জনমেজয় কহিলেন, হে বৈশম্পায়ন! আপনি দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষসদিগের জন্ম বৃত্তান্ত বিস্তার ক্রমে কীর্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন! প্রজাবিধাতা দক্ষ স্বয়ম্ভূ কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া যেরূপে ভূত নিচয়ের সৃষ্টি করিয়াছিলেন উহা আমি বর্ণন করিতেছি অবধান করুন। প্রভু প্রজাপতি দক্ষ প্রথমে ঋষি দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব, অসুর, রাক্ষস, যক্ষ, ভূত পিশাচ, পশু, পক্ষী ও মৃগ প্রভৃতিকে মানসে সৃষ্টি করিয়া যখন দেখিলেন মানসসৃষ্ট প্রজাবর্গ আর বৃদ্ধি পাইতেছে না, তখন ঐ ধর্ম্মাত্মা প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টির উৎকট বাসনা বশতঃ স্ত্রী পুরুষ সহযোগে বিবিধ প্রাণীর সৃষ্টি করাই শ্রেয়ঃ কল্প বলিয়া স্থির করিলেন। তখন তিনি বীরণ প্রজাপতির তপঃপরায়ণ লোকধারিণী অসিক্নী নাম্নী এক মহীয়সী কন্যাকে বিবাহ করিলেন। অনন্তর মহামতি দক্ষ ঐ অসিক্নীর গর্ভে পঞ্চ সহস্ৰ বীর্য্যবান পুত্র উৎপাদন করেন। এই মহাভাগ দক্ষ তনয়গণ সকলেই প্রজা বৃদ্ধি করিতে অভিলাষী হইয়াছেন দেখিয়া একদা প্রিয়ম্বদ নারদ তাহাদের সন্নিধানে আসিয়া যে সকল কথা কহিয়াছিলেন, তাহাতে উহাদিগের অনুদ্দেশ এবং আপনাকেও শাপগ্রস্ত অবশেষে বিনষ্ট হইতে হয়। পূর্ব্বে ব্রহ্মপরায়ণ লোকপিতামহ ব্রহ্মা কর্ত্তৃক মানসে নারদ সৃষ্ট হইয়াছিলেন। সেই দেবর্ষি নারদ হৰ্য্যশ্ব ও সবলাশ্ব প্রভৃতি দক্ষপুত্রগণকে বিবিধ উপদেশ ও শাস্ত্র প্রতিপাদ্য পরামর্শ প্রদান করিয়া একবারে নিরুদ্দেশ করিয়া দিয়াছেন জানিতে পারিয়া অমিত পরাক্রম দক্ষ রোষপরবশ হইয়া অভিসম্পাত দ্বারা নারদকে সংহার করিলেন। তৎকালে ব্রহ্মা মরীচি প্রভৃতি ব্ৰহ্মর্ষিগণকে অগ্রে করিয়া স্বয়ং দক্ষের নিকট আসিয়া স্বীয় পুত্রের পুনর্জীবন প্রার্থনা করেন। তদনন্তর দক্ষ অভিসন্ধি করিয়া কহিলেন, আমি এই স্বকীয় কন্যা অসিক্নীকে প্রদান করিতেছি, ইহার গর্ভেই নারদ পুনরায় জন্ম গ্রহণ করিবে; অতএব ইহাকে লইয়া কশ্যপকে প্রদান করুন। এই কথা বলিয়া ব্রহ্মার হস্তে কন্যাকে অর্পণ করিলেন। অভিসম্পাত ভয়ে মহর্ষি কশ্যপ কন্যা গ্রহণ করিলেন, এবং তাহার গর্ভে নারদকে পুনরায় উৎপাদন করিলেন। জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! মহর্ষি নারদ কি জন্য প্রজাপতির পুত্রগণকে নিরুদ্দেশ করিলেন, উহা আমি যথার্থতঃ শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি, আপনি উহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন্! একদা প্রজা বৃদ্ধি সমুৎসুক মহাবীর্য্য হৰ্য্যশ্ব প্রভৃতি দক্ষতনয়গণ দেবর্ষি নারদের সহিত সমবেত হইলে, নারদ কহিলেন, হে দক্ষত্মজগণ! হায় তোমরা কি মূর্খ। তোমরা কি এই পৃথিবীর পরিমাণের বিষয় কিছুই জান না! জানিলে কখনই প্রজা সৃষ্টির এত কামনা করিতে না। আচ্ছা বল দেখি, ইহার ঊর্দ্ধ, অধঃ ও মধ্যভাগে প্রজা সৃষ্টি কিরূপে করিবে। নারদের এই কথা শ্রবণ মাত্ৰ হৰ্য্যশ্বগণ পৃথিবার পরিমাণ জানিবার নিমিত্ত, চতুর্দ্দিকে প্রস্থান করিল। যেমন তটিনী কুল সমুদ্র উদ্দেশে গমন করিলে আর প্রত্যাবৃত্ত হয় না, ইহারাও তদ্রূপ অদ্যাপি প্রতিনিবৃত্ত হইল না। হৰ্য্যশ্বগণ এই রূপে প্রস্থান করিলে সৃষ্টিপরায়ণ প্রজাপতি দক্ষ বীরণ তনয়ার গর্ভে পুনরায় সহস্র পুত্রের সৃষ্টি করিলেন। ইহাদের নাম সবলাশ্ব। সবলাশ্বগণ প্রজা বৃদ্ধি করিতে সমুৎসুক হইলে মহর্ষি নারদ মুখে পূৰ্ব্ববৎ উপদিষ্ট ও তিরস্কৃত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিল, দেবর্ষি নারদ যাহা কহিলেন, তাহাই সত্য, আমরা পৃথিবীর পরিমাণ কিছুমাত্র জানি না। অতএব পূর্ব্বতন ভ্রাতৃগণের পদবী অনুসরণ করাই আমাদের কর্ত্তব্য হইতেছে, ইহাতে আর সংশয় মাত্র নাই। পৃথিবীর পরিমাণ জানিতে পারিলে আমরা তখন সুখস্বচ্ছন্দে প্রজা সৃষ্টি করিতে পারিব। এই কথা বলিয়া ইহারও পূর্ব্ব ভ্রাতৃগণের ন্যায় তত্তৎপথাবলম্বী হইয়া কৌতুহল পূর্ণ সুস্থ হৃদয়ে ইতস্ততঃ প্রস্থান করিলেন। অদ্যাপি প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। এইরূপে সবলাশ্বগণ পলায়ন করিলে বিভু প্রজাপতি দক্ষ নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া নারদকে অভিসম্পাত করিলেন। কহিলেন, নারদ! তুমি এখনই বিনষ্ট হও এবং গর্ভবাস যন্ত্রণা পুনরায় আশ্রয় কর। হে রাজন্! তদবধি অনুদ্দিষ্ট ভাতৃগণের অন্বেষণে অন্য ভ্রাতারা গমন করিলে প্রায়ই সত্বর বিনষ্ট হয় অতএব পণ্ডিতগণ ঈদৃশ কাৰ্য্যে কখন প্রবৃত্ত হইবেন না। আমি শুনিয়াছি অতঃপর এই সমুদায় পুত্র নিরুদ্দেশ হইয়াছে জানিয়া প্রজাপতি দক্ষ স্বকীয় ধর্ম্মপত্নী বীরণ তনয়াতে ষষ্টিসংখ্যক কন্যার সৃষ্টি করিলেন। তখন এই সকল কন্যাকে কশ্যপ, সোমদেব, ধৰ্ম্ম এবং অন্যান্য মহর্ষিবর্গ ভার্য্যাৰ্থ প্ৰতিগ্ৰহ করিলেন। ধর্ম্মকে দশ, কশ্যপকে ত্রয়োদশ, সোমকে সপ্তবিংশতি, অরিষ্টনেমীকে চারি, বসুপুত্রকে দুই, অঙ্গিরা ও বিদ্বান কৃশাশ্বকেও দুই দুইটী করিয়া কন্যা দান করিলেন। ইহাদিগের নাম সমুদায় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। অরুন্ধতী, বসু, যামী, লম্বা, ভানু মরুত্বতী, সঙ্কল্পা, মুহুর্ত্তা, সাধ্যা ও বিশ্বা এই দশটা ধৰ্ম্মের ধর্ম্মপত্নী। এই সকল ধৰ্ম্মপত্নীতে যে সমুদায় অপত্য জন্মিয়াছিল, তাহাদের নামও যথাক্রমে বলিতেছি অবধান করুন। বিশ্বা হইতে বিশ্বদেবগণ, সাধ্যা হইতে সাধ্যগণ, মরুত্বতী হইতে মরুত্বৎগণ, বসু হইতে বসুগণ, ভানু হইতে ভানু, মুহূর্ত্তা হইতে মুহূর্ত্তগণ, লম্বা হইতে ঘোষ, যামী হইতে নাগবীথী, অরুন্ধতী হইতে পার্থিব পদার্থ সকল, সঙ্কল্পা হইতে সর্ব্বাত্ম রূপ সঙ্কল্প এবং যামিনী নাগবীথী হইতে বৃষল সমুদ্ভূত হন। হে রাজন্! ভগবান্ দক্ষ সোম দেবকে যে সকল কন্যা প্রদান করেন, তৎসমুদায় জ্যোতিঃপ্রদ নক্ষত্র নামে অভিহিত হইয়াছে। তদ্ভিন্ন যে সকল খ্যাতিমান্ দেবগণ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর পুরোবর্ত্তী হইয়া বাস করিতেছেন, উহারা অষ্টবসু নামে প্রখ্যাত হইয়া থাকেন। তাঁহাদের নামগুলি বিস্তারক্রমে বলিতেছি। প্রথমে আপ, অনন্তর ধ্রুব, সোম, ধর, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভাস। তন্মধ্যে আপের পুত্র বৈতণ্ড্য, শ্রম, শান্ত ও মুনি। লোকপ্রনাশন কাল ধ্রুবের পুত্র। সোমের পুত্র বর্চ্চা, যদ্দ্বারা উহার পিতা বর্চ্চস্বী নামে কীৰ্ত্তিত হইয়াছেন। ধরের পুত্র দ্রবিণ ও হুতহব্যবাহ এবং মনোহরার গর্ভে শিশির প্রাণ ও রমণ জন্মিয়াছেন। অনিলভাৰ্য্যা শিবার গর্ভে মনোজব ও অবিজ্ঞাতগতি এই দুই পুত্র উৎপন্ন হয়। অগ্নিপুত্র কুমার শরবনে জন্মিয়া শরীর কান্তিতে বন আলোকময় করিতেছিলেন, তদ্দর্শনে কৃত্তিকাগণ ইহাকে পুত্রনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করেন, তন্নিমিত্ত কুমার কার্ত্তিকেয় নামে বিশ্রুত হন। অনন্তর শাখ, বিশাখ ও নৈগমেয় এই তিনটীর জন্ম হয় সুতরাং ইহার কুমারের অনুজ। স্কন্দ ও সনৎকুমার ইহারা উভয়ে অগ্নির চতুর্থাংশে জন্ম পরিগ্রহ করেন। দেবল ঋষি প্রত্যুষের পুত্র। মহর্ষি দেবলের দুই পুত্র জন্মে। ইহারা ক্ষমাবান্ ও উদারচেতা ছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির যোগসিদ্ধা নামে এক ভগিনী ছিলেন। তিনি ব্রহ্মচারিণী অনাসক্ত হইয়া সমস্ত জগৎ বিচরণ করেন। অষ্টম বসু প্রভাস, ইহাকে ভাৰ্য্যাত্বে পরিগ্রহ করিলে মহাবাহু প্রজাপতি বিশ্বকর্ম্মা ইহা হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছিলেন। এই মহাত্মা হইতে জগতে সহস্র সহস্র শিল্পকাৰ্য্যের অবতারণা হইয়াছে। ইহা হইতেই সমস্ত জগতের স্পৃহণীয় ভূষণ সকল সৃষ্ট হইয়াছে। ইনি যাবতীয় অমরবৃন্দের অতি বিচিত্র অদ্ভুত কারুকার্য্য সংশ্লিষ্ট রমণীয় বিমান সমুদায় নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছেন। ইনি সর্ব্বশিল্পীর অগ্রগণ্য এবং ইহার প্রসাদই মানব কুলের উপজীব্য হইয়া উঠিয়াছে। সুরভি তপঃপ্রভাবে মহাদেবকে প্রীত করিয়া কশ্যপ হইতে একাদশ রুদ্রকে পুত্র রূপে লাভ করেন। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! এই পুরাণ প্রসিদ্ধ রুদ্রগণ ত্রিভুবনে অধীশ্বর হইয়া অসংখ্যভাবে নিখিল চরাচর ব্যাপিয়া রহিয়াছেন। ইহাদের নাম অজৈকপাদ অহির্ব্রধ্ন, হর, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, অপরাজিত, বৃষাকপি, শম্ভু, কপর্দ্দী, রৈবত ও কপালী। হে ভরত শার্দ্দুল! এক্ষণে কশ্যপলোক বর্ণন করিব মনোনিবেশ করুন। রাজন্! কশ্যপের কতকগুলি সত্যব্রতা পত্নী ছিলেন। ইহাদের দ্বারাই লোকত্রয় রক্ষা হয়। অদিতি, দিতি, দনু, অরিষ্টা, সুরসা, খশা, বিনতা, তাম্রা, ক্রোধ, বশা, ইরা, কদ্রু ও মুনি ইহারাই মহর্ষি কশ্যপভাৰ্য্যা। পূর্ব্বকালে চাক্ষুষ মন্বন্তরে তূষিত নামে যে সুরাগ্রগণ্য দ্বাদশ দেবতা ছিলেন, বৈবস্বত মন্বন্তর উপস্থিত হইলে তাঁহারা লোকহিতার্থ সমবেত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, হে দেবগণ! আইস আমরা শীঘ্র অদিতিগর্ভে প্রবেশ করিয়া বর্ত্তমান মন্বন্তরে প্রসূত হই, তাহা হইলেই আমাদের শ্রেয়ো লাভ হইবে। বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভারত! দেবগণ এই কথা বলিয়া এবং ঐ রূপ স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া মরীচি তনয় কশ্যপের ঔরসে দক্ষ দুহিতা অদিতির গর্ভে পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ করিলেন। ইঁহারাই বিষ্ণু, শত্রু, অর্য্যমা, ধাতা, পূষা, বিবস্বান্, সবিতা, মিত্র, বরুণ, অংশ ও ভগ নামে দ্বাদশ আদিত্য বলিয়া অভিহিত হইলেন। যে সমস্ত দেবতা চাক্ষুষ মন্বন্তরে, তূষিত নামে অভিহিত হইতেন তাঁহারাই এখন বৈবস্বত মন্বন্তরে দ্বাদশ আদিত্য নামে আবিভূত ও প্রখ্যাত হইলেন। সোমদেবের যে সপ্ত বিংশতি পত্নীর কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে এক্ষণে তাহাদের উদরেও মহাপ্রভাবশালী অনেকগুলি পুত্র জন্মিল। অরিষ্ট নেমির পত্নীদিগের গর্ভে যোড়শ পুত্র উৎপন্ন হইল। বহুপুত্রের যে চারি পুত্র হইল তাহাদের নাম বজ্র, মেঘ, ইন্দ্রধনু ও বিদ্যুত। ব্ৰহ্মর্ষি সৎকৃত ঋক্ সকল প্রত্যঙ্গিরা হইতে সৃষ্ট হইল। দেবাস্ত্র সকল, ক্বশাশ্ব দেবর্ষির সন্ততি। এই সমস্ত দেবগণই যুগ সহস্রান্তে পুনর্ব্বার জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন। তন্মধ্যে বসু প্রভৃতি ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতা কামজ বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকেন। সুতরাং দেবগণকেও জন্ম ও মরণ এই উভয় ধর্ম্মাবচ্ছিন্ন বলিতে হইবে। সকল ভুবন প্রকাশক ভগবান্ মরীচিমালী দিবাকর যেমন গগনাঙ্গণে একবার উদিত হইয়া আবার অস্তমিত হন, দেবলোকেরও সেইরূপ যুগে যুগে.
আবির্ভাব ও তিরোভাব হইয়া থাকে। আমি শুনিয়াছি, কশ্যপপত্নী দিতির গর্ভে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামক দুই পুত্র এবং সিংহিকা নাম্নী এক কন্যার জন্ম হয়। এই সিংহিকা বিপ্রচিত্তির সহধর্ম্মিণী হইলেন। সিংহিকার গর্ভে যে সকল মহাবল পরাক্রান্ত পুত্র জন্মে, তাহাদের নাম সৈংহিকেয়। ইহাদের যে কত শত শত বা সহস্র সহস্র পুত্র পৌত্র উৎপন্ন হয়, তাহার ইয়ত্তা করা দুষ্কর। হে মহাবাহো! এক্ষণে হিরণ্যকশিপুর বংশ পরম্পরা শ্রবণ করুন্। হিরণ্যকশিপুর অনুহ্রাদ, হ্রদ, প্রহ্রাদ ও সংহ্রাদ নামে বীৰ্য্যবান্ চারি পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে হ্রাদের পুত্র হ্রদ, হ্রদের পুত্র আয়ু, শিবি ও কাল। প্রহ্রাদের পুত্র বিরোচন, বিরোচন হইতে বলি উৎপন্ন হইয়া ছিলেন। এই বলির ধৃতরাষ্ট্র, সূৰ্য্য, চন্দ্রমা, চন্দ্ৰতাপন, কুম্ভনাভ, গর্দ্দভাক্ষ ও কুক্ষি প্রভৃতি একশত পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ বাণ অত্যন্ত বলশালী এবং দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় পাত্র। পূর্ব্বকালে এই বাণ তপশ্চৰ্য্যা দ্বারা ভগবান ভবানীপতি শঙ্করকে প্রসন্ন করিয়া ‘আমি আপনার পার্শ্বদেশে বিচরণ করিব’ এই রূপ বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন। হিরণ্যাক্ষের বিদ্বান এবং মহাবলশালী পাঁচ পুত্র হয়। ইহাদের নাম ঝর্ঝর, শুকুনি, ভূতসস্তাপন, মহানাভ ও কালনাভ। দনুরও একশত পুত্র জন্মে। ইহারা সকলেই তীব্র বিক্রমশালী, তপস্যানিরত অথচ বিলক্ষণ বীৰ্য্যাতিশয় সম্পন্ন ছিলেন। তাহাদের মধ্যে প্রধান প্রধান তনয়ের নাম নির্দ্দেশ করিতেছি অবধান করুন। দ্বিমুৰ্দ্ধা, শকুনি, শঙ্কু শিরাঃ, শকুকর্ণ, বিরাধ, গবেষ্ঠী, দুন্দুভি, অয়োমুখ, শম্বর, কপিল, বামন, মরীচি, মঘবান, ইরা, গর্গশিরাঃ, বৃক, বিক্ষোভণ, কেতু, কেতুবীৰ্য্য, শতহ্রদ, ইন্দ্রজিৎ, সর্ব্বজিৎ, বজ্রনাভ, বিক্রান্ত, মহানাভ, কালনাভ, একচক্র, মহাবাহু, মহাবল তারক, বৈশ্বানর, পুলোমা, বিদ্রাবণ, মহাশিরা স্বর্ভানু, বৃষপর্ব্বা, মহাসুর তুহুগু, সূক্ষ্ম, নিচন্দ্র, ঊর্ণনাভ, মহাগিরি, অসিলোম, কেশী, শঠ, বলক, মদ, গগনমূৰ্দ্ধা, মহাসুর কুম্ভনাভ, প্রমদ, ময়, কুপথ, বীৰ্য্যশালী হয়গ্রীব, বৈসৃপ, বিরূপাক্ষ, সুপথ, হর, অহর, হিরণ্যকশিপু, শতমায়, শম্বর, শরভ, শলভ এবং বিপ্রচিত্তি। এই দনুর পুত্রগণ সকলেই কশ্যপবংশসম্ভূত। বিপ্রচিত্তি প্রভৃতি মহাবল পরাক্রান্ত যে সকল দানবকুলের নাম নির্দ্দিষ্ট হইল, হে নরাধিপ! ইহাদের পুত্র পৌত্রাদি অনন্ত, সুতরাং উহাদের সংখ্যার ইয়ত্তা করা আমাদের শক্তি-সাধ্য নহে। স্বর্ভানুর কন্যা প্রভা, শচী, উপদানবী হয়শিরাঃ, শর্ম্মিষ্ঠা ও বার্ষপর্ব্বণী, এই কয়েকটী পুলোমার দুহিতা। পুলোমা ও কালকা এই দুইটা আবার বৈশ্বানর তনয়া এবং উভয়েই বহুপুত্র। মহাপ্রভাবশালিনী কশ্যপভাৰ্য্যা। মহর্ষি কশ্যপ ঐ উভয়ের গর্ভে এক ষষ্টি সহস্ৰ চারি শত পুত্র উৎপাদন করেন। ইহারা অতি কঠোর তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মার বর প্রসাদে হিরণ্যপুরবাসী হইয়া দেবগণের অজেয় ও অবধ্য হইয়া উঠিয়াছিল। অবশেষে ইহার সব্যসাচী অর্জ্জুন কর্ত্তৃক সমরক্ষেত্রে নিহত হয়। প্রভার পুত্র নহুষ, শচীর পুত্র সঞ্জয়, শর্ম্মিষ্ঠার পুত্ৰ পূরু এবং উপদানবীর গর্ভে দুষ্মন্ত নামা এক পুত্র উৎপন্ন হয়। অতঃপর আর কতকগুলি অতি দুর্দ্ধর্ষ মহাবীৰ্য্য দানব জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। ইহার বিপ্রচিত্তি হইতে সিংহিকার গর্ভে উৎপন্ন হয়। দৈত্য দানব সংসর্গে ঐ সৈংহিকেয়দিগের উৎপত্তি হয় বলিয়া উহাদিগের পরাক্রম অতীব তীব্রতর এবং বলও অপরিমেয় হইয়া উঠিল। ইহাদের নাম ব্যংশ, শল্য, বলশালী নভ, বাতাপি, নমুচি, ইল্বল, খসৃম, আঞ্জিক, নরক, কালনাভ, রাহু, শুক, পোতরণ ও বজ্রনাভ। (এই রাহু সকলের জেষ্ঠ এবং চন্দ্র সূর্য্যের প্রমর্দ্দন কারী) মূক ও ভূহুণ্ড নামে হ্রদের দুই পুত্র হয়। সুন্দ পুত্র মারীচ তাড়কার গর্ভসম্ভূত। এই সুরসদৃশ বীর্য্যশালী দনুজ কুল বিবর্দ্ধন দানবগণের পুত্র পৌত্র যে কত হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা কর দুষ্কর। অতি দীর্ঘকাল দুশ্চর তপশ্চৰ্য্যায় আসক্ত থাকিয়া সংহ্রাদ নামা দৈত্য, স্বীয় বংশে নিবাত কবচগণকে পুত্র লাভ করিল। মণিমতী নগরীতে ইহাদের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল। ইহাদের তিন কোটি সন্তান জন্মে। ঐ সমুদায় দৈত্য তপোমহিমায় দেবগণের অবধ্য হইয়া উঠিলেও কালের অখণ্ড্য নিয়মে অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধারী অর্জ্জুন হস্তে উহাদিগকে জীবন বিসর্জ্জন করিতে হইয়াছিল। তাম্ৰার গর্ভে কাকী, শ্যেনী, ভাসী, সুগ্রীবী, শুচি, গৃধ্রিকা ও উলূকী এই কএকটী কন্যার জন্ম হয়। তম্মধ্যে কাকীর গর্ভে কাক, উলূকী হইতে উলূক, শ্যেনীর উদরে শ্যেন, ভাসী হইতে ভাস, গৃধ্রিকার গর্ভে গৃধ্র, শুচির গর্ভ জলচর, পক্ষিগণ এবং সুগ্রীবী হইতে অশ্ব, উষ্ট্র ও গর্দ্দভ উৎপন্ন হয়। ইহাদিগকে তাম্রাবংশ বলে। বিনতার অরুণ ও গরুড় নামে দুই পুত্র জন্মে। গরুড় স্বীয় ক্ষমতাবলে বিহগকুলের অধৃষ্যতা ও প্রাধান্য লাভ করিলেন। সুরমার গর্ভে প্রভূত বীৰ্য্যশালী বহুশীর্ষ গগনবিহারী উদ্যমশীল এক সহস্র সর্প জন্ম গ্রহণ করিল। এই সময়ে কদ্রুর গর্ভেও অনেক মস্তক অমিতবিক্রম সহস্র নাগ সন্ততি জন্মলাভ করিল। কিন্তু ইহারা সকলেই গরুড়ের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল। তন্মধ্যে অনন্তদেব, বাসুকি, তক্ষক, ঐরাবত, মহাপদ্ম, কম্বল, অশ্বতর, এলাপত্র, শঙ্খ, কর্কোটক, ধনঞ্জয়, মহানীল, মহাকর্ণ, ধৃতরাষ্ট্র, বলাহক, কুহর, পুষ্পদংষ্ট্র, দুৰ্ম্মখ, সুমুখ, শঙ্খ, শঙ্খপাল, কপিল, বামন, নহুষ, শঙ্খরোমা ও মণি প্রভৃতি কতকগুলি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। ইহাদের যে চতুর্দ্দশ সহস্র সন্তান সন্ততি জন্মে, তৎসমুদায়ই ভুজঙ্গভুক্ ক্রূবকর্ম্মা গরুড় কর্ত্তৃক নিহত হয়। এই নিমিত্তই দংষ্ট্ৰীকুল ক্রোধপরবশ খল প্রকৃতি হইয়া উঠিল। স্থলচর ও জলচর পক্ষি মাত্রেই ধরার সন্ততি। সুরভি হইতে গো এবং মহিষকুল উৎপন্ন হয়। বৃক্ষ, লতা ও তৃণজাতীয় উদ্ভিদ পদার্থ সমুদায় ইরা হইতে উদ্ভূত হইয়া ধরাতলের সর্ব্বতঃ প্রসারিত হইল। যক্ষ রাক্ষস সিদ্ধ ও অপ্সরাগণ খশা হইতে এবং মহাসত্ব দৃপ্ত বিক্রম গন্ধৰ্ব্বগণ অরিষ্টা হইতে আবির্ভূত হইল। অতএব হে মহারাজ! এই পৃথিবীতে স্থাবর জঙ্গমাত্মক যে কিছু পরিদৃশ্যমান পদার্থ সৃষ্ট হইয়াছে প্রায়শঃ তৎসমুদায়ের বীজ পুরুষ মহর্ষি কশ্যপ। অতঃপর ঐ সমুদায় সৃষ্ট পদার্থের বংশ পরম্পরা যে কত বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। রাজন্! আমি যে সকল সৃষ্টি বিবরণ কীৰ্ত্তন করিলাম এ সমস্তই স্বারোচিষ মন্বন্তরীয়। অনন্তর বৈবস্বত মন্বন্তরে দীর্ঘকালসাধ্য মহা সমৃদ্ধ বরুণ যজ্ঞে ব্ৰহ্মা স্বয়ং হোতৃ কর্ম্মে ব্ৰতী হইয়া যে সমুদায় প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন এক্ষণে তাহাই বিশেষ রূপে বর্ণন করিব, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বকালে ব্রহ্মার মানস হইতে সপ্ত ব্ৰহ্মর্ষি সমুৎপন্ন হইলে, লোক পিতামহ ব্রহ্মা উহাদিগকে পুত্রত্বে পরিগ্রহ করিলেন। অনন্তর দেব দানবগণের মধ্যে পরস্পর বিরোধ সংঘটিত হইলে দিতি তনয়েরা নিহত হইল। তখন বিনষ্ট পুত্র দিতি নিতান্ত শোকাকুল হইয়া শুশ্রূষা দ্বারা মহর্ষি কশ্যপের প্রসাদ প্রার্থিনী হইলেন। তখন মহাতপা কশ্যপ প্রীত হইয়া বর প্রদানে উদ্যত হইলে দিতি কহিলেন, ভগবন্! যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন তবে আমি ইহাই প্রার্থনা করি যে, আমার গর্ভপ্রসূত পুত্র যেন ইন্দ্রকে সংহার করিতে সমর্থ হয়। মহামুনি কশ্যপ “তথাস্তু” বলিয়া স্বীকার করিলেন। অতঃপর শান্ত ভাবে কহিলেন, দেবি! যদি তুমি শুচিব্রত হইয়া শত বৎসর গর্ভ ধারণ করতে পার, তাহা হইলে ঐ গর্ভজাত পুত্র অবশ্যই ইন্দ্রহন্তা হইবে সংশয় নাই। দিতি “যথাজ্ঞা” বলিয়া তদীয় আজ্ঞা স্বীকার করিলেন। হে বসুধাধিপ! অনন্তর দিতি সতত পবিত্র হইয়া অবস্থান করিলে মহা মুনি কশ্যপ সর্ব্বদেব শ্রেষ্ঠ এবং অমরগণের অবধ্য পুত্র কামনা করিয়া তাহার গর্ভাধান সমান পূর্ব্বক দুশ্চর তপশ্চরণার্থ এক পর্ব্বতে গমন করিলেন। এই সকল বৃত্তান্ত অবগত হইয়া দেবরাজ ইন্দ্র ও দিতির শুদ্ধাচারবিরোধী ছিদ্র অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। একোনশত বৎসর অতীত হইলে একদা দিতি ভ্রান্তি বশতঃ পাদপ্রক্ষালন না করিয়া শয়নমন্দিরে প্রবেশ পূৰ্ব্বক নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। ইন্দ্র সুযোগ পাইয়া সশস্ত্র গর্ভ মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক বজ্রাস্ত্র দ্বারা কুক্ষিস্থ শিশুকে সপ্তধা ছিন্ন করিলেন, বালক রোদন করিয়া উঠিল। ইন্দ্র উহাকে রোদন করিতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বালক কিছুতেই নিবৃত্ত হইল না। তখন দেবরাজ, বিলক্ষণ রোষভরে উহার প্ৰতিখণ্ডকে পুনর্ব্বার সপ্তধা কৰ্ত্তিত করিলেন। এই রূপে ঐ কুক্ষি নিলীন শিশু হইতে উনপঞ্চাশত বায়ুর সৃষ্টি হইল। ইন্দ্র তৎকালে ‘মারোদীঃ’ বলিয়া ক্রন্দন করিতে যে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা হইতেই ঐ বায়ু সকল মারুত নামে অভিহিত হইয়াছে। এই মারুতগণ পরিশেষে ইন্দ্রেরই সহকারী হইয়াছিলেন। বৈশম্পায়ন কহিলেন হে মহারাজ জনমেজয়! এইরূপে ভূত সৃষ্টি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে ভগবান বিষ্ণু উহাদিগকে এক একটা শ্রেণীভুক্ত করিয়া দেবগণের মধ্য হইতে এক জনকে উহাদিগের অধ্যক্ষ রূপে নির্ব্বাচিত করিলেন। উহাদের নাম গণপতি। পৃথুই ঐ সকল গণপতিদিগের মধ্যে প্রধান ও আদিম ছিলেন। হে রাজন! যে হরি এইরূপে দেবগণকে সর্ব্বাধিপত্য প্রদান করিলেন, তিনিই প্রধান পুরুষ, তিনিই বীর, তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই জিষ্ণু এবং প্রজাপতি, পর্জ্জন্য ও তপন, তিনিই অব্যক্ত এবং নিখিল জগৎ তাঁহারই অধিকৃত। হে ভরতর্ষভ! যে ব্যক্তি ভূত সৃষ্টি বিষয়ক বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারেন, দেবগণের শুভাবহ জন্মবৃত্তান্ত পাঠ বা শ্রবণ করেন, তাঁহার আর এ জগৎ সংসারে পুনরাবৃত্তি করিতে হয় না, পরলোক ভয়ও এক বারে সুদূরপরাহত হইয়া যায়।.
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ