর নিকটে আসিলেন। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া শ্রীনবদ্বীপের ভক্তগণের সংবাদ সমুদায় বলিলেন। তাহার পরে বলিতেছেন, “শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু আপনাকে একটি তরজা বলিয়া পাঠাইয়াছেন, সে তরজাটি এই -
প্রভুকে কহিও আমার কোটি নমস্কার।
এই নিবেদন তাঁর চরণে আমার।।
“বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল।
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল।
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।।”"

মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল বলছেন যে এই চর্যা শোনার পর থেকে চৈতন্যদেবের মধ্যে বিরহযন্ত্রণা বেড়ে গেছিল, এবং ঘন ঘন বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হতে শুরু করেন তিনি, প্রলাপ বকতেও শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন জীবনী থেকে জানা যায়, চৈতন্যকে বিষাদে গ্রাস করেছিল। তিনি গৌড়ে আর ফিরতে পারবেন না, রূপ সনাতনকে হোসেন শাহের দল থেকে ভাঙিয়ে আনার পরে সেটা তো আর সম্ভব নয়, ফিরলেই প্রাণসংশয়। অদ্বৈতের এই ছড়ায় সম্ভবত উৎকলের অবস্থা সম্পর্কে চৈতন্যকে সতর্ক করা হয়েছে, প্রেমধর্মের চাউল আর হাটে বিক্রি করতে দেওয়া হচ্ছে না, এবং এসময়ে উড়িষ্যায় বসে বৈষ্ণবধর্মের প্রচারে কাজ নেই, বিপদ হতে পারে। অর্থাৎ এখানে চৈতন্যবিরোধী, বাঙালিবিরোধী ষড়যন্ত্রের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসার সাঙ্কেতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। মহাপ্রভুকে এই সময়ে বৃন্দাবন নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ও যোগাড়যন্ত্রও শুরু করেছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা, বৃন্দাবনে তাঁর জন্য বাসস্থানও নির্দিষ্ট হয়েছিল। সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। সার্বভৌম কিন্তু দেখতে পাচ্ছি নীলাচল ত্যাগ করে কাশীধামে চলে যাচ্ছেন।
মৃত্যুঞ্জয় উল্লেখ করছেন, অদ্বৈতের এই সাঙ্কেতিক বার্তা আসার পরে বেশিদিন চৈতন্য বাঁচেন নি। এই সাঙ্কেতিক বার্তার অর্থ অবশ্য এটাও হতে পারে, যে বৈষ্ণব আন্দোলন সিদ্ধিলাভ করেছে, লোকের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে, অতএব মহাপ্রভু এইবার ভবলীলা সাঙ্গ করতে পারেন, কিন্তু বৈষ্ণব আন্দোলনের তখনকার গতিপ্রকৃতি স্টাডি করলে দেখা যায়, সে অর্থটি একেবারেই লাগসই নয়। মৃত্যুঞ্জয় আবার মনে করেছেন যে এই বার্তায় অদ্বৈতর দলের সঙ্গে নিত্যানন্দের দলের বিরোধের আভাস আছে, তবে সেটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনে করি।
দীনেশ সেনই বাঙালি চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্যে বলেন যে চৈতন্যকে হত্যা করে হয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ বইতে তিনি বিষয়টি তুলেছিলেন, এবং মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর মৃতদেহ মন্দিরের মধ্যেই পুঁতে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। রাজার অনুমতি ছাড়া এই কাজ হত না, কিন্তু রাজার পক্ষে চৈতন্যহত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনতে ইতস্তত করেছেন দীনেশঃ “They buried him somewhere under the floor of the temple and would not allow any outsider to enter it until the place was thoroughly repaired and no trace left after his burial as I have already stated. This is the only rational explanation that may be advanced for explaining their conduct in shutting the temple gate. Probably they did so with the permission of Raja Pratap Rudra. But I think I go too far in suggesting that monarch's conniving at their conduct”
এইপ্রসঙ্গে দীনেশ সেন বৃহৎ বঙ্গে বলছেনঃ
“সেদিন অপরাপর দিনের ন্যায় বেলা তিনটার সময় গুণ্ডিচা বাটীর দরজা খোলা হয় নাই। চৈতন্যর পার্শ্বচরগণ মন্দিরের দ্বারে ভিড় করিয়া ছিলেন। কিন্তু আটটা রাত্রিতে দরজা খুলিয়া পাণ্ডারা বলেন – মহাপ্রভু স্বর্গে গমন করিয়াছেন, তাঁহার দেহের আর কোন চিহ্ন নাই। বেলা তিনটা হইতে রাত্রি আটটা পর্য্যন্ত সেই গৃহে পাণ্ডারা খিল লাগাইয়া কি করিয়াছিলেন? ... মন্দিরের মধ্যেই দেববিগ্রহের প্রকোষ্ঠ-সংলগ্ন বৃহৎ মণ্ডপের এককোণে তাঁহাকে সমাধি দেওয়া হয়। প্রতাপরুদ্রের অনুমতি লইয়াই সম্ভবত ঐরূপ করা হইয়াছিল, যেহেতু উক্ত পুস্তকের একখানিতে লিখিত হইয়াছে, বহু পুষ্পমাল্য সেই মন্দিরের গুপ্তদ্বার দিয়া তখন লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। ... পুরীর পাণ্ডাদের মধ্যে আর একটি ভীষণ প্রবাদ প্রচলিত আছে - তাহা আমি তথায় শুনিয়াছি। জগন্নাথ বিগ্রহ হইতেও চৈতন্যের প্রতিপত্তি বেশি হওয়াতে পাণ্ডারা নাকি গোপনে তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিল।”

চৈতন্যকে সচল জগন্নাথ বলা হত, এবং চৈতন্যের প্রভাবের সামনে পাণ্ডাদের কায়েমী স্বার্থ নিঃসন্দেহে বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। হতেই পারে যে এজন্যই প্রতাপরুদ্রের সামরিক পরাজয়ের জন্য চৈতন্য আন্দোলনকে দায়ী করার চেষ্টা হয়। চৈতন্য বহুবার দুষ্টের দমনে বলপ্রয়োগের কথা বলে গেছেন, নবদ্বীপে কাজীদলনের এপিসোডে সেই বাহুবলের স্ফুরণ আমরা দেখতে পাই। চৈতন্য আন্দোলন ভক্তির মাধ্যমে গণ আন্দোলন, অহিংসা তার মূল বাণী নয়, সামান্য কোড অভ কনডাক্ট মাত্র, এই আন্দোলনের মূল বাণী মানুষে মানুষে সাম্য, এবং হিন্দুসমাজের পুনরুজ্জীবণ। ভক্তদ্রোহীকে কড়া দৈহিক শাস্তির বিধান চৈতন্য দিয়েছেন, এবং একাধিকবার নিজেও বলপ্রয়োগ করেছেন।
কিন্তু শেষের দিকে পাণ্ডাচক্রের অনবরত বিরুদ্ধতা, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে চৈতন্য কি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? একাধিক বিবরণ থেকে তাই মনে হয়, যেটাকে ভক্তেরা কৃষ্ণবিরহে বিপর্যস্ত অবস্থা বলেছেন।
চৈতন্যের তিরোধানের পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের দশা নিয়ে দীনেশ সেন লিখছেনঃ
“চৈতন্যের তিরোধান-সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলি সকলেই নীরব। যে কয়েকখানি পুস্তকে একটু ইঙ্গিত আছে, তাহা বৈষ্ণব সমাজের সর্ব্বজনাদৃত গ্রন্থ নহে। শুধু লোচনদাস একশ্রেণীর বৈষ্ণবদের মধ্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁহার পুস্তকেও এ সম্বন্ধে সামান্য কয়েকটি কথা আছে। যে কারণেই হউক, এই নীরবতা দুঃসহ শোকজ্ঞাপক। ভগবান্‌ ধুতি চাদর পরিয়া বাঙ্গালী সাজিয়া বাঙ্গালীর মধ্যে লীলা করিয়া গিয়াছেন, এত বড় গৌরবে এদেশের লোকেরা গৌরবান্বিত ছিল, চৈতন্যের তিরোধানে সেই জাতীয় গৌরব-কিরীট শিরশ্চ্যুত হইল। জাহাজ ডুবিয়া ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গেলে যেরূপ তাহার ভগ্ন অংশগুলি অর্ণবে ইতস্ততঃ দৃষ্ট হয় – এই মহাবিপদের দিনে বৈষ্ণব সমাজ তেমনই বিচ্ছিন্ন ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। গঙ্গাতীরে যে মহাকীর্ত্তনের দল মন্দিরা, করতাল, ডম্ফ ও মৃদঙ্গনিনাদে আকাশ দিবারাত্র প্রতিশব্দিত করিত, হঠাৎ সেই আনন্দোৎসব থামিয়া গেল। অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস ও নরহরি ধীরে ধীরে শোকসন্তপ্ত হইয়া অব্যক্ত দুঃখে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। … সনাতন এবং তাঁহার ভারতপ্রসিদ্ধ ভ্রাতা রূপ গোস্বামী চৈতন্যের তিরোধান শুনিয়া তাঁহার সর্ব্বজনবন্দিত চরণ ধ্যান করিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। ১৫৩৩ খৃঃ অব্দের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সমাজের কাজ প্রায় অর্ধশতাব্দী বন্ধ ছিল। মহাশোকে মতিচ্ছন্ন চৈতন্যের অনুচরগণ যেন বজ্রাঘাতে চেষ্টাহীন ও নীরব হইয়াছিলেন” (বৃহৎ বঙ্গ )।
স্বরূপ দামোদর, চৈতন্যের অন্তরঙ্গ পরিকর চৈতন্যহত্যার অব্যবহিত পরেই নিহত হন পুরীতে। তাঁর বুক ফেটে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা যেটা বলা হয়, মালীবুড়ো বলছেন যে ওটা কুঠার বা ওরকম কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার বুকে আঘাতের ফল। আরেক চৈতন্য অন্তরঙ্গ গদাধরেরও মন্দিরের ভেতরে অন্তর্ধান ঘটে, মালীবুড়ো বৃন্দাবন দাসের পুঁথি থেকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন।
চৈতন্য সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। ১৪৮৬ সালে জন্ম, ১৫৩৩ সালে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যে সমাজসংস্কার, ধর্মসংস্কার করে গেছেন, বারবার সেসব অধ্যয়ন করতে হবে। এবং তাঁর মৃত্যু থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। পাণ্ডাদের হাতে চৈতন্যর হত্যা শিক্ষা দেয়, পাণ্ডাতন্ত্রের গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদ হিন্দুসমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি প্রায়ই তা ইসলামের আগ্রাসনের থেকেও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। চৈতন্যর হত্যা আমাদের এও শেখায় যে আমাদের একদল প্রতিবেশী বাঙালির প্রতি বিদ্বেষে উন্মত্ত হয়ে অত্যন্ত কুৎসিত কাজেও লিপ্ত হতে দ্বিধা বোধ করে না।
চৈতন্যকে আমাদের জাতির সহস্র সহস্র বছরের তারকাখচিত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বলে ভাবতেই পারি আমরা। তাঁর হত্যার উপযুক্ত অনুসন্ধান হোক, ঐতিহাসিক গবেষণা চলুক, সম্পূর্ণ সত্য সামনে আসুক, দোষীরা জনসমক্ষে উন্মোচিত হোক, বাঙালি হিসেবে এই দাবী তোলা আমাদের অবশ্যকর্তব্য।
শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের স্থান কাল ও ধরন নিয়ে নানান মতের প্রেক্ষিতে একটা সিধান্ত অবধারিত এসে পড়ে যে, বর্ণনার কোনওটিই সম্পূর্ণ সত্য নয়, কোনও কোনও কথা আংশিক সত্য হলেও হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার একেবারে নিশ্চিত, চৈতন্যে অনুগামীরা মহাপ্রভুর দেহ পাননি। ভক্তিসিধান্ত সরস্বতীর দক্ষিণ-ভারতীয় শিষ্য ড. সম্বিদানন্দ যথার্থ বলেছেন,
“সবচেয়ে হতোবুদ্ধিকর প্রশ্ন হল, তাঁর দেহের কি হল? তাঁর অনুগামী ভক্তরা কি তাঁর দেহ হাতে পেয়েছিল? এ ব্যাপারে কিছু বলা খুবই কঠিন। শ্রীচৈতন্যের প্রায় প্রতিটি পার্ষদের দেহ অতিযত্নে সমাহিত হয়েছে এবং সমাধির উপর মন্দির তুলে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছে।… রাজা হয়ত তাঁর ভগবান শ্রীচৈতন্যের দেহের উপর আরেকটি জগন্নাথ মন্দির তুলতেন। অনুগামী ভক্তরা সে সমাধিকে চোখের মণির মত রক্ষা করত ও পুজো করত। যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন, সে ঘরখানি (গম্ভীরা)- তে আজও হাজার হাজার হিন্দু অনবরত আসছেন শ্রদ্ধা ও প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ে; ঘরখানিই পূজার সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর সমাধি থাকলে, তা হতো শোকার্ত রাজার মস্ত সান্ত্বনার স্থল। তাঁকে হারিয়ে তাঁর শত শত পার্ষদের অনেকে অসহনীয় শোকে কাঁদতে কাঁদতে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন, চৈতন্য-সমাধি তাদেরও হত মস্ত বড় সান্ত্বনা।’’ (Sri Chaitanya Mahaprabhu, 1st edn.pg.215-6)
এমনটা কি হতে পারে যে, মহাপ্রভুর দেহ হাতে পেয়েছিল রাজা প্রতাপরুদ্রর শক্তিশালী কোনও প্রতিপক্ষ, যে বা যারা সিংহাসন দখল করার ইচ্ছাপোষণ করত প্রতাপরুদ্রকে সরিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য খুনও করতে পারত। এমনকি রাজার শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে ইতস্তত করত না? এরকম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের পক্ষে যুদ্ধে পরাজয় এবং জাতির সামরিক মর্যাদাহানির জন্য রাজা প্রতাপরুদ্রের জনগণকে বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা সমস্ত কিছুর জন্য রাজা ও শ্রীচৈতন্যকে দায়ী করা কি সেকালে সত্যিই অসম্ভব ছিল?
এ জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে হলে অবহিত হতে হবে চৈতন্য যুগের ঐতিহাসিক পটভুমি সম্পর্কে।
শ্রীচৈতন্য ১৫১০ সালে এসেছিলেন পুরীতে। সেই সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন প্রতাপরুদ্র। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ছিলেন যুদ্ধে লিপ্ত। কৃষ্ণদেব রায় ১৫০৯ সালে সিংহাসনে বসার সময় থেকেই উভয় রাজ্যের মধ্যে ছোটখাট যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল। এ কারণে ১৫০৯ সাল থেকেই প্রতাপরুদ্র ছিলেন দক্ষিণে। ১৫১০ সালের প্রথমদিকে শ্রীচৈতন্য তীর্থপর্যটনে বেড়িয়ে মোটামুটি উপকূল ভাগ ধরে পুরী থেকে কন্যাকুমারী হয়ে পৌঁছেছিলেন দ্বারকায়। সেখান থেকে তিনি নর্মদার তীর বরাবর হয়ে পুরীতে ফিরে আসেন ১৫১২ সালে।
Puri
তার আগেই, প্রতাপরুদ্রের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সেনাদল অতিক্রম করে ওড়িশার উত্তর সীমানা। এ সম্পর্কে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক N.B.Roy তাঁর ‘Ala-ud-din Hussain Shah’ প্রবন্ধে লিখেছেন –
“জগন্নাথ মন্দিরের নথি ‘মাদলা পাঞ্জী’তে আছে, ১৫০৮-০৯ সালে আরাম্বাগ জেলার মন্দারণশিবির থেকে বেড়িয়ে শাহ ইশমাইল গাজী বিদ্যুৎগতিতে যাজপুর-কটকে অভিযান চালিয়ে বহু হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে পুরী পর্যন্ত এগিয়ে যান। এই যুদ্ধজয়ের স্মারকমুদ্রায় যাজনগর ওড়িশার উল্লেখ করা হয়। মুসলমান সেনাদলের এই আকস্মিক অভিযানের খবর পেয়ে গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁর দক্ষিণ অভিযান থেকে ফিরে আসেন এবং আগ্রাসী মুসলিমবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে আরামবাগের নিকট মন্দারণ পর্যন্ত চলে আসেন। বিজয়ী ওড়িয়াবাহিনী মন্দারণ দুর্গ অবরোধ করে কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধর নামক জনৈক উচ্চপদস্ত রাজকর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত দুর্গ টি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়।’’
অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কথা, “গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিল। উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী, তাদের প্রধান এই গোবিন্দ।’’
‘‘Govinda was the commandant of the fort of Cuttack. He was the first of that group of traitors who were partly responsible for the fall of Orissa.” (The Gajapati Kings of Orissa)
প্রতাপরুদ্র বিশ্বাসঘাতক বিদ্যাধরকে শাস্তি দেননি, তাকে উচ্চতর পদ ও ধন সম্পদ দান করে তার মন জয় করতে চেয়েছেন। ‘মাদলা পাঞ্জী’ তে আছে “বহুত সুকৃত তাহাঙ্কু রাজা বলে।কনক স্নাহান করাইলে, বিদ্যাধর পদরে রাজা তাহাঙ্কু সাড়ী দেলে, পাত্র কলে। তাহাঙ্কু মুলে রাজা রাজ্যভার দেলে।’’ (মাদলা পাঞ্জী, প্রাচী সংস্করণ, পঃ ৫২-৫৩)
রাজা তাকে কনক-স্নান করিয়ে ‘রাজা’র পদ দান করলেন। ‘রাজ্যভার’ কথাটির অর্থ অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায় করেছেন ‘সমগ্র রাজ্যের ভার’ (Medieval Vaishnavism in Orissa, Pg. 173) এবং বলেছেন মাদলা পাঞ্জীর এ তথ্য অনৈতিহাসিক। এ বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যায়, সমগ্র রাজ্যের নয়, কলিঙ্গ প্রদেশ বা রাজ্যের ভার দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাধরকে।
বিজয়নগরাধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের গুরু শ্রী ব্যাসরায়ের সংস্কৃত জীবনী ‘শ্রীব্যাসযোগিচারিতম’ (রচনাকাল আঃ ১৫৩৫ সাল) গ্রন্থে বিদ্যাধর পাত্রকে ‘কালিঙ্গাধিপতি’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘বিদ্যাধর পাত্র নামা কলিঙ্গাধিপতি’ (পঞ্চম অধ্যায়)। এতে বলা হয়েছে – কালিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন। গুরু শ্রীব্যাসরায় অতিদ্রুত ওই গ্রন্থের একটি সুন্দর ভাষ্য রচনা করলে কৃষ্ণদেব রায় চমৎকৃত হন। ‘শ্রীব্যাসযোগিচরিতম’ এর সম্পাদক B. Venkoba Rao এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কলিঙ্গাধিপতির উল্লেখের ধরন দেখে বোঝা যায় কলিঙ্গযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে – “The manner of the reference to the lord of Kalinga shows that the Kalinga war was then over.” (Introduction, Para 132)
বিদ্যাধর পাত্র কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ঠিক কোন সময়ে এই ধরণের যোগাযোগ করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য শ্রীযুক্ত রাওয়ের মত নিশ্চিত হওয়া যায় না। বিদ্যাধরের মতো উচ্চাকাঙ্খী ও অভিসন্ধিপরায়ণ ব্যাক্তির পক্ষে কলিঙ্গযুদ্ধ চলার সময়ও কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলা অসম্ভব নয়। বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতাপরুদ্রের পক্ষে মন্দারনদুর্গ দখল করা সম্ভব হয়নি। কলিঙ্গযুদ্ধের হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফলের পিছনেও কলিঙ্গাধিপতি বিদ্যাধরের প্রতাপরুদ্র-বিরোধী ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয়।
কলিঙ্গযুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে দখল করলেন উদয়গিরি। ১৫১৫ সালে জয় করলেন গুন্তুর জেলার কোন্ডবীডু। তিনি রাজপুত্র বীরভদ্রকে বন্দি করে এগিয়ে এলেন সীমহাচলম্ পর্যন্ত। অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন প্রতাপরুদ্র। গোদাবরীর দক্ষিণে সমস্ত রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল। এইভাবে ওড়িশার রাজনৈতিক মর্যাদা হ্রাসের পিছনে চৈতন্য বা তাঁর ধর্ম কতটা দায়ী অথবা আদৌ দায়ী কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া জাতির সামরিক দক্ষতা হ্রাসের জন্য চৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ওই ধর্মের প্রতি রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরাগকে দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক কালেও ওড়িশার বিদ্বৎ সমাজের একাংশ ওড়িশার রাজনৈতিক স্বাধীনতালোপের জন্য দায়ী করে থাকেন চৈতন্যকে। অথচ দেশকে যারা ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সেই বিশ্বাসঘাতক গোবিন্দ বিদ্যাধর বা অন্যান্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা একটি কথাও বলেন না।
ওড়িশার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গোবিন্দ বিদ্যাধর অত্যন্ত হীনচরিত্রের মানুষ ছিল। প্রতাপরুদ্রের অনুগ্রহে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করে সে ১৫৪০ সালে প্রতাপরুদ্রের মৃত্যুর পরেই তাঁর দুই পুত্র কালুয়া দেব (১৫৪০-৪১) কে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। আবার বিদ্যাধরের নাতি নরসিংহকে হত্যা করে তাঁর সেনাপতি মুকুন্দদেব হরিচন্দন সিংহাসনে বসে। এইভাবে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতে দেশ ও জাতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পুর্বোক্ত পন্ডিতেরা এদিকে না তাকিয়ে রাখালদাসের মন্তব্যটিকে নির্বিচারে গ্রহণ করে ওড়িয়া জাতির পতনের জন্য চৈতন্য ও চৈতন্যধর্মকে দায়ী করে থাকেন।
তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, গোবিন্দ বিদ্যাধর বা তার সমগোত্রীয় কেউ চৈতন্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ থেকে একথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, সেকালে শ্রীচৈতন্য অধিকাংশ ওড়িশাবাসীর উপাস্য হয়ে উঠলেও (১) জনগণ ও রাজার উপর তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ আশঙ্কিত হয়েছিল। (২) ‘জগন্নাথ দারুব্রহ্ম আর চৈতন্য ছিল তাঁর সচল বিগ্রহ’ – এই জাতীয় প্রচার জগন্নাথসেবকদের একাংশের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, (৩) চৈতন্য ও তাঁর সহচরদের জাতিভেদ বিরোধী প্রচার ও ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণ পুরোহিত সম্প্রদায়ের জীবিকায় এবং সামাজিক মান মর্যাদায় ঘা পড়েছিল, দলিত সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছিল তারা এবং (৪) বিদ্যাধরের সঙ্গে অভিসন্ধি পরায়ণ রাজনীতিক ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এইসব বিক্ষুব্ধ ধর্মান্ধদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক, এই অশুভ আঁতাতের মধ্যেই সম্ভবত নিহিত আছে শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের মূল কারণ।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমির এই পরিচয়ের ভিত্তিতে চৈতন্যতিরোভাবের বিবৃতিগুলি আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
জয়ানন্দ চৈতন্যের দেহাবসানের একটা বাস্তবানুগ বিবরণ দিয়ে বলেছেন তাঁর মায়া শরীর টোটার মাটিতে পড়ে ছিল। কিন্তু তাঁর কথামত সত্যই যদি এই ঘটনা গদাধর পণ্ডিতের সামনে ঘটত, তাহলে চৈতন্যের শবদেহের সদ্গতি বা সমাধিবিষয়ে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের নিশ্ছিদ্র অজ্ঞতা সম্ভবপর হতো না। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের বাঁ পায়ে জরাব্যাধের শরাঘাত এবং চৈতন্যের বাঁ পায়ে ‘ইটাল’ বা ইটের টুকরোর আঘাত এতে যেন কৃষ্ণ-চৈতন্য সমীরণের তত্ত্বটিকেই বড় করে তুলে ধরেছেন জয়ানন্দ।
লোচনদাস বলেছেন, চৈতন্য নিজ-জনদের বাইরে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্র ‘তখন দুয়ারে নিজ লাগিল কপাট’। ভক্তদের থেকে তাকে এইভাবে কি বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছিল? উপরন্ত লক্ষনীয়, মন্দিরের ভিতর থেকে একজন ‘পড়িছা’ বা পুরোহিত ঘোষণা করল জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্য বিলীন হয়ে গেছেন। তখন ভক্তবৃন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র এবং অন্যান্য অনেকে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা স্বয়ং এ সংবাদ শুনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু চৈতন্যের পার্থিবদেহ সম্পর্কে কেউ অনুসন্ধান করলেন না। জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কূটকৌশলী কোনও চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বিগ্রহ’ কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, ‘সচল বিগ্রহ’ বাদী ভক্তরা একথা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক ব্যাপার হবে, সম্ভবত এই ছিল চতুর চক্রের চিন্তাধারা।
ঈশান নাগর বলেছেন –
‘প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।’
এই আশঙ্কার কারণ কি? আবার মন্দিরদ্বার খোলা মাত্র ‘গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল’। এরই বা কারণ কি? তবে কি সেই অশুভ ঘটনার পূর্ভাবাস কেউ কেউ পেয়েছিলেন?
ওড়িয়া গ্রন্থগুলিতে এই বিগ্রহে লীন হওয়ার তত্ত্বই সমর্থিত হয়েছে। ঈশ্বরদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ অনুসারে সেকালের একটি মাত্র মানুষ, বাসুদেব তীর্থ, এর সত্যতায় সন্দিহান হয়ে প্রকাশ্যে মুক্তিমণ্ডপে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করেছিলেন। অবশ্য তখন চৈতন্য তিরোভাবের পর অন্তত ‘একশ’ বছর কেটে গেছে (অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে ঈশ্বরদাস সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন। ড.বিমানবিহারী মজুমদারের হিসাব অনুসারে ঈশ্বরদাসের গ্রন্থ চৈতন্য তিরোভাবের ১৫০/১৭৫ বছর পরে লিখিত হয়)। এই কাল ব্যবধানেই সম্ভবত ঈশ্বরদাসকে দিয়েছিল সেই নিরাপত্তা যার ভিত্তিতে তিনি চৈতন্যের পার্থিবদেহের পরিণতি সম্পর্কে অলৌকিকতার মোড়কে মুড়ে কিছু বাস্তবতথ্য পরিবেশনে সাহসী হয়েছেন। ঈশ্বরদাসের মতে, লোকলোচনের অন্তরালে পুরী থেকে বহু দূরে নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয় চৈতন্যের পাথির্বদেহ। তাঁর মতে প্রতাপরুদ্র এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তিনি বলেছেন, তিরোধানের খবর পেয়ে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, ‘রাজন ক্রোধ কে কহিব’। চৈতন্যতিরোধানের পিছনে কোনও অপরাধমূলক চক্রান্ত না থাকলে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন কেন? সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে রাজাকে গোপন করা হল কেন? ঈশ্বরদাসের বিবরণীতে স্পষ্ট আভাস মেলে, রুদ্ধদ্বার মন্দিরমধ্যে চক্রান্তকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদেরই কেউ কেউ যখন জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্যের বিলীন হওয়ার কথা ঘোষণা করতে থাকে, তখন অন্যেরা গোপনে সে দেহ বহন করে নিয়ে বিসর্জন দেয় বহূ মাইল দূরে কোনও নদীতে।
ঈশ্বরদাস বলেছেন, তিনি তাঁর গুরুর কাছে চৈতন্যদেহ বিসর্জনের ‘অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা’ শুনেছেন। চৈতন্য তিরোধানের পর ঈশ্বরদাসের কাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ এক-দেড়শ বছর একথা গুপ্ত রইল কিভাবে? হয়তো এর আগে যারা জানতেন, রাজদণ্ডের ভয়ে তাঁরা একথা প্রকাশ করতেন না। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী কেউ এসবের মূলে না থাকলে এমন নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা এবং সমকালীন ভক্ত কবিদের চৈতন্যদেহ বাঁ চৈতন্যসমাধি সম্পর্কে এমন লৌহ কঠিন নীরবতা সম্ভব হত না। এসবই আবার প্রতাপরুদ্রের পুত্রহন্তা, সিংহাসন দখলকারী ও ভোই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ বিদ্যাধরের দিকে সন্দেহের তির ফলকটি সঞ্চালিত করে।
শ্রীচৈতন্যের কয়েকশো বছর আগে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শ্রীরামানুজ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পুরীতে। তাঁকেও যে বিষম পরিণতির সন্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁর প্রমাণ আছে ‘প্রপন্নামৃত’ সংস্কৃত গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীরামানুজস্বামীকে ‘একরাত্রে পুরুষোত্তম থেকে কূর্মতীর্থে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন’ (চৈতন্যচরিতামৃত, গৌড়ীয় মঠ সং, অমৃতপ্রবাহভাষ্য, মধ্য ৭/১১৩)। এই কিংবদন্তীর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জগন্নাথক্ষেত্রে রামানুজ ধর্ম প্রচার করতে এলে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল জগন্নাথসেবকদের সঙ্গে। ‘টেনে ফেলে দেওয়া’ কথাটির মধ্যে সেই বিরোধ ও বর্জনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ওড়িশা বাসিদের উপর রামানুজের তুলনায় চৈতন্যের প্রভাব ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। জনগনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অনেক অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়েছে গোপনে। আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি অন্তর্ধানের সময় হলে বুঝতে হবে, রথযাত্রা উৎসবে যখন দেশের মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত তখন তাদের সেই ব্যস্ততারই সুযোগ নিতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
পরিষেশে অসংকোচে বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যের যবনিকা সম্পূর্ণ উন্মোচিত করার মতো নিশ্চিন্ত কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি আজও। এ আলোচনায় উদ্দেশ্য হল অন্তর্ধানের পিছনে অপরাধমুলক ক্রিয়াকাণ্ডের সম্ভাব্যতা বিচার করা। তৎকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল তা আদৌ অসম্ভব ছিল না।
‘ভারতের সাধক’ তৃতীয় খণ্ডে শঙ্করনাথ রায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। আষাঢ় মাস। বেলা তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর। এক দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া প্রভু জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। নাটমন্দিরে গরুড় স্তম্ভের নীচে প্রতিদিন গিয়া দাঁড়ান, যুক্ত করে ভাবতন্ময় অবস্থায় পুরষোত্তম বিগ্রহের চিন্ময় রূপসুধা পান করেন, নয়নজলের ধারায় সারা দেহ ভিজিয়া যায়। কিন্তু আজ কেন তিনি সরাসরি মূল বেদীকোঠায় ঢুকিয়া পড়িলেন? কেন এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম?
ভক্তগণ সবিস্ময়ে তাঁহার কাণ্ড লক্ষ্য করিতেছেন। হটাৎ এক সময়ে অন্তগৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সবাই বাহিরে, ভিতরে রহিলেন শুধু প্রভু আর তাঁহার শ্রীজগন্নাথ।
সন্মুখে বিরাজিত পরম জাগ্রত দারুব্রহ্ম, শ্রীচৈতন্যের ধ্যানের ধন, ‘ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণ’-এর দিব্যি শ্রীবিগ্রহ। ভাবোদ্বেল প্রভু হুঙ্কার দিয়া সেদিকে ধাবিত হইলেন।
বাইশ বৎসর পূর্বে, প্রথম দর্শনের দিনটিতে এমনি আত্মহারা এমনি পাগলপারা হইয়া এই পুরুষোত্তম বিগ্রহকে কোলে নিতে তিনি ছুটিয়াছিলেন। সেদিন ঘটিয়াছিল নীলাচল-লীলার উদ্বোধন। আজ আবার এ কোন পর্ব? একই নিত্যলীলায় প্রবেশের সূচনা?
এইদিনও শ্রীবিগ্রহকে চৈতন্য তাঁহার বুকে তুলিয়া নিতে গেলেন। মূহূর্তমধ্যে এক মহা অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়া গেল। চিরতরে তিনি হইলেন অন্তর্হিত।
বহু খোঁজাখুঁজিতেও প্রভুর মরদেহের সন্ধান আর পাওয়া যায় নাই। অগণিত ভক্তের ব্যাকুল অনুসন্ধান, উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রের আপ্রাণ প্রয়াস, সব কিছু সেদিন ব্যর্থ হয়। এ রহস্যময় অন্তর্ধান চিরদুর্বোধ্য রহিয়া যায়।’’
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
আমি গবেষক নই সুতরাং এ লেখার কোনও কথা আমার কথা নয়। লেখক পরম শ্রদ্ধেয় ড.শান্তিকুমের দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত, এঁরা দুজনেই চৈতন্যগবেষক। তাঁদেরই গবেষনার ফসল ‘পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, প্রকাশক-রত্নাবলী, কলকাতা।
উক্ত গ্রন্থ থেকে বিষয় অবিকৃত রেখে কখনও ভাষা ও বানান পরিবর্তন, কখনও সম্পাদনা করে তাদের কথা আমার ভাষায়, আবার কখনও তাঁদের কথা হু-বহু তাঁদেরই ভাষায় তুলে দিলাম পাঠকের করকমলে। গবেষনামূলক এ লেখার প্রশংসা গবেষক লেখকদ্বয়েরই প্রাপ্য। লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞ রইল গ্রন্থলেখক ও তাঁর পরিবার এবং প্রকাশকের কাছে।



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ