‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ ‘আমি কোনো কিছু বা কারো পক্ষে নই’।আপনি যদি ‘নিরপেক্ষ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে আপনাকে তো মানতেই হবে ধর্ম হোক বা অন্য কোনো বিষয়ে হোক আপনি কোনোটিরই পক্ষে নন। এটাতো হতে পারে না। নিশ্চয়ই আপনার একটা পক্ষ আছে। এমনকি যে ব্যক্তি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ কথা বলছে, তারও তো একটা ধর্ম আছে (নাস্তিক হলেও সেটা তার একটা নীতি বা একটা পক্ষ)।ধর্ম-নিরপেক্ষতা কথা টা সম্পূর্ণ ভাবে মানুষ কে প্রতারনা করার জন্য বব্যহৃত হওয়া একটা শব্দ।একটা সময় ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি বেশ হুজুগ সৃষ্টি করেছিল। কয়েক দশক ধরে কিছু মানুষ তাতে মেতে ছিল। তাদের ঘুম ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। এক সময় দেখল সেক্যুলারিজমের ওপর ভিত্তি করে যেসব দেশ ও সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা খানখান হয়ে গেছে। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র অর্থ হচ্ছে ‘ধর্মহীনতা’ যা কেনভাবে সম্ভব না।
আল্লাহ বলেন, ওয়ালাও শা’ রাব্বুকালা আমানা মানফিল আরযি কুল্লুহুম জামিয়া আফাআনতা তুকরিহুন নাসাহাত্তা ইয়াকুনু মুমিনিন অর্থাৎ ‘আর তোমার প্রভু প্রতিপালক যদি চাইতেন তাহলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই অবশ্যই এক সাথে ঈমান নিয়ে আসতো। তুমি কি তবে বল প্রয়োগে লোকদেরকে মুমিন হতে বাধ্য করতে পার?’ (সুরা ইউনুস ১০ঃ১০০)
আমরাও একটু দেখি কুরআন-হাদিস কি আসলেই নাস্তিক George Jacob Holyoake-কের ধর্মনিরপেক্ষতা শেখায় কিনা!
আগেই বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিচ্ছিন্নতার কোনো বিধান কুরআন-হাদিসে নেই। বরং আল্লাহ বলছেন,
يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ ٱدْخُلُواْ فِى ٱلسِّلْمِ كَآفَّةً
"হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর।" [সূরা বাকারা: ২০৮]
ইবন কাসীর (রহ.) এ-আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন, ইবন আব্বাস (রা.) এ-আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, এ-আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন,
ادخلوا في شرائع دين محمد صلى الله عليه وسلم ولا تَدَعوا منها شيئًا
"তোমরা পরিপূর্ণভাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বীনের সমস্ত আইনের আনুগত্য কর এবং সেখান থেকে কোনো কিছুই পরিত্যাগ করো না।"
এই আয়াতের তাফসীরে মুফতি শাফী (রহ.) বলেন, কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের নামই হচ্ছে ইসলাম। কাজেই এর সম্পর্ক বিশ্বাস ও এবাদতের সঙ্গেই হোক কিংবা আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিকতা অথবা রাষ্ট্রের সঙ্গেই হোক অথবা রাজনীতির সঙ্গেই হোক, এর সম্পর্ক বাণিজ্যের সঙ্গেই হোক কিংবা শিল্পের সঙ্গে - ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দিয়েছে তোমরা সবাই তারই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। [মা’আরেফুল কুরআন]
ফটিকছড়িতে ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থনে শেখ হাসিনা কুরআনের আয়াতকে ভুলভাবে প্রয়োগ করেছেন। তিনি বলেছেন, পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, লাকুম দিনুকুম অলিইয়াদিন। যার ধর্ম সে পালন করবে।
আসলে সূরা কাফিরূনের শেষ আয়াত "লাকুম দিনুকুম অলিইয়াদিন"-এর অর্থ হলো, "তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।" অর্থটি শেখ হাসিনারই উদ্বোধনকৃত কুরআনের একেবারে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ওয়েব সাইট থেকে নেয়া!
সব তাফসীর গ্রন্থে আছে, মক্কার মূর্তিপূজারীরা মহানবী (সা.)-কে এই শর্তে সমঝোতার প্রস্তাব দেন যে, মহানবী (সা.) একবছর কাফেরদের ধর্মপালন করবেন, কাফেররাও একবছর ইসলাম পালন করবে। এ-ধরনের আরো কিছু শর্তের মাধ্যমে তারা মহানবী (সা.)-র সাথে সমঝোতা করতে চায়। ওই সময় অবতীর্ণ সূরা কাফিরূনের মাধ্যমে আল্লাহ পরিষ্কার জানিয়ে দেন, মহানবী (সা.) কোনোভাবেই তাদের ধর্মের কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারেন না:
"বলুন, হে কাফেররা, আমি ইবাদত করি না তার তোমরা যার ইবাদত কর। এবং তোমরাও ইবাদতকারী তার নও, যার ইবাদত আমি করি এবং আমি তার ইবাদতকারী নই, যার ইবাদত তোমরা কর। তোমরাও তার ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।"
সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থে [ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনূদিত] আছে, মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাদের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব দিলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর চাচা আবু তালিবকে বলেন:
يَا عَمّ، وَاَللّهِ لَوْ وَضَعُوا الشّمْسَ فِي يَمِينِي ، وَالْقَمَرَ فِي يَسَارِي عَلَى أَنْ أَتْرُكَ هَذَا الْأَمْرَ حَتّى يُظْهِرَهُ اللّهُ أَوْ أَهْلِكَ فِيهِ مَا تَرَكْتُهُ
"হে চাচা, আল্লাহর শপথ, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদও এনে দেয় এই শর্তে যে আমি আমার কাজ পরিত্যাগ করবো, তাহলেও আমি কখনো আমার কাজ বন্ধ করবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ এটিকে বিজয়ী করেন অথবা আমি ধ্বংস হয়ে যাই।"
তাই কুরআন-হাদিসে শেখ হাসিনার আবদারকৃত "যার ধর্ম সে পালন করবে" এ-রকম কোনো অর্থ "লাকুম দিনুকুম অলিইয়াদিন"-এর পাওয়া যায় না - বরং পাওয়া যায়, কাফেরদের ধর্মকে মেনে না নেয়ার কঠোরতম দৃঢ় সিদ্ধান্ত।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে যারা নিজের খেয়ালখুশি মতো ইসলামের বিধি-বিধানসমূহকে আংশিকভাবে পালন করতে চায়, যারা নিজের খেয়ালখুশি মতো কুরআনের কিছু বিধান মানবে আর কিছু বিধান মানার দাবি তুললে হত্যা-নির্যাতন করবে, তাদেরকে আল্লাহ কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন এই বলে যে,
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ ٱلْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفْعَلُ ذٰلِكَ مِنكُمْ إِلاَّ خِزْيٌ فِى ٱلْحَيَاةِ ٱلدُّنْيَا وَيَوْمَ ٱلْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ ٱلّعَذَابِ
"তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা আর কিয়ামতের দিন এরা কঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।" [সূরা বাকারা : ৮৫]
মুখে যতই ইসলামের সেবক দাবি করুক, এসব আংশিক ইসলাম বিশ্বাসকারী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি পৃথিবীতে লাঞ্ছিত হবেই, আর কিয়ামতে পাবে কঠোর শাস্তি। এটাই মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা।
সংবিধানের ‛SECULAR’ ও ‛SOCIALIST’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে ইতিমধ্যেই। প্রকৃতপক্ষে এটি ভীমরাও আম্বেদকরের তৈরি সংবিধানের আদি রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ ভীমরাও আম্বেদকরের রচিত সংবিধানের খসড়ায় Secular ও Socialist – এই দুটি শব্দের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পরে ১৯৭৬ সালে দেশে জরুরি অবস্থার সময় সংবিধান সংশোধন করেন ইন্দিরা গান্ধী এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে এই দুটি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন সংবিধানে।
ভীমরাও আম্বেদকরের খসড়াকৃত সংবিধানকে এখনো পর্যন্ত ১০৪ বার সংশোধন করা হয়েছে। তাঁর মধ্যে বিজেপি সরকার এখনও পর্যন্ত ২০ বার সংবিধান সংশোধন করেছে। কিন্তু এর মধ্যে সবথেকে ন্যাক্কারজনক সংশোধনের ঘটনা ছিল ১৯৭৬ সালের কংগ্রেসের শাসনকালে। সেটা ছিল সংবিধানের ৪২ তম সংশোধন। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে, বিরোধী নেতাদের জেলবন্দি করে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব এনেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তারপর সংবিধানে অনুপ্রবেশ ঘটে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজবাদের। কিন্তু Secular ও Socialist কি গণতন্ত্রের পক্ষে উপযুক্ত? কারণ Secularism এবং Socialism প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক মতবাদ। Secularism গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ এটি সংবিধানের স্বাধীন ধর্ম আচরণের অধিকারকে খর্ব করে, যা সংবিধানের ২৫ নং ধারায় সুনিশ্চিত রয়েছে। এছাড়া, বাক স্বাধীনতার অধিকার যা সংবিধানের ১৯(১) (এ) ধারা প্রত্যেক ভারতবাসীকে অধিকার প্রদান করে, তাও খর্ব হয়। ফলে গণতন্ত্রের পক্ষে এই দুটি মতবাদ কখনোই কাম্য নয়।
তবে ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালের অনেক আগেই এই দুটি শব্দকে সংবিধানে ঢোকানোর অনেক প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই সেইসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে অধ্যাপক কেটি শাহ প্রস্তাব দেন যে সংবিধানে “Secular, federal and Socialist Nation” কথাটি যুক্ত করা হোক। কিন্তু ১৫ই নভেম্বর সেই প্রস্তাব খারিজ করে Constituent Assembly। ওই বছর ২৫ নভেম্বর, আর একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয় যে সংবিধানে Secular শব্দটি যুক্ত করা হোক। সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। তারপর একই বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর, আর একটি প্রস্তাব আনা হয় যে সংবিধানের ১৮নং ধারায় ‛Secular’ শব্দ যোগ করা হোক। কিন্তু সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে Constituent Assembly। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে, বাবাসাহেব আম্বেদকরের আদি সংবিধানে ‛Secular’ ও ‛Socialist’ এই দুটি বস্তুর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন।
স্বাধীন ভারত যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানের উদ্দেশিকা(Preamble) অনুযায়ী, স্বাধীন, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে যে রাষ্ট্র তার সব নাগরিকের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় নিশ্চিত করবে, চিন্তা, বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা প্রদান করবে এবং আত্মমর্য্যাদা ও জাতীয় ঐক্যকে নিশ্চিত করার জন্য সৌভ্রাতৃত্বের পথ অনুসরণ করবে। সেকুলারিজম – এর কোনো কথা তখন সংবিধানে ছিল না। ছাব্বিশ বছর পর বিয়াল্লিশতম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সোভারিনিটি( সার্বভৌমত্ব ) – র পরই ‘সেকুলার’ এবং’সোসালিষ্ট’ শব্দদুটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন এই সংযোজন হল তার কোনো গ্রহণীয় বিশদ ব্যাখ্যা বা বক্তব্য পাওয়া যায় না। বস্তুতপক্ষে প্রাথমিক উদ্দেশিকার ব্যাখ্যায় প্রশাসন ও ধর্মাচরণের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে যথেষ্টভাবে – ছাব্বিশ বছর পরে ‘ সেকুলার ‘ শব্দটির সংযুক্তি উদ্দেশিকা কে সুস্পষ্ট অর্থবোধক কোনো নুতনতর মাত্রা দিতে পারে নি বরং অভিজ্ঞতা বলছে অভাবিত এক বিভ্রান্তির অবকাশ সৃষ্টি করেছে। ‘সোস্যালিস্ট’ শব্দটির অনুপ্রবেশ ও সমান্তরাল অর্থনৈতিক আদর্শের অনুল্লেখে, অস্পষ্ট এবং ঘোলাটে থেকে গেছে। যে সময়ে শব্দ দুটির সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে তার সঙ্গে বর্তমান কালের বিশ্পরিস্থিতির তুলনা করল ঐ সংযোজনের তৎকালীন যান্ত্রিকতাও দূর- ভবিষৎ ব্যাপী-উদ্দেশ্যহীনতাই প্রকটিত হয়, বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তিতে এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে সোস্যালিজমের দূরাবস্থার নিরিখে। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী বলে ঐ শব্দদুটি কে বর্জন করার দাবীও একেবারে অযৌক্তিক – তা মনে হয় না।
দেখা যাক, ‘ সেকুলার ‘ শব্দটির সংযোজন কতটা অর্থবহ বা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পেরেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। সেকুলার শব্দ টি বিদেশী ভাষা লাটিন Seculum থেকে নেওয়া। খৃষ্টীয় পরিভাষায় এর অর্থ হল – যা চার্চ সংক্রান্ত নয় বা যাজকীয় নয় – Non ecclasiastical বা Non Religious বা Non Sacred(অপবিত্র), Profane. রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মাযাজকদের ভ্রষ্টাচারে ইউরোপের সাধারণ মানুষ যখন উৎপীড়িত, ক্লিষ্ট এবং হতাশাগ্রস্ত তখন চার্চের প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনই রাষ্ট্রীয় আদর্শের ক্ষেত্রে Non ecclesiastical বা সেকুলার ( secular) রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ঘটায় যা প্রথমদিকে যতটা না ঈশ্বরবিরোধী ছিল তার চাইতে অনেক বেশী ছিল চার্চবিরোধী। শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, সমাজ চিন্তায় এই চার্চবিরোধী মানসিকতা শেষ অবধি ঈশ্বর – নিরপেক্ষতায় বা ঈশ্বর বিরোধিতায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘secular’ শব্দটিকে একটি রেঁনেশাঁধর্মী মহিমা প্রদান করে। ইতালীতে মেকিয়াভেল্লিই প্রথম রাজনীতিকে ধর্ম বা নীতিশাস্ত্রের আনুগত্য থেকে মুক্ত করার প্রয়াস করেন। সেকুলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্রনীতির জন্ম এভাবেই হয় ইউরোপে। কিন্তু এই ‘সেকুলার’ রাষ্ট্রনীতি সুস্পষ্ট এক অবয়ব পেতে সময় নিয়েছিল বহুমুখী আন্দোলন সম্মৃদ্ধ প্রায় দুই শতাধিক বছর। সেকুলার রাষ্ট্রাদর্শ অনুযায়ী মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে তাদের সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও জাগতিক উন্নতির জন্য, সমাজকে ধারণ করে রাখে ধর্ম নয় – মানুষ রচিত বিধিবিধান ও নীতি – ঈশ্বরের অস্তিত্বই অনাবশ্যক ও অযৌক্তিক। চিন্তার পথ যুক্তির পথ, যুক্তির পথ বিজ্ঞানের পথ, বিজ্ঞানের পথ ই কল্যাণের পথ। চিন্তা করতে সক্ষম, সমস্ত জীব জগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ। মানুষ ই সব। সুতরাং ঈশ্বর বা ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক। সেকুলার চিন্তার এই হল মূলমন্ত্র, এই হল ভিত্তি। বস্তুবিজ্ঞানভিত্তিক এই রাষ্ট্রাদর্শ, ধর্মকেন্দ্রিক-সংঘর্ষ, যুদ্ধ, খুনোখুনি – ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে একশো ভাগই গ্রহণীয়। কিন্তু আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তির অতি দ্রুত এবং অভাবিত উন্নতির যুগেও ধর্ম নিয়ে সংঘাত, বিশেষ বিশেষ ধর্মের অধীনে সমগ্র বিশ্ব কে আনার প্রাতিষ্ঠানিক সুকোশলী প্রয়াস, রক্তক্ষয়ী প্রয়াস ও এখনও বিদ্যমান, কেন? তাহলে কি সেকুলার রাষ্ট্রচিন্তায় অথবা তার রূপায়ণ প্রয়াসে কোনো ‘ দুর্বল ‘ দিক থেকে গেছে? এ প্রশ্নটি আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গবেষণা বিষয় হওয়া উচিৎ। একথা প্রায় অনস্বীকার্য যে সেকুলার রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভবের পথ ছিল সঠিক কিন্তু সে চিন্তার বাস্তবায়ণ এবং ব্যপকীকরণ প্রক্রিয়ায় বিবর্তনের ইতিহাসে মানব প্রজাতির মানসিকতার বর্তমান অবস্থানে ধর্ম ও ঈশ্বরচিন্তা প্রভাবের মাত্রার মূল্যায়ন হয় নি ঠিকমতো। যে ধৈর্য্য এবং স্থৈর্য্যের সাথে মানুষের অন্তর্লোকে বিপ্লব ঘটানোর দরকার ছিল তা হতে পারে নি। মানবপ্রজাতির উপর ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাবের কথা চিন্তা করেই সম্ভবতঃ জন লক, ভলটেয়ার, মন্টেস্কু, ডি এলামবার্ট, রুশো প্রমুখেরা ধর্মহীনতার চাইতে পরধর্মসহিষ্ঞুতার উপর জোর দিয়েছিলেন। স্বয়ং লেলিনও মার্কসীয় আদর্শ গ্রহণ ও তার রূপায়ণের দায়িত্ব নিয়েও বাস্তবতার বিচারে সেকুলার বা ধর্মহীনতার প্রবক্তা হন নি অন্ততঃ তার ১৯০৫ সালের বক্তব্যে তাই মনে হয়। রাশিয়ার জারের কাছে বিপ্লবীদের পেশ করা দাবিগুলির প্রসঙ্গে লেনিন লিখেছিলেন ” The state must not concern itself with rligion ; religious societies must not be connected with the state power. Every one should be absolutely free to process whatever religion he prefers or recognize no religion…. There must be no discrimination whatever in the rights of citizenson religious grounds…. No state grants must be made to ecclesiastic and volentary associations of like minded citizens “. বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় লেলিনের মৃত্যুর আগেই ধর্ম বা ধর্মাচর সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধের Non-ecclesiastic পরিকাঠামো তৈরী হয়ে গিয়েছিল। নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপনের পর স্ট্যালিনের নির্দেশে ১৯২৯ সালে গঠিত হল “The League of militant Godless. ” ঈশ্বরহীনতা প্রচারের জন্য স্লোগান চালু হল “The fight for godlessness is fight for socialism.” কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিপুল উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্তরের মানুষের এমনকি দলীয় উচ্চস্তরের মানুষের মনের গভীর থেকে ধর্মের অস্তিত্ব মুছে গেল- এমন টা হল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু নিন্দিত, সমালোচিত জাতীয়তাবাদ তথা স্বদেশভক্তিকে স্থান দিতে হল এবং ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠোরতা কে অনেকাংশে শিথিল করতে হল। অর্থাৎ এত তাড়াতাড়ি চাইলেই ধর্মবিহীন বস্তুবিজ্ঞান নির্ভর সমাজ গঠন করা যাবে না – এ সত্য প্রকটিত হল এবং হতে থাকলো। ১৯৫৩ সালের মে মাসে অর্থাৎ স্ট্যালিনের মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে কট্টর মার্কসবাদী প্রবক্তা সেলপিন ( Komosomol- এর প্রথম সেক্রেটারি) জানান দিলেন “War against religious prejudice is an integral part of the fight for the communist education of the working class, for the education of active and conscientious builders of communism free of any anf all links to the past.” ষাটের দশকে দেখা গেল ‘fight for godlessness’ অতিদ্রুত ক্ষীয়মান, পরিসংখ্যান বলছে শিশুদের মধ্যে ৬০% কে চার্চ ব্যাপটাইজ করেছে-১৫% বিবাহ এবং ৩০% মৃত্যু অনুষ্ঠান চার্চের মতেই সম্পন্ন করা হয়েছে। কট্টরপন্থীরা তথ্য পেল ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ৭০% ই চল্লিশবয়োসর্ধ, মোট জনসংখ্যার ৬০% যে মহিলারা তাদের ৭০% ই ঈশ্বরবিশ্বাসী।শত চেষ্টা সত্ত্বেও পারিবারিক স্তর থেকে ধর্মাচরণকে, ধর্মবিশ্বাস কে হঠানো গেল না। আর আজ’ গ্লাসনস্ত’, ‘পেরস্ত্রৌইকা’ পেরিয়ে এসে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়াতে ধর্ম ফিরে এসেছে বিপুলভাবে- লেলিনগ্রাড শহরের নাম হয়েছে সেন্ট পিটাসবার্গ। সেকুলার বা ধর্মহীনতা – দর্শনের এই ঐতিহাসিক পরিণতি প্রত্যক্ষ করেও কেন ‘ সেকুলার’ শব্দটি ভারতীয় সংবিধানে ঢুকে পড়লো – এটি আশ্চর্য্যের বিষয়। পন্ডিত নেহেরু ছাড়া আমাদের সংবিধান প্রণেতারা কেউ ই ‘সেকুলার’ শব্দটিকে আমল ই দেন নি – সংবিধানের আদি উদ্দেশিকায় তা স্পষ্ট হয়ে ই আছে। বস্তুতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা বা পরধর্মসহিষ্ঞুতার কথাই প্রকারান্তরে স্থান পেয়েছিল। নেহরুর অভিলাষ পূরণের জন্য ই অথবা রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ মোতাবেক মার্কসবাদীদের খুশী করার জন্যই এবং সেই সঙ্গে তথাকথিত প্রগতিশীল পরিচয় তুলে ধরতেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের ৪২তম সংশোধন ঘটিয়ে ‘ সেকুলার’ শব্দটি সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন কিনা তা অবশ্যই চর্চার দাবি রাখতে পারে।
সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে পণ্ডিত নেহেরু ছাড়া আর সবাই উদ্দেশিকায় সন্নিবেশিত প্রতিশ্রুতির মধ্যেই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ঞুতা কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন – অবাস্তব বলেই সম্ভবত ধর্মহীনতা বা সেকুলারিজম কে গুরুত্ব দেন নি। ৪২- তম সংশোধনে ‘সেকুলার’ শব্দটি যোগ করার পর ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মসহিষ্ঞুতা এবং ধর্মহীনতার এক বিচিত্র সমাবেশ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে সংবিধানকে ইচ্ছামত ভাষ্যপ্রদান করার এক অস্ত্র তুলে দিল। সংবিধানের অন্তর্নিহিত বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিহীন-সামঞ্জস্যহীন বহু ঘটনা ঘটতে লাগলো। ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত এইবার প্রাসঙ্গিকতার মধ্যে এসে যাচ্ছে।
১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদে রামলালার মূর্ত্তির অনুপ্রবেশ, সোমনাথ মন্দিরের দ্বার উদ্ঘাটনে রাষ্ট্রীয় প্রধানদের সংযুক্তি, হিন্দু কোডবিল পাশ রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে- আইনের সাম্যকে অর্থহীন করে তুলে মুসলিম পার্সোনাল ল’এর সংরক্ষণ – শাহবানু মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়কে রাজনৈতিক স্বার্থে বানচাল করা- এসবই সেকুলারিজমের নামে, ধর্মনিরপেক্ষতা নাম দ্বিচারিতা মাত্র। কিন্তু খুবই দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয় এবং উদ্বেগের বিষয়ও এই যে ভারতীয় নাগরিকের একটি অংশ প্রথম পরিচয় হিসেবে ধর্মকেই মুখ্য মনে করে- ভারতীয়তাকে গৌণ মনে করে। এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূলে কুঠারাঘাতের তুল্য। কারণ প্রথম অংশের সাথে দ্বিতীয় অংশের সংঘাত অনিবার্য। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবহমান সংঘর্ষের মূল কারণ এটাই। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের এ ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই- এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচয় কেএটাই আবছা করে দিচ্ছে আর এই আলো-আঁধারীকেই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে আগ্রহী রাজনৈতিক নেতারা। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের স্বার্থে কিছু রাজনৈতিক দল তথা নেতা কখনো সেকুলারিজম কে তুলে ধরে, কখনো বা ধর্মনিরপেক্ষতার ধূয়ো তুলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাঙ্খা ভাবাবেগ কে তুচ্ছ করে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উগ্রতা কে পরোক্ষভাবে প্ররোচনা দিতে থাকলো – রাষ্ট্রের সাধারণ স্বার্থ কে দিয়ে ও একাজ চলতে থাকলো। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষজন দেখেছে উদ্বেগের সঙ্গে, কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ এবংঅন্যান্য সীমান্ত রাজ্যগুলিতেও বহিরাগত মুসলিমরা রাজ্যের জনচিত্রের চরিত্র পাল্টে দিয়েছে – দিচ্ছে – বিশেষ করে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থা ভয়াবহ। বহিরাগত মুসলিমরা যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে এখানে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে এমন সরলীকৃত ব্যাখ্যা যে প্রযোজ্যো নয় পরিকল্পিতভাবে জনচিত্র পাল্টানোর ব্যাপারটি ও আছে যার সঙ্গে প্যান – ইসলামিক জগতের বৃহত্তর স্বার্থ এবং বৈরী পাকিস্তানের কূট অভিসন্ধিও জড়িত – এটি একটি নির্মম এবং অতি বাস্তব সত্য। আমদের সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি বালিতে মুখ গুঁজে এসব না দেখার ভান করে এসেছে এবং এখনও করছে ঐ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, সেকুলারিজমের নামে – না হলে বহিরাগতরা অতি দ্রূত রেশনকার্ড পেয়ে স্বল্পায়াসে এবং অনায়াসে ভারতীয় নাগরিকত্ব ও অর্জন করতে পারছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে কি করে? সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক গড়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রেখে রাজনৈতিক দলগুলির এই যে দ্বিচারিতা ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমের নামাবলীর আড়ালে, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ ক্রমশ বুঝতে পেরেছে এবং নিজেরাই তার প্রতিকারকল্পে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে তাদের সীমাবদ্ধ চিন্তানুযায়ী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন দেখেছে কাশ্মীরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পন্ডিত উৎখাত হয়ে আশ্রয় শিবির বাস করছে এবং সেকুলারিজম স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বিকার থেকেছে আবার গুজরাটে সাম্প্রতিক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলিমদের আশ্রয় শিবিরে যেতে হয়েছে দেখে ঐ রাজনৈতিক দলগুলিই সোচ্চার হয়েছে ঐ ‘ সেকুলারিজম ‘ এর জন্যই – কাশ্মীরে বেছে বেছে হিন্দু গণহত্যায়, মন্দিরের হিন্দু পুরোহিতদের শিরচ্ছেদে যারা নির্বাক থেকেছে, গোধরায় করসেবকদের পুড়িয়ে মারায় যারা নির্লিপ্ত থেকেছে – বাংলাদেশে হাজার হাজার মা-বোনেদের লুন্ঠিত ও ধর্ষিত হচ্ছে জেনেও যারা স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করছে, ‘ সেকুলারিজম ‘ এর স্বার্থে তারাই আবার বোমায় বিধ্বস্ত আফগানদের জন্য প্রতিবাদ মিছিল করছে, গুজরাটের ঘটনাবলীর জন্য প্রতিবাদের ঝড় তুলছে- এগুলি কি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু নয়? গুজরাটে নাকি ” রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ” চলছে! বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের পুড়িয়ে মারা- নানুরের হত্যা – ছোটো আঙারিয়ার হত্যাকাণ্ড – এরম আরো আরো ঘটনা – ওগুলি কি ” প্রগতিশীল সন্ত্রাস ” বলে উপভোগ্য? সেকুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবোধের এইসব ‘ন্যাক্কারজনক’ উদাহরণ বৃহত্তর জনসমাজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদের ধ্বংস সাধন এবং ২০০২ সালের গুজরাটের দাঙ্গা চরিত্র তার উদ্বেগজনক পরিণাম। স্বার্থান্ধে বিকৃত ‘ ধর্মনিরপেক্ষতা, সেকুলারিজ এবং মানবতাবোধ ‘ থেকে সাধারণ মানুষের নিষ্কৃতি পেতে চাইছে তার স্তরের ভাবনা-চিন্তা অনুযায়ী। কিন্তু কেন এমন হল? আমরা কি ‘ সেকুলারিজম ‘ অনুসরণ করার অযোগ্য? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে বুঝতে কি অপারগ? আসলে খুব ভালো করে বিশ্লেষণ করলে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে আমাদের দেশে জনজীবনে ‘ ধর্মহীনতা’ বা ‘ সেকুলারিজম ‘ একেবারেই অপ্রযোজ্য – ধর্মনিরপেক্ষতা বা পরধর্মসহিষ্ঞুতার তবুও একটা আবেদন আছে। সেকুলারিজম বা ধর্মহীনত অপ্রযোজ্য – তার কারণ এটিকে কৃত্রিমভাবে এবং অনুপযুক্ত সময়ে সংবিধানে ঢোকানো হয়েছে শুধুমাত্র ইউরোপীয় সেকুলার রাষ্ট্রাদর্শকে প্রগতিশীলতার প্রতীক হিসেবে সামনে রেখে। ইউরোপে সুদীর্ঘ দুই শতক ধরে সেকুলারিজম – এর আন্দোলন চলেছে- বহু উত্থান পতন অতিক্রম করেএর যথার্থতা জনসাধারণ সাধারণভাবে স্বীকার করেছে। এই স্বীকৃতির অনুকূল একটা বাতাবরণ ও ছিল। সেটি হল সেখানের জীবনচর্যা অনেকাংশে বস্তুবিজ্ঞান আধারিত । কিন্তু আমাদের দেশের জীবনচর্যা প্রধানতঃ আধ্যাত্মবিজ্ঞান বা দর্শন আধারিত এবং বহু প্রাচীনকাল থেকে যেকালে ইউরোপীয় সভ্যতার উদ্ভবই ঘটে নি। সুতরাং শিল্প বিপ্লবের পর পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ঘাত এসে পড়লেও প্রায় সাত হাজার বছর ধরে অনুশীলিত দর্শন ভুল হোক বা ঠিক ই হোক, হঠাৎ করে শূন্যে বিলীন হতে পারে না। দীর্ঘস্থায়ী যে আন্দোলন অনুশীলিত দর্শন কে পর্যায়ক্রমে প্রতিস্থাপন করতে পারতো সে আন্দোলনই হয় নি। নেহেরুর ই সমকালীন এবং এদেশে সেকুলার চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এম. এন রায় ও এ আন্দোলন করতে পারেন নি – সীমিতভাবে কযেকজন চিন্তাবিদদের মধ্যেই এটা সীমিত ছিল। সুতরাং অতি মুষ্টিমেয় কয়েকজন যেমন একজন নেহেরু, চাইলেই জনসাধারণ এবং সব নেতারা সেকুলার হয়ে যাবেন তাতো হয় না ! যারা ‘ সেকুলার ‘ হয়ে যান সময় বিশেষে, তারা প্রকৃত অর্থে কতটা সেকুলার? সেকুলার এক রাজনৈতিক দলের প্রধান রামমন্দিরের শিলান্যাস করেন কেন? সেকুলার এক রাজনৈতিক দলের নেতা এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘ শাহবানু’ দের চোখের জল মোছাতে পশ্চাৎপদ হলেন কেন? সেকুলার অপর এক ‘প্রগতিশীল’ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময়ে ধর্মসম্প্রদায় বিশেষের প্রধানের কাছে ‘ mandate’ এর ভিখারী হয় কেন? Fight for godlessness is the fight for socialism যাদের দর্শন তাদের প্রশাসন দক্ষিণবঙ্গে ‘ বনবিবি’ উৎসবে মেতে ওঠেন কোন ‘সেকুলার’ আদর্শের তাড়নায়?
ধর্মের বিপথগামীতা বা ভ্রষ্টাচার থেকে মুক্ত হয়ে ‘ সেকুলারিজমের’ ভন্ডামীর খপ্পরে পড়া, এটাই কি কাম্য ছিল? এ যেন from frying pan to fire অথবা টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস ! এই বিকৃত সেকুলারিজম পক্ষপাতপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ই স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও জাতীয় সংহতিবোধ, ভারতীয়তাবোধ এক প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। বুদ্ধিজীবীদের এক্ষেত্রে একটি বিরাট সদর্থক ভূমিকা পালন করার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ভূমিকা পালন করছেন না বা করতে চাইছেন না স্বার্গত নানা ধরনের হিসেবের জন্য। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসাধারণ এবং মুখ্য সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণ উভয়েই বিপুল ক্ষতি এবং ক্ষতচিহ্ন নিয়ে, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ নিয়ে আজ মুখোমুখি। জাতীয় স্বার্থে এই অবস্থার সদর্থক পরিবর্তন দরকার, প্রতিকার দরকার, দরকার পারস্পরিক কল্যাণ কামনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাস্তব অবস্থার সঠিক মূল্যায়নে এবং তদনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে সুস্থ পরিবেশ তৈরী করা। এ কাজ বর্তমানে কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মানসিকতা বুঝতে হবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের, অন্যদিকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতা বুঝতে হবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের। সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত ধর্মীয় কারণে দাঙ্গার মাধ্যমে ভারত ভাগ করার জন্য যে বেদনাবোধ হিন্দুদের আছে এবং তারপরেও ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিমদের দিক থেকে যে সহযোগিতামূলক আচরণ হিন্দুরা প্রত্যাশা করেছিল তা রাজনৈতিক দলগুলির স্বার্থান্ধ আচরণে ও হস্তক্ষেপে এবং পাকিস্তানের প্ররোচনায় যেভাবে বিপথগামী হয়েছে তার অনুধাবন করতে হবে ভারতীয় মুসলিম সমাজকে, অপরদিকে শিক্ষায় অনগ্রসর দারিদ্রপীড়িত হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত মুসলিম সমাজের যুগোপযোগী সামাজিক পরিবর্তনে প্রগতিশীল মুসলিম ব্যক্তিদের সহযোগিতায় হিন্দু শিক্ষিত সমাজকেও উদ্যোগী হতে হবে। একাজ যেটি সত্যিকারের সংহতি রক্ষা ও বৃদ্ধির কাজ, তা হচ্ছে না – পরন্তু অশিক্ষা ও দারিদ্রক্লিষ্ট মুসলিম আমজনতার ধর্মীয় বোধে সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এজন্যই যেখানে হিন্দু সমাজে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ইত্যাদির উত্থান সম্ভব হয়েছে – মুসলিম সমাজে তা হতে পারে নি। এটা সম্ভব করার জন্য মুসলিমদের চাইতে হিন্দুদের দায়িত্ব বেশী কারণ ” পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে”, অপর পক্ষে মুসলিম সমাজের আলোকপ্রাপ্ত অংশকে অগ্রণী হতে হবে হিন্দু মুসলিম যৌথ উদ্যোগে মুসলিম সমাজে অতি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার জন্য। ইংরাজ শাসনের শুরুতে ভারতে মুসলিম সমাজে শিক্ষিতের হার কম ছিল না। কোলকাতা মাদ্রাসা ই প্রথম ইংরাজ স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইংরাজ বিচার – ব্যবস্থায় মুসলিমদের প্রাধান্য দিয়েছিল, হিন্দু কে দিয়েছিল রাজস্ব ব্যবস্থা র। ‘দশশালা’ বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর দেখা গেল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হিন্দুদের আরথিক অবস্থা দ্রুত উন্নত হল আর সময় মতো খাজনা দিতে অক্ষম হওয়াতে মুসলিমরা আর্থিক দিক থেকে পঙ্গু হতে থাকলো। কিছুকালের মধ্যেই এক স্পষ্ট আর্থিক পুনর্বিন্যাস সাধিত হল যাতে করে অবস্থা ভালো হওয়া হিন্দুরা ইংরাজী শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে পাশ্চাত্য ধ্যান – ধারণা বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হল। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ, শাসকশ্রেণী থেকে বিচ্যুত মুসলিমরা ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা বর্জন করে সংকীর্ণ ধর্মীয় বেড়াজালে আবদ্ধ করতে থাকে নিজেদেরকে। ঊনবিংশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ যা মূলতঃ বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তা কার্য্যতঃ হিন্দু নবজাগরণে পরিণত হল। হিন্দু – মুসলিম সমাজের মধ্যে এই বৌদ্ধিক পার্থক্য ধীরে ধীরে একটা স্থায়ী রূপ পেতে থাকে – মানসিক দূরত্বও ক্রমবর্দ্ধমান হতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য এবং ঐক্য স্থাপনের জন্য গান্ধীজি খিলাফৎ-আন্দোলন শুরু করেন – হিন্দু মুসলিম কাছাকাছি আসার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও শেষ অবধি ওয়াহাবি ইন্দোলনের প্রভাবে সে সম্ভাবনা বিনষ্ট তো হলোই উপরন্তু খিলাফৎ আন্দোলনের সুবাদে সংগঠিত হওয়া মুসলিম সমাজে ধর্মীয় উগ্রতা ঠাঁই করে নিল, যার প্রকাশ দেখা যায় কেরালার মোপালা বিদ্রোহের সাম্প্রদায়িক চরিত্রে – বহু হিন্দুর নিধনে এবং বলপূর্বক ধর্মান্তকরণে। ধর্মান্তরিত হিন্দুদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে শেষ অবধি খুন হলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। কিন্তু কেন খিলাফৎ আন্দোলন ধর্মীয় উগ্রতায় পর্যবসিত হল? এটি ব্যাখ্যার জন্য আমাদের যেতে হবে মুসলিম ধর্ম বাস্তৃতির গোড়ার দিকের ইতিহাসে।
হজরত মহম্মদের জীবন দর্শনের দুটি অধ্যায় (১) মক্কার অধ্যায় এবং (২) মদিনার অধ্যায়। মক্কার মহম্মদ সত্যদ্রষ্টা মানবপ্রেমিক নীতির প্রবক্তা আর মদিনার মহম্মদ বিজয়ী বীর ও রাষ্ট্রনায়ক। মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছে মদিনার বিজয়ী রাষ্ট্রনায়ক মহম্মদের আদর্শে, যেখানে প্রয়োজন ছিল পৌত্তলিক আরব ও ইহুদীদের নির্মম শত্রুতার বিরুদ্ধে অন্ধ আনুগত্য ও বিপক্ষের প্রতি সন্দেহশীলতা – এটি ছিল তৎকালীন প্রয়োজনে সাময়িক স্ট্র্যাটেজি – যদিও মুসলিম সমাজে এটিই স্থায়িত্ব পেয়ে যায়। যেমনমদিনায় অবতীর্ণ একটি সুরার শেষে বলা হয়েছে ” হে বিশ্বাসীগণ আল্লাহর রোষে যারা পতিত হয়েছে সেই দলের লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না।” (৬০:১৩) টীকাকার বলেছেন এখানে ইহুদীদের কথাই বলা হয়েছে – সমসাময়িক মুসলমানরা হয়ত এই কথাই ভালো করে বুঝেছিলেন এবং তাদের অনুবর্ত্তি পরবর্তী মুসলমানেরা হয় তো বুঝে নিয়েছে – যারা মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না। কিন্তু এটিও সার্বিক ভাবে সত্য ছিল না। বিচারবুদ্ধি সমন্বিত সুফী মতবাদ যার প্রবক্তা ছিলেন ইমাম আবু হানিফা, তার প্রভাবও ব্যাপক ছিল। ভারতবর্ষে সুফী মতবাদ ই প্রাধান্য পাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এর প্রমাণ, যে সময়ে গজনীর মাহমুদ হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও ধনরত্ন লুঠ করেছিল ঠিক সেই সময়েই আলবিরুনী বিশেষ শ্রদ্ধায় ও যত্নে হিন্দু জ্ঞান – বিজ্ঞান আহরণ করে তাঁর দেশকে সেই জ্ঞানে সম্মৃদ্ধ করেছিলেন। তবে এ কথাটাই চরম সত্য যে বিচার বিশ্লেষণ ও মধ্যপন্থা বাদ দিয়ে কঠোরভাবে শাস্ত্রপন্থীরা (মদিনা) শেষ অবধি ইমাম গাজ্জালী তথা ত্রয়োদশ শতকের শেষে আবির্ভূত ধর্মগুরু ইবনে তায়মিয়ার প্রভাবে মুসলিম সমাজ কে গঠন করেন। ভারতে সুফী মতবাদের প্রভাব একসময় থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে তায়মিয়ার ভাবশিষ্য আব্দুল ওয়াহাবির প্রচেষ্টায় ভারতে সুফী মতবাদের অবলুপ্তি ঘটে। ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের গতি প্রকৃতি অনুধাবন করলেই তা বোঝা যায়। এককালে ভারত কে ” দারুল হরব ” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, পরে ” দারুল ইসলাম ” বলে গ্রহণ করে দ্রুত ইসলামী করণের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক মুসলমান জমিদার ও সাধারণ মানুষ বৃহৎ হিন্দু সমাজের সংস্পর্শের কারণে হিন্দু পূজা-পার্বণকে গ্রহণ করেছিল বিশেষ করে বাংলাদেশে। হিন্দু – মুসলিম সোহার্দ্যের একটি সংস্কৃতি রূপ নিচ্ছিল। কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলন তাকে ব্যহত করে এবং ভারতীয়ত্ব নির্মাণে সেটিই এক বাধায় পরিণত হয় এবং এখন সেই বাধাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে কট্টরপন্থীদের নিরন্তর প্রয়াসে। ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের মধ্যেই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ‘ জিহাদের ‘ অনুপ্রেরণায় জন্ম নিয়েছে উগ্রপন্থা, গোটা বিশ্ব আজ যে ত্রাসের সম্মুখীন, ভারত তো বটেই। এইরকম জটিল পরিস্থিতি থেকে আমরা কি মুক্তি পাব না? মিঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গর কবলে পড়াই কি আমাদের ভবিতব্য? এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে ‘তত্ত্বজ্ঞান’ নয় কিছু কান্ডজ্ঞান নিয়েই আমাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে এবং প্রধানতঃ মুসলিম সমাজকেই। এটা কোনো পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গী ভাবলে ভুল হবে। ৮০% মানুষের সঙ্গে সব ব্যাপারে পাল্লা দিয়ে তুলনা করাটা সমীচীন হয় না হতে পারে না। একজন হিন্দু পাকিস্তানে কেমন আছে, বাংলাদেশে কেমন আছে, তালিবান শাসনাধীন আফগানিস্তানে কেমন ছিল তার তুলনায় ভারতে একজন মুসলিম কেমন আছে – এটা ভাবলেই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর উদ্ভব ঘটবে। কান্ডজ্ঞানই দিকনির্দেশক হবে। দাঙ্গা ঘটিয়ে ভারত ভাগ করার পরও পর্যায়ে পর্যায়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে কারা হিন্দু না মুসলিম? কেন প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলিতে হিন্দু সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে অথচ ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এর কারণ হৃদয়ঙ্গম করা দরকার নয় কি? ভারতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে সহযোগিতার বাতাবরণ তৈরী করে থাকার জন্য সংখ্যালঘুদের প্রতি আবেদনকে ” ব্ল্যাকমেলিং” বলে চিহ্নিত করতে রাজনৈতিক ধান্ধাবাজদের অভাব নেই – আপাত গ্রাহ্য যুক্তিও খাড়া করা যায় কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এর যৌক্তিকতা কে অস্বীকার করা যায় কি? এ আবেদন অতীতেও করা হয়েছিল। একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৮৩ সালে একটি খৃষ্টান মাইনোরিটি ডেলিগেশনের কাছে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন ” …. Minority can not claim to be safeby constantly irritating the mejority. “ ইন্দিরা গান্ধী কি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গ থেকে এ কথা বলেছিলেন না বাস্তব অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন? শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মুসলিম বুদ্ধি জীবীরা এই সত্য উপলব্ধি করেন অনেকেই – সাধারণ মুসলিম জনসাধারণ ও অনেকাংশে তা করে কিন্তু করতে চায় না রাজনীতিসর্বস্ব মুসলিম নেতারা যাদের ধর্মীয় উস্কানির ফলে উপলব্ধ সত্য অন্তরালেই থেকে যায়। ‘Rediscovery of India’ – র লেখক, সুদীর্ঘকাল
U. N. O-তে কাজ করার বিপুল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ আনসার হোসেন খান তাঁর বইতে লিখেছেন “….. Mr. Sahabuddin and Mr. M. J. Akbar, leave alone the of the shahi masque in Delhi were barking up the wrong tree….. they were only leading the community of Indian Muslims astray by legislation….. those who took the line might get leadership but that road was destructive. It should be abandoned at once and the foundations laid for a permanent reconciliation. Failing that the flames would rise higher and in the end we could predict exactly which community would suffer most and count the greater number of corpses….. Indian Muslims must remember that their forefathers or rather their mediave coreligionist minority – rulers of India were beastly and frightful to Hindus( with exceptio such as Akbar). No Islam sanctioned their conduct. Temples were indeed demolished and their stones often used to construct mosques on the very site. ”
দেশ ভাগের রক্তাত পটভূমি তে প্ররোচনা থাকা সত্বেও হিন্দুরাষ্ট্রের দাবী ওঠে নি – এখনো সে দাবী নেই বললেই চলে। কিন্তু কে বলতে পারে নিরবচ্ছিন্ন- সংখ্যালঘু ধর্মীয় উগ্রতা, অসহযোগিতা এবং জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া আগামীদিনে এ দাবীকে অনিবার্য করবে কিনা ! সেই পরিস্থিতি কি মুসলিমদের কাছে বাঞ্ছনীয়হবে?
তথ্যসূত্র :
১) ” Vive constitution proceedings” , Ambedkar’s lecture
২) “Sotsializm i reliigiya” in Polnoe Sobranie Sochineii Moscow 1960 :The Radical
Humanist 41 NO 2.
৩) Kommunist No 7(1953)
৪) হিন্দু মুসলমানর বিরোধ – কাজী আব্দুল ওদুদ( বিশ্বভারতী বক্তৃতামালা)
৫) সেকুলার রাষ্ট্র : সেকুলারিজম ও ধর্ম – ‘ ভাবনা চিন্তা’ ১লা জুন, ২০০০
৬) Rediscovery of India – ANSAR HOSSIAN KHAN (Orient Longman)
৬) পুরোগামী, জানুয়ারি ১৯৯০
* ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উৎস হিন্দু ধর্ম। কেউ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিশ্বাস করলে তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। আর বিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে হিন্দু ধর্মের প্রথায়।
- ড. অমর্ত্য সেন* ইসলাম জীবনকে ধর্মনিরপেক্ষ অংশ এবং ধর্মীয় অংশ এমন বিভাজন করে না।
- প্রফেসর জেফরি লাং; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির গণিতের অধ্যাপক।
* ভারতীয় উপমহাদেশে যে সেকুলারিজম ধারণা পাওয়া যায় সেটা আসলে খাঁটি ইসলামবিদ্বেষ। ইসলামের বিরুদ্ধে এই ঘৃণা-বিদ্বেষকে আড়াল করতেই সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষবাদী শব্দটা ব্যবহার করা হয়।
- গৌতম দাস
* ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি নিরেট কুফরী মতবাদ। ইসলামের সাথে এর আপোষের কোন সুযোগ নেই।
- প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
* ধর্মনিরপেক্ষতা হলো-Green Snake in Green Grass অর্থাৎ সবুজ ঘাসে হরিৎবর্ণ বিষধর সরিসৃপ। আর এই সরিসৃপটির কাজই হলো যেকোনো উপায়ে ইসলাম ও মুসলমানকে দংশন করা।
– অধ্যাপক আবু জাফর
অতএব, দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট, জঘন্য, হীন, বদমায়েশি, শয়তানি, মানবতাবিরোধী, হারামি মতাদর্শ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা।
আধুনিক বিশ্বে ইসলাম দলন, ইসলামের বিকৃতি এবং মুসলিম নির্মুল, নিধনের জন্য যে মতবাদ বা মতাদর্শ সৃষ্টি করা হয়েছে তাই হল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা।
মুসলমান কখনও ধর্মনিরপেক্ষ বা কুরআন নিরপেক্ষ বা ইসলাম নিরপেক্ষ বা সেকুলার বা ঈমান নিরপেক্ষ হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা মানুষের সৃষ্টিকর্তা। ইসলাম তাঁর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। মানুষের জন্য তিনি এই দ্বীন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ-ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা ধর্ম মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসরণ করবে, তার পক্ষ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (আলে ইমরান ৩ : ৮৫)
যারা ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছুর অনুসারী, তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করা হবে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ
দ্বীন (গ্রহণ)-এর বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। হেদায়েতের পথ গোমরাহী থেকে পৃথকরূপে স্পষ্ট হয়ে গেছে। (বাকারা ২ : ২৫৬)
আর যারা আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা পরিপূর্ণরূপে ইসলাম অনুসরণে বাধ্য। তারা তো ইসলাম গ্রহণ করেছেই আল্লাহর ইবাদতের জন্য, তাঁর বিধান মানার জন্য। ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (বাকারা ২ : ২০৮)
অন্য আয়াতে এসেছে-
وَإِذْ نَتَقْنَا الْجَبَلَ فَوْقَهُمْ كَأَنَّهُ ظُلَّةٌ وَظَنُّوا أَنَّهُ وَاقِعٌ بِهِمْ خُذُوا مَا آَتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘এবং স্মরণ কর, যখন আমি পাহাড়কে তাদের উপর এভাবে তুলে ধরলাম, যেন একটি শামিয়ানা, আর তারা ভেবে নিয়েছিল, এটি তাদের উপর পতিত হবে, (তখন আমি হুকুম দিয়েছিলাম) আমি তোমাদেরকে যে কিতাব দিয়েছি, তা মজবুতভাবে আকড়ে ধর এবং তাতে বর্ণিত বিষয়সমুহ স্মরণ রাখ। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (আরাফ ৭ : ১৭১)
মুসলমান ইসলামের অনুশাসন মানতে বাধ্য বলেই গুনাহ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিভিন্ন শাস্তি তার উপর আপতিত হয়। দুনিয়াতে কোনো গুনাহের শাস্তি বন্দিত্ব, কোনোটার শাস্তি বেত্রাঘাত, হস্তকর্তন ও মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি। সবচে বড় গুনাহ হল মুসলিম থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া। একেই বলে ‘মুরতাদ’ হওয়া। ‘মুরতাদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম হল, ইসলাম ত্যাগ করা, ইসলামের কোনো মৌলিক আকিদা বা বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার আলামত বহন করে। এককথায় ঈমান বিনষ্টকারী যে কোনো কুফরী-শিরকী আকিদা বা বিশ্বাস পোষণ করা, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়ার নামই হল ‘ইরতিদাদ’ বা মুরতাদ হওয়া।
যে সকল কারণে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় এর বিভিন্ন কারণের মধ্য হতে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।
১. আল্লাহ তাআলার শানে বেয়াদবি করা।
২. ইসলামের শিআর তথা প্রতীকসমূহের অবমাননা করা। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা কৌতুক করা।
ইসলামের মৌলিক শিআর হল; কুরআন মাজীদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ; বিভিন্ন ইবাদত যথা-নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত, দোয়া-দরূদ; বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ স্থান যথা-মসজিদে নববী, কা’বা শরীফ, মসজিদে আকসা এবং পৃথিবীর সকল মসজিদ ইত্যাদি। এগুলোর অবমাননা যেমন, মসজিদকে গোয়ালঘর বলা, কোরআন মাজীদকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলা, নবীজীকে যুদ্ধবাজ বলা, তাঁর নামের অবমাননা করা ইত্যাদি।
৩. ইসলামের কোনো বিধান, ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ কোনো বিষয়, নবীজীর কোনো সুন্নত, এমনকি প্রমাণিত কোনো মুস্তাহাব আমল ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করা অথবা অবজ্ঞা-প্রকাশক কোনো আচরণ করা। যেমন কুকুরের মাথায় টুপি পরানো, বোরকাকে বেশ্যার পোশাক বলা ইত্যাদি।
৪. জরুরিয়াতে দ্বীন তথা সর্বজনবিদিত অকাট্য দ্বীনী বিষয়সমূহের কোনো একটি অস্বীকার করা, অপছন্দ করা, বা তার অপব্যাখ্যা করা, অথবা তার উপর আপত্তি তোলা কিংবা তা সংস্কারযোগ্য বলে মনে করা। যেমন খতমে নবুওত অস্বীকার করা, চুরির শাস্তির উপর আপত্তি করা ইত্যাদি।
৫. ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা কোনো ধর্মই না মানা। যেমন আল্লাহকে বিশ্বাস না করা, প্রকৃতিবাদী হওয়া, খৃস্টান বা তাদের ভাষায় ‘ঈসায়ী মুসলমান’ হওয়া ইত্যাদি।
৬. এমন কোনো কাজ করা বা বিশ্বাস পোষণ করা, যা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ পরিপন্থী। যেমন কোনো প্রতিকৃতির সামনে মাথা নত করা, মাজার তওয়াফ করা, উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে রিযিকদাতা, ফসলদাতা, সন্তানদাতা ইত্যাদি মনে করা।
৭. অন্যদের ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করা, কথা বা কাজে এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করা।
৮. ইসলামী শরীয়ত তথা আল্লাহ রববুল আলামীনের হাকিমিয়্যত (শাসকত্ব)-কে অস্বীকার করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহ তাআলা হালাল-হারাম, সিদ্ধ-অসিদ্ধ নির্ধারণকারী এবং তিনিই যে একমাত্র বিধানদাতা তা বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।
ইরতিদাদের সকল প্রকার সাধারণ কুফরের চে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর হল সত্যদ্বীন গ্রহণ না করা বা প্রকৃত দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতা নয়, এ হল বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতা! সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। পাশাপাশি তা ‘ইফসাদ ফিল আরদ’ তথা পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টিও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ
‘আল্লাহ এমন একটা কওমকে কীভাবে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করতে পারেন; যে সমাজ একবার ঈমান আনার পর, রাসূলকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ এসে যাওয়ার পর আবার কাফের হয়ে যায়? অবস্থা এই যে, আল্লাহ এমন জালিম সমাজকে কখনো হেদায়েতের পথ দেখান না। এই যে লোকগুলো, এদের কর্মফল হলো, এদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ! তবে এর পরে যারা তওবা করবে আর (নিজেদেরকে) সংশোধন করে নেবে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। পরন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মহাক্ষমাশীল করুণাময়। (কিন্তু) যারা একবার ঈমান আনার পর আবার কাফের হয়ে যায় এবং তাদের কুফরী আচরণ আরও বেড়ে চলে, তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না।’ (আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৯০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-
وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
‘আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে। (বাকারা ২ : ২১৭)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
(তরজমা) ‘প্রকৃতপক্ষে যারা তাদের সামনে হেদায়েত পরিস্ফুট হওয়ার পরও মুরতাদ হয়ে যায়, (আসলে) শয়তান তাদেরকে ফুসলিয়েছে এবং অমূলক আশা দিয়েছে। এসব এজন্য যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়কে অপছন্দ করে, তাদেরকে (সেই কাফেরদেরকে) তারা (মুরতাদ-মুনাফিকেরা) বলে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তোমাদের কথাও মানবো। (স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ তাদের গুপ্ত কথা সম্পর্কে অবগত। ফেরেশতারা যখন এদের চেহারায় এবং পিছন দিক থেকে আঘাত করতে করতে এদের জান কবজ করবে, তখন এদের কী দশা হবে! এসব (শাস্তি) এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে, যা আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করে এবং তারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন পছন্দ করে না। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করেছেন। (মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৫-২৮)
মুরতাদের পরকালীন এ শাস্তিগুলির ফয়সালা হবে হাশরের ময়দানে। যেখানে ফয়সালাকারী হবেন খোদ আল্লাহ রাববুল আলামীন। দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে যিনি অবগত। যিনি আহকামুল হাকিমীন। মানুষের অন্তরের একান্ত গোপন কথাও যার অজানা নয়। তাই দুনিয়াতে যে নিজের ইরতিদাদ ও কুফর লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, কেয়ামতের দিন সেও অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাকেও কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে।
কিন্তু এই দুনিয়ার আদালতে মনের অবস্থার উপর বিচার করা যায় না। এখানে কারো মনের খবর নিশ্চিতভাবে জানাও সম্ভব হয় না। তাই দুনিয়াতে বিচার হয় বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। কোনো মুনাফিক নিজের অন্তরে কুফরি আকিদা-বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলে বিচারকের সামনে তার ইরতিদাদ প্রমাণিত হবে না। সুতরাং দুনিয়াবী কোনো শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে না। দুনিয়াবী শাস্তি প্রয়োগ হবে কেবল ঐ ব্যক্তির উপর-যার ইরতিদাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং হাকিমের কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে।
মুরতাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে : এক. যে নিজের ইরতিদাদের ঘোষণা দিয়েছে। দুই. যে ইরতিদাদ-মূলক কোনো আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেও নিজেকে কথা বা কাজে মুসলমান বলে দাবী করছে। দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদকে যিন্দীক, মুলহিদ ও মুনাফিক ইত্যাদি বলা হয়।
স্বঘোষিত মুরতাদ হোক আর মুনাফিকজাতীয় মুরতাদ হোক, উভয় প্রকার মুরতাদের ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম হল, যদি আদালতে এদের ইরতিদাদ প্রমাণ হয়ে যায়, তাহলে তার বিষয়ে শরীয়ত মোতাবেক ফয়সলা করা বিচারকের উপর ফরজ। আর প্রশাসনের ফরজ হল ঐ শাস্তি অপরাধীর উপর প্রয়োগ করা।
আল্লাহ পাকের আইনে মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি কী- সেটা ইসলামী শরীয়তের অকাট্য সর্বজনস্বীকৃত ও যুগ পরম্পরায় অনুসৃত শিক্ষাগুলির একটি। এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ইজমা রয়েছে। এতে কোনো কালেই কোনো আলেমে দ্বীনের দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকলে মুলহিদ-যিন্দীকরাই করেছে। কোনো মুমিন করেনি। একজন মুমিন তো শরীয়তের সকল বিধানের উপর ঈমান রাখে। হদ-কিসাস ও দন্ডবিধি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলিকে হুবহু মেনে নেওয়াই ঈমান। এগুলির একটি হল, মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
বিচারকের জন্য নিয়ম হল, মুরতাদকে প্রথমে তওবা করার সুযোগ দিবে। তওবা করলে তো ভালো। অন্যথায় নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করবে।
মুরতাদের তওবা কবুল করা এবং এ উসিলায় তার শাস্তি মওকুফ করা শরীয়তে মুহাম্মদীর বিধান। নতুবা তাওরাতের শরীয়তে তওবা করলেও এ শাস্তি মাফ হত না। বরং তওবার মাধ্যমে পরকালীন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াবী শাস্তি গ্রহণ করা অপরিহার্য ছিল।
বনী ইসরাইলের একটি দল যখন গোবৎসের পুজা করে শিরকে লিপ্ত হল, যে কারণে তারা মুরতাদ হয়ে গেল, তখন তাদের ব্যাপারে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হল এবং এটা তাদের তওবারই একটা অংশ ছিলো। ইরশাদ হয়েছে-
(তরজমা) ‘যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়েছে, শীঘ্রই তাদের রবের গজব তাদেরকে পাকড়াও করবে আর দুনিয়ার জীবনেই লাঞ্ছনা আপতিত হবে। যারা মিথ্যা রচনা করে, আমি এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।’ (আরাফ ৭ : ১৫২)
মুরতাদের উপর আপতিত সেই গজব ও লাঞ্ছনা কী ছিল? কোরআনেই ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
তোমরা বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা কর এবং নিজেরা নিজেদের মাঝে মৃত্যুদন্ড কার্যকর কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাহলে তিনি তোমাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি তো তওবা কবুলকারী, পরম করুণাময়। (বাকারা ২ : ৫৪)
দুনিয়াতে এই ক্রোধ ও গজব এবং লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা যারা শিরক করে মুরতাদ হয়ে গেছে শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং সব ধরনের মুরতাদের জন্য। ইরশাদ হয়েছে-
(তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর তার কুফরীতে লিপ্ত হয় -অবশ্য সে নয়, যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু তার অন্তর ঈমানের উপর প্রশান্ত রয়েছে, বরং সেই ব্যক্তি, যে সহৃদয়ে কুফুরী মেনে নিয়েছে, এরূপ ব্যক্তির উপর আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (নাহল ১৬ : ১০৬)
সূরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুরতাদের উপর আপতিত খোদায়ী গজব হল মৃত্যুদন্ড। ইসলামের প্রতি দুশমনি করা অথবা যে কোনো ধরনের শিরকী-কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি -যদিও সে আচরণে-উচ্চারণে নিজেকে মুসলমান প্রমাণের চেষ্টা করে -তবু সে মুরতাদ। কোরআনের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে ‘মুনাফিক’ বলা হয়। এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন-
لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا مَلْعُونِينَ أَيْنَمَا ثُقِفُوا أُخِذُوا وَقُتِّلُوا تَقْتِيلًا سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা এবং মদীনাতে ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা যদি নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল করে দিব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাও থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায়, যেখানেই এমন লোককে পাওয়া যাবে, ধরে ধরে একে একে হত্যা করে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলার এ নিয়ম পূর্ববর্তী লোকদের জন্যও বলবৎ ছিল। আল্লাহর নিয়মে কোনো দিন আপনি কোনো ব্যত্যয় খুজে পাবেন না। (আহযাব ৩৩ : ৬০-৬২)
‘উল্লেখিত আয়াতে মুরতাদ-মুনাফিকের দুটি অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা থেকে বিরত না হলে শাস্তি লাঞ্ছনা এবং মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়াতের শেষ অংশ থেকে এ-কথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তেও মুরতাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড।’ (মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী ৭ : ২৩৪-২৩৫)
Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদটিকে "সকল ধর্মের সমান স্বাধীনতা" বা "সবাই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে" - এই মুখোশে বোঝাতে চান কেউ কেউ। প্রকৃতপক্ষে সেকুলারিজম মানে হলো, ধর্মীয় আইন-কানুন থেকে রাষ্ট্র আলাদা থাকবে।
Oxford Dictionary-তে সেকুলারিজমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে: The belief that religion should not be involved in the organisation of society, education, etc. [সমাজের গঠন/সংগঠন, শিক্ষা ইত্যাদিতে ধর্ম যুক্ত হবে না - এই বিশ্বাসের নাম সেকুলারিজম।]
Wikipedia-তে সেকুলারিজমের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে: Secularism is the principle of separation of government institutions, and the persons mandated to represent the State, from religious institutions and religious dignitaries.
অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিষ্কার মানে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কখনোই "সবাই সবার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে"- এটা নয়। বরং বলা যেতে পারে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাষ্ট্রের দেয়া সীমার মধ্যে ধর্মপালন অর্থাৎ 'পরাধীনভাবে' সবাই সবার ধর্ম খণ্ডিত আকারে পালন করবে।
১৮৫১ সালে ব্রিটিশ নাস্তিক লেখক George Jacob Holyoake (১৩ এপ্রিল ১৮১৭ – ২২ জানুয়ারি ১৯০৬) "Secularism" শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের আগে ধর্মরাষ্ট্রই ছিল - রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বিচ্ছিন্ন ছিল না। ব্রিটিশরা উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এই তিন দেশে অফিসিয়ালি ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশদের খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়া তিন কৃতি ছাত্র:
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (ভারত): রাজকোট ইংলিশ স্কুল (পরবর্তীতে আলফ্রেড হাই স্কুল)
বিদ্রোহের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড
এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, মুরতাদ (প্রকাশ্য মুরতাদ অথবা মুনাফেক মুরতাদ দুজনই) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মুহারিব। ইসলাম ও মুসলমানকে অপমানকারী বিশ্বাসঘাতক। আল্লাহর জমিনে শান্তি বিনষ্টকারী প্রতারক। সকল মুহারিব ও ফেৎনাবাজ দুষ্কৃতিকারীর শাস্তি প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদের ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (মায়েদা ৬ : ৩৩)
আয়াতে বিভিন্ন প্রকার ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুহারিবের এবং তাদের অপরাধের ধরন ও মাত্রাভেদে বিভিন্ন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর মুহারিব ও মুফসিদ (বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) এর মাঝে সবচে’ মারাত্মক হল যারা দ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে, ইসলামের অবমাননা করে মুসলিম পরিচয় দিয়ে মুমিনদেরকে তাদের ঈমানের ব্যাপারে সন্দিহান করে-ফেলার মতো দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়। উল্লিখিত আয়াতে أَنْ يُقَتَّلُوا শব্দে সর্বপ্রথম এ ধরনের মুহারিব এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া উল্লিখিত আয়াত প্রসঙ্গে লিখেছেন, (অর্থ :) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দু’ভাবে হতে পারে। একটা অস্ত্রের মাধ্যমে আরেকটা যবানের মাধ্যমে। আর দ্বীনী বিষয়ে কখনো কখনো অস্ত্রের যুদ্ধের চে’ যবানের যুদ্ধ মারাত্মক হয়ে থাকে। এই জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্রের যুদ্ধে লিপ্ত অনেককে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতেন, কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যবানি দুশমনিতে লিপ্ত কাউকে ক্ষমা করতেন না। তেমনি পৃথিবীর শান্তি শৃংখলা কখনো অস্ত্র বিস্তারের কারণে বিনষ্ট হয় আর কখনো হয় যবান দরাজির কারণে। আর দ্বীনি বিষয়ে যবান দরাজির মাধ্যমে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়, তা অস্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট বিশৃংখলার চে বহু গুণে মারাত্মক।’-আছ ছা-রিমুল মাছলূল পৃ. ৩৯১
হাদীসে নববীতে মুরতাদের শাস্তি-প্রসঙ্গ
হাদীস ইসলামী শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল এবং কুরআনের তাফসীর। এখন আমরা সহীহ হাদীস ও আছারে সাহাবার আলোকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা তুলে ধরবো। তা থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের দ্বিতীয় দলিলের ফয়সালা সামনে এসে যাবে এবং সুন্নাহর মাধ্যমেও এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উল্লিখিত আয়াতসমূহের বক্তব্য তা-ই যা উপরে বলা হয়েছে।
عن عكرمة قال : أتي علي رضي الله عنه بزنادقة فأحرقهم. فبلغ ذلك ابن عباس فقال : لو كنت أنا لم أحرقهم، لنهي رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا تعذبوا بعذاب الله، ولقتلتهم لقول رسول الله صلى الله عليه وسلم : من بدل دينه فاقتلوه.
১. ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না।’ আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)
প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে-
عن عبد الله قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا يحل دم امرء مسلم يشهد أن لا إله إلا الله، وأني رسول الله، إلا بإحدى ثلاث : النفس بالنفس، والثيب الزاني، والمفارق لدينه، التارك للجماعة.
২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল, তিন কারণের কোনো একটি ব্যতীত তার রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয় : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, বিবাহিত ব্যক্তি যেনা করা, ইসলাম ত্যাগ করে উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০২, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৮৭০৪, বায়হাকী ৮:১৯৪ ইত্যাদি)
অন্য একটি হাদীসে এসেছে-
৩. আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দু’জনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দু’জন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।
বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)
আরও এক হাদীসে এসেছে-
৪. যখন উমর রা. এর নিকট ‘তুসতার’ নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)
মুরতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে উম্মতের ইজমা
হাদীসে নববী যেমন শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল, ইজমাও তেমনি পৃথক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল। অর্থাৎ শরীয়তের কোনো বিষয়ে যদি উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে ঐ বিষয়ে সরাসরি কুরআন ও হাদীসের কোনো বক্তব্য না থাকলেও শুধু ইজমার ভিত্তিতে সেটা শরীয়তের অকাট্য বিধানরূপে পরিগণিত হয়।
মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এর উপর উম্মতের ইজমা রয়েছে। কোনো দ্বীনী বিষয়ে যুগের মুজতাহিদ আলেমগনের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে ইজমা বলে। এখানে ইজমার কিছু দলিল তুলে ধরা হচ্ছে। এ- থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের তৃতীয় দলিলের ফায়সালা সামনে এসে যাবে এবং এই দলিলের মাধ্যমেও এটা আরেকবার স্পষ্ট হবে যে, উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের বক্তব্য তা-ই, যা উপরে বলা হয়েছে।
ইমাম তিরমিযী (মৃত্যু ২৭৯- হি.) তার জামে তিরমিযীর ১৪৫৮ নম্বর হাদীস-من بدل دينه فاقتلوه অর্থাৎ যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে-এর অধীনে লিখেছেন,
والعمل على هذا عند أهل العلم في المرتد
অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে ইলমের সকল ধারক-বাহকের নিকট এটাই অনুসৃত বিধান।
ইবনে আরাবী (মৃত্যু ৫৪৩ হি.) ইমাম তিরমিযীর উপরোক্ত বক্তব্যের প্রসঙ্গে লিখেছেন,
لا خلاف في أن المرتد يقتل.
অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।-আরিযাতুল আহওয়াযী ৬/২৪৩
ইবনু আব্দিল বার (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) লিখেছেন,
إن من ارتد عن دينه حل دمه، وضربت عنقه، والأمة مجتمعة على ذلك
অর্থাৎ যে তার দ্বীন ত্যাগ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরশ্ছেদ করা হবে। মুরতাদের এ শাস্তির বিষয়ে পুরো উম্মতের সুপ্রতিষ্ঠিত ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। আততামহীদ ৫/৩০৬
ইবনে কুদামা হাম্বলী (মৃত্যু ৬২০ হি.) লিখেছেন,
وأجمع أهل العلم على وجوب قتل المرتدين. وروي ذلك عن أبي بكر، وعثمان، وعلي، ومعاذ، وأبي موسى، وابن عباس، وخالد وغيرهم، ولم ينكر على ذلك. فكان إجماعا.
অর্থাৎ সব ধরনের মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এ বিষয়ে আলেমগণের ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। হযরত আবু বকর, উসমান, আলী, মুআয, আবু মুসা, ইবনে আববাস এবং খালিদ ইবনে ওয়ালীদ প্রমুখ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে এ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আর এ শাস্তির উপর কোনো সাহাবী আপত্তি করেননি। অতএব মৃত্যুদন্ডের এ বিধানের উপর সাহাবায়ে কেরামেরও ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।-আলমুগনী ১২ : ২৬৪
এ বিষয়ে আরও যারা ইজমা নকল করেছেন, তাদের কয়েকজন যথাক্রমে,
১. ইবনুল মুনযির (মৃত্যু ৩১৮ হি.)-আলইজমা পৃ. ১২২
২. ইবনে হায্ম যাহেরী (মৃত্যু ৪৫৬ হি.)-মারাতিবুল ইজমা পৃ. ২১০
৩. ইবনে রুশদ আলহাফীদ মালেকী (মৃত্যু ৫৯৫ হি.)-বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২ : ৩৪৩
৪. ইবনে কুদামা মাকদিসী হাম্বলী (মৃত্যু ৬৮২ হি.)-আশশরহুল কাবীর ৫ : ৩৫৫
৫. বুরহানুদ্দীন আলহানাফী (মৃত্যু ৬১৬ হি.)-আলমুহীতুল বুরহানী ৭ : ৪৪৩
৬. ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী শাফেয়ী (মৃত্যু ৯৭৪ হি.)-আলই’লাম বি কাওয়াতি-ইল ইসলাম পৃ. ৪০০
৭. মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আসসানআনী (মৃত্যু ১১৮২ হি.)-সুবুহুস সালাম ৩ : ৫৩৪
৮. ইবনে আবেদীন শামী (মৃত্যু ১২৫২ হি.)-রাসায়েল ১ : ৩১৬
৯. যফর আহমদ উসমানী (মৃত্যু ১৩৯৬ হি.)-ই’লাউস সুনান ১২ : ৫৯৯
যুক্তির আলোকে মুরতাদের মৃত্যুদন্ড
শরীয়তের সকল বিধানেরই যৌক্তিকতা রয়েছে। যে সকল বিধানের দলিল কুরআন, হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতের মাঝে বিদ্যমান, সে সকল বিধানের উপর আমলের জন্য কেয়াস তথা যৌক্তিকতার অপেক্ষায় থাকা চলে না। এজাতীয় বিধানের যৌক্তিকতা বোধগম্য হোক বা না হোক, এর উপর আমল অপরিহার্য। মুতরাদের মৃত্যুদন্ডের বিষয়টিও তেমন একটি বিধান। যদিও এ-বিধানটিও খুবই যুক্তিযুক্ত। আর এখানে এটাও স্মরণ রাখা উচিতৎ যে, শরীয়তের বিধানাবলীর প্রকৃত রহস্য, হেকমত ও যৌক্তিকতা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কারণ তিনিই হলেন সৃষ্টিকর্তা শরীয়তদাতা, বিধানদাতা। তবে মানুষের সাধ্যের ভিতরে যতটুকু আছে, ততটুকু যৌক্তিকতা জানা মানুষের আন্তরিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
মুরতাদের মৃত্যুদন্ডের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যাহ (মৃত্যু ৭৫১ হি.) লিখেছেন,
فأما القتل فجعله عقوبة أعظم الجنايات، كالجناية على النفس ... وكالجناية على الدين بالطعن فيه والارتداد عنه، وهذه الجناية أولى بالقتل ... إذ بقائه بين أظهر العباد مفسرة لهم، ولا خير يرجى في بقائه ولا مصلحة.
মৃত্যুদন্ড হলো সর্বোচ্চ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি। সর্বোচ্চ অপরাধ যেমন, মানুষ হত্যা, দ্বীনের বিষয়ে কটূক্তি করা বা দ্বীন ত্যাগ করার মাধ্যমে দ্বীনের উপর আঘাত হানা ইত্যাদি।
ইরতিদাদের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। কারণ সমাজে মুরতাদের অবস্থান সংঘাত-সহিংসতা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণ হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তির বেঁচে থাকার মাঝে কোনো মঙ্গলের আশা করা যায় না। একে বাঁচিয়ে রাখা বরং অনেক বড় নির্বুদ্ধিতা।-ইলামুল মুওয়াক্যিঈন ২/৮৪
পাঠক! আমরা যদি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দিকে একটু লক্ষ্য করি, তাহলেই আমাদের সামনে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে তাকে অস্বীকারকারী এবং তার সঙ্গে অংশীদার স্থাপনকারীদের বিষয়ে অনেক সতর্কতা জারি করেছেন। অনেক ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। যাতে মানুষ সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ তাআলাকে যারা অস্বীকার করবে তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কুরআন এবং হাদিসের কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হলো-
>> ‘নিশ্চয় মুশরিক ও আহলে কিতাবের যারা কুফরি করেছে তাদের স্থান জাহান্নামে। সেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। তারাই হলো সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিজীব।’ (সুরা বাইয়্যিনা : আয়াত ৬)
>> ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণের সঙ্গে কুফরি করে (অস্বীকার) করে এবং আল্লাহ ও রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করতে ইচ্ছা করে এবং বলে, ‘আমরা কাউকে মানব আর কাউকে মানব না; আর কুফর এবং ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়।
তারা প্রকৃত পক্ষেই কট্টর কাফের (অবিশ্বাসী); আর এ কাফেরদের জন্য আমি এমন শাস্তি তৈরি করে রেখেছি; যা তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে। (সুরা নিসা : আয়াত ১৫০-১৫১)
তারা প্রকৃত পক্ষেই কট্টর কাফের (অবিশ্বাসী); আর এ কাফেরদের জন্য আমি এমন শাস্তি তৈরি করে রেখেছি; যা তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে। (সুরা নিসা : আয়াত ১৫০-১৫১)
>> হে লোকেরা! আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিতভাবেই সত্য; কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে এবং সেই বড় প্রতারক যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকা দিতে না পারে। আসলে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন; তাই তোমরাও তাকে নিজেদের দুশমনই মনে কর। সে (শয়তান) তো নিজের অনুসারীদেরকে নিজের পথে এ জন্য ডাকছে, যাতে তারা দোজখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। যারা কুফরি করবে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আর যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও বড় পুরস্কার। (সুরা ফাতির : আয়াত ৫-৭)
>> হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিরক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
পরিশেষে...
আল্লাহ তাআলাকে অবিশ্বাস নয়; আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা নয়; বরং আল্লাহ তাআলার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসই মানুষে ঈমানের একমাত্র দাবি। আল্লাহ মানুষকে সে দাবি পুরণে নসিহত পেশ করেন এবং যারা কুরআন লাভের পরও তাঁর অবাধ্যতায় জড়িয়ে পড়ে তাদেরকে সতর্ক করে বলেন-
আল্লাহ তাআলাকে অবিশ্বাস নয়; আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা নয়; বরং আল্লাহ তাআলার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসই মানুষে ঈমানের একমাত্র দাবি। আল্লাহ মানুষকে সে দাবি পুরণে নসিহত পেশ করেন এবং যারা কুরআন লাভের পরও তাঁর অবাধ্যতায় জড়িয়ে পড়ে তাদেরকে সতর্ক করে বলেন-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসারি হইও না; কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।
তোমাদের কাছে যে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীন হেদায়েত (কুরআন) আসার পরও যদি তোমাদের পদস্খলন ঘটে; তাহলে ভালোভাবে জেনে রেখ; আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ তিনি প্রচণ্ড ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী এবং তিনি জানেন কিভাবে অপরাধীদের শাস্তি দিতে হয়।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২০৮-২০৯)
সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করা থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাজত করুন। কুরআনে ও হাদিসে ঘোষিত জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব থেকে রক্ষা করুন। কুরআনের বিধান পরিপূর্ণরূপে মেনে প্রকৃত ঈমানদার হয়ে পরকালের মুক্তি লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন😁😀
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ