ইংরাজস্তোত্র - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 August, 2020

ইংরাজস্তোত্র


হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১ ||
তুমি নানাগুণে বিভূষিত, সুন্দর কান্তিবিশিষ্ট, বহুল সম্পদ্‌যুক্ত; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২ ||
তুমি হর্ত্তা-শত্রুদলের; তুমি কর্ত্তা-আইনাদির; তুমি বিধাতা-চাকরি প্রভৃতির। অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৩ ||
তুমি সমরে দিব্যাস্ত্রধারী, শিকারে বল্লমধারী, বিচারাগারে অর্দ্ধ ইঞ্চি পরিমিত ব্যাসবিশিষ্ট বেত্রধারী, আহারে কাঁটা-চাম্‌চেধারী; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৪ ||
তুমি একরূপে রাজপুরী মধ্যে অধিষ্ঠান করিয়া রাজ্য কর; আর একরূপে পণ্যবীথিকা মধ্যে বাণিজ্য কর; আর একরূপে কাছাড়ে চার চাষ কর; অতএব হে ত্রিমূর্ত্তে! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৫ ||
তোমার সত্ত্বগুণ তোমার প্রণীত গ্রন্থাদিতে প্রকাশ; তোমার রজোগুণ তোমার কৃত যুদ্ধাদিতে প্রকাশ; তোমার তমোগুণ তোমার প্রণীত ভারতবর্ষীয় সম্বাদপত্রাদিতে প্রকাশ।-অতএব হে ত্রিগুণাত্মক! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৬ ||
তুমি আছ, এই জন্যই তুমি সৎ! তোমার শত্রুরা রণক্ষেত্রে চিৎ; এবং তুমি উমেদারবর্গের আনন্দ; অতএব হে সচ্চিদানন্দ! তোমাকে আমি প্রণাম করি। ৭ ||
তুমি ব্রহ্মা-কেন না, তুমি প্রজাপতি; তুমি বিষ্ণু-কেন না, কমলা তোমার প্রতিই কৃপা করেন; এবং তুমি মহেশ্বর-কেন না, তোমার গৃহিণী গৌরী। অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৮ ||
তুমি ইন্দ্র, কামান তোমার বজ্র; তুমি চন্দ্র, ইন্‌কম টেক্‌স তোমার কলঙ্ক; তুমি বায়ু, রেইলওয়ে তোমার গমন; তুমি বরুণ, সমুদ্র তোমার রাজ্য; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৯ ||
তুমিই দিবাকর, তোমার আলোকে আমাদের অজ্ঞানান্ধকার দূর হইতেছে; তুমিই অগ্নি-কেন না, সব খাও; তুমিই যম, বিশেষ আমলাবর্গের। ১০ ||
তুমি বেদ, আর ঋক্‌যজুষাদি মানি না; তুমি স্মৃতি-মন্বাদি ভুলিয়া গিয়াছি; তুমি দর্শন ন্যায়, মীমাংসা প্রভৃতি তোমারই হাত। অতএব হে ইংরাজ! তোমাকে প্রণাম করি। ১১ ||
হে শ্বেতকান্ত! তোমার অমল-ধবল দ্বিরদ-রদশুভ্র মহাশ্মশ্রুশোভিত মুখমণ্ডল দেখিয়া আমার বাসনা হইয়াছে, আমি তোমার স্তব করিব; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১২ ||
তোমার হরিতকপিশ পিঙ্গললোহিত কৃষ্ণশুভ্রাদি নানা বর্ণশোভিত, অতিযত্নরঞ্জিত, ভল্লুকমেদমার্জ্জিত কুন্তলাবলি দেখিয়া আমার বাসনা হইয়াছে, আমি তোমার স্তব করিব; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৩ ||
তুমি কলিকালে গৌরাঙ্গাবতার, তাহার সন্দেহ নাই। হ্যাট তোমার সেই গোপবেশের চূড়া; পেণ্টুলন সেই ধড়া-আর হুইপ্ সেই মোহন মুরলী-অতএব হে গোপীবল্লভ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৪ ||
হে বরদ! আমাকে বর দাও। আমি শামলা মাথায় বাঁধিয়া তোমার পিছু পিছু বেড়াইব-তুমি আমাকে চাকরি দাও। আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৫ ||
হে শুভঙ্কর! আমার শুভ কর। আমি তোমার খোশামোদ করিব, তোমার প্রিয় কথা কহিব, তোমার মনরাখা কাজ করিব-আমায় বড় কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৬ ||
হে মানদ! আমায় টাইটল দাও, খেতাব দাও, খেলাত দাও;-আমাকে তোমার প্রসাদ দাও-আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৭ ||
হে ভক্তবৎসল! আমি তোমার পাত্রাবশেষ ভোজন করিতে ইচ্ছা করি-তোমার করস্পর্শে লোকমণ্ডলে মহামানাস্পদ হইতে বাসনা করি,-তোমার স্বহস্তলিখিত দুই একখানা পত্র বাক্সমধ্যে রাখিবার স্পর্দ্ধা করি-অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও; আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৮ ||
হে অন্তর্যামিন্! আমি যাহা কিছু করি, তোমাকে ভুলাইবার জন্য। তুমি দাতা বলিবে বলিয়া আমি দান করি; তুমি পরোপকারী বলিবে বলিয়া আমি পরোপকার করি, তুমি বিদ্বান্ বলিবে বলিয়া আমি লেখাপড়া করি। অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৯ ||
আমি তোমার ইচ্ছামতে ডিস্পেন্সরি করিব; তোমার প্রীত্যর্থ স্কুল করিব; তোমার আজ্ঞামত চাঁদা দিব; তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২০ ||
হে সৌম্য! যাহা তোমার অভিমত, তাহাই আমি করিব। আমি বুট পাণ্টালুন পরিব, নাকে চস্‌মা দিব, কাঁটা চাম্‌চে ধরিব, টেবিলে খাইব-তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২১ ||
হে মিষ্টভাষিন্! আমি মাতৃভাষা ত্যাগ করিয়া তোমার ভাষা কহিব; পৈতৃক ধর্ম্ম ছাড়িয়া ব্রাহ্মধর্ম্মাবলম্বন করিব; বাবু নাম ঘুচাইয়া মিষ্টর লেখাইব; তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২২ ||
হে সুভোজক! আমি ভাত ছাড়িয়াছি, পাঁউরুটি খাই; নিষিদ্ধ মাংস নহিলে আমার ভোজন হয় না; কুক্কুট আমার জলপান। অতএব হে ইংরাজ! আমাকে চরণে রাখিও, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৩ ||
আমি বিধবার বিবাহ দিব; কুলীনের জাতি মারিব; জাতিভেদ উঠাইয়া দিব-কেন না, তাহা হইলে তুমি আমার সুখ্যাতি করিবে। অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। ২৪ ||
হে সর্ব্বদ! আমাকে ধন দাও, মান দাও, যশঃ দাও;-আমার সর্ব্ববাসনা সিদ্ধ কর। আমাকে বড় চাকরি দাও, রাজা কর, রায়বাহাদুর কর, কৌন্সিলের মেম্বর কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৫ ||
যদি তাহা না দাও, তবে আমাকে ডিনরে আট্‌হোমে নিমন্ত্রণ কর; বড় বড় কমিটির মেম্বর কর, সেনেটের মেম্বর কর, জুষ্টিস কর, অনরারী ম্যাজিষ্ট্রেট্ কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৬ ||
আমার স্পীচ্ শুন, আমার এশে পড়, আমায় বাহাবা দাও,-আমি তাহা হইলে সমগ্র হিন্দুসমাজের নিন্দাও গ্রাহ্য করিব না। আমি তোমাকেই প্রণাম করি। ২৭ ||
হে ভগবন্! আমি অকিঞ্চন-আমি তোমার দ্বারে দাঁড়াইয়া থাকি, তুমি আমাকে মনে রাখিও। আমি তোমাকে ডালি পাঠাইব, তুমি আমাকে মনে রাখিও। হে ইংরাজ! আমি তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম করি। ২৮ ||.....✍বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস তীর্থংকর রায় pdf
ব্যবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে অর্থনীতির পরিবর্তন- মূলত এই দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য হত মূলত স্থলপথে। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-ডা-গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজ়রা ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সোজা সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার পর জলপথেও বাণিজ্য শুরু হয়ে যায়। ভারত/এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে পর্তুগিজ়দের মুনাফার পরিমাণ (অনেকসময় শতকরা এক হাজারেরও বেশি) দেখে উত্তর ইউরোপের ব্যবসায়ীরা লোভ সামলাতে পারলেন না। ভারত/এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য তাঁরা জয়েন্ট স্টক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। এভাবেই জন্ম হল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০) আর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০২)-র। তার অনেক পরে ফরাসি, ড্যানিশ প্রভৃতি কোম্পানির উদ্ভব। ষোড়শ শতকে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে পর্তুগিজ়দের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু সতেরো শতকে ডাচ আর ইংরেজরা এসে পর্তুগিজ়দের হটিয়ে দিয়ে নিজেরাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। আলোচ্য গ্রন্থে তীর্থংকর দুটো ‘বড় প্রশ্ন’-র উত্তর খুঁজেছেন। প্রথম, ব্যবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ (মানদণ্ড থেকে রাজদণ্ড)- কোম্পানির এই বিবর্তনের কারণগুলি কী? দ্বিতীয়ত, ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে অর্থনীতির কী পরিবর্তন হয়েছিল? ‘ভূমিকা’ ও ‘মূল্যায়ন’ বাদ দিয়ে সাতটি সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত অধ্যায়ে লেখক তাঁর বক্তব্য ও মূল সিদ্ধান্ত পেশ করেছেন। সে প্রসঙ্গ পরে। প্রথমে লেখকের কয়েকটি উক্তি নিয়ে একটু আলোচনা দরকার। কারণ, এগুলি ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়, ফলে তা পাঠকের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। তীর্থংকর লিখেছেন হলওয়েল বর্ণিত ‘অন্ধকূপ হত্যা’ ‘গণহত্যা’র সমান এবং ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড’র সমতুল্য! কোনও উগ্র জাতীয়তাবাদী ইংরেজও এমন কথা বলবেন কি না সন্দেহ। হলওয়েলের সমসাময়িক কর্মচারীরা ‘অন্ধকূপ হত্যা’র গল্পটাকে আজগুবি গল্প (‘specious fable’) বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ জে এইচ লিট্ল এটাকে ‘gigantic hoax’ বলে অভিহিত করেছেন। হলওয়েল তাঁর প্রথম বয়ানে বন্দির সংখ্যা ১৬৫ থেকে ১৭০ লিখে পরের বয়ানে (বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভেবে?) বন্দির সংখ্যা ১৪৬ জন করেন। তার মধ্যে নাকি ২৩ জন বেঁচে ছিল, বাকি ১২৩ জন মারা যায়। পঞ্চাশ বছরেরও আগে ব্রিজেশ গুপ্ত দেখিয়ে দেন, বন্দির সংখ্যা ছিল ৬৪ জন, তার মধ্যে ২১ জন জীবিত ছিল, মৃতের সংখ্যা ৪৩ জন। তাছাড়াও বইটিতে বেশ কিছু তথ্যগত বিচ্যুতি চোখে পড়ে। স্থানাভাবে শুধু কয়েকটি উল্লেখ করছি। লেখক বলেছেন, ১৭০০ সাল পর্যন্ত কোম্পানির প্রধান দু’টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল ঢাকাই কাপড় ও সোরা। এ দু’টি ছাড়াও একটি প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল কাঁচা রেশম। রপ্তানি পণ্যের মোট মূল্য হিসেব করলে রেশমের স্থান কাপড়ের পরেই। আসলে ১৬৮০-র প্রথম দিক পর্যন্ত রেশমই ছিল প্রধান পণ্য, তারপর কাপড় ও সোরা। ওই দশকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপের মানুষের মধ্যে রুচির একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের (ভারতের/বাংলার কাপড় পরার একটা প্রচণ্ড হুজুগ) ফলে হঠাত্‌ ইউরোপে বাংলার/ভারতের কাপড়ের চাহিদা খুবই বেড়ে যায়, বেড়ে যায় কাপড় রপ্তানিও। তাছাড়া ঢাকাই কাপড় অন্যান্য কাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি দামি বলে রপ্তানির জন্য বেশির ভাগ কাপড়ই আসত কাশিমবাজার, হুগলি, মালদা, শান্তিপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। ঢাকা থেকে যে-পরিমাণ কাপড় রপ্তানি হত, তা মোট রপ্তানির শতকরা দশ শতাংশ মাত্র। আবার লেখক বলেছেন, ১৭৬৫-র পর থেকে মধ্যগ-বণিক, দালাল প্রভৃতির পরিবর্তে কোম্পানি নিযুক্ত কর্মচারীদের (গোমস্তা) মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। আসলে ১৭৫৩ সাল থেকেই কোম্পানি গোমস্তাপ্রথা চালু করে, ১৭৬৫-তে নয়। এবার তীর্থংকরের মূল বক্তব্যে আসা যাক। কোম্পানি কী করে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ শুরু করে, তার জন্য তিনি অন্ধকূপ হত্যা ও সিরাজদ্দৌল্লাকে দায়ী করেছেন। আধুনিক গবেষণায় তা অসার বলে প্রমাণিত। পলাশি প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একাংশের বিশ্বাসঘাতকতাই পলাশির যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা, ইংরেজরাই পলাশি চক্রান্তের অন্যতম নায়ক। তাদের সক্রিয় সমর্থন ও উত্‌সাহ ছাড়া এ চক্রান্ত সফল হত না। খোদ ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকে বর্তমান প্রতিবেদক এটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আসলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা, যা ১৭৩০-এর দশক এবং চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত রমরমিয়ে চলছিল, ১৭৪০-এর শেষদিকে তা ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বিনাশুল্কে কোম্পানির কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করে দিতে সিরাজদ্দৌল্লার দৃঢ় সংকল্পের সম্মুখীন হয়ে প্রচণ্ড মার খাচ্ছিল। অথচ এই ব্যক্তিগত ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে দেশে ফিরবে বলেই ইংরেজ কর্মচারীরা সাত সমুদ্র পেরিয়ে এদেশে আসত। তাই তারা এই ব্যক্তিগত ব্যবসা পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আর তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল- তাই পলাশির যুদ্ধ এবং সিরাজদ্দৌল্লার বিতাড়ন। তীর্থংকরের আরও বক্তব্য, কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে ভারতের বাণিজ্যে ‘বিশ্বায়নের জানালা’ খুলে যায়, আর ইউরোপীয়রা পণ্য সংগ্রহের জন্য বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করে বাণিজ্য সংগঠনে নতুনত্ব আনে। এসব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। ইউরোপীয়রা ভারতে আসার বহুদিন আগে থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আর, পণ্য সংগ্রহের জন্য অগ্রিম চুক্তি নতুন কিছু নয়, বাংলার বাণিজ্যে এটি একটি সনাতন পদ্ধতি ছিল। ইউরোপীয়রা আসার অনেকদিন আগে থেকেই এশীয় বণিকরা এদেশে তাদের রপ্তানি পণ্যের সিংহভাগই সংগ্রহ করত দাদন বা অগ্রিমের মাধ্যমে। তবে লিখিত চুক্তি হত কি না, তা ঠিক জানা যায় না। অবশ্য তার কোনও প্রয়োজনও ছিল না, কারণ, পরস্পরের ওপর বিশ্বাসই ছিল এশীয় বণিকদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এটাও এখন প্রতিষ্ঠিত যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও এশীয় বণিকদের রপ্তানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়েও অনেক বেশি ছিল। তাই ইউরোপীয়দের রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি বলে পণ্য সংগ্রহের জন্য অগ্রিম চুক্তি এবং দাদন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, এমন যুক্তি সঠিক নয়। লেখকের আরও একটি উপপাদ্য- পলাশির পর যে-বিখ্যাত ‘পলাশি লুঠ’ শুরু হয়েছিল এবং বাংলা থেকে ধননিষ্ক্রমণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যার উপর এতকাল ইতিহাসবিদরা জোর দিয়ে এসেছেন, সেটি আসলে ভ্রান্ত। তীর্থংকরের মতে, এই ধননিষ্ক্রমণ তত্ত্ব জাতীয়তাবাদী ও মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের মনগড়া জিনিস, তাই সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন, এই যে ধনরত্ন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তা দিয়ে ভারতের জন্য পরিষেবা কেনা হত। কিন্তু কী পরিমাণ ধননিষ্ক্রমণ হয়েছিল, আর পরিষেবা কিনতে কত খরচ পড়েছিল, তার কোনও হিসেব লেখক দেননি। ফলে তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাছাড়া অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার তাঁতিদের উপর কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের অমানুষিক অত্যাচারের ফলে, বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় হয়, ফলে ৬০ লক্ষ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে- এ নিয়ে বইতে কিছুটা আলোচনা থাকলে ভাল হত। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তীর্থংকরের নাম সুবিদিত। তাই আমাদের আর-একটু বেশি প্রত্যাশা ছিল। সে যাই হোক, বইটি সুখপাঠ্য।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ