জন্ম মৃত্যু ও মুক্তি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

18 February, 2021

জন্ম মৃত্যু ও মুক্তি

জন্ম মৃত্যু ও মুক্তি 

সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম যোবেদ নিহিতং গুরায়াং পরমেব্যোমন্।

সোহশ্নুতে সর্ব্বান্ কামান্ সহ ব্রহ্মণা বিপশ্চিতেতি।। 

তৈত্তিরী আনন্দবঃ।অনুঃ১।।

শরীর হইতে জীবাত্মা নির্গত হওয়ার নাম "মৃত্যু" এবং শরীরের সহিত সংযোগ হওয়ার নাম "জন্ম"। যখন শরীর ত্যাগ করে তখন যমালয়ে অর্থাৎ অর্থাৎ আকাশস্থ বায়ু মধ্যে অবস্থান করে। বেদে শব্দ এসেছে "যমেন বায়ুনা"; সুতরাং যম বায়ুর একটি নাম (গরুড় পুরাণের কল্পিত যম নয়)। তৎপশ্চাৎ ধর্ম্মরাজ অর্থাৎ পরমেশ্বর উক্ত জীবকে পাপ পুণ্যানুসারে জন্ম দেন। উহা বায়ু,অন্ন,জল অথবা শরীরের ছিদ্রদ্বারা ঈশ্বেরর প্রেরণা বশতঃ অপরের শরীরে প্রবিষ্ট হয় এবং প্রবিষ্ট হইয়া ক্রমশ বীর্য্যে গমন করে,গর্ভে অবস্থান করে এবং শরীর ধারণ করিয়া বহির্গত হয়। কর্ম্ম যদি স্ত্রীশরীর ধারণ করিবার যোগ্য হয় তবে স্ত্রী শরীরে ইত্যাদি নানা শরীরে প্রবেশ করে। জীব এইরূপ নানাবিধ জন্ম ও মরণে তাবৎকাল পর্য্যন্ত জন্ম ও মৃত্যুদুঃখ রহিত হইয়া সানন্দে অবস্থান করে। যে জীবাত্মা আপনার বুদ্ধিতে এবং আত্মাতে স্থিত সত্যজ্ঞান ও অনন্ত আনন্দস্বরূপ পরমাত্মাকে জানে সেই উক্ত ব্যাপকরূপ ব্রহ্মে স্থিত হইয়া উক্ত "বিপশ্চিৎ" অর্থাৎ অনন্ত বিদ্যাযুক্ত ব্রহ্মে স্থিত হইয়া সর্ব্ব কাম প্রাপ্ত হয় ! অর্থাৎ যে যে আনন্দ কামনা করে সেই সেই আনন্দ প্রাপ্ত হয় । জীব মুক্তির অবস্থায় পরমেশ্বর হইতে পৃথক থাকে, কারণ মিলিত হইলে কে মুক্তিসুখ ভোগ করিবে..? এবং মুক্তির যাবতীয় সাধন নিস্ফল হইয়া যাইবে। এসময় জীবের প্রলয় বুঝিতে হইবে। যে জীব পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন, উত্তম কর্ম্মানুষ্ঠান, সৎসঙ্গ যোগাভ্যাস এবং সাধন করে মুক্তিলাভ করে।

মোক্ষ ও পূণরাগমন
প্রথমে জানা আবশ্যক যে মোক্ষ বা মুক্তি কি? "মুঞ্চন্তি পৃথগভবন্তি জনা যস্যাং সা মুক্তিঃ" অর্থাৎ যাহা থেকে মুক্ত হওয়া তাহার নাম মুক্তি। এখন প্রশ্ন যে কি হতে মুক্ত হওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ন্যায় দর্শনে মহর্ষি গৌতম বলেছেন -
.
দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষমিথ্যাজ্ঞা
নানামুত্তরোত্তরাপায়ে তদন্তরাপায়াদপবর
্গঃ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২)
.
দুঃখ, জন্ম, প্রবৃত্তি, দোষ এবং মিথ্যাজ্ঞানের উত্তর উত্তরের নষ্ট হওয়ার পর তাহার অনন্তরের অব্যবহিত পূর্বের নাশ হওয়ার দ্বারা মোক্ষ হয়।
.
তদত্যন্তবিমোক্ষহপবর্গঃ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২২)
দুঃখের নিবৃত্তির = মুক্তির নাম অপবর্গ = মোক্ষ।।
.
উপনিষদে মোক্ষ বিষয়ে এইরূপ বলা হয়েছে -
.
যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তামাহু পরমাং গতিম্।।
(কঠ০ ২।৩।১০)
.
শব্দার্থঃ (যদা) যখন (পঞ্চ জ্ঞানানি) যোগাভ্যা দ্বারা নিজ নিজ বিষয় থেকে পৃথক হয়ে শ্রোত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়র (মনসা সহ) মনের সাথে (অবতিষ্ঠন্তে) পরমেশ্বরে স্থির হয়ে যায় (চ) এবং (বুদ্ধিঃ) মনের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি (ন, বিচেষ্টতে) জ্ঞানের বিরুদ্ধে চেষ্টা করে না (তাম্) তাহাকে (পরমাং গতিম্) সর্বোৎকৃষ্ট মোক্ষ - অবস্থা অথবা জীবনমুক্তিদশা (আহুঃ) জ্ঞানী যোগীপুরুষ বলে।।
.
অনেকের মতে বেদ মোক্ষ বিষয়ে কোনরূপ বর্ণনা করে নি। শুধুমাত্র বেদ স্বর্গ লোক প্রাপ্তি বিষয়েই বলেছে। অথচ বেদে মোক্ষ প্রাপ্তি সমন্ধ্যে পরিস্কারভাবে বর্ণনা এসেছে -
.
যত্রানন্দাশ্চ মোদাশ্চ মুদঃ প্রমুদ আসতে।
কামস্য যত্রাপ্তাঃ কামাস্তত্র মামমৃতং কৃধীন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
(ঋগবেদ ৯।১১৩।১১)
.
পদার্থঃ (যত্র) যেখানে (আনন্দাঃ) আনন্দ (চ) এবং (মোদাঃ) হর্ষ (মুদঃ চ, প্রমুদঃ) এবং যেখানে আনন্দিত তথা হর্ষিত মুক্ত পুরুষ (আসতে) বিরাজমান হয় (কামস্য, যত্র, আপ্তা, কামাঃ) এবং যেখানে কামনা কারীর সব কামনা প্রাপ্ত হয় (তত্র) সেখানে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষসুখের ভাগী (কৃধি) করো (ইন্দো) হে পরমাত্মন! আপনি (ইন্দ্রায়) জ্ঞানযোগীর জন্য (পরি, স্রব) পূর্ণাভিষেকের নিমিত্ত হও।।
.
ভাবার্থঃ হে ভগবান! যেই অবস্থায় আনন্দ তথা হর্ষ হয় এবং যেখানে সব কামনা পূর্ণ হয় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত করাও, পরমাত্মন! সেই মুক্তি অবস্থায় যেখানে আনন্দই আনন্দ প্রতীত হয় অন্য সব সেই সময় তুচ্ছ হয়ে যায় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত হও।
.
স নো বন্ধুর্নিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভূবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবাহঅমৃতমানশানাস্তৃতীয়ে ধামন্নধ্যৈরয়ন্ত।।
(যজুর্বেদ ৩২।১০)
.
পদার্থঃ হে মনুষ্য! (যত্র) যেই (তৃতীয়ে) জীব এবং প্রকৃতি থেকে বিলক্ষণ (ধামন্) আধাররূপ জগদীশ্বরে (অমৃতম্) মোক্ষ সুখ কে (আনশানাঃ) প্রাপ্ত হয়ে (দেবাঃ) বিদ্বান লোক (অধৈরয়ন্ত) সর্বত্র নিজ ইচ্ছাপূর্বক বিচরণ করেন, যিনি (বিশ্বা) সব (ভূবনানি) লোক - লোকান্তর এবং (ধামানি) জন্ম, স্থান, নাম কে (বেদ) জানেন, (সঃ) তিনি পরমাত্মা (নঃ) আমাদের (বন্ধুঃ) ভাইয়ের তুল্য মান্য সহায়ক (জনিতা) উৎপন্ন কারক, (সঃ) তিনিই (বিধাতা) সমস্ত পদার্থ এবং কর্মফলের বিধান কারক।।
.
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্টরূপে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষের বর্ননা রয়েছে। অমৃত শব্দের অর্থে মহিধর বলেছেন - "অমৃতং মোক্ষপ্রাপকং জ্ঞানং"। শ্রী শঙ্করাচার্য জী "অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম" অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। " পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব (মুন্ডক ৩।২।৬) পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে।
.
এখন প্রশ্ন এই যে, মোক্ষ প্রাপ্ত হয়ে জীব পুনরায় কখনো সংসারে পূনরাগমন করে কি না। কারণ উপনিষদ, গীতা আদি শাস্ত্রে বলা হয়েছে "সেখান হতে পুনরাগমন হয় না। যেমনঃ -
" ন চ পুনরাবর্ত্ততে ন চ পুনরাবর্ত্ততে ইতি " (শ্বেতাঃ ৮।১৫।১৫)
"যদ গত্বা ন নির্বত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।" (গীতাঃ ১৫।০৬)
.
ইহা সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয় একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত এই কথা সত্য। কারণ প্রথমত জীবের সামর্থ্য ও দেহাদির সাধন পরিমিত। সূতরাং ঐ সকলের ফল অনন্ত হতে পারে না। জীবের অসীম সামর্থ্য, কর্ম এবং সাধন নেই। এই কারণে জীব অনন্ত ফল ভোগ করতে পারে না। যাহাদের সাধন অনিত্য, তাহাদের ফল নিত্য হতে পারে না।আবার যদি কেউ মুক্তি হতে প্রত্যাবর্তন না করে তবে সংসারের উচ্ছেদ ঘটবে অর্থাৎ জীব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
.
বেদে স্পষ্টরূপেই বলা আছে ঈশ্বর মোক্ষপ্রাপ্ত জীবদের পৃথিবীতে পূনরায় প্রেরণ করেন-
.
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দাত পিতরং চ দৃশোয়ং মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।১)
.
পদার্থঃ আমরা (কস্য) কিভাবে গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (কতমস্য) কোন বহু (অমৃতানাম্) উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের (দেবস্য) প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে (চারু) সুন্দর (নাম) প্রসিদ্ধ নাম কে (মনামহে) জানিব যিনি (নূনম্) নিশ্চয় করে (কঃ) কোন সুখস্বরূপ দেব (নঃ) মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে (মহৈ) বিশাল কারণরূপ নাশরহিত (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পুনঃ) পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে (দৃশেয়ম্) দেখতে পারি।।
.
সরলার্থঃ আমরা কিরূপ গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত কোন বহু উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে সুন্দর প্রসিদ্ধ নাম কে জানিব যিনি নিশ্চয় করে কোন সুখস্বরূপ দেব মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে বিশাল কারণরূপ নাশরহিত পৃথিবীর মধ্যে পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে দেখতে পারি।।
.
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
.
পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।। ২।।
.
সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।। ২।।
.
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্ট যে, নিশ্চয় আমাদের তিনি মোক্ষপদবী কে পৌছানো জীবকেও মহাকল্পের অন্তে পূনরায় পিতা - মাতা এবং স্ত্রী আদির মধ্যে মনুষ্যজন্ম ধারণ করান। উপনিষদেও এই সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে -
.
বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থঃ সন্নাসযোগাদ্ যতয়ঃ শূদ্ধসত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমূচ্যন্তি সর্বে।।
(মুন্ডক ৩।২।৬)
.
শব্দার্থঃ (বেদান্তবিজ্ঞান
সূনিশ্চিতার্থাঃ) বেদান্তের পুস্তক দ্বারা উৎপন্ন হওয়া যে জ্ঞান অর্থাৎ উপনিষদ্ এবং বেদান্তের দর্শন দ্বারা যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা দ্বারা যে অর্থ কে নিশ্চয় করে নেয় (সন্ন্যাসযোগাত্) বৈরাগ্য দ্বারা অর্থাৎ প্রত্যেক সাংসারিক বস্তুতে দোষ জানার দ্বারা অথবা যোগাভ্যাস দ্বারা মন কে রুদ্ধ করার দ্বারা (যতয়ঃ) যিনি ইন্দ্রীয় কে বশ করে নেয়, ইহা দ্বারা (শুদ্ধসত্ত্বাঃ) বুদ্ধি কে সব প্রকার দোষ দ্বারা শুদ্ধ করে নেয় (তে) তিনি জ্ঞানী পুরুষ (ব্রহ্মলোকেষু) ব্রহ্মলোক অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শনে (পরান্তকালে) মহা কল্পের সীমা পর্যন্ত অথবা পরাবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া শুদ্ধ সুখের অন্ত কাল পর্যন্ত (পরামৃতাঃ) পরা বিদ্যা দ্বারা মুক্ত জীব (পরিমুচ্যন্তি) সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (সর্বে) সব।
.
মূলভাব- যে মনুষ্য বেদান্তের গ্রন্থ অর্থাৎ উপনিষদ এবং বেদান্ত সূত্র ইত্যাদির সূত্র এবং মন দ্বারা জীবাত্মা এবং পরমাত্মা এবং প্রকৃতির স্বরূপ কে নিশ্চয় করে ফেলে, তিনি জীবন্মুক্ত সন্যাস অর্থাৎ বৈরাগ্য দ্বারা সব বস্তুতে দোষ দেখে অথবা যোগ দ্বারা মন ঠিক করার দ্বারা অথবা প্রকৃতির ত্যাগ এবং পরমাত্মার যোগ দ্বারা মন শুদ্ধ করে, ইন্দ্রীয় কে বশকারী মহাত্মা, ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত প্রাপ্ত হয়ে অর্থাৎ দর্শ করে পরাবিদ্যার উৎপন্ন জ্ঞানের অন্ত পর্যন্ত পরাবিদ্যা দ্বারা প্রাপ্ত মুক্তি কে ভোগ করে এবং মহাকল্পের পশ্চাৎ পুণরায় সেই দশা থেকে মুক্ত হন।
.
মহাকল্পের গণনা এইরূপঃ---তেতাল্লিশ লক্ষ, বিংশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যুগী; দুই সহস্র চতুর্যুগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিংশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এইরূপ বারমাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এক "পরান্তকাল" হইয়া থাকে। ইহা গণিতের নিয়মানুসারে সম্যক রূপে বুঝে নিতে হবে।
.
এখন প্রশ্ন এই যে, যদি এরূপ হয় তবে মুক্তিও জন্ম মরণ সদৃশ। অতএব শ্রম করা বৃথা।
.
উত্তরঃ মুক্তি জন্ম মরণ সদৃশ নয়। কেননা ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্যন্ত জীবসমূহের মুক্তির আনন্দে থাকা এবং দুঃখ ভোগ না করা কি সামান্য কথা?

মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য পঞ্চক্লেশ দূর হওয়া আবশ্যক। নীম্নে তার বর্ণনা দেওয়া হলঃ

যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা।‘অবিদ্যা ক্ষেত্রমুক্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারানাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)
পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘অবিদ্যাস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃ ক্লেশাঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩)

অর্থাৎ : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম..এই পঞ্চক্লেশ যে বৃত্তিগুলির মধ্যে থাকে, তাদেরকেই বলা হয় ক্লিষ্টবৃত্তি। ক্লেশগুলি দুঃখদায়ক। এবং যোগমতে সব ক্লেশের মূলেই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা বর্তমান (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)।

#পাঁচ প্রকার ক্লেশ অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশঃ-
#অবিদ্যাঃ অনিত্য বস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুদ্ধিতে শুচি জ্ঞান, দুঃখে সুখ জ্ঞান, অনাত্মায় (জড় পদার্থে) আত্মজ্ঞান কে অবিদ্যা বলা হয়; অর্থাৎ যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা।‘অবিদ্যা ক্ষেত্রমুক্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারানাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)
অবিদ্যা নিজে ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশের প্রসবভূমি। অর্থাৎ : অবিদ্যা থেকেই অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ উৎপন্ন হয়। এগুলি সকল সময় একভাবে থেকে কখনো প্রসুপ্ত, কখনো সূক্ষ্ম, কখনো বিচ্ছিন্ন এবং কখনো বা উদারভাবে চিত্তে বিরাজিত থাকে।
#অস্মিতাঃ পুরুষ চেতন ভোক্তা আর বুদ্ধি অচেতন ভোগ্য এই উভয়ের অভেদ জ্ঞান কে অস্মিতা ক্লেশ বলা হয়। ‘দৃক্দর্শনশক্তিঃ একাত্মতৈব অস্মিতা।’- (যোগসূত্র : ২/৬)
অর্থাৎ : দৃক্শক্তি ও দর্শনশক্তি অভেদ নয়, তবু অভেদ বা একাত্মতার জ্ঞানই হলো অস্মিতা।পুরুষ বা আত্মা দৃক্শক্তি, বুদ্ধি দর্শনশক্তি। সুতরাং আত্মাকে বুদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করাই হলো অস্মিতা। অস্মিতা ক্লেশের ফলে প্রকৃতির গুণবশত যা ঘটে, অহঙ্কারের বশে নিঃসঙ্গ ও উদাসীন পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
#রাগঃ সুখ বা সুখের উপায়ে আসক্তি বা কামনাকে রাগ বলা হয়।
রাগের ব্যাখ্যায় যোগসূত্রে বলা হয়-
‘সুখানুশয়ী রাগঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৭) অর্থাৎ : সুখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো রাগ। পূর্বানুভূত সুখস্মৃতি অনুসারে সেইরূপ সুখভোগের পুনরেচ্ছাই রাগ। নির্লিপ্ত আত্মাকে অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের প্রতি আরোপ করে ইন্দ্রিয়সুখকেই আত্মার সুখ মনে করে লুব্ধ হওয়া এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া হলো রাগ। অস্মিতা থেকে উৎপন্ন হয় রাগ ক্লেশ। রাগকে তৃষ্ণাও বলা হয়।
#দ্বেষঃ দুখঃ বা দুঃখের করাণে যে ক্রোধ হয় তাকে দ্বেষ বলে, অজ্ঞানতাই দুঃখের কারণ।
‘দুঃখানুশয়ী দ্বেষঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৮)
অর্থাৎ : দুঃখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো দ্বেষ। অনুভূত দুঃখ স্মরণপূর্বক পুনর্বার আর তা ভোগ করতে হয়, এরূপ বীতরাগের সাথে তা নিবারণের যে আন্তরিক চেষ্টা, তারই নাম দ্বেষ। দ্বেষ হলো দুঃখের সাধনগুলির প্রতি প্রতিঘাত ও হননের ইচ্ছা এবং ক্রোধের অনুভূতি। এখানেও রাগের মতো অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার ভ্রান্ত একীকরণ এবং অকর্তা আত্মাকে কর্তাজ্ঞান করার জন্য এই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
#অভিনিবেশঃ পূর্ব পূর্ব জন্মের মরণদুঃখ অনুভব করে বিজ্ঞ বা অজ্ঞ লোকের যে মৃত্যুভয় হয় তাকেই বলা হয় অভিনিবেশ। পঞ্চম ক্লেশ অভিনিবেশ হলো একপ্রকার সহজাত ক্লেশ। অভিনিবেশ অর্থ মৃত্যুভয়। যোগসূত্রে অভিনিবেশের পরিচয় দিতে গিয়ে
যোগসূত্রকার বলেন-‘স্বরসবাহী বিদুষোহপি তথারূঢ়ো অভিনিবেশঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৯)
অর্থাৎ : অবিদ্বানের ন্যায় বিদ্বানেরও যে সহজাত ও প্রসিদ্ধক্লেশ, তাই অভিনিবেশ।
মরণের প্রতি আমাদের যে ভীতি তাকেই বলে অভিনিবেশ। চিত্তে দ্বেষ বদ্ধমূল থাকায় অভিনিবেশ নামক পঞ্চম ক্লেশ উৎপন্ন হয়। জগতে সকল প্রকার দুঃখের মধ্যে মৃত্যু-ভীতিজনক যে দুঃখ, তা-ই সব থেকে তীব্র। বার বার মরণদুঃখ ভোগ করায় চিত্তে একপ্রকার সংস্কার বা বাসনা বদ্ধমূল হয়। ঐ সংস্কারকে বলে স্বরস। এই স্বরসের জন্য জ্ঞানী ও অ-জ্ঞানী সকলেরই মরণের প্রতি একটি ভীতি জন্মায়। এই ভীতিহেতু মরণের প্রতি যে বিতৃষ্ণা-বৃত্তির উদয় হয়, তাকেই অভিনিবেশ বলে। বস্তুত জীবের ‘মরণ-অভিজ্ঞতা’ জীবনকালে হয় না। কিন্তু যোগমতে, জন্মান্তরের মরণ-অভিজ্ঞতার সংস্কার জীবের চিত্তে থাকে বলেই মরণ-দুঃখের প্রতি অভিনিবেশ ক্লেশ থাকে।
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ