একই ফলের মধ্য লুকিয়ে থাকা দুই মসলা, জায়ফল-জয়ত্রী। ফল ভাংলে দেখা যায় কিছুটা রক্তিম রঙের পাতলা আবরণ ফলের বিচিটাকে আধো আধো ভাবে জড়িয়ে রেখেছে পরম যত্নে। দেখে মনে হয় তারা যেন এক আত্মা একই প্রাণ। মসলার জগতেও এরা পাশাপাশি মহা মূল্যবান উপাদান। এদের নামে যেমন একটা শাহী ভাব আছে তেমনি এদের ব্যবহারও করা হয় সব শাহী খাবারে। বেশীর ভাগ রাজকীয় খাবারে এদের একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। মনে হয় এরা যেন একে অন্যর পরিপূরক। দুজন মিলে খাবারের স্বাদ আর সুঘ্রাণ বাড়িয়ে দেয় দিগুণ। বিরিয়ানি, রোস্ট, রেজালা, তেহারি, কাবাব ইত্যাদিতে জায়ফল-জয়ত্রীর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া মাংস মেরিনেট, কেক, পেস্ট্রি, ব্রেড, স্যুপ ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। এই মসলা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তাদের ঐতিহ্যবাহী ও নামিদামী খাবারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এর স্বাদ ও সুগন্ধের জন্য।
জায়ফল-জয়ত্রী এতটাই সুগন্ধিযুক্ত যে তাদের বৈজ্ঞানিক নামের সঙ্গেই সুগন্ধ জড়িয়ে আছে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম - Myristica fragrans. এরা Myristicaceae পরিবারের সদস্য। জায়ফল ইংরেজিতে Nutmeg আর জয়ত্রী Mace নামে পরিচিত। Myristicaceae গনের জায়ফলের বেশ কিছু প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্য Myristica fragrans. আসল জায়ফল হিসেবে পরিচিত। এটাই বাণিজ্যিকভাবে তেল উৎপাদনের প্রধান উপাদান। ইন্দোনেশিয়ার ব্যান্ডা দ্বীপ জায়ফলের আদিবাস। ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় মালাক্কা প্রদেশে ব্যান্ডা দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। ১৯০০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যান্ডা দ্বীপপুঞ্জের ছোট ছোট দ্বীপগুলো 'স্পাইস আইলান্ড' নামে পরিচিত ছিল। জায়ফল উৎপাদনের একমাত্র স্থান ছিল এই দীপপুঞ্জ। এই দীপপুঞ্জগুলো মৃত আগ্নেয়গিরি দ্বারা গঠিত। জায়ফল উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে বিস্তৃতভাবে জন্মে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া তাইওয়ান, চীনের গুয়াংডং ও ইউনান, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের গ্রানাডা, ভারতের কেরালা, শ্রীলংকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচুর পরিমানে জন্মে থাকে। জায়ফল সুস্বাদু রান্না এবং মাংস সংরক্ষনের উপাদান হিসেবে ইউরোপে মধ্যযুগীয় সময়ে রন্ধনপ্রনালীর একটি মূল্যবান মসলায় পরিনত হয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে রান্নায় একটি সুগন্ধী মসলা হিসেবে জায়ফলের ব্যবহার হয়ে আসছে।
অনেক সমৃদ্ধশালী ইতিহাস রয়েছে এই জায়ফলের। শুধু স্বাদের জন্যই জায়ফল মধ্যযুগে অতি মূল্যবান ছিল না। তখনকার মানুষের ধারনা ছিল এই মসলায় প্লেগ রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে। তখন এটা নেশার জগতেও দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, এইজন্য ধনীদের কাছে এর অনেক কদর ছিল। সেইজন্য সান্ধ্যকালীন আড্ডায় জায়ফল পেতে যে কোনও দাম দিতে রাজি থাকতেন তাঁরা। তখন এমন কথা প্রচলিত ছিল যে একটা ছোট থলি ভর্তি জায়ফল বিক্রি করলে বাকি জীবন সেই টাকায় বসে খাওয়া যেত। তাই উটের পিঠে চাপিয়ে মরুভূমি পার হয়ে আরব বণিকরা যেটুকু জায়ফল নিয়ে যেতে পারত, সেইটুকুই রোজগারের জন্য যথেষ্ট হত। তুর্কিরা তখন এর বিরোধিতা করলো। ১৪৯৩ সালে ইস্তাম্বুল হয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপের বাণিজ্যপথ তারা বন্ধ করে দিল। এরপর মরিয়া হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল আরব বণিকদের নিয়ে আসা মশলা, বিশেষত জায়ফল খুঁজতে। পর্তুগাল ১৫১১ সালে খুঁজে বার করে ফেলল জায়ফলের দেশ। আলফানসো আলবুকার্ক সে বছর অগাস্টে মালাক্কা জয় করলেন। স্থানীয়দের কাছে জানলেন জায়ফলের ঠিকানা। বন্ধু অ্যান্টোনিয়ো দি আব্রেউ’কে তিনটে জাহাজ সমেত পাঠালেন খবরের সত্যতা যাচাই করতে। আব্রেউ এক মাস পরে ফেরত এলেন তিন জাহাজ ভর্তি জায়ফল ও লবঙ্গ নিয়ে। তখন পর্তুগিজরা আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে তৈরি বাণিজ্যপথের সঙ্গে ব্যান্ডা দ্বীপকে জুড়ে দিয়ে, জায়ফলের ইউরোপ যাত্রার খরচ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্য বিরূপ ছিল। লোকবল যথেষ্ট ছিল না। দ্বীপগুলোকে কব্জা করে শাসন চালাতে ব্যর্থ হল তারা, অন্য শক্তিদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেল। কিন্তু ইউরোপের কাছে জায়ফল জোগানের রাস্তাটা তারাই তৈরি করে দিল।
১৬০০ সালের দিকে ব্যান্ডা দ্বীপুঞ্জের ছোট একটা বিশেষ দ্বীপ 'রান'দ্বীপ ছাড়া জায়ফল, লবঙ্গের মতো মসলা আর কোথাও পাওয়া যেত না। এই 'রান' দ্বীপের দখলকে কেন্দ্র করে গ্রেট ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস যুদ্ধ করেছে দীর্ঘ সময়। এর একমাত্র কারণ দুর্লভ মসলায় ভরপুর ছিল দ্বীপটি। ডাচরা অনেক আগে থেকেই ‘মসলা’ দ্বীপের দিকে নজর দিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের আগেই ১৬১৬ সালে ব্রিটিশ সেনানায়ক নাথানিয়েল কোর্টহোপ ‘রান’ দ্বীপ দখল করেন। সামান্য কিছু সৈন্য নিয়েই তিনি টানা চার বছর দ্বীপটি দখলে রাখেন। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে তোলেন মসলার ফলন। তার নিজের সেনাদলের ভেতর একজন বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরের চক্রান্তে পড়ে ১৬২০ সালে ডাচদের হাতে নিহত হন কোর্টহোপ। দ্বীপটা তখন বেদখলে চলে যায়। এরপর থেকেই ব্রিটিশরা বার বার দাবি করতে থাকে ‘রান’ দ্বীপের মালিকানা। কিন্তু ডাচরা শক্ত হাতে দ্বীপটি দখলে রাখে এবং যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে এই যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। তারপর একসময় তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে শান্তি চুক্তি করে। পর্তুগিজদের দেখানো বাণিজ্য পথ দিয়েই শতাব্দীর পর শতাব্দী নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ড ব্যবসা চালিয়ে লাভবান হয়েছিল।
চিরহরিৎ বৃক্ষ জায়ফল গাছ, প্রায় ১৫/২০ মিটার উঁচু হতে পারে। এর শাখা নল আকৃতির, শাখা-প্রশাখাযুক্ত এই গাছের বাকল মসৃণ ও ধূসর বাদামি রঙের। এর পাতা দেখতে অনেকটা কাঁঠাল পাতার মত উপবৃত্তাকার। এরা প্রায় ৭-৮ সেমি লম্বা এবং গাঢ় সবুজ রঙের হয়ে থাকে। পাতাগুলো গাছের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত একান্তর বা বিপরীতভাবে সাজানো থাকে। পাতার কিনারাগুলো ধারাল ও তীক্ষ্ণ। পাতার অপর পৃষ্ঠ মসৃণ ও চকচকে। নিচের দিকে কিছুটা ধূসর রঙের। ফুল একলিঙ্গ, ছোট হলুদ রঙের এবং হালকা সুগন্ধযুক্ত। ফল ডিম্বাকৃতি, ৩-৫ সেমি লম্বা। একটি ফলে একটি মাত্র বীজ থাকে। কাঁচা ফল হালকা হলুদ এবং পাকার পর গাঢ় বাদামি রঙের হয়। ফল পাকলে ফেটে যায়। এই ফল রসালো খোসাযুক্ত। যার খোসা ছাড়ালে দেখা যায় রক্তিম বীজোপাঙ্গ যুক্ত গোলাকার ধরনের একটা বীজ। এই প্রক্রিয়াজাত বীজই মসলা জায়ফল আর এই মোড়কসদৃশ বীজোপাঙ্গই হচ্ছে জয়ত্রী নামে পরিচিত। জায়ফলের ঘ্রাণ একটু ঝাঁঝালো আর জয়ত্রীর ঘ্রান হালকা ঝাঁঝ-মিষ্টি মিশানো মনে হয়। জায়ফল এক ধরনের বাদাম আর জয়ত্রী হচ্ছে সেই বাদামের উপরে জড়ানো আস্তরণ। এটি তিন ভাবে ব্যবহার করা যায়। উপরের খোশা দিয়ে জ্যাম, জেলী, বীচির উপরের আস্তরণ জয়ত্রী এবং বীচিই হল জায়ফল। এদের সুগন্ধি মসলা এবং ঔষধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
জায়ফল-জয়ত্রী ভেষজ ও ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও জায়ফলের গুণ অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই রোমান ও গ্রীকরা জায়ফলকে 'ব্রেইন টনিক' হিসেবে ব্যবহার করে আসছে কারণ এটা ব্রেইনকে জাগিয়ে তোলে বা সচল রাখে। এর কারণে অবসাদ ও মানসিক চাপ কমে যায়। এর ঔষধি গুণের জন্য ইউনানী, আয়ুর্বেদিক এবং হোমিও চিকিৎসায় এর ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে চীনেও জায়ফলকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে বিভিন্ন রোগে। জায়ফলের তেল বহুল উপকারি। এর তেল ব্যবহারে বাতের ব্যথা, পেশীর ব্যথা, দাঁতের ব্যথা, পাকস্থলীর ব্যথা, পেটফাঁপা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জায়ফল জয়ত্রী ফাংগাস এবং ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে। ব্রণের মূল কারণ হলো মুখের ত্বকে ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাসের আক্রমণ। বিভিন্ন পদ্ধতিতে জায়ফল ব্যবহার করলে ব্রণ সেরে যায়। এটা মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যকটেরিয়াকে ধ্বংস করে নিঃশ্বাসকে সজীব রাখে। খাবার রুচি বৃদ্ধি করতে এবং হজম শক্তি বাড়াতে যে কোনো ফলের বা সবজি সালাদে সামান্য জায়ফলের গুড়ো ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। জায়ফল ব্যবহারের উপকারিতাই বেশি, তবে অতিব্যবহারে এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। এইজন্য পরিমিত জায়ফলের ব্যবহার করা উচিৎ।
জয়ত্রী
জয়ত্রী হজম শক্তিকে ভালো রাখে এবং শরীরে রক্ত সঞ্চালনকে ঠিক রাখে। শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকলে আমাদের ত্বক ও চুল সুস্থ থাকে। জয়ত্রীর অনন্য গুনাগুনের মধ্যে আরও যেগুলো সেটা হল খাওয়ার ইচ্ছে বাড়ায় ও স্মৃতিশক্তি ভালো করে। জয়ত্রী মানসিক চাপ কম করে।
জয়ত্রী
জয়ত্রীতে প্রচুর পরিমাণে তামা ও লোহা আছে যা শরীরের কোষগুলো ভালো রাখে ও নতুন কোষ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। তাই খাবারে জয়ত্রী খেলে রক্তাল্পতা দূর হয়, ক্লান্তি দূর হয় ও পেশীকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। জয়ত্রীশরীরের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
জায়ফল
জায়ফল অন্ত্রের ক্রমসংকোচন ক্রিয়াকে ঠিকঠাক কাজ করতে সহায়তা করে পাশাপাশি পাচকতন্ত্র ও ইনটেসটাইন বা অভ্যন্তরীণ থেকে হজম হওয়ার যে সব রস নির্গত হয় সেগুলোকে আরও সক্রিয় ভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এর ফলে হজম শক্তি বাড়ে। এছাড়া জায়ফলে ম্যারিসটিসিন ও মাসেলিগনেন থাকে যা আমাদের মস্তিস্ককে সতেজ রাখে।
জায়ফল
জায়ফল যেমন মিষ্টি স্বদের তেমনই খুব উপাদেয়। এই মসলাটি খেলে শরীরের ব্যথার থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া যায় তেমনই হজম শিরোক্তি বাড়ায়, শরীর থেকে বিভিন্ন অপকারী বস্তুকে দূর করে, ত্বক ভালো রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে।
শুতে যাওয়ার আগে এক কাপ উষ্ণ গরম দুধে একচিমটি জায়ফল দিয়ে কিংবা একচিমটি জায়ফলের গুঁড়ো যদি মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তা শরীরের পক্ষে খুব উপকারী।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ