ভূমিকা
শ্রী দূর্গাদাস লাহিড়ী
প্রথম পরিচ্ছেদ
পূর্বাভাষ
বেদ-বিষয়ে অনন্তকালের গবেষণা; বেদ কি -সে বিষয়ে মতভেদ, এবং বেদ কি-তার সার সিদ্ধান্ত; কাল ও রচনা-প্রসঙ্গে তর্ক-বিতর্ক; বিবাদ নিরসনে শাস্ত্র ও যুক্তি; বেদের সাথে মানব-জাতির ধর্মের ও শাস্ত্রের সম্বন্ধ-বেদের স্বরূপ ও বিভাগ।
বেদ বিষয়ে অনন্ত গবেষণা।
‘বেদ’ নিয়ে, যুগ-যুগান্ত ধরে, কত যে আলোচনা- কত যে গবেষণা চলেছে, তার ইয়ত্তা হয় না। মানব জাতির ইতিহাসে, শিক্ষার ও সভ্যতার অভ্যুদয়ের ও বিলয়ের সাথে সাথে, বেদ বিষয়ে কত মস্তিষ্ক কতভাবে আলোড়িত হয়েছে, তা নির্ণয় করা যায় না। এ জগতে বোধ হয় এমন কোন জনপদ নেই, এ পৃথিবীতে বোধ হয় এমন কোনও জাতির অভ্যুদয় ঘটেনি যাদের শিক্ষিত গর্বোন্নত সমাজ কোন-না কোনও আকারে বেদ-বিষয়ে আলোচনা করেনি। প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে, ভারতে ও ভারতের বহির্দ্দেশে, যেখানেই মানুষের সমাজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সমর্থ হয়েছে, সেখানেই স্বপক্ষেই হোক আর বিপক্ষেই হোক তাদেরকে বেদ-বিষয়ে আলোচনায় উদ্বুদ্ধ দেখতে পাই। সামনে যে অনন্ত শাস্ত্র-সমুদ্র বিদ্যমান, উহার বিশাল বুকে কি সাক্ষ্য উদ্ভাসিত রয়েছে? শাস্ত্র-রত্নাকর কে রত্নরাজি গর্ভে ধরণ করে আপন নামের সার্থকতা সম্পাদন করেছেন, তাই বা কি ঘোষণা করছে? সে কি বেদ নয়? ফলতঃ বেদ-বিষয়ে যিনি’ই যা আলোচনা করবেন, পুরাতনেরই পুনরাবৃত্তি ভিন্ন, অভিনবত্বের দাবী কারও পক্ষে সম্ভপর নয়।
‘বেদ’ কি- মতভেদ ও সার-সিদ্ধান্ত
‘বেদ’ কি? – এ সম্বন্ধে কতই মতভেদ দেখা যায়। বেদ কি- এই মুদ্রিত বা পুঁথি আকারে অবস্থিত গ্রন্থ খণ্ড? অথবা, বেদ কি কয়েকটা শ্লোক বা মন্ত্র মাত্র? অথবা, বেদ কি সেই সঙ্গীতের উচ্চ স্বর- যে স্বরে বেদ মন্ত্র উচ্চারিত হয়? অথবা, বেদ কি যাগ-যজ্ঞাদি কর্ম মাত্র? কত জন কত ভাবেই বেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু বেদ কি? ধাত্বর্থের অনুসরণ করলে, জ্ঞানমূলক ‘বিদ’ ধাতু হতে ‘বেদ’ শব্দের উৎপত্তি উপলব্ধি হয়। ‘বিদ’-ধাতুর অর্থ ‘জানা’। ‘জানা’ বললেই ‘কি জানা’ ভাব আসে। জানা- ধর্ম জানা, অধর্ম জানা। জানা- সত্য জানা, অসত্য জানা। জানা- স্বরূপ জানা। ফলতঃ যার দ্বারা ধর্ম অধর্মের সত্য অসত্যের জ্ঞানলাভ হয়, অর্থাৎ যার দ্বারা স্বরূপ জানা যায়; এক কথায়, যার দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক সর্ববিধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়, তাহাই ‘বেদ’। সেই সর্ববিধ জ্ঞানেরই নামান্তর-পরমেশ্বরের জ্ঞান। ধাতু অর্থের অনুসরণেও (বিদ্যতে জ্ঞায়তে পরমেশ্বরোহনেন ইতি বিদ্ ধাতোঃ করণে ঘঞ্) এই অর্থই সিদ্ধ হয়। জ্ঞান সত্য, জ্ঞান নিত্য, জ্ঞান সনাতন, জ্ঞান অপৌরুষেয়; সুতরাং জ্ঞানই ধর্ম; যা জ্ঞানের বিপর্যয়, তা অধর্ম। বেদ সেজন্যই ধর্ম; বেদ-বিপর্য্যয় সে কারণেই অধর্ম। “বেদপ্রণিহিতো ধর্ম্মহ্যধর্ম্মস্তদ্বিপর্য্যয়ঃ।” বেদ যে সনাতন, বেদ যে নিত্য, বেদ যে সত্য, এই বাক্যেই তা প্রতীত হয়। এজন্যই শাস্ত্র বলছেন,- যা প্রত্যক্ষ বা অনুমান দ্বারা সিদ্ধ হয় না, বেদ তা সপ্রমাণ করে। অনুমান ও প্রমাণের অজ্ঞাত সামগ্রীর সন্ধান করে বলেই বেদের বেদত্ব।
প্রত্যক্ষেণানুমিত্য বা যস্তুপায়ো নঃবুধ্যতে।
এতং বিন্দতি বেদেন তস্মাৎ বেদস্য বেদতা ॥
যা স্বপ্রমাণ, যা স্বতঃসিদ্ধ, যার প্রমাণের আবশ্যকতা করে না, তাই ‘বেদ’। মহর্ষি আপস্তুম্বের মতে- মন্ত্র রুপ ও ব্রাহ্মণ রুপ শব্দ রাশিই ‘বেদ’ মন্ত্র জ্ঞান মূলক; ব্রাহ্মণ কর্মবিধি প্রবর্ত্তক। মন্ত্রের অর্থজ্ঞান না হলে বৈদিক কর্মে জ্ঞান হয় না; কর্মজ্ঞানের অভাবে, কর্মে প্রবৃত্তির অভাব সংঘঠিত হয়। কর্মে অপ্রবৃত্তি-নিবন্ধন, কর্মানুষ্টান হতে পারে না; কর্মের অনুষ্টানে কর্মের ফললাভ কদাচ সম্ভবপর নয়; এজন্য মন্ত্র জ্ঞানমূলক। এই বিষয়ে নিরুক্ত নামক বেদাঙ্গ গ্রন্থ রচয়িতা মহর্ষি যাস্ক বলেছেন যে- ‘মননাৎ মন্ত্রাঃ’ অর্থাৎ স্বর(উদাত্তাদি) এবং ছন্দ(অনুষ্টুভাদি) সহযোগে উচ্চার্য্যমাণ শব্দসমূহ বৈদিক কর্মে প্রবৃত্তি রুপ জ্ঞানের মনন(অর্থাৎ বোধ) করায় বলে এর নাম মন্ত্র। অর্থোপলব্ধি হলে, মন্ত্র কর্মজ্ঞান প্রবর্ত্তক হয়; কিভাবে কর্ম করলে, কত্তর্ব্য কর্মের যথোক্ত ফললাভ করে, ঐহিক সুখ ও পারত্রিক মোক্ষফল প্রাপ্ত হওয়া যায়, ব্রাহ্মণ, এইপ্রকার কর্ম বিধির বিধান করেন। জ্ঞানলাভ হেতু যে কর্ম সম্পন্ন হয়, অথবা কর্ম সম্পাদন দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয়, তাকেই ‘বেদ’ বলা হয়। এখানে কর্মে ও জ্ঞানে যেন পারস্পরিক সম্বন্ধ। ফলতঃ এতেও বুঝা যায়, যে মন্ত্রে যে প্রক্রিয়ায় পরম জ্ঞান লাভ হয়, তাই বেদ। শ্রীমৎশঙ্করাচার্য্য তাই বলে গেছেন- ‘বেদশব্দেন তু সর্ব্বত্র শব্দরাশির্ব্বিরক্ষিতঃ।’ অর্থাৎ যে শব্দরাশি প্রমাণের অপেক্ষা করে না, তাই বেদ। যা সত্য, তা প্রমাণ করার কখনও প্রয়োজন হয় না। যা সনাতন, তার পরিবর্তন কখনও সম্ভবপর নয়। তা অপৌরুষেয়, মানুষের কি সাধ্য-তার প্রবর্তনার অধিকারী হবে? সত্য যেমন আজ একরূপ এবং কাল আরেক রূপ হয় না; সত্য যেমন চিরদিনই অপরিবর্ত্তিত অব্যয় ভাবে বিরাজমান থাকে; যা প্রকৃত ‘বেদ’, যা যথার্থ জ্ঞান, তা সেইরূপ অবিকৃত, অচঞ্চল ও অবিনাশী হয়ে চিরকাল বিদ্যমান রয়েছে। জ্ঞানও যা, ব্রহ্মও তাই। শ্রুতি বলছে,- ‘বিজ্ঞানং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ।’ এজন্যই প্রাচীন ঋষিগণ বলে থাকেন,- “ন বেদা বেদমিত্যাহুর্বেদো ব্রহ্ম সনাতনম্।” অর্থাৎ, মন্ত্র আদি সম্বলিত পুস্তকখণ্ড মাত্র নয়; সনাতন ব্রহ্মকেই বেদ বলে। ‘বেদ’ তারই নাম- যা সত্যরূপ, জ্ঞানরূপে ও প্রমাণরূপে চির-বিদ্যমান আছে।
বেদ ও তাঁর উৎপত্তি বিষয়ে বিতর্ক-
প্রশ্ন উঠতে পারে, বেদ নামে প্রচারিত যে গ্রন্থ প্রভৃতি দেখা যায়, তার সমস্ত তবে কি? ঐ যে ঋগ্বেদ, ঐ যে সামবেদ, ঐ যে যজুর্বেদ, ঐ যে অথর্ববেদ- এ সকল কি তবে বেদ নয়? আর যদি এই সকল গ্রন্থকে বেদ বলে গ্রহণ করতে হয়, তবে তাদের অনাদিত্ব অপৌরুষত্ব ও নিত্যত্ব কি প্রকারে স্বপ্রমাণ হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর বড়ই কঠিন। এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য দর্শনকারদের মস্তক বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছে। এই সংশয়ের নিরসন উদ্দেশেই অনন্ত শাস্ত্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বিষয়টি হৃদয়ে ধারণা করবার উপযোগী; যা ভাষায় বুঝানোর সামর্থ্য অতি অল্প লোকেরই আছে। তথাপি আমরা এখানে স্থুলভাবে প্রসঙ্গের আলোচনা করছি। এই যে মন্ত্র প্রভৃতি- ঋক্ সাম যজুঃ অথর্ব বেদের মধ্যে বিন্যস্ত রয়েছে, আমরা মনে করি, হিন্দু মাত্রই মনে করেন, এই মন্ত্রগুলি-নিত্য সনাতন স্বপ্রমাণ ও অপৌরুষেয়; আর, ঐ মন্ত্রগুলি যে উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত, তার দ্বারা সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। ভাবে, যে অবস্থায়, যে স্বরে, যে অধিকারীর যে মন্ত্র উচ্চারণ করা প্রয়োজন, সকলে তা পারে না বলেই সে মন্ত্রের ফল প্রত্যক্ষ হয় না। অনুষ্টুভ প্রভৃতি যে ছন্দ আছে, উদাত্ত সমুহে যে স্বর আছে, মন্ত্রচিত সংযম প্রভৃতির যে যজ্ঞবিধি আছে, তার অনুবর্ত্তন না করে, সে সমস্তে সিদ্ধিলাভে সমর্থ না হয়ে, বিকৃত মন্ত্রে, বিকৃত ব্যবহারে, সুফল-লাভের আশা দুরাশা মাত্র। একটা স্থুল দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করা যাক। মনে করুন- কারও নাম জগদীশ; যদি কেউ জগদীশকে জ্যোতিষ বলে ডাকে-জগদীশ কি তার উত্তর দিবেন? কে কাকে ডাকছে মনে করে তিনি নিশ্চয়ই তাকে উপেক্ষা করবেন। কিন্তু যদি কেহ জগদীশকে তাঁর প্রকৃত নাম ধরে ডাকতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই জগদীশ সে ডাকে শুনে ইসারা দিবেন। অধিকারী অনধিকারীর প্রসঙ্গও এই সূত্রে উঠতে পারে। মনে করুন, জগদীশ-সম্ভ্রান্ত লোক; পথে কতকগুলি নীচ-লোক তাঁর নাম উল্লেখ করে যদি আহ্বান করে, তিনি তাতে কখনই কর্ণপাত করবেন না, তারা তাকে আহ্বান করছে বলে মনে করতে পারবেন না। তাঁর সাথে সম্বন্ধ-বিশিষ্ট ব্যক্তিই তাঁকে আহ্বান করতে পারে। এই সাধারণ জ্ঞান থেকেই বুঝতে পারি, বেদমন্ত্র প্রভৃতি যাঁর উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত, তাঁর সাথে সম্বন্ধ বিশিষ্ট হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছে যে জন, সে’জনই তাঁকে ডাকার অধিকারী,- সে জনের আহ্বানেই, তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে। এভাবে বিচার করলে, মন্ত্র সমূহের নিত্যত্ব এবং প্রামাণ্য বিষয়ে সকল সংশয় দূরীভূত হয়। স্বরূপতত্ত্ব উপলব্ধি হয় না বলেই, বেদ-বিষয়ে নানা সংশয়-প্রশ্ন জাগরিত হয়, বেদের উৎপত্তি ও রচনা সম্বন্ধে নানা মত দেখা যায়। অপিচ, যে বস্তু যত দূর-অতীতের সাথে সম্বন্ধ-যুক্ত, যে দূর-অতীতে স্মৃতি পৌঁছাতে পারে না, তার বিষয়ে কল্পিত কথা নানা আকারে প্রকাশ পেয়ে থাকে। আবার, যাঁর দৃষ্টি যতদূর সীমাবদ্ধ, পুরাতন সনাতন সামগ্রীর উৎপত্তি-বিষয়ে তিনি সেরকম সময় নির্দেশ করতে প্রয়াস পান।
বেদের বয়স ও রচয়িতা-প্রসঙ্গে-
পাশ্চাত্য মতের অবলম্বনে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা ক্রমে বেদের বয়স তাই চার হাজার বৎসরের অধিক প্রতিপন্ন হয় না। খৃষ্টজন্মের দুই সহস্র বৎসরের অধিক পূর্বে যে বেদের জন্ম হতে পারে; পাশ্চাত্য-শিক্ষিত অধিকাংশ পণ্ডিত তা অনুমান করতেই সঙ্কুচিত হন। তাদের সে দৃষ্টির ফলে, বেদের উৎপত্তিকাল গণনাঙ্কের গণ্ডীতে নির্দ্দিষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই কালনির্ণয়ে এতই মতভেদ দেখতে পাই যে, তার কোনও মতের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারা যায় না। কেউ বলেন, ২০০০ খৃষ্টাব্দ পূর্ব, কেউ বলেন ৫০০০ খৃষ্টাব্দ পূর্ব, কেউ বলছেন- স্মরণ অতীত কাল পূর্বে বেদের উৎপত্তি হয়েছিল। এরকম নানা শ্রেণীর লোকের নানা মত দেখতে পাওয়া যায়। বেদের বয়স সম্বন্ধে যেমন বিতণ্ডা, এর রচয়িতা-সম্বন্ধেও সেরকম বিতণ্ডা দেখতে পাই। অধুনা-প্রচলিত ঋগ্বেদ প্রভৃতি যে সকল শাস্ত্র দেখতে পাই, তার সুক্ত-বিশেষের রচয়িতা বলে এক এক ঋষির নাম প্রকাশিত হয়েছে। পুরাতন পুঁথি পত্রে সূক্তের সঙ্গে সঙ্গে, মন্ত্রের বিনিয়োগকর্ত্তা এক এক ঋষির নাম সন্নিবিষ্ট আছে; তা দেখে তাঁরাই সেই সেই সূক্ত রচনা করেছেন বলে প্রচার করা হয়ে থাকে। বেদের উৎপত্তি-সম্বন্ধে, বেদের রচনা-সম্বন্ধে, এরকম নানা জনের নানা মত দেখতে পাই। যেখানে এত মতবিরোধ, সেখানে কোন্ মতে কে আস্থা স্থাপন করতে পারেন? বেদ সৃষ্টির আদিতে প্রকট হয়েছে প্রায় ২ আরব বছর পূর্বে।
বিবাদ নিরসনে শাস্ত্র ও যুক্তি-
এ ক্ষেত্রে, ‘বেদ’ যে কি- তা কিভাবে সিদ্ধান্ত হতে পারে? যেখানে মানুষের গবেষণা প্রতিহত হয়, সেখানে ঋষি-বাক্যের শাস্ত্র-বাক্যের সার্থকতা মানতে হয়। যা পুরাতন, যা সনাতন, অধুনাতন তার কি সাক্ষ্য দিবে? মহর্ষি পরাশর বলেছেন- “ন কিশ্চিৎ বেদকর্ত্তা চ বেদস্মর্ত্তাশ্চতুর্ম্মত্থঃ।”(পরাশর-সংহিতা)। অর্থাৎ, বেদের রচনাকর্ত্তা কেউ নেই; চতুর্ম্মুখ যে ব্রহ্মা, তিনিও বেদের রচয়িতা নহেন,-স্মরণকর্ত্তা মাত্র। তবেই বুঝা যায়, ব্রহ্মা যিনি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা বলে বিঘোষিত হন, তাঁরও পূর্ব্বে-সৃষ্টিরও পূর্বে, বেদমন্ত্র তাঁর স্মৃতিমূলে বিদ্যমান ছিল। মহর্ষি মনু (মনুসংহিতা, প্রথম অধ্যায়, ২১তম শ্লোকে) বলেছেন-
সর্ব্বেষান্তু স নামানি কর্ম্মাণি চ পৃথক্ পৃথক্।
বেদশব্দেভা এবাদৌ পৃথক্ সংস্থাশ্চ নির্ম্মমে ॥
অর্থাৎ- সৃষ্টির আদিতে সেই পরমাত্মা, বেদের উপদেশ অনুসারে, পৃথক্ পৃথক্ নাম, পৃথক্ পৃথক্ কর্ত্তা, পৃথক্ পৃথক্ বৃত্তি-বিভাগ নির্দেশ করে দিলেন। এতেও বুঝা যায়, এই পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বেও বেদ ছিল; আর সেই বেদ-অনুসারে সৃষ্ট-পদার্থের নাম কর্ম ও বৃত্তি প্রভৃতি নির্দ্দিষ্ট হয়েছিল। যে বেদকে অধুনাতন পাশ্চাত্য পণ্ডিত গণ পৃথিবীর আদি-গ্রন্থ বলে নির্দেশ করেন, সেই ঋগ্বেদও(পুরুষ-সূক্তে) উক্ত আছে,-
তস্মাৎ যজ্ঞাৎ সর্ব্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাৎ যজুস্তস্মাদজায়তে ॥
অর্থাৎ, ‘সৃষ্টির আদিভূত যে পুরুষ, তাঁর হতে ঋক্ ও সাম উৎপন্ন হয়েছিল, তা হতেই ছন্দসকল ও যজুঃ জন্মেছিল।’ এ উক্তি অপেক্ষা প্রাচীনত্বের প্রমাণ অধিক আর কি হতে পারে? সৃষ্টির আদিতে ‘বেদ’ ছিল, এ সংবাদ সকল শাস্ত্রই ঘোষণা করেছেন। আবার সৃষ্টি যখন অনাদি বলে প্রতিপন্ন হয়, তখন বেদও অনাদি বলে প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং বেদের জন্মকাল কে নির্ণয় করবে? তারপর, বেদের যে কেউ রচয়িতা আছে, অর্থাৎ সূক্ত-বিশেষ যে ঋষি-বিশেষের রচনা, তাও সপ্রমাণ হয় না। যে যে মন্ত্র যে যে ঋষির নামে প্রচারিত, তাঁরা সেই সেই মন্ত্রের প্রয়োগকর্ত্তা বলা যেতে পারে; কিন্তু তাঁদেরকে রচয়িতা বলতে পারা যায় না। অধুনা দেখতে পাই, অনেক সংসারে পুরুষ-পরম্পরা-ক্রমে অনেক মন্ত্র প্রচলন আছে। পিতা বা পিতামহ, পুত্র বা পৌত্রকে সে সেই মন্ত্র শিক্ষা দিয়ে গেছেন; অথবা পুত্রের বা পৌত্রের শিক্ষার জন্য তার সমুদায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাই বলে তাঁরা সে মন্ত্রের রচয়িতা নন। পিতা বা পিতামহ তাঁদের পূর্ব্বপুরুষ হতে সেসকল মন্ত্র প্রাপ্ত বলে বুঝতে পারা যায়। এভাবে অনেক মন্ত্রের আদি-অনুসন্ধানের অতীত হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্ত স্থানে, ব্রাহ্মণের গায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ করতে পারি। পুত্র পিতার নিকট হতে, পিতা-প্রপিতামহ ক্রমে, ঐ মন্ত্রের অধিকারী হয়ে আসছেন। সন্ধান করতে গেলে, ঐ মন্ত্র প্রথম কার নিকট হতে কোন জন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, কখনই তা নির্দ্দেশ করা যায় না। এভাবে বুঝতে পারি, যে বংশে যে মন্ত্র চলে আসছে, সেই বংশের পূর্বপুরুষ যাঁর অস্তিত্ব যখন সন্ধান করে পাওয়া যায়, তাঁকেই তখন স্থূল-দৃষ্টি-সম্পন্ন মানুষ সেই মন্ত্রের রচয়িতা বলে ঘোষণা করেছে; পরন্তু, তিনি রচয়িতা নন, প্রয়োগকর্ত্তা মাত্র। এরূপ আমরা বলতে পারি, সৃষ্টির আদি-কাল থেকে প্রচলিত ভগবানের উপাসনা বা স্তোত্র-বাক্যে যাঁদের রচনা বলে পরিচিত হয়, তার সমুদায় তাঁদের রচনা নয়,তাঁদের প্রবত্তনা মাত্র। এরূপে বুঝা যায়, বেদ-যা প্রকৃত বেদ, তা মানুষের রচিত নয়, তা কালের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। কাঠের মধ্যে যেমন সূক্ষ্মভাবে অগ্নি অবস্থিত আছে এবং বাইরের দৃষ্টিতে যেমন সেই অগ্নি প্রত্যক্ষ হয় না, পরন্তু পরস্পর সংঘর্ষে সেই অগ্নির অস্তিত্ব যেমন প্রকাশ পায়; গায়ত্রি প্রভৃতি মন্ত্রও সেরূপ স্বতঃশক্তি সম্পন্ন;- যথাযথ বিনিয়োগ-ক্রমে এর বিকাশ হয় মাত্র। ভাষা পরিবর্ত্তিত হতে পারে; শব্দের রূপান্তর হতে পারে; ধ্বনি বিপর্য্যস্ত হয়ে আসতে পারে; আর সেহেতু শক্তি বিকাশ পেতে পারে না, সুতরাং ভ্রান্তি এসে উপস্থিত হতে পারে; কিন্তু যা বেদ, যা জ্ঞান তাই অনাদি অব্যয় অবিকৃত।
বেদের স্বরূপ ও বিভাগ
সর্বভূত আত্মা ব্রহ্মের সম্বন্ধে একটি শ্রুতি দিয়ে উদ্ধৃত করা যায়, সেই শ্রুতির মর্ম অনুধাবন করে দেখলে, বেদ-বিষয়ে একটি বিশেষ আভাষ পাওয়া যেতে পারে। শাস্ত্রগ্রন্থ প্রভৃতির সাথে বেদের যে কি সম্বন্ধ, তার দ্বারা বিশেষভাবে উপলব্ধ হতে পারে। ব্রহ্ম-স্বরূপ সম্বন্ধে সেই শ্রুতি বলছেন ;যথা-
অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্ব্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ॥
বায়ুর্যথৈকো ভূবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্ব্বভূতান্তরাত্মা রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ॥
( কঠ উপনিষদ, ২/২/৯)
অর্থাৎ, যেমন এক অগ্নি জগতে প্রবিষ্ট হয়ে নানারূপে প্রকাশিত হয়েছে, তদ্রূপ সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মা এক ব্রহ্ম নানারূপে প্রকাশিত হচ্ছেন, আবার তিনি জগতের বাইরেও আছেন।
উপমার ভাষায় আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থ সমূহের সাথে সম্বন্ধ-বিষয়ে বেদ এভাবেই সম্বন্ধ সম্পন্ন। একই অগ্নি যেমন প্রতি পদার্থে প্রবিষ্ট হয়ে সেই সেই পদার্থের প্রতিরূপ প্রাপ্ত হন; অনন্ত শাস্ত্র-সমুদ্রের মধ্যে বেদ সেভাবে ওতঃপ্রোতঃ ভাবে বিরাজমান রয়েছে। অন্য কথায়, বেদ-রূপ আকর হতেই শাস্ত্ররত্ন-সমূহ সমুদ্ভূত হয়েছে। বেদ-এক ও অদ্বিতীয়। কালক্রমে শাস্ত্র আকারে বেদ প্রথমে ত্রিধা বিভক্ত হয়; সে কারণে বেদের এক নাম ‘ত্রয়ী’। পরিশেষে শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে অভিহিত হন। যুগ-ধর্মের সুবিধার জন্য তিনি চারভাগে বেদ বিভক্ত করেছিলেন, ইহাই সাধারণতঃ প্রকাশ। যখন বেদের নাম ছিল ‘ত্রয়ী’; তখন ঋক্, সাম, যজু এই তিন বিভাগে উহা বিভক্ত হোত। ঋক্ ভাগে পদ্য, সাম ভাগে গীত, এবং যজুঃ ভাগে গদ্য বিন্যস্ত ছিল। যজ্ঞকর্মে সুবিধার জন্য বেদ চারভাগে বিভক্ত হয়। তখন যজ্ঞবিধিতে প্রয়োজনীয় অংশ ভিন্ন অন্য অংশ অথর্ব্ববেদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যজ্ঞে অপ্রয়োজন, সুতরাং অথর্ব্ব,- এই হেতুই উহার অথর্ব্ব নাম হয়েছিল। কেউ আবার বলেন- অথর্ব্ব ঋষি যজ্ঞে সুবিধার জন্য যজ্ঞে অব্যবহার্য্য সূক্তগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে রক্ষা করেছিলেন বলে, ঋষির নাম অনুসারে ঐ অংশের নাম অথর্ব্ব-বেদ হয়েছিল। ফলতঃ একই বেদ যে চারভাগে বিভক্ত হয়, এবং ক্রমশঃ এর শাখা-প্রশাখা-রূপ শাস্ত্র-সমূহের অভ্যুদয় ঘটে, সেবিষয়ে মতবিরোধ নেই। এক হতে বহু, কাণ্ড হতে শাখা-প্রশাখা। একই অগ্নি যেমন আধার-ভেদে ভিন্ন রূপে ভিন্ন নামে অবহিত হন; একই বেদ সেই প্রকার বিভিন্ন আকারে ও বিভিন্ন নামে সংসারে বিস্তৃত হয়ে আছেন। শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন করলে সেই রত্নই উত্থিত হয়-যার নাম ‘বেদ’। সকল শাস্ত্রের, সকল জ্ঞানের, সকল ধর্মের যা সারভূত; তাকেই ‘বেদ’ বলে। সকল সমাজের, সকল লোকের, সকল জীবের যা প্রাণ স্বরূপ; তাকেই ‘বেদ’ বলা হয়।
বেদ বিষয়ে দর্শন-শাস্ত্র
[বেদ বিষয়ক বিতর্ক দর্শন শাস্ত্রে; -শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে নৈয়ায়িকদের আপত্তি;- মীমাংসক কর্তৃক সেই আপত্তির খণ্ডন;- মীমাংসাদর্শনে বেদের নিত্যত্ব বিষয়ে যুক্তি; -বেদের প্রামাণ্য-বিষয়ে গৌতমের পূর্বপক্ষ রূপে বিতর্ক ও উত্তরপক্ষ রূপে উত্তর; -বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষ রূপে অপরাপর বিতর্ক এবং উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর; বেদের অপৌরুষত্ব সম্বন্ধে বিতর্ক ও মীমাংসা;- বেদ বিষয়ে সাংখ্য, বৈশেষিক ও বেদান্ত আদির মত।]
বেদ বিষয়ক বিতর্ক
সকল শাস্ত্রেই বেদ বিষয়ে আলোচনা দেখা যায়। বেদ যে নিত্য, বেদ যে অপৌরুষেয়, বেদ যে অনাদি, এ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্কের অবধি নেই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ-সর্বত্রই বেদ-বিষয়ক আলোচনা আছে। সে সম্বন্ধে দর্শন-শাস্ত্রের বিচার ও মীমাংসা, জ্ঞানার্থি মাত্রই কৌতুহল উদ্দীপক। সুতরাং অন্যান্য শাস্ত্রে বেদের বিষয় কিভাবে আলোচিত হয়েছে, তা উল্লেখের পূর্বে, বেদ বিষয়ে দর্শন শাস্ত্রের গবেষণার আভাষ তুলে ধরা গেল। বিচারে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে বেদ প্রতিবাদ দ্বারা মীমাংসা হয়ে থাকে। এক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বেদের অপৌরুষেয়ত্ব বা নিত্যত্ব স্বীকার করেন না; এবং সেই পক্ষেই যুক্তিজাল বিস্তার করে থাকেন। অপর সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা প্রথমোক্ত সপ্রদায়ের যুক্তি-পরম্পরাকে পূর্বপক্ষরূপে পরিগ্রহণ করে, উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর দিয়ে গেছেন। এ সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ও মীমাংসকদের বিচার-প্রণালী বিশেষভাবে প্রণিধানের বিষয়।
১। বেদ নিত্য কি না-তার বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।
শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে আপত্তি।
নৈয়ায়িকরা বলেন, ‘শব্দ কখনও নিত্য হতে পারে না। বেদ যখন শব্দসমষ্টি, তখন এর নিত্যত্বে বিঘ্ন ঘটছে। এই সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ছয়টি প্রসিদ্ধ সূত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম,-“কর্ম্ম একে তত্র দর্শনাৎ।” অর্থাৎ, যত্নদ্বারা শব্দ উচ্চারিত হয়। যা চেষ্টা সাপেক্ষ, তাই কর্ম। কর্ম ধ্বংসশীল, সুতরাং শব্দও অনিত্য। দ্বিতীয়, “অস্থানাৎ” অর্থাৎ, উৎপত্তি মাত্র শব্দ নষ্ট হয়; শব্দ অস্থায়ী; সুতরাং শব্দে নিত্যত্ব সম্ভব নয়। তৃতীয়,- “করোতি শব্দাৎ” অর্থাৎ, শব্দ করে থাকে অর্থাৎ লোকে শব্দের সৃষ্টিকর্তা। যা করা হয়(লোকে তৈরি করে), তা কখনই নিত্য হতে পারে না। চতুর্থ,- “সত্ত্বান্তরে যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, শব্দ একই সময় নিকটস্থ এবং দূরস্থ বহু ব্যক্তি শুনতে পায়। সুতরাং শব্দ এক ও নিত্য হতে পারে না। পঞ্চম,- “প্রকৃতিবিকৃত্যোশ্চ” অর্থাৎ, প্রকৃতি প্রত্যয় হেতু শব্দ রূপান্তরিত হয়ে থাকে; যার রূপান্তর বা বিকৃতি ঘটে, তাকে কখনই নিত্য বলা যেতে পারে না। ষষ্ঠ,- “বৃদ্ধিশ্চ কর্ত্তৃভূম্নাস্য” অর্থাৎ, একই শব্দ একাধিক ব্যক্তি উচ্চারণ করলে, একাধিক বার সেই শব্দ উচ্চারিত হতে পারে। শব্দকর্ত্তার সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হেতু শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যা হ্রাসবৃদ্ধিশীল, তা নিত্য হতে পারে না। এরূপে নৈয়ায়িকেরা বেদের নিত্যত্ব-বিষয়ে প্রতিবাদ উত্থাপন করে থাকেন।
পূর্বোক্ত আপত্তির খণ্ডন-
মীমাংসকগণ ঐরূপ আপত্তির খণ্ডন করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে ঐ সকল আপত্তি উত্থাপন করে, মীমাংসা দর্শনের নিন্মলিখিত সূত্র পঞ্চকে তাদের নিরসন করা হয়েছে।
প্রথমে,- “স্বতঃ পরমদর্শনং বিষয়ানাগমাৎ” অর্থাৎ, শব্দ উচ্চারিত হলেও শব্দকারীর সাথে এর সম্বন্ধ থাকে না। পরন্তু যে শব্দে যে জ্ঞান, তা সমভাবেই বিদ্যমান থাকে। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়, নিত্য। ‘রাম’ এই শব্দ শ্রুতিগোচর হলে, ঐ শব্দের একটি জ্ঞান থেকে যায়; পূর্বে ঐ শব্দ যেমন শুনেছি, তার সাথে এর অভিন্নতা সূচিত হয়। সুতরাং, শব্দের নিত্য ও একত্ব অনুভবসিদ্ধ। দ্বিতীয়,-“প্রয়োগস্য পরমং” অর্থাৎ ‘শব্দ করে’ এর তাৎপর্য্য- শব্দের নির্মাণ নয়, শব্দের উচ্চারণ মাত্র। তৃতীয়,-“আদিত্যবৎ যৌগপদ্যং” অর্থাৎ সূর্য্য যেমন নিকটস্থ ও দূরস্থ সকল ব্যক্তির পরিদৃশ্যমান, অথচ তিনি যেমন এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহেন, শব্দও সেরূপ বহু ব্যক্তির কর্ণে ধ্বনিত হলেও এক ভিন্ন দ্বিতীয় হয় না। চতুর্থ,- “বর্ণান্তরমবিকারঃ” অর্থাৎ প্রকৃতি প্রত্যয় সহযোগে বর্ণের পরিবর্ত্তনে বর্ণের বিকার হয় না; বর্ণান্তরে বর্ণের অবস্থিতি ঘটে মাত্র। যেমন, ‘ই’ কার স্থানে ‘য’ কার হলে, বর্ণান্তর আদেশ হয় বটে; কিন্তু ‘ই’ কারের কোনও অসদ্ভাব ঘটে না। পঞ্চম,- “নাদবৃদ্ধিঃ পরা” অর্থাৎ, একই শব্দ বহুবার উচ্চারিত হলে ধ্বনি মাত্র বৃদ্ধি হয়; শব্দ বা শব্দ কথিত বস্তুর বৃদ্ধি ঘটে না। পুনঃ পুনঃ গো-শব্দ উচ্চারিত হলে, নাদ বা কোলাহল বৃদ্ধি হয় বটে; কিন্তু বস্তুপক্ষে কোনরূপ সংখ্যাধিক্য হয় না। সুতরাং শব্দের নিত্যত্ব অবিসম্বাদিত।
পূর্বোক্ত বিষয়ে অন্যান্য যুক্তি-
মীমাংসা দর্শন শব্দের নিত্যত্ব প্রমাণের জন্য আরও কতগুলি যুক্তি নির্দেশ করেছেন। তারই পাঁচটি যুক্তি এখানে তুলে ধরা হল।
প্রথম- “নিত্যস্তু স্যাৎ দর্শনস্য পরার্থত্বাৎ” অর্থাৎ, যখন উচ্চারণ মাত্র শব্দের অর্থ পরিগ্রহ হয়, শব্দ বিনষ্ট হয় না, তখন শব্দকে নিত্য বলাই সঙ্গত। শব্দ যদি নিত্য না হোত, শব্দের যদি অর্থবোধ কেউ না করতে পারত, তাহলে শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই ধ্বংসপ্রাপ্ত সুতরাং অনিত্য বলে অভিহিত হতে পারত। শব্দের স্থিতি মানলেই নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। দ্বিতীয়- “সর্বত্র যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি শব্দের একরকম অর্থ পরিগ্রহ করতে পারেন; সমভাবে অভ্রান্তরূপে ভিন্ন ভিন্ন জনের অর্থবোধ ঘটে; এই জন্যই শব্দ নিত্য ও এক। তৃতীয়,- “সংখ্যাভাবাৎ” অর্থাৎ, শব্দের ক্ষয় বৃদ্ধি নেই। বার বার উচ্চারণ হলেও শব্দ একই থাকে। চতুর্থ- “অনপেক্ষত্বাৎ” অর্থাৎ, শব্দ বিনষ্ট হওয়ার কোনও হেতুবাদ দেখা যায় না। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়-নিত্য। পঞ্চম- “লিঙ্গদর্শনাচ্চ” বেদ আদি শাস্ত্রে শব্দকে নিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে, শব্দের নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। শ্রুতি যাকে নিত্য বলে ঘোষণা করেছেন, শাস্ত্র যার নিত্যত্ব অঙ্গীকার করেন, তাই নিত্য। সুতরাং শব্দ মূলাধার ‘বেদ’ নিত্য বলে সপ্রমাণ হয়। শব্দের নিত্যত্ব সম্বন্ধে আরও বিবিধ বিতর্ক উত্থিত হয়। বেদে “ববরঃ প্রাবাহণিরকাময়ত” ইত্যাদি মন্ত্র আছে। কেউ কেউ এর অর্থ এভাবে নিষ্পন্ন করেন যে, ববর নামক কোনও মনুষ্য প্রাবাহণি বায়ুকে কামনা করেছিল। এমন অর্থের ফলে, সেই অনিত্য ববরের পরবর্ত্তী কালে বেদমন্ত্র রচিত হয়েছিল, প্রতিবাদকারী এরূপ প্রতিপন্ন করেন। তাহলে, বেদের নিত্যত্ব স্বতঃই অপ্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু মীমাংসকগণ এ সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। অনিত্য দর্শনরূপ উক্ত আশঙ্কার উত্তরে তাঁরা সূত্র করে গেছেন, “পরন্তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম”; অর্থাৎ, ববর আদি শব্দ দ্বারা কোনও মনুষ্যকে বুঝায় না, পরন্তু উহা ধ্বনিমাত্র; অর্থাৎ, ববর ধ্বনি বিশিষ্ট প্রবহমাণ বায়ুকে ঐস্থানে লক্ষ্য করা হয়েছে। বায়ুপ্রবাহের অনিত্যত্ব কে প্রচার করবে? সুতরাং এসকল সংশয়-প্রশ্নেও বিঘ্ন ঘটতে পারে না। বেদের নিত্য অনিত্য প্রশ্ন মীমাংসা প্রসঙ্গে আর একটি গুরুতর তর্ক উঠে থাকে। বেদে ইন্দ্র মরুৎ আদিত্য রুদ্র প্রভৃতির নাম দেখা যায়। কারও উৎপত্তি না হলে তার নাম হবে কি প্রকারে? মনে করুন, দেবদত্তের পুত্রের নাম যজ্ঞদত্ত; পুত্রের উৎপত্তি হয়েছিল বলেই তার নামকরণ হয়। সুতরাং ইন্দ্র আদি দেবগণের উৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তি স্বীকার করলে, অনিত্যত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই সকল অনিত্য দেবাদির নাম যখন বেদে দেখা যায়, তখন বেদ কেন না অনিত্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকেরা বলেন, নিত্য ও অনিত্য দুই ভাবেই দেবগণের অধিষ্ঠান সপ্রমাণ হয়। তাঁরা যখন দেহধারণ করেন, তখন তাঁদের কে অনিত্য বলতে পারি। যা আকৃতি অবয়ব বিশিষ্ট, তা অবশ্যই বিনাশশীল। কিন্তু যখন ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক স্মৃতি বা জ্ঞানে প্রকাশ পায়, তখন তার নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। পদার্থ ও পদার্থ বিষয়ক জ্ঞানে স্বাতন্ত্র্য আছে। পদার্থ ধ্বংসশীল; কিন্তু তদ্বিষয়ক জ্ঞান অবিনাশী-নিত্য। ‘রাম’ বলে সম্বোধন করলাম; এটা ব্যক্তিবিশেষকে বুঝাল; রাম নামধারী কোনও ব্যক্তি সামনে আসলেন। সে ব্যক্তি নশ্বর, সে ব্যক্তি ধ্বংসশীল। কিন্তু সেই ‘রাম’ ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ও পরে, তাঁর বিষয়ে একটি জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। সে জ্ঞান তিনি যেমন রূপবান গুণবান বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর কেমন আকৃতি প্রকৃতি ছিল ইত্যাদি। ব্যক্তি ‘রাম’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাঁর সম্বন্ধে সেই সে জ্ঞান, তা ধ্বংস হয় না। এই হিসাবে রাম ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও রাম নাম অবিনাশী নিত্য। বেদে যে ইন্দ্র আদি দেবতার নাম উল্লেখ দেখতে পাই, তা ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক জ্ঞান। সুতরাং তা নিত্য হবে না কেন? অতএব বেদের নিত্যত্ব অবিসংবাদিত।
২। বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।
বেদ বাক্যের প্রামাণ্য বিষয়ে দর্শন রচনাকারদের মস্তিষ্ক নানাভাবে আলোড়িত হয়েছে। মহর্ষি গৌতম ন্যায়-দর্শনে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে সে সন্দেহের নিরসন করে গেছেন। গৌতম সূত্রে পূর্বপক্ষ রূপে বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে সন্দেহ উপস্থাপন করা হয়েছে,- “তদপ্রামাণ্যমনৃতব্যাঘাত পুনরুক্তদোষেভ্যঃ।” অর্থাৎ, বেদ যে অপ্রমাণ, তার কারণ, উহাতে অসত্য অর্থাৎ মিথ্যাবাদ, ব্যাঘাত এবং পুনরুক্তি দোষ আছে। বেদবাক্য যে অসত্য, তার নিদর্শন-স্বরূপ টীকাকারেরা বলেন যে, বেদে লেখা আছে, পুত্রেষ্টি যাগ করলে পুত্রসন্তান লাভ হবে; কিন্তু কার্য্যতঃ সর্বত্র তার সাফল্য দেখা যায় না; সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বেদ বাক্য যে ব্যাঘ্যাতমূলক, তার দৃষ্টান্তস্থানে উল্লেখ করা হয় যে, বেদের কোথাও বলা আছে- উদয় কালে হোম করবে, কোথাও বলা হয়েছে,- অনুদয় কালে হোম করবে; এবং তাতে এক কালের প্রসঙ্গে অন্যকালের নিন্দাও দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ব্যাঘাত দোষ ঘটছে। এমন আরও দেখা যায়, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে ও শ্রুতিবাক্যের ঐক্য নেই। শ্রুতিতেও কোথাও আছে,- “একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম”, আবার কোথাও আছে, “দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে পরঞ্চাপমেব চ।” অর্থাৎ, একটিতে অদ্বৈতবাদ, অপরটিতে দ্বৈতবাদ বিঘোষিত হয়েছে। পুনরুক্তির তো কথাই নেই। একই কথা বেদে পুনঃ পুনঃ উক্ত হয়েছে। এভাবে পূর্ব্বপক্ষ ঘোষণা করে, মহর্ষি গৌতম নিজেই তা খণ্ডন করেছেন। বেদবাক্য যে মিথ্যা নয়, তারসম্বন্ধে তিনি বলছেন,- “ন কর্ম্মকর্ত্তৃসাধনবৈগুণ্যাৎ।” তাঁর মতে, তিনটি কারণে বৈদিক কর্মে ফল লাভ হয় না। প্রথমতঃ কর্মকর্তা অনধিকারী; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রের উচ্চারণে দোষ; তৃতীয়তঃ, বিধিবিহিত কর্ম অনুষ্ঠান। এই তিনটিই অভীষ্ট ফলে অন্তরায়-সাধক। উপযুক্ত কর্ম না করলে ফলের আশা কিভাবে করা যেতে পারে? সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা নয়; কর্মকারীর কর্মদোষেই কর্ম অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে থাকে। কালাকাল ঘটিত ব্যাঘাত দোষ বিষয়ে গৌতমের উত্তর,- উদয় ও অনুদয় উভয় কালই হোম আদির পক্ষে প্রশস্ত বটে; কিন্তু এককালে সঙ্কল্প করে, অন্যকালে কর্তব্য করলে অভীষ্ট লাভে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মন্ত্রের এটাই উদ্দেশ্য। ব্রহ্ম সম্পর্কেও ‘তিনি এক’ ‘তিনি দুই’ এই যে অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ দেখা যায়, তারও কারণ, -জীবের জ্ঞান বৈগুণ্য। জীবের যখন অজ্ঞান অবস্থা, জীব যখন আত্মা-পরমাত্মার অভেদভাব বুঝতে পারে না; তখন আপনাকে ও ব্রহ্মকে দুই বলে মনে করে। যখন তার তত্ত্ব-জ্ঞান উপস্থিত হয়, সে তখন সর্ব্বত্রই ব্রহ্ম ভাব উপলব্ধি করে। জীবের সেই অবস্থাদ্বয় বুঝানোর জন্যই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রসঙ্গ।
বেদের প্রামাণিক বিষয়ে এতে ব্যাঘাত ঘটার কি আছে? পুনরুক্তি সম্বন্ধে গৌতম বলেছেন- প্রয়োজন বুঝানোর জন্য যে বাক্য বার বার উচ্চারিত হয়, তা কদাচ পুনরুক্তি দোষ মধ্যে গণ্য হতে পারে না। পাছে ভ্রান্তি বশে জীব কর্তব্য ভ্রষ্ট হয়, তাই তাকে উদ্বোধিত করার জন্য বেদে কোনও কোনও বিষয় একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। উহা জীবের মঙ্গলার্থ-প্রযুক্ত, সুতরাং উহা পুনরুক্তি-দোষ-দুষ্ট নয়। যা আবশ্যক বা যা একান্ত করণীয়, সে সম্বন্ধে একাধিক বার উপদেশ দেওয়া হলে, সে উপদেশ হৃদয়ে বদ্ধমূল হতে পারে এবং তার দ্বারা সফলতা আনয়ন করে। সেই উদ্দেশ্যেই এক এক উপদেশ বার বার প্রদত্ত হয়েছে। তাকে দোষ বলা যায় না।
বেদের প্রামাণ্য ও নিত্যত্ব বিষয়ে-
অসত্য, ব্যাঘাত, পুনরুক্তি-ত্রিবিধ দোষ খণ্ডন করে গৌতম নিজমত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন- “মন্ত্রায়ুর্ব্বেদবৎ চ তৎপ্রামাণ্যং আপ্তপ্রাম্যাণ্যাৎ।” অর্থাৎ, প্রণেতার উপদেশ যথার্থ বলেই আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্র প্রমাণ মধ্যে গণ্য হয়। তেমনি বেদকর্তা যথার্থবাদী বলে বেদের বাক্য প্রামাণ্য বলতে হয়। এ বিষয়ে বৃত্তিকারের উক্তি পাঠ করলে, বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে।
“আপ্তস্য বেদকর্ত্তুঃ প্রামাণ্যাৎ যথার্থোপদেশকত্বাৎ বেদস্য তদুক্তত্বমর্থাৎলব্ধং। তেন হেতুনা বেদস্য প্রামাণ্যমনুমেয়ং। তত্র দৃষ্টান্তমাহ। মন্ত্রো বিষাদিনাশকঃ। আয়ুর্ব্বেদভাগশ্চ বেদস্য এব। তত্র সংবাদেন প্রামাণ্যগ্রহাৎ তদৃষ্টান্তেন বেদত্বাবচ্ছেদেন প্রামাণ্যমনুমেয়ং।”
যথার্থ উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে, সত্যবাণী বিঘোষিত আছে, এজন্য বেদবাক্য প্রমাণরূপে পরিগৃহীত হয়ে থাকে। মন্ত্র-বিষ আদি নাশক; আয়ুর্ব্বেদ-বেদেরই অন্তর্গত। আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্রের ফল প্রত্যক্ষ সম্যক দেখা যায়। সুতরাং আয়ুর্ব্বেদ প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত। বেদও তেমনি প্রমাণ। বেদকে যে নিত্য ও প্রমাণ বলা হয়, তার আরও কারণ এই যে, বেদে অতীত অনাগত মন্বন্তর সম্প্রদায় অভ্যাস ও প্রয়োগ অবিচ্ছিন্ন আছে। বেদের উপদেশ যথার্থ। বহুকাল প্রচারিত হেতু বেদের নিত্যত্ব এবং এতে সত্যবাক্য আছে বলেই তা প্রামাণ্য। এ বিষয়ে বৃত্তিকার বাচস্পতি মিশ্রের উক্তি; যথা,-
“মন্বন্তরযুগান্তরেষু চ অতীতানাগতেষু সম্প্রদায়াভ্যাসপ্রয়োগাবিচ্ছেদো বেদানাং নিত্যত্বং।
আপ্তপ্রামাণ্যাৎ চ প্রামাণ্যং। লৌকিকেষু শব্দেষু চৈতৎ সমানং।”
এভাবে ন্যায়দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্থাপন করে গেছেন। মীমাংসকেরা বেদের নিত্যত্ব ও প্রামাণ্য বিষয়ে আরও একটি যুক্তির অবতারণা করেন। অনেক সময় বিতর্ক উঠে থাকে, -শব্দের সাথে অর্থের একটি কল্পিত সম্বন্ধ আছে। সে সম্বন্ধ সঙ্কেতাত্মক, অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাবমূলক। কল্পিত সেই সম্বন্ধ নিয়েই শব্দ ব্যবহৃত হয়। কল্পিত সেই সম্বন্ধ যে অনেক সময় ভ্রান্তিমূলক হয়, ঝিনুকে রূপার জ্ঞানই তার প্রমাণ। শব্দে যখন সত্যের অপলাপ অসম্ভব নয়, তখন বেদবাক্য-সকল কল্পনা সঙ্কেতাত্মক শব্দ বলে নিরর্থক ও অপ্রামাণ্য হতে পারে। এভাবে পূর্বপক্ষ স্থাপন করে, মীমাংসকগণ খণ্ডনের জন্য একটি সূত্রের অবতারণা করেছেন। এ সম্বন্ধে মীমাংসা দর্শনের একটি সূত্র ও তার ভাষ্য নিচে তুলে ধরা গেল; যথা-
ঔৎপত্তিকস্তু শব্দস্য অর্থেন সহ সম্বন্ধস্তস্য জ্ঞানমুপদেশঃ
অব্যতিরেকশ্চ অর্থে অনুপলব্ধে তৎপ্রমাণং বাদরায়ণস্য।
শব্দের ও অর্থের সম্বন্ধ অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাব স্বাভাবিক ও অনিত্য। তাতে যে অস্বাভাবিকতা বা অনিত্যতা সূচিত হয়, তা বিভ্রম বা অজ্ঞানতানিবদ্ধন। ঝিনুকে রূপার জ্ঞান বিভ্রমেরই পরিচায়ক। ঝিনুক শব্দে ও রূপা শব্দে যে অর্থ উপলব্ধ হয়, সে শব্দের অর্থ অবিকৃতই আছে; ভ্রান্তি তার অর্থ-বৈপরীত্য ঘটেছে মাত্র। এ ভাবে বিচার করলে, শব্দ ও তার অর্থ নিত্য ও স্বাভাবিক বলেই প্রতিপন্ন হয়। বেদবাক্য প্রকৃত ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়। বেদবাক্য- প্রত্যক্ষ আদি প্রমাণ নিরপেক্ষ অজ্ঞাত বিষয়ের অভ্রান্ত উপদেশ প্রদান করে। সুতরাং বেদ নিত্য ও প্রামাণ্য।
প্রামাণ্যে অন্যান্য সংশয়-
বেদের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য বিষয়ে আরও যে সকল বিচার-বিতর্ক উপস্থিত হয়, তারও কতকগুলি উল্লেখ করছি। প্রমাণের দুইটি লক্ষণ সাধারণতঃ বলা হয়। যার দ্বারা সম্যক্ অনুভব সাধন হয়, অর্থাৎ যা ভ্রমশূন্য পূর্ণজ্ঞানের প্রকাশক, তাই প্রমাণ। প্রমাণের এই এক লক্ষণ। আর এক লক্ষণ- যা অনধিগত বা অজ্ঞাত বিষয় জ্ঞাপন করে, তাকেই প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণ-সম্বন্ধে এই দুই লক্ষণ, দুই সম্প্রদায় কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। পূর্বপক্ষ রূপে নৈয়ায়িকগণ বেদে ঐ দুই লক্ষণেরই অভাব ঘোষণা করেন। কতকগুলি বেদমন্ত্র বোধগম্য হয় না। যা বোধগম্যই নয়, তাতে আর কি জ্ঞান উন্মেষ সম্ভপর? মন্ত্রে আছে- (১) “সৃণ্যেব জর্ভরী তুর্ফরী তু”, (২) “অম্যকসাৎ ইন্দ্রঋষ্টিঃ”, (৩) “যাদৃশ্মিন্ধায়ি তমপস্যয়াবিদদ্”, (৪) “আপান্তমন্যুস্তৃপলপ্রভর্ম্মা”, ইত্যাদি। এ সকলের অর্থ পরিগ্রহ হয় না। যার অর্থবোধ হয় না, তার প্রামাণ্য কিভাবে স্বীকার করা যেতে পারে? একটি মন্ত্র আছে, -“অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসীৎ”; অর্থাৎ- উপরে কি নীচে? মন্ত্রে এই ভাব ব্যক্ত থাকলেও, উহা স্থাণূ-সম্বন্ধে কি পুরুষ সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ আসে। সুতরাং ঐ মন্ত্র প্রমাণ-স্বরূপ গ্রহণ করতে পারা যায় না। আবার অনেক স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতনের ন্যায় সম্বোধন করা হয়েছে; যথা- (১) “ওষধে ত্রায়স্বৈনম্”; অর্থাৎ হে ওষধে! একে উদ্ধার কর; (২) “স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ” অর্থাৎ হে ক্ষুর! এর প্রতি হিংসা করবে না; (৩) “শৃণোত গ্রাবাণ” অর্থাৎ হে পাষাণগণ তোমরা শ্রবণ কর; (৪) “আপ উন্দস্তু” অর্থাৎ হে জল! মস্তকের ক্লেদ দূর কর; (৫) “শুভিকে শির আরোহ শোভয়ন্তী মুখং মম” অর্থাৎ হে শুভিকে(টোপর)! আমার মুখের শোভা বর্ধন করতে মস্তকে আরোহণ কর। এই সকল স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতন পদার্থ রূপে সম্বোধন করায়, মন্ত্রসমূহ অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন হয়। কোথাও ‘দুই চন্দ্র’ (দ্বৌ চন্দ্রমসৌ), কোথাও রুদ্র এক-দ্বিতীয় নাই (এক এব রুদ্রো ন দ্বিতীয়োহবতহস্থ) কোথাও হাজার হাজার রুদ্র পৃথিবীতে আধিপত্য করছেন (সহস্রাণি সহস্রশো যে রুদ্রা অধিভূম্যাম); এমন উক্তি আছে। এই সকল পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য প্রমাণ পক্ষে বিশেষ বিঘ্ন উপস্থিত করে। যদি কেউ বলেন,- “আমি যাবজ্জীবন মৌন আছি;” তাঁর সে বাক্য যেমন তাঁর মৌনতার বিঘ্ন-সাধক, ঐ সকল পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবদ্যোতক মন্ত্রসকলও সেরূপ প্রমাণের ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। অতএব, বেদবাক্য প্রামাণ্য নহে।
সকল সংশয় নিরসনে।
পূর্ব্বোক্ত সংশয়-প্রশ্ন-সমূহের উত্তর মীমাংসক-সম্প্রদায়গণ প্রদান করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করে, উত্তরপক্ষরূপে তাঁরা যে তার উত্তরদান করেছেন, তারই আভাষ এখন প্রদান করা যাচ্ছে। যে সকল মন্ত্রের অর্থ হয় না বলেই বেদ বিরোধীগণ নির্দ্দেশ করেন, সেই সকল মন্ত্রের অর্থ যাস্কের “নিরুক্ত” গ্রন্থে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা তা অবগত নন, তাঁরাই ঐ সকল মন্ত্রের উল্লেখ দেখে বেদের প্রামাণ্য পক্ষে দোষ প্রদর্শন করেন। এই উপলক্ষ্যে মীমাংসকদের একটি সূত্র দেখা যায়। সূত্রটি এই; “সতঃ পরমবিজ্ঞানম,।” অর্থাৎ পরম জ্ঞান লাভ হলেই, বিদ্যমান পদার্থের স্বরূপ উপলব্ধ হয়; অজ্ঞ জন অজ্ঞানতা নিবন্ধন সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ‘জর্ভরী তুর্ফরী তু’ শব্দের অর্থ পালনকর্ত্তা সংহারকর্ত্তা। ‘জর্ভরী তুর্ফরী’ অশ্বিদ্বয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। ঐ কারণেই সূক্তটির নাম আশ্বিন সূক্ত। অন্ধব্যক্তিরা যে বিশাল স্তম্ভ পর্য্যন্তও দৃষ্টি করতে সমর্থ নয়, সে দোষ স্তম্ভের নয়, সে দোষ অন্ধেরই। কেউ অর্থ বুঝল না বলে, বেদবাক্য যে অর্থহীন হবে, তার কোনই হেতু নির্দ্ধারণ করতে পারা যায় না। “অধঃস্বিদাসীৎ” ইতি মন্ত্রের অর্থ-পরবর্তী মন্ত্র পাঠ করলে উপলব্ধ হয়। ঐ অংশের স্থূল অর্থ- উপরে বা নীচে। উহা পরম পুরুষকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে। এতে উর্দ্ধে ও অধঃদেশে সর্ব্বত্র তাঁর বিদ্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে। ওষধি, ক্ষুর, পাষাণ প্রভৃতিকে সম্বোধন করে যে সকল্প মন্ত্র উক্ত হয়েছে, তার সমুদায়ে জড় বা অচেতন পদার্থকে লক্ষ্য করা হয় নি; পরন্তু এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণের উদ্দেশেই ঐ সকল মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। ঐ সকল মন্ত্র তন্ময়ত্ব ভাব জ্ঞাপক। বিশ্বেশ্বরের বিশ্বরূপে বিরাজমানতাই এর লক্ষ্য। যদি কেউ আপন স্বর্গীয় পিতৃদেবের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রপট লক্ষ্য করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন, সে প্রণাম কখনই চিত্রপটের উদ্দেশে নয়; সে প্রণাম, তাঁর পূজ্যপাদ পিতার উদ্দেশেই বিহিত হয়। সেরূপ ওষধি, পাষাণ বা ক্ষুর প্রভৃতির সম্বোধনে যে সকল মন্ত্র দেখতে পাই, তাদের অধিষ্ঠানভূত বিশ্বপাতাই সেই সকল মন্ত্রের লক্ষ্য। উত্তর-মীমাংসায় মহর্ষি বাদরায়ণ “অভিমানিব্যপদেশস্তু” এই সূত্রে এই সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। সাধারণ-দৃষ্টিতে দুইটি মন্ত্র পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বলে বোধ হলেও, একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে সে ভাব দূর হতে পারে। শব্দের ও বাক্যের অর্থ দুইরূপ দৃষ্ট হয়। এক অর্থ- লৌকিক; অপর অর্থ-ব্যবহারিক। পিতা ও মাতা এই দুই শব্দের সাধারণ অর্থ সকলেই অবগত আছেন। এই দুই শব্দে পালনকর্ত্তা পিতা এবং স্নেহময়ী জননী অর্থাৎ পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্রভাবে দুই জনকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু আবার এমনও দেখা যায়, ঐ দুই শব্দ একই উদ্দেশ্যে একই ব্যক্তির প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। লোকে সাধারণতঃ আপন উত্তমর্ণকে ও ভূস্বামীকে “আপনি আমার মা-বাপ” বলে সম্বোধন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমরা ‘মা-বাপ’(মাতা-পিতা) শব্দদ্বয়ের লৌকিক অর্থ স্ত্রী ও পুরুষ-রূপে পরিকল্পিত হলেও, ঐরূপ ক্ষেত্রে সম্বধিত ব্যক্তিতে পিতার পালকতা ও মাতার স্নেহ-মমতা একাধারে বিদ্যমান আছে, ইহাই বুঝতে হবে। সেরূপ, “এক রুদ্র দ্বিতীয় নাই’ এবং ‘সহস্র সহস্র রুদ্র আধিপত্য করছেন’ এবম্বিধ বিপরীত ভাবসম্পন্ন মন্ত্রে কখনই বেদ-প্রামাণ্যে বিঘ্ন ঘটতেছে না। কেন না, ঐ অংশের সূক্ষ্ম অর্থ এই যে, সেই যে ব্রহ্ম-যিনি রুদ্ররূপে সম্পূজিত হন, তিনি এক হয়েও বহু এবং বহু হয়েও এক। যোগ প্রভাবে মানুষ বহুরূপ, ধারণ করতে সমর্থ হয়। সেখানে একে যেমন বহুত্বের প্রকাশ অসম্ভব হয় না, এ ক্ষেত্রে সেরূপ বিবেচনাও করা যেতে পারে। অতএব, তাঁহাকে কখনও একরূপে, কখনও বহুরূপে পরিচিত করায়, বেদপ্রামাণ্যে কোনই দোষ ঘটে না।
৩। অপৌরুষেয়ত্ব বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।
বেদ যে পৌরুষেয় তার পক্ষে যুক্তি-
বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রমাণ পক্ষে প্রধানতঃ ত্রিবিধ যুক্তির অবতারণা দেখতে পাই। এক পক্ষ বেদকে সাধারণ মানুষের রচনা বলে ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পক্ষ একে অভ্রান্ত পুরুষের রচনা বলেন। তৃতীয় পক্ষ উহা ঈশ্বর-প্রণীত বলে সিদ্ধান্ত করেন। কালিদাস ‘রঘুবংশাদির’ রচয়িতা; ‘উত্তররাম চরিত’ প্রভৃতি ভবভূতির রচনা; বেদও তেমনি পুরুষ বিশেষের রচনা বলে বিতর্ক উপস্থাপন হয়। সাধারণ গ্রন্থ প্রভৃতি দেখে যেমন তার প্রণেতার বিষয় মনে আসে, বেদ দেখেও সে ভাব মনে আসবে না কেন? এই প্রথম পক্ষের সিদ্ধান্ত। আবার, নৈয়ায়িকগণ এক ভাবে, বৈশেষিক-দর্শন আর এক ভাবে এবং বেদান্ত অন্য আর এক ভাবে এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। নৈয়ায়িকগণ বলেন- ‘বেদকর্ত্তা যথার্থবাদী হতে পারেন, বেদ অভ্রান্ত পুরুষের প্রণীত হতে পারে; কিন্তু উহা যে কারও রচনা নয়, তা বলা যেতে পারে না। কুম্ভকার ঘট প্রস্তুত করল; সে স্থানে ‘ঘট’ প্রস্তুত করল’ এই বাক্য নিশ্চয়ই সত্য। বেদে সেরূপ সত্য আছে বলেই উহা অভ্রান্ত-পুরুষের রচনা বলা যেতে পারে; কিন্তু উহা অপৌরুষের অর্থাৎ কারও রচিত নয় বলা যেতে পারে না। বাক্য অভ্রান্ত হলেই যে তা নিত্য ও অপৌরুষেয় হবে, তার কোনও কারণ নাই। তবে বেদ যখন অভ্রান্ত ও সত্যস্বরূপ, উহা ভ্রান্ত মানুষের রচনা হতে পারে না; উহা অভ্রান্ত-পুরুষের-ঈশ্বরের রচনা। ঈশ্বরের রচনা বলেই উহার প্রামাণ্য। তাছাড়া এর অপৌরুষেয়ত্ব নেই। বৈশেষিক-দর্শনের মতও অনেকাংশে ঐরূপ ভাবদ্যোতক। দর্শনকার সূত্রে(প্রথম অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, তৃতীয় সূত্র) বলেছেন,- “তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্।” অর্থাৎ বেদ ঈশ্বরবাক্য, অতএব প্রমাণ। অর্থান্তরে, বেদ ধর্ম-প্রতিপাদক ঈশ্বরবাক্য, সুতরাং প্রমাণ। বৈশেষিক-দর্শনের অন্য আর এক সূত্রে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বিবৃত দেখি। সেই সূত্র (ষষ্ঠ অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, প্রথম সূত্র)- “বুদ্ধিপূর্ব্বাবাক্যকৃতির্বেদে।” অর্থাৎ, বেদবাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্ব্বক হয়েছে। বেদে বিধি নিষেধ রূপ যে সকল বাক্য আছে, তা ধর্ম-মূলক। ধর্মাধর্মের প্রমাণ তাই বেদ। সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর সে বেদ রচনা করেছেন বলেই তার অভ্রান্ততা। ‘স্বর্গকামো যজেৎ’; অর্থাৎ, যাগযজ্ঞই স্বর্গকামী ব্যক্তির ঈষ্টসিদ্ধির কারণ; ‘গাং মা বধিষ্ঠাঃ’; অর্থাৎ, গো-বধ করিও না; কেননা, ইহা স্বর্গকামী ব্যক্তির ইষ্টসিদ্ধির অন্তরায়;- এই প্রকার যে বেদোক্ত বিধি-নিষেধ, ইহা কি কখনও মানুষে রচনা করতে পারেন? স্বর্গ অপবর্গের কথা সাধারণ মানুষের অধিগম্য নয়। এমন যুক্তির অবতারণা করেই বৈশেষিক দর্শন ধর্মাধর্ম প্রতিপাদ্য বেদকে ঈশ্বরবাক্য বলে ঘোষণা করে গেছেন। যার অসংখ্য শাখা, যার অশেষ সন্মান, বৈশেষিকের মতে, তা অভ্রান্ত-পুরুষের- ঈশ্বরের রচনা ভিন্ন কারও রচনা হতে পারে না। এইমতে, বেদ ঈশ্বর-প্রেরিত এবং মহাজনগৃহীত; আর, তার জন্যই এর প্রামাণ্য। বেদ-বিষয়ে বেদান্ত-দর্শনের যে সিদ্ধান্ত, তাতেও এইপ্রকার অভিমত অভিব্যক্ত। বেদ যে ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়েছে, ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’ (বেদান্ত-দর্শন, প্রথম পাদ, তৃতীয় সূত্র) সূত্রে এ তত্ত্ব ব্যক্ত। বেদ ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন, ব্রহ্মই বেদের সৃষ্টিকর্ত্তা; উক্ত সূত্রে এই অর্থ প্রতিপন্ন হয়। ফলতঃ, সাধারণ পুরুষ বা মনুষ্য নয়; পরম-পুরুষ পরমেশ্বর কর্তৃক বেদ সৃষ্ট হয়েছিল। বেদের পুরুষ-সুক্ত মন্ত্র অনুসারেও বেদকে পৌরুষেয় বলা যেতে পারে। কেন-না, উক্ত সূক্তে বেদ-বিধাতা ভগবানকে ‘সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ’ অর্থাৎ সহস্র-মস্তক সহস্র চক্ষু ও সহস্র-পাদ-বিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষ হতেই যখন বেদ উৎপন্ন, তখন বেদকে অবশ্যই পৌরুষেয় বলেই অঙ্গীকার করতে হয়।
বেদের অপৌরুষেয়ত্বে প্রমাণ-
এই প্রকারে বেদের পৌরুষেয়ত্ব-স্থাপনে যে সকল বিতর্ক উত্থাপিত হয়, বিবিধ যুক্তি দ্বারা তার সমস্ত খণ্ডনের প্রয়াস দেখতে পাই। প্রথমতঃ, কালিদাস ভবভূতির ন্যায় কোনও মানুষ যে বেদ-রচয়িতা ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কালিদাস ‘রঘুবংশ’ প্রণয়ন করেছিলেন; ভবভূতি কর্তৃক ‘উত্তররামরচিত’ বিরচিত হয়েছিল; -এর সাক্ষ্য পুরুষ-পরম্পরা ক্রমে প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদ-প্রণেতার কোনই পরিচয় নেই। কেউ হয় তো মনে করতে পারেন, মধুচ্ছন্দা ঋষি প্রভৃতি যাঁদের নামে বৈদিক সূক্তসমূহ প্রচারিত আছে, তাঁরই বুঝি সেই সেই সূক্তের রচয়িতা। কিন্তু এ বিষয় পূর্ব্বেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাঁদের কে মন্ত্রের রচয়িতা বলা যেতে পারে না; তাঁরা মন্ত্রের প্রবর্ত্তক মাত্র। তারপর, বৈশেষিক দর্শনের এবং বেদান্ত-দর্শনের সিদ্ধান্তের আলোচনায় বেদ যে পরমেশ্বর-রচিত বলেই সূচিত হয়, তার দ্বারাও এর পৌরুষেয়ত্ব প্রতিপন্ন হয় না। কেন-না, পুরুষ বলতে - মানুষ বলতে, কর্মফল-হেতুভূত এই জন্মজরামরণশীল দেহধারী জীবকেই বুঝায়। কর্মের ফলে জীবকে নরদেহ ধারণ করতে হয়। সেই নরদেহধারী জীবই সাধারণতঃ পুরুষ নামে খ্যাত। কিন্তু জগৎপাতা জগদীশ্বর সেরূপ পুরুষ নন। আবশ্যক অনুসারে পুরুষ-রূপে আবির্ভূত হলেও, তিনি সাধারণ পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না; কেনন-না, কর্মফলের অধীন হয়ে, কর্মফলভোগ-হেতু তাঁকে সংসারে আসতে হয় নি; সুতরাং পুরুষ হয়েও তিনি পুরুষাতীত। আর, সে অনুসারে পৌরুষের হয়েও তাঁর রচনা অপৌরুষেয়। এই পৌরুষেয় -অপৌরুষেয় প্রসঙ্গে সাংখ্য মতাবলম্বিদের যুক্তি আবার আরেক প্রকার। তাঁরা বলেন, ‘পুরুষ নিষ্ক্রিয় মুক্ত সৎস্বরূপ। কোনও বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাই আসতে পারে না। সুতরাং তিনি যে বেদ রচনা করেছেন, তা কিভাবে বলতে পারি?-ইচ্ছাপূর্ব্বক কোনও কার্য্য করা-বদ্ধ-পুরুষের লক্ষণ। অতএব, বুদ্ধিপূর্ব্বক বেদ রচনা হয়েছে যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে পুরুষকে পরমেশ্বরকে বদ্ধ-জীব বলেই স্বীকার করতে হবে। বদ্ধজীবে মুক্ত-সত্য-ভাব কখনই সম্ভবপর নয়। পুরুষ মুক্ত সত্য; সুতরাং বেদ তাঁর রচনা হতে পারে না।’ তবে তাঁর থেকে বেদ কিভাবে উৎপন্ন হতে পারে? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,- ‘অদৃষ্টবশতঃ স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মার নিশ্বাসের ন্যায় বেদের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুষ হতে অনুসৃত হলেই যে তা পৌরুষেয় হল, তা বলতে পারি না। সুষুপ্তি-কালে, নিদ্রিত অবস্থায়, মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হয়। তাকে কি ইচ্ছাকৃত পৌরুষেয় সংজ্ঞায় অভিহিত হয়ে থাকে। পুরুষ-যিনি পরমপুরুষ, তাঁতে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা কিছুরই আরোপ করা যায় না। সুতরাং বেদ পৌরুষেয় নহে। তবে বেদ কোথা হতে আসল? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,-বেদ অনাদি; বীজাঙ্কুরবৎ। বৃক্ষ আদি, কি বীজ আদি-ইহা যেমন নির্ণয় হয় না; জ্ঞান-রূপ বেদেরও সেরূপ উৎপত্তি ও লয় নির্ণয় হয় না। যা পুরুষ(সাধারণ মনুষ্য) কৃত, তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু জ্ঞানের আদি-অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে?’ সুতরাং বেদ অনাদি অপৌরুষেয়।
বেদ-পরিচয়।
[পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল;- বেদ অধ্যয়নে অশেষ জ্ঞান আবশ্যক; -ষড়বেদাঙ্গ;- শিক্ষা-এতে কি জ্ঞান লাভ করা যায়, তার মর্ম;- কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ;-ঐ সকলের সারমর্ম; পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি;- বেদে সাম্যভাব,-ঋগ্বেদের মন্ত্রে সাম্যভাবের বিকাশ; -বেদ বিষয়ে শাস্ত্রগ্রন্থের অভিমত- বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন মত পরিব্যক্ত;-বেদ বিভাগ,-সেবিষয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি; -ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদ, অথর্ব্ববেদ;-কোন্ বেদে কি কি বিষয় আলোচিত হয়েছে; বেদপরিচয়ে বিবিধ বক্তব্য।]
পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল-
ভাসা ভাসা জ্ঞান মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। বিষয়-বিশেষে গভীরভাবে মনযোগী হওয়া- সাধারণতঃ মানুষের রুচি-প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। মানুষ সকল বিষয়ই ভাসাভাসা বা উপর-উপর বুঝতে চায়। এই যে বেদ-যে বেদ নিয়ে যুগ-যুগান্ত ধরে অনন্ত-কোটি মানুষের মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত হয়ে গেল, সেই বেদ-বিষয়েও মানুষের সেই পল্লবগ্রাহিতা(ভাসা ভাসা জ্ঞান)-প্রবৃত্তির অসদ্ভাব নেই। বেদ কি এবং বেদে যে কি আছে, সকলেই এক কথায় তার স্থূল-মর্ম জানতে চান। বেদ কি-এক কথায় উত্তর পেলে অনুসদ্ধিৎসু চিত্ত যেন শান্তি লাভ করে। তাই উত্তরও অনেক সময় যথেচ্ছভাবে দিয়ে থাকে। যার যতটুকু অভিজ্ঞতা, তিনি সেরূপ উত্তরই দিয়ে থাকেন। বিশাল মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে অভিগমন করে যে জন অর্ধেক পথ হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়েছে, মহাসাগর সম্বন্ধে সে একরকম উত্তর দিবে; যে সমুদ্রতীরে পৌঁছেছিল, সে অন্য আরেক রকম উত্তর দিবে; আবার যে মধ্য-সমুদ্রে অবগাহন করেছিল, সে এসে আর এক প্রকার উত্তর দিবে। এরকম বিভিন্ন জনের নিকট বিভিন্ন প্রকার উত্তরই পাওয়া যাবে। তারপর, সে উত্তর যদি এক কথায় পাবার আকাঙ্ক্ষা কর, তাতে যে স্বরূপ-তত্ত্ব কতটুকু প্রকাশ পাবে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। এই সকল কারণেই, এক কথায় উত্তর দিতে গিয়ে, পৃথিবীর পরম-পূজ্য বেদকে কেউ বা ‘চাষার গান’ বলে ঘোষণা করে গেছেন। এতই দুর্ভাগ্য আমাদের।
বেদ অধ্যয়নে অশেষ-জ্ঞান আবশ্যক-
বেদ বিষয়টি এতই জটিল, এতই গুরুতর যে, যতই সংক্ষেপে তার বিষয় আলোচনা করা যাক, যতই এক-কথায় তাকে বুঝার প্রয়াস পাওয়া যাক; বক্তব্য বিষয় স্বতঃই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিপন্ন করেছি, বেদ শব্দের অর্থ-জ্ঞান। বেদ কি-এক কথায় তার সংজ্ঞা প্রকাশ করতে গেলে, জ্ঞান ভিন্ন তাকে অন্য আর কি বলতে পারি? তবে সে জ্ঞান-কি জ্ঞান, কেমন জ্ঞান, সেটাই বিশেষ অনুধাবনের অনুভাবনার বিষয়। সে জ্ঞান লাভ করতে হলে-সে জ্ঞানে জ্ঞানী হবার আকাঙ্ক্ষা করলে বড় আয়াস- বড় প্রযন্ত প্রয়োজন। সে চেষ্টা- সে প্রযন্ত মানব-সাধারণের অধিগম্য নয়। তাই বেদ আলোচনায় বেদ অধ্যয়নে অশেষ প্রতিবন্ধক কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে; -স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ বেদপাঠে অনধিকার। জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করবার অধিকার সকলের আছে; স্বয়ং বেদই সে সাম্যবাদ ঘোষণা করছেন। সেই অনুসারে স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ কারও বেদপাঠে অনধিকার নেই সত্য। কিন্তু তথাপি কেন, বেদ অধ্যয়নের পক্ষে নানা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়? কেন’ই বা অধিকারী অনধিকারীর প্রসঙ্গ নিয়ে মস্তিষ্ক আন্দোলিত হয়ে থাকে? তার কারণ যথেষ্ট আছে। পাহাড়ের উপর আরোহণ করতে হলে প্রথমে পাহাড়ের নীচের দিকে উপস্থিত হতে হয়; পরে মধ্যভাগে, পরিশেষে শীর্ষদেশে উঠবার প্রয়াস প্রয়োজন হয়। কেউই একেবারে তুঙ্গশৃঙ্গ স্পর্শ করতে সমর্থ হন না। বেদরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলেও তেমনি স্তরে স্তরে অগ্রসর হওয়ার আবশ্যক হয়। হঠাৎ একটি সূক্ত বা ঋক্ কন্ঠস্থ করতে পারলেই এবং সেই অংশের একটা যথেচ্ছ অর্থ স্থির করতে পারলেই যে বেদ অধ্যয়ন সম্পন্ন হয়, তা নয়। বেদ অধ্যয়ন করতে হলে, সর্ব প্রথমে বেদাঙ্গে অভিজ্ঞতা-লাভ প্রয়োজন। বেদ যে অনাদি অনন্তকাল হতে অভ্রান্ত প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত হয়ে আসছে, আর যে উহা অক্ষত অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে, বেদাঙ্গে অভিজ্ঞ হতে পারলে’ই তা বোধগম্য হতে পারে। অক্ষয় বেদাঙ্গ-সূত্র, অক্ষয় মণি-মালার ন্যায়, বৈদিক সূক্ত-সমূহকে গেঁথে রেখেছে। সুতরাং বেদাঙ্গ-তত্ত্ব আগে অনুশীলন করতে না পারলে বেদ-মধ্যে প্রবেশ করবে-সাধ্য কি?
ষড়বেদাঙ্গ-
বেদকে বুঝার জন্যই বেদাঙ্গের প্রবর্তনা। উহা ‘ষড়ঙ্গ’ নামে অবহিত হয়ে থাকে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ- এই ষড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই নিগূঢ় বেদতত্ত্ব নিষ্কাষিত করতে হয়। এই ষড়ঙ্গ ভিন্ন বেদ-পাঠের সহায়তাকারী আরও কতগুলি পাঠ্য-গ্রন্থ আছে। পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি বিষয়ক জ্ঞান সেই সকল গ্রন্থে লাভ করা যায়। তারপর আছে, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ, উপপুরাণ। জ্ঞান-বুদ্ধির তারতম্য অনুসারে এদের এক একটির মধ্য দিয়ে বেদ-রূপ অনন্ত রন্তাকরের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। যাঁরা অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন, যাঁরা সমুদ্রের তীরেও পৌঁছাতে পারে নি, তারা কি করে সে জ্ঞান-রত্নাকরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আশা করতে পারে? বেদ অধ্যয়ন করতে হলে অভিজ্ঞ হতে হবে-ষড়ঙ্গে। ষড়ঙ্গের প্রথম অঙ্গ-শিক্ষা। শিক্ষা-শিখাবে বর্ণ; শিক্ষা-শিখাবে স্বর; শিক্ষা-শিখাবে মাত্রা; শিক্ষা-শিখাবে বল; শিক্ষা-শিখাবে সাম। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সাম-শিক্ষা এই বিষয়ে-পাঁচ প্রকার শিক্ষা দেয়। যদি অকার আদি বর্ণের জ্ঞান না থাকে; যদি উদাত্তা আদি ত্রিবিধ স্বর অনুধাবন করতে অনভিজ্ঞ হও; হ্রস্ব মাত্রা, দীর্ঘ-মাত্রা প্রভৃতির জ্ঞান যদি না জন্মে; উচ্চারণ-স্থান আদির এবং সাম্য-গুণ আদির অভ্যাস যদি তুমি না করে থাক; বৃথাই তোমার বেদ অধ্যয়ন হবে। অ আ ক খ ইত্যাদি স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দ্বিবিধ। শিক্ষা-গ্রন্থ এই বর্ণজ্ঞানের শিক্ষা দেয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ- স্বর এই ত্রিবিধ। উদাত্ত-উচ্চ স্বর; অনুদাত্ত-নীচ স্বর; স্বরিৎ-উভয় স্বরের মধ্যবর্তী স্বর। এই ত্রিবিধ স্বরের জ্ঞান না থাকলে, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে গেলে, স্বর-বিকৃতি দোষ ঘটে। সে দোষে শুভ কামনায় মন্ত্র উচ্চারণে অশুভ ফল সঙ্ঘটিত হতে পারে। শাস্ত্রে এ বিষয়ে প্রশস্ত দৃষ্টান্তের উল্লেখ আছে। “ইন্দ্র শত্রুর্বর্দ্ধস্ব”- পাঠ-বিপর্য্যয়-হেতু এই মন্ত্র বিপরীত ফল প্রদান করেছিল। আদ্যোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে এক ফল; আর অন্তোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে আর এক ফল। প্রথমোত্ত পাঠে তৎপুরুষ সমাস বিধায়, অর্থ হয়-ইন্দ্রের শত্রুবৃদ্ধি হোক। আর শেষোক্ত পাঠে, আদ্যোদাত্ত হেতু, বহুব্রীহি সমাস বিধায় অর্থ হয়- ইন্দ্রের শত্রু বিনষ্ট হোক। উচ্চারণের বিভিন্নতা-হেতু এমনই অর্থ-বিপর্য্যয় ঘটে থাকে। এই জন্যই ঋক্-সমুহের উচ্চারণের উপযোগী চিহ্ন-স্বরলিপি-সমূহ-ব্যবহৃত হতে দেখি। এখনকার স্বর-বিজ্ঞানে স-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি অর্থাৎ ষড়ঙ্গ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ-এই সপ্ত স্বর প্রচলিত। অধুনা-প্রচলিত এই সপ্ত স্বর সেই বৈদিক স্বরত্রয় হতেই উদ্ভূত হয়েছে, প্রতিপন্ন হয়। উদাত্ত হতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হতে ঋষভ ও বৈধত, স্বরিৎ হতে ষড়ঙ্গ মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পিত হয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ-এই তিন প্রকার উচ্চারণ-ভেদ বুঝানোর জন্য বৈদিক গ্রন্থ-সমূহে অনেক স্থানে শব্দান্তর্গত বর্ণের উপরে ও নিন্মে বিবিধ রেখা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতের স্বরলিপিতে যে সকল চিহ্ন আদি প্রচলিত আছে, তাহা ঐ বৈদিক উচ্চারণ-মূলক রেখা-চিহ্নের অনুসৃতি বলেই মনে হয়। নিন্মে উদাহরণ ছলে ঋগ্বেদের আগ্নেয়-সূক্ত অন্তর্গত প্রথম ঋক্টি রেখাচিহ্ন অঙ্কিতরূপে যথাযথ উদ্ধৃত করেছি।
। । । ।
ওঁ অগ্নিমিলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজং।
। ।
হোতারং রন্তধাতমং ॥১॥
উদ্ধৃত ঋকের বর্ণ-বিশেষের শীর্ষদেশে যে লম্বমান রেখা অঙ্কিত হয়েছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের উদাত্ত স্বরে উচ্চারণ জানানো হয়েছে। আর, বর্ণবিশেষের নিন্মভাগে যে শায়িত রেখা দৃষ্ট হচ্ছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের অনুদাত্ত স্বরে উচ্চারণ বুঝাচ্ছে, যে যে বর্ণের নিন্মে কোনরকম রেখা অঙ্কন হয় নি, সে সে বর্ণের উচ্চারণ স্বরিৎ বলে বুঝতে হবে। সাধারণতঃ উচ্চারণ-প্রণালী এভাবে নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। এতদ্ভিন্ন, মাত্রা আদি বুঝানোর জন্য আরও নানারকম চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। মাত্রা ত্রিবিধ;- হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত। ‘কি’ হ্রস্ব, ‘কী’ দীর্ঘ, ‘কি-ই’ প্লুত। রোদনে গানে প্লুত-স্বর বিহিত হয়। উহাকে অতি-দীর্ঘ স্বর বলা যেতে পারে। ‘বল’ বলতে প্রযন্ত ও উচ্চারণ-স্থান বুঝায়। উচ্চারণ স্থান অষ্টবিধ;- কন্ঠ, তালু, মূর্দ্ধা ইত্যাদি। মতান্তরে উচ্চারণ-স্থান আরও অধিক পরিকল্পিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেগুলিকে যৌগিক উচ্চারণ-স্থান বলা যেতে পারে। যেমন, কন্ঠ ও তালু হতে উচ্চারিত বর্ণ-কণ্ঠতালব্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। প্রযন্ত বলতে ‘চেষ্টা’ বুঝিয়ে থাকে। অল্প, অস্পৃষ্ট ভেদে প্রযন্ত বিবিধ। সাম অর্থাৎ সাম্য বলতে উচ্চারণ-সাম্য বুঝায়। অতি-দ্রুত, অতিশয়-দ্রুত প্রভৃতি দোষ রহিত এবং মাধুর্য গুণ-যুক্ত উচ্চারণ’ই সাম্য। ফলতঃ, যাতে সুস্বরে সকল ভাব ব্যক্ত হয়, উচ্চারণে কোনও বৈষম্য না ঘটে, তাকেই সাম্য বলে। শিক্ষা-গ্রন্থ এই সকল শিক্ষা প্রদান করে।
পূর্বেই বলেছি, বেদ জানতে হলে, জানতে হবে-ষড়বেদাঙ্গ, জানতে হবে-ব্রাহ্মণ আরণ্যক উপনিষৎ, জানতে হবে-সংহিতা দর্শন পুরাণ। ফলতঃ তিনিই বেদ অধ্যয়নে অধিকারী, তাঁরই বেদ অধ্যয়ন সার্থক,-যিনি সর্ব্বশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ করেছেন, যিনি সর্ব্বশাস্ত্রে পারদর্শী হয়েছেন এবং যাঁর সকল বিদ্যায় অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে। সকল শাস্ত্রই বেদের অনুসারী; সুতরাং সকল শাস্ত্রেই বেদের আলোচনা দেখতে পাই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন এবং পুরাণ প্রভৃতির আলোচনায় বেদ সম্বন্ধে নানা মত দেখতে পাই। অনেক স্থানে তার এক মতের সাথে অন্য মতের সাদৃশ্য ভাবও পরিলক্ষিত হয়। শতপথ-ব্রাহ্মণে দেখি, যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন,-সেই পুরুষ প্রজাপতি, প্রজাসৃষ্টির কামনা করলেন; তাঁর কঠোর তপস্যার ফলে ত্রয়ীবিদ্যা সৃষ্ট হল। সেই ত্রয়ীবিদ্যাই ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্ব্বেদ। ব্রহ্মই সেই ত্রয়ীবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা অর্থাৎ ব্রহ্ম হতেই বেদত্রয় উৎপন্ন হয়েছিল। রূপকে এই বিষয়টি আবার আরেক ভাবে বর্ণনা করা আছে,-
“মনো বৈ সমুদ্রঃ। মনসো বৈ সমুদ্রাৎ বাচাভ্র্যা দেবাস্ত্রয়ীং বিদ্যাং নিরখনন্।
মনঃ বৈ সমুদ্রঃ। বাক্ তীক্ষাভ্রিঃ। ত্রয়ীবিদ্যা নির্ব্বপণং।”
অর্থাৎ,-মনরূপ সমুদ্র। সেই মনরূপ সমুদ্র হতে বাক্রূপ অভ্রি দ্বারা দেবগণ ত্রয়ীবিদ্যা খনন করেছিলেন। পুনশ্চ মনোরূপ সমুদ্র; বাক্রূপ তীক্ষ্ণ অভ্রি; তার দ্বারা ত্রয়ীবিদ্যা নির্ব্বপণ করা হয়েছিল।’ ফলতঃ, সৃষ্টিকাম প্রজাপতি পৃথিবী-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তিন বেদ সৃষ্টি করেন; -অগ্নি হতে ঋগ্বেদ, বায়ু হতে যজুর্ব্বেদ এবং সূর্য্য হতে সামবেদ নিঃসৃত হয়। ব্রাহ্মণে এই মতই প্রকট দেখতে পাই। উপনিষদের মধ্যে ছান্দোগ্য উপনিষদে ঐ মতেরই প্রতিধ্বনি দেখি। পুরাণ-পরম্পরার মত নানারূপে পল্লবিত। বিষ্ণূপুরাণে দেখা যায়,-ব্রহ্মার প্রথম মুখ থেকে গায়ত্রীছন্দঃ, ঋগ্বেদ, রথস্তর নামক সামবেদ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। তাঁহার দক্ষিণ মুখ থেকে যজুর্ব্বেদ, ত্রিষ্টুভ ছন্দ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। তাঁহার পশ্চিম মুখ হতে সামবেদ, জগতী ছন্দঃ প্রভৃতি নির্গত হয়। তাঁহার উত্তর মুখ হতে অথর্ব্ববেদ, অনুষ্টুপ ছন্দ প্রভৃতি উদ্ভূত হয়েছিল। ব্রহ্মা বেদের উপদেশ অনুসারেই সৃষ্ট-পদার্থের নাম-রূপ-কর্ম আদির ব্যবস্থা স্থির করেছিলেন এ সকল উক্তির নিগূঢ় তাৎপর্য্য থাকলেও স্থূলতঃ বেদ যে সৃষ্টির আদিভূত, তা বেশ বুঝতে পারা যায়। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, বৈবস্বত মন্বন্তরের দ্বাপর যুগে, বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। সে সময় হতে ঋক, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব-চার বেদ ইহলোকে প্রতিষ্ঠাপন্ন। রূপকের ভাষায় নানারূপে বেদের উৎপত্তি-তত্ত্ব পুরাণ আদি গ্রন্থে বর্ণিত থাকলেও বেদ যে সৃষ্টির আদিভূত, বেদ যে অনাদি অনন্ত কাল নিত্য-সত্যরূপে বিরাজমান, সর্বত্রই তার প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। সকল মতেরই সার-নিষ্কর্ষে বেদের অলৌকিকত্ব প্রতিপন্ন হয়।
বেদ বিভাগ সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত আছে। এক বেদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ‘ত্রয়ী’ নামে পরিচিত হয়েছিল, এবং বেদব্যাস কর্ত্তৃক উহা ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব চার বিভাগে বিভক্ত হয়েছিল,- এ বিষয়ে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এক শ্রেণীর পণ্ডিতগণ বেদকে আর এক ভাবে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। তাঁদের মতে-
(১) ক্৯প্ত ও কল্প্য ভেদে বেদ দ্বিবিধ;
(২) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড ভেদে দ্বিবিধ;
(৩) মন্ত্র ও ব্রাহ্মণভেদে দ্বিবিধ।
এ হিসাবে তিন ভাগের মধ্যে ছয় বিভাগ পরিকল্পিত হয়। প্রথম বিভাগের অন্তর্গত ক্৯প্ত ও কল্প্য বলতে কি বুঝা যায়? “যা-তু প্রত্যক্ষতঃ প্রতিপদ্যতে সা ক্৯প্ত।” যা প্রত্যক্ষ বলে প্রতিপন্ন হয়, তাই ক্৯প্ত। যে স্তবস্তুতি অক্ষয়-রচিত অর্থাৎ লেখা হয়েছে, তারই নাম-ক্৯প্ত শ্রুতি; কেন-না, সেগুলি প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। ঋক, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব- এই চতুর্ব্বেদ গ্রন্থাকারে নিবদ্ধ। ইহা ক্৯প্ত শ্রুতির অন্তর্গত। ক্৯প্ত শ্রুতি গ্রন্থভেদে চার প্রকার এবং মন্ত্রভেদে তিন প্রকার। গ্রন্থ-ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ, সামবেদ, অথর্ব্ববেদ; আর মন্ত্র-ঋকমন্ত্র, যজুর্ম্মন্ত্র ও সামমন্ত্র। ঐরূপ ক্৯প্ত শ্রুতি ব্যতীত আর এক প্রকারের শ্রুতির বিষয় বলা হয়ে থাকে। যা কিছু সত্য সংসারে আছে, যা কিছু সৎকর্ম সংসারে সম্ভবপর, সেগুলি চিরকাল অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। সে সকল নিত্য-সত্য ঐ চতুর্ব্বেদের অন্তর্ভুক্ত না হলেও সেগুলিও বেদ মধ্যে গণ্য। সেই সকলের নাম-কল্প্য-শ্রুতি। বেদ অনন্ত বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন, ঐ চতুর্ব্বেদের মধ্যে যাঁরা বেদকে সীমাবদ্ধ করতে প্রস্তুত নন, তাঁরাই কল্প্য-শ্রুতির পরিপোষক। তাঁদের নাম-অনন্তবাদী। তাঁরা বলে থাকেন,- “যা তু স্মৃতিসদাচারাভ্যাং অনুমীয়তে সা কল্প্য-শ্রুতিঃ।” স্মৃতি আর সদাচার দ্বারা যা অনুমান করা যায়, তাকেই কল্প্যশ্রুতি বলে। দেশভেদে, সমাজভেদে, অবস্থাভেদে বিবিধ সদাচার প্রচলিত আছে। সেই সকল সদাচারকে কল্প্যশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। লোকপাবন মহর্ষিগণ সমাজের শৃঙ্খলা-রক্ষার জন্য বহু বিধি-নিষেধ নিয়ম প্রবর্তন করে গেছেন। সে সকল জন হিতকর বিধান পরম্পরা কল্প্যশ্রুতি মধ্যে গণ্য হয়। দ্বিতীয় বিভাগ-কর্ম্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে। যাগযজ্ঞের উপযোগী চতুর্ব্বেদ ও ব্রাহ্মণ সমূহ কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত; এবং উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডের পর্য্যায়ভূক্ত। যাতে কর্মের উপদেশ পাওয়া যায়, তাই কর্ম্মকাণ্ড; আর যা কেবল জ্ঞান উন্মেষকর, তাই জ্ঞানকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় বিভাগ- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে। “মননাৎ মন্ত্র”; অর্থাৎ যা দ্বারা ইষ্টবস্তুর মনন বা স্মরণ করিয়ে দেয়, তাই মন্ত্র। দেব আদির উপাসনার উপযোগী যে বাক্য বা পদ, তাকেই মন্ত্র বলে। “অগ্নিমীলে পুরোহিতং” ইত্যাদি যে ঋক্, উহা উপাসনা-মূলক; সুতরাং মন্ত্র-মধ্যে গণ্য। ব্রাহ্মণ-মন্ত্র-সকলের ব্যাখ্যা-মূলক। যজ্ঞের বিনিয়োগ অর্থাৎ প্রয়োগ বা অর্পণ, ব্রাহ্মণ শিক্ষা দেয়। বেদের ব্রাহ্মণভাগ দ্বিবিধ;- (১)বিধিবাদ ও (২) অর্থবাদ। বিধিভাগ অজ্ঞাত বিষয় সম্বন্ধে জানান দেয়, অপ্রবৃত্ত অননুষ্ঠিত কর্মে প্রবৃত্ত করে। স্তুতিবাদেরই নামান্তর-অর্থবাদ। যে অংশ স্তবস্তুতিমূলক, তাই অর্থবাদের অন্তর্নিবিষ্ট। এই সকল আলোচনায় প্রতিপন্ন হয়,-ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ প্রভৃতি নিয়ে বেদ সম্পূর্ণ। উপনিষদ আদিও বেদের অন্তর্ভুক্ত।
ঋগ্বেদ আদি যে চতুর্ব্বেদ বিভাগ, এখন সে প্রসঙ্গে আলোচনা করব। এই চার বেদ আবার বিভিন্ন পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। সে সকল বিভাগে নানা মতান্তর দেখতে পাই। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ বেদের ঋকের ও মন্ত্রের সংখ্যা তুলে ধরছি। ঋকের ও মন্ত্রের সংখ্যা-গণনায় বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন মত প্রকাশ করে গেছেন। এক ঋগ্বেদের ঋক্-সংখ্যার বিষয় আলোচনা করলেই বিষয়টি বোধগম্য হতে পারে। সাধারণতঃ ঋগ্বেদের ঋক্-সংখ্যা ১০হাজার ৪০২ হতে ১০ হাজার ৬৬২টি বলা হয়। চরণব্যুহ গণনা করে নির্দ্দেশ করেন, -দশ হাজার পাঁচ শত আশিটি ঋক্ ঋগ্বেদে সন্নিবিষ্ট আছে। যথা,-
“ঋচাং দশসহস্রাণি ঋচাং পঞ্চশতানি চ। ঋচামশীতিঃ পাদশ্চ তৎপারায়ণমূচ্যতে।।”
কিন্তু অধুনাতন সংস্করণে পণ্ডিতগণ গণনা করে দশ হাজার চারশত সতেরটি ঋক্ নির্দ্দেশ করেছেন। এ হিসাবে, একশত তেষট্টি ঋক্ লোপপ্রাপ্ত হয়েছে। এরকম অন্যান্য বেদ সম্বন্ধেও মন্ত্র-সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। সামবেদের মন্ত্র-সংখ্যা বিষয়ে চরণব্যুহের মত- “অষ্টসামসহস্রাণি সামানি চ চতুর্দ্দশ।” অর্থাৎ, সাম-মন্ত্রের সংখ্যা আট হাজার চৌদ্দ। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ ভাগ নিয়ে যজুর্ব্বেদের মন্ত্র-সংখ্যা-আঠার হাজার। তন্মধ্যে শুক্লযজুর্ব্বেদের মন্ত্র-পরিমাণ-উনিশ শত। অথর্ব্ববেদের মন্ত্র-পরিমাণ-বার হাজার তিন শত। এ সম্বন্ধে চরণব্যুহের(শৌনকের) উক্তি নিন্মে উদ্ধৃত করা গেল; যথা-
“দ্বাদশানাং সহস্রাণি মন্ত্রাণাং ত্রিশতানি চ। গোপথং ব্রাহ্মণং বেদেহথর্ব্বণে শতপাঠকং।।”
কিন্তু অধুনা অথর্ব্ববেদের শৌনক-শাখাতে মাত্র ছয় হাজার পনেরটি ঋক্ পাওয়া যায়। প্রতি বেদ আবার বিভিন্ন নামধেয় বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভিন্ন সময়ে বিভক্ত হয়েছিল, বুঝা যায়। শাখা, উপনিষৎ প্রভৃতি ভেদেও বেদ-চতুষ্টয়ের বিভাগ পরিকল্পিত হয়ে থাকে। এক এক বেদের বিষয় স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করলে, কোন্ বেদ কি কি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছিল, তা বুঝতে পারা যাবে।
ঋগ্বেদ
প্রথম-ঋগ্বেদ-সংহিতা। সূক্ত, বর্গ, অধ্যায়, অষ্টক, মণ্ডল, অনুবাক্-প্রধানতঃ এই ছয় ভাগে উহা বিভক্ত হয়ে থাকে। কত গুলি বেদমন্ত্র একত্র সমষ্টিবন্ধ ভাবে অবস্থিত হলে, তাকে সুক্ত বলা হয়। এক এক দেবতার স্তবমূলক একত্র নিবন্ধিত যে ঋক্মন্ত্র, তাই সূক্ত নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কোনও কোনও স্থানে একই সূক্তে দুই তিন দেবতারও স্তুতি দেখতে পাওয়া যায়। মহাসূক্ত, ক্ষুদ্রসূক্ত, মধ্যমসূক্ত ভেদে সূক্ত বহুবিধ। দশটির অবিধ ঋক্ একত্র নিবদ্ধ থাকলে তা মহাসূক্ত, পাঁচটি পর্য্যন্ত ঋক্ একত্র থাকলে তা ক্ষুদ্রসূক্ত, পাচটির অধিক অথচ দশটির নিচে মন্ত্র-বিশিষ্ট ঋক্ মধ্যম সূক্ত। মহা-সূক্তের দৃষ্টান্ত-স্বরূপ ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দ্দশ, পঞ্চদশ, দ্বাবিংশ, ত্রয়োবিংশ, চতুর্ব্বিংশ, পঞ্চবিংশ, ষড়বিংশ, সপ্তবিংশ, ত্রিংশ, একত্রিংশ, দ্বাত্রিংশ ও ত্রয়স্ত্রিংশ প্রভৃতি সূক্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র-সূক্তের দৃষ্টান্ত ঐ প্রথম মণ্ডলের এক ঋক্মূলক নবনবতি সূক্ত, ত্রিঋক্-মূলক অষ্ট নবতি সূক্ত এবং পঞ্চ ঋক্মূলক পঞ্চসপ্ততি, ষড়সপ্ততি, অষ্টসপ্ততি প্রভৃতি সূক্ত নির্দ্দেশ করা যায়। মধ্যমসূক্তের দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রথম মণ্ডলের প্রথম, দ্বিতীয়, একাদশ প্রভৃতি সূক্ত উল্লেখযোগ্য। ঋষিসূক্ত, দেবতাসূক্ত, ছন্দঃসূক্ত প্রভৃতি ভেদে ঋক্-সমূহকে আরও এক প্রকার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। এক এক সূক্তের প্রবর্ত্তক বলে এক এক ঋষির নাম আছে। যেমন, ঋগ্বেদের প্রথম কয়েকটি সূক্তে মধুচ্ছন্দা ঋষির নাম দেখতে পাই। তিনি ঐ সূক্ত-কয়েকটির প্রবর্ত্তক বলে প্রচারিত আছে। এ ভাবে অর্থাৎ যাঁদের নামে সূক্ত-বিশেষ প্রচারিত, তাঁদের অনুসরণে সূক্তগুলি ঋষিসূক্ত নামে পরিচিত হয়। দেবতা-সূক্ত বলতে দেবতার স্তুতিমূলক সূক্তগুলিকে বুঝিয়ে থাকে। যেমন অগ্নি-দেবতার স্তুতিমূলক সূক্ত-আগ্নেয়-সূক্ত, বায়ু-দেবতার স্তুতিমূলক সূক্ত-বায়বীয় সূক্ত, ইত্যাদি। এভাবে সূক্তের বিচার করলে সূক্তগুলিকে দেবতাসূক্ত বলা যায়। ছন্দঃসূক্ত বলতে, একসূত্রে একছন্দে বিরচিত পর্য্যায়ক্রমে বিন্যস্ত সূক্তকে বুঝিয়ে থাকে। যেমন, গায়ত্রী-ছন্দে প্রথম নয়টি সূক্ত রচিত হয়েছে বলেই, ঐগুলিকে গায়ত্রী-ছন্দ অন্তর্গত ছন্দঃ-সূক্ত বলা হয়। এ হিসাবে, সকল সূক্ত উল্লিখিত ত্রিবিধ সূক্তের(ঋষি-সূক্ত, দেবতা-সূক্ত, ছন্দঃ-সূক্ত) অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ প্রথম মণ্ডলের চতুর্থ হতে নবম সূক্ত উল্লেখ করতে পারি। ঐ সূক্ত-কয়টির প্রবর্ত্তক মধুচ্ছন্দা ঋষি। সুতরাং ঐ কয়েকটি সূক্ত ঋষি-সূক্ত পর্য্যায়ের অন্তর্নিবিষ্ট হল। তার পর, ঐ কয়টি সূক্ত গায়ত্রীছন্দে বিরচিত; সুতরাং উহা ছন্দঃ-সূক্ত মধ্যে গণ্য হল। তৃতীয়তঃ, ঐ কয়েকটি সুক্তে ইন্দ্র-দেবতার স্তুতি আছে; এজন্য উহা দেবতা-সূক্ত হল। ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলে সর্ব্বসমেতে ১৯১+৪৩+৬২+৫৮+৮৭+৭৫+১০৪+১০৩+১১৪+১৯১=১০২৮টি সূক্ত আছে। মহর্ষি সনক প্রণীত ‘বৃহদ্দেবতা’ গ্রন্থে সূক্ত ও তাদের লক্ষণ আদি বিবৃত রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সূক্তে ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ ও বিনিয়োগ দেখতে পাই। যে ঋষির বাক্য বলে যে মন্ত্র পরিচিত, তিনিই সেই মন্ত্রের ঋষি। যে ছন্দে সূক্ত-সমূহ সাজানো হয়েছে, তাই সেই সূক্তের ছন্দঃ। আর যে যজ্ঞে যে সূক্ত বিনিযুক্ত হয়, তাই সেই সূক্তের বিনিয়োগ। ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ। আর যে যজ্ঞে যে সূক্ত বিনিযুক্ত হয়, তাই সেই সূক্তের বিনিয়োগ। ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ ও বিনিয়োগ বিষয়ে নিরুক্তকার যেমন সংজ্ঞা নির্দ্দেশ করে গেছেন, তা নিন্মে উদ্ধৃত করা হল; যথা,-
“যস্য বাক্যং স ঋষিঃ। যা তেনোচ্যতে সা দেবতা। যদক্ষরপরিমাণং তচ্ছনঃ। অর্থেপ সব ঋষয়ো দেবতাশ্ছন্দোভিরভ্যধাবন্।”
এখনকার-প্রচলিত সাধারণ গ্রন্থ সমূহে যেভাবে খণ্ড, পরিচ্ছেদ, অধ্যায় প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগ দেখা যায়; ঋগ্বেদ তেমনই মণ্ডল, অনুবাক, বর্গ, সূক্ত প্রভৃতিতে বিভক্ত আছে। বোধ হয়, আধুনিক পরিচ্ছেদ আদি গ্রন্থ-বিভাগের এটাই আদিরূপ। অধ্যায়, বর্গ ও অনুবাক্ প্রভৃতি কি নিয়মে প্রবর্ত্তিত হয়েছিল, তার কোনও বিশেষ লক্ষণ অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় না। তবে মণ্ডলের সম্বন্ধে একটি লক্ষণ বলা হয়ে থাকে। তাতে বুঝতে পারি, বহুসংখ্যক ঋষির পরিদৃষ্ট মন্ত্রসমূহ একজন ঋষি কর্ত্তৃক একত্রে সংগৃহীত হয়ে এক একটি মণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছিল। মণ্ডলের লক্ষণ; যথা- “তত্তদৃষিদৃষ্টাণাং বহূনাং সূক্তানামেকর্ষিকৃতঃ সংগ্রহো মণ্ডলং”। সৌনক ঋষির সর্ব্ব অনুক্রমণিকা গ্রন্থে প্রকাশ আছে,-ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডল গৃৎসমদ ঋষি সংগ্রহ করেছিলেন। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে দশ মণ্ডলের সংগ্রহকার ঐরকম দশ জন ঋষির নাম উল্লেখ আছে। যথা,-
“শতর্চিনো মাধ্যমা গৃৎসমদো বিশ্বামিত্রো বামদেবোহত্রির্ভরদ্বাজো
বাসিষ্ঠঃ প্রগাথাঃ পাচ্যমান্যাঃ ক্ষুদ্রসূক্তাঃ মহাসূক্তাশ্চ।”
এই মতে শতর্চ্চি প্রথম মণ্ডল সংগ্রহ করেন; গৃৎসমদ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় মণ্ডল, বামদেব কর্ত্তৃক চতুর্থ মণ্ডল, অত্রি কর্ত্তৃক পঞ্চম মণ্ডল, ভরদ্বাজ কর্ত্তৃক ষষ্ঠ মণ্ডল, বশিষ্ঠ কর্ত্তৃক সপ্তম এবং প্রগাথা কর্ত্তৃক অষ্টম মণ্ডল সংগৃহীত হয়। এতদ্ভিন্ন, নবম মণ্ডল পাচ্যমান-ঋষিগণ কর্ত্তৃক এবং দশম মণ্ডল ক্ষুদ্রসূক্তীয় ও মহাসূক্তীয় ঋষিগণ কর্ত্তৃক সঙ্কলিত হয়েছিল। বর্গ শব্দের অর্থ-স্বজাতীয়-সমূহ। এ অর্থ অনুসারে এক এক জাতীয় ঋক্ এক এক বর্গ মধ্যে স্থান পেয়েছে, মনে করা যেতে পারে। অনুবাক্-বিভাগেও এক শ্রেণীর ঋক্কে লক্ষ্য করা হয়ে থাকবে। অধ্যায়-ভাগে এক এক অংশে বিভিন্ন দেবতার স্তব পরিদৃষ্ট হয়। ফলতঃ, ঋষিগণ আপন-আপন কার্য্য সৌকর্ষ্যের জন্য অধ্যায় আদির বিভাগ করে নিয়েছেন। ঋগ্বেদের মণ্ডল সংখ্যা-দশটি; অধ্যায়-সংখ্যা চৌষট্টিটি, বর্গ-সংখ্যা দুই হাজার ছয়টি, অনুবাক-সংখ্যা পঁচাশিটি, সূক্তের সংখ্যা এক হাজার সতেরটি। মণ্ডল, অনুবাক্, সূক্ত প্রভৃতির পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋগ্বেদের ঋক্-সংখ্যা, প্রতি ঋকের পদসংখ্যা ও শব্দাংশের পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট আছে। অধিক কি বলব, প্রতি সূক্তে অকারান্ত, আকারান্ত, ইকারান্ত, নান্ত, সান্ত প্রভৃতি যে সকল পদ আছে, সে সকল পদের পরিচয় ও সংখ্যা কত, শাস্ত্রকারগণ তাও নির্দ্দেশ করে গেছেন। যদিও সকল পদসংখ্যা ও শব্দসংখ্যার মিল এখন পাওয়া যায় না; কিন্তু এক সময়ে যে বেদ তন্ন তন্ন করে আলোচিত হয়েছিল, তা বেশ বুঝতে পারা যায়।
ঋগ্বেদের শাখা সমূহ।
ঋগ্বেদের শাখা বিষয়ে নানা মত প্রচলিত। ঋষি শৌনক প্রণীত প্রতিশাখ্যে ঋগ্বেদের পাঁচটি শাখার নাম জানা যায়। শাকল, বাস্কল, আশ্বলায়ন, সাঙ্খ্যায়ন ও মাণ্ডুক-সেই পাঁচ শাখার নাম। সে মতে প্রকাশ আছে-শাকল ঋষি প্রথমে ঋগ্বেদ-সংহিতা অধ্যয়ন করেন; তারপর বাস্কল আদি ঋষিরা অধ্যয়ন করেছিলেন। শাকল আদি পঞ্চ ঋষি একবেদী এবং ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণগণের আচার্য্য বলে অভিহিত হন। বিষ্ণূপুরাণ এবং শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতিতে এ বিষয়ে ভিন্ন মত দেখা যায়। ঐ দুই পুরাণে বর্ণিত আছে,-বেদব্যাস বেদবিভাগ করে পৈলকে ঋগ্বেদ-সংহিতা প্রদান করেছিলেন। বৈশম্পায়নকে যজুর্ব্বেদ-সংহিতা, জৈমিনিকে সামবেদ-সংহিতা এবং সুমন্ত্রকে অথর্ব্ববেদ-সংহিতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। পৈল আবার ঋক্-সংহিতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ইন্দ্রপ্রমতি ও বাস্কলি(বাস্কল) নামক আপন শিষ্যদ্বয়কে তা প্রদান করেন। বৌধ, অগ্নিমাঠার(অগ্নিমিত্র), যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশর নামক বাস্কলির চারজন শিষ্য ছিলেন। বাস্কলি নিজের অধ্যায়ন করা বেদ-সংহিতাকে চার ভাগে বিভক্ত করে সেই চার ভাগ আপনার চার শিষ্যকে শিক্ষা দান করেন। ইন্দ্রপ্রমতি যে সংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন, আপন পুত্র মাণ্ডুকেয়কে তা অধ্যয়ন করান। মাণ্ডুকেয় হতে ক্রমশঃ তাঁর পুত্র সাকল্য এবং শিষ্য বেদমিত্র (মতান্তরে দেবমিত্র) ও সৌভরী প্রভৃতির মধ্যে উহা প্রচারিত হয়। সাকল্য আবার পাঁচখানা সংহিতা সঙ্কলন করে, মুদ্গল, গালব, বাৎস্য, শালীয় ও শিশির নামক পাঁচ জন শিষ্যকে সে বিষয়ে উপদেশ দেন। এইরূপে ঋগ্বেদ-সংহিতা নানাভাবে নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাখা-অনুসারে মণ্ডল ও অনুবাক প্রভৃতিরও নাম-পরিবর্তন দেখা যায়। সৌনক মুনির মতে, পূর্বে’ই বলেছি, ঋগ্বেদের শাখা পাঁচটি;-আশ্বলায়নী, সাঙ্খ্যায়নী, শাকলা, বাস্কলা ও মাণ্ডুকা। পঞ্চ ঋষির নাম অনুসারে যে পঞ্চ শাখার নামকরণ হয়েছিল, সে অনুসারে তাহাই প্রতিপন্ন হয়। কোথাও কোথাও আবার একুশটি শাখার উল্লেখ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাঁচ শাখাও এখন সন্ধান করে পাওয়া যায় না। মাত্র শাকলের শাখাই এখন প্রচলিত আছে, -এটাই বেদ অধ্যায়ীদের বিশ্বাস। বলা হয়, শাকল-শাখার কবিতা-সংখ্যা-১৫,৩৮১টি; এবং বাস্কল-শাখায় ১০,৬২২টি কবিতা ছিল। যাগ-যজ্ঞের নিয়মাবলী এবং ক্রিয়া-প্রণালী বিবৃত করে ঋগ্বেদের দুইটি শাখা প্রণীত হয়। সেই শাখা দুইটি দুই ‘ব্রাহ্মণ’ নামে অভিহিত। সেই দুই ব্রাহ্মণের একটির নাম-ঐতরেয় এবং অপরটির নাম-কৌষিতকী বা সাঙ্খ্যায়ন। মহিদাস ঐতরেয় নামক জনৈক ঋষি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এবং কুষিতক নামক ঋষি কৌষিতকী ব্রাহ্মণের প্রণেতা বলে কথিত আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-কিছু অংশ গদ্যে এবং কিছু অংশ পদ্যে লেখা। উহা আট পঞ্জিকায় বিভক্ত। তার প্রতি পঞ্জিকায় পাঁচটি করে অধ্যায় আছে এবং তার প্রতি অধ্যায়ে অন্যূন সাতটি করে কাণ্ড আছে। এইরূপ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কাণ্ড-সংখ্যা-২৮৫টি। কৌষিতকী ব্রাহ্মণে ত্রিশটি অধ্যায় আছে। ব্রাহ্মণ ভিন্ন ঋগ্বেদের আর দুই অংশের বা শাখার বিষয় জানতে পারা যায়। তা আরণ্যক ও উপনিষৎ নামে অভিহিত। ঐতরেয় আরণ্যক এবং ঐতরেয় উপনিষৎ বিশেষ প্রসিদ্ধতা সম্পন্ন। ঐতরেয় উপনিষৎ ‘বহ্বৃচ ব্রাহ্মণ উপনিষৎ’ নামেও অভিহিত হয়। ঐতরেয় আরণ্যকে ঋগ্বেদের প্রত্যেক ঋষির পরিচয় আছে। ঐতরেয় আরণ্যকেই ঋগ্বেদের সূক্ত, পদ, পদাংশ, শব্দ, শব্দাংশ প্রভৃতি দেখতে পাই। প্রচীনকালে ঋগ্বেদ-সম্বন্ধে যে বিশেষ আলোচনা হয়েছিল, এ সকল তারই নিদর্শন।
সামবেদ
সামবেদ-সংহিতা-সম্বন্ধে ও বহু মতান্তর আছে। পুরাণ-প্রসঙ্গে দেখতে পাই, সামবেদের সহস্রাধিক শাখা ছিল। ইন্দ্রদেব বজ্রাঘাতে সে সকল শাখা বিনষ্ট করেন। শেষ অবশিষ্ট থাকে-সাতটি শাখা। সে সাতটি শাখার নাম-কৌথুমী(কৌথুম), রাণ্যায়ণ(রাণ্যায়ণীয়), শাট্যমুগ্র, কাপোল, মহাকাপৌল লাঙ্গালিক ও শার্দ্দুলীয়। এই সাতটি শাখার মধ্যে দুইটি শাখার এখন পরিচয় পাওয়া যায়; কোথমী ও রাণ্যায়ণ। কৌথুম ঋষি-প্রথম শাখার এবং রাণ্যায়ণ ঋষি-দ্বিতীয় শাখার প্রবর্তক। এর মধ্যে বঙ্গদেশে আবার সামবেদের কৌথুমী শাখার ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য শাখার ব্রাহ্মণ আদৌ নেই। বঙ্গদেশে সামবেদীয় ব্রাহ্মণ যাঁরা আছেন, প্রধানতঃ তাঁরা সকলেই কৌথুমী শাখার অন্তর্ভুক্ত। এই সকল শাখার আবার নানা উপাশাখা ছিল বলে জানতে পারা যায়। পূর্ব ও উত্তর ভেদে সামবেদের দুই বিভাগ। প্রপাঠক নামধেয় পরিচ্ছেদ দ্বারা সামবেদ বিভক্ত। পূর্ব অংশে ছয়টি এবং উত্তর অংশে নয়টি প্রপাঠক আছে। সামবেদের পূর্ব অংশ বা পূর্ব-সংহিতা-‘ছন্দকার্চ্চিক’ নামেও অতিহিত হয়। ছন্দজ্ঞ পুরোহিতরা ঐ অংশ ব্যবহার করে থাকেন। এই অংশই প্রধানতঃ গেয়। গ্রামিকগণ অর্থাৎ সংসার আশ্রমবাসিরা সামবেদের এই পূর্ব্বাংশ(পূর্ব-সংহিতা) গান করার অধিকারী। সামবেদের উত্তরভাগ(পরসংহিতা)-‘উত্তরার্চ্চিক’ নামে পরিচিত। ঐ অংশ আরণ্যকগণ কর্তৃক গীত হয়ে থাকে। সামবেদের ব্রাহ্মণভাগ আটটি। সে আট ব্রাহ্মণের নাম,-সামবিধান ব্রাহ্মণ, মন্ত্র মহাব্রাহ্মণ, আর্ষেয় ব্রাহ্মণ, বংশ ব্রাহ্মণ, দেবতাধ্যায় ব্রাহ্মণ, তলবকার ব্রাহ্মণ, তাণ্ডব ব্রাহ্মণ, সংহিতোপনিষৎ ব্রাহ্মণ। অদ্ভুত ব্রাহ্মণ নামে সামবেদের আর একটি ব্রাহ্মণের বিষয় অবগত হওয়া যায়। সামবেদের প্রধান উপনিষৎ-দুইটি;- ছান্দোগ্য উপনিষৎ এবং কেনোপনিষৎ। আরুণি, মৈত্রারুণি এবং মৈত্রয়ী উপনিষৎ-এই উপনিষৎ তিনটি সামবেদেরই অন্তর্গত। অধুনা যে ছান্দোগ্য উপনিষৎ প্রচলিত আছে, তা মন্ত্র-ব্রাহ্মণেরই শেষ আটটি প্রপাঠক। কেনোপনিষৎ-তলবকার ব্রাহ্মণেরই অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে প্রতিপন্ন হয়। কোনও কোনও মতে তলবকার ও কেন উপনিষৎ পরস্পর অভিন্ন। সামবেদীয় উপনিষৎ সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় অদ্বিতীয় বলে উক্ত হয়। ব্রহ্ম যে কি বস্তু, সামবেদের উপনিষৎ, প্রশ্নোত্তর ছলে, সে সম্বন্ধে নিগূঢ় উপদেশ প্রদান করে গেছেন। ব্রহ্ম সম্বন্ধে উপনিষৎ প্রথমে এরকম প্রশ্ন করছেন; যথা-
কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ, কেন প্রাণঃ প্রথমং প্রৈতিযুক্তঃ।
কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি, চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি ॥১॥
আবার উপনিষৎ নিজেই তার উত্তর দিচ্ছেন; বুঝাচ্ছেন,-ব্রহ্ম কি?-
শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্ বাচো হবাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।
চক্ষুযশ্চক্ষুরতিমূচ্য ধীরা প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি ॥২॥
যদ্বাচাভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে। তদেব ব্রহ্মং ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে ॥৪॥
ন্মসা ন মনুতে যেনাহুর্ম্নো মতম্। তদেব ব্রহ্ম ত্বঃ বিদ্ধি নেদং যদিজমুপাসতে ॥৫॥
যচ্চক্ষুবা ন পশ্যতি যেন চক্ষুংষি পশ্যতি। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে ॥৬॥
যচ্ছ্রোত্রেন ন শৃণোতি যেন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে ॥৭॥
যৎপ্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্রণীয়তে। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে ॥৮॥
অথর্ব্ববেদ
অথর্ব্ব-বেদ বহু শাখায় বিভক্ত। কেউ কেউ উহার শাখার সংখ্যা পঞ্চাশ বলে নির্দ্দেশ করেন। কিন্তু নয়টি শাখার নাম মাত্র এখন পাওয়া যায়। কেউ কেউ আবার এর পাঁচটি শাখা ছিল বলে নির্দ্দেশ করেন। সে সকল শাখার নাম পৈপ্পলাদ(পৌপ্পলাদ), শৌনকীয়, দামোদ, তোত্তায়ন, জায়ল, ব্রহ্মপালাশ, কুনখা, দেবদর্শী ও চারণবিদ্যা। যাঁরা নয়টি শাখার উল্লেখ করেন, তাঁরা নয় শাখায় ঐরকম পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও আবার মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন, ঐ নয় শাখার নাম অন্যরূপ; যথা,- পৈপ্পলাদ, স্তৌদ, মৌজা, শৌনকীয়, যায়ল, জলদ, ব্রহ্মবদা, দেবদর্শ ও চরণবৈদ্য(চারণ-বিদ্যা)। যাঁরা পাঁচটি শাখার বিষয় ঘোষণা করেন, তাঁদের মতে সেই পঞ্চশাখার নাম,- আন্ধ্র, প্রদাত্ত, স্নাত, স্নৌত, ব্রহ্মদাবন। এখন কিন্তু এক শৌনক শাখা ভিন্ন অন্য শাখা পাওয়া যায় না। শৌনক শাখায় ছয় হাজার পনেরটি মাত্র ঋক আছে। অর্থর্ব্ব বেদের ব্রাহ্মণের নাম-গোপথ ব্রাহ্মণ। শৌনক আদি চারটি শাখার ব্রাহ্মণ বলেই গোপথ ব্রাহ্মণ পরিচিত। অন্যান্য শাখার ব্রাহ্মণ এখন বিলুপ্ত হয়েছে। অথর্ব্ব বেদের উপনিষদ সমূহের মধ্যে প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, অথর্ব্বাশির, অথর্ব্বশিখা, বৃহজ্জাবল ও নৃসিংহতাপনী প্রসিদ্ধ। তারমধ্যে প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, নৃসিংহতাপনীয়-এই চারটি উপনিষৎ প্রাচীন ও প্রামাণিক বলে স্বীকৃত হয়। শঙ্করাচার্য্য প্রভৃতি ঐ চারটি উপনিষদের প্রাধান্যই কীর্ত্তন করে গেছেন। প্রশ্নোপনিষৎ কে পৈপ্পলাদ শাখার এবং মুণ্ডকোপনিষৎ কে শৌনকেয় শাখার উপনিষৎ বলে প্রতিপন্ন হয়। প্রশ্নোপনিষদ পিপ্পলাদ প্রশ্নকর্ত্তা এবং মুণ্ডকোপনিষদে শৌনক প্রশ্নকর্ত্তা আছেন বলে ঐরূপ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। মাণ্ডুক্য ও নৃসিংহতাপনীয় এক শ্রেণীর উপনিষৎ বটে; কিন্তু উহা কোন্ শাখার অন্তর্ভূক্ত, তা নির্ণয় করা কঠিন। কেন-না ঐ দুই উপনিষদে প্রজাপতি বক্তা এবং দেবতাগণ প্রশ্নকর্ত্তা। মাণ্ডূক্যোপনিষদে প্রাশ্নোত্তর নেই; উহা কেবল বর্ণনা মাত্র। কোনও মতে অথর্ব্ববেদের উপনিষৎ-সংখ্যা বায়ান্নটি। সেই বায়ান্নটি উপনিষদের নাম যথা,- (১-২) অথর্ব্বশিরস দুইখানি, (৩) অমৃতবিন্দু, (৪) আত্মান, (৫) আরুণীয় (৬) আনন্দবল্লী, (৭) আশ্রম, (৮) উত্তরতাপনীয়, (৯-১০) কঠবল্লী,-পূর্ব্ব ও উত্তর দুই ভাগ, (১১) কন্ঠশ্রুতি, (১২) কালাগ্নিরুদ্র, (১৩) কেনেষিত, (১৪) কৈবল্য, (১৫) ক্ষুরিক, (১৬) গর্ভ, (১৭) গারুড়, (১৮) চুলিকা, (১৯) জাবাল, (২০) তেজোবিন্দু, (২১) নারায়ণ (২২-২৭) নৃসিংহতাপনীয়-পূর্ব্ব তাপনীয় পাঁচ খণ্ড, উত্তর তাপনীয় এক খণ্ড, (২৮) নাদবিন্দু, (২৯) নীলরুদ্র, (৩০) ধ্যানবিন্দু, (৩১) পরমহংস, (৩২) পিণ্ড, (৩৩) প্রাণাগ্নিহোত্র, (৩৪) ব্রহ্ম, (৩৫) ব্রহ্মবিদ্যা, (৩৬) ব্রহ্মবিন্দু, (৩৭-৩৮) বৃহন্নারায়ণ-দুই খণ্ড, (৩৯) ভৃগুবল্লী, (৪০) মুণ্ডক, (৪১) প্রশ্ন, (৪২) যোগতত্ত্ব, (৪৩) যোগশিক্ষা, (৪৪-৪৭) মাণ্ডুক-চারভাগ, (৪৮) সন্ন্যাস, (৪৯) সর্ব্বপনিষৎসার, (৫০-৫১) রামতাপনীয় পূর্ব্ব ও উত্তর দুই খণ্ড, (৫২) হংস। অথর্ব্ববেদ বিশটি কাণ্ডে বিভক্ত। অনুবাক, সূক্ত, ঋক্-উহার অন্যরূপ বিভাগ সূচিত করেছে। এর আর এক বিভাগের নাম-প্রপাঠক। চরণব্যুহের মতে-অথর্ব্ববেদে বার হাজার তিনশত মন্ত্র ছিল; কিন্তু এখন অথর্ব্ববেদের মন্ত্র সংখ্যা- পাঁচ হাজার আট শত ত্রিশটি মাত্র। অথর্ব্ববেদের সঙ্কলন সম্বন্ধে তিনটি মত প্রচলিত। কারও মতে অথর্ব্ব ও অঙ্গিরা ঋষির বংশধরগণ, কারও মতে ভৃগু-বংশীয়গণ অথর্ব্ববেদ সঙ্কলন করেন। অন্য মতে যজ্ঞকার্য্যে অব্যবহার্য্য হেতু অথর্ব্ব, এই বিষয়ে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ