ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম। বুদ্বের দর্শন এবং উপদেশের সংকলন। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক।
পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ - ঝুড়ি, পাত্র, বাক্স ইত্যাদি, অর্থ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষন করা হয়।এটি থেরবাদী বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। খ্রীষ্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই গ্রন্থের গ্রন্থনের কাজ শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ এর পরিনির্বানের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪৩ অব্ধে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব প্রায় ২৩৬ অব্ধে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সঙ্ঘায়নের মধ্যে এর গ্রন্থায়নের কাজ শেষ হয়। আর এতে অংশগ্রহণকারী পন্ডিত অরহত ভিক্ষু ছিল ২২০০ জন।
জাতক পঞ্চাশক
আদিত্ত রাজ জাতক
“ভবৎ, আমার যখন স্বপ্ন” এ’গাথাটি ভগবান জেতবনে অবস্থান করবার সময় তাঁর জন্মান্তরের দান- পারমীকে উপলক্ষ করে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এরূপ কথা উত্থাপন করলেন। “আহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা দেব। মানবের লৌকিক লোকুত্তর সম্পদ দায়ক। অপিচ তিনি পূৰ্বজন্মে বোধিসত্বাবস্থায় পরকে দান করে কোন সময় তৃপ্ত হননি। তাই সর্বদা তিনি দানে রত থাকতেন। এ দানবলেই তিনি এখন সর্বজ্ঞতা প্ৰাপ্ত হয়ে দেব-মনুষ্যগণকে আর্যমাৰ্গ ধর্মফল প্ৰদান করছেন। “শাস্তা গন্ধকুটি থেকে ভিক্ষুগণের এসব আলোচনা দিব্য কৰ্ণে শুনে ধৰ্মসভায় এসে উপস্থিত হলেন। তথায় প্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবিষ্ট হয়ে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ, বর্তমান তোমরা এখানে কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলে, বুদ্ধ বললেন- “হে ভিক্ষুগণ, ইহা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় নহে-তথাগত যে শুধু এখন দেব-মানবের লৌকিক লোকুত্তর সম্পদ দায়ক হয়েছেন তা’ নয়, পূর্বেও বোধিসত্ত্বাবস্থায় পরকে দান দিয়ে তৃপ্তি লাভ করতে পারিনি। ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। এ ব’লে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন অতীতের সে বিষয় বলার জন্য ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থী হয়ে তিনি তা বলতে আরম্ভ করলেন ।
অতীতে জ্যোতিঃ নামক নগরে আদিত্ত নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর ষোড়শ সহস্ৰ নারীদের মধ্যে শঙ্খাদেবী নাম্নী এক পুন্যবতী নারী ছিলেন অগ্ৰমহেষী। রাজা ছিলেন। অতিশয় শ্রদ্ধাবান। সর্বদাই তিনি দানে রত থাকতেন। তাই নগরের চারি দ্বারে চার খানা, মধ্যে এক খানা এবং নিজের প্রাসাদের দ্বারে একখানা, এ ছয়খানা দান-শালা তৈরী করায়ে প্রত্যহ প্রত্যেক দানশালায় ছয় হাজার ছয় শত টাকার দানীয় বস্তু অর্থীদের দান করতেন। সময়ে সময়ে মহারাজ মহামেঘের ন্যায় মহাদান বর্ষণ করতেন। তিনি কোন এক রাত্রির অন্তিমযামে স্বপ্নযোগে দেখলেন “দুর্বল জীর্ণ শীর্ণ এক ব্ৰাহ্মণ তাঁর নিকট এসে অন্ন যাচ্ঞা করলেন।” তিনি এরূপ স্বপ্ন দেখার পর জাগ্রত হয়ে তা পুনঃ পুনঃ স্মরণ করে উপবেশন করলেন। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পর স্বীয় অমাত্যবৃন্দকে আহবান করে নিম্নোক্ত গাথাটি বললেন-
১। “হে ভবৎগণ, এক জীৰ্ণ ব্ৰাহ্মণকে স্বপ্নে দেখার পর নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে উপবিষ্ট হয়েছি।” অমাত্যবৃন্দের নিকট স্বীয় দৃষ্ট স্বপ্ন প্রকাশ করার পর রাজা চিন্তা করলেন- “অদ্য প্ৰাতে যদি কোন যাচক আমার নিকট এসে বাহ্যিক বা আধ্যাকি কোনও বস্তু যাচ্ঞা করে, তা নিশ্চয়ই তাকে দান করব।” যদি আমার নিকট কেহ মস্তক চায়, তাও ছেদন করে দান দেব। কেহ যদি আমার হৃদয় চায়, আমার বক্ষ ভেদ করে তাও বের করে দান দেব। যদি কেহ আমার দেহের মাংস-পিণ্ড চায়, অথবা অর্ধ শরীর বা সর্বশরীর চায়, তাকে তাও দান করব। আর কেহ যদি আমাকে বলে- তুমি আমার দাস হও, তখন আমি তাও হব। কেহ যদি রাজ্য চায়, তাও তাকে দান করব। আদিত্যরাজ এরূপ চিন্তা করে অমাত্যগণ পরিবৃত হয়ে বিচারালয়ে রত্ন পালঙ্কে উপবিষ্ট হয়ে যাচকের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। এমন সময় অমাত্যবৃন্দ রাজার দৃষ্ট স্বপ্ন জ্ঞাত হবার ইচ্ছায় রাজাকে নিম্নোক্ত গাথায় বললেন–
২। রাজন, আপনি রাত্ৰিতে যে স্বপ্ন দেখেছেন বলে প্ৰকাশ করছেন তা’ আমাদের বলুন।
আদিত্তরাজ তাদের বাক্য শুনে নিম্নোক্ত গাথা দ্বয়ে স্বপ্ন বিবরণ প্রকাশ করলেন-
৩। আমি স্বপ্নে দেখলাম, “এক জীৰ্ণ ব্ৰাহ্মণ আমার নিকট এসে অন্ন যাচ্ঞা করলেন।
৪ । অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও জীবন ইত্যাদি অন্য কিছুই যাচ্ঞা করলেন না।” আমি এরূপই স্বপ্ন দেখলাম। ভবৎগণ, তা’ আপনারা চিন্তা করে দেখুন।
এরূপে তিনি অমাত্যদের নিকট স্বপ্ন-বিবরণ প্ৰকাশ করার পর আধ্যাকি দান দেওয়ার ইচ্ছক হয়ে পুনঃ চিন্তা করলেন“কোন যাচক আমার নিকট এসে বাহ্যিক দান যাচ্ঞা করে। পরে আধ্যাকি দানই যাচ্ঞা করুক।” এরূপ চিন্তা করে। প্রীতিফুল্লমনে আধ্যাকি দানই দেওয়ার প্রণিধান করতঃ নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৫। আমি অদ্য তুষ্ট মনে আধ্যাকি দান প্রদান করব। যাচকগণ শীঘই আমার নিকট এ’সে আমার আধ্যকি ধন গ্ৰহণ করুন। আমার অঙ্গ ও জীবন দান করা হবে একমাত্ৰ বোধিজ্ঞান লাভ করবারই ইচ্ছায় ।
আদিত্তরাজ এরূপ দৃঢ় সংকল্প পোষণ করে নিজের প্রাসাদে আরোহণ করলেন। অতঃপর একদিবস রাজা প্ৰত্যুষকালে নিদ্রা হতে জাগিয়ে শয্যায় সুখাসনে উপবেশন করলেন এবং ছয় দানশালায় প্রদত্ত দান সম্বন্ধে চিন্তা করতে লাগলেন। এরূপ চিন্তা করার ফলে তাঁর অন্তরে স্থায়ী প্রীতির উদ্রেক হল। সেইক্ষণে রাজা এরূপ চিন্তা করলেন- অহো! যাচকগণ আমার নিকট এসে যদি বাহ্যিক দান যাচ্ঞা না করে আধ্যকি দানই যাচ্ঞা করে চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত, অৰ্দ্ধ দেহ বা সর্বদেহও যদি যাচ্ঞা করে, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের ইচ্ছায় তাদের ইচ্ছিত বস্তু নিশ্চয়ই দান করব। সে বিষয় প্রকাশ-মানসে শাস্তা নিম্নোক্ত গাথাত্রায় বললেন–।
৬। ধর্মতঃ রাজত্বকারী আদিত্ত নামক রাজা প্রাসাদে বসে দান দেওয়ার জন্য চিন্তা করলেন।
৭। কোন ব্যক্তি যদি আমার নিকট এসে আমার চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত ও অৰ্দ্ধদেহ ইত্যাদি আধ্যাকি বস্তু দান চায়।
৮। আর যদি কোন যাচক আমাকে দাস রূপে চায়, আমি নিজকে তার দাস রূপে নিশ্চয়ই নিয়োজিত করব।
এরূপ ঐকান্তিক চেতনায় চিন্তাকারী রাজার তেজানুভাবে দ্বিলক্ষ চারিনিযুত যোজন দল বিশিষ্ট এ মহা-পৃথিবী মত্ত হন্তীর ন্যায়। সগর্জনে কম্পিত হল। মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হল, সুমেরু পর্বতরাজ সুম্বোধিত বেত্রের ন্যায় নমিত হয়ে জ্যোতিঃ নগরাভিমুখী হল। সশব্দে দেবগর্জন করে ক্ষণিক বর্ষণ হল। অকালে বিদ্যোৎলতা নিসৃঃত হল। দেবরাজ ইন্দ্র ও মহাব্ৰহ্মা সানন্দে সাধুবাদ প্ৰদান করলেন। তৎসঙ্গে সমস্ত দেবতা ও সাধুবাদ দান করলেন। মনুষ্যলোক হতে ব্ৰহ্মালোক পৰ্যন্ত মহাআনন্দ-কল্লোল উখিত হয়েছিল। সে সময় দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন ও রাজাসন উত্তপ্ত হয়েছিল। দেবরাজ এর কারণ চিন্তা করে নিম্নোক্ত গাথাটি ভাষণ করেছিলেন।
৯ । মনে হয়, কোন দেবতা বা মনুষ্য এমন দান ও ব্ৰহ্মচর্য আচরণ করছেন, যে পুণ্য প্রভাবে আমাকে এ আসন হতে চু্যত করবেন।
দেবরাজের এরূপ সন্দেহ উৎপন্ন হওয়ায় তিনি দিব্য নেত্ৰে জগতে অবলোকন করে প্রকৃত কারণ জ্ঞাত হয়ে সানন্দে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় ঘোষণা করলেন।
১০। মনুষ্যলোকে সমস্ত মনুষ্য কুশল কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন। সুসংঘতভাবে। তাই এবার নিরয় শূন্য হবে এবং দেবলোক পরিপূর্ণ হবে।
১১। আদিত্য নামক রাজা বুদ্ধান্ধুর দানে রত হয়ে পারমী ধর্ম পূর্ণ করে অনাগতে বুদ্ধ হবেন।
অতঃপর দেবরাজ এখনিই আমি গিয়ে বোধিসত্ত্ব আদিত্য রাজার পারমী ধর্ম পরিপূরণের সাহায্য করব। “এ চিন্তা করে। তখনই দেবলোক হতে মনুষ্যলোকে উপনীত হয়ে বৃদ্ধ, জীর্ণ শীর্ণ ব্ৰাহ্মণ-বেশ ধারণ করে পক্ক শিরকেশ ও কম্পমান দেহে দণ্ড পরায়ণ হয়ে রাজাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। তথায় জনগণ এ জীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণকে দেখে অতিশয় সংক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–“ভগৎগণ, এ জীর্ণ ব্ৰাহ্মণ ইতিপূর্বে এখানে আসতে দেখিনি, কিরূপে তিনি এখানে আসলেন? তখন বোধিসত্ত্ব প্রাসাদ হতে অবতরণ করে প্রাসাদ-দ্বারে প্রতিষ্ঠিত দানশালায় উপস্থিত হলেন। তখন সে বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ বোধিসত্বের নিকটবৰ্ত্ত হয়ে হস্ত প্রসারণ করে বললেন- “মহারাজের জয় হোক।” ইহা শুনে মহাসত্ব সে দণ্ড হস্তধারী জীৰ্ণ বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের প্রতি লক্ষ্য করে চিন্তা করলেন–
“এ ব্ৰাহ্মণের আগমন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন।” এ চিন্তা করে করুণাময় অন্তরে ব্রাহ্মণকে নিম্নোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস করলেন–
১২। “হে মহাব্ৰাহ্মণ, আপনি কোন প্রয়োজনে এসেছেন?” ইহা শুনে ব্ৰাহ্মণ হস্ত উত্তোলন করে বললেন- মহারাজ, আমি জীর্ণ দুর্বল, ব্যাধি-পীড়িত, অনাথ ও ক্ষুধাতুর। সুতরাং আমাকে অন্নদান করুন। এ বলে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
১৩। রাজন, আমাকে শ্রদ্ধার সহিত ভোজন দান করুন। তজন্য আমি এসেছি।
ইহা শুনে আদিত্ত্য রাজা প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে নিম্নোক্ত গাথাটি বললেন–
১৪। হে ব্ৰাহ্মণ, আপনি যে অন্ন ভোজন যাচ্ঞা করলেন, তা’ আপনাকে দেবো। দানেই আমার মন রমিত হয়।
তখন রাজা প্রার্থনা করলেন- “অদ্য আমার এ যে অন্নদান, তা অনাগতে সর্বজ্ঞ বুদ্ধদের হেতু হোক। অতঃপর স্বর্ণ থালায় উৎকৃষ্টতর অন্ন ব্যঞ্জন পরিপূর্ণ করে তা নিজের মস্তকে ধারণ করে ব্ৰাহ্মণকে প্ৰদান করলেন। ব্ৰাহ্মণও তা রাজার হস্ত হতে গ্ৰহণ করে রাজার সম্মুখেই তা’ ত্যাগ করে চলে গেলেন। শাস্তা তা’ প্ৰকাশ উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত গাথা পঞ্চক ভাষণ করলেন–
১৫। তখন সে আদিত্ত রাজ সদা সুমন চিত্তে সমাদরে ব্ৰাহ্মণকে অন্নভোজন দান করেছিলেন।
১৬। শ্রদ্ধার সহিত রাজা ব্ৰাহ্মণকে শ্রেষ্ঠ অন্ন বোধিজ্ঞান লাভের মানসে দান করেছিলেন।
১৭। রাজা তথায় দেখলেন, তিনি যে অন্ন দান করেছেন, ব্ৰাহ্মণ তা ক্রোধাভরে ত্যাগ করে চলে গেলেন।
১৮। সদা প্ৰসন্ন চিত্ত রাজা এতে মনে কোন প্রকার ক্ৰোধভােব না। এনে বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করে সুমন সম্পন্ন হলেন।
১৯। তব্দ্ধেতু পণ্ডিত জন শ্রেষ্ঠ সুখ প্রার্থনা করে তুষ্ট চিত্তে দান দিয়ে ত্রিকালে প্রসন্ন চিত্তে অবস্থান করে দেব-মনুষ্যলোকে সর্বদা দুর্লভ শ্রেষ্ঠ সুখ লাভ করেন।
সেক্ষণেই দেবরাজ জীর্ণ ব্রাহ্মণবেশ ত্যাগ করে তরুণ দর্শনীয় অভিরূপ প্ৰসন্নতা ব্যঞ্জক ও সৌভাগ্যবান ব্ৰাহ্মণবেশ ধারণ করে পুনঃ রাজাঙ্গণে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আদিত্ত রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে আলাপচ্ছলে নিম্নোক্ত গাথায় বললেন-
২০। দেব, কুশলে আছেন ত? ভবৎ, নিরাপদে আছেন ত? জনপদ সমৃদ্ধ আছে ত? সুবৃষ্টি হয় ত?
ইহা শুনে আদিত্ত রাজ সে ব্ৰাহ্মণকে সম্বোধন করে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
২১। ব্ৰাহ্মণ, আমি কুশলে ও নিরাপদে আছি। আমার জনপদ সমৃদ্ধ আছে, সুবৃষ্টি ও বর্ষণ হয়। ব্ৰাহ্মণ, বহুদূর হতে আপনার আগমন নিশ্চয়ই সু-আগমন হয়েছে।
এ’বলে মহাসত্ব চিন্তা করলেন- “এ ব্ৰাহ্মণ এ রাজাঙ্গণে অকারণে আসেননি। তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করব।” এ’মনে করে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
২২। আপনি কি কারণে, কীই বা প্রয়োজনে এ রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন? তা আমাকে বলুন।
ইহা শুনে তরুণ ব্ৰাহ্মণ বললেন- “মহারাজ, এখন আমি আপনার শঙ্খাদেবী ভাৰ্যাকে আমার ভাৰ্যারূপে বরণ করবার জন্য যাচ্ঞা করতে এসেছি। আমাকে আপনার ভার্য দান করুন।” এবলে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
২৩। বারিবহনকারী নদীর জলে যেমন কোন সময় ক্ষীরামান হয়না, আপনিও তেমন। তাই আপনার নিকট যাচ্ঞা করতে এসেছি। শীঘই আপনার ভার্য আমাকে দিন।
ইহা শুনে মহাসত্বের মন প্রীতি রসে সিক্ত হল। প্রসারিত হস্তে যেন সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রার থলি পতিত হল এবং দরিদ্র ব্যক্তি যেন সুবর্ণ-নিধি লাভ করল, সেরূপ আনন্দিত মনে বললেন–“সাধু সাধু মহাব্ৰাহ্মণ, আপনার সমস্ত মনোরথ পূর্ণ করব।” এ বলে তিনি সমগ্র জ্যোতিঃনগরে বিঘোষিত হয় মত প্ৰসন্ন মনে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন-
২৪। ব্ৰাহ্মণ, আপনি যা যাচ্ঞা করলেন, তা আপনাকে অকম্পিত হৃদয়েই প্ৰদান করব । যা আছে, তা গোপন করবনা। দানেই আমার মন রমিত হয়।
মহাসত্ব এরূপ বলে স্বীয় পত্নী শঙ্খা দেবীর মুখ-পানে চেয়ে বললেন– “ভদ্ৰে, এখন আমি তোমাকে দান দিয়ে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করব।” ইহা শুনে দেবী বললেন- মহারাজ, তা প্রার্থনা করুন, বড়ই উত্তম হবে।” এ বলে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
২৫। দেব, আপনি আমার অভিভু, স্বামী, ঈশ্বর এবং আমার প্রতিষ্ঠাপক দেবতা। আমাকে নিশ্চয়ই দান দিন।
২৬। আপনার প্রতি যাই অপরাধ করেছি, তা আমার প্রতি অনুকম্প করে ক্ষমা করুন। মহারাজ, আপনার শ্ৰী পাদপদ্মে বন্দনা জানাচ্ছি।
রাজা ইহা শুনে শীঘ্রই সুভাশিত জল পরিপূর্ণ সুবর্ণ গাডু গ্ৰহণ করে সে তরুণ ব্ৰাহ্মণের হস্তে জল ঢেলে বললেন- “হে ব্ৰাহ্মণ, এ শঙ্খাদেবী আমার অতি প্ৰিয়তমা । অপিচ এ দেবী হতেও শত-সহস্র ও লক্ষগুণে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই আমার প্রিয়তর। তদ্ধেতু আমার এ ভাৰ্যাদান সর্বজ্ঞ জ্ঞানের হেতু হোক।” এ বলে নিজের প্রিয়তমা ভার্যা শঙ্খাদেবীকে তাঁর হস্তে প্রদান করে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন-
২৭। মহাব্ৰাহ্মণ, বোধিলাভের ইচ্ছায় আপনাকে আমার ভাৰ্যা দান দিচ্ছি, আমার নিকট হতে তাকে গ্ৰহণ করুন।
এ বলে মহাসত্ব ব্ৰাহ্মণের সাথে দেবীকে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় বললেন—
২৮। মহাব্ৰাহ্মণ, আপনি আমার দানোত্তম দেবীদান গ্ৰহণ করুন। ব্ৰাহ্মণ, আমার প্রদত্ত এ দান গ্ৰহণ করে যথেচ্ছা গমন করুন।
২৯। এ নারী আমার অপ্ৰিয় নয়, কিন্তু ওর চেয়ে সর্বজ্ঞতাই আমার অতিপ্রিয়, তাই আমি আমার এ পতিব্ৰতা ভাৰ্যাকে দান দিচ্ছি।
সেক্ষণেই পৃথিবী কম্পনাদি সর্ববিধ আশ্চর্য বিষয়ের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। তদ্বিষয় প্রকাশ কার ইচ্ছায় শাস্তা নিম্নোক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন।
৩০। অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আদিত্ত রাজা জল। ঢেলে স্বীয় পত্নীকে ব্ৰাহ্মণের হস্তে দান দিয়েছিলেন।
৩১। এ দানের সময় ভীষণ লোমহর্ষ জনক পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল।
৩২। দেবীকে দান করার সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল ভৈরভ নাদ প্রবর্তিত হয়েছিল এবং মহাপৃথিবী কম্পিত হয়েছিল।
৩৩। দেবীকে দান করা হলে তখন সসাগরা মহানগর সহ পৃথিবী সংক্ষুব্ধ হয়েছিল।
৩৪। সাগরে তখন মহাগৰ্জনের সৃষ্টি হল। সুমেরু পর্বত নগরাভিমুখী হয়ে নমিত হয়েছিল। চিত্ৰবন অলঙ্কারের ন্যায়। হয়েছিল।
৩৫। পৃথিবীর সর্বদিক চালিত হল। সর্বদা ইক্ষু নিষ্পেষনীর ন্যায় পৃথিবী হতে মহা শব্দ নিঃসৃত হয়েছিল।
তখন ব্ৰাহ্মণ শঙ্খাদেবীর হস্ত ও কেশ-কলাপ নির্মমভাবে আকর্ষণ করে সে স্থানেই ভূপাতিত করলেন। ইহাতে বেদনা বিধুরা দেবী তখন রোদন করতে লাগলেন। মহাসত্ব এ ব্যাপার দেখে ব্ৰাহ্মণের প্রতি ক্রুব্ধ না হয়ে বললেন– “ভদ্র, তুমি অনুশোচনা ও রোদন করোনা। যেহেতুঃ- আমি তোমাকে ব্ৰাহ্মণের হস্তে দান করে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রার্থনা করছি। দেবী ইহা শুনে সিংহনাদে নিম্নোক্ত গাথা যোগে বললেন–
৩৬। দেব, আমি আপনার দাসী, আপনিই আমার স্বামী ও ঈশ্বর। ইচ্ছা করে আপনি আমাকে দান করেছেন। তব্দ্ধেতু তিনি আমাকে বিক্রী করুক বা বধ করুক, তাতে আমার কোনই আপত্তি থাকবে না।
তখন দেবী প্রীতিফুল্লমনা হয়ে ব্ৰাহ্মণের নিকট স্থিতা হলেন। সে বিষয় প্রকাশ করবার ইচ্ছায় শাস্তা বলেছিলেন।
৩৭। তখন সৰ্বকালের জন্য শঙ্খাদেবী ক্ৰোধ বিহীনা। হয়েছিলেন এবং রাজাও অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য ক্রোধ বিহীন হয়েছিলেন।
তৎপর দেবরাজ তাদের অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে তাঁদেরকে বহু স্তুতি করলেন। সে বিষয় প্রকাশ-মানসে শাস্তা নিম্নোক্ত গাথা পঞ্চক ভাষণ করলেন–
৩৮। দেবরাজ তাদের সংকল্প জ্ঞাত হয়ে এরূপ বললেনদিব্যমানবীয় যা কিছু আছে, সব কিছুতেই আপনার জয়।
৩৯। পৃথিবী যে নিনাদ করেছিল, তা দেবলোকে গিয়েছে। চারিদিকে যে বিদ্যুতের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, তদ্বারা গিরিগহবর পর্যন্ত আলোকিত হয়েছিল।
৪০। তা উভয় বিষয় নারদ পর্বত অনুমোদন করছে। তাঁরা সর্বদা স্বীয় বিমানের দ্বারে স্থিত হয়ে সন্তোষ লাভ করছিল।
৪১। আপনি যে স্বীয় ভাৰ্যা দান দিয়ে দুষ্কর কার্য করেছেন। তা ইন্দ্র, ব্ৰহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যমও বৈশ্রবণাদি সবাই অনুমোদন করছেন।
৪২। আপনি যে ভাৰ্যা দান উত্তমদান দিয়েছেন, ইহাতে যম-শাসন অতিক্রম করে সুগতি লাভ করবেন।
মহাসত্ব দেবরাজের বাক্য শু’নে অত্যন্ত গ্ৰীত হয়ে পালঙ্কে উপবেশন করে বললেন- “আহা, আমার দান একান্তই সুদিন্ন হয়েছে।” এবলে নিজের দান বর্ণনা করছিলেন। তখন দেবরাজ আদিত্তরাজাকে বললেন- মহারাজ, আমি ব্ৰাহ্মণ নই। আমি দেবলোকের দেবরাজ। আমি আপনার পত্নী-দান সংক্রান্ত দানপারমী যাতে পূর্ণ হয়, সে উদ্দেশ্যেই এসেছি। এখন আমার দোষ ক্ষমা করুন। এ বলে দেবরাজ দানানুমোদন মানসে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৪৩। রাজন আমাকে আপনার প্রদত্ত দান আমি অনুমোদন করছি। প্ৰসন্নচিত্তে সর্বদা দান করুন।
৪৪ । দানের ন্যায় অন্য কোন জিনিস নেই। দানই একমাত্ৰ সুখাবহ। দানই সর্বদা পরলোকের প্রতিষ্ঠা হয়।
এরূপে দেবরাজ রাজার দানানুমোদন করে চিন্তা করলেন–“আমি রাণীকে আমার নিকট না রেখে রাজাকেই দিয়ে দেব।” অতঃপর শঙ্খাদেবীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নিুোক্ত গাথাত্রয় বললেন–
৪৭। “মহারাজ, রাণী শঙ্খাদেবীকে আপনার হস্তে প্ৰদান করছি। আপনারা পরস্পর পরস্পরের দ্বারা সুখী হউন। যেমন দুগ্ধ আর শঙ্খ একই বর্ণ সম্পন্ন, তেমন আপনিও দেবী সর্বদা সম মন সম্পন্ন। আপনার উভয়েই ক্ষত্ৰিয় গোত্র সভূত। মাতৃপিতৃকুল উভয় পক্ষে সুজাত। সুতরাং আপনারা উভয়েই সুখে বাস করুন।” ইহা শুনে মহাসত্ব দেবরাজকে বললেন–
৪৮-৫১ । দেবরাজ, আমি শ্রদ্ধার সহিত শঙ্খাদেবীকে দান করেছি। আমি তাকে আর গ্রহণ করবনা। আপনিই তাকে নিয়ে যান। সে আপনার সাথেই গমন করুক। এবং আপনার নিকটই বাস করুক। তথায় তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন এবং এক সাথেই অবস্থান করবেন। দেব, আমি যা দান করি, পুণরায় তা”ধান রত্ন ভোগ সম্পদ দিয়ে গ্ৰহণ করিনা এবং তজ্জন্য কোন সময় অনুতাপও করিনা।” ইহা শুনে দেবরাজ পুনঃ রাজহস্তে–
৫২। “রাজন, আপনাকে এ” নারী প্ৰদান করছি, শীঘ্রই গ্ৰহণ করুন। আমার প্রদত্ত নারী আপনার নিকটেই অবস্থান করুক।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব দেবরাজের অনুরোধে মহিষীকে পুনর্বার গ্রহণ করে বললেন-
৫৩। “দেব, আপনার প্রদত্ত দেবীকে আমি গ্ৰহণ করলাম এবং সর্বদা তাকে সুখে রক্ষা করব।” ইহা শুনে দেবরাজ জ্যোতির্ময় দিব্যদেহ ধারণ করে তরুণ সুর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে রাজাকে বললেন–
৫৪-৫৫। “রাজন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র, দেবলোক হতে আপনার নিকট এসেছি। আপনাকে আমি করজোড়ে নমস্কার করছি। রাজন, আপনি যে জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করেছেন, তা, অতি উত্তম প্রার্থনা। ভবিষ্যতে তা’ লাভ করে আপনি তথাগত বুদ্ধ হবেন।” অতঃপর দেবরাজ আদিত্ত রাজকে দশবিধ রাজধর্ম সম্বন্ধে এরূপ উপদেশ প্ৰদান করলেন–
৫৬-৫৮। “মহারাজ, সর্বদা মাতা-পিতার সেবা করুন স্ত্রীপুত্রের উপকার করুন, এবং মিত্ৰ-অমাত্যের প্রতি সর্বদা যথাধর্ম আচরণ করুন, ইহাতে স্বৰ্গে গমন করবেন।
৫৯-৬৫ । হে জনাধিপ, রথীর্ষভ জন্যেন্দ্র ক্ষত্রিয়, সর্বদা বল-বাহনের প্রতি, গ্রাম-নগরের প্রতি, রাজ্য-জনপদের প্রতি, শীলবান শ্রমণ-ব্ৰাক্ষণের প্রতি, সিংহ মৃগ হংসাদি পশু-পক্ষীর প্ৰতি যথাধর্ম আচরণ করুন। সর্বদা ধর্মাচরণ করে স্বৰ্গে গমন করুন ।
৬৬-৬৭। “রাজন, আপনি ধর্মাচরণ করুন। ধর্মচরণে সুখ উৎপন্ন হয়, ধর্মাচরণের ইহাই সন্দৃষ্টিক ফল। ধর্মাচরণকারীরা কখনো নরকে যায়না। সর্বদা ধর্মাচরণ দ্বারা ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ এবং অন্যান্য দেবগণও শ্রেষ্টতর স্বৰ্গ লাভ করে। রাজন, আপনি অপ্ৰমত্ত হউন। আপনি ধর্মাচরণ করুন, তবে নিশ্চয়ই স্বৰ্গে যাবেন।”
দেবরাজ মহাসত্বকে এরূপ উপদেশ দান করে স্বীয় বাসভবন দেবলোকেই প্ৰত্যাবর্তন করলেন। শাস্তা সেই বিষয় প্ৰকাশ করবার মানসে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৬৮। “মঘব দেবরাজ সুজাম্পতি আদিত্ত রাজাকে এরূপ উপদেশ দিয়ে স্বৰ্গে প্ৰত্যাবর্তন করলেন।”
তখন হতে বোধিসত্ব অর্থীদের মহাদান দিয়ে স্বীয় মহিষী৷ শঙ্খাদেবীর সাথে যথাধর্মানুসারে রাজত্ব করছিলেন। তখন মহাসত্ব জনগণকে নানাবিধ বস্তুদান দিয়ে প্রতিদিন তাদেরকে নিম্নোক্ত উপদেশ প্রদান করতেন–
৬৯। “ভবৎগণ, আমি পূর্বজন্মে দান করেছিলাম। তাই এখন নানা বিষয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছি। তোমরাও সর্বদা অপ্ৰমত্ত হয়ে যথাশক্তি দান দাও।”
তখন হতে জনগণ মহাসত্বের উপদেশে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ব রাজা আদিত্য শঙ্খাদেবী সহ সারাজীবন রাজৈশ্বর্য সুখ পরিভোগ করে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদনান্তর পরিশেষে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন।”
শাস্তা অতঃপর এই জাতিক কাহিনী বর্ণনা করে বললেন–“ভিক্ষুগণ, ইহা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে- আমি পূর্বে বোধিসত্বাবস্থায় অর্থীকে দান করে কিছুতেই তৃপ্তি লাভ করিনি।” তৎপর শাস্তা নিম্নোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা বললেন–
৭০-৭৪ । আমার শাসনে দিব্যচক্ষুলাভী অগ্র উপাধি প্রাপ্ত অনুরুদ্ধই ছিল তখনকার দেবরাজ, মহারাজ শুদ্ধোদন ও রাণী মহামায়া ছিলেন। বোধিসত্বের মাতা-পিতা, রাজার মনোবাসনা পূৰ্ণকারিণী রাজ-রাণী শঙ্খাদেবী এখন যশোধরা। সমস্ত অমাত্যবর্গ ও নগরবাসী জনগণ সবাই আমার শাসন পূর্ণকারী পরিষদ। আমি ছিলাম পুণ্যকামী আদিত্য রাজা। এখন আমি তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। তোমরা গৌরব চিত্তে এই জাতক ধারণ কর ।
(আদিত্ত জাতক সমাপ্ত।)
সূত্রপিটকে দীর্ঘ নিকায় (প্রম খণ্ড) – শীলস্কন্ধ বর্গ
১. ব্রহ্মজাল সূত্র (১। ১)
১.১ পরিব্রাজক কথা
১. ব্রহ্মজাল সূত্র (১। ১)
১.১ পরিব্রাজক কথা
০১.০১ ব্রহ্মজাল সূত্র (১। ১) – পরিব্রাজক কথা
১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি১– একসময়২ ভগবান৩ মহানুভাব পঞ্চশত সংখ্যক ভিক্ষুসংঘ সমভিব্যাহারে রাজগৃহ৪ ও নালন্দার৫ অন্তর্বর্তী দীর্ঘ পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তখন সুপ্রিয়৬ পরিব্রাজকও তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্তের সহিত সেই রাস্তা দিয়া যাইতেছিল। তত্র সুপ্রিয় পরিব্রাজক অনেক প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছিল; কিন্তু তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বহুপ্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের গুণ সম্বন্ধে প্রশংসাবাদ করিতেছিল। এইরূপে আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে পরস্পর সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘের পশ্চাদানুবর্তী হইল।
১. সমগ্র বচনের উদ্দেশ্য–সূত্র নিহিত উপদেশসমূহকে ভগবদুক্তি রূপে নির্দেশ করা ও সূত্রের প্রামাণ্য বিষয়ে শ্রদ্ধা উৎপাদন করা। স্থবির আনন্দ স্বয়ং সূত্রের অকর্তা, তিনি ভগবানের মুখেই ইহা শুনিয়াছেন। (সু. বি.)
২. ইহা সূত্রের প্রস্তাবনা মাত্র। যখন ভগবানের হৃদয় করুণায় পরিপূর্ণ তখন সূত্রোক্ত উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। (সু. বি.)
২. ইহা সূত্রের প্রস্তাবনা মাত্র। যখন ভগবানের হৃদয় করুণায় পরিপূর্ণ তখন সূত্রোক্ত উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। (সু. বি.)
৩. ভগবান অর্থে গুরু, সর্বগুণ-বৈশিষ্টে যিনি সর্বসত্ত্বের গুরু, সর্বোত্তম গৌরব যুক্ত গুরু। ইহার বিশদ বর্ণনা মদানূদিত মহাপরিনিব্বান সূত্রের পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
৪. রাজগৃহ–মগধের পূর্ব রাজধানী, ইহার বর্তমান নাম রাজগির।
৫. নালন্দ–জিলা বড়গাঁও। বক্তিয়ারপুর রেলওয়ে স্টেশন হইতে মাত্র ২৪ মাইল ব্যবধান। ইহা অগ্রশ্রাবক শারিপুত্রের জন্ম ও পরিনির্বান প্রাপ্তির স্থান।
৬. সুপ্রিয় রাজগৃহের বিখ্যাত সঞ্জয় পরিব্রাজকের প্রধান শিষ্য। ধর্মসেনাপতি সারিপুত্র ও মহামোদ্গল্যায়ন প্রমে এই প্রখ্যাত নাম সঞ্জয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। বুদ্ধের উৎপত্তি হইলে সারিপুত্র অশ্বজিৎ স্থবিরের নিকট অমৃতের সন্ধান পাইয়া সঞ্জয়ের শিষ্য পরিষদ হইতে বহু সতীর্থের সহিত বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বুদ্ধোৎপত্তিতে তৈর্থিকগণের লাভ সৎকার পরিহীন হইয়াছিল। এই জন্যই পরিব্রাজকগণ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি ক্রোধাম্বিত হইয়াছিলেন। (সু.বি।)
———————
২। অতঃপর ভগবান (দিবাবসান দেখিয়া) একরাত্র যাপনের জন্য সসংঘ অম্বলট্ঠিকা১ নামক রাজার বাগানবাটীতে উপস্থিত হইলেন। সুপ্রিয় পরিব্রাজকও তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্তের সহিত তথায় রাত্রি যাপনার্থ প্রবিষ্ট হইল। সেখানেও সুপ্রিয় পরিব্রাজক নানা প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দা করিতে থাকে, কিন্তু অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বহুপ্রকারে ত্রিরতেড়বর গুণ সম্বন্ধীয় প্রশংসা করিতে থাকে। এইরূপে আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া রাত্রি যাপন করিতে লাগিল।
১. অম্বলট্ঠিকা–রাজার এক উদ্যান। এই উদ্যান দ্বারে আম্রতরু থাকায় ইহা অম্ব বা আম্রলট্ঠিকা নামে অভিহিত হয়। (২সু. বি.)
———————
৩। অতঃপর রাত্রির প্রত্যুষ সময় শয্যা হইতে উত্থিত বহু ভিক্ষু মণ্ডলমালে (বৈঠক খানায়) উপবেশন করিয়া এইরূপ কথাধর্ম আলোচনা করিতে লাগলেন− “বন্ধুগণ, বড়ই আশ্চর্য২ এবং অদ্ভূত যে সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ কর্তৃক সত্ত্বগণের আশয়-অনুশয় পর্যন্ত সুপরিজ্ঞাত। এই সুপ্রিয় পরিব্রাজক বহু প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছে; আর তাহারই অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রসংশাবাদ করিতেছে। এইরূপে ইহারা আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে পরস্পর সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া সসংঘ ভগবানের পশ্চাদানুবর্তী হইয়াছে।”
২. অন্ধের পর্বতারোহণের ন্যায় নিত্য ঘটেনা বলিয়া আশ্চর্য অথবা করতালি দেওয়ার উপযুক্ত বলিয়া আশ্চর্য। (সু. বি.)
———————
৪। অতঃপর ভগবান ভিক্ষুগণের আলোচ্যমান কথাধর্ম জ্ঞাত হইয়া৩ মণ্ডলমালে সমুপস্থিত হইলেন এবং নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিয়া ভিক্ষুগণকে আহ্বান করিলেন—
“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে কি কথা উত্থাপন করিয়া বসিয়া আছ? আমার আগমনে কর্মস্থান মনস্কার, উদ্দেশ ও পরিপৃচ্ছাদির মধ্যে তোমাদের কোন কথা সমাপ্ত হইল না? (কোন কথা বাধা প্রাপ্ত হইল?)”
এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে এইরূপ নিবেদন করিলেন :
“ভন্তে, রাত্রির প্রত্যুষসময় শয্যা হইতে উত্থিত হইয়া এই মণ্ডলমালে উপবেশন করিলে আমাদের মধ্যে এই ধর্মকথা উত্থিত হয়্ত‘বন্ধুগণ, বড়ই আশ্চর্য এবং অদ্ভূত যে সর্বদর্শী ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাণীগণের আশয়- অনুশয় পর্যন্ত সুপরিজ্ঞাত। এই সুপ্রিয় পরিব্রাজক বহু প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছে, কিন্তু তাহারই অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত অনেক প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রশংসাবাদ করিতেছে। এইরূপে ইহারা আচার্য ও অন্তেবাসী ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত হইয়াও উভয়ে পরস্পর প্রত্যক্ষভাবে বিরুদ্ধবাদী হইয়া সসংঘ ভগবানের পশ্চাদানুবর্তী হইয়াছে।’—ভন্তে, এই আমাদের সর্বদর্শী ভগবানের সর্বজ্ঞতাজ্ঞানকথার আলোচনা হইতেছিল। অতঃপর ভগবান সমাগত। (অনুকম্পাপূর্বক এতৎ সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করুন।)”
“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে কি কথা উত্থাপন করিয়া বসিয়া আছ? আমার আগমনে কর্মস্থান মনস্কার, উদ্দেশ ও পরিপৃচ্ছাদির মধ্যে তোমাদের কোন কথা সমাপ্ত হইল না? (কোন কথা বাধা প্রাপ্ত হইল?)”
এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে এইরূপ নিবেদন করিলেন :
“ভন্তে, রাত্রির প্রত্যুষসময় শয্যা হইতে উত্থিত হইয়া এই মণ্ডলমালে উপবেশন করিলে আমাদের মধ্যে এই ধর্মকথা উত্থিত হয়্ত‘বন্ধুগণ, বড়ই আশ্চর্য এবং অদ্ভূত যে সর্বদর্শী ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাণীগণের আশয়- অনুশয় পর্যন্ত সুপরিজ্ঞাত। এই সুপ্রিয় পরিব্রাজক বহু প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছে, কিন্তু তাহারই অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত অনেক প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রশংসাবাদ করিতেছে। এইরূপে ইহারা আচার্য ও অন্তেবাসী ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত হইয়াও উভয়ে পরস্পর প্রত্যক্ষভাবে বিরুদ্ধবাদী হইয়া সসংঘ ভগবানের পশ্চাদানুবর্তী হইয়াছে।’—ভন্তে, এই আমাদের সর্বদর্শী ভগবানের সর্বজ্ঞতাজ্ঞানকথার আলোচনা হইতেছিল। অতঃপর ভগবান সমাগত। (অনুকম্পাপূর্বক এতৎ সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করুন।)”
৩. ভগবান কোন বিষয় মাংসচক্ষে কোন বিষয় দিব্যচক্ষে দেখিয়া বা দিব্য শ্রোত্রে শুনিয়া অবগত হন। এস্থলে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানেই অবগত হইলেন। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
———————
৫। “ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের নিন্দাবাদ করিলে তাহাদের প্রতি তোমরা আঘাত (কোপ), অপ্রত্যয় (দৌর্মনস্য) এবং চিত্তের অপ্রসাদ উৎপাদন করিও না।”১
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের নিন্দাবাদ করিলে তাহাদের প্রতি যদি তোমরা কুপিত বা অসন্তুষ্ট হও তবে তদ্দ্বারা তোমাদেরই (ধ্যানাদির) অন্তরায় হইবে।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের অপবাদ করিলে যদি তোমরা কুপিত বা অসন্তুষ্ট হও, তবে পরের উক্তি সুভাষিত বা দুর্ভাষিত তাহা বুঝিতে পারিবে কি?”
“না, ভন্তে, (বুঝিতে পারিব না)।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের অথবা সংঘের অপবাদ করিলে তত্র অসত্যের অসত্যতা তোমরা এই বলিয়া প্রতিপনড়ব করিব্তেএই কারণে ইহা অসত্য, এই কারণেও ইহা মিথ্যা, আমাদিগের মধ্যে ইহার অস্তিত্ব নাই, আমাদিগের মধ্যে ইহা অবিদ্যমান।”২
১. নিন্দা এবং প্রশংসা লক্ষ্য করিয়াই ভগবান দেশনা আরম্ভ করিয়াছেন। সেই পঞ্চ শত ভিক্ষু মহানুভাব সম্পনড়ব বলিয়া নিন্দা শ্রবণে তাঁহাদের চিত্তে আঘাতাদি উৎপনড়ব হয় নাই। ভবিষ্যতেও এতদাবস্থায় কুলপুত্রদের অকুশলোৎপত্তি নিবারণ কল্পে বুদ্ধ ধর্ম-নীতি স্থাপন করিলেন। (সু. বি.)
২. যদি কেহ বলে যে, তোমাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ নহেন, ধর্মও সুব্যাখ্যাত নয়, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব নহেন তখন নীরব থাকা অনুচিত। ক্রুদ্ধ না হইয়া ইহার অসত্যতা প্রমাণিত করা আবশ্যক্ত‘আমাদের শাস্তা এই সমুদয় কারণে সর্বজ্ঞ, ধর্মও এই সমুদয় কারণে সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।’ তুমি বা তোমার আচার্য দুঃশীল, তোমাদিগ কর্তৃক অমুক দুষ্কার্য কৃত হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা দোষারোপ করিলে নীরবতায় আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তদ্ধেতু ক্রুদ্ধ না হইয়া অপবাদ নিরাকৃত করা কর্তব্য। ‘তুমি গরু, গাধা’ ঈদৃশ উক্তিতে কেহ আক্রোশ করিলে তাহার প্রতি উপেক্ষাভাব আনয়নে ক্ষান্তি প্রদর্শন করা উচিত। (সু. বি.)
২. যদি কেহ বলে যে, তোমাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ নহেন, ধর্মও সুব্যাখ্যাত নয়, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব নহেন তখন নীরব থাকা অনুচিত। ক্রুদ্ধ না হইয়া ইহার অসত্যতা প্রমাণিত করা আবশ্যক্ত‘আমাদের শাস্তা এই সমুদয় কারণে সর্বজ্ঞ, ধর্মও এই সমুদয় কারণে সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।’ তুমি বা তোমার আচার্য দুঃশীল, তোমাদিগ কর্তৃক অমুক দুষ্কার্য কৃত হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা দোষারোপ করিলে নীরবতায় আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তদ্ধেতু ক্রুদ্ধ না হইয়া অপবাদ নিরাকৃত করা কর্তব্য। ‘তুমি গরু, গাধা’ ঈদৃশ উক্তিতে কেহ আক্রোশ করিলে তাহার প্রতি উপেক্ষাভাব আনয়নে ক্ষান্তি প্রদর্শন করা উচিত। (সু. বি.)
———————
৬। “ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে সেজন্য তোমরা আনন্দ, সৌমনস্য, চিত্তের উৎফুল্লতা (ঔদ্ধত্যবহপ্রীতি) উৎপাদন করিও না।”১
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে ইহাতে যদি তোমরা আনন্দিত, সুমন, উৎফুল্ল (প্রীতিবন্যায় প্রবাহিত) হও তদ্দ্বারা তোমাদেরই (চিত্তচঞ্চল্যহেতু ধ্যানাদির) অন্তরায় হইবে।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে তত্র সত্যের সত্যতা এই বলিয়া স্বীকার করিব্তেএই কারণে এইরূপ হইয়াছে এবং এই কারণেও ইহা সত্য, আমাদিগের মধ্যে ইহার অস্তিত্ব আছে, আমাদিগের মধ্যে ইহা বিদ্যমান।”২
১. এইরূপ কেন উক্ত হইল? অন্যত্র উক্ত হইয়াছ্তে“বুদ্ধোতি কিত্তযন্তস্স কাযে ভবতি যা পীতি, বরমেবাহি সা পীতি কসিনেনাপি জম্বুদীপস্স” অর্থাৎ বুদ্ধ এইশব্দ কীর্তনকারী সাধু সজ্জনের শরীরে যে প্রীতি সঞ্জাত হয় উহা জম্বুদীপ প্রমাণ কৃৎসড়ব পরিকর্মাদিতে উৎপনড়ব প্রীতি অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। ‘যাহারা বুদ্ধের প্রতি প্রসনড়ব তাহারা অগ্রে প্রসনড়ব’ ইত্যাদি রূপে যে প্রীতি সৌমনস্যকে প্রশংসা করা হইয়াছে, তাহা নৈষঙঊম্যযুক্ত। এস্থলে আমারই বুদ্ধ, আমারই ধর্ম, আমারই সঙ্ঘ এইরূপ মমত্ব উৎপাদন করিয়া আয়ুষ্মান ছনড়বভিক্ষুর ন্যায় উৎপনড়ব গৃহাশ্রিত প্রীতি সৌমনস্যকে লক্ষ্য করা হইয়াছে। এইরূপ প্রীতি সৌমনস্য ধ্যানাদি লাভের অন্তরায়কর। (সু. বি.)
২. যদি কেহ বলে য্তে“আপনাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ, অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ; ধর্মও সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।” তখনও নীরব থাকা অকর্তব্য। উহার সত্যতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
২. যদি কেহ বলে য্তে“আপনাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ, অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ; ধর্মও সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।” তখনও নীরব থাকা অকর্তব্য। উহার সত্যতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রশীল
৭। “হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন(১) (সাধারণ ব্যক্তি) অনন্ত গুণশালী তথ্যগতের প্রশংসা করিলেও অল্পমাত্র, যৎসামান্য শীলাচার(২) গুণেরই প্ৰশংসা করবে। ভিক্ষুগণ, পৃথগজন তথাগতের যে অল্পমাত্র, যৎসামান্য শীলগুণের প্ৰশংসা করে তাহা কিরূপ?”
৮। “প্ৰাণীহত্যা পরিহার করিয়া শ্রমণ(৩) গৌতম(৪) প্ৰাণীহত্যা হইতে সম্পূর্ণ বিরত। সমস্ত প্রাণীজগতের প্রতি তিনি দণ্ডহীন ও শস্ত্ৰহীন, লজ্জাশীল, দয়াদ্রচিত্ত এবং অনুকম্পা পরায়ণ হইয়া অবস্থান করেন। হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াই, তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
“অদত্ত গ্ৰহণ পরিহার করিয়া শ্রমণ গৌতম অদত্ত গ্রহণ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। তিনি প্রদত্ত গ্রাহক, দত্ত প্ৰত্যাশী, অচৌর্য, শুচি, শুভ্ৰচিত্তে অবস্থান করেন। পৃথগজন তথাগতের প্রশংসা করিলে হে ভিক্ষুগণ, এই বলিয়াও প্ৰশংসা করিবে।”
“আব্ৰহ্মচর্য(৫) পরিহারপূর্বক ব্ৰহ্মচারী শ্রমণ গৌতম গ্ৰাম্য (হীন) মৈথুনধর্ম হইতে সম্পূর্ণ বিরত, অসংশ্লিষ্ট। হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
৯। “মিথ্যাবাক্য পরিহারপূর্বক মিথ্যা ভাষণ হইতে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম। তিনি সত্যবাদী, সত্যসন্ধী, স্থিরপ্রতিজ্ঞ, বিশ্বস্ত ও জগতে অবিসংবাদী। ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথাগতের প্ৰশংসা করিবে।”
১. আর্যশ্ৰাবক ব্যতীত অন্যজন। পৃথগজন দ্বিবিধ—অন্ধ ও কল্যাণ পৃথগজন। স্কন্ধ, ধাতু, অন্ধ পৃথগজন ও যাঁহাদের আছে তাহারা কল্যাণ পৃথগজন। (সু, বি.)
২. শীল যোগীর অগ্র বিভূষণ। কিন্তু প্রভাবাদি গুণ বিষয়ে শীল সমাধির ষোড়শাংশের সমানও নহে। তথা সমাধি ও প্রজ্ঞার তুলনায় সামান্যই বটে। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
৩. যাহারা পাপ শমিত হইয়াছে তিনি শ্রমণ। এ স্থলে ভগবান। (সু, বি.)
৪. গৌতমগোত্রে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া তিনি শ্রেষ্টার্থে গৌতম। (সু. বি.)
৫. হীনচর্য, ব্ৰহ্মশ্রেষ্ঠ আচার আচরণ করেন এই অর্থে ব্ৰহ্মচারী মৈথুন বিরতিই শ্রেষ্ট আচরণ। স্ত্রী-পুরুষ কামাসক্ত হইয়া যেই আচরণ করে তাঁহাই মৈথুন। মৈথুন হইতে বিরতিই ব্ৰহ্মচর্য। স্ত্রীজাতির সেবা শুশ্ৰষা প্রভৃতি সপ্তবিধ মৈথুন সংযোগ হইতে বিরতিই শুদ্ধ ব্ৰহ্মচর্য। (সু. বি.)
————-
“পিশুন বাক্য পরিহারপূর্বক শ্রমণ গৌতম, পিশুন বাচন হইতে সম্পূর্ণ বিরত। তিনি এখানে শুনিয়া ওখানে বলেন না ইহাদের ভেদের জন্য অথবা অন্যত্ৰ শুনিয়া ইহাদেরকে বলেন না। উহাদের মধ্যে ভেদের জন্য; কলহকারীদের মধ্যে তিনি মিলনদাতা, মৈত্রীপরায়ণ ব্যক্তিগণের মধ্যে উৎসাহদাতা। তিনি সমগ্রীরাম বা মিলিত অবস্থানে আরাম দায়ক সমগ্ররত, সমগ্রনন্দী ও সম্মিলনী বাক্যই সদা বলেন। ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও পৃথগজন তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
করেন। হে ভিক্ষুগণ, এই বলিয়াও পৃথগজন তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
“সম্প্রলাপ পরিহারপূর্বক শ্রমণ গৌতম সম্প্রলাপ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। তিনি কালবাদী, ভূতাবাদী, অর্থবাদী, ধর্মবাদী ও বিনয়বাদী(১)। যথাসময় উপমা পরিচ্ছেদ ও অর্থসহ সারগর্ভ বাক্যই বলিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্ৰশংসা করিলে এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১০। “শ্রমণ গৌতম বীজ এবং উদ্ভিদ সমূহের ছেদন-ভেদন বিনষ্ট মূলক কার্যাদি হইতে সম্পূর্ণ বিরত। ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
“একবেলা মাত্ৰ আহার করেন শ্রমণ গৌতম, বিকাল ভোজন হইতে সম্পূর্ণ বিরত। রাত্রিতে উপবাস পালন করেন।”
“শ্রমণ গৌতম নৃত্য-গীত-বাদ্য-বিসুক (প্ৰব্ৰজিতদের বিরুদ্ধ উৎসব, যাহা দর্শনে মন বিদ্ধ ও ক্ষুন্ন হয়) দর্শনাদি হইতে সম্পূর্ণ বিরত।”
“শ্রমণ গৌতম পুস্পমাল্য সুগন্ধি দ্রব্য, বিলোপনাদি ব্যবহার মণ্ডণ ও বিভূষণ হইতে সম্পূর্ণ বিরত।”
“শ্রমণ গৌতম উচ্চশয্যা মহাশয্যা শয়নোপবেশন হইতে সম্পূর্ণ বিরত।”
“শ্রমণ গৌতম স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রাদি গ্রহণ হইতে সম্পূর্ণ বিরত।”
“শ্রমণ গৌতম অপকৃ বা অপাচিত ধান্য ও যাবতীয় শস্য গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত।”
১. সংবর বিনয় (পাতিমোকখ—সতি-এপ্লাণ-খন্তি-বিরিয়া সংবর) ও পহাণ (তদঙ্গবিক্খভন-সমুচ্ছেদ-পটিল্পস্সদ্ধি-নিস্সরণ) বিনয় সংযুক্ত বাক্য বলেন বলিয়া বিনয়বাদী।
—————
“শ্রমণ গৌতম অপকৃ মৎস্য-মাংস গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত।”
“শ্রমণ গৌতম স্ত্রী-কুমারী গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত।”
“দাস-দাসী গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“অজ-মেষাদি গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“কুকুট-শূকরাদি গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“হস্তী, অশ্ব, গরু ও সিন্ধুঘোটকাদি গ্রহণে বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“ক্ষেত্র এবং বাস্তুভিটাদি গ্রহণে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“সংবাদপত্ৰাদি আনা-নেওয়া ইত্যাদি নানাপ্রকার দূতের(১) কাজ হইতে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“ক্রয় বিক্রয় হইতে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“তুলাকুট কাংস্যকুট(২) কার্যে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“ঘুষগ্রহণ, প্রবঞ্চনা, মায়া এবং কুটিলতা হইতে সম্পূর্ণ বিরত শ্ৰমণ গৌতম।”
“ছেদন, বধ (প্রহার), বন্ধন, গ্ৰামলুণ্ঠনাদি দুঃসাহসিক কাজ হইতে সম্পূর্ণ বিরত শ্রমণ গৌতম।”
“হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন তথাগতের প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও প্ৰশংসা করিবে।”
[ক্ষুদ্রশীল সমাপ্ত]
১. পহীন গমন—মুদ্র গমন (প্ৰেষ্য)। অনুযোগ্য—দৌত্য এবং প্ৰেষ্য উভয় কাৰ্য হইতে।
২. তুলাকুট—ওজন করিবার সময় বঞ্চনা। তাহা রূপকূট, অঙ্গকূট, গ্রহণকূট ও প্রতিচ্ছন্নকূট বশে চারি প্রকারে ঘটাইতে পারা যায়। কাংস্যকুট—আসল পাত্র সম্মুখে পরীক্ষা করাইয়া তদনুরূপ নকল পাত্ৰ দিয়া বঞ্চনা। মানকুট—তাহা ত্ৰিবিধ, যথা : হৃদয় ভেদ, রজ্জ্ব ভেদ ও শিখা ভেদ।
মধ্যম শীল
১১। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদত্ত(১) ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন মূলবীজ, স্কন্ধ-বীজ, পর্ব-বীজ, অগ্র-বীজ, বীজ-বীজভেদে পঞ্চ-বীজ(২) অথবা এতাদৃশ অন্য বীজ ও তদুর্ভূত উদ্ভিদসমূহ ছেদন-ভেদন-দগ্ধী করণাদি বিনষ্টমূলক কার্যে নিয়োজিত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্রমণ গৌতম ঈদৃশ বীজ ও উদ্ভিদসমূহ ছেদন-ভেদন দন্ধী করণাদি বিনষ্টমূলক কার্য হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্ৰশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১. শ্রদ্ধা—বিশ্বাস। কর্ম, কর্মফল, ইহলোক, পরলোক বিশ্বাস করিয়া যে দান দেওয়া হয়। তাহা শ্ৰদ্ধাদত্ত। ভোজনাদি—আহার্যসমূহ। এতদ্বারা বস্ত্ৰ, শয্যাসন ও রোগোপশমের ভৈষজ্যসম্ভার ইত্যাদিকেও বুঝিতে হইবে।
২. পঞ্চবিধ বীজ অপরিপক্কাবস্থায় বৃক্ষে সংলগ্ন থাকিলে উদ্ভিদরাপে গণ্য, তাহা নষ্ট করিলে ভিক্ষুদের “পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। পরিপক্কাবস্থায় বিচু্যতাবস্থায় বীজরাপে গণ্য, তাহা নষ্ট করিলে “দুঙ্কট’ অপরাধ হয়।
—————
১২। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদে ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, শয্যা, গন্ধদ্রব্য ও আমিষ (ডাল চাউলাদি) সন্নিধি, ইত্যাদি বা এইরূপ অন্য বিবিধ দ্রব্য সন্নিধি করিয়া পরিভোগে রত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন সন্নিধি করিয়া পরিভোগ হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্ৰশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৩। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি উপভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন নৃত্য, গীত বাদ্য, নটসমজ্যা (নাট্যাভিনয়) আখ্যান করতাল, বেতাল, (ঘনতল বা মন্ত্রদ্বারা শবে জীবন দান), কুম্ভতাল, নরনারীর কমনীয় চিত্র, লৌহগোলক ক্রীড়া, বংশ (বাঁশের) ক্রীড়া, ধোবন (মৃতব্যক্তির অস্থি ধৌত করিয়া সুরা পানক্রীড়া), হস্তী-যুদ্ধ, অশ্ব-যুদ্ধ, মহিষ, যুদ্ধ, মল্ল-যুদ্ধ, সংগ্রাম, সৈন্য-গণনা, সৈন্য-ব্যূহ, অলীক দর্শনাদি অথবা এইরূপ অন্য বিসূক দর্শনরত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন বিসূক দর্শনে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৪। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া ঈদৃশ প্রমাদকর জুতা (জুয়া) ক্ৰীড়ারত হইয়া বাস করেন, যথা : আট পদ, দশ পদ (কড়িদ্বারা পাশা ক্রীড়া), আকাশ (আকাশে উক্ত রূপ ক্রীড়া), পরিহার পথ (ভূমিতে নানা মহল করিয়া তথায় ঘুরিয়া ফিরিয়া ক্রীড়া, পরখেলা), সন্তকিং (একত্রে-স্থিত গুলি বা প্রস্তর খণ্ড হইতে অন্যগুলি না নড়ে মত এক একটি গ্রহণ, নড়িলে পরাজয়), খলিক (হাড়দণ্ডের দ্বারা পাশা খেলা), ঘটিক (দণ্ড গোলা বা ভার খেলা), শলাকহস্ত (লাক্ষা বা পিঠলিজলে হাত ভিজাইয়া দেওয়ালে অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি রূপ নির্মাণ ক্রীড়া), অক্ষা (গুলি খেলা), পঙ্গচীর (পাতার সানাই বাজাইয়া ক্রীড়া), বঙ্কক (গ্ৰাম্য ছেলেদের ন্যায় নাঙ্গলে কর্ষণ ক্রীড়া), মোক্ষটাক (দণ্ডের উপর আকাশে ঘুরা ফেরা বা পা উপরদিকে মাথা নীচের দিকে করিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া ক্রীড়া), চিঙ্গুলিক (নানা প্রকার ফরফরী ঘুরােন), পত্রাড়ক (পাতার সেৱী আড়ি তৈয়ার করিয়া ধূলা বালি মাপা ক্রীড়া), রথক (ক্ষুদ্র রথাদির দ্বারা ক্রীড়া), ধনুক (ক্ষুদ্র ধনুরদ্বারা ক্রীড়া), আক্ষরিক (আকাশে বা পৃষ্ঠে লিখিত অক্ষর বোধ ক্রীড়া), মানসিক (মনের চিন্তিত বিষয় প্রকাশ ক্রীড়া), যথাবিদ্য (আঁধা, কানা, কুজাদির ছল ধরিয়া কৌতুক প্রদর্শন করা) ইত্যাদি বা এই রূপ অন্যবিধ ক্রীড়া। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন প্ৰমাদ জনক জুতা (জুয়া) ক্রীড়া হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৫। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদাত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা ব্যবহার করিয়া বাস করেন, যথা : আসন্দী (প্রমাণাতিক্রান্ত সুখাসন) পৰ্যাঙ্ক, দীর্ঘলোম গালিচা, বিচিত্র ঊর্ণাময় আস্তরণ, ঊর্ণময় শ্বেত-আস্তরণ, ঘনপুষ্পযুক্ত ঊর্ণাময় আসন, তুলাপূর্ণ আসন, সিংহ ব্যাঘাদির রূপ চিত্রিত উর্ণাময় আসন, উভয় দিকে ঝালারযুক্ত উর্ণাময় আসন, একদিকে ঝালারযুক্ত উর্ণাময় আসন, রত্নখচিত রেশমী আসন, রত্নখচিত রেশমী সূতায় সেলাই করা আসন, অতি বৃহৎ ঊর্ণাময় আস্তরণ, অজিন মৃগচর্ম দ্বারা মঞ্চ বা ঘাটের সমান করিয়া সেলাই করা আস্তরণ, অজিন মৃগচর্ম দ্বারা মঞ্চ বা খাটের সমান করিয়া সেলাই করা আস্তরণ, মস্তক ও পায়েরদিকে রক্তবর্ণ উপাধান ইত্যাদি, অথবা এইরূপ অন্যবিধ উচ্চশয্যা মহাশয্যা। কিন্তু শ্রমণ গৌতম তেমন উচ্চশয্যা মহাশয্যা ব্যবহারে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৬। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ মণ্ডণ বিভূষণকর দ্রব্যাদি ব্যবহার করিয়া থাকেন, যথা : উচ্ছাদন, পরিমর্দন, (শরীর সুগঠনের জন্য তৈলাদির দ্বারা শরীর মর্দন), সুস্থান (সুগন্ধি তৈল ও সাবানে সুস্থান), সম্বাহন (মল্লবৎ), আদর্শ অঞ্জন, মালা, (চন্দনাদি) বিলেপন, মুখচুর্ণ, মুখালেপি, হস্তাভরণ, শিখাবর্ধন, ছড়িধারণ, স্ত্রী-পুরুষের ছবি অঙ্কিত বোতল (নালি), অসি, বিচিত্রছাত্র, বিচিত্র জুতা, খড়ম, পাগড়ী, মণি, চামর, শ্বেতবস্ত্র, দীর্ঘ ঝালরযুক্ত বস্ত্র, ইত্যাদি অথবা এই প্রকার স্বতন্ত্র মণ্ডণ বিভূষণ বিষয়ক দ্রব্যসম্ভার। কিন্তু শ্রমণ গৌতম ঈদৃশ মণ্ডণ বিভূষণকর দ্রব্যানুরক্তি হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৭। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অনড়ববস্ত্রাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ স্বর্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চান কথায় নিরত হইয়া বাস করেন, যথা : রাজ-কথা, চোর-কথা, মহামাত্য-কথা, সেনা-কথা, ভয়-কথা, যুদ্ধ-কথা, অনড়ব-কথা, পানীয়-কথা, বস্ত্র-কথা, শয্যা-কথা, মালা- কথা, গন্ধদ্রব্য-কথা, জ্ঞাতি-কথা, যান-কথা, গ্রাম-কথা, নিগম-কথা, নগর-কথা, জনপদ-কথা, স্ত্রী-পুরুষ-কথা, শূর-কথা, রথপত্তি (বিশিখা)-কথা, জল ঘাট বা জল আহরণকারিণী-কথা, পূর্বপ্ৰেত-কথা, নানাবিধ নিরর্থক-কথা, লোকাখ্যায়িকা, সমুদ্রখ্যায়িকা, বৃদ্ধি-হানি-কথা ইত্যাদি বা ঈদৃশ অন্যপ্রকার তিরশ্চন কথা। কিন্তু শ্রমণ গৌতম। এইরূপ তিরশ্চন কথা হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যগতের প্ৰশংসা করিবে।”
১৮। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ বিগ্রাহিক (বিবাদকর।) কথায় লিপ্ত হইয়া বাস করেন, যথা : তুমি এই ধর্ম-বিনয় জান না, আমি এই ধর্মবিনয় জানি, তুমি এই ধর্মবিনয় কি জানিবে? তুমি মিথ্যাপথাবলম্বী, আমি সম্যক পথাবলম্বী, আমার বাক্য শ্লিষ্ট, তোমার বাক্য অশ্লিষ্ট, পূর্বের বক্তব্য পরে বলিয়াছ, পরের বক্তব্য পূর্বে বলিয়াছ, তোমার বহুদিনের সুঅভ্যস্ত বিষয় আমি এককথায় উল্টাইয়া দিলাম, তুমি কিছু জান না, আমি তোমার প্রতিবাদারোপন করিলাম। তুমি নিগৃহীত, দোষ মোচনার্থ বিচরণ কর, যদি পার দোষ খণ্ডন কর, ইত্যাদি অথবা এইরূপ অন্যপ্রকার বিগ্রাহিক কথা। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম। এইরূপ বিগ্রাহিক কথায় সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৯। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অনড়ববস্ত্রাদি পরিভোগ করিয়া রাজাদের, রাজ মহামাত্যদের, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, কুমারদের—‘এখানে আস, ওখানে যাও, ইহা নিয়া যাও, অমুক স্থান হইতে অমুক দ্রব্য নিয়া আস’ ইত্যাদি বা এইরূপ অন্যবিধ ছোট বড় দৌত্যকার্যে নিযুক্ত হইয়া বাস করেন। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম এতাদৃশ ছােট বড় দৌত্যকাৰ্য হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবো।”
২০। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত অনড়বাদি উপভোগ করিয়া কুহকী(১) লপক (লপকী)(২) নৈমিত্তিক(৩) নিষ্পেষিক(৪) এবং লাভে লাভ অন্বেষণকারী ইত্যাদি হইয়া থাকেন; কিন্তু শ্রমণ গৌতম এইরূপ কুহনালপন হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃগজন এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
[মধ্যম শীল সমাপ্ত]
১। কুহকা—কুহকিন। অর্থলোভে ও সম্মান প্রাপ্তির জন্য অধার্মিক হইয়াও ধার্মিকতা প্রদর্শন। স্বয়ং শীলবান ধ্যানপরায়ণ, মার্গফল লাভী না হইয়াও শীলবান, ধ্যানপরায়ণ ও মার্গফল লাভীর ভাণ করিয়া লোককে প্রতারণাকরী।
২। লপক—লাভ সৎকারার্থে ভাষণশীল। নিজকে বা দায়ককে উচ্চভাবে প্রশংসা করা যেন কিছু দান করে।
৩। নিমিত্ত দ্বারা বলে বা ঈঙ্গিত-ঈশারায় জানায় বলিয়া নৈমিত্তিক। শ্রদ্ধাদির বিষয় জানাইয়া দেওয়াও বটে।
৪। নিষ্পেষিক—কিছু আদায় করিতে নিপীড়নকারী।
মহাশীল
২১। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত অন্নাদি উপভোগ করিয়া এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা। জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : অঙ্গশাস্ত্র (অঙ্গ দেখিয়া শুভাশুভ নিরূপন), নিমিত্তশাস্ত্ৰ (নিমিত্ত অবলম্বনে প্রশ্নের উত্তরদান বা গণনা), উৎপাত (বজাদি পতনে ফলাফল নির্দেশ), স্বপ্নতত্ত্ব, লক্ষণতত্ত্ব। (লক্ষণ দৃষ্টি সৌভাগ্যাদি নিরূপণ), মুষিকছিন্ন (মুষিক দ্বারা বস্ত্ৰাদি ছেদনে দোষাদোষ নিরূপণ), অগ্নি হোম, দর্বি হোম, তুষ হোম, কৰ্ণ হোম, তণ্ডুল হোম, সর্পি হোম, তৈল হোম, মুখ হোম (সরিষাদি মুখে লইয়া মন্ত্র আবৃত্তি করিয়া উহা অগ্নিতে নিক্ষেপ), লোহিত হোম (ইহাদ্বারা এইরূপে হোম করিলে এইরূপ ফল লাভ হয় বলিয়া প্রচার করিয়া হোম করা), অঙ্গবিদ্যা (অঙ্গুলি পর্বদি বা অস্থি দেখিয়া শুভাশুভ নিরূপণ), বাস্তুবিদ্যা (গৃহ বা আরাম ভিটার দোষাদোষ গণনা, মৃত্তিকা দেখিয়া ইহার অভ্যন্তরে কত হস্তের মধ্যে কি আছে, ইহার উপরিভাগে [আকাশে] কি আছে তাহা জ্ঞাত হওয়া, যাহা আছে তাহার গুণাগুণ বিচার বিষয়ক বিদ্যা), ক্ষেত্রবিদ্যা, শিববিদ্যা (শ্মশানে বসিয়া শান্তিকরণ বিদ্যা, শৃগাল রবের শুভাশুভ জােনন বিদ্যাও বটে), ভূতবিদ্যা (ভূতবৈদ্যের মন্ত্র), ভূরিবিদ্যা (মাটীর নিচে প্রস্তুত গৃহে শিখিবার মন্ত্র), অহিবিদ্যা (সৰ্পমন্ত্রাদি), বিষবিদ্যা (বিষমন্ত্রাদি), বৃশ্চিকবিদ্যা, মুষিকবিদ্যা (ইন্দুর দংশনের চিকিৎসা), শকুনবিদ্যা (পক্ষীশব্দের অর্থ নির্ণয়), কাকবিদ্যা, পকৃধ্যান (পরমায়ু গণনা), শর পরিত্রাণ (নিজ শরীরে বা পর শরীরে শর পতন নিবারণ), মৃগচক্র বিদ্যা (সমস্ত পশু-পক্ষীর শব্দ জ্ঞান) ইত্যাদি বা এতাদৃশ অন্যান্য। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এবম্বিধ তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২২। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্ৰমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত অন্নাদি উপভোগ করিয়া এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা। জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : মণি-লক্ষণ (এই লক্ষণের মণি প্রশস্ত, অধিকারীর আরোগ্য ঐশ্বৰ্য্যাদির হেতু হয়) তথা বস্ত্ৰ-লক্ষণ, দণ্ডলক্ষণ, শস্ত্ৰ-লক্ষণ, অসি-লক্ষণ, শর-লক্ষণ, ধনু-লক্ষণ, আয়ুধ (অপরাপর অস্ত্ৰ) লক্ষণ; স্ত্রী-পুরুষ, কুমার-কুমারী, দাস-দাসী লক্ষণ, হস্তী, অশ্ব, বৃষ, মহিষ, গো-লক্ষণ; অজ, মেণ্ডক, কুকুট, বর্তক, গোধা লক্ষণ; কর্ণিকা-লক্ষণ (এইরূপ কৰ্ণাভরণ এইরূপ স্ত্রীর ধারণ করা কর্তব্য অন্যথা অমঙ্গলাদি বর্ণনা, গৃহকুট সম্বন্ধেও ঈদৃশ বৰ্ণনা), কচ্ছপ-লক্ষণ, মৃগ-লক্ষণ (সমস্ত চতুষ্পদ জন্তুর লক্ষণ বিদ্যা) ইত্যাদি অথবা এতাদৃশ অন্য লক্ষণ বিদ্যা। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা। জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২৩। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত অনড়বাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ তিরশ্চান বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : রাজাদের নির্গমন হইবে, রাজাদের অনির্গমন হইবে, অভ্যন্তরস্থ (আমাদের) রাজাগণ আক্রমণ করিবেন (অমুক দিন শত্রু রাজার নিকট উপস্থিত হইবেন), বাহিরের রাজাগণ পলায়ন করিবেন, (অমুক সময়ে) বাহিরের রাজাদের আক্রমণ হইবে, অভ্যন্তর রাজাদের পলায়ন এইরূপে এ পক্ষের জয় হইবে, অপর পক্ষের পরাজয় হইবে ইত্যাদি বা এইরূপ অন্যবিধ। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এবম্বিধ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২৪। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ শ্ৰদ্ধাদত্ত অন্নাদি পরিভোগ করিয়া এই প্রকার তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : (অমুক সময়ে) চন্দ্রগ্রহণ হইবে, সূর্যগ্রহণ হইবে, নক্ষত্ৰগ্ৰহণ হইবে, চন্দ্র-সূর্যের যথানির্দিষ্ট পথে গমন হইবে, অপথে গমন হইবে, নক্ষত্রদিগের যথানির্দিষ্ট পথে গমন হইবে, উহাদের অপথে গমন হইবে, (অমুক সময়ে) উল্কাপাত হইবে, দিগদাহ হইবে, ভূমিকম্প হইবে, দেবদুন্দুভি (শুষ্ক মেঘগর্জন) হইবে। চন্দ্ৰ-সূৰ্য ও নক্ষত্ৰগণের উদয়-অস্ত মলিনতা অথবা বিশুদ্ধি হইবে। এইরূপ ফলদায়ক চন্দ্ৰ-সূৰ্য গ্রহণ হইবে, এইরূপ ফলদায়ক নক্ষত্ৰযোগ হইবে। চন্দ্ৰ-সূৰ্য ও নক্ষত্ৰগণের পথ গমনে বা অপথ গমনে এইরূপ শুভাশুভ হইবে। এই উল্কাপাতে এইফল হইবে, এই দিগদাহে এইফল হইবে, এই প্রকার ফলদায়ক ভূমিকম্প হইবে, এইরূপ ফলদায়ক দেবদুন্দুভি হইবে। চন্দ্ৰ-সূৰ্য ও নক্ষত্ৰগণের উদয়ে, অস্তগমনে, মলিনতায়, বিশদ্ধতায় এই ফল হইবে ইত্যাদি বা এইরূপ অন্যবিধ। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এবম্বিধ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২৫। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ শ্ৰদ্ধাদত্ত অন্নাদি উপভোগ করিয়া এই প্রকার তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : (এবার) সুবৃষ্টি হইবে, অনাবৃষ্টি হইবে, সুভিক্ষ হইবে, দুর্ভিক্ষ হইবে, শান্তি হইবে, ভয় হইবে, রোগ হইবে, আরোগ্য হইবে,হস্তমুদ্রা গণনা, সংখ্যান, কবিতারচনা, লোকায়ত ইত্যাদি বা এই রূপ অন্যবিধ। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২৬। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ শ্রদ্ধাদত্ত অন্নাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ তিরশ্চান বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : আবহন (এই কুমারের জন্য অমুক কুল হইতে অমুক নক্ষত্রে কুমারী আনয়ন কর বলিয়া আবাহন করােন), বিবাহন (এই কুমারীকে অমুক কুলের অমুক কুমারকে অমুক নক্ষত্রে সম্প্রদান কর, ইহাতে উভয়ের মঙ্গল হইবে বলিয়া বিবাহ কাৰ্য নিম্পাদন করােন), সংবরণ (অমুক সময় অমুক নক্ষত্রে তোমরা মিলিত হও, তাহা হইলে তোমাদের বিচ্ছেদ ঘটিবে না। বলিয়া মিলিত করােন), বিবরণ (পৃথক হইতে চাহিলে অমুক সময়ে পৃথক হইবে, তাহা হইলে আর মিলন হইবে না, এইরূপে বিয়োগ করান বা বিচ্ছেদের সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া), সংকিরণ (ঋণ উসলের সময় নির্ধারণ করিয়া ঋণের টাকা সংগ্ৰহ করােন), বিকিরণ (ঋণ দানের সময় ঠিক করিয়া দিয়া ঋণ দান দেওয়ান), সুভগকরণ, দুর্ভগকরণ, বিরুদ্ধ গর্ভকরণ (গর্ভপাত না হওয়ার জন্য ওষধ প্রয়োগ করা), জিহবা নিবন্ধন (জিহ্বা আচল করা), হনুসংহনন (হনু আচল করা), হস্তাভিজপ্লন (হস্ত কম্পনের জন্য মন্ত্র জপ করা), হনুজল্পনা (হনু চালন), কর্ণজল্পনা (বধিরতা সাধন), আদর্শ প্রশ্ন (আয়নায় দেবতা অবতরণ করাইয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা), কুমারিক প্রশ্ন (কুমারী শরীরে দেবতাশ্রয় করাইয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা), দেব। প্রশ্ন (দেবদাসী শরীরে দেবতাশ্রয় করাইয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা), জীবিকাৰ্থ আদিত্য পরিচর্যা, মহাব্ৰহ্মা পরিচর্যা, মুখ হইতে মন্ত্র বলে অগ্নি প্ৰজ্বালন, শ্ৰী (লক্ষ্মী) আনয়ন ইত্যাদি বা এইরূপ অন্যবিধা। শ্রমণ গৌতম কিন্তু এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
২৭। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ শ্রদ্ধাদত্ত অন্নাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায়। দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যথা : শান্তি-স্বস্ত্যয়ন কর্ম, প্রণিধি (মানত) কৰ্ম্ম ভূত কর্ম, ভুরি কর্ম (মৃত্তিকা অভ্যন্তরে নির্মিত গৃহে বসিয়া গৃহীত মন্ত্র প্রয়োগ করা), নপুংসককে পুরুষ করা, পুরুষকে নপুংসক করা, বাস্তুকর্ম (অকৃতভিটায় গৃহ প্রতিষ্ঠা), বাস্তু পরিকর্ম (ভিটায় পূজা করান), আচমন (জল দ্বারা মুখ শুদ্ধি করান), স্নান করান, অগ্নিহোম (যজ্ঞ) করান, বমন, বিরেচন, উর্ধর্ব বিরেচন, অধোবিরেচন, শির বিরেচন, কৰ্ণ তৈল পাক, নেত্র তর্পণ, নস্যকর্ম, ক্ষার অঞ্জন, শীতল অঞ্জন করুন, শালাক্য, শল্য-চিকিৎসা, শিশু চিকিৎসা, মূল ভৈষজ্য সমূহের প্রয়োগ (শরীর চিকিৎসা), ওষধের প্রতিমোক্ষণ (ওষধ বাহির করিয়া লওয়া) ইত্যাদি অথবা এইরূপ অন্যবিধ। শ্রমণ গৌতম। কিন্তু এইরূপ স্বৰ্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চন বিদ্যাবলম্বনে মিথ্যা জীবনোপায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
[মহাশীল সমাপ্ত]
পূর্বন্তকল্পিক
২৮। “ভিক্ষুগণ, (ইহা ছাড়া তথ্যগতের) অন্য গভীর, দুৰ্দর্শ, দুরানুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, অতৰ্ক-বিহার, নিপুণ, পণ্ডিত বেদনীয় ধর্ম (গুণ)সমূহ আছে, যে সমুদয় তথাগত স্বয়ং অভিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ করিয়া প্রকাশ করেন, যদ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
“ভিক্ষুগণ, সেই গভীর দুৰ্দর্শ, দুরানুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, অতৰ্ক-বিহার, নিপুণ, পণ্ডিত বেদনীয় ধর্ম (গুণ)সমূহ কি প্রকার, যে সমুদয় তথাগত স্বয়ং অভিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ করিয়া প্ৰকাশ করেন, যে সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে?”
২৯। “ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন পূর্বান্ত কল্পনাকারী(১) পূর্বান্তানুদৃষ্টিসম্পনড়ব(২), যাঁহারা অষ্টাদশ কারণ প্রয়োগে পূর্বান্তকে লক্ষ্য করিয়া বিবিধ দৃষ্টিদীপক বাক্য অভিব্যক্ত করেন।”
“সেই ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কি বা লক্ষ্য করিয়া পূর্বান্ত কল্পনা করেন, পূর্বান্তানুদৃষ্টিসম্পনড়ব হন, যাঁহারা অষ্টাদশ কারণ প্রয়োগে বিবিধ দৃষ্টিদীপক বাক্য অভিব্যক্ত করেন?”
———–
১। পূর্বান্ত কল্পনাকারীগণ। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধকে বা ইহাদের যেকোনোটিকে তৃষ্ণাজনিত দৃষ্টিতে আত্মা বা লোক বলিয়া ধারণা করিয়া তাহার পূর্বাংশ (অতীতাংশ) কল্পনাকারীগণ।
২। পূর্বান্তানুদৃষ্টি সম্পনড়বগণ। পঞ্চস্কন্ধ সম্বন্ধে পূর্বোক্তরূপ কল্পনানুযায়ী উৎপনড়ব মিথ্যাদৃষ্টিসম্পনড়ব ব্যক্তিগণ।
অধিমুক্তি—দৃষ্টি, মতবাদ, বিশ্বাস, আশয়ানুশয়, অভিপ্রায়।
অধিমুত্তিপদানি—দৃষ্টিদীপক বাক্যসমূহ।
শাশ্বতবাদ
৩০। “ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন শাশ্বতবাদী, যাহারা আত্মা ও লোককে চতুর্বিধ কারণ প্রয়োগে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন; সেই ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে কী লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদী হন, যাহারা আত্মা ও লোককে চতুর্বিধ কারণ প্ৰযোগে শাশ্বত বলিয়া প্রজ্ঞপ্তি করেন?”
৩১। “ভিক্ষুগণ, ইহলোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ প্রবলতম বীৰ্য (উৎসাহ) বলে একনিষ্ঠ সাধনায় অপতন চেষ্টাশীলতায় অপ্ৰমাদ পরায়ণতায় (স্মৃতিশীলতায়) সম্যক মনোনিবেশহেতু তাদৃশ চিত্তসমাধি লাভ করেন যাহার প্রভাবে বহু পূর্বনিবাস স্মরণ করেন, যথা : এক জন্ম, দুই জন্ম, তিন জন্ম, চারি জন্ম, পাঁচ জন্ম, দশ জন্ম, বিশ জন্ম, ত্ৰিশ জন্ম, চত্বারিংশৎ জন্ম, পঞ্চাশৎ জন্ম, শত জন্ম, সহস্র জন্ম, লক্ষ জন্ম, অনেক শত জন্ম, অনেক সহস্ৰ জন্ম, অনেক শত সহস্ৰ জন্মও। “আমি অমুক স্থানে ছিলাম, আমার ছিল এই নাম, এই গোত্ৰ, এই বর্ণ, এইরূপ আহার; এইরূপ সুখ-দুঃখ আমি অনুভব করিয়াছিলাম, এই পরিমাণ ছিল আমার পরমায়ু। সেখান হইতে চু্যত হইয়া আমি অমুকাস্থানে উৎপন্ন হই। সেখানেও ছিল আমার এই নাম, এই গোত্র, এই বর্ণ, এইরূপ আহার, এইরূপ সুখ-দুঃখানুভূতি, এই পরিমাণ পরমায়ু। সেখান হইতে চু্যত হইয়া আমি এইস্থানে উৎপন্ন হইয়াছি। এই প্রকারে সাকার সাউদ্দেশ বশে বিবিধ ভাবে পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন।”
“তিনি (এইরূপ ধ্যানানুভাবসম্পন্ন হইয়া মিথ্যাদৃষ্টিহেতু)(১) এইরূপ বলেন—আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য পর্বতকূট সদৃশ, ইন্দ্রকীলের ন্যায় স্থির। সত্ত্বগণ সন্ধাবন (জন্ম হইতে জন্মান্তরে গমন), সংসারণ (এক যোনি হইতে অন্য যোনিতে জন্মগ্রহণ) করিলেও চু্যত-উৎপন্ন হইলেও তাহারা শাশ্বতবৎ (মহাপৃথিবী, সুমেরু, চন্দ্র, সূর্যের ন্যায়) আছেই। ইহা বলিবার হেতু কী? আমি প্রবলতম বীর্য বলে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক মনস্কারহেতু তাদৃশ্য চিত্তসমাধি লাভ করিয়াছি। যাহার প্রভাবে বহুজন্ম অনুস্মরণ করিতেছি, যথা : এক জন্ম, দুই জন্ম, . . . অনেক শতসহস্ৰ জন্মেরও অনুস্মৃতি পাইতেছি। . . . অমুক স্থানে আমি ছিলাম, (তখন আমার ছিল) এই নাম . . . আবার আমি সেখান হইতে চু্যত হইয়া অমুক স্থানে উৎপন্ন হই। . . . অতঃপর সেই আমি তথা হইতে চু্যত হইয়া এই স্থানে উৎপন্ন হইয়াছি। এইভাবে সাকার সোদেশে (গতিবশে) বিবিধ পূর্ব জন্মানুস্মৃতি জ্ঞান পাইয়াছি।”
“এই বিশেষাধিগমহেতু আমি প্রত্যক্ষভাবে জানিতেছি (শুধু বিশ্বাস নহে) আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ ইন্দ্ৰকীলের ন্যায় স্থির। সত্ত্বগণ সন্ধাবন-সংসরণ করিলেও চু্যত-উৎপন্ন হইলেও তাহারা শাশ্বতবৎ রহিয়াছে। ভিক্ষুগণ, (চতুর্বিধ শাশ্বতবাদ কারণে) ইহা (অনেক শত সহস্ৰ জন্মনুস্মৃতি) প্রথম কারণ। যাহারা এই জন্যই শাশ্বতবাদী হইয়া আত্মা এবং লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (২)
৩২। “দ্বিতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদী হন আতা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন? ভিক্ষুগণ, ইহলোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক মনোনিবেশহেতু তাদৃশ চিত্তসমাধি লাভ করিয়া থাকেন যাহার প্রভাবে অনেক প্রকার পূর্বজন্মানুস্মৃতিসম্পন্ন হইয়া এক সংবর্ত-বিবর্তকল্প, দুই সংবর্তবিবর্তকল্প, তিন সংবর্ত -বিবর্তকল্প, চারি সংবর্ত-বিবর্তকল্প, পাচ সংবর্তবিবর্তকল্প, দশ সংবর্ত-বিবর্তকল্পও স্মরণ করিতে পারেন; ঐ স্থানে আমি ছিলাম, আমার ছিল এই নাম, এই গোত্ৰ, এই জাতি, এইবৰ্ণ, এইরূপ আহার, এইরূপ সুখ-দুঃখানুভূতি, এই পরিমাণ আয়ু। আবার তথা হইতে চু্যত হইয়া অমুক স্থানে উৎপন্ন হইয়াছিলাম। সেখানেও আমার ছিল, এই নাম, এই গোত্র, . . . এই পরিমাণ আয়ু। সেই আমি আবার সেখান হইতে চু্যত হইয়া এইখানে উৎপন্ন হইয়াছি। এইরূপে সাকার-সোদেশ বশে নানাপ্রকারে পূর্বজন্মানুস্মৃতি প্রাপ্ত হন।”
“তিনি (এইরূপ ধ্যানানুভাবসম্পন্ন হইয়া মিথ্যাদৃষ্টি” হেতু) এইরূপ বলেন—আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ, ইন্দ্ৰকীলের ন্যায় স্থির। সত্ত্বগণ সন্ধাবন-সংসরণ করিলেও চু্যত-উৎপন্ন হইলেও তাহারা শাশ্বতবৎ আছেই। ইহা বলিবার হেতু কী? আমি প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায় . . . দশ সংবর্ত-বিবর্তকল্প পর্যন্তও বহু পূৰ্বজন্ম অনুস্মরণ করিতেছি। . . .. ”
“এই বিশেষাধিগমহেতু ইহা আমি প্রত্যক্ষভাবে জানিতেছি (শুধু বিশ্বাসে নহে) আত্মা ও লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ, ইন্দ্ৰকীলের ন্যায় স্থির। সত্ত্বগণ সন্ধাবন-সংসরণ করিলেও চু্যত-উৎপন্ন হইলেও তাহারা শাশ্বতরূপে আছেই। ভিক্ষুগণ, (শাশ্বতবাদ চতুষ্টয়ে) ইহা (দশ সংবত্তবিবর্তকল্প পর্যন্ত স্মরণই) দ্বিতীয় কারণ। কোনো কোনো শ্রমণ ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করেন এবং আত্মা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (৩)
৩৩। “তৃতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদী হন এবং আতা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন? ভিক্ষুগণ, ইহলোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক মনোনিবেশহেতু তাদৃশ্য চিত্তসমাধি প্রাপ্ত হন যেইরূপ সমাহিত চিত্তে দশ সংবর্ত-বিবর্তকল্প, বিংশতি সংবর্ত-বিবর্তকল্প, ত্রিংশ সংবর্ত-বিবর্তকল্প, চতুরিংশৎ সংবর্ত-বিবর্তকল্প পর্যন্ত বহু পূর্বনিবাসানুস্মৃতি লাভ করেন এবং সাকার-সোদেশ বশে ইহাও বলিতে পারেন যে, আমি অমুক সময় অমুক স্থানে ছিলাম, তখন আমার ছিল—এই নাম, এই গোত্র, এই জাতি বর্ণ, এইরূপ আহার, এইরূপ সুখ-দুঃখানুভূতি, এই পরিমাণ পরমায়ু। সেই আমিই চু্যত হইয়া অমুক স্থানে উৎপন্ন হইয়াছিলাম। সেইখানেই আমার ছিল। এই নাম এই গোত্র, . . . এই পরিমাণ পরমায়ু। সেই আমিই সেইখান হইতে চু্যত হইয়া এখানে উৎপন্ন হইয়াছি।”
“তিনি (এইরূপ ধ্যানানুভাবসম্পন্ন হইয়া মিথ্যাদৃষ্টি বশতঃ) এইরূপ বলেন—আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ, ইন্দ্ৰকীলবৎ স্থির। সত্ত্বগণ নানা ভাবে সন্ধাবন, নানা যোনিতে সংসরণ করে বটে, চু্যত-উৎপন্ন হয় বটে, কিন্তু তাহারা শাশ্বতবৎ আছেই। ইহা বলিবার হেতু? আমি প্রবলতম বীৰ্যে . . . দশ . . . বিংশতি . . . ত্রিংশ। . . . চত্বারিংশৎ সংবর্তবিবর্তী কল্পভেদে বহু পূর্বনিবাসানুস্মৃতি লাভ করি এবং সাকার-সোদেশ বশে ইহাও বলিতে পারি যে, আমি অমুক সময়ে অমুকাস্থানে ছিলাম, আমার ছিল। এই নাম, . . . এই পরিমাণ পরমায়ু। সেই আমি সেখান হইতে চু্যত হইয়া অমুকািস্থানে উৎপন্ন হইয়াছিলাম। সেখানেও আমার ছিল, এই নাম . . . এই পরিমাণ পরমায়ু। সেই আমি আবার সেখান হইতে চু্যত হইয়া এখানে উৎপন্ন হইয়াছি।”
“এতাদৃশ বিশেষাধিগমহেতু আমি প্রত্যক্ষ জ্ঞাত হইয়াছি যে আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ, ইন্দ্ৰকীলের ন্যায় স্থির। সত্ত্বগণ নানাভাবে সন্ধাবন, নানাযোনি সংসরণ করে বটে, চু্যত-উৎপন্ন হয় বটে, কিন্তু তাহারা শাশ্বতবৎ আছেই। ভিক্ষুগণ, (শাশ্বতবাদ চতুষ্টয়ে) ইহা (চতুরিংশৎ সংবর্ত-বিবর্তকল্পানুস্মৃতিই) তৃতীয় কারণ। কোনো কোনো শ্রমণ ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করেন এবং আত্মা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (৪)
৩৪। “চতুর্থ শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করেন এবং আতা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন? ভিক্ষুগণ, ইহলোকে এমন কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ আছেন যিনি তার্কিক ও মীমাংসক। তিনি প্ৰতিভাবলে তর্কের পর তর্কে লব্ধ মীমাংসাচারী হইয়া বলেন—আত্মা এবং লোক শাশ্বত, বন্ধ্য, পর্বতকুট সদৃশ্য, ইন্দ্ৰকীলবৎ স্থির। সত্ত্বগণ নানা ভাবে সন্ধাবিত, নানা যোনিতে সংসারিত চু্যত-উৎপন্ন হইতেছে বটে, কিন্তু তাহারা শাশ্বতবৎ আছেই। ভিক্ষুগণ, ইহা চতুর্থ কারণ। কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া শাশ্বতবাদী হইয়া আত্মা ও লোককে শাশ্বত বলিয়া প্রচার করেন।” (৫)
৩৫। “ভিক্ষুগণ, শাশ্বতবাদী শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ এই চারি কারণে আত্মা এবং লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন। ভিক্ষুগণ, শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে যাহারা শাশ্বতবাদী, আতা এবং লোককে শাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন। তাহারা এই চারি। কারণে অথবা ইহাদের যে কোনটি দ্বারাই করিবেন। ইহার বাহিরে অপর কোনো কারণ নাই।”
৩৬। “ভিক্ষুগণ, ইহা তথাগত প্রকৃষ্টরূপে জানেন যে এই সমুদয় মিথ্যাদৃষ্টি, ইহা এইরূপে গৃহীত, এইরূপে স্পৰ্শিত, এইরূপ ইহার গতি এবং পারলৌকিক অবস্থা এইরূপ হইবে, ইহাও তথ্যগতের সুবিদিত। শুধু ইহাই জানেন এমন নহে, এতদুত্তরতর (শীল, সমাধি, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান) ও প্রকৃষ্টরূপে জানেন। কিন্তু তিনি (আমি প্রকৃষ্টরূপে জানি বলিয়া তৃষ্ণা, দৃষ্টি, মান বিশে) ইহা পরামর্ষ করেন না। এইরূপ অপরামর্ষহেতু সেই পরামর্ষ কলুষের (তৃষ্ণা, দৃষ্টি, মানের) নিবৃত্তিতে নিবৃতি স্বয়ং বিদিত হইয়াছেন। ভিক্ষুগণ, তথাগত বেদনা সমূহের উদয়, অস্তগমন (ব্যয়) আস্বাদ, আদীনব এবং নিঃসরণ যথাযথারূপে বিদিত হইয়া উহাদের প্রতি আসক্তি বর্জন করায় বিমুক্ত হইয়াছেন।”
৩৭। “ভিক্ষুগণ, এই সকলই সেই গভীর, দুৰ্দর্শ, দুরনুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, অতৰ্ক-বিহার, নিপুণ, পণ্ডিত বেদনীয় ধর্ম, যেই সমুদয় তথাগত স্বয়ং অভিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ করিয়া প্ৰকাশ করেন, যে সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
————–
১। দিট্ঠি—দৃষ্টি। দৃষ্টি শব্দে বাঙ্গালা ভাষায় দর্শন বা জ্ঞান বুঝায় বটে, কিন্তু পালি ভাষায় মিথ্যা, বিপরীত, অযথার্থ, অসম্পূর্ণ, ভ্রান্ত, একাঙ্গ দর্শনই দৃষ্টি। দৃষ্টি বিষয়ের যথাভূত জ্ঞান নহে। আনন্দময় (তৃষ্ণাজনিত) দর্শন, আনন্দময় বিশ্বাস। সেই হেতু দৃষ্টি অর্থ মিথ্যাদৃষ্টি, অযথার্থ দর্শন। যথাভূতদর্শনের অভাবে যাঁহারা অযথাভূত দর্শন করেন তাঁহারা মিথ্যাদর্শক, মিথ্যাধারণা পোষণকারী, আত্মবাদই মিথ্যাদৃষ্টি।
১। দিট্ঠি—দৃষ্টি। দৃষ্টি শব্দে বাঙ্গালা ভাষায় দর্শন বা জ্ঞান বুঝায় বটে, কিন্তু পালি ভাষায় মিথ্যা, বিপরীত, অযথার্থ, অসম্পূর্ণ, ভ্রান্ত, একাঙ্গ দর্শনই দৃষ্টি। দৃষ্টি বিষয়ের যথাভূত জ্ঞান নহে। আনন্দময় (তৃষ্ণাজনিত) দর্শন, আনন্দময় বিশ্বাস। সেই হেতু দৃষ্টি অর্থ মিথ্যাদৃষ্টি, অযথার্থ দর্শন। যথাভূতদর্শনের অভাবে যাঁহারা অযথাভূত দর্শন করেন তাঁহারা মিথ্যাদর্শক, মিথ্যাধারণা পোষণকারী, আত্মবাদই মিথ্যাদৃষ্টি।
২. পঞ্চস্কন্ধকে বা ইহাদের যে কোনটিকে আমি বা আত্মা মনে করিয়া আমিই ছিলাম, সেই আমিই এখন উৎপন্ন হইয়াছি; এইরূপ ধারণা হওয়াতেই দৃষ্টি মিথ্যা হইয়াছে। এইরূপ দৃষ্টি ভবাগ্রে উৎপন্ন নিরাকার ব্ৰহ্মারও থাকে। যেহেতু দৃষ্টি আসব, ওঘ, যোগ, গ্ৰন্থি, উপাদান, অনুশয়, সংযোজন এবং ক্লেশ (কলুষ)।
“প্ৰথম ভাণবার একাংশ শাশ্বতবাদ।”
৩৮। “ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন একদেশ শাশ্বতবাদী, একদেশ অশাশ্বতবাদী যাহারা চারিটি কারণ প্রয়োগে আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত ঘোষণা করেন। সেই ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদী হইয়া চতুর্বিধ কারণ প্রয়োগে আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত ঘোষণা করেন?”
৩৯। “ভিক্ষুগণ, কখন এমনো সময় হয়, সুদীর্ঘকাল পরে এই সংসার প্ৰলয়-নিমর্জিত (সংবর্তিত) হইয়া থাকে। যখন ঈদৃশ প্ৰলয় হইতে থাকে তখন সত্ত্বগণ প্রায়শ আভম্বর ব্ৰহ্মলোকে সমুৎপন্ন হন। তাহারা তথায় মনোময়, প্রীতিভক্ষী, স্বয়ম্প্রভ এবং আকাশচারী হইয়া শুভস্থিতিরূপে (উদ্যান, বিমান, কল্পতরু প্রভৃতিতে) দীর্ঘকাল অবস্থান করেন।”
৪০। “আবার ভিক্ষুগণ, কখনো এমন সময় হয়, দীর্ঘকাল পরে এই লোক (সংসার) বিবর্তিত (পুনঃ উৎপন্ন) হয়। সংসার বিবর্তিত হইবার সময় শূন্য ব্ৰহ্মবিমান প্রাদুর্ভূত হয়। অতঃপর অন্যতর সত্ত্ব আয়ুক্ষয়ে বা পুণ্যক্ষয়ে আভম্বর ব্ৰহ্মলোক হইতে চ্যুত হইয়া শূন্য ব্ৰহ্মবিমানে উৎপন্ন হন। তথায় তিনি মনোময় প্রীতিভক্ষী স্বয়ম্প্রভ আকাশ-বিহারী হইয়া শুভস্থিতিরূপে দীর্ঘ (কল্পার্ধ) কাল অবস্থান করেন।”
৪১। “শূন্য বিমানে দীর্ঘকাল একক বিহরণে তাঁহার অনভিরতি (তৃষ্ণা জনিত) উদ্বেগ উৎপন্ন হয়, তিনি কামনা করেন, “আহো, যদি অন্য সত্ত্বগণও এখানে আসেন ভালো হয়!”। অতঃপর অন্যান্য সত্ত্বগণ নিজ নিজ আয়ু বা পুণ্যক্ষয়ে আভস্বর ব্রহ্মলোক হইতে চ্যুত হইয়া ব্রহ্মবিমানে সেই সত্ত্বের সহাব্যতা বা সহ ভাবে উৎপন্ন হন। তাহারাও সেখানে মনোময় প্রীতিভক্ষী স্বয়ম্প্রভ আকাশবিহারী হইয়া শুভস্থায়ীরূপে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন।”
৪২। “ভিক্ষুগণ, সেই শূন্য বিমানে যিনি প্রথম উৎপন্ন হইয়াছিলেন। তাহার মনে এইরূপ ভাব হইল—“আমি ব্ৰহ্মা, মহাব্ৰহ্মা, অভিভু, অনভিভূত, সর্বদশী, বশবর্তী, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ, রচয়িতা, বশী (জিতেন্দ্ৰিয়), ভূত এবং ভব্য (জন্ম পর্যাম্বেষী), প্রাণীদের পিতা। এই জীবগণ আমাকর্তৃক সৃষ্ট। কি হেতু? আমি পূর্বে এইরূপ মনে করিয়াছিলাম, অহো, অন্য সত্ত্বগণও এখানে আগমন করিলে ভালো হয়। আমার আন্তরিক ইচ্ছায় এই সকল সত্ত্ব এখানে আগমন করিয়াছে। যাহারা পশ্চাতে উৎপন্ন হইলেন তাঁহাদের মনেও এই ভাবের সঞ্চার হইল যে, “এই ভদন্ত ব্ৰহ্মা, মহাব্ৰহ্মা, অভিভু, অনভিভূত, সর্বদর্শী, বশবর্তী, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ, রচয়িতা, বশী, ভূত, ভব্য (জন্ম পর্যান্বেষী) প্রাণীদের পিতা। আমরা এই ভদন্ত ব্ৰহ্মা কর্তৃক নির্মিত। কারণ, আমরা ইহাকেই এখানে প্রথম উৎপন্ন দেখিয়াছি। আমরা পরে উৎপন্ন হইয়াছি।”
৪৩। “ভিক্ষুগণ, সেই শূন্য ব্ৰহ্মবিমানে যিনি প্রথম উৎপন্ন হইয়াছিলেন। তিনি দীর্ঘায়ুতর, বর্ণবন্ততর (সুন্দরতর), মহা ঐশীশক্তিশালীতর। যাহারা পরে উৎপন্ন তাঁহারা অল্পায়ুতর, দুর্বর্ণতর, হীন ঐশীশক্তিতর।”
৪৪। “ভিক্ষুগণ, এমন কারণও বিদ্যমান আছে। কোনো এক সত্ত্ব ঐ কায়া হইতে চ্যুত হইয়া এই স্থানে উৎপন্ন হন। ইহলোকে উৎপন্ন হইয়া পরে তিনি (বৈরাগ্য বশতঃ) আগার ছাড়িয়া অনাগারিকভাবে প্ৰব্ৰজিত হন এবং প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ। পরায়ণতায় সম্যক সঙ্কল্পানুরূপ চিত্তসমাধি প্রাপ্ত হন, যাহার বলে। পূর্বনিবাসানুস্মৃতি জ্ঞান প্রাপ্ত হন। কিন্তু তৎপূর্ববর্তী জন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন।”
“ইহার ফলে তিনি এইরূপ বলেন- সেই ভদন্ত ব্ৰহ্মা, মহাব্ৰহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, বশবর্তী, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ নিয়ন্তা, বশী, ভূত এবং ভব্য প্রাণীদের (তিনি) পিতা যাহার দ্বারা আমরা সৃষ্ট হইয়াছি। তিনি নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামধ্যমী, তিনি অনন্তকাল ঐরূপেই থাকিবেন। সেই মহিমাময় ব্ৰহ্মকর্তৃক সৃষ্ট আমরা অপর যাহারা ছিলাম সকলেই অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ুক, চুতিশীল হইয়া এই লোকে আগমন করিয়াছি। ভিক্ষুগণ, ইহা প্রথম কারণ। কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ আশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ আশাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (১-৫)
৪৫। “দ্বিতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন?”
“ভিক্ষুগণ, ক্রীড়া প্রদোষিকা নামে এক শ্রেণীর দেবতা আছেন; তাহারা নিরন্তর হাস্য-ক্ৰীড়া-রতিশীলতায় বিহরণহেতু আহারে স্মৃতিবিভ্রম ঘটে। আহারে স্মৃতিবিভ্ৰমহেতু উহারা সেই দেবকীয়া (লোক) হইতে চ্যুত হন।”
৪৬। “ভিক্ষুগণ, এমনো কারণ বিদ্যমান আছে যে কোনো সত্ত্ব ঐ দেবলোক (কায়া) হইতে চ্যুত হইয়া এই লোকে উৎপন্ন হন। (একাদা বৈরাগ্যবশতঃ) তিনি আগার ছাড়িয়া অনাগরিক প্ৰব্ৰজ্যা গ্ৰহণ করেন এবং প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ। পরায়ণতায়, সম্যক সঙ্কল্পানুরূপ চিত্তসমাধি প্ৰাপ্ত হন, যাহার বলে। পূর্বনিবাসানুস্মৃতি জ্ঞান লাভ করেন। তন্দ্বারা পূর্ব জন্মের বিষয় মাত্র জানিতে পারেন।”
“কিন্তু তৎপুর্বজন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন। ইহার ফলে তিনি এইরূপ বলেন—“যেসব ভদন্ত দেবতা ক্রীড়া প্রদোষিকা নহেন, নিরন্তর হাস্যক্রীড়া-রতিশীলতায় বিহার করেন না, তাঁহাদের আহারে স্মৃতিবিভ্রম ঘটে না, এই কারণে তাঁহাদের চুতি হয় না, তাহারা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামশীল, শাশ্বতবৎ অবস্থান করিবেন। আমরা যাহারা ক্রীড়া প্রদোষিক ছিলাম, নিরন্তর হাস্য-ক্রীড়া-রতিশীল হইয়া বিহার করিয়াছি এবং যার জন্য স্মৃতিবিভ্রম হইয়া অনাহারে সেই দেবলোক হইতে চ্যুত হইয়াছি, এই অনিত্য, অধ্রুব, অল্পজীবি ও চুতিশীল হইয়া এই লোকে আগমন করিয়াছি। ভিক্ষুগণ, ইহা দ্বিতীয় কারণ; কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত ঘোষণা করেন।” (২-৬)
৪৭। “তৃতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত ঘোষণা করেন?”
“ভিক্ষুগণ, মনোপ্রদোষিক নামক এক শ্রেণীর দেবতা আছেন। তাঁহারা নিরন্তর পরস্পর পরস্পরকে বিদ্বেষপূর্ণ নেত্রে নিরীক্ষণ করেন। তাঁহাদের একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ নেত্রে নিরীক্ষণ করায় পরস্পর দূষিত চিত্ত হন। এবং তজ্জন্য ক্লান্ত কায়ে ক্লান্ত চিত্তে সেই দেবকীয়া (লোক) ভ্ৰষ্ট হইয়া পড়েন।”
৪৮। “ভিক্ষুগণ, এমনো কারণ বিদ্যমান আছে যে অন্যতর সত্ত্ব সেই দেবলোক হইতে চ্যুত হইয়া এই লোকে উৎপন্ন হন। (কালে বৈরাগ্য উৎপন্ন হইলে) আগার ছাড়িয়া অনাগরিক প্ৰব্ৰজ্যা গ্ৰহণ করেন এবং প্ৰলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টা-শীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক সঙ্কল্পানুরূপ চিত্তসমাধি প্রাপ্ত হন, যাহার বলে পূর্বনিবাসানুস্মৃতি জ্ঞান লাভ করেন। তন্দ্বারা পূর্ব জন্মের বিষয় মাত্র জানিতে পারেন। কিন্তু তৎপূর্বজন্ম স্মরণ করিতে অক্ষম হন।”
“ইহার ফলে তিনি এইরূপ বলেন, “যেসব ভদন্ত দেবতা মনপ্রদোষসম্পনড়ব নহেন তাঁহারা পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ নেত্রে দেখাদেখি করেন না এবং তজ্জন্য পরস্পরের প্রতি তাঁহাদের চিত্ত দূষিত হয় না। চিত্তের নির্মলতাহেতু অক্লান্ত কায় অক্লান্ত চিত্ততায় তাহারা দেবলোক চ্যুত হন না, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিণামী হইয়া শাশ্বতসম অনন্তকাল অবস্থান দেবকীয় (লোক) হইতে চ্যুত হইয়া অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ুক, মরণশীল এই লোকে উৎপন্ন হইয়াছি। ভিক্ষুগণ, ইহা তৃতীয় কারণ; কোনো কোনো শ্রমণব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ আশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা ও লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত ঘোষণা করেন।” (৩-৭)
৪৯। “চতুর্থ শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন?”
“ভিক্ষুগণ, ইহ লোকে এমনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন যিনি তার্কিক এবং মীমাংসক। তিনি স্বীয় প্রতিভা বলে তর্কের পর তর্কেলব্ধ মীমাংসাচারী হইয়া এইরূপ বলেন, ‘চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা এবং কায় সম্প্রযুক্ত দেহাত্মা বলিয়া যাহা কথিত হয় এই আত্মা অনিত্য, অধ্রুব, অশাশ্বত, বিপরিণামশীল এবং যে চিত্ত বা মন অথবা বিজ্ঞানরূপ জীবাত্মা কথিত হয় তাহা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অবিপরিনামশীল শাশ্বতসম অনন্তকাল বিদ্যমান থাকিবে। ভিক্ষুগণ, ইহা চতুর্থ কারণ; যাহা কোনো কোনো শ্রমণব্ৰাহ্মণ অধিগত হইয়া, লক্ষ্য করিয়া একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত বলিয়া ঘোষণা করেন।” (৪-৮)
৫০। “ভিক্ষুগণ, সেই শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ এই কারণ চতুষ্টয়েই একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, শ্রমণব্ৰাহ্মণদিগের মধ্যে যাহারা একদেশ শাশ্বত, একদেশ অশাশ্বতবাদ গ্ৰহণ করিয়া আত্মা এবং লোকের একাংশ শাশ্বত, একাংশ অশাশ্বত বলিয়া প্রচার করেন তাহারা সকলেই এই কারণ চতুষ্টয়ে অথবা ইহাদের যে কোনো একটি দ্বারাই করিয়া থাকেন; ইহার বাহিরে অন্য কোনো কারণ নাই।”
৫১। “ভিক্ষুগণ, ইহা তথাগত প্রকৃষ্টরূপে জানেন যে— এই সমুদয় মিথ্যাদৃষ্টি, ইহা এইরূপে গৃহীত, এইরূপে স্পশীত, এইরূপ ইহার গতি এবং ঐ সকলে আসক্ত মনুষ্য জন্মান্তরে এই এই দশায় উপনীত হইবে, ইহাও তথ্যগতের সুবিদিত। শুধু ইহাই জানেন এমন নহে, এতদুত্তরতর (শীল, সমাধি, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান) ও প্রকৃষ্টরূপে জানেন। কিন্তু ঐ জ্ঞান তাঁহাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া তিনি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করেন। ভিক্ষুগণ, তথাগত বেদনা সমূহের উদয়, অস্তগমন, আস্বাদ, আদীনব এবং নিঃসরণ যথাযথারূপে বিদিত হইয়া উহাদের প্রতি আসক্তি বর্জন করায় তিনি বিমুক্ত হইয়াছেন।”
৫২। “ভিক্ষুগণ, এই সকলই সেই গভীর . . . পণ্ডিতবেদনীয় ধর্ম . . . এ সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
অন্তানন্তবাদ
৫৩। “ভিক্ষুগণ, কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অন্তানন্তবাদী। তাঁহারা চারিটি কারণে লোক সান্ত-অনন্ত বলিয়া প্রচার করেন। তাঁহারা কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অন্তানন্তবাদী চারি কারণে লোক সান্ত-অনন্ত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন?”
৫৪। “ভিক্ষুগণ, ইহ লোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায় সম্যক সঙ্কল্পানুরূপ চিত্তসমাধি প্ৰাপ্ত হন, যেইরূপ সমাধিতে চিত্ত স্থিত হইলে লোক সান্ত পরিচ্ছিন্ন বলিয়া সংজ্ঞা লাভ করিয়া অবস্থান করেন।”
“ইহার ফলে তিনি এইরূপ বলেন, “এই লোক সান্ত পরিচ্ছিন্ন’। এইরূপ বলিবার হেতু? আমি প্রবলতম বীর্যে . . . চিত্তের তাদৃশ সমাধি লাভ করি, যেই সমাহিত চিত্তের বলে লোক সান্ত পরিচ্ছিনড়ব বলিয়া জ্ঞাত হইতে পারিয়াছি। ভিক্ষুগণ, ইহার প্রথম কারণ; যাহা অধিগত হইয়া যাহাকে লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অন্তানন্তবাদী এবং লোক সান্ত-অনন্ত বলিয়া প্রচার করেন।”(১-৯)
৫৫। “দ্বিতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অন্তানন্তবাদ গ্রহণ করিয়া লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্রচার করেন?”
“ভিক্ষুগণ, ইহ লোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায়, অপতন চেষ্টশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক সঙ্কল্পানুযায়ী অপরিচ্ছিন্ন বলিয়া সংজ্ঞা লাভ ঘটে।”
“তদ্ধেতু তিনি এইরূপ বলেন, ‘এই লোক অনন্ত অসীম’। যে সকল শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ বলিয়াছেন, লোক সান্ত-পরিচ্ছিন্ন তাঁহাদের উক্তি মিথ্যা। এই লোক অনন্ত অসীম। তাহা কেন বলি? আমি প্রবলতম বীর্যে . . . তাদৃশ চিত্তসমাধি লাভ করি, যেই সমাহিত চিত্তের বলে, এই লোক অনন্ত অসীম বলিয়া জ্ঞাত হইয়া অবস্থান করিতেছি। এই বিশেষত্ব অধিগমহেতু আমি ইহা প্রত্যক্ষ ভাবে জানিতেছি যে এই লোক অনন্ত অসীম। ভিক্ষুগণ, ইহা দ্বিতীয় কারণ; যাহা অধিগত হইয়া যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অন্তানন্তবাদ গ্ৰহণ করিয়া লোক সান্ত-অনন্ত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (২-১০)
৫৬। “তৃতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী সাধনায়, অপতন চেষ্টাশীলতায়, অপ্ৰমাদ পরায়ণতায়, সম্যক সঙ্কল্পানুরূপ চিত্তসমাধি লাভ করেন। যেইরূপ সমাধিতে চিত্ত স্থিত হইলে লোক উধ্বঅধঃ সান্ত চতুর্দিকে অনন্ত বলিয়া ধারণা (সংজ্ঞা) লাভ করেন। ইহার ফলে তিনি এইরূপ বলেন— “এই লোক সান্ত-অনন্ত দুই বটে। যে সকল শ্রমণব্ৰাহ্মণ বলেন যে—“লোক সান্ত পরিচ্ছিন্ন তাঁহাদের উক্তি মিথ্যা। আর যাহারা বলেন যে—‘লোক অনন্ত অপরিসীম’ তাহাদের মতবাদও মিথ্যা। বস্তুত লোক সান্তও বটে, অনন্তও বটে। কারণ আমি প্রবলতম বীৰ্যে, একনিষ্ঠ সাধনায় . . . যে চিত্তসমাধি লাভ করিয়াছি, তাহাতে দেখিতে পাইতেছি। উর্ধ্ব-অধঃ লোক সান্ত, সমন্তত অনন্ত। ভিক্ষুগণ, ইহা তৃতীয় কারণ; কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া যাহা লক্ষ্য করিয়া অন্তানন্তবাদ গ্ৰহণ করিয়া লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্ৰজ্ঞপ্তি করেন।” (৩-১১)
৫৭। “চতুর্থ শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অন্তানন্তবাদ গ্রহণ করিয়া লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্রচার করেন?”
“ভিক্ষুগণ, ইহ লোকে এমনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন যিনি তর্ককারী মীমাংসাচারী। তিনি স্বীয় প্রতিভা বলে স্বয়ং তর্ক-বিতর্ক করিয়া এমন সিদ্ধান্তে উপস্থিত হন, এমন মীমাংসায় পৌছেন এবং বলেন, “এই লোক সান্তও নহে, অনন্তও নহে। যে সকল শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ বলেন যে, “লোক সান্ত পরিচ্ছিন্ন তাঁহাদের উক্তি মিথ্যা এবং যাহারা এইরূপ বলেন, “লোক অনন্ত অসীম’ তাঁহাদের উক্তিও মিথ্যা। আর যে সকল শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ লোক সান্ত এবং অনন্ত দুইই বলেন তাঁহাদেরও উক্তি মিথ্যা। এই লোক না। সান্ত, না অনন্ত। ভিক্ষুগণ, ইহা চতুর্থ কারণ; যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ অন্তানন্তবাদ গ্রহণ করিয়া লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্রচার করেন।” (৪-১২)
“ভিক্ষুগণ, সেই অন্তানন্তবাদী শ্ৰামণ-ব্ৰহ্মণগণ এই কারণ চতুষ্টয়েই লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্রচার করেন। শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণদিগের মধ্যে যাহারা অন্তানন্তবাদী, লোক অন্তানন্ত বলিয়া প্রচার করেন তাহারা সকলেই এই কারণ চতুষ্টয়ে অথবা ইহাদের যে কোনটি দ্বারাই করিয়া থাকেন; ইহার বাহিরে অন্য কোনো কারণ নাই।”
৫৯। “ভিক্ষুগণ, তথাগত প্রকৃষ্টরূপে জানেন যে এই সমুদয় মিথ্যাদৃষ্টি, ইহা এইরূপে গৃহীত, এইরূপে স্পশীত, এইরূপ ইহার গতি এবং পারলৌকিক অবস্থা এইরূপ হইবে ইহাও তথ্যাগতের সুবিদিত। শুধু ইহাই জানেন এমন নহে, এতদুত্তরতর (শীল-সমাধি, সর্বজ্ঞতাজ্ঞান) ও প্রকৃষ্টরূপে তিনি জানেন, কিন্তু ঐ জ্ঞান তাঁহাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হইয়া তিনি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করেন। ভিক্ষুগণ, তথাগত বেদনা সমুহের উদয়, অস্তগমন, আস্বাদ, আদীনব এবং নিঃসরণ যথাযথারূপে বিদিত হইয়া উহাদের প্রতি আসক্তিবর্জন করায় বিমুক্ত হইয়াছেন।”
৬০। “ভিক্ষুগণ, এই সকলই যেই গভীর দুর্দর্শ . . . পণ্ডিত বেদনীয় ধর্ম . . . এ সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
অরমাবিক্ষেপ বাদ
৬১। “ভিক্ষুগণ, এমনো কতিপয় অমরাবিক্ষেপী(১) শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন। যাহারা প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে চারিটী কারণে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্যবিক্ষেপ করিয়া থাকেন। সেই ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে চারি। কারণে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
৬২। “ভিক্ষুগণ, ইহলোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ ‘ইহা কুশল’ বলিয়া যথার্থরুপে জানেন না, ইহা ‘অকুশল’ বলিয়াও যথার্থরূপে জানেন না। তখন তাঁহার এইরূপ মনে হয়, আমিত ইহা ‘কুশল’ বলিয়া যথাভূত ভাবে জানি না, ইহা ‘অকুশল’ বলিয়াও যথাযথারূপে জানি না। আমি ইহা কুশল বা অকুশল বলিয়া সম্যকরূপে না জানিয়া যদি ইহা কুশল এবং ইহা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করি, তবে তাহা আমার মিথ্যা হইবে; যাহা আমার মিথ্যা হইবে, তাহা হইবে আমার বিঘাত (মনের অশান্তি); যাহা আমার অশান্তিকর তদ্বারা হইবে আমার স্বৰ্গমার্গের অন্তরায়। এই প্রকারে মিথ্যারি ভয়ে, মিথ্যাকথাকে। ঘৃণা করিয়া “ইহা কুশল’ এইরূপও প্রকাশ করেন না, “ইহা অকুশল’ এইরূপও প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে এরূপও আমি বলি না। (এইরূপ, ‘না’) ওরূপও আমি বলি না (ওরূপ, ‘না) অন্যথাও বলি না, নাও বলি না, না নাও বলি না। (এইরূপ উত্তর দিয়া) অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা প্রথম কারণ; কোনো কোনো অমরাবিক্ষেপী শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া জায়গায় জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপরদিপ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (১-১৩)
৬৩। “দ্বিতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হন এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ “ইহা কুশল” “ইহা অকুশল’ বলিয়া যথাযথারূপে জানেন না, তখন তাঁহার এইরূপ মনে হয়— “ইহা কুশল’, ‘ইহা অকুশল’ বলিয়াত আমি যথার্থরুপে জানি না। এইটি কুশল, এইটি অকুশল বলিয়া যথার্থভাবে না জানিয়া যদি এইটি কুশল আর এইটি অকুশল বলিয়া প্রচার করি, তবে উহাতে আমার ছন্দ বা রাগ অথবা দ্বেষ কিম্বা প্ৰতিঘ উৎপন্ন হইবে। যেখানে আমার ছন্দ বা রাগ অথবা দ্বেষ কিম্বা প্ৰতিঘ উৎপন্ন হইবে তাহা আমার উপাদানে(২) পরিণত হইবে। যাহা আমার উপাদান হইবে তদ্বারা হইবে আমার মনকষ্ট (বিঘাত); যাহা আমার অশান্তিকর তাহা আমার ধ্যানমার্গের অন্তরায়কর হইবে। এইরূপে উপাদান ভয়ে, উপাদান ঘৃণায় ইহা কুশল বা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে, ‘এইরূপও আমি বলি না, সেইরূপও আমি বলি না, অন্যথাও বলি না, না বলিয়াও বলি না, না নহে এমনো আমি বলি না’। এইরূপ উত্তর দিয়া অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা দ্বিতীয় কারণ; কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া এবং যাহা লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন, কুশলাকুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (২-১৪)
———–
১. অমরাবিকখেপিকা—আমরাবিক্ষেপী। মরে না বলিয়া অমর, স্ত্রী লিঙ্গে আমরা। গুড়চী, দুৰ্বাঘাসকেও আমরা বলে। গুড়চী যেমন মূলে বা উপমূলে প্রতিষ্ঠিত না হইয়া তরুশিখরে অনালম্বভাবে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়, তাদৃশ অপ্রতিষ্ঠবাক্যে বাক্য বিক্ষেপী
২. রাগ ও দ্বেষ উভয়ে সন্তপ্ত করিয়া নিজকে বিহনন করে বলিয়াই উপাদান এবং বিঘাত উক্ত হইয়াছে। ছন্দ ও রাগ উপাদান। দ্বেষ আর প্রতিঘ, বিঘাত, অথবা ছন্দ, রাগ, দ্বেষ, প্রতিঘ দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে বলিয়া উপাদান; বিহনন করে বলিয়া বিঘাত বলা ইহয়াছে।
———–
৬৪। “তৃতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হন, এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ ইহা কুশল বা ইহা অকুশল তাহা যথাভূতভাবে জানেন না। (তখন) তাঁহার এইরূপ মনে হয়— “আমি ইহা কুশল। কিনা বা ইহা অকুশল। কিনা যথার্থরুপে জানি না। ইহা কুশল বা অকুশল তাহা সম্যকরূপে না জানিয়া যদি ইহা কুশল বলিয়া প্রকাশ করি বা ইহা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করি, তাহা হইলে এমন অনেক পরশাস্ত্রবিদ্(১) নিপুণ, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পনড়ব পণ্ডিত শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন, যাঁহারা স্বীয় প্রজ্ঞাবলে কেশগ্রবিদ্ধকারী(২) ধনুর্ধরের ন্যায়। পরবাদ বিমৰ্দন করিয়া বিচরণশীল। তাহারা যদি এ বিষয়ে আমার মত জিজ্ঞাসা করেন(৩), মতবাদের হেতু(৪) জিজ্ঞাসা করেন, আমার মতকে অবজ্ঞা করিয়া অনুশাসন করেন। আমিত সুন্দরীরূপে উত্তর প্রদান করিতে পারিব না। যদি না পারি তাহা হইবে আমার মনকষ্ট (মনের অশান্তি), যাহা আমার অশান্তিকর তাহা আমার স্বৰ্গমার্গের অন্তরায়কর হইবে। এই প্রকারে তিনি অনুযোগ ভয়ে অনুযোগকে ঘৃণা করিয়া ইহা কুশল বলিয়াও প্রকাশ করেন না, ইহা অকুশল বলিয়াও প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে, “এইরূপও আমি বলি না, সেইরূপও বলি না, অন্যথাও বলি না, না বলিয়াও বলি না, না। নহে এমনো বলি না”। এইরূপ উত্তর দিয়া অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা তৃতীয় কারণ; যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (৪-১৫)
৬৫। “চতুর্থ শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন এবং কুশলাকুশলাদি বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ মন্দবুদ্ধি (নির্বোধ) হইয়া থাকেন। তিনি জড়তা এবং মুর্খতা প্রযুক্ত কোনো বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। পরলোক আছে? ইহা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা পরলোক আছে, ইহা যদি আমার ধারণা হইত। তবে পরলোক আছে, ইহা তোমায় বলিতাম; কিন্তু এরূপ ধারণাও আমার নাই। ‘নাই, এরূপও আমার ধারণা নাই। এরূপ ধারণাও নাই, সেরূপ ধারণাও নাই, অন্যথাও নাই, না কিম্বা হ্যা। ইহাও নহে। পরলোক নাই? ইহা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা . . . (পূর্ববৎ)। আছে ও নাই পরলোক? না আছে, না নাই পরলোক? (উপপাতিক) সত্ত্ব আছে? উপপাতিক(৫) সত্ত্ব নাই? আছে এবং নাই উপপাতিক সত্ত্ব? না আছে, না নাই উপপাতিক সত্ত্ব? সুকৃত্য-দুষ্কৃত কর্মের ফল আছে? সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল নাই? আছে এবং নাই সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল? না আছে, না নাই সুকৃত- দুষ্কৃত কর্মের ফল? সত্ত্ব (তথাগত) মৃত্যুর পর উৎপনড়ব হয়? (বিদ্যমান থাকে?) মৃত্যুর পর সত্ত্ব উৎপন্ন হয় না? (সত্ত্বের অস্তিত্ব থাকে না?) মৃত্যুর পর কাহারও উৎপত্তি হয়, কাহারও উৎপত্তি হয় না? (অস্তিত্ব থাকে এবং থাকে না?) মৃত্যুর পর না হয়, না হয় না? যদি আমাকে ইহা জিজ্ঞাসা কর, ‘মৃত্যুর পর সত্ত্ব না হয়, না হয় না। যদি এইরূপই আমার মনের ধারণা হইত, তাহা হইলে আমি তোমাকে বলিতাম মৃত্যুর পর সত্ত্ব না হয়, না হয় না। কিন্তু এইরূপ ধারণাও নাই, (এরূপও ‘না’) সেরূপও ‘না’, অন্যথাও ‘না,’ ‘না নহে’ এমনো নহে। ভিক্ষুগণ, ইহা চতুর্থ কারণ; যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন, স্থানে স্থানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (৪-১৬)
৬৬। “ভিক্ষুগণ, অমরাবিক্ষেপী শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ এই চারি কারণেই স্থানে স্থানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে যাহারা অমরাবিক্ষেপী কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করেন, তাহারা সকলেই এই চারি কারণে বা ইহাদের যে কোনটি দ্বারা করেন। ইহা ছাড়া অন্য কোনো কারণ নাই। . . . যে সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
———
১. কতপরপ্লবাদা—পরশাস্ত্ৰবিদ।
২. বাল বেধিরূপা—বালবোধীরূপে (যাহারা দূর হইতেও লক্ষ্য করিয়া কেশগ্রবেধ করিতে সমৰ্থ) ধনুর্ধর সদৃশ। বোভিন্দন্তামঞঞে—বালবোধীতুল্য পরের অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিগতসমূহও স্বীয় প্রজ্ঞায় বেধ (খণ্ডন) করিতে সমর্থ।
৩. সমনুযুঞজ্যে—কুশল কী, অকুশল কী? এইরূপে আমার মত জিজ্ঞাসা করিলে।
৪. সমনুগাহেয্যুং–কুশল বা অকুশল বলিয়া উত্তর দিলে কোন কারণে কুশল বা অকুশল বলিলাম তাহার হেতু জিজ্ঞাসা করিলে। সমনুভাসেয্যুং—আমি কারণ প্রদর্শন করিলে, আমার কথিত কারণের দোষ দেখাইয়া যদি বলেন যে তুমি ইহা জান না; ইহা ত্যাগ কর, উহাই গ্রহণ কর বলিয়া আমাকে অনুশাসন করিলে।
৫. ওপপাতিকা—ঔপপাদুক। উৎপত্তিক্ষণে অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদিসহ পূর্ণাবয়বে উৎপন্ন সত্ত্ব। যেমন—দেবতা, ব্ৰহ্মা, কোন কোন মনুষ্য প্রেত ও নারকী সত্ত্ব।
তুলক পণ্ডিত জাতক
“মহারাজ এ চোরগণ” ইহা বুদ্ধ জেতবনে অবস্থান কালে নিজের দান পারমীকে উপলক্ষ করে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে পরস্পর এরূপ আলোচনা করছিলেন–“অহো বন্ধুগণ! আমাদের শাস্তা দেবমানবের একান্তই ত্রাণকর্তা। অতীত জন্মে তিনি দান-পারমী ধর্ম পূর্ণ করেছিলেন।” ইত্যাদি গুণ বর্ণনা করে ভিক্ষুগণ ধর্মশালায় উপবিষ্ট আছেন। এমন সময় শাস্তা এবিষয় অবগত হয়ে ধৰ্ম্ম সভায় উপস্থিত হলেন এবং আসনে উপবিষ্ট হয়ে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, এখন তোমরা কি আলোচনা নিয়ে এখানে উপবিষ্ট আছ? তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় যথাযতভাবে বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করলেন। বুদ্ধ তা, শুনে বললেন–ভিক্ষুগণ, তথাগত যে এখন দেব-নরের ত্রাণকর্তা, এ বড় আশ্চর্যের বিষয় নয়। পূর্বেও আমি বোধিসত্ত্বাবস্থায় এবং কোণাগমন বুদ্ধের শাসনে দ্বাত্রিংশ ভিক্ষু ও একজন শ্রামণের অধিনায়ক হয়ে ধনও জীবন পরিত্যাগ করেও ভগবানের শাসন-পূজা-মানসে বহু সুবর্ণ দান করেছিলাম। তা কিন্তু এর চেয়েও আশ্চর্য। এ বলে বুদ্ধ মৌনভাব ধারণ করলেন। তখন ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় তিনি সুদূর অতীতের আশ্চর্যজনক বিষয়টি বলতে আরম্ভ করলেন–
“ভিক্ষুগণ, সুদূর অতীতে কোনাগমন নামক ভগবান পরিনির্বাপিত হওয়ার পর তাঁর শাসন জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন চিন্ন নামক নগরে ‘চিন্ন’ নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। রাজার একজন মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ণ পুরোহিত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব উক্ত নগরে সুজাত নামক ব্রাহ্মণের পত্নী সুজাতা নদী ব্রাহ্মণীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। দশমাসের পর সুজাতা এক অভিরূপ পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। এ পুণ্যবান শিশু অনুক্রমে বয়ঃ বৃদ্ধির সাথে সাথে তীক্ষ প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে উঠলেন। তরুণ কালে তিনি নিজগৃহে যা করতেন, তা স্বীয় প্রজ্ঞাবলে তুলা বা তুলাদণ্ডের ন্যায় সমপরিমাণ করে করতেন। তাই পিতা মাতা তাঁর নাম রাখলেন “তুলক পণ্ডিত।” ইনি ষোড়শ বর্ষ বয়ঃক্রমকালে দর্শনীয়, শ্রী সম্পন্ন হলেন। তাঁর পিতা মাতা সম্ভার নদী এক ব্রাহ্মণ কণ্যার সহিত তাঁর বিবাহ কাজ সম্পন্ন করলেন। বিবাহের দুতিন বৎসর পরে তারা একটা পুত্র-সন্তান লাভ করলেন। সে পুত্রের নাম করণ করলেন–“সুবচ কুমার।” এক সময় কোনাগমন ভগবানের তেত্রিশজন ভিক্ষু শ্রাবক সুন্দর সংযত পদবিক্ষেপে নগর-পথে গমন করছিলেন। তখন এক পাপীষ্ট মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন রাজ পুরোহিত ব্রাহ্মণ উক্ত ভিক্ষুগণকে দেখে এরূপ চিন্তা করল–“যদি অই ভিক্ষুগণ এসে এখানে। উপস্থিত হয়, আমাদের রাজা তাদের নিত্য দর্শনে প্রসন্ন হয়ে তাদের মহা পূজা সক্কার করবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লাভসকারের ও পরিহানী ঘটবে। এখন আমি রাজার অন্তরে বিরূপভাবের সৃষ্টি করে তাদের যাতে হত্যা করা হয়, রাজাকে বলে সে চেষ্টাই করব।” এ চিন্তা করে সে তাড়াতাড়ি রাজার নিকট উপস্থিত হল এবং রাজার হস্ত ধারণ করে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করে বলল–“মহারাজ, দেখুন অই চোরগণ। ওরা নিশ্চয়ই এখানে এসে আপনার সমস্ত নগর লুণ্ঠন করবে। তাই তারা এদিকে আছে।” এ বলে ব্রাহ্মণ রাজাকে নিন্মোক্ত গাথায় বল্ল
১। “মহারাজ রথার্ষাভ এ চোরগণ যে এদিকে আসছে দেখছেন, তারা যেখানে সেখানে রাজ্য লুণ্ঠন করে বিচরণ করছে।”
তা শুনে রাজা তথায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে অবলোকণ করে ভিক্ষুগণকে দেখে বললেন–
২। এদিকে আগমনকারী মানবগণ লুণ্ঠক নহেন। তাঁরা বুদ্ধ শাসনেরই সুশীল ভিক্ষু। কোন প্রয়োজনেই তারা এখানে আসছেন।”
পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণ একথা শুনে রাজাকে বলল–
মহারাজ, আপনি এরূপ বলবেন না। এ চোরগণ শ্রমণ বেশ ধারণ করে আপনার সমস্ত রাজ্যটা লুণ্ঠন করে বিনাশ করবার উদ্দেশ্যেই এখানে আছে।”
রাজা এ পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণের কথা শুনে ক্ষুন্ন হয়ে বললেন–
“হে পুরোহিত, যদি এরা চোর হয়, তবে তাদের কি করতে হবে।” ব্রাহ্মণ বলল–“এখানেই এসব চোরের পশ্চাৎদিকে হস্ত বন্ধন করে ভীষণ ভাবে প্রহার করতে করতে আমক শ্মশানে নিয়ে সবাইকে শূলে দেওয়া উচিত।” চিন্নরাজ তার কথা অনুমোদন করে ঘাতককে ডেকে আদেশ করলেনহে ঘাতক, এখন তুমি অই চোরদের পঞ্চবন্ধনে বন্ধন করে দারুণভাবে প্রহার করতে করতে আমক শ্মশানে নিয়ে যাও এবং সবাইকে শূলে দাও।” তখন ঘাতক গিয়ে ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠ “নাগদীপক” নামক মহাস্থবির প্রমুখ ভিক্ষুদের বন্ধন করল এবং দারুণভাবে দুঃখদান করতে করতে আমক শ্মশানে নিয়ে যেতে লাগল। তখন ভিক্ষুগণ মহাদুঃখগ্রস্ত হলেন। অতঃপর নাগদীপক স্থবির ভিক্ষুগণকে আশ্বাস বাক্যে বললেন–“বন্ধুগণ, তোমরা অনুশোচনা ও রোদন করবেনা। এ দোষ কারো নয়, ইহা আমাদের জন্মান্তরের কর্মদোষই হবে নিশ্চয়। তোমরা প্রমাদগ্রস্ত হবেনা।” এ বলে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৩। আয়ুষ্মনগণ, তোমরা বিলাপ করোনা। শ্রমণের কখনো বিলাপ করা উচিত নয়।
৪। জগতে জন্মগ্রহণকারী প্রাণী সমূহ সর্বদা শোক ও ভয়শীল এবং মরণাভিমূখী। ইহা জাগতিক নিয়ম।
৫। সমস্ত সংস্কার ধর্ম অনিত্য ইহা বুদ্ধবাণী। আপন পুন্যই স্মরণ কর। অপ্রমত্ত হও।
বন্ধুগণ, উপচ্ছেদক ইত্যাদি কর্ম সকলের পশ্চাতে ছায়ার ন্যায় অনুধাবিত হয়। কর্মই আমাদের বন্ধু। এ আমক শ্মশানে সবাই কর্মের শরণাপন্ন হও।
৬। আমি পূর্বে যে পাপ কর্ম করেছি, তা-ই দুঃখের কারণ হয়েছে। তাই আমি অনুতাপ ও রোদন করিতেছিনা। তোমরা ও বিলাপ করোনা।
স্থবিরের কথা শুনে ভিক্ষুগণ সান্ত্বনা লাভ করলেন। তৎপর আমক শ্মশানে স্থবিরকে সম্মুখে রেখে ভিক্ষুগণ ঘাতকের নিকট দাঁড়াল। ভিক্ষুদের এরূপ দুর্দশার কথা তড়িৎ বেগে সমস্ত নগরে প্রচার হল। ইহাতে জনগণ সংক্ষুব্ধ হল। এখবর বোধিসত্ত্ব তুলক পণ্ডিত শুনে দ্রুতপদে শ্মশানে নাগদীপক। স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বন্দনা করে জিজ্ঞেস করলেন–
৭। “ভন্তে, এখানে আপনারা কোন দোষে দোষী হয়ে বন্ধন দশা প্রাপ্ত হয়েছেন? ঘাতক কেনই বা আপনাদের এখানে। এনেছে? তা আমাকে বলুন।”
স্থবির বললেন–“উপাসক এজন্মে আমাদের অনুমাত্রও কোন দোষ দেখা যাচ্ছেনা। তবে অতীত জন্মের দোষ ত জানি না।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৮। আমাদের অতীত কর্ম দোষের কথা জানিনা। বর্তমান জন্মের কোন দোষ আমার নিকট নেই।
৯। এসব সুশীল ও সদাচার সম্পূন্ন নির্দোষ ভিক্ষুগণ আমার সাথে বুদ্ধ-শাসনে অবস্থান করছে।
১০। বর্তমান সময়ে এ ভিক্ষুদের অনুমাত্র দোষও দেখছিনা। হে মানব, এরূপই জ্ঞাত হউন।”
বোধিসত্ত্ব স্থবিরের কথা শুনে বললেন–“ভন্তে, যদি এরূপ হয়, আপনারা চিন্তা করবেন না। এখন আপনাদের জীবন। রক্ষার জন্য আমার জীবন বিসর্জন করব।” এ বলে বোধিসত্ত্ব স্থবির প্রমুখ ভিক্ষুগণকে বন্দনা করে ঘাতকের নিকট উপস্থিত হলেন। তথায় নিজের মূল্যবান অলঙ্কারাদি উন্মোচন করে তা ঘাতকের হস্তে দিয়ে বললেন–
“তাত, তোমরা অল্পক্ষণ অপেক্ষা কর।” এ বলে তিনি রাজার নিকট গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে বললেন–“মহারাজ আপনি আমার প্রতি ও অই ভিক্ষুদের প্রতি অনুকম্পা করে তাঁদের মূল্য নির্ধারণ করুন। আমার নিকট হতে সে মূল্য বাবৎ স্বর্ণ রৌপ্য গ্রহণ করুন। আপনি যেরূপ ধন ইচ্ছা করেন, সে সব দিয়ে দিব। শীঘ্রই ভিক্ষুদের মুক্ত করে দিন।” ইহা শুনে রাজা বললেন–“হে তুলক, যদি তুমি তুলাদণ্ড গ্রহণ করে এসব ভিক্ষুর দেহের ওজন পরিমাণ সুবর্ণ আমাকে দিতে পার, তবে তাদের মুক্তি দিব। বোধিসত্ত্ব রাজার কথা শুনে প্রীতি চিত্তে “সাধু দেব” বলে রাজাকে অভিবাদনান্তে মাতার নিকট উপস্থিত হলেন। তিমি মাকে বললেন–
১১। মা, আমি শ্রমণদের বিপদ মুক্তির জন্য আপনার নিকট সুবর্ণ যাঞ্চা করতে এসেছি।
১২। মাত, শ্ৰমণদের রক্ষার জন্য আমাকে সুবর্ণ প্রদান করুন। শ্মশানে শ্রমণদের মৃত্যু দুঃখ হতে মুক্ত করব।
১৩। বুদ্ধ-শাসন বড়ই দুর্লভ। অপিচ স্বর্ণ রৌপ্যাদি ধন সম্পদ সর্বদা সুলভ। মাতঃ আমাকে সুবর্ণ প্রদান করুন।” বোধিসত্নের মাতা ইহা শুনে প্রীতি প্রমোদ্যচিত্তে বললেন–
১৪। “পুত্র, তোমার কথা অতি সুন্দর ও সুফল প্রদ, আমার নিকট হতে তুমি যথেচ্ছা সুবর্ণ গ্রহণ কর।”
মাতার এ উদার বাক্য শুনে তুলক পণ্ডিত পরম পুলকিত হলেন এবং বিকশিত পদ্মের ন্যায় সহাস্য বদনে আসন হতে উঠে মহার্ঘ পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করলেন। অতঃপর ধনাগারের দ্বার উন্মুক্ত করে বহু সুবর্ণ গ্রহণ করলেন এবং তা রাজাঙ্গনে তূপাকারে রেখে রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–“মহারাজ, আপনি এখন সুবর্ণ গ্রহণ করুন। তৎপরিবর্তে ভিক্ষুদের আমায় প্রদান করুন।” ইহা শুনে রাজা বললেন–
১৫। “হে তুলক, তুমি যদি আমাকে ভিক্ষুদের সমপরিমাণ সুবর্ণ দাও তাহলে সকলকেই তোমায় দিয়ে দেব তুমি সানন্দে তাদের গ্রহণ কর।”
তুলক পণ্ডিত রাজার কথা শুনে অত্যন্ত প্রীত হয়ে নাগদীপক স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বন্দনা করে বললেন–“ভন্তে, আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা করে এ পরিমাণ তুলাদণ্ডে আরোহণ করুন। আমি আপনার সমপরিমাণ। স্বর্ণ রাজাকে দিয়ে আপনাকে এদুঃখ হতে মুক্ত করব।
ইহা শুনে সংঘ নায়ক প্রসন্ন বদনে ‘সাধু মহাপুরুষ বলে তুলাদণ্ডে আরোহণ করলেন। মহাসত্ব স্থবিরের সম পরিমাণ সুবৰ্ণ দাড়ি পাল্লায় দিয়ে স্থবিরকে মুক্ত করলেন। এ নিয়মে ত্রিশজন ভিক্ষুকে তিনি মৃত্যু দুঃখ হতে মুক্ত করলেন বটে, কিন্তু আর দুজন ভিক্ষু ও একজন শ্রমণকে মুক্ত করতে পারলেন না, কারণ সুবর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছে তখন রাজা তুলক পণ্ডিতকে বললেন–“হে পণ্ডিত, তোমার নিকট স্বর্ণ আর আছে কি?” বোধিসত্ত্ব প্রত্যুত্তরে বললেন–“দেব, আমার নিকট আর স্বর্ণ নেই।” রাজা বললেন–হে তুলক, এখন তুমি কি করবে?” মহাস বললেন–“দেব, আপনি একটু অপেক্ষা করুন” এ বলে পুনরায় গৃহে গিয়ে স্ত্রী সম্ভার দেবীকে বললেন–“ভদ্রে, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।” পত্নী বললেন–স্বামীন, কি কথা বলতে চান? “ভদ্রে ত্রিশজন ভিক্ষুর সমপরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে তাঁদের জীবন রক্ষা করেছি। কিন্তু আরো দুজন ভিক্ষু ও শ্রামণকে এখনও মুক্ত করতে পারিনি। কারণ, স্বর্ণ নিঃশেষ হয়েছে। এখন নিজকে বিক্রয় করে তাঁদের মুক্ত করতে হবে। এতেই আমার সর্বজ্ঞতা লাভের হেতু সদ্ভুত দান পারমী পূর্ণ হবে।” ইহা শুনে সম্ভার দেবী প্রসন্ন বদনে বললেন–স্বামীন, আমারও কিছু পুণ্যের প্রয়োজন। সুতরাং আমাকে ও পুত্রকে বিক্রয় করে আপনি দান পারমী পূর্ণ করুন।” ইহা শুনে পণ্ডিত অতিশয় তুষ্ট হয়ে বললেন–
১৬। “ভদ্রে, ‘সাধু তুমি সুফল দায়ক বাক্য ভাষণ করেছ। অনাগতে পরমজ্ঞান লাভের জন্য তোমরা দুজনকে বিক্রি করব।
১৭। তোমরা উভয়েই আমার অতি প্রিয়। তবে বোধি লাভের ঐকান্তিক কামনায় তোমরা উভয়কেই বিক্রি করব।”
অতঃপর পণ্ডিত স্বীয়-স্ত্রী ও পুত্র উভয়কেই কোনও এক ধনাঢ্যকুলে বিক্রি করে দুজন ভিক্ষুকে মুক্ত করলেন। আরো অবশিষ্ট আছেন একজন শ্রামণ। সংগৃহীত সুবর্ণ সবই নিঃশেষ হয়ে গেল। শ্রামণ তা দেখে অতিশয় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অর্ধেশিরে শাশ্রু নয়নে বিলাপ করতে লাগলেন। বললেন–“এখনি আমাকে হত্যা করা হবে।” এবলে মহাদুঃখে ম্রিয়মান হয়ে সংজ্ঞা শূন্য হয়ে পড়লেন। পুনরায় সংজ্ঞা লাভ করে অশ্রু মুখে ঘাতককে বললেন–“তোমায় প্রার্থনা করছি-আমার বন্ধন একটু শিথিল করে দাও।” এ কাতর প্রার্থনায় ঘাতক শ্রমণের বন্ধন-রজু একটু শিথিল করে দিল। তখন শ্রামণ নাগদীপক স্থবিরকে বন্দনা করে বললেন–“ভন্তে আমি আপনার শিষ্য। আমার কোন দোষ থাকলে ক্ষমা করবেন। আমার পিতা-মাতা যদি আমার কোনও খবর জানতে চায়, তবে আপনি তাঁদের আমার প্রব্রজিত উপকরণগুলি দেবেন।” এবলে নিন্মোক্ত গাথা পঞ্চক ভাষণ করলেন
১৮। “বুদ্ধ-শাসনে সুপ্রসন্ন আমার পিতা-মাতা বিদ্যমান আছেন। দুঃখ মুক্তির জন্য তাঁরা আমাকে বুদ্ধ-শাসনে দান করেছেন।
১৯। তাঁরা আমার এসব শ্রমণ উপকরণ সুষ্ঠুরূপে রক্ষা করবেন এবং আমার অদর্শনে দীর্ঘকাল ধরে রোদন করবেন।
২০-২১। আমার পিতা-মাতা আমাকে না দেখে স্বীয় ঘরে বসে নিশ্চয়ই প্রব্রজ্যার প্রতি ব্যথিত চিত্তে দীর্ঘদিন রোদন করবেন।
২২। এরূপে তাঁরা আমার অদর্শনে অর্ধরাত্রি অথবা সারারাত্রি অনবরত বিলাপ করে শুষ্ক নদীর ন্যায় শুকীয়ে যাবে।”
ইহা শুনে স্থবির অতি কারুণ্য ও অচঞ্চল চিত্তে শ্রামণকে বললেন–“বন্ধু শ্রামণ, তুমি রোদন করোনা। আমিই তোমার জন্য জীবন ত্যাগ করব।” স্থবিরের এ বাক্য শুনে তুলক পণ্ডিত আপন চিত্ত দমন উদ্দেশ্যে স্বগত বললেন–“হে পণ্ডিত, তোমার কি বুদ্ধ শাসনই প্রিয়তর, না কি তুমিই তোমার প্রিয়তর?” তখন মহাসত্ত্ব এসিদ্ধান্তে উপনীত হলেন–আমা হতে বুদ্ধ শাসন শত-সহস্র গুণ প্রিয়তর।” এ চিন্তার পর রাজার নিকট গিয়ে অভিবাদনান্তে বললেন–“মহারাজ, এখন আমি শ্রামণের প্রতি অনুকম্পা করে তাঁর জীবন রক্ষা করব। তাঁর জীবনের পরিবর্তে আমার জীবনই পরিত্যাগ করব।” এবলে নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন
২৩। “শ্রামণের জীবনের পরিবর্তে আমার জীবনই ত্যাগ করব। মহারাজ, তাঁকে মুক্তি দিয়ে আমাকেই হত্যা করুন।”
ইহা শুনে রাজা তাঁকে বললেন–“হে পণ্ডিত, ইহা কি তুমি সত্যই বছ?” তুলক পণ্ডিত বললেন–”হাঁ দেব, আমি সত্যই বলছি। তখন রাজা সাধু বলে সম্মত হলেন। ইহাতে পণ্ডিত প্রমোদিত চিত্তে শ্রামণের নিকট গিয়ে বন্দনা করে তাঁকে পঞ্চবন্ধন হতে মুক্ত করে আকাশের দিকে চেয়ে নিতোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
২৪। “হে ভবৎ দেবগণ, এখানে সমাগত সবাই অনুমোদন করুন, শ্রামণের জন্যই আমার এজীবন দান।
২৫। এ দানপুণ্য প্রভাবে আমি অনাগতে নিশ্চয় বুদ্ধ হব এবং জনগণকে উত্তীর্ণ করব ও অমৃত পদ লাভ করাব।”
এবলে মহাসত্ব শ্রামণকে বললেন–“ভন্তে, আপনি শীল রক্ষা করুন কর্মস্থান ভাবনা করুন এবং মৈত্রী পরায়ণ হয়ে শ্ৰমণ ধর্ম পালন করুন। যথাসুখে চলে যান।” এবলে পঞ্চাঙ্গে বন্দনা করে সেখান হতে শ্রমণকে পাঠিয়ে দিলেন। তখন সে ঘাতকগণ তুলক পণ্ডিতকে পঞ্চবন্ধনে বন্ধন করলেন এবং প্রহার করতে করতে শ্মশানে নিয়ে আসলেন। পণ্ডিতের মাতা ব্রাহ্মণী এখবর শুনে উভয় হস্তে বক্ষে করাঘাত করে এলোকেশে। উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ পরায়ণা হয়ে ত্বরিত পদে এসে প্রিয় পুত্রকে পঞ্চবন্ধনে আবদ্ধ দেখে বললেন–“হে প্রিয় পুত্র, আমার নিকট আস,” এবলে বিলাপসুরে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২৬। “হায় হায় তাত, তোমার এখবর পেয়ে আমি অনাথিনী জীর্ণা ও দুর্বল হয়ে পড়েছি। অদ্যই আমার মৃত্যু হবে, পরদিনের কথা কীইবা বলবো। হে প্রাণপ্রতিম পুত্র আমি তোমার জন্য সমস্ত ধনই দিয়ে দেবো।”
মহাসত্ত্ব মাতার এরূপ বিলাপ শুনে বললেন–“মা, আপনি এরূপ বিলাপ করবেন না। আমি বুদ্ধ শাসনে জীবন দান করব।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২৭। “জগতে বুদ্ধোৎপত্তি বড় দুর্লভ। এরচেয়ে দুর্লভ বুদ্ধের ধর্ম। আমি এবিষয় সম্যভাবে জ্ঞাত হয়ে অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য জীবন ত্যাগ করব।”
একারণে পণ্ডিত স্বীয় মাতাকে নিবারণ করে বললেন–“মাত, আপনি এখান হতে ফিরে যান।” এবলে তিনি শূলকাষ্ঠের নিকটবর্তী হয়ে তা স্পর্শ করে বললেন–“হে শূলকাষ্ঠ, তুমি অপুণ্যবান। যেহেতু-মনুষ্যগণ বুদ্ধকে দান করার জন্য বৃক্ষের দ্বারা বিহার ও চংক্রমণাদি প্রস্তুত করেন। কিন্তু তুমি অপুণ্যবান, তাই এ অশুচী স্থান প্রাপ্তিই তোমার নিয়তি।” সে দিবসেই বোধিসত্ত্বের পিতা সুজাত ব্রাহ্মণ বহু স্বর্ণে নৌকা পরিপূর্ণ করে পাটলীপুত্র নগর হতে এসে চিন্ন নগরে প্রবেশ করলেন। তখন নগরবাসী জনগণ সুজাতকে দেখেই বললেন–“ভবৎ, আপনার তুলক পণ্ডিত স্বীয় জীবনকে তুচ্ছ মনে করে বুদ্ধ শাসনে জীবন দান দিয়ে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছেন। এখনি তাঁকে আমক শ্মশানে শূল-মস্তকে আরোপিত করা হবে।” ব্রাহ্মণ শুনিবামাত্রই কম্পিত হৃদয়ে ত্বরিত পদে আমক শ্মশানে গিয়ে পুত্রকে দেখে ঘাতককে বললেন– “ওহে, তোমরা আমার পুত্রকে বিনাশ করোনা। আমি এ পুত্রকে ছেড়ে ইহলোকে থাকতে পারবোনা। এখন আমি তাকে ক্রয় করে নিয়ে যাব। এবলে তিনি ত্বরিত গমনে রাজপ্রসাদে উপনীত হয়ে, রাজাপ্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বললেন–“মহারাজ, আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা করে আমার পুত্রকে বিনাশ করবেন না। আমি তাকে ক্রয় করে নেব।” ইহা শুনে রাজা বললেন–“হে ব্রাহ্মণ, যদি আপনার পুত্রকে মুক্ত করবার ইচ্ছা করেন, তা হলে তার দেহের সমপরিমাণ স্বর্ণ দিতে হবে। ব্রাহ্মণ ইহা শুনে রাজ-বাক্য অনুমোদন করে ত্বরিত গমনে নৌকা হতে বহু স্বর্ণ এনে রাজাকে দিলেন। রাজাও তুলক পণ্ডিতের দেহের সমপরিমাণ সুবর্ণ গ্রহণ করে পণ্ডিতকে ছেড়ে দিলেন। তখন ব্রাহ্মণ নিজের প্রিয় পুত্রকে সঙ্গে করে গৃহে উপস্থিত হলেন। তখন সংঘনায়ক নাগদীপক স্থবির ভিক্ষুদের এরূপ উপদেশ দিলেন–“বন্ধুগণ, আমরা সবাই এমহাশয় কুলপুত্রের দ্বারাই জীবন লাভ করেছি। আমাদের একান্তই অপ্রমত্ত ভাবে চল্তে হবে।” এবলে তাঁরা বত্রিশজন ভিক্ষু কোনও এক সীমায় একত্রিত হয়ে বিশ বৎসর বয়স্ক ঐ শ্রামণকে উপসম্পদা প্রদান করলেন। এখন তারা ভিক্ষু হলেন তেত্রিশ জন। তারা কোন এক নিরাপদ স্থানে এক এক জন এক এক বৃক্ষমূলে সমসীন হয়ে আধ্যক ধ্যানে মগ্ন হলেন এবং অচিরেই প্রতিসম্ভিদা সহ অরহত্ব ফল প্রাপ্ত হলেন। এ তেত্রিশজন অরহত সমাপত্তি উৎপাদন করে চীবর পরিধান ও পারুপণ করে পাত্র হস্তে ধ্যান বলে সূর্যের ন্যায় আকাশপথে গিয়ে গ্রামে পিণ্ডাচরণ করে এক বিহারে বাস করতে লাগলেন তাঁদের মধ্যে কেহ কেহ। আকাশেই চংক্রমণ করেন, কেহ কেহ আকাশেই স্থিত থাকেন, কেহ কেহ চন্দ্র সূর্যের নিকট গমন করেন, কেহ কেহ সুমেরু পর্বতের চূড়ায় গমন করেন। এসব ঋদ্ধিমান অরহত এরূপ নানাবিধ আশ্চর্য জনক ঋদ্ধি প্রকাশ করছিলেন। তখন চিন্ন রাজা স্বীয় নগরে উক্ত ভিক্ষুগণের অভূতপূর্ব আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অমাত্যকে বললেন–“ওহে এ চোরগণ আকাশ পথে এসে আমাদের হত্যা করবার ইচ্ছুক হয়েছে মনে হয়। এখন আমরা তাদের কি করতে পারি?” অমাত্য বললেন–“মহারাজ তা হলে আপনি তুলক পণ্ডিতকে ডেকে তা জিজ্ঞেস করুন।” তখনিই রাজা পণ্ডিতকে ডেকে বললেন–ভবৎ পণ্ডিত, সে চোরগণ আকাশ পথে এসে আমাদের বধ করবার ইচ্ছুক হয়েছে মনে হয়। এখন আমাদের প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা কর।” ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব প্রসন্ন বদনে বললেন–“মহারাজ, আপনি ভয় করবেন না। আমার এ প্রভুগণ আপনার দুঃখ উৎপাদন করতে আসেননি। অপিচ তারা নিজের মহাগুণ প্রকাশের জন্য এখানে আগমন করছেন।” এবলে রাজাকে আশ্বস্ত করে রাজপ্রাসাদে মহার্ঘ আসন সজ্জিত করে দীপ-ধূপ সুগন্ধি পুষ্প ও পুষ্প মাল্যে সুসজ্জিত করলেন। তৎপর তুলক পণ্ডিত কৃতাঞ্জলি হয়ে আকাশের দিকে নমস্কার করে বললেন–“ভন্তে, সুগত শ্রাবক অরহতগণ, আপনারা এখানে অবতরণ করুন।” তখন তুলক পণ্ডিতের অনুরোধে সে তেত্রিশজন অরহত ভিক্ষু আকাশ হতে অবতরণ করে রাজাঙ্গনে সুসজ্জিত মণ্ডপে উপনীত হয়ে সজ্জিত আসনে অনুক্রমে উপবেশন করলেন। সে সময় রাজা রাজ পরিষদ ও জনগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে অরহতগণকে বন্দনা করে একান্তে উপবেশন করলেন। তৎপর ভিক্ষুদের প্রধান নাগদীপক স্থবির রাজাকে ধর্মদেশনা করলেন–
২৮। “মহারাজ, যে ব্যক্তি চিন্তা না করে অন্যায় করে সে ব্যক্তির সে কাজ সর্বদা কুফল উৎপাদন করে এবং দুঃখে নিপাতিত করে।
২৯। রাজন্ যে ব্যক্তিগণ সর্বদা দোষজনক কাজ করে, সে কাজ সুফল দান করেনা, বরঞ্চ সর্বদা দুর্গতি প্রাপ্ত করায়।
৩০। যে ব্যক্তি বুদ্ধ ধর্ম ও সঙ্রে শরণ গ্রহণ করে, সে কখনো অপায়ে গমন করে না। সর্বদা স্বর্গেই গমন করে।
৩১। লোকাগ্র সম্যক সম্বুদ্ধই জগতে মঙ্গল নিদান। বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করলে সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত হয়।
৩২। বুদ্ধের দুর্দর্শনীয় গম্ভীর ধর্মই জগতে মহামঙ্গল সৃষ্টি করে। সে ধর্মের শরণ গ্রহণে সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত হয়।।
৩৩। দান গ্রহণের যােগ্য অনুত্তর সংঘই জগতের মঙ্গল দায়ক। সে সংঘের শরণাপন্ন হলে সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত হয়।
৩৪। রাজ যেমন সুক্ষেত্রে বীজ সুষ্ঠুরূপ বপিত হলে, তা নিশ্চয়ই অধিক পরিমাণে ফল প্রদান করে।
৩৫। রাজন্ সেরূপ বুদ্ধশাসনে কৃত কুশল কর্ম কাম্য-সুখ প্রদান করে।
৩৬। তদ্ধেতু পণ্ডিতগণ হইলোকে পুণ্যকর্ম সম্পাদনের পর ইহলোকেই সুখভোগ করে এবং অমৃত পদ প্রাপ্ত হয়।”
তখন রাজা স্থবিরের ধর্ম দেশনা শুনে রত্নয়ের প্রতি প্রসন্ন হয়ে সমগ্র নগরে ভেরী শব্দে ঘোষণা করালেন–“এ নগরে অবস্থানকারী জনগণ নিজের জীবন রক্ষা করতে ইচ্ছা করলে ত্রিরত্নের প্রতি প্রসন্ন হও এবং শ্রদ্ধা সহকারে সংঘরত্নে যথাশক্তি দান দাও।” তদবধি এ নগরে ঘাতক ও মিথ্যাদৃষ্টি লোক শূন্য হয়ে গেল। তৎপর রাজা তুলক পণ্ডিতকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন এবং পাপিষ্ট মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ণ ব্রাহ্মণকে রাজ্য হতে নির্বাসিত করলেন। তখনই অবীচি নরক হতে মহা অগ্নি-শিখা উত্থিত হয়ে পাপীষ্ট ব্রাহ্মণের দেহ দগ্ধ করল। তত্মুহূর্তে সে অবীচি মহানিরয়ে পতিত হয়ে মহাদুঃখে নিমগ্ন হল। রাজা নিজের গ্রাম-দ্বারে “চিন্নরাম” নামক একখানা মনোরম বিহার প্রস্তুত করে নাগদীপক স্থবিরকে দান করলেন। রাজা চিন্নারামে বাসকারী ভিক্ষুসংঘকে চতুপ্রত্যয় প্রদানে নিত্য সেবা পূজা করতে লাগলেন। তুলক পণ্ডিতও সে চিন্নরামে অবস্থানকারী স্থবির প্রমুখ সমস্ত ভিক্ষুগণকে মহাদান দিয়েছিলেন। নগরবাসীরাও সে বিহারে গিয়ে ভিক্ষুসংঘকে যথাশক্তি চীবর ও নানাবিধ দানীয় বস্তু দান দিতেন। এস্থবিরগণ তথায় যথায়ুষ্কাল অবস্থান করে বহুবিধ আশ্চর্য অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে অনুপাধিশেষ নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বাপিত হলেন। রাজা প্রমুখ মহাজনগণ কোনাগমন ভগবানের শাসন রক্ষার্থে চিরজীবন দান শীলাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ভগবান এ ধর্মদেশনা আরহণ করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, ইহা বড়ই আশ্চর্য যে-পূর্বেও আমি বোধিসত্ত্ব অবস্থায় এরূপ ধনও স্ত্রী, পুত্র, এমনকি জীবন পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছিলাম।” এবলে জাতক কথার পরিসমাপ্তি করে নিন্মোক্ত নয়টি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন—
৩৭। তখন যে পাপিষ্ঠ মিথ্যাদৃষ্টি ব্রাহ্মণ নিরয়ে প্রবেশ করেছিল, সে হল এখনকার দেবদত্ত।
৩৮। তুলক পণ্ডিতের পিতা সুজাত ব্রাহ্মণ হলেন আমার পিতা মহারাজ শুদ্ধোদন।
৩৯। তখন তুলক পণ্ডিতের মাতা-সুজাতা নামী ব্রাহ্মণী এখন আমার মাতা মহামায়া।
৪০। পণ্ডিতের পত্নী সম্ভারা নদী সুরূপা ব্রাহ্মণী এখন রাহুলমাতা যশোধরা।
৪১। তখন পণ্ডিতের পুত্র সুবচ আর অন্য কেহ নহে, সে-ই এখন আমার নুজ রাহুল।।
৪২। চিন্নরাজ্যের জনাধিপ চিন্ননামক রাজা এখন আমার সেবক আনন্দ।
৪৩। অমাত্যাদি প্রমুখ সমগ্র নগরবাসী জনগণ আমারই শাসন পরিপূর্ণকারী।।
৪৪। দানে রত তুলক পণ্ডিত নামক ব্রাহ্মণ এখন আমিই লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ।
৪৫। শ্রেষ্ঠ সুখ প্রার্থনাকারী সবাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(তুলক পণ্ডিত জাতক সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ