ন্যায়দর্শন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 August, 2020

ন্যায়দর্শন


১.০ : ভূমিকা…
        ন্যায়দর্শনের প্রাথমিক পরিচয়…
ন্যায়দর্শন
ন্যায় দর্শনের উদ্ভব
ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে ন্যায়দর্শনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ন্যায় দর্শনের দুটি শাখা- প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায়। প্রাচীন ন্যায়দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গোতম। কেউ কেউ বলেন গৌতম। মহর্ষি রচিত ‘ন্যায়সূত্র’ হলো ন্যায়দর্শনের মূল গ্রন্থ। গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ (২৫০ খ্রীঃ)। তাঁর এই নাম অনুসারে ন্যায় দর্শনকে অক্ষপাদ-দর্শনও বলা হয়ে থাকে। অক্ষপাদ গৌতমের ন্যায়শাস্ত্র বুদ্ধিবাদী বা যুক্তিবাদী।

মহর্ষি গোতমের মতে আত্যন্তিক দুঃখ ধ্বংসই মুক্তি। এই মুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ন্যায় দর্শন লিখিত হইয়াছে।

 মহর্ষি গোতম ঈশ্বর স্বীকার করেন। তিনি বলেন জগতের উপাদান পরমাণু সৎ; কিন্তু তাহা জড় বলিয়া তাহার নিজের কোন স্বতন্ত্র ক্রিয়া নাই; পরমাণু জগতের উপাদান কারণ এবং ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ। ঈশ্বরেচ্ছায় পঞ্চভূতের পরমাণু মিলিত হইয়া জগৎরূপে প্রকাশিত হয়, এবং যখন ঈশ্বরেচ্ছায় এই জগৎ নিজকারণ পরমাণুতে ফিরিয়া যায় তখনই প্রলয়। এ সম্বন্ধে অতি সুন্দর উপমা আছে। কুম্ভকার মৃত্তিকা দ্বারা ঘট নির্ম্মাণ করে; কুম্ভকারের অথবা মৃত্তিকার অভাবে ঘট নির্ম্মিত হয় না; এইরূপ যখনই কোন কার্য্য দেখা যায় তখনই তাহার কোন কর্ত্তাও দেখা যায়; অর্থাৎ প্রত্যেক কার্য্যের নিমিত্ত-করণ ও উপাদান-কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। গোতম বলেন যখন একটি অতি সামান্য কার্য্যেরও কর্ত্তা দেখিতে পাওয়া যায়, তখন এই জগৎরূপ অতি মহৎ কার্য্যেরও একজন কর্ত্তা আছেন।

 পরমাণু নিরবয়ব, অবিভাজ্য, অজ ও নিত্য। ইহার দুইটি সংযোগে দ্ব্যণুক ও তিনটি দ্ব্যণুকের সংযোগে ত্রসরেণু এইরূপে ক্রমে মহাবয়বী পর্য্যন্ত উৎপন্ন হয়। অবয়বী পদার্থ বিভাজ্য অতএব তাহার বিনাশ আছে। পরমাণু ও দ্ব্যণুক প্রত্যক্ষ হয় না, ত্রসরেণু ইন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হইয়া থাকে। জগৎ যখন ক্রম বিভাগ দ্বারা পরমাণুরূপে পরিণত হয়, তখনই তাহার বিনাশ, প্রলয় বা তিরোভাব।

 মহর্ষি গোতম ষোড়শ পদার্থ স্বীকার করেন, যথা—প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস ছল, জাতি ও নিগ্রহস্থান। ইহাদিগের মধ্যে প্রমেয় পদার্থতত্ত্বের জ্ঞানই মুখ্যভাবে মুক্তির হেতু, এবং অপরাপর তত্ত্বের জ্ঞান পরম্পরা সম্বন্ধে মুক্তির হেতু। প্রমাণাদি পঞ্চদশ পদার্থ তর্কেতেই ব্যবহৃত হয় বলিয়া সে সম্বন্ধে কোন প্রকার বিশেষ উল্লেখ করা হইল না। কেবলমাত্র প্রমেয় পদার্থ কি তাহা বলা হইতেছে।

 প্রমেয় দ্বাদশ প্রকার, যথা—আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ। আত্মা দ্রষ্টা ও ভোক্তা। যাহাকে আশ্রয় করিয়া আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম শরীর। যদ্দ্বারা আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম ইন্দ্রিয়। ভোগ্য বস্তুর নাম অর্থ। ভোগ্যবস্তুর উপলব্ধি বা জ্ঞানের নাম বুদ্ধি। যে বস্তুর সংযোগে ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় এবং যাহার বিয়োগে ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় না তাহার নাম মন। স্মরণ, অনুমান, সংশয় প্রভৃতি মনের অনেক ধর্ম্ম আছে। প্রবৃত্তি তিন প্রকার,—শারীরিক, বাচিক ও মানসিক। রাগ, দ্বেষ ও মোহ এই তিনটির নাম দোষ; ইহাই প্রবৃত্তির হেতু। পুনঃ পুনঃ জন্ম ও মৃত্যুর নাম প্রেত্যভাব। প্রবৃত্তি হইতে যে সকল সুখ ও দুঃখের অনুভব হয় তাহার নাম ফল। অসৎকর্ম্মের ফলের নাম দুঃখ। সুখের অস্তিত্ব না থাকিলে দুঃখ হয় না, অতএব সুখও একপ্রকারে দুঃখ বলিয়া পরিগণিত হইতেছে। দুঃখের অত্যন্ত বিনাশের নাম অপবর্গ।

 মহর্ষি গোতম জ্ঞানকে আত্মার স্বরূপ বলেন না; কারণ ইঁহার মতে জ্ঞান ক্ষণিক; একক্ষণে ইহার উৎপত্তি, দ্বিতীয়ক্ষণে ইহার স্থিতি ও পরক্ষণে ইহার লয় হইয়া থাকে। একটি জ্ঞানের লয় না হইলে আর একটি জ্ঞানের উদয় হইতে পারে না। একই সময়ে দুই বা ততোধিক জ্ঞান একই ভাবে থাকিতে পারে না। যদিও অনেক সময় আমাদিগের মনে হয় যে এককালে আমাদিগের একাধিক জ্ঞান রহিয়াছে, কিন্তু তাহা বাস্তবিক নহে; বস্তুতঃ একাধিক জ্ঞান এত দ্রুত ভাবে মনের মধ্যে ক্রিয়া করে এবং তাহাদিগের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় এত দ্রুতভাবে সংঘটিত হয় যে তাহারা একই সময়ে রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।[১] অতএব জ্ঞান আত্মা স্বরূপ নহে, পরন্তু ইহা আত্মা হইতে উদ্ভূত হয়।

 এক্ষণে জীব কি প্রকারে অপবর্গ বা মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম হয় তাহা বলা হইতেছে। গোতম মতে ষোড়শ পদার্থের জ্ঞানই মুক্তির কারণ। দেহাদিতে আত্মবোধই আমাদিগের সমস্ত অনর্থের কারণ। ইহা হইতে দেহাদি অনুকূল বিষয়ে রাগ ও তৎপ্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ হইয়া থাকে। এই রাগ দ্বেষই প্রবৃত্তির কারণ। প্রবৃত্তি ধর্ম্মাধর্ম্মের কারণ। ধর্ম্মাধর্ম্ম সুখ দুঃখের কারণ। জন্ম না থাকিলে ফল ভোগ হয় না, অতএব কর্ম্মফল জন্মের কারণ। মুমুক্ষুব্যক্তি এই তত্ত্বগুলি বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া জন্ম মৃত্যুর আদিকারণ দেহাত্মবোধকে একেবারে পরিত্যাগ করিবেন। তাহা হইলেই তাঁহার সমস্ত দুঃখের চিরাবসান হইবে।

মহর্ষি গোতমের মতে আত্যন্তিক দুঃখ ধ্বংসই মুক্তি। এই মুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ন্যায় দর্শন লিখিত হইয়াছে।
অক্ষপাদের জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভাষ্য অনুযায়ী (দর্শন-দিগদর্শন) ডক্টর সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মেধাতিথি গৌতমকে আন্বীক্ষিকী (= ন্যায়) শাস্ত্রের আচার্য বলেছেন, এবং প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, তিনি ৫৫০ খ্রীস্টপূর্বে জন্মেছিলেন ও তাঁর জন্মভূমি দারভাঙ্গার গৌতমস্থানে। ঋগ্বেদের ঋষি মেধাতিথি গৌতম এবং উপনিষদের ঋষি নচিকেতা গৌতমকে মিশ্রিত করে তিনি ন্যায়শাস্ত্রের মূল আচার্য মেধাতিথি গৌতমকে সৃষ্টি করেছেন বলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। বস্তুত যে ন্যায়সূত্রকে অক্ষপাদের ন্যায়সূত্র রূপে পাওয়া যায়, তার আগে এমন কোনো সুব্যবস্থিত শাস্ত্র ছিলো বলে জানা যায় না। উদ্যোতকর (৫৫০ খ্রীঃ)-এর ‘ন্যায়বার্তিক’ এবং বাৎস্যায়ন (৩০০ খ্রীঃ)-এর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ অক্ষপাদকেই ন্যায়সূত্রের কর্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, অক্ষপাদ শূন্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রীঃ) উত্তরসূরী ছিলেন। কেননা, নাগার্জুন তাঁর ‘বিগ্রহব্যবর্তণী’ গ্রন্থে প্রমাণকে চূড়ান্ত বা পরম বলে না মানার যে যুক্তি দেখিয়েছেন, অক্ষপাদ ন্যায়সূত্রে তা খণ্ডন করে চূড়ান্ত প্রমাণকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ ন্যায়সূত্র নাগার্জুনের পরে লেখা হয়েছিলো।
 .
ন্যায় দর্শনের ইতিহাস অতি প্রাচীন ও বিস্তৃত। এ দর্শনের উপর একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তবে মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’  প্রাচীন ন্যায়দর্শনের মূল গ্রন্থ। এ  গ্রন্থে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে এবং প্রতিটি অধ্যায় দুটি করে আহ্নিক বা খণ্ডে বিভক্ত। ন্যায়সূত্রের বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ হচ্ছে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ‘ন্যায়ভাষ্য’। এছাড়া উদ্দ্যোতকরের ‘ন্যায়বার্ত্তিক’, বাচস্পতি মিশ্রের (নবম শতক) ‘ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্য টীকা’, উদয়নাচার্যের (দশম শতক) ‘ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্যপরিশুদ্ধি’ এবং ‘ন্যায়-কুসুমাঞ্জলি’, জয়ন্ত ভট্টের (নবম-দশম শতক) ন্যায়মঞ্জরী ইত্যাদি গ্রন্থে ন্যায়সূত্রের তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
 .
উদয়নাচার্যের পরবর্তীকালে দ্বাদশ শতকে মহানৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে ন্যায় দর্শনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এই নতুন অধ্যায় নব্যন্যায় নামে পরিচিত। গঙ্গেশের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ এই অধ্যায়ের ভিত্তিস্তম্ভ। প্রথমে মিথিলায় এবং পরে নবদ্বীপে এর প্রসার ঘটে। ন্যায়-সম্প্রদায়ের ইতিহাসে এই নব্য-ন্যায় মতের গ্রন্থটি এমনই যুগান্তর সৃষ্টি করে যে, এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থগুলি এমনকি ন্যায়সূত্র এবং বৈশেষিকসূত্রও অবহেলিত ছিলো বলে জানা যায়। সাম্প্রতিককালে এগুলির চর্চা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
 .
ন্যায়সম্প্রদায়ে তর্কবিদ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। তবে প্রাচীন ন্যায়ে যে সকল দার্শনিক তত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়, নব্যন্যায়ে তা বহুলাংশেই অনুপস্তিত। এখানে তর্কবিদ্যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে এবং দার্শনিক তত্ত্বের তুলনায় যৌক্তিক শুদ্ধতা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপরই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে সম্প্রদায়টিতে কোনো নির্দিষ্ট দার্শনিক মত চর্চা করবার উৎসাহ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে বলে বিদ্বানদের অভিমত। নব্যন্যায়ের এক ও অদ্বিতীয় উৎসাহ কেবল তর্কেই। এই নব্যন্যায় মতকে ঘিরেও বেশ কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে। তার মধ্যে বাসুদেব সার্বভৌম (পঞ্চদশ শতক), রঘুনাথ শিরোমণি, জগদীশ তর্কালঙ্কার, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখের রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিশ্বনাথের ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’ এবং অন্নংভট্টের ‘তর্কসংগ্রহ’ ন্যায়-প্রস্থানের বিশেষ করে নব্যন্যায়ের মূল সিদ্ধান্তগুলিকে সংক্ষেপে ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস।
 .
ন্যায় দর্শনের প্রাথমিক পরিচয়
নীয়তে অনেন ইতি ন্যায়ঃ।’ অর্থাৎ এই শাস্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষের বুদ্ধি স্থির মীমাংসায় উপনীত হয় বলে এই শাস্ত্রকে বলা হয় ন্যায়। ফলে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হলে কী কী উপায় অবলম্বন করে শুদ্ধ চিন্তায় উপনীত হতে পারা যায়- তা-ই হলো ন্যায় দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। তাই যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালী হিসেবেই ন্যায় দর্শনকে আখ্যায়িত করা হয়।
 .
ন্যায় দর্শন যুক্তিমূলক বস্তুবাদী দর্শন। জ্ঞানের বিষয়ের যে জ্ঞান-ভিন্ন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে তা এই দর্শনে স্বীকৃত। অর্থাৎ বিভিন্ন বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। কারণ বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানা বা না-জানার উপর নির্ভর করে না। শুধুমাত্র যুক্তি তর্ক বিচারের মাধ্যমে নৈয়ায়িকরা বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন বলে নৈয়ায়িকদের বস্তুবাদ যুক্তিমূলক বস্তুবাদ।
 .
যেহেতু ন্যায় দর্শন বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করে, তাই ন্যায় দর্শন আস্তিক দর্শন। তবে বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করলেও এ মতবাদ স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের চিন্তাধারাকে ফলপ্রসূ করার জন্য নির্দেশ দেয় বলে ন্যায় দর্শনকে ‘ন্যায়বিদ্যা’ বলা হয়। এই মতে ‘প্রমা’ বা যথার্থজ্ঞান লাভের প্রণালীকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। প্রমা এবং প্রমাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে বলে ন্যায় দর্শনকে প্রমাণশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে অনুমান, শব্দ প্রভৃতি প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়। এই প্রমাণগুলির তত্ত্ব একমাত্র ন্যায়শাস্ত্রেই বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়া ন্যায় দর্শন সব শাস্ত্রকে নির্ভুলভাবে প্রতিভাত করে বলে ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎসায়ন ন্যায়দর্শনকে ‘সর্বশাস্ত্রপ্রদীপ’ বা ‘সকল বিদ্যার প্রদীপ’ নামে অভিহিত করেছেন। আবার যুক্তির দ্বারা বিষয়ের বিশ্লেষণকে ‘ঈক্ষা’ বা মনন বলে। এই অর্থে অনুমান হলো অন্বীক্ষা (অনু + ঈক্ষা)। ন্যায় দর্শন এই অন্বীক্ষার সমাধা করে অর্থাৎ অনুমান বা ন্যায়ের সাহায্যে বস্তুর জ্ঞানলাভের পথ উন্মুক্ত করে বলে তাকে আন্বীক্ষিকীও বলা হয়ে থাকে।
 .
ন্যায় দর্শনে যুক্তি-তর্ক এবং জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার প্রাধান্য থাকলেও যুক্তি-তর্ক করাই কিন্তু ন্যায় শাস্ত্রের চরম উদ্দেশ্য নয়। ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মতোই ন্যায় দর্শনের চরম উদ্দেশ্য বা পুরুষার্থ হলো মুক্তি বা মোক্ষ। যুক্তিসিদ্ধ চিন্তা এই পরম পুরুষার্থ লাভের সহায়ক মাত্র। কী করে এই পুরুষার্থ বা মোক্ষকে লাভ করা যায়, ন্যায়দর্শন সে সম্পর্কে আলোচনা করে বলে তাকে মোক্ষশাস্ত্রও বলা হয়। ন্যায়দর্শন মানুষের পার্থিব জীবনকে দুঃখময় রূপে এবং মোক্ষপ্রাপ্তিকেই মানব জীবনের পরমলক্ষ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। এই মতে অবিদ্যা হলো দুঃখের কারণ এবং তত্ত্বজ্ঞান বা যথার্থজ্ঞানের দ্বারাই অবিদ্যা দূর করে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব। ন্যায় মতে জীবের মোক্ষলাভের জন্য ষোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োজন। তাই ন্যায়দর্শনে এই ষোড়শ পদার্থের বিস্তৃত আলোচনা করা হয়। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা সম্ভব কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য যথার্থজ্ঞানের প্রণালী কী হতে পারে তা ঠিক করার নিমিত্তে ন্যায়শাস্ত্রে জ্ঞানতত্ত্বের প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। ন্যায় দর্শনের প্রধান তত্ত্বগুলি হলো- জ্ঞানতত্ত্ব, জগৎতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব এবং ঈশ্বরতত্ত্ব।

 মহর্ষি গোতমের মতে আত্যন্তিক দুঃখ ধ্বংসই মুক্তি। এই মুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ন্যায় দর্শন লিখিত হইয়াছে।

 মহর্ষি গোতম ঈশ্বর স্বীকার করেন। তিনি বলেন জগতের উপাদান পরমাণু সৎ; কিন্তু তাহা জড় বলিয়া তাহার নিজের কোন স্বতন্ত্র ক্রিয়া নাই; পরমাণু জগতের উপাদান কারণ এবং ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ। ঈশ্বরেচ্ছায় পঞ্চভূতের পরমাণু মিলিত হইয়া জগৎরূপে প্রকাশিত হয়, এবং যখন ঈশ্বরেচ্ছায় এই জগৎ নিজকারণ পরমাণুতে ফিরিয়া যায় তখনই প্রলয়। এ সম্বন্ধে অতি সুন্দর উপমা আছে। কুম্ভকার মৃত্তিকা দ্বারা ঘট নির্ম্মাণ করে; কুম্ভকারের অথবা মৃত্তিকার অভাবে ঘট নির্ম্মিত হয় না; এইরূপ যখনই কোন কার্য্য দেখা যায় তখনই তাহার কোন কর্ত্তাও দেখা যায়; অর্থাৎ প্রত্যেক কার্য্যের নিমিত্ত-করণ ও উপাদান-কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। গোতম বলেন যখন একটি অতি সামান্য কার্য্যেরও কর্ত্তা দেখিতে পাওয়া যায়, তখন এই জগৎরূপ অতি মহৎ কার্য্যেরও একজন কর্ত্তা আছেন।

 পরমাণু নিরবয়ব, অবিভাজ্য, অজ ও নিত্য। ইহার দুইটি সংযোগে দ্ব্যণুক ও তিনটি দ্ব্যণুকের সংযোগে ত্রসরেণু এইরূপে ক্রমে মহাবয়বী পর্য্যন্ত উৎপন্ন হয়। অবয়বী পদার্থ বিভাজ্য অতএব তাহার বিনাশ আছে। পরমাণু ও দ্ব্যণুক প্রত্যক্ষ হয় না, ত্রসরেণু ইন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হইয়া থাকে। জগৎ যখন ক্রম বিভাগ দ্বারা পরমাণুরূপে পরিণত হয়, তখনই তাহার বিনাশ, প্রলয় বা তিরোভাব।

 মহর্ষি গোতম ষোড়শ পদার্থ স্বীকার করেন, যথা—প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস ছল, জাতি ও নিগ্রহস্থান। ইহাদিগের মধ্যে প্রমেয় পদার্থতত্ত্বের জ্ঞানই মুখ্যভাবে মুক্তির হেতু, এবং অপরাপর তত্ত্বের জ্ঞান পরম্পরা সম্বন্ধে মুক্তির হেতু। প্রমাণাদি পঞ্চদশ পদার্থ তর্কেতেই ব্যবহৃত হয় বলিয়া সে সম্বন্ধে কোন প্রকার বিশেষ উল্লেখ করা হইল না। কেবলমাত্র প্রমেয় পদার্থ কি তাহা বলা হইতেছে।

 প্রমেয় দ্বাদশ প্রকার, যথা—আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ। আত্মা দ্রষ্টা ও ভোক্তা। যাহাকে আশ্রয় করিয়া আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম শরীর। যদ্দ্বারা আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম ইন্দ্রিয়। ভোগ্য বস্তুর নাম অর্থ। ভোগ্যবস্তুর উপলব্ধি বা জ্ঞানের নাম বুদ্ধি। যে বস্তুর সংযোগে ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় এবং যাহার বিয়োগে ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় না তাহার নাম মন। স্মরণ, অনুমান, সংশয় প্রভৃতি মনের অনেক ধর্ম্ম আছে। প্রবৃত্তি তিন প্রকার,—শারীরিক, বাচিক ও মানসিক। রাগ, দ্বেষ ও মোহ এই তিনটির নাম দোষ; ইহাই প্রবৃত্তির হেতু। পুনঃ পুনঃ জন্ম ও মৃত্যুর নাম প্রেত্যভাব। প্রবৃত্তি হইতে যে সকল সুখ ও দুঃখের অনুভব হয় তাহার নাম ফল। অসৎকর্ম্মের ফলের নাম দুঃখ। সুখের অস্তিত্ব না থাকিলে দুঃখ হয় না, অতএব সুখও একপ্রকারে দুঃখ বলিয়া পরিগণিত হইতেছে। দুঃখের অত্যন্ত বিনাশের নাম অপবর্গ।

 মহর্ষি গোতম জ্ঞানকে আত্মার স্বরূপ বলেন না; কারণ ইঁহার মতে জ্ঞান ক্ষণিক; একক্ষণে ইহার উৎপত্তি, দ্বিতীয়ক্ষণে ইহার স্থিতি ও পরক্ষণে ইহার লয় হইয়া থাকে। একটি জ্ঞানের লয় না হইলে আর একটি জ্ঞানের উদয় হইতে পারে না। একই সময়ে দুই বা ততোধিক জ্ঞান একই ভাবে থাকিতে পারে না। যদিও অনেক সময় আমাদিগের মনে হয় যে এককালে আমাদিগের একাধিক জ্ঞান রহিয়াছে, কিন্তু তাহা বাস্তবিক নহে; বস্তুতঃ একাধিক জ্ঞান এত দ্রুত ভাবে মনের মধ্যে ক্রিয়া করে এবং তাহাদিগের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় এত দ্রুতভাবে সংঘটিত হয় যে তাহারা একই সময়ে রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।[১] অতএব জ্ঞান আত্মা স্বরূপ নহে, পরন্তু ইহা আত্মা হইতে উদ্ভূত হয়।

 এক্ষণে জীব কি প্রকারে অপবর্গ বা মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম হয় তাহা বলা হইতেছে। গোতম মতে ষোড়শ পদার্থের জ্ঞানই মুক্তির কারণ। দেহাদিতে আত্মবোধই আমাদিগের সমস্ত অনর্থের কারণ। ইহা হইতে দেহাদি অনুকূল বিষয়ে রাগ ও তৎপ্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ হইয়া থাকে। এই রাগ দ্বেষই প্রবৃত্তির কারণ। প্রবৃত্তি ধর্ম্মাধর্ম্মের কারণ। ধর্ম্মাধর্ম্ম সুখ দুঃখের কারণ। জন্ম না থাকিলে ফল ভোগ হয় না, অতএব কর্ম্মফল জন্মের কারণ। মুমুক্ষুব্যক্তি এই তত্ত্বগুলি বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া জন্ম মৃত্যুর আদিকারণ দেহাত্মবোধকে একেবারে পরিত্যাগ করিবেন। তাহা হইলেই তাঁহার সমস্ত দুঃখের চিরাবসান হইবে।


.

ন্যায় দর্শনের উদ্দেশ্য হলো ষোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করা। এই ষোলটি পদার্থ হলো- (১) প্রমাণ, (২) প্রমেয়, (৩) সংশয়, (৪) প্রয়োজন, (৫) দৃষ্টান্ত, (৬) সিদ্ধান্ত, (৭) অবয়ব, (৮) তর্ক, (৯) নির্ণয়, (১০) বাদ, (১১) জল্প, (১২) বিতণ্ডা, (১৩) হেত্বাভাস, (১৪) ছল, (১৫) জাতি, (১৬) নিগ্রহস্থান।
ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতম তাঁর ‘ন্যায়সূত্রে’র প্রথম সূত্রেই বলেছেন-  
‘প্রমাণ-প্রমেয়-সংশয়-প্রয়োজন-
দৃষ্টান্ত-সিদ্ধান্তাবয়ব-তর্ক-নির্ণয়-বাদ-জল্প-
বিতন্ডা-হেত্বাভাসচ্ছল-জাতি-নিগ্রহস্থানানাং
তত্ত্বজ্ঞানান্নিঃশ্রেয়সাধিগমঃ।। (ন্যায়সূত্র-১/১/১)।
অর্থাৎ : সেই অর্থাৎ মোক্ষোপযোগী এই ভাব পদার্থেরই প্রকার- প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতন্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি ও নিগ্রহস্থানের অর্থাৎ এই ষোল প্রকার পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানপ্রযুক্ত নিঃশ্রেয়স লাভ হয়।

 .
সাধারণত আমরা পদার্থ বলতে যা বুঝি এখানে পদার্থ অর্থ তা নয়। ন্যায় মতে পদার্থের অর্থ হচ্ছে- ‘পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ’। পদের অর্থই হলো পদার্থ। অর্থাৎ, কোন পদ দ্বারা যে অর্থ বা বিষয় নির্দেশিত হয়, তাই পদার্থ। প্রতিটি পদার্থই  জ্ঞেয়, প্রমেয় এবং অভিধেয়। অর্থাৎ যাকে জানা যায়, যার সত্তা আছে এবং যার নামকরণ করা যায়, তাই পদার্থ। ন্যায়দর্শন অনুযায়ী পদার্থগুলির তত্ত্বজ্ঞান জীবের মোক্ষ লাভের জন্য একান্ত প্রয়েজন।
 .
উল্লেখ্য, ন্যায়দর্শন হলো অনিয়ত পদার্থবাদী দর্শন। যে দর্শনে পদার্থের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, সেটিই হলো অনিয়তপদার্থবাদী দর্শন। যদিও ন্যায়দর্শনে ষোলটি পদার্থের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পদার্থ ষোলটি একথা বলা হয়নি। মুক্তির উপায় হিসাবে ষোলটি পদার্থের জ্ঞান উপযোগী একথাই কেবল বলা হয়েছে। একারণে ন্যায়দর্শন হলো অনিয়ত পদার্থবাদী দর্শন।
 .
(১) প্রমাণ : ‘প্র’ পূর্বক ‘মা’ ধাতুর উত্তর করণবাচ্যে অনট্ প্রত্যয় দ্বারা প্রমাণ শব্দ নিষ্পন্ন হয়। ‘মা’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান। ‘প্র’ উপসর্গের অর্থ প্রকৃষ্ট বা উৎকৃষ্ট। জ্ঞানের পক্ষে উৎকৃষ্টতা হলো ভ্রান্তিশূন্যতা। ‘অনট্’-প্রত্যয়ের অর্থ করণ অর্থাৎ কারণ বিশেষ। যাহার ব্যাপার বা কার্য হলে কর্তা ক্রিয়া নিষ্পন্ন করেন সেই কারণকেই করণ বলা হয়। অর্থাৎ, যে প্রণালী দ্বারা প্রমা বা যথার্থজ্ঞান লাভ করা যায় তাকেই প্রমাণ বলা হয়। ন্যায়মতে যথার্থজ্ঞান চারপ্রকার- প্রত্যক্ষণ, অনুমিতি, উপমিতি এবং শাব্দবোধ। ফলে এই চারপ্রকার যথার্থজ্ঞানের করণ বা প্রমাণও যথাক্রমে চারপ্রকার- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘প্রত্যক্ষানুমানোপমানশব্দাঃ প্রমাণানি’।। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ নামে প্রমাণপদার্থ চতুর্বিধ।

কোনো কিছুর প্রকৃত জ্ঞান লাভ করার পদ্ধতিকে প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণের মধ্যে আমরা জ্ঞানের সব উৎস পাই। দর্শনের বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রমাণের এক বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। তা নিয়ে পরে বিস্তৃত আলোচনা হবে।
 .
(২) প্রমেয় : প্রমেয় হলো যথার্থ অনুভব বা জ্ঞানের বিষয়। ন্যায়মতে প্রমেয়ের জ্ঞান মোক্ষলাভের সহায়ক। প্রমেয় বা জ্ঞানের বিষয় বারোটি- আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়ের বিষয় বা অর্থ, বুদ্ধি অর্থাৎ জ্ঞান বা উপলব্ধি, মন, প্রবৃত্তি বা ধর্ম ও অধর্ম, দোষ অর্থাৎ রাগ, প্রেত্যভাব অর্থাৎ পুনর্জন্ম, মোহ বা মৃত্যু, ফল অর্থাৎ কর্মজন্য সুখ-দুঃখের অনুভূতি, দুঃখ এবং অপবর্গ বা মোক্ষ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘আত্ম-শরীরেন্দ্রিয়ার্থ-বুদ্ধি-মনঃ-প্রবৃত্তি-
দোষ-প্রেত্যভাব-ফল-দুঃখাপবর্গাস্তু প্রমেয়ম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৯)
অর্থাৎ : আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ অর্থাৎ এই দ্বাদশ প্রকার পদার্থই প্রমেয় পদার্থ।
ন্যায়দর্শনে যথার্থ অনুভবের জ্ঞাতাকে ‘প্রমাতা’, জ্ঞানকে ‘প্রমা’, জ্ঞানের বিষয়কে ‘প্রমেয়’ এবং জ্ঞানের করণকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। উল্লেখ্য, অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- করণ হল অসাধারণ কারণ (‘অসাধারণং কারণং করণম্’)। অর্থাৎ যেকোন কারণ করণ নয়। আর কারণের লক্ষণ হিসেবে অন্নংভট্ট বলেন- ‘যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ (‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’)। ন্যায়মতে, সাধারণ ও অসাধারণ ভেদে কারণ দু’প্রকার। ঈশ্বর, ঈশ্বরের জ্ঞান-ইচ্ছা-প্রযত্ন, অদৃষ্ট, দিক্, কাল ও তৎ তৎ কার্যের প্রাগভাব- এই আটটি যে কোন কার্যের উৎপত্তিতে কারণ। তাই এগুলি সাধারণ কারণ। এই আটটি সাধারণ কারণ ভিন্ন যে যে পদার্থ কার্যোৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয়, তাই অসাধারণ কারণ। অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন- ‘করণের লক্ষণে ‘অসাধারণ’ শব্দ না দিলে দিক্, কাল প্রভৃতি সাধারণ কারণে করণের লক্ষণ সমন্বয় হয়ে যাবে। ফলে করণের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্য করণের লক্ষণে অসাধারণ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে (‘সাধারণকারণে দিককালাদৌ অতিব্যাপ্তি বারণায় অসাধারণ ইতি’)।
 .
ন্যায়মতে একমাত্র আত্মাই জ্ঞাতা হতে পারে। তবে জ্ঞান আত্মার আগন্তুক গুণ। মোক্ষাবস্থায় আত্মায় কোন জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। মুক্ত আত্মা তাই জ্ঞাতা হয় না। নৈয়ায়িকগণ যথার্থ অনুভব বা প্রমার চারটি উৎস (প্রমাণ) স্বীকার করেন। এই চারটি উৎস হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। মূলত এই চতুর্বিধ প্রমাণের আলোচনাই হলো ন্যায় দর্শনের মুখ্য আলোচনা।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের বিভাগ
ন্যায়মতে জ্ঞান প্রথমত দুইভাগে বিভক্ত- অনিত্যজ্ঞান (জীবের জ্ঞান) ও  নিত্যজ্ঞান (ঈশ্বরের জ্ঞান)।
অনিত্যজ্ঞান আবার দুই ভাগ- (ক) অনুভব ও (খ) স্মৃতি।
স্মৃতির দুই ভাগ- (১) যথার্থ স্মৃতি ও (২) অযথার্থ স্মৃতি।
অনুভবও দুই ভাগ- (১) যথার্থ অনুভব (প্রমা) ও (২) অযথার্থ অনুভব (অপ্রমা)।
 .
প্রমা বা যথার্থ অনুভবের উৎস হলো- যথার্থ প্রত্যক্ষণ, যথার্থ অনুমিতি, যথার্থ উপমিতি ও যথার্থ শাব্দবোধ।
অপ্রমা বা অযথার্থ অনুভবের উৎস হলো- ভ্রম, তর্ক, সংশয় ইত্যাদি এবং অযথার্থ প্রত্যক্ষ, অযথার্থ অনুমিতি, অযথার্থ উপমিতি ও অযথার্থ শাব্দবোধ।
 .
ন্যায়মতে একই বিষয়কে একাধিক প্রমাণের দ্বারা জানা যেতে পারে। এই মতবাদ ‘প্রমাণসংপ্লববাদ’ নামে পরিচিত। অপরদিকে যে মতবাদ ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট বিষয় স্বীকার করে তা ‘প্রমাণব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। ন্যায়সম্প্রদায় প্রমাণসংপ্লববাদী, কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রমাণ ব্যবস্থাবাদী।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের উৎপত্তি-প্রক্রিয়া
প্রত্যক্ষ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > বিষয় (পদার্থ) > (ফল) প্রত্যক্ষজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
অনুমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > ব্যাপ্তিজ্ঞান > বিষয় > (ফল) অনুমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
উপমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > সাদৃশ্যজ্ঞান > বিষয় > (ফল) উপমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
শব্দ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > পদজ্ঞান > বিষয় > (ফল) শাব্দ।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
স্মৃতি : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > বিষয়ের > সংস্কার > (ফল) স্মৃতিজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
এই প্রমেয় পদার্থগুলির প্রত্যেকটির লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে সূত্রকার ‘ন্যায়সূত্রে’ বলেছেন-  
‘ইচ্ছা-দ্বেষ-প্রযত্ন-সুখ-দুঃখ-জ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১০)
‘চেষ্টেন্দ্রিয়ার্থাশ্রয়ঃ শরীরম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১১)
‘ঘ্রাণরসনচক্ষুস্ত্বক্-শ্রোত্রাণীন্দ্রিয়াণি ভূতেভ্যঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১২)
‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
‘গন্ধরসরূপস্পর্শশব্দাঃ পৃথিব্যাদিগুণাস্তদর্থাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৪)
‘বুদ্ধিরুপলব্ধির্জ্ঞানমিত্যনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৫)
‘যুগপজ্-জ্ঞানানুৎপত্তির্স্মনসো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৬)
‘প্রবৃত্তির্ব্বাগ্ বুদ্ধিশরীরারম্ভঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৭)
‘প্রবর্ত্তনালক্ষণা দোষাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)
‘পুনরুৎপত্তিঃ প্রেত্যভাবঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৯)
‘প্রবৃত্তিদোষজনিতোহর্থঃ ফলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২০)
‘বাধনালক্ষণং দুঃখম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২১)
‘তদত্যন্তবিমোক্ষোহপবর্গঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২২)
অর্থাৎ :
ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ ও জ্ঞান আত্মার লিঙ্গ অর্থাৎ দেহাদিভিন্ন চিরস্থায়ী জীবাত্মার অনুমাপক (ন্যায়সূত্র-১/১/১০)।  চেষ্টার আশ্রয়, ইন্দ্রিয়ের আশ্রয় এবং অর্থের (সুখ-দুঃখের) আশ্রয় শরীর (ন্যায়সূত্র-১/১/১১)।  ভূতবর্গজন্য অর্থাৎ যথাক্রমে পৃথিব্যাদি পঞ্চভূতমুলক ঘ্রাণ, রসন, চক্ষুঃ, ত্বক ও শ্রোত্র হলো ইন্দ্রিয় (ন্যায়সূত্র-১/১/১২)।  ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)।  পৃথিব্যাদির গুণ (পূর্বোক্ত পঞ্চভূতের গুণ) গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ হলো ‘তদর্থ’ বা ইন্দ্রিয়ার্থ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৪)।  বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান এগুলি অর্থান্তর নয়, অর্থাৎ একই পদার্থ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৫)।  একই সময়ে জ্ঞানের অর্থাৎ বিজাতীয় নানা প্রত্যক্ষের অনুৎপত্তি বা উৎপত্তি না হওয়াই মনের লিঙ্গ বা অনুমাপক। যার সংযোগের অভাবে অন্য ইন্দ্রিয়জন্য প্রত্যক্ষ জন্মে না তাই হলো মন (ন্যায়সূত্র-১/১/১৬)।  বাচিক, মানসিক ও শারীরিক শুভাশুভ কর্মই প্রবৃত্তি (ন্যায়সূত্র-১/১/১৭)।  প্রবৃত্তিজনকত্ব যাদের লক্ষণ এবং অনুমাপক, সেই সমস্ত হলো দোষ অর্থাৎ রাগ, দ্বেষ ও মোহ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)।  পুনরুৎপত্তি অর্থাৎ মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হচ্ছে প্রেত্যভাব (ন্যায়সূত্র-১/১/১৯)।  প্রবৃত্তি এবং দোষ-জনিত পদার্থ (সুখ-দুঃখের অনুভব) হচ্ছে ফল (ন্যায়সূত্র-১/১/২০)।  এই সমস্তই অর্থাৎ পূর্বোক্ত শরীর থেকে ফল পর্যন্ত সমস্ত প্রমেয়ই বাধনালক্ষণ অর্থাৎ দুঃখানুষক্ত দুঃখ (ন্যায়সূত্র-১/১/২১)।  তার সাথে (পূর্বোক্ত মুখ্য গৌণ সবধরনের দুঃখের সাথে) অত্যন্ত মুক্তি হচ্ছে মোক্ষ বা অপবর্গ (ন্যায়সূত্র-১/১/২২)।
 .
(৩) সংশয় বা সন্দেহ : সংশয় হলো একপ্রকার অনিশ্চিত জ্ঞান। কোনো বস্তু ঠিক কী হবে নির্ণয় করতে না পেরে বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে মনে যে সন্দেহ হয় তাকে সংশয় বলে। একই সময়ে একই বস্তুতে পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম বা গুণের উপস্থিতির জ্ঞান বা চিন্তা করা হলে তখনই সংশয় দেখা দেয়। যেমন- ‘এটি স্থানু অথবা পুরুষ’ এরূপ জ্ঞান। তাই অনিশ্চিত জ্ঞানই হলো সংশয়। এই সংশয় বা সন্দেহ প্রসঙ্গে ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে-  
‘সমানানেক ধর্ম্মোপপত্তেঃ র্ব্বিপ্রতিপত্তেঃ উপলব্ধ্যনুপলব্ধঃ অব্যবস্থাতশ্চ বিশেষাপেক্ষো বিমর্শঃ সংশয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৩)
অর্থাৎ : সাধারণ ধর্মবিশিষ্ট ধর্মীর জ্ঞানজন্য, অসাধারণ ধর্মবিশিষ্ট ধর্মীর জ্ঞানজন্য, বিপ্রতিপত্তিজন্য অর্থাৎ এক পদার্থে বিরুদ্ধার্থ-প্রতিপাদক বাক্যজন্য, উপলব্ধির অব্যবস্থাজন্য, এবং অনুপলব্ধির অব্যবস্থাজন্য ‘বিশেষাপেক্ষ’ অর্থাৎ যাতে পূর্বে বিশেষ ধর্মের উপলব্ধি হয় না, কিন্তু বিশেষ ধর্মের স্মৃতি আবশ্যক, এমন ‘বিমর্শ’ অর্থাৎ একই পদার্থে নানা বিরুদ্ধ পদার্থের জ্ঞান হচ্ছে সংশয়।
 .
(৪) প্রয়োজন : মানুষ যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মে প্রবৃত্ত হয় তাকেই প্রয়োজন বলা হয়। প্রয়োজন হলো সেই উদ্দেশ্য যা লাভ বা পরিহারের জন্য মানুষকে প্রবৃত্ত করায়। আমরা কোনো বাঞ্ছনীয় বিষয়কে পাওয়ার জন্য কাজ করি অথবা অবাঞ্ছনীয় জিনিস থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কাজ করি। এই দুটোই হলো আমাদের কর্মের উদ্দেশ্য। এই দুই ধরনের কর্মে প্রবৃত্ত হওয়াকে প্রয়োজন বলা হয়। এককথায়, প্রয়োজন হলো সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখের বিনাশ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘যমর্থমধিকৃত্য প্রবর্ত্ততে তৎ প্রয়োজনম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৪)
অর্থাৎ : যে পদার্থকে অধিকার করে অর্থাৎ গ্রাহ্য বা ত্যাজ্যরূপে নিশ্চয় করে (জীব) প্রবৃত্ত হয়, তা-ই প্রয়োজন।
 .
(৫) দৃষ্টান্ত : দৃষ্টান্ত হলো প্রমাণসিদ্ধ উদাহরণ। যার সম্বন্ধে কোনো মতভেদ থাকে না, বাদী ও প্রতিবাদী উভয়ই যা স্বীকার করে নেয় তাকে দৃষ্টান্ত বলে। যেমন, কোনো জায়গায় ধূম দেখে যদি সিদ্ধান্তে আসে যে ‘সেখানে আগুন আছে’, তখন দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বলন্ত চুল্লির উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে; কারণ জ্বলন্ত চুল্লিতে ধূম ও অগ্নির সহাবস্থান সকলেই জানেন। অর্থাৎ, দৃষ্টান্ত হলো অনুমানের সহায়ক ব্যাপ্তি সম্বন্ধের সমর্থসূচক বস্তু, যেমন পাকশালা। এ সম্বন্ধে সূত্রকার বলেছেন-
‘লৌকিকপরীক্ষকাণাং যস্মিন্নর্থে বুদ্ধিসাম্যং স দৃষ্টান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৫)
অর্থাৎ : লৌকিকদের এবং পরীক্ষকদের যে পদার্থে বুদ্ধির সাম্য (অবিরোধ) হয়, তা দৃষ্টান্ত।
 .
(৬) সিদ্ধান্ত : সিদ্ধান্ত হলো কোনো বিষয় সম্পর্কে শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। যেমন ন্যায়দর্শনের একটি সিদ্ধান্ত হলো- আত্মা এক প্রকার দ্রব্য যেখান থেকে চেতনাগুণকে আলাদা করা যায় অর্থাৎ চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ। সহজ কথায়, সিদ্ধান্ত হলো কোন কিছু যা প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘তন্ত্রাধিকরণাভ্যূপগমসং স্থিতিঃ সিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৬)
অর্থাৎ : তন্ত্রাধিকরণের অর্থাৎ প্রমাণবোধিত পদার্থসমূহের স্বীকার-সংস্থিতি হচ্ছে সিদ্ধান্ত।
.
এই সিদ্ধান্ত পদার্থ চারপ্রকার। ন্যায়সূত্রে এ সম্বন্ধে মহর্ষি বলেছেন-  
‘স চতুর্ব্বিধঃ সর্ব্বতন্ত্র-প্রতিতন্ত্রাদিকরণাভ্যুপগমসং স্থিত্যর্থান্তরভাবাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৭)
অর্থাৎ : কিন্তু তন্ত্রের ভেদপ্রযুক্ত সেই সিদ্ধান্ত পদার্থ চতুর্বিধ, যেহেতু- সর্বতন্ত্রসংস্থিতি, প্রতিতন্ত্রসংস্থিতি, অধিকরণসংস্থিতি ও অভ্যুপগমসংস্থিতির ‘অর্থান্তভাব’ (পরস্পর ভেদ) আছে।
.
তার মানে সিদ্ধান্ত চার প্রকার, যথা- সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত, প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত, অধিকরণসিদ্ধান্ত ও অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-  
‘সর্ব্বতন্ত্রাবিরুদ্ধস্তন্ত্রেঃ অধিকৃতোহর্থঃ সর্ব্বতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৮)
অর্থাৎ : তারমধ্যে সর্বশাস্ত্রে অবিরুদ্ধ, শাস্ত্রে কথিত পদার্থ হলো সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
.
ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত বুঝাতে ‘ন্যায়ভাষ্যে’ উদাহরণ দিয়ে বলেছেন- ‘যেমন ঘ্রাণাদি ইন্দ্রিয়, গন্ধ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ার্থ, ক্ষিতি প্রভৃতি ভূত, প্রমাণের দ্বারা পদার্থের যথার্থ জ্ঞান হয়, ইত্যাদি সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত’ (যথা ঘ্রাণাদীনীন্দ্রিয়াণি, গন্ধাদয় ইন্দ্রিয়ার্থাঃ, পৃথিব্যাদীনি ভূতানি, প্রমাণৈরর্থস্য গ্রহণমিতি)।
প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-  
‘সমানতন্ত্রসিদ্ধঃ পরতন্ত্রাসিদ্ধঃ প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৯)
অর্থাৎ : সমানতন্ত্রসিদ্ধ অর্থাৎ একশাস্ত্র বা স্বশাস্ত্রসিদ্ধ, (কিন্তু) পরতন্ত্রে (অন্য শাস্ত্রে) অসিদ্ধ (পদার্থ) হচ্ছে প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
.
যেমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যা সমানতন্ত্র হিসেবে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে সিদ্ধান্ত করা হয় যা অন্য দর্শনে অস্বীকৃত। একইভাবে সাংখ্য ও যোগ সমানতন্ত্র শাস্ত্র, মীমাংসা ও বেদান্ত সমানতন্ত্র শাস্ত্র, ফলে এগুলির মধ্যে মৌলিক কিছু সিদ্ধান্তে মতপার্থক্য থাকলেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সমানতান্ত্রিক।
এরপর অধিকরণসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-  
‘যৎসিদ্ধাবন্যপ্রকরণসিদ্ধঃ সোহধিকরণসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩০)
অর্থাৎ : যে পদার্থের সিদ্ধিবিষয়ে অন্য ‘প্রকরণে’র অর্থাৎ অন্য আনুষঙ্গিক পদার্থের সিদ্ধি হয়, সেই পদার্থ হলো অধিকরণসিদ্ধান্ত।
.
যেমন বৃত্তিকার বিশ্বনাথ জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্বকে অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন। কারণ, জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্ব ছাড়া সৃষ্টির প্রথমে উৎপদ দ্ব্যণুকাদির সকর্তৃকত্ব সিদ্ধ হয় না। যে পদার্থ ব্যতীত যা সিদ্ধ হয় না, সেই পদার্থই তার সিদ্ধিতে ‘অনুষঙ্গী’ পদার্থ। নৈয়ায়িক উদ্দ্যোতকর প্রভৃতি সেই অনুষঙ্গী পদার্থকেই অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন।
অতঃপর অভ্যুপগমসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-  
‘অপরীক্ষিতাভ্যূপগমাৎ তদ্বিশেষপরীক্ষণম্ অভ্যুপগমসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩১)
অর্থাৎ : (যে স্থলে) অপরীক্ষিত পদার্থের স্বীকারপ্রযুক্ত অর্থাৎ প্রমাণাদির দ্বারা বিচারপূর্বক অনির্ণীত কোন পরসিদ্ধান্তের (আপাত) স্বীকার করে যখন সেই ধর্মীর বিশেষধর্মের পরীক্ষা অর্থাৎ বিচার করা হয়, (সেই স্থলে সেই স্বীকৃত পরসিদ্ধান্ত) হচ্ছে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
.
অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত বুঝাতে গিয়ে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ব্যাখ্যানুসারে, যে স্থলে প্রতিবাদী নিজের অসম্মত কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই কোন পদার্থের বিশেষ ধর্মের পরীক্ষা বা বিচার করেন, সেই স্থলে তাঁর আপাত স্বীকৃত সেই পরসিদ্ধান্তই তাঁর পক্ষে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত। যেমন, কোন বাদী শব্দকে নিত্য ও দ্রব্যপদার্থ বললে, তখন প্রতিবাদী নৈয়ায়িক যদি বলেন যে, আচ্ছা, শব্দ দ্রব্যপদার্থই হোক, কিন্তু তা নিত্য অথবা অনিত্য, সেটি পরীক্ষণীয়। এভাবে নৈয়ায়িক শব্দের দ্রব্যত্ব মেনে নিয়েই তার বিশেষ ধর্ম নিত্যত্ব ও অনিত্যত্ব বিষয় বিচার করলে সেই স্থলে তাঁর স্বীকৃত ঐ পরসিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে ‘অভ্যুপগম-সিদ্ধান্ত’।
 .
(৭) অবয়ব : অবয়ব হলো ন্যায়দর্শন স্বীকৃত পরার্থানুমান বা অনুমানের অন্তর্গত যে-কোনো একটি অঙ্গ। পরার্থানুমানের পাঁচটি অবয়ব। অবয়ব প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্ অবয়বাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩২)
অর্থাৎ : প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পঞ্চবাক্য অবয়ব।
প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পাঁচটি বাক্যকে ন্যায়ের অবয়ব বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ-
১. পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)
২. কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)
৩. যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি (উদাহরণ)
৪. পর্বত ধূমায়মান (উপনয়)
৫. সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন) 
অবয়ব নিয়ে পরে ভিন্নভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
 ..
(৮) তর্ক : তর্ক হলো এমন এক প্রাকল্পিক যুক্তি (a hypothetical argument) যা কোনো স্বীকৃত সিদ্ধান্তের বিপরীত বক্তব্যকে অসম্ভব প্রমাণ করার জন্য প্রদর্শন করা হয় এবং তার দ্বারা পরোক্ষভাবে মূল সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণ করা হয়। যেমন- পর্বতে ধূম থাকলেও কেউ যদি পর্বতে অগ্নির অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা এরূপ তর্ক প্রয়োগ করেন যে ‘যদি অগ্নি না থাকে তাহলে ধূম অগ্নিজন্য না হোক্’। তর্কের সংজ্ঞায় ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘অবিজ্ঞাত-তত্ত্বেহর্থে কারণোপপত্তিতস্তত্ত্বজ্ঞানার্থম্ ঊহঃ তর্কঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪০)
অর্থাৎ : ‘অবিজ্ঞাততত্ত্ব’ পদার্থে অর্থাৎ সামান্যতঃ জ্ঞাত যে পদার্থের তত্ত্ব অবিজ্ঞাত, এমন পদার্থ বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞানের নিমিত্ত, কারণের উপপত্তি অর্থাৎ প্রমাণের সম্ভবপ্রযুক্ত ‘ঊহ’ (জ্ঞানবিশেষ) হচ্ছে তর্ক।
.
তর্ক প্রসঙ্গে উদয়নাচার্য্যরে মতানুসারেই বরদরাজ তাঁর ‘তার্কিকরক্ষা’য় বলেছেন-  
‘তর্কোহনিষ্টপ্রসঙ্গঃ স্যাদনিষ্টং দ্বিবিধং স্মৃতং।
প্রামাণিকপরিত্যাগস্তথেতরপরিগ্রহঃ।।’- (তার্কিকরক্ষা)
অর্থাৎ : অনিষ্টের প্রসঙ্গ বা আপত্তিই তর্ক। সেই অনিষ্ট প্রামাণিক পদার্থের পরিত্যাগ এবং অপ্রামাণিক পদার্থের স্বীকার।
.
যেমন ‘জলপান পিপাসার নিবর্তক নয়’ একথা বললে আপত্তি হয় যে, তাহলে পিপাসু ব্যক্তিরা জল পান না করুক? মহানৈয়ায়িক উদয়নাচার্য্যরে মতে ‘তর্ক’পদার্থ পঞ্চবিধ-  আত্মাশ্রয়, ইতরেতরাশ্রয়, চক্রকাশ্রয়, অনবস্থা ও অনিষ্টপ্রসঙ্গ তর্ক।
কোন পদার্থ নিজের উৎপত্তি অথবা স্থিতি অথবা জ্ঞানে অব্যবধানে নিজেকে অপেক্ষা করলে একারণে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘আত্মাশ্রয়’। আর সেই পদার্থ অপর একটি পদার্থকে অপেক্ষা করে আবার নিজেকেই অপেক্ষা করলে সেকারণে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘ইতরেতরাশ্রয়’ বা ‘অন্যোন্যাশ্রয়’। এইরূপ অপর দুটি পদার্থ বা ততোধিক পদার্থকে অপেক্ষা করে আবার নিজেকেই অপেক্ষা করলে তার ফলে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘চক্রকাশ্রয়’। আর যে আপত্তির কোথাও বিশ্রাম বা শেষ নেই, এমন যে ধারাবাহিক আপত্তি, তাকে বলে ‘অনবস্থা’। এভাবে অনন্ত আপত্তিমূলক যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাও ‘অনবস্থা’ নামে কথিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্থলে ঐরূপ আপত্তি সর্বমতে প্রমাণসিদ্ধ হলে তা ‘অনবস্থা’রূপ তর্ক হবে না। কারণ, সেরূপ স্থলে সেটি সকল মতেই ইষ্টাপত্তি। এই চারপ্রকার তর্ক ছাড়া বাকি সমস্ত তর্কই ‘অনিষ্টপ্রসঙ্গ’ নামে পঞ্চম প্রকার তর্ক।
 .
(৯) নির্ণয় : নির্ণয় হলো এমন এক যুক্তি যার সাহায্যে এক পক্ষের মতকে বর্জন করে অপর পক্ষের মতকে গ্রহণ করা হয়। পরস্পরবিরোধী মতবাদ বিচার করে একটিকে বর্জন করে অপরটিকে গ্রহণ করার নাম নির্ণয়। সোজা কথায়, নির্ণয় হলো স্বীকৃত প্রমাণের দ্বারা একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘বিমৃশ্য পক্ষপ্রতিপক্ষাভ্যামর্থ অবধারণং নির্ণয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪১)
অর্থাৎ : তর্কবিষয়ে অর্থাৎ পূর্বোক্ত তর্কস্থলে- সংশয় করে পক্ষ ও প্রতিপক্ষের দ্বারা অর্থাৎ স্বপক্ষের সংস্থাপন এবং পরপক্ষের সাধনের খন্ডনের দ্বারা পদার্থের অবধারণ হচ্ছে নির্ণয়।
 .
(১০) বাদ : বাদ হলো তত্ত্বকে জানার জন্য একপ্রকার কথা বা আলোচনা। প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা তত্ত্বনির্ণয়ের উদ্দেশ্যে আলোচনাকেই বাদ বলা হয়। যেমন আত্মার অস্তিত্ব আছে আবার নেই, দুটো সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরূপ ক্ষেত্রে আত্মার যথার্থ স্বরূপ নির্ণয় করার জন্য যে আলোচনা তাই হলো বাদ। গুরু-শিষ্যের দার্শনিক আলোচনা বাদ-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাদ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘প্রমাণ-তর্ক-সাধনোপালম্ভঃ সিদ্ধাস্তাবিরুদ্ধঃ পঞ্চাবয়বোপপন্নঃ পক্ষপ্রতিপক্ষপরিগ্রহো বাদঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪২)
অর্থাৎ : যাতে প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা ‘সাধন’ (স্বপক্ষস্থাপন) এবং ‘উপালম্ভ’ (পরপক্ষখণ্ডন) হয়, এমন ‘সিদ্ধান্তবিরুদ্ধ’ ও পঞ্চাবয়বযুক্ত ‘পক্ষপ্রতিপক্ষ-পরিগ্রহ’ অর্থাৎ যাতে বাদী ও প্রতিবাদীর স্বীকৃত বিরুদ্ধ-ধর্মদ্বয়রূপ পক্ষ ও প্রতিপক্ষের পরিগ্রহ হয়, এমন বাক্যসমূহ হচ্ছে ‘বাদ’।
 .
(১১) জল্প : কোন তত্ত্বনির্ণয়ের প্রতি লক্ষ্য না রেখে কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য যে নিছক বাক্-যুদ্ধ চলে, তাকেই বলা হয় জল্প। জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মপক্ষ সমর্থন। এখানে শাস্ত্রনীতি লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে। সোজা কথায়, জল্প সেই আলোচনা যার লক্ষ্য তত্ত্বজ্ঞান নয়, যার একমাত্র লক্ষ্য জয়লাভ করা। ন্যায়সূত্রে জল্প প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-  
‘যথোক্তোপপন্নশ্ছল-জাতি-নিগ্রহস্থান-সাধনোপালম্ভো জল্পঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৩)
অর্থাৎ : পূর্বসূত্রে বাদের লক্ষণে কথিত সমস্ত বিশেষণবিশিষ্ট হয়ে ‘ছল’, ‘জাতি’ ও সমস্ত ‘নিগ্রহস্থানে’র দ্বারা যাতে সাধন ও উপালম্ভ (পরপক্ষখণ্ডন) করা যায়, তা হচ্ছে জল্প।
 .
(১২) বিতণ্ডা : বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক। এক্ষেত্রে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে অপরের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার আলোচনা যার লক্ষ্য তত্ত্বজ্ঞান নয়, জয়লাভ করাও নয়, যার একমাত্র লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে খণ্ডন করা। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘স প্রতিপক্ষস্থাপনাহীনো বিতণ্ডা’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৪)
অর্থাৎ : সেই জল্প, প্রতিপক্ষের স্থাপনাশূন্য হলে বিতণ্ডা হয়।
 .
(১৩) হেত্বাভাস : হেত্বাভাস অনুমান সংক্রান্ত অনুপপত্তি বা অনুমানের হেতু সংক্রান্ত দোষ। যে হেতুতে সৎ হেতুর লক্ষণের কোন একটির অভাব থাকে সেটিই অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস দোষদুষ্ট হেতু। আসলে হেতু নয় অথচ হেতুর আভাস বা হেতুর মতো দেখায় তাকে হেত্বাভাস বলে। হেত্বাভাসের লক্ষণে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেছেন-  
‘হেতুলক্ষণাভাবাদহেতবো হেতুসামান্যাৎ হেতুবদাভাসমানাঃ’। (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : হেতুর সমস্ত লক্ষণ না থাকায় অহেতু অর্থাৎ প্রকৃত হেতু নয়, এবং হেতুর সামান্য বা সাদৃশ্য থাকায় হেতুর ন্যায় প্রকাশমান, এটাই ‘হেত্বাভাস’ শব্দের অর্থ।
.
হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার। এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-  
‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-প্রকরণসম-সাধ্যসম-কালাতীতা হেত্বাভাসাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৫)
অর্থাৎ : এসব লক্ষণাক্রান্ত হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, প্রকরণসম, সাধ্যসম ও কালাতীত।  
.
গুরুত্ব বিবেচনায় হেত্বাভাস নিয়ে ভিন্নভাবে আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
 .
(১৪) ছল : বক্তা যে অর্থে একটি শব্দ বা বাক্য প্রয়োগ করেন, প্রতিপক্ষ যদি সেই শব্দ বা বাক্যের অন্য অর্থ কল্পনা করে বক্তার বক্তব্যের দোষ দেখান, তাহলে তাকে বলা হয় ছল। ছলে দেখা যায় যে, বাদী বা বক্তা এক অর্থে একটি শব্দ ব্যবহার করে কিন্তু প্রতিপক্ষ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক হওয়ার জন্য শব্দটিকে অন্য অর্থে গ্রহণ করে। বাক চাতুরী দ্বারা প্রতিপক্ষের বাক্যের দোষ দেখানো হলো ছল। যেমন ‘দণ্ড’ কথাটি সময়ের অংশ এই অর্থে বাদী বললো যে- ‘দণ্ড’ হলো ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ‘দণ্ড’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো ‘শাস্তি’। প্রতিপক্ষ বিপরীত অর্থ কল্পনা করে ছল করলেন। সোজা কথায়, ছল হলো একটি বাক্যের অভিপ্রেত অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করে ঐ বাক্যের খণ্ডন (দূষণ)। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘বচনবিঘাতোহর্থাবকল্পোপপত্ত্যা ছলং’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫১)
অর্থাৎ : ‘অর্থবিকল্প’- অর্থাৎ বাদীর অভিমত অর্থের বিরুদ্ধার্থ-কল্পনারূপ উপপত্তির দ্বারা (বাদীর) বচনের বিঘাত হচ্ছে ছল।
.
ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে, ছল তিনপ্রকার- বাক্-ছল, সামান্য ছল এবং উপচার ছল।
‘তৎ ত্রিবিধং–বাক্ছলং সামান্যচ্ছলম্ উপাচারচ্ছলঞ্চ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫২)
অর্থাৎ : ছল ত্রিবিধ- বাক্-ছল, সামান্যছল ও উপচারছল।
.
এই তিনপ্রকার ছলের লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-  
‘অবিশেষাহিতেহর্থে বক্তুরভিপ্রায়াৎ অর্থান্তরকল্পনা বাক্চ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৩)
‘সম্ভবতোহর্থস্য অতিসামান্যযোগাৎ অসম্ভূতার্থকল্পনা সামান্যচ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৪)
‘ধর্ম্মবিকল্প-নির্দ্দেশেহর্থ-সদ্ভাব-প্রতিষেধ উপচারচ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৫)
অর্থাৎ :
সেই ত্রিবিধ ছলের মধ্যে অবিশেষে উক্ত হলে অর্থাৎ দ্ব্যর্থ বোধক সমান শব্দ প্রয়োগ করলে অর্থ বিষয়ে বক্তার অভিপ্রেত অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থের কল্পনা বা ঐরূপ অর্থান্তরকল্পনার দ্বারা যে দোষপ্রদর্শন, তা বাক্ছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৩)। সম্ভাব্যমান পদার্থের সম্বন্ধে অতি সামান্য ধর্মের যোগবশত অর্থাৎ যে সামান্য ধর্মটি বক্তার উদ্দিষ্ট পদার্থকে অতিক্রম করে অন্যত্রও থাকে, সেরূপ সামান্য ধর্মের সম্বন্ধবশত অসম্ভব অর্থের যে কল্পনা বা সেই কল্পনার দ্বারা যে প্রতিষেধ, তা সামান্যছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৪)।  ধর্মবিকল্পের নির্দেশ হলে অর্থাৎ কোন শব্দের লাক্ষণিক বা গৌণ অর্থে প্রয়োগ হলে অর্থসদ্ভাবের দ্বারা যে প্রতিষেধ, অর্থাৎ মুখ্যার্থ অবলম্বন করে যে দোষ প্রদর্শন, তা উপচারছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৫)।
 .
(১৫) জাতি : ব্যাপ্তির উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র সাদৃশ্য (similarity) বা বৈসাদৃশ্যের (dissimilarity) উপর ভিত্তি করে যখন কোনো অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি উপস্থাপন করা হয় তখন তাকে জাতি বলে। যদি কেউ যুক্তি দেখায় যে ‘শব্দ অনিত্য’ কারণ ঘট-পটাদির মতো উৎপত্তিশীল। বক্তার এই সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করার জন্য প্রতিপক্ষ বলেন ‘শব্দ নিত্য’ কারণ এ আকাশের মতো অমূর্ত। এখানে নিত্যত্ব এবং অমূর্তত্বের মধ্যে কোনো ব্যাপ্তি সম্পর্ক নেই। প্রতিপক্ষের এ যুক্তির নাম জাতি। অর্থাৎ, জাতি হলো মিথ্যা সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে অযথার্থ উত্তর প্রদান। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছ-  
‘সাধর্ম্ম্য-বৈধর্ম্ম্যাভ্যাং প্রত্যবস্থানং জাতিঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৯)
অর্থাৎ : সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যরে দ্বারা অর্থাৎ কেবল কোন সাধর্ম্য অথবা কোন বৈধর্ম্য গ্রহণ করে তার দ্বারা ‘প্রত্যবস্থান’ (প্রতিষেধ) হলো জাতি।
জাতি অষ্টাদশ (মতান্তরে চব্বিশ) রকমের, যথা- সাধর্ম্যসমা, বৈধর্ম্যসমা, উৎকর্ষসমা, অপকর্ষসমা, বর্ণ্যসমা, অবর্ণ্যসমা, বিকল্পসমা, সাধ্যসমা, প্রাপ্তিসমা, অপ্রাপ্তিসমা, প্রসঙ্গসমা, প্রতিদৃষ্টান্তসমা, অনুৎপত্তিসমা, উৎপত্তিসমা, উপলব্ধিসমা, নিত্যসমা, অনিত্যসমা এবং কার্যসমা।
 .
(১৬) নিগ্রহস্থান : নিগ্রহের অর্থ বিতর্কে পরাজয়ের হেতু বা কারণ। যদি যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করতে না পারে বা প্রতিপক্ষের নিজ মত খণ্ডিত হওয়ার ফলে তাকে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে তবে সে কারণ হবে নিগ্রহস্থান। ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-  
‘বিপ্রতিপত্তিরপ্রতিপত্তিশ্চ নিগ্রহস্থানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৬০)
অর্থাৎ : বিপ্রতিপত্তি অর্থাৎ বিপরীত জ্ঞান এবং কুৎসিত জ্ঞান; আর অপ্রতিপত্তি অর্থাৎ অজ্ঞতাবিশেষ নিগ্রহস্থান। অর্থাৎ যার দ্বারা বাদী বা প্রতিবাদীর বিপ্রতিপত্তি অথবা অপ্রতিপত্তি বুঝা যায়, তাকে নিগ্রহস্থান বলে।
নিগ্রহস্থান বাইশ (মতান্তরে চব্বিশ) প্রকারের। যেমন- প্রতিজ্ঞাহানি, প্রতিজ্ঞান্তর, প্রতিজ্ঞাবিরোধ, প্রতিজ্ঞাসন্ন্যাস, হেত্বান্তর, অর্থান্তর, নিরর্থক, অবিজ্ঞাতার্থক, অপার্থক, অপ্রাপ্তকাল, ন্যূন, অধিক, পুনরুক্ত, অননুভাষণ, অজ্ঞান, অপ্রতিভা, বিক্ষেপ, মতানুজ্ঞা, পর্যনুযোজ্যোপেক্ষণ, নিরনুযোজ্যোনুযোগ, অপসিদ্ধান্ত এবং হেত্বাভাস।
বিচারে পরাজয়ের কারণ নানাভাবে হতে পারে। ভ্রমাত্মক জ্ঞান অথবা অজ্ঞানতাই পরাজয়ের কারণ।
 
৩.০ : ন্যায় জ্ঞানতত্ত্ব…

ন্যায়দর্শনে বস্তুতত্ত্ব জ্ঞানতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এই দর্শনে জ্ঞানের সংজ্ঞা, জ্ঞানের প্রকারভেদ, যথার্থ জ্ঞান ও অযথার্থ জ্ঞানের প্রকৃতি কী এবং এদের মধ্যে পার্থক্য কী তা বিস্তৃত আলোচনায় করা হয়।
 .
৩.১ : জ্ঞানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়মতে জ্ঞান গুণপদার্থ। এই গুণ হলো আত্মার গুণ। জ্ঞান ও বুদ্ধি এই দর্শনে সমার্থক। তাই মহর্ষি গৌতম বলেছেন-

‘বুদ্ধিঃ উপলব্ধিঃ জ্ঞানম্ ইতি অনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র)।
অর্থাৎ : বুদ্ধি, উপলব্ধি জ্ঞান ইত্যাদি শব্দগুলি একই পদার্থকে বোঝায়।
 .
আবার অন্নংভট্ট ‘তর্কসংগ্রহ’ গ্রন্থে বুদ্ধি বা জ্ঞানের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘সর্বব্যবহারহেতুঃ গুণঃ বুদ্ধিঃ জ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে পদার্থটি সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ, সেই গুণস্বরূপ পদার্থই জ্ঞান। এবং জ্ঞান বুদ্ধির নামান্তর বা বুদ্ধি জ্ঞানের নামান্তর; যা বুদ্ধি, তাই জ্ঞান; যা জ্ঞান তাই বুদ্ধি। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন।
 .
ন্যায় মতে জ্ঞানের মাধ্যমে বিষয় আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। জ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো বিষয়ের রূপ আমাদের কাছে প্রকাশ করা। আলো যেমন তার সামনের স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল যাবতীয় বস্তুকে আলোকিত করে, তেমনি জ্ঞানও তার সম্মুখের স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল যাবতীয় বিষয়কে আমাদের কাছে প্রকাশ করে। তাই জ্ঞান সকল ব্যবহারের হেতু এবং আত্মার গুণ। পদার্থরূপে জগতের সকল বস্তুই জ্ঞান-নিরপেক্ষ। জ্ঞাতা যখন পদার্থকে জানে তখন সেই পদার্থ জ্ঞাতার জ্ঞানের বিষয় হয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় ও পদার্থ একই জিনিস হলেও কেবলমাত্র জ্ঞানের প্রসঙ্গেই পদার্থকে ‘বিষয়’ বলে অভিহিত করা হয়। জ্ঞানের প্রসঙ্গে আত্মা ‘জ্ঞাতা’ রূপে, পদার্থ ‘বিষয়’ রূপে, মন ও ইন্দ্রিয়াদি ‘করণ’ রূপে পরিচিত হয়।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞান ত্রি-ক্ষণবর্তী। প্রথমক্ষণের উৎপন্ন জ্ঞান দ্বিতীয়ক্ষণে স্থিতি লাভ করে এবং তৃতীয়ক্ষণে তার বিনাশ হয়। তবে স্থায়িত্বের এই ‘দ্বিতীয়ক্ষণ’ যদিও ‘ক্ষণ’ বলেই পরিচিত তবুও এই ‘ক্ষণ’ যে কতোটা পরিমাণ কালকে নির্দেশ করে তা সঠিকভাবে বলা যায় না। পদার্থের উপস্থিতিতে, তা প্রত্যক্ষভাবেই হোক আর পরোক্ষভাবেই হোক, পদার্থের জ্ঞানকে বলে অনুভব। অন্যান্য প্রকার জ্ঞানের ন্যায় অনুভবও উৎপত্তির পর আত্মার গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত থাকে। দ্বিক্ষণ অতিবাহিত হলে অনুভব ধ্বংস হয় এবং ঐ অনুভবের বিষয়ের সংস্কার আত্মায় আশ্রিত হয়। পরবর্তীকালে বস্তুর অ-সাক্ষাতে এই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে এক প্রকার জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এরূপ জ্ঞানকে বলা হয় ‘স্মৃতি’। এইজন্য স্মৃতিকে কেবলমাত্র সংস্কার থেকে উৎপন্ন জ্ঞান বলা হয়। তাই অন্নংভট্ট বলেন-

‘সংস্কারমাত্রজন্যং জ্ঞানং স্মৃতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে জ্ঞানে কেবল সংস্কারই কারণ হয় (চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয় কারণ হয় না), তাই স্মৃতি।
 .
 ‘কেবলমাত্র’ পদটির দ্বারা বস্তুর উপস্থিতিতে ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে বস্তুর সরাসরি সাক্ষাতকে বহির্ভুত করা হয়েছে। অতঃপর অন্নংভট্ট জ্ঞান বা অনুভবের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘তদভিন্নং জ্ঞানং অনুভবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব হলো স্মৃতি ভিন্ন জ্ঞান।
 .
ন্যায়মতে সমস্ত প্রকার জ্ঞান (তা অনুভবই হোক আর স্মৃতিই হোক) যেমন সত্য হতে পারে, তেমনি আবার মিথ্যাও হতে পারে। মিথ্যাজ্ঞানকে বলা হয় ‘ভ্রমজ্ঞান’।
 .
এই বিবেচনায় জ্ঞান বা অনুভব প্রধানত দুই প্রকার- যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা এবং অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা।
 .
প্রমা (Veridical anubhava) : প্রমা হলো অসন্দিগ্ধ যথার্থ অনুভব। অর্থাৎ যে জ্ঞানে আমাদের কোনো রকম সন্দেহ বা সংশয় নেই এবং যে জ্ঞান বিষয়ের অনুরূপ সেই জ্ঞানই হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান। তাই যথার্থ স্মৃতিও ন্যায়মতে প্রমা নয়। অনুভবই কেবল প্রমা হতে পারে। উদয়নাচার্য্য তাঁর ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’তে বলেছেন-  
‘যথার্থানুভবো মানমনপেক্ষতয়েষ্যতে।’ (ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-৪/১)
অর্থাৎ : প্রমাণ লক্ষণে যথার্থ অনুভবত্বই প্রমাত্ব।
কোনো বিষয়ের যে গুণ আছে সেই গুণ যদি জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশিত হয় অর্থাৎ সেই গুণ জ্ঞাত বিষয়ের মধ্যে যথাযথ আছে এ ধরনের জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা। উদাহরণ স্বরূপ- আমার সামনে একটি গাছ আছে। এখানে গাছ সম্পর্কে আমার যে জ্ঞান রয়েছে তাকে আমি যথার্থ জ্ঞান বলবো। কারণ এখানে গাছ সম্পর্কে কোন রকম সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রমা বলতে বিষয়ের যথার্থ অনুভব বোঝায়। তাই অন্নংভট্ট বলেন-

‘তদ্বতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবঃ যথার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় তখন সেই অনুভবকে বলা হয় যথার্থ।
 .
প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানকে উৎস অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয়- (১) প্রত্যক্ষণ (Perception), (২) অনুমান (Inference), (৩) উপমান (Comparison) ও (৪) শব্দ (Testimony)।
 .
অপ্রমা (Non-veridical anubhava) : জ্ঞানে যে ধর্মটি প্রকাশিত হয় সেটি যদি বিষয়ে বস্তুত না থাকে তাহলে সেটিকে বলা হয় অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা। অর্থাৎ কোনো বস্তুতে যে গুণ আছে বলে আমরা জানি সে গুণ সেই বস্তুতে প্রকৃতপক্ষে নেই, এ ধরনের জ্ঞানকে অযথার্থ জ্ঞান বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ- রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হলো ভ্রান্তজ্ঞান। দড়ির মধ্যে সাপের গুণ উপলব্ধি করা হয় কিন্তু আসলে দড়ির মধ্যে সাপের গুণ বর্তমান নেই। একটি বস্তুর মধ্যে বিপরীত গুণের সমাবেশ থাকলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সন্দেহ বা সংশয় যেখানে থাকে সেখানে জ্ঞান যথার্থ হতে পারে না, তখন সেটা হয় অনিশ্চিত জ্ঞান। ভ্রম যথার্থ জ্ঞান নয় কারণ ভ্রমে বিষয়ের যথার্থ অনুভব হয় না। দড়িকে সাপ বলে প্রত্যক্ষ করা হয়। এই ধরনের প্রত্যক্ষ ভ্রমাত্মক, কেননা এই প্রত্যেক্ষ বস্তুর যথার্থ অনুভব হয় না। তাই অন্নংভট্টের মতে-

‘তদভাববতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবঃ অযথার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় না তখন সেই অনুভবকে বলা হয় অযথার্থ।
 .
অপ্রমাকেও চারভাগে ভাগ করা হয়- (১) স্মৃতি (Memory),  (২) সংশয় (Doubt), (৩) ভ্রম (Illusion), এবং (৪) তর্ক (Hypothetical Argument)।
 .
৩.২ : জ্ঞানের সত্যতা নির্ণয়
তর্কের দ্বারা বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না। তর্ক প্রমাণের সহায়ক মাত্র। প্রমাণের সাহায্যে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, সেই সিদ্ধান্তের বিপরীত মতকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করার জন্য যে যুক্তি দেখানো হয় তাকে তর্ক বলে।
.
উদাহরণস্বরূপ, কোন স্থান হতে দূরবর্তী একটি গৃহ থেকে যখন ধোঁয়া দেখা গেলো তখন মনে করা হলো যে গৃহটিতে আগুন লেগেছে। একজন যুক্তি দিলেন যে সেখানে কোনো আগুন নেই। তখন তর্ক করা হলো যে যদি সেখানে আগুন না থাকে তাহলে সেখানে ধোঁয়া থাকতে পারে না। এই যুক্তিটি ‘যদি’ দিয়ে উদঘাটন করা হচ্ছে। এখানে যুক্তি দ্বারা আগুনের জ্ঞান পাওয়া যাচ্ছে না। আগুন থাকলে ধোঁয়া হবে পূর্বের অনুমানের উপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এইভাবে প্রত্যক্ষ বা অনুমান করে আমরা আগুন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারি না। তাই তর্ক সুনির্দিষ্ট জ্ঞান নয় এবং সে জন্য তর্কের দ্বারা যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে বিষয়ের স্বরূপের সঙ্গে জ্ঞানের সঙ্গতি এবং অসঙ্গতির উপর জ্ঞানের সত্যতা এবং মিথ্যাত্ব নির্ভর করে। নৈয়ায়িকদের এই মতবাদকে বৈশেষিক, জৈন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় সমর্থন করেন।  জ্ঞান যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় তখনই জ্ঞান সত্য হয়। তা না হলে জ্ঞান সত্য হয় না, সেটা অযথার্থ জ্ঞান। গোলাপ ফুলটি আমি লাল বলে জানছি। যদি গোলাপ ফুলটির রং প্রকৃতই লাল হয় তাহলে আমার জ্ঞান যথার্থ হবে। কিন্তু কী করে আমি জানবো যে জ্ঞানটি সত্য ? নৈয়ায়িকদের মতে বিষয়ের স্বভাবের সঙ্গে যখন জ্ঞানের সঙ্গতি থাকে তখনই জ্ঞান সত্য। অনুরূপের অভাবে জ্ঞান অসত্য। সে জন্য সত্য জ্ঞানের লক্ষণ হলো অনুরূপতা (Correspondence) অর্থাৎ ‘তদবতি তৎপ্রকারম’। আর অনুরূপতার অভাব (Non-correspondence) অর্থাৎ ‘তদভাববতি তৎপ্রকারম’ হলো অযথার্থ জ্ঞানের লক্ষণ।
 .
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জ্ঞানের সত্যতা বা প্রামাণ্য কিভাবে নির্ধারিত হয় ? কিসের উপর নির্ভর করে জ্ঞান যথার্থ না অযথার্থ তা বিচার করা যায় ? জ্ঞানের সত্যতা ও মিথ্যাত্ব নির্ণর করার মাপকাঠি কী ? নৈয়ায়িকদের মতে প্রবৃত্তিসামর্থ্যই হলো জ্ঞানের সত্যতার নির্ধারক। কর্মের সফলতা (প্রবৃত্তিসামর্থ্য বা প্রবৃত্তি সংবাদ) ও কর্মের বিফলতা (প্রবৃত্তি বিসংবাদ) এ দুয়ের সাহায্যে জ্ঞানের সত্যতা এবং জ্ঞানের মিথ্যাত্ব প্রমাণ করা যায়। ‘প্রবৃত্তিসামর্থ্য’ বলতে কোন একটি জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অভীষ্টসিদ্ধিকে বোঝানো হয়। কোনো বস্তুকে ‘চিনি’ বলে জেনে মিষ্টত্বের প্রবৃত্তি যদি সফল হয় অর্থাৎ কোনো বস্তুকে ‘চিনি’ বলে খেয়ে যদি কোন ব্যক্তির মিষ্ট স্বাদ লাভ হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির প্রবৃত্তি সমর্থ বা সফল হয়েছে বলে মনে করতে পারি। কিন্তু কোন জিনিসকে ‘চিনি’ বলে খেয়ে কোন ব্যক্তি যদি নোনা স্বাদ লাভ করে তাহলে তার প্রবৃত্তি সফল হয় না। প্রবৃত্তি সফল না হলে জ্ঞানটিকে প্রমা বলা যায় না। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, যথার্থ অনুভব হলো সফল প্রবৃত্তির জনক এবং অযথার্থ অনুভব হলো বিফল প্রবৃত্তির জনক। জ্ঞানের কাজ কেবল বিষয়ের স্বরূপ প্রকাশ করা। জ্ঞান নিজেই যথার্থ বা অযথার্থ হতে পারে না। জ্ঞান বা অনুভব যদি সফল প্রবৃত্তির কারক হয় তাহলে জ্ঞান যথার্থ হবে, তা না হলে অযথার্থ হবে।
 .
ন্যায় মতে একটি অনুভবের প্রামাণ্য অনুভবটির কারণ-সামগ্রির দ্বারা নির্ধারিত হয় না। কারণ বলতে বোঝায়-

‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি মানে যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
 .
 নৈয়ায়িকরা জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য (Extrinsic Validity) স্বীকার করেন। পরতঃপ্রামাণ্যের অর্থ হলো অন্য শর্তের উপর নির্ভরশীল। ন্যায় মতে জ্ঞানের প্রামাণ্য অন্য শর্তের উপর নির্ভর করে। আর জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্যের অর্থ হলো জ্ঞানের যথার্থ জ্ঞানের মধ্যেই নিহিত, অন্য কোন শর্তের উপর নির্ভর করে না। কিন্তু নৈয়ায়িকরা জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য (Intrinsic Validity) স্বীকার করেন না। ন্যায়মতে জ্ঞানের উৎপত্তি এক জিনিস, জ্ঞানের প্রামাণ্য আর এক জিনিস। জ্ঞানের প্রামাণ্য না জেনেও একজন একটি জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। তাই নৈয়ায়িকগণ হলেন পরতঃপ্রামাণ্যবাদী।
 .
ন্যায়দর্শনে যথার্থ অনুভবের জ্ঞাতাকে ‘প্রমাতা’, জ্ঞানকে ‘প্রমা’, জ্ঞানের বিষয়কে ‘প্রমেয়’ এবং জ্ঞানের করণকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। উল্লেখ্য, অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- করণ হল অসাধারণ কারণ (‘অসাধারণং কারণং করণম্’)। অর্থাৎ যেকোন কারণ করণ নয়। আর কারণের লক্ষণ হিসেবে অন্নংভট্ট বলেন- ‘যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ (‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’)। ন্যায়মতে, সাধারণ ও অসাধারণ ভেদে কারণ দু’প্রকার। ঈশ্বর, ঈশ্বরের জ্ঞান-ইচ্ছা-প্রযত্ন, অদৃষ্ট, দিক্, কাল ও তৎ তৎ কার্যের প্রাগভাব- এই আটটি যে কোন কার্যের উৎপত্তিতে কারণ। তাই এগুলি সাধারণ কারণ। এই আটটি সাধারণ কারণ ভিন্ন যে যে পদার্থ কার্যোৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয়, তাই অসাধারণ কারণ। অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন- ‘করণের লক্ষণে ‘অসাধারণ’ শব্দ না দিলে দিক্, কাল প্রভৃতি সাধারণ কারণে করণের লক্ষণ সমন্বয় হয়ে যাবে। ফলে করণের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্য করণের লক্ষণে অসাধারণ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে (‘সাধারণকারণে দিককালাদৌ অতিব্যাপ্তি বারণায় অসাধারণ ইতি’)।
 .
ন্যায়মতে একমাত্র আত্মাই জ্ঞাতা হতে পারে। তবে জ্ঞান আত্মার আগন্তুক গুণ। মোক্ষাবস্থায় আত্মায় কোন জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। মুক্ত আত্মা তাই জ্ঞাতা হয় না। নৈয়ায়িকগণ যথার্থ অনুভব বা প্রমার চারটি উৎস (প্রমাণ) স্বীকার করেন। এই চারটি উৎস হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। মূলত এই চতুর্বিধ প্রমাণের আলোচনাই হলো ন্যায় দর্শনের মুখ্য আলোচনা।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের বিভাগ
ন্যায়মতে জ্ঞান প্রথমত দুইভাগে বিভক্ত- অনিত্যজ্ঞান (জীবের জ্ঞান) ও  নিত্যজ্ঞান (ঈশ্বরের জ্ঞান)।
অনিত্যজ্ঞান আবার দুই ভাগ- (ক) অনুভব ও (খ) স্মৃতি।
স্মৃতির দুই ভাগ- (১) যথার্থ স্মৃতি ও (২) অযথার্থ স্মৃতি।
অনুভবও দুই ভাগ- (১) যথার্থ অনুভব (প্রমা) ও (২) অযথার্থ অনুভব (অপ্রমা)।
 .
প্রমা বা যথার্থ অনুভবের উৎস হলো- যথার্থ প্রত্যক্ষণ, যথার্থ অনুমিতি, যথার্থ উপমিতি ও যথার্থ শাব্দবোধ।
অপ্রমা বা অযথার্থ অনুভবের উৎস হলো- ভ্রম, তর্ক, সংশয় ইত্যাদি এবং অযথার্থ প্রত্যক্ষ, অযথার্থ অনুমিতি, অযথার্থ উপমিতি ও অযথার্থ শাব্দবোধ।
 .
ন্যায়মতে একই বিষয়কে একাধিক প্রমাণের দ্বারা জানা যেতে পারে। এই মতবাদ ‘প্রমাণসংপ্লববাদ’ নামে পরিচিত। অপরদিকে যে মতবাদ ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট বিষয় স্বীকার করে তা ‘প্রমাণব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। ন্যায়সম্প্রদায় প্রমাণসংপ্লববাদী, কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রমাণ ব্যবস্থাবাদী।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের উৎপত্তি-প্রক্রিয়া
প্রত্যক্ষ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > বিষয় (পদার্থ) > (ফল) প্রত্যক্ষজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
অনুমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > ব্যাপ্তিজ্ঞান > বিষয় > (ফল) অনুমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
উপমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > সাদৃশ্যজ্ঞান > বিষয় > (ফল) উপমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
শব্দ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > পদজ্ঞান > বিষয় > (ফল) শাব্দ।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
স্মৃতি : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > বিষয়ের > সংস্কার > (ফল) স্মৃতিজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
.
৪.০ : প্রত্যক্ষ প্রমাণ (Instrument of Perceptual Cognition) বা প্রত্যক্ষণ (Perception)
.
প্রত্যক্ষণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালী। ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্থান প্রথম ও প্রধান। কারণ প্রত্যক্ষ ভিন্ন কোন প্রমাণই ‘সিদ্ধ’ নয়। এ বিষয়ে সকল দর্শন সম্প্রদায়ই একমত যে প্রত্যক্ষই প্রধান প্রমাণ। আর প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন।
‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটি তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’-কে বোঝানো হয়। দ্বিতীয়ত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞানের করণকে (Instrumental cause) বোঝানো হয়। তৃতীয়ত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয় বা অর্থকে বোঝানো হয়। প্রত্যক্ষের লক্ষণ প্রসঙ্গে এই শব্দটিকে ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’ অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে।
 .
অনুমান, উপমান এবং শব্দ পরোক্ষ প্রমাণ। এই প্রমাণত্রয় কোন না কোনভাবে প্রত্যক্ষ নির্ভর। ন্যায়মতে একটি বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণের সাহায্যে জানা যেতে পারে। অর্থাৎ যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় সেই বিষয়ের অনুমিতি, উপমিতি বা শাব্দবোধ হতে পারে। তবে ন্যায়মতে একই বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি প্রত্যক্ষের সম্ভাবনা থাকে তাহলে ঐ বিষয়ের প্রত্যক্ষজ্ঞানই সর্বাগ্রে উৎপন্ন হয়। আর একই বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-সামগ্রী অন্যান্য প্রমার কারণ-সামগ্রীর বাধকরূপে কাজ করে। সামগ্রী বলতে এখানে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রীকে বোঝানো হয়েছে। সামগ্রী আবার সামান্য ও বিশেষ ভেদে দ্বিবিধ। জ্ঞানের সামান্যসামগ্রী সর্বজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিন্ন হলেও বিশেষ সামগ্রী জ্ঞানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিশেষকারণসামগ্রী তুলনামূলকভাবে প্রবলতর হওয়ায় ঐ সামগ্রী সেইক্ষণে অন্য জ্ঞানকে উৎপন্ন হতে দেয় না।
 .
ভারতীয় দার্শনিকেরা প্রত্যক্ষ-এর উপর বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দার্শনিকরা প্রত্যক্ষ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাননি। কেননা, তাঁরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে বিতর্কবিহীন জ্ঞান বলে মনে করেন। দার্শনিক মিল (Mill)-এর মতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রশ্নের অতীত। বার্ট্রান্ড রাসেল (Russell)-এর মতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ।
 .
৪.১ : প্রত্যক্ষের লক্ষণ
প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে সবাই একমত প্রকাশ করেন যে, বিষয় এবং ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উদ্ভব হয়
মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-

‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপনং জ্ঞানম্ অব্যোপদেশ্য অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে যে অব্যাপদেশ্য (অশাব্দ), অব্যভিচারী  (অভ্রান্ত) এবং ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ।
 .
এখানে ‘অব্যপদেশ্য’ পদের দ্বারা শব্দের করণত্ব বহির্ভূত অর্থাৎ পূর্বজ্ঞাত শব্দের জ্ঞান থেকে উৎপন্ন নয়, ‘অব্যভিচারি’ পদের দ্বারা অভ্রান্ত এবং ‘ব্যবসায়াত্মক’ পদের দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অর্থ বা বিষয়ের সন্নিকর্ষ বা সংযোগের ফলে উৎপন্ন, অশাব্দ ও সুনিশ্চিত জ্ঞানই হলো প্রত্যক্ষজ্ঞান। মহর্ষির প্রত্যক্ষজ্ঞানের এই লক্ষণ যথার্থ প্রত্যক্ষজ্ঞানের লক্ষণ। বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘অব্যপদেশ্য’ ও ‘ব্যবসায়াত্মক’ শব্দ দুটিকে যথাক্রমে ‘নির্বিকল্পক’ ও ‘সবিকল্পক’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। জয়ন্ত ভট্ট, গঙ্গেশ উপাধ্যায়, বিশ্বানাথ, অন্নংভট্ট প্রভৃতি পরবর্তী নৈয়ায়িকেরা বাচস্পতির এই মত সমর্থন করেছেন।
তর্কসংগ্রহকার অন্নংভট্ট মহর্ষির প্রত্যক্ষলক্ষণ অনুসরণ করে বলেন-

‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্যম্ জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় ও অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন যে জ্ঞান তাই প্রত্যক্ষজ্ঞান।
 .
মহর্ষি গোতমের ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎস্যায়ণ তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে বলেছেন-  
‘অক্ষস্যাক্ষস্য প্রতিবিষয়ং বৃত্তিঃ প্রত্যক্ষং। বৃত্তিস্তু সন্নিকর্ষো জ্ঞানং বা।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের স্ব স্ব বিষয়ে বৃত্তি অর্থাৎ ব্যাপার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বৃত্তি কিন্তু সন্নিকর্ষ ও জ্ঞান।
.
আবার বিশ্বনাথ তাঁর মুক্তাবলীতে প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-

‘ইন্দ্রিয়জন্যং জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’। (মুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানকে বলা হয় প্রত্যক্ষজ্ঞান।
 .
বিশ্বনাথ, অন্নংভট্ট তথা অন্যান্য পরবর্তী নৈয়ায়িকগণ কেউই প্রত্যক্ষলক্ষণে ন্যায়সূত্রকারোক্ত ‘অব্যপদেশ্যম্’, ‘অব্যভিচারি’ ও ‘ব্যবসায়াত্মকম্’ এই তিনটি পদের উল্লেখ করেন নি। তবে তাঁরা যে মহর্ষির লক্ষণকেই অনুসরণ করে প্রত্যক্ষের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ নির্দেশ করেছেন সে কথা তাঁরা নিজেরাই ব্যক্ত করেছেন।
 .
প্রত্যক্ষজ্ঞানে ইন্দ্রিয় ও অর্থের সন্নিকর্ষ গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রিয় দু’প্রকার- বাহ্য এবং আন্তর। বাহ্য ইন্দ্রিয় পাঁচটি- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক। আর আন্তর ইন্দ্রিয় হলো মন। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ঘট, পট ইত্যাদি বাহ্য বিষয়ের এবং মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ ইত্যাদি আন্তর বিষয়ের জ্ঞান হয়। উল্লেখ্য, এই ছয়প্রকার ইন্দ্রিয় ন্যায়দর্শনে জ্ঞানেন্দ্রিয়রূপে স্বীকৃত। এছাড়াও অন্যান্য দর্শনে বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ এই পাঁচপ্রকার কর্মেন্দ্রিয় স্বীকার করা হয়। এই পাঁচটি শরীরের অবয়ববিশেষ। কিন্তু ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে কর্মেন্দ্রিয় স্বীকৃত নয়।
 .
ন্যায়দর্শনে ‘ইন্দ্রিয়’ বলতে দেহের প্রত্যক্ষযোগ্য কোন অবয়বকে বোঝানো হয়নি। প্রত্যক্ষযোগ্য অবয়বের মধ্যে অপ্রত্যক্ষযোগ্য যে পদার্থ বা শক্তি বর্তমান থেকে জ্ঞানের করণ হয় তাকেই ‘ইন্দ্রিয়’ বলা হয়। যেমন চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ, কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা শ্রবণ প্রত্যক্ষণ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। ‘অর্থ’ শব্দের দ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়ার মতো বিষয়কে বোঝানো হয়েছে। মনের কল্পনা বা অসৎ পদার্থকে ‘অর্থ’ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়নি। নৈয়ায়িকদের কাছে ‘অর্থ’ সবসময় কোন অস্তিত্বশীল প্রত্যক্ষযোগ্য পদার্থ। আবার প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের নির্দিষ্ট বিষয় আছে। এই কারণে যে-কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে-কোন বিষয়ের জ্ঞান হয় না। যেমন রূপ বা বর্ণ হলো চক্ষু ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়। অনুরূপভাবে শব্দ হলো শ্রবণেন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়। এছাড়া গমন প্রভৃতি ক্রিয়া এবং ঘটত্ব প্রভৃতি সামান্যকেও অর্থ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে।
 .
‘সন্নিকর্ষ’ শব্দের অর্থ সম্বন্ধ। স্ব স্ব গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধই হলো সন্নিকর্ষ। ‘সংযোগ’ শব্দ দ্বারা এই সম্বন্ধকে ঠিক বোঝানো যায় না। কেননা বিভিন্ন ধরনের সন্নিকর্ষ রয়েছে, যার মধ্যে সংযোগ অন্যতম মাত্র। ন্যায়দর্শনে সন্নিকর্ষকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- লৌকিক ও অলৌকিক। লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয়প্রকার। যথা- সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায়, সংযুক্ত-সমবেত সমবায়, সমবায়, সমবেত-সমবায় এবং বিশেষণতা বা বিশেষ্যতা।
অপরপক্ষে অলৌকিক সন্নিকর্ষ তিনপ্রকার। যথা- সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ এবং যোগজ। প্রসঙ্গত, অন্নংভট্ট ‘সন্নিকর্ষ’ শব্দের দ্বারা কেবলমাত্র লৌকিক সন্নিকর্ষের উল্লেখ করেছেন।
 .
ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণের বিরুদ্ধে নব্য নৈয়ায়িকরা দ্বিবিধ আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রথমত, উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ অনুমিতিতে ‘অতিব্যাপ্তি’ দোষদুষ্ট। দ্বিতীয়ত, উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে ‘অব্যাপ্তি’ দোষদুষ্ট।
 .
তাঁদের মতে লক্ষ্যের অসাধারণ ধর্মকেই বলা হয় লক্ষণ। লক্ষণ লক্ষ্যে থেকেও যদি অলক্ষ্যে থাকে তাহলে লক্ষণটি অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়। নৈয়ায়িক মতে যথার্থ জ্ঞান চারপ্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমিতি, উপমিতি এবং শাব্দবোধ। প্রত্যক্ষের লক্ষণ যদি অনুমিতিতে চলে যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। নব্য নৈয়ায়িকরা বলেন যে, অনুমিতির ক্ষেত্রে মন হলো ইন্দ্রিয়। অনুমিতির বিষয় হলো অর্থ পদবাচ্য। অনুমিতির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সঙ্গে অলৌকিক জ্ঞানলক্ষণা সন্নিকর্ষ থাকে। এই কারণে অনুমিতিকেও ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন জ্ঞান বলা যায়। সুতরাং, প্রত্যক্ষের লক্ষণটি অনুমিতিতে অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়ে যাবে।
 .
দ্বিতীয়ত, লক্ষণটি যদি লক্ষ্যের সর্বাংশে না থেকে একটি অংশে থাকে তাহলে লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষদুষ্ট হয়। নৈয়ায়িক মতে প্রত্যক্ষ দ্বিবিধ। যথা- জীবের প্রত্যক্ষ এবং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ। জীবের প্রত্যক্ষ হলো অনিত্য। অর্থাৎ এই প্রত্যক্ষের উৎপত্তি এবং বিনাশ আছে। কিন্তু নৈয়ায়িক মতে ঈশ্বরের কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হয় এবং সেই প্রত্যক্ষ হলো নিত্য। অর্থাৎ ঐ প্রত্যক্ষের উৎপত্তি নেই এবং বিনাশও নেই। ঈশ্বর সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন বলে আমরা জানি। কিন্তু ঈশ্বরের ইন্দ্রিয় স্বীকৃত নয়। তাই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষকে ‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্য’ বা ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন জ্ঞান বলা যায় না। সুতরাং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ না থাকায় উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। মূলকথা, মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত প্রত্যক্ষলণে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অর্থাৎ, মহর্ষি গৌতমের প্রত্যক্ষের লক্ষণটি কেবলমাত্র জীবপ্রত্যক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
 .
উক্ত অব্যাপ্তি দোষ পরিহারের জন্য নব্যনৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় প্রত্যক্ষের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘প্রত্যক্ষস্য সাক্ষাৎকারিত্বং লক্ষণম্’।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ হলো সাক্ষৎ প্রতীতি বা সাক্ষৎ জ্ঞান।
 .
মানে এই জ্ঞান অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় উক্ত লক্ষণটিতে অব্যাপ্তির কোন আশঙ্কা নেই। সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ও ঈশ্বরের প্রত্যক্ষকে একই সঙ্গে লক্ষ্য করে গঙ্গেশ প্রত্যক্ষের একটি ভিন্ন লক্ষণ দিয়েছেন, যা বিশ্বনাথও ‘অথবা’ শব্দযোগে প্রত্যক্ষের এই বিকল্প লক্ষণটির উল্লেখ করেছেন-
‘জ্ঞানাকরণকম্ জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ হলো সেই জ্ঞান যাতে অন্য জ্ঞান করণ হয় না।
 .
এই লক্ষণ অনুযায়ী যে জ্ঞানে কোন জ্ঞান করণ হয় না সেই জ্ঞানই প্রত্যক্ষজ্ঞান। অনুমিতির ক্ষেত্রে ‘ব্যাপ্তিজ্ঞান’, উপমিতির ক্ষেত্রে ‘সাদৃশ্যজ্ঞান’, শাব্দবোধের ক্ষেত্রে ‘পদজ্ঞান’ করণরূপে স্বীকৃত হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কোন জ্ঞান করণরূপে স্বীকৃত হয় না। প্রত্যক্ষের করণ হলো ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় যেহেতু কোন জ্ঞান নয়, সেহেতু প্রত্যক্ষ হলো এমন জ্ঞান যার করণ কোন জ্ঞান নয়। তাই প্রত্যক্ষ হলো জ্ঞানাকরণক জ্ঞান।
 .
উল্লেখ্য, ন্যায়সূত্রকার গৌতম এবং তর্কসংগ্রহকার অন্নংভট্ট প্রদত্ত লক্ষণের লক্ষ্য কেবলমাত্র জন্যপ্রত্যক্ষ। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ জন্যপ্রত্যক্ষ নয়। তাই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ মহর্ষি-প্রদত্ত লক্ষণের লক্ষ্যই নয়। কিন্তু গঙ্গেশ জন্যপ্রত্যক্ষ ও ঈশ্বরপ্রত্যক্ষ উভয় প্রকার প্রত্যক্ষকেই লক্ষ্য করে প্রত্যক্ষের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন।
 .
৪.২ : প্রত্যক্ষের শ্রেণীবিভাগ
ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষণকে নানাভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষণ প্রধানত দুই প্রকার- (১) লৌকিক  (Ordinary) ও (২) অলৌকিক (Extraordinary)।
 .
(১) লৌকিক প্রত্যক্ষণ (Ordinary Perception) :
বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষের মাধ্যমে যে প্রত্যক্ষ হয় তাকে বলা হয় লৌকিক প্রত্যক্ষণ।
লৌকিক প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার- বাহ্য (External) ও মানস (Internal)।
 .
বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষকে বাহ্য প্রত্যক্ষণ বলে। বাহ্য ইন্দ্রিয় পাঁচটি- চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়, কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়, নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়, জিহ্বা বা স্বাদেন্দ্রিয়, ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয়। তাই বাহ্য প্রত্যক্ষণও পাঁচ রকমের হয়।
চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন বাইরের জগতের রূপ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ (Visual perception)।
কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন শব্দ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে শ্রবণ প্রত্যক্ষণ (Auditory perception)।
নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন গন্ধ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষণ (Olfactory perception)।
জিহ্বা বা স্বদেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন রস প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে স্বাদ প্রত্যক্ষণ (Gustony perception)।
ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন স্পর্শ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে স্পর্শন প্রত্যক্ষণ (Tectual perception)।
 .
অপরপক্ষে মনের সঙ্গে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার যে সংযোগ ঘটে তাকে বলা হয় আন্তর বা মানস প্রত্যক্ষণ। 
 .
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাঁচটি বাহ্য-ইন্দ্রিয় আবার পাঁচটি ভূত বা জড় উপাদানের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) দ্বারা গঠিত। ন্যায়মতে চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয় তেজের দ্বারা গঠিত এবং তেজের ধর্ম হলো রূপ বা বর্ণ। এজন্য চক্ষু বর্ণ বা রূপ প্রত্যক্ষ করে। কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয় ব্যোম বা আকাশের দ্বারা গঠিত এবং ব্যোমের ধর্ম হলো শব্দ। তাই কর্ণ শব্দ প্রত্যক্ষ করে। নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয় ক্ষিতির দ্বারা গঠিত এবং ক্ষিতির ধর্ম হলো গন্ধ আঘ্রাণ করা। এজন্য নাসিকা গন্ধ আঘ্রাণ করে। জিহ্বা বা স্বাদেন্দ্রিয় অপের দ্বারা গঠিত এবং অপের ধর্ম হলো রস আস্বাদন করা। তাই জিহ্বা রস আস্বাদন করতে পারে। ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয় মরুতের দ্বারা গঠিত এবং মরুতের ধর্ম হলো স্পর্শ। সেজন্য ত্বকের দ্বারা স্পার্শন প্রত্যক্ষ সম্ভব হয়। বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের মধ্যে এক একটি ইন্দ্রিয় একটি গুণই প্রত্যক্ষ করতে পারে। অর্থাৎ বাহ্য-ইন্দ্রিয়গুলি যে উপাদান দ্বারা গঠিত সেগুলির বিশেষ গুণ ও ধর্মকে এই ইন্দ্রিয়গুলি প্রত্যক্ষ করে।
 .
কিন্তু অন্তরিন্দ্রিয় বা মন বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের মতো জড় উপাদানের দ্বারা গঠিত নয়। মন সুখ, দুঃখ, দ্বেষ, ইচ্ছা, প্রযত্ন, জ্ঞান প্রভৃতি আত্মার ধর্মগুলি প্রত্যক্ষ করে। মনের সাহায্য ছাড়া কোন বাহ্য ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। তাই মন হলো বাহ্য-ইন্দ্রিয়গুলির পরিচায়ক এবং মনে কাজ হলো সকল প্রকার জ্ঞানকে যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করা।
পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয় এবং একটি অন্তর ইন্দ্রিয়, এই ছয়টি ইন্দ্রিয়কে ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা এবং জৈন মতে একসাথে জ্ঞান-ইন্দ্রিয় বলা হয়।
 .
ন্যায়দর্শনে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে লৌকিক প্রত্যক্ষণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Indeterminate Perception), সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Determinate Perception) ও প্রত্যক্ষভিজ্ঞা (Recognition)।
কিন্তু প্রত্যক্ষভিজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে বলে অনেক নৈয়ায়িক প্রত্যক্ষকে নির্বিকল্পক এবং সবিকল্পক- এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এ দুটি মূলত প্রত্যক্ষজ্ঞানের দুটি স্তরবিশেষ।
 .
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Indeterminate Perception) : দর্শন পরিভাষায় বিকল্প শব্দের অর্থ হলো বিশেষণ। দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়া- এই পাঁচটি বিশেষণ ন্যায়দর্শনে ‘বিকল্প’ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ দর্শনে এই পাঁচটি বিশেষণকে একত্রে ‘পঞ্চকল্পনা’ বলা হয়। এই পঞ্চকল্পনামুক্ত জ্ঞানই হলো নির্বিকল্পক জ্ঞান। অর্থাৎ, যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হয় তাকে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘নির্বিকল্পক’ শব্দের অর্থ হলো বিশেষণ বর্জিত বস্তুর স্বরূপমাত্র জ্ঞান (বিকল্পকেভ্যঃ নির্মুক্তম্)। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো বস্তুর সহজ উপলব্ধি (Simple apprehension)। একটি ফুলের সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয় সংযোগ হয় তখন সেটাকে একটি ফুল বলেই জানি। যেমন একটি চাঁপা ফুলের যে হলুদ রঙ আছে, সুগন্ধ আছে এসব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করি না। সে জ্ঞান আসে পরের স্তরে। কেবল সহজ উপলব্ধিটুকু ছাড়া নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণে বস্তুর সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় না। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের স্বরূপ প্রকাশ করতে বলেছেন-
‘নিষ্প্রকারকম্ জ্ঞানম্ নির্বিকল্পকম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে জ্ঞানে কোন প্রকার বা বিশেষণ বিষয় হয় না, তাকে নির্বিকল্পক জ্ঞান বলে।
 .
অতএব নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ, ক্রিয়া প্রভৃতি শূন্য বস্তুর স্বরূপমাত্র জ্ঞান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়াশূন্য বলতে নৈয়ায়িকরা নির্বিকল্পক জ্ঞানের দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়ার শূন্যতা না বুঝিয়ে নির্বিকল্পক জ্ঞানের বিষয়ের দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়ার শূন্যতা বুঝিয়েছেন। একথা স্পষ্ট করতে তাই অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন- ‘বিশেষণ-বিশেষ্যসম্বন্ধানবগাহিজ্ঞানম্’।
যেহেতু নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় কোন ধর্মের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে জ্ঞানে ভাসমান হয় না, সেহেতু এই জ্ঞানকে ‘বিশেষণ-বিশেষ্যসম্বন্ধ-অনবগাহি জ্ঞান’ বলা হয়।
 .
ন্যায়মতে নির্বিকল্পক জ্ঞানে পদার্থের ধর্ম পদার্থের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে জ্ঞানে ভাসমান হয় না। তাই নির্বিকল্পক জ্ঞানের বিষয়কে কোনভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেননা কোন বিষয়ের জ্ঞান ধর্মের দ্বারা অবচ্ছিন্ন না হলে তার জ্ঞান প্রকাশিত হয় না। ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় মহর্ষি গৌতমের উল্লেখিত ‘অব্যপদেশ’ পদটিকে বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘নির্বিকল্পক’ জ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ যে জ্ঞান পূর্বজ্ঞাত শব্দের জ্ঞান থেকে উৎপন্ন নয়। নব্য নৈয়ায়িক গঙ্গেশের মতে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো সম্পর্ক বিযুক্ত প্রত্যক্ষ। এই প্রত্যক্ষণ নাম, জাতি বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর সংযোগ থেকে মুক্ত। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র বস্তুটির সহজ উপলব্ধি বা সম্বন্ধহীন চেতনা হয়।
 .
সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Determinate Perception) : যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কোন একটি বস্তুকে গুণযুক্ত হিসেবে প্রত্যক্ষ করা হয় তাকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। অর্থাৎ, সবিকল্পক প্রত্যক্ষে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের ন্যায় কেবলমাত্র একটি বস্তুর অস্তিত্বের জ্ঞান হয় না। এক্ষেত্রে বস্তুটির স্বরূপ বা প্রকৃতির জ্ঞান হয়। বিকল্প বা বিশেষণযুক্ত প্রত্যক্ষজ্ঞান হলো সবিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের পরিচয় দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট বলেন-
‘সপ্রকারকম্ জ্ঞানম্ সবিকল্পকম্’।
অর্থাৎ : যে জ্ঞান প্রকার বিশিষ্ট তাই সবিকল্পক।
 .
সবিকল্পক প্রত্যক্ষণে আমরা বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করি। ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় মহর্ষি গৌতমের উল্লেখিত ‘ব্যবসায়াত্মক’ পদটিকে বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘সবিকল্পক’ জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বস্তুর সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে তখন বস্তুর অস্তিত্ব, তার জাতি এবং বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে জ্ঞান হয়। একটি চাঁপা ফুলের সঙ্গে যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে, তখন আমরা বলি যে ‘এটি চাঁপা ফুল’। ফুলটির রঙ হলুদ, ফুলটি সুগন্ধযুক্ত এই জ্ঞান হচ্ছে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ। এখানে ‘এটি’ হলো বিশেষ্য এবং ‘ফুলত্ব’ হলো বিশেষণ। অর্থাৎ যে জ্ঞানে বিশেষ্য, বিশেষণ এবং বিশেষ্য-বিশেষণের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান হয়, তাই সবিকল্পক জ্ঞান।
 .
তবে নৈয়ায়িকদের মতে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ হয় না। কারণ প্রথম স্তরে বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান না হলে সে বস্তুর জাতি, গুণ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয় না। সবিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয়কে ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা যায়।
 .
নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষণের পার্থক্য :
প্রথমত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষের প্রাথমিক স্তর। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষের দ্বিতীয় স্তর।
দ্বিতীয়ত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ কোন বচনের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। অন্যদিকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণকে বচনের দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
তৃতীয়ত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর হলেও স্ফূটজ্ঞান নয়। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষ ব্যবসায়াত্মক বা সুস্পষ্ট জ্ঞান।
চতুর্থত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে অনুমানের দ্বারা জানা যায়। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে অনুব্যবসায় রূপ মানস প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায়।
পঞ্চমত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ নাম, জাতি, গুণ অথবা বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ বর্জিত। অন্যদিকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষ নাম, জাতি, গুণ অথবা বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধযুক্ত।
ষষ্ঠত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র কোন বস্তুর অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ হয়, বস্তুটি কী তা জানা যায় না। সবিকল্পক প্রত্যক্ষে গুণ-সমন্বিত বস্তুকে জানা যায়।
 .
ভারতীয় দর্শনে নৈয়ায়িকদের মতো সাংখ্য ও মীমাংসক দার্শনিকরা যথার্থ জ্ঞানের উৎস হিসেবে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক- উভয় প্রকার প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন। কিন্তু বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত মতে একমাত্র নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষই যথার্থ, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ যথার্থ নয়। বস্তুত অদ্বৈত বেদান্তে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উভয়প্রকার প্রত্যক্ষের ভেদ স্বীকার করা হলেও, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একমাত্র নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকেই যথার্থ বলা হয়েছে। অন্যদিকে চার্বাক, জৈন এবং রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্ত মতে আমাদের সব প্রত্যক্ষই সবিকল্পক। বিশুদ্ধ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ রামানুজ স্বীকার করেন না। এই কারণে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের পার্থক্যকে তিনি আপেক্ষিক বলেছেন।
 .
প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition) : পূর্ব প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুকে পুনরায় প্রত্যক্ষ করে ‘এটি সেই’ এরূপ জ্ঞানকে প্রত্যভিজ্ঞা বলে। প্রত্যভিজ্ঞা এক প্রকার বিশেষ ধরনের সবিকল্পক প্রত্যক্ষজ্ঞান। এক্ষেত্রে বস্তুকে কেবলমাত্র জানা নয়, বস্তুকে পূর্বে থেকে জানা বস্তু বলে চিনতে পারা হলো প্রত্যভিজ্ঞা। পূর্বে জেনেছি এই জ্ঞানই হলো প্রত্যভিজ্ঞা। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ সম্ভব নয়, তেমনি সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া প্রত্যভিজ্ঞা সম্ভব নয়। এইরূপ জ্ঞানে স্মৃতি সহায়ক হলেও উৎপন্ন জ্ঞানটি স্মৃত্যাত্মক নয়, প্রত্যক্ষাত্মক। কারণ স্মৃতির ক্ষেত্রে বস্তু ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে উপস্থিত থাকে না। কিন্তু প্রত্যভিজ্ঞার ক্ষেত্রে বস্তু ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে উপস্থিত থাকে।
তবে নব্য মহানৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় নানা যুক্তির সাহায্যে প্রত্যভিজ্ঞা যে সবিকল্পক প্রত্যক্ষেরই অন্তর্গত, প্রত্যক্ষের তৃতীয় প্রকার নয়, তা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
 .
(২) অলৌকিক প্রত্যক্ষণ (Extraordinary Perception) :
কিছু প্রত্যক্ষণে বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক সংযোগ বা লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় না, কিন্তু অসাধারণ উপায়ে প্রত্যক্ষণ হয়, তাকেই অলৌকিক প্রত্যক্ষণ বলা হয়। ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষের অতিরিক্ত সন্নিকর্ষকেই নৈয়ায়িকগণ অলৌকিক সন্নিকর্ষ বলেন (ন লৌকিকঃ অলৌকিকঃ)। অর্থাৎ অলৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন প্রত্যক্ষকে অলৌকিক প্রত্যক্ষ বলা হয়। অলৌকিক সন্নিকর্ষ তিনপ্রকার, যথা- সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষ, জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ এবং যোগজ সন্নিকর্ষ। অনুরূপভাবে অলৌকিক প্রত্যক্ষণও তিনপ্রকার- সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Perception of a Class), জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception) এবং যোগজ প্রত্যক্ষণ (Yogaja Perception)।
 .
সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Perception of a Class) : ন্যায়মতে, কোন একটি ধূমের সঙ্গে চক্ষুর সংযোগ হলে ঐ ধূমের যেমন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়, তেমনি অন্য দেশ ও অন্য কালে স্থিত সব ধূমেরও চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু ঐ দেশান্তরীয়, কালন্তরীয় ধূমসমূহ এ স্থলে অনুপস্থিত বলে তাদের সঙ্গে চক্ষুর লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় না। তবুও চক্ষু সংযুক্ত ধূমের মতো অনুপস্থিত ধূমাদিরও প্রত্যক্ষ হয়। চক্ষুঃসংযোগ রূপ লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা চক্ষুর নিকটস্থ ধূমের প্রত্যক্ষের সময়ে অনুপস্থিত অন্যান্য ধূমেরও যে প্রত্যক্ষ হয়, তা হয় অলৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা।
 .
সামান্য (Class) যে প্রত্যক্ষের লক্ষণ অথবা বিষয়, তাই সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ। এক্ষেত্রে লক্ষণ অর্থ স্বরূপ। ন্যায়মতে একটি বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষ হলে ঐ বস্তুতে আশ্রিত সমান্যধর্মেরও প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু ঐ সামান্যের আশ্রয়ের একটিমাত্র বস্তুর সঙ্গেই কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ সম্ভব হলেও ইন্দ্রিয় অ-সন্নিকৃষ্ট সকল বস্তুর প্রত্যক্ষ হয় সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষের দ্বারা। অর্থাৎ কোনো একটি বস্তু বা ব্যক্তিকে দেখে তার সমগ্র জাতিকে প্রত্যক্ষ করাই সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষণ। যে ধর্ম বা গুণ একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত সব বস্তু বা ব্যক্তির প্রত্যেকের মধ্যে বিদ্যমান থাকে এবং এই বিশেষ গুণ বা ধর্মের উপস্থিতির জন্য জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করা সম্ভব হয় তাকেই সামান্য ধর্ম বলে। মনুষ্যত্ব মানব জাতির সামান্য ধর্ম। মনুষ্যত্ব মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বর্তমান। এই গুণ বা ধর্মটির জন্যই মানব জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করা হয়। মনুষ্যত্বের মাধ্যমে সকল মানুষকে প্রত্যক্ষ করাই হলো সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ।
 .
ন্যায়মতে কোন একটি বস্তুর প্রত্যক্ষকালে বস্তুটির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যেমন একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় তেমনি ঐ বস্তুর সামান্যধর্মের মাধ্যমে ঐ জাতীয় সকল বস্তুর সঙ্গে একটি অলৌকিক সন্নিকর্ষ হতে পারে। আমরা যখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ করি তখন ঐ ব্যক্তিটির সঙ্গে আমাদের চক্ষুরিন্দ্রিয়ের যেমন একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয়, তেমনি ঐ ব্যক্তিটির সামান্যধর্ম মনুষ্যত্বের সঙ্গেও আমাদের চক্ষুরিন্দ্রিয়ের একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয়। দ্রব্যের সামান্যধর্মের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষকে নৈয়ায়িকরা সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ বলেন। এই সামান্যধর্ম প্রত্যক্ষের মাধ্যমে মনুষ্যত্ববিশিষ্ট সকল মানুষের সঙ্গে আমাদের একটি অলৌকিক সন্নিকর্ষ হয়। এই সন্নিকর্ষের ফলে সকল মানুষের সামান্যতঃ একটি অলৌকিক প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয়। তাই পরবর্তীকালে কোন মানুষ দেখলে আমাদের কখনও এরূপ সন্দেহ হয় না যে সন্নিকষ্ট জীব কি মানুষ ? সকল মানুষের সঙ্গে যেহেতু ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সম্বন্ধ হতে পারে না সেহেতু এই সন্নিকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন প্রত্যক্ষজ্ঞান সাধারণ বা লৌকিক হতে পারে না। এই প্রত্যক্ষ হলো অলৌকিক প্রত্যক্ষ। সামান্যধর্মের দ্বারা যেহেতু এইরূপ অলৌকিক প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় সেহেতু এই অলৌকিক প্রত্যক্ষের নাম সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ।
 .
অতএব সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ অলৌকিক প্রত্যক্ষণ, কারণ এখানে বিষয়কে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা হয় না। যে রকম মনুষ্যত্ব এই ধর্মটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সকল লোকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হচ্ছে না। নৈয়ায়িকগণ সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান, তমঃ, প্রাগভাব প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন বলে ন্যায়মতে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষকে স্বীকার করা হয়েছে। তবে নব্য-নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি অবশ্য স্বকীয় যুক্তিতে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করেছেন।
 .
জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception) : সামান্যধর্মের দ্বারা যেমন একজাতীয় সকল বস্তুর একটি অলৌকিক প্রত্যক্ষ হয় তেমনি অনেক সময় পূর্বলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা আমাদের একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ হয়। যেহেতু বিষয়ের জ্ঞান এইরূপ প্রত্যক্ষের কারণ তাই এ ধরনের প্রত্যক্ষের নাম জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। জ্ঞানস্বরূপ সন্নিকর্ষই জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। এই জ্ঞান হলো স্মরণাত্মক জ্ঞান।
 .
অন্যভাবে বললে, কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অন্য ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণ প্রত্যক্ষ করা হয় তখন তাকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন চক্ষু দ্বারা এক খণ্ড বরফ প্রত্যক্ষ করে বলা হলো যে বরফ ঠাণ্ডা। এক্ষেত্রে চক্ষু দ্বারা বরফের শীতলতা প্রত্যক্ষ করাই হলো জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষকে অলৌকিক প্রত্যক্ষ বলা হয় কারণ এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানটি এমন একটা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পাওয়া যায় যে ইন্দ্রিয়টি সাধারণত সেই জ্ঞান দিতে পারে না। যেমন চক্ষু কখনও বরফের শীতলতার জ্ঞান দিতে পারে না। বস্তুত জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ আমাদের পূর্বজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। পূর্বে আমরা যখন ত্বক বা স্পর্শ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জেনেছি যে বরফ ঠাণ্ডা, তার সঙ্গে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষও যুক্ত ছিলো। এর ফলে অতীতে বরফের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের সঙ্গে স্পর্শজাত প্রত্যক্ষের এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বর্তমানে বরফের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ তার স্পর্শন প্রত্যক্ষের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার ফলেই বরফের দিকে তাকিয়ে আমাদের বরফ ঠাণ্ডা বা শীতলতার জ্ঞান লাভ হয়।
 .
উল্লেখ্য, ন্যায়মতে জ্ঞানমাত্রই জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে যে কোন ব্যক্তির যে কোন জ্ঞানের দ্বারা যে কোন বিষয়ের অলৌকিক প্রত্যক্ষের আপত্তি হবে। তাই নৈয়ায়িকেরা বলেন, ‘যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে বিষয়ের জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ জন্য প্রত্যক্ষ হবে, সেই ইন্দ্রিয় সংযুক্ত মনঃসংযুক্ত আত্মাতে সমবেত সেই বিষয়ের জ্ঞানই সেই বিষয়ের প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ।’
 .
ন্যায়দর্শনে একাধিক প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষকে স্বীকার করা হয়েছে। যেমন, ন্যায়মতে ভ্রমজ্ঞানকে ব্যাখ্যাই করা যায় না যদি জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষকে স্বীকার না করা হয়। যেমন, রজ্জুতে যখন সর্প ভ্রম হয় কিংবা শুক্তিতে রজত ভ্রম হয়, সেখানে নৈয়ায়িক মতানুসারে আমরা অন্য দেশস্থিত সর্পের এবং অন্য দেশস্থিত রজতের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করি। এটাই ন্যায়দর্শনে অন্যথাখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। এভাবে নৈয়ায়িকগণ জ্ঞানলক্ষণসন্নিকর্ষের দ্বারা প্রত্যভিজ্ঞা, অনুব্যবসায় বা মানসপ্রত্যক্ষণ, অভাব প্রভৃতির প্রত্যক্ষ প্রতিপাদন করেন।
 .
যোগজ প্রত্যক্ষণ (Yogaja Perception) : নৈয়ায়িকরা যোগীদের একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন। যোগ শব্দের অর্থ শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতিতে প্রতিপাদ্য যোগাভ্যাসজনিত ধর্মবিশেষ। যোগীরা স্বজ্ঞার (intuition) মাধ্যমে ভূত, ভবিষ্যৎ, প্রচ্ছন্ন ও অতি সূক্ষ্ম বিষয়ের যে প্রত্যক্ষ করে থাকেন তাকেই বলা হয় যোগজ প্রত্যক্ষণ। এই যোগজ প্রত্যক্ষণ অলৌকিক, যেহেতু এই জাতীয় প্রত্যক্ষে বিষয়ের সঙ্গে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোন লৌকিক সংযোগ থাকে না। এ ধরনের প্রত্যক্ষণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যোগজ প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার। যথা- যুক্ত বা সিদ্ধযোগীর প্রত্যক্ষ এবং যুঞ্জান বা বিযুক্তযোগীর প্রত্যক্ষ। যুক্তযোগী সিদ্ধপুরুষ, তাই তাঁদের প্রত্যক্ষ নিত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত। যুঞ্জানযোগী পূর্ণসিদ্ধিপ্রাপ্ত নন, তাই তাঁদের প্রত্যক্ষ অনিত্য ও সাময়িক।
 .
সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন যোগজ প্রত্যক্ষে বিশ্বাসী যেহেতু  যোগজ প্রত্যক্ষ শ্রুতি প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মীমাংসা দর্শন ও মহানৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি যোগজ প্রত্যক্ষ স্বীকার করেননি।
 .
৪.৩ : সন্নিকর্ষ

ন্যায়মতে, ইন্দ্রিয় ও অর্থ বা বিষয়ের সন্নিকর্ষ হতে উৎপন্ন জ্ঞানই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দের দ্বারা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন- এই ছ’টি ইন্দ্রিয়কে বোঝায়। ‘অর্থ’ শব্দ সৎ বা বাস্তব পদার্থকে (real entities) বোঝায়। ‘সন্নিকর্ষ’ শব্দ ইন্দ্রিয় ও অর্থের একপ্রকার বিশেষ সম্বন্ধকে বোঝায়। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের হেতু বলেছেন। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের এই সন্নিকর্ষ নানাবিধ। প্রথমত, তিন প্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষের জন্য ন্যায়মতে তিনপ্রকার অলৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়েছে। যথা- সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ। আবার লৌকিক প্রত্যক্ষ যেহেতু ছয়ভাবে হতে পারে তাই লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয় প্রকার। ন্যায়মতে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় ছ’প্রকার বলে লৌকিক সন্নিকর্ষ ছ’প্রকার বলা হয়নি। লৌকিক প্রত্যক্ষের বিষয় ছ’প্রকার বলে লৌকিক সন্নিকর্ষকে ছ’প্রকার বলা হয়েছে। এটি ষড়বিধ সন্নিকর্ষবাদ নামে প্রাচীন ন্যায় সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ মত। প্রাচীন নৈয়ায়িক উদ্যোতকর এ মতের সমর্থক। ন্যায়মতে, আমাদের ভাব পদার্থ ও অভাব পদার্থের লৌকিক প্রত্যক্ষ হতে পারে। এই লৌকিক প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা।
 .
নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ছ’টি লৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করেছেন- (১) সংযোগ, (২) সংযুক্ত সমবায়, (৩) সংযুক্তসমবেত সমবায়, (৪) সমবায়, (৫) সমবেত সমবায়, (৬) বিশেষণ-বিশেষ্যভাব। অন্নংভট্ট প্রত্যক্ষ জ্ঞানের কারণ ছ’প্রকার সন্নিকর্ষের উল্লেখ প্রসঙ্গে ‘সন্নিকর্ষ’ বলতে মূলত লৌকিক সন্নিকর্ষকেই বুঝিয়েছেন।
(ক) দ্রব্য, (খ) কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দ্রব্যে স্থিত গুণ, কর্ম ও সামান্য বা জাতি, (গ) কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ ও কর্মে স্থিত জাতি, (ঘ) আকাশ নামক অতীন্দ্রিয় দ্রব্যের শব্দ নামক গুণ, (ঙ) শব্দ নামক গুণে স্থিত শব্দত্ব জাতি এবং (চ) অভাব পদার্থ-এর প্রত্যক্ষ উল্লিখিত ছ’টি লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা হয়ে থাকে। এই ছয় প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ নিম্নরূপ।
 .
(১) সংযোগ : দ্রব্যের প্রত্যক্ষ হয় সংযোগ সন্নিকর্ষের দ্বারা। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ের প্রত্যক্ষস্থলে যদি ইন্দ্রিয় এবং বিষয় উভয়ই দ্রব্য হয় তাহলে সেক্ষেত্রে সন্নিকর্ষটি হয় সংযোগ। কারণ ন্যায়মতে সংযোগ একটি গুণ পদার্থ এবং দুটি দ্রব্যের মধ্যে সম্বন্ধ হলো সংযোগ। যেমন- চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যখন ঘটের সম্বন্ধ হয়, তখন চক্ষু ইন্দ্রিয়ও দ্রব্য এবং ঘটও দ্রব্য হওয়ায় এক্ষেত্রে সন্নিকর্ষটি হলো সংযোগ-সন্নিকর্ষ।
 .
(২) সংযুক্ত-সমবায় : ন্যায়মতে কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দ্রব্যের গুণ, কর্ম ও সামান্য বা জাতির প্রত্যক্ষ হয় সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষের দ্বারা। দ্রব্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হলেও দ্রব্যোস্থিত গুণ, ক্রিয়া বা জাতির প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হয় না। চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ঘটরূপের (colour of the jar) প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হতে পারে না। চক্ষু ইন্দ্রিয় দ্রব্য, ঘটের রূপ একটি গুণ। এ দুটির মধ্যে সংযোগ-সন্নিকর্ষ হতে পারে না। গুণ সর্বদা দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধেই থাকে। ন্যায়মতে, চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ঘটরূপের প্রত্যক্ষে সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। এক্ষেত্রে চক্ষুর সঙ্গে সংযুক্ত ঘটে রূপ সমবেত হয়। এটি পরম্পরা সম্বন্ধ (indirect relation)। আমরা যখন ঘটের রূপকে প্রত্যক্ষ করি, এক্ষেত্রে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ঘট সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত অর্থাৎ সংযুক্ত হয় এবং ঘটের সঙ্গে তার রূপের সম্বন্ধ হলো সমবায়। সুতরাং চক্ষুর সঙ্গে ঘটের রূপ-এর সম্বন্ধ হলো সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত সমবায় অর্থাৎ সংযুক্ত-সমবায়। অনুরূপভাবে ঘ্রাণ ও রসনার দ্বারা গন্ধ ও রসের প্রত্যক্ষেও সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষই হয়।
 .
(৩) সংযুক্তসমবেত সমবায় : ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ বা কর্মে অবস্থিত সামান্য বা জাতির প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য নৈয়ায়িকরা সংযুক্তসমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করেছেন। এই সন্নিকর্ষ তিনটি সম্বন্ধের উপর নির্ভরশীল- (০১) ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে দ্রব্যের সংযোগ, (০২) দ্রব্যের সঙ্গে গুণাদির সমবায় এবং (০৩) দ্রব্যে সমবেত গুণাদির সঙ্গে গুণাদিগত সামান্য বা জাতির সমবায়। যেমন- আমরা যখন একটা লাল গোলাপের দিকে তাকাই তখন আমরা যেমন গোলাপ দেখি, গোলাপের লাল রঙ দেখি, তেমনি লাল রঙের মধ্যে থাকে যে রক্তত্ব জাতি তাকেও প্রত্যক্ষ করি। চক্ষুর সঙ্গে গোলাপের রক্তবর্ণের সম্বন্ধ হলো সংযুক্ত-সমবায়। আবার রক্তবর্ণে রক্তত্ব জাতি সমবায় সম্বন্ধে থাকায় রক্তবর্ণে রক্তত্ব জাতি সমবেত বলা যায়। সুতরাং, চক্ষুর দ্বারা লাল গোলাপের রক্তত্ব জাতির প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ হলো সংযুক্ত-সমবেত সমবায়।
 .
(৪) সমবায় : ন্যায়মতে আকাশ নামক অতীন্দ্রিয় দ্রব্যের শব্দ নামক গুণের প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়। শব্দের প্রত্যক্ষ হয় শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা। ন্যায়মতে কর্ণবিবরবর্তী আকাশকেই শ্রবণেন্দ্রিয় বলা হয়। আকাশ দ্রব্য এবং শব্দ হলো আকাশের গুণ। ন্যায়মতে দ্রব্য এবং গুণের সম্বন্ধ হলো সমবায়। সুতরাং, শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা শব্দের প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ হলো সমবায় সন্নিকর্ষ।
 .
প্রশ্ন হলো, কর্ণবিবরবর্তী আকাশ যদি শ্রবণেন্দ্রিয় হয় তাহলে ঐ শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা দূরে স্থিত শব্দের প্রত্যক্ষ হবে কিভাবে ? কারণ যেহেতু শব্দ গুণ পদার্থ সেহেতু শব্দ নিষ্ক্রিয়। যেহেতু শব্দ নিষ্ক্রিয় সেহেতু দূরে স্থিত শব্দের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হতে পারে না।
উক্ত পূর্বপক্ষের সমাধান প্রসঙ্গে নৈয়ায়িকরা বলেন যে দূরস্থিত শব্দের থেকে অন্য শব্দের উৎপত্তি হয়, তার থেকে আবার অন্য শব্দের উৎপত্তি হয়। এইভাবে শ্রবণেন্দ্রিয়-রূপ আকাশে উৎপন্ন শেষ শব্দের সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হওয়ার ফলে আমরা শব্দ প্রত্যক্ষ করি। এই যুক্তিটি বীচিতরঙ্গন্যায় নামে পরিচিত। কোন শান্ত জলাশয়ে যদি পাথর নিক্ষেপ করা হয় তাহলে সেখানে একটি তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এইরূপে তরঙ্গ পরম্পরার সৃষ্টি হওয়ার ফলে শেষ তরঙ্গটি এসে তটদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। অনুরূপভাবে শব্দ পরম্পরার শেষ শব্দটি শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ে উৎপন্ন হয়ে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। সুতরাং, এই মতে বক্তার মুখে উৎপন্ন প্রথম শব্দটির সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ অর্থাৎ সন্নিকর্ষ হয় না।
 .
পুনরায় প্রশ্ন হতে পারে যে, এক বক্তার মুখনিঃসৃত শব্দ একই সময়ে অনেক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেন কিভাবে ?
ন্যায়দর্শনে কদম্বমুকুলন্যায় অনুসরণ করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। যেমন কদম্ব ফুল বিকশিত হওয়ার সময় তার চারদিকে পাপড়ি উৎপন্ন হয়, সেরকমভাবে প্রথম শব্দ উৎপন্ন হওয়ার পরে তার সাহায্যে তার চারিদিকে অনেক শব্দ উৎপন্ন হয়। আবার এই শব্দগুলি প্রবাহক্রমে সকল শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৃথক পৃথক শব্দ উৎপন্ন করার ফলে ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ প্রত্যক্ষ করে থাকে।
 .
(৫) সমবেত সমবায় : ন্যায়মতে শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা কেবল শব্দ (গুণ) প্রত্যক্ষ করি না, বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ শব্দের অনুগত ধর্ম শব্দত্ব জাতিও প্রত্যক্ষ করি। শব্দত্ব শব্দে সমবায় সম্বন্ধে থাকে এবং শব্দের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ সমবায় হওয়ায় শব্দত্বের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হলো সমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ।
 .
(৬) বিশেষণ-বিশেষ্যভাব : ন্যায়মতে ভাবপদার্থের মতো অভাবেরও প্রত্যক্ষ হয়। ন্যায়মতে অভাব একটি স্বতন্ত্র (অধিকরণ থেকে ভিন্ন) পদার্থ এবং অভাবের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই হয়। অভাবের গ্রাহক প্রমাণ হলো অনুপলব্ধি। অভাবের লক্ষণ বা সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘অথোপলম্ভ যোগ্যত্বে সত্যপ্যনুপলম্ভনম্ । অভাবাখ্যং প্রমাণম্ স্যাদভাবস্যাবোধকম্’। (মানমেয়োদয়)।
অর্থাৎ : যদি কোন বস্তু প্রত্যক্ষ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তার প্রত্যক্ষ না হয়, তাহলে সেই অপ্রত্যক্ষের দ্বারা বস্তুটির অভাবের জ্ঞান হয়। এরূপ অভাবের অববোধক প্রমাণ হলো অনুপলব্ধি বা অভাব।
 .
অভাব প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যে সন্নিকর্ষ হয়, তাকে বলা হয় বিশেষণ-বিশেষ্যভাব। ভাব অর্থ সম্বন্ধ। অভাবকে কখনও বিশেষ্যরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়, আবার কখনও বিশেষণরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। অভাবকে যখন বিশেষ্যরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্ত-বিশেষ্যতা এবং অভাবকে যখন বিশেষণরূপে প্রত্যক্ষ করা হয় তখন সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্ত-বিশেষণতা।
 .
ন্যায়মতে, সাধারণত অভাব যে অধিকরণে থাকে তার বিশেষণ হয়। ‘ভূতলটি ঘটাভাববিশিষ্ট’ এরূপ প্রত্যক্ষস্থলে ভূতল (অধিকরণ) হলো বিশেষ্য এবং ঘটাভাব হলো ভূতলের বিশেষণ। এক্ষেত্রে প্রথমে চক্ষুর সঙ্গে ভূতলের সংযোগ সন্নিকর্ষ হয়। ভূতলের বিশেষণ হলো ঘটাভাব। সুতরাং চক্ষুর সঙ্গে ঘটাভাবের সম্বন্ধ হলো সংযুক্ত-বিশেষণতা। এভাবে বিশেষণ-বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষের দ্বারা ভূতলে ঘটাভাবের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। বিশেষণ-বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষকে সংক্ষেপে ‘বিশেষণতা’ সন্নিকর্ষও বলা হয়।
কিন্তু ‘ভূতলে ঘটাভাব’ এরূপ প্রত্যক্ষস্থলে ঘটাভাব হলো বিশেষ্য আর ভূতল হলো বিশেষণ। চক্ষুর সঙ্গে ভূতলের সম্বন্ধ হলো সংযোগ। চক্ষুর সঙ্গে সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত ভূতলে ঘটাভাব বিশেষ্যরূপ জ্ঞাত হয়। এজন্যে এই সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্তবিশেষ্যতা।
.
৫.০ : অনুমিতি বা অনুমান প্রমাণ
অনুমিতি (Inferential knowledge) বা অনুমান প্রমাণ (Inference as instrument)
.
ন্যায়মতে যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা চারপ্রকার। যথা- প্রত্যক্ষণ, অনুমিতি, উপমিতি ও শাব্দবোধ। সে অনুযায়ী যথার্থ জ্ঞান লাভের স্বীকৃত প্রণালী বা প্রমাণ হলো চারটি- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। অনুমান হলো দ্বিতীয় প্রমাণ।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অনুমানের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘অনুমিতিকরণম্ অনুমানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুমিতি জ্ঞানের করণকে অনুমান বলে।
 .
‘অনুমান’ শব্দটি করণবাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয়সিদ্ধ হলে তার অর্থ হয় অনুমিতি জ্ঞানের করণ। কিন্তু ভাবার্থে ল্যুট্ প্রত্যয়সিদ্ধ হলে তার অর্থ হয় অনুমিতি জ্ঞান। মূলত ‘অনুমান’ শব্দটি জ্ঞান ও জ্ঞানের করণ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়।
‘অনু’ শব্দের অর্থ হলো পশ্চাৎ, আর ‘মান’ শব্দের অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ ‘অনুমান’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘পশ্চাৎ জ্ঞান’। ফলে সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। যেমন ধূমের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ করে বহ্নির অস্তিত্ব অনুমান করা। দূরের কোন পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে বলা হয় যে পর্বতটি বহ্নিবান। কারণ যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি, এটি আমাদের চূলা বা রান্নাঘরের পূর্ব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাই পর্বতে ধূমের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করে সেখানে বহ্নির অনুমান করি। এই অগ্নির জ্ঞান হলো অনুমানলব্ধ জ্ঞান। এই অনুমানের ভিত্তি হলো ধূম ও বহ্নির নিয়ত সম্বন্ধ সম্পর্কে আমাদের পূর্বে অর্জিত জ্ঞান। তাই অনুমান হলো পরোক্ষ জ্ঞান। কোনো একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষণ করে, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অপর একটি অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রক্রিয়াকে অনুমান বলে।

৫.১ : অনুমিতির লক্ষণ…

অনুমিতির লক্ষণ বোঝার আগে অনুমিতির ক্ষেত্রে সাধ্য, পক্ষ এবং হেতু– এই তিনটি বিষয় আমাদের জানা দরকার। অনুমিতিস্থলে আমরা যে বিষয়ের অনুমান করি তাকে বলা হয় সাধ্য। ন্যায়শাস্ত্রে সাধ্য ও লিঙ্গী শব্দ দুটি সমার্থক। যেখানে সাধ্য আছে বলে অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় পক্ষ। যার সাহায্যে পক্ষে সাধ্যের উপস্থিতি অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় হেতু। যেমন, ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ অর্থাৎ পর্বতটি বহ্নিমান কারণ ওখানে ধূম আছে- এই অনুমিতি স্থলে ‘পর্বত’ হলো পক্ষ। কারণ পর্বতে বহ্নি আছে- এরূপ অনুমান করা হয়। ‘বহ্নি’ হলো সাধ্য। কারণ পর্বত নামক পক্ষে বহ্নির অনুমান করা হয়। ‘ধূম’ হলো হেতু কারণ পক্ষ পর্বতে ধূমকে দেখে সাধ্য বহ্নির অনুমান করা হয়। ন্যায়দর্শনে হেতু, ধর্ম, সাধন, লিঙ্গ সমার্থক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। এবার আসা যাক অনুমিতির লক্ষণে।
মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্রে অনুমানের লক্ষণে বলেছেন-

‘অথ তৎ পূর্বকম্ অনুমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞানই অনুমান।
 .
উল্লেখ্য, এখানে ‘অনুমান’ শব্দটি অনুমিতি অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই অনুমিতির লক্ষণের পূর্বে মহর্ষি প্রত্যক্ষের লক্ষণ দিয়েছেন। তাই ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা প্রত্যজ্ঞানকে নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুমিতি প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অনুমিতিকে প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞান বলা হলে অনুমিতির লক্ষণ ‘অব্যাপ্তি’ দোষে দুষ্ট হয় বলে অন্য নৈয়ায়িকদের অভিমত। তাঁদের মতে সমস্ত অনুমিতিই প্রত্যক্ষজন্য নয়। অনুমান বা শব্দ প্রমাণের দ্বারা কোন হেতুর জ্ঞান এবং তাতে কোন পদার্থের ব্যাপ্তি (নিয়ত-সম্বন্ধ) নিশ্চয় হলেও তার দ্বারা সেই পদার্থের অনুমিতি হয়। তাই ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’-এর বদলে ‘লিঙ্গ-পরামর্শ’-কেই ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা নির্দেশ করা যুক্তিযুক্ত। এ লক্ষ্যে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অনমিতির লক্ষণ দিয়েছেন-
‘পরামর্শজন্যং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পরামর্শ হতে উৎপন্ন যে জ্ঞান তাই অনুমিতি।
 .
কিন্তু পরামর্শ বা লিঙ্গ-পরামর্শ কাকে বলে তা না বুঝলে অনুমিতির এ লক্ষণ বোঝা যায় না। এজন্যে পরামর্শ জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অন্নংভট্ট আবার বলেন-
‘ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতা-জ্ঞানং পরামর্শঃ। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতাজ্ঞান হলো পরামর্শ।
 .
এর মানে দাঁড়ালো, পরামর্শ হলো একটি জটিল জ্ঞান যেখানে ব্যাপ্তিজ্ঞান বিশেষণের কাজ করে এবং পক্ষধর্মতাজ্ঞান (পক্ষে ধর্ম বা হেতুর জ্ঞান) বিশেষ্যের কাজ করে। এই বক্তব্য বুঝতে হলে আমাদের আগে ব্যাপ্তিজ্ঞান এবং পক্ষধর্মতাজ্ঞান কাকে বলে তা বোঝা প্রয়োজন।
 .
ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো ব্যাপ্তিবিষয়ক জ্ঞান। অর্থাৎ যে জ্ঞানের বিষয় ব্যাপ্তি তাই ব্যাপ্তিজ্ঞান। হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধকে বলে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ। ব্যাপ্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উদাহরণরূপে বলা হয়, ধূম থাকলেই বহ্নি থাকে। ধূমের সঙ্গে যখন বহ্নির সাহচর্য প্রত্যক্ষ করা হয়, তাদের উভয়কে সমান অধিকরণে (স্থানে) উপস্থিত থাকতে দেখা যায়, তখন বলা হয় তাদের মধ্যে সামানাধিকরণ্য আছে। এখানে ধূম (হেতু) এবং বহ্নির (সাধ্যের) সামানাধিকরণ্যই (নিয়ত-সম্বন্ধ) হলো ব্যাপ্তি।
 .
যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের সামানাধিকরণ্য আছে, সেই হেতুকে পক্ষে বর্তমান বলে জানা হলো পক্ষধর্মতা। যেমন, পর্বত প্রভৃতি পক্ষে হেতু ধূমকে প্রত্যক্ষ করলে পক্ষধর্মতা জ্ঞান জন্মায়। পক্ষধর্মতাকে যখন ব্যাপ্তিবিশিষ্ট বলে জানা যায় তখন তাকে বলা হয় পরামর্শ। ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’- এই অনুমিতির ক্ষেত্রে ‘যে ধূমের সঙ্গে বহ্নির ব্যাপ্তিসম্পর্ক আছে, পর্বতে দেখা ধূম হলো সেই ব্যাপ্তিবিশিষ্ট ধূম’। এবং এর ফলে ‘বহ্নিব্যাপ্যধূমবান এই পর্বত’- এই জ্ঞান হলো পরামর্শ। এখানে ‘বহ্নি’ হলো সাধ্য, ধূম হলো হেতু এবং পর্বত হলো পক্ষ। অর্থাৎ ন্যায়মতে, সাধ্যব্যাপ্যবিশিষ্ট হেতুমান পক্ষ- এটিই হলো পরামর্শ জ্ঞান।
 .
অনুমিতির ক্ষেত্রে প্রথমে পক্ষধর্মতাজ্ঞান, তারপর ব্যাপ্তিস্মরণ এবং তারপর পরামর্শের জ্ঞান জন্মায়। ন্যায়মতে বলা হয়, প্রত্যক্ষাদি যে কোন প্রমাণের দ্বারা লব্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞানাদি জন্য যে লিঙ্গ পরামর্শ হয় সেই লিঙ্গ পরামর্শের পরক্ষণেই অনুমিতি জন্মে। বিষয়টিকে বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন-
.
‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ বা ‘পর্বতে বহ্নি আছে যেহেতু পর্বতে আমরা ধূম প্রত্যক্ষ করছি’- এই অনুমিতিস্থলে ধূম হলো হেতু। হেতুর অপর নাম হলো লিঙ্গ। বহ্নি হলো সাধ্য এবং পর্বত হলো পক্ষ। এক্ষেত্রে পূর্বে কোন এক সময়ে রান্নাঘর প্রভৃতি স্থানে আমাদের ধূম ও বহ্নির সহচার দর্শন হয়েছিলো এবং বহ্নিশূন্য স্থানে ধূম না দেখতে পাবার জন্য ধূমের সাথে বহ্নির একটি ব্যাপ্তি-প্রত্যক্ষ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান জন্মায়। নৈয়ায়িক মতে এটিই হলো প্রথম লিঙ্গদর্শন (ব্যাপ্তিজ্ঞান)। পরে পর্বত প্রভৃতি স্থানে যখন আবার ধূম-দর্শন হয়, তখন ‘পর্বত ধূমবিশিষ্ট’ এরূপ প্রত্যক্ষ জন্মে। এই জ্ঞানের নাম পক্ষধর্মতাজ্ঞান। নৈয়ায়িক মতে এটি দ্বিতীয় লিঙ্গদর্শন। দ্বিতীয় লিঙ্গদর্শনের পর দৃষ্ট লিঙ্গ (ধূম) যে লিঙ্গী (বহ্নি)-ব্যাপ্য এরূপ ব্যাপ্তির স্মরণ হয়। এরই নাম ব্যাপ্তিস্মরণ। অর্থাৎ পূর্বে প্রথম লিঙ্গদর্শনে যে ব্যাপ্তিজ্ঞান হয়েছিলো এবং সেই জ্ঞান যে সংস্কার সৃষ্টি করেছিলো, সেই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘ধূম বহ্নিব্যাপ্য’ বা ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’ এরকম স্মরণ বা স্মৃতি উৎপন্ন হয়। নৈয়ায়িক মতে তা-ই ব্যাপ্তিস্মরণ। এই ব্যাপ্তিস্মরণের পরেই পর্বতে দৃষ্ট ধূম যে বহ্নিব্যাপ্য অর্থাৎ ‘বহ্নিশূন্য থাকে না এমন যে ধূম তা পর্বতে আছে’ এরূপ তৃতীয় লিঙ্গদর্শন হয়। এর নাম ব্যাপ্তিবিশিষ্টপক্ষধর্মতাজ্ঞান। এ জ্ঞানের আকার হলো ‘বহ্নিব্যাপ্যঃ ধূমবান পর্বতঃ’। এই তৃতীয় লিঙ্গদর্শনকেই বলা হয় লিঙ্গপরামর্শ বা কেবল পরামর্শ। এই পরামর্শ থেকে উৎপন্ন যে জ্ঞান (পর্বত বহ্নিযুক্ত), তাকেই ন্যায়দর্শনে অনুমিতি বলা হয়।
 .
এই পক্ষধর্মতাজ্ঞান বা লিঙ্গদর্শন, লিঙ্গ (হেতু) ও লিঙ্গীর (সাধ্য) ব্যাপ্তিসম্বন্ধের জ্ঞান এবং পরামর্শ থেকে অনুমিতি উৎপন্ন হয় বলে এগুলি সমস্তই অনুমিতির কারণ। কিন্তু সবগুলিই অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ নয়। প্রাচীন ন্যায়মতে করণের সংজ্ঞা বা লক্ষণ হলো-
‘ফলাযোগ-ব্যবচ্ছিন্নং কারণং করণম্’।
অর্থাৎ : যে কারণের অব্যবহিত পরে কার্যের উৎপত্তি হয় তাই করণ।
 .
এর মানে হলো চরম কারণ বা অন্তিম কারণই করণ। ফলে প্রাচীন ন্যায়মতে চরম কারণ লিঙ্গপরামর্শকেই অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ বলা হয়েছে। নব্য নৈয়ায়িক অন্নংভট্টও এক্ষেত্রে প্রাচীন ন্যায়সম্মত করণের লক্ষণ অনুসরণ করেছেন এই বলে যে- ‘পরামর্শজন্যং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ’। কিন্তু নব্যন্যায় মতে করণের লক্ষণ হলো-
‘ব্যাপারবৎ অসাধারণং কারণং করণম্’।
অর্থাৎ : যে অসাধারণ কারণ ব্যাপারবৎ, তাই করণ।
 .
এবং নব্যন্যায় মতে ব্যাপার বলতে বোঝানো হয়-
‘তজ্জন্যতে সতি তজ্জন্য জনকত্বং ব্যাপারত্বম্’।
অর্থাৎ : যা কারণের দ্বারা জন্য (উৎপন্ন) এবং কারণের দ্বারা জন্য কার্যের জনক তাই ব্যাপার।
 .
ফলে এই নব্যন্যায় মতে পরামর্শ বা লিঙ্গপরামর্শ অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ নয়। নব্যন্যায় প্রণেতা গঙ্গেশ উপাধ্যায় তাঁর পরামর্শ গ্রন্থে ব্যাপ্তিজ্ঞান বা ব্যাপ্তিস্মরণকে অনুমিতির করণ এবং লিঙ্গপরামর্শকে সেই কারণের ব্যাপার বলেছেন। বিশ্বনাথ এই মতকেই সমর্থন করেছেন। তবে উদ্দ্যোতকর, অন্নংভট্ট, কেশব মিশ্র ও অনেকে পরামর্শকেই অনুমিতির করণ বলেছেন।
 .
কিন্তু পরামর্শ থেকে উৎপন্ন জ্ঞানকে অনুমিতি বললে অনুমিতির উক্ত লক্ষণে এক প্রকার অতিব্যাপ্তি দোষ দেখা দেয়। এটাকে বলা হয় সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে অনুমিতি লক্ষণের অতিব্যাপ্তি দোষ। তাহলে সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ কী ?
.
দূরস্থিত বা অস্পষ্ট আলোকে কোন পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে বস্তুটির বিশেষ ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের সংশয় হয়। অস্পষ্ট আলোকে কোন একটি দণ্ডায়মান বস্তু স্থাণু না মানুষ তা আমরা সঠিক বুঝতে পারি না। এই সংশয় নিরসনের জন্য বস্তুটির কাছে গিয়ে বস্তুটির হাত, পা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করে বস্তুটি যে একটি পুরুষ এই জ্ঞান আমাদের হয়। এইরূপ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্য হওয়ায় এবং ন্যায়মতে একই বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য জ্ঞানের সামগ্রির তুলনায় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সামগ্রী বলবান হওয়ায় এই জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলতে হয়। তাছাড়া এই জ্ঞানের অনন্তর জ্ঞাতা বস্তুটিকে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই মনে করেন, অনুমানের দ্বারা বস্তুটিকে জেনেছেন বলে মনে করেন না। এইরূপ প্রত্যক্ষের নাম হলো সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ।
 .
সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলেও তা পরামর্শের অনুগামী অর্থাৎ পরামর্শ জ্ঞানের থেকে উৎপন্ন। কারণ ‘এটি পুরুষ’ এই জ্ঞানের জন্য ‘এই বস্তুটি পুরুষত্ব ব্যাপ্যহস্তপদবিশিষ্ট’- এই পরামর্শ প্রয়োজন। অর্থাৎ ধূম বহ্নিব্যাপ্য হওয়ায় ‘এই পর্বতটি বহ্নিব্যাপ্তিবিশিষ্ট’- এরূপ জ্ঞানকে যেমন পরামর্শ বলা হয়, অনুরূপভাবে হস্তপদাদিও পুরুষত্বের ব্যাপ্যা হওয়ায় ‘এই বস্তুটি পুরুষত্বব্যাপ্য হস্তপদাদিবিশিষ্ট’- এইরূপ জ্ঞানকেও পরামর্শ বলতে হবে। সুতরাং পরামর্শজন্য জ্ঞানকে অনুমিতি বলা হলে সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষকেও অনুমিতি বলতে হয়। এইভাবে অনুমিতির প্রদত্ত লক্ষণের দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞান আক্রান্ত হওয়ায় অনুমিতির লক্ষণ অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়।
 .
এই অতিব্যাপ্তি দোষ দূরীকরণের জন্য নৈয়ায়িক দার্শনিকরা অনুমিতির লক্ষণে ‘পক্ষতা’ পদটি যোগ করে ‘পরামর্শজ্ঞান’ বলতে ‘পক্ষতা সহকৃত পরামর্শজ্ঞান’-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ কেবল পরামর্শের থেকে উৎপন্ন জ্ঞান অনুমিতি নয়। পক্ষতাযুক্ত পরামর্শের থেকে উৎপন্ন জ্ঞান হলো অনুমিতি। ‘পক্ষতা’ একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ হলো ‘ইচ্ছার অভাববিশিষ্ট সিদ্ধির অভাব’। ন্যায়দর্শনে বলা হয়েছে-
‘সিষাধয়িষাবিরহসহকৃতসিদ্ধ্যভাবঃ পক্ষতা’।
.
এক্ষেত্রে ‘সিষাধয়িষা’ পদের অর্থ সাধ্যকে অনুমান করার ইচ্ছা। সিদ্ধি পদের অর্থ ‘পক্ষে সাধ্য আছে’ এরূপ নিশ্চিত জ্ঞান। ন্যায়মতে বলা হয়, যেখানে জ্ঞাতার সিষাধয়িষা বা অনুমিতির ইচ্ছা আছে কিন্তু জ্ঞাতার সিদ্ধির অভাব আছে, যেখানে জ্ঞাতার সিষাধয়িষা বা অনুমিতির ইচ্ছা আছে কিন্তু জ্ঞাতার ঐ বিষয়ে সিদ্ধি (জ্ঞান) আছে এবং যেখানে জ্ঞাতার অনুমিতির ইচ্ছা নেই কিন্তু ঐ বিষয়ে জ্ঞাতার সিদ্ধির অভাব আছে- এই তিন ক্ষেত্রে পক্ষতা থাকে। কিন্তু যেখানে জ্ঞাতার অনুমিতির ইচ্ছা নেই এবং জ্ঞাতার ঐ বিষয়ে সিদ্ধি আছে, সেখানে পক্ষতা থাকে না। পক্ষতার অভাবে অনুমিতি হয় না। তাই সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে পরামর্শজ্ঞান থাকলেও পক্ষতা না থাকায় সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে অনুমিতি-লক্ষণের অতিব্যাপ্তির আশঙ্কা আর থাকে না।

৫.২ : অনুমানের অঙ্গ বা অবয়ব…
        প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয়, নিগমন  
(The Constituents of Inference) 
ন্যায়দর্শনে অনুমানের অঙ্গ হিসেবে একাধিক অবয়ব ও পদ স্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যেক অনুমানে তিনটি পদ এবং অনুমানভেদে তিনটি বা পাঁচটি বাক্য থাকে। তিনটি পদ হলো- সাধ্য (Major Term), পক্ষ (Minor Term) এবং হেতু (Middle Term)।
যে বাক্যগুলির দ্বারা অনুমান গঠিত হয় সেই বাক্যগুলিকে অনুমানের অবয়ব বলা হয়।
 .
উল্লেখ্য যে, ন্যায়ের জ্ঞানতত্ত্বে পদার্থই জ্ঞানের বিষয়, এবং পদ সেই পদার্থের অভিধা। হেতুর সাহায্যে যে পদার্থকে অনুমান করা হয় তাকে সাধ্য বলে, এবং সেই পদার্থ বোধক পদের নাম সাধ্যপদ (Major Term)। যে আধার বা অধিকরণে সাধ্যকে অনুমান করা হয় তাকে বলে পক্ষ এবং সেই আধার বা অধিকরণপদকে পক্ষ বা পক্ষপদ (Minor Term) বলা হয়। আর যে পদার্থের সাহায্যে অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় হেতু, সাধন বা লিঙ্গ এবং তার বোধক পদকে বলে হেতুপদ (Middle Term)। হেতু হলো মধ্যপদ। হেতুর মধ্যস্থতায় সাধ্য ও পক্ষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। আমরা পর্বতে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান করি তখন পর্বত হলো পক্ষ, ধূম হলো হেতু এবং বহ্নি হলো সাধ্য।
 .
পাশ্চাত্য তর্কবিজ্ঞানের নিরপেক্ষ বচনে অবশ্যই দুটি পদ ও একটি সংযোজক থাকে। ভারতীয় ন্যায়ের অবয়বের সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অবয়বে সংযোজকের কোন ভূমিকা নেই। আবার কেবলমাত্র একটি পদের দ্বারাই একটি অবয়ব গঠিত হতে পারে।
ভারতীয় ন্যায়ের প্রত্যেক অনুমানে কম পক্ষে তিনটি বচন (proposition) থাকবে। এই তিনটি বচন নিরপেক্ষ (categorical) হবে এবং এই বচন সদর্থক বা নঞর্থক- উভয়ই হতে পারে। অনুমিত বচনে পক্ষ হলো উদ্দেশ্য, সাধ্য হলো বিধেয়।
 .
প্রথম বচনে সাধ্য ও পক্ষের সম্বন্ধের কথা বলা হয়। এখানে সাধ্যকে পক্ষের বিধেয় করা হয়। যেমন- ‘পর্বত বহ্নিমান’। দ্বিতীয় বচনে পক্ষের সঙ্গে হেতুর সম্বন্ধের কথা বলা হয়, ‘কারণ পর্বত ধূমায়মান’। তৃতীয় বচনে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তির কথা বলা হয়, যেমন- ‘যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে’।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে অনুমান দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। নিজের জন্য যে অনুমান করা হয় তাকে স্বার্থানুমান বলা হয়। স্বার্থানুমানে অনুমানটি যথাযথভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না। অনুমানের বা ন্যায়ের ন্যায়শাস্ত্রসম্মত রূপ প্রকাশ করাই হলো যথাযথভাবে ব্যক্ত করা।
যখন অপরের জন্য অনুমান করা হয় অর্থাৎ অপরের কাছে কোনো সত্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় তখন তাকে বলা হয় পরার্থানুমান। এক্ষেত্রে অনুমানকে যথাযথভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন আছে।
 .
ন্যায়মতে স্বার্থ ও পরার্থ ভেদে অনুমানের প্রকারভেদ অনুযায়ী ন্যায়ের অবয়বের সংখ্যারও ভেদ আছে। স্বার্থানুমানে থাকে তিনটি অবয়ব, কিন্তু পরার্থানুমানে থাকে পাঁচটি অবয়ব। পরার্থানুমানের এই পাঁচটি অবয়ব হলো- (১) প্রতিজ্ঞা, (২) হেতু, (৩) উদাহরণ, (৪) উপনয়, (৫) নিগমন। স্বার্থানুমানের ত্রি-অবয়ব পরার্থানুমানের এই পঞ্চ-অবয়বেরই প্রথম বা শেষ তিনটি অবয়ব। স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানের অবয়বগুলিকে যুক্তির আকারে নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে-
 .
পরার্থানুমান :
(১) পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)
(২) কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)
(৩) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- মহানস বা পাকশালা, কামারশালা ইত্যাদি (উদাহরণ)
(৪) পর্বতও ধূমায়মান (উপনয়)
(৫) সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)।
 .
স্বার্থানুমান :
(১) পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)
(২) কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)
(৩) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- মহানস ইত্যাদি (উদাহরণ)।
অথবা,
(১) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- পাকশালা ইত্যাদি (উদাহরণ)
(২) পর্বতও ধূমায়মান (উপনয়)
(৩) সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)।
.
পঞ্চ-অবয়ব সম্বন্ধে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্ অবয়বাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩২)
অর্থাৎ : প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পাঁচটি পঞ্চবাক্য অবয়ব।
 .
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে ‘ন্যায়’ নামক মহাবাক্যের পাঁচটি অবয়বের নাম সহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এবং তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকাগ্রন্থে প্রত্যেক অবয়বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।
 .
প্রতিজ্ঞা : যে বাক্যে পক্ষ সাধ্যধর্মবিশিষ্ট বলা হয়, তাই প্রতিজ্ঞা (‘সাধ্যবত্তয়া পক্ষবচনং প্রতিজ্ঞা’)। প্রতিজ্ঞা হলো প্রতিপাদ্য বিষয় বা সাধ্য-জ্ঞাপক বিষয়। অর্থাৎ এই বিষয়টিকে প্রমাণ করতে হবে। যেমন, ‘পর্বত বহ্নিমান’ এরূপ প্রতিজ্ঞাবাক্যের দ্বারা আমরা জানতে পারি যে, পর্বতে বহ্নির অস্তিত্ব প্রমাণ করাই অনুমানকর্তার অভিপ্রায়। এক্ষেত্রে খোদ ন্যায়সূত্রেও বলা হয়েছে-  
‘সাধ্যনির্দ্দেশঃ প্রতিজ্ঞা’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৩)
অর্থাৎ : যথাবিভক্ত সেই পঞ্চাবয়বের মধ্যে ‘সাধ্য-নির্দেশ’ অর্থাৎ সাধনীয় ধর্মবিশিষ্ট ধর্মিমাত্রের বোধক বাক্য প্রতিজ্ঞা।
 .
হেতু : হেতুবাক্যে পঞ্চমী বিভক্তিযুক্ত পদের দ্বারা হেতু বা লিঙ্গের প্রতিপাদন করা হয় (‘পঞ্চম্যন্তং লিঙ্গপ্রতিপাদকং বচনং হেতুঃ’)। হেতু-জ্ঞাপক অবয়বের নাম হেতু। হেতু অবয়ব পক্ষপদের সঙ্গে হেতুপদের সম্বন্ধ ঘোষণা করে। হেতুই প্রতিজ্ঞার কারণ নির্দেশ করে। যার সাহায্যে পক্ষে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয় তাই হলো হেতু বা লিঙ্গ। আর ন্যায়সূত্রে হেতুর লক্ষণে বলা হয়েছে-  
‘উদাহরণসাধর্ম্ম্যাৎ সাধ্যসাধনং হেতুঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৪)
‘তথা বৈধর্ম্ম্যাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৫)
অর্থাৎ :
উদাহরণ অর্থাৎ কেবল দৃষ্টান্তপদার্থের সাথে ধর্মপ্রযুক্ত অর্থাৎ কেবল দৃষ্টান্ত-পদার্থের সাথে সাধ্য ধর্মীর যা কেবল সমান ধর্ম, তাতে প্রযুক্ত সাধনীয় পদার্থের সাধনত্ববোধক বাক্যবিশেষ হচ্ছে হেতু (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৪)।  একইভাবে অর্থাৎ উদাহরণবিশেষের বৈধর্মপ্রযুক্ত ও সাধ্যসাধন অর্থাৎ যা সাধ্য ধর্মের সাধনত্ববোধক বাক্যবিশেষ তাই (বৈধর্ম্য) হেতু (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৫)।
 .
উদাহরণ : যে বাক্যে হেতুতে সাধ্যের বা সাধ্যাভাবে হেতুর অভাবের ব্যাপ্তির প্রতিপাদন করা হয়, তাকে উদাহরণ বাক্য বলা হয় (‘ব্যাপ্তি প্রতিপাদকং বচনম্ উদাহরণম্’)। পরিচিত দৃষ্টান্ত সহযোগে সাধ্যপদের সঙ্গে হেতুপদের সার্বিক সম্পর্ক জ্ঞাপক অবয়ব হলো উদাহরণ। অর্থাৎ বাক্যের প্রতিজ্ঞা এবং হেতুর মধ্যে যে ব্যাপ্তি সেটিকে পরিচিত দৃষ্টান্তের দ্বারা ব্যাপ্তি সম্বন্ধকে সমর্থন করা হয়। যেহেতু দৃষ্টান্ত সর্বজন স্বীকৃত সে জন্য দৃষ্টান্তে কোনো প্রকার মতভেদ থাকে না। আর ন্যায়সূত্রে উদাহরণের লক্ষণে বলা হয়েছে-  
‘সাধ্য-সাধর্ম্ম্যাত্তদ্ধর্ম্মভাবী দৃষ্টান্ত উদাহরণং’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৬)
‘তদ্বিপর্য্যয়াদ্বা বিপরীতং’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৭)
অর্থাৎ :
সাধ্য ধর্মীর সাথে সমানধর্মবত্তা-প্রযুক্ত সেই সাধ্য ধর্মীর ধর্মের (সাধ্য ধর্মের) ভাববিশিষ্ট পদার্থ দৃষ্টান্ত, সেই দৃষ্টান্তের বোধক বাক্য উদাহরণ (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৬)।  তদ্বিপর্য্যয় অর্থাৎ বিপরীত দৃষ্টান্তবোধক বাক্যবিশেষও (বৈধর্ম্য) উদাহরণ (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৭)।
 .
উপনয় : যে বাক্যে ব্যাপ্তিবিশিষ্টি হেতু বা লিঙ্গের প্রতিপাদন করা হয়, তাকে উপনয় বাক্য বলা হয় (‘ব্যাপ্তিবিশিষ্ট লিঙ্গ প্রতিপাদকং বচনম্ উপনয়ঃ’)। সাধ্যের সঙ্গে সার্বিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হেতুপদের ও পক্ষপদের সম্বন্ধজ্ঞাপক অবয়বই উপনয়। এই বাক্যে পক্ষে সাধ্যের ব্যাপ্তিবিশিষ্ট হেতুর প্রতিপাদন করা হয়। উপনয়ে সামান্য বচনটিকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আর উপনয়ের লক্ষণে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘উদাহরণাপেক্ষঃ তথেতি উপসংহারো ন তথেতি বা সাধ্যস্য উপনয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৮)
অর্থাৎ : সাধ্য ধর্মীয় সম্বন্ধে উদাহরণানুসারী ‘তথা’ কিংবা ‘ন তথা’ এভাবে উপসংহার অর্থাৎ অনুরূপ হেতুবোধক বাক্য হচ্ছে উপনয়।
 .
নিগমন : যে বাক্যে ব্যাপ্তি ও পক্ষধর্মতাবিশিষ্ট হেতুর দ্বারা পক্ষে সাধ্য আছে তা প্রতিপাদিত হয়, তাকে নিগমন বাক্য বলা হয় [‘হেতু সাধ্যবত্তয়া (পক্ষ প্রতিপাদকং) বচনং নিগমনম্’]। নিগমন হলো সিদ্ধান্ত অবয়ব। পূর্ববর্তী বাক্যগুলির উপর নির্ভর করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তাকে নিগমন বলে। প্রতিজ্ঞার সঙ্গে নিগমনের পার্থক্য এই যে, প্রতিজ্ঞাতে যা অপ্রমাণিত, অথচ যা প্রমাণিত হতে চলেছে নিগমনে তা-ই প্রমাণিত। হেতু-অবয়বের সঙ্গে উপনয় অবয়বের পার্থক্য হলো, হেতু-অবয়বে যে হেতুপদের কথা বলা হয় সে হেতুপদের সঙ্গে সাধ্যের সম্বন্ধ আছে কিনা তা তখন অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু উপনয় অবয়বে যে হেতুপদের কথা বলা হয় সে হেতুপদের সঙ্গে সাধ্যের যে সার্বিক সম্বন্ধ আছে তা আমাদের জ্ঞাত। আর ন্যায়সূত্রে নিগমনের লক্ষণে বলা হয়েছে-  
‘হেত্বপদেশাৎ প্রতিজ্ঞায়াঃ পুনর্ব্বচনং নিগমনম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৯)
অর্থাৎ : হেতুবাক্যের কথনপূর্বক প্রতিজ্ঞাবাক্যের পুনঃ কথন হচ্ছে নিগমন।
 .
অবয়বসমষ্টি যখন যুক্তির আকারে প্রকাশিত হয় তখন তাকে ন্যায় বলে। স্বার্থানুমানকে ত্রি-অবয়বী ন্যায় এবং পরার্থানুমানকে পঞ্চাবয়বী ন্যায় বলা হয়। ভারতীয় ন্যায় অনুমানে অবরোহ অনুমান ও আরোহ অনুমান উভয়ের সমন্বয় করা হয়েছে। এতে আকারগত ও বস্তুগত উভয়বিধ সত্যতা প্রমাণ হয় বলে যুক্তিগুলির সত্যতা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়। এই প্রকার যুক্তি বাক্যের দ্বারা সমর্থিত হয়ে একটি অবশ্য-স্বীকার্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
 .
ন্যায়সম্মত পঞ্চাবয়বী ন্যায় নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। যেমন, বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্যে অপরের নিকট বাক্য প্রয়োগের জন্য দশটি অবয়ব স্বীকার করেছেন এমন এক নৈয়ায়িক সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। সেই অবয়বগুলি হলো- জিজ্ঞাসা, সংশয়, শক্যপ্রাপ্তি, প্রয়োজন, সংশয়-অব্যুদাস এবং নৈয়ায়িক স্বীকৃত পাঁচটি অবয়ব। কিন্তু উক্ত মত খণ্ডন প্রসঙ্গে ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন বলেছেন যে, জিজ্ঞাসা প্রভৃতিকে ন্যায়ের অবয়ব বলা যায় না যেহেতু জিজ্ঞাসা প্রভৃতি ন্যায়বাক্যের অংশ নয়।
 .
সাংখ্য ও বৈশেষিক সম্প্রদায় পঞ্চাবয়বী ন্যায়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তবে মীমাংসা এবং বেদান্ত সম্প্রদায় মনে করেন ন্যায়সম্মত স্বার্থানুমানের ন্যায় প্রথম তিনটি অবয়ব অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ বা শেষের তিনটি অবয়ব অর্থাৎ উদাহরণ, উপনয় ও নিগমনের সাহায্যেই সকল প্রকার অনুমান সম্ভব হতে পারে। আবার জৈনমতে অনুমানের অবয়ব দুটি- প্রতিজ্ঞা ও হেতু। কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেন উদাহরণ ও উপনয় এই দুটি মাত্র অবয়বের সাহায্যেই অনুমান সম্ভব। এর অতিরিক্ত অবয়ব স্বীকার নিষ্প্রয়োজন ও নিরর্থক। কোন কোন মতে আবার নিগমন বাক্য প্রতিজ্ঞাবাক্যের পুনরুক্তিমাত্র। নৈয়ায়িকগণ অবশ্য তাঁদের স্বকীয় যুক্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, অনুমিত সত্যকে প্রতিপাদন করার জন্য পঞ্চ-অবয়বই একান্ত প্রয়োজন।

৫.৩ : অনুমানের ভিত্তি… (ব্যাপ্তিজ্ঞান, ব্যাপ্তিগ্রহ)
        ব্যাপ্তির স্বরূপ ও ব্যাপ্তিজ্ঞান…
        ব্যাপ্তিগ্রহ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়…
        (অন্বয়, ব্যতিরেক, ব্যভিচারাগ্রহ, উপাধিনিরাস, তর্ক, সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ)
অনুমানের ভিত্তি (The Grounds of Inference) 
অনুমান যার উপর নির্ভর করে সম্ভব হয় অর্থাৎ অনুমান করতে গেলে যে জিনিসের নিতান্তই প্রয়োজন তাকে বলা হয় অনুমানের ভিত্তি। অনুমানের লক্ষণে দেখা যায় যে, অনুমিতির ক্ষেত্রে পক্ষধর্মতাজ্ঞান (পক্ষে হেতুর প্রত্যক্ষ) এবং ব্যাপ্তিজ্ঞান (সাধ্য ও হেতুর ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্পর্কজ্ঞান) হলে পরামর্শ হয়, যাকে বলে ব্যাপ্তিবিশিষ্টপক্ষধর্মতাজ্ঞান। পরামর্শজ্ঞান থেকে অনুমিতি হয়। এ প্রেক্ষিতে নৈয়ায়িকগণ অনুমানের দু’প্রকার ভিত্তির কথা উল্লেখ করেছেন- মানস ও যৌক্তিক।
 .
মানস ভিত্তিকে বলা হয় পক্ষতা। পক্ষতা হলো ইচ্ছার অভাববিশিষ্ট সিদ্ধির অভাব। অর্থাৎ যেখানে সিদ্ধি বর্তমান এবং ইচ্ছা অনুপস্থিত সেখানে পক্ষতা থাকে না, ফলত অনুমান হয় না। উল্লেখ্য, সিদ্ধি বর্তমান মানে যেখানে সিদ্ধির অভাব নেই। তাই অনুমিতির ক্ষেত্রে সিদ্ধির অভাব বা ইচ্ছার অন্তত যে কোন একটি থাকলেই পক্ষতা থাকে, এবং অনুমান হয়।
 .
যৌক্তিক ভিত্তির নাম ব্যাপ্তি। ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো সাধ্য ও হেতুর ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্বন্ধজ্ঞান। এই জ্ঞান ব্যতীত কোন অনুমিতি সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ-
পর্বত বহ্নিমান, যেহেতু পর্বত ধূমায়মান এবং যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে।
এই অনুমানে দেখা যাচ্ছে পর্বত (পক্ষ) ধূমায়মান যেখানে ধূম (হেতু) আছে সেখানে বহ্নি (সাধ্য) আছে। বহ্নি ও ধূমের মধ্যে ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্পর্ক বিদ্যমান। হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে নিয়ত সম্পর্ক অথবা সার্বিক সম্বন্ধ (universal relation) তার নাম হলো ব্যাপ্তি। এই ব্যাপ্তি ন্যায় দর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
 .
ব্যাপ্তির স্বরূপ ও ব্যাপ্তিজ্ঞান (The nature and definition of Vyapti)
ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো ব্যাপ্তিবিষয়ক জ্ঞান। ন্যায়মতে ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমানের ভিত্তিস্বরূপ। ব্যাপ্তি হলো একপ্রকার সম্বন্ধ বিশেষ। ব্যাপ্তি শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা। একটি বস্তু বা বিষয় আর একটি বস্তু বা বিষয়ে ব্যাপ্ত। যে বস্তুটি ব্যাপ্ত হয়, তাকে বলা হয় ব্যাপ্য এবং যার দ্বারা ব্যাপ্য হয়, তাকে বলা হয় ব্যাপক। হেতু ব্যাপ্য এবং সাধ্য ব্যাপক।
 .
অন্যভাবে বললে, একটি বস্তু যখন অপর একটি বস্তুর সঙ্গে সর্বত্র উপস্থিত থেকেও তদ্ভিন্ন অন্যত্র উপস্থিত থাকতে পারে, তখন সেই বস্তুকে বলা হয় ব্যাপক। কিন্তু একটি বস্তু যখন অপর একটি বস্তুর নিয়ত সহচর হয় এবং ঐ বস্তুর অনুপস্থিতিতে কোথাও থাকে না, তখন ঐ বস্তুকে ব্যাপ্য বলা হয়। যেমন বহ্নি থাকলেই সর্বক্ষেত্রে ধূম নাও থাকতে পারে, উদাহরণস্বরূপ বিদ্যুৎ, উত্তপ্ত লৌহপিণ্ড। কিন্তু যেখানে ধূম থাকে সেখানে বহ্নি থাকতে দেখা যায়, যেমন রান্নাঘর ইত্যাদি। অর্থাৎ বহ্নি বা আগুনের বিস্তৃতি বেশি বলে বহ্নি ব্যাপক, সে তুলনায় ধূমের বিস্তৃতি কম বলে ধূম ব্যাপ্য। এখানে ধূম বহ্নির দ্বারা ব্যাপ্য, এবং বহ্নি ধূমের ব্যাপক। এই ব্যাপ্য বা হেতু  ও সাধ্য বা ব্যাপকের মধ্যে যে সম্বন্ধ তাই হলো ব্যাপ্তি। তাই ব্যাপ্তিকে ব্যাপ্য-ব্যাপক সম্বন্ধও বলা হয়। বেশি জায়গা জুড়ে থাকা হলো ব্যাপকতা, আর অল্প জায়গা জুড়ে থাকা হলো ব্যাপ্যতা।
 .
নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তিকে দুইভাগে ভাগ করেছেন- সমব্যাপ্তি ও অসমব্যাপ্তি বা বিষমব্যাপ্তি।
ব্যাপ্য ও ব্যাপকের বিস্তৃতি যদি সমান হয় তাকে সমব্যাপ্তি বলে। অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের বিস্তৃতি সমান হলে উভয়ের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ হয় তা সমব্যাপ্তি। এইরূপ ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে যে কোন একটি থেকে অপরটিকে অনুমান করা যায়। যেমন মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন জীব। এখানে মানুষ ও বুদ্ধিসম্পন্ন জীব- দুটোরই বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা সমান। এভাবে কার্য ও কারণ, দ্রব্য ও গুণের মধ্যে যে ব্যাপ্তি তা হলো সমব্যাপ্তি।
অন্যদিকে ব্যাপ্য ও ব্যাপক অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের বিস্তৃতি যদি সমান না হয় তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সম্বন্ধকে বলা হয় অসমব্যাপ্তি বা বিষমব্যাপ্তি। যেমন ধূম ও বহ্নির বিস্তৃতি সমান না হওয়ায় যেখানে যেখানে ধূম থাকে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকলেও যেখানে যেখানে বহ্নি থাকে সেখানে সেখানে ধূম থাকে না। এরূপ ব্যাপ্তি বিষমব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত।
 .
ব্যাপ্তি ছাড়া অনুমান হয় না। যেমন, ‘যেখানে ধূম সেখানে অগ্নি’- এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞান থাকলে কোন ব্যক্তির দ্বারা পর্বতে(পক্ষ) ধূম (হেতু) প্রত্যক্ষ করে পর্বতে অগ্নির (সাধ্য) অনুমান করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ অনুমান স্থলে হেতুর (ধূম) দ্বারা পক্ষে (পর্বত) সাধ্যের (অগ্নি) জ্ঞান হয়। এই জ্ঞানই অনুমিতি।
তবে অনুমানকে যথার্থ হতে হলে প্রযুক্ত হেতুকে সৎ হতে হবে। আবার, হেতুকে সৎ হতে হলে হেতুকে ব্যাপ্তির একটি সম্বন্ধী হতে হবে। ন্যায়মতে ব্যাপ্তি হলো দুটি পদার্থের মধ্যে নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধ। অনুমানের ক্ষেত্রে এই দুটি পদার্থ হলো হেতু ও সাধ্য। হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধ তাই অনুমানের ভিত্তি। এই সম্বন্ধই ব্যাপ্তি। ন্যায়দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট ব্যাপ্তির লক্ষণ প্রসংগে বলেন-
‘যত্র যত্র ধূমঃ তত্র তত্র অগ্নিঃ ইতি সাহচর্য নিয়মঃ ব্যাপ্তিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যেখানে যেখানে ধূম সেখানে সেখানেই অগ্নি- এই সাহচর্য নিয়মকেই ব্যাপ্তি বলা হয়।
 .
দুটি পদার্থ সহগামী হলেই তাদের সহচর বলা হয়। এই একসঙ্গে থাকাই সাহচর্য বা সহ-উপস্থিতি (co-existence)। সাহচর্য মানে সামানাধিকরণ্য বা সমান অধিকরণতাও বোঝায়। অর্থাৎ দুটি পদার্থ হেতু ও সাধ্য একই অধিকরণে থাকলে তাদের মধ্যে সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্য আছে বলা যায়। ব্যাপ্তি হলো হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়ম। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়ত বা অবশ্যম্ভাবিতা। অর্থাৎ যার কোন ব্যতিক্রম হয় না। অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্যই ব্যাপ্তি। ধূম থাকলে আগুন থাকবেই। এখানে হেতু ধূম, সাধ্য আগুন। এখন যদি আগুনকে হেতু ধরে সাধ্য হিসেবে ধূমের অনুমান করতে হয়, তাহলে যেখানে অগ্নি সেখানেই ধূম এই সাহচর্য নিয়ত সম্বন্ধ হবে না। কারণ ধূম ছাড়াও আগুনের অস্তিত্ব থাকতে পারে। তবে এই সাহচর্য নিয়ম শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেন-
‘হেতু সমানাধিকরণ অত্যন্তাভাব অপ্রতিযোগী সাধ্য সামানাধিকরণ্যং ব্যাপ্তিঃ’।
অর্থাৎ : হেতুর সমান অধিকরণে যে অত্যন্তাভাব থাকে, সেই অত্যন্তাভাবের অপ্রতিযোগী যে সাধ্য, তার সঙ্গে হেতুর সামানাধিকরণ্যই ব্যাপ্তি।
 .
যেমন, পর্বতে আগুন আছে যেহেতু পর্বতে ধূম আছে- এরূপ অনুমিতিস্থলে পর্বতে ধূমকে প্রত্যক্ষ করে আমরা যখন বহ্নির অনুমান করি, তখন সেই অনুমানে ধূম হলো হেতু এবং বহ্নি বা আগুন হলো সাধ্য এবং পর্বত হলো পক্ষ। ধূম হেতুর অধিকরণ হলো মহানস বা রান্নাঘর, গোষ্ঠ, চত্বর প্রভৃতি। এই সকল ধূমের অধিকরণে যে অত্যন্তাভাব থাকে ঐ অত্যন্তাভাব বহ্নির অত্যন্তাভাব হতে পারে না। (অত্যন্তাভাব মানে অত্যন্ত অভাব, অর্থাৎ অনুপস্থিত)। কোন পদার্থের অত্যন্তাভাবের উপস্থিতিতে সেই পদার্থের উপস্থিতি ঘটতে পারে না। অর্থাৎ বহ্নি হলো ধূমের অধিকরণে বর্তমান অত্যন্তাভাবের অপ্রতিযোগী। যার অভাব তাকে বলে প্রতিযোগী। যেমন, ঘটের অভাব হলো ঘাঁভাব। সুতরাং ঘটাভাবের প্রতিযোগী হলো ঘট। কাজেই সাধ্য আগুন এই অভাবের প্রতিযোগী না হওয়ায় তা অপ্রতিযোগী। অতএব, ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে হেতু ঘট পট ইত্যাদি অন্যান্য পদার্থের অত্যন্তাভাবের সমানাধিকরণ হলেও সাধ্যের অত্যন্তাভাবের সঙ্গে সমানাধিকরণ হয় না। ফলে এখানে হেতু ধুম এবং সাধ্য আগুনের সামানাধিকরণ্য বর্তমান। এই কারণে ধূম হেতু এবং বহ্নি সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি আছে বলা যাবে।
 .
তবে ন্যায়দর্শনে যে কোন সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্যের সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা যায় না। যে সাহচর্য ব্যতিক্রমহীন তাই নিয়ত সাহচর্য বা নিয়ত সামানাধিকরণ্য। এই সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্যই ব্যাপ্তি।  ধরা যাক্ ধূম থাকে পর্বত, চত্বর, গোষ্ঠ, মহানস বা রান্নাঘরে।  যেখনেই ধূম দেখি সেখানেই অগ্নির অস্তিত্ব দেখা যায়। অর্থাৎ আগুন ছাড়া ধূমের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। যেখানে আগুন নেই সেখানে ধূমও নেই। এখানে ধূম ও অগ্নির যে সাহচর্য, তার কোন ব্যতিক্রম নেই। ফলে যেখানে ধূম সেখানে অগ্নির সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্য রয়েছে বলে তাদের সম্পর্ক ব্যাপ্তি সম্পর্ক।
 .
কিন্তু বহু অগ্নি আছে যেখানে যেখানে ধূম নেই। যেমন- বিদ্যুৎ, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড ইত্যাদি। আগুনে পুড়ে টকটকে লাল যে লৌহপিণ্ড তার মধ্যে ধূম নেই। কাজেই যেখানে অগ্নি সেখানেই ধূম আছে তা বলা চলে না। ফলে অগ্নির সাথে ধূমের ব্যাপ্তিসম্বন্ধ স্বীকার করা যায় না। কারণ অগ্নি ও ধূমের মধ্যে সামানাধিকরণ্য বা নিয়ত সাহচর্য নেই। তাই নৈয়ায়িকরা বলেন যে সাধারণত হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা হয়, কিন্তু যে-কোন সাহচর্যের সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা যায় না। ব্যাপ্তি সম্পর্ক হবে অনৌপাধিক অর্থাৎ উপাধিহীন। অগ্নির সাথে ধূমের যে সহচার সম্বন্ধ, তা একটি শর্ত বা উপাধির উপর নির্ভরশীল। সেই শর্তটি হলো আর্দ্র ইন্ধন বা ভেজা কাঠ। বস্তুত আর্দ্রতা না থাকলে অগ্নির সঙ্গে ধূম উপস্থিত থাকে না। কাজেই অগ্নি ও ধূমের সহচার সম্বন্ধ অনৌপাধিক বা শর্তহীন না হওয়ায় তা ব্যাপ্তি নয়। অপরপক্ষে ‘যেখানেই ধূম সেখানেই অগ্নি’- এক্ষেত্রে ধূমের সঙ্গে অগ্নির যে সহচার সম্পর্ক, তা উপাধিহীন (unconditional) হওয়ায় ব্যাপ্তি সম্পর্ক নামে পরিচিত। কাজেই ব্যাপ্তি হলো হেতু ও সাধ্যের সেই সহচার সম্বন্ধ যা অনৌপাধিক। যেহেতু এই সম্বন্ধ অনৌপাধিক সেহেতু এটি নিয়ত এবং অব্যভিচারী। অতএব হেতুর সঙ্গে সাধ্যের শর্তশূন্য বা অনৌপাধিক নিয়ত-সাহচর্যকেই ব্যাপ্তি বলা হয়। অর্থাৎ অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাপ্তি হলো দুটি পদের ব্যতিক্রমহীন (invariable), উপাধিহীন (unconditional) ও নিয়ত (universal) সহ-উপস্থিতি (co-existence)-এর সম্পর্ক।
 .
ব্যাপ্তিগ্রহ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায় (The ways of ascertaining vyapti)
অনুমানকে যাঁরা যথার্থ অনুভবের উৎস বলে স্বীকার করেন, ব্যাপ্তিজ্ঞানকে তাঁরা কোনো না কোনো ভাবে স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তির স্বরূপ নির্ণয়ের পর ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার উপায় নির্দেশ করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ব্যাপ্তিগ্রহ অর্থাৎ ব্যাপ্তির জ্ঞান কিভাবে হয় ? যেমন সকল ধূমযুক্ত বস্তু হয় বহ্নিযুক্ত- এরূপ সার্বিক বচনকে আমরা কিভাবে জানি ? এ প্রশ্নের উত্তর বিষয়ে বিভিন্ন দর্শনের মতভেদ দেখা যায়।
 .
প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী চার্বাক দার্শনিকরা ব্যাপ্তিজ্ঞানের সম্ভাব্যতাই স্বীকার করেন না। কারণ প্রত্যক্ষের দ্বারা সমস্ত ধূম এবং সমস্ত বহ্নির একত্র অবস্থান কখনোই জানা সম্ভব নয়। সুতরাং হেতু এবং সাধ্যের সাহচর্য বা ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায় না।
 .
আবার বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে তাদাত্ম্য নীতি (The principle of essential identity) ও তদুৎপত্তি নীতি (The principle of causality)-র ভিত্তিতে ব্যাপ্তির জ্ঞান হয়। তাদাত্ম্য অর্থ অভিন্নতা। দুটি জিনিস যদি স্বরূপগত এক হয় তাহলে ঐ দুটি জিনিসের মধ্যে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে বলে মনে করা হয়। যেমন শিংশপার সঙ্গে বৃক্ষের তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে। শিংশপা হলো একজাতীয় (শিশু) বৃক্ষ। সুতরাং বৃক্ষের সারধর্ম বৃক্ষত্ব যেমন অন্যান্য বৃক্ষে আছে, তেমনি শিংশপাতেও আছে। শিংশপাতে বৃক্ষত্ব না থাকলে শিংশপাত্বও থাকে না। তাদাত্ম্য সম্বন্ধ যাদের মধ্যে থাকে তাদের একটি থেকে অপরটিকে সহজেই অনুমান করা যায়।
 .
আর তদুৎপত্তি হলো কার্য-কারণ সম্বন্ধ। দুটি বস্তুর মধ্যে একটি যদি কারণ হয় এবং অপরটি যদি কার্য হয়, তাহলে তাদের মধ্যে একটি সার্বত্রিক সম্বন্ধ স্বীকার করতে হয়। সুতরাং যে দুটি বস্তুর মধ্যে কার্য-কারণ সম্বন্ধ থাকে, তাদের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ নির্ণয় করা যেতে পারে। বৌদ্ধমতে কার্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করা হয় পঞ্চকারণীর দ্বারা। সেগুলি হলো- (১) কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কারণের অনুপলব্ধি, (২) কারণের উপলব্ধি, (৩) কার্যের উপলব্ধি, (৪) কার্যের অনুপলব্ধি এবং (৫) কারণের অনুপলব্ধি। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা ধূম এবং বহ্নির কার্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়। সুতরাং ধূম এবং বহ্নির ব্যাপ্তি জ্ঞান নিশ্চিতভাবে জানা যায়।
 .
কিন্তু নৈয়ায়িক মতে তাদাত্ম্য ও তদুৎপত্তি বা কার্য-কারণ সম্বন্ধের থেকে ব্যাপ্তিজ্ঞান হতে পারে না। কারণ যেস্থলে হেতু এবং অনুমেয় বিষয়ের কার্য-কারণ সম্বন্ধ নেই অথবা তাদাত্ম্য সম্বন্ধ নেই, সেস্থলেও অনুমিতি হতে দেখা যায়। সেকারণে নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বৌদ্ধমত গ্রহণ করেন নি।
 .
বৈদান্তিকরা অবাধিত (uncontradicted) অভিজ্ঞতার সাহায্যে দুটি বস্তুর সহচার দর্শনের মাধ্যমে ব্যাপ্তি নির্ণয় করেছে (ব্যাভিচারাদর্শনে সতি সহচারদর্শনম্)। দুটি বস্তুর একত্র উপস্থিতি (অন্বয়) দর্শন হলো সহচারদর্শন। অর্থাৎ বেদান্তমতে যেখানে হেতু সেখানে সাধ্যের উপস্থিতি দর্শন এবং এর ব্যতিক্রমের অদর্শনের মাধ্যমেই দুটি জিনিসের মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় সম্ভব।
নৈয়ায়িকরা বেদান্ত মতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করলেও তাঁরা ব্যাপ্তি নির্ণয়ের জন্য ছয়টি স্তরবিশিষ্ট একটি উপায় বা ছয়টি বিকল্প উপায়ের নির্দেশ করেছেন।  এই ছয়টি স্তর বা উপায় হলো- (১) অন্বয়, (২) ব্যতিরেক, (৩) ব্যভিচারাগ্রহ, (৪) উপাধিনিরাস, (৫) তর্ক ও (৬) সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ।
 .
(১) অন্বয় : দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই দুটি বস্তুর অন্বয় লক্ষ্য করতে হয়। সর্বদাই যদি দেখা যায় যে, একটি বস্তু যেখানে উপস্থিত হয়, সেখানে আর একটি বস্তুও উপস্থিত, তাহলে ঐ দুটি বস্তুর মধ্যে অন্বয় দর্শন হয়। যেখানে ধূম থাকে সেখানেই বহ্নি থাকে, তাই ধূম ও বহ্নির মধ্যে অন্বয় বোঝা যায়।
 .
(২) ব্যতিরেক : ব্যতিরেক পদ্ধতির দ্বারাও দুটি বস্তুর সাহচর্য দর্শন করা যায়। সর্বাদাই যদি দেখা যায় যে, একটি বস্তু অনুপস্থিত হলেই আর একটি বস্তু অনুপস্থিত হয়, তাহলে ঐ দুই বস্তুর সাহচর্য ব্যতিরেক প্রণালীর দ্বারা বোঝা যায়। যেখানে বহ্নি থাকে না সেখানে ধূম থাকে না- এরূপ ব্যতিকেক দৃষ্টান্তের দ্বারা ধূম ও বহ্নির সাহচর্য নির্ণয় করা যায়। উল্লেখ্য যে, ব্যতিরেক ব্যাপ্তিতে হেতুর অনুপস্থিতিতে সাধ্যের অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয় না, বরং সাধ্যের অনুপস্থিতিতে হেতুর অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয়। বহ্নির অনুপস্থিতিতে ধূমের অনুপস্থিতি থেকে বহ্নি দেখে ধূমের অনুমান করা যায় না, ধূম থেকে বহ্নির অনুমান করা যায়।
 .
(৩) ব্যভিচারাগ্রহ : অন্বয় ও ব্যতিরেক দুটিই সহচার প্রত্যক্ষ। অর্থাৎ অন্বয় সহচার হলো দুটি বস্তুর উপস্থিতি সংক্রান্ত ঐক্য, এবং ব্যতিরেক সহচার হলো দুটি বস্তুর অনুপস্থিতির ঐক্য। এই পুনঃ পুনঃ সহচারদর্শনকে ভূয়োদর্শনও বলা হয়। কিন্তু দুটি বস্তুর অন্বয় ও ব্যতিরেক দর্শন হলেই দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে- একথা বলা যায় না। অন্বয় ও ব্যতিরেক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে লব্ধ দুটি বস্তুর সাহচর্যের কোন ব্যতিক্রম আছে কিনা তাও বিচার করে দেখতে হবে। এই ধরনের ব্যতিক্রম বা বিরোধী দৃষ্টান্তের অভাবদর্শনই হলো ব্যভিচার দর্শন। কেননা নব্যনৈয়ায়িকদের মতে সহচারের ভূয়োদর্শন (বিস্তৃত অভিজ্ঞতা) ব্যাপ্তিজ্ঞানের জনক নয়। অর্থাৎ সহস্রবার সহচার দর্শন হলেও ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা দূর হয় না। অর্থাৎ বারবার ধূম ও বহ্নির সহচার দর্শন করলেও তাদের মধ্যে ব্যাপ্তিসম্বন্ধ আছে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সহচার দর্শন অর্থাৎ ‘যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি’ এরূপ ধূম ও অগ্নির সহচার দর্শন যদি একবার হয় তাহলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হবে যদি ব্যভিচার জ্ঞান না থাকে। ব্যভিচার জ্ঞান থাকলে পুনঃ পুনঃ সহচার দর্শন হলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হতে পারে না। নব্যনৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় ভূয়োদর্শন শব্দের অর্থ করেছেন- ‘ব্যভিচার জ্ঞান বিরহ সহকৃত সহচার জ্ঞান’। মানে, ভূয়োদর্শনকে অবশ্যই ব্যতিক্রমহীন হতে হবে। তাই অন্নংভট্টের মতে-
‘ব্যভিচার জ্ঞানবিরহ সহকৃত সহচারজ্ঞানস্য ব্যাপ্তিগ্রাহকত্বাৎ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : (দুটি বস্তুর) সাহচর্য বিষয়ে জ্ঞান এবং ব্যভিচার জ্ঞানের অভাব হতেই ব্যাপ্তিগ্রহ হয়।
 .
ব্যভিচার জ্ঞান ব্যাপ্তিজ্ঞান বা ব্যাপ্তিগ্রহের প্রতিবন্ধক। ব্যভিচারজ্ঞান দুভাবে ব্যাপ্তিজ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা করতে পারে। তাই ব্যভিচারজ্ঞান দু’প্রকার- (ক) ব্যভিচার নিশ্চয় ও (খ) ব্যভিচার সংশয়।
ব্যভিচারের নিশ্চয় বা প্রত্যক্ষ হলে ব্যাপ্তিজ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্যভিচারের সংশয় হলেও এরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, বহ্নির সহচারের পর যদি ব্যভিচার প্রত্যক্ষ হয় তাহলে যেমন ব্যাপ্তিগ্রহ হয় না, তেমনি ব্যভিচারের শঙ্কা থাকলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হবে না। সুতরাং, যেখানে ধূম থাকে সেখানে বহ্নি থাকে কি না- এরকম কোন শঙ্কা বা সংশয় থাকলে ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’- এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না। ফলে ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের জন্য ব্যভিচার সংশয়ের নিবৃত্তি প্রয়োজন।
 .
(৪) উপাধিনিরাস : ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ উপাধিশূন্য বা শর্তহীন। তাই যে দুটি বস্তু বা সম্বন্ধীর মধ্যে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় তাদের মধ্যে কোন উপাধি আছে কিনা তা অনুসন্ধান করা দরকার হয় এবং যদি কোন উপাধি থাকে তবে উপাধিনিরাস প্রয়োজন। উপাধি নির্ধারণের প্রকৃষ্ট উপায় হলো ভূয়োদর্শন বা বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। ভূয়োদর্শন বা বিস্তৃত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে, ব্যাপ্তিজ্ঞাপক হেতু ও সাধ্যের মধ্যে কোন উপাধি বা শর্ত নেই।
 .
(৫) তর্ক : উপরিউক্ত উপায়ে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও কোন প্রতিবাদী ঐ ব্যাপ্তি সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করতে পারেন। প্রতিবাদীর এই সংশয় নিরাস করার জন্য নৈয়ায়িকরা ‘তর্ক’ নামক একটি যুক্তিপ্রণালীর কথা উল্লেখ করেন। তর্ক একপ্রকার পরোক্ষ যুক্তিপ্রণালী। এই যুক্তিপ্রণালীতে বাদীর বিরোধী সিদ্ধান্তকে খণ্ডনের মাধ্যমে বাদীর সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ‘যেখানে ধূম আছে সেখানেই বহ্নি আছে’- এরূপ ব্যাপ্তির বিরোধী সিদ্ধান্ত হলো ধূম বহ্নির ব্যভিচারী, মানে, কোন কোন স্থলে ধূম থাকলেও বহ্নি থাকে না অর্থাৎ বহ্নি ছাড়াও কোন কোন স্থলে ধূম থাকতে পারে। কিন্তু বাদীর সিদ্ধান্তের এই বিরোধী সিদ্ধান্ত দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বা সহচার দর্শন দ্বারা খণ্ডিত হয়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বহ্নি ছাড়া ধূম থাকে না। বহ্নি ছাড়া  যদি ধূম থাকতো, তাহলে ধূমপায়ীদের বহ্নিসংযোগের প্রয়োজন হতো না। ফলে বহ্নিশূন্য স্থানেও ধূম থাকবে। যেহেতু তা সম্ভব নয় অর্থাৎ প্রতিবাদীর সিদ্ধান্ত দৈনন্দিন ব্যবহারের দ্বারা খণ্ডিত হয়, তাই প্রতিবাদীর সিদ্ধান্ত খণ্ডিত হওয়ায় বাদীর সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এভাবে তর্কের দ্বারা প্রমাণ হয় যে ধূম ও বহ্নির মধ্যে ব্যাপ্তি আছে।
 .
(৬) সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ : ন্যায়সম্মত ব্যাপ্তি নির্ণয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ। সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ। যেমন আমরা পর্বত, পাকশালা প্রভৃতি কোন কোন ক্ষেত্রে ধূম ও বহ্নির ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু ব্যাপ্তি সম্বন্ধ সার্বজনীন। তাই আমাদের বলার উদ্দেশ্য এরকম হয় না যে, শুধু পর্বতীয় ধূমের সঙ্গে পর্বতীয় বহ্নির ব্যাপ্তি আছে বা পাকশালার ধূমের সঙ্গে পাকশালার বহ্নির ব্যাপ্তি আছে। সকল ধূমের সঙ্গে সকল বহ্নির ব্যাপ্তিই আমরা জানতে চাই। কিন্তু সকল ধূম ও সকল বহ্নির সঙ্গে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাধারণ বা লৌকিক সন্নিকর্ষ সম্ভব নয়। তা সমাধানকল্পেই ন্যায়দর্শনে সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষের দ্বারা সকল ধূম ও সকল বহ্নির ব্যাপ্তিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
 .
এই সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে আমরা কোন একটি স্থানে ধূমকে প্রত্যক্ষ করার সময় ঐ ধূমের মাধ্যমে ধূমত্ব জাতিকে এবং ঐ ধূমত্ব জাতির মাধ্যমে সকল ধূমকে প্রত্যক্ষ করতে পারি। অনুরূপভাবে বহ্নিত্ব জাতির মাধ্যমে আমরা সকল বহ্নিকে প্রত্যক্ষ করতে পারি। ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের প্রত্যক্ষকালে ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের সম্বন্ধও আমাদের প্রত্যক্ষের বিষয় হয়। ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের এই সম্বন্ধের সাহায্যে আমরা সামান্যত সকল ধূমের সঙ্গে সকল বহ্নির একটি সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ করি। এই প্রত্যক্ষ হয় এক ধরনের অলৌকিক প্রত্যক্ষ। এটাই সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ। এইভাবে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় করা যেতে পারে।

৫.৪ : অনুমানের শ্রেণীবিভাগ…
       (ক) স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান…
       (খ) পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট…
       (গ) কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী…

পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যায় অনুমানের দুটি মূল শ্রেণীবিভাগ রয়েছে- অবরোহ অনুমান (Deductive Inference) এবং আরোহ অনুমান (Inductive Inference)। অবরোহ অনুমানকে আবার দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- অমাধ্যম অনুমান (Immediate Inference) এবং মাধ্যম অনুমান (Mediate Inference)। কিন্তু ভারতীয় অনুমান পদ্ধতি অবরোহ ও আরোহ অনুমানের মিলিত প্রণালী।
ন্যায়দর্শনে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে বিভিন্ন নীতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তাঁদের মতে অনুমানের বিভিন্ন ধরনের তিন প্রকার শ্রেণীবিভাগ আছে। যথা- (ক) স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান; (খ) পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট; (গ) কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী।
 .
(ক) স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান :
অভিপ্রায়ের দিক থেকে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে স্বার্থ ও পরার্থ বলেছেন। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেছেন, অনুমান দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান (‘অনুমানং দ্বিবিধং স্বার্র্থং পরার্থং চ’)।
 .
স্বার্থ শব্দের অর্থ নিজের জন্য কৃত। স্বার্থানুমানের অর্থ হলো নিজের জন্য কৃত অনুমিতির করণ। ব্যক্তিগত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে যে অনুমান করা হয় তাকে স্বার্থানুমান বলা হয়। স্বার্থানুমান দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে বলা হয় স্বার্থানুমিতি। অর্থাৎ যে অনুমানের দ্বারা অনুমান-কর্তার নিজের সাধ্যবিষয়ক অনুমিতি হয় তাকে বলা হয় স্বার্থানুমিতি। এক্ষেত্রে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে একটি বাস্তব দৃষ্টান্তের সাহায্যে স্বার্থানুমিতির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন।
 .
পাকশালা বা বিভিন্নস্থানে ধূম ও বহ্নির মধ্যে নিয়ত সাহচর্য লক্ষ্য করে ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’ এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞানের পর কোন ব্যক্তি পর্বত থেকে ধূম নির্গত হতে দেখে ঐ পর্বতে বহ্নি আছে কিনা (১) তার অগ্নি বিষয়ে সংশয় হয়। তারপর (২) সে পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে (৩) তাঁর ধূম-বহ্নির ব্যাপ্তিসম্পর্কের কথা মনে পড়ে। এই ব্যাপ্তিস্মরণের পর (৪) তাঁর ‘পর্বত বহ্নিব্যাপ্য ধূমবিশিষ্ট’ বা ‘যে ধূম বহ্নির সঙ্গে ব্যাপ্তিবিশিষ্ট সেই ধূম এই পর্বতে আছে’- এরূপ পরামর্শজ্ঞান হয়। তখন (৫) সেই ব্যক্তির ‘পর্বত বহ্নিযুক্ত’ এরূপ জ্ঞান হয়।
 .
ন্যায়ের পরিভাষায় (১) প্রথমটি হলো সাধ্যসংশয়, (২) পক্ষধর্মতাজ্ঞান, (৩) ব্যাপ্তিস্মৃতি, (৪) পরামর্শ, (৫) অনুমিতি। এই অনুমিতি স্বার্থানুমিতি। এই অনুমিতির করণ স্বার্থানুমান। স্বার্থানুমানে অপরের উপলব্ধি বা জ্ঞানের জন্য অনুমান করা হচ্ছে না বলে অপরকে নিজ মত বোঝানোর জন্য অনুমানটিকে যথার্থভাবে লেখার বা বলার প্রয়োজন হয় না বা কোন বাক্য প্রয়োগ হয় না।
 .
অপরপক্ষে অন্যের কাছে কিছু প্রমাণ করার জন্য যে অনুমান করা হয় তাকে পরার্থানুমান বলা হয়। পরার্থানুমানের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে বলা হয় পরার্থানুমিতি। পরার্থানুমানে অপরের কাছে প্রমাণ করার জন্য অনুমান করা হয় বলে অনুমানটিকে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা প্রয়োজন হয়। অনুমিত বিষয়কে অন্যের কাছে প্রতিপাদন করতে হয় বলে নৈয়ায়িকগণ এই অনুমানকে পাঁচটি অবয়বের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, কোনো একটি উহ্য থাকলে চলবে না। পাঁচটি অবয়ব আছে বলে নৈয়ায়িক অনুমানকে ‘পঞ্চ-অবয়বী’ (five membered syllogism) বলা হয়। ইতঃপূর্বে ‘অনুমানের অবয়ব’ অনুচ্ছেদে বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে।
 .
(খ) পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট :
কার্যকারণ নীতিকে অবলম্বন করে মহর্ষি গৌতম ‘ন্যায়সূত্রে’ অনুমানের একপ্রকার বিভাগ উল্লেখ করেছেন। এই মতে অনুমান তিনপ্রকার। যথা- পূর্ববৎ, শেষবৎ এবং সামান্যতোদৃষ্ট। ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে-  
‘অথ তৎপূর্ব্বকং ত্রিবিধমনুমানং পূর্ব্ববচ্ছেষবৎ সামান্যতো দৃষ্টঞ্চ’।। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)
অর্থাৎ : অনন্তর প্রত্যক্ষবিশেষমূলক জ্ঞান- অনুমান-প্রমাণ ত্রিবিধ- পূর্ব্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট।
 .
পূর্ববৎ অনুমান : ন্যায়মতে পূর্ব শব্দের অর্থ হলো কারণ। অতএব, পূর্ববৎ অনুমান হলো কারণহেতুক অনুমান। অর্থাৎ, যে অনুমানে কারণকে প্রত্যক্ষ করে তার থেকে যখন অপ্রত্যক্ষ কার্যের কথা অনুমান করা হয় তখন তাকে পূর্ববৎ অনুমান বলা হয়। ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ন্যায়ভাষ্যে বলেছেন-  
‘পূর্ব্ব’দিতি–যত্র কারণেন কার্য্যমনুমীয়তে, যথা–মেঘোন্নত্যা ভবিষ্যতি বৃষ্টিরিতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : যে স্থলে কারণের দ্বারা কার্য অনুমিতি হয় অর্থাৎ কারণ বিশেষের জ্ঞানের দ্বারা তার ব্যাপক কার্যের অনুমিতি জন্মে, সে স্থলে অনুমানপ্রমাণ ‘পূর্ববৎ’ নামে কথিত হয়। যেমন মেঘের উন্নতি-বিশেষের দ্বারা অর্থাৎ তার প্রত্যক্ষ দ্বারা ‘বৃষ্টি হবে’ এরূপ অনুমিত হয়।
এক্ষেত্রে কারণবিশেষের জ্ঞানের সাহায্যে তার ব্যাপক কার্যবিশেষের অনুমিতি হয়। পূর্ব দৃষ্টান্ত বা পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অনুমান করা হয়। যেমন- আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখে আমরা অনুমান করি যে বৃষ্টি হবে। এখানে মেঘ হলো কারণ, বৃষ্টি হলো কার্য।
 .
শেষবৎ অনুমান : ন্যায়মতে ‘শেষ’ শব্দের অর্থ হলো কার্য। সুতরাং, শেষবৎ অনুমান হলো কার্যহেতুক অনুমান। অর্থাৎ, যে অনুমানে কার্যকে প্রত্যক্ষ করে অপ্রত্যক্ষ কারণকে অনুমান করা হয়, তাকে বলা হয় শেষবৎ অনুমান। ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বাৎস্যায়ন বলেছেন-  
‘শেষবাৎ’ তৎ,–যত্র কার্য্যণে কারণমনুময়ীতে, পূর্ব্বোদকবিপরীতমুদকং নদ্যাঃ পূর্ণত্বং শীঘ্রত্বঞ্চ দৃষ্টা স্রোতসোহনুমীয়তে ভূতা বৃষ্টিরিতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : যে স্থলে কার্যের দ্বারা কারণ অনুমিত হয় অর্থাৎ কার্যবিশেষের জ্ঞানের দ্বারা তার ব্যাপক করণের অনুমিতি জন্মে, তা অর্থাৎ সেই স্থলীয় অনুমান প্রমাণ ‘শেষবৎ’। যেমন নদীর পূর্বস্থিত জলের বিপরীত জলরূপ পূর্ণত্ব এবং স্রোতের তীব্রতা বা শীঘ্রত্ব দেখে ‘বৃষ্টি হয়েছে’ এরূপ অনুমিত হয়।
এক্ষেত্রে কার্যবিশেষের জ্ঞানের সাহায্যে তার ব্যাপক কারণ-বিশেষকে অনুমান করা হয়। যেমন- সকালবেলা মাটি ভেজা দেখে গতরাতের বৃষ্টির অনুমান করা হয়।
হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ তারই ভিত্তিতে অনুমানের এই শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে।
 .
সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান : আবার পূর্ব অভিজ্ঞতা ও সাদৃশ্যের ভিত্তিতে যে অনুমান করা হয় তাকে সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান বলা হয়। বাৎস্যায়নের ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘সামান্যতো দৃষ্টং’–ব্রজ্যাপূর্ব্বকমন্যত্র দৃষ্টস্যান্যত্র দর্শনমিতি তথাচাদিত্যস্য, তস্মাদস্ত্যপ্রত্যক্ষাপ্যাদিত্যস্য ব্রজ্যেতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : ‘সামান্যতো দৃষ্ট’ অনুমান (যথা)–অন্যত্র দৃষ্ট দ্রব্যের অন্যত্র দর্শন ‘ব্রজ্যাপূর্বক’ অর্থাৎ সেই দ্রব্যের গতিক্রিয়াপ্রযুক্ত; সূর্যের অনুরূপ, অর্থাৎ প্রাতঃকালে এক স্থানে দৃষ্ট সূর্যের কালান্তরে অন্যত্র দর্শন হয়, অতএব অপ্রত্যক্ষ হলেও সূর্যের গতি আছে তা অনুমিত হয়।
এই অনুমানের ব্যাপ্তি কার্য-কারণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা এ অনুমানের হেতু ও সাধ্য কার্য-কারণ সম্বন্ধে সংবদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ- পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে গরু, মহিষের শিং আছে এবং তাদের খুরও দ্বিখণ্ডিত। অনুরূপভাবে শিংযুক্ত প্রাণী দেখে অনুমান করা হয় যে সেই প্রাণীর দ্বিখণ্ডিত খুর আছে।
 .
(গ) কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী :
ন্যায়মতে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিকে ভিত্তি করে অনুমানকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে- কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী এবং অন্বয়-ব্যতিরেকী।
 .
কেবলন্বয়ী : যে অনুমানের ব্যাপ্তি কেবলমাত্র অন্বয়ী পদ্ধতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সেই অনুমানকে বলা হয় কেবলান্বয়ী অনুমান। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কেবলান্বয়ী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘অন্বয়মাত্রব্যাপ্তিকং কেবলান্বয়ি’।
অর্থাৎ : যে হেতু (লিঙ্গ) কেবলমাত্র অন্বয়ব্যাপ্তিবিশিষ্ট তাকে কেবলান্বয়ী লিঙ্গ বলে।
 .
কেবলান্বয়ী অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের কেবল অন্বয় ব্যাপ্তি থাকে। যেখানে হেতু সেখানেই সাধ্য যখন অনুমান করা হয় তখন সেই অনুমানকে কেবলান্বয়ী অনুমান বলা হয়। এই অনুমানে কোন নঞর্থক বা ব্যতিরেকী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ-
সব ধূমায়মান বস্তুই বহ্নিমান
পর্বত ধূমায়মান
পর্বত বহ্নিমান।
 .
এই অনুমানে সাধ্য বাক্যটি একটি সার্বিক বাক্য, যে বাক্যে ‘বহ্নিমান’ এই বিধেয়টি সব ধূমায়মান বস্তু সম্পর্কেই স্বীকার করা হয়েছে। এমন কোনো ধূমায়মান বস্তু দেখা যায় না, যা বহ্নিমান নয়। এখানে কোনো ব্যতিরেকী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। একইভাবে-
সব জ্ঞেয় পদার্থই নামযুক্ত (অভিধেয়), যেমন- পট,
ঘট একটি জ্ঞেয় পদার্থ,
অতএব, ঘট নামযুক্ত।
 .
এখানে জ্ঞেয়ত্ব হেতু, অভিধেয়ত্ব সাধ্য এবং ঘট হলো পক্ষ। ন্যায়দর্শনে জ্ঞেয়ত্ব, বাচ্যত্ব, অভিধেয়ত্ব, প্রমেয়ত্ব প্রভৃতি ধর্মকে কেবলান্বয়ী ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এই ধর্মগুলি সকল পদার্থের মধ্যেই থাকে। এই কারণে উক্ত ধর্মগুলির একটিকে হেতু এবং অন্যটিকে সাধ্যরূপে গ্রহণ করে অনুমিতি করলে, সেগুলি হবে কেবলান্বয়ী অনুমিতি। তাই কোন পদার্থের ক্ষেত্রে ‘যেখানে যেখানে অভিধেয়ত্বের অভাব সেখানে সেখানে প্রমেয়ত্বের অভাব’ এরূপ ব্যতিরেকব্যাপ্তি সম্ভবই হয় না, যেহেতু এখানে সমর্থনসূচক দৃষ্টান্ত নেই।
 .
কেবল-ব্যতিরেকী : যে অনুমিতির সমর্থনে কেবলমাত্র ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, কিন্তু অন্বয় দৃষ্টান্ত যেখানে সম্ভব নয়, তাকে বলা হয় কেবল-ব্যতিরেকী অনুমান। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কেবল-ব্যতিরেকী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘ব্যতিরেকব্যাপ্তিমাত্রকং কেবলব্যতিরেকি’।
অর্থাৎ : যে হেতু বা লিঙ্গ কেবল ব্যতিরেকব্যাপ্তি বিশিষ্ট তাকে কেবলব্যতিরেকী লিঙ্গ বলে।
 .
যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের অন্বয়ব্যাপ্তি সম্ভবই নয়, সাধ্যের অভাবের সঙ্গে হেতুর অভাবের ব্যাপ্তিই সম্ভব, সেই হেতু কেবলব্যতিরেকী হেতু। এই অনুমানে হেতু ও সাধ্যের অনুপস্থিতি বা অভাবের সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করেই সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ-
যা অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন নয় তা গন্ধবান নয়, যেমন- জল,
পৃথিবী গন্ধবান,
অতএব, পৃথিবী অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন।
 .
এই অনুমানের পক্ষ ‘পৃথিবী’, ‘গন্ধবত্ব’ হেতু এবং ‘অন্য ভূতদ্রব্য হতে ভিন্ন’ হচ্ছে সাধ্য। এ অনুমানের ‘গন্ধবত্ব’ হেতুটি কেবলব্যতিরেকী হেতু। কেননা, পৃথিবী গহৃবান কিন্তু পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোন পদার্থ গন্ধবান না হওয়ায় এই অনুমানের অন্বয় দৃষ্টান্ত (‘যা গন্ধবান তা অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন’) সম্ভব নয়। তাই এরূপ অনুমানকে কেবল-ব্যতিরেকী অনুমান বলে। একইভাবে-
কোনো অবহ্নিমান বস্তুই নয় ধূমায়মান,
পর্বত হয় ধূমায়মান,
অতএব, পর্বত হয় বহ্নিমান।
 .
এই অনুমানে ব্যাপ্তি সম্পর্ক কেবলমাত্র ব্যতিরেকী দৃষ্টান্তের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ যেখানে হেতু নেই সেখানে সাধ্য নেই।
 .
অন্বয়-ব্যতিরেকী : যে অনুমানের সমর্থনে অন্বয় এবং ব্যতিরেক উভয়প্রকার ব্যাপ্তিই পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট অন্বয়ব্যতিরেকী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘অন্বয়েন ব্যতিরেকেন চ ব্যাপ্তিমৎ অন্বয় ব্যতিরেকি’।
অর্থাৎ : যে লিঙ্গ অন্বয় এবং ব্যতিরেক ব্যাপ্তি বিশিষ্ট তাকে অন্বয়ব্যতিরেকী লিঙ্গ বলে।
 .
অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে ব্যাপ্তি সম্পর্ক অন্বয় ও ব্যতিরেকী এই দুই প্রকার দৃষ্টান্তের উপর নির্ভরশীল। যেখানেই হেতু সেখানেই সাধ্য এবং যেখানে হেতু নেই সেখানে সাধ্য নেই। এই অনুমানের আকারটি উদাহরণস্বরূপ-
যা ধূমবান তাই বহ্নিমান, যেমন- পাকশালা,
পর্বতটি ধূমবান,
অতএব, পর্বতটি বহ্নিমান।
এবং-
যা বহ্নিমান নয় তা ধূমবান নয়, যেমন-  হ্রদ,
পর্বতটি ধূমবান,
অতএব, পর্বতটি বহ্নিমান।
 .
অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের অন্বয় ও ব্যতিরেকী এই উভয়প্রকার ব্যাপ্তি দেখা যায়। এখানে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে অন্বয় বা সহ-উপস্থিতি এবং ব্যতিরেক বা সহ-অনুপস্থিতি এই উভয় প্রকার সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। উপরিউক্ত অনুমানের অন্বয় দৃষ্টান্ত পাকশালা এবং ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত হ্রদ উভয়ই জ্ঞানের বিষয় হওয়ার যোগ্যতাবিশিষ্ট অর্থাৎ দৃষ্টান্ত হিসেবে তাদের জ্ঞান সম্ভব। তাই এই অনুমান হলো অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান।

৫.৫ : হেত্বাভাস…
        পক্ষ, সপক্ষ, বিপক্ষ…
       (ক) সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস…
            সাধারণ সব্যভিচার
            অসাধারণ সব্যভিচার
            অনুপসংহারী সব্যভিচার
       (খ) বিরুদ্ধ হেত্বাভাস…
       (গ) সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস…
       (ঘ) অসিদ্ধ হেত্বাভাস…
            আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস
            স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস
            ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস
       (ঙ) বাধিত হেত্বাভাস…

 (Fallacies in Inference) 
.
ভারতীয় চিন্তাবিদদের মতে অনুমানের বস্তুগত সত্যতা নির্ভর করে অনুমানে ব্যবহৃত হেতুর বস্তুগত সত্যতার উপর। ন্যায়মতে হেতু  সৎ বা যথার্থ ও  অসৎ বা অযথার্থ হতে পারে। তবে হেতু বলতে সব সময় যথার্থ হেতুকেই বোঝানো হয়। অযথার্থ হেতু প্রকৃতপক্ষে হেতুই নয়। অসৎ হেতুই হেত্বাভাস।  হেত্বাভাসের লক্ষণে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেছেন-  
‘হেতুলক্ষণাভাবাদহেতবো হেতুসামান্যাৎ হেতুবদাভাসমানাঃ’। (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : হেতুর সমস্ত লক্ষণ না থাকায় অহেতু অর্থাৎ প্রকৃত হেতু নয়, এবং হেতুর সামান্য বা সাদৃশ্য থাকায় হেতুর ন্যায় প্রকাশমান, এটাই ‘হেত্বাভাস’ শব্দের অর্থ।
সহজ কথায়, যে অনুমানে হেতুর আভাস মাত্র থাকে, অর্থাৎ আসলে যা আছে তা হেতু নয়, হেতুর মতো দেখায় মাত্র, সেই অনুমান ভ্রান্তিজনক এবং এই ভ্রান্তির নাম হেত্বাভাস। দোষযুক্ত হেতুকেই হেত্বাভাস বলে। ‘হেত্বাভাস’ শব্দটিতে দুটি শব্দ রয়েছে (হেতু+আভাস)। যথার্থ হেতু না হয়েও যা হেতু বলে প্রতীয়মান হয় (‘হেতুবদ্ আভাসন্তে’) তাই হেত্বাভাস বা ‘দুষ্ট হেতু’।
 .
ন্যায়মতে একটি প্রকৃত বা যথার্থ হেতুর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হলো- (১) সৎ হেতু পক্ষে থাকবে (পক্ষসত্ত্ব বা পক্ষধর্মতা), (২) সৎ হেতু সপক্ষে থাকবে (সপক্ষসত্ত্ব), (৩) সৎ হেতু বিপক্ষে থাকবে না (বিপক্ষাসত্ত্ব), (৪) অন্য কোন প্রমাণ সাধ্য ধর্মের অভাব সাধক হবে না (অবাধিতত্ত্ব), (৫) গৃহীত হেতুর তুল্য বলশালী কোন প্রতিপক্ষ হেতু থাকবে না (অসৎপ্রতিপক্ষত্ব)। কোন হেতুতে সৎ হেতুর এই পাঁচটি লক্ষণের যে কোন এশটির অভাব থাকলে ঐ হেতুকে বলা হয় অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস।
 .
সৎ হেতুর লক্ষণ পাঁচটি বলে হেতুর দোষও পাঁচ প্রকার এবং দোষযুক্ত হেতু বা হেত্বাভাসও পাঁচ প্রকার। এ প্রসঙ্গে যদিও ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-প্রকরণসম-সাধ্যসম-কালাতীতা হেত্বাভাসাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪/৪৫)
অর্থাৎ : এসব লক্ষণাক্রান্ত হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, প্রকরণসম, সাধ্যসম ও কালাতীত।
তবে এ বিষয়ে অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেন-
‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-সৎপ্রতিপক্ষ-অসিদ্ধ-বাধিতাঃ পঞ্চ হেত্বাভাসাঃ’।
অর্থাৎ : অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস পাঁচ প্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, সৎপ্রতিপক্ষ, অসিদ্ধ ও বাধিত।
 .
এ অনুযায়ী নৈয়ায়িকগণ পাঁচ রকমের হেত্বাভাস স্বীকার করে থাকেন। যথা- (ক) সব্যভিচার, (খ) বিরুদ্ধ, (গ) সৎ প্রতিপক্ষ, (ঘ) অসিদ্ধ, (ঙ) বাধিত। এই পাঁচ প্রকার হেত্বাভাসের আবার কোন কোনটির উপবিভাগ করা হয়েছে।
 .
হেত্বাভাসের প্রকারভেদে যাওয়ার আগে আমাদের আরেকটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আবশ্যক। অনুমানে এবং বিশেষভাবে হেত্বাভাসের আলোচনায় পক্ষ, সপক্ষ, বিপক্ষ- এই তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়।
 .
পক্ষ, সপক্ষ, বিপক্ষ : নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে এই তিনটির লক্ষণ ও উদাহরণ দিয়েছেন। তর্কসংগ্রহে পক্ষ-এর লক্ষণ দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘সন্দিগ্ধ সাধ্যবান পক্ষঃ’।
অর্থাৎ : যে অধিকরণে সন্দিগ্ধ সাধ্য থাকে তাকে পক্ষ বলে।
 .
যেমন, ধূম থেকে পর্বতে বহ্নির অনুমান স্থলে পর্বত পক্ষ, ধূম হেতু এবং বহ্নি সাধ্য। ধূম থেকে পর্বতে বহ্নির এই অনুমান স্থলে ‘পর্বতে বহ্নি আছে কিনা’ এরূপ সন্দেহ থাকে। সাধ্য বিষয়ে সন্দেহ না থাকলে অনুমিতি হয় না বা ন্যায় প্রয়োগ হয় না। সাধ্যের সিদ্ধি অনুমিতির প্রতিবন্ধক। সাধ্য যদি নিশ্চিতভাবে জ্ঞাতই থাকে তাহলে অনুমিতি হয় না। অনুমিতির পূর্বে সাধ্য বিষয়ে সন্দেহ থাকলে ন্যায়বাক্যের প্রয়োগ হয়। এরূপ সন্দিগ্ধ সাধ্য যে অধিকরণে থাকে তাকে পক্ষ বলে।
তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট সপক্ষ-এর লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘নিশ্চিত সাধ্যবান্ সপক্ষঃ’।
অর্থাৎ : যে অধিকরণে সাধ্যের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে থাকে, তাই সপক্ষ। 
 .
যেমন, যখন কোন ব্যক্তি পর্বতে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান করে, তখন সেই অনুমানের পূর্বে ঐ ব্যক্তির মহানস বা পাকশালা, চত্বর, যজ্ঞশালা প্রভৃতি স্থানে ধূমের সাথে সাধ্য বহ্নির উপস্থিতি বিষয়ে পূর্ব প্রত্যক্ষ বা অভিজ্ঞতার কারণে (অন্বয়ব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে) নিশ্চিত জ্ঞান থাকে। তাই ‘পর্বত বহ্নিমান যেহেতু পর্বত ধূমায়মান’ এই অনুমান স্থলে পাকশালা প্রভৃতি সপক্ষ হয়।
.
আর বিপক্ষ-এর লক্ষণ দেখাতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেন-
‘নিশ্চিত সাধ্যাভাববান্ বিপক্ষঃ’।
অর্থাৎ : যে অধিকরণে সাধ্যের অভাব নিশ্চিতরূপে থাকে, তাই বিপক্ষ।
 .
যেমন, যখন কোন ব্যক্তি পর্বতে ধূম দেখে সেখানে বহ্নির অনুমান করে, তখন সেই অনুমানের পূর্বে ঐ ব্যক্তির জলহ্রদে ধূমের অভাবের সাথে সাধ্য বহ্নির অভাব বিষয়ে (ব্যতিরেকব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে) নিশ্চিত জ্ঞান থাকে। তাই উক্ত অনুমান স্থলে জলহ্রদ বিপক্ষ হয়।
 .
(ক) সব্যভিচার  বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস (Irregular middle) : 
সব্যভিচারী হেতু হলো ব্যভিচারযুক্ত হেতু। প্রকৃত হেতুর বিপক্ষাসত্ত্ব বৈশিষ্ট্যটি এই হেত্বাভাসের থাকে না। বিপক্ষাসত্ত্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সাধ্যের অভাবে হেতুর উপস্থিতি (আগুন নেই অথচ ধূম হচ্ছে ,তা) ঘটতে পারে না। কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম করে এই হেতু সমভাবে সপক্ষ সাধ্যে ও বিপক্ষ সাধ্যাভাবের সঙ্গেও উপস্থিত থাকে বলে এই হেতু ব্যভিচারযুক্ত। তাই তা সব্যভিচার হেত্বাভাস। যেহেতু, এই হেতু সাধ্যের সঙ্গে ঐকান্তিকভাবে (নিয়ত সাহচর্যে) থাকে না, সেহেতু এই হেতুকে অনৈকান্তিক হেতুও বলা হয়। তাই ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘অনৈকান্তিকঃ সব্যভিচারঃ’। (১/২/৪৬)
অর্থাৎ : হেতুরূপে গৃহীত যে পদার্থ প্রকৃত সাধ্যধর্মের সম্বন্ধে ঐকান্তিক নয়, তা সব্যভিচার হেত্বাভাস।
এবং অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘সব্যভিচারঃ অনৈকান্তিকঃ’।
অর্থাৎ : যে হেতু অনৈকান্তিক অর্থাৎ ঐকান্তিক নয়, সেই হেতু সব্যভিচার হেত্বাভাস।
 .
যেমন, যদি কেউ অনুমান করে ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে স্পর্শগুণের অভাব আছে’ তাহলে ‘স্পর্শগুণ-অভাবত্ব’ হবে অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। কেননা ‘স্পর্শগুণাভাবত্ব’ হেতু যেমন আত্মায় আছে (ন্যায়মতে আত্মাকে নিত্যবস্তু স্বীকার করা হয়), আবার বিপক্ষ অনিত্য বস্তুতে যেমন জ্ঞানক্রিয়ায় আছে। অনৈকান্তিক হেতু হলো সেই হেতু যার সঙ্গে সাধ্যের নিয়ত সাহচর্য নাই। অর্থাৎ ঐ হেতুর সঙ্গে সাধ্যের ব্যাপ্তি নাই। ফলে ঐ হেতুর দ্বারা যথার্থ অনুমিতি হয় না। ঐ হেতু অনুমিতি প্রতিবন্ধক।
 .
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস তিনপ্রকার- সাধারণ, অসাধারণ, অনুপসংহারী।
 .
সাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সাধ্যাভাববৎবৃত্তিঃ সাধারণঃ অনৈকান্তিকঃ’।
অর্থাৎ : যে হেতু সাধ্যাভাবের অধিকরণে (বিপক্ষে) থাকে তাই সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।
 .
অন্যভাবে বললে, যে অনুমানে হেতুর ব্যাপকতা সাধ্যের ব্যাপকতার তুলনায় অধিক তাকে ‘সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস’ বলা হয়। যেমন, ‘পর্বত ধূমযুক্ত, যেহেতু পর্বত বহ্নিযুক্ত’- এই অনুমানে বহ্নি হেতুটি সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। যেহেতু ‘বহ্নি’ হেতুটি পাকশালা প্রভৃতি সপক্ষে আছে, আবার জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডেও (বিপক্ষে) আছে। এখানে হেতু বহ্নির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে পক্ষ পর্বতে ধূমের অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় ‘বহ্নি’ হেতুটি পাকশালা প্রভৃতি (সপক্ষ) অধিকরণে ধূমের সাহচর্য প্রত্যক্ষ করা গেলেও জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড জাতীয় (বিপক্ষ) অধিরণে ধূমের অভাব (সাধ্যাভাব) প্রত্যক্ষ হয়েছে। অর্থাৎ জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে বহ্নি ও ধূমের নিয়ত সাহচর্য ব্যাপ্তি নেই। তাই বহ্নি থাকলেই ধূম থাকবে কথা নেই। এই অনুমানের হেতু বহ্নির বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা সাধ্যের চেয়ে বেশি অর্থাৎ পাকশালা, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড উভয়টিতেই বহ্নির উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু সাধ্য ধূমের উপস্থিতি কেবল পাকশালায় দেখা যায়, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে নয়। ফলে হেতুর তুলনায় সাধ্যের ব্যাপকতা কম বলে এই অনুমানের হেতুটি সাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।
 .
একইভাবে আরেকটি উদাহরণ- ‘সমস্ত হাঁস বিজ্ঞ যেহেতু দ্বিপদ প্রাণী বিজ্ঞ’। এই অনুমানের সিদ্ধান্তে বস্তুগত সত্যতা নেই। কারণ দ্বিপদ প্রাণী বিজ্ঞ নয়। অতএব এই সিদ্ধান্ত ভ্রান্তিজনক। এখানে হেতু পদের (দ্বিপদ প্রাণীর) বিস্তৃতি সাধ্য পদের (বিজ্ঞ) বিস্তৃতি হতে বেশি। যেহেতু কেবল সপক্ষে না থেকে বিপক্ষেও থাকে, তাই হেতুটি সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস।
 .
অসাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : অসাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাসে হেতু পদের ব্যাপকতা এতোই কম যে, হেতু কেবলমাত্র পক্ষ পদের মধ্যে একটি বিশেষ ধর্মরূপে উপস্থিত থাকে। কিন্তু সাধ্য পদে উপস্থিত থাকে না। এই অনুমানে হেতু সপক্ষ বা বিপক্ষ কোনোটিতেই থাকে না।  নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সর্বসপক্ষ-বিপক্ষ ব্যাপৃত্তঃ পক্ষমাত্রবৃত্তিঃ অসাধারণঃ’।
অর্থাৎ : যে হেতু সপক্ষ, বিপ্ক্ষ কোথাও থাকে না, কেবলমাত্র পক্ষে থাকে, তাই অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।
 .
উদাহরণস্বরূপ, ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে শব্দত্ব আছে’- এই অনুমানে শব্দ পক্ষ, নিত্য সাধ্য, শব্দত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘শব্দত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। কেননা, ‘শব্দত্ব’ হেতুটি সাধ্যের অধিকরণ যেমন, দিক্, কাল প্রভৃতি নিত্যবস্তুতে (সপক্ষে) কখনও থাকে না, আবার সাধ্যাভাবের অধিকরণ ঘট, পট প্রভৃতি কোন অনিত্যবস্তুতে (বিপক্ষে) কখনও থাকে না। ‘শব্দত্ব’ হেতুটি কেবলমাত্র থাকে শব্দে, যা আলোচ্য অনুমানে পক্ষ হয়েছে। তাই ‘শব্দত্ব’ হেতু ও ‘নিত্যত্ব’ সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি না থাকায় শব্দত্ব হেতু দ্বারা উল্লিখিত অনুমিতি হবে না। ফলে ‘শব্দত্ব’ হেতুটি অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। অসাধারণ সব্যভিচার হেতু সাধারণ সব্যভিচার হেতুর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। সাধারণ আর অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের মধ্যে পার্থক্য হলো, সাধারণ অনৈকান্তিক হেতু সপক্ষে থাকে, আবার বিপক্ষেও থাকে, অন্যদিকে অসাধারণ অনৈকান্তিক হেতু সপক্ষ বা বিপক্ষ কোথাও থাকে না।
 .
অনুপসংহারী সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : এই অনুমানে হেতু পদের ব্যাপকতা এতো বেশি যে,  সপক্ষ বা বিপক্ষ কোনরূপ দৃষ্টান্তের দ্বারা হেতুকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অন্বয়ব্যতিরেক দৃষ্টান্তরহিতঃ অনুপসংহারী’।
অর্থাৎ : যে হেতুর সমর্থনসূচক অন্বয় ও ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত নাই, সেই হেতু অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।
 .
উদাহরণস্বরূপ, ‘সবকিছু অনিত্য, যেহেতু তা জ্ঞেয়’- এই অনুমানে ‘সবকিছু’ পক্ষ, অনিত্য সাধ্য, জ্ঞেয়ত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতুটি এখানে অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘যেখানে যেখানে জ্ঞেয়ত্ব সেখানে সেখানে অনিত্যত্ব’ এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব নয় বলে ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতুটি হেত্বাভাস। কেননা আলোচ্য অনুমানে ‘সবকিছু’ (`Everything’) পক্ষ হওয়ায় সপক্ষে বা বিপক্ষে এরূপ ব্যাপ্তির সমন্বয়সূচক কোন অন্বয় (সদর্থক) বা ব্যতিরেক (নঞর্থক) দৃষ্টান্ত নাই যা ‘সবকিছু’র অন্তর্গত নয়। কোনরূপ দৃষ্টান্ত দ্বারা হেতুকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যাপ্তি না থাকায় ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতু থেকে আলোচ্য অনুমিতি হবে না। অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেতু ব্যাপ্তি-সংশয়-জ্ঞান দ্বারা ব্যাপ্তি জ্ঞানের প্রতিবন্ধক হয়ে অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়। এই হেতু দ্বারা পক্ষে হেতু ও সাধ্যের সম্বন্ধ বিষয়ে কোন সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত বা উপসংহার করা সম্ভব হয় না বলে এই হেতুটিকে ‘অনুপসংহারী’ বলা হয়।
 .
(খ) বিরুদ্ধ হেত্বাভাস (Contradictory middle) : 
যে হেতু পক্ষে সাধ্যকে প্রতিপাদন না করে সাধ্যের বিরুদ্ধকে প্রতিপাদন করে, তাকে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস বলে। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘সিদ্ধান্তম্ অভ্যুপেত্য তদ্বিরোধী বিরুদ্ধঃ’। (১/২/৪৭)
অর্থাৎ : সিদ্ধান্তরূপে কোন পদার্থ স্বীকার করে, তার বিরোধী পদার্থ অর্থাৎ যে পদার্থ স্বীকৃত সিদ্ধান্তের ব্যাঘাত্বক তা বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।
এবং নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বিরুদ্ধ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সাধ্যাভাবব্যাপ্তো হেতুঃ বিরুদ্ধঃ’।
অর্থাৎ : যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যাভাবের ব্যাপ্তি আছে, সেই হেতু বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।
 .
ন্যায়মতে, অনুমান স্থলে হেতু ব্যাপ্য এবং সাধ্য ব্যাপক হলে হেতু থেকে সাধ্যের অনুমান সম্ভব হয়। কিন্তু যে হেতু সাধ্যের ব্যাপ্য না হয়ে সাধ্যের অভাবের ব্যাপ্য হয়, সেই হেতু বিরুদ্ধ হেত্বাভাস। যেমন, ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দের উৎপত্তি আছে’- এই অনুমানে শব্দ হলো পক্ষ, নিত্য সাধ্য, উৎপত্তিত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু উৎপত্তিত্ব হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। উৎপত্তিত্ব হেতু শব্দের নিত্যতাকে প্রতিপাদন না করে শব্দের অনিত্যতাকে প্রতিপাদন করে। অনিত্যতা নিত্যতার বিরুদ্ধ হওয়ায় উৎপত্তিত্ব হেতু এখানে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।
 .
যার উৎপত্তি আছে, তা অনিত্যই হয়। উৎপন্ন বস্তু নিত্য হয় না। তাই ‘যেখানে যেখানে উৎপত্তিত্ব আছে, সেখানে সেখানে নিত্যত্ব আছে’ এরূপ ব্যাপ্তি নাই। বরং ‘যেখানে যেখানে উৎপত্তিত্ব আছে, সেখানে সেখানে নিত্যতার অভাব আছে’ এরূপ ব্যাপ্তি দেখা যায়। তাই ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুর সঙ্গে ‘নিত্যত্ব’ সাধ্যের ব্যাপ্তি না থাকায় ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুর দ্বারা পক্ষ শব্দের নিত্যত্বের অনুমান হয় না বলে ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুটি এখানে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস। বিরুদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাপ্তি বিষয়ে যথার্থ জ্ঞানের উৎপত্তি প্রতিহত করে অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়।
সব্যভিচার ও বিরুদ্ধ হেতুর মধ্যে পার্থক্য হলো, সব্যভিচার হেত্বাভাসে সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে না, কিন্তু বিরুদ্ধ হেত্বাভাসে যে সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে হবে তার বিরুদ্ধ বচন প্রমাণ করে।
 .
(গ) সৎ প্রতিপক্ষ হেত্বাভাস (Fallacy of inferentialy contradicted middle) :
সৎ প্রতিপক্ষ অর্থ হলো যার প্রতিপক্ষ আছে। কোন একটি অনুমানের হেতু যে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, তারই বিরোধী আরেকটি হেতু অপর একটি অনুমানে সেই সাধ্যেরই অভাব প্রমাণ করে। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘যস্য সাধ্যাভাবসাধকং হেত্বন্তরং বিদ্যতে স সৎপ্রতিপক্ষঃ’।
অর্থাৎ : যে অনুমানে সাধ্যের সাধক হেতুর মত সাধ্যের অভাব সাধক অন্য হেতু বা প্রতিপক্ষ হেতু থাকে, সেই হেতু সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস।
 .
এই ‘সৎপ্রতিপক্ষ’ হেত্বাভাসকে মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্র গ্রন্থে ‘প্রকরণসম’ হেত্বাভাস বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ন্যায়সূত্রে প্রকরণসম হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘যস্মাৎ প্রকরণ চিন্তা স নির্ণয়ার্থম্ অপদিষ্ট প্রকরণসমঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৮)।
অর্থাৎ : যে পদার্থ প্রযুক্ত বাদীর সাধ্যধর্ম ও প্রতিবাদীর সাধ্যধর্ম কোন পক্ষেরই নির্ণয় না হওয়ায় বাদী ও প্রতিবাদীর প্রকরণ বিষয়ে চিন্তা বা সংশয় জন্মে, সেই পদার্থ যদি সাধ্যধর্ম নির্ণয়ের জন্য হেতুরূপে অপদিষ্ট বা প্রযুক্ত হয়, তাহলে সেই পদার্থ হবে ‘প্রকারণসম’ নামক হেত্বাভাস।
 .
অন্যান্য হেত্বাভাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি অনুমান উল্লেখ যথেষ্ট হলেও এই সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস ব্যাখ্যায় পাশাপাশি দু’টি অনুমান প্রয়োগ বা উল্লেখের প্রয়োজন হয়।
এক্ষেত্রে প্রথম অনুমানে ধরা যাক্ বাদী নিজ পক্ষ সমর্থনের জন্য বললেন- ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে শ্রাবণত্ব আছে, যেমন শব্দত্ব’।
দ্বিতীয় অনুমানে প্রতিবাদী তখন বললেন- ‘শব্দ অনিত্য, যেহেতু শব্দ উৎপত্তিশীল, যেমন ঘট’।
 .
বাদী ও প্রতিবাদীর নিজ নিজ পক্ষ ও তার অভাবরূপ প্রতিপক্ষই এস্থলে প্রকরণ। বাদীর শব্দের নিত্যত্ব এবং প্রতিবাদীর শব্দের অনিত্যত্ব এস্থলে প্রকরণ। এ দুটি অনুমানে দেখা যায় যে, বাদী প্রদত্ত প্রথম অনুমানের হেতু শ্রাবণত্ব প্রতিবাদী প্রদত্ত দ্বিতীয় অনুমানের হেতু উৎপত্তিশীলতার দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এস্থলে প্রতিবাদীর হেতুর প্রেক্ষিতে বাদীপ্রদত্ত হেতু সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস।
ন্যায়মতানুসারে বাদী ও প্রতিবাদীর অনুমান দুটি যথার্থ ব্যাপ্তি নির্ভর বলে দুটি অনুমানই বৈধ বলতে হয়। কিন্তু বাদীর নিত্যত্বসাধক শ্রাবণত্ব হেতু এবং প্রতিবাদীর অনিত্যত্বসাধক উৎপত্তিশীলত্ব হেতু পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক হয় বলে বাদী বা প্রতিবাদী কারও সাধ্যই সিদ্ধ হয় না।
 .
(ঘ) অসিদ্ধ হেত্বাভাস (Fallacy of unproved middle) :
অনুমিতি স্থলে হেতু সাধ্যের সিদ্ধি ঘটায়। তার জন্য পূর্বে ঐ হেতুর সিদ্ধি প্রয়োজন। যদি হেতু সাধ্যের মতোই অসিদ্ধ থাকে তাহলে হেতু সাধ্যকে সাধন করতে পারে না। এই ধরনের পূর্বাসিদ্ধ হেতুকে অসিদ্ধ হেত্বাভাস বলে। সাধ্যের মতো অসিদ্ধ বলে এই হেতুকে ‘সাধ্যসম’ হেত্বাভাসও বলা হয়। অসিদ্ধ হেত্বাভাসকে মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্র গ্রন্থে ‘সাধ্যসম’ হেত্বাভাস নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি ন্যায়সূত্রে সাধ্যসম হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সাধ্য-অবিশিষ্ট সাধ্যত্বাৎসাধ্যসমঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৯)।
অর্থাৎ : যে হেতু সাধ্য পদার্থের মতোই অসিদ্ধ, সে হেতু সাধ্য পদার্থের তুল্য বলে তা সাধ্যসম হেত্বাভাস।
 .
উদাহরণস্বরূপ, ‘আকাশকুসুম সুগন্ধযুক্ত, যেহেতু তাতে কুসুমত্ব আছে’- এরূপ অনুমানে কুসুমত্ব হেতু নিজেই পক্ষ আকামকুসুমে অসিদ্ধ, কারণ আকাশকুসুম বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এই হেতুর দ্বারা সুগন্ধত্ব সাধ্য প্রতিপাদিত হয় না। তাই এই অনুমানটি অসিদ্ধ।
 .
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন, অসিদ্ধ হেত্বাভাস তিন প্রকার- (১) আশ্রয়াসিদ্ধ, (২) স্বরূপাসিদ্ধ এবং (৩) ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ।
 .
আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস : যে অনুমানের আশ্রয়টি বা পক্ষটি অসিদ্ধ, সেই অনুমানস্থলে যে হেতু প্রযুক্ত হয় তা প্রকৃত হেতু নয়, তা আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বা তর্কসংগ্রহদীপিকায় আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাসের কোন লক্ষণ দেননি, তবে দৃষ্টান্তের সাহায্যে আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
‘গগনারবিন্দং সুরভি অরবিন্দত্বাৎ সরোজারবিন্দবৎ’।
অর্থাৎ : আকাশপদ্ম গন্ধযুক্ত, যেহেতু তা পদ্ম, যেমন জলজপদ্ম।
 .
এই অনুমানে ‘আকাশপদ্ম’ পক্ষ, গন্ধ সাধ্য, পদ্মত্ব হেতু। এখানে অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘পদ্মত্ব’ হেতুটি দোষযুক্ত। কারণ ন্যায়মতে সৎ হেতুর লক্ষণে বল হয় যে- ‘অনুমানস্থলে যা হেতু, তা অনুমানের পক্ষে থাকবে (পক্ষসত্ত্ব)’। কিন্তু আলোচ্য অনুমানের পক্ষ ‘আকাশপদ্ম’ অলীক বা অস্তিত্বহীন, ফলে ঐ পক্ষে ‘পদ্মত্ব’ হেতু থাকতে পারে না। আলোচ্য অনুমানে পক্ষ বা আশ্রয় আকাশপদ্ম অলীক বা অস্তিত্বহীন বলে আশ্রয়টি বা পক্ষটি অসিদ্ধ। তাই ‘পদ্মত্ব’ হেতুতে যে দোষ হয় তা আশ্রয়াসিদ্ধ এবং হেতুটি হয় আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস।
 .
স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস : অনুমানস্থলে যে হেতুর স্বরূপ অনুমানের পক্ষে থাকে না, সেই হেতু স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস। একটি বস্তুর স্বরূপ ঐ বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। তাই স্বরূপাসিদ্ধ হেতু হলো এমন হেতু যা পক্ষে থাকে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
‘শব্দো গুণঃ চাক্ষুষত্বাৎ’।
অর্থাৎ : শব্দ গুণ, যেহেতু শব্দে চাক্ষুষত্ব আছে।
 .
এই অনুমানে শব্দ পক্ষ, গুণ সাধ্য, চাক্ষুষত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘চাক্ষুষত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘চাক্ষুষত্ব’ হেতুটি শব্দ পক্ষে বস্তুতই থাকে না। কেননা শব্দ শুনা যায় অর্থাৎ শব্দে শ্রাবণত্ব আছে, কিন্তু শব্দ দেখা যায় না অর্থাৎ চাক্ষুষত্ব নেই। এখানে পক্ষ শব্দ অলীক নয়, অস্তিত্বশীল। কিন্তু শব্দ রূপের মতো দেখা যায় না বলে চাক্ষুষত্ব হেতুটির সঙ্গে পক্ষ শব্দের সম্বন্ধ নাই। তাই চাক্ষুষত্ব হেতুটি পক্ষ শব্দে থাকে না। চাক্ষুষত্ব হেতুটি স্বরূপতই অসিদ্ধ বলে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়।
 .
ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস : ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেতু হলো সেই হেতু যার সাধ্যের সঙ্গে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রমাণিত হয়নি। কারণ ব্যাপ্তি সম্বন্ধ অন্য উপাধি বা শর্তের উপর নির্ভর করে। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সোপাধিকো হেতুঃ ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধঃ’।
অর্থাৎ : যে হেতু সোপাধিক অর্থাৎ উপাধিযুক্ত, তাই ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস।
 .
‘ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ’ এই সমাসবদ্ধ পদের অর্থ ‘যাতে ব্যাপ্যত্বের অভাব আছে’। অর্থাৎ ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হলো সেই হেতু যাতে সাধ্যের ব্যাপ্তি নাই। ফলে পরামর্শ সম্ভব হয় না। এভাবে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস অনুমিতির করণ পরামর্শের প্রতিবন্ধক হয়ে যথার্থ অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন-
‘পর্বতো ধূমবান্ বহ্নিমত্ত্বাৎ’।
অর্থাৎ : পর্বত ধূমযুক্ত, যেহেতু তা বহ্নিযুক্ত।
 .
এ অনুমানস্থলে পর্বত পক্ষ, ধূম সাধ্য, বহ্নি হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি এখানে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস। কেননা ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি উপাধিযুক্ত (সোপাধিক)। এস্থলে উপাধি হলো ‘আর্দ্রেন্ধনসংযোগ’ অর্থাৎ ভেজা কাঠ জাতীয় আর্দ্র ইন্ধনযোগ্য বস্তুর উপস্থিতি। ন্যায়মতে, যা সাধ্যের ব্যাপক ও সাধন বা হেতুর অব্যাপক তাই উপাধি।
 .
সোজা কথায়, ‘যেখানে যেখানে বহ্নি সেখানে সেখানে ধূম’ এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব নয়, যেহেতু জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে বহ্নি থাকলেও ধূম নাই। বহ্নির সঙ্গে আর্দ্রেন্ধনের সংযোগ থাকলে ধূম থাকে, এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব। সুতরাং বহ্নি হেতু আর্দ্রেন্ধনসংযোগ উপাধিযুক্ত হলে সাধ্য ধূমের প্রতিপাদক হয়। তাই উপরিউক্ত অনুমানে বহ্নি হেতু সোপাধিক হওয়ায় তা ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস।
 .
(ঙ) বাধিত হেত্বাভাস (Non-inferentially contradicted middle) :
বাধিত হেত্বাভাস হলো সেই হেতু যা অন্য প্রমাণ বা যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। এই হেতু সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায় কিন্তু অন্য প্রমাণের দ্বারা সাধ্যের অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বাধিত হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘যস্য সাধ্যাভাবঃ প্রমাণাস্তরেণ নিশ্চিতঃ স বাধিতঃ’।
অর্থাৎ : যে অনুমানস্থলে পক্ষে সাধ্যের অভাব অন্য প্রমাণের দ্বারা নিশ্চিতরূপে জানা যায় সে স্থলে হেতুটি হয় বাধিত হেত্বাভাস।
 .
এক্ষেত্রে অন্নংভট্ট একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বাধিত হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন-
‘বহ্নিঃ অনুষ্ণঃ দ্রব্যত্বাৎ’।
অর্থাৎ : বহ্নি অনুষ্ণ বা শীতল, যেহেতু বহ্নি দ্রব্য।
 .
এই অনুমানস্থলে বহ্নি পক্ষ, অনুষ্ণ সাধ্য, দ্রব্যত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু দ্রব্যত্ব হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। এখানে দ্রব্যত্ব হেতুটি বাধিত হেত্বাভাস, কেননা এখানে হেতু ‘দ্রব্যত্ব’ বহ্নি বা অগ্নিতে অনুষ্ণতা বা শীতলতার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাইলেও স্পর্শ ইন্দ্রিয় বা স্পার্শন প্রত্যক্ষের দ্বারা বহ্নি পক্ষে অনুষ্ণ সাধ্যের অভাব অর্থাৎ উষ্ণত্বের প্রমাণ হয়ে যায়। তাই এখানে কোন হেতুর দ্বারাই বহ্নিতে অনুষ্ণত্ব প্রমাণিত হবে না।
 .
ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতম বাধিত হেত্বাভাসকে কালাতীত হেত্বাভাস বলেছেন। তিনি ন্যায়সূত্র গ্রন্থে কালাতীত হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘কালাত্যয়-অপদিষ্টঃ কালাতীতঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৫০)।
অর্থাৎ : যে হেতু অনুমানে কালাত্যয়ে অপদিষ্ট (প্রযুক্ত) হয়, তাকে কালাতীত হেত্বাভাস বলে।
 .
এর তাৎপর্য হলো, যে কাল পর্যন্ত অনুমানের সাধ্যধর্ম বিষয়ে সংশয় থাকে, সেই কালপর্যন্ত ঐ ধর্মের অনুমানের জন্য হেতু প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু বলবৎ প্রমাণের দ্বারা সাধ্যের অভাবের নিশ্চয় জন্মালে কোন হেতুর দ্বারাই সেই সাধ্যের অনুমিতি হতে পারে না। কারণ সেই ধর্মের সংশয় ও অনুমিতি কাল অতীত হওয়ায় উক্ত ধর্মের অনুমিতির জন্য প্রযুক্ত যে কোন হেতুই ‘কালাতীত’ নামক হেত্বাভাস। একে ‘কালাত্যয়াপদিষ্ট’ হেত্বাভাসও বলে। পরবর্তী নৈয়ায়িকরা এরূপ হেতুকেই ‘বাধিত’ হেত্বাভাস বলেছেন।
 .
সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস বাধিত হেত্বাভাস থেকে পৃথক। কারণ সৎপ্রতিপক্ষের হেত্বাভাসে একটি অনুমান অপর একটি অনুমানের দ্বারা অযথার্থ বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু বাধিত হেত্বাভাসের একটি অনুমান প্রত্যক্ষের দ্বারা বা অনুমান নিরপেক্ষ জ্ঞানের দ্বারা অযথার্থ প্রমাণিত হয়।
.
‘ন্যায়মঞ্জরী’কার জয়ন্ত ভট্ট কালাতীত হেত্বাভাসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অনুমানের ধর্মীতে প্রত্যক্ষ বা আগমের দ্বারা সাধ্যধর্মের অভাবনিশ্চয় না হওয়া পর্যন্তই সেই সাধ্যধর্মের সাধনের জন্য কোন হেতুর প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু সেই হেতুপ্রয়োগের কালাত্যয়ে অপদিষ্ট অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বা আগমের দ্বারা সাধ্যধর্মের অভাব নিশ্চয় হলে প্রযুক্ত হেতুই ‘কালাতীত’ নামক হেত্বাভাস। প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ ও আগমবিরুদ্ধ ন্যায়াভাস-স্থলীয় সমস্ত হেতুই তার উদাহরণ।
.
৬.০ : উপমিতি বা উপমান প্রমাণ…
        (উপমিতির প্রকারভেদ)… সাধর্ম্য, বৈধর্ম্য, ধর্মমাত্র উপমিতি
(Comparison)
.
ন্যায়দর্শনে স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে তৃতীয় প্রমাণ হলো উপমান। পূর্ব পরিচিত কোন একটি বস্তুর সঙ্গে নতুন ও অপরিচিত কোন বস্তুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করে যখন নতুন বস্তুটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয তখন জ্ঞান লাভের এই পদ্ধতিটিকে উপমান বলা হয়। ন্যায়মতে, উপমান হলো সেই প্রমাণ যার দ্বারা কোন ব্যক্তি প্রথমে জানে কোন একটি বিশেষ শব্দ কোন্ বস্তুকে বোঝায়। শব্দ ও শব্দার্থের জ্ঞান অন্য উপায়ের দ্বারাও হয়ে থাকে। কিন্তু ন্যায়মতে, শব্দ ও শব্দার্থের জ্ঞান কখনও কখনও উপমান বা সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ন্যায়দর্শনে উপমান একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকৃত।
 .
অনুমানের ন্যায় ‘উপমান’ও জ্ঞান ও করণ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ‘উপ’ অর্থ সাদৃশ্য, ‘মান’ অর্থ জ্ঞান- এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে উপমান হলো সাদৃশ্যজ্ঞান। করণ অর্থে উপমান ‘উপমিতি’ নামক জ্ঞানের করণ। ন্যায়সূত্র-এ মহর্ষি গৌতম উপমিতির লক্ষণে বলেছেন-

‘প্রসিদ্ধ সাধর্ম্যাৎ সাধ্যসাধনম-উপমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৬)।
অর্থাৎ : কোন পদার্থে প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ হলে কোন সাধ্য পদার্থের যে নিশ্চয়াত্মক অনুভব হয়, তাই উপমিতি এবং তার করণ হলো উপমান-প্রমাণ।
 .
গৌতম বলেন, সংজ্ঞা-সংজ্ঞিসম্বন্ধ নির্ণয়ই উপমানের ফল এবং তা অন্য কোন প্রমাণের দ্বারা জন্মে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে উপমিতি জ্ঞানের করণকে উপমান বলেছেন। তাই অন্নংভট্ট উপমিতির লক্ষণে বলেছেন-

‘সংজ্ঞাসংজ্ঞিসম্বন্ধ জ্ঞানম্-উপমিতিঃ। তৎ করণং সাদৃশ্যজ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : একটি শব্দ (সংজ্ঞা) এবং তার দ্বারা বোধিত বস্তু (সংজ্ঞী)- এই উভয়ের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান উপমিতি। সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা উপমিতি বা উপমান প্রমাণ হয়।
 .
উপমিতি জ্ঞান সাদৃশ্য জ্ঞান থেকে হয়। কোন অজ্ঞাত পদার্থে যদি কোন জ্ঞাত পদার্থের সাদৃশ্যের জ্ঞান হয় এবং ঐ সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা যদি ঐ অজ্ঞাত পদার্থ ও তার নামের সম্বন্ধের জ্ঞান হয়, তাহলে ঐ জ্ঞানকে উপমিতি বল হয়। যেমন ন্যায়মতে, ‘গবয়ত্ববিশিষ্ট পশুতে গো সাদৃশ্য দর্শনের দ্বারা গবয়ত্ববিশিষ্ট পশুতে গবয় শব্দের বাচ্যত্ব বোধই উপমিতি’।
যখন কোন ব্যক্তি কোন শব্দের অর্থ প্রথম জানে তখন উপমান প্রমাণের প্রয়োগ হয়। এভাবে উপমিতি জ্ঞান হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ-
 .
গবয় নামে একপ্রকার পশু আছে যাকে ‘নীলগাই’ বলে। তার গলদেশে গলকম্বল (লম্বমান চর্ম) নাই, তাই তা গো বা গরু নয়, কিন্তু গরু’র সদৃশ।
কোন নগরবাসী গবয় পদার্থ কী তা জানে না। সে কখনও গবয় প্রত্যক্ষ করেনি। অথচ ঐ নগরবাসী গবয় শব্দের সঙ্গে পরিচিত। অর্থাৎ গবয় শব্দটি সে জানে, কিন্তু তার অর্থ জানে না।
সে একজন অরণ্যবাসীর কাছে শুনলো যে, ‘গবয় গরু সদৃশ’। গরুর গলকম্বল (সাস্না) থাকে, গবয়ের তা নেই। গবয়ের অন্যান্য অংশ গরুরই মতো। ‘গবয় গরুরই মতো একপ্রকার পশু’- অরণ্যবাসীর এরূপ বাক্যকে ‘অতিদেশবাক্য’ বলা হয়।
এরপর ঐ নগরবাসী বনে গিয়ে গরুর সদৃশ একটি পশুকে প্রত্যক্ষ করলো। তখন তার ‘গবয় গরুর সদৃশ’ এই পূর্বশ্রুত অতিদেশবাক্যার্থের স্মরণ হলো। এবং তখন তার এরূপ জ্ঞান হলো যে সম্মুখস্থ পশুটি সেই বস্তু যা ‘গবয়’ শব্দের দ্বারা বোধিত হয় (‘অয়ং গবয় পদবাচ্যঃ’)। অর্থাৎ এখানে দৃষ্টপশু (সংজ্ঞী) এবং গবয় শব্দটির (সংজ্ঞা) সম্বন্ধের জ্ঞান হয়। এরূপ সংজ্ঞাসংজ্ঞিসম্বন্ধ জ্ঞানই উপমিতি।
 .
সংজ্ঞা-সংজ্ঞীর এই সম্বন্ধজ্ঞান প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্যদ্বারা উৎপন্ন হয়। সংজ্ঞার অর্থ হলো কোন বস্তুর বিশদ বিবরণ। সংজ্ঞা দ্বারা যে বস্তু নির্দিষ্ট হয় তাকে সংজ্ঞী বলে। যখন সংজ্ঞার সাহায্যে সংজ্ঞী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় তখন সে জ্ঞানকে উপমান বলা হয়। উপমানলব্ধ জ্ঞানকে উপমিতি বলে।
.
সংজ্ঞা-সংজ্ঞীর সম্বন্ধজ্ঞান হলো নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান। কোন একটি পদার্থের সঙ্গে ঐ পদার্থের নামের যে সম্বন্ধজ্ঞান, তাকে বলে ‘নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান’। ন্যায়মতে এই সম্বন্ধজ্ঞান নানাভাবে হতে পারে। নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান ন্যায় দর্শনে প্রধানত শাব্দজ্ঞানের অন্তর্গত। কিন্তু উপমিতি এক বিশেষ ধরনের নাম-নামীর জ্ঞান। এরূপ জ্ঞান কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে শ্রুত সাদৃশ্যজ্ঞানের স্মরণ ও ব্যক্তির (জ্ঞাতার) পদার্থের প্রত্যক্ষের মাধ্যমে উদ্ভূত।
 .
ন্যায়মতে উপমিতি সর্বদা সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারাই হয় না, কখনও কখনও উপমিতি অসাধারণ ধর্মের জ্ঞান থেকেও হয়। অর্থাৎ, প্রসিদ্ধ পদার্থের সাধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যেমন উপমিতি হয়, তেমনি প্রসিদ্ধ পদার্থের বৈধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমেও উপমিতি হয়। আবার পদার্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দর্শনের মাধ্যমেও উপমিতি হয়। এজন্য উপমিতিকে সাধর্ম্য, বৈধর্ম্য ও ধর্মমাত্র ভেদে ত্রিবিধ বলা হয়েছে।
 .
সাধর্ম্য উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্য বা সাধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই সাধর্ম্য উপমিতি। যেমন-  উপরিউক্ত গোসদৃশ কোন অ-পূর্বদৃষ্ট পশুকে দেখে ‘গবয়’ পদবাচ্যের উপমিতি জ্ঞান।
 .
বৈধর্ম্য উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের বৈসাদৃশ্য বা বৈধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই বৈধর্ম্য উপমিতি। যেমন- ‘অশ্বের ক্ষুর গরুর ক্ষুরের মতো দ্বিধাবিভক্ত নয়’- গরু ও অশ্বের ক্ষুরাকৃতির এই বৈধর্ম্যের অতিদেশবাক্য (অভিজ্ঞ ব্যক্তির যথার্থ বাক্য) শ্রবণের পর অশ্বক্ষুরে গো-ক্ষুরের বৈধর্ম্যজন্য অশ্ব ও গরুর বৈধর্ম্য-উপমিতি হয়।
 .
ধর্মমাত্র উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের উপমানে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই ধর্মমাত্র উপমিতি। যেমন- ‘নাসিকার উপরিভাগ একটি শৃঙ্গ বিশিষ্ট এরূপ জন্তু গণ্ডার’- এই অতিদেশবাক্য শুনে কোন ব্যক্তি ঐরূপ জন্তু প্রত্যক্ষ করার পর উক্ত অতিদেশবাক্যার্থের স্মরণ হলে তার ‘এটি গণ্ডার পদবাচ্য’ এরূপ জ্ঞান হয়। এই জ্ঞানই ধর্মমাত্র উপমিতি জ্ঞান।
 .
নৈয়ায়িকরা উপমানকে জ্ঞান লাভের একটি স্বতন্ত্র উপায় হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উপমান প্রমাণ বিষয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। উপমানের সাহায্যে শব্দের বাচ্যার্থ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না বলে চার্বাক সম্প্রদায় উপমানকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ দর্শনেও উপমান স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকৃত নয়। বৌদ্ধ দার্শনিকেরা উপমানকে প্রত্যক্ষ ও অনুমানের সংযুক্ত ফল বলে মনে করেন। জৈন দার্শনিকেরা উপমানকে প্রত্যভিজ্ঞা’র অন্তর্গত করেন। বৈশেষিক এবং সাংখ্য দার্শনিকেরা উপমানকে অনুমানেরই একটি বিশেষ রূপ বলে ব্যাখ্যা করেন। তবে মীমাংসা এবং বেদান্ত দর্শনে উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করা হয়, কিন্তু তাদের ব্যাখ্যার সাথে ন্যায়দর্শনের উপমানের ব্যাখ্যার অমিল উল্লেখযোগ্য। মীমাংসকদের উপমিতির আকার হলো- ‘পূর্বদৃষ্ট ও বর্তমানে স্মৃত গরু বর্তমানে দৃষ্ট গবয়ের মতো’, আর নৈয়ায়িকদের উপমিতির আকার হলো- ‘বর্তমানে দৃষ্ট গবয় পূর্বদৃষ্ট ও বর্তমানে স্মৃত গরুর মতো’।
.
৭.০ : শাব্দ বা শব্দ প্রমাণ…
         শব্দপ্রমাণের বিভাগ…
         পদ ও শব্দার্থজ্ঞান…
         পদের বৃত্তি… (শক্তি, লক্ষণা)
         বাক্যার্থজ্ঞান…
         (১) আকাঙ্ক্ষা…
         (২) যোগ্যতা…
         (৩) সন্নিধি বা আসত্তি…
         (৪) তাৎপর্য…
(Testimony)
.
ন্যায়দর্শন স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে চতুর্থ প্রমাণ হলো শব্দপ্রমাণ। শাব্দ জ্ঞানের করণকে বলা হয় ‘শব্দ’। ভারতীয় দর্শনে শব্দপ্রমাণের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সকল শাস্ত্রই গুরু পরম্পরায় শ্রবণের মাধ্যমে লালিত-পালিত হয়েছে। তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি। ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষকে প্রধান প্রমাণ বলা হলেও এই দর্শনে শব্দের বিচারও অতি সূক্ষ্ম পর্যায়ের। এ প্রেক্ষিতে জগদীশ, গদাধর প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক শব্দের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।
আধুনিক কালে পাশ্চাত্যে শাব্দবোধ ও বাক্যার্থবোধ নিয়ে যে আলোচনা দেখা যায়, ন্যায় দর্শন তথা ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও শাব্দিক সম্পদায় খ্রিস্টপূর্বযুগেই তা আলোচনা করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে শব্দের আলোচনা ভারতবর্ষে ঋগ্বেদের যুগেই শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
 .
যথার্থ জ্ঞান লাভের জন্য শব্দ হলো একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ। ন্যায়সূত্র-এ মহর্ষি গৌতম শব্দের লক্ষণে বলেছেন-
‘আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৭)
অর্থাৎ : আপ্তব্যক্তির উপদেশবাক্যই শব্দ প্রমাণ।
 .
আর নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে শব্দ প্রমাণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘আপ্তবাক্যং শব্দঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলে।
 .
ন্যায়মতে, ভ্রম (একটি বস্তুকে অন্যরূপে জানা), প্রমাদ (অসাবধানতা), বিপ্রলিপ্সা (বঞ্চনা করার ইচ্ছা) ও করণাপাটব (ইন্দ্রিয়ের ত্রুটি)- এই চারটি দোষশূন্য যথার্থ বক্তাই আপ্তব্যক্তি। অন্নংভট্টে মতে-
‘আপ্তঃ তু যথার্থবক্তা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আপ্তব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি যথার্থ বক্তা।
 .
যিনি পদার্থের যথাযথ ধর্ম-সাক্ষাৎ (তত্ত্বসাক্ষাৎ) করেছেন এবং যিনি নিজে যেরূপ সাক্ষাৎ করেছেন, অপরকে জানানোর অভিপ্রায়ে ঠিক সেইরূপ উপদেশই দেন, তাঁকে বলা হয় আপ্তব্যক্তি। এরূপ আপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকে যথার্থ শাব্দজ্ঞান হয়। তাই এরূপ আপ্তব্যক্তির উচ্চারিত বাক্য শ্রবণ করে শ্রোতার যে জ্ঞান হয় তাই শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ এবং ঐ আপ্তবাক্যই শব্দপ্রমাণ।
 .
সাধারণভাবে শব্দ থেকে উৎপন্ন যে কোনো জ্ঞানই শাব্দজ্ঞান। তবে শাব্দজ্ঞান মাত্রই তাই যথার্থ শাব্দজ্ঞান নয়। আপ্তের ন্যায় অনাপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকেও শাব্দজ্ঞান হতে পারে। কিন্তু সে শাব্দজ্ঞান যথার্থ নয়।  ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব- এই চারটি দোষের কোন একটি থাকলে কোন ব্যক্তিকে আপ্ত বলা হয় না। ঐরূপ ব্যক্তি অনাপ্ত হয়। অনাপ্ত ব্যক্তির বাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয় না।
 .
শব্দ প্রমাণের বিভাগ :
ন্যায়মতে শব্দ প্রমাণ নানা প্রকার। জ্ঞানের বিষয় অনুসারে এবং বাৎস্যায়নের মতে শব্দ প্রমাণ দুই প্রকার- দৃষ্টার্থ এবং অদৃষ্টার্থ। ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে-  
‘স দ্বিবিধো দৃষ্টাদৃষ্টার্থত্বাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৮)
অর্থাৎ : দৃষ্টার্থক ও অদৃষ্টার্থক ভেদে তা (শব্দপ্রমাণ) দুই প্রকার।
.
ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন দৃষ্টাথর্ক ও অদৃষ্টার্থক শব্দপ্রমাণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ন্যায়ভাষ্যে বলেছেন-  
‘যস্যেহ দৃশ্যতেহর্থঃ স দৃষ্টার্থো যস্যামুত্র প্রতীয়তে সোহদৃষ্টার্থঃ। এবমৃষিলৌকিক-বাক্যানাং বিভাগ ইতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : ইহলোকে যার অর্থ (প্রতিপাদ্য) দৃষ্ট হয়, তা ‘দৃষ্টার্থ’। পরলোকে যার অর্থ প্রতীত হয় অর্থাৎ যে বাক্যের প্রতিপাদ্য ইহলোকে দৃষ্ট হয় না, তা ‘অদৃষ্টার্থ’। এইভাবে ঋষিবাক্য ও লৌকিকবাক্যসমূহের বিভাগ।
 .
জাগতিক বিষয় সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির যে বচন সেগুলি হলো দৃষ্টার্থ শব্দ-প্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ প্রত্যক্ষযোগ্য বা ইহলোকে দৃষ্ট হতে পারে, তাদের দৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আদালতে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর সাক্ষ্য, বিশ্বাসযোগ্য কৃষকের বৃষ্টি অথবা ভূমি সম্পর্কে জ্ঞান, উদ্ভিদের গুণাবলি সংক্রান্ত আয়ুর্বেদের উক্তি, শাস্ত্র বা আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির দেয় নির্দেশ ইত্যাদি দৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত।
 .
প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোনো বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির যে বচন তাই হলো অদৃষ্টার্থ শব্দ-প্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ ইহলোকে প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, তাদের অদৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আত্মা, পরমাত্মা, পাপ, পুণ্য, পরলোক সম্বন্ধে শ্রুতিবাক্য, পরমাণু সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও বৈজ্ঞানিকদের উক্তি অদৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত।
 .
আরেকটি শ্রেণীবিভাগ অনুসারে শব্দ বৈদিক ও লৌকিক ভেদে দুই প্রকার। বেদোক্ত বাক্য হলো বৈদিক শব্দ। বেদে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা বেদকে অভ্রান্ত বলে মনে করেন, কেননা তাঁদের মতে বেদের বাক্য ঈশ্বরের বাক্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বাক্য হলো লৌকিক শব্দ, এ বাক্য সত্যও হতে পারে ভ্রান্তও হতে পারে। লৌকিক শব্দের মধ্যে কেবল আপ্তব্যক্তির বাক্যই শব্দপ্রমাণ। অনাপ্তব্যক্তির বাক্য শব্দপ্রমাণ নয়।
ন্যায়মতে কি বৈদিক কি লৌকিক সকল প্রকার শব্দই পৌরুষেয়। সুতরাং আপ্ত পুরুষের বাক্য, তা লৌকিকই হোক আর বৈদিকই হোক, শব্দপ্রমাণ বলে বিবেচিত।
 .
পদ ও শব্দার্থজ্ঞান :
‘শাব্দ’ শব্দটি ন্যায় দর্শনে শুধু যে উপদেশ (আপ্ত বা অনাপ্ত) অর্থেই ব্যবহৃত হয়, তা নয়। শব্দকারণক যে কোন জ্ঞানকেই কেউ কেউ শাব্দ বলেছেন। অনেকে আবার শব্দবিষয়ক জ্ঞানকেও শাব্দ বলেছেন। জগদীশ প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক আবার পদের অন্বয়বোধ বা বাক্যার্থবোধকে শাব্দবোধ বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে শব্দের আলোচনা প্রধানত বাক্যার্থ ও শব্দার্থ কেন্দ্রিক। ন্যায়মতে ‘শব্দ’ ও ‘পদ’ সাধারণত অভিন্নার্থেই ব্যবহৃত হয়।
 .
নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বাক্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
‘বাক্যং পদসমূহঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)
অর্থাৎ : বাক্য হলো কতকগুলি পদের সমষ্টি।
 .
একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তি হলো বাক্য। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। যেমন, ‘গরুটি আন’ একটি বাক্য। এই বাক্য ‘গরু’ ও ‘আন’ এই দুটি পদের সমষ্টি। তাহলে প্রশ্ন, পদ কাকে বলে ? এর উত্তরে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রদীপিকায় বলেছেন-
‘শক্তং পদম্’। (তর্কসংগ্রদীপিকা)
অর্থাৎ : যা শক্তি বিশিষ্ট তাই পদ।
 .
ন্যায়মতে, যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কোন পদার্থকে নির্দেশ করার বা সংকেত করার শক্তিসম্পন্ন, তাকে পদ বলে। পদ বা শব্দের অর্থ হলো শব্দার্থ। অর্থাৎ একটি পদ শুনলে একটি পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদ শুনলে ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘পট’ পদ শুনলে পট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদের দ্বারা পটের বা ‘পট’ পদের দ্বারা ঘটের জ্ঞান হয় না। যে কোন পদের দ্বারা যে কোন পদার্থের জ্ঞান হয় না। একটি পদের দ্বারা একটি বিশেষ পদার্থেরই জ্ঞান হয়। পদের এই জ্ঞানোৎপাদন সামর্থ্যই শক্তি। এরূপ শক্তি যার আছে তাই পদ।
ন্যায়মতে, পদের যোগ (অবয়বশক্তি) ও রূঢ়ি (সামগ্রিকশক্তি) শক্তি অনুসারে পদকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে- যোগরূঢ়, যৌগিক, রূঢ় ও যৌগিকরূঢ়।
 .
পদের বৃত্তি :
যার দ্বারা একটি পদ একটি পদার্থকে বোঝায় তাকে পদের বৃত্তি বলে। একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের এই সম্বন্ধরূপ বৃত্তি দুই প্রকার- শক্তি ও লক্ষণা।
 .
শক্তি : একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের অর্থাৎ ঐ পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর সম্বন্ধ আছে। যে পদের সঙ্গে যে পদার্থের সম্বন্ধ আছে, সেই পদ সেই পদার্থকেই বোঝায়। পদ ও পদার্থের সম্বন্ধই শক্তি। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় শক্তির লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অর্থস্মৃত্যনুকূলঃ পদপদার্থসম্বন্ধঃ শক্তিঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : শক্তি হলো পদ ও পদার্থের সম্বন্ধ যা পদার্থের স্মরণের সহায়ক।
 .
এর তাৎপর্য হলো, একটি পদ যে অর্থ বা বস্তুকে বোঝায় তার সঙ্গে সেই পদের একটি সম্বন্ধ আছে। কিন্তু পদ ও পদার্থের এই সম্বন্ধকেই শক্তি বলে না। একটি পদ শুনলে যখন শ্রোতা একটি বস্তুকে বোঝে, তখন তার পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকে এবং এই জ্ঞানের দ্বারাই সেই ব্যক্তি ঐ পদ নির্দেশিত বস্তুকে বোঝে। অর্থাৎ পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকার ফলেই কোন ব্যক্তি ‘ঘট’ পদটি শুনলে ঘট বস্তুকে স্মরণ করে এবং তার ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। একেই শাব্দবোধ বলে।
 .
লক্ষণা : শক্তির দ্বারা যেখানে পদের অর্থ নির্ধারিত হয় না সেখানে লক্ষণা করতে হয়। ন্যায়মতে শক্তির মতো লক্ষণাও শব্দ বা পদের একটি বৃত্তি। একটি পদ তার শক্তির দ্বারা যেমন একটি পদার্থের বোধক হয়, তেমনি লক্ষণার দ্বারাও একটি পদার্থের বোধক হয়ে থাকে। তবে শক্তি ও লক্ষণার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি পদ শক্তির দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় সাক্ষাৎভাবে (directly), কিন্তু একটি পদ লক্ষণার দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় পরম্পরাভাবে, অসাক্ষাৎভাবে (indirectly)।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : একটি পদের শক্তির দ্বারা যা বোধিত হয় তাই শক্য, সেই শক্যের সঙ্গে সম্বন্ধই লক্ষণা।
 .
যেমন গঙ্গা শব্দের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ। গঙ্গার অতি নিকটে, গঙ্গার তীরে ঘোষপল্লী আছে- এটি বোঝানোর জন্য কেউ বললেন ‘গঙ্গার ঘোষেরা’। এখানে গঙ্গা পদের মূখ্যার্থ বা শক্যার্থ গ্রহণ করলে বাক্যটির অর্থের উপপত্তি হবে না। গঙ্গার পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং জলপ্রবাহে ঘোষপল্লী থাকতে পারে না। ‘গঙ্গার ঘোষেরা’ বাক্যটির অর্থের উপপত্তির জন্য গঙ্গা পদের শক্যার্থ বাদ দিয়ে গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীরকে বুঝতে হবে। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহের অতি নিকটে তীর থাকায় গঙ্গা পদের শক্যের সঙ্গে তীরের নৈকট্য সম্বন্ধ আছে এবং এই নৈকট্য সম্বন্ধের দ্বারাই গঙ্গা পদ অসাক্ষাৎভাবে তীরকে বোঝায়। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং তার সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধে যুক্ত তীর লক্ষণার্থ। তাই অন্নংভট্ট দীপিকায় বলেছেন- ‘শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা’।
 .
বাক্যার্থজ্ঞান :
ন্যায়মতে আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয়েছে এবং আপ্তবাক্য শ্রবণের ফলে শ্রোতার যে জ্ঞান হয়, তাকে শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ বলা হয়। এই শাব্দবোধই অর্থান্তরে বাক্যার্থজ্ঞান।
 .
একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তি হলো বাক্য। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় সম্বন্ধপ্রকাশক। তাই যে কোন পদসমষ্টিই বাক্য নয়। অর্থপূর্ণ পদসমূহের উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবেশ হলো বাক্য। একটি বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবিষ্ট হওয়ার জন্য কতকগুলি শর্তের উপর নির্ভর করে। নৈয়ায়িকেরা এ প্রেক্ষিতে বাক্যার্থ-নির্ধারক চারটি শর্তের উল্লেখ করেছেন। এই চারটি শর্ত হলো- (১) আকাঙ্ক্ষা, (২) যোগ্যতা, (৩) সন্নিধি বা আসত্তি ও (৪) তাৎপর্য।
 .
(১) আকাঙ্ক্ষা : আকাঙ্ক্ষা হলো একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের অন্বয়ের প্রয়োজন বোধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ দিয়েছেন-
‘পদস্য পদান্তর ব্যতিরেক প্রযুক্ত অন্বয়-অননুভাবকত্বম্ আকাঙ্ক্ষা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অন্য পদ ছাড়া একটি পদ যদি ঐ দুটি পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর অন্বয় বা সম্বন্ধের জনক না হয় তাহলে বলা যায় ঐ দুটি পদ পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত।
 .
যেমন, ‘জল আন’ বাক্যটির অন্তর্গত পদগুলির সামগ্রিক অর্থ হলো অন্বয়। এখন ‘জল’, ‘আন’ পদ দুটির একটি অন্যটি ছাড়া বাক্যের সামগ্রিক অর্থ অর্থাৎ অন্বয়ের জনক হয় না। এই অন্বয়ের জনক না হওয়াই ‘আকাঙ্ক্ষা’ পদের অর্থ। আকাঙ্ক্ষা হলো ‘শব্দবিন্যাসগত অপেক্ষা’। ‘জল আন’ এই দুটি পদ আকাঙ্ক্ষাযুক্ত। ‘আন’ পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয়- কী আনতে হবে ? এই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন ‘জল’ পদটি। আবার ‘জল’ এই পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয় ‘জল নিয়ে কী করতে হবে’ ? এই আকাক্সার নিবৃত্তি হয় ‘আন’ এই পদের দ্বারা। এখন যদি বলা হয়- ‘জল অশ্ব পুরুষ হস্তী’, এই পদগুলি পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত না হওয়ায় এই পদগুলির দ্বারা বাক্যার্থবোধ জন্মে না।
 .
অর্থাৎ বাক্যের ভাব বা বাক্যার্থ পরিস্ফুট করার জন্য পদগুলির মধ্যে একটি অন্বয়বোধ থাকা প্রয়োজন। কতকগুলি পদ পর পর বসালেই একটি বাক্য হয় না। পদগুলি ব্যবহারের একটি নিয়ম আছে। যে পদের সঙ্গে যে পদের অন্বয় হয়, সেই পদের সঙ্গে সেই পদকেই বসাতে হবে। কর্তা অনুসারে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। তেমনি বিশেষ্য অনুযায়ী বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। সুতরাং একটি পূর্ণ বাক্যার্থবোধ উৎপন্ন করার জন্য পদগুলির মধ্যে একটি অন্বয়বোধ থাকা প্রয়োজন। এই নিয়মকে অনুসরণ করেই আমরা বক্তার ভাবকে গ্রহণ করতে পারি। ব্যাকরণ অনুযায়ী কারকপদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধ থাকে।
 .
(২) যোগ্যতা : যোগ্যতা হলো পদসমূহের পারস্পরিক অবিরোধ সম্বন্ধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে যোগ্যতার লক্ষণ দিতে গিয়ে বলেছেন-
‘অর্থাবাধো যোগ্যতা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের বাধ না থাকাই যোগ্যতা।
 .
একটি বাক্যের অর্থবোধের ক্ষেত্রে ঐ বাক্যস্থিত পদগুলির দ্বারা বোধিত পদার্থগুলির মধ্যে অবিরোধ সম্বন্ধ থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ বাক্যস্থিত পদগুলির দ্বারা বোধিত পদার্থগুলির সম্বন্ধের ক্ষেত্রে বাস্তবিক কোন বাধ থাকবে না। বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের এই বাধ না থাকাই যোগ্যতা। যেমন, ‘জলে’র সঙ্গে ‘তাপে’র এবং ‘বহ্নি’র সঙ্গে ‘শীতলতা’র অবিরোধ সম্বন্ধ নেই। ‘বহ্নি শীতল’ একথা হাস্যকর, কেননা এস্থলে অর্থ-বাধ হয়। সুতরাং অর্থপূর্ণ বাক্যের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পদসমূহই পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে পারে।
 .
(৩) সন্নিধি বা আসত্তি : সন্নিধি বা আসত্তি হলো বাক্যে ব্যবহৃত পদসমূহের মধ্যস্থিত নৈকট্য। সন্নিধির লক্ষণ দিতে গিয়ে তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-
‘পদানাম-অবিলম্বেন উচ্চারণং সন্নিধিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : একটি বাক্যস্থিত পদসমূহের অবিলম্বে অর্থাৎ সময়ের অব্যবধানে উচ্চারণই সন্নিধি। 
 .
একটি বাক্য অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য পদগুলিকে দেশ ও কালের সান্নিধ্যে ব্যবহৃত হতে হয়। সকাল বেলায় ‘জল’ পদ উচ্চারণ করার পর বিকেল বেলায় যদি ‘আন’ পদ উচ্চারণ করা হয়, তাহলে এই শব্দদ্বয় কোনো বাক্যার্থবোধ উৎপন্ন করতে পারে না।
 .
(৪) তাৎপর্য : তাৎপর্য হলো কোনো পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তার ঈপ্সিত অর্থ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও সন্নিধি এই তিনটিকে শাব্দবোধের হেতু হিসেবে উল্লেখ করলেও টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় ‘বাক্যার্থ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘তাৎপর্যজ্ঞান কারণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
.
যে সকল পদের একাধিক অর্থ আছে, সেই সকল পদের ক্ষেত্রে তাৎপর্য অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন। বক্তা পদটি কোন্ অর্থে ব্যবহার করেছেন তা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করা না হয় তাহলে সে বাক্য বক্তার মনের যথার্থ ভাব প্রকাশ করতে পারে না। যেমন, ‘সৈন্ধব’ পদের ব্যাকরণগত অর্থ দ্বিবিধ- অশ্ব এবং লবণ। এই দুই অর্থের কোন্ অর্থে বক্তা শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা অনুধাবন না করলে বাক্য যথার্থ হবে না। পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গ বিচার করেই বাক্যের তাৎপর্য গ্রহণ করতে হয়।
.
৮.০ : ন্যায় পরাতত্ত্ব…
৮.১ : জগৎ…
ন্যায়মতে জগতের স্বতন্ত্র সত্তা আছে। তাই জাগতিক বস্তুরও স্বতন্ত্র সত্তা আছে, সেগুলো নিছক মনের ধারণা নয়। ফলে এদের অস্তিত্ব জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়।
 .
ন্যায়সূত্রানুযায়ী, যোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান থেকে নিঃশ্রেয়স বা মুক্তি হয়। এই যোড়শ পদার্থ হচ্ছে- প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান। আবার নৈয়ায়িকেরা বৈশেষিক মতের সাতটিই পদার্থ যেমন দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় এবং অভাব- এর অস্তিত্বও স্বীকার করেন। অতএব ন্যায়সূত্রের ষোড়শ পদার্থের সিদ্ধান্তের সাপেক্ষে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কিভাবে বলা যায় যে পদার্থ কেবলমাত্র সাতটিই। এ প্রেক্ষিতে নব্য নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেন-
‘সর্বেষাং পদার্থানাং যথাযথমুক্তেষবন্তর্ভাবাৎ সপ্তৈব পদার্থা ইতি সিদ্ধম’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সকল পদার্থ উল্লিখিত সাতটি পদার্থের যে কোন একটির অন্তর্ভুক্ত বলে পদার্থ সাতটি এবং কেবলমাত্র সাতটি।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে জ্ঞানের বিষয় বা প্রমেয় বারোটি, যথা- আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ।
এখানে প্রবৃত্তি বলতে ধর্ম ও অধর্ম (শুভ-অশুভ কর্ম) বোঝায়। দোষ বলতে রাগ, দ্বেষ ও মোহকে বোঝায়। রাগ বলতে ইচ্ছাকে, দ্বেষ বলতে ক্রোধকে, মোহ বলতে শরীরাদিতে আত্মভ্রমকে বোঝায়। প্রেত্যভাব বলতে মরণের পর পুনরুৎপত্তি বা পুনর্জন্মকে বোঝায়। ফল বলতে সুখদুঃখের ভোগকে বোঝায়। অপবর্গ বলতে নিঃশ্রেয়স বা মোক্ষকে বোঝায়। আত্মার অপবর্গ বা মুক্তি বলতে বোঝায় এমন এক অবস্থা যখন সকল দুঃখ ধ্বংস হয় এবং যখন দুঃখ ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না। অর্থাৎ মুক্তি দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়।
 .
এইসব জ্ঞানের বিষয় ভৌতিক জগতে দেখা যায় না। যেসব বিষয় বা পদার্থ ভৌতিক দ্বারা গঠিত সেগুলি দেখা যায়। আত্মা ও মন যেহেতু ভৌতিক নয়, সেহেতু জাগতিক নয়। নৈয়ায়িকগণ বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁদের মতে আত্মা হলো একটি অভৌতিক দ্রব্য। দেশ ও কালের দ্বারা আত্মা সীমিত হয় না। দেশ ও কালের বস্তুগত সত্তা আছে। কাল অনন্ত ও অখণ্ড, দেশও অনন্ত অখণ্ড।
 .
পৃথিবী ও যাবতীয় বস্তুসকল চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই উপাদান হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি) ও মরুৎ (বাতাস)। এই উপাদানগুলির অন্তিম অংশ হলো চার প্রকারের পরমাণু। এই পরমাণুগুলি নিত্য, অবিভাজ্য ও অপরিবর্তনীয়। পরমাণুগুলি ও ঈশ্বর সহাবস্থানকারী। ঈশ্বর এই পরমাণুগুলি সৃষ্টি করেননি। তিনি এই পরমাণুর সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাই ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত কারণ মাত্র। জগতের সকল বস্তু যৌগিক এবং পরমাণু দ্বারা গঠিত। যৌগিক বস্তু, ইন্দ্রিয়, জীবদেহ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ সবই এই যৌগিক পদার্থের অন্তর্ভুক্ত।
 .
নৈয়ায়িকরা দ্বৈতবাদী। তারা জড়জগৎ ও আত্মা উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করেন।
৮.২ : আত্মা ও অপবর্গ বা মোক্ষ…
       আত্মার স্বরূপ…
       আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ…
       আত্মার মুক্তি বা অপবর্গ…

আত্মা ও অপবর্গ
ন্যায়দর্শনে মুখ্যত জ্ঞানতত্ত্ব ও যুক্তিবিদ্যার আলোচনা গুরুত্ব পেলেও আত্মা বা আত্মার অপবর্গের আলোচনা এই দর্শনে কখনোই উপেক্ষিত হয় নি। মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’, বাৎস্যায়নের ভাষ্যগ্রস্থ ‘ন্যায়ভাষ্য’ ও তাদের টীকা-টিপ্পনী ছাড়াও আত্মা বিষয়ে নৈয়ায়িক উদয়নাচার্যের ‘আত্মতত্ত্ববিবেক’ স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 .
আত্মার স্বরূপ :
আত্মা বলতে জীবাত্মা এবং পরমাত্মা উভয়কেই বোঝায়। ন্যায়মতে ঈশ্বরই পরমাত্মা, তাই সাধারণভাবে আত্মা বলতে জীবাত্মাকেই বোঝানো হয়। নৈয়ায়িকদের মতে আত্মা একটি অভৌতিক, নিত্য ও সর্বব্যাপী দ্রব্য। দেশ ও কাল আত্মাকে সীমিত করতে পারে না। তাঁদের মতে এক একটি দেহে এক একটি আত্মা বিদ্যমান।
 .
মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়দর্শনে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে বারোটি প্রমেয়-পদার্থের আলোচনায় আত্মা ও অপবর্গ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশ করেছেন। বৈশেষিক দর্শনে আত্মা নবদ্রব্যের অন্যতম দ্রব্য পদার্থরূপে স্বীকৃত। ‘আত্মন’ শব্দ গমনার্থক ‘অত্’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন্’ প্রত্যয়ের মাধ্যমে নিষ্পন্ন। ‘অত্’ ধাতুর অর্থ গমন। তাই আত্মার অর্থ হলো গমনকারী। দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে বলেই আত্মাকে গমনকারী বলা হয়। আবার গমনার্থক ধাতুমাত্রই জ্ঞানার্থক। সুতরাং ‘আত্মন্’ শব্দের অপর অর্থ হলো জ্ঞাতা বা জ্ঞানের আশ্রয়। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আত্মার লক্ষণ দিয়েছেন-
‘জ্ঞানাধিকরণমাত্মা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আত্মা জ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
আত্মা জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপ নয়। জ্ঞানাধিকরণত্ব আত্মার লক্ষণ। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার একটি গুণ। ন্যায় ও বৈশেষিক উভয় সম্প্রদায়মতেই আত্মা জ্ঞান ও ইচ্ছাদি (ইচ্ছা, দ্বেষ, বুদ্ধি বা প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি) গুণের আশ্রয়। এ বিষয়ে অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-
‘সুখাদৌ আশ্রয়ত্বং জীব লক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : সুখ, দুঃখ, দ্বেষাদির আশ্রয় হলো জীব (জীবাত্মা)।
 .
তবে জ্ঞান আত্মার নিত্য গুণ নয়, আগন্তুক গুণ। আত্মাতে জ্ঞান সর্বদা থাকে না। আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞান বা চৈতন্য ও ইচ্ছা প্রভৃতি গুণ আত্মা বা আত্মদ্রব্যের বিশেষ গুণ। এই গুণগুলি অভৌতিক। এর ফলে কোন ভৌতিক দ্রব্যে এই গুণগুলি থাকতে পারে না। গুণের আলাদা অস্তিত্ব থাকে না, গুণ হয় দ্রব্যাশ্রিত। অর্থাৎ যে কোনো গুণ কোনো না কোনো দ্রব্যকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি গুণগুলি যেহেতু ভৌতিক নয়, তাই এই গুণগুলি কোনো অভৌতিক দ্রব্যকে আশ্রয় করেই অবস্থান করতে হয়। এই অভৌতিক গুণগুলির আশ্রয়রূপে যে অভৌতিক দ্রব্য স্বীকৃত, তাই আত্মা। ন্যায়-বৈশেষিক মতে এই আত্মদ্রব্য বা আত্মা নিত্য অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিনাশরহিত, মূর্ত, বিভু ও সংখ্যায় বহু। প্রতি শরীরে জীবাত্মা ভিন্ন ভিন্ন। বিভু অর্থ পরমমহৎপরিমাণবিশিষ্ট। শরীরের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বলে জীবাত্মাকে সীমিত বলে মনে হয়।
 .
ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবাত্মার স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি মতবাদ হলো- জড়বাদী, অভিজ্ঞতাবাদী, ভাববাদী ও বস্তুস্বাতস্ত্র্যবাদী মতবাদ। জড়বাদী দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাকদের মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা, দেহ ছাড়া আত্মার ভিন্ন কোনো সত্তা নেই এবং অভৌতিক আত্মা বলে কিছু নেই, অর্থাৎ আত্মা এবং দেহ অভিন্ন। চার্বাকমতে দেহ বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনষ্ট হয়, তাই আত্মা অমর নয়। অভিজ্ঞতাবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে আত্মা (পুৎগল) হলো পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থা। ভাববাদী অদ্বৈত বেদান্তমতে  আত্মা বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ ও নিত্য। এই মতে আত্মা জ্ঞাতাও নয়, জ্ঞেয়ও নয়। আর রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত মতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ নয়, আত্মা হলো সক্রিয় ও সগুণ সচেতন দ্রব্য।
 .
নৈয়ায়িকরা আত্মাকে একটি চৈতন্যবিশিষ্ট দ্রব্য বলে মনে করেন। তাঁদের মতে আত্মা জ্ঞাতা, ভোক্তা ও কর্তারূপে সব কিছু জানে। ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন আত্মার লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন-  
‘তত্রাত্মা সর্ব্বস্য দ্রষ্টা, সর্ব্বস্য ভোক্তা, সর্ব্বজ্ঞঃ, সর্ব্বানুভাবী। তস্য ভোগায়তনং শরীরম্ । ভোগসাধনানীন্দ্রিয়াণি। ভোক্তব্য ইন্দ্রিয়ার্থঃ। ভোগো বুদ্ধিঃ।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : সেই ‘আত্মা’ সমস্তের অর্থাৎ সমস্ত সুখদুঃখকারণের দ্রষ্টা (বোদ্ধা), সমস্তের অর্থাৎ সমস্ত সুখদুঃখের ভোক্তা, (সুতরাং) ‘সর্বজ্ঞ’ অর্থাৎ স্বকীয় সুখদুঃখের সমস্ত কারণ ও সমস্ত সুখদুঃখের জ্ঞাতা, (সুতরাং) ‘সর্ব্বানুভাবী’ অর্থাৎ স্বকীয় সুখদুঃখের সমস্ত কারণ ও সমস্ত সুখদুঃখপ্রাপ্ত। সেই আত্মার ভোগের স্থান ‘শরীর’। ভোগের সাধন ‘ইন্দ্রিয়’ অর্থাৎ ঘ্রাণাদি বহিরিন্দ্রিয়বর্গ। ভোগ্য ‘ইন্দ্রিয়ার্থ’বর্গ, অর্থাৎ গন্ধ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়। ভোগ ‘বুদ্ধি’ অর্থাৎ জ্ঞান।
.
আত্মা সকল কর্ম সম্পাদন করে এবং সকল কিছু ভোগ করে। তবে ন্যায়মতে চৈতন্য বা জ্ঞান আত্মার বিশেষ গুণ হলেও তা আত্মার স্বাভাবিক বা অবিচ্ছেদ্য গুণ নয়। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ, যা কিছু সম্বন্ধের মাধ্যমে আত্মায় আশ্রিত হয়। আত্মা স্বরূপত অচেতন, নিষ্ক্রিয়। আত্মা যখন মনের সঙ্গে, মন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এবং ইন্দ্রিয় বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়, তখন আত্মার চেতনা বা বুদ্ধির আবির্ভাব হয়। এই সম্বন্ধগুলির অভাবে জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। আবার আত্মা যখন দেহ বিযুক্ত হয় তখন তাতে আর চৈতন্যরূপ থাকে না। মোক্ষাবস্থায় আত্ম-মন-সংযোগ না থাকায় আত্মায় জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না এবং আত্মা জ্ঞানহীন শুদ্ধ সত্তারূপে বিরাজ করে। কিন্তু এই জ্ঞানহীন শুদ্ধ সত্তা বদ্ধ আত্মারই অবস্থান্তর। বদ্ধাবস্থায় আত্মা জ্ঞানের অধিকারী হয়। এজন্য মুক্ত আত্মাকে জ্ঞানহীন বলা যায়, কিন্তু জ্ঞানাযোগ্য বলা যায় না।
 .
আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ :
ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতম এবং অন্যান্য নৈয়ায়িকেরা বিভিন্ন যুক্তির সাহায্যে আত্মা যে ইন্দ্রিয়াদি, শরীর, প্রাণ প্রভৃতি থেকে ভিন্ন, তা নিরূপনের মাধ্যমে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
শরীর ও ইন্দ্রিয় যে আত্মা হতে ভিন্ন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নৈয়ায়িকদের বক্তব্য হচ্ছে, শরীর কিংবা ইন্দ্রিয় আত্মা হতে পারে না। আত্মা শরীর ও ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন।
 .
শরীর আত্মা হলে, অর্থাৎ শরীর ও আত্মা অভিন্ন হলে শরীরের কোন অঙ্গের নাশে শরীরের নাশ হলে আত্মারও নাশ হয়- একথা বলতে হয়। কিন্তু একথা স্বীকার করলে স্মৃতি ব্যাখ্যা করা যায় না। শরীরের কোন অঙ্গের নাশে আত্মার নাশ স্বীকার করলে শরীরের ঐ অঙ্গের নাশের পূর্বে অনুভূত বিষয়ের স্মরণ করা সম্ভব হবে না। স্মৃতির ব্যাখ্যার জন্য শরীরাতিরিক্ত এক অভিন্ন সত্তা অবশ্য স্বীকার্য। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল শরীর আত্মা হতে পারে না।
 .
আবার ইন্দ্রিয় ও আত্মা অভিন্ন হলে অনুসন্ধান বা প্রত্যভিজ্ঞা ব্যাখ্যা করা যাবে না। ‘যে আমি ঘটকে দেখেছিলাম সেই আমি এখন ঘটকে স্পর্শ করছি’ এরূপ প্রত্যভিজ্ঞা আমাদের হয়। এরূপ প্রত্যভিজ্ঞাস্থলে প্রত্যক্ষ কর্তা ও স্পর্শকর্তা অভিন্নরূপে প্রতীত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্পর্শ স্থলে যে ইন্দ্রিয় কাজ করে ও প্রত্যক্ষ স্থলে যে ইন্দ্রিয় কাজ করে তা ভিন্ন। ইন্দ্রিয় ও আত্মা অভিন্ন হলে স্বীকার করতে হয় যে, অনুভব হয়েছে একজনের আর স্মরণ হচ্ছে অন্যজনের। কিন্তু অনুভবকর্তা ও স্মরণকর্তা অভিন্ন না হলে স্মরণ সম্ভব হয় না। অভিন্ন আত্মা স্বীকার না করলে অনুভব হবে একজনের আর স্মরণ হবে অন্যের। সুতরাং শরীর ও ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন এক নিত্য আত্মার অস্তিত্ব অবশ্য স্বীকার্য।
 .
মহর্ষি গৌতম ও বাৎস্যায়ন আত্মাকে অনুমেয় বলেছেন। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘ইচ্ছা-দ্বেষ-প্রযত্ন-সুখ-দুঃখ-জ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১০)
অর্থাৎ : ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ ও জ্ঞান আত্মার লিঙ্গ অর্থাৎ দেহাদিভিন্ন চিরস্থায়ী জীবাত্মার অনুমাপক।
এই প্রাচীন নৈয়ায়িকদের মতে আত্মার অস্তিত্ব সাক্ষাৎভাবে জানা যায় না। অনুমানের সাহায্যে আত্মার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তাঁদের মতে ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ প্রভৃতির অস্তিত্ব থেকে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে। এছাড়া আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে শ্রুতিতে উল্লেখ আছে। যেহেতু শ্রুতি শব্দপ্রামাণ্য গ্রন্থ, তাই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার্য।
 .
ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ প্রভৃতির অস্তিত্ব আমরা স্বীকার না করে পারি না। কিন্তু কোনো স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা না হয় তাহলে ইচ্ছা, দ্বেষ প্রভৃতির ক্রিয়াকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। কোনো একটি বস্তু সুখদায়ক বলে সেই বস্তুটি লাভ করার ইচ্ছা করি। কোনো দুঃখজনক অবস্থার উদ্ভব হলে আমরা মনে করি যে পূর্বের মতো আমরা দুঃখ পাবো। এই সুখ দুঃখের অনুভূতি অতীত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। এই অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিই প্রমাণ করে যে স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব আছে। জ্ঞান ও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করে কোনো বিষয়ে প্রথমে জানার ইচ্ছা করে পরে সেই সম্বন্ধে চিন্তা করলে তার জ্ঞান লাভ করা যায়। এই কারণেও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 .
তবে উদ্দ্যোতকর, আচার্য উদয়ন প্রভৃতি নব্য নৈয়ায়িকদের মতে অহং-প্রত্যয়ের বিষয়রূপে স্ব স্ব আত্মার মানস-প্রত্যক্ষের সাহায্যে আত্মাকে জানা যায়। তাঁদের মতে, আমাদের মনের সঙ্গে যখন শুদ্ধ আত্মার সংযোগ ঘটে তখন আত্মা সম্পর্কে আমাদের সাক্ষাৎ জ্ঞান জন্মে। এই আত্মসচেতনতাই মানস-প্রত্যক্ষ। কোনো কোনো নৈয়ায়িকের মতে শুদ্ধ আত্মা প্রত্যক্ষের বস্তু নয়। বুদ্ধি, অনুভূতি, প্রযত্ন প্রভৃতি গুণের মাধ্যমে আত্মাকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা যখন বলি ‘আমি আছি’, ‘আমি সুখী’, ‘আমি দুঃখী’ তখন আমাদের আত্মা সম্পর্কে জ্ঞান প্রকাশিত হয়।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে চৈতন্যের অস্তিত্বও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আত্মার সঙ্গে চৈতন্যের সমবায় সম্বন্ধ। চৈতন্য আত্মারূপ দ্রব্যকেই আশ্রয় করে বিরাজ করে। অতএব আত্মার অস্তিত্ব আছে।
আবার ন্যায়মতে অলৌকিক প্রত্যক্ষের সাহায্যেও আত্মার অস্তিত্ব জানা যায়। তাঁদের মতে, যোগীরা ধ্যানের মাধ্যমে আত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
 .
আত্মার মুক্তি বা অপবর্গ :
আত্মার মোক্ষলাভকে ন্যায়ের পরিভাষায় বলা হয় অপবর্গ। চার্বাক ব্যতীত প্রায় সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়েরই মূল লক্ষ্য হলো আত্মার মুক্তি। বৌদ্ধ মতে যদিও স্থায়ী আত্মা স্বীকার করা হয়নি, তবুও তাঁদেরও মূল লক্ষ্য চৈতন্য প্রবাহের নির্বাণ।
ন্যায়মতে আত্মা স্বভাবতই নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ ও চৈতন্যহীন দ্রব্য। আত্মা মনের সঙ্গে যুক্ত হলে এবং মন, ইন্দ্রিয় ও বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত হলেই বুদ্ধি, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, প্রযত্ন প্রভৃতি গুণ আত্মার মধ্যে আবির্ভুত হয়। মন ও দেহের সঙ্গে আত্মার এই সংযোগ ঘটলে আত্মার বদ্ধাবস্থা সূচনা করে। এর ফলে এই বদ্ধ-আত্মারূপ দেহ সুখ-দুঃখাদি ভোগ করে। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘বাধনালক্ষণং দুঃখম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২১)
অর্থাৎ : সমস্ত প্রমেয়ই বাধনালক্ষণ অর্থাৎ দুঃখানুষক্ত দুঃখ।
ন্যায়মতে এই সুখ-দুঃখাদি ভোগের আত্যন্তিক মুক্তি বা নিবৃত্তিই হলো মোক্ষ বা অপবর্গ। মূলত মুক্তি বলতে নৈয়ায়িকেরা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকেই বোঝান। দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হলে তার আর পুনরাবৃত্তি হয় না। তাই ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  
‘তদত্যন্তবিমোক্ষোহপবর্গঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২২)
অর্থাৎ : তার সাথে (সর্ববিধ দুঃখের সাথে) অত্যন্ত মুক্তিই অপবর্গ।
.
এবং এই অপবর্গ সম্বন্ধে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন ন্যায়ভাষ্যে বলেছেন-  
‘যত্র তু নিষ্ঠা যত্র তু পর্য্যবসানং সোহয়ং (অপবর্গঃ)।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : যাতে সবকিছু সমাপ্তি (নিষ্ঠা), যাতে সর্বতোভাবে অবসান, তাই (অপবর্গ)।
 .
প্রশ্ন হলো, কী কারণে দুঃখ হয় ? মিথ্যাজ্ঞান বা অবিদ্যা হেতু দুঃখ হয়। তাহলে অবিদ্যা কী ? অনিত্যবস্তুকে নিত্য মনে করাই অবিদ্যা। যেমন আমরা মন, ইন্দ্রিয়, শরীর প্রভৃতিকেই আত্মারূপে মনে করি। কিন্তু আত্মা মন, শরীর ও ইন্দ্রিয়- এই কোনোটির সঙ্গেই অভিন্ন নয়। এই ভ্রান্ত জ্ঞানই মিথ্যাজ্ঞান। অজ্ঞানতাবশত মানুষ নিজেকে কর্তা, জ্ঞাতা এবং ভোক্তা মনে করে। আত্মাকে সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ প্রভৃতির অধীন মনে করে মোহগ্রস্ত হয়। আত্মাকে এরূপ মনে করাই অবিদ্যা। এই অবিদ্যা বা মিথ্যজ্ঞান থেকে তিন প্রকার দোষ জন্মে, যেমন- রাগ, দ্বেষ ও মোহ। এই দোষের তাড়নায় জীব ভালো মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। এর ফলে ধর্ম ও অধর্মের উৎপত্তি হয়। এই প্রবৃত্তির জন্য মানুষের আবার জন্ম হয় এবং এই জন্ম হেতু দুঃখ হয়। ভারতীয় কর্মফলবাদ তথা জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী জীবের ধর্মাচরণের ফলস্বরূপ সুখ ভোগ করার জন্য এবং অধর্মাচরণের ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগের জন্যই জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। জীবের জন্য এই জন্মগ্রহণই মূলত সকল দুঃখের কারণ। ন্যায়মতে, সকল দুঃখের মূল যে মিথ্যাজ্ঞান, সেই মিথ্যাজ্ঞান যথার্থ জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হলে জীবকে আর জন্মগ্রহণ করতে হবে না। ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্যে তারই প্রতিধ্বনি দেখা যায়-  
‘তেন দুঃখেন জন্মনাহত্যন্তং বিমুক্তিরপবর্গঃ। কথম্? উপাত্তস্য জন্মনো হানমন্যস্য চানুপাদানম্ । এতামবস্থামপর্যন্তাম্ অপবর্গং বেদয়ন্তেহপবর্গবিদঃ। তৎ অভয়ম্ অজরম্ অমৃত্যুপদং ব্রহ্ম ক্ষেমপ্রাপ্তিরিতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : সেই জন্মরূপ দুঃখের সাথে অর্থাৎ জয়মান শরীরাদি সর্বদুঃখের সাথে অত্যন্ত বিমুক্তি ‘অপবর্গ’। (প্রশ্ন) কী প্রকার? অর্থাৎ জন্মরূপ দুঃখের সাথে অত্যন্ত বিমুক্তি কিরকম? (উত্তর) গৃহীত জন্মের ত্যাগ এবং অপর জন্মের অগ্রহণ। অবধিশূন্য অর্থাৎ চিরস্থায়ী এই অবস্থাকে (আত্মার শরীরাদি সর্বদুঃখশূন্য কৈবল্যাবস্থাকে) অপবর্গবিদগণ অপবর্গ বলে জানেন। তা অভয়, অজর, অমৃত্যুপদ, ব্রহ্ম, ক্ষেমপ্রাপ্তি।
 .
দেহ ও ইন্দ্রিয় হতে আত্মার সম্পূর্ণ বিচ্যুতি না হওয়া পর্যন্ত তার দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব নয়। দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার সংযোগই আত্মার বদ্ধাবস্থা এবং আত্মা যখন দেহ ও ইন্দ্রিয় হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন আত্মার মুক্তাবস্থার সূচনা হয়। এই মুক্তাবস্থার পূর্ব পর্যন্ত আত্মা তার স্বরূপে অবস্থান করে না এবং পুনঃ পুনঃ জীবের জন্মচক্র সংঘটিত হতে থাকে। মুক্তাবস্থায় আত্মা তার স্বরূপে অবস্থান করলে আর কখনো সুখ-দুঃখাদির অনুভব হয় না এবং এই অবস্থাকেই বলা হয় আত্যন্তিক নিবৃত্তি বা মোক্ষ বা অপবর্গ।
 .
মোক্ষ অবস্থায় সুখ অনুভূতি থাকে কিনা এই নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মহর্ষি গৌতম সুখানুভূতির অস্তিত্বের কথা স্পষ্ট প্রকাশ করেননি। তবে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের মতে মোক্ষতে সুখের অনুভূতি থাকে না। এই অপবর্গ বা আত্মার মুক্তিলাভের উপায় কী ? নৈয়ায়িকদের মতে যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানই মুক্তি লাভের উপায়। আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় হতে যে ভিন্ন এই জ্ঞানই তত্ত্বজ্ঞান। অপবর্গ লাভই যে ন্যায় দর্শনের লক্ষ্য, তা ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতমের প্রথম সূত্রেই উক্ত হয়েছে। ন্যায়মতে প্রমাণাদি ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান অপবর্গ লাভের সহায়ক মাত্র। তবে অন্যান্য বৈদিক সম্প্রদায়ের মতো নৈয়ায়িকগণও অপবর্গের উপায়রূপে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের উল্লেখ করেছেন। আত্মার যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে শ্রুতিবাক্য বা শাস্ত্রবাক্যের শ্রবণ ও অনুধাবন হলো শ্রবণ। মনন হলো ঐ সকল বাক্যাদির যুক্তিপূর্ণ বিচার, সঠিক অর্থগ্রহণ এবং ঐ অর্থের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন। নিদিধ্যাসন হলো যোগ ও সাধনার মাধ্যমে আত্মার স্বরূপকে সতত ধ্যান করা। এই ত্রিবিধ স্তরের মাধ্যমে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়াদির অতিরিক্ত এক শুদ্ধ আত্মার উপলব্ধি ঘটে। জীব তখন আর মন, শরীর বা ইন্দ্রিয়কে আমিরূপে উপলব্ধি করে না। আত্মোপলব্ধির ফলে মিথ্যাজ্ঞান, বিভিন্ন প্রকার দোষ ও প্রবৃত্তির চির-বিলুপ্তি ঘটে।
 .
শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের ফলে একদিকে যেমন পূর্বে সঞ্চিত কর্মফল ভোগের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়, তেমনি অপরদিকে প্রবৃত্তির বিনাশে নতুন কর্মফল আর উৎপন্ন হয় না। স্বাভাবিকভাবেই জীবের অদৃষ্টভোগ সমাপ্ত হয়। অদৃষ্টভোগের সমাপ্তিতে এবং নতুন কর্মফলের অনুৎপত্তিতে জীবাত্মার পুনর্জন্ম রোধ হয় এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। এরই নাম মোক্ষলাভ বা অপবর্গলাভ।
নৈয়ায়িকদের মতে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই, সেই ব্যক্তি সন্ন্যাসীই হোন বা গৃহস্থই হোন, তিনি মোক্ষ লাভের অধিকারী।

৮.৩ : ঈশ্বর…
      
ন্যায়মতে ঈশ্বরই পরমাত্মা। এই পরমাত্মা জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কারণ। বেদান্তমতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত (নিমিত্ত ও উপাদান উভয়ই)। সাংখ্যমতে জগৎ প্রকৃতির পরিণাম। কিন্তু ন্যায়মতে জগৎ পরমাণুর সাহায্যে ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট। জগতের উপাদান কারণ পরমাণু এবং নিমিত্ত কারণ ঈশ্বর। দেশ, কাল, আকাশ প্রভৃতি জগৎ সৃষ্টির সহকারি কারণ। দেশ, কাল, আকাশ প্রভৃতি এবং জগতের আদি উপাদান নিত্যপরমাণু ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট নয়। ঈশ্বর তাই জগৎ-স্রষ্টা হলেও জগতের আদি উপাদানের স্রষ্টা নন। কুম্ভকার যেমন প্রাপ্ত মৃত্তিকার সাহায্যে ঘট নির্মাণ করে, ঈশ্বর তেমনি নিত্য স্থিত পরমাণুর সাহায্যে এই বৈচিত্র্যময় জগৎ সৃষ্টি করেছেন।
 .
ন্যায়দর্শনে মহর্ষি গৌতম যে ষোলটি পদার্থে কথা উল্লেখ করেন তাতে ঈশ্বরের কোন উল্লেখ নেই। তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও ‘ন্যায়সূত্র’-এর চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকে তিনটি সূত্রে ঈশ্বরের কথা উল্লেখ করেছেন। সিদ্ধান্তসূত্রতে মহর্ষি গৌতম দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে ঈশ্বরই জীবের কর্ম ও কর্মফল নিয়ন্ত্রণ করেন।
পরবর্তী নৈয়ায়িকেরা ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অভিমত দেন যে, ঈশ্বরের করুণা লাভ করলেই মোক্ষ লাভ সম্ভব হয়। ঈশ্বরের করুণা ছাড়া জীবাত্মার মুক্তি সম্ভব নয়। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। তিনি শুধু জগতের সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি জগতের রক্ষাকর্তা এবং ধ্বংসকর্তাও বটে।
 .
ঈশ্বরের স্বরূপ :
ন্যায়মতে প্রমেয় পদার্থের অন্যতম পদার্থ হলো আত্মা। আত্মা দু’প্রকার- জীবাত্মা ও পরমাত্মা। এই পরমাত্মাই ঈশ্বর। জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য, কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্য জ্ঞানবান। ঈশ্বরের লক্ষণ বর্ণনা করে নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-
‘নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বং ঈশ্বরত্বম’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্যজ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
নিত্যজ্ঞান পরমাত্মার গুণ। সুতরাং ঈশ্বর সগুণ। সর্বজ্ঞ পরমাত্মা সর্ববিষয়ক নিত্যজ্ঞানের আশ্রয়, কিন্তু নিত্যজ্ঞানস্বরূপ নন। তিনি জ্ঞানাদি গুণবিশিষ্ট, নিত্য, সর্বজ্ঞ। তাই ঈশ্বর অতীন্দ্রিয়দর্শী, অনাদী, অসীম, সর্বশক্তিমান।
.
ন্যায়মতে ঈশ্বর আত্মদ্রব্য হলেও জীবাত্মার ন্যায় ঈশ্বর সুখ-দুঃখাদি ভোগ করেন না। মুক্ত আত্মাতে নৈয়ায়িকেরা যেমন জ্ঞানের স্বরূপযোগ্যকারণতা স্বীকার করেন, কিন্তু ফলোপধায়ককারণতা স্বীকার করেন না তেমনি ঈশ্বর বা পরমাত্মাতে তাঁরা সুখ-দুঃখাদির স্বরূপযোগ্যকারণতা স্বীকার করেন, কিন্তু ফলোপধায়ককারণতা স্বীকার করেন না। ফলোপধায়ককারণ বাস্তবিক পক্ষে কার্য উৎপন্ন করে, কিন্তু স্বরূপযোগ্যকারণ কার্য উৎপন্ন করার ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও বাস্তবিক পক্ষে কার্য উৎপন্ন করে না। শরীর, অদৃষ্ট প্রভৃতি সহকারি কারণের অনুপস্থিতিতে ঈশ্বর বা পরমাত্মায় সুখ-দুঃখাদি উৎপন্ন হতে পারে না।
 .
পরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ, মন ও আত্মা- এগুলি হলো নিত্য দ্রব্য। ন্যায়মতে ঈশ্বর এই নিত্য দ্রব্যগুলি সৃষ্টি করেননি। জগৎ সৃষ্টির পূর্বে এই নিত্য দ্রব্যগুলির ঈশ্বরের ন্যায় অস্তিত্ব ছিলো এবং এদের অস্তিত্ব জগৎ ধ্বংসের পরেও থাকবে। কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ করে, তেমনি ঈশ্বরও পরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ, মন এবং আত্মার সাহায্যে এই জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরই জগতের স্রষ্টা। জগৎ সৃষ্টির পর তিনি জগতকে রক্ষা করেন, আবার প্রয়োজনবোধে তিনি এই জগতকে ধ্বংস করেন। তিনি পরমাণুর সংযোগ সাধান করে জগৎ সৃষ্টি করেন এবং পরমাণুর বিচ্ছেদ সাধান করে জগতের ধ্বংস সাধন করেন।
 .
ঈশ্বর অদৃষ্ট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীব নিজের ইচ্ছায় কর্ম করে এবং কর্মের গুণাগুণ বিচার করে কর্মের গুণানুসারে ঈশ্বর তার ফল প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। কর্ম অনুযায়ী জীব ফল ভোগ করে। কর্ম অনুযায়ী জীব যে পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয়, এই পাপ-পুণ্য যার মধ্যে সঞ্চিত হয় তাকে বলে অদৃষ্ট। ঈশ্বর এই অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীবের কর্মফল প্রাপ্তির ব্যবস্থা করার জন্য ঈশ্বরকে জীবের অদৃষ্ট শক্তির উপর নির্ভর করতে হলেও ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি সর্বজ্ঞ, সব কিছুর যথাযথ স্বরূপ সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। ঈশ্বরের এই অনন্ত জ্ঞান তার অবিচ্ছেদ্য গুণ।
 .
ঈশ্বর এক ও শাশ্বত পরম সত্তা। ঈশ্বর সকল জীবের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীবের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকলেও ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বরই কর্মফল প্রদান করেন। তিনিই আমাদের নৈতিক জীবনের সুখ দুঃখের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। তাই-
‘তত্র ঈশ্বরঃ সর্বজ্ঞঃ পরমাত্মা এক এব’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : নিত্য পরমাত্মা বা ঈশ্বর এক ও সর্বজ্ঞ।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ :
বলা হয়ে থাকে, ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির নিকট ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বতঃই প্রমাণিত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক প্রমাণ তাই তাঁর কাছে নিরর্থক। কিন্তু দার্শনিকদের কাছে, বিশেষ করে যুক্তিবাদী দার্শনিকদের কাছে প্রমাণের গুরুত্ব অবশ্যস্বীকার্য। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মন অন্ধভাবে কোন কিছু স্বীকার করতে চায় না। তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক প্রমাণ পর্যাপ্ত হোক বা না হোক, ঈশ্বরোপলব্ধির পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রমাণগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
 .
ঈশ্বরবিশ্বাসী অন্যান্য দার্শনিকদের ন্যায় নৈয়ায়িকেরাও ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন। এই যুক্তিগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে ‘প্রমাণ’ বলে পরিচিত। তাঁদের প্রদত্ত প্রমাণগুলির কোনো না কোনোটার সাথে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তির সাদৃশ্য দেখা যায়। অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রায় সব প্রমাণই নৈয়ায়িকদের প্রদত্ত প্রমাণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
.
নৈয়ায়িকদের সুপ্রসিদ্ধ ও সমধিক প্রচলিত প্রমাণ-চতুষ্টয় হলো- (ক) কার্যকারণ বিষয়ক প্রমাণ (The Causal Argument), (খ) অদৃষ্টভিত্তিক প্রমাণ (Argument from Adrista), (গ) বেদ-কর্তারূপে ঈশ্বর প্রমাণ (The Argument from the Authoractiveness of the Vedas), (ঘ) ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে বেদ বা শ্রুতি প্রমাণ (The Testimony of Sruti)।
 .
(ক) কার্যকারণ বিষয়ক প্রমাণ : কার্য-কারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি কার্য-পদার্থেরই একটি কারণ আছে। নৈয়ায়িকেরা আরম্ভবাদী। তাঁদের মতে কার্য সৃষ্টির পূর্বে অসৎ থাকে। কারণসামগ্রিই কার্যকে উৎপন্ন করে। বিচিত্র বস্তু সমন্বিত এই জগৎ একটি কার্য। অতএব এই জগতেরও একটি কারণ আছে। জগতের এই কারণই ঈশ্বর।
 .
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রতিটি কার্যেরই কারণ আছে এ সত্য নৈয়ায়িকেরা আবিষ্কার করলেন কী করে ? আবার প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে এরূপ সার্বিক নিয়ম স্বীকার করে নিলেও জগৎ যে একটি কার্য তাতেই বা প্রমাণ কী ? এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকেরা বিভিন্ন দৃষ্টান্তের সাহায্যে অন্বয় প্রক্রিয়ার দ্বারা কার্য-কারণ বিষয়ক একটি সার্বিক নীতিকে এবং ভিন্ন যুক্তির সাহায্যে জগৎ যে একটি কার্য তা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
 .
কোন কার্য উৎপন্ন হওয়ার পেছনে দু’প্রকার কারণ থাকে- উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ। যেমন, ঘট হলো একটি কার্য। এই কার্যের উপাদান কারণ হলো মৃত্তিকা। আর নিমিত্ত কারণ হলো কুম্ভকার। এখানে কুম্ভকার চেতন কর্তা। অর্থাৎ কোন কার্য কোনও চেতন কর্তা ব্যতীত উৎপন্ন হয় না। যখনই কোন কার্য উৎপন্ন হয় কার্যের পেছনে তখনই তার নিমিত্ত কারণরূপে কোন একটি চেতন সত্তা থাকে। ন্যায়মতে একই ক্ষণে কার্য ও কারণ উভয়ই উৎপন্ন হতে পারে না। তাই কারণ কার্যের সমকালীন না হয়ে পূর্ববর্তীই হয়। কার্যের চেতন কারণ ন্যায়মতে নিমিত্ত কারণের অন্তর্গত।
 .
জগৎ যে কার্য এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে নৈয়ায়িকেরা সাবয়বত্ব ও অবান্তরমহত্ত্ব নামক দুটি হেতুর সাহায্য নিয়েছেন। সাবয়ব মানে অবয়ববিশিষ্ট এবং অবান্তরমহৎ মানে মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট। ন্যায়মতে নিরবয়ব পরমাণু ও অতিমহৎ দেশকালাদি (দেশ, কাল, আকাশ, মন, আত্মা) নিত্য। তাই এরা কার্যরূপ নয়। কিন্তু ঘট, পট, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি পার্থিব বস্তু দেশকালাদির ন্যায় অতিমহৎও নয় আবার পরমাণুর ন্যায় অনুপরিমাণও নয়। পার্থিব সকল বস্তুই সাবয়ব এবং অবান্তরমহৎ বা মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট। সাবয়ব এবং অবান্তরমহৎ পদার্থ মাত্রই কার্যরূপ- যেহেতু এগুলি অংশের সমষ্টি এবং সীমিত পরিসর যুক্ত। সুতরাং জাগতিক সকল বস্তুই কার্য। এই কার্যরূপ জগতের নিমিত্তকারণরূপে একটি চেতন সত্তা প্রয়োজন।
কার্যের নিমিত্ত কারণরূপ চেতন সত্তা অবশ্যই কার্যের সূক্ষ্ম উপাদানের সুস্পষ্ট জ্ঞান, কার্য উৎপন্ন করার ইচ্ছা এবং কার্য উৎপন্ন করার ক্ষমতা সম্পন্ন হবেন। অন্যথা জড় উপাদান ও চেতন কর্তার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। জগতের উপাদান সূক্ষ্মপরমাণুর এবং সহকারি কারণ দেশ-কালাদির সার্বিক জ্ঞান কোন সীমিত জ্ঞানের অধিকারী চেতন কর্তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং জগতের যিনি নিমিত্ত কারণ তাঁকে অসীম জ্ঞানের অধিকারী বা সর্বজ্ঞ হতে হবে। জগতের মতো বিরাট কার্য উৎপন্ন করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা এক সর্বশক্তিমান সত্তার পক্ষেই থাকা সম্ভব। তাই একমাত্র সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সত্তা যে ঈশ্বর তিনিই এ নিখিল জগতের সৃষ্টিকর্তা ও নিমিত্তকারণ।
 .
(খ) অদৃষ্টভিত্তিক প্রমাণ : অদৃষ্ট হলো জীবের নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী সঞ্চিত পাপ-পুণ্যের সমষ্টি বা ভাণ্ডার। অদৃষ্টে সঞ্চিত কর্ম অনুযায়ী জীব তার কর্মফল ভোগ করে। এটাকে কর্মবাদ বলা হয়।
এ জগতে দেখা যায় যে, সকল জীবের জীবন একরূপ নয়। জগতে কেউ সুখী, আবার কেউ দুঃখী। শুধু তাই নয়, কেউ হয়তো সৎ উপায়ে জীবনযাপন করা সত্ত্বেও দুঃখভোগ করে। আবার কেউ অসৎ উপায়ে জীবনযাপন করেও দুঃখভোগ করে না। জীবের সুখ-দুঃখের এই তারতম্য ও আপাত-অসংগতি দূর করার জন্য ভারতীয় দর্শনে একটি সার্বিক নৈতিক নিয়ম স্বীকার করা হয়, যা কর্মবাদ নামে পরিচিত।
 .
কর্মবাদ অনুযায়ী জীবের প্রতিটি সকাম কর্মেরই ফল আছে এবং প্রতিটি জীবকেই তার নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মের সুফলকে বলা হয় পুণ্য এবং কুফলকে বলা হয় পাপ। প্রতিটি জীবের জীবনেই সুকর্ম থেকে সুখভোগ এবং কুকর্ম থেকে দুঃখভোগ হয়। কর্মফল সবসময় কর্মানুযায়ী হয়। তারপরও, কোন কোন ব্যক্তির জীবনে কর্মের এই নিয়মের আপাত-ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আপাত-ব্যতিক্রমের জন্য সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অস্বীকার করা হলে মানবজীবন যথেচ্ছাচারের দাস হয়ে পড়ে। এজন্যে এই ব্যতিক্রমের হেতু অনুসন্ধান  করে কর্মবাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়, জীব একটি মাত্র জন্মে তার সকল কৃতকর্মের ফল-ভোগ সমাপ্ত করতে সক্ষম হবে এমন কোন কথা নেই। জীব তার কৃতকর্মের ফলের পরিমাণ অনুযায়ী জন্ম-জন্মান্তরে তা ভোগ করে থাকে। এই জন্মান্তরবাদের উপর ভিত্তি করেই কর্মবাদ প্রতিষ্ঠিত। যে ব্যক্তি ইহজীবনে সৎকর্ম করেও দুঃখভোগ করে সে আসলে এই ইহজীবনের কর্মফল ভোগ করে না। পূর্বজন্মের কৃত কুকর্মের পাপ তার পূর্বজন্মেই শেষ হয়ে যায় নি বলেই সেই সঞ্চিত পূর্বজন্মের পাপ সে এই জীবনে ভোগ করে চলেছে। এজন্যেই ইহজীবনে তার কর্ম ও ফলভোগের মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি জীবের কর্মফলভোগ তার নিজস্ব পাপপুণ্যের সমষ্টি বা ভাণ্ডার অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এই কর্মফল-ভাণ্ডার বা সঞ্চিত পাপপুণ্যের সমষ্টি ন্যায়দর্শনে জীবের অদৃষ্ট বলে পরিচিত।
 .
এই অদৃষ্ট হলো অচেতন বা জড় পদার্থ। সে নিজে নিজে পরিচালিত হতে পারে না। প্রতিটি জীবের অদৃষ্ট সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং জন্মান্তরে জীবকে নিজ নিজ অদৃষ্ট অনুযায়ী যথাযোগ্য ফল অর্পণ আকস্মিকভাবে বা কোন সসীম জীবের দ্বারা সম্ভব হতে পারে না। জীব কোন্ কর্মের কী ফল তা জানে না। তাছাড়া জীব নিজেই অদৃষ্টের দাস। অদৃষ্টের সঠিক পরিচালনার জন্য অদৃষ্টের বহির্ভুত অর্থাৎ যিনি নিজে অদৃষ্টের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন এরূপ নিরপেক্ষ, সর্বশক্তিমান একটি সত্তা স্বীকার করা প্রয়োজন, যাঁর দক্ষ ও সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি জীব তার নিজ নিজ অদৃষ্টের অধিকারী হয়ে জন্ম-জন্মান্তরে নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করতে পারে। এই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, অদৃষ্ট-নিয়ন্ত্রক সত্তাই হলেন ঈশ্বর।
নিজের কর্ম জীব নিজেই করে এবং সেই কর্মের ফল সে নিজেই ভোগ করে। ঈশ্বর জীবের অদৃষ্টের রক্ষক ও পরিচালক মাত্র। ঈশ্বর কখনো অদৃষ্টের পরিবর্তন করেন না।
 .
(গ) বেদ-কর্তারূপে ঈশ্বর প্রমাণ : সকল আস্তিক সম্প্রদায়ই বেদকে অভ্রান্ত ও সর্বপ্রকার জ্ঞানের আকর বলে মনে করেন। আস্তিক সম্প্রদায়গুলির কাছে বেদ প্রামাণিক শাস্ত্র। দৃষ্টার্থ বেদবাক্য থেকে বেদের প্রামাণ্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। যেমন আয়ুর্বেদ রোগ নিরাময়ের যে সকল বিধান দেয় সেই সকল বিধান পালন করে রোগগ্রস্ত মানুষ স্বচ্ছন্দে রোগমুক্ত হতে পারে। এরূপ দৃষ্টার্থ বেদবাক্যের ন্যায় অদৃষ্টার্থ বেদবাক্যও অভ্রান্ত মানতে হবে। সসীম মানুষের পক্ষে বেদের সকল বাক্যের ব্যবহারিক প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
 .
ন্যায়মতে, আসলে বেদের প্রামাণ্য বেদের রচয়িতার প্রামাণ্য থেকে নিঃসৃত। বেদের বহু উপদেশ সাধারণ মানুষের জ্ঞানগম্যই নয়। এমন অতিসূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় পদার্থ বিষয়ক বেদবাক্য রচনা কোন সর্বজ্ঞ পুরুষের দ্বারাই সম্ভব, সসীম মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। বস্তুতঃপক্ষে বেদ সর্ব জ্ঞানের অধিষ্ঠান বা আকর। এরূপ অধিষ্ঠান বা আকরের রচয়িতা সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।
অতএব, ন্যায়মতে বেদ সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বাক্য যার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং যাবতীয় বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে। এভাবে বেদের কর্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
 .
(ঘ) ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে বেদ বা শ্রুতি প্রমাণ : বেদ ও উপনিষদ বিভিন্ন স্থানে ঈশ্বরের স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বিভিন্ন উক্তি প্রকাশ করেছে। প্রায় সকল উপনিষদেই কোন না কোন ভাবে সৃষ্টিকর্তারূপে এক সর্বজ্ঞ সত্তার ইঙ্গিত আছে। এসব শ্রুতির প্রামাণ্য স্বীকার করে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-
‘যঃ সর্বজ্ঞঃ স সর্ববিৎ’ ইতি আগমোহপি তত্র প্রমাণম্ । (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : ‘যঃ সর্বজ্ঞ স সর্ববিৎ’- এরূপ আগম বা শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
 .
অন্নংভট্ট শ্রুতি হিসেবে যে ‘যঃ সর্বজ্ঞঃ স সর্ববিৎ’- বেদবাক্যটি (মুণ্ডক উপনিষদ-১/১/৯) উল্লেখ করেছেন, এতে যাঁকে ‘সর্বজ্ঞ’ (‘যিনি সামান্যত সবকিছুতে জানেন’) ও ‘সর্ববিৎ’ (‘যিনি সবকিছুকে বিশদভাবে জানেন’) বলা হয়েছে, তিনিই ঈশ্বর। উল্লেখ্য, মুণ্ডকোপনিষদের মূল শ্লোকটি হচ্ছে-
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ।
তস্মাদেতৎ ব্রহ্ম নাম রূপম্ অন্নম্ চ জায়তে।। (মুণ্ডক উপনিষদ : ১/১/৯)।
অর্থাৎ : যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে। (অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকেই সবকিছুর প্রকাশ, বিকাশ।)
 .
যদিও আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়েও সাংখ্য ও মীমাংসা সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু বৃহদারণ্যক, শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি উপনিষদে ও ভগবদ্গীতায় যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে নৈয়ায়িকদের অভিমত।
গীতায় সুস্পষ্টভাবে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য তিনি বারংবার আবির্ভূত হন-  
‘পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতা।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৮)
অর্থাৎ : সাধুদের রক্ষার জন্য, দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরাদিরূপে অবতীর্ণ হই।
ঈশ্বর সর্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। তিনিই জগতের পিতা, মাতা, ভর্তা ও প্রভু। বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে- ‘তিনি সকলের প্রভু, সকলের নিয়ামক, সকলের শাসনকর্তা এবং সকল জীবের স্বামী।’ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরই পরম পুরুষ, তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ এবং সর্বভূতের আশ্রয়স্থল। যেমন-  
‘যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো যন্মিন্নিদং সং চ বি চৈতি সর্বম্ ।
তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিমত্যন্তমেতি।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)
অর্থাৎ : ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছুর মূল। জগৎ প্রকাশিত হলে সেই জগৎকে তিনিই পালন করেন। আবার প্রলয়কালে জগৎ তাঁর কাছেই ফিরে যায়। তিনি সবকিছুর নিয়ন্তা। একমাত্র তিনিই ভক্তদের বর দেন। তিনিই একমাত্র আরাধ্য। এই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হলে শাশ্বত শান্তি লাভ করা যায়।
মোটকথা বিভিন্ন উপনিষদে ঈশ্বরকে কখনো সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তারূপে, কখনো সকল ভূতের আশ্রয়রূপে, কখনো ন্যায় ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠাতারূপে, আবার কখনো জীবের মোক্ষের উপায়রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রুতি যদি অভ্রান্ত হয় তাহলে এ সকল উক্তি থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্দেহাতীতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
 .
এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, শাস্ত্র বাক্যকে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে মেনে নেবো কেন ? সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও দার্শনিকরা শাস্ত্রবাক্যকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে নিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করবেন কী করে। একথার খণ্ডন করে বলা হয়, কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ দ্বারা প্রমাণিত হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বও প্রত্যক্ষ উপলব্ধির বিষয়। যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছে সেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, কারণ সব যুক্তিই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পূর্বে স্বীকার করে নিয়ে তারপর ঈশ্বরে অস্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।
.
প্রত্যক্ষই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। কিন্তু যারা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি, তাদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের আপ্তবাক্যের উপর নির্ভর করা শ্রেয়। বেদ ও উপনিষদে ঈশ্বরের যে অস্তিত্বের কথা আছে সেগুলি বিশ্বাসযোগ্য। ঋষিদেরও শ্রুতিবাক্য আপ্তবাক্য-প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা উচিত।
এভাবেই নৈয়ায়িকেরা শ্রুতির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নৈয়ায়িকদের যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি :
নৈয়ায়িকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেসব যুক্তির বিরুদ্ধে সাংখ্য, মীমাংসা ও জৈন দার্শনিকেরা কতকগুলি আপত্তি এনেছেন। এবং নৈয়ায়িকেরাও এই অভিযোগগুলি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন।
 .
নৈয়ায়িকদের ঈশ্বর সম্পর্কিত যুক্তিগুলির মধ্যে কার্য-কারণ বিষয়ক প্রমাণের বিরুদ্ধে অপর দার্শনিকদের আপত্তি হলো, ঈশ্বর যদি এই জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তবে তার অবশ্যই দেহ থাকতে হবে। আর যদি ঈশ্বরের দেহ থাকে তাহলে তিনি অসীম নন। কুম্ভকার শারীরিক ক্রিয়ার দ্বারা মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ করেন। ঈশ্বরও নিত্য দ্রব্যগুলির সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর যদি এই জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তবে ঈশ্বরের অবশ্যই দেহ থাকা প্রয়োজন।
নৈয়ায়িকেরা এই আপত্তি খণ্ডন করে বলেন, কর্ম করার জন্য জীবের দেহের প্রয়োজন, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য দেহের কোনো প্রয়োজন নেই। যেসব পরমাণুর দ্বারা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন সেই পরমাণুগুলি ঈশ্বরের ইচ্ছায় সংযুক্ত হয় এবং সেই পরমাণুগুলিই ঈশ্বরের দেহের কাজ করতে পারে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই পরমাণুগুলি গতিশীল হয়ে ওঠে।
 .
নৈয়ায়িকদের বিরুদ্ধে অপর আপত্তি হলো, ঈশ্বর যদি জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তাহলে জগৎ সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। বিরোধীপক্ষ বলেন, যেহেতু ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না সেহেতু ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা নন। আরো বলা হয়ে থাকে যে, ঈশ্বর করুণাবশত এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর যদি করুণাবশত জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তিনি সকল জীবকে সুখী করতেন। কিন্তু জগতে অনেক দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। মানুষ অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি।
এই আপত্তির উত্তরে নৈয়ায়িকেরা বলেন, ঈশ্বর করুণাবশত এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। জীবকে তার নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়। ঈশ্বর জীবের পাপ-পুণ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। জীবকে স্বাধীনভাবে কর্ম করার সুযোগ দিয়েছেন। জীবই স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নিজের সুখ ও দুঃখের সৃষ্টি করে। মানুষের কর্মফলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঈশ্বর কোন মানুষকে সুখী, কোন মানুষকে দুঃখী করেন।
 .
শেষের দুটি অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ প্রমাণে নৈয়ায়িকেরা বেদের ও শ্রুতির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। নৈয়ায়িকদের এ দুটি প্রমাণ সম্বন্ধে পরস্পরাশ্রয় বা অন্যোন্যাশ্রয় বা চক্রক দোষের আপত্তি উঠেছে। দুটি তত্ত্ব বা বস্তু যদি পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরস্পরকে প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে অন্যোন্যাশ্রয় বা পরস্পরাশ্রয় বা চক্রক দোষ ঘটে। তৃতীয় যুক্তিতে নৈয়ায়িকেরা বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠার জন্য বেদকে ঈশ্বর-নির্ভর বলেছেন। আবার চতুর্থ প্রমাণে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা ঈশ্বরকে বেদ বা শ্রুতি-নির্ভর বলেছেন। অর্থাৎ নৈয়ায়িকেরা বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদের সাহায্য নিয়েছেন। বেদ ও ঈশ্বর পরস্পর পরস্পরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে কেউই কাউকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এরূপ দোষের নামই পরস্পরাশ্রয় দোষ।
নৈয়ায়িকেরা উপরিউক্ত আপত্তি খণ্ডন করতে বলেন, পরস্পরাশ্রয় সব সময় দোষের নয়। দুটি বস্তু যদি একই বিষয়ে পরস্পরের উপর নির্ভর করে, তাহলেই পরস্পরাশ্রয় দোষ হয়। অর্থাৎ যে জন্য বেদ ঈশ্বর-নির্ভর, সেজন্যই যদি ঈশ্বর বেদ-নির্ভর হতেন, তাহলে সেখানে অন্যোন্যাশ্রয় দোষ ঘটতো। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক তৃতীয় ও চতুর্থ প্রমাণে এরূপ নির্ভরশীলতার কথা বলা হয়নি। তৃতীয় প্রমাণে বেদ রচনা-বিষয়ে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঈশ্বর যেহেতু বেদের সৃষ্টিকর্তা, সেহেতু সৃষ্টির জন্য বেদ ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঈশ্বর জ্ঞপ্তি বিষয়ে বেদের উপর নির্ভরশীল, অস্তিত্ব বিষয়ে নন। অর্থাৎ ঈশ্বরতত্ত্ব উপলব্ধির জন্য আমাদের বেদের উপর নির্ভর করতে হয়, ঈশ্বরের উৎপত্তির জন্য নয়। নিত্য ঈশ্বরের উৎপত্তির প্রশ্নই উঠে না। নির্ভরতার বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় ঈশ্বর ও বেদের অন্যোন্যাশ্রয় দোষের আশঙ্কা অর্থহীন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ