মুণ্ডকোপনিষদের ৩য় মুণ্ডকের ১ম খণ্ড।
এই খণ্ড শুরু হয়েছে চমৎকার একটি বেদ মন্ত্রের দ্বারা। মন্ত্রটি হচ্ছে -
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি।।
সরলার্থঃ অনাদিকাল থেকে একসাথে অবস্থানকারী পরস্পর মৈত্রীভাবযুক্ত ঈশ্বর এবং জীবরূপ দুই পক্ষী অনাদিরূপ স্বসমান বৃক্ষকে আশ্রয় করে আছেন। এই উভয়ের মধ্যে ঈশ্বর থেকে ভিন্ন জীব সুখ দুঃখাত্মক কর্মফলকে উৎকৃষ্ট মনে করে ভোগ করে, অন্য পরমাত্মা কর্মফল ভোগ না করে কেবল সাক্ষীরূপে দেখেন।
এটি ঋগ্বেদ ১/১৬৪/২০ নং মন্ত্র হবে ।। এই মন্ত্রে আলঙ্কারিক ভাষাতে ঈশ্বর, জীব এবং প্রকৃতির বর্ণনা আছে। প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন এই ব্রহ্মাণ্ড এক বৃক্ষ সদৃশ। এই বৃক্ষে দুটি পক্ষী, যার মধ্যে একজন বৃক্ষের সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করছে এবং অন্যজন ভক্ষণ না করে সাক্ষী মাত্র।
ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বর নিজের সর্বব্যাপকত্ব দ্বারা ওতপ্রোত এবং জীব মনুষ্যাদি যোনীতে এসে সাংসারিক বস্তুসমূহের উপভোগ করছে। এজন্য জীব এই পক্ষি যিনি ফলকে ভক্ষণ করছেন আর সাক্ষীমাত্র যিনি রয়েছেন তিনি ঈশ্বর। মন্ত্রে প্রযুক্ত "সযুজা" এবং "সখায়া" শব্দ ঈশ্বর এবং জীব উভয়ের বিশেষণ যার অভিপ্রায় হচ্ছে - ঈশ্বর এবং জীবের নিত্যত্বে কোনো পার্থক্য নেই। আর প্রকৃতিকেও বৃক্ষের উপমা দিয়ে তাকে উভয় পক্ষীর আশ্রয়স্থান বলা হয়েছে, তাহলে প্রকৃতিরও নিত্যত্ব ঈশ্বর এবং জীবের সমানই রয়েছে।
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোঽনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
সরলার্থঃ প্রকৃতিরূপ বৃক্ষে ভোক্তা জীবাত্মা অজ্ঞানে নিমগ্ন প্রকৃতির অবর্ণাত্মক শক্তি দ্বারা মোহিত হয়ে শোক করেন। যখন যোগীগণ দ্বারা সেবিত ঈশ্বরকে নিজ থেকে ভিন্নরূপে দেখেন এবং এঁর সংসাররূপ মহিমাকে দর্শন করেন তখন শোকরহিত হয়ে যান।।
দুটি পক্ষীর মধ্যে প্রথম পক্ষী ভোক্তারূপ জীবাত্মা প্রকৃতিরূপ বৃক্ষে অজ্ঞানে নিমগ্ন এবং মিথ্যাজ্ঞানে সন্তপ্ত। এই দশা ততক্ষণ পর্যন্ত থাকে যতক্ষণ তিনি নিজের সখা অন্য পক্ষীকে (যিনি কার্যকারণরূপ জগতের গুণ থেকে পৃথক সেই পরমাত্মাকে) না জানেন এবং তাঁর বিভূতিকে যা সর্বত্র বিস্তৃত আছে তা নিজের জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা না দেখেন। যখন তিনি বহু জন্মের পুরুষার্থ এবং নানা সাধনসম্পন্ন হয়ে সেই সর্বশক্তিমান শ্লোকে "জুষ্টম" এবং "অন্যম" এই দুটি পদ স্পষ্টভাবে জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে ভেদ সিদ্ধ করে।
যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্।
তদা বিদ্বান্ পুণ্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি।।
সরলার্থঃ যখন উপাসক জীব স্বতঃপ্রকাশ, বিশ্বের কর্তা, সর্বশক্তিসম্পন্ন, সর্বোপরি কারণ পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ করেন, তখন ওই ব্রহ্মবেত্তা পুরুষ পাপ পূণ্য উভয়কে দূর করে অবিদ্যারূপ ক্লেশ রহিত হয়ে পরমাত্মার নিষ্পাপাদি ধর্মের সমতাকে প্রাপ্ত হন।।
এই শ্লোকের একটি বিশেষতা আছে। মায়াবাদীদের মতে জীব ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্ম হয়ে যান কিন্তু তা নয়। এই শ্লোকে বলা হয়েছে জীব ঈশ্বরের সমতাকে প্রাপ্ত হয়। আর এটি সিদ্ধ করে যে, জীব কখনো ব্রহ্ম হয়ে যায় না বরং তদ্ধর্মতাপত্তি দ্বারা ব্রহ্মের ধর্মকে ধারণ করেন। যদি এখানে জীব ব্রহ্মের একতার কথা বলা হতো তবে শ্লোকে "সাম্যমুপৈতি" = মুক্তি অবস্থাতে জীব ব্রহ্মের সমতাকে প্রাপ্ত হন, এই কথা বলা হতো না।
তৃতীয় মুণ্ডক ১ম খন্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ শ্লোকের আলোকপাত করতেছি। উপরে বলে দিয়েছি
আমরা ঈশ্বরকে কিভাবে লাভ করতে পারি সে বিষয়ে বলা হচ্ছে -
সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ অাত্মা সম্যগ্ জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্যেণ নিত্যম্।
অন্তঃশরীরে জ্যেতির্ময়ো হি শুভ্রো যং পশ্যন্তি যতয়ঃ ক্ষীণদোষাঃ।।
সরলার্থঃ শরীরের মধ্যে প্রকাশস্বরূপ শুদ্ধ এই আত্মা নিশ্চিতরূপে সত্য, যথার্থ জ্ঞান এবং ব্রহ্মচর্যরূপ তপ দ্বারা লব্ধ হয়। যাঁর অবিদ্যাদি দোষ ক্ষীণ হয়েছে, এইরূপ সাধনসম্পন্ন পুরুষই তাঁকে দর্শন করেন।।
এই পরমাত্মা (যিনি শরীরের মধ্যে প্রকাশমান হয়ে আছেন) সত্যের যথার্থ সেবন দ্বারা প্রকট হন অর্থাৎ তাঁর প্রাপ্তির সবচেয়ে উত্তম সাধন সত্য (মন, বাক্য এবং কর্মের অভিন্নতা)। যার মন, বাক্য এবং কর্মের একতা নেই তিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করতে পারে না। অতএব ব্রহ্মের জিজ্ঞাসুকে সবার প্রথমে সত্যের ব্রত ধারণ করা উচিত।
সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।
যেনাক্রমন্ত্যৃষয়ো হ্যাপ্তকামা যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্।।
সরলার্থঃ সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়। সত্যের দ্বারাই জ্ঞানরূপী মার্গ বিস্তৃত হয়। যে মার্গ দ্বারা আপ্তকাম ঋষিগণ নিশ্চিতভাবে গমণ করেন, যেখানে ওই সত্যের পরম অধিষ্ঠান ব্রহ্ম ।।
'সত্যমেব জয়তে' এই বাক্য আমরা বহু জায়গায় বহুবার শুনেছি। এটিই সেই উপনিষদের বিখ্যাত একটি বাক্য।
এখন উক্ত সৎরূপ ব্রহ্মের স্বরূপের বর্ণনা করছেন -
বৃহচ্চ তদ্ দিব্যমচিন্ত্যরূপং সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি।
দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্।।
সরলার্থঃ ওই ব্রহ্ম মহান এবং প্রকাশস্বরূপ, অচিন্ত্যস্বরূপ, তিনি সূক্ষ্ম থেকেও অতিসূক্ষ্ম, দীপ্তিমান। তিনি দূর থেকেও দূরে এবং এই জীবের অন্তঃকরণের নিকটে, এই জগতে জ্ঞানদৃষ্টিসম্পন্ন দ্রষ্টাদের মধ্যে অন্তঃকরণরূপী গুহাতে বিরাজমান।।
ব্রহ্ম সর্বব্যাপক হওয়ার কারণে "বৃহৎ", স্বপ্রকাশ হওয়ার কারণে "দিব্য স্বরূপ", ইন্দ্রিয়াগোচর হওয়ার কারণে "অচিন্তরূপ", কুটস্থ নিত্য হওয়ার কারণে সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্ম, অজ্ঞানীদের জন্য অতি দূর এবং জ্ঞানীর জন্য অতি নিকটে। অর্থাৎ পরমাত্মা যদিও সর্বত্র বিদ্যমান তবুও যারা পরমাত্মা বিমুখ তাদের নিকট তিনি অনেক দূরে।
ব্রহ্ম সর্বব্যাপক হওয়ার কারণে "বৃহৎ", স্বপ্রকাশ হওয়ার কারণে "দিব্য স্বরূপ", ইন্দ্রিয়াগোচর হওয়ার কারণে "অচিন্তরূপ", কুটস্থ নিত্য হওয়ার কারণে সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্ম, অজ্ঞানীদের জন্য অতি দূর এবং জ্ঞানীর জন্য অতি নিকটে। অর্থাৎ পরমাত্মা যদিও সর্বত্র বিদ্যমান তবুও যারা পরমাত্মা বিমুখ তাদের নিকট তিনি অনেক দূরে।
ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা নান্যৈর্দেবৈস্তপসা কর্মণ বা।
জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্বস্ততস্তু তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মানঃ।।
न चक्षुषा गृह्यते नापि वाचा नान्यैर्देवैस्तपसा कर्मण वा ।
ज्ञानप्रसादेन विशुद्धसत्त्वस्ततस्तु तं पश्यते निष्कलं ध्यायमानः ॥মান্ডূক্যোপনিষদ্ ৩।১।৮
সরলার্থঃ সেই ব্রহ্ম না চক্ষুদ্বারা, না বাক্যদ্বারা, না অন্য ইন্দ্রিয়গুলিদ্বারা, না তিতিক্ষা আর না কর্ম দ্বারা গৃহীত হন। জ্ঞানের মহত্ত্ব দ্বারা বিশুদ্ধ অন্তঃকরণযুক্ত ঐ ধ্যানশীল পুরুষ সেই নিরবয়ব পরমাত্মাকে দর্শন করেন।।
যে বস্তুর আকার বা পরিমাণ আছে তা আমরা নেত্র দ্বারা দেখতে পারি কিন্তু অপ্রমেয় বস্তুকে (যার কোন বর্ণ এবং পরিমাণ নেই তাঁকে) এই চর্মচক্ষু দ্বারা কিভাবে দেখা যেতে পারে? যেমন নির্বচনীয় বস্তুর বাক্য দ্বারা নির্বচন হতে পারে। কিন্তু যিনি অচিন্ত্য এবং অনির্বচনীয়, যাঁর বিষয়ে মহান ঋষিগণ "নেতি নেতি" বলে নিজেদের অপর্যাপ্ত নির্বচনকে সমাপ্ত করেছেন, তাঁকে বাক্য কিভাবে প্রকাশ করতে পারে? যখন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রধান চক্ষু এবং কর্মেন্দ্রিয়ের মুখ্য বাক্যের এই দশা, তখন অন্য ইন্দ্রিয়ের কি কথা।
এখন জীবাত্মার স্বরূপ বলে মুক্তির বর্ণনা করছেন -
এষোহণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্ প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্ বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ অাত্মা।।
সরলার্থঃ উক্ত পরমাত্মার ধ্যানশীল এই জীবাত্মা সূক্ষ্ম, এই কথা জিজ্ঞাসুগণ নিজের অনুভব দ্বারা জানেন। এই আত্মায় পাঁচ প্রকারের প্রাণ সন্নিবিষ্ট এবং মুক্তি অবস্থায় এই জীবাত্মা শুদ্ধ পরমাত্মাতে বিরাজমান হন, যাঁর মধ্যে সম্পূর্ণ প্রজার ইন্দ্রিয়ের সাথে চিত্তও ওতপ্রোত থাকে।।
এই শ্লোকে জীবাত্মা এবং পরমাত্মার স্বরূপ বর্ণনা করে উপাস্য উপাসকভাব দ্বারা উভয়ের পার্থক্য স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রাণ, অপান, উদান, সমান এবং ব্যান এই পাঁচ প্রকারের প্রাণ সন্নিবিষ্ট তিনি জীবাত্মা। এই জীবাত্মা স্বরূপে অণু অর্থাৎ সূক্ষ্ম। তিনি মুক্তির অবস্থাতে শুদ্ধ ব্রহ্মে বিরাজমান হন।
যং যং লোকং মনসা সংবিভাতি বিশুদ্ধসত্ত্বং কাময়তে যাংশ্চ কামান্।
তং তং লোকং জয়তে তাংশ্চ কামাং স্তস্মাদাত্মজ্ঞং হ্যর্চয়েদ্ ভূতিকামঃ।।
সরলার্থঃ নির্মল অন্তঃকরণযুক্ত মুক্ত পুরুষ যেই যেই অবস্থাকে আত্মভূত সামর্থ্য দ্বারা চিন্তন করেন এবং যে সকল ভোগ কামনা করেন, তিনি সেই সেই অবস্থা এবং সেই সকল ভোগ প্রাপ্ত হন। এজন্য মুক্তিরূপ বিভূতিকামী আত্মজ্ঞ মুক্ত পুরুষকে গুরুভাবে পূজা অর্থাৎ শ্রদ্ধা-সৎকার করবে।
এই শ্লোকে মুক্ত পুরুষের বিশেষতার বর্ণনা করে বলা হয়েছে তিনি যে কামনা করেন সেটিই পূর্ণ হয়। সত্যকাম হওয়ার কারণে তাঁর সংকল্প বৃথা হয় না। এখানে এই শঙ্কা উৎপন্ন হয় যে- যখন তত্তজ্ঞানের প্রভাবে মানুষ এই সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন তিনি লোক বা ভোগের বন্ধনে কেন আসবেন? এর সমাধান হচ্ছে - তিনি সাধারণ মানুষের মতো কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জন্ম এবং ভোগের ভাগী হন না বরং স্বেচ্ছাচারী হওয়ার কারণে যদি সংসারে জন্ম নিতে চান অথবা ভোগের ইচ্ছা করেন তখন নিজের সংকল্পমাত্র সেটি করতে পারেন। কারণ তিনি অমোঘসংকল্প হওয়ার কারণে যা ইচ্ছা করেন, তা বৃথা হয় না।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ