মনুষ্য মাংসাহারী নাকি শাকাহারী - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

22 October, 2020

মনুষ্য মাংসাহারী নাকি শাকাহারী

মনুষ্য মাংসাহারী নাকি শাকাহারী
বায়ু, জল এবং খাদ্য সমস্ত জীবের জীবনের ভিত্তি। বায়ু এবং জল পরিষ্কার হওয়া উচিত এবং দূষিত নয়, এটিও সর্বমান্য। মানুষ ব্যতীত অন্য সকল জীবেরা নিজেদের খাদ্য সম্পর্কে স্পষ্ট, যে তাদের খাদ্য কী? এটা কি বড় পরিহাস যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান শরীরধারী মানুষ তার খাবার সম্পর্কে স্পষ্ট নয়। আমি আমার মনুষ্য বন্ধুদের কাছে এই কথা বলে ক্ষমা চাইবো যে খাবারের সিদ্ধান্তে মানুষের অবস্থান একটি গাধার চেয়েও নিচে। যারা মানুষকে খাবার সম্বন্ধে বক্তব্য রাখে যথা ডাক্তার, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, ধর্মগুরু তারা কপটতার মতো কথা বলে। স্পষ্ট নির্ণয় কার থেকে নেবেন? খাদ্য সম্পর্কে স্পষ্ট নির্ণয় আমরা শুধুমাত্র সিদ্ধান্ত থেকেই পেতে পারি, কারণ সিদ্বান্তই হলো সর্বোপরি। আসুন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখেনি যে মানুষের খাদ্য আসলে কি?
১. কোনো মেশিন সম্পর্কে তথ্য, ব্যবহারকারীর চেয়ে স্রষ্টার কাছে বেশি থাকে।
২. মেশিনের জ্বালানি এবং শরীরের খাদ্য তার গঠন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
৩. উপযুক্ত (গঠন অনুযায়ী) জ্বালানি বা খাবার দ্বারা মেশিন বা শরীর ভালো কাজ করবে আর দীর্ঘ কাল পর্যন্ত ভালো করে কাজ করবে অন্যথায় জ্বালানি বা খাবার দ্বারা কম কাজ করবে আর শীঘ্র খারাপ হয়ে যাবে।
৪. জ্বালানি বা খাবার হলো সেই পদার্থ, যার দ্বারা মেশিন কাজ করে আর শরীর জীবিত থাকে। যে পদার্থকে খাদ্য হিসেবে শরীরে প্রবেশ করানো হয় এবং শরীর বাঁচে না, তা খাদ্য হতে পারে না।
৫. সকল শরীর (আস্তিকদের জন্য) ঈশ্বর বানিয়েছেন অথবা (নাস্তিকদের জন্য) প্রকৃতি বানিয়েছে। একটিও শরীর কোনো ডাক্তার, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, ধর্মগুরু বানায়নি।
৬. আমরা এই সংসারে আমাদের চারপাশে দুই ধরনের দেহ দেখতে পাই- মাংসাহারী এবং শাকাহারী।
এখানে আমরা ১, ২, ৫ আর ৬ এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবো মানুষের খাদ্য মাংসাহারী না শাকাহারী?
সকল শরীর ঈশ্বর অথবা প্রকৃতি বানিয়েছে, ঈশ্বর বা প্রকৃতির জ্ঞান মানুষের চেয়ে বেশি আর খাবার গঠন অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমাদের সামনে দুই ধরনের শরীর মাংসাহারী (সিংহ,বাঘ, চিতা, হায়না, নেকড়ে ইত্যাদি) আর শাকাহারী (গরু, ছাগল, ঘোড়া, হাতি, উট ইত্যাদি) উপস্থিত আছে, তাই সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হলো শরীরের গঠন অনুযায়ী খাবার ঠিক করে দিয়েছে ঈশ্বর বা প্রকৃতি যিনি শরীর তৈরি করেছে আর ঈশ্বর বা প্রকৃতির কথা মানুষের চেয়ে বেশি সঠিক হবে, এই ভিত্তি ব্যবহার করে, আমরা মানুষের খাদ্য নির্ধারণ করবো। সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, আমরা শাকাহারী এবং মাংসাহারীদের শরীরের গঠন তুলনা করবো আর দেখা যাক মানবদেহের গঠন কিসের সাথে মিলে যায়? যদি মানুষের শরীর শাকাহারী দেহের অনুরূপ, তবে মানুষের খাদ্য শাকাহারী এবং যদি দেহের গঠন মাংসাহারী দেহের সাথে মিলে যায়, তবে মানুষের খাবার হবে মাংসাহারী। এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে এবং আমাদের কোনো ধর্মগুরু, বিজ্ঞানী বা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই, কারণ ঈশ্বর বা প্রকৃতির কাছে তাদের কোনো যোগ্যতাই নেই আর যাই হোক একজন মানুষের পক্ষে নিষ্পক্ষ হওয়া খুব কঠিন। নিম্ন তালিকায় মাংসাহারী-শাকাহারী দেহের গঠনের তুলনামূলক তথ্য দেওয়া হচ্ছে-
১. মাংসাহারী- চোখ গোলাকার হয়, অন্ধকারে দেখতে পায়, অন্ধকারে চকচক করে, জন্মের ৫-৬ দিন পরে খোলে।
শাকাহারী- চোখ লম্বা হয়, অন্ধকারে দেখতে পায় না, অন্ধকারে চকচক করে না আর জন্মের সাথে সাথেই খোলে।
২. মাংসাহারী- ঘ্রাণ শক্তি (গন্ধ অনুভূতির শক্তি) অনেক অধিক হয়ে থাকে।
শাকাহারী- ঘ্রাণ শক্তি মাংসাহারীর তুলনায় অনেক কম হয়ে থাকে।
৩. মাংসাহারী- খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারে।
শাকাহারী- খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারে না।
৪. মাংসাহারী- দাঁত ধারালো হয়, পুরো মুখে শুধু দাঁত আছে, দাঢ় নেই আর দাঁত একবারই আসে।
শাকাহারী- দাঁত আর দাঢ় দুটোই আছে, চ্যাপ্টা হয়ে থাকে, একবার পরে গেলে দ্বিতীয়বার আবার নতুন দাঁত জন্মে।
৫. মাংসাহারী- এরা মাংসকে ছিঁড়ে গেলে, তো এদের চোয়াল কেবল উপর-নিচে চলে।
শাকাহারী- এরা খাদ্যকে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, তো এদের চোয়াল উপর-নিচে আর ডানপাশে-বামপাশ চলে।
৬. মাংসাহারী- মাংস খাওয়ার সময় বারংবার মুখকে খোলে এবং বন্ধ করে।
শাকাহারী- খাওয়ার সময় খাদ্য একবার মুখে নেওয়ার পর গেলা পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখে।
৭. মাংসাহারী- জিহ্বা সামনের দিক থেকে চ্যাপ্টা ও পাতলা এবং সামনের দিক থেকে চওড়া।
শাকাহারী- জিহ্বা প্রস্থে কম এবং সামনের দিক থেকে গোলাকার হয়।
৮. মাংসাহারী- জিহ্বাতে টেস্ট বুড্স (Taste Buds) যার সাহায্যে স্বাদকে চিনতে পারে, সংখ্যায় খুব কম হয় (৫০০ - ২০০০)।
শাকাহারী- জিহ্বায় অনেক পরিমানে টেস্ট বুড্স থাকে (২০,০০০ - ৩০,০০০), মানুষের জিহ্বাতে এর সংখ্যা ২৪,০০০ - ২৫,০০০ হয়ে থাকে।
৯. মাংসাহারী- মুখের লালা অম্লীয় (acidic) হয়।
শাকাহারী- মুখের লালা ক্ষারীয় (alkaline) হয়।
১০. মাংসাহারী- পেটের গঠন এক কক্ষীয় হয়।
শাকাহারী- পেটের গঠন বহু কক্ষীয় হয়। মানুষের পেট হলো দুই কক্ষীয়।
১১. মাংসাহারী- পাকস্থলীর পাচক রস খুব তেজ (ঘন) হয়। শাকাহারীদের পাকস্থলীর পাচক রসের তুলনায় ১২-১৫ গুণ অধিক তেজ হয়ে থাকে।
শাকাহারী- শাকাহারীদের পাকস্থলীর পাচক রস মাংসাহারীদের তুলনায় অনেক কম তেজ হয়। মানুষের পাকস্থলীর পরিপাক রসের তেজ শাকাহারীদের সমান।
১২. মাংসাহারী- পাচনতন্ত্র (মুখ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত) দৈর্ঘ্য কম থাকে। সাধারণত শরীরের দৈর্ঘের ২.৫ – ৩ গুণ হয়।
শাকাহারী- পাচনতন্ত্রের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে। প্রায় শরীরের দৈর্ঘের ৫-৬ গুণ হয়।
১৩. মাংসাহারী- ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহৎ অন্ত্রের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।
শাকাহারী- ছোট অন্ত্র বৃহৎ অন্ত্রের তুলনায় প্রস্থে অনেক ছোট এবং দৈর্ঘ্যে অনেক বেশি হয়।
১৪. মাংসাহারী- এগুলিতে কার্বোহাইড্রেট থাকে না, এই কারণে, মাংসাহারীদের অন্ত্রে কোনো কিণ্বন (Fermentation bacteria) ব্যাকটেরিয়া নেই।
শাকাহারী- এদের অন্ত্রে কিণ্বন (Fermentation bacteria) ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা কার্বোহাইড্রেট হজমে সাহায্য করে।
১৫. মাংসাহারী- অন্ত্রগুলি পাইপের মতো অর্থাৎ ভিতর থেকে সমান।
শাকাহারী- অন্ত্রে স্ফীতি (bulges) এবং খাঁজ grooves আছে, অর্থাৎ, ভিতরের গঠন চুড়িগুচ্ছের মতো।
১৬. মাংসাহারী- এদের লিভার চর্বি এবং প্রোটিন হজম করার জন্য অধিক পাচক রস নির্গত করে। পিত্তে জমা করে। আকারে বড় হয়।
শাকাহারী- এদের লিভারের পাচক রস চর্বি হজমকারী পাচক রসের তুলনায় কম হয়। পিত্ত হতে ছাড়ে। তুলনামূলকভাবে ছোট হয়।
১৭. মাংসাহারী- অগ্ন্যাশয় অল্প পরিমাণে এনজাইম নিঃসরণ করে।
শাকাহারী- মাংসাহারীদের তুলনায় অধিক পরিমানে এনজাইম নিঃসরণ করে।
১৮. মাংসাহারী- রক্তের প্রকৃতি অম্লীয় (acidic) হয়।
শাকাহারী- রক্তের প্রকৃতি ক্ষারীয় (alkaline) হয়।
১৯. মাংসাহারী- রক্তে এক ধরনের লাইপোপ্রোটিন থাকে, যা শাকাহারীদের থেকে আলাদা।
শাকাহারী- মানুষের রক্তের লাইপোপ্রোটিন (Lipoprotein) শাকাহারীদের সাথে মেলে।
২০. মাংসাহারী- প্রোটিন হজমের ফলে ইউরিয়া এবং ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়, তাই রক্ত থেকে প্রচুর পরিমাণে ইউরিয়া ইত্যাদি অপসারণের জন্য বড় আকারের কিডনি (Kidney) রয়েছে।
শাকাহারী- এদের কিডনি মাংসাহারীদের থেকে ছোট হয়।
২১. মাংসাহারী- এদের মলদ্বারের (Rectum) উপরে কোন অংশ নেই।
শাকাহারী- এদের Rectum আছে।
২২. মাংসাহারী- এদের মেরুদণ্ডের গঠন এমন যে এরা পিঠে ভার বহন করতে পারে না।
শাকাহারী- এরা পিঠে ভার বহন করতে পারে।
২৩. মাংসাহারী- এদের নখ সামনের দিক থেকে তীক্ষ্ণ, গোলাকার এবং লম্বা।
শাকাহারী- এদের নখ চ্যাপ্টা এবং ছোট।
২৪. মাংসাহারী- এরা তরল পদার্থকে চেটে পান করে।
শাকাহারী- এরা তরল পদার্থকে চুমুক দিয়ে পান করে।
২৫. মাংসাহারী- এদের ঘাম আসে না।
শাকাহারী- এদের ঘাম আসে।
২৬. মাংসাহারী- এদের প্রসবের সময় (বাচ্চা জন্ম করতে সময়) কম লাগে। প্রায় ৩ - ৬ মাস।
শাকাহারী- এদের প্রসবের সময় মাংসাহারীদের তুলনায় অধিক সময় লাগে। প্রায় ৬ - ১৮ মাস।
২৭. মাংসাহারী- এরা জল কম পান করে থাকে।
শাকাহারী- এরা তুলনামূলকভাবে বেশি জল পান করে।
২৮. মাংসাহারী- এদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়।
শাকাহারী- এদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার কম, এদের আয়ুষ্কাল দীর্ঘ হয়।
২৯. মাংসাহারী- ক্লান্ত হলে ও গরমে মুখ খুলে এবং জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে।
শাকাহারী- মুখ খুলে হাঁপায় না আর গরমে জিভ বের করে না।
৩০. মাংসাহারী- প্রায়ই দিনের বেলা ঘুমায়, রাতে জাগে ও ঘুরে বেড়ায়।
শাকাহারী- রাতে ঘুমায়, দিনে সক্রিয় থাকে।
৩১. মাংসাহারী- এরা নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, প্রয়োজনে নিজের সন্তানকে মেরে খেতে পারে।
শাকাহারী- নিজের সন্তানকে হত্যা করে না এবং সন্তানের প্রতি হিংসক হয় না।
৩২. মাংসাহারী- অন্য প্রাণীদের ভয় দেখানোর জন্য হুংকার দেয়।
শাকাহারী- অন্য প্রাণীদের ভয় দেখানোর জন্য হুংকার দেয় না।
৩৩. মাংসাহারী- এদের রক্তে প্রচুর পরিমাণে রিসেপ্টর রয়েছে যা রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে।
শাকাহারী- এদের রক্তে রিসেপ্টরের পরিমাণ কম রয়েছে। মানুষের রক্তেও কম পরিমাণে রয়েছে।
৩৪. মাংসাহারী- এরা কোনো প্রাণীকে হত্যা করে এবং তার মাংস কাঁচাই খেয়ে ফেলে।
শাকাহারী- মানুষ কোনো প্রাণীকে হত্যা করে তার কাঁচা মাংস খায় না।
৩৫. মাংসাহারী- এদের মলমূত্রে দুর্গন্ধ রয়েছে।
শাকাহারী- এদের মলমূত্রে দুর্গন্ধ হয় না (যদি কোনো মানুষ শাকাহারী হন এবং তার হজমশক্তি সুস্থ থাকে, তাহলে সেই মানুষের মলমূত্রে খুব কম গন্ধ থাকে)।
৩৬. মাংসাহারী- হজমের সময় শক্তি পেতে এদের পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন ব্যবহার হয়, যা শাকাহারীদের থেকে আলাদা।
শাকাহারী- এরা শক্তি পেতে বিভিন্ন প্রোটিন ব্যবহার করে।
৩৭. মাংসাহারী- এদের পরিপাকতন্ত্র, যা এনজাইম তৈরি করে, তারা মাংসই হজম করে।
শাকাহারী- এদের পরিপাকতন্ত্র, যা এনজাইম তৈরি করে, তারা শুধুমাত্র বনস্পতি জাতীয় পদার্থ হজম করে।
৩৮. মাংসাহারী- এদের শরীরের তাপমাত্রা কম, কারণ মাংসাহারীদের BMR (Basic Metabolic Rate) শাকাহারীদের থেকে কম।
শাকাহারী- মানুষের শরীরের তাপমাত্রা শাকাহারী প্রাণীদের কাছাকাছি।
৩৯. মাংসাহারী- দুটি পাত্র নিন, একটিতে মাংস রাখুন এবং অন্যটিতে শাকাহার রাখুন, তাহলে মাংসাশী প্রাণী মাংস বেছে নেবে।
শাকাহারী- মানব শিশু শাকাহারকে বেছে নেবে।
উপরোক্ত তথ্য অনুসারে, মানবদেহের গঠন কোনোরূপ ব্যতিক্রম ছাড়াই ১০০% শাকাহারী প্রাণীদের শরীরের গঠনের সাথে মেল খায় এবং খাদ্য দেহের গঠন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, তাই মানুষের খাদ্য হলো শাকাহার, মাংসাহার কখনোই নয়। শাকাহার ভোজন করার ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত হওয়া উচিত এবং মাংসাহার খাবারের কারণে অনেক ধরনের ক্ষতি হয় তাই এর থেকে দূরে থাকতে হবে।
শাকাহারে মানবের কল্যাণ আর মাংসাহারে বিনাশ। প্রকৃতির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বিনাশ থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই।

ডাঃ ভূপসিং
Retired Associate Professor, ভৌতিক বিজ্ঞান
ভিবানী (হরিয়ানা)

যেসব লোকেরা মনে করে যে ফলাহার দ্বারা শ্রম করার শক্তি থাকে না, তারা ভুল করছে। ১৮ মে ১৯০২ সালে জার্মানির বিটসনটাইড নামক স্থানে আন্তর্জাতিক পায়ে হাঁটা দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। এই দৌড় ড্রস্ডন থেকে বার্লিন পর্যন্ত ১২৪ মাইল লম্বা ছিল। সব মিলে ৩২ জন দৌড়বিদ ছিল। আবহাওয়া গরম ছিল। দৌড়বিদরা ড্রস্ডন থেকে ৭ টা ৩০মিনিটে বের হয়, এদের মধ্যে কিছু ফলাহারী, কিছু শাকান্নহারী আর কিছু মাংসাহারী ছিল। শাকান্নহারীদের মধ্যে বার্লিনের প্রসিদ্ধ কার্লমানও ছিল। বার্লিনে যে ছয় জন সবার আগে পৌঁছে ছিল তারা তো শাকান্ন আর ফলাহারী ছিল, এদের মধ্যে কার্লমান প্রথম হয়। কার্লমান ২৬ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের মধ্যে যাত্রা সমাপ্ত করেছিল। দৌড় সমাপ্ত হওয়ার পরেও সে একদম সতেজ ছিল, কিন্তু বড়ো-বড়ো প্রসিদ্ধ মাংসাহারী পালোয়ান ক্লান্তিতে দিশেহারা হয়ে গেছিল। এই ঘটনা বলছে যে মানুষ মাংসাহারী নয় বরং ফলাহারী, কারণ মানুষের শরীরের গঠন, তার দাঁত আর অন্ত্র দেখে চিকিৎসকরা নির্ণয় করেছে যে ফলই হল মানুষের স্বাভাবিক ভোজন। ডক্টর লুই কুন্হকে উদ্ধৃত করে পূজ্য পণ্ডিত মহাবীরপ্রসাদ দ্বিবেদী বলেছেন যে মানুষের স্বাভাবিক ভোজন হল ফল, ফুল আর কন্দ আদি। স্বাভাবিক ভোজনকে ছেড়ে দেওয়ার কারণেই আমরা বিভিন্ন রোগে পীড়িত হচ্ছি। অভ্যাসে আজ মানুষ নিজের ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক শক্তিকে এত নষ্ট করেছে যে যেই বস্তুকে দেখে আমাদের ঘৃণা হওয়া উচিত, তাকেই আমরা প্রসন্নতাপূর্বক খাচ্ছি। এই বিষয়ে পশুই আমাদের থেকে ভালো। যে পশু ঘাস খায় সে মাংসের দিকে দেখেই না আর যে মাংস খায় সে ঘাসের দিকে দৃষ্টিপাতও করে না। এইভাবে ফল আর কন্দ আদির ভক্ষক জীবও সেই পদার্থ ছেড়ে ঘাস পাত খায় না আর তৃষ্ণা লাগলেও সোডাওয়াটার আর মদ্য পান করে না, কিন্তু মানুষ হল এক বিলক্ষণ পশু, যে ঘাস- পাত, ফল-ফুল, মাংস-মদ্য সবকিছুই উদরস্থ করে ফেলে। তাহলে তার শরীর কেন রোগের ঘর হবে না।
ভোজনের অনুসারে স্থলচর পশুদের তিনটি ভেদ রয়েছে যথা - মাংসভক্ষী, বনস্পতিভক্ষী আর ফলভক্ষী। বিড়াল, কুকুর আর সিংহ আদি যত হিংস্র পশু রয়েছে, তারা সবাই হল মাংসভক্ষী। মাংসই হল তাদের স্বাভাবিক ভোজন, এইজন্য তাদের দাঁত লম্বা, ধারালো আর প্রসারিত। এইধরনের দাঁত দিয়ে এরা জীবের মাংসকে টেনে ছিড়ে গিলে নেয়। এদের দাঁতের রচনা দ্বারা এটা সূচিত হচ্ছে যে পরমেশ্বর এদের মাংস খাওয়ার জন্যই এরকম দাঁত দিয়েছে। গাভী, বৃষ, মহিষ, ছাগ আদি জীব হল বনস্পতিভক্ষী, তাই পরমেশ্বর তাদের দাঁত এরকম বানিয়েছে যা দিয়ে তারা ঘাসকে সহজেই কাটতে পারে। তাদের দাঁতের রচনাই হল তাদের বনস্পতিভক্ষী হওয়ার প্রমাণ, কিন্তু মানুষের দাঁত না তো মাংসভক্ষী পশুদের সঙ্গে মেলে আর না ঘাসভক্ষী পশুদের সঙ্গে। তাদের গঠন সেইরকম যেমনটা বাঁদর আদি ফলভোগী জীবদের হয়।এইজন্য একথা নির্বিবাদ, নির্ভ্রান্ত আর নিঃসংশয় যে পরমেশ্বর মানুষের দাঁত ফল খাওয়ার জন্যই বানিয়েছে, কিন্তু আমরা যদি সেটা দিয়ে মাংস আর মাছ কাটা আরম্ভ করি, এর মাথা ওর পা চিবিয়ে ভাঙ্গি, তারপরও কি কেউ নিরোগ থাকার কথা ভাবতে পারে? মাংসভক্ষী জীবদের আমাশয় ছোটো আর গোল হয়। তাদের শরীর থেকে তাদের অন্ত্র ৩ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত অধিক লম্বা হয়। বনস্পতিভক্ষী জীবদের আমাশয় অনেক বড়ো হয়, সে খাবারও খায় অনেক বেশি। তাদের অন্ত্র তাদের শরীরের থেকে ২০ থেকে ২৮ গুণ পর্যন্ত অধিক লম্বা হয়।
এখন বাকি রইলো ফলভক্ষী, তাদের আমাশয় মাংসভক্ষী জীবদের আমাশয়ের থেকে অধিক চওড়া হয় আর তাদের অন্ত্র তাদের শরীরের থেকে ১০ থেকে ১২ গুণ পর্যন্ত অধিক লম্বা হয়। এখন এই তিন প্রকারের জীবদের সঙ্গে মানুষের মিলিয়ে দেখুন। মাথা থেকে মেরুদণ্ডের হাড্ডির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত মানুষের দৈর্ঘ্য ১ থেকে ২ ফুট পর্যন্ত হয় আর মানুষের অন্ত্রের দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ২৮ ফুট পর্যন্ত হয়, অর্থাৎ তার দৈর্ঘ্য শরীরের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ১০ থেকে ১২ গুণ অধিক হয়। এখানেও ফলভক্ষী জীবদের সঙ্গে মানুষের সমতা মিলে যায়। শরীরের অনুসারে মানুষের অন্ত্র ফলভক্ষী জীবদেরই মতো বের হল, অতএব মানুষ যে ফলভক্ষী তার এটা দ্বিতীয় প্রমাণ হল। এইভাবে "Odontogeaphy" নামক গ্রন্থের ৪৭১ পৃষ্ঠাতে প্রফেসর ওয়েন (Owen) বলেছেন যে মানুষের দাঁত বনমানুষ আর বাঁদরের সঙ্গে অনেকটা অনুরূপ আর এদের ভোজনও ফল, অন্ন এবং বাদাম একই ধরনের। এই চার পাওয়ালা আর মানুষের দাঁত সম্বন্ধিত সাদৃশ্য থেকে বিদিত হচ্ছে যে সৃষ্টির আরম্ভে মানুষের জন্য স্বাভাবিক ভোজন ফলই নির্মাণ করা হয়েছিল।
এর সম্বন্ধে লিনাকুস (Linnacus) বলেছেন যে ফল-মূল হল মানুষের জন্য অত্যন্ত হিতকর ভোজন যা চার পাওয়ালাদের থেকে প্রকাশিত হয় তথা বনমানুষ আর লাঙ্গুরের সাদৃশ্য এবং তাদের মুখ, পেট আর হাতের গঠন দ্বারাও প্রকট হয় (Linnasi Amoonitales Academical, Vol. X, Page 8)। একইভাবে ডক্টর ইব্রামৌস্কি যিনি একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আর যিনি সমস্ত রোগের একটাই সহজ ঔষুধ বের করেছেন, লিখেছেন যে আমরা যেসব রন্ধন আদি করে, গুঁড়ো করে কৃত্রিম ভোজন করি তা আমাদের জন্য অস্বাভাবিক। আমাদের শরীরকে বৃদ্ধি তথা পুষ্টি পাওয়ার জন্য প্রায়শঃ এন্দ্রিক পদার্থেরই (Organic Matter) আবশ্যকতা হয়ে থাকে, ফল তথা খাদ্যশস্যের মধ্যে সেটা প্রচুরমাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু যদি ফল আর খাদ্যশস্যকে আগুনে রন্ধন করা হয় তাহলে তার অনেকটা এন্দ্রিক অংশ পৃথক হয়ে যায়। শেষ পদার্থ না কেবল কঠিনতার সঙ্গে পচে, বরং পচে গিয়ে আমাদের শরীরের জন্য কিছুই লাভ দেয় না। যখন এরকম ভোজন করলে অনেক ধরনের অকেজো পদার্থ আমাদের শরীরের মধ্যে ঘর করে নেয় তখন অনেক রোগের উৎপত্তি হয়। প্রায়শঃ সব আন্তরিক রোগের উৎপত্তি এরকম অকেজো পদার্থের একত্র হয়ে যাওয়ার জন্য হয়, সুতরাং এই রোগগুলোর একটাই ঔষধ রয়েছে যে যেভাবেই হোক সেই অকেজো পদার্থ আমাদের শরীর থেকে যেন বেরিয়ে যায় আর নতুন করে যেন প্রবেশ না করে। এরকমটা হলেই সেই রোগ স্বয়ংই নষ্ট হয়ে যাবে, এইজন্য প্রায়শঃ নব সম্মতির চিকিৎসকেরাও রোগীদের উপবাস করান। তাদের বেশ কয়েকদিন ধরে কেবল উষ্ণ জল ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয় না। এই ঔষধি প্রায়শঃ লাভদায়ক সিদ্ধ হয়েছে। যথাশক্তি উপবাস দ্বারা প্রায়শঃ রোগ দূর হয়ে যায়, কিন্তু এই ঔষধি করার একটা ভয় থাকে যে কখনও-কখনও অনেকদিন পর্যন্ত শরীরের আধারভূত পদার্থ না পাওয়ার কারণে রোগী এতটাই দুর্বল হয়ে যায় যে বৃদ্ধি হওয়ার স্থানে ধীরে-ধীরে ক্ষয়ের রাজ্য হয়ে যায় আর রোগী কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুর গ্রাসে চলে যায়, এইজন্য কেবল উপবাসের স্থানে ফলোপবাস অধিক উপযোগী, কারণ ফল খাওয়াতে কোনো অকেজো পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে না আর বল প্রাপ্ত হয়ে যায়, রোগও নষ্ট হয়ে যায় আর শক্তির হ্রাস হয় না।
এই বিদেশি প্রমাণগুলো থেকেও সিদ্ধ হচ্ছে যে ফলই হল মানুষের আদিম আর মৌলিক ভোজন আর ফলের সেবন হতে মানুষ অসুস্থ তো হয়ই না বরং যদি অসুস্থ থাকে তাহলেও ঠিক হয়ে যায় আর সুদৃঢ় তথা দীর্ঘজীবি হয়, এইজন্য আর্যরা নিজেদের মূল সভ্যতাতে ফল আর দুধেরই স্থান দিয়েছে আর কৃষিকে তথা কৃষি থেকে উৎপন্ন হওয়া অন্নকে আপত্কালে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ব্রত আর উপবাসের মধ্যে ফলাহারের মহিমা হতে তথা আর্য পরম্পরা আর আর্য সভ্যতাতে নিষোজ্ঞার বিশেষত্বগুলো হতে এটাই সূচিত হচ্ছে যে আর্যদের আহার সাত্ত্বিকই যারমধ্যে ফল আর দুধ-ঘীয়েরই প্রাধান্য রয়েছে, কারণ ফল-ফুল আর দুধ-ঘৃতাদি সাত্ত্বিক আহারই অর্থের পাঁচ শর্তের সঙ্গে সংগ্রহ হতে পারে তথা তার থেকেই আয়ু, বল, কান্তি, মেধা আর সত্ত্ব আদিও প্রাপ্ত হতে পারে তথা সেসবের আহার থেকেই সংসারের মধ্যে কারও আয়ু আর ভোগের মধ্যে হস্তক্ষেপও হবে না আর য়োগাভ্যাস, মোক্ষসাধনেও সহায়তা পাওয়া যায়, এইজন্য আর্যরা নিজেদের সভ্যতাতে সাত্ত্বিক আহারকেই স্থান দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ