গীতা কি প্রক্ষিপ্ত ? - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

19 August, 2020

গীতা কি প্রক্ষিপ্ত ?

ভারত মহাসাগর অন্তর্গত যবদ্বীপে প্রথমে হিন্দু রাজ্য ছিল, 1478 খ্রিস্টাব্দে যখন যবদ্বীপে মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয় ৷ তখন যবদ্বীপের বাহুরাহু নামক জনৈক ব্রাহ্মণ বহু শত শাস্ত্র গ্রন্থ সাথে নিয়ে আত্মরক্ষার্থে বালিদ্বীপে এসেছিলেন। সেই ব্রাহ্মণের আনিত মহাভারতের ভীষ্পর্ব অন্তগর্ত এক গীতা পাওয়া গেছে যাতে মাত্র ৭০টি শ্লোক ছিল ৷ তাই বর্তমানে প্রচারিত ৭০০ শ্লোকযুক্ত গীতা প্রক্ষিপ্ত ৷ মহাভারতের ১০০ বছরের পূর্বে মানুষ বেদ বিরূদ্ধ আচরণ শুরু করে, এই সময় ঋষি ও মুনি থাকা সত্ত্বেও আলস্য প্রমোদ ঈর্শা ও দ্বেশের কারন বশত নিজেদের মধ্যে বিবদ ও বিরোধ আরম্ভ হয়, যার প্রমান মহাভারতের যুদ্ধ।
এর পরপর পোপের উদ্ভব হয় যারা নিজ নিজ চরন পূজা করাইতে আরম্ভ করিল এবং ইহাতে মানুষ্যের কল্যান হবে বোঝাতে শুরু করেন। সাথে মদ্য মাংশ ভক্ষন করিতেও আরম্ভ করিল। পরে পরে মহাভারতের যুদ্ধের শেষে পোপ দের মধ্য থেকে বামমার্গীর উদয় হয়,যারা "শিব উবাচ","পার্ব্বত্মউবাচ","ভৈরব উবাচ" নামক গ্রন্থের রচনা যাহা তন্ত্র নাম দিলেন। এই সকল পোপের অনাচার দেখে মহাভয়ঙ্কর ও বেদাদি শাস্ত্রের নিন্দুক বৌদ্ধ এবং জৈন মত প্রচলিত হয়েছিল। তাদের মতই ভয়ঙ্কর মত বৈষ্ণব মত যারা যোগীরাজ মানবশ্রেষ্ট ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে ঈশ্বরের অবতার প্রমানের চেষ্টা দ্বারা এমন কি পুরাণের গল্পে রাধার নাম দিয়ে নিজেদের দোকান খুলে নিয়েছে। 
তিনশত বছর আর্যবর্ত্তে জৈন দিগের রাজত্ব চলে,এই জৈনগণ হইতেই পাষাণাদি মূর্ত্তি পূজার মূল আরম্ভ হয়। পরে পরে বেদার্থ জ্ঞান প্রায়ই লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। অনুমানুসারে প্রায় সার্দ্ধ দ্বিসহস্র বৎসর অতীত হইল যখন এই সকল ঘটনা ঘটিয়াছিল। দ্বাবিংশ শত বর্ষ অতীত হইল দ্রাবিড় দেশোৎপন্ন শঙ্করাচার্য্য নামক এক ব্রাহ্মন শাস্ত্রার্থ দ্বারা জৈন মত খন্ডন করেন এবং শঙ্করাচার্য্যের মত অখন্ডিত রহিল। এই ভাবে তিনি দেশে পরিভ্রমণ করতঃ জৈনমত খন্ডন ও বেদমত মন্ডন করিত থাকেন। শঙ্করাচার্য্য ও সুধন্বা রাজা প্রায় ২৫০০ বছর আগে জৈন মত প্রধ্বংস করেন। শঙ্করাচার্য্যের পূর্ব্বে শৈব মত ও অল্প পরমাণে প্রচলিত ছিল। তিনি উক্ত মতের এবং বামমার্গীর মতের খন্ডন করিয়াছিলেন। শঙ্করাচার্য্যের মৃত্যুর কিছুকাল পরে পুনঃ আর্য্যাবর্ত্তে জৈনদিগের এবং শঙ্করাচার্য্যের মতাবল্বীদিগের উপদেশের কিছু পরিমাণে সংস্কার হইয়াছিল এবং পরস্পরের খন্ডন ও মন্ডন চলিতেছিল। শঙ্করাচার্য্যের তিনশত বৎসর পরে উজ্জয়িনী নগরীতে বিক্রমানদিত্য রাজা রাজ্যত্ব করেন। তৎপশ্চাৎ রাজা ভর্ওৃহরি কাব্যাদি শাস্ত্র এবং অনান্য বিষয়ে কিঞ্চিৎ বিদ্বান্ হইয়া পরে বৈরাগ্যবান্ হইয়া রাজ্য পরিত্যাগ করেন। ভোজরাজা বিক্রমাদিত্যের পাঁচশত বৎসর পরে রাজ্য করিয়াছিলেন,তাঁহার রাজ্যে ছাগপালক কালিদাসও রঘুবংশ কাব্যের রচনাকর্ত্তা হইয়াছিলেন। ভোজের নিকট যে কেহ উত্তম শ্লোক রচনা করিয়া লইয়া যাইত তাহাকে বহূল পরিমাণে ধন প্রদত্ত এবং তাহার প্রতিষ্ঠা হইত। মহারাজ বিক্রমাদিত্য হইতে শৈবদিগের বল বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সেই সময় লোকে শঙ্করার্য্যকে শিবের অবতার নিশ্চয় করিল। ঐ সময় নানা প্রকার ভুলভাল শ্লোক ইহারা রচনা করিল। পশ্চাৎ বামমার্গী এবং শৈবগণ মিলিত হইয়া ভগলিঙ্গের স্থাপন করিল। ইহাকে জলাধারী এবং লিঙ্গ কতিয়া থাকে। শিবের পত্নী বামমার্গীদিগের দেবী। "স্বার্থী দোষং ন পশ্যতি "- স্বার্থপর লোক আপনার কার্যসিদ্ধির আশয়ে দুষ্কার্য্যকেও শ্রেষ্ঠ মনে করিয়া উহাতে দোষ দেখিতে পায় না।
ভোজরাজের রাজ্য সময়ে মহাত্মা ব্যাসের নাম লইয়া কেহ মার্কন্ডেয় পুরাণ এবং শিব পুরাণ রচনা করিয়াছিলেন। এই সকল বিষয় ভোজরাজ রচিত সঞ্জীবনী নামক ইতিহাসে লিখিত আছে। গোয়ালিয়র রাজ্যে "ভিন্ড" নামক নগরের তেওয়ারী ব্রাহ্মণদিগের গৃহে এই লিখিত গ্রন্থ আছে,যাহা লখুনার রাও সাহেব এবং তাঁহার গোমস্তা রামদয়াল চৌবে মহাশয় স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিলেন-(স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী)। ইহাতে স্পষ্ট লিখিত আছে মহাত্মা ব্যাস চারি সহস্র ও চারি শত (৪৪০০) এবং তাঁহার শিষ্যগণ পাঁচ সহস্র ছয় শত (৫৬০০) শ্লোকযুক্ত ভারত রচনা করিয়াছিলেন। উহাতে মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সময়ে বিংশ সহস্র (২০০০০) শ্লোকে পরিনত হয়। মহারাজা ভোজ কহিতেন যে তাঁহার পিতার সময়ে ২৫ সহস্র এবং তাঁহার অর্দ্ধেক বয়সেই ৩০ সহস্র শ্লোকযুক্ত মহাভারত পাওয়া যায়। ভোজরাজের ১৫০ বৎসর পরে বৈষ্ণব মত আরম্ভ হয়। কঞ্জর বা ব্যাধ জাতিতে শঠকোপ নামে একজন উৎপন্ন হয়। তাহার কয়েকজন শিষ্য হইয়াছিল। তৎপশ্চাৎ হাড়ি জাতি হইতে মুনিবাহন এবং তৃতীয় যবন কুলোৎপন্ন যাবনাচার্য্য হইয়াছিল। তৎপশ্চাৎ ব্রাহ্মণকুলজাত চতুর্থ রামানুজ হইয়া ছিলেন। তিনিই বৈষ্ণব মতের প্রচার করেন। শৈবগণ শিবপুরাণ আদি, শাক্তগণ দেবীভাগবতাদি,এবং বৈষ্ণবগণ বিষ্ণুপুরাণাদি রচনা করিয়াছিলেন। ঐহারা এজন্য উহাতে আপনাদিগের নাম দেয় নাই,কারণ যদি উহারা রচনা করিয়াছে ইহা প্রকাশ পায় তাহা হইলে কেহই ঐগুলি প্রামাণ্য জ্ঞান করিবে না। এই জন্য ব্যাসাদি ঋষি এবং মুনির নাম লিখিয়া পুরাণ রচনা করিয়াছিলেন। 

সনাতন ধর্মের সবচেয়ে গ্রহনীয় এবং সহজ লভ্য গ্রন্থটির নাম শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ।সংক্ষেপে গীতা বলা হয় । ভিষ্মপর্বের ২৫ হইতে ৪২ অধ্যায়ই ভগবদ্‌গীতা । কিন্তু শান্তি ও অশ্বমেধ পর্বে এবং অন্যান্য বহু স্থলে ব্যাসদেব ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্‌গীতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন । ইহা হইতে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ, প্রক্ষিপ্ত নহে । গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে বিভিন্ন মত আছে । 

ব্যাসদেবের মত

শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৬২০ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৫৭ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৬৭ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭৪৫ শ্লোকসংযুক্ত ব্যাসদেব কথিত গীতা  [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৭]
षट्शतानि सविंशानि श्लोकानां प्राह केशवः । अर्जुनः सप्तपञ्चाशत्सप्तषष्टिं तु सञ्जयः ॥ धृतराष्ट्रः श्लोकमेकं गीताया मानमुच्यते । [Mahabharata, Bhisma Parva, 43|4]
ষট্শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্রাহ কেশবঃ । অর্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎসপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ॥ ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে । [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৪]
শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৫৭৫ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৮৪ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৪০ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭০০ শ্লোকসংযুক্ত প্রচলিত গীতা

শঙ্করাচার্যের মত

কিন্তু দক্ষিণ ভারতে কাশ্মীরী গীতার প্রচার ছিল না বলিয়া সম্ভবতঃ উহা শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিগোচর হয় নাই । সেই যুগে এখনকার মতো যাতায়াতের, মুদ্রাযন্ত্রের বা ডাকের কোন সুবিধা না থাকায় এক প্রদেশের হস্তলিখিত পুঁথি অন্য প্রদেশে তেমন যাতায়াত করিতে পারিত না । তাই শঙ্করাচার্য গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় । যাহার ফলে তাঁহার পরবর্তী ভাষ্যকার ও টীকারগণও এই শ্লোকসংখ্যার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করিতে সাহসী হন নাই । কিন্তু তিনিও তাঁহার ভাষ্যে ১|১ শ্লোকের কোন উল্লেখ করেন নাই ও ১৩|১ শ্লোকও অব্যাখ্যাত রাখিয়াছেন । অর্থাৎ তিনিও উক্ত শ্লোকদ্বয় গ্রহণ করেন নাই ।শঙ্করাচার্যের পূর্বেও ৭৪৫ শ্লোকযুক্ত গীতার উপর বহু টীকা ছিল । কিন্তু মধ্যযুগে ধর্মান্ধ মুসলমানদিগের হাতে সংস্কৃত সাহিত্যের যে দুর্গতি হইয়াছিল তাহার ফলে অধিকাংশ হস্তলখিত পুঁথি বিনষ্ট হইয়াছে ।
কাথিয়াবাড়স্থ গণ্ডাল স্টেটের রাজবৈদ্যজীবরাম কালিদাস শাস্ত্রী সুরাট ও কাশী হইতে দুইটি প্রাচীন ভূর্জপত্রে হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ করিয়াছেন যাহা পুস্তকাকারে গণ্ডাল রসশালা ঔষধাশ্রম হইতে প্রকাশিত হইয়াছে । ১১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত সুরাট থেকে সংগৃহীত গীতা অধিকাংশ স্থলে কাশ্মীরী গীতার অনুরূপ । ইহাতে প্রচলিত গীতা হইতে ২১টি নূতন ও অধিক শ্লোক এবং ২৫০টি পাঠান্তর পরিদৃষ্ট হয় । ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত কাশী থেকে সংগৃহীত গীতায় ৭৪৫টি শ্লোক আছে । এই গীতাদ্বয়ের প্রকাশের পর দেশি, বিদেশি গীতাবিদ্‌গণের মধ্যে গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে গভীর জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হইয়াছে । ৭৪৫টি শ্লোকসংযুক্ত গীতা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও প্রকাশিত হইয়াছে, যদিও পাঠকসাধারণের ইহা অবিদিত । গীতা যে কত প্রাচীন সেই সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে বিশেষ মতভেদ আছে । অনেকের মত – গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পরবর্তী । ডাঃ লরিনসারের মতে গীতা বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক পরে; এমন কি যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পরে রচিত । মারাঠী পণ্ডিতটেলাং তাঁহার গীতার উপক্রমণিকায় লিখিয়াছেন যে, উহা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীরও কিছু পূর্বে লিখিত এবং ডাঃ লরিনসারের অযৌক্তিক উক্তির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন ।
স্যার আর.জি.ভাণ্ডারকর তাঁহার “Vaisnavism and Saivism” (p.13) গ্রন্থে বলেন – “গীতাতে ব্যূহের কোন উল্লেখ নাই । সুতরাং ইহার জন্মতারিখ, শিলালিপি ও নির্দেশ পতঞ্জলির বহু পূর্বে অর্থাৎ গীতার উৎপত্তি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভের পরে কিছুতেই নহে; তবে চতুর্থ শতাব্দীর কত পূর্বে ইহার জন্ম তাহা নিশ্চয় করা সুকঠিন । গীতা যখন রচিত হয়, তখন বাসুদেব ও নারায়ণ অভেদ-জ্ঞানে পূজিত বা বাসুদেব বিষ্ণুর অবতাররূপে গৃহীত হন নাই । গীতাতে [১০|২১] বিষ্ণুকে প্রধান আদিত্য বলা হইয়াছে, পরমপুরুষ বলা হয় নাই এবং দশম অধ্যায়ে বাসুদেবকে সীমান্বিতভাবে বিষ্ণু বলা হইয়াছে; প্রত্যেক শ্রেণী বা জাতির মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই তাঁহার দিব্য বিভূতি, ‘তেজোহংশসম্ভবম্‌’ । সুতরাং মারাঠী পণ্ডিত ভাণ্ডারকরের মতে গীতার জন্ম অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে ।
জার্মান পণ্ডিত গার্বের মতে মূল গীতা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এবং গীতার আধুনিক কলেবর খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে উৎপন্ন ।
নবম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্য রচনা করেন । পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভূত মহাকবিকালিদাস গীতার বিষয় অবগত ছিলেন । কালিদাসের ‘রঘুবংশে’ [১০|৩১] একটি বাক্য আছে, যাহার সহিত গীতার একটি শ্লোকের [৩|২২] নিকট-সাদৃশ্য আছে । সপ্তম শতাব্দীতেবাণভট্ট তাঁহার গ্রন্থে গীতার উল্লেখ করিয়াছেন । খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বহু পুরাণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনুকরণে অন্যান্য গীতা সৃষ্টি করিয়াছেন । ভাসের ‘কর্ণভার’ নাটকে‘হতোহপি লভতে স্বর্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ’ – এই বাক্যটি গীতার একটি শ্লোকের [২|৩৭]প্রথমার্ধের প্রতিধ্বনি মনে হয় । ভাসের আবির্ভাবকাল কখনও খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে, কখনও বা খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয় । বোধায়নের (সম্ভবতঃ পঞ্চম শতাব্দীর) গৃহসূত্র ও পিতৃমেধসূত্রে গীতার শ্লোক উদ্ধৃত এবং বাসুদেবের উপাসনা বিবৃত আছে ।
ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন্‌ বলেন, গীতা খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতা বুদ্ধের পূর্ববর্তী কালে উৎপন্ন এবং উহা ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ । ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনত্ব তিলকসেনার্টও বুহ্‌লার কর্তৃক স্বীকৃত । বুহ্‌লার সাহেব বলেন যে, খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জৈনধর্মের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ভাগবত-ধর্মের উৎপত্তি । ডাঃ দাশগুপ্ত আরও বলেন, “গীতাতে বৌদ্ধ মতের কোন প্রকার উল্লেখ নাই এবং উহার ভাষাও পাণিনীয় নহে । সুতরাং গীতা নিশ্চিতই বুদ্ধের পূর্বে রচিত, কিছুতেই বুদ্ধের পরবর্তী যুগের নহে ।”
কেহ কেহ গীতায় নির্বাণ-শব্দটি কয়েকবার উল্লিখিত দেখিয়া মত প্রকাশ করেন যে, গীতা বৌদ্ধযুগে সৃষ্ট; কিন্তু এই প্রকার যুক্তি নিতান্ত অগভীর ও অর্বাচীন । কারণ, নির্বাণ-শব্দটি বৌদ্ধদের নিজস্ব নহে, উহা গীতাতে পাঁচবার ব্যবহৃত হইয়াছে [২|৭২, ৫|২৪,২৫,২৬, ৬|১৫] । কিন্তু এই পাঁচটি শ্লোকে নির্বাণ-শব্দটি ব্রহ্ম-শব্দের সহিত সদা সংযুক্ত দৃষ্ট হয় । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণের অর্থ ব্রাহ্মী স্থিতি, বৌদ্ধ নির্বাণের মতো ‘শূন্য’ নহে । সুতরাং বৌদ্ধগণই যে গীতা হইতে নির্বাণ-শব্দটি গ্রহণ করিয়াছেন – এই মতই অধিকতর সমীচীন মনে হয় । অতএব স্পষ্টই প্রতীত এবং প্রমাণিত হয় যে, গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পূর্বে রচিত । মহাভারত যত প্রাচীন, গীতাও তত প্রাচীন । ১৯৪৪ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে কাশীতে যে নিখিল ভারত প্রাচ্য সম্মেলন হইয়াছিল তাহাতে তিনজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত গীতার কালনির্ণয়বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করেন ।মিঃ কারান্তিকর বলেন খ্রীঃপূঃ ১৯৩১ অব্দে গীতোক্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হইয়াছিল । ডাঃ দফ্‌তরীর মতে খ্রীঃপূঃ ১১৬২ এবং অধ্যাপক সেনগুপ্তের মতে খ্রীঃপূঃ ২৫৬৬ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল ।
লোকমান্য তিলক ‘মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্‌’[১০|৩৫] – গীতার এই শ্লোকাংশ জ্যোতিষশাস্ত্রের দিক হইতে আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, খ্রীষ্টজন্মের ১৪০০ বৎসর পূর্বে গীতা রচিত হইয়াছিল ।
ভারতীয় সাহিত্যে বা বিশ্ব সাহিত্যের অমুল্য ধ্রুপদী সম্পদ । এর সুললিত ছন্দের ঝংকারে অবচেতন মনে সম্মোহনি আবেগ সৃষ্টি হয় । তাই “গীতা” নামের সার্থকতা প্রশ্নাতীত । বেদান্ত দর্শনের সহিত গীতার যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ , তাহা আর অধিক বলিবার আবশ্যক নাই। -সে সম্বন্ধ পদে পদে প্রতীয়মান হয়। পঞ্চদশ অধ্যায়ের এক স্থানে ভগবান ‘বেদান্তকৃত’ বলিয়া আপনার পরিচয় দিতেছেন। শ্রীধর স্বামী তাহার এই অর্থ করেন, “ আমি তৎসম্প্রদায় প্রবর্তক জ্ঞানদাতা গুরু” । যদি শ্রীকৃষ্ণকে বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের গুরু বলিয়া স্বীকার করা যায়, তাহা হইলে গীতার সময়ে বেদান্ত দর্শনের অস্তিত্ব ও লোকসমাজে প্রচার সহজেই প্রতিপন্ন হয়। 
উল্লেখ্য হিন্দু ধর্মের অন্যান্য গ্রন্থের মতই গীতাও প্রথমে সাধারন হিন্দুদের হাতে ছিলনা ।১৭৮৫ সালে গীতার সর্ব প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন চার্লস উইলকিন্স । ১৮২৩ সালে জার্মান পন্ডিত শ্লেগেল লেটিন ভাষায়,১৮২৫ সালে ইউজেন বুর্নক ফরাসী ভাষায় ১৮৫৭ সালে ডোমোট্রীয়ার গ্রীক ভাষায়১৮৬৯ সালে এফ লরিনসার জার্মান ভাষায় ,১৮৮৫ সালে এডউইন আরনলড ইংরেজী ভাষায় এবং১৯২৭ সালে নভিকভের নামক এক রাশিয়ান ভদ্রলোক এর রুশ অনুবাদ করেন যার ভুমিকা লেখেন উয়ারেন হেস্টিং । স্বামী বিবেকান্দ এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন “ব্রাহ্মনরাই টাকার বিনিময়ে গীতাকে ম্লেচ্ছদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

এবার আসুন গীতার ভীত্তি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক ।
অষ্টম শতাব্দীতে শংকরাচার্য গীতাকে উপনিষদ বলে আখ্যায়িত করেছেন । এজন্য গীতাকে অনেকে গীতোপনিষদ ও বলে থাকেন।প্রকৃত পক্ষে গীতা প্রাচীন উপনিষদের অনেক পরবর্তী রচনা ।পন্ডিত কাশীনাথ ত্রম্ব্যক তেলাং দেখিয়েছেন ভগবতগীতার সাথে অন্তত ১৩টি উপনিষদের কোন না কোন মিল রয়েছে ।
স্বামী বিবেকান্দের মতে গীতা প্রচীনতর উপনিষদগুলোর পরবর্তী কালের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য. এবং মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের অংশ ।
আবার অনেক ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য পন্ডিত গীতাকে মহাভারতের অংশ হিসাবে মনে করেন না । তাদের মতে পল্লবিত মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত সংযোজন এটি । এ ব্যাপারে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,গঙ্গাধর তিলক,ভাণ্ডার কর এবং ভারতের ২য় রাষ্ট্রপতি ও সনাতন ধর্মের বিশিষ্ট গবেষক ড.সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ ভারতীয় পন্ডিত এবং লাসেন,লরিনসার,গার্বে,ভ্যান বুইটানিন প্রমুখ পাশ্চাত্য পন্ডিত ও ধর্ম বিশেষজ্ঞগন মনে করেন গীতা বহু লেখকের রচনা এবং বহুকাল ধরে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফসল। ড.অক্টো,র মতে গীতার কুরুক্ষেত্র বিষয়ক আখ্যায়িকা অংশই মহাভারতের প্রকৃত অংশ ।এর শ্লোক সংখ্যা১২৮ ।তার মতে ভক্তি,জ্ঞান,কর্ম,যোগ ইত্যাদি পৃথক পৃথক গ্রন্থের অংশ যা শ্রী কৃষ্ণের বানী হিসাবে চালিয়ে দেয়ার জন্য মহাভারতে সংযোজন করা হয়েছে ।

মহাভারতের সঙ্গে গীতার সম্পর্ক নিয়ে বঙ্কিম বলেছেন “যাহা আমরা ভাগবত গীতা বলে পাঠ করি তাহা কৃষ্ণ প্রনীত নহে; উহা ব্যাস প্রনীত বলিয়া খ্যাত “বৈয়াসিকী সংহিতা”নামে পরিচিত । ইহার প্রণেতা ব্যাসই হোক আর যেই হোক তিনি কৃষ্ণের মুখের কথাগুলো নোট করিয়া রাখিয়া এই গ্রন্থ সংকলন করেন নাই ””
বঙ্কিমের এমন মতামতের কারন একবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না । দুপক্ষের যুদ্ধকে থামিয়ে ,রনসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদের মাঝে দীর্ঘ্য ১৮ অধ্যায়ের যোগ ধর্ম শোনা সম্ভবপর নয় ।
এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য হলো“ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে থামিয়ে রেখে সমস্ত গীতা আবৃতি করা সাহিত্যের আদর্শ হিসাবে অপরাধ”রাজা রাম শাস্ত্রীর মতে “গীতায় প্রথমে শুধুমাত্র ৬০টি শ্লোক ছিল,পরে ৬টি পর্যায়ে ক্রমবর্ধিত হয়ে বর্তমান ৭০০ শ্লোক বিশিষ্ট গীতায় পরিনত হয়”
জার্মান গীতা বিশেষজ্ঞ অন হামবোল্ড বলেন “গীতা প্রথমে ১১টি অধ্যায়ে সম্পুর্ন ছিল,বাকি ৭টি পরিচ্ছেদ অনেক পরে সংযোজিত হয়েছে”
রিচার্ড গার্বে মনে করেন গীতার প্রথম লেখকের রচনা কাল ২০০-১০০খৃষ্টপুর্বাব্দে ।
টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এল বেশম এক বক্তৃতায় বলেছিলেন “গীতা তিন পর্যায়ে তিনজন লেখকের রচনা ।প্রথম পর্যায়ে ১ম অধ্যায়ে ৪৭ এবং ২য় পর্যায়ে ৩৮ টি ,মোট ৮৫ টি শ্লোক নিয়ে গীতা রচিত হয়েছিল ।এই শ্লোক গুলোতে ধর্ম যুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ত আরোপ করা হয়েছিল ।২য় পর্যায়ে একজন বেদান্তবাদি লেখক অদ্বৈত ব্রহ্মের তথ্য যোগ করে গীতার কলেবর বৃদ্ধি করেন ।শেষ পর্যায়ে একজন বিষ্ণু ভক্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী বিষ্ণুর অবতারত্ব সংযোজন পুর্বক বাসুদেব কৃষ্ণকে অবতার রুপে প্রতিষ্টিত করতে চেষ্টা করেন ”
মাত্র ৭০টি শ্লোকের গীতার সন্ধানও পাওয়া গেছে । কাথিয়াবার গন্ডাল স্টেটে ১১৭৯ সালে হাতে লেখা গীতার যে পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে,তাতে প্রচলিত গীতা থেকে ২১টি অতিরিক্ত শ্লোক ও ২৫০টি পাঠান্তর দেখা যায় । 
মাদ্রাজের ধর্মমন্ডলের মুদ্রিত গীতায় প্রচলিত গীতা থেকে ৩৭টি শ্লোক বাদ দিয়ে মহাভারতের উদ্যোগ,অনুশাসন ও শান্তি পর্বের ৮২টি শ্লোক গ্রহন পুর্বক ৭৪৫টি শ্লোকের গীতা তৈরি করা হয় ।
১১শতকের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল-বেরুনী তাঁার গ্রন্থে গীতার যেসকল শ্লোকের উদ্বৃতি দিয়েছেন সেগুলো বর্তমান গীতায় নেই ।
সম্রাট আকবরের সময় গীতার যে ফারসী অনুবাদ প্রকাশিত হয় তার শ্লোক সংখ্যা ছিল ৭৪০ । অনেক পন্ডিত গীতার৭৪৫ শ্লোককেই সমর্থন করেন । যদিও শংকরাচার্যের সময়ে ৭০০ শ্লোকের গীতার সন্ধান মিলে যা বর্তমানেও পাওয়া যায় ।
গীতার রচনাকাল,রচয়ীতা,মহাভারতে গীতার সংযোজনের সময় ও পরবর্তিকালে এর কলেবর বৃদ্ধি নিয়ে বিবেকান্দ বলেন “শংকরভাষ্য রচনার পূর্বে গীতা সাধারনত খুব পরিচিত ছিলনা ।সম্ভবত তিনিই গীতার রচনাকার ও মহাভারতে সংযোজনকারী ” যদিও বর্তমান কালের কোন গবেষক বিবেকান্দের এই ভাষ্যে একমত পোষন করেননি ।
আচার্য শংকরের মতে “গীতা শাস্ত্র বেদার্থ সার সংগ্রহ বিধায় উহা বেদানুকুল হওয়া উচিৎ ।কৃষ্ণ ভগবানের অবতার ।গীতার বক্তা কৃষ্ণ তাই গীতা ভগবানের উক্তি ,একথা বেদ বিরুদ্ধ ”।

আমাদিগের বিচার্য বিষয় যে, মহাভারতের কোন কোন অংশ প্রক্ষিপ্ত। এক্ষণে দেখিতে হইবে যে, এই বিচার সম্পন্ন করিবার কোন উপায় আছে কি না। অর্থাৎ কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত এবং কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত নহে, তাহা স্থির করিবার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় কি না?
মনুষ্যজীবনে যে সকল কার্য সম্পন্ন হয়, সকলই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া নির্বাহ করা যায়। তবে বিষয়ভেদে প্রমাণের অল্প বা অধিক বলবত্তা প্রয়োজনীয় হয়। যে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমরা সচরাচর জীবনযাত্রার কার্য নির্বাহ করি, তাহার অপেক্ষা গুরুতর প্রমাণ ব্যতীত আদালতে একটা মোকদ্দমা নিষ্পন্ন হয় না, এবং আদালতে যেরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া বিচারক একটা নিষ্পত্তিতে উপস্থিত হইতে পারেন, তাহার অপেক্ষা বলবান্ প্রমাণ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞানসম্বন্ধীয় কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন না। এই জন্য বিষয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণশাস্ত্র সৃষ্ট হইয়াছে। যথা—আদালতের জন্য প্রমাণসম্বন্ধীয় আইন (Law of Evidence), বিজ্ঞানের জন্য অনুমানতত্ত্ব (Logic বা Inductive Philosophy) এবং ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিরূপণ জন্য এইরূপ একটি প্রমাণশাস্ত্রও আছে। উপস্থিত তত্ত্ব নিরূপণ জন্য সেইরূপ কতকগুলি প্রমাণের নিয়ম সংস্থাপন করা যাইতে পারে; যথা—
১ম,—আমরা পূর্বে পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের কথা বলিয়াছি। যাহার প্রসঙ্গ সেই পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে নাই, তাহা যে নিশ্চিত প্রক্ষিপ্ত, ইহাও বুঝাইয়াছি। এইটিই আমাদিগের প্রথম সূত্র।
২য়,—অনুক্রমণিকাধ্যায়ে লিখিত আছে যে, মহাভারতকার ব্যাসদেবই হউন, আর যিনিই হউন, তিনি মহাভারত রচনা করিয়া সার্ধশত শ্লোকময়ী অনুক্রমণিকায় ভারতীয় নিখিল বৃত্তান্তের সার সঙ্কলন করিলেন। ঐ অনুক্রমণিকাধ্যায়ের ৯৩ শ্লোক হইতে ২৫১ শ্লোক পর্যন্ত এইরূপ একটি সারসঙ্কলন আছে। যদিও ইহাতে সার্ধশতের অপেক্ষা ৯টি শ্লোক বেশী হইল, তাহা না ধরিলেও চলে। এমনও হইতে পারে যে, ৯টি শ্লোক ইহারই মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এখন এই ১৫৯ শ্লোকের মধ্যে যাহার প্রসঙ্গ না পাইব, তাহা আমরা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিতে বাধ্য।
৩য়,—যাহা পরস্পর বিরোধী, তাহার মধ্যে একটি অবশ্য প্রক্ষিপ্ত। যদি দেখি যে, কোন ঘটনা দুই বার বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ দুটি বিবরণ ভিন্নপ্রকার বা পরস্পর বিরোধী, তবে তাহার মধ্যে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করা উচিত। কোন লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি, এবং অনর্থক পুনরুক্তি দ্বারা আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনবধানতা বা অক্ষমতাবশতঃ যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। তাহাও অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।
৪র্থ,—সুকবিদিগের রচনাপ্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। মহাভারতের কতকগুলি এমন অংশ আছে যে, তাহার মৌলিকতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ হইতে পারে না—কেন না, তাহার অভাবে মহাভারতে মহাভারতত্ব থাকে না, দেখা যায় যে, সেগুলির রচনাপ্রণালী সর্বত্র এক প্রকার লক্ষণবিশিষ্ট। যদি আর কোন অংশের রচনা এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই, এবং এমন সকল লক্ষণ আছে যে, তাহা পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে অসঙ্গত, তবে সেই অসঙ্গতলক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়।
৫ম,—মহাভারতের কবি একজন শ্রেষ্ঠ কবি, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসঙ্গত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, তবে সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। মনে কর, যদি কোন হস্তলিখিত মহাভারতের কাপিতে দেখি যে, স্থানবিশেষে ভীষ্মের পরদারপরায়ণতা বা ভীমের ভীরুতা বর্ণিত হইতেছে, তবে জানিব যে, ঐ অংশ প্রক্ষিপ্ত।
৬ষ্ঠ,—যাহা অপ্রাসঙ্গিক, তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, না হইলেও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত পাঁচটি লক্ষণের মধ্যে কোন লক্ষণ দেখিতে পাই, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ আছে।
৭ম,—যদি দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বিবরণের মধ্যে একটিকে তৃতীয় লক্ষণের দ্বারা প্রক্ষিপ্ত বোধ হয়, যেটি অন্য কোন লক্ষণের অন্তর্গত হইবে, সেইটিকেই প্রক্ষিপ্ত বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে।
এখন এই পর্যন্ত বুঝান গেল। নির্বাচনপ্রণালী ক্রমশঃ স্পষ্টতর করা যাইবে।

পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী


 


মহাভারত পুনঃ পুনঃ পড়িয়া এবং উপরিলিখিত প্রণালীর অনুবর্তী হইয়া বিচারপূর্বক আমি এইটুকু বুঝিয়াছি যে, এই গ্রন্থের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। প্রথম, একটি আদিম কঙ্কাল; তাহাতে পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত এবং আনুষঙ্গিক কৃষ্ণকথা ভিন্ন আর কিছুই নাই। ইহা বড় সংক্ষিপ্ত। বোধ হয়, ইহাই সেই চতুর্বিংশতিসহস্রশ্লোকাত্মিকা ভারতসংহিতা। তাহার পর আর এক স্তর আছে, তাহা প্রথম স্তর হইতে ভিন্নলক্ষণাক্রান্ত; অথচ তাহার অংশ সমুদায় এক লক্ষণাক্রান্ত। আমরা দেখিব যে, মহাভারতের কোন কোন অংশের রচনা অতি উদার, বিকৃতিশূন্য, অতি উচ্চ কবিত্বপূর্ণ। অন্য অংশ অনুদার, কিন্তু পরমার্থিক দার্শনিকতত্ত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, সুতরাং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্রাপ্ত; কবিত্বশূন্য নহে, কিন্তু যে কবিত্ব আছে, সে কবিত্বের প্রধান অংশ অঘটনঘটনকৌশল, তদ্বিষয়ে সৃষ্টিচাতুর্য। প্রথম শ্রেণীর লক্ষণাক্রান্ত যে সকল অংশ, সেগুলি এক জনের রচনা; দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট যে সকল রচনা, তাহাই তাহাই দ্বিতীয় ব্যক্তির রচনা বলিয়া বোধ হয়। প্রথম শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট অংশই প্রাথমিক, বা আদিম; এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণযুক্ত অংশগুলি পরে রচিত হইয়া, তাহার উপর প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, এরূপ বিবেচনা করা যাইতে পারে। কেন না, প্রথম কথিত অংশ উঠাইয়া লইলে, মহাভারত থাকে না; যাহা থাকে, তাহা কঙ্কালবিচ্যুতমাংসপিণ্ডের ন্যায় বন্ধনশূন্য এবং প্রয়োজনশূন্য নিরর্থক বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট যাহা, তাহা উঠাইয়া লইলে, মহাভারতের কিছু ক্ষতি হয় না, কেবল কতকগুলি নিষ্প্রয়োজনীয় অলঙ্কার বাদ যায়; পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত অখণ্ড থাকে। অতএব প্রথম শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট অংশগুলিকে আমি প্রথম স্তর, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট রচনাগুলিকে দ্বিতীয় স্তর বিবেচনা করি। প্রথম স্তরে ও দ্বিতীয় স্তরে, আর একটা গুরুতর প্রভেদ এই দেখিব যে, প্রথমস্তরে কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার বা বিষ্ণুর অবতার বলিয়া সচরাচর পরিচিত নহেন; নিজে তিনি আপনার দেবত্ব স্বীকার করেন না; এবং মানুষী ভিন্ন দৈবী শক্তি দ্বারা কোন কর্ম সম্পন্ন করেন না। কিন্তু দ্বিতীয় স্তরে, তিনি স্পষ্টত্ বিষ্ণুর অবতার বা নারায়ণ বলিয়া পরিচিত এবং অর্চিত; নিজেও নিজের ঈশ্বরত্ব ঘোষিত করেন; কবিও তাঁহার ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করিবার জন্য বিশেষ প্রকারে যত্নশীল।
ইহা ভিন্ন মহাভারতে আরও এক স্তর আছে। তাহাকে তৃতীয় স্তর বলিতেছি। তৃতীয় স্তর অনেক শতাব্দী ধরিয়া গঠিত হইয়াছে। যে যাহা যখন রচিয়া “বেশ রচিয়াছি” মনে করিয়াছে, সে তাহাই মহাভারতে পূরিয়া দিয়াছে। মহাভারত পঞ্চম বেদ। এ কথার একটি গূঢ় তাৎপর্য আছে। চারি বেদে শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের অধিকার নাই কিন্তু Mass Education লইয়া তর্কবিতর্ক আজ নূতন ইংরেজের আমলে হইতেছে না। অসাধারণ প্রতিভাশালী ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন যে, বিদ্যা ও জ্ঞানে স্ত্রীলোকের ও ইতর লোকের, উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গে সমান অধিকার। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, আপামর সাধারণ সকলেরই শিক্ষা ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই। কিন্তু তাঁহারা আধুনিক হিন্দুদিগের মত প্রতিভাশালী পূর্বপুরুষদিগকে অবজ্ঞা করিতেন না। তাঁহারা “অতীতের সহিত বর্তমানের বিচ্ছেদকে” বড় ভয় করিতেন। পূর্বপুরুষেরা বলিয়া গিয়াছেন যে, বেদে শূদ্র ও স্ত্রীলোকের অধিকার নাই।—ভাল, সে কথা বজায় রাখা যাউক। তাঁহারা ভাবিলেন, যদি এমন কিছু উপায় করা যায় যে, যাহা শিখিবার, তাহা স্ত্রীলোকে ও শূদ্রে বেদ অধ্যয়ন না করিয়াও এক স্থানে পাইবে, তবে সে কথা বজায় রাখিয়া চলা যায়। বরং যাহা সর্বজনমনোহর, এমন সামগ্রীর সঙ্গে যুক্ত হইয়া সর্বলোকের নিকট সে শিক্ষা বড় আদরণীয় হইবে। তিন স্তরে সম্পূর্ণ যে মহাভারত এখন আমরা পড়ি, তাহা ব্রাহ্মণদিগের লোক-শিক্ষার উদ্দেশে অক্ষয় কীর্তি;* কিন্তু এই কারণে ভালমন্দ অনেক কথাই ইহার ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে। শান্তিপর্ব ও অনুশাসনিক পর্বের অধিকাংশ, ভীষ্মপর্বের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায়, বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা পর্বাধ্যায়, উদ্যোগপর্বের প্রজাগর পর্বাধ্যায়, এই তৃতীয় স্তর-সঞ্চয় কালে রচিত বলিয়া বোধ হয়। পক্ষান্তরে আদিপর্বের শকুন্তলোপাখ্যানের পূর্বের যে অংশ এবং বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায় প্রভৃতি অপকৃষ্ট অংশও এই স্তর-গত।
এই তিন স্তরের, নিম্ন অর্থাৎ প্রথম স্তরই প্রাচীন, এই জন্যই তাহাই মৌলিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। যাহা সেখানে নাই, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরে দেখিলে, তাহা কবিকল্পিত অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত বলিয়া আমাদিগের পরিত্যাগ করা উচিত।
* স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতং—শ্রীমদ্ভাগবত। ১ স্ক। ৪অ। ২৫।
এখন যে মহাভারত প্রচলিত, তাহাকে ঠিক সমসাময়িক গ্রন্থ বলিতে পারি না। আদিম মহাভারত ব্যাসদেবের প্রণীত হইতে পারে, কিন্তু আমরা কি তাহা পাইয়াছি? প্রক্ষিপ্ত বাদ দিলে যাহা থাকে, তাহা কি ব্যাসদেবের রচনা? যে মহাভারত এখন প্রচলিত, তাহা উগ্রশ্রবাঃ সৌতি নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষিদিগের নিকট বলিতেছেন। তিনি বলেন যে, জনমেজয়ের সর্পসত্রে বৈশম্পায়নের নিকট যে মহাভারত শুনিয়াছিলেন, তাহাই তিনি ঋষিদিগের শুনাইবেন। স্থানান্তরে কথিত হইয়াছে যে, উগ্রশ্রবাঃ সৌতি তাঁহার পিতার কাছেই বৈশম্পায়ন-সংহিতা অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। এক্ষণে মহাভারতে ব্যাসের জন্মবৃত্তান্তের পর, ৬৩ অধ্যায়ে, বৈশম্পায়ন কর্তৃকই কথিত হইয়াছে যে—
বেদানধ্যাপয়ামাস মহাভারতপঞ্চমান্। সুমন্তুং জৈমিনিং পৈলং শুকঞ্চৈব স্বমাত্মজম্ || প্রভুর্বরিষ্ঠো বরদো বৈশম্পায়নমেব চ। সংহিতাস্তৈঃ পৃথক্‌ত্বেন ভারতস্য প্রকাশিতাঃ || —আদিপর্ব। ৬৩অ। / ৯৫-৯৬
অর্থাৎ ব্যাসদেব, বেদ এবং পঞ্চম বেদ মহাভারত সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, স্বীয় পুত্র শুক, এবং বৈশম্পায়নকে শিখাইলেন। তাঁহারা পৃথক্ পৃথক্ ভারতসংহিতা প্রকাশিতা করিলেন।*
তাহা হইলে, প্রচলিত মহাভারত বৈশম্পায়ন প্রণীত ভারতসংহিতা। ইহা জনমেজয়ের সভায় প্রথম প্রচারিত হয়। জনমেজয়, পাণ্ডবদিগের প্রপৌত্র।
সে যাহা হউক, উপস্থিত মহাভারত আমরা বৈশম্পায়নের নিকটও পাইতেছি না। উগ্রশ্রবাঃ বলিতেছেন যে, আমি ইহা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছি। অথবা তাঁহার পিতা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছিলেন, তিনি তাঁহার পিতার নিকট পাইয়াছিলেন। উগ্রশ্রবাঃ যাহা বলিতেছেন, তাহা আমরা আর এক ব্যক্তির নিকট পাইতেছি। সেই ব্যক্তিই বর্তমান মহাভারতের প্রথম অধ্যায়ের প্রণেতা, এবং মহাভারতের অনেক স্থানে তিনিই বক্তা।
তিনি বলিতেছেন, নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষি উপস্থিত; সেখানে উগ্রশ্রবাঃ আসিলেন, এবং ঋষিগণের সঙ্গে উগ্রশ্রবাঃর এই ভারত সম্বন্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে যে কথোপকথন হইল, তাহাও তিনি বলিতেছেন।
তবে ইহা স্থির যে, (১) প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়সিকী সংহিতা নহে। (২) ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না, তাহা সন্দেহ। তার পর প্রমাণ করিয়াছি যে, (৩) ইহার প্রায় তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত। অতএব আমাদের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক যে, মহাভারতকে কৃষ্ণচরিত্রের ভিত্তি করিতে গেলে অতি সাবধান হইয়া এই গ্রন্থের ব্যবহার করিতে হইবে।
সেই সাবধানতার জন্য আবশ্যক যে, যাহা অতিপ্রকৃত বা অনৈসর্গিক, তাহাতে আমরা বিশ্বাস করিব না।
আমি এমন বলি না যে, আমরা যাহাকে অনৈসর্গিক বলি, তাহা কাজে কাজেই মিথ্যা। আমি জানি যে, এমন অনেক নৈসর্গিক নিয়ম আছে, যাহা আমরা অবগত নহি। যেমন একজন বন্যজাতীয় মনুষ্য, একটা ঘড়ি, কি বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রীকে অনৈসর্গিক ব্যাপার মনে করিতে পারে, আমরাও অনেক ঘটনাকে সেইরূপ ভাবি। আপনাদিগের এরূপ অজ্ঞতা স্বীকার করিয়াও বিশেষ প্রমাণ ব্যতীত, কোন অনৈসর্গিক ঘটনায় বিশ্বাস করিতে পারি না। কেন না, আপনার জ্ঞানের অতিরিক্ত কোন ঐশিক নিয়ম প্রমাণ ব্যতীত কাহারও স্বীকার করা কর্তব্য নহে। যদি তোমাকে কেহ বলে, আমগাছে তাল ফলিতেছে দেখিয়াছি, তোমার তাহা বিশ্বাস করা কর্তব্য নহে। তোমাকে বলিতে হইবে, হয় আমগাছে তাল দেখাও, নয় বুঝাইয়া দাও কি প্রকারে ইহা হইতে পারে। আর যে ব্যক্তি বলিতেছে যে, আমগাছে তাল ফলিয়াছে, সে ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি দেখি নাই—শুনিয়াছি,’ তবে অবিশ্বাসের কারণ আরও গুরুতর হয়। কেন না, এখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাওয়া গেল না। মহাভারতও তাই। অতিপ্রকৃতের প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাইতেছি না।
বলিয়াছি যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইলেও অতিপ্রকৃত হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। নিজে চক্ষে দেখিলে হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, বরং আমাদিগের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি সম্ভব, তথাপি প্রাকৃতিক নিয়মলঙ্ঘন সম্ভব নহে। বুঝাইয়া দাও যে, যাহাকে অতিপ্রকৃত বলিতেছি, তাহা প্রাকৃতিক নিয়মসঙ্গত, তবে বুঝিব। বন্যজাতীয়কে ঘড়ি বা বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রী বুঝাইয়া দিলে, সে ইহা অনৈসর্গিক ব্যাপার বলিয়া বিশ্বাস করিবে না।
আর ইহাও বক্তব্য যে, যদি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করা যায় (আমি তাহা করিয়া থাকি), তাহা হইলে, তাঁহার ইচ্ছায় যে কোন অনৈসর্গিক ব্যাপার সম্পাদিত হইতে পারে না ইহা বলা যাইতে পারে না। তবে যতক্ষণ না শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারা যায়, এবং যতক্ষণ না এমন বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি মনুষ্য-দেহ ধারণ করিয়া ঐশী শক্তি দ্বারা তাঁহার অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতেন, ততক্ষণ আমি অনৈসর্গিক ঘটনা তাঁহার ইচ্ছা দ্বারা সিদ্ধ বলিয়া পরিচিত করিতে পারি না বা বিশ্বাস করিতে পারি না।
কেবল তাহাই নহে। যদি স্বীকার করা যায় যে, কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার, তিনি স্বেচ্ছাক্রমে অতিপ্রকৃত ঘটনাও ঘটাইতে পারেন, তাহা হইলেও গোল মিটে না। যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ, তাহাতে যেন বিশ্বাস করিলাম, কিন্তু যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ নহে, এমন সকল অনৈসর্গিক ব্যাপারে বিশ্বাস করিব কেন? সাল্ব অসুর অন্তরীক্ষে সৌভনগর স্থাপিত করিয়া যুদ্ধ করিল; বাণের সহস্র বাহু; অশ্বত্থামা ব্রহ্মশিরা অস্ত্র ত্যাগ করিলে তাহাতে ব্রহ্মাণ্ড দগ্ধ হইতে লাগিল; এবং পরিশেষে অশ্বত্থামার আদেশানুসারে, উত্তরার গর্ভস্থ বালককে গর্ভমধ্যে নিহত করিল, ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বাস করিব কেন?
তার পর কৃষ্ণের নিজ-কৃত অনৈসর্গিক কর্মেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করিলেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তিনি মানবশরীর ধারণ করিয়া যদি কোন অনৈসর্গিক কর্ম করেন, তবে তাহা তাঁহার দৈবী বা ঐশী শক্তির দ্বারা! কিন্তু দৈবী বা ঐশী শক্তি দ্বারা যদি কর্ম সম্পাদন করিবেন, তবে তাঁহার মানব-শরীরধারণের প্রয়োজন কি? যিনি সর্বকর্তা সর্বশক্তিমান্, ইচ্ছাময়—যাঁহার ইচ্ছায় এই সমস্ত জীবের সৃষ্টি ও ধ্বংস হইয়া থাকে, তিনি মনুষ্যশরীর ধারণ না করিয়াও কেবল তাঁহার ঐশী শক্তির প্রয়োগের দ্বারা, যে কোন অসুরের বা মানুষের সংহার বা অন্য যে কোন অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতে পারেন। যদি দৈবী শক্তি বা ঐশী শক্তি দ্বারা কার্য নির্বাহ করিবেন, তবে তাঁহার মনুষ্যশরীরধারণের প্রয়োজন নাই। যদি ইচ্ছাময় ইচ্ছাপূর্বক মনুষ্যের শরীর ধারণ করেন, তবে দৈবী বা ঐশী শক্তির প্রয়োগ তাঁহার উদ্দেশ্য বা অভিপ্রেত হইতে পারে না।
তবে শরীরধারণের প্রয়োজন কি? এমন কোন কর্ম আছে কি যে, জগদীশ্বর শরীরধারণ না করিলে সিদ্ধ হয় না?
ইহার উত্তরের প্রথমে এই আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে যে, জগদীশ্বরের মানবশরীরধারণ কি সম্ভব?
প্রথমে ইহার মীমাংসা করা যাইতেছে।

* জৈমিনিভারতের নাম শুনিতে পাওয়া যায়। ইহার অশ্বমেধ-পর্ব বেবর সাহেব দেখিয়াছেন। আর সকল বিলুপ্ত হইয়াছে। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে আছে—“সুমন্তুজৈমিনিবৈশম্পায়নপৈল-সূত্র-ভারতমহাভারত-ধর্মচার্যাঃ। তাহা হইলে সুমন্তসূত্রকার, জৈমিনি ভারতকার, বৈশম্পায়ন মহাভারতকার, এবং পৈল ধর্মশাস্ত্রকার।
পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
গীতার উপর বহু ভাষ্য ও টীকাদি (১৫-১৬টি) লিখিত হইয়াছে । গীতার শঙ্করভাষ্যইপ্রাচীনতম প্রাপ্ত ভাষ্য । শঙ্করের পূর্বেও যে গীতার ভাষ্যাদি রচিত হইয়াছিল, তাহার স্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায় । গীতার শঙ্করভাষ্যের টীকায়[২|১০] আনন্দজ্ঞান গিরি বলেন, বেদান্তসূত্রের টীকাকার বোধায়ন গীতার উপর একটি বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু উহা এখন পাওয়া যায় না । বোধায়নকে এইজন্য বৃত্তিকার বলা হয় ।
শঙ্করভাষ্য হিন্দী, মারাঠী, বাংলা, ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । শঙ্করভাষ্যের উপর আনন্দগিরি এবং রামানন্দ-কৃত যথাক্রমে ‘বিবরণ’ ও ‘ব্যাখ্যা’ নামক টীকাদ্বয় আছে । শঙ্করের পরে গীতার উপর ভাষ্যাদি রচনা কিছুকালের জন্য বন্ধ ছিল, মনে হয় ।
মধ্বাচার্য (আনন্দতীর্থ) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর জয়তীর্থকৃত ‘প্রমেয়দীপিকা’ নামক টীকা আছে । মধ্বাচার্য-কৃত ‘ভগবদ্‌গীতা-তাৎপর্য-নির্ণয়’র উপর জয়তীর্থ ‘ন্যায়দীপিকা’ নামক টীকা লিখিয়াছেন ।
রামানুজাচার্য (ব্রহ্মসূত্রের ‘শ্রীভাষ্য’-রচয়িতা) একাদশ শতাব্দীতে বিশিষ্টাদ্বৈত-মতানুযায়ী যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর বেঙ্কটনাথের (বেদান্তাচার্যের) ‘তাৎপর্য-চন্দ্রিকা’ নামক টীকা আছে ।
রামানুজ-গুরু যামুনাচার্য-কৃত ১০ম শতাব্দিতে রচিত ‘গীতার্থ-সংগ্রহে’র উপর নিগমান্ত মহাদেশিকের ‘গীতার্থ-সংগ্রহ-রক্ষণ’ এবং ১৪শ শতাব্দীর বরাবর মুনি-কৃত ‘গীতার্থ-সংগ্রহদীপিকা’ নামক টীকাদ্বয় বর্তমান । উল্লিখিত দ্বিতীয় টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত ।
যামুনাচার্য নামধারী দুই ব্যাক্তির গীতার উপর গদ্যে ও পদ্যে দুইটি টীকা পাওয়া যায় । গদ্য টীকাকার যামুনাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী হইলেও রামানুজের গুরু নহেন । এই গদ্য টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত । উহাতে অন্বয়মুখে সরল পদার্থ দেওয়া আছে ।
বোম্বাই নির্ণয় সাগর প্রেস হইতে অষ্টভাষ্য-টীকা সম্বলিত যে গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা ‘ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা’ এবং মধুসূদন সরস্বতীরটীকার ব্যাখ্যা ‘গূঢ়ার্থ-দীপিকা-তত্ত্বালোক’ (মৈথিলী পণ্ডিত শ্রীধর্মদত্ত শর্মা-কৃত) আছে ।
একমাত্র ভারতীয় ভাষা মারাঠীতে গীতার উপর দুইটি প্রসিদ্ধ টীকা আছে – (i) মহারাষ্ট্রের ধর্মগুরু জ্ঞানেশ্বর-রচিত, (ii)বালগঙ্গাধর তিলক-কৃত ‘গীতারহস্য’
তিলকের ‘গীতারহস্য’ এবং শ্রীঅরবিন্দের‘গীতানিবন্ধনিচয়’ বর্তমান যুগের দুইটি শ্রেষ্ঠ ভাষ্য । উভয় ভাষ্যই বাংলা ও হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে ।

উপনিষদ্‌ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য

উপনিষদের কয়েকটি শ্লোক গীতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায় । উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কিছু সমানার্থক শ্লোক উদ্ধৃত করা হইল । আরও সাদৃশ্যযুক্ত শ্লোক উদ্ধৃত করা যাইতে পারে । অতএব গীতাপাঠ করিলেই উপনিষদ্‌পাঠ হয় । গীতা উপনিষদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্য ।
কঠোপনিষদের ১|২|১৫ : গীতার ৮|১১
কঠোপনিষদের ২|৭,১৫,১৮-১৯ : গীতার ৮|১১, ২|২০, ২|১৯
ঈশোপনিষদের ৫ : গীতার ১৩|১৬ ও ৬|২৯
মুণ্ডক উপনিষদের ২|১|২ : গীতার ১৩|১৫
গীতা ও ভাগবতে একই তত্ত্ব উপদিষ্ট । উভয় গ্রন্থে একই অবতারের উপদেশ প্রবিবৃত । গীতার বক্তা কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্‌ভাগবতে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের বাণী গ্রথিত । গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এবং ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে জ্ঞানযোগ বর্ণিত । গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে এবং ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভক্তিযোগ বিবৃত । উভয় গ্রন্থেই সমানভাবে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগতত্ত্ব স্থান পাইয়াছে ।
“অব্যভিচারিণী ভক্তি দ্বারা ত্রিগুণাতীত হওয়া যায়” [গীতা ১৪|২৬]
“আত্মারাম মুনিগণ অহৈতকী ভক্তি লাভ করেন” [ভাগবত]
আবার গীতার ন্যায় ভাগবতেও আত্মতত্ত্ব উপদিষ্ট । ভাগবতের ১২শ স্কন্ধের শেষেশুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেছেন । ভাগবতের বেদস্তুতিতে আছে – “আত্মতত্ত্ব প্রকাশের জন্যই ভগবান্‌ মানবরূপে অবতীর্ণ হন ।” গীতার মতে যুগে যুগে অবতার আগমন করেন । ভাগবতেও উক্ত হইয়াছে ‘অবতার অসংখ্য’ ।
গীতায় শ্রীভগবান্‌ ভক্তকে সর্বধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক তাঁহার শরণাগত হইবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন [১৮|৬৬] । তদ্রূপ শ্রীমদ্‌ভাগবতেও আছে “সর্বপ্রযত্নে সকল প্রাণীর আত্মস্বরূপ আমার শরণাগত হও । তাহা হইলে আমার দ্বারা অকুতোভয় (সর্বত্র নির্ভয়) হইবে [১১|১২|১৫] ।” শরণাগতি দ্বারাই ভক্ত অভয় লাভ করেন । শ্রীশ্রীচণ্ডীর অন্তে মেধা ঋষিও রাজা সুরথকেভবভয়নাশের জন্য পরমেশ্বরী ভগবতীর শরণাগত হইতে বলিতেছেন । 


এত গুলো গীতার মধ্যে কোনটার ব্যাখা সঠিক? গীতা কয়টি  👈তা বোঝাও কঠিন।ষাট রকমের গীতার উল্লেখ আছে আমাদের পুরাণে

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (জগদীশচন্দ্র ঘোষ) (বড়) – https://bit.ly/2l6pxfL
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (জগদীশচন্দ্র ঘোষ) (ছোট) – https://bit.ly/2mos3hi
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ) – https://bit.ly/2kJXORB
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (যথার্ত গীতা) (অড়গড়ানন্দ) – https://bit.ly/2lgjtkA
শিব গীতা – https://bit.ly/2mLvGOF
অবধূত গীতা – https://bit.ly/2kKnUnA
অষ্টাবক্র গীতা – https://bit.ly/2mipBsS
অনুগীতা – https://bit.ly/2mirHJg
দেবী গীতা – https://bit.ly/2lgqIZO
ব্যাধ গীতা – https://bit.ly/2lg4qr6
শান্তি গীতা – https://bit.ly/2mfADix
রাম গীতা – https://bit.ly/2mk0ENP
পাণ্ডব গীতা – https://bit.ly/2mGbduy
অর্জুন গীতা – https://bit.ly/2kO386E
গৌড়ীয় গীতা – https://bit.ly/2lg9RGD
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (গীতা যথাযথ) (প্রভুপাদ) – https://bit.ly/2mOCTh3
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শক্তিবাদ ভাষ্য) – https://bit.ly/2lgzOWB
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (অধরচন্দ্র চক্রবর্তী) – https://bit.ly/2mJ5Iv7
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (আশুতোষ দাস) –https://bit.ly/2mNiclE
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কালীপ্রসন্ন সিংহ) – https://bit.ly/2mfMddv
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৃষ্ণানন্দ) – https://bit.ly/2mpB5dZ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কেদারনাথ দত্ত) – https://bit.ly/2mOmYPO
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৈলাসচন্দ্র) (শঙ্কর-আনন্দগিরি-শ্রীধর টিকা সহ) – https://bit.ly/2lgKJzq
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (গান্ধী ভাষ্য) – https://bit.ly/2kL2BCt
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (দেবেন্দ্র) – https://bit.ly/2mNqlGK
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (ধ্রুবানন্দ) – https://bit.ly/2mhtUVt
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (নবীনচন্দ্র সেন) – https://bit.ly/2mJODkM
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (নারায়ণ দাস) – https://bit.ly/2mkjww9
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রমথনাথ তর্কভূষণ) – https://cutt.ly/kw13H97
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রশন্নকুমার শাস্ত্রী) – https://cutt.ly/9w135zL
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (মথুরানাথ তর্করত্ন) – https://cutt.ly/mw18uZQ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (লক্ষ্মণ শাস্ত্রী) – https://cutt.ly/5w18zN9
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শশীধর তর্কচূড়ামনি) – https://cutt.ly/Rw18T9q
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর) – https://cutt.ly/Uw18NH7
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৃষ্ণাপ্রসন্ন সেন) – http://tiny.cc/0qsadz

ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া কি সম্ভব ?

{শ্রীমদ্‌ভাগবতের ন্যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও অবতারবাদ প্রচার করেন । সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম গীতাতেই অবতার-তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত ।  গীতায় [৪|৭-৯] ভগবান্‌ স্বয়ং বলিয়াছেন –
“যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের উত্থান হয় তখনই আমি অবতীর্ণ হই । সাধুরক্ষা, দুষ্টবিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরদেহ ধারণ করি ।”
অবতারে বিশ্বাস হইলে মুক্তিলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না । শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাই বলিতেন, “অবতারে বিশ্বাস পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ ।” মূঢ়গণই মনুষ্যতনুধারী ভগবানে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না । অবতারবাদেই ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত ।
অবতার মায়ামনুষ্য । তিনি মায়াধীশ; জীবের ন্যায় মায়াধীন নহেন । তিনি যেন দেহবান্‌ হন, যেন জাত হন । অবতার নরদেহধারী ভগবান্‌ । দেহধারণকালে তিনি তাঁহার ভাগবতস্বরূপ বিস্মৃত হন না । অবতার দেব-মানব, ‘নির্গুণ গুণময়’, ‘নিরঞ্জন নররূপধর’ ।
দেবত্ব ও মানবত্বের অপূর্ব মিলন অবতারে দৃষ্ট হয় । ভক্তিতে মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব প্রস্ফুটিত হয় । ঈশ্বর ও মানবের মিলনভূমি এই অবতার । অবতারকে দর্শন করিলেই ঈশ্বরদর্শন করা হয় । অবতারগণের জন্ম অলৌকিক; কারণ তাঁহারা জীবের ন্যায় কর্মাধীন নহেন । ঈশ্বরের নরলীলাই সর্বোত্তম । অবতারের লীলাস্মরণ, তাঁহার নামজপ ও তাঁহার মূর্তিধ্যানই ধর্মজীবনের প্রধান সাধন । এইজন্য ভগবান্‌ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইলেন ।
নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্ম কিরূপে সাকার ও সগুণ হন, কিরূপে রক্তমাংসের শরীরে আবির্ভূত হন – এই গভীর রহস্য দুর্ভেদ্য । অবতারকে আশ্রয় করিলে ধর্মসাধন সহজ হইয়া যায় । বিশ্বরূপ দর্শনান্তে শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনের ভগবদ্বুদ্ধি আসা মাত্র অর্জুনের মোহরাত্রি অতীত হইল । যীশুখ্রীষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস আসিতেই সল পলে পরিণত হইলেন । মানবের দেবত্ব এবং ভগবানের মানবত্ব প্রকটিত হয় অবতারবাদে । অবতারকে চিন্তা করিলেই ঈশ্বরকে চিন্তা করা হয় । বেদে অবতারবাদ ব্যক্ত হয় নাই । পরবর্তী যুগে ভক্তিধর্মের উৎপত্তির সঙ্গে অবতারবাদ উৎপন্ন হয় । পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মে উক্ত মত কোন-না-কোন প্রকারে বিকশিত হইয়াছে ।}

 যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?


ইহা অসম্ভব নহে । ইতিহাসে দৃষ্টান্ত আছে । রোমান সম্রাট্‌ মার্কাস্‌ অরেলিয়াস যে যুদ্ধে যাইয়া নিহত হন, সেই যুদ্ধে যাইবার পূর্বে তিনি তিন দিবস স্বীয় রাজধানীর বিদ্বদ্‌বর্গকে প্রাসাদে আহ্বানপূর্বক দর্শনালোচনা করিয়াছিলেন ।
কৃষ্ণের শৈশব সম্বন্ধে কতকগুলি বিশেষ অনৈসর্গিক কথা পুরাণে কথিত হইয়াছে। একে একে তাহার পরিচয় দিতেছি।
১। পূতনাবধ। পূতনা কংসপ্রেরিতা রাক্ষসী। সে পরমরূপবতীর বেশ ধারণ করিয়া নন্দালয়ে কৃষ্ণবধার্থ প্রবেশ করিল। তাহার স্তনে বিষ বিলেপিত ছিল। সে শ্রীকৃষ্ণকে স্তন্যপান করাইতে লাগিল। কৃষ্ণ তাহাকে এরূপ নিপীড়িত করিয়া স্তন্যপান করিলেন যে, পূতনার প্রাণ বহির্গত হইল। সে তখন নিজ রূপ ধারণ করিয়া ছয় ক্রোশ ভূমি ব্যাপিয়া নিপতিত হইল।

মহাভারতেও শিশুপালবধ-পর্বাধ্যায়ে পূতনাবধের প্রসঙ্গ আছে। শিশুপাল, পূতনাকে শকুনি বলিতেছেন। শকুনি বলিলে, গৃধ্র, চীল এবং শ্যামাপক্ষীকেও বুঝায়। বলবান্ শিশুর একটা ক্ষুদ্র পক্ষী বধ করা বিচিত্র নহে।
কিন্তু পূতনার আর একটা অর্থ আছে। আমরা যাহাকে “পেঁচোয় পাওয়া” বলি, সূতিকাগারস্থ শিশুর সেই রোগের নাম পূতনা। সকলেই জানে যে, শিশু বলের সহিত স্তন্যপান করিতে পারিলে এ রোগ আর থাকে না। বোধ হয়, ইহাই পূতনাবধ।

২। শকটবিপর্যয়। যশোদা, কৃষ্ণকে একখানা শকটের নীচে শুয়াইয়া রাখিয়াছিলেন। কৃষ্ণের পদাঘাতে শকট উল্টাইয়া পড়িয়াছিল। ঋগ্বেদসংহিতায় ইন্দ্রকৃত ঊষার শকটভঞ্জনের একটা কথা আছে। এই কৃষ্ণকৃত শকটভঞ্জন, সে প্রাচীন রূপকের নূতন সংস্কারমাত্র হইতে পারে। অনেকগুলি বৈদিক উপাখ্যান কৃষ্ণলীলান্তর্গত হইয়াছে, এমন বিবেচনা করিবার কারণ আছে।

৩। তাহার পর মাতৃক্রোড়ে কৃষ্ণের বিশ্বম্ভরমূর্তিধারণ, এবং স্বীয় ব্যাদিতানন-মধ্যে যশোদাকে বিশ্বরূপ দেখান। এটা প্রথম ভাগবতে দেখিতে পাই। ভাগবতকারেরই রচিত উপন্যাস বোধ হয়।
৪। তৃণাবর্ত। তৃণাবর্ত নামে অসুর কৃষ্ণকে একদা আকাশমার্গে তুলিয়া লইয়া গিয়াছিল। ইহার যেরূপ বর্ণনা দেখা যায়, তাহাতে বোধ হয়, ইহা চক্রবায়ু মাত্র। চক্রবায়ুর রূপ ধরিয়াই অসূর আসিয়াছিল, ভাগবতে এইরূপ কথিত হইয়াছে। এই উপাখ্যানও প্রথম ভাগবতেই দেখিতে পাই। সুতরাং ইহাও অমৌলিক সন্দেহ নাই। চক্রবায়ুতে ছেলে তুলিয়া ফেলাও বিচিত্র নহে।
৫। কৃষ্ণ একদা মৃত্তিকা ভোজন করিয়াছিলেন। কৃষ্ণ সে কথা অস্বীকার করায়, যশোদা তাঁহার মুখের ভিতর দেখিতে চাহিলেন। কৃষ্ণ হাঁ করিয়া বদনমধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখাইলেন। এটিও কেবল ভাগবতীয় উপন্যাস।

৬। ভাগবতকার আরও বলেন, কৃষ্ণ হাঁটিয়া বেড়াইতে শিখিলে তিনি গোপীদিগের গৃহে অত্যন্ত দৌরাত্ম্য করিতেন। অন্যান্য দৌরাত্ম্যমধ্যে, ননী মাখন চুরি করিয়া খাইতেন। বিষ্ণুপুরাণেও এ কথা নাই; মহাভারতেও নাই।
হরিবংশে ননী মাখন চুরির কথা প্রসঙ্গক্রমে আছে। ভাগবতেই ইহার বাড়াবাড়ি। যে শিশুর ধর্মাধর্মজ্ঞান জন্মিবার সময় হয় নাই, সে খাদ্য চুরি করিলে কোন দোষ হইল না। যদি বল যে, কৃষ্ণকে তোমরা ঈশ্বরাবতার বল; তাঁহার কোন বয়সেই জ্ঞানের অভাব থাকিতে পারে না। তাহার উত্তরে কৃষ্ণোপাসকেরা বলিতে পারেন যে, ঈশ্বরের চুরি নাই। জগতই যাঁহার—সব ঘৃত নবনীত মাখন যাঁহার সৃষ্ট—তিনি কার ধন লইয়া চোর হইলেন? সবই ত তাঁহার। আর যদি বল, তিনি মানবধর্মাবলম্বী-মানবধর্মে চুরি অবশ্য পাপ, তাহার উত্তর এই যে, মানবধর্মাবলম্বী শিশুর পাপ নাই, কেন না, শিশুর ধর্মাধর্ম জ্ঞান নাই। কিন্তু এ সকল বিচারে আমাদের কোন প্রয়োজনই নাই—কেন না, কথাটাই অমূলক। যদি মৌলিক কথা হয়, তবে ভাগবতকার, এ কথা যে ভাবে বলিয়াছেন, তাহা বড় মনোহর।

ভাগবতকার বলিয়াছেন যে, ননী মাখন ভগবান্ নিজের জন্য বড় চুরি করিতেন না; বানরদিগকে খাওয়াইতে না পাইলে শুইয়া পড়িয়া কাঁদিতেন। ভাগবতার বলিতে পারেন যে, কৃষ্ণ সর্বভূতে সমদর্শী; গোপীরা যথেষ্ট ক্ষীর নবনীত খায়,—বানরেরা পায় না, এজন্য গোপীদিগের লইয়া বানরদিগকে দেন। তিনি সর্বভূতের ঈশ্বর, গোপী ও বানর তাঁহার নিকট ননী মাখনের তুল্যাধিকারী।
এই শিশু সর্বজনের জন্য সহৃদয়তাপরবশ, সর্বজনের দুঃখমোচনে উদ্যুক্ত। তির্যকজাতি বানরদিগের জন্য তাঁহার কাতরতার ভাগবতকার এই পরিচয় দিয়াছেন। আর একটি দুঃখিনী ফলবিক্রেত্রীর কথা বলিয়াছেন। কৃষ্ণের নিকট সে ফল লইয়া আসিলে কৃষ্ণ অঞ্জলি ভরিয়া তাহাকে রত্ন দিলেন। কথাগুলির ভাগবত ব্যতীত প্রমাণ কিছু নাই; কিন্তু আমরা পরে দেখিব, পরহিতই কৃষ্ণের জীবনের ব্রত।
৭। যমলার্জুনভঙ্গ। একদা কৃষ্ণ বড় “দুরন্তপনা” করিয়াছিলেন বলিয়া, যশোদা তাঁহার পেটে দড়ি বাঁধিয়া, একটা উদূখলে বাঁধিয়া রাখিলেন। কৃষ্ণ উদূখল টানিয়া লইয়া চলিলেন। যমলার্জুন নামে দুইটা গাছ ছিল। কৃষ্ণ তাহার মধ্য দিয়া চলিলেন। উদূখল, গাছের মুলে বাধিয়া গেল। কৃষ্ণ তথাপি চলিলেন। গাছ দুইটা ভাঙ্গিয়া গেল।
এ কথা বিষ্ণুপুরাণে এবং মহাভারতের শিশুপালের তিরস্কারবাক্য আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি? অর্জুন বলে কুরচি গাছকে; যমলার্জুন অর্থে জোড়া কুরচি গাছ। কুরচি গাছ সচরাচর বড় হয় না, এবং অনেক গাছ ছোট দেখা যায়। যদি চারাগাছ হয়, তাহা হইলে বলবান্ শিশুর বলে ঐরূপ অবস্থায় তাহা ভাঙ্গিয়া যাইতে পারে।
কিন্তু ভাগবতকার পূর্বপ্রচলিত কথার উপর, অতিরঞ্জন চেষ্টা করিতে ত্রুটি করেন নাই। গাছ দুইটি কুবেরপুত্র; শাপনিবন্ধন গাছ হইয়াছিল, কৃষ্ণস্পর্শে মুক্ত হইয়া স্বধামে গমন করিল। কৃষ্ণকে বন্ধন করিবার কালে গোকুলে যত দড়ি ছিল, সব যোড়া দিয়াও কচি ছেলের পেট বাঁধা গেল না। শেষে কৃষ্ণ দয়া করিয়া বাঁধা দিলেন।
বিষ্ণুর একটি নাম দামোদর। বহিরিন্দ্রিয়নিগ্রহকে দম বলে। উদ্ উপর, ঋ গমনে, এজন্য উদর অর্থে উৎকৃষ্ট গতি। দমের দ্বারা যিনি উচ্চস্থান পাইয়াছেন, তিনিই দামোদর। বেদে আছে, বিষ্ণু তপস্যা করিয়া বিষ্ণুত্ব লাভ করিয়াছেন, নহিলে তিনি ইন্দ্রের কনিষ্ঠ মাত্র। শঙ্করাচার্য দামোদর শব্দের অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি বলেন, “দমাদিসাধনেন উদরা উৎকৃষ্টা গতির্যা তয়া গম্যত ইতি দামোদরঃ।” মহাভারতেও আছে, “দমাদ্দামোদরং বিদুঃ।”
কিন্তু দামন্ শব্দে গোরুর দড়িও বুঝায়। যাহার উদর গোরুর দড়িতে বাঁধা হইয়াছিল, সেও দামোদর। গোরুর দড়ির কথাটা উঠিবার আগে দামোদর নামটা প্রচলিত ছিল। নামটি পাইয়া ভাগবতকার দড়ি বাঁধার উপন্যাসটি গড়িয়াছেন, এই বোধ হয় না কি?
এক্ষণে নন্দাদি গোপগণ পূর্ববাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে চলিলেন। কৃষ্ণ নানাবিধ বিপদে পড়িয়াছিলেন, এইরূপ বিবেচনা করিয়াই তাঁহারা বৃন্দাবন গেলেন, এইরূপ পুরাণে লিখিত আছে। বৃন্দাবন অধিকতর সুখের স্থান, এ জন্যও হইতে পারে। হরিবংশে পাওয়া যায়, এই সময় ঘোষনিবাসে বড় বৃকের ভয় হইয়াছিল। গোপেরা তাই সেই স্থান ত্যাগ করিয়া গেল।
কৈশোর লীলা
এই বৃন্দাবন কাব্যজগতে অতুল্য সৃষ্টি। হরিৎপুষ্পশোভিত পুলিনশালিনী কলনাদিনী কালিন্দীকূলে কোকিল-ময়ূর-ধ্বনিত-কুঞ্জবনপরিপূর্ণা, গোপবালকগণের শৃঙ্গবেণুর মধুর রবে শব্দময়ী, অসংখ্যকুসুমামোদসুবাসিতা, নানাভরণভূষিতা, বিশালায়তলোচনা ব্রজসুন্দরীগণসমলঙ্কৃতা বৃন্দাবনস্থলী, স্মৃতিমাত্র হৃদয় উৎফুল্ল হয়। কিন্তু কাব্যরস আস্বাদন জন্য কালবিলম্ব করিবার আমাদের সময় নাই। আমরা আরও গুরুতর তত্ত্বের অন্বেষণে নিযুক্ত।
ভাগবতকার বলেন, বৃন্দাবনে আসার পর কৃষ্ণ ক্রমশঃ তিনটি অসূর বধ করিলেন,—(১) বৎসাসুর, (২) বকাসুর, (৩) অঘাসুর। প্রথমটি বৎসরূপী, দ্বিতীয়টি পক্ষিরূপী, তৃতীয়টি সর্পরূপী। বলবান্ বালক, ঐ সকল জন্তু গোপালগণের অনিষ্টকারী হইলে, তাহাদিগকে বধ করা বিচিত্র নহে। কিন্তু ইহার একটিরও কথা বিষ্ণুপুরাণে বা মহাভারতে, এমন কি, হরিবংশেও পাওয়া যায় না। সুতরাং অমৌলিক বলিয়া তিনটি অসুরের কথাই আমাদের পরিত্যাজ্য।

এই বৎসাসুর, বকাসুর এবং অঘাসুরবধোপাখ্যান মধ্যে সেরূপ তত্ত্ব খুঁজিলে না পাওয়া যায়, এমত নহে। বদ্ ধাতু হইতে বৎস; বন্‌ক্ ধাতু হইতে বক, এবং অঘ্ ধাতু হইতে অঘ। বদ ধাতু প্রকাশে, বন্‌ক্ কৌটিল্যে, এবং অঘ্ পাপে। যাহারা প্রকাশ্যবাদী বা নিন্দক, তাহারা বৎস, কুটিল শত্রুপক্ষ বক, পাপীরা অঘ। কৃষ্ণ অপ্রাপ্তকৈশোরেই এই ত্রিবিধ শত্রু-পরাস্ত করিলেন। যজুর্বেদের মাধ্যন্দিনী শাখার একাদশ অধ্যায়ে অগ্নিচয়নমন্ত্রের ৮০ কণ্ডিকায় যে মন্ত্র, তাহাতে এইরূপ শত্রুদিগের নিপাতনের প্রার্থনা দেখা যায়। মন্ত্রটি এই;—

“হে অগ্নে! যাহারা আমাদের অরাতি, যাহারা দ্বেষী, যাহারা নিন্দক এবং যাহারা জিঘাংসু, এই চারি প্রকার শত্রুকেই ভস্মসাৎ কর।”[1]
এই মন্ত্রের বেশির ভাগ অরাতি অর্থাৎ যাহারা ধন দেয় না (ভাষায় জুয়াচোর), তাহাদের নিপাতেরও কথা আছে। কিন্তু ভাগবতকার এই রূপক রচনাকালে এই মন্ত্রটি যে স্মরণ করিয়াছিলেন, এমত বোধ হয়। অথবা ইহা বলিলেই যথেষ্ট হয় যে, ঐ রূপকের মূল ঐ মন্ত্রে আছে।

তার পর ভাগবতে আছে যে, ব্রহ্মা, কৃষ্ণকে পরীক্ষা করিবার জন্য একদা মায়ার দ্বারা সমস্ত গোপাল ও গোবৎসগণকে হরণ করিলেন। কৃষ্ণ আর এক সেট্ রাখাল ও গোবৎসের সৃষ্টি করিয়া পূর্ববৎ বিহার করিতে লাগিলেন। কথাটার তাৎপর্য এই যে, ব্রহ্মাও কৃষ্ণের মহিমা বুঝিতে অক্ষম। তার পর একদিন, কৃষ্ণ দাবানলের আগুন সকলই পান করিলেন। শৈবদিগের নীলকণ্ঠের বিষপানের উপন্যাস আছে। বৈষ্ণবচূড়ামণি তাঁহার উত্তরে কৃষ্ণের অগ্নিপানের কথা বলিলেন।
এই বিখ্যাত কালিয়দমনের কথা বলিবার স্থান। কালিয়দমনের কথাপ্রসঙ্গমাত্র মহাভারতে নাই। হরিবংশে ও বিষ্ণুপুরাণে আছে। ভাগবতে বিশিষ্টরূপে সম্প্রসারিত হইয়াছে। এই উপন্যাসমাত্র—অনৈসর্গিকতায় পরিপূর্ণ। কেবল উপন্যাস নহে—রূপক। রূপকও অতি মনোহর।
উপন্যাসটি এই। যমুনার এক হ্রদে বা আবর্তে কালিয় নামে এক বিষধর সর্প সপরিবারে বাস করিত। তাহার বহু ফণা। বিষ্ণুপুরাণের মতে তিনটি,[2] হরিবংশের মতে পাঁচটি, ভাগবতে সহস্র। তাহার অনেক স্ত্রী পুত্র পৌত্র ছিল। তাহাদিগের বিষে সেই আবর্তের জল এমন বিষময় হইয়া উঠিয়াছিল যে, তজ্জন্য নিকটে কেহ তিষ্ঠিতে পারিত না। অনেক ব্রজবালক ও গোবৎস সেই জল পান করিয়া প্রাণ হারাইত। সেই বিষের জ্বালায়, তীরে কোন তৃণলতা বৃক্ষাদিও বাঁচিত না। পক্ষিগণও সেই আবর্তের উপর দিয়া উড়িয়া গেলে বিষে জর্জরিত হইয়া জলমধ্যে পতিত হইত। এই মহাসর্পের দমন করিযা বৃন্দাবনস্থ জীবগণের রক্ষাবিধান, শ্রীকৃষ্ণের অভিপ্রেত হইল। তিনি উল্লম্ফনপূর্বক হ্রদমধ্যে নিপতিত হইলেন। কালিয় তাঁহাকে আক্রমণ করিল। তাহার ফণার উপর আরোহণ করিয়া বংশীধর গোপবালক নৃত্য করিতে লাগিলেন। ভুজঙ্গ সেই নৃত্যে নিপীড়িত হইয়া রুধিরবমনপূর্বক মুমূর্ষু হইল।

তখন তাহার বনিতাগণ কৃষ্ণকে মনুষ্যভাষায় স্তব করিতে লাগিল। ভাগবতকার তাহাদিগের মুখে যে স্তব বসাইয়াছেন, তাহা পাঠ করিয়া ভুজঙ্গমাঙ্গনাগণকে দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা বলিয়া বোধ হয়। বিষ্ণুপুরাণে তাহাদিগের মুখনির্গত স্তব বড় মধুর; পড়িয়া বোধ হয়, মনুষ্যপত্নীগণকে কেহ গরলোদ্গারিণী মনে করেন করুন, নাগপত্নীগণ সুধাবর্ষিণী বটে। শেষে কালিয় নিজেও কৃষ্ণস্তুতি আরম্ভ করিল। শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হইয়া কালিয়কে পরিত্যাগ করিয়া যমুনা পরিত্যাগপূর্বক সমুদ্রে গিয়া বাস করিতে তাহাকে আদেশ করিলেন। কালিয় সপরিবারে পলাইল। যমুনা প্রসন্নসলিলা হইলেন।
এই গেল উপন্যাস। ইহার ভিতর যে রূপক আছে, তাহা এই। এই কলবাহিনী কৃষ্ণসলিলা কালিন্দী অন্ধকারময়ী ঘোরনাদিনী কালস্রোতস্বতী। ইহার অতি ভয়ঙ্কর আবর্ত আছে। আমরা যে সকলকে দুঃসময় বা বিপৎকাল মনে করি, তাহাই কালস্রোতের আবর্ত। অতি ভীষণ বিষময় মনুষ্যশত্রু সকল এখানে লুক্কায়িত ভাবে বাস করে। ভুজঙ্গের ন্যায় তাহাদের নিভৃত বাস, ভুজঙ্গের ন্যায় তাহাদের কুটিল গতি, এবং ভুজঙ্গের ন্যায় অমোঘ বিষ। আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক, এবং আধিদৈবিক, এই ত্রিবিধবিশেষে এই ভুজঙ্গের তিন ফণা। আর যদি মনে করা যায় যে, আমাদের ইন্দ্রিয়রতিই সকল অনর্থের মূল, তাহা হইলে, পঞ্চেন্দ্রিয়ভেদে ইহার পাঁচটি ফণা, এবং আমাদের অমঙ্গলের অসংখ্য কারণ আছে, ইহা ভাবিলে, ইহার সহস্র ফণা। আমরা ঘোর বিপদাবর্তে এই ভুজঙ্গমের বশীভূত হইলে জগদীশ্বরের পাদপদ্ম ব্যতীত, আমাদের উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই। কৃপাপরবশ হইলে তিনি এই বিষধরকে পদদলিত করিয়া মনোহর মূর্তিবিকাশপূর্বক অভয়বংশী বাদন করেন, শুনিতে পাইলে জীব আশান্বিত হইয়া সুখে সংসারযাত্রা নির্বাহ করে। করালনাদিনি কালতরঙ্গিণী প্রসন্নসলিলা হয়। এই কৃষ্ণসলিলা ভীমনাদিনী কালস্রোতস্বতীর আবর্তমধ্যে অমঙ্গলভুজঙ্গমের মস্তকারূঢ় এই অভয়বংশীধর মূর্তি, পুরাণকারের অপূর্ব সৃষ্টি! যে গড়িয়া পূজা করিবে কে তাহাকে পৌত্তলিক বলিয়া উপহাস করিতে সাহস করিবে?

আমরা ধেনুকাসুর (গর্দভ) এবং প্রলম্বাসুরের বধবৃত্তান্ত কিছু বলিব না, কেন না, উহা বলরামকৃত—কৃষ্ণকৃত নহে। বস্ত্রহরণ সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য, তাহা আমরা অন্য পরিচ্ছেদে বলিব, এখন কেবল গিরিযজ্ঞবৃত্তান্ত বলিয়া এ পরিচ্ছেদের উপসংহার করিব।
বৃন্দাবনে গোবর্ধন নামে এক পর্বত ছিল, এখনও আছে। গোঁসাই ঠাকুরেরা এক্ষণে যেখানে বৃন্দাবন স্থাপিত করিয়াছেন, সে এক দেশে, আর গিরিগোবর্ধন আর এক দেশে। কিন্তু পুরাণাদিতে পড়ি, উহা বৃন্দাবনের সীমান্তস্থিত। ঐ পর্বত এক্ষণে যে ভাবে আছে, তাহা দেখিয়া বোধ হয় যে উহা কোন কালে, কোন প্রাকৃতিক বিপ্লবে উৎক্ষিপ্ত হইয়া পুনঃস্থাপিত হইয়াছিল। বোধ হয়, অনেক সহস্র বৎসর ঐ ক্ষুদ্র পর্বত ঐ অবস্থাতেই আছে, এবং ইহার উপর সংস্থাপিত হইয়া উপন্যাস রচিত হইয়াছে যে, শ্রীকৃষ্ণ ঐ গিরি তুলিয়া সপ্তাহ ধারণ করিয়া পুনর্বার সংস্থাপিত করিয়াছিলেন।
উপন্যাসটা এই। বর্ষান্তে নন্দাদি গোপগণ বৎসর বৎসর একটা ইন্দ্রযজ্ঞ করিতেন। তাহার আয়োজন হইতেছিল। দেখিয়া কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন যে, কেন ইহা হইতেছে? তাহাতে নন্দ বলিলেন, ইন্দ্র বৃষ্টি করেন, বৃষ্টিতে শস্য জন্মে, শস্য খাইয়া আমরা ও গোপগণ জীবনধারণ করি, এবং গোসকল দুগ্ধবতী হয়। অতএব ইন্দ্রের পূজা করা কর্তব্য। কৃষ্ণ বলিলেন, আমরা কৃষী নহি। গাভীগণই আমাদের অবলম্বন, অতএব গাভীগণের পূজা, অর্থাৎ তাহাদিগকে উত্তম ভোজন করানই আমাদের বিধেয়। আর আমরা এই গিরির আশ্রিত, ইহার পূজা করুন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষুধার্তগণকে উত্তমরূপে ভোজন করান। তাহাই হইল। অনেক দীনদরিদ্র ক্ষুধার্ত এবং ব্রাহ্মণগণ (তাঁহারা দরিদ্রের মধ্যে) ভোজন করিলেন। গাভীগণ খুব খাইল। গোবর্ধনও মূর্তিমান্ হইয়া রাশি রাশি অন্নব্যঞ্জন খাইলেন। কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ নিজেই এই মূর্তিমান্ গিরি সাজিয়া খাইয়াছিলেন।

ইন্দ্রযজ্ঞ হইল না। এখন পাঠক জানিতে পারেন যে, আমাদিগের পুরাণেতিহাসোক্ত দেবতা ও ব্রাহ্মণ সকল ভারী বদ্‌রাগী। ইন্দ্র বড় রাগ করিলেন। মেঘগণকে আজ্ঞা দিলেন, বৃষ্টি করিয়া বৃন্দাবন ভাসাইয়া দাও। মেঘসকল তাহাই করিল। বৃন্দাবন ভাসিয়া যায়। গোবৎস ও ব্রজবাসিগণের দুঃখের আর সীমা রহিল না। তখন শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন উপাড়িয়া বৃন্দাবনের উপর ধরিলেন। সপ্তাহ বৃষ্টি হইল, সপ্তাহ তিনি পর্বত এক হাতে তুলিয়া ধরিয়া রাখিলেন। বৃন্দাবন রক্ষা পাইল। ইন্দ্র হার মানিয়া, কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ ও সন্ধি স্থাপন করিলেন।
মহাভারতে শিশুপালবাক্যে এই গিরিযজ্ঞের কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ আছে। শিশুপাল বলিতেছে যে, কৃষ্ণ যে বল্মীকতুল্য গোবর্ধন ধারণ করিয়াছিল, তাই কি একটা বিচিত্র কথা? কৃষ্ণের প্রভূত অন্নব্যঞ্জনভোজন সম্বন্ধেও একটু ব্যঙ্গ আছে। এই পর্যন্ত। কিন্তু গোবর্ধন আজিও বিদ্যমান,—বল্মীক নয়, পর্বত বটে। কৃষ্ণ কি এই পর্বত সাত দিন এক হাতে ধরিয়া রাখিয়াছিলেন? যাঁহারা তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলেন, তাঁহারা বলিতে পারেন ঈশ্বরের অসাধ্য কি? স্বীকার করি—কিন্তু সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসাও করি, ঈশ্বরাবতারের পর্বতধারণের প্রয়োজন কি? যাঁহার ইচ্ছা ব্যতীত মেঘ এক ফোঁটাও বৃষ্টি করিতে সমর্থ হয় না, সাত দিন পাহাড় ধরিয়া বৃষ্টি হইতে বৃন্দাবন রক্ষা করিবার তাঁহার প্রয়োজন কি? যাঁহার ইচ্ছামাত্রে সমস্ত মেঘ বিদূরিত, বৃষ্টি উপশান্ত, এবং আকাশ নির্মল হইতে পারিত, তাঁহার পর্বত তুলিয়া ধরিয়া সাত দিন খাড়া থাকিবার প্রয়োজন কি?

ইহার উত্তরে কেহ বলিতে পারেন, ইহা ভগবানের লীলা। ইচ্ছময়ের ইচ্ছা, আমরা ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝিব কি? ইহাও সত্য, কিন্তু আগে বুঝিব যে, ইনি ভগবান্, তাহার পর গিরিধারণ তাঁহার ইচ্ছাবিস্তারিত লীলা বলিয়া স্বীকার করিব। এখন, ইনি ভগবান্ ইহা বুঝিব কি প্রকারে? ইঁহার কার্য দেখিয়া। যে কার্যের অভিপ্রায় বা সুসঙ্গতি বুঝিতে পারিলাম না, সেই কার্যের কর্তা ঈশ্বর, এরূপ সিদ্ধান্ত করিতে পারা যায় কি? না বুঝিয়া কোন সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া যায় কি? যদি তাহা না যায়, তবে অনৈসর্গিক পরিত্যাগের যে নিয়ম আমরা সংস্থাপন করিয়াছি, তাহারই অনুবর্তী হইয়া এই গিরিধারণবৃত্তান্তও উপন্যাসমধ্যে গণনা করাই বিধেয়। তবে এতটুকু সত্য থাকিতে পারে যে, কৃষ্ণ গোপগণকে ইন্দ্রযজ্ঞ হইতে বিরত করিয়া গিরিযজ্ঞে প্রবৃত্ত করিয়াছিলেন। তার পর বাকি অনৈসর্গিক ব্যাপারটা গোবর্ধনের উৎখাত ও পুনঃস্থাপিত অবস্থা অনুসারে গঠিত হইয়াছে।
এরূপ কার্যের একটা নিগূঢ় তাৎপর্যও দেখা যায়। যেমন বুঝিয়াছি, তেমনই বুঝাইতেছি।
এই জগতের একই ঈশ্বর। ঈশ্বর ভিন্ন দেবতা নাই। ইন্দ্র বলিয়া কোন দেবতা নাই। ইন্দ্ ধাতু বর্ষণে, তাহার পর রক্ প্রত্যয় করিলে ইন্দ্র শব্দ পাওয়া যায়। অর্থ হইল যিনি বর্ষণ করেন। বর্ষণ করে কে? যিনি সর্বকর্তা, সর্বত্র বিধাতা, তিনিই বৃষ্টি করেন,—বৃষ্টির জন্য একজন পৃথক্ বিধাতা কল্পনা করা বা বিশ্বাস করা যায় না। তবে ইন্দ্রের জন্য যজ্ঞ বা সাধারণ যজ্ঞে ইন্দ্রের ভাগ প্রচলিত ছিল বটে। এরূপ ইন্দ্রপূজার একটা অর্থও আছে। ঈশ্বর অনন্ত প্রকৃতি, তাঁহার গুণ ভাগ প্রচলিত ছিল বটে। এরূপ ইন্দ্রপূজার একটা অর্থও আছে। ঈশ্বর অনন্ত প্রকৃতি, তাঁহার গুণ সকল অনন্ত, কার্য অনন্ত, শক্তি সকলও সংখ্যায় অনন্ত। এরূপ অনন্তের উপাসনা কি প্রকারে করিব? অনন্তের ধ্যান হয় কি? যাহাদের হয় না, তাহারা তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন শক্তির পৃথক্ পৃথক্ উপাসনা করে। এরূপ শক্তি সকলের বিকাশস্থল জড়জগতে বড় জাজ্বল্যমান। সকল জড়পদার্থে তাঁহার শক্তির পরিচয় পাই। তৎ-সাহায্যে অনন্তের ধ্যান সুসাধ্য হয়। এই জন্য প্রাচীন আর্যগণ তাঁহার জগৎপ্রসবিতৃত্ব স্মরণ করিয়া সূর্যে, তাঁহার সর্বাবরকতা স্মরণ করিয়া বরুণে, তাঁহার সর্বতেজের আধারভূতি স্মরণ করিয়া অগ্নিতে, তাঁহাকে জগৎপ্রাণ স্মরণ করিয়া বায়ুতে, এবং তদ্রূপে অন্যান্য জড়পদার্থে তাঁহার আরাধনা করিতেন।[3] ইন্দ্রে এইরূপ তাঁহার বর্ষণকারিণী শক্তির উপাসনা করিতেন। কালে, লোকে উপাসনার অর্থ ভুলিয়া গেল, কিন্তু উপাসনার আকারটা বলবান্ রহিল। কালে এইরূপই ঘটিয়া থাকে; ব্রাহ্মণের ত্রিসন্ধ্যা সম্বন্ধে তাহাই ঘটিয়াছে; ভগবদ্‌গীতায় এবং মহাভারতের অন্যত্র দেখিব যে, কৃষ্ণ ধর্মের এই মৃতদেহের সৎকারে প্রবৃত্ত—তৎপরিবর্তে অতি উচ্চ ঈশ্বরোপাসনাতে লোককে প্রবৃত্ত করিতে যত্নবান্। যাহা পরিণত বয়সে প্রচারিত করিয়াছিলেন, এই গিরিযজ্ঞে তাহার প্রবর্তনায় তাঁহার প্রথম উদ্যম। জগদীশ্বর সর্বভূতে আছেন; মেঘেও যেমন আছেন, পর্বতে ও গোবৎসেও সেইরূপ আছেন। যদি মেঘের বা আকাশের পূজা করিলে তাঁহার পূজা করা হয়, তবে পর্বত বা গোগণের পূজা করিলেও তাঁহারই পূজা করা হইবে। বরং আকাশাদি জড়পদার্থের পূজা অপেক্ষা দরিদ্রদিগের এবং গোবৎসের সপরিতোষ ভোজন করান অধিকতর ধর্মানুমত। গিরিযজ্ঞের তাৎপর্যটা এইরূপ বুঝি।

—————-
1 সামশ্রমীকৃত অনুবাদ।
2 “মধ্যমং ফণং” ইহাতে তিনটি বুঝায়।
3 যখন আমি প্রথম “প্রচার” নামক পত্রে এই মত প্রকাশিত করি, তখন অনেকে কথা বলিয়াছিলেন। অনেকে ভাবিয়াছিলেন, আমি একটা নূতন মত প্রচার করিতেছি। তাঁহারা জানেন না যে, এ আমার মত নহে, স্বয়ং নিরুক্তকার যাস্কের মত। আমি যাস্কের বাক্য নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি-
“মাহাত্ম্যাদ্ দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তৃয়তে। একস্যাত্মনোহন্যে দেবাঃ প্রত্যঙ্গানি ভবন্তি। * * আত্মা এব এষাং রথো ভবতি, আত্মা অশ্বাঃ, আয়ুধম্, আত্মা ইষবঃ, আত্মা সর্বদেবস্য।”

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ