হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ
কোন অন্ধবিশ্বাসে বশ হওয়া নয়। বহুজনে বা বিখ্যাতজনে মেনে নিয়েছেন বলে কোন ধারণাকে মেনে নেওয়া নয়। যুক্তি দিয়ে বিচার করব, যাচাই করব শুধু। তারপরই গ্রহণ করব বা বাতিল করব।
কোন অন্ধবিশ্বাসে বশ হওয়া নয়। বহুজনে বা বিখ্যাতজনে মেনে নিয়েছেন বলে কোন ধারণাকে মেনে নেওয়া নয়। যুক্তি দিয়ে বিচার করব, যাচাই করব শুধু। তারপরই গ্রহণ করব বা বাতিল করব।
হিস্টিরিয়া রােগী সাধারণত অশিক্ষিতদের মধ্যে বেশি। অশিক্ষিত, কুসংস্কারে আচ্ছন্নদের মস্তিষ্কের কোষের নমনীয়তা (elasticity) কম এবং আবেগপ্রবণতা খুব বেশি। ফলে কোনও কিছুই তারা যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে পারে না। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রােগীর সংখ্যাও কমছে। তবে, নামসংকীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবাবেগ চেতনা হারিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়তে এখনও কিছু কিছু নারী-পুরুষকে দেখা যায় বই কী।
প্রাচীনকালে গণ-হিস্টিরিয়া সৃষ্টির বিষয়ে প্রধান ভূমিকা ছিল ধর্মের। এখন ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা। ধর্মান্ধতা, আবেগপ্রবণ জাতীয়তাবােধ, তীব্র প্রাদেশিকতা, রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অন্ধ আনুগত্য বহুজনের যুক্তি-বুদ্ধিকে গুলিয়ে দিয়ে তীব্র ভাবাবেগে চলতে বাধ্য করে। এই গণ-হিস্টিরিয়া বা গণ-সম্মােহনের ক্ষেত্রে সম্মােহন-ঘুম না পাড়িয়ে Suggestion দিয়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি করা হয়। প্রয়ােজনীয় ফল লাভ করা যায়। সাধারণত মানুষ যখন কোনও কারণে ভীত, উত্তেজিত বা ভক্তিরসে আপ্লুত হয় তখন ধর্মগুরু, রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের Suggestion অনেক সময় অসম্ভব রকম কার্যকর হয়।
আত্ম-সম্মােহন ও স্ব-নির্দেশ (auto-suggestion) যেমন একজন ব্যক্তির নিজের ইচ্ছের হতে পারে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তার অজ্ঞাতসারেই সে autosuggestion দ্বারা নিজেকে নিজে সম্মােহিত করতে পারে। এইসব ক্ষেত্রেও শারীরবৃত্তি তার স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চলে না। অস্বাভাবিক আচরণ করে। এই ধরণের আচরণ অস্বাভাবিক হলেও শারীরবৃত্তিরই অংশ। | তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথকে পুজো দেওয়ার জন্য ভক্তরা যখন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন ভক্তি ও বিশ্বাস মস্তিষ্কের কোষগুলােকে ঠাণ্ডা লাগার জন্য নির্দেশ পাঠায় না, ফলে ঠাণ্ডা লাগে না। এই ভক্তরাই প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দুপুরে আগুন হয়ে থাকা দেবস্থানের সিমেন্ট বা পাথরে ছাওয়া চাতালে খালি পায়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। যে তাপ অসহ্য, দেবস্থানে এলে সেই তাপেই কষ্টের কোন অনুভুতি ভক্তদের মধ্যে দেখা যায়।
দুটি ক্ষেত্রেই ঈশ্বর-মাহাত্ম্যের কথা ভেবে ভক্তেরা নিজের অজান্তেই নিজেরা সম্মােহিত হয়ে পড়েন এবং সেইভাবেই তাদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু স্নায়ুকে auto Suggestion-এর দ্বারা পরিচালিত করেন।
অতীতের এক বিখ্যাত সাধক সম্বন্ধে শােনা যায়, খাবারের সঙ্গে তাঁকে কোনও দুষ্টপ্রকৃতির লােক বিষ খাইয়েছিল। বিষ খাওয়ার পরেও সাধকের জীবনহানি ঘটেনি। কী করে এমনটা হলাে? যুক্তিবাদী হিসেবে ধরে নিচ্ছি কারণ ছিল। এ-যুগে আধুনিক চিকিৎসায় বিষপানের রােগীর পাকস্থলী পাম্প করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। সেই সাধকও কী তবে আত্ম-সম্মােহন ও স্ব-নির্দেশের দ্বারা বমি করে পাকস্থলীর বিষাক্ত খাবার উগরে দিয়েছিলেন? প্রাচীন এই কাহিনির সত্যতা কতটুকু তা জানতে না পারলেও এইটুকু বলতে পারা যায়, আত্ম-সম্মােহনের ও স্ব-নির্দেশের দ্বারা বমি করা সম্ভব।
ভাবুন, আপনি খেতে বসেছেন। পরিপাটি করে খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন আপনার স্ত্রী। ভাত ভেঙে মাছের ঝােলের বাটিটা ভাতে ঢালতেই টকটকে লাল ঝােলটা ভাতের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল থালায়। মুহূর্তে আপনার মনে পড়ে গেল, ঘণ্টাখানেক আগে দেখা সেই বাসে-চাপা পড়ে মরে যাওয়া লােকটার কথা। তার সারা শরীর বেয়ে এমনি ঝােলের মতােই গড়িয়ে পড়ছিল রক্ত। ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আপনার গা গুলিয়ে উঠল। আপনি বমি করে ফেললেন। আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্য আপনার মস্তিষ্কের সেই স্নায়ুগুলােকে উদ্দীপিত করল, যা বমি নিয়ে আসে। এবার, যখন বমি করা প্রয়ােজন তখন যদি আপনি তীব্র ঘৃণা সঞ্চার করে, এমন কোন দৃশ্য চোখের সামনে জীবন্ত করে ভাসিয়ে রাখতে পারেন, তবে মস্তিষ্কের বিশেষ স্নায়ুগুলাে এমনভাবে উদ্দীপিত হবে, যার দরুন আপনার গা গুলিয়ে বমি এসে পড়বে।
১৯৮৩-র জানুয়ারিতে এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম একটি বিশেষ কাজে। উঠেছিলাম কলাভবনের কাছেই একটি হােটেলে। পৌছতে বেশ রাত হয়েছিল। মধ্যরাতে খাওয়ার পাট চুকোলাম ভাত আর হাঁসের ডিম দিয়ে। তারপর, আরও অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল অস্বস্তিতে। আমার হার্টে একটু গণ্ডগােল আছে। সেটাই বেড়ে উঠল ডিম খাওয়ার ফলে উইন্ডে, বুকে চিনচিনে ব্যথা, বাঁ হাত, ঠাণ্ডা, সারা মুখও স্যাতসেঁতে ঠাণ্ডা। এই রাত-দুপুরে ডাক্তার চাইলেই পাব কি না সন্দেহ। বমি করে পেটের খাবার বের করে দিলে ভাল লাগবে। গলায় আঙুল দিয়ে যে বমি করব, তারও উপায় নেই। গলায় একটা ক্ষত আছে এই অবস্থায় নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় আত্মসম্মােহন করে বমি করা। কুকুরের গায়ের এঁটুলি দেখলেই ঘেন্নায় আমার গা শিরশির করে ওঠে। শরীরের বেশ কিছু লােম খাড়া হয়ে ওঠে। গা চুলকোতে থাকে। বমি এসে পড়ে। আমি একান্তভাবে এঁটুলি বােঝাই কুকুরের কথা ভাবতে শুরু করলাম, সঙ্গে সঙ্গে সত্যিকারের এঁটুলি দেখলে, আমার শরীরে যেসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে থাকে সেগুলি হতে শুরু করল, তারপরই আরম্ভ হলাে প্রবল বেগে বমি। বমিতে পেট হালকা হতেই শরীরের অস্বস্তি ও কষ্ট দূর হলাে।
অনেক সাধু-সন্তদের সম্বন্ধে শােনা যায়, তাঁরা প্রচণ্ড শীতেও খালি গায়ে থাকতেন, যােগ সাধনার ফলে নাকি শীত বােধ হতাে না। অনেক সময় মানুষ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা বা গরমকে সহ্য করে নেয়। এই প্রসঙ্গে আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল, গল্পটি সম্ভবত রস-সাহিত্যিক কুমারেশ ঘােষের মুখে শুনেছিলাম। একবার কুমারেশদা কনকনে শীতের সকালে পুরুলিয়ার রাস্তায় (বাঁকুড়াও হতে পারে। একটি অনাবৃত গায়ের খাটো ধুতি পরা রাখাল ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী রে, এই শীতে খালি গায়ে তাের কষ্ট হচ্ছে না?”
ছেলেটি উত্তরে বলেছিল, “আপনার মুখটাও তাে বাবু খালি রয়েছে, ঢাকেননি, মুখে ঠাণ্ডা লাগছে না?”
সহ্য-শক্তির ব্যাপার ছাড়াও কিন্তু আর একটি ব্যাপার আছে, যার সাহায্যে কেউ কেউ সহ্যাতীত শীত বা গরমকেও আত্ম-সম্মােহনের দ্বারা নিজের সহ্য সীমার মধ্যে নিয়ে আসেন।
একজন সম্মােহনকারী যে সব সময়েই সম্মােহন-ঘুম পাড়িয়ে suggestion
দিয়ে থাকেন, তেমন কিছু নয়। অন্ধ বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে
ঘুম না পাড়িয়েও একজনের মস্তিষ্ক কোষে
suggestion পাঠিয়ে আশ্চর্য ভাল ফল
পাওয়া যেতে পারে। এই ধরনের
সম্মােহনের একটি ঘটনা বলছি।
দিয়ে থাকেন, তেমন কিছু নয়। অন্ধ বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে
ঘুম না পাড়িয়েও একজনের মস্তিষ্ক কোষে
suggestion পাঠিয়ে আশ্চর্য ভাল ফল
পাওয়া যেতে পারে। এই ধরনের
সম্মােহনের একটি ঘটনা বলছি।
একসময় ফলিত জ্যোতিষ নিয়ে পড়াশুনা করেছি। পড়ে এবং বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে স্পষ্টই বুঝেছি ফলিত জ্যোতিষ নেহাতই ক্ষীণ চান্সের ব্যাপার। অর্থাৎ মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে। অনেকেই আমার কাছে ছক বা হাত হাজির করেছে। আমি রাশিচক্র বা হস্তরেখা বিচার করে যখন অতীত নিয়ে বলেছি, তখন প্রায় সব-ই ভুল হয়েছে। একটু সাধারণ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যখন অতীত বা বর্তমান বিষয়ে বলে গেছি, তখন অনেক কথাই মিলেছে। যদিও আমি জানি, আমার যত ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে, মেলেনি তার বহুগুণ। আর এও জানি, ফলিত জ্যোতিষ ও অলৌকিকে বিশ্বাসী লােকেরা ওই দু-একটি মিলে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীকেই মনে রাখেন এবং অন্যের কাছে সেটাকেই আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তােলেন। না মেলা কথাগুলাে চটপট ভুলে যান। আসলে, ফলিত জ্যোতিষের প্রতি অন্ধবিশ্বাসই তাদের এমনটা করতে বাধ্য করে। আমার বেলায় তার অন্যথা হয়নি। সুতরাং একটা পরিচিত গণ্ডির মধ্যে জ্যোতিষী হিসেবে ফাটাফাটি নাম ছিল। আমার প্রতি এমনই এক অন্ধবিশ্বাসী হলাে দমদমের বাঙুর অ্যাভিনিউ নিবাসী প্রবীর সাহা। ঘটনাটি ১৯৮১ সালের। বয়েসে তরুণ প্রবীর একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল আমার অফিসে। কাঁদো-কাঁদো ভাবে বললাে “প্রবীরদা, আমাকে বাঁচান।” | ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার, খুলে বল তাে। আমার যদি সাধ্যে কুলােয় নিশ্চয়ই করব।” | প্রবীর আমার মুখখামুখি বসে যা বলল তা হলাে, সম্প্রতি বন্ধুদের সঙ্গে ও একটা পিকনিকে গিয়েছিল, সেই পিকনিকে একটি ছেলে ছিল যে জ্যোতিষী হিসেবে একটু-আধটু নাম কিনেছে। জ্যোতিষী বন্ধু প্রবীরের ভাগ্য বিচার করে জানিয়েছে, ওর মৃত্যুযােগ খুব কাছেই। মাস কয়েকের মধ্যেই। পিকনিক থেকে ফেরার পর দিনকয়েক জ্যোতিষী বন্ধুর কথাটা মনের মধ্যে খচখচ করে বিধতে লাগল। শেষ পর্যন্ত একদিন কলকাতার অন্যতম সেরা গ্রহরত্নের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলাে। সেখানকার এক জ্যোতিষীকে বন্ধু জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণীর কথা বলে জানতে চাইলাে—সত্যটা কী? জ্যোতিষীর থেকে যা উত্তর পেল তাতে বেচারা একেবারে ভেঙে পড়ল। জ্যোতিষীর মতে, খুব কাছেই মৃত্যুযােগ। হা, জীবনের পরিধি আর মাত্র মাসকয়েক। এবার বাড়িতে মা-বাবার কাছে দুঃসংবাদটা ভাঙল। মােটামুটি সচ্ছল পরিবারের আদরের ছেলে। মা আর দেরি না করে প্রবীরকে ধরে নিয়ে গেলেন তার পরিচিত এক তান্ত্রিকের কাছে। সব শুনে, হাত দেখে তান্ত্রিক খুব একটা ভরসা দিতে পারেননি, পাঁচ হাজার টাকা খরচের যজ্ঞ করার পরও। অতএব, ও যে এখন মৃত্যুর মুখােমুখি এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে। দিনকয়েক আগে ডালহৌসি স্কোয়ারে টেলিফোন ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে গাড়িতে চাপা পড়া একটা লােকের মৃতদেহ দেখে প্রবীরের গা গুলিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে যায়। ফুটপাতেই বসে পড়ে নিজের পতন রােধ করে। তারপর থেকে ওর সব সময়ই মনে হচ্ছে, এই বােধহয় কোন দুর্ঘটনা হবে। মৃত্যু যে ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছে! ওই বীভৎস মৃত্যুটা দেখার পর থেকে গত ছ'টা রাত এক মিনিটের জন্যেও ঘুমােতে পারেনি। | ঘটনাটা বলে বলল, “আপনি আমাকে বাঁচান, আমি আর সহ্য করতে পারছি । দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে আমার হাত-পা কেমন যেন কাঁপে, মাথা ঘােরে। হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৫৯ রাতে সকলে যখন ঘুমােয়, আতঙ্কে আমার চোখে কিছুতেই ঘুম আসে না। ক্যামপােস খেয়ে দেখেছি, তাতেও কাজ হচ্ছে না। আমি আর পারছি না। আমাকে আপনার বাঁচাতেই হবে।” কথাগুলাে শেষ করবার আগেই ওর গলা ধরে এলাে। দেখলাম, ও একান্তভাবে কান্না চাপার চেষ্টা করছে। বেচারা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বুজরুক জ্যোতিষী আর তান্ত্রিকদের ওপর রাগে সারা শরীর রি-রি করে উঠল। সমাজের বুকে বসে সম্মানের সঙ্গে ওরা প্রবীরকে একটু একটু করে খুন করছে। প্রবীরের মৃত্যু হলে তার জন্য দায়ী ওই সব প্রতারকরা। প্রবীরকে বললাম, “দুটো হাতই পাশাপাশি মেলে ধরাে তাে।” মেলে ধরল। হাতের রেখাগুলাের ওপর গভীরভাবে চোখ বােলাবার অভিনয় করলাম। কিছুক্ষণ মাপামাপি করে বললাম, “দিন কয়েকের মধ্যে তােমার পেটে কোনাে গণ্ডগােল হয়েছে, এই পেট খারাপের মতাে কিছু?” প্রবীর সাহা উৎসুক চোখে বলল, “হ্যা, সত্যিই তাই।” আমার এই সঠিক বলতে পারার পেছনে অলৌকিকত্ব বা হাত দেখার কোনও ব্যাপারই ছিল না। স্নায়ুদুর্বলতার দরুন কয়েকটা রাত ভাল ঘুম না হলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর, এই সম্ভাবনাটুকুর কথাই আমি প্রশ্নের আকারে প্রকাশ করেছিলাম। আমার এই সামান্য মিলে যাওয়া কথাটাই আমার প্রতি প্রবীর সাহার বিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলল। এবার ওর ডান হাতের প্রায় অস্পষ্ট একটা রেখাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, “আমার ওপর তােমার বিশ্বাস আছে তাে?” “নিশ্চয়। আর, সেই জন্যেই তাে বাধ্য হয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আসা।” জ্যোতিষশাস্ত্র কোনই বিজ্ঞানই নয়, একটি অপবিজ্ঞান, এই কথাটা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে এখন প্রবীরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা বৃথা। ওর বর্তমান মানসিক অবস্থা যুক্তি বিচারের পর্যায়ে নেই। এই মানসিক অবস্থার কোনও মানুষকে তার অন্ধ বিশ্বাসের মূলে আঘাত করার মত বােকামি প্রায় কোনও মানসিক চিকিৎসকই করবেন না। সাময়িকভাবে ওর জ্যোতিষ বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই ওকেই বাঁচাতে চাইলাম। অর্থাৎ সেই প্লাসিবাে চিকিৎসা। এবার কণ্ঠস্বরে যথাসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সুর মিশিয়ে বললাম, “তােমার জ্যোতিষ বিচার করতে গিয়ে সকলেই এক জায়গায় মারাত্মক রকমের ভুল করেছেন। আমি তােমাকে বলছি, তুমি বাঁচবেই। তােমার কিছুই হবে না। এই ছােট্ট রেখাটা বলে দিচ্ছে, একটা কিছু ঘটার যে সম্ভাবনা ছিল, তা কেটে গেছে। তােমার জীবনের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বলছি, তােমার কিছুই হবে না। তবে তােমাকে একটা জিনিস ১৬০ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) পরতে বলব। পরলে তােমার গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না।” এবার ও প্রশ্ন করল, “কী?” বললাম, “একটা পাঁচ-ছ’রতির ভাল মুক্তো সােনায় বাঁধিয়ে আগামী শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার সকালে পরতে হবে। ক্ষুক্তোটা দিয়ে আংটি বানিয়ে শােধন করে নিও। আর, এই শুক্লপক্ষ পর্যন্ত দিনগুলাের জন্যে তােমার ভাল-খারাপের দায়িত্ব আমি নিলাম। আর একটা কথা, বাড়ি ফিরে ধনে ও মৌরি ভিজিয়ে রাখবে শােবার আগে ওই ধনে-মৌরি ভেজানাে জলটা খেয়ে ফেলবে। আজ থেকে তােমার সুন্দর ঘুম হবে, কোন চিন্তা নেই।” | মুক্তোর কথাটা এলােমেলােভাবে মনে এলাে বলেই বলে ফেললাম। প্রবীর সাহার প্রবল জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসই ওকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলেছিল। এই জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস দিয়েই ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম, ওর স্নায়ুগুলােকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। কাজও পেলাম হাতে হাতে। পরের দিনই প্রবীর এসে উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে খবর দিল, “কাল রাতে ভালই ঘুম হয়েছিল।” বুঝলাম আমার Suggestion-এ ভালই কাজ হচ্ছে। এই লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত প্রবীর দিব্যি সুস্থ-সবল হয়ে বেঁচে রয়েছে তিন জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীকে উপেক্ষা করে। বিয়েও করেছে প্রবীর। কয়েক মাসের বদলে কয়েকটা বছর নিশ্চিন্তে পার হওয়ার পর প্রবীরকে উপহার দিলাম এই বইটি-ই, বললাম তােমার কথাও লেখা আছে এখানে। | এবার যে ঘটনাটার কথা বলছি, তার নায়ক আমারই সহকর্মী অরুণ চট্টোপাধ্যায়। থাকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পােলঘাট গ্রামপঞ্চায়েতের অধীন মানিকপুরে। ১৯৭৮-এর পঞ্চায়েতের নির্বাচনে পােলঘাট এলাকা থেকে অরুণ নির্বাচিত হয় নির্দল প্রার্থী হিসেবে। নির্দল হিসেবে জিতলেও ওর গায়ে আছে। একটা রাজনৈতিক গন্ধ। ওই এলাকায় বিরােধী রাজনৈতিক দলের তখন দারুণ রমরমা। ডামাডােলের বাজারে ওই তল্লাটে রাজনৈতিক খুন তখন ডাল-ভাত। অরুণ তখন নতুন বিয়ে করেছে। বউ, একটি ছেলে, মা-বাবা আর ভাই-বােন নিয়ে গড়ে ওঠা সুখের সংসারে হঠাৎই হাজির হলাে রাজনৈতিক আক্রমণ শঙ্কার কালাে মেঘ। বিরােধী আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত অরুণ একদিন আমাকেই মুশকিল আসানের জন্য গ্রহশাস্তির ব্যবস্থাপত্র করে দিতে বলল। অরুণের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্টতই আমার ধারণা হয়েছিল ও এবং ওদের পরিবারের সকলেই গভীরভাবে ভাগ্যে এবং জ্যোতিষ বিচারে বিশ্বাসী। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ পরিবারে যে পরিবেশে অরুণ এত বড় হয়েছে, আমার শুকনাে উপদেশে সেই পরিবেশের সংস্কার এক মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যাবে না। অথচ, চোরাগােপ্তা খুন হওয়ার চিন্তায় হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৬১ ওর মানসিক ভারসাম্যের যে অভাব দেখতে পেলাম, সেই অভাবটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূর করার প্রয়ােজন রয়েছে। | এই মুহূর্তে অফিসের পাশাপাশি চেয়ারে বসে সম্মােহন-ঘুম এনে Suggestion দিয়ে ওর মানসিক জোর ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চিন্তা একান্তই অবাস্তব। অথচ, ওর ফলিত জ্যোতিষ-বিশ্বাসকে এই মুহূর্তে যুক্তির কূটকৌশলে ভাঙার চেষ্টা করে, যদি ওর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই মনােবল বাড়াতে পারি, বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারি যে, ও খুন হবে না, তবে অরুণের সঙ্গেসঙ্গে ওর পরিবারের সকলেরও মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসবে। অরুণের হাত দেখে বললাম, “তাের রক্তপাতের কারণ মঙ্গল। তুই, ডান হাতে একটা ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের তামার বালা পর। বালাটা যে কোন চেনা সােনার দোকানে বললে বানিয়ে দেবে। কয়েকটা কথা স্পষ্ট মনে রাখবি। (১) বালাটা বানাতে দোকানদার যে দাম চাইবে, সেই দামই দিবি। কোন দরদাম করবি । (2) বালাটা শােধন করিয়ে আগামী মঙ্গলবার ভােরে সূর্য ওঠার সঙ্গেসঙ্গে স্নান করে ডান হাতে পারবি। (৩) বালাটার ওজন কম হলে কাজ হবে না। কিন্তু বেশি হলে বালাটা পরার পর সারা শরীরে যেন বিদুৎ খেলে যাবে, গা প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠবে। | সেদিনই বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার সেকরার কাছে আমার বালা বানাতে দিয়ে গেল অরুণ। তারপর বােধহয় দিন-দুয়েক পরেই একদিন আমাকে বালাটা দেখাল। বলল, “ঠিক আছে?” | বললাম, “বালাটা খাঁটি তামার বটে, কিন্তু ওটার ওজন তাে মনে হচ্ছে অনেক বেশি। তুই ওজন দেখে নিসনি?” অরুণ বলল, “না, নেওয়ার সময় আর ওজন দেখে নিইনি। ঠিক আছে, আজই যাওয়ার পথে দোকান থেকে ওজনটা জেনে যাব। আজ রাতে বালাটা শােধন করে নেব, কালই তাে পরব।” পরের দিন অরুণ অফিসে এলাে ঝােড়াে কাকের মতাে। বালাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বালার বাঁকানাে, জোড়া না লাগানাে মুখের কাছটা এমনভাবে হাঁ হয়ে আছে যে, বুঝতে অসুবিধে হয় না, বালাটা যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করে হাত থেকে তাড়াতাড়ি খােলা হয়েছে। অরুণ যা বলল, তাতে জানতে পারলাম, কাল সােনার দোকানে বালাটা ওজন করিয়ে দ্যাখে, ওটা প্রায় ৪৫ গ্রামের। রাতে শােধন করিয়ে সকালে পরেছে। তারপর বেরিয়ে পড়েছে অফিসে। ট্রেনে ওঠার পর সারাগায়ে কেমন একটা জ্বালা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শরীর গরম হয়ে উঠতে থাকে, অসহ্য গরম। সেই সঙ্গে গায়ের লােমগুলাে খাড়া হয়ে ওঠে, শিরশির করে ওঠে। গােটা শরীরটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। অরুণের বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই সবই বেশি ওজনের অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)- ১১ ১৬২ অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) তামা ধারণের ফল।
ট্রেনে বালাটা খুলে ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার শরীর স্বাভাবিক হয় । অরুণের এই শরীর খারাপ হওয়ার পেছনে বেশি ওজনের তামার কোনও কার্যকর ভূমিকা ছিল না। গােটা ব্যাপারটাই ছিল মনস্তাত্ত্বিক। আমার কথার ওপর অন্ধবিশ্বাসের দরুনই এমনটা ঘটেছে। অরুণের মস্তিষ্ক কোষে যে ধারণা আমি সঞ্চার করেছিলাম তারই ফলে অরুণের শরীর এইসব অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। অরুণের মনের ভুল ধারণাটা ভাঙার দরকার ছিল। ১৯৯০ সালে ওকে বইটি উপহার দিই। অরুণ সব জানার পরও ঠিকঠাক আছে। ফোটো-সম্মােহন কি সম্ভব? আজকাল পঞ্জিকার ব্যবহার কিছুটা কমে গেছে। আমাদের ছােটবেলায় পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন পড়ে বেশ মজা পেতাম। তাতে কত যে অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপন থাকত তার ইয়ত্তা নেই। এখনও থাকে। ফোটো-সম্মােহনের বিজ্ঞাপন এখনও পঞ্জিকা খুললে চোখে পড়বে। সেসব বিজ্ঞাপনের ভাষাও বিচিত্র—“আপনি কি ভালবাসায় ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়েছেন? ফোটো সম্মােহনের সাহায্য নিন। দেখবেন, যিনি আপনাকে দূর দুর করেছেন, তিনিই আপনার হুকুমের চাকর হয়ে গেছেন, আপনার বিরহে ছটফট করছেন।” ফোটো-সম্মােহন করার ব্যাপারটা কী? আপনি যাকে সম্মােহিত করে হুকুমের চাকর করতে চান, তার একটা ছবি আর মােটা টাকা দক্ষিণা তুলে দিন যে সম্মােহন করবেন, তার হাতে। তাহলেই নাকি যার ছবি সে আপনার হুকুমের দাস, আপনার ভালবাসায় পাগল হয়ে যাবে। ফোটো-সম্মােহন করতে পারেন, এমন দাবি যারা করেন, তাদের মধ্যে খ্যাতি বা কুখ্যাতির শীর্ষে আছেন হাওড়ার জানবাড়ির পাগলাবাবা, প্রাক্তন লেকটাউন নিবাসী গৌতম ভারতী। | ফোটো-সম্মােহন একটি আগাপাশতলা প্রতারণা বই কিছু নয়। গৌতম ভারতীর ফোটো সম্মােহনের বুজরুকি ফাস করেছিলাম। তারপর সে এক বিশাল ব্যাপার। গৌতমের মিথ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার, বিজ্ঞাপনের মিথ্যেচারিতা ফঁস, সাময়িক ভারসাম্য হারিয়ে গৌতমের আত্মহত্যার চেষ্টা (গােটা ঘটনাটাই লিখেছি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে)। ফোটো-সম্মােহনের বুজরুকি নিয়ে আলােকপাত’ বাংলা মাসিক পত্রিকায় আমার কিছু উঁছাছােলা বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর একজন আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। চ্যালেঞ্জারের নাম : কাজী খােদা বক্স সিদ্দিকী। নিবাস : বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া। আলােকপাত এর ১৯৮৮-র জানুয়ারি সংখ্যায় কাজী সাহেব ঘােষণা হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৬৩ করলেন—“প্রবীরবাবু যদি তার পরিচিত কোন নারীকে প্রকৃতই বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তাহলে কোন ছবি-টবি নয়, শুধুমাত্র কয়েকটি প্রকৃত তথ্য দিলেই হবে। তথ্যগুলাে অবশ্যই অপার্থিব নয়। যদিও তিনি ফোটো-সম্মােহন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন তবুও তিনি আগ্রহী হলে তার এ প্রক্রিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি।” চ্যালেঞ্জের অর্থ মূল্য আমার তরফ থেকে তখন ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে চিঠি দিলাম। জানালাম, আমি বিবাহিতা। আমার চিকিৎসক বন্ধু অনিরুদ্ধ কর অবিবাহিত। তার মনের মত মেয়েটিকে জীবনসঙ্গিনী করে দিলে হার মেনে নেব। মেয়েটির বিষয়ে অবশ্যই প্রয়ােজনীয় এবং জানা সম্ভব, এমন সব তথ্যই দেব, এমনকি বাড়তি দেব মেয়েটির ছবি। অনিরুদ্ধ আমাকে বলেছিলে, “মেয়েটিকে পছন্দ করার পর কাজী সাহেব যদি সেই মেয়েটির সঙ্গে যােগাযােগ করে ওর হাতে পায়ে ধরে আমার সঙ্গে বিয়ে ঘটিয়ে দেয়?” | বলেছিলাম, “আপনার শ্রীদেবী, রেখা অথবা এদের চেয়েও দুর্লভ মেয়েকে বিয়ে করতে কোনও আপত্তি নেই তাে?” | অনিরুদ্ধ প্রাণখােলা হাসি হেসে বলেছিলেন, “কাজী সাহেব আপনার চিন্তার হদিশ পেলে চ্যালেঞ্জ জানাবার দুঃসাহস দেখাতেন না।” | প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি-সম্মােহন করে স্কুমের দাস বানানাে বাস্তবে সম্ভব নয়। ওসব বিজ্ঞাপনে আর গল্পে হয়।
ট্রেনে বালাটা খুলে ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার শরীর স্বাভাবিক হয় । অরুণের এই শরীর খারাপ হওয়ার পেছনে বেশি ওজনের তামার কোনও কার্যকর ভূমিকা ছিল না। গােটা ব্যাপারটাই ছিল মনস্তাত্ত্বিক। আমার কথার ওপর অন্ধবিশ্বাসের দরুনই এমনটা ঘটেছে। অরুণের মস্তিষ্ক কোষে যে ধারণা আমি সঞ্চার করেছিলাম তারই ফলে অরুণের শরীর এইসব অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। অরুণের মনের ভুল ধারণাটা ভাঙার দরকার ছিল। ১৯৯০ সালে ওকে বইটি উপহার দিই। অরুণ সব জানার পরও ঠিকঠাক আছে। ফোটো-সম্মােহন কি সম্ভব? আজকাল পঞ্জিকার ব্যবহার কিছুটা কমে গেছে। আমাদের ছােটবেলায় পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন পড়ে বেশ মজা পেতাম। তাতে কত যে অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপন থাকত তার ইয়ত্তা নেই। এখনও থাকে। ফোটো-সম্মােহনের বিজ্ঞাপন এখনও পঞ্জিকা খুললে চোখে পড়বে। সেসব বিজ্ঞাপনের ভাষাও বিচিত্র—“আপনি কি ভালবাসায় ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়েছেন? ফোটো সম্মােহনের সাহায্য নিন। দেখবেন, যিনি আপনাকে দূর দুর করেছেন, তিনিই আপনার হুকুমের চাকর হয়ে গেছেন, আপনার বিরহে ছটফট করছেন।” ফোটো-সম্মােহন করার ব্যাপারটা কী? আপনি যাকে সম্মােহিত করে হুকুমের চাকর করতে চান, তার একটা ছবি আর মােটা টাকা দক্ষিণা তুলে দিন যে সম্মােহন করবেন, তার হাতে। তাহলেই নাকি যার ছবি সে আপনার হুকুমের দাস, আপনার ভালবাসায় পাগল হয়ে যাবে। ফোটো-সম্মােহন করতে পারেন, এমন দাবি যারা করেন, তাদের মধ্যে খ্যাতি বা কুখ্যাতির শীর্ষে আছেন হাওড়ার জানবাড়ির পাগলাবাবা, প্রাক্তন লেকটাউন নিবাসী গৌতম ভারতী। | ফোটো-সম্মােহন একটি আগাপাশতলা প্রতারণা বই কিছু নয়। গৌতম ভারতীর ফোটো সম্মােহনের বুজরুকি ফাস করেছিলাম। তারপর সে এক বিশাল ব্যাপার। গৌতমের মিথ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার, বিজ্ঞাপনের মিথ্যেচারিতা ফঁস, সাময়িক ভারসাম্য হারিয়ে গৌতমের আত্মহত্যার চেষ্টা (গােটা ঘটনাটাই লিখেছি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে)। ফোটো-সম্মােহনের বুজরুকি নিয়ে আলােকপাত’ বাংলা মাসিক পত্রিকায় আমার কিছু উঁছাছােলা বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর একজন আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। চ্যালেঞ্জারের নাম : কাজী খােদা বক্স সিদ্দিকী। নিবাস : বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া। আলােকপাত এর ১৯৮৮-র জানুয়ারি সংখ্যায় কাজী সাহেব ঘােষণা হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মােহন, নির্দেশ ১৬৩ করলেন—“প্রবীরবাবু যদি তার পরিচিত কোন নারীকে প্রকৃতই বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তাহলে কোন ছবি-টবি নয়, শুধুমাত্র কয়েকটি প্রকৃত তথ্য দিলেই হবে। তথ্যগুলাে অবশ্যই অপার্থিব নয়। যদিও তিনি ফোটো-সম্মােহন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন তবুও তিনি আগ্রহী হলে তার এ প্রক্রিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি।” চ্যালেঞ্জের অর্থ মূল্য আমার তরফ থেকে তখন ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে চিঠি দিলাম। জানালাম, আমি বিবাহিতা। আমার চিকিৎসক বন্ধু অনিরুদ্ধ কর অবিবাহিত। তার মনের মত মেয়েটিকে জীবনসঙ্গিনী করে দিলে হার মেনে নেব। মেয়েটির বিষয়ে অবশ্যই প্রয়ােজনীয় এবং জানা সম্ভব, এমন সব তথ্যই দেব, এমনকি বাড়তি দেব মেয়েটির ছবি। অনিরুদ্ধ আমাকে বলেছিলে, “মেয়েটিকে পছন্দ করার পর কাজী সাহেব যদি সেই মেয়েটির সঙ্গে যােগাযােগ করে ওর হাতে পায়ে ধরে আমার সঙ্গে বিয়ে ঘটিয়ে দেয়?” | বলেছিলাম, “আপনার শ্রীদেবী, রেখা অথবা এদের চেয়েও দুর্লভ মেয়েকে বিয়ে করতে কোনও আপত্তি নেই তাে?” | অনিরুদ্ধ প্রাণখােলা হাসি হেসে বলেছিলেন, “কাজী সাহেব আপনার চিন্তার হদিশ পেলে চ্যালেঞ্জ জানাবার দুঃসাহস দেখাতেন না।” | প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি-সম্মােহন করে স্কুমের দাস বানানাে বাস্তবে সম্ভব নয়। ওসব বিজ্ঞাপনে আর গল্পে হয়।
অলৌকিক নয়, লৌকিক
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ