রঘুনন্দন ভট্টাচার্য - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

04 October, 2020

রঘুনন্দন ভট্টাচার্য

রঘুনন্দন চৈতন্য মহাপ্রভু আবির্ভাবের প্রায় ২৫ বৎসর পর নবদ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন হরিহর বন্দোপাধ্যায় ভট্টাচার্য্য। হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ভট্টাচার্য স্মৃতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপে তার সংস্কৃত টোল ছিলো। রঘুনন্দন মাত্র ২৫ বছর বয়সে স্মৃতিগ্রন্থ বা "অষ্টবিংশতিতত্ত্ব' প্রণয়ন করেন। এই ২৫ বৎসর বয়সেই তিনি কঠোর পরিশ্রম করে নানা দেশ ভ্রমণ পূর্বক এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থটি প্রণয়নের পর অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গ, কঞ্চিদেশ, কাশীদেশ ও দ্রাবিড় দেশে স্মার্ত্ত পণ্ডিত বা স্মার্ত্ত রঘুনন্দন নামে তাঁর যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
রঘুনন্দন ভট্টাচার্য নিজের ইচ্ছেমত বেদবিরোধী স্মৃতি শাস্ত্র তৈরী করে ধর্ম্মের নামে অধর্ম্মের বোঝাকে সমাজের মানুষের মাথায় চাপিয়ে নিজের ব্রাহ্মণত্ত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ধর্ম্মের নামে নতূন নতূন নিয়ম ও আদেশ জারি করে। এই কুলাঙ্গার হিন্দু সমাজের বিশেষ করে বাংলাভাষীদের চরম সর্বনাশ করেছে। গুরুবাদ,পাপ পুন্য,ইহকালের সুখ,পরকালের প্রলোভন পূজাপার্বন, ব্রাহ্মন ভক্তিও দান। দেব-দেবীর মূর্তি কে সাক্ষী গোপাল হিসাবে দাঁড় করিয়ে কৌশলে চালিয়েছে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অবাধ লুন্ঠন। বল্লাল সেনের পর এই রঘুনাথ বাংলাই বেশী ক্ষতি করেছে। হরে কৃষ্ণ হরে রাম নামেরপ্রচার রঘুনাথের আদেশে নিতাই প্রথম করেছিল। সতীদাহ নামক নোংরা প্রথার প্রচলন চালু রাখার পেছনে এই রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের হাত রয়েছে। তাঁর লেখা সর্বনাশী গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শ্রাদ্ধতত্ত্ব, তিথিতত্ত্ব,শুদ্ধিতত্ত্ব, স্মৃতিতত্ত্ব, দুর্গাপূজাতত্ত্ব, তীর্থতত্ত্ব, যাত্রাতত্ত্ব, জ্যোতিস্তত্ত্ব,অষ্টবিংশতিতত্ত্ব,দায়তত্ত্ব ইত্যাদি প্রয়োগগ্রন্থ।
রাজা বল্লালসেনের কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন ও মানব সমাজকে চিতায় তুলে দিলেন এবং এরপর রঘুনন্দন সেই মানবসমাজের চিতায় অগ্নিসংযোগ করে ভস্ম করার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন। রাজা বল্লাল সেন সমাজকে ধ্বংস করেন এবং রঘুনন্দন ভট্টাচার্য সমাজ ও নারী জাতিকে সমূলে বিনাশ করেন।
রঘুনন্দন

.নবদ্বীপে ভগ্ন কুলীন ব্রহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। এই সময় মিথিলায় শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য গিয়েছিল রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। সেখানে নিয়ম ছিল শাস্ত্র অধ্যান করে কিছু লিপিবদ্ধ করে দেশে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই কিছুদিন শাস্ত্র অধ্যায়ন করে ব্যাকরণে তিনি খুব প্রতিভাবান হয়েছিলেন। তিনি দেশে ফিরে "অষ্টাবিংশতিত্ত্ব স্মৃতি" রচনা করলেন। এই নব্যস্মৃতির বজ্রবাঁধনে বাংলা এলাকার জনসাধারণকে তিনি আবদ্ধ করে ফেলেছেন।
এই সেদিন আয়ুব খাঁন যেমন বাংলাদেশে মার্শাল "ল" জারি করে প্রজাবর্গের কঠোর শাসন বিধান করেছিল, ঠিক তেমনি রঘুনন্দনের সঙ্গে রাজা বল্লাল সেন যোগ দিয়ে, চান্ডাল নীতিতে বঙ্গে অবৈদিক বিধি প্রচারে ইন্ধন যোগালেন। যদিও বেদ চর্চা ছিল না; তবুও জনসাধারণের মধ্যে বেদের প্রতি সকলের খুবই বিশ্বাস ছিল। কোনটা বেদের বিধান, তা জানার উপায় ছিল না। তাই রঘুনন্দন নব্যস্মৃতির মধ্যে ভেজাল দিয়ে 'ডালে চালে' খিচুড়ী পাকালেন।
বেদের মন্ত্র বা উপদেশ না থাকলে জনসাধারণকে আয়ত্ত করা যায় না। তাই তিনি বেদমন্ত্রের কদর্থ করে দেশে প্রচার করে দেশবাসীকে রঘুনন্দন ভাঁওতা দিলেন। কিন্তু সে সময় তার সুষ্ঠ প্রতিকার কেহ করতে পারে নি। তাই আলেয়ার পিছে পিছে ছুটতে ছুটতে মানুষ ভুল দীশাই চলতে শুরু করলো।
.গীতা বিরুদ্ধ ভাবে চতুরবর্ণ হতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে ছাঁটিয়ে সকলকে শূদ্র শ্রেণীতে পরিনত করলেন।
ব্রাহ্মণদের প্রধান্য বিস্তার করার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন-
"যুগে জঘন্যে দ্বিজাতি ব্রাহ্মণ শূদ্র এবহি"।
অর্থাৎ কলি যুগে মাত্র দুটি জাতি আছে একটি ব্রাহ্মণ ও অপরটি শূদ্র।
রঘুনন্দন নব্যরচিত লেখার দ্বারা সনাতন (হিন্দু) সমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সমাজকে বিলুপ্ত করলেন নব্যস্মৃতির আদেশ বলে। এভাবে রঘুনন্দন সম্পূর্ণ ভাবে বৈদিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে ধ্বংস করলেন। সাধারণ দেশবাসীর চোখে ধুলি নিক্ষেপ করে ব্রাহ্মণ সমাজের প্রভুত্ব পাকা করার জন্য নির্দয় কসাই বা জল্লাদের মত সমাজকে হত্যা করলেন।
.
তার নব্যলেখনিতে বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ, পাল, সাহা, কুন্ডু সহ সকল শ্রেনীর হিন্দু মানুষ বল্লাল সেনের গড়া জাত বিভাগে সবাই শূদ্র শ্রেনীতে ঘোষিত হলো। তার লেখনিতে বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ, পাল, সাহা, কুন্ডু, নাপিত সহ সকল শ্রেণীর হিন্দুমানুষ বল্লালসেনের গড়া জাত বিভাগে সবাই শূদ্র শ্রেণীতে ঘোষিত হল। রঘুনন্দন ব্রাহ্মণসমাজ যাতে সহজে শূদ্রদের শোষণ করতে পারে তার লেখনীর মাধ্যমে নানাবিধ ব্যবস্থা করে দিলেন। ব্রাহ্মণ সমাজ রঘুনন্দনের নববিধান মুঠোয় পেয়ে শূদ্র জাতিকে শোষণের জন্য তৎপর হয়ে উঠল। শ্রাদ্ধ, বিবাহ, পঞ্চামৃত, সাধভক্ষণ, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, পুকুরখনন, গৃহপ্রবেশ, বিদেশযাত্রা, পুজো-পার্বন, তিথি, নক্ষত্রদোষ প্রভৃতি কাজে ব্রাহ্মণের খাজনা বা তোলা চাই শূদ্রের কাছ থেকে।
মৃত যজমান শ্মশানে চলেছে, সেখানেও ব্রাহ্মণের খাজনা আদায়। যজমান মৃত মাতা-পিতার বা পুত্র-কন্যার শোকে পাগল, ব্রাহ্মণ চোদ্দো পুরুষের পিণ্ডদানের ফর্দ করে শোকাতুর যজমানের শোকের অবসরে যজমানকে লুণ্ঠন ও শোষণ করে, রাস্তার ভিখারিতে পরিণত করে। কেন-না ভিক্ষা করে হলেও ব্রাহ্মণদের আবদার পূরণ করতে হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। মৃতদের স্বর্গে বসবাসের জন্য কত রকমের ব্যবস্থা, কত রকমের ফন্দিফিকির। তার বদলে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা, যতটুকু তিল ততটুকু স্বর্ণ, জমি, সবৎস গাভী, ষোড়শ দান, পাত পেড়ে ভোজ সারা ইত্যাদি প্রাপ্তি। শোষণের করতে করতে লোভ এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ব্যক্তির পরমাত্মীয়র মৃত্যু হওয়ার কারণে পেট ভরতি করে চব্যচোষ্য ভোজ করার মতো অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথা চালু করা।
বিয়ের আনন্দে ভোজ খাওয়া যেতেই পারে, সন্তান প্রথম ভাত খাচ্ছে সেই আনন্দেও ভোজ চলতেই পারে – তাই বলে কারোর প্রাণপ্রিয় আত্মীয়ের মৃত্যু হলে সেই আনন্দে ভোজ খাওয়া যায়? মৃত্যু কি আনন্দের বিষয় ! কারোর আত্মীয়-বিয়োগ হলে কি সেই আনন্দে মিষ্টিমুখ করা যায় ! মৃতদেহ সৎকার(দাহ) করার আর কোনো কাজ থাকে না। তাছাড়া যাঁর শোক সেই-ই বহন করে, আর কেউ নয়।
পবিত্র বেদ বলছে- "ভস্মান্ত শরীরম্" অর্থাৎ শরীরকে ভস্মে পরিণত করো। যজুর্বেদ ৪০/১৫।
শরীরকে ভস্ম করার ক্রিয়াকে বেদে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বলা হয়েছে। বেদে যে ১৬ সংস্কারের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে শেষ সংস্কার হলো এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। অর্থাৎ এ শরীরের সংস্কার ভস্ম করা পর্যন্ত হয়।
মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ করা বেদ বিরুদ্ধ। শ্রাদ্ধ মানে শ্রদ্ধা জানানো, মস্তক মুণ্ডন করে গণ্ডায়পিণ্ডায় গেলানো নয়। আমরা যাঁরা শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে যাই, তাঁরা কোন্ আনন্দে সেজেগুজে মৃতব্যক্তির বাড়ি গিয়ে মুখে অন্ন তুলি ! নিজেকে অসভ্য, বর্বর বলে মনে হয় না! না, মনে হয় না। মনে হয় না বলেই আমরা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে ত্রুটি খুঁজি, রান্নার ভালো-মন্দের চর্চা করি, আপ্যায়নের বিচার করি।
শূদ্রেরা মনে করেন ব্রাহ্মণরাই ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরাই মানুষকে স্বর্গে পাঠানোর ঠিকা পেয়েছেন। মনে করেন ব্রাহ্মণের হাতেই মৃতব্যক্তির স্বর্গ ও নরক। ব্রাহ্মণের দাবি মেটালে স্বর্গ, না-মেটালে অবশ্যই নরকে ঠাঁই। শূদ্রের মাথায় ব্রাহ্মণের পা না-চড়ালে স্বর্গ কোথায় !(ছবি দেখুন) ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
.
রঘুনন্দন এবার তার ভেদনীতি আরও বিস্তার করলেন। বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ থেকে ডোম, মেথর পর্যন্ত, সকলকেই তিনি ব্রাহ্মণের দাস, শূদ্র বা গোলাম বলে ঘোষণা করলেন। শূদ্রের দ্বারা কোন কাজ করিয়ে নিলে কোন ব্রাহ্মণকে কোন পারিশ্রমিক দিতে হবে না, কারন ব্রাহ্মণদের সেবা করার জন্য ভগবান শূদ্রের সৃষ্টি করেছে। এই সব মনগড়া খেয়ালী নীতি রচনা করে তথাকথিত ব্রহ্মণ পন্ডিতেরা শূদ্রদের মান, অপমান এবং জীবন নিয়ে খেলেছে চিরদিন।
তারপর তিনি শূদ্রদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে সৎ বা অসৎ শূদ্র বলে ঘোষণা করলেন। রঘুনন্দনের প্রদত্ত উপাধি আবার কোনো কোনো শূদ্র খুব গর্বভরে গ্রহণ করেলেন।ভাবতে থাকলেন “আমি অন্য শূদ্রদের থেকে একটু ভালো, কারণ আমি কুলীন শূদ্র”। ব্রাহ্মণদের পদাঘাত নীরবে হজম করে শত শত শূদ্রগোষ্ঠী বা গোলামগোষ্ঠী অন্য শূদ্র বা গোলামদের উপর অত্যাচার শুরু করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করল না। তারা ভুলে গেলেন যে – ‘আমরা সকলেই শূদ্রশ্রেণী তথাকথিত ব্রাহ্মণদের চোখে’। ভুলে গেল বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পুজো-পার্বন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে শূদ্রদের বসার আসন ব্রাহ্মণদের আসন থেকে সর্বদা আলাদা রাখা হয়। অবমাননার এখানেই শেষ নয় । যেমন -- শূদ্রের সামনে দেবতাকে ভোগ দেওয়া যাবে না। শূদ্রের সৎকারে কোনো ব্রাহ্মণ অংশগ্রহণ করতে পারবে না, অন্যথায় ব্রাহ্মণের ব্রহ্মত্ব নষ্ট হবে। ব্রাহ্মণদের হুঁকোয় শূদ্র শ্রেণির মানুষ তামাক পান করতে পারবে না। স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে বৈঠকখানায় বাবার বিভিন্ন জাতের জন্য আলাদা আলাদা হুঁকো সাজানো থাকত। পাছে জাত যায়, সেই কারণে কেউ কারোর হুঁকোয় মুখ দিতে পারত না। বিবেকানন্দ স্বয়ং সবকটি হুঁকোয় মুখ দিয়ে টেনে দেখেছিলেন কীভাবে জাত যায়।
শ্মশানে শূদ্রের চিতা ভস্মের কাছাকাছি ব্রাহ্মণদের শবদাহ নৈব নৈব চ। শূদ্রের বেদে ও গায়ত্রী মন্ত্রে অধিকার নেই ; শূদ্র ওম স্বধা বা স্বাহা প্রভৃতি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করবে না(এটা নিয়ে এর আগে লেখা হয়েছে)। ব্রাহ্মণ শূদ্রের বাড়ির কোনো দেবতাকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে পারবে না, কারণ শূদ্রের বাড়ির দেবদেবীও শূদ্র। কোনো পুরোহিত শালগ্রাম শিলা নিয়ে কোনো শূদ্রের বাড়ি যাবে না, গেলে সেই বিগ্রহকে প্রায়শ্চিত্ত করে ঘরে তুলতে হবে। শূদ্রের খাবার গ্রহণ করলে পাপ হয়। শূদ্রের বাড়ির পুজোর ভোগ শূদ্রান্ন, তাই কোনো অজুহাতেই এই খাবার গ্রহণ করা যাবে না। কোনো শূদ্র প্রতিমা বা ঠাকুরের মূর্তিকে স্পর্শ করবে না, অন্যথায় মূর্তিরূপ দেবতার অশুদ্ধ হয়ে যাবে, জাতিপাত হবে। আহা রঘুনন্দন বাবা, আপনি কত মহান !!! আপনার সেই অসন্মানের ধ্বজা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি পরম আনুগত্যতায়।
এখানেই শেষ নয়,,
সতীদাহ নামক নোংরা প্রথার প্রচলন করে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। এটা রঘুনন্দন প্রথা বলে পরিচিতি হয়। রঘুনন্দন বেদ মন্ত্র এবং অর্থকে বিকৃত করে হাজার হাজার বিধবা নারীকে জোড় করে তার মৃত্য স্বামীর জলন্ত চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে। অনেক বিধবা স্ত্রী জলন্ত চিতায় মরার ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে। অনেকে অন্য ধর্ম গ্রহন করে শান্তি লাভ করেছে। এখনো সতীপ্রথার কথা স্বরণ করলে মানব শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে, এবং দুঃখের গভীর সাগরে অন্তর ভরে যায়। যুগে যুগে সনাতনী (হিন্দুরা) কতই না পাপ কার্য করেছে, তার হিসেব নেই। পাইকারী ভাবে সমাজ এই কুসংস্কার বহন করেছিল।
অনেকে ধর্ম এবং পুণ্যের লোভে জগন্নাথের রথের চাকায় পিষ্ট হয়ে মরেছে। আবার কেহ কেহ দেব-দেবীর সামনে পাঠা বলীতো দিয়েছেই, এমনকি নরবলী দিতেও মানব রূপী পশুর দল দ্বিধাবোধ করেনি। এই ভাবে বর্ণের গুরু ব্রাহ্মণেরা এই সব অবৈদিক অপকর্মের ইন্ধন দান করেছে। আর সকলে পরকালের স্বর্গের লোভে, পুণ্যের লোভে, ধর্ম রক্ষার ভয়ে এইভাবে দলে দলে অপমৃত্যুতে মরেছে।
.
ব্রিটিশ জাতি এই দেশে আগমনের পর রাজা রামমোহন রায় প্রথম সতীদাহ রঘুনন্দন প্রথার প্রতিবাদ করে এবং সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী যুগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বিধবা বিবাহ প্রচলন চালু করে। সে সময় রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর মতো মহান মনীষীদের আগমন না ঘটলে আজও হয়তো এই পাষন্ড রঘুনন্দনের সতীদাহ প্রথা চালু থাকতো।
.
এখন সতীদাহ প্রথা না থাকলেও এখনো সনাতন (হিন্দু) সমাজ রঘুনন্দন রচিত নব্যস্মৃতির বজ্র বাঁধন পরিত্যাগ করতে পারে নাই। সকলে ওই জালিয়াৎ নব্যশাস্ত্রের মোহে পড়ে ধর্ম নষ্ট হবার ভয়ে সেই অবৈদিক বিধি বিধান পালন করে আসছে।
পরিশেষে বলতে হয়, এতোকিছুর পরও সনাতন(হিন্দু) সমাজ আজও জেগে জেগে ঘুমাই। আমাদের সমাজে শিক্ষিত লোকের অভাব নেই, কিন্তু এতো শিক্ষিত হয়ে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে কোন লাভ নেই যদি প্রকৃত জ্ঞানবোধ উদিত না হয়।

রঘুনন্দন নির্দেশিত পূজা পদ্ধতি অনুযায়ী বর্তমান কালের অধিকাংশ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি দুর্গোৎসব সম্পর্কিত তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলি যথাক্রমে "দুর্গোৎসব তত্ত্ব", "দুর্গাপুজা তত্ত্ব" ও "কৃত্যতত্ত্ব"। গ্রন্থগুলিতে তন্ত্র ও পুরাণের উল্লেখ এবং প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। গ্রন্থগুলিতে তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠানকে পুজার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রঘুনন্দন গ্রন্থগুলিতে দুর্গোৎসবের ছয়টি কল্পের বিধান দিয়েছেন। সেই গুলি হলো যথাক্রমে কৃষ্ণনবম্যাদি কল্প, প্রতিপাদাদি কল্প, ষষ্ঠ্যাদি কল্প, সপ্তম্যদি কল্প, মহাষ্টাম্যাদি কল্প এবং মহানবমী কল্প। এর মধ্যে বঙ্গদেশ, বিহার, ওড়িশা এবং আসাম অঞ্চলে ষষ্ঠ্যাদি কল্প প্রচলিত। রঘুনন্দন এর মতানুসারে ষষ্ঠ্যাদি কল্প ষষ্ঠির দিন সন্ধ্যায় বেল গাছের তলায় দেবীর বোধন সম্পন্ন হয়, তার পর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ওই দিনের পূজা হয় ঘটে, পরের দিন অর্থাৎ সপ্তমী থেকে নবমী অবধি মৃন্ময়ী প্রতিমায় পুজাপাঠ হয়। রঘুনন্দনের মতে দুর্গোৎসবের সকল তিথির পূর্বে "মহা" বিশেষণটি যোগ করা যায় না। যেমন- "মহাষষ্ঠি" ও "মহাসপ্তমী" কথা দুটি মোটেও শাস্ত্র সঙ্গত নয়। রঘুনন্দনের মতানুসারে কেবল অষ্টমী ও নবমী তিথি দুটি এই অভিধা পেতে পারে, অর্থাৎ মহাষ্টমী ও মহানবমী। রঘুনন্দন বলেছেন

অর্থাৎ মহাশক্তি দুর্গার আবির্ভাবে মহাবিপদ কেটে গেলো বলে অষ্টমী তিথির নাম হলো মহাষ্টমী এবং মহাসম্পদ লাভ হলো বলে নবমী তিথি হলো মহানবমী।

তিনি প্রথম "মল" বা "অধিক" মাসের ধারণা দেন। এই বিষয়ে স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ‘মলমাসতত্ত্বম’ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, যদি সূর্য এক রাশিতে অবস্থিত থেকে দু’টি অমাবস্যা তিথিকে অতিক্রম করে তা হলে সেই মাসকেই মলমাস বলে। মলমাসের অর্থ অধিকমাস।

ষোড়শ শতকে নবাব হোসেন শাহের অত্যাচারে বাংলার হিন্দু সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। নবাবের অত্যাচারে হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রঘুনন্দন ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজকে রক্ষা করতে হিন্দু সমাজ সংস্কার মূলক গ্রন্থ "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব"(স্মৃতিগ্রন্থ) প্রণয়ন করেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজের সাথে রঘুনন্দনের লেখ্য স্মৃতিগ্রন্থে মতবাদের সাথে বিরোধ বাঁধায় বাংলার বহু স্থানের পণ্ডিতগণ তার বিরুদ্ধে বিচার বসিয়েছিলেন। কিন্তু, রঘুনন্দন বিচারে জয়ী হলেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে সারা দেশ ব্যাপি ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শিষ্য হওয়ার জন্য লোকেরা আসতে থাকেন। শিষ্যরা তার "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব" (স্মৃতিগ্রন্থ) অধ্যায়ন করে কাজেই লোকমুখে প্রচার বাড়ে এবং খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে এই গ্রন্থ বাংলার হিন্দুর সামাজের মধ্যে আদৃত হয়। হিন্দু সমাজের শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকাণ্ড "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব" অনুসারে সম্পন্ন হতে থাকে।

"অষ্টবিংশতিতত্ত্ব" গ্রন্থ রচনার কয়েক বছর পর তিনি পিতৃপুরুষের পিণ্ডদানের জন্য গয়াধাম যান। কিন্তু, পিণ্ডদানের জন্য পাণ্ডারা অধিক অর্থ দাবি করেন, তিনি গয়াক্ষেত্রে পরিমাপ এক ক্রোশ পরিমাপ করে একেবারে শেষ প্রান্তরে এসে পিণ্ডদান করতে উদ্ধত হলে পাণ্ডারা পণ্ডিতের আসল পরিচয় পেয়ে বিপদে পড়লেন। পাণ্ডারা দেখলেন যদি স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্য মাঠেই পিণ্ডদান করেন তাহলে পাণ্ডা সমাজের ঘোর বদনাম ঘটে যাবে। তাই তারা পণ্ডিতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নম্র ব্যবহারে পণ্ডিতকে সন্তুষ্ট করে মন্দিরেই পিণ্ড দানের ব্যবস্থা করেন। রঘুনন্দন পণ্ডিত সারা জীবন শাস্ত্রলোচনা ও গ্রন্থরচনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে আনুমানিক ৭০ বছর বয়সে প্রাণ ত্যাগ করেন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ