হরিবংশ পুরাণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

16 March, 2021

হরিবংশ পুরাণ

 ১ম অধ্যায় 

নারায়ণ নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে। নিখিল জগৎ যাঁহার বদনারবিন্দ নির্গলিত বাঙ্ময় অমৃত পান করিতেছে এবং যাঁহার ওষ্ঠপুট বিনিঃসৃত অপ্রমেয় কলুষনাশন শুভাবহ পবিত্র গীয়মান ভারত প্রাপ্ত হইয়া পরম প্রীতি লাভ করিতেছে, সেই পরাশর তনয় সত্যবতী হৃদয়নন্দন। ব্যাসদেব জয়যুক্ত হউন। যিনি পিতামহ ব্রহ্মা হইতে ষষ্ঠ মহর্ষি বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকেন সেই অংশাবতার নারায়ণ বেদমহানিধি অক্ষয্য বিভূতিমান্ অজ্ঞান তিমির নাশন বেদব্যাসকে বারংবার নমস্কার করি। যিনি আদিপুরুষ পরব্রহ্মস্বরূপ, বেদসমুদায় যাহার যশোগান করিয়া থাকে। যিনি সত্যস্বরূপ এবং অদ্বিতীয় ও অবিনশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ; যিনি স্থূল সূক্ষ্ম ও নিত্য অনিত্য এবং নিত্যনিত্য বিশ্বাত্মস্বরূপ অথচ বিশ্ব হইতে নির্লিপ্ত থাকিয়া সমস্ত চরাচর সৃষ্টি করিতেছেন। যিনি ইন্দ্রিয় সকলের নিয়ন্তা জীবগণের মঙ্গলবিধাতা স্বয়ং আনন্দস্বরূপ সেই নিষ্পাপ পবিত্ৰাত্মা ভূতভাবন হরিকে প্রণাম করিয়া কুলপতি মহামুনি শৌনক নৈমিষারণ্যে সর্ব্বশাস্ত্র বিশারদ সৌতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন। হে সূত নন্দন! তুমি মধুর বাক্যে অতি বিস্তীর্ণ ভারতীয় উপাখ্যান আমার নিকট কীৰ্ত্তন করিলে এবং প্রসঙ্গ ক্রমে অন্যান্য মহীপতিগণ, দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, উরগ, রাক্ষস এবং দৈত্য সিদ্ধগণ ও গুহ্যকদিগের অত্যদ্ভুত কার্য্যকলাপ বিক্রম, ধৰ্ম্ম-নিশ্চয়, অনুত্তম জন্মবৃত্তান্ত সংবলিত পবিত্র পুরাণ, বিচিত্র কথা সমুদায়ও কীৰ্ত্তন করিলে। তোমার এই অমৃতায়মান বাক্য পরম্পরা শ্রবণ করিয়া আমার মন ও কর্ণ পরম পরিতোষ লাভ করিয়াছে, কিন্তু তুমি এতাবৎ কাল যাহা কিছু বর্ণন করিয়াছ তৎসমুদায়ই কুরুবংশীয়দিগের, বৃষ্ণি বা অন্ধকদিগের বংশোপাখ্যান কিছুমাত্র উল্লেখ কর নাই এক্ষণে তাহাই সম্যকরূপে কীৰ্ত্তন কর। সৌতি কহিলেন, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! মহারাজ জনমেজয় ব্যাসশিষ্য ধৰ্ম্মজ্ঞ বৈশম্পায়নকে বৃষ্ণি বংশ বিষয়ক যাহা কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমি তৎসমুদায় কীৰ্ত্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। সেই ভরতকুলশ্রেষ্ঠ মহাপ্রাজ্ঞ রাজা জনমেজয় স্বকীয় বংশের ইতিহাস আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া বৈশম্পায়নকে কহিলেন। হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! অর্থসমন্বিত শ্রুতিসঙ্গত পবিত্র মহাভারতোপাখ্যান বিস্তারিত রূপে আপনার নিকট শ্রবণ করিলাম। উহাতে মহাধনুর্দ্ধারী পুরুষশ্রেষ্ঠ মহারথ বৃষ্ণি ও অন্ধকদিগের নাম এবং কার্য্যকলাপ কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। কিন্তু আমি উহাতে তৃপ্তি লাভ করিতে পারি নাই। আপনি উহাদের বংশবৃত্তান্ত বিলক্ষণ রূপে জ্ঞাত আছেন প্রত্যুত স্বচক্ষে সমুদায় প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। অতএব হে থপোধন! যে যে বংশে যে সকল মহাত্মা জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন আপনি প্রজাপতি হইতে আরম্ভ করিয়া তৎসমুদায় কৰ্ত্তন করুন। উহাদের আমূলবৃত্তান্ত জানিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে। সৌতি কহিলেন, এই রূপে রাজা জনমেজয় কর্ত্তৃক সৎকৃত ও জিজ্ঞাসিত হইয়া মহাত্মা তপোধন বিস্তারিতঃ সমস্ত বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক বলিতে আরম্ভ করলেন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন্‌! যাহা ধারণ অথবা পুনঃ পুনঃ শ্রবণ করিলে বংশসমন্বিত হইয়া স্বর্গলোকে নিহার করে সেই পবিত্র পাপ প্রমোচন বিস্তৃতার্থসমন্বিত বেদসংঙ্গত বিচিত্র মহাভারতীয় কথা কীর্ত্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। মহারাজ! যাঁহাকে অব্যক্ত সদসৎস্বরূপ নিত্য কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করে পরমেশ্বর সেই প্রধান পুরুষকে সৃষ্টি করিয়া তাহা হইতে এই বিশ্ব নির্ম্মাণ করিয়াছেন। অমিততেজ নারায়ণপরায়ণ সৰ্ব্বভূতের স্রষ্টা সেই প্রধান পুরুষকেই ব্ৰহ্ম বলিয়া জানিবেন। প্রথমে মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হইতে আকাশাদি সূক্ষ্ম ভূতনিচয়ের সৃষ্টি হয়। অনন্তর সেই সূক্ষ্ম মহাভূত হইতে জরায়ুজ প্রভৃতি প্রাণি সমুদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। ইহাই সৃষ্টি বিষয়ক চিরন্তন নিয়ম। আমি স্বকীয় জ্ঞানানুসারে সৃষ্টি প্রকরণ হইতে যথাশ্রুত বৃষ্ণিবংশ বিস্তার ক্রমে বর্ণন করিতেছি শ্রবণ করুন। পুরাতন পুন্যকৰ্ম্মা স্থির কীর্ত্তি মহাত্মাদিগের মাহাত্মাদি বর্ণন করিলে ও যশোবৃদ্ধি, শক্রক্ষয়, আয়ুবুদ্ধি ও স্বর্গ প্রাপ্তি হইয়া থাকে।

ভগবান্ স্বয়ম্ভূ বিবিধ প্রজা সৃষ্টি করিতে অভিলাশী হইয়া প্রথমে সলিল রাশির সৃষ্টি করিলেন। ঐ সলিলোপরি ব্রহ্মাণ্ডের বীজ নিক্ষিপ্ত হইল। জল নর হইতে সৃষ্ট হইল বলিয়া উহা নর নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ঐ জলই বিষ্ণুর আশ্রয়, সুতরাং ভগবান বিষ্ণু, নারায়ণ নামে খ্যাত হইয়াছেন। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে বীজ সলিলোপরি নিক্ষিপ্ত হয়; ঐ উদকশায়ী বীজ ক্রমে হিরণ্য বর্ণ অণ্ডাকারে পরিণত হইলে তন্মধ্যে ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। ভগবান্ হিরণ্যগর্ভ ঐ অণ্ড মধ্যে এক বৎসর বাস করিয়া উহা দুই ভাগে বিভক্ত করেন। উহার এক ভাগ স্বর্গ অপর ভাগ পৃথিবী নামে খ্যাত হইল। প্রভু ঐ উভয় খণ্ডের মধ্যবর্ত্তিস্থানকে আকাশ করিলেন। এই সলিল পরিপ্লুত অণ্ডাকার পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া দশ দিকের বিধান করিলেন। অতঃপর উহাতে কাল, মন, বাক্য, কাম, ক্রোধ, অনুরাগ প্রভৃতির ও বিধান করিলেন। অনন্তর প্রজাগণকে সৃষ্টি করিতে অভিলাশী হইলেই মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও মহাতেজা বশিষ্ট, এই মনঃ সমুত্থিত সপ্ত প্রজাপতি সমুদ্ভূত হইলেন। এই সপ্ত প্রজাপতির জন্ম গ্রহণ করিবার পরে ব্রহ্মা হইতে সনক, সনন্দ, সনাতন, সনৎ কুমার, স্কন্দ, নারদ ও রোষাত্মক রুদ্রদেব এই সাতজন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে সপ্ত প্রজাপতি ও রুদ্রদেব প্রজা সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। অপর ভ্রাতৃগণ উহাতে বিরত রহিলেন। এই সপ্ত মহাবংশীয়গণই লোকোত্তর গুণসম্পন্ন ক্রিয়াবান্ প্রজাশালী। ইহাদের বংশে ভূরিশঃ মহর্ষি জন্ম পরিগ্রহ করিয়া স্ব স্ব কুলকে অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। অনন্তর বিদ্যুৎ, বজ, মেঘ, ইন্দ্রধনু, পক্ষী ও পর্জ্জন্য এবং সজ্ঞকাৰ্য্য সমাধানার্থ ঋক্, যজুঃ, সাম এই বেদত্রয়ের সৃষ্টি হইল। এই বেদত্রয়ের দ্বারা দেবগণ যজ্ঞভূক হইলেন। বশিষ্ঠ প্রজাপতির দেহ হইতে নানাবিধ ভূত অর্থাৎ প্রাণীর সৃষ্টি হইতে লাগিল। অতঃপর ভগবান প্রজাপতি যখন দেখিলেন যে এই রূপে আর প্রজাসংখ্যা বৃদ্ধি হয় না তখন তিনি স্বকীয় শরীর দুই ভাগে বিভক্ত করলে এক ভাগে পুরুষ অপরার্দ্ধে নারী এই দ্বিবিধ প্রজা উৎপন্ন হইল। এই রূপে যে সকল প্রজা সৃষ্ট হইল  উহা দ্বারা পৃথিবী ও স্বর্গ ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। তদনন্তর বিষ্ণু হইতে যে বিরাটপুরুষ জন্ম গ্রহণ করেন ইনি মনু নামে অভিহিত হইয়া ছিলেন। এই সময়কে মন্বন্তর বলে এবং স্ত্রী পুরুষ সংসর্গে যে সৃষ্টি হইতে লাগিল ইহারই নাম দ্বিতীয় সৃষ্টি। মনুর পূর্ব্বে ভগবান নারায়ণ হইতে যে সৃষ্টি হয় উহাকে অযোনিজা প্রথম সৃষ্টি বলে। সৃষ্টি প্রকরণের এই আদি বৃত্তান্ত অবগত হইলে লোকে দীর্ঘজীবী, কীর্ত্তিমান্ ও পুত্রবান্ হইয়া চরমে পরম গতি লাভ করে। তথ্যসূত্র হরিবংশ পুরাণ শ্রীযুক্ত চন্দ্রমোহন তর্করত্ন কর্তৃক অনুবাদিত মুদ্রণ: সন ১২৮৮ সাল। ভাদ্র।

হে মহারাজ! ভগবান বশিষ্ঠ এই রূপে অযোনিজ সৃষ্টি সমাপ্ত করিয়া স্বকীয় শরীরার্দ্ধ দ্বারা পুরুষ রূপ ধারণপূৰ্ব্বক অপরাৰ্দ্ধসম্ভূতা শতরূপাকে পত্নী রূপে লাভ করিলেন। তদীয় মহিমা ও ধৰ্ম্ম বলে শতরূপা স্বীয় নামকে অর্থ করিয়া তুলিলেন। ঐ বহুরূপধারিণী শত রূপ দশ সহস্র বৎসর অতিদুশ্চর তপশ্চৰ্য্যা করিয়া দীপ্ততপাঃ ঐ মহাপুরুষকে সন্তানোৎপাদনাৰ্থ পতিত্বে লাভ করেন। ইঁহার অপর নাম স্বায়ম্ভুব মনু। তাঁহারই এক সপ্ততি যুগে এক মন্বন্তর হইয়া থাকে। এই বিরাট পুরুষের ঔরসে শতরূপার গর্ভে বীর নামে এক পুত্র জন্ম পরিগ্রহ করেন। এই বীরপুরুষ হইতে প্রজাপতি বশিষ্ঠকন্যা কাম্যা প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র প্রসব করেন। হে মহাবাহো! কর্দ্দম নামক প্রজাপতির কাম্যা বলিয়া এক কন্যা ও সম্রাট, কুক্ষি, বিরাট ও প্রভু এই চারি পুত্র হয়। এই কাম্যা প্রিয়ব্রতকে পতি লাভ করিয়া বহু পুত্র প্রসব করেন। প্রজাপতি অত্রি, উত্তানপাদকে পুত্র রূপে গ্রহণ করিলেন। উত্তানপাদ অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্ভূতা সূনৃতা নাম্নী দিব্য লাবণ্য সম্পন্না ধৰ্ম্ম তনয়ার পাণি গ্রহণ করেন। সুনৃতা যথাকালে ধ্রুব, কার্ত্তিমান্‌, আয়ুস্মন্ ও বসু নামে চারি পুত্র প্রসব করিলেন। হে মহারাজ! ধ্রুব সুমহৎ যশঃ প্রাপ্তির আশয়ে তিন সহস্র দিব্য বৎসর কাল অতি কঠোর তপস্যা করলে ভগবান নারায়ণ প্রীত হইয়া সপ্তর্ষিগণের পুরোভাগে বৈকুণ্ঠধাম সদৃশ এক অচল স্থান প্রদান করিলেন। ধ্রুবের এইরূপ অভিমান, সমৃদ্ধি ও মহিমা সন্দর্শন করিয়া দেবাসুর গুরু শুক্রাচার্য্য ইঁহার যশোগান করিতে লাগিলেন। কহিলেন, ধ্রুবের কি অদ্ভুত তপোবল। কি চমৎকারই বা তপস্যা! যাঁহাকে সম্মুখে করিয়া সপ্তর্ষিগণ অবস্থিত রহিয়াছেন। ধ্রুবের পুত্র শ্লিষ্টি ও ভব্য। ভব্যের শম্ভু নামক এক পুত্র জন্মে। স্বকীয় পত্নী সুচ্ছায়ার গর্ভে শ্লিষ্টির পবিত্র স্বভাব পাঁচ পুত্র উৎপন্ন হয়। ইহা দের নাম রিপু, রিপুঞ্জয়, রিপ্র, বৃকল ও বৃকতেজা। রিপু বৃহতী গর্ভে অতি তেজস্বী চাক্ষুষ নামে এক পুত্র উৎপাদন করেন। চাক্ষুষ হইতে মহাত্মা অরণ্য প্রজাতির দুহিতা বীরণী পুষ্করিণীর গর্ভে মনুর জন্ম হয়। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! মহাত্মা বৈরাজ প্রজাপতির দুহিতা লড্বলার গর্ভে মহাতেজা মনুর, ঊরু, পূরু, শতদ্যুম্ন, তপস্বী, সত্যবাক্‌, কবি, অগ্নিষ্ট, অতিমাত্র, শ্রদ্যুম্ন ও অভিমন্যু এই দশ পুত্র জন্মলাভ করিল। ঊরু হইতে অগ্নিকন্যা অঙ্গ, সুমনা, স্বাতি, ক্রতু, অঙ্গিরা ও গয় এই ছয় পুত্র প্রসব করেন। সুনীথ কন্যা এই অঙ্গ হইতে বেণ নামে এক পুত্র লাভ করিলেন। এই সময়ে বেণের দেব দ্রোহিতা প্রভৃতি অহিতাচায় আরম্ভ হইলে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া ঋষিগণ প্রজাগণের হিত কামনা করিয়া ঐ বেণের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করেন। উহাতে এক তেজঃপুঞ্জ ঋষির জন্ম হয়। তদ্দর্শনে ঋষিগণ পরস্পর কহিতে লাগিলেন—এই মহা তেজাই প্রকৃতিবর্গের আনন্দবর্দ্ধন করিয়া অতি গরীয়সী কীর্ত্তিলাভ করিবে। এই বেণপুত্র পৃথু নামে বিশ্রুত হইয়াছিলেন। ইনিই ক্ষত্ররাজন্য কুলের প্রথম রাজা। অনন্তর অনল সদৃশ অতিদ্যুতিশালী সেই মহারাজ পৃথু ধনুর্দ্ধারণ ও কবচ পরিধানপূর্ব্বক প্রজাপালন করিতে লাগিলেন এবং রাজসূয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া রাজসূয়াভিষিক্ত নৃপতিগণের অগ্রগণ্য হইলেন। উহা হইতে কার্য্যকুশল সূত ও মাগধ সমুদ্ভূত হইয়াছিলেন। প্রকৃতিবর্গের হিত কামনা করিয়া উহাদের জীবিকা সম্পাদনার্থ মহারাজ পৃথু দেব, দানব, ঋষি, পিতৃগণ, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরাগণ, নাগলোক, উদ্ভিদ পর্ব্বতাদি সমন্বিত হইয়া গোরূপ-ধরা ধরাকে দোহন করেন। বসুন্ধরা এইরূপে দুহ্যমান হইয়া পৃথক পৃথক পাত্রে প্রার্থনানুরূপ যথেপ্সিত বস্তুজাত প্রদান করিয়াছিলেন। তদ্বারাই জীবলোক প্রাণ ধারণ করিতে সমর্থ হইয়াছে। অনন্তর পৃথুর অন্তর্দ্ধান ও পালী নামে দুই পুত্র জন্মে। এই অন্তর্দ্ধানের ঔরসে শিখণ্ডিনীর গর্ভে হবির্দ্ধান নামে এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন। হবির্দ্ধানের ছয় পুত্র। ইহার প্রাচীন-বর্হি, শুক্র, গয়, কৃষ্ণ, ব্রজ ও অজিন নামে বিখ্যাত হইয়াছিল। উহাদের মাতার নাম আগ্নেয়ধিষণা। হে মহারাজ! এই সময়ে প্রাচীনবৰ্হি হইতে প্রজা সৃষ্টির বাহুল্য হওয়াতে ইনি পিতা অপেক্ষাও অধিকতর মহত্ত্ব লাভ করিয়াছিলেন, এই প্রাচীন বর্হির ঔরসে সমুদ্র তনয়া সবর্ণার গর্ভে প্রাচীনা কুশ প্রভৃতি দশ পুত্র জন্মে। ইহারা সকলেই প্রচেতা নামে অভিহিত হইয়া ধনুর্ব্বেদ বিশারদ এবং অভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী হইয়া উঠিলেন। এই প্রচেতা সকল সমুদ্রশায়ী হইয়া দশ সহস্র বৎসর অতি কঠোর তপশ্চৰ্য্যা করিলে পৃথিবী বৃক্ষলতাদি দ্বারা পরিপূর্ণ. 
হইয়া উঠিল। এমন কি নভোমণ্ডলকেও আচ্ছন্ন করিয়া বায়ুর গতি পর্য্যন্ত রোধ করিল। দশ সহস্র বৎসর পৰ্য্যন্ত প্রজাগণের আর বিচরণ করিবার স্থান রহিল না, সুতরাং ভূরি ভূরি প্রজাক্ষয় আরম্ভ হইল, এবং সমুদায় প্ৰজাই চাক্ষুষ মনুর শরীরাভ্যন্তরে  প্রত্যাহৃত হইল। তখন তপোবলে এই অদ্ভুত ব্যাপার অবগত হইয়া প্রচেতাগণ তপশ্চৰ্য্যায় বিরত হইলেন এবং রোষ পরবশ হইয়া তৎক্ষণাৎ মুখ হইতে বায়ু ও অগ্নিকে সৃষ্টি করিলেন। এই বায়ু ভীষণতর প্রবল হইয়া বৃক্ষ সকল উন্মূলিত ও শুষ্ক করিতে লাগিল। এ দিকে প্রচণ্ড অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়া ঐ সমস্ত বিটপিশ্রেণী ভস্মাবশেষ করিতে আরম্ভ করিল। পৃথিবী প্রায় বৃক্ষ শূন্য হইয়া উঠিল, অল্পমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে বৃক্ষাধিপতি সোম দেব প্রচেতাগণের সন্নিধানে গমন করিয়া তাহাদিগকে বিনয় নম্র বচনে কহিতে লগিলেন হে প্রচেতাগণ! তোমরা ক্রোধ পরিহার কর, পৃথিবী বৃক্ষ শূন্য হইয়াছে, এক্ষণে তোমাদের বায়ু ও অগ্নিকে শান্ত কর। আমি ভবিষ্য তত্ত্ব জানিতে পারিয়া এই বরবর্ণিনী কন্যারত্নকে গর্ভে ধারণ করিয়াছি। এ কন্যা সমুদায় বৃক্ষের তেজোরূপে নির্ম্মিত হইয়াছে ইহার নাম মারিষা। হে মহাভাগগণ! তোমরা ইহাকে ভাৰ্য্যাত্বে পরিগ্রহ করিলে সোম কুল বিস্তৃত হইবে। তোমাদিগের ও আমার তপোবলের অৰ্দ্ধাৰ্দ্ধ ভাগ দ্বারা ইহাতে দক্ষপ্রজাপতি নামে এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করিবে। সেই দক্ষ আপনাদিগের তেজঃপ্রভাবে অনল সদৃশ প্রখর তেজস্বী হইয়া এই দগ্ধ প্রায় ধরণীকে পুনর্ব্বার রক্ষা করিবে এবং প্রজাকুলের বৃদ্ধি করিবে। হে ভরতবংশাবতংস! তদনন্তর প্রচেততাগণ সোমদেবের বচনানুসারে ক্রোধ সংবরণ করিয়া যথাবিধি মারিষার পাণি পীড়ন করিলেন। অনন্তর ঐ দশ প্রচেতার মানসে মারিষার গর্ভাধান হইল। অতঃপর যথা সময়ে সোম দেবের অংশে ঐ গর্ভে মহাতেজা প্রজাপতি দক্ষ সমুৎপন্ন হইলেন। দক্ষপ্রজাপতি সোমবংশবিবৰ্দ্ধন অনেকগুলি পুত্রোৎপাদন করিলেন। অনন্তর তিনি স্থাবর জঙ্গম দ্বিপদ চতুষ্পদ প্রভৃতি বিবিধ পদার্থ সৃষ্টি করিয়া কতকগুলি মনঃকল্পিত কন্যার সৃষ্টি করিলেন। এই সকল কন্যার মধ্যে দশটী ধৰ্ম্মকে, ত্রয়োদশটী কশ্যপকে অবশিষ্ট নক্ষত্র নামধেয় একবিংশতি কন্যা সোমদেবকে প্রদান করিলেন। ইহাদেরই গর্ভে গো, পক্ষী, নাগ, দৈত্য, দানব, গন্ধর্ব্ব, অরোগণ প্রভৃতি নানা জাতির সৃষ্টি হইল। হে রাজেন্দ্র! এই সময় হইতে স্ত্রী পুরুষ সহযোগে প্রজা সৃষ্টির আরম্ভ হয়। ইতঃপূৰ্ব্বে, যে, মনন দর্শন ও স্পর্শ দ্বারা প্রজা সৃষ্টি হইয়া আসিতেছিল উহা রহিত হইয়া গেল। জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! আপনি পূর্ব্বে যখন দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, উরগ ও মহাত্মা দক্ষের জন্ম বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করেন তৎকালে ব্ৰহ্মার দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠ হইতে দক্ষ, বামাঙ্গুষ্ঠ হইতে তৎপত্নী সমুদ্ভূত হইয়াছেন বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। এখন আবার সেই মহাত্মা দক্ষ, কি রূপে প্রচেতোগণের পুত্রত্ব প্রাপ্ত হইলেন এবং কি রূপেই বা প্রজাপতি সোমদেবের দৌহিত্র হইয়া আবার তাঁহারই শ্বশুর হইলেন। এ বিষয়ে আমার মহান্ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। আপনি সম্যকরূপে ব্যাখ্যা করিয়া আমায় বুঝাইয়া দেন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! উৎপত্তি নিরোধ অর্থাৎ জন্ম মৃত্যু প্রাণিমাত্রেরই নিয়ত ধর্ম্ম, তাহাতে ঋষি ও জ্ঞানিগণের মোহের বিষয় কি? যুগে যুগেই দক্ষ প্রভৃতি নৃপতিগণের এক বার উৎপত্তি আবার লয় প্রাপ্তি হইতেছে উহাতে বিচক্ষণ ব্যক্তির সংশয় হয় না। হে নরাধিপ! পূর্ব্বে উহাদের জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠত্ব কিছুই ছিল না। কারণ তপোবলই ইহাদের উৎকৰ্ষাপকর্ষের হেতু হইত। হে মহারাজ! এই প্রজাপতি দক্ষ নৃপতির চরাচর সৃষ্টির বিষয় যিনি সম্যক্‌ অবগত হন তিনি পুত্রবান্ হইয়া চরমে স্বর্গলোক লাভ করিয়া থাকেন।   [এই স্থানে নানা পুস্তকে নানা রকম পাঠ দেখা যায়। কোন পুস্তকে লিখিত আছে ধ্রুব হইতে শম্ভূ দুই পুত্র উৎপাদন করেন। উহাদের নাম শ্লিষ্ট ও ভব্য। অপর পুস্তকে ভব্য স্থানে ধন্য পাঠ আছে।].

জনমেজয় কহিলেন, হে বৈশম্পায়ন! আপনি দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষসদিগের জন্ম বৃত্তান্ত বিস্তার ক্রমে কীর্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন! প্রজাবিধাতা দক্ষ স্বয়ম্ভূ কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া যেরূপে ভূত নিচয়ের সৃষ্টি করিয়াছিলেন উহা আমি বর্ণন করিতেছি অবধান করুন। প্রভু প্রজাপতি দক্ষ প্রথমে ঋষি দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব, অসুর, রাক্ষস, যক্ষ, ভূত পিশাচ, পশু, পক্ষী ও মৃগ প্রভৃতিকে মানসে সৃষ্টি করিয়া যখন দেখিলেন মানসসৃষ্ট প্রজাবর্গ আর বৃদ্ধি পাইতেছে না, তখন ঐ ধর্ম্মাত্মা প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টির উৎকট বাসনা বশতঃ স্ত্রী পুরুষ সহযোগে বিবিধ প্রাণীর সৃষ্টি করাই শ্রেয়ঃ কল্প বলিয়া স্থির করিলেন। তখন তিনি বীরণ প্রজাপতির তপঃপরায়ণ লোকধারিণী অসিক্নী নাম্নী এক মহীয়সী কন্যাকে বিবাহ করিলেন। অনন্তর মহামতি দক্ষ ঐ অসিক্নীর গর্ভে পঞ্চ সহস্ৰ বীর্য্যবান পুত্র উৎপাদন করেন। এই মহাভাগ দক্ষ তনয়গণ সকলেই প্রজা বৃদ্ধি করিতে অভিলাষী হইয়াছেন দেখিয়া একদা প্রিয়ম্বদ নারদ তাহাদের সন্নিধানে আসিয়া যে সকল কথা কহিয়াছিলেন, তাহাতে উহাদিগের অনুদ্দেশ এবং আপনাকেও শাপগ্রস্ত অবশেষে বিনষ্ট হইতে হয়। পূর্ব্বে ব্রহ্মপরায়ণ লোকপিতামহ ব্রহ্মা কর্ত্তৃক মানসে নারদ সৃষ্ট হইয়াছিলেন। সেই দেবর্ষি নারদ হৰ্য্যশ্ব ও সবলাশ্ব প্রভৃতি দক্ষপুত্রগণকে বিবিধ উপদেশ ও শাস্ত্র প্রতিপাদ্য পরামর্শ প্রদান করিয়া একবারে নিরুদ্দেশ করিয়া দিয়াছেন জানিতে পারিয়া অমিত পরাক্রম দক্ষ রোষপরবশ হইয়া অভিসম্পাত দ্বারা নারদকে সংহার করিলেন। তৎকালে ব্রহ্মা মরীচি প্রভৃতি ব্ৰহ্মর্ষিগণকে অগ্রে করিয়া স্বয়ং দক্ষের নিকট আসিয়া স্বীয় পুত্রের পুনর্জীবন প্রার্থনা করেন। তদনন্তর দক্ষ অভিসন্ধি করিয়া কহিলেন, আমি এই স্বকীয় কন্যা অসিক্নীকে প্রদান করিতেছি, ইহার গর্ভেই নারদ পুনরায় জন্ম গ্রহণ করিবে; অতএব ইহাকে লইয়া কশ্যপকে প্রদান করুন। এই কথা বলিয়া ব্রহ্মার হস্তে কন্যাকে অর্পণ করিলেন। অভিসম্পাত ভয়ে মহর্ষি কশ্যপ কন্যা গ্রহণ করিলেন, এবং তাহার গর্ভে নারদকে পুনরায় উৎপাদন করিলেন। জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! মহর্ষি নারদ কি জন্য প্রজাপতির পুত্রগণকে নিরুদ্দেশ করিলেন, উহা আমি যথার্থতঃ শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি, আপনি উহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন্! একদা প্রজা বৃদ্ধি সমুৎসুক মহাবীর্য্য হৰ্য্যশ্ব প্রভৃতি দক্ষতনয়গণ দেবর্ষি নারদের সহিত সমবেত হইলে, নারদ কহিলেন, হে দক্ষত্মজগণ! হায় তোমরা কি মূর্খ। তোমরা কি এই পৃথিবীর পরিমাণের বিষয় কিছুই জান না! জানিলে কখনই প্রজা সৃষ্টির এত কামনা করিতে না। আচ্ছা বল দেখি, ইহার ঊর্দ্ধ, অধঃ ও মধ্যভাগে প্রজা সৃষ্টি কিরূপে করিবে। নারদের এই কথা শ্রবণ মাত্ৰ হৰ্য্যশ্বগণ পৃথিবার পরিমাণ জানিবার নিমিত্ত, চতুর্দ্দিকে প্রস্থান করিল। যেমন তটিনী কুল সমুদ্র উদ্দেশে গমন করিলে আর প্রত্যাবৃত্ত হয় না, ইহারাও তদ্রূপ অদ্যাপি প্রতিনিবৃত্ত হইল না। হৰ্য্যশ্বগণ এই রূপে প্রস্থান করিলে সৃষ্টিপরায়ণ প্রজাপতি দক্ষ বীরণ তনয়ার গর্ভে পুনরায় সহস্র পুত্রের সৃষ্টি করিলেন। ইহাদের নাম সবলাশ্ব। সবলাশ্বগণ প্রজা বৃদ্ধি করিতে সমুৎসুক হইলে মহর্ষি নারদ মুখে পূৰ্ব্ববৎ উপদিষ্ট ও তিরস্কৃত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিল, দেবর্ষি নারদ যাহা কহিলেন, তাহাই সত্য, আমরা পৃথিবীর পরিমাণ কিছুমাত্র জানি না। অতএব পূর্ব্বতন ভ্রাতৃগণের পদবী অনুসরণ করাই আমাদের কর্ত্তব্য হইতেছে, ইহাতে আর সংশয় মাত্র নাই। পৃথিবীর পরিমাণ জানিতে পারিলে আমরা তখন সুখস্বচ্ছন্দে প্রজা সৃষ্টি করিতে পারিব। এই কথা বলিয়া ইহারও পূর্ব্ব ভ্রাতৃগণের ন্যায় তত্তৎপথাবলম্বী হইয়া কৌতুহল পূর্ণ সুস্থ হৃদয়ে ইতস্ততঃ প্রস্থান করিলেন। অদ্যাপি প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। এইরূপে সবলাশ্বগণ পলায়ন করিলে বিভু প্রজাপতি দক্ষ নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া নারদকে অভিসম্পাত করিলেন। কহিলেন, নারদ! তুমি এখনই বিনষ্ট হও এবং গর্ভবাস যন্ত্রণা পুনরায় আশ্রয় কর। হে রাজন্! তদবধি অনুদ্দিষ্ট ভাতৃগণের অন্বেষণে অন্য ভ্রাতারা গমন করিলে প্রায়ই সত্বর বিনষ্ট হয় অতএব পণ্ডিতগণ ঈদৃশ কাৰ্য্যে কখন প্রবৃত্ত হইবেন না। আমি শুনিয়াছি অতঃপর এই সমুদায় পুত্র নিরুদ্দেশ হইয়াছে জানিয়া প্রজাপতি দক্ষ স্বকীয় ধর্ম্মপত্নী বীরণ তনয়াতে ষষ্টিসংখ্যক কন্যার সৃষ্টি করিলেন। তখন এই সকল কন্যাকে কশ্যপ, সোমদেব, ধৰ্ম্ম এবং অন্যান্য মহর্ষিবর্গ ভার্য্যাৰ্থ প্ৰতিগ্ৰহ করিলেন। ধর্ম্মকে দশ, কশ্যপকে ত্রয়োদশ, সোমকে সপ্তবিংশতি, অরিষ্টনেমীকে চারি, বসুপুত্রকে দুই, অঙ্গিরা ও বিদ্বান কৃশাশ্বকেও দুই দুইটী করিয়া কন্যা দান করিলেন। ইহাদিগের নাম সমুদায় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। অরুন্ধতী, বসু, যামী, লম্বা, ভানু মরুত্বতী, সঙ্কল্পা, মুহুর্ত্তা, সাধ্যা ও বিশ্বা এই দশটা ধৰ্ম্মের ধর্ম্মপত্নী। এই সকল ধৰ্ম্মপত্নীতে যে সমুদায় অপত্য জন্মিয়াছিল, তাহাদের নামও যথাক্রমে বলিতেছি অবধান করুন। বিশ্বা হইতে বিশ্বদেবগণ, সাধ্যা হইতে সাধ্যগণ, মরুত্বতী হইতে মরুত্বৎগণ, বসু হইতে বসুগণ, ভানু হইতে ভানু, মুহূর্ত্তা হইতে মুহূর্ত্তগণ, লম্বা হইতে ঘোষ, যামী হইতে নাগবীথী, অরুন্ধতী হইতে পার্থিব পদার্থ সকল, সঙ্কল্পা হইতে সর্ব্বাত্ম রূপ সঙ্কল্প এবং যামিনী নাগবীথী হইতে বৃষল সমুদ্ভূত হন। হে রাজন্! ভগবান্ দক্ষ সোম দেবকে যে সকল কন্যা প্রদান করেন, তৎসমুদায় জ্যোতিঃপ্রদ নক্ষত্র নামে অভিহিত হইয়াছে। তদ্ভিন্ন যে সকল খ্যাতিমান্ দেবগণ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর পুরোবর্ত্তী হইয়া বাস করিতেছেন, উহারা অষ্টবসু নামে প্রখ্যাত হইয়া থাকেন। তাঁহাদের নামগুলি বিস্তারক্রমে বলিতেছি। প্রথমে আপ, অনন্তর ধ্রুব, সোম, ধর, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভাস। তন্মধ্যে আপের পুত্র বৈতণ্ড্য, শ্রম, শান্ত ও মুনি। লোকপ্রনাশন কাল ধ্রুবের পুত্র। সোমের পুত্র বর্চ্চা, যদ্দ্বারা উহার পিতা বর্চ্চস্বী নামে কীৰ্ত্তিত হইয়াছেন। ধরের পুত্র দ্রবিণ ও হুতহব্যবাহ এবং মনোহরার গর্ভে শিশির প্রাণ ও রমণ জন্মিয়াছেন। অনিলভাৰ্য্যা শিবার গর্ভে মনোজব ও অবিজ্ঞাতগতি এই দুই পুত্র উৎপন্ন হয়। অগ্নিপুত্র কুমার শরবনে জন্মিয়া শরীর কান্তিতে বন আলোকময় করিতেছিলেন, তদ্দর্শনে কৃত্তিকাগণ ইহাকে পুত্রনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করেন, তন্নিমিত্ত কুমার কার্ত্তিকেয় নামে বিশ্রুত হন। অনন্তর শাখ, বিশাখ ও নৈগমেয় এই তিনটীর জন্ম হয় সুতরাং ইহার কুমারের অনুজ। স্কন্দ ও সনৎকুমার ইহারা উভয়ে অগ্নির চতুর্থাংশে জন্ম পরিগ্রহ করেন। দেবল ঋষি প্রত্যুষের পুত্র। মহর্ষি দেবলের দুই পুত্র জন্মে। ইহারা ক্ষমাবান্‌ ও উদারচেতা ছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির যোগসিদ্ধা নামে এক ভগিনী ছিলেন। তিনি ব্রহ্মচারিণী অনাসক্ত হইয়া সমস্ত জগৎ বিচরণ করেন। অষ্টম বসু প্রভাস, ইহাকে ভাৰ্য্যাত্বে পরিগ্রহ করিলে মহাবাহু প্রজাপতি বিশ্বকর্ম্মা ইহা হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছিলেন। এই মহাত্মা হইতে জগতে সহস্র সহস্র শিল্পকাৰ্য্যের অবতারণা হইয়াছে। ইহা হইতেই সমস্ত জগতের স্পৃহণীয় ভূষণ সকল সৃষ্ট হইয়াছে। ইনি যাবতীয় অমরবৃন্দের অতি বিচিত্র অদ্ভুত কারুকার্য্য সংশ্লিষ্ট রমণীয় বিমান সমুদায় নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছেন। ইনি সর্ব্বশিল্পীর অগ্রগণ্য এবং ইহার প্রসাদই মানব কুলের উপজীব্য হইয়া উঠিয়াছে। সুরভি তপঃপ্রভাবে মহাদেবকে প্রীত করিয়া কশ্যপ হইতে একাদশ রুদ্রকে পুত্র রূপে লাভ করেন। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! এই পুরাণ প্রসিদ্ধ রুদ্রগণ ত্রিভুবনে অধীশ্বর হইয়া অসংখ্যভাবে নিখিল চরাচর ব্যাপিয়া রহিয়াছেন। ইহাদের নাম অজৈকপাদ অহির্ব্রধ্ন, হর, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, অপরাজিত, বৃষাকপি, শম্ভু, কপর্দ্দী, রৈবত ও কপালী। হে ভরত শার্দ্দুল! এক্ষণে কশ্যপলোক বর্ণন করিব মনোনিবেশ করুন। রাজন্! কশ্যপের কতকগুলি সত্যব্রতা পত্নী ছিলেন। ইহাদের দ্বারাই লোকত্রয় রক্ষা হয়। অদিতি, দিতি, দনু, অরিষ্টা, সুরসা, খশা, বিনতা, তাম্রা, ক্রোধ, বশা, ইরা, কদ্রু ও মুনি ইহারাই মহর্ষি কশ্যপভাৰ্য্যা। পূর্ব্বকালে চাক্ষুষ মন্বন্তরে তূষিত নামে যে সুরাগ্রগণ্য দ্বাদশ দেবতা ছিলেন, বৈবস্বত মন্বন্তর উপস্থিত হইলে তাঁহারা লোকহিতার্থ সমবেত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, হে দেবগণ! আইস আমরা শীঘ্র অদিতিগর্ভে প্রবেশ করিয়া বর্ত্তমান মন্বন্তরে প্রসূত হই, তাহা হইলেই আমাদের শ্রেয়ো লাভ হইবে। বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভারত! দেবগণ এই কথা বলিয়া এবং ঐ রূপ স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া মরীচি তনয় কশ্যপের ঔরসে দক্ষ দুহিতা অদিতির গর্ভে পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ করিলেন। ইঁহারাই বিষ্ণু, শত্রু, অর্য্যমা, ধাতা, পূষা, বিবস্বান্, সবিতা, মিত্র, বরুণ, অংশ ও ভগ নামে দ্বাদশ আদিত্য বলিয়া অভিহিত হইলেন। যে সমস্ত দেবতা চাক্ষুষ মন্বন্তরে, তূষিত নামে অভিহিত হইতেন তাঁহারাই এখন বৈবস্বত মন্বন্তরে দ্বাদশ আদিত্য নামে আবিভূত ও প্রখ্যাত হইলেন। সোমদেবের যে সপ্ত বিংশতি পত্নীর কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে এক্ষণে তাহাদের উদরেও মহাপ্রভাবশালী অনেকগুলি পুত্র জন্মিল। অরিষ্ট নেমির পত্নীদিগের গর্ভে যোড়শ পুত্র উৎপন্ন হইল। বহুপুত্রের যে চারি পুত্র হইল তাহাদের নাম বজ্র, মেঘ, ইন্দ্রধনু ও বিদ্যুত। ব্ৰহ্মর্ষি সৎকৃত ঋক্ সকল প্রত্যঙ্গিরা হইতে সৃষ্ট হইল। দেবাস্ত্র সকল, ক্বশাশ্ব দেবর্ষির সন্ততি। এই সমস্ত দেবগণই যুগ সহস্রান্তে পুনর্ব্বার জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন। তন্মধ্যে বসু প্রভৃতি ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতা কামজ বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকেন। সুতরাং দেবগণকেও জন্ম ও মরণ এই উভয় ধর্ম্মাবচ্ছিন্ন বলিতে হইবে। সকল ভুবন প্রকাশক ভগবান্ মরীচিমালী দিবাকর যেমন গগনাঙ্গণে একবার উদিত হইয়া আবার অস্তমিত হন, দেবলোকেরও সেইরূপ যুগে যুগে.
আবির্ভাব ও তিরোভাব হইয়া থাকে। আমি শুনিয়াছি, কশ্যপপত্নী দিতির গর্ভে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামক দুই পুত্র এবং সিংহিকা নাম্নী এক কন্যার জন্ম হয়। এই সিংহিকা বিপ্রচিত্তির সহধর্ম্মিণী হইলেন। সিংহিকার গর্ভে যে সকল মহাবল পরাক্রান্ত পুত্র জন্মে, তাহাদের নাম সৈংহিকেয়। ইহাদের যে কত শত শত বা সহস্র সহস্র পুত্র পৌত্র উৎপন্ন হয়, তাহার ইয়ত্তা করা দুষ্কর। হে মহাবাহো! এক্ষণে হিরণ্যকশিপুর বংশ পরম্পরা শ্রবণ করুন্। হিরণ্যকশিপুর অনুহ্রাদ, হ্রদ, প্রহ্রাদ ও সংহ্রাদ নামে বীৰ্য্যবান্ চারি পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে হ্রাদের পুত্র হ্রদ, হ্রদের পুত্র আয়ু, শিবি ও কাল। প্রহ্রাদের পুত্র বিরোচন, বিরোচন হইতে বলি উৎপন্ন হইয়া ছিলেন। এই বলির ধৃতরাষ্ট্র, সূৰ্য্য, চন্দ্রমা, চন্দ্ৰতাপন, কুম্ভনাভ, গর্দ্দভাক্ষ ও কুক্ষি প্রভৃতি একশত পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ বাণ অত্যন্ত বলশালী এবং দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় পাত্র। পূর্ব্বকালে এই বাণ তপশ্চৰ্য্যা দ্বারা ভগবান ভবানীপতি শঙ্করকে প্রসন্ন করিয়া ‘আমি আপনার পার্শ্বদেশে বিচরণ করিব’ এই রূপ বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন। হিরণ্যাক্ষের বিদ্বান এবং মহাবলশালী পাঁচ পুত্র হয়। ইহাদের নাম ঝর্ঝর, শুকুনি, ভূতসস্তাপন, মহানাভ ও কালনাভ। দনুরও একশত পুত্র জন্মে। ইহারা সকলেই তীব্র বিক্রমশালী, তপস্যানিরত অথচ বিলক্ষণ বীৰ্য্যাতিশয় সম্পন্ন ছিলেন। তাহাদের মধ্যে প্রধান প্রধান তনয়ের নাম নির্দ্দেশ করিতেছি অবধান করুন। দ্বিমুৰ্দ্ধা, শকুনি, শঙ্কু শিরাঃ, শকুকর্ণ, বিরাধ, গবেষ্ঠী, দুন্দুভি, অয়োমুখ, শম্বর, কপিল, বামন, মরীচি, মঘবান, ইরা, গর্গশিরাঃ, বৃক, বিক্ষোভণ, কেতু, কেতুবীৰ্য্য, শতহ্রদ, ইন্দ্রজিৎ, সর্ব্বজিৎ, বজ্রনাভ, বিক্রান্ত, মহানাভ, কালনাভ, একচক্র, মহাবাহু, মহাবল তারক, বৈশ্বানর, পুলোমা, বিদ্রাবণ, মহাশিরা স্বর্ভানু, বৃষপর্ব্বা, মহাসুর তুহুগু, সূক্ষ্ম, নিচন্দ্র, ঊর্ণনাভ, মহাগিরি, অসিলোম, কেশী, শঠ, বলক, মদ, গগনমূৰ্দ্ধা, মহাসুর কুম্ভনাভ, প্রমদ, ময়, কুপথ, বীৰ্য্যশালী হয়গ্রীব, বৈসৃপ, বিরূপাক্ষ, সুপথ, হর, অহর, হিরণ্যকশিপু, শতমায়, শম্বর, শরভ, শলভ এবং বিপ্রচিত্তি। এই দনুর পুত্রগণ সকলেই কশ্যপবংশসম্ভূত। বিপ্রচিত্তি প্রভৃতি মহাবল পরাক্রান্ত যে সকল দানবকুলের নাম নির্দ্দিষ্ট হইল, হে নরাধিপ! ইহাদের পুত্র পৌত্রাদি অনন্ত, সুতরাং উহাদের সংখ্যার ইয়ত্তা করা আমাদের শক্তি-সাধ্য নহে। স্বর্ভানুর কন্যা প্রভা, শচী, উপদানবী হয়শিরাঃ, শর্ম্মিষ্ঠা ও বার্ষপর্ব্বণী, এই কয়েকটী পুলোমার দুহিতা। পুলোমা ও কালকা এই দুইটা আবার বৈশ্বানর তনয়া এবং উভয়েই বহুপুত্র। মহাপ্রভাবশালিনী কশ্যপভাৰ্য্যা। মহর্ষি কশ্যপ ঐ উভয়ের গর্ভে এক ষষ্টি সহস্ৰ চারি শত পুত্র উৎপাদন করেন। ইহারা অতি কঠোর তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মার বর প্রসাদে হিরণ্যপুরবাসী হইয়া দেবগণের অজেয় ও অবধ্য হইয়া উঠিয়াছিল। অবশেষে ইহার সব্যসাচী অর্জ্জুন কর্ত্তৃক সমরক্ষেত্রে নিহত হয়। প্রভার পুত্র নহুষ, শচীর পুত্র সঞ্জয়, শর্ম্মিষ্ঠার পুত্ৰ পূরু এবং উপদানবীর গর্ভে দুষ্মন্ত নামা এক পুত্র উৎপন্ন হয়। অতঃপর আর কতকগুলি অতি দুর্দ্ধর্ষ মহাবীৰ্য্য দানব জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। ইহার বিপ্রচিত্তি হইতে সিংহিকার গর্ভে উৎপন্ন হয়। দৈত্য দানব সংসর্গে ঐ সৈংহিকেয়দিগের উৎপত্তি হয় বলিয়া উহাদিগের পরাক্রম অতীব তীব্রতর এবং বলও অপরিমেয় হইয়া উঠিল। ইহাদের নাম ব্যংশ, শল্য, বলশালী নভ, বাতাপি, নমুচি, ইল্বল, খসৃম, আঞ্জিক, নরক, কালনাভ, রাহু, শুক, পোতরণ ও বজ্রনাভ। (এই রাহু সকলের জেষ্ঠ এবং চন্দ্র সূর্য্যের প্রমর্দ্দন কারী) মূক ও ভূহুণ্ড নামে হ্রদের দুই পুত্র হয়। সুন্দ পুত্র মারীচ তাড়কার গর্ভসম্ভূত। এই সুরসদৃশ বীর্য্যশালী দনুজ কুল বিবর্দ্ধন দানবগণের পুত্র পৌত্র যে কত হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা কর দুষ্কর। অতি দীর্ঘকাল দুশ্চর তপশ্চৰ্য্যায় আসক্ত থাকিয়া সংহ্রাদ নামা দৈত্য, স্বীয় বংশে নিবাত কবচগণকে পুত্র লাভ করিল। মণিমতী নগরীতে ইহাদের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল। ইহাদের তিন কোটি সন্তান জন্মে। ঐ সমুদায় দৈত্য তপোমহিমায় দেবগণের অবধ্য হইয়া উঠিলেও কালের অখণ্ড্য নিয়মে অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধারী অর্জ্জুন হস্তে উহাদিগকে জীবন বিসর্জ্জন করিতে হইয়াছিল। তাম্ৰার গর্ভে কাকী, শ্যেনী, ভাসী, সুগ্রীবী, শুচি, গৃধ্রিকা ও উলূকী এই কএকটী কন্যার জন্ম হয়। তম্মধ্যে কাকীর গর্ভে কাক, উলূকী হইতে উলূক, শ্যেনীর উদরে শ্যেন, ভাসী হইতে ভাস, গৃধ্রিকার গর্ভে গৃধ্র, শুচির গর্ভ জলচর, পক্ষিগণ এবং সুগ্রীবী হইতে অশ্ব, উষ্ট্র ও গর্দ্দভ উৎপন্ন হয়। ইহাদিগকে তাম্রাবংশ বলে। বিনতার অরুণ ও গরুড় নামে দুই পুত্র জন্মে। গরুড় স্বীয় ক্ষমতাবলে বিহগকুলের অধৃষ্যতা ও প্রাধান্য লাভ করিলেন। সুরমার গর্ভে প্রভূত বীৰ্য্যশালী বহুশীর্ষ গগনবিহারী উদ্যমশীল এক সহস্র সর্প জন্ম গ্রহণ করিল। এই সময়ে কদ্রুর গর্ভেও অনেক মস্তক অমিতবিক্রম সহস্র নাগ সন্ততি জন্মলাভ করিল। কিন্তু ইহারা সকলেই গরুড়ের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল। তন্মধ্যে অনন্তদেব, বাসুকি, তক্ষক, ঐরাবত, মহাপদ্ম, কম্বল, অশ্বতর, এলাপত্র, শঙ্খ, কর্কোটক, ধনঞ্জয়, মহানীল, মহাকর্ণ, ধৃতরাষ্ট্র, বলাহক, কুহর, পুষ্পদংষ্ট্র, দুৰ্ম্মখ, সুমুখ, শঙ্খ, শঙ্খপাল, কপিল, বামন, নহুষ, শঙ্খরোমা ও মণি প্রভৃতি কতকগুলি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। ইহাদের যে চতুর্দ্দশ সহস্র সন্তান সন্ততি জন্মে, তৎসমুদায়ই ভুজঙ্গভুক্ ক্রূবকর্ম্মা গরুড় কর্ত্তৃক নিহত হয়। এই নিমিত্তই দংষ্ট্ৰীকুল ক্রোধপরবশ খল প্রকৃতি হইয়া উঠিল। স্থলচর ও জলচর পক্ষি মাত্রেই ধরার সন্ততি। সুরভি হইতে গো এবং মহিষকুল উৎপন্ন হয়। বৃক্ষ, লতা ও তৃণজাতীয় উদ্ভিদ পদার্থ সমুদায় ইরা হইতে উদ্ভূত হইয়া ধরাতলের সর্ব্বতঃ প্রসারিত হইল। যক্ষ রাক্ষস সিদ্ধ ও অপ্সরাগণ খশা হইতে এবং মহাসত্ব দৃপ্ত বিক্রম গন্ধৰ্ব্বগণ অরিষ্টা হইতে আবির্ভূত হইল। অতএব হে মহারাজ! এই পৃথিবীতে স্থাবর জঙ্গমাত্মক যে কিছু পরিদৃশ্যমান পদার্থ সৃষ্ট হইয়াছে প্রায়শঃ তৎসমুদায়ের বীজ পুরুষ মহর্ষি কশ্যপ। অতঃপর ঐ সমুদায় সৃষ্ট পদার্থের বংশ পরম্পরা যে কত বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। রাজন্! আমি যে সকল সৃষ্টি বিবরণ কীৰ্ত্তন করিলাম এ সমস্তই স্বারোচিষ মন্বন্তরীয়। অনন্তর বৈবস্বত মন্বন্তরে দীর্ঘকালসাধ্য মহা সমৃদ্ধ বরুণ যজ্ঞে ব্ৰহ্মা স্বয়ং হোতৃ কর্ম্মে ব্ৰতী হইয়া যে সমুদায় প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন এক্ষণে তাহাই বিশেষ রূপে বর্ণন করিব, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বকালে ব্রহ্মার মানস হইতে সপ্ত ব্ৰহ্মর্ষি সমুৎপন্ন হইলে, লোক পিতামহ ব্রহ্মা উহাদিগকে পুত্রত্বে পরিগ্রহ করিলেন। অনন্তর দেব দানবগণের মধ্যে পরস্পর বিরোধ সংঘটিত হইলে দিতি তনয়েরা নিহত হইল। তখন বিনষ্ট পুত্র দিতি নিতান্ত শোকাকুল হইয়া শুশ্রূষা দ্বারা মহর্ষি কশ্যপের প্রসাদ প্রার্থিনী হইলেন। তখন মহাতপা কশ্যপ প্রীত হইয়া বর প্রদানে উদ্যত হইলে দিতি কহিলেন, ভগবন্! যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন তবে আমি ইহাই প্রার্থনা করি যে, আমার গর্ভপ্রসূত পুত্র যেন ইন্দ্রকে সংহার করিতে সমর্থ হয়। মহামুনি কশ্যপ “তথাস্তু” বলিয়া স্বীকার করিলেন। অতঃপর শান্ত ভাবে কহিলেন, দেবি! যদি তুমি শুচিব্রত হইয়া শত বৎসর গর্ভ ধারণ করতে পার, তাহা হইলে ঐ গর্ভজাত পুত্র অবশ্যই ইন্দ্রহন্তা হইবে সংশয় নাই। দিতি “যথাজ্ঞা” বলিয়া তদীয় আজ্ঞা স্বীকার করিলেন। হে বসুধাধিপ! অনন্তর দিতি সতত পবিত্র হইয়া অবস্থান করিলে মহা মুনি কশ্যপ সর্ব্বদেব শ্রেষ্ঠ এবং অমরগণের অবধ্য পুত্র কামনা করিয়া তাহার গর্ভাধান সমান পূর্ব্বক দুশ্চর তপশ্চরণার্থ এক পর্ব্বতে গমন করিলেন। এই সকল বৃত্তান্ত অবগত হইয়া দেবরাজ ইন্দ্র ও দিতির শুদ্ধাচারবিরোধী ছিদ্র অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। একোনশত বৎসর অতীত হইলে একদা দিতি ভ্রান্তি বশতঃ পাদপ্রক্ষালন না করিয়া শয়নমন্দিরে প্রবেশ পূৰ্ব্বক নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। ইন্দ্র সুযোগ পাইয়া সশস্ত্র গর্ভ মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক বজ্রাস্ত্র দ্বারা কুক্ষিস্থ শিশুকে সপ্তধা ছিন্ন করিলেন, বালক রোদন করিয়া উঠিল। ইন্দ্র উহাকে রোদন করিতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বালক কিছুতেই নিবৃত্ত হইল না। তখন দেবরাজ, বিলক্ষণ রোষভরে উহার প্ৰতিখণ্ডকে পুনর্ব্বার সপ্তধা কৰ্ত্তিত করিলেন। এই রূপে ঐ কুক্ষি নিলীন শিশু হইতে উনপঞ্চাশত বায়ুর সৃষ্টি হইল। ইন্দ্র তৎকালে ‘মারোদীঃ’ বলিয়া ক্রন্দন করিতে যে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা হইতেই ঐ বায়ু সকল মারুত নামে অভিহিত হইয়াছে। এই মারুতগণ পরিশেষে ইন্দ্রেরই সহকারী হইয়াছিলেন। বৈশম্পায়ন কহিলেন হে মহারাজ জনমেজয়! এইরূপে ভূত সৃষ্টি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে ভগবান বিষ্ণু উহাদিগকে এক একটা শ্রেণীভুক্ত করিয়া দেবগণের মধ্য হইতে এক জনকে উহাদিগের অধ্যক্ষ রূপে নির্ব্বাচিত করিলেন। উহাদের নাম গণপতি। পৃথুই ঐ সকল গণপতিদিগের মধ্যে  প্রধান ও আদিম ছিলেন। হে রাজন! যে হরি এইরূপে দেবগণকে সর্ব্বাধিপত্য প্রদান করিলেন, তিনিই প্রধান পুরুষ, তিনিই বীর, তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই জিষ্ণু এবং প্রজাপতি, পর্জ্জন্য ও তপন, তিনিই অব্যক্ত এবং নিখিল জগৎ তাঁহারই অধিকৃত। হে ভরতর্ষভ! যে ব্যক্তি ভূত সৃষ্টি বিষয়ক বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারেন, দেবগণের শুভাবহ জন্মবৃত্তান্ত পাঠ বা শ্রবণ করেন, তাঁহার আর এ জগৎ সংসারে পুনরাবৃত্তি করিতে হয় না, পরলোক ভয়ও এক বারে সুদূরপরাহত হইয়া যায়।. 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ