রচনাকাল অনুযায়ী প্রধান গৃহ্যসূত্রগুলিকে তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে : আশ্বালায়ন, গোভিল গৃহসূত্রম্, বৌধায়ন, মানব ও কৌথুম। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে : ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, শাখায়ন, কাঠক ও পারস্কার। তৃতীয় বা শেষ স্তরে রয়েছে : সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী, জৈমিনীয়, খাদির ও দ্রাহ্যায়ণ। এইসব সূত্রের যথাযথ রচনাকাল নির্ণয় প্রায় অসম্ভব; বিষয়বস্তু অর্থাৎ গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ কোনো বিস্মৃতি যুগের ধূসর অতীতে উদ্ভূত হয়েছিল। এইসব অনুষ্ঠান পালনের বিধিসমূহ সাংকেতিক সূত্রে চুড়ান্তভাবে গ্রথিত হওয়ার পূর্বে অসংখ্য প্রজন্মের মধ্য দিয়ে পরিশীলিত হয়েছিল।ঋগ্বেদের সাতটি গৃহ্যসূত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে; পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত হওয়ার আমরা এদের নাম জানতে পেরেছি : শৌনক, শাকল্য, ঐতরেয়, বহ্বৃচ, ভারবীয়, পরাশর ও পৈঙ্গি। ঋগ্বেদের দুটিমাত্র গৃহ্যসূত্ৰ–শাঙ্খায়ন ও আশ্বলায়ন আমাদের কাছে পৌঁছেছে। শুক্লযজুর্বেদের গৃহ্যসূত্রগুলির মধ্যেও দুটি এখন পাওয়া যায় : বাজসনেয় ও পারস্কার (‘কার্ষীয়’ নামেও পরিচিত–কাত্যায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত); ‘বাজবাপ’ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে কৃষ্ণ যজুর্বেদের ন’টি গৃহ্যসূত্রের সবগুলি আমরা পেয়েছি। এদের মধ্যে ছ’টি তৈক্তিরীয় শাখার অন্তর্গত : বৌধায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশী সত্যাষাঢ়, বৈখানস ও অগ্নিবেশ। অবশিষ্ট তিনটি মৈত্রায়ণ শাখার অন্তর্গত : মানব, কাঠক (বা লৌগাক্ষি) ও বারাহ। সামবেদের সঙ্গে চারটি গৃহ্যসূত্র সংশ্লিষ্ট : গোভিল, জৈমিনীয়, খাদির (দ্রাহ্যায়ণ নামেও পরিচিত) এবং কৌথুম। শেষোক্ত গ্রন্থের সামান্য কিছু অংশমাত্র পাওয়া যায়; এই গুলি বিশ্লেষণ করে। মনে হয়, একে যথার্থ গৃহ্যসূত্র অপেক্ষা ‘পদ্ধতির প্রকৃতি যুক্ত সহায়ক শ্রেণীর রচনা বলাই সঙ্গত। অথর্ববেদের কৌশিক সূত্র মিশ্রশ্রেণীর রচনা।শৌতসূত্রগুলিতে যেখানে প্রধান সামূহিক যজ্ঞসমূহ বিবৃত হয়েছে, গৃহ্যসূত্রগুলিতে সেখানে গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানবিষয়ের নিয়মাবলী আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানসমূহ-সন্তানসম্ভাবনা থেকে মৃত্যুর বহু পরবর্তী পারলৌকিক ক্রিয়া পর্যন্ত সেসব বিস্তৃত। এগুলি তাদের লক্ষ্য, বিষয়পরিধি ও ক্রমিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে শৌতি অনুষ্ঠান অপেক্ষা ভিন্ন। শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলি যেখানে মূলত সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সামূহিক কল্যাণ কামনা করে, গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ সেক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, কেননা এগুলি সর্বতোভাবে পরিবার-কেন্দ্ৰিক। গৃহ্যসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে ‘পাকযজ্ঞ’ নামে অভিহিত প্ৰায় চল্লিশটি অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী বিবৃত হয়েছে। এদের আবার তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : (ক) হুত অর্থাৎ যখন অগ্নিতে আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন বিবাহে বা গর্ভবতী রমণীর সীমস্তোন্নয়ন অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। (খ) অহুত অর্থাৎ যেখানে আহুতি আদান-প্ৰদান হয়; যেমন উপনয়নে ও স্নাতকদের জন্য দীক্ষান্ত অনুষ্ঠানে। (গ) প্ৰহুত অর্থাৎ যেখানে বিশেষ ধরনের আহুতি অৰ্পণ করা হয়; যেমন জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠানে। প্রধান অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে বহু গৌণ সহায়ক আচারও রয়েছে; যেমন, গর্ভাবস্থার অনুষ্ঠানগুলি-এদের মধ্যে আছে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন।
জন্মের পরে নবজাত শিশুর কল্যাণের জন্য জাতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একে-একে পালিত হয় আদিত্যদর্শন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চোল বা চুড়াকরণ, গোদান ও উপনয়ন অনুষ্ঠান। উপনয়নের পরে বেদাধ্যয়ন বা স্বাধ্যায়ের সূচনা হয়; এই সঙ্গে থাকে। অন্যধ্যায় ও শেষে সমাবর্তন। তারাপ স্নাতক গ্রামে প্ৰত্যাবর্তন করে গ্ৰাহঁত্যু আশ্রমে প্রবেশের জন্য প্ৰস্তুত হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাণিগ্রহণ, অগ্নিপরিগ্রহণ, অশ্বারোহন, সপ্তপদী ও লাজহােম। বিবাহিত গৃহস্থকে প্রতিদিন আবশ্যিক নিত্যকর্ম ও বিভিন্ন সাময়িক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়।
এইসব প্ৰধান অনুষ্ঠান ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সমস্ত সম্ভাব্য ক্ষেত্রের জন্য নানাধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে; যেমন–গৃহনির্মাণ, বীজ বপন, শস্য আহরণ, সর্প ও বিষাক্ত কীট বিতাড়ন, অতিথিকে খাদ্য ও আশ্রয়দান, আরোগ্যলাভ, দারিদ্র্য নিবারণ, বিভিন্ন উদ্যোগে সফলতা, অমঙ্গলসূচক লক্ষণ, এমনকি অশুভ স্বপ্নের জন্য উপযুক্ত প্ৰতিবিধান। মানুষের সমগ্র জীবন প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুষ্ঠান দ্বারা আবৃত ছিল; আদিম মানুষের মানসিকতায় ধর্মীয় ও লোকায়িত জীবনধারার মধ্যে কোনও স্পষ্ট ভেদরেখা ছিল না। এই মানসিকতায় পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অসংখ্য অমঙ্গল শক্তির দ্বারা আকীর্ণ ছিল; এদের মধ্যে রয়েছে জীবনের সুখকর ভোগ থেকে বঞ্চিত মৃতমানুষের আত্মা—এরা জীবিত মানুষ সম্পর্কে অসূয়াপরায়ণ হয়ে সর্বদা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে এমন বিশ্বাস ছিল। জীবনকে যেহেতু নেতিবাচক ও ধবংসাত্মক শক্তি থেকে রক্ষা করতে হবে, তাই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যযুক্ত পরিস্থিতির জন্য কোনো অনুষ্ঠান নির্দেশিত হয়েছিল, যার সাহায্যে এইসব অমঙ্গলপ্রদ শক্তিকে শান্ত, সন্তুষ্ট, বিতাড়িত বা সংগ্রামে প্রতিহত করা যায়। তাই শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় গৃহ্যসূত্ৰসমূহ অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ঐন্দ্রজালিক। এটা সত্য যে সূত্র-সাহিত্য রচিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা আদিম অবস্থা থেকে বহুদূর সরে এসেছিলেন; কিন্তু সূত্রগুলি বহু সহস্ৰ বৎসরের পুরাতন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলিকে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র। জীবনের প্রতি প্ৰাগ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃতিক স্তরে মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে প্ররোচিত করেছে।
কয়েকটি প্রধান গৃহ্যসূত্র পরীক্ষা করে আমরা এদের বিষয়বস্তু প্ৰকৃতি ও বিশেষ চরিত্রলক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। ভি . এম. আপ্টে গৃহ্য অনুষ্ঠানে প্ৰযুক্ত মন্ত্রসমূহকে পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত করেছেন : (ক) ধর্মানুষ্ঠানসংশ্লিষ্ট : এ-ধরনের মন্ত্রই সূত্রসাহিত্যে সর্বাধিক পাওয়া যায়–যার অধিকাংশ বিবাহ ও পারলৌকিক ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হত। (খ) দেব-আহ্বানসূচক : এখানে অনুষ্ঠানের আয়োজকের প্রতি আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছে। (গ) দেবকাহিনীবিষয়ক : এখানে প্রার্থনা অপেক্ষা কোনো দেবতা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রত্নকথা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (ঘ) আহুতিসংক্রান্ত : এখানে অনুষ্ঠান অপেক্ষাও আহুতির উপর তৎসম্পর্কিত মন্ত্রের প্রভাব বেশি। (ঙ) আকস্মিক : এধরনের মন্ত্রের ক্ষেত্রে কিছু বিক্ষিপ্ত শব্দ বা বাক্যাংশ ছাড়া অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ যোগসূত্র থাকে না।
এই বিশ্লেষণ থেকে গৃহ্যসূত্রগুলিতে অভিব্যক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা সম্পর্কে আমরা অবহিত হই : ক্রমশ মন্ত্রসমূহ তাদের যথাৰ্থ বৈদিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এর দুটি কারণ বলা যেতে পারে : (ক) একটি নতুন যৌগিক প্রত্নপৌরাণিক ধর্মের উদ্ভবের ফলে বৈদিক যজ্ঞধর্মের ক্ৰমিক অবনতি এবং (খ) প্ৰাচীনতর। ঐতিহ্যের সঙ্গে কাল্পনিকভাবে হলেও সূক্ষ্ম একটি যোগসূত্র রক্ষা করার জন্য প্রাচীন মন্ত্রসমূহের উচ্চারণ মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রয়োজনীয় বিবেচিত হওয়া। বর্তমান ভারতীয় সমাজে সম্পূর্ণত পৌরাণিক গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠান পালিত হওয়ার মধ্যে এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাই আয়োজিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না। থাকা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত মুখ্যত বৈদিক মন্ত্রই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আশ্বালায়ন চারটি অংশে বিভক্ত; প্ৰথম অংশে গাৰ্হাপত্য অগ্নি প্রজ্বলনের বিধি এবং আর্যজীবনে গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত অনুষ্ঠানসমূহ আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়নির্ভর অনুষ্ঠান : যেমন, প্ৰধানত বর্ষাকালীন সৰ্পের বিরুদ্ধে আয়োজিত শ্রাবণ-যাগ এবং পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শীতকালে করণীয় অষ্টকা ও অন্বষ্টক্য-যুক্ত আশ্বযুজ। তাছাড়া রথারোহন ও তিনটি উচ্চতর বর্ণের গৃহনির্মাণের উপযোগী অনুষ্ঠানসমূহ এই অংশে বিবৃত হয়েছে। তৃতীয় অংশে রয়েছে বিবিধ বিষয়বস্তু; এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : গৃহস্থদের পঞ্চবিধ অনুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন, লোকায়ত ধর্মবোধের উপাদান, ঋষিদের তালিকা, কাম্যেষ্টি, অশুভ-লক্ষণ ও তাজনিত প্ৰায়শ্চিত্ত, ছাত্রাবস্থা ও স্নাতকের আচারবিধি ইত্যাদি। বিশেষত এখানে রচনাটির অর্বাচীনতার লক্ষণ পরিস্ফুট। শেষ অংশে রয়েছে রোগ, মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত নানাবিধ আলোচনা, সপ্তবিধ শ্ৰাদ্ধ এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির জন্য রুদ্রের প্রতি নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান।
ত্রিশটি কণ্ডিকায় বিন্যস্ত আশ্বলায়ন-গৃহপরিশিষ্ট মহাকাব্যিক ছন্দে প্রথিত পবরতীকালের সম্পূরক রচনা। এর ব্যাকরণ, ছন্ম ও পদাঘােয়রীতি ত্রুটিপূর্ণ; ছন্দোগত বিচ্যুতি-পূরণের জন্য অব্যয় বারেবারে প্রযুক্ত হয়েছে। গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত ঋগ্বেদীয় মন্ত্রগুলিকে ব্যাখ্যা করা ও প্রয়োগপদ্ধতির ভাষ্য রচনা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।
ঋগ্বেদের অপর গৃহ্যসূত্র, অর্থাৎ শাখায়ন, বাষ্কল শাখার অনুগামীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। লেখকের নাম হিসাবে সুযজ্ঞ শাঙ্খায়ন উল্লিখিত হয়েছেন; তবে গ্ৰন্থকর্তাররূপে নিম্মোক্তদের নামও পাওয়া যায় : কৌষীতকি, মহাকৌষীতকি, ঐতরেয়, মহৈতরেয়, আশ্বলায়ন ও কহােল। প্ৰথম অধ্যায় অষ্টকা, শ্রাবণী, আগ্রহায়ণী, চৈত্রী, আশ্বযুজী ও নির্দিষ্ট সময়ে আয়োজিত শ্ৰাদ্ধসমূহ–এই সপ্তবিধ পাকযজ্ঞ বিবৃত হয়েছে। প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হলো শ্ৰাদ্ধ-অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ও আমন্ত্রণযোগ্য অতিথি। ক্রমশ বিবাহ অনুষ্ঠান, গর্ভাবস্থা, জন্মসংক্রান্ত অনুষ্ঠান, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চুড়াকরণ ইত্যাদিও আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপনয়ন, বেদাধ্যয়ন ও বিদ্যার্থীদের আচরণ-বিধি বৰ্ণিত হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে গৃহনির্মাণ পদ্ধতি, শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদি। চতুর্থ অধ্যায়ে উপকরণ, অন্যধ্যায় ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। তারপর শুরুর প্রতি কৃত অন্যায় ও তজ্জনিত প্ৰায়শ্চিত্ত বৰ্ণনা-প্রসঙ্গে ঋষিদের বিভিন্ন বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় ব্যাসের চারজন শিষ্য উল্লিখিত হওয়ায় মনে হয়, আলোচ্য গৃহ্যসূত্র মহাভারতের চূড়ান্ত রচনাপর্বের সমকালীন। পুরুষ ঋষিদের সঙ্গে গার্গী বাচক্লবী, বড়বা আতিথেয়ী ও সুলভা মৈত্রেয়ীর মতো ঋষিকাও এতে উল্লিখিত হয়েছেন। তাছাড়া দেবগৃহে প্ৰদক্ষিণের বিধি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, তখন মন্দির ও দেবপ্রতিমা প্ৰদক্ষিণ করার নিয়ম প্ৰচলিত ছিল। শ্রাবণ আহুতিতে বিভিন্ন লোকের সর্পের উল্লেখ লক্ষণীয়। পরিশেষে রয়েছে বিভিন্ন ঋতুর অনুষ্ঠান ও রুদ্রহােম।
পঞ্চম অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে বৈশ্বদেব, প্ৰায়শ্চিত্ত এবং কূপ, দীঘি ও উদ্যান শুদ্ধকরণের অনুষ্ঠান এবং পরিশেষে অশুভ লক্ষণ, ব্যাধি ও বিবিধ প্রয়োজনীয় আচারসহ প্ৰায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানের বিবরণ। শেষ অধ্যায়ে স্বাধ্যায় বা বেদাধ্যয়নের বিষয়বস্তুরূপে আরণ্যক হোমের নির্দেশাবলী এবং সেই সঙ্গে কমবিরতির তালিকা ও বেদমন্ত্র আবৃত্তির পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে।
বিভিন্ন গৃহ্যসূত্রে বিষয়সূচী খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়; শুধুমাত্র গুরুত্বআরোপের ক্ষেত্রে এদের পারস্পরিক ভিন্নতা নিরাপিত হতে পারে। শুক্ল যদুর্বেদের পারস্কার গৃহ্যসূত্র প্রকৃতপক্ষে কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের পরিশিষ্ট; তাই তা ‘কাতীয়’ নামেও পরিচিত। এর তিনটি অংশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অংশের সূচনায় রয়েছে গাৰ্হাপত্য অগ্নি প্ৰজ্বলনের প্রস্তুতি, ও অতিথি-আপ্যায়নের পদ্ধতি। লক্ষণীয়, বলা হয়েছে অতিথির উপযুক্ত খাদ্য হল গোমাংস। তারপর পাকযজ্ঞ ও বিবাহসংক্রান্ত বিভিন্ন অনুপুঙ্খ বর্ণিত হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের প্রাধান্য তর্কাতীত; সপ্তপদী অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোথাও–প্রত্নকথা বা অনুষ্ঠানের গঠনের পিছনে প্রধান প্রেরণাদায়ী ভূমিকা যে লোকায়তা লঘু ঐতিহ্যের অনুষ্ঠানবিধির ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জন্মবিষয়ক অনুষ্ঠানের বহু অবৈদিক জনপ্রিয় দেবতাকে আহ্বান করা হত, যাদের নাম এইখানেই প্ৰথমবার শোনা গেলো। ষণ্ড, মর্ক, উলূখলের মতো ব্ৰাহ্মণ্য উপদেবতা ছাড়াও এদের রয়েছে মলিম্লুচ, দ্রোণাশ, চ্যবন, আলিখৎ, অনিমিষ, কিংবদন্ত উপশ্রুতি, হৰ্যক্ষ, কুন্তী, শত্ৰু-হন্তমুখ ও সর্ষপারুণ। লঘু ঐতিহ্যের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের বিস্তর ইঙ্গিত মেলে এই নামগুলিতে।
দ্বিতীয় অংশে রয়েছে শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণ ভোজনের বিধি, উপনয়ন, বেদধ্যয়ন, অন্যধ্যায়, প্ৰায়শ্চিত্ত, হলকর্ষণ, বিভিন্ন ঋতুর উপযুক্ত যজ্ঞ ইত্যাদি। তৃতীয় অংশে প্রাগুক্ত যজ্ঞসমূহের বিবরণ ছাড়াও রয়েছে শ্ৰাদ্ধ, গৃহনির্মাণ, শিরঃপীড়ার উপশম, ভৃত্যের পলায়ন রোধের জন্য ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান, রুদ্রের প্রতি রক্তের আহুতিপূর্ণ অনুষ্ঠান–এই সম্পূর্ণ অভিনব আচরণে সম্ভূত প্রত্ন-তান্ত্রিক ধর্মের উপাদান অভিব্যক্ত হয়েছে। তারপর বিভিন্ন ধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ, পশুযাগ প্রভৃতি বৰ্ণিত হয়েছে। দেবতার পক্ষে অনুকূল পবিত্র স্থানের ধারণা বৈদিক যুগের প্ৰথম পর্যায়ে দেখা যায় নি; এখানে তার প্রকাশ ঘটায় একে আমরা প্রত্ন-পৌরাণিক যুগের লক্ষণ রূপে গ্রহণ করতে পারি, যখন বিভিন্ন পবিত্র বন, বৃক্ষ, নদী ইত্যাদির কল্পনা ক্রমশ লোকপ্ৰিয় হয়ে ওঠে; তাছাড়া মন্দির ও প্রতিমার ধারণা এ সময়ে দেখা দেয়। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিচারালায়, রণ; পববর্তী দুটি অধ্যায়ে রথ বা হস্তী আরোহন ও বিভিন্ন দেবতার আহ্বান এবং ষোড়শ অধ্যায়ে জনৈক বৈদিক বিদ্যার্থীর মর্মাম্পশীী প্রার্থনা ব্যক্ত হয়েছে।
পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত ঋগ্বিধান গ্রন্থটি অর্বাচীনতর সূত্র-জাতীয় রচনা। এর একমাত্র বিষয়বস্তু হল ইন্দ্ৰজাল এবং প্রধান উদ্দেশ্য, ঋগ্বেদীয় মন্ত্রের ঐন্দ্ৰজালিক প্রয়োগবিধির নির্ধারণ। মহাকাব্যিক অনুষ্টুপ ছন্দে গ্রন্থের অধিকাংশই রচিত। যদিও লেখকরূপে শৌনকের নাম উল্লেখ করা যায়, তবুও এই গ্রন্থে দীর্ঘ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত রচয়িতাদের প্রচেষ্টার নিদর্শনও রয়েছে। ঋগ্বেদের সঙ্গে এর যোগাযোগ ক্ষীণ ও কৃত্রিম, কেননা কোনো প্রকৃত আন্তরিক প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত মন্ত্রসমূহ প্রেতিনিবারণ, অশুভলক্ষণ-দূরীকরণ, অভিচার ও অন্যান্য ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে—মূল লক্ষ্য বা প্রয়োগের সঙ্গে যেগুলির পার্থক্য মৌলিক। এদিক দিয়ে সামবিধানের সঙ্গে এর নিবিড় সাদৃশ্য বয়েছে; কেননা তা ব্ৰাহ্মণরূপে অভিহিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ব্রাহ্মণ শ্রেণীর রচনা নয়। তেমনি কৌশিকসূত্র বা ঋদ্বিধানকেও প্রকৃত গৃহ্যসূত্র বলা যায না, এরা নিববয়ব প্রত্নপৌরাণিক ধর্মীয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। ঋশ্বিধানের শেষ অংশে রয়েছে। ফলশ্রুতি বা রচনা-মাহাত্মযা পরবর্তী ধর্মীয় সাহিত্য, বিশেষত মহাকাব্য ও পুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এতে যে সমাজ চিত্রিত হয়েছে তা ব্ৰাহ্মণ ও পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণে—যারা শুধুমাত্র যজ্ঞানুষ্ঠানই করতেন না, কল্যাণ ও অকল্যাণপ্ৰদ ঐন্দ্ৰজালিক মনুষ্ঠানেও নিরত থাকতেন। তারা নানাবিধ প্রেত ও লোকদেবতাকে আহ্বান জানাতেন; পদ্মফুল, চন্দন, তৈল, লবণ, বিন্ধপত্র ও শালগ্ৰাম শিলার সাহায্যে পূজা করতেন। ভক্তি, মন্দির, প্রতিমা, কৃচ্ছসাধন, যোগ, জপ, উদ্ভিজ্জ আহুতি দিয়ে পূজা, রক্ষাকবচ, ন্যাস, প্রতিমূর্তির ঐন্দ্রজালিক অঙ্গচ্ছেদ, আতিশয্যের প্রবণতা—এ সমস্তই বেদোত্তর হিন্দু ঐতিহ্য-সম্পূক্ত সাহিত্যের চরিত্রলক্ষণ। আহুত দেবতাদের অধিকাংশই পৌরাণিক, তান্ত্রিক ও বৈষ্ণবীয় ধারার অন্তৰ্গত : এমন কি, এসমস্ত সম্প্রদায়ে প্রচলিত পূজাপদ্ধতিও প্রাধান্য পেয়েছে। জাতিভেদপ্ৰথা দুর্লঙ্ঘা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে; এ-পর্যায়ে পুরোহিতদের দক্ষিণার বৈচিত্র্য ও পরিমাণ বহুগুণ বর্ধিত যেহেতু ইতোমধ্যে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রকৃতপক্ষে অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছিল।
ঋগ্বিধানের বিলম্বিত আত্মপ্ৰকাশ শুধুমাত্র বহু পৌবাণিক বিযয়বস্তু, অৰ্চনাপদ্ধতি ও অচিত বস্তুর অন্তর্ভুক্তির মধ্যেই প্রমাণিত নয়—মূল বৈদিক সমাজ থেকে এর প্রচুর দূরত্বের মধ্যেও এই তথ্য অভিব্যক্তি। অধ্যাত্মভাবনায় নিষ্ণাত ঋগ্বেদের ‘অস্যবামীয়’ সূক্তকে এখানে পাপমোচনের জন্য আবৃত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; তেমনি বন্ধনদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শুনঃশেপ উপাখ্যান আবৃত্তি করার যান্ত্রিক নির্দেশ লক্ষ্য করা যায়। রতি, প্ৰদ্যুম্ন, কেশব, মাধব, গোবিন্দ, মধুসূদন, ত্রিবিক্রম, বামন, শ্ৰীধর, হৃষীকেশ, পদ্মনাভ ও দামোদরের মতো দেবতারা শুধু পৌরাণিক দেবতার অস্তিত্বই প্রমাণ কবে না, বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং আলোচ্য গ্ৰন্থকে বৈদিক ও পৌরাণিক ঐতিহ্যের অন্তর্বতী তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্ররূপে যথাযথভাবে গ্রহণ করা সমীচীন। আরো কয়েকটি অর্বাচীন গৃহসূত্রের সঙ্গে এই গ্রন্থটি আমাদের নিকট নিশ্চিতভাবে যুগসন্ধিক্ষণের লক্ষণসমন্বিত প্রত্নপৌরাণিক ও প্রাক-হিন্দুযুগের ধর্মীয় কাঠামোটি তুলে ধরে—আপন অবৈদিক কাঠামো আবৃত করার জন্যই মাকে বৈদিক পরিচ্ছেদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, উন্নতিশালী যে বণিক সম্প্রদায় তৎকালীন অর্থনীতি ও ফলত কিছু কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রণ করত, তারা সে-যুগের প্রধান ধর্মীয় প্রবণতাগুলিরও নিয়ামক হয়ে উঠেছিল। এই বণিক সম্প্রদায় যে অরক্ষণশীল অথবা অপেক্ষাকৃত প্ৰগতিশীল বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের সঙ্গে বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছিল-তা তাদের ক্রমোন্নতির ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট; এছাড়া কিছু কিছু লোকদেবতার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিল।
তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্র বাধূল শাখার উপবিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত। রচনাটি তিনটি প্রশ্নে বিন্যস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে পুংসবন থেকে সন্ন্যাস পর্যন্ত সবগুলি গৃহ্য অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। শেষ প্রশ্নে রয়েছে বিবিধ বিষয়বস্তু : শ্ৰাদ্ধ এবং গর্ভবতী ও সংসার-পরিত্যাগীর জন্য অনুষ্ঠান ছাড়াও নারায়ণ-বলি’র মতো পিতৃপুরুষের উদ্দেশে আয়োজিত অনুষ্ঠান ও শিকল-হােমের মতো গৌণ আচারও এতে রয়েছে। আবার এই গ্রন্থে বিবৃত কয়েকটি অনুষ্ঠান অন্য কোথাও পাওয়া যায় না : ‘স্থাগরালঙ্কার’ নামক বিচিত্র অনুষ্ঠানে আটটি বস্তু ব্যবহৃত হতমালাবার অঞ্চলে এটি সাধারণত ‘অষ্টমাঙ্গল্য’ নামে পরিচিত এবং বঙ্গদেশে অনুষ্ঠিত একটি আচারের সঙ্গে এর সাদৃশ্য বেশ স্পষ্ট। অনেকটা তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত দেবতারাধন অংশে ‘যন্ত্ৰী’ উল্লিখিত হলেও প্রতিমার কোনো উল্লেখ নেই–সম্ভবত তা পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল। বোধায়ন, কুশহারােত, পুষ্করসাদি ও কৌষীতকি–এই চারজন শিক্ষকের নামও উল্লিখিত হয়েছে।
অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্রকে অর্বাচীন রচনা বলে মনে হয়; বৌধায়ন শাখার সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে-সম্ভবত তা এর বিকল্প পাঠান্তর। মহাকাব্যিক অনুষ্ট্রপ ছন্দে দীর্ঘ স্তবকগুলি রচিত হওয়ার মধ্যে এর নবীনতা স্পষ্ট; তবে এই শ্লোকগুলি পরবর্তীকালের সংযোজনও হতে পারে। এমন কি, প্রাচীন সূত্র আঙ্গিকে রচিত অংশ অপেক্ষা এর গদ্যাংশ অনেক বেশি সম্পূর্ণতর। যদিও রচনার মধ্যে বেশ কিছু অপাণিনীয় শব্দ ব্যবহার রয়েছে, তবু এর ভযাকে খুব একটা প্ৰাচীন বলা যায় না।
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র দুটি প্রশ্নে বিন্যস্ত-প্রতি প্রশ্ন আটটি পটলে বিভক্ত। প্রথম প্রশ্নে বিবৃত উপনয়ন উৎসবে আমবা ‘শাক’ ও ‘জঞ্জভ’ নামে দুটি নূতন গ্রহের কথা জানতে পারি। ঐন্দ্রজালিক আচার সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ অংশের পরে বিবাহ অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ আকস্মিক দুর্ঘটনা ও অবস্থা সম্পর্কে আচার ও ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠান। গুরুগৃহ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মাতাপিতার প্রতি বিদ্যার্থীর কর্তব্য ও বিবাহের পর গাৰ্হস্থ্য আশ্রমের সূচনা এবং তদপযোগী প্রার্থনা বর্ণিত হয়েছে। প্রার্থিত বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের মধ্যে সেযুগের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির নিদর্শণ পাওয়া যায়। এছাড়া প্ৰথম প্রশ্নে রয়েছে যজ্ঞাগ্নির প্রজ্জ্বলন ও গৃহনির্মাণ। দ্বিতীয় প্রশ্নের সূচনা হয়েছে জন্মপূর্ববর্তী অনুষ্ঠান দিয়ে; তারপর জন্মকালীন অনুষ্ঠান, নামকরণ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। শিশুর একটি গোপন নামের ব্যবস্থায় আদিম মানুষের মানসিকতার সঙ্গে সম্পূক্ত রহস্য ও ঐন্দ্ৰজালিক চেতনা অভিব্যক্তি। কৈশোরকালীন অনুষ্ঠানগুলির পরে আচারগত বিচূতি ও তজনিত প্ৰায়শ্চিত্ত বৰ্ণিত হয়েছে। বিবিধ সারমেয়-দানবের মধ্যে যে ‘দুলা’ নামটি পাওয়া যায়, তা ছ’জন কৃত্তিকার অন্যতমা এই নামেরই অধিকারিণী। তৎপরবর্তী অনুষ্ঠান ‘শূলগব’-এ বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে চন্দন উল্লিখিত হওয়ায় দক্ষিণ্যত্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আভাসিত হয়েছে, যেহেতু কেবলমাত্র সেই অঞ্চলেই চন্দন বৃক্ষ দেখা যায়। রুদ্রের পানীয়রূপে সুরা ইত্যাদি নির্দেশিত হওয়ায় আমাদের মনে হয় এর অন্তরালে রয়েছে কোনও আদিম লৌকিক দেবতা বা অশুভ আত্মার উপস্থিতির প্রভাব। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের একটি বিচিত্র প্রার্থনায় যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিথিলতার ইঙ্গিত রয়েছে। অষ্টকা অনুষ্ঠানে পিতৃপুরুষের প্রতি গোমাংস নিবেদিত হয়েছে। একে একে শ্রাবণ অনুষ্ঠান, স্নাতক অনুষ্ঠান, প্রাচীন শিক্ষকদের তালিকা এবং জ্বর, ক্ৰোধ, ধর্ম প্রভৃতি বিশুদ্ধ বিমূর্ত বস্তুর সঙ্গে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন, বাজশ্রব, বিষ্ণু, রুদ্র, স্কন্দ ও কাশীশ্বর প্রভৃতি বশিষ্ঠ ও পরাশর দ্বারা উল্লিখিত হয়েছেন। অধ্যয়নের বিষয়সমূহের মধ্যে ইতিহাস ও পুরাণ উল্লিখিত হওয়ায় আলোচ্য গ্ৰন্থ যে পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। পদপাঠের রচয়িতারূপে আত্ৰেয়া, ভাষ্যকাররূপে কৌণ্ডিণ্য ও সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশীর উল্লেখ এবং অরণ্যবাসী মুনি, শিক্ষক ও ব্যতিদের বর্ণনা এবং একপত্নীক ব্যক্তিদের প্রশংসা থেকে তৎকালীন সমাজের পরিস্থিতি সম্পর্কে কতকটা ধারণা করে নেওয়া হয়েছে।
খাদির গৃহ্যসূত্র দ্রাহ্যায়ণ নামেও পরিচিত; এর পাঁচটি পঞ্চিক প্রত্যেকটি কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। এতে কয়েকটি নূতন বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে যেমন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যথাযথ সময় ও ক্রিয়াপদ্ধতি, গৃহের জন্য বিশেয অনুষ্ঠান এবং সমৃদ্ধিকামী ব্যক্তির আচরণীয় ক্রিয়া। হােতা ও ব্ৰহ্মাশ্রেণীর পুরোহিতদের ক্রিয়াকর্মকে সংযুক্ত করার জন্য প্রদত্ত একটি নির্দেশ আমরা সেই যুগের অভিব্যক্তি দেখি যখন একজন মাত্র পুরোহিত যজ্ঞ সমাধা করতেন। যজ্ঞ সম্পর্কিত কিছু কিছু নির্দেশ থেকে বিলাসী সমাজের চিত্র পাওয়া যায়।
সামবেদের গোভিল গৃহ্যসূত্র কৌথুম শাখার মন্ত্র-ব্ৰাহ্মণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। চারটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত এই গ্রন্থটি কয়েকটি কণ্ডিকায় বিভক্ত; তবে এই বিভাগ নিতান্ত কৃত্রিম। যদি প্রতি ভাগকে একটি দিনের পাঠরূপে গ্ৰহণ করা যায়, শুধুমাত্র তা হলেই এর অর্থবোধ হতে পারে। প্ৰধানত সূত্রশৈলীর গদ্যে রচিত এই গ্রন্থে অল্প কয়েকটি শ্লোকও পাওয়া যায়। স্নান, শ্রাদ্ধ ও সান্ধ্য অৰ্চনা সম্পর্কিত আরো পাঁচটি গ্রন্থের রচয়িতা রূপে গোভিলের নাম উল্লিখিত হয়ে থাকে। গোভিল গৃহসূত্রে বিষয়বস্তুর অনুরূপ; শুধু সামমন্ত্র গায়ক ছাত্রের উপর অধিকতর গুরুত্ব এখানে আরোপিত হয়েছে। পক্ষিমাংস ভক্ষণ তার পক্ষে নিষিদ্ধ হওয়ায় মনে হয়, এটি সহানুভূতিনিষ্ঠ ইন্দ্ৰজালের প্রতি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত-সুরশিক্ষার্থীর পক্ষে সুরস্ৰষ্টা জীবের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে নিরস্ত করার অভিপ্ৰায়েই এ নির্দেশ পরিকল্পিত। গোভিলপুত্র রচিত গৃহ-সংগ্ৰহ প্রকৃতপক্ষে গোভিল গৃহ্যসূত্রের পরিশিষ্ট এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের প্রয়োজন নির্বাহ করার জন্য তা পরিকল্পিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাৰ্হাপত্য অগ্নি যে ছত্রিশটি ভিন্ন ভিন্ন নাম পরিগ্রহ করে, তার বিবরণ দিয়ে এই গ্রন্থের সূত্রপাত; এই অগ্নিতে আহুতিদানের তাৎপর্য মহত্ত্ব ও তার যথার্থ পদ্ধতি এবং উপযুক্ত ইন্ধন প্রয়োগের উপর এখানে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। প্রধানত যে সমস্ত বিষয় এই রচনায় আলোচিত, তার মধ্যে রয়েছে—আনুষ্ঠানিক আসনভঙ্গি, যজ্ঞবিষয়ক দেবতার পবিত্রতা, কুশ-ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র, আনুষ্ঠানিক স্নান, সুরার ব্যবহার, বালিকাদের বিবাহের উপযুক্ত বয়স, উপনয়ন, আহুতি প্ৰদান, শ্ৰাদ্ধ, ব্ৰাহ্মণভোজন আনুষ্ঠানিক অশুচিতা ও তার প্রতিবিধান, স্বকীয় বৈদিক শাখার প্রতি আনুগত্য এবং তদভাবে অনৌচিত্য ইত্যাদি।
লৌগাক্ষি গৃহ্যসূত্র (কাঠক, চরক ও চারায়ণীয় নামেও পরিচিত) কৃষ্ণ যজুর্বেদের কাঠক শাখার অন্তর্গত এবং মহাকাব্যিক শৈলীতে এর শ্লোক সমূহ রচিত হওয়ায় মনে হয়। এটি পরবর্তী কালের গ্রন্থ। বিষয়বস্তুর বিন্যাসে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ নেই। মানব ও বারাহ গৃহ্যসূত্রের সঙ্গে এই গ্রন্থের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। সাধারণত অন্যান্য গৃহ্যসূত্রে যে সমস্ত বিষয়-বস্তু পরিলক্ষিত হয়, লৌগাক্ষি গৃহ্যসূত্রেও সেসব পাওয়া যায়। তবে নববধূর শুদ্ধীকরণ ও বধূবরণ অনুষ্ঠানের উপর এতে কিছু গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে; এছাড়া দেবপূজায় প্রযুক্ত পবিত্র সঙ্গীতও কিছু গুরুত্ব পেয়েছে। যোগ্য ছাত্রদের তালিকায় ধনদাতা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় স্পষ্টত এই তথ্য আভাসিত হচ্ছে যে ইতোমধ্যে শিক্ষাজগতেও কিছু পরিমাণে বাণিজ্যিক মনোভাব সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। বৈদিক বিদ্যার পক্ষে উপযুক্ত অন্যবিধ ব্যক্তিরূপে শিক্ষকের জন্য কায়িক পরিশ্রমে নিরত কর্মকৃৎ নির্দেশিত হয়েছে। বালিকাদের বিবাহের উপযুক্ত বয়স ছিল দশ বা বারো; কুমারীদের জন্য দুটি বিশেষ উৎসব ছিল ‘রাকা’ ও ‘হােলকা’। গাৰ্হস্থ্য অঙ্গল মোচনের জন্য পরিকল্পিত বিভিন্ন সাময়িক অনুষ্ঠান, রাক্ষস, মুষিক ও কপোতের বিরুদ্ধে প্ৰযুক্ত হত। পিণ্ডপিতৃ যজ্ঞ নামক পিতৃপুরুষের উদ্দেশে নিবেদিত অনুষ্ঠানে প্ৰযুক্ত অন্ন দিয়ে ব্রাহ্মণদের ভোজন করাতে হত। এই শেষোক্ত অনুষ্ঠানটি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও এইরূপ ব্ৰাহ্মণদের সমাজে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়, কারণ সম্ভবত এরা প্ৰাচীনতর কালেও সামাজিকভাবে হেয় ছিলেন। যেসব অমঙ্গল প্ৰদ অপশক্তিকে বিতাড়নের চেষ্টা করা হয়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ নাম অন্যান্য গৃহ্যসূত্রে পাওয়া গেলেও চুপনী—এই নূতন নামও পাওয়া যায়। ছয়জন কৃত্তিকার অন্যতম চুপুনিক নামটির উৎস এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত রয়ে গেছে!
তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র চারটি প্রশ্নে বিন্যস্ত; এদের মধ্যে প্রথমটির বিবাহক্রিয়া দিয়ে শুরু এবং গর্ভাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলির চূড়ান্ত রূপটি দিয়ে সমাপ্তি। দ্বিতীয় প্রশ্নের শুরুতে রয়েছে জন্মকালীন অনুষ্ঠান এবং ক্রমে ক্রমে এতে বাল্যবস্থা বেদাধ্যয়ন ও গাৰ্হস্থ্যসংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলি আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় প্রশ্নে বিবৃত হয়েছে বিবিধ আনুষ্ঠানিক বিচূতি ও প্ৰায়শ্চিত্ত, সৰ্প ও অন্যান্য উপদেবতার শাস্তিবিধান এবং কল্যাণ-বিধানের জন্য কিছু কিছু অনুষ্ঠান। শেষ অধ্যায়ে বিবিধ আকস্মিক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত নিয়মাবলী কথিত হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে ভাবী অমঙ্গলসূচক লক্ষণ এবং তৎপ্রসূত অমঙ্গল নিবারণের উপযোগী অনুষ্ঠান সমূহ। রচনার প্রধান অংশের পরে যে পরিভাষা অংশটি রয়েছে তাতে আনুষ্ঠানিক মান, শুভদিন ও গৃহস্থের পক্ষে অবশ্য পালনীয় পঞ্চবিধ অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী বিবৃত হয়েছে। এর পরবর্তী অংশটি গৃহ্যশেষ রূপে অভিহিত; যে-সমস্ত বিষয় পূর্বসূরীদের রচনায় যথাযথভাবে আলোচিত হয় নি, এতে সে-সব স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বিষ্ণু, রুদ্র, দুর্গা, রবি, জ্যেষ্ঠ, বিনায়ক, ঈশান প্রভৃতি দেবতার প্রতিমায় প্ৰাণ-প্ৰতিষ্ঠার এবং নারায়ণের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনের নিয়মাবলী-এই অংশে আমরা পৌরাণিক যুগের প্রাথমিক পর্বে প্রবেশ করেছি। পিতৃমেধ ও পিতৃমেধ-শেষ সম্পর্কে বৌধায়ন রচিত আরো দুটি সম্পূরক রচনার সন্ধানও পাওয়া যায়। তেইশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্রের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এর পার্থক্য খুব সামান্য—তবে গাৰ্হাপত্য অগ্নিপ্রজালন এবং নববধূর সঙ্গে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান-সমূহের উপর এতে অধিকতর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। অপর স্ত্রী গ্ৰহণ করা থেকে স্বামীকে নিবৃত্ত করার জন্য এবং স্বামীর মন আকৃষ্ট করার জন্য পত্নী কর্তৃক পালনীয় অনুষ্ঠানও এখানে রয়েছে। বিবাহ মণ্ডপে উপস্থিত হওয়ার পর বরকে একটি গোদান করে তবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হত। বন্ধু ও বরের মধ্যে শুভ ও অশুভসূচক লক্ষণ নির্ণয়ের চেষ্টায় লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠানে ইন্দ্ৰজালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অষ্টকা শ্ৰাদ্ধ অনুষ্ঠানে গোমাংস অর্পিত হওয়ায় মনে হয় গোমাংস ভক্ষণ সম্পর্কে সামাজিক নিষেধ তখনও পর্যন্ত ব্যাপকভাবে প্ৰচলিত ছিল না। তুলনামূলকভাবে নুতন দেবতারূপে ঈশানকে কেন্দ্র করে পৃথক চর্যবিধি যে গড়ে উঠেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পূরক রচনা অর্থাৎ গৃহ্যাশেষে আমরা একটি বিশেষ ধরনের চেষ্টায় সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি যেখানে গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানের সীমাকে নূতন যুগের ধর্মবোধে প্রসারিত করে ক্রমোন্নতিশীল পৌরাণিক পূজাপদ্ধতিকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়া দেখা যায়। এই গৃহ্যাশেষ ছাড়াও আমরা একটি আপস্তম্ব গৃহ্যুপরিশিষ্টের সন্ধান পাই যা আপস্তম্ব শাখার গৃহ্য অনুষ্ঠান-বিষয়ক রচনার পদ্যে গ্রথিত ও পরবর্তীকালে প্রণীত পরিশিষ্ট। বধূসম্প্রদানের সময় বধু ও বরের মাতামহ ও পিতামহের নাম আমরা উল্লিখিত হতে দেখি কিন্তু তাদের মাতামহী ও পিতামহীর নাম উল্লিখিত হয় না–এটি পূৰ্ণবিকশিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই নিদর্শন। ইতোমধ্যে গ্রহগুলি দেবতায় পরিণত হয়ে পূজা পেতে শুরু করেছে। গ্রহগুলি প্রতিমারূপে পূজিত হত; প্রত্যেক প্রতিমার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিমাপ ছিল এবং গোষ্ঠীগত অবস্থানে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ভূমিকাও ছিল সুপরিমিত। রাজা ও ব্রাহ্মণের উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, তারা উপাসকদের যথোপযুক্ত প্রতিদান দিয়ে থাকেন এবং অবজ্ঞাকারীদের বিনাশ করেন। কূপ ও পুষ্করিণী খননের মত মূর্তিকর্ম সম্পর্কে যে সমস্ত নিয়ম বিবৃত হয়েছে—তার মধ্যে রয়েছে ব্ৰাহ্মণদের বিপুল দক্ষিণা ও ভোজ্যদ্রব্য অর্পণের নির্দেশ। এছাড়া এতে স্বাধ্যায় সম্পর্কিত যেসব নির্দেশ রয়েছে, তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে ইতিমধ্যে উপনিষদের জনপ্ৰিয়তা বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানব গৃহ্যসূত্র কৃষ্ণ যদুর্বেদের মৈত্রায়ণীয় শাখার অন্তর্গত। এর দুটি খণ্ড আবার পঁয়তাল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। ছাত্রাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলি এখানে সানুপুঙ্খ আলোচিত হয়েছে এবং এই অনুষ্ঠানগুলি দিয়ে গ্রন্থ সূচনা হওয়ার পর গাৰ্হস্থ্য জীবনের সূচনা যে বিবাহ অনুষ্ঠান তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। শেষ অংশে বিভিন্ন ঋতুকালীন যজ্ঞ এবং দৈবদূর্বিপাকের সঙ্গে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। আরো কয়েকটি গৃহ্যসূত্রের মতো মানব গৃহ্যসূত্রেও সেই বিদ্যার্থীদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অংশ রয়েছে যারা উপনিষদ অধ্যয়নের পক্ষে অধিকারী। ছাত্রাবস্থায় কৃত পাপ সম্পর্কিত আলোচনায় বলা হয়েছে যে-কোনো মহাপাতকের উপযুক্ত প্ৰায়শ্চিত্ত হল যুদ্ধে মৃত্যুবরণ। বিবাহের পাঁচটি উদ্দেশ্য কল্পিত হয়েছে; সম্পদ, সৌন্দর্য, জ্ঞান, বুদ্ধি ও সাহচর্য। যদি সবগুলি একসঙ্গে না পাওয়া যায়, তবে পূর্বোক্ত ক্রম অনুযায়ী প্রথম তিনটি বর্জন করা যেতে পারে। অতিথিকে আপ্যায়নে গোমাংস নিবেদন করা ছিল বাধ্যতামূলক; তবে গৃহস্থের কর্তব্যও ছিল অতিথিদের সঙ্গে আরো চারজন ব্ৰাহ্মণকে মাংস-ভোজনে আমন্ত্রণ করা। কর্ম সঙ্ঘ অনুষ্ঠানে সীতা ও রেবতী নামে দুজন নূতন দেবতা উল্লিখিত হয়েছেন। ‘বিনায়ক কল্প’ ও ‘ষষ্ঠীকল্পে’র মতো নূতন অনুষ্ঠান এই গ্রন্থে প্রথম পাওয়া যায়।
তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র তিনটি প্রশ্ন ও সাতাশিটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। গৃহ্যসূত্রের সমস্ত প্রচলিত বিষয়বস্তু এতে আলোচিত হয়েছে; এতে রয়েছে বিবাহ, গৃহস্থের পালনীয় অনুষ্ঠান-সমূহ, বিশেষ জরুরি কিছু আচার, প্ৰায়শ্চিত্ত এবং মৃত্যু, অন্ত্যেষ্টি ও প্রেতিক্রিয়ামূলক অনুষ্ঠান। এই গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে যে বুদ্ধিমতী নারীকে বিবাহ করা উচিত এবং এই সঙ্গে উপযুক্ত পত্নী নির্বাচনের জন্য কিছু কিছু শুভ লক্ষণের তালিকাও রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলা হয়েছে যে সমস্ত শুভ লক্ষণ বর্তমান থাকলেও নিজস্ব মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী বধু নির্বাচন করা উচিত, যে স্বামীর হৃদয় এবং চক্ষু, এই দুই এর পক্ষেই গ্ৰীতিকর হবে। তৎকালীন পরিস্থিতির পক্ষে এরূপ উদারতাপূর্ণ মনোভঙ্গীর প্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। এই ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্রটি প্রাচীনতর ও দীর্ঘতর গৃহ্যসূত্রগুলির অন্যতম।
মৈত্রায়ণীয় শাখার অন্তর্গত বারাহ গৃহ্যসূত্র চরক উপশাখায় বিন্যস্ত এবং সম্ভবত তা খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থটি সতেরোটি খণ্ডে বিভক্ত, এদের মধ্যে প্রথমটি প্রকৃতপক্ষে মৈত্রায়ণীর সূত্রের পরিশিষ্ট। বাকি অংশসমূহে গৃহ্যসূত্রের প্রচলিত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে; যেমন নবজাত শিশুর জনা অনুষ্ঠান, দীক্ষা, বেদাধ্যয়ন ও অন্যধ্যায়-এর নিয়মাবলী বিবাহ, গৰ্ভবতী নারীর উপযোগী অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
বৈখানস-সূত্র অর্বাচীনতম সূত্রসাহিত্যের নিদর্শন। সাতটি প্রশ্নে বিন্যস্ত বৈখানসা গৃহ্যসূত্র আবার কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। এই গ্রন্থে যথাক্রমে আনুষ্ঠানিক স্নান, এবং চতুরাশ্রমের জন্য মুখ-প্রক্ষালন, অগ্নিবিষয়ক অনুষ্ঠান, পিতৃপুরুষের উদ্দেশে অনুষ্ঠান, স্নাতক, বিদ্যার্থী ও গৃহস্থদের জন্য অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। বহু অনুষ্ঠানে অপরিচিত দেবতা বা প্ৰেতাত্মাকে আহ্বান জানানো হত। বাসভবন শুদ্ধীকরণের জন্য অনুষ্ঠানের পরে প্রচলিত গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলি অর্থাৎ গর্ভাধান থেকে শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত সমস্ত আচার আলোচিত হয়েছে। শ্ৰাদ্ধ এবং অন্তেষ্টিক্রিয়াসমূহ এই রচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তারপর আকস্মিক দুর্ঘটনা ও অশুভ লক্ষণ নিরাকরণের উপযোগী প্ৰায়শ্চিত্ত বর্ণিত হয়েছে; আনুষ্ঠানিক অশৌচ অবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা এতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়েছিল। বইটির অষ্টম ক্ষেত্রে দশম প্রশ্নের নাম বৈখানস ধর্মসূত্র।
অথর্ববেদের শৌনক শাখার অন্তৰ্গত ‘কৌশিক সূত্র’ বা ‘সংহিতা বিধি’ একমাত্র অথর্ববেদীয় গৃহ্যসূত্ররূপে পরিচিত। এর নামকরণের মধ্যে ‘গৃহ্য’ শব্দটি উল্লিখিত হয় নি, একে শুধুই সূত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘বৈতানসূত্র’ নামের মধ্যে শ্রৌত কথাটি অনুল্লিখিত থাকলেও বিষয়গুলির দিক থেকে শ্রৌতসূত্ররূপে তা গৃহীত হওয়ার পক্ষে কোনও বাধা নেই। কৌশিকসূত্র বিশুদ্ধ গৃহ্যসূত্র বা বিশুদ্ধ শ্রৌতসূত্র নয়–এই উভয়ের সংমিশ্রণ। অথর্ববেদ সংহিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এই গ্রন্থটি অথর্ববেদীয় মন্ত্রের যজ্ঞীয় বিনিয়োগ নির্দেশ করতে চেয়েছে এবং বহুবার একই মন্ত্রের জন্য একাধিক অনুষ্ঠানের বিধান দিয়েছে। যেমন বিবাহ ও তৎসম্পর্কিত স্ত্রী-আচার, জন্মকালীন অনুষ্ঠান ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। যদিও এটি শৌনক শাখার অন্তর্গত তথাপি সূত্ৰ সাহিত্যের অর্বাচীনতম গ্রন্থগুলির অন্যতমরূপে এটি কখনো কখনো অন্য তিনটি অথর্ববেদীয় শাখায় অর্থাৎ জলদ, জাজল ও ব্ৰহ্মদেব, শাখায় প্রচলিত আচার পদ্ধতির উল্লেখ করেছে। একদিক দিয়ে কৌশিকসূত্রকে আমরা অথর্ববেদ সংহিতার অনুষ্ঠানমূলক ভাষ্যরূপে গ্ৰহণ করতে পারি। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা হলেও এর বিষয়বস্তু অথর্ববেদের প্রাচীনতম অংশেরই সমকালীন।
একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক দিয়ে গৃহ্যসূত্রগুলি ব্রাহ্মণ সাহিত্য ও অথর্ববেদ থেকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভব হয়েছে। আর শ্রৌতসূত্রগুলি উদ্ভূত হয়েছে শুধু ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য থেকে। অথর্ববেদ সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা দেখেছি যে তা অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও আদর্শগত বাতাবরণ সৃষ্ট হয়েছিল; একদিকে ছিল তিনটি বেদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রয়োগবিধি-জনিত একমুখী সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে অথর্ববেদ—যা কিছু মৌলিক উপায়ে ত্রয়ীর তুলনায় শুধুমাত্র ভিন্ন ছিল না, সম্পূর্ণ বিরোধিতাও করেছিল। পরবর্তীকালে অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই ধারায় প্রচলিত গৃহ্য অনুষ্ঠানসমূহের প্রবল উপস্থিতি। সামূহিক শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে সামাজিক জীবন সম্পূর্ণত গড়ে উঠেছিল; জনসাধারণ তাদের পারিবারিক, গাৰ্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনযাপনে বহুবিধ বাধাবিয়ের সম্মুখীন হত-ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য বা শ্রৌতসূত্রগুলি দিয়ে যাদের পুরোপুরি সমাধান করা যেত না। এইসব ক্ষেত্রে জিকরি প্রয়োজনসমূহ ছিল নিতান্ত বাস্তব ও পৌনঃপুনিক; এইগুলি অবস্থার উন্নতি সাধন, শাস্তিবিধান, প্রেতবিতাড়ন ও আশীৰ্বাদ প্ৰাপ্তির জন্য উপযুক্ত আনুষ্ঠানিক প্ৰতিবিধান অনিবাৰ্য করে তুলেছিল। অথর্ববেদ তার ব্যবস্থা করেছিল; সুদূর অতীত কাল থেকে বৈদিক ধর্মের পশ্চাৎপটে অথর্ববেদীয় পুরোহিতেরা সক্রিয় ছিলেন এবং জনসাধারণের বিপদে পড়ে তাদের শরণাপন্ন হতেন। তারপর ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্রমোন্নতিশীল ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রধানরা প্রতিবেশী রাজাদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত হওয়ার জন্য ঐন্দ্ৰজালিক প্রতিরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। প্রাচীনতর ধর্মে এধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা খুব কমই ছিল; তাই অথর্ববেদীয় পুরোহিত যখন উদ্যোগী হলেন, তাকে রাজপুরোহিতরূপে নিয়োগ করা হল এবং কালক্রমে তার গোষ্ঠী ও মতবাদ বিলম্বিত স্বীকৃতি লাভ করল। এই স্বীকৃতি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত অনিচ্ছা! সত্ত্বেই দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু রাজপুরোহিত রূপে অথর্ববেদীয় পুরোহিত যেহেতু একটি নক্ষতাসম্পন্ন অবস্থান থেকে দরকষাকষি করতে সমর্থ ছিলেন। তাই তিনি আপন অধিকার অর্জন করে নিলেন। তার জয়ের স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে : সমগ্ৰ যজ্ঞদক্ষিণার অর্ধেক অংশ একা ব্ৰহ্মার প্রাপ্য, বাকি অর্ধেক হােতা, উদগাতা ও অধিবৰ্ষর। অন্যভাবে বলা যায়, অন্য তিনজন পুরোহিত একত্রে যা লাভ করতেন, ব্ৰহ্মাশ্রেণীর পুরোহিত একই তা পেয়ে যেতেন। অথর্ববেদীয় পুরোহিতের ক্ষমতার অপর বাস্তব উৎস নিহিত ছিল গাৰ্হস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে—সেখানে তাঁর মতবাদ ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপ অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সমগ্ৰ সূত্রসাহিত্য যেহেতু পরবর্তীকালে রচিত, গৃহ্যসূত্রগুলিতে শুধুমাত্র অথর্ববেদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির জয় প্রতিফলিত হয় নি, অন্যান্য বেদের শাখাগুলিতেও তার অন্তর্ভুক্তি প্রমাণিত হয়েছে। অথর্ববেদের পরিগ্রহণের পশ্চাতে রয়েছে লোকায়ত ধর্মের স্বীকৃতি অর্থাৎ নিজস্ব দেবতা, আচার অনুষ্ঠান, প্ৰত্নকথা ও বিশ্বাসসহ লঘু ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি। তাই এখানে আমরা বহু-সংখ্যক অপরিচিত অর্ধদেবতা, উপদেবতা, দানব ও পিশাচ প্রভৃতির সম্মুখীন হই, কেননা লোকায়ত ধর্ম মূলত এদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসময়ে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের উল্লেখ আমরা লক্ষ্য করি–হস্তরেখা-বিচার, সর্ববিধ ভবিষ্যৎ-কথন, জ্যোতির্বিদ্যা অর্থাৎ অন্তরিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ থেকে আহৃত শুভাশুভ গণনা, স্বপ্নবিশ্লেষণ করে আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস নির্ণয়, বস্ত্রে মুষিকদংশনের ফলে উদ্ভূত চিহ্ন ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যদবাণী, অগ্নির উদ্দেশ্যে যজ্ঞ, বহুবিধ দেবতার প্রতি অৰ্পিত অৰ্ঘ্য, শুভাশুভ স্থান নিরাপণ, প্ৰেত-সঞ্চালন, সৰ্প নিয়ন্ত্রণ বিদ্যা, প্ৰেত্যাবিষ্ট বালিকার মাধ্যমে দেবতাদের পরামর্শ গ্ৰহণ, পরামদেবতার উপাসনা, ব্ৰতপালন ও মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা সন্তান-উৎপাদনের শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস ইত্যাদি।
এই পর্যায়ে জনপ্রিয় ধর্মের মধ্যে বৃহৎ ও লঘু ঐতিহ্যের যে বিচিত্র সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়, তার সম্ভাব্য কারণ এই যে, দুটি ধারার মধ্যে পরস্পর অভিমুখীনতা সর্বদা অব্যাহত ছিল। তাই দীর্ঘ-নিকায়ের মহাসময়সুত্তান্ত অংশে পৃথিবী ও বিশাল পর্বতসমূহের আত্মা, দিকসমূহের চারজন অধিপতি, গন্ধৰ্ব, নাগ, গরুঢ়, দানব এবং ব্ৰহ্মা, পরমাত্মা ও সনৎকুমার উল্লিখিত। ‘বেদাঙ্গ’গুলিতে বিদেহী আত্মার উপাসনা অধিকতর প্রকট; কারণ আদিম মানুষের মানসিকতায় বিশ্বজগৎ বৈরিতাকামী মন্দ আত্মার পরিপূর্ণ যারা নিয়ত মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সুখ আক্রমণ এবং ধ্বংস করতে উদ্যত। তাই বহুদূর পর্যন্ত গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলি আপাত-দৃষ্টিতে নেতিবাচক, মুখ্যত অমঙ্গল দূর করাই এগুলির উদ্দেশ্য।
শৌতি ও গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে বিপুল অংশ এক সাধারণ বৃত্তের অন্তর্গত; যেমন অগ্নিহোত্র, দর্শপূৰ্ণমাস, পিণ্ডপিতৃ যজ্ঞ এবং কিছু কিছু চাতুর্মাস্য অনুষ্ঠান উভয়বিধ গ্রন্থেই আলোচিত হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র কল্পসূত্রই প্রচলিত ছিল; পরবর্তীকালে অনুষ্ঠানসমূহ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুযায়ী রচনাকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছিল। তিনটি যজ্ঞাপ্লির প্রয়োগদ্বারাও নির্ধারিত হত–কোন বিষয় কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে; শ্রৌত যাগে যেহেতু এই তিনটি অগ্নিরই প্রয়োজন ছিল, তাই এই তিনটির যে কোনো একটি অগ্নিদ্বারা অনুষ্ঠিত যে কোনো যজ্ঞ প্ৰাচীনতম শ্রৌতসূত্র গুলিতে আলোচিত হয়েছিল এবং ফলত প্রত্যেকটি গৃহ্য অনুষ্ঠান তার অন্তর্ভুক্ত হল। ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে এমন কিছু বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে যা গৃহ্যসূত্রগুলির পক্ষে উপযোগী; স্পষ্টত এর কারণ এই যে, সে সময় কোনো পৃথক সূত্র সাহিত্যের অস্তিত্ব ছিল না–গৃহ্যসূত্রের তো কোনো প্রশ্নই উঠে না। উপনয়ন, গার্হ্যপত্য অগ্নির প্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মৃত্যু ও মরণোত্তর শ্ৰাদ্ধাদি এসবই মূলত গৃহ্যানুষ্ঠান—এগুলি ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতেও আলোচিত হয়েছে। যখন পৃথক শ্রেণীর রচনারূপে সূত্রগুলিতে আলোচিত হয়েছে। যখন পৃথক শ্রেণীর রচনারূপে সূত্রগুলি রচিত হতে লাগল, তখনো যে মিশ্র বিষয়বস্তুনির্ভর একটি সূত্র ছিল—তা আপস্তম্ব সূত্র থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম চৌদ্দটি অধ্যায়ে শ্রৌতসূত্রটি গঠিত; তারপর যথাক্রমে পরিভাষা ও গৃহসূত্রের মন্ত্রপাঠ অংশ পাওয়া যায়; শেষ দুটি অধ্যায়ে ধর্ম ও শুদ্ধৰ সূত্রগুলি গঠিত হয়েছে। এর থেকে আমরা কল্পসূত্র সাহিত্যের স্পষ্ট ঐতিহাসিক স্তর সম্পর্কে অবহিত হই; এর প্রাথমিক স্তরে প্রতি শাখা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল।
সামূহিক বৈদিক যজ্ঞে তিনটি অগ্নি প্রয়োজনীয় ছিল-আহবনীয়, দক্ষিণা ও গাৰ্হাপত্য–মোটামুটিভাবে এগুলি দেবতা, পিতৃপুরুষ ও মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের মধ্যে শুধুমাত্ৰ গাৰ্হাপত্য অগ্নি গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত হয়। শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি দেবকাহিনীতে। ইড়া বা শ্রৌত যাগের যজ্ঞীয় হব্যের উৎস বর্ণিত হয়েছে। এটা যেহেতু মনু কর্তৃক নিবেদিত প্ৰথম পাক যজ্ঞে উদ্ভূত হয়েছিল, তাই কোনো পাক যজ্ঞে ইড়া নেই। প্রকৃতপক্ষে এই অনুপস্থিতি সামূহিক ও গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলির প্রধান প্রতীকী পার্থক্যকে সূচিত করছে। এদিক দিয়ে এই শেষোক্ত অনুষ্ঠানগুলি প্রাচীনতর ও অধিকতর সর্বজনীন–সম্ভবত ইড়া আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে কোনও সময়ে এর উদ্ভব হয়েছিল।
গোভিল গৃহসুত্রম ১ম খন্ড
Title Pages.pdf | আখ্যাপত্র | 143.57 kB | Adobe PDF | View/Open |
Content.pdf | সূচীপত্র | 494.8 kB | Adobe PDF | View/Open |
Chapter1-1-80p.pdf | ১-৮০পৃষ্ঠা | 28.4 MB | Adobe PDF | View/Open |
Chapter2_81-148p.pdf | ৮১-১৪৮পৃষ্ঠা | 24.75 MB | Adobe PDF |
www.ধর্ম্মতত্ত্ব.com
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ