হিন্দু সমাজের ইতিহাস.পিডিএফ
মনুস্মৃতি মধ্যে অনেক শ্লোক রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিও যদি শ্রেষ্ঠ কর্ম না করে তবে সে শুদ্র (অশিক্ষিত) বলে গন্য হবে।
যেমন- মনুস্মৃতি ২।১০৩ – যে মনুষ্য নিত্য প্রাত এবং সন্ধ্যায় ঈশ্বরের আরাধনা করে না তাহাকে শুদ্র বলে জানবে।
মনুস্মৃতি ২।১৭২ – যে ব্যক্তি বেদের শিক্ষাই দীক্ষিত হয় নি সে শুদ্র তুল্য।
মনুস্মৃতি ২।১৬৮ – যে ব্রাহ্মণ বেদের অধ্যয়ন বা পালন ছেড়ে অন্য বিষয়ে প্রযত্ন করেন সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।
মনুস্মৃতি ৪।২৪৫ – ব্রাহ্মণ বর্নস্থ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ অতিশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সঙ্গ করে এবং নিচ থেকে নিচতর ব্যক্তির সঙ্গ ছেড়ে অধিক শ্রেষ্ঠ হয়। ইহার বিপরীত আচরনে পতিত হয়ে সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। . অতঃএব ইহা স্পষ্ট যে, ব্রাহ্মণ উত্তম কর্ম কারী বিদ্বান কে বলে। এবং শুদ্রের অর্থ অশিক্ষিত ব্যক্তি। ইহা কোন জন্মগত সমন্ধ্য নয়।
মনুস্মৃতি ২।১২৬ – এমনকি কেন ব্রাহ্মণ হোক, কিন্তু যদি সে অভিবাদনের উত্তর শিষ্টতার সহিত দিতে না জানে, তবে সে শুদ্র। . অর্থাৎ মনু জন্মসিদ্ধ বর্ণ প্রথার সমর্থন করে নি। মনুস্মৃতি অনুসারে মাতা পিতা তার সন্তানদের বাল্যকালে তার রূচি এবং প্রকৃতি জেনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের বর্ণের জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করার জন্য উপদেশ প্রদান করবেন। কোন ব্রাহ্মণ পিতা মাতা যদি তার সন্তান কে ব্রাহ্মণ তৈরী করতে চায় তবে অবশ্যই তার মধ্যে ব্রাহ্মণোচিত গুণ,কর্ম, স্বভাব জাগিয়ে তুলবেন।
মনুস্মৃতি ২।১৫৭ – যেমন কাষ্ঠনির্মিত হস্তি ও চর্ম্মনির্মিত মৃগ কোন কার্যকারক নহে। তদ্রুপ যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন না করে তিনিও কোন কার্যক্ষম নহে। কেবল ব্রাহ্মণের নাম মাত্র ধারন করেন।
শিক্ষাই বাস্তবিক জন্ম – . মহর্ষি মনুর মতে মানুষের বাস্তবিক জন্ম বিদ্যাপ্রাপ্তিতেই ঘটে। জন্মত প্রত্যেক মানুষই শুদ্র অর্থাৎ অশিক্ষিত। এবং সংস্কার দ্বারা সে পরিশুদ্ধ হয়ে তার দ্বিতীয় জন্ম হয়। আর একেই দ্বিজ বলে। সংস্কারে অসমর্থ ব্যক্তি শুদ্রই রয়ে যায়।
মনুস্মৃতি ২।১৪৮ – সমস্ত বেদশাস্ত্রের পারদর্শী আচার্য্য অভিজাত বালকের যথাবিধিনুসারে গায়ত্রী উপদেশ করিয়া যে যথার্থ জন্ম উৎপাদন করেন, সে জন্মই ব্রহ্মপ্রাপ্তির কারন বলিয়া অজর ও অমর রূপে গণ্য হয়।
মনুস্মৃতি ২।১৪৬ – জন্মদাতা পিতা থেকে জ্ঞান দাতা আচার্য্য অধিক বড় এবং মাননীয়। আচার্য্য দ্বারা প্রদান করা জ্ঞান মুক্তি প্রদান করে।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সম্পর্কে আমাদের পবিত্র ‘বেদ’ এ কি আছে—
ঋগবেদ ১.১১৩.৬
"একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে(ব্রাক্ষ্মন) ,অপরজন বীরত্বের গৌরবে(ক্ষত্রিয়) , একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে(পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে(শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।
ঋগবেদ ৯.১১২.১
একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বেশ্য কেউ শূদ্র।
ব্রাক্ষ্মন কে? ঋগবেদ ৭.১০৩.৮
যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস,সত্,নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল,বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সে ব্রাক্ষ্মন।
ক্ষত্রিয় কে?
ঋগবেদ ১০.৬৬.৮
দৃড়ভাবে আচার পালনকারী, সত্ক৮র্মের দ্বারা শূদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন,অহিংস,ঈশ্বর সাধক,সত্যের ধারক ন্যায়পরায়ন,বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা,অসত্ এর বিনাশকারী সে ক্ষত্রিয়।
বৈশ্য কে ?
অথর্ববেদ ৩.১৫.১
দক্ষ ব্যবসায়ী দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী।
ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শুদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।
অনুবাদ : বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করার কারণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য দ্বিজ। এই প্রকার বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্ত না করার কারণে চতুর্থ একজাতি শুদ্র ।
শূদ্র কে?
ঋগবেদ ১০.৯৪.১১
যে অদম্য,পরিশ্রমী, ¬ অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা,লোভমুক্ত ¬ কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।
এ হচ্ছে নির্ভেজাল যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা। যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়, যজ্ঞোপবীত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি ঘটলে যজ্ঞোপবীত নিয়ে নেয়া হতো বর্ণগুলোর। ডাক্তার এর ছেলে যেমন ডাক্তার হবেই এমন কোন কথা নেই।ডাক্তার এর ঘরে জন্ম নিলেই এম.বি.বি.এস এর সার্টিফিকেট যেমন পাওয়া যায়না ঠিক তেমন ব্রাহ্মন এর ঘরে জন্ম নিলেই ব্রাহ্মন হওয়া যায়না।বৈদিক বর্নাশ্রম ও একই। বর্ণপ্রথায় অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল না। বর্ণগুলি ছিল মুক্ত ও উদার যােগ্যতা অনুসারে কেউ এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে উন্নীত হতে পারত।
চার বর্ণের বাইরে আরো একটি বর্ণ উৎপত্তি হয়। এই পঞ্চম ভাগটি হল চন্ডাল বা অস্পৃশ্য।
( Thapar, Romila (২০০৪)। Early India: From the Origins to AD 1300। University of California Press। পৃষ্ঠা 63) চন্ডাল একটি বল-বীর্য সমন্বিত অর্থ দ্যোতক শব্দ। চন্ডের সঙ্গে জাতি সূচক আল প্রত্যয় যুক্ত হলে চন্ডাল হয়। এমনি ভাবে লাঙ্গল,জোঙ্গাল,জঙ্গল,ডাঙ্গাল,বহাল,খেড়ওয়াল,সাঁওতাল,বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই চণ্ডাল শব্দের গুনগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠবে। কার্যসিদ্ধির জন্য সুদাস,মনু,অগ্নী,বরুন প্রভৃতি দাস বা অসুর নেতাদের ও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো বৈদিক সাহিত্যে। অর্থাৎ রক্ষস (পরবর্তী কালে রাক্ষস বলা হয়েছে), অসুর,নাগ,চণ্ডাল শব্দগুলি কোন ভাবেই ঋণাত্মক নয় বরং গুণবাচক এবং ধ্বনাত্মক ।
অন্যদিকে নমঃশূদ্র শব্দটি একেবারেই অর্বাচিন বৃটিশ আমলের আরোপিত হীনাত্মক শব্দ। প্রাচীন কোন শাস্ত্রেই এই জাতির কোন উল্লেখ নেই।
পরবর্তী অংশ মূল লেখা থেকে পড়ুন.pdf
পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজে নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হলে পুরােনাে বর্ণভিত্তিক জনগােষ্ঠীগুলি থেকেই নতুন নতুন জনগােষ্ঠীর সৃষ্টি হয়।
অভিধানে জাত শব্দটির অর্থ জন্মগত সামাজিক শ্রেণী, অপরপক্ষে শ্রেণী অর্থ সারি বা বিভাগ। শ্রেণী এবং জাতপ্রথা দুই’ই অর্জিত হয় জন্মসূত্রে। জাতভেদ বনাম শ্রেণীভেদ দুটোই এমন এক সামাজিক অবস্থান যা কিনা বিশেষ কোন গোত্রকে নীচু বা উঁচু পদে দলভুক্ত করে সমষ্টিকে বিভক্ত করে।জাতপাত শব্দটি মূলত ভারতীয় শব্দ নয়, যদিও বর্তমানে এটি ইংরেজি এবংভারতীয় ভাষাগুলিতে উভয় ক্ষেত্রেই বহুল ব্যবহৃত হয়। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুসারে, এটি পর্তুগিজ কাস্টা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "জাতি, বংশ, জাত" এবং মূলত, "খাঁটি বা অমীমাংসিত (মজুদ বা জাত)"।("Caste, n."। Oxford English Dictionary। ১৯৮৯।)
ম্যাকলেভার এবং ডেভিস যেভাবে এই সমস্যা পর্যালোচনা করেছেন; জাতভেদ এবং শ্রেণীভেদ প্রথা দুই উল্টো মেরুতে অবস্থিত। উভয়ের উদ্দেশ্য সমাজিক ভেদাভেদ তৈরির মাধ্যমে সাম্যতার বিরোধী অবস্থান নেওয়া। দুই প্রথাতেই উঁচু স্তর গোত্রীয়রা দলগতভাবে নীচু অবস্থানের মানুষগুলোর উপর অনৈতিক আচরণ করে, কখনো সমাজিক মূল্যবোধের অজুহাতে কখনো ধর্মের।নীচু অবস্থানের মানুষগুলো বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। যখন শ্রেণীবিন্যাসের প্রশ্ন ওঠে, তখন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সেই অবস্থানের উত্তরণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সেই আইন সমাজে প্রচলনের চর্চা গৃহিত হয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠিকে দাবী মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। অপরপক্ষে জাতভেদ প্রথায় বলে দেওয়া হয় যে তাদের কর্মযোগ জন্মগত এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত, সুতরাং পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বিধানে তারা সেই নিগ্রহ পালন করে বংশ পরস্পরায় বিনা প্রতিবাদে।
বেদ পাঠ এবং পরমাত্মার উপাসনাতে নিযুক্ত থেকে বিদ্যা আদি উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণ বলা হয় ।
অধ্যাপনমধ্যয়নং য়জনং য়াজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহশ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।
অনুবাদ : অধ্যয়ন , অধ্যাপনা , যজ্ঞ করা ও করানো , দান দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা এই ছয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্ৰাহ্মণশ্চেতি শূদ্ৰতাম্ ।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবস্তু
বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_দশ_শ্লোক_65
অনুবাদ-- যদি কেউ শূদ্র কূলে উৎপন্ন হয়ে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যর,গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট হয় তবে সে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য হবে।
সেইরূপ, কেউ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যকূলে জন্মগ্রহণ করে শূদ্রের গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট হলে সে শুদ্র হবে।
অর্থাৎ,চার বর্ণের মধ্যে যে,
যে বর্ণের সদৃশ হবে,সে সেই বর্ণেরই হবে।
স্বাধ্যায়েন ব্রতৈহোমৈস্ত্রৈবিদ্যেনেজ্যয়া সুতৈঃ।
মহাযজ্ঞৈশ্চ যজৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে তনুঃ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_দ্বিতীয়_শ্লোক_28
অনুবাদ----বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা,হোম ও পঞ্চ মহাযজ্ঞ পালন, ধর্ম অনুসারে সন্তান উৎপাদন ইত্যাদি দ্বারা এই শরীর ব্রাহ্মণের করা যায়।
এবার দেখুন মনু স্মৃতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণের কাজ কি কি এবং তা পালন না করার শাস্তি-------
অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্ৰহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_প্রথম_শ্লোক_88
অনুবাদ-বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা,যজন, যাজন,দান ও প্রতিগ্ৰহ হল ব্রাহ্মণদের কাজ।
যোহনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রমম্।
স জীবন্নেব শূদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_দ্বিতীয়_শ্লোক_168
অনুবাদ---যে ব্রাহ্মণ আদি তিন বর্ণ, বেদ অধ্যয়ন না করে অন্যান্য অর্থশাস্ত্র স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতিতে অত্যন্ত যত্ন করেন তিনি জীবিত অবস্থাতেই অতি শীঘ্র শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।
ব্রাহ্মণদের প্রধান কাজ বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা। কাঁধে পৈতে থাকলেই কেউ ব্রাহ্মণ হয় না।
দেখুন মনু স্মৃতিতে কি বলা হয়েছে------
যথা কাষ্ঠময়ো হস্তী যথা চর্মময়ো মৃগঃ।
যশ্চ বিপ্রোহনধীয়ানস্ত্রয়স্তে নাম বিভ্রতি।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_দ্বিতীয়_শ্লোক_157
অনুবাদ--যেমন কাঠের তৈরি হাতি ও চামড়ার তৈরি মৃগ অকেজো ও অসার তেমনি যে ব্রাহ্মণ বেদ অধ্যয়ন করেন না, তিনিও অপ্রয়োজনীয় ও অসার!!
যথা ষন্ডোহফলঃ স্ত্রীষু যথা গৌর্গবি চাফলা।
যথা চাজ্ঞেহফলং দানং তথা বিপ্রোহনৃচোহফলঃ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায়_দ্বিতীয়_শ্লোক_158
অনুবাদ--নপুংসক যেমন কোনও স্ত্রীলোকের কাছে অকেজো,
একটি স্ত্রী জাতীয় গরু যেমন অন্য একটি স্ত্রী জাতীয় গরুতে নিষ্ফল এবং অজ্ঞ ব্যক্তিকে দান যেমন বিফল হয় তেমনি অনৃচ অর্থাৎ বেদ অধ্যয়ন বর্জিত ব্রাহ্মণও অচল বা অকেজো।
ব্রাহ্মণত্ত্ব যে, জন্মগত নয়,গুণ ও কর্মগত এই বিষয়ে গীতার প্রমাণ দেখুন----
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।
বঙ্গানুবাদ--- (আমি)গুণ ও কর্ম অনুযায়ী চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছি।
কিন্তু চার বর্ণের স্রষ্টা হলেও আমি আসক্তিহীন। আমাকে অকর্তা বলেই জানবে।
ব্রাহ্মণ হলেন,সাত্ত্বিক গুণ বিশিষ্ট।
গীতার,ষোড়শ অধ্যায়ের,1-2-3 শ্লোকে সাত্ত্বিক ব্যক্তিদের মধ্যে যে, ছাব্বিশটি গুণ দেখা যায়, তার বর্ণনা আছে।
এর মধ্যে অন্যতম প্রধান গুণ হল,বেদপাঠ ও যজ্ঞ।
প্রমাণ দেখুন-----
অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধিজ্ঞান যোগব্যবস্থিতিঃ।
দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্।।
গীতা_দৈবসুরসম্পদ্বিভাগযোগঃ_ শ্লোক_1
বঙ্গানুবাদ---1.ভয় না পাওয়া 2. অকুটিলতা 3.জ্ঞান 4.লব্ধ জ্ঞানের আচরণে নিষ্ঠা 5.দান 6.বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দমন 7.যজ্ঞ 8.বেদের অধ্যয়ন 9. তপস্যা 10.সরলতা।
বিশ্লেষণ-- পৌরাণিক ব্রাহ্মণেরা,শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর ভাবেন। কিন্তু, শ্রীকৃষ্ণের বাণী মানেন না!!
বেদপাঠ ও যজ্ঞ কোন ব্রাহ্মণই করেন না।সাত্ত্বিক গুণও তাঁদের নেই।
কিন্তু, মূর্তি পূজার মত, তামসিক কাজ করেন, শ্রীকৃষ্ণের বাণীকে অবহেলা করে।
প্রমাণ দেখুন-----
যৎ তু কৃৎস্নবদেকস্মিন্ কার্যে সক্তমহৈতুকম্।
অতত্ত্বার্থবদল্পঞ্চ তৎ তামসমুদাহৃতম্।।
বঙ্গানুবাদ_ যে জ্ঞান একটি মাত্র কার্যে অর্থাৎ দেহ বা প্রতিমায় সমগ্ররূপে আসক্ত অর্থাৎ যে জ্ঞান, কোন প্রতিমাকে সর্বস্বরূপ ব্রহ্মজ্ঞান করে,যা, অহৈতুক অর্থাৎ অযৌক্তিক,অতত্ত্বার্থবৎ অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানরহিত এবং অল্প,সে জ্ঞান তামস বলে কথিত হয়।
কারুরহং ততো ভিষগুপলপ্রক্ষিণী নানা।
নানাধিয়ো বসূযবোহনু গা ইব তস্থিমেন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
••ঋগ্বেদ_মন্ডল_9_সূক্ত_112_মন্ত্র_3
••রমেশচন্দ্র দত্তের, আক্ষরিক অনুবাদ---
দেখ আমি,স্তোত্রকার পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা পাথরের ওপর যব ভাঙ্গে।
আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।
ব্যাখ্যা_ স্তোত্রকার অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, চিকিৎসক অর্থাৎ বৈশ্য ও যব ভাঙ্গার কাজ অর্থাৎ শূদ্র।
এই মন্ত্রে স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যাচ্ছে এক পরিবারের লোকেরা আলাদা পেশায় নিযুক্ত হত,যোগ্যতা অনুসারে।
জন্ম অনুযায়ী নয়।
••ইমে যে নার্বাঙ্ ন পরশ্চরন্তি ন ব্রাহ্মণাসো ন সুতেকরাসঃ।
ত এতে বাচমভিপদ্য পাপয়া সিরীস্তন্ত্রং তন্বতে অপ্রজজ্ঞয়ঃ।।
••ঋগ্বেদ_মন্ডল_10_সূক্ত_71_মন্ত্র_9
••রমেশচন্দ্র দত্তের আক্ষরিক অনুবাদ---
যে সকল ব্যক্তি ইহকাল বা পরকাল কিছুই পর্যালোচনা করেনা, যারা স্তুতি প্রয়োগ বা সোমযাগ কিছুই করে না, তারা পাপযুক্ত অর্থাৎ দোষাশ্রিত ভাষা শিক্ষা করে, নির্বোধ ব্যক্তির মত কেবল লাঙ্গল চালনা করবার উপযুক্ত হয় অথবা তাঁতির কাজ করবার উপযুক্ত হয়।
ব্যাখ্যা---- এই মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, যারা ইহকাল ও পরকাল পর্যালোচনা করত ও স্তুতি অভ্যাস ও সোম যাগ করত,তারাই স্তোত্রা(ব্রাহ্মণ) হত আর যারা ঐ ধর্ম ক্রিয়া সাধনে অসমর্থ তারা কৃষক বা তাঁতি হত।
অর্থাৎ যোগ্যতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কাজ ,জন্ম অনুসারে নয়।
এইবার,বেদের যে মন্ত্রটি নিয়ে তথাকথিত নামধারী ব্রাহ্মণরা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের পুরুষসূক্তের,সেই বিখ্যাত মন্ত্রটি ও তার পূর্ব মন্ত্রটির
ব্যাখ্যা করা হল-----
যত্ পুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন্।
মুখং কিমস্যাসীত্ কিং বাহূ কিমূরূ পাদা উচ্যেতে।।10
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্ বৈশ্যঃ পদ্ভাং শূদ্রো অজায়ত।।11
যজুর্বেদ_অধ্যায়_31_মন্ত্র_10-11
ঋগ্বেদ_মন্ডল_10_সূক্ত_90_মন্ত্র_11-12
••অনুবাদ--(আচার্য সত্যব্রত সামশ্রমী)---
যাঁহাকে পুরুষ বলিয়া বিধান করা হইল, তিনি কি কি প্রকারে কল্পিত হইলেন?----- ইঁহার মুখ কি? বাহুদ্বয়ই বা কি? এবং কোন বস্তুই বা পাদদ্বয়রূপে কথিত হইয়া থাকে?(10)
বাহ্মণগণ ইঁহার মুখ রূপে কল্পিত হন, রাজন্য জাতি দ্বারাই ইঁহার বাহুদ্বয় কল্পিত,আরএই যে বৈশ্য জাতি ইহারাই উরূদ্বয়- স্থানীয় এবং পাদদ্বয় হইতেই শূদ্রের উৎপত্তি।
আচার্য সত্যব্রত সামশ্রমী'র ব্যাখ্যা----
পূর্ব মন্ত্রে(31/10)কোন বস্তুই বা পাদদ্বয়রূপে কথিত হয়ে থাকে,এই প্রশ্ন থাকায় এবং পরবর্তী মন্ত্রে(31/11) ব্রাহ্মণাদি মুখাদিরূপে কল্পনীয় এই উক্তি থাকায়,এই মন্ত্রের শেষভাগে অর্থাৎ পাদদ্বয় হতে শূদ্রের উৎপত্তি এই অংশটুকুরও ঐ অনুসারে ব্যাখ্যা কর্তব্য।
সুতরাং, শূদ্র তাঁর পাদদ্বয়রূপে কল্পিত হয়, এটাই প্রকৃত অর্থ বলে বুঝতে হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কৃত-----
(সত্যার্থ প্রকাশ_চতুর্থ সমুল্লাস)--------
এখানে "পুরুষ" অর্থাৎ নিরাকার ব্যাপক পরমাত্মার অনুবৃত্তি রয়েছে।পরমাত্মা নিরাকার বলে তাঁর মুখাদি অঙ্গ হতে পারে না।
অতএব এই মন্ত্রের অর্থ এই যে------
যিনি(অস্য) পূর্ণ ব্যাপক পরমাত্মার সৃষ্টিতে মুখের ন্যায় সকলের মধ্যে মুখ্য বা শ্রেষ্ঠ তিনি (ব্রাহ্মণঃ)"ব্রাহ্মণ"।
"বাহুবৈ বলং বাহুবৈ বীর্য্যম্"(শতপথ ব্রাহ্মণ_6/3/2/35)।
বল বীর্যের নাম বাহু। যার মধ্যে বল-বীর্য বেশি তিনি(রাজন্যঃ) ক্ষত্রিয় ।
যিনি পদার্থের সংগ্ৰহের জন্য সকল দেশে ঊরূবলে গমন করেন তিনি(বৈশ্যঃ) "বৈশ্য"।
আর, যে ব্যক্তি পায়ের মত মূর্খতাদি দুর্গুণ বিশিষ্ট,সেই ব্যক্তি "শূদ্র"।
যদি মুখাদি অঙ্গ হতে, বাহ্মণ উৎপন্ন হত তবে তাদের আকৃতি, উপাদান কারণের মত হত।
যে রূপ মুখের আকার সেইরূপ ব্রাহ্মণদের আকার হত।
বৈশ্যদের, ঊরুর মত আকার হত এবং
শূদ্রদেরর পায়ের মত আকার হওয়া উচিত ছিল!!!
কিন্তু তা হয় না।
যদি কেউ যুক্তি দেখায়,
যারা মুখাদি হতে উৎপন্ন হয়েছিল তাদের সংজ্ঞা ব্রাহ্মণ হোক কিন্তু সেই যুক্তিও অনর্থক।
কেননা সব মানুষই নিজের মায়ের গর্ভাশয় হতেই উৎপন্ন হয়।
(মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর ব্যাখ্যা অতি উত্তম। আধুনিককালেও, মুখ বলতে প্রধানকেও বোঝান হয়। যেমন, বিজেপির মুখ বললে নরেন্দ্র মোদির কথাই মনে আসে বা পতঞ্জলির মুখ, রামদেব।
পরমাত্মা নিরাকার।এই বিষয়ে প্রমাণ এই পোষ্টের শেষে দেওয়া হল।)
তৃতীয় ব্যাখ্যা----
অধ্যাপনা প্রভৃতি কাজ ব্রাহ্মণের মুখসাধ্য তাই ব্রাহ্মণকে পরমাত্মার মুখ থেকে উৎপন্ন বলে কল্পনা করা হয়েছে।
ক্ষত্রিয়ের কাজ বাহুসাধ্য যুদ্ধ তাই ক্ষত্রিয়কে পরমাত্মার হাতরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
বৈশ্যের কাজ ঊরুর ওপর নির্ভর।কারণ, পশু রক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতির জন্য বিভিন্ন স্থানে গমন ঊরুর শক্তির উপর নির্ভর করে। তাই বৈশ্যকে পরমাত্মার ঊরুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
অধ্যাপনা,প্রশাসন ও বাণিজ্য ছাড়াও অনেক প্রকার কাজ আছে সমাজে,যা শূদ্রদের কাজ বা নিম্ন ভাগের কাজ।
আবার,পায়ের উপর যেমন গোটা দেহ দাঁড়িয়ে থাকে,ঠিক তেমন সমাজে মানুষের জীবন ও ধর্মকে স্থায়ী হতে হলে,শূদ্র-রূপ শক্ত পায়ের প্রয়োজন।
{পরমাত্মা নিরাকার। সুতরাং,এই মন্ত্রটি আক্ষরিক অর্থ করলে বেদ বিরোধী অনুবাদ করা হবে।
পরমাত্মা যে নিরাকার তার প্রমাণ-------
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ-
র্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
ঈশোপনিষদ:মন্ত্র:8
যর্জুবেদ:অধ্যায়_ 40,মন্ত্র নং_8
সঃ(সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্(শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ(ক্রান্তদর্শী), মনীষী(সর্বজ্ঞ),পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান),স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ),[সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ(লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
অনুবাদ-----
তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা, সর্বব্যাপী,জ্যোতির্ময় ও অশরীরী(অশরীর শব্দে পরমাত্মার লিঙ্গ শরীরের নিষেধ) ক্ষতরহিত,শিরাহীন, স্নায়ুহীন,(ক্ষতরহিত ও শিরাহীন শব্দে, স্থূল শরীরের নিষেধ), নির্মল (নির্মল শব্দে,কারণ শরীরের নিষেধ করা হল) ও অপাপবিদ্ধ।তিনি, সর্বদর্শী,সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান ও স্বয়ম্ভূ।পরমাত্না, চিরকাল ধরে, লোকের যথাযথ কর্মফল অনুসারে কর্তব্য বিধান করছেন}
যিনি জনগণের রক্ষা কার্য তথা আক্রমণ , ক্ষতি হতে যিনি প্রজাদের রক্ষা করেন তাঁকে ক্ষত্রিয় বলা হয় ।
প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ॥
অনুবাদ : ব্রহ্মচর্যপূর্বক বেদের অধ্যয়ন করা , অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করা , সুপাত্রকে দান করা , প্রজার রক্ষা করা বিষয়ে অনাসক্ত হয়ে জীতেন্দ্রিয় থাকা ক্ষত্রিয়ের কর্ম ।
যিনি বিবিধ ব্যবহারিক বিষয়ে প্রবিষ্ট থাকে এবং বিবিধ বিদ্যাতে কুশল , তিঁনিই বৈশ্য । পশুপালন দ্বারা বৈশ্যের সমৃদ্ধ হয় , এটি বৈশ্যের কর্তব্য ।
পশুনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদং চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।।
অনুবাদ : গবাদি পশুর পালন এবং বৃদ্ধি করা , বিদ্যা ও ধর্মের বৃদ্ধি করতে ও করাইতে ধনসম্পত্তি ব্যয় করা , অগ্নিহােত্রদি যজ্ঞ করা , বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করা , সর্বপ্রকার বাণিজ্য করা এবং বৃদ্ধির জন্য ধন প্রয়োগ করা এগুলো বৈশ্যের গুণ ও কর্ম ।
শূদ্র সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অজ্ঞানতার কারণে কোন প্রকারের উন্নত স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারে না এবং যিনি নিজের নিম্ন স্থিতি হওয়ার কারণে তথা নিজের উন্নতির চিন্তা করেন তথা নিজের প্রভূর ভরণ পোষণের চিন্তা করেন এরূপ সেবক মানুষ হলেন শূদ্র । অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে যার নিম্ন জীবনস্থিতি , যে কেবল সেবা আদি কার্য করে , ওইরূপ মানুষ শূদ্র ।
একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেৰ বর্ণনাং শুশ্রষামনসূয়য়া।।
অনুবাদ : নিন্দা , ঈর্ষা এবং অভিমানাদি দোষ পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , এবং বৈশ্যদিগের যথাযথ ভাবে সেবা করা শূদ্রের কর্তব্য এবং তদ্দ্বারাই জীবন যাত্রা নির্বাহ করা । এটিই শূদ্রের একমাত্র গুণ এবং কর্ম ।
তাহলে মূল বিষয় হল - বেদজ্ঞানী এবং পরমাত্মার উপাসনাতে নিযুক্ত উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তি হল ব্রাহ্মণ ।
যিনি জনগনের রক্ষা কার্য করেন তিঁনি ক্ষত্রিয় ।
আর বিভিন্ন ব্যবহারিক বিদ্যাতে কুশল এবং ব্যবসায়ী তিঁনি বৈশ্য ।
এবং অজ্ঞান তথা বিদ্যাহীন মানুষদের শূদ্র বলা হয় , কারণ তারা বিজ্ঞান সম্বন্ধিয় কোনো কার্য করতে পারে না কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন । এজন্য শূদ্র সর্বদা সেবামূলক কার্যে নিযুক্ত থাকেন ।
আমাদের শাস্ত্র অনুযায়ী সকলেই জন্ম অনুযায়ী শুদ্র। কিন্তু যারা শাস্ত্র পড়ে জ্ঞানী হন তারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হতে পারেন আর যিনি মূর্খই রয়ে যান তিনিই হলো শুদ্র। ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণ কে দ্বিজ বলা হয়, এই তিন বর্ণ কে দ্বিজ বলার কারণ হলো এদের দুইবার জন্ম হয়, একবার মাতৃ গর্ভ হতে জন্ম হয় আর একবার ব্রহ্মজন্ম অর্থাৎ উপনয়ন সংস্কারে দীক্ষিত হয়ে বেদ অধ্যয়ন আদি বিদ্যাপ্রাপ্তি রূপী দ্বিতীয় জন্ম হয়, আর শুদ্র কে এক জাতি বলা হয়, কারণ শুদ্ররা বিদ্যাপ্রাপ্তি রূপী দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে না। (মনুস্মৃতি ২/১৪৬, ১০/৪)
এভাবে গুণ ও কর্মানুসারে বর্ণবিভাগ করা হয়েছে ।
তাহলে এখন সর্বশেষ প্রশ্ন রইলো - যদি বর্ণ জন্মগত না হয় তাহলে উপনয়নের জন্য ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বালকের জন্য ৮ , ১১ ও ১২ বৎসর অর্থাৎ আলাদা আলাদা বর্ষ নির্ধারিত কেন ? আর শুদ্রের জন্য কেন উপনয়নের কোন দিন নির্ধারিত হলো না ?
তাহলে শুনুন - এই প্রশ্নের উত্তর উপরের বর্ণনার মধ্যেই রয়েছে , শুধু বিচারের প্রয়োজন মাত্র । কোন ছোট শিশুই কোন বর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন না । প্রত্যেক শিশু তো অজ্ঞানী হয়েই জন্মগ্রহণ করেন তারপর বিদ্যা অর্জনের পর নিজের মেধা অনুসারে নিজ নিজ পদ গ্রহণ করতে পারে ।
কেউ বেদবিশারদ্ , কেউ ভালো যোদ্ধা , কেউ ব্যবহারিক বিদ্যাতে নিপুন আবার কেউবা এসবের কোনটাতেই দক্ষ না হয়ে অজ্ঞানীই রয়ে যান ।
সেইজন্য সন্তানের ইচ্ছায় অথবা পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী সেই বর্ণে সেই সন্তানকে উক্ত বর্ষে উপনয়ন সংস্কার করা হয় ।
মনু কি শুদ্র তথা দলিত বিরোধী ছিলেন ?
জেনে নিন গবেষক দের মতামত
3 )
যে সন্তান যে বর্ণের প্রবেশ করতে চায় সে সন্তান সেই বর্ণেই দীক্ষা গ্রহণ করবেন । অর্থাৎ পিতামাতার সংকল্প অনুযায়ী সন্তান ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণে দীক্ষিত হন । এভাবে শিক্ষা দীক্ষার পর যে এই তিন বর্ণের গুণকে ধারণ করতে পারে না তিনি শূদ্র হয়ে থাকেন ।
ইতিহাসের কিছু প্রমানঃ
১/ ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্ব লাভ
[ বাল্মীকি রামায়ণ/ বালকাণ্ড/ ৫১- ৬৫ সর্গ]
২/ ক্ষত্রিয় বীতহব্যের ব্রাহ্মণত্ব লাভ
বর্চ্চার পুত্র বিহব্য। বিহব্যের পুত্র বিতত্য। বিতত্যের পুত্র সত্য, সত্যের পুত্র সন্ত। শন্তের পুত্র শ্রবা। শ্রবার পুত্র তম। তমের পুত্র প্রকাশ। প্রকাশের পুত্র বাগিন্দ্র। বাগীন্দ্রের পুত্র প্রমতি। প্রমতির ঔরসে ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামে এক পুত্র জন্মে। রুরুর ঔরসে প্রমদ্বরার গর্ভে শুনকের জন্ম হয়। মহাত্মা শৌনক সেই শুনকের পুত্র। এরা সকলেই ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন।
[মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব/ ৩০ অধ্যায়]
৩/ মহাভারতের আদিপর্বের ৭৫ তম অধ্যায়,
রাজা নহুষের ছয় পুত্রের মধ্যে যতি তপস্যার বলে ব্রহ্মের মত হয়েছিলেন।
৪/ ভীম যখন কর্ণকে অপমান করেন,
দুর্যোধন প্রতিবাদ করেন দুর্যোধন বলেছিলেন, “ ‘ হে ভীম , কর্ণের প্রতি এমন কটূক্তি প্রয়োগ করা তোমার উচিত হচ্ছে না। ক্ষত্রিয়দের বলই শ্রেষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়দের সাথেই যুদ্ধ করবে ; বীরদের ও নদীদের উৎসস্থল নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়। …যারা ক্ষত্রিয় কুলে জন্মেছিলেন কালক্রমে তারাও ব্রাহ্মণ হয়েছেন; বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ক্ষত্রিয় হয়েও অক্ষয় ব্রহ্মত্ব লাভ করেছিলেন। মহানুভব দ্রোণাচার্য কুম্ভ থেকে জন্মেও অদ্বিতীয় শস্ত্রধারী হয়েছেন । গৌতম বংশে শরস্তম্ভ হতে গৌতম উৎপন্ন হন; আর তোমাদের যেভাবে জন্ম হয়েছে, আমাদের তা অজানা নেই।“
[ মহাভারত, আদিপর্ব/ ১৩৭ অধ্যায়]
৫/ নাভাগারিষ্টের দুই পুত্র। তারা উভয়েই পূর্বে বৈশ্য ছিলেন, কিন্তু কালক্রমে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হন।
করুষের পুত্রেরা কারুষ নামে বিখ্যাত। তারা সকলেই ক্ষত্রিয়জাতীয়। তাদের মধ্যে পৃষধ্র নামে একজন নিজের গুরুর গোহত্যা করাতে শাপগ্রস্ত হয়ে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।“
[হরিবংশ/ ১১ অধ্যায়]
৬/ “গৃৎসমদের পুত্র শুনকের বংশীয়রা শৌনক নামে বিখ্যাত। শুনকের বংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চার বর্ণেরই উদ্ভব হয়েছিল। “
[ হরিবংশ/২৯ অধ্যায়]
৭/ বৃহদ্দর্ভ রাজার বৃহন্মনা এক পুত্র ছিল।বৃহন্মনার দুই স্ত্রী। একের নাম যশোবতী, অপরের নাম সত্যা।
যশোদেবীর গর্ভে জয়দ্রথের জন্ম হয়। সত্যার পুত্র বিজয়। এই বিজয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্র উভয় ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
[ হরিবংশ/ ৩১ অধ্যায়]
৮/ বৎস্য হতে বৎস্যভূমি ও ভার্গব হতে ভৃগুভূমি উৎপন্ন হয়েছে। এরা সকলেই অঙ্গীরার পুত্র ভৃগু বংশে জন্মগ্রহণ করে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য , শূদ্র চতুর্বর্ণে বিভক্ত হয়েছিল।
[ হরিবংশ/৩২ অধ্যায় ]
৯/ ঋষভদেব ও জয়ন্তীর উপরোক্ত ঊনবিংশতি পুত্রের কনিষ্ঠ আরও একাশি জন পুত্র ছিল। তাদের পিতার আদেশ অনুসারে তারা অত্যন্ত বিনীত, বেদনিপুন, যজ্ঞপরায়ণ ও সদাচাররত আদর্শ ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/স্কন্ধ ৫/ অধ্যায় ৪ / শ্লোক ১৩]
১০/ শুকদেব গোস্বামী বললেন- হে ভারত, যে বংশে আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন, যে বংশে বহু রাজর্ষি ও ব্রাহ্মণগণের আবির্ভাব হয়েছে , আমি এখন সেই পুরুবংশের বর্ণনা করবো।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/ ৯/ ২০/১ ]
১১/ রথীতরের পত্নীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করার ফলে তারা রথীতর গোত্র ; কিন্তু যেহেতু তাহারা অঙ্গীরার বীর্য থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন , তাই তারা অঙ্গীরা গোত্রও। রথীতরের সমস্ত সন্তানদের মধ্যে এরাই শ্রেষ্ঠ , কারণ জন্মসূত্রে তারা ছিলেন ব্রাহ্মণ।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/৯/৬/৩ ]
১২/ গর্গ হতে শিনি এবং শিনি হতে গার্গ্য জন্মগ্রহণ করেন। গার্গ্য ক্ষত্রিয় হলেও তার থেকে ব্রাহ্মণবংশের উদ্ভব হয়। মহাবীর্য থেকে দুরিতক্ষয় নামে এক পুত্রের জন্ম হয়, যার পুত্রদের নাম ত্র্যয়ারুণি, কবি এবং পুষ্করারুণি । যদিও দুরতিক্ষয়ের এই পুত্ররা ক্ষত্রিয়বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবুও তারা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন ।
প্রিময়মেধ আদি অজমীঢ়ের বংশধরগণ সকলে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/৯/২১/১৯-২১]
১৩/ শান্তির পুত্র সুশান্তি, সুশান্তির পুত্র পুরুজ, পুরুজের পুত্র অর্ক। অর্ক থেকে ভর্ম্যাশ্ব এবং ভর্ম্যাশ্ব থেকে মুদ্গল, যবীনর, বৃহদ্বিশ্ব, কম্পিল্ল এবং সঞ্জয় নামক পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়। ভর্ম্যাশ্ব তার পুত্রদের বলেছিলেন, “ হে পুত্রগণ, তোমরা আমার পাঁচটি রাজ্যের ভার গ্রহণ কর , কারণ তোমরা সেই কার্য সম্পাদনে সমর্থ। এই কারণে তার পঞ্চপুত্র পঞ্চাল নামে অভিহিত হন। মুদ্গল থেকে মৌদ্গল্য ব্রাহ্মণবংশের উৎপত্তি হয়।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/ ৯/২১/৩১-৩৩]
১৪/ ধৃষ্ট নামক মনুর পুত্র হতে ধার্ষ্ট নামক ক্ষত্রিয়জাতির উৎপত্তি হয় , যারা পৃথিবীতে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/ ৯/২/১৭]
১৫/ দিষ্টের নাভাগ নামে এক পুত্র ছিল। …
এই দিষ্টপুত্র নাভাগ কর্মের দ্বারা বৈশ্যত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।“
[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/ ৯/২/২৩]
A fiction that created mindboggling tragedy on humanity with shocking consequences in India. The Constitution of India framed by Dr. Babasaheb B. R. Ambedkar and adopted by the Constituent Assembly of India banned caste based discrimination.
ReplyDelete