ত্বষ্টুর্হ বৈ পুত্র।ত্রিশীর্ষা ষডক্ষ আস ত্রীণ্যেব মুখান্যসুস্তদ্যদেবংরূপ আস তস্মাদ্বিশ্বরূপো নাম।
- শ০ ব্রা০ ১/৭/৩/১/ তস্য ( বিশ্বরূপস্য) সোমপানমেবৈকং মুখমাস।
শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শনেই কি প্রমাণ হয় তিনি ঈশ্বর?
১। ভাগবত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ তার মা যশোদাকে নিজের মুখের ভেতর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
(যত দিন যায় তত কৃষ্ণের দুষ্টুমি বাড়ে। কিছুতেই তাকে আর সামলানো যায় না। প্রতিবেশী প্রায় সকলেই তার নামে অভিযোগ জানায়। মা যোশদা সব শোনেন। তার গোপালকে শাসন করবেন কী ছোট্ট ছোট্ট হাতে যখন আঁকড়ে ধরে তখন সব ভুলে যান যশোদা। তাঁর ছোট্ট গোপাল যে রয়েছে জীবন জুড়ে। তাঁর আদরের গোপাল।
অনেকেই এসে যশোদাকে বলে, তোমার গোপাল অনেক ছল-চাতুরি করতে শিখেছে। বড় হলে কী যে হবে! বাঁধা বাছুরকে খুঁটি থেকে খুলে দেয়। বাঁধন-হারা বাছুর গাভীর সব দুধ খেয়ে নেয়। এমনকী ননী চুরি করে খেয়ে নেয়। আবার বন্ধুদেরও বিলোয়। কিছু বললে আমাদের বেণি ধরে টানও মারে।
যশোদা সব শোনেন। মাঝেমধ্যে শাসনও করেন তাঁর আদরের গোপালকে। এভাবেই দিন যায়। ক্রমশ বড় হয় কৃষ্ণ-বলরাম। একদিন হয়েছে কি যশোদাকে কৃষ্ণের গোপ-বন্ধুরা এসে বলল, দেখো না কৃষ্ণ মাটি খেয়েছে। এই অভিযোগকারীদের দলে কৃষ্ণ-ভ্রাতা বলরামও ছিল। কৃষ্ণ বলল, ওরা সব মিছে কথা বলছে। আমি মাটি খাইনি। মা তুমি দেখো না আমি হাঁ করছি। তাহলে তো আমি মিছে না সত্যি বলছি।
যশোদার সামনে বালক কৃষ্ণ একটা বিশাল হাঁ করল। এ কী দেখছেন যশোদা! কৃষ্ণের মুখের ভিতর সারা বিশ্বচরাচর! মাতা যশোদাকে বিশ্বরূপ দর্শন করাল বালক কৃষ্ণ। এসব দেখে যশোদা অবাক! এ কী দেখালো তাঁর গোপাল! পরম মমতায় আদর করতে লাগলেন যশোদা। বুঝতে পারলেন তাঁর আদরের গোপালের দেবমায়া!)
২। শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে কৌরব সভায় বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
দূর্যোধন শ্রীকৃষ্ণকে বন্দি করতে গেলে পুরো সভার লোকজনের সামনে কৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখান-
ইহেব পান্ডবাঃ সর্বে তথৈবান্ধকবৃষ্ণয়ঃ৷
ইহাদিত্যাশ্চ রুদ্রাশ্চ বসুবশ্চ মহর্ষিভিঃ||
অর্থ- দেখ,সব পান্ডব এখানেই আছে৷ অন্ধক এবং বৃষ্ণিবংশের বীরগণও এখানে আছে,আদিত্যগণ,রুদ্রগণ তথা মহর্ষিদের সহিত বসুগণও এখানে আছে৷
[ মহাভারত- উদ্যোগ পর্ব- অধ্যায় ১৩১- শ্লোক ৩]
তস্য ব্রহ্মা ললাটস্থো রুদ্র বক্ষসি চাভবত্ঃ||
লোকপালা ভুজেষ্বাসন্নগ্নিরাস্যাদজায়ত৷
আদিত্যাশ্চৈব সাদ্ধাশ্চ বসোবঽথাশ্বিনাবপি||
মরুতশ্চ সহেন্দ্রেণ বিশ্বদেবাস্তথৈব চ৷
বভূবুশ্চৈব যক্ষ্মাশ্চ গন্ধর্বারগরাক্ষ্মসাঃ||
অর্থ- ললাটে ব্রহ্মা এবং বক্ষস্থলে রুদ্রদেব বিরাজমান আছে৷ সমস্ত লোকপাল ভুজাতে স্থিত ৷ মুখ থেকে অগ্নির শিখা বের হতে লাগলো৷ আদিত্য,সাধ্য,বসু,দুই অশ্বিনীকুমার ইন্দ্রের সহিত মরুদগণ,বিশ্বদেব,যক্ষ,গন্ধর্ব,
নাগ এবং রাক্ষসগণও তার বিভিন্ন অঙ্গতে প্রকট হয়ে গিয়েছিল ৷
[ মহাভারত- উদ্যোগপর্ব-অধ্যায় ১৩১- শ্লোক ৫-৭ ]
৩।ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
৪। বামন আবতার কতৃক বলিকে বিশ্বরূপ দর্শণঃ(ভাগবত ৮/১৪)
এগুলো ছিলো সব বিষ্ণুর অবতারের উদাহরণ ( পুরাণ মতে ) ।
কিন্তু একমাত্র বিষ্ণু/কৃষ্ণই কি বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেছেন?
না
মোটেও তা নয়।
নিচের উদাহরণগুলো দেখুন।
৫। দক্ষের কন্যা সীতা জন্মের পরেই দক্ষকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন:
কোটী-সূর্যপ্রতীকাশং তেজোবিম্বং নিরাকূলম্ ।
জালামালা সহস্রাঢ্যাং কালানল শতোপমম্।।
দংষ্ট্রাকবাল দুর্ধর্ষং জটামণ্ডলমণ্ডিতম্।
ত্রিশূলববহস্তঞ্চ ঘোবরূপং ভয়ানকম্।।
সর্বত: পাণি-পাদন্তং সর্বতোহক্ষিশিবোমুখম্।
সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠন্তীং দদর্শ পরমেশ্ববীম্।।
(কূর্মপুরাণ, পূর্বভাগ ১২।৫২-৫৩,৫৮)
৬। বৃহৎসংহিতায় ইন্দ্রের যে বর্ণনা আছে তা বিশ্বরূপের আনুরূপ:
অজোহব্যয়ঃ শাশ্বত কএরূপো বিষ্ণুর্ববাহঃ পুরুষঃ পুরাণঃ।
ত্বমন্তক সর্বহবঃ কৃশানুঃ সহস্রশীর্ষা শতমনুবীভ্যঃ।।
কবিং সপ্তজিহবং ত্রাতারমিন্দ্রমবিতারং সুবেশম্।
হবযামি শত্রুং বৃত্রহনং সুষেণমস্মাকং বীবা উত্তরে ভবন্তু।।
(বৃহৎ সং- ৪৩।৫৪-৫৫)
ইন্দ্র এখানে অজ অর্থাৎ স্বয়ম্ভু, শাশ্বত অর্থাৎ নিত্য, বিষ্ণু, বিরাহ বিষ্ণুর অবতার, পুরাতন পুরুষ, যম, অগ্নি, সহস্র শির বিশিষ্ট, কবি, সপ্তজিহ্বা সমন্বিত, রক্ষাকর্তা, দেবরাজ, শত্রু, বৃত্রাঘাতী এবং সুষেণ।
৭। গণেশ গীতাতে গণেশ রাজা বরেণ্যকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন:
অসংখ্যবক্ত্র ললিতমসংখ্যাঙ্ঘ্রি কবং মহৎ।
অসংখ্যনয়নং কোটীসূর্যরশ্মিধৃতাষুধম্।
(গণেশ গীতা - ৮।৬-৭)
৮। ভবিষ্যপূরাণে সূর্য বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
৯। মার্কেন্ডেও পূরাণে চন্ডির যে বর্ণনা আছে তা বিশ্বরূপের আনুরূপ।
ব্রহ্মা চন্ডিকে স্তুতি করে বলছেনঃ
ত্বষৈব ধার্যতে সর্বং ত্বষৈতৎ সূজ্যতে জগৎ।
ত্বষৈতৎ পাল্যত দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
(চণ্ডী- ১। ৬৮-৬৯)
-হে দেবী, তুমিই সবকিছু ধারণ কর, তুমি জগৎ সৃষ্টি কর, তুমিই পালন কর, তুমিই প্রলকালে গ্রাস কর।
১০। একৈবাহং জগত্যাত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পৈশ্যৈতা দুষ্ট ময়েব্য বিশস্ত্যা মদবিভূতয়:।।
(চণ্ডী - ১০। ৮)
- এই জগতে আমি একাই, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে? এই দুষ্ট দেখো- আমার বিভূতি আমাতেই প্রবেশ করছে।
১১।বরাহ পুরাণে শিবের বিশ্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে:
প্রদেশমাত্রং রুচিরং শতশীর্ষং শতোদবম্।।
সহস্রবাহুচরণং সহস্রাক্ষিশিরোমুখম্।
অনীযসামণীযাংসং বৃহদবহদ্ বৃহত্তবম্।
(বরাহ পুরাণ - ১।৯।৬৮)
- শিব এখানে প্রোদেশ প্রমাণমাত্র হয়েও শতশীর্ষ, শত উদর বিশিষ্, সহস্র বাহু, সহস্র পদ, সহস্র চক্ষু, সহস্র মস্তক ও সহস্র মুখ সমন্বিত। অণু থেকে ক্ষুদ্র হয়েও সর্ববৃহৎ।
১২।বায়ু পুরাণেও শিবের বিশ্বমূর্তি বর্ণিত হয়েছে:
অব্যক্তং বৈ যস্য যোনিং বদন্তি
ব্যক্তং দেহং কালমন্তর্গতঞ্চ।
বহ্নিং বক্ত্রং চন্দ্রসূর্যৌ চ নেত্রে
দিশ: শ্রোত্রে ঘ্রাণমাহুশ্চ বায়ুম্।।
বাচো বেদাংশ্চান্তরীক্ষং শরীরং
ক্ষিতিং পাদৌ তারকা বোমকূপান্।।
(বায়ু পু - ১/৯/৬৮)
- শিবের উৎপত্তি অব্যাক্ত, তার দেহ ব্যাক্ত অর্থাৎ প্রকাশিত। তার দেহের অন্তর্গতসমূহ কাল। অগ্নি তাঁর মুখ, চন্দ্র ও সূর্য তার নেত্রদ্বয়, দিকসমূহ তাঁর কর্ণ, বায়ু তার ঘ্রাণ, বেদ তার বাক্য, অন্তরীক্ষ শরীর, পৃথিবী পদদ্বয়, তারকাগণ রোমকূপ।
১৩।বামন পূরাণে শিবের বিশ্বরূপ :
ত্বমেব বিষ্ণুশ্চতুবাননতস্তৃং
ত্বমেব মৃত্যুর্বদদস্তৃমেব।।
ত্বমেব যজ্ঞো নিবমস্তমেব।
ত্বমেব ভূতং ভবিতা ত্বমেব।।
ত্বমেব সূর্যো রজনীকরশ্চ।
ত্বমেব ভূমিঃ সলিলং ত্বমেব।
স্থুলশ্চ সুক্ষ্মঃ পুরুষস্তৃমেব।।
(বামন পু: ৫৪/৯৬-৯৯)
- তুমিই বিষ্ণু, তুমিই ব্রহ্মা, তুমিই মৃত্যু, তুমিই বরদ, তুমি সূর্য ও চন্দ্র, তুমি ভূমি, তুমি জল, তুমি যজ্ঞ, নিয়ম, তুমি অতীত, ভবিষ্যৎ, তুমি আদি ও অন্ত, তুমি সূক্ষ্ম ও স্থুল, তুমিই (বিরাট) পুরুষ।
১৪।পদ্মপুরাণে ব্রহ্মার বিশ্বরূপের বর্ণনা:
বক্ত্রাণ্যনেকানি বিভো তবাহং
পাশ্যামি যজ্ঞস্য গতিং পুরাণম্।
ব্রহ্মাণমীশং জগতাং প্রসূতিং
নমোহস্তু তুভ্যং প্রপিতামহায়।।
( পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ড - ৩৪/১০০)
হে বিভু, আমি দেখছি তোমার অনেক মুখ, তুমি যজ্ঞের গতি, তুমি পুরাণ পুরুষ, তুমি ব্রহ্মা, ঈশ, জগৎসমূহের সৃষ্টিকর্তা। প্রপিতামহ, তোমাকে নমস্কার।
১৫।গণেশ গীতাতে গণেশকে ব্রহ্মস্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গণেশ নিজের স্বরূপ বর্ণনা করছেন এভাবে:
শিবে বিষ্ণৌ চ শক্তৌ চ সূর্যে মযি নরাধিপ।
যা ভেদবুদ্ধির্যোগঃ স সম্যগ্ যোগো মতো মমো।।
অহমেব জগৎ যস্মাৎ সৃজামি চ পালয়ামি চ।
কৃত্বা নানাবিধিং বিষং সংহরামি স্বলীলয়া।।
অহমেব মহাবিষ্ণুবহমেব সদাশিবঃ।
অহমেব মহাশক্তিরহমেবার্ষিমা প্রিয়।।
( গণেশ গীতা - ১/২০-২২)
- হে রাজন। শিব, বিষ্ণু, শক্তি এবং সূর্যে যে ভেদবুদ্ধি সে আমারই সৃষ্টি, যেহেতু আমিই জগৎ সৃষ্টি করি, হে প্রিয়। আমিই মহা বিষ্ণু, আমিই সদাশিব, আমিই মহাশক্তি, আমিই অর্যমা।
১৬।মহাভারতের মার্কেণ্ডেয়-কৃত কার্তিকেয় স্তবে কার্তিকেয়ে বিশ্বমূর্তিরূপে বন্দিত হয়েছেনঃ
ত্বং পুরস্করাক্ষরস্ত্বরবিন্দবক্ত্রঃ সহস্রবক্ত্রোহসি সহস্রবাহুঃ।
ত্বং লোকপালঃ পরমং হবিশ্চ ত্বং ভাবনঃ সর্বসুরাসুরাণাম্।।
( মহাভাঃ বনপর্বঃ ২৩১, অঃ৪৩)
-তুমি পদ্মপলাশলোচন, তুমি অরবিন্দতুল্যমুখ-বিশিষ্ট, তোমার সহস্র বদন,সহস্র বাহু, তুমি লোকপাল, শ্রেষ্ঠ হরি, সকল দেব ও অসুরগণের আবাধ্য।
১৭। কথিত আছে শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানান্দকে ঈশ্বর দর্শণ করিয়েছিলেন। যেটাকে বিশ্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। (এটা গুজব হওয়াও অসম্ভব কিছু না)
১৮। লিঙ্গপুরাণ পূর্বভাগের ৩৬ তম অধ্যায়ে এরকম বর্ননা এসেছে। শ্রীবিষ্ণু ব্রাহ্মণবেশে দধীচি মুনির নিকট এসে বললেন - আমি আপনার নিকট বর প্রার্থনা করি আমাকে বর প্রদান করুন। দধীচি মুনি বললেন রুদ্রদেবের অনুগ্রহে ভূত ভবিষ্যত আমি জানি। আপনাকে আমি চিনিতে পারিয়াছি আপনি স্বরূপে ফিরে আসুন। আপনি কৃপা করে বলুন শিব আরাধনা পরায়ন ব্যক্তির কোন ভীতি থাকে? আমি কাহারও সমীপে ভয় পাই না। তখন বিষ্ণু ছদ্মবেশ ত্যাগ করে বললেন - হে বিপ্র আমি জানি তুমি কাহারো নিকট ভয় পাও না তবুও তুমি সভামধ্যে ক্ষুপভূপতিকে বলো আমি ভয় পাইতেছি। তখন মহামুনি বললেন আমি ভয় পাই না। তখন বিষ্ণু ক্ষুব্ধ হইয়া মহামুনিকে চক্র উত্তোলন করে মারতে উদ্যত হলেন। তখন মুনির সহিত ভয়ানক যুদ্ধ বাধলো। অতপরঃ বিষ্ণু মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন
ততো বিস্ময়নার্থায় বিশ্বমূর্তিরবূদ্ধরিঃ।
তস্য দেহে হরেঃ সাক্ষাদপশ্যদ্বিজসত্তমঃ।।৫৮।।
দধীচী ভগবান্বিপ্রঃ দেবতানাং গণনা পৃথক।
রুদ্রাণাং কৌটয়শ্চৈব গণনাং কৌটয়স্তদা।।৫৯।।
অনন্তর হরি মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন। মুনিবর ভগবান দধিচী নারায়ন শরীর মধ্যে পৃথক পৃথক দেবতা, কোটি কোটি রুদ্র এবং কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড অবলোকন করলেন।
অতঃপর দধীচি মুনি মুনি বললেন -
মায়াং ত্যজ মহাবাহো প্রতিভাসা বিচারতঃ।
বিজ্ঞানানাং সহস্রাণি দুর্বিজ্ঞেয়াণি মাধবঃ।।৬২।।
ময়ি পশ্য জগৎসবৈ ত্বয়া সাধমনিন্দিত।
ব্রহ্মাণং চ তয়া রুদ্রং দিব্যাং দৃষ্টি দদামি তে।।৬৩।।
হে মহাবাহো! বিচারপূর্বক প্রতিভা দ্বারা মায়া ত্যাগ করুন, হে মাধব! বিজ্ঞানসহস্র নিতান্ত দূর্বিজ্ঞেয়। হে অনিন্দিত! আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দান করিতেছি, তুমি আমার শরীর মধ্যে তোমা সহ সমস্ত জগৎ ব্রহ্মা, রুদ্র এই সকল অবলোকন করো।
ইত্যুক্তত্বা দর্শয়ামাস স্বতনৌ নিখিলং মুনিঃ।
তং প্রাহু চ হরি দেবং সর্বদেবভবোদ্ভবম।।৬৪।।
মায়য়া জ্ঞানয়া কিং বা মন্ত্রশক্তয়াথ বা প্রভো
বস্ত শক্তয়াথ বা বিষ্ণো ধ্যানশক্তয়াথ বা পুনঃ।।৬৫।।
ত্যক্ত মায়ামিমাং তস্মাদ্যোদ্ধর্মহসি যত্নতঃ।
এই কথা বলিয়া দধিচী মুনি নিজ শরীররর মধ্যে সমস্ত জগৎ দর্শন করিয়া সর্বদেবজনক হরিকে বললেন - হে বিষ্ণো! এই মায়া, মন্ত্রশক্তি দ্রব্য শক্তি ও ধ্যানশক্তিতে কি হইবে? অতএবঃ মায়া ত্যাগ করে যত্নপূর্বক যুদ্ধ করুন।
শ্লোকগুলোতে দধীচি মুনি বিশ্বরূপ কে মায়ার সাথে তুলোনা করেছেন এমনকি তিনি নিজেও বিষ্ণুকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। অতঃএব বিশ্বরূপ প্রদর্শন একজন মুনির পক্ষেও সম্ভব।
এবার উপনিষদ হতে দেখে নেই
ছান্দোগ্য উপনিষদে সনৎকুমার তাঁর শিষ্য নারদকে বলেছেন-
"....অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং দক্ষিণতোহহমুত্তরতোহহমেবেদং সর্বমিতি।।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.
অর্থ: আমিই অধো ভাগে, আমি উর্ধ্বে, আমি পশ্চাতে, আমি সম্মূখে, আমি দক্ষিণে, আমি উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।
তাহলে এখানে সনৎকুমারকে ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে?
আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে –
অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। উর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোহক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ– শীক্ষাবল্লী ১০ম অনুবাক।
অর্থ: আমি সংসার বৃক্ষের উচ্ছেদক, আমার কীর্তি পর্বতের শিখরের মতো উন্নত। অন্নোৎপাদক শক্তিযুক্ত সূর্য যেরূপ অমৃতের মতো, আমিও সেরূপ। আমিই ধনের ভাণ্ডার, আমিই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন, আমিই অমৃত– এরূপ ঋষি ত্রিশঙ্কুর অনুভূত বৈদিক বচন।
তাহলে এখানে ত্রিশঙ্কু ঋষিকে ঈশ্বর বলে গণ্য করতে হয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে আরও আছে–
হা৩বু হা৩বু হা৩বু।
অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩হহমন্নাদো৩হহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোহমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩বাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্।। সুবর্ণ জ্যোতীঃ য এবং বেদ।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ–ভৃগুবল্লী ১০ম অনুবাক।
অর্থ: আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন। আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা। আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী। আমি সত্যের অর্থাৎ প্রতক্ষ্য জগত অপেক্ষা সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রথম উৎপন্ন এবং দেবতাগণ হতেও পূর্বে বিদ্যমান অমৃতের কেন্দ্র হচ্ছি আমি। যে কেউ আমাকে অন্ন দেয় সে কার্য দ্বারা আমার রক্ষা করে। আমিই অন্নস্বরূপ হয়ে অন্ন ভক্ষণকর্তাকে ভক্ষণ করি। আমি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে অভিভূত করি। আমার প্রকাশের এক ঝলক সূর্যের ন্যায়। যে এরূপ জানে সেও স্থিতি লাভ করে।
১৯। পূরাণ উপনিষদ থেকে তো অনেক উদাহরণ দিলাম। এবার বেদ দিয়ে শেষ করি। ঋগ্বেদ ৪/২৬/১-৩ খেয়াল করুনঃ
এখন কি আপনারা ঋষি বামদেবকে ঈশ্বর বলে দাবি করবেন?
২০। অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।।
ঋগবেদ ১০/১২৫/১
অর্থ: আমি বাক্-আমব্রীনী, অসীম জ্ঞানের কন্ঠস্বর, মহাবিশ্বের বাক্, (আমি) ১১ রুদ্র, ৮ বসু, ১২ আদিত্য এবং সকল বিশ্বদেবগনের সহিত সকল কিছু বহনকারী ও একই সঙ্গে বিদ্যমান৷ আমি মিত্র ও বরুন (দিবস ও রাত্রি) উভয়ের সাথে ব্যাপ্ত ও ইহাদের ধারন করি৷ আমি ইন্দ্র ও অগ্নি (বাতাস ও আগুন) উভয়ের সহিত ব্যাপ্ত ও ইহাদের ধারন করি৷ আমি অশ্বিনীদ্বয়কে বহন করি ও ধারন করি৷
এটি ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবী সূক্তের প্রথম মন্ত্র। যার দ্রষ্টা হচ্ছেন ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক। এই সূক্তে ৮ টি মন্ত্র রয়েছে এবং প্রতিটিতেই আমি শব্দটি রয়েছে। ফলে এখানে "আমি" শব্দ দ্বারা মন্ত্রের বক্তাকেই ঈশ্বর মানলে ঋষিকা বাককে ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে।
বেদ-পুরাণ ঘাটলে বিশ্বরূপের এমন আরো অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে।
সুতরাং বলা যায় শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শনেই প্রমাণ হয় না তিনি ঈশ্বর।
এতদ্বৈ বিশ্বরূপং সর্বরূপং গোরূপম্।। অথর্ব ৯/৭/২৫
( এতদ) এই দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ড (বৈ) নিশ্চয়ই ( বিশ্বরূপম্) বিশ্বরূপ হয়, (সর্বরূপম্) সর্বরূপ ই (গোরূপম্) গোরূপ। গো ই বাণীরূপ। বৈদিক বাণী তত্ত্ব হতেই সকল পদার্থের সৃষ্টি হয়। যাহা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তাহা বৈদিক বাক্ রশ্মি তথা বানী হতে সৃষ্টি হয়েছে।
অথর্ব মন্ত্র এটি স্পষ্ট যে বাক্ তত্ত্বই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রূপে প্রকাশিত হয়েছে।
এই সৃষ্টিই বিশ্বরূপ। তাই ঈশ্বর বিশ্বরূপ নয়।
বেদ ও শ্রুতিমন্ত্র
১। স পৰ্য্যগাক্ৰমকায়মত্ৰণমবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম।
কবিৰ্মনীষী পরিভূ স্বয়্যাথাব্যতােহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাধ্য।
(যজু ৪০। ৪]
তিনি সর্বব্যপক, শরীর রহিত, শারীরিক বিকার রহিত ইত্যাদি।
অজো অক্ষা দাধার পৃঙ্খীং তস্তম্ভ দ্বাং মন্ত্রেভিঃ সতৈঃ।
প্রিয় পদানি পশশ্যা নিপাহি বিশ্বায়ুরগ্নে গুহা গুহংগা।। [ঋক্ ১। ৬৭। ৩]
শন্নো অজ এক পান্দেববাহ
(ঋক্ ৭। ৩৫। ১৩]
ব্রহ্ম বা অজঃ। [শতপথ ৬। ৪। ৪। ১৫]
বেদাহমেতমজরং পুরাণং সর্বাত্মানং সর্বগতং বিভূত্বাৎ।
জন্মনিরােধ প্রবদন্তি যস্য ব্রহ্মবাদিনাে হি প্ৰবদন্তি নিত্যম্।
[ শ্বেতাশ্বতর ৩। ২' 24
৬। একধৈবানুদ্রষ্টব্যমেদমেয়ং ধুবং।
বিরজঃ পর আকাশ অজঃ আত্মা মহান্ ধুবঃ ।। বৃহদারণ্যক ৪|৪২৭]
৭। দিব্যোহ্যমূঃ পুরুষঃ বাহ্যভ্যন্তরােহ্যজঃ।
অনােহমনাঃ শুভ্র হ্যক্ষরাই পরতঃ পরঃ।। [মুণ্ডক ২। ১]
এইভাবে বেদ এবং শ্রুতিতে সর্বত্রই যাঁকে “অজ, অকায়ম, অশুক্র, অাবিরং,
অমূৰ্ত্ত, অক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ,” বলা হয়েছে, ব্রহ্মবাদিগণ যাঁকে ‘
নিত্য জেনে
‘জন্মনিরােধ” অর্থাৎ তার জন্ম হয় না বলেছেন, সেই সর্বান্তরাত্মা সর্বব্যাপক পরমাত্মা
অবতার গ্রহণ করেন না, এই কথাই স্বতঃসিদ্ধ। ডাঃ সেনগুপ্তের মিথ্যা আস্ফালন
সুধী পাঠকের হাসির উদ্রেক করবে মাত্র!
হিটলারী নীতিতে দক্ষ, Micn Kampf এর আদর্শে দীক্ষিত, গােয়েবলস্ এর
উত্তরসাধক ডাঃ সেনগুপ্তরা মিথ্যা রটনায় সিদ্ধহস্ত। যে কোনও শিষ্টলােক কারও
রচনা থেকে কোনও অংশ উদ্ধৃত করলে সেই অংশ বা লাইনটি বিকৃত করেন না।কিন্তু ওঁদের কোনও শিষ্টনীতির বালাই নেই। “আলােক তীর্থকে লােকচক্ষে হেয়
করবার জন্য স্বীয় “শাস্ত্ৰমৰ্যাদা রক্ষায় যেখানে যেখানে আলােক তীর্থের উদ্ধৃতি
দিয়েছেন সেগুলি সবই খণ্ডাংশ মাত্র এবং বিকৃত। এমন কি, আমি যে প্রসঙ্গে যে।
কথা বলিনি সেই অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে এনেই ‘উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে
চাপিয়েছে।
বাক্যার্থ বােধের প্রধানতঃ চারটি কারণ :-আকাঙক্ষা, যােগ্যতা, আসক্তি এবং
তাৎপৰ্য। পূর্বাপর প্রসঙ্গ, গ্রন্থকারের অভিপ্রায় ধরেই কোনও প্রস্থের অংশ বুঝতে
হয়। কিন্তু যে ডাঃ সেনগুপ্তরা বেদ শ্রুতিবাক্যগুলির উপরেই নিজেদের সংকীর্ণত ও
সাম্প্রদায়িকতার বিষ-ছুরি মারতে পারেন, তারা আলােক তীর্থের অংশগুলি বিকৃত
করে জনতাকে ধোঁকা দিবার জন্য লিখবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? ঐ অবতারবাদ
প্রসঙ্গেই ডাঃ সেনগুপ্ত লিখেছেন-“শৈলেন্দ্র ঘােষাল বলিতেছে, অবতারবান অশস্তব ;
মানুষীর ক্ষুদ্র জরায়ু মধ্যে অমূর্ত, অসীম অবতার হয়ে আসা তাঁহার আত্মহত্যা। এই
কথা খুব পণ্ডিতের মত বলিল অথচ অন্যত্র লিখিতেছে-“দরিয়ায়ে মহিতিদার
শুবয়েদার সুরত খাক ইসমায়ে। অর্থাৎ একটি কলসীতে বিশাল সমুদ্র বন্ধ থাকার
মত এই মনুষ্যদেহে তিনিও গুপ্ত আছে। এত ক্ষুদ্রস্থানে থাকিয়াও আত্মরক্ষা হইল।
পরমাত্মার এখানে আত্মহত্যা হইল না। সে কি? শৈলেন্দ্র ঘােষাল পূর্বে বলিয়াছে
যে ইহাতে আত্মহত্যা হয়। কিন্তু এখন বলিতেছে আত্মরক্ষা হয়। এমন অসহব
লােক কখনও দেখিয়া কি?
জবাব না! ডাঃ সেনগুপ্ত যেমন অবলীলাক্রমে এখানে সত্য মিথ্যা মিশিয়ে,
অংশবিশেষ ছিন্নভিন্নভাবে উদ্ধৃত করে, এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশ লাগিয়ে মিথ্যা
প্রচারের কৌশল দেখালেন—এরকম কুটকৌশলী মিথ্যাচারী লােক, “শাস্ত্ৰমৰ্য্যাদা
রক্ষার নামে শামৰ্য্যাদা নাকারী, বেদ প্রতিপাদিত ধর্মের গুপ্ত আততায়ী এর পূর্বে
কখনও দেখিনি, এ কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি। প্রথমেই বলি ঐ ফারসী দোঁহাটি
ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। দরিয়ায়ে নয়—কথাটি ‘দরিয়ায়ে, ‘ঝয়ে নয়-‘শুবুয়ে’, ‘মহিতদর শুয়েন্দার’ নয়—কথাটি ‘মহিত দারশুবুয়ে', সুরত' নয়—
সুরতে। যে কথাটি যা, সেটিকে বিকৃত করে উদ্ধৃত করলে ব্যাকরণগত, ভাবগত
এবং অর্থগত যে বিকৃতি ঘটে—তা কি অবতার-কিঙ্করদের জানা নেই। “ডাঃ নলিনী
রঞ্জন রকে বসে আব–“ডাঃ নলিনীরঞ্জ নরকে বসে” একথার মধ্যে কি কি
প্রভেদ নেই?
আলােক তীর্থে ইহজীবনেই ঈশ্বর লাভ সম্ভব এই বিষয় আলােচনা করতে গিয়ে
লিখেছি—“তাই এই Dying while Living জিজিত্ মরণা’ প্রকৃত পক্ষে হল
আলােক রাজ্যে নবজন্ম। এই New_birth না হলে এই দেহে, ইহলােকেই দয়ালকে
জানা বোঝা যায় না। দেখা যায় না, বিন্দুর মাঝেই সিন্দুর নাচন
“দরিয়ায় মহিত দারণ্ডবুয়ে।
দার সুরতে আৰু ইসমায়ে।”
অর্থাৎ একটি কলসীতে বিশাল সমুদ্র বন্ধ থাকার মত, এই মনুষ্যদেহে তিনি গুপ্ত
আছে”। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আপনারা বুঝতে পারকেন আমার ঐকথায় অবতারবাদের কোনও কথাই আসে না। যে অনর্থকরী কদৰ্থকারীরা
বৈদিক ঋষিদের মনে বা ঐশীবাণীতে অবতারবাদ মূৰ্ত্তিপূজার কথা না থাকলেও বেদে
অবতারবান ও মূর্তিপূজার প্রসঙ্গ জোর করে লাগিয়েছে তারা আলােক তীর্থেরও
কোনও কথার কমালের বিড়াল বাখ্যা করবে এতে আর বিচিত্র কি! সেই সর্বব্যাপক
পরমাত্মা সর্বত্র আছেন, সর্বত্রই তার প্রকাশ, মহত্তম বন্ধুর মধ্যেও তিনি আছেন,
ক্ষুদ্রতম বস্তুতেও খ্রিন আছে—এ কথা বলা আর সেই সর্বব্যাপক পরমাত্মা স্থান
কাল পাত্রের দ্বারা পরিচ্ছিন্ন হয়ে, একটি নির্দিষ্ট স্থানে জন্মগ্রহণ করে রাম, বামন,
শূকর, সীতারামদাস হয়ে লীলা করে বেড়াচ্ছেন, এ কথা কি এক? সূর্যের প্রতিবিম্ব
বিরাট সমুদ্রে পড়ে। স্ফটিকে আয়নায় পড়ে আর এক টুকরাে কয়লাতেও তার
প্রতিবিম্ব বা প্রকাশ পড়ে একথা বলা—আর বিরাট সূৰ্য্য অন্তরীক্ষ থেকে তত
করে ষােলকলা সহ নেমে এসে এক টুকরাে কয়লা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এ কথাতে
কি একই ভাবের দ্যোতনা? আলাে সব স্থানে আছে, ঐ কাঠ টুকুরােটার মধ্যেও
আছে এই কথা বলা আর বিশ্বের সমূহ আলে সংহত হয়ে ঐ কাঠটুকরােটা হয়ে
পড়ে আছে, একথা কলম কি একই মর্ম? অবতারবাদীরা বলে--সেই পূর্ণ পরমাত্মা
নাকি তাঁর ষােল আনা সত্ত্বা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্লিষ্ট দেহ
নিয়ে জন্মেন, লীলা করেন তাদের এই কথা আর—পরমাত্মা সর্বত্র আছে
স্বমহিমায় তিনি অণু পরমাণুতেও আছেন, এ কথার মধ্যে যে রাত দিন তফাৎ, এ 24
কি জড়বাদীদের জড় মস্তিষ্কে ঢােকে না? “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে এই ভাণ্ডে,
'বিন্দু মাঝে সিন্দুর নাচন'—এ সব কথার নিগুঢ় মর্ম বুঝলে, মনুষ্যদেহে তিনি গুপ্ত
আছেন (অর্থাৎ মনুষ্যদেহের মধ্যেও তিনি বিরাজিত, তাঁর মহাচেতন সত্ত্বার প্রকাশ)
এ কথা নিয়ে শ্লেষ কার দুর্মতি ডাঃ সেনগুপ্তের হত না। তিনি মনুষ্য, ‘দেহ' এই
কথা কয়টি দেখেই অবতারদাস বড়ই ভাবস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ওখানে ঐ কথার
অর্থ-অবতারবাদীদের ধারণার—ঈশ্বরের নরদেহ নিয়ে অবতরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।
যে অর্থে গীতায় বলা হয়েছে, “ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহৰ্জুন! তিষ্ঠতিহে
অর্জুন! ঈশ্বর সকল প্রাণীর হৃদয়ে বিরাজমান”—ঠিক সেই রকম ভাবার্থেই ওখানে
বলা হয়েছে “এই মনুষ্যদেহে তিনি গুপ্ত আছেন।”
(ক) যে ভাব প্রকাশ করার জন্য বেদে বলা হয়েছে“প্রজাপতিরতি গর্ভ অন্তর জায়মাননা বহুধা বিজায়তে” (যজু ৩১। ১৯]
“সেই অজ পরমাত্মা গর্ভস্থ জীবাত্মা এবং সকলের হৃদয়েই বিরাজ করছেন।
অর্থাৎ তার সত্ত্বা, তাঁর প্রকাশ গর্ভস্থ জীবাত্মার মধ্যেও আছে,
(খ) যে ভাব প্রকাশ করার জন্য শ্রুতিমন্ত্র বলা হয়েছে
“তৎ সৃষ্ট তদেবানুপ্রাবিশৎ"
তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করে তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট আছে,
—ঠিকই ঐ রকম ভাবই ঐ দোহাটিতে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি অনুপ্রবিষ্ট
আছেন একথা বললে যেমন সেই অসীম অনন্ত পরমেশ্বরের পূর্ণ সদ্য নিয়ে
জন্মগ্রহণ বােঝায় না, তেমনি একটি কলসিতে বিশাল সমুদ্র বন্ধ থাকার মত এই
মনুষ্য দেহে জিন গুপ্ত আছেন—একথা বললেও অবতারবাদীদের Principle অনুযায়ীকুধারণা অনুযায়ী তিনি জন্মগ্রহণ করেন, এ কথা কোন মতেই বােঝায় না। কাজেই
পূর্বাপর প্রসঙ্গ উপেক্ষা করে, কথা কয়টি বিকৃত করে আমাকে ব্যঙ্গ করায় তার
কিরূপ প্রবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে?
ফহা মিথ্যা কল্পনার আশ্রয়ে, স্বকপােলকল্পিত কাহিনী রচনাতেও ডাঃ সেনগুপ্ত
রহস্য রােমাঞ্চ সিরিজকেও হার মানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—Alom Bomb
পরীক্ষার প্রাক্কালে জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক 0ppenheimer নাকি গীতার ‘কালােহমি
লােকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো' এই শ্লোকটি মনে করে Aton Bomb এর switch টিপতে
কিংবা Hydrogen Borth তৈরী করতে রাজী হন নাই।!! (শামৰ্য্যাদা রক্ষা]।
কৃষ্ণ বাক্য স্মরণ করেই যে Openheimer উদ্গত অঞ হয়ে, ভাববিহুল হয়ে
পড়েছিলেন, সে কথা ডাঃ সেনগুপ্ত কোথায় পেলেন? Oppenheimer On
মুহূর্থেই কৃষ্ণের বর্তমান সংস্করণ ‘অবতারের প্রিয় অনুচরকে কি টেলিফোন করে
জানিয়েছিলেন? না- রাষ্ট্রীয় চরম গােপনীয়তা অবলম্বন করে যে Alom Bomb
তৈরী করা হয়েছিল, সেই গােপন গবেষণাগারে United States Govt. Special
Messenger HGW w সেনগুপ্তকে আবাহন করে নিয়ে গিয়ে স্বচক্ষে
Oppenheimer এর ঐ ভাবস্থ অবস্থাটি নিরীক্ষণ করার সুযােগ দিয়েছিলে
অথবা, আমারই ভুল হচ্ছে সঞ্জয় যেমন দিব্যদৃষ্টি প্রভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিরী 24
করতেন, কলির ‘সঞ্জয়' ডাঃ সেনগুপ্তও বুঝি দিব্যদৃষ্টি (!) প্রভাবে Oppenheimer
এর ঐ মনের কথা টের পেয়েছিলেন। সম্প্রদায়ীদের ঐরূপ অগ্রাকৃতলীলা'
‘অপ্রাকৃত দৃষ্টিভ’ তাে আর নূতন গল্প নয়!! ডাঃ সেনগুপ্ত উপন্যাস রচনায় মন
দিলে ভাল করতেন!!!
আলােক তীর্থে যা আমি লিখিনি, তাই বিকৃত করে পরিবেশন করে ডাঃ সেনগুপ্ত
জনসাধারণের সামনে আলােক তীকে হেয় করবার জন্য বদ্ধপরিকর। আমি ভেবে
আশ্চর্য হচ্ছি, যখন নিরপেক্ষ পাঠক ‘আলােক তীর্থ পঞ্চবেন, তখন যে,
ডাঃ সেনগুপ্ত আলােক তীর্থের বিষয়বস্তু কি ভাবে misrepresent করেছেন, সে
প্রবঞ্চনা ধরা পড়বে, তা কি তিনি বােঝেন না? ডাঃ সেনগুপ্ত পুরাণ এবং কিংবদন্তির
যুগে থাকতে পারেন, কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের দোলনায় দোল খেতে পাব্লেন,
কিন্তু যুগ এবং জাতি অনেক এগিয়ে গেছে, সে বােধ কি তার নেই। আত্মসচেতন
সুধী পাঠকগণ এখন আর মুখে ঝাল খান না, কুৎসা রটনাকারীদের সম্প্রদায়ীদের
অভিসন্ধি তাঁৱা বােঝেন। আলােক তীর্থ পড়ে ডাঃ সেনগুপ্তের বর্ণনার সত্যাসত্যটা
যখন মিলিয়ে দেখবেন, তখনই বুঝবেন সম্প্রদায়ীদের গােয়েনীতির মহিমা!
যেমন ডাঃ সেনগুপ্ত লিখেছেন—“শীতার বক্তা শৈলেন্দ্রনাথ ঘােষালের ন্যায় একজন
সাধারণ মানুষ, এরূপ কথা শৈলেন্দ্র ঘােযালের মত উদ্ধত মুখেই বাহির হইতে
জবাব # মিথ্যাবাদীদের এটি একটি জঘন্য মিথ্যা কথা। কারণ, আলােক তীর্থে
আমি, শ্রীকৃষ্ণ মানুষ ছিলেন, সমাজনীতি, রাজনীতি, রণনীতি, তপস্যা এবং
যােগশক্তিতে একজন অসাধারণ মানুষ ;—“পূর্ণ ভগবান” নন—এই কথাই প্রমাণ সহ
উল্লেখ করেছি। কোথাও তিনি আমার মত মানুষ ছিলেন—এ কথা বলি নি আমি।
[লেখক শ্রীশৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী ]
আলোক বন্দনা গ্রন্থ হতে সংগৃহীত।।
আমি তুমি হয়ে যাই ; তুমি আমি হয়ে যাই। তখন সংসারের সব আশির্বাদ সফল হয়ে যায়। (ঋকঃ ৮/৪৪/২৩)
* বেদের এই উক্তি প্রমান করে যে যোগী পুরুষ যোগযুক্ত অবস্থায় নিজেকে আমি বলে সম্বোধন করে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তদ্রুপ নিজেকে আমি বলে সম্বোধন করেছে।তাই গীতার আমি মানে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ নয়। কারন দেহধারী জীব কখনও ঈশ্বর হতে পারেন না। বা জীব ঈশ্বরে কখনও পুরোপুরি মিশে যায় না। সর্বদা ভেদ থাকে।
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷
গীতা-৪।৭
পদার্থঃ- হে ভারত! (যদা যদা হি) যখন, যখন ই (ধর্মস্য) ধর্মের (গ্লানিঃ) হানি (ভবতি) হয় এবং (অধর্মস্য অভ্যুত্থানম) অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয় অর্থাৎ যখন অধর্ম বেড়ে যায় (তদা) তখন (অহম) আমি (আত্মানম) আত্মাকে (সৃজামি) রচনা অর্থাৎ শরীর ধারণ করি। [কিন্তু কেন?]
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে৷৷
গীতা-৪।৮
পদার্থঃ- (সাধুনাং) সাধুশ্রীদের (পরিত্রাণায়) রক্ষা করার জন্য (চ) এবং (দুষ্কৃতাম) পাপিদেরকে (বিনাশায়) বিনাশ করার জন্য (ধর্মসংস্থাপনার্থায়) ধর্ম স্থাপন করার জন্য (যুগে যুগে) প্রত্যেক যুগে (সম্ভাবামি) হই অর্থাৎ শরীর ধারণ করি।
ভাষ্যঃ- এই শ্লোকদ্বয়ে যোগীদের জন্মের হেতু ধর্মরক্ষা বলা হয়েছে, কিন্তু এই শ্লোকদ্বয়কে অবতারবাদীগণ অবতার সিদ্ধ করাতে উদ্ধৃত করে, তাহারা এই অর্থ করে যে - যখন, যখনই ধর্মের গ্নানি হয় তখন তখনই পরমেশ্বর অধর্ম নাশার্থে অবতার হয়ে আসেন, কিন্তু তারা এই শ্লোকদ্বয়কে পুরোপুরি অবতারবাদে সিদ্ধ করতে পারে না, কেননা তাদের মতের বুদ্ধদেব কোন অধর্ম নাশের হেতুতে অবতার হয়েছেন? পরশুরাম কোন সাধুদের পরিত্রাণ তথা দেশের কল্যাণ করার জন্য অবতার হয়েছন? এবং মোহিনী কাহার মোহ দূর করেছেন? ইত্যাদি অনেক দোষ তাদের ঈশ্বরাবতারবাদে রয়েছে, যার কোন সমাধান তাদের নিকটে নেই, আমাদের অনুযায়ী তো যোগ সামর্থবান পুরুষ [ব্যক্তি] সাধুশ্রীদের কল্যাণ ও দেশের কল্যাণের জন্য জন্ম ধারণ করে থাকেন তারা সকলেই অবতার। যদি তাদের কল্পনার অনুকূলে ঈশ্বরের অবতার মেনেও নেওয়া হয় তাহলে ধর্মের হানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির সময়ে সেই ঈশ্বর কেন অবতার হয়নি? কেহ বলতে পারবে কি, যে সোমনাথ এবং বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙ্গা ধর্মের হানি ছিলনা?
(আর্যমুনি ভাষ্য)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ