চার্বাক দর্শন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 August, 2020

চার্বাক দর্শন

চার্বাক দর্শনের মূল গ্রন্থ এখনো পাওয়া যায়নি বলে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে, এ সম্পর্কে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে চার্বাক এক ঋষি ছিলেন ; তিনিই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। আবার কারো মতে চর্ব ধাতু থেকেই চার্বাক শব্দটির উৎপত্তি। চর্ব ধাতুর অর্থ চর্বণ বা খাওয়া । এই দর্শন খাওয়া দাওয়াকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করে । তাই এ দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন । আর একদলের মতে চা্বাক শব্দের অর্থ চারু+বাক্ , অর্থাৎ মধুর কথা ।
নাস্তিকতা
আবার কারো মতে অসুরগনকে ধ্বংস করবার জন্য লোক-পুত্র বৃহস্পতি অসুরদের মধ্যে এই ভোগমূলক বা জড়বাদী দর্শনের প্রচলন করেছিলেন । চার্বাক শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন বা যিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা হোক না কেন চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায় । সাধারন মানুষের কাম্য হলো জাগতিক সুখভোগ , এই দর্শনের মতেও জীবনের চরম লক্ষ্য সুখভোগ । সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাধারন লোকের চিন্তা ও ভাবধারা এই দর্শন তুলে ধরেছে । এ কারনে এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন ।মৈত্রায়ণীয় ও ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাকালেই চার্বাক মতবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।চার্বাক গোষ্ঠীর নিজস্ব রচনা হিসেবে জয়রাশি ভট্টের আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত তত্ত্বোপপ্লবসিংহ নামক একটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কারণে চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে অধিকাংশ তত্ত্বের উৎস হিসেবে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থের চার্বাকী মতবাদের বিরুদ্ধ সমালোচনাগুলোরই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ন্যায় দার্শনিক জয় ভট্টের নবম শতাব্দীতে রচিত ন্যায়মঞ্জরী, বৌদ্ধ পন্ডিত শান্তরক্ষিতের ও অষ্টম শতাব্দীতে রচিত তত্ত্বসংগ্রহ। ভারতীয় দর্শনের যে সকল সঙ্কলন গ্রন্থ চার্বাক দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অষ্টম শতাব্দীতে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ষড়দর্শনসমুচ্চয়, চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত মাধবাচার্যের "সর্বদর্শনসমগ্র" ও শঙ্করাচার্যের রচনা বলে পরিচিত সর্বদর্শনসিদ্ধান্তসংগ্রহ।চার্বাক গোষ্ঠীর নিজস্ব রচনা হিসেবে জয়রাশি ভট্টের আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত তত্ত্বোপপ্লবসিংহ নামক একটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। 
চার্বাক নামের উৎস
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে বস্তুবাদী দর্শনটির নজির যত প্রাচীনই হোক-না কেন, এ মতবাদের চার্বাক নামকরণ সে তুলনায় অর্বাচীন। অষ্টম-নবম শতকের আগে দর্শন সাহিত্যে এ নামের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন চোখে পড়ে না। প্রাচীনেরা এ মতটিকে প্রধানত লোকায়ত নামেই উল্লেখ করেছেন। ওই অষ্টম-নবম শতক থেকেই বস্তুবাদী অর্থে লোকায়ত বা চার্বাক মতের সমালোচনায় বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় বিভিন্ন মতের দার্শনিকগণকে। এদের মধ্যে নবম শতকের ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্ট প্রধানতম। অন্যরা হলেন অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় শান্তরক্ষিত ও কমলশীল এবং জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী।
 .
লোকায়ত নামে চার্বাক মতের প্রাচীনতম অন্তর্ভুক্তির নিদর্শন হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য হলেও বস্তুবাদ অর্থে চার্বাক শব্দের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত। কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তাঁর গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের নামও উল্লেখ করেছেন। চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে এই পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের কথা আদৌ জানা যায় না।
 .
চার্বাক মতের প্রধানতম সমালোচক নবম শতকের ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত প্রতিনিধি জয়ন্ত ভট্ট। জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্য যেমন প্রগাঢ়, যুক্তি ও বিচার যেমন প্রখর, তেমনি তাঁর আশ্চর্য লেখার কায়দা বা রচনা কৌশলের বন্যায় যেন বিপক্ষমতকে একেবারে ভাসিয়ে নেবার মতো। স্বীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি তাঁর রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে অন্যতম বিপক্ষ মত খণ্ডনে চরম বস্তুবাদী মত বোঝাতে সুস্পষ্টভাবে চার্বাক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবং তার সঙ্গে রকমারি বিশেষণ যোগ করে মতটি নিয়ে তিনি হাসি-তামাশা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতেও পিছপা হননি। কোথাও তিনি চার্বাককে হাবাগোবা অর্থে ‘বরাক’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ’ উদ্ধৃতি দিয়ে, কোথাও বা চার্বাককে তুখোড় প্রতারক অর্থে ‘ধূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কোথাও ‘সুশিতিতরাঃ’ বিশেষণও ব্যবহার করেছেন। জয়ন্ত ভট্টের এরকম বিচিত্র বিশেষণ ব্যবহার থেকে ঐতিহাসিকেরা চার্বাকদের বিভিন্ন প্রাচীন গোষ্ঠির উপস্থিতির অনুমানও করে থাকেন। তবে একাধিক গোষ্ঠি থাকলেও জয়ন্ত ভট্টের লেখায় চার্বাক শব্দ চরম বস্তুবাদেরই নিদর্শক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
 .
খ্রীস্টিয় অষ্টম শতকে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ নামকরণেই বোঝা যায় সেকালের ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে জৈন মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই এর উদ্দেশ্য। সেকালের প্রখ্যাত ছটি দার্শনিক মতের অন্যতম ছিলো বস্তুবাদী লোকায়ত মত। হরিভদ্র কোথাও চার্বাক শব্দটি উল্লেখ না-করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে চার্বাক এবং লোকায়ত অভিন্ন। এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন রচনা করেন বিখ্যাত  ‘তর্করহস্যদীপিকা’ টীকাগ্রন্থটি। এটারও উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য দার্শনিক মত আরো বিশদভাবে বিচার করে জৈন মতই সবচাইতে সেরা এরূপ সিদ্ধান্ত করা। এই অন্যান্য মতের অন্যতম চরম বস্তুবাদেরও বিস্তৃত বিচার করা হয় এ গ্রন্থে এবং গুণরত্নের রচনায় এই বস্তুবাদ চার্বাক নামেই অভিহিত হয়েছে।
একইভাবে বেদব্যস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্র’-র প্রখ্যাত ভাষ্যকার রামানুজ একাদশ শতকে তাঁর রচিত ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে চার্বাক নামেই অভিহিত করেছেন।
 .
তবে বিভিন্ন দার্শনিক মতের পর্যালোচনা হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি হলো চতুর্দশ শতকের অদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনকার সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। অদ্বৈত বেদান্তই যে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মত- এটি প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই সেকালে প্রচলিত আরো পনেরোটি দার্শনিক মত বিচারমূলকভাবে খণ্ডন করার বিস্তৃত প্রয়াস এই গ্রন্থ। এ লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম যে মতটি খণ্ডন করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন তা হলো বস্তুবাদী দর্শন। এবং মাধবাচার্য তাকে চার্বাক নামেই উল্লেখ করেছেন। এজন্যেই তাঁর গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘চার্বাক-দর্শনম’।
 .
চার্বাক বলতে যে এক প্রখর বস্তুবাদী দর্শনই বোঝায়- এ ধারণাই হয়তো পরবর্তীকালের ভারতীয় সাহিত্যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এমন কি দার্শনিক সাহিত্য পেরিয়ে এই ধারণার প্রভাব যে নাট্যসাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণমিশ্র রচিত রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’। এ নাটকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতীক চরিত্রটির নাম ‘চার্বাক’।
 .
চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। ‘নয়তে চার্বী লোকায়তে’ এই কাশিকাবৃত্তিতে জানা যায় যে, লোকায়ত শাস্ত্রে চার্বী নামক আচার্য পদার্থের ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, বৃহষ্পতির শিষ্য চার্বাক নামে কোন একজন প্রাচীন ঋষি এই দর্শনের সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করেছেন। আবার কারো মতে চারু হচ্ছে বৃহষ্পতির নাম। তাঁর উপদেশরূপ বাক্যকে অনুসরণ করায় চার্বাক নাম হয়েছে। এছাড়াও চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে চার্বাক শব্দটির আরো দু’রকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টাও চোখে পড়ে। যেমন, প্রথমতঃ কারো মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) ধাতু থেকে চার্বাক শব্দটি নিষ্পন্ন। এই দর্শনে মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘খাও, পান করো ও আনন্দ করো’, খাওয়া-পান করাকে অত্যধিক জোর দেওয়ায় এই দর্শনকে চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয়তঃ কারো মতে ‘চারু বাক্’ থেকে চার্বাক। ‘চারু (সুন্দর, মিষ্ট) বাক্ (বচন, বাক্য) যার’ এই বিগ্রহে বহুব্রীহি সমাসে ‘চার্বাক’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। কেননা অদৃষ্ট অপেক্ষা দৃষ্ট সুখের জন্য বা দৃষ্ট দুঃখের নিবৃত্তির জন্য প্রাণিকূল সাধারণত প্রবৃত্ত হয়। স্বর্গসুখ প্রাপ্তির জন্য খুব কম ব্যক্তিই যজ্ঞাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। তেমনি নরকদুঃখ ভয়ে খুব কম লোকই পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়। সেকারণে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কারো কথা শুনে যা অনায়াসে চারুরূপে (=মধুরভাবে) গৃহীত হয় তা হচ্ছে লোকায়ত চার্বাক। প্রতিপক্ষের কটাক্ষ বা বিদ্রূপ থেকেই এই মানে তৈরির প্রবণতা লক্ষ্যণীয় বলে কারো কারো ধারণা। কেননা ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে কোনটাই টেকে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত।
 .
খ্রীস্টিয় সপ্তম বা তার পরবর্তীকালে ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনে প্রখর জড়বাদী মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ‘চার্বাক’ শব্দটি সুপরিচিতি লাভ করলেও প্রাচীন সাহিত্যে এ শব্দটি একেবারেই নিরব। বিশিষ্ট চিন্তাধারাকে স্বনামে পরিচিত করার উপযোগী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন চার্বাকের অস্তিত্বের সমর্থনে কোন তথ্যের একান্তই অভাব বলে চার্বাক নামটির উৎস নিয়ে একটা অনুন্মোচিত রহস্যের জট থেকেই যায়। তবে প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্মানুশাসন প্রসঙ্গে চার্বাক নামে এক রাক্ষসের উপাখ্যান আছে (মহাভারত : ১২/৩৮/২২-৩৬)। ‘সাক্ষ্য, শিখী এবং ত্রিদণ্ডী’ ব্রাহ্মণরূপী এ রাক্ষস চার্বাক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পরম শত্র“ দুর্যোধনের সখা এবং প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যমতের তীব্র সমালোচক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতকে আমরা বর্তমানে যে আকারে পাই তার রচনাকালের পূর্ব সীমা খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ এবং শেষ সীমা খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক বলে সাধারণত ধরে নেয়া হয়। আর মহাভারতের এই অংশের রচনাকাল আনুমানিক খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক। চার্বাক দর্শনের ইতিহাস বা চার্বাকের উৎস খুঁজতে গিয়ে আগ্রহী গবেষকদের দৃষ্টি মহাভারতের এই উপাখ্যানের দিকেই আকর্ষিত হয় স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এখানে জড়বাদ বা নাস্তিক্যবাদ সম্বন্ধে কোন কথা নেই। বরং যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় এই চার্বাকের স্বল্পস্থায়ী উপস্থিতি রাজা যুধিষ্ঠিরকে অপমান করতেই ব্যয়িত হয়েছে, যার পরিণামে সভায় ক্রমাগত ব্রাহ্মণদের রোষাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মহাভারতের উপাখ্যানটি এরকম-
‘পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে সহস্র সহস্র পুরবাসী-প্রজা দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া তথায় আগমন করিতে লাগিল। …ঐ সময় সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ পূর্বক অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না-করিয়াই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্বিতবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন পূর্বক কহিল,-
.
চার্ব্বাক উবাচ।
ইমে প্রাহুর্দ্বিজাঃ সর্ব্বে সমারোপ্য বচো ময়ি।
ধিগ্ভবন্তং কু-নৃপতিং জ্ঞাতিঘাতিনমস্তু বৈ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৬)
কিং তে রাজ্যেন কৌন্তেয় ! কৃত্বেমং জ্ঞাতিসঙ্ক্ষয়ম্ ।
ঘাতয়িত্বা গুরূংশ্চৈব মৃতং শ্রেয়ো ন জীবিতম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৭)
ইতি তে বৈ দ্বিজাঃ শ্র“ত্বা তস্য দুষ্টস্য রক্ষসঃ।
বিব্যথুশ্চু ক্রুশুশ্চৈব তস্য বাক্যপ্রধর্ষিতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৮)
ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে স চ রাজা যুধিষ্ঠিরঃ।
ব্রীড়িতাঃ পরমোদ্বিগ্নাস্তুষ্ণীমাসন্ বিশাংপতে!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৯)।
যুধিষ্ঠির উবাচ।
প্রসীদন্তু ভবন্তো মে প্রণতস্যাভিযাচতঃ।
প্রত্যাসন্নব্যসনিনং ন মাং ধিক্কর্ত্তুমর্হথ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩০)
ততো রাজন্ ! ব্রাহ্মণাস্তে সর্ব্ব এব বিশাংপতে!।
ঊচুর্নৈষ দ্বিজোহস্মাকং শ্রীরস্তু তব পার্থিব!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩১)
জজ্ঞুশ্চৈব মহাত্মানস্ততস্তং জ্ঞানচক্ষুষা।
ব্রাহ্মণা বেদবিদ্বাংসস্তপোভির্বিমলীকৃতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩২)।
ব্রাহ্মণা ঊচুঃ।
এষ দুর্য্যোধনসখা চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।
পরিব্রাজকরূপেণ হিতং তস্য চিকীর্ষতি।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৩)
ন বয়ং ব্রূম ধর্ম্মাত্মন্ ! ব্যেতু তে ভয়মীদৃশম্ ।
উপতিষ্ঠতু কল্যাণং ভবন্তং ভ্রাতৃভিঃ সহ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৪)
ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে হুঙ্কারৈঃ ক্রোধমূর্চ্ছিতাঃ।
নির্ভর্ৎসয়ন্তঃ শুচয়ো নিজঘ্নুঃ পাপরাক্ষসম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৫)
স পপাত বিনির্দগ্ধস্তেজসা ব্রহ্মবাদিনাম্ ।
মহেন্দ্রাশনিনির্দগ্ধঃ পাদপোহঙ্কুরবানিব।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৬)
পূজিতাশ্চ যযুর্বিপ্রা রাজানমভিনন্দ্য তম্ ।
রাজা চ হর্ষমাপেদে পাণ্ডবঃ সসুহৃজ্জনঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৭)
.
অর্থাৎ :
চার্ব্বাক বলিল- ‘পাণ্ডুনন্দন! এই ব্রাহ্মণেরা সকলে আমার উপরে বাক্য স্থাপিত করিয়া বলিতেছেন, (আমার মুখে বলিতেছেন)- ‘আপনি জ্ঞাতিহত্যাকারী ঘৃণিত রাজা; সুতরাং আপনাকে ধিক্ । ২৬।
কুন্তীনন্দন! এইরূপ জ্ঞাতি ক্ষয় করিয়া এবং গুরুজনদিগকে বধ করাইয়া, আপনার রাজ্যদ্বারা কি হইবে। আপনার এখন মৃত্যুই ভাল- জীবন নহে’। ২৭।
তখন ব্রাহ্মণেরা সকলেই সেই দুষ্ট রাক্ষসের এই প্রকার বাক্য শুনিয়া এবং তাহার পূর্ব্বোক্ত বাক্যে আক্রান্ত হইয়া ব্যথিত হইলেন ও আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ২৮।
তাহার পর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলে ও সেই রাজা যুধিষ্ঠির লজ্জিত ও বিশেষ উদ্বিগ্ন হইয়া, কিছুকাল নীরব থাকিলেন। ২৯।
তৎপরে যুধিষ্ঠির বলিলেন- ‘ব্রাহ্মণগণ! আমি অবনত হইয়া, আপনাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করিতেছি। আপনারা আমার উপরে প্রসন্ন হউন’। আমার মৃত্যু অতিনিকটবর্ত্তী; সুতরাং আমার উপরে ধিক্কার দেওয়া আপনাদের উচিত নহে’। ৩০।
তদনন্তর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলেই একযোগে বলিলেন- ‘রাজা ! এই ব্রাহ্মণটা আমাদের কেহই নহে। আপনি জীবন ধারণ করুন, আপনার রাজলক্ষ্মীও চিরস্থায়িনী হউক। ৩১।
তাহার পর বেদবিদ্বান্ ও তপোবলে নির্ম্মলচিত্ত সেই মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা জ্ঞানদৃষ্টিদ্বারা চার্ব্বাককে চিনিতে পারিলেন। ৩২।
ব্রাহ্মণেরা বলিলেন- ‘মহারাজ ! দুর্য্যোধনের সখা চার্ব্বাকনামক এই রাক্ষস পরিব্রাজকরূপে দুর্য্যোধনেরই হিতসাধন করিবার ইচ্ছা করিতেছে। ৩৩।
ধর্ম্মাত্মা ! আমরা এরূপ কথা বলি নাই। অতএব আপনার এইরূপ নিন্দার ভয় তিরোহিত হউক এবং ভ্রাতৃগণের সহিত আপনার মঙ্গল হউক। ৩৪।
তাহার পর সেই পবিত্র ব্রাহ্মণেরা সকলে ক্রোধে উত্তেজিত হইয়া, ভর্ৎসনা করিতে থাকিয়া, হুঙ্কারদ্বারা সেই পাপাত্মা রাক্ষসটাকে মারিয়া ফেলিলেন। ৩৫।
তখন ইন্দ্রের বজ্রদগ্ধ অঙ্কুরযুক্ত বৃক্ষের ন্যায় সেই রাক্ষসটা বেদবাদী ব্রাহ্মণগণের তেজে দগ্ধ হইয়া পতিত হইল। ৩৬।
তৎপরে সেই ব্রাহ্মণেরা বিশেষ সম্মানিত হইয়া, যুধিষ্ঠিরের অভিনন্দন করিয়া, যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন এবং যুধিষ্ঠিরও সুহৃজ্জনের সহিত আনন্দিত হইলেন। ৩৭।
 .
এমন এক দুরাত্মা পাপী রাক্ষসের নামের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনটিকে জুড়ে দিলে সাধারণ পাঠকের মনে দর্শনটির প্রতি সহজেই আতঙ্ক ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হবার কথা। এ কারণেই এই জড়বাদী দর্শনটিকে চার্বাক নামে উল্লেখ করার প্রথা গড়ে উঠেছিলো কিনা তা বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনার বিষয় হতেই পারে। তবে চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধের বলি করে উপাখ্যানটি এই ব্রাহ্মণবেশী দুর্যোধনসখার মধ্যে ব্রাহ্মণবিরোধী এক মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। আর এ ইঙ্গিতটাকে স্পষ্টতর করে তোলে মহাভারতেরই অন্তর্গত অন্য এক উপাখ্যান, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার প্রসাদপুষ্ট অপর এক চার্বাকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপাগত এই চার্বাকের অভিন্নতা প্রদর্শন করেন। (মহাভারত: ১২/৩৯/৩-১১) । উপাখ্যানটি এরকম-
বাসুদেব উবাচ।
ব্রাহ্মণাস্তাত ! লোকেহস্মিন্নর্চ্চনীয়াঃ সদা মম।
এতে ভূমিচরা দেবা বাগ্বিষাঃ সুপ্রসাদকাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/২)
পুরা কৃতযুগে রাজন্ ! চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।
তপস্তেপে মহাবাহো ! বদর্য্যাং বহুবার্ষিকম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৩)
বরেণ চ্ছন্দ্যমানশ্চ ব্রহ্মণা চ পুনঃ পুনঃ।
অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো বরয়ামাস ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৪)
দ্বিজাবমানাদন্যত্র প্রাসাদ্বরমনুত্তমম্ ।
অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো দদৌ তস্মৈ জগৎপতিঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৫)
স তু লব্ধবরঃ পাপো দেবানমিতবিক্রমঃ।
রাক্ষসস্তাপয়ামাস তীব্রকর্ম্মা মহাবলঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৬)
ততো দেবাঃ সমেতাশ্চ ব্রাহ্মাণমিদমব্রুবন্ ।
বধায় রক্ষসস্তস্য বলবিপ্রকৃতাস্তদা।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৭)
তানুবাচ ততো দেবো বিহিতস্তত্র বৈ ময়া।
যথাস্য ভবিতা মৃত্যুরচিরেণেতি ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৮)
রাজা দুর্য্যােধনো নাম সখাস্য ভবিতা নৃষু।
তস্য স্নেহাববদ্ধোহসৌ ব্রাহ্মণানবমংস্যতে।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৯)
তত্রৈনং রুষিতা বিপ্রা বিপ্রকারপ্রধর্ষিতাঃ।
ধক্ষ্যন্তি বাগ্বলাঃ পাপং ততো নাশং গমিষ্যতি।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১০)
স এষ নিহতঃ শেতে ব্রহ্মদণ্ডেন রাক্ষসঃ।
চার্ব্বাকো নৃপতিশ্রেষ্ঠ ! মা শুচো ভরতর্ষভ !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১১)।
 .
অর্থাৎ :
কৃষ্ণ বলিলেন- ‘মাননীয় রাজা ! এই জগতে ব্রাহ্মণেরা সর্ব্বদাই আমার পূজনীয়। কারণ, ইঁহারা পৃথিবীচারী দেবতাস্বরূপ এবং ইঁহাদের বাক্যই বিষ, আবার প্রসন্নতা উৎপাদন করাও সহজ। ২।
মহাবাহু রাজা ! পূর্ব্বকালে সত্যযুগে এই রাক্ষস চার্ব্বাক বদরিকাশ্রমে বহু-বৎসর যাবৎ তপস্যা করিয়াছিল। ৩।
ভরতনন্দন ! তাহার পর ব্রহ্মা আসিয়া বর লইবার জন্য বার বার অনুরোধ করিলে, চার্ব্বাক সমস্ত প্রাণী হইতেই নিজের অভয় বর প্রার্থনা করিয়াছিল। ৪।
তখন অপমানিত ব্রাহ্মণ ভিন্ন অপর সমস্ত প্রাণী হইতেই সর্ব্বোত্তম অভয় বর তাহাকে ব্রহ্মা দান করিয়াছিলেন। ৫।
তৎপরে অসাধারণ বিক্রমশালী, নিষ্ঠুর কার্য্যকারী, মহাবল ও পাপাত্মা চার্ব্বাক ব্রহ্মার নিকট সেই বর লাভ করিয়া, দেবগণকে সন্তপ্ত করিতে লাগিল। ৬।
তাহার পর একদা দেবতারা সেই চার্ব্বাক রাক্ষসের প্রভাবে নিপীড়িত হইয়া, ব্রহ্মার নিকটে যাইয়া, চার্ব্বাকের বধের জন্য এই কথাই বলিলেন। ৭।
ভরতনন্দন ! তদনন্তর ব্রহ্মা দেবগণকে বলিলেন- ‘যাহাতে অচিরকালমধ্যে চার্ব্বাক নিহত হয়, সে বিষয়ে আমি উপায় করিয়াছি। ৮।
মনুষ্যলোকে দুর্য্যোধননামে এক রাজা জন্মিবেন এবং তিনি চার্ব্বাকের সখা হইবেন। কালক্রমে এই চার্ব্বাক সেই দুর্য্যোধনের সৌহার্দ্দসূত্রে আবদ্ধ হইয়া, ব্রাহ্মণগণের অবমাননা করিবে। ৯।
তখন বাক্শক্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের অবজ্ঞায় ক্রুদ্ধ হইয়া, ব্রহ্মতেজেই পাপাত্মাকে দগ্ধ করিবেন; তাহাতেই চার্ব্বাক বিনষ্ট হইবে’। ১০।
ভরতশ্রেষ্ঠ রাজপ্রধান ! সেই চার্ব্বাক রাক্ষসই এই ব্রাহ্মণের তেজে বিনষ্ট হইয়া শয়ন করিয়াছে। অতএব আপনি ব্রহ্মহত্যা হইয়াছে বলিয়া অনুতাপ করিবেন না। ১১।
 .
যুধিষ্ঠিরের সভায় সমাগত চার্বাকের বিনাশের মূলে কার্যকর ব্রহ্মার অভিশাপ এবং ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার মাধ্যমে অভিশাপটিকে ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব স্বয়ং চার্বাকেরই। উপাখ্যানের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তকে দৃষ্টিপটে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট।
 .
চার্বাক নামে কোন ব্যক্তির কাহিনী মহাভারতের অন্যত্র বা অন্য কোন গ্রন্থেও আর দেখা যায় না। মহাভারতে চার্বাক নামের এই রাক্ষসের সামান্য উল্লেখ থেকে চার্বাক মতবাদের এরকম নামকরণের পক্ষে সুনিশ্চিত কোন যুক্তি বা সাক্ষ্য আদৌ আছে কিনা জানা নেই। তবে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে চার্বাক এখানে বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী দর্শনের এক মূর্ত রূপ। তাই বিরোধী প্রখর জড়বাদী মতের প্রতি বৈদিক সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের তীব্র বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ এমন চার্বাক নামকরণের মধ্যে দিয়ে ঘটে যাওয়া অসম্ভব না-ও হতে পারে।
চার্বাক দর্শনের মতে প্রত্যক্ষই (Perception) একমাত্র প্রমান অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় । চার্বাক দর্শন অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরুপে গ্রহন করে নাই । অনুমান (Inference) ও শব্দের (Testimony) দ্বারা কোন নিঃসন্দিগ্ধ ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না । চার্বাকপন্থীরা বলেন যা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ লব্ধ নয় তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । যে বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা যায় বা অনুভব করা যায় , একমাত্র সে বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় ।
ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনগুলির নিকট চার্বাকমত বুঝি এক জীবন্ত প্রহেলিকা। যুক্তিনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে অধ্যাত্ম বা অলৌকিকতার বিরুদ্ধে লৌকিক বাস্তবতার প্রচণ্ড সাঁড়াশি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিত যে-দর্শনমতের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলো তাকে অধ্যাত্মবাদীরা যে প্রাণপণে প্রতিহত করবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী! অধ্যাত্মবাদীদের এই প্রতিহতকরণ-প্রচেষ্টা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিলো তা অনুধাবন করা যায় চার্বাকদের বিরুদ্ধে তাঁদের ঘৃণা আর খেদোক্তি বা অভিশন্তাপের বাহুল্য দেখেও। প্রচলিত সাধারণ-জনমানসেও দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে বিরোধী কাউকে মনমতো শায়েস্তা করতে না পারলে অক্ষম যন্ত্রণায় শেষতক অভিশাপ দিয়েই সান্ত্বনা খোঁজে, ‘ধর্মই তোর বিচার করবে, তুই নরকবাসী হবি!’

এই নরকবাস আসলে কী? শান্ত্রে নরকের নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। বোঝাই যায় শাস্ত্রমতে নরক একরকমের নয়। কেবল ‘মনুস্মৃতি’তেই (মনুসংহিতা-৪/৮৮-৯০) একুশ রকম নরকের ফর্দ রয়েছে। ‘মনুস্মৃতি’র এই ফর্দ থেকেই বোঝা যায় সম্ভব-অসম্ভব রকমারি পার্থিব যন্ত্রণার বিবরণই নরক-কল্পনার মূল উপাদান। যেমন–
তামিস্রমন্ধতামিস্রং মহারৌরবরৌরবৌ।
নরকং কালসূত্রঞ্চ মহানরকমেব চ।। (মনু-৪/৮৮)
সঞ্জীবনং মহাবীচিং তপনং সম্প্রতাপনম্ ।
সংঘাতঞ্চ সকাকোলং কুড্মলং পূতিমৃত্তিকম্ ।। (মনু-৪/৮৯)
লোহশঙ্কুমৃজীষঞ্চ পন্থানং শাল্মলীং নদীম্ ।
অসিপত্রবনঞ্চৈব লোহদারকমেব চ।। (মনু-৪/৯০)
অর্থাৎ :
এই একুশ-রকমের নরকগুলি– তামিম্র (অন্ধকার), অন্ধতামিস্র (নিবিড় অন্ধকার), মহারৌরব (মহাকোলাহলপরিপূর্ণ), রৌরব (কোলাহলপরিপূর্ণ), কালসূত্র (যেখানে সকলরকম উপায়ে পীড়ন করা হয়), সঞ্জীবন (যেখানে বার বার বাঁচিয়ে বার বার মেরে ফেলা হয়), মহানরক (যেখানে অগ্নিপ্রভৃতির দ্বারা সন্তাপ দেওয়া হয়), মহাবীচি (মতান্তরে, অবীচি; যেখানে অত্যন্ত জলতরঙ্গ), তপন (আগুন প্রভৃতির দ্বারা দগ্ধ করা হয় যেখানে), সম্প্রতাপন (কুম্ভীপাক; যেখানে কুম্ভে নিক্ষেপ করা হয়), সংঘাত (যেখানে অত্যন্ত সংকীর্ণস্থানে বহু লোককে স্থাপন করা হয়), কাকোল (যেখানে কাকদের দ্বারা ভক্ষণ করানো হয়), কুড্মল (যেখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে পীড়ন দেওয়া হয়), পূতিমৃত্তিক (যেখানকার মাটি বিষ্ঠার গন্ধে পূর্ণ), লোহশঙ্কু (যেখানে সূচের দ্বারা ভেদন করানো হয়), ঋজীষ (যেখানে তপ্ত কড়াইতে নিক্ষেপ করা হয়), পন্থা (যেখানে বারংবার গমনাগমন করানো হয়), শাল্মলী (অন্যমতে, শাল্মল; যেখানে শাল্মলীর কাঁটার দ্বারা শরীরকে বিদ্ধ করানো হয়), নদী (বৈতরণী প্রভৃতি যে সব নদী দুর্গন্ধ-রুধির পূর্ণ, অস্থিপ্রভৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন, উষ্ণজলপরিপূর্ণ ও বেগবতী– তার উপর ভাসানো হয়), অসিপত্রবন (যেখানে তরবারীর তীক্ষ্ণাংশদ্বারা শরীর ছিন্নভিন্ন করা হয়) এবং লোহদারক (যেখানে লৌহশৃঙ্খলের দ্বারা বেঁধে রাখা হয়)। (মনসংহিতা-৪/৮৮-৯০)।।

কোন্ পাপে কার জন্য কোন্ নরকের নিবন্ধন ঘটে তাও নিশ্চয়ই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। আর টীকাকার কুল্লুকভট্টই বলছেন, রকমারি নরকের আরো বিস্তৃত বিবরণের জন্য ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় নরক-বর্ণনা নয়। তবে এতো রকমের নরকের একটি যে মহানরক, যেখানে সমস্ত রকম যন্ত্রণার আয়োজনই রাখা হয়েছে তা বোধ করি বোঝার বাকি নেই। এই মহানরকের উল্লেখ করা হচ্ছে এজন্যেই যে, প্রসিদ্ধ ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘ভামতি’ গ্রন্থে (ভামতি-৩/৩/৫৪) বলছেন–
‘এ-হেন মহানরকেই নাস্তিক চার্বাকের স্থান। অবশ্য সাধারণত মরবার পরে নরকে যাবার কথা। কিন্তু চার্বাকের অবস্থা তা নয়। মহানরকবাসের জন্যে তার মরবারও দরকার পড়ে না, জীবদ্দশাতেই ঐ নরকবাস। কেননা, চার্বকের এমনই মত যে তা মানলে মহানরকের যন্ত্রণা ছাড়া গত্যন্তর নেই।’

বাচস্পতির এই উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৪৩) থেকে। কিন্তু কী এমন মত যে তা মানলে জীবদ্দশাতেই এ-হেন যন্ত্রণা? দেবীপ্রসাদ-কৃত উদ্ধৃতিতে বাচস্পতি বলছেন–
‘চার্বাক প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণই মানে না। তাই তার অবস্থা জানোয়ারেরও বেহদ্দ। জানোয়ারেরাও হিত-প্রাপ্তি ও অহিত-পরিহারের ব্যাপারটা বোঝে, কিন্তু বুঝতে গেলে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন, জানোয়ারেরাও হিতপ্রাপ্তির জন্যে কোমল ঘাসের ক্ষেত্রে বিচরণ করে; অহিত পরিহারের জন্যে শুকনো কাঁটার জঙ্গল এড়িয়ে যায়। নিছক প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করে এজাতীয় ব্যবহার সম্ভব নয় : হিতপ্রাপ্তির ও অহিত-পরিহারের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির জন্যে অনুমানের উপর নির্ভরতা প্রয়োজন। কিন্তু চার্বাক অনুমান বলে কোনো প্রমাণই মানে না; পশুর ব্যবহারের মধ্যে যেটুকু অনুমানের আয়োজন তাও নয়। তাছাড়া, চার্বাকের পক্ষে তো বেবাক বোবা হয়ে থাকবার কথা, কেননা অপরকে কিছু বলতে গেলে শব্দ ব্যবহার প্রয়োজন এবং শব্দ প্রত্যক্ষ হলেও শব্দ থেকে শব্দযোগ্য পদার্থ অনুমানসাপেক্ষ। অতএব চার্বাক জন্মান্তরের কথা উড়িয়ে দিতে গেলেও ইহজন্মেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, নিশ্চেষ্ট এবং মূক অবস্থায় মহানরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য।’

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বাচস্পতি মিশ্র যে যেনতেন লোক নন, দার্শনিক হিসেবে দিকপাল-বিশেষ, তা বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণই অবগত। নানা প্রসিদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় তাঁর গ্রন্থ প্রামাণ্য বলেই স্বীকৃত। কিন্তু বিদগ্ধ চিন্তাশীলও যখন চিন্তাচেতনার বালাই চুকিয়ে দিয়ে চার্বাককে এমন গাল দিতে উদ্যত হন তা নিশ্চয়ই হেলাফেলার বিষয় নয়। কিন্তু চার্বাকের নিন্দা– বিশেষত তার প্রত্যক্ষপরায়ণতার বিবরণ যে অতিরঞ্জিত এটুকু অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কেননা চার্বাকদের বিরুদ্ধে একটা প্রচলিত অভিযোগ এই যে সুখাদ্যের প্রতি চার্বাকের অত্যন্ত অভিরুচি। তাই কচি ঘাস দেখে ছাগলেও তার প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য যতটুকু অনুমান-পরায়ণতার পরিচয় দেয়, চার্বাকের মধ্যে তারও অভাব– এমনতর অসম্ভব উক্তি দার্শনিক প্রতিভা তো দূরের কথা, সামান্যতম সততারও পরিচায়ক নয় বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত। বিষয়গুলি স্পষ্টতর হওয়ার লক্ষ্যেই ভারতীয় দর্শনে চার্বাকী-সিদ্ধান্তের আলোচনায় আমরা অনুপ্রবিষ্ট হতে পারি। তবে এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা আবশ্যক যে, আলোচনার স্পষ্টতার নিরীখে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে আলোচিত চার্বাক সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট বিশেষ কিছু দৃষ্টান্তের পুনরোল্লেখ ঘটতে পারে প্রাসঙ্গিক বিবেচনার আলোকে।
প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ

।। ক।।  প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ।
চার্বাক দর্শন সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গ্রন্থে বিশেষত দর্শনের সঙ্কলন গ্রন্থগুলিতে চার্বাক নামের সঙ্গে প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। যেমন কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হয়েছে–
‘লোকায়তমেব শাস্ত্রং যত্র প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্…বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্।
তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্’। -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।
অর্থাৎ : লোকায়তশাস্ত্রমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। …বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।

বেদান্ত অনুসারী সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায় বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদিতয়া অনুমানাদেরনঙ্গীকারেণ প্রামাণ্যাভাবাৎ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিত্ব হেতু অর্থাৎ একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলে, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলে দেহাতিরিক্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়।

‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদীদের দ্বারাও অদৃষ্ট কখনও দৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, বিশেষ কোন স্থানে বা কোন সময়ে দৃষ্ট হলেও এর অদৃষ্ট নামের সার্থকতা থাকে না। নিত্য অদৃষ্ট কোন বস্তুর সত্তাকে যদি আমরা অনুমোদন করি তাহলে ‘শশশৃঙ্গ’ বা অনুরূপ অসম্ভব পদার্থের অস্তিত্বকেও আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়। চার্বাকী বা লোকায়তিক এই মতবাদই বর্ণিত হয়েছে অদ্বৈতবেদান্তের প্রবর্তক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে–
‘প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।
অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।
‘ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্রুবতে কথম্ ।
নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।
অর্থাৎ :
লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে– এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।  যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।

নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাকের বর্ণনায় বলছেন–
তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী-১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।
‘সর্বমতসংগ্রহ’ গ্রন্থেও চার্বাকদেরকে বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিনো’। (সর্বমতসংগ্রহ)
অর্থাৎ : কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী।

বলা যায়, ভারতীয় গোটা দর্শন সাহিত্যেই চার্বাকের প্রধান পরিচিতি প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে। তবে কি অন্যান্য দর্শনগুলি প্রত্যক্ষকে স্বীকার করেন না? অবশ্যই করেন। প্রমাণসমূহের অন্যতম হিসেবে ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্বীকৃতির উল্লেখ আছে সবকটি দর্শন-মতেই, ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে তার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।
লৌকিক মতে প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ জ্ঞানের দ্যোতক। কিন্তু দার্শনিক পরিভাষায় এর অর্থ পৃথক। আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের পর্যায়ে সাধারণত পাঁচটি ইন্দ্রিয় অন্তর্ভুক্ত। এগুলির কোনও একটির সাহায্যেই প্রত্যক্ষজ্ঞানের উদ্ভব হতে পারে। চক্ষু এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির অন্যতম হলেও কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক– এই চারটি ইন্দ্রিয়ের ভূমিকাও প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন অংশে কম নয়। এই ইন্দ্রিয় পাঁচটির প্রত্যেকটিই নিজ নিজ বিভাগে জ্ঞান আহরণের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। কোন বস্তু যখন বিশেষ কোন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসে তখন ইন্দ্রিয়টির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা বস্তুটি সম্বন্ধে বিশেষ ধরনের জ্ঞান লাভ করি। যেমন একটি ফুল সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে চক্ষু, নাসিকা এবং ত্বকেরই কেবল কার্যকারিতা দেখা যায়, অন্য ইন্দ্রিয়ের নয়। চোখ দিয়ে আমরা ফুলটিকে দেখি; নাকের সাহায্যে গন্ধ উপভোগ করি এবং ত্বক দিয়ে ফুলটিকে স্পর্শ করি। আবার গান শোনা বা সুখাদ্য ভোজন ইত্যাদি ব্যাপারে যথাক্রমে কর্ণ এবং জিহ্বার বৈশিষ্ট্য কাজ করে, অন্য ইন্দ্রিয় নয়। মনের ভূমিকা কোন কোন ক্ষেত্রে বাহ্য বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের মাধ্যম হিসেবে, আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র এক ইন্দ্রিয় রূপে। জ্ঞানেন্দ্রিয় হিসেবে মন আন্তর প্রত্যক্ষের কারণ হয়, অন্য ইন্দ্রিয়গুলির বা বাহ্য বস্তুনিচয়ের যেখানে কোন কার্যকরিতা নেই।

প্রমাণগুলির মধ্যে একমাত্র এই প্রত্যক্ষের সঙ্গেই যাঁরা চার্বাকের যোগ স্বীকার করেন তাঁদের মতে চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে সঞ্চয় এই ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথেই কেবল হওয়া সম্ভব। জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–
‘লোকায়তা বদন্ত্যেবং নাস্তি দেবো ন নির্বৃতিঃ।
ধর্মাধর্মৌন বিদ্যেতে ন ফলং পুণ্যপাপয়োঃ।।
এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮১)
অর্থাৎ : লোকায়তরা বলেন, দেবতা বলে কিছু নেই, মোক্ষ বলেও নয়। ধর্ম ও অধর্ম বলে কিছু হয় না, পুণ্য ও পাপের ফল বলেও নয়। যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক (অতএব সত্য)।

তার মানে, ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের বক্তব্য হলো, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যতটুকু জানা সম্ভব চার্বাকের জগৎ তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এভাবে বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও অনুরূপ একটি লোকায়ত বচনের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যেমন–
‘এতবানেব পুরুষো যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)
অর্থাৎ : যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক।

চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে চার্বাকেতর দার্শনিকদের সাধারণ মনোভাব এই ধারণারই অনুগামী বলে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে চার্বাকের পরিচিতিও সেই ধারণারই অনুসরণে গড়ে উঠেছে বা তৈরি করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারে একমাত্র বস্তুজগতের মালমসলাই সঞ্চিত হয়। প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম করার জন্য এই উপাদানের অতিরিক্ত অন্য কিছু চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে তার সঞ্চয় রাখতে পারে না, ফলে স্থূল বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করেই রূপায়িত হয়ে ওঠে চার্বাকের সম্পূর্ণ নিজস্ব বস্তুবাদী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু সাধারণভাবে এই রূপে চার্বাকের পরিচিতি তৈরি করা হলেও ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে চার্বাকের সামগ্রিক রূপের প্রতিফলন এখানে হয়নি এবং কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবেও চার্বাককে সব ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা যায় না। ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে চার্বাক সম্প্রদায়ের শ্রেণীভেদ প্রসঙ্গে চার্বাকগোষ্ঠির মধ্যে বৈতণ্ডিক, ধূর্ত, সুশিক্ষিত ইত্যাদি একাধিক মতবাদের প্রচলনের উল্লেখ করা হয়েছে এবং চার্বাক সিদ্ধান্তের সামগ্রিক রূপের বিচারের জন্য এগুলির আলোচনা সহ বিভিন্ন দার্শনিকগোষ্ঠির মনোভাব বিশ্লেষণও  আবশ্যক বলেই মনে হয়।

.
চার্বাক প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টর বক্তব্য এবং তত্ত্বোপপ্লবসিংহ :
যদিও চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তভট্টর প্রকৃত বক্তব্য নির্ণয় করার বেশ সমস্যা রয়েছে, তবু এ প্রসঙ্গে চার্বাক সম্বন্ধে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্তভট্টর মন্তব্য উল্লেখ্য। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাক গোষ্ঠিকে সাধারণভাবে বিশেষিত করে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় সরাসরি বলেছেন–
তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।

শুধু এটুকু বললে সিদ্ধান্ত করা যেতো যে, তাঁর দৃষ্টিতে চার্বাকমতে প্রত্যক্ষাতিরিক্ত অনুমান বলে কোনো প্রমাণ সম্ভব নয়। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, এই ‘ন্যায়মঞ্জরী’রই অন্যত্র তিনি ভিন্ন ধরনের অপর এক মতবাদকে চার্বাক নামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং এই মতবাদের সমর্থক চার্বাকেরা তাঁর ভাষায় ‘ধূর্ত’ সংজ্ঞায় চিহ্নিত। যেমন–
‘চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্’। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।
অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো– এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।

জয়ন্তের বর্ণনায়, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে প্রমাণ এবং প্রমেয়ের সংখ্যা এবং লক্ষণের নিয়ম করা সম্ভব নয়। সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যই এঁদের পরিভাষায় ‘তত্ত্ব’ আখ্যা পেয়েছে এবং এই অর্থানুসারী তত্ত্বের ব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে এঁরা এমন অনেক প্রমিতির উদাহরণ দিয়েছেন যাদের উদ্ভব প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের মাধ্যমে হয় না। সহজভাবে বললে, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে কোন রকম প্রমাণেরই লক্ষণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়, মানে কোন রকম প্রমাণই সম্ভব নয়– ফলে প্রত্যক্ষও সংশয়াতীত নয়। তার মানে, এই মতটি যে অবশ্যই প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকদের মতাদর্শ নয়, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আবার এই একই ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেই জয়ন্ত ভট্ট আবার ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের সম্পর্কেও বলেন–
অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।

.
এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ইতঃপূর্বে উল্লেখকৃত মন্তব্যটি পুনরায় প্রণিধানযোগ্য–
জয়ন্তর স্বীয় সম্প্রদায়ের– অর্থাৎ ন্যায় সম্প্রদায়ের– দাবি এই যে প্রমাণ আসলে চার রকম। অতএব স্বমত সমর্থনে যে-দার্শনিকেরা প্রমাণের সংখ্যা চারের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন, জয়ন্তর পক্ষে তাঁদের মত খণ্ডনের প্রয়োজন বোধ করার কথা। কিন্তু কারা চারের চেয়ে বেশি প্রমাণ মানেন? জয়ন্ত বলছেন : প্রভাকর-পন্থী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ পাঁচ রকমের; কুমারিলভট্টর অনুগামী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ ছয় রকমের; কেউ-কেউ আবার বলেন, প্রমাণ আট রকমের; কিন্তু ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’রা বলেন, প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। কথাটার তাৎপর্য কি এই যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, নাকি, প্রমাণ বলেই কিছু নেই? -(ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।

মোটকথা, জয়ন্তভট্ট বর্ণিত চার্বাক-গোষ্ঠির সম্পূর্ণ চিত্রায়ণ কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ এ প্রসঙ্গে চার্বাক পক্ষের নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপিত করতে পারে এমন রচনার প্রকৃত অভাব। এ-প্রেক্ষিতে ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচিত জয়রাশি ভট্টর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ নামের গ্রন্থটির উল্লেখ করা যেতে পারে। তার মধ্যেই জয়ন্ত বর্ণিত ধূর্ত চার্বাকদের ছবি আবিষ্কার করা হয়তো সম্ভব হতে পারে। প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণের মর্যাদা দান সম্বন্ধে চার্বাক প্রসঙ্গে সাধারণ যে ধারণার প্রচলন করা হয়েছে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সাক্ষ্য তারও পরিপন্থী। এই গ্রন্থের গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্ট অন্য প্রমাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কার করতে আগ্রহী এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিও তাঁর কাছে প্রমেয়ের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ বিচারে আমরা যাকে ‘তত্ত্ব’ বলি বিভিন্ন প্রমাণগ্রাহ্য সেই তত্ত্বের অস্তিত্বকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলেছেন–
‘পৃথিব্যাদীনি তত্ত্বানি লোকে প্রসিদ্ধানি, তান্যপি বিচার্যমানানি ন ব্যবতিষ্ঠন্তে, কিং পুনরন্যানি’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)।
অর্থাৎ : সাধারণ লোকে যে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ এই পঞ্চভূতকে তত্ত্ব বলে স্বীকার করেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে দেখা যায় যে এরকম কোন প্রমেয় তত্ত্বেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। (মুক্ততর্জমা)

নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় জয়রাশি যে তত্ত্বকে উপজীব্য করেন, প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণসম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যের সঙ্গে তা একার্থক। বাস্তবিকপক্ষে জাগতিক বস্তুনিচয়ের সত্যাসত্য নির্ণয় করার মান, আমরা যেভাবেই ঠিক করি না কেন– কোন সময়েই তা ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না, এটা প্রদর্শন করাই তত্ত্বোপপ্লববাদীর উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য জয়রাশি তর্কের বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে একই সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখার সিদ্ধান্তে ত্রুটি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে–
‘কথং কথং তানি ন সন্তি? তদুচ্যতে সল্লক্ষণনিবন্ধনং মানব্যবস্থানং, মাননিবন্ধনা চ মেয়স্থিতিঃ, তদভাবে ন তথা সদ্ব্যবহারবিষয়ত্বং কথং…’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)
অর্থাৎ : প্রমাণের অস্তিত্ব সৎ লক্ষণের উপর নির্ভরশীল, আবার এই প্রমাণের মাধ্যমেই প্রমেয় বস্তুবিষয়ের ব্যবস্থাপনা। প্রমাণের লক্ষণে যদি ত্রুটি থাকে, তাহলে তাকে কখনই সৎ বলা চলে না এবং এই ত্রুটিপূর্ণ লক্ষণযুক্ত প্রমাণের অস্তিত্বও স্বীকৃত হতে পারে না। প্রমাণ অস্বীকৃত হলে প্রমাণের মাধ্যমে আমরা প্রমেয় যে বস্তু বা বিষয়ের ধারণা করি সেগুলিকেও অগ্রাহ্য করতে হয়।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, প্রমাণসম্বন্ধীয় নিয়মের বিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে চার্বাকদের প্রগতিবাদী মনোভাবের ঐক্য সূচক, যা দার্শনিক মতবাদ ছাড়াও আমাদের আচরণ বিধির প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম-বন্ধনকে শিথিল করার প্রয়াসে তৎপর। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি যে সুকঠোর বিধিনিয়মের ভারে ভারাক্রান্ত বৈদিক আচারের প্রভাব থেকে মুক্তির প্রচেষ্টার মধ্যেই চার্বাকী চিন্তার প্রথম উন্মেষ। আবির্ভাবের প্রাথমিক মুহূর্তে যে প্রগতিবাদী দৃষ্টি চার্বাকী মনে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিলো, উত্তর যুগের চার্বাকী চিন্তাতেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব লক্ষণীয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন বিভাগে প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়ম প্রসঙ্গে যে সূক্ষ্ম মতভেদ, চার্বাকী সমালোচনা তার মূলে আঘাত করেছে। এ-ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্টকেও কেউ কেউ হয়তো নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের অনুসরণ করে চার্বাকগোষ্ঠির অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছেন। শ্রদ্ধেয় লতিকা চট্টোপাধ্যায়ও এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন কিনা তা অস্পষ্ট। যদিও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিদ্বজ্জনদের মধ্যেই জয়রাশি ভট্টকে চার্বাকগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্তিকরণে তীব্র মতভেদ রয়েছে। সে যাক্, তবে জয়রাশির সঙ্গে ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে ধূর্ত সংজ্ঞায় অভিহিত চার্বাকগোষ্ঠির সম্পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে বলেই মনে হয়।

এ-প্রেক্ষিতে লতিকা চট্টোপাধ্যায় বলেন–
সংখ্যা ও লক্ষণের নিয়মে প্রমাণের শ্রেণীবিভাগে ব্রতী দার্শনিকদের বিরুদ্ধে চার্বাকদের যে ধরনের প্রতিবাদ ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে দেখা যায় তারই অনুরূপ প্রতিবাদে সোচ্চার চার্বাক জয়রাশি বৈয়াকরণকৃত শব্দের লক্ষণগত নিয়মের বিপক্ষে, তাঁর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। বৈয়াকরণেরা প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের দুর্লঙ্ঘ্য বন্ধনে শব্দকে আবদ্ধ রেখেছেন। ব্যাকরণের সূত্রগুলি তাঁদের মতে লক্ষণের পর্যায়ভুক্ত। এবং এই লক্ষণান্বিত শব্দসমূহকে তাঁরা ‘সাধু’ আখ্যায় ভূষিত করেন। এইভাবে সাধুত্বের ছাড়পত্র লাভে যে শব্দগুলি সক্ষম, একমাত্র সেগুলিই তাঁদের নির্দেশে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
চার্বাক জয়রাশির সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণা প্রসারিত হয়েছে বৈয়াকরণ নির্দেশিত বিশেষ লক্ষণযুক্ত সাধু শব্দের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ব্যাপারে। বৈয়াকরণদের মতে বিশেষ লক্ষণ দ্বারা যেগুলি নির্দেশিত হয় না, সেগুলি অসাধু শব্দ এবং এই অসাধু শব্দের প্রয়োগকে তাঁরা অনুমোদন করেন না। জয়রাশি অসাধু শব্দের প্রয়োগের ফলে সম্ভাব্য কয়েকটি দোষের উল্লেখ করে যুক্তির মাধ্যমে সব কটি দোষেরই অবাস্তবতা প্রতিপাদন করেছেন। আর উপসংহারে সাধু শব্দের সঙ্গে অসাধু শব্দেরও সমান সার্থকতা সম্বন্ধে নিজস্ব মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭০)

কিন্তু এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ জয়রাশি অবলম্বিত প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি কিরূপ? এ সম্বন্ধে একান্ত আগ্রহী পাঠকের ধারণা লাভের ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে বর্ণিত প্রত্যক্ষ প্রমাণসম্বন্ধীয় প্রারম্ভিক আলোচনার কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। এ-বিষয়ে লতিকা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৭০-৭২) ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করেছেন। আমরা এ-ক্ষেত্রে সংক্ষেপে তাঁর আলোচনা-রীতিই অনুসরণ করতে পারি।

আমরা জানি যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্জগতের সঙ্গে সরাসরি যোগের ফলে আমাদের যে জ্ঞান হয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণকে তার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন–
‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপনং জ্ঞানম্ অব্যোপদেশ্য অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে যে অব্যাপদেশ্য (অশাব্দ), অব্যভিচারী  (অভ্রান্ত) এবং ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ।

সহজ কথায়, প্রত্যক্ষ বলতে সেই ধরনের জ্ঞান বোঝায় যা ইন্দ্রিয় এবং অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়। তবু ইন্দ্রিয় এবং অর্থ পরস্পর নিকটবর্তী হলেই যে প্রকৃত প্রত্যক্ষজ জ্ঞান সম্ভব হয় না তা বোঝাবার জন্য সূত্রকার ‘অব্যপদেশ্য’ বা অশাব্দ, ‘অব্যভিচারী’ বা অভ্রান্ত এবং ‘ব্যবসায়াত্মক’ বা নিশ্চয়াত্মক, এই কয়েকটি বিশেষণে এই জ্ঞানকে চিহ্নিত করেছেন।

প্রথম বিশেষণ ‘অব্যাপদেশ্য’ দ্বারা সংজ্ঞা, পরিচয় ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত বস্তুকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরিধি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। সম্মুখস্থ কোন ব্যক্তির আকৃতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সাক্ষাৎভাবে যে জ্ঞান আমাদের মনের গোচরীভূত হয় তাকে প্রত্যক্ষ বলা চলে। লোকটি সম্বন্ধে আমাদের পূর্ববর্তী জ্ঞানের সহযোগিতায় নাম ধাম ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত তার যে সম্পূর্ণ পরিচয় আমরা তখন লাভ করি তা প্রত্যক্ষ-বহির্ভূত।
সূত্রে ব্যবহৃত ‘অব্যভিচারী’ পদ মিথ্যা জ্ঞানকে প্রত্যক্ষের পরিসর থেকে অপসারিত করেছে। সূর্যকিরণে (মরীচিকায়) জলের বা রজ্জুতে সর্পের বোধ প্রকৃত প্রত্যক্ষ পদবাচ্য নয়।
আর ‘ব্যবসায়াত্মক’ শব্দের দ্বারা প্রকৃত বিচার বা অবধারণাকে জ্ঞানের একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যার অভাবে কেবল মাত্র অর্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষের ফলে জ্ঞানের উৎপত্তি সম্ভব নয়। চক্ষুর সন্নিকটে অসংখ্য বস্তু উপস্থাপিত হলেই যে তাদের সবগুলির প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় তা বলা চলে না। বস্তুগুলির মধ্যে বিশেষভাবে যেটি অবধারণায় আসে সেটিই প্রত্যক্ষপদবাচ্য। সেটি যদি ফুল হয় তাহলে জ্ঞাতা ব্যক্তির ধারণা জন্মে ‘এটি একটি ফুল’। ‘ব্যবসায়’ নামে অভিহিত এই বিশেষ ধারণা ন্যায়ের অভিমতে প্রকৃত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অপরিহার্য সোপান।

প্রত্যক্ষলক্ষণের বিচার প্রসঙ্গে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ প্রথমেই ন্যায়সূত্রবর্ণিত এই লক্ষণকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে এর সর্বাত্মক ত্রুটি প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছে। ন্যায়সূত্র-বর্ণিত ‘অব্যভিচারী’ পদ গ্রন্থমতে আরও বিস্তারের অপেক্ষা রাখে। অব্যভিচারিতা নানাভাবে হতে পারে– যে কারক বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই জ্ঞানের উৎপাদন তার অদুষ্টতা, জ্ঞানের পথে বাধার অস্তিত্বের অভাব অথবা প্রবৃত্তিসামর্থ্য। প্রথমটিকে অব্যভিচারিতার কারণ হিসাবে নির্দেশ করা সম্ভব নয়। কারণ চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের কুশলতার বিচার ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয় না, যে জন্য প্রত্যক্ষ এই বিচারের মাধ্যম হতে পারে না। এ ব্যাপারে অনুমানেরও অসার্থকতা একই সঙ্গে প্রতিপন্ন হয়, কারণ অনুমানের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষজ্ঞানেরই ভিত্তিতে। যে হেতু বা লিঙ্গ অনুমানের অপরিহার্য অঙ্গ, সেই লিঙ্গ এখানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উদ্ভূত জ্ঞান। ইন্দ্রিয়োত্থ জ্ঞানেরই সহায়তায় ইন্দ্রিয়ের অদুষ্টতা বিচার করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ প্রত্যক্ষজ্ঞানের অব্যভিচারিতা প্রমাণের চেষ্টা করলে ইতরেতরাশ্রয়দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।
বাধারহিতত্ব এবং প্রবৃত্তিসামর্থ্য– অব্যভিচারী জ্ঞান উৎপাদনে এ দুটির মধ্যেও কোনটি যে প্রকৃত কারণ হতে পারে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়,– সম্ভাব্য নানা রকম দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটিকে বিচার করার পর এ সম্বন্ধে গ্রন্থকার তাঁর মন্তব্য করেন। মোট কথা, বিশেষ কোন বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞানে প্রত্যক্ষজ জ্ঞান প্রকৃতই বস্তুটির পরিচয় বহন করে কিনা স্থির করার প্রস্তুতি হিসাবে অব্যভিচারী জ্ঞানের বিভিন্ন কারণ আগে নির্ণয় করা প্রয়োজন, যেগুলির অনুপস্থিতিতে যথার্থ জ্ঞানের পর্যায়ে কোন জ্ঞান উন্নীত হতে পারে না। কিন্তু এই কারণগুলি নির্ণয়যোগ্য না হওয়ায় ‘অব্যভিচারী’ বিশেষণও কোন জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।
তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে প্রত্যক্ষলক্ষণে ‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষ’ পদকে অন্তর্ভুক্ত করে নৈয়ায়িকেরা ‘অব্যভিচারী’ পদকে আরও অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। বাহ্য বস্তুর জ্ঞানে অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তু যদি ইন্দ্রিয়ের নিকটবর্তী হয় তাহলে আপনা থেকে জ্ঞানে ব্যভিচারিতা শঙ্কার নিবৃত্তি হয়। নৈয়ায়িকেরা এ ক্ষেত্রে স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন যে ইন্দ্রিয় অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকৃষ্ট হলেও বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত বস্তুজ্ঞানের পরিবর্তে ভ্রমের উৎপাদন হয়। যেমন সূর্যরশ্মিতে জলের প্রতীতি। এ যুক্তির বিপরীত পক্ষে গ্রন্থকারের যুক্তি এই যে উল্লিখিত নয়নেন্দ্রিয়ের যোগ হয় নিকটবর্তী সূর্যরশ্মির সঙ্গে; যে উদক বা জলের প্রতীতি এ ক্ষেত্রে হয়, সেই উদক নয়নের সন্নিকটে একেবারেই আসে না। কাজেই ন্যায়সূত্রবর্তী ‘অব্যভিচারী’ পদ এখানে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থকার ব্যভিচারী জ্ঞান বা ভ্রম সম্বন্ধে সুদীর্ঘ এক আলোচনার অবতারণা করেছেন। সূক্ষ্ম বিচারে কোন জ্ঞানই যে ‘অব্যভিচারী’ সংজ্ঞা লাভ করতে পারে না নানাভাবে তা দেখানো হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, লতিকা চট্টোপাধ্যায়)

অতএব, ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থের অভিমতে ন্যায়সূত্রে অন্তর্ভুক্ত ‘অব্যভিচারী’ পদটি সব দিক দিয়েই অসার্থক–
‘তস্মাৎ স্থিতমেতদ্ অব্যভিচারিপদমনর্থকম্’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১৭)
অর্থাৎ : তাই স্থির সিদ্ধান্ত যে, ‘অব্যভিচারী’ পদের ব্যবহার অর্থহীন। (মুক্ততর্জমা)

ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষ লক্ষণ সম্বন্ধে প্রযুক্ত অপর তিনটি পদের অসার্থকতাও ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে অনুরূপভাবেই অসার্থক প্রতিপন্ন করার প্রয়াস দেখা যায়। পরিশেষে গ্রন্থকার প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয় বা বাহ্য অর্থের যে কোন অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের অকার্যকারিতার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখাতেও প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে নিজস্ব লক্ষণ আছে। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সমালোচনা থেকে এগুলিও বাদ যায়নি। দর্শনের সূক্ষ্ম তর্ককে উপজীব্য করায় তাতে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য এবং হেতুবাদের পূর্ণ প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও এই সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরস। তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কেননা, কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তার নমুনাস্বরূপ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবে ন্যায়দর্শনের উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়– সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে– অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে– উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, কিন্তু সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যাঁরা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তাঁরা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রিস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে যে ব্যাপক অস্পষ্টতা রয়েছে তা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি প্রয়োজন বিবেচনায় আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন–

মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস– এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।
তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার।
জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয়? সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য– বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’– সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)।

অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে অবশ্যই। যেহেতু চার্বাকমতের নিজস্ব রচনার প্রকৃত অভাব রয়েছে তাই কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ আলোচনা করলে চার্বাক দর্শনের ভিন্ন এক ধরনের পরিচয় আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। কিংবা চার্বাকদর্শনের রূপরেখা গঠনে গ্রন্থটি কোন কোন ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কেননা ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ক্ষেত্রে চার্বাকী ধারণার সাদৃশ্য থাকতে পারে।
চার্বাকেতর বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনায় প্রত্যক্ষনির্ভর বস্তুবাদী এক দর্শন হিসেবে চার্বাকের যে পরিচিতি, তা থেকে স্বভাবতই ধারণা হতে পারে যে চার্বাক সিদ্ধান্তে যে ইতিবাচক বক্তব্য আছে, যার কেন্দ্র হলো স্থূল বস্তুবাদ এবং এই বক্তব্যের বিপরীত সব কিছুই এই দর্শনের সমালোচনার বিষয়ীভূত। অনুমান প্রমাণের বিরোধিতায় চার্বাকপক্ষের তৎপরতার মূল এই ব্যাপারে, এবং একই কারণে চার্বাকেরা বাদ দিতে চান আত্মা, পরলোক ইত্যাদিকে– প্রত্যক্ষের মাপকাঠি দিয়ে যেগুলির বিচার চলে না। কিন্তু ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে যখন দেখা যায় যে চার্বাকদের প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কৃত করতে উন্মুখ এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিকেও প্রমেয়ের মর্যাদা দিতে আপত্তি তখন গ্রন্থ-রচয়িতার নির্দিষ্ট বক্তব্য সম্বন্ধে সংশয় জাগে।

ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিতণ্ডা প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছিলো। এই বিতণ্ডারই পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। কেননা, বৈতণ্ডিকের কাজ শুধুই অপরপক্ষের সমালোচনা। এই সমালোচনাতেই বৈতণ্ডিক তাঁর সমগ্র প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেন এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে অপরপক্ষের প্রতিপক্ষ যে স্বপক্ষ, সেই স্বপক্ষের মতামত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। সোজা কথায়, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক, যেখানে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে কেবল অপরের মত খণ্ডন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদী জগতের কোন তত্ত্বই মানেন না, কিন্তু নিজস্ব কোন তত্ত্বের প্রতিষ্টাও তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। অপরের বিচারের ত্রুটি প্রদর্শন করাই যে জয়রাশির মুখ্য উদ্দেশ্য, আলোচ্য গ্রন্থের পরস্পরবিরোধী কয়েকটি সিদ্ধান্ত থেকেও তা পরিস্ফুট হয় বলে লতিকা চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য। যেমন–
ন্যায়দর্শনের সমালোচনা প্রসঙ্গে জাতি বা সামান্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃতি জানিয়ে (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃপৃ:৪-৭) একই গ্রন্থে জয়রাশি ভট্ট বৌদ্ধদের বিচারে ত্রুটি প্রদর্শনকালে জাতির বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তি খণ্ডনে তৎপর হয়েছেন (ঐ, পৃপৃ:৪৬-৫১)। বৌদ্ধ ক্ষণিকসন্তানবাদীদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় গ্রন্থকারের প্রয়াস দেখে মনে হয় তিনি বুঝি আত্মবাদী দার্শনিকদেরই সগোত্র (ঐ, পৃ:৫৫)। কিন্তু পরক্ষণেই অধ্যাত্ম দর্শনে অনুসৃত অনুমান প্রমাণের সাহায্যে আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করার প্রয়াস থেকে বোঝা যায় (ঐ, পৃপৃ:৭৪-৮৩) যে ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া [তাঁর] লক্ষ্য নয়।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)

কারো কারো মতে এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদীরা চার্বাক-সম্প্রদায়েরই ভিন্ন একটি গোষ্ঠি। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে চার্বাকের এক বৃহৎ গোষ্ঠিই এই নেতিবাচক প্রবণতায় সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেনি এবং প্রত্যক্ষকে স্বীকৃতি দিয়ে সাধারণগ্রাহ্য এই প্রমাণের মাধ্যমে পাওয়া বস্তুজগৎকে তার বিষয়বস্তুর পরিসরে এনেছে। এই স্বাভাবিক ধারণারই প্রতিফলন দেখা যায় বস্তুবাদের সঙ্গে চার্বাকী মতবাদের একাত্মীকরণে। এ-প্রসঙ্গে লতিকা চট্টোপাধ্যায় মনে করেন–
কিন্তু চার্বাকের এই বস্তুবাদী প্রকাশকে তার নেতিবাচক প্রবণতারই অঙ্গবিশেষ হিসাবে দেখাটা বোধ হয় অযৌক্তিক নয়। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক মতকে বস্তুবাদের পরিবর্তে হেতুবাদের সঙ্গেই একাত্ম করা অধিকতর সমীচীন। এই হেতুবাদেরই দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী প্রকাশের মধ্যে একটির আশ্রয় বস্তুজগৎ, প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যার পরিচিতি। অপরটির প্রকাশ ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’তে রূপায়িত চার্বাকী ধারায়, বস্তুজগৎকে স্বীকৃতি দিতে না পারায় যা বাস্তববাদী দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত বৌদ্ধ এবং অদ্বৈত বেদান্তের সমপর্যায়ভুক্ত হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)
এ-প্রেক্ষিতে জৈন দার্শনিক বিদ্যানন্দীর ‘তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক’ গ্রন্থের বক্তব্যটি স্মর্তব্য–
‘সর্বথা শূন্যবাদিনস্তত্ত্বোপপ্লববাদিনো ব্রহ্মবাদিনো বা জাগ্রদুপলব্ধার্থক্রিয়ায়ং কিং ন বাধকপ্রত্যয়ঃ’। (তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক)
অর্থাৎ : শূন্যবাদী, তত্ত্বোপপ্লববাদী ও ব্রহ্মবাদী জাগ্রতোপলব্ধিজাত অর্থক্রিয়া বা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুজগতের সত্তাকে সত্য বলে স্বীকার করেন না। (মুক্ততর্জমা)

শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্য’ গ্রন্থেও এই তিনটি মতবাদ একই শ্রেণীর অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, এ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে চার্বাক প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে যে– ‘চার্বাকেরা কোন প্রমাণকে স্বীকার করেন না’–
‘সোহয়মপূর্বঃ প্রমাণাদিসত্তানভ্যুপগমাত্মা’। (খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ : পৃষ্ঠা ২৬)।

হেতুবাদ প্রসঙ্গেও ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনার চেষ্টা হয়েছে। অতএব, সে আলোচনা না বাড়িয়ে এটুকু বলা যায় যে, হেতুবাদের বিপরীতধর্মী দুটি অভিব্যক্তির মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষ যেখানে প্রামাণ্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত, প্রচলিত পরিভাষায় ‘চার্বাক’ সংজ্ঞা সেই দর্শনেরই পরিচয় বহন করে। প্রচলিত প্রত্যক্ষবাদী চার্বাক মতে তত্ত্বের বর্তমানতা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে লভ্য বস্তুজগতকে কেন্দ্র করে। এই বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মতে পাঁচ– ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা মাটি, অপ্ বা জল, তেজ বা আগুন, মরুৎ বা বাতাস এবং ব্যোম বা আকাশ। যেমন ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে–
‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ : ক্ষিতি বা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ।

কিন্তু প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা এই মূল তত্ত্বের সংখ্যা চারে সীমিত রাখতে চান। ব্যোম বা আকাশকে তারা গ্রাহ্য করেন না যেমন–
‘পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি।
তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা।’ (বার্হস্পত্য-সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
চার্বাকেতর দার্শনিকদের বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক-মতের পরিচয়ে এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন অদ্বৈত-বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্য তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে বলেছেন–
লোকায়তিকপক্ষে তু তত্ত্বং ভূতচতুষ্টয়ম্ ।
পৃথিব্যাপস্তথা তেজো বায়ুরিত্যেব নাপরম্ ।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১)।।
অর্থাৎ : লোকায়ত মতে চারটি ভূতকেই তত্ত্ব বলা হয়। উক্ত চারটি ভূত হলো যথাক্রমে পৃথিবী, জল, তেজ এবং বায়ু। অপর কোন ভূত এই মতে স্বীকৃত নয়।

মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকমতে তত্ত্বের উল্লেখ এবং একই লোকায়তিক মতের উপস্থাপনায় এ-প্রসঙ্গে যে লোকগাথাটি উল্লেখ করেছেন, তা হলো–
তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : এই চার্বাকমতে পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু– এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।
.
অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস– শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।
কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–
‘পৃথিব্যপ্ তেজোবায়বস্তত্ত্বানি’। (প্রবোধচন্দ্রোদয়)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।
জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে চতুর্ভূত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–
‘পৃথ্বী জলং তেজো বায়ুর্ভূত চতুষ্টয়ম্’…। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু– এই চারটি ভূত স্বীকৃত।

এভাবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়তিক মতের বহু উল্লেখ করা যেতে পারে। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও সূত্রের মাধ্যমে চতুর্ভূত সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণার অভিব্যক্তি দেখা যায়–
‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি…’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৫৯)
অর্থাৎ : পৃথিবী বা মাটি, জল, তেজ বা আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।

চার্বাকেতর দর্শন-স্বীকৃত পঞ্চভূতের মধ্যে চার্বাক-মতে ব্যোম বা আকাশকে যে তত্ত্ব হিসেবে গ্রাহ্য করা হয় না তার একটাই কারণ, ব্যোম বা মহাশূন্যের জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে হয় না। প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের কাছে প্রত্যক্ষসিদ্ধ এই চারটি তত্ত্ব ছাড়া অন্য কিছু অনুমোদন লাভ করেনি। এই চার তত্ত্বের সমবায়ে দেহ, ইন্দ্রিয় এবং জাগতিক সব পদার্থের সৃষ্টি। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীল তাই এ-প্রসঙ্গে লোকায়তসূত্র উদ্ধৃত করে আরো বলেন–
‘তৎসমুদায়ে বিষয়েন্দ্রিয়সংজ্ঞা’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৬০)
অর্থাৎ : তার (চতুর্ভূতের) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।

বিভিন্ন প্রাণিদেহের উপাদানরূপেও মৌল এই চারটি তত্ত্বের নির্দেশ চার্বাক দর্শনে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বস্তুজগতের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অনুমোদিত চার্বাকী তত্ত্বের সংখ্যা ভারতের প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম হলেও, চার্বাক-দর্শনের ইতিহাসে এটা কাকতালীয় কিনা কে জানে, প্রাচীন গ্রিক চিন্তায়ও কিন্তু এর এক অনুলিপি দেখা যায়। যেমন–
(Plato) প্লেটো’র মতে– ‘there are four elements out of which the body is composed, earth and fire and water and air…’।
আর অ্যারিস্টটল বলেন– ‘Since the bodies of all animals, and likewise of all plants, are composed from the four elements, in some of them earth predominates, as in plants, in others, water, as in aquatic animals, and in others air of fire, as in pedestrious and winged animals.‘ -(‘plato Dictionary, p.74’ : সূত্র: লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)

অতএব, এই আলোচনা থেকে চার্বাক-মত প্রসঙ্গে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে, চার্বাকেরা অবশ্যই প্রত্যক্ষ-প্রমানবাদী। কিন্তু তাঁরা প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদী কিনা অর্থাৎ চার্বাকেরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন কিনা এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমাদেরকে প্রমাণবাদের অন্যতম অনুমান-প্রমাণের আলোচনায় প্রবিষ্ট হতে হবে।
।। খ।।  প্রত্যক্ষ-অনুগামী অনুমান।
প্রত্যক্ষের পরেই প্রাধান্যের বিচারে ভারতীয় দর্শনে যে প্রমাণের অগ্রগামিতা সাধারণভাবে স্বীকার্য সেই অনুমানকেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তীব্রভাবে চার্বাকী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর অনুমান প্রমাণ হিসেবে যাঁদের দ্বারা পূর্ণভাবে অনুমোদিত, প্রতি-আক্রমণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরাও স্ব-স্ব মতবাদের ভিত্তিমূল দৃঢ় ও নিষ্কণ্টক করার মরিয়া প্রচেষ্টায় পশ্চাৎপদ হননি। অনুমান-প্রমাণকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দার্শনিকদের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে প্রবেশের আগে দর্শনের পরিভাষায় অনুমানের লক্ষণ সম্বন্ধে কিছুটা প্রাথমিক পরিচয় সেরে নেয়া দরকার।

মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষলক্ষণের বর্ণনার পর অনুমানকে প্রত্যক্ষ-আশ্রিত বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে–
‘অথ তৎ পূর্বকম্ অনুমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিই অনুমান।

অনুমান প্রত্যক্ষের মতো স্বনির্ভর প্রমাণ নয়। ‘অনু’ শব্দের অর্থ ‘পশ্চাৎ’ এবং ‘মান’ অর্থ জ্ঞান। তার মানে, প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের পর প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সংগৃহীত উপকরণগুলির সাহায্যে নতুন জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয় এই অনুমান প্রমাণ।
ন্যায়বর্ণিত অনুমানের গঠন বোঝাতে সবচেয়ে প্রচলিত দৃষ্টান্ত হলো–
‘পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ– যত্র যত্র ধূমোহস্তি তত্র তত্র অগ্নিঃ, যথা মহানসাদৌ।
অর্থাৎ : পর্বতে বহ্নি আছে যেহেতু পর্বতে আমরা ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করছি। কারণ যেখানে যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে। যেমন রান্নাঘরের চুল্লি।

তার মানে, পর্বতে ধূম বা ধোঁয়ার অস্তিত্ব থেকে বহ্নি বা আগুনের অস্তিত্ব জানা গেলো। আগুনের এই অস্তিত্ব জানলাম অনুমান করে। অনুমানের ভিত্তি এখানে ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে এক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ, যে সম্বন্ধের অভিব্যক্তি ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’ এই ভূয়োদর্শন-জনিত ধারণা। এ ধারণার উৎস আমাদের পুরাতন প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা, যথা– রান্নাঘর এবং অন্যান্য স্থানে ধোঁয়াকে সব সময়ে আগুনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে দেখা গেছে।
এই অনুমানে তিনটি পদ আছে– ধূম, অগ্নি, পর্বত। ভারতীয় ন্যায়ের পরিভাষায় এখানে–
‘ধূম’ হলো ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’ বা ‘সাধন’
‘অগ্নি’ হলো ‘সাধ্য’
‘পর্বত হলো ‘পক্ষ’।

ধোঁয়া দেখে আগুনের অস্তিত্ব আমরা অনুমান করি; কাজেই ধোঁয়া এখানে আমাদের অনুমানলব্ধ জ্ঞানের ‘হেতু’, ‘সাধন’ বা ‘লিঙ্গ’। হেতুর সাহায্য নিয়ে যা অনুমান করা হয়– এ ক্ষেত্রে আগুন– ন্যায়ের পরিভাষায় তার নাম ‘সাধ্য’। যে স্থানে বা অধিকরণে সাধ্যের অস্তিত্ব স্থির করা হয় তার নাম ‘পক্ষ’। উপরের উদাহরণে পক্ষের ভূমিকা পর্বতের। কিন্তু ধূম (হেতু) থেকে পর্বতে (পক্ষতে) অগ্নির (সাধ্যের) অনুমান করা গেলো কী করে? কেননা হেতুর (ধূমের) সঙ্গে সাধ্যর (অগ্নির) নিয়ত-সম্বন্ধ জানা আছে এবং তার কোনো ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম জানা নেই : যেখানেই ধূম সেখানেই আগুন, যেমন রান্নার চুল্লিতে; এবং জলাশয় প্রভৃতি অগ্নিহীন স্থানে ধূম কখনো দেখা যায় না। ‘সাধন’ বা ‘হেতু’র সঙ্গে ‘সাধ্য’র এই চিরকালীন বা নিয়ত এবং অব্যভিচারী সম্বন্ধকে ন্যায়ের ভাষায় বলা হয় ‘ব্যাপ্তি’ বা অবিনাভাব। ব্যাপ্তি হচ্ছে ব্যাভিচররহিত সম্বন্ধ। অতএব ‘ব্যাপ্তি’র ভিত্তিতেই অনুমান সম্ভব; ‘ব্যাপ্তি’ সম্ভব না-হলে অনুমানও অসম্ভব হবে।

অনুমানের ক্ষেত্রে ‘ব্যাপ্তি’র গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ অনুমানের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে এই ব্যাপ্তির জ্ঞানকেই নির্দেশ করা যেতে পারে। ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’– এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে ভিত্তি করে আমরা ‘পক্ষ’ বা পর্বতের সঙ্গে ‘সাধ্য’ বা আগুনের যোগ সাধন করি। ধোঁয়া এখানে ‘সাধ্য’ এবং ‘পক্ষ’ উভয়েরই সাধারণ ধর্ম বা ‘লিঙ্গ’। ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’র সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত থাকার জন্য ‘সাধ্য’র অপর নাম ‘লিঙ্গী’।

প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে পৌঁছানোর যে পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া তাকে বলে অনুমান। অনুমানকে প্রত্যক্ষপূর্বক বলা হয়েছে, কারণ অনুমানগত জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রত্যক্ষের উপর আমাদের নানাভাবে নির্ভর করতে হয়। দৃষ্টি ও অনুভূত নিয়মকে ভিত্তি করে কোন অদৃষ্ট ও অননুভূত বস্তুর সত্তাকে আমরা অনুমান করি। উদাহরণে ধোঁয়াকে প্রত্যক্ষ করে তবেই ধোঁয়ার কারণ হিসেবে আগুনের সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়। নির্ভুল অনুমানের ভিত্তি যে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের জ্ঞান, সেই ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের মূলেও আছে প্রত্যক্ষের কার্যকরিতা। অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধোঁয়া এবং আগুন বা সাধন এবং সাধ্যের একত্র অবস্থানকে প্রত্যক্ষ করে তবেই এই ব্যাপ্তিজ্ঞানের ধারণা সম্ভব। ন্যায়সূত্রের ব্যাখ্যাকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ তাই বলেন–
‘তৎপূর্ব্বকমিত্যনেন লিঙ্গলিঙ্গিনোঃ সম্বন্ধদর্শনং লিঙ্গদর্শনঞ্চাভিসম্বধ্যতে। (ন্যায়ভাষ্য-১/১/৫)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিতে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান নির্ণীত হয় পূর্বে কোন স্থানে লিঙ্গ ও লিঙ্গীর সম্বন্ধদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার (স্মৃতির) মাধ্যমে। (মুক্ততর্জমা)

এ-প্রেক্ষিতে অনুমান প্রমাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের সেই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই প্রধানত চার্বাকেরা অনুমানের প্রামাণ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তিতেই রচিত অনুমান প্রমাণের বিশাল সৌধ, চার্বাকেতর গ্রন্থগুলির বিভিন্ন নজির থেকেই অনুমান হয়, চার্বাকপক্ষের বিচারে এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে অভ্রান্ততার ছাড়পত্র পেতে নিশ্চয়ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই প্রশ্নগুলির বিশ্লেষণমূলক সমাধানের মধ্যেই হয়তো সেই সিদ্ধান্তটাও নিহিত আছে যে, চার্বাকমত কি প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী অর্থাৎ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন, না কি তাঁরা প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী তথা প্রত্যক্ষ ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমানকেও প্রমাণ বলে স্বীকার করেন? এর সুরাহার জন্য নিরূপায় আমাদেরকে চার্বাকেতর দর্শন-সাহিত্যেরই আশ্রয় নিতে হবে।
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে যেটুকু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই মতবাদের সূচনার কাল বা ‘চার্বাক’ নামের সঙ্গে এর সংযুক্তির কাহিনী কিছুই সঠিকভাবে নির্ণয় করা এখনো সম্ভব নয়। তাছাড়া এই চিন্তাধারা চার্বাক দর্শন নামে পরিচিতি লাভ করলেও চার্বাক নামে কোন ব্যক্তিকে এর প্রবর্তক বলে স্বীকার করার কোন প্রমাণও এযাবৎ পাওয়া যায়নি। তবে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এই মতবাদের আদি প্রচারক হিসেবে বৃহস্পতির নাম উল্লেখ করা আছে। ব্যক্তিরূপী চার্বাক এসব গ্রন্থে স্বীকৃতি পেলেও তা উদ্ধৃত হয়েছে বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে।

যেমন চতুর্দশ শতকের মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘চার্বাক-দর্শনম’-এর শুরুর দিকে বলছেন-
‘অথ কথং পরমেশ্বরস্য নিঃশ্রেয়স-প্রদত্বমভিধীয়তে ? বৃহস্পতি-মতানুসারিণা নাস্তিক-শিরোমণিনা চার্বাকেণ তস্য দুয়োৎসারিতত্বাৎ।’ -(সর্বদর্শনসংগ্রহ, পৃষ্ঠা ০২)।
অর্থাৎ : আপনি কিভাবে পরমেশ্বরকে নিঃশ্রেয়সপ্রদ বলছেন ? বৃহস্পতির মতানুসারী নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক কর্তৃক তিনি দূরোৎসারিত- দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ তাঁদের মতে ঈশ্বর নামক কোন পদার্থ নাই।
 .
আর কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হচ্ছে-
‘লোকায়েতামেব শাস্ত্রং… …বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্ ।
তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্ । -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।
অর্থাৎ : বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।
 .
অন্যদিকে অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা হিসেবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে রচিত আরেক জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় ‘যদুবাচ বাচস্পতিঃ’ অর্থাৎ ‘বাচস্পতি যা বলেন’ উল্লেখ করে বাচস্পতি বা বৃহস্পতির উক্তি হিসেবে তিনটি সূত্র উদ্ধৃত করেন। সেগুলো হচ্ছে-
‘অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)
‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি তত্ত্বানি।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব।
‘তৎসমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়সংজ্ঞা।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)
অর্থাৎ : এর (তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
 .
লক্ষ্য করার বিষয় যে, সম্ভাব্য অষ্টম শতকের প্রথমদিকে রচিত জয়রাশি ভট্টের ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে রচয়িতার নাম উল্লেখ না করে এই তিনটি সূত্রই উদ্ধৃত হয়েছে বস্তুবাদী নিদর্শন হিসেবে। আবার বৌদ্ধ পণ্ডিত কমলশীলের (অষ্টম শতক) ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় লোকায়তসূত্র হিসেবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রেরই উদ্ধতি রয়েছে। যদিও সূত্র দুটি কমলশীলের উদ্ধৃতিতে সামান্য পরিবর্তিত আকারে দেখা যায়, যেমন- ‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি তেভ্যশ্চৈতন্যম্’ এবং ‘তৎসমুদায়ে’। এতে অবশ্য ভাবগত অর্থে শ্লোকগুলির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হয় না। যেমন বাংলা তর্জমায় সূত্র দুটির সমন্বিত অর্থ দাঁড়ায়- ‘পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটি তত্ত্বের সমন্বয়ে চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়।’ 
 .
অন্যদিকে উল্লেখিত প্রথম সূত্রটি (অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ)-কে জয়ন্ত ভট্টের (নবম শতক) ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে চার্বাক দর্শনের আদি সূত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (ন্যায়মঞ্জরী ১, পৃঃ-৫৯)। অথচ সংকলিত বার্হস্পত্যসূত্রে এই সূত্রটির অন্তর্ভুক্তিই পাওয়া যায় না কোথাও। এসব দেখেশুনে মনে হয় যে চার্বাক গ্রন্থকাররা প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণে এই আদি সূত্রে অন্তর্ভুক্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, যদিও প্রত্যেকেরই ধারণায় তাঁদের নিজ নিজ ব্যাখ্যাটি প্রকৃত সূত্রকারেরই অনুমোদন-সাপেক্ষ। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থের ভাষ্যকারদের রচনায় এরকম প্রচুর সূত্রের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এগুলির প্রচারক কখনও চার্বাক, কখনও লোকায়ত, আবার কখনও বা বার্হস্পত্য বিশেষণে বিশেষিত হয়েছে।
 .
সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায়ও এরকম কিছু শ্লোকের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। মাধবাচার্যের মতে এগুলি চার্বাক সিদ্ধান্তের প্রবর্তক বৃহস্পতির উক্তি।  
‘অর্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ’- (অর্থাৎ : অর্থ ও কামই পুরুষার্থ)।
‘তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি।’- (অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু- এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।)
‘কিণ্বাদিভ্যো মদশক্তিবৎ চৈতন্যমুপজায়তে।’- (অর্থাৎ : কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে মদশক্তির ন্যায় চৈতন্য জন্মে।)
‘ত্রয্যা ধূর্ত্তপ্রলাপমাত্রত্বেন’- (অর্থাৎ : বেদত্রয়ী ধূর্তের প্রলাপমাত্র।)
‘অগ্নিহোত্রাদের্জীবিকামাত্রপ্রয়োজনত্বাৎ।’- (অর্থাৎ : অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ কর্মের প্রয়োজন জীবিকামাত্র, অন্য কিছু নয়।)
‘লোক-সিদ্ধো রাজা পরমেশ্বরঃ।’- (অর্থাৎ : লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর।)
‘দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ।’- (অর্থাৎ : দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ।)
ইত্যাদি।
 .
এসব শ্লোকেরই অনুরূপ কিছু শ্লোক ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্ন পাতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে, কোথাও বা চার্বাক দর্শনের সাথে যুক্ত হয়ে, কোথাও অন্যভাবে দেখা যায়। শ্লোকগুলির রচয়িতা প্রকৃতই বৃহস্পতি নামে কোন ব্যক্তি কিনা তা বলা কঠিন। তবে যথার্থ ইতিহাসের পর্যায়ে ফেলা না গেলেও চার্বাক মতবাদের সাথে বৃহস্পতির নামে যোগ বহন করে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে কয়েকটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
 .
দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি। কথিত চার্বাক আচার্য বৃহস্পতির প্রকৃত পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তিনি যে ক্রমে এই দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছেন তা ওই উপাখ্যানগুলোর কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয়। ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে চার্বাক মতের প্রচারক বৃহস্পতি যে এই দেবগুরুর সঙ্গে অভিন্ন এবং বাচস্পতি আখ্যায় অভিহিত, তা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে। বাচস্পতি শব্দের অর্থ বাক্যের অধিপতি এবং দেবগুরু বৃহস্পতি সাধারণত এই নামের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে বৃহদারণ্যক উপনিষদ স্মর্তব্য-

এষ উ এব বৃহস্পতি। বাগ্ বৈ বৃহতি, তস্যা এষ পতিঃ, তস্মাদ্ উ বৃহস্পতি।। ১/৩/২০।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রাণের আর-এক নাম বৃহস্পতি। বাক্যকে বলে বৃহতী। যেহেতু তিনি বাক্যের গতি, তাই বৃহস্পতি।
 .
 প্রচলিত বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ধারণা এই চার্বাক মতবাদের মাধ্যমে প্রচারিত, দেবতাদের গুরুর সঙ্গে সে ধারণার মিল বা সংগতি খুঁজে পাওয়া কঠিন বৈকি। তাই হয়তো এ ক্ষেত্রে উভয়ের যোগের সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে কিছু কল্পনার মাধ্যমে। আর এই কল্পনা বিভ্রান্তি বা মায়ামোহের রূপ নিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
 .
বিষ্ণুপুরাণে (৩/১৭/১৪-২৬) বলা হয়েছে, অসুরদের মোহগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই মায়ামোহ তাঁদের মধ্যে এই মারাত্মক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। মায়ামোহের ওই উপদেশগল্পে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে নর্মদা নদীর তীরে কিছু দৈত্য শ্রুতিপ্রতিপাদিত পথে একাগ্র অন্তঃকরণে তপস্যা করছিলো। তাতে ভীত দেবগণ নারায়ণের শরণাপন্ন হন। তারপর নারায়ণ তাঁদেরকে সেমত অবস্থায় দেখে তাঁদের মনোব্যাথা দুর করার জন্য নিজ শরীর হতে মায়ামোহ নামে একজন পুরুষকে উৎপন্ন করে ‘এই ব্যক্তি আপনাদের কার্য সম্পাদন করবে’ বললেন। মায়ামোহ নিজের নাম অনুসারে নিজ প্রবৃত্তি প্রদর্শন করে নিজ মায়ায় দৈত্যদের মোহিত করে সন্মার্গ হতে ভ্রষ্ট করেছিলো। বৃহস্পতির প্রণীত সূত্রানুসারে মায়ামোহ উপদেশ শুনাতে শুনাতে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে তপস্যা হতে নিবৃত্ত করেছিলো।
নাস্তিক মতের প্রচার করে মায়ামোহ যে উপদেশ দিয়েছিলো তা অনেক প্রকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সর্বসাধারণ। যেমন যজ্ঞাদি কর্ম ধর্ম নয়, একথা স্বীকার করতে হয়। কেননা সেখানে পশু সকল হত্যা করা হয়। আর অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম। বেদ হচ্ছে ধূর্ত ব্যক্তিদের প্রলাপ। এরই মোহে পড়ে অসুরেরা বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাঁদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতারা শক্তি সঞ্চয় করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন।
 .
এই মায়ামোহ যে মূলত দেবগুরু বৃহস্পতি তা স্পষ্ট হয় সম্ভাব্য বুদ্ধ-পরবর্তী কালে সৃষ্ট মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের (৭,৮,৯) অন্তর্ভুক্ত অনুরূপ একটি পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্যে। এই উপাখ্যান অনুযায়ী- দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই অসুরদের মধ্যে এই মারাত্মক অবিদ্যা-মূলক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। সেই অবিদ্যার প্রভাবেই অসুরেরা অধর্মকে ধর্ম এবং ধর্মকে অধর্ম মনে করতে শুরু করে।
 .
বেদ বিরোধী এই মতাদর্শ যে আসলে চার্বাক দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা বৃহস্পতির বচন হিসেবেই বিভিন্ন স্থানে পরিদৃষ্ট হয়। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে দেবগুরু বৃহস্পতির কুল রক্ষা করা গেলো বটে, তবে একই সাথে এই চার্বাক মতকে অমঙ্গলের প্রতীক অসুর মত হিসেবেও প্রচার করার প্রয়াসও দেখতে পাই আমরা। এই অসুর বলতে যাঁদেরকেই বোঝাক না কেন, তাঁদের সংস্কৃতি যে বেদবিরোধী ছিলো এ নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা তাঁদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখেই দেখার চেষ্টা করেছিলেন। বৈদিক সংস্কৃতিতে এই অসুর মত যে একান্তই পরিত্যাজ্য সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত প্রচারণার লক্ষ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।। ১৬/৬।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : হে পার্থ, এই জগতে দেবস্বভাব ও অসুরস্বভাব- এই দুই প্রকার মানুষ সৃষ্ট হয়েছে। দেবস্বভাবসম্পন্ন মানুষের কথা বিস্তৃতভাবে বলেছি। এখন অসুরস্বভাববিশিষ্ট মানুষের কথা আমার নিকট শ্রবণ কর।
 .
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ ধর্মবিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্মবিষয় হতে নিবৃত্ত হতে জানে না; তাদের শৌচ নাই, সদাচার নাই এবং সত্যও নাই।
 .
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ।
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ।। ১৬/৮।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : আসুরভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, এই জগৎ সত্যশূন্য; ইহা ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন। ইহার কর্মফলদাতা ঈশ্বর নাই এবং কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই ইহা উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই।
 .
এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবোদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ।। ১৬/৯।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : এই লোকায়তিক মত আশ্রয়পূর্বক পারলৌকিক-সাধনচ্যুত ক্রূরকর্মা, অনিষ্টকারী ও অল্পবুদ্ধি আসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে।
 .
উল্লেখ্য, বেদের সারাংশকে উপনিষদ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’কে উপনিষদের সার বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হচ্ছে মহাভারতের (আনুমানিক ৪০০খ্রীস্টপূর্ব-৪০০খ্রীস্টাব্দ) ভীষ্মপর্বের এক বিশিষ্ট অংশও। তাই গীতায় এ অসুর-মত বিষয়ক আরো শ্লোক উদ্ধৃত থাকলেও উল্লেখকৃত শ্লোক-ক’টি থেকেই কথিত অসুর মত সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বর্ণিত শ্লোক অনুযায়ী এই মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি তথাকথিত ঈশ্বর প্রদত্ত কর্মফল তথা এতদসংশ্লিষ্ট জন্মান্তরবাদও অসার বলে ঘোষিত হয়েছে। অসুর মতের সৃষ্টিতত্ত্বে এই জগৎ যে স্ত্রী-পুরুষের মিলনজাত ও কামোদ্ভূত এবং এর পেছনে অদৃষ্ট নামের কোন ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্য বা স্বর্গ-নরক ও আত্মা এসব অলৌকিক অবাস্তব কোন কারণ নেই তাও এই শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি আমরা। এবং এ শ্লোক থেকে আরেকটি যে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পেয়ে যাই  তা হলো, গীতায় এই অসুর মতকে লোকায়তিক মত হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি। ফলে চার্বাক মতের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে বৃহস্পতির সম্পর্কসূত্রে শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাই লোকায়ত মত নামের এক প্রাচীন ধারণার কাছাকাছি। তবে কি চার্বাক দর্শনের আদি রূপটি লুকিয়ে আছে প্রাচীন লোকায়ত মতের গভীরে কোথাও ? নিশ্চয়ই তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। কিন্তু সে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি-আকর্ষণ করা যেতে পারে।
.
বামাচার :
লোকায়ত-মত পর্যালোচনার আগে চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় বর্ণিত উদ্ধৃতাংশটি প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে-
।। অথ লোকায়তমতম্।।
প্রথমম্ নাস্তিক স্বরূপমুচ্যতে। কাপালিকাঃ ভস্মোদ্ধুলনপরাঃ যোগিনঃ ব্রাহ্মণাদ্যস্ত্যজাতাশ্চ কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ জীবপুণ্যপাপাদিকং ন মন্যন্তে। চতুর্ভূতাত্মকং জগদাচক্ষতে। কেচিত্তু চার্ব্বাকৈকদেশীয়া আকাশং পঞ্চমং ভূতমভিমন্যমানাঃ পঞ্চভূতাত্মকং জগদিতি নিগদন্তি। তন্মতে ভূতেভ্যো মদশক্তিবচ্চৈতন্যমুতূদ্যতে। জলবুদ্বুদবজ্জীবাঃ। চৈতন্যবিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ ইতি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপিকুর্বতে। বর্ষে বর্ষে কস্মিন্নপি দিবসে সর্বে সংভূয় যথানামনির্গমং স্ত্রীভিরভিরমন্তে। ধর্মং কামাদপরং ন মন্যতে। তন্নামানি চার্ব্বাকাঃ লোকায়তাঃ ইত্যাদীনি। গলচর্ব অদনে। চর্ব্বয়ন্তি ভক্ষয়ন্তি তত্ত্বতঃ ন মন্যন্তে পুণ্যপাপাদিকং পরোক্ষং বস্তুজাতমিতি চার্ব্বাকাঃ। …লোকাঃ নির্ব্বিচারাঃ সামান্যাঃ লোকাস্তদ্বদাচরন্তি স্মেতি লোকায়তা লোকায়তিকা ইত্যপি। বৃহস্পতিপ্রণীতমতত্বেন বার্হস্পত্যাশ্চ ইতি।
অর্থাৎ :
অনন্তর লোকায়ত। প্রথমে নাস্তিকদের কথা। কাপালিক :- ভস্ম আচ্ছাদিত যোগীগণ এবং অন্ত্যজ ব্রাহ্মণাদি কেহ কেহ নাস্তিক। তাহারা জীবগণের পুণ্য পাপ প্রভৃতির বিচার করে না। তাহারা জগতকে চতুর্ভূতাত্মক বলিয়া মনে করে। চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদিগের কেহ কেহ আকাশকে পঞ্চম ভূত রূপে ধরিয়া জগতকে পঞ্চভূতাত্মক বলিয়া থাকে। তাহাদের মতে চৈতন্য মদশক্তির ন্যায় আবির্ভূত হয়। জীবগণ জলবুদবুদ্ তুল্য। পুরুষ চৈতন্যবিশিষ্ট শরীরমাত্র। তাহারা মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিয়া থাকে এবং মাতা প্রভৃতি অগম্য নারী প্রভৃতিতেও গমন করিয়া থাকে। প্রতি বৎসর কোনো একদিনে সকলে একত্র হইয়া যথাভিপ্রেত স্ত্রীগণের সহিত রমন করিয়া থাকে। কাম ব্যতীত ধর্ম নাই। এই জন্যই চার্বাকদিগকে লোকায়ত বলা হইয়া থাকে। পরোক্ষ বস্তুসমূহ হইতে জাত গলাধঃকরণ ও চর্বণ হেতুই চার্বাক বলা হইয়া থাকে। …নির্বিচারে সাধারণ লোকের ন্যায় আচরণ করে বলিয়াই তাহাদিগকে লোকায়ত বা লোকায়তিকও বলা হইয়া থাকে। তাহাদের মত বৃহস্পতি প্রণীত বলিয়াই তাহাদের বার্হস্পত্যও বলে।
 .
উদ্ধৃতিটিতে প্রাচীন তান্ত্রিক মত বামাচারের সাথে চার্বাক মতকে মিশিয়ে ফেলে তথ্য বিচ্যুতি ঘটানোর প্রবণতা অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না। তবে ভারতীয়  সভ্যতার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক ধ্যানধারণায় প্রকৃতিস্বরূপা নারীযোনির আদিম জাদুবিশ্বাস সংশ্লিষ্ট প্রাচীন তান্ত্রিক আচারের সাথে চার্বাকী লোকায়ত মতাদর্শকে এক করে দেখানোর অন্যতম কারণ হয়তো উভয়ই বেদবহির্ভূত লোকায়তিক চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভূত বলেই। কিন্তু এই তন্ত্র-সাধনার সাথে চার্বাক মতের সরাসরি পার্থক্যটাই হলো তান্ত্রিক আচার সুস্পষ্টভাবেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যনিষ্ট কিন্তু দেহাচারী স্বতন্ত্র সাধন-পদ্ধতি, অন্যদিকে চার্বাক মতাদর্শ সম্পূর্ণই দেহাত্মবাদী বস্তুতান্ত্রিক দর্শন। যার সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনই সম্পর্ক নেই। তাই আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে পঞ্চমকারপূর্ণ অর্থহীন তান্ত্রিক সাধনার বীভৎসতায় এর আদি-তাৎপর্য না খুঁজে কেবল লোকায়তিক আচারের দোহাই দিয়ে নির্দিষ্ট দর্শনদৃষ্টির সাথে মিশিয়ে ফেলাটা যথাযথ উপস্থাপন নয় বলেই মনে হয়। বিষয়টির কিঞ্চিৎ অনুধাবনের নিমিত্তে প্রাচীন তন্ত্র-সাধনার গূঢ়তত্ত্ব উদ্ঘাটন না-হলেও রহস্য-চিহ্নায়ক তন্ত্র-নির্দেশনার কিছু উদ্ধৃতি টানা যেতে পারে।
.
এক্ষেত্রে প্রাচীন ‘কুলার্ণব-তন্ত্র’-এ (সূত্র: লোকায়ত দর্শন / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) বলা হচ্ছে-
মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রামৈথুনমেবচ।
মকারপঞ্চকং দেবি দেবতাপ্রীতিকারকম্ ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন- এই পাঁচটি বস্তুর নামের আদিতে ‘ম’ অক্ষরটি থাকায় ইহাদের সংক্ষিপ্ত নাম মকার। এই পঞ্চমকার দেবতাদিগের জন্যও প্রীতিকারক।
.
মকারপঞ্চকং দেবি দেবানামপি দুর্লভং।
মদ্যৈর্মাংসৈন্তথা মৎসৈর্মুদ্রাভির্মৈথুনৈরপি।।
স্ত্রীভিঃ সার্দ্ধং মহাসাধুরর্চ্চয়েৎ জগদম্বিকা।
অন্যথা চ মহানিন্দা গীয়তে খণ্ডিতৈঃ সুরৈঃ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার তন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। পঞ্চমকার ব্যতীত তান্ত্রিকের কোনো কার্যেই অধিকার নাই। পঞ্চমকার দেবতাদিগেরও দুর্লভ ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকার দ্বারা জগদম্বিকাকে পূজা করিতে হয়।
.
পঞ্চমেন বিনা দেবি চণ্ডিমন্ত্রং কথং জপেৎ। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার ব্যতীত চণ্ডিমন্ত্র কেমন করিয়া জপ হইতে পারে ?
 .
যদিও তান্ত্রিক রিচ্যুয়াল বা আধ্যাত্মিক তন্ত্রবিশ্বাস মতে বলা হয়ে থাকে, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গূঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়, তবু একই প্রাকৃত উৎস থেকে উদ্ভূত এই আদিম তান্ত্রিক বিশ্বাস আর বার্হস্পত্য মতাদর্শের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য তা বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

তন্ত্রসাধনায় যত গূঢ় রহস্যই থাকুক না কেন, এটা যে কামপ্রধান আচারই তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যেমন-
কামেন মায়য়া চৈব পুটিতং কামবীজকম্ ।
তদা কামেশ্বরো মন্ত্রঃ সর্ব্বকামফলপ্রদঃ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৩৫)
অর্থাৎ : কামবীজ (কীং) এবং মায়াবীজ (হ্রীং) দ্বারা কামবীজকে পুটিত করিলে, তাহা সর্ব্বকাম ফলপ্রদ কামেশ্বর মন্ত্র হয়। (কীং হ্রীং কীং হ্রীং কীং)।
.
শ্রীপার্ব্বত্যুবাচ-
মন্ত্রার্থং মন্ত্রচৈতন্যং যোনিমুদ্রাং নবেত্তি যঃ।
শতকোটিজপেনাপি তস্য বিদ্যা ন সিধ্যতি।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/১)
মহাদেব মহাদেব ইতি যৎ পূর্ব্বসূচিতম্ ।
এতত্তত্ত্বং মহাদেব কৃপয়া বদ শঙ্কর।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/২)।
অর্থাৎ :
পার্ব্বতী বলিলেন- হে মহাদেব ! যে জন মন্ত্রার্থ মন্ত্রচৈতন্য এবং যোনিমূদ্রা জানে না, শতকোটি যপের দ্বারাও তাঁহার বিদ্যা (ইষ্টমন্ত্র) সিদ্ধ হয় না। আপনি পূর্বে এইরূপ যে সূচনা করিয়াছিলেন, হে শঙ্কর ! এই তত্ত্ব কৃপাপূর্ব্বক বলুন। ১-২।
 .
তবে চার্বাকরা বেদকে প্রামাণিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তন্ত্রসাধকদের ধ্যান-ধারণায় ব্রাহ্মণ্যবাদী বিশ্বাসের ছাপ পুরোদমেই বিদ্যমান দেখা যায়। যেমন-
অস্যাঃ স্মরণমাত্রেণ জীবন্মুক্তশ্চ সাধকঃ।
একোচ্চারণমাত্রেণ অশ্বমেধাযুতং ফলম্ ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৪৯)
অর্থাৎ : কালিকামন্ত্র স্মরণমাত্রই সাধক জীবন্মুক্তি লাভ করে এবং একবার মাত্র উচ্চারিত হইলে অযুত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পাদনের ফল লাভ হয়।
 .
এই যাগযজ্ঞ বা বৈদিক বিশ্বাসের সাথে অবাধ কামাচারের মণি-কাঞ্চণ যোগের বৈধ সংকলকের ভূমিকায় তান্ত্রিকদের কালিকামন্ত্রের কার্যকর শক্তি যে কী বিপুল, তা তন্ত্রসাধনায় কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের ‘কুলাচার-কথন’ উপাখ্যানের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়-
শ্রীদেব্যুবাচ-
দেবদেব মহাদেব জগৎপ্রলয়কারকঃ।।
কুলাচারে তু মদ্যাদ্যৈঃ কথং সিদ্ধির্ভবেৎ প্রভো।
অর্ধমকারণং হ্যেতৎ সংশয়ং ছিন্দি মে প্রভো।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১)
শ্রীভৈরব উবাচ-
সাধু পৃষ্ঠো হি দেবেশি কথয়ামি শৃণুম্ব মে।
পুরা দারুবনে রম্যে মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মদ্যং পিবন্তি নিত্যশঃ।
তদ্দষ্টানুচিতং কর্ম্ম বির্ষ্ণুমাং সমুপস্থিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৩)
দেবদেব মহাদেব সৃষ্টিস্থিতিলয়াত্মকঃ।
প্রভো দারুবনে পাপা মদ্যপানরতাস্তথা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৪)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।
দিগম্বরাশ্চ মত্তাশ্চ কিং গতিশ্চ ভবিষ্যতি।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৫)
ইতি বিষ্ণুবচঃ শ্রুত্বা তমবাদমহং প্রিয়ে।
কালিকায়া মহাবিদ্যা অনিরুদ্ধঃ সরস্বতী।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৬)
বিদ্যারাজ্ঞীতি সা প্রোক্তা এতন্মন্ত্রপ্রজপকাঃ।
পরং মুক্তা ভবিষ্যন্তি তদ্গায়ত্রীং জপন্তি চ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/৭)
কালিকায়াঃ প্রভাবেন সর্ব্বে দেবা বিমোহিতাঃ।
ভ্রুণহত্যা-মাতৃবধাৎ পরশুরামো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৮)
দত্তাত্রেয়শ্চ ত্রিপুরঃ সুরাপানাদ্বিমোচিতঃ।
ব্রহ্মহত্যা-শিরচ্ছেদাদহং রুদ্রোহপি মোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৯)
গৌতমস্ত্রীধর্ষণাচ্চ দেবেন্দ্রোহপি বিমোচিতঃ।
কন্যায়া ধর্ষণাদ্বাপি ব্রহ্মাবাচং বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১০)
চাণ্ডালীগমনাদ্বাপি বশিষ্ঠোহপি বিমোচিতঃ।
রাবণস্য বধাচ্চাপি রামচন্দ্রো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/১১)
.
অর্থাৎ :
দেবী কহিলেন- হে দেবদেব মহাদেব। আপনি জগৎ প্রলয়কারক। হে প্রভু ! কুলাচারবিধি-নির্দ্দিষ্ট মদ্যাদি পঞ্চমকার অধর্ম্ম অর্থাৎ পাপ সৃষ্টির কারণ। সুতরাং তৎসমুদয় কিরূপে মন্ত্রসিদ্ধি-প্রদায়ক হইতে পারে প্রকাশ করিয়া আপনি আমার সন্দেহ দূর করুন। ১।
ভৈরব কহিলেন- দেবেশি ! তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে মুনিগণ কামমোহিত চিত্তে রম্য দারুবনে নিয়ত মদ্যপান এবং পরস্ত্রী ধর্ষণকার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। মুনিগণের এই সকল অন্যায় কার্য্য দর্শন করিয়া, বিষ্ণু আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। ২-৩।
তখন বিষ্ণু আমাকে বলিতে লাগিলেন, হে দেবদেব মহাদেব ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের কর্ত্তা। হে প্রভো ! দারুবনে কামমোহিত মদ্যপায়ী পাপাত্মা দিগম্বর ও পানমত্ত মুনিগণ পরস্ত্রী ধর্ষণ করিতেছে। ইহাদের  কি গতি হইবে। ৪-৫।
হে প্রিয়ে ! তৎকালে বিষ্ণুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, কালিকা-নামক যে মহামন্ত্র এবং অনিরুদ্ধ যাহার সরস্বতী, যাহা মন্ত্রসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এই সকল মুনিগণ সেই মহামন্ত্র জপ করে। সেই কালিকা গায়ত্রী জপ করিয়া ইহারা সকলেই শ্রেষ্ঠ মুক্তি লাভ করিবে। ৬-৭।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দেবতারাও বিমোহিত হইয়া থাকেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে পরশুরাম ভ্রুণহত্যা ও মাতৃবধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। ৮।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দত্তাত্রেয় এবং ত্রিপুর সুরাপানের পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। আমি রুদ্রও স্বয়ং ব্রহ্মহত্যা বা ব্রহ্মার শিরচ্ছেদরূপ পাতক হইতে কালিকাদেবীর প্রভাবেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলাম। ৯।
সুরপতি ইন্দ্রও কালিকাদেবীর প্রভাবে গুরুপত্নী গৌতমীতে ধর্ষণজনিত পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন এবং ব্রহ্মাও কন্যাধর্ষণহেতু পাপ হইতে, বশিষ্ঠ চাণ্ডালীগমন পাপ হইতে এবং রামচন্দ্র রাবণবধজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। ১০-১১। 
 .
এবং কালিকামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে কুলাচার পালন করতে হবে তারও বর্ণনা রয়েছে কুমারীতন্ত্রে-
ব্রাহ্মণস্তাম্রপাত্রে তু মধুমদ্যং প্রকল্পয়েৎ।
নটী কাপালিকা বেশ্যা রজকী-নাপিতাঙ্গনা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২১)
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২২)
এতাসু কাঞ্চিদানীয় ততস্তু যোনিমণ্ডলে।
পূজয়িত্বা মহাদেবীং ততো মৈথুনমাচরেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২৩)
.
অর্থাৎ :
ব্রাহ্মণ তাম্রপাত্রস্থিত মধুকেই মদ্যরূপে কল্পনা করিবে।
নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা এবং মালাকার কন্যা- ইহারা নবকন্যা বা গ্রহণীয়া কুলযুবতী বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ২১-২২।
এই সকল কুলযুবতী মধ্যে অন্যতমা কুলযুবতী গ্রহণ করিয়া তাহার শক্তিমণ্ডলে কালিকা দেবীর পূজা করিবে। তৎপর কুলযুবতীর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। ২৩।
 .
 বামাচারী তান্ত্রিক সাধনায় দেহজ কামের সাথে আধ্যাত্মিকতা মেশানো এই প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই শুদ্ধ বৈদিক আচার বা সামাজিক রুচি ও সদাচারের পরিপন্থী ছিলো। তাই হয়তো ব্রহ্মবাদীরা একে কদাচারের তুল্য হিসেবে বিবেচনা করতে কার্পণ্য করেননি। অন্যদিকে স্রেফ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত চার্বাক মতাদর্শকেও এই ব্রহ্মবাদীরা নিন্দনীয় দেহজ কামনা-বাসনার দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে গেছে সবসময়ই। ফলে এ দুটোকে এক করে দেখানোর প্রবণতা বোধ করি অস্বাভাবিক নয়। তার উপর এই বামাচারী তান্ত্রিক সাধনার নিমিত্তে যখন অতি সম্মান ও জ্ঞানীর আসনে বৃহষ্পতির নাম উদ্ধৃত হয়, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। কেননা বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তা রীতিমতো লোমহর্ষক-
বৃহস্পতিসমো যন্তু ভবিতুং কাময়েন্নরঃ।
সর্ব্বো বৃহস্পতিসমো ভবেচ্চৈব ন সংশয়ঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/১৯)
সুন্দরীং যৌবনোন্মত্তাং নারীমানীয় নিত্যশঃ।
অষ্টোত্তরশতং জপ্তা কুলমামন্ত্র্য মন্ত্রবিৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২০)
মৈথুনং যঃ করোত্যেব স তু সর্ব্বং ফলং লভেৎ।
তন্মুখে চ মুখং চ দত্ত্বা সহস্রং মানসং জপেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২১)
স ভবেৎ সর্ব্বসিদ্ধিদো নাত্র কার্য্যবিচারণা।
সর্ব্বেষাং সাধনাং মধ্যে শ্রেষ্ঠঃ স্যাৎ কুলসাধনম্ ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২২)
তস্মাৎ সর্ব্বপ্রযতেœন সাধয়েৎ সুসমাহিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২৩)।
 .
অর্থাৎ :
যে ব্যক্তি বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হইতে ইচ্ছা করে সে ব্যক্তি এই সাধনাপ্রভাবে বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান হইয়া থাকে, এতদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ১৯।
প্রত্যহ সুন্দরী যৌবনোন্মতা কুলযুবতী আনয়নপূর্ব্বক প্রথমে কুলাগার অভিমন্ত্রিত করিবে। তৎপর মন্ত্রজ্ঞ সাধাক অষ্টোত্তর শতবার কালিকামন্ত্র জপ করিয়া ঐ কুলস্ত্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে কুলস্ত্রীর সহিত রতিক্রিয়া সম্পন্ন করিলে সাধক পূর্ণফল লাভ করিয়া থাকে।
রতিকালে কুলযুবতীর মুখে মুখ প্রদান করিয়া এক-সহস্র সংখ্যক মানস জপ করিবে। ২০-২১।
যে ব্যক্তি এইরূপে কার্য্য করে সে সর্ব্বসিদ্ধিদাতা হইয়া থাকে। এতদ্বিষয়ে বিচার বিতর্ক অনাবশ্যক। সর্ব্বপ্রকার সাধন পদ্ধতির মধ্যে কুলাচারমতে সাধনই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং সর্ব্বপ্রযত্নে অত্যন্ত একাগ্রতার সহিত কুলাচার পদ্ধতিতে সাধন করিবে। ২২-২৩।  
.
বৃহস্পতির তুল্য জ্ঞানী হওয়ার এই দেহাচারী তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতির নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয়, পরবর্তীকালের ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক দর্শনের আদিতে বৃহস্পতির নামেই এই দর্শনটিকে হয়তো নিচু ভোগবাদী মতাদর্শ হিসেবে প্রচারের প্রবণতা কার্যকর ছিলো। এবং তা হয়তো সফলও হয়েছিলো।
.
উল্লেখ্য, সহজ কথায় তান্ত্রিক মতের মূল চেতনা হলো- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে দেহভাণ্ডে।’ তান্ত্রিক সাধনার এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরণন আমরা নির্ব্বাণতন্ত্রে দেখতে পাই এভাবে-
মহাব্রহ্মাণ্ডকে যদ্ যদ্ প্রকারং পরমেশ্বরি।
তত্তৎ সর্ব্বং হি দেবেশি বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ডমধ্যতঃ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/১৯)
তদ্রূপঞ্চ দেহমধ্যে ভুবনানি চতুর্দ্দশ।
সৃষ্টিপ্রকারব্রহ্মাণ্ডে ভেদো নাস্তি সুনিশ্চিতম্ ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/২০)।
অর্থাৎ :
হে দেবাধীশ্বরি ! পরমেশ্বরি ! মহাব্রহ্মাণ্ড মধ্যে যাহা যে প্রকারে রহিয়াছে বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ড মধ্যেও সেই সকল সেইভাবে রহিয়াছে। ১৯।
সেইরূপ দেহমধ্যে চতুর্দ্দশ ভূবন বর্ত্তমান। সৃষ্টিপ্রকার ব্রহ্মাণ্ডে কোন ভেদ নাই ইহা সুনিশ্চয়রূপে জানিবে। ২০।
.
ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ সংস্করণ এই দেহভাণ্ডকে উপলক্ষ করে সাধনমার্গের মাধ্যমেই ব্রহ্মাণ্ডের যে সাধনা বিস্তার তান্ত্রিক বিশ্বাস-সম্মত, এর সাথে ইন্দ্রিয়াতীত কোন সত্তায় অবিশ্বাসী ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক মতের বিরাট দার্শনিক প্রভেদ বর্তমান। তবু হয়তো তাদের মধ্যকার অন্তর্গত সাদৃশ্য কেবল এখানেই যে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় উভয়ের লক্ষ্যই দেহপ্রত্যক্ষতা। ভাববাদী বা ব্রহ্মবাদীদের দৃষ্টিতে একটি অনাচারী, অন্যটি বেদবিদ্বেষী। ফলে প্রতিপক্ষ কর্তৃক বিরুদ্ধতার সমান্তরাল অবস্থানে উভয় মত হয়তো তাঁদের কাছে একই রেখায় মিশে গেছে একসময়। আর তাই প্রাচীন জড়বাদী লোকায়ত দর্শনের প্রতি অন্যান্য মতাবলম্বীদের দিক থেকে গুণরত্নের উপরিউক্ত বক্তব্যটি হয়তো এই সাধারণ প্রবণতারই লক্ষণ। চার্বাক মতের আদিরূপ সন্ধানে এই লক্ষণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা আবশ্যক যে, জৈন দার্শনিক গুণরত্ন চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের সাথে তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতিকে মিশিয়ে দিলেও আধুনিককালের অতি-প্রসিদ্ধ বিদ্বান-গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কিন্তু এই লোকায়তের সাথে বৌদ্ধ-তান্ত্রিকদের একাত্ম করে উত্তরকালের সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধ-সহজযান হিসেবে উল্লেখ করে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তাঁর ‘বৌদ্ধধর্ম’ গ্রন্থে বলেছেন যে, নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিক সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি সহজিয়া-সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, সহজিয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়? কোত্থেকেই বা এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হলো? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন, এই সহজিয়া সম্প্রদায় বা সহজযান আসলে হলো বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল-
‘যে পঞ্চকামোপভোগ নিবারণের জন্য বুদ্ধদেব প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে চরিত্র-বিশুদ্ধি বৌদ্ধধর্মের প্রাণ, যে চরিত্রবিশুদ্ধির জন্য হীনযান হইতেও মহাযানের মহত্ত্ব, যে চরিত্র বিশুদ্ধির জন্য আর্যদেব ‘চরিত্র বিশুদ্ধি প্রকরণ’ নামে গ্রন্থই রচনা করিয়া গিয়াছেন, সহজযান সেই চরিত্রবিশুদ্ধি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিল। বৌদ্ধধর্ম সহজ করিতে গিয়া, সহজযানীরা যে মত প্রচার করিলেন তাহাতে ব্যভিচারের স্রোত ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বৌদ্ধধর্ম নেড়ানেড়ীর দলে গিয়া দাঁড়াইল। সহজযানীরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ আলো-আঁধারী ভাষা। কানে শুনিবামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে তাহার গূঢ় অর্থ অতি ভয়ানক। তাঁহারা দেহতত্ত্বের গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন।… যে বোধিচিত্ত মহাযানমতে নির্বাণ পাইবার আশায় ক্রমেই আপনার উন্নতি করিতেছিলেন, দেহতত্ত্বের মধ্যে আসিয়া তাহার যে কী দশা হইল তাহা আর লিখিয়া জানাইব না। জানাইতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৩)

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বৌদ্ধধর্মের এই ভয়াবহ অধঃপতনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরো বলছেন-
‘বৌদ্ধধর্মে অনেকদিন হইতেই ঘুণ ধরিয়াছিল। বুদ্ধদেব নিজে যেদিন স্ত্রীলোকদিগকে দীক্ষা দিয়া ভিক্ষুণী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন- সেইদিন হইতেই তাঁহাকে সঙ্ঘের বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম করিতে হইয়াছিল। তিনি ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের এক বিহারে থাকিতে দিতেন না। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পাঁচ ছয় শত বৎসর পর হইতে ভিক্ষুরা ক্রমে বিবাহ করিতে লাগিল- ক্রমে একদল গৃহস্থ ভিক্ষু হইল। এইখান হইতেই ঘুণ ধরা আরম্ভ হইল।… ভিক্ষুর ছেলে- সে একেবারেই ভিক্ষু হইত।… আমাদের দেশে যেমন ‘জাত বৈষ্ণব’ বলিয়া একটা জাতি হইয়াছে- সেকালেও তেমনি ‘জাত ভিক্ষু’ বলিয়া একটা জাতির মত হইয়াছিল। উহাদের যত দলপুষ্টি হইতে লাগিল, আসল ভিক্ষুদের অবস্থা তত হীন হইতে লাগিল। গৃহস্থ ভিক্ষুরা কারিগরি করিয়া জীবন নির্বাহ করিত- ভিক্ষাও করিত- কেন বা রাজমজুর হইত, কেন বা স্যাকরা হইত, কেন বা ছুতার হইত- অথচ ভিক্ষাও করিত, ধর্মও করিত, পুজাপাঠও করিত। বৌদ্ধধর্মের পৌরহিত্যটা ক্রমে নামিয়া আসিয়া কারিগরদের হাতে পড়িল।… লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধির নামগন্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে লোপ পাইল।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৯)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহামহোপাধ্যয়ের এই অনুমান যদি নির্ভুল হয় তাহলে এ-থেকে ঠিক কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব? ওই তথাকথিত অধঃপতনের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করে দেবীপ্রসাদ বলছেন-
‘ওই ‘অধঃপতিত’ বৌদ্ধধর্মের রূপটিকে বিশ্লেষণ করে কি তার মধ্যে শুধুমাত্র স্থূলবুদ্ধি, নির্বুদ্ধি এবং নিরক্ষরতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? না, এমন কিছু কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে ইতিপূর্বেই আমাদের পরিচয় ঘটেছে?
যদি প্রথম সম্ভাবনাটি ঠিক হয় তাহলে মানতে হবে, প্রাকৃতজনের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধধর্মের মহত্তর ও বৃহত্তর আদর্শগুলির স্থূল-ব্যাখ্যা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঠিক হয়- যদি দেখা যায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং জাত-আলাদা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতকগুলি আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এই তথাকথিত অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের প্রাণবস্তু হয়ে দাঁড়ালো- তাহলে স্বীকার করতে হবে, সমাজের নিচের মহলের মানুষদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়া সত্ত্বেও তাদের চিন্তাচেতনায় এই বৌদ্ধধর্ম কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ, সমাজের নিচের মহলের ওই মানুষদের বিশ্বাসাদির উপর যদিও কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রলেপ এসে পড়লো তবুও তারা আসলে তাদের আদিম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই মেতে রইলো। এই সম্ভাবনা অনুসারে সহজিয়া-সম্প্রদায়কে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে মনে না করে কৃত্রিম বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচায়ক মনে করাই সঙ্গত হবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৬০)

বস্তুত এটাই যৌক্তিক যে, সহজিয়া সম্প্রদায়ের উপর বৌদ্ধতত্ত্বের ওই প্রলেপটাই কৃত্রিম এবং অর্বাচীন। তাই একে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের পরিচায়ক না বলে বরং আদিম জাদুবিশ্বাসের কৃত্রিম বৌদ্ধসংস্করণ মনে করাই ন্যায়সঙ্গত। এবং এই প্রভেদটা এইজন্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, দেবীপ্রসাদের মতে, কেননা, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করলে এ-সম্প্রদায়ের মূল কথাগুলিকে বোঝবার সময় বৌদ্ধধর্মের মৌলিক তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেখতে হবে একদা-মহৎ কতকগুলি ধ্যানধারণা কীভাবে অশিক্ষিত ও মূর্খ মানুষদের চেতনায় স্থূল ও বিকৃত অর্থে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ-পরিভাষায় কৃত্রিমভাবে সজ্জিত এক আদিম বিশ্বাসের পরিচায়ক বলে গ্রহণ করলে এই সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ওই বৌদ্ধ-পরিভাষাগুলিই অপ্রাসঙ্গিক বলে স্বীকৃত হবে এবং সে-ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের স্বরূপ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করবার প্রয়োজন হবে।

এখানে স্মর্তব্য যে, আমরা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট অন্য অধ্যায়ে সিন্ধু-ধর্ম প্রসঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক উর্বরতামূলক আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে শক্তি-উপাসনার যে সুপ্রাচীন উপাদানগুলির পরিচয় পেয়েছি তার সাথে সহজিয়া-সম্প্রদায়ের মূল তত্ত্বগুলির বিচার করলেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, সমাজ-বিকাশের পিছনদিককার পর্যায়ে আটকে পড়ে থাকা মানুষদের মধ্যেই সেই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের স্পষ্টতর স্বাক্ষর রয়েছে। তাছাড়া শাস্ত্রী মহাশয়ের রচনাতেও এমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন (বৌদ্ধধর্ম ১০৬), বৌদ্ধধর্ম কোথায় গেল? উত্তরে তিনিই বলছেন, প্রধানত মুসলমান আক্রমণের দরুনই বাংলা দেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। উড়িষ্যার জঙ্গলে, চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আজো ওই (অধঃপতিত) বৌদ্ধধর্মের জীবন্ত নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলগুলি যে প্রধানতই দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের অঞ্চল সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে দেবীপ্রসাদ প্রশ্ন রাখেন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে-সব ধ্যানধারণাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে অনুমান করছেন সেগুলি টিকে থাকবার মতো স্বাভাবিক জমি কেন এই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেই পেলো? এইদিক থেকেও, ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের সঙ্গে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অনুমান করা সঙ্গত নয় কি?

এ-প্রেক্ষিতে আরো বলা বাহুল্য হবে না যে, ওই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায় একটি নয়, বহু। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নানান নামের অন্তরালে মূলত ওই একই সম্প্রদায়কে টিকে থাকতে দেখা যায় : কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব এবং আরো অনেক নাম। এবং শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/৩২৫)- ‘সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা- সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।’
আর নৃতাত্ত্বিক যুক্তি অনুসারে এই জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, উক্ত ধ্যানধারণার উৎসে যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানই বর্তমান থাকে এবং যদি বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদন-পদ্ধতিতে খুব বড়ো রকমের মৌলিক উন্নতি দেখা না দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নানান দলের চেতনায় উক্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব নানান নামে প্রতিভাত হওয়াই সম্ভব এবং স্বাভাবিক।

যদিও অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এই সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মেরই স্মারক বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তবুও তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, আধুনিক বিদ্বানদের এই সিদ্ধান্তটি সহজিয়াদের নিজেদের কাছেই অজ্ঞাত-
‘The Sahajias would by no means confess that they were Buddhists, nor refer to any Buddhist texts whick would make it far easier to trace the doctrines to their genuine origin…. It is the duty of a historian and scholar to thrash out grains from the chaff and find out the true Buddhist elements in their views and practices.’
অর্থাৎ : সহজিয়ারা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে তারা আসলে বৌদ্ধ। তারা কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থেরও উল্লেখ করবে না- তাহলে তাদের মতের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হতো।… ঐতিহাসিক ও বিদ্বানের কর্তব্য হলো, ধানকুটে চাল বের করবার মতো করেই সহজিয়াদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিকে খুঁজে বের করা। (তর্জমা- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৬৩)

ধান কুটে চাল বের করার দৃষ্টান্তটি জুতসই বলা চলে। কেবল কোনটি চাল আর কোনটি তুষ- এখানেই বিভেদ। দেবীপ্রসাদ বলেন, ওই বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিই তুষের মতো- সহজিয়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এই তুষই বাদ দিতে হবে। বাদ দিলে কী পড়ে থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান। আর এর সূত্রের মাথাটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেই সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগের উর্বরতাকেন্দ্রিক আদিম জাদু-বিশ্বাসের মধ্যেই হয়তো। তাহলে আমাদের আলোচ্য লোকায়তিক দর্শনের সাথে ওই সহজিয়া-সম্প্রদায়গুলির সাদৃশ্য কোথায়? মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে হয়তো বা লোকায়তিকদের সঙ্গে এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের কোনভাবে সাদৃশ্য রয়েছে যা গভীর পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। তবে মোটাদাগে অন্তত একটা সাদৃশ্য খুবই দৃশ্যমান যে, সনাতন বেদপন্থীরা মূলত উভয় সম্প্রদায়কেই ঘৃণার চোখে দেখেছেন। আর তার ফলেই তাঁদের মধ্যে এই দুটিকে এক করে দেখা কিংবা উপস্থাপনের উৎসাহ ব্যাপক বলে মনে হয়।

কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠা উচিৎ যে, তথাকথিত অধঃপাত নির্ণয়ে বেদপন্থীদের এই উৎসাহ আসলে কতোটা প্রাসঙ্গিক? কেননা লোকায়তিক বা সহজিয়াদের ওই বামাচার বা কামাচার যদি তাঁদের কাছে অবৈদিক ও অধঃপাত হিসেবেই বিবেচিত হয় তাহলে বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত বামাচার বা কামাচার-সদৃশ উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্যগুলিকে বেদপন্থীরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

বৈদিক সাহিত্যে বামাচার :
বৈদিক সাহিত্যে বেদ-ত্রয়ীর অন্যতম যজুর্বেদের নিদর্শন দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। শুক্ল-যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার ২৩/২১ থেকে ২৩/৩১ বেদমন্ত্রগুলিতে কিছু দৃশ্য ও সংলাপের বর্ণনা রয়েছে। কিসের সংলাপ? মৈথুনের। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মৈথুন-দৃশ্যে ও মৈথুন-সংলাপে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা কেউই আজকালকার লম্পটের মতো লোক নন। বরং এরা হচ্ছেন পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক- অধ্বয্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা প্রমুখ। তার মধ্যে ২৩/২২-২৩ : অধ্বয্যু কুমারীকে অভিমেথন করছেন- দুটি মন্ত্রে অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৪-২৫ : ব্রহ্মা মহিষীকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৬-২৭ : উদ্গাথা কুমারী বাবাতাকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে অনুরূপ সংলাপ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক, হরফ প্রকাশনী কলকাতা থেকে প্রকাশিত শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার অনুবাদক ২৩/২০ মন্ত্রের পর আগেভাগেই টীকায় বলেছেন-

‘এখান থেকে ৩১ কণ্ডিকা পর্যন্ত মহীধর ভাষ্যে অশ্লীল অর্থ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক পবিত্র বৈদিক মন্ত্রে এ অশ্লীল অর্থ কেন, তা আমাদের বোধগম্য হয় না। ভাষ্যকার কারণ বলেছেন অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্বের সংস্কারের জন্য তা করা হয়েছে। যাজ্ঞিক অর্থ সম্বন্ধে আমাদের বলবার কিছু নেই, তবে মন্ত্রসকলের অন্য অর্থও সম্ভব। আমরা এখানে ভাষ্য অনুযায়ী সাধারণ একটা অর্থ দিয়েছি।’
তার মানে, মন্ত্রের অশ্লীলতাটুকু বাদ দিয়ে ভাষ্যবিহীন সাধারণ একটা অর্থসহ শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার আলোচ্য অংশটুকু (শুক্লযজুর্বেদ-২৩/২১-৩০) হলো-


উৎসক্থ্যা অবস্তদং ধেহি সমঞ্জিং চারয়া বৃষন্ । য স্ত্রীণাং জীবভোজনঃ।। ২১।।  যকাহসকৌ শকুন্তিকাহহহলগিতি বঞ্চতি। আহন্তি গভে পস্যে নিগল্গলীতি ধারকা।। ২২।।  যকোহসকৌ শকুন্তক আহলগিতি বঞ্চতি। বিবক্ষত ইব তে মুখমধ্বর্ষো মা নস্ত¡মভিভাষথাঃ।। ২৩।।  মাতা চ তে পিতা চ তেহগ্রং বৃক্ষস্য রোহতঃ। প্রতিলামীতি তে পিতা গভে মুষ্টিমতংসয়ৎ।। ২৪।।  মাতা চ তে পিতা চ তেহগ্রে বৃক্ষস্য ক্রীড়তঃ। বিবক্ষত ইব তে মুখং ব্রহ্মন্মা ত্বং বদো বহু।। ২৫।।
ঊর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব। অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৬।। ঊর্ধ্বমেনমুচ্ছ্রয়তাদ্গিরৌ ভারং হরন্নিব। অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৭।।  যদস্যা অংহুভেদ্যাঃ কৃধু স্থূলমুপাতসৎ। মুষ্কাবিদস্যা এজতো গোশফে শকুলাবিব।। ২৮।।  যদ্দেবাসো ললামগুং প্রবিষ্টীমিনমাবিষুঃ। সক্থ্না দেদিশ্যতে নারী সত্যস্যাক্ষিভুবো যথা।। ২৯।। যদ্ধরিণো ববমত্তি ন পুষ্টং পশূ মন্যতে। শূদ্রা যদর্যজারা ন পোষায় ধনায়তি।। ৩০।।
অর্থাৎ :
হে বর্ষণকারী অশ্ব, তুমি বীর্য ধারণ কর, যা রমণীগণের জীবন ও ভোজন স্বরূপ। ২১/১।।  ক্ষুদ্র পক্ষীর মত কুমারী হলে হলে শব্দ করে যাচ্ছে। ২২/১।। হে অধ্বর্যুগণ, পক্ষীর মত তোমাদের মুখই শব্দ করছে, আমাদের প্রতি এরূপ বলো না। ২৩/১।। তোমার মাতা ও পিতা কাষ্ঠময় মঞ্চকের অগ্রভাগ রোহন করেছিলেন। ২৪/১।। তোমার মাতা ও পিতা পূর্বে মঞ্চকের আগে ক্রীড়া করেছিল। তোমার মুখ যেন আরও বলতে চায়, হে ব্রাহ্মণ, আর বহু কথা বলো না। ২৫/১।।
পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ একে উপরে তোল। ঠান্ডা বাতাসে কৃষক যেমন ধান ঝেরে ধান্যপাত্র উপরে রাখে, সেরূপ একে উপরে রাখ। ২৬/১।। পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ হে নর, উদ্গাতাকে উর্ধ্বে রাখ। শীতল বায়ুতে কম্পমান লোকের মত একে কাঁপাও। ২৭/১।।  জলপূর্ণ গাভীর খুরে মৎস্য যেমন কাঁপে, সেরূপে হ্রস্ব ও স্থূল শিশ্ন যোনি প্রাপ্ত হয়ে কাঁপে। ২৮/১।।  যখন দেবগণ ক্রীড়া করে, তখন চোখে দেখা প্রত্যক্ষের মত নারীর উরু দেখা যায়। ২৯/১।। হরিণ ক্ষেত্রস্থ ধান্য ভক্ষণ করলে ক্ষেত্রপতি যেমন সুখী হয় না, সেরূপ শূদ্রা স্ত্রী বৈশ্যগামিনী হলে তার পতি সুখী হয় না। ৩০/১।।


বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় জোর করে এই সাধারণ অর্থ আরোপ থেকে বৈদিক-ভাষায় অনভিজ্ঞ সাধারণ পাঠক এতে কতটুকু কী বুঝবেন জানি না। বোঝার সুবিধার্থে মন্ত্রগুলির প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা-ভাষ্য জরুরি বৈকি। তাই আলোচনার প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বোঝবার সুবিধার্থে শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার ২৩/২৬-২৭ মন্ত্র দুটির অর্থের সঙ্গে উবটভাষ্যও উদ্ধৃত করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়, যেমন-


ঊর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৩/২৬।।
উবটভাষ্য :- উদ্গাতা বাবাতাম্ অভিমেথয়তি ঊর্ধ্বাম্ এনাম্ কম্ চিৎ পুরুষম্ আহ। ঊর্ধ্বম্ এনাম্ বাবাতাম্ উচ্ছ্রিতাম্ কুরু। কথম্ ইব। গিরৌ ভারম্ মধ্যে নিগৃহ্য হরেৎ এবম্ এনাম্ মধ্যে নৃগৃহ্য ঊর্ধ্বাম্ উচ্ছ্রাপয়। অথ যথা ইতি এতস্য স্থানে। তথাচ উচ্ছ্রাপয় যথা অস্যা বাবাতায়া মধ্যম্ যোনিপ্রদেশঃ এধতাম্ । ‘এধ্ বৃদ্ধৌ’ বৃদ্ধিম্ যায়াৎ অথ এনাম্ গৃন্থীয়াঃ। শীতে বাতে পুনন্ ইব। যথা কৃষীবলঃ ধ্যান্যম্ বাতে শুদ্ধম্ কুর্বন্ গ্রহনমোক্ষৌ ঝটিতি করোতি।
ঊর্ধ্বমেনমুচ্ছ্রয়তাদ্গিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৭।।
উবটভাষ্য :- বাবাতা প্রত্যাহ উদ্গাতারম্ । ভবতঃ অপি এতৎ এবম্ । ঊর্ধ্বম্ এনম্ । উদ্গাতারম্ উচ্ছ্রয়তাম্ উচ্ছ্রাপয়। অত্র স্ত্রী পুরুষায়তে। গিরৌ ভারম্ হরন্ ইব। অথ এবম্ ক্রিয়মাণস্য অস্য মধ্যম প্রজননম্ এজতু চলতু। অথ এনম্ নিগৃহীষ¦ শীতে বাতে পুনন্ ইব যবান্ ।
তর্জমা-
২৩/২৬ : এই স্ত্রীকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। পর্বতে যেমন করিয়া ভার উত্তোলন করে। অনন্তর ইহার মধ্যদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। বায়ুতে শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করিলেন। কোনো পুরুষকে বলিলেন, এই বাবাতাকে উর্ধ্বে তুলিয়া উষ্প্রিত করো। কেমন করিয়া? পর্বতে ভারবস্তুকে মধ্যস্থানে ধরিয়া যেমন ভাবে উত্তোলন করা হয় তেমনি ইহাকে মধ্যে ধরিয়া উত্তোলন করো। অনন্তর যাহাতে এই বাবাতার যোনিপ্রদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় সেইভাবে ইহাকে ধরো। যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুদ্ধ করিতে করিতে গ্রহণ করে ও বপন করে…
২৩/২৭ : ঊর্ধ্বে এই পুরুষকে তুলিয়া ধরো। যেমন করিয়া পর্বতে ভারবস্তুকে উত্তোলন করা হয়। অনন্তর ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক। শীতল বায়ুতে যব শস্য শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : প্রত্যুত্তরে বাবাতা উদ্গাতাকে বলিল, তোমা কর্তৃকও এই রকমই করা হউক। এই পুরুষকে, অর্থাৎ উদ্গাতাকে, উর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। এইখানে স্ত্রীলোক পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছে। পর্বতে যেমন করিয়া ভার তোলে। অনন্তর এইরূপ ক্রিয়মান ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক, অর্থাৎ মৈথুন চলিতে থাকুক। অনন্তর ইহাকে চাপিয়া ধরো। যেমন কৃষক শীতল বায়ুতে যব শুদ্ধ করিতে করিতে ঝটিতে গ্রহণ এবং বপন করে…


সাধারণ পাঠক নিশ্চয়ই এই দুটি বেদমন্ত্রের আভাসিত অর্থ যাচাইয়ের মাধ্যমে পূর্ব-উদ্ধৃত অন্য মন্ত্রগুলির অন্তর্গত বিশেষ অর্থও অনুধাবনে সমর্থ হবেন আশা করি। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মৈথুন-সংলাপের মধ্যে ক্ষেত্রে বীজ বপনের দৃষ্টান্তের ব্যবহার। তার মানে বামাচারের সঙ্গে বার্ত্তা-বিদ্যার সংযোগ শুধুমাত্র কাপালিক-লোকায়তিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, খোদ বৈদিক ঐতিহ্যেও একই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদপন্থীদের জন্য এখানে সমস্যা হলো রচনাটি খোদ বৈদিক ঋষিদেরই।
‘অবশ্যই, পরের যুগের বেদপন্থীরা এই মন্ত্রগুলি নিয়ে খুবই বিপদে পড়েছেন। তার কারণ, তাঁদের উত্তরযুগের রুচির সঙ্গে এগুলি কিছুতেই খাপ খায় না। তাই পরের যুগে এমনকি বিধান দেওয়া হয়েছে, এই বৈদিক মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করবার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত-বিধানের মূলে নিশ্চয়ই পাপ-বোধ। অথচ, পুরাকালে বৈদিক ঋষিরা যদি সত্যিই একে পাপাচরণ মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য পাঁচ-পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিককে নিয়োগ করতে চাইতেন না। তাই তাঁদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই যে একটি বৈদিক যজ্ঞ-বিশেষ সে-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহেরই অবকাশ নেই। বস্তুত, বেদের ছাত্রমাত্রই জানেন এই মন্ত্রগুলির সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞের কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৫)

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৈথুনের সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের কী সম্পর্ক? বিষয়টা নিশ্চয়ই কৌতুহলজনক। তবে যজ্ঞ মানে যাই হোক না কেন, অনেক জায়গায় দেখা যায় প্রাচীনেরা মৈথুনকেও সরাসরি যজ্ঞের মতোই মনে করেছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের শেষের দিকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়-


‘এষাং বৈ ভূতানাং পৃথিবী রসঃ, পৃথিব্যা আপোহপাম্ ওষধয়, ওষধীনাং পুষ্পাণি, পুষ্পাণাং ফলানি, ফলানাং পুরুষঃ, পুরুষস্য রেত। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।। সহ প্রজাপতিরীক্ষাঞ্চক্রে হন্তাস্মৈ প্রতিষ্ঠাং কল্পয়ানীতি। স স্ত্রীয়ং সসৃজে। তাং সৃষ্টবাধ উপাস্ত; তস্মাৎ স্ত্রিয়মধ উপাসীত। স এতং প্রাঞ্চং গ্রাবাণমাত্মন এব সমুদপারয়ৎ। তেন এনাম অভ্যসৃজৎ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।।  তস্যা বেদিরুপস্থো, লোমানি বহিশ্চর্মাধিষবণে, সমিদ্ধ্যো মধ্যতস্তৌ মুস্কৌ। স যাবান্ হ বৈ বাজপেয়ন যজমানস্য লোকে ভবতি, তাবানস্য লোকো ভবতি, য এবং বিদ্বান্ অধোপহাসং চরত্যাসাং স্ত্রিয়ঃ সুকৃতং বৃঞ্জতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।
অর্থাৎ :
যাবতীয় ভূতের রস এই পৃথিবী। জল পৃথিবীর রস। ওষধি লতা-পাতা জলের রস। ফুল ওষধির রস। ফল ফুলের রস। ফলের সার পুরুষ। রেতঃ বা জীববীজ পুরুষের রস বা নির্যাস। এইভাবে ক্রমানুসারে পুরুষদেহে এলো সৃষ্টির বীজ- বীর্য। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।।  সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি সেই জীববীজকে দেখে চিন্তিত হলেন- এর উপযুক্ত আধার (পাত্র) কোথায়? অনেক ভেবে তিনি এর পাত্ররূপে সৃষ্টি করলেন নারীকে, স্ত্রীকে। সৃষ্টি করে, তিনি তাকে নিচে রেখে তার অধোদেশে মিলিত হয়ে মৈথুনকর্মের উপাসনা করেছিলেন। সেই কারণে, আজও পুরুষ স্ত্রীকে নিচে রেখেই তার অধোদেশে মৈথুনের উপাসনা করে আসছে। প্রজাপতি তাঁর সোমলতা পেষার পাষাণদণ্ড বা নোড়ার মতো সুকঠিন জননেন্দ্রিয় বা পুরুষাঙ্গ দিয়ে সেই স্ত্রী সংসর্গ করে তাকে গর্ভবতী করেছিলেন। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।।  তার (স্ত্রীলোকটির) উপস্থ অর্থাৎ নিম্নাঙ্গ বা নিতম্ব হলো যজ্ঞের বেদী, তার লোমরাজি কুশ বা যজ্ঞ-তৃণ, তার চর্মাবরণ আশ্রয় বা অধিযবন (=সোমরস নিষ্কাশনের যন্ত্র), তার মধ্যস্থল প্রদীপ্ত অগ্নি, মুষ্কদ্বয় অর্থাৎ দুদিকের দুটি স্থূল মাংসপিণ্ড হোমকুণ্ডের দুদিকের দুই ফলক বা পাথরের আড়াল। বাজপেয় যজ্ঞ যারা করে তারা যে সুফল পায়, স্ত্রীর নিম্নাঙ্গকে যারা এইভাবে দেখে, তারাও সেই সুফল পায়। এটি জেনে যে ‘অধোপহাস’ অর্থাৎ মৈথুন কর্ম করে, সে স্ত্রী দ্বারা নিজে শক্তিমান হয়। আর যে এ তত্ত্ব না জেনে মৈথুন করে সে তার সুকৃতি স্ত্রীকে দেয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।


এ-রকম প্রকট বামাচারী চিন্তা কিন্তু উপনিষদে মাত্র একবারই উঁকি দেয়নি, ছান্দোগ্য উপনিষদেও দেখা যায় ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন-


যোষা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিদ্ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরর্চির্যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।।  তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।
অর্থাৎ :
হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি। তার উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশ-ক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতিসম্ভোগই হলো বিস্ফুলিঙ্গ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।।  দেবতারা এই অগ্নিতে রেত বা শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।

এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও হুবহু এ-কথারই প্রতিধ্বনি দেখা যায়-


‘যোষা বা অগ্নির্গৌতম। তস্যা উপস্থ এব সমিৎ, লোমানি ধূমো। যোনিরর্চিঃ। যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা, অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি। তস্যা আহুত্যৈ পুরুষঃ সংভবতি। স জীবতি যাবজ্জীবত। অথ যদা ম্রিয়তে। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অর্থাৎ :
গৌতম, যোষা অর্থাৎ স্ত্রী যজ্ঞের অগ্নি। তার উপস্থদেশ হলো সেই অগ্নির সমিধ বা ইন্ধন। (উপস্থদেশের) লোমরাজি হলো সেই ইন্ধনের ধোঁয়া। যোনিদেশ হলো সেই অগ্নির শিখা। মৈথুন হলো অঙ্গার। আর শীৎকারাদি যে ক্ষণিক পুলক শিহরণ, তা হচ্ছে সেই যজ্ঞাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। এই যজ্ঞাগ্নিতে দেবতারা সেই রেতঃ বা জীববীজ আহুতি দেন। তা থেকে উৎপন্ন হয় পুরুষ (প্রজাতি)। যতদিন প্রাণ থাকে, সেই সন্তান বেঁচে থাকে। তারপর মারা যায়। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।


অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপনিষদের অতি প্রসিদ্ধ ঋষিরাই মৈথুন-ক্রিয়াকে খোলাখুলিভাবেই যজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন। এবং কথায় কথায় সোমযাগ থেকে উপমা নেয়ার চেষ্টাটাও লক্ষ্য করবার মতো বলে দেবীপ্রসাদ তাঁর লোকায়ত দর্শন গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। আমাদের আধুনিক রুচিতে এ-সব কথাবার্তা যতোই কদর্য লাগুক না কেন (যেমন আধুনিককালের স্বামী লোকেশ্বরানন্দও তাঁর উপনিষদ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের ৫/৮/১-২ শ্রুতির বাংলা তর্জমা প্রায় গোটাটাই ফাঁকা রেখে এড়িয়ে গেছেন),  উপনিষদের ঋষিরা এই তত্ত্বটির প্রতিই যে কতোখানি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান দিক থেকে। যেমন বৃহদারণ্যকের ঋষি এই তত্ত্ব বলবার পরই তিনজন প্রাচীন জ্ঞানীর নজির দেখিয়ে বলেছেন, বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, বিদ্বান নাক মৌদ্গল্য ও বিদ্বান কুমারহারিত- এই তিনজনই নাকি এই তত্ত্ব জানতেন এবং সেই মর্মে উপদেশ দিয়েছেন। এবং এই তত্ত্বের অসাধারণ গুরুত্ব বিবেচনায় বৃহদারণ্যকের ঋষি আরো এগিয়ে উপদেশ প্রদান করতে করতে বলছেন-


এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ উদ্দালক আরুণিয়াহ, এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ নাকো মৌদ্গল্য আহৈতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ কুমারহারিত আহ-বহবো মর্যা ব্রহ্মণায়না নিরিন্দ্রিয়া বিসুকৃৎতোহস্মাল্লোকাৎ প্রষন্তি য ইদম্ অবিদ্বাংসোহধোপহাসং চরন্তীতি বহু বা ইদং সুপ্তস্য বা জাগ্রতো বা রেতঃ স্কন্দতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।।  অথ যদ্ উদক আত্মানং পণ্যেৎ তদভিমন্ত্রয়েত-মরি তেজ ইন্দ্রিয়ং যশো দ্রবিণং সৃকৃতমিতি শ্রীর্হ বা এষা স্ত্রীণাং যন্মলোৎবাসাঃ তস্মাৎ মলোৎবাসসং যশস্বিনীম্ অভিক্রম্য উপমন্ত্রয়েতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।।  সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমেনাম্ অবক্রীণীয়াৎ। সা চেদস্মৈ নৈব দদ্যাৎ কামমেনাং যষ্ট্যা বা পামিনা বোপহত্যা অতিক্রামেৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদদ ইতি। যশা এব ভবতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।।  সা চেদস্মৈ দদ্যাৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদধামীতি যশাস্বিনৌ এব ভবতঃ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।।  স যামিচ্ছেৎ কাময়েত মেতি তস্যাং অর্থং নিষ্ঠাং, মুখেন মুখং সন্ধ্যায় উপস্থমস্যা অভিমৃশ্য জপেৎ অঙ্গাদঙ্গাৎ সংভবসি, হৃদয়াৎ অধিজায়সে, স ত্বং অঙ্গকষায়োহসি দিগ্ধবিদ্ধামিব মাদয় ইমাম্ অমূং ময়ীতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।
অর্থাৎ :
(বাজপেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মতোই এই অধোপহাস অর্থাৎ মৈথুনকর্ম জেনে) বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, মুদ্গল-তনয় নাক ঋষি, কুমারহারিত বলেছিলেন- নামেমাত্র ব্রাহ্মণ, এমন অনেকে আছে যারা এই বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞান না জেনে স্ত্রীসংসর্গ এবং মৈথুনকর্ম করার ফলে বিকলেন্দ্রিয় হয়ে এবং সুকৃতি হারিয়ে মারা যায়। জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত, যে কোন অবস্থাতেই তাদের অনেক-অনেক বীর্যস্খলন ঘটে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।।  যদি কেউ জলে স্খলিত বীর্য হয়ে নিজের ছায়া দেখে তবে সে নিজের মঙ্গলের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা জানাবে-‘ময়ি তেজ…সুকৃতম্’ অর্থাৎ আমার তেজ, ইন্দ্রিয়শক্তি, যশ, ধন, সৌভাগ্য দেবতারা আমায় দান করুন। যে নারী মলোদ্বাসা অর্থাৎ ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা। অতএব মলোদ্বাসা সেই সৌভাগ্যবতী নারীতে গর্ভাধান করার জন্য পুরুষ তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আহ্বান করবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।।  যদি সেই নারী পুরুষকে কাম দিতে রাজী না হয়, তবে প্রথমে উপহার সামগ্রি দিয়ে তাকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করবে। যদি তাতেও সে সাড়া না দেয় তবে সেই স্ত্রীকে হাত বা লাঠি দিয়ে প্রহার করে অভিভূত করে বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ তে…আদদ’ অর্থাৎ আমার ইন্দ্রিয়শক্তিরূপ যশ দিয়ে আমি তোমার যশ কেড়ে নিচ্ছি। এই বলে তাতে উপগত হবে। তখন সেই নারী বশে আসতে বাধ্য হবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।।  আর আহ্বান-মাত্রেই যদি সে স্ত্রী পুরুষের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য নিজেকে দান করতে চায়, বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ…আদধাম’- অর্থাৎ, আমার ইন্দ্রিয়রূপ যশ দিয়ে তোমাকে যশস্বী করছি। এতে নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যশস্বী হয়, সুখী হয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।।  পুরুষ যদি নারীটিকে কামনাপরায়ণা করে তুলতে চায়, তবে সে স্ত্রী-অঙ্গে নিজের অর্থ অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ সংযোগ করে, মুখে মুখ রেখে বা মুখচুম্বন করে স্ত্রীর উপস্থ অর্থাৎ নিতম্ব ছুঁয়ে এই মন্ত্র জপ করবে-‘অঙ্গাদঙ্গাৎ…ময়ীতি’- অর্থাৎ, হে রেতঃ, তুমি উৎপন্ন হয়েছো আমার প্রতিটি অঙ্গ হতে, তোমার জন্ম আমার হৃদয়ে। তুমি আমার সর্বাঙ্গের রস। বাণবিদ্ধা হরিণীর-মতো তুমি এই নারীকে বিদ্ধ করো। রসসিক্তা করে একে আনন্দে অধীরা করে তোলো। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।


বলাই বাহুল্য, আজকের দিনে এ-ধরনের উপদেশ দিতে গেলে ঋষির গৌরব পাবার বদলে কপালে কী ঘটবে ! কিন্তু বৃহদারণ্যক উপনিষদের ঋষি মেয়েদের লাঠি-পিটে, কিলচড় লাগিয়ে কামভাব চরিতার্থ করতে দিতে বাধ্য করবার উপদেশ দিয়েও নাজেহাল হয়েছিলেন বলে কোথাও লেখা নেই। বরং তাঁর রচিত গ্রন্থকে প্রাচীনেরা জ্ঞানের আকর বলেই মনে করেছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় মৈথুন ও কাম সম্বন্ধে আজকের দিনের ধারণার সঙ্গে সেকালের মানুষদের ধারণার একেবারে আকাশ-পাতাল তফাত। এবং এ-বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যখন দেখা যায় মহাভারতের যুগে এসেই এ-বিষয়ে পুরনো কালের ধ্যানধারণার সঙ্গে নতুন কালের ধ্যনধারণাগুলি আর মিল খাচ্ছে না। যেমন, মহাভারতের আদিপর্বের ১১৬ অধ্যায়ে বর্ণিত হচ্ছে (মহাভারত-আদিপর্ব-১১৬/৩-২১)-


অথ ত্বিদং প্রবক্ষ্যামি ধর্ম্মতত্ত্বং নিবোধ মে।
পুরাণমৃষিভির্দৃষ্টং ধর্ম্মবিদ্ভির্মহাত্মভিঃ।। ৩।।
অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্ বরাননে!।
কামচারবিহারিণ্যঃ স্বতন্ত্রাশ্চারুহাসিনি!।। ৪।।
তাসাং ব্যুচ্চরমাণানাং কৌমারাৎ সুভগে! পতীন্ ।
নাধর্ম্মোহভূদ্বরারোহে! স হি ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ৫।।
তঞ্চৈব ধর্ম্মং পৌরাণং তির্য্যগ্-যোনিগতাঃ প্রজাঃ।
অদ্যাপ্যনুবিধীয়ন্তে কামদ্বেষবিবর্জিতাঃ।। ৬।।
প্রমাণদৃষ্টো ধর্ম্মোহয়ং পূজ্যতে চ মহর্ষিভিঃ।
উত্তরেষু চ রম্ভোরু! কুরুষ্বদ্যাপি পূজ্যতে।
স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ৭।।
অস্মিংস্তু লোকে নচিরান্মর্য্যাদেয়ং শুচিস্মিতে!।
স্থাপিতা যেন যস্মাচ্চ তন্মে বিস্তরতঃ শৃণু।। ৮।।
বভূবোদ্দালকো নাম মহর্ষিরিতি নঃ শ্রুতম্ ।
শ্বেতকেতুরিতি খ্যাতঃ পুত্রস্তস্যাভবন্মুনিঃ।। ৯।।
মর্য্যাদেয়ং কৃতা তেন ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা।
কোপাৎ কমলপত্রাক্ষি! যদর্থং তন্নিবোধ মে।। ১০।।
শ্বেতকেতোঃ কিল পুরা সমক্ষং মাতরং পিতুঃ।
জগ্রাহ ব্রাহ্মণঃ পাণৌ গচ্ছাব ইতি চাব্রবীৎ।। ১১।।
ঋষিপুত্রস্ততঃ কোপং চকারামর্ষচোদিতঃ।
মাতরং তাং তথা দৃষ্ট্বা নীয়মানাং বলাদিব।। ১২।।
ক্রুদ্ধন্তু তং পিতা দৃষ্ট্বা বেপমানমুবাচ হ।
মা তাত! কোপং কার্ষীস্ত্বম্ এষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ১৩।।
অনাবৃতা হি সর্ব্বেষাং বর্ণানামঙ্গনা ভুবি।
যথা গাবঃ স্থিতাস্তাত! স্বে স্বে বর্ণে তথা প্রজাঃ।। ১৪।।
তথৈব চ কুটুম্বেষু ন প্রমাদ্যন্তি কর্হিচিৎ।
ঋতুকালে তু সম্প্রাপ্তে ভর্ত্তারং ন জহুস্তদা।। ১৫।।
ঋষিপুত্রস্তু তং ধর্ম্মং শ্বেতকেতুর্ন চক্ষমে।
চকার চৈব মর্য্যাদামিমাং স্ত্রীপুংসয়োর্ভুবি।। ১৬।।
মানুষেষু মহাভাগে! ন ত্বেবান্যেষু জন্তুষু।
ততঃ প্রভৃতি মর্য্যাদা স্থিতেয়মিতি নঃ শ্রুতম্ ।। ১৭।।
ব্যুচ্চরন্ত্যাঃ পতিং নার্য্যা অদ্যপ্রভৃতি পাতকম্ ।
ভ্রূণহত্যাসমং ঘোরং ভবিষ্যত্যসুখাবহম্ ।। ১৮।।
ভার্য্যাং তথা ব্যুচ্চরতঃ কৌমারব্রহ্মচারিণীম্ ।
পতিব্রতামেতদেব ভবিতা পাতকং ভুবি।। ১৯।।
পত্যা নিযুক্তা যা চৈব পত্নী পুত্রার্থমেব চ।
ন করোতি বচস্তস্যা ভবিষ্যত্যেতদেব হি।। ২০।।
ইতি তেন পুরা ভীরু! মর্য্যাদা স্থাপিতা বলাৎ।
উদ্দালকস্য পুত্রেণ ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা।। ২১।।
অর্থাৎ :
তার পর, ধর্ম্মজ্ঞ মহাত্মা ঋষিরা যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, আমি সেই প্রাচীন ধর্ম্মতত্ত্ব তোমার নিকট বলিব; শ্রবণ কর। ৩।।  চারুহাসিনি! পূর্ব্বকালে সকল স্ত্রীলোকই অনবরুদ্ধ ছিল এবং তাহারা ইচ্ছা অনুসারে বিহার করিয়া বেড়াইত এবং স্বাধীন ছিল। ৪।।  সুন্দরি! তাহারা বিবাহের পর হইতে পতিকে ছাড়িয়া ইচ্ছানুসারে অন্য পুরুষের সহিত বিচরণ করিত; তাহাতে তাহাদের অধর্ম্ম হইত না। কেন না, তাহাই প্রাণিগণের চিরন্তন স্বভাব। ৫।।  মনুষ্যভিন্ন প্রাণীরা আসক্তি ও বিদ্বেষশূন্য হইয়া এখনও সেই প্রাচীন ধর্ম্মেরই অনুসরণ করিয়া থাকে। ৬।।  মহর্ষিরাও প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন বলিয়া এই ব্যবহারের আদর করেন এবং উত্তর কুরুদেশে এখনও এই ব্যবহার আদৃত হইয়া থাকে; আর, এই আচার স্ত্রীলোকদিগের প্রতি অনুগ্রহসূচক এবং চিরকালই চলিয়া আসিতেছে। ৭।।  সুন্দরি! অধিক কাল হয় নাই; যে কারণে যিনি এই দেশে এই নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি বিস্তরক্রমে আমার নিকট শ্রবণ কর। ৮।।
আমাদের শুনা আছে- উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন; শ্বেতকেতু নামে তাঁহার এক পুত্র ছিলেন, তিনিও মুনি ছিলেন। ৯।।  পদ্মনয়নে! সেই শ্বেতকেতু যে কারণে ক্রোধবশতঃ এই ন্যায়সঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি আমার নিকট শোন। ১০।।  একদা এক ব্রাহ্মণ সেই উদ্দালকের সমক্ষে শ্বেতকেতুর মাতার হস্ত ধারণ করিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন যে, ‘চল, আমরা যাই’। ১১।।  তাহার পর, বলপূর্ব্বকই যেন মাতাকে সেইভাবে লইয়া চলিয়াছে- ইহা দেখিয়া শ্বেতকেতু অসহিষ্ণুতাবশতঃ ক্রোধ প্রকাশ করিলেন। ১২।।  কিন্তু তখন পিতা উদ্দালক, পুত্র শ্বেতকেতুকে ক্রোধকম্পিত দেখিয়া বলিলেন- ‘বৎস! তুমি ক্রোধ করিও না; ইহাই স্ত্রীলোকদিগের চিরাচরিত নিত্যধর্ম্ম। ১৩।।  জগতে সকল বর্ণের স্ত্রীলোকেরাই অনবরুদ্ধ; সুতরাং গরুগুলি যেমন স্বেচ্ছাচারিণী, মনুষ্যরমণীরাও তেমন আপন আপন বর্ণে স্বেচ্ছাচারিণীই হইয়া থাকে। ১৪।। তবে তাহারা কখনও রন্ধনাদি গৃহকার্য্যে অনবধানতা করিত না, কিংবা ঋতুকালে ভর্ত্তাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিত না’। ১৫।।  ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু সে প্রাচীন আচার সহ্য করিলেন না; কিন্তু জগতে সকল স্ত্রী-পুরুষের জন্যই এই নিয়ম স্থাপন করিলেন। ১৬।। কুন্তি! আমাদের শুনা আছে যে, তদবধি এই নিয়ম কেবল মনুষ্যসমাজেই চলিয়াছে; কিন্তু অন্য প্রাণীর মধ্যে নহে। ১৭।। ‘আজ হইতে যে রমণী পতিকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিবে, তাহার ভ্রূণহত্যা তুল্য ঘোরতর দুঃখজনক পাপ হইবে। ১৮।। আবার, কন্যাকালে ব্রহ্মচারিণী এবং বিবাহের পর পতিব্রতা- এহেন ভার্য্যাকে পরিত্যাগ করিয়া যে পুরুষ অন্য স্ত্রীর সংসর্গ করিবে, তাহারও এই পাপই হইবে। ১৯।।  আর, যে রমণী ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করিবার জন্য পতির আদেশ পাইয়াও সে আদেশ পালন করিবে না, তাহারও এইরূপ পাপই হইবে’। ২০।।  কুন্তি! পূর্ব্বকালে উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু তপোবলে এই ধর্ম্মসঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন। ২১।।


যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা যে একটি বিশেষ যুগেই বদলেছে- আগে একরকম ছিলো, পরে অন্যরকম হলো- উদ্ধৃত শ্বেতকেতুর কাহিনীটাই এ-কথার স্পষ্ট প্রমাণ হতে পারে। যদিও সেই যুগ বলতে ঠিক কোন যুগ,- কোন যুগ থেকে কামজীবন সম্বন্ধে আধুনিক ধ্যানধারণার শুরু,- এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু সেকালের ধারণাটা ঠিক কী রকম বা কীরকম ধারণার বশবর্তী হলে বৈদিক ঋষিদের পক্ষে কামজীবনকে এতাটা গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক মনে করা সম্ভবপর?
এর-জবাবে দেবীপ্রসাদ বলেন, ‘এ-প্রশ্নের পুরো জবাবটা অবশ্যই শুধুমাত্র বৈদিক সাহিত্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।… কিন্তু, যেটা খুবই বিস্ময়ের কথা, এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্য আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে না। উপনিষদ এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির কাছ থেকেই প্রশ্নটার অন্তত আংশিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৯)
কী উত্তর? এ-প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে ছান্দোগ্য-উপনিষদের বামদেব্য-ব্রতের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বামদেব্য’ নামটা এখানে উল্লেখযোগ্য। কেননা তাঁর মতে, বৈদিক সাহিত্যেও যে বামাচারের স্মারক রয়েছে তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ওই নামেই মধ্যেই পরিদৃষ্ট হয়। এই বামদেব্য-ব্রত সম্পর্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য-২/১৩) বলা হয়েছে-


‘উপমন্ত্রয়তে স হিঙ্কারো জ্ঞপয়তে স প্রস্তাবঃ স্ত্রিয়া সহ শেতে সঃ উদ্গীথঃ প্রতি স্ত্রীং সহ শেতে স প্রতিহারঃ কালং গচ্ছতি তন্নিধনং পারং গচ্ছতি তন্নিধনমেতদ্-বামদেব্যং মিথুনে প্রোতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
‘স য এবমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতং বেদ মিথুনীভবতি মিথুনান্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্-জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।
অর্থাৎ :
মৈথুনে লিপ্ত হওয়ার আগে যে পুরুষ স্ত্রীলোককে আহ্বান করে সেই হলো পঞ্চবিধ সামের প্রথম সাম ‘হিঙ্কার’। স্ত্রীর মনোরঞ্জন করা বা তাকে সন্তুষ্ট করা হলো দ্বিতীয় সাম ‘প্রস্তাব’। স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় শয়ন হলো ‘উদ্গীথ’। সঙ্গমের প্রাক-মুহূর্তে স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করা ‘প্রতিহার’। মিথুন-অবস্থায় থাকা হলো ‘নিধন’। আবার চরিতার্থতাও ‘নিধন’। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে জানে সে নিয়ত মিথুনে মিলিত হয়। (তার) প্রত্যেক মিথুন থেকেই প্রজার (সন্তানের) উৎপত্তি হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।


অতএব, বামদেব্য ব্রতে- ‘মিথুনাৎ মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বম্ আয়ুঃ এতি জ্যোক্ জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা’- এই হলো আসল কথা। মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে? তালিকা হলো-
সন্তান পাওয়া যাবে।
পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে।
পশু পাওয়া যাবে।
মহান কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে।

এখানে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো, উপনিষদের ঋষি মৈথুনকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেরই উপায় মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ধন-উৎপাদনের উপায় বলেও বর্ণনা করছেন। উপনিষদের যুগেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানিই পশুপালনমূলক বলে আমরা জানি, তাই ধনউৎপাদন বলতে প্রধানতই পশুবৃদ্ধি। আর এই ধারণার দরুনই মিথুনকে এতোটা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে যে, উপনিষদের ঋষি মিথুনের বিভিন্ন স্তরকে যজ্ঞের হিঙ্কার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার প্রভৃতি পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে এক বলে বর্ণনা করছেন। শুধু তাই নয়, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’- কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, এই-ই ব্রত।

তাহলে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাচীনদের মনে মিথুন সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক একালের আমাদের মতো নয়। আমাদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? উত্তর হলো, সন্তান। কিন্তু প্রাচীন ঋষিদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? শুধু সন্তান নয়, ধনসম্পদও। আমাদের ধারণায় সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে ধনসম্পদ উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাঁদের ধারণায়, ধনসম্পদ উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন- দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক বড়ো গভীর। কিন্তু কোন্ ধারণা সঠিক এ-নিয়ে কি তর্ক তোলার আদৌ দরকার আছে? এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন-
‘এখন, আমাদের ধারণাটা ঠিক না তাঁদের ধারণাটা ঠিক, এ-নিয়ে তর্ক তোলবার দরকার নেই। অবশ্যই, এ-বিষয়ে আমাদের ধারণা তাঁদের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক নির্ভুল। তার তুলনায়, তাঁদের ধারণাটার প্রায় পরেরো আনাই কল্পনা। কিন্তু যেটা আসলে ঢের বড়ো কথা, তাঁদের যুগে তাঁদের মনে এই রকমের একটা কল্পনা সত্যিই ছিলো, ছিলো ওই রকমের একটা ভুল ধারণা। তাই তাঁদের লেখা পুঁথিপত্র আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের একালের ধ্যান-ধারণাগুলিকে তাঁদের লেখার উপর আরোপ করে বসলে প্রকাণ্ড ভুল হবে- ঠিক কী ভেবে তাঁরা কী লিখেছিলেন সে-কথা আমরা বুঝতেই পারবো না।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১০)

দেবীপ্রসাদ আরো বলেন (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১১), ‘তাঁদের মনে যে সত্যিই ওই রকমের একটা ধারণা ছিলো এ-কথার প্রমাণ শুধুই উপনিষদ নয়, ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিও। বরং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে এই কথা এতোবার এবং এতো স্পষ্টভাবে তাঁরা লিখে রেখেছেন যে সেদিকে চোখ না পড়াটাই বিস্ময়কর। স্থানসংকুলানের খাতিরে আমরা এখানে মাত্র একটি নমুনার উল্লেখ করতে পারবো; উৎসাহী পাঠক…অন্যান্য বহু দৃষ্টান্তের উল্লেখ পাবেন। আমাদের এই দৃষ্টান্তটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম পঞ্চিকা প্রথম অধ্যায় থেকে সংগৃহিত, তর্জমা শ্রদ্ধেয় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ/৬-৭) :

‘যে যজমান আপনাকে অপ্রতিষ্ঠিত মনে করে সে ঘৃতপক্ক চরু নির্বাপন করিবে। (অপ্রতিষ্ঠিত অর্থে, পুত্রাদিরহিত ও গবাদিরহিত)।
হে বৎস, যে এইরূপ প্রতিষ্ঠারহিত সে ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত (শ্লাঘ্য) হয় না। (ঘৃতচরুর দ্বারা সেই অপ্রতিষ্ঠার পরিহার হয়)।
তাহাতে (সেই ঘৃতপক্ক চরুতে) যে ঘৃত আছে তাহা স্ত্রীর পয়ঃ (শোনিতস্বরূপ) আর যে তণ্ডুল আছে তাহা পুরুষের (রেতঃ স্বরূপ); সেই ঘৃততন্ডুল মিথুন সদৃশ; সেই জন্য এই মিথুনদ্বারাই (ঘৃততন্ডুলময় চরুপ্রদানদ্বারা) ইহাকে (যজমানকে) সন্ততিদ্বারা ও পশুদ্বারা বর্ধিত করা হয়। (সেই হেতু এই চরু) প্রতিষ্ঠারই হেতু।’


এখানেও সেই একই ধারণার প্রতিচ্ছবি- মিথুন থেকে শুধুই যে সন্তান পাওয়া যাবে তাই নয়, পশু অর্থাৎ ধনসম্পদও। তার মানে, সে-যুগের যাঁরা জ্ঞানী তাঁদের ধারণায় ধনউৎপাদন আর প্রজনন এমন কিছু আলাদা ব্যাপার নয়। মিথুন থেকে শুধু সন্তান পাবার আশা নয়, পশুদ্বারা বর্ধিত হবার আশাও। আর এই বিশ্বাস যদি অটুট হয় তাহলে তাঁরা স্বভাবতই উপদেশ দেবেন : ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’, কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত।

এখানে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। এই ব্রাহ্মণমন্ত্রে ঋষি-কর্তৃক মিথুন-সদৃশ ঘৃততণ্ডুলের মধ্যে স্ত্রীর স্বরূপে যে ঘৃতের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে এদিকে বেদপন্থী পণ্ডিত-দার্শনিকদের শ্যেন-দৃষ্টি যে-কোনো অদৃশ্য কারণে পিছলে গেলেও লোকায়ত চার্বাক-মতগোষ্ঠির নামে প্রচলিত প্রবাদ- ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো সুখেই বাঁচো, প্রয়োজন হলে ঋণ করেও ঘি খাও- উদ্ধৃত করে ভোগবাদিতার পরাকাষ্ঠায় নিন্দামুখর হয়ে তাঁরা লোকায়তিকদের উপর সম্মিলিতভাবে হামলে পড়তে কোন দ্বিধাবোধ করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আধুনিক কালের বেদপন্থী পণ্ডিতেরা বেদ-উপনিষদে এ-ধরনের লেখা আছে দেখে কী-ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন? হয়তো বা এ-কারণে বিলক্ষণ বিরক্তিবোধ করতে পারেন। কেননা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জাতিগোষ্ঠির মধ্যে আদিম বিশ্বাসজনিত কামাচার বা বামাচারের স্বাক্ষর দেখে যেভাবে তাঁরা আধুনিক রুচি-বিগর্হিত অধঃপাতের নমুনা আবিষ্কার করেন, যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে বেদ-উপনিষদের রচয়িতাদের মধ্যে অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি কল্পনা না করে উপায় থাকে কি? কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তাঁরা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি ! ফলে আধুনিক বেদপন্থী পণ্ডিতদের পক্ষে হয়তো একমাত্র উপায় হলো ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে যাওয়া। এই প্রবণতার নমুনা খুঁজলে তার কমতি হবে না বলেই মনে হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা তাঁদের কথিত অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মে বামাচারের কদর্যতা প্রকাশ করতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে হয় বললেও অন্যদিকে বৈদিক সাহিত্যে প্রকটিত বামাচারের জ্বলজ্যান্ত স্মারকগুলি নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন কিনা জানা নেই। আর খুব একটা গুরুত্ববহ না হলেও অতি-সাম্প্রতিক একটা ভিন্নধরনের উদাহরণ এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে হয়। যেমন, ইতঃপূর্বে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের ত্রয়োদশ খণ্ডে বর্ণিত বামদেব্য-ব্রতের (ছান্দোগ্য-২/১৩/১-২) শ্রুতিদ্বয় প্রয়োজনীয় তর্জমাসহ উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ কৃত ‘উপনিষদ’ দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যায় মূল সংস্কৃতে বামাদেব্য ব্রতের এই শ্রুতিদুটির উল্লেখ থাকলেও তার বাংলা তর্জমা দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘উপরোক্ত মন্ত্র দুটির অন্তনির্হিত অর্থ হল, জাগতিক বলতে আমাদের কিছুই নেই। আমাদের সবকিছুই আধ্যাত্মিক, এমনকি দৈহিক অভিজ্ঞতাগুলিও।’- (উপনিষদ দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮২)

বাস্তবে কি তাই? প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্যগুলিকে এভাবে চেপে যাওয়া বা ভণিতার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটাই যে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দেবীপ্রসাদের মতে, প্রাচীনেরা কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন- তাই একালের ধ্যানধারণাগুলি তাঁদের মধ্যে কল্পনা করাটাই অসঙ্গত ও যুক্তিহীন।

বৈদিক সাহিত্যের মূল গ্রন্থাবলি অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হলেও তবুও এখনো বিরল নয়, বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, প্রাচীন জড়বাদী চার্বাক-মতের নিজস্ব গ্রন্থাবলির বিলুপ্তিজনিত কারণে তাঁদের বিবৃতি ও বক্তব্য খুঁজে পেতে আমাদেরকে যখন বিরোধীপক্ষের গ্রন্থের উপরই নির্ভর করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চার্বাক-মত নির্ধারণে সুনিশ্চিতভাবেই অদ্ভূত এক জটিলতার সম্মুখীন হতেই হয়, কোনটা তাঁদের প্রকৃত মত কিংবা কোনটা বিরোধীপক্ষের বিকৃত-উপস্থাপনের ভণিতা তা নির্ধারণের অসহায়তা।

.
সে যাক, আমাদের মনোযোগের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো একই জড়বাদী দর্শনের বিভিন্ন নামকরণের প্রবনতা পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ চার্বাকই বার্হস্পত্য এবং বার্হস্পত্যই যে লোকায়ত, এ বিষয়টি ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময়ই একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়েই উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। ফলে সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন থেকেই লোকায়ত মতের গভীরে চার্বাক দর্শনের আদি রূপটিকে খুঁজে দেখা যৌক্তিকভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে চার্বাক দর্শনের মূল স্পন্দনটুকু। তবে লোকায়তিক আলোচনায় প্রবেশের আগে বৃহস্পতির সূত্র তথা বার্হস্পত্য-দর্শনের সাথে আরেকটু নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।

বার্হস্পত্য, চার্বাক-মতের আদিরূপ
চার্বাকী জড়বাদী চিন্তাধারার উপর কেবলি এক দেহাত্মবাদী ভোগলিপ্সু দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে এই মতটি যে ঘৃণ্য অসুর মত তা প্রমাণ ও প্রচারে ব্যস্ত হওয়ার নিদর্শন শুধু ভিন্নমতাবলম্বী দার্শনিকদের মধ্যেই নয়, বরং এর প্রবনতা-উৎস ঢের পেছনে সেই উপনিষদ যুগ থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীন ছান্দোগ্য-উপনিষদের (৭০০খ্রিস্টপূর্ব) ‘প্রজাপতি ও ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ’ উপাখ্যানে এই নমুনা অস্পষ্ট নয়। উপাখ্যানটি এরকম-
য আত্মাপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুর্বিশোকা বিজিঘৎসঃ অপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ স সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাঃশ্চ কামান্ যস্তম্ আত্মানম্ অনুবিদ্য বিজানাতীতি হ প্রজাপতিরুবাচ।। ৮/৭/১।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি এক সময় বলেছিলেন যে, পাপ-জরা-মৃত্যু-শোক-আহারেচ্ছা-পিপাসা রহিত যে আত্মা সত্যকাম, সত্যসঙ্কল্প তাঁকেই অন্বেষণ করতে হবে, বিশেষভাবে জানতে হবে। যে তাঁকে অনুসন্ধান করে জানতে পারে তার কাছে কোন লোক (জগৎ) যেমন অপ্রাপ্য থাকে না, তেমনি কোন কামনাই অপূর্ণ থাকে না।
.
তৎ হ উভয়ে দেবাসুরা অনুবুবুধিরে। তে হোচুঃ- হন্ত তম্ আত্মানম্ অন্বিচ্ছামো যমাত্মানম্ অন্বিষ্য সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ ইতি। ইন্দ্রো হৈব দেবানাম্ অভিপ্রবব্রাজ। বিরোচনোহসুরাণাং। তৌ হ অসংবিদানৌ এব সমিৎপাণী প্রজাপতি-সকাশম্ আজগ্মতুঃ।। ৮/৭/২।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : দেব ও অসুরগণ উভয়েই লোকপরম্পরায় এই উপদেশের কথা শুনলেন। দুপক্ষই নিজেদের মধ্যে বসে আলোচনা করলেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সর্বলোক ও সর্বকাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা সেই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো’। (এ উদ্দেশ্যে) দেবগণের মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্র এবং অসুরগণের মধ্যে অসুররাজ বিরোচন (প্রজাপতির) অভিমুখে গমন করলেন। তাঁরা পরস্পরকে না জানিয়ে সমিৎপাণি অর্থাৎ সমিধ হাতে শিষ্য হয়ে প্রজাপতির সমীপে উপস্থিত হলেন।
.
তৌ হ দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণি ব্রহ্মচর্যম্ ঊষতুঃ। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ কিম্ ইচ্ছন্তৌ অবাস্তমিতি ? তৌ হোচতুঃ- য আত্মাপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুঃ বিশোকো বিজিঘৎসঃ অপিপাসঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্য স সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ যস্তম্ আত্মানম্ অনুবিদ্য বিজানাতীতি ভগবতো বচো বেদয়ন্তে। তম্ ইচ্ছন্তৌ অবাস্মম্ ইতি।। ৮/৭/৩।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁরা সেখানে দুজনেই বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য নিয়ে রইলেন। তারপর একদিন প্রজাপতি তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী ইচ্ছা করে তোমরা এখানে এমনভাবে রইলে ?’ তাঁরা বললেন, ‘ভগবানের বাক্য বলে বিদিত যে- যে-আত্মা পাপরহিত, জরারহিত, শোকরহিত, অশনেচ্ছারহিত, যিনি সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প- তাঁকেই অন্বেষণ করতে হবে, তাঁকেই বিশেষরূপে জানতে হবে। যিনি এ আত্মাকে অনুসন্ধান করে জানেন, তিনি সর্বলোক ও সমুদয় কাম্যবস্তু লাভ করেন। সেই আত্মাকে জানার ইচ্ছা নিয়েই আমরা এখানে আপনার কাছে রয়েছি।’
.
তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- এষোহক্ষিণি পুরুষো দৃশ্যত এষ আত্মোতি হোবাচ এতদ্ অমৃতম্ অভয়ম্ এতদ্ ব্রহ্মেতি। অথ যোহয়ং ভগবঃ অপ্সু পরিখ্যায়তে, যশ্চ অয়ম্ আদর্শে কতম এষ ইতি ? এষ উ এবৈষু সর্বেষু অন্তেষু পরিখ্যায়তে ইতি হোবাচ।। ৮/৭/৪।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি তাঁদের প্রার্থনা শুনে বললেন- ‘চক্ষুতে যে পুরুষ দৃষ্ট হয়, ইনিই আত্মা।’ তিনি আরো বললেন- ‘ইনিই অমৃত অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ প্রজাপতির এই উপদেশের মর্মার্থ ধরতে না পেরে তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন- হে ভগবন্ ! এই যে পুরুষ জলে দৃষ্ট হয়, আর এই যে পুরুষ দর্পণে দৃষ্ট হয়, ইহা কে ? প্রজাপতি বললেন- ‘এই সমুদয়েই আত্মা পরিদৃষ্ট হন।’
.
উদশরাব আত্মানম্ আব্যে, যদাত্মনো ন বিজানীথঃ তন্মে প্রব্রূতমিতি। তৌ হ উদশরাবে অবেক্ষাংচক্রাতে। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- কিং পশ্যথ ইতি ? তৌ হোচতুঃ- সর্বমেবেদম্ আবাং ভগব আত্মানং পশ্যাব আলোমভ্য আনখেভ্যঃ প্রতিরূপমিতি।। ৮/৮/১।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি বললেন- ‘জলপূর্ণ পাত্রে আপনাকে (দেখো), দেখে আত্মার বিষয়ে যা বুঝবে না, তা আমাকে বোলো।’ তাঁরা জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদেরকে দেখলেন। এরপর প্রজাপতি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’ তাঁরা বললেন- হে ভগবন্ ! আমরা সমগ্র আত্মা- লোম ও নখ পর্যন্ত এর প্রতিরূপ দর্শন করলাম।
.
তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বা উদশরাবে অবেক্ষেথাম্ ইতি। তৌ হ সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বা উদশরাবে আবেক্ষাংচক্রাতে। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- কিং পশ্যথ ইতি ?।। ৮/৮/২।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি তাঁদেরকে বললেন- ‘(এবার) সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে, সুবসন পরিধান করে, পরিষ্কৃত হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করো।’ তাঁরা সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে সুবসন পরিধান করে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করলেন। প্রজাপতি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’
.
তৌ হোচতুঃ- যথৈবেদমাবাং ভগবঃ সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ স্ব এবমেব ইমৌ ভগবঃ সাধ্বলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ইতি। এষ আত্মেতি হোবাচ, এতদ্ অমৃতম্ অভয়ম্ এতদ্ ব্রহ্মেতি। তৌ হ শান্তহৃদয়ৌ প্রবব্রজতুঃ।। ৮/৮/৩।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁরা বললেন- ‘হে ভগবন ! এই আমরা যেমন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত এবং পরিষ্কৃত, তেমনি জলের মধ্যেও এই দু’জন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত ও পরিষ্কৃত।’ প্রজাপতি বললেন- ‘ইনিই আত্মা; ইনিই অমৃত ও অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ (এই জ্ঞান নিয়ে) এরপর দু’জন শান্ত হৃদয়ে ফিরে গেলেন।
.
তৌ হ অন্বীক্ষ্য প্রজাপতিরুবাচ- অনুপলভ্য আত্মানম্ অননুবিদ্য ব্রজতে যতর এতদুপনিষদো ভবিষ্যন্তি দেবা বা অসুরা বা তে পরাভবিষ্যন্তীতি। স হ শান্তহৃদয় এব বিরোচনোহসুরান্ জগাম। তেভ্যো হ এতাম্ উপনিষদং প্রোবাচ। আত্মৈব ইহ মহয্য আত্মা পরিচর্য আত্মানম্ এবেহ মহয়ন্ আত্মানম্ পরিচরণ্ উভৌ লোকৌ অবাপ্নোতি ইমং চ অমুংচেতি।। ৮/৮/৪।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁদেরকে (চলে যেতে) দেখে প্রজাপতি মনে মনে বললেন- ‘(এরা) আত্মাকে উপলব্ধি না করেই, আত্মাকে অবগত না হয়েই চলে গেলো। এদের মধ্যে যে এটাকে উপনিষৎ (অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞান) বলে গ্রহণ করবে- দেবতা হোক বা অসুরই হোক- সে বিনাশপ্রাপ্ত হবে।’
বিরোচন শান্ত হৃদয়ে অসুরদের নিকট গেলেন এবং তাঁদেরকে এই উপনিষৎ শিক্ষা দিলেন- ‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করবে এবং দেহেরই পরিচর্যা করবে। দেহকে মহীয়ান করলে এবং দেহের পরিচর্যা করলেই ইহলোক ও পরলোক- এই উভয় লোকই লাভ করা যায়।’
.
তস্মাদ্ অপি অদ্য ইহ অদদানম্ অশ্রদ্দধানম্ অযজমানম্ আহুঃ আসুরো বতেতি অসুরাণাম্ হি এষা উপনিষৎ- প্রেতস্য শরীরং ভিক্ষয়া বসনেন অলঙ্কারেণেতি সংস্কুর্বন্তি; এতেন হি অমুং লোকং জেষ্যন্তো মন্যন্তে।। ৮/৮/৫।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : এইজন্য আজও দানহীন, শ্রদ্ধাহীন, যজ্ঞহীন ব্যক্তিকে অসুর বলা হয়। এটাই অসুরগণের উপনিষৎ। তারা গন্ধমাল্যাদি এবং বসন ও অলঙ্কার দ্বারা মৃতব্যক্তির দেহকে সজ্জিত করে এবং মনে করে এর দ্বারা পরলোক জয় করবে।
 .
এই দীর্ঘ উপাখ্যানের এখানেই শেষ নয়। এরপর, অসুরদের প্রতিনিধি বিরোচন ওইভাবে দেহকেই আত্মা বলে জেনে সন্তুষ্ট হলেও দেবতাদের প্রতিনিধি ইন্দ্রের কাছে এই দেহাত্মবোধ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি প্রজাপতির কাছে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেহাত্মবোধের ভ্রম উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর ক্রমশ সচ্চিদানন্দ আত্মাকে উপলব্ধি করার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়া একে একে বর্ণিত হয়েছে।
 .
দেহাতিরিক্ত এই আত্মার ধারণাই মূলত ভারতীয় আস্তিক দর্শনগুলোর মূল বিবেচ্য বিষয়। অন্যদিকে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনে ইন্দ্রিয়াতিরিক্ত কোন সত্তা স্বীকৃত নয়, যা চার্বাক দর্শনের মূল কথা। উল্লেখিত উপাখ্যানে ব্রহ্মার বদান্যতায় অসুর মতের যে দেহাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারিত হয়েছে, তাতে বৈদিক সংস্কৃতির বিপরীত ধারণাটাই অসুর মতের মাধ্যমে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে করে অনুমিত হয় যে, প্রাচীন উপনিষদ যুগের শুরুতে কিংবা তারও আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে চার্বাক মতের জড়বাদী চিন্তাধারার উদ্ভব হয়ে গেছে।  এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো বা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বলেই হয়তো প্রাচীন উপনিষদে একে প্রতিরোধের নিমিত্তে বিভিন্ন উপাখ্যানেরও সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রাচীন উপনিষদে দেহাত্মবাদ বিরোধী আধ্যাত্মবাদী ধারণা ও মতামতের মধ্যেও পরবর্তী যুগের পরিণত চার্বাকী দেহাত্মবাদের প্রাথমিক রূপের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঐতরেয় উপনিষদে (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০) বলা হয়েছে-
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- পৃথিবী বায়ুরাকাশ আপোজ্যোতীংষি ইতি এতানি, ইমানি চ ক্ষুদ্রমিশ্রাণি ইব বীজানি, ইতরাণি চেতরাণি চ- অণ্ডজানি চ জারুজানি চ স্বেদজানি চ উদ্ভিজানি চ- অশ্বা গাবঃ পুরুষা হস্তিনঃ, যৎকিঞ্চ ইদং প্রাণি জঙ্গমং চ পতত্রি চ যচ্চ স্থাবরং;- সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।। ৩/৩।। (ঐতরেয় উপনিষদ)।
.
অর্থাৎ : সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত (মাটি, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি বা তেজ)। ইনিই ক্ষুদ্র কীটাণুকীট, উভচর থেকে সব কিছুর উৎপত্তিস্থল- বীজ। অণ্ডজ (পাখি ইত্যাদি), উদ্ভিজ্জ (গাছপালা প্রভৃতি) থেকে শুরু করে ঘোড়া, গরু, মানুষ, হাতি- যত প্রাণী, এমনকি স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যেও ইনিই হলেন সেই প্রাণ। প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সেই প্রজ্ঞাই হল সব কিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সব কিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনিই সেই আত্মা।
 .
উপনিষদীয় এই আধ্যাত্ম ধারণার বিরোধী চার্বাক মতের দেহাত্মবাদ সংশ্লিষ্ট দার্শনিক সূত্রে আমরা দেখি-
‘পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি। তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা। (বার্হস্পত্য-সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
 .
এখানে আত্মার অস্তিত্ব তো নেই-ই, এমনকি আকাশ নামের কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহীন ভূত বা তত্ত্বও স্বীকৃত হয়নি। এই দেহাত্মবাদী চার্বাক চেতনার উৎসকাল জানার কোন প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে না থাকলেও এটা কল্পনা করতে বাধা নেই যে, উপরিউক্ত উপনিষদীয় ধারণার প্রেক্ষাপটেও যদি বিরোধী দেহাত্মবাদী মত সৃষ্ট হয়ে থাকে তাহলেও উপনিষদ যুগেই চার্বাক ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছিলো।
 .
একইভাবে বৃহদারণ্যক উপনিষদের (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০) একটি অনুচ্ছেদে আত্মতত্ত্ব বিশ্লেষণে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি দেখা যায়-
স যথা সৈন্ধবখিল্য উদকে প্রাস্ত উদকম্ এবানুবিলীয়েত ন হ অস্য উদ্গ্রহণায় এব স্যাৎ। যতো যতস্ত¡াদদীত লবণম্ এবৈবং বা অর ইদং মহৎ ভূতং অনন্তমপারং বিজ্ঞানঘন এব। এতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তানি এব অনুবিনশ্যতি ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তীতি অরে ব্রবীমিতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ।। ২/৪/১২।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
অর্থাৎ : (মৈত্রেয়ীকে) যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- একটা নুনের ডেলা জলে পড়ে গেলে ডেলাটাকে তুলে আনতে পারবে না। জলের সঙ্গে সে মিশে একাকার হয়ে যাবে। জলটাই নোনতা হয়ে যাবে। যেখান থেকেই চুমুক দাও, সেই মিশে-যাওয়া নুনের স্বাদটুকু ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। আমাদের সেই মহান বস্তুটিও তেমনি অনন্ত, অপার, বিজ্ঞানময়। ব্রহ্মাণ্ডের স্থাবর থেকে শুরু করে দেবতা, মানুষ যত জঙ্গম দেখি সবই অভিব্যক্ত হয়েছে ঐ মহান আত্মা থেকে। এক এক রূপ, এক এক নাম। যখন এদের সংজ্ঞা লোপ পায়, পরমায়ু শেষে মৃত্যু আসে, তখন সবই গিয়ে মিশে যায় তাঁর সঙ্গে। সেই মহান আত্মাই হল তত্ত্ব।
 .
অন্যান্য উপনিষদের বিভিন্ন স্থানেও আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যায় এই জলের সাথে মিশে থাকা লবণের দৃষ্টান্ত উক্ত হতে দেখা যায় (যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদ: ঋষি উদ্দালক-শ্বেতকেতু উপাখ্যান ২/৪/১২, ৬/১৩/১-২ ইত্যাদি)। ভূতাত্মক দেহ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি এবং দেহনাশের সমকালীন চৈতন্যের বিনাশসম্বন্ধীয় যে ধারণা চার্বাক মতে অঙ্গীভূত তার প্রতিচ্ছবি এই উপনিষদীয় অনুচ্ছেদে লক্ষ্যণীয়। এই উপনিষদীয় ধারণা থেকে আত্মাটাকে বাদ দিলেই চার্বাকীয় দেহাত্মবাদী রূপটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
 .
তবে কঠোপনিষদের (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-৪০০) নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানের এক পর্যায়ে পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায় বিশেষের উল্লেখ (কঠোপনিষদ: ১/১/২০) আমাদেরকে ভিন্ন বা আদিরূপে চার্বাক মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সেই উপনিষদীয় যুগেই চার্বাক দর্শনের আদিরূপের অস্তিত্বে আধ্যাত্মবাদ বিরোধী বস্তুবাদী ধারণার উপস্থিতির সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। আলোচ্য এই দীর্ঘ নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানটির উদ্দিষ্ট অংশটুকুতে আমরা দেখি-
 .
ঋষি গৌতম রাজশ্রবস যজ্ঞদানকালে একবার রেগেমেগে কথায় কথায় পুত্র নচিকেতাকে যমকে দান করলে পিতৃবাক্য পালনে নচিকেতা যমালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন। পরবর্তীতে নচিকেতার গুণে সন্তুষ্ট যমরাজ নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চাইলেন। তৃতীয় বর চাইতে গিয়ে নচিকেতা বললেন-
যেয়ং প্রেতে বিচিকৎসা মনুষ্যেহস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে। এতদ্ বিদ্যাং অনুশিষ্টস্ত্বয়াহহং বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ।। ১/১/২০।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : মানুষ মাত্রেই মরণশীল। জন্মালে মরতেই হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর কী ? কেউ বলেন আত্মা আছে। কেউ বলেন বাজে কথা, আত্মা থাকে না। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে ততদিনই আত্মা থাকে, কাজ করে। মরে প্রেত হয়ে গেলে নাকি আত্মারও আর কিছু করার থাকে না। এ-নিয়ে আমাদের মধ্যে দারুণ সংশয় আছে। এ-ব্যাপারে কোনটা ঠিক, মৃত্যুর অধিপতি আপনি যেমন জানেন, আর কেউ তেমন জানেন না। এর রহস্য জানতে আমার খুব ইচ্ছে। আপনি যখন স্বেচ্ছায় আমাকে বর দিতে চেয়েছেন, তখন এটাই আমার তৃতীয় প্রার্থনা। পরলোকের রহস্য আমায় বলুন।
.
নচিকেতার বর প্রার্থনা শুনে যমরাজ চমকে উঠলেন। ভাবতেও পারেননি যে ঐটুকু ছেলে নচিকেতা তাঁকে এমন একটা প্রশ্ন করে বসতে পারেন। এ যে দারুণ গোপন ব্যাপার। পরলোকের এই রহস্য যদি কোন মানুষ জানতে পারে, তাহলে আর তো সে তার আওতার মধ্যে থাকবে না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন-
.
দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং পুরা না হি সুবিজ্ঞেয়মণুরেষ ধর্মঃ। অন্যং বরং নচিকেতো বৃণীষ মা মোপরোৎসীরতি মা সৃজৈনম্ ।। ১/১/২১।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : তোমার এই প্রশ্নের জবাব দেয়া বড়ই কঠিন। সহজে বোঝানো যায় না, বোঝাও যায় না। দেবতারাও এখনো এ-নিয়ে সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছেন, মানুষ তো কোন্ ছার। তুমি ও-বিষয়ে জানার জন্য আমাকে অনুরোধ কোরো না। অন্য বর চাও।
.
নচিকেতা বললেন-
দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং কিল ত্বঞ্চ মৃত্যো যন্ন সুবিজ্ঞেয়মাত্থ। বক্তা চাস্য ত্বাদৃগন্যো ন লভ্যো নান্যো বরস্তুল্য এত্য কশ্চিৎ।। ১/১/২২।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : (সে কি কথা যমরাজ!) পরলোকের এমনি রহস্য যে বোঝানোও যায় না, বোঝাও যায় না ? আবার দেবতারাও সঠিক জানেন না !  মহারাজ, যদি তাই হয়, তাহলে, এই বর ছাড়া আমার আর অন্য বর নেই। বিশেষ করে আপনার মত ধর্মরাজের অনুগ্রহ যখন পেয়েছি, তখন এই রহস্য ছাড়া আমি আর অন্য কিছু জানতে চাই না। কেননা, আত্মতত্ত্বই হল পরমপুরুষার্থ- সবরকমের বন্ধনমুক্তির একমাত্র উপায়।
 .
অতঃপর উপাখ্যানটি পরলোক, আত্মা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক ধারণার জটিল থেকে জটিলতর বুননের দিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সেই উপনিষদের যুগেই যে ইন্দ্রিয়াতীত আত্মা বা পরলোকের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক প্রতিষ্ঠিত ছিলো তা নিয়ে হয়তো সন্দেহ থাকে না। এবং চার্বাক মতের আদিরূপে এসব ভাববাদী চেতনায় অবিশ্বাসী বস্তুবাদীদের উপস্থিতিও বেশ জোরেশোরে ছিলো বলে প্রতীতী হয়।
.
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই জড়বাদী চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন নামেই অভিহিত করা হয় এবং তাকেই বার্হস্পত্য মত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর বার্হস্পত্য মত মানে বৃহস্পতির মত বা বৃহস্পতি-প্রণীত মত। পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে বৃহস্পতি দেবগুরু বা দেবতাদের আচার্য। কিন্তু স্বয়ং দেবগুরু-প্রণীত মত হওয়ায় বৈদিক সংস্কৃতির বাহকদের কাছে দর্শনটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কথা থাকলেও তা না-হয়ে যে ঠিক উল্টোটিই হয়েছে, এর কারণ তার জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই। এবং এই জড়বাদী মত কী করে দেবগুরুর উদ্ধৃতিতে প্রচারিত হলো, এটাই ভারতীয় দর্শনে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ রহস্য। অবশ্য পৌরাণিক উপাখ্যানেই এই রহস্যের জবাবও দেয়া হয়েছে বেশ কৌশলে। মৈত্রায়নী উপনিষদের উপাখ্যান অনুসারে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা হেরে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতি ফন্দি করে অসুর গুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে এই বেদবিরোধী বস্তুবাদী দর্শনের প্রচার করেন। এবং এই ভ্রান্ত ও ঘৃণ্য মতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অসুরেরা এমন অধঃপাতে গেলো যে সেই সুযোগে তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দেবতারা হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে একটা প্রতারণামূলক নাস্তিক্যবাদী শাস্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে বৃহস্পতিকে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। সাথে হয়তো এটাও শিক্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই শাস্ত্র অসুরদের নাশের জন্যেই সৃষ্ট, তাই এটা অনুসরণ করলে অনুসরণকারীর জন্য অধঃপাত অনিবার্য।
 .
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে আমাদেরকে পুনরায় স্মরণ করতে হয় যে, উপনিষদ হলো বেদের অন্তিম অংশ। সংহিতা বা মন্ত্রের মাধ্যমে যে বৈদিক যুগের প্রারম্ভ এবং বৈদিক ‘ব্রাহ্মণে’ যার পূর্ণ বিকাশ, সেই বৈদিক যুগের পরিসমাপ্তি এই উপনিষদের যুগে। কিন্তু এই যুগের পরিধিকে কোন বিশেষ সীমারেখায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের কালকে ইতিহাসের এক বিশেষ সীমা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সাপেক্ষে ‘ছান্দোগ্য’, ‘বৃহদারণ্যক’ প্রভৃতি কয়েকটি প্রধান উপনিষদের রচনাকালকে বহু প্রাচীন এবং বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে মনে করা হলেও ‘মৈত্রায়ণীয়’ এবং অন্যান্য বহু উপনিষদ বুদ্ধোত্তর বলে অনেকেরই ধারণা। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘দর্শন-দিগদর্শন’ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য উপনিষদগুলির ক্রমিক সৃষ্টিকাল নির্ণয় করেছেন এভাবে-
(১) প্রাচীনতম উপনিষদ (৭০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) ঈশ, (খ) ছান্দোগ্য, (গ) বৃহদারণ্যক।
(২) দ্বিতীয় যুগের উপনিষদ (৬০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) ঐতরেয়, (খ) তৈত্তিরীয়।
(৩) তৃতীয় যুগের উপনিষদ (৫০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) প্রশ্ন, (খ) কেন, (গ) কঠ, (ঘ) মুণ্ডক, (ঙ) মাণ্ডুক্য।
(৪) চতুর্থ যুগের উপনিষদ (২০০-১০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) কৌষীতকি, (খ) মৈত্রী বা মৈত্রায়ণীয়, (গ) শ্বেতাশ্বতর।
 .
সেক্ষেত্রে এই মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের উপাখ্যান কল্পনা যে দেবগুরুর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের এক কৌশলী প্রয়াস হিসেবেই করা হয়ে থাকতে পারে এই সন্দেহ অযৌক্তিক হবে না। অর্থাৎ এই পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টির আগেই চার্বাক বা লোকায়ত মত ভারতীয় সমাজে ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো। তাছাড়া বৈদিক সংস্কৃতির ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বুদ্ধমতেরও সূচনা হয়েছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
 .
এছাড়াও বুদ্ধের প্রায় সমকালবর্তী ও বয়োজ্যেষ্ঠ দার্শনিক অজিত কেশকম্বলীর (৫২৩ খ্রিস্টপূর্ব) উক্তিতেও চার্বাকী চিন্তার প্রতিচ্ছবি রয়েছে। বৌদ্ধ ত্রিপিটকের কয়েক জায়গায় যেমন দীঘনিকায় (১/২), মজ্ঝিমণিকায় (২/১/১০, ২/৬/৬) অজিত কেশকম্বলীর দার্শনিক মতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘দান-ধ্যান …যজ্ঞ নেই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল বিপাক নয়। ইহলোক-পরলোক নয়, মাতা-পিতা-দেবতা নেই। সত্যলোকে পৌঁছে যাওয়া এমন কোন সত্যারূঢ় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি স্বয়ং ইহলোক-পরলোককে জ্ঞাত হয়ে মানুষকে বোঝাতে পারেন। মনুষ্য চতুর্ভূতের সৃষ্টি। মৃত্যুর পর (দৈহিক) পৃথিবী পৃথিবীতেই বিলীন হয়। …অনল অনলে …জল জলে …বায়ু বায়ুতেই লয় প্রাপ্ত হয়। ইন্দ্রিয় আকাশে গমন করে। মৃত ব্যক্তিকে খাটে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। চিতায় অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হয়; তারপর অস্থিসমূহ ক্রমশ ক্ষুদ্র ও ধূসরবর্ণ হয়ে আসে, অবশেষে চিতাভস্ম ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। দান করার পরামর্শ মূর্খের উপদেশ, যিনি আস্তিক্যবাদের কথা বলেন তিনি তুচ্ছ ও মিথ্যা কথা বলেন। মূর্খ-বিদ্বান সকলেই বিনষ্ট হয়, বিচ্ছিন্ন হয়, মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না।’ (পৃষ্ঠা-৭৪, দর্শন-দিগদর্শন ২য় খণ্ড / রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
 .
বৈদিক যজ্ঞ ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিশেষ সুবিধাভোগের বিরোধিতা এবং বেদবিহিত শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের সমালোচনার মাধ্যমে কেশকম্বলী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা অজিত কেশকম্বলীর উপরিউক্ত চিন্তাধারা চার্বাক দর্শনের সঙ্গে একই আসনে নিজের স্থান করে নিয়েছে বলা যায়। এখানে-
 .
‘চার্বাকের মত অজিতও মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আর পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, কর্মফল ইত্যাদি ধারণাও অস্বীকার করেন। জাগতিক বস্তুনিচয়ের উপাদান হিসাবে পঞ্চ মহাভূতের পরিবর্তে চার মহাভূতের স্বীকৃতিতে ভারতীয় সাধারণ ধারণার যে ব্যতিক্রম চার্বাক মতবাদে পরিস্ফুট, অজিতের মধ্যে আমরা তার সূচনা লক্ষ্য করি। …অজানিত ভবিষ্যতে সুখের আশায় জীবনের প্রতিদিনের সাধারণ আনন্দের প্রতি যাঁরা উদাসীন- তাঁদের আদর্শবাদী চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত হল এই সম্প্রদায়ের মনোভাব। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে চার্বাকদের সঙ্গে কেশকম্বলীদের অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’ (পৃষ্ঠা-১৬, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
 .
এরকম নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা রামায়ণেও বিরল নয়। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) ব্রাহ্মণ জাবালির উক্তির মধ্যে এই মতাদর্শিয় যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামযুক্ত দর্শনের রূপ সুস্পষ্টভাবেই পরিস্ফুট হয়েছে।
 .
‘পিতার মৃত্যুর পর ভরত বনবাসী রামকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে পিতৃসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য অনুরোধ জানালে পিতৃসত্য পালনে কৃতসংকল্প রাম তাঁর সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং অরণ্যজীবনের কঠোরতা বরণের সমর্থনে অভিমত জ্ঞাপন করেন। রামকে কৃচ্ছ্রসাধনের দৃঢ় সংকল্প থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ জাবালি উপদেশাত্মক এক বিবৃতি দেন এবং রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত নাস্তিকবাদ এই প্রচেষ্টারই সাক্ষ্য বহন করে।
জাবালি বলেন যে, পারলৌকিক ধর্মের মোহে বৈষয়িক সুখকে বিসর্জন দেওয়ার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এর ফলে বর্তমান জীবন দুঃখময় হয়, কিন্তু পরিণামে দেহত্যাগের পর সুখের কোন সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ফলভোক্তার দেহাতিরিক্ত কোন পৃথক সত্তা নেই। অন্ন প্রভৃতি ভোজ্য বস্তুর সাহায্যে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য যে ভোগ সম্ভব, শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমরা সেটাকেই কেবল নষ্ট করি, নতুন কোন ফল পাই না। জাবালি বলেন যে, মৃত্যুর পর প্রাণীর কোন অস্তিত্ব থাকে না। কাজেই মৃতের উদ্দেশ্যে আমরা যে ভোজনের আয়োজন করি তা নিরর্থক হয়।
আপাতঃ রমণীয় হলেও জাবালির উপদেশকে রাম প্রতিপালনের অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন এবং এঁর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে নিজ সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেননি।’ (পৃষ্ঠা-১১, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)
 .
উল্লেখ্য, বর্তমানে মহাভারতকে যে আকারে পাওয়া যায় তার রচনাকালের পূর্বসীমা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ এবং শেষ সীমা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।  অন্যদিকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকেই রামায়ণ রচনা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অর্থাৎ রামায়ণ এবং মহাভারতের পূর্ণ রূপায়ণের বহু পূর্বেই ভারতীয় দর্শনের জগতে ‘চার্বাক’ নাম বিশিষ্ট না হলেও এই মতের আবির্ভাব সূচিত হয়েছিলো বলেই প্রতীয়মান হয়। এবং এই মত যে প্রকৃতই তৎকালীন লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো, প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে এর উপস্থিতি এই সাক্ষ্যই দেয়। হতে পারে এই মতকে অসার বা প্রয়োগযোগ্যতাহীন প্রতিপন্ন করার প্রয়োজনেই তৎকালীন সাহিত্য-আয়োজনে এর উপস্থাপন করা হয়েছিলো, তবু ইতিহাসের নিরীখে এই উপস্থিতির গুরুত্ব কোনভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই।
 .
প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ‘অবশ্যই মহাভারত একজনের রচনা নয়। অধুনালভ্য মহাভারতের সংস্করণটি নানা কবির হাত ঘুরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তাই মহাভারতের সর্বত্র হুবহু একই মতাদর্শের পরিচায়ক হবার কথা নয়।’ (পৃষ্ঠা-২২, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। অতএব মহাভারতে নাস্তিক্য বা লোকায়ত বস্তুবাদী মতের আভাস যেমন বিরল নয়, তেমনি বস্তুবাদ-বিদ্বেষের নজির দেখানোও কঠিন নয়।
 .
মহাভারতের বনপর্বে (মহাভারত: ৩/৩০-৩১) দেখা যায়, দ্যুত ক্রীড়ায় পরাজিত পঞ্চপাণ্ডব যখন বন থেকে বনান্তরে ঘুরে অশেষ দুর্দশায় কালাতিপাত করছিলেন, সে সময় যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে দ্রৌপদী বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের অনুকুলে নানা ধরনের যুক্তি দেখিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তাতে ‘নাস্তিক্য’ মতের আভাসই পরিলতি হয়। নিজ শক্তিতে বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করে নেবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করার যে প্রয়াস দ্রৌপদীর বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায়, তা যে তৎকালীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতিতে প্রচলিত অদৃষ্ট, প্রাক্তন বা পূর্বজন্মের কর্মের সংস্কার ইত্যাদি ধারণার পরিপন্থি ছিলো বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা সনাতন ধর্মের এই সংস্কারে পূর্ণ প্রভাবিত মানুষ গভীরতম দুঃখেও বিচলিত না হয়ে নিজের দুর্দশাকে অতীতেরই স্বকৃত কর্মফল হিসেবে বিচার করে তা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকেন। ঈশ্বরের ন্যায়বিচার এবং ধর্ম ও শাস্ত্রবিহিত ক্রিয়ানুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে আধ্যাত্মিক মতের মোক্ষকে চরম লক্ষ্য স্থির করে তারই প্রস্তুতি হিসেবে প্রাত্যহিক জীবনের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেন এই শ্রেণীর লোকেরা। ফলে ধর্মকে একান্তভাবে অবলম্বন করেও যে ঐহিক উন্নতি লাভে যুধিষ্ঠির অসমর্থ, ধর্মকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র নিজ শক্তিতে কর্মের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দুর্যোধন তা অর্জন করেছেন বলে দ্রৌপদীর অভিমত। এখানে দ্রৌপদীর উল্লেখিত ‘কর্ম’ প্রচলিত সনাধন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয়। মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদীর উল্লিখিত দীর্ঘ বক্তব্যের কিছু নমুনা, যেমন-
‘দ্রৌপদ্যুবাচ।
নাবমন্যে ন গর্হে চ ধর্ম্মং পার্থ! কথঞ্চন।
ঈশ্বরং কুত এবাহমবমংস্যে প্রজাপতিম্ ।। (বনপর্ব-১২৮/১)।।
জঙ্গমেষু বিশেষেণ মনুষ্যা ভরতর্ষভ!।
ইচ্ছন্তি কর্ম্মণা বৃত্তিমবাপ্তুং প্রেত্য চেহ চ।। (বন-১২৮/৫)।।
উত্থানমভিজানন্তি সর্ব্বভূতানি ভারত!।
প্রত্যক্ষং ফলমশ্নন্তি কর্ম্মণাং লোকসাক্ষিকম্ ।। (বন-১২৮/৬)।।
উৎসীদেরন্ প্রজাঃ সর্ব্বা ন কুর্য্যুঃ কর্ম্ম চেদ্ভুবি।
তথা হ্যেতা ন বর্দ্ধেরন্ কর্ম্ম চেদফলং ভবেৎ।। (বন-১২৮/১১)।।
যশ্চ দিষ্টপরো লোকো যশ্চায়ং হঠবাদিকঃ।
উভাবপসদাবেতৌ কর্ম্মবুদ্ধিঃ প্রশস্যতে।। (বন-১২৮/১৩)।।
যচ্চাপি কিঞ্চিৎ পুরুষো দিষ্টং নাম ভজত্যুত।
দৈবেন বিধিনা পার্থ! তদ্দৈবমিতি নিশ্চিতম্ ।। (বন-১২৮/১৭)।।
যৎ স্বয়ং কর্ম্মণা কিঞ্চিৎ ফলমাপ্নোতি পুরুষঃ।
প্রত্যক্ষমেতল্লোকেষু তৎ পৌরুষমিতি স্মৃতম্ ।। (বন-১২৮/১৮)।।
মনসার্থান্ বিনিশ্চিত্য পশ্চাৎ প্রাপ্নোতি কর্ম্মণা।
বুদ্ধিপূর্ব্বং স্বয়ং বীর! পুরুষস্তত্র কারণম্ ।। (বন-১২৮/২৫)।।
সংখ্যাতুং নৈব শক্যানি কর্ম্মাণি পুরুষর্ষভ!।
অগারনগরাণাং হি সিদ্ধিঃ পুরুষহৈতুকী।। (বন-১২৮/২৬)।।
ইষ্টাপূর্ত্তফলং ন স্যান্ন শিষ্যো ন গুরুর্ভবেৎ।
পুরুষঃ কর্ম্মসাধ্যেষু স্যাচ্চেদয়মকারণম্ ।। (বন-১২৮/৩০)।।
সর্ব্বমেব হঠেনৈকে দৈবেনৈকে বদন্ত্যুত।
পুংসঃ প্রযত্নজং কিঞ্চিল্রৈধমেতন্নিরুচ্যতে।। (বন-১২৮/৩২)।।
ত্রিদ্বারামর্থসিদ্ধিন্তু নানুপশ্যন্তি যে নরাঃ।
তথৈবানর্থসিদ্ধিঞ্চ যথা লোকাস্তথৈব তে।। (বন-১২৮/৩৮)।।
পৃথিবীং লাঙ্গলেনেহ ভিত্ত্বা বীজং বপত্যুত।
আস্তেহয়ং কর্ষকস্তৃষ্ণীং পর্জ্জন্যস্তত্র কারণম্ ।। (বন-১২৮/৪৭)।।
কুর্ব্বতো নার্থসিদ্ধির্মে ভবতীতি হ ভারত!।
নির্ব্বেদো নাত্র কর্ত্তব্যো দ্বাবন্যৌ হ্যত্র কারণম্ ।। (বন-১২৮/৫০)।।
গুণাভাবে ফলং ন্যূনং ভবত্যফলমেব চ।
অনারম্ভে তু ন ফলং ন গুণো দৃশ্যতে ক্বচিৎ।। (বন-১২৮/৫২)।।
ন ত্বেবাত্মাবমন্তব্যঃ পুরুষেণ কদাচন।
ন হ্যাত্মপরিভূতস্য ভূতির্ভবতি শোভনা।। (বন-১২৮/৫৮)।।
এবং সংস্থিতিকা সিদ্ধিরিয়ং লোকস্য ভারত!।
তত্র সিদ্ধিগতিঃ প্রোক্তা কালাবস্থাবিভাগতঃ।। (বন-১২৮/৫৯)।।
ব্রাহ্মণং মে পিতা পূর্ব্বং বাসয়ামাস পন্ডিতম্ ।
সোহপি সর্ব্বামিমাং প্রাহ পিত্রে মে ভরতর্ষভ!।। (বন-১২৮/৬০)।।
নীতিং বৃহস্পতিপ্রোক্তাং ভ্রাতৃন্ মেহগ্রাহয়ৎ পুরা।
তেষাং সকাশাদশ্রৌষমহমেতত্তদা গৃহে।। (বন-১২৮/৬১)।।
অর্থাৎ :
দ্রৌপদী বলিলেন-
পার্থ! আমি কোন প্রকারেই ধর্ম্মকে অবজ্ঞা বা নিন্দা করি নাই এবং কেনই বা লোকনিয়ন্তা ঈশ্বরের প্রতি অবজ্ঞা করিব। (বন-১২৮/১)।।  তবে, ভরতশ্রেষ্ঠ! জঙ্গম প্রাণিগণের মধ্যে মনুষ্যেরাই বিশেষ বিশেষ কর্ম্মদ্বারা পরলোকে এবং ইহলোকে স্থিতিলাভ করিবার ইচ্ছা করে। (বন-১২৮/৫)।।  ভরতনন্দন! জগতের সকল প্রাণীই কর্ম্মের উদ্যম করিতে জানে এবং আপন প্রত্যক্ষে ও লোকপ্রত্যক্ষে সেই কর্ম্মের ফল ভোগ করে। (বন-১২৮/৬)।।  জগতে যদি প্রাণীরা কর্ম্ম না করিত, তবে সমস্ত প্রাণীই উৎসন্ন হইয়া যাইত এবং কর্ম্ম যদি নিষ্ফল হইত, তাহা হইলে প্রাণীরা বৃদ্ধি পাইত না। (বন-১২৮/১১)।।  যে লোক কেবল দৈবকেই আশ্রয় করিয়া থাকে এবং যে লোক ‘অতর্কিত ভাবেই সকল সিদ্ধ হয়’ এই কথা বলে, তাহারা উভয়েই অধম; আর যে লোক দৈবসহকারে কর্ম্ম করিবার ইচ্ছা করে, সে-ই প্রশংসনীয়। (বন-১২৮/১৩)।।  পার্থ! মানুষ দেবতার আরাধনা দ্বারা যে কিছু ধর্ম্ম লাভ করে, তাহাকেই দৈব বলা হয়। (বন-১২৮/১৭)।।  মানুষ জনসাধারণের প্রত্যক্ষে আপন কর্ম্ম দ্বারা যে ফল লাভ করে, তাহাকে পৌরুষ বলা হয়। (বন-১২৮/১৮)।।  বীর! প্রাণিগণ প্রথমে মনে মনে কর্ত্তব্য বিষয় নিশ্চয় করিয়া, পরে চেষ্টা দ্বারা বুদ্ধিপূর্ব্বক সেই কার্য্য আরম্ভ করে; সুতরাং তাহাদের দেহ নিমিত্ত কারণ। (বন-১২৮/২৫)।।  পুরুষশ্রেষ্ঠ! কর্ম্মগুলির সংখ্যা করা যায় না; (তবে ইহা বলা যায় যে,) গৃহনগরপ্রভৃতি সমস্ত কার্য্যসিদ্ধির প্রতিই পুরুষের দেহ-হেতু। (বন-১২৮/২৬)।।  মানুষ যদি কর্ম্মফলের প্রতি কারণ না হইত, তবে কেহই যাগ ও কূপ-নির্ম্মাণপ্রভৃতি কর্ম্মের ফল পাইত না এবং কেহ কাহারও শিষ্য বা গুরু হইত না। (বন-১২৮/৩০)।।  নাস্তিকেরা বলে- ‘সকল কার্য্যই স্বভাবতঃ সিদ্ধ হয়’, আস্তিকেরা বলেন- ‘সকল কার্য্যই দৈববশতঃ সিদ্ধ হয়’ এবং প্রাকৃত লোকেরা বলে- ‘সকল কার্য্যই মানুষের চেষ্টায় সিদ্ধ হয়’। এইভাবে ত্রিবিধ লোক ত্রিবিধ কারণ নিরূপণ করে। (বন-১২৮/৩২)।।  অতএব ইষ্ট বা অনিষ্ট সমস্ত ফলের প্রতিই ঈশ্বর, প্রারব্ধ কর্ম্ম এবং পুরুষকার- এই তিনটিই কারণ; ইহা যাহারা পর্যালোচনা করিয়াও বোঝে না, তাহারা ইতর লোকের ন্যায় একেবারে অনভিজ্ঞ। (বন-১২৮/৩৮)।।  কৃষক লাঙ্গলদ্বারা ভূমি কর্ষণ করিয়া বীজ বপন করে এবং তাহার পরে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কেন না, তখন ফলের কারণ হয়- মেঘ। (বন-১২৮/৪৭)।।  অতএব ভরতনন্দন! আপনিও পুরুষকার করুন; তাহাতে ফল না হইলেও আপনি যেন নিজের অবমাননা করেন না। কারণ, ফলসিদ্ধিবিষয়ে (ঈশ্বরের ইচ্ছা ও প্রাক্তন কর্ম্মস্বরূপ) আরও দুইটি কারণ আছে। (বন-১২৮/৫০)।।  কার্য্য আরম্ভ করিলে পর তাহার অঙ্গহানি হইলে, অল্প ফলও হয়, একেবারে ফল নাও হয়; কিন্তু কার্য্য আরম্ভ না করিলে, কোথাও ফল বা কর্ত্তার উৎকর্ষ, কোনটাই দেখা যায় না। (বন-১২৮/৫২)।।  পুরুষ কখনো নিজের প্রতি নিজে অবজ্ঞা করিবে না। কারণ, সেরূপ লোকের ভাল সম্পত্তি হয় না। (বন-১২৮/৫৮)।।  ভরতনন্দন! আমি এই নিয়মে লোকের কার্য্যসিদ্ধির কথা এবং দেশ ও অবস্থার বিভাগ অনুসারে কার্য্যসিদ্ধির উপায়ের কথা বলিলাম। (বন-১২৮/৫৯)।।  ভরতশ্রেষ্ঠ! পূর্ব্বে আমার পিতা কোন পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে বাস করাইয়াছিলেন; তিনিই এই সমস্ত নীতি আমার পিতার নিকট বলিয়াছিলেন। (বন-১২৮/৬০)।।  এবং সেই ব্রাহ্মণই এই বৃহস্পতিপ্রোক্ত নীতি পূর্ব্বে আমার ভ্রাতৃগণকে শুনাইয়াছিলেন; আবার আমি আমার ভ্রাতাদের নিকট তখন ইহা শুনিয়াছিলাম। (বন-১২৮/৬১)।।
 .
ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও দ্রৌপদীর অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়। যুধিষ্ঠিরকে বিপদ এবং দুর্যোধনকে সম্পদ প্রদান করার মধ্যে যে পক্ষপাতিত্বের প্রকাশ তার জন্য দ্রৌপদী ঈশ্বরকে দোষারোপ করেন। কর্মফলবাদের নীতি অনুসারে স্বকৃত কর্মের ফল প্রত্যেককেই ভোগ করতে হয়। এই নীতি স্বীকৃতি পেলে ঈশ্বরও তাঁর কৃতকর্মের জন্য পাপে লিপ্ত হতে এবং সে অনুযায়ী ফল ভোগ করতে বাধ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে স্বকৃত পাপের ফল ভোগের ব্যাপারে অব্যাহতি লাভ করেন তার মূলে ঈশ্বরের শক্তি ও প্রতাপ কার্যকরী। অর্থাৎ দ্রৌপদী তাঁর বক্তব্যে এটাই পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন যে, নিজ শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তিযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই কেবল জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব। ধর্ম, কর্মফল বা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নয়। যেমন, মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদীর কিছু আক্ষেপ- 

নেহ ধর্ম্মানৃশংসাভ্যাং ন ক্ষান্ত্যা নার্জ্জবেন চ।
পুরুষঃ শ্রিয়মাপ্নোতি ন ঘৃণিত্বেন কর্হিচিৎ।। (বন-১২৬/৩)।।
নহি তেহধ্যগমন্ জাতু তদানীং নাদ্য ভারত!।
ধর্ম্মাৎ প্রিয়তরং কিঞ্চিদপি চেজ্জীবিতাদিহ।। (বন-১২৬/৫)।।
রাজানং ধর্ম্মগোপ্তারং ধর্ম্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।
ইতি মে শ্রুতমার্য্যাণাং ত্বান্তু মন্যে ন রক্ষতি।। (বন-১২৬/৮)।।
মণিঃ সূত্র ইব প্রোতো নস্যোত ইব গোবৃষঃ।
স্রোতসো মধ্যমাপন্নঃ কূলাদ্বৃক্ষ ইব চ্যুতঃ।। (বন-১২৬/২৬)।।
ধাতুরাদেশমন্বেতি তন্ময়ো হি তদর্পণঃ।
নাত্মাধীনো মনুষ্যোহয়ং কালং ভজতি কঞ্চন।। (বন-১২৬/২৭)।। (যুগ্মকম্)
অজ্ঞো জন্তুরনীশোহয়মাত্মনঃ সুখদুঃখয়োঃ।
ঈশ্বরপ্রেষিতো গচ্ছেৎ স্বর্গং নরকমেব চ।। (বন-১২৬/২৮)।।
পশ্য মায়াপ্রভাবোহয়মীশ্বরেণ যথা কৃতঃ।
যো হন্তি ভূতৈর্ভূতানি মোহয়িত্বাত্মমায়য়া।। (বন-১২৬/৩২)।।
আর্য্যান্ শীলবতো দৃষ্ট্বা হ্রীমতো বৃত্তিকর্ষিতান্ ।
অনার্য্যান্ সুখিনশ্চৈব বিহ্বলামীব চিন্তয়া।। (বন-১২৬/৩৯)।।
তবেমামাপদং দৃষ্ট্বা সমৃদ্বিঞ্চ সুযোধনে।
ধাতারং গর্হয়ে পার্থ! ডবষমং যোহনুপশ্যতি।। (বন-১২৬/৪০)।।
আর্য্যশাস্ত্রাতিগে ক্রূরে লুব্ধে ধর্ম্মাপচায়িনি।
ধার্ত্তরাষ্ট্রে শ্রিয়ং দত্ত্বা ধাতা কিং ফলমশ্নুতে।। (বন-১২৬/৪১)।।
কর্ম্ম চেৎ কৃতমন্বেতি কর্ত্তারং নান্যমৃচ্ছতি।
কর্ম্মণা তেন পাপেন লিপ্যতে নূনমীশ্বরঃ।। (বন-১২৬/৪২)।।
অথ কর্ম্ম কৃতং পাপং ন চেৎ কর্ত্তারমৃচ্ছতি।
কারণং বলমেবেহ জনান্ শোচামি দুর্ব্বলান্ ।। (বন-১২৬/৪৩)।।
অর্থাৎ :
এই জগতে ধর্ম্ম, কোমলতা, ক্ষমা, সরলতা কিংবা দয়া দ্বারা কেহ কখনও সম্পদ লাভ করিতে পারে না। (বন-১২৬/৩)।।  ভরতনন্দন! আপনার ভ্রাতারা তখন বা এখন বা কোন সময়েই ধর্ম্ম অপেক্ষা কোন বস্তুকেই প্রিয়তর বলিয়া জানেন নাই; জীবন অপেক্ষাও ধর্ম্মকেই প্রিয়তর বলিয়া জানেন। (বন-১২৬/৫)।।  আমি গুরুজনবর্গের নিকট শুনিয়াছি যে, রাজা ধর্ম্মকে রক্ষা করিলে, ধর্ম্মও রাজাকে রক্ষা করেন; কিন্তু সে ধর্ম্ম আপনাকে রক্ষা করেন না- ইহা আমি মনে করি। (বন-১২৬/৮)।।  জগতের সকল প্রাণীই ঈশ্বরময় এবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করিয়া রহিয়াছে; সুতরাং সূত্রগ্রথিত মণির ন্যায়, নাসিকাবদ্ধ বৃষের ন্যায় এবং তীরচ্যুত ও স্রোতের মধ্যে পতিত বৃক্ষের ন্যায় প্রাণিগণ বিধাতার আদেশেরই অনুসরণ করে; কিন্তু স্বাধীন হইয়া কোন সময়েই চলিতে পারে না। (বন-১২৬/২৬-৭)।।  নিজের সুখ-দুঃখবিধানে অসমর্থ মূঢ় প্রাণীরা ঈশ্বরপ্রেরিত হইয়াই স্বর্গে বা নরকে যায়। (বন-১২৬/২৮)।।  মহারাজ! ঈশ্বর এই মায়ার প্রভাবকে যেমন করিয়াছেন, তাহা দেখুন। যিনি নিজের মায়ায় মোহিত করিয়া প্রাণিগণ দ্বারাই প্রাণিগণকে বধ করিতেছেন। (বন-১২৬/৩২)।।  সচ্চরিত্র ও লজ্জাশীল সজ্জনদিগকে দুঃখিত দেখিয়া এবং অসজ্জনদিগকে সুখী দেখিয়া আমি চিন্তায় যেন বিহ্বল হইতেছি। (বন-১২৬/৩৯)।। পার্থ! আপনার এই বিপদ এবং দুর্য্যােধনের সম্পদ দেখিয়া আমি বিধাতাকেই নিন্দা করিতেছি। কারণ, যিনি বিপরীতভাবে পর্য্যালোচনা করিতেছেন। (বন-১২৬/৪০)।।  হায়! দুর্য্যােধন ধর্ম্মশাস্ত্র অতিক্রম করিয়া ধর্ম্ম নষ্ট করিয়াছে এবং সে ক্রূরস্বভাব ও লুব্ধপ্রকতি; তথাপি বিধাতা তাহাকে সম্পত্তি দান করিয়া কি ফল পাইতেছেন ! (বন-১২৬/৪১)।।  যদি প্রাক্তন কর্ম্ম কর্ত্তারই অনুসরণ করে, অন্যের অনুসরণ করে না; তবে নিশ্চয়ই সেই পাপকর্ম্মে ঈশ্বরও লিপ্ত হইতেছেন। (বন-১২৬/৪২)।।  তা’র পর, যদি ইহা বলা যায় যে, প্রাক্তন কর্ম্ম কর্ত্তার অনুসরণ করে না, তবে বলিতে হইবে যে, তাহার কারণ একমাত্র বল। এমন হইলে, দুর্ব্বল লোকদের জন্যই আমার শোক হইতেছে। (বন-১২৬/৪৩)।।
দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু ঈশ্বরে সরাসরি অস্বীকৃতি না থাকলেও দ্রৌপদী বণিত এই নাস্তিক্য মত যে আমাদের পরিচিত বার্হস্পত্য বা চার্বাক মতের মূল নীতিগুলিরই অনুগামী, তা অস্পষ্ট নয়।
 .
আবার মহাভারতের শান্তিপর্বে সাংখ্যাচার্য পঞ্চশিখকে নিজ মতবাদ প্রচারের সময় সমসাময়িক যে সব মতগোষ্ঠীর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো সেবিষয়ক উপাখ্যানও দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ‘চার্বাক’ বিশেষণের প্রয়োগ না হলেও চার্বাক মতের অনুরূপ মতেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে (মহাভারত: ১২/২১৮/২৩-২৯)। যেমন- 

জাতিনির্বেদমুক্ত্বা স কর্ম্মনির্বেদমব্রবীৎ।
কর্ম্মনির্বেদমুক্ত্বা চ সর্বনির্ব্বেদমব্রবীৎ।। (শান্তিপর্ব-২১৫/২২)।।
যদর্থং ধর্ম্মসংসর্গঃ কর্ম্মণাঞ্চ ফলোদয়ঃ।
তমনাশ্বাসিকং মোহং বিনাশি চলমধ্রুবম্ ।। (শান্তি-২১৫/২৩)।।
দৃশ্যমানে বিনাশে চ প্রত্যক্ষে লোকসাক্ষিকে।
আগমাৎ পরমস্তীতি ব্রুবন্নপি পরাজিতঃ।। (শান্তি-২১৫/২৪)।।
অনাত্মা হ্যাত্মনো মৃত্যুঃ ক্লেশো মৃত্যুর্জরাময়ঃ।
আত্মানং মন্যতে মোহাত্তদসম্যক্ পরং মতম্ ।। (শান্তি-২১৫/২৫)।।
অথ চেদেবমপ্যস্তি যল্লোকে নোপপদ্যতে।
অজরোহয়মমৃত্যুশ্চ রাজাসৌ মন্যতে যথা।। (শান্তি-২১৫/২৬)।।
অস্তি নাস্তীতি চাপ্যেতত্তস্মিন্নসতি লক্ষণে।
কিমধিষ্ঠায় তদ্-ব্রূয়াল্লোকযাত্রাবিনিশ্চয়ম্ ।। (শান্তি-২১৫/২৭)।।
প্রত্যক্ষং হ্যেতয়োর্মূলং কৃতান্তৈতিহ্যয়োরপি।
প্রত্যক্ষেণাগমো ভিন্নঃ কৃতান্তো বা ন কিঞ্চন।। (শান্তি-২১৫/২৮)।।
যত্র যত্রানুমানেহস্মিন্ কৃতং ভাবয়তোহপি চ।
নান্যো জীবঃ শরীরস্য নাস্তিকানাং মতে স্থিতঃ।। (শান্তি-২১৫/২৯)।।
রেতো বটকণীকায়াং ঘৃতপাকাধিবাসনম্ ।
জাতিঃ স্মৃতিরয়স্কান্তঃ সূর্য্যকান্তোহন্বুভক্ষণম্ ।। (শান্তি-২১৫/৩০)।।
প্রেতীভূতেহত্যয়শ্চৈব দেবতাদ্যুপযাচনম্ ।
মৃতে কর্ম্মনিবৃত্তিশ্চ প্রমাণমিতি নিশ্চয়ঃ।। (শান্তি-২১৫/৩১)।।
নন্বেতে হেতবঃ সন্তি যে কেচিন্মুর্ত্তিসংস্থিতাঃ।
অমূর্ত্তস্য হি মূর্ত্তেন সামান্যং নোপপদ্যতে।। (শান্তি-১২৫/৩২)।।
অর্থাৎ :
পঞ্চশিখ প্রথমে জন্মের দোষ বলিয়া পরে কর্ম্মের দোষ বলিলেন এবং কর্ম্মের দোষ বলিয়া লৌকিক সমস্ত কার্য্যরেই দোষ বলিলেন। (শান্তি-২১৫/২২)।।  মানুষ মীমাংসকের মত অনুসরণ করিয়া যে মুক্তির জন্য নিষ্কামভাবে ধর্ম্মানুষ্ঠান করে; সে মুক্তিলাভ করায় বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তত্ত্বজ্ঞান ভিন্ন কেবল ধর্ম্মে মুক্তি হয় না। আর মানুষ যে পুত্রাদি ফললাভের জন্য কাম্যকর্ম্ম করে, তাহাও মোহ-প্রযুক্ত। কেন না, কাম্যকর্ম্মের ফল বিনশ্বর, অস্থির ও অনিশ্চিত। (শান্তি-২১৫/২৩)।।  নাস্তিকেরা বলেন- দেহই আত্মা, দেহ ভিন্ন আত্মা নাই। কারণ, দেহেরই বিনাশ দেখা যায়, প্রত্যক্ষ করা যায় এবং মানুষেরাই তাহা প্রত্যক্ষ করে; অতএব শাস্ত্র অনুসারে দেহ ভিন্ন আত্মা আছে-এইরূপ বলিতে থাকিয়া আস্তিকগণ পরাজিতই হয়। (শান্তি-২১৫/২৪)।।  আত্মার মৃত্যুর মূর্ত্তি নাই; সুতরাং সেই মৃত্যুকে দেখা যায় না। সে যাহা হউক, ছেদভেদাদিজনিত কষ্ট, জরা, রোগ ও বিনাশ এইগুলি দেহেরই ধর্ম্ম; সুতরাং দেহই আত্মা, অতএব আস্তিকগণ দেহভিন্ন আত্মা আছে বলিয়া যে মনে করে, তাহাদের সে মত সমীচীন নহে। (শান্তি-২১৫/২৫)।।  তারপর তোমরা (আস্তিকেরা) যদি বল যে, জগতে যাহা দেখা যায় না, এরূপ বস্তুও আছে; যেমন অঙ্কুর দেখা যায় না, অথচ তাহা বীজে আছে। সে বিষয়ে আমাদের (নাস্তিকদের) বক্তব্য এই যে, স্তুতিপাঠকেরা যেমন রাজাকে অজর ও অমর মনে করিয়াই যেন তাঁহার সেইরূপ বর্ণনা করে; তোমরাও (আস্তিকেরাও) তেমন আত্মাকে অজর ও অমর মনে করিয়া সেইরূপ বলিয়া থাক। বাস্তবিকপক্ষে রাজার ন্যায় আত্মারও জরা এবং মৃত্যু আছে। (শান্তি-২১৫/২৬)।।  আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে দৃঢ়তর প্রমাণ না থাকিলে এবং আত্মা আছে কি নাই- এইরূপ সন্দেহ চলিতে লাগিলে, মানুষ কি অবলম্বন করিয়া সাংসারিক কার্য্য করিবে; তাহা আপনার (নাস্তিকের) বলা উচিত। (শান্তি-২১৫/২৭)।।  প্রত্যক্ষই অনুমান ও আগমের মূল; সুতরাং প্রত্যক্ষকর্ত্তৃক বাধিত হইলে অনুমান ও আগম কিছুই নহে (ইহা নাস্তিকের উক্তি)। (শান্তি-২১৫/২৮)।।  এই অনুমানদ্বারা যেখানে যেখানে সাধ্যের সিদ্ধি হইল বলিয়া তুমি মনে কর, সেইখানে সেইখানে তাহা করিবে না; কারণ, আমাদের নাস্তিকদের মতে অনুমান প্রমাণ নহে এবং দেহভিন্ন অন্য জীবাত্মা নাই। (শান্তি-২১৫/২৯)।।  বটবৃক্ষের ক্ষুদ্র বীজে যেমন প্রথমে তাহার পত্র, শাখা ও প্রশাখাপ্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে থাকে, পরে প্রকাশ পায়; তেমন পুরুষের শুক্রে প্রথমে মনপ্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে থাকে, পরে প্রকাশ পায়। ভুক্তঘৃত পরিপাক পাইলে তাহা হইতে যেমন শুক্র জন্মে, তেমন পিতার শুক্র পরিণত হইলে তাহা হইতে পুত্র ও কন্যার শুক্র ও শোণিত জন্মিয়া থাকে। চন্দনবাসিত কাষ্ঠ হইতে যেমন সৌরভ উৎপন্ন হয়, তেমন স্ত্রীশোণিতসংযুক্ত পুরুষের শুক্র হইতে রক্তপ্রভৃতি উৎপন্ন হয়। পর্য্যুষিত তণ্ডুল-প্রভৃতি বহুদ্রব্যনির্ম্মিত মদ্যে যেমন মাদকতাশক্তি জন্মে; তেমন ক্ষিতি, জল, তেজ ও বায়ু- এই চারিটি দ্রব্যনির্ম্মিত দেহে চৈতন্য জন্মে। যেমন জড় মন হইতে অজড় স্মৃতি উৎপন্ন হয়, তেমন জড়দেহ হইতে অজড় চৈতন্য উৎপন্ন হইয়া থাকে। জড় অয়স্কান্তমণি যেমন লৌহকে সঞ্চারিত করে, তেমন জড় দেহ ও ইন্দ্রিয়গণকে সঞ্চালিত করে। শীতল সূর্য্যকান্তমণি যেমন সূর্য্যরশ্মিসংযোগে অগ্নি আবিষ্কার করে, তেমন শীতল শুক্র ও রসরক্তসংযোগে জঠরানল আবিষ্কার করে। আর জলোৎপন্ন বড়বানল যেমন জলই ভক্ষণ করে, তেমন শুক্র হইতে উৎপন্ন দেহ শুক্র ধারণ করে। (শান্তি-২১৫/৩০)।।  (আস্তিকের বক্তব্য) চৈতন্য দেহের ধর্ম্ম হইলে দেহ প্রাণশূন্য হইয়া পড়িলে চৈতন্য থাকে না কেন? গুরুতর রোগ জন্মিলে চৈতন্য রক্ষার জন্য নাস্তিকেরাও দেবতাপ্রভৃতির নিকট প্রার্থনা করে কেন? এইগুলিই আমাদের আস্তিকদের মতে চৈতন্য যে দেহ হইতে ভিন্ন এবং জীবাত্মা তাহার পক্ষে প্রমাণ; আর ইহাই নিশ্চয়। (শান্তি-২১৫/৩১)।।  নাস্তিক! আপনি যে যুক্তিগুলি দেখাইয়াছেন, তাহা কি সম্ভবপর হয়? কখনই না। কারণ, জগতে যে কিছু মূর্ত্তিমান্ পদার্থ আছে, তাহা হইতে অমূর্ত্ত পদার্থের উৎপত্তি হয় না। কেন না, মূর্ত্তিমান্ পদার্থের সহিত অমূর্ত্ত পদার্থের সাদৃশ্য থাকে না। (শান্তি-১২৫/৩২)।।
 .
তবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র সাক্ষ্যে বার্হস্পত্য সম্পর্কে চমৎকার প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রথম অধিকরণ বিনয়াধিকারিকম্ এর বিদ্যাসমুদ্দেশ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যা ও তাদের সম্মন্ধে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধেয় আচার্যগণের মতভঙ্গি উদ্ধৃত করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেন-
[কৌটিল্যস্য স্বমতং চ।] আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ।
.
ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি মানবাঃ। ত্রয়ীবিশেষো হ্যান্বীক্ষিকীতি।
.
বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি।
.
দণ্ডনীতিরেকা বিদ্যেত্যৌশনসাঃ। তস্যাং হি সর্ববিদ্যারম্ভাঃ প্রতিবদ্ধা ইতি।
.
চতস্র এব বিদ্যা ইতি কৌটিল্যঃ। তাভির্ধর্মার্থৌ যদ্বিদ্যাত্তদ্বিদ্যানাং বিদ্যাত্বম্ ।। ১/২/১।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
.
অর্থাৎ :
কৌটিল্যের মতে, বিদ্যা চার প্রকারের, যথা- আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
.
মানব সম্প্রদায় অর্থাৎ মনু-শিষ্যগণ বলেন- ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি- বিদ্যা এই তিনপ্রকার। কারণ, আন্বীক্ষিকী (বা হেতুবিদ্যা) ত্রয়ীর অর্থবিচার করে বলে সেটি ত্রয়ীবিশেষ-মাত্র অর্থাৎ ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।
.
বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি- এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।
.
ঔশনস (উশনা-পুত্র শুক্রাচার্যের শিষ্য-) গণের মতে, দণ্ডনীতি বা অর্থশাস্ত্রই একমাত্র বিদ্যা, কারণ দণ্ডনীতিতেই অন্যান্য সমস্ত বিদ্যার আরম্ভ (অর্থাৎ কর্মনীতিপদ্ধতি এবং যোগক্ষেম) প্রতিষ্ঠিত আছে।
.
কিন্তু কৌটিল্যের মতে, (প্রথম উক্ত) চারটিই বিদ্যা। (এই চারটিকে বিদ্যা বলবার কারণ-) এই চারটির দ্বারাই ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার এবং অর্থ বা জাগতিক সকল প্রয়োজনবস্তু জানা যায় ; এবং এদের দ্বারা জানা যায় বলেই এদের ‘বিদ্যাত্ব’ সার্থক হয়েছে।
 .
এবং এই বিদ্যাগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৌটিল্য আবার বলেন-
সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী।
.
ধর্মাধর্মৌ ত্রয্যাম্ । অর্থানর্থৌ বার্তায়াম্ । নয়াপনয়ৌ দণ্ডনীত্যাম্ । বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি, ব্যসনেহভ্যুদয়ে চ বুদ্ধিমবস্থাপয়তি, প্রজ্ঞাবাব্যক্রিয়াবৈশারদ্যং চ করোতি।
.
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। ১/২/২।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
অর্থাৎ :
সাংখ্যদর্শন, যোগদর্শন ও লোকায়ত- এই তিনটি শাস্ত্রই উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত।
.
এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।
.
আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
 .
উল্লেখ্য, আন্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত যে যোগদর্শনের উল্লেখ রয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটা আসলে পতঞ্জলির (২৫০ খ্রিস্টাব্দ) যোগদর্শন নয়, মূলত ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে প্রাচীন যোগ বোঝানো হয়েছে। কেননা, পণ্ডিত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী উভয়েই মূল্যবান সাক্ষ্য ও যুক্তি প্রদর্শন করে নিশ্চিত করেছেন যে, পরবর্তীকালে যে-দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায়-বৈশেষিক নামে সনাক্ত করতে অভ্যস্ত, প্রাচীন কালে তাকেই ‘যোগ’ নামে অভিহিত করার প্রথা ছিলো। কৌটিল্যর রচনাতেও যোগ শব্দ এই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহৃত।
 .
এখানে কৌটিল্যের মতে বিদ্যা চারটি হলেও উল্লেখিত শ্লোক অনুযায়ী কৌটিল্যবর্ণিত বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যার সংখ্যা দুই- দণ্ডনীতি এবং বার্তা। বেদ অথবা আন্বীক্ষিকীকে বার্হস্পত্যরা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তাঁরা বেদকে ‘লোকযাত্রাবিদ্’ বা লৌকিক ব্যবহারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ‘সংবরণ’ বা পোশাক বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বার্হস্পত্যদের অভিমত অনুসারে সে সময়ে বেদজ্ঞ বলে যাঁরা নিজেদের প্রচার করতেন তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ সব সময়ই বেদজ্ঞানের আবরণে গোপন থাকতো। তা থেকে অনুমিত হয় যে, ‘অর্থশাস্ত্রে’র সময়কালে অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই বার্হস্পত্য মতবাদ বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
 .
তবে এখানে যে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি নজর এড়িয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না, তা হলো, কৌটিল্য বর্ণিত যে আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে লোকায়তের পরিচিতি, সেই আন্বীক্ষিকীকে কৌটিল্য সর্ব ধর্মের আশ্রয় বলে বর্ণনা করলেও বার্হস্পত্যরা এই আন্বীক্ষিকীকে বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এখানে আন্বীক্ষিকী মানে অনুমান-মূলক দর্শন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে কি প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্র আর পরবর্তীকালের চার্বাক দৃষ্টিভঙ্গির লোকায়ত মত এক নয় বা পরস্পর বিপরীত ? হতেও পারে। কেননা পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামে বিশেষিত লোকায়তিক দর্শনের পরিধি থেকে ধর্ম সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত হওয়ার কারণেই হয়তো এই বৈপরিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে দর্শনমতের বিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়।
 .
তাই কৌটিল্যের এই বার্হস্পত্য মত বর্ণনার সাপেক্ষে পরবর্তীকালের সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের সাযুজ্য বিশ্লেষণ করতে একাদশ শতকের কৃষ্ণমিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকটিকে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা-উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই রূপক নাটকে বর্ণিত চার্বাক সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে-
দণ্ডনীতিরেব বিদ্যা। অত্রৈব বার্তান্তর্ভর্বিষ্যতি ধূর্ত প্রলাপস্ত্রয়ী।। (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৫)।
অর্থাৎ : দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা। বার্তা দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়ী বা বেদ ধূর্তদের প্রলাপ।
 .
আবার অষ্টম শতকের প্রখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য লোকায়ত প্রসঙ্গে তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
কৃষিগোরক্ষবাণিজ্যদণ্ডনীত্যাদিভির্বুধঃ। দৃষ্টৈরেব সদোপায়ৈর্ভোগাননুভবেদ্ ভুবি।। ২/১৫।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : (লোকায়তরা) কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ইত্যাদি দৃষ্ট উপায়ের মাধ্যমে জাগতিক বস্তু উপভোগের পরামর্শ দেন।
 .
অতএব, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-চার্বাক বা ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-লোকায়তের আদি রূপ হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত বর্ণিত বার্হস্পত্যের অনুমান করা খুব অসঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়। তারপরও প্রশ্ন থাকে, চার্বাক তথা বার্হস্পত্য দর্শনের প্রকৃত উৎস কোথায় ?
বার্হস্পত্য-সূত্র

ভারতীয় দর্শন বা প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বৃহস্পতি-সূত্র নাম দিয়ে যে সূত্রগুলি ব্যবহার করা হয় তার স্পষ্ট উৎস আমাদের কাছে অজ্ঞাত এখনো। অথচ ভারতীয় দার্শনিক প্রথা বা ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিটা দর্শনেরই একেকটি সূত্রগ্রন্থ থাকলেও যে সূত্রগুলির উপর ভিত্তি করে চার্বাক দর্শন নামে একটা প্রতিপত্তিশালী শক্ত দর্শন দাঁড়িয়ে আছে, ভারতীয় দর্শন-রীতিতে তারও একটা সূত্রগ্রন্থ থাকার কথা ছিলো, যার প্রণেতা হয়তো বৃহস্পতি নামের কেউ। কিন্তু সেরূপ গ্রন্থ আদৌ ছিলো কি ছিলো না, তা নিয়েও দার্শনিক মহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়ে গেছে।
 .
তবে অন্যতম পরোক্ষ উৎস হিসেবে চতুর্দশ শতকের বেদান্ত দার্শনিক সায়ণমাধবাচার্যের যে বিখ্যাত গ্রন্থটির বিস্তৃত পূর্বপক্ষ বয়ান থেকে চার্বাক দর্শনের বিশিষ্ট রূপটিকে অনুমান করা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে, সেই ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেও মাধবাচার্য প্রধানত চার্বাক-ষষ্ঠিকে অবলম্বন করেই চার্বাক-দর্শন সংকলন করেছেন। প্রায়ক্ষেত্রেই তিনি চার্বাক-ষষ্ঠির বচনকেই প্রমাণরূপে প্রদর্শন করেছেন, কোথাও বার্হস্পত্য-সূত্রের উল্লেখ করেন নি। এতে করে পণ্ডিতদের ধারণা, তিনি অন্যান্য কোন কোন গ্রন্থে বার্হস্পত্য-সূত্র দেখে থাকলেও সম্পূর্ণ বার্হস্পত্য সূত্র দেখেন নি অর্থাৎ বার্হস্পত্য-সূত্র নামের কোন গ্রন্থের খোঁজ তিনি পান নি। এবং গ্রন্থশেষে তিনি ‘তদেতৎ সর্বং বৃহস্পতিনাপ্যুক্তং’ বলে চার্বাকষষ্ঠির শ্লোকাকার বচনগুলির উল্লেখ করেছেন। বৃহস্পতি সূত্রাকারে চার্বাকমত বললেও শ্লোকাকারে বলেন নি। তবে চার্বাক-ষষ্ঠি যে বৃহস্পতির সূত্র অবলম্বনে রচিত, এ ব্যাপারে পণ্ডিতেরা মোটামুটি নিঃসন্দেহই বলা যায়। এবং নানান প্রাচীন গ্রন্থে ভারতীয় দর্শনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসরণে সৃষ্ট এরূপ কোন কোন সূত্রের উল্লেখ থেকে অনুমান হয়, বার্হস্পত্য-সূত্র অতি প্রাচীন। (সূত্র: চার্বাক-দর্শনম্ /শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী)।
 .
চার্বাক বা বার্হস্পত্য দর্শনসংশ্লিষ্ট কোন সূত্রগ্রন্থের অস্তিত্ব এখনো অজ্ঞাত হলেও অতীতে কোন এককালে এরকম সূত্রগ্রন্থ থাকার সম্ভাব্যতাকে অস্বীকারও করা যায় না। কেননা প্রখ্যাত ব্যাকরণকার পাণিনির (আনুমানিক ৬০০-৪০০ খ্রীস্টপূর্ব) কালজয়ী ব্যাকরণসূত্র ‘অষ্টাধ্যায়ী’র ভাষ্যকার পতঞ্জলির (আনুমানিক অন্যুন ১৫০ খ্রীস্টপূর্ব) ‘মহাভাষ্যে’ ‘ভাগুরি’ নামে লোকায়তের এক ‘বর্তিকা’ বা ভাষ্যের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে- ‘বর্ণিকা ভাগুরী লোকায়তস্য, বর্তিকা ভাগুরী লোকায়তস্য’ (মহাভাষ্য: ৭/৩/১)। অর্থাৎ ভাগুরী লোকায়তের বর্ণিকা বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ। মূলগ্রন্থ ছাড়া কোন ভাষ্যগ্রন্থের অস্তিত্ব অনুমান কঠিন বলেই মহাভাষ্যের সাক্ষ্য অনুযায়ী লোকায়তের কোন গ্রন্থ ও তার ভাষ্য ছিলো বলেই অনুমান করা হয়। এছাড়া বৌদ্ধদের লেখা সংস্কৃত গ্রন্থ (অনুমান সম্রাট অশোকের কিছুটা পরবর্তীকালের) ‘দিব্যাবদানে’ও লোকায়ত শাস্ত্রের মূল গ্রন্থের উপর লেখা ভাষ্য ও প্রবচনের উল্লেখ রয়েছে- ‘লোকায়তং ভাষ্যপ্রবচনম্’ (দিব্যাবদান, পৃষ্ঠা ৬৩০) উদ্ধৃতিতে।
 .
জীবনের দীর্ঘকাল ব্যাপী চার্বাক বা লোকায়ত নিয়ে একনিষ্ঠভাবে অনুসন্ধান ও আলোচনায় রত থাকা প্রখ্যাত ভারতীয় সংস্কৃতিবিদ পণ্ডিত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থের শেষে ‘বার্হস্পত্যসূত্রম্’ শিরোনামে একটি পরিশিষ্ট সংযোজন করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাকমত বর্ণনায় চার্বাকদের নিজস্ব উক্তি হিসেবে যে-সব উদ্ধৃতি পাওয়া যায় তারই সংকলন এটি। তাঁর তালিকায় মোট ৫৪ টি ‘সূত্র’ বর্তমান। শাস্ত্রী মহাশয়ের ভাষায়- ‘…বৃহস্পতি, চার্বাক, লোকায়ত, পুরন্দর, কম্বলাশ্বতর- এই কয়জন দার্শনিকের অর্ধশতাধিক সূত্র এবং যে গ্রন্থ হইতে যেরূপ অবস্থায় সংগৃহীত হইয়াছে তা প্রদত্ত হইল।
 .
দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় কর্তৃক এভাবে বিভিন্নজনের সূত্রগুলিকে ‘বার্হস্পত্যসূত্রম’ নামে পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্তির কারণ তাঁর ধারণা- বৃহস্পতি ব্যক্তিবিশেষের নাম নয় ; ব্যাস, শঙ্করাচার্য ইত্যাদি উপাধির মত বৃহস্পতিকেও উপাধিবিশেষ বলা চলে। চার্বাক মতের প্রচারে যাঁরা সহায়তা করেছেন এই উপাধি তাঁরাই লাভ করেছেন। এবং তাঁর মতে- ‘সুদূর অতীতে কোনও সময়ে এই বৃহস্পতিগণ মিলিত হইয়া বার্হস্পত্য মত প্রবর্তন… …করেন।’ কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয়ের এই ধারণা বা সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে যথোপযুক্ত প্রমাণের অভাব থাকায় তা সমর্থনযোগ্য নয় বলেই গবেষকরা মনে করেন।
 .
এছাড়া তাঁর প্রদত্ত তালিকায় চার্বাকদের নামে প্রচলিত নানান প্রামাণিক লোকগাথাও অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই কোন কোন গবেষকদের মধ্য থেকে এরকম প্রশ্নও উত্থিত হয়েছে যে- পারিভাষিক অর্থে লোকগাথাকেও ‘সূত্র’ আখ্যা দেয়া সঙ্গত কিনা। তবে চার্বাকালোচনা করতে হলে কোনভাবেই তাঁর পরিশিষ্টটিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই বলেই মনে হয়।
 .
অন্যদিকে বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক এফ. ডব্লু. টমাস (F. W. Thomas) ‘বৃহস্পতি-সূত্র’ নামে একটি পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন বলে জানা যায় এবং ১৯২১ সালে অনুবাদসহ তার মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকৃত চার্বাক মতের পরিচায়ক হতে পারে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত। কেননা আরেক প্রখ্যাত গবেষক ‘তুচ্চি (Twcci) গ্রন্থটির ওপর মন্তব্য করেছেন যে, এই বই ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবে ভরপুর। গ্রন্থটি থেকে হয়তো বড়জোর চার্বাক-সংক্রান্ত সামান্য খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত আভাস পাওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। চন্দ্রকীর্তির ‘প্রজ্ঞাশাস্ত্র’ এবং আর্যদেবের ‘শাস্ত্রাশাস্ত্র’ গ্রন্থে প্রকৃত বার্হস্পত্য-সূত্র উদ্ধৃত হয়েছে বলে তুচ্চি উল্লেখ করেন। তাই বিভিন্ন দার্শনিকের চার্বাক-বর্ণনায় উদ্ধৃত বৃহস্পতি-সূত্রগুলি বা চার্বাকদের নিজস্ব উক্তি হিসেবে বাক্যগুলির প্রকৃত উৎস জানবার সুযোগ না থাকলেও উদ্ধৃতিগুলি উড়িয়ে দেবার মতো নয়। অনেকসময় চার্বাকমত পুনর্গঠনে এগুলি বিশেষ মূল্যবান উপাদান হতে পারে।’ (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।
 .
তবে যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন, চার্বাকমতের সেসকল সূত্র কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন প্রামাণিক গ্রন্থের অনুশীলনে পুনঃসঙ্ঘটিত এসব সূত্র পরবর্তীকালে বার্হস্পত্য-সূত্র নামে সংকলিত হয়েছে। শ্রীমৎ-সায়ণমাধব-কৃত ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থ অবলম্বনে শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী রচিত ‘চার্বাক-দর্শনম্’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে সংস্কৃতভাষায় এরকম একশটি বার্হস্পত্য-সূত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। উপস্থাপিত এই সংকলিত বার্হস্পত্য-সূত্রগুলি সম্যক অনুধাবনের লক্ষ্যে সম্ভাব্য তর্জমাসহ নিচে উপস্থাপন করা হলো। 
.
ইতোপূর্বেও সূত্রের লক্ষণে বলা হয়েছে, অল্প অক্ষরযুক্ত, সন্দেহমুক্ত, সারযুক্ত, সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য এবং নির্দোষ নিয়মকেই সূত্র বলে। সূত্র হলো সংক্ষিপ্ত বাক্যের নম্র উপচার। ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বচনের সাহায্যে এরকম কিছু সূত্রের আবরণে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাকে সযত্নে গেঁথে রাখা হতো। স্বল্পতম অক্ষরবিশিষ্ট এরকম কিছু সংখ্যক সূত্রের মাধ্যমে দর্শন-চিন্তার প্রথম আত্মপ্রকাশই ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত ধারা এবং ভারতীয় দর্শনের অধিকাংশ শাখারই আদি রচনা এই জাতীয় কিছু সূত্রের সমষ্টি বলে মনে করা হয়। সূত্রগুলোয় অক্ষরসংখ্যা নিয়মনের দিকে খুব জোর দেয়া হয়েছে, ফলে সংক্ষিপ্ততম অবয়বে ব্যাপকতম অর্থব্যঞ্জনার প্রবণতা প্রত্যেক সূত্রে দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে। কেননা সূত্রগুলির মর্মার্থের পেছনে যে ব্যাপক তথ্য ও যুক্তির শাস্ত্রীয় আধার সুপ্ত থাকে সেগুলির বিশ্লেষণ ছাড়া বস্তুত সূত্রগুলির ব্যাখ্যা সমার্থক হয় না। তারপরও ব্যাখ্যাকারের নিজস্ব চিন্তা ও মতের সাপেক্ষে ব্যাখ্যাগুলির বক্তব্য-চেহারাও পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর তাই যে-কোন তর্জমার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের একান্ত আক্ষরিক তর্জমা বলতে গেলে অসম্ভবই প্রায়। সেই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই বার্হস্পত্য-সূত্রের তর্জমাগুলি স্ব-স্ব সূত্রের সাথে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে।
 …
বৃহস্পতি-প্রণীতম্ বার্হস্পত্য-সূত্রম্
লোকায়ত-মতে তত্ত্বানি দর্শয়তি-
(লোকায়ত-মতে তত্ত্বাদির বিচার)
 .
১) পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি।
[ পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। ]

২) তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা।
[ এর (পদার্থ বা তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট। ]

৩) তেভ্যশ্চৈতন্যম্ ।
[ (দেহের আকারে পরিণত ভূত-চতুষ্টয় হতে) চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়। ]

৪) কিণ্বাদিভ্যো মদশক্তিবৎ।
[ কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে যেরূপ মদশক্তি জন্মে। ]

৫) শরীরেন্দ্রিয়-সঙ্ঘাত এব চেতনঃ ক্ষেত্রজ্ঞঃ।
[ শরীর ও ইন্দ্রিয়ের সংঘাতের মাধ্যমে দেহে চেতনার জন্ম হয়।]
 .
সুকৃত-দুষ্কৃত-কর্মণাং ফলাভাবং দর্শয়তি-
(ধর্মশাস্ত্রের সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফলের অভাব বিচার)
 .
৬) ন ধর্ম্মাংশ্চরেৎ।
[(প্রত্যক্ষের অগোচরে অতীন্দ্রিয় সত্তা নেই বলে) ধর্ম কর্ম অনুষ্ঠেয় নহে।]

৭) এষ্যৎ ফলত্বাৎ।
[এ-রকম অদৃষ্ট ব্যাখ্যাত ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না।]

৮) সাংশয়িকত্বাচ্চ।
[(ধর্মশাস্ত্র-বর্ণিত যজ্ঞাদি বা পারলৌকিক বিষয়াদি সাধিত হলেও ফল হবে কিনা) সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।]

৯) কো হ্যবালিশো হস্তগতং পরগতং কুর্য্যাৎ।
[মূর্খ ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?]

১০)  বরমদ্য কপোতঃ শ্বো ময়ূরাৎ।
[আগামীকাল ময়ূর লাভের আশার অপেক্ষা আজকের প্রাপ্ত কপোত মন্দের মধ্যে ভালো।]

১১)  বরং সাংশয়িকান্ নিষ্কাদসাংশয়িকঃ কার্যাপণঃ।
[সংশয়সঙ্কুল শত স্বর্ণমুদ্রা লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহ এক কার্যাপণ লাভও মন্দের ভালো।]

১২)  ন ভস্মধারণম্ ।
[ (প্রতিক্ষণে শরীরের অনিত্যতাকে উপলব্ধির জন্য) শরীরে চিতা-ভস্মধারণ করা অর্থহীন কাজ। ]

১৩)  নাগ্নিহোত্র-বেদপাঠাদীনি চ।
[(পারলৌকিক ফলপ্রাপ্তির আশায়) যাগ-যজ্ঞ অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠেয় নহে, বেদ পাঠও নিষ্ফল। ]

১৪)  ন তীর্থযাত্রা।
[(অর্থহীন অপচয় করে কাল্পনিক ফললাভের আশায়) তীর্থযাত্রা করণীয় নয়। ]

১৫)  সর্বমর্থার্থং করোত্যগ্নিহোত্র-সন্ধ্যা-জপাদীন্ ।
[অগ্নিহোত্র-সন্ধ্যা-জপ ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা সর্ব অর্থেই অর্থহীন অপ্রয়োজনীয়।]

১৬)  স্বদোষং গূহিতুং কামার্ত্তো বেদং পঠতি।
[বস্তুত স্বীয় দোষ ঢাকবার অভিপ্রায়ে বেদ-পাঠের কথা বলা হয়।]

১৭)  অগ্নিহোত্রাদীন্ করোতি।
[(পারলৌকিক স্বর্গপ্রাপ্তির কামনায়) অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করা নির্বুদ্ধিতা।]

১৮) সুরাপানার্থং মহিলামেহনার্থং করোতি।
[সুরাপান রমণী-সম্ভোগ সুখার্থেই করণীয়।]

১৯) বিষ্ণ্বাদয়ঃ সুরাপায়িনঃ।
[সুরাপান উপভোগ-স্পৃহার জন্ম দেয়।]

২০) শিবাদয়ঃ। [নিজের কামনা পূরণার্থে রমণীয় সুখ উপভোগ্য।]
 .
 শৃঙ্গারবেশাদীনাং কর্ত্তব্যত্বং দর্শয়তি-
 (শৃঙ্গারবেশ ইত্যাদির কর্তব্য বিচার)
 .
২১) শৃঙ্গারবেশং কুর্য্যাৎ।
[ (নিজেকে উপভোগ্য করতে) শৃঙ্গার বেশ করণীয়। ]

২২) অক্ষৈর্দীব্যাৎ।
[পণ-পূর্বক অক্ষ বা দ্যুতক্রীড়া ক্ষতির কারণ হয়।]

২৩) নৈব দীব্যাচ্চ।
[তাই কখনো এতে আসক্ত হওয়া উচিৎ নয়।]

২৪) আসবানি সেবয়েৎ।
[ আসব পান করণীয়। ]

২৫) মাংসানি চ।
[(ভোগ-সামর্থ্যের প্রয়োজনে) মাংস ভোজন দোষণীয় নয়। ]

২৬) মত্তকাশিন্যঃ সেব্যাঃ।
[সামর্থ অনুযায়ী সুখ উপভোগ করা উচিৎ।]

২৭) দিব্য-প্রমদা-দর্শনঞ্চ।
[(মনোমুগ্ধতার জন্য) দিব্য প্রমদার দর্শন উচিৎ। ]

২৮) নেত্রাজনঞ্চ।
[(সৌকর্য্যের প্রয়োজনে) নেত্রাঞ্জন গ্রহন করা উচিৎ। ]

২৯) আদর্শ-দর্শনঞ্চ।
[(নিজেকে আকর্ষণীয় করার প্রয়োজনে) দর্পণে মুখাদির দর্শন করণীয়।]

৩০) তম্বুল-চর্বণঞ্চ।
[(সুখকর তৃপ্তির জন্য) তাম্বুল চর্বণ করা যেতে পারে।]

৩১) কর্পূর-চন্দনাগুরুধূপঞ্চ।
[ কর্পূর চন্দন ও অগুরু অনুলেপন করণীয়। ]
 .
 বেদাপ্রামাণ্যং দর্শয়তি-
(বেদের অপ্রামাণ্য বিচার)
 .
৩২) যাগশ্রূতিরপ্রমাণং প্রত্যক্ষবিরুদ্ধত্বাৎ গ্রাবোন্মজ্জন-শ্রূতিবৎ।
[পাথর ভাসতে থাকার মতোই যজ্ঞের ফল বিষয়ে বেদের সত্যতা প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ অসম্ভব।]

৩৩) অনিত্য-দর্শনাচ্চ।
[বেদানুগ ভাবনা শূন্যগর্ভ।]

৩৪) শাস্ত্রদৃষ্ট-বিরোধাচ্চ।
[কেননা শাস্ত্রে প্রচুর বিরোধ দৃষ্ট হয়।]

৩৫) তথা ফলাভাবাৎ।
[(শাস্ত্রে যেসব পারলৌকিক ফলপ্রাপ্তির কথা আছে) সে-সব নিষ্ফল।]

৩৬) অন্যানর্থক্যাৎ।
[শাস্ত্র-কথিত অনর্থক বাক্যের অর্থ করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা।]

৩৭) অভাগি-প্রতিষেধাচ্চ।
[বেদের পরস্পরবিরোধী বাক্যই একটি আরেকটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে।]

৩৮) অনিত্য-সংযোগাৎ।
[বেদবাক্যের একটির সাথে অন্যটির সাযুজ্য নেই।]

৩৯) স্ত্র্যপরাধাৎ কর্ত্তুশ্চ পুত্রদর্শনাৎ।
[(বেদোক্ত শূদ্র ইত্যাদি অশূচি বর্ণের দোষ) স্ত্রীলোকের অপরাধ হিসেবে পুত্রে সঞ্চারিত হতে দেখা যায়।]

৪০) বিধিশ্চানর্থকঃ ক্বচিৎ তস্মাৎ স্তুতিঃ প্রতীয়েত
তৎসামান্যাদিতরেষু তথাত্বম্ ।
[বেদে বিধিবাক্যের নামে যেসব স্তুতি রয়েছে তাতে চিরায়ত সামান্যের-কল্পনা নিরর্থক।]

৪১) তদর্থ-শাস্ত্রাৎ।
[শাস্ত্র ব্যতীত ধর্মে কোনো প্রমাণ নেই- এই অর্থে বেদ অপ্রামাণ্য।]

৪২) বাক্য-নিয়মাৎ।
[শাস্ত্র-বাক্য লৌকিক নিয়ম বহির্ভূত।]

৪৩) বুদ্ধশাস্ত্রাৎ।
[বেদ মনুষ্য-রচিত, তাই তা নিত্য সত্য হতে পারে না।]

৪৪) অবিদ্যমান-বচনাৎ।
[বেদের অবিদ্যমান বচন থেকে যে জ্ঞান হয় তার কোনো বাস্তব রূপায়ন নেই।]

৪৫) অচেতনেহর্থবন্ধনাৎ।
[ফলপ্রাপ্তির কামনায় বেদে অচেতন পদার্থের স্তুতি রয়েছে বলে বেদের অযথার্থতা প্রতীত হয়।]

৪৬) অর্থ-বিপ্রতিষেধাৎ।
[বেদবাক্যে পরস্পর অর্থ-বিরোধ দৃষ্ট হয়, যা একটি আরেকটিকে খণ্ডন করে।]

৪৭) স্বাধ্যায়বদবচনাৎ।
[স্বাধ্যায়রূপ প্রণব-ধ্বনি কোন বচন বা বাক্য হতে পারে না, এবং স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় ইষ্টদেবতার সন্দর্শন ঘটে এমন ধারণা বিশ্বাসযোগ্য নয়।]

৪৮) অবিজ্ঞেয়াৎ।
[বেদোক্ত প্রত্যক্ষ উপলব্ধিহীন অর্থবিচার গ্রহণীয় নয়।]

৪৯) অনিত্যসংযোগাদ্ মন্ত্রানর্থক্যম্ ।
[শাস্ত্রে এক মন্ত্রের সাথে অন্য মন্ত্রের অর্থগত সাযুজ্যহীনতা রয়েছে।]

৫০) হেতুদর্শনাচ্চ।
[ধর্মের পারলৌকিক কল্পনার সাথে ব্যাপ্তি-স্মরণ সম্ভব নয় বলে তা অপ্রামাণ্য।]

৫১) অস্থানাৎ।
[দেশান্তরে বা কালান্তরে সাধ্যের সাথে হেতুর ব্যাপ্তি সর্বকালীন নয়।]

৫২) করোতি-শব্দাৎ।
[(কোনো ইন্দ্রিয়াতীত সর্বজ্ঞ সত্তা হও বললেই হয়ে যায়) এমন কৃত-বাক্য গ্রহণীয় নয়।]

৫৩) সত্ত্বান্তরে চ যৌগপদ্যাৎ।
[(শ্রুতিবাক্য সর্বত্র অবিকৃত অভিন্ন হওয়ার কথা হলেও) স্থানবিশেষে ভিন্নরূপে প্রদর্শিত হয়।]

৫৪) বৃদ্ধিশ্চ কর্ত্তৃভূম্নাস্য।

৫৫) প্রকৃতি-বিকৃত্যোশ্চ।
[জগতের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রোক্ত প্রকৃতি-বিকৃতি ইত্যাদি সমর্থনযোগ্য নয়।]

৫৬) ন নিত্যত্বং বেদানাং কার্য্যত্ব-শ্রূতেঃ।
[শ্রুতি বা বেদবাক্য থেকে কোনো কার্যকর নিত্যজ্ঞান সম্ভব নয়।]

৫৭) ন শব্দ-নিত্যত্বং কার্য্যতা-প্রতীতেঃ।
[আপ্তবাক্যে শব্দ-নিত্যতা প্রমাণিত নয়।]

৫৮) তদপ্রামাণ্যমনৃত-ব্যাঘাত-পুনরুক্ত-দোষেভ্যঃ।
[ এতে (বেদে) অনৃত দোষ বা মিথ্যে কথা, ব্যাঘাত দোষ বা পরস্পর বিরুদ্ধ কথা এবং পুনরুক্ত দোষ পূর্ণ। ]

৫৯) ধূর্ত্ত-প্রলাপস্ত্রয়ী।
[ (বেদের কর্তা) ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর ত্রয়ী। ]

৬০) বৃথা ধর্মং বদত্যর্থসাধনং লোকায়তিকঃ পিণ্ডাদয়শ্চোর ইতি চ।
[লোকায়তিকরা বলেন, ধর্মশাস্ত্রে পিণ্ডদান প্রেত্যকর্ম ইত্যাদির সমর্থনে অযথা অতিকথন ভণ্ডদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত মাত্র।]

৬১) সোহপ্যশনার্থং ধর্মং বদতি।
[ আস্তিকগণ অশন বা জীবিকার জন্য ধর্ম প্রচার করেন। ]

৬২) পরাপবাদার্থং বেদশাস্ত্রং ধর্মাদীন্ পঠতি।
[ধর্মের নামে বেদশাস্ত্রে হিংসাত্মক বাক্য পাঠ করানো হয়।]

৬৩) সর্বান্ নিন্দতি।
[(বেদ) নিন্দাবাক্যে ভরপুর।]

৬৪) মহেশ্বর-বিষ্ণ্বাদীনপি।
[(ধর্মশাস্ত্রোক্ত) মহেশ্বর জাগতিক কামনা পূরণে অসমর্থ।]
 .
 পুরুষার্থং দর্শয়তি-
 (পুরুষার্থ বিচার)
 .
৬৫) কাম এবৈকঃ পুরুষার্থঃ।
[(যা কামনা করা হয় তাই কাম এবং) একমাত্র কামই পুরুষার্থ। ]

৬৬) উভয়ী প্রকৃতিঃ কামে সজ্জেৎ।
[ধর্ম ও মোক্ষ কোন প্রয়োজনই সিদ্ধ করতে পারে না বলে কামনা পূরণের জন্য শরীরই মুখ্য।]

৬৭) কাম এব প্রণিনাং কারণম্ ।
[পুরুষার্থ রূপে কামে আসক্ত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।]

৬৮) শরীরস্থিতি-হেতুত্বাদাহার-সধর্ম্মাণো হি কামাঃ।
[ শরীরের স্থিতিহেতু বলে কামগুলি আহারের সধর্মা- আহারের সমানগুণযুক্ত। ]

৬৯) ন হি ভিক্ষুকাঃ সন্তীতি স্থাল্যো নাধিশ্রীয়ন্তে।
ন হি ভিক্ষুকাঃ সন্তীতি যবা নোপ্যন্তে।
[দ্বারে ভিক্ষুক এসে দাঁড়াতে পারে বলে উনুনে হাঁড়ি চড়াবে না, এরকম করে না কেউ।
কিংবা ভিক্ষুক আছে বলে যব বপন করবে না, এটাও সুবুদ্ধির পরিচয় নয়।]
 .
 প্রমাণং দর্শয়তি-
 (প্রমাণ বিচার)
.
৭০) প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্ ।
[ কেবল প্রত্যক্ষই প্রমাণ। ]

৭১) নানুমানং প্রমাণম্ ।
[ অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়। ]

৭২) অত্যন্ত-প্রায়ৈকদেশ-সাধর্ম্ম্যাদুপমানাসিদ্ধিঃ।
[সাদৃশ্যজ্ঞান অনুমাননির্ভর। পূর্বশ্রুত সাদৃশ্য-জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞাতপূর্ব পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে যে উপমিতি জ্ঞান হয় তাকে বলে উপমান। প্রমাণ হিসেবে উপমান অসিদ্ধ।]

৭৩) শব্দোহনুমানমর্থস্যানুপলব্ধেরনুমেয়ত্বাৎ।
[শব্দ বা আপ্তবাক্য অনুমাননির্ভর বলে তা অজ্ঞাত অনুপলব্ধ বিষয়ের জ্ঞান হতে পারে না।]

৭৪) অপ্রমানং শব্দঃ।
[ শব্দ বা আপ্তবাক্য প্রমাণ নয়। ]
 .
 ঈশ্বরাভাবং দর্শয়তি-
 (ঈশ্বরের অনস্তিত্ব বিচার)
 .
৭৫) ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ।
[ ঈশ্বর অসিদ্ধ বা তার কোন অস্তিত্ব নেই। ]

৭৬) প্রমাণাভাবান্ন তৎসিদ্ধিঃ।
[ প্রমাণের অভাবেই তার (ঈশ্বর) অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না। ]

৭৭) ঈনেশ্বরাধিষ্ঠিতে ফলসম্পত্তিঃ কর্মণা তৎ-সিদ্ধেঃ।
[যদি ঈশ্বরে প্রমাণ থাকতো তবে ঈশ্বরে সিদ্ধি হতো, কিন্তু ঈশ্বরে প্রমাণ নেই বলে স্বোপার্জিত কর্মই অনুগুণ ফল প্রদান করে।]

৭৮) শোণিত-শুক্রসম্ভবঃ পুরুষো মাতাপিতৃ-নিমিত্তকঃ।
[শুক্র-শোণিত সম্ভূত এই মানুষের সৃষ্টি পিতা-মাতার মিলনহেতুই সম্ভব।]

৭৯) নাস্তি সর্বজ্ঞঃ প্রত্যক্ষাদি-গোচরাতিক্রান্তত্বাৎ।
[প্রত্যক্ষের অগোচরে সর্বজ্ঞ সর্বাধিকারী কিছুর অস্তিত্ব নেই।]

৮০) শশশৃঙ্গবৎ।
[শশক বা খরগোশের শিং-এর মতোই (অতীন্দ্রিয় বস্তু অবাস্তব)।

৮১) মুক্তবদ্ধয়োরন্যতরাভাবান্ন তৎ-সিদ্ধিঃ।
[(অতীন্দ্রিয় কিছু নেই বলে) মুক্ত বা বদ্ধ আত্মা বলে কোনো সত্তা সিদ্ধ নয়।]

৮২) স্বোপকারাদধিষ্ঠানং লোকবৎ।
[লোকের প্রয়োজনে অধিষ্ঠিত (রাজাই) ক্ষমতা শীর্ষে থাকার সুবাদে দুর্জনকে শাস্তি প্রদান করেন, সুজনকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন।]

৮৩) লৌকিকেশ্বরবদিতরথা।
[ভুবন প্রসিদ্ধ অতিক্ষমতার অধিকারী (রাজাই) লৌকিক ঈশ্বর।]

৮৪) আত্মবান্ রাজা।
[(যিনি পালক, রক্ষক, পরিচালক রূপে প্রজার অন্তরে আসন লাভ করেন) এই অমিত ক্ষমতার অধিকারীই রাজা।]

৮৫) লোকসিদ্ধো রাজা পরমেশ্বরঃ।
[(কার্যসিদ্ধির প্রয়োজনে দেশ, কাল, পাত্র অনুযায়ী বিবিধ রূপ ধারণে সক্ষম) লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর। ]
 .
পরলোকাভাবং দর্শয়তি-
(পরলোকের অনস্তিত্ব বিচার)
 .
৮৬) নাস্তি পরলোকঃ।
[ পরলোক বলে কিছু নেই। ]

৮৭) কো হি তদ্ বেদ যদমুস্মিন্ লোকে অস্তি বা নাস্তি বা।
[অদৃষ্ট বলে যদি কিছু থাকতো, তবে তা কোন না কোনভাবে দৃষ্ট হতো, দৃষ্ট না হয়ে অদৃষ্ট হতো না।]

৮৮) দৃষ্ট-বিরোধাচ্চ।
[ অতএব অদৃষ্ট নাই। ]

৮৯) পরলোকিনোহভাবাৎ পরলোকাভাবঃ।
[ যেহেতু পরলোক নাই, তাই পরলোকগামী আত্মা বা পরলোকীও নাই। ]

৯০) জাতিস্মরণমসিদ্ধম্, এক-গ্রাম-গতানং সর্বেষাং স্মরণাৎ।
[জাতিস্মরণ বা পূর্বজন্মের স্মৃতি অসিদ্ধ বা অসম্ভব। মৃতের কোন স্মৃতি ধারণ অসম্ভব।]
.
আত্মস্বরূপং দর্শয়তি-
(আত্মস্বরূপের বিচার)
.
৯১) শরীরমাত্মা।
[ শরীরই আত্মা। ]

৯২) চৈতন্য-বিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ।
[ চৈতন্যবিশিষ্ট কায়া বা দেহই পুরুষ বা আত্মা। ]

৯৩) মম শরীরমিতি ব্যবহারো রাহোঃ শির ইত্যাদিবদৌপচারিকঃ।
[(পৌরাণিকী অনুসারে রাহু বলতে যেহেতু মস্তক-সর্বস্ব শরীরই বোঝায়) ’আমার দেহ’ বললেও তা ’রাহুর মস্তক’ এর মতো অভেদ উপাচার বিশেষ, অর্থাৎ কথার কথা। ]

৯৪) এতাবানেব পুরুষো যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ।
[ যে পুরুষ ইন্দ্রিয়ের গোচর, সেই পুরুষই আছে, অন্য পুরুষ নাই। ]

৯৫) ইহলোক-পরলোক-শরীরয়োর্ভিন্নত্বাৎ
তদগতয়োরপি চিত্তয়োর্নৈকঃ সন্তানঃ।
[শরীর ভিন্ন ইহলোক পরলোক বলে কিছু নেই, শরীরের নাশ হলে চৈতন্যেরও অবলুপ্তি হয়।]
 .
মোক্ষং দর্শয়তি-
(মোক্ষ বিচার)
 .
৯৬) দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ।
[ দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ। ]

৯৭) সেবকা ন মুক্তাঃ পরতন্ত্রত্বাদ্ বদ্ধজীববৎ।
[শরীর ভিন্ন মুক্ত বা বদ্ধ আত্মা বলে কিছু নেই।]

৯৮) তর্কাপ্রতিষ্ঠানাৎ।
[(যুক্তি প্রতিষ্ঠিত বলে) তর্ক অপ্রতিষ্ঠ নয়।]

৯৯) সর্বথা লোকায়তিকমেব শাস্ত্রম্ ।
[ সর্বদা লোকায়তিকই একমাত্র শাস্ত্র। ]

১০০) ইত্যাহাচার্য্যো বৃহস্পতিঃ।
[আচার্য বৃহস্পতি কর্তৃক বর্ণনা সমাপ্ত হলো।]
.
[সবগুলো বার্হস্পত্য-সূত্রের তর্জমা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সংগৃহীত হলে যথাস্থানে তা সংযুক্ত করে দেয়া হবে।]
.
এখানে উল্লেখ্য, জয়রাশি ভট্টের ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ ও জয়ন্ত ভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে উল্লেখকৃত বার্হস্পত্য সূত্রের প্রথম বা আদি সূত্র ছিলো- ‘অথাতো তত্ত্বং ব্যাখ্যা স্যামঃ।’ কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী ও পাটনা প্রকাশিত বার্হস্পত্য-সূত্রের সংকলনে এই সূত্রটি অনুপস্থিত বলে জানা যায়। সঙ্গত কারণেই উপরে শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রীর উপস্থাপিত বার্হস্পত্য-সূত্রেও এটি নেই। এজন্যেই ‘মনে হয়, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ বিবেচনায় পরবর্ত্তীকালে ইহা পরিত্যক্ত হইয়াছে’ বলে শাস্ত্রী মহাশয় মন্তব্য-টীকায় তা উল্লেখ করেছেন।

তথ্যসূত্র

  1.  চার্বাক দর্শন - লতিকা চট্টোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ জুলাই, ১৯৮২, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১২, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা - ৭৩
  2. ↑ ঝাঁপ দাও:  প্রবোধচন্দ্রোদয়ম - কৃষ্ণ মিশ্র , বেনারস, ১৯৫৫
  3.  তত্ত্বোপপ্লবসিংহ - জয়রাশি ভট্ট , গায়কোয়াড় ওরিয়েন্টাল সিরিজ
  4.  চার্বাক দর্শন - দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী
  5.  বিজ্ঞানঘন এব এতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তান্যেবানুবিনশ্যতি, ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তীত্যরে ব্রবীমি- বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ২|৪|১২
  6.  য়েয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে- কঠোপনিষদ, ১|১|২০
  7.  লোকায়তমেব শাস্ত্রং যত্র প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম- প্রবোধচন্দ্রোদয়ম - কৃষ্ণ মিশ্র , বেনারস, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ৬৪
  8.  প্রত্যক্ষমেবৈকং প্রমাণামিতি চার্বাকাঃ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট
  9.  এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ- ষড়দর্শনসমুচ্চয়
  10.  চার্বাকধূর্তস্তু প্রমাণসংখ্যানিয়মাশক্যকরণীয়ত্বসিদ্ধেয় চ প্রমিতি ভেদান প্রত্যক্ষাদিপ্রমাণানুপজন্যানীদৃশানুপাদর্শয়েৎ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট
  11.  পৃথিব্যাদীনি তত্ত্বানি লোকে প্রসিদ্ধানি, তান্যপি বিচার্যমানানি ন ব্যবতিষ্ঠন্তে, কিং পুনরন্যানি- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  12.  তদুচ্যতে সল্লক্ষণনিবন্ধং মানব্যবস্থানং, মাননিবন্ধনা চ মেয়স্থিতিঃ, তদভাবে ন তথা সদব্যভারবিশয়ত্বং কথং- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  13.  দেশকালস্বভাববিপ্রকষার্চ্চ ন ব্যক্তীনাং সম্বন্ধাবধারণায় অলং প্রত্যক্ষম- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  14.  দেশকালদশাভেদবিচিত্রাত্মসু বস্তুযু অবিনাভাবনিয়মো ন শক্যা বস্তুমাহ চ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ