সর্ব্বপ্রথম শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণকারদের ব্যাসদেব কে ছিলেন ও তাঁদের ভাগবতের কিছুটা বর্ননা দেখি ... ব্যাসদেব,অন্যান্য নাম : কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন, দ্বৈপায়ন,বাদরায়ণ,বেদব্যাস। ইনি পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ, বেদান্তদর্শন, ভাগবত প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি। যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম হয় দ্বৈপায়ন। এঁর গায়ের রঙ কালো ছিল বলে, পুরো নাম দাঁড়ায় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। এঁর মাথায় কপিল বর্ণের জটা ছিল। তাঁর চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ছিল। ইনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ব্যাস নামে পরিচিত হন। জন্মের পরপরই ইনি তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন। এঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম। এই কারণে ইনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন। ইনি মহাভারত লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মার কাছে একজন লিপিকার নিয়োগের পরামর্শ গ্রহণ করতে গেলে- ব্রহ্মা গণেশকে নিয়োগ করতে বলেন। গণেশ এই শর্তে লিপিকার হতে সম্মত হলেন যে, লিপিবদ্ধ করার সময় ইনি ক্ষণমাত্রও থামবেন না। ব্যাস তাতে রাজী হয়ে অপর একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন যে, গণেশ কোন বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না বুঝে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না। এরপর গণেশ এই শর্তে রাজী হলে– মহাভারত লিখা শুরু হয়।ব্যাসদেব তাঁর শ্লোক রচনার মাঝে মাঝে কিছু জটিল শ্লোক রচনা করেতন- গণেশ এই শ্লোকগুলির অর্থ বুঝে লিখতে যে সময় ব্যয় করতেন, সেই সময়ের মধ্যে ব্যাসদেব আরও অনেক শ্লোক বানিয়ে ফেলতেন।
ব্যাসদেব একটি পুত্র লাভের আশায় সুমেরু পর্বতে মহাদেবের তপস্যা করতে থাকেন। শতবর্ষ আরাধনার পর মহাদেব তাঁকে পুত্রলাভের বর দেন। ব্যাসদেব পুত্র সন্তানের নাম রাখেন শূক। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ব্যাসদেবের বরেই সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ করেন। এই দৃষ্টির বলে তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের যথাযথ বিবরণ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কুরু-পাণ্ডব রমণীদের ইনি জাহ্নবী থেকে উত্থিত মৃত আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ করান। জ্ঞাতিবধের পাপস্খলনের জন্য ইনি যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধ-যজ্ঞ করতে উপদেশ দেন।
গৌতমের রচিত ন্যায়শাস্ত্রের ত্রুটি ধরার কারণে, গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, চোখ দিয়ে ব্যাসদেবের মুখ দেখবেন না। পরে ব্যাস অনুনয়-বিনয় দ্বারা গৌতমকে প্রসন্ন করলে, তিনি ব্যাসদেবের মুখদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে,- এই বিবেচনায় গৌতম তাঁর পায়ে চোখ স্থাপন করে ব্যাসদেবের মুখ দেখেছিলেন। সেই থেকে গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ।
ইনি বেদকে শতশাখাযুক্ত চার ভাগে বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে অভিহিত হয়েছেন।
ব্যাসদেব অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বেদান্তদর্শন রচনাও ব্যাসদেব অন্যতম কৃতিত্ব।
বিষ্ণু অবতার ও কৃষ্ণ জীবনকথা নিয়ে রচিত ব্যাসদেবের এই অনবদ্য রচনায় মোট বারোটি স্কন্দ (সর্গ) ও প্রায় ১৮,০০০ শ্লোকে রয়েছে। হিন্দু সমাজে সুপরিচিত বহু উপকথার উৎসভাগবত পুরাণ।
তিনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং তার চার শিষ্যকে এক একটি বেদের সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন । এই কারণে ইনি বেদব্যাস নামে খ্যাত হন। তাঁর এই পরিকল্পনার ফলেই দেশের ও জাতির বিপর্যয় এবং বিধর্মীদের হাতে কোটি কোটি হিন্দু হত্যা, হাজার হাজার মন্দির ও শাস্ত্র ধংসের পরেও হিন্দু ধর্মের ও সমাজের ভিত্তি —বেদ হারিয়ে যায় নি।
ভগবান ব্যাস পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও অষ্টাদশ উপপুরাণ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি। কলিযুগে সনাতন হিন্দু ধর্মের বর্তমান কাঠামো অনেকটাই ব্যাসদেবের নির্মিত । শৈব -শাক্ত- বৈষ্ণব -দ্বৈতবাদী -অদ্বৈতবাদী নির্বিশেষে সনাতন হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়-ই কোন না কোন সূত্রে ব্যাসের জ্ঞান , ভক্তি, তপস্যা , জীবকল্যানের আদর্শের সাথে যুক্ত আছেন। সেকারনে তিনি সনাতন হিন্দু সমাজের সার্বজনীন গুরু।
রাজা পরীক্ষিতের ভাগবত শ্রবণঃ
মহামুনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বা ব্যাসদেব বেদ রচনার পূর্বে এগুলি মুনি-ঋষিদের স্মৃতিতে ছিল এবং এ বৈদিক মন্ত্রগুলি পয়ার আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। ব্যাসদেবই সর্বপ্রথম পঠনের উপযোগী করে এগুলি সংকলন করেন এবং বেদকে চারভাগে ভাগ করেন। বেদ অর্থ জ্ঞান....
শ্রীমদ্ভাগবত রচনার ইতিহাস ও রাজা পরীক্ষিতের ভাগবত শ্রবণঃ(পৌরাণিক)
মহামুনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বা ব্যাসদেব বেদ রচনার পূর্বে এগুলি মুনি-ঋষিদের স্মৃতিতে ছিল এবং এ বৈদিক মন্ত্রগুলি পয়ার আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। ব্যাসদেবই সর্বপ্রথম পঠনের উপযোগী করে এগুলি সংকলন করেন এবং বেদকে চারভাগে ভাগ করেন। বেদ অর্থ জ্ঞান। পারমার্থিক জ্ঞান। এ জ্ঞান ধারণ করতে পারলে পার্থিব বিষয় তুচ্ছ মনে হবে। ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য সবকিছুই বেদে আছে। অভাব শুধু আমাদের জ্ঞানের। অজ্ঞানকে নাশ করে বেদের দূরূহ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে আত্মাতে জ্ঞানের বর্তিকা জ্বালাতে পারলে আমাদের মানব জনম সফল হবে। ব্যাসদেব বেদ রচনা করা ছাড়াও মহাভারত নামে মহাকাব্য রচনা করেন। মহাভারতের কাহিনী এত বিচিত্র ও হৃদগ্রাহী যে ইহার ছন্দে ছন্দে আছে রাজনীতি, আছে ষঢ়যন্ত্র, আছে মুক্তির পথ, আছে দেহান্তর, আছে আত্মোপলদ্ধি, আছে দু:খ-বেদনা, হাসি-কান্না যা শ্রবণ করলে আমাদেরকে মোক্ষলাভের পথের দিকেই ধাবিত করে। সনাতন ধর্মকে জানা ও এর ব্যাপকতা কত বিশাল তা পরিমাপ করা আমাদের এক জনমে অত্যন্ত দূরূহ ব্যাপার। জনমে জনমে আমাদের তা জানতে হবে। বৈদিক গ্রন্থাদি পাঠ করলে জানা যায় যারাই মোক্ষলাভ করেছেন তারা কখনই এক জনমে পারেনি। জনমে জনমে পূণ্য সঞ্চয় করে তারা ভগবত ধামে প্রবেশ করেছেন অথবা নিত্যদেহ লাভ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পার্ষদরূপে গণ্য হয়েছেন।
ব্যাসদেব আঠারটি পুরাণও রচনা করেছেন। পুরাণগুলিতে সনাতন ধর্মের জানা অজানা অনেক পৌরানিক কাহিনী ব্যাপৃত হয়েছে। পুরাণগুলিতে যেমন আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কথন, লীলার কথা তেমনি আছে দেবদেবীদের শক্তির বহি:প্রকাশ।
ব্যাসদেবে জন্মকাহিনী:
বশিষ্ঠ মুনির পৌত্র পরাশর। পরাশরের মাতার নাম অদৃশ্যন্তী। পিতার নাম শক্তি। একদিন পরাশর মুনি নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। নৌকা চালনা করছেন এক নারী। তার নাম মৎস্যগন্ধা। তাকে দেখে পরাশর মুনির কামভাব হয় এবং তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বলেন। ঐ কন্যা জানান তিনি কুমারী। কিন্তু পরাশর মুনির বরে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি। তার গায়ের গন্ধও দূর হয়ে যায়। তাদের এক সন্তান হয় দ্বীপে। দ্বীপে জন্ম হয় বলে তার নাম ‘দ্বৈপায়ন’। তিনিই জগতে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব নামে পরিচিতি পান। আর ঐ মৎস্যগন্ধাই সত্যবতী নামে পরিচিতি পান এবং হস্তিনাপুরের রাজা শান্তুনু তাকে বিবাহ করেন।
ব্যাসদেব যেভাবে ভাগবত রচনা করলেন:
ব্যাসদেব বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ, মহাভারত রচনা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। কিন্তু তারপরও তার মনে এক অতৃপ্ত বাসনা বিরাজ করছে। কিন্তু কি সে বাসনা তা তিনি হৃদঙ্গম করতে পারছেন না। একদিন তিনি তার আশ্রমে মৌন হয়ে বসে আছেন। এমন সময় মহর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি ব্যাসদেবকে এভাবে মৌন হয়ে বসে থাকতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। ব্যাসদেব জানান তিনি বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ ও মহাভারত রচনা করেছেন। কিন্তু তারপরও তার মনে অতৃপ্ত বাসনা বিরাজ করছে। ব্যাসদেবের অতৃপ্ত বাসনার কথা শ্রবণ করে নারদ তাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কর্ম, গুণ ও লীলা রচনা করার জন্য উপদেশ দিলেন। তারপর ব্যাসদেব মহাভারতসহ পুরাণের সমস্ত সার সংকলিত করে শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেন। ব্যাসদেব তার পুত্র শোকদেবকে প্রথম শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করে শোনান। কিন্তু ব্যাসদেব ভাগবত প্রচারের কোন ব্যবস্থা করেননি।
ভাগবত বেদ শ্রুতি বিরুদ্ধ- 👈আরো পড়ুন
হস্তিনাপুরের রাজা পরীক্ষিত একদিন শিকারে বের হলেন। তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে জলের খুঁজে শমীক মুনির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। মুনি তখন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ধ্যানে মগ্ন। রাজা মুনিকে জল দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মুনি কোন উত্তর দিলেন না। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি একটি মৃত সাপ ধনকে করে মুনির গলায় জড়িয়ে দিলেন। অদূরেই মুনি পুত্র শৃঙ্গী অন্য ঋষি পুত্রদের সাথে খেলা করছিল। পিতার এরম অবস্থা দেখে শৃঙ্গী ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাৎক্ষণিক ব্রহ্মশাপ দিলেন। সে ব্রহ্মশাপে রাজা পরীক্ষিতের সাত দিনের মধ্যে তক্ষক সর্প দংশনে মৃত্যু হবে। অভিশাপ শুনে শমীক মুনির ধ্যান ভঙ্গ হল। তিনি বিচলিত হলেন। তিনি জানেন রাজা পরীক্ষিত মৃত্যুবরণ করলে রাজ্যে বিশৃংখলা দেখা দিবে। তিনি এও জানেন মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেছিলেন। রাজার মৃত্যুকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। পুত্রকে অনেক বুঝালেন তার ব্রহ্মশাপ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন পুত্র পিতার অপমানের কারণে শাপ ফিরিয়ে নিবে না। উপায়ন্তর না দেখে রাজা পরীক্ষিতের মৃত্যু আসন্ন মনে করে তার নিকট সংবাদ পাঠালেন এবং তিনি যেন নিজেকে আত্মরাক্ষার জন্য তৈরী হন। সংবাদ শ্রবণ করে রাজা পরীক্ষিত ধীর শান্ত মনে সর্প দংশনে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। রাজা পরীক্ষিত পুত্র জন্মেজয়ের হাতে রাজ্য অর্পণ করে রাজকীয় ভোগ বাসনা ত্যাগ করে গঙ্গানদী তীরে অবস্থান করতে থাকেন। সেখানে তিনি সাত দিন ব্যাপী প্রায়োপবেশন করে ব্রহ্মশাপে দেহত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। রাজা পরীক্ষিতের প্রায়োপবেশনে দেহ ত্যাগের সংবাদ রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ে। তার এ মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য রাজা-প্রজা, ঋষি, ব্রাহ্মণ সবাই গঙ্গানদীর তীরে সমবেত হলে লাগলেন। আসলেন মহর্ষি নারদ, আসলেন মহর্ষি ব্যাসদেবও। পরীক্ষিত জানতেন এ ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হবার নয়। তাই তিনি এ মৃত্যুকে রোধ করার কোন ব্যবস্থাও করলেন না। তার শুধু ভাবনা একটিই জীবনের সাতটি দিন এমনভাবে কাটাতে চান যেন ধীর শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারেন। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে তিনি তা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় সবই সম্ভব। হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব তনয় জ্ঞানতাপস শুকদেব। সমবেত হাজার হাজার মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণগণ নড়েচড়ে বসলেন। রাজা পরীক্ষিত ষোড়শবর্ষীয় ব্যাসদেব তনয়ের চরণ ম্পর্শ করলেন। তিনি নিজে উপলব্দি করলেন হয়তো বা তার মনের আশা পূরণ হবে। নিশ্চিয় এখন তার মৃত্যুর পথ সুগম হবে।
ভাগবতকারদের প্রলাপ দেখুনঃ
শোকদেব সংসার ত্যাগী। তার নিকট স্ত্রী-পুরুষ ভেদজ্ঞান নেই। তিনি কোন জায়গায় ক্ষণমাত্র অবস্থান করেন। কিন্তু গঙ্গা তীরে হাজার হাজার মুনি-ঋষি, ব্রহ্মাণ, রাজ-প্রজাকে অবলোকন করে তিনি অভিভূত হলেন। রাজা পরীক্ষিতের প্রার্থনায় সেখানে তিনি সাত দিন ধরে অবস্থান করতে সম্মত হলেন। রাজা পরীক্ষিত শোকদেবকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন- শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজের মন-প্রাণকে উৎসর্গ করে কিভাবে দেহত্যাগ করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর শ্রবণ করার জন্য উপস্থিত রাজা-প্রজা, মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণ সকলেই সকলেই অধীর হয়ে উঠলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে নিয়োজিত করার জন্য যে গীতার অবতারণা করেছিলেন তেমনি পরীক্ষিতের প্রশ্নই শ্রীমদ্ভাগবত সংহিতার জন্ম দিয়েছে। ব্যাসদেব ভাগবত রচণা করেছিল কিন্তু শোকদেবই সর্বপ্রথম তা সাধুজনের সম্মুখে আনয়ন করেন।
দ্বাপরের শেষে কলিযুগের প্রারম্ভে পবিত্র গঙ্গানদীর তীরে শুক্লানবমী তিথি হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত একাধারে সাতদিন মহর্ষি শুকদেব রাজা পরীক্ষিতসহ অন্যান্য মুনি-ঋষিগণকে ভাগবতপুরাণ শুনিয়েছিলেন। ভাগবতের মূল উপজীব্য বিষয় ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণ, কর্ম ও লীলা। ভাগবতের সে অমৃতধারা শ্রবণ করে উপস্থিত সাধুজন পূণ্য লাভ করছেন, আনন্দ পাচ্ছেন, কিন্তু সাথেই সাথেই তা স্মৃতিতে স্মরণ রাখতে পারছেন না। শোকদেবও তা অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি তার স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারবে। অবশেষে তিনি সেই মুনিকে পেলেন। তিনি হচ্ছেন রোমহর্ষণ মুনির পুত্র সূত উগ্রশ্রবা। নৈমিষারণ্যে অনুষ্ঠিতব্য যজ্ঞে তিনি শৌনকাদি ঋষির নিকট ভাগবত পাঠ করতে সক্ষম হবেন। পববর্তী সময়ে শৌনকাদি ঋষিগণ নৈমিষারণ্যে এক যজ্ঞানুষ্ঠান করছিলেন। সে যজ্ঞানুষ্ঠানে রোমহর্ষণ পুত্র সূত উগ্রশ্রবা উপস্থিত ছিলেন। তিনিই শৌনকাদি ঋষিগণনের নিকট শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ বর্ণনা করেছিলেন। এভাবেই শ্রীমদ্ভাগবত সাধারণের মধ্যে প্রবিষ্ঠ হল।
মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যধিষ্ঠির রাজত্ব করেন ৩৬ বৎসর ৮ মাস ২৫ দিন। ইহার পর পরীক্ষিৎ রাজত্ব করেন ৬০ বৎসর, সর্বমোট ৯৬ বৎসর ৮ মাস ২৫ দিন। সুতরাং এতদিন তাঁর জীবিত থাকার কথা নয়।কারণ মহাভারতে বৈশম্পায়ন কৃত ভীষ্ম বাক্য বর্ণনায় জানা যায় যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হওয়ার পূর্বেই শুকদেবের দেহান্ত হয়েছিল-
ভীষ্ম উবাচঃ
' নারদেনা-ভ্যনুজ্ঞাতঃ শুকো দ্বৈপায়নাত্মজঃ।
অভিবাদ্য পুনর্য়োগমাস্থায়াকাশমাবিশৎ।।'-৯
নারদের অনুজ্ঞা নিয়ে শুকদেব যোগাবল্বন করতঃ আকাশে আবেশ করলেন। অনন্তর তিনি প্রজ্বলিত বিধূম পাবকের ন্যায় নিত্য নির্গুণ লিঙ্গঁ বর্জিত আদিত্যান্তর্য্যামী পরব্রহ্মে প্রতিষ্ঠি হলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বহু পূর্বেই যাঁর দেহপাত হয়েগেল তাঁর পক্ষে পুনরায় যুদ্ধ শেষের পরে দ্বাপরের শেষ প্রান্তে সুরধণীর তীরে, প্রয়োগবেশনে উপবিষ্ট রাজা পরীক্ষিতকে, তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বে মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে দিগম্বর শুকদেব, তাঁকে ভাগবত শোনান কি সম্ভব...?
শুধু তাই নয়, ব্যাসদেব কৃত মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী পরীক্ষিত নিজেকে রক্ষা করার জন্য মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে এমন এক স্তম্ভ প্রাসাদ তৈরী করালেন যেটি অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং সেখানে বসেই
তিনি উপযুক্ত পাহারায় রাজকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন। এখানে প্রশ্ন হল ভাগবতের কথা অনুযায়ী রাজা পরীক্ষিত শ্রীকৃষ্ণের পদ সেরা শ্রেষ্ঠমনে করে প্রাণত্যাগের সংকল্প নিয়ে (সুরধণী) গঙ্গার তীরে উপবেশন করলেন। অথচ ব্যাসকৃত মহাভারতের বর্ণনায় তিনি নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় একটি সুরক্ষিত দুর্গ বা প্রাসাদ তৈরী করেছিলেন। তাহলে কনটি সত্য..? নিশ্চয় কল্পিত ভাগবত নয়। করাণ একই লেখক ব্যাসদেব দুই বইয়ে একই ঘটনা নিয়ে দুই জায়গায় দুরকম লিখতে পারেন কি..? সুতরাং ভাগবত যে ব্যাসদেবের লেখা নয় এটাই সত্য।
এসব অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রসিদ্ধ গোড়ীয় বৈষ্ণবাচার্য্য রাধাবিনোদ গোস্বামীকে ও "বৈষ্ণবাচার পদ্ধতি" নামে গ্রন্থ লিখতে হয়েছিল। তিনি ওই গ্রন্থের ১৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন বর্তমান সময়ে ভোগী ব্যাবসাদার গুরুরা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে, নিজেরাই স্বয়ং কৃষ্ণ সেজে শিষ্যশিষ্যাদের দ্বারা পূজিত হন। কোন কোন প্রেমদাতা গুরু রমনী মহলে দীক্ষাদান কালে স্বয়ং কৃষ্ণ হয়ে শিষ্যাদিগের গোপীভাব আস্বাদন করান। অতএব ভগবত যে কত অশ্লীল মিথ্যাচারে ভর্তি একটি গ্রন্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার মহাভারতে আছে মহাপ্রস্থানের সময় পঞ্চ পান্ডবদের সাথে দ্রৌপদী মেরুপর্তের শিখর দেশে এসে "যাজ্ঞসেনী ভ্রষ্টযোগা নিপপাত মহীতলে" অর্থাৎ দ্রৌপদী ওখানে প্রাণ ত্যাগ করেন। আবার ভাগবতে
আছে কৃষ্ণের তিরোভাবের সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চভ্রাতা দ্রৌপদীর জন্য অপেক্ষা না করে উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করলেন। তখন দ্রৌপদী বাসুদেব উপাগত হয়ে দেহত্যাগ করেন।
"দ্রৌপদী চ তদাজ্ঞায় পতীনামন পেক্ষতাম্।
বাসুদেবে ভগবতিহ্যেকান্ত মতিরাপতম্।।" ভাগবত ১,১৫,৫০।।
এখানেও একই লেখক ব্যাসদেব একই ঘটনা দুই জায়গায় দুইরকম লিখতে পারেন কি..?
ভাগবতে আছে ,হিরণাক্ষ পৃথিবীকে মাদুরের মত মুড়ে মাথার বালিশ বানিয়ে শয়ন করেছিল। এবং বিষ্ণু তখন বরাহ রূপ ধারণ করে দাঁতে করে পৃথিবীকে তুলে ধরেছিলেন। যদি পৃথিবীই না থাকে তাহলে বরাহ রূপী বিষ্ণু তখন কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং হিরণাক্ষই বা কোথায় শয়ন করে ছিল..? ভাগবতকারের সমান্য ভূগোলের জ্ঞানটুকুও ছিল না যে, পৃথিবী কখনই মাদুরের মত মুড়ে বালিশ করা যায় না। তাহলে এটা সন্দেহ হয় যে ভাগবতকারের মাথায় ইসলামের তালা লাগানো ছিল। ভাগবতে আরো আছে অজামিল নামে এক পাপী তার পুত্রের নাম নারায়ণ রেখেছিলেন,যাতে মৃত্যুকালে নারায়ণ নামে ডাকলে নারায়ণ এসে তাকে উদ্ধার করে। এখানে অন্তর্যামী নারায়ণের এই জ্ঞান টুকু কি নেই য, সে তার পুত্রকেই ডাকছে,তাঁকে নয়! তাহলে এই নারায়ণ, জীবকে সুখ দুঃখ পাপ পুণ্যের ফল কি ভাবে দেবেন..?
শুধু তাই নয়, ভাগবতের কথা অনুযায়ী পাপিরা উদ্ধারের জন্য তাদের পুত্রদের নাম যদি নারায়ণ রাখৈ বা নিজেরা হরে হরে রাম রাম কৃষ্ণ করে উদ্ধার হয়ে যায়, তাহলে তো সবাই নির্ভয়ে পাপ কর্ম করে যাবে।
তখনতো ঈশ্বরের ন্যায় ব্যবস্থাই থাকবে না,তখন ঈশ্বরকে কেউ মানবে কি..?
শ্রীমদ্ভাগবত বেদব্যাসের লেখা প্রমান করতে গিয়ে রাধা ভক্তরা ব্যাস সুকদেবের নাম দিয়ে স্বকপোলকল্পিত রচনা করেছে। এই কথা প্রকাশ করিলেই অনেকেই বলে
আপনার কথার মাথামুন্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! ভাগবত বেদব্যাসের লেখা নয়, কি বলছেন আপনি..? আপনার মাথা ঠিক আছেত..?
আবার অনেকে বলেন তাদের পাশের বাড়ীতে ভাগবত পাঠ হয়, হাজারো লোকের সমাগম হয় তাহারা ভাগবত শুনতে শুনতে চোখের জল মুছতে থাকে দেখি ! সবাই কি পাগল হ'ন নাকি
ভাগবত গ্রন্থে কোথায় অসামঞ্জস্য আছে বলুন ....
প্রহ্লাদের উর্দ্ধতন পুরুষের তালিকানুযায়ী প্রহ্লাদ পঞ্চম পুরুষ মাত্র !
ভাগবত ১.৪.২৫ : স্ত্রী শূদ্র আর নিন্দিত দ্বিজের বেদাধিকার নেই | ব্যাসদেব তাই তাঁদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহাভারত রচনা করেন |
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ