ঈশ্বরের অবতার - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

12 August, 2020

ঈশ্বরের অবতার

বৈদিক সাহিত্যে বতার শব্দটি পাওয়া যায় না। তবে বেদ-পরবর্তী সাহিত্যে এটি ক্রিয়াপদ আকারে উল্লিখিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পরে রচিত পৌরাণিক সাহিত্যেই এই শব্দটিকে স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ্য পদের আকারে ব্যবহার করা হয়েছে। নিজ স্থিতি থেকে নিম্নে অবতরন করেন তাকে অবতার বলা হয়। পৃথিবীতে ঈশ্বরের আবির্ভাব বা আবির্ভূত জীবদেহকে "অবতার" বলা হয়। শব্দটি সাধারণ ক্ষেত্রে "ব্যক্তিবিশেষের [দেবতা] আবির্ভাবের জন্য অবতরণ" অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সম্মানীয়/শ্রদ্ধেয়/স্রষ্টার বাণী নিয়ে জীবদেহ ধারন গুরু বা কোনও মানুষকেও অবতার বলে উল্লেখ করা হয়। 
ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া কি সম্ভব? এ দেশের লোকের বিশ্বাস, কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার। শিক্ষিতের বিশ্বাস যে, কথাটা অতিশয় অবৈজ্ঞানিক, এবং আমাদিগের খ্রীষ্টান উপদেশকদিগের মতে অতিশয় উপহাসের যোগ্য বিষয়।
সব সত্যবিদ্যা এবং যা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায় সেসবের আদিমূল পরমেশ্বর। ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অণুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা।
বিভিন্ন ভাবে প্রশ্ন আসে অবতার নিয়, যেমনঃ যিনি ইচ্ছাময় এবং সর্বশক্তিমান্, তিনি ইচ্ছা করিলে নিরাকার হইলেও আকার ধারণ করিতে পারেন না কেন? তাঁহার সর্বশক্তিমত্তার এ সীমানির্দেশ কর কেন? তবে কি তাঁহাকে সর্বশক্তিমান্ বলিতে চাও না? যিনি এই জড় জগৎকে আকার প্রদান করিয়াছেন, তিনি ইচ্ছা করিলে নিজে আকার গ্রহণ করিতে পারেন না কেন?
যাঁহারা এ আপত্তি না করেন, তাঁহারা বলিতে পারেন ও বলেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান্, তাঁহার জগৎ-শাসনের জন্য, জগতের হিত জন্য, মনুষ্যকলেবর ধারণ করিবার প্রয়োজন কি? যিনি ইচ্ছাক্রমেই কোটি কোটি বিশ্ব সৃষ্ট ও বিধ্বস্ত করিতেছেন, রাবণ কুম্ভকর্ণ কি কংস শিশুপাল-বধের জন্য তাঁহাকে নিজে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, বালক হইয়া মাতৃস্তন্য পান করিতে হইবে, ক, খ, গ, ঘ শিখিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতে হইবে, তাহার পর দীর্ঘ মনুষ্য-জীবনের অপার দুঃখ ভোগ করিয়া শেষে স্বয়ং অস্ত্রধারণ করিয়া, আহত বা কখন পরাজিত হইয়া, বহ্বায়াসে দুরাত্মাদের বধসাধন করিতে হইবে, ইহা অতি অশ্রদ্ধেয় কথা।
যাঁহারা এইরূপ আপত্তি করেন, তাঁহাদের মনের ভিতর এমনি একটা কথা আছে যে, এই মনুষ্য-জন্মের যে সকল দুঃখ-গর্ভে অবস্থান, জন্ম, স্তন্যপান, শৈশব, শিক্ষা, জয়, পরাজয়, জরা, মরণ, এ সকলে আমরাও যেমন কষ্ট পাই, ঈশ্বরও বুঝি সেইরূপ। তাহাদিগের স্থূল বুদ্ধিতে এটুকু আসে না যে, তিনি সুখদুঃখের অতীত,—তাঁহার কিছুতেই দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। জগতের সৃজন, পালন, লয়, যেমন তাঁহার লীলা (Manifestation), এ সকল তেমনি তাঁহার লীলামাত্র হইতে পারে। তুমি বলিতেছ, তিনি মুহূর্তমধ্যে যাহাদিগকে ইচ্ছাক্রমে সংহার করিতে পারেন, তাহাদের ধ্বংসের জন্য তিনি মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কাল ব্যাপিয়া আয়াস পাইবেন কেন? তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, যাঁহার কাছে অনন্ত কালও পলক মাত্র, তাঁহার কাছে মুহূর্তে ও মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কালে প্রভেদ কি?
কেবল একটা কংস বা শিশুপাল মারিবার জন্য যে স্বয়ং ঈশ্বরকে ভূতলে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, ইহা অসম্ভব কথা বটে। যিনি অনন্তশক্তিমান্, তাঁহার কাছে কংস শিশুপালও যে, এক ক্ষুদ্র পতঙ্গও সে। বাস্তবিক যাহারা হিন্দুধর্মের প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিতে না পারে, তাহারাই মনে করে যে, অবতারের উদ্দেশ্য দৈত্য বা দুরাত্মাবিশেষের নিধন। অসুরবধ কথাটা আমরা বিষ্ণুর অবতার সম্বন্ধে পুরাণাদিতে শুনিয়া থাকি।
ভগবদ্গীতায় অতি সংক্ষেপে বলা হইতেছে :—
“পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংরক্ষণার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ||”
এ কথাটা অতি সংক্ষিপ্ত। “ধর্মসংরক্ষণ” কি কেবল দুই একটা দুরাত্মা বধ করিলেই হয়? ধর্ম কি? তাহার সংরক্ষণ কি কি প্রকারে হইতে পারে?
আমাদিগের শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি সকলের সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ধর্ম। এই ধর্ম অনুশীলনসাপেক্ষ, এবং অনুশীলন কর্মসাপেক্ষ।[2] অতএব কর্মই ধর্মের প্রধান উপায়। এই কর্মকে স্বধর্মপালন (Duty) বলা যায়।
মনুষ্য কতকটা নিজ রক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে, তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না—আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বর আমাদের আদর্শ হইতে পারেন না। কেন না, তিনি প্রথমতঃ অশরীরী, শারীরিকবৃত্তিশূন্য; আমরা শরীরী, শারীরিক বৃত্তি আমাদের ধর্মের প্রধান বিঘ্ন। দ্বিতীয়তঃ তিনি অনন্ত, আমরা সান্ত, অতি ক্ষুদ্র। অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবতারের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয়, তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশী সম্ভাবনা। এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?
ভগবদ্গীতায় ভগবদুক্তির তাৎপর্যও এই প্রকার।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
‍‍‌অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতিপুরুষঃ || ১৯
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি || ২০।
যদ্‌‌যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে || ২১।
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানাবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি || ২২।
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশ্ || ২৩।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪। গীতা, ৩ অ।
“পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া, কর্মানুষ্ঠান করিলে মোক্ষলাভ করেন; অতএব তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান কর, জনক প্রভৃতি মহাত্মাগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহা করিয়া থাকে, এবং তিনি যাহা মান্য করেন, তাহারা তাহারই অনুষ্ঠান অনুবর্তী হয়। অতএব তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষার্থ কর্মানুষ্ঠান কর। দেখ, ত্রিভুবনে আমার কিছুই অপ্রাপ্য নাই, সুতরাং আমার কোন প্রকার কর্তব্যও নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠান করিতেছি। যদি আমি আলস্যহীন হইয়া কখন কর্মানুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে, সমুদায় লোকে আমার অনুবর্তী হইবে, অতএব আমি কর্ম না করিলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হইয়া যাইবে, এবং আমি বর্ণসঙ্কর ও প্রজাগণের মলিনতার হেতু হইব।”
কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ।
 ঈশ্বর আছেন সত্য, এবং তিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা, ইহাও সত্য। কিন্তু তিনি গাড়ীর কোচমানের মত স্বহস্তে রাশ ধরিয়া বা নৌকার কর্ণধারের মত স্বহস্তে হাল ধরিয়া এই বিশ্বসংসার চালান না। তিনি কতকগুলি অচল নিয়ম সংস্থাপন করিয়া দিয়াছেন, জগৎ তাহারই বশবর্তী হইয়া চলিতেছে। এই নিয়মগুলি অচলও বটে, এবং জগতের স্থিতিপক্ষে যথেষ্টও বটে। অতএব ইহার মধ্যে ঈশ্বরের স্বয়ং হস্তক্ষেপণ করিবার স্থান নাই প্রয়োজনও নাই। সুতরাং ঈশ্বর মানব-দেহ ধারণ করিয়া যে ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইবেন ইহা অশ্রদ্ধেয় কথা।
মনুষ্যের উন্নতির মূল, ধর্মের উন্নতি। ধর্মের উন্নতিও ঐশিক নিয়মে সাধিত হইতে পারে, ইহাও স্বীকার করি। কিন্তু কেবল নিয়মফলে যত দূর তাহার উন্নতি হইতে পারে, ঈশ্বর কোন কালে স্বয়ং অবতীর্ণ হইলে তাহার অধিক উন্নতি সিদ্ধ হইতে পারে কিন্তু ঈশ্বর মনষ্য সৃষ্টির পর জ্ঞান হিসাবে বেদ দেওয়ার পর তার অবতীর্ণের দরকার কি..?
দেবতা বলতে বেদে তেত্রিশ রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছে।এনাদের মধ্যে এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরিক্ষে অবস্থান করছেন। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে এটি পরিষ্কার ভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।
নিরক্তে দেব শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। "দেবো দানদ বা, দীপনাদ্ বা, দৌতনাদ বা, দ্যুস্থানো ভবতীতি বা; নিঃ ৭।১৫। অর্থাৎ দেবের লক্ষন হচ্ছে দান। সবার হিতার্থে যে দান করে সে দেব। দেবের গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য,চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়। দেবের কর্ম হচ্ছে দৌতন অর্থাৎ সত্যপদেশ করা। অর্থাৎ যে মানুষ সত্য মানে, সত্য বলে এবং সত্য উপদেশ দান করে সে দেব। দেবের বিশেষতা হচ্ছে দ্যুস্খান অর্থাৎ উপরে স্থিতি লাভ। ব্রহ্মাণ্ডের উপরে স্থিতি লাভ করার জন্য সূর্যকে, সমাজের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য বিদ্যান কে এবং রাষ্টের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য রাজা কে দেব বলে।

এখন প্রশ্ন যে, এই দেব কত জন? পবিত্র বেদে স্পষ্ট রূপে উল্লেখ আছে যে, দেব তেত্রিশ জন।

যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা নিধিং রক্ষন্তি সর্বদা।
নিধিং তমদ্য কো বেদ যং দেবা অভিরক্ষথ।।
(অথর্ববেদ ১০।৭।২৩)

যেই [পরমেশ্বরের]  সংসার কে তেত্রিশ দেব সর্বদা রক্ষা করছে।  সেই সংসার কে আজ কে জানতে পারে,  যাকে হে দেব! তুমি সর্বদা রক্ষাকারী হও।

বৈদিক সংস্কৃতিতে "কোটি" শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকার। অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে দেব হচ্ছে তেত্রিশ প্রকার তেত্রিশ কোটি নয়। তেত্রিশ কোটি দেবতার কল্পনা মিথ্যা এবং ভ্রামক।

এই তেত্রিশ প্রকার দেবতা কে কে?

" অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশা চিতি"
(বৃহঃ উপঃ ৩।৯।২)

অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয় জন মিলিয়া একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলিয়া তেত্রিশ দেব।

★ অষ্ট বসুঃ (অগ্নিশ্চ পৃথিবীশ্চ বায়শ্চান্তিরিক্ষং চাদিত্যশ্চ দ্যৌশ্চ চন্দ্রমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈত্রে বসব ;
বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৩। )

অর্থাৎ অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক, চন্দ্র, নক্ষত্রপুন্জ ইহারা অষ্ট বসু। কারন নিখিল পদার্থ ইহাদের মধ্যে নিহিত আছে সেই জন্য এদের নাম বসু।

★ একাদশ রুদ্রঃ (দশমে পুরুষো প্রাণা আত্মৈকাদশন্তে ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৪)

অর্থাৎ পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায় বলিয়া রুদ্র বলা হয়। এগুলো হচ্ছে -
পঞ্চ প্রাণঃ প্রাণ, উদান,সমান, ব্যান, অপান।
উপ প্রাণঃ নাগ, কুর্ম, কৃকল, দেব, ধনন্জয়।
এবং জীবাত্মা।

★ দ্বাদশ আদিত্যঃ (দ্বাদশ বৈ মাসা ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৬)
সম্বৎসরে বার মাস আছে ইহারাই আদিত্য। কারন ইহারা এই সমস্তকে আদান করিয়া যান। যেহেতু এই সমস্ত কে আদান করিয়া যান অতএব তাহারা আদিত্য। দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে -
চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঁঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্ত্তিক, মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন।

★ ইন্দ্রঃ (স্তনযিত্নুরেবেন্দ্রো ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) অর্থাৎ বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র । কারন ইহা ঐশ্বর্যের সাধন গতি শক্তি, প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্ত হয়।

★ প্রজাপতিঃ (যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) যজ্ঞ হচ্ছে প্রজাপতি। কারন ইহার দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণীদের সুখ মিলে। গীতা ৩।১৪ মধ্যে বলা হয়েছে - প্রাণী অন্ন থেকে, অন্ন বৃষ্টি থেকে এবং বৃষ্টি যজ্ঞ দ্বারা উৎপন্ন হয়। এই প্রকার ইহা প্রাণীদের জীবন ও সুখের আধার।

বেদের উল্লেখিত দেবতাগুলো কি

বেদের প্রত্যেকটি মন্ত্রেরই এক বা একাধিক দেবতা রয়েছে।পবিত্র বেদ সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব থাকায় আমরা অধিকাংশ মানুষ মনে করে এগুলো হল মানুষ আকৃতির বিভিন্ন দেবতা যাদেরকে ওই মন্ত্রটিতে স্তুতি করা হয়েছে। অথচ এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের ঘোষনা দেয়া পবিত্র বেদে এরকম কোন দেবতা ই নেই।তাহলে প্রত্যেকটি মন্ত্রের সাথে উল্লেখিত এই দেবতাগুলো কি?

 আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে পবিত্র বেদের অধ্যয়সূচী(Index) যাতে প্রত্যেকটি মন্ত্রের অধ্যয়,সেই মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি এবাং সেই মন্ত্রের দেবতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে তাকে বলা হয় অনুক্রমনি।এরকম বেশ কয়েকটি অনুক্রমনির মধ্যে ঋষি কাত্যায়ন এর সর্বানুক্রমনি সবচেয়ে খ্যতনামা বলে বিবেচিত।এই সর্বানুক্রমনিতে ঋষি কাত্যায়ন মন্ত্রের দেবতা কি তার ব্যখ্যায় বলেছেন- "যা তেন উচ্চতে সা দেবতা" অর্থাত্ মন্ত্রের যে বিষয়বস্তু অর্থাত্ যা নিয়ে মন্ত্রে কথা বলা হয়েছে তাই ওই মন্ত্রের দেবতা। মহর্ষি যস্কাযার্চ লিখিত বৈদিক শব্দকোষ ও ব্যকরন গ্রন্থ নিরুক্ত সাংহিতায় বলা হয়েছে- "যত্কাম ঋষির্যেস্যাং দেবতাযামার্থপত্যম্ ইচ্ছত্ স্তুতিং প্রযুক্তেতম্ দেবতঃ স মন্ত্রো ভবতি।।" অর্থাত্ যখন ঈশ্বর কোন একটি বিষয়ের সম্বন্ধে আমাদের মন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দেন তখন মন্ত্রের সেই বিষয়টিকে দেবতা বলা হয়। উদাহরনস্বরুপ ঋগ্বেদ ১০.১৫১ এর দেবতা হল 'শ্রদ্ধা' এবং এই সুক্তের আলোচ্য বিষয় হল ঈশ্বর ও গুরুজনে শ্রদ্ধা বা সম্মান। ঋগ্বেদ ১০.১১৭ এর দেবতা হল 'ধনদানপ্রশাংসা' এবাং এই সুক্তের মন্ত্রসমূহের আলোচ্য বিষয় হল গরীবদুঃখীদের দানে উত্সাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। ঋগ্বেদ ১০.১৪৬ এর দেবতা হল 'দ্যুতনিন্দা' এবং তাই এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হল জুয়াখেলার অপকারিতা ও নিষিদ্ধতা। ঋগ্বেদ এর প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তের দেবতা হল 'অগ্নি'। আজ ম্যাক্সমুলার সহ বিদেশী মিশনারীদের অপপ্রচারের কারনে একে সবাই নির্দিষ্ট আকৃতিযুক্ত আলাদা একটি দেবতা মনে করে যদিও তা সম্পূর্ন ভূল।

উপযোগের দেব -

এই তেত্রিশ প্রকার দেব এর মধ্যে কেবল জীবাত্মা চেতন। ইহা অন্যের উপযোগ করে অথবা স্বয়ং অন্য জীবাত্মার উপযোগে আসে। যেমন গাভী দুধ দিয়ে, ভেড়া ঊণ দিয়ে, ষাড় হাল চাষের উপযোগে আসে। তেমনি সৈনিক, বৈদ্য আদি উপযোগে আসে এবং স্বামী, রাজা আদি উপযোগ নেয়। জীবাত্মার অতিরিক্ত শেষ বত্রিশ দেব জড় এবং উপযোগের দেব বলা হয়।

ব্যবহারের দেব 

মাতা, পিতা,আচার্য, অতিথি এবং পতি-পত্নি দ্বারা সংসারের ব্যবহার সিদ্ধ হয়। এ জন্য এই পাঁচ কে ব্যবহারের দেব বলা হয়।

 প্রথম দেবতা মাতাঃ 

মাতার স্থান ঈশ্বরের পরেই তিনি জাগ্রত মূতিমতি দেবী ।সন্তান কর্তব্য হলো মাকে শ্রদ্ধা, ভক্তি, সন্মান,সেবা ও পূজা করা। মা দুঃখ-কষ্টপান এমন কাজ করা কোন সন্তানের কতর্ব্য নয়।
এ জন্য অথর্ববেদে বলা হয়েছে " মা হিংসষ্ট পিতরং মাতরং চ (অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)" অর্থাৎ পিতা মাতাকে কখনো হিংসা করো না।

 দ্বিতীয় দেবতা পিতাঃ

পিতা আমাদের সর্বদা রক্ষা করেন। তাই সন্তানের কর্তব্য মাতার সমান পিতাকেও সেবা করা। পিতাকে কখনো কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। 
যজুর্বেদ এ জন্য বলছে " মা নো বধীঃ পিতরং মাতরং যজু১৬।১৫" অর্থাৎ পিতা মাতাকে কখনো বধ করো না,  তাদের তাড়না দিও না।

 তৃতীয় দেবতা আচার্য্যঃ 

আচার্য্য  অর্থাৎ যিনি বিদ্যাদাতা তাকে কায় মন বাক্য দ্বারা সেবা করা উচিৎ। কারন তিনি আমাদের  বিকশিত শরীর মন ও উন্নত মস্তিস্কবানরূপে প্রস্তুত করেন।
 অথর্ববেদে বলা হয়েছে - "আচার্য্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিনং কৃণুতে গর্ভমন্ত (অথর্ববেদ ১১।৫।৩) অর্থাৎ আচার্য ব্রহ্মচারীকে উপনয়ন সংস্কার করে নিজের সমীপে রেখে তাহার মধ্যে বিদ্যা গর্ভরূপে স্থাপন করেন। 

চতুর্থ দেবতা অতিথিঃ

একজন গৃহস্থ  ব্রাত্য অর্থাৎ সত্যব্রতধারী, ধার্মিক, অকপকট অতিথিকে সৎকার করবে।
অথর্ববেদে বলা হয়েছে " ব্রাত্যোহপরিমিতা রাত্রীরতিথির্গৃহে বসতি.....তেনাব রুন্ধে (অথর্ববেদ ১৫।১৩।৯) অর্থাৎ অতিথি  বহু রাত্রী গৃহ মধ্যে অবস্থান করলে তাকে সৎকার দ্বারা গৃহস্থ  সুরক্ষিত করবে। 

পঞ্চম দেবতা পতিপত্নিঃ

অর্থাৎ স্ত্রীর পক্ষে পতি এবং পতির পক্ষে স্বপত্নী।  অর্থাৎ স্বামী তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধা করবেন।  এবং স্ত্রীও তার  স্বামীকে শ্রদ্ধা করবেন

"পূজ্যা ভুষয়িত ব্যাশ্চ বহু কল্যাণমীপসুভীঃ।মনুঃ ৩।৫৫"  অর্থাৎ শুধু  পতিই স্ত্রীকে পূজা করবেন এমন নয়।  কি  ভ্রাতা,  পিতা,  দেবর সবাই ইহাকে ভোজনাদি দ্বারা পূজা করবেন এবং বস্ত্রালংকার দ্বারা ভূষিত করবেন। 
এবং স্ত্রীও পতিকে দেবতাজ্ঞানে সেবা করবেন - " উপচর্যঃ স্ত্রীয়া সাধ্ব্যা সততং দেবব পতিম্। মনুঃ ৫।১৫৪"

এই পাঁচজন বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ দেব-দেবী। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও আমরা এইরূপ দেবতাদেরকেই দেখতে পাই এবং তাদের পূজনের কথা পাই। "মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব, আচার্য দেবো ভব, অতিথি দেবো ভব।" তৈত্তিরীয়_উপনিষদ্ ১।১১।২" 

 তাহলে কি সমস্ত মানুষ ই দেব হয়ে যায়? না, দেব হচ্ছে বহু বিশেষন যুক্ত। একজন মাতা যদি নিজ পুত্রের পক্ষপাত করে অন্যের সাথে বিবাদ করে। তখন সে মাতা দেব এর সঙ্গার মধ্যে পড়ে না। দেব হবে সেই যার মধ্যে উত্তম গুনাবলী তথা বিভিন্ন দৈবী সম্পদ রয়েছে।

উপরের বর্ণিত যে তেত্রিশ প্রকার দেবের বর্ণনা করা হলো। ইহাদের হইতে সুখ যেমন মিলে তেমনি দুঃখ ও মিলে। অগ্নি দেব কিন্তু অনেক সময় সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়, অতিথী দেব কিন্তু পরবর্তিতে শত্রু ও হতে পারে। রাজা দেব কিন্তু কুপিত হয়ে দুঃখদায়ী হতে পারে। এই কারনে ইহা সদুপযোগ এবং সৎকারের মর্যাদা দ্বারা বাধে। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী এর সদুপযোগ করা মর্যাদা। মাতা, পিতা আচার্য এবং অতিথির সেবা করা ধর্ম। পূর্বজ মহাপুরুষের পথ অনুসরন, সংবিধান পালন এবং দেশের রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য। কিন্তু এরা কোন উপাস্য দেব নয়। উপাস্য দেব কেবল পরমাত্মা, কারন পরমাত্মাই সবার ইষ্ট দেব। এই সৃষ্টির সব কাল এবং পরিস্খিতির মধ্যে পূর্ণতম দেব এক এবং সেই পরমাত্মা। সেই জন্য পবিত্র বেদ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন -

" হে মিত্র! পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কাহারো স্তবন করো না এবং দুঃখী হয়ো না। এই উৎপন্ন জগতের সাথে মিলে সেই শক্তিশালী শত্রুর নাশকারী প্রভূর স্তুতি করো এবং বারংবার উক্ত স্তোত্রের স্তবন করো (অথর্ববেদ ২০।৮৫।১)"
অর্থাৎ আমাদের শুধু সেই এক পরমাত্মার উপাসনা করা উচিৎ।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ