সত্যার্থ প্রকাশ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

07 October, 2020

সত্যার্থ প্রকাশ

ও৩ম্ 

সচ্চিদানন্দেশ্বরায় নমাে নমঃ
* এতব্যতীত তিনি সংস্কার বিধি, পঞ্চ মহাযজ্ঞবিধি, আর্য্যাভিনয়, আর্য্যোদ্দেশ্যরত্নমালা, সংস্কৃতবাক্যপ্রবোধ, ভ্রান্তি নিবারণ, ভ্রমোচ্ছেদন, ব্যবহারভানু, গোকরুণানিধি রচনা করিয়াছিলেন।
অথ সত্যার্থ – প্রকাশস্য ভূমিকা 
স্বামী বিরজানন্দ পাঞ্জাবের অন্তর্গত কর্ত্তারপুরের সন্নিকট কোন পল্লিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার জন্ম বই নদীর তীরবর্ত্তী বলিয়া প্রসিদ্ধ। তিনি সারস্বত ব্রহ্মণ,ভরদ্বাজ গোত্রীয়। তাঁহার পিতা নারায়ণ দত্ত। তাঁহার বয়ঃক্রম পঞ্চম বৎসর,তখন বসন্তরোগে তাঁহার চক্ষুদ্বয় বিনষ্ট হইয়াছিল। তিনি ইহলোকে প্রায় একানব্বই বৎসর বিদ্যমান ছিলেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে,ইহলোকে আর্য গ্রন্থ সকল অধীত বা আলোচিত হইলেই মনুষ্যের যথার্থ মঙ্গল সাধিত হইবে। তিনি শ্রুতি-প্রতিপাদিত ধর্ম্মের পক্ষপাতী ছিলেন। যে ধর্ম্ম শ্রুতি-প্রতিপাদিত নহে,-প্রত্যুত শ্রুতি-প্রতিকূল; বিরজানন্দ তাহাকে সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিতেন না।বিরজানন্দের মত শ্রুতিধর ব্রাহ্মণ পন্ডিত, বেদ প্রাণ সন্ন্যাসী ভারত ভূমিতে আল্পই অভ্যুদিত হইয়াছেন। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বোম্বাই শহরে উপনীত হন, এখানে অবস্থান কালে তিনি "সত্যার্থ প্রকাশ"(১৮৭৫) অমর গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়া রাজা জয়কৃষ্ণ দাসকে তাহা মুদ্রিত করিবার ভার দিয়েছিলেন।
যে সময় আমি এই “সত্যার্থ-প্রকাশ” গ্রন্থ রচনা করি, সেই সময় ও তাহার পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় ভাষণ দিতাম এবং অধ্যয়নও অধ্যাপনাতেও সংস্কৃতই বলিতাম—যদিও আমার মাতৃভাষা গুজরাটী। এই সব কারণে এই (হিন্দী) ভাষায় আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না। এখন এই ভাষা (হিন্দী) বলিবার ও লিখিবার অভ্যাস হইয়াছে। এইজন্য এই গ্রন্থকে ভাষা-ব্যাকরণ অনুসারে সংশােধিত করিয়া দ্বিতীয়বার মুদ্রিত করা হইল। কোথাও কোথাও শব্দ, বাক্য ও রচনার পার্থক্য ঘটিয়াছে; এইরূপ করা উচিতই হইয়াছিল। কারণ পরিবর্তন না করিলে ভাষার প্রণালী সংশােধন করা কঠিন হইত। কিন্তু অর্থের কোনও পরিবর্তন করা হয় নাই, প্রত্যুত বিশেষ লেখা হইয়াছে। প্রথম মুদ্রাঙ্কনের স্থানে স্থানে যে সকল ভুল ছিল, সে সকল অবশ্য বাহির করিয়া সংশােধন করা হইয়াছে।


এই গ্রন্থ ১৪ চতুর্দশ সমুল্লাসে অর্থাৎ চতুদর্শ বিভাগে রচিত হইয়াছে তন্মধ্যে দশ সমুল্লাস লইয়া পূর্বাৰ্দ্ধ এবং চারি সমুল্লাস লইয়া উত্তরার্ধ রচিত। কিন্তু শেষের দুই সমুল্লাস এবং পরবর্তী স্বসিদ্ধান্ত কোনও কারণ বশতঃ প্রথমে মুদ্রিত হইতে পারে নাই। এখন ঐ সকলও মুদ্রিত হইয়াছে।


প্রথম সমুল্লাস – ঈশ্বরের ওঙ্কারাদিনামের ব্যাখ্যা। 


দ্বিতীয় সমুল্লাস – সন্তানদিগের শিক্ষা।


তৃতীয় সমুল্লাস – ব্রহ্মচর্য্য, পঠন পাঠন ব্যবস্থা, সত্য ও অসত্য গ্রন্থসমূহের নাম এবং অধ্যয়ন অধ্যাপনার রীতি। 


চতুর্থ সমুল্লাস – বিবাহ ও গৃহাশ্রমের ব্যবহার। 


পঞ্চম সমুল্লাস – বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের বিধি। 


ষষ্ঠ সমুল্লাস — রাজধর্ম। 


সপ্তম সমুল্লাস – বেদ ও ঈশ্বরের বিষয়।


অষ্টম সমুল্লাস – জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়। 


নবম সমুল্লাস - বিদ্যা, অবিদ্যা, বন্ধন ও মােক্ষের ব্যাখ্যা। 


দশম সমুল্লাস — আচার, অনাচার ও ভক্ষাভক্ষ্য বিষয়। 


একাদশ সমুল্লাস — আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় মত মতান্তরের খণ্ডন-মণ্ডন বিষয়। 


দ্বাদশ সমুল্লাস – চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন মত বিষয়। 

ত্রয়ােদশ সমুল্লাস – খৃষ্টান মত বিষয়। 


চতুর্দশ সমুল্লাস – মুসলমানদের বিষয় এবং,


চতুর্দশ সমুল্লাসের শেষে আৰ্যদিগের সনাতন বেদবিহিতমতের বিশেষ ব্যাখ্যা লিখিত হইয়াছে, আমিও তাহা যথাবৎ স্বীকার করি।


আমার এই গ্রন্থ প্রণয়নের মুখ্য প্রয়ােজন—সত্য-সত্য অর্থের প্রকাশ করা অর্থাৎ যাহা সত্য তাহাকে সত্য এবং যাহা মিথ্যা তাহাকেমিথ্যাই প্রতিপাদন করাকে আমি সত্যার্থের প্রকাশ বলিয়া বুঝিয়াছি। সত্যের স্থানে অসত্য ও অসত্যের স্থানে সত্য প্রকাশ করাকে সত্য বলা যায় না। কিন্তু যে মানুষ পক্ষপাতী, সে নিজের অসত্যকে সত্য এবং অন্য বিরুদ্ধ মতালম্বীর সত্যকেও অসত্য সিদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হয়। এজন্য সে সত্য মতকে প্রাপ্ত হইতে পারে না। অতএব উপদেশ বা লেখার দ্বারা সব মানুষের সম্মুখে সত্যাসত্যের স্বরূপ উপস্থিত করাই বিদ্বান্ আপ্ত-পুরুষদের মুখ্য কর্ম। ইহার পর তাহারা সকলে নিজনিজ হিতাহিত বুঝিয়া নিজেরাই সত্যার্থ গ্রহণ ও মিথ্যার্থ বর্জন করিয়া সর্বদা আনন্দে থাকিবেন। মনুষ্যের আত্মা সত্যাসত্যের জ্ঞাতা। তথাপি সে স্বীয় প্রয়ােজন-সিদ্ধি, হঠকারিতা, দুরাগ্রহ এবং অবিদ্যাদির দোষ বশতঃ সত্য পরিত্যাগ করিয়া অসত্যের প্রতি ঝুঁকিয়া পড়ে। কিন্তু এই গ্রন্থে সেইরূপ কোনও কথা রাখা হয় নাই এবং কাহারও মনে ব্যথা দেওয়া বা কাহারও অনিষ্ট করা আমার অভিপ্রায় নহে। কিন্তু যাহাতে মনুষ্য জাতির উন্নতি ও উপকার হয় এবং মনুষ্যগণ সত্যাসত্য জানিয়া সত্যাগ্রহণ ও অসত্য পরিত্যাগ করে তাহাই অভিপ্রায়। কেননা সত্যোপদেশ ব্যতীত মানবজাতির উন্নতির অপর কোনও উপায় নেই।


এই গ্রন্থে কোনও স্থলে যদি অনবধানতা বশতঃ সংশােধনে এবং মুদ্রণে ভুল ভ্রান্তি থাকিয়া যায়, তাহা আমি জানিলে অথবা কেহ আমাকে জানাইলে যাহা সত্য হইবে, তাহাই করা যাইবে। কিন্তু যদি কেহ তাহা না করিয়া পক্ষপাত বশতঃ শঙ্কা বা খণ্ডন-মণ্ডন করেন তাহা হইলে সে বিষয়ে বিবেচনা করা হইবে না। অবশ্য যদি কেহ মনুষ্য মাত্রের হিতৈষী হইয়া কিছু জানান, তাহা হইলে যাহা সত্য বলিয়া বুঝা যাইবে, তাহারই মত গৃহীত হইবে।


আজকাল প্রত্যেক মতেই বহু বিদ্বান ব্যক্তি আছেন। যদি তাহারা পক্ষপাত পরিত্যাগ করিয়া সৰ্ব্ব তন্ত্র সিদ্ধান্ত অর্থাৎ যে সকল বিষয় সকলের অনুকূলে এবং সকল মতে সত্য, সেইসব গ্রহণ করিয়া এবং পরস্পরের বিরুদ্ধ সমুহ বৰ্জন করিয়া প্রীতি পূৰ্ব্বক আচরণ করেন ও করান তাহা হইলে জগতের পূর্ণ হিত সাধিত হইবে। কেননা, বিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে বিরােধ হইলে অবিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্যে বিরােধের মাত্রা বৃদ্ধি হইয়া বহুবিধ দুঃখের ও সুখের হানি হইয়া থাকে। এই হানি স্বার্থপর মনুষ্যদিগের পক্ষে প্রীতিকর। ইহা মনুষ্যকে দুঃখ সাগরে নিমগ্ন করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে যদি কেহ সার্বজনিক হিত লক্ষ্য করিয়া কাৰ্যে প্রবৃত্ত হন, তখন স্বার্থপর লােকেরা বিরােধ করিতে তৎপর হইয়া নানা প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কিন্তু 'সত্যমেব জয়তে নানৃতং, সত্যেন পন্থা বিততাে দেবয়ানঃ',অর্থাৎ সর্বদা সত্যের বিজয় এবং অসত্যের পরাজয় এবং সত্যের দ্বারাই বিদ্বানদের পথ প্রশস্ত হয়। এই দৃঢ় নিশ্চয়ের অবলম্বন দ্বারা আপ্তপুরুষগণ পরােপকারে উদাসীন হইয়া কখনও সত্যার্থ প্রকাশ করিতে পশ্চাৎপদ হন না। আবার ইহাও দৃঢ় সত্য যে, ‘য়ত্তদগ্ৰে বিষমিব পরিণামেऽমৃততাপমম্। ইহা গীতার বচন ইহার অভিপ্রায় এই যে, বিদ্যা ধর্ম প্রাপ্তির কাৰ্য্য সমূহ বিষবৎ কিন্তু পরে অমৃততুল্য হইয়া থাকে। আমি এইরূপ কথা বিবেচনা করিয়া এই গ্রন্থ রচনা করিয়াছি। শ্রোতা এবং পাঠকবৃন্দও প্রথমে প্রীতি সহকারে অবলােকন করিয়া গ্রন্থস্থ তাৎপর্য অবগত হইয়া যাহা অভীষ্ট তাহাই করিবেন।


ইহাতে এই অভিপ্রায় রাখা হইয়াছে বলিয়া মতমতান্তরের সমূহের মধ্যে যে সব সত্য কথা আছে, সেগুলি সকলের পক্ষে অবিরুদ্ধ হওয়া স্বীকার করা হইয়াছে এবং বিভিন্ন মতের মধ্যে যে সব মিথ্যা কথা আছে তাহার খণ্ডন করা হইয়াছে। মতমতান্তরের গুপ্ত বা প্রকাশ্য গহিত বাক্য সমূহ প্রকাশ করিয়া বিদ্বান ও অবিদ্বান জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করাও ইহার অভিপ্রায়, যাহাতে পরস্পর পরস্পরের মত আলােচনা পূৰ্ব্বক সকলে প্রীতির সহিত একই সত্য মত গ্রহণ করিতে পারে।

যদিও আমি আৰ্য্যাবৰ্ত্ত দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি এবং বাস করিতেছি, তথাপি, যেরূপ এতদ্দেশীয় বিভিন্ন মতের মিথ্যা বিষয়গুলির প্রতি পক্ষপাত না করিয়া উহা যথার্থরূপে প্রকাশ করিতেছি সেইরূপ ভিন্ন দেশীয় এবং ভিন্ন মতালম্বীদের সহিতও আচরণ করিতেছি। মনুষ্যোন্নতির জন্য স্বদেশ বাসীদের সহিত যেরূপ আচরণ করি বিদেশীদের সহিতও সেইরূপ আচরণ করিয়া থাকি। সকল সজ্জনেরই এইরূপ করা উচিত। আমি কোন মতবিশেষের প্রতি পক্ষপাতী হইলে আধুনিক মতবাদীরা যেমন স্বমতের স্তুতি, মণ্ডন ও প্রচার করিয়া এবং পরমতের নিন্দা, হানি ও প্রতিরােধ করিতে তৎপর হয়, আমিও সেইরূপ করিতাম কিন্তু এই কাৰ্য মনুষ্যত্বের বহির্ভূত। কারণ যেরূপ পশু বলবান হইয়া বলহীন প্রাণীদের দুঃখ দেয় এবং মারিয়াও ফেলে, মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হইয়া সেইরূপ কাৰ্য্যকরিলে তাহারা মনুষ্য স্বভাব বিশিষ্টনহে, তাহারা পশুতুল্য। যাহারা বলবান হইয়া বলহীনকে রক্ষা করে, তাহাদিগকেই মনুষ্য বলে। যাহারা স্বার্থের বশবর্তী হইয়া কেবল পরের অনিষ্ট সাধন করিতে তৎপর হন তাহাদিগকে পশুরও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া জানিবে। 


একাদশ সমুল্লাস পর্যন্ত আৰ্য্যাবর্তীদের বিষয়ে বিশেষ করিয়া লিখিত হইয়াছে। এই সকল সমুল্লাসের মধ্যে যে সত্য মত প্রকাশ করা হইয়াছে, উহা বেদোক্ত বলিয়া আমার পক্ষে সর্বৰ্থা মান্য এবং নবীন এবং পুরাণ ও তন্ত্রাদি গ্রন্থােক্ত যে সকল বাক্যের খণ্ডন করিয়াছি ঐ সকল পরিত্যাজ্য।


দ্বাদশ সমুল্লাসে যে চার্বাকমত প্রদর্শিত হইয়াছে, উহা এখন ক্ষীণ ও লুপ্তপ্রায় এবং অনীশ্বরবাদ প্রভৃতি বিষয়ের সহিত চার্বাকের ও বৌদ্ধ, জৈন মতের নিগূঢ় সম্পর্ক রহিয়াছে। এই চার্বাক সর্বাপেক্ষা বড় নাস্তিক। তাঁহার প্রচেষ্টার প্রতিরােধ অবশ্য কর্তব্য। কারণ মিথ্যার প্রতিরােধ না হইলে জগতে বহু অনর্থ ঘটে। চার্বাকের এবং বৌদ্ধ ও জৈনদের যে মত তাহাও দ্বাদশ সমুল্লাসে সংক্ষেপে লিখিত হইয়াছে। বৌদ্ধ এবং জৈন মতেরও চার্বাক এবং বৌদ্ধমতের সহিত বহুলাংশে সাদৃশ্যও আছে, কোন কোন বিষয়ে পার্থক্যও আছে। এজন্য জৈনদিগকে একটি ভিন্ন শাখা বলিয়া গণ্য করা হয়। দ্বাদশ সমুল্লাসে উক্ত পার্থক্য সম্বন্ধে লিখিত হইয়াছে। সে স্থলে উহা যথােচিত ভাবে জানিয়া লইবেন। যেখানে পার্থক্য তাহা দ্বাদশ সমুল্লাসে দেখান হইয়াছে। বৌদ্ধ ও জৈন মতের বিষয়ও লিখিত হইয়াছে এ সম্বন্ধে বৌদ্ধদের ‘দীপবংশ’ প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থসমূহে, বৌদ্ধমত সংগ্রহ ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। সেই সমস্ত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহা ছাড়া জৈনদের নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রন্থ আছে। তন্মধ্যে – 


চারিটি মূল সূত্র, যথাঃ – 

(১) আবশ্যকসূত্র, (২) বিশেষ আবশ্যক সূত্র, (৩) দশবৈকালিক সূত্র, এবং (৪) পাক্ষিক সূত্র। 


একাদশ অঙ্গ, যথাঃ—

(১) আচার সূত্র,(২) সুগডাঙ্গসূত্র, (৩) থানাঙ্গ সূত্র, (৪) সমবায় সূত্র, (৫) ভগবতী সূত্র, (৬) জ্ঞাতাধর্মকথা সূত্র, ((৭) উপাসক-দশা সূত্র (৮) অন্তগড়দশা সূত্র, (৯) অনুত্তরােব বাইসূত্র, (১০) বিপাক সূত্র, (১১) প্রশ্ন ব্যাকরণ সূত্র।


দ্বাদশ উপাঙ্গ, যথাঃ–

(১) উপবাঈ সূত্র, (২) রাউয়পসেনী সূত্র, (৩) জীবাভীগম সূত্র, (৪) পন্নগণা সূত্র, (৫) জম্বুদ্বীপপন্নতী সূত্র, (৬) চন্দপন্নতী সূত্র, (৭) সূরপন্নতী সূত্র, (৮) নিরিয়াবলী সূত্র, (৯) কপ্পিয়া সূত্র, (১০) কপবড়ীসয়া সূত্র, (১১) পুঞ্জিয়া সূত্র, (১২) পুপচুলিয়া সূত্র।


পঞ্চকল্প সূত্র, যথাঃ – 

(১) উত্তরাধ্যয়ন সূত্র, (২) নিশীথ সূত্র, (৩)কল্প সূত্র, (৪) ব্যবহার সূত্র এবং 


জীত-কল্পসূত্র ঘটছেদ, যথাঃ —

(১)মহানিশীথ বৃহদ্বাচনা সূত্র, (২) মহানিশীথ লঘুবাচনা সূত্র, (৩)মধ্যম বাচনা সূত্র (৪) পিণ্ড-নিরুক্তি সূত্র, (৫) ঔঘনিরুক্তি সূত্র এবং (৬) পযূষণা সূত্র।


দশপয়ান্ন সূত্রঃ – 

(১) চতুস্রণ সূত্র, (২) পঞ্চখাণ সূত্র, (৩) তদুল বৈয়ালিক সূত্র, (৪) ভক্তিপরিজ্ঞান সূত্র ও (৫) মহাপ্রত্যাখ্যান সূত্র, (৬) চন্দ্রাবিজয় সূত্র, (৭) গণীবিজয় সূত্র, (৮) দেবেন্দ্রস্তবন সূত্র (৯) মরণ সমাধি সূত্র, ও (১০) সংসার সূত্র।

এতদ্ব্যতীত নন্দীসূত্র ও অনুযােগদ্বার সূত্রও প্রামাণিক বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে। 


পঞ্চাঙ্গ, যথাঃ – 

(১) পূর্বোক্ত সমস্ত গ্রন্থের টীকা, (২) নিরুক্তি, (৩) চরণী এবং (৪) ভাষ্য এই চারি অবয়ব এবং সমস্ত মূলভাগ মিলিয়া পঞ্চাঙ্গ কথিত হয়।


টুন্টিয়াগণ এই সকল গ্রন্থের মধ্যে অবয়বসমূহকে স্বীকার করেন না। এই সকল গ্রন্থ ব্যতীত বহু গ্রন্থ জৈনগণ মানিয়া থাকেন। দ্বাদশ সমুল্লাসে ইহাদের মত সম্বন্ধে বিশেষ আলােচনা দ্রষ্টব্য।


জৈন-গ্রন্থসমূহের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পুনরুক্ত দোষ এবংইহাদের এটাও স্বভাব যে, নিজস্ব গ্রন্থ কোন ভিন্ন মতালম্বীদের হাতে থাকিলে বা মুদ্রিত হইলে কেহ কেহ উহাকে অপ্রমাণ বলিয়া থাকেন।তাহাদের একথা মিথ্যা। কারণ যে গ্রন্থ কোন একজন জৈন মানেন এবং কোন একজন জৈন মানেন না, উহা জৈনমতের বহির্ভূত হইতে পারেনা। অবশ্য যে গ্রন্থ কোনও জৈন মানেন না, এবং কোন জৈন কখনও মানেন নাই; উহা অগ্রাহ্য হইতে পারে। কিন্তু এমন কোনও জৈন গ্রন্থনাই যাহা কোন জৈনইমানেন না। সুতরাং যিনি যে গ্রন্থ মানেন, সে গ্রন্থবিষয়ক খণ্ডন-মণ্ডনও তাহারই জন্য বুঝিতে হইবে। কিন্তু এমন অনেক জৈন আছেন যে, তাঁহারা ঐ গ্রন্থ মানা এবং জানা সত্ত্বেও সভায় অথবা তর্ক-বিতর্ক স্থলে মত পরিবর্তন করেন। এই কারণ জৈনগণ নিজেদের গ্রন্থগুলি লুকাইয়া রাখেন এবং কোন ভিন্ন মতালম্বীকে দেন না, শুনান না এবং পড়ান না। কেননা, উক্ত গ্রন্থ সমূহ এইরূপ অসম্ভব কথায় পরিপূর্ণ যে, জৈনদিগের কেহই ঐ সকলের উত্তর দিতে পারেন না। মিথ্যা কথাগুলির বর্জন করাই ইহার উত্তর।


ত্রয়ােদশ সমুল্লাসে খৃষ্টানদের মতলিখিত হইয়াছে। খৃষ্টানগণ বাইবেলকে তাহাদের ধর্মপুস্তক বলিয়া মানেন। ত্রয়ােদশ সমুল্লাসে তাহাদের বিশেষ সমাচার দ্রষ্টব্য। চতুদর্শসমুল্লাসে মুসলমানদের মত সম্বন্ধে লিখিত হইয়াছে। মুসলমানগণ কোরাণকেতঁহাদের মতের মূল পুস্তক বলিয়া মানেন। ইহাদেরও বিশেষ আচরণ সম্বন্ধে চর্তুদশ সমুল্লাসে দ্রষ্টব্য। ইহার পর বৈদিক ধর্ম সম্বন্ধে লিখিত হইয়াছে।


যিনি গ্রন্থকারের তাৎপর্যের বিরুদ্ধ মনােভাব লইয়া ইহাকে দেখিবেন, তিনি ইহার কিছুমাত্র তাৎপর্য জানিতে পারিবেন না। কারণ বাক্যার্থ বােধের চারটি কারণ থাকে-আকাঙ্ক্ষা, যােগ্যতা, আসত্তি এবং তাৎপর্য। যিনি এই চারটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া পাঠ করেন, তিনি গ্রন্থের অভিপ্রায় যথােচিত অবগত হন। 


আকাঙ্ক্ষাঃ" কোন বিষয় সম্বন্ধে বক্তা ও বাক্যস্থ পদ সমূহের মধ্যে পরস্পর আকাঙ্ক্ষা থাকে।


যােগ্যতাঃ" যাহা দ্বারা যাহা হইতে পারে, তাহাকে তাহার যােগ্যতা বলে, যথা জল দ্বারা সিঞ্চন। 


আসত্তিঃ” যে পদের সহিত যাহার সম্বন্ধ, তাহারই সমীপে সেই পদ বলা অথবা লেখার নাম আসক্তি। 


তাৎপর্যঃ” বক্তা যে অর্থে যে শব্দ উচ্চারণ করেন অথবা লেখেন সেই অর্থের সহিত সেই বচন অথবা লেখাকে যুক্ত করার নাম তাৎপর্য।


এরূপ বহু হঠকারী ও দুরাগ্রহকারী ব্যক্তি আছেন, যাঁহারা বক্তার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধ কল্পনা করিয়া থাকেন। বিশেষত মতালম্বীরাই এইরূপ করিয়া থাকেন। কারণ মতের প্রতি আগ্রহ বশত তাঁহাদের বুদ্ধি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া যায়। অতএব যেমন আমি পুরাণ, জৈনগ্রন্থ, বাইবেল এবং কোরাণকে প্রথমে কুদৃষ্টিতে না দেখিয়া ঐ সকলের মধ্য হইতে গুণ সমূহের গ্রহণ, দোষ সমূহের বর্জন করিয়া এবং যাহাতে মানব জাতির উন্নতি হয় সে জন্য চেষ্টা করিতেছি, সকলেরই সেইরূপ করা কর্তব্য।


এই সকল মতের দোষ অল্পমাত্রই প্রকাশ করিয়াছি, যাহাতে এইসকল দেখিয়া মনুষ্যজাতির সত্য ও অসত্য মতের নির্ণয় এবং সত্য গ্রহণ ও অসত্য বৰ্জন করিতে ও করাইতে সমর্থ হয়। কারণ মনুষ্যদিগকে বিভ্রান্ত করিয়া একই মনুষ্য জাতিতে বিরুদ্ধ বুদ্ধি উৎপন্ন করা, একে অপরের সহিত শত্রুভাব উৎপন্ন করা এবং কলহ-বিবাদ বাধাইয়া দেওয়া বিদ্বান ব্যক্তিদের স্বভাববিরুদ্ধ। অবিদ্বান ব্যক্তি এইগ্রন্থ পাঠকরিয়া যদিও অন্যরূপমনে করে, কিন্তু যাহারা বুদ্ধিমান তাহারা ইহার অভিপ্রায় যথােচিত উপলব্ধি করিবেন। এইজন্য আমি আমার পরিশ্রমকে সফল মনে করিতেছি। এবং আমার অভিপ্রায় সজ্জনদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি। তাঁহারা ইহা দেখিয়া ও অপরকে দেখাইয়া আমার পরিশ্রম সফল করিবেন। এইরূপে পক্ষপাত না করিয়া সত্যের অর্থ করা আমার এবং সকল সদাশয় ব্যক্তির মুখ্য কর্ম।


সৰ্বাত্মা, সৰ্বান্তর্যামী, সচ্চিদানন্দ পরমাত্মা নিজ কৃপায় এই উদ্দেশ্যকে প্রসারিত ও চিরস্থায়ী করুন।


অলমতিবিস্তরেণ বুদ্ধিমদ্বর শিরােমণিষু। 

ইতি ভূমিকা 

স্থান : মহারাণজীর উদয়পুর, 

ভাদ্রপদ শুক্ল পক্ষ সংবৎ ১৯৩৯

(স্বামী) দয়ানন্দ সরস্বতী

৷৷ স্বমন্তব্যামন্তব্য প্রকাশঃ ৷৷ 

যে সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত অর্থাৎ সার্বভৌমিক ও সার্বজনিক ধর্মসকলে সর্বদা মান্য করিয়া আসিতেছে, এখনও মান্য করে এবং ভবিষ্যতেও মান্য করিবে; তথা যে ধর্মের বিরােধী কেহই হইতে পারে , তাহাকে সনাতন ও নিত্যধর্ম বলে। 

অজ্ঞ লােকেরা অথবা ভিন্নমতবাদী কর্তৃক বিভ্রান্ত লােকেরা যে বিরুদ্ধ জ্ঞান এবং ধারণা পােষণ করে, তাহা সুধীজনের পক্ষে গ্রহণীয় নহে; কিন্তু আপ্ত অর্থাৎ সত্যবিশ্বাসী, সত্যবাদী, সত্যকর্মা, পরিহিতব্রত ও পক্ষপাতরহিত জ্ঞানীগণ যাহা বিশ্বাস করেন, তাহাই সকলের পক্ষে বিশ্বাসের উপযুক্ত; তাঁহারা যাহা বিশ্বাস করেন না; তাহা বিশ্বাস ও প্রমাণযােগ্য নহে। 

ঈশ্বর এবং যাবতীয় পদার্থ সম্বন্ধে বেদাদি সত্য শাস্ত্রসমূহে যাহা লিখিত আছে এবং ব্রহ্মা হইতে জৈমিনি পৰ্য্যন্ত মুনিঋষিগণ যাহা বিশ্বাস করিতেন আমিও তাহাইবিশ্বাস করি এবং তাহাই সজ্জনদিগের নিকট প্রকাশ করিতেছি।

আমি জানি যে যাহা তিন কালে সকলের পক্ষে সমভাবে বিশ্বাসের উপযুক্ত, তাহাই আমার মত। কোন নবীন কল্পনা বা মত প্রচলিত করিব, এমন উদ্দেশ্যের লেশমাত্রও আমার নাই; কিন্তু স্বয়ং সত্য বিশ্বাস করা এবং অপরকেও সত্য বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্ত করানই আমার উদ্দেশ্য।

আমি যদি পক্ষপাত করিতাম, তাহা হইলে আৰ্য্যাবর্ত্তের প্রচলিত মত সমূহের মধ্যে কোন। একটির প্রতি বিশেষ আগ্রহশীল হইতাম। কিন্তু আমি আৰ্য্যাবর্ত্ত কিংবা অপর কোন দেশের ধর্ম-বিরুদ্ধ আচার-ব্যবহার গ্রহণ এবং সঙ্গত আচার-ব্যবহার বর্জন, কিংবা বর্জনের ইচ্ছাও করি না; কারণ তাহা করা মানবতার বহির্ভূত।

যিনি মননশীল হইয়া সকলের সুখ দুঃখ ও লাভালাভ নিজের ন্যায় মনে করেন, এবং যিনি শক্তিশালী অন্যায়কারীকে ভয় করেন না, কিন্তু দুর্বল ধর্মাত্মা হইতেও ভীত হন, তাহাকেই মনুষ্য বলে। কেবল তাহাই নহে, কিন্তু ধর্মাত্মা ব্যক্তি যতই অসহায় দুর্বল ও গুণহীন হউন না কেন, তিনি তাহার শক্তি প্রয়ােগ করিয়া তাঁহাদের রক্ষা ও উন্নতি বিধানে যত্নবান থাকেন এবং তাহাদের প্রিয় আচরণ করেন। অধার্মিক ব্যক্তিরা সাম্রাজ্যাধিকারী, সহায়সম্পন্ন প্রবল-পরাক্রম এবং গুণবান্ হইলেও তিনি সর্বদা তাহাদের অধঃপতন ও বিনাশ সাধনে সচেষ্ট থাকেন এবং তাহাদের প্রতি অপ্রিয় আচরণ করেন। তাৎপৰ্য্য এই যে, যতদূর সম্ভব, অন্যায়কারীদিগকে সর্বতােভাবে হীনবল এবং ন্যায়কারীদিগকে শক্তিশালী করিবার জন্য দারুণ দুঃখভােগ, এমন কি প্রাণ বিসর্জন করিতে হইলেও এই মানবতারূপ ধর্মর্সাধনে পশ্চাৎপদ না হওয়াই মনুষ্যের কর্তব্য।

এই বিষয়ে শ্রীমন্মহারাজ ভর্তৃহরি এবং অন্যান্য জ্ঞানীদিগের রচিত কয়েকটি শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

নিন্দন্তু নীতিপুণা, যদি বা স্তুবন্তু, 
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতূ গচ্ছতু বা য়থেষ্টম্৷৷
অদ্যৈব বা মরণমস্তু যুগান্তরে বা 
ন্যায়াৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ ॥১॥ (ভর্তৃহরিঃ) 

ন জাতু কামান্ন ভয়ান্ন লােভাদ্, ধর্মং ত্যজেজ্জীবিতস্যাপি হেতােঃ। 
ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে, 
জীবো নিত্যো হেতুরস্য ত্বনিত্যঃ ॥২॥ (মহাভারতে) 

এক এব সুহৃদ্ধর্মো নিধনেপ্যনুয়াতি য়ঃ।
শরীরেণ সমং নাশং সর্বৰ্মন্যদ্ধি গচ্ছতি ॥৩॥ (মনুঃ) 

সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততাে দেবয়ানঃ। 
য়েনাSSক্রমন্তৃ-্যষয়ো হ্যাপ্তকামা য়ত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্ ॥৪॥ (মুন্ডকো) 

নহি সত্যাৎপরাে ধর্মো নানৃতং পাতকং পরম্।
নহি সত্যাৎ পরং জ্ঞানং তস্মাৎ সত্যং সমাচরেৎ।। ৫।।
(উপনিষদ) 

এ সকল মনস্বী রচিত শ্লোকের মর্মানুসারে সকলেরই দৃঢ়নিশ্চয় থাকা কর্তব্য। যে যে বিষয়ে আমার যেরূপ বিশ্বাস এস্থলে তাহা সংক্ষেপে বর্ণনা করা যাইতেছে। এই গ্রন্থের পৃথক পৃথক প্রকরণে এ সকল বিষয়ের বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছে।

১। প্রথমতঃ “ঈশ্বর” —যাঁহার ব্রহ্ম এবং পরমাত্মা প্রভৃতি নাম, যিনি সচ্চিদানন্দাদি লক্ষণযুক্ত, যাঁহার গুণ, কর্ম ও স্বভাব পবিত্র, যিনি সর্বজ্ঞ, নিরাকার, সর্বব্যাপক, জন্মরহিত, অনন্ত, সর্বশক্তিমান, দয়ালু, ন্যায়কারী, সকল সৃষ্টির কর্তা, ধর্ত, হর্ত্তা এবং সত্য ও ন্যায়ানুসারে জীবদিগের কর্মফলদাতা ইত্যাদি লক্ষণযুক্ত, তাহাকেই পরমেশ্বর বলিয়া স্বীকার করি।

২। চারি “বেদ” কে – (বিদ্যা ধর্মযুক্ত, ঈশ্বর প্রণীত, সংহিতা মন্ত্রভাগকে) অভ্রান্ত ও স্বতঃ প্রমাণ বলিয়া বিশ্বাস করি। বেদ স্বতঃ প্রমাণ, বেদের প্রমাণ অন্য কোন গ্রন্থ সাপেক্ষ নহে। যেমন সূৰ্য্য ও প্রদীপ স্বভাবতঃ স্ব স্ব স্বরূপ প্রকাশ করে এবং ভূমণ্ডল প্রভৃতিরও প্রকাশক, চারি বেদও সেইরূপ। চারিটি বেদের ব্রাহ্মণ – অঙ্গ ছয়টি, উপাঙ্গ ছয়টি, উপবেদ চারিটি এবং (এগার শত সাতাশটি) শাখা আছে। এ সকল গ্রন্থ ব্রহ্মাদি মহর্ষি রচিত বেদব্যাখা স্বরূপ পরতঃ প্রমাণ। এগুলি বেদানুকূল হইলেই প্রমাণ; তন্মধ্যে বেদবিরুদ্ধ বচনগুলিকে অপ্রমাণ মনে করি।।

৩। “ধর্মাধর্ম” – বেদের অবিরুদ্ধ পক্ষপাত রচিত, ন্যায়াচরণ, সত্যভাষণ এবং ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন ইত্যাদি “ধর্ম”। বেদবিরুদ্ধ পক্ষপাত অন্যায়াচরণ, মিথ্যাভাষণ এবংঈশ্বরের আজ্ঞালঙ্ঘন ইত্যাদি “অধর্ম”।

৪।“জীব” – যাহা ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ এবং জ্ঞানাদি গুণাযুক্ত, অল্পজ্ঞ এবং নিত্য তাহাকে “জীব”মানি!

৫।“ঈশ্বরের সহিত জীবের সম্বন্ধ” – ঈশ্বর ও জীবের স্বরূপ বৈধৰ্ম বশতঃ ভিন্ন; কিন্তু ব্যাপ্য, ব্যাপকত্ব ও সাধর্ম্য বশতঃ অভিন্ন। অর্থাৎ যেমন মূর্ত্ত দ্রব্য আকাশ হইতে কখনও পৃথক ছিল না, পৃথক নহে এবং পৃথক থাকিবে না, সেইরূপ পরমেশ্বরের সহিত জীবের ব্যাপ্য-ব্যাপক, উপাস্য-উপাসক এবং পিতা-পুত্র ইত্যাদি সম্বন্ধ স্বীকার করি।

৬। “ঈশ্বর, জীব এবং প্রকৃতি” —প্রথম ঈশ্বর, দ্বিতীয় জীবাত্মা ও তৃতীয় প্রকৃতি অর্থাৎ জগতের কারণ – এই তিন পদার্থ “অনাদি”, ইহাকে নিত্যও বলে। নিত্য পদার্থের গুণকর্মস্বভাবও নিত্য।

৭।“প্রবাহরূপে অনাদি” –সংযােজক দ্রব্য, গুণ ও কর্ম বিয়ােগের পর থাকে না; কিন্তু যে সামর্থ্য প্রথম সংযােগের কারণ, তাহা ঐ সকলের মধ্যে অনাদি। তদ্দ্বারা পুনরায় সংযােগ ও বিয়ােগ ঘটিয়া থাকে। এই তিনটিকে প্রবাহরূপে “অনাদি” বলিয়া মানি।

৮।“সৃষ্টি” –পৃথক পৃথক দ্রব্য সমূহের জ্ঞান ও যুক্তি পূর্বক মিলিত হইয়া নানারূপে গঠিত হওয়াকে “সৃষ্টি”বলে।

৯। “সৃষ্টির প্রয়ােজন” – সৃষ্টি দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিনিমিত্ত গুণকর্মস্বভাবের সফলতা হয়; যেমন, – যদি কেহ কাহাকেও জিজ্ঞাসা করে, “নেত্রের প্রয়ােজন কী? সে উত্তরে বলে দর্শন। সেইরূপ সৃষ্টিদ্বারাই পরমেশ্বরের সৃষ্টিশক্তির সফলতা এবং জীবের সমুচিত কর্মফলভােগ ইত্যাদি সম্ভব। 

১০। “সৃষ্টির সকর্ত্তৃকা” – সৃষ্টি রচনা দেখিলেই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের প্রমাণ পাওয়া যায়। | যেহেতু পদার্থসমূহের মধ্যে এমন সামর্থ্য নাই যে, সে নিজে নিজে যথাযােগ্যভাবে মিলিত হইয়া বীজাদি স্বরূপে নির্মিত হইতে পারে, অতএব, সৃষ্টিকর্তা অবশ্য আছেন। 

১১।“বন্ধ" সনিমিত্তক – অবিদ্যাই বন্ধনের হেতু। ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্যের উপসনারূপ পাপকর্ম এবং অজ্ঞান প্রভৃতির ফল দুঃখ, এই দুঃখের নাম বন্ধন, কারণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভােগ করিতে হয়।

১২।“মুক্তি”—সর্ববিধ দুঃখ ও বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বব্যাপক ঈশ্বর এবং তাঁহার সৃষ্টির মধ্যে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করাকে 'মুক্তি’ বলে। নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মুক্তির আনন্দ ভােগ করিবার পর পুনরায় জীবকে সংসারে আগমন করিতে হয়। 

১৩। “মুক্তির সাধন" – ঈশ্বরােপাসনা অর্থাৎ যােগ্যাভ্যাস, ধর্মানুষ্ঠান, ব্রহ্মচর্য দ্বারা বিদ্যোপার্জন, আপ্তবিদ্বানদের সংসর্গ, সত্যবিদ্যা, সুবিচার এবং পুরুষকার ইত্যাদি 'মুক্তির সাধন'।

১৪। “অর্থ” – যাহা ধর্ম দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা অর্থ’, যাহা অধর্ম দ্বারা সিদ্ধ হয় তাহা অনর্থ। 

১৫। “কাম” – যাহা ধর্ম ও অর্থ দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাকে “কাম” বলে। 

১৬।“বর্ণাশ্রম” – গুণ ও কর্মের যােগ্যতানুসারে বর্ণাশ্রম’ব্যবস্থা স্বীকার করি।

১৭। “রাজা” – যিনি শুভ গুণ-কর্ম-স্বভাব দ্বারা প্রকাশমান্; যিনি পক্ষপাত রহিত হইয়া ন্যায় ও ধর্মানুসারে প্রজাদের সহিত পিতৃবৎ আচরণ করেন এবং তাহাদিগকে পুত্ৰতুল্য জানিয়া তাহাদের উন্নতি ও সুখবৃদ্ধিকল্পে সর্বদা যত্নবান্ থাকেন, তাঁহাকে রাজা’বলে।

১৮।“প্রজা” —যাঁহার গুণ-কর্ম-স্বভাব পবিত্র, যিনি পক্ষপাত রহিত হইয়া ন্যায় ও ধর্মাচরণ সহকারে রাজা ও সর্বসাধারণের উন্নতি কামনা করেন এবং যিনি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিয়া তাঁহার সহিত পুত্রবৎ আচরণ করেন, তাহাকে ‘প্রজা’বলে।

১৯। “ন্যায়কারী” – যিনি সর্বদা বিচার পূর্বক অসত্য বর্জন ও সত্যগ্রহণ করেন, যিনি অন্যায়কারীদিগকে বিতাড়িত করিয়া ন্যায়কারীদের উন্নতি বিধান এবং আত্মবৎ সকলের সুখ কামনা করেন তিনিই 'ন্যায়কারী'। আমি তাহার আচরণ সঙ্গত মনে করি।

২০। “দেব” – বিদ্বানদিগকে “দেব”, মূর্খদিগকে “অসুর”, পাপীদিগকে “রাক্ষস” এবং অনাচারীদিগকে “পিশাচ” মনে করি।

২১।“দেবপূজা” – পূর্বোক্ত বিদ্বান, মাতা, পিতা, আচাৰ্য্য, অতিথি, ন্যায়বান্ রাজা, ধর্মাত্মা, পতিব্রতা স্ত্রী এবং স্ত্রীব্রত পতি ইহাদের সম্মানকে 'দেবপূজা’এবং তাহার বিপরীত আচরণকে ‘অদেব’ পূজা বলি। ইহারাই পূজার্হ। পাষাণ নির্মিত জড়মূৰ্ত্তিকে সর্বথা অপূজ্য মনে করি।

২২। “শিক্ষা" – যদ্বারা বিদ্যা, সভ্যতা, ধর্মপরায়ণতা এবং জিতেন্দ্রিয়তা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায় ও অজ্ঞতা প্রভৃতি দূরীভূত হয়, তাহাকে ‘শিক্ষা’বলে।।

২৩।“পুরাণ” – ভাগবতাদি গ্রন্থ পুরাণনহে; কিন্তু ব্রহ্মাদিরচিত “ঐতরেয়” প্রভৃতি ব্রাহ্মণগ্রন্থ সমূহেরই নাম 'পুরাণ’, 'ইতিহাস, 'কল্প’, ‘গাথা’ এবং 'নারাশংসী' বলিয়া মনে করি।

২৪। "তীর্থ"– সত্যভাষণ, বিদ্যাচর্চা, সৎসঙ্গ, যমাদি যােগাভ্যাস, পুরুষকার এবং বিদ্যাদান প্রভৃতি যে সকল শুভকর্ম দ্বারা দুঃখসাগর হইতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, সে সকলকে ‘তীর্থ’ বলি, অন্য জলস্থল প্রভৃতি তীর্থ নহে।

২৫। “প্রারন্ধ ও পুরুষকার” – যেহেতু পুরুষকার হইতে সঞ্চিত প্রারদ্ধ উৎপন্ন হয় এবং পুরুষকার সুপরিচালিত হইলে সমস্তই শুদ্ধ, এবং বিকৃত হইলে সমস্তই বিকৃত হয়, অতএব প্রারন্ধ অপেক্ষা পুরুষকার শ্রেষ্ঠ।

২৬। "মনুষ্যের কর্তব্য” – সুখ-দুঃখ এবং লাভালাভ বিষয়ে সকলের সহিত আত্মবৎ ব্যবহার করা শ্রেয়ঃ; বিপরীত আচরণ করা নিন্দনীয়।

২৭। “সংস্কার” – যদ্দ্বারা শরীর, মন এবং আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, তাহার নাম ‘সংস্কার। গর্ভাধান হইতে অন্ত্যোষ্টি পৰ্য্যন্ত ষােড়শবিধ সংস্কারকে কর্তব্য বলিয়া মনে করি। দাহান্তে মৃতের পক্ষে করণীয় কিছুই নাই।

২৮। “যজ্ঞ” – বিদ্বানদের প্রতি সমুচিত সম্মান প্রদর্শন, শিল্পকাৰ্যে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার উপযােগ, বিদ্যাদান, শুভগুণবৃদ্ধি এবং অগ্নিহােত্রানুষ্ঠানকে 'যজ্ঞ’ বলে। অগ্নিহােত্র দ্বারা বায়ু, বৃষ্টি, জল এবং ওষধি পবিত্র হয়, তাহাতে জীবগণ সুখানুভব করে। ইহাকে উত্তম মনে করি।

২৯। শ্রেষ্ঠ মনুষ্যদিগকে “আর্য্য” এবং দুষ্টপ্রকৃতির মনুষ্যদিগকে “দস্যু”বলে। আমারও এই মত স্বীকার্য।

৩০। “আৰ্য্যাবর্ত” — এ দেশের নাম “আৰ্য্যাবর্ত”,কারণ আদিসৃষ্টিহইতে আর্য্যগণ এ দেশে বাস করিতেছেন। আর্যাবর্তের উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল, পশ্চিমে অটক নদী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী। এই চতুঃসীমার মধ্যবর্তী ভূমিখণ্ডের নাম “আৰ্য্যাবর্ত”। যাঁহারা এ দেশে চিরকাল বাস করিতেছেন, তাহাদের নাম “আর্য্য”। 

৩১। “আচাৰ্য” – যিনি সাঙ্গোপাঙ্গো বেদের অধ্যাপক, যিনি সত্যাচার গ্রহণ এবং মিথ্যাচার বর্জন করান, তাঁহাকে 'আচাৰ্য’বলে।

৩২। “শিষ্য” – যিনি সত্যবিদ্যা ও সত্যশিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত; যিনি ধর্মাত্মা ও বিদ্যাকাঙ্ক্ষী এবং যিনি আচার্যের প্রিয় আচরণ করেন তাহাকে ‘শিষ্য’ বলে।।

৩৩।“গুরু” –মাতা এবং পিতা ‘গুরু’; তদ্ব্যতীত যাঁহার উপদেশে সত্যগ্রহণ এবং অসত্য বর্জন করা হয় তাহাকেও ‘গুরু’ বলে।

৩৪। “পুরােহিত” —যিনি যজমানের হিতকারী এবং সত্যোপদেষ্টা, তাহার নাম ‘পুরােহিত'।

৩৫। “উপাধ্যায়” – যিনি বেদের অংশ বিশেষ কিংবা বেদাঙ্গ সমুহের অধ্যাপক, তাহার নাম। উপাধ্যায়।

৩৬। “শিষ্টাচার”– ধর্মাচরণ ও ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদ্যালাভ করিয়া প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের সাহায্যে সত্যাসত্য নির্ণয় করাকে “শিষ্টাচার” বলে। যিনি তাহা করেন, তিনি শিষ্ট।

৩৭। “প্রমাণ” – প্রত্যক্ষাদি অষ্টবিধ ‘প্রমাণ’ স্বীকার করি।

৩৮ । “আপ্ত” —যিনি যথার্থ বক্তা ও ধর্মাত্মা এবং যিনি সকলের সুখের জন্য সচেষ্ট তাঁহাকেই ‘আপ্ত’ বলি।

৩৯। “পরীক্ষা” – পরীক্ষা পাঁচ! প্রথমতঃ —ঈশ্বর ও তাঁহার গুণ-কর্ম-স্বভাব এবং বেদবিদ্যা; দ্বিতীয়তঃ – প্রত্যক্ষাদি অষ্টবিধ প্রমাণ; তৃতীয়তঃ – সৃষ্টিক্রম; চতুর্থঃ- আপ্তদের ব্যবহার; পঞ্চমতঃ —নিজ আত্মার পবিত্রতা এবং বিদ্যা। এই পঞ্চবিধ পরীক্ষা দ্বারা সত্যাসত্য নির্ণয় করিয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্যবর্জন করা কর্তব্য। 

৪০। “পরােপকার” – যদ্বারা সকলের দুরাচার ও দুঃখ দূরীভূত এবং শ্রেষ্ঠচার ও সুখ বৰ্দ্ধিত হয়, তাহাকে পরােপকার’বলে।

৪১। “স্বতন্ত্র ও পরতন্ত্র” – জীব নিজ কর্মে স্বতন্ত্র, কিন্তু ভােগ বিষয়ে ঐশ্বরিক বিধানে পরতন্ত্র। পরমেশ্বরও সেইরূপ তাহার সত্য ও মঙ্গল কর্মে স্বতন্ত্র।

৪২। “স্বর্গ” – অত্যন্ত সুখভােগ এবং তাহার সাধন প্রাপ্তির নাম ‘স্বর্গ'। 

৪৩। “নরক” – অত্যন্ত দুঃখভােগ ও দুঃখের সাধন প্রাপ্তির নাম 'নরক'।

৪৪।“জন্ম” – শরীর ধারণ পূর্বক প্রকট হওয়ার নাম জন্ম। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ভেদে জন্ম ত্রিবিধ।

৪৫।“জন্ম ও মৃত্যু” – শরীরের সহিত জীবাত্মার সংযােগ হওয়াকে ‘জন্ম’ এবং বিয়ােগ হওয়াকে মৃত্যু’বলে।

৪৬। "বিবাহ” – স্বেচ্ছায় প্রকাশ্যভাবে যথাবিধি পাণিগ্রহণের নাম ‘বিবাহ'। 

৪৭। “নিয়ােগ” – বিবাহের পর, পতির মৃত্য ঘটিলে কিংবা অন্য কোন কারণে পতিবিয়ােগ ঘটিলে, কিংবা পতির স্থায়ী নপুংসকত্ব প্রভৃতি রােগ, স্ত্রীর স্ববর্ণ অথবা তদপেক্ষা উচ্চবর্ণ পুরুষ দ্বারা এবং আপৎকালে পুরুষের তাদৃশ স্ত্রীতে সন্তানােৎপত্তি করাকে 'নিয়ােগ’ বলে।

৪৮। "স্ততি” – গুণজ্ঞান, গুণকীর্তন এবং গুণশ্রবণের নাম 'স্তুতি’, স্তুতির ফল প্রীতি ইত্যাদি।

৪৯। “প্রার্থনা” – যাহা জ্ঞান-বিজ্ঞানাদি নিজ শক্তির অতীত, কিন্তু ঈশ্বরের সহিত যােগবশতঃ প্রাপ্ত হওয়া যায়, ঈশ্বরের নিকট তাহা যাঞ্চা করাকে ‘প্রার্থনা’ বলে। প্রার্থনার ফল নিরহঙ্কার ইত্যাদি।

৫০। “উপাসনা” – ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের ন্যায় নিজের গুণ-কর্ম-স্বভাব পবিত্র করা এবং ঈশ্বর সর্বব্যাপক, আমি তাহার নিকটে আছি এবং তিনি আমার নিকটে আছেন, এইরূপ জ্ঞানসহকারে যােগাভ্যাস দ্বারা ঈশ্বর সাক্ষাৎকার করার নাম উপাসনা। উপাসনার ফল জ্ঞানােন্নতি ইত্যাদি।

৫১। সগুণ ও নিষ্ঠুর্ণ “স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা” –পরমেশ্বরে যেসকল গুণ বিদ্যমান তাহাকে সে সকল গুণবিশিষ্ট এবং যে সকল গুণের অভাব, সে সকল গুণরহিত জানিয়া প্রশংসা করাকে
যথাক্রমে সগুণ ও নির্গুণ স্তুতি বলে। শুভ গুণ গ্রহণ এবং দোষ বর্জনার্থ পরমাত্মার সহায়তা প্রার্থনা করাকে যথাক্রমে সগুণ ও নির্গুণ প্রার্থনা বলে। পরমেশ্বর সর্বগুণময় এবং সর্বদোষরহিত জানিয়া নিজ আত্মাকে তাহাতে এবং তাহার আজ্ঞায় সমর্পণ করাকে সগুণ এবং নির্গুণ উপাসনা বলে।

আমার সিদ্ধান্ত সমূহ সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইল। এসকলের ব্যাখ্যা এই “সত্যার্থ প্রকাশে" বিভিন্ন প্রকরণে প্রদত্ত হইয়াছে। “ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা” গ্রন্থেও এ সকল ব্যাখ্যাত হইয়াছে। তাৎপৰ্য্য এই যে, যে সকল বিষয় সকলের পক্ষে বিশ্বাসের উপযুক্ত, আমিও সে সকল বিশ্বাস করি; যেমন সকল মতেই সত্যবাদিতা শ্রেষ্ঠ, এবং অসত্যবাদিতা হেয়; এইরূপ সিদ্ধান্ত আমিও মানি। মত-মতান্তরের বিরােধ আমার নিকটপ্রীতিকর নহে। কারণ, সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচারের ফলে মনুষ্যেরা অন্ধবিশ্বাসে জড়িত হইয়া পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। আমি অসত্য খণ্ডন এবং সত্যপ্রচার দ্বারা সকলকে একইমতে আনিবার জন্য যত্নবান রহিয়াছি। আমার অভিপ্রায় এই যে, সকল বিদ্বেষ পরিত্যাগ পূর্বক পরস্পরের প্রতি পরমপ্রীতিপরায়ণ হউক এবং সকলেই পরস্পরের সাহায্যে যত্নবান হউক। সর্বশক্তিমান পরমাত্মারও সহায়তা এবং আপ্তদের সহানুভূতি প্রভাবে আমার এই সিদ্ধান্ত সত্ত্বর পৃথিবীতে সর্বত্র প্রসারিত হউক। এই সিদ্ধান্ত দ্বারা সকলে সহজে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মােক্ষ লাভ করিয়া উন্নতি ও আনন্দ লাভ করিতে থাকুন। ইহাই আমার জীবনের সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।

অলমতিবিস্তরেণ বুদ্ধিমদ্বর্য়েযু।।

ওম্ শন্নো মিত্রঃ শং বরুণঃ। 

শন্নো ভবত্বর্য়্যমা ৷৷ 
শন্ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ। 
শন্নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ ॥ 
নমাে ব্ৰহ্মণে নমস্তে বায়াে। 
ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। 
ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাবাদিষম্। 
ঋত্মবাদিষম্।। 
সত্যমবাদিষম্। 
তন্মমাবীৎ তদ্বক্তারমাবীৎ। 
আবীন্মাম্। 
আবীদ্বক্তারম্। 
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।। 

ইতি শ্রীমৎপরমহংসপরিব্রাজকাচাৰ্যাণাং পরমবিদূষাং শ্রীবিরজানন্দ সরস্বতী স্বামীনাং শিষ্যেণ শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী-স্বামিনা বিরচিতঃ স্বমন্তব্যামন্তব্যসিদ্ধান্তসমন্বিতঃ সুপ্রমাণযুক্তঃ সুভাষাবিভূষিতঃ সত্যার্থপ্রকাশোSয়ম্ গ্রন্থঃ সম্পূৰ্ত্তিমগমৎ৷৷

বিঃদ্রঃ- হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদে ভুল হলে আমি দুঃখিত, তাতে মূল পুস্তকের কোন দোষ না। নীচে হিন্দি সত্যার্থ প্রকাশের পিডিফ দেওয়া হলো, সাথে আরো অনেক ভাষায় 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ