উপনিষদে মাংসাহার - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

23 October, 2020

উপনিষদে মাংসাহার

অনেক মুসলিম, নাস্তিকদের দেখা যায় - বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-৬/৪/১৮ কণ্ডিকায় গোমাংস ভক্ষণের বিধান রয়েছে বলে অপপ্রচার করে। বিশেষ করে মুসলিমরা অপপ্রচার করে সনাতনীদের বিভ্রান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কণ্ডিকাটির বিষয়ে শাস্ত্র অধ্যয়নকারী কেহ কিছু বললে, এরা বিভিন্ন ভাষ্যকারের ভাষ্য,এবং তথাকথিত শব্দকোষ থেকে শব্দার্থ দেখিয়ে কণ্ডিকাটিতে গোমাংস ভক্ষণের বিধান সিদ্ধ করার চেষ্টা করে। এরা যে ভাষ্যাদি দেখানোর চেষ্টা করে তা একই ভাষ্যনুসারে বা একই ভাষ্য অনুসরণ অথবা কপি করে করা হয়েছে, আর যে শব্দকোষ থেকে শব্দ দেখায় তাহাও উপনিষদের শব্দার্থ বুঝতে যথেষ্ট নয় বরং এই শব্দকোষ পড়েই উপনিষদের শ্লোকার্থ বুঝতে গেলে ভুল ভ্রান্তি উৎপন্ন হয়। কারন সংস্কৃত একেকটা শব্দের অনেক অর্থ হয়, তাছাড়াও বিভিন্ন কারন তো আছেই । কণ্ডিকাতে উল্লেখিত তিনটি শব্দই তাদের অপপ্রচারের মূল স্তম্ভ। শব্দ তিনটি হল - ১. মাংস ২.ঔক্ষেণ ৩.আর্ষভেণ।

তারা বিভিন্ন ভাষ্যকারের ভাষ্য ও শব্দকোষ থেকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, কয়েকজন মাংস অর্থ মাংস, অথবা ঔক্ষেণ, আর্ষভেন অর্থ বৃষ লিখলে সেটাই সঠিক। তাদের মান্যতা অনুযায়ী আমরাও ভিবিন্ন ভাষ্যকার এবং শাস্ত্রাদি হইতে উদ্ধৃত করেই তাদের অপপ্রচারের খণ্ডন করার চেষ্টা করবো। প্রথমেই কণ্ডিকার ভাষ্যানুবাদ - 


অথ য ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পণ্ডিতো বিগীতঃ সমিতিঙ্গমঃ শুশ্রূষিতাং বাচং ভাষিতা জায়েত সর্বান্ বেদাননুব্রুবীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্নীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবৈ ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা।। (বৃহদারণ্যকোপনিষদ- ৬/৪/১৮)
পদার্থঃ- (অথ যঃ ইচ্ছেত্ ) আর- যে এই ইচ্ছা করে যে ; (পুত্রঃ মে) আমার পুত্র ; (পণ্ডিতঃ) পণ্ডিত [বিদ্যা-বুদ্ধি সম্পন্ন, চতুর] ; (বিগীতঃ) প্রশংসিত, প্রখ্যাত, যশস্বী ; (সমিতিম গমঃ) সভায় গমনকারী [সভা কার্য্যে কুশল] ; (শুশ্রূষিতাম) শ্রবণ যোগ্য, যাহার সব শ্রবণ করার মতো এমন ; (বাচম্) বাণীর ; (ভাষিতা) ভাষণ প্রদানকারী [অপূর্ব রমণীয় বচনের বক্তা] ; (জায়েত) উৎপন্ন হোক ; (সর্বান্) সর্ব [চার] ; (বেদান্ অনুব্রুবীত) বেদের ব্যাখ্যাতা [জ্ঞাতা] হোক ; (সর্বম্ আয়ুঃ ইয়াত্) পূর্ণ আয়ু প্রাপ্তকারী হোক; (ইতি) এমন [চায়, তাহারা] ; (মাংস+ঔদনম্) ঔষধের সার [কোমল ভাগ] এবং চাউল কে, [এইস্থানে উচিৎ পাঠ ভেদে] (মাষ+ঔদনম্) মাষকলাইয়ের সহিত চাউলকে ; (পাচয়িত্বা) রন্ধন করে ; (সর্পিষ্মন্তম্) ঘী মিশ্রিত করে ; (অশ্নীয়াতাম্) [পতি-পত্নী উভয়ে] আহার করে ; (ঈশ্বরৌ জনয়িতবৈ) [তারা এমন পুত্র] উৎপন্ন করতে সমর্থ হয় ; (ঔক্ষেণ বা) [সেই সার ভাগ] বা 'উক্ষা' [জীবক] নামক ঔষধির হোক; (আর্ষভেণ বা) বা 'ঋষভ'-নামক ঔষধিরই হোক।
সরলার্থঃ- আর- যে এই ইচ্ছা করে যে, আমার পুত্র পণ্ডিত [বিদ্যা-বুদ্ধি সম্পন্ন, চতুর] ; প্রশংসিত, প্রখ্যাত, যশস্বী, সভায় গমনকারী ; শ্রবণ যোগ্য, যাহার সব শ্রবণ করার মতো এমন বাণীর ভাষণ প্রদানকারী [অপূর্ব রমণীয় বচনের বক্তা] ; উৎপন্ন হোক, সর্ব - ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ এই চার বেদের ব্যাখ্যাতা [জ্ঞাতা] হোক ; পূর্ণ আয়ু প্রাপ্তকারী হোক, এমন চায়, তাহারা ; মাষকলাইয়ের সহিত চাউলকে রন্ধন করে ; ইহার সহিত ঘী মিশ্রিত করে ; [পতি-পত্নী উভয়ে] আহার করে ; তারা এমন পুত্র উৎপন্ন করতে সমর্থ হয় ; ঔক্ষেণ বা 'উক্ষা' [জীবক] নামক ঔষধির হোক বা 'ঋষভ'-নামক ঔষধিরই হোক।
ভাষ্যকার :"অখিল-ভারতীয়-মঙ্গলাপ্রসাদ-পারিতৌষিক-বিজেতা (ভূতপূর্ব) সংসদ-সদস্য তথা গুরুকুল কাংড়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকুলপতি - বিদ্যামার্তণ্ড ডা: সত্যব্রত সিদ্ধান্তলঙ্কার"।
"মাংস শব্দের অর্থ"
১. মাংস = (ক). উত্তম অন্ন (খ).উত্তম রস (গ). সাদন (ঘ). রসালো পদার্থ, (ঙ). মাংস (চ).পুরীষ (ছ).শুদ্ধ..........ইত্যাদি ইত্যাদি।(বৈদিক কোষ [চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় এবং শ্রী অনিল কুমার উপাধ্যায় I.A.S])
২. মাংসম্=ফলের মূল অংশ (অথর্ববেদ-৬/৭০/১.[
পণ্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার] )
৩.(মাংসম্ মাননং বা মানসং বা মনঃ অস্মিন সীদতী ইতি [নিরুক্ত-৪/৩]) অর্থাৎ যা মাননীয় , চিন্তনীয়......।
৪.মাংসম্ = মনন চিন্তন আদি কার্য্যে উপযোগী ফল.. আদি পদার্থ। (অথর্ববেদ-৯/৬/৯ - আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক)
৫.মাংসম্ = মন্যতে জ্ঞায়তেऽনেন তত্ মাংসম্ (উণাদিকোষ-৩/৬৪)
৬.মাংসম্ = জ্ঞান (অথর্ববেদ-৬/৭০/১ [ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী])
৭.মাংসম্ = দুধ হইতে উৎপন্ন ক্ষীর, দধি, মালাই, ঘি... ইত্যাদি পদার্থ। (অথর্ববেদ-৯/৬/৯ [পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার])
৮. " (মাংসৌদনম্) ঔষধি অথবা ফলের মূল অংশ"
(গীতাপ্রেস থেকে প্রকাশিত বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮ [শঙ্করাচার্য])
৯. মাংসম্ পুরীষম্ = পুরীষই মাংস (শ০ ব্রা০-৮/৭/৪/১৬) পুরীষ কি? উ: পুরীষম্ = পূর্ণ বল (যজুর্বেদ-১২/৪৬ [ঋষি দয়ানন্দ])
১০. মাংসম্ = উত্তম অন্ন (অথর্ববেদ-৬/৭০/১ [পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার])
"ঔক্ষেণ বা আর্ষভেন শব্দের অর্থ"
১.পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্মাজী লিখেছেন - (ঔক্ষেণ+বা+আর্ষভেন+বা) ঔক্ষ বিধি বা ঋষভ বিধি {ঔষধি} [বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮]
২. ঔক্ষেণ বা আর্ষভেন = উক্ষা বা ঋষভ নামক ঔষধির নরম অংশ। (গীতাপ্রেস থেকে প্রকাশিত বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮ [শঙ্করাচার্য])
৩.প্রোফেসর রাজারাম -(ঔক্ষেণ বা আর্ষভেণ) ঔক্ষ দ্বারা অথবা ঋষভ দ্বারা। [বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮]
৪.শ্রী মহাত্মা নারায়ণ স্বামী জী মহারাজ লিখেছেন- ঔক্ষ দ্বারা বা ঋষভ বিধি দ্বারা।( অর্থাৎ ঔক্ষ বা ঋষভ বিধিতে ঔষধ তৈরি করে আহার করতে বলা হয়েছে।) তিনি এ নিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন যেমন-
(ক)ঔক্ষ :- ঔক্ষ শব্দ উক্ষ সেচনে ধাতু হতে এসেছে। উক্ষ দ্বারা উক্ষণ এবং উক্ষণের বিশেষণ ঔক্ষ। ঔক্ষ বিধিসমূহ উল্লেখিত শাস্ত্রকে ঔক্ষ শাস্ত্র বলা হয়। কোন মিশ্রিত ঔষধি, পাক আদি দ্বারা তৈরি করতে কোন কোন ঔষধি কতটুকু দেওয়া উচিত এমন বিধি উল্লেখিত শাস্ত্রকে ঔক্ষ শাস্ত্র বলা হয়। অভিপ্রায় এই যে উপযুক্ত তিলৌদনম্, [মাষৌদনম্] তৈরি করতে ঔক্ষ শাস্ত্রকে লক্ষ্য করা উচিত্।...
(খ)আর্ষভ :- আর্ষভ - ঋষভ শব্দের বিশেষণ। ঋষভ এবং ঋষি শব্দ পর্যায়বাচক একার্থক শব্দ। আর্ষভ অর্থ ঋষিকৃত অথবা ঋষিদের তৈরি করা বিধি শাস্ত্র।......... [বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮]
৫.শ্রীরাম শর্মা আচার্য - উক্ষা বা ঋষভ = উক্ষা বা ঋষভ নামক ঔষধি [বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/৪/১৮]
৬.পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী - (ঋষভাণাম্, ঔষধীনাম্) শ্রেষ্ঠ ঔষধি। (অথর্ববেদ-৪/৪/৪)
৭.পণ্ডিত হরিশরন সিদ্ধান্তলঙ্কার - (ঋষভাণাম্) শক্তিসেচন্-সমর্থ ঔষধি।(অথর্ববেদ-৪/৪/৪)
৮.চিকিৎসা শাস্ত্র, ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টু ১২৩+... - (জীবকর্ষভকৌ) জীবক এবং ঋষভক ঔষধি।
৯.নিরুক্ত ১২/৯ (উক্ষণঃ) বৃদ্ধিকারক উক্ষ।
১০. উণাদিকোষ ১/১৫৯ (উক্ষা) উক্ষতি সিঞ্চনীতি উক্ষা বলিবর্দো বা।
১১. পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী- (ঔক্ষঃ)..ঔষধ। (অথর্ববেদ-২/৩৬/৭)
১২. স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক - ঋষভাঃ = ঋষভক ঔষধি (অথর্ববেদ-৩/২৩/৪)
তিনটি শব্দের বিভিন্ন ভাষ্যকারের ভাষ্য এবং বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে বিভিন্ন অর্থ আমরা দেখিয়েছি, এছাড়াও আরো অনেক দেখানো যাবে। কিন্তু উপনিষদের উক্ত কণ্ডিকায় তো যার যা ইচ্ছে সেই অর্থ ব্যবহার করলে সঠিক হবেনা। তাহলে?
তাহলে প্রথমত আমরা দৃষ্টিপাত করি যে উপনিষদের উক্ত কণ্ডিকাটির বিষয়বস্তু কি?
উক্ত কণ্ডিকাটি যে অধ্যায়ের যে ব্রাহ্মণে রয়েছে, সেটি গর্ভাধান বিষয়ক। গর্ভধারণ অর্থাৎ গর্ভাশয়ে বীর্যস্থাপন স্থিরীকরণ যে ক্রিয়ার দ্বারা হয় তাহাকে গর্ভাধান বলে। বৈদিক সংস্কৃতিতে গর্ভাধান সংস্কারকে এক নবীন, শ্রেষ্ঠ গুণ, কর্ম, স্বভাবী আত্মাকে সন্তান হিসেবে পাওয়ার জন্য ধার্মিক পবিত্র যজ্ঞ মানা হয়। যেমন উত্তম বৃক্ষ, শস্য উৎপাদন করার জন্য - উত্তম ভূমি, বীজ, খাদ, জল, জলবায়ু তথা তাহার রক্ষাদির জন্য বিশেষ খেয়াল রাখা হয়ে থাকে, ঠিক তেমনই এক বলিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ সংস্কারী আত্মাকে সন্তান হিসেবে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য গর্ভাধান পূর্বক অনেক প্রকার তৈয়ারি করতে হয়। আর সেই বিষয়েই উক্ত কণ্ডিকায় বলা হইয়াছে। বর্ণন করা হইয়াছে শ্রেষ্ঠ পুত্র লাভের জন্য কি ঔষধি ভোজন করবে।
তাহলে উক্ত কথন অনুযায়ী মাংসম্ শব্দের - ১.চ ও ৯ (পুরীষ) এবং ৬ (জ্ঞান) এইসকল অর্থ এখানে অপ্রযোজ্য। "সর্পিষ্মন্তম্" শব্দে আলাদা করে দুধ হইতে উৎপন্ন ঘী এর উল্লেখ রয়েছে, এবং ১৪,১৫ কণ্ডিকায় ক্ষীর ও দধি+ঔদনম্ এর প্রকরণ বর্ণিত করা হয়েছে। অতঃ ৭ নাম্বারে উল্লেখিত অর্থও এখানে অগ্রহণীয়।
একটি শাস্ত্রকে বুঝতে হলে কেবল ঐ শাস্ত্র পড়লেই বুঝা যায়না, অন্যান্য শাস্ত্রও অধ্যয়ন করা প্রয়োজন, আর সেজন্যই বলা হয় এক শাস্ত্র অন্য শাস্ত্রের পরিপোরক। সেই দৃষ্টিতে মাংসাহার নিয়ে মনুস্মৃতি দৃষ্টিপাত করলে দেখি যে বলা হয়েছে-
নিবর্তেত সর্বমাংসস্য ভক্ষণাৎ (মনুস্মৃতি-৫/৪৯)
অর্থাৎ সর্বপ্রকার মাংস ভক্ষণ থেকে দূরে থাকো [কোন প্রকার মাংস'ই ভক্ষণ করিবে না]।
আরও বলা হয়েছে যে -
অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী।
সংস্কর্ত্তা চোপহর্ত্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ।। (মনুস্মৃতি- ৫/৫১)
পদার্থঃ- (অনুমন্তা) বধ করার আজ্ঞাকারী (বিশসিতা) মাংস কর্তনকারী (নিহন্তা) পশু বধকারী (ক্রয়-বিক্রয়ী) মাংসের ক্রয়-বিক্রয়কারী (সংস্কর্ত্তা) রন্ধনকারী (চোপহর্ত্তা) পরিবেশনকারী (চ) এবং (খাদকশ্চেতি) ভোজনকারী (ঘাতকাঃ) ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী আর পাপী।
অনুবাদঃ- পশু বধ করার জন্য যিনি আজ্ঞা করেন, যিনি মাংস কর্তন করেন, যিনি পশু বধ তথা হত্যা করেন, যিনি মাংস ক্রয় করেন এবং যিনি বিক্রয় করেন, যিনি মাংস রন্ধন করেন, যিনি মাংস পরিবেশন করেন এবং যিনি ভোজন করেন, তাহারা ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী আর পাপী।
তাহলে উক্ত কণ্ডিকায় ১.মাংসম্ অর্থ প্রচলিত মাংস করাও সঠিক হবেনা।
তাছাড়া উক্ষা বা আর্ষভ অর্থ বৃষ (গো) করাও সঠিক হবেনা, কেননা উপরে দেওয়া শ্লোকে মাংস ভক্ষণাদি নিষিদ্ধ বলা হয়েছে এছাড়াও বেদে বলা হয়েছে -
"প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়মা গামনা গামদিতিং বধিষ্ট" (ঋগ্বেদ-৮/১০১/১৫)
অনুবাদঃ- (পরমাত্মা উপদেশ দিতেছেন যে) জ্ঞানবান ব্যক্তির নিকট আমি বলিতেছি যে, নিরপরাধ পৃথিবী সদৃশ অহিংস গোজাতিকে হত্যা করিওনা।
"গাম্ মা হিংসীঃ" (যজুর্বেদ-১৩/৪৩)
গৌকে হত্যা করিওনা।
গর্ভাধান বিষয়ক ঔষধি গুণসম্পন্ন ভোজন প্রকরণ অনুযায়ী ঔষধি অর্থই গ্রহণীয়। চিকিৎসা বিদ্যার ভাণ্ডার হলো অথর্ববেদ। সেই সর্বোচ্চ প্রামাণিক বেদেও গর্ভাধানের উক্ত বিষয়ে বলা হয়েছে-
ঋষভক [ঋষভ] নামক ঔষধি বীজের ব্যাবহার আমাদের অমোঘ-বীর্য বানায়। এই বীজ প্রয়োগকারী মাতা জীবিত সন্তানের জন্মদাত্রী হয়ে তাকে দুধ প্রদানকারী হয় [পান করায়] ।। (অথর্ববেদ-৩/২৩/৪)
সুতরাং এক্ষেত্রে অন্য কোন মতই (গোমাংস ভক্ষনের মত ঘৃণ্য মত) অগ্রহণীয় এবং অযৌক্তিক।
এরূপ ভিবিন্ন বিষয়াদি লক্ষ্য রেখেই উপনিষদের বিভিন্ন ভাষ্যকার মাংসৌদনম অর্থ [মনন চিন্তন আদি কার্য্যে উপযোগী] ঔষধি অথবা ফলের মূল অংশ করিয়াছেন। আবার - সত্যব্রত সিদ্ধান্তলঙ্কার সহ অনেক ভাষ্যকার পূর্ব কণ্ডিকা লক্ষ্য করেন যে সেই কণ্ডিকায় ১০টি ঔষধি অন্নের নাম উদ্ধৃত করা হয়েছে, যথা-
ব্রীহি ও যব ; তিল ও মাষ (মাষ=মাষকলাই); বাজরা ও প্রিয়ঙ্গু ; গোধূম, মসূর ও খল্ব (মটরের ন্যায়); খলকুল। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্- ৬/৩/১৩)
১৭ নং কণ্ডিকায় তিল+ঔদনম্ প্রকরণের উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে তিলের পরেই মাষ এর উল্লেখ রয়েছে, আর সেজন্য প্রকরণ ও ক্রম অনুযায়ী মাষ+ঔদনম্ লিখেন যার অর্থ মাষকলাই এর সহিত চাউল.....। পাঠভেদ্ অনুযায়ী মাংসৌদনম্ হয় এরূপ উল্লেখও করেছেন।

অতঃ উপনিষদে গো মাংস ভক্ষণের কোন বিধান নেই।

বেদের জ্ঞান দ্বারাই পরবর্তিতে অনেক শাস্ত্র রচিত হয়েছে। সেই বেদে আমরা গোহত্যার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ পাই।

গো হত্যা সমন্ধ্যে বেদ বলছে যে, 

"মা গাম অনাগাম অদিতিম বধিষ্ট"

(ঋগবেদ ৮।১০১।১৫

অর্থাৎ নিরপরাধ গাভী এবং ভূমিতূল্য গাভীকে কখনো বধ করো না।


শুধু তাই নয় গোহত্যাকারীকে দন্ডের বিধান দিয়ে বেদ বলছে যে -


যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে  যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব। (অথর্ববেদ ১।১৬।৪)। 

উপনিষদ বেদেরই ব্যাখ্যা  হওয়ার হেতু  উপনিষদে গোমাংস আহারের নির্দেশ কদাপি থাকতে পারে না।  আমাদের স্থুল বিচার বিবেচনার জন্যই মূলত এরূপ শঙ্কার উদ্ভব হয়েছে। আসুন বিষয়টি নিয়ে একটু  বিস্তারিত বিশ্লেষন করা যাক - 

অথ য ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পন্ডিতো বিজিগীতঃ সমিতিঙ্গমঃ শুশ্রুষিতাং বাচ্য ভাষিতা জায়েত সর্বাণ বেদাননুববীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাষৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্নীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবা ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা।। 

(বৃহঃ উপঃ ৬।৪।১৮) 

শব্দার্থঃ (অথ যঃ ইচ্ছেত্ পুত্রঃ মে) এবং যে এই ইচ্ছা করে যে আমার পুত্র (পন্ডিতঃ) বিদ্বান (বিজিগীথঃ) প্রসিদ্ধ (সমিতিয় গমঃ) সভায় গমন যোগ্য (শুশ্রুষিতাম বাচম্ ভাষিতা) আদরের সহিত শ্রবণ যোগ্য ভাষনকারী (জায়েত) হবে (সর্বাণ বেদাননুববীত সর্বম্ আয়ু ইয়াত্ ইতি) সমস্ত বেদের জ্ঞাতা পূর্নায়ুর উপভোক্তা হবে তো (মাষৌদনম্) [পাঠভেদ - মাংসৌদম্] মাষের [কলাই বিশেষ] সাথে চাউল (পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তম্ অশ্নীয়াতাম্ ইশ্বরী জনয়িতবৈঃ) পাক করে ঘৃতের সাথে উভয়ে [স্বামী স্ত্রী] আহার করে তো (অপেক্ষেত পুত্র) পুত্র উৎপন্ন করতে সমর্থ হবে (ঔক্ষেণ বা আর্ষভেণ) ঔক্ষ [বিধি] দ্বারা অথবা ঋষভ [বিধি] দ্বারা। 

সরলার্থঃ এবং যে এই ইচ্ছা করে যে আমার পুত্র বিদ্বান প্রসিদ্ধ সভায় গমন যোগ্য আদরের সহিত শ্রবণ যোগ্য ভাষনকারী হবে,  সমস্ত বেদের জ্ঞাতা পূর্নায়ুর উপভোক্তা হবে তো  মাষের [কলাই বিশেষ] সাথে চাউল পাক করে ঘৃতের সাথে উভয়ে [স্বামী স্ত্রী] আহার করে তো পুত্র উৎপন্ন করতে সমর্থ হবে ঔক্ষ [বিধি] দ্বারা অথবা ঋষভ [বিধি] দ্বারা। 

তাৎপর্যঃ এই কন্ডিকার মধ্যে বর্ণিত পুত্র প্রাপ্তির জন্য বলা হয়েছে যে, মাষের সাথে পাককৃত চাউল বিধির সাথে আহার করা উচিৎ।  এই পুত্র এবং পুত্রি উৎপন্ন করার জন্য অপেক্ষিত সাধনের কাজে নেবার শিক্ষাকে সমাপ্ত করে ইহা বলা হয়েছে যে, সব প্রকারে পুত্র কে উৎপন্ন করা আদির কৃত্য ঔক্ষ এবং আর্ষভ বিধি দ্বারা করা উচিৎ। 

ঔক্ষ বিধিঃ ঔক্ষ শব্দ উক্ষ (সেচনে) ধাতু হতে এসেছে।  উক্ষ দ্বারা উক্ষণ এবং উক্ষণের বিশেষন ঔক্ষ। ঔক্ষ বিধি বর্ণনাকারী শাস্ত্রকে ঔক্ষ শাস্ত্র বলে।  কোন মিশ্রিত ঔষধি পাক আদি তৈরীতে কোন কোন ঔষধি কি কি মাত্রায় পড়া উচিৎ তাহা বর্ণনাকারী শাস্ত্রের নাম ঔক্ষ শাস্ত্র। অভিপ্রায় এই যে, উপরিউক্ত মাষের অথবা তিলৌদন আদির প্রস্তুতে এই (ঔক্ষ শাস্ত্র) র মর্যাদা কে লক্ষ্য রেখে কাজ করা উচিৎ। 

আর্ষভ বিধিঃ আর্ষভ - ঋষভ শব্দের বিশেষন। ঋষভ এবং ঋষি শব্দ পর্যায়বাচক।  আর্ষভের অর্থ ঋষিকৃত অথবা ঋষিদের বানানো কিছু।  ঔক্ষ শাস্ত্রের সাথে এই আর্ষভ শব্দের ভাব এই যে, ঋষিদের বানানো বিধি (পদ্ধতি) র নামই ঔক্ষ শাস্ত্র। অর্থাৎ কোন অনভিজ্ঞর বানানো বিধিকে ঔক্ষ শাস্ত্র বলা হয় না।  ঋষিকৃত পদ্ধতিই ঔক্ষ শাস্ত্র। 

মাষৌদনঃ  নিরুক্তেও মাংস শব্দের অর্থের মনন, সাধক, বুদ্ধিবর্ধক মন কে রুচি দানকারী বস্তুকে বলা হয়েছে। যা ফলের রসালো অংশ,  ঘী,  মাখন, ক্ষীর আদি পদার্থ (মাংস মাননং বা মানসং বা মনোস্মিনৎসীদতীতি ; নিরুক্ত ৪।৩)।  নিরুক্তেও মাংস শব্দের অর্থের মনন, সাধক, বুদ্ধিবর্ধক মন কে রুচি দানকারী বস্তুকে বলা হয়েছে। যা ফলের রসালো অংশ,  ঘী,  মাখন, ক্ষীর আদি পদার্থ (মাংস মাননং বা মানসং বা মনোস্মিনৎসীদতীতি ; নিরুক্ত ৪।৩)। 

এবং এই দৃষ্টি দ্বারা মাষৌদন কে মাংসৌদন বলা যায়।  এই জন্য কোন প্রকরণে গো মাংস অর্থে মাংসের প্রয়োগ  যা  এই প্রকরনে নেই। এইজন্য যে দশ ঔষধিকে দ্বারা মাষ এবং ঔদন বর্ননার বিধান  রয়েছে তাহার নাম স্বয়ং উপনিষদই  উল্লেখ করেছে - 

(i) ধান্য (ii)  যব (iii) তিল (iv) মাষ (v) বাজরা (vi) প্রিয়জু (vii) গোধূম (viii) মসুর (ix)  খল্ব (x) থলকুল। 

(বৃহঃ উপঃ ৬।৩।১৩) 

এখানে একটা বিষয়ে গভীর ভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ যে, এই ঔষধির গণনা করে  দেখা যাচ্ছে তিলের পরেই মাষের উল্লেখ রয়েছে। এইজন্য সতেরো কন্ডিকায় তিলৌদন এবং তাহার পরে আঠারো কন্ডিকায় মাষৌদনের উল্লেখ। অন্যথা মাংসের তো এখানে যেমন বলা হলো তার কোন প্রকরনই নেই। 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ