মানুষ যত পার্থিব প্রয়োজন বোধ করে, স্বার্থান্বেষীরা তার প্রতিটির জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর মূর্তিপূজা চালু করেছে। তারা মানুষকে বুঝিয়েছে, প্রতিটি প্রয়োজন পূরণের জন্য এক ভগবানেরই দেবদেবী নামে ভিন্ন ভিন্ন অংশ রয়েছে। তাই বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেবমূর্তি তৈরি করতে হবে। প্রতিটি মূর্তির ভিতরে পুরোহিতের সাহায্যে দেবতাকে আহ্বান করতে হবে, এরপর পূজা করতে হবে।
কারা কিভাবে মূর্তিপূজার বিস্তার ঘটিয়েছে, সে সম্পর্কে লিখতে গিয়ে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন, “প্রস্তর মূর্তি নির্মাণ করিয়া গুপ্ত কোনো পর্বতে-অরণ্যাদিতে রাখিত। পরে ইহারা চেলাদের মাধ্যমে প্রচার করিত যে, রাত্রিকালে মহাদেব, পার্বতী, রাধাকৃষ্ণ, সীতারাম, লক্ষ্মীনারায়ণ, ভৈরব এবং হনুমান প্রভৃতি তাহাকে স্বপ্নে বলিয়া দিয়াছেন, ‘আমি অমুক স্থানে আছি, আমাকে সে স্থান হইতে আনিয়া মন্দিরে স্থাপন করো এবং তুমি আমার পূজারী হইলে মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করিব।’
জ্ঞানান্ধ ধন্যাঢ্যগণ এ সকল পোপলীলা সত্য বলিয়া মানিয়া লইতেন এবং জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘এখন এই মূর্তি কোথায় আছে?’ তখন পোপ-মহারাজ বলিতেন, ‘অমুক পর্বতে বা অরণ্যে আছে; আমার সঙ্গে চল, দেখাইব।’ তখন জ্ঞানান্ধ সেই ধূর্তের সঙ্গে সে স্থানে যাইয়া মূর্তি দর্শন করিত এবং আশ্চর্য হইয়া তাহার পায়ে পড়িয়া বলিত, ‘আপনার এই দেবতার বড়ই কৃপা; এবার ইহাকে আপনি লইয়া চলুন, আমি মন্দির নির্মাণ করাইয়া দিব। মন্দিরে এই দেবতার স্থাপনা করিয়া আপনিই পূজা করিবেন। আমরাও মনোবাঞ্ছিত ফল লাভ করিব।’
একজনের এইরূপ লীলাখেলা রচনার পর দেখাদেখি অন্যান্য সকল ‘পোপ’ তাহাদের জীবিকার্থে ছলনা-কপটতা সহকারে মূর্তি স্থাপন করিতে লাগিল।”
[মূর্তিপূজা সমীক্ষা, সত্যার্থ প্রকাশ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী; পৃষ্ঠা ২৩৮]
এভাবেই অসংখ্য দেবমূর্তির ভিতরে ভগবানের আগমনের তত্ত্ব দিয়ে একেশ্বরবাদী মূল হিন্দুধর্মকে স্বার্থবাদীদের লোভলালসা চরিতার্থ করার যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করে দেখা হয়নি যে, ‘মৃণ্ময় মূর্তির’ ভিতরে যদি ‘চিন্ময় ভগবানেরই’ আবির্ভাব ঘটলো, তবে তাঁকে কেন গরু-ঘোড়া-হাঁস-পেঁচা-ইঁদুরের পিঠে করে আসতে হবে? তাঁকে কেন হাত-পা ধুইয়ে বিভিন্ন ভোগ দিতে হবে? ‘পান-তামুক’ খাওয়াতে হবে? চিন্ময় ভগবানের এসবে কী প্রয়োজন?
যখন আমরা ভারত বর্ষ এবং আর্য জাতির মহান পতনের কারণ এর ওপর বিচার করি তখন আমাদের প্রাচীন ইতিহাসে আমাদের দৃষ্টি অবতারবাদ এর মিথ্যা প্রমাণ এবং মূর্তি পূজার ওপর আসে। আমরা দেখি যে সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমাদের আর্য জাতি উন্নতির চরম শিখরে সদৈব বিরাজমান ছিল। যে জাতি এক পরমেশ্বরের উপাসক ছিল। যার আধ্যাত্মিক উন্নতি অনেক উচ্চতাতে পৌঁছে গিয়েছিল। সারাবিশ্ব যাকে নিজের আধ্যাত্মিক গুরু মানতো। যে আর্য জাতির মহর্ষিরা আমাদের দেশে যোগের দ্বারা সমাধিস্থ হয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাক্ষাৎকার করেছিল। লোক লোকান্তর এর স্থিতির তথ্য প্রাপ্তি করেছিল। যেই জাতি ভৌতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পূর্ণতা সীমাতে পা রেখেছিল। সেই আমাদের বিশ্ব শিরোমনি আর্য জাতি এই মূর্তি পূজার আড়ম্বরে জড়িয়ে নিজের আরাধ্য দেব পরমেশ্বরকে ভুলে তাঁকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বনির্মিত ইট-পাথরে পূজা করতে শুরু করলো, তার আস্থা পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জড় উপাসনাতে যখন থেকে হয়েছে, তখন থেকে তার পতন আরম্ভ হয়েছে। আমাদের ইতিহাস বলে এই মূর্তি পূজার আরম্ভ সর্বপ্রথম জৈনদের সময় থেকে হয়েছে তারা নিজেদের মতকে প্রাচীন সিদ্ধ করার জন্য নিজেদের সংস্থাপকদের পূর্বে আরোও ২৩ টি নিজেদের কল্পিত তীর্থঙ্কর মহাপুরুষের তালিকা দিয়েছে। তাদের দেখাদেখি হিন্দুরাও নিজেদের ২৪টি অবতারের কল্পিত তালিকা তৈরী করেছে। জৈনরা নিজেদের তীর্থঙ্করদের মূর্তি তৈরি করে, নিজেদের সমাজে মন্দির স্থাপনা করে পূজা আরম্ভ করেছিল। হিন্দুরাও তাঁদের নকল করে নিজেদের অবতারের মূর্তি বানিয়ে, মূর্তি পূজার ক্রম চালু করে দিয়েছিল।দিগম্বর জৈনরা নিজেদের তীর্থঙ্করদের নগ্ন মূর্তি তৈরি করে পূজা প্রারম্ভ করেছিল। তখন হিন্দুরাও শিব এবং পার্বতীর জননেন্দ্রিয়কে পূজা করতে শুরু করলো। শ্বেতাম্বর জৈনরা নিজেদের মহাবীর কে ধুতি পরিয়ে মূর্তি পূজা শুরু করেছিল, তখন হিন্দুরাও বিষ্ণুকে সাত্ত্বিক মূর্তি বানিয়ে পূজা প্রচলিত করেছিল। তখন হিন্দুদের সঙ্গে বৌদ্ধ এবং জৈনদের সংঘর্ষ হত। লোকেদেরকে নিজেদের দিকে আকর্ষিত করার জন্য যা কিছু জৈন এবং বৌদ্ধরা করত, হিন্দুরাও লোকেদেরকে নিজেদের দিকে আনার জন্য এবং তাদের(জৈন এবং বৌদ্ধদের) দিকে যাওয়ার থেকে আটকানোর জন্য তেমনটাই করত।
বেদে মূর্তি পূজার বিধান নেই। বেদে বলাই আছে— ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্দ্যশঃ। যজুর্বেদ ৩২/৩
অর্থাৎ যিনি মহান যশের অধিকারী সেই পরমাত্মার কোনো মূর্তি, তুলনা, প্রতিকৃতি, প্রতিনিধি, মডেল নেই। উক্ত মন্ত্রে মূর্ত্তি পূজা নিশেধ করা হয়েছে।
যে সমস্ত মূর্তি মন্দিরে রাখা হয় সেগুলির রূপ-রঙ বস্ত্র দৈর্ঘ্য প্রস্থ ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করলে ঐ সমস্ত মূর্তি থেকেও অনেক ভালো মূর্তি পাওয়া যায়। কিন্তু যজুর্বেদ ৮/৩৬ অনুসারে পরমাত্মার মতো দ্বিতীয় কেউ নেই। যদি কেউ প্রশ্ন করে পরমাত্মার কোনো মূর্তি নেই তাহলে তার ধ্যান কিভাবে হতে পারে ইহার উত্তর এই মন্ত্রে দেওয়া আছে। য়স্য নাম মহদ্দ্যশঃ যাহার নাম স্মরণ, আজ্ঞা পালন মহাযশ। ধ্যান নামই চিন্তনের। চিন্তন নিরাকারেরও হয়। শব্দ নিরাকার কিন্তু তাহা শুনে সব মানুষ চিন্তন করে,যত সাংসারিক পদার্থ আছে, সেগুলো থেকে আনন্দ,সুখ, দুঃখ সেগুলো নিরাকার। পরমাত্মা আনন্দ স্বরুপ এবং নিরাকার।
যজুর্বেদ ৪০/৮ পরমাত্মা সর্বব্যাপক অর্থাৎ যিনি সমস্ত জায়গায় বিরাজমান , সর্বশক্তিমান অর্থাৎ যিনি নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত কর্ম একাই করতে সক্ষম, অকায়ম্ অর্থাৎ স্থূল-সূক্ষ্ম কারণ শরীর রহিত, অস্নাবিরম্ অর্থাৎ নাড়ী আদি সম্বন্ধ হতে রহিত, পরি অগাত্ অর্থাৎ সর্বব্যাপক।
ঋকবেদ ৬/৯/৫ অনুসারে পরমাত্মা সচ্চিদানন্দ। মূর্তি কখনো সচ্চিদানন্দ হয় না।
জড় পদার্থের উপাসনাকারীদের বিষয়ে বেদে বলা আছে।
অন্ধংতমঃ প্রবিশন্তি য়েসংভুতিমুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য় উ সংভূত্যাং রতাঃ।। যজুর্বেদ ৪০/৯
অর্থাৎ যে সমস্ত মানুষ কারণ রূপ প্রকৃতির উপাসনা করে, তাঁরা অন্ধকার প্রাপ্ত হয় তথা যাঁরা প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন কার্যরূপ জগতের পদার্থের পূজা উপাসনা করে, তাঁরা(প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন কার্যরূপ জগতের পদার্থের পূজা উপাসনাকারী) তাঁদের (সেই সমস্ত মানুষ যাঁরা প্রকৃতির উপাসনা পূজা করে) থেকেও অধিক মহাঅবিদ্যারূপ অন্ধকার এবং দুঃখ প্রাপ্ত হয়।
বেদে উপরোক্ত মন্ত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রকৃতি অথবা প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন কোন জড় পদার্থ এবং মূর্তি আদি পূজা উপাসনা কারীদের বিনাশ হয়। তাঁরা অজ্ঞানী হয়ে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে। তাঁদের লোক-পরলোক দুটিই বিনষ্ট হয়। কিছু পৌরানিক বিদ্বান ‘সম্ভূতি অসম্ভূতি’ পদের ভুল অর্থ বলে। তাঁদের মহীধর এর নিম্ন অর্থে মনসংযোগ দিতে হবে।
সম্ভূতি— কার্যস্যোত্পত্তিঃ। তস্যা অন্যা অসম্ভূতিঃ প্রকৃতিঃ- কারণমথবা কৃতাখ্যম্।
অর্থাৎ কার্য জগতকে সম্ভূতি বলে এবং তার থেকে আলাদা কারণরুপ প্রকৃতিকে অসম্ভূতি বলে।
এবার স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠতে পারে মূর্তি পূজার প্রচলন কখন থেকে শুরু হয়েছে এবং কে শুরু করেছে। মহর্ষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশ এর একাদশ সমুল্লাসের প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে লিখেছেন—
প্রশ্ন – মূর্তি পূজা কখন থেকে শুরু হয়েছে?
উত্তর – জৈনদের সময় থেকে।
প্রশ্ন— জৈনরা কোথা থেকে চালু করেছে?
উত্তর – নিজের মূর্খতার থেকে।
পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর অনুসারে মূর্তি পূজা বৌদ্ধদের সময় থেকে প্রচলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন—
“ ইহা এক মনোরঞ্জক ধারনা যে মূর্তি পূজা ভারতে গ্ৰীস থেকে এসেছে। বৈদিক ধর্ম সমস্ত প্রকার মূর্তি তথা প্রতিমা পূজার বিরোধী ছিল। সেই সময় (বৈদিক যুগে) দেবদেবীর কোনো প্রকার মন্দির ছিল না।* প্রারম্ভিক বৌদ্ধধর্ম ইহার ঘোর বিরোধী ছিল* অপর দিক থেকে বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ হয়েছিল। ফার্সি তথা উর্দু ভাষায় প্রতিমা অথবা মূর্তির জন্য এখনো বূত শব্দ প্রযুক্ত হয় যা বুদ্ধের রূপান্তর।” হিন্দুস্তান কী কাহানী পৃষ্ঠা নম্বর 132
একটি অন্য স্থানে তিনি লিখেছেন—
গ্ৰীস আদি দেশে দেবতাদের মূর্তি পূজা হতো। সেখান থেকে ভারতে মূর্তি পূজা এসেছে। বৌদ্ধরা মূর্তি পূজা আরম্ভ করেছিল। এবং তা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব ইতিহাস কী ঝলক পৃষ্ঠা 664।
উক্ত উদাহরণ থেকে এটা নিশ্চিত যে মূর্তি পূজা জৈন-বৌদ্ধ কাল থেকে আরম্ভ হয়েছিল। যে সময় ভারতে মূর্তি পূজা আরম্ভ হয়েছিল এবং লোকেরা মন্দিরে যাওয়া শুরু করেছিল তখন ভারতীয় বিদ্বানগণ ইহার ঘোর খন্ডন করেছিল। মূর্তিপূজার খন্ডনে তিনি লিখেছেন —
গজৈরাপীড্য়মানোপি ন গচ্ছেজ্জৈনমন্দিরম্। ভবিষ্য প্রতিসর্গপর্ব ৩/২৮/৫৩
হাতি যদি মারার জন্য দৌড়ে আসে এবং জৈনদের মন্দিরে গিয়ে যদি প্রাণও রক্ষা হয় তবুও জৈনদের মন্দিরে যাওয়া উচিত নয়।
ব্রাহ্মণ, উপদেশক এবং বিদ্বানদের কথন সাধারণ জনতার উপর কোনো প্রভাব না পড়ায় তাঁরাও মন্দির নির্মাণ করতে শুরু করে দিল। জৈনদের মন্দিরে উলঙ্গ মূর্তি ছিল। এই মন্দিরে ভব্যবেশে অলঙ্কার শৃঙ্গার যুক্ত মূর্তি স্থাপনা এবং পূজা শুরু হলো। যে পূজা করে তাকে পূজারি বলা হত।
পূজারি এর অর্থ পূজা+অরি অর্থাৎ পূজার শত্রু। পূজাদি সত্যিই পূজার শত্রু ছিল। একবার কোনো এক যুবক পূজারিকে বললেন “আপনি তো মূর্তিপূজার খন্ডন করতেন এখন নিজেই পূজার আরম্ভ করে দিলেন এটা কেমন কথা হলো?” পূজারি বললো আমি তো পূজার শত্রু। আগামীকাল সকাল বেলা আসুন আমি আপনাকে বোঝাবো।
দ্বিতীয় দিন যুবক মন্দিরে পৌঁছালো। সকালের সময় ছিল। সূর্য উদিত হয়ে গিয়েছিল। সূর্যের প্রকাশে পূজারি একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করলেন যাতে সাতটি বাতি ছিল। নিজের হাতে একটা ঘন্টা নিল এক ব্যক্তিকে নগাড়া এবং আর এক ব্যক্তিকে ঘড়িয়াল বাজানোর আদেশ দিল। পূজারি মূর্তির সম্মুখে দাঁড়ালো এবং সেই প্রদীপকে মূর্তির পায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে যুবককে দেখাতে লাগল এবং মৌন ভাষায় বলতে লাগল, ধ্যান পূর্বক দেখো ইহা পাথর। তারপর সেই প্রদীপকে মূর্তির একটি হাতের কাছে নিয়ে আসলো এবং হাতকে দেখিয়ে মৌন ভাষায় সংকেত করতে লাগল ধ্যান পূর্বক দেখো ইহা পাথর। পুনরায় সেই প্রদীপকে মূর্তির মুখের কাছে নিয়ে গেল, যদি কোনো ব্যক্তি শুয়ে আছে এবং তার চোখের ওপর তীব্র আলো নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে তার চোখ অবশ্যই একটু না একটু ঝাপটাবে। পূজারী মূর্তির চোখের কাছে দেখিয়ে বলল ধ্যানপূর্বক দেখো ইহা পাথর তারপর পূজারী মূর্তির অপর হাতের কাছে প্রদীপ নিয়ে গিয়ে সেটাও দেখাতে লাগল এবং শেষে ঘোড়ায় মূর্তির পায়ের কাছে প্রদীপ থেকে নিয়ে গেল। এই ক্রিয়াকে পুজারি এক দুবার নয় বরং সাত বার দেখেছিলেন এবং মৌন উপদেশে বলেছিলেন, ধ্যানপূর্বক দেখো ইহা উপর থেকে নিচের পাথরই পাথর। যুবক যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে এই জন্য এক ব্যক্তি ঘড়িয়াল এবং এক ব্যক্তি নগাড়া বাজিয়েছিল এবং অন্যদিকে পূজারী নিজেই ঘন্টি বাজাচ্ছিলেন। যুবক এই সমস্ত কিছু দেখেও হাত জোড় করে দাঁড়ালো। তখন পূজারী কিছুটা জল নিয়ে তাঁর ওপর ছুঁড়ে দিলো এবং নিজের মৌন ভাষায় বলল এখনো বুঝতে পারছ না তাহলে ওই কিছুটা জলেই ডুবে মরো!
এইভাবে বিদ্বান্বেরা মূর্তি পূজার খন্ডন করেছিলেন।
ন প্রতীকে ন হি সঃ। বেদান্ত ৪/১/৪
প্রতীকে মূর্তিতে পরমাত্মার উপাসনা কখনো হয় না, কেননা প্রতীক পরমাত্মা নয়।
কথাটাও ঠিক। ঈশ্বরের স্থানে অন্যকে পূজা করা মূর্খতা।
শ্রী শঙ্করাচার্য পরাপূজাতে লিখেছেন—
পূর্ণস্যাবাহনং কুত্র সর্বাধারস্য চাসনম্।
স্বচ্ছস্য পাদ্দ্যমর্ধ্য চ, শুদ্ধস্যাচমনং কুতঃ।।
সর্বব্যাপক এর আবাহন কিভাবে করা যেতে পারে? সর্বাধারকে বসানোর জন্য আসনের দরকার কি? নিত্য স্বচ্ছকে চরণ ধোয়ানোর জন্য পাদ্য, মুখ ধোয়ানোর জন্য অর্ঘ্য এবং নিত্য শুদ্ধকে আচমন করার জন্য জল কিভাবে দেওয়া যেতে পারে?
নির্মলস্য কুতঃ স্নানং বস্ত্রং বিশ্বোদররস্য চ।
অগোত্রস্য ত্ববর্ণস্য,কুতন্তস্যোপবীতম্।।
যিনি সদা নির্মল, তাঁর স্নানের কি প্রয়োজন? যার উদরে সম্পূর্ণ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সমাবিষ্ট হয়ে রয়েছে তাকে বস্ত্র কিভাবে পরাবে? যিনি গোত্র এবং বর্ণ রহিত তাকে পৈতা কেমন ভাবে ধারন করাবে?
নির্লেপস্য কুতো গন্ধং পুষ্পং নির্বাসনস্য চ।
নির্বিশেষস্য কা ভূষা কোলংকারো নিরাকৃতেঃ।।
নির্লেপের জন্য গন্ধ কোথায়? যে সুঁখতে পারে না এবং এই কারণেই তাঁর সুগন্ধির প্রতি কামনাও নেই, তিনি হাতে পুষ্প নিয়ে কী করবেন? যিনি নির্বিশেষ তাঁর বেশভুষা কেমন হবে?
নিরঞ্জনস্য কিং ধূপৈদীপৈর্বা সর্বসাক্ষিণঃ।
নিজানন্দৈকতৃপস্য নৈবেদ্যং কিং ভবেদিহ।।
যিনি নিরঞ্জন, তাঁর ধূপের কি দরকার? যিনি সবাইয়ের সাক্ষীদাতা, তাঁকে দেখার জন্য প্রদীপের প্রকাশের কি দরকার? যিনি চলেন স্বয়ং আনন্দস্বরূপ তিনি পূর্ণরূপে তৃপ্ত, তাঁকে নৈবিদ্যের অপেক্ষা কেন?
বিশ্বানন্দয়িতুস্তস্য কিং তাম্বুলং প্রকল্পয়তে।
স্বয়ং প্রকাশশ্চিদ্রুপো যোऽ সাবর্কাদিভাসকঃ।।
যিনি সমস্ত সংসারকে আনন্দ দেন, সে যদি পান খান তাহলে তাঁকে কতটা আনন্দ আসবে? যিনি স্বয়ং প্রকাশস্বরূপ এবং জ্ঞানস্বরূপ এবং সূর্য আদিকে প্রকাশ দেন, তাঁকে দেখার জন্য ভৌতিক সাধন থেকে প্রাপ্ত আলোকের কি দরকার?
চাণক্য মূর্তি পূজাকে মূর্খের জন্য বলেছেন—
অগ্নির্দেবা দ্বিজাতীনাং মুনীনাং হৃদি দৈবতম্।
প্রতিমা স্বল্পবুদ্ধিনাং সর্বত্র সমদর্শিনঃ।। চাণ্যকনীতি ৪/১৯
অগ্নিহোত্র করা দ্বিজদের কর্তব্য। মুনিরা হৃদয়ে পরমাত্মার উপাসনা করেন। অল্প বুদ্ধি লোকেরা মূর্তি পূজা করেন। বুদ্ধিমানের জন্য দেবতা সর্বত্রই আছেন।
মূর্তি পূজার পদ্ধতিটাই হলো ভূল। একটি নব যুবক হনুমান মন্দিরে যেতো। প্রতিদিন হনুমানজীর দন্ডায়মান হয়ে উঠতো এবং বসতো, প্রার্থনা করতো এবং বাড়ি ফিরে আসতো। এইভাবে 6 মাস হনুমানজীর পূজা করতে করতেই কেটে গেল। কিন্তু যুবকের মনের কামনা পূর্ণ হলো না। যুবকের উদাস মুখমন্ডলকে দেখে একদিন পূজারী জিজ্ঞেস করল, “কি হল তোমার? তোমার মুখমন্ডল প্রতিদিন ম্লান দেখায় কেন?” যুবক বললেন, “কি কারণে আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসে কিন্তু তা ভেঙে যায়?” আমি মন্দিরে এসে প্রতিদিন হনুমানজির কাছে প্রার্থনা করি, “কৃপা করে শীঘ্রই যেন আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়।” ইহা শুনে পূজারী বললেন, “তোমার পূজার বিধিটাই ভুল। আরে! ইনার তো নিজেরই বিবাহ হয়নি, তাহলে তোমার বিবাহ কিভাবে দিতে পারে?”
গুরু নানকের উপদেশ—
পান্থর লে পূজহি মুগধ গংবার।
ওহিজা আপি ডূবো তুম কহা তারনহার।।
সন্ত রৈদাসজী বলেছেন—
রাম ম্ঞে পূঁজা কহাঁ চঢ়াঊঁ, ফল অর ফুল অনুপ ন পাঊঁ।
থন হর দূধ জো বহরু ঝুটারী, পহুপ ভঁবর জল মীন বিগাড়ী।
মন হী পূজা মন হী ধূপ, মন হী সেঊঁ সহজ স্বরূপ।।
এক মহাত্মা বলেছেন—
পাথরকে যদি ভোগ লাগাও সে কি ভোজন খাবে রে।
অন্ধের সামনে যদি প্রদীপ জ্বালাও বৃথাই তেল খরচ হবে রে।।
দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশ এই মূর্তি পূজার খন্ডন করেছেন। এখানে বোম্বাইতে মূর্তি পূজা খন্ডনের উনার ব্যাখ্যান এর কিছু অংশ তুলে ধরলাম—
“মূর্তি জড়বস্তু, তাকে যদি ঈশ্বর মানো তাহলে ঈশ্বরকেও জড় মানা হচ্ছে। অথবা ঈশ্বরের সমান আরো একটি ঈশ্বরকে যদি মানো তাহলে পরমাত্মার পরমাত্মাপন থাকে না। এর দ্বারা ঈশ্বর অখন্ড সিদ্ধ হয় না। ভাবনায় ভগবান আছেন টা যদি বলো তাহলে আমি বলব কাষ্ঠ খন্ডে, ইক্ষু দন্ডে এবং ঠোঁটে মিছরির ভাবনা করলে কি মুখ মিষ্টি হয়ে যায়? মৃগ তৃষ্ণাতে জলের ভাবনা করে কিন্তু তার তৃষ্ণা মেটে না। বিশ্বাস, ভাবনা, কল্পনার সঙ্গে সত্য হওয়া/থাকা আবশ্যক।” দয়ানন্দ প্রকাশ
জগতের সুপ্রসিদ্ধ কবি স্বর্গীয় নাথুরাম শংকর একবার এক শিব মন্দিরের গিয়েছিলেন। সেখানে কিছু লোক বললেন আপনিও নিজের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পিত করুন। তখন তিনি নিম্ন শব্দে নিজের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করলেন—
শৌল বিশাল মহীতল ফাড়, বঢ়ে তিনকো তুম তোড় কঢ়ে হো।
লৈ লুঢ়কী জলধার ধড়াধড়, নে ধর গোল মটোল গঢ়ে হো।।
গুণবিহীন কলেবর ধার বিরাজ রহে, ন লিখে ন পঢ়ে হো।।
হে জড় দেব ! শিলাসুত শংকর ! ভারত পে করি কোপ চঢ়ে হো।।
এখানে এটা লিখে দেওয়া আবশ্যক যে শিবলিঙ্গ দেওয়া কোনো পদার্থ অগ্রাহ্য।
শিবপুরাণে বলা হয়েছে—
লিংগোপরি চ যদ্ দ্রব্যং তদগ্ৰাহ্যং মুনিশ্বরাঃ।
সুপবিত্রং চ তজ্জ্ঞেয়ং যল্লিংগস্পর্শবাহ্যতঃ।। শিবপুরাণ বিদ্দ্যেশ্বর সংহিতা ২২/২০
হে মুনিশ্বর! লিঙ্গে যে সমস্ত পদার্থ অর্পণ করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যে বস্তু শিব লিঙ্গে স্পর্শ হয়নি সেটাই পবিত্র।
এক উর্দু ভাষার কবি বলেছেন—
বুতপরস্তো কা হৈ দস্তুর নিরালা দেখো।
খুদ তরশা হৈ মগর নাম খুদা রখা হৈ।
আরোও একজন কবি বলেছেন—
সত্যি তো এটাই যে নিরাকার তো নিরাকারই এবং বুত(জড় বস্তু/প্রতিমা) বুতই।
ভাবুন নিজে নিজেই বুঝতে পারবেন কে কোথায়।।
প্রায় সকল গীতাতেই মূর্তি পূজার খন্ডন করা হয়েছে। বেশি বিস্তারিত না বলে এখানে কেবল একটি গীতার একটি শ্লোক লিখছি—
নাবাহনং নৈব বিসর্জনং বা পুষ্পাণি পত্রাণি কথং ভবন্তি।
ধ্যানানি মন্ত্রাণি কথং ভবন্তি সমাসমং চৈব শিবার্চনং চ।। অবদূত গীতা ৪/১
দত্তাত্রেয় বলেছেন- যখন ঈশ্বর সর্বব্যাপক তাহলে তাঁর আবাহন এবং বিসর্জন কিভাবে হতে পারে? যিনি শরীররহিত হওয়ায় ঘ্রাণেন্দ্রিয় আদি থেকে রহিত তাঁকে ফুল-পত্র সমর্পণ করা কিভাবে হতে পারে? যখন তাঁর আবাহন এবং বিসর্জন হতে পারেনা তাহলে তাঁর ধ্যান এবং মন্ত্র কিভাবে হতে পারে? প্রত্যেক প্রাণীতে এক আত্মার দর্শন বস্তুতঃ শিবপূজন।
গান্ধীজী মূর্তি পূজা নিষেধ করেছেন। তিনি লিখেছেন—
কিছু লোক সার্বজনীক স্থানে আমার মূর্তি দন্ডায়মান করতে চায়, কিছু ছবি চায় এবং জন্মদিনকে ছুটির দিন বানিয়ে দিতে চায়। মূর্তি চিত্র এবং এমন জিনিসের আজকের দিন নয়। যে একটা প্রশংসাকে আমি পছন্দ করব এবং মূল্যবান মনে করব সেটা হলো, সেই প্রবৃত্তিতে যোগ দেওয়া যাতে আমার জীবন লেগে আছে। সমস্ত স্ত্রী-পুরুষ যাঁরা সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন উৎপন্ন করা অথবা অস্পৃশ্যতা কলঙ্ক মেটাতে অথবা গ্রামের হিতসাধন করার কোনো না কোনো একটা কাজ করে তাঁরা আমাকে সত্যি কারের সুখ এবং শান্তি দেয়। গান্ধী অভিনন্দন গ্রন্থ পৃষ্ঠা ৭
আজ গান্ধীজীর পথের অনুগামীরা গান্ধীজীর আশাকে হত্যা করে চলেছে। গান্ধীজীর শিষ্য গান্ধীজির মূলনীতিতে আঘাত করে চলেছে। গান্ধীজী যেই কার্য গুলোকে নিষেধ করেছিল গান্ধীজীর অনুগামীরা এখন সেই কার্য গুলোই করে। এখন গান্ধীজির সঙ্গে নেহেরুজি, শাস্ত্রীজি, ইন্দিরাজির কবরকেও পূজা করা হয়। দেশে কোটি কোটি টাকা মূর্তি পূজার মাধ্যমে খরচ করা হচ্ছে।
শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, হনুমান জি এই সমস্ত মহাপুরুষদের মূর্তিকে ঈশ্বরাবতারের নামে পূজা করা হয়। এই সমস্ত মহাত্মারা পরমাত্মার উপাসনা, সন্ধ্যা, অগ্নিহোত্রাদি নিত্যকর্ম করতেন। তাহলে যারা স্বয়ং ঈশ্বর ভক্ত তাদেরকে পরমাত্মা মানা পাগলের মত কাজ নয় তো আর কি? মহাপুরুষ মানুষ ছিলেন ঈশ্বর ছিলেন না। না তাঁরা জীবনে এমন কোনো কার্য করেছিল যা মানবের পক্ষে সম্ভব নয় (সৃষ্টির রচনা, পালন, রক্ষা এবং প্রলয়)। কোনো মানুষই সে যত বড়ই হোক না কেন নিজের সীমিত কার্য ক্ষেত্রের বাইরে ঈশ্বরীয় রচনার ক্ষেত্রে কোনো কার্য করে দেখায়নি। যদিও তাঁরা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা মহামানব ছিলেন, জাতির পথ-প্রদর্শক ছিলেন এবং সেই রূপে তাঁদের সমাদর করা উচিত। সময় এলে সকলের মৃত্যুও হয়েছিল। আজ কেউ জানে না যে পবিত্র আত্মারা কোন যোনীতে কোথায় হবে অথবা জন্ম জন্মান্তরের তপস্যা স্বরূপ মোক্ষানন্দের উপভোগ করছে। তাঁদের মূর্তি পূজা করে তাঁদের নাম জপ করে কি লাভ হবে যখন তাঁদের ঠিকানাই কারোর জানা নেই। তাঁরা যখন নিজেরাই পরমেশ্বরের ভক্ত ছিলেন, তাহলে সকলকে ঈশ্বরের ভক্ত হতে হবে। ঈশ্বরের ভক্তের উপাসক হয়ে তাঁদের মূর্তিকে পূজা করা এবং তাঁদের নামের জপ করা ঠিক নয়। যেই পরমেশ্বরের উপাসনা করে তাঁরা নিজেদের কল্যান করেছিল, সেই পরমেশ্বর নিজের সকল ভক্তদের কল্যাণ করবেন।
এখানে আরও একটা বিচার্য কথা রাম,কৃষ্ণ, হনুমান শরীর ধারী মানুষ ছিলেন। দশরথের পুত্র ছিলেন রাম। জন্মের পরে কথা বলা, চালচলন ব্যবহার দেখে, পণ্ডিতেরা রামচন্দ্র নাম দিয়েছিলেন। বসুদেব এবং দেবকীর পুত্র ছিলেন কৃষ্ণ। অঞ্জনী এবং কেসরী ঋষির পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল হনুমান। জন্মের আগে এদের কোনো নাম ছিল না যখন শরীর এবং আত্মার সংযোগ হলো তখন নাম রাখা হয়েছিল। যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁদের সেই নামেই ডাকা হতো। মৃত্যুর পরে বলা হয় যে, এটা শব(মৃতদেহ) অমুক লোকের বা অমুক নারীর তথা অমুক ব্যক্তির আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। মৃত্যুর পরে এই ভাবে রাম এবং কৃষ্ণের মৃত শরীর ছিল তথা তাদের আত্মা শরীর ত্যাগ করে গিয়েছিল। রাম এবং কৃষ্ণ না তো শরীরে নাম ছিল না তাদের প্রবিষ্ট আত্মাদের নাম ছিল।
মৃত্যুর পর শরীর নষ্ট হয়ে গেছে তথা আত্মা শরীর ত্যাগ করে জানিনা কোথায় চলে গেছে এবং পুনর্জন্মের চক্রে কোথায় কোথায় ঘুরছে অথবা যদি মুক্তি পেয়ে গেছে তাহলেও এই পৃথিবীতে কোনো মোহ থাকবে না, কেননা মোহ বন্ধনের কারণ হয় তথা মুক্তিতে মমতা,মোহ থাকেনা। তাঁদের জন্ম এবং স্মরণে তাঁদের কোনো সত্তার সঙ্গে সম্বন্ধ থাকে না কেননা যে জীব শরীরের সংযুক্ত অবস্থার জন্য প্রযুক্ত ছিল, মৃত্যুর পরে সেই নাম ধারী সত্তা থাকে না।
এইভাবে এই সমস্ত ব্যক্তিদের মূর্তি তৈরি করে তাঁদের দর্শন এবং নাম জপ অথবা প্রার্থনা করলে কোনো ফল হবেনা। এই দৃষ্টি থেকে মূর্তি পূজা সর্বদা মিথ্যা কর্ম সিদ্ধ হয়। মহাপুরুষদের আদর্শ এবং গুনকে নিজের জীবনে প্রয়োগ এবং তার পালন করা, এটাই সর্বোত্তম তাঁদের প্রতি প্রেম বা ভক্তি প্রদর্শিত করানোর জন্য, তাঁদের চিত্র এবং মূর্তি পূজা উপাসনা করলে নয়।
ধর্মকে বিশ্বাসের উপর নির্ভর না করিয়ে যুক্তিসাপেক্ষ করাও। বিশ্বাস তো ইসলাম, খ্রিস্টান এবং মত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে হয়। বইতে যেটা লেখা আছে তাঁরা সেটাই বিশ্বাস করে নেয়, নিজবুদ্ধি দিয়ে বিচার করে না। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন “অজ্ঞানী হওয়া দোষের নয়, কিন্তু অজ্ঞানী হয়ে থাকা দোষ”। সনাতন ধর্মেও এরকম অনেক সম্প্রদায় আছে যাঁরা শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে, কখনোও যুক্তি তর্ক দিয়ে বিচার করে না, আমি সম্প্রদায়গুলোর নাম বলছিনা। সেই সম্প্রদায় শ্রী রামচন্দ্র এবং শ্রী কৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার মানে। তাঁদের উদ্দ্যেশ্য হলো যেকোনো ভাবে অবতারবাদ সিদ্ধ করা, সেটা ঠিক হোক আর না হোক। সনাতন ধর্মের অনেকেই শাস্ত্র কোনগুলো তা জানেনা। যে কারোর বইকেই শাস্ত্র হিসেবে মেনে নেয়। প্রশ্ন করলে তাঁরা বলে “তুমি নাস্তিক” এছাড়াও আরও অনেক কিছু বলে। তাঁরা এই বাক্যটি ব্যবহার করে “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর”। আমি বলি “বিশ্বাসে ঢাকা পড়ে যায় সত্য, তর্কে সত্য উদঘাটন।”
আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মূর্তিপূজারিদের উদ্দেশে বলেন, “যখন তোমরা বেদ-নিষিদ্ধ মূর্তিপূজা প্রভৃতি কাজ কর, তখন তোমরা পাপী হবে না কেন?”
তিনি আরো বলেন, “জড়পূজা দিয়ে মানুষের জ্ঞান কখনও বৃদ্ধি হতে পারেনা, বরং মূর্তিপূজা দিয়ে যে জ্ঞান আছে, তাও নষ্ট হয়ে যায়।” তিনি বলেন, “পাথর-মূর্তির পূজা দিয়ে কেউ কি কখনও পরমেশ্বরকে ধ্যানে আনতে পারে? না না।”
তিনি বলেন, “মূর্তিপূজা উপলক্ষ্যে মানুষ কোটি কোটি টাকা মন্দিরে ব্যয় করে দরিদ্র হয়ে পড়ে।”
স্বামী সরস্বতী বলেন, “দুষ্টবুদ্ধি পূজারীদেরকে যে ধন দেওয়া হয়, তা তারা বেশ্যা, পরস্ত্রীগমন, মদপান, মাংসাহার এবং কলহবিবাদে ব্যয় করে। তাতে দাতার সুখের মূল নষ্ট হয়ে দুঃখ সৃষ্টি করে।”
[মূর্তিপূজা সমীক্ষা, সত্যার্থ প্রকাশ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী; পৃষ্ঠা ২৩৮-২৪৬]
কণ্ঠি, তিলক মালা এবং মূর্তিপূজা প্রভৃতি পাষণ্ড মত
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ