মধ্যযুগে ইউরোপের একটি কুখ্যাত ও ভয়ানক শব্দ ছিল ‘ইনকুইজিশন’ (Inquisition)। এটা রোমান ক্যাথলিক চার্চের এমন একটি কমিশনের নাম, যার দায়িত্ব ছিল ঐ সমস্ত লোকদেরকে সনাক্ত করা যারা ক্যাথলিক ধর্ম-বিশ্বাস ব্যতীত অন্য কোন মতবাদে বিশ্বাসী। তন্মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি পায় ‘স্পানিশ ইনকুইজিশন’ (Spanish Inquisition) যা ‘টমাস ডা টোরকোমাডা’র (১৪২০ – ১৪৯৮) (Tomas de Torquemada) পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। স্পেনের মাটিতে যখন মুসলমানরা তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল, ঠিক তখনই ইনকুইজিশনের বহির্প্রকাশ ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও এ অভূতপূর্ব তদন্ত-পদ্ধতিটি শুধুমাত্র মুসলমান ও ইহুদীদের জন্য প্রয়োগ করা হয়; কিন্তু সময়ের আবর্তনে খৃষ্টানদেরকেও তাদের নিজেদের তৈরী ফাঁদে পা দিতে হয় এবং তাদের উপরও দুর্দিন আসতে লাগে।
ইনকুইজিটাররা (Inquisitor) মানুষের ঘরে ঘরে হানা দিয়ে যাদের উপর তারা সামান্য মাত্র সন্দেহ করত – তাদেরকে ‘ধর্মদ্রোহীতা’র (Heresy) অভিযোগ দিয়ে গ্রেফতার করত। অতপর শুরু হত তদন্ত পর্ব। তথ্য উদগাঠন এবং অপরাধ স্বীকারোক্তির নামে করা হত নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক পৈশাচিক নির্যাতন । তারপর বিচারের নামে প্রহসন করে গীর্জার একপক্ষীয় শুনানির পরই শাস্তি ঘোষণা করা হত। উইচক্রাফ্ট (Witch-craft) তথা জাদুবিদ্যা চর্চার শাস্তি ছিল – জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া। এ সময় খৃষ্টবাদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হলে, অন্যান্য খৃষ্টধর্মীয় মতবাদগুলোর অনুসারীদেরকেও পড়তে হয় ইনকুইজিশনের কবলে। প্রটেস্টানদেরকে শুলীবদ্ধ করে জীবন্ত জালিয়ে দেয়া হয়।
(দেখুন: http://
খৃষ্টান পাদ্রীরা ধর্মের নামে কৃষক ও নিম্নবিত্তদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের মাশুল ও কর আদায় করত । এতে করে অনেক গীর্জাই সম্পদের খাজানায় পরিণত হয়। গীর্জার নানা ধরণের জুলুম ও অত্যাচারের প্রভাব পড়তে শুরু করে জনমনে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্ররা গীর্জায় হানা দিয়ে লুটতরাজ চালায়। ১৭৮৯ সালে তৎকালীন ফ্রান্সের রাজা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর (বিত্তবান) জুলুম ও অত্যাচারে জর্জরিত জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে গণবিপ্লব ঘটায় যাঁকে বলে ফ্রান্স রেভোল্যুশন । পরবর্তীতে এ বিপ্লব গণতান্ত্রিক বিপ্লব রূপে উদীয়মান হয়। ধীরে ধীরে পাদ্রীদের শান ও শওকত হৃাস পায়। ইউরোপের গীর্জাগুলো ভক্তশুন্য হয়ে পড়ে। ফ্রান্স এর দেখাদেখি ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে উন্নয়ন ঘটার শুরু করে।
(দেখুন: http://www.britannica.com/
খৃষ্টবাদের লেবাসে নরপশু, সম্পদলোভী পাদ্রীদের জুলুম – অত্যাচারের দৃশ্যগুলো তখনকার লিখিত অনেক উপন্যাস, নাটক এবং কবিতাসমূহে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইনকুইজশনের উপর অনেক ফিল্ম ও তৈরী করা হয় ।
অবশেষে সাধারণ খৃষ্টানদের আক্রোষ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। জন্ম হয় নতুন কিছু মতবাদের ।মার্টিন লুথার আবিষ্কার করেন প্রটেস্টান্ট মতবাদ। দার্শনিকরা নিয়ে আসেন বিভিন্ন বস্তুবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী থিওরী। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন তার মহাবিতর্কিত ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিজ বাই মীন্স অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ (On the Origin of Species by Means of Natural Selection) গ্রন্থটি রচনা করেন; যা পশ্চিমা সমাজে এক নব উত্তাল সৃষ্টি করে। ডারউইন তার গ্রন্থে বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তার বীজ বপন করেন। যদিও তার ‘থিওরী অব ইভোলুশন’ (Theory of Evolution) পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর মাধ্যমে অনেক কিছুই কন্ট্রাডিকশন এবং ও বানোয়াট বলে প্রমানিত হয়, তথাপি পশ্চিমারা এটার বহুল প্রচার প্রসার করে। কারণ এ থিওরী খৃষ্টবাদের উপর মুগুরের মত আঘাত করে।
(দেখুন: http://www.bbc.co.uk/
পর্যায়ক্রমে পশ্চিমা জগতে খৃষ্টধর্মের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা লোপ পায়। ‘ধর্মপ্রাণ’ একটি গালিতে পরিণত হয়। শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে ইউরোপে বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা খুবই দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। রাষ্ট্রকে গীর্জা ও ধর্মযাজকদের আগ্রাসী কবল থেকে আলাদা করার দাবী-দাবা উঠতে থাকে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে রাজা-বাদশারা পাদ্রীদের খোদাপ্রদত্ত (?) ক্ষমতাকে কেড়ে নেয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ধর্মকে চীর বিতাড়িত করে এর বদলে নিয়ে আসা হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ এবং এধরণের আরো অনেক মানবতৈরী মতবাদসমূহকে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ