ভারতীয় ইতিহাসে পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের এক অনন্য মেলবন্ধন হিসেবে চানক্য ( ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে- ২৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মতান্তরে ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। প্রাচীন ভারতীয় গুরু ও দার্শনিক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জনকারী চাণক্য কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্ত নামেও সুপরিচিত। তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( পাকিস্তান) অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও তাঁর পুত্র বিন্দুসারের শিক্ষক ও রাজ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।তাঁর জন্মস্থান নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে, একদিকে যেমন পাটলিপুত্রের কুসুমপুরে ( পাটনা) তাঁর জন্ম বলে প্রচলিত আবার অন্যদিকে, মহাবংশ টিকা অনুযায়ী তিনি তক্ষশীলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খুব ছোট বয়সেই বেদ পড়তে শুরু করেন। তিনি বাণিজ্য, সংগ্রাম ও অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি কাজ হল চাণক্যনীতি, অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র প্রভতি। একজন শিক্ষক হিসবে তিনি সর্বদা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। তাঁকেই ভারতের প্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করা হয়। তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। মগধের পতন ও মৌর্য্য সাম্রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা নিয়েছিলেন। কৌটিল্য ও চন্দ্রগুপ্ত মগধের পতনের জন্য একটি ছোটো বাহিনী তৈরি করেন ও যথেষ্ট সামরিক শক্তি তৈরি করে রাখেন। সেইসময় মৌর্য্য সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে চন্দ্রগুপ্তকে বহুবিধ সাহায্য করেছেন। তাঁর রাজনৈতক চিন্তাগুলি তিনি অর্থশাস্ত্রে লিখেছেন। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের যে সমস্ত ধারনা প্রতিফলিত হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তব ও একেবারেই আবেগজড়িত নয়। অর্থশাস্ত্র রাষ্ট্র ও রাজনীতির একটি ধ্রুপদী। এটি মূলত রাজনীতির নীতি ও কিভাবে রাষ্ট্র কাজ হয় সেই সম্পর্কে লেখা। তিনি প্রকাশ্যে বিতর্কিত বিষয় যেমন গুপ্তহত্যা, গোপন এজেন্টদের কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, কোন সময়ে চুক্তি লঙ্ঘন প্রয়োজন প্রভতি বিষয়ে লিখেছেন। কূটনীতি ও সরকারি প্রশাসন সম্পর্কে কৌটিল্য একটি অগ্রণী ভমিকা নিয়েছেন। আজও ভারতের কূটনীতির দিক থেকে চাণক্যর অর্থশাস্ত্রকে এক নম্বরে রাখা হয়।
চাণক্যের প্রধান পরিচয় অতিপ্রসিদ্ধ একজন প্রাচীন ভারতীয় কূটনীতিজ্ঞ হিসেবে। মানবজীবনের প্রায় সকল কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে তাঁর শ্লোকসমূহ শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকলের কাছেই অল্পবিস্তর পরিচিত। ভারতীয় বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে চাণক্যকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’-প্রণেতা কৌটিল্য আর ‘চাণক্যশ্লোক’ নামে প্রসিদ্ধ শ্লোকসমূহের রচয়িতা একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও চাণক্যের একাধিক নামের মধ্যে কৌটিল্যও অন্যতম।
তাঁর একাধিক নাম বিষয়ে হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
তাঁর একাধিক নাম বিষয়ে হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘বাৎস্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চ ণকাত্মজঃ।
দ্রামিলঃ পক্ষিলস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ।।’
চাণক্য তার্কিক ছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছে ‘পক্ষিল’। রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে তিনি ‘কৌটিল্য’। জ্যোতির্বিদ্যার ‘বিষ্ণুগুপ্তসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে তাঁর নাম বিষ্ণুগুপ্ত। কামশাস্ত্রের গ্রন্থ ‘কামসূত্র’ এবং ন্যায়সূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ ‘ন্যায়ভাষ্যে’র রচয়িতা হিসেবে নাম বাৎস্যায়ন। নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থে নাম চাণক্য। বিরাট যোদ্ধা হিসেবে নাম হয়েছে ‘মল্লনাগ’। তাঁর ডাক নাম ছিলো ‘খণ্ডদৎ’। মায়ের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে তিনি তাঁর একটি দাঁত উপড়ে ফেলেন বলে প্রবাদ চালু আছে।
.
তাঁর অবস্থিতিকাল কালিদাস যুগেরও আগে বলে ধারণা করা হয়। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর পণ্ডিত চাণক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো বিষ্ণুগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩)। কিন্তু জন্মগ্রাম ‘চানকা’ থেকে, মতান্তরে পিতার নাম ‘চানক’ থেকে, ‘চাণক্য পণ্ডিত’ হিসেবেই তিনি ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র।
.
চাণক্য ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কামন্দকের ‘নীতিসার’ গ্রন্থে এভাবে বলা হয়েছে-
‘বংশে বিশালবংশ্যানামৃষীণামিব ভূয়সাম্ ।
অপ্রতিগ্রাহকাণাং যো বভুব ভুবি বিশ্রুতঃ।।
অর্থাৎ : (চাণক্য) ঋষিদের মতো বিশাল এবং উচ্চবংশের অপ্রতিগ্রাহী ব্রাহ্মণগণের বংশে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
উপমহাদেশের উচ্চতর জ্ঞান আহরণের প্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপিঠ যেখানে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান পাকিস্তানের সেই তক্ষশীলায় তাঁর জন্ম এবং পরবর্তীতে তক্ষশীলা বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষাগুরুও ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে সেখানকার পরিবেশ তাঁর সহজাত প্রতিভাকে করে তুলেছে ক্ষুরধার প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল। ‘কূটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভুত ছিলেন বলে পরবর্তীতে গোত্র নামটিকে টিকিয়ে রাখার সদিচ্ছা থেকে ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম ধারণ করে লিপিবদ্ধ করেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’। কিন্তু এই ‘অর্থশাস্ত্র’ তো আর এমনি এমনি লিখিত হয়নি। এর পেছনের যে ইতিহাস, সেখানেই রয়ে গেছে একজন চাণক্য পণ্ডিত বিষ্ণুগুপ্তের কৌটিল্য হয়ে ওঠার ঘটনাবহুল পটভূমি।
.
চাণক্যের বিচিত্র জীবনকথা রবিনর্ত্তকের ‘চাণক্যকথা’, সোমদেবভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, কামন্দকের ‘নীতিসার’ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায় বলে জানা যায়। কিংবদন্তী আছে, মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। জরাসন্ধের রাজধানী ছিলো রাজগৃহ। জরাসন্ধের পর অনেকেই মগধের সিংহাসনে বসেন। অবশেষে রাজা হন মহাপদ্মনন্দ। তাঁর মহিষী রত্নাবলীর গর্ভে নন্দ প্রভৃতি আট পুত্রের জন্ম হয়। মুরা নামে মহাপদ্মনন্দের এক দাসী ছিলো। এই দাসীর গর্ভে মহাপদ্মনন্দের এক সন্তান ছিলো, নাম চন্দ্রগুপ্ত। মুরার পুত্র বলে চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরবর্তীতে ‘মৌর্য’ বংশ নামে খ্যাত হয়। মহাপদ্মনন্দের পুত্রদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তই জ্যেষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু দাসীর পুত্র হওয়ায় শেষপর্যন্ত তিনি পিতৃরাজ্য থেকে বঞ্চিত হন।
.
পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ধনানন্দ, যিনি তার অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাসাধারণের কাছে ভীষণ অপ্রিয় ছিলেন, একবার চাণক্যকে অপমান করেন বলে কিংবদন্তী আছে। মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রী শকটার উপর। তিনি চাণক্যকে মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার অনুরোধ জানান। সে অনুরোধ অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁকে তিরস্কার করে চুলের শিখা ধরে আসন থেকে তুলে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পণ্ডিত চাণক্য প্রথমে রুষ্ট না হয়ে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কোন প্রবোধ না মেনে অন্য লোক দ্বারা চাণক্যকে যথেষ্ট অপমান করেন। চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
.
এদিকে নন্দ রাজা ধনানন্দের সৎভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাত) পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র করেন। কারণ রাজা ধনানন্দ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর দাসীমাতা মুরা ও সৎভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। ঘটনাচক্রে চাণক্যের সাথে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের ক্ষণলগ্নই যে একটা বিশাল জাতিগোষ্ঠির ভাগ্যচাকার মোড় ঘুরিয়ে চিরকালের নতুন বাঁক তৈরি করে দেবে তা কে জানতো। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। অতঃপর চানক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরুর সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে শেষপর্যন্ত নন্দরাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য়েরই দ্বিতীয় পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক।
.
শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উৎখাতের পেছনে চাণক্যের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও কুশলী কর্মকাণ্ড অসাধারণ কৃতিত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। এবং তাঁর অবদানেই সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পঞ্চম শতাব্দিতে রচিত প্রাচীন নাট্যকার বিশাখদত্তের শতশত বছর জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ নন্দবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে চন্দ্রগুপ্তের বিশাল মৌর্যসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে বলে জানা যায়।
.
তবে এতৎবিষয়ক তথ্যসূত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যেটিকে বিবেচনা করা হয়, তা হলো গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে অবস্থান করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেন। এখান থেকেই জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহন করেই পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই ছিলো পাটালিপুত্রের অবস্থান। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিলো। প্রজাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিলো সমৃদ্ধিতে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছিলো চন্দ্রগুপ্তের জীবনে স্বর্গীয় দূতের মতো অভিভাবক হয়ে আসা সত্যিকারের বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু চাণক্যের কারণে।
.
জানা যায়, এর আগে মহামতি আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিকার নিয়ে আলেকজান্ডারের দুই সেনাপতির তুমুল বিবাদ হয়। এ সুযোগে গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয়, গুরু চাণক্যের পরামর্শে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরবর্তীতে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য একে একে জয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য তিনি একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে চাণক্যকে প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন।
.
চন্দ্রগুপ্তের অতি-নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন যাপনের অবারিত সুযোগ থাকার পরও, কথিত আছে যে, চাণক্য এক শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস জীবন-যাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি শিষ্যবর্গকে রাজ্যশাসন কৌশল শিক্ষাসহ নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে জ্ঞান দান করতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তাঁর অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহিত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। দু’হাজারেরও অধিক বছরের কাল পরিক্রমায় এসেও চাণক্য নীতি শ্লোকগুলো এখনো যে গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি, এখানেই ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে চাণক্যের অভূতপূর্ব দার্শনিক প্রাজ্ঞতা প্রমাণীত। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চাণক্যের খ্যাতি অপরিমেয়। সিদ্ধান্তে অটল তাঁর কাছে অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিলো না। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।
.
কালজয়ী গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসকের প্রতি পরামর্শ হিসেবে চাণক্যের কিছু বাণীকে দু’হাজার বছরের এতো দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এখনো অসম্ভব সমকালীন মনে হয়-
.
চাণক্যের বিচিত্র জীবনকথা রবিনর্ত্তকের ‘চাণক্যকথা’, সোমদেবভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, কামন্দকের ‘নীতিসার’ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায় বলে জানা যায়। কিংবদন্তী আছে, মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। জরাসন্ধের রাজধানী ছিলো রাজগৃহ। জরাসন্ধের পর অনেকেই মগধের সিংহাসনে বসেন। অবশেষে রাজা হন মহাপদ্মনন্দ। তাঁর মহিষী রত্নাবলীর গর্ভে নন্দ প্রভৃতি আট পুত্রের জন্ম হয়। মুরা নামে মহাপদ্মনন্দের এক দাসী ছিলো। এই দাসীর গর্ভে মহাপদ্মনন্দের এক সন্তান ছিলো, নাম চন্দ্রগুপ্ত। মুরার পুত্র বলে চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরবর্তীতে ‘মৌর্য’ বংশ নামে খ্যাত হয়। মহাপদ্মনন্দের পুত্রদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তই জ্যেষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু দাসীর পুত্র হওয়ায় শেষপর্যন্ত তিনি পিতৃরাজ্য থেকে বঞ্চিত হন।
.
পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ধনানন্দ, যিনি তার অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাসাধারণের কাছে ভীষণ অপ্রিয় ছিলেন, একবার চাণক্যকে অপমান করেন বলে কিংবদন্তী আছে। মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রী শকটার উপর। তিনি চাণক্যকে মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার অনুরোধ জানান। সে অনুরোধ অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁকে তিরস্কার করে চুলের শিখা ধরে আসন থেকে তুলে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পণ্ডিত চাণক্য প্রথমে রুষ্ট না হয়ে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কোন প্রবোধ না মেনে অন্য লোক দ্বারা চাণক্যকে যথেষ্ট অপমান করেন। চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
.
এদিকে নন্দ রাজা ধনানন্দের সৎভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাত) পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র করেন। কারণ রাজা ধনানন্দ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর দাসীমাতা মুরা ও সৎভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। ঘটনাচক্রে চাণক্যের সাথে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের ক্ষণলগ্নই যে একটা বিশাল জাতিগোষ্ঠির ভাগ্যচাকার মোড় ঘুরিয়ে চিরকালের নতুন বাঁক তৈরি করে দেবে তা কে জানতো। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। অতঃপর চানক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরুর সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে শেষপর্যন্ত নন্দরাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য়েরই দ্বিতীয় পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক।
.
শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উৎখাতের পেছনে চাণক্যের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও কুশলী কর্মকাণ্ড অসাধারণ কৃতিত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। এবং তাঁর অবদানেই সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পঞ্চম শতাব্দিতে রচিত প্রাচীন নাট্যকার বিশাখদত্তের শতশত বছর জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ নন্দবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে চন্দ্রগুপ্তের বিশাল মৌর্যসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে বলে জানা যায়।
.
তবে এতৎবিষয়ক তথ্যসূত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যেটিকে বিবেচনা করা হয়, তা হলো গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে অবস্থান করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেন। এখান থেকেই জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহন করেই পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই ছিলো পাটালিপুত্রের অবস্থান। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিলো। প্রজাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিলো সমৃদ্ধিতে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছিলো চন্দ্রগুপ্তের জীবনে স্বর্গীয় দূতের মতো অভিভাবক হয়ে আসা সত্যিকারের বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু চাণক্যের কারণে।
.
জানা যায়, এর আগে মহামতি আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিকার নিয়ে আলেকজান্ডারের দুই সেনাপতির তুমুল বিবাদ হয়। এ সুযোগে গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয়, গুরু চাণক্যের পরামর্শে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরবর্তীতে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য একে একে জয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য তিনি একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে চাণক্যকে প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন।
.
চন্দ্রগুপ্তের অতি-নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন যাপনের অবারিত সুযোগ থাকার পরও, কথিত আছে যে, চাণক্য এক শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস জীবন-যাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি শিষ্যবর্গকে রাজ্যশাসন কৌশল শিক্ষাসহ নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে জ্ঞান দান করতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তাঁর অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহিত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। দু’হাজারেরও অধিক বছরের কাল পরিক্রমায় এসেও চাণক্য নীতি শ্লোকগুলো এখনো যে গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি, এখানেই ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে চাণক্যের অভূতপূর্ব দার্শনিক প্রাজ্ঞতা প্রমাণীত। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চাণক্যের খ্যাতি অপরিমেয়। সিদ্ধান্তে অটল তাঁর কাছে অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিলো না। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।
.
কালজয়ী গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসকের প্রতি পরামর্শ হিসেবে চাণক্যের কিছু বাণীকে দু’হাজার বছরের এতো দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এখনো অসম্ভব সমকালীন মনে হয়-
“যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।”
.
“সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চব্বিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজকর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করে বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব; কিন্তু রাজকর্মচারির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।”
.
যুগে যুগে প্রজাবৎসল শাসককূলের উত্তম শাসনকার্যের সবচাইতে প্রাচীন ও অসাধারণ সহায়িকা হিসেবে রচিত ধর্ম-দর্শন-ন্যায়পরায়ণতা-কূটনীতি-অর্থনীতি-রাষ্ট্রনীতির আকর-গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-কে তৎকালীন প্রজাহিতৈষী মৌর্য শাসকরা যে হেলাফেলা করেননি তা বুঝা যায় চাণক্য-সহায়তায় মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের চব্বিশ বছরের শাসনকালের পরও দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারা’র জনপ্রিয়তা যাচাই করলে। তারও পরে এই মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের শাসনকাল তো প্রতীকী স্থায়িত্ব পেয়ে আছে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামে প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের দৃশ্যমান অবস্থিতিতে।
.
চাণক্য-নীতিশাস্ত্র
‘ইয়মিদানীমাচার্যবিষ্ণুগুপ্তেন মৌর্যার্থে ষড্ভিশ্শ্লোকসহস্রৈসসংক্ষিপ্তা’।– ‘দশকুমার-চরিত’ গ্রন্থের এই শ্লোকটি থেকে জানা যায় যে, চাণক্য বিষ্ণুগুপ্ত রচিত নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থ ছয় হাজার শ্লোকসমন্বিত ছিলো।
চাণক্যের এই শ্লোকসমূহ এতোই প্রসিদ্ধ ছিলো যে পরবর্তীকালের পণ্ডিতেরা স্বেচ্ছানুসারে শ্লোক নির্বাচন করে ‘বৃদ্ধ-চাণক্য’, ‘বোধিচাণক্য’, ‘লঘুচাণক্য’ প্রভৃতি নামে একাধিক গ্রন্থে পরিণত করেন বলে জানা যায়। প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্য গবেষকরা চাণক্যশ্লোকের বহু সংস্করণের কথা বললেও অন্তত ছয়টি সংস্করণ স্বীকৃত। এগুলো হচ্ছে- ‘বৃদ্ধচাণক্য’ (অলংকৃত), ‘বৃদ্ধচাণক্য’ (সরল), ‘চাণক্যনীতিশাস্ত্র’, ‘চাণক্যসংগ্রহ’, ‘লঘুচাণক্য’ এবং ‘চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র’। তবে এই নামকরণ যে প্রাচীনসম্মত নয়, পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতেই এরকম করা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
.
‘চাণক্যনীতিশাস্ত্র’ গ্রন্থটি বাছাই করা মাত্র একশ’ আটটি শ্লোক সম্বলিত। তবে চাণক্যের নামে চালু থাকলেও এর মধ্যে কোনগুলি প্রকৃতই চাণক্যের রচনা তা বলা দুঃসাধ্য। কারণ প্রসিদ্ধির কারণে যে-কোন সুভাষিত শ্লোকই চাণক্যশ্লোক বলে লোকে ধারণা করতো। ফলে অন্যান্য বহু পণ্ডিতের সুভাষিত শ্লোক যে প্রক্ষিপ্তভাবে অনেককাল আগেই ‘চাণক্যশ্লোকে’র অন্তর্গত হয়ে গেছে এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। অনেক ক্ষেত্রে মূল শ্লোকের অনুকরণে লেখা কোন মনোরম শ্লোক যে মূলকে অপসারণ করে নি তাও নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
.
সংস্কৃত কাব্যে অনুষ্টুপ ছন্দেরই অপর নাম শ্লোক। এই অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত ‘চাণক্যনীতিশাস্ত্রে’র শ্লোকের সংখ্যা ১০৮টি হলেও আলোচ্য বিষয়বস্তু অনেক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্ডিত কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে সর্বক্ষেত্রে শ্লোকের ক্রমও সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি বলে শ্লোকগুলো বিষয়ানুগ শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়। গ্রন্থটির বিচিত্র বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যা বিদ্বান-শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত-প্রশংসা, মূর্খ-নিন্দা, সুপুত্র-প্রশংসা, কুপুত্র-নিন্দা, সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য, প্রকৃত বন্ধু এবং ছদ্ম বন্ধুর পার্থক্য নির্ণয়, দুর্জনের স্বরূপ এবং নিন্দা, সুজনের স্বরূপ এবং প্রশংসা, বিভিন্ন জীবিকায় নিযোজ্য লোকের যোগ্যতানির্দেশ, পরিবর্জনীয় বিষয়, স্ত্রীচরিত্রের দুর্বলতা নির্দেশ, অর্থকৌলীন্য এবং দারিদ্র্যনিন্দা, জীবন চলার পথে একান্ত অভিলষিত কিন্তু দুর্লভ বিষয়ক নির্দেশ ইত্যাদি সহ বহু বিষয়।
.
‘চাণক্যনীতিশাস্ত্রে’র শ্লোকগুলোর অধিকাংশই চিরন্তন মূল্যবোধের দ্বারা প্রণোদিত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটাও পরিলক্ষিত হয় যে গ্রন্থকার শেষপর্যন্ত সমাজের উর্ধ্বে নন। তৎকালীন সমাজের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিই চাণক্যের শ্লোকসমূহে প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমান চিন্তাধারায় এর কিছু কিছু অনভিপ্রেত হলেও চাণক্য যে তাঁর সময়ে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক শ্রেণীরই প্রতিনিধি ছিলেন সেটাও ভুলে গেলে চলবে না।
তথ্যসূত্র ↑
- কখ গ ঘ V. K. Subramanian (১৯৮০)। Maxims of Chanakya: Kautilya। Abhinav Publications। আইএসবিএন 978-0-8364-0616-0। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৬-০৬।
- ↑ S. K. Agarwal (১ সেপ্টেম্বর ২০০৮)। Towards Improving Governance। Academic Foundation। পৃষ্ঠা 17। আইএসবিএন 978-81-7188-666-1। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৬-০৬।
- ↑ কখ Mabbett, I. W. (১৯৬৪)। "The Date of the Arthaśāstra"। Journal of the American Oriental Society। American Oriental Society। 84 (2): 162–169। doi:10.2307/597102। জেস্টোর 597102। ISSN 0003-0279।
- ↑ L. K. Jha, K. N. Jha (1998). "Chanakya: the pioneer economist of the world", International Journal of Social Economics 25 (2–4), p. 267–282.
- ↑ কখ Waldauer, C., Zahka, W.J. and Pal, S. 1996. Kauṭilya's Arthashastra: A neglected precursor to classical economics. Indian Economic Review, Vol. XXXI, No. 1, pp. 101–108.
- ↑ Tisdell, C. 2003. A Western perspective of Kauṭilya's Arthashastra: does it provide a basis for economic science? Economic Theory, Applications and Issues Working Paper No. 18. Brisbane: School of Economics, The University of Queensland.
- ↑ Sihag, B.S. 2007. Kauṭilya on institutions, governance, knowledge, ethics and prosperity. Humanomics 23 (1): 5–28.
- ↑ "The Indian Machiavelli" or Political Theory in India Two Thousand Years Ago by Herbert H. Gowen. Political Science Quarterly Vol. 44, No. 2 (Jun. 1929), pp. 173–192. Published by: The Academy of Political Science.
- ↑ Namita Sanjay Sugandhi (২০০৮)। Between the Patterns of History: Rethinking Mauryan Imperial Interaction in the Southern Deccan। ProQuest। পৃষ্ঠা 88–89। আইএসবিএন 978-0-549-74441-2। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৬-০৬।
- ↑ Renu Saran (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। Chanakya। Diamond Pocket Books Pvt Ltd। পৃষ্ঠা 4–। আইএসবিএন 978-93-5083-482-4।
- ↑ কখ The Indian Encyclopaedia by Subodh Kapoor (2002). Cosmo Publications. Page 1372. আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৭৫৫-২৫৭-৭. Retrieved 14 April 2012.
- ↑ Iyengar, P. T. Srinivasa (১৯২৯)। History of the Tamils from the Earliest Times to the Present Day।
- ↑ P. E. Granoff (১ জানুয়ারি ১৯৯৩)। The Clever Adulteress and Other Stories: A Treasury of Jaina Literature। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 189–190। আইএসবিএন 978-81-208-1150-8। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১২।
- ↑ কখ Trautmann, Thomas R. (১৯৭১)। Kautilya and the Arthaśāstra: A Statistical Investigation of the Authorship and Evolution of the Text। Leiden: E.J. Brill। পৃষ্ঠা 10।
- ↑ "Chanakya, The Legend"। Chanakya National Law University। ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৩।
- ↑ "Sri Chanakya Niti-Sastra"। philosophy.ru। ১২ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১৩।
- ↑ Wilhelm Geiger (১৯০৮)। The Dīpavaṃsa and Mahāvaṃsa and their historical development in Ceylon। H. C. Cottle, Government Printer, Ceylon। পৃষ্ঠা 40। ওসিএলসি 559688590।
- ↑ M. Srinivasachariar। History of classical Sanskrit literature (3 সংস্করণ)। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 550। আইএসবিএন 978-81-208-0284-1।
- ↑ Jainism in South India by P. M. Joseph. International School of Dravidian Linguistics, 1997. আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮৫৬৯২-২৩-৪.
- ↑ Nury Vittachi (২০০৭)। The Kama Sutra of Business: Management Principles From Indian Classics। Wiley India Pvt. Limited। পৃষ্ঠা 87। আইএসবিএন 978-81-265-1454-0। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৬-০৬।
- ↑ Sri Chanakya Niti-shastra; the Political Ethics of Chanakya Pandit Hardcover। Translated by Miles Davis and V. Badarayana Murthy। Ram Kumar Press। ১৯৮১। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৮-১৫।
- ↑ Paul Halsall. Indian History Sourcebook: Kautilya: from the Arthashastra c. 250 BC Retrieved 19 June 2012
- ↑ T. Burrow ("Cāṇakya and Kauṭalya", Annals of the Bhandarkar Oriental Research Institute 48–49 1968, p. 17 ff.
- ↑ Ghosh, Ajit Kumar (২০০১)। Dwijendralal Ray। Makers of Indian Literature (1st সংস্করণ)। New Delhi: Sahitya Academy। পৃষ্ঠা 44–46। আইএসবিএন 81-260-1227-7।
- ↑ Raha, Kironmoy (২০০১) [1978]। Bengali Theatre (3rd সংস্করণ)। New Delhi: National Book Trust, India। পৃষ্ঠা 81। আইএসবিএন 978-81-237-0649-8।
- ↑ "Chanakya Chandragupta (1977)"। IMDb।
- ↑ "Manoj Joshi to play Chanakya in Ashoka"। Timesofindia.indiatimes.com। ২০১৪-১২-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৩-৩০।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ