দর্শন শাস্ত্র - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

16 September, 2020

দর্শন শাস্ত্র

                                               ধ্যাত্মিকতা ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের মূল ভিত্তি। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ, এই চতুর্বর্গের মধ্যে মোক্ষই পরম পুরুষার্থ। চিত্তশুদ্ধির কারণ কর্ম। বেদের কর্মকাণ্ড নিয়েই মীমাংসা দর্শন। জৈমিনি এই দর্শন শাস্ত্রের প্রণেতা। কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য স্বর্গাদি লাভ ও চিত্তশুদ্ধি। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন(নিরন্তর অনুধ্যান বা বিচার), এই তিনটি চিত্ত শুদ্ধির উপায়। প্রথমে বিষয়টি শুনতে হয়, তার পর চিন্তা করতে হয়, বিচার করে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হয়, তার পর সতত ধ্যান-পরায়ণ হতে হয়। ধ্যান দ্বারাই সত্য জ্ঞানের স্ফুরণ হয়। চিত্তশুদ্ধি না হলে জীবন গঠিত হয় না। ঐ তিন উপায়ের দ্বারাই আত্ম-সাক্ষাৎকার ঘটে। শুধু আপ্তবাক্যের দোহাই দিলে হয় না, সেটি বিচার ও নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যান দ্বারা জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হয়। জীবন কে গঠন করা নিজের হাতে, তাই দর্শন শাস্ত্রের আর এক নাম মনন শাস্ত্র। এই শাস্ত্র সাহায্যে তত্ত্বজ্ঞান আসতে পারে, কিন্তু মাত্র তত্ত্ব বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষ আত্ম-ভ্রম-ইন্দ্রিয়গত অহং বোধ যায় না, সুতরাং চাই সাক্ষাৎকার বা প্রত্যক্ষাত্মক তত্ত্বজ্ঞান, যাতে ঐ ভ্রম দূরীভূত হয়।

ছয়টি দর্শন শাস্ত্র প্রসিদ্ধ- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, পাতঞ্জল, মীমাংসা ও বেদান্ত। ন্যায় ও বৈশেষিক কে সমান তন্ত্র বলা হয়। সাংখ্য ও পাতঞ্জল এক শ্রেণীভুক্ত, সাধারণ নাম- সাংখ্য প্রবচন। পাতঞ্জল দর্শন কে সেশ্বর সাংখ্য বলা হয়, কপিলের সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর সাংখ্য নামে বিদিত (সাংখ্য= সম্যক জ্ঞান)। মীমাংসা ও বেদান্ত শ্রুতি প্রমাণ কে অবলম্বন করে বিচার করেছেন, অন্যান্য দর্শন কেবল যুক্তির দ্বারাই বুঝিয়েছেন। মাধবাচার্য তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহে ১৫টি দর্শন শাস্ত্রের নাম করেছেন; তাঁর অন্য একটি গ্রন্থে শাঙ্কর দর্শনের উল্লেখ করেছেন। অতএব হয় ১৬টি দর্শন অর্থাৎ ঐ প্রসিদ্ধ ষড়দর্শন ও আরও ১০টি দর্শন। চার্বাক দর্শন, আর্হত (জৈন) দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, রামানুজ দর্শন, পূর্ণ-প্রজ্ঞ দর্শন, রসেশ্বর দর্শন ও পাণিনি দর্শন -এই ৭টি ষড়দর্শনের অতিরিক্ত দর্শন। পূর্ণপ্রজ্ঞ দর্শন ও শৈব দর্শন, বেদান্তের প্রস্থান বিশেষ বলে গণ্য। বেদ যেমন সকল দর্শনের মূল ভিত্তি, তন্ত্রের মধ্যেও তেমনি সমস্ত দর্শনের মূল তত্ত্ব বিদ্যমান। পূর্বমীমাংসা বা কর্ম-মীমাংসা বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়েই তার মীমাংসা করেছেন। এই শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে তবে কর্মকাণ্ড বোঝা যায়। কর্ম-মীমাংসার আর একটি নাম অধ্বর-মীমাংসা, আর ব্যাস প্রণীত মীমাংসা দর্শনের নাম উত্তর মীমাংসা বা শারীরিক মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন। অতএব মীমাংসা শাস্ত্র একটি ও তার দুটি অংশ। বেদ অপৌরুষেয় -এটা সকলে স্বীকার করেন।

কর্ম মীমাংসা মতে বেদরাশি নিত্য অর্থাৎ শব্দ নিত্য। ধ্বনি ঐ শব্দের অভিব্যক্তি মাত্র। শব্দ নিত্য, শব্দের বোধ, পরে প্রকাশ পায় উচ্চারণে।

[পূর্ব-মীমাংসা দর্শন, ১ম অ, ১ম পা, ১৮ সু।] 

ঐ ২১ সূত্রে, অনপেক্ষত্বাৎ, অর্থাৎ শব্দ কোন বস্তুর অপেক্ষা রাখে না। যোগীজনগম্য অনাহত শব্দও আছে, সুতরাং শব্দ সর্বাতীত ও নিত্য।

[‘বর্ণাত্মকা নিত্যাঃ শব্দাঃ’- (পরশুরাম কল্পসূত্ৰ-১/৭) ‘মন্ত্রাণামচিন্ত্যশক্তিতা'- ঐ ১/৮ দ্রঃ]

গমন, একটি স্ফোট শব্দ। গ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ঐ ধ্বনির লয় হয়, মা ও ন- প্রত্যেকটি পৃথক ধ্বনি, পরে পরে লয় হয়। পৃথক পৃথক ধ্বনি গুলি, ধ্বনি মাত্র, কিন্তু ঐ তিনটির সংযোগে যে অর্থ প্রকাশ পায় সেটি বক্তার বুদ্ধিতে আরূঢ় হয়ে একটি ধ্বনি উচ্চারিত হয় মাত্র- পূর্ব হতেই সেটি ছিল, অতএব স্ফোট ও ধ্বনি এক বস্তু নয়। শব্দ ও শব্দার্থ বোধের সম্বন্ধ নিত্য। তন্ত্রমতে ও শব্দ নিত্য, শব্দের যথার্থ প্রকাশকই মন্ত্র এবং মন্ত্রের অচিন্ত্য শক্তি।


যেমন কর্ম কারোর দুঃখের কারণ হয় না অথচ কর্তার অভ্যুদয় হয়, এরকম কর্মের প্রেরণাই বিধি ও তার অনুসরণই ধর্ম -এটাই জৈমিনির মত।

[চোদনা লক্ষণোহর্থ ধর্ম্ম -১ম অ, ১ম পা ২য় সূ। (চোদনা= প্রেরণা-অভ্যুদয় জনকত্ব)]

অন্যের দুঃখ উৎপাদক কোন কর্মে সুখ ফল দাতা স্বর্গলাভ হয় না। সুতরাং বোঝা যায় যে, কর্মকাণ্ডে যেখানে অভিচার, মারণ, উচাটন এসবের কথা আছে সেগুলি ধর্ম নয় -সেগুলির উদ্দেশ্য অন্য, এটি মনে রাখতে হবে। জৈমিনি বৈদিক বাক্যকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন- বিধি, নামধেয়, মন্ত্র, অর্থবাদ ও নিষেধ। বিধি তিন প্রকার- উৎপত্তি বিধি, নিয়ম বিধি ও পরিসংখ্যা বিধি। এই পরিসংখ্যা বিধি’র কথা স্মরণ রাখতে বলি, কারণ তন্ত্রে ও এই বিধির প্রয়োগ আছে। পরিসংখ্যা বিধি মানে, কার্য সাধক বহু বিধি থাকলে যেগুলি শ্রেষ্ঠ, মাত্র সেগুলিকে গ্রহণ করা।

চার্বাক দুষ্ট বুদ্ধির আশ্রয়ে বেদের বচন গুলি তুলে এ রকম ব্যঙ্গ বা কদর্থ করেছেন যা অনুসরণ করলে স্বেচ্ছাচার জীবন হয়। চার্বাক বেদ মানেন নি, সুতরাং তাঁর দর্শন নাস্তিক দর্শন নামে আখ্যাত। চার্বাক মতটি ঠিক (Epicurus) যেন এপিকিউরাস বাদ। (Epicurus-341-270 B.C. খৃঃ পূঃ ৩৪১-২৭০)। চার্বাক মত, লোকায়ত বাদের গদ্যে ও পদ্যে নিবদ্ধ। মহাভারতে ও চার্বাক শব্দটি দেখতে পাওয়া যায়। কথিত আছে, ২৪ জন বুদ্ধের আবির্ভাব হয়; সুতরাং এই হিসাবে গৌতম বুদ্ধ বা শ্রীবুদ্ধের বহু বহু পূর্ব হতে ভারতে একটি বিশিষ্ট সম্প্রদায় ও মত প্রচলিত ছিল। জৈন মত ও বহু প্রাচীন। এরা প্রথমে সম্পূর্ণ বেদানুগ ছিল। যোগবশিষ্টে, রামচন্দ্র জৈন সাধুর প্রশংসা করেছেন দেখা যায়। আদি জৈন (জিন-মোক্ষ) বা আদি তীর্থঙ্কর ঋষভ দেবের কথা ভাগবতে পাই। প্রিয়ব্রতের পুত্র আগ্নীধ্র, তার পুত্র নাভি এবং নাভির পত্নী মেরুর গর্ভে ঋষভ দেবের জন্ম হয়। এই ঋষভ দেব, নগ্ন ছাড়ানো কেশ ব্রহ্মবতী মৌন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী ছিলেন। ঋষভের চরিত্রে ঈর্ষা যুক্ত হয়ে কোন রাজা বেদ বিরুদ্ধ আচার ও নিজমত প্রবর্তন করেন। এটাই পরবর্তী জৈনধর্ম। জৈন, চৈতন্য ও জড় এই দুই সত্তা স্বীকার করেন, (প্রমাণ, অনুমান ও প্রত্যক্ষ) জড়ের কর্ম নেই, সুতরাং মোক্ষ ও নেই। অতএব জীবতত্ত্ব বা জীব, ক্ষেত্র অবগাহী অর্থাৎ জড় পদার্থ মিশ্রিত থাকা পর্যন্ত মোক্ষ হন না। মোক্ষ মানে 'কৃৎস্নকর্ম্ম বিয়োগো লক্ষণো মোক্ষঃ’ সমস্ত কর্মের বিয়োগ বা সম্যক বিনাশ। জীবতত্ত্বের বিপরীত আজীবতত্ত্ব। শুভ অশুভ কর্মদ্বার রূপ বহমানতা কে বিনাশ করতে হলে অনুপ্রেক্ষা রূপ সাধন সহায়ে মনকে নিশ্চল করতে হয়। এর নাম মনো গুপ্তি; বাগ ইন্দ্রিয় বশীভূত হওয়াই বাক্‌ গুপ্তি ও শরীরকে কর্ম হতে সম্পূর্ণ বিরত রাখাই কায় গুপ্তি, যাতে ধীরে ধীরে দেহক্ষয় হয়ে মৃত্যু হয়। জৈনধর্মে আত্মা= জীবতত্ত্ব বা জীব, লঘু স্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি সম্পন্ন কর্ম পরমাণু হতে অব্যাহতি পেলে সিদ্ধি লাভ হয়। নির্বাণ বা মোক্ষ সময়ে সূক্ষ্ম অবস্থা প্রাপ্ত জীব, ব্যাপ্ত হয়ে কর্পূরের মত উড়ে গেলে, আত্মা দেহ হতে মুক্ত হয়ে (সিদ্ধ-শিলায়) যায়, আর ফেরে না- এটাই মুক্ত বা সিদ্ধ ভগবান। জৈন সাধনে (অনুপ্রেক্ষায়) সমস্তই অনিত্য চিন্তা করতে হয়, (বার বার জন্ম মৃত্যু ভোগে অনুশোচনা)-দ্বন্দ্বভাব হতে ধর্মই রক্ষা করতে সমর্থ। আরও ভাবতে হয় যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হর্তাকর্তা বিহীন ও অনাদি। সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান, সম্যক চরিত্র, অহিংসা ধর্ম অর্থাৎ সত্য, ক্ষমা, বিনয়, ব্রহ্মচর্য, উপশম, নিয়ম, দান, অপরিগ্রহ প্রভৃতি আচরণ দ্বারা মোক্ষ সুখ পাওয়া যায় বা ‘ধর্ম্মণূপ্রেক্ষা’ লাভ হয়। আজীব, একটি পরমাণু। মিশ্রণ ঘটায় একমাত্র কর্ম পরমাণু। ধর্ম নিত্য, কিন্তু গুণ-বোধ রূপ ধর্ম অনিত্য অর্থাৎ ধ্বংসশীল। জৈন ক্ষণিক বিজ্ঞানবাদী মতে, জগৎ দৃশ্য মাত্র-গুণমাত্র, অতএব ধর্মকে আশ্রয়, এর কোন অধ্যায় নেই। ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে শেষ তীর্থঙ্কর নাতপুত্ত মহাবীর স্বামীর নাম প্রসিদ্ধ। ২৪ জন বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত বুদ্ধের নাম ও প্রচলিত। শাক্য-বংশের শ্রীবুদ্ধই আজ জগতে পূজিত। তিনি ধ্যান ও সাধনের উপর, কর্ম জীবনের উপর জোর দিয়েছেন, নিজে অবিদ্যা তত্ত্বের সাক্ষাৎকার করে অহং তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, নির্বাণ তত্ত্ব অবিদ্যার পারে। যাই হোক, জৈনমত ও বৌদ্ধমত ভারতে পাশাপাশি বর্ধিত হয় ও আশ্চর্য নয় যে ঐ উভয় মত পরস্পর পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত। আচার ও মত পার্থক্য সত্ত্বেও তাঁরা হিন্দু।

ভারতের আচার্যেরা সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন, কারণ সকল সংস্কারই অভ্যুদয় জনক, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, যাতে মানব চিত্তের উন্নতি আনে না বা যা অভ্যুদয় জনক নয় সেগুলি সংস্কার নয়।

শিবলিঙ্গের পূজা দেখে অনেকের বিষম ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, ভারতে বুঝি একসময়ে লিঙ্গ পূজা ছিল (সাধারণ অর্থে)। বেদে 'শিশ্নোপাসক’দের উপর কটাক্ষ আছে।

[“বৈদিক যুগের বিবাহ প্রথায়, কুমারী কন্যার মাতৃভক্তি বিকাশের অধিকারিণী হবার প্রথম পরিচয় প্রাপ্তি মাত্র ‘গর্ভং ধেহি সিনিবলি’ ইত্যাদি মন্ত্রে তার মাতৃ মুখের পূজার বিধান থাকায় স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ কাল হতেই ভারত, নারীতে মাতৃপূজা করে আসছে। মাতৃ মুখ বা স্ত্রী চিহ্নের বেদোক্ত ঐ পূজা যে দ্রাবিড় জাতির মত স্ত্রী চিহ্নের পূজার ন্যায় ছিল না, এটা বেশ বুঝা যায়। উদ্দেশ্যের প্রভেদ দেখেই ঐ কথা অনুমিত হয়। বৈদিক পূজার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মাতৃ শক্তির সম্মান, প্রাচীন দ্রাবিড় অনুষ্ঠান সকলের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র জায়ার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত নারী শক্তিরই পূজা, এবং তান্ত্রিক পূজার লক্ষ্য মাতা এবং জায়া উভয় ভাবে প্রকাশিতা নারীশক্তিরই মহিমা প্রচার। বেদে ঐভাবে নারীর মাতৃত্ব শক্তির পূজা বিধান অল্পবিস্তর পাওয়া গেলেও দ্রাবিড় জাতির মত স্ত্রী-পুং চিহ্নের কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না। পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন ঐ উপাসনা সুমের এবং তাদের শাখা দ্রাবিড় জাতিরই নিজস্ব সম্পত্তি-বৈদিক আর্যদের নয়, নতুবা বেদেই তার প্রমাণ পাওয়া যেত। তিনি আরও বলতেন, লিঙ্গাইত শৈব-সম্প্রদায়-লিঙ্গোপাসনা বেদ বিরুদ্ধ নয় এবং অথর্ববেদ নিবদ্ধ যূপ স্কম্ভের (স্তম্ভের) উপাসনাই লিঙ্গ উপাসনা বলে প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু অনুধাবন করে দেখলে ঐ কথা (যূপস্কম্ভের উপাসনাকে লিঙ্গ উপাসনা বলে স্থির করা) সত্য বলে বিশ্বাস করা যায় না, কারণ, যদি ঐ রকমই হবে তবে বেদের অন্য কোন স্থানেই স্ত্রী-পুং চিহ্নের পূজা পরিচায়ক কোনও মন্ত্র বিধান আদি প্রমাণ স্বরূপ পাওয়া যায় না কেন ? শিব লিঙ্গের পূজা যে পুং চিহ্নের পূজা নয় তার অন্য কারণ উহার পূজা কালে পূজকের ‘ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চাকচন্দ্রাবতসাং’-ইত্যাদি মন্ত্রে ধ্যান ধারণা করা। এজন্য বেদোক্ত বহু প্রাচীন শিব পূজার সাথে বৌদ্ধ যুগের স্তূপ সমূহের সংযোগ করেই যে কালে বর্তমান লিঙ্গ উপাসনা প্রবর্তিত হয়েছে এটা স্বামীজি যুক্তিযুক্ত মনে করতেন।” (ভারতে শক্তিপূজা-স্বামী সারদানন্দ)। (উক্ত গ্রন্থে যে সামান্য মুদ্রণ দোষ আছে তা সংশোধিত করে উদ্ধৃত হল। দুঃখের বিষয়, ফ্রান্সে ফরাসী ভাষায়, যূপ স্কম্ভ সম্বন্ধে স্বামীজির মূল বক্তৃতা এ পর্যন্ত অনূদিত হয়নি)।]

জৈন প্রভাব একসময়ে বাংলায় খুব বিস্তার লাভ করলেও, এখন বাংলায় জৈন শাস্ত্রের আলোচনা অত্যন্ত কম। অন্যান্য দর্শনের আলোচনা কমবেশি থাকলেও, বর্তমানে অদ্বৈত বেদান্তের ও তন্ত্র শাস্ত্রের আলোচনা বাংলায় আরম্ভ হয়েছে, তবু অনেকে বীরশৈব সম্প্রদায়ের নাম পর্যন্ত জানেন না।

আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক -জীব এই ত্রিতাপ দগ্ধ। দেহ মনের অভাব জাত তাপ আধ্যাত্মিক তাপ; দস্যু, তস্কর ও জীবজন্তুর উৎপাত জনিত দুঃখই আধিভৌতিক তাপ; নৈসর্গিক কারণে উপজাত দুঃখই আধিদৈবিক; যেমন ঝড়, প্লাবন, ভূকম্প ইত্যাদি। জীব এই ত্রিতাপ হতে মুক্তি পেতে চায়। তাই মুক্তির অন্বেষণে বিবিধ উপায়ে মানব সদা রত। মুক্তি- নির্বাণ মুক্তি ছাড়া চার প্রকার, (১) সালোক্য- একই লোকে বা স্বর্গে বাস করা, (২) সামীপ্য- সর্বদা নিকটে থাকা, (৩) সাযুজ্য- এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা, বিম্বের মত, (৪) সার্ষ্টি- কল্পান্তে ব্রহ্মে ব্রহ্মে লীন হয়ে যাওয়া।

সাধকের বাসনা অনুসারে ঐ গুলি এক একটি ধাপ, অদ্বৈত বেদান্ত মতে, অবিদ্যার সম্পূর্ণ নির্বাণ ও আত্মজ্ঞানই জীবকে ত্রিতাপ হতে মুক্ত করতে পারে, স্বরূপে স্থিত করতে পারে, তখনই কেবল জন্ম মৃত্যুর প্রবাহ বন্ধ হতে পারে যখন অবিদ্যার নাশ হয়। স্বরূপ স্থিতিই নির্বাণ মুক্তি। সকল দর্শন শাস্ত্রেরই এক একটি মত আছে, কিন্তু তাদের এই আপাত-প্রতীয়মান মতভেদ সত্ত্বেও, সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, আত্মজ্ঞান ভিন্ন মুক্তি হয় না। রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থ বিদ্যা বা জ্যোতিষ শাস্ত্র সমস্তই একই বিজ্ঞান শাস্ত্রের অন্তর্গত, কিন্তু যে শাস্ত্রের যে অধিকার, সেই দিক দিয়েই ঐ শাস্ত্র আলোচিত হয়েছে-সকলে একই কথা খুঁটিনাটী ব্যাপারে বলতে পারেন না। দর্শন শাস্ত্রের মতভেদ জনিত কুট তর্কের সময় এটা মনে রাখা দরকার, নতুবা বৃথা বাক্যজাল বিস্তার হয়। বৈশেষিক মতে, আত্মা = দেহ ও ইন্দ্রিয় আদির অধিষ্ঠাত্রী সঞ্জীবনী শক্তি। আত্মা দু রকম- জীবাত্মা ও পরমাত্মা। জীব= প্রাণী। পরম বা শ্রেষ্ঠ আত্মা বা পরম প্রভু (ঈশ্বর)= পরমাত্মা। আত্ম অনুভূতিতেই সর্বপ্রকার দুঃখের নিবৃত্তি হয়, তখন সত্য প্রকাশ পায়। এই সত্য অনুভূতিই আত্মজ্ঞান- মুক্তির কারণ। ন্যায়শাস্ত্র প্রণেতা মহর্ষি গৌতমের মতে, জীবাত্মা অপেক্ষা পরমাত্মা বা পরমেশ্বরের অসীম ক্ষমতা, অসীম প্রভাব আছে, বিভিন্ন দেহে বিভিন্ন জীবাত্মার অধিষ্ঠান। আত্মা যে শরীর নয় এই জ্ঞান উদয়ে দুঃখের নিবৃত্তি হয় অর্থাৎ মুক্তি হয়, তখন জন্ম মৃত্যুর অধিকার আর থাকে না। মীমাংসা দর্শন, এক উচ্চতম ভূমির-উচ্চতম অবস্থার কথা স্বীকার করেন, কিন্তু নিরীশ্বরবাদী। মীমাংসা মতে, দেবতার (ঈশ্বরই হোন আর যেই হোন) মন্ত্র ময় কায়া। শাস্ত্রবিধি অনুসারে মন্ত্র- সাধনায়, জীব উচ্চাৎ উচ্চতার ভূমিতে আরোহণ করে নিজের গন্তব্য স্থানে উপনীত হয়। সাংখ্য দর্শন প্রণেতা কপিলের মতে, জীব যখন ত্রিতাপ দগ্ধ, তখন জীবের কর্তব্য ঐ ত্রিতাপ-জালা হতে মুক্ত হবার চেষ্টা করা। তবে এর জন্য জীবাত্মার অতিরিক্ত, জীবাত্মা হতে স্বতন্ত্র, একজন সর্বশক্তিমান়্ সর্বাতীতকে মানবার দরকার নেই। তা ছাড়া, যুক্তি দ্বারা ঈশ্বর প্রমাণিত হয় না। পুরুষ ও প্রকৃতি কে বিকৃত করে বোঝবার জন্যই জীব ত্রিতাপ হতে মুক্তি লাভ করতে পারে না। তত্ত্বজ্ঞান এলে- পুরুষ ও প্রকৃতি কি উপলব্ধ হলে, উক্ত ত্রিতাপ ধ্বংস হয়। শরীর দুই রকম- স্থূল ও সূক্ষ্ম। স্থূল শরীর= দৃশ্য পঞ্চভূত+সূক্ষ্ম পঞ্চভূত, সূক্ষ্ম শরীর= মন+বুদ্ধি+অহংকার+পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়+পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়+পঞ্চ তন্মাত্রা (মূল ছাঁচ)। প্রকৃতি হতেই বুদ্ধি ও অন্যান্য তত্ত্ব পরে পরে আসে। সত্ত্ব, রজঃ ও তম- এই তিন গুণের সাম্য অবস্থার নাম মূলপ্রকৃতি। পুরুষ চেতন, প্রকৃতি জড়। জড় নিষ্ক্রিয় হলেও, পুরুষ হতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। পুরুষের সান্নিধ্য বশতঃ, প্রকৃতি হন চেতন ও তখন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতিতে প্রতিবিম্বিত জীব রূপী পুরুষ অসংখ্য। এই অসংখ্যের মুক্তির জন্যই প্রকৃতির ক্রীড়া। পাতঞ্জল দর্শনে ঈশ্বরবাদ ছাড়া আর সমস্তই সাংখ্যের অনুরূপ। পাতঞ্জল মতে, প্রকৃতি হতে আলাদা একজন দ্রষ্টা বা সাক্ষী আছেন। তিনিই সাধকের অভীষ্ট পূরণ করেন। শ্রী শঙ্কর মতে, জীবাত্মা ও পরমাত্মায় ভেদ নেই- সৃষ্টি জ্ঞানের জন্যই এই ভেদ বোধ হয়। ব্রহ্ম সত্য, ব্রহ্ম জ্ঞানই নির্বাণ মুক্তি।

একই উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ঐ সকল দর্শন শাস্ত্র হতে অসংখ্য সম্প্রদায়, অসংখ্য মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে ও এখনও হচ্ছে, এই রকম করেই আর্য প্রভা ভারত ময় বিকীর্ণ হয়েছে, এই রকম করেই সমগ্র হিন্দু জাতি একই লক্ষ্যে ছুটেছে, এইরকম করেই বিনা রক্তপাতে, আর্য জাতি ভারতকে গড়ে তুলেছেন ভারতে তর অপর কোন জাতির উপর লোলুপ দৃষ্টি না রেখে।

হিন্দু নামটি বিদেশীর দেওয়া। বেদানুগ ধর্মের একটি সাধারণ নাম ছিল- আর্যধর্ম, সনাতন ধর্ম। যাহোক, হিন্দু নামটি যেরকম মনোভাব নিয়ে দেওয়া হয়ে থাকুক, ঐ নামটি পরে একটা বিশিষ্টতার পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। স্বামীজি চিকাগো ধর্মসভায় (১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে) বলেছিলেন যে, হিন্দু শব্দটি হিন্দুর কাছে যে অর্থে গৃহীত ভারতে আজ, তার অর্থ বৈদিক যুগ হতে আর্য কৃষ্টি ধারা। সকল জাতিরই একটা বৈশিষ্ট্য আছে, ভারতের প্রত্যেক অন্তর্জাতির ও একটা বিশেষত্ব আছে, সে সব বৈশিষ্ট্যের কারণ-আবহাওয়া, ভূসংস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জীবন সংগ্রাম বা এই রকম অনেক কিছু। ভারতের বিশিষ্টতা মানে মৌলিকতা-যা অন্যত্র কোথাও নেই। এই মৌলিকতা সকল জাতির- বিগত, বর্তমান ও অনাগত বৈশিষ্ট্য কে কুক্ষিগত করতে সমর্থ, কারোর বিশিষ্টতায় বা ভাবে আঘাত না দিয়ে। বৌদ্ধধর্ম নামে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন ধর্ম ভারতে কোন কালে ছিল না। বুদ্ধের বাণী ও তাঁর বৈরাগ্য ময় জীবনের জন্য তিনি দশ অবতারের মধ্যে একজন শ্রীবুদ্ধের মত বেদ সম্মত। যে সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি তে পরে ভারতে সমাজ ও সংস্কৃতি মহা বিপন্ন হয়, ভারত কে- সমগ্র জাতি কে- মাত্র একটি ভাবে গঠিত করার চেষ্টা হয়, আচার্য শঙ্কর সেই তথাকথিত বৌদ্ধ নামে পরিচিত মতবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান প্রথম। শ্রী শঙ্কর ও শ্রীরামানুজ আবার চতুর্বর্গের প্রচার করে, সমাজ তথা জাতিকে রক্ষা করেন। একঘেয়ে গোঁড়ামির ভাব ভারতের ভূমিতে ফলপ্রসূ কোন কালে হয় নি।

শ্রীবুদ্ধের নাম নিয়ে, আজ ও যে বৌদ্ধধর্ম কে একটি পৃথক ধর্ম বলে প্রচার করা হয়, তার উদ্দেশ্য-ভগিনী নিবেদিতার মতে-নিছক ইউরোপীয় নীতি (এশিয়ার)।

"The idea that there were once in India two rival religions known as Hinduism and Buddhism respectively, is a neat little European fiction, intended to affect Asiatic politics in the way that is dear to the European heart It cannot be too often repeated that there never was a religion in India known as Buddhism with temples and priests and dogmas of its own -(Nivedita-vide Probuddha Bharata Vol XI, May 1935)

আজও বুদ্ধ গয়ার মন্দির খাড়া হয়ে বয়েছে কেমন করে, কেন আজও তা হিন্দুর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে, কেন তা বরাবর ইংরেজ আমলে ও ছিল শঙ্কর সম্প্রদায়ের হাতে? এগুলি কি ভাবার বিষয় না ? নিবেদিতা আরো বলেন যে, ভারতের অদ্বৈতবাদ সর্বপ্রকার প্রতীক কে রক্ষা করে, কিন্তু পাশ্চাত্য প্রােটাসটেন্ট বা ইউনিটেরিয়ান ধর্ম স্ব স্ব মতবাদের একটু এদিক ওদিক সহ্য করতে পারে না।

[বক্তৃতার শেষে আপনারা একটি প্রশ্ন করেছেন। তার উত্তর সংক্ষেপে এই যে, জৈন প্লাবনের বেগ রুদ্ধ করেন বাসর নামে একজন বীরশৈব। বীরশৈবদের মতে, বাসবদেব ছিলেন একজন শিব প্রেরিত প্রমথ। বাসর কিছুদিন কল্যাণ রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন (দ্বাদশ শতাব্দী 12th century A D)। যুপ স্তম্ভটি ব্রহ্মের প্রতীক। যজ্ঞাগ্নি, ধূম, অগ্নিশিখা, ভস্ম, সােমলতা, শিবের বাহন বৃষ, যজ্ঞ কাষ্ঠ, শিবের শুভ্র জটাজাল প্রভৃতি সব নিয়েই শিব-তনু, শিবের নীলকণ্ঠ, যূপ স্তম্ভ আদি সমস্তটাই শিবলিঙ্গ। শিবের নাম ঋগ্বেদে আছে, পশুপতি নাম ব্রাহ্মণ আদি গ্রন্থে আছে, বিশেষ যজুর্বেদে এই তত্ত্বটি পরিস্ফুট। পশুর পাশ বলি প্রদত্ত হয় জ্ঞান অগ্নিতে, আর ঐ বলিভূক কাল অগ্নিই নন্দী। শিব লিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ ও বলা হয়, যে জ্যোতি অনন্ত ও সীমাহীন। বহু স্থানে এই সব তত্ত্ব পল্লব আকারে বহু বিস্তৃত দেখা যায়।]

'সমস্ত দিকেই ব্যাপ্ত-সমস্ত কিছুই ঈশ্বর ময়' 'তত্ত্বমসি' 'আত্মানং বিদ্ধি'-বাক্যগুলোর তাৎপর্য কি ?
উত্তর : 'তত্ত্বমসি’র অর্থ , অর্থাৎ স আত্মা = পরমাত্মা ,
তৎ = স আত্মা অন্তর্যামী যস্য , তাদৃশত্ত্বমসি ।
সমাধিস্থ অবস্থায় 'তত্ত্বমসি’ মুনিরা এইরূপ বলেছেন , কিন্তু সাহচর্য্যের প্রতি ধ্যান দিলে মুনিদের এই উক্তি "জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন" এই মতের পোষক হয় না । কারণ এই কথনের (কি উক্তির) পূর্বভাগে এই সমস্ত স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতের কারণ রূপে পরমাত্মার ঐতদাত্ম্য (কথিত) বিদ্যমান । পরমাত্মার আত্মা ভিন্ন নয় , 'স আত্মা' সেই আত্মা 'তদন্তর্যামী ত্বমসি' যিনি সমস্ত জগতের আত্মা সে তোমারই । এ কারণ জীবাত্মা ও পরমাত্মা ইহাদের মধ্যে পরস্পর সেব্যসেবক , ব্যাপ্যব্যাপক , আধারাধেয় এই সমস্ত বাস্তবে খাঁটে ।
যেমন , দেখুন ঐতরেয় উপনিষদে বলা হয়েছে -
‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ বাক্যটি ।
এর মহাবাক্য - বিবরণে ‘প্রজ্ঞামানন্দং ব্রহ্ম’ এইরূপ বিস্তার করা হয়েছে , তথাপি পরমেশ্বরই সৃষ্টি রচনা করেছেন , এইরূপ অর্থ “তৎসৃষ্টিং প্রাবিশত” এই বাক্যের আধারে অর্থ করিলে কার্য কারণের ভিন্নতা হওয়া সম্ভব । ঈশ্বর যদি জ্ঞানবান্ হন , তাহলে তিনি অবিদ্যা মায়া আদির অধীন হইয়া সৃষ্টি উৎপত্তির কারণ হবেন । এরূপ বলিলে “তিনি ভ্রান্ত" এইরূপ প্রতিপাদন করতে হবে ।
যেখানে দেশ , কাল , বস্তুর পরিচ্ছেদ হবে , উহা ভ্রান্তময় । ব্রহ্মের এই ভ্রান্তি হয়েছে যদি বলা হয় তাহলে ব্রহ্মের জ্ঞান অনিত্য প্রমাণিত হবে । অতএব এটা বিচারণীয় বিষয় ।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ