নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 August, 2020

নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর

ইসলাম, নবি মুহাম্মদ এবং…

আরব জাতির ইতিহাস

বিশ্ব-ইতিহাসে ইসলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ধর্ম। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নবি মুহাম্মদ ইতিহাসের একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। অন্যান্য ধর্মের প্রচারকদের সাথে নবি মুহাম্মদের অন্যতম তফাৎ হচ্ছে তিনি কেবল একাধারে সফল ধর্মপ্রচারকই নন, তিনি ছিলেন একইসাথে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ এবং দক্ষ প্রশাসক। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে বহু বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে প্রচণ্ড পরিশ্রম, ত্যাগ আর লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি কেবল বিশ্বের বুকে ইসলামের বিস্তারই ঘটাননি, একই সাথে একটি রাষ্ট্রের গোড়পত্তন ঘটিয়েছেন, আরব-জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে বহু গোত্রে বিভক্ত মরুবাসী বেদুইনদের একত্রিত করেছেন। জীবদ্দশাতেই তিনি স্থির লক্ষে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় সাড়ে তেরশ বছর পার হয়ে গেছে। আজ শুধু মরুবাসী আরব-ই নয়, বিশ্বের বহু দেশের, বহু জাতির লক্ষ-কোটি অনারব মুসলমান এই পতাকাতলে সমবেত। ফলে এদিক দিয়ে দেখলে নবি মুহাম্মদ অতুলনীয়। তিনি নিঃসন্দেহে সফল।
ইসলামের ইতিহাস, নবি মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। এই বইগুলির বেশিরভাগই হয় স্তুতিভিত্তিক-অলৌকিকতার ধূম্রজালে আবদ্ধ আবার কোনোটা হয় অযথাই নিন্দা আর সমালোচনাকে ভিত্তি করে। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণে খুবই কমসংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে। এটা স্বীকার করতে হবে ইসলাম আজও গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য, নবি মুহাম্মদের জীবনী আজও কোটি মানুষের চর্চার বিষয়। অনেকের কাছে এটিই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।
অন্য আরও সকল ধর্মের মতোই সুদূর অতীতকাল থেকে ইসলাম নিয়েও লৌকিক ভিত্তি ত্যাগ করে অলৌকিক-গায়েবি সংস্কারে নিমজ্জিত প্রচুর মানুষ। ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক-বিশ্লেষণী আলোচনা আমাদের এই সমাজে এমনিতে বিরল। ভাববাদী-আধ্যাত্মবাদী বহু দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলাম আলোচিত হয়েছে বহুজনের লেখনীতে। কিন্তু ইসলামের উত্থান-বিকাশ এবং নবি মুহাম্মদের অসাধ্য সাধন নিয়ে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইসলামকে জানার ও বোঝার চেষ্টা দুর্লভ বটে। সে-হিসেবে ইরানের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী আলি দস্তি রচিত নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর গ্রন্থটি ঐতিহাসিক এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
আলি দস্তির মতে, অলৌকিকতা কোনো ঐশী নির্দেশ নয়। অলৌকিকতা কেবল দুর্বলচিত্তের জনগণের কাছে ধোঁয়াশার জালে আবদ্ধ সংস্কার নয়। কিংবা নয় কোনো ধরনের বিভ্রম। অলৌকিকতা একটি অর্থবহ বিষয়। একজন ব্যক্তি যখন তার দক্ষতা, কৌশল, বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে আপাত অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হন, তখন সেই কাজকে অলৌকিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। নবি মুহাম্মদও এই অর্থে অসাধ্য সাধন করেছেন। প্রায় একা একজন মানুষ অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর কৌশল অবলম্বন করে নিজ জাতির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রচণ্ড লড়াই করে নিজস্ব ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছেন। অসংখ্য মানুষের পূর্বতন ধর্মমতের বিলোপ ঘটিয়েছেন। নবি মুহাম্মদের এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিশাল কর্মযজ্ঞ কোনো অর্থেই অলৌকিকতার মহিমা থেকে খাটো নয়। আলি দস্তি তাঁর বইয়ে ইসলাম এবং নবি মুহাম্মদের জীবন নিয়ে সকল রহস্যময় ও আলঙ্কারিক মিথ্যে ভাষণের ঢালি সরিয়ে নির্মোহভাবে বস্তুবাদী ইতিহাস রচনা করেছেন। যার জন্য এই বইও ইতিহাসে ধ্রুপদী গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে।
আজকের এই একুশ শতকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকার মুসলিম-প্রধান দেশগুলিতে একদিকে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে সেখানকার স্বৈরতান্ত্রিক শাষকগোষ্ঠীর ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অত্যাচার-নিপীড়ণে অতিষ্ঠ জনতা আবার আল কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, তালেবান ইত্যাদি জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর নৃশংস কর্মকাণ্ডে বিশ্বের বুকে ইসলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য। এই অবস্থায় ইসলামকে খাটাে বা হেয় করে নয়, নবি মুহামদকে নিন্দা বা অবহেলা করে নয়, যাবতীয় আধ্যাতিক ও গায়েবি দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে প্রাকৃতিক জগতের নিয়মের লঙ্ঘন না ঘটিয়ে মানব মুহাম্মদের বিশাল কীর্তি ও ইসলামের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের পুনর্পাঠ অতি জরুরি। আর এই বিষয়টিই আলি দস্তির শক্তিশালী লেখনী থেকে ফুটে উঠেছে দ্বিধাহীনভাবে।

আলি দস্তি ও তাঁর বই
আশির দশকের কথিত ইসলামি বিপ্লবের আগে আলি দস্তি ছিলেন ইরানের হাতে গোণা কয়েকজন প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, রাজনীতিমনস্ক বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে তুখোড় সাংবাদিক, লেখক, সমাজ-চিন্তক সেইসাথে ছিল তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। গেল শতাব্দীতে শুধু ইরান নয়, গোটা আরব দেশগুলোর মধ্যে অল্প যে কয়েকজন প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সমাজ-ধর্ম বিশ্লেষক ও সংস্কারবাদী ভূমিকা রেখেছেন আলি দস্তি তাঁদের অন্যতম। যদি ইউরোপের রেনেসাঁসের মত কখনো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর যুক্তিবাদের আলোকায়নের তুলনা করা হয়, তবে সেই তালিকায় বিংশ শতাব্দীতে আলি দস্তি অবস্থান করবেন শীর্যে। অথচ ধর্মতান্ত্রিক মতাদর্শে আবদ্ধ আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইরানে আলি দস্তি আজ ব্রাত্যজন।
আলি দস্তির জন্ম ১৮৯৬ সালে পারস্য উপসাগরের উত্তরে অবস্থিত বুশেহর রাজ্যের দাস্তেস্তান জেলার একটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম শেখ আব্দুল হোসেন দাস্তেস্তানি। লেখাপড়ার হাতেখড়ি স্থানীয় মাদ্রাসায়। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য তরুণ বয়সে আলি দস্তি উসমানীয় শাসনাধীন ইরাকের কারবালা শহরে আসেন।
ইরাকের কারবালা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ একটি শহর। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নবি মুহাম্মদের দৌহিত্র হোসেন বিন আলি শহীদ হয়েছেন এই প্রান্তরে; এবং এখান থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাজাফ শহরে নবি মুহামদের চাচাতো ভাই এবং জামাতা আলি বিন আবু তালিব (মৃত্যু ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে) শায়িত আছেন।
সময়টা তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিক, আলি দস্তি কারবালা শহরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কারবালা ও নাজাফ উভয় শহরেই লেখাপড়া করেন। সেখানে তিনি ইসলামি ধর্মবিদ্যা, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, ধ্রুপদী সাহিত্য এবং আরবি ও ফার্সি ব্যাকরণ শিক্ষা লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক আলোড়ন তীব্র হয়। একদিকে পতনোন্মুখ তুর্কি উসমানীয় ধর্মীয় শাসন-ব্যবস্থা, অন্যদিকে পরাক্রমশালী ব্রিটেনসহ ইউরোপের একাধিক দেশের উপনিবেশিক শাসন আর
সৃষ্টি করে। প্রবাস জীবনে দস্তির মধ্যে প্রবল দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। একই সাথে তিনি মার্কসীয় বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আলোড়িত হন। তাঁর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা জন্ম নেয়। ১৯১৮ সালের দিকে ইরাক থেকে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এসে বসবাস করেন ফার্স রাজ্যের শিরাজ শহরে। পেশা হিসেবে তখন বেছে নেন সাংবাদিকতা। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর তিনি থিতু হন ইরানের রাজধানী তেহরানে।
১৯২২ সালের পহেলা মার্চ আলি দস্তির সম্পাদনায় তেহরানে চালু হয় শাফাক-ই সরকা (লালের উদয়) নামের বামপন্থী পত্রিকা। পত্রিকাটি ১৯৩৫ সালের ১৮ই মার্চ পর্যন্ত চালু থাকলেও আলি দস্তি এই পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে ছিলেন প্রায় নয় বছরের মত। ১৯৩১ সালের পহেলা মার্চে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন নতুন সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন মায়েল তুয়েসারকানি। সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর থেকে আলি দস্তি তাঁর বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ লেখনীর কারণে ক্ষমতাসীন শাসকদের বিরাগভাজনে পরিণত হন। ১৯১৯ সালে তাঁকে কারাগারে যেতে হয় ইঙ্গো-ইরানীয় চুক্তির বিরোধিতা করে কলাম লেখার কারণে। পরবর্তী দুই বছর তাঁকে একাধিকবার কারাগারে প্রেরণ করা হয় উপনিবেশিক শাসন-ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করায়। জেল থেকে বের হয়ে আলি দস্তি জেলখানার দিনলিপি (আওয়ামী মাহবাস) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। দস্তির প্রগতিশীল, কুসংস্কারমুক্ত বিপ্লবী চিন্তাধারা, সুগভীর পর্যবেক্ষণ-সমৃদ্ধ এবং কিছুটা রাজনৈতিক ব্যঙ্গার্থকধর্মী লেখনীর কারণে বইটি দ্রুতই বিশাল সংখ্যক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে গোটা ইরানে। অসংখ্যবার বইটির সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। অলপ বয়সে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জনের ফলে দস্তির শাফাক-ই সরক’ পত্রিকাটিও দ্রুত পারস্যের শোষিত জনগণের মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। এই পত্রিকায় রাশিদ ইয়াসমেনি, সাইদ নাফিসি, আব্বাস ইকবাল, মুহাম্মদ মুহিত তাবাতাবাইয়ের মত ইরানের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী-ইতিহাসবিদরা কলাম লিখে নিজেদের গোড়পত্তন ঘটিয়েছেন।
এই সময়কালে আলি দস্তি ফরাসি, ইংরেজি, রুশভাষা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। বিশেষ করে আধুনিক ফরাসি এবং রুশ সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প তাঁর শৈলিপক মনে দারুন ছাপ ফেলে। তৎকালীন পারস্যে আলি দস্তি হচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি আধুনিক আরবি সাহিত্য(বিশেষ করে মিশরীয় সাহিত্য) ও ইসলামি গ্রন্থগুলোকে বস্তুবাদী বীক্ষণে আত্মস্থ করেছেন। যে-সময়কালে পারস্যের কবি-সাহিত্যিকরা রূপক শব্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে জটিল বাক্য তৈরি করে একের পর এক দুর্বোধ্য আধ্যাত্মিক সাহিত্য-চৰ্চায় নিমগ্ন, সে-সময় আলি দস্তি সাহিত্য জগতে ছোটছোট বাক্য দিয়ে সাধাসিধে ভাষায় কিন্তু সুতীক্ষনির্মোহভাষায় লেখনীর নতুন ধারা তৈরি করেন, যা পাঠক-সমাজে ব্যাপক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯২৭ সালে রুশ বিপ্লবের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে রাশিয়া ভ্রমণ করেন। এ-সময় ফ্রান্সসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণের সুযোগ হয় তাঁর।
উল্লেখ্য ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর থেকে ইরান হয়ে ওঠে যুদ্ধের এক বিরাট ময়দান। ব্রিটেনের সমাজতন্ত্র-বিরোধী শাসকগোষ্ঠী একাধিকবার ইরানকে ব্যবহার করে রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা করে। কিন্তু তা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। বিশ্বজুড়ে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পূর্বে ইরানকে নিজের কজায় রাখার জন্য ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে এক-ধরনের পরোক্ষ স্নায়ুযুদ্ধ বাধে তখন থেকেই। ফলে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলির ভূমি দখলের তৎপরতায় ইরানের শাসকগোষ্ঠী আদতে ক্রীড়ানড়কে পরিণত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইরান সোভিয়েত ব্লকে যোগদান করে। ১৯২৮ সালের দিকে দস্তি রাশিয়া ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে এলে বুশেহর আসন থেকে মজলিসের(পার্লামেন্ট) নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন(ইরানে তখন রেজা শাহ পাহলভি সরকার) এবং পরের টানা দুই মজলিশেও তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে জায়গা করে নেন। সাহিত্য-সাংবাদিকতার জগতে দস্তি সাহেব যেমন দক্ষ লেখনীশক্তির কারণে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন, তেমনি মজলিসে এসে সুদক্ষ বক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের দিকে ইরানের নবম মজলিস ভেঙে গেলে তাঁকে চৌদ্দ মাসের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৩৯ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন তেহরানের নিকটবর্তী দামাবন্দ আসন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে (১৯৪১ সালে) ইঙ্গো-রাশিয়ীয় উপনিবেশিক বাহিনী বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভিকে (১৮৭৮-১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের পর আলি দস্তি একই আসন (১৯৪১ ও ১৯৪৩ সালে) থেকে নির্বাচিত হন। ইরানের প্রগতিশীল ও সমাজ-সংস্কারবাদী রাজনৈতিক দল আদালত পার্টির নেতৃস্থানীয় ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালের শুরুর দিকে ইরানে সোভিয়েত প্রভাবিত তুদেহ পার্টি ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আহমদ কাভাম সালতানাহ (১৮৭৬-১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ইরানে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ইরানের তেল সম্পদের মালিকানা এবং খনি থেকে তেল উত্তোলনের জন্য চুক্তি করতে প্রবল আগ্রহী সোভিয়েত ইউনিয়ন। আলি দস্তি তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং দেশাত্মবোধের কারণে এই চুক্তির কতিপয় ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন মজলিসে, যা তুদেহ পার্টিকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ফলে পুনরায় একই বছরের এপ্রিল মাসে জেলে প্রেরণ করা হয়। ছয় মাস জেল খেটে বের হবার পর তাঁকে নিরাপত্তার জন্য ফ্রান্সে আশ্রয় নিতে হয়। বছর দুয়েক সেখানে থেকে ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে তিনি পুনরায় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে মিশর ও লেবাননের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হোসেন আলা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে (মুহামদ মুসাদ্দেকের ক্ষমতা গ্রহণের আগে) সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আলি দস্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইরানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সিনেটর নিযুক্ত হন। ইরানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে অর্ধেক সংখ্যক সিনেটর জনতার ভোটে নির্বাচিত হতেন আর বাকি অর্ধেক শাহ সরকার কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীরা নিযুক্ত হতেন। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবে ইরানের শাহানশাহ মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সিনেটর ছিলেন আলি দস্তি।
রাজনৈতিক জীবনের মত দস্তির সাহিত্যিক জীবনও এরূপভাবে মুখরিত। ১৯৪৬ সালে ‘সায়া’ নামে প্রকাশিত প্রবন্ধ-গ্রন্থে ইরানের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংস্কার ঘটিয়ে আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন জোরালোভাবে। ১৯৩৬ সালের আগ পর্যন্ত ইরানে পর্দা-প্রথার প্রচলন তেমন ছিল না। ওই বছরে স্থাপিত তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে একত্রে লেখাপড়া করতো। ১৯৬৩ সালে ইরানে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মেয়েদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করা হয় এবং পার্লামেন্টে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়। পারিবারিক নিরাপত্তা আইন সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের তালাক প্রদানের অধিকার দেয়া হয়, সন্তানকে মায়ের জিমায় দেয়ার আইনি নির্দেশ দেয়া হয়। মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৩ থেকে ১৮ নির্ধারণ করা হয় এবং ছেলেদের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য আদালতের অনুমতির নির্দেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। ইসলামি বিপ্লবের প্রাক্কালে ইরানের পার্লামেন্টে ২২জন নারী সাংসদ ছিলেন এবং স্থানীয় পর্যায়ে ৩৩৩ জন নারী কাউন্সিলর দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ছিলেন নারী। সরকারি বেসামরিক পদে প্রায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার নারী চাকুরিজীবী কর্মরত ছিলেন। কিন্তু খোমেনির বিপ্লবের পর ইরানের অবস্থা পাল্টে যায়। সরকারি সকল পদ থেকে নারীদের অপসারণ করা হয়। স্কুল-মাদ্রাসার একদম প্রথম শ্রেণি থেকে মেয়েদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানের পরিবারিক আইন সংশোধন করে নারী-অধিকার বিঘ্নিত করা হয়। পুরুষদের সুবিধা মত তালাকের সুযোগ করে দেয়া হয় এবং সন্তানকে পুরুষের জিমায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সমাজে বহুগামিতার যে আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল সেটা তুলে দেয়া হয়। এমন কী, মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৮ করা হয়েছিল সেটাকে কেটে ইসলামি শাস্ত্র মেনে ৯ বছর করা হয়। ১৯৮১ সালে ইরানের মোল্লাতান্ত্রিক সরকার পার্লামেন্টে একটি বিল পাস করেন, যেখানে বলা হয়েছে, ইসলামি ড্রেস কোড কেউ ভঙ্গ করলে ব্যভিচারের শামিল বলে গণ্য করা হবে এবং এ-জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। আলি দস্তি তাঁর ফিৎনা (১৯৪৩ ও ১৯৪৯), জাদু’(১৯৫১) এবং ‘হেন্দু (১৯৫৫) উপন্যাসগুলিতে পারস্যের সমাজের নারীর প্রতি বৈষম্য, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, নিপীড়ণের বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকার ভঙ্গিমায়।
এরপর আলি দস্তি ইসলাম বিষয়ে লেখনীতে মনোনিবেশ করেন। শৈশবকালের মাদ্রাসা-শিক্ষা, আধুনিক মিশরীয় ও ইউরোপের রেনেসাঁসের প্রভাবে সমুজ্জ্বল বিশ্লেষণধর্মী যুক্তিবাদী রচনাগুলো তাঁকে প্রেরণা দান করে। ইসলামি সুফিবাদের উপর লেখা পর্দাইয়ে পিঞ্জর (১৯৭৪), ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা ও নিয়তিবাদীর মধ্যেকার কথোপকথন নিয়ে রচিত জিবর ইয়া এখতিয়ার (প্রকাশনার সঠিক তারিখ জানা যায় না। সম্ভবত ১৯৭১ সালে এটি প্রকাশিত হয়), ধর্মীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আল-গাজ্জালির বক্তব্যের যৌক্তিক সমালোচনা করে লিখিত আকলা বার খেলাফ-ই আকল’(প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫ এবং এরপরে আরও দুইবার পুনঃপ্রকাশিত হয়) এবং পর্দা-ইয়ে পিঞ্জর গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড ‘দার দিয়ারে সুফিয়ান’(১৯৭৫) গ্রন্থগুলি আলি দস্তিকে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা দান করে। তবে আলি দস্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে বিশত ও সেহ সাল’। বিষয়বস্তুর কারণে এই বইটি প্রকাশের সঠিক তারিখ ও স্থান কখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এবং আলি দস্তির নিজস্ব বক্তব্য অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের আগে লেবাননের বৈরুত থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। নবি মুহাম্মদের নবুওতির বস্তুবাদী ইতিহাস নিয়ে ফার্সি ভাষায় রচিত এই বইটি শুধু ইরানে নয় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
বিশত ও সেহ সাল বইটি ইরানের ধর্মীয় চিন্তাবিদদের ব্যাপক ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গোটা ইরান জুড়ে ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে মার্কসবাদী ও ইসলামপন্থীদের মধ্যেকার সংঘর্ষ যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ আরোপের বিধিবিধান কার্যকর হতে থাকে একের পর এক। আলি দস্তির বইটি বিদেশে (বৈরুতে) প্রকাশিত হলেও ইরান সরকার কোনো ধরনের নামপ্রকাশ ব্যতিরেকে বইটি বাজেয়াপ্ত করে।
কথিত ইসলামি বিপ্লবের পরপরই ইরানের খোমেনি সরকার আশি উর্ধ্ব আলি দস্তিকে গ্রেফতার করে গোপন কারাগারে নিয়ে যায়। তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, তাঁর লেখনী বিশেষ করে বিশত ও সেহ সাল’বইটি প্রকাশের জন্য ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে রিমান্ডে নিয়ে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। প্রহারের ফলে দস্তির উরুর হাড় ভেঙে যায়। এরপর গণমাধ্যমে আলি দস্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। লোকমুখে শোনা যায় তাঁকে একসময় গোপনে ছেড়ে দেয়া হয়। বয়স বিবেচনায় হোক অথবা অসুস্থতার কারণেই হোক ঠিক কিভাবে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন তা পরিষ্কার নয়। তবে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাঁকে নিজ বাড়িতে ফিরতে দেয়া হয়নি। তেহরানের উত্তরে জারগান্ধে উপশহরে একখণ্ড বাগান নিয়ে ছিল তাঁর ছোট্ট একটি কুটির। এরপর অনেকটা আকস্মিকভাবে ইরানের পাক্ষিক পত্রিকা ‘আয়ান্দা (সংখ্যা ২২ ডিসেম্বর ১৯৮১-২০ জানুয়ারি ১৯৮২) ছোট করে আলি দস্তির মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে। ব্যাস এতটুকুই। ইরানের সরকারের কাছ থেকে এরপর আলি দস্তি সম্পর্কে আর কোনো তথ্য কখনো প্রকাশিত হয়নি।

‘বিশত ও সেহ সাল’ থেকে ‘টুয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স’
আলি দস্তির সাথে ইংরেজ অনুবাদক এফ. আর. সি. ব্যাগলির (F. R. C. Bagley) প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৫ সালের বসন্তে তেহরানে এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দেবার সময়। দস্তির প্রাণোবন্ত চেহারা আর ভরাট কণ্ঠস্বর সহজেই নজর কাড়ে অনুবাদকের। গল্প, চুটকি আর ঠাট্টার মাধ্যমে পরিচয়। আলি দস্তি এফ. আর. সি. ব্যাগলিকে বিশত ও সেহ সাল’বইটি উপহার দেন এবং অনুরোধ করেন সম্ভব হলে ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য। তবে তাঁর মৃত্যুর আগে যেন অনুবাদটি প্রকাশিত না হয়। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় সাক্ষাৎ হলে আলি দস্তি তাঁর পূর্বের অনুরোধের কথা সারণ করিয়ে দেন। পরের বছরে জুন মাসে আলি দস্তির প্যারিস ও লন্ডনে একটি সংক্ষিপ্ত সফরের সময় অনুবাদ নিয়ে ফোনালাপ ও চিঠি চালাচালি হয়েছে দুজনের।
আলি দস্তির মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরই বই প্রকাশে উদ্যোগী হন অনুবাদক এফ. আর. সি. ব্যাগলি। ১৯৮৫ সালে লন্ডন থেকে টুয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স অ্যা স্টাডি অব দ্যা প্রফেটিক ক্যারিয়ার অব মুহাম্মদ শিরোনামে বইটি হার্ডকাভারে প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। এরপর বইটি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মাজদা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মাজদা পাবলিশার্স থেকে বইটির ১৯৮৫ ও ১৯৯৪ সালে দুইটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। হার্ডকভার ও পেপারব্যাক মুদ্রণে বইটি বাজারে পাওয়া যায়।

‘টুয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স’ থেকে ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’
আলি দস্তির বইটি বাংলায় অনুবাদের জন্য আমরা এফ. আর. সি. ব্যাগলি অনুদিত মাজদা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত (১৯৯৪ সালের সংস্করণ) বইটির সাহায্য নিয়েছি। পূবেই উল্লেখ করা হয়েছে সমাজ-সচেতন ও নির্মোহ হয়ে ইসলামের ইতিহাস পাঠের জন্য আলি দস্তির বই একটি অনন্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থ মূলভাব বজায় রেখে বাংলায় সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। আলি দস্তি তাঁর বইয়ে আয়াত উদ্ধৃতির জন্য মূল আরবি কোরান ব্যবহার করেছেন। আমরা কোরানের আয়াত বাংলায় ব্যবহার করার জন্য একাধিক বাংলায় অনূদিত কোরান অনুসরণ করেছি। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রয়াত সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কোরান শরিফ সরল বঙ্গানুবাদ, মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান অনুদিত তফসীর মারেফুল কোরআন এবং হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদের অনূদিত কোরআন শরীফ-এর সহায়তা নিয়েছি। ইংরেজি বইটির মূলভাব বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় তৃতীয় বন্ধনী ব্যবহার করে অনুবাদকের নিজস্ব মন্তব্য ও ভাবনা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুবাদকের মন্তব্যে কিছু জায়গায় তথ্যসূত্র হিসেবে হাদিস নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকার সাউথদান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর মুসলিম-জিউস এনগেজমেন্ট- এর উদ্যোগে পরিচালিত কোরান ও হাদিসের অনলাইন আর্কাইভ রয়েছে। হাদিসের জন্য এই সাইটের অনলাইন ঠিকানা : http://www.usc.edu/org/cmje/religious-texts/hadith/। এখানে বুখারির হাদিস ছাড়াও রয়েছে মুসলিম শরিফ, দাউদ শরিফের বিশাল অনলাইন সংগ্রহ। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী, লেখক, পাঠক, ধর্মীয়গবেষক এই সাইট ব্যবহার করে থাকেন সহজবোধ্য ইংরেজি ও সহজে ব্যবহার-উপযোগী বলে। অনুবাদের সময় হাদিসের সূত্র ব্যবহারে আমরা এই সাইটে ব্যবহৃত ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেছি। এছাড়া অনেক জায়গায় বাংলায় হাদিস অনুবাদের জন্য বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ বুখারী শরীফ এর সহায়তা নেয়া হয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, আলি দস্তির ব্যবহৃত কোরানের আয়াতের নম্বরের সাথে বর্তমানে প্রচলিত কোরানের আয়াত নম্বর পুরোপুরি মিলে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়াতের নম্বরে দুয়েকটি সংখ্যার উপর-নিচ হতে দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে আমরা আলি দস্তির লিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করিনি। দস্তির বইয়ে উদ্ধৃত কোরানের আয়াতের সাথে বর্তমানে প্রচলিত কোরানের আয়াত মিলিয়ে নিয়ে সেই নাম্বারটি ব্যবহার করেছি। আশা করি এর ফলে মূল বিষয়ের কোনো ব্যতয় ঘটেনি।
সবশেষে বলতে চাই, আমাদের এই অনুবাদটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশের জন্য একাধিক তরুণ অপরিসীম সহায়তা করেছেন। পাণ্ডুলিপির প্রফ দেখা, সংশোধন, সম্পাদনা ইত্যাদি পরিশ্রমী কাজে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের নিরলস শ্রমের বিনিময়ে পুস্তকারে প্রকাশে আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে, এজন্য তাঁদেরকে অশেষ ধন্যবাদ।
জন্ম পরিচিতি
‘পথ খুঁজি আমি, কিন্তু কাবা-মসজিদের পথ নয়। জানি ঐ কাবায় আছে একদল পৌত্তলিক আর এর মসজিদে একদল পূজারী।’ – জালালুদ্দিন রুমি।

মক্কায় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আমিনা বিনতে ওহাব এক শিশুর জন্ম দেন। শিশুর চোখ খোলার আগে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ মারা যান। আর শিশুর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাঁর মা আমিনা মারা যান। এরপর শিশুটির দেখাশোনার ভার বর্তায় তাঁর প্রভাবশালী ও উদার পিতামহ আব্দুল মোতালেবের উপর। কয়েক বছর পর শিশুর পিতামহও মারা যান। ঐ শিশুর অনেক বিত্তবান চাচা থাকা সত্ত্বেও লালন-পালনের দায়িত্ব নেন তাঁর সবচেয়ে দরিদ্র চাচা আবু তালিব। দরিদ্র অথচ সাহসী আবু তালিবের যত্নেলালিত এই শিশুই পরে বিকাশিত হন বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং একজন অনন্যসাধারণ মহাপুরুষ রূপে। সম্ভবত ইতিহাসে এই লব্ধপ্রতিষ্ঠিত মহামানবের দৃষ্টান্ত আর কখনো দেখা যায়নি বা যাবেও না।
এই অসাধারণ ব্যক্তির জীবন নিয়ে সহস্র পুস্তক রচিত হয়েছে। বিশেষত তাঁর জীবনের শেষ তেইশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ, এবং সমস্ত কিছু যা তিনি বলেছেন এবং করেছেন তা নিয়ে প্রচুর লেখা রয়েছে। বিদগ্ধজন এবং গবেষকেরা এই মহাপুরুষের জীবনের উপর যত কাজ করেছেন তা আর কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির উপর হয়নি। এতদসত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তাঁর উপর যুক্তিসিদ্ধ এবং বস্তুনিষ্ঠ কোনো পুস্তক, যার মধ্যে কোনো অতিরঞ্জিত উগ্র যুক্তিহীন এবং কাল্পনিক ব্যাপার নেই-এরকম বই বোধহয় রচিত হয়নি।
দেখা যায় যে মুসলিম এবং অন্যান্যরা যাঁরা মুহাম্মদের জীবন নিয়ে ব্যগ্র, তাঁরা ঐতিহাসিক সত্য অগ্রাহ্য করেন। তাঁরা সর্বদা মুহাম্মদকে এক কাল্পনিক অতিমানব বা কাপড়ে ঢাকা দ্বিতীয় ঈশ্বর হিসেবে পরিচিত করতে সচেষ্ট। এটা করতে গিয়ে তারা মানুষ মুহাম্মদকে বারেবারে উপেক্ষা করে গেছেন। এর ফলে তারা প্রকৃতিতে কার্যকারণের যে অমোঘ নিয়ম বিদ্যমান তা এড়িয়ে গেছেন। তাই তাঁদের বর্ণনায় শুধু দেখা যায় কাল্পনিক এবং অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ।
মুহাম্মদের জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর, অর্থাৎ ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, তেমন কিছু জানা যায় না। নবির জীবনীতে অথবা লোকপ্রবাদেও এই সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে তৃতীয় হিজরি বা নবম শতাব্দীতে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং কোরানের তফসিরকারক আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল-তাবারি সুরা বাকারার ২৩ নম্বর আয়াতের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে মুহাম্মদের জন্ম নিয়ে এক ভিত্তিহীন দাবি করেন। এ থেকে বোঝা যায় সেই সময় সাধারণ মানুষ নবির জীবন-কাহিনী নিয়ে প্রচুর কাল্পনিক বক্তব্যে বিশ্বাস করতো। এমন কী কাল্পনিক লোককথার প্রভাব থেকে তাবারির মতো ঐতিহাসিকও মুক্ত ছিলেন না। সুরা বাকারা’র ঐ আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আমি আমার দাসের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মতো কোনো সুরা আনো। আর তোমরা যদি সত্য বল, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে ডাকো।’ (২:২৩)। তাবারি এই আয়াতের তফসির করতে গিয়ে নিজস্ব মন্তব্য যোগ করেছেন : ‘নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে মক্কায় একবার লোকমুখে কথা রটলো যে, আল্লাহ মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তিকে তাঁর প্রেরিত পুরুষ (রসুল) হিসেবে পাঠাবেন এবং পূর্ব ও পশ্চিমে যা কিছু আছে তার সবই ঐ ব্যক্তির আয়ত্তে আসবে। সে-সময় মক্কার চল্লিশজন নারী গর্ভবতী ছিল। গর্ভবতী প্রত্যেক মাতা চাচ্ছিলেন তার শিশু সেই প্রেরিত পুরুষ হোক। তাই শিশুর জন্মের সাথে সাথে প্রত্যেক মাতা তার পুত্রের নাম মুহাম্মদ রাখলেন।’
উপরের উক্তি যে বাস্তবতাবর্জিত তা বলা নিম্প্রয়োজন। সে সময় মক্কায় কেউ এই ধরনের গুজব শুনেনি অথবা কেউই মুহাম্মদ নামে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ সমন্ধে অবহিত ছিল না। মুহাম্মদের অভিভাবক আবু তালিব এ-ব্যাপারে কিছু না জেনেই অথবা কিছু না শুনেই এবং ইসলামে দীক্ষিত না হয়েই মারা যান। নবুওতের স্বীকৃতি পাবার পূর্বে মুহাম্মদ কোনোদিনও ভাবতে পারেননি যে তিনি নবি হতে যাচ্ছেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সুরা ইউনুসের ১৬ আয়াতে : ‘বলো, আল্লাহর তেমন ইচ্ছা থাকলে আমি তোমাদের কাছে এটি পড়তাম না, আর তিনি তোমাদেরকে এ-বিষয়ে জানাতেন না। আমি তো এর আগে তোমাদের মধ্যে দীর্ঘকাল কাটিয়ে দিলাম, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?”(১০:১৬)। মক্কার ইতিহাসে কখনো জানা যায় না যে,৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চল্লিশজন নারী সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন এবং প্রত্যেকেই তার শিশুর নাম রাখেন মুহামদ। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য যে, সেসময় মুহামদ তাঁর সমবয়সী ও একই নামধারী চল্লিশজন খেলার সাখী পেয়েছিলেন?
ঐতিহাসিক ওয়াকেদিনবির জন্ম সম্পর্কে তাবরি থেকে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। ওয়াকেদি লিখেছেন ; মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়েই মুহাম্মদ উচ্চারণ করেন- আল্লাহ সবার উর্ধ্বে। এক মাস বয়সে মুহাম্মদ হামাগুড়ি দিতে থাকেন, দুই মাসে দাঁড়িয়ে যান, তিন মাসে হাঁটতে শুরু করেন, চার মাসে দৌড়াতে পারেন এবং নয় মাস বয়সে তীর ছুড়তে থাকেন। উল্লেখ্য মির্জা জানি কাশানি (মৃত্যু ১২৬৮ হিজরি বা ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর নাকাত আল-কাফ” বইয়েও বাহাই মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আলি মুহাম্মদ সিরাজি সম্পর্কে একই ধরনের বক্তব্য লিখেছেন। যদিও বাহাই সম্প্রদায় পরে এই ধরনের প্রচারণাকে চাপা দেবার প্রয়াস চালায়। মির্জা কাশানির বক্তব্য অনুযায়ী সাইয়েদ আলি জন্মের সাথে সাথে নাকি উচ্চারণ করেছিলেন : ‘আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। যা-হোক ওয়াকেদি যেমনটা বলেছেন মক্কায় এধরনের অলৌকিক কিছু হয়ে থাকলে তখনকার পৌত্তলিক মক্কাবাসীরা নিশ্চয়ই জানতেন এবং মুহাম্মদের কাছে শুরুতেই মাথা নত করতেন।’
উপরে উল্লেখিত উদাহরণ থেকে সে-সময়কার মুসলমানদের মধ্যে অবাস্তব এবং ইতিহাসের নামে কাল্পনিক কাহিনী রচনার প্রবণতা দেখা যায়। আবার অনেক পাশ্চাত্য খ্রিস্টান লেখক কোনো যুক্তিপূর্ণ আলোচনা ছাড়াই মুহাম্মদকে মিথ্যাবাদী, ভণ্ড, যোদ্ধা, ক্ষমতালোভী এবং লম্পট বলে প্রচার করে থাকেন। আদতে এই দুই দলের কেউই হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে বাস্তব এবং প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেননি। এর কারণ হতে পারে ভাবাদর্শের প্রতি গভীর আসক্তি। রাজনৈতিক, ধর্মীয় অথবা গোত্রীয় হোক, সে পুরুষ অথবা নারীই হোক অন্ধভাবাদর্শে বিভোর একজন ব্যক্তি তার পরিষ্কার বিশ্লেষণী চিন্তা করতে অক্ষম। ভাল-মন্দ সম্পর্কে তার পূর্বধারণা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। হৃদয়ে প্রোথিত ব্যক্তিপ্রেম কিংবা ব্যক্তি-ঘৃণা এবং উগ্র মৌলবাদী চিন্তা ও সংস্কার তাকে ঘিরে রাখে সবসময়। এর ফলাফল হয় কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি কুয়াশাচ্ছন্ন এবং অবাস্তব কল্পনায় বিভোর থাকেন।
নিঃসন্দেহে হজরত মুহাম্মদ একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। যেসব গুণের জন্য মুহামদকে অন্যদের থেকে পৃথক করা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে-তাঁর তীক্ষ্ণবুদ্ধি, চিন্তার গভীরতা এবং তৎকালীন সর্বপ্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আপোষহীন মনোভাব। তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি যা দিয়ে তিনি একাই পাপকার্যের বিরদ্ধে লড়ে গেছেন। প্রতারণা এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে তিনি সবাইকে সাবধান করে দিয়েছেন। অন্যায়, অসত্য, স্বার্থপরায়ণতাকে তিনি প্রবলভাবে তিরস্কার করেছেন। বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং হতদরিদ্রের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন আজীবন। স্বদেশবাসীকে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মূর্তিপূজার জন্য ভর্ৎসনা করেছেন। স্বাভাবিকভাবে মক্কাবাসী যারা তখন সম্মানিত এবং ক্ষমতাশালী ছিল তারা নবির কথায় কর্ণপাত করেননি। নবির আহ্বানে সাড়া দেয়ার অর্থ ছিল, তাদের শত বছরের লালিত সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা এবং ধর্মবিশ্বাস পরিহার করা। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের কাছেও ছিল একমাত্র সত্য এবং এই বিশ্বাসের বাইরে ভিন্ন কিছু তারা চিন্তা করতে পারতেন না।
তবে মক্কার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে সবচেয়ে যে বিষয়টি অসন্তুষ্টির কারণ ছিল তা হলো মুহাম্মদ তাঁদের শতাধিক বছরের সনাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিতে চাচ্ছিলেন। অথচ মুহাম্মদের সামাজিক পদমর্যাদা ছিল তাদের চেয়ে নিচুতে। মুহাম্মদ কুরাইশ গোত্রের হলেও তাঁর সামাজিক পদমর্যাদা তাদের পর্যায়ে ছিল না। এর কারণ হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই মুহাম্মদ ছিলেন এতিম এবং লালিত-পালিত হয়েছিলেন তাঁর এক চাচার অনুগ্রহে। মুহাম্মদের শৈশব কেটেছে চাচা এবং প্রতিবেশীদের উটের রাখাল হিসেবে। জীবিকার তাগিদে অলপ বয়সে খাদিজা নামের এক বিত্তবান মহিলার কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন তিনি। তখন মুহাম্মদের কিছুটা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তথাপি মুহাম্মদ কুরাইশ নেতাদের কাছে একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এই অপাংক্তেয়া ব্যক্তি সহসা নিজেকে আল্লাহর এক নবি বলে ঘোষণা করে কুরাইশদের উপর কর্তৃত্ব দাবি করে তাদেরকে নতুন ধর্মীয় শিক্ষা দিতে চাইলেস্বাভাবিকভাবেই কুরাইশরা তা মানতে রাজি ছিলেন না।
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে কুরাইশ নেতাদের মনোভাব বোঝা যায় ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরার একটি দাম্ভিক উক্তিতে। মুহাম্মদের নবুওতির প্রারম্ভে ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা ছিলেন কুরাইশদের মাখজুম গোত্রের প্রভাবশালী নেতা। তিনি মারা যান ৬১৫ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে। ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা একবার মন্তব্য করেছিলেন : যখন কুরাইশরা আমার মতো নেতা পেয়েছে এবং বানু তামিমের নেতা হচ্ছে ওরওয়া বিন মাসুদ, তখন মুহামদ কেমন করে নিজেকে নবি দাবি করেন?”কোরানের সুরা জুখরুফে মুগিরার বক্তব্য উঠে এসেছে এভাবে ; আর এরা বলে কোরান কেন অবতীর্ণ হল না দুই জনপদের (মক্কা ও তায়েফের) কোনো বড়লোকের ওপর? এরা কি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ বণ্টন করে? আমি তাদের পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করি, আর এককে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নত করি যাতে তারা একে অপরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে। আর তারা যা জমা করে তার চেয়ে তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ অনেক ভালো। (৪৩: ৩১-৩২)।
ঐ সময়ে মাখজুম গোত্র মক্কায় বেশ সুবিধাজনক পর্যায়ে ছিল। কুরাইশদের মধ্যে আবদে মনাফ বংশ একাধিক কয়েকটি ছোট দলে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর পুত্রদের বিভাজনের ফলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হাশেম বংশ এবং ধনাঢ্য আবদে শামস বংশ ও তাঁর পুত্র উমাইয়া বংশ। মুহাম্মদ জন্মেছিলেন হাশেম বংশে। আবু জেহেল তখন মাখজুম গোত্রের পরবর্তী প্রধান হবেন ঠিক হয়েছিলেন। মুহাম্মদের নবুওতি নিয়ে আবু জেহেল আরেকটি বংশের নেতা আকনাস বিন শারিককে বলেন,”প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে আমরা আবদে মনাফের প্রধান প্রতিদ্বন্দী। সর্ববিষয়েই আমরা প্রায় তাঁদের সমকক্ষ হয়ে এসেছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে তাঁদের একজন নবুওতির দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে। বানু মনাফ এইভাবেই পুনরায় আমাদের উপর তাঁদের প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। ”
এই বক্তব্যগুলি থেকে মুহাম্মদের নবুওতি নিয়ে আমরা কুরাইশ নেতাদের মনোভাব বুঝতে পারি। বোঝাই যায় তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। তারা কোনোভাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন না। আবার তাদের মধ্য থেকেই একজন ব্যক্তি ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদেরকে ধর্ম শিক্ষা দিতে আসছেন-এটা তারা কোনোভাবে মানতে পারছিলেন না। কোরানের বিভিন্ন আয়াতে তাদের এই প্রতিবাদ-আপত্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন সুরা আনআম ; আয়াত ৮; সুরা হুদ ; আয়াত ১৩-১৪; সুরা ফুরকান ; আয়াত ৭-৮। কুরাইশরা বললেন, আল্লাহ যদি সত্যি পরিচালিত করতে চাইতেন তবে কোনোভাবেই তাদের মধ্য থেকে একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ করতেন না। তিনি কোনো ফেরেশতা বা দেবদূত পাঠিয়ে দিতেন। তাদের এই বক্তব্যের উত্তরে আকাশ থেকে এক ফেরেশতাকেই ওদের কাছে রসুল করে পাঠাতাম।” (সুরা বনি-ইসরাইল ; আয়াত ৯৫)।
আসল কথা হচ্ছে মক্কার নেতারা মুহাম্মদের ভিন্নধরনের চিন্তাভাবনা এবং ভাবধারা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চাইলেন না। তারা আগ্রহী হয়ে মুহাম্মদের কোনো কথা শুনতে রাজি ছিলেন না। মুহাম্মদের চিন্তাভাবনায় তাদের সমাজের উন্নতি হতে পারে এই মনোভাব তাদের মধ্যে কখনো ছিল না। তারা যুক্তি এবং সুসংগতভাবে মুহাম্মদের মতামতের সত্যতা যাচাইয়ে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তবে যে কোনো সমাজ যতই খারাপ হোক না কেন, ঐ সমাজে সবসময়ই কোনো না কোনো সৎ মানুষ পাওয়া যায় যারা নির্মোহ এবং নির্মল চিন্তার মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি করতে পারেন, সেই সত্য যে কেউ বলুক না কেন। মক্কাবাসীর মধ্যে হজরত আবু বকরকে ধরা যেতে পারে প্রথম ব্যক্তি, যিনি মুহাম্মদের বাণীর সত্যতা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। আবু বকরের উদাহরণ দেখে আরও কয়েকজন কুরাইশ ব্যক্তি, যেমন আব্দুর রহমান বিন আউফ, উসমান বিন আফফান, জুবায়ের বিন আল-আওয়াম, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার প্রত্যেক সমাজেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতদরিদ্র লোক থাকেন যারা সমাজের ধনী ব্যক্তির সম্পদের কোনো কিছুই পান না। ফলে এরা প্রচলিত সমাজধারার প্রতি থাকেন বিক্ষুব্ধ এবং অসন্তুষ্ট। মক্কার এই দুই দল মুহাম্মদের মতবাদের প্রশংসা করে তাঁর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এই পরিস্থিতিতে সংঘাত ছিল অনিবার্য। মক্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ছিল বিত্তবানদের সমর্থক এবং বিত্তবানরাও তাদের সম্পদ ও অর্থের জন্য ছিল গর্বিত। যে মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘু জনতা মুহাম্মদের সমর্থক ছিলেন তারা ভাবলেন মুহাম্মদের নতুন মতবাদের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হবে। ফলে সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সবরকম ত্যাগ এবং লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। নবি জীবিত থাকালীন সময়ে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিমিত পর্যায়ে ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এই আন্দোলন ক্রমশ গতিশীল হতে থাকে। ফলে জনসাধারণের মাঝে মুহাম্মদ হয়ে পড়েন একজন অতিমানব এবং তারা তাঁকে ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ হতে যে-সব গুণের দরকার সেই গুণাবলী দ্বারা আবৃত করে ফেলেন। এদিকে ঈশ্বর বা আল্লাহ হলেন সৃষ্টিকর্তা এবং পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক।
নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে এ-ধরনের অলীক কল্পনা কেমন করে দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল তার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। উদাহরণটি অত্যন্ত পরিষ্কার এবং অখণ্ডনীয়। মুসলমানরা মনে করেন কোরানই হচ্ছে একমাত্র চূড়ান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ। কোরানের মক্কি সুরা বনি-ইসরাইলের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে এক রাতে নবি স্বর্গে ভ্রমণ করেছেন। আয়াতটি খুব সরল এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যাসাধ্য। আয়াতে বলা হয়েছে : ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর দাসকে তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য রাত্রে সফর করিয়েছিলেন মসজিদ-উল-হারাম থেকে মসজিদ-উল-আকসায়, যেখানে পরিবেশ তাঁরই আশীবাদপূত। তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন।’(১৭:১)। আয়াতটিতে যা বলা হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে আধ্যাতিক ভ্রমণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। এধরনের আধ্যাত্মিক ভ্রমণ আরও অনেক ভাবতান্ত্রিক ব্যক্তিরও হয়েছে বলে শোনা যায়।
কিন্তু মুসলমানরা এই অতি সাধারণ ভ্রমণকে বিস্ময়কর, অযৌক্তিক এবং অবাস্তব বক্তব্য দ্বারা সজ্জিত করেছেন। এই আয়াত সম্পর্কে আমি তফসির আল-জালালাইনের অপেক্ষাকৃত কিছুটা সংযত ব্যাখ্যার উদ্ধৃতি দিব। তফসির আল-জালালাইন হচ্ছে কোরানের বিশ্বস্ত তফসির-বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোরানের সুন্নি তফসিরগুলোর মধ্যে একে ধ্রুপদী মর্যাদা দেয়া হয়। মিশরের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল-মাহালি এই তফসির লেখা শুরু করেন ১৪৫৯ সালে এবং তাঁর ছাত্র জালালউদ্দিন আল-সুয়ুতি লেখাটি শেষ করেন তাঁর মৃত্যুর আগে ১৫০৫ সালে। আল-মাহালি এবং আল-সুয়তি দুজনের নামই জালাল, তাই তাঁদের নামানুসারে এই তফসিরের নামকরণ হয় তফসির আল-জালালাইন’, যার অর্থ হচ্ছে, দুইজন জালালের তফসির।
ধারণা করা হয় তাঁরা দুজনেই ধর্মকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সমস্ত দলীয়-উপদলীয় কোন্দলের উর্ধ্বে ছিলেন। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোরানের আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া এবং এর প্রসঙ্গ জানানো। তথাপি তাঁরা তফসিরে সুরা বনি-ইসরাইলের প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অপ্রমাণিত বক্তব্য নবি মুহাম্মদের মুখের উপর বসিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কি উদ্দেশ্য ছিল-ব্যাখ্যাও প্রসঙ্গ জানানো নাকি তৎকালীন সময়ে মুসলমানদের মধ্যে যেসব কাহিনী প্রচলিত ছিল সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার দেয়া? যাহোক নবির যেসব উদ্ধৃতি তাঁরা দিয়েছেন তফসিরে, সেগুলোর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। হাদিস সংকলনকারীরাও নবির উপর অর্পিত কথাবার্তার ব্যাপারে প্রচলিত সংবাদের প্রমাণের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। এই চেষ্টার পরও এটা প্রমাণ করে না যে, নবি আদৌ একথাগুলো বলেছিলেন। তাই হাদিস-সংকলনকারীদের তথ্যও নির্ভরযোগ্য নয়। তফসির আল-জালালাইনের লেখকদ্বয় তাঁদের ব্যাখ্যার কোনো সূত্রও দিতে পারেননি। ফলে বোঝা যায় খুব সম্ভবত তাঁরাও হয়তো নিজেরা এই কাহিনী বিশ্বাস করতেন না।
তফসির আল-জালালাইন’-এ রয়েছে নবি বলেছেন : ‘ঐ রাতে জিব্রাইল আসলেন। জিব্রাইলের সাথে ছিল একটা চতুষ্পদী জন্তু যা দেখতে গাধার চেয়ে বড় আবার খচ্চরের চেয়ে ছোট। এই জন্তুর পায়ের খুর ছিল বহির্মুখী। আমি এই জন্তুর উপরে বসলাম এবং পবিত্র মসজিদের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানে পৌছালে আমি বোরাকটির (সেই জন্তু) লাগাম বেঁধে দিলাম সেই আংটার সাথে যাতে নবিরা তাঁদের বাহন পশুকে বেঁধে দিতেন। সেই দূরের মসজিদে গিয়ে আমি তিনবার ভূমিতে মাথা নত করে প্রার্থনা করলাম। যখন বাইরে এলাম তখন জিব্রাইল আমাকে দুটি পাত্র দিলেন। একটি পাত্র ছিল দুধভর্তি আর আরেকটি পাত্র ভর্তি ছিল সুরায় আমি যখন দুধ-ভর্তি পাত্র গ্রহণ করলাম তখন জিব্রাইল তা সমর্থন করলেন। তারপরে আমরা উড়ে গেলাম প্রথম স্বর্গে। আমরা প্রথম স্বর্গের ফটকে পৌছালে একজন রক্ষী চিৎকার করে আওয়াজ দিলেন : “এখানে কে? জিব্রাইল উত্তর দিলেন : এখানে আছে জিব্রাইল। ফটকরক্ষী জিজ্ঞাসা করল : আপনার সাথে কে? জিব্রাইল উত্তর দিলেন : মুহাম্মদ। রক্ষী আবারও জিজ্ঞাসা করলেন : “তাঁকে কী ডাকা হয়েছে?’ জিব্রাইল উত্তর দিলেন: “হ্যাঁ। এরপর রক্ষী স্বর্গের ফটক খুলে দিলেন। হজরত আদম আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন এবং বললেন : ‘আপনাকে স্বাগতম। (এভাবে নবি মুহাম্মদ সপ্তস্বর্গ ভ্রমণ করলেন এবং প্রত্যেকটি স্বর্গেই একজন নবি তাঁকে স্বাগতম জানালেন।) সপ্তম স্বর্গে পৌছে আমি দেখলাম হজরত ইব্রাহিম সেই জনপ্রিয় স্থানে হেলান দিয়ে বসে আছেন। এ-স্থানেই প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন কিন্তু কেউ বাইরে আসেন না। এরপরে জিব্রাইল আমাকে নিয়ে যান সর্বশেষ লোট গাছের কাছে। এই গাছের এক একটি পাতা ছিল হাতির কানের মতো বড়। এরপর আমি এক দৈববাণী পেলাম যাতে আমাকে আদেশ করা হলো প্রতিদিন এবং রাতে পঞ্চাশবার নামাজ পড়ার। আমি যখন ফিরে আসছিলাম তখন নবি মুসা আমাকে বললেন : “পঞ্চাশবার নামাজ পড়া বেশি হয়ে যাবে। আপনি আল্লাহকে অনুরোধ করুন নামাজের সংখ্যা কমানোর জন্য। আল্লাহ নামাজের সংখ্যা কমিয়ে চল্লিশ করে দিলেন। এরপর নবি মুসা বললেন : ‘আমি আমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি এই ব্যাপারে। তারা এক দিন এবং এক রাতে চল্লিশবার নামাজ পড়তে সক্ষম নয়। আমি আবার আল্লাহর কাছে গেলাম…। (সংক্ষিপ্তভাবে বলতে হয় মুহাম্মদ আল্লাহর কাছে অনুরোধ করতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ নামাজের সংখ্যা পাঁচে নামিয়ে আনেন।)
নবির রাত্রি-ভ্রমণ নিয়ে তফসির আল-জালালাইন-এ যা লেখা হয়েছে তা ইরানের বিশিষ্ট এবং প্রভাবশালী সুন্নি চিন্তাবিদ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল-তাবারির (৮৩৯-৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) বিখ্যাত তফসির অথবা তফসিরকারক আবু বকর আতিক নিশাপুরির রচনার তুলনায় নিতান্ত নগণ্য। মুহামদের রাত্রি-ভ্রমণ ঘিরে মুসলিমদের মধ্যে যে ধরনের কাহিনী প্রচারিত হয়েছে তা দুঃসাহসিক অভিযানের মতোই শোনায়। মিশরীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী মুহাম্মদ হোসেন হায়কলং আধুনিককালের অত্যন্ত যুক্তিবাদী লেখক। তিনি নবি মুহাম্মদের জীবনী লিখেছেন ১৯৩৩ সালে। তাঁর বইয়ে সশরীরে নবির রাত্রি ভ্রমণকে অস্বীকার করলেও একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন কিছুটা পরিবর্তিত রূপে। এই বর্ণনা তিনি পেয়েছেন ফরাসি লেখক এমিলি ভারমেনগেমের মুহাম্মদের জীবনীভিত্তিক লেখা বই থেকে।
যারা কোরানের সাথে পরিচিত তারা জানেন যে, কোরান হচ্ছে মুহাম্মদের নবি-জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলক। কোরান থেকেই বোঝা যায় নবি কখনো এই ধরনের বর্ণনা দেননি। এ-ধরনের উপকথা সাধারণ জনগণের কালপনিক আবিষ্কার। গভীরভাবে বিশ্বাসী সাধারণ জনগণ মনেমনে ভাবতেন যাঁরা ওহি পেয়ে থাকেন তাঁরা শাসকদের মতো ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী। সুরা বনি-ইসরাইলের প্রথম তিনটি আয়াতে আধ্যাত্মিক ব্যাপার বলা হয়েছে। এই সুরার ৯৩ নম্বর আয়াতে নবিকে বলা হয়েছে . . . . বলো, আমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা! আমি একজন মানুষ, সুসংবাদদাতা রসুল ছাড়া আর কী?” (১৭৯৩)। সূরা আশ-শুরার ৫১ আয়াতে বলা হয়েছে : এ কোনো দেহধারী মানুষের জন্য নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন কোনো প্রত্যাদেশ ছাড়া, পর্দার অন্তরাল ছাড়া, বা আল্লাহর ইচ্ছা প্রকাশ করবে তাঁর অনুমতি নিয়ে এমন কোনো ফেরেশতা প্রেরণ না করে। তিনি তো সর্বোচ্চ জ্ঞানী। (৪২:৫১)। আল্লাহ যেখানে নিজেই নবিকে প্রত্যাদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেখানে নবির ভূলোক থেকে উর্ধ্বলোকে ভ্রমণের কোনো প্রয়োজন ছিল না। যদিও ধরে নেয়া যায় ঐ ভ্রমণের প্রয়োজন ছিল তাহলেও ডানাবিশিষ্ট চতুষ্পদ পশুর পিঠে চড়ে আকাশে উড্ডীয়মান হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? যাকে বলা হয়ে থাকে দূরের মসজিদ সেটা কী স্বর্গে পাড়ি দেবার পথে ছিল কি? আল্লাহ যদি সর্বত্র বিদ্যমান তবে আল্লাহর কী মানুষের প্রার্থনার প্রয়োজন আছে? এবং নবি যখন স্বর্গে পৌছালেন তখন কেন ফটকরক্ষীদের নবির আগমনবার্তা আগে জানানো হয়নি?
সরল বিশ্বাসী মানুষ কার্যকারণ বিষয়ে বাস্তববাদী নন। তারা মনে করেন নবি বহু দূরের ভ্রমণে যাবেন, এজন্য তাঁর এক বাহন দরকার। এক ডানাবাহী পশু এই কাজে সক্ষম হবে, যা পায়রার মতো উড়ে যেতে পারবে, তাই তারা ধারণা করতেন। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন তাঁর রাজকীয় দ্যুতি দিয়ে নবির চোখ ধাঁধিয়ে দিবেন। তাই স্রষ্টা জিব্রাইলকে আদেশ দিলেন নবিকে স্বর্গের বিস্ময় দেখাতে এবং জিব্রাইলের ডানার সংখ্যা ৬০০ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বুখারি শরীফের হাদিসে, যা জিব্রাইলকে অতি দ্রুতগামী বলে ধারণা দেয়, ভলিউম ৬, বুক ৬০ নম্বর ৩৮০] । একজন প্রতাপশালী রাজা রাজ্যের খরচ মেটানোর জন্য তাঁর কর্মচারীকে কর আদায়ের আদেশ দেন। রাজার অর্থমন্ত্রী রাজাকে সাবধান করে দেন যেন উন্নয়নের জন্যে প্রজাদের উপর অধিক কর চাপানো না হয়। এমনিভাবে আমাদের স্রষ্টা বান্দাদের কাছ থেকে তাঁর প্রার্থনা দাবি করেন। তখন নবি আজি করলেন দিন-রাতে পঞ্চাশবার নামাজ আদায় করা অতিরিক্ত হয়ে যাবে।
মুহাম্মদের মহানুভবতা প্রশ্নাতীত। ইতিহাসে যেসব মহামানবের উল্লেখ আমরা পাই তার মধ্যে মুহাম্মদ অতুলনীয়। তাঁর সমসায়িক সমাজ বিবেচনা করলে বোঝা যায় তিনি যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনয়ন করেছেন তা অনন্যসাধারণ। আলেকজান্ডার, সিজার, নেপোলিয়ন, হিটলার, সাইরাস, চেঙ্গিস খান অথবা তৈমুর লং এদের সাথে নবি মুহাম্মদের কোনো তুলনা হয় না। এই নেতাদের পেছনে ছিল সামরিক বাহিনী এবং গণসমর্থন। কিন্তু মুহাম্মদ যা আয়ত্ত করেছেন তা সবই এক বৈরী সমাজের বিরুদ্ধে একা রিক্তহস্তে লড়াই করে।
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা সম্ভবত ভুদিমির ইলিচ লেনিন। মুহাম্মদের সাথে হয়তো লেনিনের তুলনা করা যেতে পারে। বিশ বছর ধরে (১৯০৪-১৯২৪) লেনিন অবিশ্রান্ত কর্মশক্তি, দক্ষতা, প্রতাপ এবং একাগ্রতার সাথে তাঁর অবিচল নীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, নিরলসভাবে লিখে গেছেন এবং বহুদূর থেকে নিজ দেশে বিপ্লবী কার্যক্রম সজীব রেখেছিলেন। রাশিয়ার সমাজ তখন তাঁর প্রতি ছিল অতিশয় বিরূপ। তথাপি সত্যিকারের প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠন না করা পর্যন্ত লেনিন বিশ্রাম নেননি। এটা নিশ্চিত যে সাফল্য অর্জন করতে লেনিনকে অনেক অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। অপরপক্ষে বলা যায় লেনিনের পূর্বেই রাশিয়ায় এক বিপ্লবী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। শতসহস্র বিপ্লবী এবং প্রচুর বিক্ষুব্ধ জনতা লেনিনকে সমর্থন দিতে প্রস্তুত ছিল। মুহাম্মদের সাথে লেনিনের একটি পার্থক্য হচ্ছে যে মুহাম্মদ সারা জীবন কাটিয়েছেন দারিদ্রতায়, অথবা স্বেচ্ছায় অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবে মহাপুরুষদের প্রস্থানের পর তাঁদের ঘিরে ভক্তবৃন্দ দ্বারা অনেক লোককাহিনী রচিত হয়। সময়ের সাথে সাথে তাঁদের দুর্বল দিকগুলিও চাপা পড়ে যায়। শুধু ভালো দিকগুলি প্রচার করা হয়। অনেক চিন্তাবিদ এবং শিল্পীদের নৈতিক জীবন নিখুঁত ছিল বলা যায় না। তা সত্ত্বেও তাঁদের কীর্তি বেঁচে থাকে এবং প্রশংসিত হয়। ইরানের বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী নাসির উদ্দিন তুসি” (১২০১১২৭৪ খ্রিস্টাব্দ) কেমন করে মঙ্গোলীয় শাসক হালাকু খানের মন্ত্রী হলেন তা আমরা জানি না। নাসির উদ্দিন তুসির ব্যক্তিগত জীবনে নীতি-বহির্ভূত কার্য সত্ত্বেও দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও স্থাপত্যবিদ্যার উপর তাঁর প্রচুর রচনার জন্যে পারস্যের একজন ঐতিহাসিক সমানিত ব্যক্তি হয়ে আছেন। আশ্চর্য হবার কিছু নেই একজন বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক নেতার মৃত্যুর পর তাঁকে প্রচুর কাল্পনিক সদগুণ এবং যোগ্যতা দিয়ে আবৃত করা হয়। সমস্যা হচ্ছে এই প্রক্রিয়া পরিমিত বোধের মধ্যে না থেকে বেশিরভাগ সময়ই অমার্জিত, বাণিজ্যিক এবং অযৌক্তিক হয়ে পড়ে।
লক্ষ লক্ষ শিশুর মতো নবি মুহাম্মদেরও জন্ম ছিল স্বাভাবিক। তাঁর জন্মের সাথে কোনো কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নবির এই জন্ম নিয়ে অযথাই অলৌকিক ব্যাখ্যা, উপাখ্যান দাঁড় করানো হয় এবং প্রচুর লোক তা বিশ্বাসও করে। যেমন বলা হয়ে থাকে নবির জন্মের সাথে সাথে ইরাকের প্রাচীন শহর তাসিবনের ধনুকাকৃতির খিলানে ফাটল ধরেছিল এবং পারস্যের ফার্সে রাজ্যে অবস্থিত খাজেরুন অগ্নিমন্দিরের আগুনও নিভে যায়। এ-ধরনের ঘটনা যদি ঘটেও থাকে তবে তার সাথে নবির জন্মের কী সম্পর্ক? আর এগুলি কেমন করে মহান সৃষ্টিকর্তার সতর্কবার্তা হতে পারে?
যুক্তি, পর্যবেক্ষণ এবং গণিত অনুযায়ী যে কোনো ঘটনার পিছনে কারণ থাকে। বিশ্বের সমস্ত ঘটনা তা নৈসর্গিক, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক হোক না কেন, সবকিছুর পিছনে কার্যকারণ অবশ্যই আছে। অনেক সময় এই কারণ প্রতীয়মান হয় দ্রুত। যেমন সূর্যালোক দেয় উষ্ণতা এবং আলো, অনিয়ন্ত্রিত আগুন দগ্ধ করে, পাম্প দিয়ে উত্তোলন না করলে পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। আবার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জানা না গেলে অনেক সময় এই নিয়ম প্রতীয়মান হয় না আমাদের কাছে। যেমন কোনো ব্যাধির উপশম কিংবা আপাত রহস্যময় অন্যকিছু।
মক্কায় এক শিশুর জন্মের সাথে পারস্যের ফার্সের অগ্নিমন্দিরের আগুন নিভে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। তাসিবনের ধনুকাকৃতির খিলানে কোনো ফাটল ধরলে তা হয়তো ভূমিধ্বসের জন্য হতে পারে। পরবর্তীকালে ভক্তবৃন্দ যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা ছাড়াই এই ঘটনাগুলিকে স্রষ্টার সাবধানবাণী হিসেবে প্রচার করতে থাকেন। এই গুজব প্রচারের উদ্দেশ্য হতে পারে যে ইরাকের তাসিবনের অধিবাসীদেরকে এবং বিশেষ করে ইরানের রাজাকে জানিয়ে দেয়া যে, স্রষ্টা তাদের উপর এক মহাদুর্যোগ প্রেরণ করতে যাচ্ছেন। আর ফার্সের অগ্নিমন্দিরের রক্ষকদের এক শিশুর জন্ম সংবাদ জানিয়ে দেয়া যে, এই শিশু তাদের অগ্নিপূজা বন্ধ করে দিবেন। কিন্তু এটা কেমন করে সম্ভব যে, ইরানের রাজা কিংবা জরথুস্ত্রের পুরোহিতরা বহু দূরের মক্কার এক শিশুর জন্মের সাথে তাসিবনের খিলানের ফাটল ও অগ্নিমন্দিরের আগুন নিভে যাওয়ার সাথে সমিলন ঘটাবে? যেখানে নবি মুহামদই তাঁর ধর্মীয় প্রচারণা শুরু করেন জন্মের চল্লিশ বছর পর। মুহামদের বয়স যখন চল্লিশ বছর তখন আল্লাহ তাঁকে নতুন ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত করেন। সর্বজ্ঞানী এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন স্রষ্টা কেন ইসলাম আগমনের চল্লিশ বছর আগেই তাদের জানিয়ে দিবেন? কোরানে রয়েছে আল্লাহ যে মুহাম্মদকে ধর্মপ্রচারক হিসেবে নিয়োগ দিবেন এ-ব্যাপারে মুহাম্মদের কাছে কোনো পূর্বাভাষ ছিল না। প্রাক-ইসলামি আরবের অবস্থা থেকে কোরানের এই দাবির সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহ যদি মুহাম্মদের জন্মের অসাধারণ গুরুত্ব সবাইকে জানাতে চাইতেন তবে কেন তিনি খোদ মক্কাবাসীদেরকেই ইশারা দিলেন না? সর্বশক্তিমান আল্লাহ চাইলে কাবা ঘরের মূর্তিগুলোকে ভেঙে দিতে পারতেন এবং ছাদকে ধ্বসিয়ে দিতে পারতেন নিমিষে। দূরদেশের অগ্নিমন্দিরের আগুন নেভানোর চাইতে কাবার এই ঘটনা হতো কুরাইশদের জন্য এক শক্তিশালী সতর্কবাণী। এছাড়া প্রশ্ন থেকে যায় নবি হবার সাথে সাথে কেন আল্লাহ তাঁর নবিকে দিয়ে কোনো ব্যতিক্রমী কাজ দেখালেন না? এমনটা হলেই কুরাইশরা নবি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে যেতেন, এবং আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষকে তেরো বছর ধরে শক্রতা ও শত উৎপীড়ন সহ্য করতে হতো না। সত্য ধর্ম ইসলামের প্রভাবে কেন পারস্যের জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী বাদশাহ খসরু পারভেজের (৫৭০-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) অন্তর প্রভাবিত হলো না? তাহলে তো তিনি ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে নবির লেখা চিঠি পড়ে রাগে ছুড়ে ফেলে দিতেন না, মুহাম্মদের বার্তাবাহক আব্দুল্লাহ ইবনে হুদহাফা আস-সামিকে অপমান করে তাড়িয়ে দিতেন না; এবং ইরানিরা তাদের সম্রাটের উদাহরণ অনুসরণ করে সবাই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলতেন। ফলে তাদেরকে আর আরব মুসলমানদের সাথে কাদেসিয়া ও নেহাবন্দের ভয়ানক লড়াইয়ে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হতো না?
অনেকদিন পূর্বে আমি ফরাসি দার্শনিক জোসেফ আর্নেস্ট রেনানের (১৮২৩-১৮৯২) লেখা Vie de Jesus (যিশুর জীবনী, ১৮৬৩) বইটি পড়ি। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যিশুর জীবনকাহিনীকে বাস্তবানুগ এবং প্রাণবন্তভাবে প্রকাশ করেছেন। এর কিছুদিন পরে আমি জার্মানির বিশিষ্ট ইতিহাস-গবেষক এমিল লুদভিগের(১৮৮১-১৯৪৮) লেখা ‘The Son of Man: The Story of Jesus ( ১৯২৮) বইটা পড়ি। লুদভিগের মতে যিশুর জীবনকাহিনী নিয়ে অন্য রেফারেন্স বইয়ে যতটুকু বাস্তবসমত বলে মনে হয়েছে ততটুকুই তিনি লিখেছেন। কারণ তাঁর মতে এই বিষয়ে বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক দলিল দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্লভ। আমার এই ক্ষুদ্র বইয়ে আমি নবি মুহাম্মদের ৬৩ বছরের জীবনের মধ্যে ২৩ বছরের সুদীর্ঘ বিবরণ দিতে পারব না। আমি স্বীকার করে নিতে চাই আর্নেস্ট রেনানের মতো মেধা ও সংবেদনশীলতা আমার নেই। এমন কী আমার নেই এমিল লুদভিগের মতো গবেষণা করার দক্ষতা। যে নবির আধ্যাত্মিক এবং বিশাল নৈতিক শক্তি মানব-ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, তাঁর চরিত্র পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণনার জন্য একজন লেখকের এই ধরনের গুণাবলী অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। আমার এই নাতিদীর্ঘ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে নবির জীবন সম্বন্ধে একটা সীমিত রূপরেখা দেখানো এবং তাঁকে ঘিরে অযথাই যেসব অলীক কাহিনী এবং মিথ প্রচলিত রয়েছে দীর্ঘদিন তার অবসান ঘটানো। এই বই লেখার অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি কোরান অধ্যয়ন করে এবং ইসলামের জন্ম ও বিকাশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে।
আরও সত্যি করে বললে বলতে হয় আমার লেখার তাগিদ এসেছে এক মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া এবং পর্যবেক্ষণ থেকে। আমার পর্যবেক্ষণ এই যে, গোঁড়া, অন্ধবিশ্বাস একজন মানুষের কাণ্ডজ্ঞান বা বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনাকে ভোঁতা করে দিতে পারে। আমরা সবাই জানি শিশুকালে সামাজিকীকরণের সময় আমাদের মনে যেসব ধারণা প্রবিষ্ট করানো হয় তা পরবর্তীতে সবসময় আমাদের চিন্তার পটভূমিতে থাকে। ফলে যেকোনো অযৌক্তিক ভাবনাও যদি আমাদের মনে আসে তবে আমাদের শিশুকালে লব্ধ ভাবধারণার সাথে মিলিয়ে তার বৈধতা দিতে চাই। স্বল্প কিছু বিরল ব্যক্তি ছাড়া অনেক বিদ্বান ব্যক্তিও এই প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। অযৌক্তিকতা অথবা কালপনিক ভাবনাকে বাস্তব বলে গ্রহণের জন্য প্রায়শ তাঁরা সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেন না অথবা করলেও তখনই করেন যখন তা তাঁদের মনে প্রোথিত ধারণার সাথে খাপ খেয়ে যায়। মানবজাতি পর্যবেক্ষণ এবং ন্যায্য বিচারবিবেচনার অধিকারী। মানুষ তার এই জ্ঞানের জন্য নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু যখন ধর্ম ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী সামনে আসে তখন মানুষ তার বিচার-বুদ্ধি, বিশ্লেষণী চিন্তা এবং যৌক্তিকতাকে পদদলিত করে ফেলে।
নবির বাল্যকাল
মুহাম্মদের বাল্যকাল সম্পর্কে তথ্য অত্যন্ত অপ্রতুল। একজন পিতৃমাতৃহীন শিশু হিসাবে তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের গৃহে লালিতপালিত হন। আবু তালিব ছিলেন হৃদয়বান কিন্তু বিষয়সম্পত্তিহীন। জীবিকার তাগিদে মুহাম্মদ তাঁর চাচা এবং প্রতিবেশীদের উট চরানোর কাজ করতেন। তাই মুহাম্মদের দিন কাটতো রুক্ষ মরুভূমিতে একাকী।
মুহাম্মদ ছিলেন স্পর্শকাতর ও বুদ্ধিমান। মুহাম্মদের কয়েক বছরের মরুভূমির অভিজ্ঞতা পারস্যের ভাষায় এক তেতো গাছের ডাল চিবানোর সাথেই তুলনীয়। স্বাভাবিকভাবে তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন কেন এই পৃথিবীতে এসেছেন এক পিতৃহীন শিশু হিসেবে; আর তিনি যখন তাঁর মায়ের কাছে স্নেহ-ভালবাসা চেয়েছিলেন তখনই কেন তাঁর তরুণী মাতা মারা গেলেন। মুহাম্মদ আরও চিন্তা করলেন কেন নিষ্ঠুর ভাগ্য তাঁর প্রভাবশালী ও উদার পিতামহকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং তাঁকে দরিদ্র চাচার গৃহে ফেলে দিল। মুহামদের চাচা আবু তালিব ছিলেন উদার এবং উপকারী। কিন্তু আবু তালিবের ছিল বিশাল পরিবার। তাই মুহাম্মদ তাঁর চাচাতো ভাই-বোনদের মতো স্নেহ-মমতা পাননি। মুহামদের অন্যান্য চাচা যেমন আব্বাস ও আব্দুল ওজা (আবু লাহাব নামে পরবর্তীতে পরিচিত হন) আরাম-আয়েশে বসবাস করলেও তাঁরা মুহাম্মদকে লালন-পালনে উপেক্ষা করলেন। দীর্ঘ দুঃখকষ্টের দিনগুলিতে মুহাম্মদের মনে নিশ্চয় এইসব ঘটনা বাজতে থাকতো।
বৈচিত্র্যহীন, শুষ্ক মরুভূমিতে উটের দল তাদের গ্রীবা ঘষিয়ে চলে একগুচ্ছ তৃণলতা বা এক কঙ্কটপূর্ণ ডালপালার খোঁজে। এহেন পরিবেশে এলোমেলো চিন্তা করা ছাড়া আর কী-ই থাকতে পারে? দুর্ভাগ্য মানুষের মনকে তিক্ততায় ভরে দেয়। যখন কোনো উপায় থাকে না তখন সে দুঃখ-বেদনার প্রতি সচেতন হয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে বাল্যকালের এই পরিবেশ থেকে মুহাম্মদ চিন্তা করতে শুরু করলেন তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁর জীবনের দুঃখ-কষ্টের প্রধান কারণ হচ্ছে তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা। মুহাম্মদের সমবয়সী অন্যান্য বালকের পিতারা কাবা ঘরের পরিচর্যায় নিয়োজিত ছিল। তাদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। তাই ঐ বালকেরা সুখে দিনযাপন করতো। তাদের পিতারা কাবায় যে বাৎসরিক তীর্থযাত্রীরা আগমন করতো তাদেরকে পানি, রুটি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবারহ করতেন। সিরিয়া থেকে নিয়ে আসা পণ্যসামগ্রী তারা অতি উচ্চদামে বিক্রি করতো তীর্থযাত্রীদের কাছে। আর তীর্থযাত্রীদের আনা সামগ্রী তারা অতি নিম্নমূল্যে ক্রয় করতো। এইভাবে অর্জন করতো প্রচুর মুনাফা। এই বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ছিল তাদের ছেলে-মেয়েদের সুখের কারণ।
প্রশ্ন হতে পারে অনেকগুলো গোত্র কেন কাবায় আসতো এবং কুরাইশদের ক্ষমতা ও প্রভাবকে সহ্য করতো? এর উত্তর হচ্ছে কাবা ঘরে তখন ছিল অনেক দেবদেবীর প্রতিমা। আর ছিল একটি কৃষ্ণ পাথর যাকে আরবেরা পবিত্র বলে গণ্য করতেন। তারা মনে করতেন ঐ পাথরের চতুর্দিকে ঘুরে আসলে সুখ এবং মুক্তি পাওয়া যায়। সাফা ও মারওয়া পাহড়ের মাথায় ছিল আরও দুই মূর্তি। তাই তারা এই দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, এমন করলে তাদের প্রার্থনা ফলপ্রসু হবে। প্রত্যেক দলই তাদের মূর্তির কাছে এসে চিৎকার করে অনুনয়-বিনয় করতেন, কাবাকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে এবং সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়দৌড়ি করতেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী মুহাম্মদের বয়স যখন এগারো কি বারো তখনই তিনি চিন্তা করলেন, কৃষ্ণপাথরের কি সত্যিই কোনো গুপ্তশক্তি আছে? আরও চিন্তা করলেন, নিম্প্রাণ মূর্তিগুলো কি কোনো কাজ করতে পারে? তাঁর এই সন্দেহের উৎপত্তি হয় ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা থেকে। এটা হয়তো বলা যাবে না যে, দুঃখ ও আধ্যাতিক সংশয়ে মুহ্যমান মুহামদ কখনো কাবার মূর্তিগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেননি; এবং তাঁর সাহায্য-প্রার্থনা যে, পরবর্তীতে নিস্ফল হয়েছিল তাও বলাবাহুল্য। এই ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায় কোরানের দুটি আয়াত থেকে। এই দুটি আয়াত মুহাম্মদের মুখে শোনা যায় ত্রিশ বছর পরে। প্রথম আয়াতটি হচ্ছে সুরা মুদ্দাসসির এর ৫ নম্বর আয়াত : ‘আর অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। (৭৪:৫)। দ্বিতীয় আয়াতটি উল্লেখ আছে সুরা দোহা’য় ; তিনি কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পাননি, আর তোমাকে আশ্রয় দেননি?”(৯৩:৬)।
কুরাইশ নেতাদের এ-ব্যাপারে অজানা থাকার কথা নয়। তারা কাবার উপাসনালয়ের কাছাকাছি থাকতেন এবং জানতেন পাথরের তৈরি মূর্তিগুলো না-পারে নড়াচড়া করতে, না-পারে কোনো অনুগ্রহ বা কৃপা প্রদর্শন করতে। এ-সম্পর্কে নীরবতা পালন ও লাত, মানাত এবং ওজা দেবীদের পূজো করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের অর্থনৈতিক লাভ। পারস্যের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে একজন ঋষির পুণ্যতা নির্ভর করে তার সমাধির তত্ত্বাবধায়কের উপর। কুরাইশরা ভালো করেই জানতেন যে, তারা যদি কাবার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হারিয়ে ফেলেন তাহলে তাদের বিশাল আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। আর সিরিয়ার সাথে তাদের যে বর্ধিত বাণিজ্য চলছিল তাও কমে যাবে। কারণ কোনো বেদুইন তীর্থযাত্রীরা আর কাবায় আসবে না এবং কুরাইশরাও তাদের পণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন না এবং তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকেও পণ্যসামগ্রী অতি অল্পমূল্যে ক্রয় করতে পারবেন না।
সূর্যস্নাত রুক্ষ মরুভূমিতে একাকী দুঃসহ অবস্থায় মুহাম্মদ দেখেছেন কত কষ্ট করে উটগুলি তাদের সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে। এই অবস্থা জাগিয়ে তোলে মুহাম্মদের কল্পনাবিহারী মনকে। সূর্য ডোবার সাথে মুহাম্মদ যখন উটেরপাল হাঁকিয়ে শহরে নিয়ে আসতেন তখন আবার বাস্তবে ফিরে যেতেন। উটগুলিকে বারেবারে হাঁক দিয়ে তাদেরকে সঠিকভাবে চালিত করতে হতো যাতে তারা হারিয়ে না যায়। এভাবে উটগুলিকে নিশ্চিতভাবে তাদের মালিকদের খোঁয়াড়ে দিয়ে আসতেন রাতের বেলায়। রাতে মুহামদ চিন্তায় মগ্ন থাকতেন এবং তাঁর সামনে ভেসে উঠতো অনেক মানসচিত্র। প্রত্যুষে সূর্যের আলোকের পুনরাবৃত্তি ঘটলে আবার সেই বৈচিত্র্যহীন মরুভূমিতে চলে যেতেন। ধীরে ধীরে এসব বিভিন্নমুখী চিন্তাভাবনা তাঁর মানসকোঠরে দানা বাঁধতে শুরু করল।
একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি ভাবুক এবং স্বপ্নবিলাসী হয়ে থাকে। বাইরের কোনো শোরগোল বা স্বাভাবিক কোনো আনন্দ তাদের বিচলিত করে না, বরং সময়ের সাথে তারা আরও অন্তর্মুখী হয়ে যায়। তাই বলা যায় দীর্ঘদিন ধরে মরুভূমিতে একাকী সময় কাটানোর জন্য মুহাম্মদও একসময় অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন। ফলে আকস্মিকভাবে অনেক সময় তাঁর ভূত দেখার অথবা সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শোনার বিভ্রম হতো।
এভাবেই গতানুগতিক কয়েক বছর চলে গেল। মরুভূমির অভিজ্ঞতা মুহাম্মদের মনে গভীর রেখাপাত করে। এগারো বছর বয়সে মুহাম্মদ তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে বাণিজ্য-ভ্রমণে সিরিয়া গমণ করেন। সিরিয়াতে মুহামদ অন্য এক বিশ্বের সাথে পরিচিত হন। এই বিশ্ব ছিল উজ্জ্বল, অজ্ঞানতাবিহীন এবং কুসংস্কারমুক্ত। মক্কার আরবেরা ছিল অতিশয় রূঢ় এবং অমার্জিত। সিরিয়ার জীবনযাত্রা ভিন্ন।
সিরিয়ার যেখানেই মুহাম্মদ কারো দেখা পেলেন সেই-ই তাঁর সাথে ভদ্রতা রক্ষা করল। সিরিয়ার সমাজে বিরাজমান ছিল খুশির আমেজ এবং তাদের সামাজিক রীতিনীতি ছিল অনেক উঁচুমানের। সিরিয়া-ভ্রমণ মুহাম্মদের অন্তর আলোড়িত করে। এ-অভিজ্ঞতার দ্বারাই হয়তো তিনি উপলদ্ধি করলেন তাঁর নিজের লোকেরা আদিম, অমার্জিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তখন তাঁর মনে ভাবনা আসে তাঁর সমাজও উন্নতির পথে আসুক, সমাজে শৃঙ্খলা থাকুক, কুসংস্কারমুক্ত হোক। মক্কার সমাজ যেন আরও মানবিক হোক। তবে এটা পরিষ্কার নয় যে, এই ভ্রমণে মুহাম্মদ প্রথমবারের মতো কোনো একেশ্বরবাদীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন কি না। তখন মুহাম্মদের এ-বিষয়গুলি বুঝার জন্য খুব অল্পবয়স্ক ছিলেন। তাই এধরনের কোনো সংস্রব হলেও তাতে তাঁর চিন্তাধারায় রেখাপাত হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মুহাম্মদের সংবেদনশীল ও চঞ্চল মনে ছাপ ফেলেছিল। হয়তো এজন্যই মুহাম্মদ দ্বিতীয়বার ভ্রমণে আগ্রহী হন। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় ভ্রমণের সময় মুহামদ অল্পবয়স্ক ছিলেন না। তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে ধর্মের কথা শুনলেন।
মুহাম্মদের বাল্যকাল এবং তরুণ বয়স সম্পর্কে এত অপ্রতুল তথ্যের কী কারণ তা কেউ জানেন না। হয়তো বলা যেতে পারে, এক অনাথ বালক যে তার চাচার গৃহে লালিত-পালিত হয়েছে তার জীবন কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে বাল্যকালে এবং যৌবনে মুহাম্মদ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। কেউ মুহাম্মদের স্মৃতিও মনে রাখেননি। এখানে যা লেখা হচ্ছে তার বেশির ভাগই অনুমানভিত্তিক। বলা হয় যে মরুভূমির একাকীত্ব এবং এক ঘেয়েমিপূর্ণ জীবন বালক-মুহামদকে কল্পনাবিলাসী, অন্তৰীক্ষণিক এবং দর্শনশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে।
কোরানের প্রারম্ভিক আয়াতগুলো পড়লে মনে করা যেতে পারে এই আয়াতগুলো আসছে এক যুবক মুহাম্মদের নিদারুণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট মন থেকে। এই আয়াতগুলিতে প্রকৃতি ও নৈসর্গিক বিষয়ে অনেক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। এখানে সুরা গাশিয়ার কয়েকটি আয়াত উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে ; তবে কি ওরা লক্ষ করে না, উট কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? কীভাবে আকাশ উর্ধ্বে রাখা হয়েছে? পৰ্বতমালাকে কীভাবে শক্ত করে দাঁড় করানো হয়েছে, আর পৃথিবীকে কীভাবে সমান করা হয়েছে? ( ৮৮:১৭-২০)।
কোরানের মক্কি সুরাতে দেখা যায় একজন ভাবুক মানুষের মানসচরিত্র। মনে হবে যেন এই ব্যক্তি নিজেকে সংসারের আকর্ষণ থেকে দূরে রেখে প্রকৃতির আশীৰ্বাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন আর নিজেকে সমর্পণ করেছেন প্রকৃতির কাছে। এই সুরাগুলিতে দাম্ভিক এবং অহঙ্কার ব্যক্তিদের প্রতি রোষ দেখানো হয়েছে। সে-সময়ে এধরনের ব্যক্তিরা হলেন আবু লাহাব’ এবং আবুল আসাদ ১৩।
পরে মুহাম্মদ যখন ধর্ম প্রচারে সফল হলেন এবং সামাজিক সমান ও মর্যাদা বিশাল পরিমাণে বৃদ্ধি পেল, তখন তাঁর অনুগ্রাহীরা নিজস্ব কল্পনা-ভাবনা দিয়ে নবির জীবন নিয়ে অনেক কাহিনী তৈরি করেন। এই অতিমানবীয় কাহিনীগুলো লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে তাবারি এবং ওয়াকেদির লেখনীতেও একসময় স্থান পেয়ে যায়।
আরেকটি বিষয়ে এখানে স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা দরকার। মুসলিম লেখকেরা হয়তো ইচ্ছে করে নবির ধর্মপ্রচারণার পূর্বের সময়ের হেজাজ (মক্কা ও মদিনা শহরকে একত্রে হেজাজ নামে অভিহিত করা হয়), বিশেষ করে মক্কাকে এক অন্ধকার যুগের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তব তেমন ছিল না। অনেক মুসলিম লেখকের তথ্য মতে তৎকালীন মক্কার আরবেরা বর্বরতা এবং পৌত্তলিকতার অন্ধকারে চরমভাবে নিমজ্জিত ছিল। তাদের মাঝে না ছিল কোনো উচ্চ চিন্তাভাবনা, না ছিল কোনো ধর্মের পরিচর্যা। ধারণা করা যায় এই ধরনের অতিরঞ্জিত বর্ণনা দেয়া হয় মূলত নবি মুহাম্মদের উত্থান ও তাঁর শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্য। অবশ্য আধুনিক যুগের একাধিক আরব চিন্তাবিদ যেমন আলি জায়াদ, আবদুল্লাহ সামান, তাহা হোসেন’, মুহাম্মদ হোসেন হায়কল, মুহাম্মদ ইজ্জাত দারওয়াজা, অধ্যাপক হাঁদাদ প্রমুখ মতামত দেন যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর হেজাজে কিছুটা সভ্যতা বিরাজমান ছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মবিশ্বাস ও আস্তিকতাও প্রচলিত ছিল সেখানে যা কোনোমতেই খাটো করে দেখা উচিৎ নয়। এছাড়া এই আধুনিক আরব চিন্তাবিদদের গবেষণা এবং আরও প্রাচীন সূত্র থেকে জানা যায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হেজাজে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
প্রথমদিকে হেজাজে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয় তার বিকাশ ঘটে কিছুটা ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রভাবে। ইহুদিরা ইয়াসরিবে (পরবর্তীতে মুসলমান জয়ের পর এই শহরের নাম হয় মদিনা) খুব প্রভাবশালী ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল। আর খ্রিস্টানরা সিরিয়া থেকে হেজাজে এসে বসতি স্থাপন করে। এছাড়াও হেজাজে ধর্মতান্ত্রিক তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক একটি দল ছিল যারা ‘হানিফ নামে পরিচিত। মক্কায় হানিফেরা পৌত্তলিকতা এবং বহুঈশ্বরবাদের প্রতি প্রার্থনার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল। এ
ওজ্জাকে পূজা করার জন্য তায়েফের এক পাম-বাগানে সমবেত হন। ওজা ছিলেন বানু সাকিফদের প্রধান দেবী। এসময় চারজন ব্যক্তি পূজারী ও ভক্তদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করেন, মক্কার লোকেরা ভুল পথে আছে। তারা আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে। এরপর এই চারজন অন্যান্য পূজারীদের প্রতি চিৎকার করে বলেন, ‘একি হলো, তোমরা অন্য-ধর্ম পালন করছ! একটি পাথর, যা না পারে দেখতে, না পারে শুনতে, আর যা তোমাদের সাহায্যও করে না এবং অনিষ্টও করে না, তোমরা কেন তাকে বৃত্ত করে ঘুরে বেড়াও?’ এই চারজন ব্যক্তি হচ্ছেন ওয়ারাকা বিন নওফল,
ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাস, উসমান বিন আল-হুয়ারিস এবং জায়েদ বিন ওমর। এই ঘটনার পর থেকে এই চারজন নিজেদেরকে হানিফ মতাবলম্বী হিসেবে পরিচিতি প্রদান করেন এবং তাঁরা ইব্রাহিমের ধর্মের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁদের মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তি (জায়েদ বিন ওমর) নিজস্ব রীতিতে প্রার্থনার সময় উচ্চারণ করতেন : ‘এখানে আমি সত্যে আছি, সত্যে আছি উপাসনায় এবং বিনম্রতায়। ইব্রাহিম যেখানে আশ্রিত ছিলেন আমিও সেই আশ্রয়ে। আমি আপনার থেকে উদাসীন ছিলাম। আমার ভাগ্যে যা ঘটবে তা আমারই প্রাপ্য। এরপর জায়েদ নতজানু হতেন এবং মাটিতে তাঁর মাথা ঠেকিয়ে দিতেন।”
সন্দেহ নাই যে, আরবে তখন অজ্ঞানতা এবং কুসংস্কার বিরাজমান ছিল। সংখাগরিষ্ঠ আরবেরা মূর্তিপূজারী ছিলেন। তবু একেশ্বরবাদ তাদের কাছে কোনো অভিনব বিষয় ছিল না। হেজাজ, বিশেষত মদিনা এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চলে যেখানে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা বসবাস করতেন, সেখানে একেশ্বরবাদ অনেক আগে থেকে প্রচলিত ছিল। মুহাম্মদের পূর্বেও অনেকে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। যাদের সম্পর্কে কোরানে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। যেমন আদ সম্প্রদায়ের হুদ নবি, সামুদ সম্প্রদায়ের সালেহ নবি, মিদিয়ান (উত্তর-পশ্চিম আরব-উপসাগরীয় অঞ্চল) সম্প্রদায়ের শুয়েব নবি। আবার আরবইতিহাসে একাধিক ধর্মপ্রচারক ব্যক্তির কথা জানা যায়, যেমন হানজালা বিন সাফওয়ান, খালেদ বিন সিনান, আমির বিন জারিব আল-আদওয়ানি এবং আবদুল্লাহ বিন আল-কোদাই। এছাড়া সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী এবং সুবক্তা কাসা বিন সায়িদা আল-ইয়াদি নামের একজন কবির নাম জানা যায়। ইসলাম-পূর্ব যুগে মক্কার পূর্বে নাখালা উপত্যকার পাশে বাণিজ্য নগরী ‘ওকাজ’- এ বিশাল পরিসরে বার্ষিক মেলা হতো যাকে সারা আরবে ওকাজের মেলা বলতো। এই মেলার সবচেয়ে আকষণীয় দিক ছিল বার্ষিক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান। সারা আরব থেকে খ্যাতিমান কবিরা এসে এখানে নিজস্ব কবিতা আবৃত্তি করতেন। জিলকদ মাসের সাতদিনব্যাপী (ভিন্নমতে বিশদিন) ওকাজে মেলার আয়োজন করা হতো। এই সময় আরববাসীর মধ্যে হত্যা-মারামারিহানাহানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। ওকাজের মেলা সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাদ ছিল এরকম : ওকাজ আজকে যা বলে, সারা আরবে আগামীকাল তার পুনরাবৃত্তি হয়। ওকাজের মেলা ছিল আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায়-গোত্র ও বহু ধর্মের মানুষের সমন্বয়শীল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলন মেলা। মুক্ত আলোচনা, বিতর্ক, জনপ্রিয় কবিদের কাসিদা ( গীতিকবিতা) প্রতিযোগিতা ছিল মেলা বা সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। স্বাভাবিকভাবে এই সাহিত্য সমেলনের ফলাফল সারা আরব জাহানে মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো। এখানে এসে কবিতা পাঠ করা কবিদের কাছে অত্যন্ত সমানের ও জীবনের আরাধ্য একটি বিষয় ছিল। কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে বিজয়ী কবিতাকে পুরস্কারস্বরূপ স্বর্ণীক্ষরে পর্দার কাপড়ে লিখে কাবা ঘরসহ দেব-দেবীর মন্দিরের দেয়ালে টানিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তখন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কায়েসসহ আমর ইবনে কুলসুম, তারাফা, অন্তরা, নাবিঘা, জুহাইর, আশা প্রমুখ শ্রেষ্ঠ কবিদের স্বর্ণীক্ষরে লিখিত মোয়াল্লাকাত বা ঝুলন্ত কবিতায় কাবা ঘরের দেয়াল অলংকৃত হতো।-অনুবাদক)।
ওকাজের কবিতা সম্মেলনে কবি কাসা বিন সায়িদা প্রকাশ্যেই কবিতা এবং ধর্মোপদেশ দ্বারা লোকজনকে মূর্তি পূজা পরিহার করার আহ্বান জানাতেন। তায়েফের সাকিফ গোত্রের ওমায়া বিন আবু-সালাত মুহাম্মদের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি সে-সময়ের বিখ্যাত হানিফ এবং একশ্বরবাদের প্রবক্তা ছিলেন। ওমায়া বিন আবু-সালাত প্রায়ই সিরিয়ায় যেতেন এবং সেখানকার খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও ইহুদি পণ্ডিতদের সাথে সংলাপে বসতেন। একদা সিরিয়াতে অবস্থানকালে তিনি মুহাম্মদের উত্থানের সংবাদ শুনতে পান। অনেকে বলেন ওমায়া এবং মুহাম্মদের মধ্যে সাক্ষাত হয়েছিল। কিন্তু ওমায়া ইসলাম গ্রহণ করেননি, মুসলিম হননি। জানা যায় যে তায়েফ প্রত্যাবর্তনের পর ওমায়া তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন : অন্যান্য ধর্ম এবং প্রথার উপর আমার জ্ঞান মুহাম্মদের চাইতে অনেক বেশি। আমি আরমেনীয় এবং হিব্রুভাষাও জানি। কাজেই নবি হবার দাবি আমার অধিকতর।’ বুখারির মতে, পরবর্তীতে মুহামদ একথা শুনে বলেছিলেন ; ওমায়া বিন আবু-সালাত মুসলমান হবার কাছাকাছি এসেছিলেন।
তৎকালীন তরুণ কবিদের লেখা কবিতায় এক জাতির সচেতনতা এবং সামাজিক রীতিনীতি প্রাণবন্তভাবে প্রকাশিত হয়। প্রাকইসলামি যুগের কিছু আরবি কবিতা আছে। তখনকার একটি কবিতা খুব সম্ভবত কবি জোহাইর’ এর লেখা হতে পারে। এই কবিতা এখানে দেয়া হলো :
তোমার আতুীয় যা আছে তা আল্লাহর কাছে গোপন করবে না,
কেন-না তুমি যেমনভাবেই তা ঢাকার চেষ্ট্র কর না কেন আল্লাহ তা জেনে যাবেন/
হয়তো বা স্থগিত থাকবে, অথবা এক বইতে লিখিত হবে এবং জমা হবে
হিসাবের দিন, অথবা শীঘ্রই তা পরিশোধ করা হবে।’
অথবা আবদুল্লাহ বিন আল-আবরাসের লেখা এই কবিতা :
জনতা চায় তারই উপাসনা করতে
কারণ ঈশ্বর-সন্ধানীরা হতাশ হবে না।
ঈশ্বরের মাধ্যমে সকল আশীৰ্বাদ নাগাল পাওয়া যায়,
যে কিছুর উল্লেখ করলেই বিজয় প্ররোচতে হয়ে যায়।
ঈশ্বরের কোনো অংশীদার নাই
এবং হৃদয়ে যা গোপন আছে তা তিনি অবগত।
শোনা যায় একদা নবি মুহামদ কবি লাবিদের এই কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন :
আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই প্রথা
সমস্ত সাফল্য একদিন অবসান পাবে/
লক্ষণীয় যে লাবিদসহ প্রাক-ইসলামি যুগের কবিরা স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে ‘আল্লাহ বলেই সম্বোধন করতেন। মুহাম্মদের পিতাসহ অনেক পৌত্তলিক কুরাইশদের নাম রাখা হতো আবদুল্লাহ-যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর দাস। মুহাম্মদের অনেক পূর্বকাল থেকে মক্কাবাসীদের কাছে আল্লাহ নামটি পরিচিত ছিল, তারা মনে করতেন তাদের দেবদেবী হচ্ছেন আল্লাহর সান্নিধ্য পাবার মাধ্যম। তাদের এই ধারণা কোরানের সুরা ইউনুসে বর্ণিত হয়েছে : ‘ওরা আল্লাহ ছাড়া যার উপাসনা করে তা তাদের ক্ষতি করে না, উপকারও করে না। ওরা বলে, এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলো, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশ ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি পবিত্র, মহান। আর তারা যাকে শরিক করে তিনি তার উর্ধ্বে।’ ( ১০:১৮)। আমর বিন ফজল নামের আরেকজন প্রাক-ইসলামি যুগের আরব কবি মূর্তিপূজাকে সরাসরি প্রত্যাখান করেছেন। তিনি লিখেছেন:
আমি তো লাত এবং ওজ্জাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছি,
যে কোনো বলিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এই রকমই করবে।
আমি কোনোমতেই ওজা এবং তার দুই কন্যাকে দেখতে যাব না
অথবা বানু ঘনমের দুটি মৃতিকে।
আর আমি তো হুবালকেও বার বার দর্শন দিব না,
ভাগ প্রতিকুল হতে পারে, আমার ধৈর্য সামান্য।
কাজেই মক্কাবাসীর কাছে পৌত্তলিকতা ছেড়ে এক ঈশ্বরের উপাসনা করার আহ্বান নতুন কিছু ছিল না। যেটা অভিনব সেটা হলো এই উপাসনাকে আশু করার জন্য পীড়াপীড়ি করা। মুহাম্মদের অসামান্য কাজ ছিল, তিনি দৃঢ়ভাবেই সমস্ত অপমান, হয়রানি এবং প্রতিরোধের মোকাবেলা করে গেছেন। আরব-উপদ্বীপে ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত মুহাম্মদ ক্ষান্ত হননি; এবং আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একই পতাকাতলে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আরবের বিভিন্ন গোত্রের জীবনযাপন ছিল খুব সেকেলে। তারা ছিলেন অনেকাংশে বস্তুবাদী এবং একমাত্র বাস্তব ও দৃশ্যমান বস্তু নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আধ্যাতিক ব্যাপারে তারা ছিলেন উদাসীন। তাৎক্ষণিক মুনাফার প্রতি তাদের ছিল তীব্র আকর্ষণ। অন্যের বিষয়-সম্পত্তি জব্দ করতে তারা কুষ্ঠাবোধ করতেন না। ক্ষমতা লাভের জন্য তারা যা খুশি তাই করতেন। তাদের এই মানসিকতার পরিচয় পূর্বেই আকনাস বিন শারিকের কাছে আৰু জেহেলের উক্তিতে ফুটে উঠেছে। আবু জেহেলের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ নবুওতির ভান করছিলেন আবদে মনাফ বংশের প্রাধান্যতা প্রতিষ্ঠা করতে। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬০ হিজরি বা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ-৬৪ হিজরি বা ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ) মন্তব্যে একই ধারণার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। মুহাম্মদ যেভাবে তাঁর বিরোধীপক্ষকে বদর যুদ্ধে (২ হিজরি বা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) পরাজিত করেছিলেন ঠিক একইভাবে উমাইয়া বংশের সৈন্যরা বানু হাশেমি গোত্রকে পরাজিত করে এবং কারবালার যুদ্ধে (৬১ হিজরি বা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) হোসেন বিন আলিকে হত্যা করেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই ঘটনার পর ইয়াজিদ এক পঙক্তি কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন :
‘হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে, কিন্তু কোনো শব্দ আসলো না, কোনো দৈববাণীও নামলো না।’
পরিচ্ছেদটি শেষ করার পূর্বে এখানে না বললেই নয় যে, আধুনিক যুগের কোনো কোনো আরব পণ্ডিত প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। যাহোক, প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবে পৌত্তলিকতার উপর মোহমুক্ত হয়ে একাধিক ব্যক্তির হাত ধরে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
নবুওতির সমস্যা
ইদানীং প্রচুর বিদগ্ধজন ইসলামের উত্থান ও প্রসার নিয়ে সবিস্তারে অনুসন্ধান করেছেন। সেই-সাথে কোরানের আয়াতের অর্থ, বিন্যাস, প্রসঙ্গ এবং হাদিসের উদ্ভব নিয়েও হচ্ছে অনেক গবেষণা। পাশ্চাত্য পণ্ডিত যেমন জার্মান বংশোদ্ভূত প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ থিওদর নোলদেক(১৮৩৬-১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ), হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইজহাক গোল্ডজিহার (১৮৫০-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ), অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত অধ্যাপক আলফ্রেড ভন ক্রেমার (১৮২৮-১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ), জার্মান বংশোদ্ভূত আরবি সাহিত্য বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম মেজ (১৮৬৯-১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ), ফরাসি বংশোদ্ভূত প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ এবং কোরানের ফরাসি অনুবাদক রেগিস ব্লাশের (১৯০০-১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ এ-ব্যাপারে তাঁদের গবেষণালব্দ কর্ম দিয়ে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখার মতো তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করেছেন ইসলাম, কোরান, হাদিস, আরব-ইতিহাসসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী। পর্যবেক্ষণ করেছেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। বরং তাঁদের গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য ইসলামি-নথিপত্র।
অবশ্য কোনো কোনো ইউরোপীয় লেখক নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গবেষণার কাজকে স্থিমিত করে ফেলেছেন। তারা মুহামদকে একজন স্রেফ অভিযাত্রিক ও ভণ্ড হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে কোরান হচ্ছে ক্ষমতালাভের একটি হাতিয়ার। অবশ্য কোরানের এই পশ্চিমা-সমালোচকেরা মুসা এবং যিশুকেও যদি সমালোচনা করতেন তবে হয়তো তাদের বক্তব্য কিছুটা বিবেচনাযোগ্য হতো (যদিও বিষয়টি এই বইয়ের আলোচনার বাইরে)। কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মুসা এবং যিশুকে ঈশ্বর স্বয়ং নিয়োজিত করেছিলেন, কিন্তু মুহামদকে নয়। তাঁদের এই বক্তব্যের সমর্থনে যৌক্তিকভাবে স্বীকৃত কোনো প্রমাণ নাই। এরকম ধারণা যারা পোষণ করেন তাঁদেরকে শুরুতেই নৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। নীতিগতভাবে তাঁদেরকে প্রথমেই নবুওতির বিষয়টি মেনে নিতে হবে। কারণ তারা একটি ক্ষেত্রে নবুওতির তত্ত্ব মানবেন, কিন্তু অন্যক্ষেত্রে মানবেন না, এটা যৌক্তিক আচরণ নয়।
আরবের প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদ মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া’ এবং সিরিয়ীয় অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারিং নবুওতির দাবিকে স্বীকার করতেন না। তাঁদের মতে ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নবুওতি বা পয়গম্বরের দাবি অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য। ধর্মবিশ্বাসীরা বলেন স্রষ্টা অনুগ্রহপূর্বক কোনো ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেন মানুষকে বিপথ এবং পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য। যুক্তিবাদীরা বলেন স্রষ্টা যদি সৎকর্ম এবং মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে এতই চিন্তিত থাকেন তবে তিনি সবাইকে নিষ্পাপ এবং উত্তম করেই তৈরি করতেন। মানুষকে ঈশ্বরের মনমতো করে সৃষ্টি করলে কোনো পয়গম্বর বা তাঁর কোনো প্রতিনিধি পাঠানোর দরকার থাকত না। ধর্মবিশ্বাসীরা উত্তর দেন ভাল ও মন্দ ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়। ঈশ্বর নিজে থেকে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হলেও ভাল এবং মন্দ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ-থেকেও স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তুলেন যুক্তিবাদীরা – একজন ব্যক্তি কি ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ভালো বা খারাপ গুণের অধিকারী হতে পারেন?
একজন মানুষ তার বৈশিষ্ট্য লাভ করে পিতা-মাতা থেকে, গর্ভধারণের ক্ষণে। প্রত্যেক নবজাত শিশুই জন্মগ্রহণ করে কিছু শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এই বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে শিশুটির শারীরিক গঠনের উপর। কেউ ইচ্ছে করলেই যেমন পছন্দ করে নিতে পারে না তার চোখের রঙ, নাকের গঠন, হৃৎপিণ্ডের রক্তচাপ, দৈহিক উচ্চতা অথবা চোখের দৃষ্টিশক্তি, তেমনি কেউ ইচ্ছে করে তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা, স্নায়ুশক্তি এবং সহজাত প্রবৃত্তিকে বেছে নিতে পারে না। কেউ কেউ শান্ত এবং পরিমিত মেজাজের, আবার অনেকে উচ্ছঙ্খল, জেদি এবং চরমপন্থী। যারা সন্তোষজনক ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী তারা অন্য কারো স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে না। যারা আগ্রাসী তারা প্রায় হিংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হন।
বলা হয় যে, নবিদের পাঠানো হয় মানুষের চরিত্রের পরিবর্তনের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে একজন ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে কী পুরোপুরি সন্তোষজনক ভারসাম্যের ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করা যেতে পারে? মানবীয় আচরণের যে গুণাবলী বংশগত, সেগুলি কি অন্য ব্যক্তির সদুপদেশ দ্বারা পরিবর্তিত করা সম্ভব? আর তাই যদি সম্ভব হতো তবে মানব-ইতিহাসে ধর্মের আগমনের পরও কেন এতো হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা বিরাজ করেছে এবং বিস্তার লাভ করেছে? ফলে আমরা বলতে বাধ্য হই যে, ঈশ্বর তাঁর প্রেরিত নবিদের দ্বারা মানবজাতির সকল নারী-পুরুষকে ভালো এবং সুখী বানাতে পারেননি। একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে এই বিষয়ে মন্তব্য করা যেতে পারে যে, এর চাইতে সঠিক, সহজ এবং নিরাপদ ব্যবস্থা হতো যদি ঈশ্বর প্রথমেই সকল নারী-পুরুষকে ভালো বানাতেন।
ধর্মবিদদের কাছে এই সমালোচনার উত্তর প্রস্তুত আছে। তারা বলেন পার্থিব জীবন হচ্ছে একটা পরীক্ষা। ভালো ও মন্দ কর্তৃত্বপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। একজন নবি পাঠিয়ে ঈশ্বর চূড়ান্তভাবে ভালো কর্মের লোক, যারা ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে, তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, ভবিষ্যতে তাদের জন্য রয়েছে স্বর্গের পুরস্কার। আর যারা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করবেন ভবিষ্যতে তাদের জন্য রয়েছে নরকের কঠোর শাস্তি।
নবুওতির অস্বীকারকারীরা বলেন ইহজীবন যে একটা পরীক্ষা এই যুক্তি অসার এবং অসমর্থনযোগ্য। যদি স্রষ্টা বা ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তবে তার বান্দাদের মনে যেসব গোপন চিন্তা আছে তা তো ঈশ্বর ঐ ব্যক্তির চাইতেও ভালো করে জানেন বা জানার কথা। তথাপি ঈশ্বর সবকিছু জেনেশুনে কেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নিবেন? তিনি কি আগে থেকেই জানেন না যে কে এই পরীক্ষায় কৃতকার্য হবে আর কে অকৃতকার্য হবে? ঈশ্বরের সবকিছুই কি পরিকল্পিত কিংবা এই মহাবিশ্বে ঈশ্বরের পরিকল্পনার বাইরে বা
কখনো নিজেদের কাজকে পাপ বলে মনে করবে না। ওরা যা করে তা ওদের মেজাজের বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্রের সাথে খাপ খায়। সবার যদি একই ধরনের সহজাত প্রবৃত্তি হতো তাহলে কেউ কেউ ঈশ্বরের আদেশ পালন করেন আর কেউ করেন না এর ব্যাখ্যা করা যায় না। সোজা ভাষায় বলা যায়, সবার মাঝে যদি ভাল মন্দ করার প্রবণতা সমানভাবে থাকতো তাহলে হয় সবাই ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে, নয়তো সবাই ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে না। সাধারণ এই বিবেচনার সাথে মুসলিম চিন্তাবিদদের এটাও মনে রাখা দরকার যে কোরানের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে, মানুষের ভ্রান্তি এবং সাধুতা নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর। যেমন : ‘কাউকে প্রিয় মনে করলেই তুমি তাকে সৎপথে আনতে পারবে না; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন,
আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে। (সুরা কাসাস ; আয়াত ৫৬)। আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। (সুরা সিজদা ; আয়াত ১৩)। . . . আল্লাহ যাকে ইচ্ছা (উত্তম বাণীসংবলিত কিতাব) দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। (সুরা জুমার ; আয়াত ২৩)। কোরানে এই ধরনের আয়াত এত অধিক যে এখানে সব উদ্ধৃত করা অসম্ভব। এই আয়াতগুলো এবং মানবকুলে মৌলিক পরিবর্তনে নবিদের অক্ষমতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধৰ্মজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী নবির প্রয়োজনীয়তার দাবি আসলে অর্থহীন।
ধর্মীয় পণ্ডিতদের অসার বক্তব্যগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়ে। তাঁদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে যে, সৃষ্টিকর্তা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা নবি এবং অবতার পাঠিয়ে থাকেন। এছাড়া ধর্মীয় পণ্ডিতরা মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা দ্বারা সৃষ্টির আগে মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি শূন্য হতে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এই ধরনের দাবি যাচাই-অযোগ্য। আমরা কেমন করে জানতে পারবো যখন ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন, অথচ মহাবিশ্ব, মহাকাশ কোনো কিছুই ছিল না। এটা সত্য যে, আজকের সৌরমণ্ডল ও তারকা, এবং নীহারিকার সর্বদা অবস্থিতি ছিল না। কিন্তু এগুলোর কোনো উপাদান মহাবিশ্বে বর্তমান ছিল না বরং হঠাৎ করে ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে এই মতবাদ যৌক্তিক নয়। ঈশ্বর মহাবিশ্বের সৃষ্টির উপাদানগুলো কোথা হতে কোন উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করলেন? তারচেয়ে বরং পূর্ব থেকেই পরমাণুর অস্তিত্ব ছিল মেনে নেয়া যেতে পারে। পরমাণুর সংমিশ্রণে সূর্যের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু এখনো আমরা পরিষ্কারভাবে জানি না, কেমন করে পরমাণুর সংমিশ্রণ ঘটে এবং বস্তুর উদ্ভব হয়। তবে এই অনুকল্পের প্রমাণ দেখা যায় মহাকাশে অবিরামভাবে তারকাদের উদ্ভবে এবং তাদের মৃত্যুতে।
তাই বলা যেতে পারে যে সৃষ্টির সূচনা পদার্থ থেকে নয় বরং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর। এই পরিস্থিতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানো খুব কঠিন। আবার আমরা যদি ধরে নেই যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টির পূর্বে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল না তাহলে সমস্যা দেখা দিবে। সেই সমস্যা হচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ কী? আমরা চেষ্টা করেও দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। প্রশ্ন দুটি হচ্ছে ; বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আগে থেকে কেন ছিল না? আর ঈশ্বর কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন? প্রশ্নগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই ধর্মবিদদের কাছে। ফলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষেও কোনো যুতসই প্রমাণ দেখানো যাবে না।
এই রকম বিভ্রান্তির মাঝে আমাদের পার্থিব মনে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য জীবের সাথে একই শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে রাজি নই। মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি এবং বহু পূর্ব থেকে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে এই বিশ্বমহাবিশ্বের সবকিছু কেউ না কেউ একজন শুরু করেছেন এবং তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন সকল শুভ এবং অশুভ প্রভাব। এই ধারণা যুক্তি দিয়ে হোক বা গর্ব অনুভবের জন্য অন্য প্রাণি থেকে মানুষকে পৃথক করে দেখার মানসিকতাই হোক, ধর্মগুলির উদ্ভব ঘটিয়েছে। আদিম অথবা প্রগতিশীল, সব সমাজে আমরা দেখি ধর্মের শক্তিশালী প্রভাব বিরাজমান। আদিম সমাজে আছে কুসংস্কার এবং মোহ। আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রভাবে সভ্য এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। চিন্তাবিদরা আবির্ভূত হয়েছেন আইন প্রণয়নকারী, সমাজ সংস্কারক, অথবা দার্শনিকরূপে। যেমন হামুরাবি, কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, সক্রেটিস এবং প্লেটোসহ বিভিন্নজনের নাম উল্লেখ করা যায়। সেমিটিকদের মধ্যে সর্বদা এই ধরনের ব্যক্তিরা আবির্ভূত হয়েছেন নবি বা রসুল হিসেবে। অর্থাৎ তাঁরা স্বঘোষিতভাবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন।
মুসা সিনাই পর্বতে আরোহণ করে নিয়ে আসলেন লিপিফলক, যার ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করলেন ইসরাইলিদের সমাজব্যবস্থা সংস্কারের জন্য। যিশু দেখলেন ইহুদিরা অহংকার এবং মিথ্যা ধর্মানুরাগে নিমজ্জিত। তাই তিনি তাদেরকে উত্তম নৈতিকতা শিক্ষা দিতে উপস্থিত হলেন। তিনি ঈশ্বরকে তাঁর দয়াময় পিতা বলে প্রচার করলেন। তাই যিশু নিজস্ব বক্তব্যকে পিতা-পুত্রের বাণী হিসেবে প্রচার করলেন। অথবা যিশু এ-রকমটি না করে থাকলেও তাঁর ভক্তরা অলৌকিকতার প্রচার চালিয়ে যিশুর মহিমা প্রচার করলেন। ফলে এটা হতে পারে যে, নতুন বাইবেলের চারটি গসপেল যিশুর জন্মবৃত্তান্তকে বিকৃত করেছে অথবা তাঁর সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত গল্প সাজিয়েছে।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুহাম্মদের উত্থান ঘটে আরবের হেজাজে। তিনি সমাজ-সংস্কারের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালেন। কিন্তু তিনি মুসা এবং যিশুর সাথে কীভাবে পার্থক্য সূচনা করলেন? সরলমনা ধর্মবিশ্বাসীরা অলৌকিক ঘটনার ভিত্তিতে নবুওতি বিশ্বাস করেন। এজন্য ইসলামি লেখকেরা শতাধিক অলৌকিক কাহিনী মুহাম্মদের ওপর আরোপ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে হাদাদ নামে একজন খ্রিস্টীয় আরব পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রচুর গবেষণা করে তিনি দ্যা কোরান অ্যান্ড দ্যা বাইবেল”নামে একটি বই রচনা করেছেন। কোরান থেকে প্রচুর উদাহরণ সংগ্রহ করে তিনি দেখিয়েছেন নবি মুহাম্মদ আসলে কোনো অলৌকিক কাজ করেননি। এরপর তিনি অর্বাচীনের মতো দাবি করেন যেহেতু অলৌকিক ঘটনা দিয়ে নবিদের মূল্যায়ন করা হয় তাই যিশু ও মুসার নবুওতি প্রমাণিত। আদতে সমস্ত অলৌকিক ঘটনাই অপ্রতিপাদনযোগ্য কল্পকাহিনী অথবা দৃষ্টিভ্রম। যিশু যদি সত্যি সত্যি কোনো মৃতব্যক্তিকে জীবিত করে ফেলতেন তবে ইহুদিদের মধ্যে একজনও থাকতো না যে যিশুর নবুওতিতে অবিশ্বাস করতো বা যিশুর প্রতি মাথা নত করতে দ্বিমত পোষণ করতো। ঈশ্বর যদি চাইতেন তাঁর প্রেরিত একজন রসুলের প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক এবং তাঁর শিক্ষা থেকে সবাই সুফল গ্রহণ করুক তবে ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক হচ্ছে সবাইকে ভালো এবং বিশ্বাসী বানিয়ে দেয়া। অথবা ঈশ্বর এটাও করতে পারেন যে, ঐ নবিকে মানুষের মনের উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারতেন। এই প্রক্রিয়া একজন মৃতব্যক্তিকে পুনঃজীবিত করার ক্ষমতার চাইতে অনেক সহজতর। তখন সে নবির প্রয়োজন পড়তো না কোনো নদীর প্রবাহ বন্ধ করা বা আগুনকে প্রজ্জ্বলিত হতে বাধা দেয়া ইত্যাদি করতে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে নবুওতির সমস্যাকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করতে হবে। নবিকে দেখতে হবে একজন ব্যক্তি হিসেবে যাঁর রয়েছে অসাধারণ মানসিক এবং আধ্যাতিক প্রতিভা যা সচরাচর একজন সাধারণ ব্যক্তির মধ্যে নেই। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সামরিক নেতাদের মধ্যে আছেন সাইরাস, আলেকজান্ডার, সিজার, নাদির এবং নেপোলিয়ন। যুদ্ধ-পরিকল্পনায় এবং যুদ্ধে জয়ী হবার পদ্ধতিতে তাঁরা ছিলেন অসাধারণ কুশলী। কিন্তু জনসাধারণকে শিক্ষা দেবার মতো তাঁদের কিছুই ছিল না। শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানে আছেন অ্যারিস্টটল, ইবনে সিনা, নাসির উদ্দিন তুসি, টমাস অ্যাডিসন, আইনস্টাইন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, বিটোফেন, হোমার, ফেরদৌস, অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারি, হাফিজ, এবং আরও শতজন। তাঁদের আবিষ্কার, উদ্ভাবন, রচনা, এবং সেরা শিল্পকর্ম বিশ্বসভ্যতাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে। ফলে আধ্যাত্মিক জগতেও এই ধরনের ব্যক্তিত্ব থাকবেন না কেন? কোনো ব্যক্তি যদি গভীর ধ্যান বা চিন্তাশক্তি দ্বারা কোনো অসীম ক্ষমতাধরের ধারণা আবিষ্কার করেন এবং জনতাকে পথ-প্রদর্শনের জন্য সে ধারণা ধীরে ধীরে প্রেরিত বাণী বলে প্রচার করেন তবে তাঁর সেই ধারণা সহজে কোনো যুক্তি দিয়ে নাকচ করা যায় না।
বাল্যকালে মুহামদের মনেও একই ধরনের চিন্তা স্থান পায়। এজন্য সিরিয়া ভ্রমণকালে বাণিজ্যের কাজে ব্যস্ত না থেকে তিনি চট করে খ্রিস্টান সন্ন্যাসী এবং পাদ্রিদের সাথে আলাপে বসেন। ফেরার পথে মিদিয়ান, আদ এবং সামুদ সম্প্রদায়ের অনেক গল্প শোনেন। মক্কাতেও মুহামদ প্রায়ই ধর্মীয় ও আধ্যাতিক নেতা, সন্ন্যাসীদের সাথে আলাপ করতেন। তিনি মারওয়া পাহাড়ের নিকটে জাবর নামে এক ব্যক্তির দোকানে প্রচুর সময় কাটাতেন। সে-সময় খাদিজার চাচাতো ভাই হানিফ মতাবলম্বী ওয়ারাকা বিন নওফল নতুন বাইবেলের অংশবিশেষ আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। মুহাম্মদ ওয়ারাকার সাথেও প্রচুর সময় নিয়ে মতবিনিময় করতেন। এই আলোচনা-অভিজ্ঞতাগুলি মুহাম্মদের মনে দীর্ঘদিনের যে সুপ্ত চিন্তাভাবনা ছিল তা ঘূর্ণির মতো জেগে ওঠে।
জাবরের সাথে মুহাম্মদের ঘনঘন এবং দীর্ঘ আলোচনার কথা কোরানে উল্লেখ আছে। জাবর ছিলেন ভিনদেশি। তাই কুরাইশরা বলতেন, মুহাম্মদ কোরানের আয়াত পেয়েছেন এক বিদেশির কাছে। কোরানের সুরা নাহলে এ-বিষয়ে বলা হয়েছে : ‘আমি অবশ্যই জানি যে ওরা বলে, তাকে (মুহাম্মদকে) শিক্ষা দেয় এক মানুষ। ওরা যার প্রতি ইঙ্গিত করে তার ভাষা তো আরবি নয়, কিন্তু এ কোরান তো পরিষ্কার আরবি ভাষা।’ ( ১৬:১০৩)। মুহাম্মদের জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করার আগে অনেক ধর্মবিদ, সন্ন্যাসী-ঋষি এবং জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে ভাবের আদান-প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছেন : হুয়ারিব গোত্রের সন্ন্যাসী আয়েশ, পারস্যের সালমান আল-ফার্সি এবং আবিসিনিয়ার (বর্তমান নাম ইথিওপিয়া) অধিবাসী বেলাল। এছাড়া আবু বকরও অনেক সময় মুহাম্মদের সাথে আলোচনা করে ধর্মীয় বিষয়ে একমত হন।
মুহাম্মদের জীবনী, হাদিস এবং কোরানের বেশকিছু আয়াতের ভিত্তিতে যে-কোনো অনুসন্ধানী ব্যক্তি প্রকৃত ঘটনা বের করে নিতে পারবেন। এই আলামতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় মুহাম্মদের ভাবুক মনের দুর্নিবার যাতনার ফলস্বরূপ তিনি এক অশরীর আত্মা বা দেবদূতের সাক্ষাৎ পান। কোরানের সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতে রয়েছে :
আরক্তি করে তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিও থেকে।
আবৃত্তি করো, তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত নাr( ৯৬১-৫) /
মুহাম্মদের নবুওতি প্রাপ্তির প্রথম সূরা। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। উচ্চতায় তিনি মাঝারি, শ্বেত বর্ণের ত্বক অনেক সময় লালাভ হয়ে যেত, কৃষ্ণকায় চুল ও চোখ। মুহাম্মদ কদাচিত কৌতুক করতেন বা হাসতেন। কখনো হাসলেও হাত দিয়ে হাসি চেপে রাখতেন। তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে স্বাচ্ছন্দে হাটতেন এবং হাঁটার সময় এদিক-ওদিক তাকাতেন না। কিছু লোকভাষ্য থেকে জানা যায় মুহাম্মদ কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কখনো কুরাইশ যুবকদের সাথে আমোদ-ফুর্তি বা লঘু কথাবার্তায় যোগদান করেননি। তিনি যৌবনে সততার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, এমন-কী তাঁর শত্রুপক্ষ থেকেও। খাদিজাকে বিয়ের পর মুহাম্মদের আর্থিক চিন্তা দূরীভূত হয়। তখন তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক সময় ব্যয় করতেন। বেশিরভাগ হানিফ মতাদশীর মতো তিনিও নবি ইব্রাহিমকে নিখুঁতভাবে ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত মনে করতেন। আর এটা বলার অবকাশ থাকে না যে, তিনি তাঁর বংশের লোকদের পৌত্তলিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন।
আধুনিক যুগের আরবের খ্যাতিমান পণ্ডিত তাহা হোসেনের মতে তখন বেশিরভাগ কুরাইশ নেতাও কাবার মূর্তিগুলোর উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সম্মান দেখানোর বাহানা করতেন, কেননা বেদুইনদের মাঝে তখনও পৌত্তলিকতা শক্তভাবে বিদ্যমান ছিল। বেদুইনদের এই ধর্মীয় বিশ্বাস আর প্রথা পালন মক্কার কুরাইশদের জন্য নিয়ে আসতো আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা।
শব্দচয়নে মুহামদ ছিলেন সবসময় সুচিন্তিত এবং হুশিয়ার। একটি লোকভাষ্য অনুযায়ী মুহাম্মদ একসময় একজন কুমারী তরুণীর মতো লাজুক ছিলেন। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিল সুন্দর এবং তিনি কথা বলার সময় সর্বদা অর্থহীন পুনরাবৃত্তি এবং দীর্ঘ বক্তৃতা থেকে বিরত থাকতেন। তাঁর মাথার কেশ ছিল লম্বা এবং তা কানদ্বয়কে ঢেকে রাখত। মাথায় সচরাচর তিনি সাদা পাগড়ি পরতেন। মাথা এবং দাড়িতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন নিয়মিত। তিনি ছিলেন বিনয়ী এবং দয়ালু। করমর্দন করলে কখনোই তিনি নিজের হাত আগে ছাড়িয়ে নিতেন না। নিজেই নিজের পোশাক এবং জুতা মেরামত করতেন। তাঁর অধঃস্থ ব্যক্তিদের সাথে তিনি মেলামেশা করতে পারতেন অনায়াসে। একবার তিনি এক ক্রীতদাসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ক্রীতদাসের সাথে মাটিতে বসে খেজুর আহার করেন। ধর্মপ্রচারের সময় তিনি অনেকবার কণ্ঠ জোরালো করতেন বিশেষ করে যখন কোনো কাজের নিন্দা করতেন। এই সময় তাঁর চোখ দুটি এবং মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে যেত।
মুহাম্মদের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর প্রচণ্ড সাহস। একবার এক যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি একটি ধনুকে হেলান দিয়ে মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। যুদ্ধের সময় যখন মুসলমান যোদ্ধারা ভীত থাকতেন তখন মুহাম্মদ সমুখে হেঁটে শক্রর একেবারে কাছাকাছি চলে যেতেন, যা অন্য কেউ করতে পারতেন না। মুহাম্মদ মাত্র একজন ব্যক্তিকে স্বহস্তে হত্যা করেছিলেন। তাও হয়েছিল যখন সেই ব্যক্তি অসিযুদ্ধে মুহামদকে মারাত্মক আঘাত হানে। নবি মুহাম্মদের প্রচারিত কিছু বাণী হচ্ছে :
১. ‘কেউ যদি এক ব্যক্তিকে মন্দ জেনেও তার সাথে মেলামেশা করে এবং সে জানে যে ঐ ব্যক্তি মন্দ, তবে সে মুসলমান নয়।”
২. ‘পাশের ব্যক্তিটি ক্ষুধার্ত জেনেও যে ব্যক্তি একাকী আহার করেন তিনি মুসলমান নন।’
৩. ‘উত্তম নীতিমালা হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক।’
8. ‘সবচেয়ে উত্তম জিহাদ হচ্ছে একজন অনৈতিক ব্যক্তিকে সত্য জানিয়ে দেয়া।’
৫. ‘যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করেন সেই-ই অধিক শক্তিশালী।’

মুহাম্মদের নবি হয়ে ওঠা
মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত হেরা পর্বত। শুষ্ক এক শিলাময় স্থান। এই পর্বতের ঢাল বেয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু পর্বতের গুহার ভেতর তৎকালীন অনেক হানিফ নিয়মিত যেতেন নির্জন আশ্রয় ও একাকী ধ্যান করার জন্য। মুহাম্মদও বেশ কিছু দিনের জন্য তাই করছিলেন। বাস্তব জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়ে একাকী কিছু সময় অতিবাহিত করার স্পৃহা মুহামদকে অনেক বার এই স্থানে নিয়ে আসতো। কখনো কখনো মুহামদ সাথে করে আহার সামগ্ৰী নিয়ে যেতেন এবং গুহা থেকে বের হতেন না আহার ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। কখনো কখনো আবার খুব ভোরে তিনি চলে যেতেন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসতেন।
৬১০ খ্রিস্টাব্দে একদিন মুহাম্মদ ঘরে ফিরলেন না। কথা ছিল সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘরে আসবেন। উৎকণ্ঠিত খাদিজা লোক পাঠালেন মুহাম্মদের খোঁজে। অবশ্য অল্পসময় পরে মুহাম্মদ দুয়ারে উপস্থিত হয়ে গেলেন। তাঁকে বিবর্ণ দেখাচ্ছিল এবং শরীর কপিছিল। তিনি বললেন ; আমাকে আবৃত করো তখন তাঁকে চাদর দিয়ে আবৃত করা হলো। কিছু সময় পর যখন মুহাম্মদ স্বাভাবিক হলেন এবং সংবিৎ ফিরে আসলে তিনি খাদিজাকে ঘটনা বর্ণনা করেন।
নির্ভরযোগ্য হাদিস সংগ্রাহক বুখারি, মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ, আবু দাউদ আল তায়ালিসি, ইবনে আব্দুল আল-বার, নুয়ারি এবং ইবনে সাইয়েদ আন-নাস প্রণীত হাদিস গ্রন্থে এবং বিখ্যাত ধর্মবিশারদ ইমাম আহমদ বিন হানবলের (১৬৪ হিজরি বা ৭৮০ খ্রিস্টাব্দ-২৪১ হিজরি/৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) মুসনাদে বর্ণিত : হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ-এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি হেরা-গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, এভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন।
তারপর খাদিজা (রা)-র কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্ৰী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে হেরা-গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহি এলো। তাঁর কাছে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পড়ুন। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন ; আমি বললাম, আমি পড়ি না”। [বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বুখারী শরীফ, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩, পৃ. ৫ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।-অনুবাদক]
হাদিস অনুযায়ী মুহাম্মদ তাঁর অভিজ্ঞতা খাদিজাকে জানালেন এভাবে ; তারপর তিনি (ফেরেশতা) আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন। আমি বললাম আমি তো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন : পড়ুন। আমি জবাব দিলাম, আমি তো পড়ি না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন, আর আপনার রব মহামহিমাম্বিত। (৯৬:১-৩)। এরপর ফেরেশতা উধাও হয়ে গেলেন। আমি সজাগ হলাম এবং ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। হাদিসের অনুবাদটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বুখারী শরীফ থেকে সংগৃহীতঅনুবাদক)। পরে মুহাম্মদ খাদিজাকে জানালেন যে তিনি তাঁর জীবনের জন্য ভীত ছিলেন। এ-সবের কী ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে? কেন তিনি এত ভীত হলেন? মুহাম্মদ কী ভেবেছিলেন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন, কোনো জাদুর প্রভাবে পড়েছেন, অথবা কোনো নিরাময়-অযোগ্য রোগ তাঁকে কাবু করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কিছুটা পাই খাদিজা যখন মুহাম্মদকে সান্তুনা দিয়ে উত্তর দিলেন: আপনি একজন অতিশয় সৎ ব্যক্তি। আপনি দরিদ্রদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, আপনি অতিথি-বৎসল, আপনি আপনার পরিবারের প্রতি এত স্নেহশীল, পীড়িতদের প্রতি আপনি অত্যন্ত উপকারী। তাই বিধাতা কখনোই আপনাকে তাঁর যত্ন থেকে বঞ্চিত করবেন না।”
খাদিজার সাথে কথোপকথনের পর মুহাম্মদ স্বাভাবিক হলেন। তখন খাদিজা তাড়াতাড়ি গৃহ থেকে বের হলেন এ ঘটনা তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফলকে জানানোর জন্য। হানিফ মতাবলম্বী ওয়ারাক মক্কাবাসীর পৌত্তলিকতাকে ঘৃণা করতেন। তাই ওয়ারাকা একদা মুহামদকে উপদেশ দিয়েছিলেন কুরাইশদের এড়িয়ে চলতে। তিনি মুহামদকে ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক কর্মে অনুরক্ত হতেও উপদেশ দিয়েছিলেন। খাদিজার মুখে ঘটনাবলী শুনে ওয়ারাকা বললেন: “খুব সম্ভবত এই ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে আল্লাহ তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক করছেন এবং মানবতাকে পথ দেখানোর জন্য তাঁকে নির্দিষ্ট করেছেন।”
আয়েশার এই বক্তব্য থেকে অতিপ্রাকৃত কিছুই পাওয়া যায় না। তাঁর সকল বর্ণনা মনোবিজ্ঞানের সাধারণ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা থাকলে কল্পনার জগতে মানুষ তার বাস্তবায়ন ঘটায় নানাকিছু ভাবনা-চিন্তা করে, নানা কাহিনীর জাল বুনে। কল্পনার জগতে বিরাজ করতে করতে মানুষ অনেক সময় কল্পনার জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে তফাৎ করতে পারে না। তার মধ্যে ভ্রম সৃষ্টি হতে পারে। তার মনে হয় দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা যেন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। মুহাম্মদ ত্রিশ বছর ধরে চিন্তা-ভাবনায় মশগুল ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ন্যাসী-ঋষির সাথে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। একেশ্বরবাদের প্রতি গভীরভাবে একনিষ্ঠ হয়েছেন। এরপর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানরত হন এবং সেখানে অনেক কঠোর তাপসদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের পৌত্তলিকতা বিরোধিতা এবং একেশ্বরবাদের ভাষ্য তাঁকে আলোড়িত করে। সব মিলিয়ে স্রষ্টা-সৃষ্টি-ধর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নে মুহাম্মদের মন প্রচণ্ড উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাই একসময় হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে ধ্যান করতে করতে তাঁর ধারণা হলো, কোনো অশরীরী আত্মা তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছে। অথবা এটা এমনও হতে পারে যে, ধ্যানরত অবস্থায় তাঁর অবচেতন মন থেকে সাড়া আসলো এখন সময় এসেছে সক্রিয় হবার। সক্রিয় হবার ভীতি তাঁর মনে এতোই প্রভাব বিস্তার করল যে, তিনি প্রণত হলেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পূর্বে দেবদূত (ফেরেশতা) তাঁকে কাবু করে ফেলার ঘটনার আর কোনো বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবসমত ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। এখানে দেবদূতের আবির্ভাব তাঁর মনে দীর্ঘ লালিত সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন মনে করা যেতে পারে।
এই বিশ্লেষণ পুরোটা অনুমানিক হলেও এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্য এক ভাষ্য থেকে। এই ভাষ্য অনুযায়ী মুহাম্মদ একবার খাদিজাকে বলেছিলেন : ‘আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন তিনি (ফেরেশতা) একটা সুদৃশ্য কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা বই নিয়ে আসলেন। ফেরেশতা বললেন, ‘পড়ুন! আমি জেগে উঠলাম এবং মনে হলো যেন আমার হৃদপিণ্ডে একটা বই স্থাপিত হয়েছে। এই ভাষ্য থেকে মনে করা যায়, প্রগাঢ় ধ্যানের শ্রান্তি মুহামদকে ক্রমেই মোহগ্ৰস্ত করে ফেলে। তিনি ঘুমের সময়ও তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পান স্বপ্নে। এই স্বপ্নদর্শন তাঁর চেতনার জগতকে সন্ত্রস্ত করে দেয়। হজরত আয়েশার আরেকটি বর্ণনা আছে : ‘আল্লাহর নবির তখন শরীর কাঁপছিল। তিনি খাদিজাকে বললেন, “আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও!”খাদিজা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর কাঁপুনি দূর হলো। [ আয়েশা বর্ণিত হাদিসটির বাংলা অনুবাদের সূত্র উপরে উল্লিখিতঅনুবাদক)। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মুহাম্মদের শরীরে কাঁপুনি সৃষ্ট হয়েছিল তার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে। ধারণা করা যায়, এই ধরনের অবস্থা হয় সেই ব্যক্তির, যে দ্বৈত জীবনযাপন করে-একদিকে সাধারণ জীবন, অন্যদিকে স্বপ্নময় অলীক অভ্যন্তর জীবন। এই দুই জীবনের মধ্যেকার তফাৎ তৈরি করতে অক্ষম সেই ব্যক্তি। এই ঘটনার পর মুহাম্মদ আরও দুইবার হেরা পর্বতের ঐ নির্জন গুহায় যান। কিন্তু এবার আর কোনো কিছু দেখলেন না; কোনো ফেরেশতা আসলেন না, বা কারো কণ্ঠস্বরও শুনতে পেলেন না। মুহামদকে লেখাপড়া না-জানা একজন মানুষ হিসাবে চিত্রিত করা হয়। তাহলে কেন মহান আল্লাহ তাকে ইকুরা অর্থাৎ “পড় এই আদেশ দিয়ে সুরা নাজিল করবেন?]
মুহাম্মদের এই পুরো অভিজ্ঞতাটি স্বপ্ন বা অলীক বিশ্বাস ছাড়া কি বেশি কিছু ছিল? এটা কী নবুওতি প্রদানের কোনো আলামত ছিল কিংবা ওয়ারাকা বিন নওফলের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ছিল? এরপর থেকে ক্ষয়িষ্ণু সন্দেহে মুহামদের মন জর্জরিত হতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, কয়েকবার তিনি উচু পাহাড়ের উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু খাদিজা ও ওয়ারাকা সর্বদা মুহামদকে শান্ত করতেন এবং আশার বাণী শোনাতেন।
ইসলামের ঐতিহাসিক ভাষ্যমতে মুহাম্মদের কাছে প্রত্যাদেশ বন্ধ থাকার সময়কাল বিভিন্ন রকম। অনেকের মতে এই ফাঁকা সময় ছিল তিনদিন, কেউ বলেন তিন মাস, আবার কারো কারো মতে তিন বছর। আবার কেউ কেউ বলেন এই অবস্থা বিরাজমান থাকে যতক্ষণ না সুরা মুদ্দাসসির নাজিল হয়। এরপরে আবার প্রত্যাদেশ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
কী কারণে প্রত্যাদেশ আসা বিঘ্নিত হয় তা বোঝা কঠিন নয়। প্রথমবার স্বপ্নবিভোর হয়ে দেবদূত দেখার পর মুহাম্মদের মনে যে দীর্ঘদিনের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা ছিল তা প্রশমিত হয়ে যায়। ঐ দৈবদর্শনে সুদীর্ঘ সময় ধরে লালিত মনের গভীরে সঞ্চিত প্রশ্নসমূহের উত্তরের আগ্রহমিটে যায়। স্বভাবিকভাবেই এরপর আসে সন্দেহ এবং নৈরাশ্য। মনের ভেতর গচ্ছিত আকাঙ্ক্ষাকে পুনর্বার প্রজ্জ্বলিত করার জন্য প্রয়োজন আরও একনিষ্ঠ ধ্যান এবং গভীর একাগ্রতা; যা মস্তিষ্ককে আলোড়িত করবে, এবং একসময় আবারও বাস্তব ও কল্পনাএই দুই জগতের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে। ফলে অন্তর্মুখী মুহাম্মদের মানস সরোবরে যা লুকিয়ে আছে তা আবার ভেসে উঠবে এবং তাঁকে তাড়িত করবে।
উপরে হজরত আয়েশার দেয়া বিবরণ আমরা পড়েছি। মুহাম্মদের মৃত্যুর এক শতাব্দী পূরণের আগেই একেবারে ভিন্ন বক্তব্য আসতে থাকে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর জীবন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী সত্য বক্তব্যের ভেতরে ঢুকে পড়ে। যতই দিন যেতে থাকে ততই কাল্পনিক ও অলৌকিক ঘটনার সমারোহ বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে ইবনে ইসহাকের লেখা নবির জীবনী যা ইবনে হিশামের পাণ্ডুলিপিতে এখনো পাওয়া যায়, তার কিছু কিছু উল্লেখ রয়েছে। ইবনে ইসহাক হিজরি ১৫০ (৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারা যান এবং মৃত্যুর কিছু আগে তাঁর লেখা শেষ করেন। এখানে তাঁর বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হলো: নবি হবার আগে যখন মুহাম্মদ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মক্কার বসতবাড়ির বাইরে যেতেন এবং যখন বসতবাড়ি একটি বাঁকের পেছনে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেত, তখন প্রত্যেক পাথরের শীলাখণ্ড যার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন, এরা বলে উঠতো ; হে আল্লাহর প্রতিনিধি! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক! কিন্তু এদিক-সেদিক তাকালে মুহাম্মদ কাউকে দেখতে পেতেন না। তাঁর চারিদিকে শুধু দেখতেন গাছপালা এবং পাথরখণ্ড।’
একখণ্ড পাথর নিম্প্রাণ বস্তু। আর গাছগাছালির শব্দ সৃষ্টির জন্য কণ্ঠনালী নেই, যা দ্বারা তারা তাদের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। যুক্তির বিচারে এই গল্প এতোই অনুপযুক্ত যে, পরবর্তীতে নবির অনেক জীবনীকারক এই গল্প সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেতে পারেননি। তাঁরা বলেন, যে কণ্ঠস্বর শোনা যেত তা হবে ফেরেশতার কণ্ঠস্বর। নবির জীবনীকারকদের ভাবনায় এই বিষয়টি আসেনি যে, মুহাম্মদ যদি এরকম ডাক কখনো শুনেও থাকেন সেটা হতে পারে নিজেরই অন্তরের ডাক। গায়েবি কিছু নয়। অনেক বছরের একাগ্র ধ্যান ও একই চিন্তায় নিমগ্নতার ফলে সে চিন্তাভাবনা বাস্তব মনে হতে পারে এবং তা অনেক সময়
যাহোক, ধর্মবিশারদের উদ্বিগ্ন হলেও ইবনে হিশামের বক্তব্য নিয়ে বিরোধিতা করতে চান না। তাই তাঁরা এই রহস্যপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে কোনো দেবদূত বা ফেরেশতার কণ্ঠস্বর বলে চালিয়ে দিতে চান। কিন্তু এর ফলে কী অনুসিদ্ধান্ত দাঁড়ায় তা বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ। ফেরেশতা যদি মুহামদকে সত্যিই সম্ভাষণ করতেন, নিশ্চয়ই তাঁরা তা করতেন প্রকাশ্যে, সবার সামনে। আড়ালে বা লুকিয়ে সম্ভাষণ করার কোনো প্রয়োজনীয় দিক বা উপযোগিতা নেই। প্রকাশ্যে করলে মক্কাবাসী সকলে একবাক্যে মুহাম্মদের কথায় বিশ্বাস করতেন, এবং আল্লাহর যে আসল অভিপ্রায় ছিল সমস্ত আরবজাতিকে ইসলামে দীক্ষিত করার, তাও পূর্ণ হয়ে যেত তাড়াতাড়ি কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই। এসব ধর্মবিশারদদের নজরে আসেনি যে তথাকথিত গায়েবি আওয়াজ নবির নিজস্ব কাল্পনিক ভাবনা থেকে উৎপন্ন হতে পারে। অথবা অন্য বিষয়েও কিছু চিন্তা করা যেত। নবি শহরের বাইরে শুধুমাত্র একা গেলেই যদি সেই কণ্ঠস্বর শুনতেন তবে অন্যরা কিভাবে তা জানতে পারলেন? নবি কোনোদিন এই বিষয়ে কিছু বলেননি। এমন-কী কোনো প্রামাণিক হাদিসেও এই ঘটনার বিবরণ নেই। সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবে এক কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে ইবনে ইসহাক যে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছেন তাও বলা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই কারো কাছ থেকে এই বক্তব্য শুনেছেন এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা গ্রহণ করেছেন। কেননা এই বক্তব্য তাঁর নিজের অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাসের সাথে খাপ খায়। সম্ভবত ইবনে ইসহাক নিজেকে বা সংবাদদাতাকে জিজ্ঞাসা করেননি যে, অন্য কেউ কী শুনেছে পাথরের টুকরো অথবা গাছপালা নবিকে সম্ভাষণ জানিয়েছে। তাছাড়া নবি নিজে এই ঘটনা ব্যক্ত করেছেন এই ধরনের কোনো আলামত সংবাদদাতার কাছে ছিল কী না। আল্লাহ যে মুহাম্মদকে নিজের মনোনীত দূত বানিয়েছেন তার একমাত্র দাবি হচ্ছে মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশার বিবৃতি, যা আগেই আমরা দেখেছি।
বেশিরভাগ মানুষই তার অর্জিত বিশ্বাসের মধ্যে বন্দী এবং শারীরিক ও সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। আর এতে মানুষের যৌক্তিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। পরিষ্কারভাবে চিন্তা-বিশ্লেষণ তারা করতে পারে না। তখন তারা আসল ঘটনাকে উপেক্ষা করে যা তাদের বিশ্বাসের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। তারা যা কিছুর মধ্যে তাদের ধারণা ও বিশ্বাসের আলামত পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে। মানুষের এই আচরণ ও মানসিকতাই হচ্ছে কুসংস্কার এবং বিভ্রম বিস্তারের কারণ।

নবুওতি অর্জনের পর

মুহাম্মদের বয়স যখন চল্লিশ, তখন এক প্রত্যাদেশ দ্বারা আল্লাহ মুহামদকে প্রেরিত পুরুষ হিসেবে নিয়োজিত করেন। প্রত্যাদেশের এই বাণী সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতে বর্ণিত আছে। কিন্তু ইসলামের প্রচার কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, কারণ ওহি নাজিল হওয়াতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিঘ্ন ঘটেছে একাধিকবার। প্রথম দিকে ইসলামের প্রচার হয়েছে গোপনে এবং সামান্য কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুরা আলাকের পরে আরও সাতটি কিংবা দশটি সুরা প্রকাশ পায়। এ-থেকে প্রতীয়মান হয় যে শুরুতে ইসলামের প্রচার মক্কাবাসীর কাছে উপহাস্যবলে পরিগণিত হয় এবং প্রত্যাখাত হয়। মুহামদ তখন বিমর্ষ হয়ে যান, তার মধ্যে দ্বিধাবোধ তৈরি হয়। ইসলামের জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, কোরান সম্পাদিত হয়েছে অগোছালোভাবে। কোরানের বিষয়বস্তুকে নিতান্ত এলোমেলোভাবে সাজানো হয়েছে। যারা কোরান অধ্যয়ন করবেন তারা বিসিত হবেন যে, কোরানের সংকলকেরা কেন সুরা বা আয়াতের আগমনের ধারা অনুযায়ী কোরানের সুরা ও আয়াতগুলোকে বিন্যস্ত করেননি। মুহাম্মদের চাচাতো ভাই হজরত আলি বিন আবু তালিব সময়ের ক্রমানুযায়ী একটি কোরান সংকলন করেছিলেন; যদিও তা পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। সময়কাল অনুযায়ী কোরান সংকলন হলে কোরানের বিষয়বস্তু অনেক অর্থবহ ও বাস্তবসম্মত হত, এবং এর ফলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ইসলামের উত্থান এবং এর প্রতিষ্ঠাতার অনুপ্রেরণা ও চিন্তাভাবনার সাথে সহজে পরিচিত হতে পারতো।
কোরান সংকলনের প্রথম পদক্ষেপ নেন হজরত ওমর। আবু বকর খলিফা হবার পর ওমর তাঁর সাথে দেখা করে কোরান সংকলনের পক্ষে যুক্তি দেখান। হজরত ওমর বলেন, নবির মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই কোরানের বিষয়বস্তু ও শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে মুসলমিদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোরানের বাণী যেসব সাহাবি মুখস্ত রাখতেন তাদের কেউ কেউ ইয়ামামার যুদ্ধে মারা গেছেন। এছাড়া তাল গাছের পাতায় লিখিত কোরানের বাণী খেয়ে ফেলেছে পশুরা। ওমরের বক্তব্যে হজরত আবু বকর আপত্তি জানালেন। তিনি বললেন : কোরানের সংকলন যদি আবশ্যিকই হতো তাহলে নবি তাঁর জীবিত থাকাকালেই এ-বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেন। এরপরও ওমরের দীর্ঘ অনুরোধের জন্য শেষমেশ মদিনার খাজরাজ গোত্রে জন্মগ্রহণকারী সাহাবি জায়েদ বিন সাবিতকে ডাকা হয়। জায়েদ ছিলেন মুহাম্মদের সর্বশেষ কোরান লেখক। খলিফা আবু বকর জায়েদকে কোরান সংকলনের ভার অর্পণ করেন। আবু বকরের পর ওমর খলিফা হলে কোরান সংকলনের ভার গিয়ে পৌছায় হজরত উসমানের উপর। উসমান তাঁর সহকর্মীদের আদেশ দিলেন কোরানের সুরার দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কোরানের সংকলনের জন্য। এতে করে মক্কার অনেক আয়াত মদিনার সুরাতে এবং মদিনার আয়াত মক্কার অনেক সুরাতে ঢুকে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ও ইউরোপের গবেষক বিশেষ করে থিওদর নোলদেক কোরানের বিষয়বস্তুর অবিচ্ছন্নতা, ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ও ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সুরাগুলির মানে ও মোটামুটি তারিখ অনুযায়ী কোরান বিন্যস্ত করেছেন”। যা-হোক, প্রারম্ভিক মক্কার সুরাগুলিতে ইসলামের প্রথম কয়েক বছরের প্রচুর সংগ্রামের বিবরণ পাওয়া যায়। সুরা দোহার প্রথম দুই আয়াতের পরই আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন :
‘তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্টও নন।
তোমার জন্য পরকাল ইহকালের চেয়ে ভালো।
তোমার প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ করবেনই আর তুমিও সন্তুষ্ট হবে।
তিনি কি তোমাকে ভুল পথে পেয়ে পথের হদিস দেননি?
তিনি কি তোমাকে অভাব দেখে অভাবমুক্ত করেননি? ( সুরা দোহা আয়াত ৩-৮)।
মুহাম্মদের কী হয়েছিল যে আল্লাহ তাঁকে সান্তনা দিবেন এবং উৎসাহিত করবেন? সুরা দোহার তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ বলছেন : ‘তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্টও নন -এই আয়াতটা কী প্রত্যাদেশ প্রেরণের যে বিরতিটুকু চলছিলতা শেষ হবার পর নাজিল হয়েছিল! প্রত্যাদেশ প্রেরণের মধ্যবর্তী বিরতিতে মুহাম্মদ কি বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যেতাঁর রব তাঁকে হয়ত ত্যাগ করেছেন? পরে তিনি নিজেকে যা দিয়ে প্রবোধ দেন সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সুরা দোহা। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এ সুরা নিজের সাথে নিজের কথা বলা মাত্র। যদি কোরান অবতরণের উদ্দেশ্য থাকে মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করা তবে সেক্ষেত্রে এই সুরার কোনো উপযোগিতাই নেই, একই কথা অন্যান্য অনেক সুরা ও আয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য]। তফসির আল-জালালাইনে এভাবেই লেখা হয়েছে। এই ধারণা যদি সঠিক হয় তবে কালানুক্রম অনুযায়ী সুরা দোহা কোরানের দ্বিতীয় সুরা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ধারাবাহিকতার ক্রম হিসেবে ১১তম সুরা ধরা হয় এবং বর্তমান কোরানের সংকলনে এটির অবস্থান ৯৩তম। সুরা দোহা পাঠ করলে বোঝা যায় এই সুরায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মুহামদকে আল্লাহ সান্তনা এবং উৎসাহ দিচ্ছেন। এই ধারণা করা যায় যখন আমরা সুরা দোহার পরবর্তী ৯৪তম সুরা ইনশিরাহ এর প্রথম দুটি আয়াত পাঠ করি। কালানুক্রমিকভাবে ইনশিরাহকে ১২তম বলে ধরা হয়। এই সুরার আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ মুহাম্মদকে বলছেন : ‘আমি কি তোমার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি? আমি হালকা করেছি তোমার ভার (৯৪:১-২)। এই দুই আয়াত ও অন্য আয়াতগুলি এবং এর পূর্বের সুরা দোহার বিষয়বস্তু প্রায় একই। তাই বলা যায়, এই দুই সুরায় আল্লাহ মুহাম্মদের দুশ্চিন্তা লাঘব করে তাঁর দৃঢ়সংকল্পকে শক্তিশালী করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, আসলে এই দুইটি সুরা মুহাম্মদের মনের ভেতরে লুকায়িত ইচ্ছা ও আশার প্রতিফলন মাত্র।
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে মুহামদ গোপনে অল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্যেই তাঁর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন। পরে সুরা শোআরার ২১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নতুন এক আদেশ দিলেন : “তুমি তোমার আতীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও।”(২৬:২১৪)। এই আয়াত প্রাপ্ত হয়ে মুহাম্মদ (৬১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে) কুরাইশ নেতাদের সাফা পর্বতে এক সভায় ডাকলেন। তারা সমবেত হলে মুহাম্মদ তাঁদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আবেদন জানান। নেতাদের মধ্যে থেকে মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাব উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ও ক্রুদ্ধস্বরে বললেন : মুহাম্মদ, তুমি ধ্বংস হও! তুমি কী এ-জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছ? আবু লাহাবের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের জবাব আসলো ১১১তম সুরা লাহাব বা আল-মাসাদের মধ্য দিয়ে। এই সুরার প্রথম আয়াতে আবু লাহাবের উচ্চারিত শব্দ অর্থাৎ ধ্বংস হও ব্যবহৃত হয়েছে : “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত! আর সে নিজে। (১১১:১) আবু লাহাব তার সম্পদ এবং সন্তানদের জন্য গর্বিত ছিল। তাই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন :
তার ধনসম্পদ ও উপজিন তার কোনো কাজে আসবে না।
সে ভুলবে অগ্নিশিখায় ( ১১১: ২-৩) /
মুহাম্মদ যে পথ দিয়ে হাটতেন সে পথে আবু লাহাবের স্ত্রী উমে জামিল কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। তিনিও আল্লাহর শাস্তি থেকে নিস্তার পেলেন না। নাজিল হলো পরবর্তী আয়াত :
‘আর তার জ্বালানিভারাক্রান্ত স্ত্রীও, যার গলায় থাকবে কড়া আঁশের দড়ি।’ (১১১:৪-৫)।
নবি হবার পর তেরো বছরের ঘটনাসমূহ এবং সর্বোপরি মক্কায় নামানো সুরাগুলি পাঠ করলে মনে হয় এ-যেন একজন ব্যক্তির উপাখ্যান যিনি একা তাঁর গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং তাদেরকে বোঝানোর জন্য ও তাদের বিরোধিতা অতিক্রম করার জন্য কোনো পদ্ধতিই বাদ দেননি। এমন-কী সাহায্যের জন্য আবিসিনিয়ার সম্রাট নিগাসের নিকট তিনি তাঁর কয়েকজন অনুগতকে পাঠালেন। উপহাস ও বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ কখনো পিছপা হননি। যখন মুহাম্মদের পুত্র কাসেম মারা যায় তখন আলাস বিন ওয়ায়েল মুহাম্মদকে উপহাস করেন উত্তরাধিকারহীন বলে। এজন্য সুরা কাউসারে বলা হলো : যে তোমার দুশমন, সে-ই তো নির্বংশ।’ (১০৮:৩)। হজের সময় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি তীর্থযাত্রী হতেন। যখন মুহামদ প্রভাবশালী লোকদের ইসলামে দীক্ষিত হবার আমন্ত্রণ জানাতেন তখন তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁকে অনুসরণ করতেন এবং তীর্থযাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতেন । আমার এই ভ্রাতুষ্পপুত্র এক পাগল। সে কী বলে তার প্রতি আপনারা কর্ণপাত করবেন না। সুরা তুর কোরানের জীবন্ত এবং সুরেলা সুরাগুলোর মধ্যে অন্যতম মক্কি সুরা। মুহাম্মদের সাথে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশবাসীর বচসার বর্ণনা এই সুরায় পাওয়া যায়। এখানে এই সুরার ২৯-৩১ এবং ৩৩-৩৪ আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি ভবিষ্যদ্বক্তা বা পাগল নও।
ওরা কি বলে সে এক কবি আমরা তার অনিশ্চিত দেবের (মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি2
বলো তোমরা প্রতীক্ষা করে আমিও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছি। ”
ওরা কি বলে এ (কোরান) তার নিজের রচনা2 না তারা বিশ্বাস করে না।
তারা যদি সত্যবাদ হয় এর মতো কোনো রচনা নিয়ে আসুক-না/’ (৫২:২৯-৩১, ৩৩-৩৪) /
মুহাম্মদের সাথে তাঁর স্বদেশবাসীদের বাদানুবাদের আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে মক্কি সুরা তাহায় (২০)। মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় সুরা ফুরকানে : অবিশ্বাসীরা বলে, “এ মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। সে (মুহাম্মদ) এ বানিয়েছে ও অন্য সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করেছে। ওরা তো সীমালঙ্ঘন করে ও মিথ্যা বলে। ওরা বলে, “এগুলো তো সেকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তাকে শেখানো হয়। ’ বলো, “এ তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সব রহস্য জানেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ওরা বলে, “এ কেমন রসুল যে খাবার খায় ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করে! তার কাছে কেন ফেরেশতা পাঠানো হয় না যে তার সঙ্গে থাকবে ও ভয় দেখাবে, বা তাকে ধনভাণ্ডার দেওয়া হয় না কেন, বা তার একটাও বাগানও নেই কেন যেখান থেকে সে তার খাবার যোগাড় করতে পারবে? সীমালঙ্ঘনকারীরা আরও বলে, “তোমরা তো এক জাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছ!’ (সুরা ফুরকান ; আয়াত 8:৮)
মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিবরণ একাধিক মক্কি সুরাতে রয়েছে। মক্কাবাসীরা তাঁকে বলতো, উন্মাদ, জিনের প্রভাবে আক্রান্ত, একজন জাদুকর, কবি এবং শয়তানের দোসর। কোরানের আয়াতগুলোকে বলা হলো জাদুমন্ত্র। কখনো বলা হলো যে,
মুহাম্মদের মুখনিঃসৃত বাক্য যা নিশ্চিতভাবে অন্যের দ্বারা লিখিত, কেননা তিনি লেখাপড়া জানতেন না। যারা তাঁর সমালোচনায় অপেক্ষাকৃত নরম ছিলেন তারা বলতেন মুহাম্মদ আসলে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনি অলীক স্বপ্নে আচ্ছন্ন অথবা একজন কবি যিনি তাঁর কল্পনা প্রকাশ করছেন ছন্দযুক্ত গদ্যের মধ্য দিয়ে।
মক্কি সুরাতে অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলো সুরার প্রধান বাদানুবাদ থেকে বিচ্যুত। এ-থেকে বোঝা যায় মুহাম্মদ প্রবল বিরোধিতার মুখে কখনো নিরাশ হয়ে যেতেন এবং তাঁর সংকল্প দুর্বল হয়ে যেত। ফলে তাঁর মধ্যে অপোষ করার ভাবনা তৈরি হয়। তিনি মনে করলেন এই আপোষের বিনিময়ে তাঁর বিপক্ষের লোকের থেকে শক্রতা মুক্ত হয়ে বন্ধুত্ব পেতে পারবেন। তিনি পৌত্তলিকদের সাথে সমঝোতায় আসার কথা বিবেচনা করলেন। এই বিষয়ে সুরা বনি-ইসরাইলে বর্ণিত হয়েছে : ‘আমি তোমার কাছে যে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তার থেকে তোমার বিচ্যুতি ঘটানোর জন্য ওরা চেষ্টা করবে যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে কিছু মিথ্যা কথা বানাও, তা হলে, ওরা অবশ্যই বন্ধু হিসেবে তোমাকে গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি ওদের দিকে কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তুমি ঝুঁকে পড়লে অবশ্যই আমি তোমাকে ইহজীবন ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতাম, তখন আমার বিপক্ষে তোমাকে কেউ সাহায্য করত না।’ ( ১৭:৭৩-৭৫)।
উক্ত তিনটি আয়াতের বিশ্লেষণ প্রয়োজন রয়েছে। সত্যি কী একটা সময় ছিল যখন কুরাইশদের প্রবল বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং আপোষ অথবা নিদেনপক্ষে কিছু সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন? হয়তোবা এ-বিষয়টি সত্য হতে পারে। মানব-চরিত্র এমনই যে, সে সমস্যায় পড়লে অথবা যখন জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে যায় তখন এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এছাড়াও কোরানের অনেক তফসিরকারক বলেছেন, এই আয়াতগুলোর পরিপ্রেক্ষিত ছিল একটা ঘটনা যাকে সারসের ঘাড় বাঁকানোর ঘটনাবলা হয়ে থাকে। এই ঘটনার বিবরণ মুহাম্মদের অনেক জীবনীকারক বর্ণনা করেছেন।
এই বর্ণনানুযায়ী একদা কাবার নিকটবর্তী এক স্থানে নবি কয়েকজন কুরাইশের কাছে সুরা নজম আবৃত্তি করে শোনান। ছন্দোবদ্ধ এই সুরায় যেমন আছে আধ্যাত্মিক অনুভূতি, তেমনি মন কেড়ে নেবার শক্তি। নবি যখন তাঁর ধর্মের সত্যতা ব্যাখ্যা করছিলেন তখনই ফেরেশতা নিয়ে আসলেন এক নতুন অনুপ্রেরণা। ফলে নবি উচ্চারণ করলেন সেই প্রসিদ্ধ আয়াতদ্বয় ; তোমারা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওজা সম্বন্ধে, আর তৃতীয়টি মানাত সম্বন্ধে? (৫৩:১৯-২০)। আয়াত দুটি উচ্চারণের সময় নবির গলার স্বর ছিল প্রায় ঘৃণাপূর্ণ, অর্থাৎ নবি বোঝাতে চেয়েছিলেন এইসব মূর্তিগুলো আসলে অসার। কিন্তু এরপর নেমে আসলো আরও দুটি আয়াত, যা পরবর্তীতে কোরান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, আয়াত দুটি নাকি শয়তান নবির মুখে দিয়েছিল, যার জন্য নবি পরে আক্ষেপ করেছেন। আয়াতদ্বয় ছিল : ‘এরা হচ্ছে সেই উড়ন্ত সারস। তাই এদের মধ্যস্ততা আশা করা যেতে পারে। এ-কথা বলে নবি নতজানু হলেন। তা দেখে তাঁর সাথে কুরাইশরাও নতজানু হলেন তিন দেবীকে সম্মান দেখানোর জন্য। তারা ভাবলো এতদিন পরে মুহাম্মদ তিন দেবীর মধ্যস্থতার ক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
যারা মনে করেন নবি মুহাম্মদ ছিলেন ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে তাঁরা আসলে অস্বীকার করবেন যে, মুহামদ কোনোদিনই এমন কথা বলেননি যা তাঁর নীতির সাথে সামঞ্জস্যহীন। তাই তাঁরা ঐ কাহিনীকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। এমনকি কোরান থেকে দুটি আয়াত মুছে ফেলতেও দ্বিধা করেননি। এরপরও অনেক প্রামাণ্য দলিল এবং কোরানের তফসিরকারকদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় আসলেই এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কোরানের বিখ্যাত তফসিরগ্রন্থ তফসির আল-জালালাইনে লেখা হয়েছে ঐ দুই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয় আরও একটি আয়াত। সুরা হজের আয়াত ৫১। ধারণা করা হয় সুরা নজমের দুটি আয়াত উচ্চারণের জন্য নবির মনে তীব্র অনুশোচনা সৃষ্টি হয় তা থেকে নিবৃত্তির জন্য এবং নবিকে সান্তনা দেবার জন্য সুরা হজের এই বিশেষ আয়াত নাজিল হয়। নবিকে এই বলে আশ্বস্ত করা হয় ; আমি তোমার পূর্বে যেসব নবি ও রসুল পাঠিয়েছিলাম তারা যখনই কিছু আবৃত্তি করত তখনই শয়তান তাদের আবৃত্তিতে বাইরে থেকে কিছু ছুড়ে ফেলত। কিন্তু শয়তান যা বাইরে থেকে ছুড়ে ফেলে আল্লাহ তা দূর করে দেন। তারপর আল্লাহ তাঁর আয়াতগুলোকে সুসংবদ্ধ করেন। আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ তত্ত্বজ্ঞানী। (সুরা হজ, ২২:আয়াত (৫২) |
কোরানের অন্যত্র এই ধরনের আয়াত আরও আছে। এই (শয়তান-সংশ্লিষ্ট) আয়াতগুলি ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, নবি আসলে ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন না। ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনেক পণ্ডিতেরাও এরকম মনে করেন-নবি শুধুমাত্র তাঁর নবুওতির নীতির ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন। এখন যদি স্বীকার করে নেয়া হয় যে, নবি মুহামদ আসলে ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন না, তাহলে উপরে বর্ণিত ঘটনার যৌক্তিক এবং সহজ ব্যাখ্যা দেয়া যায়। প্রবল বিরোধিতার মুখে মুহাম্মদ যখন পর্যুদস্ত, তখন কিছু সহনশীলতা ও বন্ধুত্ব দেখানোর প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। তাই কুরাইশদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য কৌশলী হয়ে মিষ্টি বাক্য বললেন। এতে কুরাইশরা খুশি হলেন এবং মুহাম্মদসহ তাঁরা একসাথে নতজানু হলেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এই উপাখ্যান শেষ হলো এবং সবাই ঘরে ফিরে গেল, নবি মুহাম্মদের মনের ভেতরে শুরু হলো প্রবল তোলপাড়। তিনি অনুভব করলেন কেউ যেন তাঁকে এই ধরনের সমঝোতা না করার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছে। কারণ ত্রিশটি বছর ধরে মুহামদ যে আদর্শ ধারণ করে এসেছেন, একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে কুরাইশদের পৌত্তলিকতাকে বিরোধিতা করে গিয়েছেন এর সাথে সাংঘর্ষিক। আজকের এই সমঝোতা তাঁর সারা জীবনের বিশ্বাস, আদর্শ, চিন্তা, দর্শন সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেবে। এরপরে সুরা বনি-ইসরাইলের ৭৩-৭৫ আয়াতগুলি তৈরি হয়। উপরে যে যৌক্তিক বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা প্রমাণিত হয়। আর শুধুমাত্র অন্য একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, এই কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা। অর্থাৎ মুহাম্মদ নিজেই চেয়েছেন কুরাইশদের সাথে সমঝোতা ও বন্ধুত্ব করতে তথাপি আল্লাহ তাঁকে নিষেধ করে দেন। কিন্তু যেহেতু নবি তাঁর সততা এবং সত্যবাদিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তাই এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।

অলৌকিকত্ব  👈পডুন

দেশান্তর


ইতিহাস চলমান। তবে এর পাতায় পাতায় আমরা এমন অনেক তারিখ খুঁজে পাই যা বিরাট কোনো পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে আমাদের মনে গেথে থাকে। এমনই একটি দিন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর বা ১২ রবিউল আউয়াল। এই দিন নবি মুহামদ ইয়াসরিব শহরে পদার্পণ করেন। স্রেফ ধর্মীয় কারণে মুসলমানরা নবির এই দেশান্তরকে (হিজরত) একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখে থাকেন। প্রাচীন আরবীয়রা নির্দিষ্ট কোনো যুগের অন্তর্গত ছিল না। খুব সম্ভবত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আব্রাহার নেতৃত্বে আবিসিনীয় বাহিনী মক্কা আক্রমণ করে পৌত্তলিকতার তীর্থভূমি কাবাঘর ধ্বংস করে ফেলতে চান। এটি হাতির বছর নামেও পরিচিত”। কারণ আবিসিনীয় বাহিনী এই যুদ্ধে শতাধিক হাতি ব্যবহার করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবিসিনীয় বাহিনী মক্কাবাসীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়। অনেকে সেদিন হতে নতুন দিনপঞ্জি গণনা করতে শুরু করেন। হিজরতের সময় হতে মুসলমানদের নতুন যুগের সূচনার দাবির পিছনে আরেকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। হিজরতের পর থেকে নবির প্রতি আনুগত্যের কারণে মুসলমানদের সাহস অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁরা ক্ষমতা পেয়েছেন এই হিজরতের পর। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের সদস্যরাও এ-সময় নবিকে নিরাপত্তাদানের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাদের পরিচিতি হয় ‘আনসার’ হিসেবে।
তবে ইসলামের নতুন যুগের গণনা শুরু রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ থেকে শুরু হয়নি। একই বছরের প্রথম মাস মহরমের প্রথম তারিখ (১৬ জুলাই, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে গণনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে তৎকালীন আরবদের মনে এমন কোনো চিন্তা আসেনি যে, ওই বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখটিই পরবর্তীতে তাদের জীবনধারায় এক বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়ে দাঁড়াবে। সমসাময়িক বিশ্বেরও কেউ ভাবতে পারেনি যে একদল মরুবাসী, যারা সভ্যতার ইতিহাসে কখনো কোনো অবদান রাখেনি, যারা উন্নততর গোষ্ঠী রোমান রাজা সিজার ও ইরানি বাদশাহ খসরু-১’র অনুগত হয়ে নিজেদের গর্বিত মনে করত, তারা দ্রুতই প্রাচীন সভ্যতার এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ডের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে। (পারস্যের জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী এই রাজার নাম খসরু১ আনুশিরুওয়ান’, যার অর্থ ‘অমর আত্মা খসরু। তিনি ৫৩১ থেকে ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাসানিদ রাজবংশের শাসক ছিলেন। তার জন্ম ৫০১ খ্রিস্টাব্দে। পারস্যের ইতিহাসে শিল্পকলার একজন মহান সংস্কারক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত হন।)
এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া আরবদের নিকট নতুন কিছু ছিল না। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে ইয়েমেনের প্রাচীন মারিব(৪৫) বাঁধ ভাঙার পর দক্ষিণ আরবীয় গোষ্ঠীগুলোর উত্তর সীমান্তের দিকে অভিবাসিত হওয়া। সে তুলনায় মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের এবং কুরাইশ পৌত্তলিকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কিছু অভিবাসীর মক্কা থেকে ইয়াসরিবে স্থানান্তরকে ইতিহাসের আলোকে অগুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। তবে অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এক দশকের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দশ বছরের মাথায় যে সকল ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন, তারাই মক্কার শাসক হয়ে ওঠেন এবং তাদের প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। প্রতিপক্ষের উপাস্য সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। কুরাইশদের পরিচালিত কাবার চিরাচরিত নিয়মকানুন সব বাদ দেয়া হয়। আবু লাহাব ও আবু জেহেলের উত্তরসূরি আবু সুফিয়ান প্রাণভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া অন্যান্য সকলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। ছোট ছোট ঘটনার সমন্বয়ে একটি বড় ঘটনার সৃষ্টি হওয়া ইতিহাসে বিরল নয়। উদাহরণ হিসেবে আছে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এবং ইরানে মঙ্গলীয় আগ্রাসন।
মুহাম্মদকে ধর্ম প্রচারকালের শুরু থেকে কুরাইশ প্রধানদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রথমে আশা করেননি যে, তার প্রচারিত ধর্ম প্রাথমিকভাবে যৌক্তিক ও অন্যান্য দুই সেমিটিক ধর্মের সাথে সদৃশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এমন বিরোধের সমূখীন হতে হবে। তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে এটা ভেবে দেখেননি যে, তার দীক্ষা গ্রহণের কারণে কুরাইশদের প্রাধান্য ক্ষমতা, অর্থ, বিত্তকে খাটো করে দেবে। তাদের শত্রুভাবাপন্নতা যখন বেড়ে যায় তখন নবি তা প্রতিরোধ করার উপায় বের করার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হন। ইয়াসরিবে চলে যাওয়ার আগে তিনি এ ব্যাপারে আগেই দুটি পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল আবিসিনিয়ায় কিছু মুসলমানকে পর পর দুই দলে বিভক্ত করে পাঠানো। গরিব, অসহায় ও কুরাইশ কর্তৃক নির্যাতিত মুসলমানরা নবির কাছ থেকে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার পরামর্শ পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দলের সদস্যের (যাদের মধ্যে নবির চাচাত ভাই এবং হজরত আলির আপন বড়ভাই জাফর বিন আবু তালেবও ছিলেন) পরিচয় লাভের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়। নিগাসের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশাও মুহাম্মদের মনে এসেছিল। আবিসিনিয়ার একজন খ্রিস্টান শাসক হিসেবে নিগাস স্বাভাবিকভাবে পৌত্তলিকতার বিরোধী হবেন। যখন তিনি জানতে পারবেন মক্কায় একদল একেশ্বরবাদী জোট হয়ে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের চেষ্টা করছেন এবং তাঁরা সেখানে নিগৃহীত হচ্ছে, তখন তিনি তাদের সহায়তা করার জন্য একটি বাহিনী হয়তো পাঠিয়ে দিতে পারেন। নিগ্রহের শিকার না হওয়া ও তুলনামূলক সন্ত্রান্ত পরিবার থেকে আসা জাফর বিন আবু তালিবের অংশগ্রহণের কারণ এ থেকে বোঝা যায়। একই সময়ে কুরাইশরা আমর ইবনে আল-আস ও আব্দুল্লাহ বিন আবু রাবিয়াকে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নিগাসের কাছে কিছু উপহারসহ পাঠিয়ে দেন। তাদের আশা ছিল এতে করে মুসলমানদের প্রস্তাবিত কোনো বিষয়ে নিগাস যেন রাজি না হন এবং সম্ভব হলে তাদের ঐতিহ্য রক্ষার্থেও তিনি যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিল ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা। নিজের চাচা ও আশ্রয়দাতা আবু তালিব এবং বিবি খাদিজাকে হারানোর পর তাঁকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্রভাবাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তিনি তায়েফ-নিবাসী বানু সাকিফ গোষ্ঠীর নিকট থেকে সাহায্য আশা করেছিলেন, যাদের সাথে তার মাতৃবংশীয় সম্পর্ক ছিল। তায়েফে অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বানু সাকিফদের অবস্থান সমানের দিক থেকে অনেক উচুতে ছিল। তায়েফের জনগণ মক্কার অবস্থান ও বেদুইনদের মাঝে কুরাইশদের সমানকে ঈর্ষার চোখে দেখত। কুরাইশদের আধিপত্য এড়ানোর জন্য তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিজেদের শহরকে আরবীয়দের মিলনমেলায় পরিণত করতে চাইত। এটা কোনো কলপনা নয় বরং প্রমাণিত সত্য। কারণ নবিকে সাকিফ-প্রধানদের সাথে একটি সাক্ষাতের কথা স্মরণ করতে দেখা গেছে। সাকিফ-প্রধানরা বলেছিলেন, তায়েফকে নতুন ধর্মের কেন্দ্র ও পবিত্র ভূমি ঘোষণা করা হয় তবে তায়েফের জনগণ অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করবে। এর আগে তায়েফের আরেকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানু আমেরও নবির কাছে এরকম একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁরা অনুরোধ করেছিল তাদের সাহায্যে যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে তবে কুরাইশদের স্থলে তাদেরকেই যেন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানিয়ে দেয়া হয়। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে নবির তায়েফ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা। তাঁকে সাহায্য করার ইচ্ছা যদি বানু সাকিফদের মধ্যে থাকত তবে কুরাইশদের পরাস্ত করা সম্ভব ছিল। এ-কারণে তিনি গোপনে তার মুক্ত ক্রীতদাস ও পালিত পুত্র জায়েদ বিন হারিসকে নিয়ে অন্য কোনো সঙ্গী ছাড়াই তায়েফ সফরে গিয়েছিলেন। তবে তার আশা অবশ্য ভঙ্গ হয়েছিল, কারণ বানু সাকিফ-প্রধানরা তাঁকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
আরব বেদুইনদের মাঝে আধ্যাত্মিক বিষয়ে কখনো তেমন আগ্রহ ছিল না। এমনকি আজও মুহাম্মদের চৌদ্দ শতক পরেও তারা ধর্মকে পার্থিব অর্জন হিসেবে দেখে। বানু সাকিফরা ভবিষ্যতের মুক্তির কথা ভেবে নিজেদের জীবিকার প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তায়েফ মূলত গ্রীষ্মকালে ব্যস্ত হয়ে উঠত। তায়েফের জনগণ মক্কার পর্যটকদের কাছ থেকে এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করতেন। কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাঁকে কোনোরূপ সাহায্য দিতে দেখলে আরও বেশি শত্রভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। কাজেই নবির অপ্রমাণিত প্রতিশ্রতির তুলনায় তায়েফের জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দিকে নজর দেয়াটাকে বানু সাকিফদের যৌক্তিক মন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। লাভ ক্ষতির এমন সমীকরণের সামনে থেকে তায়েফের-প্রধানরা মুহাম্মদকে সাহায্য করতে শুধু অস্বীকৃতিই জানাননি, তার প্রতি বিদ্বেষও সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা নবিকে আঘাত করেছিল, অপমানিত করেছিল, এমনকি নবির শেষ অনুরোধটিও পর্যন্ত তাঁরা রাখেননি। যা ছিল তার এই অসফল সফর প্রসঙ্গে কুরাইশদেরকে কিছু না জানানো। কিন্তু কুরাইশরা ঠিকই বার্তা পেলেন। ফলে মক্কায় নবির বিরোধীরা আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেন। শেষে পৌত্তলিকদের কিছু নেতা মুহাম্মদের নবুওতি ভাবনার (যা তাদের অবস্থান ও বিত্তের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছিল) সমাপ্তি টানার উপায় বের করার জন্য সমাবেশে মিলিত হন। যে তিনটি প্রস্তাব উঠে এসেছিল সেগুলো ছিল নবিকে নির্বাসিত করা, কারাবন্দী করা অথবা হত্যা করা। এক্ষেত্রে তাঁরা শেষ প্রস্তাবটিই বেছে নেন।
তায়েফের পাশাপাশি হেজাজের আরেকটি শহরও অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে মক্কার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছিল। সেটি ছিল ইয়াসরিব, যা মদিনা (স্থানীয় ইহুদিদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ “নগর)(৪৭) নামে পরিচিত। আরবের জনপ্রিয় মূর্তিগুলোর সুসজ্জিত উপাসনালয়গুলোর কারণে মক্কা শহরটি আরবদের কাছে, বিশেষ করে বেদুইন ও কুরাইশদের কাছে ধর্মীয় তীর্থভূমি বলে বিবেচিত হতো। কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও এর পরিদর্শকদের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত যা মক্কায় একেবারে ছিল না। সেইসাথে বাণিজ্যিক উন্নয়ন ও তিনটি ইহুদি গোত্রের কারণে অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হারের সন্তোষজনক অবস্থানের ফলে ইয়াসরিবের সাংস্কৃতিক-সামাজিক মান মক্কার তুলনায় উচ্চতর অবস্থায় ছিল। তারপরও হেজাজের শহরগুলোর মধ্যে ইয়াসরিবকে মক্কার পরে দ্বিতীয় স্থানে গণ্য করা হতো।
ইয়াসরিবের অধিবাসীদের মধ্যে কুরাইশদের সাথে শত্রভাবাপন্ন দুটি আরবীয় গোষ্ঠী বসবাস করত। এরা হচ্ছে আউস এবং খাজরাজ। দুই গোষ্ঠীরই আবার ইয়াসরিবের দুই-একটি ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আউস এবং খাজরাজ ছিল কাহতানি আরব, অর্থাৎ ইয়েমেন-বংশোদ্ভূত। আদনানি বা উত্তর আরবীয় বংশোদ্ভূত কুরাইশদের সাথে তাদের বিরোধ বহু প্রাচীন। কৃষি ও বাণিজ্যে অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে আউস এবং খাজরাজ গোত্র তাদের ইহুদি প্রতিবেশীদের মতো অগ্রসর ছিলেন না। তাদের অনেকে ইহুদিদের অধীনে কাজ করতেন। ফলে কিছু নির্দিষ্ট ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে মিত্রতা থাকলেও যেসব ইহুদিদেরকে তাঁরা প্রভু মানতেন, তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে সহজভাবে নেননি। মক্কায় নবি মুহাম্মদের উত্থান ও ইসলামের প্রচার এবং কুরাইশদের সাথে তার বিরোধের সংবাদ হেজাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ইয়াসরিবের অনেকেই এ-বিষয়ে অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন। মক্কা থেকে আগত ইয়াসরিবের পর্যটকদের বর্ণনা শুনে কিছু সংখ্যক আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কথা ভাবতে থাকেন। নবি মুহামদ ও তার সঙ্গীদের যদি এখানে আনা যায় এবং কোনোভাবে যদি মুহাম্মদের সাথে জোট বাঁধা যায়, তবে হয়তো অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারে। যেহেতু মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরাও কুরাইশ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তাই এতে করে কুরাইশদের সংহতির দেয়ালও ভেঙে ফেলা যেতে পারে। মুহামদ ও তার সঙ্গীদের সাথে গড়ে তোলা জোটের সাহায্যে আউস এবং খাজরাজের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের জাতিগত বিদ্বেষও মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে। তাছাড়া মুহাম্মদ একটি নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছেন। এই ধর্ম যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তবে ইহুদিরা আর তাদের উপর অবস্থান করতে পারবে না। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সাথে সমঝোতার ফলে ইয়াসরিবের তিন ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে আউস ও খাজরাজের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে।
৬২০ খ্রিস্টাব্দের হজ মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে দেখা করেন এবং মুহাম্মদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরের বছর একই সময়ে মক্কার বাইরে আল-আকাবায় বারো সদস্যের একটি দল নবির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা দেখলেন নবির শিক্ষার একটা সুদূরপ্রসার প্রভাব রয়েছে এবং নবির চাওয়াও খুব বেশি কিছু নয়। সবাইকে ব্যাভিচার,
সুদের ব্যবসা, মিথ্যাচার পরিহার করতে হবে এবং মানব নির্মিত মূর্তির পরিবর্তে এক আল্লাহ- তে বিশ্বাস করতে হবে। সেই বারো জন ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ইয়াসরিবে ফিরে আসেন ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের জানান যে, তাঁরা মুসলমান হয়ে গিয়েছেন এবং মুহাম্মদের সাথে তাদের চুক্তিও হয়েছে। তাদের কাজ ও প্রস্তাবনা ইয়াসরিবের অনেক স্থানে স্বীকৃতি লাভ করে। পরের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারীর একটি বড় প্রতিনিধিদল মুহাম্মদের সাথে একই স্থানে দেখা করতে যান এবং দ্বিতীয় চুক্তি সম্পন্ন করেন।
দেশান্তরের বিষয়টি মুহাম্মদের মনে হঠাৎ করে জেগে ওঠেনি। যে-সব মুসলমান আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলেন তাদের সূত্রে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। সুরা জুমার’র এই আয়াতে রয়েছে বলো, হে বিশ্বাসী দাসগণ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। যারা এ-পৃথিবীতে ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। (৩৯:১০)। আল-আকাবা চুক্তিতে অবশ্যই মুহাম্মদের আশার প্রতিফলন ঘটেছিল। তের বছর ধরে মক্কায় তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কিছু সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলমান তাদের আরব-চরিত্রের কারণে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় পূর্বের ধর্মে ফিরে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন তাঁরা দেখলেন মুহাম্মদের আদর্শ খুব একটা বিস্তার লাভ করছে না এবং মুসলমান বলে তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। ধনী ও প্রভাবশালী পৌত্তলিকরা তাদের অনেককে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করেছিল। তায়েফের বানু সাকিফদের সাথে নবির যোগাযোগ শুধু ব্যর্থই হয়নি, এতে করে কুরাইশদের সাথে তার শক্রতা তীব্রতর হয়ে গিয়েছিল। যদিও নিজ গোষ্ঠী বানু হাশেমি তাঁকে রক্ষা করে আসছিল, তবে তাঁরা শুধু শারীরিকভাবে আহত হওয়া থেকে রক্ষা করতেন। তাঁরা কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নেবে এমনটা আশা করা সম্ভব ছিল না। আউস এবং খাজরাজদের সাথে স্থাপিত মিত্রতা অবশ্য এই আশা পূরণ করতে পারত। তাদের সমর্থন থাকলে কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল। মক্কায় ইসলাম দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি তবে ইয়াসরিবে সেটা সম্ভব ছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কুরাইশদের সাথে আউস এবং খাজরাজ গোষ্ঠীর ঈর্ষাকাতরতা। এছাড়া ইয়াসরিবের উন্নত বাণিজ্য ও কৃষিব্যবস্থার কারণে মুসলমানরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজও খুঁজে নিতে পারবেন।
আল-আকাবায় নবি এবং আউস ও খাজরাজদের মধ্যে আলাপকালে আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেব (তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তবে নিজের ভাতিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন) হাজির হন। তিনি অন্যদেরকে তাদের অবস্থান ও ইচ্ছার ব্যাপারে স্পষ্ট হতে বলেন। ইয়াসরিবের প্রতিনিধিদের আব্বাস সরাসরি বলেন: তাঁরা এবং মুহাম্মদ কুরাইশদের হামলার শিকার হতে পারে; এবং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাঁরা মুহাম্মদকে ততটাই প্রতিরক্ষা দিবে যতটা তাঁরা নিজেদের স্ত্রীসন্তানদের দিয়ে থাকে এবং তাঁরা যেন মিথ্যা প্রতিশ্রতি দিয়ে মুহাম্মদকে বিভ্রান্ত না করেন। এ-সময় খাজরাজ গোত্রের প্রতিনিধির মধ্য থেকে আল-বারা বিন আল-মারুর উত্তেজনার বশে বলেন, তাঁরা সবাই নির্ভীক, লড়াকু যোদ্ধা এবং তাঁরা সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আছেন। একজন বয়োজ্যষ্ঠ ও অভিজ্ঞ আউস প্রতিনিধি আবুল হাসিম বিন তায়েহান নবিকে বলেন: ইহুদিদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা আপনার ও আপনার সঙ্গীদের সাথে করা চুক্তির কারণে ভেঙে যেতে পারে।
হয়তো আপনার আদর্শ আরও এগিয়ে যাবে। তখন আপনি কি আমাদের ছেড়ে দিয়ে আপনার নিজ গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করে ফেলবেন? প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম (মৃত্যু হিজরি ২১২/২১৮ বা ৮২৮৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) , যিনি ইবনে হিশাম নামে বেশি পরিচিত, তার সম্পাদিত দ্যা লাইফ অব দ্যা প্রফেট গ্রন্থ অনুসারে নবি তখন হেসে উত্তর দিয়েছিলেন: রক্তের জন্য রক্ত, ধ্বংসের জন্য ধ্বংস। আমি আপনাদের সাথে থাকব, আপনারা আমার সাথে থাকবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আর যারা আপনাদের সাথে শান্তি বজায় রাখবে আমিও তাদের সাথে শান্তি বজায় রাখব।;
এখানে ‘রক্ত’, ‘ধ্বংস’ শব্দগুলোর উল্লেখ বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবী জ্যাঁ পল মারাতের উক্তি ‘আমি রক্ত চাই’- এর কথা মনে করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য আবুল হাসিম বিন তায়েহানের প্রশ্নের উত্তরে আরেকটি কথা নবি বলেছিলেন বলে জানা যায়, লাল ও কালোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সম্ভবত এর দ্বারা তিনি সকল বর্ণের সাথে যুদ্ধের কথা বুঝিয়েছিলেন; আরবীয় হোক আর অনারবীয় হোক। এ-বক্তব্য নবি মুহাম্মদের ভবিষ্যত চিন্তা ও গোপন অভীপ্সার কথা জানান দেয়। আবুল হাসিমকে দেয়া উত্তর নির্দেশ করে, এটা ছিল নবি হৃদয় থেকে বের হয়ে আসা আর্তনাদ, দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আউস ও খাজরাজদের সমর্থন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দিতে পারে। এতে করে নবি ইসলামের প্রসারে আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন, বিরোধী কুরাইশদের বিরোধিতার জবাব দিতে পারবেন এবং দীর্ঘদিনের নিজস্ব চিন্তাও প্রকাশ করতে পারবেন। মক্কায় গত তের বছর ধরে তার প্রচার খুবই ক্ষীণ প্রভাব ফেলেছে, সমগ্র আরবের সামনে এখন ইসলামকে আনা সম্ভব হবে।

একটি সুগঠিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা 
ইয়াসরিবে গমনের পর নবি মুহাম্মদ তার স্থানীয় সমর্থক (আনসার) আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোক এবং অভিবাসী মুসলমানদের (মুহাজির) সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। আনসাররা মুহাজিরদের পালক ভ্রাতা হিসেবে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেন। মুহাজিররা কর্মঠ ছিলেন। তাঁরা ইয়াসরিবে এসে কৃষি-শ্রমিক এবং বাজারে দোকানের কাজ জুটিয়ে নেন। তথাপি এখানে তাদের অবস্থান সহজ কিংবা নিরাপদ, কোনোটাই ছিল না। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে কুরাইশদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে তাঁরা নির্ভরযোগ্য জীবিকার অন্বেষণ করছিলেন,যা তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারবে। নবি মুহাম্মদ নিজে কোনো পেশা গ্রহণ করেননি। মুহাজির ও আনসারদের অনুদানের ওপর নির্ভর করতেন। তিনি এ-সময় কঠোর সময়কাল অতিক্রম করছিলেন। তাঁকে প্রায়শ রাত্রিকালীন আহার না করে শয্যায় যেতে হতো কিংবা কয়েক দিনের ক্ষুধা এক দিনে উপশম করতে হত। ফলে ইয়াসরিবে এসে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমূখীন হতে হলো। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে একটি কম বিপজ্জনক এবং স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তি খুঁজে নিতে হবে। এ-সমস্যার সমাধানে নবির গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
ইসলাম-পূর্ব সময় থেকে আরব গোত্রগুলোর সম্পদ বৃদ্ধির একটি ঐতিহ্যগত প্রথা হচ্ছে এক গোত্র কর্তৃক অন্য গোত্রকে আক্রমণ, অপরের গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদ দখলে নেয়া। কৃষিভিত্তিক স্থায়ী পেশা বা জীবিকা অর্জনের পথ খুব দুরূহ থাকায় তৎকালীন আরবের বেশিরভাগ গোত্র এভাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইয়াসরিব-অভিবাসী মুসলমানদেরও নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অন্য কোনো উপায় ছিল না। ফলে তাঁরা বিদেশ যাত্রী, বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা শক্রগোত্রের ওপর হঠাৎ আক্রমণের পন্থা বেছে নিলেন। আরবি গাজওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে আকস্মিক আক্রমণ’। এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা গোত্রের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করে তাদের সম্পদ ও নারীদের ছিনিয়ে নেয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে এভাবে অর্জিত সম্পদ আরব অঞ্চলের শুষ্ক রুক্ষ পরিবেশে জীবনযাপনকে তাৎক্ষণিকভাবে সহজ করে দিত।
একবার নবির কাছে সংবাদ পৌছাল কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা আমর বিন আল-হাদরামির নেতৃত্বে বিশাল মালামালের বহর নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নবি আব্দুল্লাহ বিন জাহেশ এর নেতৃত্বে মুহাজিরদের একটি দলকে ওই কাফেলার সম্পদ দখলের জন্য প্রেরণ করেন। মুহাজিররা নাখলা নামক একটি যাত্রাবিরতির স্থানে আকসিক আক্রমণ এলেন মুহাজিররা। সাথে দুইজনকে জিমি করেও নিয়ে আসা হলো। ইসলামের ইতিহাসে এই সফল অভিযানকে নাখলার অভিযান’নামে অভিহিত করা হয়।
মুহাজিরদের নাখলা-অভিযানের ঘটনা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে মক্কায় এবং ইয়াসরিবে। কারণ এটি ছিল মুসলমানদের প্রথম আক্রমণ এবং যা রজব মাসের প্রথম দিনে সংঘটিত হয়েছিল। প্রাচীন আরব-রীতি অনুযায়ী চারটি মাসে (মহরম, রজব, জিলকুদ ও জিলহজ) আক্রমণ করা নিষিদ্ধ, যার মধ্যে রজব মাস একটি। স্বাভাবিকভাবে এই আক্রমণের পর কুরাইশরা তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করল মুহাজিরদের প্রতি। অন্যান্য গোত্র থেকেও তেমনি প্রতিক্রিয়া নির্গত হলো। ইতিহাস-পাঠে মনে হয় এই প্রতিকূল প্রেক্ষাপট নবিকেও শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ও তার লোকজনের প্রতি শীতল আচরণ করলেন। ভবিষ্যতপন্থা নির্ধারণেও কিছুটা সংশয়ী মনোভাব প্রকাশ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন জাহশ দাবি করলেন এই আক্রমণ জুমাদা আস-সানি মাসের শেষ দিনে করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি সমাধানের পথ পাওয়া গেল। কিন্তু যুদ্ধে লব্ধ মাল নিয়ে সমস্যা রয়ে গেল, যা মুহাজিরদের প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানে প্রয়োজনীয় ছিল। এ-কারণে কুরাইশদের দাবির মুখে মালগুলো ফিরিয়ে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। হয়তো কয়েকজন সাহাবি নবিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যা ঘটে গেছে তা আর বদলানো যাবে না এবং কোনো প্রকারের অস্বীকারমূলক বক্তব্য মুহাজিরদের অপরাধী এবং শক্রকে নির্দোষ বানাবে। মুহাজিরদের অর্থনৈতিক অবস্থার মুক্তির জন্য গনিমতের মালের প্রয়োজনীয়তার কথা নিশ্চিতভাবে তাদের মনে কাজ করছিল।
একটি সুস্পষ্ট এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সমাধান আসে সুরা বাকারার এই আয়াতে: পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বলো, সেই সময় যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় আল্লাহর পথে বাধা দেয়া, আল্লাহকে অস্বীকার করা, কাবাশরিফে উপাসনায় বাধা দেয়া ও সেখানকার অধিবাসীদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া। ফিৎনাং হত্যার চেয়েও ভীষণ অন্যায়। পারলে তারা সব সময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে-পর্যন্ত না তারা তোমাদের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে ফিরিযে দেয় (২:২১৭)। নাখলা অভিযানের পর কুরাইশ এবং আরও কয়েকটি শক্রভাবাপন্ন গোত্রের ওপর সফল গাজওয়া পরিচালিত হলে মুহাজিরদের আর্থিক অবস্থানে পরিবর্তন আসে। এ-অভিযানগুলো নবি এবং সাহাবিদের ক্ষমতার শীর্ষে পৌছানোর রাস্ত করে দেয় এবং সমগ্র আরবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল চূড়ান্ত রূপ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যে পদক্ষেপটি মুসলমানদের মর্যাদা ও আর্থিকভিত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল তা হচ্ছে ইয়াসরিবের ইহুদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
ইয়াসরিবে তিনটি ইহুদি গোত্র বাস করত। এরা হচ্ছে বানু কায়নোকা, বানু-নাজির ও বানু কুরাইজা। এই ইহুদি গোত্রগুলি ইয়াসরিবে কৃষি ও শিল্পে নিজস্ব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাহিত্যের চর্চার মাধ্যমে তারা ইয়াসরিবের অন্য দুটি গোত্র আউস ও খাজরাজের চেয়ে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী হয়ে ওঠে। ইহুদিরা অনেক আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোককে কৃষিশ্রমিক ও দোকান-গুদামের বিক্রময়কর্মী ও প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করে। আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা এ-জন্য প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভুগতেন এবং ইহুদি গোত্র তিনটির প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা নবি মুহাম্মদের সাথে আল-আকাবা চুক্তি সম্পাদন করার মূল কারণ ছিল ইয়াসরিবে ইহুদিআধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করা। ইয়াসরিবে আগমনের পর নবির মধ্যে প্রথমে একটি বিচক্ষণ পরিণামদৰ্শিতা বজায় ছিল। তিনি ইহুদিদের সাথে যে কোনো প্রকার বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। ইহুদিরা ছিল শক্তিশালী ও বিত্তশালী। তিনি তাদের সাথে অনাক্রমণমূলক একটি চুক্তিও (আহদ আল-মুয়ারা) করেছিলেন, যা উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে। চুক্তিতে ঠিক হল মুসলমান ও ইহুদিরা নিজস্ব ধর্মীয় সমাজে বসবাস করবে এবং কুরাইশ ও অন্য যে কোনো গোত্র থেকে আক্রমণ করা হলে উভয় ধর্মাবলম্বী যৌথভাবে ইয়াসরিবকে রক্ষা করবেন। একই সাথে উভয় পক্ষই মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্কের যোগসূত্র হচ্ছে উভয় গোষ্ঠী পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা পরিহার করেছিলেন এবং প্রার্থনার সময় উভয় গোষ্ঠীই একই দিকে তাদের মাথা নত করতেন।
ইয়াসরিবে মুসলমানরা যখন দুর্বল ছিলেন তখন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন-কি ইয়াসরিবে অভিবাসনের দেড় বছর ধরে নবি প্রার্থনার জন্য কিবলার দিক দূরতম মসজিদকে (জেরুজালেমে অবস্থিত) অনুসরণ করতেন তখনও কোনো বিরোধ বাধেনি। কিন্তু পরে কিবলার দিক পরিবর্তন করে মক্কার কাবাঘরের দিকে করা হয়। এই পদক্ষেপের পর থেকে ইহুদিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাদের প্রশ্নের জবাব আসে সুরা বাকারা-এর এই আয়াতে: পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবিদের ওপর বিশ্বাস করলে করলে…। (২:১৭৭)। এই নির্দেশনাটি আসলে ইহুদিদের জন্য ছিল একটি সতর্কবার্তা। তাদের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল যখন ছোটোখাট আকসিক অভিযান ও মক্কার বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর গাজওয়ার সাফল্য আসতে লাগল। ইহুদিদের উৎকণ্ঠার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেল বদরের ময়দানে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কুরাইশদের বিপক্ষে নবি এবং সাহাবিদের বিজয়ের মাধ্যমে। এবার ইয়াসরিবের ইহুদিরা মুখোমুখি হলেন আউস ও খাজরাজ গোত্রের সাথে। যাদের একদা কিছুই ছিল না, তারপরও ইহুদি মালিকদের অধীনে তাঁরা কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন না। ইহুদিরা দেখলেন মুহাজির আর আনসাররা নবি মুহাম্মদের পতাকাতলে মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী জোটবদ্ধ সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার আসল নাম ইসলাম। ইসলামের উত্থানে মক্কায় গিয়ে পরাজিত কুরাইশদের প্রতি সহমর্মিতা জানালেন। কুরাইশদেরকে মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তাগিদ দিলেন। এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সুরা নিসা-এর এই আয়াতে: তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল? তারা প্রতিমা ও অসত্য দেবতার ওপর বিশ্বাস করে। তারা অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলে যে, বিশ্বাসীদের চেয়ে এদের পথই ভালো।’(৪:৫১)। এই আয়াতে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা নিষেধকারী ধর্মশাস্ত্রের অধিকারী বলে দাবি করা লোকদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে যারা কিনা আবার পৌত্তলিকদের সাথেই ঐক্য গড়ে তোলে এবং নবি মুহাম্মদের একেশ্বরবাদী অনুসারীগণের তুলনায় সেই সব পৌত্তলিকদের বড় দেখানোর চেষ্টা করে।
এ-সন্ধিক্ষণে ইয়াসরিবের বাজারে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানু কায়নোকার গোত্রের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এর সমাপ্তি ঘটে মুসলমানদের দ্বারা কায়নোকা গোত্রের রাস্তা দখলের মাধ্যমে। ইয়াসরিব নিবাসী একজন আনসার নারী কায়নোকা গোত্রের একজন স্বর্ণকারের দোকানে গিয়েছিলেন। স্বর্ণকার নারীকে দেখে কৃত্রিম ভালোবাসা দেখাতে শুরু করে এবং ওই নারী তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিশোধ স্পৃহার বশবর্তী হয়ে স্বর্ণাকার তখন নারীকে হয়রানি করেন এবং চেয়ারের সাথে ওই নারীর ঘাগরা ও ব্লাউজ পিন মেরে আটকে দেয়। নারীটি যখন ওঠে দাঁড়ান তখন পোশাকের নিম্নভাগ উন্মোচিত হয়ে যায় এবং উপস্থিত লোকজন হাসিতে ফেটে পড়ে। ওই নারী উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানালে একজন মুসলমান তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। ক্রুদ্ধ মুসলমান ওই স্বর্ণকারকে হত্যা করেন। এ-খবর শোনা মাত্র অন্য ইহুদিরা স্বর্ণাকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং ওই মুসলমান ব্যক্তিকে তারা হত্যা করেন। গোটা ঘটনাটিই দ্রুত দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। মুসলমানরা নবির কাছে বিচারের দাবি জানান। তাঁরা নবির অনুমতিক্রমে বানু কায়নোকা গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা জোরপূর্বক দখলে নিলেন এবং কায়নোকা গোত্রের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল। পনের দিন পর প্রস্তাবিত কিছু শর্ত মেনে বানু কায়নোকা গোত্র আত্মসমর্পণ করে। শর্তগুলো হল তাদের জীবন রক্ষা পাবে তবে ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যেতে হবে। যাবার আগে তারা সমস্ত সম্পদ একত্রে জমা করবে, সেখান থেকে ভারবাহী পশু বহনে সক্ষম সম্পদগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো ওই স্থানে রেখে যাবে যা ইয়াসরিবের গৃহহীন, দরিদ্র মুহাজিরদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
এ-ঘটনার পর ইয়াসরিবে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সুসংহত হয়। আর স্বাভাবিকভাবে ইহুদি গোত্রগুলো আতঙ্কিত মুহাম্মদ বিন মাসলামা। বানু-নাজির গোত্রের কাব বিন আল-আশরাফের রক্তের দাম নির্ণয়ে নবি এবং তার অনুসারীদের সাথে বিতর্ক হয়। এ-সময় সুযোগ বুঝে নবিকে হত্যা করতে গেলে মুসলমানদের সাথে লড়াই বেধে যায় বানু-নাজির গোত্রের। নবির আদেশে যুদ্ধ শুরু হলে মুসলমানরা বানু-নাজির গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা অবরোধ করে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। বানু-নাজির পূর্ব থেকেই যুদ্ধের কৌশল কিছুটা আন্দাজ করায় তারা বানু কায়নোকা থেকে তীব্রভাবে পাল্টা আক্রমণ করে। মুসলমানরাও সাহসিকতার সাথে লড়াই করছিলেন। বানু-নাজিরের লড়াকু প্রতিক্রিয়া দেখে নবি আশঙ্কা করলেন মুসলমানরা হয়তো যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে পারবেন না, তারা আরবের ঐতিহ্যগত পরিবর্তশীলতায় বশীভূত হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যাবে। তিনি দ্রুত আদেশ দিলেন বানু-নাজির গোত্রের খেজুরগাছগুলো যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
উট এবং ভেড়ার মতো খেজুরগাছও আরবের অন্যতম খাদ্য ও সম্পদের উৎস। বানু-নাজির এ-ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা নবিকে প্রশ্ন করে: কিভাবে এই কাজটি করা সম্ভব হল?”, তাহলে কিভাবে আপনি নিজেকে সতর্ককারী হিসেবে এবং মন্দ ও ধ্বংসের বিরোধী হিসেবে দাবি করেন, যেখানে আপনি নিজেই একটি উৎপাদনশীল উৎসভাণ্ডার ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই প্রশ্নবাণে নবি পশ্চাৎপদ হননি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাজিল হলো সুরা হাশর-এর এই আয়াতগুলো: আল্লাহ ওদেরকে নির্বাসন দেয়ার সিদ্ধান্ত না করলে পৃথিবীতে অন্য শাস্তি দিতেন; আর পরকালে ওদের জন্য রয়েছে আগুনের শাস্তি। উহা এজন্য যে ওরা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। আর কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে, আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। তোমরা যে কত খেজুরগাছ কেটেছ আর কতক না-কেটে রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে। উহা এজন্য যে, এ দিয়ে আল্লাহ সত্যত্যাগীদেরকে অপদস্থ করবেন।’(৫৯:৩-৫)। এই আয়াতত্ৰয়ের গৃঢ় অর্থ হচ্ছে শেষ পরিণতি দ্বারাই যুদ্ধজয়ের পদক্ষেপগুলো নির্ধারিত হয়। অমানবিক হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের এই কৌশল তৎকালীন আরব গোত্রগুলোর কাছে গৃহীত হয়েছে। অষ্টম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) সাকিফ গোত্রের সাথে লড়াইয়ে এবং তায়েফ দখলের সময়েও নবি এই আয়াতগুলো ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (৬১ হিজরি) নবির দৌহিত্র এবং হজরত আলির পুত্র হোসেন বিন আলিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য উমাইয়া সেনারাও প্রাসাদে নারী-শিশুসহ সকলের জন্য খাদ্য-পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা হোক, বানু-নাজির গোত্র শেষ পর্যন্ত বিশ দিন পর আত্মসমর্পণ করে। খাজরাজ গোত্রের কয়েকজন নেতার মধ্যস্থতায় এই মতৈক্যে পৌছানো হলো বহনযোগ্য সকল সম্পদ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের জন্য জমা রেখে তারা নিরাপদে ইয়াসরিব ত্যাগ করবে।
ইয়াসরিবে অবস্থানকারী বাকি একমাত্র ইহুদি গোত্র ছিল বানু কুরাইজা। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে (হিজরি ৫ম বর্ষে) তাদের অবস্থা খারাপ হয়। অভিযোগ পাওয়া গেল তারা ইয়াসরিবে থেকে মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং কুরাইশদেরকে সাহায্য করতেও রাজি হয়েছে। নবি কৌশলে কুরাইজার মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছেন, ফলে তারা শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান বাহিনীকে সহায়তা করেনি। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান যখন মদিনা দখলের আশা ত্যাগ করে অবরোধ তুলে নিলেন মুসলমানরা তখন বানু কুরাইজার রাস্তা পচিশ দিন ধরে অবরোধ করে রাখেন। কুরাইজা গোত্র তখন তাৎক্ষণিকভাবে অন্য গোত্রের ন্যায় আত্মসমর্পণের চুক্তি করে সহায়সম্পত্তি জমা দিয়ে নিরাপদে স্থান ত্যাগ করার জন্য রাজি ছিল। কিন্তু আবু সুফিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে নবি তাদের উপর খুব রুষ্ট ছিলেন। ফলে তিনি তাদেরকে এই সুযোগ দিলেন না। তিনি হয়তো আরও চিন্তা করেছিলেন ইসলামের গরিমা বৃদ্ধির জন্য এবং প্রতিপক্ষের প্রতি ভীতিপ্রদ সতর্কবার্তার জন্য ধ্বংসও প্রয়োজন আছে। পূর্বের দুইটি ইহুদি গোত্র খাজরাজ গোত্রের নেতাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেয়েছিল। কুরাইজা গোত্র এবার আউস গোত্রের সাহায্য কামনা করলেন। নবিও মুসলমানদের পক্ষে আউস গোত্রের একজনকে মধ্যস্থতাকার নিয়োগ দিলেন। তার নাম সাদ ইবনে মুয়াজ। তিনি পূর্ব থেকেই কুরাইজা গোত্রের ওপর ক্ষিপ্ত এবং কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধ চলার সময় তিনি লড়াইয়ে আহত হয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ সাদ ইবনে মুয়াজ রায় দিলেন কুরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে, তাদের নারী-শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হবে এবং তাদের সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত অন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও তা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। কারণ আউস গোত্রের লোকেরা সাদ ইবনে মুয়াজের রায় মেনে নিয়েছিলেন। একটি টেকসই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় অনেক নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধেও তাই এ-রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইয়াসরিবের বাজারে কিছু পরিখা খনন করা হয়েছিল যাতে যুদ্ধের সময় নিরাপদে স্থান ত্যাগ করা যায়। ওই পরিখাগুলো কুরাইজা গোত্রের আত্মসমর্পণকৃত সাতশজন (ভিন্নসূত্র মতে এক হাজার সংখ্যক) পুরুষ ইহুদির শিরোচ্ছেদকৃত দেহ দাফন করা হয়। অবশ্য সাদ ইবনে মুয়াজের নির্দেশ অমান্য করে একজন ইহুদি নারীকেও হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন কুরাইজা গোত্রের হাসান আল-কুরাইজির স্ত্রী। তিনি বিবি আয়েশার বান্ধবী ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে তিনি বিবি আয়েশার সাথে কথা বলছিলেন। পরে তিনি সহাস্যে এবং উৎফুল্ল চিত্তে শিরোচ্ছেদের স্থানে হেঁটে গেলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বানু কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধের সময় তিনি মুসলমানদের ওপর পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন। ওই নারী সম্পর্কে বিবি আয়েশার বক্তব্য ছিল: ‘আমি তার মতো সুন্দরী, ভদ্র এবং দয়ালু মহিলা কখনো দেখিনি। তিনি যখন শিরোচ্ছেদের স্থানে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, আমি তাকে বললাম, আপনাকে নির্ঘাৎ হত্যা করা হবে। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, বেঁচে থাকাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।’

সারাংশ
বিশ্ব-ইতিহাসে ইসলামের উত্থান এবং বিস্তার এক অদ্বিতীয় ঘটনা। অতীত পর্যালোচনা করা অনেক ক্ষেত্রেই খুব দুরূহ বিষয়, কেননা প্রকৃত বিষয় জানতে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, যা সহজে প্রাপ্ত নাও হতে পারে। তাই প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণার। সে- তুলনায় ইসলামের ইতিহাস জানা অনেক সহজ কারণ এই ইতিহাসের সমর্থনে পাওয়া যায় অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্য। সচেতন এবং পক্ষপাতমুক্ত ঐতিহাসিকদের পক্ষে ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরা অনেক সহজ। ভবিষ্যত গবেষকদেরও উচিত ইসলাম নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলে তাঁদের মনে কোনো ধরনের পূর্বধারণা, অন্ধবিশ্বাস বা বিদ্বেষ থাকলে সেগুলি থেকে আগে মুক্ত হতে হবে। আমার এই ছোট বইটি সুগভীর গবেষণার ফসল নয়। তথাপি যথাসম্ভব যে কোনো ধরনের অন্ধআবেগ থেকে নির্মোহ থেকে অতিসংক্ষেপে এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে হজরত মুহাম্মদের তেইশ বছরের নবুওতি জীবন। এই অধ্যায়ে সে বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
(এক) মুহাম্মদ ছিলেন একজন অনাথ শিশু। ছয় বছরের পিতৃমাতৃহীন অসহায় শিশু লালিত-পালিত হন আত্নীয়ের গৃহে। ওই বয়সের শিশুরা সাধারণত যেসব সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে লালিত-পালিত হত, মুহামদ তা থেকে বঞ্চিতই ছিলেন। খুব ছোট বয়স থেকেই মুহাম্মদ মক্কার নিকটস্থ উষর মরুভূমিতে উটের চারণ করে সময় কাটাতেন। তাঁর দৃষ্টি ছিল তীক্ষ এবং মন ছিল কল্পনাপ্রবণ। পাঁচ থেকে ছয় বছর তিনি মরুভূমিতে অতিবাহিত করেন। মরুভূমির নিজস্ব নির্জনতা ও একাকীত্ব মুহাম্মদের মনে জন্ম দেয় ভাবাবেগ এবং দূরদর্শিতা। প্রতিবেশিদের ধনদৌলতের সাথে নিজের কর্পদকশূন্য অবস্থার তুলনা করে মুহাম্মদের মনে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় এক মানবিক বিরাগ। এই জটিল মানসিকতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর শিশুকালের খেলার সার্থীদের সাথে এবং নিকট আত্মীয়দের সাথে। তারপর ধনী পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং সবশেষে ওই সমস্ত ধনদৌলতের উৎসের উপর। সে উৎস ছিল কাবা ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন। মুহাম্মদের জন্মের বহুপূর্ব থেকেই কাবা ছিল মূর্তিপূজার এক বিশাল মন্দির এবং আরব সমাজের ধর্মীয় কেন্দ্রভূমি। বাল্যকালে মুহাম্মদ কাবায় অনেক প্রার্থনা-অৰ্চনা করেছেন, পরবর্তীতে তাঁর কাছে এগুলো সব বৃথা মনে হয়, একেশ্বরবাদে একনিষ্ঠ হওয়ায়। সেজন্য বোধ করি তাঁর মনে মূর্তিপূজার প্রতি অগাধ ঘৃণা এসে যায়। [ একটি হাদিসের বর্ণনানুযায়ী : (৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে) নবি মুহামদ তখন পৌত্তলিক দেবদেবীর উপাসনা করতেন, একদা কাবা ঘরের দেবতাকে উৎসর্গ করা কোরবানির মাংস রান্না করে একেশ্বরবাদী হানিফ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট আরবি কবি জায়েদ বিন ওমরের ( খলিফা ওমরের চাচা) জন্য নিয়ে যান তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য, তখন জায়েদ মুহামদকে তিরষ্কার করেন এবং পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থেকে একেশ্বরবাদ চর্চার পরামর্শ দেন। দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬৭, নম্বর ৪০৭। – অনুবাদক । মূর্তিপূজা-বিরোধী চিন্তা কেবল মুহাম্মদের একার ছিল না। এ- সময় মক্কার অনেক বাসিন্দার কাছে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মপুস্তক ছিল। এছাড়াও অনেক চিন্তাশীল মক্কাবাসী ছিলেন যারা নিম্প্রাণ মূর্তিগুলো পূজা করাকে অসার মনে করতেন। তাঁদের কেউ কেউ হানিফ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তিগুলোর সংস্পর্শে আসায় মুহাম্মদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এ-সময় তিনি একবার সিরিয়ায় বাণিজ্য ভ্রমণে যান। বাইরের জগতের সাথে নিজের অঞ্চলের লোকজনের সংস্কার-কুসংস্কার-প্রথা-নিয়ম-নীতি পালনে বিশাল পার্থক্য মুহাম্মদের কাছে দৃশ্যমান হয় এই সফরের সময়। ধর্মপুস্তকপ্রাপ্ত (ইহুদি ও খ্রিস্টান) লোকদের উপাসনালয় দেখে এবং যাজক- পুরোহিতদের সাথে আলাপ করে মুহাম্মদ তাঁদের নবি এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারেন। এরপর মুহামদ নিজের ধারণায় প্রত্যয়ী হন।
(দুই) যখন একেশ্বরবাদ এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে পাওয়া মতবাদ মুহাম্মদের জীবনের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল, ঠিক সে- সময় তিনি মক্কার এক ধনী নারীকে ( খাদিজা) বিয়ে করেন। ফলে মুহাম্মদ বস্তুজীবনের বিড়ম্বনা থেকে নিকৃতি পেয়ে যান। মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন- নওফল ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর সাথে ঘন-ঘন সাক্ষাত মুহাম্মদের আসক্তিতে পরিণত হয়। মুহাম্মদের মন সর্বদা আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো এক সর্বশক্তিমান এবং ঈর্ষাপরায়ণ স্রষ্টার উপর। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস হলো যে, এই স্রষ্টা নিশ্চয়ই চান না, হেজাজের লোকজন অন্য দেবদেবীর পূজা করুক। ইহুদি- খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে এবং লোককাহিনিতে বর্ণিত, পৌত্তলিকতা উপাসনার অপরাধে সর্বশক্তিমান এক ঈশ্বর আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন – এই বর্ণনা পাঠে মুহাম্মদের মনে আশংকার সৃষ্টি করে। তিনি চিন্তা করলেন যে তাঁর নিজের লোকজনও একইভাবে দেবদেবীর উপাসনায় নিয়োজিত। এ- অপরাধে তাই স্রষ্টা হয়তো খুব শীঘ্ৰ তাদের এক ঘোরতর সাজা দিবেন। এ- অবস্থায় তাঁর নিজের জরুরি কর্তব্য লোকজনদের পথ দেখানো। মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাঁর আশংকা মিলে যায়। তিনি দাবি করতে শুরু করেন যে স্রষ্টা ( পরে আল্লাহ হিসেবে সম্বোধন করেন) তাঁকে দৈববাণী পাঠাচ্ছেন মক্কাবাসীকে হুশিয়ার করতে। বিবি খাদিজা এবং ওয়ারাকা বিন- নওফল মুহাম্মদের ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের দাবির সত্যতা মেনে নেন। তাঁরা জানালেন আল্লাহ-ই মুহামদকে অনুপ্রাণিত করেছেন। নিজের ঘর থেকে সমর্থন পেয়ে মুহাম্মদ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস জন্ম নিল যে আল্লাহ তাঁকেই মনোনীত করেছেন হেজাজের জনগণকে সাবধান বাণী জানানোর জন্য। যেমন করে স্রষ্টা হুদ এবং সালেহকে নবি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যথাক্রমে আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে সাবধান করার জন্য। মুহাম্মদ আরও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, নবি শুধুমাত্র ইহুদিদের মধ্য থেকেই আবির্ভূত হবেন তা নয়। আরব এবং ইহুদিরা একই বংশের লোক। তাই নবি আরবদের মধ্য থেকেও আসবে। এই বিশ্বাস আর আধ্যাতিক সন্ধিক্ষণে আচ্ছন্ন অবস্থায় মুহাম্মদ চল্লিশ বছরে পদার্পণ করলেন এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট তাঁর নতুন মতবাদ প্রচার শুরু করেন।
(তিন) মুহাম্মদ ওই সময়ের যতো চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করেছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই একমত ছিলেন যে, মানুষের হাতে তৈরি প্রস্তর- মূর্তির উপাসনা করা আসলে অকার্যকর। তিনি আশান্বিত হয়ে গেলেন যে, অতি মতবাদ মেনে নিলেন। ফলে হতাশ হবার কোনো কারণ থাকল না। মুহামদ জোরেশোরে চালাতে থাকলেন তাঁর প্রচার কাজ। এ-সময় ওহি আসে ; তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও। (সুরা শোআল্লারা ; আয়াত ২১৪) । কিন্তু এবার মুহাম্মদের ভাবনার সাথে পরিস্থিতি অনুকূল হলো না। তাঁর লোকজন তাঁকে উপহাস আর অবজ্ঞা করল। মুহাম্মদ ছিলেন সরল মনের ব্যক্তি। তিনি ভেবেছিলেন উপকারী বক্তব্য এবং যুক্তিপূর্ণ বাণী দিয়ে অতি সহজে তাঁদের মনে রেখাপাত করতে পারবেন। কিন্তু তা হলো না। আরবেরা যে তাদের সনাতন ধর্মের প্রতি এতোই অনুরক্ত থাকবে, মুহামদ তা শুরুতে ধরতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে পুরানো ধর্মকে উৎখাত করতে। কিন্তু পুরনো ধর্মব্যবস্থা ছিল কুরাইশ নেতাদের প্রচুর ধনসম্পদ এবং খ্যাতি ও যশের ভিত্তি। তাই মুহাম্মদের মতাদর্শ শুনে তারা প্রমাদ গুণলেন এবং নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে মুহাম্মদের চরম বিরোধিতায় নামলেন। মুহামদের চাচা আবু লাহাব ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথে প্রকাশ্যে বৈরিতা ঘোষণা করেন। একদা কুরাইশ প্রধানদের সভায় আবু লাহাব ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠেন : “তুমি ধ্বংস হও, মুহাম্মদ! আমাদের কি এইসব আবোল-তাবোল শোনানোর জন্য ডেকেছ?”
(চার) ওই সময় মাখজুম গোত্র এবং আবদে মনাফের বংশধরদের মধ্যে বিরোধ বাধে। আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে মাখজুম গোত্রের ভবিষ্যত নেতা আবু জেহলের এক উক্তি থেকে তৎকালীন নেতাদের মনোবৃত্তির স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মাখজুম গোত্র তখন অবস্থা- প্রতিপত্তি- সহায়- সম্পদে বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। তাই আবু জেহেল নবি হিসেবে সাজিয়েছে। এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হোসেন বিন আলিকে উদ্দেশ্য করে এক কবিতা রচনা করেন। এই কবিতায়ও একই মনোভাব প্রকাশ পায়। ইয়াজিদ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন : হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে। কিন্তু কোনো বার্তা আসেনি, কোনো দৈববাণীও আসেনি। কী উদ্দেশ্যে কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরোধিতা করেছে তা আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে আবু জেহেলের উক্তি থেকে পরিষ্কার। মুহাম্মদ ছিলেন গরীব অনাথ। জীবনযাত্রার জন্য নির্ভরশীল ছিলেন স্ত্রীর সম্পদের উপর। এহেন দুঃস্থ ও নির্ভরশীল ব্যক্তির সাথে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নীত পদমর্যাদার অধিকারী ও ধনী কুরাইশ নেতাদের কোনো তুলনা হবার নয়। মুহাম্মদের ধর্মপ্রচার সফল হলে এই নেতাদের অবস্থান হয়ে পড়বে দুর্বল। এমনও হতে পারে যে, তাঁরা নিজেদের এতোদিনের সমানের আসন থেকে পড়ে যেতে পারেন। সত্য হচ্ছে যে, আবদুল মোতালেবের গোষ্ঠী কখনো মুহাম্মদের সমর্থক ছিলেন না। এমন কি আবু তালেব ও নবির অন্য চাচারা চান নাই কুরাইশ বংশের উপগোত্রের মধ্যে ফাটল ধরুক। নবুওতির দাবির পর মুহাম্মদ তের বছর মক্কায় বসবাস করেন। ক্রমে তিনি দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পারেন কুরাইশরা তাঁকে অবজ্ঞা করবে এবং তাঁর বিরোধিতা করে যাবে। শেষমেশ তাই-ই হল। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মুহাম্মদ ভাবলেন, প্রস্তুতি না নিয়ে তাঁর হয়তো উচিত ছিল না নবুওতির দাবিতে আত্মোৎসর্গ করা। ওয়ারাকা বিন- নওফল, ওমায়া বিন আবু-সালাত, এবং কাস বিন সায়েদার মতো একেশ্বরবাদীরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেই চুপচাপ থাকতেন। পরে তাঁরা নিজ নিজ পথে চলে যান। মুহামদ একবার চিন্তা করলেন যে তাঁরও হয়তো এ- রকম করা উচিত। মুহাম্মদের নবুওতির কর্মজীবন পর্যালোচনা করে বুঝা যায় যে, তিনি তাঁর বিশ্বাসে শেষমেশ এতোই অটল হলেন যে কোনো কিছুতেই তিনি আর ভীত বা নিরুৎসাহ হতেন না। কাজেই তাঁর লক্ষ থেকে তিনি পিছপা হলেন না। সকল বাধা সত্ত্বেও একবিশ্বাসে নিবিষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। হেজাজের জনগণকে নিজের বিশ্বাসে চালিত করার দায়িত্ব তিনি পালন করে গেলেন প্রায় ত্রিশটি বছর। শুধু বিশ্বাসের শক্তি নয়, মুহাম্মদের বাকপটুতা ছিল অসাধারণ। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা- বঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে এই গুণ থাকা সত্যি ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। তিনি আবেগপূর্ণ ভাষায় জনতাকে সুনীতিসম্পন্ন, সৎ এবং দয়াশীল হতে বলতেন। শোভন ব্যবহার, ন্যায়পরায়ণতা, এবং কর্তব্যনিষ্ঠতা যে মুক্তির পথ, তা প্রমাণের জন্য জন্য ভুরিভুরি উদাহরণ দিলেন অতীতের নবিদের কাহিনী থেকে।
(পাঁচ) অতীত ইতিহাস গবেষণা থেকে এটা এখন প্রমাণিত যে, মক্কার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মূর্তি পূজার বিরোধিতাকারী হানিফসহ বিভিন্ন একেশ্বরবাদীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তির দিকে ছিল। মক্কায় ধনী এবং ক্ষমতাশালী লোকদের চেয়ে অভাবী-দরিদ্র, বিত্তহীন লোকের সংখ্যা বেশি ছিল। ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই এই অভাবী-নিঃস্ব মানুষের পক্ষ হয়ে কথা বলতে লাগলেন তিনি। পৃথিবীর যাবতীয় বিপ্লবের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সকল বিপ্লবের আসল সৈনিক হচ্ছে বঞ্চিত এবং অত্যাচারিত জনগণ। স্বাভাবিকভাবে মক্কার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা অলস হয়ে বসে ছিলেন না। অসহায়, গরীব মানুষ যারা মুহাম্মদের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন, তাদেরকে নিয়ত নির্যাতন এবং হয়রানি করা হতে লাগল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মুহাম্মদ এবং সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিম, মক্কার প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য যেমন আবু বকর, ওমর, হামজাকে কোনো প্রকার উৎপীড়ন করতেন না। নিঃস্ব মুসলমানদের প্রায়শ ভয়ভীতির সম্মুখীন হতে হতো। তারাই ছিল নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তি, যেমন করে পিরামিডের ভিত্তি থাকে। এ- অবস্থায় তের বছর ধরে মুহামদ তাঁর প্রচারণা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর ভক্তের সংখ্যা একশ’র বেশি হলো না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এখান থেকে একমাত্র উপসংহার টানা যায় : মুহামদের সব নির্ভুল প্রচার, বাকপটুতা, কঠোর সংযম, এবং দোজখের ভয় দেখানো কোনোটাই কাজে আসল না। মক্কায় ইসলাম প্রচারে মুহাম্মদের যে নিরলস পরিশ্রম ছিল, তার প্রাপ্য তিনি পেলেন না।
(ছয়) শেষ পর্যন্ত নবিকে অস্ত্র তুলে নিতে হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। এছাড়া তাঁর আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ সবই তিনি করলেন। এখানে একটি বিষয় আমাদের সারণে রাখা উচিৎ, কার্য সম্পাদনের জন্য শক্তি প্রয়োগ শুধু নবি একাই করেননি। শক্তি প্রয়োগ আরব জাতির এক পুরনো অভ্যাস। হেজাজ এবং নেজদের মরুভূমির কঠোর পরিবেশে আরবদের কৃষিকাজের তেমন কোনো সুযোগ ছিল। তাঁরা তখন মনুষ্য- রচিত বা ঈশ্বর- প্রদত্ত দাবিকারী কোনো আইনের অধীনে বাস করত না। সাধারণত আরব বেদুইনদের জীবন চলত অন্য দলের উপর লুটতরাজ এবং হানাহানি করে। এই অবিরাম হানাহানি থেকে কিছুসময় বিশ্রাম নেবার জন্য তাঁরা বছরের চারটি মাস নির্ধারণ করেছিলেন যখন কেউ কারো উপর আক্রমণ করবেন না। এই চারটি মাসকে তাঁরা পবিত্র মাস হিসাবে গণ্য করতেন। বছরের অন্য সময়ে এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের এই লুটতরাজ, খুনোখুনি এবং নারীদের অপহরণের হাত থেকে দূরে থাকার একটি উপায় ছিল সদা সতর্ক থাকা এবং নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা। যখন মদিনায় বসবাসকারী আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা মুহামদের জীবন-রক্ষার আশ্বাস প্রদান করেন তখন তিনি মদিনাতে গমন করেন। মদিনায় তখন মুহাম্মদের মাতা আমিনার বংশের লোকেরা বসবাস করতেন। মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। মুহাম্মদ জীবনে যতো যুদ্ধ, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রায় সবই হয়েছে মদিনাতে আসার পর। এখানে নবির প্রধান লক্ষ ছিল মদিনা এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়গুলো। ইহুদি গোত্রগুলোর সাথে সংঘর্ষ থেকে নবি তাঁর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি পেলেন। এই ইসলামি রাষ্ট্রের আইনকর্তা রাষ্ট্রের প্রধান কার্যনির্বাহক এবং সামরিক প্রধান হলেন মুহামদ নিজেই। এবার নতুন এই রাষ্ট্রের উন্নতি এবং পরিসরে বিস্তৃতিতে মুহামদ পূর্ণমাত্রায় মনোনিবেশ করতে পারলেন।
(সাত) প্রাক-ইসলামি যুগে আরববাসী ছিল একইসাথে বাস্তববাদী এবং আবেগপ্রবণ। একটি আবেগময় কবিতা শুনে তাঁদের মন হয়ে যেত আন্দোলিত আবার কোনো কদৰ্য কবিতা শুনলে তাঁরা হত্যা করতেও উদ্যত হয়ে যেত। তাঁদের চিন্তাভাবনা ছিল সবসময় বৈষয়িক বিষয়াবলী এবং দৈনিক অভিজ্ঞতার উপরে। কোনো রকম আধ্যাতিক, অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক বিষয় তাঁদের ধর্তব্যের বাইরে ছিল। সহিংসতা তাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আইন ও বিচারের প্রতি তাঁদের কোনো ভ্রক্ষেপ থাকত না। লুটের মাল হস্তগত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবই করতে প্রস্তুত ছিল তাঁরা। একজন ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেছেন, আরব বেদুইন কোনো সময়ে ভিন্ন দলের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলে সে শক্রদলে যোগদান করতে দ্বিধা করত না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আরব বেদুইনদের এই ব্যবহার ছিল ব্যতিক্রমী। যে সমাজে কোনো সংগঠিত সরকার ছিল না, ছিল না কোনো শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা, সেই সমাজকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হতো ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ভীতির উপর।
আরবরা দম্ভ এবং আত্মপ্রশংসা করতে ভালবাসে। তাঁরা যে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোত্রগত গুণাবলী অতিরঞ্জিত করত তা নয়, তাঁরা তাদের দোষক্রটির জন্য পর্যন্ত গর্বিত থাকত। আত্মসমালোচনা করা তাঁদের অভ্যাসে ছিল না। ভোরবেলায় অপহরণ করা নারীকে ধর্ষণ করার পর তাঁরা কবিতা রচনা করত। এ- কবিতায় নিজেরা নিজেদের হিমতের বড়াই এবং সাহস প্রকাশ করত আবার ভুক্তভোগী নারীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিত। যেভাবে বেদুইন কবিরা তাঁদের আদিম সহজাত মনোবৃত্তি প্রকাশ করত তা সভ্যতার কোনো পর্যায়েই তা পড়ে না। বেদুইনদের আধ্যাত্মিক এবং অলৌকিক ধারণা বলতে যা কিছু ছিল তা মূলত পার্থিব জগত থেকে নেয়া কোনো মনগড়া চিত্র। একই রকম মানসিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি ইসলামি-যুগেও, বিশেষ করে হানবলিদের মধ্যে। হানবলিরা যে কোনো রকমের যৌক্তিক এবং বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনাকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। [ সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক আহমদ ইবনে হানবলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারীদের হানবলি বলা হয়। হানবলিরা ধর্মীয় বিষয়াবলীতে চরমপন্থা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সিরিয়া এবং ইরাকে হানবলিদের প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। আধুনিক ইসলাম-গবেষকরা হানবলিদের কট্টরপন্থী ওয়াহাবিবাদ, সালাফি মতাদর্শের পূর্বসূরি বলে অভিহিত করে থাকেন। -অনুবাদক ।]
(আট) হিজরি সনের প্রথম দশ বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি মুহাম্মদ আরবদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর সুযোগ নিয়েছিলেন ইসলামের সাফল্য এবং শক্তি প্রয়োগের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে নবি পরাজয়ের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য দুর্বল গোত্রকে আক্রমণ করতেন। ফলে আরবের সাধারণ জনগণ সর্বদা আতঙ্কে থাকত। কোনো দুর্বল গোত্রের পরাজয় ইসলামের জন্য এনে দিত সফলতা নয়ত, আক্রমণ না- করার চুক্তি। ইসলামের বিস্তারের পিছনে রয়েছে আরবদের গনিমতের মালের প্রতি আকর্ষণ। গনিমতের মালের অংশ পাবার জন্য অনেকে জিহাদে যোগদানের আগ্রহ দেখায়। যারা জিহাদে যাবে তাদেরকে আল্লাহ গনিমতের মালের প্রতিশ্রুতি দিলেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির পর আল্লাহ বললেন : ‘আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে। তিনি তোমাদের জন্য এ ত্বরান্বিত করবেন। তিনি তোমাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন যেন বিশ্বাসীদের জন্য এ হয় এক নিদর্শন আর আল্লাহ তোমাদেরকে এ দিয়ে সরল পথে পরিচালনা করেন। (সুরা ফাতহ ; আয়াত ২০) । এছাড়া বেহেশতের অশেষ সুখের উৎসাহ দিয়ে বলা হলো : যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিচে নদী বইবে। এ-ই মহাসাফল্য। (সুরা বুরুজ ; আয়াত ১১) । নবির অনুসারীদের মধ্যে কতজন সুযোগ-সন্ধানী ছিলেন তাঁর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত কেউ সংকলন করেন নাই। তথাপি অনুমান করা যায় যে, নবির মৃত্যু অদি যত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের একটা বেশ বড় অংশই ভীতি অথবা সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, নবির মৃত্যুর পরপরই বিপুল সংখ্যক আরব ইসলাম ত্যাগ করে আবার পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়, যার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও চালাতে হয় খলিফাদের।
মদিনা ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। এখানেও হজরত আলি বিন আবু তালেব, আমার বিন ইয়াসির এবং আবু বকর আস-সিদিকদের মতো ত্যাগী ও সৎ লোকের সংখ্যা ছিল অতি-নগণ্য। বেশির ভাগই ইসলাম গ্রহণ করেছিল গভীর বিশ্বাস থেকে নয়। বরং বিভিন্ন সুবিধা পাবার আশায়। নবির মৃত্যুর পরে ক্ষমতা দখল নিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলী এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নবির মৃত্যুর পরে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিরোধ লাগে ক্ষমতা দখল নিয়ে। এই বিরোধ- হাঙ্গামার জন্য নবির শবদেহ সৎকারে বিলম্ব ঘটে যায় তিন দিন পর্যন্ত। হজরত আলি, তালহা এবং জুবায়ের থেকে গেলেন ফাতেমার ঘরে। তাঁরা প্রতিদ্বন্দীদের নিয়ে যে ঝগড়া চলছিল তার সম্বন্ধে কিছুই জানলেন না। আবু বকর, ওমর, আবু উবায়দাসহ আরও কয়েকজন সাহাবি বিবি আয়েশার ঘরে ছিলেন। এ- সময় মদিনার আনসাররা খাজরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন ওবায়দার নেতৃত্বে এক গৃহে সমবেত হন। একজন ব্যক্তি বিবি আয়েশার গৃহে এসে আবু বকর এবং ওমরকে জানালেন, ক্ষমতা আনসারদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা থামাতে হবে। আনসাররা কী করছিলেন তা জানার জন্য সাথে সাথে হজরত আবু বকর এবং ওমর সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন সাদ বিন ওবায়দা তাঁদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমরা হচ্ছি আনসার। আমরাই ইসলামের আসল সৈনিক। আমরা ছিলাম নবির সমর্থক। আমাদের পেশিবহুল বাহুর জন্য ইসলামের শক্তি এসেছে। আর মক্কাবাসী তোমরা হচ্ছ মুহাজির। তোমরাও সাহায্য করেছ। তাই এসো, তোমরা আমাদের সাথে যোগদান কর। একথা শোনার সাথে সাথে ওমর ক্ষুব্ধ হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু আবু বকর ওমরের হাত ধরে তাঁকে থামালেন। এরপর আবু বকর তাঁর স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠস্বরে সাদ বিন ওবায়দাকে বললেন : ‘আনসারদের সম্পর্কে আপনি যা বলেছেন তা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষমতার আইনসমত অধিকার আছে শুধুমাত্র কুরাইশদের। কারণ কুরাইশরা অন্যান্য আরব গোত্রের উর্ধ্বে। তারপর আবু বকর করমর্দন করলেন ওমর এবং আবু উবায়দার সাথে এবং আনসারদের উদ্দেশ্যে বললেন : আপনারা তাঁদের যে কোনো একজনের প্রতি আনুগত্য প্রদান করুন।”
ওমর ছিলেন বাস্তব ও দূরদর্শী ব্যক্তি। তিনি এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে গা ভাসাতে চাননি। ওমর বুঝলেন ক্ষমতা দখলের এই যে পরিস্থিতি, তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে আবু বকরকে সবাই নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নেয়া। কারণ আবু বকরই ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাজির এবং তিনি নবির সাথে একই গুহায় বিপদসংকুল অবস্থায় বাস করেছিলেন। নবি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন নবি আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিয়েছিলেন। এসব কারণ চিন্তা করে ওমর উঠে দাঁড়ালেন এবং আবু বকরের সাথে করমর্দন করে তাঁর প্রতি নিজের আনুগত্যের ঘোষণা জানালেন। এভাবে ওমর এক ধাক্কায় নেতৃত্বের সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ওমরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ তর্ক করার অবকাশ পেলেন না। স্বাভাবিকভাবেই মুহাজিররা ওমরের আদেশ অনুসরণ করলেন তবে আনসাররা তাৎক্ষণিকভাবে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিছু সময় পরে তাঁরাও আবু বকরের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। কথিত আছে যে, ওমর মদিনার খাজরাজ গোত্রের বয়োবৃদ্ধ ও রোগাক্রান্ত নেতা সাদ বিন ওবায়দার ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা দেখে এতোই ক্রোধান্বিত হন যে, তিনি তাঁকে সভাকক্ষের বাইরে টেনে নিয়ে আসেন এবং কয়েকজনের সাহায্যে বেদম প্রহার করেন। কথিত আছে, এ- প্রহারেই সাদ বিন ওবায়দা” ঘটনাস্থলেই মারা যান। হজরত আলি বিন আবু তালিব প্রথমে আবু বকরের খেলাফতের প্রতি আনুগত্য জানালেন না। কিন্তু ওমর ভালোভাবেই জানতেন, আলি সমর্থন না দিলে অচিরে হাশেমি গোত্রের অনেকেই আলির পথ অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ আবু বকর হাশেমি গোত্রের পূর্ণসমর্থন হারিয়ে ফেলবেন। ফলে আবু বকরের খেলাফত নিরাপদ থাকবে না। সে- জন্য ওমর প্রতিনিয়ত আলির সাথে দেখা করতে লাগলেন, আলাপ-আলোচনা, তর্ক চালালেন। শেষ পর্যন্ত ছয় মাস পরে আলি আবু বকরের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা দেন।
(নয়) মক্কার তের বছর বাদ দিলে ইসলামের ইতিহাসে বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে যুদ্ধ এবং ক্ষমতার লড়াই। নবি জীবিত থাকাকালীন সময়ে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল ইসলামের প্রসারের জন্য। পৌত্তলিকদের ইসলাম মেনে নিতে বল প্রয়োগও হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যে বারংবার বিরোধ আর সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার কারণ ছিল ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দিতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আবু বকরের ক্ষমতা দখল সম্ভব হয়েছে ওমরের দক্ষতার জন্য। মৃত্যুকালীন সময়ে আবু বকর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ওমর হবেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত। কোনো সমস্যা ছাড়াই আবু বকরের মৃত্যুর পর ওমর খলিফা হয়ে যান। কেউ তাঁর বিরোধিতা করেননি। দশ বছর পর ওমর তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তে ছয় সদস্য বিশিষ্ট এক পরিষদ গঠন করেন তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করার জন্য। এই পরিষদের সদস্যরা ছিলেন: আলি, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আউফ, তালহা, জুবায়ের এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস। এই পরিষদ যখন বৈঠকে বসে তখন কেউই খলিফার পদের জন্য কারো নাম প্রস্তাব করেননি। কারণ প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন খলিফা হতে। আব্দুর রহমান বিন আউফ খলিফা পদের প্রার্থী হওয়া থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। কেউ কোনো মন্তব্য করলেন না। তখন আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে পরিষদের বৈঠক তিনদিনের জন্য মুলতুবি রাখা হল। এমনটি করা হলো মুহাজির ও আনসারদের মনোভাব বোঝার জন্য। এই তিনদিন আব্দুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে পরিষদের প্রত্যেক সদস্যদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তাদের কী ধারণা অন্যদের সম্পর্কে। শোনা যায় আব্দুর রহমান হজরত উসমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন উসমান যদি খলিফা মনোনীত না হন, তবে তিনি কাকে প্রস্তাব করবেন খলিফা হবার জন্য। উসমান জবাব দিলেন, খলিফা পদের জন্য আলিই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। আব্দুর রহমান তখন আলিকে একই প্রশ্ন করলেন। আলিও উত্তর দিলেন খলিফা পদের জন্য উসমানই হবেন যোগ্যতম ব্যক্তি। এ- থেকে সবাই বুঝতে পারলেন, পরবর্তী খলিফা হবেন আলি অথবা উসমান।
এই দুজনের (আলি এবং উসমানের) চরিত্রে অনেক পার্থক্য ছিল। উসমান ছিলেন আয়েশি, বিনয়ী, নিরহঙ্কার এবং উদার। আলি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর সাহস, অনুরক্ততা এবং ধর্মীয় ব্যাপারে কঠোরতার জন্য। ওমর ছিলেন ভীষণ কঠোর এবং প্রচণ্ড মিতব্যয়ী। তাই ওমরের দশ বছরের শাসন ছিল অনেকের কাছে অসহনীয়। ভোগবাদী ব্যক্তিদের কাছে ওমরের শাসন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই তাঁরা চাচ্ছিলেন না আলির শাসন আসুক। কারণ তাঁরা জানতো আলির শাসনও হবে ওমরের মতোই কঠোর এবং আত্মসংযমী। কোরানের বিশিষ্ট সুন্নি তফসিরকারক এবং পারস্যের মুসলিম পণ্ডিত আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল-তাবারির (৮৩৮- ৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) মতে, এই ব্যক্তিরা কুরাইশ বংশের বানু সাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আসকে নিয়োগ করলেন মধ্যস্থতার জন্য। একদিন আমর আলির সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে জানালেন যে আব্দুর রহমান বিন আউফ প্রথমে আলিকে খলিফার পদ নিতে প্রস্তাব করবেন। কিন্তু আলির মতো উচ্চাসনের ব্যক্তির উচিত হবে না, সাথে সাথে আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে রাজি হওয়া। খলিফার পদের মর্যাদা এবং সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দ্বিতীয়বার যেন আব্দুর রহমান আলিকে এই পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। যে দিন পরিষদের বৈঠক বসার কথা ছিল, সেদিন আব্দুর রহমান মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে আলির দিকে মুখ করে বললেন : তিনিই (আলি) হচ্ছেন একত্রে নবির চাচাতো ভাই এবং জামাতা, প্রথম মুসলিম এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত সৈনিক। আলি যদি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শ পালন করবেন, এবং আগের দুই খলিফাদের (আবু বকর ও ওমর) উদাহরণ অনুকরণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) আলিকে খলিফা মেনে আলির প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করবেন। আলি উত্তর দিলেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির রীতি-নীতিতে থাকবেন এবং যা উত্তম মনে করবেন তাই করবেন। এরপর আব্দুর রহমান উসমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আলির পর তিনিই হচ্ছেন খলিফা পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। উসমান যদি অঙ্গীকার করেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শকে অনুসরণ করবেন এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার উদাহরণ গ্রহণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানাবেন। উসমান একইভাবে অঙ্গীকার করলেন এবং আলিকে বাদ দিয়ে আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি আনুগত্য জানালে উসমান খলিফা হয়ে গেলেন। এটা হচ্ছে তাবারির বক্তব্যের সারাংশ। যদিও এখানে পুনরাবৃত্তি দেখাবে তবুও তাবারির বই থেকে বালামির” ফার্সি অনুবাদ তুলে দেয়া হলো। এখানে আমরা দেখতে পাই, ওমরের খেলাফতে জনগণ বিরক্ত হয়ে উঠলে নবির কয়েকজন সাহাবির মনে প্রাধান্য পায় ক্ষমতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষ।
হিজরত ওমর মারা গেলে মরুভূমির বেদুইনরা ওমরের জন্য শোক-বিলাপ করতে মদিনায় আসেন। আব্দুর রহমান তাঁদের সাথে আলাপ করলেন। তাঁদের প্রত্যেকে বললেন, উসমান হবেন খলিফার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি। এক সন্ধ্যায় আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে দেখা করলেন। আবু সুফিয়ান আমরকে জানালেন যে, ওই সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান তাঁর সাথে দেখা করে বলেছেন, যে খলিফা পদের জন্য দুজন প্রতিদ্বন্দী রয়েছেন, তাঁরা হলেন উসমান এবং আলি। আবু সুফিয়ান বললেন, তিনি উসমানকে পছন্দ করেন। আমর ইবনে আল-আস বললেন, ইতিমধ্যে আব্দুর রহমান তাঁর সাথেও এই ব্যাপারে দেখা করেছেন। এরপর আমর বললেন, আবু সুফিয়ানের মতো তিনিও উসমানকে খলিফা হিসাবে পছন্দ করবেন। এরপর আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন: আমরা কি করতে পারি? উসমান হচ্ছেন আয়েশি; তাই হয়ত অনেক ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে তাঁর কর্তব্য অন্যের উপর বর্তে দিতে পারেন। কারো অনুপস্থিতে হয়তো আলি খলিফা হয়ে যেতে পারেন। আবু সুফিয়ান আমরের গৃহে সেই রাত কাটালেন এবং আমরকে বারবার জিজ্ঞাসা করলেন কী উপায়ে উসমানকে খলিফা নিশ্চিত করা যায়। সে রাত্রে আমর আলির গৃহে গেলেন এবং আলিকে বললেন : আপনি জানেন যে আমি আপনার বন্ধু। সেই পুরনো দিন থেকেই আপনি আমার কাছে প্রিয়। খলিফা পদের প্রার্থীর জন্য অন্য সবাই সরে গেছেন। এখন শুধু আপনি আর উসমান রয়েছেন এই পদের জন্য। আজ সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অনেকে আপনাকে চায়, আবার অনেকে উসমানকে চায়। এখন আব্দুর রহমান আমার সাথে আলাপ করলেন। আমি তাঁকে জানিয়েছি, আমি আপনাকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাই। আপনি যদি আমার কথায় মত দেন তবে আমি বলতে পারি, আগামীকালই আপনি খলিফার পদ পেয়ে যাবেন। আলি উত্তর দিলেন : ‘আপনি যা বলবেন আমি তা মানব।” আমর বললেন : “প্রথমে আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে আমাদের এই কথোপকথন আপনি কাউকে জানাবেন না। আলি এই ব্যাপারে আমরকে অঙ্গীকার দিলেন। আমর বললেন : আব্দুর রহমান একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি আপনাকে চাইবেন যখন তিনি দেখবেন যে আপনি সংশয়ী এবং খলিফার পদ নিতে বিলম্ব করছেন। তিনি যদি দেখেন যে আপনি খলিফার পদের জন্য অধীর এবং পদটা পেলে সাথে সাথে নিয়ে নিবেন তখন তিনি আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবেন । আলি উত্তর দিলেন ; আমি আপনার কথামত চলব। পরে, ওই রাতে আমর উসমানের গৃহে গিয়ে উসমানকে বললেন : আগামী কালই আপনি খলিফা হয়ে যাবেন যদি আপনি আমার কথা শোনেন। আর আপনি যদি আমার কথায় মন না দেন তবে আলি আপনার কাছ হতে খলিফার পদ কেড়ে নিবেন। উসমান বললেন : ‘আমি আপনার কথায় কান দিচ্ছি, আপনি বলুন। এরপর আমর বললেন: আব্দুর রহমান একজন সৎ এবং অকপট ব্যক্তি। কেউ কিছু সতর্কভাবেই বলুক বা স্পষ্টভাবেই বলুক, আব্দুর রহমান তার কোনো তোয়াক্কা করেন না। তাই আগামীকাল আপনাকে খলিফার পদের জন্য আহ্বান করা হলে আপনি অনিচ্ছা দেখাবেন না। কোনো শর্ত দেয়া হলে তাতেও অসমতি জানাবেন না। তিনি যা বলবেন আপনি সাথে সাথে তার সাথে রাজি হয়ে যাবেন । উসমান উত্তর দিলেন: আপনি যে পরামর্শ দিলেন আমি তা মেনে চলব। এরপর আমর উঠলেন এবং নিজের গৃহে ফিরে গেলেন।
পরের দিন আমর মসজিদে গেলেন। ভোরের নামাজে আব্দুর রহমান ইমামতি করলেন। তারপর আব্দুর রহমান প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘আল্লাহ ওমরকে আশীৰ্বাদ করুন। আপনারা সবাই জানেন যে ওমর তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম বলে যাননি। তাঁর স্থলাভিষিক্তের নাম বলে গেলে তিনি যে পাপ বা পুণ্যের মালিক হতেন তার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাই তিনি তা না করে আমাদের পাঁচ জনের উপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সাদ এবং জুবায়ের তাদের মতামতের ভার আমার উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। আর আমি খলিফা পদের প্রার্থী থেকে আমার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এখন পছন্দের জন্য দুইজন রয়েছেন, আলি এবং উসমান। আপনারা কাকে চান? আমি কার প্রতি আমার আনুগত্য দেখাব? আপনারা এই নামাজের পর গৃহে ফেরার আগে আমাকে জানান কে হবে বিশ্বাসীদের শাহজাদা? কেউ কেউ চাইলেন আলিকে, আবার কেউ চাইলেন উসমানকে। এই নিয়ে উভয় পক্ষে চলল হট্টগোল। সাদ বিন জিয়াদ তখন আব্দুর রহমানকে বললেন: আমরা আপনাকে সবচেয়ে পছন্দ করি। আপনি নিজেই আপনার উপর আনুগত্য জানান, কেউই তাতে আপত্তি জানাবে না। আব্দুর রহমান বললেন: এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিতর্ক বন্ধ করুন। ভালোভাবে চিন্তা করুন, এই দুজনের মধ্যে কে আপনাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবেন। আমার বিন ইয়াসির বললেন : বিরোধ এড়াতে চাইলে আপনি আলির উপর আনুগত্য দিয়ে দিন। মেকাদা” বললেন ; আমার সঠিক বলেছেন। আপনি আলির প্রতি আনুগত্য দেখালে কেউ তার বিরোধিতা করবেন না। আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ” (তিনি হজরত উসমানের দুধ- ভাই। ইসলাম ত্যাগ করে পরবর্তীতে নবির মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে আবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে খলিফা উসমানের আমলে মিশরের গর্ভনর নিযুক্ত হন) জনতার মাঝে উঠে দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আপনি উসমানের উপর আনুগত্য না দেখালে কিছু লোক আপনার বিপক্ষে যাবে। আব্দুল্লাহকে অভিশাপ দিয়ে আমার বললেন ; ওহে ধৰ্মত্যাগী! তুমি এখানে কেন? আমাদের জন্য কে হবেন বিশ্বাসীদের শাহজাদা তা তোমার মতো মুসলিমের বলার প্রয়োজন নাই। মাখজুম গোত্রের এক ব্যক্তি আমারকে উদ্দেশ্য করে বললেন ; ওহে ক্রীতদাস এবং ক্রীতদাসের সন্তান। তুমি এখানে কুরাইশদের বিষয়ে নাক গলাচ্ছ কেন?
উপস্থিত মুসলমানরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে শুরু হল তুমুল বিবাদ। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুর রহমানকে বললেন : ‘এখনি এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করুন। নয়তো খুনোখুনি লেগে যাবে। আব্দুর রহমান আবার উঠে দাঁড়ালেন, এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আপনারা শান্ত হোন। আমি যেভাবে ভাল বুঝি সেভাবে সমাধান করছি। এবার জনতা চুপ হল। আব্দুর রহমান আলিকে ডাকলেন : ‘আলি, আপনি দাঁড়ান। আলি দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছে গেলেন। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত দিয়ে আলির ডান হাত ধরলেন। নিজের ডান হাত উত্তোলন করে আলির ডান হাত করমর্দনের প্রস্তুতি নিলেন এবং আলিকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? আলি সারণ করলেন রাত্রে আমরের দেয়া উপদেশ। আলি উত্তর দিলেন : “এই সব শর্তে কাজ করা দুরূহ হবে। আল্লাহ যেসব আদেশ দিয়েছেন তার সবগুলো আদেশ কেউ কি জানেন? আর নবির সকল সুন্নাহ কি কেউ জানেন? তবে আমার জ্ঞান, সাধ্য, এবং শক্তি অনুযায়ী আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। আমি আল্লাহর কাছে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছি। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত থেকে আলির হাত ছেড়ে দিলেন, এবং তখনও তাঁর নিজের হাত উত্তোলিত রেখে আলিকে বললেন : “আপনার শর্তে চললে শিথিলতা ও দুর্বলতা এসে যাবে। তারপর আব্দুর রহমান উসমানকে বললেন : আপনি এখানে আসুন। উসমান দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছ গেলেন। আব্দুর রহমান আগের মতো তাঁর বাম হাত দিয়ে উসমানের ডান হাত ধরলেন এবং বললেন : আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? উসমান উত্তর দিলেন: হ্যাঁ, আমি তা করব। আব্দুর রহমান এবার তাঁর ডান হাত দিয়ে আলির বাম হাত ধরে উসমানের হাতের উপর রাখলেন; এবং আব্দুর রহমান উসমানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বললেন: আল্লাহ আপনাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহ আপনাকে আশীৰ্বাদ করুন। উপস্থিত সবাই তখন উসমানের নিকটে গিয়ে উসমানের প্রতি তাঁদের আনুগত্য জানাল। আলি বিসিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে আলি বললেন : ‘আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আলি ভাবলেন আমর ইবনে আল- আস তাঁকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তা আব্দুর রহমান, উসমান, জুবায়ের এবং সাদের সাথে যোগসাজশ করেই দিয়েছেন।
হতাশ হয়ে আলি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং চলে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। আব্দুর রহমান আলিকে বললেন : আপনি কি আনুগত্য দেখাতে নারাজ? আল্লাহ বলেছেন : “যারা তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ নেয় তারা তো আল্লাহর আনুগত্যের শপথ নেয়। আল্লাহ ওদের শপথের সাক্ষী। সুতরাং যে তা ভাঙে ভাঙার প্রতিফল তারই, (সুরা ফাতহ ; আয়াত ১০) । আপনি কি জানেন না, আমি নিজেই এই প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে গিয়েছিলাম যেহেতু আমার ধারণা ছিল আমি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না কেন আপনি তা মেনে নিবেন? ওমর কি বলেননি যে আব্দুর রহমানের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না, তাঁকে মেরে ফেলতে হবে?’ এ- কথা শোনার পর আলি ফিরে গেলেন এবং উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য দিয়ে দিলেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হলো ওই দিনেরই অপরাহ্নের নামাজের আগে। এরপর উসমান ইমাম হলেন।
এ- হল তাবারির পূর্ণ বিবরণ। বিবরণ থেকে বুঝা যায় আলি খলিফা হলে কী হবে তা নিয়ে আৰু সুফিয়ান উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তাই উসমানের খলিফা হওয়া নিশ্চিত করতে আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে যোগসাজশ করছিলেন। ১২ বছর আগে যখন আবু বকর খলিফা হন তখন আবু সুফিয়ান এতোই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে, তিনি আলিকে প্ররোচিত করেছিলেন যেন আলি আবু বকরের প্রতি আনুগত্য না দেখান। এছাড়াও আবু সুফিয়ান বলেছিলেন প্রয়োজন পড়লে তিনি মদিনা ভরে দিবেন কুরাইশ সৈন্য দিয়ে। কিন্তু যখন সময় আসল আলি এবং উসমানের মধ্যে পছন্দের তখন আবু সুফিয়ান নিলেন উসমানের পক্ষ। তার কারণ ছিল আবু সুফিয়ান জানতেন উসমানের শাসন তাঁর জন্যে ভালো হবে। আবু সুফিয়ান আলিকে ভয় করতেন কারণ আলি ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ, যা আবু সুফিয়ানের জন্য বিপদসংকুল।
এটা এখন বলা যায়, ওমরের পর যদি আলি খলিফা হতেন তবে ইসলামের উজ্জ্বল দিনগুলি আরও অনেক দিন থাকত এবং ইসলামের প্রধান নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকত না। উসমানের স্বার্থপর আত্মীয়স্বজনেরা সুযোগ পেতেন না প্রধান প্রধান সরকারি পদগুলো কুক্ষিগত করতে। এছাড়া যেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুয়াবিয়া এবং উমাইয়া বংশের উত্থান হয় সেগুলোও এড়িয়ে যাওয়া যেত।
(দশ) নবির মৃত্যুর পর তাঁর সহচরেরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক দল তাঁকে সত্যি সত্যি আল্লাহর নবি’ হিসাবে গ্রহণ করেন আর আরেক দল তাঁকে গ্রহণ করেন এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানে অবদান রাখেন। তাঁরা মনে করতেন যে, তাঁরাই হচ্ছেন এই রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী এবং এর সংরক্ষণ ও প্রতিরক্ষার জন্য তাঁরা বাধ্য। কিন্তু উভয় দলই নবির প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় দলে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ওমর ছিলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাষ্ট্রের সংরক্ষণের প্রতি উদ্বেগ থেকে ওমরকে শক্তভাবে তরবারি ধরতে হয়। এই তরবারি উচিয়েই তিনি নবির গৃহের দরজা থেকে বের হয়ে নবির মসজিদে আসেন এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : নবি মুহাম্মদ মরেননি, নবি মুসার মতো তিনি চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকবেন। আবু বকর ওমরকে সারণ করিয়ে দিলেন কোরানের বাণী : তোমার মৃত্যু হবে, এবং তাদেরও। (সুরা জুমার ; আয়াত ৩১) । এরপর আবু বকর মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন : তোমরা যদি ব্যক্তি মুহামদকে উপাসনা করে থাকো তবে সেই মুহাম্মদ মৃত। কিন্তু তোমরা যদি আল্লাহর উপাসনা করো তবে জেনে রাখো আল্লাহ কোনোদিন মারা যান না। তারপর আবু বকর এই আয়াত আবৃত্তি করলেন : মুহাম্মদ রসুল ছাড়া আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসুল গত হয়েছে। সুতরাং সে যদি মারা যায় বা নিহত হয় তবে কি তোমরা পিঠ ফিরিয়ে পিছু হটবে? আর যে পিঠ ফিরিয়ে সরে পড়ে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন। (সূরা আল-ইমরান ; আয়াত ১৪৪) । নবির মৃত্যুর পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দিতা দেখা দেয় শেষ পর্যন্ত তা ওমরের বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং কুশলতার জন্যই এড়ানো গেল। সে- জন্য ওমরের প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। ওমরের প্রচেষ্টার জন্যই আবু বকর খলিফা হয়ে যান। আর ওমরের নির্দেশেই আবু বকর ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং কঠোর হস্তে বিদ্রোহী গোত্রদের দমন করেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে ওমরের মনে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, ইসলাম ধর্ম না ইসলামি রাষ্ট্র? যাহোক, একটি ইসলামি রাষ্ট্র যখন গঠিত হয়েছে তখন তাকে রক্ষা করতেই হবে। মুহাম্মদের প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকার আরবদের মাঝে বিরাজমান অজ্ঞানতা এবং বর্বরতার অবসান ঘটায়। এই অবস্থানকে সুদৃঢ় করা অতীব প্রয়োজন ছিল। বেদুইনদের মধ্যে যে অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিরাজমান ছিল তা নির্বাপিত করে ইসলামের ছায়ায় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। ওমর ছিলেন খুবই বাস্তববাদী ব্যক্তি। তিনি আরবদের চরিত্র ভালো করে জানতেন। ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে (রিদা যুদ্ধ) যুদ্ধের পর যে সৈন্যরা ফিরে এলো ওমর তাদেরকে রোম এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এই ধরনের যুদ্ধের কথা আগে কেউ চিন্তাই করতে পারতেন না। ওমর জানতেন যে মরুভূমির বেদুইনরা কোনো দিন কৃষি কাজ অথবা শিল্পে মন দিবে না। কারণ এইসব বিষয়ে বেদুইনরা একেবারে অজ্ঞ। তাদের মধ্যে যে সুপ্তশক্তি আছে তার বহিঃপ্রকাশ দরকার। আরবের সীমান্তের বাইরে যে বিপুল ধনসম্ভার আছে তা দখল নেবার জন্য এই অশান্ত টগবগে বেদুইনদের প্রস্তুত করার চেয়ে আর ভালো কাজ কি হতে পারে? ইতিহাস প্রমাণ করে, হজরত ওমরের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
(এগারো) ইরান এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। [ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ডগলাস হওয়ার্ড জনসনের মতো ঐতিহাসিকদের মতে গ্রিক-রোমান বনাম পারস্য সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক যুদ্ধ খ্রিস্ট পূর্ব ৯২ অব্দ থেকে শুরু হয়ে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। -অনুবাদক । কয়েক শতাব্দী ব্যাপী চলমান যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, ওই দুই সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর আরব বসবাস করতো। দুই থেকে তিন শতাব্দী ধরে উত্তর আরব অঞ্চল থেকে আগত আরবেরা জর্দানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং সিরিয়া ও ইরাকে অনুপ্রবেশ করেছিল। রোমান ও ইরানের কর্তৃত্বতায় তারা একাধিক রাজ্য গঠন করেছিল। তারা (আরব সম্প্রদায়) অথবা তাদের চাইতে নিচু- সম্প্রদায়ের লোকেরা আরব খলিফার সৈন্যদের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ করত। ফলে এদের সহায়তা নিয়ে ওমরের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছিটিয়ে থাকা আরবেরাই ওমরকে প্রেরণা দেয় সৈন্য-সামন্ত নিয়ে অগ্রসর হতে; কারণ তখন ইসলাম আরব জাতীয়তাবাদকে একটি সুসংঘটিত শক্তিতে পরিণত করেছে। এই যুদ্ধগুলি জয় ছিল একেবারে মহাকাব্যের কাহিনীর মতো, বিজয়ী হওয়ায় লব্ধ গনিমতের মাল আরবদের প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করে। একে একে সামরিক বিজয় তাদের মনে দীর্ঘদিনের বিদেশিদের বশ্যতার যে কলঙ্ক ছিল তা দূর করে দিল।
(বারো) এটা সত্যি যে অনেকে আন্তরিক বিশ্বাস নিয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সিরিয়া এবং ইরাকে যখন আক্রমণ চালানো হয় তখনো অনেকেই ইসলামের আদেশ মান্য করে এই ধর্মযুদ্ধে (জিহাদ) যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাও পাওয়া যায় যে গনিমতের মালের লোভেও অনেকে এই আক্রমণে শরিক হয়েছিলেন। কঠোর সংযম, তপস্যা, এবং পার্থিব ধনদৌলতের প্রতি অনীহা সীমিত সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নবির অনেক সাহাবিও যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে প্রচুর ধনদৌলতের অধিকারী হন। এরকম দুজন হচ্ছেন হজরত তালহা এবং হজরত জুবায়ের। নবি একসময় তাদেরকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন। খলিফা ওমর তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের জন্য যে পরিষদ গঠন করেছিলেন তার সদস্যও ছিলেন তাঁরা উভয়ে। তাঁরা উভয়ে মৃত্যুর সময়ে মক্কা, মদিনা, ইরাক, এবং মিশরে বিশাল ধনসম্পদ রেখে যান যার পরিমাণ ছিলো তিন থেকে চার কোটি দিরহাম। উসমানের হত্যার পর এরা দুজনেই আলির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা যখন দেখলেন যে আলি পূর্বের খলিফা উসমানের মতো অপচয়ের পথ ধরবেন না এবং সরকারি তহবিলে অবৈধ হস্তক্ষেপ করবেন না, তখন আলির উপর থেকে তাঁরা আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিলেন।
নবির স্ত্রী আয়েশা হলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম সমানিত নারী। নবি তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে গভীর ভালোবাসতেন। কোরানে আয়েশার ছিল অগাধ জ্ঞান এবং নবির উক্তি ও কর্ম সম্পর্কে তিনি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস বলেছেন। আলি যখন খলিফা মনোনীত তখন আয়েশা হজরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিষয় ধরে জনতার রায়ের প্রতি ভ্রক্ষেপ দেখালেন। বিবি আয়েশা মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করলেন আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে। এটি জামালের যুদ্ধ (উটের যুদ্ধ) নামে পরিচিত। কিন্তু আয়েশার এরকম পদক্ষেপের পিছনে প্রধান কারণ ছিল খলিফা উসমান সরকারি কোষাগার থেকে তাঁকে যে ভাতা দিতেন আলি খলিফা হবার পর সেই ভাতা বন্ধ করে দেন। আর একটি কারণ হতে পারে, যখন আয়েশার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয়েছিল তখন হজরত আলি বিবি আয়েশার বিরুদ্ধে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছিলেন। যদিও হজরত আলির এই মন্তব্য পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ, নাহরাবানের যুদ্ধ, এসব যুদ্ধের মূল কারণ ছিল, খলিফা উসমানের আমলে যে শিথিলতা চলছিল, আলি তা আর চলতে দিলেন না। খলিফা ওমরের শাসনামলে যারা কঠোর সীমাবদ্ধতার মাঝে ছিলেন, তাঁরা উসমানের সময় বিলাসিতা ও আরামের সাথে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। আলি খলিফা হবার পর কৃচ্ছতা সাধনের নীতি অবলম্বন করলেন। আলির এই নীতিতে অনেকেই বিরাগ হলেন। মুয়াবিয়াসহ অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন।
(তের) নবি জীবিত থাকাকালে আত্মিক-বিষয়ে উদাসীন, যোদ্ধা বেদুইন গোত্রের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেছিলেন প্রথমত কোরানের বাণী ও কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে। শক্তি ব্যবহার করেছেন একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে। নবির মৃত্যুর পর খলিফারা এই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। খলিফারা নবির নাম ভাঙ্গিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য কায়েমে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ- সময়েই নবিকে “অতিমানব’ হিসেবে পরিচিত করানো শুরু হয়। অনেক অবাস্তব বর্ণনাকে নবির অলৌকিক ঘটনা দাবি করে তাঁকে এক রহস্যময় অতিমানবে পরিণত করা হয়। যে নবি জীবিতকালে নিজেকে সাধারণ আল্লাহর দাস বলে পরিচিত করেছিলেন মৃত্যুর পরে তাঁকে মানুষের স্তর থেকে উঠিয়ে ফেরেশতা- রূপ দেয়া হয়। একজন মহামানবের মৃত্যুর পর তাঁর চরিত্রকে কেন্দ্র করে এ-ধরনের গুজব বা অবাস্তব- বর্ণনা রচনা করা একটা বহুল প্রচলিত অভ্যাস। সত্য এই যে, দুনিয়ার সব মহামানবের তাঁদের মহানুভবতা, তাঁদের যুগান্তকারী ভূমিকা, তাঁদের অনন্যসাধারণ কর্ম থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষদের মতোই তাদেরও নানা দুর্বলতা ছিল। তাঁরাও বিভিন্ন সময় ভুল করেছিলেন। তাঁদের ক্ষুধা পেয়েছে, পিপাসার্ত হয়েছেন, শীত-গ্রীষ্মে কষ্ট পেয়েছেন। তাঁদেরও যৌন- কামনা ছিল, যা হয়তো সাধারণ আচরণের বাইরে চলে যেত। তাঁরা পথ চলতে গিয়ে হোচট খেয়েছেন। তাঁরা বিরোধিতা সহ্য করেননি। এমনকি অনেক সময় তাঁরা পরশ্রীকাতর হয়েছেন। যা- হোক মহামানবদের মৃত্যুর পর অন্যান্যদের সাথে যে তাঁদের বিরোধ, তাঁদের ব্যর্থতা, তাঁদের দুর্বলতা জনসাধারণ ভুলে যায়। দেখা যায় যে জনতা কেবল মহামানবদের উৎকৃষ্ট কাজগুলিকেই মনে রাখে। এ- জন্য আমরা আবু আলি সিনা (হিজরি ৩৭০ বা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দ- হিজরি ৪২৮ বা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর রচিত “আল কানুন ( আরবিতে) এবং দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ের উপর লেখা আশ শেফা (আরবিতে) ও দানেশনামা-ই আলাই (ফার্সিতে) বইগুলির কথা মনে রেখেছি। এছাড়াও আমরা মনে রেখেছি তাঁর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মজীবনের কথা। কিন্তু তাঁর জীবনের ব্যর্থতাকে আমরা গোপন রেখেছি অথবা কৌশলে ঢেকে রেখেছি। দুনিয়ার কোটি কোটি লোক গভীর বিশ্বাস নিয়ে ধর্ম পালন করে থাকেন। ফলে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে “অতিমানবীয় চরিত্র দাঁড় করানো খুব প্রচলিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
পরিখা যুদ্ধের (আহজাবের যুদ্ধ) সময় কুরাইশ প্রধান ওয়ায়না বিন হোসেন নামের গাতাফান গোত্রের এক ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি করে নবির কাছে পাঠাল। সে নবিকে প্রস্তাব দিল, নবি যদি মদিনার সে বছরের সমস্ত খেজুর দিতে রাজি হন, তবে তারা তাদের সমিলিত অবরোধকারী সৈন্য সরিয়ে নিবে। নবি রাজি হলেন না। তখন সেই প্রতিনিধি বলল, তারা মদিনার এক-তৃতীয়াংশ খেজুরে রাজি আছে। অর্থাৎ এ-পরিমাণ খেজুর পেলে তারা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিবে। এর আগে নবি মদিনা রক্ষার জন্য পরিখা খনন করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই সব গোত্রের সাথে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন করা তাঁর জন্য এক বিরাট বিপদ। তথাপি নবি গাতাফান গোত্রের প্রতিনিধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। যুদ্ধ-বিরতির চুক্তি লেখার সময় সাদ বিন মুয়াজ (আউস গোত্রের একজন নেতা) নবির কাছে জানতে চাইলেন তাঁর এই সিদ্ধান্ত আল্লাহ প্রদত্ত কি না? নবি বললেন, “এ আল্লাহ প্রদত্ত নয়; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিলে অবরোধকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং তাদের ও ইহুদিদের সাথে যোগসাজশের যে ঝুঁকি আছে, তাও ভেঙে দেয়া যাবে, পরবর্তীতে ইহুদিদেরকে দেখে নেয়া যাবে। সাদ বিরক্তিভরে উত্তর দিলেন তাঁদের পৌত্তলিক আমলে কেউ সাহস করত না, একটা খেজুরও তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করতে। এখন তারা মুসলিম হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারা মৈত্রীচুক্তি করার নামে অপমানিত হতে চায় না। গাতাফান গোত্রের অপমানের একমাত্র সঠিক জবাব হবে তরবারি। এ- বক্তব্য শোনার পর নবি তাঁর ভাবনা পরিবর্তন করলেন। তিনি সাদের কথা মেনে নিয়ে গাতাফান গোত্রের সাথে চুক্তি সই করা থেকে সরে আসলেন। এ-ধরনের অনেক ঘটনা নবির তেইশ বছরের নবুওতির সময়কালে ঘটেছিল। অনেক সময় নবির কোনো সহচর তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে আলাপ করে পরামর্শ নিতেন, আবার অনেক সময় নবিও তাঁর সহচরদের উপদেশ গ্রহণ করতেন। সহচররা অনেক উপর ছেড়ে দিতেন। যা- হোক নবির মৃত্যুর পর তাঁর মানুষসুলভ চরিত্রের কথা সবাই ভুলে যান। নবির প্রত্যেকটি কর্ম আদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হতে লাগল। তাঁর প্রত্যেক কাজকেই আল্লাহর ইচ্ছা মনে করা হতে লাগল। সরকারি এবং বিচারবিভাগীয় কর্তারা নবির প্রত্যেক কাজকে অতীতের উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করতে লাগলেন। তখনকার দিনের সরল মনের সাধারণ নবি যা ছিলেন তারচেয়েও অনেক উচু আসনে বসিয়ে দিলেন। যে কেউ দাবি করত, সে নিজে নবির মুখ হতে কিছু শুনেছে তখন সে পেয়ে যেত অশেষ মর্যাদা ও কদর। কোরানে যে- সব আদেশ এবং আইনের কথা বলা হয়েছে তা পরিষ্কার এবং পূর্ণাঙ্গ নয়। সে- জন্য বিশ্বাসীদেরকে খুঁজতে হতো নবির উদাহরণ। যেমন কোরানে মুসলমানদের দৈনিক নামাজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে এই নামাজ পালন করতে
হবে তার বিশদ কিছু নেই। তাই নামাজ পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি নবির উদাহরণ থেকে নিতে হলো। এ- জন্যে প্রয়োজন পড়ল নবির জীবনকালের কাজ-কর্মের রীতিনীতি সঙ্কলনের। একে সুন্নাহ বলা হয়। তাঁর বাণীগুলিকে হাদিস হিসাবে সঙ্কলন করা হতে লাগল। ফলে হিজরি ৩- ৪ (খ্রিস্টাব্দ ৯-১০) শতাব্দীর মধ্যে সুন্নাহ ও হাদিসের সংখ্যা হাজার হাজার হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, শতশত অনুসন্ধান হতে লাগল সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। ফলে এক শ্রেণীর পেশাদার হাদিস- সংকলকের আবির্ভাব হতে লাগল যারা প্রচুর সম্মানের অধিকারী হলেন। তাঁরা হাজার হাজার হাদিস এবং সুন্নাহ মুখস্ত করে ফেললেন। তাঁদের একজন হলেন ইবনে ওকদা (মৃত হিজরি ৩৩২ বা খ্রিস্টাব্দ ৯৪৩) । বলা হয়ে থাকে তিনি আড়াই লক্ষ হাদিস জানতেন। সেইসাথে হাদিস বর্ণনাকারীদের ধারা।
পারস্যের এক প্রবাদে বলা হয় ; ‘কেউ যদি একটি বিশাল প্রস্তর হাতে নেয়, তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, সে কখনো ওই প্রস্তর নিক্ষেপ করবে না। সাধারণ জ্ঞান থেকে আমরা বলতে পারি এই যে, বিশাল হাদিস সঙ্কলন করা হল সেগুলোর সবই নির্ভরযোগ্য নয়। এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এইসব হাদিস সংকলনে যারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইবনে তায়মিয়া (হিজরি ৬৬১ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬৩ – হিজরি ৭২৮ বা খ্রিস্টাব্দ ১৩২৮) বলেছেন : নবি মুহাম্মদের কাছ থেকে আসা ব্যতীত আর কিছুই সত্য নয়।’ শোনা যায় যে হাসান বিন মুহাম্মদ আল-আরবিলি (মৃত হিজরি ৬৬০ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬১) নামে আর একজন মুসলিম পণ্ডিত বলেছেন : আল্লাহ আমাদেরকে সত্য জানিয়েছেন কিন্তু ইবনে সিনা আমাদেরকে মিথ্যা বলেছেন।”
(চৌদ্দ) নবির মৃত্যুর পর যতই দিন যেতে লাগল এবং হেজাজ থেকে দূরত্ব যত বেশি হলো নবিকে নিয়ে অলৌকিক দাবি ততোই বেশি হতে লাগল। এভাবেই একজন মানুষ যিনি ইতিহাসের বিশাল মোড় ঘুরিয়ে ছিলেন নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, স্বকীয়তা, ধৈর্য, সাহস, কৌশলের সাথে, তাঁকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে এক উপকথার নায়কে রূপান্তরিত করা হলো।
(পনের) আরবদের আক্রমণে ইরান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। হিজরি ১৫-১৬ সালে (৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) কাদেসিয়ার যুদ্ধে বারবার পরাজয় এবং হিজরি ২১ সালে (৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) নেহাবন্দে পরাজয়ের গ্লানি আলেকজান্ডার এবং মঙ্গোলদের কাছে পরাজয়ের গ্লানির চাইতে বেশি ছিল। ইরানের দীর্ঘ দুৰ্দশার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই জাতি করুণভাবে পরাজিত হয়, কারণ এখানে কোনো যোগ্য নৃপতি অথবা নেতা অথবা রাষ্ট্রনায়ক, অথবা সেনাপতি ছিলেন না। ইরান পরাজিত হয় স্বল্পসংখ্যক, অদক্ষ আরব সেনাবাহিনীর হাতে। শহরের পর শহর, প্রদেশের পর প্রদেশ আরব সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর এসব স্থানের বাসিন্দারা আরবদের ধার্য করা শর্ত যেমন ইসলাম গ্রহণ অথবা জিজিয়া কর প্রদান করতে বাধ্য হয়। যারা জিজিয়া করের আশ্রয় নিল তারা পেল অতি নিম্নমর্যাদা। জিজিয়া কর এড়ানোর জন্য অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। আবার অনেকে অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্র পুরোহিত মবেদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ খুব সহজ। শুধু দরকার আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদের নবুওতি মেনে নেওয়া। ধীরে ধীরে ইসলাম জনসাধারণের মাঝে বিস্তার লাভ করে। সেই অতীতে ইরানিদের জাতীয় চরিত্র ছিল এই রকম, যখন কেউ তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করত তখন ইরানিরা বিজয়ী শাসকের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে যেত। তারা নতুন শাসকদের আজ্ঞাপালন, সেবা পরিচর্যায় নিয়োজিত হতো। এছাড়া কৃপা পাবার জন্য ইরানিরা তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি নতুন প্রভুদের হাতে সমর্পণ করে দিত। তাই আরবরা যখন ইরান দখল নেয়, তখন ইরানিরা আরবি ভাষা রপ্ত করে নেয়। আরবদের আদব-কায়দা অনুকরণ করা শুরু করে। অবশ্য ইরানিরাই আরবি ব্যাকরণ এবং বাক্যগঠনবিধি নিয়মাবদ্ধ করে। ইরানিরা তাদের নতুন প্রভুদের অধীনে চাকুরি পাবার জন্য যে কোনোভাবে আজ্ঞানুবর্তী হতে কুষ্ঠা বোধ করত না। ক্ষেত্রবিশেষে ইরানিরা ইসলামি রীতিনীতি পালনে আরব শাসকদেরও ছাড়িয়ে যায়। আর নিজেদের হাজার বছরের পারস্য সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতিনীতি, প্রথা, কৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞা আর অবহেলা প্রদর্শন করে। আরব জাতি এবং আরব বীরদের উচ্চপ্রশংসায় তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই-ই নয় ইরানিরা প্রমাণ করতে চাইল বীরত্ব, বদান্যতা, এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র আরবদের মধ্যেই আছে। প্রাক-ইসলামি যুগের আরবের বেদুইন কবিদের কবিতাগাঁথা আর সাধারণ উক্তিকে পাণ্ডিত্যের রত্নভাণ্ডার এবং আচার আচরণের আদর্শ হিসাবে গণ্য করল ইরানিরা। তারা আরব গোত্রের আশ্রিত ব্যক্তি এবং আরব নেতাদের (আমির) ভৃত্য হয়ে নিজেদের ধন্য মনে করত। বিবাহের জন্য তাদের কন্যাদেরকে আরবদের হাতে তুলে দিলে যারপরনাই খুশি হতো। আরও খুশি হতো যখন তারা আরবি ভাষার নাম দিয়ে নিজেদের ভূষিত করত। স্বকীয়তা, সাহিত্য, কৃষ্টি ত্যাগ করে পরাজিত জাতি হিসেবে ইরানিরা শীঘ্রই আরবি সাহিত্য, হাদিস সংকলন, ইসলামি আইনের পেছনে নিজেদের মেধা- শ্রম- সময় ব্যয় করে। ইসলামি সাহিত্য নিয়ে যত মুখ্য কাজ হয়েছে, তার বেশির ভাগই করেছেন ইরানের জনগণ। যদিও প্রথমদিকে ইরানে ইসলাম গৃহীত হয়েছে ভীতি থেকে এবং আরব শাসকদের প্রচারণায়। তবে দুই-তিন প্রজন্ম পর চিত্র পাল্টে যায়। খোদ আরব-মুসলমানদের চেয়ে ইরানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়।
তোষামোদ এবং মিষ্টিকথা দিয়ে নতুন শাসকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে ইরানিরা এতোই সুদক্ষ হয়ে উঠে যে, কথিত আছে একজন প্রসিদ্ধ উজির আয়নায় কখনো নিজের চেহারা দেখতেন না, পাছে তিনি এক ইরানির চেহারা দেখে ফেলেন এই লজ্জায়। প্রথমদিকে ইরানিরা তাদের নতুন শাসকদের আজ্ঞাবহ হয়ে সেবা করত, মনোরঞ্জনের যথাসাধ্য চেষ্টা করত, কারণ তারা মনে করেছিলেন আরবরা ফিরে গেলে তারা নিজেরা শাসক হয়ে যাবে এবং গনিমতের মালের ভাগ পাবেন। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগল তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে দ্বন্দুের মধ্যে পড়ে গেল। হিজরি তৃতীয়- চতুর্থ শতাব্দীর (নবম-দশম খ্রিস্টাব্দ) দিকে ইরানে প্রচুর লোক ছিল, যারা নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে হেজাজকেই মানবজাতির জন্য স্রষ্টার আশীর্বাদ হিসেবে মনে করতো। ইরানের এই জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, কেমন করে এ ভূখণ্ডে কুসংস্কার আর অতিলৌকিক বিশ্বাস মানুষের মনে বিস্তার লাভ করেছিল। নবির নবুওতি লাভের পর প্রথম তের বছরের মক্কা জীবন আর পরের দশ বছরের মদিনা জীবনে যে ভয়াবহ বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন হেজাজে, সে-সম্পর্কে বাস্তব তথ্য জানা থাকলে ইরানের জনগণ এতো সহজে আরবের বশ্যতা স্বীকার করে নিত না। ধর্মও প্রতিষ্ঠা পেত না।
এ- প্রসঙ্গে মুহাম্মদ বাকের মাজলেসির’ (হিজরি ১০৩৭ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬২৭ – হিজরি ১১১০ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬৯৯) লেখা বেহার আল- আনোয়ার’ বইয়ের কথা আবার উল্লেখ করা যেতে পারে। পারস্যের সাফাবিদ শাসনকালের শেষের দিকের এই লেখক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ (শিয়া ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামি আইনবিশারদ) । তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন : “কথিত আছে একদা ইমাম হাসান এবং হোসেন তাঁদের পিতামহের (নবি মুহাম্মদ) কাছে রোজা ভাঙার দিনে নতুন পোশাক উপহার চাইলেন। এ- সময় জিবরাইল ফেরেশতা এসে গেলেন এবং প্রত্যেকের জন্য একটি করে সাদা পোশাক দিয়ে দিলেন। নবি বললেন, এই দুই বালক রঙিন পোশাক পরতে পছন্দ করে, কিন্তু জিবরাইল নিয়ে আসলেন সাদা পোশাক। নবির কথা শুনে জিবরাইল বেহেশত থেকে একটি টব এবং একটি জগ নিয়ে আসলেন। এরপর জিবরাইল বালকদের বললেন, তিনি টবটি এক বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করে দিবেন। তারপর বালকেরা তাদের নিজস্ব পোশাক ওই টবে ডুবিয়ে দিলে তাঁরা যে রং চাইবেন তাই পাবেন। ইমাম
হাসান সবুজ রং চাইলেন এবং ইমাম হোসেন চাইলেন লাল রং। যখন পোশাকদ্বয় রঞ্জিত হচ্ছিল তখন জিবরাইল কেঁদে উঠলেন। নবি জিবরাইলকে তাঁর কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, কেননা বালকেরা তাদের পোশাকে রং পেয়ে খুশি হয়েছে। জিবরাইল বললেন, ‘হাসানের সবুজ রঙ পছন্দের অর্থ হলো তিনি বিষপানে শহীদ হবেন, এতে তাঁর দেহ সবুজ হয়ে যাবে। আর হোসেনের লাল রং পছন্দের অর্থ হল তিনি শহীদ হবেন যখন তাঁর রক্তে তাঁর পোশাক ভিজে যাবে। উল্লেখ্য এই কাল্পনিক বক্তব্য বাহাই মতাবলম্বী লেখক মির্জা জানি তাঁর “নক্তাত আল- কাফ-১৫২ বইয়েও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। বাহাইরা নিজেদের শিয়া ইসলামের সংস্কারক এবং এক নতুন শিয়া- ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপে মনে হয়, মুখে দাবি করলেও কুসংস্কার এই সংস্কারবাদী শিয়াদের মন থেকে বিদায় হয়নি।
মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম বছর নবি মুহাম্মদ এবং সাহাবিরা নিদারুণ আর্থিক অনটন আর অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করেন। নাখলাতে যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। নবির সাহাবির মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফ ছাড়া আর কারো ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো তেমন অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ছিল না। মদিনায় আসার পর আব্দুর রহমান আউফ মদিনার বাজারে একটি ব্যবসা স্থাপন করেন। এই ব্যবসায়ে তাঁর কিছু মুনাফা আসে। নবির আরও কয়েকজন সাহাবি মদিনার ইহুদি বাসিন্দাদের তালবাগানে চাষাবাদ এবং কূপখননের কাজ পান। অবশ্য এই সাহাবিরা খেজুর বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ বা চাষের কোনো কিছুই জানতেন না। ফলে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া তাঁদের অন্যকিছু করার সুযোগ ছিল না। নবির ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করার মানসিকতা অসম্ভব রকমের দৃঢ় ছিল। মদিনায় গিয়ে তিনি যখন অসহায় অবস্থায় পড়েন তখন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রায়ই দুই- একটি খেজুর খেয়ে বিছানায় যেতেন। অনেক সময় তাঁর কপালে রাতের আহারও জুটতো না। নবির প্রতি অসমান না দেখানোর জন্য এই সত্য প্রকাশ করা হয় না। এর পরিবর্তে শুধু নবির কীর্তি ও অবদানের কথা প্রকাশ করা হয়। নবির লক্ষ্য ছিল সমগ্র আরবে তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। তিনি দরিদ্রতা এবং অসঙ্গতিকে কোনো সময়ই তাঁর লক্ষের অন্তরায় হিসাবে দেখেননি। ইতিহাসে এই ধরনের মানসিক শক্তিতে বলীয়ান পুরুষের উদাহরণ পাওয়া বিরল।
মুহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবন থেকে বোঝা যায়, তিনি মনুষ্য সমাজেরই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো অতিমানব বা আলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন না। অলৌকিক শক্তির সাহায্যও তিনি কখনো লাভ করেননি। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়েছিলেন, তার কারণ যে তাঁরা সাহসী এবং অবিচল থেকে লড়াই অব্যহত রেখেছিলেন। আর কুরাইশদের মাঝে দেখা দিয়েছিল অবহেলা আর শিথিলতা। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ ছিল, তাঁরা নবির যুদ্ধ-কৌশলের প্রতি অনুগত ছিলেন না। সৃষ্টিকর্তা যদি সর্বদাই মুসলমানদের সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকতেন তবে মুসলমানদের শক্রর সাথে ভয়ঙ্কর লড়াই, যুদ্ধ, হানাহানি, সংঘর্ষে লিপ্ত হবার প্রয়োজন পড়ত না, কিংবা মদিনার রক্ষার জন্য পরিখা খননেরও দরকার ছিল না। এমন-কী বানু কুরাইজা গোত্রকে হত্যার প্রয়োজন পড়ত না। কোরানে রয়েছে : ‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। (সুরা সিজদা : আয়াত ১৩) । বুঝা যায়, এটা অনেক যৌক্তিক যে আল্লাহ ইচ্ছা করলেই দুনিয়ার সকল অবিশ্বাসী ও ভণ্ডদের হৃদয় ইসলাম দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ চান নাই বলে এমনটা হয়নি।
নবি একপক্ষ কালব্যাপী মদিনার ইহুদি গোত্র বানু কায়নোকার বাসস্থানে সামরিক অবরোধ দেন এবং তাদের খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে কায়নোকা গোত্রের ইহুদিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নবি তাঁদেরকে হত্যা করতে চাইলে তাদের পুরানো বন্ধু আব্দুল্লাহ বিন উবায় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন।
তিনি সতর্ক করে দেন, যদি ইহুদি বানু কায়নোকা গোত্রকে হত্যা করা হয়, তবে তিনি এর বিরোধিতায় নেমে পড়বেন এবং নবির সঙ্গ ছেড়ে দিবেন। আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের এ- বক্তব্যে নবির মুখ ক্রোধে কালো হয়ে যায়। তথাপি তিনি চিন্তাভাবনা করে তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্ত বদল করেন। হত্যার বদলে তিনদিনের সময় দেয়া হলো মদিনা ত্যাগ করার জন্য। এই ধরনের আরও ভজন- খানেক ঘটনা থেকে আমরা নবি মুহাম্মদের জীবনী এবং ইসলামের উত্থানের ইতিহাস জানতে পারি। এই ঘটনাগুলি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে, নবির জন্য কোনো অলৌকিক শক্তি আসলে কাজ করেনি। ইতিহাসের অন্যান্য ঘটনার মতোই মুহাম্মদের জীবনে যা ঘটেছিল তার পিছনে ছিল প্রাকৃতিক কারণ। কোনো দৈবের হাত নয়। এই বিশ্লেষণ বা দৃষ্টিভঙ্গি নবি মুহাম্মদকে কোনোভাবেই হীন বা দুর্বল করে না। বরং ইতিহাসের একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে নবি মুহামদের দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীকে আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে মানুষ অনেক সময় সবকিছুর বিশদ অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ করে যাচাই করতে অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাল্পনিক মন সবকিছুর পিছনে অলৌকিক ঈশ্বরের হাত দেখে। আদিমযুগের লোকেরা বজ্রপাত এবং বিদ্যুতকে স্রষ্টার কণ্ঠস্বর এবং ঝলক বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত ওই নৃপতি মানুষের অবাধ্যতার জন্য ক্ষেপে গিয়ে এই ধরনের কার্যকলাপ প্রদর্শন করেন। আমাদের চারপাশের অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও অনেক সময় ভুলে যান যে প্রত্যেক ঘটনার পিছনে কার্যকারণ রয়েছে। ফলে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনার পিছনেও স্বগীয় হস্তক্ষেপ আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা মনে করেন ওই সর্বশক্তিমান নৃপতি তাদেরই মতো। যেসব ব্যক্তি এই ধরনের চিন্তা করেন তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই মহাবিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহ বেহেশত থেকে নবির দৌহিত্র হাসান এবং হোসেনের জন্য পোশাক পাঠিয়ে দেন এবং স্রষ্টার বার্তাবাহক পোশাক দুটিকে সবুজ এবং লাল রঙে রঞ্জিত করে দেন।
এটা সত্য যে মাজলেসির লেখা বেহার আল আনোয়ার কোনো ব্যতিক্রমী বই নয়। আর এটাই একমাত্র বই নয় যে, কারকারা নামে এক মাছ যে সারসারার পুত্র, যে সারসারা আবার ঘারঘারার পুত্র, সে আলি বিন আবু যেতে পারেন। এই ধরনের শতশত বই ইরানের বাজারে পাওয়া যায়। যেমন কয়েকটা বইয়ের নাম হচ্ছে : হেলায়াল আল- মোল্লাকিন”, জান্নাল আল-কলুব, আনোয়ার-ই নোমানি, মেরসাদ আল- ইবাদ*। এছাড়াও রয়েছে নবি ও ওলামাদের কাহিনি সংকলন করে লেখা প্রচুর বই। একটা জাতির মানসিকতাকে বাস্তব-বুদ্ধি-চিন্তাশক্তি এবং যুক্তিবোধকে বর্জন করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলতে এই ধরনের যে কোনো একটি বই- ই যথেষ্ট। অলৌকিক গল্প ছড়িয়ে দেয়া আসলে মাদকদ্রব্য ব্যবসার পর্যায়েই পড়ে। এই মাদকে আসক্ত নারী-পুরুষ উভয়েই যুক্তি-চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
মুহাম্মদ তাঁর নবি জীবনে যা আয়ত্ত করেছেন, যা প্রচার করেছেন, যা প্রয়োগ করেছেন তার সবই লোকেরা জানে। লোকেরা আরও জানে যে তাঁর ক্ষুধা পেত, তিনি খাবার খেতেন, এবং সাধারণ জনগণ যেভাবে তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বশে চলে নবিও সেইভাবে চলেছেন। তাঁর চরিত্রকে অতিমানব হিসাবে দেখিয়ে, জনতাকে বিভ্রান্ত করা কোনো মতেই মানবজাতির জন্য মঙ্গলকর নয়।

——————
পাদটীকা
৯৬. আবু উবায়দা বিন আব্দুল্লাহ বিন আল জারাহ নবির ইসলাম প্রচারের শুরু দিকেই ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সাময়িকভাবে আবিসিনিয়ায় দেশান্তরী হন। যে দশজনকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন আবু উবায়দা তাঁদের একজন। তিনি সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন হিজরি ১৫ (৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হিজরি ১৮ (৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত। প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান হিজরি ১৮ সালে। তিনি হম, আলেপ্পো এবং আন্তিওক (Antioch) দখল করেন।
৯৭. ভিন্নমতে আহত সাদ বিন ওবায়দা অসুস্থ অবস্থায় মারা যান চার-পাঁচ বছর পর।
৯৮. আবু আলি মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বালামি (মৃত্যু হিজরি ৩৬৩ বা ৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ) । সামানিদ বংশের শাসনামলে (আমির আবদুল মালেক- ১ এবং মানসুর- ১- এর আমলে) তিনি বোখারার উজির ছিলেন। (উল্লেখ্য পারস্যে সামানিদ বংশের শাসনকাল ধরা হয় ৮১৯-৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।) আমিরদের অনুরোধে তিনি আল-তাবারির লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘History of the Prophets and Kings’ ফারসিতে অনুবাদ করেন ‘Tarikh-e Bal’ami নামে। নব্যফার্সি গদ্য লেখার মধ্যে এই লেখা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই অনুবাদ তাবারির মৌলিক আরবি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য। অনুবাদটিতে অনেক সম্পূরক বিষয় স্থান পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রধানত ইরানের বিষয়াবলী। এই গ্রন্থের ফরাসি সংকলন হচ্ছে : H. Zotenberg, Chronique de… Tabari traduite sur la version persane de… Belami, 4 vols. Paris 1876 1874, reprinted 1948.
৯৯. আমার বিন ইয়াসির এবং আল মিকদাদ বিন আমর ছিলেন ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকের মুসলমান। নবির উল্লেখযোগ্য সাহাবি এবং আলির বিশিষ্ট সমর্থক। আমারের মাতা ছিলেন একজন ক্রীতদাসী, যার মালিক ছিলেন কুরাইশ গোত্রের মাখজুম বংশের এক ব্যক্তি। ওমরের আমলে আমার কুফার শাসক নিয়োজিত হন এবং খুজেস্তান জয় করেন। হিজরি ৩৭ (৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলির পক্ষ নিয়ে সিফিফনের যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমার প্রাণ হারান। আমার, মিকদাদ, আবুজর গিফারি এবং সালমান আল-ফার্সিদেরকে প্রথম শিয়া মতাবলম্বী হিসাবে ধরা হয়।
১০০ দ্রষ্টব্য : তৃতীয় অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
১০১. বেহার আল- আনোয়ার’ হচ্ছে আরবি ভাষায় রচিত ১০২ খণ্ডের হাদিসের এক বিশাল সংকলন। মুহামদ বাকের মাজলেসি ফার্সি ভাষায় আরও জনপ্রিয় গ্রন্থও রচনা করেছেন। এর মধ্যে আছে নবি এবং বারো ইমামের জীবনী। তিনি ক্ষমতায় এসে ইরানের সুন্নি, সুফি, ইহুদি এবং অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্রপন্থীদের উপর নিপীড়ন চালান। এর ফলে পারস্যের সাফাবিদ রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে হিজরি ১১৩৫ (১৭২২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আফগান সুন্নিরা এই রাজত্বের অবসান ঘটায়।
১০২. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ৩।
১০৩. মুহামদ বাকের মাজলেসি লিখিত ফার্সি গ্রন্থ।
১০৪. শায়খ নাজিম উদ্দিন দায়ার (মৃত হিজরি ৬৫৪ বা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত পুস্তক। তিনি সুফিবাদের বিশিষ্ট প্রবক্তা। তাঁর লেখা মেরশাদ আল ইবাদ গ্রন্থে ওমর খৈয়ামের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, যেখানে খৈয়ামকে দার্শনিক এবং নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ভৎসনা করা হয়েছে।




No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ