শ্রীরাম হলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম। শুধু ভারত বর্ষ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে শ্রীরাম এক সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব । হাজার হাজার বৎসর ধরে ভারত ভূমি ছাড়াও সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে ( অখণ্ড ভারতের অংশ) তিনি পূজিত ও চর্চিত হচ্ছেন। তবুও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু তথাকথিত পন্ডিত শ্রীরামকে মনে করেন কাল্পনিক চরিত্র, কেউবা আবার শ্রী রামের চরিত্রে কালিমা লেপন-এর প্রচেষ্টায় উদ্যোগী। শ্রীরামের চরিত্রে কালিমা অন্বেষণ দেদীপ্যমান সূর্যের মধ্যে অন্ধকার অন্বেষণের মতই। তবুও অনেক মানুষ তাতেই প্রভাবিত হন কারণ বাল্মিকী রামায়ণ তাঁদের পড়া নেই। বিদ্যালয়, যেখানে শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়, সেখানেও রামকথা পাঠ করা বা ব্যাখ্যা করা হয় না, কারণ ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সেটা নাকি সাম্প্রদায়িক! অথচ সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসাতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা যেতে পারে ইসলামী শিক্ষা। অভিনব এই ধর্মনিরপেক্ষতা! যাইহোক শ্রী রামের যেসব কর্মকাণ্ড আধুনিক পণ্ডিতদের চোখে বিসদৃশ মনে হয় তার মধ্যে অন্যতম হল কিস্কিন্ধ্যা কাণ্ডে বর্ণিত বালী বধের ঘটনা ।এই নিবন্ধে তুলে ধরতে চেষ্টা করব বালি বধ-এর পটভূমি যাতে করে পাঠক নিজেই বিচার করতে পারেন এই কর্মকান্ডের ঔচিত্য ।
প্রায়ই দেখবেন অনেকেই বলে যে রামায়ণে শ্রী রাম নাকি নির্দোষ বালী কে লুকিয়ে থেকে মেরেছিল । এই কথার মাধ্যমে এরা বোঝাতে চায় যে শ্রীরাম বীর ছিলোনা ভীতু ছিল এবং এই কথা গুলো দ্বারা শ্রীরাম কে নানান ভাবে অপমান করা হয় , তাই আজ এই সমস্ত আবাল ব্যক্তিদের জন্য আমার এই লিখা । শ্রী রাম কখনোই বালী কে লুকিয়ে থেকে মারেনি এবং বালী কে কেন মেরেছিল তা জানুন রামায়ণ থেকে
বাল্মীকি রামায়ণ / কিষ্কিন্ধাকাণ্ড / সর্গ ১০
সুগ্রীব নিজে বালী কে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি হতে বলেন আর বালীর স্ত্রী তারা এই যুদ্ধ কে থামানোর চেষ্টা করেন , শ্রীরাম যে বালীর অপকর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন তা কিন্তু বালীর স্ত্রী তারা এবং বালী নিজেও জানতেন , বালীর স্ত্রী তারা শ্রীরামের সম্পর্কে বলছে দেখুন .…
কিষ্কিন্ধাকাণ্ড / সর্গ ১০সর্গ / ৪ , ১৬ এবং ১৭ শ্লোক , অর্থ :- শ্রীরাম যশ এর পাত্র , তিনি লৌকিক জ্ঞান ও শাস্ত্র জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ আর তিনি পিতার আজ্ঞা পালনকারী । পর্বতরাজ হিমালয় যেমন বিভিন্ন ধাতুর সংমিশ্রণ ঠিক এই প্রকারে শ্রীরামও গুণের মহাত্মা । তাই মহাত্মা শ্রীরামের বিরোধ করা তোমার উচিত নয় ।
এই শ্লোক গুলোতে থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে , শ্রীরাম যে বালীর বিরুদ্ধে ছিল তা বালী এবং তার স্ত্রী তারা আগের থেকেই ভালো করে জানতো যার কারণে বালীর স্ত্রী বালীকে উক্ত কথা গুলো বলে । তাহলে তো এর পরে কোনো প্রশ্নই আসেনা যে শ্রীরাম বালী কে পেছন থেকে লুকিয়ে থেকে মেরেছিল , কারণ লুকিয়ে থেকে মারা আর এই কথা টি পুরোই স্ববিরোধী । এইবার পরের শ্লোক গুলোতে আসুন ....
শ্রীরাম যখন বালী কে তীর মারেন তখন বালী শ্রীরাম কে প্রশ্ন করেন যে রাম কেন তার সাথে এমন অন্যায় করলেন ,সুগ্রীব কে প্রসন্ন করার জন্য শ্রীরাম তাকে অধর্ম পূর্বক মেরেছেন যা করা শ্রীরামের উচিত হয়নি ইত্যাদি অনেক কথা বলেন, এর উত্তরে শ্রীরাম কি বলে দেখুন ......
কিষ্কিন্ধাকাণ্ড / সর্গ ১৩ / শ্লোক ১০ , ১৪ এবং ১৫ , অর্থ :- শ্রীরাম বলেন তুমি ধর্মের হননকারী , তুমি কুকর্মে রত থাকো , তুমি শুধু মাত্র কাম এর দাস হয়ে রাজ ধর্মের উপেক্ষা করো। তুমি মানবীয় পরম্পরাগত ধর্ম কে ত্যাগ করে তুমি নিজের ছোটো ভাইয়ের ধর্মপত্নী কে পত্নী ভেবে উপভোগ করেছ , এই সমস্ত কুকর্মের জন্য আমি তোমায় প্রাণদণ্ড দিয়েছি । শ্রীরাম আরো বলেন যে - তোমার ভাই সুগ্রীব জীবিত হওয়া সত্ত্বেও তার পত্নী রুমা এর সাথে তুমি কাম আসক্ত হয়ে পাপ আচরণ করেছ , যে রুমা তোমার পুত্র বধূর মতো সম্মানীয় ।
অনেকেই বলে যে বালী নাকি নির্দোষ ছিল , এর পর তাদের কাছে বিষয় টি অবশ্যই পরিষ্কার যে শ্রীরাম কেন বালীকে বালী কে প্রাণ দণ্ড দিয়েছিল । এইবার পরের শ্লোক গুলোতে আসুন ....
উক্ত ১৩ সর্গ / ২০ , ২১ এবং ২২ শ্লোক .....
শ্রুয়েতে মনুনা গীতৌ শ্লোকৌ চারিত্রত্সলৌ।
গৃহীতৌ ধর্মকুশলৈসত্তথা চরিতং হরে । ।২০।।
অর্থ :- হে বানর ! এই বিষয়ে মহর্ষি মনু জীর শুভাচরণ প্রতিপাদক দুই শ্লোক শোনা যায় , এগুলোকে ধর্মজ্ঞ পুরুষগণ স্বীকার করে আর আমিও এগুলোকে যথাযথ মেনে চলি ।
এখন শ্রীরাম জী মনুস্মৃতির দুই শ্লোক বলেন ....
রাজভির্ধৃতদণ্ডাস্তু কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।
নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা ।।২১।।
অর্থ :- যে মনুষ্য পাপকর্ম করাই রাজা যদি যথাযথ দণ্ডিত করে । সে ব্যক্তি পাপ হতে মুক্ত হয়ে পুনরায় সুখ কে লাভ করে অর্থাৎ রাজার দেওয়া দণ্ড কে প্রায়শ্চিত্ত দোষ মুক্ত হয়ে সুখ কে প্রাপ্ত হয় । ( তা এই জন্মে অথবা পুনর্জন্মে অবশ্যই সুখ লাভ করবে )
শাসনাদ্বা বিমক্ষাদ্বা স্তেনঃ স্তেয়াদ্বিমুচ্যতে ।
রাজা ত্বশাসন্পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।২২।।
অর্থ :- যে চোর অথবা পাপী রাজার রাজার কাছে গিয়ে নিজের পাপকে স্বীকার করেন আর দণ্ড প্রাপ্ত হতে চান , রাজা চাইলে দণ্ড দিতে পারে অথবা ক্ষমা করে দিতে পারে , দুই অবস্থাতেই সেই পাপী পাপ মুক্ত হয়ে যায় কিন্তু পাপী কে যথাযথ দণ্ড না দেওয়ার কারণে রাজা স্বয়ং ওই পাপের ভাগীদার হয়ে যায় । কারণ রাজা যদি দোষী কে সাজা না দিয়ে তাকে মুক্ত করেন তাহলে সেই দোষী ব্যক্তি পুনরায় পাপ কর্মে লিপ্ত হবে তখন প্রজারা রাজাকেই অন্যায় কারী দোষী বলবে ।
রামায়ণ থেকে যে যে প্রমাণ গুলো দেওয়া হলো তার শ্লোক গুলো দেখে নেবেন রামায়ণ থেকে , এই লিং (রামায়ণ ভাষ্যকার পরমহংস জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী )
|
মনুস্মৃতি ১৫,২০,২১,২২ দেখুন |
|
| রামায়ণ ১০,১১,১২,১৩,১৪
|
|
শ্রী রাম যে বালীর কু কর্মের বিরূদ্ধে ছিল তা বালী ও তাঁর স্ত্রী তারা তা আগে থেকেই জানতেন। শ্লোক ১৩,১৭ দেখুন |
এই নিচের দুই শ্লোক অর্থাৎ ২১ ও ২২ শ্লোক মনুস্মৃতি তে স্পষ্ট ভাবে আছে । মনুস্মৃতি অষ্টম অধ্যায় / ৩১৬ এবং ৩১৮ শ্লোক দেখে নেবেন এই শ্লোক গুলো
|
রাম ধর্মের জন্য শ্রীরাম যে মহর্ষি মনুর লিখা মনুস্মৃতির দুটি শ্লোক বলেছিলেন
|
এই শ্লোক গুলোতে শ্রীরাম মহর্ষি মনু জীর মনুস্মৃতির দুই শ্লোক বলেন , এর থেকে স্পষ্ট ধারণা হয় যে শ্রীরামের সময়েও মনুজীর মনুস্মৃতি বিদ্যমান ছিল আর তখনও এই মনুস্মৃতি আমাদের আর এক সংবিধান ছিল যার দ্বারা সমস্ত ধরণের ধর্মাচরণ করা হতো । আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী রামায়ণ হয় ত্রেতা যুগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ বছর আগে ।
যে সমস্ত হিন্দুরা মনুস্মৃতি পড়ে মনুস্মৃতি কে গালি দেন তাদের এই বিষয় টি ভালো করে জেনে রাখা উচিত, প্রক্ষিপ্ত মনুস্মৃতি না পড়ে তাদের অবশ্যই উচিত প্রকৃত মনুস্মৃতি পড়া উচিত । যা শুধু মাত্র আছে আর্যসমাজের কাছে , এবং আর্যমুনি মনুস্মৃতি ভাষ্য, ডক্টর সুরেন্দ্র কুমার দুই টি মনুস্মৃতি ভাষ্য মেলে মনুস্মৃতি ভাষ্য ও বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ভাষ্য । ডক্টর সুরেন্দ্র কুমারের "মনুস্মৃতি " অবশ্যই পড়া উচিৎ যেখানে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে কোন কোন শ্লোক গুলোকে সুবিধাবাদী ভন্ড বামুন রা ঢুকিয়েছে ।
এর পর আর কোনো প্রশ্নই থাকতে পারেনা যে বালী কে কেন কীভাবে মারা হয়েছিল ।
নৃশংসমনৃশংসং বা প্রজারক্ষণ কারণাৎ / পাতকং বা সদোষং বা কর্তব্যং রক্ষতা সদা ।। / রাজ্যভারনিযুক্তানামেষ ধর্ম: সনাতন।” (বাল কান্ড/২৫/১৮-১৯)।
অর্থাৎ প্রজা রক্ষার নিমিত্তে নৃশংস, অনৃশংস, পাপ জনক বা দোষ যুক্ত সকল কর্মই করতে হবে। যাঁদের উপর রাজ্য চালনার ভার আছে, এটা তাঁদের সনাতন ধর্ম।
“তদেতৎ কারনং পশ্য যদর্থং ত্বং ময়াহত ।
ভ্রাতুর্বতসি ভার্যায়াং ত্ব্যত্ত্বা ধর্মং সনাতনম্ ” ।।
(কিষ্কিন্ধ্যা : ১৮: ১৮)
অর্থাৎ, বালী সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে কাম পরায়ণ হয়ে পুত্রবধূসম ভাতৃজায়া (সুগ্রীব পত্নী রুমা) কে গ্রহণ করেছেন। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী ভাইয়ের জীবদ্দশাতেই ভাতৃবধূ কে গ্রহণ করা অপরাধ। বালী
সুগ্রীব এর জীবদ্দশাতে রুমাকে গ্রহণ করে সেই অপরাধ করেছেন , যে অপরাধের উপযুক্ত দন্ড মৃত্যুদণ্ড । শ্রীরাম আরও বলেন যে রাজা ধর্ম রক্ষার্থে পাপীকে শাস্তি দেন। পাপী রাজদণ্ড ভোগ করলে তবেই নির্মল ও পূণ্যবান হন, অপরদিকে পাপীকে শাস্তি না দিলে রাজা পাপগ্রস্থ হন । অতএব ইক্ষ্বাকু (তিনি সমগ্র পৃথিবীর রাজা ছিলেন) বংশের প্রতিনিধি হিসাবে পাপাচারী বালীকে বধ করে তিনি সঠিক কাজ করেছেন।
✍বিক্রম আর্য
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ