পুরাণ রচনার রহস্য-
ভারতে মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পর, হিন্দুদের প্রতি মুসলমান শাসকদের নির্দেশ ছিলো- হয় ইসলাম গ্রহন, নয় তো মৃ্ত্যু; এর ফলে ১০০ জনে ৯০ জন হিন্দু জীবন দিচ্ছিলো, কিন্তু ধর্মত্যাগ করছিলো না। এতে করে মুসলমান শাসকরা চিন্তা করলো, ধর্মের কারণে সব প্রজাকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে রাজ্য পরিচালনা করবে কাদের নিয়ে ? কারা দেবে খাজনা ? আর কিভাবেই বা বসে বসে খাওয়ার অর্থ কড়ি আসবে? তাই তারা, সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী হলেও জিজিয়া করের বিনিময়ে ধনী হিন্দুদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার জন্য রচনা করে এক দীর্ঘ পরিকল্পনার, যার ফসল হলো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ।
ইসলামে কবিতা লিখা হারাম, তাই মুসলমান শাসকরা রাজসভায় রাখতো হিন্দু কবিদের এবং তার থেকে তারা কাব্যরস আস্বাদন করতো। এই রকম কোনো এক হিন্দু কবিকে দিয়ে কোনো এক মুসলমান শাসক লিখায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং রচয়িতা হিসেবে নাম দেয় বহু পুরাণ রচয়িতা বেদব্যাসের নাম। ফলে সাধারণ হিন্দুরা ধোকা খায় এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান রচনার আসল উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে এই পুরাণের কথাকে বিশ্বাস করে ক্ষতি করে বসে হিন্দুধর্ম ও সমাজের।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই প্রথম রাধার উৎপত্তি এবং রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ও যৌনলীলার শুরু, যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার; কারণ- হরিবংশ, মহাভারত, সংস্কৃত মূল ভাগবত যাতে কৃষ্ণের প্রামান্য জীবনী রয়েছে, সেগুলোতে রাধার নামের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণের যে চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা হরিবংশ, মহাভারত এবং সংস্কৃত মূল ভাগবতের কৃ্ষ্ণের যে চরিত্র, তার সাথে মোটেই মিল নেই। এই সমগ্র বিষয় উপলব্ধি করলেই বোঝা যায় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ লিখাই হয়েছিলো সনাতন ধর্মের প্রধান পুরুষ কৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করার জন্য।
একটা বিষয় খেয়াল করুন, হরিবংশ, ভাগবত এবং মহাভারতে কৃষ্ণের একজন স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে তিনি রুক্মিনী, তার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের কথা বাদ দিয়ে এক নারীকে তার কৃষ্ণের পাশে দাঁড় করানো হয়, যিনি অন্যের স্ত্রী, আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা হয় তিনি নাকি কৃষ্ণের মামী। যদি কৃষ্ণের সাথে এমন একটি মেয়ের প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কের কথা বলা হতো, যেটা সাধারণ, যেমন রুক্মিনী, তাহলে কিন্তু কোনো কথা ছিলো না; কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক এবং তার পৃষ্ঠপোষকদের উদ্দেশ্য ছিলো তো অন্য, তাই তারা কৃষ্ণের পাশে এমন একজনকে দাঁড় করিয়েছে, যার সাথে কৃষ্ণের সম্পর্ক হয়েছে অনৈতিক ও অবৈধ, উদ্দেশ্য একটাই, এর মাধ্যমে কৃষ্ণ চরিত্রকে ধ্বংস করা গেলে সমগ্র হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করা যাবে এবং ভারতে ইসলামকে কায়েম করা যাবে।
যা হোক, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অবলম্বনে এই পুরাণে বর্ণিত রাধা ও কৃষ্ণের চরিত্রকে তুলে এনে আপনাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, রাধাকে নিয়ে কৃষ্ণ সম্পর্কে যা বলা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা, এই ঘটনা সীমাবদ্ধ শুধু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই, আর বাংলা পদ্য ভাগবতগুলোতে রাধাকে নিয়ে যেটুকু বলা আছে, তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেরই প্রভাব এবং বহুল প্রচারণার ফল।
নিচে দেখে নিন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে- আসলে রাধা ও কৃষ্ণকে কিভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে এবং দিব্যজ্ঞানীরা যেটা বলে থাকে যে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম- অপ্রাকৃত অপার্থিব, সেটা প্রকৃতই সত্য কি না ?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ- ব্রহ্মখণ্ড, প্রকৃতি খণ্ড, গণপতি খণ্ড এবং শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ড- এই চার খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ডের বিভিন্ন পর্ব বা অধ্যায়ে রাধা সম্পর্কে বলা হয়েছে। শুরুর দিকে "শ্রীমতির ভয়ে বিরজার নদীরূপ পরিগ্রহ" পর্বে বলা হয়েছে-
একটি নির্জন কাননে অর্থাৎ বনে রাধার সাথে তার স্বামী কৃষ্ণ, বিচরণ করছে এবং মনের সুখে বিহার অর্থাৎ যৌনক্রিয়া করছে, এমন সময় কৃষ্ণের, তার অপর স্ত্রী বিরজার কথা মনে পড়ে এবং তার সাথে যৌনক্রিয়া করার জন্য সেখান থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এবং বিরজার ভবনে এসে হাজির হয় এবং বিরজার সাথে যৌনক্রিয়া শুরু করে। এটা দেখে ফেলে রাধার এক সখী এবং সে দ্রুত যায় রাধার বাড়িতে এই খবর দিতে।
এখানে খেয়াল করুন, নির্জন বনে ছিলো রাধা এবং কৃষ্ণ, সেখান থেকে কৃষ্ণ হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এবং গিয়ে ঢোকে বিরজার ভবনে, সেই প্রাসাদোপম ভবনের কোনো একটি কক্ষে- কৃষ্ণ, বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়, যেটা দেখে ফেলে রাধার এক সখী এবং সে যায় সেই ঘটনার কথা বলতে রাধার বাড়িতে, এটা কীভাবে হয়, রাধা তো তখন বনেই ছিলো এবং বিরজার বাড়িতে ঢুকে কৃষ্ণ যে বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছে, সেটা রাধার সখী বাইরে থেকে দেখলো কিভাবে? আর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, বিরজা ছিলো কৃষ্ণের স্ত্রী, তাহলে তার সাথে কৃষ্ণ যদি যৌনতায় লিপ্তই হয়, এতে কৃষ্ণের অপরাধ কী ? ঘটনা বানিয়ে বানিয়ে লিখলে এমনই হয়, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের লেখকের যে স্থান কাল পাত্রের কোনো জ্ঞান ছিলো না, এটা নিশ্চিত, না হলে সে এমন অবাস্তব দৃশ্য রচনা করতে পারতো না, অথচ এই পুরাণ চালানো হয়েছে মহামতি বেদব্যাসের নামে, যে বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছেন, যাতে তিনি কৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং যে মহাভারতের কাহিনীর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে এই প্রবাদ প্রচলিত যে, মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে ? এর মানে মহাভারতের মধ্যে কোনো কিছু ভুল নেই, এমন বিশুদ্ধ মহাভারতের যিনি রচয়িতা, তার হাতে কি এমন উদ্ভট কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচিত হতে পারে ?
যা হোক, কৃষ্ণ যখন বিরজার সাথে যৌনতায় লিপ্ত এবং সেই খবর যখন রাধার কোনো এক সখী রাধাকে দিলো, তখন রাধা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার সখীদেরকে বলে, তোরা সব চল আমার সাথে, আজ দেখবো বিরজা সুন্দরী কেমন, তার কী অবস্থা করি তোরা সব আজ দেখবি, আমার স্বামীকে নিয়ে বিছানায় শোয় এমন সাহস তার হলো কিভাবে ?
রাধার বলা এসব কথায় মনে হয়- যেন বিরজা, কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমিকা, তার ঘরে ঢুকে কৃষ্ণ মহা অন্যায় করে ফেলেছে, তাই তার শাস্তি দিতে রাধা যাচ্ছে বিরজার ভবনে; শুধু তাই নয়, বিরজার ভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, রাধা, কৃষ্ণ সম্পর্কে মন্তব্য করছে- সে কেমন স্বামী যে এমন কর্ম করে, তার অন্তরে কি কোনো ভয় ডর নেই ? উচিত শাস্তি আজ দেবো তাকে, কপালে যা আছে তা হবে, লম্পটের চরিত্র কোনো দিন শুধরায় না; এই বলে রাধা কৃষ্ণের ভবনের দিকে রথে চড়ে গমন করে, তার সাথে যায় তিন কোটি গোপী! খেয়াল করুন সংখ্যাটি তিন কোটি !
যা হোক, রাধা যাচ্ছে তিন কোটি সঙ্গী সাথী নিয়ে কৃষ্ণের ভবনে, বিরজার সাথে কৃষ্ণ যৌনক্রিয়া ক'রে, রাধার মতে কৃষ্ণ যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি দিতে ! বিরজা থাকে কৃষ্ণের ভবনে, তার মানে বিরজা কৃষ্ণের বৈধ স্ত্রী; আর রাধা, কৃষ্ণের সাথে দেখা করে জঙ্গলের মধ্যে, এতেই প্রমানিত হয়, রাধা, কৃষ্ণের বৈধ বা সমাজ স্বীকৃত স্ত্রী নয়, অবৈধ বা গোপনে বিয়ে করা স্ত্রী; অথচ এই অবৈধ স্ত্রী যাচ্ছে, তার স্বামীকে এবং স্বামীর বৈধ স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে তাদের স্বাভাবিক যৌন মিলনের জন্য, এরকম অবাস্তব এবং উদ্ভট ঘটনা পৃথিবীর কোথাও না ঘটলেও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক তা ঘটিয়েছে এবং এটাকে হিন্দুরা ধর্মগ্রন্থ মনে করে তার শ্রদ্ধা ও পূজা করছে, হিন্দুদের বর্তমান দূরবস্থা আর পতন কি আর এমনি এমনি ?
এখানে আরেকটি তথ্যের দিকে নজর দিন, তিন কোটি গোপীকে নিয়ে রাধা যাচ্ছে কৃষ্ণের বাড়ি ঘেরাও করতে, সেই ৫ হাজার বছর আগে সারা ভারত মিলে ১ কোটি মানুষ ছিলো কিনা সন্দেহ, আর রাধা বৃন্দাবনেই পেয়ে যাচ্ছে তিন কোটি গোপী অর্থাৎ তিন কোটি যুবতী নারী ! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক কী পরিমান গাঁজা খেয়ে কলম ধরেছিলো, সেটা একবার কল্পনা করুন।
যা হোক, কৃষ্ণের ভবনে রাধা পৌঁছে দেখে গেটে পাহারা দিচ্ছে শ্রীদাম এবং সে রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে নারাজ, তখন রাধা, শ্রীদামকে বলে-
লম্পটের সহচর তুমি পাপাচার।
পলাও দূরেতে ত্বরা পাপের আধার।।
শ্রীহরি লম্পট যথা তুমিও তেমন।
ত্বরা পথ ছাড়ো দুষ্ট আমার বচন।।
তোমার বচনে রব কিসের কারণ।
ত্বরা করে যাবো আমি কৃষ্ণের ভবন।।
দেখিব লম্পটে আমি কিরূপ সে জন।
ত্যজ দুষ্ট ত্বরা দ্বার কহিনু বচন।।
অর্থাৎ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, রাধাই কৃষ্ণকে লম্পট বলে মনে করতো, সেই রাধাকে না ভজলে নাকি কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে না, যে রাধার মনে কৃষ্ণ সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা ভক্তিই ছিলো না।
যা হোক, শ্রীদাম, রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না, আর রাধা ভেতরে ঢুকবেই, এই নিয়ে গেটে চলছে ঘোর বিবাদ, এই খবর যখন কৃষ্ণের কাছে যায়, তখন কৃষ্ণ ভয় পেয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায় অর্থাৎ লুকিয়ে পড়ে; খেয়াল করুন, এই সেই কৃষ্ণ- যিনি আঙ্গুলের উপর পর্বত তুলে ধরেছিলেন, ভয়ংকর কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন, ভয়ংকর সব রাক্ষসদেরক শিশু ও বাল্যকালেই হত্যা করেছিলেন, বাল্যকালেই কংসের মতো শক্তিশালী যোদ্ধাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করেছিলেন, চারজনের পক্ষে যে ধনুক তোলা সম্ভব নয়, মথুরায় সেই ধনুক কৃষ্ণ একাই তুলে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন, একাই পাঞ্চাল রাজের পুরো বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দ্রৌপদীকে কন্যা হিসেবে স্বীকার করতে পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদকে বাধ্য করেছিলেন, শান্তি প্রস্তাব নিয়ে একাই হস্তিনাপুর গিয়ে দুর্যোধনের হাতে বন্দী হয়ে সেই কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের নিক্ষেপ করা তীরের সামনে নির্ভিক চিত্তে দাঁড়িয়েছিলেন- এই কৃষ্ণ নাকি রাধার ভয়ে লুকাচ্ছে! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের লেখকের লাগামছাড়া কল্পনায় সত্যিই আমি মুগ্ধ।
যা হোক, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, কৃষ্ণের অবৈধ প্রেমিকা বা স্ত্রী রাধার ভয়ে কৃষ্ণ একাই লুকায় নি, কৃষ্ণের স্ত্রী বিরজাও রাধার ভয়ে জলের রূপ ধরে নদী হয়ে প্রবাহিত হয়েছিলো, হ্যাঁ, সেই কথাই লেখা আছে ব্রহ্মববৈর্ত পুরাণে, দেখুন নিচে-
রাধিকার ভয়ে হরি অন্তর্হিত হৈল।
কোপ ভরে রাধা শেষে পুরে প্রবেশিল।।
বিরজা জলের রূপ ধরিল সভয়ে।
নদী জলে নিজ অঙ্গ রাখিল লুকায়ে।।
বিরজা যে নদীতে পরিণত হলো, সেই নদীর রূপ নাকি অপরূপ, হংস হংসী সেই জলের উপর শুধু ক্রীড়াই করে নি, যোগীগন সেই নদীর তীরে যোগাভ্যাস করেছে, সন্ন্যাসীরা তপস্যা করেছে।
যা হোক, তারপর রাধা, কৃষ্ণ এবং বিরজাক খুঁজে না পেয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলে কৃষ্ণ স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে সেই নদীর পাশে দাঁড়ায়, নদীরূপ বিরজাকে নিরীক্ষণ করে, অন্তরে কাতর হয়, কান্না করে নদীর তীরে বসে, বলে- তুমি জলের রূপ ত্যাগ করে দেহ ধারণ করে আমার কাছে ফিরে এসে আমার জীবন বাঁচাও; রাধা ভক্তদের কাছে এই রাধাই নাকি কৃষ্ণের পরম প্রেয়সী, কৃষ্ণের প্রেমের গুরু, তাহলে সেই রাধাকে ছেড়ে কৃষ্ণ বিরজা প্রেমে এমন ব্যাকুল কেনো ?
রাধা ভক্তরা, পারলে এর জবাবটা দিয়ে যাবেন।
যা হোক, কৃষ্ণের কাতর অনুরোধে বিরজা জলের রূপ ছেড়ে আবার মানবীর রূপ ধরে এবং কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়, এতে বিরজার গর্ভ সঞ্চার হয়, সেই গর্ভ নাকি শত বছর ধরে থাকে এবং তারপর তা থেকে একে একে কৃ্ষ্ণের সাতটি পুত্রের জন্ম হয়।
বিরজা নাকি শত বর্ষ ধরে গর্ভধারণ করেছিলো, ওরে কেউ যদি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক এবং তার সমর্থকদের সন্ধান পাস, তাদেরকে দুই ছিলিম গাঁজা বেশি দিস।
এখানেই শেষ নয়, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক, কৃষ্ণকে কী পরিমাণ লম্পট হিসেবে তুলে ধরেছে তার পরিচয় পাবেন নিচের এই ঘটনায়- শ্রীকৃষ্ণের শাপে বিরজার পুত্রগণের সাগররূপ পরিগ্রহ- পর্বে:
একদিন শ্রীকৃষ্ণ, তার স্ত্রী বিরজার সাথে যৌন ক্রিয়া করছিলো, ভবনের বাইরে তার সাত পুত্র খেলা করছিলো, এমন সময় পুত্রেরা একে অপরের সাথে ঝগড়া মারামারি করে এবং সেই অভিযোগ এসে জানায় মায়ের কাছে, মা তখন, তাদের পিতা কৃষ্ণের সাথে যৌন ক্রিয়ায় রত ছিলো, পুত্রেরা ঘরে ঢুকে পড়ায়, কৃষ্ণের যৌন ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে এবং কৃষ্ণ ক্ষেপে গিয়ে তার পুত্রদেরকে অভিশাপ দেয়। এই ঘটনার বর্ণনা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রয়েছে এই ভাবে-
একদা শ্রীহরি দেব বিরজার সনে।
করিছেন কত কেলি বসি একাসনে।
সহসা বিরোধ করি যত পুত্রগণ।
জননী সকাশে আসি করে নিবেদন।।
তনয়ে দেখিয়া কৃষ্ণ কোপ পরায়ণ।
রতি ছাড়ি কালশশী উঠেন তখন।।
বিরজা তনয়গণে অঙ্কেতে লইল।
রতিভঙ্গে জনার্দন কুপিত হইল।
সম্বোধিয়া জনার্দন সপ্ত পুত্রগণে।
অর্পিলেন অভিশাপ আরক্ত নয়নে।।
আমার বচন শুন তনয় নিকর।
সপ্তজনে হবি তোরা সাতটি সাগর।
-এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের উদ্দেশ্য যে লম্পট হিসেবে তুলে ধরে কৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করা এবং এভাবে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে খেয়ে ফেলে হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করা, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞান বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, দিব্যজ্ঞানী না হয়ে একটু কাণ্ডজ্ঞানী হলেও হয়। অথচ এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণকে বেদব্যাসের নাম দিয়ে চালানো হয়েছে এবং হয়, গীতা অনুসারে যে বেদব্যাস নিজেই শ্রীকৃষ্ণ এবং যে বেদব্যাস- মহাভারত, ভাগবত এবং হরিবংশের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরেছেন, সেই বেদব্যাস কিভাবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণকে এমন লম্পট এবং যৌনকাতর ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারেন ? সুতরাং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ যে বেদব্যাসের লেখা নয়, এ বিষয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই।
এরপর - রাধিকার প্রতি শ্রীদামের অভিশাপ- পর্বের শুরুতেই বলা হয়েছে-
সমাগতা যবে রাধা বিরজার দ্বারে।
শ্রীদাম না ছাড়ে দ্বার রাধিকা সতীরে।।
কোপ ভরে গেলো রাধা নিজের আলয়।
শ্রীদামের প্রতি হৈল কোপ অতিশয়।।
-খেয়াল করুন, এখানে বলা হচ্ছে শ্রীদাম, রাধাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় নি; কিন্তু আগের পর্বে বলা হয়েছিলো-
রাধিকার ভয়ে হরি অন্তর্হিত হৈল।
কোপ ভরে রাধা শেষে পুরে প্রবেশিল।।
যা হোক- রাধা, দল বল নিয়ে কৃষ্ণের ভবনে এসে কৃষ্ণ ও বিরজাকে শাস্তি দিতে না পেরে রেগে মেগে নিজের ভবনে চলে যায় এবং তারপর কৃষ্ণও সেখানে গিয়ে হাজির হয়, কৃষ্ণকে দেখে রাধা আরও ক্ষেপে যায় এবং রাগে তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। তারপর -
কোপভরে কৃষ্ণ প্রতি শ্রীমতি কহিল।
এ কি দেখি ওহে হরি তব কীর্তি ভাল।।
এখানে কিসের লাগি কৈলে আগমন।
বিরজা সমীপে যাও বিরজার ধন।।
অথচ আগের পর্বে বলা হয়েছিলো, বিরজা নদীরূপ ধারণ করলে শোকে কৃষ্ণ সেই নদীর তীরে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিরজাকে পুনরায় মানবী রূপ ধারণ করে তাকে বাঁচাতে বলেছিলো। এই কৃষ্ণ নাকি আবার রাধার মান ভাঙ্গাতে গিয়েছিলো রাধার বাড়ি! কৃষ্ণ যেহেতু ঈশ্বর, তাই একই সাথে দুই জায়গায় অবস্থান করা তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু কৃষ্ণের চরিত্রে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কেনো ? কৃষ্ণ, প্রেম ও যৌনতার জন্য একবার রাধার কাছে, আরেকবার বিরজার কাছে দৌড়াচ্ছে কেনো ? নাকি এমনভাবে তুলে না ধরলে কৃষ্ণকে লম্পট হিসেবে প্রমান করা যায় না ?
যা হোক, রাধার কাছে গেলে, রাধা, কৃষ্ণকে নানা কথা বলে, তারপর-
ইহা শুনি জনার্দন কহেন রাধারে।
কেন প্রিয়ে তিরস্কার করিতেছ মোরে।।
না জানি কিছুই আমি ওগো প্রাণ প্রিয়ে।
তোমার বাক্যেতে কষ্ট পেতেছি হৃদয়ে।।
-কৃষ্ণ নাকি কিছুই জানে না, এই কৃষ্ণ নাকি আবার ঈশ্বর ! রাধার ভয়ে কৃষ্ণ লুকিয়ে থাকলো, আর একটু পরেই রাধার বাড়িতে গিয়ে বলছে, কী হয়েছে, আমি তো কিছুই জানি না, তুমি আমাকে তিরস্কার করছো কেনো, কষ্ট পাচ্ছি।
এই ঘটনার মাধ্যমে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৃষ্ণকে শুধু লম্পটই নয়, মিথ্যাবাদি হিসেবেও তুলে ধরেছে।
যা হোক, তারপর-
শুনিয়া পতির বাক্য রাধা সতী কয়।
এখন জান না কিছু ওহে দয়াময়।।
শুন হে লম্পট নাথ বচন আমার।
বিরজা সনেতে এবে করহ বিহার।।
-রাধার এসব কথা শুনে কৃষ্ণ নানা কথা বলে রাধাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, কিন্তু-
শ্রীকৃষ্ণ যতেক কহে বিনয় বচন।
শ্রীমতি ততই হয় কোপ পরায়ণ।।
কোপ হেরি জনার্দন স্থানান্তরে যায়।
পুনশ্চ আসিয়া ধরে শ্রীমতির পায়।। (কৃষ্ণ, রাধার পা ধরছে, অবস্থা চিন্তা করুন।)
পুনঃ পুনঃ যাতয়াত করে জনার্দন।
শ্রীদাম সনেতে বনে করেন সান্ত্বন।।
কিছুতে কোপের শান্তি না হয় রাধার।
স্থানান্তরে যান হরি দয়ার আধার।।
-কৃষ্ণের এই অবস্থা দেখে শ্রীদাম যায় রাধার কাছে এবং বলে-
একি দেখি ওগো সতী তব আচরণ।
কৃষ্ণের বিনয় বাক্য করিলে লঙ্ঘন।।
কি হেতু কুপিতা এত হয়েছ বল না।
ব্রহ্মাণ্ডের পতি কৃষ্ণ তাহা কি জানো না।।
-যেই শ্রীদাম রাধার পথ আটকানোয় এত ঘটনা ঘটলো, যেই শ্রীদাম রাধার রাগের মূল কারণ, সেই শ্রীদাম রাধাকে গিয়ে বলছে, তোমার এত রাগের কারণ কী ? ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক মনে হয় একবেলা মুখ দিয়ে খবার খেতো, অন্যবেলা পাছা দিয়ে।
যা হোক, তারপর-
শ্রীদামের বাক্য শুনি শ্রীরাধিকা সতী।
ঘূর্ণিত নয়নে চান শ্রীদামের প্রতি।।
মোর নিন্দা কর তুমি ওহে পাপাচার।
হরির প্রশংসা মুখে কর অনিবার।। ( রাধা, কৃষ্ণের প্রশংসাই সহ্য করতে পারছে না।)
দানবরূপেতে তুমি লইয়া জনম।
আসুরিক কর্মে সদা রহিবে মগন।।
অভিশাপ দিনু আমি ওরে অভাজন।
শ্রীকৃষ্ণ সমীপে গিয়ে বলহ এখন।।
তারপর-
অভিশাপ বাক্য শুনি শ্রীদাম তখন।
বলিলেন কোপভরে রাধারে বচন।।
বিনা দোষে অভিশাপ করিলে প্রদান।
উপযুক্ত পাবে ফল নাহি হৈবে আন।।
গোপ গৃহে হৈবে জন্ম হইবে গোপিনী।
মানবী আকারে যাবে অবশ্য ধরণী।।
- এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীদাম ও রাধার এই কথোপকথন কোথায় হচ্ছে, পৃথিবীতে না স্বর্গে ? যদি স্বর্গে হয়ে থাকে, তাহলে শ্রীদাম ও রাধা হবে দেব-দেবী এবং তাদের নাম হবে অন্য; আর পৃথিবীতেই যদি হয়, তাহলে রাধার জন্ম মানবী রূপে গোপ গৃহে তো হয়েছেই, আবার এই কথা আসছে কেনো ? যে কাহিনী মিথ্যা, সেটা নিয়েই এত প্রশ্ন তোলা সম্ভব, সত্য কাহিনী এসবের উর্ধ্বে।
এই স্বর্গীয় কথাবার্তার বাকি অংশ হলো-
আয়ান হৈবে স্বামী আমার কথায়।
ক্লীববেশি জ্ঞানবীর আয়ানের কায়।।
কৃষ্ণ অংশে জন্ম তার হরি মায়াধারী।
বিবাহ করিবে তোমায় শুন গো ঈশ্বরী।।
কৃষ্ণগানে সদা তুমি করিবে বিহার।
বৃন্দাবনে রবে দোঁহে কহিলাম সার।।
শত বর্ষ কৃষ্ণ সহ বিচ্ছেদ হইবে।
বিষম যাতনা তাহে অবশ্যই পাইবে।।
তারপর গোলকেতে হইবে আগমন।
কৃষ্ণের সনেতে আসি লভিবে মিলন।।
-তারপর গোলকেতে হইবে আগমন। এই কথার মাধ্যমে অবশেষে বোঝা গেলো যে শ্রীদাম ও রাধার এই সব কথাবার্তা চলছে গোলকে, কিন্তু যে কারণে বা যে ঘটনা থেকে এইসব কথাবার্তার সূত্রপাত, সেই ঘটনা কি গোলোকে ঘটেছিলো ? ঘটে নি। এই ঘটনার সূত্রপাত পৃথিবীতে- রাধা, কৃষ্ণ ও বিরজার ত্রিমুখী প্রেম ও যৌনতাকে ঘিরে, তাহলে এখানে আবার গোলোকের কথা আসছে কোথা থেকে আর গোলোকের বর্ণনায় রাধা-কৃষ্ণ-শ্রীদাম এই নামগুলোই বা আসবে কেনো ? শ্রীকৃ্ষ্ণের নাম গোলোকে তো নারায়ণ, আর নারায়ণের নারী শক্তির নাম লক্ষ্মী বা যোগমায়া, গোলোকের বর্ণনা হলে নামগুলো হবে নারায়ণ, লক্ষ্মী, যোগমায়া এরকম; গোলোকে- রাধা, কৃষ্ণ, শ্রীদাম নামে তো কেউ নেই।
একদিন নন্দ, কৃষ্ণকে কোলে করে বনের মধ্যে গেছে গরু বাছুরকে খাওয়াতে, সেখানে হঠাৎ যুবতী রাধার আবির্ভাব, এখানে যুবতী রাধার রূপের বর্ণনা এরকম :
কিবা উচ্চ স্তনযুগ শোভে বক্ষপরে।
নিতম্ব দেখিয়া ধরা লাজেতে বিদরে।।
করিশুণ্ড সম উরু অপূর্ব বাহার।
দেখিয়া রাধার শোভা লাগে চমৎকার।।
রাধারের দেখিয়া কৃষ্ণ পুলকে বিভোর।
মরি মরি কিবা হায় প্রণয়ের ডোর।।
-যে কৃষ্ণ তখনও হাঁটতে শিখে নি, সেই কৃষ্ণ নাকি রাধার রূপ দেখে পুলকে বিভোর! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনার উদ্দেশ্যটা একবার বিচার করুন।
যা হোক, তারপর রাধাকে দেখে নন্দ বলে,
জগৎ জননী তুমি জগত মোহিনী।
প্রকৃতিস্বরূপা সতী হরি বিমোহিনী।।
আদ্যাশক্তি তুমি মাতা জগত ঈশ্বরী।
তব পদে শত শত প্রণিপাত করি।।
-------------------
ব্রজের ঈশ্বরী তুমি হরি তব ধন।
কৃষ্ণের জনম শুধু তোমার কারণ।।
- কৃষ্ণের জন্ম শুধু নাকি রাধার কারণে, আরো খোলামেলা বলতে গেলে বলতে হয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে কৃষ্ণের জন্ম শুধু রাধার সাথে প্রেম এবং যৌনক্রিয়া করার জন্য, দেখুন নিচে-
তারপর রাধা সতী হরি অঙ্কে করি।
অন্য বনে যান ত্বরা ব্রজের ঈশ্বরী।।
বনমাঝে গুপ্তস্থানে হরিরে লইয়ে।
কামেতে মাতিল রাধা হরিষে মজিয়ে।।
রাসমণ্ডলের কথা জাগিল অন্তরে।
চু্ম্বন হরির মুখ পুনঃ পুনঃ করে।।
- যে শিশু তখনও হাঁটতে শিখে নি, তাকে দিয়ে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক যৌনক্রিয়া করাচ্ছে যুবতী মেয়ের সাথে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখকের উদ্দেশ্যটা কী এবার বুঝতে পারছেন ? এখানে আরেকটি অসঙ্গতি লক্ষ্য করুন, শিশু কৃষ্ণের সাথে যৌনক্রিয়া করার সময় রাধার রাসমণ্ডলের কথা মনে পড়ছে, যেই রাস হয়েছিলো কৃষ্ণের আট বছর বয়সের সময়; এই পুরাণের লেখককে বলছি, আরে বলদা, মিথ্যা কাহিনী লিখতে গেলেও তো একটু আগে পিছে ভেবে লিখতে হয়, যাতে মিথ্যাটা সাদা চোখে সবার কাছে ধরা না পড়ে। যা হোক, তারপর রাধা-
অঙ্কে করি হরিধনে শয়ন করিয়া।
মনের বাসনা পুরে পুলকে মাতিয়া।।
একদৃষ্টে হরি প্রতি করে দরশন।
মূহুর্মুহুঃ মুখপদ্ম করেন চুম্বন।।
- এই রাধার সাথে কৃষ্ণের নাকি আবার অপ্রার্থিব, অপ্রাকৃত, নিষ্কাম প্রেম, যেখানে যৌনতার লেশ গন্ধ মাত্র নেই ! হ্যাঁ, এই কথাই বলে বা প্রচার করে থাকে- অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অল্পজ্ঞানী, দুই এক বইয়ের পাঠক বৈষ্ণব গুরুরা, যারা কোনো দিন ভাগবত, গীতা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ভালো করে পড়েও দেখে নি। রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ও বিবাহের কোনো ঐতিহাসিক দলিল না থাকলেও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধার সাথে কৃষ্ণের বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এই বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্মা; আমার এই কথার প্রমান পাবেন কোলকাতার অক্ষয় লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪০৩ নং পৃষ্ঠায়।
যা হোক, বিয়ের আগেই তো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রাধা কৃষ্ণ, বাসর সেরে ফেলেছিলো, এবার দেখা যাক বিয়ের পর তারা কীভাবে বাসর করছে এবং বৈষ্ণব গুরুদের মতে, সেখানে রাধা কৃষ্ণের অপার্থিব অপ্রাকৃত নিষ্কাম প্রেম আছে কি না ?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে- শ্রীকৃষ্ণেরসহ রাধিকার বিহার- পর্বে বলা হয়েছে,
বিভা (বিবাহ) দিয়া পদ্মাসন (ব্রহ্মা) করিল গমন।
দেখিতে দেখিতে রাত্রি করে আগমন।।
ঘন ঘন শ্রীরাধিকা কৃষ্ণপানে চায়।
ক্ষণে ক্ষণে নম্রমুখী বিষম লজ্জায়।।
কামবানে জর জর কাঁপে থর থর।
মূহুর্মূহু রতিপতি মারে খর শর।।
রাধা প্রতি কৃষ্ণ ধন করে দরশন।
কামেতে উন্মত্ত হয়ে পড়ে দুইজন।।
--------------
লজ্জাতে রাধিকা করে মুখ আচ্ছাদন।
এই রূপে ক্রীড়া করে সুখে দুই জন।।
ক্ষণপরে শ্রীরাধারে তুলি বক্ষপরে।
ঘন ঘন চুম্বে তার বদন কমলে।।
কামেতে মাতিল দোঁহে অপূর্ব দর্শন।
অধরে অধর দোঁহে করিছে দংশন।।
------------------
বিকল দোঁহার অঙ্গ অজ্ঞান জীবন।
রতিক্রীড়া দোঁহে ক্রমে করে সমর্পন।।
নখ দন্তাঘাত কত দেহেতে হইল।
তবু মদনেতে মত্ত দোঁহেতে থাকিল।।
মুহুর্মুহু রতিক্রীড়া করে দুই জন।
ঘর্মজল অঙ্গ মাঝে দিল দরশন।।
অলকা তিলকা যত বিনষ্ট হইল।
নূপুরের মিষ্ট শব্দ বাজিতে লাগিল।।
---------------------।
এইরূপে রতিক্রিয়া হৈলে সমাপন।
বালরূপ পরে কৃষ্ণ ধরেন তখন।।
----------------
প্রতিদিন রাত্রিকালে করি আগমন।
বিহার করিব আমি বলিনু বচন।।
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, নন্দের কাছ থেকে শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে যুবতী রাধা যখন গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে, তখন কৃষ্ণ শিশুর রূপ ছেড়ে নাকি যুবকের রূপ ধারণ করে, হ্যাঁ, এই কথাই বলা আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪০১ পৃষ্ঠায়, এভাবে-
তখন শিশুর রূপ করি বিসর্জন।
নটবর বেশ ধরে দেব সনাতন।।
-এই কথা ই কৃষ্ণ আবার বলেছে ৪০৫ পৃষ্ঠায়, এভাবে-
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-কৃষ্ণ, জন্মের পর থেকেই সব অসাধ্য সাধন করেছে, যেমন- যমলার্জুন ভঙ্গ, রাক্ষসদের বধ, কালীয়নাগ দমন, গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন, মুষ্টিকের সাথে লড়াই, কংসের সাথে লড়াই ও তাকে হত্যা এবং এসব করার সময় তাকে কখনো তার রূপ পাল্টাতে হয় নি, আর কৃষ্ণ যে এমন রূপ পাল্টাতে পারে বা তাকে কখনো রূপ পাল্টাতে হয়েছে, এমন কোনো নিদর্শন বা উদাহরণ হরিবংশ, মহাভারত, ভাগবতের কোথাও নেই কেনো ? কোনো তথ্য প্রমান ছাড়া কোনো এক পুরাণ যদি হঠাৎ কোনো কথা বলে, সেই কথাকে কেনো বিশ্বাস করতে হবে ? কৃষ্ণের শিশুরূপ ছেড়ে যুবক দেহ ধারণের কোনো ইঙ্গিত কোনো প্রমান হিন্দু শাস্ত্রের প্রামান্য কোনো গ্রন্থে না থাকলেও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে; কারণ, কৃষ্ণকে লম্পট ও যৌনকাতর পুরুষ প্রমান করতে এই লেখকের আর তর সইছিলো না, তাই সে কৃষ্ণের জীবনে কাম ও প্রেমের আবির্ভাব ঘটাতে এই থিয়োরি আবিষ্কার করেছে; কেননা, মূল কাহিনীতে তো আছে, যে কৃষ্ণ ১০ বছর ২ মাস বয়সে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে যাবে, তারপর সে আর কোনোদিন বৃন্দাবনে ফিরবে না, তাহলে যুবক কৃষ্ণের সাথে যুবতী রাধার প্রেম ও যৌনতা দেথাবে কিভাবে? তাই এই লেখক শিশুকৃষ্ণকে দিয়েই যৌনক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে, যাতে কৃষ্ণকে লম্পট ও চরিত্রহীন হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, কিন্তু কোনো শিশুর সাথে যুবতী মেয়ের প্রেম ও যৌনতা তো অসম্ভব, এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখকের এই অতি আশ্চর্য থিয়োরির আবিষ্কার-
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-এইভাবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক এটা বুঝিয়েছে যে, পৃথিবীতে কৃষ্ণের অবতরণের একমাত্র কারণ শুধু প্রেম ও যৌনলীলা করা। কিন্তু গীতার ৪র্থ অধ্যায়ে ১০ম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পৃথিবীতে তার অবতরণের একমাত্র কারণ, অধর্মকে বিনাশ করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই পথে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে না ধরে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক শ্রীকৃষ্ণকে যৌনকাতর ও লম্পট পুরুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন, হিন্দুধর্মের প্রধান পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। আর সেটা না বুঝে, আমরা হিন্দুরা, হরিবাসরে কৃষ্ণ সম্পর্কে এসব কথা প্রচার করে তিলে তিলে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
যা হোক, শিশু কৃষ্ণের সাথে রাধা কেবল একদিন বা দুইদিন এই কুকর্ম করে নি, এটা ছিলো তার প্রতিদিনের কাজ, দেখুন নিচে-
প্রতিদিন রাত্রিকালে করি আগমন।
বিহার করিব আমি বলিনু বচন।।
----------------
এই রূপে প্রতিদিন শ্রীমতি সুন্দরী।
বনমধ্যে ক্রীড়া করে লইয়া শ্রী হরি।।
শ্রীকৃষ্ণকে লম্পট প্রমানে বাংলা পদ্য ভাগবতগুলো এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রধান বিষয়গুলোর একটি হলো কৃষ্ণ কর্তৃক গোপীনীদের বস্ত্রহরণ। এই বস্ত্রহরণ পর্বের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, মেয়েরা যাতে নগ্ন হয়ে জলে স্নান করতে না নামে সেই শিক্ষা প্রদান করা, অথচ পদ্য ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে কৃষ্ণকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মনে হয়, নগ্ন নারীদেহ দেখাই কৃষ্ণের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এভাবে কৃষ্ণকে লম্পট প্রমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। মূল সংস্কৃত ভাগবতে তো রাধার কথাই নেই, তাই বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার উল্লেখ থাকার প্রশ্নই আসে না। সুবোধ চন্দ্রের ভাগবতেও বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু বেণী মাধবের ভাগবতে বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানেও রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্কের কোনো ইঙ্গিত নেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তো মিথ্যার ছড়াছড়ি, তাই বস্ত্রহরণ পর্বেও সেই মিথ্যা ধরা পড়েছে এভাবে-
কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের কাপড় চোপড় তথাকথিত চুরি করে গাছে উঠে বসেছে, তখন-
ব্রজাঙ্গনা দেখে লয় রাখালে বসন।
জানাইল গোপীগণ শ্রীরাধা সদন।।
জলে স্থিতা কোপান্বিতা শ্রীরাধা তখন।
সঙ্গের সঙ্গিনীগনে করে আবাহন।।
-কিন্তু গোপিনীদের কথায় কৃষ্ণ তাদের বসন ফিরিয়ে না দিলে, একজন গোপিনী বলছে-
"চলহ সত্বরে, রাধার গোচরে
জানাও এ সমাচার।" ( ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অক্ষয় লাইব্রেরী, পৃষ্ঠা ৪৮১)
- রাধা যদি সেখানে জলে ডুবে উপস্থিতই থাকে, তাহলে গোপিনীরা আবার কেনো বলছে যে, চল, রাধাকে এই বিষয়টি জানাই ?
যা হোক, উপরের এই কথা শুনে কৃষ্ণ বলছে-
"বলিলে তাহারে, সে রাধা আমারে,
বল কি করিতে পারে ।
এ সত্য বচন, শুন গোপিগণ,
নাহি রাখি ভয় তারে।'
আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, এই রাধার ভয়ে কৃষ্ণ একবার লুকিয়েছিলো এবং বিরজা ভয়ে জলের রূপ ধরে নদী হয়ে গিয়েছিলো, পরে রাধার রাগ ভাঙাতে কৃষ্ণ, রাধার পা পর্যন্ত ধরেছিলো, সেই কৃষ্ণ এখন বলছে, বল গিয়ে তাকে, তাকে আমি ভয় করি ?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখকের কাহিনী বর্ণনা এবং চরিত্র নির্মান যে বাংলা সাহিত্যে একেবারে নিচু মানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, এই জন্য তিনি মিথ্যা বলতে গিয়ে বার বার ধরা খেয়েছেন, তারপরও হিন্দু সমাজের কিছু নির্বোধ ধর্মগুরু আছে, যারা প্রকৃত সত্যটাকে উপলব্ধিই করতে না পেরে এটাকেই ধর্মগ্রন্থ বলে মনে করে।
কৃষ্ণের লীলাগুলোর মধ্যে বস্ত্রহরণের পর জনসাধারণে বহুল চর্চিত বিষয় হলো রাস, এই রাস এতটাই জনপ্রিয় যে, লীলা কীর্তনের হরিবাসরে রাস একটা প্রধান বিষয় এবং রাস কতটা জমে বা কোনো নর্তকী রাস কতটা জমাতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে হরিবাসরে সাফল্য বা সার্থকতা। যা হোক, রাস প্রসঙ্গে রাধা ভক্তদের জন্য একটা চরম দুঃসংবাদ হলো- মূল সংস্কৃত ভাগবতে রাধার নাম তো নেই ই, তাই সেখানে রাস প্রসঙ্গে রাধাকে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই, কিন্তু বাংলায় প্রচলিত বেণীমাধব শীলের ভাবগত এবং সুবোধচন্দ্র মজুমদারের ভাগবত, যেখানে রাধার অস্তিত্ব ইনিয়ে বিনিয়ে প্রমান করা চেষ্টা আছে, সেই ভাগবতগুলোতেও রাস অধ্যায়ে রাধার কোনো নাম নেই, যদিও এই দুই ভাগবতে রাস লীলার বর্ণনায় অশ্লীলতার ছাড়াছড়ি এবং রাস হলো একটা খোলামেলা সেক্স পার্টি, আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে এই দুই ভাগবতের রাস অধ্যায়গুলো পড়ে দেখতে পারেন।
যা হোক, সুবোধ এবং বেণীমাধবের ভাগবতে রাস অধ্যায়ে রাধার নাম না থাকলেও, রাস অধ্যায়ে রাধার নাম আছে এবং বেশ জমিয়ে আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে; ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪৮৮ পৃষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রা পর্বে বলা হয়েছে, রাধার ২৭ জন সখী ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার গোপিনীকে সাথে নিয়ে রাসমণ্ডলে উপস্থিত হয় এবং তারপর সেখানে যা ঘটে তার কিছু অংশ আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিচে নিবেদন করছি-
পুষ্প মধুপানে মত্ত ভ্রমরী সহিত।
এ সময়ে রাধা রাসে হৈল উপনীত।।
----------------
দেখিয়া রাধারে কৃষ্ণ কামেতে মোহিতা।
সখীগণমধ্যে রত্ন ভূষণে ভূষিতা।।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখছি এবং আমার পাঠকদেরকে এই তথ্যটি ভালো করে মনে রাখার জন্য অনুরোধ করছি যে রাসলীলার সময় কৃষ্ণের বয়স কিন্তু ছিলো মাত্র আট। এই আট বছর বয়সী বালক কৃষ্ণকে দিয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক কিভাবে যৌনলীলা করাচ্ছে, সেই বিষয়টি একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করবেন, আর ভাববেন এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনার আসলে উদ্দেশ্যটা কী ছিলো ?
যা হোক, ৮ বছর বয়সী কৃষ্ণ, রাধাকে দেখেই কামে মোহিতা হয়ে যায় এবং কৃষ্ণ এমন মদন বাণ ছাড়ে যাতে-
মূর্চ্ছিত হইল রাধা মদনের বাণে।
শ্রীঅঙ্গ পুলকিত কামে হতজ্ঞানে।।
-----------------
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে শ্রীরাধা সদন।
আইলেন মনোল্লাসে মদনমোহন।।
রাধার করিলা কৃষ্ণ শ্রীমুখ চুম্বন।
কৃষ্ণ-অঙ্গ-সঙ্গে রাধা পাইল চেতন।।
প্রাণাধিক প্রাণকান্তে করি আকর্ষণ।
শ্রীরাধা করেন কামে বদন চুম্বন।।
বচনে হরিলা কৃষ্ণ মানস রাধার।
রসিকা আইল দেখি কামের আগার।।
--------------------
তদন্তর তথা কামে সুরতি উন্মুখে।
শুইলা রাধার অঙ্গে রতিকল্পে সুখে।।
শৃঙ্গার অষ্ট প্রকার বিপরীত মত।
করেন কোমল অঙ্গে নখ দন্তে ক্ষত।।
কামশাস্ত্রে সুগোপন অষ্টম প্রকার।
চুম্বন করেন কৃষ্ণ রণে পারাবার।।
অঙ্গে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে কামপরে।
কামুক কামুকীদ্বয় আকর্ষণ করে।
- এই রাধা কৃষ্ণের প্রেম নাকি- নিষ্কাম, অপার্থিব, অপ্রাকৃত ?!
যা হোক, তার বলা হয়েছে,
শৃঙ্গার কুশল কামশাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
রতি যু্দ্ধ বিরাম না হয় কদাচিত।।
এইমত ঘরে ঘরে নানামূর্তি ধরি।
রমন গোপীর সঙ্গে রাস করে হরি।।
অভ্যন্তরে রতিক্রিয়া করিয়া সাদরে।
কত মত রাসক্রীড়া করেন বাহিরে।।
রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।
এই অষ্টাদশ লক্ষ শ্রীরাস-মণ্ডলে ।
গোপ আর গোপীকার বিহার সে স্থলে।।
মুক্তকেশ নগ্নবেশ বিচ্ছিন্ন ভূষণ।
প্রমত্ত মূর্চ্ছিত সবে কামে অচেতন।।
-------------------
এই মত ক্রীড়া করি সবে কুতূহলে।
ততপরে বিহার করে যমুনার জলে।।
জলক্রীড়া করি পরিশ্রান্ত জনে জন।
উঠিয়া পরিল সবে স্বকীয় বসন।।
রাস মণ্ডলের এই বর্ণনার পর, "শৃঙ্গার রহস্য" পর্বে বলা হচ্ছে-
কেহ কামরসে, প্রেমের সাহসে,
নগ্ন করি শ্রীহরিরে।
কাড়ি পীতবাস, কৌতুকেতে হাস,
আনন্দে রতি মন্দিরে।
---------------
করি আকর্ষণ, বদন চুম্বন,
পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন।
আননে আনন, করি আরোপন,
ঘর্ষণ স্তন জঘন।
কোন গোপীগন, করান দর্শন,
বক্ষোপরি সুললিত।
কান্ত করে ধরি, রাখি তদুপরি,
করেন চূড়া নির্মিত।।
-------------
সব বরাঙ্গনা, কামে মত্তমনা,
কৌতূকের নাহি পার।
গোপে নিলে হরি, সেই ত মুরারী,
আনি দেয় পুনর্বার।।
কেহ নগ্ন করি, কানে কান্ত হারি,
ক্রোড়ে করে কুতূহলে।
কেহ রঙ্গভরে, সুখে নৃত্য করে,
কান্তে রাখি মধ্যস্থলে।।
সুনির্জন বনে, নাচে কোন জনে,
হরিয়া কৃষ্ণের বাস।
সেই বস্ত্র দ্বারে, নগ্না গোপিকারে,
সাজায়ে কৌতূকে হাস।
কৃষ্ণ কুতূহলে, নিজ বক্ষঃস্থলে,
বসাইল শ্রীরাধারে।
আনন্দে শ্রীহরি, রাধার কবরী,
নির্মায় স্বকর দ্বারে।।
-----------
স্তন শ্রেণীভাগে, কাম অনুরাগে,
নখেতে করেন চিত্রিত।
দন্তেতে দলন, করে ঘন ঘন,
বিম্বাধর সুললিত।
------------
শৃঙ্গার বাসরে, চেতন অন্তরে,
বরিয়া রাস বাসর।
নখদন্তাঘাত, করে অচিরাত,
কামশরে পরস্পর।।
গোপী স্তনোপরে, কৃষ্ণাঘাত করে,
কর কমলে সঘন।
শ্রেণীর উপরে, নখচিত্র করে,
হৈল অপূর্ব শোভন।।
কামে মত্তানন্দ, শ্লথ নীধিবন্ধ,
ক্ষুদ্র ঘন্টিকা কবরী।
বসন ভূষণ, রত্ন আভরণ,
গোপীর হরিল হরি।।
নবধা প্রকার, আলিঙ্গন আর,
অষ্টম মত চু্ম্বন।
ষোড়শ শৃঙ্গার, করে অনিবার,
রাসেশ্বর সনাতন।।
অঙ্গে অঙ্গে মিলে, ভিন্ন নহে তিলে,
ব্রজাঙ্গনা অঙ্গ সঙ্গ।
করে আলিঙ্গন, কামে মগ্ন মন,
নাহি তার ক্ষণভঙ্গ।।
-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে এই হলো কৃষ্ণের রাসলীলা, যদিও আমি একে বলি ওপেন সেক্স পার্টি; যা হোক, যদিও এক জায়গায় বলা হয়েছে,
রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।
-কিন্তু অন্য এক জায়গায় রাধার ২৭ জন সখী মিলে যতজন গোপিনীকে রাস মণ্ডলে নিয়ে এসেছে, তার সংখ্যা ৩৮ লক্ষ, ৯ হাজার। এখন এই সংখ্যাতত্ত্বের দিকে একটু খেয়াল করুন, এক জায়গায় বলা হচ্ছে মোট ১৮ লক্ষ, অন্য জায়গায় হিসেব দেওয়া হচ্ছে ৩৮ লক্ষের! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক যদি সত্য কাহিনী বর্ণনা করতো, তাহলে কিন্তু এমন হতো না। যা হোক, এই দু্ই হিসাবের মধ্যে ৩৮ লক্ষের হিসাবটাই নিচ্ছি; কারণ, রাধার ২৭ জন সখী মিলে এই ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার জনকে রাসমণ্ডলে নিয়ে এসেছে এবং এই সংখ্যক যুবতী মেয়ে যদি সেই সময় বৃন্দাবনে থাকে, তাহলে আরও কমবেশি ৩৮ লক্ষ সক্ষম পুরুষ ছিলো বৃন্দাবনে, ছিলো তাদের বাপ মা মানে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, এই সংখ্যা আরও কম বেশি ৩৮ লক্ষ; ছিলো ছেলে মেয়ে, ৩৮ লক্ষ যুবতী বধূর কম পক্ষে ৭৬ লক্ষ সন্তান থাকা সম্ভব, তাহলে সব মিলিয়ে সেই সময় বৃন্দাবনের লোক সংখ্যার হিসেব দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ কোটি, যা বর্তমানের ঢাকা বা দিল্লি বা মুম্বাইয়ের লোক সংখ্যার সমান; সেই ৫২০০ বছর আগে সারা ভারত মিলেও ২ কোটি লোক ছিলো না, আর এক বৃন্দাবনেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক ২ কোটি জনসংখ্যার কথা বলছে, এই একটি তথ্য থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সব কথা মিথ্যা।
যা হোক, রাধার অভিশাপ পেয়ে শ্রীদাম যায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে এবং কৃষ্ণ, তাকে বলে রাধার অভিশাপ অবশ্যই ফলবে, তুমি দানব শঙ্খচূড় হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেবে এবং তুলসীর সাথে তোমার বিয়ে হবে। অথচ পৌরাণিক কাহিনী মতে, দেবী বৃন্দা, পরে যিনি তুলসী নামে খ্যাত হন, তার বিয়ে হয় দানব জলন্ধরের সাথে এবং জলন্ধরের উৎপত্তি হয়েছিলো শিবের ক্রোধ থেকে, তার মানে জলন্ধর ছিলো শিবের অংশ এবং এই ঘটনাগুলো পুরোটাই পৌরাণিক, কিন্তু কৃ্ষ্ণের ঘটনা ঐতিাসিক, আর কৃষ্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে রাধা ও শ্রীদামের ঘটনাও হবে ঐতিহাসিক। আর ঐতিহাসিক ঘটনা মানে পৃথিবীর ঘটনা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মানুষ- রাধা ও শ্রীদাম, একে অপরকে স্বর্গের দেব-দেবীর মতো অভিশাপ দিচ্ছে এবং শ্রীদাম রাধাকে যে অভিশাপ দিচ্ছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে- সেই ভাবে রাধার জন্ম অলরেডি পৃথিবীতে হয়েই গেছে, তাহলে এখানে আবার অভিশাপের প্রয়োজন কী ? যে ব্যক্তি জেল খাটছে, তাকে আবার জেলের ভয় দেখিয়ে লাভ কী বা জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েই বা লাভ কী ? এই সব বিবেচনায়- উদ্ভট ও গাঁজাখুরি কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচয়িতা যে সুস্থ মস্তিষ্ক্যের মানুষ ছিলো না, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এমনই উদ্ভট আর অবান্তর কাহিনীর মাধ্যমে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ও যৌনতাকে তুলে ধরা হয়েছে, যেটা চালানো হয়েছে মহাভারতের মতো বিশুদ্ধ গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাসের নামে এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই প্রেম নাকি নিষ্কাম এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই লীলা নাকি অপার্থিব, অপ্রাকৃত ! আসলে এসব বলে শত শত বছর ধরে বৈষ্ণব গুরুরা এবং হরিবাসরে যারা লীলাকীর্তন পরিবেশন করে, তারা, হিন্দু সমাজকে এক বিশাল ধোকা দিয়ে যাচ্ছে, এখন সময় এসেছে সত্যকে গ্রহন করে মিথ্যাকে বিলুপ্ত করার; কারণ, মিথ্যাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
কিবা উচ্চ স্তনযুগ শোভে বক্ষপরে।
নিতম্ব দেখিয়া ধরা লাজেতে বিদরে।।
করিশুণ্ড সম উরু অপূর্ব বাহার।
দেখিয়া রাধার শোভা লাগে চমৎকার।।
রাধারের দেখিয়া কৃষ্ণ পুলকে বিভোর।
মরি মরি কিবা হায় প্রণয়ের ডোর।।
-যে কৃষ্ণ তখনও হাঁটতে শিখে নি, সেই কৃষ্ণ নাকি রাধার রূপ দেখে পুলকে বিভোর! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনার উদ্দেশ্যটা একবার বিচার করুন।
যা হোক, তারপর রাধাকে দেখে নন্দ বলে,
জগৎ জননী তুমি জগত মোহিনী।
প্রকৃতিস্বরূপা সতী হরি বিমোহিনী।।
আদ্যাশক্তি তুমি মাতা জগত ঈশ্বরী।
তব পদে শত শত প্রণিপাত করি।।
-------------------
ব্রজের ঈশ্বরী তুমি হরি তব ধন।
কৃষ্ণের জনম শুধু তোমার কারণ।।
- কৃষ্ণের জন্ম শুধু নাকি রাধার কারণে, আরো খোলামেলা বলতে গেলে বলতে হয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে কৃষ্ণের জন্ম শুধু রাধার সাথে প্রেম এবং যৌনক্রিয়া করার জন্য, দেখুন নিচে-
তারপর রাধা সতী হরি অঙ্কে করি।
অন্য বনে যান ত্বরা ব্রজের ঈশ্বরী।।
বনমাঝে গুপ্তস্থানে হরিরে লইয়ে।
কামেতে মাতিল রাধা হরিষে মজিয়ে।।
রাসমণ্ডলের কথা জাগিল অন্তরে।
চু্ম্বন হরির মুখ পুনঃ পুনঃ করে।।
- যে শিশু তখনও হাঁটতে শিখে নি, তাকে দিয়ে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক যৌনক্রিয়া করাচ্ছে যুবতী মেয়ের সাথে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখকের উদ্দেশ্যটা কী এবার বুঝতে পারছেন ? এখানে আরেকটি অসঙ্গতি লক্ষ্য করুন, শিশু কৃষ্ণের সাথে যৌনক্রিয়া করার সময় রাধার রাসমণ্ডলের কথা মনে পড়ছে, যেই রাস হয়েছিলো কৃষ্ণের আট বছর বয়সের সময়; এই পুরাণের লেখককে বলছি, আরে বলদা, মিথ্যা কাহিনী লিখতে গেলেও তো একটু আগে পিছে ভেবে লিখতে হয়, যাতে মিথ্যাটা সাদা চোখে সবার কাছে ধরা না পড়ে। যা হোক, তারপর রাধা-
অঙ্কে করি হরিধনে শয়ন করিয়া।
মনের বাসনা পুরে পুলকে মাতিয়া।।
একদৃষ্টে হরি প্রতি করে দরশন।
মূহুর্মুহুঃ মুখপদ্ম করেন চুম্বন।।
- এই রাধার সাথে কৃষ্ণের নাকি আবার অপ্রার্থিব, অপ্রাকৃত, নিষ্কাম প্রেম, যেখানে যৌনতার লেশ গন্ধ মাত্র নেই ! হ্যাঁ, এই কথাই বলে বা প্রচার করে থাকে- অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অল্পজ্ঞানী, দুই এক বইয়ের পাঠক বৈষ্ণব গুরুরা, যারা কোনো দিন ভাগবত, গীতা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ভালো করে পড়েও দেখে নি। রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ও বিবাহের কোনো ঐতিহাসিক দলিল না থাকলেও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধার সাথে কৃষ্ণের বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এই বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্মা; আমার এই কথার প্রমান পাবেন কোলকাতার অক্ষয় লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪০৩ নং পৃষ্ঠায়।
যা হোক, বিয়ের আগেই তো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রাধা কৃষ্ণ, বাসর সেরে ফেলেছিলো, এবার দেখা যাক বিয়ের পর তারা কীভাবে বাসর করছে এবং বৈষ্ণব গুরুদের মতে, সেখানে রাধা কৃষ্ণের অপার্থিব অপ্রাকৃত নিষ্কাম প্রেম আছে কি না ?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে- শ্রীকৃষ্ণেরসহ রাধিকার বিহার- পর্বে বলা হয়েছে,
বিভা (বিবাহ) দিয়া পদ্মাসন (ব্রহ্মা) করিল গমন।
দেখিতে দেখিতে রাত্রি করে আগমন।।
ঘন ঘন শ্রীরাধিকা কৃষ্ণপানে চায়।
ক্ষণে ক্ষণে নম্রমুখী বিষম লজ্জায়।।
কামবানে জর জর কাঁপে থর থর।
মূহুর্মূহু রতিপতি মারে খর শর।।
রাধা প্রতি কৃষ্ণ ধন করে দরশন।
কামেতে উন্মত্ত হয়ে পড়ে দুইজন।।
--------------
লজ্জাতে রাধিকা করে মুখ আচ্ছাদন।
এই রূপে ক্রীড়া করে সুখে দুই জন।।
ক্ষণপরে শ্রীরাধারে তুলি বক্ষপরে।
ঘন ঘন চুম্বে তার বদন কমলে।।
কামেতে মাতিল দোঁহে অপূর্ব দর্শন।
অধরে অধর দোঁহে করিছে দংশন।।
------------------
বিকল দোঁহার অঙ্গ অজ্ঞান জীবন।
রতিক্রীড়া দোঁহে ক্রমে করে সমর্পন।।
নখ দন্তাঘাত কত দেহেতে হইল।
তবু মদনেতে মত্ত দোঁহেতে থাকিল।।
মুহুর্মুহু রতিক্রীড়া করে দুই জন।
ঘর্মজল অঙ্গ মাঝে দিল দরশন।।
অলকা তিলকা যত বিনষ্ট হইল।
নূপুরের মিষ্ট শব্দ বাজিতে লাগিল।।
---------------------।
এইরূপে রতিক্রিয়া হৈলে সমাপন।
বালরূপ পরে কৃষ্ণ ধরেন তখন।।
----------------
প্রতিদিন রাত্রিকালে করি আগমন।
বিহার করিব আমি বলিনু বচন।।
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, নন্দের কাছ থেকে শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে যুবতী রাধা যখন গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে, তখন কৃষ্ণ শিশুর রূপ ছেড়ে নাকি যুবকের রূপ ধারণ করে, হ্যাঁ, এই কথাই বলা আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪০১ পৃষ্ঠায়, এভাবে-
তখন শিশুর রূপ করি বিসর্জন।
নটবর বেশ ধরে দেব সনাতন।।
-এই কথা ই কৃষ্ণ আবার বলেছে ৪০৫ পৃষ্ঠায়, এভাবে-
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-কৃষ্ণ, জন্মের পর থেকেই সব অসাধ্য সাধন করেছে, যেমন- যমলার্জুন ভঙ্গ, রাক্ষসদের বধ, কালীয়নাগ দমন, গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন, মুষ্টিকের সাথে লড়াই, কংসের সাথে লড়াই ও তাকে হত্যা এবং এসব করার সময় তাকে কখনো তার রূপ পাল্টাতে হয় নি, আর কৃষ্ণ যে এমন রূপ পাল্টাতে পারে বা তাকে কখনো রূপ পাল্টাতে হয়েছে, এমন কোনো নিদর্শন বা উদাহরণ হরিবংশ, মহাভারত, ভাগবতের কোথাও নেই কেনো ? কোনো তথ্য প্রমান ছাড়া কোনো এক পুরাণ যদি হঠাৎ কোনো কথা বলে, সেই কথাকে কেনো বিশ্বাস করতে হবে ? কৃষ্ণের শিশুরূপ ছেড়ে যুবক দেহ ধারণের কোনো ইঙ্গিত কোনো প্রমান হিন্দু শাস্ত্রের প্রামান্য কোনো গ্রন্থে না থাকলেও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে; কারণ, কৃষ্ণকে লম্পট ও যৌনকাতর পুরুষ প্রমান করতে এই লেখকের আর তর সইছিলো না, তাই সে কৃষ্ণের জীবনে কাম ও প্রেমের আবির্ভাব ঘটাতে এই থিয়োরি আবিষ্কার করেছে; কেননা, মূল কাহিনীতে তো আছে, যে কৃষ্ণ ১০ বছর ২ মাস বয়সে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে যাবে, তারপর সে আর কোনোদিন বৃন্দাবনে ফিরবে না, তাহলে যুবক কৃষ্ণের সাথে যুবতী রাধার প্রেম ও যৌনতা দেথাবে কিভাবে? তাই এই লেখক শিশুকৃষ্ণকে দিয়েই যৌনক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে, যাতে কৃষ্ণকে লম্পট ও চরিত্রহীন হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, কিন্তু কোনো শিশুর সাথে যুবতী মেয়ের প্রেম ও যৌনতা তো অসম্ভব, এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখকের এই অতি আশ্চর্য থিয়োরির আবিষ্কার-
নটবর সাজে আমি আসিব সুন্দরী।।
-এইভাবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক এটা বুঝিয়েছে যে, পৃথিবীতে কৃষ্ণের অবতরণের একমাত্র কারণ শুধু প্রেম ও যৌনলীলা করা। কিন্তু গীতার ৪র্থ অধ্যায়ে ১০ম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পৃথিবীতে তার অবতরণের একমাত্র কারণ, অধর্মকে বিনাশ করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই পথে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে তুলে না ধরে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক শ্রীকৃষ্ণকে যৌনকাতর ও লম্পট পুরুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন, হিন্দুধর্মের প্রধান পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রকে ধ্বংস করে হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। আর সেটা না বুঝে, আমরা হিন্দুরা, হরিবাসরে কৃষ্ণ সম্পর্কে এসব কথা প্রচার করে তিলে তিলে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
যা হোক, শিশু কৃষ্ণের সাথে রাধা কেবল একদিন বা দুইদিন এই কুকর্ম করে নি, এটা ছিলো তার প্রতিদিনের কাজ, দেখুন নিচে-
প্রতিদিন রাত্রিকালে করি আগমন।
বিহার করিব আমি বলিনু বচন।।
----------------
এই রূপে প্রতিদিন শ্রীমতি সুন্দরী।
বনমধ্যে ক্রীড়া করে লইয়া শ্রী হরি।।
শ্রীকৃষ্ণকে লম্পট প্রমানে বাংলা পদ্য ভাগবতগুলো এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রধান বিষয়গুলোর একটি হলো কৃষ্ণ কর্তৃক গোপীনীদের বস্ত্রহরণ। এই বস্ত্রহরণ পর্বের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, মেয়েরা যাতে নগ্ন হয়ে জলে স্নান করতে না নামে সেই শিক্ষা প্রদান করা, অথচ পদ্য ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে কৃষ্ণকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মনে হয়, নগ্ন নারীদেহ দেখাই কৃষ্ণের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এভাবে কৃষ্ণকে লম্পট প্রমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। মূল সংস্কৃত ভাগবতে তো রাধার কথাই নেই, তাই বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার উল্লেখ থাকার প্রশ্নই আসে না। সুবোধ চন্দ্রের ভাগবতেও বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু বেণী মাধবের ভাগবতে বস্ত্রহরণ পর্বে রাধার উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানেও রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্কের কোনো ইঙ্গিত নেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তো মিথ্যার ছড়াছড়ি, তাই বস্ত্রহরণ পর্বেও সেই মিথ্যা ধরা পড়েছে এভাবে-
কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের কাপড় চোপড় তথাকথিত চুরি করে গাছে উঠে বসেছে, তখন-
ব্রজাঙ্গনা দেখে লয় রাখালে বসন।
জানাইল গোপীগণ শ্রীরাধা সদন।।
জলে স্থিতা কোপান্বিতা শ্রীরাধা তখন।
সঙ্গের সঙ্গিনীগনে করে আবাহন।।
-কিন্তু গোপিনীদের কথায় কৃষ্ণ তাদের বসন ফিরিয়ে না দিলে, একজন গোপিনী বলছে-
"চলহ সত্বরে, রাধার গোচরে
জানাও এ সমাচার।" ( ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অক্ষয় লাইব্রেরী, পৃষ্ঠা ৪৮১)
- রাধা যদি সেখানে জলে ডুবে উপস্থিতই থাকে, তাহলে গোপিনীরা আবার কেনো বলছে যে, চল, রাধাকে এই বিষয়টি জানাই ?
যা হোক, উপরের এই কথা শুনে কৃষ্ণ বলছে-
"বলিলে তাহারে, সে রাধা আমারে,
বল কি করিতে পারে ।
এ সত্য বচন, শুন গোপিগণ,
নাহি রাখি ভয় তারে।'
আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, এই রাধার ভয়ে কৃষ্ণ একবার লুকিয়েছিলো এবং বিরজা ভয়ে জলের রূপ ধরে নদী হয়ে গিয়েছিলো, পরে রাধার রাগ ভাঙাতে কৃষ্ণ, রাধার পা পর্যন্ত ধরেছিলো, সেই কৃষ্ণ এখন বলছে, বল গিয়ে তাকে, তাকে আমি ভয় করি ?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখকের কাহিনী বর্ণনা এবং চরিত্র নির্মান যে বাংলা সাহিত্যে একেবারে নিচু মানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, এই জন্য তিনি মিথ্যা বলতে গিয়ে বার বার ধরা খেয়েছেন, তারপরও হিন্দু সমাজের কিছু নির্বোধ ধর্মগুরু আছে, যারা প্রকৃত সত্যটাকে উপলব্ধিই করতে না পেরে এটাকেই ধর্মগ্রন্থ বলে মনে করে।
কৃষ্ণের লীলাগুলোর মধ্যে বস্ত্রহরণের পর জনসাধারণে বহুল চর্চিত বিষয় হলো রাস, এই রাস এতটাই জনপ্রিয় যে, লীলা কীর্তনের হরিবাসরে রাস একটা প্রধান বিষয় এবং রাস কতটা জমে বা কোনো নর্তকী রাস কতটা জমাতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে হরিবাসরে সাফল্য বা সার্থকতা। যা হোক, রাস প্রসঙ্গে রাধা ভক্তদের জন্য একটা চরম দুঃসংবাদ হলো- মূল সংস্কৃত ভাগবতে রাধার নাম তো নেই ই, তাই সেখানে রাস প্রসঙ্গে রাধাকে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই, কিন্তু বাংলায় প্রচলিত বেণীমাধব শীলের ভাবগত এবং সুবোধচন্দ্র মজুমদারের ভাগবত, যেখানে রাধার অস্তিত্ব ইনিয়ে বিনিয়ে প্রমান করা চেষ্টা আছে, সেই ভাগবতগুলোতেও রাস অধ্যায়ে রাধার কোনো নাম নেই, যদিও এই দুই ভাগবতে রাস লীলার বর্ণনায় অশ্লীলতার ছাড়াছড়ি এবং রাস হলো একটা খোলামেলা সেক্স পার্টি, আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে এই দুই ভাগবতের রাস অধ্যায়গুলো পড়ে দেখতে পারেন।
যা হোক, সুবোধ এবং বেণীমাধবের ভাগবতে রাস অধ্যায়ে রাধার নাম না থাকলেও, রাস অধ্যায়ে রাধার নাম আছে এবং বেশ জমিয়ে আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে; ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৪৮৮ পৃষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রা পর্বে বলা হয়েছে, রাধার ২৭ জন সখী ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার গোপিনীকে সাথে নিয়ে রাসমণ্ডলে উপস্থিত হয় এবং তারপর সেখানে যা ঘটে তার কিছু অংশ আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিচে নিবেদন করছি-
পুষ্প মধুপানে মত্ত ভ্রমরী সহিত।
এ সময়ে রাধা রাসে হৈল উপনীত।।
----------------
দেখিয়া রাধারে কৃষ্ণ কামেতে মোহিতা।
সখীগণমধ্যে রত্ন ভূষণে ভূষিতা।।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখছি এবং আমার পাঠকদেরকে এই তথ্যটি ভালো করে মনে রাখার জন্য অনুরোধ করছি যে রাসলীলার সময় কৃষ্ণের বয়স কিন্তু ছিলো মাত্র আট। এই আট বছর বয়সী বালক কৃষ্ণকে দিয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক কিভাবে যৌনলীলা করাচ্ছে, সেই বিষয়টি একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করবেন, আর ভাববেন এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনার আসলে উদ্দেশ্যটা কী ছিলো ?
যা হোক, ৮ বছর বয়সী কৃষ্ণ, রাধাকে দেখেই কামে মোহিতা হয়ে যায় এবং কৃষ্ণ এমন মদন বাণ ছাড়ে যাতে-
মূর্চ্ছিত হইল রাধা মদনের বাণে।
শ্রীঅঙ্গ পুলকিত কামে হতজ্ঞানে।।
-----------------
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে শ্রীরাধা সদন।
আইলেন মনোল্লাসে মদনমোহন।।
রাধার করিলা কৃষ্ণ শ্রীমুখ চুম্বন।
কৃষ্ণ-অঙ্গ-সঙ্গে রাধা পাইল চেতন।।
প্রাণাধিক প্রাণকান্তে করি আকর্ষণ।
শ্রীরাধা করেন কামে বদন চুম্বন।।
বচনে হরিলা কৃষ্ণ মানস রাধার।
রসিকা আইল দেখি কামের আগার।।
--------------------
তদন্তর তথা কামে সুরতি উন্মুখে।
শুইলা রাধার অঙ্গে রতিকল্পে সুখে।।
শৃঙ্গার অষ্ট প্রকার বিপরীত মত।
করেন কোমল অঙ্গে নখ দন্তে ক্ষত।।
কামশাস্ত্রে সুগোপন অষ্টম প্রকার।
চুম্বন করেন কৃষ্ণ রণে পারাবার।।
অঙ্গে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে কামপরে।
কামুক কামুকীদ্বয় আকর্ষণ করে।
- এই রাধা কৃষ্ণের প্রেম নাকি- নিষ্কাম, অপার্থিব, অপ্রাকৃত ?!
যা হোক, তার বলা হয়েছে,
শৃঙ্গার কুশল কামশাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
রতি যু্দ্ধ বিরাম না হয় কদাচিত।।
এইমত ঘরে ঘরে নানামূর্তি ধরি।
রমন গোপীর সঙ্গে রাস করে হরি।।
অভ্যন্তরে রতিক্রিয়া করিয়া সাদরে।
কত মত রাসক্রীড়া করেন বাহিরে।।
রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।
এই অষ্টাদশ লক্ষ শ্রীরাস-মণ্ডলে ।
গোপ আর গোপীকার বিহার সে স্থলে।।
মুক্তকেশ নগ্নবেশ বিচ্ছিন্ন ভূষণ।
প্রমত্ত মূর্চ্ছিত সবে কামে অচেতন।।
-------------------
এই মত ক্রীড়া করি সবে কুতূহলে।
ততপরে বিহার করে যমুনার জলে।।
জলক্রীড়া করি পরিশ্রান্ত জনে জন।
উঠিয়া পরিল সবে স্বকীয় বসন।।
রাস মণ্ডলের এই বর্ণনার পর, "শৃঙ্গার রহস্য" পর্বে বলা হচ্ছে-
কেহ কামরসে, প্রেমের সাহসে,
নগ্ন করি শ্রীহরিরে।
কাড়ি পীতবাস, কৌতুকেতে হাস,
আনন্দে রতি মন্দিরে।
---------------
করি আকর্ষণ, বদন চুম্বন,
পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন।
আননে আনন, করি আরোপন,
ঘর্ষণ স্তন জঘন।
কোন গোপীগন, করান দর্শন,
বক্ষোপরি সুললিত।
কান্ত করে ধরি, রাখি তদুপরি,
করেন চূড়া নির্মিত।।
-------------
সব বরাঙ্গনা, কামে মত্তমনা,
কৌতূকের নাহি পার।
গোপে নিলে হরি, সেই ত মুরারী,
আনি দেয় পুনর্বার।।
কেহ নগ্ন করি, কানে কান্ত হারি,
ক্রোড়ে করে কুতূহলে।
কেহ রঙ্গভরে, সুখে নৃত্য করে,
কান্তে রাখি মধ্যস্থলে।।
সুনির্জন বনে, নাচে কোন জনে,
হরিয়া কৃষ্ণের বাস।
সেই বস্ত্র দ্বারে, নগ্না গোপিকারে,
সাজায়ে কৌতূকে হাস।
কৃষ্ণ কুতূহলে, নিজ বক্ষঃস্থলে,
বসাইল শ্রীরাধারে।
আনন্দে শ্রীহরি, রাধার কবরী,
নির্মায় স্বকর দ্বারে।।
-----------
স্তন শ্রেণীভাগে, কাম অনুরাগে,
নখেতে করেন চিত্রিত।
দন্তেতে দলন, করে ঘন ঘন,
বিম্বাধর সুললিত।
------------
শৃঙ্গার বাসরে, চেতন অন্তরে,
বরিয়া রাস বাসর।
নখদন্তাঘাত, করে অচিরাত,
কামশরে পরস্পর।।
গোপী স্তনোপরে, কৃষ্ণাঘাত করে,
কর কমলে সঘন।
শ্রেণীর উপরে, নখচিত্র করে,
হৈল অপূর্ব শোভন।।
কামে মত্তানন্দ, শ্লথ নীধিবন্ধ,
ক্ষুদ্র ঘন্টিকা কবরী।
বসন ভূষণ, রত্ন আভরণ,
গোপীর হরিল হরি।।
নবধা প্রকার, আলিঙ্গন আর,
অষ্টম মত চু্ম্বন।
ষোড়শ শৃঙ্গার, করে অনিবার,
রাসেশ্বর সনাতন।।
অঙ্গে অঙ্গে মিলে, ভিন্ন নহে তিলে,
ব্রজাঙ্গনা অঙ্গ সঙ্গ।
করে আলিঙ্গন, কামে মগ্ন মন,
নাহি তার ক্ষণভঙ্গ।।
-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে এই হলো কৃষ্ণের রাসলীলা, যদিও আমি একে বলি ওপেন সেক্স পার্টি; যা হোক, যদিও এক জায়গায় বলা হয়েছে,
রাসেতে বিহার করে গোপ গোপীগণ।
নব লক্ষ গোপী নব লক্ষ গোপজন।।
-কিন্তু অন্য এক জায়গায় রাধার ২৭ জন সখী মিলে যতজন গোপিনীকে রাস মণ্ডলে নিয়ে এসেছে, তার সংখ্যা ৩৮ লক্ষ, ৯ হাজার। এখন এই সংখ্যাতত্ত্বের দিকে একটু খেয়াল করুন, এক জায়গায় বলা হচ্ছে মোট ১৮ লক্ষ, অন্য জায়গায় হিসেব দেওয়া হচ্ছে ৩৮ লক্ষের! ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক যদি সত্য কাহিনী বর্ণনা করতো, তাহলে কিন্তু এমন হতো না। যা হোক, এই দু্ই হিসাবের মধ্যে ৩৮ লক্ষের হিসাবটাই নিচ্ছি; কারণ, রাধার ২৭ জন সখী মিলে এই ৩৮ লক্ষ ৯ হাজার জনকে রাসমণ্ডলে নিয়ে এসেছে এবং এই সংখ্যক যুবতী মেয়ে যদি সেই সময় বৃন্দাবনে থাকে, তাহলে আরও কমবেশি ৩৮ লক্ষ সক্ষম পুরুষ ছিলো বৃন্দাবনে, ছিলো তাদের বাপ মা মানে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, এই সংখ্যা আরও কম বেশি ৩৮ লক্ষ; ছিলো ছেলে মেয়ে, ৩৮ লক্ষ যুবতী বধূর কম পক্ষে ৭৬ লক্ষ সন্তান থাকা সম্ভব, তাহলে সব মিলিয়ে সেই সময় বৃন্দাবনের লোক সংখ্যার হিসেব দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ কোটি, যা বর্তমানের ঢাকা বা দিল্লি বা মুম্বাইয়ের লোক সংখ্যার সমান; সেই ৫২০০ বছর আগে সারা ভারত মিলেও ২ কোটি লোক ছিলো না, আর এক বৃন্দাবনেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখক ২ কোটি জনসংখ্যার কথা বলছে, এই একটি তথ্য থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সব কথা মিথ্যা।
যা হোক, রাধার অভিশাপ পেয়ে শ্রীদাম যায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে এবং কৃষ্ণ, তাকে বলে রাধার অভিশাপ অবশ্যই ফলবে, তুমি দানব শঙ্খচূড় হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেবে এবং তুলসীর সাথে তোমার বিয়ে হবে। অথচ পৌরাণিক কাহিনী মতে, দেবী বৃন্দা, পরে যিনি তুলসী নামে খ্যাত হন, তার বিয়ে হয় দানব জলন্ধরের সাথে এবং জলন্ধরের উৎপত্তি হয়েছিলো শিবের ক্রোধ থেকে, তার মানে জলন্ধর ছিলো শিবের অংশ এবং এই ঘটনাগুলো পুরোটাই পৌরাণিক, কিন্তু কৃ্ষ্ণের ঘটনা ঐতিাসিক, আর কৃষ্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে রাধা ও শ্রীদামের ঘটনাও হবে ঐতিহাসিক। আর ঐতিহাসিক ঘটনা মানে পৃথিবীর ঘটনা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মানুষ- রাধা ও শ্রীদাম, একে অপরকে স্বর্গের দেব-দেবীর মতো অভিশাপ দিচ্ছে এবং শ্রীদাম রাধাকে যে অভিশাপ দিচ্ছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে- সেই ভাবে রাধার জন্ম অলরেডি পৃথিবীতে হয়েই গেছে, তাহলে এখানে আবার অভিশাপের প্রয়োজন কী ? যে ব্যক্তি জেল খাটছে, তাকে আবার জেলের ভয় দেখিয়ে লাভ কী বা জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েই বা লাভ কী ? এই সব বিবেচনায়- উদ্ভট ও গাঁজাখুরি কাহিনী সমৃদ্ধ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচয়িতা যে সুস্থ মস্তিষ্ক্যের মানুষ ছিলো না, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এমনই উদ্ভট আর অবান্তর কাহিনীর মাধ্যমে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ও যৌনতাকে তুলে ধরা হয়েছে, যেটা চালানো হয়েছে মহাভারতের মতো বিশুদ্ধ গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাসের নামে এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই প্রেম নাকি নিষ্কাম এবং রাধা ও কৃষ্ণের এই লীলা নাকি অপার্থিব, অপ্রাকৃত ! আসলে এসব বলে শত শত বছর ধরে বৈষ্ণব গুরুরা এবং হরিবাসরে যারা লীলাকীর্তন পরিবেশন করে, তারা, হিন্দু সমাজকে এক বিশাল ধোকা দিয়ে যাচ্ছে, এখন সময় এসেছে সত্যকে গ্রহন করে মিথ্যাকে বিলুপ্ত করার; কারণ, মিথ্যাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
রাধা রানী কে ?
এমন কোনো পৌরানিক বা বৈদিক নাই যারা জানেনা রাধা কে, শুধু তাই নয় আমাদের দেশের প্রায় মুসলিম খ্রিষ্টান এবং বিদেশিরাও ইসকনের জন্য জানতে পেরেছে রাধা কে ? এক কথায় সকলে জানে রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা এবং রাধা হলো আয়ান ঘোষের স্ত্রী। কিছু লোক রাধা ও শ্রীকৃষ্ণের প্রেম কে ভুল প্রমাণ করার জন্য ভাগবত, রঘুবংশ আদি গ্রন্থ থেকে তথ্য দিয়ে বোঝাতে চায় যে রাধা বলে শ্রীকৃষ্ণের জীবনে কেউ ছিলোনা, শ্রীকৃষ্ণ ছোট বেলায় বৃন্দাবন ত্যাগ করেছে আর রাধা কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী যা পাওয়া যায় সবই বৃন্দাবনের তাই। তাই রাধা বলে শ্রীকৃষ্ণের জীবনে ছিলোনা, এইটা একটা শিশু সুলভ যুক্তি! বৈষ্ণবরা কি এতোই বোকা যে এই সামান্য কথনের জন্য রাধা কে মিথ্যা মনে করবে ? রাধার নাম ভাগবতে নেই ঠিকই কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তো আছে, এই পুরাণ কখন লেখা হয়েছে সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের লেখকও ব্যাসদেবকেই মনে করা হয় আবার ভাগবতও তাই মনে করা হয়। কাজেই ভাগবতে রাধার নাম নেই তো কি হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তো আছে, আবার যে চৈতন্য কে শ্রীকৃষ্ণের অবতার মনে করে পুরো বৈষ্ণব সমাজ সেই চৈতন্যের চৈতন্যচরিতামৃত তে রাধার বহু গল্প আছে, কাজেই বৈষ্ণবদের বোঝানো মুশকিল যে রাধা নামে কেউ ছিল না।
ঋষি দয়ানন্দ শ্ৰীকৃষ্ণের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের গুণ কর্ম স্বভাব আপ্ত পুরুষের সাদৃশ্য(যে ব্যক্তি জীবনেও কোনো ভুল কাজ করেনা সে আপ্ত পুরুষ) শ্রীকৃষ্ণ জন্ম থেকে মরণ পর্যন্ত অধর্ম আচরণ করেছিল এমন মহাভারতে কোথাও লেখা নেই,
সত্যার্থ প্রকাশ, ১১ সমুল্লাস। আমরা ঋষি দয়ানন্দ জীর এই কথন অনুযায়ী যোগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ যথাযথ সম্মান করি। আমরা(বৈদিক) ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ আদি যত ১৮+ কথিত পুরাণ আছে তা আমরা মানিনা কারণ এগুলোতে আমাদের মহাপুরুষদের কামুক, লম্পট আদি বানানো হয়েছে এবং তাদের অপমান করা হয়েছে।
আমরা বৈদিকরা, মুসলিম বা নাস্তিকরা যখন রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ে বলি তখন তারা বলে থাকে যে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ছিল নিষ্কাম, লীলা মাত্র, এতে খারাপ কিছু ছিলোনা। আসুন এইবার দেখি কেমন নিষ্কাম প্রেম ____
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড, ১৫ অধ্যায়, ১৩১-১৬৩ শ্লোক।
রাধা শ্রীকৃষ্ণ কে তাম্বুল(পান) খেতে দিলেন শ্রীকৃষ্ণ তা ভক্ষণ করলেন এবং সেই চিবানো পান রাধাকে খেতে দিলেন, রাধাও তা খেলেন। অতঃপর শ্রীকৃষ্ণ রাধার পুরো শরীরে চন্দন, কস্তুরী প্রভৃতি গন্ধ লেপন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলেন, নতুন সঙ্গমে রাধার সমস্ত অঙ্গ পুলকিত হতে লাগলো, রাধা মুর্চ্ছিত হলো এবং দিনরাত্রি তার জ্ঞান থাকলো না
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, ৫ অধ্যায়
২০-২৭ শ্লোক
শ্রীকৃষ্ণের বাম পাশ থেকে একটি কন্যার আবির্ভাব হলো সেই কন্যাকে পণ্ডিতরা রাধা নামে ডেকে কীর্তন করেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্ৰীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড, ৩ অধ্যায়
এখানে রাধা শ্রীকৃষ্ণ কে বলছে- হে লোল, অতি লম্পট, রতিচোর তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও।
ওপরে যে যে প্রমাণ দিলাম তা পঞ্চানন তর্করত্ন এর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুবাদ থেকে, ছবি সহকারে দেখেনিন সমস্ত প্রমাণ
আদৌ রাধাং সমুচ্চার্য্য পশ্চাৎ কৃষ্ণম্ বদেদ্বুদঃ।
ব্যতিক্রমে ব্রহ্মহত্যাং লভতে নাত্র সংশয়ঃ।। ৫৯
অর্থাৎ অগ্রে রাধার নাম উচ্চারণ করে পশ্চাৎ কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করিবে। অন্যথা অগ্রে কৃষ্ণ পশ্চাৎ রাধা উচ্চারণে ব্রহ্মহত্যারপাপভাগী হইবে।
হরে কৃষ্ণ = রাধা কৃষ্ণ তাদের মান্য অর্থ। পুরাণ অনুযায়ীও তাহাই দাঁড়ায়। অসংখ্য ব্যক্তিদের মনে যে রাধা অবস্থান করছেন সেই রাধা আসলে কে? ছোট এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যখন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের প্রশ্নটি করেছি তখন তারা বিভিন্নরকম উত্তর দিয়েছেন। যেমন -
১. রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা।↓
রাধা যে কৃষ্ণের প্রেমিকা সেকথা পুরাণের যত্রতত্র উল্লেখিত রয়েছে। আর যারা প্রেমিকা বলেন, তাদের অনেকেই রাধার সহিত কৃষ্ণের বিবাহ হয়েছে এরূপ মান্যতা দেন না। তাদের নিকট যখন প্রশ্ন করা হয় প্রেমিকা হলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বিয়ে করেন নি কেন? তাদের মধ্যে অনেকেই উত্তরে বলেন যে - শ্রীকৃষ্ণই রাধা, রাধা'ই শ্রীকৃষ্ণ। কেহ কি নিজেকে নিজে বিয়ে করতে পারে? সেইজন্য বিয়ে করেননি। আর ইহার প্রমাণও পাই ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/২৯ শ্লোকে। সেখানে বলা হয়েছে -
দক্ষিণাঙ্গঞ্চ শ্রীকৃষ্ণো বামাঙ্গং সা চ রাধিকা।।২৯
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ অংশ শ্রীকৃষ্ণরূপ হলো এবং বাম অংশের অঙ্গ রাধারূপ ধারণ করেছেন।
২.শ্রীকৃষ্ণই রাধা রাধাই শ্রীকৃষ্ণ
উপরেই এর প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছি, তারপরেও আরও একটি প্রমান দেখিতে পাই যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলছেন যে, রাধা! তুমিই আমি, আমিই তুমি , আমাদের কোন ভেদ নেই।
যথা তঞ্চ তথাহঞ্চ ভেদো হি নাবয়োর্ধ্রুবম্।। জন্মখণ্ড-১৫/৫৭
৩.রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী। ↓
গর্গ সংহিতা, গোলকখণ্ড, ১৬ তম অধ্যায়ে ব্রহ্মা দ্বারা রাধা-কৃষ্ণের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ব্রহ্মাকে তারা চার মস্তকযুক্ত মনে করিয়া থাকেন। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৭ শ্লোকেও 'স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী' বলিয়া উল্লেখিত আছে।
৪.রাধা হলো শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড-১৫/৬৩ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে -
হে রাধা! তুমি আমার এবং সকলের শক্তিস্বরূপা।
স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুখণ্ডের শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্য-১/২২, ২/১১ শ্লোকে রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের আত্মা বলা হয়েছে।
৫. রাধা শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত ছিল।
রাধা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করিতেন এর উল্লেখ ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৩৮ শ্লোকে রয়েছে -
রাধা ভজতি শ্রীকৃষ্ণং স চ তাঞ্চ পরস্পরম।। ৩৮
অর্থাৎ রাধা শ্রীকৃষ্ণকে এবং শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে আরাধনা করতেন।
এখানে শ্রীকৃষ্ণকেও রাধার ভক্ত বলা হয়েছে।
৬.রাধা মানে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত অর্থাৎ যে/যারা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত সে/তাহারাই রাধা।
এরূপ বিভিন্ন উত্তর পেয়েছি। যারা রাধাকে কৃষ্ণ হইতে আলাদা এবং নির্দিষ্ট এক ব্যক্তি বলিয়া থাকেন তারা সকলেই রাধাকে বৃষভানুর কন্যা বলিয়া জানেন, যার উল্লেখ পুরাণাদিতেও রয়েছে। রাধার মাতার নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায় যে রাধার মাতার নাম কলাবতী। -
বৃষভানুসুতা সা চ মাতা যস্যাঃ কলাবতী। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ-জন্মখণ্ড-১৩/৯৩)
অর্থাৎ রাধা বৃষভানুসুতা তাহার মাতার নাম কলাবতী।
প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৫৫ শ্লোকেও রাধার পিতা-মাতার নাম বৃষভানু-কলাবতী পাওয়া যায়।
যখন রাধা ভক্তদের কতিপয় এই উত্তর ব্যতীত আর কোন উত্তর আছে কি নেই তা জানার জন্য গ্রন্থাদি অধ্যয়ণ করি, তখন চমৎকার কিছু তথ্য আমাদের নজরে আসে। আর সে তথ্যানুযায়ী রাধার আরও কিছু পরিচয় -
৭. রাধা শ্রীকৃষ্ণের মামি।
শ্রীকৃষ্ণের মামি পরিচয়ের মধ্যেই অন্য একটি পরিচয় বিদ্যমান রয়েছে, তা হলো রাধা শ্রীকৃষ্ণের কোন মামার স্ত্রী? পুরাণে বলা হয়েছে -
অতীতে দ্বাদশাব্দে তু দৃষ্ট্বা তাং নবযৌবনাম্।
সার্দ্ধং রায়াণবৈশ্যেন তৎ সম্বন্ধং চকার সঃ।। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ডম- ৪৯/৩৯)
অনুবাদঃ- দ্বাদশ বৎসর অতীত হইলে, বৃষভানু, রায়াণ বৈশ্যের সহিত নবযৌবনা নিজ-কন্যার [রাধার] বিবাহ সম্বন্ধ করে।
অর্থাৎ ১২ বৎসর বয়সেই রাধার বিবাহ হয় রায়াণ বৈশ্যের সহিত। আর রায়াণ শ্রীকৃষ্ণের এক মাতা যশোদার আপন ভ্রাতা বলিয়াই পুরাণে উল্লেখিত রয়েছে-
কৃষ্ণমাতা যশোদা যা রায়াণস্তৎসহোদরঃ। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ডম- ৪৯/৪২)
অনুবাদঃ- রায়াণ, কৃষ্ণজননী যশোদার সহোদর (অর্থাৎ এক মাতার গর্ভজাত ভ্রাতা)
৮.রাধা শ্রীকৃষ্ণের কন্যা।
আবির্বভূব কন্যৈকা কৃষ্ণস্য বামপার্শ্বতঃ। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড-৫/২৫)
তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরাবিদভির্শ্বজোত্তম ॥ (ব্রহ্মখণ্ড-৫/২৬)
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হইতে এক কন্যা আবির্ভূত হইয়াছিলো, পুরাণজ্ঞ পন্ডিতেরা তাহাকে রাধা নাম দিয়াছেন।
প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪১ ও শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড-১৭/২৩৪, দেবী ভাগবত পুরাণ-৯/২/৫৪ শ্লোকেও শ্রীকৃষ্ণের বামাংশ হইতে রাধার উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে।
যে যার হইতে উৎপন্ন হয় সে তাহার সন্তান, আর রাধা যেহেতু মেয়ে/নারী সেহেতু পুরাণের উক্ত শ্লোকানুযায়ী সে শ্রীকৃষ্ণের কন্যা বলিয়া প্রমাণিত হয়।
অনেকে বলে থাকেন শ্রীরাধা লক্ষ্মী দেবীর অবতার। কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৪ শ্লোকে বলা হয়েছে-
রাধাবামাংশভাগেন মহালক্ষ্মীবভূব সা।
চতুর্ভূজস্য সা পত্নী দেবী বৈকুণ্ঠবাসিনী।। ৪৪
অর্থাৎ রাধার বাম অংশ হইতে মহালক্ষ্মী উৎপন্ন হন এবং তিনি চতুর্ভুজ নারায়ণের প্রিয়তমা ; বৈকুণ্ঠে তাঁহার বাস।।
তারপর বলা হয়েছে -
তদংশা রাজলক্ষ্মীচ রাজসম্পৎপ্রদায়িনী॥ ৫
অর্থাৎ মহালক্ষ্মীর অংশ রাজলক্ষ্মী, রাজগণের সম্পদ বৃদ্ধি করেন।
শুধু তাহাই নয়, অন্যান্য গোপীসকলেও রাধার অংশ বিশেষ বলয়া উল্লেখিত রয়েছে।
তাছাড়াও অনেকেই বলেন যে রায়াণ বৈশ্যের সহিত রাধার নয় বরং রাধার ছায়ার বিবাহ হয়েছিল। এর ভিত্তিও রয়েছে, যেমন -
বভূব তস্য বৈশ্যস্য বিবাহশ্চছায়য়া সহ।। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৯/৪০
অর্থাৎ রাধার ছায়ার সহিত রায়াণ বৈশ্যের বিবাহ হয়।
আরও বলা হয়েছে - স্বয়ম্ রাধা হরেঃ ক্রোড়ে ছায়া রায়াণ মন্দিরে।। ৪৯/৪৪
অর্থাৎ রাধা স্বয়ম্ শ্রীকৃষ্ণের ক্রোড়ে বাস করিতেন এবং রায়াণ গৃহে রাধার ছায়া অবস্থান করিতেন।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে আরও একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে-
নন্দাত্মজেন রাধায়া রহোবস্থানতোমুনে।
সহালাপাৎ সহাবেশা দনুরাগাৎ পরস্পরং।। (ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ - ২৪/১)
অনুবাদঃ- জগৎস্রষ্টা জগৎপিতা পিতামহ ব্রহ্মা অঙ্গিরাকে কহিতেছেন - হে বৎস! এইরূপে নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণের সহিত শ্রীরাধিকার সর্ব্বদা গোপন স্থানে সহবাস এবং যমুনাকচ্ছে আলাপন ও রতিক্রীড়া পরস্পর উভয়ের লীলানুরাগ ও রসাবেশের জন্য গোকুলবাসীজনেরা পরস্পর কর্ণাকর্ণি করিতে লাগিলেন। [ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ অনুযায়ী এইসকলের জন্যই রাধা - কলঙ্কিনী রাধা বলিয়া পরিচিত হন ]
ছোট করে একটি কথা না বললেই নয় যে- কোন ছায়ার সহিত পৌরাণিক পদ্ধতিতে কারো বিবাহ সম্পন্ন করা আদৌতে কি সম্ভব? মালাবদল আদি কতো কি আচার অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব কি? আর এখানে শ্রীকৃষ্ণকে রায়াণের সহিত ছলনা করার, ধোকাবাজ বলে আরোপ করার একটা রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।
৯. রাধা হল মূল প্রকৃতি।
প্রশ্ন- প্রকৃতি কাকে বলা হয়?
উত্তর : কার্য্য জগতের মূল উপাদান কারণ তথা সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুণের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়।
আর এই মূল প্রকৃতি জড় পদার্থ। শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড-১৫/৬৬ শ্লোকে রাধাকে মূল প্রকৃতি বলিয়াছেন।
এইসকল বিরোধী বিভিন্ন পরিচয়াদি - ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ,ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ,দেবীভাগবত,স্কন্দ পুরাণ,চৈতন্য চরিতামৃত আদি কতিপয় নব্য গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। এগুলোতে রাধা সহ রাধার অংশাদি গোপীদের শ্রীকৃষ্ণের সহিত যুক্ত করে অসংখ্য অশ্লীল কাহিনি উল্লেখ করে শ্রীকৃষ্ণকে চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে স্বয়ম্ রাধা শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে-
সংগৃহ্যেমাং প্রিয়ামিষ্টাং গোলোকাদ্গচ্ছ লম্পট।
অন্যথা ন হি তে ভদ্রং ভবিষ্যতি ব্রজেশ্বর।। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ডম্ - ১১/৪৪)
অনুবাদঃ- লম্পট! তুমি এই প্রিয় ভার্য্যা লইয়া গোলোক হইতে দূর হও। ব্রজেশ্বর। তাহা না হইলে কিছুতেই তোমার মঙ্গল নাই।
পুরাণের বিভিন্ন স্থানেই রাধাকে খুব রাগান্বিতা নারী বলেই পরিচয় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
➤কিন্তু বৈষ্ণবদিগের অতি প্রিয় ও প্রধান গ্রন্থ ভাগবত পুরাণেই রাধার নাম উল্লেখ নেই। অনেকে বলে শ্রীমদ্ভাগবত-১০/৩০ অধ্যায়ে রাধার উল্লেখ আছে, তা আদৌতে সত্য নয়। সেখানে শুধু এটা উল্লেখ আছে যে সকল গোপিদের মধ্য থেকে কোন এক গোপিকে নিয়ে কৃষ্ণ পালিয়েছিলো।
➤শ্রীকৃষ্ণের প্রমাণ্য ইতিহাস -মহাভারতে এই রাধার উল্লেখ নেই। মহাভারতে কর্ণের লালনপালন করেছেন যে মাতা সেই মাতা রাধার নাম উল্লেখ আছে। কর্ণ স্বয়ম্ শ্রীকৃষ্ণের সহিত বলেছেন যে - [যখন শিশু ছিল তখন] সুত আমাকে এনে নিজ পত্নী রাধাকে দিয়েছে, আর রাধা একজন মাতার যা দায়িত্ব তা সম্পূর্ণই করেছেন। (মহাভারত, উদ্যোগপর্ব - ১৪১/৫-৬)
➤যেসকল পুরাণে রাধার উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে প্রায় পুরাণেই শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য বিবাহের উল্লেখ করা হয়েছে, অনেকের নামও দেওয়া হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণ-৪/১৩/৬৯ শ্লোকে ষোড়শ সহস্র, ৪/১৫/১৯ শ্লোকে ষোড়শ সহস্র একশত একটি স্ত্রী রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে সব মিলিয়েও এত সংখ্যক স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়না। অপরদিকে মহাভারতে বলা হয়েছে -
বৈদেহ্যাং চ যথা রামো রুক্মিণ্যাং চ জনার্দনঃ। (উদ্যোগপর্ব-১১৭/১৭)
অর্থাৎ যেমন বিদেহনন্দিনী সীতার জন্য রাম তেমনি রুক্মিণীর জন্য ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ।
রাধার এত এত পরিচয় দ্বারা এটা প্রমাণিত যে রাধার পরিচয়েরই ঠিক নেই। ঠিক থাকার কথাও নয় কেননা আদৌতে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা.... রাধার কোন অস্তিত্বই ছিলনা। বিয়ের পূর্বেই রুক্মিণী দেবী শ্রীকৃষ্ণের গুণে মুগ্ধ ছিল, ভালোবেসেও ছিল শ্রীকৃষ্ণকে, শ্রীকৃষ্ণও রুক্মিণীর প্রতি তেমনই ছিল। দুজন বিয়ের পর ১২ বছর ব্রহ্মচর্য পালন করে প্রদ্যুম্ন নামের এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। অথচ পুরাণে অসংখ্যাত পুত্রাদির গল্প রচনা করে দিয়েছে।
রাধার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে অনেকেই অনেক গবেষণা করেছেন। সেই গবেষকগণ এটাই বলেছেন যে রাধার উল্লেখ প্রথমে অর্বাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ থেকেই শুরু হয়, সেই কাল্পনিক রাধার বিস্তার হতে হতে অন্যান্য পুরাণেও প্রবেশ করানো হয় রাধার বিষয়ে। কবিদের কল্পনায় বহু গল্প রচিত হয় রাধাকে নিয়ে, কিন্তু সত্যিকারে রাধা বলতে এমন কারো অস্তিত্বই ছিলনা।
শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের জন্য কলঙ্ককর বিষয় রাধা গোপীদের লীলা কাহিনি । অনেকেই বলেন যে তখন কৃষ্ণ শিশু ছিল, তাই কলঙ্কের প্রশ্ন আনাটাই ভুল। কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড -১৫ অধ্যায়ের শ্লোকানুযায়ী কৃষ্ণ শিশু থেকে কিশোর হতে পারতেন এবং হইতেন।
অতঃ আমাদের উচিত রাধা-কৃষ্ণ নয় বরং রুক্মিণী-কৃষ্ণ বলেই মান্যতা দেওয়া।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ