প্রস্তাবনা,তীব্র আবেগ ও কল্পনা শক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করাকে বলা হয় হিপনোসিস। হিপনোসিস অর্থ সম্মোহন।জেনে রাখুন, হিপনোটাইজড সবাইকেই করানো সম্ভব। অনেকে মনে করেন, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
দেখা গেছে, মোটামুটিভাবে কোনো জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ।অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল “প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড”। এটা অনেক দ্রুত পদ্ধতি, যা কিনা সমস্যার মূলে সরাসরি হিট করতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক না-হলে মনের প্রোগ্রামিংয়ে হয়ে যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে একটা-দুটো অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে। সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা উচিত এক্কেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ওষুধে।
ছবি ২ দেখুন। এখানে যে চারটি দীর্ঘ রেখা দেখা যাচ্ছে সেগুলােকে দেখলে বাঁক মনে হলেও চারটি দীর্ঘ রেখাই সরল-সমান্তরাল।
ছবি- ২ছবি ৩ দেখুন। চারটি অক্ষরই বাঁকা বলে আমাদের দৃষ্টিতে মনে হলেও বাস্তবে প্রতিটি অক্ষরই খাড়া।
ছবি- ৩
দেখা গেছে, মোটামুটিভাবে কোনো জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ।অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল “প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড”। এটা অনেক দ্রুত পদ্ধতি, যা কিনা সমস্যার মূলে সরাসরি হিট করতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক না-হলে মনের প্রোগ্রামিংয়ে হয়ে যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে একটা-দুটো অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে। সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা উচিত এক্কেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ওষুধে।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, সম্মোহন মানে জাদুবিদ্যা।
কোন অন্ধবিশ্বাসে বশ হওয়া নয়। বহুজনে বা বিখ্যাতজনে মেনে নিয়েছেন বলে কোন ধারণাকে মেনে নেওয়া নয়। যুক্তি দিয়ে বিচার করব, যাচাই করব শুধু। তারপরই গ্রহণ করব বা বাতিল করব।
কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। এই সম্মোহন শব্দটাকেই ভিত্তি করে বিশ্বে এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে অনেক আগে, যার নাম হিপনোথেরাপি।
সম্মোহন বিদ্যা - রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র
অনলাইন পড়ুন ও পিডিএফ ডাউনলোড করুন: http://goo.gl/wDKSk9
এটি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও প্রমাণিত। আমাদের দেশে অনেক থেরাপিই প্রচলিত যেমন- কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি, যা ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। হিপনোথেরাপি শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও এর তেমন কোনো কার্যকর প্রয়োগ আমাদের দেশে এখনও দেখা যায়নি।
হিপনোথেরাপি এমন এক থেরাপি, যা একজন ব্যক্তির চেতনা পরিবর্তন করে। হিপনোথেরাপিকে বলা হয় ‘প্রোগ্রামিং অব সাব কনসাস মাইন্ড’। একজন রোগীকে যখন হিপনোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়, তখন তার মস্তিষ্কের আলফা স্তরে এক ধরনের তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।
এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিশ্বের অনেক দেশ যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই মানুষের নানাবিধ সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। হিপনোথেরাপির মাধ্যমে মানুষের মানসিক সমস্যা, ডিপ্রেশন, উত্তেজনা, অনিদ্রা, ভয়, ক্ষুধামন্দা, স্থূলতা ও ব্যথাসহ অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতিটির জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা হিপনোটাইজ থিওরি।
সেন্টার হসপিটালিয়ার ইউনিভার্সিটায়ার ডি-টুর এর ডাক্তার ইলেস জেমুরা ও তার সহকর্মীরা অ্যানেস্থেসিয়ার পরিবর্তে হিপনোসিস প্রয়োগের ধারণা নিয়ে ২০১১ সাল থেকে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশেও এটির বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সাইকোলজিক্যাল সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব হবে এই অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে। তাছাড়া হিপনোথেরাপির মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব।
শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে অপরাধীদের কাছ থেকে বের করা যাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় হিপনোথেরাপি হবে অনেক ফলপ্রসূ। দেশে দক্ষ হিপনোথেরাপিস্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কোর্স, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে খুলে যেতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জুনকে “বিশ্বদর্শন করিয়েছিলেন—তা কি সম্মােহন ছিল? হিটলার যে একটা গােটা জাতিকে হিস্টিরিক করে তুলেছিলেন? তার একান্ত বাধ্য করে তুলেছিলেন? তাকে কি হিটলারের সম্মােহন শক্তি বলা যায়? রজনীশ কি তার চোখ ও কথা দিয়ে মানুষকে সম্মােহন করে রাখতেন? আমরা যে অভিনয় দেখতে দেখতে হাসি, কাদি, ক্রুদ্ধ হই, উত্তেজিত হই, তাকে কি অভিনেতার সম্মােহনী শক্তি বলবাে? মহরমে বা চরকে ভক্তরা যে নিজেদের শরীরকে কষ্ট দেয়, কিন্তু কষ্ট অনুভব করে না—এর কারণ কী ওরা কি সেই সময় আত্মসম্মােহিত থাকে? ম্যানড্রেকের কমিকসে যেমন থাকে ভিলেনগুলি করতে গিয়ে দেখে হাতের রাইফেল বিষাক্ত সাপ হয়ে গেছে ইত্যাদি-সম্মােহনে এমন কিছু কি সত্যিই করা সম্ভব? জাদুকর কি সম্মােহন করে জাদু দেখান? পি.সি. সরকারের আগেও এমনি ঘড়ির কাটা পিছিয়ে দেওয়ার গণসম্মােহনের আষাঢ়ে গল্প আরও অনেক জাদুকরকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে চালু ছিল। এইসব জাদুকররা হলেন রাজা বােস, জাদুকর গণপতি, রয়-দি-মিসটিক। পৃথিবীতে যাঁকে নিয়ে আষাঢ়ে গল্পটির শুরু, তিনি হলেন এক মার্কিন জাদুকর হাওয়ার্ড থার্সটন। জাদুকররা মাঝে-মধ্যে কেন, কোনও সময়ই সম্মােহনের সাহায্যে জাদু দেখান না। শূনাে মানুষ ভাসিয়ে রাখতে, একটা ডাণ্ডার উপর মানুষকে ঝুলিয়ে রাখতে, করাতে দেহ দু'টুকরাে করার খেলা, দেখাতে বা অন্য কোনও খেলায় জাদুকর চোখ বড় বড় করে দু'হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে, যে সম্মােহন (?) করেন, সেটা আদৌ সম্মােহন নয়। অভিনয়। জাদুকরের সঙ্গিনী বা সঙ্গী সম্মােহিত হওয়ার অভিনয় করেন। তারপর যা দেখানাে হয়, তা সম্পূর্ণই কৌশলে দেখান। এইসব জাদুর পিছনে সম্মােহনের কোনও ভূমিকাই নেই।
জাদুকরদের এই অভিনয় বা প্রতারণামূলক সম্মােহন কয়েক প্রজন্ম ধরে দেখতে দেখতে দর্শকরা সম্মােহন সম্বন্ধে ভুল ধারণা একটু একটু করে নিজের মনের মধ্যে গড়ে তুলেছেন। কোনও জাদুকর যখন জাদু দেখান, তখন সেসবই দেখান নিছক কৌশলে, কোনও অলৌকিক ক্ষমতায়। প্রতিটি জাদুকরই সেকথা মঞ্চে ও মঞ্চের বাইরেস্বীকারও করেন। কিন্তু কেউ যদি তেমনটা না করে কোনও জাদু দেখাতে গিয়ে দাবি করেন—এটা এবার দেখাচ্ছেন মন্ত্রশক্তিতে, ঈশ্বরের কৃপায় বা ভুতকে কাজে লাগিয়ে, তবে তা হবে সত্য-লঙ্ঘন, প্রতারণা। এবং এক্ষেত্রে যুক্তিবাদী প্রতিটি মানুষের উচিত এমন এক ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরা। ঠিক একইভাবে উচিত অভিনয়কে সম্মােহন বলে মানুষকে প্রতারণার যে ঘটনা সুদীর্ঘকাল ধরে জাদু জগতে ঘটেই চলেছে, তাকে বন্ধ করা। সম্মােহন বা মস্তিষ্কে ধারণা সঞ্চারের মধ্য দিয়ে বাস্তবিকই যা হয় তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেই সীমাবদ্ধতাকে, সেই সত্যকে মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার স্বার্থেই এইসব না-সম্মােহন’কে ‘সম্মােহন’ বলে চালানাের বুজরুকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে দরকার। পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ কি আদৌ কোনও কৌশলে দেখানাে সম্ভব? ওই ব্যাপারটার পিছনে কি গণসম্মােহন কাজ করেনি? এ-জাতীয় অনেক প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হয় আমাকে এবং যুক্তিবাদী সমিতি’কে। উত্তরে প্রত্যেককেই যা জানিয়েছি, তা আবারও জানাচ্ছি— ট্রেন ভ্যানিশের ম্যাজিকে না ছিল অমৃতসর এক্সপ্রেস, না একজন দর্শকও দেখেছিল ট্রেনটাকে ভ্যানিশ হতে। ম্যাজিকটা আদৌ দেখানােই হয়নি। গােটা । ম্যাজিকটার ভিত্তি ছিল মিথ্যে প্রচার। পুরাে ঘটনাটা বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির চতুর্থ খণ্ডে, উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা পড়ে নিতে পারেন। জাদুকর ম্যানড্রেকের কাহিনিতে যে সব সম্মােহন শক্তির কথা আপনারা কমিক্সের বইতে পড়েন, সেসব নেহাতই ‘গুল-গপ্পো’। অথচ অনবরত ওসব কাহিনি পড়তে পড়তে অনেকেই ভাবে, সম্মােহনের সাহায্যে সত্যিই বােধহয় এমনটাও ঘটানাে সম্ভব। মজার কথা কী জানেন, বছর কয়েক আগে আনন্দমেলা'র পুজো সংখ্যায় সমরেশ মজুমদার ম্যানড্রেকের গল্পে প্রভাবিত হয়ে তার উপন্যাসে ম্যানড্রেকি সম্মােহন’ হাজির করেছিলেন। এমনকী সন্দেশ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৪০২ (ডিসেম্বর, ১৯৯৫) সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের অপ্রকাশিত নতুন যে ফেলুদা-উপন্যাস ইন্দ্রজাল রহস্য’ প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে সূর্যকুমার নামে এক জাদুকর লালমােহনবাবুকে মঞ্চে ডেকে এনে তাঁকে সম্মােহন করে পেন্সিল খাওয়াচ্ছেন অথচ সম্মােহিত লালমােহনবাবু ভাবছেন তিনি চকোলেট খাচ্ছেন। বাস্তবে এমনটি ঘটে না, এবং সবই হল ম্যানড্রেকি গল্পের প্রভাবের ফল বা জাদুকরদের মিথ্যে সম্মােহনের ফল। অনেকে এমনও ভাবে, সম্মােহন করতে পারেন এমন লােকের কাছে যাওয়া দস্তুরমতাে বিপজ্জনক। ওরা সম্মােহিত করে চুরি খুন-খারাপি—সবই করিয়ে নিতে পারে। এসবই, সম্মােহন সম্বন্ধে না জানার ফল। সম্মােহনের ইতিহাস, নানা মত | সম্মােহন’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ “হিপনােটিজম’ (Hypnotism)। হিপনােটিজম্ কথাটি আবার এসেছে হিপনােসিস (Hypnosis) কথা থেকে। ‘হিপনােসিস কথার অর্থ ‘ঘুম’। স্বাভাবিক ঘুমের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও সম্মােহন ঘুম আর স্বাভাবিক-ঘুম’ এক নয় কারণ অ-সাদৃশও কম নয়। তবে এটা বলা যায়, সম্মােহন জেগে থাকা ঘুমের একটা অন্তর্বর্তী অবস্থা। আধ্যাত্মিকতাবাদ ও জাদুবিদ্যার কবল থেকে মনােবিজ্ঞানকে মুক্ত করে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নত করতে প্রচুর বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। সম্মােহনের ক্ষেত্রে এই বাধা ছিল আরও বহুগুণ বেশি। কারণ, এখানে রয়েছে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার। | ভারত, চীন ও গ্রীসের প্রাচীন সভ্যতার আদিপর্বে ধর্মীয় ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সম্মােহনের প্রচলন ছিল। আমাদের অথর্ববেদে সম্মােহনের উল্লেখ দেখতে পাই। মহাভারতেও সম্মােহনের প্রয়ােগের উল্লেখ আছে। | প্রাচীনযুগে সম্মােহনের যে মর্যাদা ছিল মধ্যযুগে সেই মর্যাদা হারিয়ে সম্মােহন হয়ে দাঁড়ায় ‘ব্ল্যাক-ম্যাজিক’ বা ডাকিনীবিদ্যা। কাপালিক বা তান্ত্রিকরা ইচ্ছে করলেই তাদের সম্মােহন শক্তির দ্বারা ক্ষতি করতে পারে, এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার বশ আজও অনেকেই এদের সযত্নে এড়িয়ে চলেন। আধুনিক যুগের সম্মােহনের সুচনা আঠারশ’ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ডক্টর মেসমার অনেক দুরারােগ্য রােগীকে সম্মােহিত করে মস্তিষ্কে ধারণা সঞ্চার করে (Suggestion পাঠিয়ে) সারিয়ে তুললেন। মেসমারের সম্মােহন চিকিৎসার এই অভাবনীয় সাফল্যে ইউরােপে হৈ-হৈ পড়ে গেল। সম্মােহন পরিচিত হলাে ‘মেসমারিজম’ নামে। এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি স্কটল্যান্ডের ডাক্তার জেমস ব্রেইড-এর সম্মােহন নিয়ে গবেষণা আবার আলােড়ন তুলল। তিনি সম্মােহনের নাম দিলেন ‘হিপনােসিস’)। ডক্টর জেমস্ ব্রেইড সম্মােহন-ঘুমের ব্যাখ্যা করলেন বটে, কিন্তু, সম্মােহনকারী ও সম্মােহিত ব্যক্তির মধ্যে সম্মােহনকালে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। অতএব জানা গেল না, কীভাবে সম্মােহনকারী সম্মােহিত ব্যক্তিকে প্রভাবিত করেন। অর্থাৎ এটুকু বােঝা গেল যে, সম্মােহনকারী সম্মােহিতকে জেগে থাকা ও ঘুমের একটি অন্তর্বর্তী অবস্থায় নিয়ে এসে সম্মােহিতের মস্তিষ্কে বিশেষ একটি ধারণার সঞ্চার করতে থাকেন। যেই ধারণাটি সম্মােহিতের মস্তিষ্কে পৌছে দিতে সেই ধারণাটি সম্মােহিতের সামনে বারবার একঘেয়েভাবে আউড়ে যাওয়া হয়। সম্মােহনকারী ও সম্মােহিতের এই যােগাযােগটিকে মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলা হয় সম্পর্ক’ (rapport)। উনিশ শতকের শেষ দশকে প্যারিসে শার্কো এবং ন্যানসিতে বার্নহাইম-এর নেতৃত্বে হিপনােসিস নিয়ে শুরু হলাে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। হিস্টিরিয়া ও সম্মােহনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করে শার্কো মতপ্রকাশ করলেন—সম্মােহন হলাে তৈরি করা নকল হিস্টিরিয়া। সম্মােহিত ব্যক্তিরা সকলেই নিউরােটিক। সম্মােহনকারীর ধারণা সঞ্চারের (Suggestion) ব্যাপারটাকে আদৌ গুরুত্ব দিলেন না তিনি। বার্নহাইম মত প্রকাশ করলেন, সম্মােহন ধারণা সঞ্চারের ফল। সব মানুষের মস্তিষ্কেই কম-বেশি কোনও ধারণা সঞ্চারিত করা যায়। অর্থাৎ, সব মানুষকেই সম্মােহিত করা যায়। অবশ্য সম্মােহনের গভীরতা সব মানুষের ক্ষেত্রে সমান নয়। তবে যদি বােধ-বুদ্ধি থাকে। | আরও অনেক নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে এলেন মেতেল, জিমসেন, ভেরওর্ন এবং বেকটেরেফ। ভেরওর্ন বললেন, সম্মােহন হলাে অতি জাগ্রত অবস্থা, অর্থাৎ এই অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক থাকে সবচেয়ে সজাগ। বেকটেরেফ বললেন—সম্মােহন হলাে স্বাভাবিক ঘুমেরই রকমফের। এলেন ফ্রান্সের এক বিখ্যাত মনােবিদ স্যানেট। তিনি যে তত্ত্ব দিলেন সেটা শাকোর তত্ত্বের উন্নত সংস্করণ মাত্র। ফ্রয়েড হাজির হলেন তার সাইকো-অ্যানালিটিক থিওরি নিয়ে। ফ্রয়েডের মতে নকারী ও সম্মােহিতের মধ্যে সম্পর্ক বা rapport গড়ে ওঠে পারস্পরিক প্রেম বা ভালবাসার ফলে। প্রেমে পড়া ও সম্মােহিত হওয়া একই ধরনের ব্যাপার। ফ্রয়েডের তত্ত্বে সম্মােহিত অবস্থার বিবরণ এবং সম্মােহনকারী ও সম্মােহিতের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যাখ্যা মেলে। কিন্তু মেলে না সম্মােহিতের স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ ও সম্মােহনের কারণ। এলেন পাভলভ। বললেন, সম্মােহন আংশিক ঘুম। জেগে থাকা ও ঘুমের একটা অন্তর্বতী অবস্থা। স্বাভাবিক ঘুমে মস্তিষ্কের কর্মবিরতি বা নিস্তেজনা (inhibiation) বিনা বাধায় সারা মস্তিষ্কে ও দেহে ছড়িয়ে পড়ে। সম্মােহন-ঘুম বা হিপনােটিক ঘুমে মস্তিষ্কের যে-অংশ সম্মােহনকারীর নির্দেশে ও কণ্ঠস্বরে উদ্দীপ্ত হচ্ছে সেই অংশ জেগে থাকে। মস্তিষ্কের এই জেগে থাকা অংশই সম্মােহিত ব্যক্তির সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগের একমাত্র পথ। সম্মােহনকারীর নির্দেশ ছাড়া সম্মােহিতের পক্ষে কোন কিছু করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ, সম্মােহিতের স্বাধীন কোন ইচ্ছে থাকলেও নিষ্ক্রিয় থাকে। পাভলভ ও ফ্রয়েড এতক্ষণে আমি ছােট্ট করে আলােচনা করেছি সম্মােহনের ইতিহাস নিয়ে, কারণ সম্মােহন নিয়ে আলােচনার গভীরে ঢোকার আগে সম্মােহনের ইতিহাস জানবারও প্রায়ােজন আছে। সম্মােহনের ইতিহাস বলতে গেলেই শুরু করতে হবে প্রাচীন সভ্যতার আদিপর্ব থেকে, আর শেষ করতে হবে এ যুগের মনােবিদ্যার দুই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব পাভলভ ও ফ্রয়েডের পরস্পরবিরােধী তত্ত্ব আলােচনার মধ্য দিয়ে। পাভলভ ও ফ্রয়েডকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর মনােবিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠাণ্ডা-গরম লড়াই। পাভলভ ও ফ্রয়েড দু’জনেই সমসাময়িক। পাভলভ জন্মেছিলেন ১৮৪৮ সালে। মারা যান ১৯৩৬-এ। ফ্রয়েড জন্মেছিলেন ১৮৫৬ সালে। মৃত্যু ১৯৩৯ সালে। আমৃত্যু এই দুই মনীষীই ছিলেন স্বতত্ত্বে আত্মপ্রত্যয়ী ও সক্রিয়। | মানসিকতার হদিস পেতে পাভলভ মেতেছিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানের পথে উচ্চ-মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার গবেষণায়, আর ফ্রয়েড় মানসিকতার সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া মনে গভীরে। পাভলভ এগিয়ে ছিলেন উচ্চ-স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে, ফ্রয়েড এগিয়ে ছিলেন মনােবিজ্ঞানের চিকিৎসক ও রােগী দু'জনেরই মনােসমীক্ষার পথে। পাভলভকে আবিষ্কার ‘উচ্চতর স্নায়ুবিজ্ঞান এবং ফ্রয়েডের আবিষ্কার—অবচেতন, মনের বিজ্ঞান’। পাভলভ-তত্ত্বকে ঘিরে রয়েছেন ‘Objective' (বস্তুবাদী) দৃষ্টিভঙ্গির মনােবিজ্ঞানীরা, আর ফ্রয়েডের তত্ত্বকে ঘিরে রয়েছেন ‘Subjective' (আত্মবাদী) অন্তর্দর্শনে বিশ্বাসী মনােবিজ্ঞানীরা। এই দুই মহারথীর তত্ত্বে বিরােধিতা রয়েছে ঘুম, স্বপ্ন, শিশুমন, শিশুশিক্ষা, মনােবিকারের কারণ, এবং চিকিৎসা প্রভৃতি নানা বিষয়ে। যাই হােক, আসুন, এবার আমরা ইতিহাস ছেড়ে সম্মােহনের ভেতরে ঢুকি। সম্মােহন নিয়ে কিছু কথা কোলের ছােট্ট বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানাের কৌশল ও সম্মােহন-ঘুম পাড়ানাের কৌশল কিন্তু অনেকটা একই ধরনের। শিশুদের ঘুম পাড়ানাে হয় একটানা একঘেয়ে সুরে গান গেয়ে। সম্মােহন-ঘুমের জন্যেও সম্মােহনকারী প্রায় একই ধরনের পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। সম্মােহনকারী যাকে সম্মােহন করতে চায়, তাকে শুইয়ে দেয় একটা সুন্দর নরম-সরম ছিমছাম বিছানায়। নরম বালিশে মাথা রেখে সারা শরীরটাকে হালকাভাবে ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকেন রােগী। ঘরে জ্বলে খুব কম শক্তির নাইটল্যাম্প। | সম্মােহনকারী ধীরে-ধীরে কিছুটা সুর করে টেনে-টেনে বলতে থাকেন, “আপনি এখন ঘুমিয়ে পড়ুন, ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনার ঘুম আসছে। আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে যাচ্ছে। কপালের ও গালের পেশী শিথিল হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের পেশী শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এমনি করে হাত, বুক, পেট, কোমর, পা ইত্যাদি অঙ্গ শিথিল হয়ে যাচ্ছে, অবশ হয়ে আসছে। আপনার ঘুম আসছে, গভীর ঘুম আসছে। | ...বাইরের সব শব্দ আপনার কাছে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাইরের গাড়ির শব্দ, ট্রামের শব্দ, কোন শব্দই আপনার কানে যাচ্ছে না। আমার কথা ছাড়া অন্য কোনও শব্দ আপনি শুনতে পাচ্ছেন না। ...আপনার হাত-পা ভারী হয়ে গেছে। ঘুম আসছে...” সম্মােহনকারী টানাটানা একঘেয়ে সুরে বলে যেতে থাকে। এই কথাগুলাে শুনতে শুনতে সম্মােহনের ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন শুয়ে-থাকা ব্যক্তি। | সম্মােহিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সম্মােহনকারীর এই কথা বা নির্দেশগুলােকে বলা হয় Suggestion', বাংলায় অনুবাদ করে বলতে পারি ধারণাসঞ্চার’ বা ‘চিন্তাসঞ্চার'। অবশ্য আরও অনেক পদ্ধতির সাহায্যেই সম্মােহন-ঘুম আনা সম্ভব। যে কোনও ইন্দ্রিয়কে মৃদু উদ্দীপনায় উত্তেজিত করলেই ঘুম আসবে। পাভলভ ও ফ্রয়েড দু’জনেই সম্মােহিত অবস্থাকে এক ধরনের ঘুমন্ত অবস্থা বলেই মত প্রকাশ করেছিলেন। সম্মােহন সম্বন্ধে জানতে গেলে ঘুম সম্বন্ধে দু-একটা কথা জানা খুবই প্রয়ােজন, কারণ, ঘুম আর সম্মােহন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ঘুম ও সম্মােহন আমরা আমাদের জীবনের প্রায় তিনভাগের একভাগ ঘুমিয়েই কাটাই। মানুষ যখন ঘুমােয়, তখন কিন্তু তার সম্পূর্ণ মস্তিষ্কই কর্মহীন হয়ে পড়ে না। কিছু মস্তিষ্ক কোষ জেগে থাকে বা আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। সামগ্রিকভাবে উচ্চ-মস্তিষ্ক কাজ করে বিশ্রাম নিলেও কিছু জেগে থাকা কোষের সাহায্যে আমরা ঘুমের মধ্যেও নড়াচড়া করি, পাশ ফিরি, মশা কামড়ালে জায়গাটা চুলকোই, স্বপ্ন দেখি ইত্যাদি অনেক কিছু করি। এই অবস্থায় কিন্তু সব পেশিও শিথিল হয়ে পড়ে না। ঘুমের মধ্যে মলমূত্রের নির্গমন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ না হারায় সেদিকে মস্তিষ্ক লক্ষ্য রাখে। ঘুমের গুরুত্ব মানুষের জীবনে অসীম। পনেরাে-কুড়ি দিন না খেয়ে থাকলে শরীর দুর্বল হয় বটে, কিন্তু সাধারণত মানসিক ভারসাম্যের অভাব হয় না। অথচ, পনেরাে-কুড়ি দিন সম্পূর্ণ না ঘুমিয়ে কাটালে প্রায় ক্ষেত্রেই মানসিক ভারসাম্যের অভাব ঘটে।
আপনাদেরই পরিচিত এমন দু-একজন হয়তাে আছেন যাঁরা মাসের পর মাস অথবা বছরের পর বছর অনিদ্রা রােগে ভুগছেন। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শ্রীবিমল মিত্র সুদীর্ঘ বছর অনিদ্রা রােগে ভুগেছেন। আপনাদের মনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারবে, এত দীর্ঘ অনিদ্রার পরেও এঁদের প্রত্যেকেরই মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন কীভাবে?
না, আগে আমি যা বলেছি, সেটা মিথ্যে বলিনি। আবার, আপনারা যা দেখেছেন তাও মিথ্যে নয়। অনিদ্রারােগ’ মস্তিষ্কের বিশেষ অসুস্থ অবস্থা। এই বিশেষ অবস্থায় মস্তিষ্কের অনেকগুলাে কোষ দিনের ১৭/১৮ ঘণ্টা প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। রাতে ৬/৭ ঘণ্টা কোষগুলাে গভীর ঘুম দিয়ে বিশ্রাম নেয় এবং সজীব ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। অধিকাংশ অনিদ্রা রােগে গভীর ঘুম হয় না বটে, কিন্তু আধা-ঘুমন্ত অবস্থার মধ্যে একটা সময় কাটে। এই সময়টায় মস্তিষ্ককোষ তাদের প্রয়ােজনীয় বিশ্রাম নিয়ে নেয়, ফলে মস্তিষ্ককোষের বিশেষ কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এই ধরনের আধাঘুম অবস্থায় আমরা সুস্থ মানুষরা অনেক সময় কাটাই। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে অথবা ইজিচেয়ারে বিশ্রাম নিতে নিতে অথবা নেহাতই অফিসের চেয়ারে বসে অনেক সময় ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় থাকি। মনােবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থার নাম hypnoid State' অনিদ্রা লােগ এই ‘hypnoid State'-এরই দীর্ঘতম অবস্থা।
পাভলভ কী বলেন
পাভলভীয় বিজ্ঞানে ঘুমিয়ে-পড়া থেকে জেগে ওঠার মধ্যে চারটি প্রধান পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে। প্রথম পর্যায় প্রায় জাগ্রত অবস্থার মতাে। দ্বিতীয় পর্যায়-ও প্রায় প্রথম পর্যায়েরই মতাে, তবে ঘুমের গভীরতা প্রথম অবস্থার চেয়ে দ্বিতীয় অবস্থায় বেশি। একে বলে ফেজ অব ইকোয়ালিটি। তৃতীয় পর্যায়-এর নাম ফেজ অব প্যারাডক্স। এই পর্যায়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। শেষ এবং চতুর্থ পর্যায়-এর নাম ফেজ অব আলট্রা-প্যারাডক্স। এই পর্যায়ে আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি।
সম্মােহিত অবস্থায় ঘুমের তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ প্যারাডক্সিকাল ফেজ’ দেখা যায়। ঘুমের এই পর্বকে আর. ই. এম. বা র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ পর্ব বলে। এই প্যারাডক্সিকাল ফেজে সম্মােহিতের ওপর সম্মােহনকারীর নির্দেশ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং প্রতিক্রিয়া খুবই অভাবনীয়। মস্তিষ্কের শারীরবৃত্তিক ধর্ম এবং বিশিষ্টতাই সম্মােহনকারীর শক্তি বলে প্রচারিত হয়ে আসছে। স্বাভাবিক ঘুমে মস্তিষ্কের প্রায় সব স্নায়ুগুলাে নিস্তেজ বা নিষ্ক্রিয় হতে থাকে এবং সারা দেহে এই নিষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই নিস্তেজ বা নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে বলা হয় Inhibition। সম্মােহন-ঘুমে মস্তিষ্কের সব স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হয় । সম্মােহনকারীর নির্দেশমতাে মস্তিষ্কের একটা অংশ জেগে থাকে ও উদ্দীপ্ত হতে থাকে। এই জেগে থাকা মস্তিষ্কের অংশ বা স্নায়ু সম্মােহিত ব্যক্তির সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগের একমাত্র পথ। সম্মােহনকারী ও সম্মােহিত ব্যক্তির মধ্যে এই যােগসূত্রকে বলা হয় ‘rapport বা সম্পর্ক।
কিন্তু উত্তেজনার অভাব বা অনুপস্থিতি নয়। উত্তেজনার বিপরীতধর্মী একটি প্রক্রিয়াকে বােঝাতে ‘Inhibitionকথাটি ব্যবহৃত হয়। মস্তিষ্কে উত্তেজনাধর্মী ও নিস্তেজধর্মী দুই ধরনের স্নায়ুপ্রক্রিয়া রয়েছে। এই দুই মিলেই স্নায়ুপ্রক্রিয়ার প্রকৃত রূপ। দুই প্রক্রিয়াই সব সময় গতিশীল এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মস্তিষ্কের কোন স্নায়ু বা কেন্দ্রবিশেষ উত্তেজিত হলে, উত্তেজনার ঢেউ প্রথমে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতাকে বলা হয় ‘irradiation। সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজিত স্নায়ুকেন্দ্রের আশেপাশের স্নায়ুকেন্দ্রগুলােতে উত্তেজনার বিপরীতধর্মী নিস্তেজ অবস্থা বা inhibition' দেখা দেয়। | ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলাে বাইরের উদ্দীপনায় সাড়া দেয় না। উলটো দিক থেকে বাইরের উদ্দীপনা মস্তিষ্কে প্রবেশ করার পথগুলাে আমরা বন্ধ করে দিলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে। জার্মানে ডাক্তার স্ট্রামপল তার এক বালক রােগীর কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, বালকটির একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একটি কানে শুনতে পেত না। দেহের ত্বকের অনুভূতি শক্তিও গিয়েছিল নষ্ট হয়ে। বালকটির সুস্থ চোখ ও কানের দেখা ও শােনা কোন কিছু দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বালকটি ঘুমিয়ে পড়ত। পাভলভও এই ধরনের একটি রােগীকে তার ইন্দ্রিয়-উপলব্ধি বন্ধ করে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন। গ্যালকিস পামের আর এক বিজ্ঞানী কয়েকটি কুকুরের ঘ্রাণ, শ্রবণ ও দর্শন-ইন্দ্রিয়গ্রাহী স্নায়ুগুলাে কেটে ফেলে দেখেছিলেন, কুকুরগুলাে সারা দিনরাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২৩ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলাের অবসাদ থেকেই যে সব সময় ঘুম আসে, এমনটি নয়। পাভলভের মতে, ঘুম একরকম ‘conditioned reflex’ বা ‘শর্তাধীন প্রতিফলন। ঘুমের ব্যাপারে নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখলে সাধারণত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে । কিন্তু একজন লােকের দীর্ঘ ঘুমের পরেও একটা বিশেষ পরিবেশে একজন সম্মােহনকারী আবার তাকে ‘suggestion দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে, এই সম্মােহন-ঘুমের ক্ষেত্রে ঘুম ‘conditioned reflex বা শর্তাধীন প্রতিফলন। আমি আমার এক পুস্তক প্রকাশক ব্রজ মণ্ডলের কথা আগেই বলেছি। ব্রজদা প্রতি রাত্রেই ঘুম আনতে ঘুমের ওষুধ খেতেন। আমি একবার ঘুমের জোরাল ওষুধ বলে ভিটামিন ক্যাপসুল দিয়েছিলাম। ক্যাপসুল খেয়ে ব্রজদার খুব ভাল ঘুম হয়েছিল। আমার ‘suggestion বা ধারণা সঞ্চারের জন্য ভিটামিন ক্যাপসুল ‘conditioned stimilus’ বা শর্তাধীন উদ্দীপক বস্তুর কাজ করেছিল। নানা ধরনের রােগের ওপরই হিপনােটিক সাজেশন বা সম্মােহন ধারণা সঞ্চারের ফলাফল ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। দেখা গেছে স্ট্যামারিং,অ্যাজমা, কোলাইটিস, ইমনােটেন্সি, ফ্রিজিডিটি, হাইপােকনড্রিয়া এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি reflex বা প্রতিফলন বিশৃঙ্খলায় (সাইকো-সােমাটিক) হিপটনিক-সাজেশনের সাহায্যে খুবই ভাল ফল পাওয়া যায়। উন্মাদরােগের মধ্যে স্কিজোফ্রিনিয়া এবং প্যারানইয়াতে হিপনটিক-সাজেশনে ভালই ফল পাওয়া যায়। অবশ্যই সেই সঙ্গে ওষুধও দিতে হয়। এছাড়াও যে কোন রােগেই সাহায্যকারী চিকিৎসা হিসেবে হিপনটিক-সাজেশন দেওয়া যেতে পারে। সম্মােহনের সাহায্যে সম্মােহনকারী এমন অনেক ঘটনাই ঘটাতে পারেন যেগুলি শুনলে প্রাথমিকভাবে অসম্ভব বা অবাস্তব বলে মনে হয়। সম্মােহনকারী সম্মােহিতকে যদি সাজেশন’ দিতে থাকেন, এবার তােমার ডান হাতের কজিতে একটা গনগনে লােহা খুব সামান্য সময়ের জন্য ছোঁয়াব। লােহাটা আগুনে পুড়ে টকটকে লাল হয়ে রয়েছে, টকটকে লাল গরম লােহাটা এবার তােমার ডান কজিতে ঠেকানাে হবে। ফলে একটা ফোসকা পড়বে। ভয় নেই, শুধু একটা ফোসকা পড়বে এই সাজেশনের সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের কজিতে ঠাণ্ডা লােহা ঠেকালেও দেখা যাবে যে ওখানে Second degree burn সৃষ্টি হয়ে ফোসকা পড়েছে। আধুনিক শারীরবিজ্ঞানে শিক্ষিত অনেকের কাছেও আমার কথাগুলাে একান্তই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কারণ, শারীরবিজ্ঞানে বলে, শরীরের কোন স্থানে প্রচণ্ড উত্তাপ লাগলে সেখানে অনেকগুলাে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বহু কোষ ফেটে যায়। কোষগুলাের ভেতরের রস বেরিয়ে আসে। এই কোষগুলাের রসই ফোসকায় জমা রসের প্রধান অংশ। শারীরবিজ্ঞানে এই ফোসকা পড়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যােগাযােগ না থাকলেও ফোসকা পড়ার মূহুর্ত থেকে পরবর্তী পর্যায়গুলােতে Autonomus (অটোনােমাস) স্নায়ুতন্ত্রের কিছু প্রভাব দেখা যায়, যা শরীরকে দুর্বল করে বা মানসিক আঘাত (shock) দেয় কিংবা peripheral circulatory failure ইত্যাদির ক্ষেত্রে কাজ করে। Autonomus nervous system (অটোনােমাস নার্ভাস সিস্টেম) সম্পর্কে নতুন ধারণা না থাকার দরুন এবং উচ্চ মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবের দরুন অনেকের কাছেই আমার কথাগুলাে উদ্ভট ও অবাস্তব মনে হতে পারে। এই বিষয়ে অবগতির জন্য জানাই, ১৯২৭ সালে বহু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সামনে V Finne শুধুমাত্র হিপনােটিক-সাজেশনের দ্বারা একজন সম্মােহিতের শরীরে ফোসকা ফেলে দেখান। তারপর আজ পর্যন্ত বহুবার প্রয়ােগ হয়েছে। একজন মনযােগ দিয়ে সাজেশন’ শুনলে তার পাঁচটি কর্মইন্দ্রিয়-ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিয়ন্ত্রণ করবেন সম্মােহনকারী। নিয়ন্ত্রিত হবে সম্মােহিত মানুষটির ইন্দ্রিয়গুলাে। পাঁচটি কর্মইন্দ্রিয় হলাে : চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক।
কয়েকশাে অনুষ্ঠানে মঞ্চে দর্শকদের এনে সম্মােহিত অবস্থায় কাগজ ছুইয়ে বলছি—“ছুঁচ ফোটাচ্ছি।” তাঁরা প্রত্যেককেই ছুঁচ ফোটাবার যন্ত্রণা অনুভব করে চিৎকার করে উঠেছেন। আবার যখন সাজেশন’ দিয়েছি—হাত অসাড় হয়ে গেছে, তখন ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে পুরােটা ঢুকিয়ে দিয়েছি। যাদের হাতে ঢুকিয়েছি, তাঁরা কেউ-ই টেরই পাননি।
দর্শকদের মঞ্চে ডেকে সাজেশন দেওয়ার পর তারা সিগারেট পান করে বিভিন্ন রকমের স্বাদ পেয়েছেন। কেউ টক, কেউ ঝাল, তাে কেউ মিষ্টি। যাকে যেমন ‘সাজেশন’ দিয়েছি, তিনি তেমন স্বাদ পেয়েছেন। এইসব অনুষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি হয়েছে কালটিভেশন অফ সায়েন্স, ‘এশিয়াটিক সােসাইটি’, ‘আই আই টি খগপুর, প্রেন্সিডেন্সি কলেজ-এর মতাে উচ্চমেধার মানুষদের সামনে।
বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ আজ পৃথিবী থেকে মহাকাশ
পর্যন্ত বহু বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করলেও মানুষ
তার মন বা মস্তিষ্কের সম্বন্ধে
এখনও অনেক কিছুই
জানতে পারেনি।
পর্যন্ত বহু বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করলেও মানুষ
তার মন বা মস্তিষ্কের সম্বন্ধে
এখনও অনেক কিছুই
জানতে পারেনি।
(মনের নিয়ন্ত্রণ ও মেডিটেশান নিয়ে বিস্তৃত জানতে পারেন, ‘মনের নিয়ন্ত্রণ-যােগ-মেডিটেশান)
হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ
হিস্টিরিয়া রােগী সাধারণত অশিক্ষিতদের মধ্যে বেশি। অশিক্ষিত, কুসংস্কারে আচ্ছন্নদের মস্তিষ্কের কোষের নমনীয়তা (elasticity) কম এবং আবেগপ্রবণতা খুব বেশি। ফলে কোনও কিছুই তারা যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে পারে না। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রােগীর সংখ্যাও কমছে। তবে, নামসংকীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবাবেগ চেতনা হারিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়তে এখনও কিছু কিছু নারী-পুরুষকে দেখা যায় বই কী।
প্রাচীনকালে গণ-হিস্টিরিয়া সৃষ্টির বিষয়ে প্রধান ভূমিকা ছিল ধর্মের। এখন ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা। ধর্মান্ধতা, আবেগপ্রবণ জাতীয়তাবােধ, তীব্র প্রাদেশিকতা, রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অন্ধ আনুগত্য বহুজনের যুক্তি-বুদ্ধিকে গুলিয়ে দিয়ে তীব্র ভাবাবেগে চলতে বাধ্য করে। এই গণ-হিস্টিরিয়া বা গণ-সম্মােহনের ক্ষেত্রে সম্মােহন-ঘুম না পাড়িয়ে Suggestion দিয়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি করা হয়। প্রয়ােজনীয় ফল লাভ করা যায়। সাধারণত মানুষ যখন কোনও কারণে ভীত, উত্তেজিত বা ভক্তিরসে আপ্লুত হয় তখন ধর্মগুরু, রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের Suggestion অনেক সময় অসম্ভব রকম কার্যকর হয়।
আত্ম-সম্মােহন ও স্ব-নির্দেশ (auto-suggestion) যেমন একজন ব্যক্তির নিজের ইচ্ছের হতে পারে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তার অজ্ঞাতসারেই সে autosuggestion দ্বারা নিজেকে নিজে সম্মােহিত করতে পারে। এইসব ক্ষেত্রেও শারীরবৃত্তি তার স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চলে না। অস্বাভাবিক আচরণ করে। এই ধরণের আচরণ অস্বাভাবিক হলেও শারীরবৃত্তিরই অংশ। | তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথকে পুজো দেওয়ার জন্য ভক্তরা যখন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন ভক্তি ও বিশ্বাস মস্তিষ্কের কোষগুলােকে ঠাণ্ডা লাগার জন্য নির্দেশ পাঠায় না, ফলে ঠাণ্ডা লাগে না। এই ভক্তরাই প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দুপুরে আগুন হয়ে থাকা দেবস্থানের সিমেন্ট বা পাথরে ছাওয়া চাতালে খালি পায়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। যে তাপ অসহ্য, দেবস্থানে এলে সেই তাপেই কষ্টের কোন অনুভুতি ভক্তদের মধ্যে দেখা যায়।
দুটি ক্ষেত্রেই ঈশ্বর-মাহাত্ম্যের কথা ভেবে ভক্তেরা নিজের অজান্তেই নিজেরা সম্মােহিত হয়ে পড়েন এবং সেইভাবেই তাদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু স্নায়ুকে auto Suggestion-এর দ্বারা পরিচালিত করেন।
অতীতের এক বিখ্যাত সাধক সম্বন্ধে শােনা যায়, খাবারের সঙ্গে তাঁকে কোনও দুষ্টপ্রকৃতির লােক বিষ খাইয়েছিল। বিষ খাওয়ার পরেও সাধকের জীবনহানি ঘটেনি। কী করে এমনটা হলাে? যুক্তিবাদী হিসেবে ধরে নিচ্ছি কারণ ছিল। এ-যুগে আধুনিক চিকিৎসায় বিষপানের রােগীর পাকস্থলী পাম্প করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। সেই সাধকও কী তবে আত্ম-সম্মােহন ও স্ব-নির্দেশের দ্বারা বমি করে পাকস্থলীর বিষাক্ত খাবার উগরে দিয়েছিলেন? প্রাচীন এই কাহিনির সত্যতা কতটুকু তা জানতে না পারলেও এইটুকু বলতে পারা যায়, আত্ম-সম্মােহনের ও স্ব-নির্দেশের দ্বারা বমি করা সম্ভব।
ভাবুন, আপনি খেতে বসেছেন। পরিপাটি করে খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন আপনার স্ত্রী। ভাত ভেঙে মাছের ঝােলের বাটিটা ভাতে ঢালতেই টকটকে লাল ঝােলটা ভাতের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল থালায়। মুহূর্তে আপনার মনে পড়ে গেল, ঘণ্টাখানেক আগে দেখা সেই বাসে-চাপা পড়ে মরে যাওয়া লােকটার কথা। তার সারা শরীর বেয়ে এমনি ঝােলের মতােই গড়িয়ে পড়ছিল রক্ত। ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আপনার গা গুলিয়ে উঠল। আপনি বমি করে ফেললেন। আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্য আপনার মস্তিষ্কের সেই স্নায়ুগুলােকে উদ্দীপিত করল, যা বমি নিয়ে আসে। এবার, যখন বমি করা প্রয়ােজন তখন যদি আপনি তীব্র ঘৃণা সঞ্চার করে, এমন কোন দৃশ্য চোখের সামনে জীবন্ত করে ভাসিয়ে রাখতে পারেন, তবে মস্তিষ্কের বিশেষ স্নায়ুগুলাে এমনভাবে উদ্দীপিত হবে, যার দরুন আপনার গা গুলিয়ে বমি এসে পড়বে।
১৯৮৩-র জানুয়ারিতে এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম একটি বিশেষ কাজে। উঠেছিলাম কলাভবনের কাছেই একটি হােটেলে। পৌছতে বেশ রাত হয়েছিল। মধ্যরাতে খাওয়ার পাট চুকোলাম ভাত আর হাঁসের ডিম দিয়ে। তারপর, আরও অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল অস্বস্তিতে। আমার হার্টে একটু গণ্ডগােল আছে। সেটাই বেড়ে উঠল ডিম খাওয়ার ফলে উইন্ডে, বুকে চিনচিনে ব্যথা, বাঁ হাত, ঠাণ্ডা, সারা মুখও স্যাতসেঁতে ঠাণ্ডা। এই রাত-দুপুরে ডাক্তার চাইলেই পাব কি না সন্দেহ। বমি করে পেটের খাবার বের করে দিলে ভাল লাগবে। গলায় আঙুল দিয়ে যে বমি করব, তারও উপায় নেই। গলায় একটা ক্ষত আছে এই অবস্থায় নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় আত্মসম্মােহন করে বমি করা। কুকুরের গায়ের এঁটুলি দেখলেই ঘেন্নায় আমার গা শিরশির করে ওঠে। শরীরের বেশ কিছু লােম খাড়া হয়ে ওঠে। গা চুলকোতে থাকে। বমি এসে পড়ে। আমি একান্তভাবে এঁটুলি বােঝাই কুকুরের কথা ভাবতে শুরু করলাম, সঙ্গে সঙ্গে সত্যিকারের এঁটুলি দেখলে, আমার শরীরে যেসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে থাকে সেগুলি হতে শুরু করল, তারপরই আরম্ভ হলাে প্রবল বেগে বমি। বমিতে পেট হালকা হতেই শরীরের অস্বস্তি ও কষ্ট দূর হলাে।
অনেক সাধু-সন্তদের সম্বন্ধে শােনা যায়, তাঁরা প্রচণ্ড শীতেও খালি গায়ে থাকতেন, যােগ সাধনার ফলে নাকি শীত বােধ হতাে না। অনেক সময় মানুষ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা বা গরমকে সহ্য করে নেয়। এই প্রসঙ্গে আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল, গল্পটি সম্ভবত রস-সাহিত্যিক কুমারেশ ঘােষের মুখে শুনেছিলাম। একবার কুমারেশদা কনকনে শীতের সকালে পুরুলিয়ার রাস্তায় (বাঁকুড়াও হতে পারে। একটি অনাবৃত গায়ের খাটো ধুতি পরা রাখাল ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী রে, এই শীতে খালি গায়ে তাের কষ্ট হচ্ছে না?”
ছেলেটি উত্তরে বলেছিল, “আপনার মুখটাও তাে বাবু খালি রয়েছে, ঢাকেননি, মুখে ঠাণ্ডা লাগছে না?”
সহ্য-শক্তির ব্যাপার ছাড়াও কিন্তু আর একটি ব্যাপার আছে, যার সাহায্যে কেউ কেউ সহ্যাতীত শীত বা গরমকেও আত্ম-সম্মােহনের দ্বারা নিজের সহ্য সীমার মধ্যে নিয়ে আসেন।
একজন সম্মােহনকারী যে সব সময়েই সম্মােহন-ঘুম পাড়িয়ে suggestion
দিয়ে থাকেন, তেমন কিছু নয়। অন্ধ বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে
ঘুম না পাড়িয়েও একজনের মস্তিষ্ক কোষে
suggestion পাঠিয়ে আশ্চর্য ভাল ফল
পাওয়া যেতে পারে। এই ধরনের
সম্মােহনের একটি ঘটনা বলছি।
দিয়ে থাকেন, তেমন কিছু নয়। অন্ধ বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে
ঘুম না পাড়িয়েও একজনের মস্তিষ্ক কোষে
suggestion পাঠিয়ে আশ্চর্য ভাল ফল
পাওয়া যেতে পারে। এই ধরনের
সম্মােহনের একটি ঘটনা বলছি।
একসময় ফলিত জ্যোতিষ নিয়ে পড়াশুনা করেছি। পড়ে এবং বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে স্পষ্টই বুঝেছি ফলিত জ্যোতিষ নেহাতই ক্ষীণ চান্সের ব্যাপার। অর্থাৎ মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে। অনেকেই আমার কাছে ছক বা হাত হাজির করেছে। আমি রাশিচক্র বা হস্তরেখা বিচার করে যখন অতীত নিয়ে বলেছি, তখন প্রায় সব-ই ভুল হয়েছে। একটু সাধারণ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যখন অতীত বা বর্তমান বিষয়ে বলে গেছি, তখন অনেক কথাই মিলেছে। যদিও আমি জানি, আমার যত ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে, মেলেনি তার বহুগুণ। আর এও জানি, ফলিত জ্যোতিষ ও অলৌকিকে বিশ্বাসী লােকেরা ওই দু-একটি মিলে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীকেই মনে রাখেন এবং অন্যের কাছে সেটাকেই আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তােলেন। না মেলা কথাগুলাে চটপট ভুলে যান। আসলে, ফলিত জ্যোতিষের প্রতি অন্ধবিশ্বাসই তাদের এমনটা করতে বাধ্য করে। আমার বেলায় তার অন্যথা হয়নি। সুতরাং একটা পরিচিত গণ্ডির মধ্যে জ্যোতিষী হিসেবে ফাটাফাটি নাম ছিল। আমার প্রতি এমনই এক অন্ধবিশ্বাসী হলাে দমদমের বাঙুর অ্যাভিনিউ নিবাসী প্রবীর সাহা। ঘটনাটি ১৯৮১ সালের। বয়েসে তরুণ প্রবীর একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল আমার অফিসে। কাঁদো-কাঁদো ভাবে বললাে “প্রবীরদা, আমাকে বাঁচান।” | ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার, খুলে বল তাে। আমার যদি সাধ্যে কুলােয় নিশ্চয়ই করব।” | প্রবীর আমার মুখখামুখি বসে যা বলল তা হলাে, সম্প্রতি বন্ধুদের সঙ্গে ও একটা পিকনিকে গিয়েছিল, সেই পিকনিকে একটি ছেলে ছিল যে জ্যোতিষী হিসেবে একটু-আধটু নাম কিনেছে। জ্যোতিষী বন্ধু প্রবীরের ভাগ্য বিচার করে জানিয়েছে, ওর মৃত্যুযােগ খুব কাছেই। মাস কয়েকের মধ্যেই। পিকনিক থেকে ফেরার পর দিনকয়েক জ্যোতিষী বন্ধুর কথাটা মনের মধ্যে খচখচ করে বিধতে লাগল। শেষ পর্যন্ত একদিন কলকাতার অন্যতম সেরা গ্রহরত্নের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলাে। সেখানকার এক জ্যোতিষীকে বন্ধু জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণীর কথা বলে জানতে চাইলাে—সত্যটা কী? জ্যোতিষীর থেকে যা উত্তর পেল তাতে বেচারা একেবারে ভেঙে পড়ল। জ্যোতিষীর মতে, খুব কাছেই মৃত্যুযােগ। হা, জীবনের পরিধি আর মাত্র মাসকয়েক। এবার বাড়িতে মা-বাবার কাছে দুঃসংবাদটা ভাঙল। মােটামুটি সচ্ছল পরিবারের আদরের ছেলে। মা আর দেরি না করে প্রবীরকে ধরে নিয়ে গেলেন তার পরিচিত এক তান্ত্রিকের কাছে। সব শুনে, হাত দেখে তান্ত্রিক খুব একটা ভরসা দিতে পারেননি, পাঁচ হাজার টাকা খরচের যজ্ঞ করার পরও। অতএব, ও যে এখন মৃত্যুর মুখােমুখি এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে। দিনকয়েক আগে ডালহৌসি স্কোয়ারে টেলিফোন ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে গাড়িতে চাপা পড়া একটা লােকের মৃতদেহ দেখে প্রবীরের গা গুলিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে যায়। ফুটপাতেই বসে পড়ে নিজের পতন রােধ করে। তারপর থেকে ওর সব সময়ই মনে হচ্ছে, এই বােধহয় কোন দুর্ঘটনা হবে। মৃত্যু যে ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছে! ওই বীভৎস মৃত্যুটা দেখার পর থেকে গত ছ'টা রাত এক মিনিটের জন্যেও ঘুমােতে পারেনি। | ঘটনাটা বলে বলল, “আপনি আমাকে বাঁচান, আমি আর সহ্য করতে পারছি । দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে আমার হাত-পা কেমন যেন কাঁপে, মাথা ঘােরে। হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৫৯ রাতে সকলে যখন ঘুমােয়, আতঙ্কে আমার চোখে কিছুতেই ঘুম আসে না। ক্যামপােস খেয়ে দেখেছি, তাতেও কাজ হচ্ছে না। আমি আর পারছি না। আমাকে আপনার বাঁচাতেই হবে।” কথাগুলাে শেষ করবার আগেই ওর গলা ধরে এলাে। দেখলাম, ও একান্তভাবে কান্না চাপার চেষ্টা করছে। বেচারা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বুজরুক জ্যোতিষী আর তান্ত্রিকদের ওপর রাগে সারা শরীর রি-রি করে উঠল। সমাজের বুকে বসে সম্মানের সঙ্গে ওরা প্রবীরকে একটু একটু করে খুন করছে। প্রবীরের মৃত্যু হলে তার জন্য দায়ী ওই সব প্রতারকরা। প্রবীরকে বললাম, “দুটো হাতই পাশাপাশি মেলে ধরাে তাে।” মেলে ধরল। হাতের রেখাগুলাের ওপর গভীরভাবে চোখ বােলাবার অভিনয় করলাম। কিছুক্ষণ মাপামাপি করে বললাম, “দিন কয়েকের মধ্যে তােমার পেটে কোনাে গণ্ডগােল হয়েছে, এই পেট খারাপের মতাে কিছু?” প্রবীর সাহা উৎসুক চোখে বলল, “হ্যা, সত্যিই তাই।” আমার এই সঠিক বলতে পারার পেছনে অলৌকিকত্ব বা হাত দেখার কোনও ব্যাপারই ছিল না। স্নায়ুদুর্বলতার দরুন কয়েকটা রাত ভাল ঘুম না হলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর, এই সম্ভাবনাটুকুর কথাই আমি প্রশ্নের আকারে প্রকাশ করেছিলাম। আমার এই সামান্য মিলে যাওয়া কথাটাই আমার প্রতি প্রবীর সাহার বিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলল। এবার ওর ডান হাতের প্রায় অস্পষ্ট একটা রেখাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, “আমার ওপর তােমার বিশ্বাস আছে তাে?” “নিশ্চয়। আর, সেই জন্যেই তাে বাধ্য হয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আসা।” জ্যোতিষশাস্ত্র কোনই বিজ্ঞানই নয়, একটি অপবিজ্ঞান, এই কথাটা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে এখন প্রবীরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা বৃথা। ওর বর্তমান মানসিক অবস্থা যুক্তি বিচারের পর্যায়ে নেই। এই মানসিক অবস্থার কোনও মানুষকে তার অন্ধ বিশ্বাসের মূলে আঘাত করার মত বােকামি প্রায় কোনও মানসিক চিকিৎসকই করবেন না। সাময়িকভাবে ওর জ্যোতিষ বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই ওকেই বাঁচাতে চাইলাম। অর্থাৎ সেই প্লাসিবাে চিকিৎসা। এবার কণ্ঠস্বরে যথাসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সুর মিশিয়ে বললাম, “তােমার জ্যোতিষ বিচার করতে গিয়ে সকলেই এক জায়গায় মারাত্মক রকমের ভুল করেছেন। আমি তােমাকে বলছি, তুমি বাঁচবেই। তােমার কিছুই হবে না। এই ছােট্ট রেখাটা বলে দিচ্ছে, একটা কিছু ঘটার যে সম্ভাবনা ছিল, তা কেটে গেছে। তােমার জীবনের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বলছি, তােমার কিছুই হবে না। তবে তােমাকে একটা জিনিস ১৬০ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) পরতে বলব। পরলে তােমার গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না।” এবার ও প্রশ্ন করল, “কী?” বললাম, “একটা পাঁচ-ছ’রতির ভাল মুক্তো সােনায় বাঁধিয়ে আগামী শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার সকালে পরতে হবে। ক্ষুক্তোটা দিয়ে আংটি বানিয়ে শােধন করে নিও। আর, এই শুক্লপক্ষ পর্যন্ত দিনগুলাের জন্যে তােমার ভাল-খারাপের দায়িত্ব আমি নিলাম। আর একটা কথা, বাড়ি ফিরে ধনে ও মৌরি ভিজিয়ে রাখবে শােবার আগে ওই ধনে-মৌরি ভেজানাে জলটা খেয়ে ফেলবে। আজ থেকে তােমার সুন্দর ঘুম হবে, কোন চিন্তা নেই।” | মুক্তোর কথাটা এলােমেলােভাবে মনে এলাে বলেই বলে ফেললাম। প্রবীর সাহার প্রবল জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসই ওকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলেছিল। এই জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস দিয়েই ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম, ওর স্নায়ুগুলােকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। কাজও পেলাম হাতে হাতে। পরের দিনই প্রবীর এসে উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে খবর দিল, “কাল রাতে ভালই ঘুম হয়েছিল।” বুঝলাম আমার Suggestion-এ ভালই কাজ হচ্ছে। এই লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত প্রবীর দিব্যি সুস্থ-সবল হয়ে বেঁচে রয়েছে তিন জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীকে উপেক্ষা করে। বিয়েও করেছে প্রবীর। কয়েক মাসের বদলে কয়েকটা বছর নিশ্চিন্তে পার হওয়ার পর প্রবীরকে উপহার দিলাম এই বইটি-ই, বললাম তােমার কথাও লেখা আছে এখানে। | এবার যে ঘটনাটার কথা বলছি, তার নায়ক আমারই সহকর্মী অরুণ চট্টোপাধ্যায়। থাকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পােলঘাট গ্রামপঞ্চায়েতের অধীন মানিকপুরে। ১৯৭৮-এর পঞ্চায়েতের নির্বাচনে পােলঘাট এলাকা থেকে অরুণ নির্বাচিত হয় নির্দল প্রার্থী হিসেবে। নির্দল হিসেবে জিতলেও ওর গায়ে আছে। একটা রাজনৈতিক গন্ধ। ওই এলাকায় বিরােধী রাজনৈতিক দলের তখন দারুণ রমরমা। ডামাডােলের বাজারে ওই তল্লাটে রাজনৈতিক খুন তখন ডাল-ভাত। অরুণ তখন নতুন বিয়ে করেছে। বউ, একটি ছেলে, মা-বাবা আর ভাই-বােন নিয়ে গড়ে ওঠা সুখের সংসারে হঠাৎই হাজির হলাে রাজনৈতিক আক্রমণ শঙ্কার কালাে মেঘ। বিরােধী আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত অরুণ একদিন আমাকেই মুশকিল আসানের জন্য গ্রহশাস্তির ব্যবস্থাপত্র করে দিতে বলল। অরুণের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্টতই আমার ধারণা হয়েছিল ও এবং ওদের পরিবারের সকলেই গভীরভাবে ভাগ্যে এবং জ্যোতিষ বিচারে বিশ্বাসী। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ পরিবারে যে পরিবেশে অরুণ এত বড় হয়েছে, আমার শুকনাে উপদেশে সেই পরিবেশের সংস্কার এক মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যাবে না। অথচ, চোরাগােপ্তা খুন হওয়ার চিন্তায় হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৬১ ওর মানসিক ভারসাম্যের যে অভাব দেখতে পেলাম, সেই অভাবটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূর করার প্রয়ােজন রয়েছে। | এই মুহূর্তে অফিসের পাশাপাশি চেয়ারে বসে সম্মােহন-ঘুম এনে Suggestion দিয়ে ওর মানসিক জোর ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চিন্তা একান্তই অবাস্তব। অথচ, ওর ফলিত জ্যোতিষ-বিশ্বাসকে এই মুহূর্তে যুক্তির কূটকৌশলে ভাঙার চেষ্টা করে, যদি ওর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই মনােবল বাড়াতে পারি, বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারি যে, ও খুন হবে না, তবে অরুণের সঙ্গেসঙ্গে ওর পরিবারের সকলেরও মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসবে। অরুণের হাত দেখে বললাম, “তাের রক্তপাতের কারণ মঙ্গল। তুই, ডান হাতে একটা ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের তামার বালা পর। বালাটা যে কোন চেনা সােনার দোকানে বললে বানিয়ে দেবে। কয়েকটা কথা স্পষ্ট মনে রাখবি। (১) বালাটা বানাতে দোকানদার যে দাম চাইবে, সেই দামই দিবি। কোন দরদাম করবি । (2) বালাটা শােধন করিয়ে আগামী মঙ্গলবার ভােরে সূর্য ওঠার সঙ্গেসঙ্গে স্নান করে ডান হাতে পারবি। (৩) বালাটার ওজন কম হলে কাজ হবে না। কিন্তু বেশি হলে বালাটা পরার পর সারা শরীরে যেন বিদুৎ খেলে যাবে, গা প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠবে। | সেদিনই বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার সেকরার কাছে আমার বালা বানাতে দিয়ে গেল অরুণ। তারপর বােধহয় দিন-দুয়েক পরেই একদিন আমাকে বালাটা দেখাল। বলল, “ঠিক আছে?” | বললাম, “বালাটা খাঁটি তামার বটে, কিন্তু ওটার ওজন তাে মনে হচ্ছে অনেক বেশি। তুই ওজন দেখে নিসনি?” অরুণ বলল, “না, নেওয়ার সময় আর ওজন দেখে নিইনি। ঠিক আছে, আজই যাওয়ার পথে দোকান থেকে ওজনটা জেনে যাব। আজ রাতে বালাটা শােধন করে নেব, কালই তাে পরব।” পরের দিন অরুণ অফিসে এলাে ঝােড়াে কাকের মতাে। বালাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বালার বাঁকানাে, জোড়া না লাগানাে মুখের কাছটা এমনভাবে হাঁ হয়ে আছে যে, বুঝতে অসুবিধে হয় না, বালাটা যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করে হাত থেকে তাড়াতাড়ি খােলা হয়েছে। অরুণ যা বলল, তাতে জানতে পারলাম, কাল সােনার দোকানে বালাটা ওজন করিয়ে দ্যাখে, ওটা প্রায় ৪৫ গ্রামের। রাতে শােধন করিয়ে সকালে পরেছে। তারপর বেরিয়ে পড়েছে অফিসে। ট্রেনে ওঠার পর সারাগায়ে কেমন একটা জ্বালা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শরীর গরম হয়ে উঠতে থাকে, অসহ্য গরম। সেই সঙ্গে গায়ের লােমগুলাে খাড়া হয়ে ওঠে, শিরশির করে ওঠে। গােটা শরীরটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। অরুণের বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই সবই বেশি ওজনের অলৌকিক নয়, লৌক্তি (প্রথম খণ্ড)- ১১ ১৬২ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) তামা ধারণের ফল। ট্রেনে বালাটা খুলে ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার শরীর স্বাভাবিক হয় । অরুণের এই শরীর খারাপ হওয়ার পেছনে বেশি ওজনের তামার কোনও কার্যকর ভূমিকা ছিল না। গােটা ব্যাপারটাই ছিল মনস্তাত্ত্বিক। আমার কথার ওপর অন্ধবিশ্বাসের দরুনই এমনটা ঘটেছে। অরুণের মস্তিষ্ক কোষে যে ধারণা আমি সঞ্চার করেছিলাম তারই ফলে অরুণের শরীর এইসব অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। অরুণের মনের ভুল ধারণাটা ভাঙার দরকার ছিল। ১৯৯০ সালে ওকে বইটি উপহার দিই। অরুণ সব জানার পরও ঠিকঠাক আছে। ফোটো-সম্মােহন কি সম্ভব? আজকাল পঞ্জিকার ব্যবহার কিছুটা কমে গেছে। আমাদের ছােটবেলায় পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন পড়ে বেশ মজা পেতাম। তাতে কত যে অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপন থাকত তার ইয়ত্তা নেই। এখনও থাকে। ফোটো-সম্মােহনের বিজ্ঞাপন এখনও পঞ্জিকা খুললে চোখে পড়বে। সেসব বিজ্ঞাপনের ভাষাও বিচিত্র—“আপনি কি ভালবাসায় ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়েছেন? ফোটো সম্মােহনের সাহায্য নিন। দেখবেন, যিনি আপনাকে দূর দুর করেছেন, তিনিই আপনার হুকুমের চাকর হয়ে গেছেন, আপনার বিরহে ছটফট করছেন।” ফোটো-সম্মােহন করার ব্যাপারটা কী? আপনি যাকে সম্মােহিত করে হুকুমের চাকর করতে চান, তার একটা ছবি আর মােটা টাকা দক্ষিণা তুলে দিন যে সম্মােহন করবেন, তার হাতে। তাহলেই নাকি যার ছবি সে আপনার হুকুমের দাস, আপনার ভালবাসায় পাগল হয়ে যাবে। ফোটো-সম্মােহন করতে পারেন, এমন দাবি যারা করেন, তাদের মধ্যে খ্যাতি বা কুখ্যাতির শীর্ষে আছেন হাওড়ার জানবাড়ির পাগলাবাবা, প্রাক্তন লেকটাউন নিবাসী গৌতম ভারতী। | ফোটো-সম্মােহন একটি আগাপাশতলা প্রতারণা বই কিছু নয়। গৌতম ভারতীর ফোটো সম্মােহনের বুজরুকি ফাস করেছিলাম। তারপর সে এক বিশাল ব্যাপার। গৌতমের মিথ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার, বিজ্ঞাপনের মিথ্যেচারিতা ফঁস, সাময়িক ভারসাম্য হারিয়ে গৌতমের আত্মহত্যার চেষ্টা (গােটা ঘটনাটাই লিখেছি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে)। ফোটো-সম্মােহনের বুজরুকি নিয়ে আলােকপাত’ বাংলা মাসিক পত্রিকায় আমার কিছু উঁছাছােলা বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর একজন আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। চ্যালেঞ্জারের নাম : কাজী খােদা বক্স সিদ্দিকী। নিবাস : বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া। আলােকপাত এর ১৯৮৮-র জানুয়ারি সংখ্যায় কাজী সাহেব ঘােষণা হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৬৩ করলেন—“প্রবীরবাবু যদি তার পরিচিত কোন নারীকে প্রকৃতই বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তাহলে কোন ছবি-টবি নয়, শুধুমাত্র কয়েকটি প্রকৃত তথ্য দিলেই হবে। তথ্যগুলাে অবশ্যই অপার্থিব নয়। যদিও তিনি ফোটো-সম্মােহন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন তবুও তিনি আগ্রহী হলে তার এ প্রক্রিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি।” চ্যালেঞ্জের অর্থ মূল্য আমার তরফ থেকে তখন ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে চিঠি দিলাম। জানালাম, আমি বিবাহিতা। আমার চিকিৎসক বন্ধু অনিরুদ্ধ কর অবিবাহিত। তার মনের মত মেয়েটিকে জীবনসঙ্গিনী করে দিলে হার মেনে নেব। মেয়েটির বিষয়ে অবশ্যই প্রয়ােজনীয় এবং জানা সম্ভব, এমন সব তথ্যই দেব, এমনকি বাড়তি দেব মেয়েটির ছবি। অনিরুদ্ধ আমাকে বলেছিলে, “মেয়েটিকে পছন্দ করার পর কাজী সাহেব যদি সেই মেয়েটির সঙ্গে যােগাযােগ করে ওর হাতে পায়ে ধরে আমার সঙ্গে বিয়ে ঘটিয়ে দেয়?” | বলেছিলাম, “আপনার শ্রীদেবী, রেখা অথবা এদের চেয়েও দুর্লভ মেয়েকে বিয়ে করতে কোনও আপত্তি নেই তাে?” | অনিরুদ্ধ প্রাণখােলা হাসি হেসে বলেছিলেন, “কাজী সাহেব আপনার চিন্তার হদিশ পেলে চ্যালেঞ্জ জানাবার দুঃসাহস দেখাতেন না।” | প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি-সম্মােহন করে স্কুমের দাস বানানাে বাস্তবে সম্ভব নয়। ওসব বিজ্ঞাপনে আর গল্পে হয়।
সম্মােহন কীভাবে করবেন?
সম্মােহন কীভাবে করবেন—তা জানার আগে সম্মােহন নিয়ে আরও একটু আলােচনা করে নিলে ভালাে হয়। আমরা চিন্তা করি মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের সাহায্যে। অর্থাৎ, আমাদের চিন্তা-ভাবনা হলাে মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের কাজ-কর্মের ফল। সম্মােহন হলাে মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে কোনও একটা ধারণাকে সঞ্চারিত করা বা পাঠান। একথা আগেই আলােচনা করেছি। মনে করুন টিভি’তে জুরাসিক পার্ক’ দেখছেন। দেখতে দেখতে এতটাই মগ্ন যে, বাইরের জগতের সঙ্গে আপনার চেতনার সম্পর্কটা গেছে ছিন্ন হয়ে। সমস্ত চিন্তাচেতনা জুড়ে শুধু ছবির জগৎ, ডাইনােসরদের ঘিরে রােমাঞ্চকর সব কাণ্ডকারখানা। মা কঁধ ধরে ধাক্কা দেওয়ায় মগ্নতা ভঙ্গ হলাে। “কি রে? তখন থেকে কলিংবেল বেজে যাচ্ছে হুঁশ নেই যা, তলায় গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।” মা’র কথাগুলাে শুনতে শুনতেই কানে আসতে লাগলাে কলিংবেলের আওয়াজ। আশ্চর্য! অথচ মা’র কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়ার আগেও এই আওয়াজ হচ্ছিল। কিন্তু খেয়ালই করতে পারেননি। টিভির দিকে গভীর মনঃসংযােগের জন্যে টিভির বাইরের জগতের সঙ্গে মনের যােগাযােগ ছিন্ন হওয়ার পরিণতিতেই এমনটা হয়েছে। মনে করুন ফুটবল খেলার দিনগুলাের কথা। খেলা শেষ হওয়ার পর একসময় আপনার খেয়াল হয়েছে পায়ের ক্ষতের দিকে। খেলার দিকে মনােযোেগ এতটাই ছিল যে তখন এই আঘাতের কথা খেয়ালই হয়নি। তারপর পায়ে ব্যথা অনুভব করায় এতক্ষণে নজরে এসেছে ক্ষত। | এই যে দুটি উদাহরণ হাজির করলাম, তার থেকে একটা জিনিস নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন; কোনও কিছুতে গভীরভাবে মনঃসংযােগ করলে পারিপার্শ্বিক অপরাপর বিষয়ে মনঃসংযােগ শিথিল হয়। সম্মােহন করার সময় একজন সম্মােহন করে এবং অপরজন সম্মােহিত হয়। সম্মােহন কীভাবে করবেন ? ১৬৫ দু’জনেরই গভীর মনঃসংযােগের প্রয়ােজন হয়। সে মনঃসংযােগ সম্মােহিতের জ্ঞাতসারে না হয়ে অজ্ঞাতসারে হতে পারে। কিন্তু মনঃসংযােগহীন সম্মােহন কখনই সম্ভব নয়। ‘অজ্ঞাতসারে মনঃসংযােগ’ কথাটা শুনে যাঁরা হোঁচট খেয়েছেন, ওঁদের বিষয়টা বােঝাতে একটি উদাহরণ হাজির করছি। সম্মােহনে আত্মা এলাে সানন্দায় বছর কয়েক আগের ঘটনা। সানন্দা' একটি বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকা। পত্রিকার দপ্তরে গিয়েছি। যেতেই সম্পাদক সংযােগী দীপান্বিতা জানালেন, আগামী সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি প্ল্যানচেট' নিয়ে। তুমি ওসব মান না বলে তােমাকে কাজে লাগাচ্ছি । বুঝলাম, প্ল্যানচেটের ব্যাপারটা পাঠক-পাঠিকাদের খাওয়াতে চাইছেন ওঁরা। তাই প্ল্যানচেট বিরােধিতার কথা ছেপে জনগণের অন্ধ আবেগের উত্তেজনায় ঠাণ্ডা জল ঢালতে নারাজ। আমার একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেলে গেল। বললাম, “না না, প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করব না কেন? প্ল্যানচেট তাে হয়ই। আমি নিজেই তাে প্ল্যানচেট করি।” শুনে অবাক দীপান্বিতা বললেন, “প্ল্যানচেট করে দেখাবে?” “কেন দেখাব না। নিশ্চয়ই দেখাব।” “কবে?” “বললে আজই, এখুনি, এ ঘরেই দেখাতে পারি।” সম্পাদকের ঘরে বসল সম্মােহনের বৈঠক। ঘরে জনা দশেক সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিক। প্ল্যানচেট করতে মিডিয়াম’ দরকার। মিডিয়াম’ অর্থাৎ যার মাধ্যমে আত্মা উত্তর দেবে। মিডিয়াম’ হলেন নিবেদিতা মজুমদার। একটা কাগজে যােগ চিহ্ন এঁকে যােগ চিহ্নের কেন্দ্রে সুতােয় আংটি ঝুলিয়ে বসলেন নিবেদিতা। যোেগ চিহ্নের দুই বিপরীত দিকে হা’ ও ‘না’ লেখা। নিবেদিতার উল্টো দিকের চেয়ারে বসলাম আমি। ঘরে স্বল্প আলাে। উত্তেজিত কিছু মানুষ অদ্ভুত কিছু দেখার আগ্রহে কার আত্মা আনা হবে? সাংবাদিকরা চাইলেন উত্তমকুমার। আমি নিবেদিতার উদ্দেশে বলতে লাগলাম—“একমনে ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের কথা। গভীরভাবে ভাবতে থাকুন। যােগ চিহ্নের কেন্দ্র বিন্দুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকুন। উত্তমকুমারের আত্মা নেমে আসবেনই। আত্মা নামলেই আংটিটা আপনা আপনি দোল খেতে থাকবে।” কথাগুলাে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একনাগাড়ে ধীরে ধীরে, গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে আমি বলে যাচ্ছিলাম। মিনিট দুয়েক পার হয়নি, আংটি দুলতে লাগলাে। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বললাম, “উত্তমকুমারের আত্মা এসে গেছেন। আপনারা এমন প্রশ্ন ১৬৬ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) করুন, যার উত্তর ‘ঘ’ ও ‘না’ তে হয়। আত্মা আংটিটাকে স্পষ্টভাবে ‘হা’ বা ’-এর দিকে দোলাতে দোলাতে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।” | প্রশ্ন শুরু হলাে। প্রশ্ন করছিলেন সাংবাদিক বন্ধুরা। আংটি পেন্ডুলামের মতাে দুলতে দুলতে কখনও হ্যা’, কখনও বা ‘না’য়ের উপর দোল খেতে খেতে উত্তর দিতে লাগল। এমসময় মিডিয়াম’ পাল্টাতে হল নিবেদিতা বেহুঁশের মতাে হয়ে যাওয়ায়। সাংবাদিকদের দাবিতে এবার মিডিয়াম হলেন সুদেষ্ণা রায়। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। একইভাবে আংটি বাঁধা সুতাে ধরলেন। এলেন সত্যজিৎ রায়ের আত্মা। আবার প্রশ্নবাণ। আবার আংটির উত্তরদান। একসময় দীপান্বিতা জিজ্ঞেস করলেন, “আত্মাকে দিয়ে রাইটিং প্যাডে লেখানাে যাবে না?” বললাম, “নিশ্চয়ই যাবে।” রাইটিং প্যাড এলাে। প্যাডে ডটপেন ঠেকিয়ে মিডিয়াম’ হিসেবে সুদেষ্ণা আবার রাজীব গান্ধীর আত্মার আগমন কামনা করতে লাগলেন। আমি ধীর ও প্রত্যয়ী স্বরে বলে যাচ্ছিলাম, “গভীরভাবে ভাবতে থাক রাজীব গান্ধীর আত্মা আসছে। পেনের ডগার দিকে তাকিয়ে থেকে গভীরভাবে ভাবতে থাক। আমি এই যে ধারণা সঞ্চার করছিলাম, বা সাজেশন’ দিচ্ছিলাম তা কিন্তু বেশিক্ষণ দিতে হল না। মাত্র মিনিট দুয়েক। পেন কাঁপতে লাগল। আবার সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ। এবার প্রশ্নের উত্তরগুলাে আসতে লাগল লিখিতভাবে। | অনেক ছবি-টবি উঠল, এবং প্ল্যানচেট পর্ব শেষ হতে রহস্য ভাঙলাম। আমি নিবেদিতা ও সুদেষ্ণার মনে ধারণা সঞ্চারিত করেছিলাম আত্মাকে গভীরভাবে ভাবতে থাকলে আত্মা আসবেন এবং উত্তর দেবেন। দু'জনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে অতি বিশ্বাসযােগ্য মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দু’জনের মনেই সচেতন বা অচেতনভাবে আত্মার অমরত্ব নিয়ে একটা বিশ্বাস বা দ্বিধা ছিল। এসবের ফলস্বরূপ দু’জনেই সম্মােহিত হয়ে আংটি দুলিয়েছেন, লিখেছেন। এঁরা কেউই সচেতনভাবে বা জ্ঞাতসারে এসব উত্তর দেননি। অবচেতন বা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই গভীরভাবে মনঃসংযােগ করেছিলেন বলেই এমনটা ঘটেছিল। একইভাবে যাকে সম্মােহিত করছেন, তাকে যদি বলেন, “একমনে শুধু আমার কথাই শুনবে” এবং যে যদি আপনার নির্দেশ মেনে আপনার কথা গভীরভাবে শুনতে থাকে, তবে একসময়ে বাইরের কোনও শব্দ, কোনও আওয়াজ আর তার চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। কী যা বলতে পার, বাইরের জগতের শব্দ এবং সমস্ত চিন্তা থেকেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে তখন একমাত্র যােগসূত্র থাকে যিনি সম্মােহিত করছেন তিনি। এই সময়ে যিনি সম্মােহিত করছেন। তিনি যদি বলতে থাকেন (ধারণা সঞ্চারিত করতে থাকেন) শরীরের সম্মােহন কীভাবে করবেন? ১৬৭ কোনও একটি অঙ্গ অসাড় হয়ে যাচ্ছে, তবে একসময় অসাড়ই হয়ে যায়। সম্মােহন নিয়ে নানা ভুল ধারণা ৯ জানুয়ারি ৯৬। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা জমা দিতে গিয়েছিলাম। লেখাটি পেতেই সম্পাদক পড়তে দিয়ে দিলেন এক সম্পাদক সহকারীকে। বিষয়—‘সম্মােহন'। লেখাটি হাতে নিয়ে এবিষয়ে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার আমার কাছে উপুড় করে দিতে বললেন “এ তাে জানি-ই। সম্মােহন ব্যাপারটাই তাে বুজরুকি।” তাঁর মারাত্মক জানার পরিচয়ে চমকে উঠলাম। বললাম, “সম্মােহন ব্যাপারটা কেন বুজরুকি হতে যাবে। যে সব মনােরােগ চিকিৎসক পাভলভিয়ান পদ্ধতিতে মনােরােগের চিকিৎসা করেন, তারা সম্মােহনের সাহায্য নেন। জাদুকরেরা সম্মােহনের নামে বুজরুকি করেন বলেই অনেকেই ‘সম্মােহন ব্যাপারটাকে বুজরুকি’ বলে ভুল করেন।” সম্মােহন’ সম্বন্ধে দু-দল মানুষের মধ্যে দুটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। এক, জাদুকররা সম্মােহন জানেন এবং জাদু দেখাতে সম্মােহন প্রয়ােগ করেন। দুই, সম্মােহন’ ব্যাপারটা অস্তিত্বহীন কল্পনা’, বুজরুকি। দুটি ধারণাই ভুল। ইভান পেত্রভিচ পাভলভ-এর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল 'Conditioned reflex' বা শর্তাধীন প্রতিফলন। পরিপাকগ্রন্থি নিয়ে কাজ করতে করতে পাভলভ শর্তাধীন প্রতিফলনের সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যে শর্তাধীন প্রতিফলন গবেষণার হাত ধরে বস্তুবাদী মনােবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাভলভ ১৯০৪ সালে “ফিজিওলজি অ্যান্ড মেডিসিন বিভাগে নােবেল পুরস্কার পান তার গবেষণা কর্মের জন্য। প্রাক-সম্মােহন প্রস্তুতি সম্মােহন করার আগে যাকে সম্মােহিত করণ, তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেওয়াটা খুবই জরুরি। যখন কোনও সভায় বা সেমিনারে সম্মােহন করি, তখন সম্মােহন নিয়ে একটা মােটামুটি আলােচনা সেরে নিই। এই আলােচনা সাধারণত চলে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত। বিপুল শ্রোতা ও দর্শকদের সামনে কয়েকজনকে সম্মােহন করে দেখাবার আগে এই সময়টা ব্যয় করা প্রয়ােজনীয় বলে আমার মনে হয়। কারণ আলােচনা শেষে দর্শকদের কাছে আমি আবেদন রাখি, যাঁরা বাস্তবিকই সততার সঙ্গে আমার কথা বা সাজেশন’ গভীর মনােযোেগর সঙ্গে শুনবেন, তাঁরা মঞ্চে উঠে আসুন। ১৬৮ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) উঠে আসাদের মধ্যে থেকেই প্রথম আসা দু-তিনজনকে প্রথম দফায় বেছে নিই। সভার সময়, দর্শকদের মুড ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে কত রকমের সম্মােহন দর্শকদের সামনে হাজির করব, তা ঠিক করি। তারপর প্রয়ােজন মতাে দফায় দফায় কয়েকজন করে দর্শককে মঞ্চে ডেকে নিই। ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্যে যখন কাউকে সম্মােহন করার প্রয়ােজন হয় তখন তার সঙ্গে সম্মােহন বিষয়ে কিছু আলােচনা সেরে নিই। উদ্দেশ্য : (ক) সম্মােহন সম্পর্কে অলীক ভয় দূর করা। (খ) সম্মােহনের কার্যকারিতা ও উপকারিতা। (গ) সম্মােহনের ক্ষেত্রে রােগীর চুড়ান্ত মনােযােগ ও সহযােগিতার প্রয়ােজনীয়তা। প্রয়ােজনে দু-একটি সম্মােহনের ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আর এই প্রয়ােজনটা সাধারণভাবে হয় সেমিনার বা সভায়। এটা গেল যাকে সম্মােহিত করব, তাকে মানসিকভাবে তৈরি করার প্রথম ধাপ। এবার আসছি দ্বিতীয় ধাপে। রােগীর ক্ষেত্রে যেভাবে সাজেশন দেওয়া হয় | রােগীদের সাজেশন দেওয়ার বেলায় সাধারণত তঁাকে সুন্দর ও আরামদায়ক বিছানায় শােবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ঘরের জোরালাে আলাে নিভিয়ে দিয়ে জ্বেলে দেওয়া হয় নাইট ল্যাম্প। নাইট ল্যাম্প এমনভাবে লাগানাে দরকার, যাতে সম্মােহিত বিছানায় শুয়ে চোখ মেলার পর বাটি দেখতে না পায়। খুব লাে ভলিউমে উত্তেজক নয়, মনকে আরাম দেওয়ার মতাে বাজনার ক্যাসেট চালাবার ব্যবস্থা রাখতে পারলে আরও ভাল হয়। যাঁকে সম্মােহিত করা হবে, তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে প্রথম ধাপ অতিক্রম করুন। দ্বিতীয় ধাপে বলুন, “আমি আপনাকে সাজেশন’ দেব। অর্থাৎ কিছু কথার বলব। আপনি খুব মন দিয়ে কথাগুলাে শুনতে থাকবেন। এই শােনার ফলে আপনার মধ্যে একটা আধা-ঘুম আধা-জাগরণের অবস্থা তৈরি হবে। তারপর আপনার সমস্যা মেটাতে সাজেশন দেব। সমস্যা মিটে যাবে।” রােগী বিছানায় আরাম করে শুলেন। পুরুষ হলে ট্রাউজারে সার্ট গোঁজা থাকলে সার্টটা ট্রাউজার থেকে বের করে নিতে বলুন। কোমরে বেল্ট থাকলে খুলতে বলুন। খুলে ফেলতে বলুন ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি। ট্রাউজার কোমরে টাইট হলে বােম খুলে হালকা হয়ে শুতে বলুন। মেয়েদের ক্ষেত্রে শাড়ি, সালােয়ার বা প্যান্ট কোমরে টাইট হলে হালকা করে পরতে বলুন। ব্রা ঢিলে করতে বলুন। ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি একইভাবে খুলে রাখতে বলুন। মেয়েদের ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ সম্মােহিত করতে চাইলে ঝুঁকি না নিয়ে সম্মােহন কীভাবে করবেন? মহিলার কোনও সঙ্গীকে ঘরে বসাবার ব্যবস্থা করুন। নতুবা ভয় বা অস্বস্তির জন্য আপনার কাছে মহিলাটির স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কিছুটা কম থাকে। এছাড়াও মহিলার তরফ থেকে কোনও অভিযোেগ এড়াতে সঙ্গীকে ঘরে রাখা জরুরি। বড় লাইট বন্ধ করে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিন। বাজিয়ে দিন খুব লাে ভলিউমে মনকে প্রশান্ত করার মতাে বাজনা। তারপর শুরু করুন সাজেশন দেওয়া। প্রতিটি বাক্য চার-পাঁচ বার করে ধীরে, সামান্য টেনে, গভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ গলায় বলে যেতে থাকুন। সাজেশনের বাক্যগুলাে এই ধরনের : “একমনে এবার আপনি আমার কথাগুলাে শুনতে থাকুন। আপনার ঘুম পাচ্ছে। ঘু...ম। চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। চোখের পাতাগুলাে ভারী হয়ে আসছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে আপনার ভাল লাগছে। আপনার কপালের চিন্তার রেখাগুলাে মিলিয়ে যাচ্ছে। কপালের পেশীগুলাে নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার গালের পেশী নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার চোয়ালের পেশী নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। ঘু...ম।” “আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। দু'চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। আপনার ডান কাঁধটা নিয়ে ভাবুন। ডান কাঁধের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। আপনার ডান কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত পেশীগুলাে শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের কনুই থেকে কজি পর্যন্ত ভাবুন। কনুই থেকে কজি পর্যন্ত পেশীগুলাে শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের তালু ও আঙুলগুলাের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে গেছে।” একইভাবে বাঁ কাঁধ থেকে সাজেশন দেওয়া শুরু করে হাত ভারীতে শেষ করুন। “আপনার বুকের কথা ভাবুন। বুকের পেশীগুলাে শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।” “আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ ধীরে ও গভীরভাবে হচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমােতে আপনার ভাল লাগছে।” “আপনার পেটের পেশীগুলাে শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।” “ডান পায়ের থাইয়ের পেশী নিয়ে ভাবতে থাকুন। থাইয়ের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের কাফের পেশী নিয়ে ভাবুন। পেশীগুলাে শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের পাতা ও আঙুলগুলাের পেশী শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পাটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভারী হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে।” ১৭০ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) একইভাবে বাঁ পা নিয়ে সাজেশন দিতে থাকুন। সাজেশন শেষে বাস্তবিকই যদি পরীক্ষা করতে চান—সম্মােহন করতে পেরেছেন কি না, তবে এই ধরনের সাজেশন দিন : “আপনার ডান হাতটায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে বিরাট একটা গ্যাসবেলুন। গ্যাসবেলুনের টানে আপনার ডান হাতটা হালকা মনে হচ্ছে। ডান হাতটা একটু একটু করে ওপরে উঠছে।” | দেখতে পাবেন—সাজেশনের সঙ্গেসঙ্গে সম্মােহিতের ডান হাত বিছানা ছেড়ে একটু একটু করে উপরে উঠে যাচ্ছে। এবার আমরা আসব বিভিন্ন রােগ বা সমস্যায় সাজেশনের রকমফের প্রসঙ্গে। সাজেশনের রকমফের সম্মােহিত করা তাে শেখানাে গেল। কিন্তু কেন সম্মােহিত করা? কোনও সমস্যা সমাধানের জন্যে? তাহলে সম্মােহিতকে প্রয়ােজনীয় সাজেশন’ দিতে হবে। নাকি শুধুই সম্মােহন নিয়ে খেলা? খেলা হলে, কিছুক্ষণ সম্মােহিত অবস্থায় রাখার পর সাজেশন দিতে থাকুন—‘আপনার ঘুম ভাঙছে।” সাজেশনে ঘুম না ভাঙলে বুঝবেন ঘুমটা একটু কড়া হয়ে গেছে। তালি বাজান বা দুআঙুলে চুটকি বাজান এবং সঙ্গে ঘুম ভাঙার সাজেশন দিন। সম্মােহন অবস্থা থেকে রােগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন।
ঈশ্বর দর্শন ও ভ্রান্ত অনুভূতির রকমফের
বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মীয় বহু সাধকদের সম্বন্ধেই প্রচলিত আছে, তারা ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন। যাঁরা ঈশ্বর দেখেছেন বা ঈশ্বরের বাণী নিজের কানে শুনেছেন বলে দাবি করেন, মনােবিজ্ঞানের চোখে তারা মানসিক রােগী মাত্র। ঠিকমতাে চিকিৎসা হলে তাদের এই ধরনের মানসিক ভ্রান্তি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা আবার ফিরে আসতে পারেন সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে। মনােবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের ভ্রান্ত অনুভূতিকে বলা হয় illusion' ‘hallucination, delusion’, ও ‘paranoia' ইত্যাদি। মনােবিজ্ঞান কিন্তু একজন মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষকে নিস্তেজ রেখে hallucination (হালুসিনেশন) বা delusion (ডিলিউশন)-এর অবস্থা সৃষ্টি করে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ জেমস ওল্ড, সুইজারল্যাণ্ডের প্রখ্যাত
মনােবিজ্ঞানী ডঃ ওয়াল্টার হেজ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ জে,
ডেলাগাজো সহ বিশ্বের বহু মনােবিজ্ঞানী এবং এই লেখক
বহু মানুষের মনে ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বরের কথা
শােনার অনুভূতি সৃষ্টি করতে
সমর্থ হয়েছেন।
মনােবিজ্ঞানী ডঃ ওয়াল্টার হেজ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ জে,
ডেলাগাজো সহ বিশ্বের বহু মনােবিজ্ঞানী এবং এই লেখক
বহু মানুষের মনে ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বরের কথা
শােনার অনুভূতি সৃষ্টি করতে
সমর্থ হয়েছেন।
এঁরা প্রমাণ করেছেন, বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্য মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্নায়ুকোষে উত্তেজনা ও নিস্তেজ অবস্থার সৃষ্টি করে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আনা সম্ভব, একইভাবে সম্ভব প্রেম, ঘৃণা, ভয় ও সাহসের অনুভূতি তৈরি করা। আবার ধারণা সঞ্চারের সাহায্যেও এমন অবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
Illusion ( ভ্রান্ত অনুভুতি)
অভিধানে illusion ও delusion এর অর্থ দেওয়া আছে, ‘মােহ’ এবং ভ্রান্তি'। কিন্তু মনােবিজ্ঞানে illusion, hallucination ও delusion প্রতিটি কথাই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।
মনােবিজ্ঞানে illusion হচ্ছে, কোন বস্তু প্রকৃতপক্ষে যা, তাকে সেইভাবে উপলব্ধি না করা। একটা সােজা হাতলের চামচের কিছুটা অংশ জলে ডুবিয়ে রাখলে সােজা চামচটা আর সােজা দেখায় না। দেখলে মনে হয় চামচটা বেঁকে আছে। আমাদের দর্শানুভুতি ভুল করছে। ছবি ১ দেখুন।
ছবি- ১

ছবি ২ দেখুন। এখানে যে চারটি দীর্ঘ রেখা দেখা যাচ্ছে সেগুলােকে দেখলে বাঁক মনে হলেও চারটি দীর্ঘ রেখাই সরল-সমান্তরাল।


১৯৯১ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের একটা ঘটনা বলছি। আমার স্ত্রী সুমি চেয়ারে বসে বই পড়ছে। ডাইনিং টেবিলের আর একটা চেয়ারে বসে ছেলে পিংকি মেতে রয়েছে এর কার্টুন সিরিজ বার্ডম্যান’ আঁকা নিয়ে। আমি ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে রেডিও সংকর্ষণ রায়ের বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প শুনছিলাম। সুমি পড়তে পড়তেই একটা চড় বসাল কাঁধে। মুখে বলল, “মশা বেড়েছে।”
একটু পরেই দেখলাম পিংকি উঠে দাঁড়াল। আর তার একটু পরেই সুমি আবার চাপড় বসাল ঘাড়ের নীচে। পিংকি হাে-হাে করে হেসে উঠল। সুমি বলল, “দেখলে, তােমার ছেলে কেমন দুষ্টু হয়েছে?”
আসল ঘটনা ছিল, পিংকি ওর মায়ের ঘাড়ের নীচে আলতাে করে আঁকার তুলিটা ছুঁইয়েছে। তুলির ছোঁয়াকে মশার উপস্থিতি ভেবে সুমি চড় চালিয়েছে। এটা স্পর্শানুভূতির ভ্রান্তি।
মরুভূমিতে অনেক সময় দূর থেকে বালিকেই জল বলে ভুল হয়। এটা দর্শানুভূতির ভ্রমের উদাহরণ।
১৯৮৪-র ডিসেম্বরের শীত শীত সন্ধ্যায় ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে লিখতে বসেছি, হঠাৎ ‘ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ একটানা চিৎকারে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বারান্দায় বেরােলাম, কী ব্যাপার হঠাৎ এত কুকুরের চেঁচামেচি? দেখি না ‘ঘেউ ঘেউ নয়, ভােটের মিছিল বেরিয়েছে, তারাই চেঁচাচ্ছে ‘ভােট দিন'। ভােট দিন’ শব্দটাই ‘ঘেউ-ঘেউ হয়ে আমার কানে পৌছচ্ছে। শ্রবণানুভূতির ভুলে এমনটি হয়েছে।
আপনি হয়ত সকালবেলায় চায়ের কাপটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আয়েস করে খবরের কাগজটা পড়ছেন। পড়ছেন আপনার প্রিয় দলের ফেডারেশন কাপ জেতার বিবরণ, এমনি সময় গিন্নি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে এসে হাজির হলেন। বললেন, “আজ কিন্তু চা আনতে হবে। দুশাে গ্রামের একটা হলুদ গুঁড়াে আনবে।”
আপনার পড়ায় মন দিতে অসুবিধা হচ্ছে। বললেন, “আর কিছু লাগবে না তাে? ঠিক আছে ব্যাগ এখানেই”।
কথা শেষ করতে পারলেন না। লাফিয়ে উঠলেন শিরশিরে এক আতঙ্কে। খােলা কাঁধের ওপর কী যেন একটা বিছে নয় তাে? চলকানাে চায়ের কাপটা ইজিচেয়ারের সামনে রাখা টুলটায় নামিয়ে রেখে প্রায় লাফাতে লাফাতে ডান হাত দিয়ে কাঁধটা ঝেড়ে ফেলতেই মেঝেতে পড়ল এক টুকরাে সুতাে। গিন্নির হাত থেকে বা ব্যাগ থেকে কাঁধে পড়েছে। স্পর্শানুভূতির ভ্রান্তিতে আপনি সুতােকেই ভেবেছিলেন বুঝি বিছে।
এই ধরনের ভ্রম স্বাদগ্রহণের অনুভূতি ও ঘ্রাণানুভূতির ক্ষেত্রেও হতে পারে। পঞ্চেন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে বা ভ্রান্তিকে (illusion) পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—১. দর্শানুভূতির ভ্রম (optical illusion অথবা visual illusion), ২. শ্রবণাভূতির ভ্রম (auditory illusion), ৩. স্পর্শানুভূতির ভ্রম (talctile illusion), ৪. ঘ্রাণানুভূতির ভ্রম (offactory illusion), ও ৫. স্বাদগ্রহণের বা
জিহ্বানুভূতির ভ্রম (taste illusion)
Hallucination (অলীক বিশ্বাস)
অভিধানে hallucination কথার বাংলা অর্থ দেওয়া আছে ‘অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস। অলীক বা অস্তিত্বহীন কোন কিছু সম্পর্কে অনুভূতি লাভ করাকেই মনােবিজ্ঞানের ভাষায় hallucination বলা হয়। অতএব, hallucination এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘অলীক বিশ্বাস’ কথাটাই আশা করি ঠিক হবে।
ধরে নিলাম, রামবাবু পুজো-আর্চা করেন। অফিস যাওয়ার আগে স্নানটি সেরে ঠাকুরপুজো করে খেতে বসেন। সেদিন শনিবার, কালীর ছবিতে অপরাজিতার মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনাে দিয়ে পুজো করছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন মা কালী ছবি ছেড়ে একপা এক’পা করে বেরিয়ে এলেন। Optical hallucination বা Visual hallucination-এর রােগীরা এই ধরনের দৃশ্য দেখেন।
সুন্দরী তরুণী সুমনা বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়েছে। স্বামী শ্যামলেন্দু অফিস যাওয়ার পথে স্কুটার অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। শ্যামলেন্দুর ব্যাঙ্কে সুমনা চাকরি পেয়েছে। সহকর্মী ধ্রুবকে ভালই লাগে। ধ্রুবও ওকে চায়, সেটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না। একদিন ধ্রুব বিয়ের প্রস্তাব দিল সুমনাকে। আর, সেই রাতেই শুতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্লিনজিং মিল্ক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে করতে সুমনা তাকাল ড্রেসিং টেবিলে রাখা শ্যামলেন্দুর ছবির দিকে, আর অমনি স্পষ্ট শুনতে পেল শ্যামলেন্দুর গলা, “তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে সুমনা?” Auditory hallucination-এর রােগী এই ধরনের কথা শুনতে পায়।
আমার বন্ধু অমিত সেন-এর বড়দা (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ সত্যেন সেনের ভাইপাে) সুজিত সেন মারা যান ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ সালে কেদারে। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে অমিতের বড়দা ও বৌদি খুবই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। বেরিয়েছিলেন তীর্থদর্শনে। কেদারের পথে হাঁটতে হাঁটতেই অমিতের বড়দা হার্টে ব্যথা অনুভব করেন। আত্মীয় বন্ধুহীন এই তীর্থযাত্রায় দাদার একমাত্র সঙ্গী বৌদি পাগলের মতােই সাহায্যের জন্য চেঁচাতে থাকেন। একসময় বৌদি হঠাৎ-ই দেখতে পান এক সন্ন্যাসী ছুটতে ছুটতে আসছেন। মরণপথযাত্রী বড়দার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বড়দার মুখে প্রসাদ ও কমণ্ডলুর জল দিয়ে, যেমন এসেছিলেন তেমনি আবার ছুটতে ছুটতে চলে যান। একটু পরেই বড়দা মারা যান। বৌদি আশ্রয় পেলেন এক আশ্রমে। বড়দার শেষ কাজ বৌদিই করলেন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের উপদেশ মতাে। সন্ন্যাসীরা এই মৃত্যুকে মহাপুরুষের মৃত্যু হিসেবে ধরে নিয়ে মৃতদেহ না পুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দিলেন। দু-একদিন পরে বৌদি কেদারনাথকে দর্শন করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কী, এই কী কেদারনাথ? ইনিই তাে সেদিন স্বামীর মুখে জল ও প্রসাদ তুলে দিয়েছিলেন। | অমিতের বৌদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, দীর্ঘদিনের সংস্কার, তীর্থক্ষেত্রের ধর্মীয় পরিবেশ, প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের আবেগ ও সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক কথাবার্তা এই ধরনের Visual hallucination সৃষ্টি করেছিল।
আমার সহকর্মী মণি দালালের এক আত্মীয় হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলেন তার বাড়িতে কলকাতা কর্পোরেশনের যে জল আসে তাতে প্রস্রাবের গন্ধ। তার দৃঢ় ধারণা হলাে এর পেছনে আছেন তাঁরই এক আত্মীয়। বাড়ির লােকজনেরা বােঝালেন, এটা অলীক চিন্তা। ভদ্রলােক কিন্তু বুঝলেন না। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন, দুষ্টু আত্মীয়টি কর্পোরেশনের লােকজনদের হাত করে প্রস্রাব মেশাচ্ছেন। | দীর্ঘদিন ধরে আর স্নান করেননি তিনি। অতি সামান্য জল খেতেন এবং সেই জলও নিজেই নিয়ে আসতেন দুরের এক টিউবওয়েল থেকে। এটা ঘ্রাণভিত্তিক ভ্রান্তির (Olfactory Hallucination) উদাহরণ।
আমার অফিসের এক বড় অফিসার তার চেম্বারে ডেকে আমাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী বােধহয় কোনও তুকতাক করেছে, অথবা কোন পিশাচ ঘরে ঢুকেছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঘরে পিশাচের গন্ধ পাচ্ছেন। পিশাচের গন্ধ তিনি কী করে চিনলেন, কে জানে? ভদ্রলােক আমাকে একদিন তার বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি পিশাচের’ কোনও গন্ধ না পেলেও তিনি কিন্তু তখনও গন্ধ পাচ্ছিলেন, এটাও একটা ঘ্রাণভিত্তিক হ্যালুসিনেশনের দৃষ্টান্ত।
একদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম চিত্রকর গণেশ হালুইয়ের সল্টলেকের বাড়িতে। সেই আড্ডায় আমরা দু’জন ছাড়া ছিলেন আর একজন ছিলেন আর একজন শিল্পী। তার নাম প্রকাশে একটু অসুবিধে থাকায় ধরে নিচ্ছি তার নাম শ্যামবাবু। শ্যামবাবু শ্রীমার পরম ভক্ত। সঙ্গের ওয়ালেটে সব সময় শ্রীমার ছবি থাকে। একদিন তিনি অসতর্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে ডবলডেকার বাসে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যান। সেদিনের আড্ডায় শ্যামবাবুর প্রতিটি কথা আক্ষরিকভাবে মনে না থাকলেও কথার ভাবটুকু আমার স্মৃতিতে জমা পড়ে রয়েছে। শ্যামবাবু মােটামুটিভাবে সেইদিন এই ধরনের কথা বলেছিলেন, বুঝতে পারছিলাম চাপা পড়বই। আর এক মুহুর্তের মধ্যে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। শেষ সময়ে শ্রীমাকে স্মরণ করতেই ঘটে গেল অলৌকিক ঘটনা। দেখতে পেলাম আমার পাশে শ্রীমা। তারপরই অনুভব করলাম একটা হ্যাচকা টান। হুড়মুড় করে চলে গেল বাসটা। দেখলাম আমি বেঁচে আছি। সেদিনের সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলতে গেলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অস্তিত্বহীন শ্রীমার আত্মা উপস্থিত হয়ে শ্যামবাবুকে বাঁচিয়েছেন এবং শ্যামবাবু স্বচক্ষে শ্রীমাকে দেখেছেন এই অলীক চিন্তাই হলাে দৃষ্টিভিত্তিক হ্যালুসিনেশন।
অতীন মিত্র একটা আধা সরকারি সংস্থায় মােটামুটি ভাল পদেই কাজ করেন। একমাত্র সন্তান রুণা রসগােল্লা খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যায়। তারপর থেকেই অতীনবাবুর স্ত্রী কোন মিষ্টি খেতে পারেন না। মুখে দিলেই মনে হয় বিষ তেতাে। এটা স্বাদভিত্তিক বা taste hallucination অসুস্থ মস্তিষ্কের ফল। Hallucination ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে পাঁচ ভাগে বিভক্ত।
বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের (chemical stimulus) সাহায্যেও hallucination সৃষ্টি করা সম্ভব। গাঁজা, আফিম, L.S.D., ভাঙ, কোকেন, চরস ইত্যাদি প্রয়ােজনীয় মাত্রায় শরীরে গ্রহণ করলেও অনেক সময় তুরীয় আনন্দ, আধ্যাত্মিক আনন্দ, দেবদর্শন বা দেববাণী শােনা যায়। আমার এক পরিচিত তরুণ আমাকে বলেছিল, সে একবার L.S.D, খাওয়ার পর অনুভব করেছিল, তার দেহটা খাটে শুয়ে আছে এবং আত্মা সিলিং-এ ঝুলে রয়েছে।
Delusion (মােহ, অন্ধ ভ্রান্ত ধারণা)
Delusion কথার অর্থ যে মােহ তা আমরা আগেই আলােচনা করেছি। Illusion ও hallucination এর সঙ্গে Delusion (ডিলিউশন) এর অনুভূতির পার্থক্য রয়েছে।
Delusion রােগীর মধ্যে বদ্ধমূল কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকে। এই যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা অসুস্থ মস্তিষ্কেরই ফল। Delusion রােগী ভাবল, সে এমন একটা মন্ত্র পেয়ে গিয়েছে, যার সাহায্যে দূরের যে কোন লােকের মৃত্যু ঘটাতে পারে। | কেউ হয়তাে ভাবতে শুরু করল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ তার স্বামী। যে যখন রাতে শােয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ তার শয্যায় নেমে আসে।
আমাদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত একটি মেয়ের কথা বলছি। মেয়েটির নাম প্রকাশে অসুবিধা থাকায় ধরে নিলাম তার নাম শ্রী। বয়েস বছর যােলাে। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। মেয়েটির মা আরও অনেক বেশী সুন্দরী। মেয়েটির হঠাৎ বদ্ধমুল, ধারণা হলাে মা ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, জলে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন। ও বাড়ির জল খায় না, আশেপাশের বাড়িতে গিয়ে জল খেয়ে আসে। আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর অন্ধবিশ্বাস তার শ্বশুরমশাই পূর্বজন্মে তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিলেন। বন্ধুর সংসার বলতে নিজে, স্ত্রী, একটি ছােট্ট মেয়ে ও বাবা। বন্ধু অফিসে বেরােলেই ওর স্ত্রী ভয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। বাড়িতে সবসময়ই কাজের জন্য একটি মেয়ে ছিল, মেয়েটি কখনও দু-চার দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলে বন্ধু-পত্নীও মেয়েকে নিয়ে চলে যেত বাপের বাড়ি। বন্ধু-পত্নীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওর বদ্ধমূল ধারণা পূর্বজন্মে ওর শ্বশুর ছিলেন আকবর, আর ও ছিল আনারকলি।
রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, বামাক্ষ্যাপা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন মা কালী বা মা তারা তাদের সঙ্গে সবসময় কথা বলছেন, ঘুরছেন, ফিরছেন, দৈনন্দিন কাজকর্মে সাহায্য করছেন। দীর্ঘকাল ধরে লালিত বিশ্বাসই একসময় বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস বা delusion-এ পরিণত হয়েছে।
আমার এক মধ্যবয়স্ক সহকর্মী ছিলেন, যিনি delusion-এর রােগী। নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় ধরে নিচ্ছি তার নাম যদুবাবু। যদুবাবুর দৃঢ় ধারণা সহকর্মীরা তার প্রতি সহানুভূতিহীন, হীনচরিত্র ও দুষ্ট প্রকৃতির। সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে যদুবাবু ধরে নেন ওরা তাঁর সম্বন্ধেই কথা বলছে। কোন দুই সহকর্মী নিজেদের দিকে তাকালে যদুবাবু ধরে নেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করেই ওরা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। ও কেন আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সিগারেটের প্যাকেট বের করল? আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কেন আমজাদ খার গল্প করল এরা? আমি কি ভিলেন? অফিসের বিবেক ঘােষ কেন আমাকে হেমামালিনীর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দিল? আমি কী লম্পট? আমি সেকশনে ঢুকতেই ওরা সকলে হেসে উঠল। আমি কী ওদের হাসির রসদ? এই রকম নানা ধরনের আত্মপ্রাসঙ্গিক ভ্রান্তি নিজের সঙ্গে জুড়ে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে রােগী। নির্যাতনমূলক এই delusion রােগী কিন্তু নিজের প্রতিটি ধারণা ও ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত বলে মনে করে।
পাভলভের মতে Delusion-এর উৎপত্তির মূলে রয়েছে প্রথমত মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিকারগত অনড়ত্ব, আর দ্বিতীয় কারণ হলাে, অতি স্ববিরােধী মানসিক অবস্থা। এই দুটি ব্যাপারই একসঙ্গে বা পরপর ঘটতে পারে। সেই অনুসারে delusion রােগীর উপসর্গেরও কিছু হেরফের হয়।
Paranoia
‘Paranoia' কথাটির অভিধানগত অর্থ বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি। বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করার চেষ্টা না করে একে আমরা বরং বাংলায় প্যারানইয়া'ই বলি।
‘প্যারানইয়া’ রােগী delusion রােগীর মতােই অন্ধ ভ্রান্ত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয় বটে, কিন্তু প্যারানইয়া রােগী তার এই বিশ্বাসের পেছনে এমন সুন্দর যুক্তি হাজির করতে থাকেন যে, একজন মনােরােগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও অনেক সময় বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে—উনি মানসিক রােগী অথবা বক্তব্যের যুক্তিগুলাে সত্যি? ধরুন, মধুবাবু একদিন আপনাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। শুধু এই কথাটাই বললেন না, তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে যে সব ঘটনা ও যুক্তি হাজির করলেন তাতে আপনি প্রাথমিকভাবে হয়ত বিশ্বাসই করতে বাধ্য হবেন, মধুবাবুর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। মধুবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে আপনি আপনার পরিচিত প্রাইভেট গােয়েন্দা লাগালেন, নিজেও লেগে পড়লেন বন্ধুকে নষ্টা স্ত্রীর হাত থেকে বাঁচাতে। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন বন্ধুর প্রতিটি সন্দেহ ভিত্তিহীন।
নিজের ভুল বিশ্বাসকে যুক্তিসহ হাজির করার প্রচেষ্টাই প্যারানইয়া রােগীর বৈশিষ্ট্য। নিজের ওই বিশেষ ভ্রান্ত বদ্ধমূল বিশ্বাসের বাইরে প্যারানইয়া রােগীকে পুরােপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হয়। এবার এক সুন্দরী রমণীর কথা বলছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাশয় এখানে তার নাম দিলাম রাধা। রাধা শুধু সুন্দরীই নন, যথেষ্ট গুণীও। স্বাী, ধরা যাক নাম তার সত্য, সমাজে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। রাধার বদ্ধমূল ধারণা সত্যর চরিত্র ভাল নয়। সুযােগ পেলেই আত্মীয়-অনাত্মীয়া, কুমারী, সধবা, বিধবা, যে কোন বয়েসের মেয়ের সঙ্গেই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যান। এই বিষয়ে রাধা যেসব যুক্তি হাজির করেন, যেসব ঘটনার অবতারণা করেন, সেসব শােনার পর রাধার বান্ধবীদের অনেকেরই ধারণা সত্য একটি প্লে-বয়।
বেচারা সত্যকে রাধার তৈরি যুক্তি-তর্কের কালি মেখেই থাকতে হচ্ছে।
প্রখ্যাত মনােবিজ্ঞানী ম্যাকডুগালের মতে প্যারানইয়া রােগীর গােপন মনে হীনমন্যতাবােধ বা পাপবােধ লুকিয়ে থাকার দরুন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এক ধরনের শান্তি পায়। নিজের অন্যায় কাজকে ‘জাস্টিফাই’ করে প্রশান্তি পায়।
অলৌকিক নয়, লৌকিক- প্রবীর ঘোষের লেখা থেকে
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ