চাণক্য নীতি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

07 August, 2020

চাণক্য নীতি

চাণক্য নীতি
চাণক্য-নীতিসূত্রম্
চাণক্যের প্রধান পরিচয় অতিপ্রসিদ্ধ একজন প্রাচীন ভারতীয় কূটনীতিজ্ঞ হিসেবে। মানবজীবনের প্রায় সকল কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে তাঁর শ্লোকসমূহ শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকলের কাছেই অল্পবিস্তর পরিচিত। ভারতীয় বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে চাণক্যকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’-প্রণেতা কৌটিল্য আর ‘চাণক্যশ্লোক’ নামে প্রসিদ্ধ শ্লোকসমূহের রচয়িতা একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও চাণক্যের একাধিক নামের মধ্যে কৌটিল্যও অন্যতম।
তাঁর একাধিক নাম বিষয়ে হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-

‘বাৎস্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চ ণকাত্মজঃ।
দ্রামিলঃ পক্ষিলস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ।।’

চাণক্য তার্কিক ছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছে ‘পক্ষিল’। রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে তিনি ‘কৌটিল্য’। জ্যোতির্বিদ্যার ‘বিষ্ণুগুপ্তসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে তাঁর নাম বিষ্ণুগুপ্ত। কামশাস্ত্রের গ্রন্থ ‘কামসূত্র’ এবং ন্যায়সূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ ‘ন্যায়ভাষ্যে’র রচয়িতা হিসেবে নাম বাৎস্যায়ন। নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থে নাম চাণক্য। বিরাট যোদ্ধা হিসেবে নাম হয়েছে ‘মল্লনাগ’। তাঁর ডাক নাম ছিলো ‘খণ্ডদৎ’। মায়ের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে তিনি তাঁর একটি দাঁত উপড়ে ফেলেন বলে প্রবাদ চালু আছে।
.
তাঁর অবস্থিতিকাল কালিদাস যুগেরও আগে বলে ধারণা করা হয়। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর পণ্ডিত চাণক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো বিষ্ণুগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩)। কিন্তু জন্মগ্রাম ‘চানকা’ থেকে, মতান্তরে পিতার নাম ‘চানক’ থেকে, ‘চাণক্য পণ্ডিত’ হিসেবেই তিনি ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র।
.
চাণক্য ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কামন্দকের ‘নীতিসার’ গ্রন্থে এভাবে বলা হয়েছে-

‘বংশে বিশালবংশ্যানামৃষীণামিব ভূয়সাম্ ।
অপ্রতিগ্রাহকাণাং যো বভুব ভুবি বিশ্রুতঃ।।
অর্থাৎ : (চাণক্য) ঋষিদের মতো বিশাল এবং উচ্চবংশের অপ্রতিগ্রাহী ব্রাহ্মণগণের বংশে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
উপমহাদেশের উচ্চতর জ্ঞান আহরণের প্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপিঠ যেখানে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান পাকিস্তানের সেই তক্ষশীলায় তাঁর জন্ম এবং পরবর্তীতে তক্ষশীলা বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষাগুরুও ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে সেখানকার পরিবেশ তাঁর সহজাত প্রতিভাকে করে তুলেছে ক্ষুরধার প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল। ‘কূটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভুত ছিলেন বলে পরবর্তীতে গোত্র নামটিকে টিকিয়ে রাখার সদিচ্ছা থেকে ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম ধারণ করে লিপিবদ্ধ করেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’। কিন্তু এই ‘অর্থশাস্ত্র’ তো আর এমনি এমনি লিখিত হয়নি। এর পেছনের যে ইতিহাস, সেখানেই রয়ে গেছে একজন চাণক্য পণ্ডিত বিষ্ণুগুপ্তের কৌটিল্য হয়ে ওঠার ঘটনাবহুল পটভূমি।
.
চাণক্যের বিচিত্র জীবনকথা রবিনর্ত্তকের ‘চাণক্যকথা’, সোমদেবভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, কামন্দকের ‘নীতিসার’ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায় বলে জানা যায়। কিংবদন্তী আছে, মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। জরাসন্ধের রাজধানী ছিলো রাজগৃহ। জরাসন্ধের পর অনেকেই মগধের সিংহাসনে বসেন। অবশেষে রাজা হন মহাপদ্মনন্দ। তাঁর মহিষী রত্নাবলীর গর্ভে নন্দ প্রভৃতি আট পুত্রের জন্ম হয়। মুরা নামে মহাপদ্মনন্দের এক দাসী ছিলো। এই দাসীর গর্ভে মহাপদ্মনন্দের এক সন্তান ছিলো, নাম চন্দ্রগুপ্ত। মুরার পুত্র বলে চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরবর্তীতে ‘মৌর্য’ বংশ নামে খ্যাত হয়। মহাপদ্মনন্দের পুত্রদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তই জ্যেষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু দাসীর পুত্র হওয়ায় শেষপর্যন্ত তিনি পিতৃরাজ্য থেকে বঞ্চিত হন।
.
পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ধনানন্দ, যিনি তার অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাসাধারণের কাছে ভীষণ অপ্রিয় ছিলেন, একবার চাণক্যকে অপমান করেন বলে কিংবদন্তী আছে। মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রী শকটার উপর। তিনি চাণক্যকে মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার অনুরোধ জানান। সে অনুরোধ অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁকে তিরস্কার করে চুলের শিখা ধরে আসন থেকে তুলে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পণ্ডিত চাণক্য প্রথমে রুষ্ট না হয়ে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কোন প্রবোধ না মেনে অন্য লোক দ্বারা চাণক্যকে যথেষ্ট অপমান করেন। চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
.
এদিকে নন্দ রাজা ধনানন্দের সৎভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাত) পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র করেন। কারণ রাজা ধনানন্দ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর দাসীমাতা মুরা ও সৎভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। ঘটনাচক্রে চাণক্যের সাথে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের ক্ষণলগ্নই যে একটা বিশাল জাতিগোষ্ঠির ভাগ্যচাকার মোড় ঘুরিয়ে চিরকালের নতুন বাঁক তৈরি করে দেবে তা কে জানতো। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। অতঃপর চানক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরুর সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে শেষপর্যন্ত নন্দরাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য়েরই দ্বিতীয় পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক।
.
শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উৎখাতের পেছনে চাণক্যের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও কুশলী কর্মকাণ্ড অসাধারণ কৃতিত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। এবং তাঁর অবদানেই সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পঞ্চম শতাব্দিতে রচিত প্রাচীন নাট্যকার বিশাখদত্তের শতশত বছর জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ নন্দবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে চন্দ্রগুপ্তের বিশাল মৌর্যসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে বলে জানা যায়।
.
তবে এতৎবিষয়ক তথ্যসূত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যেটিকে বিবেচনা করা হয়, তা হলো গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে অবস্থান করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেন। এখান থেকেই জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহন করেই পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই ছিলো পাটালিপুত্রের অবস্থান। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিলো। প্রজাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিলো সমৃদ্ধিতে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছিলো চন্দ্রগুপ্তের জীবনে স্বর্গীয় দূতের মতো অভিভাবক হয়ে আসা সত্যিকারের বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু চাণক্যের কারণে।
.
জানা যায়, এর আগে মহামতি আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিকার নিয়ে আলেকজান্ডারের দুই সেনাপতির তুমুল বিবাদ হয়। এ সুযোগে গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয়, গুরু চাণক্যের পরামর্শে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরবর্তীতে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য একে একে জয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য তিনি একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে চাণক্যকে প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন।
.
চন্দ্রগুপ্তের অতি-নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন যাপনের অবারিত সুযোগ থাকার পরও, কথিত আছে যে, চাণক্য এক শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস জীবন-যাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি শিষ্যবর্গকে রাজ্যশাসন কৌশল শিক্ষাসহ নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে জ্ঞান দান করতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তাঁর অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহিত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। দু’হাজারেরও অধিক বছরের কাল পরিক্রমায় এসেও চাণক্য নীতি শ্লোকগুলো এখনো যে গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি, এখানেই ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে চাণক্যের অভূতপূর্ব দার্শনিক প্রাজ্ঞতা প্রমাণীত। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চাণক্যের খ্যাতি অপরিমেয়। সিদ্ধান্তে অটল তাঁর কাছে অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিলো না। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।
.
কালজয়ী গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসকের প্রতি পরামর্শ হিসেবে চাণক্যের কিছু বাণীকে দু’হাজার বছরের এতো দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এখনো অসম্ভব সমকালীন মনে হয়-
“যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।”
.
“সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চব্বিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজকর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করে বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব; কিন্তু রাজকর্মচারির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।”

.
যুগে যুগে প্রজাবৎসল শাসককূলের উত্তম শাসনকার্যের সবচাইতে প্রাচীন ও অসাধারণ সহায়িকা হিসেবে রচিত ধর্ম-দর্শন-ন্যায়পরায়ণতা-কূটনীতি-অর্থনীতি-রাষ্ট্রনীতির আকর-গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-কে তৎকালীন প্রজাহিতৈষী মৌর্য শাসকরা যে হেলাফেলা করেননি তা বুঝা যায় চাণক্য-সহায়তায় মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের চব্বিশ বছরের শাসনকালের পরও দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারা’র জনপ্রিয়তা যাচাই করলে। তারও পরে এই মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের শাসনকাল তো প্রতীকী স্থায়িত্ব পেয়ে আছে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামে প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের দৃশ্যমান অবস্থিতিতে।
.
চাণক্য-নীতিশাস্ত্র
ইয়মিদানীমাচার্যবিষ্ণুগুপ্তেন মৌর্যার্থে ষড্ভিশ্শ্লোকসহস্রৈসসংক্ষিপ্তা’।– ‘দশকুমার-চরিত’ গ্রন্থের এই শ্লোকটি থেকে জানা যায় যে, চাণক্য বিষ্ণুগুপ্ত রচিত নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থ ছয় হাজার শ্লোকসমন্বিত ছিলো।
চাণক্যের এই শ্লোকসমূহ এতোই প্রসিদ্ধ ছিলো যে পরবর্তীকালের পণ্ডিতেরা স্বেচ্ছানুসারে শ্লোক নির্বাচন করে ‘বৃদ্ধ-চাণক্য’, ‘বোধিচাণক্য’, ‘লঘুচাণক্য’ প্রভৃতি নামে একাধিক গ্রন্থে পরিণত করেন বলে জানা যায়। প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্য গবেষকরা চাণক্যশ্লোকের বহু সংস্করণের কথা বললেও অন্তত ছয়টি সংস্করণ স্বীকৃত। এগুলো হচ্ছে- ‘বৃদ্ধচাণক্য’ (অলংকৃত), ‘বৃদ্ধচাণক্য’ (সরল), ‘চাণক্যনীতিশাস্ত্র’, ‘চাণক্যসংগ্রহ’, ‘লঘুচাণক্য’ এবং ‘চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র’। তবে এই নামকরণ যে প্রাচীনসম্মত নয়, পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতেই এরকম করা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
.
‘চাণক্যনীতিশাস্ত্র’ গ্রন্থটি বাছাই করা মাত্র একশ’ আটটি শ্লোক সম্বলিত। তবে চাণক্যের নামে চালু থাকলেও এর মধ্যে কোনগুলি প্রকৃতই চাণক্যের রচনা তা বলা দুঃসাধ্য। কারণ প্রসিদ্ধির কারণে যে-কোন সুভাষিত শ্লোকই চাণক্যশ্লোক বলে লোকে ধারণা করতো। ফলে অন্যান্য বহু পণ্ডিতের সুভাষিত শ্লোক যে প্রক্ষিপ্তভাবে অনেককাল আগেই ‘চাণক্যশ্লোকে’র অন্তর্গত হয়ে গেছে এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। অনেক ক্ষেত্রে মূল শ্লোকের অনুকরণে লেখা কোন মনোরম শ্লোক যে মূলকে অপসারণ করে নি তাও নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
.
সংস্কৃত কাব্যে অনুষ্টুপ ছন্দেরই অপর নাম শ্লোক। এই অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত ‘চাণক্যনীতিশাস্ত্রে’র শ্লোকের সংখ্যা ১০৮টি হলেও আলোচ্য বিষয়বস্তু অনেক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্ডিত কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে সর্বক্ষেত্রে শ্লোকের ক্রমও সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি বলে শ্লোকগুলো বিষয়ানুগ শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়।  গ্রন্থটির বিচিত্র বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যা বিদ্বান-শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত-প্রশংসা, মূর্খ-নিন্দা, সুপুত্র-প্রশংসা, কুপুত্র-নিন্দা, সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য, প্রকৃত বন্ধু এবং ছদ্ম বন্ধুর পার্থক্য নির্ণয়, দুর্জনের স্বরূপ এবং নিন্দা, সুজনের স্বরূপ এবং প্রশংসা, বিভিন্ন জীবিকায় নিযোজ্য লোকের যোগ্যতানির্দেশ, পরিবর্জনীয় বিষয়, স্ত্রীচরিত্রের দুর্বলতা নির্দেশ, অর্থকৌলীন্য এবং দারিদ্র্যনিন্দা, জীবন চলার পথে একান্ত অভিলষিত কিন্তু দুর্লভ বিষয়ক নির্দেশ ইত্যাদি সহ বহু বিষয়।
.
‘চাণক্যনীতিশাস্ত্রে’র শ্লোকগুলোর অধিকাংশই চিরন্তন মূল্যবোধের দ্বারা প্রণোদিত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটাও পরিলক্ষিত হয় যে গ্রন্থকার শেষপর্যন্ত সমাজের উর্ধ্বে নন। তৎকালীন সমাজের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিই চাণক্যের শ্লোকসমূহে প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমান চিন্তাধারায় এর কিছু কিছু অনভিপ্রেত হলেও চাণক্য যে তাঁর সময়ে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক শ্রেণীরই প্রতিনিধি ছিলেন সেটাও ভুলে গেলে চলবে না।
। ০১।
বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।।
অর্থাৎ : বিদ্যাবত্তা এবং রাজপদ কখনোই সমান হয় না। রাজা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যেই সম্মান পান, বিদ্বান (স্বদেশ-বিদেশ) সর্বত্র সম্মান পান।
.
। ০২।
পণ্ডিতে চ গুণাঃ সর্বে মূর্খে দোষা হি কেবলম্ ।
তস্মান্মূর্খসহস্রেভ্যঃ প্রাজ্ঞ একো বিশিষ্যতে।।
অর্থাৎ : পণ্ডিত ব্যক্তি সকল গুণের আর মূর্খ ব্যক্তি সকল দোষের আধার- এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সহস্র মূর্খ অপেক্ষা একজন পণ্ডিত বিশিষ্ট বা অধিকতর গ্রাহ্য রূপে পরিগণিত হন।
.
। ০৩।
মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্টবৎ।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি পরের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে দেখেন, পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মতো জ্ঞান করেন (অর্থাৎ নির্লোভ থাকেন) এবং সকল জীবে আত্মজ্ঞান পোষণ করেন- তিনিই যথার্থ জ্ঞানী।
.
। ০৪।
কিং কুলেন বিশালেন গুণহীনস্তু যো নরঃ।
অকুলীনোহপি শাস্ত্রজ্ঞো দৈবতৈরপি পূজ্যতে।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি গুণহীন, তার উচ্চবংশে জন্মগ্রহণেও সার্থকতা কোথায় ? বিপরীতপক্ষে, যিনি শাস্ত্রজ্ঞ, তিনি উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ না করলেও দেবতাদের দ্বারা পূজিত (সমাদৃত) হন।
.
। ০৫।
রূপযৌবনসম্পন্না বিশালকুলসম্ভবাঃ।
বিদ্যাহীনা ন শোভন্তে নির্গন্ধা ইব কিংশুকাঃ।।
অর্থাৎ : বিদ্যাহীন পুরুষ রূপযৌবনযুক্ত অথবা উচ্চবংশজাত হলেও গন্ধহীন পলাশ ফুলের মতো সমাদর লাভে সক্ষম হন না।
.
। ০৬।
নক্ষত্রভূষণং চন্দ্রো নারীণাং ভূষণং পতিঃ।
পৃথিবীভূষণং রাজা বিদ্যা সর্বস্য ভূষণম্ ।।
অর্থাৎ : চাঁদ তারকাদের অলঙ্কার, স্বামী নারীর অলঙ্কার, রাজা পৃথিবীর অলঙ্কার আর বিদ্যা সকলজনের অলঙ্কার।
.
। ০৭।
মাতা শত্রুঃ পিতা বৈরী যেন বালো ন পাঠিতঃ।
ন শোভতে সভামধ্যে হংসমধ্যে বকো যথা।।
অর্থাৎ : যে পিতামাতা তাঁদের পুত্রকে যথাযোগ্য শিক্ষা প্রদান করেননি, সেই পুত্রের কাছে মাতা এবং পিতা শত্র“রূপে পরিগণিত হন। কেননা হাঁসের মধ্যে বক যেমন শোভা পায় না, তেমনি সেই পুত্রও বিদ্বৎসমাজে স্থান পায় না।
.
। ০৮।
বরমেকো গুণী পুত্রো ন চ মূর্খশতৈরপি।
একশ্চন্দ্রস্তমো হন্তি ন চ তারাগণোহপি তৎ।।
অর্থাৎ : (বহু মূর্খ পুত্রের তুলনায়) একটিমাত্র গুণবান পুত্র তুলনামূলকভাবে ভালো, কেননা শত মূর্খ পুত্রেও কোন কাজ হয় না। একটিমাত্র চন্দ্রই (রাতের) অন্ধকার দূর করে, অসংখ্য তারা তা পারে না।
.
। ০৯।
লালয়েৎ পঞ্চ বর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ।।
অর্থাৎ : সন্তানের পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত তাকে (পিতামাতা) স্নেহে প্রতিপালন করবেন, তারপরের দশ বৎসর তাকে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদান করে (শিক্ষা দেবেন) এবং পুত্রের ষোল বৎসর বয়স হলে তার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবেন।
.
। ১০।
লালনে বহবো দোষাস্তাড়নে বহবো গুণাঃ।
তস্মাৎ পুত্রঞ্চ শিষ্যঞ্চ তাড়য়েন্ন তু লালয়েৎ।।
অর্থাৎ : (শৈশব অর্থাৎ জন্মাবধি পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে) অকারণে স্নেহ প্রদর্শন করলে অনেক দোষের সৃষ্টি হয়, উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করলে কিন্তু বহু গুণের জন্ম হয়। সুতরাং পুত্র এবং শিষ্যকে যেন যথাযোগ্য শাসন করা হয়, অতিরিক্ত স্নেহ দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
.
। ১১।
একেনাপি সুবৃক্ষেণ পুষ্পিতেন সুগন্ধিনা।
বাসিতং স্যাদ্ বনং সর্বং সুপুত্রেণ কুলং যথা।।
অর্থাৎ : যেমন সুগন্ধ ফুলে ভরা একটিমাত্র গাছের দ্বারাই সমগ্র বনভূমি (সুগন্ধে) আমোদিত হয়, তেমনি একটিমাত্র সুপুত্রের দ্বারা সমগ্র বংশ গৌরবান্বিত হয়।
.
। ১২।
একেনাপি কুবৃক্ষেণ কোটরস্থেন বহ্নিনা।
দহ্যতে তদ্বনং সর্বং কুপুত্রেণ কুলং যথা।।
অর্থাৎ : যেমন একটিমাত্র কুবৃক্ষের কোটরের আগুনের দ্বারা সেই সমগ্র বন দগ্ধ হয়, তেমনি একটিমাত্র কুপুত্রের দ্বারা সমগ্র কুল কলঙ্কিত হয়।
.
। ১৩।
দূরতঃ শোভতে মূর্খো লম্বশাটপটাবৃতঃ।
তাবচ্চ শোভতে মূর্খো যাবৎ কিঞ্চি ন্ন ভাষতে।।
অর্থাৎ : মূর্খ ব্যক্তি দীর্ঘ পোশাক পরিচ্ছদে ভূষিত হয়ে দূর থেকেই শোভা পায়, যতক্ষণ পর্যন্ত মূর্খ কোন কথা না বলে ততক্ষণই শোভা পায়, (কথা বললেই তার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে)।
.
। ১৪।
বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহ্যমমেধ্যাদপি কাঞ্চ নম্ ।
নীচাদপ্যুত্তমাং বিদ্যাং স্ত্রীরতœং দুষ্কুলাদপি।।
অর্থাৎ : অমৃত বিষ থেকেও গ্রহণ করা চলে, সোনা অশুচি স্থল থেকেও গ্রহণ করা চলে, শ্রেষ্ঠ বিদ্যা নীচ ব্যক্তির কাছ থেকেও গ্রহণ করা চলে, রমণীশ্রেষ্ঠা নীচ কুল থেকেও গ্রহণ করা চলে।
.
। ১৫।
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে শত্র“বিগ্রহে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি আনন্দানুষ্ঠানে, বিপদকালে, আকালের সময়, শত্র“র সঙ্গে সংগ্রামকালে, বিচারালয়ে (অর্থাৎ মামলা-মোকদ্দমা চলাকালীন সাক্ষ্যাদির প্রয়োজনে) এবং শবদাহকালে (পাশে) উপস্থিত থাকেন, তিনিই প্রকৃত বন্ধু।
.
। ১৬।
পরোক্ষে কার্যহন্তারং প্রত্যক্ষে প্রিয়বাদিনম্ ।
বর্জয়েৎ তাদৃশং মিত্রং বিষকুম্ভং পয়োমুখম্ ।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি সাক্ষাতে মিষ্ট কথা বলে কিন্তু অসাক্ষাতে কাজের ক্ষতি করে, সেরকম মুখে মধু অন্তরে বিষ বন্ধুকে ত্যাগ করা উচিত।
.
। ১৭।
সকৃদ্ দুষ্টঞ্চ মিত্রং যঃ পুনঃ সন্ধাতুমিচ্ছতি।
ম মৃত্যুমুপগৃহ্নাতি গর্ভমশ্বতরী যথা।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি একবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে এমন বন্ধুর সঙ্গে পুনরায় বন্ধুত্ব কামনা করে সে প্রকৃতপক্ষে কাঁকুড়লতার গর্ভধারণের মতো নিজের মৃত্যু ডেকে আনে।
.
। ১৮।
ন বিশ্বসেদবিশ্বস্তে মিত্রে চাপি ন বিশ্বসেৎ।
কদাচিৎ কুপিতং মিত্রং সর্বং দোষং প্রকাশয়েৎ।।
অর্থাৎ : অবিশ্বাসীকে কখনো বিশ্বাস করবে না এবং বন্ধুকেও (অতিরিক্ত) বিশ্বাস করবে না। কেননা, বন্ধু কখনো (কোনো কারণে) ক্ষুব্ধ হলে সে (তোমার) সকল দোষ অন্যের কাছে প্রকাশ করে দিতে পারে।
.
। ১৯।
জানীয়াৎ প্রেষণে ভৃত্যান্ বান্ধবান্ ব্যসনাগমে।
মিত্রঞ্চাপদি কালে চ ভার্যাঞ্চ বিভবক্ষয়ে।।
অর্থাৎ : ভৃত্যের যথার্থ স্বরূপ তাঁর কাজের মাধ্যমে জানবে, বন্ধুর যথার্থ স্বরূপ রোগাদি বিপদের সময়ে জানবে। মিত্রের যথার্থ স্বরূপ উপদ্রব উপস্থিত হলে জানবে এবং ধনসম্পত্তি নাশের কালে স্ত্রীর যথার্থ স্বরূপ জানবে।
.
। ২০।
উপকারগৃহীতেন শত্র“ণা শত্র“মুদ্ধরেৎ।
পাদলগ্নং করস্থেন কণ্টকেনেব কণ্টকম্ ।।
অর্থাৎ : হাতের কাঁটা দিয়ে যেমন পায়ে বেঁধা কাঁটা তোলা হয় তেমনি তোমার উপকার গ্রহণ করেছে এমন শত্র“ দিয়ে অন্য শত্র“কে উচ্ছেদ করবে।
.
। ২১।
ন কশ্চিৎ কস্যচিন্মিত্রং ন কশ্চিৎ কস্যচিদ্রিপুঃ।
কারণেন হি জানাতি মিত্রানি চ রিপূংস্তথা।।
অর্থাৎ : (অকারণে) কেউ কারো মিত্রও হয় না, শত্র“ও হয় না। কারণবশতঃই (ব্যবহার প্রভৃতি দ্বারাই) কেউ কারো মিত্র বা শত্র“ বলে পরিগণিত হয়ে থাকে।
.
। ২২।
দুর্জনঃ প্রিয়বাদী চ বৈতদ্বিশ্বাসকারণম্ ।
মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে হৃদয়ে তু হলাহলম্ ।।
অর্থাৎ : দুর্জন ব্যক্তি মিষ্টভাষী হলেও তা বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। কেননা, তার জিভের ডগায় থাকে মধু- আর অন্তরে থাকে তীব্র বিষ।
.
। ২৩।
দুর্জনঃ পরিহর্তব্যো বিদ্যয়ালংকৃতোহপি সন্ ।
মণিনা ভূষিতঃ সর্পঃ কিমসৌ ন ভয়ঙ্করঃ।।
অর্থাৎ : দুর্জন ব্যক্তি বিদ্যায় বিভূষিত হলেও তাকে ত্যাগ করা উচিত। কোনো সাপ মণিতে ভূষিত হলেও তা ভয়ঙ্করই থাকে।
.
। ২৪।
সর্পঃ ক্রূরঃ খলঃ ক্রূরঃ সর্পাৎ ক্রূরতরঃ খলঃ।
মন্ত্রৌষধিবশঃ সর্পঃ খলঃ কেন নিবার্যতে।।
অর্থাৎ : সাপের স্বভাব ক্রূর (নৃশংস)- দুর্জনেরও তাই। তবে দুর্জন সাপের চাইতেও বেশি ক্রূর। কেননা, সাপকে মন্ত্র কিংবা ওষধি দ্বারা বশে আনা যায়- কিন্তু দুর্জনকে কে নিবৃত্ত করবে ?
.
। ২৫।
নখিনাঞ্চ নদীনাঞ্চ শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাম্ ।
বিশ্বাসো নৈব কর্ত্তব্যঃ স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ।।
অর্থাৎ : নখযুক্ত প্রাণী, নদী, শিং আছে এমন প্রাণী, শস্ত্রধারী পুরুষ, নারী এবং রাজপুরুষকে কখনও বিশ্বাস করা উচিত নয়।
.
। ২৬।
হস্তী হস্তসহস্রেণ শতহস্তেন বাজিনঃ।
শৃঙ্গিনো দশহস্তেন স্থানত্যাগেন দুর্জনঃ।।
অর্থাৎ : হাতী থেকে হাজার হাত দূরে থাকবে, ঘোড়া থেকে একশ’ হাত দূরে থাকবে, শিংওয়ালা প্রাণী থেকে দশ হাত দূরে থাকবে আর দুর্জন লোক কাছে এলে সেই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে।
.
। ২৭।
আপদর্থং ধনং রক্ষেদ্ দারান্ রক্ষেদ্ধ নৈরপি।
আত্মানং সততং রক্ষেদ্ দারৈরপি ধনৈরপি।।
অর্থাৎ : বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ধন-সম্পত্তি রক্ষা করবে, ধন সম্পত্তির বিনিময়েও স্ত্রীকে রক্ষা করবে, স্ত্রী বা ধন-সম্পত্তির বিনিময়েও নিজেকে সকল সময় রক্ষা করবে।
.
। ২৮।
পরদারান্ পরদ্রব্যং পরীবাদং পরস্য চ।
পরিহাসং গুরোঃ স্থানে চাপল্যঞ্চ বিবর্জয়েৎ।।
অর্থাৎ : পরের স্ত্রী, পরের জিনিস, পরনিন্দা, অন্যের প্রতি উপহাস এবং গুরুজনের সামনে চপলতা পরিত্যাগ করবে।
.
। ২৯।
ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জন পদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীন্ত্যজেৎ।।
অর্থাৎ : কুল রক্ষার জন্য একজনকে ত্যাগ করা চলে, গ্রাম রক্ষার ন্য কুল ত্যাগ করা চলে, দেশ রক্ষার জন্য একটি গ্রাম ত্যাগ করা চলে আর নিজেকে রক্ষার জন্য (সমগ্র) পৃথিবী ত্যাগ করা চলে।
.
। ৩০।
চলত্যেকেন পাদেন তিষ্ঠত্যেকেন বুদ্ধিমান্ ।
নাহসমীক্ষ্য পরং স্থানং পূর্বমায়তনং ত্যজেৎ।।
অর্থাৎ : বুদ্ধিমান ব্যক্তি একপায়ে চলেন, আরেক পায়ে স্থির থাকেন। পরের জায়গা না দেখে আগের জায়গা ছাড়া উচিত নয়।
.
। ৩১।
লুব্ধমর্থেন গৃহ্নীয়াৎ ক্রুদ্ধমঞ্জলিকর্মণা।
মূর্খং ছন্দোহনুবৃত্তেন তথা তথ্যেন পণ্ডিতম্ ।।
অর্থাৎ : লোভীকে টাকা-পয়সা দিয়ে, ক্রুদ্ধকে হাত জোড় করে, মূর্খকে তার মন জুগিয়ে এবং পণ্ডিতকে যথার্থ কথা বলে বশীভূত করবে।
.
। ৩২।
অর্থনাশং মনস্তাপং গৃহে দুশ্চরিতানি চ।
বঞ্চ নঞ্চাপমানঞ্চ মতিমান্ ন প্রকাশয়েৎ।।
অর্থাৎ : প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ধনক্ষয়, মনঃকষ্ট, নিজ বাড়ির অনাচার, বঞ্চনা এবং অপমানের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করবেন না।
.
। ৩৩।
ধনধান্যপ্রয়োগেষু তথা বিদ্যাগমেষু চ।
আহারে ব্যবহারে চ ত্যক্তলজ্জসদা ভবেৎ।।
অর্থাৎ : সম্পত্তি এবং শস্য প্রভৃতির ক্রয়-বিক্রয় অথবা এই সব জিনিস ধার দিয়ে সুদের আদান-প্রদানের সময়, বিদ্যার্জনের সময়, খাওয়ার সময় এবং মামলা-মোকদ্দমার সময় সর্বদা লজ্জাশূন্য হওয়া উচিত (অর্থাৎ এইসব ব্যাপারে লজ্জা করা উচিত নয়)।
.
। ৩৪।
ধনিনঃ শ্রোত্রিয়ো রাজা নদী বৈদ্যস্তু পঞ্চ মঃ।
পঞ্চ যত্র ন বিদ্যন্তে তত্র বাসং ন কারয়েৎ।।
অর্থাৎ : ধনবান ব্যক্তি, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, রাজা, নদী এবং পঞ্চমতঃ (চিকিৎসক) বৈদ্য- এই পাঁচজন যে দেশে বাস করেন না সেই দেশে বসবাস করা উচিত নয়।
.
। ৩৫।
যস্মিন্ দেশে ন সম্মানো ন বৃত্তির্ন চ বান্ধবাঃ।
ন চ বিদ্যাগমঃ কশ্চিৎ তং দেশং পরিবর্জয়েৎ।।
অর্থাৎ : যে দেশে (গুণীর) সম্মান নেই, জীবিকার ব্যবস্থা নেই, কোন বন্ধু নেই এবং বিদ্যার্জনের কোন ব্যবস্থা নেই- সেই দেশ পরিত্যাগ করা উচিত।
.
। ৩৬।
মনসা চিন্তিতং কর্ম বচসা ন প্রকাশয়েৎ।
অন্যলক্ষিতকার্যস্য যতঃ সিদ্ধিঃ ন জায়তে।।
অর্থাৎ : কাজের পরিকল্পনা মনে থাকবে- তা মুখে যেন প্রকাশ না পায়। কেননা, যে কাজের কথা অন্য লোক আগেই জেনে ফেলে- সেই কাজে সাফল্য আসে না।
.
। ৩৭।
কুদেশঞ্চ কুবৃত্তিঞ্চ কুভার্যাং কুনদীম্ তথা।
কুদ্রব্যঞ্চ কুভোজ্যঞ্চ বর্জয়েচ্চ বিচক্ষণঃ।।
অর্থাৎ : বিচক্ষণ ব্যক্তি (রোগ-দুর্ভিক্ষ-পীড়িত) খারাপ দেশ, (চুরি প্রভৃতি) নিন্দনীয় জীবিকা, দুশ্চরিত্রা (অথবা রুগ্না) স্ত্রী, খারাপ নদী, খারাপ দ্রব্য এবং খারাপ আহার্য বর্জন করবেন।
.
। ৩৮।
ঋণশেষোহগ্নিশেষশ্চ ব্যাধিশেষস্তথৈব চ।
পুনশ্চ বর্দ্ধতে যস্মাৎ তস্মাচ্ছেষং ন কারয়েৎ।।
অর্থাৎ : যেহেতু ঋণের অবশেষ, আগুনের অবশেষ, রোগের অবশেষ পুনরায় বাড়ে, সেহেতু এগুলির অবশেষ রাখবে না।
.
। ৩৯।
চিন্তা জ্বরো মনুষ্যাণাং বস্ত্রাণামাতপো জ্বরঃ।
অসৌভাগ্যং জ্বরঃ স্ত্রীণাম্ অশ্বানাং মৈথুনং জ্বরঃ।।
অর্থাৎ : মানুষের জ্বর চিন্তা, প্রখর সূর্যতাপ কাপড়ের জ্বর, স্ত্রীর জ্বর স্বামীর সোহাগ না পাওয়া আর মৈথুন অশ্বের জ্বর।
.
। ৪০।
অস্তি পুত্রো বশে যস্য ভৃত্যো ভার্যা তথৈব চ।
অভাবে সতি সন্তোষঃ স্বর্গস্থোহসৌ মহীতলে।।
অর্থাৎ : যাঁর পুত্র, ভৃত্য, স্ত্রী বশে আছে, অভাবের মধ্যেও যিনি প্রসন্ন থাকেন- তিনি এই পৃথিবীতে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে স্বর্গে আছেন।
.
। ৪১।
দুষ্টা ভার্যা, শঠং মিত্রং ভৃত্যশ্চোত্তরদায়কঃ।
সসর্পে চ গৃহে বাসো মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ।।
অর্থাৎ : যাঁর স্ত্রী দুশ্চরিত্রা, বন্ধু প্রতারক, ভৃত্য মুখে মুখে উত্তর করে এবং যিনি সর্পযুক্ত গৃহে বাস করেন- তাঁর মৃত্যু অবধারিত- এ ব্যাপারে সংশয় নেই।
.
। ৪২।
মাতা যস্য গৃহে নাস্তি ভার্যা চ অপ্রিয়বাদিনী।
অরণ্যং তেন গন্তব্যং যথারণ্যং তথা গৃহম্ ।।
অর্থাৎ : যার ঘরে মা নেই অথবা যার স্ত্রী রুক্ষভাষিণী- তার বনে যাওয়া উচিত। কেননা তার পক্ষে বনও যা ঘরও তা-ই।
.
। ৪৩।
ঋণকর্তা পিতা শত্রুঃ মাতা চ ব্যভিচারিণী।
ভার্যা রূপবতী শত্রুঃ পুত্রঃ শত্রুরপণ্ডিতঃ।।
অর্থাৎ : ঋণী পিতা, দুশ্চরিত্রা মাতা, অতিরূপবতী স্ত্রী এবং মূর্খ পুত্র শত্রুরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে।
.
। ৪৪।
অবিদ্যং জীবনং শূন্যং দিক্ শূন্যা চেদবান্ধবা।
পুত্রহীনং গৃহং শূন্যং সর্বশূন্যা দরিদ্রতা।।
অর্থাৎ : বিদ্যাহীনের জীবন শূন্য, বন্ধুহীনের (সকল) দিক শূন্য, পুত্রহীনের গৃহ শূন্য আর দরিদ্রের সকলই শূন্য।
.
। ৪৫।
কোকিলানাং স্বরো রূপম্ নারীরূপং পতিব্রতম্ ।
বিদ্যা রূপং কুরূপাণাং ক্ষমা রূপং তপস্বিনাম্ ।।
অর্থাৎ : কোকিলের কণ্ঠস্বরই তার রূপ, পাতিব্রত্যই স্ত্রীর রূপ, কুৎসিত পুরুষের বিদ্যাই রূপ এবং তপস্বীদের ক্ষমাই রূপ (বলে গণ্য হয়ে থাকে)।
.
। ৪৬।
অদাতা বংশদোষেণ কর্মদোষাদ্ দরিদ্রতা।
উন্মাদো মাতৃদোষেণ পিতৃদোষেণ মূর্খতা।।
অর্থাৎ : বংশের দোষে কৃপণ হয়, কর্মের দোষে দরিদ্র হয়, মাতার দোষে (মায়ের বংশের ধারাবাহিকতা বশতঃ) পাগল হয় এবং পিতার দোষে মূর্খ হয়।
.
। ৪৭।
গুরুরগ্নির্দ্বিজাতীনাং বর্ণানাং ব্রাহ্মণো গুরুঃ।
পতিরেকো গুরুঃ স্ত্রীণাং সর্বত্রাভ্যাগতো গুরুঃ।।
অর্থাৎ : আগুন দ্বিজাতির (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের) গুরু, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের) গুরু, নারীদের স্বামীই একমাত্র গুরু এবং সকলের পক্ষেই অতিথি গুরু।
.
। ৪৮।
অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ।
অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তগর্হিতম্ ।।
অর্থাৎ : অতিরিক্ত অহঙ্কারে লঙ্কা নগরী বিনষ্ট হয়েছিলো, অতিরিক্ত অভিমানের কারণে কৌরবেরা বিনষ্ট হয়েছিলো, অতিরিক্ত দানের ফলে (রাজা) বলি সত্যে আবদ্ধ হয়েছিলেন, কোন কিছুরই অতিরিক্ত ভালো নয় (অর্থাৎ সব কিছুরই বাড়াবাড়ি পরিণামে অমঙ্গলের হয়)।
.
। ৪৯।
বস্ত্রহীনস্ত্বলঙ্কারো ঘৃতহীনঞ্চ ভোজনম্ ।
স্তনহীনা চ যা নারী বিদ্যাহীনঞ্চ জীবনম্ ।।
অর্থাৎ : (উপযুক্ত) পরিচ্ছদ ছাড়া অলঙ্কার শোভা পায় না, ঘৃত বিহীন আহার সুখকর হয় না, যে নারীর (সুন্দর) স্তন নাই- সে নারী শোভা পায় না, বিদ্যাহীন জীবনও নিরর্থক।
.
। ৫০।
ভোজ্যং ভোজনশক্তিশ্চ রতিশক্তির্বরস্ত্রিয়ঃ।
বিভবো দানমক্তিশ্চ নাল্পস্য তপসঃ ফলম্ ।।
অর্থাৎ : আহার্য দ্রব্য এবং তা গ্রহণের ক্ষমতা (হজম শক্তি) থাকা, কামোপভোগের ক্ষমতা এবং সুন্দরী স্ত্রী থাকা, ধন-সম্পত্তি এবং দানের ইচ্ছা থাকা- এসব অল্প তপস্যার ফল নয়।
.
। ৫১।
পুত্রপ্রয়োজনা দারাঃ পুত্রঃ পিণ্ড প্রয়োজনঃ।
হিতপ্রয়োজনং মিত্রং ধনং সর্বপ্রয়োজনম্ ।।
অর্থাৎ : পুত্রের জন্য (বিবাহিতা) স্ত্রীর প্রয়োজন, (পিতৃপুরুষের) পিণ্ডদানের জন্য পুত্রের প্রয়োজন, হিতসাধনের জন্য বন্ধুর প্রয়োজন আর সব কিছুর জন্যই ধনের প্রয়োজন।
.
। ৫২।
দুর্লভং প্রাকৃতং বাক্যং দুর্লভঃ ক্ষেমকৃৎ সুতঃ।
দুর্লভা সদৃশী ভার্যা দুর্লভঃ স্বজনঃ প্রিয়ঃ।।
অর্থাৎ : যথার্থ বাক্য দুর্লভ, (পিতামাতার) সুখকর পুত্র দুর্লভ, সমানগুণসম্পন্না স্ত্রী দুর্লভ, মঙ্গলকারী আত্মীয়স্বজন দুর্লভ।
.
। ৫৩।
শৈলে শৈলে ন মাণিক্যং মৌক্তিকং ন গজে গজে।
সাধবো ন হি সর্বত্র চন্দনো ন বনে বনে।।
অর্থাৎ : সকল পর্বতে মাণিক্য মেলে না, সকল হাতীতে গজমুক্তা উৎপন্ন হয় না, সজ্জন পুরুষের সর্বত্র দেখা পাওয়া যায় না, সকল বনে চন্দন থাকে না।
.
। ৫৪।
অশোচ্যা নির্ধনঃ প্রাজ্ঞোহশোচ্যঃ পণ্ডিতবান্ধবঃ।
অশোচ্যা বিধাব নারী পুত্রপৌত্রপ্রতিষ্ঠাতা।।
অর্থাৎ : জ্ঞানী নির্ধন হলেও শোচনীয় নন, যে ব্যক্তির বন্ধু পণ্ডিত তিনিও শোচনীয় নন, পুত্রপৌত্রের দ্বারা পরিপালিতা বিধবা নারীও শোচনীয় নন।
.
। ৫৫।
অবিদ্যঃ পুরুষঃ শোচ্যঃ শোচ্যং মৈথুনমপ্রজম্ ।
নিরাহারাঃ প্রজাঃ শোচ্যাঃ শোচ্যং রাজ্যমরাজকম্ ।।
অর্থাৎ : বিদ্যাহীন পুরুষ শোকের বিষয়, বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষের যে মিলনে সন্তান উৎপাদিত হয় না- তাও শোকের। (করদাতা) প্রজাসাধারণ যদি নিরাহার থাকে তবে তাও দুঃখের আর অরাজক রাজ্যও দুঃখের।
.
। ৫৬।
কুলীনৈঃ সহ সম্পর্কং পণ্ডিতৈঃ সহ মিত্রতাম্ ।
জ্ঞাতিভিশ্চ সমং মেলং কুর্বাণো ন বিনশ্যতি।।
অর্থাৎ : শ্রেষ্ঠ বংশীয় পুরুষের সঙ্গে বিবাহাদি দ্বারা সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন এমন ব্যক্তি বিপদে পড়েন না, পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন এমন ব্যক্তি বিপদে পড়েন না এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন এমন ব্যক্তি বিপদে পড়ে না।
.
। ৫৭।
কষ্টা বৃত্তিঃ পরাধীনা কষ্টো বাসো নিরাশ্রয়ঃ।
নির্দ্ধনো ব্যবসায়শ্চ সর্বকষ্টা দরিদ্রতা।।
অর্থাৎ : পরাধীন জীবিকা কষ্টকর, নিরাশ্রয় ব্যক্তির পরগৃহে বসবাস কষ্টকর, ধনহীনের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কষ্টকর আর দারিদ্র্য সকল কষ্টের কারণ।
.
। ৫৮।
তস্করস্য কুতো ধর্মো দুর্জনস্য কুতঃ ক্ষমা।
বেশ্যানাঞ্চ কুতঃ স্নেহঃ কুতঃ সত্যঞ্চ কামিনাম্ ।।
অর্থাৎ : চোরের আবার ধর্ম কী ! দুষ্টের আবার ক্ষমা কী ! গণিকার আবার স্নেহ কী ! কামুকের আবার সততা কী !
.
। ৫৯।
প্রেষিতস্য কুতো মানং কোপনস্য কুতঃ সুখম্ ।
স্ত্রীণাং কুতঃ সতীত্বঞ্চ কুতো মৈত্রী খলস্য চ।।
অর্থাৎ : ভৃত্যের আবার সম্মান কোথায় ! ক্রোধপরায়ণ ব্যক্তির আবার সুখ কোথায় ! স্ত্রীলোকের আবার সতীত্ব কোথায় ! আর দুষ্টের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব কোথায় !
.
। ৬০।
দুর্বলস্য বলং রাজা বালানাং রোদনং বলম্ ।
বলং মূর্খস্য মৌনিত্বং চৌরাণামনৃতং বলম্ ।।
অর্থাৎ : দুর্বলের রাজাই বল, শিশুর রোদনই বল, মূর্খের নীরব থাকাই বল আর চোরের মিথ্যাশ্রয়ই বল।
.
। ৬১।
যো ধ্র“বাণি পরিত্যজ্য অধ্রুবাণি নিষেবতে।
ধ্র“বাণি তস্য নশ্যন্তি অধ্রুবং নষ্টমেব চ।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি নিশ্চিত বিষয় ত্যাগ করে অনিশ্চিতের আশ্রয় গ্রহণ করে, তার নিশ্চিত বিষয় নষ্ট হয় আর অনিশ্চিত তো নষ্ট হয়ই।
.
। ৬২।
শুষ্কং মাংসং স্ত্রিয়ো বৃদ্ধা বালার্কস্তরুণং দধি।
প্রভাতে মৈথুনং নিদ্রা সদ্যঃ প্রাণহরাণি ষট্ ।।
অর্থাৎ : শুকনো মাংস খাওয়া, বৃদ্ধা স্ত্রীর সঙ্গে মিলন, শরতের রোদ গায়ে লাগানো, সদ্য পাতা দই (যে দই জমেনি) খাওয়া, ভোরে স্ত্রীসঙ্গম, ভোরে ঘুমানো- এই ছয়টি সদ্যপ্রাণঘাতক।
.
। ৬৩।
সদ্যোমাংসং নবান্নঞ্চ বালা স্ত্রী ক্ষীরভোজনম্ ।
ঘৃতমুষ্ণোদকঞ্চৈ ব সদ্যঃ প্রাণকরাণি ষট্ ।।
অর্থাৎ : সদ্য কাটা হয়েছে এমন মাংস আহার, সদ্য প্রস্তুত অন্ন গ্রহণ, যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস, দুগ্ধপান, ঘৃতসেবন এবং (ঈষৎ) উষ্ণ জল পান- এই ছয়টি সদ্য সদ্যই প্রাণবর্ধক।
.
। ৬৪।
সিংহাদেকং বকাদেকং ষট্ শুনস্ত্রীণি গর্দভাৎ।
বায়সাৎ পঞ্চ শিক্ষেত চত্বারি কুক্কুটাদপি।।
অর্থাৎ : সিংহের কাছ থেকে একটি, বকের কাছ থেকে একটি, কুকুরের কাছ থেকে ছয়টি, গাধার কাছ থেকে তিনটি, কাকের কাছ থেকে পাঁচটি এবং মোরগের কাছ থেকে চারটি গুণ শেখার আছে।
.
। ৬৫।
প্রভূতমল্পকার্যং বা যো নরঃ কর্ত্তুমিচ্ছতি।
সম্যগ্ যত্নেন তৎ কুর্যাৎ সিংহাদেকং প্রকীর্তিতম্ ।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি ক্ষুদ্র বা মহৎ যে কোন কাজ করতে চান তিনি সেই কাজ খুব ভালোভাবে যত্নের সঙ্গে করবেন- সিংহের কাছ থেকে এই একটি শিক্ষণীয়ের কথা বিদ্বানেরা বলে থাকেন।
.
। ৬৬।
সর্বেন্দ্রিয়াণি সংযম্য বকবৎ পণ্ডিতো জনঃ।
কালদেশোপপন্নানি সর্বকার্যাণি সাধয়েৎ।।
অর্থাৎ : পণ্ডিত ব্যক্তি বকের মতো সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে (অর্থাৎ বশীভূত রেখে) স্থান-কাল-পাত্র বিচারপূর্বক যথাযথ কাজ করবেন- বকের কাছ থেকে ইন্দ্রিয় সংযত রাখার এই একটি শিক্ষণীয়ের কথা পণ্ডিতেরা বলে থাকেন।
.
। ৬৭।
বহ্বাশী স্বল্পসন্তুষ্টঃ সুনিদ্রঃ শীঘ্রচেতনঃ।
প্রভুভক্তশ্চ শূরশ্চ জ্ঞাতব্যাঃ ষট্ শুনো গুণাঃ।।
অর্থাৎ : প্রভুর মঙ্গলের জন্য সর্বদা চিন্তা, অল্পে সন্তুষ্টি, সহজে ঘুম আসা, তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা, প্রভুভক্তি, সাহস- এই ছয়টি কুকুরের গুণ বলে জানবে, অর্থাৎ কুকুরের কাছ থেকে শিক্ষণীয় গুণ বলে জানবে।
.
। ৬৮।
অবিশ্রামং বহেদ্ ভারং শীতোষ্ণঞ্চ ন বিন্দতি।
সসন্তোষস্তথা নিত্যং ত্রীণি শিক্ষেত গর্দভাৎ।।
অর্থাৎ : গাধা বিশ্রামহীনভাবে ভার বহন করে, শীতে বা গরমে কষ্ট বোধ করে না এবং সকল সময়ই সন্তুষ্ট থাকে। গাধার কাছ থেকে এই তিনটি বিষয় শিক্ষণীয় আছে।
.
। ৬৯।
গূঢ়ঞ্চ মৈথুনং ধার্ষ্ণ্যং কালে কালে চ সংগ্রহম্ ।
অপ্রমাদমনালস্যং পঞ্চ শিক্ষেত বায়সাৎ।।
অর্থাৎ : গোপনে মৈথুন ক্রিয়া, প্রগল্ভতা (চটপটে ভাব), যথাকালে খাদ্যাদি সংগ্রহ, কখনো অসচেতন না থাকা এবং আলস্যহীনতা- এই পাঁচটি গুণ কাকের কাছ থেকে শিক্ষণীয়।
.
। ৭০।
যুদ্ধঞ্চ প্রাতরুত্থানং ভোজনং সহবন্ধুভিঃ।
স্ত্রিয়মাপদ্গতাং রক্ষেৎ চতুঃশিক্ষেত কুক্কুটাৎ।।
অর্থাৎ : আপ্রাণ যুদ্ধ, প্রত্যুষে নিদ্রাত্যাগ, পরিবারের সকলের সঙ্গে (অথবা বন্ধুর সঙ্গে) আহার গ্রহণ এবং বিপদাপন্ন স্ত্রীলোককে রক্ষা করা- মোরগের কাছে এই চারটি গুণ শিক্ষণীয় আছে।
.
। ৭১।
কোহতিভারঃ সমর্থানাং কিং দূরং ব্যবসায়িনাম্ ।
কো বিদেশঃ সবিদ্যানাং কঃ পরঃ প্রিয়বাদিনাম্ ।।
অর্থাৎ : সক্ষম ব্যক্তির কাছে কোন কাজই কঠিন নয়, ব্যবসায়ীর কাছে কোন পথই দূর নয়, বিদ্বানের কাছে কোন দেশই বিদেশ নয় এবং মিষ্টভাষীর কাছে কেউই পর নয় (-সকলেই আপন)।
.
। ৭২।
আপদাং কথিতঃ পন্থা ইন্দ্রিয়াণামসংযমঃ।
তজ্জঃ সম্পদাং মার্গো যেনেষ্টং তেন গম্যতাম্ ।।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়ের অসংযম সকল অনিষ্টের পথ, ইন্দ্রিয়ের জয় সকল উন্নতির পথ। যে পথে মঙ্গল, সে পথে চল।
.
। ৭৩।
ন চ বিদ্যাসমো বন্ধুর্ন চ ব্যাধিসমো রিপুঃ।
ন চাপত্যসমঃ স্নেহো ন চ দৈবাৎ পরং বলম্ ।।
অর্থাৎ : বিদ্যার সমান বন্ধু নাই, ব্যাধির সমান শত্রু নাই, পুত্রস্নেহের সমান স্নেহ নাই এবং দৈবের সমান বল নাই।
.
। ৭৪।
সমুদ্রাবরণা ভূমিঃ প্রাকারাবরণং গৃহম্ ।
নরেন্দ্রাবরণা দেশাশ্চরিত্রাবরণাঃ স্ত্রিয়ঃ।।
অর্থাৎ : পৃথিবীর আবরণ সমুদ্র, গৃহের আবরণ প্রাচীর, দেশের আবরণ রাজা আর স্ত্রীলোকের আবরণ চরিত্র।
.
। ৭৫।
ঘৃতকুম্ভ সমা নারী তপ্তাঙ্গারসমঃ পুমান্ ।
তস্মাৎ ঘৃতঞ্চ বহ্নিঞ্চ নৈকত্র স্থাপয়েদ্বুধঃ।।
অর্থাৎ : স্ত্রীলোক ঘৃতপূর্ণ ঘটের সমান আর পুরুষ জ্বলন্ত আগুনের সমান। তাই পণ্ডিত ব্যক্তি ঘৃত এবং বহ্নিকে কখনোই একত্রে রাখবেন না (অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ সম্পর্করহিত স্ত্রী এবং পুরুষকে কখনোই এক জায়গায় রাখবেন না)।
.
। ৭৬।
আহারো দ্বিগুণঃ স্ত্রীণাং বুদ্ধিস্তাসাং চতুর্গুণা।
ষড্গুণো ব্যবসায়শ্চ কামশ্চাষ্টগুণঃ স্মৃতঃ।।
অর্থাৎ : স্ত্রীলোকের আহার পুরুষের দুই গুণ, পুরুষ অপেক্ষা তাদের বুদ্ধি চতুর্গুণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের বুদ্ধি পুরুষ অপেক্ষা ছয়গুণ আর কামশক্তি (অথবা ভোগলিপ্সা) পুরুষ অপেক্ষা আটগুণ- এরকম কথা শাস্ত্রে কথিত আছে।
.
। ৭৭।
জীর্ণমন্নং প্রশংসীয়াৎ ভার্য্যাঞ্চ গতযৌবনাম্ ।
রণাৎ প্রত্যাগতং শূরং শস্যঞ্চ গৃহমাগতম্ ।।
অর্থাৎ : যে আহারের পরিপাক হয়েছে তাকে প্রশংসা করবে, নির্দোষভাবে যৌবন অতিক্রম করেছে এমন স্ত্রীর প্রশংসা করবে, যুদ্ধ থেকে (সসম্মানে) ফিরে আসা বীরের প্রশংসা করবে এবং যে ফসল ঘরে উঠেছে তার প্রশংসা করবে।
.
। ৭৮।
অসন্তুষ্টা দ্বিজা নষ্টাঃ সন্তুষ্টা ইব পার্থিবাঃ।
সলজ্জগণিকা নষ্টা নির্লজ্জশ্চ কুলস্ত্রিয়ঃ।।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ অসন্তুষ্ট হলে তাঁর (আত্মিক) উন্নতি হয় না, রাজা সন্তুষ্ট হলে তাঁর (রাজ্যবিস্তারাদি) উন্নতি হয় না, বেশ্যা লজ্জাশীলা হলে তার (ব্যবসায়ে) উন্নতি হয় না আর কুলবধূরা নির্লজ্জ হলে তাদের সতীত্ব থাকে না।
.
। ৭৯।
অবংশপতিতো রাজা মূর্খপুত্রশ্চ পণ্ডিতঃ।
অধনেন ধনং প্রাপ্য তৃণবন্মন্যতে জগৎ।।
অর্থাৎ : নীচবংশে জন্মগ্রহণ করে যদি কেউ রাজা হয়, কোন মূর্খের পুত্র যদি পণ্ডিত হয় অথবা কোন দরিদ্র যদি (হঠাৎ প্রচুর) সম্পত্তি লাভ করে তবে তারা এই জগৎকে তৃণের মতো তুচ্ছ জ্ঞান করে।
.
। ৮০।
ব্রহ্মহাহপি নরঃ পূজ্যো যস্যাস্তি বিপুলং ধনম্ ।
শশিনস্তুল্যবংশোহপি নির্ধনঃ পরিভূয়তে।।
অর্থাৎ : যার প্রচুর ধনসম্পত্তি আছে সে যদি ব্রহ্মঘাতীও হয়, লোকে তাকে মেনে চলে, আর ধনসম্পত্তি না থাকলে চন্দ্রের মতো নির্মল বংশে জন্মগ্রহণ করলেও লোকে মান্য করে না।
.
। ৮১।
পুস্তকস্থা তু যা বিদ্যা পরহস্তগতং ধনম্ ।
কার্যকালে সমুৎপন্নে ন সা বিদ্যা ন তদ্ধনম্ ।।
অর্থাৎ : যে অধীত বিদ্যা পুঁথিতেই থেকে যায় (অর্থাৎ কাজে প্রয়োগের সময় মনে পড়ে না), যে ধন পরের হাতে চলে গেছে (অর্থাৎ নিজের অধিকারে নেই)- প্রয়োজনের সময় তা পাওয়া যায় না বলে সেই বিদ্যাকে বিদ্যা বলা চলে না, সেই ধনকে ধন বলা চলে না।
.
। ৮২।
পাদপানাং ভয়ং বাতাৎ পদ্মানাং শিশিরাদ্ভয়ম্ ।
পর্বতানাং ভয়ং বজ্রাৎ সাধূনাং দুর্জনাদ্ভয়ম্ ।।
অর্থাৎ : বৃক্ষের ভয় ঝড়কে, পদ্মের ভয় শীতকালকে, পর্বতের ভয় বজ্রকে আর সজ্জনের ভয় দুর্জনকে।
.
। ৮৩।
প্রাজ্ঞে নিযোজ্যমানে তু সন্তি রাজ্ঞস্ত্রয়ো গুণাঃ।
যশঃ স্বর্গনিবাসশ্চ বিপুলশ্চ ধনাগমঃ।।
অর্থাৎ : রাজা যদি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির উপর কার্যভার ন্যস্ত করেন তবে তাঁর তিনটি জিনিস লাভ হয়- যশ, স্বর্গলাভ এবং প্রভূত অর্থলাভ।
.
। ৮৪।
মূর্খে নিযোজ্যমানে তু ত্রয়ো দোষা মহীপতেঃ।
অযশশ্চার্থনাশশ্চ নরকে গমনং তথা।।
অর্থাৎ : রাজা যদি মূর্খ লোকের হাতে কাজের ভার অর্পণ করেন তবে তিনি তিনটি দোষের ভাগী হন- নিন্দা, অর্থনাশ এবং নরকগমন।
.
। ৮৫।
বহুভির্মূর্খসংঘাতৈরন্যোন্যপশুবৃত্তিভিঃ।
প্রচ্ছাদ্যন্তে গুণাঃ সর্বে মেঘৈরিব দিবাকরঃ।।
অর্থাৎ : পশুর মতো পরস্পর হিংসাদি স্বভাবের বহু মূর্খের দ্বারা সূর্য যেমন মেঘের দ্বারা আবৃত হয় তেমনি সকল গুণ আচ্ছাদিত হয়।
.
। ৮৬।
যস্য ক্ষেত্রং নদীতীরে ভার্যা বাপি পরপ্রিয়া।
পুত্রস্য বিনয়ো নাস্তি মৃত্যুরেব ন সংশয়।।
অর্থাৎ : যে লোকের শস্যক্ষেত্র নদীর পাড়ে, যে লোকের স্ত্রী পরপুরুষে আসক্ত, যে লোকের পুত্র অবিনীত- সেই লোকের জীবনধারণ মৃত্যুর সমান- এই ব্যাপারে সংশয় নাই।
.
। ৮৭।
অসংভাব্যং ন বক্তব্যং প্রত্যক্ষমপি দৃশ্যতে।
ডশলা তরতি পানীয়ং গীতং গায়তি বানরঃ।।
অর্থাৎ : পাথর জলে ভাসছে, বানর গান করছে- এইরকম অসম্ভব ঘটনা স্বচক্ষে ঘটতে দেখলেও বলা উচিত নয়।
.
। ৮৮।
সুভিক্ষং কৃষকে নিত্যং নিত্যং সুখমরোগিণি।
ভার্যা ভর্তুঃ প্রিয়া যস্য তস্য নিত্যোৎসবং গৃহম্ ।।
অর্থাৎ : যে কৃষকের ঘরে (প্রচুর) অন্ন থাকে- তার ঘরে সর্বদা সুখ বিরাজ করে, যার শরীরে রোগ নাই- সে সর্বদা সুখী, যে স্বামীর স্ত্রী (স্বামীতে একান্ত অনুরক্তির কারণে) প্রিয়তমা- সেই লোকের ঘরে সর্বদা উৎসবের আনন্দ।
.
। ৮৯।
হেলা স্যাৎ কার্যনাশায় বুদ্ধিনাশায় নির্ধনম্ ।
যাচনা মাননাশায় কুলনাশায় ভোজনম্ ।।
অর্থাৎ : অবহেলা কার্যনাশের কারণ হয়, দারিদ্র্যের কারণে বুদ্ধিনাশ ঘটে, লোকের কাছে প্রার্থনা অসম্মানের কারণ হয় আর (যেখানে-সেখানে অখাদ্য-কুখাদ্য) আহার গ্রহণ বংশগৌরব নাশের কারণ হয়।
.
। ৯০।
সেবিতব্যো মহাবৃক্ষঃ ফলচ্ছায়াসমন্বিতঃ।
যদি দৈবাৎ ফলং নাস্তি ছায়া কেন নির্বার্যতে।।
অর্থাৎ : ফল এবং ছায়াযুক্ত বিশাল বৃক্ষের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। কেননা দৈববশতঃ তাতে ফল না থাকলেও ছায়া সবসময়ই পাওয়া যায়।
.
। ৯১।
প্রথমে নার্জিতা বিদ্যা দ্বিতীয়ে নার্জিতং ধনম্ ।
তৃতীয়ে নার্জিতং পুণ্যং চতুর্থে কিং করিষ্যতি।।
অর্থাৎ :  জীবনের প্রথমভাগে (অর্থাৎ বাল্যে) যিনি বিদ্যা অর্জন করেননি, জীবনের দ্বিতীয়ভাগে (অর্থাৎ যৌবনে) যিনি ধন অর্জন করেননি, জীবনের তৃতীয়ভাগে (অর্থাৎ প্রৌঢ়দশায়) যিনি পুণ্য অর্জন করেননি- জীবনের চতুর্থভাগে (অর্থাৎ বার্ধক্যে) তিনি আর কী করবেন ? অর্থাৎ তখন আর কিছুই করণীয় থাকবে না।
.
। ৯২।
নদীকূলে চ যে বৃক্ষাঃ পরহস্তগতং ধনম্ ।
কার্যং স্ত্রীগোচরং যৎ স্যাৎ সর্বং তদ্বিফলং ভবেৎ।।
অর্থাৎ : যে সকল বৃক্ষ নদীর পাড়ে, যে ধন অন্যের হস্তগত, যে কাজের কথা স্ত্রীলোক (কাজ হওয়ার আগেই) জেনেছে- এই সবই বিফল হয়।
.
। ৯৩।
কুদেশমাসাদ্য কুতোহর্থসঞ্চয়ঃ কুপুত্রমাসাদ্য কুতো জলাঞ্জলিঃ।
কুগোহিনীং প্রাপ্য কুতো গৃহে সুখং কুশিষ্যমধ্যাপয়তঃ কুতো যশঃ।।
অর্থাৎ : কুদেশে গিয়ে অর্থসঞ্চয়ের আশা কোথায় ? কুপুত্রের জন্ম দিয়ে পারলৌকিক জলাঞ্জলি (এবং পিণ্ড প্রভৃতি) পাওয়ার আশা কোথায় ? দুর্বিনীতা (অথবা দুশ্চরিত্রা) স্ত্রী লাভ হলে ঘরে সুখের আশা কোথায় ? দুর্বিনীত ছাত্রকে শিক্ষাদান করে যশের আশা কোথায় ?
.
। ৯৪।
কূপোদকং বটচ্ছায়া শ্যামা স্ত্রী ইষ্টকালয়ম্ ।
শীতকালে ভবেদুফ’ গ্রীষ্মকালে চ শীতলম্ ।।
অর্থাৎ : কূপের জল, বটগাছের ছায়া, মধ্যযৌবনে উপনীত এমন স্ত্রী এবং ইটের তৈরি বাড়ি- এগুলি শীতকালে উষ্ণ থাকে আর গ্রীষ্মে থাকে শীতল (অর্থাৎ এগুলি সকল ঋতুতে সুখদায়ক হয়)।
.
। ৯৫।
বিষষং চঙ্ক্রমণং রাত্রৌ বিষং রাজ্ঞোহনুকূলতা।
বিষষং স্ত্রিয়োহপ্যন্যহৃদো বিষষং ব্যাধিরবীক্ষিতঃ।।
অর্থাৎ : রাত্রিতে ভ্রমণ বিষতুল্য, রাজার আনুকূল্য বিষতুল্য, যে স্ত্রী পরপুরুষের প্রতি আসক্ত সেই স্ত্রীও বিষতুল্য, যে ব্যাধিকে উপেক্ষা করা হয়েছে তাও বিষতুল্য।
.
। ৯৬।
দুরধীতা বিষষং বিদ্যা অজীর্ণে ভোজনং বিষম্ ।
বিষষং গোষ্ঠী দরিদ্রস্য বৃদ্ধ স্য তরুণী বিষম্ ।।
অর্থাৎ : যে বিদ্যার যথার্থ তাৎপর্য গৃহীত হয়নি- সে বিদ্যা বিষতুল্য, হজমের গণ্ডগোলে আহার বিষতুল্য, দরিদ্রের বহু সন্তান এবং আত্মীয়স্বজন থাকা বিষতুল্য, বৃদ্ধ লোকের তরুণী স্ত্রী বিষতুল্য।
.
। ৯৭।
প্রদোষে নিহতঃ পন্থাঃ পতিতা নিহতাঃ স্ত্রিয়ঃ।
অল্পবীজং হতং ক্ষেত্রং ভৃত্যদোষাদ্ধতঃ প্রভুঃ।।
অর্থাৎ : সন্ধ্যাকালে পথ দেখা যায় না, চরিত্রহীন নারীর জীবন মৃত্যুর সমান, যে ক্ষেতে অতি সামান্য ফসল হয় তা কোন উপকারে আসে না, ভৃত্যের দোষে প্রভুর অপকারই হয়।
.
। ৯৮।
হতমশ্রোত্রিয়ং শ্রাদ্ধং হতো যজ্ঞস্ত্বদক্ষিণঃ।
হতা রূপবতী বন্ধ্যা হতং সৈন্যমনায়কম্ ।।
অর্থাৎ : যে শ্রাদ্ধে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ উপস্থিত থাকেন না সেই শ্রাদ্ধ নিষ্ফল, যে যজ্ঞে দক্ষিণা দেওয়া হয়নি সেই যজ্ঞ বিফল, রূপ থাকলেও যে নারী বন্ধ্যা তার জীবন নিরর্থক, সেনাপতিবিহীন সৈন্যেরা নিষ্ফল, অর্থাৎ যুদ্ধে পরাভূত হয়ে থাকে।
.
। ৯৯।
বেদবেদাঙ্গতত্ত্বজ্ঞো জপহোমপরায়ণঃ।
আশীর্বাদপরো নিত্যমেষ রাজপুরোহিতঃ।।
অর্থাৎ : যিনি বেদ-বেদাঙ্গে পারদর্শী, যিনি সর্বদা জপ ও হোমে নিরত, যিনি সর্বদা (রাজার) মঙ্গল কামনা করেন- তিনিই রাজপুরোহিত।
.
। ১০০।
কুলশীলগুণোপেতঃ সর্বধর্মপরায়ণঃ।
প্রবীণঃ প্রেষণাধ্যক্ষো ধর্মাধ্যক্ষো বিধীয়তে।।
অর্থাৎ : যিনি সদ্বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁর চরিত্র নির্দোষ, যিনি বিভিন্ন গুণে ভূষিত, যিনি সবল ধর্মে নিষ্ণাত বা অভিজ্ঞ, যিনি প্রাজ্ঞ এবং ভৃত্য প্রভৃতি লোকনিয়োগে বিচক্ষণ- তিনিই বিচারক হওয়ার যোগ্য।
.
। ১০১।
আয়ুর্বেদকৃতাভ্যাসঃ সর্বেষাং প্রিয়দর্শনঃ।
আর্যশীল গুণোপেত এষ বৈদ্যো বিধীয়তে।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি চিকিৎসাশাস্ত্রে নিষ্ণাত বা অভিজ্ঞ, যিনি সবলের চোখেই সৌম্যদর্শন, যিনি সৎস্বভাবিশিষ্ট- তিনিই চিকিৎসক হওয়ার যোগ্য।
.
। ১০২।
সকৃদুক্তগৃহীতার্থো লঘুহস্তো জিতাক্ষরঃ।
সর্বশাস্ত্রসমালোকী প্রকৃষ্টো নাম লেখকঃ।।
অর্থাৎ : যিনি কোন কথা একবার শুনলেই তার অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম, যিনি দ্রুত লিখতে পারেন, শব্দরাশি যার বশীভূত, সকল শাস্ত্র যার অধিগত- তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক বলে পরিগণিত হন।
.
। ১০৩।
সমস্তশস্ত্রশাস্ত্রজ্ঞো বাহনেষু জিতশ্রমঃ।
শৌর্যবীর্যগুণোপেতঃ সেনাধ্যক্ষো বিধীয়তে।।
অর্থাৎ : যিনি সবলপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র এবং শাস্ত্রে নিষ্ণাত বা অভিজ্ঞ, বহুকাল রথ, অশ্ব প্রভৃতি আরোহণ করেও যিনি ক্লান্ত হন না, যিনি সাহস, পরাক্রম প্রভৃতি গুণযুক্ত- তিনিই সেনাপতি হওয়ার যোগ্য।
.
। ১০৪।
মেধাবী বাক্পটুঃ প্রাজ্ঞ পরিচিত্তোপলক্ষকঃ।
ধীরো যথোক্তবাদী চ এষ দূতো বিধীয়তে।।
অর্থাৎ : তীক্ষè স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, সুবক্তা, বিচক্ষণ, অন্যের মনোগত ভাব অনুধাবন করতে সক্ষম, শান্ত, যথাযথভাবে বক্তব্য নিবেদন করতে সক্ষম- এরকম ব্যক্তিই যোগ্য দূত বলে বিবেচিত হন।
.
। ১০৫।
পুত্রপৌত্রগুণোপেতঃ শাস্ত্রজ্ঞো মিষ্টপাচকঃ।
শূরশ্চ কঠিনশ্চৈব সূপকারঃ স উচ্যতে।।
অর্থাৎ : পুত্র-পৌত্র আছে এমন, পাকশাস্ত্রে নিষ্ণাত বা অভিজ্ঞ, যার তৈরি আহার মধুর আস্বাদযুক্ত, বলবান এবং দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি উপযুক্ত পাচক বলে পরিগণিত হন।
.
। ১০৬।
ইঙ্গিতাকারতত্ত্বজ্ঞো বলবান্ প্রিয়দর্শনঃ।
অপ্রমাদী সদা দক্ষঃ প্রতীহারঃ স উচ্যতে।।
অর্থাৎ : যিনি লোকের মনোগত অভিপ্রায় অনুধাবন করতে সক্ষম, শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করে তার কারণ অনুমানে সক্ষম, যিনি সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট, যিনি সর্বদা সাবধানে থাকেন (তাই কখনও ভুল করেন না), যিনি সকল কাজে নিপুণ- তিনিই দ্বাররক্ষকের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন।
.
। ১০৭।
যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিম্ ।
লোচনাভ্যাং বিহীনস্য দর্পণঃ কিং করিষ্যতি।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তির নিজস্ব কোন বুদ্ধি নই শাস্ত্রোপদেশ তার কী কাজে লাগবে ? যে লোকের দুই চোখই নষ্ট- আয়নায় তার কী কাজ হবে ?
.
। ১০৮।
কিং করিষ্যন্তি বক্তারঃ শ্রোতা যত্র ন বিদ্যতে।
নগ্নক্ষপণকে দেশে রজকঃ কিং করিষ্যতি।
অর্থাৎ : যে সভায় (যোগ্য) শ্রোতা নেই- বক্তা সেখানে কী করবেন ? (অর্থাৎ বক্তার পরিশ্রম নিরর্থক)। যে দেশে সকলেই উলঙ্গ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী- সে দেশে ধোপার কী কাজ ?
.
। ১০৯।
যস্য বিজ্ঞানমাত্রেণ নৃণাং প্রজ্ঞা প্রজায়তে।
শতমষ্টোত্তরং পদ্যং চাণক্যেন প্রযুজ্যতে।।
অর্থাৎ : যে শাস্ত্র (বা গ্রন্থ) পাঠ করা মাত্র মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান জন্মায় সেই একশ’ আট শ্লোকবিশিষ্ট গ্রন্থ চাণক্য প্রণয়ন করলেন।

[সংগ্রহ-সূত্র: চাণক্য-নীতি-শাস্ত্র-সমীক্ষা/ শ্রী সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী/ সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলিকাতা।]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানম্

  বে দ ছন্দ রূপ ! ছন্দ বিষয়ে মহর্ষি যাস্ক বলেছেন- "ছন্দাংসি ছাদনাত্" (নিরুক্ত ৭।১২) এই বিষয়ে দৈবত ব্রাহ্মণ ৩।১২ তে বলা হয়েছে "...

Post Top Ad

ধন্যবাদ