অহল্যা পুরাণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

03 November, 2020

অহল্যা পুরাণ

অহল্যা পুরাণ
অহল্যা পুরাণ(উপাখ্যান)
 ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতেই প্রথম ইন্দ্রের সঙ্গে অহল্যার সম্পর্কের আভাস দেওয়া হলেও রামায়ণেই ( প্রথম স্পষ্টভাবে ও সবিস্তারে তাঁর পরকীয়া সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে (৩০ অ - ১৯–৩১) অহল্যার এই রূপ বিবরণ লিখিত হইয়াছে।রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে(রামাযণের এই কান্ড টি প্রক্ষিপ্তব্রহ্মা সংস্কৃত "অহল্যা" নামটির সংজ্ঞায় বলেছেন "যিনি অসৌন্দর্যের অখ্যাতি হতে মুক্ত" অথবা "যিনি নিখুঁত সুন্দরী"। এই প্রসঙ্গে ইন্দ্রকে তিনি বলেছেন কীভাবে তিনি সকল সৃষ্টির বিশেষ সৌন্দর্য আহরণ করে তা অহল্যার শরীরের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন।( Gita Press 1998, পৃ. 681–2 (Verses 7.30.22–23)।)
ইন্দ্র #অহল্যা কাহিনী পাওয়া যায় বাল্মীকি রামায়ণের দুই জায়গায়-
১)আদিকাণ্ডে
২) উত্তরকাণ্ডে
तस्य अन्तरम् विदित्वा तु सहस्राक्षः शची पतिः |
मुनि वेष धरो भूत्वा अहल्याम् इदम् अब्रवीत् || १-४८-१७
सहस्राक्षः=সহস্রাক্ষ शची पतिः= শচী পতি।
ঋষি গৌতম বিদেশে গমন করেছিলেন জেনে শচী পতি ইন্দ্র মুনি বেশ ধারণ করে অহল্যাকে এই কথা বলেছিলেন (রামায়ণ আদিকাণ্ড (48/17)।
রামায়ণ আদিকাণ্ড 48 অধ্যায়ের 27 তম শ্লোকে পাই,
मम रूपम् समास्थाय कृतवान् असि दुर्मते |
अकर्तव्यम् इदम् यस्मात् विफलः त्वम् भविष्यति || १-४८-२७
विफलः=বিফলঃ (ফলবিহীন বা পুরুষত্বহীন)
त्वम्=ত্বম (তুমি) भविष्यति=ভবিষ্যান্তি( ভবিষ্যতে)
ঋষি গৌতম অহল্যাগমনের ফলে ইন্দ্রের অণ্ডকোষ ধ্বংস হবার অভিশাপ দেন।
রামায়ণে ইন্দ্রের সহস্রাক্ষ হবার ব্যাপারে ঋষি গৌতমের অভিশাপের কোনো ভূমিকা নেই।।
মহাভারতে বারংবার ইন্দ্র কর্তৃক অহল্যাকে ধর্ষণের বিভিন্ন রকম বৃত্তান্ত পাওয়া যায়।
মহাভারত শান্তিপর্ব 342/23 মতে গৌতমের অভিশাপে ইন্দ্রের শ্মশ্রু হরিদ্বর্ণ হয়েছিল।
আবার শান্তিপর্ব 165 অধ্যায় মতে, গৌতম তার পুত্র চিরকারীকে ধর্ষিত হবার অপরাধে অহল্যাকে হত্যা করে আদেশ করে তিনি বনে গমন করেন। কিন্তু চিরকারী মাতৃহত্যা অনুচিত বিধায় আদেশ পালনে বিলম্ব করেন।ততক্ষণে গৌতম বুঝতে পারেন অহল্যা নিরপরাধা।তাই তিনি দীর্ঘ বিলাপপূর্বক পাষাণবৎ অহল্যাকে ক্ষণা করেন।
পদ্মপুরাণ সৃষ্টিখণ্ডে সর্বপ্রথম ইন্দ্রের সহস্রাক্ষ হবার উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও বাংলা মহাকাব্যে ও এই উপাখ্যান পাওয়া যায় যেখানে ইন্দ্রের সহস্রাক্ষের কারণ হিসেবে গৌতম মুনির অভিশাপ বর্ণিত।
নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই কাহিনীকেই যুগোচিত পরিবর্তন সাধন করে পাষানী নাটকে স্থান দিয়েছেন। অহল্যা উপাখ্যান যে রুপক কাহিনী তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অহল্যার প্রসঙ্গ বেদে পাওয়া যায়না। কিন্তু ইন্দ্র সহস্রাক্ষ বেদে পুরাণে সর্বত্র আছেন।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র অহল্যা-উপাখ্যানের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন "অহল্যা অর্থাৎ যে ভূমি হলের দ্বারা কর্ষিত হয়না_কঠিন, অনুর্বর। ইন্দ্র বর্ষণ করিয়া সেই কঠিন ভূমিকে কোমল করেন, জীর্ণ করেন__ এই জন্যে ইন্দ্র অহল্যার জার। জ্ঞ ধাতু হইতে জার শব্দ নিস্পন্ন হয়। বৃষ্টির দ্বারা ইন্দ্র তাহাতে প্রবেশ করেন, এইভাবে তিনি অহল্যা অভিগমন করেন।" বঙ্কিমচন্দ্রের মতে আকাশই ইন্দ্র এবং আকাশের সহস্র তারকা ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু।
"ইন্দ্র ধাতুবর্ষণে। তদুত্তর 'র ' প্রত্যয় করিয়া ইন্দ্র শব্দ হয়। অতএব যিনি বৃষ্টি করেন তিনিই ইন্দ্র। আকাশ বৃষ্টি করে, অতএব ইন্দ্র আকাশ "
"ইন্দ্র সহস্রাক্ষ,কিন্তু ইন্দ্র আকাশ। আকাশের সহস্র চক্ষু কে না দেখিতে পায়?.....
সহস্র তারকাযুক্ত আকাশ, সহস্রাক্ষ ইন্দ্র।"
বঙ্কিমচন্দ্র প্রমাণস্বরুপ গ্রীকপুরানের সহস্রাক্ষ আকাশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় ইন্দ্রের মতো গ্রীকদেবতা
আর্গস সহস্রলোচন।
"Greeks had still present to their thought the meaning of Argos Pannoptes, Io's hundred eyed all seeing guard, who was slain by Hermes and obanged into a peacock for Maorobus writes as reoognizing in him the star-eyed heaven itself ; as the Aryan Indra--the Sky-- is the 'thousand eyed'."
ইন্দ্র দেবতার প্রকৃত স্বরুপ পূর্বেই বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। সূর্যের বা অগ্নির যে শক্তি বা মূর্তি বারিবর্ষণের উপযোগী অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেন, তিনিই ইন্দ্র।
শীতে ও গ্রীষ্মে শুষ্ক মৃত্তিকা থাকে, হলকার্যের অযোগ্য →(অহল্যা)।
এই সময়ে সূর্যের হরিদ্বর্ণ রশ্মি ভূভাগ থেকে রস আহরণ করে। বাষ্পীভূত রস আকাশে মেঘরুপে পুঞ্জীভূত হয়। ইন্দ্র বজ্রদ্বারা বারিবর্ষণের প্রতিকূল অবস্থা বৃত্রাদি অসুরকূলকে ধ্বংস করে বৃষ্টিরুপে অহল্যা মৃত্তিকার সঙ্গে মিলিত হন,→অহল্যা ভূমি হল্যা কর্ষণোপযোগী হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্ষার আগমনে সূর্যাগ্নি-রুপী ইন্দ্র সহস্রকিরণে শোভিত হয়ে প্রকাশিত হন,→ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু উন্মীলিত হয়। এই সর্বজনবিদিত প্রাকৃতিক ঘটনাই ইন্দ্র - অহল্যা সংবাদের রুপকে প্রকাশিত হয়েছে।
ঋগ্বেদের দুটি ঋকে সীতার স্তুতি করা হয়েছে। একটি ঋকে বলা হয়েছে→
"ইন্দ্র সীতাং নিগৃ্হ্লাতু, তাং পুষাণুযচ্ছতু।"
→ইন্দ্র সীতাকে গ্রহন করুন,পূষা তাকে বর্ধিত করুন।সায়নের মতে সীতা লাঙ্গল - পদ্ধতি অথবা 'সীতাধারকাষ্ঠা' লাঙ্গলের যে অংশে ফাল লাগানো থাকে সেই অংশ। আচার্য মহীধরের মতে সীতা শব্দের অর্থ মৃত্তিকায় লাঙ্গলের দ্বারা চিহ্নিত রেখা,; → ইন্দ্রকৃত বারিবর্ষনের ফলে সীতা অর্থা লাঙ্গল-পদ্ধতি বা হলচালনরেখা সুগম হবে এবং সূর্যরুপা পূষা সে হল কার্যকে সার্থক করে তুলবেন, এই বক্তব্য ঋষিকবির। ঋগ্বেদের উক্ত সুক্তটি চাষ আরম্ভ করার পূর্বে পঠিত হয় বলে গৃহসুত্রে উল্লেখিত আছে,ইন্দ্র-সীতা সংযোগই পরবর্তীকালে ইন্দ্র-অহল্যা-সংবাদে­ রুপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করি।
সূর্যই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চক্ষুস্বরুপ। সহস্র সূর্যকিরনই ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু। অথবা যে অগ্নি বর্ষার অপগমে স্বতেজে সহস্র লেলিহান শিখার প্রদীপ্ত হয়ে ওঠেন সেই অগ্নির সহস্র শিখাই ইন্দের সহস্র চক্ষু। বেদে সূর্য এবং অগ্নি উভয়েই সহস্রাক্ষ। সূর্য সহস্র শৃঙ্গও।
↑↓↑↓
"সহস্রশৃঙ্গো বৃষভো যঃ সমুদ্রা দুধাচরৎ।"→সহস্রশৃঙ্গ­ বৃষভ(বর্ষনকারী)সূর্য­,
যিনি সমুদ্র হতে উদিত হন,,,
"ইমং মা হিংসীদ্বিপাদং পশুং সহস্রাক্ষো মেধাব চীয়মনঃ।"→ হে সহস্রাক্ষ অগ্নি, যজ্ঞে চীয়মান হয়ে তুমি দ্বিপাদ পশুদের
(মানুষ্যগনের) হিংসা করোনা।
অগ্নে সহস্রাক্ষ শতমূর্খস্থতং তে প্রানাঃ সহস্রং ব্যানাঃ
সুব্রহ্মাত্মা সুবর্চস্বঃ সহস্রাচিঁবিঁভাবসুঃ।।
→হে অগ্নি, তুমি তুমি সহস্র চক্ষুবিশিষ্ট, শত তোমার মস্তক, শত তোমার প্রান,সহস্র ব্যান,তুমি ব্রহ্মস্বরুপ,শ্রেষ্ঠ­ তেজসমন্বিত, সহস্র কিরনমন্ডিত বিভাবসু।
গৌতমের অভিশাপে অভিশাপে ইন্দ্রের দেহে সহস্র ভগক্ষত হয়েছিলো। আধুনিক কালে ভগ অর্থ যোনি বুঝায়। ভগ শব্দের প্রাচীন অর্থ ধন বা ঐশ্বর্য। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন, "ভগো ভজতেঃ।" ভজ ধাতুর সঙ্গে ঘঞ প্রত্যয় ক'রে ভগ শব্দ নিস্পন্ন।
অতএব ভগ শব্দের অর্থ ধন বা সম্পদ।ভগ বা ঐশ্বর্য যার আছে তিনিই ভগবান্। এখানে ঐশ্বর্য বলতে পার্থিব ঐশ্বর্য না বুঝিয়ে ষড়ৈশ্বর্য বা বিভুতি বোঝায়। যার যোনি আছে, এই অর্থে ভগবান হওয়া সম্ভব নয়। গীতায় শ্রীভগবান্ তার ভগ্ বা বিভুতির বর্ননা দিয়েছেন দশম অধ্যায়ে। সূর্য যে বিশ্বের আত্মারুপে, মানবের পরিচিত জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যবান, তাতে আর সন্দেহ কি? সুতরাং সূর্যাগ্নিরুপি ইন্দ্র সহস্র প্রকার ভগ্ বা ঐশ্বর্যের অধিকারী, →এত স্বতঃসিদ্ধ। ভগবান্ সূর্য সম্পর্কে গৌতমের অভিশাপ নিছক উপন্যাস।
পুরানাদিতে ভগ দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। কর্মপুরানানুসারে ভগ ভাদ্র মাসের সূর্য, "স্কন্দপুরানে ভগ মাঘ মাসের সূর্য।" মৈত্রাষনী সংহিতা অনুসারে ভগ শব্দের অর্থ অনুদিত আদিত্য। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে ভগ আদিত্যরুপেই বর্ণিত হয়েছেনঃ
"প্রাতর্জিতংভগমুগ্রং­ হুবেম্ বর্ষং পূত্রমদিতেঃ।
→আমরা প্রাতঃকালে তমোবিজয়ী অদিতির অর্থাৎ প্রাতঃসন্ধ্যার পুত্র উদ্গর্ণ অর্থাৎ উদষার্থ সমুদ্ভুত বা উদিত প্রায় ভগকেই আহ্বান করিতেছি।
নিরুক্তকার বলেছেন যে ভগ অন্ধ।
↓↓
"অন্ধ ভগ ইত্যাহুরমুৎসৃপ্তো ন দৃশ্যতে।"
→ভগ অন্ধ ইহা বলা হয়ে থাকে, সূর্য ভাবপ্রাপ্ত না হইলে দৃষ্টিগোচর হননা।
রাত্রিকালে জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন সুতরাং ভগ অন্ধ। দিবাভাগে তিনি চক্ষুমান, সর্বজগৎ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
"জনং ভগো গচ্ছতীতি বা বিজ্ঞায়তে,
জনং গচ্ছত্যাদিত্য উদ্বয়েন।"
ভগ মনুষ্যকে প্রাপ্ত হয়, ইহাও বিজ্ঞাত হইয়া থাকে, - আদিত্য উদিত হইয়াই ভগ প্রাপ্ত হয়।
যাস্কের মতানুযায়ী ভগ উদয়কাশীন সূর্য। যে মাসের বা যে সময়ের সুর্য হোন না কেন, ভগ যে সুর্য বা সূর্য রশ্মি, তাও কোন সন্দেহ নাই।
সূর্যাগ্নিরুপি ইন্দ্রের সহস্র কিরণ বা কিরণরুপী বিভূতিই যে সহস্র ভগ তা ত অত্যন্ত প্রাঞ্জল।
আচার্য কুমারিল ভট্র ইন্দ্রকে সুর্যরুপে গ্রহন করে অহল্যা উপখ্যানের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন:- ↓↓
"সমস্ততেজাঃ পরমেশ্বর নিমিতেন্দ্র শব্দবাচ্যঃ সবিতৈবাহনি নীয়মানতয়া বাত্রেধহল্যাশব্দবাচ্­যায়াঃ ক্ষয়াত্মক জবণহেতুত্বাজ্জীর্জত্­যস্মাদনেন বোধিতেন অহল্যাজাব ইত্যুচ্যতে ন পরস্ত্রীব্যাভিচারাৎ।­"
→সকল তেজের আধার সবিতা পরম ঐশ্বর্যময়ত্বহেতু ইন্দ্র পদবাচ্য। দিবাভাগকে লয় করে বলেই রাত্রির নাম অহল্যা। সেই রাত্রিকে ক্ষমাত্মক জবণকার্যের জন্যে অর্থাৎ জীর্ণ করার জন্যে ইন্দ্রকে অহল্যাজাব বলা হয়েছে, পরস্ত্রী ব্যাভিচারের জন্যে নয়।
অহল্যা কৃষিকার্যের অনুপযোগী ভূমিই হোক আর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিই হোক ইন্দ্রের অহল্যাভিগমন মানববেশি দেবরাজের দৈববৃত্তিক ক্রিয়া একথা কোনমতেই স্বতঃসিদ্ধ নয়। বরং সূর্যরূপী ইন্দ্রের ক্রিয়াবিশেষ।

বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৪৮-৫১ তম অধ্যায়ে
উত্তরকাণ্ডের ৩০ তম অধ্যায়ে

প্রসঙ্গত, এখানে দুটো কাণ্ডে ঘটনা সম্পূর্নভাবে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গিয়েছে। আদিকাণ্ডে যেখানে অহল্যা ও ইন্দ্র সেচ্ছায় পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে সেখানে উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছে। অর্থাৎ এখানে স্পষ্টই দুইস্থানে পরষ্পরবিরুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। তাই প্রথমেই আমাদের এদের থেকে একটাকে গ্রহণ করতে হবে।
আদিকাণ্ডের কাহিনী কতকটা এরকম-
মহর্ষি গৌতম ও তার পত্নী অহল্যা মিথিলার উপকণ্ঠে এক তপোবনে বাস করতেন, একদিন সেখানে শচীপতি ইন্দ্র, গৌতমমুনির অনুপস্থিতিতে গৌতম মুনির বেশ ধারন করে যান এবং অহল্যার সাথে শারীরিক মিলন প্রত্যাশা করেন। যদিও অহল্যা তাকে চিনতে পারেন কিন্তু তাও তিনি ইন্দ্রের সাথে মিলনে প্রবৃত্ত হন, এবং তারা দুজনেই সন্তৃপ্ত হন। এরপর যখন ইন্দ্র অহল্যাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গৌতম মুনির হাতে ধরা পরে যান। তখন গৌতম মুনি তাদের দুজনকে অভিশাপ দেন।
মুনির অভিশাপে ইন্দ্র তার অণ্ডকোষ হারান, রূপক বাদ দিয়ে বললে পুরুষত্ব হারান। আর অহল্যাকে অভিশাপ দেন, সে সকল প্রাণীর অদৃশ্য হয়ে (বর্ষসহস্রাণি বহূণি) অর্থাৎ বহু সহস্র বছর অনাহারে শুধুমাত্র বায়ুভক্ষণ করে ভস্মশয্যাগ্রহণপূর্বক প্রায়শ্চিত্তরুপ তপস্যা করবে। যখন রাম এখানে আসবে তখনই সে যদি তার আতিথ্য সৎকার করে তবেই সে শুদ্ধ হবে আর গৌতম মুনিও তখন তার কাছে ফিরে আসবে। এই বলে গৌতম মুনি চলে যান। পরবর্তীতে রাম এসে তাকে উদ্ধার করেন ও গৌতম মুনিও ফিরে আসেন।
অন্যদিকে উত্তরকাণ্ডের ঘটনাটিও এরকমই কিন্তু সেখানে বাড়তি বলা হচ্ছে অহল্যার সম্মতি ব্যাতিরেকে ইন্দ্র থাকে ধর্ষণ করেন। বাকি সব ঘটনা একই রকম।
কুমারিলভট্টের মতে অহল্যা এবং ইন্দ্রের গল্প কেবল রূপক বর্ণনা মাত্র। অহল্যা শব্দে রাত্রি কে বুঝায়, এবং সূর্য্যকে ইন্দ্র। দিবসে সূর্য্যোদয় হইলে রাত্রি থাকে না (অহনি লীয়মানতরা), এই ঘটনা অবল্বন করিয়া অহল্যা এবং ইন্দ্রের বৃত্তান্ত কল্পনা করা হইয়াছে।
-(বিশ্বকোষ প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৬৮৫)

 রামায়ণে আছে, প্রজা সৃষ্টির পর সেই প্রজাদের বিশিষ্ট প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্রহ্মা এক কন্যা সৃষ্টি করেন। অদ্বিতীয়া সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তার নাম রাখেন অহল্যা।(রামায়ণ, ৭।৩০ “যস্মাৎ ন বিদ্যতে হল্যং”) তাঁর স্বামী ঋষি গৌতম বয়সে তাঁর থেকে অনেক বড়ো ছিলেন।ব্রহ্মা তাকে গৌতম ঋষির নিকট ‘ন্যাসভূতা’ অর্থাৎ গচ্ছিত রেখেছিলেন। ইন্দ্র অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহের মানস করেন। কিন্তু বহু বছর বাদে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার নিকট ফিরিয়ে দিলে, ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে অহল্যার সহিত গৌতমের বিবাহ দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে ছলনা করে ধর্ষণ করেছিলেন।[রামায়ণ, ৭।৩০]
 এই কারণে, গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে যুদ্ধে তাকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে ইন্দ্র করলেন তার অর্ধেক পাপ তাকেই বহন করতে হবে; এবং জগতে দেবরাজের স্থানও স্থাবর হবে না। পুনশ্চ, তাকে অণ্ডকোষহীন হয়ে থাকতে হবে। [রামায়ণ, ৭।৩০ “যে ইন্দ্র সে ন ভবিষ্যতি”]

 প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শাপের ফলে ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কায় বন্দী করে আনেন ও নির্যাতন করেন। গৌতম অহল্যাকেও শাপ দেন, “মমাশ্রমা সমীপতঃ বিনিধ্বংস”; এবং অহল্যা অপেক্ষাও অধিক সুন্দরী পৃথিবীতে তার রূপের গৌরব খর্ব করতে জন্মগ্রহণ করবেন। অহল্যা স্বামীকে বোঝান যে তিনি নির্দোষ, ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধারণ করে তাকে ধর্ষণ করেছেন।[ রামায়ণ, ৭।৩০ “ত্বদ্-রূপেণ দিবৌসকা ধর্ষিতা”] গৌতম তখন শান্ত হন। তিনি অহল্যাকে বলেন, রামের দর্শনে তিনি পবিত্র হবেন । গৌতম এরপর নিজের আশ্রমে ফিরে যান ও অহল্যা তপস্যা করতে থাকেন।

অহল্যা পুরাণ

 প্রাচীনতম পূর্ণাঙ্গ উপাখ্যানগুলিতে বলা হয়েছে, অহল্যা ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে চিনতে পারলেও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেননি। কিন্তু পরবর্তীকালের গ্রন্থগুলির মতে, অহল্যা নির্দোষ ছিলেন। তিনি ইন্দ্রের শঠতার শিকার হয়েছিলেন অথবা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। সকল উপাখ্যানেই দেখা যায়, ঋষি গৌতম অহল্যা ও ইন্দ্র উভয়কেই অভিশাপ দিয়েছিলেন। অভিশাপটি ঠিক কী ছিল, তা নিয়ে অবশ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে মতভেদ আছে। তবে সকল গ্রন্থেই কথিত হয়েছে যে, রাম অহল্যার ত্রাতা ও মুক্তিদাতা রূপে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রাচীনতর গ্রন্থগুলিতে আছে, প্রায়শ্চিত্তের জন্য অহল্যা কঠোর তপস্যা করেছিলেন এবং রামকে আতিথ্য দান করে পাপমুক্ত হন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রচলিত হওয়া জনপ্রিয় পুনর্কথনগুলিতে দেখা যায়, ঋষির অভিশাপে অহল্যা পাথর হয়ে যান এবং রামের পাদস্পর্শে পুনরায় মানবী রূপ ফিরে পান।

শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে অহল্যার যে জীবনকথা পাওয়া যায়, তার সব ক’টিরই কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল ইন্দ্র কর্তৃক অহল্যাকে প্রলুব্ধকরণ এবং তার প্রতিফল।

কৃত্তিবাস উপাখ্যানটি সামান্য অন্যভাবে বর্ণিত করেছেন। এই উপাখ্যানে বলা হয়েছে, মিথিলার নিকটস্থ এক উপবনে নিজের আশ্রমে গৌতম অহল্যাকে নিয়ে বাস করতেন। একদিন মুনির অনুপস্থিতির সুযোগে, তার বেশ ধরে এসে ইন্দ্র অহল্যার নিকট সঙ্গম প্রার্থনা করেন। পূজারত অহল্যা তাকে প্রতীক্ষা করতে বললেও, তার শাপের ভয়ে মিলনে রাজি হন। অহল্যার সাথে যৌন মিলন করার পর ইন্দ্র পালাতে যান। পালাতে গিয়ে ইন্দ্র ধরা পড়ে যান। গৌতম স্নান করে তখন সমিধকুশ নিয়ে ফিরছিলেন। ইন্দ্রকে তিনি অভিশাপ দেন যে তাকে বৃষণ অর্থাৎ অণ্ডকোষহীন হতে হবে।{রামায়ণ, ১।৪৮।২৭ “বিফলত্বং ভবিষ্যসি”} অহল্যাকে তিনি শাপ দেন যে তাকে বহু সহস্র বছর “বায়ুভক্ষা, নিরাহারা, ভস্মশায়িনী, তপ্যন্তী, প্রস্তরবৎ ও অদৃশ্যা” হয়ে থাকতে হবে।{রামায়ণ, ১।৪৮।৩০} রাম তাকে আতিথ্য দিলে তিনি পবিত্র হবে ও কামরহিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবেন। এরপর গৌতম হিমবৎ পর্বতের শিখরে তপস্যায় নিমগ্ন হন। মিথিলার পথে এই উপাখ্যান শুনতে শুনতে রাম ও লক্ষ্মণ মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। অহল্যার শাপমুক্তি ঘটে। তিনি ভস্মশয্যা থেকে উঠে এসে অতিথি সৎকার করে। রাম ও লক্ষ্মণও তার পদধূলি নেন। দেবতারা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঘটান ও অহল্যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। গৌতম ঋষি ফিরে আসেন এবং রামচন্দ্রকে পূজা করে স্ত্রীকে নিয়ে তপস্যা করতে চলে যান।

বিষ্ণুপুরাণে লিখিত আছে (৪। ১৯। ১৬), মুগল হইতে মোল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণ উৎপন্ন হইয়াছেন। তাহার ক্ষত্রিয়ের অংশ। মুগলের পুত্রের নাম বৃদ্ধাশ্ব। বৃদ্ধাশ্ব হইতে দিবোদাস এবং অহল্যা এই যমজ পুত্ৰকঙ্কার छम्रा श्ब्राझिण । श्रब्रध्नाप्नद्र सेब्रtग dद९ अश्लTाद्र श्रté শতানদের জন্ম হয়।




এই সূত্র প্রসঙ্গে মহর্ষি দয়ানন্দ শাস্ত্রোক্ত প্রমাণ সহকারে একটি মন্তব্য দিয়েছেন যা নিন্মরূপ-
মহর্ষি লিখছেন-
পূরাণকর্তারা উপরোক্ত (ইন্দ্র অহল্যা) কথার অনর্থ করিয়া লিখিয়াছেন, পরন্তু সত্যগ্রন্থে এরূপ কথা লিখিত নাই। আমি এস্থানে শতপথ ব্রাহ্মণ হইতে প্রকৃত ইন্দ্ৰ অহল্যা ব্যাপার কীরূপ, তাহা বর্ণন করিতেছি যথা :

ইন্দ্রাগচ্ছেতি। গৌরাবস্কন্দিন্নহল্যায়ৈ জারেতি। তদ্যান্যেবাস্য চরণামি তৈরেবৈনমেতৎ প্রমোদয়িষতি। [শতপথ ব্রাহ্মণ ৩।৩।১।১৮]
রেতঃ সোমঃ [শতপথ ৩।৩।৫।১]
সূর্য্যরশ্মিশ্চন্দ্রমা গন্ধর্ব (যজু০১৮।৪০) ইত্যপি নিগমো ভবতি ৷ সোऽপি গৌরুচ্যতে।।৪।। নিরু০ অ০ ২ খং০ ৬।
জার আ ভগম্ জারঃ ইব ভগম্ । আদিত্যোऽত্রজার উচ্যতে, রাত্রের্জরযিতা।৫।।নিরু০ অ০ ৩ খং০ ১৬।
এষ এবেন্দ্রো য এষ তপতি । শ০কাং০১ অ০৬। ব্রা০৪ কং০১৮।
ভাষ্যম্ঃ - ইন্দ্রঃ সূর্য়ো য় এষ তপতি, ভূমিস্থান পদার্থাংশ্চ প্ৰকাশয়তি । অস্যেন্দ্রেতি নাম পরমৈশ্বর্যপ্রাপ্তের্হেতুত্বাৎ । স অহল্যায়া জারোऽস্তি। সা সোমস্য স্ত্রী। তস্য গোতম ইতি নাম। গচ্ছতীতি গৌরতিশয়েন গোরিতি গৌতম শ্চন্দ্ৰঃ ৷ তয়ো স্ত্রীপুরুষবৎ সম্বন্ধোऽস্তি। রাত্রিরহল্যা। কস্মাদ্ ? অহর্দিনং লীয়তেऽস্যাং তস্মাদ্রাত্রি রহল্যোচ্যতে ৷ স চন্দ্রমাঃ সর্বাণি ভূতানি প্রমোদয়তি, স্বস্ত্রিষাऽহল্যয়া সুখয়তি।
অত্র স সূর্য্য ইন্দ্রো, রাত্রেরহল্যায়া গোতমস্য চন্দ্রস্য স্ত্রিয়া জার উচ্যতে । কুতঃ ? অয়ং রাত্রের্জরয়িতা। ‘জুষ বয়োহানা’ বিতি ধাত্বর্থোऽভিপ্রেতোऽস্তি। রাত্রেরায়ুষো বিনাশক ইন্দ্ৰঃ সূৰ্য্য এবেতি মন্তব্যম্।।
ভাষ্যার্থঃ (ইন্দ্রোগচ্ছতি ইত্যাদির) তাৎপর্য্য এই যে, ইন্দ্র শব্দে সূৰ্য্য বুঝায়, এবং রাত্রিকে অহল্যা বলা যায়, তথা চন্দ্রমা গৌতম সদৃশ হইয়া থাকেন। এস্থানে রূপকালঙ্কার মতে রাত্রিকে চন্দ্রমার স্ত্রীরূপে বর্ণন করা হইয়াছে। চন্দ্রমা আপনার স্ত্রীর সহিত রাত্রিকালে সকল প্রাণীর আনন্দদায়ক হইয়া থাকে । এই রাত্রিকালের জার, আদিত্য অর্থাৎ সূৰ্য্য হইয়া থাকে, কারণ সূর্যের উদয় হইলেই, রাত্রি অন্তর্ধান হইয়া যায় অর্থাৎ চন্দ্রমাকে ছাড়িয়া দেয়, বিশেষতঃ সূর্য্যকে রাত্রীর জার এইজন্য বলা যায় যে, সূর্য্যের আগমনেই চন্দ্রমার ছাড়িয়া দেয়, সূর্য্যকে রাত্রীর জার এইজন্য বলা যায় যে, সূর্য্যের আগমনেই চন্দ্রমার সহিত রাত্রির শৃঙ্গার ভঙ্গ বা নষ্ট করাইয়া দেয়, এইজন্য রাত্রি চন্দ্র ও সূর্য্য, স্ত্রীপুরুষ ও জারকর্ত্তা রূপে রূপকালঙ্কার দ্বারা বর্ণিত হইয়াছে। যেরূপ স্ত্রীপুরুষ একত্রে থাকে, তদ্রূপ রাত্রি ও চন্দ্রমা একত্রিত হইয়া থাকে । চন্দ্রমাকে গৌতম এইজন্য বলা যায় যে উক্ত চন্দ্রমা অত্যন্ত বেগশালী এবং রাত্রিকে অহল্যা এই কারণে বলা যায় যে ঐ রাত্রিতে দিবস লয় হইয়া যায়, পুনরায় সূর্য্যই রাত্রির নিবৃত্তকারী, এজন্য সূর্য্যকে রাত্রির জার বলা যায়।
এবং সদ্বিদ্যেপদেশার্থালঙ্কারায়াং ভূষণরূপায়াং সচ্ছাস্ত্রেষু প্রণীতায়াং কথায়াং সত্যাং য়া নবীনগ্রন্থেষু পূর্বোক্তা মিথ্যা কথা লিখিতাস্তি, সা কেনচিৎ কদাপি নৈব মন্তব্যা হি, এতাদৃশ্যেऽন্যাশ্চাপি।
অর্থঃ এইরূপ চমৎকার রূপকালঙ্কারকে অল্পবুদ্ধি ও বিদ্যাহীন পুরুষেরা নষ্ট ও শ্রীভ্রষ্ট করাইয়া তাহার অনর্থ প্রকাশ করিয়া, সকল মনুষ্যের হানিকারক ফল প্রসব করাইতেছেন। এজন্য সজ্জনমাত্রেই পুরাণোক্ত মিথ্যা ও অনর্থযুক্ত বাক্য গুলিকে মূলের সহিত যেন ত্যাগ করেন।

তাহলে দেখা গেল শাস্ত্রীয় ভাবে একটি প্রাকৃতিক বর্ণনাকেই অতিরঞ্জিত করে গৌতম পত্নী অহল্যা ও ইন্দ্র চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ