অদ্বৈতবাদ খন্ডন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

18 December, 2020

অদ্বৈতবাদ খন্ডন

অদ্বৈতবাদ

অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাকর্তা হলেন আদি শঙ্কর।[Nakamura 2004, পৃ. 211] তবে তিনি এই মতের প্রবর্তক নন। পূর্বপ্রচলচিত অদ্বৈতবাদী মতগুলিকে তিনি সুসংবদ্ধ করেছিলেন।[ Nakamura 2004, পৃ. 680] অদ্বৈতবাদ হল বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী,সর্বেশ্বরবাদী এ মতে, মানুষের সত্যিকারের সত্ত্বা আত্মা হল শুদ্ধ চৈতন্য এবং পরম সত্য ব্রহ্মও শুদ্ধ চৈতন্য।

অদ্বৈতবাদের তত্ত্ব হল ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। (১) ব্রহ্মা সত্যং মিথ্যা এটি বেদান্তের মূল তত্ত্ব। আচার্য শঙ্কর বলতেন______ অর্দ্ধ শ্লোকে প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ_____ কোটি কোটি গ্রন্থে যা লেখা আছে তা আধখানা শ্লোকে আমি বলছি,

ব্ৰহ্ম সত্যং জগমিথ্যা কীবো ব্রহ্মৈার নাপরঃ। 

ইসমের ভূ সজ্জাত্রমিতি বেদান্ত ডিত্তিমা। ২১ (ব্রহ্ম জ্ঞানী মালা)


এই শ্লোকের সরল অর্থ______ ব্রহ্মা সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মস্বরূপ, ব্রহ্ম হতে জীব ও জগতের পৃথক কোন কথা নাই। এই হল সমস্ত কোত্তের উচ্চনিনাদ বা ঘোষণা।

ব্রহ্মা সৎ চিৎ আনন্দস্বরূপ, নির্বিশেষ, স্বপ্রকাশ, দেশ কাল পাত্র দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন এক অদ্বয় পরমতত্ত্ব_______ আশা করি এই ঋষিবাক্যে আপনাদের কোন সংশয় নাই। এই দৃশ্যমান জগৎ, আপনাদের ভাষায় এত সুখের ও সাধের পৃথিবী মিথ্যা_____ এই কথাটি নিয়ে আপনাদের গোল বেধেছে। কিন্তু আচার্য এখানে কোন নঞ্র্থক (Negative) ভাবে 'মিথ্যা' শব্দটি প্রয়োগ করেন নি। মিথ্যা মানে আত্যন্তিক সত্তার অভাব। জলের কাছে দাঁড়ালে আপনাদের ছায়া পড়ে, আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে ছায়াকেও দণ্ডায়মান দেখা যাবে, বসে থাকলে ছায়াও বসবে, আপনারা জলের কাছ হতে দূরে সরে যান, তাহলে জলের মধ্যে আর ছায়া দেখা যাবে না। তাহলেই বুঝে দেখুন আপনাদের ছাড়া ছায়ার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা সত্তা নাই। এই অর্থে জগৎ মিথ্যা। জগৎ যে মিথ্যা তা জগৎ শব্দের মধ্যেই প্রতিপাদিত রয়েছে। গচ্ছতীতি জগৎ (গম্ + ড) যা নিয়ত গমন করে, নিয়ত পরিবর্তিত হয়, ever fleeting, ever changing, always inconstant, তাকে মিথ্যা ছাড়া আর কি বলা যাবে ?!

সত্য আমরা কাকে বলি ? কালত্রয়মবাধিডং সত্যং____ যা ত্রিকালে অবাধিত। যা পূর্বে ছিল, এখন আছে এবং পরেও থাকবে তারই নাম ঋষিরা দিয়েছেন 'সত্য'। যা পূর্বে ছিল, এখন নাই, তা সত্য নয়। পূর্বে ছিল না কিন্তু পরে হয়ত দেখা যাবে তাও সত্য নয়। আজ যে ৭০ তলা বা ১৫০ তলা বিশিষ্ট আকাশচুম্বী অট্রালিকার কথা শুনে আপনারা বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন, বিশ পঁচিশ বা পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ঐরকম ছিল না, কয়েক বৎসর পরে হয়ত দেখবেন তার রূপ এবং আকৃতি সবই বদলে গেছে! আপনারা আপনাদের স্ব স্ব স্থানেও দেখতে পাবেন এখানেও নানা পরিবর্তনের ধারা। জগতের প্রতি বস্তু সম্বন্ধেই এই কথা প্রযোজ্য। জাগতিক যে কোন বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখুন, বিচার করলেই বুঝতে পারবেন, এখানে কোন বস্তুই নিত্য স্থির নয়। দৃশ্যপট, তার রূপ, রঙ প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে। এইভাবে যার উৎপত্তি বৃদ্ধি, বিবর্ধন ও বিলুপ্তি ঘটে, তা স্বভাবতই মিথ্যা।

কোন কোন টীকাকারের মতে, জগৎ শব্দের অর্থ যা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের বিষয়। এই অর্থে তাবৎ দৃশ্য পদার্থই জগৎ পদবাচ্য। ব্রহ্মা জ্ঞেয় বা দৃশ্য হন না আবার যা সোনার পাথরবাটি, কাঠালের আমসত্ত্ব এবং বন্ধাপুত্রাদির ন্যায় অসৎ তাও দৃশ্য হয় না। সুতরাং জগৎ সৎ নয়, অসৎও নয়। মিথ্যা বলতে যা সৎ নয়, অসৎ নং এবং সদসৎও নয় তাকে বুঝায়। 

_______যেমন রজ্জুতে যে সর্পের জ্ঞান হয়, সেই সর্প মিথ্যা। মিথ্যা বস্তু তিনকালেই থাকে না অথচ তা জ্ঞানের বিষয় হয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে জ্ঞান হয় এজন্য এটি সৎ কিন্তু তিনকালে বিদ্যমান থাকে না, এজন্য এটি অসৎ। আবার অধিষ্ঠানের জ্ঞানে (রজ্জুকে রজ্জু বলে বুঝামাত্রই) এর নিবৃত্তি হয় বলে একে অসৎও বলা যায় না। এইভাবে এটি সদসৎ হতে ভিন্ন বস্তু। যা সদসৎ হতে ভিন্ন তা মিথ্যা। জগৎ এইরূপ মিথ্যা বস্তু।

যাইহোক, আমি আর একটি উদাহরণ দিয়ে পুনরায় তত্ত্বটি পরিস্ফুট করার চেষ্টা করছি। মনে করুন কোন মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে সন্ধেবেলা নদীর ধারে বেড়াতে গেছেন। 

আকাশে চাঁদ উঠেছে। ছেলেটি নিতান্ত খেলার ছলে জলে একটা ঢিল ছুঁড়ল। ঢেউ উঠল। বাচ্চা ছেলেটা তার মাকে বলল_________ দেখ দেখ মা জলের ভিতর চাঁদ নাচছে। ভেবে দেখুন 

ছেলেটার ঐ কথা কি ঠিক ? আকাশের চাঁদ আকাশেই আছে, পুকুরে চাঁদ নাই সে নাচছে না, মা হয়ত ভুল শুধরে দিবার জন্য বললেন না না, চাঁদ নাচছে না, জলের নীচে চাঁদের প্রতিবিম্বটাই নাচছে..." কিন্তু একথাও যথার্থ নয়। বিম্বে যা থাকে প্রতিবিম্বে ত তারই প্রতিফলন ঘটে। কাজেই চাঁদ যখন নাচছে না, তখন তার প্রতিবিম্বও নাচতে পারে না। বলা বা গতি জলে বাধা পেয়ে wave length সৃষ্টি করেছে, সেটাই কেঁপে কেঁপে চলেছে। পুকুরে চাঁদ নাই, তা নাচছে না, তার প্রতিবিম্বও নাচছে না।

এই উদাহরণ থেকে তাহলে একথাটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হল যে চর্মচক্ষুতে যা প্রত্যক্ষ দেখা যায়, সর্বদা তা সত্য হয় না। তাই আচার্য শঙ্করের অভিমত_______ জগৎ মিথ্যা। যোগী যার স্বরূপ জ্ঞান হয়, তাঁর চোখে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। এই দৃশ্যমান ব্যবহারিক জগৎ অবিদ্যামানোঽপি অবভাসতে। বাস্তবিক পক্ষে নাই অথচ আছে বলে মনে হয়, এই ভ্রান্ত জ্ঞানের উপরই জগৎ চলছে। এটি কেমন ? না শঙ্কর জী বলছেন যেমন, রজ্জুতে সর্পজ্ঞানবৎ। সত্যি সত্যি সাপ নাই অথচ একগাছি দড়ি দেখে মনে হল সেটা সাপ। ভ্রান্তিবশে দড়িতে সাপের চিত্র ভেসে উঠল। 

পরম বৈজ্ঞানিক ঋষিরা বলেছেন________ এই যে অবস্পন্দিত দৃষ্টি, এই যে ভ্রান্তি দর্শন, এর কারণ আপেক্ষিকতা (due to Relativity)। আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে একমাত্র তুরীয় ভূমিতে জীবাত্মার সম্মুখান ঘটলে তবেই বুঝা যায় যে নাভাবো বিদাতে সতঃ- সংএর বিদ্যমানতার কখন অভাব ঘটে না অর্থাৎ কিনা যা সৎ তা সদৈব অবিনাশী। সর্বব্যাপী ব্রহ্মে রজ্জুতে সর্পবং জগৎ ভাসে, কেবল প্রতীত হয়, প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে জগতের ব্রহ্মনিরপেক্ষ কোন আন্তরিক সত্তা নাই। কাজেই জগৎ যে মিথ্যা- এটি যুক্তিসিদ্ধ এবং অনুভবসিদ্ধ তত্ত্ব।

আদি শঙ্করের পূর্বে অদ্বৈতবাদ

ব্রহ্মসূত্র  রচনার আগে বেদান্তের কোনো শাখা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। ব্রহ্মসূত্র ও শঙ্করের মধ্যবর্তী সময়ের (বিশেষত খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় কথাও বিশেষ জানা যায় না। এই সময়ে লেখা দুটি বই পাওয়া যায়: ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় (পঞ্চম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ) ও গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকা (সপ্তম শতাব্দী)।[Nakamura 2004, পৃ. 3] অদ্বৈতবাদ খন্ডন করিবার পূর্বে তা কি অর্থাৎ এই মতবাদ ব্রহ্ম ও জীব সম্পর্কে কি ধারনা দেয় দেখে নেব। 

অদ্বৈত অর্থ দুই না অর্থাৎ ব্রহ্ম ও জগৎ বা পরমাত্মা ও জীবাত্মা দুই নয়, এক। ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদের কোন প্রকার ভেদই নেই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১/৪/১০) আছে- ‘‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ তদাত্মানমেবাবেৎ অহং ব্রহ্মাস্মীতি’’ অদ্বৈতবাদীদের মতে এই জগৎ ব্রহ্ম রূপেই বর্তমান ছিল। তিনি নিজেকে ‘আমিই ব্রহ্ম’ রূপ জেনেছিলেন। এখানে উল্লখ্য যে অদ্বৈতবাদীগন উপনিষদের অর্থের ব্যাখ্যা বেদ বিরুদ্ধ করেছেন তাই 'আমি ব্রহ্ম' অর্থ এসেছে। বৈদিক মতে উক্ত শ্লোকের অর্থ নিম্নরূপঃ

পদার্থঃ (বৈ অগ্রে ইদং ব্রহ্ম) নিশ্চয়রূপে প্রথমে ব্রহ্মই ছিলাে (ত আত্মান এব অবে তিনি নিজেকে জানলেন যে (অহ ব্ৰহ্ম অম্মি ইতি) আমি ব্রহ্ম।
ব্যাখ্যা- এই ব্রাহ্মণের প্রথম কন্ডিকায় জীবাত্মার হওয়ার কথন করা হয়েছে এবং যখন তিনি নিজের জন্য অহমশ্মি” আমি হই ইহা বললেন তাে তিনি অহম নামধারী হলেন। আর এই কন্ডিকাতে ব্রহ্মের প্রারম্ভে হওয়ার কথন করে বলা হয়েছে যে, যখন তিনি নিজেকে জানলেন তাে তিনি ”অহ ব্ৰহ্মাস্মি এই বাক্য বললেন। যাহার অভিপ্রায় এই যে, জীব এখানে অহম নামধারী তাে ঈশ্বর ব্রহ্ম নামধারী। এইপ্রকার জীব এবং ঈশ্বরের পৃথক্তা এবং স্বতন্ত্রতা হওয়ার বর্ণনা, এই ব্রাহ্মণে উপস্থিত।(বৃহদারণ্যক ১।৪।১০)

মাণ্ডূক্য উপনিষদে আছে ‘‘সর্বং হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ এই সকলই ব্রহ্ম, এই আত্মাই ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদে আছে-‘‘যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি’’ অর্থাৎ ঐ যে সূর্যমণ্ডলস্থ পুরুষ আমিই তিনি। ছান্দোগ্য উপনিষদে তত্ত্বমসি (তুমিই সেই) ও সঃ অহম (আমিই তিনি) বাক্যদ্বয় রয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যত্র আছে ‘‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ সব কিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সংক্রান্ত এই বিদ্যাকে শাণ্ডিল্য বিদ্যা বলা হয়। অতএব একথা স্পষ্ট যে উপনিষদ বা বেদান্তই অদ্বৈতবাদ দর্শনের ভিত্তি।

জীবের সাথে ব্রহ্মের এবং জগতের সাথে ব্রহ্মের যদি কোন পার্থক্য বা ভেদ না থাকে তবে জীব-জগৎকে ব্রহ্ম হতে পৃথক মনে হচ্ছে কেন? প্রকৃতপক্ষে এই ভেদজ্ঞান অজ্ঞানতাবশত সৃষ্টি হয়। প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হলে রাতের অন্ধকার যেমন দিনের আলোর সাথে মিলিয়ে যায় তেমন করে এই অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। জগৎই ব্রহ্ম অর্থাৎ জগৎ ও ব্রহ্মে কোন ভেদ নেই, এরকম চিমত্মাই হল জ্ঞান আর জগৎ ও ব্রহ্মে ভেদ কল্পনা করাই হল অজ্ঞান বা অবিদ্যা।

প্রকৃতপক্ষে এই দৃশ্যমান জগৎ মিথ্যা এর অর্থ জগৎ অস্তিত্বহীন নয়। জগৎ মিথ্যা বলতে বোঝায় জগৎ আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল ও পরিণামী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে জগতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক এক স্থানে জগৎ এক এক রকম, এক এক সময়ে জগৎ এক এক রকম এবং এক এক জনের কাছে জগৎ এক এক রকম। অর্থাৎ জগৎ সব সময়, সব স্থানে এবং সবার কাছে এক রকম মনে হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে প্রাচ্য দেশে ও পাশ্চত্য দেশে জগতের রূপ এক রকম নয়। বসমত্ম ঋতুতে জগৎকে যেমন দেখা যায় বর্ষা ঋতুতে তেমন দেখা যায় না। একজন মানুষ জগৎকে যেমন দেখে একটি গরু বা অন্য প্রাণী কিন্তু তেমন দেখে না। তাই জগৎকে সৎ মনে হলেও অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল হওয়ায় জগৎকে মিথ্যা বলা হয়েছে। ভগবান শঙ্করাচর্য তাঁর বিবেকচূড়ামণি নামক গ্রন্থে বলেছেন-
  ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেত্যেবংরূপো বিনিশ্চয়ঃ।
    সোহয়ং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ সমুদাহৃতঃ।।
                                                                                   -বিবেকচূড়ামণি (২০)
-‘ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে। জগৎকে সত্য বলে মনে করা মূলত ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। রজ্জুতে যেমন সর্প ভ্রম হয় ব্রহ্মতে তেমনি জগৎ ভ্রম হয়। ভগবান শঙ্করাচার্য এ সম্পর্কে বলেছেন-
 সম্যগ্ বিচারতঃ সিদ্ধা রজ্জুতত্ত্বাব ধারণা                    
ভ্রান্তোদিতমহাসর্পভয়দুঃখ বিনাশিনী।।
                                                                                                -বিবেকচূড়ামণি (২)
অর্থাৎ অজ্ঞানের জন্যে ভ্রান্তিবশত রজ্জুতে মহাসর্পের মিথ্যাজ্ঞান থেকে ভয়, হৃদকম্প ইত্যাদি যে সব দুঃখের উদ্ভব হয় সেসবের নাশ হয় রজ্জুকে রজ্জু বলে জানলে। ঠিক-ঠিক বিচারের দ্বারা জ্ঞানের উন্মেষ হলে সর্পের মিথ্যাজ্ঞান চলে গিয়ে রজ্জুর পরিচয়ই সত্য হয়। দড়িকে অনেক সময় সাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞানতা বা ভ্রমের কারণে এমন মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে দড়ি দড়িই, সাপ নয়। তেমনি ব্রহ্মকেও অজ্ঞানতাবশত জগত মনে হয়। যখন অজ্ঞানতা দূর হয় তখন কিন্তু দড়িকে সাপ মনে হয় না। ভ্রম যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হবে ঠিক ততক্ষণ পর্যমত্ম দড়িকে সাপ মনে হবে এবং ভ্রমের ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে সাপের আর অস্তিত্ব থাকবে না। সাপ যেমন মিথ্যা এবং দড়িই সত্য তেমনি এই জগৎ মিথ্যা এবং একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। 

ব্রহ্ম অনাদি, অসীম, অনন্ত, নিরাকার ও অপরিণামী। ব্রহ্মের সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই। ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়নি। ব্রহ্ম আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে এবং ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে। বস্ত্তত জগৎ সৃষ্টির ধারণা ভ্রম মাত্র। কোন কিছু সৃষ্টি করতে হলে উপাদান বা উপকরণ প্রয়োজন। ব্রহ্ম যদি এক ও অদ্বিতীয় হয় তবে উপকরণ সৃষ্টি হবে কিভাবে? যদি উপকরণের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয় তখন ব্রহ্ম দুই হয়ে যাবে। ব্রহ্ম থেকেও উপকরণের সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ ব্রহ্ম চৈতন্যয় ও অপরিণামী। কিন্তু উপকরণ হল জড় ও পরিণামী। একই বস্ত্তর মধ্যে পরিণামী ও অপরিণামী এই দ্বৈত-সত্ত্বা থাকা অসম্ভব। তাই ব্রহ্মের কোন উপাদান বা উপকরণ নেই। যেহেতু উপাদান নেই সেহেতু সৃষ্টি অসম্ভব। সুতরাং কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। যা কিছু  সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় তা আসলে মায়া। মায়ার কারণেই ব্রহ্ম ও জীবে এবং ব্রহ্ম জগতে ভেদজ্ঞান হয়। মায়া কেটে গেলে দৃশ্যমান জগৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই যতক্ষণ মায়া থাকবে ঠিক ততক্ষণ জগৎকে সত্য বলে মনে হবে। এই মায়াকে ত্রিগুণাত্বিকা প্রকৃতিও বলা হয়।

কোন হ্রদের জলে সূর্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে সে প্রতিবিম্ব মিথ্যা। দর্পণে যে প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাকে সত্য বলে মনে হলেও তা আসলে সত্য নয়। ঐ প্রতিবিম্ব যেমন মিথ্যা, জগৎও তেমনি মিথ্যা। জলে যে বুদবুদের সৃষ্টি হয় সে বুদবুদ জল থেকে পৃথক নয় অর্থাৎ জল ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তদ্রূপ জগৎও ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। অদ্বৈতবাদ দর্শনে জীবাত্মা ও পরমাত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই।

অদ্বৈতবাদ কি শূণ্যবাদকে সমর্থন করে? শঙ্কর বলেছেন দড়িতে সর্প-ভ্রমের কথা কিন্তু তিনি শূন্যে অর্থাৎ যেখানে কোন কিছু নেই এমন স্থানে সর্প-ভ্রমের কথা বলেননি। দড়ি ছিল বলে সর্প-ভ্রম হয়েছে কিন্তু দড়ি না থাকলে সর্প-ভ্রম হত না। অজ্ঞানতাবশত শূন্যস্থানে জগৎ কল্পিত হয় না ব্রহ্মকেই জগত বলে মনে হয়। সুতরাং অদ্বেতবাদ শূণ্যবাদকে সমর্থন করে না। তাই অদ্বৈতবাদের মুলকথা হল মায়ার কারণেই ব্রহ্মকে জগৎ বলে মনে হয়। মায়াই মরুভূমিতে মরীচিকা সৃষ্টি করে। মরুভূমিতে মরীচিকার কারণে তপ্ত বালিকে জল বলে মনে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কাছে না যাওয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জলের অসিত্মত্ব থাকে কাছে গেলে জলের অস্তিত্ব থাকে না তখন শুধু বালিই দেখা যায়। তাই মায়া দূর হলে অথাৎ জ্ঞানের উদয় হলে জগতের অস্তিত্বও দূর হয়ে যায়।

রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈত দর্শন মতে জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। কিন্তু পরমাত্মা অখণ্ড ও পূর্ণ এবং তাঁকে কর্তন ও ছেদন করা যায় না। সুতরাং পরমাত্মার কোন অংশ হতে পারে না। উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘‘পূর্ণমদ, পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’’ অর্থাৎ এই পরব্রহ্ম পূর্ণ (অখণ্ড), এই নাম-রূপস্থ ব্রহ্মও পূর্ণ, পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হন। পূর্ণের (নাম-রূপস্থ ব্রহ্মের) পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্ম) অবশিষ্ট থাকেন। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদজ্ঞান মূলত ভ্রম বা মায়া। একটি ঘটের মধ্যেও আকাশ আছে আর ঘটের বাইরেও আকাশ আছে তাই জীবাত্মা যদি হয় ঘটের আকাশ তবে পরমাত্মা হবে বাইরের উন্মুক্ত আকাশ। ঘটের ভেতরের আকাশ ও ঘটের বাইরের আকাশ মূলত একই। তাই জীবাত্মা ও পরমাত্মাও এক কিন্তু মায়ার কারণে ভেদজ্ঞান সৃষ্টি হয়। শঙ্কর বলেছেন, ‘‘অজ্ঞানযোগাৎ পরমাত্মনস্তব হ্যনাত্মবন্ধস্তত এব সংসৃতিঃ’’ অর্থাৎ অজ্ঞানযুক্ত হওয়ার ফলেই তোমার এই দেহাদি অনাত্মবস্তুতে বন্ধন, বস্ত্ততঃ তুমি পরমাত্মাই।

এখন মায়া প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মায়া আসলে কি? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? মায়া কি ব্রহ্ম ? এসব প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর বলেছেন,‘‘মায়া ব্রহ্মের শক্তি। মায়াকে অব্যক্তও বলা হয়। এই মায়া অনাদি, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট, কারণসরূপা। বিজ্ঞ ব্যক্তি জগতের সৃষ্টিকার্য থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করেন। এই মায়া যে আছে তাও নয় আবার নেই এরকমও নয়। আছেও আবার নেইও এ দুই এর মিশ্রণও নয়। মায়া পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয় অভিন্নও নয় আবার ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়রূপাও নয়। মায়া অঙ্গযুক্ত বা অঙ্গহীন নয় অথবা অঙ্গ আছে আবার নেই এই দুয়ের একত্র অবস্থাও নয়। মায়া অতি অদ্ভুতরূপা ও বাক্যের দ্বারা অবর্ণনীয়’’।

প্রকৃতপক্ষে মায়া অজ্ঞেয়। মানুষের চোখ তার নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্য মানুষ তার বদন-মণ্ডল দেখতে পায়। চোখ বদনমণ্ডলে অবস্থিত, তাই চোখ নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্যের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায়। জীব মায়ার মধ্যে বাস করে তাই সে মায়া উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ মায়াকে উপলব্ধি করতে হলে মায়া-সমুদ্রের ওপারে যেতে হবে যা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব মায়া অজ্ঞেয়। মায়া অজ্ঞেয় বলেই সৃষ্টিপ্রবাহ বেঁচে আছে। মায়াকে জানলে সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে এই জগৎ-প্রপঞ্চ মনের ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু মন কি? মন কি দেহ থেকে পৃথক? আসলে মন-দেহ সবই মায়া। পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা কোন বস্তুর অস্তিত্ব উপলদ্ধি করা হয়। যতক্ষণ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ পর্যমত্ম জগতের অসিত্মত্ব থাকে। ঘুমের সময় পঞ্চ-ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক) মনে লুপ্ত হয়। তাই স্বপ্ন দেখার সময় মনই জগৎকে বিভিন্ন রূপে দর্শন করায়। কিন্তু স্বপ্নহীন নিদ্রা বা সুসুপ্তির সময় পঞ্চ ইন্দ্রিয় মনে এবং মন আত্মাতে লীন হয়। তখন জগৎকে আর উপলব্ধি করা যায় না। তখন মনই জগৎকে উপলব্ধি করায়। এই মন আছে কি নেই তা বোঝা কষ্ট, তাই এই মনও মায়া। যদি জগৎ সত্য হত তবে সুসুপ্তির সময়ও জগৎকে উপলব্ধি করা যেত। যেহেতু সুসপ্তিতে জগৎকে উপলব্ধি করা যায় না সেহেতু জগৎ মিথ্যা।

এখন অদ্বৈতবাদ দর্শনের মুক্তি প্রসঙ্গে আসা যাক। যেহেতু আত্মা মুক্ত অর্থাৎ আত্মার কোন বন্ধন নেই সেহেতু মুক্তির প্রশ্নই আসে না। যদি জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই হয় তাহলে আবার মুক্তি কিসের? অদ্বৈত দর্শনে মুক্তি অর্থ অজ্ঞানতা বা মায়া থেকে মুক্তি। কারণ মায়ার কারণেই আত্মার বন্ধন হয়েছে এমন মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ভগবান শঙ্কর বলেছেন-
ব্রহ্মাভিন্নত্ববিজ্ঞানং ভবমোক্ষস্য কারণম্।
      যেন অদ্বিতীয়মানন্দং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে বুধৈঃ।।
-ব্রহ্মের থেকে আমি অভিন্ন এই জ্ঞানই সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তির কারণ স্বরূপ। আর এই জ্ঞানের দ্বারাই বিবেকী ব্যক্তিরা অদ্বিতীয় আনন্দরূপ ব্রহ্ম লাভ করেন ও ব্রহ্মই হয়ে যান। আবার তিনি বলেছেন- সকাম কার্য নাশ হলে বিষয়-চিন্তার নাশ হয় আর তার থেকে বাসনা ক্ষয় হয়ে যায়। বাসনার পুরোপুরি ক্ষয় হওয়াই হল মোক্ষ। এই অবস্থাকেই জীবন্মুক্তি বলে। মায়া দূর হলেই বিষয় চিমত্মা দূর হবে। তাই মায়া থেকে মুক্তি পেতে গেলে নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভেদ ভাবতে হবে এবং বেদবিহিত কর্ম করতে হবে। ভেতরের আমি-আমি ভাব বা অহংকার দূর করতে হবে কারণ এই অহং ভাবই ভেদজ্ঞান সৃষ্টি করে।
শঙ্কারচার্যের মতে কর্ম হতে হবে নিষ্কাম। মুমুক্ষু জীব যখন বিষয়-তৃষ্ণা ত্যাগ করে, নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন মনে করে উপাসনা করবে, তখন মায়া দূর হবে এবং মোক্ষ লাভ হবে।
এখন প্রশ্ন হলো একজন্মে অথবা অনেক জন্মে মুক্তি হয়?
উত্তর অনেক জন্মে জীবের মুক্তি হয় কারনঃ
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্ব্বসংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্ম্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরহবরে।।
মুন্ডক ২।খঃ২।।মঃ৮।।
যখন জীবের হৃদয়স্থ অবিদ্যা ও অজ্ঞানরূপ গ্রন্থি ছিন্ন হয়,যখন যখন সংশয়ের খন্ডন হয় এবং দুষ্কর্ম্মের ক্ষয় হয় তখনই জীব সেই পরমাত্মায় অর্থাৎ যিনি আপনার আত্মার ভিতরে বা বাহিরে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন তাঁহাতে নিবাস করে। মুক্তির অবস্থায় জীব পরমেশ্বর থেকে পৃথক থাকে কারণ মিলিত হইলে কে মুক্তিসুখ ভোগ করিব..? এবং মুক্তির যাবতীয় সাধন নিষ্ফল হইয়া যাইবে। উক্ত ঘটনাকে মুক্তি বলা যাইতে
পারে না, কিন্তু উহা জীবের প্রলয় এইরূপ বুঝতে হইবে। যে জীব পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন,উত্তম কর্ম্মানুষ্ঠান,সৎসঙ্গ যোগাভ্যাস এবং ধর্ম্মন্যায় সমস্থ সাধন করে সেই মুক্তিলাভ করে।
সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রজ্ম যোবেদ নিহিতং গুহায়াং পরমেব্যোমন্।
সোহশ্নুতে সর্ব্বান্ কামান্ সহ ব্রহ্মণা বিপশ্চিতেতি।।-তৈত্তিরী আনন্দবঃ।অনুঃ ১।।
যে জীবাত্মা আপনার বুদ্ধিতে এবং আত্মাতে স্থিত সত্যজ্ঞান ও অনন্ত আনন্দ স্বরূপ পরমাত্মাকে জানে সেই উক্ত ব্যাপকরূপ ব্রহ্মে স্থিত হইয়া উক্ত 'বিপশ্চিৎ" অর্থাৎ অনন্তবিদ্যায়ুক্ত ব্রহ্মে স্থিত হইয়া সর্ব্ব কাম প্রাপ্ত হয়; অর্থাৎ যে যে আনন্দ কামনা করে সেই সেই আনন্দ প্রাপ্ত হয় এবং ইহাকেই মুক্তি কহে।
জীবাত্মা যেমন শরীরের আধারে সংসারিক সুখ ভোগ করে তদ্রুপ পরমেশ্বরের আধারে মুক্তির আনন্দ ভোগ করে। উক্ত মুক্ত জীব অনন্তব্যাপক ব্রহ্মে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, শুদ্ধ জ্ঞানদ্বারা সমস্ত সৃষ্টি দর্শন করে,অন্য মুক্ত জীবের সহিত মিলিত হয়, সৃষ্টি বিদ্যার ক্রমানুসারে দর্শন করতঃ সমস্ত লোক ও লোকান্তরে অর্থাৎ যাহা মুনষ্যে দেখিতে পায় এবং যাহা পায় না তৎসমুদরে বিচরণ করে এবং উহাদিগের জ্ঞানের
অভিমুখীন সমস্ত পদার্থই দর্শন করে। জ্ঞান যতই অধিক হইবে উহরা ততই অধিক আনন্দ হইয়া থাকে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে ব্রহ্ম ও জীব যদি এক সত্ব্যা হয় তাহলে পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর তো সচ্চিদানন্দস্বরূপ জীবের মোক্ষের সময় 'বিপশ্চিৎ" হওয়া কেন..? মুক্তির অবস্থায় জীবাত্মা নির্মল এবং পূর্ণজ্ঞানী হওয়াতে উহার সমস্ত সন্নিহিত পদার্থের যথাবৎ জ্ঞান(লাভ)হয় এবং উক্ত সুখবিশেষের নাম স্বর্গ।
"স্বঃসুকং গাচ্ছতি যস্মিন্ স স্বর্গঃ" -"অতো বিপরীতো দঃখভাগো নরক ইতি" সাংসারিক সুখকে সামান্য স্বর্গ এবং পরমেশ্বর প্রাপ্তি নিব্ধন আনন্দকে বিশেষ স্বর্গ কহে। সকল জীব স্বভাবতঃ সুখ প্রাপ্তির ইচ্ছা করে এবং দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইবার কামনা করে এর দ্বারা প্রমান হয় জীব ব্রহ্ম হতে ভিন্ন।
অদ্বৈত বেদান্ত প্রথা অনুসারে সন্ন্যাস দীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তিরা চারটি প্রধান মহাবাক্য মন্ত্র হিসেবে শিক্ষা করেন "যাতে তাঁরা সেই সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছতে পারেন যে অবস্থায় ব্যক্তির আত্মা অবিচ্ছেদ্যভাবে ব্রহ্মে লীন হতে পারে"।( kamakoti.org, The Upanisads)

অদ্বৈত বেদান্ত প্রথা অনুসারে চারটি ঔপনিষদ্‌ মহাবাক্য ব্যক্তির আত্মা ও পরম ব্রহ্মের সর্বোচ্চ মিলনের দ্যোতক। 

মহাবাক্যগুলি হল:

  1. প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম - "প্রজ্ঞা হল ব্রহ্ম"{{refn|group=note|"The Absolute", "অনন্ত" বা "ব্রহ্ম" হলেন প্রজ্ঞা" 
  2. অয়ং আত্মা ব্রহ্ম - "আমিই সেই আত্মা যা ব্রহ্ম" 
  3. তৎ ত্বং অসি - "তুমিই সেই" 
  4. অহং ব্রহ্মাস্মি - "আমিই ব্রহ্ম", বা "আমি দিব্য"
মুনি ঋষিরা যোগযুক্ত অবস্থায় কেউ কেউ বলেছেন 'অহং ব্রহ্মাস্মি',আবার কেউ কেউ বলেছেন অয়মাত্মাব্রহ্ম,তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা সকলে সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়ে গেছেন। উপনিষদের এই বচনগুলির বৈদিক ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক অর্থ না করে অনেকে ইহার অনর্থই করেছেন। আর এই উক্তিগুলির ভিত্তি করেই শিষ্যের দল তাদের গুরুদের অবতার বানিয়ে ছেড়েছে। এবং এই সব গুরুরা নিজেরা এক একজন স্বঘোষিত ভগবান্ হয়ে মঠমন্দির তৈরী করে শিষ্য বাড়িয়ে মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছে। উপরিক্ত উপনিষদের বচনগুলি সমাধি প্রাপ্ত যোগী বা মুক্তাত্মা সম্বন্ধে বলা হয়েছে বুঝতে হবে।
জীবাত্মা নির্গুণ বলে পরমাত্মার সহিত পূর্ণ ভাবে সম্বন্ধ উৎপন্ন করে,তাহাতে যোগী সমাধি প্রাপ্ত হয়ে তদাকার হয়ে ব্রহ্মভাব ধারণ করে,যা য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণের হয়েছিল। মুনি ঋষিরা তাঁদের ওই অবস্থার ব্যাখ্যার জন্য "অহংব্রজ্মাস্মি,অয়মাত্মা ব্রহ্ম,তত্ত্বমসি" ইত্যাদি বচন সমূহের ব্যবহার করেছেন। কাউকে ভ্রমে পতিত করার জন্য নহে। লৌকিক সংস্কৃত দ্বারা এই সমস্ত বচনের অর্থ করা যায় না, বৈদিক ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করা প্রয়োজন। মহর্ষি পাণিনীর ব্যাকরণ অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র আছে-'তাতৎস্তোপাধি' তৎসহচরিত উপাধি। ঐস্থলে 'স্থ' শব্দ উহ্য আছে জানতে হবে। অহং ব্রহ্মাস্মি শব্দের অর্থ 'অহং ব্রহ্মস্থ অস্মি'। অর্থাৎ আমি সর্ব্বব্যাপক ব্রহ্মেই অবস্থিত আছি এইরূপ বুঝিতে হইবে। অয়মাত্মা ব্রহ্ম শব্দে বুঝতে হবে অয়মাত্মা ব্রহ্মস্থ অর্থাৎ আমার আত্মা ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত। তত্ত্বমসি এ ছান্দোগ্য উপনিষদের বচন। শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা বলেছেন তুমি সেই অন্তর্যামী পরমাত্মাকেই যুক্ত আছো।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্ত মূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বাভূতানি ন চাহং তেস্বাস্থিতঃ।।-গীতা।।৯।৪
অর্থাৎঃ আমি অব্যক্তরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি।সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত,আমি কিন্তু তৎ সমুদেয়ে অবস্থিত নই। এখানে এই "আমি"কথার অর্থ বৈষ্ণবরা বা অনেকেই শ্রী কৃষ্ণকেই প্রতিপন্ন করতে চান। কিন্তু এখানে 'আমি' অর্থে পরমাত্মার কথাই বেলছেন। কারন গীতার ৯।৫ শ্লোকে বলেছেন-
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে য়োতমৈশ্বরম্।। অর্থাৎঃ তিনি অর্জুনকে যত উপদেশ দিয়েছেন, তা তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। এ কারণে তিনি গীতার বহু জায়গায় একাধিকবার পশ্য মে য়োগমৈশ্বম্ কথাটি অর্জুনের প্রতি ব্যবহার করেছেন।
ব্রহ্ম শব্দটি 'বৃংহ্' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, যার মানে to swell, to expand(বিস্তৃত হওয়া)।
আমরা দেখতে পাই যজুর্বেদের ৩৪ নং অধ্যায়ের ৫৩ মন্ত্রে "অজ একপাৎ" অর্থাৎঃ আমি এক,আমি জন্ম গ্রহণ করিনা। "সপর্য্যগাচ্ছূক্রমকারম্"-যজুর্বেদের ৪০ অধ্যায়ের ৮ নং মন্ত্রে উল্লেখ আছেঃ-স পর্য্য গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমব্রণমসন্বিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম। কবির্মনীষী পরিভূতঃ স্বয়ং ভূর্য়াথাতথ্যতোৎর্থান ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্য সমাভ্য।অর্থঃ- ঈশ্বর সমগ্র জগতে পরিপূর্ণভাবে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন তিনি সমগ্র জগতের রচয়িতা এবং অনন্ত বিদ্যাবলযুক্ত।তিনি কদাপি কোনরুপ জন্ম বা শরীর গ্রহণ করেন না।তিনি সদা ছিন্দ্র রহিত বা অক্ষতরুপে সদা বিরাজমান।তার কোন প্রকার বন্ধন বা আবরণ নাই। তিনি অবিদ্যা,অস্মিতা,রাগ দ্বেষ ও অভিনিবেশাদি রুপ অজ্ঞান, ক্লেশ ও দোষ হইতে পৃথক রুপে বর্তমান আছেন। তিনি কদাপি পাপযুক্ত বা পাপকারী নহেন।তিনি সকলের অর্ন্তযামীরুপ হইয়া ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান যথাবৎ জ্ঞাত আছেন।তিনি সদা সর্বোপরি বিরাজমান। তিনি কদাপি উৎপন্ন হন না।তিনি অনাদি,অনন্ত নিজ সত্য সামর্থের সহিত বর্তমান আছেন।

 অথর্ব বেদের ১৩নং কাণ্ডের ৪ অনুবাকের ১৬,১৭,১৮ নং মন্ত্রে আছে,

"ঈশ্বর একোমেবাদ্বিতীয়ম ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।

ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।।

অর্থঃ- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, তদ্ভিন্ন কোন দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ পরমেশ্বের নাই।তিনি ব্যতীত কোন পঞ্চম, ষষ্ট বা সপ্তম পরমেশ্বর নাই।এইরুপে তদ্ভিন্ন কোন অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর নাই।
অর্থাৎ ব্রহ্ম জীবাত্মা হতে ভিন্ন।
সত্ত্ব,রজঃ এবং সমোগুণের অনুসারে যে যেরূপ কার্য্য করে তাহার তদ্রূপ ফল প্রাপ্তি হয়। যে মুক্ত হয় সে গুণাতীত হয় অর্থাৎ সমস্ত গুণের স্বভাবে আসক্ত না হইয়া মহাযোগী হইয়া মুক্তির সাধন করে করানঃ-
যোগাশ্চিত্ত বৃত্তিনিরোধঃ।।১।।পাতঞ্জল যোগশাস্ত্র।১২।।
তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপেহবস্থানম্।।২।।পাতঞ্জল যোগশাস্ত্র ১।৩।।
মূল সংস্কৃত বাক্য অহং ব্রহ্মাস্মীতি।

অহং (আমি) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম) অস্মি (হই) ইতি (এইরূপে)।

বেদান্তের এই মন্ত্রের উৎস হলঃ

ঋগ্বেদে ৪র্থ মণ্ডলে ২৬ নং সূক্তের ১মন্ত্র

অহং মনুরভবং, সূর্যশ্চাহং কক্ষীবী ঋষিরস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ং ন্যৃংজে অহং কবিরুশনা পশ্যতা মা।।

अ॒हं मनु॑रभवं॒ सूर्य॑श्चा॒हं क॒क्षीवाँ॒ ऋषि॑रस्मि॒ विप्रः॑।

 अ॒हं कुत्स॑मार्जुने॒यं न्यृ॑ञ्जे॒ऽहं क॒विरु॒शना॒ पश्य॑ता मा ॥

पदार्थान्वयभाषाः -हे मनुष्यो ! जो (अहम्) मैं सृष्टि को करनेवाला ईश्वर (मनुः) विचार करने और विद्वान् के सदृश सम्पूर्ण विद्याओं का जनानेवाला (च) और (सूर्य्यः) सूर्य्य के सदृश सब का प्रकाशक (अभवम्) हूँ और (अहम्) मैं (कक्षीवान्) सम्पूर्ण सृष्टि की कक्षा अर्थात् परम्पराओं से युक्त (ऋषिः) मन्त्रों के अर्थ जाननेवाले के सदृश (विप्रः) बुद्धिमान् के सदृश सब पदार्थों को जाननेवाला (अस्मि) हूँ और (अहम्) मैं (आर्ज्जुनेयम्) सरल विद्वान् ने उत्पन्न किये हुए (कुत्सम्) वज्र को (नि) अत्यन्त (ऋञ्जे) सिद्ध करता हूँ और (अहम्) मैं (उशना) सब के हित की कामना करता हुआ (कविः) सम्पूर्ण शास्त्र को जाननेवाला विद्वान् हूँ, उस (मा) मुझको तुम (पश्यत) देखो ॥


भावार्थभाषाः -इस मन्त्र में वाचकलुप्तोपमालङ्कार है। हे मनुष्यो ! जो जगदीश्वर मन्त्रियों अर्थात् विचार करनेवालों में विचार करने और प्रकाश करनेवालों का प्रकाशक, विद्वानों में विद्वान्, अखण्डित न्याययुक्त, सर्वज्ञ और सब का उपकारी है उस ही का विद्या, धर्म्माचरण और योगाऽभ्यास से प्रत्यक्ष करो ॥-स्वामी दयानन्द सरस्वती
"অস্য লোকস্য কা গতিরিত্যাকাশ ইতি হোবাচ"- ছান্দগ্য উপনিষদে্র প্রঃ ১খন্ড ৯মঃ ১ ব্রহ্মকে "আকাশ" শব্দে বাচ্য বলা হয়েছে। আকাশের মতো ব্রহ্ম অশরীর সূক্ষ্ম অর্থাৎ দুর্বিজ্ঞেয় বলে ব্রহ্ম "আকাশ" শব্দের দ্বারা অভিহিত হয়ে থাকে।

“সোহহমস্মি” বেদান্তের অন্যতম একটি মহাবাক্য।

উৎসঃ “যজুর্বেদ” ঈশোপনিষদের ১৬ নং মন্ত্র, বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৫/১৫ নং মন্ত্র এবং ছান্দোগ্য উপনিষদের ৪/১১/১ নং মন্ত্রে সোহহমস্মি বাক্যটির উল্লেখ রয়েছে।

পদার্থঃ সোহহমস্মি = সঃ + অহম্ + অস্মি

অর্থাৎ সেই পুরুষই আমি। আমিই সেই পুরুষ(আত্মা)। আমিই হই সেই (পুরুষ) ।
উপনিষদের যে স্থলে "অহং ব্রহ্মাস্মি,অয়মাত্মা ব্রহ্ম" ইত্য়াদি বাক্য দেখিতে পাওয়া যায় সেখানে সমাধিপ্রাপ্ত যোগী ও মুক্ত আত্মার সম্বন্ধে পরামর্শ বুঝিতে হইবে।বৈদিক সংস্কৃত ও বৈদিক
ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করা প্রয়োজন।মহর্ষি পাণিণির ব্যকরণ ও অষ্টধ্য়ায়ীতে সূত্র আছে "তাতৎস্তোপাধি" তৎসহচরিত উপাধি। ঐস্থলে স্থ শব্দ উহ্য আছে জানিতে হইবে।
"অহং ব্রহ্মাস্মি" শব্দের অর্থ অহং ব্রহ্মস্থ অস্মি অর্থাৎ আমি সর্বব্যাপক ব্রহ্মেই অবস্থিত এইরূপ বুঝিতে হইবে।"অয়মাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী অমর গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশে বলেছেন জীব ও ব্রহ্মের একতা এবং জগৎ মিথ্যা ইত্যাদিরূপ যে শঙ্করাচার্য্যের মত ছিল তাহা উৎকৃষ্ট মত নহে,তবে যদি শঙ্করাচার্য্য জৈনমত কন্ডনের নিমিত্ত উক্ত মত স্বীকার করিয়া থাকেন তবে অপেক্ষাকৃত ভাল। নবীব বেদান্তীদিগের মতে জগৎ স্বপ্নবৎ,রজ্জুতে সর্প,শুক্তিকায় রজত,মৃগতৃষ্ণিকায় জল,গন্ধর্ব্ব নগর এবং ইন্দ্রজালের সদৃশ এই সংসার মিথ্যা এবং এক ব্রহ্মই সত্য। বাস্তবে নবীন বেদদন্তীগন রজ্জুকে বস্তু এবং সর্পকে অবস্তু মনে করিয়া এই ভ্রমজালে পতিত হইয়াছে। প্রশ্ন আসে সর্প কি বস্তু নহে..? যদি বল রজ্জুতে উহা নাই, তবে দেশান্তরে আছে উহার সংস্কার তোমার হৃদয়ে আছে" অতএব সর্প ও আর অবস্তু রহিলনা । এইরূপ স্থানুতে পুরুষ এবং সুক্তিকায় রজত ইত্যাদির; ব্যবস্থা বুঝিয়া লইতে হইবে। স্বপ্নাবস্থায়ও যাহার ভান (জ্ঞান) হয়, তাহা দেশান্তরে আছে এবং তাহার সংস্কার মনেও (আত্মাতেও) আছে। সুতরাং স্বপ্ন ও বস্তুতে অবস্তুর আরোপণের তুল্য নহে। অত্বৈত্যবাদী দের মতে রজ্জুতে সর্প তিন কালেই নাই অথচ অন্ধকার এবং অল্প প্রকাশের সংযোগে অকস্মাৎ রজ্জুর দর্শন হইলে সর্পভ্রম উপস্থিত হইয়া ভীতিবশতঃ কম্প উপস্থিত হয়। পরে যখন দীপাদি দ্বারা দেখা যায় তখন উক্ত ভয় এবং ভ্রম নিবৃত্ত হইয়া যায়; তদ্রূপ ব্রহ্মে জগতের মিথ্যা প্রতীতি হইয়াছে। ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হইলেই জগতের নিবৃত্তি এবং ব্রহ্মের প্রতীতি হইয়া যায়, যে রূপ সর্পের নিবৃত্তি 
এবং রজ্জুর প্রতীতি হইয়া থাকে। এখন কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার যেমন ব্রহ্মে জগতের ভান কাহার হইয়াছে? নিশ্চয় জীবের এবং এই ভান (জ্ঞান) অজ্ঞানতার কারনে হয়। ইহাও বিচার্য অজ্ঞানতা কোথা হইতে হইয়াছে এবং কোথায় রহিয়াছে..? যদি বল অজ্ঞান অনাদি এবং ব্রহ্মে অবস্থান করে তাহলে 
ব্রহ্মে ব্রহ্ম বিষয়ক অজ্ঞান হইল অথবা অন্য কোন বিষয়ের অজ্ঞান হইল এবং ঐ অজ্ঞান কাহার হইল..?
যদি বল ব্রহ্ম,নিজ ব্রহ্মবিষয় অজ্ঞান হইয়া অর্থাৎ আপনার স্বরূপকে আপনিই ভুলিয়া যান তাহলে তাঁহার ভ্রম হইবার নিমিত্ত কারন অবিদ্যা..!!??
 অবিদ্যা কি সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বজ্ঞের গুণ, নিশ্চয় নয় তা অল্পজ্ঞের গুণ হওয়া স্বাভাবিক। তাহা হইলে এক অনন্ত সর্ব্বজ্ঞ চেতন ব্যাতিরেকে অন্য কোন চেতন সত্ব্যার প্রমান মেলে। যদি অল্পজ্ঞ চেতন ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন বলিয়া বিশ্বাস কর তাহা হইলে সমীচীন হয়। যদি এক স্থানে ব্রহ্মে অপনার স্বরূপ সম্বন্ধীয় অজ্ঞান হয় তাহা হইলে উক্ত অজ্ঞান সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়ে। যেরূএ শরীরের (এক স্থানর) বিষ্ফোটকের পীড়া সমস্ত শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আতুর অপটু করিয়া দেয় তদ্রুপ,ব্রহ্ম ও একদেশে অজ্ঞানী এবং ক্লেশযুক্ত হইলে সমস্ত ব্রহ্মই অজ্ঞানী এবং পীড়াভবনুযুক্ত হইয়া পড়েন।
শতপথ ১৪।৪।২।১ তে আমরা দেখতে পাই
আত্মৈবেদমগ্র আসীৎ।
পুরুষবিধঃ সোঽ নুবীক্ষ্য নান্যদাত্মনোঽপশ্যৎ সোঽহমস্মীত্যগ্রে ব্যাহরত্ততোঽহং নামাভবত্তস্মাদপ্যেতামন্ত্রিতোঽহমিত্যেবাগ্র উক্ত্বাথান্যন্নাম প্রব্রূতে যদস্য ভবতি॥

An sent Today at 2:49 PM

পদার্থঃ (বৈ অগ্রে ইদং ব্রহ্ম) নিশ্চয়রূপে প্রথমে ব্রহ্মই ছিলাে (ত আত্মান এব অবে) তিনি নিজেকে জানলেন যে (অহ ব্ৰহ্ম অম্মি ইতি) আমি ব্রহ্ম। ব্যাখ্যা- এই ব্রাহ্মণের প্রথম কন্ডিকায় জীবাত্মার হওয়ার কথন করা হয়েছে এবং যখন তিনি নিজের জন্য অহমশ্মি” আমি হই ইহা বললেন তাে তিনি অহম নামধারী হলেন। আর এই কন্ডিকাতে ব্রহ্মের প্রারম্ভে হওয়ার কথন করে বলা হয়েছে যে, যখন তিনি নিজেকে জানলেন তাে তিনি ”অহ ব্ৰহ্মাস্মি এই বাক্য বললেন। যাহার অভিপ্রায় এই যে, জীব এখানে অহম নামধারী তাে ঈশ্বর ব্রহ্ম নামধারী। এইপ্রকার জীব এবং ঈশ্বরের পৃথক্তা এবং স্বতন্ত্রতা হওয়ার বর্ণনা, এই ব্রাহ্মণে উপস্থিত।
ভাষার্থ- সেই পরমাত্মা প্রথমে ছিলেন। তিনি ব্যাপক ছিলেন। উনি বিচার করে দেখলেন, উনি ব্যাতিত আর কেউ নেই। তখন তিনি নিজেকে প্রথমে 'অহমস্মি' বলেন। তখন থেকে 'অহম্' নামযুক্ত হয়ে গেলেন। এই কারণেই এই পৃথিবীতে যা 'অহম', তা প্রথমে এই নাম বলে তারপশ্চাতে উনার অন্যকোন নাম থাকলে বলে থাকে। এতে পরমাত্মার 'অহম' নামের উতকৃষ্টতা বর্ণনা করা হয়েছে। সমগ্র পাঠে এক পদ ও এমন নেই যার অর্থ করা যায় যে, এই ব্রহ্ম থেকেই এই সমস্ত সংসারের জড়-চেতন এর উৎপত্তি হয়েছে। কেন যে আপনি এত বড় লম্বা অর্থ কোথা থেকে আনলেন? বরং বেদ এ ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি - এই তিনকে অনাদি মানে তথা এই তিনের দ্বারাই এই জগত।




No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ