অগ্নিকে বলা হয় দেবতাদের মুখ। অগ্নিমুখে দেবতারা যজ্ঞভাগ গ্রহণ করতেন।
বৈদিক যুগে যজ্ঞই ছিল প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাই যজ্ঞকর্মকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণসাহিত্য নামে এক বিশাল বৈদিক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। যজ্ঞকে মনে করা হয় সর্বপাপহর। যজ্ঞকর্মের সঙ্গে অগ্নির অবস্থান অপরিহার্য। অগ্নিকে বলা হয় দেবতাদের মুখ; তার মাধ্যমেই সকল দেবতা আহুতি দ্রব্য লাভ করে থাকেন। অর্থাৎ কোনো দেবতাকে উদ্দেশ্য করে সমন্ত্রক অগ্নিতে আহুতি প্রদান করলে অদিক্ষ্ম তা উদ্দিষ্ট দেবতার নিকট পৌঁছে দেয়।
যজ্ঞের বর্ণানুক্রমিক তালিকা
অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, আয়ুষ্টোম, ইষ্টিযজ্ঞ, গোষ্টম, জ্যোতিষ্টোম, দেবযজ্ঞ, পুত্রেষ্টি, পিতৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, মনুষ্যযজ্ঞ, ব্রহ্মযজ্ঞ, রাজসূয়যজ্ঞ।
বৈদিক যুগে অনুষ্ঠেয় যজ্ঞকর্মকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় : হোম, ইষ্টি, পশু, সোম ও সত্রযাগ। এছাড়া রাজ্যলাভ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কর্মে সাফল্য লাভের জন্য রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, নরমেধ প্রভৃতি যজ্ঞেরও ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ রামায়ণ-মহাভারতের যুগেও বিশেষ পরিচিত ছিল। যজ্ঞে দুগ্ধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং শস্যচূর্ণ দ্বারা প্রস্ত্তত পুরোডাশ আহুতি দেওয়া হয়।
যজ্ঞ শব্দের অর্থ খুবই ব্যাপক ।সংস্কৃতের 'য়জ্' ধাতু থেকে 'যজ্ঞ' শব্দ উত্পন্ন হয় ।এর অর্থ হলো 'সংকল্প'। অর্থাত্ যে কোন শুভকর্ম বা লোক কল্যাণকারী কর্মের উপর ব্রতী হওয়াকেই যজ্ঞ বলা যেতে পারে । কিন্তু এখানে অগ্নিহোত্র বা হবনের জন্যই যজ্ঞ শব্দের রূর ব্যবহার করা হয় ।এই স্থানে যজ্ঞের অর্থ হবে ,প্রকৃতি-আবহাওয়া-পরিবেশ কে রক্ষা করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করে কার্যান্বিত করাই যজ্ঞ ।
কিছু অনাস্থাবাদী যজ্ঞকে অর্থহীন ,অযৌক্তিক,অবৈজ্ঞানিক ,স্বার্থাম্বেষী কর্মকাণ্ড ক্রিয়া মনে করে প্রচার করে থাকে ।বৈদিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত যজ্ঞের ঠিক ঠিক অভিপ্রায়কে না বোঝার জন্যেই চার্বাক ,বৈদ্ধ ও জৈন ইত্যাদির জন্ম হয়েছে । এইরকম নানাবিধ মত ,পথ ,সম্প্রদায় ,গোষ্ঠি ও বর্গকে দেখে তত্কালীন বিদ্বান্ স্বামী শঙ্করাচার্য এদের প্রবল খণ্ডন করেছিলেন ।
যদ্যপি কিছু সম্প্রদায় সম্বন্ধিত লোক এই যজ্ঞের উপর চিন্তন ,মনন ,অধ্যয়ন করেছিলেন ।তত্কালীন সময়ে এর কারণ ছিল বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাব ,বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যজ্ঞের সামাজিকতা ,আধ্যাত্নিকতা ইত্যাদির পূর্ণ বিকাস সম্ভব হয় । মীমাংসা সূত্রের মধ্যে নিনাবিধ যজ্ঞের আলোচনা করে যজ্ঞকে নিত্যকর্মের মধ্যে সন্নিহিত করে বোঝানো হয়েছে ।
যজ্ঞের বিভেদের মধ্যে অনেক প্রকারই উপস্থিত হয় । কিন্তু আর্য নর-নারীদের মধ্যে পঞ্চ-মহাযজ্ঞের বিধান মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী করে দিয়েছেন ।
যেমন-১) ব্রহ্মযজ্ঞ ,২)দেবযজ্ঞ , ৩) পিতৃযজ্ঞ ,৪)বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞ, ও ৫)অতিথি যজ্ঞ ।
এখানে কেবল দেবযজ্ঞের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
দেবযজ্ঞের অন্য নাম হলো অগ্নিহোত্র ,হবন ,যজ্ঞ ইত্যাদি । মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যে দেবযজ্ঞের প্রতিপাদন করেছেন তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই এখানে উদ্দেশ্য । কারণ হল- যে এখানে এই সব বিধি কেন চয়ন করা হচ্ছে ?অন্য কোন বিধিকে কেন গ্রহণ করা হলো না ?
মহর্ষি দয়ানন্দের অর্থ অনুসারে অর্থ হল- দেবপূজা ,সংগতিকরণাদি কিন্তু প্রচলিত অর্থে হবন বা অগ্নিহোত্রকেই নেওয়া হয়েছে । ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্ত অনুসারে সৃষ্টি যজ্ঞে দিব্যপুরুষের প্রেরণায় দেবতাগণ হবি প্রযুক্ত যজ্ঞের প্রসার করেন ,যার মধ্যে ঋতু অনুকুল সামগ্রীর প্রয়োগ দেখা যায় ।যাজ্ঞিকের অনুসারে যজ্ঞের তিনটি আংশ-সংকল্প ,মন্ত্র ও আহুতি ।
কালাক্রমানুসারে উত্তর বৈদিক কালের পর ব্রাহ্মণ কালের সময়ে ব্রাহ্মণ গন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যজ্ঞের বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা ।তাই তখন দৈনিক পাক্ষিক ,মাসিক ,চাতুর্মাসিক ,ষান্মাসিক এবং বার্ষিক যজ্ঞের আয়োজন করা হতো ।
বাসন্তি ,আষাঢ়ী ছাড়াও দশেষ্টি ও পৌণমাসেষ্টির সময়েও বৃহত যজ্ঞের আয়োজন করা হতো ।
এবারে যজ্ঞের মহত্বের উপর দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে।
ভৌতিক যজ্ঞ এক রাসয়নিক ক্রিয়া । এই যজ্ঞের ফলে নানা রকম রাসায়নিক গ্যাস উত্পন্ন হয় ।এই গ্যাসের মাধ্যমে সদ্ভাবনা সর্বত্রই ছড়িয়ে লোককল্যাণ সাধন হয়ে থাকে । তাছারা যজ্ঞের মাধ্যমেই সমস্ত জীবজগত্ ও প্রাণীজগতের কল্যাণ সাধন করা যায় ।যজ্ঞ একপ্রকার সুষম বিতরণ প্রণালীর নাম । মানুষ বা জীব ও প্রাণী নিজ সামর্থ অনুসারে যজ্ঞের পরে উত্পন্ন সুগন্ধ ,উপকারিতা গ্রহণ করতে পারে ।এর মধ্যে কোনরকম বিদ্বেষপূর্ণ পক্ষপাত নেই ।পক্ষপাতই হল সমস্তপ্রকার হিংসার মূল কারণ । একে দৈব প্রণালীও বলা যেতে পারে ।যজ্ঞের মাধ্যমেই সমস্ত মানবের অর্থাত্ মানব মাত্রেরই কল্যাণ সম্ভব । তাই যজ্ঞ সার্বভৌম মানবের জন্য , কোন হিন্দু ,মুসলমান ,পারসী ইত্যাদি কোন একক সম্প্রদায় ও জাতির জন্য নয় ।তাই একে সম্প্রদ্রায়গত দোষারোপণ করা নিতান্ত মুর্খতা ছাড়া অন্য কিছুই নয় ।।
বর্তমানে বৈদিক যাগ-যজ্ঞের প্রাধান্য কমে এসেছে; সেস্থলে প্রাধান্য পেয়েছে ভক্তিশাস্ত্রানুমোদিত জ্ঞানযজ্ঞ, জপযজ্ঞ, নামযজ্ঞ ইত্যাদি। তবে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে (যেমন বিবাহ, মৃত্যু ইত্যাদি) আজও সংক্ষিপ্ত আকারে বৈদিক যজ্ঞকর্ম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রাজসূয়যজ্ঞ
অশ্বমেধ যজ্ঞ
যজুর্বেদের ব্যাখ্যা ব্রাহ্মণ গ্রন্থ হচ্ছে শতপথ ব্রাহ্মণ । শতপথের ১৩।২।২।১৪,১৫,১৭ এবং ১৯ এ বলা হয়েছে –
“প্রজাপতির্বৈ জমদগ্নিঃ সো অশ্বমেধঃ। ক্ষত্রং বাশ্বো বিডিতরে পশবঃ। ক্ষত্রস্যৈতদ্রূপং য়দ্ধিরণ্যং ।
জ্যোতির্বৈ হিরণ্যম্।”
অর্থাৎ রাজ্যপালনের কর্মই অশ্বমেধ। রাজার নাম অশ্ব এবং প্রজার নাম অশ্ব ব্যতীত অপরাপর পশুর নাম । অশ্বমেধে রাজ্যের শোভা স্বরূপ ধন হয়ে থাকে এবং সেই জ্যোতির নাম হিরণ্য ।
শতপথ ব্রাহ্মণের ১৩।১।৬ এ বলা হয়েছে-
“রাষ্ট্রং বা অশ্বমেধঃ। বীর্য়ং বা অশ্বঃ।” অর্থাৎ অশ্ব শব্দ বল বাচক । যে কর্মে রাজ্যের প্রজাদের বল বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটে তাই অশ্বমেধ ।
শতপথ ব্রাহ্মণে আরো বলা হয়েছে- “রাষ্ট্রমশ্বমেধো জ্যোতিরেব তদ্রাষ্ট্রে দধাতি। ক্ষত্রায়ৈব তদ্বিশং কৃতানকরামনুবর্তমানং করোতি ।। অথো ক্ষত্রং বা অশ্বঃ ক্ষত্রস্যৈতদ্রূপং য়দ্ধিরণ্যং । ক্ষত্রমেব তৎ ক্ষত্রেণ সমর্ধয়তি । বিশমেব তদ্বিশা সমর্ধয়তি।।” -শতপথ ১৩।২।২।১৬,১৫,১৭,১৯
অর্থাৎ যা দ্বারা রাজ্যের প্রকাশ বা উন্নতি হয় তাই অশ্বমেধ । রাজ্যের উন্নতিবাচক কর্ম ধারণ করাই রাজ্যসভার কার্য । ঐ রাজ্যসভা নিজ পক্ষ থেকেই প্রজার প্রতি কর ধার্য করে থাকে । সেই রাজা দ্বারাই রাজ্য ও প্রজা দ্বারাই প্রজাদের বৃদ্ধি বা উন্নতি হয়ে থাকে ।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি অশ্বমেধ হচ্ছে সেই কর্ম যা দ্বারা দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়ে থাকে । এখানে অশ্লীলতার কোনো স্থান নেই ।
বৈদিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ
ব্রহ্মযজ্ঞ-(অধ্যাপনং ব্রহ্ময়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) বেদ শাস্ত্রের স্বাধ্যায় অন্যকে স্বাধ্যায় করানো, সন্ধ্যোপসনা করা ব্রহ্মযজ্ঞ বলে।
মিমীহি শ্লোকমাস্যে পর্জন্য ইব ততনঃ।
গায় গায়ত্রমুক্থ্যম্।। (ঋ০ ১।৩৮।১৪)
পদার্থঃ হে বিদ্বান! (শ্লোকম্) বেদবাণীকে (আস্যে) নিজের মুখে (মিমীহি) ভরে নাও, আবার ওই বেদবাণীকে (পর্য়ন্যঃ ইব ততনঃ) মেঘ-বাদলের সমান গর্জন করে দূর-দূর পর্যন্ত গম্ভীর স্বর দ্বারা প্রচার করো, তাহার উপদেশ সর্বত্র করো। (গায়ত্রম্) প্রাণের রক্ষাকারী (উক্থ্যম্) বেদ মন্ত্রকে (গায়) স্বয়ং গান করো, স্বয়ং পড় আর অন্যকে পড়াও।।১৪।।
ভাবার্থঃ প্রস্তুত মন্ত্রে মনুষ্য মাত্রের জন্য কি সুন্দর শিক্ষার সমাবেশ দিয়েছে।
১.প্রত্যেক মনুষ্যের বেদ-মন্ত্রের দ্বারা নিজের মুখে ভরে নেওয়া উচিত, মন্ত্রকে পড়া-পড়ে তাহার কন্ঠস্থ করা উচিত।
২.বেদ পড়ে যে জ্ঞানামৃত প্রাপ্ত হয় তাহাকে নিজের কাছেই সীমিত রাখা উচিত নয়, পরন্তু যে প্রকার বাদল সমূদ্র থেকে জল নিয়ে তাহাকে গম্ভীর গর্জনের সাথে সর্বত্র বর্ষণ করেন ওই প্রকার মনুষ্যেরও বেদরূপী সমূদ্র থেকে রত্ন আর জ্ঞানের সঞ্চয় করে তাহার লেখন আর বাণী দ্বারা প্রচার করা উচিত।
৩.বেদে আয়ুবৃদ্ধির, স্বাস্থ্যরক্ষার আর প্রাণশক্তিকে বলিষ্ঠ বানানোর সহস্র মন্ত্র আছে। শরীর রক্ষার জন্য এই প্রকারের মন্ত্রকে স্বয়ং পড়া উচিত আর অন্যকে পড়ানো উচিত।।১৪।।
ভাষ্যঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী
সায়ংসায়ং গৃহপতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা।
বসোর্বসোর্বসুদান এনি বয়ং ত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম।।৩।। (অথর্ব০ ১৯।৫৫।৩)
পদার্থঃ (সায়ংসায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলা (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (সৌম্যনসস্য) সুখ (দাতা) প্রদাতা (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে প্রকাশিত করিয়ে (বয়ম্) আমরা মনুষ্য (তন্বম্) শরীরকে (পুষেম) পুষ্ট করি।।৩।।
ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৩।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
বদযজ্ঞ-(হোমঃ বেঃ। মনু০ ৩/৭০) সায়ং-প্রভাতে হবন করা দেবযজ্ঞ বলে।
প্রাতঃপ্রাতর্গৃহপতির্নো অগ্নিঃ সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা।
বসোর্বসোর্বসুদান এধীন্ধানাস্ত্বা শতংহিমা ঋধেম।।৪।। (অথর্ব০ ১৯/৫৫/৪)
পদার্থঃ (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (সায়ং সায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলাতে (সৌমনসস্য) সুখের (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন প্রদাতা (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে (ইন্ধানাঃ) প্রকাশিত করিয়ে (শতংহিমাঃ) শত শীতল ঋতুতে আমরা মনুষ্য (ঋন্ধানাঃ) বিস্তার হতে থাকি।।৪।।
ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৪।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
সমিধাগ্নিং দুবস্যত ঘৃতৈর্বোধয়াতিথিম্। অস্মিন্ হব্য জুহোতন।।১।। (যজুর্বেদ ৩/১)
পদার্থঃ হে বিদ্বানগণ! তোমরা (সমিধা) যে জ্বালানি দ্বারা উত্তম প্রকার প্রকাশ হয়, ওই কাঠ-ঘী আদির দ্বারা (অগ্নিম্) ভৌতিক অগ্নিকে (বোধয়ত) উদ্দীপন অর্থাৎ প্রকাশিত করো তথা যেরূপ (অতিথিম্) অতিথিকে অর্থাৎ যাহার আসা-যাওয়া বা নিবাসের কোন দিন-সময় নেই, ওই সন্ন্যাসীর সেবন করায়, ঐরূপ অগ্নির (দুবস্যত) সেবন করাও আর (অস্মিন্) এই অগ্নিতে (হব্যা) সুগন্ধ কস্তুরী, কেসর আদি, মিষ্টি, গুড়, চিনি আদি পুষ্ট ঘী, দুধ আদি, রোগ নাশক সোমলতা আদি ওষধি, এই চার-প্রকারের সমগ্রতাকে (আজুহোতন) উত্তম প্রকার হবন করো।।১।।
ভাবার্থঃ এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালংকার আছে। যেরূপ গৃহস্থ মনুষ্য আসন, অন্ন, জল, বস্ত্র আর প্রিয় বচন আদি দ্বারা উত্তম গুণবান সন্ন্যাসী আদির সেবন করায়, ঐরূপই বিদ্বান গণের যজ্ঞ, বেদী, কলাযন্ত্র আর যানে স্থাপন করো যথাযোগ্য জ্বালানী, ঘী, জলাদি দ্বারা অগ্নিকে প্রজ্বলিত করে বায়ু, বর্ষা জলের শুদ্ধি বা যানের রচনা নিত্য করা উচিত।।১।।
ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
পিতৃযজ্ঞ- (তর্পণং পিতৃয়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) মাতা-পিতা আদির সেবা-সুশ্রূষা তথা ভোজন আদি দ্বারা তৃপ্তি করা পিতৃযজ্ঞ বলে।
উর্জং বহন্তীরমৃতং ঘৃতং পয়ঃ কীলালং পরিশ্রুতম্।
স্বধাস্থ তর্পয়ত মে পিতৃন্য।। (যুজুর্বেদ ২/৩৪)
পদার্থঃ হে পুত্রাদি! তোমরা (মে) আমার (পিতৃন্) পূর্বোক্ত গুণযুক্ত পিতা-মাতার (ঊর্জম্) অনেক প্রকারের উত্তম-উত্তম রস (বহন্তীঃ) সুখ প্রাপ্তকারী স্বাদিষ্ট জল (অমৃতম্) সব রোগের দূর প্রদানকারী ওষধি মিষ্টাদি পদার্থ (পয়ঃ) দুধ (ঘৃতম্) ঘী (কীলালম্) উত্তম-উত্তম রীতি দ্বারা রন্ধন করা অন্ন তথা (পরিস্রুতম্) রসে রসালো ফল দিয়ে (তর্পয়ত) তৃপ্ত করো। এই প্রকার তুমি তাহাদিগের সেবন দ্বারা বিদ্যার প্রাপ্ত হয়ে (স্বধাঃ) পরধনকে ত্যাগ করে নিজের ধনের সেবনকারী (স্থ) হও।।
ভাবার্থঃ ঈশ্বর আজ্ঞা দেন যে সব মনুষ্যের পুত্র আর চাকর আদির আজ্ঞা দিয়ে বলতে চায় যে তোমাদের আ পিতাদি অর্থাৎ পিতা-মাতা আদি বা বিদ্যা প্রদানকারীর প্রীতি দ্বারা সেবা করার যোগ্য। যেরূপ তোমাদিগের বাল্যাবস্থা বা বিদ্যাদানের সময় তোমাদের পালন করেছ, ঐরূপ তোমরাও তাহাদের সব সময়ে সৎকার করার যোগ্য, যাহা দিয়ে আমরা লোকের মধ্যে বিদ্যার নাশ আর কৃতজ্ঞতা আদি দোষ কখনো প্রাপ্ত না হই।।৩৪।।
ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
অতিথিযজ্ঞ-(অতিথিপূজনম্ নুয়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) অতিথিদের ভোজন দেওয়া আর সেবা করে সৎকার করা নৃযজ্ঞ অথবা অতিথিযজ্ঞ বলে।
অশিতাবত্যতি থাবশ্নীয়াদ্যজ্ঞস্য সাkত্মত্বায়।
য়জ্ঞস্যাবিচ্ছেদায় তদ্ব্রতম্।।৮।।
এতদ্বা উ স্বাদীয়ো য়দধিগবং ক্ষীরং।
বা মাংসং বা তদেব নাশ্নীয়াত্।।৯।। (অথর্ব০ ৯/৬/৮-৯)
পদার্থঃ (অতিথৌ অশিতবতি) অতিথির ভোজন করার পরে (অশ্নীয়াত্) সে [গৃহস্থ] আহার করবে, (য়জ্ঞস্য) যজ্ঞ [দেব পূজা, সঙ্গতিjরণ আর দান] এর (সাত্মত্বায়) অনুভূতির জন্য আর (য়জ্ঞস্য) যজ্ঞের (অবিচ্ছেদায়) নিরন্তর প্রবৃত্তির জন্য (তত্) সে (ব্রতম্) নিয়ম।।৮।।
ভাবার্থঃ অতিথির সৎকার করাতে গৃহস্থর শুভকর্ম নির্বিঘ্ন হয়ে সদা চলতে থাকে।।৮।।
পদার্থঃ (এতদ্ বৈ) ইহা (উ) নিশ্চয় করে (স্বাদীয়ঃ) অধিক উত্তম-স্বাদযুক্ত, (য়ত্) যে (তত্ এব) তাহাকেই (অধিগবম্) অধিকৃত জল, (বা) আর (ক্ষীরম্) দুধ (বা) আর (মাংসম্) মনন সাধক [বুদ্ধিবর্ধক] বস্তুকে (ন) এখন [অতিথির ভোজন করানোর পরে-ম০৮] (অশ্নীয়াত্) সে [গৃহস্থ] আহার করবে।।৯।।
ভাবার্থঃ গৃহস্থের ইহাই সুখদায়ী হয় যে তিথির উত্তম-উত্তম রুচিকারক বুদ্ধিবর্ধক পদার্থ ফল, বাদাম, অক্ষোট আদি ভোজন করিয়ে আপনি ভোজন করবেন, যাহা থেকে সে সৎকৃত বিদ্বাস যথাবত উপদেশ করেন।।৯।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
বলিবৈশ্বশ্বদেব যজ্ঞের বিধান-
বৈশ্বদেবস্য সিন্ধস্য গৃহ্যেহগ্নৌ বিধিপূর্বকম্।
আভ্যঃ কুর্য়াদ্দেতাভ্যো ব্রাহ্মনো হোমমন্বহম্।। (মনু০ ৩/৮৪)
ব্রাহ্মণ অর্থাৎ প্রত্যেক দ্বিজ ব্যক্তি পাকশালার অগ্নিতে বিধিপূর্বক সিদ্ধ=তৈরী হয়ে বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞের ভাগের ভোজনকে প্রতিদিন। এই দেবতাদের=ঈশ্বরীয় দিব্যগুণের চিন্তন পূর্বক আহুতি দিয়ে হবন করেন।
অহরহর্বলিমিত্তে হরন্তোহশ্বায়েব তিষ্ঠতে ঘাসমগ্নে।১। (অথর্ব০ (১৯/৫৫/৬)
রায়স্পোষেণ সমিষা মদন্তো মা তে অগ্নে প্রতিবেশা রিষাম।২। (অথর্ব০ (১৯/৫৫/১)
পদার্থঃ (অহরহর্বলি) হে পরমেশ্বর! আপনার আজ্ঞায় যাহারা প্রতিদিন বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাহারা (রায়ষ্পোষেণ) চক্রবর্ত্তী রাজ্যলক্ষ্মী ও ঘৃত, দুগ্ধাদি পুষ্টিকর পদার্থ প্রাপ্তি ও সম্যক শুভেচ্ছা দ্বারা, (মদন্তঃ) নিত্যানন্দ প্রাপ্ত হন, এবং মাতা, পিতা ও আচার্যদিগের প্রীতিপূর্বক উত্তমোত্তম পদার্থ দ্বারা নিত্য সেবা করেন। (অশ্বায়েব তিষ্ঠন্তে ঘাসম্) যেরূপ অশ্বের সম্মুখে তাহার ভক্ষ্য তৃণ, লতাদি এবং পানার্থ জলাদি প্রচুর পরিমাণে সংস্থাপিত হয়, সেই রূপ পিতা, মাতা ও আচার্যর সেবার জন্য বহুবিধ উত্তমোত্তম পদার্থ প্রদান পূর্বক তাহাদিগের প্রসন্নতা সম্পাদন করিবে। ।১।।
(মা তে অগ্নে প্রতিবেশরিসাম) হে পরম গুরু ঈশ্বর! আপনার আজ্ঞার বিরুদ্ধ ব্যবহারে আমরা যেন কদাপি প্রবৃত্ত না হই। অন্যায় পূর্বক আমরা যেন কদাচিৎ কোন প্রাণীকে পীড়া না দেই, পরন্তু সমস্ত জীবনমাত্রকে নিজ মিত্রবৎ ও আপনাকে সকলের মিত্রজ্ঞান করিয়া পরস্পরের উপকার সাধনে রত থাকি। ইহাই ঈশ্বর আজ্ঞা।।২।।
ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
।।বেদানুকূল পঞ্চমহাযজ্ঞ সমাপ্ত হল।।
।।ওম্ শান্তিঃ। শান্তিঃ।। শান্তিঃ।।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ